১৮. উত্তরা
আমাদের দেশের সামাজিক পরিস্থিতিই ব্যাপারটাকে একেবারে জলভাত করে দিয়েছে। এটা এই সেদিন পর্যন্তও খুব অস্বাভাবিক লাগত না, অসামাজিক তো নয়ই। হাটে-মাঠে, বাসে-ট্রেনে এখনও দেখতে পাই রীতিমতো জীর্ণ বয়সের বর কচি বউ বিয়ে করে নিয়ে সদর্পে পথ বেয়ে চলেছে। জানি, এ-সবের মধ্যে কন্যাপক্ষের সামাজিক বিপন্নতা আছে, আছে অর্থনৈতিক অসহায়তা। আরও জানি– এ-সব প্রেম-ভালবাসার ক্ষেত্র নয়, এ হল বলবত্তর পৌরুষেয়তার কাছে আর্থিক অস্বাতন্ত্রের পরাজয়। কিন্তু তেমন কোনও ঘটনা আমি লিখতে বসিনি এখানে, প্রায় বৃদ্ধ দশরথের সঙ্গে তরুণী কৈকেয়ীর বিবাহ-সংবাদের মতো ঘটনাও এটা নয়, পাছে আপনারা এইরকমই কিছু একটা ভেবে বসেন, সেইজন্যই বরঞ্চ আগে থেকে কিছু সাফাই গেয়ে রাখছি।
এটা তো নিশ্চয়ই খুব অস্বাভাবিক ভাববেন– আমার এক বন্ধু তখন আমরা উনিশ-কুড়ি হব– সে আমার অপর এক বন্ধুর বড় দিদিকে বেশ পছন্দ করত। দিদি তখন পঁচিশ-ছাব্বিশ হবেন– আবেগের আতিশয্যে বন্ধু তাকে প্রেম নিবেদন করবে বলেই ঠিক করল। যে বন্ধুর দিদি, সেই বন্ধু বাড়িতে আসন্ন বিপদ এবং স্বয়ং দিদির চড়-চাপড়ের ভয়ে চরম অস্বস্তিতে দিন কাটাতে আরম্ভ করল। চা-চক্রীরা প্রচুর উত্তপ্ত আলোচনার পর পুঁথিগত নানান বিদ্যার ওপর নির্ভর করে ঘটনাটাকে নেহাত ইনফ্যাচুয়েশন আখ্যা দিয়ে প্রেম-প্রবৃত্ত বন্ধুকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করল। ঘটনার শেষটা অবশ্য অজা-যুদ্ধের পরিণতি লাভ করেছিল। বলা বাহুল্য, দিদি তার প্রতি এই বালক-কিশোর উত্তীয়-বন্ধুর প্রেমমত্ততা জানতে পেরে অন্তরে পুলকিত, কিন্তু বাহ্যে সমাজ রক্ষার তাগিদে ছেলেটিকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং প্রচুর বাৎসল্য বিকিরণ করে সামাজিক সার্থকতার পথ নির্দেশ করেছিলেন।
বলতে পারেন, প্রথমে অস্বাভাবিক হলেও শেষ পর্যন্ত এখানে স্বাভাবিকতার জয় হয়েছে। কিন্তু যদি ঘটনাটা উলটো হয়, অর্থাৎ যদি কোনও কৈশোরগন্ধী রমণী তার চেয়ে অনেক বেশি বয়সি পুরুষের প্রেমে পড়েন তবে সেখানে প্রথমে একটু উত্তেজনা এবং চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু এমন একটা বিয়ে হলে পুরুষটিকে বড় জোর বুড়ো বর বলে কিছু নিন্দা সইতে হয়, এমনকী বুড়ো বয়সে সে তরুণী বিয়ে করেছে বলে খানিকটা তর্জনও তাকে লাভ করতে হয় মাঝে মাঝে, অপিচ মেয়েটির ওপরে বেশ মায়াও হয় এ-সব ঘটনায়। কিন্তু কোনওভাবেই সমাজ এটাকে অস্বাভাবিকও বলে না, অসামাজিকও বলে না।
আমি মহাভারতের এই ঘটনাটা লিখতে গিয়ে বারবারই থমকে গেছি, কতবার যে বসেছি, আর কতবার যে থেমেছি তার ঠিক নেই। শেষ পর্যন্ত লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই কথা ভেবে যে, মহাভারতের কবির সৃষ্টির তপস্যার মধ্যে কী অসীম বৈচিত্র্য ছিল। সমস্ত জগৎটা তো বটেই, কিন্তু জীবনের মধ্যে কোথায়, কখন যে কার হৃদয়তন্ত্রী বেজে উঠছে, তার সূক্ষ্ম সুরটুকু ঠিক তার কানে এসে বেজেছে। হাজারো ব্যস্ত ঘটনার মধ্যে সে সুর তিনি পাঠককে শুনিয়েও দেন সময়মতো। নইলে দেখুন, মহাকাব্যের কবির ব্যস্ততা তখন কম। নয়। পাণ্ডবদের বনবাস-পর্ব শেষ হয়ে গেছে। তারা এবার বিচার-বিবেচনা করছেন– কে। কেমন ছদ্মবেশে বিরাট-গৃহে প্রবেশ করবেন, কে কোন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন এবং তাদের কর্ম, বেশ এবং ব্যবহার কতটাই বা প্রত্যয় জাগাতে পারে বিরাট রাজার মনে। পাঁচ ভাই পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুনের বেশ-ভাব-আচারই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার কথা, কেনা তিনি নিজের স্বরূপটাকেই পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। নিজের পৌরুষ এবং ব্যক্তিত্বকে তিনি ক্লীবত্বের আবরণে প্রায় লুকিয়ে ফেলেছিলেন।
এটা অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, মৎস্যদেশের রাজা বিরাট অতি সদাশয় এবং উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাঁর যদি তেমন সন্দেহ কুটিলতা থাকত, তা হলে যুধিষ্ঠির-ভীম বা নকুল-সহদেবকে ধরে ফেলতে তার অসুবিধে হত না, কিন্তু অর্জুন সেই যে একবার নিজের পরিচয় দিয়ে বিরাট রাজার কন্যান্তঃপুরে প্রবেশ করেছিলেন, তারপর বেরিয়েছিলেন এক্কেবারে অজ্ঞাতবাসের কাল ফুরোনোর পরে। যাঁরা ভাবেন– অর্জুন ইন্দ্রপুরীতে উর্বশীর অভিশাপ লাভ করে এক্কেবারে সম্পূর্ণ একটি নপুংসকে পরিণত হয়েছিলেন, তাদের অগাধ বিশ্বাস এবং আস্থার জন্য তাদের আমি মহাভারতের কবির আশীর্বাদ জানাই। কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না।
আসলে উর্বশীর অভিশাপকে আমরা লৌকিকভাবেই বেশ বুঝতে পারি। এটা তো মানবেন যে, অর্জুনের মতো মহাবীর, যিনি প্রসিদ্ধ পাশুপত অস্ত্রের অধিকারী, যিনি গাণ্ডীবধ, তিনি যদি পট্টশাটিকায় আবৃত হয়ে, হার-অলংকার ধারণ করে নর্তকের বৃত্তি অবলম্বন করেন, তবে সেটাই তার চরম নপুংসকত্ব। এই নপুংসকত্বের আবরণ তার পক্ষে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ছিল, কেননা এই স্বরূপ-পরিবর্তন ছাড়া তাঁর মতো দীপ্ত ব্যক্তিত্বকে চিনে ফেলাটা খুব সহজসাধ্য ছিল। তবে হ্যাঁ, এটা তখনই বিরাট রাজার পক্ষে সহজসাধ্য হত, যদি সেই গূঢ়পুরুষের বেশ, ব্যবহার, আকার, ইঙ্গিত এবং শারীরিক প্রয়াসগুলি ততটা আবৃত না হত এবং তা তেমন বিশ্বাসযোগ্য না হত। বিরাট রাজার বিশ্বাস করার বৃত্তিটাই যথেষ্ট বেশি ছিল, নইলে দেখুন– যুধিষ্ঠির, ভীম একে-একে আসছেন, নিজেদের মিথ্যা পরিচয় দিচ্ছেন এবং রাজার কাজে লেগে যাচ্ছেন, বিরাট তাতে এতটুকু সন্দেহ করছেন না।
বিরাট-গৃহে অজ্ঞাতবাসের জন্য প্রবেশ করার সময় পাণ্ডব-ভাইরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন এবং অপর মানুষ বলে প্রমাণ করার জন্য নিজেদের ভ্রাতৃম পরিবর্তন করেছিলেন। বিরাট রাজ্যে প্রথমে প্রবেশ করলেন যুধিষ্ঠির, অনুক্রমে ঢুকলেন ভীম এবং দ্ৰৌপদী, তারপর সহদেব, তারপরে অর্জুন এবং একেবারে শেষে নকুল। কিন্তু এই ক্ৰম-পরিবর্তনই কি শুধু যথেষ্ট ছিল? একই দিনে খানিকক্ষণ বাদে বাদে এক-এক ভাই এসে নিজের নিজের বিশেষজ্ঞতা খ্যাপন করার পরেই বলছেন– আমি পূর্বে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের কাছে অমুক কাজ করতাম, তমুক কাজ করতাম– এই কথাগুলি আজকের এই সন্দেহবাতিক যুগে কতটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? এমনকী দ্রৌপদী পর্যন্ত পূর্বে দ্রৌপদীরই পরিচারিকা সৈরিন্ধ্রী ছিলেন এবং বৃহন্নলা অর্জুনও দ্রৌপদীর পরিচারিকা ছিলেন– এই কথাগুলি বিরাট রাজা বিনা কোনও ভ্রুকুটি-কুটিলতাতেই বিশ্বাস করলেন- এটা বিরাট রাজার অসাধারণ সরল মানসিকতা প্রকাশ করে। অথবা বিরাট রাজাকে এমন চারিত্রিকতায় স্থাপন করাটাই মহাকাব্যের কবির কাব্যসিদ্ধি তৈরি করে।
তবু বলি এতগুলি ছদ্মবেশের মধ্যে বুঝি অর্জুনের ছদ্মবেশই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ছিল। প্রথমত তিনি নকুল-সহদেবের মতো অশ্বরক্ষক-গোরক্ষকের পরিচিত ভূমিকা গ্রহণ করেননি অথবা রাজার সঙ্গে নিরন্তর রসে-বশে পাশা খেলার অলস ব্যসনও তার পছন্দ হয়নি যুধিষ্ঠিরের মতো। অন্যদিকে ভীমের মতোও তিনি পারেন না। প্রচুর রান্না করা এবং হাতির সঙ্গে লড়াই করার মতো স্কুল ব্যবহারও তাঁর রুচি-রোচন হয় না। অর্জুন সূক্ষ্ম প্রকৃতির মানুষ, দেবরাজ ইন্দ্রের স্ত্রী-প্রিয়তার পরম্পরায় অর্জুনও বড় স্ত্রীপ্রিয় মানুষ অর্থাৎ মেয়েরা তাকে যথেষ্টই ভালবাসে; অথচ এমনও নয় যে, অর্জুন সব সময় মেয়েদের সঙ্গে মেশার জন্য ছোঁক ছোঁক করছেন। আসলে তার স্বভাব, বীরত্ব এবং সম্পূর্ণ অভিব্যক্তির মধ্যেই এমন একটা ব্যাপার আছে, যেখানে প্রিয়ত্ব এবং দূরত্ব দুইই আছে। পণ্ডিতেরা পাশ্চাত্যের ‘মিথলজিক্যাল প্যাটার্ন’ মেনে অর্জুনের কথা উঠলেই ইন্দ্রের কথা তোলেন। বলেন– পুরাযুগের ইন্দ্রের গুণগুলি অর্জুনের মধ্যে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। ইন্দ্র বীর এবং স্ত্রীপ্রিয় দেবতা। তিনিই যেহেতু অর্জুনের জন্মদাতা পিতা হিসেবে চিহ্নিত অতএব অর্জুন পুরাকালিক ইন্দ্রের মহাভারতীয় সংস্করণ।
এ-সব বাঁধা গতের ওপর আমাদের আধুনিক শ্রদ্ধার অভিনন্দন রইল, কিন্তু এও বলি যে, ইন্দ্রের গুণগুলি অর্জুনের মধ্যে তেমন কিছু সংক্রান্ত হয়নি। বীরত্বের দিকে ইন্দ্র তো বারবার অসুরদের কাছে হারেন, কিন্তু যুদ্ধে অর্জুনের সমকক্ষ বীর তার কালে দ্বিতীয় নেই কেউ। আর স্ত্রীপ্রিয়তা! দেবরাজ ইন্দ্র প্রধানত কামুক এবং ধর্ষক হিসেবেই চিহ্নিত, সুন্দরী রমণীর সন্ধান পেলেই তাকে আমরা চঞ্চল দেখি আর এও জানি স্ত্রীলোকের জন্য যে পুরুষ বেশি ছোঁক ছোঁক করে, কোনও বিদগ্ধা রমণী তাকে প্রশ্রয় দেন না। প্রতিতুলনায় অর্জুনকে দেখুন। একমাত্র কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা ছাড়া অন্য সকল স্ত্রী-বিষয়েই তার একটা ‘হিরোয়িক আইসোলেশন’ আছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও রমণীর সঙ্গে তিনি সঙ্গত হননি, বরঞ্চ দেবসভায় উর্বশীকে তিনি যেভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তা তার জন্মদাতা পিতা ইন্দ্রেরও কল্পনার বাইরে ছিল, নৃত্যরতা উর্বশীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন বলেই ইন্দ্র আপন স্বভাবে বুঝে নিয়েছিলেন যে উর্বশীর সঙ্গে অর্জুনের মিলনের ব্যবস্থা করা দরকার। তার পরিকল্পনা খাটেনি এবং উর্বশী অভিশাপ দিয়েছিলেন।
লৌকিক দৃষ্টিতে সেই অভিশাপের ফল এত জোরদার নাও হতে পারে যাতে এক বছরের জন্য অর্জুন পুরুষত্ব হারিয়ে একেবারে নপুংসক হয়ে গেলেন। বরঞ্চ আমরা মনে করি– অর্জুনের মতো বীরের পক্ষে নপুংসকের আবরণটাই তো একটা চরম নপুংসকত্ব। তিনি অস্ত্র হাতে নেবেন না, বিরাট রাজার রাজধানীতে কোনও দিকে নজর দেবেন না, শুধু নাচ-গান নিয়ে থাকবেন– মহাভারতের কবি মহাবীরের এমন বঞ্চনা সহ্য করতে পারেননি বলেই সুরসুন্দরী উর্বশীর অভিশাপ সৃষ্টি করে রেখেছেন, যেন সাধারণ যুক্তিতে এটা কল্পনাও করা যায় না যে, মহাবীর অর্জুন হাতে চুড়ি পরে বেণী দুলিয়ে বিরাট রাজার ঘরে ঢুকছেন। বিরাটের কন্যান্তঃপুরে শুধু মেয়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন– এ-কথা ভাবতেও মহাভারতীয় ভাবুকের কষ্ট হয়। আর ওই বিরাট রাজার কথাই একবার ভাবুন– পাণ্ডব-ভাইদের চেহারা দেখে তারও বিশ্বাস হয়নি যে, তারা কেউ ভৃত্যবর্গের মানুষ, কিন্তু তাদের মধ্যেও অর্জুনকে দেখে বিরাট রাজা শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে।
বিরাট রাজা আর তার সভাসদ-সদস্যেরা প্রাচীরের পাশ বরাবর যাঁকে ঘুরে ফিরে বেড়াতে দেখলেন, তাকে তারা পুরুষ বলেই শনাক্ত করেছিলেন সে পুরুষ শুধু স্ত্রীলোকের অলঙ্কার পরে থাকে স্ত্রীণামলঙ্কারধরো বৃহৎ পুমা– তিনি যথেষ্ট দীর্ঘাকৃতি পুরুষ অর্থাৎ লম্বা মানুষের সুন্দর চেহারায় কানে দুটো বড় বড় দুল, হাতে শাঁখা, এবং দুই বাহুতে দুটি সোনার কেয়ূর। কিন্তু অলঙ্কার যতই পরে থাকুন, তাকে দেখে মহাবিক্রমশালী বলে মনে হচ্ছিল। বিশেষত তার লম্বা চেহারা এবং দৃপ্ত পদক্ষেপ, অথচ তারই সঙ্গে মাথার ওপর আলুলায়িত কেশরাশি– বহুংশ্চ দীর্ঘাংশ্চ বিমুচ্য মূর্ধজা। গতেন ভূমিমভিকম্পয়ংস্তদা– বিরাট রাজা অর্জুনকে দেখে যেমন বিভ্রান্ত হয়েছেন, তেমনই আকৃষ্ট বোধ করেছেন। লোক-জন ডেকে জিজ্ঞাসা করেছেন- লোকটা কে? আগে তো কখনও দেখিনি একে? লোকেরা বলল–আমরাও একে চিনি না, আগে দেখিওনি কখনও। বিরাট আরও বিভ্রান্ত হয়ে অর্জুনকেই ডেকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন– তোমার গায়ের রংটি কালো বটে, তবে হস্তিযুথের যুথপতির শক্তি তোমার গায়ে, অথচ দুটি শাঁখা আর কেয়ুর পরে চুল এলিয়ে দিয়েছ এমন! বড় অদ্ভুত লাগছে আমার বিমুচ্য কন্ধু পরিহাটকে শুভে। বিমুচ্য বেণীমপিনহ্য কুণ্ডলে। এর চাইতে তুমি যদি ভাল করে চুল বেঁধে কারণ, সেটাই যোদ্ধার লক্ষণ, সে চুল খুলে রাখে না– তাই চুল বেঁধে, ধনুক বাণ-ঢাল হাতে নিয়ে রথে করে ঘুরে বেড়াতে, তা হলে তোমাকে যেমন মানাত, এখন তেমন মানাচ্ছে না। আর দেখছই তো, আমি বুড়ো হয়ে গেছি, রাজ্য-টাজ্য আর আমার ভাল লাগে না। আমি মনে করি, তোমার সেই শক্তি আছে, যাতে এই মৎস্যদেশ তুমি শাসন করতে পারো। আর আমার দৃঢ় ধারণা, তোমার মতো মানুষ কখনও নপুংসক-ক্লীব হতে পারে না– নৈবংবিধাঃ ক্লীবরূপা ভবন্তি/কণ্বঞ্চনেতি প্রতিভাতি মে মতিঃ।
অর্জুনের চেহারা এবং ভাব-সাব দেখে বিরাট যে কিছুতেই তাকে ক্লীব বলে মেনে নিতে পারছেন না, সেটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু এই অবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে অর্জুনও কিন্তু নিজেকে আর ক্লীব বলে পরিচয় দিচ্ছেন না। তিনি বললেন– মহারাজ! আমি গান গাই, নেচে বেড়াই, বাজনা বাজাই– গায়ামি নৃত্যামথ বাদয়ামি– আমি নাচ-গানই ভালবাসি। আপনি আপনার মেয়ে উত্তরাকে আমার হাতে দিন, আমি তার নৃত্যগুরু হতে চাই– ত্বমুত্তরায়ৈ প্রদিশস্ব মাং স্বয়ম্। ভবামি দেব্যা নরদেব নর্তকঃ। বিরাটের কাছে অত্যন্ত সন্দিগ্ধ ছিল সেই ক্লীবত্ব এবং অর্জুনও সে-সম্বন্ধে দৃঢ়ভাবে কিছু বললেন না। শুধু জানালেন যে কারণে আমার এই ক্লীবত্ব, সেই কষ্টের কথা আপনাকে অবসর সময়ে বলব আমি। এখন শুধু এইটুকু জানুন– আমার নাম বৃহন্নলা এবং আমার পিতা-মাতা কেউ নেই। আমি আপনারই পুত্র বা কন্যা হতে পারি– সুতং সুতাং বা পিতৃমাতৃবর্জিতাম।
পুত্র বা কন্যা– অর্থাৎ সেই ধোঁয়াশাটা রয়েই গেল। বিরাট রাজাও উদার-হৃদয় মানুষ। অর্জুনকে দেখে তিনি এতই মুগ্ধ যে, বেশি কথা না বলে অর্জুনকে তিনি আশীর্বাদের সুরে বললেন– তোমাকে আমি বর দিলাম, বৃহন্নলা! আমার মেয়েকে তুমি নৃত্যশিক্ষা দাও ইচ্ছেমতো। কিন্তু ব্যাপারটা আমি পছন্দ করতে পারলাম না। এটা তোমার কাজ নয় বাপু, অস্ত্র হাতে নিলে তুমি এই পৃথিবী জিতে আনতে পারো। তবু তুমি যখন ইচ্ছে করছ– আমার মেয়ের নৃত্যগুরু হবে তুমি তখন তাই হোক; তুমি আমার মেয়ে এবং তার অন্য সমবয়সি বন্ধুদের নাচই শেখাও সুতাঞ্চ মে নর্তয় যাশ্চ তাদৃশীঃ। কথ্য ভাষার মতো এই মহাভারতীয় শব্দটা একেবারে মর্মে এসে লাগে– নাচাও তুমি, আমার মেয়েকে নাচাতে থাকো– সুতাঞ্চ মে নর্তয়।
অর্জুনের ক্লীবত্বের একটা পরীক্ষা হল বটে, তবে সে পরীক্ষা খুব কঠোর সত্য যাচাই করবার জন্য নয়। বিরাট বোধহয় অর্জুনের নপুংসকোচিত ভাব-সাবগুলি পরীক্ষা করলেন এবং খুব ভাল করে শুনলেন অর্জুনের নপুংসকত্ব-লাভের কাহিনিটি- অপুংস্ত্বমপ্যস্য নিশম্য চ স্থিরং– আর দেবলোকের সেই কাহিনি শুনেই অর্জুনের কথা বিশ্বাস করে নিলেন সরলহৃদয় বিরাট। অর্জুনের স্থিতি হয়ে গেল বিরাট রাজার কন্যান্তঃপুরে যেখানে কুমারী উত্তরা তার সমবয়সি সখীদের নিয়ে অবস্থান করেন।
সেকালের এই কন্যান্তঃপুর বড় বিচিত্র জায়গা। এখানে পুরুষ মানুষেরা সচরাচর আসে না, এমনকী বয়স্কা মহিলারা মেয়েদের মা বা অন্যান্য কেউও কৈশোরগন্ধী অথবা যৌবনগন্ধী বালিকাদের স্বাতন্ত্রে ব্যাঘাত ঘটায় না। নিরাপত্তার কারণে মন্ত্রী-অমাত্যদের মধ্যে যাঁরা কিঞ্চিৎ ভীরু প্রকৃতির অর্থাৎ যে-সমস্ত মন্ত্রী-অমাত্যরা তেমন ডাকাবুকো বা দাপুটে নন এবং যাদের মানসিকতায় রাজপুত্রী বা তার সখী-সহচরীদের শ্লীলতাহানির সম্ভাবনা থাকত না, সেইসব পুরুষই কন্যান্তঃপুরে মাঝে মাঝে প্রবেশ পেতেন এবং তারাই অনীতি পুরুষের দুরভিলাষ থেকে রক্ষা করতেন মেয়েদের। বিরাট রাজার গৃহে কন্যান্তঃপুরের সুরক্ষা-প্রযুক্তি কেমন, মহাভারতে তার তেমন কোনও স্পষ্ট বর্ণনা নেই। তবে এটা অবশ্যই বোঝা যাচ্ছে যে, অর্জুন এই অন্তঃপুরে কোনও অনভীষ্ট ব্যক্তিত্ব নন, কারণ প্রথমত অর্জুন এক অসাধারণ নৃত্যগুরু হিসেবে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। দ্বিতীয়ত তার হাব-ভাব, ক্রিয়াকলাপ সব নপুংসকের মতো, তৃতীয় মহারাজ বিরাট তাকে নিয়োগ করেছেন আপন কন্যার নৃত্যশিক্ষার আচার্য হিসেবে।
অর্জুন যেদিন বিরাট রাজার কন্যান্তঃপুরে প্রথম প্রবেশ করলেন, সেদিন তাকে দেখে কৈশোরগন্ধী বয়সের সেই মেয়ের কেমন লেগেছিল, কতটা শ্রদ্ধায়, কতটা দূরত্ব থেকে তাকে দেখেছিলেন উত্তরা, মহাভারতের কবি সেই বর্ণনার মধ্যে যাননি। মহাভারতের বিশাল কর্মকাণ্ড, উত্তরোত্তর ঘটনা-পরম্পরার মধ্যে উত্তরাকে নিয়ে তার নিভৃতে বসার উপায় ছিল না। আমরা শুধু এইটুকু জানতে পারলাম যে, অর্জুন বিরাট রাজার কন্যান্তঃপুরে বিরাট-সুতা উত্তরাকে নৃত্য-গীত শিক্ষা দিতে লাগলেন, উত্তরার সঙ্গে তার সখীরাও অর্জুনের কাছে নৃত্য-গীত বাদ্যের পাঠ নিতে লাগল এবং কিছুদিনের মধ্যেই পাণ্ডব অর্জুন তাদের কাছে বেশ প্রিয় হয়ে উঠলেন– প্রিয়শ্চ তাসাং স বভূব পাণ্ডবঃ। পরবর্তী শ্লোকে এই কথাটাই বড় হয়ে উঠেছে যে, মেয়েদের শিক্ষা দেবার এই আচ্ছাদন নিজের ওপরে ঘনিয়ে নিলেন অর্জুন, তাতে অজ্ঞাতবাসের এই ছলনাটুকু বিরাট-রাজধানীর ঘরে বাইরে কেউ বুঝতে পারল না। অর্থাৎ অজ্ঞাতবাসের ভাবনায় অর্জুন এখন বেশ সুরক্ষিত, তাঁকে নিয়ে কোনও চিন্তা রইল না। এই একই শ্লোকের মধ্যে আরও একটি অর্ধপক্তির সংযোজন আছে। সেটা হল– মেয়েদের নৃত্যগুরু অর্জুন কিন্তু তার ছাত্রীদের মন জয় করে নিয়েছিলেন তাদের প্রিয়কার্য সম্পাদন করে এবং এই স্ত্রী-ব্যাপারে তার ধীরতার হানি ঘটেনি কখনও– তথা চ সত্ৰেণ ধনঞ্জয়োেহবসৎ/প্রিয়াণি কুৰ্বন সহ তাভিরাত্মবান।
যে অবস্থায় ধনঞ্জয় অর্জুন বিরাট রাজার কন্যান্তঃপুরে প্রবেশ করলেন, সেদিন সেই অন্তঃপুরের মেয়েগুলি তাকে কেমন চোখে দেখল, বিরাট-নন্দিনী উত্তরাই বা তার নপুংসক গুরুকে কীভাবে, কোন দৃষ্টিতে গ্রহণ করলেন, সেটা দেখানো মহাকাব্যের কবির দায় নয় বলেই আমরা এই সব জায়গায় কেমন যেন মর্মান্তিক শূন্যতা বোধ করি। তবে কিনা আমরা তো বড় ক্ষুদ্রমনা মানুষ, ‘ভিকটোরিয়ান রোমান্টিসিজম’ এ-দেশে পয়দা হবার পর থেকেই আমাদের নিপুণ বুদ্ধিজীবিতা মহাকাব্যের কবির বৃহদাশয় বুঝতে পারে না। মনুষ্য-হৃদয়ের গহনে ক্ষণিক বা তাৎক্ষণিক যে-সব পদসঞ্চার ঘটে, তাই নিয়ে মাথা ঘামিয়ে মহাকাব্যের কবি মুখ্য বস্তুর বহতা স্বভাব আহত করেন না। তার কাজ ছিল অজ্ঞাতবাসী অর্জুনকে সযৌক্তিকভাবে বিরাটের কন্যান্তঃপুরে পৌঁছে দেওয়া। তিনি সেটা করার পরে সাধারণ মন্তব্যে অর্জুনের কর্মকাণ্ড এক লাইনে শেষ করে দিয়েছেন তিনি বিরাটনন্দিনী উত্তরাকে গান শেখাচ্ছেন, বাজনা শেখাচ্ছেন, নাচ শেখাচ্ছেন, উত্তরার সঙ্গে তার সখীরাও অর্জুনের কাছ থেকে পাঠ নিচ্ছে- স শিক্ষয়ামাস চ গীত-বাদিতং। সুতাং বিরাটস্য ধনঞ্জয়ঃ প্রভু। অর্থাৎ নাচের গুরুমশাই নাচ-গান শেখানোর কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করছেন, আর অর্জুন সেটা এতই ভাল করছিলেন– মহাকাব্যের কবির গৌণ বস্তুর প্রতি মেদবর্জিত মন্তব্য– অর্জুন কিছু দিনের মধ্যেই অন্তঃপুরচারিনী কন্যাদের বড় প্রিয় হয়ে উঠলেন।
ঠিক এইখানেই একবিংশ শতাব্দীর দ্বন্দ্বজড়িত মনের মধ্যে জল্পনা শুরু হয়– কেমন এই প্রিয়ত্ব। কেমন দেখতে ছিলেন কুমারী উত্তরা? কত বয়স তার? অর্জুন যে নিজেই বিরাট রাজার কাছে এই মেয়েটিকে প্রিয়শিষ্যা হিসেবে চেয়ে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন– আমাকে আপনার মেয়ের কাছে নৃত্যগুরুর মর্যাদায় স্থাপন করুন– হুম উত্তরায়ৈ প্রদিশস্ব মাং স্বয়ম্। স্বয়ংবৃত আচার্যত্বের এই ভূমিকায় থেকে কোন মন্ত্রগুণে অর্জুন এতগুলি মেয়ের প্রিয় হয়ে উঠলেন– এই সব গৌণ সংবাদ মহাকাব্যের কবির প্রবাহিনী লেখনীতে এতটুকুও ধরা পড়ে না। কিন্তু তিনি শব্দের ইঙ্গিত রেখে যান এখানে-ওখানে, তাও এমন শব্দ যা স্পষ্ট করে কিছুতেই বোঝাবে না যে, মহাকবি তাই বলছেন, যা আমি ভাবছি। বরঞ্চ তিনি বলবেন– অন্যের, অন্য চরিত্রের শব্দগ্রন্থির আবরণে, ব্যঞ্জনায়।
ভবিষ্যতে বিরাটনন্দিনী উত্তরাকে আমরা যেমনটি দেখতে পাব, তাতে অনুমান করতে পারি– এখন তিনি নেহাত কিশোরীটি নন। রাজবাড়ির মেয়ে বলে কথা, আদরে আহ্লাদে এখনও তার পুতুলের সংসার সাজানোর অভ্যাস যায়নি। কিন্তু এই অর্জুন যখন প্রবেশ করেছেন অন্তঃপুরে, তখন তিনি কিশোরীর অবভাস কাটিয়ে যৌবন-সন্ধিতে উপস্থিত হয়েছেন অবশ্যই। জয়পুর-ভরতপুর-আলোয়ার অঞ্চলের মেয়ে, তার শারীরিক সৌন্দৰ্য্য শব্দ তাৎপর্যে বর্ণনা করা মুশকিল। তবে এই মুহূর্তে তার কোনও বর্ণনাও কবি দেননি। যাতে আমরা অযথা কোনও সম্পর্ক তৈরি না করি, সেই কারণেই বিরাট নগরে অর্জুনের প্রবেশ ঘটার পর থেকে আমরা একটি ক্ষুদ্র নৃত্যগীতের আসরও দেখিনি, যেখানে অর্জুন উত্তরাকে নৃত্য-গীত-বাদিত্রের একটাও পাঠ দিচ্ছেন। অথবা একদিনও দেখলাম না বিরাট নন্দিনী উত্তরাকেও, যেদিন তিনি নিবিষ্ট প্রিয়শিষ্যার মতো ললিতকলার পাঠ শিখছেন অর্জুনের কাছে। পতাক, ত্রিপতাক, অর্ধচন্দ্রকের একটি শব্দও উচ্চারিত হতে দেখলাম না অর্জুনের ভঙ্গিমায়, উত্তরাকেও কোনওদিন জিজ্ঞাসা করতে দেখলাম না মুষ্টিক শিখর অথবা কপিখ-তাম্রচূড়কের রহস্য।
অথচ এইসব জিজ্ঞাসা, পরিশ্ন, উত্তর এবং এক-একটি প্রত্যঙ্গ-মুদ্রা প্রদর্শন, ‘ডিমনস্ট্রেশন’-এর জন্য অর্জুনকে কিছু-না-কিছু করতেই হয়েছে। বার বার স্পর্শ করতে হয়েছে উত্তরার শরীর, বারবার ঠিক করে দিতে হয়েছে করাঙ্গুলির সংস্থান, হস্ত-মণিবন্ধ থেকে জানু-জঘন-পন্যাসের বিপরিবর্তন। মনে আছে সেই কবির কথা, যিনি নৃত্যারম্ভে হর-পশুপতির প্রশিক্ষণ-অভ্যাস শুনিয়েছিলেন আমাদের। পার্বতাঁকে নাচের পাঠ দেবার সময় শিব বলছেন– আরে না, না, অমন নয়, তুমি হাতটা বাড়াও এইভাবে, হা হা, দাঁড়িয়ে পড় এবার এই ‘পজিশনে। ওঃ হোঃ হাতটা অত উঁচু করছ কেন, আরও একটু নীচ, আরে পায়ের গোড়ালি তুলে শুধু অগ্রচরণের আঙুলগুলোর ওপর দাঁড়াও হচ্ছে না, হচ্ছে না আমার দিকে তাকাও, দেখ আমি করছি– নাতুচ্চৈনৰ্ম কুঞ্চিতাচরণং মাং পশ্য তাবৎ ক্ষণম্।
আমরা বলি– হ্যাঁ, এমন অসংশ্লিষ্টভাবেও একটু দূর থেকে নাচ শেখানো যায়। কিন্তু এখানে নৃত্যের পাঠ দিচ্ছেন নৃত্যশিক্ষার জনক তাণ্ডবী শিব, আর যাকে শেখাচ্ছেন, তিনি নৃত্যশিক্ষার জননী লাস্যময়ী পার্বতী। এঁরা বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী, ফলে এতদিনে নাচ শেখানোর জন্য আর হাতে ধরে অঙ্গুলি-মুদ্রা ঠিক করে দিতে হয় না, ঠিক করে দিতে হয় না কটিভঙ্গের কৌশল। কিন্তু এখনও যাঁরা ভারতীয় নৃত্য শেখান– ভরতনাট্যম, কুচিপুরি অথবা মোহিনী আট্টম– তাঁদের অনেককেই দেখেছি গুরুরা স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে কাছে এসে শিষ্য শিষ্যাদের জানু-জঘন-কটি-পৃষ্ঠের বিভঙ্গ পরিশোধন করেন নিজের হাতে। হয়তো নিতান্ত অনাসক্তভাবেই করেন, কিন্তু এই ধরনের অঙ্গস্পর্শে আচার্য এবং যুবতী শিষ্যার সামান্যতম বিকারও কখনও হয় না– একথা নীতিগতভাবে স্বীকার্য না হলেও মন বড় জটিল স্থান, সেখানে কখন কার নিঃশব্দ পদসঞ্চার ঘটে, তা শুধু মনই জানে। জানে গুরুর মন, শিষ্যার মন, মনে যদি বা কিছু হয়, বুদ্ধি সেটা শোধন করে, তবু সেই ক্ষণটুকু মিথ্যে হয় যায় না।
অন্তঃপুরে থাকার কালে অর্জুনকে আমরা বিশেষ বাইরে বেরোতে দেখিনি খুব একটা। এ-বিষয়ে তার স্বাধীনতা ছিল না, তা নয়। ভীম যুধিষ্ঠির, নকুল-সহদেব সব ভাইদেরই আমরা প্রকাশ্যে বিচরণ করতে দেখেছি। এমনকী দ্রৌপদীকেও প্রতিদিন বিরাট রাজার চন্দন-বিলেপন নিয়ে অন্তঃপুর থেকে রাজসভার প্রসাধন-কক্ষে যেতে দেখেছি আমরা। কিন্তু অর্জুন! তিনি সেই যে উত্তরার নৃত্যশিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে বিরাট রাজার কন্যান্তঃপুরে প্রবেশ করলেন, আর তাকে একবারও বাইরে বেরোতে দেখলাম না। নপুংসক অথবা নপুংসকবেশি অর্জুনের বহিস্টারিতায় তো বাধা ছিল না কোনও। হ্যাঁ একটা খবর অবশ্যই আছে যে, পাণ্ডব-ভাইরা যে-যেখানে যেমন গোপনেই থাকুন, তারা নিজেদের লব্ধ অর্থ একে অপরকে দিতেন গোপনে। এমনকী বিক্রয়ের ছলে ভীম বিরাট রাজার রন্ধনশালার ভক্ষ্য ভোজ্য যুধিষ্ঠিরকে দিতেন, অথবা অর্জুন নাচঘরের পুরনো বর্জিত কাপড়-জামা ভাইদের দিতেন, অথবা গোপালক সহদেব ভাইদের দুধ-দই খাওয়াতেন– এ-সব খবর আমরা পাই বটে, কিন্তু অর্জুনের সম্বন্ধে এইরকমই প্রচার শুনতে পাই যে, তিনি কন্যান্তঃপুরের বাইরে খুব একটা যাতায়াত করতেন না।
এটা মানতেই হবে যে, যথেষ্ট কর্তব্যবুদ্ধিতে নিজের কাজটা খুব ভালভাবেই করছিলেন অর্জুন। কর্মের দায় এবং কর্তব্যগুলি ভাল না লাগলেও যে মানুষ সানন্দে সেগুলি সম্পাদন করে, সেই বুদ্ধিমান মানুষ দায় এবং কর্তব্যের মধ্যেই নিজের পরিবেশ তৈরি করে নেয়। এই ব্যাপারটা নিতান্ত নিরাসক্তভাবেই এমন সুষ্ঠুভাবে করেছিলেন অর্জুন যে অন্তঃপুরের মেয়েরা অতি অল্পকালের মধ্যেই তাঁকে বড় প্রিয় ভাবতে আরম্ভ করেছে। স্ত্রীপ্রিয়তা অথবা নায়কত্বের সমস্ত গুণই অর্জুনের মধ্যে থাকায় বিরাট রাজার অন্তঃপুরে প্রিয় হয়ে উঠতে তাঁর সময় লাগেনি বটে, কিন্তু যৌবনসন্ধিস্থিতা রমণীদের প্রিয়ত্বের অবগুণ্ঠনে থেকেও অর্জুন নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি। আবার দায় পূর্ণ করে কন্যা রমণীদের নৃত্যগীত শেখাতে শেখাতে বাইরে বেশি না বেরোনোটাও তিনি রপ্ত করে ফেলেছিলেন।
কন্যান্তঃপুরের অবগুণ্ঠনের মধ্যে তার এই লুকিয়ে থাকার অভ্যাসটা কিন্তু তার পরিণীতা স্ত্রী দ্রৌপদীও খুব একটা পছন্দ করেননি। ভীম-যুধিষ্ঠির, নকুল-সহদেব কারও সম্বন্ধে দ্রৌপদীর কোনও ঈর্ষা-অসূয়া ছিল না, কিন্তু অর্জুন, মহাবীর অর্জুন অন্তঃপুরের মধ্যে নৃত্যশিক্ষা দিচ্ছেন– এই ক্লীবতা তাকে যত না দুঃখ দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি তিনি ঈর্ষান্বিত হয়েছেন এই ভাবনায় যে, অর্জুন বিরাট রাজার অন্তঃপুরে কন্যাদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে আছেন– কন্যাপরিবৃতং দৃষ্টা ভীম সীদতি মে মনঃ। গাণ্ডীবধন্বার হাতে বলয়– কেয়ুর, স্ত্রীলোকের ধার্য্য অলংকারে তার শারীরিক শোভা দ্রৌপদীকে অবসন্ন করে, কিন্তু অন্তঃপুরের মধ্যেই সহবাসের পরিচয়বশে অল্পবেশি মেয়েরা যখন বয়োজ্যেষ্ঠ অর্জুনের কাছে বায়না করে, অকল্পনীয় প্রার্থনা করে, তখন দ্রৌপদীর মনে হয় তিনি অন্তঃপুরের মেয়েদের পরিচারক হয়ে গেছেন– আস্তে বেশ-প্রতিচ্ছন্নঃ কন্যানাং পরিচারকঃ।
দ্রৌপদী এসব দুঃখের কথা জানাচ্ছিলেন তার মধ্যম স্বামী ভীমকে। বিরাট রাজার সেনাপতি কীচকের কামৈষণায় দ্রৌপদী যখন বিপন্ন বোধ করছেন, তখন তিনি রাত্রির অন্ধকারে ভীমের কাছে এসে নিজের অনন্ত দুর্গতির কথা জানাচ্ছিলেন। অথচ এই সময়ে অর্জুনের কাছে তার আসাটা অনেক সমীচীন ছিল সম্মান বাঁচানোর জন্য অথবা প্রাণ বাঁচানোর জন্য একজন স্ত্রীলোক বিরাটের কন্যান্তঃপুরে প্রবেশ করছে এবং একজন স্ত্রী প্রতিম নপুংসকের সঙ্গে কথা বলছে– দ্রৌপদীর পক্ষে তাই অর্জুনের কাছে আসাটাই অনেক সহজ হত এবং অজ্ঞাতবাসে ছদ্মবেশের সমস্ত অজ্ঞাতচর্যা তা হলে অনেক সদর্থকও হয়ে উঠত। দ্রৌপদী নিজেই অর্জুনের সম্বন্ধে বলেছেন– স্ত্রীবেশে বিকৃত অর্জুনকে দেখে আমর মন কেমন করে স্ত্রীবেশ-বিকৃতং পার্থং দৃষ্টা সীদতি মে মনঃ। অথচ আসন্ন বিপদের সময় সেই স্ত্রীবেশী অর্জুনের কাছে তিনি যাননি। মন অবসন্ন, দুঃখিত বলে যাননি–এটা যতখানি তার চেয়ে অনেক বেশি ঈর্ষা কাজ করেছে তার মনে। তার প্রমাণ আছে উপরি উক্ত শ্লোকের পরবর্তী ভাষার মধ্যে। তিনি ভীমকে বলেছেন– আমি যখন হস্তিনী-পরিবৃত মদাবী হস্তীর মতো দেবরূপী অর্জুনকে কন্যাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখি– যদা হ্যেনং পরিবৃতং কন্যাভির্দেবরূপিণম– তখন যেন আর সইতে পারি না, আমার চোখটা যেন নষ্ট হয়ে যায়– দৃশশা নশ্যন্তি মে তদা।
ভীমের কাছে উদগার করবার সময় অর্জুনের জন্য যত শ্লোক দ্রৌপদী খরচ করেছেন, তার মধ্যে বারবার এই শব্দটা বড় হয়ে উঠেছে যে, অর্জুন কনা-পরিবৃত হয়ে বেশ মজায় আছেন- সোহদ কন্যাপরিবৃতা গায়ন্নাস্তে ধনঞ্জয়ঃ। অর্জুন কতখানি মজায় ছিলেন আমাদের জানা নেই, অথবা মজায় ছিলেনও হয়তো কেননা থাকতেই হবে যেখানে সেখানে রসেবশে থেকে কার্যোদ্ধার করাই ভাল– এই নীতিতে বীর ধনুষ্কের সমস্ত স্বপ্ন পরিহার করে নাচে-গানে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু বিরাটের মেয়েকে অথবা আরও অন্যান্য মেয়েদের তিনি নৃত্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন নৃত্যগুরুর সাধারণ প্রশিক্ষণ-নৈকট্য বজায় রেখে, এই নৈকট্য দ্রৌপদীর ভাল লাগেনি। দ্রৌপদী তো কোনওভাবেই অর্জুনকে নপুংসক ভাবতে পারেন না। তার অন্তত মনে আছে যে, একবার তার চোখের আড়াল হতেই উলূপী, চিত্রাঙ্গদা এবং সুভদ্রার প্রণয়-পক্তি কতটা গ্রাস করেছিল অর্জুনকে। তাঁকে তো এখনও তিনি যুবক বয়সি অর্জুনই ভাবেন– মেয়েদের সর্ব অর্থেই নাচাতে পারেন এমন যুবক– কন্যানাং নর্তকো যুবা– কিন্তু এতকালে অর্জুন কতটা নাচছেন, এ বিষয়ে দ্রৌপদীর নিতান্ত একপেশে এবং পূর্বাবস্থিত ধারণা থাকলেও এটা অবশ্যই ঠিক যে, মেয়েরা তাকে খুব একটা ছাড়তে চাইত না, বিশেষত উত্তরা, কুমারী উত্তরা দ্রৌপদীর মনে এক ধরনের সন্দেহ-দ্বন্দ্ব তৈরি করে।
সেই কীচকের যখন প্রাণান্ত ঘটল ভীমের হাতে, কীচকের ভাইরাও মারা গেল, তখন দ্রৌপদী নগরে ফিরে এসে কীচক এবং উপকীচকদের হস্তস্পর্শ প্রক্ষালণ করেছিলেন অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে। তারপর একবার বেরিয়ে সর্বরক্ষক ভীমকে অন্তরের ধন্যবাদ জানিয়ে সাভিমানে ঢু মেরেছিলেন ধনঞ্জয়ের নর্তনাগারে। তিনি দেখলেন–অর্জুন নির্বিকার, এত বড় যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। এত বড় যে একটা স্রোত বয়ে গেল তার ওপর দিয়ে অথচ অর্জুন সব জানেনও এমনকী তার নটী শিষ্যারাও সব জানে– অর্জুনের মনের মধ্যে কোনও আতঙ্কিত শিহরণ তৈরি হয়নি দ্রৌপদীর জন্য। অন্তত দ্রৌপদীর তাই মনে হয়, তিনি দুঃখিত, আহত বোধ করেন। অর্জুন অবশ্য খুব ভালভাবে জানেন যে, ভীম দ্রৌপদীর পিছনে আছেন এবং উদ্ধারকর্তা হিসেবে তার কোনও জুড়ি নেই। বরঞ্চ এই স্ত্রীবেশে যদি কীচক, উপকীচকদের বধ করতে হত, তাতে অজ্ঞাতবাসের শর্তহানি হলে বিপদ আরও বাড়ত।
যাই হোক, এগুলো অন্তত আর্তা, বিপন্না দ্রৌপদীর যুক্তি নয়। তিনি ভীমের রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে বিরাট রাজার নর্তনাগারে প্রবেশ করলেন এবং দেখলেন ধনঞ্জয় অর্জুনকে। ভাল লাগল না দ্রৌপদীর, নিশ্চয়ই ভাল লাগল না। তিনি দেখলেন– নিরুদ্বেগ-চিত্তে বিরাট রাজার মেয়েদের নৃত্যশিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন রাজ্ঞঃ কন্যা বিরাটস্য নর্তয়ানং মহাভুজ। চতুর-মধুর মহাকাব্যের কবি একবারও বিরাট-নন্দিনী উত্তরার নামও করলেন না। কিন্তু ভাবে বুঝি– উত্তরাকে নৃত্যশিক্ষা দেওয়াই তো অর্জুনের প্রধান লক্ষ্য ছিল, তাঁকেই তো তিনি শিষ্যা হিসেবে চেয়ে নিয়েছিলেন বিরাটের কাছ থেকে। আজ দ্রৌপদীর সামনে তাকে কন্যামণ্ডলীর মেলায় মিশিয়ে রেখে মহাকাব্যের কবি নৈতিকতার সমস্ত মানগুলি বজায় রেখে দিলেন। দ্রৌপদীকে দেখেই কন্যান্তঃপুরের কন্যারা সদলে বেরিয়ে এল নর্তনাগার থেকে, সঙ্গে অর্জুন– কন্যা দদৃশুরায়ান্তীং… বিনিম্য সহাৰ্জুনাঃ। এখানে অর্জুনকে সহ স্থানে রেখে কন্যারা বেরিয়ে এলেন, এই কর্তৃকারকের মধ্যে অর্জুনের গৌণতা স্থাপন। করার মধ্যেও মহাকাব্যের কবির ইঙ্গিত আছে। অর্জুনের নিঃস্পৃহতা দেখানোই অবশ্য এখানে প্রধান ইঙ্গিত নয়, বরঞ্চ ইঙ্গিত হল– অর্জুনের নাচের মেয়েরা যা করছে, অর্জুন তাদের সঙ্গে গৌণ ভূমিকায় তাই করছেন। বিরাট-ঘরের মেয়েরা অর্জুনকে নিয়ে বেরোল দ্রৌপদীকে স্বাগত জানাতে এবং তারাই প্রথমে বলল– ভাগ্যিস তুমি দুষ্টু লোকেদের হাত থেকে বেঁচ্ছে, সেই কারণেই আবার তোমায় দেখতে পেলাম। তোমার কোনও অন্যায় না থাকা সত্ত্বেও যারা তোমার প্রতি হিংসার আচরণ করেছে, তারা মারা গেছে ভাগ্যিস!
দ্রৌপদী মেয়েদের কথার কোনও উত্তর দেননি, তার আগেই প্রশ্ন করেছেন ক্লীববেশী অর্জুন। অর্জুন বলেছেন– কেমন করে তুমি এই বিপদ থেকে বাঁচলে, কেমন করেই বা ওই বদমাশ লোকগুলো মারা পড়ল, বল তো গুছিয়ে, আমাদের সব শুনতে ইচ্ছে করছে। দ্রৌপদী এই প্রশ্নেরও যথাযথ কোনও উত্তর দেননি। বরঞ্চ উত্তরে ভেসে উঠেছে সেই চরম অভিমান সৈরিন্ধ্রীর কি বিপদ হল না হল, সেসব দিয়ে তোমার কাজ কি বৃহন্নলা? বেশ তো আছ, মেয়েদের মধ্যে বেশ সুখেই তো দিন কাটছে তোমার– যা ত্বং বসসি কল্যাণি সদা কন্যাপুরে সুখ।
‘মেয়েদের মধ্যে’– এই কথাটা বোধহয় গৌরবে বহুবচন। তার তুলনায় উত্তরা এতই ছোট এবং সকলের মাঝে তাকে আলাদা করে সন্দেহ করলে দ্রৌপদীর মান কিছুমাত্র বাড়ে না বলেই বিদগ্ধা দ্রৌপদীর মুখে এমন সাভিমান সংকেত। তবু আমরা উত্তরার কথা একেবারেই স্পষ্ট করে জানি না, কিন্তু দ্রৌপদীর মুখে অর্জুন সম্বন্ধে বারংবার এই অভিমানী ভাষণ আমাদের মধ্যে নিরুচ্চার এক সংকেত পৌঁছে দেয় এবং সে-সংকেত আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে পূর্বশেষে যখন কুমার উত্তর যুদ্ধে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
কৌরবযোদ্ধারা যখন বিরাট রাজার গোধন হরণ করে নিয়ে গেছেন, তখন মহারাজ বিরাট অন্যত্র যুদ্ধকার্যে ব্যাপৃত। তিনি রাজধানীতে নেই। নগর রক্ষক লোকজন কুমার উত্তরকে জানাল– কৌরবরা আমাদের হাজার হাজার গোরু নিয়ে গেছে, আপনি যুদ্ধে যাবার উদ্যোগ করুন কুমার! রাজার অনুপস্থিতিতে আপনিই এখানকার রক্ষক রাজা। মহারাজ বিরাটও আপনার যুদ্ধনৈপুণ্যের কথা বারবার বলেন। অতএব কুমার! এই সেই সময়, যখন আপনি আপনার যুদ্ধনৈপুণ্য দেখিয়ে সমস্ত দেশবাসীর আশ্রয় হয়ে উঠতে পারেন।
মুশকিল হল, নগরপাল যখন এসে উত্তরকে এই পশুহরণের সংবাদ দিয়েছিল, কুমার উত্তর তখন অন্তঃপুরে মেয়েদের মধ্যে বসেছিলেন। মেয়েদের সামনে কোনও ভীরুতা প্রকট না হয়ে যায়, এই ভাব প্রকাশ করেই উত্তর বলেছিলেন– আমি অবশ্যই যুদ্ধে যেতে পারি, কিন্তু একটা ভাল সারথি না থাকায় আমি মুশকিলে পড়েছি– যদি মে সারথিঃ কশ্চিদ ভবেদশ্বেষু কোবিদ। সেই যে মাসখানেক ধরে যে বড় যুদ্ধটা হয়েছিল, তাতে আমার সারথিটি মারা গেছে। কিন্তু আমার ঘোড়াগুলো চালাতে পারে এমন একজন লোকও আমি দেখছি না। রথের ঘোড়া বোঝে এমন একটা লোক পেলে আমি আমার ধ্বজা উঁচিয়ে যুদ্ধে যাব। কৌরবদের মনে আসবে যে, তারা কার সঙ্গে যুদ্ধ করছে, মার খাওয়ার পর মনে হবে– এটা অর্জুন এল নাকি?
মেয়েদের সামনে উত্তর অনেক নরম-গরমকথা বলছেন। নিজের সঙ্গে অর্জুনের তুলনা শুনেই দ্রৌপদীর গা পুড়ে গেল, তবু মুখের মধ্যে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব ঘনিয়ে এনে উত্তরকে বললেন রাজপুত্র! বৃহন্নলা নামে এখানে সবাই যাকে চেনে, সেই মহাহস্তিতুল্য অত্যন্ত প্রিয়দর্শন ওই যে যুবক যোহসৌ বৃহদারণাভো যুবা সুপ্রিয়দর্শনঃ–ও কিন্তু আগে অর্জুনের সারথি ছিল। ও যুদ্ধও ভাল জানে, অর্জুনের কাছেই যুদ্ধবিদ্যা শিখেছে। ওর মতো সারথি তুমি এই তল্লাটে খুঁজে পাবে না–ন যন্তাস্তি তাদৃশঃ।
অন্তত দুইবার দ্রৌপদীর মুখে এই স্পষ্ট উচ্চারণ– অর্জুন এক নর্তক যুবা– কন্যানং নর্তকো যুবা, আবারও এখন– যুবা সুপ্রিয়দর্শনঃ– তা হলে কি স্ত্রীবেশী অর্জুনকে যুবক পুরুষের মতোই দেখাত। অন্তত সেই বেশের মধ্যেও অর্জুন যে তার যুবক চেহারাটা লুকোতে পারতেন না– সেটা কী অন্তত মেনে নেব। দ্রৌপদীর মুখে এর পরের প্রস্তাবটা আরও সাংঘাতিক। কুমার উত্তর দ্রৌপদীর মুখে বৃহন্নলার কথা শুনে যদি তাকেই বলেন, কিংবা অন্য কাউকেও বলেন যে ডেকে দাও তবে বৃহন্নলাকে, তাকেই আমি সারথি করে নিয়ে যাব– তা হলে দ্রৌপদী এতটুকুও ভরসা পাচ্ছেন না। কিন্তু অন্তঃপুরগত অর্জুনকে উত্তরার নৃত্যগুরু হিসেবে তিনি যতটুকু চিনেছেন, সেই দৃষ্টি মাথায় রেখে দ্রৌপদী বললেন– এই যে তোমার ছোট বোনটি আছে, কুমারী উত্তরা– যেয়ং কুমারী সুশ্রোণী ভগিনী তে যবীয়সী– সেই সুনিতম্বা উত্তরাকে তুমি বল– অর্জুনকে যাতে সে তোমার সারথি হতে অনুরোধ করে।
কুমার উত্তর অন্তঃপুরে বসে কথা বলছিলেন, সেখানে যেমন দ্রৌপদী ছিলেন, তেমনই ছিলেন উত্তরাও। দ্রৌপদী উত্তরাকে দেখিয়েই অর্জুনকে ডেকে আনার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সর্বশেষে জানিয়েছেন আপন প্রত্যয়ের কথা। দ্রৌপদী বলেছেন– উত্তরা যদি বৃহন্নলাকে একবার অনুরোধ করে, তবে সেই মহাবীর তার কথাটা একেবারেই ফেলবে না বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস– অস্যাঃ স বীরো বচনং করিষ্যতি ন সংশয়ঃ।
এই প্রথম অন্যান্য কন্যাকুলের মধ্য থেকে উত্তরার পৃথকীকরণ ঘটল দ্রৌপদীর বাক্যে, তাও এমন একটা প্রত্যয়ের মাধ্যমে যা আমাদের আগে জানা ছিল না। অর্জুন উত্তরার কথা ঠিক শুনবেন, তার কথা তিনি ফেলতে পারবেন না– এই কথা দ্রৌপদীর মুখে যখন শুনতে পাই, তখন হঠাৎই এই প্রিয় শিষ্যার কোমল অন্তর-তন্তুগুলি আমাদের কাছে নতুন বিধানে ধরা দেয়। এই প্রথম উত্তরার এক প্রত্যঙ্গ-বৈশিষ্ট্য– সুশ্রোণী, দ্রৌপদীর মুখে উচ্চারিত হয় এবং এই প্রথম আমরা বুঝতে পারি– এতদিন নৃত্যশিক্ষার আসরে অর্জুনের সহবাস নিতান্ত উদাসীন হলেও এই নৈকট্য, শিক্ষা চালনার সৌকর্যের জন্য দৈনন্দিন কর-চরণ স্পর্শ এবং স্ত্রীবেশ-বিকৃত বৃহন্নলার মধ্যেও মহাবীর অর্জুনের আঙ্গিক প্রতিভাস– কুমারী উত্তরাকে কোনও-না-কোনওভাবে আন্দোলিত করে রেখেছিল। মহাকাব্যের কবি আমাদের সেই খবর দিতে চাননি মহাকাব্যিক নৈতিকতার প্রশ্রয়ে। কিন্তু এতদিন কুমারী-মনের যে সংবাদ শুধুমাত্র দ্রৌপদীর বিদগ্ধমধুর উৎকণ্ঠিত বচনের মধ্যে সংগোপনে রেখে দিয়েছিলেন, সেই সংবাদ হঠাৎ তার মুখেই বিস্ফোরণের মতো বেরিয়ে আসে– সুনিতম্বা উত্তরা যদি বলে, তবে সে-কথা সে রাখবেই– অস্যাঃ স বীরো বচনং করিষ্যতি ন সংশয়ঃ। এর পর আরও স্পষ্টতর বোধনের জন্য যা পড়ে থাকে, তা শুধুই তার প্রতিক্রিয়াটুকু সুশ্রোণী উত্তরার মানসিক, শারীরিক এবং বাঁচিক প্রতিক্রিয়া।
দ্রৌপদীর প্রস্তাব শুনে কুমার উত্তর নিকটে থাকা বোনকে শুধু বলেছিলেন– এই যে সুন্দরী! যাও তবে, ডেকে আন সেই বৃহন্নলাকে আর অমনই কুমারী উত্তরা দৌড়তে আরম্ভ করলেন নর্তনাগারের দিকে– সা দ্রবৎ কাঞ্চনমাল্য-ধারিণী। এই এতকালে সময় হল মহাভারতের কবির তিনি উত্তরার রূপ বর্ণনা করছেন, তিনি উত্তরার আভূষণ অলংকার, বেশ-বাস বর্ণনা করছেন, বর্ণনা করছেন সুশ্রোণী যুবতীর রমণীয় গতিভঙ্গি এবং কোনও প্রসঙ্গে এই বর্ণনা– উত্তরা বৃহন্নলা-রূপী অর্জুনের কাছে যাচ্ছেন। শুধুই নপুংসক বৃহন্নলার কাছে যাবার জন্য কি যুবতী উত্তরার এই প্রস্তুতি প্রয়োজন ছিল, নাকি মহাকাব্যের কবির প্রয়োজন ছিল নপুংসক-প্রত্যয়ে এমন রমণীয় বর্ণনার। বড় ভাই একবার মাত্র তাকে বলেছেন আর উত্তরা ছুটছেন তার নৃত্যগুরুর কাছে যাবার জন্য, তার গলায় সোনার মালা দুলছে– যা দ্রবৎ কাঞ্চনমাল্যধারিণী।
উত্তরা চললেন অর্জুনের কাছে তার গায়ের রং পদ্মের পাতার মতো রক্তাভ, কৃশ কটি তার স্তন-জঘনের উচ্চতা জানান দেয়, মাথার উপর চুল এমন ছাঁদে বাঁধা যাতে ময়ূরপুচ্ছ গোঁজা আছে একটি-দুটি বেদিবিলগ্নমধ্যা/ সা পদ্মপত্রাভনিভা শিখণ্ডিনী। তন্বঙ্গী উত্তরা মণিচিত্রের মেখলা ধারণ করেছেন নিতম্বের শোভা হিসেবে, তাঁর চোখের পাতায় বক্রতার কাপন, কৃষ্ণবর্ণ অর্জুনের কাছে তিনি পৌঁছচ্ছেন যেন বিদ্যুৎ এসে পৌঁছল মেঘের কাছে তন্নর্তনাগারমরালপক্ষ্মা। শতদা মেঘমিবান্ধপদ্যত। হাতির শুড়ের মতো তার দুই উরু সুসংহত, তার প্রত্যঙ্গ-ভঙ্গে কোনও ত্রুটি নেই, হাসলে দাঁতগুলিকে মুখের শোভা মনে হয়– সেই উত্তরা পার্থ অর্জুনের কাছে উপস্থিত হলেন– যেন নাগবধূ এসে পৌঁছলেন যূথপতি হস্তি-নায়কের কাছে পার্থং শুভা নাগবধূরিব দ্বিপম্।
মহাকাব্যের এই সব চিরপ্রথিত উপমা-খণ্ডগুলি বিদ্যুৎ-মেঘের উপমা, নাগবধূ আর হস্তির উপমা নায়ক-নায়িকার মিলন-সূত্রে ব্যবহৃত হয়। মহাভারতের কবি কিছুতেই স্বকণ্ঠে বলবেন না স্পষ্ট উচ্চারণে যে, উত্তরা প্রিয়া নায়িকার মতো প্রিয়মিলনের ভঙ্গিমায় উপস্থিত হয়েছেন অর্জুনের কাছে। অথচ এইসব বিশ্রুত উপমা প্রয়োগ করে উত্তরার একটা সংজ্ঞাও তিনি নির্ধারণ করছেন। পার্থ অর্জুনও উত্তরাকে এতদবস্থায় প্রিয়শিষ্যার মতো সম্বোধন করছেন না। বলছেন– মৃগাক্ষি তরুণী! এমন তাড়াহুড়ো করে আসছ কেন তুমি-মৃগাক্ষি কিং ত্বং ত্বরিতেব ভামিনি। হঠাৎ করে কেন এখন এলে এখানে? তোমার মুখখানা দেখে ভাল লাগছে না হে সুন্দরী! বল শিগগির, কী হয়েছে তোমার কিং তে মুখং সুন্দরি ন প্রসন্নম/ আচক্ষ তত্ত্বং মম শীঘ্রমঙ্গনে।
কিছু কিছু মহাভারতীয় পুঁথি অর্জুনের কাছে উত্তরার এই আসার অংশটুকু বাদ দিয়েছে; ফলে মহাভারতের শুদ্ধিবাদী পণ্ডিতেরা এই শ্লোকগুলিকে প্রক্ষেপ-পঙ্কে নিক্ষেপ করে উত্তরার নায়িকা-প্রতিমতা ছেটে দিয়েছেন, অর্জুনকেও করে তুলেছেন অজ্ঞাতবাসের মর্যাদারক্ষী শ্রদ্ধেয় এক নপুংসক। এঁরা মনে রাখেননি, এমনকী ভাণ্ডারকরের শুদ্ধিবাদী পণ্ডিতেরাও মহাকাব্যের কবির হৃদয় বোঝেন বলে মনে হয় না, নইলে এঁরা বুঝতেন কাহিনির শুদ্ধতা এবং পরম্পরা রাখাই মহাকাব্যের কবির একমাত্র কাজ নয়, এই জগৎসংসারের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়ের নীতিবোধের মধ্যেও আরও এক ধূসর মনের জগৎ আছে, যেখানে শুধুই অন্তর্গত অভিলাষ কাজ করে, কাজ করে কতগুলো মানবিক প্রবণতা যার মীমাংসা করা যায় না। এখানে যে অংশে উত্তরার এই সবিশেষ আলংকারিক প্রত্যভিগমন বর্ণিত হল, এর মধ্যেও সেই নিরুচ্চার অভিলাষ আছে, যা স্পষ্ট করে বোঝা যায় না। আর এমনটা দেখলে উদাসীন নপুংসকও নিজের নৃত্যগুরুর মর্যাদা খানিকটা বিগলিত করে দিয়ে সুন্দরী আর ‘মৃগাক্ষী’ সম্বোধনে অপ্রতিভ নায়িকার প্রসন্ন মুখ দেখতে চায়। অন্য কেউ না বুঝুন, টীকাকার নীলকণ্ঠ শুদ্ধিবাদী সংশয়ী পণ্ডিতদের চেয়ে অনেক প্রাচীন, তিনিও এই অংশের টীকা করেছেন দেখেই বুঝতে পারি– মহাভারতের কবির কাছে উত্তরার এই প্রত্যভিগমন বর্জ্য নয় মোটেই। তিনি কিশোরী-যুবতীর বীরপূজার তত্ত্ব বোঝেন, বোঝেন– হিরো ওয়ারশিপ’-এর মধ্যে অনির্বচনীয় নারী-হৃদয়ের দুর্বলতা থাকে। সে দুর্বলতা প্রেম নয় বটে, এমনকী অনেক সময় তার পরিণতিও ঘটে না, কিন্তু পরিণামে একটা বীজ তার মধ্যে থেকে যায়। ব্যাস সেই অপরিণত রমণীর মোহটুকু জানেন বলেই উত্তরাকে বর্ণনা করছেন অকারণের আনন্দে। এবং টীকাকার নীলকণ্ঠও এই অংশ বর্জন না করে বুঝিয়ে দিয়েছেন– তিনি মহাকবির সমান-হৃদয়।
উত্তরা যখন অর্জুনের কাছে এসে উপস্থিত হলেন, তখন পিছন পিছন তার অন্য সখীরাও ছুটতে ছুটতে এসেছিল। রাজবাড়িতে রাজপুত্রীর সখীরা কখনওই সম-মর্যাদার হয় না বলে রাজার মেয়ের সঙ্গে যতই সমভাব দেখাক, সখীদের মনে কিছু হীনমন্যতা থাকে, ফলে রাজার মেয়ের সম্মান-অসম্মান নিয়ে কিছু কৌতূহলও থাকে। দ্রৌপদী বলেছেন– উত্তরা বললেই অর্জুন শুনবেন– সেই উত্তরা বড় ভাইয়ের নির্দেশে অর্জুনের কাছে ছুটতে ছুটতে যাচ্ছেন, এখন অর্জুন-বৃহন্নলা তার কথা শোনেন কিনা, সেটা অন্তর্গত ঈর্ষায় বুঝে নেবার জন্য উত্তরার সখীরাও কৌতূহলী হয়ে তার সঙ্গেই ছুটতে ছুটতে গেল। অর্জুনের প্রশ্নের মধ্যে মমতা, স্নেহ এবং প্রণয়োচিত কৌতুক ছিল- কী সুন্দরী! মুখখানা এমন শুকনো কেন? কী হয়েছে বল তাড়াতাড়ি কিং তে মুখং সুন্দরি ন প্রসন্ন। আচক্ষ তত্ত্বং মম শীগ্রমঙ্গনে।
উত্তরা যেহেতু সখীদের মধ্যে রয়েছেন, অতএব ক্ষুদ্র শিষ্যার অনুরোধ যাতে ফিরিয়ে না দেন, তাই অর্জুনের প্রতি সোড়শীর প্রণয় মাখিয়ে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন প্রণয়ং ভাবয়ন্তী সা সখীমধ্যে ইদং বচঃ। উত্তরা বললেন– কৌরবরা সব আমাদের গোধন হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। আমার ভাই উত্তর যুদ্ধে যেতে চায়, কিন্তু তার সারথিটি গত যুদ্ধে মারা গেছে, তার মতো সারথিও আর নেই যে আমার ভাইয়ের সহায় হতে পারে। তবে সারথির প্রসঙ্গ উঠতে সৈরিন্ধ্রী তোমার অশ্ববিষয়ে অগাধ জ্ঞান এবং সারথি হিসেবে তোমার নৈপুণ্যের কথা বার বার বলল। আমি তাই তোমার কাছে এসেছি। আমি শুনলাম তুমি অর্জুনের সারথি ছিলে, তোমার সহায়তায় অর্জুন পৃথিবী জয় করেছিলেন অনেক কথা শুনলাম তোমার সম্বন্ধে। আমি চাই তুমি আজ আমার ভাই উত্তরের সারথির কাজ করো– সা সারথ্যং মম ভ্রাতুঃ কুরু সাধু বৃহন্নলে– নইলে কৌরবরা আমাদের গোরুগুলোকে আরও অনেক দূরে নিয়ে চলে যাবে।
রাজবাড়িতে রাজার মেয়ে আশ্রিত নৃত্যগুরুকে এইটুকু অনুনয় করলেই তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু উত্তরার কুমারী-মনে বৃহন্নলা-অর্জুনের বিষয়ে আরও কিছু ‘আমি-আমার’-বোধ আছে যাতে অর্জুন কোনও উত্তর দেবার আগেই তিনি বললেন– আমি! আমি তোমাকে অনুরোধ করেছি, আমি বলেছি তোমাকে এই সারথির কাজটুকু করে দিতে হবে, এখন তুমি যদি আমার কথা না শোনো- অথৈত বচনং মেহদ্য নিযুক্তা ন করিষ্যসি– কেন শুনবেই বা না তুমি আমি যথেষ্ট ভালবাসা নিয়েই তোমাকে অনুনয় করেছি– প্রণয়াদুচ্যমানা ত্বং– তবুও যদি না শোনো, তবে জেনো আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে নিশ্চয়– প্রণয়াদুচ্যমানা ত্বং পরিত্যক্ষ্যামি জীবিতম।
রমণীর মন! এ কেমন কমলকলির পাপড়ি, একটা একটা করে একটু একটু করে মেলে ধরতে হয়! কেমন চিত্রকর এই মহাকাব্যের কবি, যিনি তুলি দিয়ে একটু একটু করে উন্মীলিত করছেন রমণীর হৃদয়-কমল-কলিকা! এ কেমন সম্পর্ক, যেখানে একবার কথা না রাখলে প্রিয় শিষ্যা প্রাণ দিতে চায়! ব্যাস দ্বৈপায়ন বলেননি স্পষ্ট করে। বলবেনও না। তবু শব্দমন্ত্রে জানিয়ে দিচ্ছেন শুধু পরিণতি নেই; কিন্তু এমনও হয়, এমনও হয়। শব্দ আছে আরও। ব্যাস বললেন– সুনিতম্বা সখী এমনটা বলার পর এবমুক্তস্তু সুশ্রোণ্যা তয়া সখ্যা পূরন্তপঃ- অর্জুন দ্বিতীয় কোনও প্রশ্ন না করে সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত্র উত্তরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
ওপরের শ্লোকটার মধ্যে ব্যাস উত্তরার নামের বদলে সর্বনাম ব্যবহার করেছেন, আর তার বিশেষণ দিয়েছেন দুটো– সুশ্রোণী এবং সখী। সুশ্রোণী’ শব্দটা বোঝা গেল পরিষ্কার– ওটা একটা শারীরিক অভিজ্ঞান, আর মহাকাব্যের কবিরা তাঁদের যুবতী নায়িকাদের সুশ্রোণী, সুস্তনী ইত্যাদি সম্বোধন করেন অকারণেও। কিন্তু ‘সখী’ শব্দটা তো কোনও প্রত্যঙ্গ বিশ্লেষণ নয়, এটা মানবিক-বৃত্তি-সম্পন্ন মানুষের সম্পর্কের কথা। নৃত্যগুরু অর্জুনের সঙ্গে তার প্রিয়শিষ্যা উত্তরার প্রভু-সম্মিত সম্পর্কের মধ্যে এতটাই তা হলে দ্রবীভবন ঘটেছিল, যাতে শিষ্যা একসময় সখী হয়ে গেছেন। সখ্যের মধ্যে যে সমপ্রাণতা প্রয়োজন হয়, উত্তরা সেই সমপ্রাণতা থেকেই অর্জুনের কাছে উত্তর-সারথ্যের অনুনয় জানিয়েছিলেন এবং অর্জুনও – সেই সমপ্রাণতা অস্বীকার করতে পারেননি বলেই বিনা বাক্যে তার অনুনয় স্বীকার করে নিয়েছেন। সংস্কৃতের নীতিশাস্ত্র সখ্যের সংজ্ঞা করতে গিয়ে ‘সমপ্রাণতা’র বৈশিষ্ট্যটুকুই সখ্যের অন্তঃসার হিসেবে উল্লেখ করেছে– সমপ্রাণঃ সখা মতঃ। সেই সূত্রে অর্জুনের এই প্রিয় শিষ্যাটিকে সখিত্বের সংজ্ঞায় চিহ্নিত করাটা দ্বৈপায়ন ব্যাসের এক মহাকাব্যিক অভিসন্ধি বটে।
অর্জুন উত্তরার কথা সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেওয়ায় উত্তরার মনে বেশ গর্ব হয়েছিল। আপন অনুনয়-সিদ্ধিতে তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি, কিংবা নিজের ঘরে গিয়েও পুলকিত হতে পারেননি। বরঞ্চ অর্জুন-বৃহন্নলা তার কথা শুনেছেন, এটা সগর্বে উপভোগ করার জন্য উত্তরা অর্জুনের পিছন পিছন ছুটেছেন এবং আবার ব্যাসের সেই চিরাচরিত উপমা ঠিক যেমন গজবধূ তার দয়িত মদস্রাবী হস্তী-স্বামীর পিছন পিছন যায়– অন্বগচ্ছদ বিশালাক্ষী গজং গজবধূমিব। আপনাদের ভাল করে বোঝাতে পারব না– এই উপমার গভীরার্থ কোথায় পৌঁছায়। মহাকাব্য এই বিশাল পশুটিকে প্রেমিক হিসেবে এক চিরাচরিত মর্যাদা দিয়েছে। গজবধূ তার প্রেমিক হস্তীটির পদানুসরণ করে সবসময়। সেই গজবধূর উপমায় উত্তরাকে অর্জুনের পিছনে নিয়ে যাবার যে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা, সেটা অন্তর দিয়ে বোঝাই ভাল, বুদ্ধি দিয়ে নয়, নীতিবুদ্ধিতে তো নয়ই।
কুমার উত্তরের সঙ্গে অর্জুনের দেখা হতেই তিনি পূর্ববং সৈরিন্ধ্রীর প্রশংসা-শব্দ উচ্চারণ করে রথের সারথি হতে অনুরোধ করলেন অর্জুনকে। উত্তরের প্রস্তাব শুনে বেশ খানিকটা বৃহন্নলোচিতভাবেই কৌতুক বজায় রেখে অর্জুন বললেন– এত বড় একটা যুদ্ধের মধ্যে আমি কেমন করে সারথির কাজ করি বল। আমাকে গান গাইতে বল, গাইছি। বাদ্যি বাজাতে বল তাল-লয় ধরে, বাজিয়ে দেব। নাচতে বল, নাচতেও পারি, কিন্তু সারথির কাজটা করি কী করে– গীতং বা যদি বা নৃত্যং বাদিত্রং বা পৃথগুবিধম। উত্তর বৃহন্নলার ভণিতা শুনে বললেন– তুমি গাইয়ে হও, বাজিয়ে হও, আর নাচিয়েই হও, কিছু যায় আসে না। তুমি তাড়াতাড়ি আমার রথে ওঠো দেখি। অর্জুন যুদ্ধ-জানা মানুষ, রাজনীতিও কম জানেন না। বিশেষত অজ্ঞাতবাসের কাল তার হিসেব করা হয়ে গেছে। তার ওপরে এও জানেন যে, কৌরবরা গোরু নিয়ে পালিয়ে যাবে না, তারা যুদ্ধ করতেই এসেছে। অতএব এই অবস্থায় যুদ্ধবীরের কৌতুকটুকু তিনি হারিয়ে ফেলেন না। তার বরং মনে হল– হঠাৎ এই যুদ্ধ সংকেতের মধ্যে আতঙ্কিতা কুমারী উত্তরাকে একটু হাসিয়ে তোলা যায় কিনা। অর্জুন ভঙ্গি করে দেখাতে লাগলেন– একজন নপুংসক যদি যুদ্ধে যায় তা হলে কতখানি হাস্যাস্পদ কাজ সে করতে পারে। যুদ্ধভূমির সমস্ত পরিচিত প্রয়োজনগুলি জেনেও অর্জুন তবু উত্তরার কৌতুক-প্রসাধনের জন্য উত্তরায়াঃ প্রমুখতঃ- নানারকম মজা আরম্ভ করলেন স তত্র নর্মসংযুক্তমকরোৎ পাণ্ডববা বহু।
এত সব কৌতুকের একটা-মাত্র উদাহরণ দিয়েছেন মহাভারতের কবি। যুদ্ধে যেতে হলে রথের সারথিকেও বুকে বর্ম এঁটে যেতে হয় নিজের প্রাণের জন্য এবং রথস্থ যোদ্ধার বিঘ্ন প্রশমনের জন্য। তো সেইরকমই একটা লোহার বর্ম এনে দেওয়া হল অর্জুনকে তারই বুকের মাপে। অর্জুন সেটাকে এদিকে-ওদিকে ঘুরিয়ে উলটো করে বাঁধার চেষ্টা করলেন নিজের বুকে–উত্তরাকে দেখিয়ে দেখিয়ে। রাজবাড়ির মেয়েরা সব– জন্ম থেকে যুদ্ধ দেখছে কীভাবে বর্ম পরতে হয়, নিজেরাও তা জানে নপুংসক-প্রতিম বৃহন্নলার কাণ্ড দেখে উত্তরা এবং তাঁর সখীরা সব হেসে কুটিকুটি হল– কুমাৰ্য্যস্তত্র তং দৃষ্টা প্ৰাহস পৃথুলোচনাঃ। তবু কিছুতেই অর্জুন লৌহকবচটি ঠিক করে পরলেন না। সরলপ্রাণ কুমার উত্তর ভাবলেন– অর্জুনের ভ্রান্তি ঘটছে অথবা বিভ্রান্তি; উত্তর নিজেই তখন একটি মহামূল্য বর্ম এনে এঁটে দিলেন অর্জুনের বুকে সতু দৃষ্টা বিমুহ্যন্তং স্বয়মেবোত্তরস্ততঃ।
আর দেরি নয় বৃহন্নলা-অর্জুন এবার সারথি হয়ে ধরলেন ঘোড়ার লাগাম। উত্তর যুদ্ধযাত্রায় অভিমুখ হলে উত্তরা এবং তার সখীরা ঘিরে ধরলেন রথের সারথিকে। তারা বললেন– বৃহন্নলা! তুমি যুদ্ধে আসা ভীষ্ম-দ্রোণ– এতসব মহারথীদের উত্তরীয় বস্ত্রগুলি নিয়ে এস। সেগুলো যেমন রং-বেরং হয়, তেমনই পাতলা আর নরম। আমাদের পুতুল-খেলার জন্য সেইসব বস্ত্রগুলি নিয়ে আসবে তুমি– পঞ্চালিকাৰ্থং চিত্রাণি সূক্ষ্মাণি চ মৃদুনি চ।
দ্বৈপায়ন ব্যাসের এই তথ্যের ওপর দুটো কথা না বলে চলে যাই কী করে? অর্জুনকে দেখছেন! লক্ষ করছেন তার অদ্ভুত মনঃশৈলী, অদ্ভুত পৌরুষেয়তা! যৌবন সন্ধি-স্থিতা এক কুমারীর অন্তর্গত দুর্বলতাকে তিনি কী সযত্নে লালন করছেন। অর্জুন তার কথা শুনছেন, তার অভিমান উপভোগ করছেন, কিন্তু একই সঙ্গে প্রৌঢ়তার কৌতুকগুলি মনে প্রাণে-ভাষায় এমনভাবেই তিনি মাখিয়ে রেখে দিয়েছেন যাতে করে কোনওভাবেই বলা যাবে না যে, তার দিক থেকে উত্তরার প্রতি অর্জুনের দুর্বলতা আছে। উত্তরা যখন প্রৌঢ় বয়সী অর্জুনের সখী হয়ে ওঠেন, তখন বুঝি দূরত্বের জায়গাটা এখানে অনেকটাই কম, কিন্তু প্রণয়ের প্রশ্ন যদি আসে, তখন প্রৌঢ়-পক্ষটিকে এমন যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ দেখি যে, কৈশোরগন্ধী যুবতী উত্তরার জন্য কেমন মায়া হয়। অথচ এমন ঘটনা ঘটে পৃথিবীতে, ঘটেই। মহাভারতের কবি তথ্য-সংকলনে এমন বিপ্রতীপ প্রণয়ের ইঙ্গিত দেন মাত্র, কিন্তু পরিণাম দেন না।
কুমার উত্তরের সঙ্গে কৌরবপক্ষের কেমন যুদ্ধ হল, সে আমরা বেশ জানি। কিন্তু এই যুদ্ধকাণ্ডের প্রস্তুতিতেই এটা বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল যে, অর্জুন মোটেই নপুংসক হয়ে যাননি, তিনি নপুংসক সেজে থাকতেন। কুমার উত্তর অর্জুনকে বলেছেন– আমার কিছুতেই বিশ্বাস আসে না যে, আপনি নপুংসক। আপনার চেহারা, দেহের গঠন এবং রূপ– সবটার মধ্যেই একজন শক্তিমান পুরুষের লক্ষণ বড় প্রকট এবং যুক্তাঙ্গরূপস্য লক্ষণেরুচিতস্য চ– আপনাকে আমি ক্লীবের বেশে শূলপাণি শিব অথবা দেবরাজ ইন্দ্র বলেও বরং ভাবতে পারি, কিন্তু ক্লীব কিছুতেই নয়। অর্জুন এই কথার উত্তর দিয়েছিলেন– আমি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম– অজ্ঞাতবাসের এই একটা বছর আমি ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করব, বাস্তবে মোটেই ক্লীব নই আমি–নাস্মি ক্লীবো মহাবাহো পরবান ধর্মসংযতঃ। এখন আমার ব্রহ্মচর্যের ব্রত সমাপ্ত হয়ে গেছে, আমার প্রতিজ্ঞায় আমি উত্তীর্ণ। কুমার উত্তর বলেছিলেন- এইরকম যার চেহারা সে কখনও নপুংসক হয়! কৌরবরাও বেণীকৃতবেশ অর্জুনকে এক নজরেই চিনে গিয়েছিলেন।
আমাদের বক্তব্য– তা হলে উর্বশীর শাপ নয়, অন্য কিছু নয় অর্জুন মেয়েদের সঙ্গে দিন কাটাবেন, তাদের প্রত্যঙ্গ-স্পর্শে নৃত্যশিক্ষা দেবেন, অতএব ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কাছে তাকে সত্যপ্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিল– এই এক বছর তিনি নপুংসকের বেশে ইন্দ্রিয়-সংযম করে ব্রহ্মচারী ব্রত গ্রহণ করবেন। আমরা বেশ বুঝতে পারি– অর্জুনের ক্লীবত্ব নিয়ে একটা সন্দেহ সকলের মনেই ছিল, বিরাট রাজা, কুমার উত্তর কেউই তাকে ক্লীব ভাবেননি, সেখানে এই উদ্দাম পুরুষকে যুবতী উত্তরা নপুংসকের অভয় মাহাত্মে মন থেকে বিসর্জন দিয়ে রেখেছিলেন– এ-কথা ভাবতে অসহজ লাগে।
বিরাট যুদ্ধ হল। সেই যুদ্ধের বর্ণনা এখানে ঈপ্সিত নয়। যুদ্ধের মতো যুদ্ধ হয়ে গেল। কৌরব পক্ষের মহা-মহাবীরেরা রণে ভঙ্গ দিলেন বারবার। অবশেষে অর্জুনের সম্মোহন বাণে সকলে সংজ্ঞাশূন্য নিশ্চেষ্টভাবে শায়িত হলেন ভূমিতে। অন্য কোনও বীর হলে, এমনকী কুমার উত্তরও যদি যুদ্ধ জিতে নিতেন, তা হলে এই সময়ে যুদ্ধজয়ের গৌরবই তাঁর মন অধিকার করে থাকত। কিন্তু পরম এবং চরম মুহূর্তেও প্রিয়শিষ্যা উত্তরার অনুনয় অর্জুনের মনে আছে। কুরুবীরেরা সংজ্ঞাহীন হতেই তার মনে পড়ল– উত্তরা বায়না করে বলেছিল- কৌরবরা হেরে গেলে তুমি ভীষ্ম-দ্রোণদের মৃদু-সূক্ষ্ম উত্তরীয় বস্ত্রগুলি নিয়ে আসবে আমাদের পুতুল-সাজানোর জন্য। উত্তরা কী জানতেন না– ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ কত বড় যুদ্ধবীর। তিনি জানতেন না– তার ভাই কতটা পারেন? নাকি সৈরিন্ধ্রী দ্রৌপদীর মতো তিনিও বুঝেছিলেন– বৃহন্নলা যদি যুদ্ধে যায়, তবে কৌরবরা সকলেই পরাজিত হবেন। কিন্তু অর্জুনকেও দেখুন– এত বড় যুদ্ধ জেতার পরেও কৈশোর-গন্ধী উত্তরার পুতুলখেলার বায়নাক্কা তিনি ভোলেননি। রথ ঘোরাবার আগেই মনে পড়েছে উত্তরার বালিকা-মুখের আবেদন– তথা বিসংজ্ঞেষু পরেষু পার্থঃ। স্মৃত্বা চ বাক্যানি তথোত্তরায়াঃ। কুমার উত্তরকে তিনি আদেশ দিলেন– যাও বৎস! কুরুবীরেরা যতক্ষণে সংজ্ঞালুপ্ত হয়ে আছে, ততক্ষণে তুমি ওদের মাঝখান দিয়ে নির্ভয়ে চলে যাও। দেখো, দ্রোণ আর কৃপের বস্তুগুলি হল সাদা, কর্ণেরটা হলুদ আর অশ্বত্থামা আর দুর্যোধনের উত্তরীয় দুটো নীল। যাও তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো এগুলো বস্ত্রে সমাদৎস্ব নরপ্রবীর।
খুব বেশি সময় তো ছিল না, তা ছাড়া ভীষ্ম-পিতামহ জ্ঞান হারাননি, তিনি মটকা মেরে পড়ে আছেন, মহাবীর নাতির অস্ত্র-কৌশল তিনি বোঝেন আবার প্রশ্রয়বশত অজ্ঞানের ভাণ করেও পড়ে থাকেন। কাজেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে সাদা, হলুদ আর নীল বসন যা জুটল, তাতেই বালিকা-হৃদয়ের মনস্তুষ্টি ঘটবে বলেই অর্জুন সার্থক প্রেমিকের মতো বাড়াবাড়িটাও করেননি, আবার উত্তরার প্রতি স্নেহ-প্রণয়ে তার কথাটাও রেখেছেন।
আমরা জানি– অর্জুনও আবার বৃহন্নলার ক্লীবত্ব স্বীকার করে রথে উঠলেন সারথির ভূমিকায় এবং উত্তরকে বীরের সম্মানে ফিরিয়ে আনলেন রাজধানীতে। বিরাট রাজার সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের তর্কাতর্কি রীতিমতো ক্ষোভজনক অবস্থায় পৌঁছেছিল, যুধিষ্ঠিরের মুখে বৃহন্নলার কোনও প্রশংসা তার সহ্য হচ্ছিল না, যদিও অর্জুন সেইদিনই নিজেদের পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক থাকায় কুমার উত্তরের সঙ্গে তাকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছিল পরের দিন তাদের আত্মপ্রকাশের সিদ্ধান্ত আলোচনায়। কিন্তু অনন্ত ব্যস্ততার মধ্যেও অর্জুন যখন আপন নর্তনাগারে ফিরে এলেন, তখন কিন্তু নিজের হাতে সেই চিত্রবর্ণ বস্ত্রগুলি বিরাট-নন্দিনী উত্তরার হাতে তুলে দিলেন– প্রদশেী তানি বাসাংসি বিরাটদুহিতুঃ স্বয়ম্। মহাকাব্যের কবি তখন তার প্রধান কাহিনি নিয়ে ব্যস্ত। পরের দিনই অজ্ঞাতবাসের আবরণ মোচন করে আত্মপ্রকাশ করবেন পঞ্চ পাণ্ডব এবং দ্ৰৌপদী। অতএব উত্তরাকে নিয়ে আর সময় কাটানোর উপায় নেই তার। শুধু এইটুকু জানলাম– অর্জুনের হাত থেকে অতগুলি সুন্দর সুন্দর দামি কাপড় পেয়ে উত্তরা বড় আনন্দিত মনে সেগুলি গ্রহণ করলেন প্রত্যগৃহ্নাৎ ততঃ প্রীতা তানি বাসাংসি ভামিনী।
কিছু কিছু সম্পর্ক এইরকম আছে– মানুষের জীবনেও আছে; আছে মহাকাব্যেও তার ধূসর প্রতিফলন– কিছু কিছু এমন সম্পর্ক, যা উন্মুখ হয়েও কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়। স্তব্ধ হতেই হয়, একজন ব্যবহারে যা করছে, তা হয়তো তত ভেবে করছে না হয়তো বা সে। নিজেও বুঝে উঠতে পারে না, সে কী করছে। বিপরীতে আর একজন হয়তো তেমন করে ভাবছেই না, অন্যতরের ব্যবহারগুলি সে স্বাভাবিক ছন্দে গ্রহণ করছে মনের জটিল আবর্তগুলি পরিহার করে। এর সঙ্গে আছে পরিবেশ, সমাজ, ভব্যতা– যা উন্মুখীন অমুখর সম্পর্ক স্তব্ধ করে দেয়। এমনিতেও যা ঘটত না হয়তো, তা যদি ঘটানোর চেষ্টা করে কেউ, সামাজিকতা সেখানে নিজস্ব গাম্ভীর্যে সম্পর্কের পরিত্রাণ ঘটায় তথাকথিত নৈতিকতায়।
পরের দিন পাণ্ডবরা বিরাট রাজার সভা আলো করে রাজাসনে বসে রইলেন পর্দার পিছনে পূর্বাবস্থিত কুশীলবের মতো। বিরাট রাজা তাঁদের দেখে বিস্মিত, শ্রুকুটি-কুটিল এবং ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতেই অর্জুনই সকলের পরিচয় দিলেন বিরাট রাজার কাছে। এবার বিরাটের মুগ্ধ, স্নিগ্ধ এবং আবারও বিস্মিত হবার পালা। পাঁচ পাণ্ডব ভাইকে তিনি ভালও বাসেন শ্রদ্ধাও করেন যথেষ্ট। তারা এতদিন তারই বাড়িতে থেকেছেন, ভৃত্যের মতো কাজ করেছেন এবং অবশেষে শত্রুর হাত থেকে তাঁর রাজ্যও রক্ষা করেছেন বিরাট রাজা কৃতজ্ঞতায়, বিনয়ে, ভালবাসায় একেবারে আপ্লুত হয়ে গেলেন। এই বিশাল, বিশদ আপুতির শেষেই কিন্তু তার মুখে সেই বিখ্যাত প্রস্তাবনা ভেসে এল। বিরাট বললেন যুধিষ্ঠিরকে এখন আমি যেটা বলব, সেই কথাটা কিন্তু অর্জুনকে নিঃসংশয়ে মেনে নিতে হবে– যচ্চ বক্ষ্যামি তৎ কার্যম অর্জুনেন অবিশঙ্কয়া। আমার মেয়ে উত্তরাকে আমি অর্জুনের হাতে দিতে চাই। অর্জুন তাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করুন। অর্জুনের মতো পুরুষ আমার উত্তরার সবচেয়ে উপযুক্ত বর বলে আমি মনে করি। যুধিষ্ঠির আপনি অনুমতি করুন।
বিরাটের এই প্রস্তাব যুধিষ্ঠিরের কাছে খুব মনঃপূত হয়নি। বয়সের একটা পার্থক্য তো আছেই, তার মধ্যে জড়িয়ে আছে গুরু-শিষ্যার পবিত্র সম্পর্ক– সব কিছু মিলিয়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এই বৈবাহিক প্রস্তাব খুব খুশি মনে গ্রহণ করতে পারেননি। আর খুশি মনে না নিলে যা হয়– এমন একটা আনন্দের প্রস্তাব শুনেও তার চোখ-মুখ উৎফুল্ল হয়ে উঠল না, হৃদয় হল না বিকশিত। বরঞ্চ বিরাট অর্জুনের ব্যাপারে চরম আপ্লতি দেখানোমাত্রেই যুধিষ্ঠির একবার সচকিত বিস্ময়ে তাকালেন অর্জুনের দিকে। ভাবটা এই– তা হলে ব্যাপারটা এতদূর! তা হলে দ্রৌপদী এত দিন যে ঈষদীষৎ সন্দেহ পোষণ করতেন, সেটাই কি ঠিক। যুধিষ্ঠির অর্জুনের দিকে চকিত দৃষ্টিতে একবার তাকালেন এবমুক্তো ধর্মরাজঃ পার্থমৈক্ষদ ধনঞ্জয়ম।
অর্জুন যে বিরাটের প্রস্তাবে খুব পুলিকত হয়েছিলেন, তা নয়। তবে এখনও এই বয়সে এমন সপ্রশংস বৈবাহিক প্রস্তাব দিলে কোন পুরুষের হৃদয় স্ফীত না হয়। কিন্তু অর্জুন বাস্তব অবস্থা বোঝেন, বিশেষত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ধর্মরাজের ওই চকিত দৃষ্টি তাকে সুস্থিত হতে সাহায্য করেছে আরও। অর্জুন বিরাট রাজার সম্মান রেখে বললেন– আপনার কন্যা আমি গ্রহণ করব, তবে আমার জন্য নয়। আপনার কন্যাকে আমি পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করব আমার পুত্র অভিমন্যুর জন্য প্রতিগৃহ্যাম্যহং রাজন্ সুষাং দুহিতরং তব। ভরতবংশীয় এই জাতকের সঙ্গে মৎস্যদেশীয়া এই কন্যার বিবাহ-কর্মটা সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হবে।
সেই মৌলিক প্রশ্নটা এবার উঠল বিরাট রাজার দিক থেকেই। জানি না, তিনি তার কন্যার মানসিক প্রবণতা কিছু বুঝেছিলেন কিনা! বিরাট বললেন– এটা তো বড় আশ্চর্য ব্যাপার। আমার মেয়ে, আমিই স্বেচ্ছায় তাকে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি, তাতে তোমার দিক থেকে কীসের এত আপত্তি যে, তুমি নিজে তাকে বিয়ে করতে চাইছ না- প্রতিগৃহীতুং নেমাং ত্বং ময়া দত্তামিহেচ্ছসি? এবার অর্জুন যে যুক্তিগুলি দিলেন, তাতে বোঝা যায়, এতকালের সাংবৎসরিক অভ্যস্ততায় উত্তরার যদি বা কোনও মানসিক দুর্বলতা থেকেও থাকে তার প্রতি, তবু সেখানে প্রশ্রয় দেওয়াটাকে ঠিক মনে করেননি অর্জুন। অর্জুন বললেন– আপনার মেয়ের সঙ্গে এই এক বছর অন্তঃপুরের মধ্যে আমি থেকেছি, সব সময়ে তাকে দেখেছি বড় কাছ থেকে, তার ওঠা-বসা, চলা-ফেরা প্রত্যেকটি অঙ্গ-বিক্ষেপ আমি চিনি– অন্তঃপুরেইহমুষিতঃ সদাপশ্যং সুতাং তব। আপনার মেয়ের সমস্ত গোপনীয়তা এবং তার প্রকাশ্য যে-সব আচরণ– তাও আমার সব জানা। আমার ওপরে সে বিশ্বাসও রেখেছে পিতার মতো– রহস্যঞ্চ প্রকাশঞ্চ বিশ্বস্তা পিতৃবন্ময়ি।
সংস্কৃতে উপরি উক্ত পঙক্তিটির অর্থ সিদ্ধান্তবাগীশ যা করেছেন, তা আমার কাছে তেমন মনঃপূত নয়। তার অনুবাদে অর্জুনের জবানিটা দাঁড়ায়– আপনার কন্যাও গোপনে এবং প্রকাশ্যে পিতার মতোই আমার উপরে বিশ্বাস করিয়াছেন। আমার মনে হয় এই ‘রহস্যঞ্চ প্রকাশঞ্চ’- এটাকে ক্রিয়া-বিশেষণ না ভেবে সোজাসুজি দ্বিতীয়া বিভক্তির একবচন ভাবা ভাল। যে মানুষটি দিনের পর দিন অন্তঃপুরে উত্তরার সঙ্গে দিন কাটিয়েছেন, তিনি তার গোপনীয়তাও জানেন এবং প্রকাশও সবটুকু জানেন। সত্যি কথা বলতে কি, বহুকাল একসঙ্গে থাকতে থাকতে– তাও যদি থাকাটা এমন উদ্দেশ্যমূলক হয় যে, এই কোনও মতে একটা বছর সংযত হয়ে কাটিয়ে দিলেই তো আবার ইন্দ্রপ্রস্থের রাজবাড়িতে ফিরে যাব- সেইরকম একটা মানুষ কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবেই কোনও আন্তর বিচ্যুতির দিকে যায় না। অর্জুনও সেই দৃষ্টিতেই দেখছেন উত্তরাকে এবং বলছেন– সে আমাকে সব সময় পিতার মতো, গুরুর মতো দেখেছে।
আমাদের মনে শুধু জিজ্ঞাসা হয়– সত্যিই কি তাই! অর্জুন না হয় তার বয়স এবং নিজস্ব প্রয়োজনে একটা পিতৃবৎ সস্নেহ ভাব রাখার চেষ্টা করেছেন উত্তরার প্রতি, কিন্তু এই নৃত্যগুরুর সঙ্গে তার যে ভাব-সংলাপ আমরা লক্ষ্য করেছি, তা খুব অল্পই বটে, হয়তো তা দীর্ঘতর হবার প্রয়োজনও নেই, কেননা এই সম্পর্কের কোনও পরিণতি কোনও পক্ষ থেকেই খুব ঈপ্সিত ছিল না কিন্তু সেই অত্যল্প সংলাপ এবং অর্জুনের কাছে তার যাবার ভঙ্গি, অনুগমনের ভঙ্গি এবং তার প্রার্থনার আন্তরিকতা এমন একটা মোহ সৃষ্টি করে আমাদের মধ্যে, যাতে বিশ্বাস হতে চায়– ওই মোহটুকু উত্তরার মধ্যেও ছিল। নৃত্যশিক্ষার কালে অলৌকিক পৌরুষেয়তার অধিকারী অর্জুনের প্রতিনিয়ত দর্শন-স্পর্শ-সংলাপ এই কৈশোরগন্ধী যুবতীর মনে এমন কোনও আকুলতা নিশ্চয়ই তৈরি করেছিল– যা একদিকে যেমন দ্রৌপদীর মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে– সে সন্দেহ অবশ্য অনেকটাই স্ত্রীজনোচিত মৌখিকতায় বহুলীকৃত– কিন্তু অন্যদিকে সেই আকুলতা প্রত্যাখ্যাত হলে বালিকা উত্তরা আত্মহত্যার মন্ত্রণা করেন স্বকণ্ঠে সর্বসমক্ষে। প্রণয়, মান মিথ্যা হোক, এই আবেগটুকু মিথ্যা নয়। হয়তো অর্জুনের সঙ্গে তার সম্পর্কটুকুও ওই স্ফুরিত আবেগেই শেষ হয়ে গেছে।
অর্জুন বিরাট রাজাকে বলেছিলেন– আমি আপনার মেয়েকে দিনের পর দিন নাচ, গান শিখিয়েছি। একজন নর্তক এবং ভাল গায়ক হিসেবে দিনে দিনে আমি যেন তার প্রিয় হয়ে উঠেছি, তেমনই তার প্রশংসাও পেয়েছি অনেক প্রিয়ো বহুমতশ্চাসং নর্তকো গীতকোবিদঃ– তবু আপনার মেয়ে কিন্তু আমাকে আচার্য, গুরুর মতোই দেখে। এই পরস্পর বিরোধী এক দ্বৈরথ– আমি তার প্রিয় হয়ে উঠেছি, তার প্রশংসা এবং আদরের পাত্র হয়ে উঠেছি, অথচ সে আমাকে আচার্যের মতো মনে রাখবেন, ‘আচার্যের মতো’ দেখে– আচার্যবচ্চ মাং নিত্য মন্যতে দুহিতা তব– এই দুই স্বতো-বিভিন্ন আবেগ এবং আরোপিত সম্পর্কের মধ্যেও যে ফঁকটুকু থেকে যায়, সেখানে কিন্তু প্রথম-যৌবনবতী উত্তরার শিথিল বিভ্রান্ত হৃদয়টুকু অদ্ভুত এক অনির্বচনীয়তায় ধরা পড়ে। অর্জুন সেখানে সুচতুরভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন এবং তিনি সাফাই গেয়ে কন্যাপিতাকে বলেন– মহারাজ! আমি একটি বয়স্থা মেয়ের সঙ্গে পুরোটা বছর একসঙ্গে কাটিয়েছি বয়স্থয়া তয়া রাজন সহ সংবৎসরোষিতঃ– এখন যদি সেই মেয়েটিকেই আমি বিয়ে করে বসি, তা হলে লোকে যেভাবে সন্দেহ করবে, আপনারও সেই সন্দেহই হবার কথা, এবং সেই সন্দেহ হওয়াটা খুব অযৌক্তিকও নয়– অভিশঙ্কা ভবেৎ স্থানে তব লোস্য চোভয়োঃ। অর্জুন ভাবছেন– এক বৎসর কাল কন্যান্তঃপুরে ক্লীবের ছদ্মবেশে থাকার পর হঠাৎ যদি এখন তিনি উত্তরাকে বিবাহ করেন, তা হলে মানুষের এই সন্দেহ তো হবেই যে, এ-লোকটা রাজনন্দিনী উত্তরার সঙ্গে কীভাবে সময় কাটিয়েছে, নৃত্যগুরুর শিক্ষার ছলে, ক্লীবত্বের আবরণে এ-মানুষটা কী-না-কী করেছে, যাতে এখন এই বয়সে কন্যা-সমান একটি মেয়েকে বিবাহ করতে বাধ্য হচ্ছে।
অর্জুনের দিক থেকে এইসব যুক্তি-তর্কের সারবত্তা আছে, এবং অর্জুন নিজের পৌর্বাহ্নিক ভাবনা অনুসারে উত্তরাকে বিবাহ করবেন না বলেই তার যুক্তি-তর্কও যথেষ্ট শাণিত। কিন্তু এই মুহূর্তে এই আলাপ-আলোচনার কালে উত্তরা কী ভাবছিলেন, সে-খবর মহাভারতের কবি দেননি। অর্জুনের প্রতি তার যদি বা কোনও বীরভোগ্য আকর্ষণ-দুর্বলতা থেকেও থাকে, রমণীর হৃদয় লজ্জাপুটে সে-হৃদয় বেঁধে রেখে পুরুষের বিধি-বিধান মেনে নিয়েছে। অবশ্য এটাও ঠিক উত্তরার এই আকর্ষণ তখনও কোনও কোমলতম মাত্রায় পৌঁছয়নি, যাকে প্রণয় বলতে পারি, যার জন্য সন্ধিনী যুবতী প্রকট অভিমান ব্যক্ত করতে পারে। ফলত অর্জুন যখন নিজের বদলে তাঁর মহাবীর পুত্র অভিমন্যুর জন্য উত্তরাকে যাচনা করলেন, তখন এই বিবাহ-সম্বন্ধের মধ্যে নতুন মাত্রা এল যেন। নিজেকে সম্পূর্ণ দিলেন না বটে, কিন্তু– আত্মা বৈ জায়তে পুত্রঃ– নিজেই তো সে পুত্র হয়ে জন্মায়। এই পরম্পরাগত চিরন্তন নিয়মে অর্জুন পুত্রের প্রতিরূপে ধরা দিলেন উত্তরার কাছে দিব্য বালকের মতো তার চেহারা, মহামহিম কৃষ্ণের ভাগনে, বালককাল থেকেই তার অনৈপুণ্য প্রবাদে পরিণত হয়েছে। তবু সমস্ত বিশেষণের মধ্যে আপন প্রৌঢ়ত্বের বিপ্রতীপ ভূমিতে দাঁড়িয়ে অর্জুনের এই ঘোষণা– তাকে দেখতে সাক্ষাৎ দেবশিশুর মতো সাক্ষাদ্ দেবশিশু যথা– নবযৌবনবতী উত্তরার প্রতি এটাই যেন অর্জুনের সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মদান। তিনি এই মায়াময়ী বালিকাকে ঠকাতে চাননি।
একজন বয়স্ক মানুষ হিসেবে অর্জুন কন্যাপ্রতিমা এই বালিকার ইনফাচুয়েশন-টুকু বুঝেছিলেন, অথচ সমাজের ভয়-ত্রাস-সন্দেহ যাতে না হয়, কলঙ্ক যাতে তাকে এবং এই বীরমোহগ্ৰস্তা বালিকাকেও গ্রাস না করে, সেই প্রৌঢ়বুদ্ধিতেই তিনি বিরাটকে বলেছিলেন– আমার ছেলের সঙ্গে যদি আপনার মেয়ের বিয়ে দিই, তবে একদিকে যেমন আমিও নির্দোষ প্রমাণিত হব, তেমনই আপনার মেয়ের শুদ্ধি প্রমাণ করাটাও আমারই দায়িত্বের অগ্রভাগে পড়ে। আমি তাই করছি– তস্যাঃ শুদ্ধিঃ কৃতা ময়া। ছেলে বা ভাইয়ের সঙ্গে যদি একত্রে বাস করা যায়, তবে আমার মেয়ে বা পুত্রবধূর সঙ্গে একত্রে এক বৎসর থেকেছি, এটাও কোনও দোষের ব্যাপার নয়। এতে আমাকে এবং অন্য কাউকেই মিথ্যা অপবাদ দেবে না এই সমাজ। আমার কাছে মিথ্যা অপবাদের মতো অভিশাপ আর কিছু হতে পারে না অভিশাপাদহং ভীততা মিথ্যাবাদাৎ পরন্তপ। প্রৌঢ়ের শাণিত যুক্তির কাছে উত্তরাকে সর্বথা কলঙ্কমুক্ত রাখার সামাজিক দায়টাই তখন এমন বড় হয়ে উঠল যে, বালিকার বর্ষভোগ্য কৌতুক, অভিমান, নৃত্যশিক্ষার কালে প্রত্যক্ষ-স্পর্শের মৌহুর্তিক শিহরণ– সব কিছু এক দিনের মধ্যেই অন্যতর এক অপেক্ষা তৈরি করল বালিকার মনে– অন্যতর এক অর্জুন যাকে সাক্ষাৎ দেবশিশুর মতো দেখতে তার জন্য অপেক্ষা।
বিরাট রাজার কী বা আসে যায় অর্জুনকে জামাই হিসেবে লাভ করলে তিনি যত খুশি হতেন, তাঁকে বৈবাহিক লাভ করেও তিনি ততটাই খুশি হলেন। কিন্তু এমন সময়েই উত্তরার বিবাহ স্থির হল, যখন পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধকাল ঘনিয়ে আসছে। আর কিছু দিনের মধ্যেই যুদ্ধের উদ্যোগপর্ব আরম্ভ হবে। অজ্ঞাতবাসের ঠিক অব্যবহিত কাল পরে এবং যুদ্ধের উদ্যোগপর্বের অব্যবহিত কাল পূর্বে উত্তরার বিবাহ স্থির হল। এই বিবাহ শেষ হওয়ামাত্রেই বিরাট রাজ্যে বসেই অজ্ঞাতবাসের পরবর্তী রাজনৈতিক কর্তব্য স্থির হবে বিবাহ-উপলক্ষে সমাগত রাজন্যবর্গের সামনে। বলরাম এবং কৃষ্ণ এলেন দ্বারকা থেকে। ভাগিনেয় অভিমন্যু এখন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বটে, কিন্তু তার সঙ্গে অনুগতিতে এলেন যদু-বৃষ্ণি-বীরেরা সব, সবাই এলেন বিবাহোত্তর যুদ্ধালোচনায় অংশ নিতে। মহারাজ দ্রুপদ, পঞ্চ পাণ্ডবের শ্বশুর তিনি নাতি-প্রতিম অভিমন্যুর বিবাহ-উৎসবে যোগ দিতে এলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীকে সঙ্গে নিয়ে। আর এলেন দ্রৌপদীর ছেলেরা ভাই-দাদার বিয়ে দেখতে। কাশী থেকে এলেন কাশীর রাজা, এলেন শৈব্য। সবাই এলেন এক-এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে পাণ্ডবদের মিত্রগোষ্ঠী।
কেমন দাঁড়াল এই বিবাহের আসর! বিরাট রাজা নিজের রাজধানীর অদূরে অন্য এক নতুন শহর উপপ্লব্যে পাণ্ডবদের পৃথক নিবাস ব্যবস্থা করলেন। বিবাহ উৎসব এবং সেনা ছাউনি একসঙ্গে চালনার জন্যই হয়তো এই পৃথক ব্যবস্থাপনা। রাজা-রাজড়ারা বেশির ভাগ আগেই এসে গিয়েছিলেন, সবার শেষে কৃষ্ণ অভিমন্যুকে নিয়ে উপপ্লব্যে প্রবেশ করলেন। সাময়িকভাবে উদ্যত যুদ্ধের আলোচনা থেমে গিয়ে বেজে উঠল শঙ্খ, বেজে উঠল তুরী-ভেরী-গোমুখ। বিরাট রাজার লোকেরা বিবাহ উপলক্ষে বহু রকমের হরিণ আর মনুষ্য-খাদ্য পশু মেরে মাংস রান্না করল, ব্যবস্থা হল বহুতর সুরা, মৈরেয় এবং মদ্যপানের। গায়েনরা গাইতে লাগল, কণ্বক ঠাকুরেরা কথকতা করতে লাগল, সূত-মাগধেরা স্তুতিপাঠ করতে লাগল। মৎস্যদেশের সঙ্গে পাণ্ডবদের বৈবাহিক সম্বন্ধ হচ্ছে, রাজরানি সুদেষ্ণা এবং রাজবাড়ির মেয়েরা যেমন সুন্দর তাঁদের দেখতে, তেমনই গয়নাগাটি পরে তারা সেজে বেরোলেন– আজগুশ্চারুসৰ্বাস্থ্যঃ সুমৃষ্টমণিকুণ্ডলাঃ।
এই বিশাল বিয়ে বাড়ির আসরে, যেখানে সুচারু সুন্দরীদের বেশ-অলংকারের হট্টমেলা বসেছে, সেখানেও এক রমণীকে কী অসাধারণ শব্দসজ্জায় পৃথক করে দিলেন ব্যাস। মৎস্যদেশের মেয়ে মানে এখনকার জয়পুর-ভরতপুরের মেয়ে, তখনকার আর্যদের আদি নিবাস। ব্যাস বলেছেন সেখানে সকল মেয়েদেরই গায়ের রং ভীষণ সুন্দর, অর্থাৎ ফরসা ফরসা মেয়েরা সব, তার ওপরে বেশ-বাস অলঙ্কার বর্ণোপপন্নাস্তা নাৰ্য্যো রূপবত্যঃ স্বলঙ্কৃতঃ। কিন্তু এদের সবাইকে ছাপিয়ে যাঁর ব্যক্তিত্ব, সৌন্দৰ্য্য এবং রূপ প্রকট প্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে উঠল- তিনি হলেন কৃষ্ণা দ্রৌপদী– সর্বাভ্যশ্চাভবৎ কৃষ্ণা রূপেণ যশসা শিয়া। নিজের পেটের ছেলে না হলেও অভিমন্যুকে তিনি কম ভালবাসতেন না। সেই অভিমন্যুর আজ বিয়ে, পাণ্ডবগৃহের পরবর্তী প্রজন্মের প্রথম বিয়ে। তার মধ্যে অর্জুনের প্রতি নিজের অত্যধিক আকর্ষণ থাকার ফলে উত্তরাকে নিয়ে তাঁর যত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল, সেই ভ্রান্তিবিলাস একেবারেই কেটে গেল অভিমন্যুর সঙ্গে উত্তরার বিবাহ-পরিণামে। অতএব এই বচ্ছর ভর ক্লিষ্ট অজ্ঞাতবাসের পর আজ দ্রৌপদীকে সবচেয়ে ব্যক্তিত্বসম্পন্না সুন্দরী শোভনা লাগছিল।
বিরাট-পত্নী সুদেষ্ণা অন্যান্য রমণীদের নিয়ে সালংকারা উত্তরাকে চার দিক থেকে ঘিরে রইলেন। বিবাহ-মঙ্গলে সজ্জিতা উত্তরাকে ঠিক দেবনন্দিনীর মতো লাগছিল– সুতামিব মহেন্দ্রস্য পুরস্কৃত্যোপতস্থিরে। বিবাহ-বাসরে বর এসে পৌঁছলেন– অভিমন্যু। বরকর্তা হিসেবে বসলেন অর্জুন, তিনি পুত্রের জন্য সর্বাঙ্গসুন্দরী উত্তরাকে গ্রহণ করলেন পুত্রবধূ হিসেবে তাং প্রত্যগৃহৎ কৌন্তেয়ঃ সুতস্যার্থে ধনঞ্জয়। মহামতি যুধিষ্ঠির এবং বিশালবুদ্ধি কৃষ্ণের সামনে অর্জুন তার আত্মজ অভিমন্যুর সঙ্গে উত্তরার বিবাহ সুসম্পন্ন করালেন। আমি কিছুতেই ধারণা করতে পারি না এই মুহূর্তটি! কেমন লাগছিল কন্যাসনে-বসা উত্তরার, মনে কি পড়ছিল সেই নৃত্যময় দিনগুলি! মনে কি পড়ছিল অর্জুনের কাছে সেই ছুটে যাওয়া, সেই অনুযোগ আমার কথা না শুনলে আমি আত্মহত্যা করব! মহাকবির হৃদয় চুপ করে থাকে এইখানে। সত্যবতীর হৃদয়নন্দন ব্যাস এইখানে শুধু ঘটনা বলে যান, নিরুপায় নিরুত্তাপ অনাসক্ত কবির হৃদয় অর্জুনের আত্মপ্রতিম নবযৌবনোদ্ধৃত অভিমন্যুকে উত্তরার সামনে বসিয়ে দিয়েই সমস্ত আত্মগ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে যান। আর এই কালে বসে আমার নারীর কবিতা মনে পড়ে–
নিজের ভিতরে তুমি একা কাদো
বড় অশ্রুহীন
বন্ধ রাখো ত্রিকালদর্শী ত্রিনয়ন
সত্যকার সঙ্গমে রমণ
কে দেবে তোমায় নারী?
কোথায় সে পুরুষোত্তম?
তাই অভিনবা।
শমীবৃক্ষে শস্ত্র তুলে রাখো
খুলে রাখো রমণীধরম
কিম্পুরুষের সঙ্গে ঘটে যায় পৃথিবীর
সমস্ত অফলা সঙ্গমে।
উত্তরার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল অভিমন্যুর। যুধিষ্ঠির অনেক দানধ্যান করলেন বিবাহমঙ্গলের কৌতুকে। কিন্তু যে সুরে এই বিবাহ-রাগিণী বাঁধা হল তার মধ্যে ইমন-বেহাগের সুর যত মেশানো ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল আসন্ন রণসঙ্গীতের সুর। বিরাট-রাজধানীতে তখন পাণ্ডব-পক্ষে যোগ দিতে-আসা রাজা-রাজড়াদের সৈন্যবাহিনীর কুচকাওয়াজ চলছে। মুহুর্মুহু কথা চলছে উত্তেজনার এই অজ্ঞাতবাসের পর কৌরব দুর্যোধনকে কোন কৌশলে মোকাবিলা করতে হবে; কোন ভাবনায় বৃদ্ধপক্ষ ভীষ্ম, দ্রোণ, এমনকী ধৃতরাষ্ট্রেরও সম্মান বজায় রেখে দুর্যোধন-কৰ্ণ, শকুনি-দুঃশাসনের মতো দুষ্ট-চতুষ্টয়কে শেষ করে দেওয়া যায়– এইরকম সব দুরন্ত ভাবনার মধ্যেই উত্তরার বিবাহ সম্পন্ন হল। বিবাহে খাদ্য-পানীয়। থাকবে, সাধারণের হৃষ্টি-পুষ্টি হবে, এটা কোনও নতুন কথা নয়, বিশেষত রাজবাড়িতে ভোজনানি চ হৃদ্যানি পানানি বিবিধানি চ–কিন্তু এই বিবাহের মধ্যে মহোৎসবের নির্ভার আনন্দময়তা যত না ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল আসন্ন যুদ্ধের দুশ্চিন্তা। লক্ষ করে দেখুন, আগের দিন রাত্রে উত্তরার সঙ্গে অভিমন্যুর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে, রাত্রির পূর্বভাগ যদি বা উৎসব-মুখরতাতেই কেটে গিয়ে থাকে, কিন্তু উত্তর-রাত্রির সামান্য বিশ্রামের পরেই পাণ্ডবরা সকলে তাদের স্বপক্ষীয়দের নিয়ে বিরাট রাজার সভায় গিয়ে উপস্থিত হলেন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার জন্য কৃত্বা বিবাহং তু কুরুপ্রবীরাঃ।… সভাং বিরাটস্য ততোহভিজম্মু। এমনকী ঠিক আগের রাত্রেই যে অভিমন্যুর বিয়ে হয়েছে, সেই বিবাহোত্তীর্ণ সদ্য-স্বামীও নবযোবনবতী উত্তরার সরসতা ছেড়ে উপস্থিত হয়েছেন বিরাটের রাজসভায় বিরাট-পুত্রদের সঙ্গে বিরাটপুত্ৰৈশ্চ সহাভিমন্যুঃ।
মহাকবি দ্বৈপায়ন ব্যাস এখন বড় ব্যস্ত আছেন। বিশাল কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের ভূমিকা রচনা হচ্ছে মহাভারতের উদ্যোগপর্বে। এই বিরাট রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে বালিকার কোনও সংবাদ দেবার সময় নেই তার। অর্জুনের পরিবর্তে অন্য এক ছোট্ট অর্জুনকে পেয়ে তিনি যে বাতাহত কদলীর মতো শুয়ে পড়েছিলেন, এমন আভাস পাইনি আমরা। কিন্তু যে কৈশোরগন্ধী যুবতী খেলার পুতুল সাজানোর জন্য অর্জুনের মতো মহাবীরের কাছে বস্ত্রসজ্জা চেয়েছিল, বিবাহের রজনীতে তার অনেক স্বপ্ন দেখার কথা ছিল। কিন্তু এ-কেমন বীর-স্বামী সে লাভ করেছে যে, বিবাহের রাত্রি প্রভাত হতে-না-হতেই বিরাট রাজার রাজসভায় পৌঁছেছে যুদ্ধের অভিসন্ধিতে বিশ্রম্য রাত্রাবুষসি প্রতীতাঃ। সভাং বিরাটস্য ততোহভিজম্মুঃ। এমন বীর-স্বামীর জন্য বৈরাটী উত্তরার গর্ব হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু নববধূর সেই সতত উৎসারিত রোমাঞ্চ! মহাকবির সময় নেই, উপায়ও সেই রোমাঞ্চকর সংবাদ দেবার।
বিরাটের রাজসভায় অনেক উত্তপ্ত আলোচনা হল। পাণ্ডবের দূত গেল ধৃতরাষ্ট্রের সভায়, ধৃতরাষ্ট্রের প্রতিদূত সঞ্জয় এলেন পাণ্ডবদের কাছে। যুদ্ধ এড়িয়ে যাবার কোনও সমাধান-সূত্র মিলল না, অবশেষে শেষ শান্তির প্রস্তাব নিয়ে স্বয়ং কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় যাবেন, এই তো ঠিক হল। এই শান্তির প্রস্তাবের মধ্যে অবশ্য যুদ্ধের উন্মাদনা কম ছিল না এবং এই উন্মাদ পরিস্থিতিতে উত্তরার স্বামীর স্থিতি ঠিক কোথায়, তা বীরপত্নী দ্রৌপদীর একটিমাত্র বাক্য থেকেই প্রমাণ হয়ে যাবে। শান্তি-সন্ধিতে দ্রৌপদীর আপত্তি ছিল। তিনি কৃষ্ণের সামনে দুঃশাসনের ধর্ষিত কেশদাম মুক্ত করে ওজস্বিনী ভাষায় বলেছিলেন– তোমরা যদি যুদ্ধ না কর, তা হলে কৌরদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে আমার ছেলেরা এবং সে যুদ্ধ হবে অভিমন্যুর নেতৃত্বে অভিমং পুরস্কৃত্য যোৎস্যন্তে কুরুভিঃ সহ।
আমরা জানি, ভবিষ্যতে যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হবে, সেখানে অর্জুন-ভীমের মতো মানুষেরাই যুদ্ধনায়কের ভূমিকা পালন করবেন, কিন্তু অভিমানে আহতা দ্রৌপদীর মুখে অভিমন্যুর জন্য যে আশা ব্যক্ত হয়েছে, তাতে অভিমন্যুর যুদ্ধশৌর্য যেমন একদিকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তেমনই কৌরবপক্ষের মহাপ্রভাবশালী বীরদের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধজীবনের অস্থিরতাও প্রকট হয়ে ওঠে। বিশেষত সদ্যকৈশোরোত্তীর্ণ যৌবন-সন্ধানী অভিমন্যু তো যুদ্ধ-বস্তুটাকে হৃদয়ের তাড়নায় পরম অভীষ্ট বলে মনে করেন, সেখানে নববধূ উত্তরার নতুন দাম্পত্যের অর্গল কতটুকু শক্তিশালী।
উত্তরা যে অর্জুনের পরিবর্তে অভিমন্যুকে লাভ করে খুব অসুখী হয়ে পড়েছিলেন, তা আমরা মনে করি না। অর্জুনের মতো প্রৌঢ় মহাবীরের জন্য তাঁর ‘ইনফ্যাচুয়েশন’ ছিল, ‘হিরো-ওয়রশিপ’ ছিল, এবং অবশ্য অনেক বিভ্রান্তিও ছিল এবং তা ছিল অর্জুনের অজ্ঞাতবাসের ‘আইডেনটিটি’র কারণেই। ফলত বিভ্রান্তি দূর হয়ে যেতেই উত্তরারও মানসিক স্থিতি তৈরি হতেও খুব একটা সময় লাগেনি বলেই মনে হয়। বিশেষত, অর্জুনের কৃত্রিম ক্লীবত্ব এবং ব্যক্তিত্ব প্রকাশ হয়ে যাবার ব্যাপারটা এতটাই আকস্মিক ছিল এবং সেই আকস্মিকতায় কুমার অভিমন্যর রঙ্গপ্রবেশ এত তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে, উত্তরার কিশোরী হৃদয়ের শূন্যতা পূরণ হতেও দেরি হয়নি। হয়তো দেরি হয়নি!
কিন্তু যে কিশোর-বীরকে তিনি স্বামী হিসেবে লাভ করলেন, তার সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যের কাল কাটল কতদিন! এটা মনে রাখতে হবে যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হবার আগে যুদ্ধের উদ্যোগ-পর্বে যত সময় কেটেছে, ওই সময়টুকুই উত্তরার সঙ্গে তার স্বামীর দাম্পত্য জীবন। অথচ এই যুদ্ধোদ্যোগের মধ্যে, চারিদিকে সাজ-সাজ রবের মধ্যে, উপপ্লব্য আর হস্তিনাপুরের সীমানায় বারংবার দূত-বিনিময় এবং তাদের সান্ধি-বিগ্রহিক শব্দ-বিনিময়ের উত্তেজনার মধ্যে অভিমন্যুর মতো বীরের মানসিক ‘ইনভলবমেন্ট’ যতটা হতে পারে, তাতেই কিন্তু উত্তরার দাম্পত্য জীবনের সরসতা এবং সময় অনুমেয় হয়ে ওঠে সহজেই। এটা অবশ্যই মানতে রাজি আছি যে, তখনকার দিনের ক্ষত্রিয়-চরিত্রের কঠিন আদর্শ যেভাবে পুরুষ রমণী সকলের মধ্যে সঞ্চারিত এবং প্রচারিত হত, তাতে বিরাট-নন্দিনী উত্তরার কাছে তার স্বামীর যুদ্ধ বিষয়িনী উন্মাদনা অতিশয় স্বাভাবিক ছিল, বরঞ্চ তাঁর পক্ষে ‘প্রেমের সময় পাচ্ছি না বলে অভিমানে মানিনী হওয়াটাই অস্বাভাবিক ছিল। বিশেষত বিরাট রাজ্য মানে এখনকার জয়পুর-ভরতপুর-আলোয়ার অঞ্চল, এই মরুভূমির মেয়ের চরিত্রে বাষ্পসংমিশ্র কোমলতার চেয়ে মঞ্জরীহীন মরুভূমির লতার আচরণটাই অনেক বেশি সদর্থক।
তবুও তো দাম্পত্য-জীবনের একটা অভীপ্সিত কাল থাকে সকল নর-নারীর অন্তত সর্বনিম্ন যে সময়টুকু পেলে একজন রমণী বলতে পারে আমার স্বামীকে আমি আমার মতো করে যতটুকু পেয়েছি। উত্তরা কিছুই বলতে পারেন না, বিবাহ থেকে স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত তার দাম্পত্য জীবন মাত্র ছ’মাস, আর এই ছয় মাসই তাকে ঘরে বসে যুদ্ধের উত্তেজনার আগুন পোয়াতে হয়েছে। অথচ এর মধ্যেও উত্তরার অযান্ত্রিক মনে বালক-বীরের ছায়া পড়েছে, ছায়া পড়েছে তার শরীরেও। এরই মধ্যে উত্তরা অভিমন্যুর তেজ ধারণ করে গর্ভবতী হয়েছেন। কিন্তু ঠিক ছমাস। বিয়ের পর ছয় মাস মাত্র গেছে, কুরুক্ষেত্রের সর্বক্ষয়ী যুদ্ধে সপ্তরথীর হাতে নৃশংসভাবে মারা গেলেন উত্তরার স্বামী অভিমন্যু। যুদ্ধের সময় অর্জুন কাছাকাছি ছিলেন না। এদিকে যুদ্ধতাড়িত যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকৃত চক্রব্যুহের দুরভিসন্ধি তেমন বুঝতে না পেরে পুত্রপ্রতিম অভিমন্যুকে অনুরোধ করলেন চক্রব্যুহ ভেদ করে ব্যুহের ভিতরে প্রবেশ করার জন্য।
দুর্ভাগ্য এমনই, অভিমন্যু ব্যুহে প্রবেশের উপায় জানতেন, কিন্তু ব্যুহ থেকে নির্গমনের উপায় জানতেন না। যুধিষ্ঠির-ভীমরা আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তাঁরা অভিমন্যুর পিছন পিছন ব্যুহে প্রবেশ করবেন, কিন্তু কৌরবপক্ষে জয়দ্রথ সেদিন অদম্য ছিলেন, তার শক্তিমত্তার কারণে পাণ্ডবপক্ষের অন্য কেউই অভিমন্যুর সহায় হতে পারলেন না। বালক-বীর অভিমন্যু সপ্তরথীর সম্মিলিত আক্রমণে একসময় বীরের মতো মৃত্যুবরণ করলেন।
অভিমন্যুর এই মৃত্যু কোনও সাধারণ মৃত্যু নয়, এক সদ্যোযুবকের মৃত্যু। এই নৃশংস মৃত্যুর প্রভাব যাঁদের ওপরে সবচেয়ে বেশি হবার কথা, তাদের নাম আছে মহাভারতে। প্রথমত অর্জুন, পিতা হিসেবে মৃত পুত্রের জন্য তার করুণ অভিব্যক্তি মহাকাব্যিক মর্যাদায় উপস্থাপন করেছেন দ্বৈপায়ন ব্যাস। দ্বিতীয় যুধিষ্ঠির, যিনি অভিমন্যুকে চক্রব্যুহে প্রবেশ করার প্রথম প্ররোচনা দিয়েছিলেন, তিনি অনুতাপে মুখ দেখাতে চাইছিলেন না কাউকে। তৃতীয়ত, যুধিষ্ঠির আর অর্জুনের মুখেই শোনা গেল তিনজন রমণীর কথা এবং সেই নামগুলি শুনেই তাদের মানসিক অবস্থার তর-তম বিচার করা যায় না কিন্তু। অভিমন্যুর মৃত্যুর পর যুধিষ্ঠির সানুতাপে বলেছিলেন– সুভদ্রা, কৃষ্ণ এবং অর্জুনের সবচেয়ে অপ্রিয় ঘটনাটা আমিই ঘটিয়েছি– অহমেব সুভদ্রায় কেশবাৰ্জুনগোরপি। সুভদ্রার কথা এই প্রথম এল, কিন্তু এখনও উত্তরার নাম উচ্চারিত হয়নি যুধিষ্ঠিরের মুখে। এরপরে অর্জুন যখন অভিমন্যুর জন্য করুণ বিলাপ করছেন, তখন প্রথমে তিনি দুটি রমণীর নাম উচ্চারণ করে বলেছেন– সুভদ্রার জন্য আমার বড় কষ্ট হচ্ছে, প্রিয়তম পুত্রকে না দেখে সুভদ্রা আমাকে কী বলবে, আর দ্রৌপদীই বা আমাকে কী বলবে, আর তাদেরই বা আমি কী বলব– সুভদ্রা বক্ষ্যতে কিং মাম্ অভিমন্যুমপশ্যতী। একেবারে শেষ কল্পে এসে অর্জুন উত্তরা বন্ধুর কথা বলছেন। বলছেন– আমার হৃদয়টা নিশ্চয়ই বজ্রের কঠিন সারটুকু দিয়ে তৈরি, নইলে এই ভয়ংকর খবর শুনে বধূ উত্তরা যখন ভীষণভাবে রোদন-ক্রন্দন করবে, তবু এই কঠিন হৃদয় হাজারটা টুকরো হয়ে ফেটে যাবে না- সহস্ৰধা বধূং দৃষ্টা রুদতীং শোক কর্ষিতাম।
একে একে বিচার করি এবার। আগে বলা দরকার– মহাকাব্যের কবি এখন-এখনই উত্তরার বিলাপে নিখিল বিশ্ব ধ্বনিত করে তোলেননি। তিনি আঠেরো দিনের যুদ্ধপর্বে বীররসে ভাসছেন এখন, একটু পরেই অর্জুনের মুখে জয়দ্রথের বধ-প্রতিজ্ঞা শুনতে পাব। তবুও যে ক্রমান্বয়ে সুভদ্রা, দ্রৌপদী এবং উত্তরার কথা এল তারও একটা হেতু আছে, এমনকী ইঙ্গিতও আছে বধূ-জীবনের অসহায়তার প্রতিও–মহাকবি যা স্বকণ্ঠে বলেন না, শুধু ইঙ্গিত দেন।
প্রথমে সুভদ্রার প্রসঙ্গটা খুব স্বাভাবিক, কেননা তিনি অভিমন্যুর জননী। সন্তানের মৃত্যু হলে জননীর হৃদয় যত বিদারিত হয়, এমনটি বোধহয় অন্য কারও নয়। তা ছাড়া অর্জুনের দৃষ্টিতে তাঁর সন্তানের জন্য এবং এতদিনের লালন ঘটেছে যার মাধ্যমে, সেই সুভদ্রা তো তার স্ত্রী। অতএব স্ত্রী সুভদ্রা অভিমন্যুর মাতৃত্ব হারিয়ে কতটা কষ্ট পাবেন, এই আশঙ্কা বার বার এসেছে তার মনে। অন্যদিকে বিমাতা হওয়া সত্ত্বেও দ্রৌপদীর কথাও যে আসছে আশঙ্কার রূপ ধরে, তার কারণ দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্ব এবং অভিমন্যুর ওপরে তার পুত্ৰাধিক মমতা। ভীম-অর্জুনের মত মহাবীর এবং কৃষ্ণের মতো বুদ্ধিমান সহায় থাকতেও অভিমন্যুর কেন এই মৃত্যুগতি হল তার জবাবদিহি যিনি চাইতে পারেন, তিনি কিন্তু একমাত্র দ্রৌপদী। তৃতীয়ত এসেছে উত্তরার কথা– আজকের দিনে হলে এখনকার আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে পরিবারগুলির দাম্পত্যের কেন্দ্রায়ন যেহেতু অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এমনকী পরিবারের সরকারি সংজ্ঞার মধ্যেও যেহেতু স্বামী-স্ত্রী এবং তাদেরই সন্তান ভিন্ন অন্যতরের কোনও অস্তিত্ব নেই, তাই উত্তরার কথাটাই সবচেয়ে সংবেদনশীল হয়ে উঠত। বিশেষত তিনি গর্ভবতী এবং মাত্র ছয় মাসের মধ্যে তার দাম্পত্যের সমস্ত অনুষঙ্গ ব্যর্থ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় বর্তমান যুগের সমস্ত অনুকম্পা, সহৃদয়তা এবং সামাজিকভাবে সযৌক্তিক করুণা উত্তরার প্রতিই বাহিত হয়, ধাবিত হয়।
অথচ দেখুন, মহাকাব্যের বিশাল পটভূমির মধ্যে উত্তরার কথা আসছে সবার শেষে। আজকের দিনের নারী-মর্যাদার নতুন নিরিখে দাম্পত্য জীবনের সার্থকতা এবং সদর্থকতাই যেহেতু অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেখানে মহাকাব্যের কবির এই ক্রমান্বয়ী অনুকম্পা-বোধ আমাদের তখনকার দিনের আর্থ-সামাজিক বোধ সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে, যদিও তাদের বোধ-ভাবনাটুকুই তাদের মতো করে বুঝলে এখনকার কালেও অসহনীয় হবে না।
এটা মানতেই হবে যে, মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে যত চিন্তা, তার চেয়ে অনেক বেশি চিন্তা কিন্তু যারা বেঁচে রইলেন তাঁদের নিয়ে এবং বেঁচে-থাকা শোকাতুর মানুষগুলির বিচার কিন্তু সব সময়েই ক্রমান্বয়ী গুরুত্ব লাভ করে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে শোকার্তের সম্বন্ধ এবং সেই সম্বন্ধের সময়কালের নিরিখে। আজকের দিনে হলে আমরা উত্তরার কথাই বেশি চিন্তা করতাম, কেননা তিনি অভিমন্যুর স্ত্রী এবং তিনি গর্ভবতী অভিমন্যুর সন্তান বীজ তিনি বহন করছেন। তোক না, মাত্র ছয় মাস তার সঙ্গে বিবাহ হয়েছে, কিন্তু এখনকার দিনের পরিবারতন্ত্রের গুরুত্বের ভাবনায় স্ত্রী-সম্বন্ধই বেশি, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষত স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর পরিবারের মধ্যে তাঁর সন্তানের ভরণ-পোষণের ব্যাপারটা অনেক সময়েই অর্থনৈতিক অবহেলা এবং সামাজিক অবহেলার বিষয় হয়ে উঠত বলেই বিধবা স্ত্রী, বিশেষত গর্ভবতী অবস্থায় বিধবা রমণীর ওপর এখনকার সামাজিকদের অনুকম্পা বেড়ে ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু মহাকাব্যের কালে এই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নিষ্ঠুরতা কল্পনাই করা যায় না। একটি রমণী একটি বিখ্যাত বংশের বধূ হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল মানেই বধূ হিসেবে তার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। কুরুকুলে মহারাজ শান্তনুর বিধবা স্ত্রী সত্যবতীর মর্যাদা ভীষ্মের চেয়েও বেশি ছিল এবং অকালমৃত বিচিত্রবীর্যের দুই বিধবা স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভলাভের জন্য পরিবারের বাইরে থেকে পুরুষের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই উদারতার মধ্যে সামাজিক অবহেলার তো প্রশ্নই ওঠে না, আর অর্থনৈতিক চাপটাও রাজবাড়িতে তেমন করে অনুভূত হয়নি। ফলত উত্তরার গর্ভস্থ অভিমন্যুর সন্তান কীভাবে মানুষ হবে, অথবা অকালমৃত স্বামীর কারণে বধূর সামাজিক সুরক্ষা কতটা সুস্থির হবে, তা নিয়ে কোনও ভাবনা বা দুর্ভাবনা ছিল না।
বরঞ্চ এখানে যেটা বড় হয়ে উঠেছে, তা হল মৃত ব্যক্তির সঙ্গে সম্বন্ধ এবং সেই সম্বন্ধের সময়কাল এবং অবশ্য সম্বন্ধের নিবিড়তাও। অভিমন্যু হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে মানুষ হননি। তিনি জননী সুভদ্রার মাতৃস্নেহচ্ছায়ায় মানুষ হয়েছেন মামাবাড়িতে। বারো বছর বনবাস আর এক বছরের অজ্ঞাতবাসের কারণে অভিমন্যুর জীবনে পিতার নৈকট্য অধরা রয়ে গেছে অনেক কাল। স্বামীর অনুপস্থিতিতে অভিমন্যুর অনেকটাই জুড়ে ছিলেন সুভদ্রা এবং অনেকটাই তার মামা মহামতি কৃষ্ণা অভিমন্যু বিবাহও করতে এসেছিলেন দ্বারকা থেকে। এত বছর যিনি জননীর তত্ত্বাবধানে এবং স্নেহমায়ায় বড় হয়ে উঠেছেন, সেই অভিমন্যু বিবাহ করতে এলেন বিরাটরাজ্যে এবং তার পরের ছয় মাসের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হল– এখানে মহাকাব্যের কবির সমস্ত অনুকম্পা পুঞ্জীভূত হয়েছে অভিমন্যুর জননীর ওপরে।
জননীর বাৎসল্য, সে তো সব জননীর ক্ষেত্রেই সাধারণ, কিন্তু বীর স্বামীর অনুপস্থিতিতে পুত্রকে স্বামীর মতোই বীর করে তুলবার মধ্যে অভিমন্যুর মামা কৃষ্ণের যত নিষ্ঠা ছিল, তেমনই সুভদ্রারও বড় দায় ছিল। তিনি এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলেন এতটাই সময় ধরে যে, এই সময়-জোড়া বাৎসল্যই মহাকাব্যের কবির কাছে উত্তরার দ্বৈরথে বড় হয়ে উঠেছে। এই কারণেই যুধিষ্ঠিরের আশঙ্কিত চিত্তে সুভদ্রার হৃদয়-ভাবনা প্রথমে আঘাত করে, উত্তরার নাম সেখানে আসেই না। আর অর্জুনের ব্যক্তিগত ভয়ংকর শোকার্তির মধ্যেও একই ভাবে সুভদ্রার ভাবনা এসেছে প্রথমে এবং তার কারণ সেই একই, দায়িত্বশীলা জননীর কাছে দায়িত্ব পালন-না-করা পিতার দায়। তারপরেই এসেছে দ্রৌপদীর কথা, কেননা দ্রৌপদী অভিমন্যুকে শুধুমাত্র পুত্ৰাধিক মর্যাদা দিতেন, তাই শুধু নয়, এই মৃত্যু-ঘটনার জন্য তিনি কুঞ্চিত নাসিকায় ধিক্কার দেবেন অর্জুনের ধনুষ্মত্তার প্রতি, ভীমের বাহুবলের প্রতি। এতসব বীর-নাম থাকতে কেন মরতে হল এই কৈশোরগন্ধী যুবককে– এই জবাবদিহি চাইবেন দ্রৌপদী স্বভাবতই। কিন্তু অর্জুন পরিশেষে তাঁর প্রিয়শিষ্যা উত্তরার কথাও ভোলেননি। যে আশা নিয়ে তিনি কিশোরী-যুবতীর বর না হয়ে বরকর্তা হয়েছিলেন, সেই উত্তরা যে এইভাবে বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে এমনভাবে স্বামী হারিয়ে বিধবা হবেন, এ কষ্ট তার মতো করে কে বুঝবে! অতএব সুভদ্রা, দ্রৌপদী ছাড়াও উত্তরার জন্য বড় কষ্ট হল অর্জুনের এবং উত্তরার কথা মনে আসতে শুধু একটাই কথা তার মনে হল– বউটা আছাড়ি-পিছাড়ি করে কত কাঁদবে– আমার বুকটা তবু ফেটে যাবে না সেই কান্না দেখে, কতটা কঠিন মানুষ আমি– সহস্ৰধা বধূংদৃষ্টা রুদতীং শোককর্ষিতাম।
অর্জুন জয়দ্রথ-বধের ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কেননা এই জয়দ্রথই হলেন সেই দুষ্টতম লোক, যিনি অভিমন্যুর পশ্চাদ্ভাগে-আসা ভীম এবং অন্যান্য যোদ্ধাদের আটকে দিয়েছিলেন, যাতে তারা অভিমন্যুকে সুরক্ষা দিতে না পারেন। অর্জুন এই ভীষণ প্রতিজ্ঞা করার পরেই কিন্তু কৃষ্ণকে বললেন– তুমি তোমার বোন সুভদ্রার কাছে যাও, একই সঙ্গে যাও বধূ উত্তরার কাছেও আশ্বাসয় সুভদ্রাং ত্বং ভগিনীং সুষয়া সহ। আসলে অর্জুন নিজেও প্রিয় পুত্রের অকাল মৃত্যুতে এত শোকগ্রস্ত ছিলেন যে, তার পক্ষে সুভদ্রা এবং উত্তরার মুখোমুখি হওয়া সম্ভবই ছিল না। বিশেষত পরিচিত অতিনিকট নিজের জন হবার কারণে সুভদ্রা এবং উত্তরার শোকার্তি এমন মাত্রায় পৌঁছবে– অর্জুন জানেন– তাতে পরের দিন ভোরেবেলাতেই জয়দ্রথকে বধ করার শক্তিটুকু খানিকটা আর্দ্র হয়ে উঠতে পারে। তবে অর্জুন যে উত্তরার মানসিক অবস্থাটা সুভদ্রার চেয়ে কম করে দেখছেন না, বরঞ্চ এই গর্ভবতী বালিকা-বধূর অসহায়তা তিনি এতটাই বোঝেন যে, কৃষ্ণকে তিনি বলেছিলেন– শুধু আমার বধূ উত্তরাই নয়, তুমি তার সখী এবং দাসীদেরও সান্ত্বনা দিয়ে শোকমুক্ত করবে– সুষা-প্ৰেষ্যা-বয়স্যাশ্চ বিশোকাঃ কুরু মাধব।
অর্জুনের কথায় কৃষ্ণ ভগিনীর কাছে গেছেন, তাঁর উদ্বেল শোক যথাসম্ভব মুক্ত করার পরে একবার তিনি ভগিনী সুভদ্রাকেই বলেছিলেন– তুমি বধূ উত্তরাকে একটু শান্ত করার চেষ্ট করো। ক্ষত্রিয়-যোদ্ধার জীবনটাই এমন অনিশ্চিত, তার জন্য শোক কোরো না আশ্বাসয় সুষাং রাজ্ঞি মা শুচঃ ক্ষত্রিয়ে ভূশম। কিন্তু স্বজন-বিয়োগের শোক, বাৎসল্যময়ী জননীর শোক এমনই উত্তাল হয়ে উঠল যে, সুভদ্রার রোদন-শব্দ শুনে উত্তরা বোধহয় নিজেই সুভদ্রার কাছে চলে এসেছিলেন। কেননা একটু পরে যখন পাঞ্চালী দ্রৌপদীকে সুভদ্রার কাছে উপস্থিত হতে দেখছি, তখনই বোঝা যাচ্ছে– বৈরাটী উত্তরা সেখানেই আছেন শোককর্ষিতা মাতার কাছে অভ্যপদ্যত পাঞ্চালী বৈরাটী-সহিতং তদা। সদ্য পুত্রহারা, স্বামীহারা এই শোকাকুলা রমণীদের শান্ত করা যে কত কঠিন, সেটা কৃষ্ণ খুব তাড়াতাড়িই বুঝে গেছেন এবং বুঝেছেন– ভগিনী সুভদ্রাকে তিনি যদি বা কিছু সান্ত্বনা দিতে পেরে থাকেন, উত্তরার প্রতি তিনি তেমন নজরই দিতে পারেননি। এই সময়ে দ্রৌপদী সেখানে এসে যাওয়ায় তার বড় সুবিধা হল। সুভদ্রাকে যথাসম্ভব সান্ত্বনা দেবার পরেই কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বললেন- তুমি উত্তরাকে একটু বোঝানোর চেষ্টা করো– সুভদ্রে মা শুচঃ পুত্ৰং পাঞ্চালী আশ্বাসয়োত্তরা। কৃষ্ণ পুনরায় চলে এলেন অর্জুনের কাছে।
সত্যি কথা বলতে কি, উত্তরাকে আমরা এই সময়ে খুব পরিণত, ‘ম্যাচিয়র’ দেখছি। হয়তো মহাকাব্যের কবি পুনরুক্ত-বর্ণনার ভয়ে সুভদ্রার পাশাপাশি আর উত্তরার সন্তাপ-দুঃখ সবিস্তারে বর্ণনা করেননি, কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, সুভদ্রার উদ্বেল রোদন-মুহূর্তে যখনই উত্তরাকে তার পাশে দেখছি, তখনই বোঝা যায় নিজের উদগত অশ্রু যথাসম্ভব সম্বরণ করে শোকার্তা শাশুড়িকেই তিনি শান্ত করবার চেষ্টা করছেন হয়তো। কেননা অভিমন্যুর জন্য যত বিলাপ, তা সবই নিবদ্ধ হয়েছে জননী সুভদ্রার মুখে, উত্তরার অসহায় আর্ত কণ্ঠস্বর সেখানে শুনতে পাই না বলেই মনে হয় সুভদ্রার উদ্দেশে কৃষ্ণের সান্ত্বনা-বাক্যগুলি উত্তরা নিজের মতো করে আত্মস্থ করে নিয়েছেন। বৈরাটী উত্তরাকে আমরা অনেক পরিণত দেখতে পাই এখানে। অথবা স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে একদিনের মধ্যেই তাঁর অকাল গম্ভীর সেই পরিণতি এসেছে, যা বর্ণনা করার অবকাশ পাননি মহাভারতের কবি।
কুরুক্ষেত্রের তেরো দিনের দিন অভিমন্যু মারা গেলেন। সেই দিন সন্ধ্যা থেকে রাত্রির তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত শোক এবং ক্রোধের উদ্বেল পরিবেশের মধ্যে আমরা বারবার তবু উত্তরার নাম শুনি। আরও পাঁচ দিন যুদ্ধের পর আঠেরো দিনের দিন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়। এর মধ্যে এত ক্ষয়, এত ধ্বংস এবং এত প্রতিশোধ আমরা দেখেছি যে, তার মধ্যে বৈরাটী বালিকা-বধূর নাম উচ্চারিতই হতে পারেনি। অবশেষে যেদিন যুদ্ধ থেমে যাবার দিন এল, সেদিনও কিন্তু এক চরম বিপদ নেমে এল এই উত্তরার ওপরেই। যুদ্ধের শেষ দিনে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামার হাতে দ্রৌপদীর পাঁচটি ছেলে মারা পড়লেন। অর্থাৎ সুভদ্রার গর্ভজাত অভিমন্যুর সঙ্গে দ্রৌপদীর পুত্রেরাও কালগ্রাসে গ্রস্ত হবার ফলে পাণ্ডবদের বংশে পরবর্তী প্রজন্ম এক্কেবারে লুপ্ত হয়ে গেল।
পাণ্ডবরা নিজেরা বেঁচে রইলেন প্রত্যেকে অথচ কোনও যুদ্ধ ছাড়াই অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের বংশ ধ্বংস করার পর নিজের ব্রহ্মশির অস্ত্রখানি সম্বরণ করতে না পেরে লক্ষ্য স্থির করলেন উত্তরার গর্ভস্থ অভিমন্যুর সন্তানটি নষ্ট করার জন্য এবং সেটা অভিমন্যুর মৃত্যুর ঠিক পাঁচ দিন পরে, অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হবার দিন। এই বিড়ম্বনা আমার অদ্ভুত লাগে। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় উত্তরার স্বামী মারা গেলেন, এখন তার গর্ভস্থ সন্তানটিও মৃত্যুর জন্য নির্ধারিত হলেন। যে রমণী সংসার জীবনের ওঠা-নামা, পোড় খাওয়া কিছুই টের পেল, সে আকস্মিকভাবে তার স্বামী হারাচ্ছে এবং পুত্রকেও হারাতে বসেছে। এ কেমন যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা যুবতী বধূর বুকে। এই তো সেদিনও, ভীষ্ম বহু চেষ্টা করেও পাণ্ডবদের কোনও ক্ষতি করতে পারছিলেন না বলে দুর্যোধন তাকে দুঃখ দিয়ে বলেছিলেন- আপনি মনে হচ্ছে পাণ্ডবদের খানিকটা বাঁচিয়ে রাখছেন ইচ্ছে করে, বরঞ্চ এই যুদ্ধের ভার আপনি আমার ওপরে বা কর্ণের ওপরে ছাড়ুন, আমরাই যুদ্ধ করব। ভীষ্ম সেদিন খুব রেগে গিয়ে অর্জুনের যুদ্ধশক্তির প্রশংসা করার সময় বালিকামতি উত্তরার প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেছিলেন– যেদিন বিরাট নগরে কর্ণকে বেহুশ করে দিয়ে শুধু বালিকা উত্তরার খেলার পুতুলের জন্য তার মাথার পাগড়ি নিয়ে গিয়েছিল বিনা বাধায়, সেদিনই ওই অর্জুনের ক্ষমতা, আর তোমাদের মুরোদ বুঝেছি, বাছা– উত্তরায়ৈ দদৌ বস্ত্ৰং পর্যাপ্তং তন্নিদর্শন।
তার মানে, এই বিরাট যুদ্ধভূমিতে বিচিত্র কথাপ্রসঙ্গে এখনও উত্তরার যে বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত হয়, সে হল তার ছেলেমানুষি, তার আদর-কাড়া স্বভাব। অথচ সেই ছেলেমানুষটির ওপর দিয়ে যেন আকালিক দৈবের ঝড় বয়ে গেল। স্বামীর মৃত্যু হয়েছে পাঁচ দিন আগে, আর এখন পেটের ছেলেটিও যেতে বসেছে। উত্তরার ক্ষুদ্র-পরিসর দাম্পত্য জীবনে স্বামীর ঘরের জ্ঞাতি-কলহ যত দুর্দশা ডেকে আনল তার, তাতে আজকের দিনে হলে এই বাড়িটার ওপরেই তার একটা ঔদাসীন্য আসত। কিন্তু সেকালের দিনে একজন রাজবধূ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত হতাশায় চালিত হতেন না, পরিবারের ঐতিহ্য-গর্ব এবং রাজকীয় মর্যাদা তার মধ্যে জীবনধারণের অন্যতর আসক্তি দান করত। লক্ষ্য করে দেখুন, অশ্বত্থামা তার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য দুর্দম্য পাণ্ডবদের কাউকে লক্ষ্য বেছে নেননি, ক্ষত্রিয়ের রক্ত তার ধমনীর মধ্যে কোনও বীরোচিত উষ্ণতা জাগায় না বলেই তিনি এমন একটা টারগেট’ নিয়েছেন যাতে পাণ্ডবদের পরবর্তী প্রজন্মটাই নষ্ট হয়ে যায়। তিনি আগে দ্রৌপদীর পাঁচটি ছেলেকে নিদ্রাগত অবস্থায় ঘুম থেকে তুলে মেরে ফেলেছেন, এখন তিনি লক্ষ্য স্থির করেছেন পাণ্ডবদের শেষ সন্তানবীজটির ওপর।
অথচ ঠিক এই জায়গা থেকেই স্বামীহারা উত্তরার পারিবারিক মর্যাদা বিপ্রতীপভাবে বাড়তে থাকে। কুরুক্ষেত্রের এই বিরাট যুদ্ধের মধ্যে একজন সামান্য কুলবধূ– কেননা তিনি দ্রৌপদীও নন, এমনকী সুভদ্রাও নন– মাত্র ছয় মাসের বিবাহিতা বধূটি হঠাৎই যেন বিপ্রতীপভাবে ভাস্বর হয়ে ওঠেন। হয়তো এখানেও সকলের অলক্ষ্যে সেই পুরুষতান্ত্রিকতা আছে, কেননা উত্তরার গর্ভে রাজবংশের শেষ সন্তানটি জীবিত আছে যার মধ্যে পাণ্ডববংশের সুস্থিতির আশ্বাস পাওয়া যায়। কিন্তু ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে মহাকাব্যের বিচার না করলেও চলে, কেননা উত্তরা অভিমন্যুর স্ত্রী ছয় মাস মাত্র বিয়ে হলেও তার জন্য পাণ্ডবরা যথেষ্টই অবহিত। দ্রৌণি অশ্বত্থামা সত্যিই তার ব্রহ্মশির অস্ত্রসম্বরণের উপায় জানতেন না– এই সরল মহাকাব্যিক বিশ্বাসের চেয়েও যেটা বড় হয়ে ওঠে, সেটা হল– অশ্বত্থামা ঠিক করেই রেখেছিলেন যে, উত্তরার গর্ভস্থ সন্তানটিকে নষ্ট করে তিনি পাণ্ডবদের অস্তিত্ব নষ্ট করে যাবেন। তিনি বলেছিলেন– আপনারা আমার মাথার মণি চেয়েছেন, সেটা নিন, কিন্তু আমার ছোঁড়া বাণটা কিন্তু লাগবেই– ঈষিকা তু পতিষ্যতি৷ পাণ্ডবরা সকলে সন্তান-বীজের যে আধার-গর্ভটির ওপর নির্ভর করে আছেন, সেখানে এই অস্ত্রপাত নিশ্চিত ঘটবে– গর্ভেযু পাণ্ডবেয়ানাম্ অমোঘষ্ণৈত উদ্যতম।
বৃহত্তর স্বার্থে, বৃহত্তর ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে মধ্যস্থ ভগবান ব্যাস মেনে নিয়েছিলেন অশ্বত্থামার কথা বলেছিলেন– তবে তাই হোক। কিন্তু কৃষ্ণ, যিনি ভাগিনেয় অভিমন্যুর মৃত্যুতে ভগিনী সুভদ্রা এবং পাণ্ডব কুলবধূ উত্তরার জন্য মর্মে মরে আছেন, তিনি অশ্বত্থামার এই বেয়াদপি সহ্য করলেন না। তিনি বললেন–দেখ অশ্বত্থামা! বিরাট রাজার মেয়ে গাণ্ডীবধন্বা অর্জুনের পুত্রবধূ। উপপ্লব্যে যখন ওঁরা ছিলেন, তখন এক ব্রাহ্মণ এসে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, উত্তরাকে– কৌরব-পাণ্ডবের বংশ যখন ক্ষীণ, পরিক্ষীণ হয়ে আসবে, তখন তোমার গর্ভে পুত্র আসবে– পরিক্ষীণেষু কুরুষু পুত্রস্তব ভবিষ্যতি! ব্রাহ্মণের সেই বচন মিথ্যা হবে বলে মনে করি না। পরিক্ষীণ বংশে উত্তরার পুত্র পাণ্ডবদের বংশ রক্ষা করবে বলেই তার নামও হবে পরিক্ষিৎ পরিক্ষিভবিতা হোষাং পুনর্বংশকরঃ সুতঃ। অতএব তুমি যা ভাবছ, তা হবে না অশ্বত্থামা। পরিক্ষিৎ’ নামটা ব্যাকরণের যন্ত্রণা, যাতে ‘পরীক্ষিৎ পরিক্ষিৎ হয়েছেন।
অশ্বত্থামা যে পূর্বপরিকল্পতভাবে পাণ্ডবদের নিরীহ বংশধর সন্তানদেরই ধ্বংস করার জন্য ফন্দি এঁটেছিলেন, তা এই জায়গায় আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। অশ্বত্থামা কৃষ্ণকে বললেন– জানি এবং বুঝি তোমার ব্যাপার। ভাগনে-বউ বলে কথা, তোমার সখার পুত্রবধূ। তার ওপরে একটা স্নেহ-পক্ষপাত তো তোমার থাকবেই। তবু জেনো, যেমনটি তুমি বলছ, তেমনটা হবে না– নৈতদেবং যথাস্থ ত্বং পক্ষপাতেন কেশব। আমি যা বলেছি, তা হবেই। বিরাটনন্দিনী উত্তরার যে গর্ভ তুমি রক্ষা করতে চাইছ, আমার এই ব্রহ্মশির অস্ত্র তার গর্ভ নষ্ট করবেই। কৃষ্ণ অশ্বত্থামার বাক্য মেনে নিয়েও প্রবেশ করলেন আপন স্বকীয়তার মধ্যে। পাণ্ডবদের বংশকর সন্তানবীজটিকে তিনি ধ্বংস হতে দেবেন না। তিনি বললেন– হ্যাঁ, ব্রহ্মশির অস্ত্রের মতো অমোঘ অস্ত্রের নিক্ষেপ ব্যর্থ হবে না, জানি। কিন্তু এও তুমি জেনে রেখো–উত্তরার গর্ভস্থ সন্তান যদি মৃত হয়েও জন্মায়, তবু সে দীর্ঘ আয়ু লাভ করবে– স তু গর্ভো মূতো জাতো দীর্ঘমায়ুরবাতি। কিন্তু মাঝখান দিয়ে তোমার দশাটা কী হবে? গর্ভশয্যায়-থাকা শিশুহত্যার জন্য তুমি শাস্তি পাবে সারাজীবন। লোকে তোমাকে কাপুরুষ বলবে, পাপী বলবে- অসকৃৎ পাপকর্মাণং বাল-জীবিতঘাতকম্। তুমি আমার ক্ষমতা দেখো, অশ্বত্থামা! তোমার শাগ্নিদগ্ধ শিশুকে আমি বাঁচিয়ে তুলব। উত্তরার সেই ছেলের নাম হবে পরিক্ষিৎ এবং সেই পাণ্ডব-কুরুবংশের রাজাও হবে। আমার যদি কোনও সত্য প্রতিষ্ঠা থাকে, তপস্যার শক্তি থাকে, তবে এই সন্তানকে আমি বাঁচিয়ে তুলব, সেটা তুমি দেখে নিয়ো– অহং তং জীবয়িষ্যামি দগ্ধং শস্ত্রাগ্নিতেজসা।
এই মুহূর্তে উত্তরার গর্ভস্থ পুত্রকে বাঁচানোর কথাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। স্বামীহারা উত্তরার কাছেও হয়তো তার পুত্রের জীবনের আশ্বাসটাই সবচেয়ে বড় কথা, তবু বারবার অশ্বত্থামার প্রতি কৃষ্ণের যে ক্রোধ-আক্ষেপ বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্যে কুরু পাণ্ডবদের বংশকর সন্তানের জন্য দুর্ভাবনাই যেন বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। উত্তরার হৃদয়ে, মনে মৃতপতিকা রমণীর অন্তর-যাতনার চেয়েও অতি পৃথক ভাবে তার স্ফীত-ফুট গর্ভটুকুই যেন এই মুহূর্তে বড় বেশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সঙ্গে-সঙ্গে বড় বেশি অনুভূত হয় পৌরুষেয়তার সেই চিরাচরিত অভিসন্ধি– উত্তরার গর্ভ যদি সুরক্ষিত থাকে, তবে পাণ্ডবরাও বংশলাভ করবেন। স্বামীহারা জননীর সমস্ত আকাঙ্ক্ষা, এই সন্তানজন্মের সাফল্যের সঙ্গে মিশে থাকায় পৌরুষেয়তায় অভিসন্ধি কেমন অদ্ভুত ছলে মিশে যায় তার সঙ্গে, আর সেইজন্যই মাত্র ছয়-সাত মাসের এই নায়িকাকে বড় অসহায় লাগে। কিন্তু স্বামীর জন্য উত্তরা-বৈরাটীর হৃদয় কত পোড়ে, তা বোঝা যায় যুদ্ধশেষে, হাজারো স্ত্রীকুলের মধ্যে উত্তরাকে যখন দেখতে পাই মহাভারতের স্ত্রীপর্বে।
মহাভারতের স্ত্রীপর্ব এমন একটা জায়গা, যেখান থেকে মহাভারতের রমণী-নায়িকাদের অনেককেই খুব ব্যক্তিগতভাবে চেনা যায়। সেই বিরাটপর্বে যখন থেকে উত্তরার সঙ্গে অভিমন্যুর বিয়ে হয়েছে, তখন থেকে এতাবৎ পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে উত্তরার দাম্পত্য জীবনের কোনও সংবাদ পাইনি। মহাকবিদের এই এক স্বভাব– তাঁরা সব চরিত্রের সব কথা পরপর লিপিবদ্ধ করেন না, মূল ঘটনা চালিয়ে যেতে যেতে প্রসঙ্গান্তর হয় বটে, তবু গভীর অপ্রসঙ্গে না গিয়ে কোনও এক জায়গায় বিপরীত বর্ণনায় তিনি পূর্বের কথা, পূর্বের ব্যবহার জানিয়ে দেন। যেমন, আমরা তো জানতামই না যে, অভিমন্যুর দাম্পত্য-জীবনের মধ্যেও একটা দারুণ রোম্যান্টিক অ্যাপ্রোচ’ ছিল। আমরা জানতাম– অভিমন্যু তার বীরোচিত ক্রিয়াকর্মে এতটাই ব্যাপৃত এবং ব্যস্ত ছিলেন যে, স্ত্রীকে বুঝি তিনি সময়ই দিতে পারতেন না কোনও। এই ভাবাটা খুব অস্বাভাবিকও নয়। এত সংক্ষিপ্ত অভিমন্যুর জীবন এবং ততোধিক সংক্ষিপ্ত যেহেতু তাদের দাম্পত্যের কাল এবং তদুপরি বিবাহোত্তর জীবনে এতই তাড়াতাড়ি এমন বিরাট যুদ্ধ এসে গেল, সেখানে মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই অভিমন্যু এমন মধুর অভিসার সৃষ্টি করেছিলেন নববধূ উত্তরার জীবনে– এ-কথা আমরা জানতেই পারতাম না– যদি না এই অন্তিম স্ত্রীপর্বে এসে জননী গান্ধারীর জবানিতে উত্তরা-অভিমন্যুর পূর্বজীবনের হদিশ পেতাম।
কৃষ্ণ-যুধিষ্ঠিরদের সঙ্গে নিয়ে গান্ধারী যখন রণক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন সেই বীরভূমিতে করুণ-রসের রাজত্ব চলছে। শত শত রমণীর ক্রন্দনে রণাজির কর্দমাক্ত, মৃতদেহগুলি বেশির ভাগ অঙ্গহীন, বিকৃত, তার মধ্যে শেয়াল-শকুনের অতি-সতর্কতায় এবং ক্রন্দনরতা রমণীদের অসতর্কতায় অদ্ভুত এক বীভৎসতা সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে গান্ধারীর দিব্য-দৃষ্টি পড়ল বৈরাটী উত্তরার ওপর। সপ্তরথীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হলেও অভিমন্যুর বীর-শরীর এখনও অবিকৃত। অনিন্দ্যসুন্দরী বালিকা উত্তরা শোকে মুহ্যমান। তবুও প্রিয় স্বামীর রণশায়িত মূর্তি দেখে আপন জীবনবোধে তার শব-শরীর থেকে সমস্ত ধূলি সরিয়ে দিচ্ছিলেন কোমল অঙ্গুলি-চালনায় বিরাটদুহিতা কৃষ্ণ পাণিনা পরিমার্জিতে।
মহাভারতের ‘অপূর্ব-নির্মাণ-নিপুণ কবি এই মুহূর্তে তিনটি বিশেষণ দিয়েছেন উত্তরার। বলেছেন– উত্তরা মনস্বিনী রমণী, উত্তরা ‘কামরূপবর্তী’ অর্থাৎ রাজনন্দিনীর যেমন রূপ আমরা কল্পনা করি, উত্তরা তেমনই সুন্দরী, আর তিনি হলেন ‘ভাবিনী’ অনুরাগবতী, অর্থাৎ অভিমন্যুর ভাবের ভাবিনী, তদগতা, তদাত্মিকা। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই যিনি স্বামী হারিয়েছেন তার তো শোকে-দুঃখে তদৃগতা হবারই কথা, কিন্তু শোকের কারণ এই আকস্মিক মৃত্যুই তদাত্মতার একমাত্র কারণ নয়। এর পিছনে নব-বিবাহিত উত্তরা অভিমন্যুর পূর্বনির্মিত অনুরাগ-পদ্ধতি থাকায় দুটি বিশেষণ আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ মনস্বিনী, অনুরাগবতী এবং তদ্ভাব-ভাবিনী উত্তরার শোক-সংকুল করুণ অবস্থার মধ্যেও কোথা থেকে শৃঙ্গার-রসের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এ-সব রসশাস্ত্রের কথায় পরে আসছি।
উত্তরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না যে, অভিমন্যু মারা গেছেন। মৃত অবস্থাতেও অভিমন্যুর প্রতি এই জীবিতবৎ আচরণ তার স্বল্পকালীন বৈবাহিক জীবনের ক্রমিকতা ফুটিয়ে তুলছে, জাগিয়ে তুলছে সেই হাহাকার– এখনও সব কিছু বোধহয় শেষ হয়ে যায়নি। নিপুণ অঙ্গুলিচালনায় অভিমন্যুর শরীর থেকে সব ধূলিকণা সরিয়ে দিয়ে উত্তরা তার প্রিয় স্বামীর বুক থেকে রুধিরলিপ্ত স্বর্ণখচিত বর্মখানি খুলে দিলেন, তারপর তাকিয়ে রইলেন সেই উন্মুক্ত শরীরের দিকে বিমুচ কবচং বীরশরীরমভিবীক্ষতে। অদূরবর্তী গান্ধারী দিব্য দৃষ্টিতে দেখছেন– কী করছেন উত্তরা। মৃত স্বামীর বর্মমুক্ত বীর-শরীরের প্রতি নববধূ উত্তরার এই অভীক্ষণের অর্থ জননী গান্ধারী যত বোঝেন, তার চেয়েও বেশি বোঝেন রমণী গান্ধারী। গান্ধারীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন কৃষ্ণ। উত্তরা অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কৃষ্ণকে বললেন- তোমার চোখের মতোই এর চোখ দুটো ছিল, কৃষ্ণ! শক্তি, তেজ, রূপ সবই তো তোমার মতো, সেই তোমার অভিমন্যু আজ মাটিতে পড়ে আছে– অয়ং তে পুণ্ডরীকাক্ষ শেতে ভুবি নিপাতিতঃ। আসলে এ যেন কৃষ্ণের প্রতি এক অধিক্ষেপ। ভাবটা এই– আপন সদৃশ মানুষকে সদৃশ জন আপন মায়ায় বাঁচাতে চেষ্টা করে। তুমি এই অভিমন্যুকে বাঁচাতে পারোনি, কৃষ্ণ!
অভিমন্যুর এই ধূলিশায়িত মলিন অবস্থা দেখে কেঁদে উঠেছেন উত্তরা। কিন্তু সেখানেও তার শৃঙ্গার-শোভন প্রত্যঙ্গ-অনুভূতি কাজ করছে। উত্তরা বলছেন– বীরত্বে যতই কঠিন হও তুমি, তোমার সমস্ত শরীর বড় নরম ছিল, তুমি শয়ন করতে রঙ্কু-মৃগের চর্মশয্যায়। সেই তোমার শরীর এমন করে মাটিতে লুণ্ঠিত হচ্ছে, তোমার কঠিন দুই বাহু, যা নাকি এখনও ধনুষ্ঠুণ সঞ্চালনের জন্য কঠিন চর্মাবৃত, সেই বাহু-দুটিকে কেমন প্রসারিত করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তুমি শুয়ে আছ–তোমার কষ্ট হচ্ছে না– কাঞ্চনাঙ্গদিনৌ শেষে নিক্ষিপ্য বিপুলৌ ভুজৌ। ক্ষণিকের মধ্যেই উত্তরার মনে হচ্ছে বড় ঘুম পেলে বুঝি মানুষের এইরকম হয়। বিস্রস্ত বাসের মধ্যে এমন এলোমেলো চুল উতলা শয়নের ভঙ্গি বুঝি একমাত্র ঘুমোলেই হয়– এমন বোধে উত্তরা বললেন– বুঝেছি, সারা দিন এতটাই যুদ্ধব্যায়াম গেছে তোমার, তাতেই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আর কথাই বলছ না আমার সঙ্গে। আমি তো অন্যায় কাজও করিনি, তবু তুমি কথা বলছ না কেন আমার সঙ্গে, কেন? কেন? ক্ষণিকের মধ্যেই আবার সেই বাস্তব চেতনা ফিরে আসে উত্তরার। উত্তরা বলেন– আগে কত দূর থেকে তুমি যদি আমায় দেখতে পেতে, তো তখনই তুমি আমায় অভিভাষণ করে কাছে ডাকতে– ননু মাং ত্বং পুরা দুরাদভিবীক্ষ্যাভিবাষসে– আজ তা হলে কী হল।
আমরা পূর্বে উত্তরার বিবাহ-মুহূর্ত থেকে অভিমন্যুর যে ব্যস্ত জীবনধারা দেখেছি, তাতে আমাদের ধারণাও ছিল না যে, এই কয় মাসের যুদ্ধোদ্যোগের মধ্যে উত্তরার সঙ্গে এই বালক-বীরের কতটা প্রণয় জন্মেছে যে, দূর থেকে দেখতে পেলেও তাকে অভিভাষণ না করে থাকতে পারতেন না অভিমন্যু। এই প্রণয়ের গভীরতা আজকে এসে জানতে পাচ্ছি, এই স্ত্রীপর্বে উত্তরার বিলাপ-ধ্বনির মধ্যে। এ এক অদ্ভুত কৃতিত্ব মহাভারতের কবির। মহাকাব্যের বিশাল কাহিনি-তন্তুর জমাট বাঁধুনির মধ্যে ভীষ্ম-দুর্যোধন অথবা ভীমার্জুনের তুলনায় উত্তরার চরিত্র নেহাৎই অকিঞ্চিৎকর এবং তার চেয়েও বুঝি অকিঞ্চিৎকর উত্তরা-অভিমন্যুর প্রেমালেখ্য-তত্ত্ব। পাঠকের মন বুঝেই মহাকবি তাই উত্তরা-অভিমন্যুর দাম্পত্য-জীবনের বিস্তার নিয়ে এতটুকু মাথা ঘামাননি। তাদের বিবাহের পরেই কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধোদ্যোগ এবং অবশেষে যুদ্ধ। সেই অষ্টাদশ দিবসের যুদ্ধও তিনি শেষ হতে দিয়েছেন, কিন্তু আজ এই স্ত্রী বিলাপ-পর্বে এসে মহাকবির শব্দমন্ত্রে এমন দু’-একটি পঙক্তি তিনি লিখে ফেলছেন, যাতে এক-একজন উপেক্ষিত যুদ্ধ বীরের অথবা বহু-উপেক্ষিতা রমণীর অস্ফুট রোমাঞ্চ জীবন্ত। হয়ে উঠছে। সেই সব সরস পঙক্তির কাব্য-ব্যঞ্জনা-মহাভারতের স্ত্রী-বিলাপের এক-একটি খণ্ডাংশে বিধৃত আছে এবং সেগুলি প্রাচীন আলংকারিকদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অলংকার-গ্রন্থে উল্লিখিত সেইরকম একটা মহাকাব্যিক উদাহরণ দিলে উত্তরার সামগ্রিক জীবনটাও আমাদের কাছে যেমন পরিষ্কার হয়ে উঠবে, তেমনই বিপ্রতীপভাবে অভিমন্যুর মৃত্যুতে তার কষ্টটাও আমাদের কাছে মর্মন্তুদ হয়ে উঠবে।
মহাভারতের যুদ্ধকালে দুর্যোধনের পক্ষে ভূরিশ্রবা নামে এক বীর ভয়ংকর যুদ্ধ করেছিলেন অর্জুনের সঙ্গে। ভূরিশ্রবাকে ঠিকমতো পর্যদস্ত করতে না পেরে অর্জুন একসময় তার হাত দুটি কেটে ফেলেন একেবারে কঁধ থেকে। পরে অর্জুন-শিষ্য সাত্যকি তাকে মেরে ফেলেন। মহাভারতে ভূরিশ্রবার এই মৃত্যু নিয়ে কিছু তর্ক-বিতর্ক আছে, কিন্তু সে সব বাদ দিয়ে বলা যায়– ভূরিশ্রবার সঙ্গে আমাদের সঠিক এবং সংক্ষিপ্ত পরিচয় হয়। এই আঠেরো দিন যুদ্ধের কালেই শুধু। সেই অনুল্লেখ্য ভূরিশ্রবারও যে একটা রোমাঞ্চকর রমণীমোহন শক্তি ছিল, তা শুধু প্রকট হয়ে ওঠে এই স্ত্রীপর্বে গান্ধারীর মুখে। গান্ধারী দেখছেন– ভূরিশ্রবার অনেকগুলি স্ত্রী, প্রত্যেকেই তারা ভূরিশ্রবার অঙ্গস্পর্শে পাগল ছিল। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে ভূরিশ্রবার মৃতদেহটি দেখতে পেল এবং একটু দূরেই পেল তার কর্তিত হস্তদুটি। ভূরিশ্রবার প্রিয়া পত্নীরা ভূরিশ্রবাকে ঘিরে শোক করছিলেন, এরই মধ্যে ক্ষীণকটি এক প্রিয় (পাঠক! শুধুমাত্র ক্ষীণকটি ব্যাসের ভাষায় মুষ্টিতে ধরা যায় এমন মাজা– কর-সম্মিত-মধ্যমা– শুধুমাত্র এই একটা শব্দে এই রমণীর স্তন-জঘনের রূপ বোঝা যায়), সেই প্রিয়া রমণী ভূরিশ্রবার ছিন্ন বাহুটি কোলের ওপরে তুলে নিয়ে বলল– এই সেই হাত! যে হাত একদিন আমার নাভি-ঊরু-জঘন-স্পর্শী রশনার বাঁধ ভেঙে দিত, যে হাত আমার পীন-স্তনের মর্দন-সুখ অনুভব করত– এই সেই হাত, যে হাত একদিন সমস্ত শত্রুর বিনাশ ডেকে এনেছিল, বন্ধুদের দিয়েছিল বরাভয়, এই সেই হাত–অয়ং স রশনোৎকষী পীন স্তন-বিমর্দনঃ।
যুদ্ধক্ষেত্রে বিলাপরতা সুন্দরীর স্বমুখ-কীর্তিত এই শৃঙ্গার ঘোষণা আমাদের সংবেদনশীল আলংকারিকদের চোখ খুলে দিয়েছে। তারা বলেছেন– আপাতদৃষ্টিতে খুব বিপরীতধর্মী মনে হতে পারে এই সরসতা; মনে হতে পারে যে, কাব্যের মধ্যে যেখানে করুণ রসই প্রধান, সেখানে প্রিয়জনের জন্য আলুথালু মরণ-বিলাপের মধ্যে এমন শৃঙ্গার-রসের আমদানি কাব্যান্তরবাহী প্রধান করুণ-রসটাকে একেবারে লঘু করে তোলে এবং সেটাকে রস না বলে রসাভাস বলাটাই ঠিক হয়। তারা এই প্রশ্ন তুলে সিদ্ধান্ত শুনিয়ে বলেছেন– মোটেই নয়। শৃঙ্গার অথবা বীররস আপাতদৃষ্টিতে করুণ-রসের পরিপন্থী বলে মনে হতেই পারে, কিন্তু এমনও ক্ষেত্র আছে যেমন এই ভূরিশ্রবার ছিন্ন বাহু দেখে তাঁর অন্যতম প্রিয়ার যেমন অনুভূতি হয়েছিল, তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, ক্ষেত্রবিশেষে শৃঙ্গার-রস এবং বীর রস গৌণ ভূমিকায় থেকে কাব্যবাহী প্রধান করুণ-রসকে আরও পরিপুষ্ট করতে পারে, বিশেষত মৃত্যুর কারুণিক বিলাপ-বাক্যের মধ্যে পূর্বকালীন অবস্থার স্মরণ-মনন যেহেতু ঘটতেই পারে, তাই এই আর্তা সুন্দরীর মুখে ভূরিশ্রবার শৃঙ্গার-মোহন পূর্বকথা করুণ-রসের পরিপোষণ ঘটাচ্ছে–আলংকরিক মম্মটাচার্যের ভাষায়–অত্র পূর্বাবস্থা-স্মরণং শৃঙ্গারাঙ্গম অপি করুণং পরিপোষয়তি। এমনকী সেই বিলাপের মধ্যে যখন ভূরিশ্রবার শত্রু-বিজয়ের ক্ষমতা এবং বীরদর্প প্রকট হয়ে ওঠে, তখন বীররসও অপ্রধান ভূমিকায় থেকে মৌল করুণ রসকে পুষ্ট করে।
আরও পরিপুষ্ট করতে পারে, বিশেষত মৃত্যুর কারুণিক বিলাপ-বাক্যের মধ্যে পূর্বকালীন অবস্থার স্মরণ-মনন যেহেতু ঘটতেই পারে, তাই এই আর্তা সুন্দরীর মুখে ভূরিশ্রবার শৃঙ্গার মোহন পূর্বকথা করুণ-রসের পরিপোষণ ঘটাচ্ছে–আলংকরিক মম্মটাচার্যের ভাষায়–অত্র পূর্বাবস্থা-স্মরণং শৃঙ্গারাঙ্গম্ অপি করুণং পরিপোষয়তি। এমনকী সেই বিলাপের মধ্যে যখন ভূরিশ্রবার শত্রু-বিজয়ের ক্ষমতা এবং বীরদর্প প্রকট হয়ে ওঠে, তখন বীররসও অপ্রধান ভূমিকায় থেকে মৌল করুণ-রসকে পুষ্ট করে।
আমরা মহাভারতের ভূরিশ্রবা-সংক্রান্ত আলংকারিক উদাহরণটি এই কারণেই পর্যালোচনা করলাম, যাতে উত্তরার পূর্বকালীন মধুর দাম্পত্যটুকুও আমরা বুঝতে পারি। যে বালিকা একদিন মহাবীর অর্জুনের বীরত্বে মুগ্ধা ছিলেন, সেই বালিকাকে যুবতীর পরিপূর্ণতা দিতে তরুণ অভিমন্যুর সময় লাগেনি এতটুকু। এই তারুণ্যের বিকাশ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা প্রকট হয়ে ওঠে জননী গান্ধারীর জবানিতে। আশ্চর্য লাগে–তাঁর কানেও উত্তরা-অভিমন্যুর প্রেমজল্প ঠিক পৌঁছে গেছে। মহাভারতের কবির শব্দমন্ত্রে যুবতী উত্তরার বিশ্লেষণ সেই তিন শব্দ–সকলে স্পৃহা করে এমন তার রূপ, তিনি মনস্বিনী এবং তদ্ভাব-ভাবিনী। গান্ধারী বলছেন– উত্তরা মৃত অভিমন্যুর প্রস্ফুটিত পদ্মের মতো মুখখানির ঘ্রাণ নিতে গিয়েই একটু লজ্জা পেলেন সকলের সামনে–তস্য বক্তৃপাম্ৰায় সৌভদ্রস্য মনস্বিনী–তবু তিনি নির্লজ্জের মতোই আলিঙ্গন করলেন দয়িত অভিমন্যুকে–কামরূপবতী চৈষা পরিস্বজতি ভাবিনী।
এই যে গান্ধারী, কৃষ্ণ-বাসুদেব, যুধিষ্ঠির ইতাদি মহাব্যক্তিত্বের সামনে প্রথমত খানিক লজ্জিত হয়েও পূর্ণ আলিঙ্গনে মৃত অভিমন্যুর মস্তকাঘ্রাণ করলেন উত্তরা–এ থেকে একদিকে যেমন তার মমত্বময়ী প্ৰেম-চেতনা বেপরোয়াভাবে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে, তেমনই অন্যদিকে তাঁর পূর্বকালীন অভ্যাসগুলিও প্রকট হয়ে ওঠে। গান্ধারী অনুমান করছেন–পূর্বেও নিশ্চয়ই এই রাজনন্দিনী উত্তরা প্রিয়মিলনের আনন্দে এইভাবেই মদ্যপানে মত্ত হত এবং সম্ভবত এইভাবেই অভিমন্যুকে আলিঙ্গন করত–লজ্জমানা পুরা চৈনং মাধ্বীকমদমূৰ্ছিতা। গান্ধারীর একটি বাক্য থেকেই বিলাপ-করুণ উত্তরার পূর্ব-দাম্পত্যের শৃঙ্গার-মধুর গভীরতা এক মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা সেই বৈবাহিক কাল থেকে উত্তরা-অভিমন্যুর যে দাম্পত্য জীবন কল্পনা করেছি, যা অনেকটাই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আমাদের অগম্য ছিল, তা এক মুহূর্তে অভিমন্যুর শৃঙ্গার-সুবাসে প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গান্ধারী বলছেন–উত্তরার কোনও বোধ কাজ করছে না। সে কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে প্রিয়তম স্বামীর সঙ্গে, ভাবছে যেন বেঁচে আছে তার স্বামী। নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলছে মৃত-মূক অভিমন্যুকে। অথচ সে একটা কথারও জবাব পাচ্ছে না– উৎসঙ্গে বাধায় জীবন্তমিব পৃচ্ছতি।
উত্তরা অভিমন্যুর মাথার কাছে এসে বসেছেন। তার শোণিতদিগ্ধ ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত কেশগুলি সরিয়ে দিয়ে তার মুখখানি নিজের কোলের ওপর ন্যস্ত করলেন উত্তরা। তারপরে প্রশ্ন করলেন জীবিতমানিতায়–আচ্ছা! তুমি না বাসুদেব-কৃষ্ণের ভাগনে, তুমি না গাণ্ডীবধন্থা অর্জুনের পুত্র! তবু তোমাকে এইসব মহারথ যোদ্ধারা যুদ্ধভূমিতে মেরে ফেলল কী করে–কথং ত্বাং রণমধ্যস্থং জঘুরেতে মহারথাঃ। মনস্বিনী উত্তরা দুই ধারে কথা বলছেন। অভিমন্যুর বীরত্ব এবং শৌর্য-বীর্যের প্রতি কোনও দিন তাঁর অশ্রদ্ধা ছিল না, এখন এই দীর্ণ মরণের পরেও তার সেই অশ্রদ্ধা নেই। কিন্তু এতক্ষণে তিনি জেনে গেছেন–পাণ্ডবরাই তাকে চক্রব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করতে বলেছিলেন। তা নয় প্রবেশ করলেনও, কিন্তু একই সঙ্গে কৃষ্ণ-বাসুদেবের ভাগনে, অর্জুনের পুত্র এবং বিপক্ষ-কুলকে যেন বেশি সম্মান দিয়ে ‘মহারথ’ বলে সম্বোধন করায় উত্তরার মুখে এই মুহূর্তে কৃষ্ণ এবং অর্জুন যেন ছোট হয়ে গেছেন। তিনি বোঝাতে চাইছেন–এই বহুকীর্তিত সম্বন্ধের কী মূল্য হল, যখন কৃষ্ণ এবং অর্জুন রণক্ষেত্রে থাকলেও দ্রোণ-কৃপ-কর্ণ-অশ্বথামা–এঁরা কত বড় মহারথ যোদ্ধা, যাতে তরুণ অভিমন্যুকে মরতে হল এইভাবে।
অভিমন্যুর স্ত্রী বলেই সেই বীরমানিতা তার মধ্যেও আছে, আছে সেই মহাকাব্যিক যুদ্ধনীতির বোধ, যাতে কিছুতেই উত্তরা ক্ষমা করতে পারছেন না প্রতিপক্ষের সপ্তরথীকে, যাঁরা সকলে মিলে একক অভিমন্যুকে বধ করেছেন। ধিক্কারে-ধিক্কারে উত্তরা তুচ্ছ করে দিয়েছেন মহারথ যোদ্ধাদের সমস্ত বীরদর্প। অদ্ভুত মনস্তত্ত্ববিচারণায় উত্তরা বলেছেন– তাদের তুলনায় তুমি নিতান্তই বালক এবং তাও একাকী। কেমন হয়েছিল এই সময়ে তাদের মন যারা আমাকে বিধবা করে দুঃখ দেবার জন্য এতগুলো তোক একসঙ্গে এমন প্রহার করেছিলেন তোমাকে–বালং ত্বং পরিবার্যেবং কণ্বমাসীত্তদা মনঃ। সুন্দরী উত্তরা জানেন না–একত্রে যারা তাঁর স্বামীকে আঘাত হেনেছিল, তারা কেউ সেই মুহূর্তে উত্তরার কথা ভাবেনি। যুদ্ধবীর অভিমন্যুকে হত্যা করাই তাদের সেদিন প্রথম এবং শেষ কাজ ছিল। প্রিয় স্বামীর এই মৃত্যুতে উত্তরা যেমন বিপক্ষীয় যোদ্ধাদের ক্ষমা করতে পারছেন না, তেমনই পারছেন না স্বপক্ষীয় বীরদেরও সহ্য করতে। বারবার তিনি বলছেন–মহাবীর পাণ্ডব ভাইদের এবং পাঞ্চালদের কেমন সেই সুরক্ষা-ব্যবস্থা যাতে এমন অনাথের মতো প্রাণ হারাতে হল তোমাকে–কথং নু পাণ্ডবানাঞ্চ পাঞ্চালনাঞ্চ পশ্যতাম। উত্তরার শেষ ক্ষোভ সেই অর্জুনের ওপর যাকে দেখে এককালে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন বালিকার বীরপূজা ভাবনায়। আজ অর্জুনকে দেখে তাঁর অদ্ভুত লাগছে। উত্তরা বলছেন–এতগুলো লোক একসঙ্গে তোমাকে মারল দেখেও তোমার পুরুষশ্রেষ্ঠ বীর পিতা বেঁচে রয়েছেন কী করে– বীরঃ পুরুষ-শার্দুলঃ কথং জীবতি পাণ্ডবঃ। তুমি মারা যাওয়ায় আজকের এই সর্বশত্রু পরাজয় অথবা রাজ্যলাভ–কোনওটাই পাণ্ডবদের কাছে মধুর হবে না।
এই ধিক্কার-বিলাপের পরে আবারও উত্তরার মুখে ভেসে আসে সেই দাম্পত্য-জীবনের পূর্ব-রোমাঞ্চ। তিনি বলেন–কোথায় যাবে তুমি আমাকে ফেলে? তুমি যে শত্ৰুবিজয়ীর স্বর্গে গেছ, আমিও শীগগিরই যাব। সেখানে কিন্তু তুমি আমাকে আগের মতোই দেখে রাখবে–ক্ষিপ্রমন্বগমিষ্যামি তত্র মাং পরিপালয়। উত্তরার কেমন এক ঈর্ষাও হচ্ছে মনে মনে। পুরাণ-প্রসিদ্ধিতে তিনি শুনেছেন–পিতৃলোকে, স্বর্গলোকে কত সব সুন্দরী অপ্সরাদের আবাস, যখন-তখন তাঁরা পুণ্যবান জনের সমাশ্লেষে ধরা দেন। উত্তরা বলেছেন–তোমাকে স্বর্গসুখে ছেড়ে দিয়েও সুখ পাই না আমি। সেখানে হয়তো ধীর-মধুরভাবে আমার সঙ্গে যেমন কথা বলতে, তেমনই অন্য কোনও রমণীর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেবে তুমি, আর আমারই মতো সেই সব স্বর্গসুন্দরীর মন হয়ে উঠবে উথাল-পাথাল-নূনমন্সরসাং স্বর্গে মনাংসি প্রমথিষ্যসি। তোমার এই রূপ, এমন চতুর-মধুর কথা, এমন মিঠে হাসি–তবু বলি তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমি যত ভালবেসেছি তোমায়–সে-সব সুভগ-ভাবনা একবার স্মরণ কোরো তুমি-সৌভদ্র বিহরন কালে স্মরেথাঃ সুকৃতানি মে।
উত্তরার এই মর্মস্পর্শী বিলাপের সঙ্গে শুধু কালিদাসের রতিবিলাপ-সঙ্গীতের তুলনা হয়। আমি এই বিলাপের বিস্তারে যেতাম না এতটুকু যদি-না এর মধ্যে উত্তরাকে বোঝার অথবা উত্তরার পূর্বজীবনবোধের কোনও উপাদান থাকত। মহাকবির লেখন-শৈলীই এমনতর সংক্ষিপ্ত হয় কখনও, তিনি গৌণ-চরিত্রের বিবরণে সবিস্তারে পূর্বজীবন উল্লেখ না করে ধ্বংসের বর্ণনায় পূর্বের গরিমা বুঝিয়ে দেন। ঠিক সেখানেই কাব্যবাহী মুখ্য করুণ-রসের মধ্যেও গুণীভূত শৃঙ্গার-জীবন, ভালবাসার জীবন কেমন মূর্ত হয়ে ওঠে। উত্তরার বিলাপ সঙ্গীত এমন বিরহ-মধুর মূৰ্চ্চনা তৈরি করেছে এখানে যে, বিরাট রাজ্যের কুলবতী রমণীরা আর বেশিক্ষণ তাঁকে অভিমন্যুর পাশে বসে থাকতে দিতে চাইলেন না, তাঁরা জোর করে টেনে অন্যত্র নিয়ে গেলেন উত্তরাকে উত্তরামপকৃষ্যৈনাং…মৎস্যরাজকুলস্ত্রিয়ঃ। উত্তরার পিঠে সান্ত্বনার হস্তস্পর্শ ঘটার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর চেতনা ফিরেছে, তাঁর শেষ কথাটা তাই ভীষণ রকমের অপ্রিয় সত্য হয়ে উঠেছে। উত্তরা বলেছেন–ছয় মাস! মাত্র ছয় মাস তুমি আমার সঙ্গে ছিলে, সাত মাসে পড়তে-না-পড়তেই আমার বৈবাহিক জীবন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল–যগ্ৰাসান সপ্তমে মাসি ত্বং বীর নিধনং গতঃ। কারও কি এমন হয়? তোমার সঙ্গে আমার সহবাসের সময় কি এইটুকুই মেপে রাখা হয়েছিল? হায় বিধাতা! এতাবানিহ সংবাসো বিহিতস্তে ময়া সহ।
মৎস্যরাজের অন্যান্য কুলবধূরা আর উত্তরাকে অভিমন্যুর কাছে থাকতে দেননি। বিশেষত উত্তরা তখন গর্ভবতী, ছয় মাসের স্বামী ইহলোকে নেই, অন্তত তার পেটের ছেলেটার যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, হয়তো সেই বোধেই উত্তরাকে প্রকৃতিস্থা করার চেষ্টা করেছেন বিরাট রাজ্যের বয়স্কারা। আমরা খুব ভালভাবে জানি–বাল-বিধবা উত্তরার জীবনে এত তাড়াতাড়ি শোকশান্তি হবার কোনও কারণ নেই, তবুও এই ভয়ংকর শোকের মধ্যেও প্রদীপের শেষ শিখার মতো যে আশা ছিল, সে হল উত্তরার গর্ভে অভিমন্যুর তেজোনিহিত গর্ভ। তবে সেখানেও কাঁটা দিয়ে রেখেছেন অশ্বত্থামা। তিনি ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন উত্তরার গর্ভে নিহিত পাণ্ডবদের বংশকর পুত্রটিকে ধ্বংস করার জন্য। এখানে শুধু আশা এই যে, কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, উত্তরার গর্ভস্থ সন্তানকে তিনি বাঁচিয়ে তুলবেন।
আমাদের ধারণা, অভিমন্যু যখন মারা যান, তখন উত্তরার গর্ভ দুই কি তিন মাসের পরিপক্কতা লাভ করেছে। কারণ যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবারও প্রায় ছয় মাস পরে ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছেন, এবং তখনও উত্তরার প্রসব ঘটেনি। এর পরে যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভ করে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছেন এবং যজ্ঞের প্রারম্ভিক কাজ সুষ্ঠু সম্পাদন করার পরামর্শ নিয়েই কৃষ্ণ তাঁর আত্মীয় স্বজন নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন হস্তিনাপুরে। কৃষ্ণ সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হস্তিনায় আছেন–বসৎসু বৃষ্ণিবীরেষু–পূর্ণোদ্যমে অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রস্তুতি চলছে, এমন সময় একদিন উত্তরার গর্ভ থেকে অভিমন্যুর পুত্র জন্মাল। মহাভারতের কবি অন্যত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দিয়ে উত্তরার পুত্রজন্মের সমস্যাটা জটিল করে দিয়েছেন আমাদের জন্য। সেই আদিপর্বে বলা হয়েছে যে, গর্ভধারণের ছয় মাস অতিবাহিত হবার পরেই উত্তরার এই আকালিক সন্তান মৃত অবস্থায় জন্মেছে। কৃষ্ণ সেই ছয়মাসের বাচ্চার ‘দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন–একে আমি বাঁচাব–ষান্মাসিকং গর্ভমেনং জীবয়িষ্যামি। আমাদের লৌকিক দৃষ্টিতে মহাকাব্যের অতিশায়নী বর্ণনাকে আক্ষরিক মূল্য না দিয়ে যদি ছয়/সাত মাসের ‘প্রিম্যাচিওর বেবি’র জন্মে বিশ্বাস করি, তাহলে এই আকালিক পুত্রজন্মের সমস্যাই তো অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে গণ্য হতে পারে এবং তার বেঁচে যাওয়াটাও কৃষ্ণের অসামান্য চেষ্টার ফল বলা যেতে পারে। যাই হোক, মহাকাব্যের অতিশায়িনী বর্ণনায় উত্তরার সদ্যোজাত পুত্রটি মৃত, তার কোনও আঙ্গিক চেষ্টা নেই, সে নড়া-চড়াও করছে না। হস্তিনা রাজবাড়িতে বংশকর পুত্র জন্মেছে এই সংবাদ পুরবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই মৃত পুত্রের খবর তাদের বিষাদ ডেকে আনল–শববা বভূব নিশ্চেষ্টো হর্ষ-শোক-বিবর্ধনঃ। পুরবাসীরা সিংহনাদ করে ডাক ছাড়তেই মুহূর্তের মধ্যে সে কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেল। একটা ভয়ানক কিছু ঘটেছে, এমন আন্দাজ পেতেই কৃষ্ণ সাত্যকির সঙ্গে হস্তিনার অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করেই তিনি দেখলেন–র নাম করে ডাকতে ডাকতেই কুন্তী ধেয়ে আসছেন তাঁর দিকে। কুন্তীর পিছন পিছন আসছেন পঞ্চপুত্রহারা দ্রৌপদী এবং আর এক পুত্রহারা সুভদ্রা। কুন্তী শুধু বলে যাচ্ছেন–শীগগির এসো কৃষ্ণ! শীগগির এসো হেথায়–ক্রোশন্তীমভিধাবেতি বাসুদেবং পুনঃ পুনঃ।
উত্তরার এই বিষণ্ণ পুত্রজন্মের জন্য এতগুলি রমণী–বৃদ্ধা-মধ্যমা-কনিষ্ঠাকুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা সকলেই ছুটে এসেছেন সর্বাৰ্তিহর কৃষ্ণের কাছে। কেননা, এই পুত্র শুধু উত্তরার মাতৃক্রোড় শান্তির বাহক নয়, এই পুত্র পাণ্ডবদের সকলের কাছে অনেক কিছু। সবচেয়ে অভিজ্ঞা বলে কুন্তী সেই কথাই জানালেন কৃষ্ণকে। বললেন–এই সন্তানটিই আমার শ্বশুর-স্বামীর মুখে জল-পিণ্ড দেবে–পাণ্ডাশ্চ পিণ্ডদানাহঁ তথৈব শ্বশুরস্য মে। আমাদের সকলের প্রাণ এই বালকের ওপর নির্ভর করছে। তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে, তুমি বলেছিলে এই পুত্রকে বাঁচাবে–ত্বয়া হ্যেতৎ প্রতিজ্ঞাতম্ ঐষিকে যদুনন্দন। আজ সেই সময় এসেছে, তোমার প্রিয় এবং সদৃশ অভিমন্যুর প্রিয়কার্য করো তুমি। আপন বংশের সার্বিক শুভোদয় এই গতাসু পুত্রের ওপরেই নির্ভর করছে–এই কথা বলবার সময় কুন্তী অদ্ভুত একটা কথা বললেন কৃষ্ণকে। কুন্তী বললেন–আমার বধূ উত্তরা বার-বার এ-কথা বলে আমায়। বলে–অভিমন্যু তাকে নাকি এ-সব কথা বলত। তাতেই বুঝি-বেচারা মিথ্যে কথা বলছে না, মৃত স্বামীর নাম নিয়ে এমন মিথ্যে সে বলতেই পারে না–উত্তরা হি পুরোক্তং বৈ কণ্বয়ত্যরিসূদন! অভিমন্যোর্বচঃ কৃষ্ণ…। কথাটা তোমার প্রিয়ই হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই বাছা। অভিমন্যু নাকি উত্তরার কাছে বলেছে যে, তোমার যে ছেলে হবে, বউ! সে ছেলে আমার মামার বাড়িতে মানুষ হবে। আমার মামা কৃষ্ণের বংশ বৃষ্ণি অন্ধকদের কাছে সে সমস্ত অস্ত্রবিদ্যা শিখবে, শিখবে রাজনীতির গূঢ় তত্ত্ব–মাতুলস্য কুলং ভদ্রে তব পুত্রো গমিষ্যতি। উত্তরার কাছে এ-সব কথা অভিমন্যু বলেছে বলেই আরও আমার মনে হয়–তোমার এখানে একটা দায়িত্ব আছে, কৃষ্ণ!
কুন্তীর মুখে এই কথাও কিন্তু উত্তরার পূর্ব দাম্পত্যের অনুশ্রুতি। আসন্ন যুদ্ধের প্রাক কালে অভিমন্যুর সঙ্গে উত্তরার বিয়ে হয়েছিল। অভিমন্যু কি বুঝেছিলেন–এগিয়ে আসছে। সেই ধ্বংস, হয়তো সেই ধ্বংসের হাত থেকে তাঁর বাপ-জ্যাঠা এবং তিনি নিজেও বুঝি বাঁচবেন না। এমনটা না হলে সদ্য-গর্ভধারিণী প্রিয়া পত্নীর কাছে এমন কথা তিনি বলবেন কেন? উত্তরা হয়তো এত-শত বোঝেননি, এখন অভিমন্যু মারা যাবার পর প্রিয় স্বামীর বলা কথা তার মনে পড়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভেরী যখন গভীর-শব্দে বেজে উঠেছে, তখন আসন্নসত্ত্বা উত্তরার লজ্জারুণ কানের কাছে অভিমন্যুর এই স্বপ্ন-জল্পনা নিশ্চয় ছিল যে, তার ছেলে তার মামা কৃষ্ণের বাড়িতেই মানুষ হবে, যেমনটি তিনি হয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর অশ্বত্থামার হাতে যখন গর্ভস্থ পুত্রের জীবনও সংশয়িত, তখন অভিমন্যুর এই কথাগুলি হয়তো বালিকা-বিধবার মনে আশার সঞ্চার করত।
কুন্তীর পরে সুভদ্রাও অনেক আর্তি জানালেন উত্তরার জন্য। তিনি বললেন–এত বড় কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে গেল, আজ অর্জুনের নাতিও জন্মাল মৃত অবস্থায়। অশ্বত্থামার বাণ আজ শুধু উত্তরা নয়, আমার ওপরেও এবং অর্জুনের ওপরেও এসে পড়েছে। আজকে আমার ছেলেও মরে গেছে, নাতিও মরেছে, অর্জুন সহ সমস্ত পাণ্ডব ভাইদের কী প্রতিক্রিয়া হবে এতে। তারা তো এটাই ভাববে যে, যুদ্ধ জেতার পরেও অশ্বত্থামা সবাইকে হারিয়ে দিল। সুভদ্রা যতখানি উত্তরার দিক থেকে ঘটনাটা বিচার করছেন, মৃতপুত্ৰা জননী হিসেবে এই ঘটনাটাকে তিনি অনেকটাই দেখছেন অভিমন্যুর দৃষ্টি থেকে। কৃষ্ণকে তিনি বলেছেন–তুমি বেঁচে থাকতে যদি অভিমন্যুর ছেলেটাই না বাঁচে, তবে তোমাকে দিয়ে আমার কী হবে– জীবতি ত্বয়ি দুর্ধর্ষ কিং করিষ্যাম্যহং ত্বয়া।
ভগিনীর আর্তনাদ, পিতৃস্বসার অবরুদ্ধ ক্ষোভ দেখে কৃষ্ণ বিগলিত হলেন এবং প্রায় কথাই দিয়ে দিলেন যে, তিনি বাঁচাবেন উত্তরার মৃত পুত্রকে। কৃষ্ণ রাজবাড়ির সূতিকাগৃহের দিকে যাবার আগেই দ্রৌপদী উপস্থিত হলেন সেখানে। সদ্যপ্রসবা রমণীর সুচারুতার চেতনা থাকে না, বেশ-বাস থাকে অবিন্যস্ত। দ্রৌপদী তাই পূর্বাহ্নেই এসে খবর দিলেন উত্তরাকে। বললেন–তোমার মামা-শ্বশুর আসছেন এই ঘরে। তার অনেক প্রভাব, নিশ্চয়ই তোমার ভাল হবে–অয়মায়াতি তে ভদ্রে শ্বশুরো মধুসূদনঃ। উত্তরার সত্যিই মনে হল–বরদ দেবতা আসছেন ঘরে, এক মুহূর্তের মধ্যে রাজনন্দিনী নিজের বসন-পরিধান সুসংবৃত করে আবৃত দেহে কৃষ্ণের সামনে দাঁড়ালেন আর্তনাদ, অশ্রুমোচন বন্ধ করে–সুসংবৃতাভবদ্দেবী দেববৎ কৃষ্ণমীয়ুষী।
আমাদের গ্রাম্যকালে যেমন দেখেছি, তাতে আতুর-ঘরের অবস্থাটা খুব অস্বাস্থ্যকর ছিল। যেভাবে তা বানানো হত এবং যে ধরনের ব্যবস্থা সেখানে থাকত, যেভাবে মশা তাড়ানোর জন্য ধোঁয়া দেওয়া হত, তার সবটাই প্রসূতি এবং সদ্য-প্রসূতের পক্ষে খুব উপযুক্ত নয়। তবে উত্তরা যে সূতিকাগৃহে রয়েছেন, সেটা রাজার বাড়ি বলে কথা। মহাভারতের বিরাট কাহিনি-কাণ্ডের মধ্যে সে-কালের দিনের রাজবাড়ির একটা আতুর-ঘরের ছবি পেয়ে এত কষ্ট, এত আর্তনাদের মধ্যেও একটা সমাজ আবিষ্কারের কৌতুক বোধ হচ্ছে। কৃষ্ণ এসে দেখলেন–সূতিকাগৃহের চার পাশে সাদা-সুন্দর মালা ঝুলছে–সিতৈর্মাল্যৈ যথাবিধি। ঘরের চারদিকে পূর্ণকুম্ভের জল–মঙ্গলের প্রতীক। ঘৃতপাত্র ছিল সদ্য-প্রসূতির প্রয়োজনে। পুরাতন বিশ্বাসবশত গাব-গাছের দগ্ধশাখা এবং সর্ষেধরা সর্ষে গাছ। আছে নির্মল (স্টেরিলাইজড) অস্ত্র, হয়তো নাড়ী কাটার জন্য, আর এই সেদিনও সেঁক দেবার জন্য যে আগুন লাগত, তাও মজুত ছিল সেখানে। বৃদ্ধা অভিজ্ঞা মহিলারা ছিলেন প্রসূতি এবং প্রসূতের পরিচারণ তথা শুশ্রূষার জন্য। এমনকী চরম বিপন্নতায় রোগ নির্ণয়-নিপুণ দক্ষ চিকিৎসকেরাও চারদিকে ঘিরে রয়েছেন।
এমন একটা পরিচ্ছন্ন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসম্পন্ন আতুরঘর দেখে কৃষ্ণ পর্যন্ত বলে উঠলেন–দারুণ সুন্দর, দারুণ ব্যবস্থা হয়েছে তো- হৃষ্টোহভবদ্ধৃষীকেশঃ সাধু সাধ্বিতি চাব্রবীৎ। কৃষ্ণকে দেখামাত্রই উত্তরা আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মিনতি করে বললেন–দেখুন, অভিমন্যু এবং আমি দু’জনেই কিন্তু পুত্রহীন হলাম। অশ্বত্থামার অস্ত্রপ্রহারকালে আপনি, ভীম অথবা ধর্মরাজ যদি বলতেন–ওই অস্ত্র জননীকে বধ করুক, তাহলেও ভাল ছিল, আমি মরতাম বটে, কিন্তু আমার বাচ্চাটা বেঁচে যেত–অহমেব বিনষ্টা স্যাং নায়মেবংগতো ভবেৎ। এই বিলাপ-প্রার্থনার কালেও উত্তরা কিন্তু অশ্বত্থামার কথা ভোলেননি এবং পাণ্ডবরা যতই দ্রোণকে গুরু-আচার্যের মাহাত্ম্যমণ্ডিত করুন, মনস্বিনী উত্তরা কিন্তু সেই অপ্রিয় সত্যটুকু উচ্চারণ করেছেন, যা পাণ্ডবরা কখনও করেননি। উত্তরা বলেছেন–এই অশ্বত্থামা যেমন কৃতঘ্ন, তেমনই তার বাপটাও, পাণ্ডবরা তার কম উপকার করেনি এবং দুর্যোধনের আশ্রয় ছেড়ে পাণ্ডবদের সঙ্গে থাকলে তাদের সম্পদ কম হত না। কিন্তু সেটা না করে একটা তো যমের বাড়ি গেছে, আর যেটা বেঁচে রইল, সেটাও এমন নৃশংস যে, আমার ছেলেটাকেই খেয়ে বসে রইল, যেমন বাপ তেমনই ছেলে–কৃতঘোহয়ং নৃশংসোহয়ং যথাস্য জনকথা।
পুত্রহীনা জননী ছাড়া দ্রোণাচার্যের সম্বন্ধে এমন কঠিন সত্য বোধহয় কেউ উচ্চারণ করতে পারত না। উত্তরা এবার সমস্ত ভাবনা ত্যাগ করে কৃষ্ণের শরণাগত হয়ে বললেন–এই ছেলের জন্য আমার অনেক স্বপ্ন ছিল–বহব আসন্ন মনোরথাঃ। ইচ্ছে ছিল, আজ ছেলে কোলে নিয়ে তোমাকে এই পাণ্ডবগৃহে অভিবাদন করব–অভিবাদয়িষ্যে হৃষ্টেতি…পুত্রোৎসঙ্গা জনার্দন। কিন্তু আমার দুর্দৈব তা হতে দিল না। আমি তোমার কাছে আর কিছুই চাই না, অভিমন্যু মারা গেলেও আমি যে মরিনি, তা এই ছেলের জন্য। আমার একান্ত প্রার্থনা–অশ্বত্থামার অস্ত্র-নিদগ্ধ এই ছেলেটিকে তুমি বাঁচিয়ে দাও–দ্রোণপুত্ৰাস্ত্র নিদগ্ধং জীবয়ৈনং মমাত্মজ। একই সঙ্গে মৃতপুত্র কোলে নিয়ে মর্মান্তিক সুরে উত্তরা তাঁর মৃত পুত্রকেই বললেন–বৎস তোমার হল কি? তুমি বৃষ্ণিবংশের প্রবীর পুরুষ কৃষ্ণকে অভিবাদন করছ না, তুমি ধর্মজ্ঞ অভিমন্যুর ছেলে হয়ে ধর্ম বুঝতে পারছ না, এ তোমার হল কি, বাছা–যত্ত্বং বৃষ্ণিপ্রবীরস্য কুরুষে নাভিবাদনম।
কৃষ্ণ আর উত্তরাকে বিলাপ করতে দেননি এবং এও তিনি বুঝতে পারছিলেন–সময় বড় তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে। একটা কিছু করা দরকার। আমরা জানি-কৃষ্ণের ভাবনা-শক্তিতে উত্তরার মৃতজাত পুত্র বেঁচে উঠেছিল এবং রহস্যের সমাধান দিতে হলে আমার অধীত বিদ্যার বঞ্চনা ঘটবে। যদি বিশ্বাসের কথা বলেন, তাহলে বলব–মহামতি কৃষ্ণ পূর্ণভগবৎস্বরূপ, তিনি ইচ্ছে করলে হ্যাঁ-কে না করতে পারেন, না-কে হা করতে পারেন এবং ইচ্ছে হলে যেটা যেমন ঘটছে, সেটাকে অন্যভাবেও ঘটাতে পারেন–কতুম, অকর্তুম, অন্যথা কর্তৃং সমর্থঃ। তবে কিনা তিনি নরলীলায় মানুষের ব্যবহার করছেন, তিনি তাঁর ভ্রুকুটিমাত্রেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বন্ধ করে পাণ্ডবপক্ষের গৌরব-বর্ধন করেননি। বরঞ্চ যত অঘটন-অন্যায় ঘটেছে, তার দায় নিজে গ্রহণ করে সখ্যরসের গৌরব বাড়িয়েছেন। এক্ষেত্রেও যদি আপনি ঈশ্বর-সম্মিত অলৌকিকতায় বিশ্বাস না করেন, তবে বলব–কী অদ্ভুত ইঙ্গিত দিয়েছেন দ্বৈপায়ন ব্যাস।
আমরা ধারণা করি–উত্তরার পুত্রটি একেবারে মৃত হয়েই জন্মায়নি, তবে কিনা অশ্বত্থামা প্রেরিত ব্রহ্মশির অস্ত্রই হোক, অথবা অন্য কিছু, সেটার কোনও সর্বধ্বংসী ক্ষমতা থাকুক অথবা আঘাত কিংবা বিষদিগ্ধ করার শক্তি, যা কিছুই হোক সেটা কিছু ক্ষতি করে দিয়েছিল উত্তরার গর্ভস্থ সন্তানের। সে ক্ষতির প্রতিক্রিয়া সদ্যোজাত শিশুর ওপর এতটাই যে, সে শিশু জন্মে মৃতবৎ পড়ে ছিল, তার শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকভাবে চলছিল না, স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন–মহাভারত যাকে বলেছে ‘নিশ্চেষ্ট। এই সদ্যোজাত নিশ্চেষ্ট শিশুকে কীভাবে জীবনের ধর্মে ফিরিয়ে আনা যায়, তার উপায় হস্তিনার অন্তঃপুরের বৃদ্ধা মহিলারা জানতেন না, বিভ্রান্ত ছিলেন তত্রস্থ চিকিৎসকেরাও। এই অবস্থায় কৃষ্ণ ত্বরিতে অন্তঃপুরে প্রবেশ করেন এবং তিনি এমন কিছু লৌকিক উপায় জানতেন যাতে আঘাত জনিত এই নিশ্চেষ্ট স্তব্ধ ভাব তিনি দূর করে দিতে পেরেছিলেন।
আমাদের ধারণায়–অনেক শিশুরই জন্মকালীন প্রথম ক্রন্দন শব্দের পূর্বে অনেক সময়ই একটা নিশ্চেষ্টভাব থাকে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসও তখন ঠিক মতো চলে না বলেই ধাত্রী চিকিৎসকেরা নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুকে কাঁদাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কৃষ্ণ বোধহয় এই শারীরিক ব্যায়াম বা ফিজিওথেরাপির কাজটি ভালই জানতেন, কেননা পূর্বে মথুরা প্রবেশ কালে কুজা-সুন্দরীর ওপর তার এই প্রয়োগ নিপুণতা আমরা দেখেছি। হয়তো সেই প্রক্রিয়াতেই তিনি উত্তরার পুত্রকে জীবন দিতে সমর্থ হন, যদিও শিশুটিকে প্রকৃতিস্থ করার কালে তিনি সেই সত্য এবং ধর্মের স্তুতিবাচনকেই রোগহরণের নিদান হিসেবে উপস্থিত করেছেন। বারবার বলেছেন–আমি যদি সত্যে এবং ধর্মে সদা-সর্বদা প্রতিষ্ঠিত থেকে থাকি, তবে এই শিশু এখনই বেঁচে উঠুক–তেন সত্যেন বাললাহয়ং পুনঃ সঞ্জীবতামিহ। লক্ষণীয়, কৃষ্ণের মুখে এই সত্য-ধর্মের বহুমিনন সম্পূর্ণ হতেই শিশুটি হঠাৎই একবারে চনমন করে উঠল না, যেমনটি অলৌকিকভাবে হওয়া উচিত ছিল। ব্যাস কিন্তু রীতিমতো চিকিৎসা বিধির প্রক্রিয়াতে প্রথমেই বলেছিলেন–কৃষ্ণ প্রথমেই আচমন করে অর্থাৎ এখনকার চিকিৎসাবিধিতে দুই হস্ত বীজাণুমুক্ত করে প্রথমেই অশ্বত্থামা-নিহিত ব্রহ্মাস্ত্রটি বার করে নিলেন নিপুণ শল্য-চিকিৎসকের মতো–উপস্পৃশ্য ততঃ কৃষ্ণো ব্রহ্মাস্ত্রং প্রত্যসংহরৎ।
হয়তো এই শিশুর গায়ে অস্ত্রের কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল, যেভাবেই হোক কৃষ্ণ সেই প্রতিক্রিয়ার অবসান ঘটিয়েছেন এবং সেটাই হয়তো ব্রহ্মাস্ত্রের প্রতিসংহার। এর পরে সেই সত্য-ধর্মের গৌরব উচ্চারণ এবং তারপরেই দেখছি–উত্তরার গর্ভজ পুত্র আস্তে-আস্তে অঙ্গ-সঞ্চালন করছে এবং আস্তে আস্তে তার মধ্যে চৈতন্যের লক্ষণও প্রকট হয়ে উঠছে– শনৈঃ শনৈৰ্মহারাজ প্রাস্পন্দত সচেতনঃ। দ্বৈপায়ন ব্যাস কিন্তু শেষ কথাটা লিখেছেন এইভাবে–কৃষ্ণ যেইমাত্র শিশুর শরীর থেকে ব্রহ্মাস্ত্রের অপসরণ করলেন, তখনই শিশুর নিজস্ব চেতনায় সেই সুতিকাগৃহ আলোকময় হয়ে উঠল–ব্রহ্মাস্ত্রং তু যদা রাজন্ কৃষ্ণেন প্রতিসংহৃতম। তার মানে, জন্মকালেই এই শিশুর দেহে হয়তো কোনও অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, যে কাজটা অন্যান্য চিকিৎসকের দ্বারা সম্ভব হয়নি, কৃষ্ণকেই সেটা করতে হয়েছে। আর এটা মনে রাখতেই হবে, যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষত্রিয়রা আহত হবার পর শরীর থেকে অস্ত্রাংশ বার করে তার চিকিৎসা নিরাময় নিজেরাই করতেন। সে-সব মহাভারতের যুদ্ধকাণ্ডে অনেক দেখেছি। এ-ক্ষেত্রে ঠিক কী হয়েছে জানি না, কিন্তু এটা লৌকিকভাবে মনে হয় যে, নরলীল কৃষ্ণ সত্য-ধর্মের স্তুতি গৌরব করার সঙ্গে-সঙ্গে শল্য-চিকিৎসার প্রক্রিয়াও কিছু প্রয়োগ করেছিলেন, যাতে শিশুর শরীরে থাকা এমন কোনও কিছু তাকে বার করতে হয়েছিল, যাকে অশ্বত্থামা-প্রণিহিত ব্রহ্মাস্ত্র বলে চিহ্নিত করতে হয়েছে রূপকের মাধ্যমে। এই উপসংহরণের পরেই ক্ৰমে উত্তরার শিশুপুত্র তার নিজের জীবনীশক্তি অনুসারে হাত-পা নাড়তে আরম্ভ করল–ব্যচেষ্টত চ বালোইসৌ যথোৎসাহং যথাবলম। আর যদি ‘স্টিল-বর্ন’-এর তত্ত্ব না মেনে উত্তরার ছেলে যদি ছয়ের বদলে সাত-আট মাসের ‘প্রিম্যাচিওর বেবি’ হয়ে থাকে, তাহলে বলব–তার অবস্থা মহাভারতের অন্যত্র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী–সে অকালজাত ছিল বলেই সে অন্যান্য স্বাভাবিক বাচ্চাদের তুলনায় বলহীন, শক্তিহীন, শিশুসুলভ পরাক্রমী অঙ্গ-সঞ্চালনও তার ছিল না। সেই অবস্থায় কৃষ্ণের অসামান্য শুশ্রূষায় সেই শিশু বেঁচে উঠেছে, ধীরে ধীরে তার আঙ্গিক প্রক্রিয়াগুলিও শুরু হয়েছে–স ভগবতা বাসুদেবেন অসঞ্জাত-বল-বীর্য-পরাক্রমো-অকালজাত-অস্ত্রাগ্নিনা দগ্ধঃ তেজসা স্বেন সঞ্জীবিতঃ। এবং আমাদের ধারণা–এত ক্ষীণ, দুর্বল, হীনতেজ আকালিক শিশু বলেই কৃষ্ণ তার নাম রেখেছিলেন ‘পরিক্ষিৎ’–পরিক্ষীণ বংশের তুলনায় পরিক্ষীণ অপরিণত শিশুর যুক্তিটাই বেশি বাস্তব। যাই হোক বেঁচে গেলেন কৃষ্ণের চেষ্টায় এবং ক্ষমতায়। ব্রাহ্মণেরা স্বস্তিবাচন করতে আরম্ভ করলেন। উত্তরা, জননী উত্তরা সজীব, সচেষ্ট পুত্রকে কোলে নিয়ে সানন্দে কৃষ্ণকে অভিবাদন করলেন–অভ্যবাদয়ত প্রীতা সহ পুত্রেণ ভারত। কৃষ্ণ নিজেই শিশুর নামকরণ করলেন পরীক্ষিৎ। বললেন–যেহেতু এই কুরুবংশ পরিক্ষীণ হয়ে যাবার পর অভিমন্যুর এই পুত্রটি জন্মাল তাই এর নাম হোক পরীক্ষিৎ– পরিক্ষীণে কুলে যম্মাজ্জাতিহয়স অভিমন্যুজঃ। পরীক্ষিদিতি নামাস্য ভবত্বিত্যব্রবীত্তদা।
উত্তরা জননী হলেন। বালিকা থেকে পরম অভিজ্ঞতায় যুবতী হওয়া, বিবাহিতা হওয়া, বিধবা হওয়া এবং জননী হওয়া–মাত্র একবছরের মধ্যে উত্তরা এতগুলি জীবন-প্রকোষ্ঠ পার হয়ে এলেন। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, পাণ্ডবকুলের পর-প্রজন্ম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় উত্তরার এই পুত্রজন্ম তাকে অধিকতর উজ্জ্বল করেছে। বিশাল এবং বিখ্যাত ভরত বংশের উত্তরাধিকার পৃথিবীতে রয়ে গেল–এই পুরুষতান্ত্রিকতাই উত্তরাকে মহীয়সী করে তুলল কিনা, সেই তর্কের মধ্যে সাধারণ পুরুষতান্ত্রিকতার সেই আংশিক সত্যটুকু থাকবেই। তবে কিনা যে বংশে পরবর্তী প্রজন্ম বলতে একটি প্রাণীও বেঁচে রইল না, সেখানে বংশের এই কনিষ্ঠা বধূটির জন্য পুরুষ এবং স্ত্রীলোক কারওরই উৎকণ্ঠার অন্ত ছিল না। উত্তরার স্বামী নেই, তার বাপ-ভাই সকলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মারা গেছে, কিন্তু ভরত বংশের সমস্ত কুলবধূরা অভিমন্যুর প্রতি সম্পূর্ণ ভালবাসাটুকু উত্তরাকে দিয়েছিলেন, তাঁর সুখ-প্রসবের জন্য প্রত্যেকের আন্তরিক প্রার্থনা ছিল। মহাভারতের কবি উপমা দিয়ে বলেছেন–স্ত্রিয়ো ভরতসিংহানাং নাবং লন্ধেব পারগাঃ–অর্থাৎ নদীর তীরে এসে নদী পার হবার জন্য বসে থেকে-থেকে যদি নদী পার হবার নৌকো পাওয়া না যায়, সেইরকম ভাবেই কিন্তু ভরতবংশের স্ত্রীরা এই দশ মাস ধরে অপেক্ষা করেছেন–কবে উত্তরার ছেলে হবে। সেই ছেলের জন্য কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা এবং উত্তরা তো বটেই সকলের সদিচ্ছা একত্র হয়ে গিয়েছিল। অতএব উত্তরার ছেলে যখন আপন জীবনী শক্তিতে সচেতন হয়ে উঠল, তখন অপেক্ষমাণ পথিকের নৌকোয় উঠে নদী পার হবার সার্থকতা তৈরি হল ভরতবংশের সকল কুলবধূর অন্তরে-কুন্তী দ্রুপদপুত্রী চ সুভদ্রা চোত্তরা তথা। খ্রিয়ো ভরতসিংহানাং নাবং লন্ধেব পারগাঃ। ভরতবংশের সকল কুলবধূ এই মুহূর্তে একাকার হয়ে গেছেন উত্তরার মধ্যে।
আশা করি, কোল-আলোকরা ভরতবংশের আদরণীয় পুত্র লাভ করে উত্তরা তার উত্তর জীবন অপেক্ষাকৃত ভাল কাটিয়েছেন। পরবর্তী কালে যুধিষ্ঠির যখন হস্তিনার রাজরমণীদের নিয়ে আশ্রমে-থাকা বানপ্রস্থী ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী এবং কুন্তীকে দেখতে গেলেন, তখন সকলের সঙ্গে উত্তরাও সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানে দ্বৈপায়ন ব্যাসের অলৌকিক শক্তিতে সকলে যখন প্রয়াত স্বামী-পুত্র, পিতা-ভ্রাতাকে দেখতে পেল, সেখানে উত্তরা তাঁর পিতা বিরাট এবং প্রয়াত ভাইদের সঙ্গে পরম অভীষ্ট অভিমন্যুকে দেখতে পেয়েছিলেন।
মহাভারতের বিশালবুদ্ধি নায়িকা যারা আছেন–সত্যবতী কুন্তী অথবা দ্রৌপদী–উত্তরা এঁদের মতো সপ্রতিভ নন। মূল কাহিনির প্রবহমান পথে উত্তরা কোনও মৌল চরিত্রও নয়। কিন্তু অন্য চরিত্র থেকে তিনি পৃথক এবং জীবনের গতি এবং সন্ধিতে একান্তভাবে তিনি স্বতন্ত্র এবং তাঁর জীবনের সমস্যাগুলি খুব আধুনিক দৃষ্টিতে দেখা যায়, চেনা যায়। তাঁর শৈশব আমরা জানি না, কিন্তু যৌবনসন্ধিরও পূর্বে অধিকবয়স্ক মহাবীর অর্জুনের প্রতি আপন বীরমানিতায় মুগ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বৈবাহিক জীবনে তাঁরই পুত্রকে তিনি গভীর রোমাঞ্চের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই রোমাঞ্চও তার জীবন থেকে এত তাড়াতাড়ি চলে গেল যে, তিনি ভারতীয় গৃহের প্রতিপদ-বিপন্না ভাগ্যহীনা বালবিধবার জীবন লাভ করলেন। পুত্র তার কোল ভরে দিয়েছিল বটে, কিন্তু হৃদয়ান্তের প্রাণ ভরে দিয়েছিল কিনা জানি না। একটা সন্দেহ হয়ই।
দ্বৈপায়ন ব্যাস যখন যুদ্ধাবশিষ্ট পাণ্ডব-কৌরব এবং কুলবধূদের সবাইকে তাঁদের প্রয়াত স্বজন-বান্ধবদের দেখিয়ে দিলেন অলৌকিক বিভূতিতে, তখন তার পরেই তিনি একটা অদ্ভুত প্রস্তাব করলেন। স্বামী-পুত্রহীনা রমণীদের উদ্দেশে তিনি বললেন–তোমরা যারা তোমাদের স্বামীদের এতক্ষণ দেখলে, একটা গোটা রাত্রি তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আলাপ করলে, তারা এই গঙ্গার জল থেকেই উঠে এসেছিল, তোমরা যারা পতিনোক লাভ করতে চাও, তারা নেমে এসো এই গঙ্গার জলে–তা জাহ্নবী-জলং ক্ষিপ্রম অবগাহত্ত্বতন্দ্রিতাঃ। এই কথা শুনে কুরু-পাণ্ডব-পাঞ্চালদের স্ত্রীরা অনেকেই গঙ্গার জলে নামলেন, ডুব দিলেন, আর উঠলেন না। মহাভারতের কবি লিখলেন–তাঁরা সবাই মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে পতিলোকে স্বামীদের সঙ্গে মিলিত হলেন–বিমুক্তা মানুষৈর্দেহৈ যুতস্তা ভর্তৃভিঃ সহ।
অলৌকিকতার এই মহাকাব্যিক অতিশায়ন আমাদের পরিচিত। মহাভারতের কবি স্বয়ং যেহেতু এই মহাকাব্যের চরিত্রদের অন্যতম বৃদ্ধ চরিত্র এবং এই বৃহৎ পরিবারের সবচেয়ে হিতকামী পুরুষ, তিনি তার অভিজ্ঞতা এবং কবিজনোচিত বেদনাবোধেই জানেন যে, দুর্যোধন, দুঃশাসন, অভিমন্যু–এঁদের স্ত্রীরা কেউ আর মনে-মনে ভাল নেই। আমাদের উত্তরাও হয়তো এই পতিলোক-পিয়াসীদের অন্যতমা। আমরা পরীক্ষিতের রাজা হবার খবর পেয়েছি এক সময়, মহাকাব্যে উপেক্ষিতা উনূপী চিত্রাঙ্গদাদেরও শেষ সংবাদ এবং গতি আমরা জানি। কিন্তু এই ঘটনার সময় ছাড়া পরে আর আমরা উত্তরার খবর পাইনি। আমাদের ধারণা–ব্যস-কথিত পতিলোকের এই স্পৃহনীয়তা আসলে আত্মহত্যারই অন্য কোনও রূপ। ব্যাস বুঝেছিলেন জীবন নিয়ে তারা যত ভাল আছেন, তার থেকে জীবনের অপর পারে তাঁরা অনেক ভাল থাকবেন। সেই কারণেই স্রোবে জীবন জাহ্নবীর অতলান্তে নিমগ্ন হয়ে উত্তরা বোধহয় সেই রোমাঞ্চ কামনা করেছিলেন আত্মহত্যা করে। সেই রোমাঞ্চ তাঁর বিশ্বাসের মধ্যে ছিল। মৃত স্বামীকে জড়িয়ে ধরে তিনি একসময় বলেছিলেন সেই কথা, বলেছিলেন–ওগো! তুমি যুদ্ধবীরের প্রাপ্য স্বর্গে গেছ, আমিও খুব শিগগিরই আসব সেখানে, সেখানেও আমাকে তুমি দেখে রেখ–ক্ষিপ্রম অন্ধগমিষ্যামি তত্র মাং পরিপালয়।