জয়গুন আহার-নিদ্রা ভুলে দিনের পর দিন ছেলের শয্যা-পার্শ্বে কাটিয়ে দেয়। মায়মুনও থাকে মা-র কাছে। প্রত্যেক দিন খাবার সময়ে করিম বক্শের ইঙ্গিতে আঞ্জুমন জয়গুনের হাত ধরে টানাটানি করে খাওয়ার জন্যে। বলে—এই রহম পেডে পাথর বাইন্দা থাইক্য না। দুইডা দানাপানি মোখে দ্যাও বুজান, নালে শরীল তোমার ভাইঙ্গা যাইব।
জয়গুন খেতে যায় না। সে ভাবে, এ বাড়ীর ভাত তার কপাল থেকে অনেক আগেই উঠে গেছে।
হাসু রোজ খাবার নিয়ে আসে। রেখে যাওয়া সে খাবার সে মায়মুনকে দেয়। নিজেও খাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তার খাওয়া আসে না। দু’এক মুঠো জোর করে গিলে এক মগ পানি খেয়ে একদিন কাটিয়ে দেয়।
দিনের বেলা যেমন তেমন কেটে যায়। কিন্তু রাত্রি বেলা জয়গুনের আর দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সে রাত্রির জন্যে প্রস্তুত হয়। বাতির তেল না থাকলে মায়মুনকে পাঠিয়ে পাশের বাড়ী থেকে কুপি মেপে তেল ধার আনে। একটা মালসাতে তুষ সাজিয়ে আগুন দিয়ে রাখে।
রাত্রে জয়গুনের কাছে থাকার জন্যে শফির মা আসে। সে ‘বুড়া মানু’ তাই তার ঘুম কম। রাত্রের যে কোন সময়ে ডাক দিলে তার সাড়া পাওয়া যায়। সে কাছে থাকলে মনে বল পাওয়া যায়। হাসুও দুই রাত্রি ছিল। কিন্তু ও ছেলে মানুষ। সন্ধ্যার পরেই ঘুমিয়ে পড়ে। সারা রাত্রির জন্যে আর তাকে সজাগ পাওয়া যায় না। শফির মা-র জন্যে জয়গুন। সন্ধ্যার আগেই বেশী করে পান ঘেঁচে রাখে, যাতে কাসুর কানের কাছে ঠনর ঠনর করতে না হয়।
শফির মা অনেকক্ষণ বসে থাকে জয়গুনের পাশে। তারা মুখোমুখি বসে। আগুনের মালসার ওপর হাতগুলোকে গরম করে। মাঝে মাঝে কান মুখ ও অন্যান্য অঙ্গে গরম হাত বুলিয়ে শীত তাড়াবার চেষ্টা করে। শফির মা কখনও পান চিবোতে চিবোতে পিচ ফেলে মালসার মধ্যে। তুষের আগুন থেকে ধোঁয়া বের হয়। নানা কথায় সে জয়গুনকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তার নিরাশ মনে আশা জাগিয়ে তোলে। থানার ঘন্টা যখন জোড়ায় জোড়ায় বাজে, তখন সে গুণতে আরম্ভ করে সাথে সাথে। বলে—বারোখান বাজল। এইবার এট্ট কাইত অই। আত দিয়া দ্যাখ, কাপড় ভিজা প্যাচপেইচ্যা অইয়া গেছে।
শফির মা কাঁথা উঠিয়ে মায়মুনের পাশ দিয়ে শুয়ে পড়ে। তার শীতল শরীরের ছোয়া লেগে মায়মুন একবার নড়াচড়া করে ওঠে। শফির মা বলে—চুপ কইর্যা থাক বেডি, অহনি উম অইয়া যাইব।
শফির মা গরম হাত দুটো মায়মুনের গায়ে বুলিয়ে এবার ক্ষতি পূরণের চেষ্টা করে। জয়গুনকে বলে—আমারিক্ত ঠাণ্ডা অইয়া গেছে। খাড়াকাড়ি গরম অয় না। ওগ রক্ত গরম। আমার শফিরে বুকে লইয়া হইলে মুহতুকের মইদ্যে উম অয়। তা না অইলে পৌষ মাইস্যা শীতে ঠকঠক করতে করতে জান কবচ অওনের জোগাড়। মাইনষে কইতেই কয়—
পৌষের হিমে ভীম দমন,
মাঘের শীতে বাঘের মরণ।
শফির মা শুয়ে শুয়ে গল্প আরম্ভ করে—ভীম একদিন তার মা-রে জিগায় ‘মা, আমার তন বড় জোয়ান কে? তার মা কয়—‘আছে একজন। গাঙ্গের পাড় দিয়া আঁটলেই তার দ্যাহা পাইবা। তহন পৌষ-মাইস্যা রাইত। ভীম কতক্ষুণ পর শীতে ঠকঠক করতে করতে বাড়ীতে আহে। মায় জিগায়—দ্যাহা পালি বাজান? ভীম কয় ‘হ গো মা।’
জয়গুন কাঠি দিয়ে তুষের আগুন ঘেঁটে তাতিয়ে নেয়। আগুনে হাত-পাগুলোকে গরম করে।
ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উত্তুরে হিমশীতল বাতাস ঢোকে। জয়গুনের শরীরের রক্ত জমে ওঠে যেন!
বাতাসে নিবুনিবু করে কুপিটা। জয়গুন উঠে সলতে উস্কিয়ে দেয়। এক প্রস্ত কাঁথা এনে আগুনে গরম করে গায়ের ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে কাঁথাগুলো পালটিয়ে দেয়।
করিম বক্শ এক সময়ে ডাকে—কাসু কি ঘুমাইছে?
বার দুই ডেকে করিম বক্শ ক্ষান্ত হয়। শফির মা ঘুমিয়ে পড়েছে। জয়গুন ডান হাত বাড়িয়ে তাকে ধাক্কা দেয়। শফির মা ধড়ফড় করে ওঠে। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে—আল্লা-রছুল! কি কাসুর মা? সারা রাইত এম্বায় বইস্যা থাকবি? তুই আয়, আমার বালিশে মাথা রাইখ্যা এটু ক্যাইত অইয়া থাক। ও এহন চুপ মাইর্যা আছে।
করিম বক্শ আবার ডাকে—ও কি ঘুমাইছে?
—হ ভাই, এহন ঘুমেই আছে।
নিঝুম রাত। কোন দিকে সাড়া-শব্দ নেই। অনেকক্ষণ পরে পরে পাখীর কলবল এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। তারপর আবার নিস্তব্ধ। এমন নিস্তব্ধতার মধ্যে ঘরে শোয়া করিম বক্শের নিশ্বাস পতন পর্যন্ত গণনা করা যায়। কানের কাছে কাসুর বুকে কফের ঘ্যাড়-ঘ্যাড় শব্দ এবং তার অনিয়মিত হ্রস্ব দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস জয়গুনের আশঙ্কাঘন মনে উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। ঘন কালো অন্ধকার যেন চারদিক থেকে গিলে ধরবার জন্যে হা করে আছে।
শেষ রাতে ভয়ঙ্কর শীত নেমে আসে। জয়গুন আর একবার কাঁথা বালিশ গরম করে কাসুর বিছানা বদলে দেয়। নিজের হাত-পা শরীর তুষের আগুনের তাপে গরম করে। তারপর কাসুর কাঁথার নিচে শুয়ে তাকে নিজের বুকের তাপ দিয়ে গরম করবার চেষ্টা
সপ্তাহ খানেক পরে একদিন ডাক্তার বলেন—আর চিন্তা করো না, মা। ভয় কেটে গেছে। তোমার ছেলে এবার ভালো হয়ে উঠবে!
জয়গুনের মুখের ওপর থেকে নৈরাশ্যের মেঘ কেটে যায়। আশার আলোয় মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার। ডাক্তারের ওপর কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে বুক। কিন্তু তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা তার জানা নেই। সে বলে–বাবা—তুমিই আমার কাসুরে বাঁচাইল। মরণঘর তন তুমিই ওরে ফিরাইয়া আনছ।
ডাক্তার আশ্চর্য হন। তার সমস্ত জীবনে এমন সহজ সোজা কথা কোন নিরক্ষরের মুখে তিনি কখনও শোনেন নি। ডাক্তার মানুষ বাঁচাতে পারে, এ-কথা বিশ্বাস করে না কেউ।
ডাক্তার বলেন—আমার চিকিৎসা ছাড়াও তোমার শুশ্রূষা অনেক সাহায্য করেছে। তুমি কাছে না থাকলে, সময় মত ওষুধ-পথ্য না দিলে এ রোগী বাঁচান এত সহজ ছিল না।
কাসু ভালো হয়ে ওঠার সাথে সাথে জয়গুনের কর্তব্যও যেন ফুরিয়ে যায়। একদিন ভোর রাত্রে কাসুকে ঘুমে রেখে সে মায়মুনকে নিয়ে হাসর সাথে বাড়ী চলে আসে।
জয়গুনের এমনি করে চলে আসার কারণও ‘ঘটেছিল।
শফির মা সেদিন আসে নি। জ্বর হয়েছিল তার। রাত্রে মা-র কাছে থাকবার জন্যে হাসু এসেছিল।
গভীর রাত্রি। হাসু ও মায়মুন ঘুমে অচেতন। কাসুও কতক্ষণ ছুটফট করে কিছু আগে। মুমিয়ে পড়েছে। তার শিয়রে আগুনের মালসার ওপর হাত রেখে জয়গুন ঝিমোচ্ছে।
করিম বক্শ অন্ধকারে বালিশ থেকে মাথা উঁচিয়ে ঘর ও বারান্দার মাঝের বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকায়। কয়েকদিন ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে তার কেমন নেশা ধরে গেছে। কুপির অস্পষ্ট আলোকে জয়গুনের মুখখানা বড়ই সুন্দর লাগে তার চোখে। চোখ দুটো ঘুমে ঢুলুঢুলু, কখনও বুজে আসে। সারা মুখে বেদনার ছাপ যেন সুন্দরতর করেছে তার মুখখানা।
করিম বক্শ আস্তে আস্তে বারান্দায় নেমে আসে। আওয়াজ পেয়ে জয়গুন গা ঝাড়া দিয়ে বসে। তাড়াতাড়ি মাথার কাপড় লম্বা করে টেনে দেয়।
করিম বক্শ এসে কাসুর মাথায় হাত দিয়ে শরীরের তাপ দেখে। জয়গুন বুঝতে পারে, কথা বলার ভূমিকা ছাড়া এ আর কিছু নয়। সে একটু দূরে সরে বসে হাসু ও মায়মুন যেখানে শুয়ে আছে।
করিম বক্শ বলে—আমারে দেইখ্যা তুমি ঘুমডা দ্যাও ক্যাঁ?
বার তিনেক হল এই একই অভিযোগ।
জয়গুন উত্তর দেয় না।
—আমারে আবার শরম কিয়ের? এত বচ্ছর আমার ঘর করলা, আর এহন আমারেই শরম! মাথার কাপড় উডাও, লক্ষ্মী। হোন আমার কথা।
জয়গুনের বুকের ভেতর টিপটিপ করতে শুরু করে।
করিম বক্শ বলে—আমার কথা যদি রাখ, তয় একটা প্রস্তাব করতে চাই।
জয়গুন নিরুত্তর।
-আইচ্ছা, আমি যদি আবার—
জয়গুন শক্ত একটা কিছু বলার জন্যে মনে মনে মুসাবিদা করে কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বের হয় না।
—তোমারে আবার আমি ঘরে আনতে চাই।
কম্পিত কণ্ঠে জয়গুন বলে–না।
-ক্যাঁ? আমি শরা-শরিয়ত মতই করতাম।
শরিয়ত মত আগে একজনের লগে সাঙ্গা বইয়া হেইখান তন তালাক লইয়া তারপর? ওহোঁ।
—ওয়াতে দোষ কি? লক্ষ্মী, তুমি রাজী অও। তহন কি আম্মুকি করছি ঘরের লক্ষ্মী ছাইড়্যা দিয়া। শরিয়তে আইন আছে এই রহম নিকার।
—শরিয়তে থাকলেও আমি পারতাম না।
—ক্যাঁ? সতীনের ঘর বুইল্যা? যদি একবার মোখ ফুইট্যা কও ‘সতীনের ঘর করতাম না’ তয় ফুলির মা-রে রাইত পোয়াইলেই খেদাইয়া দিতে পারি। তুমি একবার একটু–
—ওহোঁ।
—ক্যাঁ? ঘরের লক্ষী তুমি। করিম বক্শ জয়গুনের একটা হাত ধরে আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। জয়গুন ঝাড়া দিয়ে সে হাত ছাড়িয়ে নেয়। পাশে হাসুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়—হাসু হাসু ওঠ।
করিম বক্শ চোরের মতো সরে যায়।
বাকী রাতটা জয়গুন বসে কাটিয়ে দেয়। প্রথম মোরগের বাকের সময়, সে হাসু ও মায়মুনকে ডেকে তোলে। কাসু ঘুমিয়ে আছে। তার রোগ-শীর্ণ পাণ্ডুর মুখের দিকে চেয়ে জয়গুন চোখের পানি রাখতে পারে না। কাসুর গালে একটা চুমো দিয়ে তার গালের সাথে নিজের গাল ঠেকিয়ে রাখে কিছুক্ষণ।
সে আঞ্জুমনকে ডেকে কাসুর কাছে রেখে যায়। আঞ্জুমন কিছু বুঝতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করে—আইজ যাইবা ক্যাঁ?
—যাইমু না কি করমু আর? এহন ও ভাল অইয়া উডব। তুমি এটু নজর রাইখ্য বইন। তোমার ত পোলা নাই। মনে কইর্য এইড়া তোমার প্যাডের।
জয়গুন বাড়ী এসে প্রথমেই শফির মার বিছানার পাশে গিয়ে বসে।
শফির মা বলে—চইল্যা আলি ক্যাঁ? তোরে দ্যাখতে না পাইলে যদি ও চিল্লায়?
—চিল্লাইলে কি করতাম, বইন? যার পোলা হে-ই রাখব। আমার কি! সখেদে বলে জয়গুন।
—আমার ত মনে অয় না করিম বক্শ ওরে রাখতে পারব। ঘুমের তন উইঠ্যাই যখন তোরে দ্যাখব না, তহন করিম বকশের দিল-কইলজাডা খুইল্যা খাইয়া ফ্যালাইব না!
—তার আমি কি করতাম! হেদিন কইছিলাম—ওরে আমার কাছে আইন্যা কিছু দিন রাহি। তারপর ভালা অইয়া গেলে যার পোলা হে-ই লইয়া যাইত। ব্যারাম তন ওঠলে এট্টু আবদার করব। হেইয়া সইজ্য আইলে তয় ত! কিন্তু তুমি মত করলা না।
–কেমন কইর্যা করি? আমাগ সূর্য-দীগল বাড়ী। এই বাড়ীতে মানুষ উজাইতে পারে না। আবার এক বছর ধইর্যা পাহারা নাই। এমন সোনার চান মানিকরে এইখানে আনলে যদি এটটু উনিশ-বিশ অয়, তয় বদনাম অইব তোর।
—ক্যাঁ। আমরা তো কতদিন ধইরা আছি। আমাগ কি অইছে?
আমাগ কতা আলাদা। আমাগ সইয়া আইছে। আর এতদিন বাড়ীর পাহারা আছিল। পাহারা যেই দিন তন নাই, হেই দিন তন আমার জ্বর যেন ঘন ঘন ওঠতে আছে! আবার মায়মুনেরও পরের বাড়ীর ভাত ওঠল। এইগুলা কি কম চোট?
সূর্য-দীঘল বাড়ীর অমঙ্গল আশঙ্কা করে জয়নুন সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করে। তবুও তার মন মানে না। তার অন্তর কেঁদে ওঠে। রোগশীর্ণ কাসুর কান্না শুনতে পায় সে তার অন্তরে। স্পষ্ট দেখতে পায়, ঘুম থেকে জেগে কাসু মা-মা বলে কাঁদছে।
অসুখ ভালো হয়ে আসার পর প্রথম চোখ মেলেই সে মা-কে চিনতে পেরেছিল। তারপর যতক্ষণ সে জেগে থাকত, কখনও জয়গুনের বুকে মাথা রেখে, কখনও হাত আকড়ে ধরে থাকত। তার বিছানা ছেড়ে জয়গুনের কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। সে কোথাও গেলে কাসু কান্না জুড়ে দিত। দুর্বল হাত-পা দিয়ে কাঁথা বালিশ ছুঁড়তে আরম্ভ করত। আজও জয়গুন তার মনের চোখে দেখতে পায়—কাসু পায়ের লাথি মেরে গায়ের কাঁথা ফেলে দিচ্ছে। করিম বক্শ বা আমন কেউ তাকে শান্ত করতে পারছে না।
আসলেও তাই ঘটেছিল। করিম বক্শ নানা রকম লোভ দেখিয়েও কাসুর কান্না থামাতে পারে নি।
রমেশ ডাক্তার জয়গুনকে আনবার জন্যে লোক পাঠাতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি করিম বক্শের কাছে জানতে পারেন, জয়গুন আর আসবে না।
ডাক্তার তার সুন্দর থার্মোমিটারটা কাসুর হাতে দিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেটা সে মাটির ওপর ছুঁড়ে ভেঙে দেয়।
ডাক্তার করিম বক্শকে ভৎর্সনা করেন—শিগগির ওকে ওর মা-র কাছে পাঠিয়ে দাও। এভাবে একে রাখতে পারবে না। এখনও শরীর দুর্বল। এক্ষুণি নিয়ে যাও। দেরী করো না। আমি ওখানে গিয়ে দেখে আসব। ঐ তালগেছো বাড়াটা তো? হ্যাঁ, চিনেছি। ওর মা-র কাছে ভালো থাকবে।
করিম বক্শ কাচুমাচু করে। ডাক্তারের আদেশ লঙ্ঘন করার সাহস তার হয় না। সে যখন কাসুকে কোলে করে নিয়ে যায়, তখন রোদের তেজ বেড়েছে। মাঠের আধা-পাকা মশুর, কলাই ও সর্ষের গাছে শিশির তখনও ঝলমল করছে।
করিম বক্শ কাসুকে এনে জয়গুনের ঘরের দরজার ওপর ছেড়ে দেয়। হাসু ও মায়মুন এসে কাসুর হাত ধরে ঘরে নিয়ে যায়। জয়গুন বসে আছে নিশ্চল। চোখের পানি শুকিয়ে তার দুই গালে দুটি রেখা স্পষ্ট হয়ে আছে। জয়গুন কাসুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় না, বলেও না কিছু মুখে। কাসু দু’হাত দিয়ে তাকে ধরতেই জয়গুন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। হাসু ও মায়মুন পাশে বসে কাসুর পিঠে ও মাথায় হাত বুলায়।
উঠানে করিম বক্শ দাঁড়িয়ে আছে। মায়মুনকে উঠানে একখানা পিঁড়ে দিয়ে আসতে বলে জয়গুন।
মায়মুন সসঙ্কোচে পিঁড়ে হাতে বাপের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। করিম বক্শের মমতাহীন লাল চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। হাত বাড়িয়ে মায়মুনকে ধরতে যায়। কিন্তু তার হাত কাঁপছে কেন? মেহেরনকে হত্যা করার সময় যে হাত কাঁপেনি, মায়মুনসহ জয়গুনকে মেরে তাড়িয়ে দেয়ার সময় যে হাত তার বিচলিত হয় নি, আজ সেই হাত কাঁপছে কেন? সেই হাতের শক্তি কোথায়? নিজের মেয়েকে স্পর্শ করার শক্তিও যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। মায়মুনকে স্পর্শ করার অধিকার যেন হারিয়েছে সে।
করিম বকশের হাতটা আপনার থেকেই নেমে আসে। মাথা নিচু করে সে বাড়ীর দিকে পথ নেয়।
শফির মা জ্বরের শরীর নিয়ে লাঠি ভর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে আসে। বলে—আহা, হুকাইয়া এক্কেরে কাষ্ট অইছে মানিক। খালি আড়গুলা আছে।
—আড় বাঁইচ্যা থাকলে মাংস একদিন অইবই। কাসুর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে জয়গুন বলে।
—হ, আল্লায় বাঁচাইয়া রাখুক। আমার যত গাছ চুল আছে, তত বচ্ছর আয়ু যেন খোদায় ওরে দ্যায়।
করিম বক্শ এখন রোজ আসে কাসুকে দেখতে। কোনদিন মাঠের মাঝ দিয়ে তাকে আসতে দেখে কাসু আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঝোপের আড়ালে বসে থাকে যতক্ষণ না করিম বক্শ চলে যায়। তার ভয়—করিম বক্শ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই আসে। তার এ বিশ্বাসে ইন্ধন যোগায় মায়মুন। রোজ ভোরে সে পথের দিকে চেয়ে থাকে। করিম বক্শকে দেখতে পেলেই সে হুশিয়ারী সঙ্কেত দেয়। করিম বক্শ ব্যর্থ হয়ে শফির মা-র ঘরে গিয়ে কথাবার্তা বলে। তার ছেঁচা পানে ভাগ বসায়।
–কি করলা, ভাজ? পরস্তাবডা করছিলা? করিম বক্শ জিজ্ঞেস করে।
—করছিলাম। কিন্তুক রাজী অয় না। বহুত দিন ধইর্যা আমিও চেষ্টা করতে আছি। চক-চেহারায় তো কম না। মাইনষে দ্যাখলে এহনও এক নজর চাইয়া দ্যাহে। ষাইডের বান্দে ছান্দেও ঠিক আছে। এহনও নিকা দিলে গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা-কাচ্চা অয়। আমি এত কইর্যা বুঝাই, আমার কথা কানেই নেয় না। গদু পরধান কত ঘুরাঘুরি করে! দুই কানি জমিন আর একখান ঘর লেইখ্যা দিতে চাইছিল।
—আমি ভালার লেইগ্যা কইছিলাম। আমার সংসারও চলত, আর আমার পোলা মাইয়াও সুখে থাকত। আমার তিন কানি জমিন ওর নামে দলিল রেজেষ্টি কইর্যা লেইখ্যা দিতাম। তুমি আর একবার কইয়া দেইখ্য না। যদি সতীনের ঘর করতে রাজী না অয়, তয় আঞ্জুমনরেও তালাক দিয়া দিতে পারি। এর বেশী আর কি চায়?
—কিন্তুক ও যে কিছুই চায় না। আমার মোখের উপরে কইয়া দিছে,—’যেই থুক একবার মাডিতে ফ্যালাইছি, তা মোখ দিয়া চাটতে পারতাম না।’
করিম বক্শ এবার ফতুয়ার পকেট থেকে একটা পান বের করে শফির মা-র হাতে দিয়ে বলে-খবরদার কেও যেন না জানে। তোমার ঘরে ডাক দিয়া এই পানডা খাওয়াইয়া দিও। নাগর বাইদ্যার আতে পায়ে ধইর্যা এইডা যোগাড় করছি। বান্দরের নউখের কলম আর মানিকজোড়ের রক্ত দিয়া এই পানের উপরে লেইখ্যা দিছে আর কইয়া দিছে,—’সাত রোজের মইদ্যে যদি ও তোমার লেইগ্যা পাগল না অয় তো আমার নামে কুত্তারে ভাত দিও।’