০৬. গান্ধারী
০১.
এই একটা অলংকার কাব্য রচনায় ব্যবহৃত হয়, যেখানে দক্ষতম প্রযোক্তা বোধহয় কালিদাস। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি– এ-সব অলংকার প্রয়োগ করা কালিদাসের কাছে বামহন্তের কৌশল। কিন্তু যৌবনবতী পার্বতীর স্মিতহাস্যের তুলনা দেওয়ার সময় কালিদাস বুঝিয়ে দিলেন– দেখো পাঠক! চাঁদের জ্যোৎস্না-মাখানো হাসি, কি মুক্তোর দ্যুতি-মাখা দাঁতের কথা অনেক হয়েছে, আমার স্টকে এমন কোনও উপমান নেই, যার সঙ্গে পার্বতীর স্মিতহাস্যের তুলনা করতে পারি।
তবে হ্যাঁ, যা দেখোনি, যা শোনোনি, এমন অসম্ভব বস্তুর সম্বন্ধ যদি কল্পনা করার ক্ষমতা তোমার থাকে, তবে সেই অমন্দ স্মিতহাসির মাধুর্য খানিকটা আন্দাজ করতে পারবে। কালিদাস এবার বললেন– বড় বড় গাছে– অশ্বত্থা-গাছে, নিমগাছে যখন নতুন কচি পাতা বেরোয়, তখন তার মধ্যে একরকম গভীর তাম্রাভ রক্তিমতা থাকে। সেই তাম্রাভ রক্তিমার মধ্যে যদি দুই ছড়া তরলজ্যোতি মুক্তো বসিয়ে দেওয়া যায়, তবেই পার্বতীর স্মিতহাসির সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে- নবপ্রবালোপহিতং যদি স্যাৎ মুক্তাফলং বা ফুটবিমস্থম।
রসশাস্ত্রে এই অলংকারের নাম নিদর্শনা। নতুন কচি রক্তিম বৃক্ষপত্রের মধ্যে মুক্তোর ছড়া বসিয়ে দিয়ে পরস্পর সম্পর্কহীন দুটি বস্তুর অসম্ভব সম্পর্ক ঘটিয়ে দিয়ে পার্বতীর স্মিতমুখের তুলনা সম্ভব করে তোলাটাই এখানে অলংকার তৈরি করেছে। কবির ভাবটা এই, এমন যদি হত, তবেই সেই মধুরশ্মিতের একটা উপমা দেওয়া যায়, নচেৎ নয়– ততোহনুকুর্যাৎ বিশদস্য তস্যাস্তস্রৌপৰ্য্যস্তরুচঃ স্মিতেন।
আমরা যে গান্ধারীর চরিত্র আলোচনা করতে গিয়ে এমন এক কালিদাসী উপমার গল্প ফেঁদে বসেছি, তার কারণ গান্ধারীকেও কোনও একটা বিশেষ ‘ভাল’-র ছাঁচে ফেলা যায় না। এমন বলা যায় না যে, তিনি সীতা-সাবিত্রীর মতো সতী, কেননা তিনি তাদের চেয়েও বেশি সতী, অথচ অন্যার্থে তিনি তাদের মতো সতী ননও, কেননা মাঝে-মাঝেই তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে ভীষণ রকমের প্রতিবাদিনী, যা তথাকথিত সতীত্বের মুখে বঁটা মারে। সার্থক এক জননী হিসেবেও তার স্নেহের অন্ত নেই, অথচ এই স্নেহের ধারা এমনই বিচিত্র যে, তার নিজের ছেলেরাই তার স্নেহের বিষয়ে সংশয়িত, অথচ অন্যের ছেলেরা সেই স্নেহে আপ্লুত। আরও অদ্ভুত হল– তিনি নিজের ছেলেদেরও ক্ষমা করেন না, আবার অপরের ছেলের পক্ষপাতী হওয়া সত্ত্বেও, তাদেরও তিনি পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেন। সেইজন্যই আমরা ওই কালিদাসী উপমার কথা বলেছি। অর্থাৎ এক কথায় গান্ধারীকে প্রকাশ করা খুব কঠিন, যদি তাকে প্রকাশ করতেই হয়, তবে পরস্পর-সম্বন্ধহীন বস্তুর মধ্যেও সম্বন্ধ ঘটাতে হবে।
ব্যাস, মহাভারতের কবি, চেষ্টা করেছিলেন এক কথায় গান্ধারী-চরিত্রের ‘ফোকাল পয়েন্ট’টি খুঁজে বার করার। তিনি বলেছিলেন- আমি এই প্রসিদ্ধ কুরুবংশের বিস্তার বর্ণনা করবার সময় গান্ধারীর ধর্মশীলতার কথাও বলব– বিস্তরং কুরুবংশস্য গান্ধাৰ্য্যা ধর্মশীলতাম। কিন্তু আমি বেশ জানি– আজকের দিনে যুগহ্রাস-জর্জরিত অল্পশ্রুত পাঠক শুধুমাত্র ধর্মশীলতা’ শব্দটুকু তেমন গভীর অর্থবোধে বুঝতে পারবেন না। কেননা ‘ধর্ম’ বলতে মহাভারতের যুগে যে গভীর ব্যাপ্ত সমাজবোধ এবং ন্যায়ের ভাবনা ভাবা হত, সেই ব্যাপ্তি আমাদের আধুনিক ধর্মচেতনায় নেই। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধারণ করার মধ্যে যে বৈশদ্য এবং ব্যাপ্তি আছে, সেই ধারণই মহাভারতীয় ধর্মের প্রধান তাৎপর্য এবং প্রথম অর্থ। যদি আকাশ-সদৃশ উদারতায় সেই ধর্ম অনুধাবন করতে পারেন, তবে ব্যাস কথিত ওই ‘ধর্মশীলতা’ই গান্ধারীর উপযুক্ত বিশ্লেষণ হতে পারে। কিন্তু আধুনিক মহাভারত পাঠকের হৃদয় যেহেতু নিরন্তর মহাভারতচর্চায় তেমন বিশদীভূত নয়, তাই প্রারম্ভেই উপমার অঙ্গুলি-সংকেতে গান্ধারী চরিত্রের মুখ্য উপাদানটুকু গৌণভাবে নির্দেশ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ আমরা সোজাসুজি বলতে পারছি না যে ঘঁা, গান্ধারীর চরিত্র এইরকম। জায়া-জননীর অভিধেয় একান্ত-নির্দিষ্ট স্বার্থ-সম্ভব গুণগুলির মধ্যে যদি সার্বভৌতিক মঙ্গলের চেতনা অনুসূত হয়, তবেই প্রবাল-পত্রোপহিত মুক্তাফলের মতো গান্ধারীর চরিত্রও উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমার ভাষার দীনতা, আমার একান্ত পার্থিব নির্মাণশৈলী শেষ পর্যন্ত ব্যাসকথিত গান্ধারী-চরিত্রের মহাকাব্যিক উত্তরণ ঘটাতে পারবে কিনা– আমার ভয় আছে, সংশয় আছে।
এখনকার দিনের ছিন্নতন্তু পরিবারগুলিতেও যদি কোনও বৃদ্ধ থাকেন, তবে তিনি স্মরণ করতে পারবেন– গাঁয়ে-গঞ্জে জ্ঞাতি-শরিক, বড় তরফ, ছোট তরফ এবং অবশ্যই কর্তামা, বড়মা, মেজমা, রাঙামা ইত্যাদি বিচিত্র তন্তুসমৃদ্ধ পরিবারগুলিতে এমন মহীয়সী মহিলা থাকতেন সেকালে, যাঁরা অমুকের ছেলে নাডু ভালবাসে বলে বিনা কারণে নাডু বানাতেন, যাঁরা নিজের ছেলে পরীক্ষায় ফেল করলে পরের বছরের জন্য আশ্বাস দিতেন এবং সেজ বউ বা রাঙা-বউয়ের ছেলে পরীক্ষায় ‘ফার্স্ট’ হলে ভবিষ্যতে তার আয়েই বৃদ্ধ-জীবন কাটাবেন বলে সার্থক সান্ত্বনা পেতেন। কোনও কোনও সময় নিজের ছেলের অপদার্থতার জন্য কষ্ট পেতেন না, এমন নয়, অথবা জ্ঞাতি-শরিকদের প্রত্যক্ষ দূষতেন না, এমনও নয়, তবে সেই স্বার্থভাবনা পদ্মপত্রে জলবিন্দুর মতো এতটাই ক্ষণস্থায়ী যে, পরক্ষণে অন্যতর গৃহপুত্রদের সমৃদ্ধিতে তা একেবারেই চাপা পড়ে যেত। শুধু কুরুপাণ্ডবের জ্ঞাতিবিরোধের নিরিখে গান্ধারী যে এই ধরনের অনুগুণসম্পন্ন মহীয়সী মহিলা, কিন্তু নয়। তা নয়। এইজন্য যে, গান্ধারীর পিছনে এক বিশাল মহাকাব্যিক ‘ফ্রেম’ আছে, আছে বিশাল এক রাজবংশের ঋদ্ধ পটভূমি। সেখানে কারণে-অকারণে ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাস খুব একটা ধরা পড়ে না, ধরা পড়ে না সামান্য মান-অপমান, সুখ-দুঃখ-ভাবনা। অথচ আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে জন্মালেই মহাকাব্যের প্রচ্ছায়াহীন বিরাট গৃহস্থালীর মধ্যে আমাদের যে কোনও বড়-মা, মেজ-মা বা রাঙা-মাকে আমরা গান্ধারীর বিবর্তিত রূপে দেখতে পেতাম। তার মানে এখানেও মেলানো গেল না। কিন্তু যদি মহাকাব্যিক পটচিত্রের মধ্যে অথবা বলা উচিত সুপ্রসিদ্ধ ভরতবংশের ততোধিক সুপ্রসিদ্ধা কুলজননীর চালচিত্রের মধ্যে যদি পঞ্চাশ ষাট বছর আগের স্বার্থসন্ধিহীন বড়-মাকে পুরে দিতে পারতাম, তবেই ‘নবপ্রবালোপহিত মুক্তাফলের মতো গান্ধারীর কণ্বঞ্চিৎ উপমা করা যেত, নচেৎ নয়।
মহাভারতের প্রত্যেকটি বড় চরিত্র বর্ণনার সময়, তাদের একটা পূর্বরূপ কল্পনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে– অমুকের অংশে অমুকের জন্ম হয়েছে যেমন কলহস্বরূপ কলির অংশে দুর্যোধনের জন্ম, অথবা ধর্ম বিদুর-রূপে জন্মেছিলেন, অথবা সিদ্ধি দেবীর অংশে কুন্তীর জন্ম। লক্ষণীয়, মহাভারতীয় বিরাট পুরুষদের অংশাবতার বর্ণনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেবতা এবং উপদেব বসুগণ, গন্ধর্বদের উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনই গান্ধারী-কুন্তীর পূর্বজন্মের প্রকৃতি বর্ণনায় একটা ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’ আছে। পুজো করার সময় দেখবেন– এখনও একবার উচ্চারণ করতে হয় ‘এতে গন্ধপুষ্পে ষোড়শমাতৃকাভ্যো নমঃ। তার মানে ষোলোজন চিরন্তনী মাতৃকামূর্তি আছেন।
এঁদের মূর্তিকল্প একটু ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট’ বটে, কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই মনুষ্যজীবনে মাতৃকল্প স্ত্রীলোকের এক-একটি চিরন্তনী মূর্তি প্রকাশিত করে। এই যে দেখুন, পাণ্ডবজননী কুন্তীকে যে সিদ্ধি-দেবীর অংশ বলা হয়েছে, তার জীবনে সেটা সম্পূর্ণ প্রতিফলিত। কুন্তী তার জন্মলগ্ন থেকে, কুন্তিভোজের কাছে দত্তক দেওয়া থেকে বিবাহিত জীবনে পুত্রদের ওপর অত্যাচার সব কিছু মিলিয়ে চরম যন্ত্রণার জীবনযাপন করেছেন। অবশেষে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধজয়ে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ধর্মস্বরূপ যুধিষ্ঠির সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হতেই তিনি তাঁর সারা জীবন অস্ত্রহীন যুদ্ধের সিদ্ধি লাভ করেছেন। কুন্তী তাই সিদ্ধিস্বরূপিণী। পার্থিব জীবনের ‘আলটিমেট গেইন’ ‘চরম প্রাপ্তি’ অথবা ‘অ্যাবস্ট্রাক্টলি যদি বলি ‘সাকসেস’–তবে সেটাই কুন্তীর ‘আলটিমেট চেহারা। এই দৃষ্টিতে দেখলে গান্ধারীকে যে মাতৃকা-মূর্তির অবতার হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে, তার চেয়ে সঠিক বোধহয় আর কিছু হতে পারে না। গান্ধারী পূর্বস্বরূপে ছিলেন ‘মতি’ অর্থাৎ মননের প্রতিমূর্তি। মনন’ কথাটা কি কখনও গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন– ‘ম’ থেকে ধাতু থেকে প্রত্যয়নিষ্পন্ন এই শব্দের মধ্যে মনের সংবেদনশীলতার সঙ্গে সর্বকল্যাণময়ী বুদ্ধিও একত্তর হয়ে গেছে। এই মনন-শব্দেরই স্ত্রীলিঙ্গ-রূপ মতি, তিনিই গান্ধারী।
গান্ধারী যে দেশে জন্মেছিলেন, সেই দেশের তেমন সুখ্যাতি সে-কালেও ছিল না এবং সেই দেশ থেকে আসা শকুনির চরিত্র এমনভাবেই আমরা মহাভারতে পেয়েছি, যাতে গান্ধার দেশের ওপর আমাদের বিলক্ষণ অভক্তি হয়। কিন্তু ওই যে প্রাচীন ব্যবহারজীবীরা বলেছেন– কোনও মানুষকে দেশ তুলে গালাগালি দিয়ো না, এমন গালাগালি দণ্ডযোগ্য অপরাধ। কথাটা এইজন্যই নিশ্চয় বলা হয়েছে যে, একটি দেশের সব মানুষই একরকম হন না। কেউ বা ব্যক্তিগত চরিত্রেই মন্দ, আবার কেউ বা ভাল। প্রাচীনদের এমন সদর্থক আইন থাকা সত্ত্বেও এ-কথা বোধহয় সত্যি যে, বিশেষ দেশ, দেশের জলবায়ু, ডেমোগ্রাফি, নদ নদী, অরণ্য, একটি বিশেষ দেশের মানুষের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য তৈরি করে। এ-কথা পণ্ডিত গবেষকরাও স্বীকার করেন। মহাভারতের মধ্যেই মদ্র দেশ, বাহীক দেশ, কাশ্মীর দেশ, কেকয় দেশ অথবা মথুরার বিশেষ বৈশিষ্ট্য কীর্তিত হয়েছে এবং শকুনি যেহেতু এই দেশের মানুষ, অতএব তার কথা বলতে গিয়েই গান্ধার দেশের বৈশিষ্ট্যের কথাও বার-বার এসেছে মহাভারতে।
ভারতীয় সভ্যতার প্রথম লগ্ন থেকে যদি বিচার করি, তবে বলতেই হবে যে, আর্যায়ণের প্রথম কল্পে আর্যদের পুণ্য বসতি ঘটেছিল এই গান্ধার দেশে। খোদ ঋগ্বেদে, এই দেশের নাম উল্লিখিত হয়েছে এবং তা উল্লিখিত হয়েছে এক রমণীর মুখে– তিনিই সেই মন্ত্রের দ্রষ্টা ঋষি। তার মানে সেই প্রাচীন সময়েও এখানকার মেয়েদের মধ্যে এতটাই লেখা-পড়ার চল ছিল যাতে এক রমণীর মুখে ঋক-মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে। এই শিক্ষা এবং বিদ্যাবত্তার উত্তরাধিকারই হয়তো গান্ধারী লাভ করেছিলেন। ভৌগোলিক দিক থেকে গান্ধার দেশটি এখনকার পাকিস্তানের পেশাওয়ার, রওয়ালপিণ্ডি এবং লাহোরের খানিকটা অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল বলে সাধারণ ধারণা। কিন্তু পারস্য দেশের শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এখনকার আফগানিস্তানের কাবুল অঞ্চলও তখন গান্ধারের সীমার মধ্যে ছিল। গবেষক পণ্ডিতদের ধারণা– গান্ধার-রাজ্যটা সেকালে আধুনিক আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল থেকে আরম্ভ করে একেবারে উত্তর-পশ্চিম পঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সেদিন যে আফগানিস্তানের কান্দাহারে ভারতীয় বিমান-অপহরণের ঘটনা ঘটল, সেই ‘কান্দাহারও অতীত গান্ধারের শব্দ-অপভ্রংশের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।
সে যাই হোক, বৈদিক যুগে এবং তৎপরবর্তীকালেও বেশ কিছুদিন, এমনকী ভগবান বুদ্ধের সময়েও গান্ধার রীতিমতো সমৃদ্ধ দেশ ছিল এবং সমৃদ্ধির কারণে যুদ্ধ-বিগ্রহও অনেক হয়েছে এ-দেশে, ফলে রাজ্যের সীমা কখনও বেড়েছে কখনও কমেছে। মহাভারতে গান্ধার দেশকে যেমনটি চেনা যায়, তাতে বৈদিক যুগের সেই সমৃদ্ধি গান্ধার থেকে তখন অনেকটাই অন্তর্হিত। আমাদের ধারণা আৰ্যায়ণের পরবর্তী পর্যায়ে সিন্ধু পেরিয়ে অনেকটা চলে আসার পর আর্য-পুরুষেরা যখন সরস্বতী-দৃষদ্বতীর প্রথম বসতির মায়া কাটিয়ে উঠেছেন, তখন গান্ধার দেশে আর্য সংস্কৃতির অবক্ষয় ঘটে গেছে অনেকটা। মহাভারতের গান্ধার দেশের নাম উচ্চারিত হচ্ছে যবন, খশ, কাম্বোজ ইত্যাদি তথাকথিত অধম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। স্বয়ং কর্ণ বহুকাল গান্ধার-রাজপুত্র শকুনির সহচর হওয়া সত্ত্বেও গান্ধার-দেশের আচার-ব্যবহার যে শুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যের অনুগামী নয়– সে কথা সোচ্চারে বলেছেন এবং যথেষ্ট নিন্দাসূচকভাবেই তা বলেছেন। অথচ গান্ধারী এই সমস্ত দেশ-নিন্দা এবং জন-নিন্দার উর্ধ্বে পৃথক এবং অন্যতর এক শান্ত জগতের প্রতিনিধি। কোনও দেশ, সেই দেশের মানুষ অথবা দেশ জাতি-বর্ণের কোনও বিশেষ লক্ষণ দিয়ে গান্ধারীর চরিত্র একটা বিশেষ ছাঁচে বেঁধে ফেলা যায় না। তিনি নিজেই একটা বিশেষ, একটা অননুকরণীয় ব্যতিক্রম।
গান্ধারীর নিজের কোনও নাম নেই, দেশের নামেই তার নাম। এতে মনে হয়– গান্ধারীর পিতা সুবল বিশাল কোনও পিতৃপরম্পরায় রাজ্য পাননি। তিনি নিজের ক্ষমতায় এবং গুণে রাজ্য পেয়েছিলেন বলেই আপন রাজ্যগৌরবে কন্যার নাম রেখেছিলেন গান্ধারী। আশ্চর্য ব্যাপার হল- মহাভারতের অন্যতম প্রবীণা নায়িকার শৈশব কিংবা যৌবন সন্ধির কোনও সংবাদ মহাভারতের কবি দেননি। আমরা প্রথম তার ব্যক্তিপরচয় পাচ্ছি কুরুকুলের পিতামহ ভীষ্মের মুখে, তাও কোন প্রসঙ্গে? না, মহামতি ভীষ্ম তার বৈমাত্রেয় ভাই বিচিত্রবীর্যের পুত্র ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ দেবেন। অতএব ভীষ্ম এমন একটি কন্যা খুঁজছেন যে বিখ্যাত ভরত-কুরু বংশের বৃদ্ধি ঘটাবে। আসলে ভীষ্ম এবং তার বিমাতা সত্যবতী দু’জনেই কুরুবংশের সন্তান নিয়ে যথেষ্ট চিন্তান্বিত ছিলেন। ভীষ্ম তার ভীষণ প্রতিজ্ঞার কারণে রাজাও হননি বিবাহও করেননি, স্বয়ং সত্যবতী নিজের দোষ প্রায় স্বীকার করেও ভীষ্মকে নিয়োগ-প্রথায় বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রীর গর্ভাধানে স্বীকৃত করাতে পারেননি। অবশেষে ব্যাসের কৃপায় ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুরের জন্ম। মহারাজ শান্তনুর পর থেকেই কুরুবংশের সিংহাসনে রাজার স্থিতিকাল সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর হচ্ছে। ভীষ্ম তাই ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর জন্য এমন মেয়েদেরই কুরুবাড়িতে বউ করে নিয়ে আসতে চান, যাঁরা সন্তান ধারণের অত্যন্ত উপযুক্ত।
কিন্তু সন্তান লাভ করা এমনই এক অকল্পনীয় তত্ত্ব যা আগে থেকে পরীক্ষা করা যায় না। শারীরিক-মানসিক কিছু লক্ষণ থেকে সাধারণ একটা বিচার হয় বটে, কিন্তু পুরোটা হয় না। ভীষ্ম দিগ-দিগন্তরে ব্রাহ্মণ-সজ্জনদের পাঠিয়েছিলেন সুলক্ষণা কন্যার সংবাদ সংগ্রহ করতে। তাদেরই একজন এসে ভীষ্মকে সংবাদ দিয়ে বললেন– আছে মহাবীর। তেমন একটি কন্যাই আছে গান্ধার রাজ্যে। তিনি মহারাজ সুবলের কন্যা গান্ধারী। সে ভগবান শিবের কাছে এই বর পেয়েছে যে, সে নাকি শত পুত্রের জননী হবে– গান্ধারী কিল পুত্ৰাণাং শতং লেভে বরং শুভা। ব্রাহ্মণের মুখের কথা শুনেই বসে থাকলেন না ভীষ্ম। এর-তার কাছে খবর নিয়ে তিনি বুঝলেন বামুন ঠিকই বলেছে– ইতি শুশ্রাব তত্ত্বেন ভীষ্মঃ কুরুপিতামহঃ।।
সর্বক্ষেত্রে কন্যার পিতাই সম্বন্ধ নিয়ে আসেন পুত্রের পিতার বাড়িতে। এ ক্ষেত্রে উলটো হল। ভীষ্মই ভ্রাতুস্পুত্র ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ-সম্বন্ধ দিয়ে লোক পাঠালেন গান্ধাররাজ সুবলের কাছে– ততো গান্ধাররাজস্য প্রেষয়ামাস ভারত। দূত এসে পূর্বাপর সবই জানাল। এবং অবশ্যই ভীষ্মের এই নির্দেশ ছিল যেন দূত আনুপূর্বিক জানায় স্বয়ং বিবাহপাত্র ধৃতরাষ্ট্র সম্বন্ধেও– কারণ ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ। অসামান্য সুন্দরী কন্যার জন্য হস্তিনাপুর থেকে বিবাহ সম্বন্ধে এসেছে এই সংবাদে গান্ধাররাজ সুবল যতখানি পুলকিত হয়েছিলেন, ঠিক ততটাই হয়েছিলেন আশাহত। সর্বানবদ্যা আত্মজা গান্ধারীকে শেষ পর্যন্ত এক অন্ধ পাত্রের হাতে তুলে দেবেন? পাত্র পাওয়া গেছে বলেই এমন একটা অন্যায় কাজ করবেন তিনি? মনে মনে তিনি ছটফট করতে থাকলেন– অচক্ষুরিতি তত্রাসীৎ সুবলস্য বিচারণা।
বিয়ের ব্যাপারে গরিব ঘরে একরকম যন্ত্রণা, বড় মানুষের ঘরে আর একরকম এবং সেটা একালেও যেমন, প্রাচীন কালেও তেমনই। কিন্তু একটা ব্যাপারে গরিব-বড়লোকের সমস্যাটা একই, সেটা হল– একটা জায়গাতে কন্যার পিতাকে আপোশ করতেই হয় এবং সুবল-রাজা সেই বড়লোকের আপোশটাই করলেন শেষ পর্যন্ত। গান্ধার রাজ্যের রাজা সেকালের দিনে, অন্তত মহাভারতের কালে এমন কিছু নামকরা রাজ্য ছিল না, অতএব সেই রাজ্যের রাজার কাছে যদি হস্তিনাপুরের মতো বিখ্যাত রাজবংশের প্রধান পুরুষ ভীষ্ম নিজের ভ্রাতুস্পুত্রের জন্য কন্যা যাচনা করে তোক পাঠান, তা হলে অন্তরে এক ধরনের স্ফীতিবোধ অবশ্যই কাজ করে। সুবলের মতো ক্ষুদ্র রাজাকে তখন মনের উদ্গত আবেগ চেপে রেখে বুদ্ধি দিয়ে বিচার আরম্ভ করতে হয়। ভাবী জামাতার অন্ধত্বের কথা মাথায় রেখেও আবারও তাকে তর্কযুক্তি জুগিয়ে নিয়ে ভাবতে হল– বিখ্যাত ভরত-কুরুবংশের উজ্জ্বল গৌরবের কথা, ভাবতে হল– হস্তিনাপুর রাজ্যের সমৃদ্ধ রাজশক্তির কথা।
বলা উচিত– মহামতি ভীষ্মের অসম্ভব শক্তি এবং ক্ষমতার ব্যাপারটাও এখানে কাজ করছিল। তিনি পূর্বে বৈমাত্রেয় ভাই বিচিত্রবীর্যের বিবাহের জন্য কাশীরাজ্যে সমাগত বিরুদ্ধ রাজাদের চোখের ওপর দিয়ে অম্ব-অম্বিকা-অম্বালিকাকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন। অতএব সেই ভীষ্মের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করাটা ক্ষুদ্র গান্ধার রাজ্যের পক্ষে ভয়ংকর ছিল। কিন্তু আমরা জানি– এই ভীতি ছিল অমূলক। কেননা বিচিত্রবীর্যের জন্য কাশীরাজ্য থেকে তিন কন্যা আনতে গিয়ে অম্বার পূর্ব প্রণয়বদ্ধতার কারণে ভীষ্ম যে বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন, তাতে ভ্রাতুস্পুত্রদের জন্য আবারও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা ভীষ্মের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। কাজেই ভীষ্মের ভয় ব্যাপারটা এখানে নিতান্তই অমূলক ছিল। অন্যদিকে ভীষ্মও এগিয়েছেন খুব সন্তর্পণে, ধাপে-ধাপে৷ তিনি কন্যা যাচনা করে তোক পাঠিয়েছেন এবং পাত্র ধৃতরাষ্ট্রের জন্মান্ধতাও গোপন করেননি। গান্ধাররাজ সুবল যে শেষমেশ এ বিয়েতে রাজি হলেন, তার কারণ একটাই– বড়ঘরের স্টেটাস’, ভরত-কুরুবংশের খ্যাতি, কীর্তি এবং পরম্পরার কথা ভেবে কুলং খ্যাতিঞ্চ বৃত্তঞ্চ বুদ্ধ্যা তু প্রসমীক্ষ্য চ।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কথাটা এখানে আসবেই। যে মেয়েটি তার যৌবন-সন্ধি বয়সে স্বপ্নের পুরুষের কাছে সমস্ত দেবার বাসনা নিয়ে বসে ছিল, তাকে একবার পিতা জিজ্ঞাসাও করলেন না, একবারও বললেন না যে, তোমার ভবিষ্যৎ স্বামী অন্ধ, তোমার আপত্তি আছে কিনা। জিজ্ঞাসা করলেন না এবং পিতা সুবল সামান্য দ্বিধা করেই জামাইয়ের কুল-শীল জাতি-মান দেখেই ঠিক করলেন যে, তিনি অন্ধের হাতেই মেয়ে দেবেন। তিনি তৃপ্ত হলেন কুটুম্বের সম্বন্ধের গৌরবে, কিন্তু গান্ধারী, যুবতী, সদ্যোদ্ভিন্নযৌবনা, গান্ধারীর মন ভরে উঠল অভিমানে। অন্তত আমার তো অভিমানই মনে হয়। অন্যেরা বলেন– পাতিব্ৰত্য, এমনকী মহাভারতের কবিও সমকালীন সমাজের ধর্মদর্শিতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বলেছেন যে, ভবিষ্যৎ-স্বামীর অন্ধ জীবনের যন্ত্রণার কথা স্মরণ করে পতিব্রতা গান্ধারী সমব্যথায় একখানি পট্টবস্ত্র অনেকগুলি ফেরতা দিয়ে বেঁধে নিলেন নিজের চোখ– ততঃ সা পট্টমাদায় কৃত্বা বহুগুণং তদা। ববন্ধ নেত্রে স্বে রাজন্…।
আমি কোথাও মহাভারতের কবির শব্দশরীর অতিক্রম করিনি, এখানে যে করছি তা নয়। তবে কিনা মহাকবির শব্দার্থমাহাত্ম্য প্রয়োগ-পরম্পরার মধ্যে কবির আপন মনের কথা এমনভাবেই নিহিত থাকে যা বিশ্লেষণ করলে কবির হৃদয়টি ঠিক ধরা পড়ে। কবি লিখেছেন– মহারাজ সুবল তার ভাবী জামাতার কুল-খ্যাতির কথা শুনে মেয়েকে মৌখিকভাবে দিয়েই দিলেন ধৃতরাষ্ট্রের হাতে। সব হয়ে-যাওয়া ঘটনার খবর এবার গান্ধারীর কানে এল। তিনি শুনলেন যে, তার ভাবী স্বামী অন্ধ গান্ধারী ত্বথ শুশ্রাব ধৃতরাষ্ট্রমচক্ষুষ– অথচ এই অন্ধ মানুষটির হাতেই তার পিতামাতা তাকে তুলে দিতে চাইছেন। এখানে যে বিবাহ-কৌতুকিনী রমণীর হৃদয় উপেক্ষিত হয়ে গেছে, মেয়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছার চেয়ে বরের খ্যাতি-কুল-মান যে এখানে বড় হয়ে গেছে, এটা এক লহমায় বুঝতে পারলেন। মহাকবি লিখেছেন– গান্ধারী যখন দেখলেন যে, এমন অন্ধ স্বামীর হাতেও তার বাবা-মা তাকে দিতে চাইছেন– আত্মানং দিৎসিতামস্মৈ পিত্রা মাত্রা চ ভারত– সেই মুহূর্তেই তিনি পট্টবস্ত্রের আবরণে বেঁধে নিলেন নিজের চোখ দুটি। মহাকবি শেষ বিশেষণ দিলেন– পতিব্রতপরায়ণা। রক্ষণশীল সমাজকে বুঝিয়ে দিলেন শেষ কথাটা তার চলমান সমাজে সমাজপতিদের সাংস্কারিক চোখে বিশেষণের ধুলো। গান্ধারীর বিদীর্ণ হৃদয় মহাকবি প্রকাশ করে দিয়েছেন বাক্যবন্ধে কর্মবাচ্যের ব্যবহারে। অর্থাৎ গান্ধারী এখানে স্বতন্ত্র নন। তার স্বকীয় স্বাধীন আত্মার দাতা তিনি নন, কর্তা তিনি নন, সেটা বিসর্জন দেবার জন্য দুটি অনুক্ত কর্তা আছে তার বাবা এবং মা– যাঁরা এমনিতে অনুক্ত কর্তায় তৃতীয়া বিভক্তি হলেও ঠুটো জগন্নাথের মতো গান্ধারী এখানে কর্মবাচ্যের কর্তা হয়ে আছেন– আত্মানং দিৎসিতামস্মৈ পিত্রা মাত্রা চ ভারত। আর ঠিক তখনই যেখানে তার কর্তৃত্ব আছে, ঠিক সেই জায়গা থেকে কন্যাজন্মের সমস্ত অভিমান একত্র করে পুরু ফেরত দিয়ে বেঁধে ফেললেন নিজের চোখ যাতে বাবা-মাকেও আর দেখতে না হয়, স্বামীকেও আর দেখতে না হয়। কন্যার স্বাভিমান কবির শব্দমন্ত্রের পরম্পরায় অবশেষে অভিষিক্ত হল সামাজিক বিশেষণের সম্মানে– পতিব্রতপরায়ণা। ববন্ধ নেত্রে স্বে রাজন পতিব্রতপরায়ণা– তিনি চোখ বেঁধে ফেললেন।
ব্যাস কারণও দেখিয়েছেন– কেন এমন করলেন গান্ধারী। আমি জানি, অভিমান যদি চরম আকার ধারণ করে এবং তাতে যদি কাউকে কিছু করা না যায়, তখন মানুষ আত্মপীড়ন করে। ব্যাস লিখেছেন– চক্ষুষ্মতী রমণী যদি তার স্বামীকে অন্ধ দেখে, তা হলে পদে পদে যেমন অনভিনন্দন তাকে আক্রান্ত করে, তেমনই মনে জাগে অসূয়া আমার আছে, ওর নেই। এই অসূয়া যাতে তৈরি না হয়, আপন ইন্দ্রিয়ের শক্তি যাতে তাকে একান্তে স্বামীর চেয়ে অহংকারী না করে তোলে, এই সমব্যথাও যেমন তাঁকে স্বারোপিত অন্ধত্বের দিকে নিয়ে গেল, তেমনই তৃপ্ত হল তার হৃদিস্থিত অভিমান– যা আত্মনিপীড়নের পথ ধরেই শান্ত পরিণতি লাভ করল পতিপরায়ণতার ব্যাখ্যায় পিতামাতা যখন এইভাবেই আমাকে অন্ধের হাতে সঁপে দিলেন, তখন আমিও দেখব না এই পৃথিবী, আমি তাকে অতিক্রম করব না– গান্ধারী মনকে বেঁধে নিলেন পরম নির্ধারিতের কাছে আত্মনিবেদন করে– নাভ্যসূয়াং পতিমহমিত্যেবং কৃতনিশ্চয়।
বিয়ে করার নানান রীতি এই সেদিনও কত প্রচলিত ছিল। বরপক্ষে, কন্যাপক্ষে একাধিক বিভিন্ন রীতি। এই তো শুনেছি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির একাংশে এমন নিয়ম ছিল যে, মেয়েকে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে এসে তারপর যথাবিহিত নিয়মে বিয়ে করতেন ঠাকুরবাড়ির বর-পুরুষেরা। এটা কোনও বাবুয়ানি, নাকি পুরুষতান্ত্রিকতা, এসব তর্কে না গিয়েও বলতে পারি যে, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভবই ছিল না বিবাহ করার জন্য এতদূর পথ যাওয়া; সেই হস্তিনাপুরের দিল্লি অঞ্চল থেকে গান্ধার-কান্দাহারের পার্বত্য-বন্ধুর পথ বেয়ে একজন অন্ধ মানুষ বিবাহ করতে যাবেন– এটা বোধহয় কনেপক্ষের প্রধান পুরুষ সুবলও ক্ষমা করে দিয়েছেন।
অতএব গান্ধারীকেই হস্তিনাপুর নিয়ে যাবার প্রশ্ন উঠল। ভার পড়ল রাজপুত্র শকুনির ওপর। বিবাহের বধূ হিসেবে গান্ধারী যাচ্ছেন, তাকে বধূপূর্ব বৈবাহিক সজ্জায় অনেক অলংকারে, বেশে-বাসে সাজিয়ে দিল গান্ধারের রাজবাড়ি। নবীন বয়সের সালংকারা বোনটিকে নিয়ে শকুনি কৌরবদের রাজধানী হস্তিনাপুরে রওনা দিলেন স্বসারং বয়সা লক্ষ্মা যুক্তামাদায় কৌরবান। এত দূর পথ যেতে দীর্ঘদর্শিনী গান্ধারীর কেমন লেগেছিল, মহাভারতের কবি তার এতটুকু বর্ণনাও দেননি। চোখে চার-ফেরতা কাপড় বাঁধা, সঙ্গে পরিচারিকা, রাজবাড়ির কিছু অনুচর, আর ভাই শকুনি। এমন চোখ বাঁধা অবস্থায় স্বামী গৃহের কল্পনাটুকুই তার প্রধান সহায়, কেননা কিছুই তিনি চোখে দেখবেন না, এমনকী স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকেও না। এতটাও তো গান্ধারীর পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিল না যে, আজ যে তার ভাই শকুনি তাকে বধূবেশে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সম্প্রদান করার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন, সেই শকুনিই একদিন তার সমস্ত সাধু-কল্পনার ধ্বংসবীজ হয়ে উঠবেন।
গান্ধারী হস্তিনাপুরে এসে পৌঁছালে কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করলেন। মহাভারতে সেই নির্দিষ্ট দিনের আড়ম্বরের কোনও বর্ণনা নেই, নেই কোনও বৈবাহিক কর্মসূচি। তবু জানি, বরবধূর শুভদৃষ্টি যখন হলই না, তখন প্রয়োজনীয় আঙ্গিক হিসেবে সপ্তপদীগমন বা অশ্বারোহণের ঘটনাটুকু অবশ্যই ছিল, নইলে শুধু ধৃতরাষ্ট্রের সাত পাকে বাঁধা গান্ধারী এমন অশ্মময় ধৈর্য নিয়ে থাকলেন কী করে। সালংকারা গান্ধারীকে ধৃতরাষ্ট্রের হাতে দিয়ে গান্ধার রাজ্যে তখনকার মতো ফিরে গেলেন গান্ধারীর ভাই শকুনি। এই বিবাহে গান্ধার রাজ্যের পক্ষ থেকে উপহার-উপঢৌকনের ব্যবস্থা ছিল ভালই, অন্যদিকে মহামতি ভীষ্মও শকুনিকে যথাযোগ্য সম্মান-অভ্যর্থনায় তুষ্ট করেছিলেন। বিবাহের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটাই চলেছিল ভীষ্মের তত্ত্বাবধানে এবং তাঁর সৎকার-সংবর্ধনার শেষে শকুনি ফিরে গেছেন গান্ধারে পুনরায়াৎ স্বনগরং ভীষ্মেণ প্রতিপূজিতঃ।
বিবাহের পরে গান্ধারী কেমন ছিলেন হস্তিনাপুরে, তার একটা ছোট্ট ছবি এঁকেছেন ব্যাস, মহাভারতের কবি। ছবিটার মধ্যে বেশিটাই প্রথামাফিক সাধ্বীতার বর্ণনা, কিন্তু তবু সেখানে একটা কথা আছে, যেখানে তার কঠিন আত্মনিগ্রহের প্রাথমিক আবেশটুকু বোঝা যায়। এই কথাগুলি অবশ্য মহাকাব্যিক গড্ডলিকার মধ্যেই পড়ে- যেমন, গান্ধারী তার চারিত্রিক গুণ এবং সদাচারে সমস্ত কুরুকুলের তুষ্টি বিধান করেছিলেন। কুরুবংশের প্রধান পুরুষেরা অন্তত যাঁরা ধৃতরাষ্ট্রের নিকট জন বটে– তাঁরা সকলেই গান্ধারীর আচার ব্যবহারে কোনও ত্রুটি দেখতে পাননি। দোষ-দর্শনের কোনওই কি সম্ভাবনা ছিল, তা হয়তো নয়, কিন্তু যে জায়গায় একটা সংশয়িত ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে, মহাভারতের কবি সেখানে সংশয়টা স্পষ্ট করে না বলে গান্ধারীর বৃত্তিটুকু উদ্ধার করেছেন।
ব্যাস কথাটা লিখেছেন এইরকম– গান্ধারী কোনও পুরুষের নামও কোনওভাবে উচ্চারণ করতেন না– বাঁচাপি পুরুষান অন্যান্ সুব্রতা নান্থকীর্তয়ৎ। গান্ধারীর পতিপরায়ণতা দেখাতে গিয়ে এই শ্লোকটির অনুবাদ পণ্ডিতমশাইদের হাতে হয়ে উঠেছে ভয়ংকর। ওঁরা বলতে চান বাড়ির সম্মানিত শ্রদ্ধেয় গুরুজনদের প্রতি গান্ধারী এতটাই বাধ্য আচরণ করতেন, যাতে তারা কথা বললে তাদের মুখের ওপর তিনি প্রত্যুত্তর পর্যন্ত দিতেন না। এমনকী প্রাচীন টীকাকার নীলকণ্ঠ পর্যন্ত এই কথা বলে গান্ধারীর ব্যক্তিত্বকে একটা মধ্যযুগীয় তাৎপর্যে পরিবেশন করতে চেয়েছেন। নীলকণ্ঠ বলেছেন অন্য কোনও পুরুষের কথায় তিনি প্রত্যুত্তর পর্যন্ত দিতেন না– নান্বকীর্তয়; ন প্রত্যুত্তরং দত্তবতী।
নীলকণ্ঠ টীকাকারের দোষ দিই না, তিনি যে সময়ে জন্মেছিলেন, তার ওপরে সেই কালের ছায়া পড়েছে। নীলকণ্ঠ তো মধ্যযুগেরই মানুষ। তার সময়ে তিনি যেমন দেখেছেন, সমাজ তখন অনেকটাই নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেছে, স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা অনেকটাই ক্ষুণ্ণ। হয়তো বা পুরুষের কথার ওপর কোনও উত্তর না দেওয়াটাই তখন স্ত্রী-ব্যবহারের চরম আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক সেই কারণেই মহাভারতীয় শ্লোকটির অর্থনির্ণয় করার সময় লিখলেন– নাম্বকীর্তয়ৎ, ন প্রত্যুত্তরং দত্তবতী।
এই কথা অবশ্য মহাকাব্যের উদার পরিবেশে মানায় না; কথাটা নিতান্তই মধ্যযুগীয়। বরঞ্চ এখানে মহাভারতের কবি যা বলতে চাইছেন, সেটা একটু অন্যভাবেও ভাবা যেতে পারে। কুরুবাড়ির প্রধান এবং প্রধানত ভীষ্ম চরম দায়িত্ব নিয়ে এই বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু তবু এই আশঙ্কা তার মনে থাকার কথা যে, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী হয়ে গান্ধারীর মনের গহনে একটা দুঃখ থাকতেই পারে। মনে হতেই পারে– কাশী, কাঞ্চী অথবা অবন্তীর মতো কোনও ছোট রাজ্যের রাজপুত্রও তার মনের মানুষ হতে পারতেন। এক অন্ধের সঙ্গে এই অন্ধ জীবন কাটানোর থেকে অন্য যে কোনও পুরুষই তার বিবাহের পাত্র হতে পারতেন। ঠিক এই আশঙ্কার উত্তরেই মহাভারতের কবির নিরপেক্ষ মন্তব্য– সুব্রতা গান্ধারী অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী হয়েও অন্য কোনও পুরুষের কথা একবারও ভাবেননি, মনে-মনেও উচ্চারণ করেননি, তাঁদের নাম– বাঁচাপি পুরুষান অন্যান সুব্রতা নান্থকীৰ্তয়ৎ। এখানে ‘অনুকীর্তন মানে ধৃতরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের নাম আকাঙিক্ষত হিসেবে উচ্চারণ করা গান্ধারী তা করেননি। এমনকী তা মনে মনে ভাবেনওনি। আমার ধারণা, এই অর্থই এখানে আকাঙ্ক্ষিত, প্রত্যুত্তর দেবার অর্থ এখানে আসে না।
.
০২.
আসলে মানুষের জীবনে কতকগুলি ঘটনা নিয়তির মতো নেমে আসে। স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্ব সেইভাবেই গান্ধারীর ওপরে নেমে এসেছিল বলেই তিনি সেটাকে শেষ পর্যন্ত সহজভাবে গ্রহণ করেছিলেন। এর পিছনে পাতিব্ৰত্য যতখানি কারণ, তার চেয়ে অনেক বড় কারণ গান্ধারীর মানসিক শক্তি, যা তাকে চিরতরে ধৈর্যশালিনী করে রেখেছে। তবু এই অসম্ভব ধৈর্যের মধ্যেও তিনি তার নিজস্ব বিশ্বাস এবং নীতিতে স্থির থাকতে পারেননি এবং তার কারণও তিনি নিজে নন, সেখানেও তার স্বামী আছেন। এ-কথা স্পষ্ট করে সোচ্চারে কোথাও বলেননি মহাভারতের কবি। কিন্তু তার বর্ণনার ক্রম থেকে বোঝা যায় যে, স্বামীর প্রতি গান্ধারীর আনুগত্যের সুযোগ নিয়েই অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র তার নিজের মানসিক বিকারগুলি খানিকটা অন্তত অনুপ্রবিষ্ট করতে পেরেছিলেন গান্ধারীর মধ্যে।
খেয়াল করে দেখুন, কৌরব-পাণ্ডবদের অধস্তন পুরুষ যখন বৈশম্পায়নের মুখে মহাভারতের আখ্যান শুনছেন, তখন তিনি সরলভাবেই এই তির্যক প্রশ্নটি তুলেছিলেন। বলেছিলেন– আচ্ছা! গান্ধারীর শত পুত্র হল কীভাবে? আর তার সঙ্গে এটাও বলুন যে, গান্ধারী তো চিরকাল স্বামীর অনুকূলেই চলছিলেন, কিন্তু সেই ধৰ্মচারিণী অনুরূপা স্ত্রীর প্রতি ধৃতরাষ্ট্র কেমন ব্যবহার করেছিলেন? ভাবটা এই– আপনি গান্ধারীর পতিপরায়ণতার কথা বলেছেন বটে। বলেছেন যে, তিনি কুরুকুলের গুরুজনদের অতিক্রম করেননি কখনও। কিন্তু এমন অনুকূলা স্ত্রীর প্রতি পুরুষ হিসেবে ধৃতরাষ্ট্রের কী মানসিকতা ছিল– কণ্বঞ্চ সদৃশীং ভার্যাং ধৃতরাষ্ট্ৰোইভ্যবৰ্তত?
এই প্রশ্নের উত্তরে কণ্বকঠাকুর বৈশম্পায়ন প্রথমে জানিয়েছেন যে, কীভাবে গান্ধারী শত পুত্র লাভের বর পেলেন? বস্তুত এই বরলাভের ঘটনার মধ্যে বর পাওয়া এবং বরলাভের ‘কনফার্মেশন’ আছে। আমরা গান্ধারীর বিবাহের আগেই দেখতে পেয়েছি যে, মহামতি ভীষ্ম পর্যটক ব্রাহ্মণদের মুখে গান্ধারীর বরপ্রাপ্তি সম্বন্ধে খবর পাচ্ছেন। ব্রাহ্মণরা জানিয়েছিলেন যে, গান্ধারী ভগবান শিবের আরাধনা করে শতপুত্রের জননী হবার বর লাভ করেছেন– আরাধ্য বরদং দেবং ভগনেত্রহরং হরম। এই বরপ্রাপ্তির নিরিখেই মহামতি ভীষ্ম গান্ধারীর সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ স্থির করেছিলেন, কেননা পূর্বে বারবার কুরুকুলের উত্তরাধিকারের সংকট দেখে তিনি পুত্রবধূদের বহুপুত্ৰতার ভাবনাটুকু মাথায় রেখেছিলেন। এখন জনমেজয়ের প্রশ্নের পর আবারও গান্ধারীর বরলাভের প্রসঙ্গ উঠছে। দেখতে পাচ্ছি।
বৈশম্পায়ন জানাচ্ছেন– মহর্ষি দ্বৈপায়ন ব্যাস, যিনি এক অর্থে গান্ধারীর শ্বশুরপ্রতিমও বটে, তিনি নাকি একদিন শ্রান্ত ক্লান্ত অবস্থায় উপস্থিত হয়েছিলেন গান্ধারীর ভবনে। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় তার শরীর অবসন্ন হয়ে গেছে। শ্বশুরপ্রতিম ঋষির অবস্থা দেখে গান্ধারী প্রাণমন দিয়ে যথোচিত সৎকারে ব্যাসকে পরিতুষ্ট করেন। তৃপ্ত ব্যাস তখন গান্ধারীকে বর চাইতে বললে গান্ধারী আবারও শত পুত্র লাভের বর চান– তোষয়ামাস গান্ধারী ব্যাসস্তস্যৈ বরং দদৌ। বস্তুত দ্বিতীয়বার এই বর যাচনা করে গান্ধারী তার প্রথম বারের যাচনাটিকেই নিঃসংশয় করে তুলেছেন।
এ কথা বলতে পারি না যে, গান্ধারী তার স্বামীকে ভালবাসতেন না। অন্তত তখনও পর্যন্ত ভাল না বাসার মতো বিশিষ্ট কোনও কারণ ঘটেনি। বিশেষত এই যে ব্যাসের কাছে সন্তান যাচনার সময় বহু পুত্র লাভের ইচ্ছা জানালেন গান্ধারী, সেখানেও কিন্তু তিনি প্রিয় স্বামীর অনুরূপ এবং সদৃশ পুত্রলাভের বাসনা জানিয়েছেন– সা বব্রে সদৃশং ভর্তুঃ পুত্ৰাণাং শতমাত্মনঃ। একজন অনুকূলা স্ত্রী হিসেবে স্বামীর প্রতি এই নিষ্ঠা প্রদর্শন করলেও ধৃতরাষ্ট্রের অন্তরস্থিত ইচ্ছা, অভিমান এবং আকাঙ্ক্ষাগুলি কিন্তু গান্ধারীর মধ্যে কিছুটা সংক্রমিত হয়েছিল, অন্তত সাময়িকভাবে সংক্রমিত হয়েছিল।
কেন এ কথা বলছি, তার কারণ হল– ভবিষ্যতে ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে যে অন্যায় লোভ এবং রাজ্যাকাঙ্ক্ষা দেখতে পাবেন গান্ধারী এবং যে অত্যুগ্র আকাঙ্ক্ষা তিনি ভবিষ্যতে খুব একটা সহ্য করতে পারেননি, সেই লোভ তো সেই দিন থেকেই ধৃতরাষ্ট্রের অন্তরশায়ী হয়েছিল, যেদিন তিনি জ্যেষ্ঠ হয়েও অন্ধত্বের কারণে রাজ্যের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আমাদের বিশ্বাস করার এমন কোনও কারণও ঘটেনি যে, সাধারণ দাম্পত্য জীবনে যেমনটি সাধারণভাবে ঘটে, অর্থাৎ যেমন নববধূর মনের মধ্যে বিবাহিত পুরুষ তার আশা আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ-বেদনার সংক্রান্তি ঘটায়, সেখানে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী সেখানে ব্যতিক্রম। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস- ধৃতরাষ্ট্র যখন অজস্রবার ভবিষ্যতেও গান্ধারীর কাছে তার এইভাবে রাজ্য হারানোর পরিতাপ জানিয়েছেন, তখন বিবাহিতা পত্নীর কাছে তিনি প্রথম থেকেই এই দুঃখ জানাননি এটা আমরা বিশ্বাস করি না।
বরঞ্চ কার্যক্ষেত্রে যে-সমস্ত ঘটনা ঘটল, তাতে এই অনুমান আরও দৃঢ় হয়। দেখুন, ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু প্রায় সম-সময়েই বিবাহ করেন। বিবাহের পরেও পাণ্ডু বেশ কিছুদিন পররাজ্য জয় করে স্বরাজ্যের ভৌগোলিক বিস্তারে মন দিয়েছিলেন। পাণ্ডু রাষ্ট্রজিত সম্পদ এবং অর্থ ধৃতরাষ্ট্রের হাতেও প্রচুর তুলে দিয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রকেও দেখছি– তিনি যজ্ঞ-টজ্ঞ করছেন, কিন্তু এতৎ সত্ত্বেও রাজা না হবার দুঃখ তার মন থেকে দূরীভূত হয়েছিল কিনা সে-খবর মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে উচ্চারণ না করলেও পাণ্ডু যে তার দুই সহধর্মচারিণী স্ত্রীকে নিয়ে বনবাসী হলেন হঠাৎ, বিনা কোনও প্ররোচনায়, বিনা কোনও ঘটনায়– এটা খুব স্বাভাবিক লাগে না। মহাভারতে স্পষ্ট কথা কিছু নেই বলেই আরও অনুমান হয়– এখানে মনে মনে, অন্তরে-অন্তরে কিছু কঠিন টিপ্পনী ছিল যাতে পাণ্ডু আকস্মিকভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে স্ত্রীদের নিয়ে বনবাসী হয়েছেন। বনের মধ্যে বিভিন্ন আশ্রয়ে থাকার সময় রাজোচিত স্বচ্ছন্দতার জন্য ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর কাছে অর্থ পাঠিয়েছেন নানা লোকের মাধ্যমে এবং সেটাও পাঠিয়েছেন খুব ‘মেটিকুলাসলি’–উপজহুর্বনান্তেষু… নরা নিত্যম অতন্দ্রিতাঃ।
কিন্তু এইসব সচেতন ক্রিয়া-কর্ম সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র কোনওদিন পাণ্ডুকে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি লোকও পাঠালেন না, কিংবা বিদুরের মাধ্যমে পাঠালেন না এমন কোনও সংবাদ, যাতে পাণ্ডু জ্যেষ্ঠের আহ্বানে ফিরে আসেন। গান্ধারীর প্রসঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের এই ব্যবহারটুকু এইজন্য জানাচ্ছি যে, গান্ধারীও কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এ বিষয়ে কোনও প্রস্তাব করেননি, এমনকী তার তরফ থেকে শোনা যাচ্ছে না কোনও উচ্চবাচ্যও। তাতেই অনুমান করি যে, তখনও পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্র তার অক্ষমতা এবং তার ঈর্ষা-অসূয়ার যুক্তিগুলি সাময়িকভাবে গান্ধারীর অন্তর্নিহিত করতে পেরেছিলেন। এ-বিষয়ে আরও একটা প্রায় নিশ্চিত প্রমাণ আছে।
গান্ধারী ব্যাসের কাছে শত পুত্রের জননী হবার বর লাভ করেছেন এবং গর্ভও ধারণ করেছেন, কিন্তু এক বৎসর চলে যাবার পরেও তার গর্ভমুক্তির কোনও সম্ভাবনা দেখা গেল না, কোনও সন্তানও জন্মাল না। ওদিকে কুন্তী গান্ধারীর পরে গর্ভধারণ করেও তার প্রথম সন্তান প্রসব করলেন পাণ্ডুর অরণ্য আবাসে। এই যে তার পরে গর্ভধারণ করেও কুন্তীর পুত্রলাভের ঘটনা ঘটে গেল এবং তিনি গর্ভ নিয়েই বসে আছেন, এতে কিন্তু গান্ধারী মোটেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তার মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল– অপ্রজা ধারয়ামাস ততস্তাং দুঃখমাবিশৎ।
গান্ধারীর মনে, ধৈর্যশীলা গান্ধারীর মনে এই দুঃখ কেন– তার একটা চর্চা কিন্তু অবশ্যই আসে। যে গান্ধারীকে আমরা ভবিষ্যতে সদা-সর্বদা ঈর্ষাসূয়ার ক্লিন্ন চক্র থেকে মুক্ত দেখব, সেই গান্ধারীর মনে এ ঈর্ষা-অসূয়া আপনিই সৃষ্টি হয়েছিল বলে মনে হয় না। আমরা তার স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকেই এ ঈর্ষার পিছনে কারণ বলে মনে করি। ধৃতরাষ্ট্র নিশ্চয়ই গান্ধারীকে এইভাবে বোঝাতে পেরেছিলেন যে আমি জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অন্ধত্বের কারণে রাজা হতে পারিনি বটে, কিন্তু আমার পুত্র যদি পরবর্তী বংশে জ্যেষ্ঠ হয়ে জন্মায়, তবে পাণ্ডুর পরেই অন্তত তার রাজ্যাধিকার আসবে। উত্তরাধিকার এবং রাজ্যাধিকারের এই কালনীতি ধৃতরাষ্ট্রের সমস্ত সত্তার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, নইলে এ বিষয়ে কতটা তিনি মানসাঙ্ক করতেন তার প্রমাণ মিলবে যুধিষ্ঠির-দুর্যোধনের ক্রম-জন্মের পরেই। দুর্যোধন জন্মাতেই তিনি কুরুকুলের প্রধান পুরুষদের সভায় ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করেছিলেন– আচ্ছা! যুধিষ্ঠির তো বংশের বড় ছেলে, অতএব এখন তো সেই রাজা হবে সেটা বুঝলাম, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের পরে তো আমার ছেলে দুর্যোধনই রাজা হবে তো, না কি…– অয়ং ত্বনন্তরং তস্মাদ অপি রাজা ভবিষ্যতি।
মাত্র এক বছরের ছোট-বড় দুই ভাইয়ের জন্মমাত্রেই এই হিসেব অবশ্যই জ্যেষ্ঠের মৃত্যু অথবা অপসারণের ভাবনা জাগিয়ে তোলে এবং ভবিষ্যতে সেই চেষ্টাই চলেছে বার বার। ধৃতরাষ্ট্রের এই অন্তর্ভাবনা উল্লেখ করে আমরা বোঝাতে চাইছি যে, যাঁর মনের মধ্যে অন্তহীন এইরকম আলোড়ন চলছিল, তিনি তার স্ত্রীর কাছে শুধুই আকাশ-বাতাস, পুষ্প, নদীর রোমাঞ্চ-বর্ণনা করতেন, তা মনে হয় না। বরঞ্চ বলা উচিত, তিনি তার এই অস্থিরতা গান্ধারীর মধ্যেও সাময়িকভাবে সংক্রামিত করতে পেরেছিলেন। নইলে কুন্তীর পুত্র জন্মাতেই গান্ধারীর মতো ধৈর্যশীলা রমণী এমন ঈর্ষাকাতর দুঃখিত হয়ে পড়বেন কেন! কেনই বা দেবর-দেবরপত্নীর এই পুত্রজন্মের সংবাদ তার মতো মনস্বিনীর কাছে দুঃসংবাদ হয়ে উঠেছিল।
যদিবা তিনি শুধু দুঃখিত বা ক্ষুব্ধ হয়েই থাকতেন, তাও এক রকম হত। কুন্তীর পুত্রজন্মের কথা শুনে গান্ধারী এমন একটা কাণ্ড করে বসলেন, যা পরবর্তী কালে আমাদের পরিচিত গান্ধারী-চরিত্রের সঙ্গে মেলে না এবং তাতে এই ধারণা আরও দৃঢ় হয় যে, সেই ঘটনার পিছনেও স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের সবিকার মানসিকতার সংক্রমণ ছিল। গান্ধারী কী করলেন? কুন্তীর পুত্রলাভের সংবাদ শুনে গান্ধারী বিহ্বল হয়ে গেলেন। ভাবলেন- এতকাল ধরে আমি গর্ভধারণ করে রইলাম, অথচ পুত্র হল না। মাঝখান দিয়ে কুরুবংশের জ্যেষ্ঠ পুত্র জন্মে গেল কুন্তীর গর্ভে উদরস্যাত্মনঃ স্থৈর্যমুপলভ্যান্তচিন্তয়ৎ। নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় আত্মপীড়নের পথ বেছে নিলেন তিনি। একদিন, কাউকে কিছু না বলে ধৃতরাষ্ট্রকেও তিনি একটা কথা জিজ্ঞাসা করলেন না, ঈর্ষায় তাড়িতা গান্ধারী নিজের গর্ভপাত করার চেষ্টা করলেন, নিজেরই গর্ভে আঘাত করে সোদরং ঘাতয়ামাস গান্ধারী দুঃখমূৰ্ছিতা।
গান্ধারীর বিরাট এবং স্নিগ্ধ-ধীর জীবনে এ যেন কেমন এক হিংসার প্রশ্রয়। আত্মঘাতী হবার জন্য যে দীর্ঘ অভিমান প্রয়োজন হয়, আত্মহত্যার জন্য যে অন্তহীন ক্রোধের প্ররোচনা থাকে, অথবা আত্মপীড়নের জন্য যে নিরন্তর দুঃখ-ভাবনা লাগে তার সবকটিই কেমন বিপরীতভাবে এসে আশ্রয় করেছিল মনস্বিনী গান্ধারীর মধ্যে। এতটাই তা বিপরীত যে, সেই অভিমান, ক্রোধ এবং দুঃখ গান্ধারীর স্বরূপের সঙ্গে মেলে না। বস্তুত এ ক্ষেত্রে যদি তার হৃদয়ের ওপর অভিমানী ধৃতরাষ্ট্রের বাক্-ইন্দ্রিয় মনোবুদ্ধির নিরন্তর ছায়াপাত না ঘটে থাকে, তা হলে আত্মহত্যার চেয়েও কঠিন এই গর্ভনাশের ভাবনা গান্ধারীর মন অধিকার করত না। বৈদ্য-চিকিৎসকেরা কেন জানি না আজও বলেন যে, গর্ভাবস্থায় সুচিন্তা এবং সুমঙ্গলী ভাবনায় দিন কাটালে সুসন্তানের জন্ম হয়। জানি না শরীরের সঙ্গে মন তৈরি হবার ব্যাপারেও এমন বৈজ্ঞানিক কোনও পরামর্শ আছে কিনা যাতে সুভাবনা, সুচিন্তায় সন্তানেরও ভাবগঠন হয়।
ধরে নেওয়া যাক, এ সব কথার কোনও মানে নেই, কিন্তু এই ঈর্ষা, ক্রোধ, অসূয়া মনস্বিনী গান্ধারীর অন্তশ্চেতনায় অবশ্যই কাজ করেছিল এবং তা স্বামী ধৃতরাষ্ট্রেরই নিরন্তর উত্তরাধিকার চর্চার ফল, যাতে তিনি কুন্তীর সন্তানজন্ম নিজেকে আর সফল মনে করেননি; অতএব গর্ভে আঘাত করে নিজের প্রয়োজন-সিদ্ধিতে অক্ষম সন্তানকে আর জন্ম দিতে চাননি। এবং হয়তো বা এও সেই অভিমান, যেখানে উত্তরাধিকারের ব্যাপারে স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের নিরন্তর প্ররোচনা সহ্য করতে না পেরে তিনি গর্ভনাশে উদ্যত হয়েছেন। অথচ মহাভারতের কবি তথ্য দিলেন যে ধৃতরাষ্ট্রের অজ্ঞাতেই তিনি তাঁর গর্ভনাশের চেষ্টা করেন। কথাটা ঠিকই, কেননা যার এত প্ররোচনা, সেই স্বামীর ইচ্ছাপূরণ করতে পারেননি বলেই অভিমানিনী গান্ধারী তাঁর অজ্ঞাতেই গর্ভনাশের চেষ্টা করেছেন।
অঘটন তবু ঘটেই গেল। এমন বলার উপায় রইল না যে সন্তান হয়ইনি, তাই উত্তরাধিকার এল না রাজ্যে। গর্ভে আঘাতের ফলেই হোক অথবা অসময়ে গর্ভপাতের কারণেই হোক, গান্ধারী স্কুল মাংসপেশীর মতো একটি বস্তু প্রসব করলেন– ততো জজ্ঞে মাংসপেশী লোহাষ্ঠীলেব সংহতা। অষ্ঠীলা’ শব্দের অর্থ মাংসপিণ্ড। লোহাষ্ঠীলা’– মানে লোহার মতো শক্ত একটা গোলাকার মাংসপিণ্ডের আকারে কিছু। এরকম অদ্ভুত একটা বস্তু দেখে গান্ধারী সেটাকে কোনও অস্পৃশ্য ভূমিতে ফেলে দেবার কথাই ভাবছিলেন। এরই মধ্যে খবর গেল দ্বৈপায়ন ব্যাসের কাছে তিনি গান্ধারীকে শতপুত্রের জননী হবার বর দিয়েছিলেন। আর ব্যাসের মতো পরমর্ষি যাকে আশীর্বাদ করেছেন, সে আশীর্বাদ বৃথা যাচ্ছে, সেটা যেমন সাধারণ মানুষের কাছেও সহনীয় নয়, তেমনই ভগবান ব্যাসেরও কিছু দায় থেকে যায় গান্ধারীর কাছে, কেননা তিনি বর দিয়েছেন। অতএব লোকেও তাকে তাড়াতাড়ি খবর দিল এবং তিনিও তাড়াতাড়ি এলেন গান্ধারীর ভবনে। মহাভারতের কণ্বকঠাকুর লিখেছেন– ব্যাস ধ্যানে জানতে পেরেছেন গান্ধারীর অবস্থা অথ দ্বৈপায়নো জ্ঞাত্বা… দদর্শ জপতাং বরঃ। যোগী পুরুষের এই ধ্যানগম্য প্রত্যয় এখনকার মানুষের ধারণাগম্য নয়। তবে ধ্যানযোগীর কাছে এই জেনে ফেলার ঘটনা তেমন অসম্ভব কিছু নয়। আর এই বিশ্বাস না থাকলে বুঝুন– তার কাছে খবর পৌঁছেছে যেভাবে হোক এবং তিনি এসেছেন তার সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য।
ব্যাস এসে দেখলেন সেই লোহাষ্ঠীলা’ গোলাকার মাংসপিণ্ড। দেখেই বললেন– মহারাজ সুবলের মেয়ে তুমি। এ তুমি কী করার কথা ভাবছিলে– কিমিদং তে চিকীর্ষিতম? গান্ধারী পরমর্ষি শ্বশুর দ্বৈপায়ন ব্যাসের কাছে একটি কথাও গোপন করলেন না। মহাভারতের নিরপেক্ষ কণ্বক-ঠাকুর মন্তব্য করেছেন- গান্ধারী যেমনটি ভেবে এই কাজ। করেছিলেন, সেই সমস্ত কথা তিনি সত্যভাবে উপস্থিত করলেন পরমর্ষি শ্বশুরের কাছে স চাত্মনো মতং সত্যং শশংস পরমর্ষয়ে। গান্ধারী বললেন আমি শুনলাম কুন্তীর পুত্র হয়েছে। প্রথমজাত সূর্যের মতো সে পুত্র। আর সেই পুত্ৰই তো এই বিখ্যাত বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে জন্মাল– জ্যেষ্ঠং কুন্তীসূত জাতং ত্বা রবিসমপ্রভম৷ আমি আর তাই স্থির থাকতে পারিনি। দুঃখে-অভিমানে আমি গর্ভপাতের চেষ্টা করেছি উদরে আঘাত করে।
গান্ধারীর এই সত্য এবং স্বাভিমান উক্তি থেকে আরও বোঝা যায় যে, তার ইচ্ছার মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছা সংক্রমিত হয়েছিল। বর প্রার্থনার ক্ষেত্রে তিনি শত পুত্রের জননী হবার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন– এখানে তাঁর সরলতা ছিল, কিন্তু সেই সন্তান কুলজ্যেষ্ঠ হোক অথবা কুরুরাজ্যে তার প্রথম উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা হোক সেই জ্যেষ্ঠত্বের সুবাদে এমন প্রার্থনা পূর্বেও তার মনে ছিল না, পরেও এই জটিলতা সৃষ্টি হবার কথা নয়। এই জটিলতা স্বামী ধৃতরাষ্ট্রই তার মনে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। আর ঠিক সেই কারণেই কুন্তীর জ্যেষ্ঠ প্রথম পুত্রজন্ম স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকে ভীষণভাবে আহত করবে বলেই তার অজ্ঞাতেই এই স্বাভিমান গর্ভনাশের চেষ্টা। ভগবান ব্যাসের উদ্যত প্রশ্নের মুখেও গান্ধারী তাকে বলেছেন– আপনি বর দিয়েছিলেন, আমি শতপুত্রের জননী হব। কিন্তু কী পেলাম আমি! শতপুত্রের বদলে এই লৌহকঠিন মাংসময় অণ্ড– ইয়ঞ্চ মে মাংসপেশী জাতা পুত্রশতায় বৈ।
গান্ধারীর মনের ক্ষতে ক্ষার নিক্ষেপ করেননি ব্যাস। তিনি গান্ধারীকে শতপুত্রের বরদান করেছেন বটে, কিন্তু সেই পুত্রই কুলজ্যেষ্ঠ পুত্র হবে, এমন বর তো তিনি দেননি, এবং তেমন বর তো চানওনি গান্ধারী। তবু তিনি গান্ধারীর কাছে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন না। কেননা বর নিয়ে এখন ঝগড়ার সময় নয়। বিশেষত, তারই ক্ষেত্রজ পুত্র ধৃতরাষ্ট্রের অভিলাষ এবং ক্ষোভ তিনি জানেন। অতএব এই প্রসঙ্গে না গিয়ে বরঞ্চ সেই শতপুত্রের বরদান বিষয় সত্য করার জন্যই তিনি বললেন– আমি যে সত্য উচ্চারণ করেছি, তা তো মিথ্যা হবার নয়, সৌবলেয়ী! আমি তো স্বেচ্ছালাপের সময়েও কখনও মিথ্যে কথা বলিনি বাছা। অতএব আমার এ কথাও মিথ্যে হবে না– বিতথং নোক্তপূর্বং মে স্বৈরেস্পপি কুতোহন্যথা। জ্যেষ্ঠপুত্রের বিচারণা ত্যাগ করে ব্যাস মাংসময় বস্তুপিণ্ডটির মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করার জন্য গান্ধারীকে নির্দেশ দিলেন– তুমি এক শত কলসি নিয়ে এসো ঘি ভর্তি করে। এই ঘৃতপূর্ণ কুম্ভগুলি রাখতে হবে সুরক্ষিত স্থানে এবং অত্যন্ত শীতল জল দিয়ে এই মাংসপিণ্ডটিকে সিক্ত করতে হবে প্রথমে শীতাভিরদ্ভিরষ্ঠীলাম্ ইমাঞ্চ পরিসেচয়!
শীতল জলে ঠান্ডা টেমপারেচারে’ রাখতেই সেই ‘অষ্ঠীলা’ মাংসময় পিণ্ডটি বহু ভাগে ভাগ হয়ে গেল এবং সংখ্যায় তার পরিমাণ দাঁড়াল একশো একটি। পৃথক পৃথক ঘৃতপূর্ণ কুম্ভে স্থাপন করার সময় এক-একটি ভ্রণের চেহারা ছিল অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ অর্থাৎ প্রায় এক আঙুল– অঙ্গুষ্ঠপর্বমাত্ৰাণাং গর্ভাণাং পৃথগেব তু! এই অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ ণতুল্য মাংসপিণ্ডগুলি যথাকালে ঘৃতকুম্ভের মধ্যেই বৃদ্ধিলাভ করতে লাগল। গান্ধারী কুম্ভগুলিকে সুরক্ষিত স্থানে রেখে যথোচিত সতর্কতায় রক্ষা করতে লাগলেন। ব্যাস বললেন এক বছর পরে এই কলসিগুলির মুখ খুলবে। গান্ধারী যে আর বেদব্যাসের কথা অমান্য করবেন না, সেটা বোঝা যেতেই ব্যাস চলে গেলেন হিমালয়ে তপস্যা করার জন্য।
সম্পূর্ণ এই ঘটনার মধ্যে অনেকটাই অলৌকিকতার আভাস রয়েছে বটে, কিন্তু ঘৃত সেকালের দিনে সমস্ত ওষধি-রসায়নের প্রতীক এবং কুম্ভ শব্দের অর্থ যতই কলসি হোক, এটি অন্য শত রমণীর গর্ভে গান্ধারীর গর্ভ সংস্থাপন কিনা- এমন একটা বৈজ্ঞানিক কল্প কল্পনার অবসর এখানে থেকেই যায়। একবার তো ভাবতেই হবে যে, মহাকাব্যে অন্তত তিনজন বিখ্যাত মানুষকে আমরা জানি যাদের বিশেষণ কুম্ভজন্মা অথবা কুম্ভযোনি। বিখ্যাত অগস্ত্য ঋষি এবং বশিষ্ঠ মুনির জন্ম হয়েছে কুম্ভের মধ্যে বা কলসিতে। পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরুও কুম্ভজন্ম দ্রোণাচার্য নামে চিহ্নিত। এসব শুনে আপনাদের কী মনে হয়– এঁরা সব কলসির মধ্যে জন্মেছিলেন? নাকি বাস্তবসম্মতভাবে মনে হয় যে, এঁদের পিতাদের বীজ অন্য কোনও নারীর গর্ভে সংস্থাপিত বা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। সংস্কৃতে কুম্ভদাসী নামে একটি কুখ্যাত শব্দ আছে, যার অর্থ– বেশ্যাপতির দাসী বা কুট্টনী। এঁদের গর্ভে পুত্র হত বলেই এই দাসীদের কুম্ভশব্দে লক্ষিত করা হয়েছে। আমরা এ-কথা মানছি যে, সেই মহাভারতের যুগে গর্ভ প্রতিস্থাপন-পদ্ধতি হয়তো বৈজ্ঞানিকভাবে জানা ছিল না, কিন্তু মনে রাখতে হবে দা ভিন্সি বিমান আবিষ্কার না করলেও আপন কল্পনাতে বিমানের যে ছবি এঁকেছিলেন, তা আধুনিক বিমানের কল্পবৈজ্ঞানিক প্রতিকল্প বটে। কিংবা এইচ. জি. ওয়েলস-এর চাঁদের মানুষটিও কম রোমহর্ষক নয় বৈজ্ঞানিক হিসেবে। সেখানে দা ভিন্সি কিংবা ওয়েলস-এর তুলনায় ক্রান্তদর্শী ব্যাস কি খুব ফ্যালনা মানুষ! আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই– শুক্ৰবীজ অন্যত্র প্রতিস্থাপন করার জন্য অতিশীতলতার সঙ্গে আয়ুষ্কারী ঘৃতস্বরূপ রসায়নের কথা কল্পনা করাটাই তো এক বিশাল বৈজ্ঞানিক চেতনার উদাহরণ। আধুনিক কালের নল-জন্ম শিশু অথবা অন্য মাতার গর্ভে প্রতিস্থাপিত বীজের সন্তান– এই কঠিন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির নিরিখে কুম্ভজন্মা শিশুদের কল্পনাটাই তো ঋষি-কবির প্রজ্ঞা বিজ্ঞাপিত করে। যাই হোক, গান্ধারীর গর্ভসংস্থ বীজ শত কুম্ভে সংস্থাপিত হল এবং এক বৎসর পূর্ণ হলে গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে প্রথম পুত্র লাভ করলেন– যার নাম হল দুর্যোধন। এই পুত্রজন্মের পরেই ব্যাস এসে কিন্তু ভীষ্ম বিদুরের মতো কুরুকুলের প্রধানদের জানিয়ে গেলেন যে, জন্মের ক্রম অনুযায়ী কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিরই কিন্তু কুলজ্যেষ্ঠ এবং তিনিই রাজা হবার উপযুক্ত জন্মতস্তু প্রমাণেন জ্যেষ্ঠো রাজা যুধিষ্ঠিরঃ।
গান্ধারীর প্রথম পুত্র দুর্যোধন যেদিন জন্মালেন, যখন তিনি শৈশবের প্রথম নির্ধারিত কান্নাটুকু কাঁদলেন, সেই ক্রন্দনের আওয়াজ নাকি ছিল গাধার ডাকের মতো। মহাকাব্যের অতিশয়িনী বর্ণনায় তার কান্নার ডাক শুনে নাকি অন্য গাধারাও ডেকে উঠেছিল, ডেকে উঠেছিল শেয়াল, শকুন, কাক– যারা দুর্নিমিত্ত, দুর্লক্ষণের বাহন- তং খরাঃ প্রত্যভাষন্ত গৃ-গোমায়ু-বায়সাঃ। এই যে সব দুর্লক্ষণের ভাবনা, এসব হয়তো মহাকাব্য-রচনায় প্রয়োজনীয় অঙ্গ। ভবিষ্যতে যে মানুষ অন্যায়-অধর্মের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠবেন, তার কর্মজীবন দেখেই মহাকাব্যের কবিরা তার জন্মের সময়েই দুর্নিমিত্ত বর্ণনা করেন। ধরে নিলাম– দুর্যোধন তার শৈশবের স্বাভাবিক ক্রন্দন-শব্দেই তার জননীকে আপ্লুত করেছিলেন, হয়তো গাধা, শকুন, শেয়াল কিছুই ডেকে ওঠেনি দুর্যোধনের শব্দে-প্রতিশব্দে। কিন্তু এর থেকেও বড় দুর্নিমিত্ত ছিল– যখন পুত্রজন্মের সংবাদ লাভ করেই হস্তিনাপুরের কার্যনির্বাহী রাজা ধৃতরাষ্ট্র সভা ডেকে ভীষ্ম-বিদুরের মতো প্রধান পুরুষদের জিজ্ঞাসা করলেন– যুধিষ্ঠির কুন্তীপুত্র এই বংশের সবার বড় এবং সেই এ-রাজ্যের রাজা হবে, তা জানি। কিন্তু তারপরে আমার ছেলে দুর্যোধন রাজা হবে তো? আপনারা সঠিকভাবে আমাকে এই তথ্যটা দিন তো, বলুন তো ঠিক কী হবে– এতৎ প্রব্রুত মে তথ্যং যদত্ৰ ভবিতা ধ্রুবম্।
প্রায় সমবয়সি মাত্র এক বছরের ছোট রাজপুত্রের সম্বন্ধে কার্যনির্বাহী রাজার এই ভয়ংকর প্রশ্ন জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের প্রাণের অনিশ্চয়তা তৈরি করে। বিশেষত রাজযন্ত্র যাঁর হাতে রয়েছে, তিনি যদি পুত্রের রাজ্যাধিকার সম্বন্ধে এই নিশ্চয়তা দাবি করেন, তবে অন্যতর বয়োজ্যেষ্ঠের প্রাণের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে এবং ভবিষ্যতে বারবার বিচিত্র আঘাত এসেছেও যুধিষ্ঠিরের প্রাণহানির জন্য। শেয়াল-শকুনের প্রতিশব্দের চেয়েও এই দুর্নিমিত্ত হস্তিনাপুরের রাজসভা আরও অনেক ভয়ংকর ছিল, যার জন্য মহাকাব্যের রীতিতে ধৃতরাষ্ট্রের বক্তব্য শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই আবারও নিতান্ত প্রতীকীভাবে অমঙ্গলসূচক মাংসভোজী প্রাণী আর শেয়াল-শকুনের ডাক শোনা গেল– ক্ৰব্যাদাঃ প্রাণদন ঘোরাঃ শিবাশ্চাশিবশংসিনঃ।
সভায় সমবেত ব্রাহ্মণেরা এবং উচিতবক্তা বিদুর এই শেয়াল-শকুনের অমঙ্গল শব্দের কথাটাই তুললেন, কারণ কার্যনির্বাহী রাজার মুখের ওপর তাকে বলা যায় না যে, আপনার এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড় ভয়ের সংকেত দিচ্ছে। অতএব মহাকাব্যের অমঙ্গল কল্পগুলিকে উপলক্ষ করেই সমবেত ব্রাহ্মণেরা এবং বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন তোমার পুত্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যখন এতসব দুর্লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তখন তোমার এই ছেলেটি বংশনাশের কারণ হয়ে উঠবে। আমাদের মতে এ-ছেলেকে এখনই ত্যাগ করা ভাল, কারণ এঁকে রাখলে শুধু অনর্থেরই সম্ভাবনা থেকে যাবে– তস্য শান্তিঃ পরিত্যাগে গুপ্তাবপনয়ে মহান।
স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের ওপর ব্রাহ্মণদের এই নির্দেশ, তার পূর্বে পুত্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সভায় সকলকে ডেকে পাঠানো, এই সমস্ত কিছুর পিছনে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা গান্ধারীর দিকে একবার দৃষ্টি দিন। ব্যাস এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন– জন্মের প্রমাণে যুধিষ্ঠিরই সবার বড়। এ ঘটনা জেনেও গান্ধারী কিন্তু স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকে একবারের তরেও বাধা দেননি সভা ডেকে ওই বিচিত্র প্রশ্ন করার জন্য। মহাকাব্যিক রীতি অনুযায়ী কোনও ইষ্ট পুরুষের জন্ম হলে রাজপুরুষ সেখানে আচণ্ডাল-ব্রাহ্মণদের অর্থদানে ব্যস্ত থাকেন। ধৃতরাষ্ট্র তার মধ্যে গেলেন না। গান্ধারী তাকে অবশ্যই কোনও প্ররোচনা দেননি, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের মন সম্পূর্ণ পড়ে নিয়েও তাকে তিনি সভাস্থলে যেতে বাধাও দিলেন না একটুও। মাঝখান দিয়ে ব্রাহ্মণরা যে আগাম উপদেশ দিলেন পুত্রত্যাগের বিষয়ে– এ-কথা নিশ্চয়ই তার কানে এসেছে। কেমন লেগেছিল গান্ধারীর? তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া মহাভারতের কবি বর্ণনা করেননি। হয়তো পুত্রজন্মের পরেই জননীর যে বাৎসল্য একটি শিশুকে সর্বগত দৃষ্টিতে ঘিরে থাকে; সেই বাৎসল্যেই গান্ধারী সুরক্ষিত রেখেছিলেন দুর্যোধনকে।
মহাভারত বলেছে- সভাস্থিত ব্রাহ্মণেরা এবং প্রধানত বিদুরই ধৃতরাষ্ট্রকে পুত্রত্যাগের বিষয়ে কঠিন পরামর্শ দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দুর্যোধনের স্বভাব-ক্লিষ্টা গান্ধারী যখন কুরুবংশ-ধ্বংসের লক্ষণ দেখে দুর্যোধনের সম্বন্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তখন তিনি বিদুরের কথাই প্রধানত উল্লেখ করছেন। অতএব ব্রাহ্মণরা নন, ধৃতরাষ্ট্রের অনুজ বিদুরের কথা শুনে নিজের প্রথমজাত স্নেহাধার পুত্র সম্বন্ধে কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল গান্ধারী জননীর মনে? মহাভারতের কবি কোনও উল্লেখ করেননি এই মানসিক বিক্রিয়ার। এমন তো হতেই পারে না যে, কোনও বিক্রিয়া হয়নি। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন– একশো জনের এক কম নিরানব্বইটি পুত্র থাকুক আপনার। কিন্তু যদি এই বংশের পরম্পরায় এতটুকু শান্তি চান, তবে এই একটি পুত্র আপনি ত্যাগ করুন, আপনার নিরানব্বইটি পুত্র থাকুক শতমেকোন অপ্যস্তু পুত্ৰাণাং তে মহীপতে। বিদুর মহাজন-প্রবাদ উল্লেখ করে বলেছিলেন- সমগ্র কুল রক্ষার জন্য বংশের একজনকে ত্যাগ করাটা অনেক ভাল। সমগ্র একটা গ্রাম বাঁচাতে হলে একটা বংশ ত্যাগ করাও ভাল। আবার দেশ-রক্ষার মতো জাতীয় বিপর্যয়ে একটা গ্রাম ত্যাগ করাটাও কিছু নয়। আর এমন যদি হয়– আমি নিজেই না বাঁচি, তখন নিজের বাঁচার জন্য সমগ্র পৃথিবীকেও ত্যাগ করা যায়। কেননা নিজের প্রাণের চেয়ে বড় কিছু নেই, নিজেরই মতো আরও একটি প্রাণ সৃষ্টির ক্ষমতা আমাদের নেই।
বিদুর অথবা ব্রাহ্মণদের এই কথা শুনে–স তথা বিদুরেণোক্ত স্তৈশ্চ সর্বৈর্ষিজোত্তমৈঃ– ধৃতরাষ্ট্র নিশ্চয়ই কষ্টে কানে আঙুল দিতে চেয়েছেন। পুত্রস্নেহে অন্ধ রাজা দুর্যোধনকে ত্যাগ করার কথা ভাবতেও পারেননি। মহাভারতের কবি স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন ধৃতরাষ্ট্রের কথা, কিন্তু গান্ধারীর সম্বন্ধে কোনও স্পষ্টোক্তি এখানে নেই। কেন নেই? মহাভারত বলেছে– প্রথমজাত পুত্রস্নেহে ধৃতরাষ্ট্র পুত্রত্যাগ করতে পারেননি– ন চকার তথা রাজা পুত্রস্নেহসমন্বিতঃ। কিন্তু কথাটা তো গান্ধারীর সম্বন্ধেও খাটে। যে গান্ধারী ভবিষ্যতে সহস্রবার পুত্রের দুষ্কর্ম-বিষয়ে সচেতন করে দিয়েছেন, এমনকী পুত্রত্যাগের কথাও বলেছেন অনেক বার, কিন্তু এই সময়ে, এই প্রথমজাত শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনিও কিন্তু পুত্রত্যাগের কথা একবারও বলেননি। নাকি এখানেও সেই অভিমান কাজ করছে যে অভিমানে তিনি নিজের চোখে কাপড় বেঁধে নিজেও অন্ধ হয়েছিলেন, সেই অভিমানেই আজ তিনি উদাসীন। স্বামীর মতো তিনিও পুত্রত্যাগের কথা ভাবলেন না। বস্তুত, এই যে সময় এবং অবস্থা চলছে, তাতে এক সুগভীর পুত্রস্নেহ তার মধ্যেও কাজ করছে। এখনও তিনি ভাবতেও পারেন না– এই পুত্র ভবিষ্যতে কী ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে। আর ভাবতে পারেন না বলেই বহির্জগতের শত কটুক্তি এবং আপন স্বামীর দুরভীষ্টা উচ্চাশাকে প্রশ্রয় দিয়েও প্রথমজন্মা শিশুর প্রতি স্নেহের আধ্রুতিতে তিনি দুর্যোধনকে ক্রোড়ে চেপে ধরেছিলেন।
ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি গান্ধারীর ভালবাসা, অথবা খুব নিষ্ঠাও এটা নয়। বরঞ্চ এটাকে কোনও অনির্দিষ্ট অভিমানই আমরা বলতে পারি। বলতে পারি– সে অভিমান আপাতত এক উদাসীনতারও জন্ম দিয়েছে। এই যে মহাভারতের কবি উল্লেখ করলেন– ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হলে কী হবে, গান্ধারীর জন্য তিনি তো ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে বসে থাকেননি। গান্ধারী যখন গর্ভধারণ করেছিলেন, তার উদর গর্ভভারে স্ফীত থেকে স্ফীততর হচ্ছিল, তখনও ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রীলোক প্রয়োজন হয়েছিল ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য। এক বৈশ্যা রমণী গান্ধারীর গর্ভবুদ্ধিকালে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের ইন্দ্রিয়তৃপ্তির সহায়তা করেছেন। সেই পরিচারিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের যে সন্তান, সেই যুযুৎসু কিন্তু দুর্যোধনের চেয়েই শুধু বয়সে ছোট, আর সবার বড়। মহাভারতের কবি একবারের তরেও লেখেননি– এই বৈশ্যা পরিচারিকার সঙ্গে স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের শারীরিক সংশ্লেষ গান্ধারীকে এতটুকুও বিচলিত করেছিল। লেখেননি কবি। কিন্তু গান্ধারীর মনে কি এ-ঘটনার সামান্যও ছায়াপাত ঘটেনি? জানি না।
পুত্রজন্মের পর থেকে বহুকাল পর্যন্ত একটি শব্দও তার মুখ থেকে শুনিনি। তাতে এটা বেশ মনে হয় যে, সেই বিবাহকালীন সময় থেকে পুত্রজন্মের কাল পর্যন্ত স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যলাভ সংক্রান্ত যে মানসিক বিকারগুলি গান্ধারী অধিগ্রহণ করেছিলেন, পুত্রজন্মের পর থেকেই সেই সব বিকারের বাস্তবচিত্র নেমে এল তাঁর সামনে। তা ছাড়া বংশের প্রথম এবং জ্যেষ্ঠ পুত্রলাভের ব্যাপারে কুন্তীর ওপরে যে ঈর্ষা ধৃতরাষ্ট্রের মাধ্যমে তার মধ্যে তৈরি হয়েছিল, সে-ঈর্ষা কি গান্ধারী খুব তাড়াতাড়ি কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন? অন্তত হস্তিনাপুরের রাজকীয় জীবনে পরপর যে ঘটনাগুলি ঘটেছে, তাতে কিছুতেই এ-কথা মনে হয় না যে, তাঁর মন থেকে সবকিছু মুছে গিয়েছিল।
অথচ এমনিতে বেশ সুখেই থাকার কথা ছিল তার। প্রথম কিছু দিন, বড় জোর এক দুই বৎসর এই ঈর্ষা-অসূয়া টিকে থাকার কথা। বিশেষত সন্তান-জন্মের সময়, সে জ্যেষ্ঠ হবে, নাকি কারও চেয়ে এক বছরের ছোট, সেটা যে একেবারেই দৈবের ঘটনা, এটা নিয়ে কোনও সহৃদয় রমণী কতদিন দুঃখ পুষে রাখেন। অথবা সেই দুঃখে অন্যের ওপর ক্রোধ করে থাকেন। অতএব বেশ সুখেই থাকার কথা ছিল গান্ধারীর। স্বামীর সঙ্গে একাত্মতায় তিনি তো নিজেই নিজের চোখ বেঁধে অন্ধ হয়ে ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে তার সমস্ত আশাই তো পূরণ হবার কথা। তিনি শত পুত্রের জননী হতে চেয়েছিলেন, মহর্ষি ব্যাসের করুণায় তিনি তা হয়েছেন স্বচ্ছন্দে। এমনকী ব্যাসের কর্মকাণ্ডে যখন এক-একটি ঘৃতপূর্ণ কুম্ভে সন্তান বীজের প্রতিস্থাপন চলছে তখনই গান্ধারীর মনে হয়, শত পুত্রের সঙ্গে তাঁর যদি একটি মেয়ে থাকত, তা হলে বেশ হত, তাঁর সে ইচ্ছেও তো পূরণ হয়েছে, এমনকী ইচ্ছামাত্রেই তা পূরণ হয়েছে।
অতিবিশ্বস্তা এক ধাত্রীর মাধ্যমে জীবন-রসায়ন ঘৃতের মধ্যে, শীতল জলের মধ্যে একটি একটি করে পুত্রভাগ সংস্থাপন করছেন ব্যাস– শীতাভিরদ্ভিরাসিচ্য ভাগং ভাগমকল্পয়ং- ঠিক তখনই গান্ধারীর মনে হল আমার যদি একটা মেয়ে থাকত দুহিতুঃ স্নেহসংযোগমনুধ্যায় বরাঙ্গনা! বস্তুত শ্বশুর ব্যাসের ক্রিয়াকারিতায় তাঁর সম্পূর্ণ বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। তিনি বুঝেই গিয়েছিলেন যে মানসিকতায় এই ঋষি শ্বশুর তাকে শতপুত্রের জননী হবার বর দিয়েছিলেন এবং যে কার্যকারিতায় আজ তিনি কুম্ভে-কুম্ভে পুত্র বীজ সংস্থাপন করছেন তাতে তিনি শত-পুত্রের জননী হবেনই– ভবিষ্যতি ন সন্দেহোন ব্রবীত্যযথা মুনিঃ। কিন্তু এই একশোটা ছেলের ওপরে যদি একটি মেয়ে থাকত তাঁর, তবে বুঝি তার হৃদয় পূর্ণ হয়ে যেত। কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে গান্ধারীর জননী-হৃদয় অদ্ভুত সুন্দর এক সংসার-কল্প ভেসে উঠল। তিনি ভাবতে লাগলেন– আহা আমার যদি একটি মেয়ে থাকত, তা হলে কী আনন্দই না হত– মমেয়ং পরমা তুষ্টির্দহিতা মে ভবেৎ যদি।
এইখানেই গান্ধারীকে অন্য সমস্ত মহাকাব্যিক রমণীদের মধ্যে প্রতিবিশিষ্ট মনে হয়। কুন্তী এবং মাদ্রী সন্তানলাভের উপায় যাঁদের হস্তামলকবৎ সহজ ছিল, তারা কিন্তু কেউই একটি কন্যা সন্তান চাননি। মহাকাব্যের যুগে উচ্চকোটি, উচ্চবর্ণ অথবা ঐশ্বর্যশালী মানুষের মধ্যে কন্যা সন্তান কামনা করাটা খুব অস্বাভাবিক ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে কন্যা-সন্তানের জন্ম হবার পর অনেক বাড়িতেই মহাকাব্যিক উল্লাস দেখেছি– পুষ্পবৃষ্টি থেকে আরম্ভ করে। দান-ধ্যানও কম দেখিনি, তবু সেই মহাকাব্যের যুগেও কন্যা-সন্তানের জন্ম নিয়ে জনক জননীর দুশ্চিন্তার প্রসার ছিল। তবে দুশ্চিন্তা যা ছিল, তা মেয়ে মানুষ করতে হবে বলে নয়, সে-দুশ্চিন্তার অনেকটাই জুড়ে ছিল মেয়ের বিয়ে নিয়ে। সেই বিয়েতেও কন্যা-পণ কত হবে, তা নিয়ে কোনও মহাকাব্যিক দুশ্চিন্তা ছিল না, বরঞ্চ অনেক বেশি দুশ্চিন্তা ছিল শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের সুখ নিয়ে। সবার ওপরে ছিল- মেয়েকে দিয়ে দিতে হবে অন্যের হাতে। তবু কন্যা-জন্মের সমস্ত অনিশ্চয়তা জেনেও গান্ধারী একটি মেয়ে চান। মনে মনে কল্পনা করেন– একশো ভাইয়ের পরে সর্বকনিষ্ঠা একটি মেয়ে– পিতামাতাই শুধু নয়, একশো ভাইয়ের সবার ছোট বোনটি কত প্রিয় হবে সকলের একা শতাধিকা কন্যা ভবিষ্যতি কনীয়সী।
সেকালের পিতারা পরলোকে পিণ্ড লাভ করার জন্য পুত্র কামনা করতেন, তেমনই পুত্র না হলে অন্তত মেয়ের ঘরের নাতি যদি মাতামহ-পিতামহের পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করে, তাতেও তারা তৃপ্তি লাভ করতেন। এমনকী পুত্র হলেও কন্যার ঘরের পারলৌকিক ক্রিয়াও মৃত প্রেতপুরুষের কাম্য তৃপ্তি বহন করত বলেই স্মার্ত বিধায়কদের বিশ্বাস ছিল। একটি মেয়ের জন্য গান্ধারীর আকাঙ্ক্ষাটা শুধু পারলৌকিক জীবনের প্রত্যাশা-সূত্রে বাধা ছিল না। বরঞ্চ তিনি অনেক বেশি আপ্লুত ছিলেন– ভবিষ্যতে আপন দুহিতার বিবাহ-সজ্জিত তরুণারুণ মুখমণ্ডলের স্বপ্ন নিয়ে। হয়তো বা এখানেও তার নিজের জীবনের বঞ্চিত ছায়াটুকু ভেসে উঠেছে। যেদিন অন্ধ স্বামীর কথা শুনে তিনি নিজের চোখ বেঁধে ফেলেছিলেন, সেদিন থেকেই বিবাহ-লগ্নের সাজসজ্জা-অলংকরণ সব মিথ্যা হয়ে গিয়েছিল তার কাছে। গান্ধারী ভাবছিলেন তার একটি মেয়ে যদি হত, তবে মহা আড়ম্বরে তিনি তার বিয়ে দিতেন। ঘরে নতুন জামাই আসত, লজ্জাবস্ত্রের আড়ালে মেয়ের আপ্লুত মুখের ছবি দেখে তিনি আপন কন্যাজন্মের সার্থকতা অনুভব করতেন– অধিকা কিল নারীণাং প্রীতিৰ্জামাতৃজা ভবেৎ। নিজের ঘরে একশো ছেলে, মেয়ের ঘরের নাতি– সব মিলিয়ে তাঁর রাজবাড়িটি গাৰ্হস্থ্যের সমস্ত পরিপূর্ণতা নিয়ে ভরে উঠবে কৃতকৃত্যা ভবেয়ং বৈ পুত্র-দৌহিত্র-সংবৃতা।
একটি মেয়ের জন্য গান্ধারীর এই আকুতি গান্ধারীকেই নতুন করে চিনতে শেখায় আমাদের। মহাভারতের কিছু কিছু সংস্করণে গান্ধারীর এই কন্যাকাঙ্ক্ষার সূত্র-শ্লোকগুলি ধরা হয়নি। সেখানে ব্যাস আসছেন, ঘৃতপূর্ণ কুম্ভগুলি ভাগ করে রাখছেন এবং অবশেষে গান্ধারীকে তিনি জানাচ্ছেন– তোমার শতাধিক একটি কন্যাও হল। কিন্তু গান্ধারীর নিজের জীবনের নিরিখে একটি মেয়ের জন্য তার মানসিক আকাঙ্ক্ষা থাকবারই কথা। অন্ধ স্বামীকে বিবাহ করার জন্য যিনি চোখ বেঁধে শ্বশুরবাড়িতে এসে বিবাহিত হয়েছিলেন, তিনি যে একটি মেয়ে চাইবেন, একটি জামাই চাইবেন অথবা জামাই বরণ করার মাতৃসুখের মধ্যে দিয়ে কন্যাজন্মের সার্থকতা চাইবেন, এটাই আমাদের কাছে স্বাভাবিক লাগে। বিশেষত মহাভারতের কবি অসাধারণ মানসিক জটিলতা বোঝেন বলেই মহাভারতের বঙ্গবাসী সংস্করণে গান্ধারীর ভাবনা-লোকের পাঠগুলি আমার কাছে সঠিক লাগে। গান্ধারী ভাবলেন– আমি যদি কোনও তপস্যা করে থাকি, যদি উপযুক্ত পাত্রে দান-ধ্যান করে থাকি, যদি আহুতি দিয়ে থাকি ইচ্ছাপূরক দেবতার উদ্দেশে এবং যদি গুরুজনদের সেবা করে থাকি কায়মনোবাক্যে, তা হলে যেন শতাধিক একটি মেয়ে হয় আমার গুরস্তোষিতা বাপি তথাস্তু দুহিতা মম।
মহর্ষি ব্যাস তখনও প্রতিকুম্ভে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর সন্তান-বীজ সংস্থাপন করছিলেন। গান্ধারীর কন্যা-কল্পনার সুখস্মৃতি তখনও মেলায়নি, ঠিক সেই সময়েই দ্বৈপায়ন ব্যাস সোচ্ছাসে বলে উঠলেন– যা বলেছিলাম এতটুকুও মিথ্যে হয়নি কিন্তু তোমার একশো ছেলে তো হবেই, কিন্তু সেই সঙ্গে একটি কন্যারও সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি যেন। নইলে এক-এক করে একশোটি অংশ গুণে নেবার পরেও একটি অংশ বেশি হচ্ছে। তাতেই মনে হচ্ছে, একটি কন্যাও তুমি লাভ করবে, যেমনটি তুমি মনে মনে চেয়েছ– এষা তে সুভগা কন্যা ভবিষ্যতি যথেপ্সিতা। এই কথা বলে ব্যাস আরও একটি ঘৃত-রসায়ন-সংযুক্ত কুম্ভপাত্রে সেই শতাধিক কন্যাভাগ সংস্থাপন করলেন।
আমি জানি, আমার কাছে অবধারিত এই প্রশ্ন আসবে যে ব্যাসের কথার মূল্য কি এতটাই যে, তিনি একবার মুখ ফসকে বললেন- তোর একশো ছেলে হবে আর অমনই গান্ধারীর একশো ছেলে হল। আবার গান্ধারী একটি মেয়ে চাইলেন মনে মনে, অমনই তার একটা মেয়েও হয়ে গেল। উত্তরে জানাই– এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। তবে প্রথম কল্পে বলা যায় যে, এটা অনেকটাই বিশ্বাসের ওপর। সেকালে এমন ঋষি-মুনি সিদ্ধ মহাপুরুষ ছিলেন যাঁরা সিদ্ধবাক, তাদের শব্দোচ্চারণ বৃথা হত না অর্থাৎ তারা যা বলতেন, তাই হত। বিশেষত দ্বৈপায়ন ব্যাস, যাঁকে অনেক সময়েই ভগবান বলে সম্বোধন করা হয়েছে এবং কোনও কোনও মতে, তিনি ভগবানের অবতার বলেই চিহ্নিত, সেই ব্যাসের কথা কখনও মিথ্যা হতে পারে না। কেননা ভগবত্তার একটা বড় লক্ষণই হল–তিনি ‘না’-কে “হ্যাঁ’ করতে পারেন, ‘হা’কে ‘না’ করার শক্তিও তার আছে এবং যেমনটা ঘটছে সেটাকে অন্যরকম করার শক্তিও তার মধ্যেই আছে– কতুম অকম অন্যথা কর্তৃং সমর্থঃ। মহাভারতের কবি ব্যাস যখন গান্ধারীর পুত্রোৎপত্তির বিষয়ে অংশগ্রহণ করছেন, সেখানে তার নিজের মুখেই বারবার শোনা যাচ্ছে– আমি আপন স্বচ্ছন্দতায় অথবা কোনও স্বৈরতান্ত্রিকতাতেও বৃথা বাক্য উচ্চারণ করিনি, সেখানে সুস্থ মানসিকতায় তোমাকে যে বর দিয়েছি, তা ঘটবেই– বিতথং নোক্তপূর্বং মে স্বৈরেষ্পপি কুতোহন্যথা।
আমি জানি– আজকের এই উপভোগ-জর্জর সামাজিক পরিবেশে আমার এই প্রথম তর্কযুক্তি একেবারেই বোকা-বোকা শোনাবে। সবচেয়ে বড় কথা- জ্ঞান, ভক্তি, বৈরাগ্য, তপস্যা এবং পরহিতব্রতের মাধ্যমে যাঁদের অন্তর নিষিক্ত হয়েছে, তেমন অভ্যুদয়-সম্পন্ন সিদ্ধ মহাপুরুষ এখন প্রায় আমাদের মধ্যে নেই, যদি থাকেন তা হলেও লোকচক্ষুর অন্তরালে আছেন। কিন্তু তেমন মানুষের কথা আমরা শুনেছি, মানুষই যে আপন আন্তর শক্তিতে ভগবত্তার লক্ষণে চিহ্নিত হন, তেমন দৃষ্টান্তও কী ভারতবর্ষে কম আছে। চৈতন্যদেব অথবা রামকৃষ্ণ তো চাক্ষুষ-পরম্পরায় চরম কোনও অতীত মানুষ নন। কাজেই যদি বিশ্বাস থাকে, তা হলে মানতেই হবে যে, পরম অভ্যুদয়-সম্পন্ন মানুষ যে বাক্য উচ্চারণ করেন, তা মিথ্যা হয় না; এমনকী স্বয়ং বিধাতা পুরুষও বোধহয় তার চিরন্তনী ললাট-লেখনিটি ফেলে দিয়ে বিভূতিমান মহাপুরুষের বাক্য সার্থক করার জন্য নিজের আত্ম-অহংকার বিসর্জন দেন। উত্তর রামচরিতের কবি ভবভূতি একটি ঘটনায় দেখিয়েছেন যে, রঘুবংশীয়দের কুলপুরোহিত বশিষ্ঠ স্বয়ং রামচন্দ্রকে তার ভবিষ্যৎ পুত্রলাভের সম্ভাবনা জানাচ্ছেন। ঠিক এইখানে অসাধারণ শব্দবিন্যাসে ভবভূতি স্বয়ং রামচন্দ্রের জবানিতে আদি-ঋষিদের সম্বন্ধে বলছেন– যাঁরা লৌকিক এবং সাধারণ সাধুমাত্র তাদের কথাবার্তা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ঘটে যাওয়া ঘটনার অনুসরণ করে– লৌকিকানাং হি সাধূনাম অর্থং বাগনুবর্ততে। কিন্তু যারা আদিকালের ঋষি বশিষ্ঠ তো বিখ্যাত সপ্তর্ষিমণ্ডলেরই একজন– সেই আদ্য ঋষিরা যদি ধ্যানাবস্থিত তগত মনে কোনও শব্দ উচ্চারণ করেন, তবে ভবিষ্যতে ঘটিতব্য বিষয় বিধিলিপি অতিক্রম করে আদ্য ঋষির বাক্যকেই অনুসরণ করে ঋষীণাং পুনরাদ্যানাং বাচমর্থোহনুধাবতি।
আবারও বলছি– এই ধরনের বিশ্বাসই কিন্তু দ্বৈপায়ন ব্যাসের অঘটনঘটনপটীয়সী বিভূতিময়ী সত্তার সার্থকতা প্রতিপাদন করে এবং গান্ধারীর পুত্রলাভের ঘটনাটাও সেখানে লৌকিক যুক্তি অতিক্রম করে ভগবান ব্যাসের বাক্যমহিমায় সত্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে স্বয়ং গান্ধারীর মানস-সিদ্ধির দিকে তাকিয়ে দেখুন। তার মতো তপস্বিনী রমণীর একটি কন্যা লাভের ইচ্ছামাত্রেই সিদ্ধিদাতার মনেও সেই ইচ্ছার সংক্রমণ ঘটছে। ব্যাস বলছেন একটি মেয়েও তোমার হবে, কেননা তুমি যে সেইরকম ইচ্ছা করেছ– এষা তে সুভগা কন্যা ভবিষ্যতি যথেন্সিতা। আর যারা আমার মতো বিশ্বাসীর যুক্তি মানবেন না, জ্ঞান-বিজ্ঞান বস্তুতাত্ত্বিকতায় আস্থিত যাঁরা এই আদ্য ঋষির সার্থক শব্দ-সন্ধান মেনে নেবেন না, তাদের উদ্দেশে আমাদের যুক্তিকল্পও খুব সাধারণ। অর্থাৎ পুত্র লাভের ক্ষেত্রে গান্ধারীর প্রাথমিক কিছু সমস্যা হয়েছিল বটে, কিন্তু ঠিক সময়মতো উপযুক্ত বৈদ্যের হস্তক্ষেপ ঘটে যাওয়ায়– (সেই বৈদ্য ব্যাসও হতে পারেন–) গান্ধারী অনেকগুলি পুত্রের সঙ্গে একটি কন্যারও জননী হন। অর্থাৎ ঘটনা ঘটে গিয়েছিল এবং সেই ঘটনার জটিলতাকে মহাকাব্যিক অভিসন্ধিতে পূর্ণ করে দ্বৈপায়ন ব্যাসের মাহাত্ম প্রচার করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, দ্বিতীয় কল্পে আমার তেমন অভিরুচি নেই। যে মহর্ষি আপন ধর্মাত্মতায় মহাভারতের মতো অসাধারণ মহাকাব্য রচনা করতে পারেন, যিনি তার দৃষ্ট চরিত্রগুলির জীবনের মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, তিনি তার আপন ঐশী শক্তিতে স্নেহভাজনের বিপদ উত্তরণ করে তাঁর সুখবাসনা পূরণ করতে পারেন, এটাই আমার বিশ্বাস।
যেভাবেই হোক, ব্যাসের কর্মনিয়ন্ত্রণে গান্ধারীর পুত্র হল। অনেকগুলিই পুত্র হল এবং একটি কন্যাও তার আপন স্ত্রী-সাধনার ইচ্ছাপূরণের বার্তা নিয়ে আহিত হয়ে রইল শীতল জলে ঘৃতসিক্ত কুম্ভের মধ্যে। যথাসময়ে, ঠিক যেমনটি দ্বৈপায়ন ব্যাস বলেছিলেন– কৃত্রিমভাবে প্রতিস্থাপিত গর্ভ পরিণত হতে যতটুকু সময় লাগে, সেই নির্দিষ্ট সময় কালেনৈতাবতা পুনঃ–পেরিয়ে গেলেই কুম্ভাধারগুলির আবরণ মুক্ত করতে হবে– উদঘাটনীয়ানি-এতানি কুণ্ডানীতি স সৌবলীম। ঠিক সেইভাবেই গান্ধারী শত পুত্রের জননী হলেন। সঙ্গে লাভ করলেন একটি কন্যাও।
একটি নয়, দুটি নয়– একশোটা ছেলে। আমরা জানি, সমালোচনামুখর মনে সন্দেহ একটা আসবেই। এমনকী সে-সন্দেহ নিতান্তই স্বাভাবিক বলে মহাভারতের শ্রোতা জনমেজয় সোৎসাহে বক্তা বৈশম্পায়নকে প্রশ্ন করছেন– আপনি জ্যেষ্ঠ এবং অনুজ্যেষ্ঠের ক্রমিকতায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের নাম বলুন। বৈশম্পায়ন বলতে আরম্ভ করেছেন একে একে শত নাম। আশ্চর্য হই– মহাভারতের অনেক ক্ষেত্রেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পরবর্তী উত্তরণ বাদ পড়ে গেছে, অনেক আখ্যান-উপাখ্যানের একান্ত ঈপ্সিত শেষাংশ উপেক্ষিত রয়ে গেছে অন্য ঘটনার তাড়নায়, অথচ বৈশম্পায়ন একটি পূর্ণ অধ্যায় জুড়ে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর শত পুত্রের নাম বলছেন। এতে সন্দেহ আরও বাড়ে। বেশ বুঝতে পারি– পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইয়ের প্রতিপক্ষতায় ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের সংখ্যাগত বাহুল্যের যে একটা বিশাল জোর আছে, সেটা দেখানোটাই হয়তো খুব বড় হয়ে উঠেছে মহাভারতের কবির কাছে। কিন্তু মহাকাব্যিক আচরণ তো ভেদ করি প্রতিনিয়ত, তাতে বাস্তবতার অভিসন্ধি মেশালে এইরকমই মনে হয় যে, আমরা তো রেগে গেলেই বলি– একশোবার বলব, হাজার বার বলব, অথবা বলি– একশো রকমের ঝামেলা; এইসব নির্বচন-প্রবচনে যেমন সংখ্যাগত দিকটি বহুত্ব বা অনেকত্ব নির্দেশ করে, মহাকাব্যের রাজ্যেও তেমনই– দশরথ রাজার হাজার বছর বয়স, যযাতির হাজার বছরের জরা, কৃষ্ণের ষোলো হাজার স্ত্রী– এইসব সংখ্যা বহুত্ব নির্দেশ করে। এই কারণেই মহাভারতের এক অধ্যায় জুড়ে দুর্যোধন, দুঃশাসনের ক্রমে শত পুত্রের একশোটি নাম করা হয়েছে বটে, কিন্তু দুর্যোধন-দুঃশাসন এবং আরও কয়েকজন ছাড়া তাদের কোনও গুরুত্বই ছিল না এবং এই গুরুত্বহীনতাই প্রমাণ করে যে গান্ধারীর অনেকগুলি পুত্র ছিল হয়তো, কিন্তু সেই সংখ্যা একশো হয়তো নয়। বরঞ্চ আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, গান্ধারী একটি কন্যা সন্তানের জন্য এবং তার বৈবাহিক আড়ম্বর নিয়ে যত স্বপ্ন দেখেছিলেন, দ্বৈপায়ন ব্যাস সে বিষয়ে প্রায় নীরব রয়ে গেলেন। গান্ধারীর শতপুত্রের নামকীর্তন করে শেষে এক পংক্তিতে দ্বৈপায়ন ব্যাস গান্ধারীর স্বপ্নশায়িনী কন্যা দুঃশলার জন্ম, নামকরণ এবং বিবাহ একসঙ্গে সেরে দিলেন। আজকের দিনে সদা দোষদর্শী মানুষ যেন আবার না ভাবেন যে, গান্ধারী প্রতিপক্ষের জননী বলেই অথবা দুঃশলা মেয়ে বলেই এই অহবেলা। আমরা বলে থাকি, এই ধরনের মহাকাব্যিক উপেক্ষা কিছু আশ্চর্য নয়, মহাভারতে মহানায়িকা দ্রৌপদীর পুত্রগুলির জীবন সম্বন্ধেও ব্যাস একই রকম নীরব। অতএব প্রকৃত প্রস্তাবে ফিরে আসি।
.
০৩.
জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধনের জন্মলগ্নেই ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে যে রাজসিক তাড়না তৈরি হয়েছিল– অর্থাৎ তার ছেলে রাজা হবে কিনা, অন্তত যুধিষ্ঠিরের পরেও সে-সম্ভাবনা আছে কিনা, এই বিষয়ে জননী গান্ধারী যে খুব বিচলিত ছিলেন, তা মনে হয় না। ধৃতরাষ্ট্রের অন্তর্গত হৃদয়ে রাজ্যলাভের জন্য যে উদগ্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, যা গান্ধারীর মধ্যে সংক্রমিত হবার ফলেই তিনি কুন্তীর ওপর ঈর্ষায় আপন গর্ভে আঘাত করেছিলেন, এ কথা সম্পূর্ণ নিশ্চিত। আবার পুত্রজন্মের পর ধৃতরাষ্ট্র যে ভাবে তার ছেলের রাজা হবার সম্ভাবনা নিয়ে সভা ডাকলেন, সেখানেও গান্ধারীর দিক থেকে কোনও শব্দ আমরা শুনিনি। ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি বিরতও করেননি কোনও তর্কে জড়িয়ে না পড়তে। এমনকী বিদুর ইত্যাদি সভাসদেরা ধৃতরাষ্ট্রের মতিগতি বুঝে তাকে যেভাবে পুত্র বিসর্জন দেবার কথা বলেছিলেন, তাতে ধৃতরাষ্ট্র যেমন একেবারেই রাজি হননি– ন চকার তথা রাজা পুত্রস্নেহসমন্বিতঃ- তেমনই গান্ধারীও মৌন-সম্মতিতে ধৃতরাষ্ট্রের পাশেই সেদিন দাঁড়িয়েছিলেন, তার পক্ষে দুর্যোধনকে ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। প্রথমজন্মা পুত্রের ওপর যে স্নেহাকর্ষণ জন্মলগ্নেই সৃষ্ট হয়, কোনও সহৃদয় জননী সেই স্নেহকে উপেক্ষা করে পুত্রকে বিসর্জন দিতে পারেন না। এমনকী গান্ধারীও পারেন না।
গান্ধারী-চরিত্রের এই অন্ধকার দিকটি– আমরা সত্যি একে কোনও অন্ধকার দিক বলব কিনা এবং বলাটাও কোনও ধৃষ্টতা হবে কিনা, সেটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে– তবে আমরা এটাকে এখন থেকেই অন্ধকার দিক বলতে চাই। সবচেয়ে বড় কথা, মহাকাব্যের এই বিশাল চরিত্রটি বুঝতে গেলে প্রথমত পূর্ব-নির্মাণ-নিপুণ দ্বিতীয় সেই মহাকবি, যিনি গণিকা শ্যামাকে নায়িকাতে পরিণত করেছেন অথবা কর্ণ-কুন্তী সংবাদে যিনি কর্ণকে অন্য এক উত্তরণে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেই মহাকবির লেখা গান্ধারীর আবেদন মাথায় না রেখে যদি মহাকাব্যের গান্ধারীকে একবার ভাল করে বিচার করেন, তা হলে দেখবেন জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে মহাভারতের কবি যেমন মাঝে মাঝেই পুত্রস্নেহে অন্ধ বলে বর্ণনা করেছেন, তেমনই একবারের তরেও মহাকবি সে কথা উচ্চারণ না করলেও গান্ধারীর মধ্যেও সেই স্নেহান্ধতা আছে। হয়তো এই হোন্ধকার ধৃতরাষ্ট্রের মতো সহজাত বা অন্তর্জাত নয়, হয়তো ধৃতরাষ্ট্রের কাছ থেকে তা সহবাস-পরিচয়-বশে আহৃত বলেই গান্ধারীর চোখের উপর আহাৰ্য্য আবরণটির মতোই তা নিতান্তই বাইরের আবরণ। তবুও সে বাহ্য আবরণ যেমন অতি তীব্রভাবে না হলেও কৃত্রিমভাবে আলোর অভাব ঘটায়ই বটে, সেইভাবেই দুর্যোধনের ব্যাপারে গান্ধারীরও স্নেহান্ধতা কম ছিল না।
বিশেষত কতকগুলি ঘটনা আমাদের চোখে পড়ে, বিশেষত সেই দিনটার কথা– যেদিন মৃত স্বামীর শবদেহ এবং মাদ্রীর সুসংবৃত শব নিয়ে জননী কুন্তী ঋষিদের সহায়তায় হিমালয়ের অরণ্য আবাস ছেড়ে হস্তিনাপুরে এসে পৌঁছালেন। সঙ্গে পাঁচটি ছেলে, আভরণহীন, বদন মলিন। আর তাদের সকলকে বিস্ময় কুতুকে দেখার জন্য হস্তিনার রাজবাড়ি থেকে গান্ধারীর একশো ছেলে বসনে ভূষণে অলংকৃত হয়ে বেরিয়ে এসেছিল দুর্যোধনকে সামনে নিয়ে ভূষিতা ভূষনৈশ্চিত্রৈঃ… দুর্যোধন-পুরোগমাঃ। সেদিন সেখানে একইভাবে বেরিয়ে এসেছিলেন গান্ধারী, রাজবাড়ির অন্তঃপুরবাসিনী রাজরমণীদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে– রাজদারৈঃ পরিবৃতা গান্ধারী চাপি নির্যযৌ। কিন্তু আশ্চর্য লাগে, ওই যে স্বামী পাণ্ডু আর সপত্নী মাদ্রীর শবদেহ পাশে নিয়ে বিধবা রাজরানি কুন্তী পঞ্চপুত্রের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন, আর অন্যদিকে তার সহযাত্রী, সহায়ক ঋষিরা সমস্ত ঘটনা ভীষ্ম-ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের কাছে নিবেদন করছিলেন কতক্ষণ ধরে, এই পুরো সময়টা জুড়ে কুন্তী দাঁড়িয়ে রইলেন পূর্ব পরিচিত রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে, কিন্তু একবারের তরেও কৌরব-বাড়ির যুবতী বৃদ্ধা কুলবধূদের একজনকেও দেখলাম না যে, কেউ তারা কুন্তীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন সমদুঃখের মর্মজ্ঞতায়।
উন্মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ঋষিরা পাণ্ডুর মৃত্যু-পূর্ব ঘটনা, তার পুত্রজন্মের কথা এবং কুন্তীর বিপন্ন অবস্থার বিবরণ দিচ্ছিলেন, আমরা রাজবাড়ির অন্দরমহল থেকে কতকগুলি উৎসুক নারীমূর্তি দেখেছি, দেখেছি বৃদ্ধা সত্যবতীকে, দেখেছি কৌশল্যা অম্বালিকাকে–মৃত পাণ্ডুর জননী–সা চ সত্যবতী দেবী কৌশল্যা চ যশস্বিনী। কিন্তু এই বৃদ্ধা-প্রৌঢ়া রমণীরাও কেউ কুন্তীর দিকে এগিয়ে গেলেন না। হয়তো পাণ্ডুর স্থলাভিষিক্ত ধৃতরাষ্ট্রের প্রভাব এমনই ছিল, অথবা এটা ধৃতরাষ্ট্র-চালিত রাজবাড়ির শাসন, নাকি প্রোটোকল যাতে অন্দরমহলের বৃদ্ধা-প্রৌঢ়ারাও শোকসন্তপ্তা বিধবার পাশে এসে দাঁড়াতে পারেননি। আমাদের জিজ্ঞাসা, গান্ধারীও কি এই দলে পড়েন? আমরা তো ভবিষ্যতে অনেকবার ধৃতরাষ্ট্রকে অতিক্রম করতে দেখব তাকে, কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে যখন কুন্তীর স্বামী মৃত এবং কয়েক বৎসর আগেই যিনি রাজরানির ভোগ্য সুখ ত্যাগ করে স্বামীর অনুবর্তী হয়েছিলেন, সেই কুন্তীর বৈধব্য-মুহূর্তে গান্ধারীই বোধহয় সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন, যিনি তার মর্যাদাটুকু অন্তত ফিরিয়ে দিতে পারতেন, কারণ গান্ধারী এবং কুন্তী বধূ হিসেবে দু’জনের মর্যাদাই কুরুবাড়িতে সমান।
রাজরমণীদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে গান্ধারী কুন্তীকে সপুত্ৰক দেখতে এলেন বটে, কিন্তু গান্ধারী তাঁকে একান্ত আপন করে বরণ করে নিলেন না রাজবাড়ির অন্দরমহলে। ধৃতরাষ্ট্র ধূমধাম করে পাণ্ডু এবং মাদ্রীর শবদাহের আদেশ দিলেন, আদেশ দিলেন শ্রাদ্ধ-তর্পণের। পাণ্ডুর শব চিতায় উঠল, জননী অম্বালিকা পুত্রশোকে মূৰ্ছা গেলেন, কুন্তীর আর্তনাদে, হা-হুঁতাশে সকলের চোখে জল এল, কুরুবাড়ির অন্যান্যদের কাঁদতে দেখা গেল কুন্তীর সমদুঃখভাবে, কিন্তু কোথাও এখানে আমরা গান্ধারীর নাম উচ্চারিত হতে দেখলাম না। মনে রাখা দরকার, মহাকাব্যের বিশালবুদ্ধি কবি সব সময় স্পষ্টভাবে কথা বলেন না। বহুতর মহাকাব্যিক চরিত্রের গতি-বৈশিষ্ট্য তাঁকে সামলাতে হয়, অতএব অনেক কথা তিনি উহ্য রেখে বলে দেন, অনেক কথা বলেও বলেন না। যে গান্ধারী ভবিষ্যতে পুত্রের বিরুদ্ধে, স্বামীর বিরুদ্ধে স্পষ্ট উচ্চারণ করবেন, তিনি যে এখনও সেই ঔদার্যের পরিসরে আসেননি, সেটা স্পষ্ট করে বলতে তাঁর কবিজনোচিত ব্যথা কাজ করে। অতএব গান্ধারীর অনুপস্থিতি মাত্র প্রকাশ করে পাণ্ডুর শ্রাদ্ধ-শান্তির পর তিনি নিজেই কুরুবাড়ির প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হয়েছেন এবং জননী সত্যবতীকে বলেছেন দিন দিন বড় খারাপ সময় আসছে মা, তুমি আমার সঙ্গে বনবাসে বাণপ্রস্থী হও। এই অস্পষ্ট উচ্চারণ জননী সত্যবতী প্রকট করে দিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রের জননী অম্বিকার কাছে। বলেছেন- তোমার নাতির অন্যায়ে সমস্ত কুরুকুল ধ্বংস হয়ে যাবে– অম্বিকে তব পৌত্রস্য দুর্নয়াৎ কিল ভারতাঃ।
ওই একটা শব্দই যথেষ্ট– অম্বিকা! তোমার নাতি, অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্রের ছেলে। এটা কোনও আর্য ভবিষ্যদ্বাণী নয়, কোনও দৈববাণীও নয়। আমাদের ধারণা– ততদিনেই কুমার দুর্যোধন যথেষ্টই বেয়াড়া হয়ে গিয়েছিলেন–বেয়াড়া এইকারণে যে, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যলিপ্সা তাঁর মধ্যে ততদিনে সংক্রমিত হয়েছিল ভালমতো এবং জননী গান্ধারীও কিন্তু এখনও উদাসীন ভূমিকায় আছেন। পুত্রকে সংযত করার ভূমিকা, যা তিনি বারবার গ্রহণ করবেন ভবিষ্যতে, বারবার যিনি চরম নিস্পৃহতায় তীক্ষ্ণ শব্দ উচ্চারণ করবেন দুর্যোধনের অন্যায় লক্ষ করে, তিনি কিন্তু এখনও পর্যন্ত দুর্যোধনকে একবারের তরেও কোনও কটু কথা বলেননি। এমনকী তার নিজের আচরণও আমাদের বিভ্রান্ত করে। কুন্তী এলেন পঞ্চপুত্রের হাত ধরে, রাজরানির প্রাপ্য সম্মান দূরে থাক, বিধবা রানির সামনে কুমার দুর্যোধনের সালংকার উপস্থিতি, রাজরমণীদের দ্বারা পরিবৃতা গান্ধারীর সকৌতুক আগমন, অথচ তারপরে কিছু নেই, কুন্তী কোনও মতে রাজবাড়ির কোনও অকীর্তিত স্থানে আশ্রয় পেয়েছেন এবং সত্যবতী, অম্বিকা, অম্বালিকা ব্যাসের সঙ্গে বানপ্রস্থী হবার পরেই আমরা ভীমকে বিষ খাওয়াতে দেখছি দুর্যোধনের অধিনায়কতায়।
লক্ষণীয় ঘটনা হল, দুর্যোধন যে এত স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছেন, সেখানে ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীর কোনও বিবেকের ভূমিকা নেই। অপিচ পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই ভীম যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন– এ কথা একজন স্ত্রী হিসেবে কুন্তী কিন্তু তার বড় দিদি গান্ধারীকে জানাতে পারছেন না। তিনি বিদুরকে তার বাড়ি থেকে ডাকিয়ে আনছেন নিজের অবসন্ন গৃহের মধ্যে এবং তখনই তার কাছে এটা বড় স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে গেছে যে, দুর্যোধন বেশ নিষ্ঠুর এবং তিনি রাজ্যলুব্ধ হয়েই তার অতি বলবান পুত্রটিকে মেরে ফেলতে চাইছেন ভবিষ্যৎ প্রতিযোগী ভেবে। অথচ ধৃতরাষ্ট্রকে তো নয়ই কুন্তী গান্ধারীকেও তার আকস্মিক বিপন্নতার কথা জানাতে পারছেন না, জানাতে পারছেন না যে, তোমার ছেলেটি কিন্তু ভাল নয়, তুমি তাকে শাসন করো। বোঝা যায়, গান্ধারী পুত্রকে এতটুকুও শাসন করেননি অথবা শাসন করবার ইচ্ছেও তাঁর ছিল না, অথবা ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্রয়-পুষ্ট পুত্রকে তারই সংক্রমিত উদগ্র রাজ্যলালসা থেকে নিবারণ করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল না। নাকি শেষ কথাটা সেই কাল-চালিত পুরুষশাসিত সমাজের চিরন্তনী অভিসন্ধি যাতে ধৃতরাষ্ট্রকে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি গান্ধারীর পক্ষে। কিন্তু তাতে শেষ কথার পরে সেই শেষ প্রশ্নটাও উঠে পড়ে– তা হলে পরে তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে অতিক্রম করলেন কী করে বারবার। তাতেই সন্দেহ হয়– দুর্যোধনের দুর্বিনীত হয়ে ওঠার পিছনে গান্ধারীর সচেতন ঔদাসীন্য কাজ করেছে হয়তো। অন্তত দুর্যোধনের প্রথম জীবনে বড় হয়ে ওঠার পিছনে ধৃতরাষ্ট্রের ঈর্ষা-অসূয়া যেভাবে সংক্রমিত হয়েছিল, সেখানে গান্ধারী নিজেকে ‘কনট্রোল এলিমেন্ট হিসেবে এতটুকুও কাজে লাগাতে পারেননি, অথবা নিজের মধ্যেও সেই ঈর্ষা-অসূয়া অবচেতনে ক্রিয়া করছিল বলে তা কাজে লাগাননি।
এ কথা নিশ্চয়ই একবার ভেবে দেখা উচিত যে, তার ভাই শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের রাজশাসনের মধ্যে আগন্তুক রাজপুত্রের মতো ছিলেন না। তার নিজের রাজ্য গান্ধার কিংবা কান্দাহারের শাসনভার কার হাতে সঁপে দিয়ে শকুনি কোন আশায় ধৃতরাষ্ট্রের রাজধানীতে চিরতরে থেকে গেলেন? গান্ধারীর সামান্যতম প্রশ্রয় না পেলে কেমন করেই বা দেখছি যে, শকুনি কী সুন্দরভাবে নিজের শৃঙ্গ দুটি ভেঙে হস্তিনাপুরের অল্পবয়সিদের বাছুর-দলে প্রবেশ করে গেছেন এবং কুমার দুর্যোধন প্রথম যে সুচিন্তিত প্রয়াস গ্রহণ করলেন পাণ্ডবদের জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার জন্য, সেখানে পরিকল্পনা-পর্বে মহাভারতের বিখ্যাত দুষ্ট-চতুষ্টয়ের মধ্যে সৌবলেয় শকুনি প্রথমেই স্বমহিমায় বিরাজ করছেন– তত সুবল পুত্ৰস্তু রাজা দুর্যোধনশ্চ হ। ধরে নেওয়া যেতে পারে– রাজসভায় যে কর্মকাণ্ড চলছে, ধৃতরাষ্ট্র কণিক নামে এক স্বার্থ-বিধায়ক অমাত্যের সঙ্গে পাণ্ডবদের বিষয়ে দুর্মন্ত্রণা করছেন, সে-সব গান্ধারী কিছুই জানতেন না। কিন্তু তার ভাই শকুনি যে রাজসভার বাইরে তারই পুত্রের সঙ্গে দিন-রাত ওঠা বসা করছেন, দিন-রাত তাকে বুদ্ধি দিচ্ছেন, এটাও কি গান্ধারী বুঝতেন না? এটা ভাবার তো কোনও কারণ নেই যে, ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় এসেই শকুনি বুদ্ধিমান হয়ে উঠলেন এবং তার বুদ্ধির চরিত্র গান্ধারে থাকাকালীন গান্ধারীর জানা ছিল না। আমাদের মনে হয়, গান্ধারী সময়কালে সচেতন হননি এবং এক ধরনের ইচ্ছাকৃত উদাসীনতাও কাজ করেছে তার মনে। লক্ষণীয়, হস্তিনাপুরে যখন জতুগৃহদাহে পাণ্ডবদের মিথ্যা-মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছাল, তখন ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের জন্য পুরবাসীদের সঙ্গে একত্রে অনেক মায়াকান্না কেঁদেছেন। পাণ্ডব জননী কুন্তীর জন্য পুরবাসীদের শোকও এখানে চাপা থাকেনি। কুন্তীমাতা শোচন্ত উদকং চক্রিরে জনাঃ। প্রজাদের দুঃখ, এত শোক, এত কান্না, এমনকী কুন্তীসহ পাণ্ডবদের শ্রাদ্ধও হয়ে গেল, অথচ মহাভারতের কবি অসামান্য কবিত্ব-কৌশলে একবারের তরেও গান্ধারীর সম্বন্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না। বারণাবতে যাবার আগে পাণ্ডবেরা কুন্তী সহ হস্তিনাপুরের কুরুবৃদ্ধদের সঙ্গে গান্ধারীরও চরণবন্দনা করেছিলেন। সকলের সঙ্গে হয়তো বা গান্ধারীরও পুণ্যাশীর্বাদশব্দ উচ্চারিত হয়েছিল পাণ্ডবদের উদ্দেশে প্রসন্নমনসঃ সর্বে পুণ্যা বাচো বিমুঞ্চত। কিন্তু কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডবদের মৃত্যুর খবর হস্তিনাপুরে আসার পর গান্ধারীর উল্লেখ পর্যন্ত করলেন না মহাভারতের কবি, তাতে বুঝি– গান্ধারীর কোনও অবচেতন চরিত্র তিনি সস্নেহে এড়িয়ে গেছেন। স্পষ্ট করে তা বলা যায় না, অথবা বললে পরে গান্ধারীর চিরখ্যাত ধৈর্যশীলতায় তা আঘাত করতে পারে, এইজন্যই কি গান্ধারীর কথা একবারও উল্লেখ করছেন না ব্যাস? আচ্ছা! গান্ধারীর দিক থেকে এই নৈঃশব্দ্য, এই উদাসীনতা আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? ‘বিল্পিক্যাল সেন্সে’–resist not evil! কিন্তু মহাভারত তো এমন ধর্মে বিশ্বাস করে না, সে কথায় কথায় চেতাবনি দেয়। পরবর্তীকালে পুত্র দুর্যোধনের উদ্দেশে বারংবার যে-সব তিরস্কার উচ্চারিত হয়েছে, তা তো বিষবৃক্ষ স্বয়ং সংবর্ধিত করার পর তার শাখা-ছেদনের অপপ্রয়াস বলে মনে হয় আমাদের। মহাভারতের সেই বিখ্যাত উপাখ্যানে দেখেছি অন্যায় চোখে দেখেও যদি চুপ করে থাকা যায়, তবে রাজদণ্ড নেমে আসে তার ওপরে। তা হলে গান্ধারীর এই নিঃশব্দ উদাসীনতার সবচেয়ে বড় ফল যে, পরে হাজার শব্দ উচ্চারণ করেও উদ্ধত পুত্রকে তিনি মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি।
অন্যায় দেখেও চুপ করে থাকলে নিজেও সেই পাপের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে যেতে হয়, তার একটি বিশিষ্ট উপাখ্যান আছে মহামতি বিদুরের পূর্বজন্মকাহিনিতে। মাণ্ডব্য ঋষি আপন আশ্রমের বৃক্ষমূলে বসে যোগ তপস্যা আচরণ করছিলেন মৌন ব্রত ধারণ করে। হঠাৎই সেই আশ্রমে দস্যরা উপস্থিত হল লুটপাটের মাল সঙ্গে নিয়ে। তাদের পিছনে রাজপুরুষেরা ধাওয়া করে আসছিল। রাজরক্ষীরা অনেক পিছনে থাকায় দস্যুরা মাণ্ডব্য মুনির অরণ্য আশ্রমের গোপন জায়গায় লুঠের মাল লুকিয়ে রেখে নিজেরাও লতাবৃক্ষের অন্তরালে লীন হয়ে থাকল। রক্ষীপুরুষেরা দস্যুদের খুঁজতে খুঁজতে মাণ্ডব্য মুনির আশ্রমেই এসে উপস্থিত হল। তপস্বী মুনিকে তারা জিজ্ঞাসা করল– কোন পথে গেছে দস্যুরা? আমরা ওদের ধরতে চাই। মৌনব্রতী মুনি ভালমন্দ, ঠিক-বেঠিক কিচ্ছু বললেন না– ন কিঞ্চিৎ বচনং রাজন অব্রবীৎ সাধ্বসাধু বা। কোনও উত্তর না পেয়ে রাজপুরুষেরা আপন অনুসন্ধানের বুদ্ধিতে আশ্রম তোলপাড় করে খুঁজল এবং বমাল-সমেত চোরদের ধরে ফেলল। চোর ধরার পরে এবার তাদের সন্দেহ সৃষ্টি হল মৌনধারী ঋষির ওপর। চোরদের সঙ্গে তারা মাণ্ডব্য মুনিকেও বেঁধে নিয়ে গেল রাজার কাছে।
লক্ষণীয়, ব্রাহ্মণ-ঋষি হওয়া সত্ত্বেও রাজা কিন্তু তাকে ছাড়লেন না। চোরদের সঙ্গে একইভাবে মুনিকেও শূলে চড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিলেন রাজা। রাজপুরুষেরা নির্দিষ্ট স্থানে চোরদের সঙ্গে মাণ্ডব্য মুনিকেও শূলে চড়িয়ে দিল। অদ্ভুত যেটা ঘটল সেটা হল– চোরেরা মারা গেল, কিন্তু তপঃপ্রভাবে মাণ্ডব্য মুনি বেঁচে রইলেন এবং তিনি সেই অবস্থাতেও তপশ্চরণ করতে লাগলেন। লোক মারফত খবর এল রাজার কাছে, রাজা নিজের ভুল এইটুকু বুঝতে পারলেন যে, এঁকে দস্যু-চোরদের সঙ্গে একই দায়ে দায়ী করা উচিত হয়নি। যাই হোক, অন্যদিকে মুশকিল হল যে শূল দেহের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছিল, সেটাকে বার করা তো সম্ভব নয়, অতএব রক্ষীরা অর্ধেক শূল কেটে মাণ্ডব্যমুনিকে শূলাসন থেকে নামান। কিন্তু অর্ধেক শূল তার দেহের ভূষণ হয়েই রইল। যেখানেই তিনি যেতেন, লোকে তাকে এই অবশিষ্ট শূলের কাহিনি জিজ্ঞাসা করত এবং তাকে পূর্বকাহিনি শোনাতে হত।
বারংবার একই প্রশ্নে জর্জরিত মুনির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত ধর্মের দেখা হয় এবং শূল-ব্যথার উৎসও জানা যায়, কিন্তু সেটা আমাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। এই উপাখ্যানে আমাদের কাছে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, সেটা হল– অন্যায় দেখেও যদি চুপ করে বসে থাকা যায় তবে বাহ্যিক রাজদণ্ড বাইরে থেকে এড়ানো গেলেও চুপ করে থাকার দণ্ডটুকু অর্ধেক শূলের প্রতাঁকে নিজের মধ্যেই প্রবিষ্ট হয়ে থাকে। গান্ধারী কিন্তু সেই সচেতন উদাসীনতার দায় এড়াতে পারবেন না সারাজীবন ধরে। যখন তিনি মুখ খুলবেন, তখন বড় দেরি হয়ে গেছে। তখন সেই অর্ধেক শূল প্রতীকীভাবে তার অন্যায়ের স্মরণটুকু ঘটিয়েই দেয়। মহাভারতে একেবারে অন্য প্রসঙ্গে উল্লিখিত এই কাহিনি আমরা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, মহাভারতের মহাকাব্যিক পরিমণ্ডলে ধর্ম ব্যাপারটা এত বিশদ এবং গভীর যে, তা বুঝতে গেলে মহাভারতের কবির সূক্ষ্মতম টিপ্পনীগুলিও খেয়াল করতে হয়। দিনের পর দিন অন্যায় হতে দেখেও যিনি চুপ করে থাকলেন, সেই গান্ধারী ভবিষ্যতে বারবার ধর্মের কথা বলবেন এবং তা বলবেন বলেই সরাসরি তাকে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্মক করে দেখতে পারেননি মহাভারতের কবি, এমনকী বহুকাল চুপ করে থাকার জন্য সরাসরি তাকে অন্যায়কারী বলে চিহ্নিতও করতে চাননি।
আমরা অবাক হয়ে যাই– বারণাবতের জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা হল, দ্রৌপদীর সঙ্গে বিবাহের পর পাণ্ডবদের রাজ্যভাগ হয়ে গেল, ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞে পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য দেখে পুত্র দুর্যোধন মুখ শুকিয়ে বাড়ি ফিরলেন, শকুনির সঙ্গে দুর্যোধনের নিরন্তর পরিকল্পনা চলল– এমনকী ধৃতরাষ্ট্রও তা টের পেয়ে গেলেন, অথচ গান্ধারী কিছুই জানলেন না এবং বুঝলেনও না। এও কি সম্পূর্ণ বিশ্বাস্য! আমরা অবাক হয়ে যাই– পাশা খেলার জন্য পাণ্ডবদের ডাকা হয়েছে, পাণ্ডবরা দ্রৌপদী সহ ধৃতরাষ্ট্রের গৃহে প্রবেশ করে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে দেখা না করে, আগে গান্ধারীর সঙ্গে দেখা করেছেন– দদর্শ তত্র গান্ধারীং দেবী পতিমব্রতা। গান্ধারী তখন পুত্রবধূদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে বসেছিলেন, তাকে দেখাচ্ছিল তারামণ্ডলের মধ্যস্থিত রোহিণী নক্ষত্রের মতো। যুধিষ্ঠির প্রমুখ পাণ্ডবেরা দ্রৌপদী সহ গান্ধারীকে অভিবাদন জানালে গান্ধারীকে আমরা কুশল জিজ্ঞাসা করতে দেখছি মাত্র, অভিবাদ্য স গান্ধারীং তয়া চ প্রতিনন্দিতঃ।
মনে মনে জিজ্ঞাসা হয়– পাণ্ডব-কুলবধূ দ্রৌপদীকে দেখে কতটুকু পুলকিত হয়েছিলেন দীর্ঘদর্শিনী গান্ধারী। দীর্ঘদর্শিনী’–চোখে পট্টি বাঁধা থাকা সত্ত্বেও তাকে এই বিশেষণে ভূষিত করেছেন স্বয়ং ব্যাস। অথচ এইখানে দ্রৌপদী এতকাল পরে কৌরব-গৃহে এলেন, ইন্দ্রপ্রস্থের রাজরানি এলেন শাশুড়ি-প্রতিমা কৌরব রাজমাতার কাছে, ব্যাস পৃথকভাবে কোনও প্রত্যভিনন্দনের কথা স্পষ্ট করে বললেন না। পরের দিন সেই বিখ্যাত পাশা খেলা যখন চলছিল, যুধিষ্ঠির একটার পর একটা বাজি হারছিলেন, চারদিকে এত হইচই, দুঃশাসন কর্ণ-দুর্যোধনদের উল্লাস, বিকর্ণ-বিদুরদের প্রতিবাদ এই বিরল ঘটনার একটি শব্দও কি পৌঁছায়নি গান্ধারীর কানে! আমরা জানি– অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র তার হৃদয়বিকার চেপে রাখতে পারেননি, শকুনির প্রত্যেকটা চালের পরেই তার পাগলপারা প্রশ্ন ছিল– কিং জিতং কিং জিতমিতি– শকুনি জিতেছে কি? জিতেছে?
আমরা জানি– গান্ধারী এমন নন। কিন্তু রাজসভার মধ্যে যে উদ্বেল চক্রান্ত চলছিল, তার উচ্ছ্বাস-ধ্বনি শুধু রাজ-অন্তঃপুরের পূর্বদ্বারেই স্তব্ধ হয়ে গেল! হ্যাঁ জানি, সেকালে রাজসভা সংলগ্ন হত না রাজ-অন্তঃপুর। কিন্তু কতদূরে ছিল এই অন্তঃপুর যেখানে রাজসভার উদীর্ণ বিকারগুলি কোনওভাবেই পৌঁছচ্ছে না। যখন দুর্যোধনের আদেশ হল– যাও প্রাতিকামী, কৌরবদের দাসী কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে এসো– কৃষ্ণাং দাসীং সভাং নয়– তখন তো প্রতিকামী এই গেলেন দ্রৌপদীর কাছে, আর এই এলেন তার ক্রোধোদ্দীপ্ত বার্তা নিয়ে। তখন কিন্তু একবারও মনে হয় না– রাজসভা থেকে অন্তঃপুর খুব দূরে ছিল। তারপরেই দুঃশাসন গেলেন দ্রৌপদীর কাছে। তার অসভ্য শব্দ-রাশি, ধর্ষকসুলভ নির্লজ্জ উচ্চারণ- তুই এক কাপড়েই থাক অথবা বিবস্ত্রই থাক, তোকে টেনে নিয়ে যাব রাজসভার মধ্যে, অথবা দ্রৌপদীর সোচ্চার ব্যক্তিগত প্রতিরোধের মধ্যেই তাকে টেনে-হিঁচড়ে চুল ধরে রাজসভায় নিয়ে আসা– এগুলো কেউ কি দেখেনি, কেউ কি শোনেনি– রাজ-অন্তঃপুর থেকে রাজসভার পথের অন্তরে। মহাভারতের কালের মেয়েরা কেউ পর্দানশীন ছিলেন না এবং পুরুষেরা অশালীন আচরণ করলে সেটা বীরদর্পেই করত। অতএব দ্রৌপদীর চুল ধরে নিয়ে যাবার দৃশ্য কারও চোখে পড়েনি, সদা মুখর দাস-দাসী, পরিচারক-কঞ্চুকী প্রতিহারিণীরা সব রাজ-চর্চা-পরিবাদ বাদ দিয়ে অন্তর্মুখ হবার চেষ্টা করছিল এবং রাজসভার সমুদ্যত কার্যকলাপ কেউ জানে না, শোনেনি, কারও কানেও আসছে না– এমন ভাবা আমাদের পক্ষে দুরূহ।
না হয় এটাও ধরে নিলাম– দ্রৌপদী রজস্বলা ছিলেন বলে রাজগৃহের মুখ্যস্থানে তিনি ছিলেন না, তাকে হয়তো রাখা হয়েছিল পৃথক নির্দিষ্ট কোনও প্রকোষ্ঠে, যেখানে সাময়িকভাবে ঋতুকালীন অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠেন রাজগৃহের রমণীরা। কিন্তু সেটাই বা অন্তঃপুরের অন্তগৃহ ছাড়া কত দূরে হতে পারে? আর রাজবাড়িতে অন্তঃপুরের সুরক্ষায় যারা নিযুক্ত থাকত, তাদের কেউ এই পৃথক-নির্দিষ্ট গৃহের ওপর নজর রাখত না, এটা তো অসম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, যে প্রকোষ্ঠে একজন থাকলে অন্যতরা রমণীও সে প্রকোষ্ঠ পরিহার করে চলেন, সেখানে একবার পুরুষ প্রাতিকামী এসে প্রবেশ করলেন, অন্যবার দুঃশাসন এসে চিৎকার করতে করতে দ্রৌপদীর চুল ধরে নিয়ে যাচ্ছেন– এই সংবাদ গান্ধারীর কাছে পৌঁছায়নি– এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না। মহাভারতের কবি এইসব তুচ্ছ কথা বলতে ভুলে গেলেন নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যান্য জব্বর খবর দিয়ে ব্যস্ত রেখেছেন আমাদের। গান্ধারীর চুপ করে থাকাটা এই সময় তাকে মানায় না বলেই, বিশেষ করে তার পরবর্তী সময়ের চরিত্রের সঙ্গে মানায় না বলেই ব্যাস নিপুণভাবে রাজসভার বিচিত্র ঘটনায় মনোনিবেশ করেছেন। বস্তুত মহাকাব্যের কবির এই শিল্পীজনোচিত বেদনাবোধ এবং বিচারবোধ তার প্রত্যেক সৃষ্ট চরিত্রের ওপরেই থাকে। ভবিষ্যতে গান্ধারীর মুখে আমরা এমন সব কথা শুনব, যেখানে আজ পর্যন্ত যত তার বিমিশ্র মূক ব্যবহার আস্তে আস্তে লীন হয়ে যাবে ধর্মের মাহাত্মঘোষে।
বস্তুত দুর্যোধন-দুঃশাসন-কৰ্ণরা দ্রৌপদীকে উন্মুক্ত রাজসভার মধ্যে যে চরম অপমান করলেন, সেটাকে আধুনিক নারীবোধের দৃষ্টিতে যেমন চরম নিন্দনীয় মনে হয়, তেমনই এই ঘটনাই কিন্তু সেই মহাকাব্যিক মুহূর্ত যেখানে হস্তিনার রাজবাড়ির অমার্জনীয় পৌরুষেয়তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ভেসে এসেছিল মেয়েদের তরফ থেকে। এবং আমাদের ধারণা, এই আকস্মিক প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গান্ধারী।
মুশকিল হল, দুর্ঘটনা যা ঘটার তখন ঘটে গেছে, বিষবৃক্ষ যতখানি সিঞ্চিত হলে পুষ্ট হয়ে যায়, গান্ধারীর নীরবতায় ততদিনে ধৃতরাষ্ট্রের ঘরে বিষবৃক্ষের ডালপালা ছড়িয়ে গেছে। শকুনি-কৰ্ণরা ততদিনে দুর্যোধন-রূপ বিষমের শক্তপোক্ত শাখায় পরিণত হয়েছেন। যে শকুনির সম্বন্ধে পাণ্ডব-কনিষ্ঠ সহদেব পর্যন্ত সধিক্কারে বলেছিলেন- তোর সঙ্গে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের দেখা না হলে কৌরব-ভাইদের সঙ্গে আমাদের কোনওদিন শত্রুতা হত না– ধৃতরাষ্ট্রস্য সম্বন্ধো যদি ন স্যাৎ ত্বয়া সহ সেই শকুনির চরিত্র সম্পূর্ণ জানা সত্ত্বেও গান্ধারী তাকেও তার দুশ্চেষ্টাগুলি থেকে নিবারণ করেননি, স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকেও না। পাণ্ডবদের সঙ্গে কৌরবদের দূতক্রিয়া-পর্বেও গান্ধারীর কোনও বিকার দেখিনি আমরা। আমরা এই সন্দেহ প্রকাশ করেছি আগেই আর সেই কারণেই দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে তাকে রাজসভায় নিয়ে যাওয়া এবং রাজসভায় তার বস্ত্রাকর্ষণ থেকে দুর্যোধনের ঊরু-প্রদর্শন পর্যন্ত বিশাল বিক্রিয়াগুলি ঘটে গেল গান্ধারীর অর্ধচেতনার মধ্যেই। প্রতিবাদ যখন ভেসে এল তখন বড় দেরি হয়ে গেছে; তবু সেটা প্রতিবাদ এবং গান্ধারীর বিপরীত অবস্থানের সেই আরম্ভ-বিন্দু। ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয় থেকে সংক্রমিত হওয়া ঈর্ষা-অসূয়া, যা এতদিন গান্ধারীর অবচেতন ধূমাচ্ছন্ন করে রেখেছিল, এই মুহূর্তটাই ছিল তার অপসারণ-বিন্দু।
অথচ আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে যেন ব্যাপারটা খুব জানান দিয়ে আরম্ভ হয়নি। মানে, প্রতিবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি, তা হলে তার আগে দ্রৌপদীর অপমান কাণ্ডটাই বিপ্রতীপভাবে অনেক বেশি ভাস্বর, প্রতিবাদের জায়গাটা একেবারেই নড়বড়ে। কিন্তু মহাভারতের কল্প-বিশ্লেষণ করলে দেখবেন, এই ঘটনার পর ভীম দুঃশাসনের রক্ত পানের প্রতিজ্ঞা করেছেন। দ্রৌপদীর সযৌক্তিক প্রশ্নে ভীষ্ম কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি এবং দুর্যোধন তখনও জঘন্য ইঙ্গিতে দ্রৌপদীকে চরম অপমান করে যাচ্ছেন। অপমান করার তাড়নায় দুর্যোধন যখন নিজের ঊরুপ্রদর্শন করে ফেলেছেন, সেই মুহূর্তেই ভীমের তীব্র প্রতিজ্ঞা ভেসে এসেছে কুরুসভায়। ক্রোধে তাঁর সমস্ত রোমকূপ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ছিল। হঠাৎই প্রাকৃতিক দুর্লক্ষণে মুখর হয়ে উঠল ধৃতরাষ্ট্রের সভাগৃহ এবং গৃহ। তার হোমগৃহে অশিব শিবাশব্দ শোনা গেল, সেই শব্দের পরেই গর্দভ-শকুনের চিৎকার।
দুর্নিমিত্তের সমস্ত চিহ্নিত শব্দ শুনতে পেলেন বিদুর, গান্ধারী, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ– তং বৈ শব্দং বিদুরস্তত্ত্বদর্শী। শুশ্রাব ঘোরং সুবলাত্মজা চ। আপনারা জানেন- চরম অন্যায়ের পর এই প্রাকৃতিক দুর্লক্ষণ সূচিত হয়, এর একটা পুরাকাল্পিক অভিসন্ধি আছে। ধৃতরাষ্ট্রের হোমগৃহে কোনও শৃগাল সত্যিই ডেকে উঠেছিল কিনা, অথবা গর্দভ-শকুনের অকস্মাৎ শব্দ সত্যিই বিদুর-গান্ধারীর কর্ণে প্রবেশ করেছিল কিনা, সে তর্কে আমরা এতটুকুও প্রবেশ করব না। তবে দ্রৌপদীর নারীসত্তার যে চরম অবমাননা ঘটল তাতে সবচেয়ে যাঁরা আঘাত পেলেন, তাঁদের মধ্যে বিদুর-ভীষ্ম, কৃপ-দ্রোণের সঙ্গে যে নামটি এখন এই মুহূর্তে নতুন করে যুক্ত হল, তিনি হলেন সুবলাত্মা গান্ধারী। ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ দুর্যোধনের বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারলেও তার ব্যবহারে ব্যথিত ছিলেন সব সময়। আর বিদুর তো ছিলেন সর্বদাই দুর্যোধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী, এখনও পর্যন্ত সোচ্চারভাবে পুত্রের বিরুদ্ধে কোনওদিন তেমন করে কিছু বলেননি। কিন্তু আজ এ তিনি কী দেখলেন?
আমাদের বিশ্বাস বিদুর, ভীষ্ম, দ্রোণ-কৃপের মতো গান্ধারীও রাজসভাতেই উপস্থিত ছিলেন সেদিন। হয়তো চিরন্তন সেই পৌরুষেয়তার ভিড়ে দুর্যোধন-দুঃশাসনের অসভ্যতার সামনে তিনি এগোতেও পারেননি। কিন্তু গান্ধারী যখন অনুভবে দেখলেন– তারই পুত্র তারই গৃহের কুলবধূকে সকলের সামনে উলঙ্গ করে দিতে চাইছে, সেদিন তার অন্তরের নারীসত্তাটুকু জাগ্রত হয়ে উঠল। যাকে জননীর স্নেহে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন এতকাল, সেই হৃদয় থেকে বেরিয়ে এল নারী-সত্তার একাত্মতা। তিনি বুঝলেন– ধৃতরাষ্ট্রের ঘরে আজ গর্দভ-শেয়াল-শকুনেরাই একত্র সমাবিষ্ট হয়ে কুলবধূর ধর্ষণ-সমারোহ সৃষ্টি করেছে। তিনি বিদুরের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এসে আর্ত আবেদন জানালেন– ততো গান্ধারী বিদুরশ্চৈব বিদ্বান। নিবেদয়ামাসতু-রাৰ্তবত্তদা।
মহাভারতে এই সময়ে যে বর্ণনাটুকু আছে, তা খুব বিস্তারিত নয় এবং বিস্তারিত নয় বলেই কে কাকে কী বলছেন এবং তার পরে কী ঘটছে, সেটা যেন খুব ঘুলিয়ে যায়। এই যেমন এখানে আছে যে, গান্ধারী এবং বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দুর্যোধনের অনিয়মে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা উচ্চারণ করার সঙ্গে-সঙ্গেই ধৃতরাষ্ট্রের মুখ থেকে এই সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে- দুর্যোধন! ছোটলোক কোথাকার। তুই একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিস– হতোহসি দুর্যোধন মন্দবুদ্ধে– নইলে কুরুশ্রেষ্ঠদের সবার সামনে পাণ্ডবদের ধর্মপত্নী দ্রৌপদীর সঙ্গে আলাপ করছিস- স্ত্রিয়ং সমাভাষসি দুর্বিনীত। বিশেষত দ্রৌপদীং ধর্মপত্নীম। আমরা মনে করি যে ধৃতরাষ্ট্র এতক্ষণ ধরে দুর্যোধন-কর্ণ-দুঃশাসনের মুখে যত অপশব্দ উচ্চারণ নীরবে সহ্য করে যাচ্ছিলেন এবং একবারও বাধা দেননি, তিনি হঠাৎ গান্ধারী আর বিদুরের মুখে (বিদুর তো একটু আগেই যা-তা বলছিলেন দুর্যোধনের সম্বন্ধে) একবার মাত্র প্রাকৃতিক দুর্লক্ষণের কথা শুনে কথার ভোল পালটে ফেললেন। আমাদের ধারণা, যে-কথাগুলি তিনি দুর্যোধনের উদ্দেশে বলেছেন, তা গান্ধারীর মুখে প্রথম উচ্চারিত হয়েছে। এই কথার মধ্যে যে ঘৃণা আছে; ঘরের বউ দ্রৌপদীর সঙ্গে আলাপ-সম্ভাষণ করছিস এই শব্দগুলির মধ্যে। যে রমণীসুলভ মর্যাদাবোধ আছে, তাতে এই কথা কখনও ধৃতরাষ্ট্রের হতে পারে না। কেননা, ধৃতরাষ্ট্র এতক্ষণ ধরে তার ছেলে এবং ছেলের বন্ধুদের মুখে যে সব অপশব্দ শুনেছিলেন, সেগুলি আর আলাপ-সম্ভাষণের পর্যায়ে ছিল না, সেগুলি ধর্ষক-পুরুষের কামোন্মত্ত উল্লাস এবং বাক্য-রমণে পর্যবসিত হয়েছিল। তবু ধৃতরাষ্ট্র নিপে বসেছিলেন। আর এখন তিনি বলছেন কিনা– মেয়েদের সঙ্গে, বউ-ঝি’র সঙ্গে এইভাবে আলাপ-সম্ভাষণ করছিস! বস্তুত শব্দের মর্যাদা রক্ষা করে নিতান্ত স্ত্রীজনোচিতভাবে এ কথা গান্ধারীর মুখ দিয়েই প্রথমত বেরিয়েছে এবং গান্ধারীর ভয়েই ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর কথাগুলি পুনরুচ্চারণ করেছেন মাত্র। ধৃতরাষ্ট্র নিজের ইচ্ছায় দুর্যোধনকে কিচ্ছুটি বলেননি, প্রাকৃতিক দুর্লক্ষণ আমাদের মতে পুরাকল্পের ব্যবহার ছাড়া আর কিছু নয়, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র বস্তুত গান্ধারীর নারীসত্তার তদাত্মতায় ভীত হয়েছিলেন সেই মুহূর্তে, শুধু সেই মুহূর্তে।
শুধু সেই মুহূর্তে কেন বলছি, এক মুহূর্তে ভোল পালটে ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে কঠিন তিরস্কার করলেন এবং সেই ভোলেই দ্রৌপদীকে বর দিয়ে পাণ্ডবদের রাজ্যপাট, ধনসম্পত্তি সব ফিরিয়ে দিলেন। এই ঘটনাগুলো যে ধৃতরাষ্ট্র চাপের মাথায় করেছিলেন, অথবা বলা উচিত তার অন্তরঙ্গ স্ত্রীমহলের প্রতিক্রিয়াতেই করেছিলেন, তা বোঝা যায় ধৃতরাষ্ট্রের দুটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখে। প্রথম কাজটা হল– পাণ্ডবদের রাজ্যপাট ফিরিয়ে দেবার পরেই তিনি দুর্যোধন-শকুনি-কর্ণদের কথায় উদ্বেলিত হয়ে আবারও পাশা খেলার আহ্বান জানিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে। দ্বিতীয়ত, এই দূতক্রীড়ার পরেই আবারও দুঃশাসন-কর্ণ-দুর্যোধনের মুখ থেকে অবিরাম নষ্ট কুপ্রস্তাব আসে দ্রৌপদীর কাছে। কিন্তু কেউ প্রতিরোধ করেনি, ধৃতরাষ্ট্র সব শুনে চুপ করে থেকেছেন। তবু এর মধ্যে দ্রৌপদীর প্রতি অশালীন আঙ্গিক ইঙ্গিতগুলি বাদ গেছে বলেই হয়তো গান্ধারীর আবেদন প্রয়োজন হয়নি।
আমাদের তৃতীয় যুক্তিটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সেখানেই গান্ধারীর সত্তা প্রমাণিত হয়। পাণ্ডবরা তখন দ্রৌপদীকে নিয়ে বনবাসে চলে যাচ্ছেন, কুন্তীর চোখের জল বাধ মানছে না, রাজ্যের মানুষ এই অন্যায় বন-প্রয়াণ চোখের সামনে দেখছে– এই অবস্থায় কৌরব শিবিরে দুর্যোধনে-অনুগামীদের যতই উল্লাস শোনা যাক, কৌরব বাড়ির বউ-ঝিয়েরা কিন্তু ভারাক্রান্ত মনে মুখ লুকোচ্ছেন লজ্জায়। কৌরব বাড়ির বউরা সকলেই যে সব কিছু চোখের সামনে দেখেছেন, তা নয়। তারা সবকিছু এর-তার কাছে শুনেছেন। এই শোনাটুকু কেমন শোনায়– আন্দাজ আছে আপনাদের– তোমার স্বামী ভীম-অর্জুনের বউকে টানতে টানতে রাজসভায় নিয়ে এসেছিল। ও মা! ও মা! তোমার স্বামী তার কাপড় খুলে দিয়েছিল। তোমার স্বামী আবার তাকে কাপড় তুলে নিজের ঊরু দেখাচ্ছিল।
মহাভারতের কবি লিখেছেন– ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূরা আত্মীয়-স্বজনের মুখে শুনলেন কেমন করে তাদের স্বামীরা দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে রাজসভায় নিয়ে গিয়েছিল– ধার্তরাষ্ট্র স্ক্রিয়শ্চৈব স্বজনা উপলভ্য তৎ– কীভাবে তারা দ্রৌপদীর বস্ত্রাকর্ষণ করেছিল এবং কত ইতর ভাষায় তার সঙ্গে কথা বলেছিল– গমনং পরিকঞ্চ কৃষ্ণায়া দূতমণ্ডলে। স্বামীদের এই কীর্তিকলাপ একমাত্র ম-মনের মানুষ ছাড়া আর যে কোনও ভদ্রজনের রুচিসম্মত হতে পারে না, এটা কুরুকুলের বউ-ঝি’রা উপলব্ধি করেছিলেন। বিশেষত কোনও বিবাহিতা স্ত্রী যদি নিরন্তর লোকের কাছে শুনতে থাকেন যে, তার স্বামী স্থির বুদ্ধিতে ঠান্ডা মাথায় একজন মহিলার জামাকাপড় খুলে উলঙ্গ করে দিতে চাইছে, তবে তার এই ধর্ষণ-ভাবনা একজন স্ত্রীর মনে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে? আমরা এটা জানি– চিরন্তনী পৌরুষেয়তা নারী-মানসের এইসব প্রতিক্রিয় বৃত্তিগুলিকে কোনওদিনই তো তেমনভাবে আমল দেয় না, যেমন আজও এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
এই ভাবনার উত্তরে বলতেই হবে যে, একটি মেয়ের এই ধর্ষণ-প্রতিম অপমান ধর্ষকের স্ত্রীকে অবশ্যই আলোড়িত করে এবং তা এখনও করে। মহাভারতের কালে পৌরুষেয়তার যে সুনাম এবং বীরোচিত মাহাত্ম্য বিখ্যাত ছিল, সেই নিরিখে দুর্যোধন-দুঃশাসনদের এই ধর্ষণকামী ব্যবহারগুলি কুরু-স্ত্রীদের মনে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। বিশেষত জননী হিসেবে এবং একজন স্ত্রীলোক হিসেবে গান্ধারীর মতো অনুভবপ্রবণ স্ত্রীতমা মহিলা কী করে পুত্রবধূদের সামনে তার লজ্জা প্রকাশ করবেন। মহাভারতে দেখতে পাচ্ছি– দ্রৌপদীর প্রতি তাদের স্বামীদের এই নির্লজ্জ ব্যবহারের কথা শুনে কুরুকুলের বউরা– যাঁদের মধ্যে গান্ধারীও অবশ্যই আছেন তারা সব কুরু-পুরুষদের গালাগাল দিতে দিতে বহুক্ষণ ধরে ডাক ছেড়ে কেঁদেছিলেন–রুরুদুঃ সস্বনং সর্বা বিনিন্দন্ত্যঃ কুরুস্ত্রিয়ঃ। ডাক ছেড়ে কাদা মানে তো সেই ওগো এ আমার কী হল গো, লোকের কাছে আমি এখন কী করে মুখ দেখাব গো–এই তো সেই চিরন্তনী ভাষা যা ভদ্রলোকে-ছোটলোকে একই রকম।
এমন সলজ্জ সশব্দ রোদনের পরেও উদ্যত পৌরুষেয়তার বিরুদ্ধে যখন কিছু করার ছিল না, কুরুকুলের স্ত্রীরা তখন স্তিমিত-প্রদীপ অর্ধরাত্রি পর্যন্ত গালে হাত দিয়ে মুখ লুকিয়ে ভেবে গেছেন নিশ্চয় যে, এইসব অপদার্থ স্বামীদের বীরপনা তাদের আজ কোনও কলঙ্কযাত্রায় শায়িত করেছে–দধশ্চ সুচিরং কালং করাসক্ত মুখাম্বুজাঃ। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এই দুশ্চিন্তিত লজ্জাকুল কুরুকুল-বধূদের মধ্যে গান্ধারীও অন্যতমা নারী, যিনি সমস্ত বউ ঝিদের নিয়ে দ্রৌপদীর ধর্ষণের বিরুদ্ধে তৎকালেই সোচ্চার হয়েছিলেন। এর প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। পাণ্ডবরা বনে চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্র-মহারাজকে আমরা সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন দেখছি, বারবার পুত্রদের অসহ্য অন্যায় আচরণ এখন তার অন্ধচক্ষুর সামনে ভেসে আসছে, ভেসে আসছে পুত্রবধূদের আর্ত রোদন-দিগ্ধ কণ্ঠস্বর ধ্যায়ন উদ্বিগ্নহৃদয়ঃ পুত্ৰাণাম অনয়ং তথা- তিনি আর শাস্তি পাচ্ছেন না।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ধৃতরাষ্ট্রকে উথালি-পাথালি ভাবতে দেখে সাক্ষী এবং দ্রষ্টার মতো সঞ্জয় বলেই ফেললেন– সমস্ত ঘটনার জন্য আপনিই তো দায়ী মহারাজ! ধৃতরাষ্ট্র লুকোলেন না, নিজের দায় অস্বীকার করলেন না, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, সেটা হল মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র এখন দুই পক্ষের দুটি অবলা স্ত্রীলোককে দেখে ভয় পাচ্ছেন। সঞ্জয়কে তিনি বলছেন– দুর্যোধন-দুঃশাসন দ্রৌপদীর উদ্দেশে নির্লজ্জ কথাগুলি বলতে থাকলে দ্রৌপদীর চোখ দুটি যেমন ক্রোধরক্ত হয়ে উঠেছিল বলে শুনেছি, সে চোখ বুঝি এই পৃথিবীটাকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, দ্রৌপদীকে সভায় টেনে আনার ফলে সমবেত কুরুকুলবধূদের সঙ্গে স্বয়ং গান্ধারী যে ভয়ংকর আক্রোশ প্রকাশ করেছিলেন ভরতানাং স্ত্রিয়ঃ সর্বা গান্ধাৰ্য্যা সহ সঙ্গতাঃ–সেই ঘটনাতেও আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন বোধ করছি। গান্ধারীর নেতৃত্বে কুরু-ভরতকুলের স্ত্রীদের অমন ভৈরব চিৎকার আমি কোনওদিন শুনিনি– প্রাক্রোশন ভৈরবং তত্র দৃষ্টা কৃষ্ণাং সভাগতাম।
ধৃতরাষ্ট্র এবার বুঝতে পারছেন, তাঁর প্রিয়তমা পত্নী যিনি পাতিব্রত্যের ভাবনায় তারই জন্য কৃত্রিমভাবে অন্ধ হয়ে আছেন, তার ঈর্ষা-অসূয়া যার মধ্যে কৃত্রিমভাবে তারই জন্য সঞ্চারিত হয়েছিল এতকাল ধরে, সেই গান্ধারী এবার তার পাশ থেকে সরে যাচ্ছেন। নইলে দ্রৌপদীকে রাজসভায় কটুক্তি বর্ষণের পর এক সময় ভীষ্ম-দ্রোণ, কৃপ-সোমদত্তরা সভা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু গান্ধারী তার সমভাবিনী কুরুবংশীয়া রমণীদের সঙ্গে একত্রে তার স্বামীর বিরুদ্ধে এবং পুত্রদের বিরুদ্ধে ভৈরব শব্দে চিৎকার করছেন– এই ঘটনার সমূহ প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল ধৃতরাষ্ট্রের ওপর, যদিও সেই প্রতিক্রিয়া তিনি নিজেই ধরে রাখতে পারেননি অন্ধস্নেহবশে। গান্ধারীর সোচ্চার প্রতিবাদে মুহূর্তের জন্য ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে তিরস্কার করে পাণ্ডবদের সব ফিরিয়ে দিলেন বটে, কিন্তু পুত্রের রাজ্যলালসায় নিজের রাজ্যলালসা মেটাতে গিয়ে আবারও তিনি আদেশ দিলেন– ফিরিয়ে আন পাণ্ডবদের। ইন্দ্রপ্রস্থের পথে অনেকটা যদি এগিয়ে গিয়ে থাকে, তবু আবার ফিরিয়ে আন তাদের তৃর্ণং প্রত্যানয়ম্বেতা কামং ব্যধ্বগতানপি।
পাশাখেলার জন্য ধৃতরাষ্ট্রের এই পুনরাদেশের সংবাদ সঙ্গে সঙ্গে গান্ধারীর কানে পৌঁছেছে। আমরা বলেছিলাম– উন্মুক্ত রাজসভায় রমণীমণি দ্রৌপদীর লজ্জাবস্ত্র হরণের ঘটনা এতটাই ধাক্কা দিয়েছিল গান্ধারীকে যে অসহায় দৃষ্টিহীন প্রিয় পতিকে আর তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। বোঝা যায়, ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যলোভ যদিও বা তিনি স্বামীর যুক্তি দিয়েই সহ অনুভূতি দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কুলবধূর প্রতি তার পুত্রদের নগ্ন ব্যবহার এবং সেখানে ধৃতরাষ্ট্রের নিশ্চল বসে থাকাটা গান্ধারীকে এক ধাক্কায় ধৃতরাষ্ট্রের পাশ থেকে সরিয়ে দিল। আরও বুঝতে পারি- গান্ধারীই বোধহয় মহাকাব্যের সেই প্রথমা রমণী যিনি একটি প্রায়ধর্ষিতা রমণীর সমদুঃখিতায় কঠিন প্রতিবাদ রচনা করেছেন নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে, নইলে এতদিন গান্ধারীকে আমরা একটি কথাও বলতে শুনিনি। পুত্রদের অসভ্যতা অন্যায়গুলি এতকাল তিনি দেখে গেছেন, কিন্তু তা যে এমন কুৎসিত পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা বোধহয় রাজসভায় দ্রৌপদীর অপমানের পূর্বে তিনি এমন করে বোঝেননি।
এবার তিনি ধৃতরাষ্ট্রের পাশ থেকে সরে গেছেন। আস্থিত হয়েছেন আপন স্বতন্ত্রতায়। অতএব যে মুহূর্তে তিনি শুনলেন– পাণ্ডবদের আবারও পাশাখেলার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে, সেই মুহূর্তেই তিনি উপস্থিত হয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। মহাভারতের কবি লিখেছেন– গান্ধারী দুটি কারণে স্বামীর কাছে গেছেন– প্রথমত পুত্রের প্রতি স্নেহবশত, দ্বিতীয়ত ভয়ে– পুত্রস্নেহা ধর্মপূর্বং গান্ধারী শোককর্ষিতা। এতদিনে গান্ধারী বুঝেছেন– ধৃতরাষ্ট্রের যে স্নেহ এতাবৎকাল হৃদয়-নিহিত তৃষ্ণা এবং রাজ্যলোভ বাড়িয়ে তুলেছে, এইটাকে স্নেহ বলে না। যে স্নেহ তাকে সত্যি মানুষ করে তুলতে পারে, আজ গান্ধারী সেই স্নেহে কথা বলছেন– সেই স্নেহ যার অনুবন্ধে ধর্ম আছে, নিয়মের নিয়ন্ত্রণ আছে– পুত্রস্নেহাদ ধর্মপূর্বৎ দ্বিতীয়ত সেই বাস্তব গান্ধারী এবার ভয় পাচ্ছেন। ক্ষত্রিয়গৃহের বধূ হিসেবে ক্ষত্রিয়ের প্রতিজ্ঞা তিনি চেনেন। রাজসভায় সকলের সামনে ভীম দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছেন, দুঃশাসনের রক্তপান করার প্রতিজ্ঞাটাও ভীমেরই, যিনি কখনও অপমান ভুলে যান না। তা ছাড়া দ্রৌপদীর যে অপমান ঘটেছে, তার প্রতিশোধ স্পৃহা সমস্ত পাণ্ডবদের সব সময় তাড়িত করবে চরম ফলাফলের জন্য। এরই মধ্যে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র আবারও পুত্রের কথায় চালিত হয়ে পাণ্ডবদের পুনরায় পাশাখেলায় আবাহনের চিন্তা করছেন। গান্ধারী তাই এগিয়ে এসেছেন সেই স্বামীর কাছে, যিনি পুত্রের মধ্যে নিজের লোভ সঞ্চারিত করেছেন এবং পুত্রের কারণেই যার বুদ্ধি স্থির থাকে না।
গান্ধারী কোনও ভণিতা না করেই বললেন–দুর্যোধন জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই মহামতি বিদুর এই পুত্রটিকে মেরে ফেলার কথা বলেছিলেন– জাতে দুর্যোধনে ক্ষত্তা মহামতিরভাষত। এই ছেলে জন্মের সময়েই শেয়ালের মতো বিকৃত স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল, সেই অমঙ্গল কিন্তু এই বংশের ধ্বংস ডেকে আনবে। এই প্রথম গান্ধারী বিদুরের কথা উচ্চারণ করছেন শ্রদ্ধা সহকারে। শৃগালের বিকৃত স্বরের মধ্যে যে দুর্লক্ষণ আছে সেটা দিয়েই যে পুত্রের ভবিষ্যৎ-ক্রিয়া নির্দেশ করা যায় না, সেটা তিনি জানেন। বস্তুত দুর্যোধন জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র যেভাবে রাজ্যলোভে উদভ্রান্ত হয়ে উঠেছিলেন, সেটাই যে বাস্তবিক অমঙ্গল সূচনা করে দিয়েছিল, তার দিকে খেয়াল রেখেই আজ গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন–তুমি নিজের দোষে এই দুঃখসমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ো না নিজেকে। মূর্খ এবং অশিষ্ট পুত্রেরা তোমাকে যা বলছে তুমি তাই করছ। ওদের কথা এইভাবে নির্বিচারে মেনে নিয়ো না তুমি মা বালানাম অশিষ্টানাম অনুসংস্থা মতিং প্রভো।
লক্ষ করে দেখুন, গান্ধারী কিন্তু ছেলেদের দোষ দিচ্ছেন না তেমন করে। ওই একবার মাত্র বিদুরের কথা বলে দুর্যোধনের জন্মমাত্রিক রাজনৈতিক সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন গান্ধারী। কেননা দুর্যোধনের জন্মলগ্নেই জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে অতিক্রম করে দুর্যোধনকেই রাজা করার ভাবনা ভাবতে আরম্ভ করেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। সেই পুত্রকে মানুষ করার সময়েও নিজের ঈর্ষা-অসূয়াগুলি পূর্ণমাত্রায় সংক্রমিত করে তার লোভ এবং কামনার ইন্ধন তিনিই জুগিয়ে যাচ্ছেন। এত বড় একটা গণ্ডগোলের পর পাণ্ডবরা বাড়ি পৌঁছনোর আগেই মাঝপথ থেকে তাদের তুলে এনে পাশা খেলতে বসানোর পরিকল্পনাটা যদি ধৃতরাষ্ট্র অনুমোদন না করতেন, তা হলে দুর্যোধনের লেশমাত্র ক্ষমতা ছিল না ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে ডেকে আনার। গান্ধারী সরাসরি ধৃতরাষ্ট্রকে দায়ী করে বলেছেন– এই বংশের ধ্বংসলীলায় তুমি কেন এমন কারণ হয়ে উঠছ– মা কুলস্য ক্ষয়ে ঘোরে কারণং ত্বং ভবিষ্যসি৷ কৌরবরা কৌরবদের জায়গায় আছে, পাণ্ডবরা পাণ্ডবদের জায়গায়, তাদের মধ্যে আত্মীয়তার সুস্থ সেতু রচিত হয়ে গেছে রাজ্য ভাগ করে দেবার পর থেকেই। সেই আত্মীয়তার সেতুটুকু তো তুমিই ভেঙে দিচ্ছ। বিশেষত রাজসভায় এই ঘৃণ্য কাণ্ড ঘটে গেল, কেবলই পাণ্ডবরা শান্ত হয়েছে, তুমি আবারও সেই নির্বাপিত অগ্নি জ্বালিয়ে তোলার চেষ্টা করছ– বদ্ধং সেতু কো নু ভিন্দা ধমেচ্ছান্তঞ্চ পাবকম।
গান্ধারী ভেবেছিলেন– দূতসভায় যে-অপমানই হয়ে থাকুক, ধৃতরাষ্ট্র দানে-মানে পাণ্ডবদের যেভাবে তুষ্ট করেছেন, তাতে আপাতত তাদের প্রজ্জ্বলিত ক্রোধ শান্ত হয়েছে হয়তো। কিন্তু এই যে আবার অর্ধপথ থেকে তাদের ডেকে আনা হচ্ছে পুনরায় পাশাখেলার জন্য, তাতে তো পাণ্ডবদের সমস্ত সংবৃত ক্রোধ পুনরায় আসবে এবং সেই ক্রোধ যে একটি বিখ্যাত বংশ ধ্বংস করে দেবে– সেটা গান্ধারী মনে-প্রাণে বুঝতে পারছেন এখন। গান্ধারী বললেন–পাণ্ডবরা যেভাবেই হোক শান্ত হয়েছে, তুমি একবার ভাবো তো কোনও সুস্থ মানুষ কি আবার তাদের ক্রোধ জাগিয়ে তুলবে। তুমিও হয়তো আমার মতোই এই কথাটা বেশ বুঝতে পারছ, কিন্তু তবু আমি তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আবার। নিয়ম, আচার, শাস্ত্র– এগুলো দুর্বুদ্ধি, দুষ্ট-জনকে কোনও শিক্ষা দিতে পারে না, তাকে মঙ্গলের দিকেও চালিত করতে পারে না অথবা অমঙ্গল থেকেও তাকে নিবৃত্ত করতে পারে না– শাস্ত্রং ন শাস্তি দুর্বুদ্ধিং শ্রেয়সে চেতরায় চ। আর কোনও বুড়ো মানুষ নিশ্চয়ই বাচ্চা ছেলের যেমন বুদ্ধি, তেমন বুদ্ধি নিয়ে কাজ করে না, যা তুমি করতে চাইছ ন বৈ বৃদ্ধো বালমতিৰ্ভবে রাজন্ কথঞ্চন।
এই শেষ কথাটায় গান্ধারী ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন যে বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের বুদ্ধিতেই চলছেন, তার নিজের বুদ্ধিতে নয়। গান্ধারী বোঝেন– তার অন্ধ স্বামীর হৃদয়ে অদ্ভুত এক দ্বৈরথ কাজ করে। কখনও তিনি বেশ ভাল, ছোট ভাই পাণ্ডুর ছেলেদের তিনি আপন পিতৃত্বের বাৎসল্যে অভিষিক্ত করেন, কিন্তু পরক্ষণেই পুত্রের স্বার্থ সেই পিতৃত্বের মহিমা কলুষিত করে দেয়। গান্ধারী বললেন– তোমার ছেলেদের চলার পথে তুমি তাদের প্রকৃত চক্ষু হয়ে ওঠো, এই আমি চাই। আমি চাই তুমি তাদের পথ দেখাও, তা নইলে একদিন বিপক্ষের আঘাতে তারা ধ্বংস করে ফেলবে নিজেদেরই ত্বঘ্নেত্রাঃ সন্তু তে পুত্রা মাং ত্বাং দীনাঃ প্রহাসিষুঃ। ছেলের ওপর অন্ধ বাৎসল্যে তুমি দুর্যোধনকে ত্যাগ করোনি, কিন্তু আজকে যে সময় এসেছে, তুমি ত্যাগ করো এই ছেলেকে। আমার কথা রাখো–ত্যাগ করো এই বংশনাশা দুর্যোধনকে– তস্মাদয়ং মদ্বচনাত্ ত্যাজ্যতাং কুলপাংসনঃ। বরঞ্চ আগেই যদি বিদুরের কথায় এই একটি ছেলেকে তুমি ত্যাগ করতে, তা হলে আজকে এই সামগ্রিক ধ্বংসের মুখে এসে পড়তে হত না। তুমি তাকে ছাড়নি, তার ফল আজ পাচ্ছি– তস্য প্রাপ্তং ফলং বিদ্ধি কুলান্তকরণায় হ।
গান্ধারী তাঁর স্বামীকে আগেও দেখেছেন, আগেও বোঝবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এতখানি মান-মর্যাদাহীন তিনি ছিলেন না বোধহয়। এই মানুষটাই তো পিতৃহীন পাণ্ডবদের আশ্রয় দিয়েছিল, এই মানুষটাই তো রাজ্যভাগ করে দিয়ে পাণ্ডবদের নিজস্ব সত্তা প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই গান্ধারীর মনের মধ্যে সেই কুচক্রী রাজার ছায়া পড়ে– এই মানুষটাই জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনায় শামিল ছিলেন; এই মানুষটাই রাজসভায় বসে বসে যৌবনবতী পুত্রবধূর বস্ত্রহরণের রোমাঞ্চ অনুভব করলেন মানস-চক্ষে অথবা পুত্রদের নয়ন-মাধ্যমে। গান্ধারী কেমন মেলাতে পারেন না সবকিছু। প্রিয় স্বামীর এই মানসিক বিক্রিয়া তাকে পীড়িত করছে। তিনি বুঝেছেন– দুর্মদ অশালীন জ্যেষ্ঠ পুত্রকে ধৃতরাষ্ট্র কিছুতেই ছেড়ে থাকতে পারবেন না। শেষবাক্যে তাই বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলেন স্বামীকে– আগে কিন্তু তোমার বুদ্ধি নির্মল ছিল, সেই বুদ্ধির মধ্যে শান্তি, ধর্ম এবং ন্যায়ের অভিসন্ধি ছিল। আজকে যখন তুমি তোমার আপন ভ্রাতুস্পুত্রদের আবারও পাশাখেলার জন্য ডেকে পাঠাচ্ছ, তখন সেই ন্যায়-ধর্মের বুদ্ধি ফিরে আসুক তোমার মধ্যে– শমেন ধর্মেন নয়েন যুক্তা। সা তে বুদ্ধিঃ সাহস্তু তে মা প্রমাদীঃ তুমি এমন করে উদাসীন বসে থেকো না। এটা ভাল করে জেনে রেখো– রাজলক্ষ্মী যদি ক্রুর নৃশংস অন্যায়ী মানুষের হাতে ন্যস্ত হয়, তবে সেই রাজলক্ষ্মী ধ্বংস ডেকে আনবে, আর সে যদি কোমল ভদ্রলোকের হাতে থাকে, তবে সেই বাড়িতেই রাজলক্ষ্মী তার নিজের বয়স বাড়িয়ে প্রৌঢ়া হয়ে ওঠে, নাতি-নাতনি পর্যন্ত তার স্নেহচ্ছায়া প্রসারিত হয়– প্ৰধ্বংসিনী তূর সমাহিতা শ্ৰীঃ মৃদুপ্রৌঢ়া গচ্ছতি পুত্র-পৌত্রান।
গান্ধারীর এই সুচিন্তিত ভাবনার কোনও মূল্য দিলেন না ধৃতরাষ্ট্র। আসলে প্রথম পাশাখেলার পর দুর্যোধনের হাতে আসা সমস্ত ঐশ্বর্য তিনি এমন উদারতায় নিঃশেষে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন যে, তার জন্য অন্ধ রাজার মনেও বুঝি কিছু অনুশোচনা ছিল মনে মনে। গান্ধারী এবং কুরুকুলের স্ত্রী-সমাজের আক্রোশে সাময়িকভাবে তার সততা জেগে উঠেছিল বটে, কিন্তু সেটা যে তার খুব স্বাভাবিক উদারতা ছিল না, সেটা বোঝা যায় যখন দুর্যোধনের তাড়নাতে ধৃতরাষ্ট্র দ্বিতীয় বার পাশাখেলার জন্য মাঝপথ থেকেই তুলে আনতে বললেন পাণ্ডবদের। দুর্যোধনের কথায় এত তাড়াতাড়িই তিনি সিদ্ধান্তে স্থির হয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি যেহেতু জানতেনই যে, শ্যালক শকুনি তার অভীষ্ট জয় এনে দেবেন, অতএব এই সময়ে গান্ধারীর দূরদর্শিতার উত্তরে তিনি সমান মানসিক প্রস্তুতিতে একথা বলতে পারেননি যে, তবে তাই হোক। তুমি যখন বলছ, তবে তাই হোক। বরঞ্চ, মনে মনে যিনি একেবারেই হিতৈষিণী স্ত্রীর কথা মানতে পারছেন না, অথচ হিতৈষিণী বলেই তার মুখের ওপরেও সরাসরি নিজের অন্যায় ইচ্ছেটুকুর কথা স্পষ্ট করে বলতে পারেন না, এমন স্বামীরা নিজের বদলে ছেলের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে বলেন– কী আর করবে বলো, কপাল সবই কপাল। ও শেষ হয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে এই বংশ। আমি আর কত করব, অনেক বুঝিয়েছি। পারিনি। ও শুনবে না।
ধৃতরাষ্ট্র, একমাত্র ধৃতরাষ্ট্রই পারতেন এই অন্যায় পাশাখেলা ঠেকাতে। কিন্তু পুত্রের উদগ্র লালসার সঙ্গে যেহেতু তার অন্তরশায়ী সুচিরসুপ্ত রাজ্যলোভ একাকার হয়ে গিয়েছিল, তাই তিনি হিতৈষিণী স্ত্রীর কথা শুনেও শুনলেন না। সব শোনার পর সেই নিজের সুপ্ত অভিলাষ অসম্ভব চতুরতায় ঢেকে দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি কথা শেষ করলেন ধৃতরাষ্ট্র। গান্ধারীর যুক্তিগুলি শুনেও না শোনার ভান করে ধৃতরাষ্ট্র বললেন- দেখো, হাজার চেষ্টা করা সত্ত্বেও এই বংশের ধ্বংস আমি ঠেকাতে পারব না। অতএব তুমি আর কিছু বোলো না, ওদের যা ইচ্ছে তাই করুক, পাণ্ডবরা আবার ফিরে আসুক যথেচ্ছন্তি তথৈবাস্তু প্রত্যাগচ্ছন্তু পাণ্ডবাঃ। ওরা যেমন চাইছে, সেই রকমই আর একবার না হয় আমার ছেলেরা পাণ্ডবদের সঙ্গে পাশা খেলুক পুনর্ভূতং প্রকুন্তু মামকাঃ পাণ্ডবৈঃ সহ।
ধৃতরাষ্ট্র যেভাবে কথা বললেন, তাতে বেশ বোঝা যায় যে ছেলেদের ওপর যতই তিনি দোষ চাপিয়ে দিন, তিনি নিজেও ওই একই ভাবনায় শামিল। তিনি নিজেই চান পাশাখেলা হোক।
ধৃতরাষ্ট্রের কৃত্রিমতা আমরাই বুঝে যাচ্ছি, আর তার স্ত্রী হয়ে গান্ধারী কিছুই বোঝেননি, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। পাণ্ডবরা পাশাখেলায় হেরেছেন এবং বনে চলে যাবার সময় দুর্যোধন এবং তার ভাইয়েরা দ্রৌপদীর উদ্দেশে যত অকথা-কুকথা বলেছেন, তার প্রতিক্রিয়া কুরুকুলের বউদের ওপরে মোটেই ভাল হয়নি। প্রিয় স্বামীদের পরস্ত্রীলোলুপতার ভাষা শুনে একদিকে যেমন তাঁরা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে বসেছিলেন হাতের তালুতে দধশ্চ সুচিরং কালং করাসক্ত-মুখাম্বুজাঃ–তেমনই অন্যদিকে স্বামীদের ব্যবহারে তারা ক্ষুব্ধ-মানসে কান্নাকাটিও করেছেন অনেক, এমনকী স্বামীদের চরিত্র এবং ব্যবহার নিয়ে নিজেদের মধ্যে যথেষ্ট নিন্দেমন্দ উচ্চারণ করেছেন।–রুরুদুঃ সম্বনং সর্বা বিনিন্দ্যঃ কুরূন ভশম। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস– স্পষ্ট করে না বললেও এই কুরুকুলের স্ত্রীলোকের সঙ্গে গান্ধারীও আছেন। বিশেষত, বনে যাবার সময় দুর্যোধন দুঃশাসনেরা যেভাবে পাণ্ডবদের অসহ্য অপমান করেছেন এবং উত্তরে ভীমার্জুন প্রত্যেকেই যেভাবে কৌরব-বংশ ধ্বংসের প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন, তাতে গান্ধারীর মন সব দিক থেকেই বিপর্যস্ত হবার কথা। গান্ধারী বিপর্যস্তবোধ করেন নিশ্চয়।
.
০৪.
তবুও বড় আশ্চর্য লাগে। পাণ্ডবরা বনে চলে গেলেন, প্রিয় পুত্রদের প্রস্থানের সময় জননী। কুন্তী উথাল-পাথাল করে কাঁদছেন, বিলাপ করছেন, নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছেন, তবু এই শোকার্ত সময়ে আমরা কিন্তু গান্ধারীকে একবারও তার পাশে এসে দাঁড়াতে দেখছি না। আশ্চর্য লাগে কুন্তীর আর্তনাদে সমব্যথিত পুরুষ বিদুর তার সৌভ্রাত্রের হস্ত প্রসারণ করে নানা যৌক্তিকতায় কুন্তীকে আশ্বস্ত করে তাঁকে নিজগৃহে প্রবেশ করিয়েছেন, কিন্তু কর্তব্য তো গান্ধারীরই ছিল। তিনি যদি পুত্রদের ব্যবহারে অসন্তুষ্টই হয়ে উঠেছিলেন, তা হলে বড় জা হিসেবে গান্ধারীর পক্ষেই তো সবচেয়ে স্বাভাবিক ছিল বিপন্না কুন্তীকে সান্ত্বনা-বাক্যে প্রশমিত করা অথবা তাকে নিজের ভবনে আশ্রয় দেওয়া, যা বিদুর দিয়েছিলেন। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে- গান্ধারী পাণ্ডব-ভাই অথবা পাণ্ডববধূর ব্যাপারে যতই করুণাঘন হোন না কেন, কুন্তীকে তিনি সহ্য করতে পারছেন না এখনও পর্যন্ত। এ কি পৌর্বকালিক কারণ, কুন্তী যেহেতু গান্ধারীরও আগে জননী হয়েছেন, যে-কারণে তিনি গর্ভে আঘাত করেছিলেন বিষণ্ণতায় অথবা কুন্তীর পুত্র জ্যেষ্ঠ বলেই আজও জ্ঞাতিশত্রুতার মূল কারণ তিনিই। গান্ধারী কি সেই জন্যই তাকে সহ্য করতে পারেন না? এখনও কি পারেন না? নইলে দুর্বুদ্ধি পুত্রকে জন্মলগ্নেই কেন বিসর্জন দেননি বলে দুঃখ পাচ্ছেন, তিনি তো বনবাসী পাণ্ডবদের জননীকে আপন স্নেহচ্ছায়ায় আবৃত করলেন না এখনও।
আসলে গান্ধারীর অন্তরের মধ্যে অদ্ভুত এক দ্বৈরথ কাজ করে। আর এটাও তো সত্যি যে, পুত্রবাৎসল্য এমনই এক বিষম বস্তু যেখানে মায়ের অতি কঠোর তিরস্কার বাক্য, এমনকী পুত্রের মৃত্যু-কামনাও সেই তিরস্কারের অন্তর্গত বটে, কিন্তু সেই তিরস্কারও বোধহয় খানিকটা মৌখিকতায় চালিত হয়। আমরা নিজেদের জীবনেও তাই দেখি বারবার। পুত্র-কন্যা যখন সঠিক সৎ পথে চলে না, তখন চিরন্তনী মায়ের মুখে বহুবার এই খেদবাক্য শুনেছি- তুই মর, তুই মরলে আমার শান্তি। কিন্তু পুত্র-কন্যা মায়ের অভিশাপে মরে না, বরঞ্চ সে-অভিশাপে তাদের নাকি আয়ু বাড়ে– এমনই জনশ্রুতি। বিষম পরিস্থিতিতে মায়েরা আবারও আশায় বুক বাঁধেন, যদি সন্তানের সুমতি হয়। গান্ধারীর দ্বৈরথটা কোথায়, তিনি পুত্রকে তিরস্কার করছেন, তার জন্য হিতবাক্য উচ্চারণ করছেন, কিন্তু বিপরীতপক্ষে তাকে পাণ্ডবদের প্রতি তেমন কোনও সমব্যথায় আচ্ছন্ন হতে দেখছি না। একবারও তার মুখে সেই উদ্বেগ-বচন শুনছি না যে, এই অবস্থায় পাণ্ডবরা কী করবেন অথবা পুত্রহারা জননী কুন্তীর মনের অবস্থাই বা কতটা করুণ হতে পারে। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণকালে সমস্ত কুরুভার্যাদের নিয়ে যে গান্ধারী সমস্ত সভাস্থল আলোড়িত করে দিয়েছিলেন, তিনি দ্বিতীয়বার দূতক্রীড়ার সময় ধৃতরাষ্ট্রের উদ্দেশে সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন বটে সানুক্রোশে কিন্তু দূতক্রীড়া বন্ধ করার জন্য তিনি কিন্তু কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করলেন না, এমনকী পুত্রদেরও কিছুটি বললেন না সরাসরি। পাণ্ডবরা বনে চলে গেলেন, পুত্রহারা কুন্তী সাকণ্ঠে বিদুরের অতিথি-গৃহে প্রবেশ করলেন অসহায়ের মতো অথচ গান্ধারীকে একবারের তরেও আমরা কুন্তীর কাছে এসে সান্ত্বনা-বাক্য উচ্চারণ করতে দেখলাম না।
এই ঘটনাতে গান্ধারী-চরিত্রের দ্বৈরথ অথবা তার দ্বৈধীভাব খানিকটা অনুমান করা যায়। অর্থাৎ দুষ্ট পুত্রের ওপর তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন বটে, এমনকী ধৃতরাষ্ট্রের সতোর ব্যাপারেও তার মনে এখন এক গভীর সংশয় তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তাই বলে পাণ্ডবজননী কুন্তীর প্রতি তার কোনও করুণাঘন মমত্ব দেখছি না এবং পাণ্ডবদের সহায়তার জন্য দুর্যোধনের বিরুদ্ধেও তিনি কোনও প্রকট প্রতিরোধ-শব্দ উচ্চারণ করছেন না। ধৃতরাষ্ট্র নিজের অভিলাষ পূরণ করবার জন্যই একবার বললেন– এই মহাকুলের ধ্বংস আমি এড়াতে পারব না, বরঞ্চ আবার পাণ্ডবরা আমার ছেলেদের সঙ্গে পাশা খেলুক– এই কথার উত্তরে গান্ধারী একটি কথাও বললেন না। সবই কি তিনি দৈবের ওপর ছেড়ে দিলেন, নাকি দুর্যোধন-দুঃশাসনেরা তাকে যতই ক্ষুব্ধ করে থাকুক, একটা জায়গায় তাদের চরম আঘাত হানতে কিন্তু এখনও তার বাধছে, হয়তো তার অন্তরশায়ী স্নেহপ্রবৃত্তিই এই বাধা দিচ্ছে যে স্নেহ ধৃতরাষ্ট্রের মতো অন্ধ নয় বটে, কিন্তু তা কুপুত্ৰা জননীর বাৎসল্যের ঊর্ধ্বে নয়। এটা অবশ্যই ঠিক, ধৃতরাষ্ট্র প্রথমবার দ্যূতক্রীড়ার পর বিপুল উল্লসিত হয়েও গান্ধারীর আক্রোশে পুত্র-কৃত দ্রৌপদীর অপমান স্মরণে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন, তেমনই দ্বিতীয়বার পাশাখেলার ভাবনাটাও যে গান্ধারীর পছন্দসই হতে পারে না, সেটা আমরা বুঝি এমনকী ধৃতরাষ্ট্রও সেটা খুব ভাল করে বোঝেন। আমরা বনপর্বে দেখেওছি যে, মহামতি ব্যাস যখন তেরো বছর পর পাণ্ডবদের ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ প্রত্যাগমনের সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, তখন ভীষ্ম-দ্রোণ বিদুরের সঙ্গে তিনি গান্ধারীর কথাও বলছেন। বলছেন যে, পাশা খেলে পাণ্ডবদের বনবাসে পাঠানোর ব্যাপারটা কেউই পছন্দ করেননি, এমনকী গান্ধারীও আমাকে বারণ করেছেন, কিন্তু পুত্রস্নেহের মোহে আমি ব্যাপারটা এড়াতে পারিনি– গান্ধারী নেচ্ছতি দূতং তচ্চ মোহাৎ প্রবর্তিতম্।
বুঝতে পারি– সুবুদ্ধি-প্রণোদিত হলে ধৃতরাষ্ট্রও কার্যত উপলব্ধি করেন যে, তিনি যা করেছেন বা করছেন তাতে গান্ধারীর সায় নেই, কিন্তু গান্ধারীর দিক থেকে যখন ব্যাপারটা ভাবি, তখন বার বার মনে হয়– ধৃতরাষ্ট্র যেমন পুত্রবাৎসল্যে অন্ধ আচরণ করছেন, তেমনই গান্ধারী যতখানি পুত্রের ওপরে স্নেহশীল, তার চেয়েও বোধহয় তার অনেক বেশি স্নেহ-বাৎসল্য আছে স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের ওপর। নইলে পুত্রের ব্যাপারে তিনি কঠিন শব্দ হাজার উচ্চারণ করেছেন বটে, কিন্তু স্বামীর অন্যায় অপকর্মগুলি তিনি তেমন কোনও অপশব্দে প্রতিহত করেন না অথবা চরম বাধা দিয়েও ব্যাহতও করেন না। হয়তো ধৃতরাষ্ট্রের ওপরে এই স্নেহচ্ছায়া, বাৎসল্য, যা শৃঙ্গার-রসের অন্যতম গৌণ অঙ্গ তো বটেই– হয়তো এই স্নেহচ্ছায়া গান্ধারীর মনে তৈরি হয়েছিল বিবাহোত্তর মুহূর্তেই। যেদিন থেকে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের মুখে তার অন্ধত্বের কষ্টগুলি শুনেছেন, অন্ধত্বের জন্য তাঁর রাজা হবার তীক্ষ্ণ বাসনা কীভাবে প্রতিপদে আহত হয়েছে, এটা যে মুহূর্তে তিনি বুঝেছেন, সেই মুহূর্ত থেকেই স্বামী নামক এই বয়স্ক বালকটির ওপর তার অন্যতর এক মায়া কাজ করে। তিনি কিছুতেই ধৃতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন প্রতিরোধ তৈরি করতে পারেন না, যাতে অন্ধ তার এই স্বামীটির উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ভোগাকাঙ্ক্ষা তিনি ঘৃণা করতে পারেন না ক্ষুব্ধ অভিমানে।
গান্ধারীর দিক থেকে ধৃতরাষ্ট্রের ওপর এই স্নেহ-প্রশ্রয় এতটা বিপুল ছিল বলেই হয়তো এখনও পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্রের অন্তর্গত হৃদয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে পাণ্ডব-জননী কুন্তী এবং পাণ্ডবদের সঙ্গে তিনি নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারেন না। তা ছাড়া দুর্যোধনও যে শেষ পর্যন্ত এমন দুর্বিনীত প্রশ্রয়ে বিষবৃক্ষে পরিণত হলেন, সেটাও ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি গান্ধারীর দুর্বলতায়। গান্ধারী তার অন্ধ স্বামীর লোভ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা তেমন করে কোনও দিনই প্রতিহত করেননি, হয়তো সেই কারণেই এখনও পর্যন্ত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে পাণ্ডবদের প্রতিও কোনও মহান স্নেহ প্রদর্শন করেননি তিনি। আর একই কারণে পুত্রবর্জিত অসহায় কুন্তীকেও তিনি কোনও সুখ-সুবিধা-সান্ত্বনা এতটুকুও দেবার চেষ্টা করেননি। অথচ এটাই হয়তো তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। তা নইলে সারা বনবাস-পর্বের সময় তেরো বছরের মধ্যে একবারও কিন্তু আমরা গান্ধারীকে রাজার অন্তঃপুর ছেড়ে কুন্তীর সঙ্গে কথা বলতে শুনিনি, আসতে দেখিনি বিদুরের ঘরে একবারের তরেও। আর তেরো বৎসরের মধ্যে হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে কম ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু সব মিলিয়ে গান্ধারীর নাম উচ্চারিত হয়েছে একবার, দুইবার কি তিনবার। তাও একবার নিতান্ত অপ্রয়োজনে, সেটা যখন দুর্যোধন ধর্মে মতি রেখে যজ্ঞ করছিলেন, তখন একবার। আর একবার নিতান্তই প্রয়োজনে– যখন দ্রৌপদীকে হরণ করবার কারণে ভীম জয়দ্রথকে ধরতে যাচ্ছেন অর্জুনের সঙ্গে, তখন ভীমের আক্রোশ মাথায় রেখে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন– জয়দ্রথকে যেন তুমি প্রাণে মেরো না ভীম, জননী গান্ধারীর কথা তুমি মনে রেখো। মনে রেখো ভগিনী দুঃশলার কথা– দুঃশলামভিসংঘৃত্য গান্ধারীঞ্চ যশস্বিনীম্।
যা চলেছে হস্তিনাপুরে, তাতে এই তেরো বছরে দুর্যোধন এতটুকুও সংশোধিত হননি। বরঞ্চ এই সময়ের মধ্যেও গোধন গণনা করার নামে বনবাসী পাণ্ডবদের তিনি উত্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন, দুর্বাসা মুনিকে বনে পাঠিয়ে পাণ্ডবদের হেনস্থা করবার চেষ্টা করেছেন, আর জামাই জয়দ্রথ তো আপনাতে আপনি বিকশিত। আমাদের জিজ্ঞাসা, তা হলে গান্ধারী এতদিন কী করলেন? যে-সব অমূল্য উপদেশ, দুর্যোধনের প্রতি তার তিরস্কার-নিগ্রহ, এমনকী স্বামী ধৃতরাষ্ট্রেরও বিরুদ্ধ-কোটিতে অবস্থান, যা আমরা যুদ্ধের উদ্যোগ পর্ব থেকে আমৃত্যু তার মধ্যে দেখতে পাব, সেগুলি কিন্তু এই তেরো বছরে কিছুই প্রকট হয়ে উঠল না। এতে কিছু প্রশ্ন জাগে মনে।
তবে প্রশ্ন তোলার আগে মনে রাখতে হবে– দ্বৈপায়ন ব্যাস মহাভারতের কবি, তার দৃষ্টিতে গান্ধারী-চরিত্রের ‘ফোকাল পয়েন্ট হল তার ধৈর্য; ব্যাস সারা মহাভারত জুড়ে গান্ধারীর ধীরতা প্রদর্শন করতে চেয়েছেন, কিন্তু কেন এই ধীরতা তা স্পষ্ট করে বলেননি কোথাও। আমরা তো সেই পরিসরে প্রশ্ন তুলতেই পারি যে সভাপর্বের শেষে একবার মাত্র গান্ধারীকে আমরা ফুঁসে উঠতে দেখেছি, কিন্তু তারপর তেরো বছর ধরে গান্ধারী কিচ্ছুটি বললেন না দুর্যোধনকে। কেন এই ধীরতা– প্রশ্ন জাগে মনে।
বার বার বলেছি, আবারও একই কথা বলছি বটে, তবে এবার এক নতুন মাত্রা চড়িয়ে বলব। সেই বিবাহের কাল থেকে এই বনপর্ব পর্যন্ত আমরা গান্ধারীকে যতটুকু দেখলাম, তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস– কোনও পৌরুষেয়তার চাপে নয়, কিংবা পুত্রের প্রতি স্নেহবশে নয়, গান্ধারী যে এ পর্যন্ত ছেলেকে কিছু বলেননি অথবা একদিনের জন্যও সরাসরি তিরস্কার করেননি, তার সবটাই তার স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি ভালবাসায়। ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধতার জন্য গান্ধারীর হৃদয়ে যত মায়া তৈরি হয়েছিল, সেই অন্ধতার কারণে সর্বদিকে সক্ষম সেই মানুষটি রাজ্যলাভ না করায় স্বামীর প্রতি তার সমব্যথা তৈরি হয়েছিল আরও অনেক বেশি। হয়তো এই কারণেই ধৃতরাষ্ট্র যা যা পছন্দ করেননি অথবা যেখানে-যেখানে তাঁর বিরূপতা, ঔদাসীন্য এবং শীতলতা ছিল, ঠিক সেখানে-সেখানেই গান্ধারীও এতদিন উদাসীন, শীতল এবং স্পষ্টতই বিরূপ ব্যবহার করেছেন। গান্ধারীর বিরূপতা, ঔদাসীন্য অথবা শীতলতা স্পষ্ট করে বোঝা যায় না, কেননা তা সোচ্চারভাবে বানান করে পড়া যায় না। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি তার অসীম ভালবাসা এবং প্রেম যদি অন্তঃকরণ দিয়ে উপলব্ধি করেন, তা হলে এতাবৎ পর্যন্ত গান্ধারীর সমস্ত ব্যবহার অর্থবহ হয়ে উঠবে।
আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি- উপযুক্ত ক্ষমতা সহকারে রাজ্যশাসন চালাতে চালাতে আকস্মিকভাবে পাণ্ডু যে সস্ত্রীক বনে চলে গেলেন, এর পিছনে ধৃতরাষ্ট্রের অন্তরশায়ী রাজ্যলালসাই সবচেয়ে বড় হেতু ছিল। পাণ্ডু চলে যাবার পর ধৃতরাষ্ট্রই অস্থায়ী রাজা হিসেবে কাজ করেছেন এবং একবারের জন্যও পাণ্ডুকে তিনি ফিরে আসতে বলেননি হস্তিনাপুরে। প্রথম দিকে বিদুরের মারফত তিনি যোগাযোগ রাখতেন, শেষে তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এইসব সময় গান্ধারীকে আমরা কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। অতঃপর বিধবা কুন্তী নিজের পুত্র এবং মাদ্রীর পুত্রদের নিয়ে বাড়ি ফেরার পর ধৃতরাষ্ট্র যে শীতল ব্যবহার করলেন তাদের সঙ্গে, গান্ধারী একটি কথাও বললেন না সেখানে। ধর্ম নিয়ে গান্ধারীর মুখে প্রচুর কথা শুনব ভবিষ্যতে, কিন্তু ধর্মের সমস্ত কল্প অনুপস্থিত রইল কুন্তীর প্রতি তার ব্যবহারে। বারণাবতে পাঠিয়ে ধৃতরাষ্ট্র কুন্তীসহ সমস্ত পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন একথা প্রথমে প্রচারিত হয়নি বটে, কিন্তু দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবদের বিবাহের পর সব খবর এমনকী দুর্যোধনের পরিকল্পনাও যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময়েও কিন্তু গান্ধারীর মুখে একটি ধর্ম-শব্দও উচ্চারিত হয়নি। পাশাখেলার সময়েও ধর্মমতি যুধিষ্ঠির গান্ধারীর সঙ্গে দেখা করে গেছেন, এখানে কেমন পাশাখেলা হবে, তার কোনও আগাম খবর গান্ধারী পাননি, অথচ স্বামীকে গান্ধারী চিনতেন, চিনতেন দুর্যোধন এবং শকুনিকেও। সমস্ত ঘটনা থেকে আমার এই বোধই প্রকট হয়ে ওঠে যে, গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রকে এতই ভালবাসেন যে, স্বামী চাননি বলেই পাণ্ডুজায়া কুন্তীর সঙ্গে তিনি কোনও সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি এবং স্বামী চাননি বলেই বনবাসে যাত্রাকালে যুধিষ্ঠির-ভীম ইত্যাদি পাণ্ডব তথা চরম-অপমানিতা পাণ্ডব-বধূ দ্রৌপদীর প্রতিও কোনও সমবেদনা জানাননি গান্ধারী। যাত্রাকালে তিনি সেখানে ছিলেনই না! অথচ কুন্তী বহির্গহের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে দিগন্তে নিলীয়মান পুত্রদের দিকে তাকিয়ে হা-হুঁতাশ করে কাঁদছেন, চরম কষ্ট পাচ্ছেন লাঞ্ছিত পুত্রবধূর জন্য। কিন্তু গান্ধারী সেখানে ছিলেন না। নিশ্চয়ই ধৃতরাষ্ট্র চাননি, অন্তত তার মনোভাব তাই ছিল এবং সেইজন্যই গান্ধারী সেখানে বেমানান-ভাবে অনুপস্থিত। নিজের মায়ায়, নিজের ভালবাসাতেই গান্ধারী এতদিন ধৃতরাষ্ট্রকে অতিক্রম করতে পারেননি, এখনও পারছেন না। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, তাই তিনি দেখতে পান না, কিন্তু যিনি ধৃতরাষ্ট্রের জন্যই পাঁচ-পুরু কাপড় বেঁধে নিয়েছেন চোখের ওপর, সেই কাপড়ের রন্ধ্রপথে এধার-ওধার দিয়ে ধর্মের সূর্যকিরণ প্রবেশ করলেও গান্ধারী এখনও সত্যদৃষ্টিকে রুদ্ধ করে রেখেছেন স্বামীর জন্যই।
ব্যাপারটা যে গান্ধারীর দিক থেকে বেমানান, তার সামগ্রিক ধর্মবোধ এবং সত্যদৃষ্টির নিরিখে এই ব্যবহার যে তাকে মানায় না, সেটা কবির কবি রবীন্দ্রনাথ ঠিক বুঝেছেন। যে কারণে পাণ্ডবদের বনযাত্রার কালে কবি তাঁকে অনুপস্থিত রাখতে পারেননি। কবির মানসলোকে যুধিষ্ঠির স্বভাবসম্মতভাবে গান্ধারীর কাছে এসে বলেছেন–
আশীর্বাদ মাগিবারে এসেছি জননী,
বিদায়ের কালে।
গান্ধারী কত যে আশীর্বাদ করেছেন যুধিষ্ঠিরকে, সেইসব মহাকাব্যিক উদার আশীর্বাদ, যেখানে শত্রুগৃহের রাজমাতা পুত্রের অন্যায় স্বীকার করে নিয়ে শত্রুর ঐশ্বর্য এবং জয় কামনা করেন সেই ভাষায়–
মোর পুত্র করিয়াছে যত অপরাধ
খণ্ডন করুক সব মোর আশীর্বাদ,
পুত্ৰাধিক পুত্রগণ। অন্যায় পীড়ন
গভীর কল্যাণসিন্ধু করুক মন্থন।
বস্তুত ভবিষ্যতে গান্ধারীর যে মহনীয় রূপ দেখতে পাব, যে রূপ মহাভারতের কবির একান্ত দৃষ্টিতে তাঁকে পরম ধৈর্যশীলা এবং ধর্মদৃষ্টি নারী হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে শেষ পর্যন্ত, অথবা রবীন্দ্রনাথ যার মুখে পাণ্ডব-ভাইদের উদ্দেশে ‘পুত্ৰাধিক পুত্রগণ’– এমন একটা উদার সম্বোধন নিঃসারিত করেছেন, গান্ধারীর এই রূপ, এই উদার চারিত্রিক আভাস আমরা কিন্তু এখনও এই বনবাস-পর্ব পর্যন্ত পাইনি মহাভারতে। যে দ্রৌপদীর জন্য তিনি প্রথম প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছিলেন এবং বংশধ্বংসের ভয়ে তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে দ্বিতীয় পাশাখেলা বন্ধ করার জন্য একান্তে অনুরোধ করেছিলেন, গান্ধারীর সেই রূপ কিন্তু প্রতিফলিত হয়নি তার নিজস্ব ব্যবহারের মধ্যে। পাণ্ডবদের বনবাস-যাত্রাকালে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের মুখের ওপর তিনি দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন করে মহাকবির জবানিতে বলতে পারেননি–
ভূলুণ্ঠিতা স্বর্ণলতা, হে বৎসে আমার,
হে আমার রাহুগ্রস্ত শশী, একবার
তোলো শির, বাক্য মোর কর অবধান।
যে তোমারে অবমানে তারি অপমান
জগতে রহিবে নিত্য- কলঙ্ক অক্ষয়।
তব অপমানরাশি বিশ্বজগন্ময়
ভাগ করে লইয়াছে সব কুলাঙ্গনা
কাপুরুষের হস্তে সতীর লাঞ্ছনা।
ঠিক এমনটি হলেই যে গান্ধারীকে মানাত সেটা আমরা বুঝি, কিন্তু মহাভারত তো কাব্য নয়, এখানে মানুষের জটিল মানস-লোক রাজনীতি, ধর্মনীতি এবং জৈবিক সম্পর্কের বিচিত্র বিন্যাসে আরও জটিলতর হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় দূতক্রীড়ার পূর্বে গান্ধারী যেভাবে তার স্বামীর উদ্দেশে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, তা যতখানি ধর্মবোধে তাড়িত হয়ে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রখর বাস্তববোধের তাড়নায়। তিনি বুঝেছিলেন– রাজসভার মধ্যে যেভাবে পাণ্ডব-কুলবধূ দ্রৌপদীর সঙ্গে অশালীন আচরণ করেছে তার পুত্রেরা, যেভাবে কপটতার জালে আবদ্ধ করে ভীম এবং অর্জুনের মতো ব্যক্তিত্বকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল, তার ফল হবেই। পরিশেষে তাদের সব ফিরিয়ে দেবার মতো একটা বিরাট ঠাট্টা করে পুনরায় দূতক্রীড়ার মাধ্যমে রাজ্য থেকে তাদের বনে নির্বাসিত করার যে কী বিষময় ফল হতে পারে, তা গান্ধারী অনুধাবন করেছিলেন। কিন্তু তার স্বামী সেটা বোঝেননি এবং তিনি বোঝাতেও পারেননি।
.
০৫.
দেখতে দেখতে বারো বছর কেটে গেছে, গান্ধারী একটা কথাও কাউকে বলেননি। অজ্ঞাতবাসের কালে তার ছেলেরা বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেছে পাণ্ডবদের, কোনও হদিশ মেলেনি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, তেরো বছর ধরে ধৃতরাষ্ট্র যেমন নির্বিকার থাকলেন, গান্ধারীও কিন্তু ততটাই নির্বিকার। একটা কথাও তিনি বলেননি। তেরো বৎসরের শেষে বিরাট-রাজার ঘরেই পাণ্ডবদের সভা বসল ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য। ধৃতরাষ্ট্র নিজে থেকে কিছুই বলছেন না, তিনি খুব ভালই জানেন যে, পাণ্ডবরা বিরাট রাজ্যেই অজ্ঞাতবাসের কাল কাটিয়েছেন বিরাট রাজার গোধন হরণ করতে গিয়েই সমগ্র কৌরবপক্ষ তা বুঝে এসেছে। আর ধৃতরাষ্ট্র এখন যতই নিশ্ৰুপে থাকুন, যাঁকে তিনি বয়সের এবং সম্পর্কের গৌরবে পাশা খেলতে বাধ্য করেছিলেন, সেই যুধিষ্ঠির যতই ভোলেভালা নির্বিবাদী মানুষ হোন না কেন, তিনি কিন্তু বনে যাবার সময়েও ঠান্ডা মাথায় ধৃতরাষ্ট্র-সমেত সমস্ত কুরুবৃদ্ধদের বলে গিয়েছিলেন– সকলের কাছে বিদায় চাইছি, ফিরে এসে আবার দেখা হবে– সর্বান আমন্ত্র গচ্ছামি দ্রষ্টাস্মি পুনরেত্য বঃ। অথচ ধৃতরাষ্ট্র এখন একটি কথাও বলছেন না। চুপ করে বসে আছেন, যেন কোনও কিছুই হয়নি।
উপপ্লব্য-নগরীতে সভা শেষ করার পর সকলের মতামত নিয়ে যুধিষ্ঠিরই শেষ পর্যন্ত দূত পাঠালেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। দূত হিসেবে এলেন দ্রুপদ রাজার পুরোহিত, তার কথাবার্তা কিছু কর্কশ, মনেও খুব রস-কষ নেই। হয়তো জেনে-বুঝেই এমন লোককে পাঠিয়ে ছিলেন পাণ্ডবরা। ব্রাহ্মণ-দূত ধৃতরাষ্ট্র-ভীষ্ম ইত্যাদি সভাসদদের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কড়া করেই পাণ্ডবদের বক্তব্য নিবেদন করলেন। এতে অবশ্য দুর্যোধন-কর্ণদের এতটুকুও হেলদোল হল না, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র অনেক বেশি বুদ্ধিমান লোক, তিনি সকলের সামনেই কর্ণকে বেশ একটু বকাবকি করে বললেন– আমি সঞ্জয়কে দূত করে পাঠাচ্ছি পাণ্ডবদের কাছে। ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের মুখ দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে অনেক শান্তির কথা শোনালেন বটে, কিন্তু একবারের তরেও তিনি রাজ্য ফিরিয়ে দেবার কথা বললেন না। ধৃতরাষ্ট্রের এই দ্বিচারিতা যুধিষ্ঠিরের মতো সরল লোকও ধরে ফেলেছেন। ফলে প্রচুর শান্তিকামনা করার পরেও তাঁর শেষ বাক্য ছিল– আমাদের ইন্দ্রপ্রস্থ আমাদের ফিরিয়ে দিন, নয়তো যুদ্ধ হোক।
পাণ্ডবদের তপ্ত মনের সংবাদ বহন করে সঞ্জয় ফিরে এসেছেন হস্তিনাপুরে। কয়েক দিন ধরে যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণ এবং অন্যান্য পাণ্ডব ভাইদের সঙ্গে সঞ্জয়ের চাপান-উতোর চলেছে; দূত হিসেবে ধৃতরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা যথাসম্ভব গোপনে রেখে বাগজাল বিস্তার করতে হচ্ছিল বলেই তিনি একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। তারপর সারাদিন রথে আসার পরিশ্রম; অতএব সন্ধ্যাবেলায় সঞ্জয় এসে পৌঁছলে ধৃতরাষ্ট্র যতই পাণ্ডব-শিবিরের খবর শোনার জন্য উৎসুক হয়ে থাকুন, সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে খানিকটা তিরস্কার না করে যেতে পারলেন না। আর সম্পূর্ণ সংবাদ তিনি একা ধৃতরাষ্ট্রের সামনে বলতেও চাইলেন না। বললেন– যা বলার কাল সকলের সামনে সভায় বলব– প্রাতঃ শ্রোতারঃ কুরবঃ সভায়াম। অজাতশত্রাবচনং সমেতাঃ।
সঞ্জয়ের এই কথায় ধৃতরাষ্ট্রের ছটফটানি আরও বেড়ে গেল। তিনি নিজে তো ভালভাবেই জানেন- এতদিন তিনি কী করেছেন এবং এখনও তিনি রাজ্য ফিরিয়ে দেবার কথা একবারও বলছেন না। অতএব সেই রাত্রে পাণ্ডবদের ভয়ে তার হৃদয় উত্তাল হয়ে উঠল। তিনি বিদুরকে ডাকিয়ে নানান নীতিকথা শুনলেন, অশান্ত হৃদয় শান্ত করার জন্য শুনলেন সনৎ-সুজাতের সংবাদ। সারা রাত ধৃতরাষ্ট্র ঘুমোতে পারলেন না। পরের দিন কুরুসভায়। সমবেত কুরুপ্রধানদের সামনে সঞ্জয় যথোচিত কুশলতায় পাণ্ডবদের প্রাথমিক সৌজন্য এবং রাজ্য ফিরিয়ে না দিলে তাদের আস্ফালন-হুংকার শব্দ ক্রমে ক্রমে প্রকাশ করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের মনে ভয় তীব্র থেকে তীব্রতর হল। ভীষ্মের মতো মানুষ বারবার রাজ্য ফিরিয়ে দেবার অনুরোধ জানালেন ধৃতরাষ্ট্রকে। কিন্তু তিনি এতটাই ধুরন্ধর চতুরতার মানুষ যে, সামনাসামনি ভীম-অর্জুনের ভয়ে ত্রস্ত হয়ে উঠলেও দুর্যোধন-কর্ণদের কথায় আবারও মনে মনে পাণ্ডবদের হারিয়ে দেবার কথাও ভাবছেন।
সভায় কথা-চালাচালি কম হল না, আমরাও সে-বিস্তারে প্রবেশ করব না, কিন্তু এই প্রশ্ন তো উঠবেই যে, গান্ধারীর জীবন-চর্যা করতে গিয়ে আমরা ধৃতরাষ্ট্রের কথা বলছি কেন? উত্তর একটাই– গান্ধারীর সমস্ত জীবনের ওপর তার এই অন্ধ স্বামীর ছায়া এত দীর্ঘাকার যে, এখনও পর্যন্ত তাকে সেই ছায়ায় অপাবৃত দেখছি। কিন্তু এই তেরোটা বছর চলে গেল। এবং ধৃতরাষ্ট্র একবারও রাজ্য ফিরিয়ে দেবার কথা বলছেন না, অথচ এই অন্ধ-বৃদ্ধ নিরন্তর এস্ত হয়ে আছেন ভীম-অর্জুনের ভয়ে– গান্ধারী কিন্তু এবার বুঝতে পারছেন যে, তার স্বামী ভুল পথে চলছেন এবং যে পুত্রের জন্য তাঁর এত প্রয়াস, সেই পুত্রের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠবে এবার। দ্বিতীয়বার দ্যূতক্রীড়ার পূর্বে গান্ধারী যেভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে, স্বামী তা মেনে না নিলেও সেই প্রতিবাদের ভাষা একেবারে মৌখিকমাত্র ছিল না। বিশেষত ধৃতরাষ্ট্র যেভাবে কপালের দোষ দিয়ে পুত্র-প্রেরিত স্বাত্মাভিলাষ পূরণ করে নিলেন, গান্ধারী সেটা বেশ বুঝে ফেলেছিলেন। অতএব এই তেরো বছর ধরে তিনি সেই অনিবার্য ধ্বংস দেখার অপেক্ষাতেই বসে আছেন। আর সঞ্জয়ের কথা শুনে একবার পাণ্ডবদের ওপর সহানুভূতি প্রকাশ করেই দুর্যোধন-কর্ণের কথায় আবার যেভাবে ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন দেখছেন, স্বামীর এই বিভ্রান্তি গান্ধারীর কাছে এখন লোভ এবং তৃষ্ণার জাগ্রত ফল বলেই মনে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, দুর্যোধনকে যতই তিনি সোচ্চারে তাড়িয়ে দেবার কথা বলুন, সেটা তিনি ধৃতরাষ্ট্রকেই বলছেন, যিনি কিছুতেই পুত্রের সংস্রব ত্যাগ করবেন না এবং সেই সংস্রব গান্ধারীই বা কোন অপত্য স্নেহের সংজ্ঞায় ত্যাগ করবেন। তিনি কিন্তু নিজে দুর্যোধনকে একটা কথাও বলেননি এখনও। অথচ এখন তার সুস্থিত হৃদয়ে এই বোধ জাগ্রত হচ্ছে যে, দুর্যোধনের বিপদ ঘনিয়ে আসছে ধীরে ধীরে, ধৃতরাষ্ট্র যেভাবে দুর্যোধনের দ্বারা চালিত হচ্ছেন এবং ভ্রষ্টবুদ্ধিতে তিনিও যেভাবে চালনা করছেন দুর্যোধনকে, তাতে আর কোনও আশা আছে বলে মনে হচ্ছে না তাঁর।
এ বড় অদ্ভুত জটিলতা– অন্ধ স্বামীর চতুরতা, দ্বিচারিতা জেনেও তার স্বাঝারোপিত বঞ্চনার বোধ থেকে কীভাবে মুক্ত করতে পারেন গান্ধারী, কতটা মায়া, কতটা করুণা স্ত্রীর দিক থেকে আশা করবেন ধৃতরাষ্ট্র, যিনি এখনও রাজ্যলোভে সম্মোহিত হয়ে পুত্রকে মৃত্যুর পথে নিয়ে যাচ্ছেন। গান্ধারীর মনে এখন অদ্ভুত এক ঔদাসীন্য সৃষ্টি হচ্ছে, অনিবার্য ধ্বংসকে আর কোনওভাবে রোধ করতে পারবেন না বুঝেই তিনি নিজের সত্যে এখন সুস্থিত হতে চাইছেন, ধৃতরাষ্ট্রের নিজস্ব সত্যবোধ আস্তে আস্তে মূল্যহীন হয়ে উঠছে তাঁর কাছে। সত্যি বলতে কি, তার অন্তরের এই পরিবর্তন বাইরের মানুষেরাও বুঝতে পারে এখন। ওই যে সঞ্জয়কে নিয়ে সভা বসল, সমবেত কুরুপ্রধানেরা পাণ্ডবদের পক্ষে সওয়াল করলেন কত, ধৃতরাষ্ট্র ভীত হলেন, ত্রস্ত হলেন, তবু দুর্যোধন-কর্ণের কথায় পুনরায় মনে মনে উত্তপ্ত হয়ে যুধিষ্ঠিরের সৈন্যবল গণনা করছেন নিজের ক্ষমতা বুঝে নেবার জন্য। সভা তখন শেষ হয়ে গেছে, সমস্ত সভাসদ কুরুপ্রধানেরা ভীম, অর্জুনের ধ্বংস-শপথ শুনেছেন। কুমার দুর্যোধন সঞ্জয়ের এসব খবর পছন্দ করেননি। তবু সভায় বসে সব শুনতে হয়েছে সকলকেই। আস্তে আস্তে সকলেই চলে গেছেন নিজের নিজের বুদ্ধি-কল্পনায় শান দেবার জন্য।
সঞ্জয় যেহেতু সব দেখে এসেছেন, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের পক্ষে যাঁরা আছেন, তাদের সকলের ক্ষমতা যাচাই করার সুযোগটা তিনিই যেহেতু সবচেয়ে ভাল করে পেয়েছেন, অতএব সকলেই সভা ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাবার পর ধৃতরাষ্ট্র নির্জনে সঞ্জয়কে একা পেয়ে জিজ্ঞাসা করতে আরম্ভ করলেন– রহিতে সঞ্জয়ং রাজা পরিপ্রষ্ঠুং প্রচক্রমে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন– তুমি তো সব দেখে এসেছ সঞ্জয়! আর আমরাও সৈন্যসামন্ত যা জোগাড় করেছি। তা তুমি ভালমতই জানো। এবার তুমি আমাকে সার সত্য কথাটা বলো তো– গাবগণে ব্রুহি নঃ সারফর্মু- তুমি পাণ্ডবদের সব ব্যাপারটা দেখে এলে, এখন বলো তো ওদের শক্তিই বেশি নাকি আমাদের শক্তি বেশি– কিমেষাং জ্যায়ঃ কিছু তেষাং গরীয়ঃ।
বহু সাহচর্যের ফলে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে খুব ভাল করে চেনেন। তিনি জানেন যে, এই চতুর অন্ধ বৃদ্ধ সকলের সামনে এক রকম বলেন, আর নির্জনে আর একরকম ভাবেন। এমনকী নির্জনে যা বলেন, পরে তা পরিবর্তনও করেন। অতএব নির্জনে সঞ্জয়ের পেট থেকে কথা বার করে নেবার এই যে পদ্ধতি, সেটা সঞ্জয় মোটে পছন্দ করলেন না। এবং এক মুহূর্তেই একক ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি তাঁর অবিশ্বাসটাও প্রকাশ করে ফেললেন। সঞ্জয় বললেন– আপনাকে একা-একা আমি কিছুই বলব না, মহারাজ! ঈর্ষা-অসূয়া-পরশ্রীকাতরতা পদে পদে আপনাকে ব্যতিব্যস্ত করে– ন ত্বাং ক্ৰয়াং রহিতে জাতু কিঞ্চি। অসূয়া হি ত্বাং প্রবিশেত রাজন। এর পরেই সেই বিশাল প্রত্যয়ের কথাটা বললেন সঞ্জয়। তিনি বললেন– আমি আপনার একার সামনে কিছুতেই কিছু বলব না। আপনি আপনার পিতা মহামতি ব্যাসদেবকে ডাকুন, ডাকুন আপনার স্ত্রী দীর্ঘদর্শিনী গান্ধারীকে, তাদের সামনে আমি খুলে বলব সব কথা– আনয়স্ব পিতরং মহাব্রতং/ গান্ধারীঞ্চ মহিষীমাজমীঢ়।
এটা মনে রাখা দরকার যে, সঞ্জয় শুধু দূতমাত্র নন, তিনি ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য। সবদিকে সঞ্জয়ের দৃষ্টি প্রসারিত বলেই যেমন তাকে দূত করে পাঠানো হয়েছিল, তেমনই রাজা ধৃতরাষ্ট্রের অন্যায়কে তিনি অন্যায় বলতে ভয় পান না। নিজস্ব অভিজ্ঞতায় সঞ্জয় দেখেছেন যে, ধৃতরাষ্ট্র কারও ভাল কথা শোনেন না, নিজেও বড় অস্থিরমতি, তদুপরি পুত্রস্নেহে অন্ধ। কিন্তু শত অন্ধতা সত্ত্বেও গান্ধারী যখন কৌরব কুলবধূদের সঙ্গে দ্রৌপদীর অপমানের সময় তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ করেছিলেন, তখন সে-কথা তিনি ফেলে দিতে পারেননি। দ্বিতীয় দূতক্রীড়ার পূর্বে ধৃতরাষ্ট্র অবশ্য গান্ধারীর অনুরোধ-প্রতিবেদন শোনেননি, কিন্তু সেদিনের পর থেকে গান্ধারীর শান্ত হৃদয়ের প্রতিবাদ তিনি উপলব্ধি করছেন। এই সঞ্জয়কেই তিনি বলেছিলেন যে, গান্ধারী কিছুতেই দ্রৌপদীর অপমানের কথা ভুলতে পারছেন না, তিনি ভীষণ প্রতিবাদ করেছিলেন। হয়তো এই তেরো বছর যে এ-বিষয়ে গান্ধারী একটাও কথা বলেননি ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে, তার কারণও হয়তো এই মৌন প্রতিবাদ। স্বামীকে আর তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি বুঝতে পারছেন যে তার দুর্মতি পুত্র দুর্যোধন বেড়ে উঠেছে তার স্বামীর কারণেই। সর্বদর্শী সঞ্জয়ও গান্ধারীর এই উপলব্ধির কথা বুঝতে পেরে গেছেন এবং এটাও তিনি বুঝেছেন যে, ধৃতরাষ্ট্র তার মহিষীর এই সত্যদৃষ্টিকেও ভয় পাচ্ছেন। অন্তত তাঁর সামনে যে ধৃতরাষ্ট্রের চতুরালি চলবে না, সে-কথা সঞ্জয় বুঝে গেছেন বলেই ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি বললেন– আপনার পিতা এবং স্ত্রীকে আগে ডেকে আনুন এখানে, তারপর সব খুলে বলব। কেন এই দুইজনকে ডাকছেন সঞ্জয়? লক্ষণীয় মহামতি বেদব্যাস এবং গান্ধারী– এই দু’জনের নাম এখানে এক নিশ্বাসে উচ্চারিত। তার মানে, এঁরা দুজনেই এক ধরনের কাজ করতে পারেন এবং একই রকম সত্যবোধ তাদের আছে। সঞ্জয় বলেছেন– ব্যাস এবং গান্ধারীই আপনার অন্তর্জাত অসূয়া এবং পরশ্রীকাতরতা প্রশমন করতে পারেন, কেননা তাঁরা ধর্ম জানেন এবং এই পরিস্থিতিতে সঠিক কী করা উচিত, তাও তারা জানেন তৌ তেহসূয়াং বিনয়েতাং নরেন্দ্র। ধর্মজ্ঞৌ তৌ নিপুণৌ নিশ্চয়জ্ঞে। আমি তাদের সাক্ষাতেই শুধু অর্জুন আর কৃষ্ণের বক্তব্য আপনাকে জানাতে পারি।
নাচার এবং ভীত-কৌতূহলী ধৃতরাষ্ট্রের কথায় বিদুর ডেকে আনলেন পিতা ব্যাস এবং গান্ধারীকে। সঞ্জয় কথা আরম্ভ করলেন তাদের সামনে। সঞ্জয় আর কোনও বিস্তারে গেলেন না, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন কারও আস্ফালন তিনি আর পুনরুক্তি করলেন না, শুধু কৃষ্ণের কথা বললেন। তার কথার মধ্যে অলৌকিকতার গন্ধ মাখানো ছিল। আসলে কৃষ্ণকে সর্বাধিক চূড়ান্ত স্থানে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই হয়তো এই অলৌকিকতার আশ্রয় নিতে হয়েছে সঞ্জয়কে এবং স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রও কৃষ্ণের এই অলৌকিক মাহাত্ম মেনে নিচ্ছেন। হয়তো কৃষ্ণের যে অসাধারণ বুদ্ধি এবং তার সঙ্গে যে চরম ন্যায়বোধ এই ব্যাপারটাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রকাশ করার জন্যই সঞ্জয়ের মুখে অলৌকিকতার অবতারণা এবং তাতে ধৃতরাষ্ট্রও সাময়িকভাবে চিন্তান্বিত হয়ে দুর্যোধনকে বললেন– ওরে বাছা! ওই কৃষ্ণের শরণ নে, সঞ্জয় আমাদের একালের বিশ্বাসী লোক, ও যা বলছে শোন, কৃষ্ণকে মেনে নে বাছা– আপ্তো নঃ সঞ্জয়স্তাত শরণম।
দুর্যোধন তার স্বাভাবিক অহংকারে পিতার কথা উড়িয়ে দিতেই ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর দিকে তাকিয়ে বললেন– তোমার ছেলে একেবারে নীচে নেমে গেছে, গান্ধারী! একেবারে নীচে নেমে গেছে- অর্বাগ্ গান্ধারী পুত্ৰস্তে গচ্ছত্যেষ সুদুর্মতিঃ। ঈর্ষায়, অহংকারে এতই সে ফুলে উঠেছে যে, বড়দের কথা শোনারই প্রয়োজন বোধ করে না। আমরা জানি এ সেই চিরকালীন পিতাদের চিরন্তন দোষারোপ। ছেলে খারাপ ব্যবহার করলে বা কথা না শুনলেই পিতা কিংবা মাতা পরস্পরে অপর জনকে বলেন– তোমার ছেলে। তোমার ছেলে এই এই অসভ্যতা করছে। গান্ধারী তার স্বামীর কথার কী উত্তর দেবেন। এতকাল ধৃতরাষ্ট্র ছেলেকে প্রশ্রয় দিয়ে ছেলের সমস্ত বায়না পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। আর আজ তিনি বলছেন– গান্ধারী! তোমার ছেলে এত নীচে নেমেছে। গান্ধারী কী উত্তর দেবেন এ-কথার। তবু স্বামীর প্রতি এখনও সেই মায়া আছে তার, এখনও পর্যন্ত তিনি স্বামীর ওপর ক্রোধটুকু ছেলের ওপরেই প্রকাশ করেন। আজকে গান্ধারীকে সভায় ডেকে আনা হয়েছে মহর্ষি ব্যাসের সঙ্গে। এতদিন যদিও তিনি সোজাসুজি দুর্যোধনের দোষগুলি প্রকটভাবে উচ্চারণ করেননি এবং প্রকটভাবে তিনি কোনওদিন দুর্যোধনকে তিরস্কারও করেননি, কিন্তু আজ শ্বশুর-মহর্ষির সামনে স্বামীর সম্মান রেখেই গান্ধারী দুর্যোধনকে বললেন– এত তোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা, এত তোর লোভ, তুই সমস্ত শাসনের বাইরে চলে গেছিস, বড়দের কথা শোনার এতটুকু প্রয়োজন বোধ করছিস না- ঐশ্বর্যকাম দুষ্টাত্মন বৃদ্ধানাং শাসনাতিগ। আজ তুই এতটাই বেড়ে উঠেছিস যে এরপর তোর আকাঙিক্ষত ঐশ্বর্যও পাবি না, জীবনটাও যাবে। তখন জীবন-ধন খুইয়ে, বাবা-মা সব ছেড়ে এমন একটা জায়গায় এসে তুই দাঁড়াবি, যে তাতে শত্রুদেরই ফুর্তি বাড়বে। আমার কথা, তোর বাবার কথা, এখন তোর কিছুই পছন্দ হবে না, এরপর যখন ভীমের হাতে তোর মরণ ঘনিয়ে আসবে, সেদিন এই বুড়ো বাপের কথা তোর মনে পড়বে– নিহতো ভীমসেনেন স্মর্তাসি বচনং পিতুঃ।
লক্ষণীয়, জননী গান্ধারীও এখন উদ্যত-উদ্ধত ভীমসেনের ভয় পাচ্ছেন এবং আমরা মনে করি– তাঁর এই ভয়ও সঞ্চারিত হয়েছে তার স্বামীর হৃদয় থেকে। সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করে আসার পর ধৃতরাষ্ট্রই তাঁর কাছে নিজের দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বলেছিলেন– রেগে যাওয়া বাঘ দেখলে হরিণ যেমন ভয় পায়, আমিও তেমনি ক্রুদ্ধ-ক্ষুব্ধ ভীমসেনকে ভয় পাই– ভীমসেনাদ্ধি মে ভুয়ো ভয়ং সংজায়তে মহৎ। এই যে ধৃতরাষ্ট্রের মনোজাত ভয়, এই ভয়ই সংক্রমিত হয়েছে গান্ধারীর হৃদয়ে, তিনিও এখন দুর্যোধনকে ভীমের ভয় দেখাচ্ছেন ধৃতরাষ্ট্রের অনুবাদে। তবু বলতে হবে– গান্ধারীর মনের মধ্যে বিরাট একটা পরিবর্তন আসছে। সেই সভাপর্বে দ্রৌপদীর অপমানের পরে এবং দ্বিতীয় দূতক্রীড়ার পরে তিনি যে প্রতিবাদ করেছিলেন, সেদিন থেকেই তিনি বুঝি এটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন যে, তিনি আর মনে মনে তার স্বামী-পুত্রের পাশে নেই। হয়তো সেই কারণেই ধৃতরাষ্ট্র যখন শুভবুদ্ধিতে প্রণোদিত হচ্ছেন, তখন তিনি গান্ধারীকে ডেকে পাঠাচ্ছেন রাজসভায় যেন তিনি পারবেন দুষ্ট পুত্রকে প্রশমিত করতে।
সত্যি কথা বলতে কি, বিপন্ন অবস্থায় গান্ধারীকে এইভাবে ডেকে পাঠানোর ব্যাপারটাও ধৃতরাষ্ট্র-চরিত্রের নিরিখে অভিসন্ধিমূলক মনে হয়। অতি অদ্ভুত তার দ্বিচারিতা– তিনি রাজ্য ফিরিয়ে দেবেন না, পুত্রের লোভে কণ্ডুয়ন করবেন, অথচ শান্তি চাইছেন মুখে। এই অবস্থায় শেষ চেষ্টা করার জন্য শান্তির প্রস্তাব নিয়ে কুরুসভায় উপস্থিত হয়েছেন কৃষ্ণ। তাকে নিয়ে কুরুসভায় দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ধৃতরাষ্ট্র তাকে প্রচুর খাইয়ে-দাইয়ে, উপহার দিয়ে, স্বপক্ষে নিয়ে আসার কথা ভাবছেন, দুর্যোধন তাকে বন্দি করবেন বলে ভাবছেন, ভীষ্ম পিতামহ এঁদের ভাবনা-চিন্তা দেখে গালাগালি দিচ্ছেন, বিদুর সকলের চাতুরী ধরে ফেলে সমালোচনা করছেন এবং এত রকম উত্তেজনার মধ্যে কৃষ্ণ এসেছেন হস্তিনাপুরে। কিন্তু এত ঘটনার মধ্যেও যেটা উজ্জ্বলভাবে চোখে পড়ে, সেটা হল– পাণ্ডবজননী কুন্তী তো বিদুরের গৃহেই রয়েছেন, তার সঙ্গে এক বিদুর ছাড়া কারুরই কিন্তু যোগাযোগ নেই এখন পর্যন্ত। ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধনের কথা বাদই দিলাম, কিন্তু যে গান্ধারী এখন সম্পূর্ণ ন্যায়-অন্যায় বুঝতে পারছেন, তিনিও কিন্তু একবারও এই পুত্রবিরহিতা জননীর সঙ্গে কথা বলছেন না। এতকালেও কিন্তু এই অপরিবর্তিত ব্যবহার আমাদের বিভ্রান্ত করে। কৃষ্ণ যখন কুরুসভায় সকলের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকার করে কুন্তীর কাছে এসেছিলেন, তখন কুন্তী তাকে অনেক কথার মধ্যে তাঁর অসহায় জীবনধারণের দুঃখটুকুও প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন যে নারী পরের ঘরে থেকে জীবনধারণ করে, তাকে ধিক্কার দিই আমি। জীবিকার জন্য যেখানে পরের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়, অনুনয় করতে হয় তেমন জীবিকা না থাকাই ভাল– বৃত্তেঃ কার্পণ্যলব্ধায়াঃ অপ্রতিষ্ঠৈব জ্যায়সী। আমরা জানি বিদুরের সম্মান-ব্যবহারে কুন্তী এতটুকুও অসুখী ছিলেন না, কিন্তু এতকাল তিনি এইখানে পড়ে থাকলেন, অথচ নিজের জা গান্ধারীর কাছে যে মহাকাব্যিক উদারতা কুন্তীর প্রাপ্য ছিল, তা এতটুকুও পাননি বলেই এখনও কুন্তী আশ্রয়দাতা বিদুরের ঘরে অসহায় বোধ করেন। একটা সময়ে গান্ধারী ন্যায় এবং ধর্মের পক্ষে দাঁড়িয়ে পুত্রের প্রতিপক্ষতা করবেন, অথচ আজও তিনি তেমন স্বতন্ত্রা নন, তাঁর সেই উদার মহিমা এখনও তেমন স্বপ্রকাশ নয়। গান্ধারী এখনও ধৃতরাষ্ট্রকে অতিক্রম করতে পারেন না।
কুরুসভায় কৃষ্ণের দুতিয়ালি বিফল হল, কৃষ্ণের তর্কযুক্তি, শান্তিকামনার সারবত্তা মেনে নিয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, ধৃতরাষ্ট্র সকলেই দুর্যোধনকে পথে আনবার চেষ্টা করলেন প্রায় একই ধরনের কথা বলে। একমাত্র বিদুর, শুধু বিদুর দুর্যোধনের অবিমৃশ্যকারিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন– আমি তোমার জন্য এতটুকু দুঃখ পাই না, দুর্যোধন! তোমার যা হবার তা তো হবে। কিন্তু দুঃখ পাই তোমার মা গান্ধারী এবং বৃদ্ধ পিতা ধৃতরাষ্ট্রের জন্য ইমৌ তু বৃদ্ধৌ শোচামি গান্ধারীং পিতরঞ্চ তাম। বিদুর মনে করেন– দুর্যোধনের মতো রাজ্যলোভীর হাতে রাজ্যশাসনের ভার দেওয়ায় অপক্ক মানুষের হাতে রাজ্যের সুরক্ষা তুলে দিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীও সেখানে নিরুচ্চার সাক্ষী। বিদুর বলেছেন- তোমার মতো মানুষ যেখানে রক্ষকের ভূমিকায় আছে, সেখানে তোমার পিতামাতা, মন্ত্রী-অমাত্য, স্বজন-বান্ধব হারিয়ে একদিন ডানাকাটা পাখির মতো ঘুরে বেড়াবেন। বিদুর তাঁর ক্ষোভ চেপে রাখলেন না, গান্ধারী এবং ধৃতরাষ্ট্রের উদ্দেশে তিনি শেষ তিরস্কারে বললেন– যে পিতামাতা এইরকম কুলবিধ্বংসী পাপিষ্ঠ ছেলের জন্ম দিয়েও তার প্রশমনের ব্যবস্থা না করেন, তাদের একদিন ঘুরে বেড়াতে হবে ভিক্ষুকের সাজে ভিখারির মতো কষ্ট পেতে পেতে ভিক্ষুকৌ বিচরিষ্যেতে শোচন্তৌ পৃথিবীমিমাম।
বস্তুত বিদুরই বার বার ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীকে পুত্রত্যাগ করার কথা বলেছেন। বারবার বলেছেন– এই একটা ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করলে তিনি নিরানব্বইটি ছেলে নিয়ে সুস্থ থাকতে পারবেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র কোনওদিন সে-কথা শোনেননি, গান্ধারীও মাতৃস্নেহে শুধু রাগের সময়েই ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন– বিদুর ঠিক কথাই বলেছেন, এই পুত্রকে তোমার ত্যাগ করাই উচিত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এমন কোনও উদ্যোগ যেমন ধৃতরাষ্ট্র দেখাননি, তেমনি ক্ষোভ প্রকাশের সময় ছাড়া গান্ধারীও তেমন কোনও উদ্যোগ দেখাননি। আর আজ কী হল, কুরুসভায় শতেক আলোচনা, শান্তির প্রস্তাব নিয়ে দুই পক্ষের চাপান উতোর, ভীষ্ম-দ্রোণের উপদেশ, দুর্যোধন-কর্ণদের কাছে হিত বোঝানোর চেষ্টা– সব যখন ব্যর্থ হয়ে গেল, তখন কৃষ্ণ কিন্তু শেষ কথা যেটা বললেন, সেটা কিন্তু বিদুরেরই কথার পুনরুক্তি। কৃষ্ণ বললেন– আপনারা সমবেত কুরুপ্রধানেরা কর্তব্য কাজটা কিন্তু করছেন না– সর্বেষাং কুরুবৃদ্ধানাং মহানয়ম অতিক্রমঃ। আপনারা একটা মূর্খকে রাজশাসনের মূল কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, অথচ তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার এতটুকু চেষ্টাও করেননি। রাজ ঐশ্বর্য পেলে যাদের মাথা খারাপ হয়ে যায় তেমন মানুষদের নিয়ন্ত্রিত করাটা আপনাদের কর্তব্য ছিল–প্ৰসহ্য মন্দম ঐশ্বর্যে ন নিযচ্ছন্তি যনৃপম। আপনারা আমাদের দিকেই তাকিয়ে দেখুন। মথুরাধিপতি কংস পিতা উগ্রসেনকে বন্দি করে রাজ্য দখল করেছিল। এই অবস্থায় বৃষ্ণি-অন্ধকদের সঙঘমুখ্য কুলপতিরা সকলে তার সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করেন। এই সময়েই কিন্তু নির্বান্ধব কংসকে আমরা মেরে মথুরার সিংহাসন মুক্ত করেছি। এখানেও ঠিক একই কথা বলতে চাই অন্যভাবে– আমি ধৃতরাষ্ট্রকেই বলছি– আপনারা দুর্যোধন-দুঃশাসন এবং কর্ণ-শকুনিকে বন্ধন করে পাণ্ডবদের হাতে দিয়ে দিন। আর যদি এতটা নাও করতে চান, তা হলে শুধুমাত্র দুর্যোধনকে বন্দিশালায় নিক্ষেপ করে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করুন আপনি– রাজন দুর্যোধনং বধ্ব ততঃ সংশাম্য পাণ্ডবৈঃ। মনে রাখবেন, যেন আপনার জন্যই ক্ষত্রিয়রা সর্বনাশের মুখে না পড়ে।
এই কথার মধ্যে দুর্যোধনের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রকে দায়টুকুও পরিষ্কার করে দিয়েছেন কৃষ্ণ এবং তার পরামর্শের অন্যতম পাথেয় ছিল বিদুরের নীতিবাক্য বংশের সবাইকে বাঁচানোর জন্য একজনকে ত্যাগ করাও ভাল, একটা গ্রাম রক্ষার জন্য একটা বংশকেও ত্যাগ করা যায় আর একটা দেশ রক্ষার জন্য গ্রামটাকেও ত্যাগ করতে হয়- ত্যজেদেকং কুলস্যার্থে গ্রামস্যার্থে কুলং ত্যজেৎ। ঠিক একই কথা। বহুকাল আগে বিদুর ওই একই কথা বলেছিলেন। তা যতখানি সদ্যোজম্মা দুর্যোধনের কারণে বলেছিলেন, তার চেয়ে বেশি বলেছিলেন দুর্যোধনের বিষয়ে ধৃতরাষ্ট্রের উন্মত্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখে। আজ কৃষ্ণও একই কথা বললেন এবং দুর্যোধনের কথা ছাড়াও কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে চিহ্নিত করে বলেছেন- দেখবেন মহারাজ! আপনি ক্ষত্রিয়দের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। আপনার জন্য যেন ক্ষত্রিয়রা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ধ্বংসের পথে না যায়– ত্বৎকৃতে ন বিনশ্যেয়ুঃ ক্ষত্রিয়াঃ ক্ষত্রিয়র্ষভ।
কৃষ্ণের এই শেষ সাবধানবাণীর অর্থ কী ধৃতরাষ্ট্র তা বোঝেন। বাইরে তিনি যতই অন্ধ সরল প্রকৃতির আবেশ দেখান, ধৃতরাষ্ট্র এবার বুঝতে পারছেন– তাঁর নিজের অবদমিত রাজ্যস্পৃহা এবং সেই কারণেই পুত্রের রাজ্যগৃধুতায় তার অপার প্রশ্রয়– সব এবার ধরা পড়ে গেছে। স্বয়ং যুধিষ্ঠির তাকে বিশ্বাস করছেন না, কৃষ্ণ তো করছেনই না। অথচ কৃষ্ণের মতো ভয়ংকর বুদ্ধিমান মানুষ প্রতিকূলে প্রতিপক্ষে থাকলে তার যে ভয়ংকর বিপদ– এই ভয়ও ধৃতরাষ্ট্রকে সাময়িকভাবে চেপে বসল। কিন্তু তাই বলে এই অবস্থায় তিনি যে কৃষ্ণের কথামতো পুত্র দুর্যোধনকে বন্দিশালায় নিক্ষেপ করে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধিবিষয়ক কথা বলবেন– এমন মনোবল আর নেই তার। অতএব শেষ চেষ্টা হিসেবে এবার গান্ধারীর ওপর তার পরম নির্ভরতা- যে গান্ধারী স্বামীর দ্বিচারিতায় ছিন্ন-ভিন্ন, পুত্রের ঐশ্বর্যলোভে তিক্ত, বিরক্ত, লজ্জিত। অথচ স্বামীর প্রতি মায়ায় গান্ধারীর নিজের অন্তর্গত ধর্মবোধ বারবার খণ্ডিত হয়, পীড়িত হয়।
ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে বললেন– যাও বিদুর! গান্ধারীকে নিয়ে এসো এখানে, তিনি মহাপ্রাজ্ঞা। তাকে নিয়ে এসো এইখানে। আমি তার সঙ্গে একত্রে অনুরোধ করব, যদি দুর্বুদ্ধি পুত্রের সুমতি হয় তাতে– আনয়েহ তয়া সার্ধমনুনেষ্যামি দুর্মতি। যদিও গান্ধারীর সঙ্গে নিজেকেও এখানে যুক্ত করেছেন ধৃতরাষ্ট্র, কিন্তু নিজের চেয়ে তিনি গান্ধারীর ওপরেই নির্ভর করছেন বেশি। কারণ তাঁর নিজের বলা শাসন যে পুত্রের আত্মবিশ্বাসে কিছুক্ষণ পরেই পরিবর্তিত হয়ে যায়, সে-কথা বুঝি নিজেও বোঝেন ধৃতরাষ্ট্র। কৃষ্ণের বক্তব্যে এখন তিনি এতটাই ভীত যে, এখন তিনি বলছেন– গান্ধারীও যদি পুত্র দুর্যোধনকে শেষ পর্যন্ত সংযত করতে না পারেন, তবে কৃষ্ণ যেমন বলেছেন, তেমনই আমরা করব– যদি সা ন দুরাত্মানং শময়ে দুষ্টচেতসম। তবে আমার বিশ্বাস আমি যা পারিনি, গান্ধারী তা পারবেন। লুব্ধ, দুর্বুদ্ধি এবং দুর্জনের সহায়তায় সে যতই বেড়ে উঠুক গান্ধারী যদি যুদ্ধশান্তির জন্য তাকে উপদেশ দেন, তবে সেটা সে ফেলতে পারবে না বলেই আমার মনে হয়– অপি লোভাভিভূতস্য পন্থানমুপদর্শয়েৎ। তবে আবার একটু সন্দেহও হয় মনে দুর্যোধনের কারণে যে বিপদ আমাদের মাথায় এসে চেপে বসেছে, চিরকালের জন্য সেই বিপদ তিনি দূর করতে পারবেন কিনা– অপি নো ব্যসনং ঘোরং দুর্যোধনকৃতং মহৎ।
এখানে পর পর দুটি শ্লোকে ‘অপি’ শব্দের প্রয়োগ করেছেন মহাভারতের কবি। এই ‘অপি’ শব্দটা প্রশ্ন-অর্থে ব্যবহার হয়, সম্ভাবনা-অর্থে ব্যবহার হয় আবার সামান্য একটু সন্দেহ-অর্থেও ব্যবহার হয়। তবে কিনা প্রশ্নার্থেই এই ব্যবহার বেশি, আর প্রশ্ন মানেই তার মধ্যে সন্দেহটুকু থেকেই যায়। তার মানে, সিদ্ধান্তবাগীশ এই শব্দের মধ্যে যতই সম্ভাবনার অর্থ অনুবাদ করুন, আমাদের ধারণা, গান্ধারীকে ব্যবহার করাটা শেষ চেষ্টা হিসেবে ধৃতরাষ্ট্র ধরে নিয়েছেন বটে, কিন্তু তার মনের মধ্যে এই সন্দেহ যথেষ্টই আছে যে, গান্ধারীও শেষ পর্যন্ত পারবেন কি তার দুর্দম্য পুত্রকে শাসন করতে?
ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে মহামতি বিদুর ডেকে আনলেন দীর্ঘদর্শিনী গান্ধারীকে– পট্টবস্ত্রে চোখ বাঁধা থাকলেও সমস্ত ঘটনা, ঘটনার জের তিনি বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পান। আনয়ামাস গান্ধারীং বিদুরো দীর্ঘদর্শিনীম। গান্ধারী নিশ্চয়ই খুব ভালভাবে জানেন যে, কুরুসভায় কৃষ্ণ এসেছেন, সেখানে শান্তির বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে এবং হয়তো এও জানেন যে, তার দুর্মতি পুত্র সবাইকে অমান্য করে সভা থেকে বেরিয়ে গেছে। গান্ধারী রাজসভায় উপস্থিত হয়েছেন– তখন কেউ নেই সেখানে। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ সকলে সভা ছেড়ে চলে গেছেন, চলে গেছেন কৃষ্ণ তাঁর শেষ সাবধানবাণী শুনিয়ে, আর চলে গেছেন দুর্যোধন কর্ণেরা সকলে। সভায় একা বসে ধৃতরাষ্ট্র, আর তার বিপদের পরামর্শদাতা বিদুর।
গান্ধারীকে দেখেই ধৃতরাষ্ট্র বললেন- এই যে গান্ধারী! তোমার ছেলের কথা বলছি, সে-বদমাশ সমস্ত শাসনের বাইরে চলে গেছে– এষ গান্ধারি পুত্ৰস্তে দুরাত্মা শাসনাতিগঃ। এত তার ঐশ্বর্যের লোভ যে সেই লোভে এবার ঐশ্বর্যও হারাবে, জীবনটাও হারাবে। তুমি কি জানো, এখানে একটা সভা চলছিল সেখানে মান্যগণ্য মানুষেরা সব ছিলেন, ছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণ। তুমি ভালই বোঝ– এই সভার একটা মর্যাদা আছে, শিষ্টতা আছে, এখানে যা ইচ্ছে তাই করা যায় না; অথচ দুর্যোধন অশিষ্টের মতো কারও মর্যাদা না মেনে, কারও কথা না শুনে তার নিজের দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেল, এটা কোন দেশি সভ্যতা– সভায়া নির্গত মূঢ়ো ব্যতিক্রম্য সুহৃদচঃ।
পুত্রের সম্বন্ধে ধৃতরাষ্ট্র বেশ কিছু অপশব্দ প্রয়োগ করলেন বটে, কিন্তু গান্ধারীর সামনে বলবার সময় সেই ধ্রুবপদটি তোমার ছেলে– এষ গান্ধারি পুত্রস্তে– এই কথাটি বহুদিন শুনছেন গান্ধারী এবং সেটা তার কানে বড় অসহ্য লাগে। সারা জীবন বিপুল প্রশ্রয়ে যিনি ছেলেকে লোভী এবং দুষ্ট তৈরি করলেন, তিনি এখন জননীকে বলছেন– তোমার ছেলে দুষ্ট। গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের কথা শুনেই বললেন– সেই রাজ্যকামুক লোভী ছেলেকে নিয়ে এসো এখানে, তুমি বলছ যখন, নিয়ে এসো– আনয়ানয় সুতং ক্ষিপ্রং রাজ্যকামুকম আতুরম। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা, যে লোকটা অশিষ্ট, অবিনীত এবং ধর্ম তথা অর্থের পুরুষার্থ-প্রয়োজন যে জানে না, সে লোকটার তো রাজ্য পাবার অধিকারই নেই। তবুও দুর্যোধন সর্বতোভাবে বিনা বাধায় সেই রাজ্য লাভ করেছে রাজ্যম্… আপ্তং তথাপীদ অবিনীতেন সর্বথা।
গান্ধারী এতকাল শুনেছেন, কিন্তু এভাবে-ওভাবে নীতি কথা বলেও স্বামী এবং রাজোপাধিযুক্ত ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি ন্যায়ের পথে আনতে পারেননি। অথচ তিনি আজ নীতিকথা বলছেন। বিশেষত, বিনয়-শিক্ষা তো রাজধর্মের মূল কথা। ইন্দ্রিয় দমনের শিক্ষা, নিজেকে সংযত রাখার শিক্ষা, ঐশ্বর্য লাভ করেও উৎফুল্ল না হবার শিক্ষা এবং বিপন্ন হলেও বিষণ্ণ না হবার শিক্ষা– এইসব কিছু বিনয়-শিক্ষার মধ্যে পড়ে এবং তা রাজা হবার প্রাথমিক শর্তের মধ্যে পড়ে। ধৃতরাষ্ট্র পিতা হয়েও নিজেই এই শিক্ষা সম্পূর্ণ পাননি এবং গান্ধারীর পক্ষে তা স্বামীকে বলাও সম্ভব নয় সোচ্চারে। কিন্তু পুত্রের বিনয়-শিক্ষার প্রশ্ন তুলে তিনি যেন ধৃতরাষ্ট্রকেই বলতে চাইলেন– তবু দুর্যোধন রাজা হল কী করে, কার প্রশ্রয়ে– ন হি রাজ্যমশিষ্টেন শক্যং ধর্মার্থলোপিনা।
সত্যিই তো, সেই যেদিন জতুগৃহের অগ্নিমুক্ত পাণ্ডবদের ঊষর খাণ্ডবপ্রস্থে পাঠিয়ে দিয়ে হস্তিনাপুরের পরম্পরাপ্রাপ্ত রাজ্যভার অযোগ্য দুর্যোধনের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্র, সেদিন তো এমন বলেননি– গান্ধারী তোমার ছেলে আজ রাজা হল। অথবা যেদিন শকুনির পাশাখেলার এক-একটি চালের পরে ধৃতরাষ্ট্র উন্মত্তের মতো বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন– জিতেছে কি? শকুনি জিতেছে– সেদিন তো তিনি গান্ধারীকে একবারও বলেননি– তোমার ছেলে পাশা খেলে অধর্ম করছে, দ্রৌপদীকে সভার মাঝখানে টেনে এনে অসভ্যতা করছে। ইত্যাদি কিছুই বলেননি ধৃতরাষ্ট্র। আর আজকে যখন যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে তার নিজেরই গোঁয়ার্তুমির ফলে, তখন তিনি গান্ধারীকে দুষছেন। আজকে গান্ধারী এসেছেন অন্যায়-দূষণের জবাব দিতে। গান্ধারী প্রথমেই প্রশ্ন তুলেছেন- যাকে তুমি অশিষ্ট, অবিনয়ী, অভদ্র বলছ, সে ছেলে রাজ্য পেল কী করে? এবারে একেবারে সোজাসুজি অধিক্ষেপ– নিন্দা করলে আগে তো তোমাকেই সবচেয়ে বেশি দোষ দিতে হয়, কেননা ছেলের ব্যাপারে এতটাই তোমার মুগ্ধতা যে, কোনওদিন তুমি তার দোষ দেখতে পাওনি, অতএব তোমার দোষটাই সবচেয়ে বেশি– ত্বং হ্যেবাত্ৰ ভূশং গর্হো ধৃতরাষ্ট্র সুতপ্রিয়।
এতদিন পরে স্বামীকে এক কথায় ছেড়ে দিলেন না গান্ধারী। প্রধানত এই একটি অন্ধ মানুষের ওপর মায়াবশত এতদিন কত অন্যায় তিনি সয়েছেন, আর নয়। গান্ধারী স্বামীকে বললেন– এই ছেলের পাপ-প্রবণতার কথা তুমি সব জানতে। তার সমস্ত অন্যায় কাজে তুমি সবচেয়ে বড় সহায় ছিলে এবং সব জেনেশুনেই তুমি ছেলের বুদ্ধি অনুসারেই চলেছ– যো জান পাপতামস্য তৎপ্রজ্ঞাম অনুবর্তসে। গান্ধারী বুঝিয়ে দিলেন যে, এতকাল ছেলের কথামতো কাজ করে আজকে এতদিন পরে তাকে দু-চারটে জ্ঞানমূলক বাণী শোনালেই সে ভাল পথে চলতে আরম্ভ করবে– এই ভাবনাটাই বৃথা। তিনি বললেন– দুর্যোধন আপাদমস্তক লোভী, তার মধ্যে আবার এই রাজ্যের লোভ তার কামনা আরও চতুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে, আর এই কামনা সামান্য প্রতিহত হবার উপক্রম হলেই তার ক্রোধ বাড়িয়ে তুলছে। এই অবস্থায় যে পৌঁছে গেছে, এবং তুমিই তাকে এই জায়গায় পৌঁছে দিয়েছ, তাকে এখন জোর করে নিয়ন্ত্রণ করা, সংযত করা প্রায় অসম্ভব– অশকোহয়ং ত্বয়া রাজ বিনিবর্তয়িতুং বলাৎ- এবং তোমার পক্ষে তো একেবারেই অসম্ভব। তুমি নিজে জানতে যে, তোমার ছেলে মূর্খ, মূঢ়, সংযমহীন। সে বদলোকের সঙ্গে মেশে এবং তাদের কথাতেই চলে। এমন ছেলের হাতে তুমি যখন রাজ্য তুলে দিয়েছিলে, তারই ফল তুমি ভোগ করছ ধৃতরাষ্ট্র দুঃসহায়স্য লুব্ধস্য ধৃতরাষ্ট্ৰোহণুতে ফলম।
একেবারে ব্যক্তিগত আলোচনা এবং দোষারোপের মধ্যেও হঠাৎ ঘনিয়ে ওঠা যুদ্ধোদ্যোগের ব্যাপারেও গান্ধারী কিছু রাজনৈতিক কথা বললেন। এতকাল রাজবাড়িতে আছেন, রাজমহিষীও বটে, রাজমাতাও বটে, অতএব রাজনীতি কিছু তিনি বোঝেন না, এমন তো নয়। গান্ধারী বললেন একান্ত আত্মীয়দের সঙ্গে আমাদের বিভেদ উপস্থিত হয়েছে, অথচ রাজা হয়ে তুমি সেই ভেদ উপেক্ষা করেছ। আর আত্মীয়দের সঙ্গে বিভেদ উপস্থিত হলে, পূর্বে যারা শত্রু ছিল, তারা আমাদের বিভেদ বুঝে আক্রমণ করবে। আমি রাজনীতির দিক থেকে শুধু এইটুকুই বুঝি যে, আত্মীয়দের সঙ্গে যে আমাদের বিভেদ ঘটেছে তা শুধু তাদের সঙ্গে কথা বলে আলোচনার মাধ্যমেই এই বিভেদ মিটিয়ে নেওয়া যেত। যদি আলোচনা ফলবতী নাও হত, তা হলে অন্তত শত্রুদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করেও তো তাদের সমস্ত পরিকল্পনা বিপর্যস্ত করে দেওয়া যেত। কিন্তু সাম-দান-ভেদ কোনও রাজনৈতিক উপায়ের মধ্যেই তোমরা গেলে না, অথচ রাজনীতির শেষ উপায় যুদ্ধ করবার জন্য ব্যস্ত হচ্ছ আত্মীয়দের সঙ্গে নিস্ততুমাপদঃ স্বেষু দণ্ডং কস্তত্র পাতয়েৎ।
গান্ধারী বলতে চাইলেন- আত্মীয় ভাইদের সঙ্গে আলোচনার পক্ষে না গিয়ে যুদ্ধ করবার এই প্ররোচনা কি শুধুমাত্র তার ছেলের, না ছেলের বাবা ধৃতরাষ্ট্রের। ধৃতরাষ্ট্র অবশ্য এইসব সযৌক্তিক কথার কোনও প্রত্যুত্তর করেননি। ইতোমধ্যে বিদুর দুর্যোধনের কাছে মায়ের কথা বলে তার প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ জানিয়ে কোনও মতে দুর্যোধনকে গান্ধারীর সামনে উপস্থিত করালেন মাতুশ্চ বচনাৎ ক্ষত্তা সভাং প্রবেশয়ৎ পুনঃ। পিতার প্রতি সম্মানেও নয়, বিদুরের প্রতি সম্মানেও নয়, এমনকী মায়ের প্রতিও যে খুব সম্মানবশত তাও নয়, দুর্যোধন সভায় প্রবেশ করলেন শুধু এই কারণে যে, গান্ধারী কী বলেন– তাই শোনার জন্য– স মাতুচনাকাঙ্ক্ষী প্রবিবেশ পুনঃ সভাম। সত্যি কথা বলতে কি, গান্ধারী সচরাচর পুত্রের সঙ্গে বেশি কথা বলেন না, তার অন্যায়-কর্মেও তিনি তেমন করে সহায় হননি কোনওদিন, ফলে ছেলের সঙ্গে তার একটা সম্মানসূচক দূরত্ব আছে, এমন একটা ওজনও আছে তার কথার যে, দুর্যোধনের পক্ষেও তা না শুনে উপায় নেই।
তবু একটা রাগ দুর্যোধনের হয়েই ছিল। সভাস্থলে সকলে, এমনকী তার পিতাও যেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং যেহেতু সকলের কাছে শুনতে হয়েছে তার স্বভাবিত আকাঙ্ক্ষার বিপরীত কথা, তাই আবারও যখন তাকে মায়ের কথা শোনবার জন্য সভায় ফিরে আসতে হয়, তখন স্বভাবতই তাঁর মুখ-চোখ-শরীরের মধ্যে ক্রোধ এবং অহংকারের পরিস্ফুট অভিব্যক্তি দেখা গেল। তার চোখ লাল হয়ে গেছে এবং সভায় প্রবেশের সময় তিনি ক্রোধে সাপের মতো নিশ্বাস ছাড়তে লাগলেন– অতিতাস্রেক্ষণঃ ক্রোধান্নিশ্বসন্নিব পন্নগঃ। গান্ধারী পুত্রের ভাব বুঝতে পারলেন এবং এও বুঝলেন যে, উৎপথচালিত পুত্রকে আর মিষ্টি কথা বলে লাভ নেই। বৃহত্তর প্রয়োজন শান্তি এবং স্বাভাবিক প্রয়োজন পুত্রের জীবন–দু-দিক থেকে ভাবলেও আজ তাকে নিন্দা করাই প্রয়োজন। সুবৃহৎ এবং সুচিন্তিত একটি অনুশাসনের মধ্যে দুর্যোধনের প্রতি তার মাতৃ সম্বোধনগুলিই একমাত্র স্নেহসূচক শব্দ বলা যেতে পারে। ‘পুত্র’, ‘তাত’ ইত্যাদি শব্দগুলিকে বাংলায় যদি বলে ‘বাছা আমার’ তবে মাঝে মাঝে দুর্যোধনের প্রতি তার ‘মহাপ্রাজ্ঞ’ সম্বোধনটির বাংলা করা উচিত– ‘তুমি তো বুদ্ধিমান ছেলে, তুমি তো সব বোঝো।’ কিন্তু এই শব্দগুলি ছাড়া আর যত কথা আছে, তার মধ্যে দুর্যোধনের প্রতি সমস্ত ব্যক্তিগত অনুরোধগুলিই উচ্চারিত হয়েছে রাজনৈতিক পরামর্শের ভাবনায়। এখন যে সময় এসেছে, তাতে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানটাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক, আর গান্ধারী সেই রাজনীতির কথাই বলছেন, কেননা সুস্থ রাজনীতি তিনি ধৃতরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি বোঝেন, অন্তত তার মধ্যে ব্যক্তিগত প্রশ্রয় নেই, মা বাবার আত্মীয়তা নেই।
গান্ধারী বললেন– বাছা আমার! তোমার এবং তোমার সঙ্গে যারা আছে, তাদের সকলের ভালর জন্যই বলছি বাছা। আমার কথা শোনো, তোমার ভবিষ্যতে ভাল হবে– দুর্যোধন নিবোধেদং বচনং মম পুত্রক। গান্ধারী এতক্ষণ ধৃতরাষ্ট্রকে সোচ্চারে তিরস্কার করেছেন বটে, কিন্তু দুর্যোধনের সামনে তার সম্মান নষ্ট করলেন না, কেননা ধৃতরাষ্ট্র নাচার হয়ে তার শরণ গ্রহণ করেছেন। গান্ধারী বললেন, দুর্যোধন! তোমার পিতা, পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ, কৃপ এবং বিদুর যেটা বলছেন, সেটা তুমি শোনো; তাদের কথা শোনা মানেই কিন্তু তাদের সম্মান রক্ষা করা। রাজ্য ব্যাপারটা এমনই যে, একটি মানুষ ইচ্ছে করলেই রাজ্য পায় না, একজন ইচ্ছে করলে সে রাজ্য রক্ষা করতে পারে না, কিংবা ইচ্ছে করলেই সেটা ভোগ করা যায় না– অবাপ্তং রক্ষিতুং বাপি ভোং ভারতসত্তম। গান্ধারী বোঝাতে চাইলেন যে, দুর্যোধন যে আজ রাজা হয়ে বসেছেন, সেখানে তার নিজস্ব কৃতিত্ব কিছু নেই, তার নিজের রাজা হবার ইচ্ছেটাও সেখানে বড় কথা নয়। কেননা অন্তত এই হস্তিনাপুরের অংশে রাজত্বদানের পিছনে ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ-কৃপ-বিদুরেরও বিশিষ্ট ভূমিকা আছে, অথচ দুর্যোধন এখন তাদেরই মানছেন না।
এবার ছেলের রাজা হবার যোগ্যতা এবং যদি দুর্যোধন অন্যের পৃষ্ঠপোষণে রাজা। হয়েও থাকেন, তবে সেই রাজত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে ছেলেকে সরাসরি আক্রমণ করলেন না গান্ধারী। কারণ বিষয়-লালসায় বিমূঢ় ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত বিকার উপশমন করার উপদেশ শোনালে আরও বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। অথচ গান্ধারী সেই কাম-ক্রোধের তাড়না নিরুদ্ধ করার উপদেশই দেবেন দুর্যোধনকে। তাই সরাসরি না বলে, মানুষের কী হয়, তাই বলছেন গান্ধারী। গান্ধারী বললেন– ইন্দ্রিয়গুলি যার বশে নেই, সে কখনও অনেক দিন ধরে প্রশাসনিক পদে অবস্থিত থাকতে পারে না–ন্য হি অবশ্যেন্দ্রিয়ে রাজ্যমীয়াদ্দীৰ্ঘমন্তর। কেননা ইন্দ্রিয়জয়ের ক্ষমতা না থাকলে কামনা এবং ক্রোধ প্রশাসক নেতাকে কর্তব্য ভুলিয়ে অন্য দিকে নিয়ে যায়। কামনা এবং ক্রোধ রাজা হবার পথে সবচেয়ে বড় শত্রু, এই শত্রু দুটিকে জয় করলেই তবে রাজার রাজ্য সুস্থিত হয়।
এই এতকাল পরে গান্ধারী অর্থশাস্ত্রের প্রাথমিক পাঠ নিচ্ছেন পুত্রকে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রই বলুন অথবা মনুসংহিতাই বলুন, অথবা রাজনীতি বিষয়ক অন্য কোনও প্রাচীন গ্রন্থ, সব জায়গাতে রাজনীতি পাঠের প্রাথমিক অধ্যায়গুলি হল ইন্দ্রিয় জয় এবং বিনয় শিক্ষা। ইন্দ্রিয়-জয়ের ব্যাপারটা বিনয়-শিক্ষার মধ্যে রাখা যায়, কেননা বিনয় মানেই যে শিক্ষার মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গুলি বশে আনা যায়। বিনীত মানেই সুশিক্ষিত। বিনয় শব্দটার মধ্যে আরও বেশ কিছু শিক্ষার ব্যাপার আছে বলেই আমরা ইন্দ্রিয়-জয়ের প্রসঙ্গটা পৃথক উচ্চারণ করলাম। গান্ধারী মনে করেন ইন্দ্রিয়-জয়ের শিক্ষা না থাকার ফলেই দুর্যোধনের এত রাজ্যলোভ এবং সেই রাজ্যলোভ ব্যাহত হচ্ছে বলেই দুর্যোধনের এত ক্রোধ। কামনা বাসনার নিয়মই এই, ব্যাহত বা প্রতিরুদ্ধ হলেই তা ক্রোধে পরিণত হয়।
কেন, কেন, দুর্যোধনের রাজ্যলোভ এত বেশি কেন, এই তর্কে না গিয়ে গান্ধারী সাধারণ যুক্তিতে বলেছেন– রাজ্য মানেই তো প্রভুত্ব, power, authority. সকলেই সে প্রভুত্ব চায়, কিন্তু যার নিজের লোভ-তৃষ্ণার ওপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, সে যদি বা রাজ্য পায়ও কোনও ভাবে সে রাজ্য সে রাখতে পারবে না– রাজ্যং নামেপ্সিতং স্থানং ন শক্যম অভিরক্ষিতুম্। প্রাচীন রাজনীতি-শাস্ত্রে ইন্দ্রিয়-জয়, বিনয়-শিক্ষার পরেই অমাত্য নিয়োগের প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র। অমাত্যকে রাজার সহায় এবং পরিচ্ছদ বলা হয়েছে, কেননা রাজা কখনও একা রাজ্য শাসন করতে পারেন না। গান্ধারী এই শুষ্ক রাজনীতির সত্যগুলিকে অদ্ভুত চাতুর্যে পরিবেশন করেছেন দুর্যোধনের কাছে। তিনি বোঝাতে চাইলেন– শত্রু বলে যদি কাউকে মানতেই হয়, তবে পাণ্ডবেরা তোমার প্রথম শত্রু নয়, যাদের দমন করতে চাইছ তুমি। প্রথমে নিজেই নিজের সামনে দাঁড়াও, দেখো তোমার নিজের ভিতরেই শত্রু আছে কিনা, প্রথমে তুমি সেই আন্তর শত্রুকে দমন করো– আত্মানমেব প্রথমং দ্বেষ্যরূপেণ যোজয়েৎ। তারপর পঁাড়াও তোমার মন্ত্রী-অমাত্যদের সামনে। যাঁরা এতকাল তোমার এবং তোমার রাজ্যের হিত চিন্তা করেছেন, তারা হঠাৎই তোমার বিরুদ্ধে কথা বলছেন কেন, সেটা তোমায় বুঝতে হবে এবং তাদের জয় করতে হবে নিজের আত্মবুদ্ধি দিয়ে। তারপর তো তৃতীয়ত তোমার বাইরের শত্রু, যারা তোমার মিত্রপক্ষে নেই, তাদের জয় করার প্রশ্ন– ততোহমাতা অমিত্রাংশ্চ ন মোঘং বিজিগীষতে।
গান্ধারী তার ছেলেকে জানেন। তিনি জানেন যে, কামনা-বাসনা, লোভ, দম্ভ, অহংকার- এই সমস্ত অসদবৃত্তি তাঁর ছেলেকে আপাদমস্তক গ্রাস করেছে এবং এই সেই কারণেই তিনি কারও কথাই শুনছেন না। গান্ধারী বললেন– যে মানুষ ইচ্ছা করে অথবা নিতান্ত ক্রোধের বশে আপন জনের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করে, সে মানুষকে কেউ সহায়তা করে না। আজকে যে ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর– কাউকে তুমি সহায় হিসেবে পাচ্ছ না, তার কারণ তোমার এই ইচ্ছাকৃত অন্যায় আচরণ। সাধারণ নৈতিক কথা শেষ করে এবারে গান্ধারী আসল কথায় এলেন। বললেন– পাণ্ডবরা পাঁচ ভাই, এককাট্টা হয়ে আছে। তারা বুদ্ধিমান এবং বীর, তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজ্য ভোগ করলেই তবে তুমি সবচেয়ে সুখে থাকবে– পাণ্ডবৈঃ পৃথিবীং তাত ভোক্ষ্যসে সহিতঃ সুখী।
সত্যি বলতে কি, কর্ণ-দুঃশাসন-শকুনির প্রতিপক্ষে অর্জুন এবং কৃষ্ণ যে কতটা বেশি শক্তিমান–এ কথা দুর্যোধনকে বোঝাতে পারছেন না গান্ধারী। ভীষ্ম এবং দ্ৰোণও পারেননি, গান্ধারীও পারছেন না। কিন্তু আজ থেকে পাণ্ডবদের বনবাস-পর্বের আগে ভীষ্ম-দ্রোণ বিদুরেরা যে অসাধারণ বুদ্ধিতে কৌরব-পাণ্ডবদের রাজ্য ভাগ করে দিয়েছিলেন, গান্ধারী সেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে বলছেন দুর্যোধনকে। গান্ধারী বলেছেন- আজকে তুমি যে যুদ্ধের জন্য লালায়িত হচ্ছ, সেই যুদ্ধে কোনও মঙ্গল নেই, ধর্ম নেই, সুখও নেই। তোমার স্বার্থও তাতে সম্পূর্ণ সিদ্ধ হবে না, আর যুদ্ধে যে জয় হবেই সে-কথাও হলফ করে বলা যায় না। সেইজন্যেই বলছি– যুদ্ধের বুদ্ধিটা তুমি একেবারে মাথা থেকে বার করে দাও– ন চাপি বিজয়ো নিত্যং মা যুদ্ধে চেত আধীথাঃ। যুদ্ধ যাতে না হয় অথচ পাণ্ডব-ভাইদের সঙ্গে তোমার চিরশত্রুতাও যাতে না হয়, সেই ভয়েই ভীষ্ম, তোমার পিতা এবং রাজসভার অন্য মন্ত্রী-অমাত্যেরা পাণ্ডবদের পৈতৃক অংশ দিয়ে তাঁদের রাজ্য আলাদা করে দিয়েছিলেন– দত্তোহংশঃ পাণ্ডুপুত্ৰাণাং ভেদাদ ভীতেররিন্দম। আর সেই রাজ্যদানের ফল এখনও তুমি বুঝতে পারছ তারা রাজ্যটাকে নিষ্কন্টক শত্রুহীন করে বনে গেছে, তুমি তাদের রাজ্যই সম্পূর্ণ ভোগ করছ– যদ্ ভুক্ষে পৃথিবীং কৃৎস্নাং শূরেনিহতকণ্টকাম্।
অর্থাৎ গান্ধারী একবারের তরেও মেনে নিলেন না যে, পাণ্ডবদের অংশটা এখন দুর্যোধনের হয়ে গেছে। বরঞ্চ বলতে চাইলেন– তোমার নিজের অংশে তুমি যদি নিশ্চিন্তে রাজ্যভোগ করতে চাও, তা হলে পাণ্ডবদের অংশ, অর্ধেক রাজ্য তাদের দিয়ে দাও যদীচ্ছসী সহামাতো ভোঙুমর্ধং প্রদীয়তাম। গান্ধারী এবার নিজের অন্তরের ক্ষোভটুকুও সর্বৈব প্রকাশ করে ফেললেন। পাণ্ডবভাইদের ওপর যত অন্যায়-অত্যাচার দুর্যোধন করেছেন, গান্ধারী সেগুলি কোনওদিন মনে মনে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু স্বামী-পুত্রের সাহংকার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় বাধাও দিতে পারেননি। কিন্তু আজ তিনি বুঝতে পারছেন স্বামী-পুত্রের জীবন এবার বিপন্ন। দুর্যোধনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার আগুনে সকলে এবার পুড়ে মরবে। এখন আর চুপ করে থাকবেন না গান্ধারী। তিনি এবার সত্য উচ্চারণ করবেন, বলবেন বাস্তবের কথা। গান্ধারী বললেন– তুমি তেরো বচ্ছর ধরে অনেক যাতনা দিয়েছ পাণ্ডবদের। আর নয়– অলম নিকারোহয়ং ত্রয়োদশ সমাঃ কৃতঃ। এই যাতনায় তাদের নিজেদের পৈতৃক রাজ্যাংশ ফিরে পাবার তীব্রতাও যেমন বেড়েছে, তেমনি তোমার অনন্ত অপমানের ফলে তাদের রাগও জমা হয়েছে অনেক। আমি বলব– তুমি তাদের এই উদ্যত ক্রোধ প্রশমন কর– শময়ৈনং মহাপ্রাজ্ঞ কাম-ক্রোধ-সমেধিতম্।
দুর্যোধন সেই যে পিতার আদেশে কোনও মতে গান্ধারীর সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন, ব্যাস। ওইটুকুই। এতক্ষণ গান্ধারী কথা বলছেন, অথচ দুর্যোধন হ্যাঁ-না কিছুই বলছেন না। কোনও কথা যেন তার কানেও ঢুকছে না, অথবা ঢুকলেও সেই কথার প্রতি তার আদৌ শ্রদ্ধা। হচ্ছে না। তিনি গোঁয়ারের মতো অবিচলিত দাঁড়িয়ে আছেন। গান্ধারী পুত্রের মানসিকতা বুঝতে পারছেন, অতএব সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পথ ছেড়ে যুদ্ধের বাস্তব ক্ষেত্রে দুর্যোধনের সুবিধে-অসুবিধের কথা বলতে আরম্ভ করলেন। গান্ধারী বললেন– তুমি যাদের ভরসায় তোমার ঈঙ্গিত যুদ্ধে জয়লাভ করবে বলে ভাবছ, সেই তুমি, কর্ণ এবং তোমার ভাই দুঃশাসন– এরা কেউই পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারবে না।-ন চৈষ শক্তঃ পার্থানাং যমর্থমভীপ্সসি। আরও একটা জিনিস মনে রেখো তুমি যে ভাবছ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ– এঁরা সব তোমার পক্ষে সমগ্র শক্তি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, সেটা ভুল, একেবারেই ভুল- য্যোৎস্যন্তে সর্বশক্ত্যেতি নৈতদভুপপদ্যতে।
গান্ধারী খুব জোরের সঙ্গে বললেন– এঁরা তোমাদেরও স্বভাব জানেন, পাণ্ডবদেরও স্বভাব জানেন, তোমাদের সঙ্গে তাদের যে আত্মীয়তার সম্পর্ক, পাণ্ডবদের সঙ্গেও তাদের ওই একই সম্পর্ক। স্নেহের ব্যাপারটাও তাদের একই রকম। রাজ্যাংশও তোমার এবং পাণ্ডবদের একই রকম– সমং হি রাজ্যং প্রীতিশ্চ স্থানং হি বিদিতাত্মনাম– কিন্তু তফাত আছে একটাই, ন্যায়, নীতি, ধর্মের দিকে পাণ্ডবদের পাল্লা ভারী। অতএব ভীষ্ম-দ্রোণ কৃপেরা নিজেদের সর্বাঙ্গীণ ক্ষমতা তোমার জন্য যুদ্ধে উজাড় করে দেবেন না। আর তুমি যে ভাবছ– আমি এঁদের খাওয়াই-পরাই, এঁরা আমার জন্য কেন করবে না, তাতে বলি– খাওয়া-পরার মূল্যটা এঁরা জীবন বিসর্জন দিয়ে চুকিয়ে দেবেন, কিন্তু তাই বলে যুধিষ্ঠিরকে এঁরা কখনও শত্রুভাবে দেখবেন না– রাজপিণ্ড-ভয়াদেতে যদি হাস্যন্তি জীবিতম। মাঝখান দিয়ে ফলটা কী হবে– যুদ্ধ লাগবে। একদিকে ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ-কর্ণেরা যুদ্ধের উত্তেজনায় যুদ্ধ করবেন, অন্যদিকে ভীম-অর্জুন-ধৃষ্টদ্যুম্নেরাও মরিয়া হয়ে লড়াই করবে– মাঝখান দিয়ে দুই পক্ষেরই অসংখ্য নিরীহ সৈন্য এবং মিত্র রাজারা মারা পড়বেন। বিপুল রক্তক্ষয় হবে। তাই বলছিলাম বাছা তুমি নিজের ক্রোধের মান রাখতে গিয়ে এত রক্তক্ষয় হতে দিয়ো না, তোমার জন্য যেন পৃথিবীটা বীরশূন্যা না হয়– এষা হি পৃথিবী কৃৎস্না মা গমৎকৃতে ক্ষয়ম। তুমি আর লোভ কোরো না বাছা। তুমি শান্ত হও।
হিতৈষিণী জননীর রাজনৈতিক প্রবচন, ব্যক্তিগত অনুরোধ এতটুকুও শুনলেন না দুর্যোধন তত্ত্ব বাক্যমনাদৃত্য সোহবন্মতৃভাষিতাম– তিনি একবারও মায়ের দিকে না তাকিয়ে তাকে অগ্রাহ্য করে সভা ছেড়ে চলে গেলেন শকুনির কাছে। ধৃতরাষ্ট্র চেয়েছিলেন– শান্তির প্রস্তাবে নিযুক্ত কৃষ্ণ পাণ্ডবদের কাছে ফেরার আগেই যাতে একটা সমাধান হয়ে যায়; তার শেষ অস্ত্র ছিলেন ধর্মদর্শিনী গান্ধারী। কিন্তু তিনিও নিষ্ফল হলেন এবং নিষ্ফল হবেন– সে-কথা তিনি বোধহয় জানতেনও। যত কথা তিনি দুর্যোধনকে বলেছিলেন এবং তার যতটুকু আমরা লিপিবদ্ধ করলাম, গান্ধারী তার চাইতেও বেশি কিছু বলেছিলেন হয়তো। তার প্রমাণ আছে কৃষ্ণের কথায়। তিনি হস্তিনাপুর থেকে উপপ্লব্যে ফিরে যুধিষ্ঠিরকে আনুপূর্বিক সব ঘটনা বলেছিলেন। কুরুসভায় শান্তির প্রস্তাবে ধৃতরাষ্ট্র কী বলেছিলেন, ভীষ্মদ্রোণ কী বলেছিলেন, কৃপ অথবা স্বয়ং দুর্যোধনই বা কী বলেছিলেন– এই সমস্ত খবর দেবার সময় কৃষ্ণ গান্ধারীর কথাও বলেছেন। কৃষ্ণের জবানি থেকে যা বোঝা যায়। তাতে গান্ধারী বেশ কড়া কথাই বলেছিলেন দুর্যোধনকে। এত কড়া কথা বলার পিছনে শুধু গান্ধারীর ধর্মবোধই নয়, কৃষ্ণ মনে করেন যে, গান্ধারী এখন পুত্রের কারণে সবংশে ধ্বংস হবার ভয় পাচ্ছেন– ধর্মার্থযুক্তং কুলনাশভীতা/ রাজ্ঞাং সমক্ষং সুতমাহ কোপাৎ। কৃষ্ণের কথা থেকে আরও বোঝা যাচ্ছে– গান্ধারী শুধুমাত্র ধৃতরাষ্ট্র বা বিদুরের সামনেই দুর্যোধনকে তিরস্কার করেননি, তিনি সভায় উপস্থিত সকলের সামনে সকলকে সাক্ষী মেনে নিজের ছেলের দোষ সোচ্চারে বলেছেন। হয়তো এতেই তার হৃদয়ের ভার কিছু লাঘব হয়েছে।
মহাভারত যতটুকু বুঝি– তাতে ‘সিকোয়েন্সটা উলটো সাজানো আছে সেখানে। আমাদের ধারণা– সকলে রাজসভার মধ্যে যখন দুর্যোধনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, তখন গান্ধারীও ছিলেন সেখানে অন্যতমা বক্তা হিসেবে। পরে দুর্যোধন সভা ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর আবারও ধৃতরাষ্ট্র তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন গান্ধারীর মাধ্যমে তাকে একান্তে বোঝানোর জন্য। সেটাও বিফলে গেছে। কিন্তু বিফলে যতই যাক, কৃষ্ণের জবানিতে গান্ধারীর বক্তব্য এতটাই আন্তরিক যাতে বোঝা যায়। আজ তিনি স্বামী-পুত্রের অন্যায়ের দায় নিয়ে চুপ করে থাকছেন না, বরঞ্চ সবাইকে সাক্ষী মেনে নিজের এতকালের চুপ করে থাকার দায় মোচন করছেন যেন। কৃষ্ণ যেমনটি দেখে এসে বলছেন, তাতে গান্ধারীর উপস্থাপনা রীতিমতো নাটকীয়, তবে সেটা অভিনয় নয়। প্রাণ, ধর্ম এবং চেতনার দায়ে তার সত্য উচ্চারণ।
দুর্যোধনকে গান্ধারী বলেছিলেন যে সব রাজা, রাজপ্রতিম মানুষেরা বসে আছেন এই সভায়, আর যাঁরা ব্রহ্মর্ষি এবং অন্যান্য সভাসদজনেরা তারা সবাই শুনুন, তাদের সামনেই দুর্যোধন, তোমার অন্যায়-অপরাধের কথা বলছি। তুমিই অত্যন্ত পাপী বলেই তোমার নিজস্ব মন্ত্রী-অমাত্যের পাপের কথাও একই সঙ্গে আমায় বলতে হচ্ছে– শৃন্বন্তু বক্ষ্যামি তবাপরাধং/ পাপস্য সামাত্য-পরিচ্ছদস্য। মনে রেখো দুর্যোধন! এই রাজ্যে রাজা হবার ব্যাপারে আমরা কুল-পরম্পরা মানি, এখানে পিতৃ-পিতামহক্রমে পর-পর রাজা হন– রাজ্যং কুরূণামনুপূর্বভোজ্যং/ ক্রমাগতো নঃ কুলধর্ম এষঃ। তুমি অত্যন্ত নৃশংস এবং অসভ্য বলেই নিজে রাজ্যের অধিকারী না হয়েও নিজের দুর্নীতিতে সমস্ত কুরুরাজ্যটাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে এসেছ। তুমি রাজা হলেটা কী করে? ধৃতরাষ্ট্রের মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তি এবং বিদুরের মতো দীর্ঘদর্শী ব্যক্তি যেখানে এই কুরুরাজ্যের পরিচালনায় রয়েছেন, সেখানে তাদের অতিক্রম করে তুই এখানকার রাজত্ব চাইছিস কী করে–এতাবতিক্রম্য কথং নৃপং/ দুর্যোধন প্রার্থয়সেহদ্য মোহাৎ।
হয়তো এই কথাটার মধ্যে একটু কৌশলও আছে। গান্ধারী যে তার স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যলোভের কথা জানেন না, তা নয়। বস্তুত তার লোভের কারণেই আজ দুর্যোধন এত পুষ্ট হয়েছেন, তাও তিনি ভাল করে বোঝেন। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে ধৃতরাষ্ট্র যখন পুত্রের সদর্প ঘোষণায় ব্যতিব্যস্ত, তখন সাময়িক শব্দপ্রচারে ধৃতরাষ্ট্রকেই অন্তত শ্রেয় বিকল্প হিসেবে অহংকারী পুত্রের সামনে উপস্থিত করতে চাইছেন গান্ধারী। তিনি বোঝাতে চাইছেন– হস্তিনাপুরের রাজপরম্পরা এমনই তাতে দুর্যোধনের রাজ্য পাবার কথাই নয়, তিনি বলেছেন– পিতামহ ভীষ্ম রাজা হননি, কিন্তু যদি হতেন তা হলে ধৃতরাষ্ট্র এবং বিদুর তার অধীন হয়েই রাজ্যপরিচালনায় আনুকুল্য করতেন মাত্র। কিন্তু তিনি রাজা হননি বলেই রাজ্য পেয়েছিলেন পাণ্ডু। নিয়ম অনুসারে পাণ্ডুর মৃত্যুর পর সমগ্র রাজ্যটাই তার ছেলেদের পাবার কথা, এবং পাণ্ডবদের পরে তাদেরই পুত্র-পৌত্রেরা– এই রাজ্য পাবে- এটাই সোজা হিসেব রাজ্য ততেন্নিখিলং পাণ্ডবানাং/ পৈতামহং পুত্র-পৌত্রানুগামি।
এই মুহূর্তেই আমরা বুঝতে পারি– গান্ধারী তার পুত্রের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রকেও একহাত নিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর স্বামীই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি দুর্যোধনের জন্ম হওয়ামাত্রই রাজসভার অধিবেশন ডেকে সভাসদদের সামনে এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন– আচ্ছা! বংশের নিয়মে যুধিষ্ঠির জ্যেষ্ঠ, জ্যেষ্ঠপুত্র রাজা হবেন, এটা ঠিক আছে কিন্তু তার পরে কে রাজা হবেন, দুর্যোধন হবেন কি অয়ং তু অনন্তরং তস্মাদপি রাজা ভবিষ্যতি? লক্ষণীয়, সবে তাঁর ছেলে হয়েছে, যুধিষ্ঠির তখনও ভাইদের সঙ্গে হস্তিনায় আসেননি, এমনকী পাণ্ডুও তখনও মারা যাননি, সেই অবস্থায় ধৃতরাষ্ট্র যেভাবে পুত্রের রাজা হবার কথা ভাবছেন, তার মধ্যে যুধিষ্ঠিরের মৃত্যু-চিন্তাই বেশি করে ধরা পড়ে। অর্থাৎ যুধিষ্ঠির মারা গেলেই দুর্যোধন রাজা হবেন কি? গান্ধারী জানেন- ধৃতরাষ্ট্রের এই লোভই তার পুত্রের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে বলে যুধিষ্ঠিরের এত যাতনা, তাঁকে আজ বনে-বনে ঘুরতে হচ্ছে শুধু মৃত্যু হয়নি বলে। এমনকী ধৃতরাষ্ট্রের ভাবনা তার পুত্রের মুখেও শব্দরূপ লাভ করেছে। এক সময় দুর্যোধনও ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন– অন্ধতার জন্য তুমি রাজা হতে পারোনি বলে তোমার বংশের ছেলে, নাতি কেউই আর রাজা হবে না, এইরকমই চলবে পরম্পরা।
ধৃতরাষ্ট্র এই দুরাশার ফাঁদে পড়েছিলেন তার কারণ– তার নিজের মধ্যেও রাজ্যলোভ ছিল। গান্ধারী কিন্তু এ ব্যাপারে নীতি এবং নিয়মের সপক্ষে। তিনি বলতে চান– পরম্পরা যদি পাণ্ডবদের রাজা বানায়, তবে তাই হবে। সেখানে তোমার এত জ্বলে যাবার কারণই নেই। কেননা রাজ্য তোমার পাবারই কথা নয়। গান্ধারী সবার ওপরে মনে রেখেছেন– ভীষ্মের মর্যাদা। তিনি রাজ্য নেননি এবং শতবার সুযোগ আসা সত্ত্বেও রাজ্য গ্রহণ করেননি। তার মর্যাদা তো কুরুরাজ্যে কম নেই। আর সেই মানুষটাও যখন শুধু পাণ্ডবদের রাজ্যাংশমাত্র ফিরিয়ে দিতে বলছেন, তখন সেই মত তো মানতে হবে। মানতে হবে ধৃতরাষ্ট্রের কথাও। তিনি আগে যাই বলে থাকুন, এখন তিনি ন্যায় উচ্চারণ করছেন। সত্যি কথা বলতে কি, গান্ধারী কথা বলার পর ধৃতরাষ্ট্রও দুর্যোধনকে একই কথা বলেছেন, অন্তত কৃষ্ণের জবানিতে আমরা তাই শুনতে পাচ্ছি। যদিও দুর্যোধন কারও কথাই শোনেননি। তিনি সভা ছেড়ে চলে গেছেন এবং পরের দিন সকালবেলাতেই সৈন্য সাজাতে চলে গেছেন।
.
০৬.
যুদ্ধের দামামা-তুরী-ভেরী বেজে উঠল চারদিকে, যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। ষোলো-সতেরো দিন তুমুল যুদ্ধ, হাতি-ঘোড়া-রথধ্বনির মধ্যে গান্ধারীর কোনও খবরই পাই না আমরা। শুধু যুদ্ধের খবর পাই, এমনকী ধৃতরাষ্ট্রের খবরও পাই, কিন্তু গান্ধারীর খবর পাই-ই না প্রায়। সেই যখন ভীষ্মের সেনাপতিত্ব চলছে, যুদ্ধের আট-দিনের দিন সাত-আটটি ছেলে মারা গেল ধৃতরাষ্ট্রের। দিব্যদর্শী সঞ্জয়ের তথ্যভাষণে যুদ্ধের বর্ণনাচিত্র যখন এইরকম মর্মস্পর্শী এই ভীম আপনার অমুক ছেলের মাথাটি নামিয়ে দিল ধড় থেকে পরাজিতস্য ভীমেন নিপপাত শিরো মহীম– তখন গান্ধারী কোথায় বসে থাকতেন? অন্তঃপুরে? আমাদের তা মনে হয় না। সঞ্জয়ের মুখে ওই বিচিত্র যুদ্ধবর্ণনা পরম কৌতূহলে গান্ধারীও নিশ্চয়ই শুনেছেন ধৃতরাষ্ট্রের পাশে বসে, কুরুবাড়ির অন্যান্য বউরাও তার পার্শ্ববাসিনী হয়েছিলেন বলেই আমাদের ধারণা। কথাটা প্রমাণ করাও যাবে।
যুদ্ধের আটদিনের মাথায় যে ছেলেগুলি মারা পড়ল, তাতে ধৃতরাষ্ট্রকে ভবিষ্যতের আশঙ্কায় শঙ্কিত হতে দেখেছি। এমনকী দুর্যোধনের নিন্দায় মুখরও হতে দেখেছি। তিনি এমনও বলেছেন– সব বিপদ এই দুর্যোধনের জন্য, আমি এত করে বললাম, ভীষ্ম, বিদুর, এমনকী গান্ধারী পর্যন্ত ওর ভালর জন্য এত করে বলল, কিন্তু বদমাশ! কিছুতেই শুনল না– গান্ধাৰ্যা চৈব দুর্মেধাঃ সততং হিতকাম্যয়া। সঞ্জয় এ সব কথা শুনে দুর্যোধনকে নয়, দোষ দিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রকেই যিনি পাশাখেলায় ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। আমাদের বিশ্বাস তখনও গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের পাশেই ছিলেন, কিন্তু তার আত্মশক্তি অনেক বেশি বলেই পুত্রদের মৃত্যুতে মুহ্যমান হননি। কিন্তু সমস্ত ঘটনার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল কর্ণের মৃত্যুর পর।
কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে দুর্যোধন ভীষ্ম-দ্রোণকে তেমন বিশ্বাস করেননি। তিনি বুঝতেন যে, এরা সর্বশক্তি দিয়ে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন না। কিন্তু কর্ণ: কর্ণের ভরসাতেই তো দুর্যোধন যুদ্ধ করতে নেমেছিলেন। কিন্তু আজ কর্ণ যখন মারা গেলেন, তখন দুর্যোধনের মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, তার মধ্যে নাই বা গেলাম, কিন্তু কর্ণের মৃত্যুসংবাদ পাবার পর ধৃতরাষ্ট্রকে আমরা অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখছি এবং দেখছি– গান্ধারীও কর্ণের মৃত্যুসংবাদ সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেছেন– তথা যা পতিতা দেবী গান্ধারী দীর্ঘদর্শিনী। আমাদের বড় অবাক লাগে এইসব জায়গায়। অন্যান্য পুত্রের মৃত্যুতেও যাঁকে তেমন মুহ্যমান দেখিনি, আজ কর্ণের মৃত্যুতে তিনি এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে, তিনি সংজ্ঞাহীন ধৃতরাষ্ট্রের পাশে বসে বিলাপ করে কাঁদছেন– শুশোচ বহুলালাপৈঃ কর্ণস্য নিধনং যুধি। আর ঠিক এইখানেই আশ্চর্য লাগে। তা হলে কি ধৃতরাষ্ট্রের মতো গান্ধারীরও মনের কোণে এমন কোনও দুরাশা ছিল যে কর্ণের ক্ষমতায় দুর্যোধন শেষ পর্যন্ত জিতবেন! আসলে ধৃতরাষ্ট্রের কথা বেশ বোঝা যায়। পাশাখেলার সময় তাকে যেমন দেখেছি, তাতে যেভাবে তিনি দুরন্ত কৌতূহলে– শকুনি জিতেছে কি, জিতেছে কি, এইভাবে উল্লসিত হয়েছিলেন, তাতে এই যুদ্ধেও যদি দুর্যোধন আস্তে আস্তে জয়ের দিকে যেতেন, তাতে ধৃতরাষ্ট্রের স্বরূপ পুনরায় উদঘাটিত হত।
কিন্তু এই ভাবনাতে আমরা গান্ধারীকে কীভাবে বিচার করব? তিনি তো পাশাখেলাও আন্তরিকভাবে চাননি, চাননি এই যুদ্ধও, তবুও একটার পর একটা ছেলে যখন ভীমের হাতে মারা যাচ্ছে, তখন একবারের তরেও তার মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, একবার অন্তত জিতুক দুর্যোধন, তাতে ছেলেরা বেঁচে থাকবে কেউ কেউ। আসলে কর্ণের মৃত্যুর আগে দুঃশাসন এবং অন্যান্য কৌরব ভাইরা অনেকেই ভীমের হাতে মারা গেছেন। কিন্তু আজ যখন কর্ণ মারা গেলেন, তখন বুঝি আর কোনও আশাই রইল না। ধৃতরাষ্ট্র যেমন বুঝলেন যে, তার ছেলে যার ভরসায় এত বড় যুদ্ধকাণ্ড বাধিয়ে দিল, সে মারা যাওয়া মানে জীবনে আর জেতার কোনও আশা নেই এবং সেই সঙ্গে এবার তার ছেলেরও সময় ঘনিয়ে আসছে। এই ভাবনা যেমন তাকে নিঃসংজ্ঞ বিচেতন করে দিল, আমাদের ধারণা– এই অনিবার্য যুদ্ধফল গান্ধারীকেও অজ্ঞান করে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠবে, তা হলে কী গান্ধারীও মনে মনে ধৃতরাষ্ট্রের মতো পুত্রের জয়াশা পোষণ করতেন, তা নইলে কর্ণের জন্য তিনি এমন হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদবেন কেন? আমরা বলব– এটা ঠিক পুত্রের জন্য জয়ৈষণা নয়, এ হল মৃত্যুর ভাবনা। প্রিয় পুত্র দিনে দিনে তিল তিল করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জানলে কোনও জননীর হৃদয়-স্থিতি স্বাভাবিক থাকে?
কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের আঠারো দিনের দিন কর্ণ মারা গেছেন, আঠারো দিনের দিন স্বয়ং ভীমের গদাঘাতে দুর্যোধনের উরুদ্বয় ভঙ্গ হল, তার আর মাটি ছেড়ে উঠবার শক্তি নেই, তিনি মৃত্যুর মুখ দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন শুয়ে শুয়ে। পাণ্ডবপক্ষে জয়ধ্বনির কোলাহল সামান্য শান্ত হতেই ধর্মমতি যুধিষ্ঠিরের মনে পড়ল গান্ধারীর কথা। তার এই রকম মনে পড়ে, বিপন্ন মুহূর্তেও এমনকী শত্রুও বিপন্ন হলে তার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, সেটা খুব মনে রাখেন যুধিষ্ঠির। সেই বনবাসকালে দ্রৌপদীকে হরণ করার দোষে ভীম যখন গান্ধারীর জামাই জয়দ্রথকে একেবারে শেষ করে দেবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে তাকে ধরবার জন্য এগোলেন, তখন যুধিষ্ঠির ভীমকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন– ভগিনী দুঃশলার কথা মনে রেখো, সে যেন বিধবা না হয়, মনে রেখো জননী গান্ধারীর কথা, তিনি যেন তার সাধের জামাইকে না হারান।
কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের এই মার্মিক ভাবনা চলেনি, কারণ সেটা মহাযুদ্ধ। কিন্তু এই মহাযুদ্ধের শেষে আজ যখন দুর্যোধন মারা গেছেন, যুধিষ্ঠিরের ভীষণভাবে মনে পড়ল জননী গান্ধারীর কথা, মনে মনে একটু ভয়ও হল– গদাযুদ্ধের নিয়ম ভেঙে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করেছেন ভীম। ধর্মদর্শিনী গান্ধারী এই অপরাধ ক্ষমা করবেন না। যুধিষ্ঠির মনে করেন– গান্ধারী এক তপস্বিনী নারী। সারা জীবন এক অপ্রকাশ ধর্মচর্যার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে চালিত করেছেন বলেই তিনি যেমন নিজের পুত্রের অন্যায়গুলি মনে মনে মেনে নেননি কখনও, তেমনি আজ অন্যপক্ষ থেকে দুর্যোধনের অন্যায় ঊরুভঙ্গ যে অধর্ম হল তাও বুঝি তিনি ক্ষমা করবেন না। যুধিষ্ঠির ভাবলেন– গান্ধারী ক্রুদ্ধ হয়ে তার তপস্যার আগুনে এই পৃথিবীটাকেই ধ্বংস করে ফেলবেন হয়তো ঘোরেণ তপসা যুক্তা ত্রৈলোক্যমপি সা দহেৎ। এমনকী যুধিষ্ঠির এই পরিস্থিতিটা সামাল দেবেন কীভাবে, সেটা ভাবতে গিয়ে নিজে গান্ধারীর মুখোমুখি হতে ভয় পেলেন।
যুধিষ্ঠির ভাবলেন– তিনি ভাইদের নিয়ে গান্ধারীর সামনে উপস্থিত হবার আগেই তার ক্রোধ শান্ত করা দরকার– গান্ধাৰ্যাঃ ক্রোধদীপ্তায়াঃ পূর্বং প্রশমনং ভবেৎ। কেননা যেভাবে ভীম দুর্যোধনকে বধ করেছেন, তাতে তীব্র পুত্রশোকের জ্বালায় আপন মানসাগ্নিতে পাণ্ডবদের তিনি ভস্মসাৎও করে দিতে পারেন, অন্তত যুধিষ্ঠিরের তাই বিশ্বাস মানসেনাগ্নিনা ক্রুদ্ধা ভস্মসান্নঃ করিষ্যতি। যুধিষ্ঠির ভয় পেয়ে কৃষ্ণের শরণ নিলেন। পাণ্ডবদের জন্য যত কষ্ট তাকে সইতে হয়েছে, সে সব স্মরণ-কৃতজ্ঞতায় উচ্চারণ করে যুধিষ্ঠির বললেন– তুমিই একমাত্র পারো এই কাজটা করতে, আমরা গেলে হবে না। গান্ধারী তার পুত্র-পৌত্রদের মৃত্যুশোকে এতটাই ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন, যে তার সামনে কেউ গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না– কশ্চ তাং ক্ৰোধতাম্ৰাক্ষীং পুত্রব্যসনকর্ষিতাম্। আমি চাই তুমি আগে সেখানে যাও, তোমার সময়োচিত শব্দমন্ত্রে তুমি তার ক্রোধ-প্রশমনের চেষ্টা কর– গান্ধাৰ্যাঃ ক্রোধদীপ্তায়াঃ প্রশমার্থমরিন্দম।
যুধিষ্ঠির গান্ধারীর ভয়ংকর ক্রোধ চোখে দেখতে পারছেন দূর থেকে। আপন ধর্মশক্তির তপস্যায় কতটা তাঁর উত্তরণ ঘটেছিল অথবা সেই তপস্যার অগ্নিবলে কতটা তিনি সকলকে ভস্ম করে দিতে পারেন, সেই অলৌকিক তর্কযুক্তিতে না গিয়ে বলা যায়– যুধিষ্ঠির এই পুত্রশোকাতুরা জননীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছেন। গান্ধারী পাণ্ডবদের অন্যায় যুদ্ধের কথা উচ্চারণ করলে তার মুখের ওপর আপনার এই ছেলে যখন আমার স্ত্রীকে ঊরুস্থান প্রদর্শন করেছিল– এই কথাটা যুধিষ্ঠির বলতে পারবেন না। কেননা কোনও চরম অপরাধের জন্যই মৃত্যুদণ্ড দেবার অধিকার মানুষের আছে কিনা, যুধিষ্ঠির সে-কথা ভাবেন বলেই এক জননীর ক্রোধ তিনি তাঁর সমদুঃখিতায় দেখতে পারেন। গান্ধারীর ক্রোধকে তিনি এতটাই সম্ভাব্য মনে করছিলেন যে, শুধু কৃষ্ণ নয়, আমার ধারণা তিনি হয়তো পিতামহ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকে উপস্থিত থাকতে বলেছেন গান্ধারীর ক্রোধ-প্রশমনের জন্য। যুধিষ্ঠিরের জবানিতে ব্যাসের কাছে এই অনুরোধ মহাভারতে স্পষ্ট উচ্চারিত হয়নি বটে, কিন্তু কৃষ্ণকে তড়িঘড়ি গান্ধারীর কাছে পাঠানোর সময় যুধিষ্ঠির তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এই অভাবনীয় পরিস্থিতিতে কৃষ্ণকে সাহায্য করার জন্য পিতামহ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসও সেখানে উপস্থিত থাকবেন– পিতামহ ভগবান কৃষ্ণস্তত্র ভবিষ্যতি।
কেন এই সতর্কতা, কেন এত দুশ্চিন্তা যুধিষ্ঠিরের? কেনই বা গান্ধারীর জন্য এত ভয়, এত আশঙ্কা? যাঁর সঙ্গে একান্ত সম্বন্ধ সেই ধৃতরাষ্ট্রকে এত ভয় পাচ্ছেন না যুধিষ্ঠির, অথচ গান্ধারী, যিনি ধৃতরাষ্ট্রের সম্বন্ধে পরম আত্মীয় হলেও দূরাগতা বধূ বটে, তাঁকে এত ভয় কেন যুধিষ্ঠিরের? বিশেষত তিনি তো ধর্মদর্শিনী, অন্যায়ের কারণে তিনি পুত্রকে নির্বাসন দিতে চেয়েছিলেন, অথচ সেই পুত্রের মৃত্যুতে তিনি এত ক্রুদ্ধ হবেন কেন? তিনি দুঃখিত, মূৰ্ছিত, আলুলায়িত হতে পারেন, কিন্তু এত ক্রুদ্ধ হবেন কেন, যাতে মানসাগ্নিতে ভস্মসাৎ করতে পারেন পাণ্ডবদের। বেশ বুঝতে পারি– এখানে একটা রহস্য আছে, যে রহস্য মহাকাব্যের কবি স্পষ্ট করে বলেন না, বলতে চান না, পাছে পরবর্তী প্রজন্ম এক মহান চরিত্রকে ভুলভাবে চিহ্নিত করে।
আসলে যিনি মহাকাব্যের কবি হন, তাঁকে সমাজ-সংসারের এমন এক বিচিত্র বিশাল পরিমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে গমনাগমন করতে হয়, যাতে করে একটি বিশাল চরিত্রের সাময়িক দোষগুলিকে তিনি অগ্রাহ্য করেন এবং অধিকাংশ গুণের মাহাত্ম্যে তার সময়োচিত স্বভাবজ প্রবৃত্তিগুলিকে কখনওই চিহ্নিত করেন না। অন্যথায় একবার ভাবুন, যে গান্ধারী পুত্রের বিসর্জন-ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন, যে গান্ধারী প্রবল ধর্মভাবনায় পুত্রের সমস্ত অন্যায় উচ্চারণ করে তাঁকে শাসন করার চেষ্টা করেছেন এবং যে গান্ধারী পাণ্ডবদের প্রতি সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবিধান চেয়েছিলেন, সেই গান্ধারী পুত্রের মৃত্যুতে যতখানি শোকগ্রস্ত হচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং সে ক্রোধ এতটাই যে যুধিষ্ঠিরের মতো মানুষও তাতে ভয় পাচ্ছেন– তাতেই বুঝি রহস্যটা খুব গভীরে, যা মহাভারতের কবি গান্ধারীর অসামান্য চরিত্রের নিরিখে বলতে চান না।
যা বলতে চান না, সেটা শুনলে আমাদেরও ভাল লাগবে না, কিন্তু তর্কযুক্তিতে মহাভারতের অনুচ্চার শব্দধ্বনি ঠিক বোঝা যায়। ভাল না লাগলেও তা সত্যি। আসল কথা হল– পুত্রের ব্যাপারে এবং তার স্বভাবের ব্যাপারে যতই অসন্তোষ থাক গান্ধারীর, তবু স্নেহ অতি বিষম বস্তু। ধর্ম, ধর্ম এবং ধর্মের ব্যাপারেই গান্ধারীর যত প্রবণতা, যত মাহাত্ম চিহ্নিত হোক, তবু অনুপম যে মাতৃস্নেহ, তাতে কুপুত্রের প্রতি শত ধিক্কার সত্ত্বেও তার মমতার শেষ প্রশ্রয়টুকু থেকেই গেছে দুর্যোধনের প্রতি। স্বামীর অপত্যস্নেহে তিনি বারংবার লজ্জিত হয়েছেন, বারবার সাবধান করেছেন, কিন্তু নিজে একবারও কিন্তু বলেননি– তুমি যা করছ করো, আমি পুত্রের মুখদর্শন করতে চাই না। তার মানে কিন্তু এই দাঁড়ায়– পুত্রের অন্যায়গুলি তিনি মেনে নিতে পারছেন না বটে, কিন্তু সে সর্বথা বঞ্চিত হোক, তার মৃত্যু ঘটুক, এটা তিনি মনে মনে চান না, কোনও জননী বা তা চান, এবং এখানে তিনি সাধারণ কুপুত্রের মাতার চেয়ে অধিক নন কিছু।
যুধিষ্ঠির ভয় পাচ্ছেন– অন্যায় যুদ্ধে দুর্যোধনকে মৃত্যুসীমায় নিয়ে যাবার কারণে গান্ধারী ক্রুদ্ধা হবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে পাণ্ডবদের ওপর যত অন্যায় করেছেন দুর্যোধন, বিশেষত পাণ্ডব-কুলবধূর ওপর, সেই সব পুত্ৰকৃত অপমান স্মরণ করলে গান্ধারীর ক্রুদ্ধ হবার এতটুকু কারণও থাকত না, কেননা সে সব অন্যায়ের কথা গান্ধারী নিজমুখেই বলেছেন এক সময়। ঠিক এই নিরিখে দেখতে গেলে এই মুহূর্তে তার ক্ৰোধতাম্র আচরণ গান্ধারীর চিরচিহ্নিত ধর্মবোধকে খণ্ডিত করে, সেই ধর্মভাবনা যেন ধর্মধ্বজিতায় পরিণত হয়। তবু তাঁকে আমরা ধর্মধ্বজি বলতে পারি না, কেননা মহাভারতের কবি তার প্রখর বাস্তববোধে তথা কবিজনোচিত বেদনাবোধে এ-কথা বোঝেন যে, মাতৃস্নেহের ধর্ম সদসদবিবেকের নিষ্কারণ ধর্মবোধকে অতিক্রম করে এবং মানুষ বলেই তা করে হয়তো। আর ঠিক সেই কারণেই তিনি এই কঠিন সময়ে উপস্থিত আছেন গান্ধারীর পাশে, যাতে তার পুত্রবধু এই ভীষণ ধর্মসংকটে শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হন। এমন যেন না হয় যে, গান্ধারী যে স্বাভাবিক ঈর্ষাবশে তাড়িত হয়ে কুন্তীর পূর্বে পুত্র লাভ করার জন্য আপন গর্ভে আঘাত করেছিলেন, আজকে সেই ঈর্ষা, সেই ক্রোধে তিনি চিরকালের জন্য চিহ্নিত হয়ে না যান।
বস্তুত ধৃতরাষ্ট্রের মতো স্পষ্ট করে না হলেও গান্ধারীও চাইতেন না যে, তাঁর পুত্র সর্বথা রাজ্যভাগ থেকে বঞ্চিত হোক। যদি রাজ্যের ব্যাপারে কোনও ক্ষীণ অভিলাষও তার না থাকত, তা হলে তিনি গর্ভে আঘাত করে কুন্তীর পূর্বে পুত্র চাইতেন না। আর সমস্ত জীবন ধরে পাণ্ডবরা তার পুত্রের দ্বারা অত্যাচারিত হোক– এটা না চাইলেও দুর্যোধন মহাযুদ্ধে হেরে যান অথবা তার মৃত্যু হোক– এমনটাও তার ঈপ্সিত ছিল না। তেমনটা হলে কর্ণের মৃত্যুর পর তিনি হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসতেন না এবং দুর্যোধনের মৃত্যুর পরেও তিনি এত ক্রোধ-তাড়িত হতেন না। ব্যাস তার পুত্রবধূকে চেনেন বলেই গর্ভে আঘাত করার পরে পরেই তিনি যেমন তার কাছে এসেছিলেন, আজকে তিনি সেই দেরিটুকুও করেননি, আজ তিনি প্রথম থেকেই গান্ধারীর পাশে পাশে আছেন, হয়তো বা যুধিষ্ঠিরের আশঙ্কা জেনেই।
কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কথায় হস্তিনাপুরে উপস্থিত হয়েছেন ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীর সামনে। ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি পূর্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি। এবং সেগুলি বলে-বলেই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, অন্যায়ী দুর্যোধনের এমন একটা শাস্তি একেবারে প্রাপ্যই ছিল। গান্ধারীকে সান্ত্বনা দেবার সময় কৃষ্ণের শব্দকৌশল আরও সুচতুর, আরও সূক্ষ্ম। কৃষ্ণ বললেন– এখনকার সময়ে আপনার মতো বিশিষ্ট নারী আর একটিও নেই– ত্বৎসমা নাস্তি লোকেহস্মিন্নদ্য সীমন্তিনী শুভে। আপনার তো মনেও থাকবে– আমি যখন শান্তির প্রস্তাব নিয়ে কুরুসভায় এসেছিলাম, তখন উভয় পক্ষের লোকেরাই অনেক হিতের কথা, ভাল ভাল কথা বলেছিলেন, কিন্তু আপনার ছেলেরা কেউ সে সব কথা শোনেননি– উক্তবত্যসি কল্যাণি ন চ তে তনয়ৈঃ কৃতম। তারপর আমার সামনেই সেই ঘটনাটা ঘটল। আপনি আমার সামনেই দুর্যোধনকে যথেষ্ট কড়া কথা বলেছিলেন– দুর্যোধনস্থয়া চোক্তো জয়ার্থী পরুষং বচঃ। আপনি দুর্যোধনকে বলেছিলেন– ওরে মূর্খ। আমার কথা শোন– ধর্ম যেখানে জয়ও সেখানে। দেখুন আজকে আপনার সেই কথাটা ফলেছে। আপনি যদি এই ধর্মের ব্যাপারটাই খেয়াল রাখেন, তা হলে সত্যিই আপনার দুঃখ করার কিছু নেই, আর পাণ্ডবদেরও আপনি প্রতিপক্ষ ভেবে নেবেন না, তাদের কোনও ক্ষতি হোক– এই চিন্তাও আপনি মাথায় রাখবেন না– পাণ্ডবানাং বিনাশায় মা তে বুদ্ধিঃ কদাচন। আমি জানি, আপনি আপনার মানসিক শক্তিতে, তপস্যার শক্তিতে এই পৃথিবীকেও দগ্ধ করতে পারেন– চক্ষুষা ক্রোধদীপ্তেন নিদগ্ধং তপসা বলাৎ।
কৃষ্ণ বাগ্মী বটে, চতুর বক্তাও বটে। গান্ধারীর কথা দিয়েই গান্ধারীকে স্তব্ধ করে দিলেন কৃষ্ণ। দুর্যোধনের মৃত্যুতে যে ভয়ংকর ক্রোধ তার মধ্যে জমা হয়ে উঠেছিল, কৃষ্ণের মধুর চতুর উক্তিতে তা প্রকাশ করতে পারলেন না গান্ধারী। শুধু বললেন– আমার মনের ব্যথা আমার বুদ্ধি বিচলিত করে দিয়েছিল– আধির্ভি-হ্যমানায়া মতিঃ সঞ্চালিতা মম– কিন্তু কৃষ্ণ! তোমার কথা শুনে আমার বুদ্ধি এখন অনেকটাই স্থির হয়েছে। আমি জানি তুমি আছ, পাণ্ডবভাইরা সকলে আছে– এখন তো তোমরাই এই পুত্রহীন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র অবলম্বন- ত্বং গতিঃ সহিতৈীরৈঃ… হতপুত্রস্য কেশব। এই কথাটার মধ্যে গান্ধারীর হতাশা, অসহায়তা যত আছে, তার চেয়ে বেশি আছে সেই ক্রোধ, যা কৃষ্ণের বাক্যচাতুরিতে প্রকাশিত হতে পারল না। যিনি এই এতদিন পুত্র দুর্যোধনের অভিমান-মঞ্চের আশেপাশে থেকে শান্তি না পেলেও আঁচটুকু পুইয়েছেন, যিনি শত পুত্রের বিশ্বস্ততায় কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, একদিন তার একটি পুত্রও বেঁচে থাকবে না, সেইসব গভীর বিশ্বাস আজ লুপ্ত হয়ে গেছে, আজ তাঁকে নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের ওপর যারা তাকে পুত্রহীনা বলে মায়া করবেন, করুণা করবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে মনস্থও করবেন যে– প্রিয় পুত্রদের অহংকারের প্রতিফল পাচ্ছে আজ বুড়ো-বুড়ি। গান্ধারী এই যাতনা বুঝতে পারছেন, তাই কৃষ্ণের কথা বুঝে নিয়েও মুখখানিতে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন কৃষ্ণের সামনে পুত্রশোকাভিসন্তপ্তা… মুখং প্রচ্ছদ্য বাসস।
কৃষ্ণ গান্ধারীকে কোনওমতে সামাল দিয়ে চলে গেলেন তাড়াতাড়ি। কেননা অশ্বত্থামার পাণ্ডববংশ-ধ্বংসের ভাবনা গুপ্তচরদের মুখে খবর হয়ে এসেছিল কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণ চলে গেলেন এবং সেই রাত্রে পাণ্ডবদের ছেলেরা, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী– সকলেই মারা পড়লেন অশ্বত্থামার হাতে। শেষ সকালে মারা গেলেন স্বয়ং দুর্যোধনও। ধৃতরাষ্ট্রের মাথায় পুত্রশোকের বজ্রপাত নেমে এল। একটা সময় পিতা দ্বৈপায়ন ব্যাসের উপদেশে যখন তিনি শান্ত হলেন, তখন সঞ্জয়কে দিয়ে রথ, শিবিকা ইত্যাদি বাহনের ব্যবস্থা করে বিদুরকে আদেশ দিলেন– তুমি গান্ধারীকে, ভরতবংশীয় সমস্ত বিধবাদের এবং কুন্তীকে শিগগির আমার কাছে নিয়ে এসো। বিদুরের প্রয়োজন হল না অবশ্য। পুত্রশোকে আকুল হলেও গান্ধারী কুরুকুলের বিধবা বন্ধুদের সঙ্গে কুন্তীকেও নিয়ে এলেন– সহ কুন্ত্যা যতো রাজা সহ স্ত্রীভিরুপাদ্রবৎ।
ঘটনাটা তেমন গুরুত্ব দিয়ে বললেন না মহাভারতের কবি, তবে আমরা যারা দূর থেকে মহাভারতের বিচিত্র ঘটনাগুলো লক্ষ করছি, তাদের কিন্তু বেশ চোখে পড়ে যে, অনেককাল পরে এই প্রথম গান্ধারী কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এলেন। বড় কঠিন শোকের সময় এখন এবং পাণ্ডব-জননী কুন্তী এখন জয়স্থানে আছেন। মহাকাব্যের কবি এ সব তুচ্ছ ঘটনা খেয়াল করেন না, ফলে এতদিন যার কাছে একবারও যাননি সেই কুন্তীকে। সঙ্গে করে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যেতে কেমন লাগছিল গান্ধারীর– সে সব কথা এতটুকুও বলেননি মহাভারতের কবি। তিনি সংবেদনশীল মানুষ, এক-একটা চরিত্রের অধিকাংশ গুণের চিহ্ন আঁকাটাই তার কাজ। তিনি তুচ্ছ কথা মনে রাখেন না। এই তো দেখছি– ধৃতরাষ্ট্র তাঁর বিলাপিনী কুলবধূদের নিয়ে, গান্ধারী-কুন্তী সবাইকে নিয়ে হস্তিনার নগর ছেড়ে বেরলেন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। পথে দেখা হল কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মার সঙ্গে, যাঁরা পাণ্ডবদের সন্তানবীজ ধ্বংস করে পালিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। আশ্চর্য লাগে এই সময় কুরুকুলের অন্যতম গুরু কৃপাচার্য ধৃতরাষ্ট্রকে যত আবেগময়ী ভাষায় সংবাদ দিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি আবেগ প্রকাশ করে কৃপাচার্য গান্ধারীকে তার পুত্রের মৃত্যুর খবর দিয়ে শাস্ত্রীয় সান্ত্বনা দিলেন। কিন্তু তারপরে যেটা কৃপাচার্য বললেন, সেটা আমাদের কাছে পরম আশ্চর্যের।
কৃপাচার্য বললেন– ভীম অন্যায়ভাবে আপনার ছেলেকে মেরেছে শুনে আমরা রাত্রের অন্ধকারে পাণ্ডব-শিবিরে ঢুকে ধুন্ধুমার কাণ্ড করে এসেছি– আমরা দ্রুপদের ছেলেগুলোকে মেরেছি, দ্রৌপদীর ছেলেগুলোকেও মেরে ফেলেছি– দ্রুপদস্যাত্মজাশ্চৈব দ্রৌপদেয়াশ্চ পাতিতাঃ। আপনার ছেলের শত্রুদের এইভাবে বিনাশ করে এসেছি বলে তারা এখন আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমাদের আর এখানে থাকা চলবে না, আপনি আমাদের অনুমতি করুন, আমরা যাই– অনুজানীহি নো রাজ্ঞি… সংস্থাতুং নোৎসহামহে। তিন জনে তিন দিকে চলে গেলেন বটে, কিন্তু কৃপাচার্য গান্ধারীকে যে খবরগুলি দিলেন, এই প্রতিহিংসার সংবাদ গান্ধারীর কাছে প্রিয় সংবাদ কিনা, সেটা আমাদের বোঝার উপায় নেই। ভীমের অন্যায় আঘাতে পুত্রের মৃত্যু হয়েছে শুনে যিনি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তিনি কি নিদ্রিত অবস্থায় দ্রৌপদীর পুত্র-বিনাশনের সংবাদ পেয়ে খুশি হলেন? খুশি হলেন কিনা জানা নেই আমাদের, মহাভারতের কবি মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন এই সময়ে, অথচ এটাও তো অনুমানের বিষয় যে, গান্ধারী খুশি হবেন বলেই কৃপাচার্যের এমনতর সংবাদের অবতারণা। অন্যায় হিংসার উত্তরে অন্যায় এই প্রতিহিংসার কথা শুনে গান্ধারী ভালমন্দ কিছুই বললেন না। এও তো বড় আশ্চর্য। আপন অন্তরস্থিত ধর্মবোধে এই মুহূর্তে খুশি হওয়া সাজে না বলেই হয়তো তিনি খুশি হননি, আবার সেই অন্তরস্থিত পুত্রহত্যার প্রতিশোধবৃত্তিও বাইরে প্রকাশ করাটা একান্ত অশোভন বলে তিনি খুশি দেখালেন না এতটুকু। গান্ধারী নিরুত্তরা কেন এত– আমরা তার প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারি না। নাকি সংবেদনশীল মহাকবি তা বুঝতে দিতে চান না।
কৃষ্ণ একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। ধৃতরাষ্ট্র ঠান্ডা মাথায় ভীমকে পিষে মারতে চেয়েছিলেন, কৃষ্ণের কৌশলে পারেননি। কৃষ্ণ তখন বলেছিলেন– আপনি বুদ্ধিমান মানুষ হওয়া সত্ত্বেও নিজেই অন্যায় করে এখন আবার ক্রোধ করছেন। আপনি আমাদের কারও কথা না শুনে দুর্যোধনের কথায় যুদ্ধে নেমেছেন, আপনি স্বাধীন ছিলেন না, দুর্যোধনের কথায় আপনি ওঠা-বসা করেছেন রাজংস্কং হ্যবিধেয়াত্মা দুর্যোধন বশে স্থিতঃ– অথচ এখন ভীমকে মারার কথা ভাবছেন। কথাটা গান্ধারীর সম্বন্ধে খাটে না আবার খাটেও। ধৃতরাষ্ট্র সরল মানুষ, তার ক্রোধ প্রকট, ক্রোধের উপশমও ততোধিক প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু গান্ধারীর সমস্ত আচার-ব্যবহার এতই উদাসীন এবং অনুচ্চারিত যে, তার ক্রোধটুকু তার ধর্মপ্রাণতার আড়াল থেকে পৃথক করা কঠিন হয়ে পড়ে। ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিত হয়েই যুধিষ্ঠির-ভীমেরা সব গান্ধারীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন এবং গান্ধারীর মনের অবস্থা তখন এইরকম যে, তিনি যুধিষ্ঠিরকেই অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন।
দ্বৈপায়ন ব্যাস এ-কথা পূর্বেই অনুমান করেছিলেন বোধহয়। আমরা দেখেছি- তিনিই বোধহয় এই পুত্রবধূটিকে সর্বাধিক চেনেন। গঙ্গায় স্নান করে ওঠার পরেই তার মনে হয়েছে বিপত্তি ঘটতে পারে পাণ্ডবদের। তিনি ত্বরায় এসে গান্ধারীর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন– এটা কিন্তু অভিশাপ দেবার সময় নয়, গান্ধারী। এটা এখন ক্ষমা করার সময় শাপকালম্ অবাক্ষিপ্য ক্ষমাকালমুদীরয়ন– অতএব গান্ধারী তুমি পাণ্ডবদের ওপর ক্রোধ কোরো না। এবারে একটা অসাধারণ যুক্তি দিয়েছেন দ্বৈপায়ন ব্যাস, যেখানে যুদ্ধের সময় আঠারো দিন ধরে গান্ধারী কীভাবে মানসিক লড়াই করেছেন পুত্রের সঙ্গেই এবং বলা ভাল, পাণ্ডবপক্ষেই, আর ঠিক এইখানেই ধরা পড়ে, কীভাবে সমস্ত খণ্ডিত ক্ষুদ্র বৃত্তিগুলিকে অতিক্রম করে গান্ধারী এক পরম উত্তরণের পথে যান। বুঝতে পারি, কেন দ্বৈপায়ন ব্যাস তুচ্ছ ঘটনাগুলি স্পষ্ট করে বলেন না– অধর্মের বিরুদ্ধে যখন অন্তর্গত ধর্মের লড়াই চলে, তখন তুচ্ছ ক্ষুদ্র ঘটনাগুলিকে কবিজনোচিত সংবেদনশীলতায় এড়িয়ে যেতেই হয়, নইলে শেষ পর্যন্ত গান্ধারীকে বোঝা যায় না।
গান্ধারী যখন পুত্রশোকে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছেন না, তখনই এই ক্রোধের উদ্গম, তিনি যুধিষ্ঠিরকে পর্যন্ত অভিশাপ দিতে উদ্যত। ব্যাস বলছেন– পাণ্ডবদের ওপর তুমি ক্রোধ কোরো না গান্ধারী! তোমার কি মনে পড়ে– যুদ্ধের এই আঠারো দিন গেছে, প্রত্যেক দিন যুদ্ধযাত্রার কালে দুর্যোধন তোমার কাছে এসে বলত– আমি যুদ্ধে যাচ্ছি, মা! আশীর্বাদ করো– আমার যেন মঙ্গল হয়– শিবমাশংস মে মাতযুধ্যমানস্য শত্ৰুভিঃ। তুমি কিন্তু তখন একদিনও সেই ব্যক্তিগত উচ্চারণ করোনি, বলোনি–যাও বীর, জয়যাত্রায় যাও, তোমার জয় হোক। প্রতিদিন পুত্রের জয়ৈষণার উত্তরে তুমি বলেছ– যাও পুত্র, যেদিকে ধর্ম আছে, সেই দিকেই জয় হবে– উক্তবত্যসি কল্যাণি যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ। ব্যাস আরও বলেছেন– তুমি তো কোনওদিন মিথ্যা বলোনি, চিরকাল সত্য কথা বলেছ, অতএব পুত্র দুর্যোধনের জয়কামনার উত্তরে তুমি নিশ্চয়ই মনে একরকম, মুখে আর এক রকম কথা বলোনি, তুমি ধর্মেরই জয় চেয়েছ–ন চাপ্যতীতাং গান্ধারি বাচং তে বিতথামহম।
আমরা অন্যত্র জানিয়েছি আমাদের মহাকাব্যের কবি এমন এক কবি, যিনি শুধু কবিতা লেখেন না, তিনি তার সৃষ্ট চরিত্রের জীবনে অংশগ্রহণ করেন এবং ধর্মের পথে উত্তরণ ঘটানোর জন্য তাদের সংশোধন করেন, সময়ে পাশে এসে দাঁড়ান। আজ যখন অন্যায়কারী পুত্রের শোকে গান্ধারী তার সদবৃত্তের চিত্তপথ থেকে প্রায় বিচ্যুত হতে যাচ্ছেন, সেখানে তার পরমর্ষি শ্বশুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন পুত্রবধূকে ধর্মবৃত্তের মধ্যে ফিরিয়ে আনার জন্য। ব্যাস বলেছেন– তুমি আগে যাদের ওপর ক্ষমাশীল ছিলে, এখন সেই ক্ষমা তুমি করছ না কেন– ক্ষমাশীলা পুরা ভূত্ব সাদ্য ন ক্ষমসে কণ্বম। তুমি ধর্ম এবং পূর্বের কথা স্মরণ করে তোমার পুত্রস্থানীয় পাণ্ডবদের ওপর তোমার উদগত ক্রোধ পরিত্যাগ করো– কোপং সংযচ্ছ গান্ধারী পাণ্ডবেষু তে।
ব্যাসের কথায় প্রকৃতিস্থ হলেন গান্ধারী। আসলে পুরোপুরি ধৃতরাষ্ট্রের মতো না হলেও তার হৃদয়েও সেই দ্বৈরথ খেলা করে। একদিকে কুপুত্র হওয়া সত্ত্বেও সেই বিষম পুত্রস্নেহ, অন্যদিকে ধর্ম। অন্তর্গত ধর্ম তাকে যতই স্থির রাখার চেষ্টা করুক, তবু পুত্রস্নেহ, স্বামীর প্রতি মমতা তাকে মাঝে মাঝে এক অচিন্ত্য সংকটের মধ্যে এনে ফেলে। তিনি চেষ্টা করেন, পারেন না এবং অবশেষে সাময়িকভাবে পারেন। গান্ধারী ব্যাসকে বললেন আমি পাণ্ডবদের ওপরে দোষারোপ করি না, তাদের বিনাশও চাই না। আমি জানি– পাণ্ডবরা কুন্তীর কাছে যে রকম, আমার কাছেও তো সেইরকমই, কাজেই তাদের বাঁচিয়ে রাখাটা আমারও উচিত কাজ যথৈব কুন্ত্যা কৌন্তেয়া রক্ষিতব্যাস্তথা ময়া।
এই অসামান্য বক্তব্য উচ্চারণ করা সত্ত্বেও গান্ধারী কিন্তু ভীমের অন্যায় গদাঘাতটুকু ভোলেননি। সারা জীবন ধরে পুত্রের অন্যায়গুলি তিনি এই মুহূর্তে ভুলে গেলেন এবং উচ্চারণ করলেন সেই কঠিন প্রতিবাদ। বললেন– ভীম আমার দুর্যোধনকে গদাযুদ্ধে আহ্বান করে কৃষ্ণের সামনেই এমন কাজটা করল কিন্তু কর্মাকরোদ ভীমো বাসুদেবস্য পশ্যতঃ। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে পুত্রের ক্ষমতা সম্বন্ধে গান্ধারীর সমস্ত গর্ববোধ জেগে উঠল। তিনি বললেন– দুর্যোধন গদাযুদ্ধে ভীমের চাইতে অনেক ভাল, অনেক নিপুণ, এবং ভীম সেটা ভালই জানত। দুর্যোধন যুদ্ধক্ষেত্রে গদা হাতে চারদিক দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল, আর ঠিক সেই অবস্থায় ভীম তার নাভির নীচে গদাঘাত করল। এই ব্যাপারটাই আমার ক্রোধ বাড়িয়ে তুলেছে– অবধা নাভ্যাঃ প্রহৃতবান্ তন্মে ক্রোধমবর্ধয়ৎ।
বেশ বোঝা যায় গান্ধারীর অনন্ত ধর্মৈষণার তলদেশে অন্যায়কারী পুত্রের সম্বন্ধে তার জননী-স্নেহ এবং গর্ববোধ কম ছিল না। হয়তো প্রশ্রয়ও ছিল, যেটা প্রকটভাবে ধরা পড়ত না সত্যধর্মের জ্বালায়, তবে তার সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের পার্থক্য এই যে, যুক্তি-তর্ক, উহ-প্রত্যুহের দ্বারা তিনি যাবতীয় ক্ষুদ্র ভাবনাগুলিকে দূর করে দিতে পারেন এবং পারেন জননীস্নেহ অতিক্রম করে ধর্মবৃত্তে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। এই তো দেখুন, গান্ধারীর এই ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখে ভীমের মতো মানুষও ভয় পেয়েছেন। তিনি সত্য স্বীকার করে বলেছেন– ধর্মই হোক আর অধর্মই হোক, আমি আত্মরক্ষার জন্য এই অন্যায় করেছি। সবচেয়ে বড় কথা, যুদ্ধনীতির সঠিক নিয়ম মানলে আমি কেন, কেউই আপনার ছেলেকে হারাতে পারত না, আর ঠিক সেইজন্যই আমাকে অধর্ম করতে হয়েছেন শকঃ কেনফিদ্ধন্তু অতো বিষমম আচরম।
ভীম এবার তর্কে এলেন। বললেন– আর অধর্মের প্রশ্নই যদি তোলেন, তবে বলব– মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে তিনি অন্যায় পাশাখেলায় জিতে তার রাজ্য কেড়ে নিয়েছিলেন। আমাদের সকলের সঙ্গে তিনি অনেক প্রতারণা করেছেন, ফলে আমাকেও অধর্মের আশ্রয় নিতে হয়েছে নিকৃতাশ্চ সদৈব স্ম ততো বিষমম আচরম। দুর্যোধনের অন্যায়ের কথা বলেই ভীম কিন্তু গান্ধারীর মনে আবারও সেই পুত্ৰগর্ব উদ্দীপিত করে দিয়ে বললেন– বিপক্ষ সৈন্যদের মধ্যে আপনার ছেলেই ছিলেন একমাত্র অবশিষ্ট। এদিকে তার মতো গদাযুদ্ধে নিপুণ ব্যক্তির সঙ্গে আমি পেরে উঠব কেন? কিন্তু তিনি বেঁচে থাকলেও আমাদের অপহৃত রাজ্য পাবার সম্ভাবনা কিছু ছিল না। অতএব অন্যায়টা করতেই হল। এবারে শেষ কথাটা বলতে আরম্ভ করলেন, বলতে আরম্ভ করলেন গান্ধারীর চরম লজ্জার কথাটা। বললেন– আপনার ছেলে দুর্যোধন পাণ্ডব-কুলবধূকে রজস্বলা অবস্থায় এক কাপড়ে টেনে। এনে কী কী কথা বলেছিলেন; সে-সব আপনি কিন্তু জানেন– ভবতা বিদিতং সর্বং উক্তবান্ যৎ সুতস্তব। সেদিন যত অপ্রিয় ঘটনা ঘটেছিল সব আমি উল্লেখ করছি না, কিন্তু সমস্ত অপ্রিয় এবং অন্যায়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় অন্যায় আপনার ছেলে উন্মুক্ত রাজসভায় সকলের সামনে পাণ্ডব-বধূকে ঊরু থেকে কাপড় সরিয়ে বাম উরু দেখিয়েছিল। আমার মতে সেইদিনই সকলের সামনে তাকে আমরা মেরে ফেলতাম, কারণ সেটাই উচিত কাজ ছিল– তদৈব বধ্য যোহস্মাকং দুরাচারোহ তে সুতঃ–কিন্তু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সত্যবদ্ধ থাকায়, সেটা আমরা পারিনি।
প্রত্যক্ষত দুর্যোধনের অন্যায় কর্মগুলি পরপর সাজিয়ে দিলে গান্ধারী সত্যিই আর সহ্য করতে পারেন না, তখন ভাবেন– এমন ছেলের মরণই ভাল। তবু ভীমের কথার মধ্যে তৃপ্তিকর সারটুকু জননীর মোহে-স্নেহে তিনি আস্বাদন করেন। বলেন– বাছা ভীম! তুমি তো তার প্রশংসাই করছ। তুমি তো বলছ– তুমি ওর সঙ্গে পেরে উঠতে না গদাযুদ্ধে, তাই তোমাকে অন্যায় করতে হয়েছে তার নাভির অর্ধেদেশে আঘাত করে। অতএব এটা তার হত্যা নয়, প্রশংসা বটে, তুমি আমার ছেলের প্রশংসাই করছ ন ত্বমৈষ বধস্তাত যৎ প্রশংসসি মে সুতম। আর তুমি যে-সব অন্যায়ের কথা বললে, সেগুলো তো সে করেইছে। সেখানে কীই বা আমার বলার আছে। তবে হ্যাঁ, দুর্যোধনকে বধ করার জন্য তোমাকে অন্যায়ের আশ্রয় নিতে হয়েছে সেটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু এ-ব্যাপারটায় কী তুমি বলবে ভীম, তুমি একটা মানুষ হয়ে দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত পান করলে– অপিবঃ শোণিতং সংখ্যে দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত পান করলে অপিবঃ শোণিতং সংখ্যে দুঃশাসন শরীরজ। এটা কি কোনও ভদ্রলোকের কাজ, নাকি কোনও ভদ্রলোক এই কাজের প্রশংসা করবে। প্রক্রিয়াটা তো অত্যন্ত নৃশংসও বটে, কাজেই এমন অযৌক্তিক কাজটা তুমি করলে কী করে, ভীম?
ভীম জবাব দিলেন। গান্ধারীর শব্দ-ব্যবহার এবং জিজ্ঞাসার কোমলতা থেকে বোঝা যায় যে, তার ক্রোধ খানিকটা উপশম হয়েছে, দুর্যোধনের অন্যায় কর্মগুলি তিনি মনে মনে মেনে নিতে পারতেন না বলেই সেগুলি উচ্চারিত হলে, তিনি নিজের দোষটুকু বুঝতে পারেন, আর সেইজন্যই এখন ক্রোধ করছেন না বটে, কিন্তু ভীমের কাছে জবাবদিহি চাইছেন রাগের মাথায় রক্ত খাব বললেই কি এইভাবে কেউ বুক চিরে রক্ত খায়? এ কেমন রাক্ষুসে অসভ্যতা! ভীম বললেন– ঠিকই তো। অন্য মানুষের রক্তই যেখানে পান করা অসম্ভব, সেখানে আমি নিজের রক্ত পান করি কী করে। ভাই তো আমার নিজেরই রক্ত যথৈবাত্মা তথা ভ্রাতা বিশেষো নাস্তি কশ্চন। ভগবান জানেন, আমি কখনওই দুঃশাসনের রক্তপান করিনি। তবে হ্যাঁ, একটা প্রতীকী ব্যাপার তো ছিলই। আমার হাত দুটো দুঃশাসনের রক্তে নিষিক্ত ছিল এবং সেই রক্ত আমি ঠোঁটে চুঁইয়েছিলাম, আমার দাঁত এবং ঠোঁটের ওদিকে যায়নি সে রক্ত, কাজেই এমন ভাববেন না যে, আমি রাক্ষসের মতো দুর্বিষহ কোনও অসভ্যতা করেছি– রুধিরং ন ব্যতিক্রামদ দন্তৌষ্ঠাদম্ব মা শুচঃ।
ভীম এবার দুঃশাসনের অন্যায়গুলো বলবার পরেই সেই অনুচ্চাৰ্য কথাটা বলে ফেললেন, কেননা গান্ধারীর ধর্মভাবিত বৃত্তির নিরিখে সেই কথাটা আমরা এতকাল বলতে পারিনি। ভীম বললেন– সেই পাশাখেলার আসরে দুঃশাসন পাণ্ডব-কুলবধূ দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে রাজসভায় টেনে এনেছিল। সেদিন আমি তার বুক চিরে রক্তপান করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি সেই প্রতিজ্ঞা পালন করেছি ক্ষত্রিয়ের ধর্মে– ততস্তৎ কৃতবান অহম্। দুর্যোধন-দুঃশাসনকে বধ করার জন্য ভীমের বক্তব্যে কোনও অজুহাত কিংবা সাফাই গাওয়া ছিল না, ভীম সব সত্যগুলি উচ্চারণ করার পর এবার গান্ধারীকেই সবচেয়ে বিপদে ফেলে দিলেন। ভীম বললেন– আমরা আগে কোনওদিন তো কোনও অপকার করিনি আপনাদের, কিন্তু আপনার ছেলেরা চিরটা কাল আমাদের ওপর অন্যায় করে গেছে, করেই গেছে। আপনি তো কোনওদিন বারণ করেননি আপনার ছেলেদের অনিগৃহ্য পুরা পুত্ৰা অম্মাসু অপকারি– অথচ আজকে আপনি আমাদের দুষছেন– কেন আমি আপনার ছেলেদের হত্যা করেছি। আপনি নিজে তাদের অন্যায় কর্মে বারণ না করে আমাকে এভাবে বারণ করতে পারেন না– ন মামৰ্হসি কল্যাণি দোষেণ পরিশঙ্কিতুম।
গান্ধারী এমন একটা প্রশ্নের মুখে পড়বেন ভাবেননি বোধহয়। আমরাও এ কথা স্পষ্ট করে বলতে পারিনি গান্ধারীর ধর্মচরিত্রে কলঙ্ক লাগে যদি! কিন্তু এও তো বড় সত্য কথা, একেবারে উদ্যোগপর্বে যুদ্ধ লাগার আগে দুর্যোধনকে বকাবকি করা ছাড়া কোনওদিন কিন্তু গান্ধারী সোচ্চারে বারণ করেননি দুর্যোধনকে। ভীমের কথায় সেইজন্যই তিনি তেমন আহত হলেন না হয়তো। বরঞ্চ এবার যা বললেন, তা অনেক বেশি কারুণ্য জাগায় মনে। গান্ধারী আর তর্ক করছেন না বটে, কিন্তু তার কথা শুনে বোঝা যায়, তার অন্তরের মধ্যেও সেই অহংকারের বীজ আছে, যে বীজ কবে কীভাবে উপ্ত হয়েছে তা তিনি নিজেও ভাল করে জানেন না। গান্ধারী বললেন– তুমি এই অন্ধ বৃদ্ধের একশোটা ছেলেকেই হত্যা করেছ। তুমি অন্তত একজনকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতে, তা হলে আমিও তোমাকেও অন্তত সম্পূর্ণরূপে অপরাধী ভাবতাম না– কস্মান্নাশেষয়ঃ কঞ্চিদ যেনাল্প অপরাধিতম। আমরা বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি, আমাদের রাজ্যও চলে গেছে, একটা ছেলেও যদি বেঁচে থাকত আজ, তা হলে ওই দুই বুড়ো-বুড়ির হাতের লাঠি হয়ে সে থাকতে পারত অন্তত একটা ছেলেকে তুমি বাঁচিয়ে রাখতে পারতে– নাশেষয়ঃ কথং যষ্টিং… বৃদ্ধয়োজঁতরাজ্যয়োঃ।
যে গান্ধারী একসময়ে দুর্যোধনকে বলেছিলেন– এ রাজ্য তোমার পাবারই কথা নয়, পিতৃ-পিতামহক্রমে এ-রাজ্য পাণ্ডবদেরই পাবার কথা, সেই গান্ধারী কিন্তু ভীমকে বলছেন– আমাদের রাজ্য চলে গেছে, আমাদের একটা ছেলেও বেঁচে নেই বৃদ্ধয়োজঁতরাজ্যয়োঃ। অর্থাৎ এবার যে পাণ্ডবদের ওপরেই নির্ভর করে থাকতে হবে– এই নির্ভরতা কিন্তু গান্ধারী ভাল করে মেনে নিতে পারছেন না। তার মানে, দুর্যোধনের আচার-আচরণ অহংকারে যতই তিনি ক্ষুব্ধ থাকুন, সেই পুত্রের ওপর নির্ভরতাও তবু তার আত্মমর্যাদার জায়গা ছিল, এবং এখন সে-মর্যাদা তিনি অনুভব করছেন না। হয়তো সেই কারণেই ভীমের পরেই যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করার মধ্যে একটা তির্যক ভঙ্গি প্রকাশ করে ফেললেন গান্ধারী। ক্রোধটা ভীমের যুক্তিতে চাপা পড়েছিল বটে, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রেই গান্ধারী সক্রোধে সেই তির্যক শব্দ উচ্চারণ করলেন তোমাদের সেই রাজা কোথায়– ক স রাজেতি সক্রোধা পুত্রপৌত্রবধার্দিতা।
একবার গান্ধারী বলেছিলেন– আমরা দুই বৃদ্ধ, যাঁদের রাজ্য হরণ করা হয়েছে– বৃদ্ধয়োজতরাজ্যয়োঃ- আর এখন যুধিষ্ঠিরকে বলছেন– সেই রাজা কোথায়? কিন্তু এই ভয়ংকর যুদ্ধের পরে যুধিষ্ঠিরের এখনও রাজ্যাভিষেক হয়নি প্রথাগতভাবে, তবু এই সম্বোধন। যুধিষ্ঠির কাঁপতে কাঁপতে এলেন গান্ধারীর কাছে, দাঁড়ালেন হাত জোড় করে– তামভ্যগচ্ছদ রাজেন্দ্রো বেপমানঃ কৃতাঞ্জলিঃ। সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে যুধিষ্ঠির বললেন– সব দোষ আমার। আমিই আপনার পুত্রহন্তা, আমিই এই সমস্ত মৃত্যুর জন্য দায়ী। আপনি আমাকে অভিশাপ দিন জননী– শাপাৰ্হঃ পৃথিবীনাশে হেতুভূতঃ শপস্ব মাম। গান্ধারী কোনও কথা বললেন না, কারণ এ-রকম করে সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে যে অবনত হয়, তাকে অভিশাপ দেওয়া যায় না, কিন্তু তবু ক্রোধ সম্পূর্ণ অপগত না হলে উপায়ান্তরের অভাবে নিশ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘতর থেকেই যায়, গান্ধারীরও তাই হল, তিনি কোনও কথা বললেন না, শুধু দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলেন অন্তর্গত ক্রোধে নোবাচ কিঞ্চি গান্ধারী নিশ্বাসপরমা ভৃশম।
অসহায় যুধিষ্ঠির জননী গান্ধারীর পুত্রশোকে সমদুঃখিত হয়ে তার দুরন্ত ক্রোধ প্রশমনের জন্য অবনত হলেন তাঁর চরণ স্পর্শ করার জন্য। চরণ স্পর্শ করে উঠে দাঁড়াতেই গান্ধারীর পট্রান্তরিত চোখের কোণ থেকে জ্বলন্ত ক্রোধবহ্নি এসে লাগল যুধিষ্ঠিরের পদাঙ্গুলির অগ্রভাগগুলিতে– অঙ্গুল্যগ্রাণি দৃশে দেবী পট্রান্তরণে সা। হয়তো অলৌকিকতার তুলিতে লেখা হয়েছে গান্ধারীর এই বহ্নি-নেত্রপাত, হয়তো সেই জননীর নেত্রবহ্নিতে যুধিষ্ঠিরের চরণস্থিত সমস্ত পদাঙ্গুলিগুলির অগ্রভাগ পুড়ে গেল। যুধিষ্ঠিরের নখগুলি নষ্ট হয়ে গেল– ততঃ স কুনখীভূততা দর্শনীয়নখো নৃপঃ। হয়তো অলৌকিকতা নয়, গান্ধারীর চোখে দেখা এই প্রতীকী নেত্রবহ্নির মাধ্যমে মহাকাব্যের কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, গান্ধারী চিরকাল যে ধর্মভাবনায় ভাবিত হয়ে স্বভাবত শুদ্ধ হতে চান, মানুষের স্বভাববৃত্তি সেখানে ফুরিত হয় নিতান্ত অসচেতনভাবেও। আপনারা যুধিষ্ঠিরকে দেখেছিলেন– সেই দূতসভায় আপন অপরাজিত ধর্মবৃত্তির মধ্যেও তিনি পাশাখেলায় দ্রৌপদীকে পণ রেখেছিলেন, আজ আরও এক ধর্মাধার জননীর চিরন্তন ধর্মবোধের মধ্যেও জাগ্রত হয়ে ওঠে সেই স্নেহান্ধতার আগুন, যা ধর্মের, ধর্মশরীরের পদাঙ্গুলি পুড়িয়ে দেয়।
যুধিষ্ঠিরের পায়ের অবস্থা দেখেই বোধহয় অর্জুনের মতো মহাবীরও কৃষ্ণের পিছনে এসে দাঁড়ালেন। কৃষ্ণসহ পাণ্ডব-ভাইরা সকলেই গান্ধারীর ক্রোধ প্রশমন করার চেষ্টা করতে লাগলেন এবং গান্ধারীর ক্রোধ অচিরেই শান্ত হল। পাণ্ডবরা ফিরে পেলেন পুরাতন জননীকে। বিদ্বেষশূন্যা গান্ধারীকে রেখে পাণ্ডবেরা এবার গেলেন জননী কুন্তীর কাছে, পুনশ্চ কুন্তী এবং দ্ৰৌপদী দু’জনকে নিয়ে পাণ্ডবেরা আবারও উপস্থিত হলেন গান্ধারীর কাছে। কুন্তী এবং দ্ৰৌপদী উভয়কে অঝোরে কাঁদতে দেখে গান্ধারী বিশেষত দ্রৌপদীকে উদ্দেশ করে বললেন– এমন করে কষ্ট পেয়ো না বাছা! তোমরা আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখো–মৈবং পুত্ৰীতি দুঃখার্তা পশ্য মামপি দুঃখিতাম। এই ভয়ংকর যুদ্ধ হয়তো কাল-নিরূপিত, স্বাভাবিক। এখন দ্রৌপদী! তুমিও পুত্রহীন, আমিও তাই, আমাদের কে সান্ত্বনা দেবে? আমি তো আমার ছেলেটাকে বারণ করে রুদ্ধ করতে পারিনি এই যুদ্ধ, তাই আমারই দোষে এত বড় বংশটা ধ্বংস হয়ে গেল মমৈব হ্যপরাধেন কুলমগ্রং বিনাশিত।
স্নেহ-মমতা, অহংকার-মম-কার– এগুলি এমনই অন্তর্গত বৃত্তি–সহজ এবং গভীর– যে, অন্তঃশক্তি না থাকলে হাজার বাহ্য চেষ্টাতেও এই বৃত্তিগুলি প্রশমিত হয় না। এটা তো ভাবতেই হবে যে, এক জননীর একশোটি পুত্র গতাসু হয়েছে, তার হৃদয়ের অবস্থা কী হতে পারে। তবু যিনি এক সময় নিজের অন্তঃশক্তিতে নিজের দোষটা আবিষ্কার করতে পারেন, তিনি কিন্তু প্রকৃত তপস্বী, তিনি ধর্মের বিষয়ে প্রামাণ্য ব্যক্তিত্ব। লক্ষ্য করলেন কী, মহারাজা যুধিষ্ঠির সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে সমস্ত ক্ষতির জন্য নিজেকেই দায়ী করেছিলেন, এই মুহূর্তে গান্ধারীকেও কিন্তু প্রায় একই বিন্দুতে মিলিত হতে দেখছি। তিনি বলছেন– আমারই দোষে এই কুল ধ্বংস হয়ে গেল। আসলে যুধিষ্ঠিরের চাইতে গান্ধারী যে অধম স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন, তার কারণ সেই অধম স্থানে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী। ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি পাতিব্ৰত্য গান্ধারীর ধর্মৈষণায় অন্যতম অন্তরায় হয়ে উঠেছে বলে। আমাদের মনে হয়।
.
০৭.
পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হবার পর কুরুকুলের সমস্ত বিধবা স্ত্রী, গান্ধারী এবং অন্যান্যদের নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র একসময় কুরুক্ষেত্রের রণস্থলে এসে পৌঁছালেন। সঙ্গে রইলেন পাণ্ডবরা এবং কৃষ্ণ কৃষ্ণ গান্ধারীর পাশে পাশে আছেন। আশ্চর্য লাগে– দ্বৈপায়ন ব্যাস অনুমতি করছেন– তোমরা যাও, রণস্থল ঘুরে দেখো। যাচ্ছেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, যাচ্ছেন দীর্ঘদর্শিনী গান্ধারী, ব্যাস এঁদের দিব্যদৃষ্টি দিয়েছেন সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাবার জন্য। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, যাঁরা জীবন থাকতে প্রিয়জনদের স্পষ্ট দেখতে পেলেন না, তারা মৃত মুখ স্পষ্ট করে দেখার জন্য যাচ্ছেন। ভারতবর্ষের ধর্মটাও এইরকম- মৃত্যুর পর প্রিয়জনের জন্য কাঁদতে দেয় না বেশি, নানা আচার-অনুষ্ঠান, ব্রত-নিয়ম-উপবাসে তিক্ত করতে করতে বুঝিয়ে দেয়– যার জন্য তুমি শোক করছ, সেই শরীরটা নিতান্তই পাঞ্চভৌতিক জড়। এবার তুমি যাও– রণস্থলে প্রিয়জনের ছিন্ন-ভিন্ন-কর্তিত শরীরগুলি দেখো।
আপনারা বললেন– এ তো বড় নিষ্ঠুর নির্দেশ। মহাকাব্যের সংবেদনশীল কবি কেমন করে এমন নির্দেশ দেন। আমরা বলি– তিনি যত বড় কবি, তত বড় দার্শনিক; দার্শনিক কবি জানেন যে, মৃত্যুর বাস্তবতা যত মুখোমুখি দেখা যায়, মনের মধ্যে বৈরাগ্য তত তীব্রতর হয়, জীবনের নশ্বরতা তত বুদ্ধিগম্য হয়। ভোগবাদী দেশে এমনটি নয়। মৃত্যুকে তারা কফিনে পুরে মাটিচাপা দেয়, মৃত্যুর করুণ চেহারা তারা চোখে দেখতে চায় না। আমাদের মৃত্যু খাঁটিয়ায় ওঠে, রজ্ঞবদ্ধ হয়, চতুর্দোলায় মাথা হধার-উধার নড়াচড়া করে অবশেষে আগুনের লেলিহান শিখায় আপাদমস্তক রীতিমতো বোধগম্য হতে হতে দগ্ধ হয়– আমরা দেখি, শেষ পর্যন্ত দেখি। এই দেখার মধ্যে যে যন্ত্রণা, সেটা একদিকে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ায়, অন্যদিকে মনকে জানায়– এই শরীরের কোনও মূল্য নেই, যার মূল্য আছে সে হয়তো ‘নতুন আলোয় নতুন অন্ধকারে, অথবা কোনও ‘নতুন সিন্ধুপারে’ নতুন কোনও ‘তুমি’ অথবা যাকে খুঁজতে হবে, তাও এই শরীর নয়, সে হল সেই মহান আত্মা, যিনি প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতব্যঃ।
অতএব ব্যাসের নির্দেশে ততো ব্যাসাভ্যনুজ্ঞাতো ধৃতরাষ্ট্রো মহীপতিঃ– সকলকে নিয়ে রণক্ষেত্র দেখতে চললেন। সকলের সামনে আছেন কৃষ্ণ যিনি সব সইতে পারেন, সব দেখতে পারেন, সব সওয়াতেও পারেন– বাসুদেবং পুরস্কৃত্য হতবন্ধুঞ্চ পার্থিবম্। রণস্থলের কাছাকাছি হতেই কুরুবাড়ির এবং পঞ্চাল-বাড়ির বউ-মায়েরা ঈষদৃস্পষ্ট বিভিন্ন শরীর দেখে একে অপরের শরীরের ওপর গিয়ে পড়লেন, কেউ কেউ অচৈতন্যও হয়ে গেলেন। রণক্ষেত্রের চেহারাটা তো ভয়ংকর, মহাকবি এক শব্দে লিখেছেন– প্রলয়-রুদ্রের নৃত্যস্থানের মতো– রুদ্রাক্রীড়নিভং দৃষ্টা তদা বিশয়ানং স্ত্রিয়ঃ–মৃত্যু ছাড়া, হিংসা ছাড়া আর কোনও চিহ্ন সেখানে নেই। মনুষ্য-বীরদের রক্ত-মাংস-কেশে রণস্থল এক বিচিত্র চেহারা ধারণ করেছে। বীরদের রক্তসিক্ত মস্তকশূন্য দেহ কোথাও, কোথাও বা দেহহীন মস্তক শরীরেরশিরস্কৈশ্চ বিদেহৈশ্চ শিরোগণৈঃ–হাতির মাথা, ঘোড়ার মাথার সঙ্গে মানুষের মাথা, বিচিত্র প্রাণহীন দেহ– সব একাকার হয়ে গেছে এই যুদ্ধস্থলে। শেয়াল, কাক, হাড়গিলে, শকুনদের মোচ্ছব লেগেছে সমস্ত জায়গাটা জুড়ে। তারা শবভক্ষণ করছে।
যে-সমস্ত রমণীরা পাঞ্চাল-গৃহ বা কুরুবাড়ির স্বাচ্ছন্দ্যের প্রাসাদ ছেড়ে কোনওদিন বাইরে বেরোননি তেমন করে, তারা তাদের বাপ-ভাই, স্বামী-পুত্রদের এমন বীভৎস রূপ দেখে কেউ চৈতন্যহীন, কেউ অসংলগ্ন-বিলাপিনী, কেউ বা একে অপরের গা জড়িয়ে ধরে আলুলায়িত হলেন– শরীরেধস্থন্নন্যা ন্যপতংশ্চাপরা ভুবি। গান্ধারী এঁদের সকলের মধ্যে ধীর, তার অনন্ত আত্মশক্তি আছে বলেই নিতান্ত নৈর্ব্যক্তিকভাবে তিনি সম্পূর্ণ যুদ্ধস্থল দেখতে পেলেন ব্যাসের প্রভাবে অথবা এই মুহূর্তে ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি একান্ত পাতিব্ৰত্য প্রদর্শনের বালাই ছিল না বলেই তিনি তার নয়নের চিরন্তন আবরণটুকু খুলে ফেলেছিলেন নাকি! গান্ধারী কাছে ডাকলেন কৃষ্ণকে তিনি আরও এক নৈর্ব্যক্তিক দ্রষ্টা, সাক্ষীর মতো সমস্ত ব্যক্তিকেন্দ্র থেকে সরে এসে ঘটনার চেহারা দেখতে পান।
গান্ধারী বললেন– দেখো কৃষ্ণ! বীরমাতা, বীরপত্নীরা রণস্থলের এদিকে-ওদিকে ছোটাছুটি করছেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অভিমন্যুর মতো বীরেরা এখানে পড়ে আছেন। এখানে-ওখানে মাথার মুকুট, কেয়ুর, অঙ্গদ, বলয় এখন রণভূমির অলংকরণ। পড়ে আছে ইতস্তত ধনুক, বাণ, শক্তি, তোমর, গদা– সমস্ত বীরদের বাহু-নিক্ষিপ্ত অস্ত্র-শস্ত্র। রণস্থলের কী বিচিত্র এই সজ্জা দেখে দেখে আমি তো আমার শোক ধারণ করতে পারছি না কিছুতেই– পশ্যমানা হি দহ্যামি শোকেনাহং জনার্দন। গান্ধারীর মুখে যুদ্ধস্থলের যে করুণ অথচ বীভৎস বিবরণ ভেসে উঠেছে, তা যদি এখানে সম্পূর্ণ বর্ণনা করা যেত, তা হলে মহাভারতের কবির প্রতি ঋণ কিছু কমত। কিন্তু আমার সেই অমানুষী ভাষা কোথায়? বিশেষত, অপূর্ব-নির্মাণের কথা ছেড়েই দিলাম, মহাকবির যে বর্ণনা রয়ে গেছে, তাকে যে পূর্ব-নির্মাণ-নিপুণতায় প্রকট করে তুলব তেমন শক্তিও আমার নেই। তবু যা না বললে নয়, সেইটুকু বলেই আমার অক্ষম ঈর্ষার শান্তি ঘটাব।
গান্ধারী কৃষ্ণকে বলেছেন যে সব বীরেরা দুগ্ধ-শয্যায় শুয়ে থাকত, তাদের দেহ এখন ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে। শেয়াল-শকুনেরা এখন মুখ-ঠোঁট দিয়ে তাদের গা থেকে অলংকারগুলি টেনে-সরিয়ে খাবার জায়গা খুঁজে নিচ্ছে। অনেক বীরদের হাতের ধনুক বাণ-তরবারি মৃত্যুকালেও এমন অবিকল, যেন মনে হচ্ছে এই তারা যুদ্ধে যাবেন– যুদ্ধাভিমানিনঃ প্রীতা জীবন্ত ইব বিভ্রতি। গান্ধারীর সবচেয়ে খারাপ লাগছে কুরুবাড়ির বউদের দেখে। কেউ বিলাপ বন্ধ করে সম্ভাবিত প্রিয়জনের দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন, কেউ নিজেই এত বিলাপ করছেন যে, অন্য রমণীর বিলাপশব্দের কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না। দুর্বিষহ ব্যথায় আকুল হয়ে উঠছে গান্ধারীর মন– তিনি দেখছেন– কতকগুলি রমণী ছিন্ন কর্তিত দেহের সঙ্গে এক একখানি অসংলগ্ন মস্তক জুড়ে আছে দেখে হঠাৎ অসম্ভাবনায় চেঁচিয়ে উঠে বলছেন– এই মাথাটি তো এই দেহের নয়–শিরঃ কায়েন সন্ধ্যায় প্রেক্ষমাণা বিচেতসঃ–অথচ অভীষ্ট যে মস্তকটি দেহের সঙ্গে জুড়ে দিলে দেহ সম্পূর্ণ হয়, সেটাও তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। এই অবস্থায় কেউ দেহশূন্য মাথা অথবা মাথা ছাড়া দেহটি দেখে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ছেন– বিশিরস্কান অথবী কায়ান্… বিদেহানি শিরাংসি চ।
সমস্ত রণস্থল ছিন্ন মস্তক, ছিন্ন বাহু, অস্ত্র-শস্ত্র, মৃত পশুতে প্রায় অগম্য হয়ে উঠেছে। আঠেরো দিনের যুদ্ধ, আঠেরো দিনের রক্ত, কত শত মনুষ্যদেহ পচে-গলে এমন অবস্থা হয়েছে যে, কিছুই চেনা যাচ্ছে না, রণক্ষেত্রে পা ফেলে এগোনোও যাচ্ছে না ভাল করে– অগম্যকল্পা পৃথিবী মাংসশোণিত-কর্দমা। এমনি করেই যেতে যেতে গান্ধারী এক সময় দুর্যোধনের কাছে এসে পৌঁছালেন। দুর্যোধনকে দেখামাত্রই গান্ধারী তাকে জড়িয়ে ধরে ‘বাছা আমার’, ‘ছেলে আমার’, ‘কোথায় লেগেছে বলে অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে হা-হা পুত্রেতি শোকার্তা বিলোপাকুলেন্দ্রিয়া। সম্মুখে-থাকা কৃষ্ণ অনেক কষ্টে তাকে তুলে। চৈতন্য সম্পাদন করলে গান্ধারী বললেন– জানো কৃষ্ণ! আমার এই ছেলে যুদ্ধের প্রতিটি দিন এসে আমায় বলত– এই ভয়ংকর জ্ঞাতিযুদ্ধে আমার জয় হোক মা, তুমি আশীর্বাদ করো– অস্মিন জ্ঞাতিসমুদ্ধর্ষে জয়মম্ব ব্রবীতু মে। আমি প্রতিদিনই বুঝতাম ওর বিপদ ঘনিয়ে আসছে, তবু সত্যে স্থির হয়ে আমি বলতাম– যে পক্ষে ধর্ম, সেই পক্ষেই জয় হবে। আর বলতাম– যুদ্ধ করার সময় তুমি যেন অসাবধান হোয়ো না বাছা! খুব সতর্ক থেকো– যথা ন যুধ্যমানং ন প্রমুহ্যসি পুত্রক। সেই ছেলে, আজ তার এই অবস্থা। তবু তার জন্য আমি শোক করি না, সে তো চলেই গেছে, কিন্তু তার ওপরে নির্ভর করে যে বেঁচে রইল, সেই ধৃতরাষ্ট্রের জন্যই আমার সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে– ধৃতরাষ্ট্রন্তু শোচামি কৃপণং হতবান্ধবম।
এ-কথা বড় সত্য, বড়ই বাস্তব। যে পরপারে চলে গেল, সে ক্ষতি যে পূরণীয় নয়, সে-কথাটা মানুষ যে কোনও মৃত্যুর পরেই বুঝতে পারে। কিন্তু যাঁরা বেঁচে রইলেন, প্রয়াত ব্যক্তির ওপর তাদের নির্ভরতা এবং দুর্বলতার নিরিখে তাদের জন্যই দুঃখ হয় বেশি। তবু সেই শোকের মধ্যে সামান্য কিছু মৌখিকতা আছে, আছে বেঁচে থেকে দেখার জ্বালা। বস্তুত, প্রিয়জনের মৃত্যুর চাইতে অধিক কিছু নেই। না হলে এরপরেই গান্ধারীর মতো মনস্বিনী মাতা পুত্র দুর্যোধনের সম্বন্ধে পূর্বস্মৃতিতে এত কথা বলতেন না। এই ছেলের জন্যই কুরুকুলের সর্বনাশ ঘনিয়ে এসেছে, এ কথা বারবার মুখে বললেও পুত্রের সম্বন্ধে গান্ধারীর গর্ববোধ কম নেই। গান্ধারী বলছেন–কালের কী পরিবর্তন দেখো কৃষ্ণ! যে ছেলে আমার সমস্ত বড় বড় রাজার মাথার ওপর বসে থাকত, সবার আগে তার নাম যোহয়ং মূর্ধাভিষিক্তানাম্ অগ্রে যাতি পরন্তপঃ– সে আজকে ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে। কত সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরা দুর্যোধনের দৈনন্দিন সেবায় নিযুক্ত থাকত এতকাল, আজ শেয়াল-শকুনে সেই সেবা করছে, ময়ূর-পুচ্ছের শান্ত ব্যজন আজ শকুনের পাখার হাওয়ায় রূপান্তরিত। একথা মানছি, কৃষ্ণ! মূঢ়-মন্দ দুর্যোধন পিতার কথা, বিদুরের কথা অগ্রাহ্য করে মৃত্যুর মুখ দেখেছে আজ, কিন্তু এও মনে রেখো এই দুর্যোধন এগারো অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, এই দুর্যোধনের অধীনেই কিন্তু তেরোটা বচ্ছর ধরে এই পৃথিবীর নিষ্কণ্টক অধিকার বর্তমান ছিল– নিঃসপত্না মহী যস্য ত্রয়োদশ সমা স্থিতাঃ। আজ সে মাটিতে ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে বটে, কিন্তু এই দুর্যোধন যখন রাজ্যশাসন করত, তখন আমাদের হাতিশাল, ঘোড়াশাল এবং গোশালা ভরে উঠেছিল প্রাচুর্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, আমি বেশিদিন এই ঐশ্বর্য দেখতে পেলাম না বাষ্ণেয় ন তু চিরম্। যে রাজ্য আগে দুর্যোধন শাসন করত, সেই রাজ্যেই আজ অন্যের শাসন নেমে এসেছে তামেবাদ্য মহাবাহো পশ্যামন্যানুশাসনাম– আজ কোথায় সেই হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে একটাও ঘোড়া নেই। শুধু আমি বেঁচে আছি, কেন যে বেঁচে আছি কে জানে– হীনাং হস্তিগবাশ্বেন কিং নু। জীবামি মাধব।
বড় অদ্ভুত লাগে এইসব সময়। বেশ বুঝতে পারি, এইসব সত্য গান্ধারীর অবচেতন থেকে নির্গত হচ্ছে। অথচ এতদিন তাকে দেখেছি, বড় চাপা স্বভাব গান্ধারীর। অন্তর্মুখীন ভাল লাগা এবং মন্দ-লাগা ভাল করে বাক্যে প্রকট হয়ে ওঠে না। আগে কি একবারও বুঝেছি যে, দুর্যোধন পাণ্ডবদের কপটপাশায় বনবাসে পাঠিয়ে তেরোটা বছর ধরে যেভাবে নিরঙ্কুশ রাজ্য-ভোগ করলেন, গান্ধারী সেটা একেবারেই উপভোগ করছেন না। তখন এই অন্যায় রাজ্যপাটে গান্ধারী পরম দুঃখিতা হয়ে থাকলে, আজকের এই ক্ষুব্ধ উচ্চারণ স্বাভাবিকভাবেই সত্য নয়, গান্ধারী বলছেন– আমি সেই ঐশ্বর্য বেশি দিন দেখতে পেলাম না– বাষ্ণেয় ন তু তচ্চির। আসলে ধৃতরাষ্ট্র যা প্রকটভাবে পারেন, গান্ধারী সেটা প্রকটভাবে পারেন না, কেননা তার অন্তর্গত ধর্মবোধে সেটা বাধে। জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার ব্যাপারে ধৃতরাষ্ট্র সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন দুর্যোধনের পাশে, কপট পাশা-খেলানোর ব্যাপারেও তাই। এইসব অন্যায় গান্ধারী কিছুতেই মানতে পারেন না বটে, কিন্তু ছেলে যখন নিরঙ্কুশ রাজা হয়ে বসে, তখন পুত্রের গরিমাটুকু তিনি উপভোগ করেন– সেটা কি জননীর অবুঝ স্নেহ-গরিমা থেকে। আজকে কী অদ্ভুত লাগছে গান্ধারীর মুখে এই কথাটা– তিনি যে পাণ্ডবদের, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের ধর্মবোধে আপ্লুত হন, সেই পাণ্ডবরা তো পুত্রপ্রতিম তার কাছে, অথচ দুর্যোধনের অন্যায়াধিকৃত রাজ্য আজ যখন পুত্রপ্রতিম পাণ্ডবদের হাতে যাচ্ছে, তখন গান্ধারী বলছেন– আজ সেই রাজ্যে অন্যের শাসন নেমে আসছে তামেবাদ্য মহাবাহো পশ্যামন্যানুশাসনাম। গান্ধারী যে ধর্মবোধে সারা মহাভারত জুড়ে চিহ্নিত হয়েছেন, সেখানে এই কথাগুলি বুঝিয়ে দেয়, তিনিও মানুষ, যে মানুষের মধ্যে ঈর্ষা অসূয়ার দোলা-চলা এখনও কাজ করে, দুর্যোধনকে তিনি অন্যায়ী জানেন, তবুও সেই অসূয়ার পক্ষপাত কাজ করে। কেমন যেন মনে হয়, তার অন্তর্মুখী স্বভাবের মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল, যাকে সরাসরি প্রশ্রয় বলতে পারি না হয়তো, কিন্তু সেটা তার চিহ্নিত ধর্মস্বরূপকে পরোক্ষে বিদ্ধ করে।
দুর্যোধনের মৃতদেহের সামনেই বসেছিলেন তার স্ত্রী। গান্ধারী তার নাম বলেননি। বলেছেন– লক্ষ্মণের মা– তিনি দুর্যোধনের কোলের কাছে বসে বিলাপ করছেন। পুত্রবধূকে দেখে, তার আকুল অবস্থা দেখে গান্ধারীর শোক চরমে উঠল। আস্তে আস্তে তার নজর পড়ল কুরুকুলের অন্যান্য রমণীদের দিকেও। দেখতে পেলেন কুমার দুঃশাসনকে– তিনি এই বাহু ঊর্ধ্বে প্রসারিত করে রণক্ষেত্রে শুয়ে আছেন। গান্ধারীর মনে পড়ল দূতসভার কথা– দুঃশাসন কীভাবে দ্রৌপদীকে দাসী বলে অপমান করেছিলেন। তার এও মনে পড়ল– তিনি অনেক বারণ করেছিলেন দুর্যোধনকে। বলেছিলেন- তুমি দুর্বুদ্ধি শকুনির সঙ্গ ত্যাগ করে পাণ্ডবদের সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপন করো। কেউ শোনেনি– দুর্যোধন যা করেছিলেন, দুঃশাসন যা বলেছিলেন, আজ তার ফল পাচ্ছেন দু’জনেই। ভীম তাদের শাস্তি। দিয়েছেন এইভাবে। দুঃশাসন যেভাবে হাত ছড়িয়ে শুয়ে আছেন রণক্ষেত্রে বিক্ষিপ্য বিপুলৌ ভুজৌ– তাতেই বুঝি গান্ধারীর মনে হচ্ছে- ভীম যেন তার সমস্ত অঙ্গ থেকে। রক্ত চুষে খেয়েছেন– পীতশোণিত-সর্বাঙ্গো ভীমেন যুধি পাতিতঃ।
গান্ধারী কৃষ্ণের পাশে পাশে আরও কয়েকটি ছেলের মৃতমুখ দেখে কষ্ট পেলেন। বিকর্ণ পড়েছিলেন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে। তার স্ত্রী তার পাশে বসে যত-না শোক করতে পারছেন, তার চেয়ে বেশি তাকে ব্যস্ত হতে হচ্ছে মৃতমাংস-লোলুপ শকুন তাড়ানোর জন্য বারয়ত্যনিশং বালা ন চ শক্লোতি মাধব। আর এক পুত্র দুর্মুখ এমনভাবে রণস্থলে শায়িত যে তাঁর মুখখানিও ভাল করে চিনতে পারছেন না গান্ধারী। তার অর্ধেক মুখ শেয়ালে-শকুনে খেয়ে ফেলেছে অস্যৈত বদনং কৃষ্ণ শ্বাপদৈরভক্ষিতম। একে একে কুমার চিত্রসেন, বিবিংশতি, দুঃসহ– এত সব পুত্রের বীভৎস মৃত্যু দেখে গান্ধারী এবার অভিমন্যুর কাছে এলেন, শুনতে পেলেন তার স্ত্রী উত্তরার করুণ বিলাপ। গান্ধারী আর ধৈর্য রাখতে পারছেন না। দুর্যোধনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু কর্ণের ওপরেও তাঁর মায়া কম নয়, হিংস্র পশু-পাখি তার শরীরের অনেকটাই খেয়ে ফেলেছে, তবু সেই অবশিষ্ট শরীরের মধ্যেই মহাবীর কর্ণের যুদ্ধোচ্ছল পূর্ব-চিত্র কল্পনা করলেন গান্ধারী।
গান্ধারী অনেক দেখলেন একে-একে। দ্রোণ, শল্য, শকুনি, ভূরিশ্রবা, দ্রুপদ, বিরাট শত্রু-মিত্রের সব দেহ একাকার হয়ে গেছে এই রণক্ষেত্রে। গান্ধারীর এই মৃত্যু-বৰ্ণনার মধ্যে যেমন যেমন তার পুত্র-পৌত্রেরা ছিলেন, তেমনই ছিলেন পাণ্ডব-পক্ষের প্রিয়জনেরাও এবং ছিলেন অন্য দেশীয় রাজারাও। একটা সময়ে দেখছি– গান্ধারী যেন একটু ঈর্ষাই বোধ করছেন পাণ্ডবরা সবাই স্বচ্ছন্দে সুস্থ অবস্থায় বেঁচে আছেন বলে। একে একে প্রত্যেকটি মহার্ঘ্য মৃত্যুর সূক্ষ্ম পরিচয় দেবার পরেই গান্ধারী কৃষ্ণকে বললেন– তুমি এবং তোমাকে। নিয়ে সমস্ত পাণ্ডবরাই বোধহয় অবধ্য অবধ্যা পাণ্ডবাঃ কৃষ্ণ সর্ব এব ত্বয়া সহ- নইলে ভীষ্ম-দ্রোণ, কৃপকর্ণ, অশ্বত্থামা-জয়দ্রথ-কৃতবর্মার মতো বীরদের অস্ত্র-হস্তের কবল থেকে যারা বেঁচে ফিরেছেন তারা তো অবধ্য বটেই– যে মুক্তা দ্রোণ-ভীষ্মভ্যাং কর্ণাৎ বৈকর্তণাৎ কৃপাৎ। অথচ এঁদের দেখো, মহাকালের কী বিশাল বিপরিণাম দেখো– যাঁরা নাকি দেবতাদেরও বধ করতে পারতেন, তারা সব এখানে মরে পড়ে আছেন– ত ইমে নিহতাঃ সর্বে পশ্য কালস্য পর্যয়।
হয়তো এমনই হয় শোকাকুল অবস্থায় অথবা মার খেতে খেতে, দুঃখ পেতে পেতে। এক-একটা মানুষকে এখনও দেখতে পাই– অর্থ আছে, অভিজাত মানুষ অথচ সংসারের বিচিত্র রঙ্গে মার খেতে খেতে বলে ওঠেন– কী কম ছিল আমার ওদের চাইতে, অথচ ওরা এমন সুখে থাকবে কেন! এই দুঃখ, এই কষ্ট যে কখন কীভাবে তৈরি হয়ে যায়, কেউ জানে না– কখনও সে দোষ নিজের মধ্যেই থাকে, কখনও অপরের মধ্যে, কখনও দুয়ের মধ্যেই। এই যে গান্ধারী কষ্ট পাচ্ছেন– এর কারণ তিনি নিজে সৃষ্টি করেননি, কারণ সৃষ্টি করেছে তার ছেলে, ইন্ধন জুগিয়েছেন তার স্বামী এবং তিনি নিজে খানিকটা উদাসীন প্রশ্রয়ে অন্তর্মুখী হয়েছেন। কিন্তু ফল যা হয়েছে, তা এতটাই বিষাদজনক যে, এই মুহূর্তে সেই বিচিত্র সুপ্ত অসূয়া তাঁর মনের মধ্যে কাজ করছে– অথচ এরা সবাই বেঁচে রইল, ধ্বংস হল আমার সব আত্মীয়, স্বজন, বংশ।
এক সময়ে গান্ধারী এতটাই ক্ষুব্ধ হলেন যে, তাঁর মনে হল– এই তার পাশের মানুষটি, যিনি এতক্ষণ ধরে তার অনন্ত দুঃখের, অনন্ত মৃত্যুর মধ্যে পাশে পাশেই হেঁটে চলেছেন সমস্ত সহানুভূতি নিয়ে, এই কৃষ্ণই সবকিছুর জন্য দায়ী। কৃষ্ণের ওপর সব রাগ গিয়ে পড়ল গান্ধারীর। তিনি বললেন- তোমার শান্তির প্রস্তাব ব্যর্থ হয়ে গেল দেখে তুমি যখন ভাঙা মনে উপপ্লব্যে ফিরে গেলে, আমি সেদিনই বুঝেছিলাম যে, আমার ছেলেরা যতই বলবান হোক তারা মারা গেছে– তদৈব নিহতাঃ কৃষ্ণ মম পুত্ৰাস্তরস্বিনঃ। কেন জানি না, সেদিনই মহামতি ভীষ্ম এবং বিদুর আমাকে ডেকে বলেছিলেন– দেবী! তোমার এই ছেলেগুলোর ওপর একেবারেই স্নেহ-মায়া রেখো না– তদৈবোক্তাস্মি মা স্নেহং কুরুষত্মসুতেম্বিতি।
ভীষ্ম-বিদুরের কথার অর্থ হতে পারে দু-রকম। প্রথমত, যুদ্ধের উদ্যোগকালে দুর্যোধন যেভাবে নিজের শক্তিতে অটল থেকে পাণ্ডবদের এবং কৃষ্ণের আন্তরিক শান্তিপ্রস্তাব উড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে ভীষ্ম-বিদুর বলে থাকবেন– তোমার ছেলেদের ওপর তোমার স্নেহই তাদের কাল হয়েছে, শাসন করো, তীব্র শাসন করো তাদের। আর দ্বিতীয় অর্থ– দুর্যোধনের হঠকারিতায় কৃষ্ণ যেভাবে প্রায় অপমানিত হয়ে ফিরে গেলেন, তাতে ভীষ্ম-বিদুর নিশ্চিত বুঝে গেলেন যে, যুদ্ধ হবেই এবং সে-যুদ্ধ হলে এতকাল ধরে অপমানিত হয়ে-থাকা পাণ্ডবরা অবশ্যই প্রতিশোধ নেবেন। অতএব গান্ধারীর প্রতি ভীষ্ম বিদুরের প্রস্তাব আর মায়া বাড়িয়ো না। যত মায়া বাড়াবে দুঃখ পাবে। গান্ধারী যেভাবে কথা বলছিলেন, তাতে মনে হয় দ্বিতীয় অর্থকল্পই প্রাসঙ্গিক, কারণ তিনি নিজেও ভেবেছিলেন– কৃষ্ণের শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া মানেই এবার যুদ্ধ এবং কৃষ্ণের মতো ধুরন্ধর রাজনীতিবিদের সহায়তা মানেই সে পক্ষের জয় অনিবার্য। গান্ধারী তাই কৃষ্ণের কাছেই শেষ খেদোক্তি করে বললেন– যেদিন তুমি চলে গেলে এবং যেদিন ভীষ্ম-বিদুর আমাকে মায়া ছাড়তে বলেছিলেন, সেদিনই আমার ছেলেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গেছে, তারা মারা গেছে সবাই অচিরেণৈব পুত্রা মে ভস্মীভূতা জনার্দন।
এতক্ষণ একের পর এক শবদেহ অনুপুঙ্খ দেখা, তাও আবার আপন পুত্রদের শব, পুত্রবধূদের মর্মন্তুদ রোদন, গান্ধারী আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন রণস্থলেই। তবে জ্ঞান ফিরে পেতে তাঁর দেরি হল না। আসলে অবচেতন। মনে হয়তো অনেকক্ষণ ধরেই এই পাশের মানুষটির প্রতি রাগ হচ্ছিল। আসলে পাশের মানুষটি যে বড় বিশালবুদ্ধির মানুষ। তিনি ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ– চতুৰ্বৰ্গকে বড় বিশাল দৃষ্টিতে বোঝেন, আর বোঝেন সাময়িক প্রয়োজন এবং দূরভবিষ্যৎ। গান্ধারী খুব ভালভাবে জানেন যে এই মানুষটি যদি চিরকাল পাণ্ডবদের পাশে থেকে সহায়তা না করতেন, তা হলে এইভাবে অক্ষত থেকে সকল পাণ্ডবেরা এইভাবে যুদ্ধপথ পেরিয়ে আসতে পারতেন না। অথচ গান্ধারীর সব গেছে– একশো ছেলের একটিও বেঁচে নেই। অতএব চেতনা ফিরতেই তার এতক্ষণের অবদমিত সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ল কৃষ্ণের ওপর। পুত্রশোকে তার চিত্ত অধীর, ক্রোধে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে ততঃ কোপপরীতাঙ্গী পুত্রশোকসমন্বিতা। তার মনে হল– তাঁর নিজের যে ক্ষতি হয়েছে এবং যে ক্ষতি তাকে মনশ্চক্ষুতে দেখতে হয়েছে, অনুভব করতে হয়েছে, সেই ক্ষতি অন্তত সেই বিশেষ মানুষটিরই হোক, যিনি আপন পক্ষকে মসৃণভাবে সুস্থিত রাখতে পেরেছেন।
গান্ধারী বললেন– কৃষ্ণ! তুমি কিন্তু পারতে; একমাত্র তুমিই পারতে এই ভীষণ যুদ্ধ বন্ধ করতে। পাণ্ডব-কৌরবরা যখন পরস্পর ক্রুদ্ধ হয়ে নিজেদের বিনষ্ট করতে উদ্যত হল, তখন তুমি কেমন উদাসীন সাক্ষীর মতো হয়ে গেলে। কেন, কেন এমন করলে তুমি উপেক্ষিতা বিনশ্যন্ত স্বয়া কস্মাজ্জনার্দন। তুমি তো সমর্থ ছিলে, তোমার ক্ষমতা ছিল, তোমার কথা শোনবার লোক ছিল, বিশাল সৈন্যবল ছিল তোমার– তা তুমি কেন এমন করে উপেক্ষা করলে এই যুদ্ধ। কৃষ্ণের ক্ষমতা সম্বন্ধে গান্ধারী যেটা বলছেন, তার মধ্যে খানিকটা রাজনৈতিক অনুবন্ধ আছে। তার থেকে ব্যক্তি-সম্পর্কগুলি অনেক বেশি সযৌক্তিক হয়ে ওঠে বলে গান্ধারী বললেন– তোমার সঙ্গে কুরুকুল এবং পাণ্ডবকুল– দুই কুলেরই সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়, ফলে তুমি যদি তেমন করে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইতে তা হলে দু’পক্ষই তোমার কথা শুনত উভয় সমর্থেন তবাক্যেন চৈহ হি। এরপরেও যখন তুমি শুধু কুরুকুল-ধ্বংসের ব্যাপারেই উদাসীন হয়ে রইলে, তখন বুঝি, ইচ্ছে করেই তুমি এটা করেছ– ইচ্ছতোপেক্ষিতে নাশঃ কুরূণাং মধুসূদন।
আমরা জানি–ইচ্ছে করে কৃষ্ণ এ-কাজ করেননি। এটা অবশ্যই ঠিক যে, সেই জতুগৃহদাহ থেকে আরম্ভ করে কপট পাশা এবং বনবাস দুঃখের যে যন্ত্রণা পাণ্ডবদের ওপর দিয়ে গেছে, তাতে একেবারে শেষ কল্পে তাঁর মনে হতেই পারে যে, আর সহ্য করা নয়, এবার চরম আঘাত করা উচিত। কিন্তু সহ্য তো তিনিও কম করেননি। আন্তরিকভাবে শান্তির প্রস্তাব করেও যিনি পাণ্ডবদের জন্য পাঁচখানি গ্রাম পর্যন্ত জোগাড় করতে পারেননি এবং নিজেও যেখানে বন্দি হবার আশঙ্কায় ছিলেন দুর্যোধনের হাতে, সেখানে তাঁর মতো বিশালবুদ্ধি মানুষের দিক থেকে যুদ্ধ এড়িয়ে যাবার প্রশ্ন ওঠে না। এটা ঠিকই, কৃষ্ণ শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ চেয়েইছিলেন। স্পষ্টত নয়, তবে পাণ্ডবদের ওপর অন্যায় বঞ্চনা এবং অপমান আর তিনি সইতে পারছিলেন না। কিন্তু দীর্ঘদর্শিনী গান্ধারী অন্যায়কারী পুত্রের জননী, অত্যাচারী রাজার গর্ভধারিণী, শত ধর্মবোধ থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি যে, তাঁর পুত্ৰকৃত অন্যায়-অপমান এবং অসভ্যতা নিয়ন্ত্রণের শেষ বিন্দুটা কোথায়। ইচ্ছা করলেই যে কৃষ্ণ দুর্যোধনের মতো অহংমন্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন না সেটা গান্ধারী বোঝেন না বলেই, তিনি কৃষ্ণকে বললেন- এর ফল তোমাকে পেতে হবে– ফলং তস্মাদ অবাধুহি। তুমি যখন ইচ্ছে করেই বিনাশে প্রবৃত্ত দুই যুযুধান শিবিরকে উপেক্ষা করেছ, তাই আমার অভিশাপ তোমাকে সইতে হবে আমার যেমন হল, তেমনি তোমার বংশও ধ্বংস হবে। আজ থেকে ছত্রিশ বছর পরে মন্ত্রী, অমাত্য, ভাই-বন্ধু ছেলে সব হারিয়ে তোমাকে কুৎসিত উপায়ে মরতে হবে। তোমার বাড়ির বউরাও আমার বাড়ির বউদের মতো মাটিতে পড়ে কাঁদবে– স্ক্রিয়ঃ পরিপতিষ্যন্তি যথৈব ভরতস্ত্রিয়ঃ।
গান্ধারীর এই অভিশাপটুকু কতটা সত্য, তাতে আমার সন্দেহ আছে। তবে মহাকাব্যের কবি যখন এই অভিশাপ বর্ণনা করেন তখন তার মধ্যে একটা মহাকাব্যিক অভিসন্ধি কাজ করে। একদিকে এই অভিশাপ গান্ধারীর ধর্মবোধের অন্তরাল থেকে তার অবুঝ মনটাকে প্রকট করে তোলে, অপরদিকে তা মহাকাব্যের ঘটনা সমন্বয় করে, কৃষ্ণের মতো বিশালবুদ্ধি মানুষের নিতান্ত মানবিক মহাপ্রয়াণের ঘটনাটাকে এই অভিশাপ সযৌক্তিক করে তোলে। যিনি নিজের অযোগ্য পুত্রকে তেমন করে কোনওদিন বাক্যের শাসনে নিয়ন্ত্রণ করেননি, তার এই অভিশাপ দেওয়ারও যে যোগ্যতা নেই, সে-কথা কৃষ্ণের বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে। দ্বিতীয়ত কৃষ্ণের নিজের ঘরে তার ভাই-বন্ধু-আত্মীয়ের মধ্যে যে জ্ঞাতিবিরোধ অনেক দিন ধরে বাসা বাঁধছে, তার ফলেই যে তার নিজের বংশ ধ্বংস হবে এবং তার জন্য গান্ধারীর বাড়তি একটা অভিশাপের প্রয়োজন নেই, সেটা কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আবার কৃষ্ণের এই বিপরীত প্রতিক্রিয়ারও একটা মহাকাব্যিক অভিসন্ধি আছে। গান্ধারীকে কেউ কোনওদিন দোষারোপ করেনি, করার সাহসও নেই কারও। তার সমস্ত আচার-ব্যবহার এবং জীবনযাত্রার মধ্যে ধর্মের, ধর্মবোধের একটা প্রকট আবরণ আছে; সেটা যে নিতান্তই বাহ্য কোনও আবরণ বা তা নিতান্তই লোক-দেখানো অথবা তা একান্তই কোনও তথাকথিত আড়ম্বর, তাও আমরা বলতে পারি না। মহাভারতের কবি দেখাতে চান– গান্ধারীর মতো এমন গভীর ধর্মপ্রাণতার অন্তরালেও পুষ্পে কীটসম তৃষ্ণা জেগে রয়। মহাভারতের বিশাল-হৃদয় কবি দেখাতে চান যে, পুত্রস্নেহ এবং স্বার্থভাবনা এমনই এক বিষম বস্তু, যা সারা জীবন ধরে সেবিত-লালিত ধর্মচিন্তাকে বিদ্ধ করে ওপরে ফুটে ওঠে। মনুষ্য-স্বভাবকে অতিক্রম করে ওঠা গান্ধারীর মতো ধর্মদর্শিনী নারীর পক্ষেও অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
আরও একটা কথা– কৃষ্ণকে অভিশাপ দেবার সময় গান্ধারী বলেছিলেন– আমি যদি পতি-শুশ্রষা করে সামান্য তপস্যার ফলও পেয়ে থাকি; সেই তপস্যার সিদ্ধিতে তোমাকে আমি অভিশাপ দিচ্ছি– পতিশুশ্ৰষয়া যন্মে তপঃ কিঞ্চিদুপার্জিত। শুশ্রূষা’ মানে সকলেই ভাবেন সেবা, কায়িক এবং মানসিক সেবা। আমরা প্রকৃতি-প্রত্যাগত অর্থে ‘শুশ্রষা’ মানে জানি শোনার ইচ্ছে +স+অ। আমরা মনে করি, এই আক্ষরিক অর্থটা এখানে বড় জরুরি। হ্যাঁ অবশ্যই দু-একটি চরম মুহূর্তে গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রকে তার অন্ধ পুত্রস্নেহের জন্য তিরস্কার করেছেন, কিন্তু সেই দু-একবার ছাড়া ধৃতরাষ্ট্র যেমন বলেছেন, যেমন চেয়েছেন, তেমনটিই শুনে গেছেন, গান্ধারী, কোনও জায়গায় তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে সোচ্চারে অতিক্রম করেননি। অতিক্রম যখন করেছেন, তখন বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। ধৃতরাষ্ট্রের মতো স্বামীর প্রতি এই পাতিব্ৰত্য, এই পাতিব্ৰত্য ধর্মের অন্তরালে অন্যায়ী পুত্রের প্রতি প্রশ্রয়টাও কিন্তু অনুক্তভাবে নিহিত রইল। আমরা এটাকেই শুশ্রূষা বলি– ধৃতরাষ্ট্র যা বলেন, তাই তিনি শোনেন– এটা বলার চেয়ে ধৃতরাষ্ট্র যা চান, তাই তিনি জীবনভর শুনেছেন। গান্ধারীর অভিশাপের প্রতিক্রিয়ায় কৃষ্ণের নিষ্কপট বাক্য প্রতিক্ষেপ গান্ধারীর অন্তরাল-চরিত্রটাকে হঠাৎ করে বাইরে এনে ফেলে।
কৃষ্ণ বললেন– আমার বংশ যে এইভাবে ধ্বংস হবে, সেটা আমি নিজেই জানি, আমার জ্ঞাতি-বন্ধু যে কাজটা নিজেরাই করবে বলে আমি জানি, সেখানে একটা অভিশাপ দিয়ে আপনি খানিক পিষ্ট পেষণ করেছেন মাত্র– জানেহহম এতদপেবং চীর্ণং চরসি সুব্রতে। যাদব-বৃষ্ণিবংশের ধ্বংস হবে দৈববশেই এবং সেটা ধ্বংস আমিই করব। ওদের পরস্পরের মধ্যে যে বিবাদ বেধেছে, সেটাই তাদের ধ্বংসের পক্ষে যথেষ্ট, সেখানে আপনার অভিশাপটা খুব কিছু কাজে লাগবে না– পরম্পরকৃতং নাশং যতঃ প্রান্স্যন্তি যাদবাঃ। তার মানে কৃষ্ণ গান্ধারীর অভিশাপের যৌক্তিকতাটাই সদম্ভে উড়িয়ে দিলেন। এবং এই উড়িয়ে দেবার মধ্যে একটা সাংঘাতিক যুক্তি আছে। কৃষ্ণ বলতে চাইলেন– নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিপদটাই বংশনাশের কারণ এবং সেটা যেমন তার নিজের ব্যাপারে খাটে, তেমনই সেটা গান্ধারীর ব্যাপারেও খাটে।
কৃষ্ণ এবার কোনও ভণিতা, শ্রদ্ধাবেশ না দেখিয়ে বেশ কঠিনভাবেই বললেন– গান্ধাররাজনন্দিনী! এবার শোকতপ্ত ধূলিশয্যা ছেড়ে উঠুন, উঠে পড়ুন। অত শোক করে, অত অভিশাপ দিয়ে কোনও লাভ নেই। আপনার নিজের দোষেই এত শত লোক মরেছে এই যুদ্ধে-তবৈব হ্যপরাধেন বহবো নিধনং গতাঃ। এই যে দুর্যোধন– আপনার গুণধর ছেলে– তার মতো দুরাত্মা দুষ্ট দ্বিতীয় দেখিনি। ঈর্ষা-অসূয়া তাকে গ্রাস করে ফেলেছিল, অহংকার অভিমানেও ধরাকে সরা জ্ঞান করত, সেই দুর্যোধনের সমস্ত অপকর্মগুলির প্রতি আপনার প্রশংসা আছে বলেই আপনি তাকে ভাল বলে মনে করছেন– দুর্যোধনং পুরস্কৃত্য দুষ্কৃতং সাধু মন্যসে। একটা ছেলে, যে ভদ্র-সজ্জনদের সঙ্গে চিরকাল নিষ্ঠুর শত্রুতা করে যাচ্ছে, বৃদ্ধ সজ্জনের সমস্ত শাসনের বাইরে চলে গেছে যে মানুষটা, সেখানে তো আপনারই দোষ আছে, প্রশ্রয় আছে। সেই নিজের দোষটা পরের ঘাড়ে চাপানোর জন্য আপনি এখন আমাকে দূষছেন, আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন; বেশ কথা বটে– কণ্বম্ আত্মকৃতং দোষং ময্যাধাতুমিহেচ্ছসি।
গান্ধারীকে, চিরকালীন ধর্মদর্শিনী গান্ধারীকে এমন কড়া করে কেউ কথা বলেনি; কৃষ্ণ বলছেন, কারণ এতক্ষণ গান্ধারী নিজের ছেলের দোষগুলো ওপর ওপর বলেছেন বটে, কিন্তু সেই দোষগুলি গভীরভাবে অনুভব না করেই তিনি বারংবার ভীমকে অভিযুক্ত করতে চেয়েছেন, যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মনিত্য মানুষকে অভিশাপ দেবার কথা ভেবেছেন। কৃষ্ণ এতক্ষণ এই মানসিকতা দেখেছেন, সহ্য করেছেন, শেষে নিজেই যখন বিনা কারণে অভিশপ্ত হলেন, তখন কৃষ্ণ দেখলেন– এঁকে সত্য কথা শোনানো দরকার, কঠিন কথা কঠিন ভাবেই তাকে বলা দরকার, না হলে তার পুত্রশোকও প্রশমিত হবে না। কৃষ্ণ গান্ধারীর দোষ স্পষ্ট করে বলেই ঝটিতি ফিরে এলেন সেই দার্শনিক যুক্তিতে। বললেন–মৃত মানুষের জন্য শোক করা মানে অপরিহার্য বিনষ্ট অতীত নিয়ে শোক করা এবং সেটা এক কথায় দুঃখের ওপর দুঃখভোগ করা, দুটো অনর্থ একসঙ্গে লাভ করা- দুঃখেন লভ্যতে দুঃখং দ্বাবনর্থেী প্রপদ্যতে। পরিশেষ সত্যবাচনের পর কৃষ্ণ এই বলেই গান্ধারীকে সান্ত্বনা দিলেন যে, ক্ষত্রিয়া রমণী, বিশেষত আপনার মতো ক্ষত্রিয়া রমণী ছেলে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যাবে বলেই গর্ভধারণ করে–বধার্থীয়ং তদ্বিধা রাজপুত্রী। গান্ধারী চুপ করে গেছেন। কৃষ্ণের মতো সর্বংসহ মানুষের কাছে কঠিন কথা শুনে গান্ধারী আর একটিও কথা বললেন না। অনন্ত শোকের মধ্যেও হয়তো তিনি অনুভব করলেন– দুর্যোধনের চিরন্তন অন্যায়গুলির পিছনে তিনিও এক পরোক্ষ কারণ বটে।
.
০৮.
যুদ্ধশেষে অনেক শোক শান্ত হল না, শান্ত হয় না। এরই মধ্যে যুধিষ্ঠির রাজা হয়েছেন এবং তিনি ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীকে সর্বাধিক মর্যাদায় স্থাপন করেছেন– হয়তো এত মর্যাদা দুর্যোধনও দেননি কোনওদিন। স্বয়ং কুন্তী থেকে আরম্ভ করে দ্রৌপদী, সুভদ্রা সকলে গান্ধারীর নিত্যসেবায় নিযুক্ত হয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী যুধিষ্ঠির মহারাজকে যা বলতেন, সে কাজ সহজ হোক বা কঠিন হোক, যুধিষ্ঠির তা অবশ্যই পালন করতেন– গুরু বা লঘু বা। কাৰ্যং গান্ধারী চ তপস্বিনী। পাণ্ডব-ভাইরা প্রত্যেকেই জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের আদেশে গান্ধারী এবং ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি সম্মান-ব্যবহার করতেন বটে, কিন্তু ভীম অপ্রকাশ্যভাবে ধৃতরাষ্ট্রের অপ্রিয় কাজ কিছু করতেন এবং যুধিষ্ঠির সেটা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতেন না। অবশ্য ব্যবহারটা একটু পারস্পরিকও বটে। পাণ্ডবরা যতই ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করুন, দুর্যোধনের মৃত্যুর কথা মনে হলেই তিনি ভীমকেই একমাত্র শত্রু বলে মনে মনে ধারণা করতেন–তদা ভীমং হৃদা রাজন্ অপধ্যাতি স পার্থিবঃ। ভীমও সেই রকম। তিনি মাঝে-মাঝেই নিজের বশে-থাকা ব্যক্তিগত দাস-দাসীদের নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের নানা কাজে বিঘ্ন ঘটাতেন। সবচেয়ে বড় কাজ, যেটা যুধিষ্ঠিরের নজরেই কোনওদিন আসেনি, ভীম মাঝে মাঝেই ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীকে শুনিয়ে শুনিয়ে অন্যদের বলতেন– সংস্রবে ধৃতরাষ্ট্রস্য গান্ধাৰ্য্যাশ্চাপ্যমৰ্ষণঃ আমার এই হাত দুটো দেখেছিস-মুগুর, দুটো মুগুর, এই মুগুর দুটোর মধ্যে ফেলে অন্ধ রাজার সবগুলো ছেলেকেই আমি যমালয়ে পাঠিয়েছি। তোরা এই চন্দন মাখানো হাত দুটোকে পুজো কর, এই হাত দুটো দিয়েই দুর্যোধনকে আমি সপুত্ৰক শেষ করে দিয়েছি।
এ-সব কথা ধৃতরাষ্ট্র কিংবা গান্ধারী কারওরই ভাল লাগত না, তবু শুনতেন, শুনতে বাধ্য। হতেন গান্ধারী- গান্ধারী সর্বধর্মজ্ঞা, তান্যলীকানি শুবে। যুধিষ্ঠিরকে তিনি কিছু বলতে পারেননি, এবং ধৃতরাষ্ট্রকেও তিনি বলতে দেননি এবং সদাই যিনি গান্ধারীর সেবাব্রতে রত, সেই কুন্তীকেও কিছু বলতে চাননি গান্ধারী। বছর পনেরো এইভাবে চলার পর ভীমের মর্মন্তুদ কথাগুলি আর সহ্য হচ্ছিল না ধৃতরাষ্ট্রের। তিনি প্রচণ্ড আত্মগ্লানি অনুভব করে বানপ্রস্থে যাবেন বলে ঠিক করলেন। গান্ধারী এখানে দ্বিতীয় সত্তা মাত্র, ধৃতরাষ্ট্র যা করেন, তিনিও তাই করবেন এবং এখানে ধৃতরাষ্ট্রের কথা থেকেই জানতে পারি যে রাজার পরম পৃষ্ঠপোষণা থাকলেও ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী বাড়িতেই যথেষ্ট নিয়ম-ব্রত মেনে চলছিলেন। এবার সেটাকেই প্রথাগত বানপ্রস্থের আশ্রমিক-রূপ দেবার জন্য ধৃতরাষ্ট্র অনুমতি চাইলেন যুধিষ্ঠিরের।
যুধিষ্ঠির কিছুতেই ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীকে এই বৃদ্ধাবস্থায় বনে পাঠাতে চাইলেন না। যুধিষ্ঠিরের অন্তহীন অনুনয়ের মধ্যে এই কথাটা ভীষণ রকমের ভাল লাগে– তিনি বলেছিলেন– আমি কোনওদিন জননী গান্ধারী এবং আমার গর্ভধারিণী কুন্তীর মধ্যে তফাত করিনি– গান্ধারী চৈব কুন্তীচ নির্বিশেষা মতির্মম। গান্ধারীর দিক থেকে এই নির্বিশেষ স্নেহপ্রবৃত্তি কতটা, তা আমাদের পক্ষে বলা মুশকিল, অন্তত এখন এই মুহূর্তে হয়তো তার আর কোনও ক্ষোভ ক্রোধ নেই। শোকও পরিপক্ক হতে হতে একদিন হৃদয়ের মধ্যেই নিথর হয়ে যায়। গান্ধারীর একমাত্র কাজ এখন বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে যথোচিতভাবে অন্তিম গতির দিকে বয়ে নিয়ে চলা। সারা জীবন তিনি এই মানুষটার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, এমনকী অন্যায়গুলিও বহন করে এসেছেন। আজ এই বার্ধক্য-চর্যার দিনে গান্ধারী সব সময় স্বামীর পাশে সদা সর্বদা শারীরিকভাবে উপস্থিত। ব্ৰত-নিয়মে ঘরের মধ্যেই ধৃতরাষ্ট্র এখন বড় ক্লিষ্ট, কিন্তু সেই নিয়ম-আচার গান্ধারী কিন্তু পালন করছেন একই সঙ্গে, একই তালে। অথচ সেই ক্লিষ্ট শরীর নিয়ে এখন তিনি ধৃতরাষ্ট্রের ছায়াসঙ্গিনী। ধৃতরাষ্ট্র উঠলে তিনি ওঠেন, বসলে বসেন এবং তিনি আহার করলে নিজে আহার করেন। আর সত্যি, ধৃতরাষ্ট্র এখন শারীরিকভাবে এতটাই দুর্বল বোধ করেন মাঝে মাঝে যে, একটু বেশিক্ষণ কথা বললেও তাঁকে এখন গান্ধারীর স্কন্ধাবলম্বন খুঁজতে হয়। যুধিষ্ঠির নিজেও এই নির্ভরতা দেখে একদিন অবাক হয়ে বলেছেন–যে মানুষটার গায়ে হাজার হাতির বল ছিল, যিনি লৌহভীম চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন, সেই মানুষটা এখন অবলা রমণীর অবলম্বন গ্রহণ করেছেন– অবলাম আশ্রিতঃ স্ত্রিয়ম।
আসলে গান্ধারী যে ধৈর্যশীলা ধর্মদর্শিনী বলে পরিচিত হয়েছেন, তা এই কারণেই। আমরা এটাকে পাতিব্ৰত্য বলতে রাজি নই। অর্থাৎ এ কথা বলতে চাই না যে, ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি অনন্য-মানসিকতার জন্যই তিনি ধর্মদর্শিনী হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কী, অন্ধ স্বামীর প্রতি আনুগত্যে গান্ধারী যে বধূ-জীবনের আরম্ভেই কয়েক ফেরতা কাপড় বেঁধে নিয়েছিলেন, সেটা আমাদের কাছে খুব জরুরি। নিজে চক্ষুষ্মতী হওয়া সত্ত্বেও চোখের ওপর ওই কৃত্রিম আবরণখানি যেমন তার জীবনে কৃত্রিম অন্ধতা ঘনিয়ে এনেছে, তেমনি নিজের ধর্মবোধ পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও সারা জীবন তাকে নিজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে স্বামীর জন্য। তার অধর্ম এবং কুটিলতা গান্ধারীকে বহন করতে হয়েছে চোখে ঠুলি পরে। মহাভারতের কবি বুঝিয়ে দেন চিরন্তন ধর্মের স্ত্রীলোকের স্বাতন্ত্র নেই। স্বামীর অধর্ম নিজের ঘাড়ে বহন করতে করতে আজ তিনি বুড়ো হয়ে গেছেন। আজ তার পুত্র-মিত্র-ভাই-বন্ধু সব চলে গেছে কোথায়, তবু বেঁচে থাকা স্বামীর ধর্ম-যাত্রায় আজ তিনি প্রধান অবলম্বন। ব্রত-নিয়ম-ক্লিষ্ট অনুতপ্ত স্বামীকে আজও তিনি শরীর দিয়ে ধারণ করে চলেছেন– গান্ধারীং শিশিয়ে ধীমান্ সহসৈব গতাসুবৎ।
বনযাত্রার সময় ধৃতরাষ্ট্র সমস্ত প্রজাদের একত্রিত হবার জন্য যুধিষ্ঠিরকে অনুরোধ করলে নির্দিষ্টস্থানে কুরুজাঙ্গল দেশের প্রজারা একত্রিত হল যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে। ধৃতরাষ্ট্র সেখানে যুধিষ্ঠিরের অকুণ্ঠ প্রশংসা করার পর দুর্যোধনকে প্রশ্রয় দেবার অন্যায়টুকুও স্বীকার করেছেন। ধৃতরাষ্ট্র সেদিন অসম্ভব সুন্দর ভাষণ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন– পরম্পরাক্রমে আমার পিতা-পিতামহরা যে শাসন চালিয়ে এসেছেন, তাতে আপনাদের প্রতি কোনও অন্যায় আমরা করিনি। এমনকী আমার পুত্র দুর্যোধন যখন এই রাজ্য শাসন করেছে, তখনও সেই দুবুদ্ধি মূর্খ আপনাদের কাছে কোনও অপরাধ করেনি। কিন্তু সে আপন অহংকার এবং মূর্খতায় যে বিশাল যুদ্ধ ডেকে এনেছিল, সেখানে আমারও অন্যায় দুর্নীতি কিছু আছে– বিমর্দঃ সুমহানাসী অনয়াৎ স্বকৃতাদথ। সে যুদ্ধে কৌরবরা নিহত হয়েছে, পৃথিবীও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এ-কাজটা আমি ভাল করেছি, কী মন্দ করেছি, অথবা যা কিছুই করে থাকি আপনারা সে-সব মনে রাখবেন না, আমি এই সবার সামনে হাত জোড় করলাম– তদ্বো হৃদি ন কর্তব্যং ময়া বন্ধোয়মঞ্জলিঃ।
সমস্ত ভাষণটার শেষে মর্মস্পর্শী ভাষায় যখন ধৃতরাষ্ট্র সমস্ত প্রজাপুঞ্জের কাছে বিদায় চাইছেন, তখন নিজের সঙ্গে তিনি তার চিরন্তনী সহধর্মচারিণীর জন্যও বিদায় চেয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন- আপনাদের এই রাজা বৃদ্ধ, পুত্রহীন এবং প্রাচীন রাজাদের বংশধর, অতএব সব ক্ষমা করে আমাকে অনুমতি করুন। আমার সঙ্গে আছেন আমার স্ত্রী গান্ধারী, তিনিও এখন করুণার পাত্রী, তিনিও বৃদ্ধা হয়েছেন, সবগুলি পুত্র হারিয়ে শোকার্তাও বটে, তিনিও আমার মাধ্যমে আপনাদের কাছে বনগমনের অনুমতি চাইছেন– গান্ধারী পুত্রশোকার্তা যুম্মান যাচতি বৈ ময়া। আমি জানি আমার লুব্ধ দুর্মতি পুত্রেরা অনেক স্বেচ্ছাচার করেছে, সেজন্য আমি আমার স্ত্রী গান্ধারীর সঙ্গে একত্রে সকলের কাছে ক্ষমা চাইছি– যাচেহদ্য বঃ সর্বান্ গান্ধারীসহিতোহনঘাঃ।
গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বনগমনে উদ্যত হলে রাজমাতা কুন্তী একেবারে অভাবিত তৎপরতায় গান্ধারীর সঙ্গে সঙ্গে চলতে আরম্ভ করলেন। যুধিষ্ঠির এবং অন্যান্য পাণ্ডব ভাইদের কল্পনার মধ্যেও ছিল না, অথচ কুন্তী বললেন– গান্ধারী আমার শাশুড়ির মতো ধৃতরাষ্ট্র আমার শ্বশুর-কল্প। আমি বনের মধ্যে আমার এই শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করব শ্ব-শ্বশুরয়োঃ পাদান শুশ্রষন্তী বনে ত্বহম। কুন্তী কারও কথা শোনেননি, কনিষ্ঠ সহদেবকে তিনি এত ভালবাসতেন, তার দিকেও আর ফিরে তাকাননি। এমনকী ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে গান্ধারীও তাকে অনুরোধ করেন–ইত্যুত্ত্বা সৌবলেয়ী তু রাজ্ঞা কুন্তীমুবাচ হ– কিন্তু কুন্তী কারও কথা না শুনে গান্ধারী এবং ধৃতরাষ্ট্রের অনুগমন করেন। সবার আগে কুন্তী পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন বদ্ধনেত্রা গান্ধারীকে, গান্ধারীর হাত কুন্তীর কাঁধে, আর অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের হাত গান্ধারীর কাঁধে কুন্তী গান্ধারীং বন্ধনেত্ৰাং ব্রজন্তীং… রাজা গান্ধাৰ্যাঃ স্কন্ধদেশেহবসজ্য।
এ যেন অদ্ভুত এক ফিরিয়ে দেওয়া, কুন্তীর সঙ্গে কোনওদিন গান্ধারী এই ব্যবহার করতে পারেননি। ছেলেরা বনবাসে যাবার পর কুন্তী বিদুরের ঘরেই ছিলেন, কিন্তু একদিনের তরেও গান্ধারীকে মিলিত হতে দেখিনি কুন্তীর সঙ্গে। হয়তো ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধতায় তাঁকেও অন্ধ হয়ে থাকতে হয়েছে চিরকাল, তার ঈর্ষা-অসূয়ার বস্ত্র-আবরণ চোখে লাগিয়ে কোনওদিন গান্ধারী তার ভগিনী-প্রতিমা কুন্তীর প্রতি স্নেহ-মমতা দেখাতে পারেননি। আজ কুন্তী ধৃতরাষ্ট্রের অনুগমন করে তাকেই যেন বুঝিয়ে দিলেন– গান্ধারীকে তিনি অন্ধ পথে চালিত করেছিলেন।
বনের মধ্যে যথোচিতভাবে ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীর সেবায় নিযুক্ত হলেন কুন্তী। সঙ্গে আছেন চিরস্নিগ্ধ বিদুর এবং সঞ্জয়। এখন গান্ধারীর যে অবস্থাটা চলছে, তার সবটাই আশ্রমিক অবস্থান। প্রথমে শতকূপের আশ্রম, তারপর বেদব্যাসের আশ্রম, পরিশেষে গভীর নির্জন বনপথে। এরই মধ্যে বিদুর যোগবলে দেহত্যাগ করেছেন এবং যুধিষ্ঠির এবং অন্যান্যরা বনে এসে দেখা করেছেন ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী এবং কুন্তীর সঙ্গে। তিনি সবাইকে নিয়ে অন্তত একমাস এখানেই আছেন। পরবর্তী অধ্যায়ে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর অরণ্য আশ্রমে এসেছেন ব্যাস, দ্বৈপায়ন ব্যাস– গান্ধারী-কুন্তীর শ্বশুর। তিনি এসে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীকে তপস্যা-ব্রত নিয়ম বৈরাগ্যের উত্তরোত্তর কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। ব্যাসের দিক থেকে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল– এত তপস্যা, ব্রত, নিয়ম করছ। তা এতদিনে তোমাদের মন থেকে পুত্র বিনাশের দুঃখ দূর হয়েছে তো– কচ্চি হৃদি ন তে শোকো রাজন পুত্র-বিনাশজঃ?
ব্যাস সেদিন অনেক কথা বলেছেন, অনেক উপদেশ দিয়েছেন এবং একটি ইচ্ছাপূরণের স্বপ্নও দেখিয়েছেন সবাইকে। বলেছেন– কী চাও বল, ধৃতরাষ্ট্র! তোমার অভীষ্ট আজ পূরণ করব তপস্যার বলে। আসল কথাটা কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র বলতে পারলেন না। ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা শোক-দুঃখ, যুদ্ধ, ছেলের দোষ, নিজের দোষ, নিরীহ মানুষের ক্ষয় ইত্যাদি বিকীর্ণ বিষয় উচ্চারণ করে সেই ধ্রুবপদে চলে এলেন– আমি এখনও শান্তি পাচ্ছি না। শোকে, দুঃখে, চিন্তায় আমার মনে এখনও সেই অস্থিরতা আছে। ধৃতরাষ্ট্রের এই স্মৃতিকাতর অবস্থা দেখে গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা সকলেরই পূর্বস্নেহ, পূর্বসুখ, আবারও শোকের স্বরূপ জাগ্রত করে দিল মনে মনে। এই অবস্থায় শোকার্ত গান্ধারী সবার সামনে উঠে দাঁড়ালেন। অন্ধ স্বামীকে তিনি সবচেয়ে ভাল চেনেন, তার কথাগুলো বুঝে নিতে হয়, তিনি স্পষ্ট করে মনের ঠিক ইচ্ছেটা বলেন না, ঠিক ইচ্ছেটা অন্যকে ভাল করে বুঝতেও দেন না।
দ্বৈপায়ন ব্যাস সরল মানুষ, এইসব অস্পষ্ট ধূসর শব্দরাশি তিনি কবির ব্যঞ্জনাতে বুঝলেও ধৃতরাষ্ট্রের মুখে এখনও সেই নিরুচ্চার দ্বৈভাষিকতা দেখে অবাক হন। এই অবস্থায় ধৃতরাষ্ট্রের ধর্মচারিণী দ্বৈভাষিক উঠে দাঁড়িয়েছেন তপস্বী যোগীর সামনে। তিনি বলেছেন– অন্য কিছু না। মুনিবর। ইনি পরলোকগত পুত্রদের দেখতে চান এবং আপনি সেটা বুঝতেও পারছেন– লোকান্তরগতা পুত্রান অয়ং কাঙক্ষতি মানদ। সেই যুদ্ধের পর আজকে ষোলোটা বছর কেটে গেল, মুনিবর! পনেরো বছর পাণ্ডবদের ঘরে কাটিয়েছি, আর এই বনে বনে এক বছর কেটে গেল। কিন্তু ষোলো বছর ধরেই ইনি ছেলেদের জন্যেই শোক করে যাচ্ছেন, কোনও শান্তি আসেনি তার মনে– অস্য রাজ্ঞো হতান পুত্রান শোচতো ন শমমা বিভো। এখনও সারারাত ইনি ঘুমোন না এবং যেভাবে তার রাত্রির নিঃশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়, তাতে বুঝি এখনও তিনি কিছুই ভোলেননি। গান্ধারী বোধহয় বোঝাতে পেরেছেন যে, তার নিজের অন্তত এই অবস্থা নয়। আপন অন্তরস্থিত দার্শনিক বোধে আজ তিনি সমস্ত শোকই কাটিয়ে উঠেছেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র যেমন এখনও রাত্রে ঘুমোতে পারেন না, তেমনটা না হলেও কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা, উত্তরা এবং অন্যান্য কৌরব-কুলবধূরা এখনও যে মৃত স্বামী-পুত্রের কথা স্মরণ করে কষ্ট পান, গান্ধারী সে-সব দুঃখ-কথা তপস্বী শ্বশুরকে জানিয়ে সকল বধূদের মনস্তত্ত্বটাও বলেছেন ব্যাসের কাছে। বলেছেন– ওরা যে আমাকে আর ধৃতরাষ্ট্রকে আরও বেশি বেশি করে সেবা করে, আমার সেবার জন্য যে বেশি আড়ম্বর করে, তার কারণ, ওরা পূর্বগত শোক ভুলতে না পেরে ব্যস্ত রাখে নিজেদের– তেনারম্ভেন মহতা মাম্ উপাস্তে মহামুনে।
গান্ধারী সকলের কথা বলেছেন, নিজের কথা বলেননি। প্রধানত সেই স্বামীর কথা ভেবেই গান্ধারী ব্যাসকে বললেন- আপনি তো সব পারেন, ঠাকুর! আপনি তপোবলে সেই মৃত্যুলোক নিয়ে আসতে পারেন আমাদের সামনে, যেখানে এই বৃদ্ধ রাজার পরলোকগত পুত্রদের দেখা যাবে। বেদব্যাস সকলের কথা বাদ দিয়ে গান্ধারীকে বললেন–ভদ্রে! তুমি ছেলে, ভাই, বন্ধু, সবাইকে দেখতে পাবে– ভদ্রে দ্রক্ষ্যসি গান্ধারি পুত্রা ভ্রাতৃ সখীংস্তথা– অন্যেরাও যাঁরা আছেন এখানে, কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা এবং তোমার পুত্রবধূরা সকলেই তাদের প্রিয়জনদের দেখতে পাবে– রাতের ঘুমে জেগে উঠে সুখস্বপ্ন দেখার মতো নিশি সুপ্তোথিতান্ ইব। ব্যাসের করুণায় সকলে দেখতে পেলেন সবাইকে এবং দেখলেন সেখানে কোনও শত্রুতা নেই, ভেদ নেই, ঈর্ষা নেই, অসূয়া নেই। গান্ধারী, কুন্তী, ধৃতরাষ্ট্র সকলে পরম তৃপ্তিতে শান্তি পেলেন।
হয়তো এই আরও একবার জীবন্ত দর্শন সকলের পক্ষেই কাম্য ছিল, অশান্ত হৃদয় দমন করার জন্যই হয়তো এই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু স্বপ্ন মিলিয়ে গেলে যেমন আর দুঃখ থাকে না, ঠিক সেইভাবেই গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্র একেবারেই শান্ত হয়ে গেছেন এবার। আরও দুবছর এর পরে কেটেছে। যুধিষ্ঠির সকলকে নিয়ে ফিরে এসেছেন এবং দু-বছর পরে নারদের কাছে খবর পেয়েছেন যে, এই দু-বছর ধরেই গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্র এবং কুন্তী কঠোর নিয়ম-ব্রতে দিন কাটিয়েছেন এবং পরিশেষে দাবাগ্নি-জ্বালায় আত্মাহুতি দিতেও তাদের আর কোনও কষ্ট হয়নি। মন-বুদ্ধি-চিত্তকে যোগ সমাধিতে নিমগ্ন করে দাবাগ্নিদাহে ভস্মীভূত হয়ে গেলেন গান্ধারী।
সারা জীবন যত অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে, স্বামী-পুত্রকে নিয়ে যত বিপরীত পরিস্থিতি তাকে দেখতে হয়েছে, সেই তুলনায় গান্ধারীর শেষ জীবন এবং মৃত্যু বড় অনাড়ম্বর। যেদিন রাজবাড়ির বধূ হয়ে এসেছিলেন গান্ধারী, সেদিনও খুব আড়ম্বরের প্রশ্ন ছিল না। কেননা তার স্বামী রাজা ছিলেন না। কিন্তু সুস্থিতভাবে তার স্বামী যদি রাজা হতেন, তা হলেও বুঝি এত বৈপরীত্যের মধ্যে তাকে পড়তে হত না যদি না অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মনের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার জটিলতা বাসা বাঁধত। তার সঙ্গে পুত্র দুর্যোধন, যিনি ছলে-বলে-কৌশলে পিতার উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরম্পরা বহন করেন আপন রক্তের মধ্যে। আমরা এটাকেই গান্ধারীর পক্ষে বিপরীত পরিস্থিতি বলেছি। আমরা গান্ধারীর জীবনটা অনুপুঙ্খভাবে দেখেছি। তিনি কিন্তু এই উচ্চাকাঙ্ক্ষায় শামিল ছিলেন না–স্বামীর-পুত্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে সংক্রমিত হয়নি কোনওদিন, কিন্তু স্বামী-পুত্রের চাপে তাকে এমনই এক অবগুণ্ঠনের মধ্যে থাকতে হয়েছে, যাতে মনে হবে যেন তিনিও পরোক্ষে আছেন তার স্বামী-পুত্রের সঙ্গে। কিন্তু থাকাটা যে কতটা না-থাকা সেটা বুঝতে পারা যায় চরম সব মুহূর্তগুলিতে। পুত্র-স্নেহের মধ্যেও তার কত যন্ত্রণা যুদ্ধের সংশয়িত মুহূর্তেও যার জয়েচ্চারণ ঘোষণা করা যায় না, যার জীবন কামনা করা যায় না, জননীর স্নেহের রাজ্যে এটা কতটা প্রতিকূল, কতটা বিপরীত পরিস্থিতি। এই বৈপরীত্য নিয়েই গান্ধারীর জীবন কেটেছে চিরকাল। একদিকে স্বামী-পুত্রের বিষয়ের প্রতি জর্জরিত লোভ, অন্যদিকে সেই স্বামী-পুত্রের প্রতিই জায়া-জননীর মোহ-স্নেহ, অথচ চরম এক মুহূর্তে হৃদয়ের সমস্ত বৈপরীত্য স্তব্ধ করে দিয়ে বলতে হয়– পুত্র! তুমি সাবধানে থেকে রণক্ষেত্রে নিজেকে রক্ষা করে চলো, তবে মনে রেখো– ধর্ম যেদিকে জয় হবে সেইদিকেই। এইভাবে এই বৈপরীত্যের মধ্যে যিনি ধর্মকে আন্তরিকভাবে ধরে রাখতে পারেন, মহাভারতের কবি তার নাম দিয়েছেন গান্ধারী আর কালিদাস তাকে বলেছেন পার্বতীর হাসি– যে হাসিতে দন্তগুলি স্ফুট হয় না অথচ হাসিটুকু বোঝা যায়, যে হাসিকে নতুন কচি তাম্রাভ পাতার মধ্যে মুক্তো বসিয়ে বুঝতে হয়– তিনি গান্ধারী।