০৭. কুন্তী
০১.
আমি এই মাটির পৃথিবীতেই এমন মানুষ অনেক দেখেছি, যাঁদের সাধারণ সমাজ-সচল নীতি-নিয়ম-শৃঙ্খলা দিয়ে বিচার করা যায় না। করা যায় না, কারণ, প্রথমত তারা সামাজিক রীতি-নীতির তোয়াক্কা করেনি এমন হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে, তাদের জীবন এমনভাবেই তৈরি হয়েছিল অথবা ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যেই এমন ধরনের বিপন্নতা মাথায় নিয়ে তাদের জীবন আরম্ভ করতে হয়েছে যে, নিয়ম-নীতি না ভেঙে তাদের উপায় ছিল না। কিংবা বিপন্নতা সামাল দিতে গিয়ে সামাজিক নিয়মটা যে তারা ভেঙে ফেললেন, এটা তাদের বোধের মধ্যেও আসে না। কিন্তু সামাজিক মানুষ যখন এইসব মানুষের বিচার করেন, তখন তারাও যে খুব নির্মম হয়ে ওঠেন, তা কিন্তু নয়। সমস্যা হল, নির্মম না হয়ে ওঠার জন্য যুক্তির প্রয়োজন হয়, এবং আরও যেটা প্রয়োজন হয়, সেটা হল–প্রিয়জনোচিত সংবেদনশীলতা। আমার মনে আছে– আমি আমার বেশি বয়সি দাদা-প্রতিম দু-একজনের কাছে শুনেছি যে, বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাট দশকে বাংলার এম, এ. ক্লাসে শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ নিয়ে এই ধরনের প্রশ্ন আসত যে, আচ্ছা! অচলাকে কি সতী বলা যায়? অথবা শ্রীকান্তের রাজলক্ষ্মীকে?
পরীক্ষার প্রশ্নে, বিশেষত শরৎচন্দ্রের স্ত্রীচরিত্র নিয়ে যত সমালোচনা হয়েছে, তাতে সংস্কার-স্থিত মানুষেরা যত তিরস্কারই করুন শরৎচন্দ্রকে, বুদ্ধিজীবী শিক্ষিত লোকের কিন্তু একটা লোকদেখানো দায় থাকে, নিজে সংস্কারবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তার প্রগতিশীল হবার দায় থাকে। ফলে উপরি উক্ত প্রশ্নে প্রশ্নকর্তা তর্কযুক্তির মাধ্যমে সেই উত্তর আশা করতেন, যেখানে অচলা অথবা রাজলক্ষ্মীকে তাদের শতেক সামাজিক অতিক্রম সত্ত্বেও সতী বলে প্রতিপন্ন করা গেছে। উত্তরদায়ী ছাত্র-ছাত্রীরাও বহুতর তর্কযুক্তি সাজিয়ে আবেগ-গম্ভীর কারুণ্যে অচলা বা রাজলক্ষ্মীকে চরম সতী প্রতিপন্ন করে শরৎচন্দ্রের সম্মান রাখার চেষ্টা করতেন এবং তাতেই নম্বর পেতেন। বলা বাহুল্য, সাংস্কারিক সমাজের মধ্যে থেকে যে মানুষ এই ধরনের প্রশ্ন করছেন অথবা যে-সব ছাত্র-ছাত্রীরা প্রায় একইরকম তর্কযুক্তি সাজিয়ে একই মর্মে অচলা বা রাজলক্ষ্মীকে সতী বলে প্রমাণ করবার চেষ্টা করছেন, তার মধ্যে একটা অসম্ভব রকমের কৃত্রিমতা আছে। অর্থাৎ কিনা, সমাজ এটা মানবে না, সামাজিক মানুষ। এটাকে স্বীকার করবে না, কিন্তু ব্যক্তিবিশেষের প্রতি সামাজিক প্রবঞ্চনা অথবা পৌরুষেয় প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে একটা যুক্তিসিদ্ধ সরব প্রতিবাদ করার জন্য কৃত্রিমভাবেও প্রগতিশীল হয়ে ওঠাটা নিতান্ত জরুরি হয়ে পড়ে। আসল জায়গায় সমাজের সাংস্কারিক সত্য কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতেও এটাই যে, স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ সতীত্বের বাইরে যদি কোনও রমণীর অন্যতর কোনও ভাল-মন্দ সম্পর্ক তৈরি হয়, তা হলে চর্চার বিষয় হিসেবে সেই রমণীচরিত্র ভীষণই ‘ইন্টারেস্টিং’ বটে; কিন্তু তাকে যদি সমর্থন করতে হয়, কিংবা তবুও তাকে যদি সতী বলতে হয়, তবে শুধুমাত্র তার জীবনযাপনের পূর্ব জটিলতা এবং ততোধিক বিচিত্র সামাজিক প্রবঞ্চনার কারণেই তার চরিত্র সমর্থনীয় হয়ে উঠতে পারে এবং ঠিক এই ধরনের ‘প্রিকনডিশনে’ই তার জীবন বহুতর যৌক্তিকতায় সহনীয় হয়ে উঠতে পারে। তা নইলে বাস্তব জীবনে একজন অচলা বা রাজলক্ষ্মীর অবস্থিতি মানুষ যদি একবার টের পায়, তা হলে এই মুখর জগতের সুখ আস্বাদনের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের কৃত্রিম সদুত্তর নিয়েও এগিয়ে আসবেন না, আর প্রশ্নকর্তারা সারাজীবন শুধু প্রশ্নই করে যাবেন, তারা উত্তর লেখেন না, শুধুই নম্বর দেন।
তবে কিনা রমণীর চরিত্র নিয়ে কথা! এ-বিষয়ে উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিত্র, ব্রাহ্মণ-শূদ্র সকলেই শুধু কথা বলতেই ভালবাসে না, রমণী-চরিত্রের শুদ্ধতা নিয়ে সন্দেহ করাটা একটা সার্বিক মুখরতার বিষয়– ভবভূতি আরও একটু বুদ্ধিদীপ্তভাবে বলেছিলেন– কবির কবিত্ব-শব্দ এবং স্ত্রীলোক– এই দুয়ের সাধুত্ব নিয়ে দুর্জন মানুষেরা সবসময়েই বড় মুখর- যথা স্ত্রীণাং তথা বাচাং সাধুত্বে দুর্জনে জনঃ। তবে মহাকবি হলেও সুজন বলেই ভবভূতির একটা ভুল থেকে গেছে। স্ত্রীলোকের চরিত্র নিয়ে মুখরতায় শুধুমাত্র দুর্জনেরাই একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করেন না, এ বিষয়ে আগেই বলেছি– সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সার্বিকভাবে আগ্রহী। এর মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা বলেন সবচেয়ে সতী রমণীরা। আমার জীবনে দু-চারজন সতী-রমণীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার ঘটেছে। অহো ভাগ্য! এঁরা স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষ জানেন না। এই আধুনিক যুগেও তারা সর্বক্ষণ সোচ্চারে সোচ্ছাসে এমনভাবেই স্বামীর কথা জানান দেন, যাতে মনে হয় অন্য যত বিবাহিতা রমণীরা স্বামীনিষ্ঠতায় ভীষণভাবেই পিছিয়ে আছেন এবং সামান্যতম হলেও অন্যতরা রমণীরা যেন একটু অন্যমনেও রয়েছেন। এই ধরনের কঠিন সতীচ্ছদের অন্তরালে এঁদের স্বামীরা ঠিক কেমন আছেন, সেটা আমার জানা হয়নি ভাল করে, তবে এঁদের একজন স্বামীকে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তিনি বাথরুমে যাবার আগেও স্ত্রীকে মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করেন এবং সেটা আমার শ্রুত হওয়ায় আমার দিকে তাকিয়ে তীব্র স্বরে সেই সতী আমাকে বলেছিলেন– দেখলেন তো আপনার বন্ধুর অবস্থা! এরা নাকি আবার পুরুষ মানুষ। একটি কাজও নিজে করার ক্ষমতা নেই। জনান্তিকে বলে রাখি– উপর্যুক্ত স্বামী পুরুষদের আমি কিন্তু স্ত্রৈণ বলি না, কেননা এটা বেশ বুঝি যে, স্ত্রৈণতার যদি কোনও মুখ্যার্থ থাকে, তবে আপন স্ত্রীর প্রতি যৌনতাও এখানে স্ত্রীর আদেশ-সাপেক্ষ, কেননা সেখানে পারস্পরিকতার কোনও প্রশ্নই নেই।
আমি এত কথা এই তথাকথিত সতীদের নিয়ে বলতাম না, কিন্তু এই ধরনের স্বামী অন্তঃপ্রাণা সতীদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য যেটা দেখেছি, সেটা হল– যে-কোনও সামান্য কামগন্ধময় যৌন বিষয়ে এঁদের নিরলস আগ্রহ এবং অন্যতরা রমণীকুলের পোশাক-পরিচ্ছদ, প্রগম্ভতা তথা তাদের জীবনে পৌরুষেয় সংক্রমণের আশঙ্কা-বিষয়ে সার্বক্ষণিক মুখরতা। পরিশেষে অবশ্যই সেখানে আপন সতীত্বের জয়গান তাঁদের নিজেদের মুখেই নেমে আসে, কিন্তু পরিশেষের আগ পর্যন্ত অন্যান্য হাজার রমণীদের সমস্ত আচরণই যে ত্রুটিপূর্ণ এবং তাদের সমস্ত অভিমুখই যে যৌনতার দিকে– এই সুবিশাল তীব্র সমালোচনার মধ্যে তাদের নিজেদের মনস্তাত্ত্বিক গহন সব সময়েই উহ্য থাকে। তাদের আলোচ্য বিষয় যে অনর্থক তথা নঞর্থকভাবে যৌনতারই আলোচনা– সেটা অপ্রমাণ হয়ে ওঠে শুধুমাত্র তাদের পরিশিষ্ট সিদ্ধান্তে আমরা এরকম নই বাবা! কিন্তু সত্য কথা বলতে আমরা কিছুতেই পিছুপা নই, যেটা বলার, সেটা আমরা বলবই।
সত্য কথাটা যে কী, তা কে জানে! অথবা তাদের সতীত্বের এই কাঠিন্য এবং অসতীত্বের বিষয়ে সার্বক্ষণিক চর্চাটা অবদমিত কোনও যৌনবিলাস কিনা সে-কথা ফ্রয়েড সাহেব বলতে পারবেন, তবে আমাদের মহাভারতের কুন্তীকে নিয়ে সতীত্বের একটা চিন্তা-তর্ক যে উঠেছিল, সেটা পরিষ্কার হয়ে যায় বেশ প্রাচীন একটা লোক-কথিত শ্লোক থেকে। কথাটা গবেষকদের মতো পাণ্ডিত্যের চালে না বলে একটু কায়দা করে বলি।
.
০২.
সবই কপাল গো দিদি, সবই কপাল। কপাল ভাল থাকলে হাজারো দোষ থাকুক, তবু লোকে সুখ্যাত করবে, আর কপালের জোর না থাকলে তার অবস্থাটা হবে ঠিক আমার মতো।
একাধারে দুঃখ, অভিমান এবং ক্রোধ মেশানো এই কথাগুলো শুনে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন অন্যতর এক মহিলা। জিজ্ঞাসা করলেন– তোর কী এমন কপাল পুড়ল যে সাত সকালেই বকর-বকর আরম্ভ করেছিস?
আজ থেকে বহুকাল আগে, মহাভারতের যুগ যখন চলে গেছে, শাস্ত্র আর আচারের বিষম বাঁধনে সমগ্র নারী সমাজকে যখন বেঁধে ফেলা হচ্ছে, তখন এই কথোপকথন চলছিল বলে আমরা মনে করি। যে ভদ্রমহিলা কপালের কারসাজি নিয়ে খুব চিন্তিত, তিনি আর কিছুই নয়, হয়তো দু-একজন পুরুষ-পড়শির সঙ্গে একটু আধটু রসিকতা করে ফেলেছেন, তাতেই পাড়ার পাঁচজনে পাঁচরকম গল্প বানিয়ে ফেলল। ভদ্রমহিলার নিন্দে হল যথেষ্ট।
তা এরকম ঘটনা ঘটলে কার না দুঃখ হয়। মনের দুঃখে তথা সময়মতো ব্যথার ব্যথী আরও এক মহিলাকে সামনে পেয়ে তিনি প্রথমেই পুণ্যবতী পাঁচ কন্যের শিকড় ধরে টান দিলেন। পুণ্যবতী পাঁচ কন্যে মানে– সেই পাকনাশিনী পাঁচ কন্যে, যাঁদের কথা সকালে উঠেই স্মরণ করতে বলেছেন শাস্ত্রকারেরা অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।
আমাদের এই মহিলাটি অবশ্য রামায়ণ-বিখ্যাতা অহল্যা, তারা এবং মন্দোদরীকে দয়া করে ছেড়ে দিয়েছেন। তার আক্রমণ এবং আক্রোশ প্রধানত দু’জনকে লক্ষ করে– কুন্তী এবং দ্ৰৌপদী। কাজেই অন্যতরা যখন সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করল– কী এমন হল যে কপালের দোষ দিচ্ছ– তখন তিনি জিহ্বার বাঁধন খুলে মহাভারতের প্রবীণা এবে নবীনা– দুই নায়িকার মুখে ঝামা ঘষে দিলেন। বললেন– কপাল না তো কী? পাঁচ-পাঁচটা পুরুষ মানুষ ওই কুন্তীর সঙ্গে আশনাই করেছে, কামনা করে সঙ্গ দিয়েছে; আর তার ব্যাটার বউ দ্রৌপদী তাকেও কামনা করেছে পাঁচ-পাঁচটা পুরুষ–পঞ্চভিঃ কামিতা কুন্তী তবধূরথ পঞ্চভিঃ। তবু এঁরা হলেন গিয়ে সতী। তা, একে কপাল বলব না তো কী? পোড়া কপাল আমার! লোকেও এদের সতী বলে। তাই বলছিলাম–কপাল থাকলে কীই বা না হয়– সতীং বদতি লোকোহয়ং যশঃ পুণ্যৈরবাপ্যতে।
বলতে পারেন–এ আমার ভারী অন্যায়। মহাভারতের এক প্রবীণা নায়িকার চরিত কথা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রথমেই এমনভাবে কথাটা আরম্ভ করলাম যাতে কুন্তীর মর্যাদা লঙ্ঘিত হতে পারে। অন্তত অনেকেই তাই ভাববেন। তবে আমার দিক থেকে সাফাই গাইবার দুটো রাস্তা আছে। এক প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর হয়তো বা উপরিউক্ত সংস্কৃত শ্লোকটি দেখে উৎসাহিত হয়েই কুন্তীর সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে মহামতি বঙ্কিমচন্দ্রের গালাগাল খেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর ‘কবিরত্নপ্রকরণে’ লিখেছিলেন– “কোনও সম্পন্ন ব্যক্তির বাটীতে মহাভারতের কথা হইয়াছিল। কথা সমাপ্ত হইবার কিঞ্চিৎ কাল পরেই বাটীর কর্তা জানিতে পারিলেন, তাঁহার গৃহিণী এবং পুত্রবধূ ব্যভিচারদোষে দূষিতা হইয়াছেন। তিনি, সাতিশয় কুপিত হইয়া তিরস্কার করিতে আরম্ভ করিলে, গৃহিণী উত্তর দিলেন, আমি কুন্তী ঠাকুরাণীর, পুত্রবধূ উত্তর দিলেন, আমি দ্রৌপদী ঠাকুরাণীর দৃষ্টান্ত দেখিয়া চলিয়াছি। ..তাহারা প্রত্যেকে পঞ্চপুরুষে উপগতা হইয়াছিলেন; আমরা তদতিরিক্ত করি নাই।”
বিদ্যাসাগরের এই উপাখ্যান প্রসঙ্গে বঙ্কিমের বক্তব্য ছিল–”এরূপ উপাখ্যান বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লিপিকৌশলেও সরস হয় নাই, অথবা তাহার নামের বা বয়সের গুণেও নীতিগর্ভ বা ভদ্রলোকের পাঠ্য বলিয়া গৃহীত হইবে না।”
দুই বিশাল ব্যক্তিত্বের এই তর্কাতর্কির নিরিখে বলতে পারি যে, চিরকালীন গৌরবের তিলক-আঁকা ব্যক্তি সম্বন্ধে অন্যথা ভাবনা অন্য সজ্জনের কটুক্তির কারণ ঘটায়। কুন্তীর সম্বন্ধে প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর মশাই কিছু অন্যথা লিখলেও বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তবে আমার কথারম্ভে বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তির পূর্ব-আলোচনা থাকায় আমার চপলতা কিছু কমে। আমার দ্বিতীয় সাফাইটা অন্য। সেটা হল–আমরা এমন একটা চরিত্র সম্বন্ধে কথা আরম্ভ করেছি, যিনি কোনও এলেবেলে ছিঁচকে সাহিত্যের নায়িকা নন। দ্রৌপদীকে বাদ দিলে মহাভারতের মতো বিরাট কাব্যের প্রথম ভাগের নায়িকা তো কুন্তীই। যিনি মহাকাব্যের নায়িকা হবেন, সঙ্গতভাবেই তার চরিত্রের বিচিত্র দিক থাকবে এবং সেই চরিত্রের এদিক-সেদিক নিয়ে নানা জনে নানা প্রশ্নও তুলবে। সেসব প্রশ্ন ঠিক কি না এবং ঠিক হলে কতটা ঠিক, বেঠিক হলেই বা কতটা বেঠিক–সেটা কুন্তী-চরিত্রের আলোচনার পরিসরে আমাদের ভাবতেই হবে। ভাবতে হবে–আরও এমন কিছু আছে কিনা যাতে করে কুন্তী-চরিত্রের ধূলিমলিন অংশগুলি ধুয়ে মুছে যেতে পারে। দেখুন, মহাকাব্যের নায়িকারা কেউ আকাশ থেকে পড়া কল্পলোকের বাসিন্দা নয়। দোষে-গুণে তারাও আমাদের মতো মানুষই। তবে কিনা তাদের চরিত্রে এমন মনোহরণ কতগুলি ‘বিশেষ’ আছে, যাতে তারা আমাদের দৈনন্দিনতা অতিক্রম করে মহাকাব্যের রসোত্তীর্ণা নায়িকাটি হয়ে উঠেছেন। কুন্তী সেই হাজারো বিশেষ-থাকা এক নায়িকা। অথচ এমনিভাবে দেখতে গেলে আমাদের দেশে কত শত বিধবা পাবেন, যারা বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি কোথাও সুখে থাকেননি, স্বামীর সুখ পাননি, ছেলের সুখও পাননি– এখন মরার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এমনিতে কুন্তীও সেইরকম। এতই সাধারণ। কুন্তীর নিজের মুখেই কথাটা শুনুন।
কুন্তী এখন জীবনের চরম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে। বারো বছর ছেলেরা বনে বনে ঘুরে বেড়িয়েছে, এক বছর তাদের কাটাতে হয়েছে লুকিয়ে-চুরিয়ে, নিজেদের গোপন করে। তেরো বছর পর আবার দুর্যোধন তাদের রাজ্যপ্রাপ্তির অধিকার অস্বীকার করেছেন। এবার কৃষ্ণ এসেছেন দুর্যোধনের কাছে পাঁচ পাণ্ডবভাইয়ের জন্য পাঁচখানা গ্রাম যদি অন্তত পাওয়া যায়। কৃষ্ণ এসে বিদুরের সঙ্গে পূর্বেই কথা বলেছেন। এখন বিকেলবেলায় সাঁঝের আঁধার যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন তিনি উপস্থিত হয়েছেন নিজের পিসি কুন্তীর কাছে–নতমুখ, লজ্জায় ম্লান। এক মুহূর্তে সারাজীবনের সমস্ত ক্ষোভ এক জায়গায় জড়ো করে কুন্তী ছেলেদের কুশল জানতে চাইলেন। ছেলে, ছেলের বউ, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর সবার সম্বন্ধে কথা বলে কুন্তী এবার কৃষ্ণের কাছে নিজের গোপন করুণ কথাটা এক নিঃশ্বাসে বললেন। বললেন নিজের ভাইয়ের ছেলে কৃষ্ণের কাছে; তিনি ঘরের লোক এবং ঘরের কথা সব জানেন। কৃষ্ণ নইলে, নিজের গভীর অন্তরের কথাটা মহাকাব্যের প্রবীণা নায়িকার মুখ থেকে এমন করে বেরোত কিনা সন্দেহ।
কুন্তী বললেন–বাপেরবাড়ি বলো আর শ্বশুরবাড়ি বলো–কোনও জায়গাতেই। আমার কপালে সুখ লেখা ছিল না। দু’ জায়গাতেই আমার জুটেছে লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা সাহং পিত্রা চ নিকৃতা শ্বশুরৈশ্চ পরন্তপ এই শ্লোকের মধ্যে কুন্তী জন্মদাতা বাবার কথা বলেছেন, যে বাড়িতে এসে তিনি কুন্তী হলেন, সেই বাড়ির কর্তা তার পালকপিতা মহারাজ কুন্তিভোজের কথা বলেননি। আর বলেছেন শ্বশুরদের কথা–অর্থাৎ শ্বশুর এখানে একজন নয়। অনেকগুলি শ্বশুর বা শ্বশুরস্থানীয় ব্যক্তিরা তার দুঃখের জন্য দায়ী– শ্বশুরৈশ্চ পরন্তপ। যিনি পাণ্ডুর সত্যিকারের বাবা সেই শ্বশুর ব্যাসদেবের সম্বন্ধে কুন্তীর কোনও বক্তব্য নেই। বক্তব্য নেই তার সম্বন্ধেও, যিনি পাণ্ডুর নামে বাবা, সেই বিচিত্রবীর্য শ্বশুর সম্বন্ধেও। কারণ তাকে পাণ্ডুই দেখেননি তো কুন্তী! তা হলে যাঁদের ওপরে কুন্তীর অভিমান তাদের একজন হয়তো পিতামহ ভীষ্ম, যিনি শ্বশুর না হলেও প্রায় শ্বশুরই, কারণ শ্বশুরের প্রথম সম্বন্ধটা তার সঙ্গেই হতে পারত। আরেকজন হলেন ধৃতরাষ্ট্র, যিনি ভাশুর। ভাশুর কথাটা সংস্কৃতে ‘ভ্রাতৃশ্বশুর’ শব্দ থেকে আসছে; ধৃতরাষ্ট্র তাই শ্বশুর পর্যায়েরই মানুষ। এই ভ্রাতৃশশুর বা ভাশুরের সম্বন্ধে কুন্তীর ক্ষোভ আছে যথেষ্ট। এবং সে ক্ষোভের কারণও আছে যথেষ্ট।
কিন্তু শ্বশুরবাড়ি তো হাজার হলেও পরের বাড়ি। তাকে আপন করে নিতে হয় চেষ্টায়, সাধনায়। বলতে পারি পাণ্ডুর অকালমৃত্যুতে এবং শ্বশুরের মতো অন্যান্যদের অনাদর, অবহেলায় শ্বশুরবাড়িকে আর আপন করে নেওয়া সেরকমভাবে সম্ভব হয়নি কুন্তীর পক্ষে। কিন্তু এই শ্বশুরকুলের ওপর যত না রাগ আছে কুন্তীর, তার থেকে অনেক বেশি রাগ আছে তার নিজের বাপের বাড়ির ওপর। এ এক অদ্ভুত মনের জগৎ যেখানে কুন্তী একা, নিঃসঙ্গ। তার দুঃখ, তার ক্ষোভ– পিতা-মাতার সহৃদয়তা নিয়ে বোঝবার মতো কেউ ছিল না সংসারে, এখনও নেই। আজ পরিণত বয়সে তিনি এমন একজনের কাছে তার মনের ব্যথা ব্যক্ত করছেন, যিনি তার বাপের বাড়ির লোক। অথবা এমন একজনের কাছে, যাঁর কুন্তীর সমতুল্য অভিজ্ঞতা খানিকটা আছে।
অভিজ্ঞতা মানে এই নয় যে, দু’জনের বয়স সমান, অতএব একে অপরকে বয়সোচিত জ্ঞান দান করে যাচ্ছেন। এখানে অভিজ্ঞতাটা সমান ঘটনায়, অথবা প্রায় সমান পরিস্থিতিতে। কৃষ্ণকেও কৃষ্ণের বাবা বসুদেব বন্ধু নন্দ গোপের কাছে রেখে এসেছিলেন বৃন্দাবনে। বেশ অনেক বয়স পর্যন্ত কৃষ্ণ নন্দরাজাকেই নিজের বাবা বলে জানতেন। সেই জায়গা থেকে কৃষ্ণ অনেক কষ্টে, অনেক বিপরীত পরিস্থিতির মধ্যেও আপন ক্ষমতায় নিজের পিতা-মাতার কাছে চলে এসেছিলেন।
কিন্তু কুন্তীর ব্যাপারটা আরও করুণ। কথাটা একটু খুলে বলি। একটি নিঃসন্তান দম্পতি যখন পিতৃমাতৃহীন একটি শিশুকে পুত্র হিসেবে পালন করেন, সেই শিশু বড় হয়ে নিজের পরিচয় জানলে, তার একরকম মনের গতি হয়। বয়ঃপ্রাপ্ত এই শিশুটির চেয়ে তার মনের গতি কিন্তু আরও বিচিত্র হবে, যার বাবা-মা বেঁচে আছেন, অথচ নির্বোধ বয়সে যাকে দত্তক দেওয়া হয়েছিল অন্যের কাছে। পরিস্থিতি কিন্তু আরও জটিল এবং কঠিন মনস্তত্ত্বের পরিসর হয়ে দাঁড়াবে যদি এমন একজনকে দত্তক দেওয়া হয় যে তার বাবা-মায়ের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন। খেলাধূলার বয়স যায়নি, কিন্তু বাবা-মাকে যে শিশু নিজের ভালবাসার মাধুর্যে। চিনে গেছে, তাকে যদি অন্যের কাছে দত্তক দেওয়া যায়, তবে তার মনের যে জটিল অবস্থা হয় কুন্তীরও তাই হয়েছে।
কুন্তী কৃষ্ণকে বলেছেন-”আমি নিজেকে দোষ দিতে পারি না, এমনকী দোষ দিই না দুর্যোধনকেও। সমস্ত দোষ আমার জন্মদাতা পিতার–পিতত্ত্বেব গহেঁয়ং নাত্মানং ন সুযোধন। আমি যখন বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে খেলা করি, তখন আমাকে তোমার ঠাকুরদাদা, অর্থাৎ আমার বাবা তার বন্ধু কুন্তিভোজকে দিয়ে দিলেন।
কুন্তী এইটুকু বলেই থামেননি। আরও ক’টা কথা বলেছেন। আজকের নারী-স্বাধীনতার প্রবক্তাদের মুখে নতুন কী কথা শুনব? তারা বলেন স্ত্রীলোককে সেকালে গয়নাগাটি, ধনসম্পত্তির মতো ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের স্বাধীন সত্তার কথা সচেতনভাবে কেউ ভাবেননি। ভাবতে অবাক লাগে আজ থেকে প্রায় দু’ হাজার-আড়াই হাজার বছর আগে কুন্তীর মুখ দিয়ে এ কী কথা বেরুচ্ছে? কুন্তী বলছেন–যাঁদের টাকা-পয়সা আছে, তাঁরা যেমন দেদার টাকা-পয়সা দান-ছত্তর করে নাম কিনতে চান, আমার বাবাও তেমনই আমাকে তাঁর বন্ধুর কাছে দত্তক দিয়ে বেশ নাম কিনলেন। আমাকে দিয়ে দিলেন যেন আমি একটা টাকার থলে-ধনং বৃত্তৈরিবার্পিতা।
বাংলায় যা বলেছি, মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ তাই বলেছেন কুন্তীর কথাটি ব্যাখা করতে গিয়ে। তিনি বলেছেন–দাতা হিসেবে খ্যাতি পাওয়ার জন্য ধনী ব্যক্তি যেমন অক্লেশে ধন দান করেন, আমার বাবাও তেমনই অক্লেশে বন্ধুর কাছে দত্তক দিয়েছিলেন। আমাকে–বৃত্তের্বদান্যত্বেন খ্যাতৈর্ধনং যথা অক্লেশেন অর্পতে, তদ্ভং যেনাহ অর্পিতা।
কুন্তী সেকালের পুরুষশাসিত সমাজের এক প্রধান প্রতিভূকে, যদুবংশীয় পিতৃতান্ত্রিকতার প্রতীক নিজের বাবাকে যেভাবে, যে ভাষায় নিন্দা করেছেন, আজ দু’ হাজার বছর পরে আধুনিক নারী প্রগতিবাদীরা এর থেকে বেশি কী বলবেন? কুন্তী বলেছেন–বাবা এবং শ্বশুর–দুই পক্ষই আমাকে বঞ্চনা করেছে, আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কী, দুঃখের চূড়ান্ত হয়েছে আমার–অত্যন্ত দুঃখিতা কৃষ্ণ কিং জীবিতফলং মম।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়–শ্বশুরবাড়িতে বিশেষত ধৃতরাষ্ট্রের কাছে ক্রমাগত বঞ্চনা পেতে পেতে আজ তার মনের অবস্থা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যাতে তার ক্ষোভ সমস্ত কিছু ছাপিয়ে একেবারে তাঁর জন্মদাতা পিতা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অন্তত এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে যে, কুন্তী এমন একজন অতিসংবেদনশীল স্পর্শকাতর মহিলা, যাঁকে বাল্যকালের এই ঘটনাটি এখনও পীড়া দিয়ে চলেছে। তাকে যখন কুন্তিভোজের কাছে দত্তক দেওয়া হয়, তখন তার পুতুল-খেলার বয়স হয়ে গিয়েছিল বলেই পিতা বলে চিহ্নিত ব্যক্তিটি সম্বন্ধে তাঁর সচেতনতাও যথেষ্টই হয়ে গিয়েছিল। যে শিশু বাবা-মাকে বাবা-মা বলেই ভালবেসে ফেলেছে, তাকে যদি হঠাৎ দত্তক দিয়ে দেওয়া হয়, তবে তার যে কিছু নিরাপত্তাবোধের অভাব ঘটে–সে কথা বোধকরি খুব কঠিন মনস্তত্ত্বের তত্ত্বকথা নয়, একেবারে সাধারণ কথা। ছোটবেলায় এই নিরাপত্তাবোধের অভাব কুন্তীর কাছে এতটাই ‘শকিং হয়ে গেছে যে, তার মানসিক গতি-প্রকৃতিও সেইভাবেই গঠিত হয়েছে, জটিলতাও কিছু এসেছে।
পণ্ডিতরা, বিশ্বভুবনের সেরা পণ্ডিতেরা দত্তক-দেওয়া বাচ্চাদের মনোজগৎ নিয়ে যে চিন্তাভাবনা করেছেন, সেটা অনেকটাই প্রদত্ত হওয়া এইসব বাচ্চাদের মনোবিকাশের দিকে নজর করে। এইসব বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা জানিয়েছেন যে, একটি বাচ্চা জন্মাবার পর অন্তত ছ’মাসের মধ্যে যদি তাকে দত্তক না দেওয়া হয়, তবে তার পরবর্তী সময়ের দত্তকদের ‘late placement’ বলেই মানতে হবে। ঠিক এই নিরিখে দেখতে গেলে দেরিতে দেওয়া দত্তক সন্তানদের, বিশেষত যাদের পাঁচ থেকে আট বছরের মধ্য-সময়ে দত্তক দেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে বিচিত্র ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় এবং দত্তক নেওয়া পিতা-মাতারা সেই প্রতিক্রিয়া কতটা সামলাতে পারেন? সময়ে সময়ে দত্তক-দেওয়া এইসব বাচ্চাদের মনে যে প্রাথমিক ধাক্কা লাগে, যাকে পণ্ডিতেরা বলেছেন ‘primary wounds’ তার প্রতিক্রিয়া ছাড়াও তাদের বিচিত্র দুঃখ-শৃঙ্খলও একরাশ প্রতিক্রিয়ার (grief-reactions) মধ্যেই ধরা পড়ে এবং সেগুলি প্রায় সময়েই একইরকম।
David Howe নামে এক বিশিষ্ট গবেষক Patterns of Adoption: নাture, nurture and psychosocial development নামে একখানি গবেষণা গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, একটু বেশি বয়সে–মানে ওই পাঁচ থেকে সাত আট বছরে যেসব বাচ্চাদের দত্তক দেওয়া হয়, তাদের মানসিক বিক্রিয়ার মধ্যে প্রথমে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে একটা প্রাথমিক ধাক্কা (initial sense of shock) এবং অবিশ্বাস (disbelief) অর্থাৎ আমাকে কেউ ভালবাসে না, আমার সঙ্গে এইরকম হল–এই ধরনের প্রতিক্রিয়া। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই দত্তকদের গ্রাস করে নিদারুণ কষ্ট এবং অন্তর্দাহজাত করুণ বিলাপ-ভাব। তৃতীয় পর্যায়ে আসে ক্রোধ এবং অনুশোচনা এবং কোনওভাবেই মুক্ত না হওয়ার ফলে হতাশা এবং এক ধরনের নির্ধ, নির্বিকল্প ভাবও কাজ করতে থাকে মনের গভীরে। অবশেষে এইসব ভাব আস্তে আস্তে থিতু হয় এবং নিরুপায় বলেই সে সবকিছু মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে, নিজের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করে অন্যভাবে প্রস্তুত করার প্রয়াসও আরম্ভ হয় এই সময়েই এবং অবশেষে একটা প্রতিজ্ঞাও তৈরি হয় নিজেকে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার।
আমরা জানি, পণ্ডিতেরা এই যে একটা প্যাটার্ন তৈরি করেছেন, স্বতোবিভিন্ন মনুষ্য হৃদয়, বিশেষত শিশুর হৃদয় সেইভাবে চলে না। কিন্তু কিছুটা অন্যরকম হলেও পণ্ডিতদের দেওয়া পরীক্ষিত সূত্রগুলিও কিন্তু অন্যরকমভাবেই এই ধরনের শিশুর হৃদয়ে অন্তঃক্রিয়া করতে থাকে। কুন্তীর ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে, একটা সময় সবকিছু বুঝে নিয়েই তিনি কুন্তিভোজের বাড়ির সঙ্গে নিজের বোঝাঁপড়া করে নিয়েছিলেন।
বস্তুত দত্তক দেওয়ার সূত্রে এই পিত্ৰন্তরের ঘটনা যদি না ঘটত, তা হলেও কুন্তীর জীবনের ঘটনাগুলি একইরকম ঘটতে পারত কিংবা ঘটতে পারত অন্য কোনও উৎপাত। দত্তক নেওয়া মেয়ে বলেই মহারাজ কুন্তিভোজ কুন্তীর বিয়ে কিছু খারাপ দেননি। তা ছাড়া এ বিয়ের ব্যাপার-স্যাপার কৃষ্ণের পিতামহ আর্যক শূর অথবা কৃষ্ণপিতা বসুদেব কিছুই জানতেন না এমনও মনে হয় না। আর সবচেয়ে বড় কথা, কুন্তী হস্তিনাপুরের অধিপতি পাণ্ডুকে বরণ করেছিলেন স্বয়ম্বরসভায়, স্বেচ্ছায়। পাণ্ডুও ভালই রাজত্ব চালাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি যে মারা যাবেন, তাই বা কে জানত? অথবা কে জানত প্রজ্ঞাচক্ষু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র তার সঙ্গে এত অপব্যবহার করবেন?
আসলে অবস্থার গতিকে সবই যখন বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছে–স্বামী মারা গেছেন, শ্বশুরবাড়িতে নিজের অধিকার নেই, সন্তানেরা বনবাসের কষ্ট ভোগ করলেন এবং এখন সমস্ত শক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা স্বরাজ্য উদ্ধার করতে পারছেন না–এমন অবস্থার গতিকে কুন্তীর সমস্ত রাগ গিয়ে জমা হয়েছে জন্মদাতা পিতার ওপরেই। অভিমান হচ্ছে–যার পিতা সেই শৈশব অবস্থায় পিতৃস্নেহে বঞ্চিত করে একটি শিশু কন্যাকে অন্যের কাছে দত্তক দিয়েছেন, তার আর জীবনের মূল্য কী–কিং জীবিতফলং মম। অথবা কুন্তী তাঁর পিতার ওপর অভিমানে তাঁর জীবনের ঘটনার শৃঙ্খল অন্যভাবে সাজাতে চান–অর্থাৎ যদি তার পিতা কুন্তিভোজকে দত্তক না দিতেন, তা হলে স্বয়ম্বরসভায় পাণ্ডু আসতেন না, যদি পাণ্ডুর সঙ্গে তার বিয়ে না হত, তা হলে… ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমরা জানি–এসব কথা ঠিক নয়। এসব কথা কুন্তী এইভাবেই ভেবেছিলেন কি না তাও মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। কিন্তু এটা বুঝতে কোনও অসুবিধা নেই যে, পিতার ওপর তার এই অসম্ভব আক্রোশ এসেছে তার সারাজীবন ভোগান্তির ফলে। বিশেষত পাণ্ডুর জীবনাবসানের পর শ্বশুরকুলে পাঁচটি সন্তান নিয়ে তাকে এতই কষ্ট পেতে হয়েছে যে, তাঁর পিতার সম্বন্ধে এই অভিমান তার মনের অবস্থাকে আরও জটিলতর এবং দ্বন্দ্বময় করে তুলেছে বলে আমরা মনে করি। কুন্তী-চরিত্র বিশ্লেষণের সময় তাঁর পিতার সম্বন্ধে এই অভিযোগ আর কোনওভাবে কাজ করেছে কিনা তাও আমরা খেয়াল করার চেষ্টা করব।
.
০৩.
মথুরা অঞ্চলে আর্যক শূর যেখানে রাজত্ব করতেন, সে রাজত্ব খুব বড় ছিল না বটে কিন্তু সেখানে গণতান্ত্রিক নিয়ম-কানুন কিছু কিছু চলত। রাজ্যগুলি ছোট ছোট ‘রিপাবলিক বা ‘সঙেঘ’ বিভক্ত ছিল। কারণ যদুবংশের অধস্তন বৃষ্ণি, ভোজ, অন্ধক পুরুষেরা এই সঙঘগুলিকেই নেতৃত্ব দিতেন বলে আমরা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পেয়েছি। যাই হোক আর্যক শূর এইরকমই একটা সঙ্ঘাধিপতি ছিলেন, আর কুন্তিভোজ ছিলেন অন্য একটি সঙেঘর অধিপতি। ছোট ছোট রাজা হলেও এঁদের সম্মান কারও কম ছিল না।
বৃষ্ণি, অন্ধক, ভোজ, কুকুর–এইগুলি একই যদুবংশের একেকজন নামী রাজার নাম। অধস্তন পুরুষেরা নিজস্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এই নাম ব্যবহারও করতেন। কুন্তীর পালক পিতা কুন্তিভোজ যেমন ভোজবংশীয়, তেমনি অত্যাচারী কংসও ছিলেন ভোজবংশীয়। কুন্তী হয়তো অভিমান করেই বলেছেন যে, তার পিতা বন্ধুত্বের খাতির রাখতে গিয়ে কুন্তিভোজের কাছে তাকে দত্তক দিয়েছিলেন–অদাস্তু কুন্তিভোেজায় সখা সখ্যে মহাত্মনে। বাস্তবে কিন্তু আর্যক শূর অর্থাৎ কুন্তীর জন্মদাতা পিতার সঙ্গে কুন্তিভোজের আত্মীয়তার বন্ধন ছিল। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস।
রাজা শূরের আপন পিসতুতো ভাই হলেন এই কুন্তিভোজ। খিল হরিবংশ থেকে জানতে পারছি–শূরের প্রথম ছেলে নাকি কৃষ্ণপিতা বসুদেব বসুদেবো মহাবাহুঃ পূর্ব আনকদুন্দুভিঃ। তারপর নাকি তাঁর আরও কয়টি ছেলে এবং একেবারে শেষে পাঁচটি মেয়ে জন্মাল–যাঁদের একজন হলেন কুন্তী। সাধারণত মানুষের ঘরে এমন সুশৃঙ্খলভাবে প্রথমে সবচেয়ে গুণশালী পুত্রটি, তারপর কতগুলি এলেবেলে এবং তারও পরে ‘লাইন দিয়ে কতগুলি মেয়ে–এরকম হয় না বলেই সন্দেহ হয় যে, হরিবংশের লেখক-ঠাকুর কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের মাহাত্মে আর্যক শূরের সন্তানদের সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়েছেন। বাস্তব ছিল অন্যরকম।
হরিবংশের প্রমাণে এটা আমরা প্রথমে স্বীকার করে নেব যে, বৃষ্ণি-সঙেঘর নেতা-রাজা আর্যক শূর বিয়ে করেছিলেন তাদেরই পালটি ঘর ভোজবংশের মেয়েকে। আবার ওই কুন্তিভোজও ছিলেন ভোজদেরই ছেলে। ঠিক এইখানটায় আমাদের মহাভারতের কবিকে স্মরণ করতে হবে। মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ থেকে আমরা জানতে পারি যে, কুন্তিভোজ ছিলেন রাজা শূরের আপন পিসতুতো ভাই। তার ছেলে-পিলে ছিল না– পিতৃহস্ৰীয়ায় স তাম্ অনপত্যায় ভারত এবং হরিবংশ জানাচ্ছে–তার অনেক বয়সও হয়ে যাচ্ছিল–শূরঃ পূজ্যায় বৃদ্ধায় কুন্তিভোজায় তাং দদৌ।
আর্যক শূরের ভোজদের ব্যাপারে একটু টান বেশি ছিল। নিজের স্ত্রী ভোজ-ঘরের, পিসির বিয়ে হয়েছে ভোজ-বাড়িতে আবার তার প্রিয় পুত্র বসুদেব–ভবিষ্যতে যিনি কৃষ্ণের পিতা হবেন–তিনিও লালিত-পালিত হয়েছেন ভোজদের বাড়িতে। ভোজ-কুলের কলঙ্ক মহারাজ কংস এক সময় বসুদেবকে গালাগালি দিয়ে বলেছিলেন–আমার বাবা তোকে মানুষ করেছে-মম পিত্রা বিবর্ধিতঃ। এই যেখানে অবস্থা সেখানে ভোজবংশীয় নিঃসন্তান কুন্তিভোজের সঙ্গে আর্যক শূরের যথেষ্ট দহরম-মহরম ছিল বলেই আমাদের অনুমান।
আসলে সাধারণ গেরস্ত-বাড়িতে যা হয় এখানেও তাই হয়েছে। কুন্তিভোজ বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন অথচ এখনও তার ছেলেপিলে কিছুই হল না। হয়তো এই অবস্থায় তিনি শূরকে। বলেন-তোমার তো বয়স কম। বাপু হে! আমাকে তোমার একটি সন্তান মানুষ করার সুযোগ দাও। মায়া পরবশ হয়ে আর্যক শূর তাকে বলেন–ঠিক আছে, আমার প্রথম যে সন্তানটি হবে, তাকেই দিয়ে দেব তোমার হাতে। হরিবংশ এ ব্যাপারে কিচ্ছুটি জানায়নি, কিন্তু মহাভারত বলেছে–আর্যক শূর রীতিমতো প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন এই কথা– অমগ্রে প্রতিজ্ঞায়–অর্থাৎ প্রথমে যে জন্মাবে, তাকেই দেব। আর্যক শূরের প্রথম সন্তান হল একটি মেয়ে–পৃথা। নিঃসন্তান কুন্তিভোজের ওপর মায়ায় আর্যক শুর তার প্রথমা কন্যাটিকে তাঁর হাতে তুলে দিলেন–অগ্রজাতেতি তাং কন্যাং শূরোহনুগ্রহকাঙক্ষয়া। অদদৎ কুন্তিভোজায়…।
পরবর্তী সময়ে কুন্তী নিজের মনের জ্বালায় কুন্তিভোজের প্রতি আর্যক শূরের এই অনুকম্পা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বটে, তবে নিজের স্বামী পাণ্ডু এবং নিজের সপত্নী মাদ্রীর পুত্রকামনার নিরিখে নিঃসন্তান পুরুষ বা রমণীর জ্বালা তার বোঝা উচিত ছিল। সেটাও যে তিনি বোঝেননি, তার কারণ–সন্তান ধারণের উপায় ছিল তার আপন করায়ত্ত। এতই সহজ, প্রায় খেলার মতো। সে কথা আসবে যথাসময়ে।
বোঝা গেল–কৃষ্ণপিতা বসুদেব তার বাবা অর্ধেক শূরের প্রথম পুত্র হলেও হতে পারেন, কিন্তু প্রথম সন্তান নন। কুন্তীই সবার বড় এবং তাকে যেহেতু দত্তক দেওয়া হয়েছে অতএব হরিবংশে বসুদেবই হয়ে গেছেন শূরের প্রথম ছেলে অথবা প্রথম সন্তানও। মহাভারতে কিন্তু কুন্তী ‘অগ্রজাতা’ এবং সে কথা কুন্তী যথেষ্টই জানতেন বলে মনে হয়। কেননা, স্বয়ং কুন্তিভোজও একথা লুকোননি। মহারাজ আর্যক শূরের প্রথম সন্তানের গৌরব, বসুদেবের মতো বিশাল পুরুষের ভগিনী হওয়ার গৌরব–কোনওটাই কুন্তিভোজ পৃথা (কুন্তী)-র কাছে লুকোননি। হয়তো সেই কারণেই কুন্তীর অভিমানটাও থেকেই গেছে। আর্যক শূরের প্রথম কন্যাটিকে দত্তক নিয়েও রাজা কুন্তিভোজ যে তাকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করেননি বা করতে পারেননি, সেই কারণেই জন্মদাতা পিতা সম্বন্ধে কুন্তীর সচেতনতা এবং অভিমান দুইই থেকে গেছে।
দত্তক কন্যা হিসেবে পৃথা যেদিন মহারাজ কুন্তিভোজের বাড়িতে এলেন, তখন তিনি নেহাতই শিশু। এই রাজ্যে এসে তার খারাপ লাগার মতো কিছু ছিল না। রাজা কুন্তিভোজ পরম আহ্লাদে তার এই নতুন-পাওয়া মেয়েকে মানুষ করছিলেন। কোনও কিছুরই অভাব নেই এবং আস্তে আস্তে শূর-দুহিতা পৃথা কুন্তীতে পরিণত হলেন। কথাটা বললাম এইজন্য যে, কুন্তিভোজের পালন-পোষণে তার নামটাই শুধু পালটে যায়নি, তিনি কুন্তিভোজের বাড়ির আচার-আচারণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলেন। মেয়েদের যেহেতু শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর ঘর করতে হয়, তাই নিজেকে পালটানোর বীজটা তাদের মধ্যে বুঝি থেকেই যায়। আর কুন্তী যেহেতু শিশুকালেই চলে এসেছেন অন্য এক বাড়িতে তাই পরিবর্তন সইয়ে নিতে তার সময় লাগেনি। শৈশব পেরিয়ে কুন্তীর শরীর থেকে কৈশোরের গন্ধও যখন যাই-যাই করছে, সেই সময়ের মধ্যে ভোজবাড়ির গৃহিণীপনার দায়িত্ব প্রায় সবই তার হাতে এসে গেছে। কুন্তিভোজও তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করেন।
নির্ভর করার কারণও আছে। মনু মহারাজ যতই বলুন–মেয়েরা ঘরের কাজ নিয়ে থাকবে, আয়-ব্যয় দেখবে ইত্যাদি, বুঝলাম, সেসব কথা মেয়েদের খানিকটা ঘরে আটকে রাখার জন্য; কিন্তু মহাভারতের সমাজ মনুর নিয়ম-মতো চলত না। সেখানে মেয়েদের স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু এত স্বাধীনতা সত্ত্বেও কুন্তী যে অল্প বয়সেই একেবারে ভোজবাড়ির গিন্নিটি হয়ে উঠলেন, সে বুঝি কুন্তিভোজের আস্কারায় আর অত্যধিক স্নেহে। একটা ঘটনা এই সূত্রেই বলে নিই।
কুন্তিভোজের বাড়িতে অতিথি এসেছেন দুর্বাসা মুনি। দুর্বাসা বড় কঠিন স্বভাবের মুনি। প্রখর তার তেজ, বিশাল তার ব্যক্তিত্ব। চেহারাটাও বেশ লম্বা-চওড়া, দর্শনীয়। মুখে দাড়ি, মাথায় জটা। তপস্যার দীপ্তি সর্বাঙ্গে। এহেন দুর্বাসা মুনি কুন্তিভোজের বাড়িতে এসে বললেন–তোমার বাড়িতে কিছুদিন ভিক্ষা গ্রহণ করতে চাই। তুমি বা তোমার বাড়ির লোকজন, আমার সঙ্গে কোনও অপ্রিয় আচরণ কোরো নান মে ব্যলীকং কৰ্ত্তব্যং ত্বয়া বা তব চানুগৈঃ।
দুর্বাসা নিজেকে চিনতেন। তাই কেমনভাবে তিনি থাকবেন কুন্তিভোজের বাড়িতে–তার একটা আভাস আগেভাগেই দিয়ে রাখলেন। ঋষি বললেন-”আমি যেমন ইচ্ছে বাড়ি থেকে বেরোব, যেমন ইচ্ছে ফিরে আসব–যথাকামঞ্চ গচ্ছেয় আগচ্ছেয়ং তথৈব চ–আমার অশন, আসন, শয়ন, বসন–সবকিছুই চলবে আমারই মতে। কেউ যেন আমাকে বাধা দিয়ে অপরাধী না হয়–নাপরাধ্যেত কশ্চন। অর্থাৎ আমাকে যেন কেউ ডিসটার্ব না করে।
কেউ যেন অপরাধ না করে–মুনির এই সাবধানবাণীর মধ্যে তার স্বেচ্ছাময়তার ইঙ্গিত যত আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আছে সেই ব্যক্তির উদ্দেশে তার ভবিষ্যৎ ক্ষমাহীনতার ইঙ্গিত–যে তাকে বাধা দেবে। কুন্তিভোজকে তিনি বলেই দিয়েছিলেন–আমি এইরকম স্বেচ্ছাচারে থাকব–এতে যদি তোমার অমত না থাকে তবেই এখানে থাকব, নচেৎ নয়– এবং বৎস্যামি তে গেহে যদি তে রোচতেহনঘ। দুর্বাসা মুনিকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন যে,–যদি তোমার অমত থাকে অথবা তোমার যদি পছন্দ না হয়–এই কথাগুলির কোনও মূল্য নেই। অর্থাৎ দুর্বাসার কথা শুনে কুন্তিভোজ যদি বলতেন–আপনার যেরকম নিয়ম-কানুন শুনছি, তাতে তো একটু অসুবিধেই হবে। মানে আপনি যদি একটু…
দুর্বাসার কাছে এসব কথার ফল–অভিশাপ। আবার তার কথা মতো চলে যদি অপরাধ ঘটে তারও ফল ওই অভিশাপই। তবু যদি কোনওক্রমে দুর্বাসা তুষ্ট হন এই আশায় অন্যদের মতোই কুন্তিভোজ বললেন–না, না, আপনি এসব কী বলছেন? আপনি যেভাবে থাকতে চাইবেন, সেইভাবেই থাকবেন–এবমস্তু। কুন্তিভোজ কথাটা বললেন বটে, কিন্তু বলেই এই অদ্ভুত সংকটে প্রথম যার কথা স্মরণ করলেন–তিনি তাঁর প্রিয় কন্যা মনস্বিনী কুন্তী। কুন্তিভোজ আগাম দুর্বাসাকে বলে বসলেন–আমার একটি বুদ্ধিমতী কন্যা আছে। নাম পৃথা। যেমন তার স্বভাব-চরিত্র, তেমনই সৎ তার প্রকৃতি, দেখতেও ভারী মিষ্টি–শীলবৃত্তান্বিতা সাধ্বী নিয়তা চৈব ভাবিনী! কুন্তিভোজ বললেন–আমার এই সর্বগুণময়ী মেয়েটি আপনার দেখাশুনো করবে। আমার ধারণা–সে আপনার অবমাননা না করে তার আপন স্বভাবেই আপনাকে তুষ্ট করতে পারবে। আমার বিশ্বাস–আপনি তুষ্ট হবেন, মুনিবর–তুষ্টিং সমুপস্যসি।
হয়তো দুর্বাসা দাঁড়িয়েছিলেন, এবার বসলেন। কুন্তিভোজ মুনির সঙ্গে কথা বলে তাঁকে পা ধোয়ার জল আর বসার আসন দিয়েই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে এলেন ভিতর বাড়িতে। কৈশোর-গন্ধী বয়সটাকে বিদায় দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত সরলতা নিজের চোখের মধ্যে পুঞ্জীভূত করে ডাগর-চোখে দাঁড়িয়েছিলেন কুন্তী–পৃথাং পৃথুললোচনাম। কুন্তিভোজ বললেন–দুর্বাসা মুনি আমার ঘরে উপস্থিত। আমাদের এখানে তিনি কিছুদিন থাকতে চান। আমি তাতে হ্যাঁ বলেছি। তাঁর পূজা-আরাধনা এবং তার থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে তুষ্টির চরম আশ্বাস আমি তাকে দিয়েছি তোমারই ভরসায়–ত্বয়ি বৎসে পরাশ্বস্য ব্রাহ্মণস্যাভিরাধনম। এখন আমার কথা যাতে মিথ্যে না হয়, তুমি তার ব্যবস্থা করো বাছা।
কুন্তিভোজ এইটুকু বলেই শেষ করতে পারতেন, কিন্তু দুর্বাসা মুনি যেভাবে তাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, তার নিরিখে তিনি আরও ক’টা কথা কুন্তীকে বলার প্রয়োজন বোধ করলেন। সেকালের সমাজে তপস্যা এবং স্বাধ্যায়নিষ্ঠ ব্রাহ্মণের সম্মান ছিল বিশাল, অতএব সেই ব্রাহ্মণের তুষ্টির জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে–এমন একটা ইতিবাচক অনুজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে কুন্তিভোজ কতগুলি মানুষের অপমৃত্যুর কথা বললেন– যাঁরা ব্রাহ্মণের অবমাননা করে ওই ফল লাভ করেছে। কুন্তিভোজ স্বীকার করলেন যে, হ্যাঁ ওই হঠাৎক্রোধী, অভিশাপ-প্রবণ একজন মুনিকে তুষ্ট করার ভার কুন্তীর ওপর তিনিই ন্যস্ত করেছেন–সোহয়ং বৎসে মহাভাগ আহিতত্ত্বয়ি সাম্প্রতম।
কুন্তিভোজ জানতেন–ব্রাহ্মণ আর দুর্বাসা মুনিতে তফাত আছে। দুর্বাসার স্বেচ্ছাময় ব্যবহার অপিচ তাঁর সাবধানবাণী সত্ত্বেও কুন্তিভোজ যে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিজের মেয়ে কুন্তীকে তার তুষ্টি-বিধানের জন্য নিয়োগ করলেন–এর মধ্যে কিছু কিছু সচেতনতা কাজ করেছে, স্বার্থও কিছু কিছু। একেবারে আপন ঔরসজাতা কন্যাকে তিনি এভাবে নিয়োগ করতে পারতেন কিনা–তাতেও আমাদের সন্দেহ আছে। আর সেইজন্যেই কুন্তিভোজকে মেয়ের কাছে সাফাই গাইতে হচ্ছে, ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে, এমনকী চাটুকারিতাও করতে হচ্ছে। কুন্তী বোধহয় সে-কথা বুঝতেও পারছেন। তাঁর অশান্তির বীজ এখানেই।
কুন্তিভোজ বললেন–অতিথি ব্রাহ্মণদের সৎকার করার ব্যাপারে তোমার নিষ্ঠার কথা আমি ছোটবেলা থেকেই জানি। আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ঘরের ভৃত্যরা–যারাই আছে, সবার প্রতি তোমার প্রীতি-ব্যবহার আমি জানি। তারাও প্রত্যেকে তোমার ব্যবহারে তুষ্ট। লোক-ব্যবহারের এইসব ক্ষেত্রে তুমি সর্বত্র তোমার উপস্থিতি প্রমাণ করেছ অর্থাৎ তুমি সর্বত্র জুড়ে বসে আছ–সর্বম্ আবৃত্য বৰ্তসে। তবু এখনও তুমি ছোট, এবং তুমি আমার মেয়ে–সেইজন্য ব্রাহ্মণের ক্রোধের ব্যাপারটা মাথায় রেখে আমি তোমায় শুধু খেয়াল রাখতে বলছি।
কুন্তিভোজ এখানেও শেষ করতে পারতেন। কিন্তু তা করলেন না। কিন্তু এইবারে তিনি যে কথাগুলি বললেন তার মধ্যে দত্তক পাওয়া কন্যার মধ্যে তার আত্মীকরণের মাধুর্য যতখানি প্রকাশ পেয়েছে, তার আড়াল থেকে উঁকি দিয়েছে এক ধরনের সংশয়; সামান্যতম হলেও সে সংশয় কুন্তীর মনে অন্য এক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে–যা সচেতন মনে বোঝা যায় না। একটু বুঝিয়ে বলি কথাটা, একটা বোকা-বোকা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলি।
ধরুন, একটি গৃহস্থ বাড়িতে পুত্রের কৃতিত্ব এবং অকৃতিত্বের ব্যাপার নিয়ে মা-বাবা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। ধরুন, ছেলেটি ভাল কোনও কাজ করেছে, তখন মা ছেলেটির বাবাকে বলেন–আমার ছেলে বলে কথা, আমি আগেই তোমাকে বলেছিলাম না, ছেলে আমার… ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ মায়ের গলার শিরা ফুলে উঠল, গর্বে মুখ উজ্জ্বল হল৷ কিন্তু এই ছেলেটি যদি খারাপ কিছু করে আসে, সেদিন তার গর্ভধারিণী স্বামীকে বলবেন– এই যে, তোমার ছেলে কী করেছে শুনেছ? আগেই আমি সাবধান করেছিলাম, তোমার ছেলেকে তুমি মানুষ করো, ইত্যাদি ইত্যাদি। এইরকম একটা কথোপকথন থেকে–বংশের ধারা যাবে কোথায়, যেমন বাপ তেমনই ছেলে–ইত্যাদি অসংখ্য গার্হস্থ্য এবং দাম্পত্য প্রবাদ আমি বহুত্র শুনেছি। অর্থাৎ এক একটা সময় আসে যখন মা কিংবা বাবা পুত্র কন্যাকে আপোসে ‘disown করেন। সাধারণ জীবনে দৈনন্দিনতার গড্ডলিকাপ্রবাহে এইসব কথোপকথন বড় বেশি মনস্তাপ ঘটায় না। বাবা-মার মনেও না, পুত্র-কন্যার মনেও না। কিন্তু পুত্র কন্যার জীবন যদি সরল না হয়, তা যদি বাঁধাধরা গতানুগতিকতার বাইরে হয়, তবে বাবা-মায়ের সাধারণ কথাও অনাত্মীকরণের বীজ বপন করতে পারে পুত্র-কন্যার মনে। আমরা এবার কুন্তিভোজের কথায় ফিরে আসব।
কুন্তিভোজ বললেন–প্রসিদ্ধ বৃষ্ণিদের বংশে তুমি জন্মেছ। মহারাজ শূরের তুমি প্রথম মেয়ে। মহামতি বসুদেবের ভগিনী তুমি। তোমার জন্মদাতা পিতা শূর প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন যে, তাঁর অগ্রজাতা প্রথম কন্যাটিকে আমার হাতেই তুলে দেবেন তিনি। তিনি কথা রেখেছেন, তিনি সানন্দে তার কন্যাটিকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন–দত্তা প্রীতিমতা মহং পিত্রা বালা পুরা স্বয়–সেইজন্যই আজ তুমি আমার মেয়ে।
বাবা হয়ে সানন্দে নিজের কন্যাকে তুলে দিয়েছেন অন্যের হাতে! যত বন্ধুই হন, তবু সানন্দে? কুন্তীর মনে খট করে বাজল না তো? কুন্তিভোজ বললেন–যেমন প্রসিদ্ধ কুলে তুমি জন্মেছ, তেমনই প্রসিদ্ধ কুলে তুমি বড় হয়েছ। এক সুখ থেকে আরেক সুখ, এক হ্রদ থেকে আরেক হ্রদে এসে পড়েছ–সুখাৎ সুখ অনুপ্রাপ্তা হ্রদাৎ হ্রদমিবাগতা। এই উপমাটি একেবারে প্রসিদ্ধ মহাকাব্যের উপমা। মহাভারতে এটি বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে যখন এক রাজবাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়েছে আরেক রাজবাড়িতে। কুন্তিভোজ সেই উপমাটি নিজের অজান্তেই ব্যবহার করে ফেললেন। কিন্তু শৈশবের পরিচিত বাবা-মাকে ছেড়ে অন্য বাড়িতে, অন্য বাবা-মার কাছে মানুষ হওয়ার কী সুখ–তা কুন্তীই শুধু জানেন। অন্যদিকে কুন্তিভোজ জানেন শুধু রাজবাড়ির সাজাত্য।
সে যাই হোক, এক কুল থেকে আরেক কুলে, এক হ্রদ থেকে আরেক হ্রদে এসে কুন্তীর না হয় বড় সুখই হল, কিন্তু কুন্তিভোজ এবার কী বলছেন? বলছেন– জানো তো, মন্দ এবং নীচ বংশের মেয়েদের যদি খানিকটা আচার-নিয়মের মধ্যে রাখা যায় তবে তারা চপলতাবশত যা করা উচিত নয়, তাই করে ফেলে–দৌস্কুলেয়া বিশেষেণ কণ্বঞ্চিৎ প্রগ্রহং গতাঃ। বালভাবা বিকুন্তি প্রায়শঃ প্রমদাঃ শুভে।
হঠাৎ এই কথাটা কেন? কুন্তিভোজ যা বলেছেন, তার অর্থ যদি একান্তই সরল-সোজা হয় তবে কিছুই বলার নেই। কিন্তু মুশকিল হল, নৈষধের কবি শ্রীহর্ষ লিখেছেন কাব্য-সাহিত্যে এত যে ব্যঞ্জনার ছড়াছড়ি তার মূল নাকি বিদগ্ধা রমণীদের বাচনভঙ্গী–বিদগ্ধনারীবচনং তাকরঃ। কাজেই কুন্তিভোজ যতই সোজা-সরলভাবেই কথাটা বলুন না কেন, মহাভারতের অন্যতমা নায়িকা কথাটার মধ্যে একটা ইঙ্গিত খুঁজে পেতে পারেন। ভাবতে পারেন–হঠাৎ করে এই মন্দ বংশের কথাটা এল কেন? নিয়ম আচারের শৃঙ্খলের মধ্যে থেকে চপলতা যদি কিছু ঘটে, তা হলে দোষ হবে বংশের, যে বংশে তিনি জন্মেছেন সেই বংশের দোষ হবে। অর্থাৎ এখন বৃষ্ণিকুলকে যতই ভাল-ভাল বলুন, তেমন তেমন কিছু ঘটলে কুন্তিভোজ অনাত্মীকরণের সুযোগ ছাড়বেন না। অর্থাৎ তিনি ‘disown’ করবেন।
কুন্তিভোজ দুর্বাসাকে তুষ্ট করার জন্য এক লহমার মধ্যে কুন্তীকে স্মরণ করেছেন বটে, কিন্তু আরও একটা সমস্যা তাঁর ছিল, যে সমস্যার কথা তিনি ঘুরিয়ে বলেছেন কুন্তীকে। বলেছেন–পৃথা! রাজকুলে তোমার জন্ম, দেখতেও তুমি ভারী সুন্দর–পৃথে রাজকুলে জন্ম রূপং চাপি তবাদ্ভূত–তুমি যেন সেই বংশের অভিমান, রূপের অভিমান ত্যাগ করে দুর্বাসার সেবা কোরো। তাতে তোমারও মঙ্গল, আমারও। মুনি যদি ক্রুদ্ধ হন তা হলে আমার বংশ ছারখার হয়ে যাবে–কৃৎস্নং দহ্যেত মে কুলম্।।
বোঝা যাচ্ছে, কুন্তিভোজ অনেক দায়িত্ব দিয়ে দিলেন কুন্তীকে, একেবারে শুষ্ক দায়িত্ব। তিনি একবারও বললেন না–অন্যথা কিছু ঘটলে–তুমি আমার মেয়ে, আমার সম্মান যাবে। বললেন–পৃথা! অর্থাৎ সেই শূর বংশের নাম–পৃথা! তোমার জন্ম রাজকুলে অর্থাৎ সেই রাজবংশের মেয়ে হয়েও অন্য কিছু ঘটলে আমার বংশ ছারখার হয়ে যাবে।
কুন্তী সব বোঝেন, সমস্ত ইঙ্গিত বোঝেন। কুন্তিভোজ তাকে মহারাজ শূরের মেয়ে, বসুদেবের ভগিনী বলে যতখানি চাটুকারিতা করেছেন, আমি বুঝি–এসব কিছুর থেকেও বড়–তিনি কৃষ্ণের পিসি। নৈষধে-বলা সেই বিদগ্ধা রমণীদের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্যা। হায়! কুন্তিভোজ যদি তার কথার ইঙ্গিতগুলি বুঝতে পারতেন? অথবা তিনি সবই বুঝেছেন।
কুন্তী প্রিয়তম সম্বোধনে ‘বাবা’ বলে কথা আরম্ভ করলেন না। কুন্তিভোজের মুখে শূর নন্দিনী ‘পৃথা’ সম্বোধনের উত্তরে কুন্তীর ভিতর থেকে জবাব দিলেন পৃথা। বললেন– রাজেন্দ্র! এই সম্বোধনের মধ্যে পিতার অভীপ্সাপূরণে কন্যা স্নেহ-যন্ত্রণা নেই, আছে–রাজার আদেশে রাজকর্মচারীর কর্ম-তৎপরতা, রাজার ইচ্ছায় প্রজার ইতিকর্তব্য পালন। এখন এই বয়সে বুঝতে পারি মহাকাব্যের কবিদের এইসব শব্দ-ব্যঞ্জনা কত গভীর করে বুঝেছিলেন কালিদাস। লোক-রঞ্জক রামের আদেশে লক্ষ্মণ যখন সীতাকে রেখে এলেন বাল্মীকির তপোবনে, তখন সীতাও এই সম্বোধনেই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন–লক্ষ্মণ! সেই রাজা রামচন্দ্রকে বোলো–বাচ্যস্খয়া মদ্বচনাৎ স রাজা–এই গর্ভাবস্থায় অনুরক্তা স্ত্রীকে যে তিনি বিসর্জন দিলেন, সে কি তার যশেরই উপযুক্ত হল, না বংশ মর্যাদার উপযুক্ত হল?
এখানেও সেই বংশ-মর্যাদা আর যশোরক্ষার প্রশ্ন এসেছে সদ্য যৌবনবতী কুন্তীর তথাকথিত কন্যাত্বের মূল্যে। কুন্তী তাই কন্যাজনোচিত মমতায় জবাব দিতে পারছেন না। তিনি বললেন–রাজেন্দ্র! আচার-নিয়ম-নিষ্ঠ ব্রাহ্মণকে আমি নিশ্চয়ই সৎকার করব। তুমি যেমনটি তাকে কথা দিয়েছ রাজা, আমি সেইভাবেই কাজ করব। ব্রাহ্মণ-অতিথি ঘরে এসেছেন, তাঁকে উপযুক্ত মর্যাদায় সৎকার করা আমাদের চিরকালের ‘স্বভাব। এতে যে তোমার ঈপ্সিত প্রিয় কার্য করা হবে অথবা আমার মঙ্গল হবে, সে আমার বাড়তি পাওনা– তব চৈব প্রিয়ং কাৰ্যং শ্রেয়শ্চ পরমং মম। এখানে ‘স্বভাব’ শব্দটি এবং সংস্কৃতে দুটি ‘চ’-এর প্রয়োগ লক্ষণীয়।
কুন্তী রাজা কুন্তিভোজকে সম্পূর্ণ অভয় দিয়ে বললেন–অতিথি ঋষি সকাল, বিকেল, মাঝরাতে যখন ইচ্ছে ঘরে ফিরুন, আমার ওপরে তাঁর রাগ করার কোনও কারণ ঘটবে না। তোমার আদেশমতো বামুন-ঠাকুরকে সৎকার করার সুযোগ পাচ্ছি–এতে তো আমারই লাভ, রাজা-লাভো মমৈষ রাজেন্দ্র। ‘আদেশ’ এবং রাজেন্দ্র’ শব্দটি পুনশ্চ লক্ষণীয়। পাঠক, মাথায় রাখবেন–এর পরের কথাগুলোও।
কুন্তী বললেন–তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, ‘রাজা’–বিশ্রন্ধো ভব রাজেন্দ্র–তোমার বাড়িতে থেকে বামুন-ঠাকুরের কোনও অসন্তোষ ঘটবে না। আমি আমার যথাসাধ্য করব, রাজা! অন্তত আমার জন্য তুমি অতিথি-ব্রাহ্মণের কাছ থেকে যে কোনও ব্যথা পাবে না– সে-কথা আমি হলফ করে বলতে পারিন মকৃতে ব্যথাং রাজ প্রান্সসি দ্বিজসত্তমাৎ।
কুন্তীর ভাষণ ছিল অনেকটাই। কিন্তু সম্পূর্ণ বক্তব্যের মধ্যে ‘রাজন’, ‘রাজেন্দ্র, ‘নরোত্তম’, ‘নরেন্দ্র’–এই সম্বোধনগুলি পিতৃসম্বোধনের প্রতিতুলনায় আমার কাছে বড় বেশি লক্ষণীয় মনে হয়েছে। তা ছাড়া শেষ বাক্যে পরম আশ্বস্ত কুন্তিভোজও এই বিদগ্ধা রমণীকে পিতৃত্বের মাধুর্যে অভিষিক্ত করেননি। কুন্তীকে তিনি জড়িয়ে ধরেছেন তার আপন আদেশ সমর্থনের আনন্দে–পরিজ্য সমর্থ চ। বলেছেন–তা হলে এই করতে হবে, ওই করতে হবে ইত্যাদি। সৌজনের চূড়ান্ত করে আরও বলেছেন–ভদ্রে: আমার ভালর জন্য, তোমার নিজের ভালর জন্য এবং আমার বংশের ভালর জন্যও এই যেমন কথা হল, তেমনটিই কোরো–এমবেতৎ ত্বয়া ভদ্ৰে কৰ্তব্যৰ্ম অবিশঙ্কয়া।
কথা শেষ করে কুন্তিভোজ মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হলেন দুর্বাসার কাছে। বললেন– ঋষিমশাই! এই আমার মেয়ে। ভুল করে যদি বা অজ্ঞানে কোনও অপরাধ করে ফেলে তা হলে মনে রাখবেন না সেটা।
দুর্বাসার জন্য আলাদা ঘর ঠিক হল একটা। রাজার দুলালী পৃথা, নাকি কুন্তী, রাজবাড়ির অভিমান ত্যাগ করে, নিদ্রালস্য ত্যাগ করে সেই বাড়িতেই তার স্নান-আহারের যত্ন-আত্তি করতে লাগলেন। নিজেকে বেঁধে ফেললেন কড়া নিয়মে, অবগুণ্ঠন রইল শুচিতার। মুনিকে নিয়ে জ্বালা কম নয়। এই তিনি বলে গেলেন– আমি সকালে ফিরব, কিন্তু ফিরে এলেন সন্ধ্যাবেলায় বা রাত্রে। হয়তো সারা বেলা কুন্তী তার জন্য খাবার-দাবার সাজিয়ে বসে থাকলেন। মনে রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, মুখে নেই অপ্রিয় কোনও শব্দ। এর মধ্যে যেটা বেড়েই চলেছিল, সেটা নিত্যনতুন ব্যঞ্জনের বাহার। দুর্বাসা অবশ্য এতেই ছেড়ে দিতেন না। হয়তো তিনি বাড়ি এসে দুর্লভ কোনও উপকরণের নাম করে বললেন– এই খাবারটার ব্যবস্থা করোনি? জোগাড় করো, তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করো–সুদুর্লভমপি হ্যন্নং দীয়তামিতি সোহব্রবীৎ। তারপর সবিস্ময়ে মুনি লক্ষ করতেন তার বলার আগেই সে খাবার তৈরি আছে–কৃতমেব চ তৎ সর্বম।
নিজের নাটকে এক চরম মুহূর্তে নাটকীয়তা ঘনিয়ে আনার জন্য মহাকবি কালিদাস দুর্বাসা মুনির ক্রোধের অংশটুকু ব্যবহার করেছেন। নাটকের সখী নায়িকার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন এই দুর্বাসার ক্রোধ বড় সুলভ, স্বভাবটাও তার বাঁকা–এষ দুর্বাসাঃ সুলভকোপো মহর্ষিঃ। কিন্তু মহাকাব্যের এই অন্যতমা নায়িকার পরিসরে আমরা দেখলাম–কুন্তীর সেবা-পরিচর্যায় দুর্বাসা মুনি পরম সন্তুষ্ট। কুন্তী এই দুর্মর্ষণ অতিথিকে দেবতার শ্রদ্ধাটুকু দিয়েছেন কিন্তু তার পরিচর্যা করেছেন–প্রিয়শিষ্যার মতো, পুত্রের মতো, বোনের মতো শিষ্যবৎ পুত্ৰবচ্চৈব স্বস্বচ্চ সুসংযতা। এই পরিচর্যার মধ্যে খোলা হাওয়ার মতো আরও যে এক সুমধুর অথবা স্বেচ্ছা সম্পর্কের অবকাশ ছিল, সেইখানে কুন্তী ছিলেন স্থির। ব্যাসকে তাই লিখতে হয়েছে–স্বস্বচ্চ সুসংযতা। জীবনের প্রান্তকালে কুন্তী যখন দেবতাকল্প শ্বশুর ব্যাসদেবের কাছে নিজের সমস্ত স্থলন-পতন-ত্রুটিগুলির স্বীকারোক্তি করছেন, সেদিন আরও একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন–সমস্ত শুচিতা আর শুদ্ধতা দিয়ে আমি সেই মহর্ষির সেবা করেছিলাম। আমার দিকে মহর্ষির ওপর রাগ করার মতো বড় বড় অনেক ঘটনা ছিল, কিন্তু আমি রাগ করিনি–কোপস্থানেপি মহৎস্যকুপন্ন কদাচন।
ভুলে গেলে চলবে না–কুন্তী অসাধারণ রূপবতী ছিলেন। স্বয়ং কুন্তিভোজ তাঁকে তাঁর রূপ সম্বন্ধে সাবধানও করেছেন, আবার দুর্বাসার জন্য সেই রূপ ব্যবহারও করেছেন– হয়তো নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অথবা ইচ্ছে করেই। কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন কাছাকাছি থাকতে থাকতে, সেবা-পরিচর্যার দান-আদানের মাঝখানে দুর্বাসার শুষ্ক রুক্ষ ঋষি-হৃদয় যদি কখনও কুন্তীর প্রতি সরস হয়ে থাকে, যদি অকারণের আনন্দে কখনও চপলতা কিছু ঘটে গিয়ে থাকে তার দিক থেকে–তবে আপন শুদ্ধতা আর সংযমের তেজে কুন্তী হয়তো মুনির সেই সরসতা এবং চাপল্য সযত্নে পরিহার করেছেন, নিজেকে স্থাপন করেছেন প্রিয়শিষ্যা, পুত্র অথবা ভগিনীর ব্যবহার-ভূমিতে। হয়তো ঋষির দিক থেকে এটাও একরকমের পরীক্ষা ছিল, অথবা নিরীক্ষা। অবশেষে দুর্বাসা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হয়েছেন। সন্তুষ্ট হয়েছেন কুন্তীর চরিত্রবলে এবং ব্যবহারেই– তস্যাস্তু শীলবৃত্তেন তুতোষ মুনিসত্তমঃ।
এক বৎসর যখন এই সেবা-পরিচর্যায় কেটে গেল, তখন মুনি খুশি হয়ে বললেন–না, কুন্তীর মধুর পরিচর্যায় সামান্যতম দোষও আমি খুঁজে পাইনি। তুমি বর চাও ভদ্রে, এমন বর, যা মানুষের পক্ষে পাওয়া দুর্লভ। এমন বর, যাতে জগতের সমস্ত সীমন্তিনী বধূদের লজ্জা দেবে তুমি। কুন্তী বললেন–আমি যা করেছি, তা আমার কর্তব্য ছিল। আপনি খুশি হয়েছেন, খুশি হয়েছেন পিতা কুন্তিভোজ, আমার বর চাওয়ার প্রয়োজন কী-ইং প্রসন্নঃ পিতা চৈব কৃতং বিপ্র বরৈমম। আজ থেকে এক বছর আগে রাজোচিত নির্মমতায় যে আদেশ নেমে এসেছিল কুন্তীর ওপর, তা সম্পূর্ণ নিষ্পন্ন করার পরই কুন্তী বোধহয় কুন্তিভোজকে আবার পিতা বলে ডাকলেন। এমনও হতে পারে মহর্ষির সামনে তাঁর পিতৃত্বের মর্যাদা ক্ষুগ্ন করতে চাননি কুন্তী।
যাই হোক কুন্তীর নিষ্কাম ব্যবহারে দুর্বাসা বোধহয় আরও খুশি হলেন। বললেন–ঠিক আছে। বর না হয় নাই নিলে। আমি তোমাকে একটা মন্ত্র দিচ্ছি, যে মন্ত্রে যে কোনও দেবতাকে আহ্বান করতে পারবে তুমি। শুধু আহ্বানই নয় এই মন্ত্রের মাধ্যমে যে দেবতাকেই তুমি ডাকবে, সেই দেবতাই তোমার বশীভূত হবেন। কামনা ছাড়াই হোক অথবা সকামভাবেই হোক এই মন্ত্রবলে যে কোনও দেবতা বাঁধা পড়বেন তোমার বাঁধনে, তিনি ব্যবহার করবেন তোমার ভৃত্যের মতো–বিবুধো মন্ত্রসংশান্তা ভবে ভৃত্য ইবানতঃ।
দুর্বাসার বর, বড় অদ্ভুত বর। পৃথিবীতে যৌবনবতী কুমারীর প্রাপ্য ছিল আরও কত কিছু, কিন্তু সব ছেড়ে কেন যে দুর্বাসা এই দেব-সঙ্গমের বর দিলেন কুন্তীকে–তা ভেবে পাই না। একটা কথা অবশ্য মনে হয়, যা একেবারেই ব্যক্তিগত। মনে হয়–কুন্তীর রূপ ছিল অলোকসামান্য। তার ওপরে তিনি এখন সদ্য যৌবনবতী। দিনের পর দিন একান্তে এই রূপের সংস্পর্শ ঋষি দুর্বাসাকে হয়তো বা যুগপৎ বিপন্ন এবং বিস্মিত করে তুলত, হয়তো বা তার মনে জাগিয়ে তুলত কোনও অকারণ বিহ্বলতা, যাতে করে কুন্তীকে তিনি স্পর্শও করতে পারতেন না, আবার ফেলেও দিতে পারতেন না–এরে পরতে গেলে লাগে, এরে ছিঁড়তে গেলে বাজে।
সংবৎসরের শেষ কল্পে দুর্বাসা যখন বিদায় নেবার কথা ভাবছেন, তখনও কুন্তীর সম্বন্ধে সেই বিস্ময়-ব্যাকুল বিপন্নতা তাকে কিন্তু মোটেই উদাসীন রাখতে পারেনি। অশব্দ অস্পর্শ এক মানসিক আসঙ্গের প্রত্যুত্তরে দুর্বাসা চেয়েছেন–হয়তো প্রতিহিংসায় নয়, হয়তো অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায় দুর্বাসা চেয়েছেন কুন্তী যেন কোনও মানুষেরই সম্পূর্ণ প্রাপণীয় না হন। পরে দেখব, তা তিনি হনওনি। এমন একটা ভাব যদি থেকে থাকে যে–আমি পেলাম না, অতএব অন্য কেউ যেন তাকে না পায়, তবেই কুন্তীর প্রতি দুর্বাসার এই বর আমার কাছে সযৌক্তিক হয়ে ওঠে। আরও সযৌক্তিক হয়ে ওঠে মহাভারতের কবির ব্যঞ্জনা। এমন ব্যঞ্জনা যে, শুষ্ক হৃদয় ঋষির বর দেওয়ার সময়েও মনে রাখতে হচ্ছে যে,–এমন একজনকে তিনি বর দিচ্ছেন যিনি রূপে অতুলনীয়া–ততস্তাম্ অনবদ্যাঙ্গীং গ্রাহয়ামাস স দ্বিজঃ দেবলোকের বিভূতি দিয়ে দুর্বাসা কুন্তীকে দেবভোগ্যা করে রাখলেন। কুন্তীর রূপ-মাধুর্য সম্বন্ধে একেবারে নিজস্ব কোনও সচেতনতা না থাকলে এক নবযুবতীর প্রতি দেব-সঙ্গমের এই প্রসঙ্গ উত্থাপন এবং বরদান একজন বিরাগী ঋষির দিক থেকে কতখানি যুক্তিযুক্ত?
একেবারে অন্য প্রসঙ্গ হলেও না বলে পারছি না যে, দুর্বাসা মুনির কাছে সংস্কৃত মহাকাব্যের কবি থেকে নাট্যকার–সবাই যেভাবে ঋণী তাতে অন্যভাবে এই ঋষির আলাদা মর্যাদা পাওয়া উচিত ছিল। পরবর্তীকালে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার মাঝখানে শুধুমাত্র দুর্বাসার শাপের আমদানি করে কালিদাস যেমন নাটক জমিয়ে দিলেন, তেমনই মহাকাব্যের কবিও দুর্বাসার বরমাত্র ব্যবহার করে কুন্তীর গর্ভে মহাভারতের ভবিষ্যৎ নায়কের সম্ভাবনা তৈরি করে রাখলেন। ভারী আশ্চর্য লাগে ভাবতে-চরম একটা নাটকীয়তার জন্য অনুকূল অথবা প্রতিকূলভাবে সেই দুর্বাসাকেই কত না ব্যবহার করেছেন মহাকবিরা। এসব কথা বলব এক সময়ে, মুনি-ঋষিদের নিয়ে আলোচনার পরিসরে।
.
০৪.
নবীন যৌবনমতী কুন্তীর কানে দেব-সঙ্গমের রহস্য-মন্ত্র উচ্চারণ করে দুর্বাসা যেই চলে গেলেন, আর অমনই কুন্তীর কুমারী-হৃদয়ে শুরু হল নতুন এক অনুভূতি। তাঁর হৃদ্যন্ত্র কথা কইতে শুরু করল পুরুষ-গ্রহণের স্বাধীনতায়। সামান্যতম সংশয় শুধু মন্ত্রের বলাবল নিয়ে–পাব তো, যাকে চাই, তাকেই কি পাব? এ কেমন মন্ত্র যাতে ইচ্ছামাত্র বশীভূত করা যায় যেকোনও অভীপ্সিত পুরুষকে! আমি পরীক্ষা করব মন্ত্রের শক্তি, দেখব–যাকে চাই সে আমার ডাক শুনতে পায় কি না? কুমারী হৃদয়ে এই নবসঙ্গমের ভাবনায় তার ঋতুভাব ত্বরান্বিত হল। ঋতুর এই অস্বাভাবিকতা বৈদ্যশাস্ত্রে মোটেই অস্বাভাবিক নয়, কারণ কুন্তী মন্ত্র পরীক্ষার জন্য সবসময় পুরুষের আসঙ্গ ভাবনায় আকুল ছিলেন এবং সঞ্চিয়ন্তী সা দদর্শর্তৃং যদৃচ্ছয়া।
তারপর একদিন। সেদিন অন্তঃপুরের অট্টালিকায় একলা ঘরে পুষ্পের বিছানায় শুয়েছিলেন পুষ্পবতী কুন্তী। ভোরের সূর্য তার কিরণ-করের স্পর্শে নবযুবতীর গালখানিও যেন লাল করে দিল। কী ভাল যে লাগছিল কুন্তীর! পূর্ব দিগন্তে আকাশের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে রক্তিম সূর্য-তার সুমধুর নান্দনিক পরাক্রমে মুগ্ধা কুন্তীর, মন এবং দৃষ্টি–দুইই নিবদ্ধ হল সূর্যের দিকে। রাত্রি-দিনের সন্ধিলগ্নের এই দেবতাটিকে এক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে কুন্তী তার মধ্যে দিব্যদর্শন এক পুরুষের সন্ধান পেলেন। দেখতে পেলেন তার কানে সোনার কুণ্ডল, বুক-পিঠ জুড়ে সোনার বর্ম–আমুক্তকবচং দেবং কুণ্ডলাভ্যাং বিভূষিতম।
মনে রাখা দরকার-দেবতার রাজ্যে সূর্য এমন এক দেবপুরুষ, যাঁর প্রাধান্য এবং মহিমা অন্য সমস্ত দেবতার চাইতে বেশি। ঋগবেদে তিনি শুধুই দেবতামাত্র নন, অন্যান্য অনেক দেবতাকেই তার বিভূতি বলে মনে করা হয়। এই তো কিছুদিন আগে দক্ষিণী পণ্ডিত অধ্যাপক সীতারাম শাস্ত্রী সমস্ত ঋমন্ত্রের সূর্যনিষ্ঠ ব্যাখ্যা করতেন। এমনকী পরবর্তীকালে যে সমস্ত দেবতার আবির্ভাব ঘটেছে–বেদের সঙ্গে যাঁদের সোজাসুজি কোনও যোগ নেই, তাদেরও সৌর-কুলীনতা প্রতিষ্ঠা করা গেলে মিথলজিস্টরা তাদের বেশি মর্যাদা দেন। বেদের পরবর্তীকালে নারায়ণ-বিষ্ণুর যে এত মহত্ত্ব দেখতে পাই, সেই বিষ্ণু-নারায়ণও কিন্তু আসলে সূর্যই। ধ্যেয়ং সদা সবিতৃমণ্ডল-মধ্যবর্তী–তারও কানে সোনার দুল, মাথায় মুকুট।
দেব-তত্ত্বের মূল-স্বরূপ ওই সূর্যকেই কুন্তী তার মন্ত্র পরীক্ষার প্রথম আধার বলে বেছে নিলেন। হৃদয়ে হাত ঠেকিয়ে আচমন-পুরশ্চরণ করে দুর্বাসা মন্ত্রে কুন্তী আহ্বান জানালেন সূর্যকে। সূর্য নিজেকে দ্বিধা বিভক্ত করলেন। আকাশ থেকে নিজের তাপ-বিতরণের কাজ যেমন চলার তেমনই চলল, কিন্তু অলৌকিকতার সূত্রে তিনি শরীর পরিগ্রহ করে কুন্তীর সামনে এসে দাঁড়ালেন–মুখে হাসি, মাথায় বদ্ধমুকুট, তেজে চারদিক উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কুন্তীর জীবনের প্রথম অভীপ্সিত পুরুষ, তিনি তাকে ডেকেছিলেন সানুরাগে–তস্য দেবস্য ভাবিনী।
অতএব এই অনুরাগের প্রত্যুত্তরের মতো সুন্দর ভাষায় সূর্য বললেন–ভদ্রে। প্রথম আলাপে স্ত্রী-লোককে ‘ভদ্রা’ সম্বোধনটি অনেকটা ফরাসিদের মাদামের মতো। এই সম্বোধনের মধ্যে প্রথম আলাপের দূরত্বটুকু বজায় রেখেই সূর্য বলেন–ভদ্রে! আমি এসেছি তোমার মন্ত্রের শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে। এখন আমি সম্পূর্ণ তোমার বশীভূত–বলো আমি কী করব–কিং করোমি বশো রাজ্ঞি? অনুরাগবতী কুন্তীর বুঝি এইবার আপন কুমারীত্বের কথা স্মরণ হল। কুন্তী বললেন–আপনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানেই ফিরে যান। আমি কৌতুকবশে অর্থাৎ এমনি মজা দেখার জন্য আপনাকে ডেকেছি, অতএব আপনি এখন ফিরে যান–কৌতূহলাৎ সমাহুতঃ প্রসীদ ভগবন্নিতি। সংস্কৃতে আছে–প্রসীদ–প্রসন্ন হোন, ফিরে যান; ইংরেজিতে এই ‘প্রসীদ’ হল–প্লিজ।
যৌবনবতী কুন্তী সানুরাগে দেব-পুরুষকে ডেকেছেন মজা দেখার জন্য-কৌতূহলাৎ সমাহুতঃ,–তিনি জানেন না একক পুরুষকে সানুরাগে ঘরে ডাকলে সে আর প্রসন্ন হয়ে ফিরে যায় না; প্রথম ভদ্র সম্বোধনের পরেই তার নজর পড়ে অনুরাগবতীর শরীরে। উচ্চাবচ প্রেক্ষণের পর যথাসম্ভব ভদ্র সম্বোধনে সে বলে কৃশকটি সুন্দরী আমার! যাব, নিশ্চয় যাব, কিন্তু আমাকে সাদরে ডেকে এনে নিজের ইচ্ছে বৃথা করে এমন করে পাঠিয়ে দেবে আমাকে–ন তু দেবং সমাহুয় ন্যায্যং প্ৰেষয়িতুং বৃথা? সূর্য পরিষ্কার বললেন–আমি তোমার ইচ্ছেটুকু জানি। তুমি চাও–সোনার বর্ম-পরা সোনার কুণ্ডল-পরা আমার একটি পুত্র হোক তোমার গর্ভে। কিন্তু তার জন্য যে তোমার শরীরের মূল্যটুকু দিতেই হবে। তুমি নিজেকে আমার কাছে ছেড়ে দাও–স মাত্মপ্রদানং বৈ কুরুষ গজগামিনি। তুমি যেমন ভেবেছ তেমন পুত্রই হবে তোমার এবং আমিও যাব তোমার সঙ্গে মিলন সম্পূর্ণ করে– অথ গচ্ছাম্যহং ভদ্রে ত্বয়া সঙ্গম সুস্মিতে।
সূর্যের প্রণয়-সম্বোধনের মধ্যে এখন রমণীর অলসগামিতা অথবা মধুর হাসিটিও উল্লিখিত হচ্ছে। অবশ্য এই সপ্রণয় ভাষণের মধ্যে পুরুষের ভয় দেখানোও ছিল। কথা না শুনলে অভিশাপ দিয়ে তোমার বাবা আর সেই ব্রাহ্মণ ঋষিটিকে ধ্বংস করব–এর থেকেও বড় দায় চাপানো হয়েছিল কুন্তীর নিজের চরিত্রের ওপরই। সূর্য বলেছিলেন–তুমি যে আমার মতো একজন দেবপুরুষকে ঘরে ডেকে এনেছ–এই অন্যায় কাজ তোমার বাবা জানেন না। কিন্তু তোমার অপরাধে আমি ধ্বংস করব তাকে এবং তার পরিজনকে। এবারে সূর্য কুন্তীর স্বভাব নিয়েই বড় গালাগালি দিয়ে ফেললেন। সূর্য বলতে চাইলেন– বোকা হলেন সেই মুনি যিনি তোমাকে এই মন্ত্র দিয়েছেন। পুরুষের সম্বন্ধে যে রমণীর সংযমটুকু নেই, সেই রমণীকে এই মন্ত্র দেওয়াটাই একটা বাতুলতা। তা সেই ব্রাহ্মণকে গুরুতর দণ্ড দেব আমি, যিনি তোমার স্বভাব-চরিত্র না জেনেই এই পুরুষ-আহ্বানের মন্ত্র তোমায় শিখিয়েছেন– শীলবৃত্তমবিজ্ঞায়… যোহসৌ মন্ত্রমদাত্তব।
সূর্য যে প্রত্যাখ্যাত হয়েই কুন্তীর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে গালাগালি দিচ্ছেন, সে-কথা আমরা বেশ বুঝতে পারি। কুন্তীর মন্ত্ৰ-পরীক্ষার মধ্যে কৌতুক ছাড়া অন্য কোনও প্রবৃত্তি ছিল বলে আমার মনে করি না। একান্ত মানবোচিতভাবে ব্যাপারটা ভেবে দেখুন–অসাধারণ কোনও লাভের অভিসন্ধি মেশানো এমন কোনও মন্ত্র যদি আমরা পেতাম, তবে আমরাও তা। পরীক্ষা করেই দেখতাম। মন্ত্রের শক্তি যে আছে, সে সম্বন্ধে মানুষ ইতিবাচক ধারণা পূর্বাহ্নে পোষণ করে না বলেই মণি-মন্ত্র-মহৌষধি-মানুষ তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করতে চায়। তার মধ্যে এই মন্ত্র হল বশীকরণের মন্ত্র; আধুনিক যুবক-যুবতীর হাতে যদি পুরুষ বা রমণী বশ করার এমন সিদ্ধমন্ত্র থাকত, তবে তা অবশ্যই পরীক্ষিত হত কুন্তীর মতোই কৌতুকে–এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।
তবে দেবপুরুষ কুন্তীকে যে গালাগালি দিচ্ছিলেন, সে কুন্তীর স্বভাব-চরিত্রের জন্য যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি নিজের সম্মানের জন্য। সুন্দরী রমণীর কাছে সাদর আমন্ত্রণ লাভ করে কোন পুরুষেরই বা প্রত্যাখ্যাত হতে ভাল লাগে, নিজের বন্ধু-বান্ধব বা সমাজের কাছেই বা তার মুখ থাকে কতটুকু? সূর্যের আসল কথাটা এবার বেরিয়ে এল। তিনি বললেন–তুমি যে আমাকে অনুরাগ দেখিয়ে এখন বঞ্চিত করছ–এসব আকাশ থেকে আমার বন্ধু দেবতারা দেখছেন আর হাসছেন–পুরন্দরমুখা দিবি। ত্বয়া প্রলব্ধং পশ্যন্তি স্ময়ন্ত ইব ভাবিনি। তোমার তত দিব্যদৃষ্টি আছে, একবার তাকিয়ে দেখো আকাশপানে। কুন্তী সুর্যের কথা শুনে আকাশের দিকে চাইলেন। দেখলেন অন্য দেবতাদের।
কুন্তী নিজের বোকামিতে সত্যিই লজ্জা পেলেন। কৌতুক-লিন্দু কুমারী এক মুহূর্তে যেন বড় হয়ে গেলেন। বললেন–তবু আপনি চলে যান সূর্যদেব। আমার পিতা-মাতা আমাকে এই শরীর দিয়েছেন, মেয়েদের কাছে এই শরীর-রক্ষার মূল্যই যে সবচেয়ে বেশি, কারণ দ্বিতীয় একটি কুমারীর শরীর তো আমি তৈরি করতে পারব না, অতএব আমার এই কুমারী শরীরটাই আমাকে রক্ষা করতে হবে–স্ত্রীণাং বৃত্তং পূজ্যতে দেহরক্ষা। কুন্তী এবার অনুনয়ের সুরে বললেন–বিশ্বাস করুন, আমি আমার অল্প বয়সের চঞ্চলতায় শুধু কৌতুকের বশে মন্ত্রশক্তি জানার জন্য আপনাকে ডেকেছি। এটা ছেলেমানুষি ভেবেই আপনি ক্ষমা করে দিন।
সূর্য বললেন–বয়স তোমার অল্প বলে আমিও তোমাকে এত সেধে সেধে বলছি। অন্য কেউ কি আমার এত অনুনয় পাওয়ার যোগ্য? তুমি নিজেকে ছেড়ে দাও আমার কাছে, তাতেই তোমার শান্তি হবে–আত্মপ্রদানং কুরু কুন্তি কন্যে শান্তিস্তবৈবং হি ভবে ভীরু। সূর্য শুধু একটা কথাই ভাবছেন। ভাবছেন–যে রমণী প্রথম যৌবনের চঞ্চলতায় সাদরে দেবপুরুষকে কাছে ডেকেছে, উপভোগের দ্বারাই তার শান্তি হবে। হয়তো এটাই ঠিক কুন্তীর প্রথম আহ্বানটুকু মিথ্যে ছিল না, কিন্তু ডাকার পর পুরুষের একান্ত দুরবগ্রহ একমুখী প্রয়াস দেখে এখন তিনি চিন্তিত, ব্যথিত। যে কোনওভাবেই হোক, সূর্য কুন্তীর শরীর সম্ভোগ ব্যতিরেকে ফিরে যেতে চান না। স্বর্গের দেবতা হওয়া সত্ত্বেও মনুষ্য-রমণীর আহ্বানে তিনি মানুষের শরীরে নেমে এসেছেন ভুয়ে। এখন এই সামান্যা মানবী তাকে প্রত্যাখ্যান করবে, এ তিনি সহ্য করতে পারছেন না। কুন্তীর কাছে বারংবার দেবসমাজে তার ভাবী অপমানের কথা তিনি বলেছেন, কারণ সেটাই তাঁর প্রধান লজ্জা–গমিষ্যামনবদ্যাঙ্গি লোকে সমবস্যতাম।
কুন্তী অনেক চিন্তা করলেন। সূর্য সতেজে তাঁর হাত ধরেই রয়েছেন। তবু মুখখানি নিচু করে তিনি কত কিছুই ভেবে নিলেন। বুঝলেন–তার প্রত্যাখ্যানে নিরপরাধ কুন্তিভোজ এবং স্বয়ং দুর্বাসার বিপদ নেমে আসতে পারে। অন্যদিকে স্বর্গের দেবতা উপযাচক হয়ে তার কাছে প্রসাদ ভিক্ষা করছেন, তাঁর হাতখানিও ধরে আছেন নিজের হাতে–এই বিচিত্র অনুভূতি তার মোহও জন্মাচ্ছে বারে বারে। একদিকে তিনি ‘শাপ-পরিত্ৰস্তা’ অন্যদিকে ‘মোহেনাভিপরীতাঙ্গী’–এই ভয় এবং মোহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কুন্তী এবার তার ভয় এবং মোহ দুই-ই প্রকাশ করলেন সূর্যের কাছে।
ভয়াবিষ্টা কুন্তী বললেন–আমার বাবা, মা, ভাই, আত্মীয়-স্বজন কী বলবে আমাকে? তারা এখন বেঁচে আছেন, আর আমি সমাজের নিয়ম ভেঙে নিজেকে হারিয়ে ফেলব? যদি সব নিয়ম ভেঙে এমনি করে হারিয়ে ফেলি নিজেকে–ত্বয়া তু সঙ্গমো দেব যদি স্যা বিধিবর্জিতঃ–তা হলে আমার বংশের মান-মর্যাদা সব যাবে।
মোহাবিষ্টা কুন্তী বললেন–আর এত কথা শুনেও যদি মনে হয়, আপনি যা বলছেন তাই ধর্ম, তবে আমি আত্মীয়-স্বজনের দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে আপনার ইচ্ছে পূরণ করব–ঝতে প্রদানা বন্ধুভ্য স্তব কামং করোম্যহম। কিন্তু আমার একটাই কথা–আমার এই শরীর দিয়েও আমি সতী থাকতে চাই। কুন্তী এই মুহূর্তে সূর্যকে সম্বোধন করলেন ‘দুর্ধর্ষ’ বলে– আত্মপ্রদানং দুর্ধর্ষ তব কৃত্বা সতী ত্বহ। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট।
মনস্তত্ত্ববিদেরা বলেন–অধিকাংশ ধর্ষণের ক্ষেত্রে–যেখানে পরস্পরের পরিচিতি আছে–সেখানে রমণীর দিক থেকে প্রাথমিক বাধাদানের ব্যাপার থাকলেও পরবর্তী সময়ে কিছু আত্মসমর্পণের ইচ্ছাও থেকে যায়। কিন্তু কি রমণী, কি পুরুষ, তিন ভুবনের সার কথাটা কুন্তীর মুখ দিয়েই বেরিয়েছে–শরীর দিয়েও আমি সতী থাকতে চাই। প্রথম যৌবনের হাজারও চঞ্চলতার মধ্যেও রমণীর পক্ষে বিধিবহির্ভূত মিলনের এই হাহাকারটুকু বড়ই স্বাভাবিক–আমি আপনাকে শরীর দিয়েও সতী থাকতে চাই–আত্মপ্রদানং দুর্ধর্ষ তব কৃত্বা সতী ত্বহ।
সূর্য সব বোঝেন। কুন্তীকে সামান্য উন্মুখ দেখা মাত্রই তিনি কথা আরম্ভ করলেন একেবারে কামুক পুরুষের স্বার্থপরতায়। বললেন–বরারোহে। বরারোহা মানে জানেন কি? A good mount for a distinguished persoনাlity. সূর্য বললেন-বরারোহে! তোমার বাবা-মা বা অন্য কোনও গুরুজন–কেউ তোমার প্রভু নন অর্থাৎ জীবনের এই বিশেষ মুহূর্তে তাদের ইচ্ছামতো চলার কথা নয় তোমার। যাতে তোমার ভাল হবে, সেই কথাই বরং আমার কাছে শোনো। সূর্য এবার পণ্ডিত-জনের পাণ্ডিত্য দেখিয়ে বললেন–’ক’ ধাতুর অর্থ কামনা করা। কন্যা শব্দটাই এসেছে এই ধাতু থেকে, অতএব কন্যাজন মাত্রই সব পুরুষকেই কামনা করতে পারে, সে স্বতন্ত্রা–সর্বান্ কাময়তে যস্মাৎ কমেধাতোশ্চ ভাবিনি। তস্মাৎ কন্যেহ সুশ্রোণি স্বতন্ত্ৰা বরবৰ্ণিনি।
সূর্য কন্যা-শব্দের মধ্যেই কামনার উৎস প্রমাণ করে দিয়ে কুন্তীর মনের আশঙ্কা দূর করতে চাইলেন। বোঝাতে চাইলেন সূর্যের প্রতি তাঁর অনুরাগবতী হওয়াটাই যথার্থ হয়েছে। কামনার চুড়ান্ত পর্যায়ে কুন্তীর কাছে সূর্যের যুক্তি হল–স্ত্রী এবং পুরুষ পরস্পরকে কামনা করবে, এইটাই স্বাভাবিক, এবং অন্যটাই বিকার–স্বভাব এষ লোকানাং বিকারোহন্য ইত্য স্মৃতঃ। সূর্য জানেন–এত যুক্তি, এত স্বভাব-বোধনের পরেও কুমারী কুন্তীর মনে সামাজিকের সেই ভ্রুকুটি-কুটিল জিজ্ঞাসাটুকু থেকেই যাবে। অতএব প্রথম যৌবনবতী রমণীর রিরংসা এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা কুন্তীকে আশ্বাস দিয়ে সূর্য বললেন–আমাদের মিলনের পর তুমি আবারও তোমার কুমারীত্ব ফিরে পাবে–সা ময়া সহ সঙ্গম পুনঃ কন্যা ভবিষ্যসি–আর তোমার ছেলেও হবে অনন্ত খ্যাতির আধার এক মহাবীর।
সূর্যের এই আশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে কুন্তী তাঁকে সম্বোধন করেছেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচার ভঙ্গীতে-হে আমার আঁধার-দূর-করা আলো–সর্বতমোনুদ। এই মুহূর্তে কুন্তী জানেন–যে ছেলে জন্ম নেবে সূর্যের ঔরসে, সেই ছেলের সঙ্গে তার থাকা হবে না, তাকে লালন পালন করার সামাজিক সাহস তার নেই। থাকলে কুমারীত্বের জন্য লালায়িত হতেন না তিনি। কিন্তু দুর্ধর্ষ এই তেজোনায়ক ফিরে যাবেন না অসঙ্গমের অসন্তোষ নিয়ে। অতএব সেই ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্মলগ্নেই তার স্বয়ম্ভরতার নিরাপত্তা চান তিনি। কুন্তী বললেন– আপনার ঔরসে আমার যে পুত্র হবে সে যেন আপনার অক্ষয় কবচ এবং কুণ্ডল নিয়েই জন্মায়। সূর্য বললেন–তাই হবে ভদ্রে! এই কবচ এবং কুণ্ডল অমৃতময়। তোমার সেই পুত্র অমৃতময় বর্ম এবং কুণ্ডল নিয়েই জন্মাবে।
কুন্তী বললেন–যদি তাই হয়, যদি আমার পুত্রের কুণ্ডল এবং বর্ম দুটিই অমৃতময় হয় অর্থাৎ জীবনে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা যদি তার স্বায়ত্তই থাকে, তবে হোক আপনার ঈঙ্গিত সঙ্গম, যেমনটি আপনি বলেছেন আমি তাতেই রাজি–অস্তু মে সঙ্গমো দেব যথোক্তং ভগবংস্কৃয়া। মনে করি–আমার পুত্র আপনারই মতো শক্তি, রূপ, অধ্যবসায়, তেজ এবং ধর্মের দীপ্তি নিয়ে জন্মাবে।
কুন্তী দেখেছেন–সূর্যের হাত থেকে যখন নিস্তার নেই-ই, সেক্ষেত্রে তার কন্যাসত্তা এবং ভাবী পুত্রের নিরাপত্তা–দুটিই তার একান্ত প্রয়োজন–একটি বাস্তব কারণে, অন্যটি মানবিক। প্রথম যৌবনের কৌতূহলে তিনি বোকার মতো ভুল করে ফেলেছিলেন, তাকে তিনি শুধরে নিয়েছেন মনস্বিনীর মতো অতি দ্রুত, সূর্যের দ্বারা প্রায় আলিঙ্গিত অবস্থায়। ভবিষ্যৎ জীবনের পরিণত মাতৃত্বের ব্যাপ্তি প্রথম যৌবনের মাদকতার মধ্যে আশা করা যায় না বলেই, অন্তত পুত্রের নিরাপত্তার ভাবনাই যে তাকে এই মুহূর্তে স্বতন্ত্র নারীর মহিমা দিয়েছে, তাতে সন্দেহ কী? ভবিষ্যতে কর্ণের শত অভিমানের উত্তরে সূর্যের দুরাগ্রহ এবং তার অসহায়তার জবাবদিহি সম্ভব ছিল না বলেই অন্তত এই নিরাপত্তার চিন্তাও আমার কাছে কুন্তীর বাস্তববোধের পরিচয়।
কুমারীত্ব এবং কুমারীপুত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতেই কুন্তী তার প্রথম মিলনের কৌতুক যেন আবারও ফিরে পেয়েছেন, অন্তত দেখাচ্ছেন সেইরকম। সূর্যের কথায় সায় দিয়ে তিনি বলেছেন–হোক সেই পরমেতি মিলন–সঙ্গমিষ্যে ত্বয়া সহ–যেমনটি তুমি চাও। আর প্রার্থিতা রমণীর সোচ্চার আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে সূর্য একাধিক প্রিয় সম্বোধনে ভরিয়ে তুলেছেন কুন্তীকে–আমার রানি, যৌবন শোভার আধার, বামোরু। সূর্য আলিঙ্গন করলেন কুন্তীকে, হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন কুন্তীর নাভিদেশ। দেবভাব থাকা সত্ত্বেও মানুষের শরীরে সূর্যের করস্পর্শের এই ইঙ্গিত পণ্ডিত হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ফুটিয়ে তুলতে দ্বিধা করেননি। বলেছেন–বসনমোচনায় ইত্যাশয়ঃ।
নবীন যৌবনবতী কুন্তী যেদিন সূর্যকে দেখে সকৌতুকে পুরুষ বশীকরণের মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, সেদিন তিনি ভেবেছিলেন-দেখি তো পুরুষকে কাছে ডাকলে কেমন হয়! দেখি তো পুরুষ ভোলালে কেমন হয়? এই কৌতুক আর কৌতুক রইল না, কঠিন বাস্তব আর সূর্যের ‘দুর্ধর্ষতা’য় সে কৌতুক এক মুহূর্তে কুন্তীকে প্রৌঢ়া করে তুলল। আর এখন সেই অভীপ্সিত সঙ্গম-কৌতুকের মুহূর্তে পুরুষের ধর্ষণ-মুখরতায় কুন্তী অচেতন হয়ে গেলেন। মহাভারতের কবি দেবতা পুরুষকে বাঁচানোর জন্য লিখেছেন–কুন্তী সূর্যের তেজে বিহ্বল হলেন, বিছানায় পড়ে গেলেন অচেতনের মতো–পপাত চাথ সা দেবী শয়নে মূঢ়চেতনা– মোহাবিষ্টা, ছিন্ন লতার মতো ভজ্যমানা লবে। আমরা জানি–ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গমে প্রবৃত্ত হয়ে কুন্তী সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন আর দুর্ধর্ষ সূর্য তার সঙ্গম সম্পন্ন করেছেন কুন্তীর অচেতন অবস্থাতেই, কারণ আমরা দেখেছি, ব্যাসদেবকে অধ্যায় শেষ করতে হয়েছে– একাকী সূর্যের সঙ্গম-সন্তোষের পর কুন্তীর চেতনা ফিরিয়ে দিয়ে–সংজ্ঞাং লেভে ভুয় এবাথ বালা। ব্যাসের শব্দ প্রয়োগও খেয়াল করবেন–’বালিকা আবারও চেতনা ফিরিয়া পাইল। এই বালা বা বালিকা শব্দের মধ্যেই কুন্তীর অজ্ঞতা, চঞ্চলতা, কৌতুকপ্রিয়তা ইত্যাদি নির্দোষ গুণগুলি নিহিত করে মহাভারতের কবি তাকে সমস্ত দোষ থেকে মুক্তি দিয়েছেন।
.
০৫.
কুন্তী আর সূর্যের প্রথম মিলন কাহিনীর্টি আমি সবিস্তারে শোনালাম। এর কারণ এই নয় যে কুমারী অবস্থায় সূর্যের সঙ্গে কুন্তীর সঙ্গম-রসের রগরগে বর্ণনা দিয়ে অল্পস্বল্প পাঠকের চিত্ত বিনোদন করায় আমার বড় মোহ আছে। এই বিস্তারটুকু আমার কাছে এইজন্য প্রয়োজনীয় যে, অনেকেই কুন্তীকে খুব দোষারোপ করে থাকেন। পরবর্তী সময়ে ভাগ্যহত কর্ণের যন্ত্রণা যত বাড়তে থাকে এই দোষারোপও ততই বাড়তে থাকে। এই বর্ণনার মাধ্যমে আমি কুন্তীর নাচার অবস্থাটা বোঝাতে চেয়েছি।
আরও কারণ আছে। সেটা মনস্তত্ত্বের পরিসর। পূর্বে কৃষ্ণের কাছে কুন্তী অনুযোগ করেছিলেন–আমি বাপের বাড়িতেও সুখ পাইনি। শ্বশুরবাড়িতেও নয়–সেই অনুযযাগের নিরিখে আমরা লক্ষ করেছি মহারাজ কুন্তিভোজ তাকে দত্তক নিলেও সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করতে পারেননি। কুন্তীও তার মধ্যে সার্থক পিতাটিকে খুঁজে পাননি। কুন্তীর মানসিক জটিলতা আরও বেড়েছে আর একটা কারণে। আমার ধারণা– ভোজবাড়িতে এসে কুন্তী একটি পালক পিতা পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু মা পাননি। সেই দত্তক নেওয়ার মুহূর্ত থেকে এখনও পর্যন্ত মহারাজ কুন্তিভোজের রানির উল্লেখ কোথাও নেই। কুন্তী যেভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই ভোজগৃহের সর্বময়ী কত্রীটি হয়ে উঠেছিলেন, তাতে এই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। প্রথম যৌবনবতী কন্যাকে দুর্বাসার মতো অতিথির সেবায় নিযুক্ত করার সময়েও কুন্তিভোজ প্রৌঢ়া জননীর মতো কারও সঙ্গে আলোচনা করেননি। এবং আজ এই বিধিবহির্ভূত মিলনের পরেও কুন্তীকে আমরা বিপন্ন হয়ে খুঁজতে দেখিনি জননীর আশ্রয়। ভাবে বুঝি, কুন্তিভোজের স্ত্রী বুঝি পূর্বেই স্বৰ্গতা হয়েছিলেন।
দশ মাস কেটে গেল, কুন্তীর প্রচ্ছন্ন গর্ভের কথা কেউ টেরই পেল না। যে বাড়িতে জননীর অস্তিত্ব আছে, সে বাড়িতে এই প্রচ্ছন্নতা কি সম্ভব? কুন্তীর গর্ভের আকার শুধু প্রতিপদের চাঁদের আকার থেকে ক্রমে বিবর্ধিত হল। কিন্তু কেউ টেরটি পেল না। কারণ তিনি থাকতেন মেয়েদের থাকবার জায়গায় এবং গর্ভের আকার লুকিয়ে রাখার অভ্যাস তিনি করেছিলেন নিপুণভাবে। অন্তঃপুরের এক ধাত্রীকন্যা ছাড়া–হয়তো গর্ভমুক্তির জন্য তাকেই রেখেছিলেন কুন্তী–সে ছাড়া দ্বিতীয় কেউ টের পেল না কুন্তীর কুমারী-গর্ভের কথা।
যথা সময়ে কুন্তীর পুত্র জন্মাল। গায়ে সোনার বর্ম, কানে সোনার কুণ্ডল, দেখতে ঠিক সূর্যের মতো–যথাস্য পিতরং তথা। প্রথম পুত্র জন্মের আনন্দে উৎসব করা হল না, মঙ্গল-শঙ্খ বাজল না, চিৎকার করে কেউ ঘোষণা করল না–রাজবাড়িতে ছেলে হয়েছে। সমাজে নিজের সম্মান রাখার তাগিদে কুন্তী ধাত্রীকন্যার সঙ্গে পরামর্শ করে একটি বেতের পেটিকার মধ্যে ভাল করে মোম লেপে দিলেন যাতে পেটিকা জলের মধ্যে ভাসলেও তাতে জল না ঢোকে। সেই পেটিকার মধ্যে সুন্দর কাপড় পেতে দিয়ে কুন্তী শুইয়ে দিলেন শিশু পুত্রকে। পেটিকার মুখ ঢেকে সদ্য-জননী কুন্তী চললেন সন্ধ্যার অন্ধকারে বাড়ির উপকণ্ঠে অশ্বনদীর দিকে। একদিকে কুমারীত্ব প্রতিষ্ঠার সামাজিক দায়, অন্যদিকে পুত্রস্নেহ–এই দুই বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ায় মাতৃস্নেহই কিন্তু বড় হয়ে উঠল কুন্তীর মনে। মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন কুমারী মেয়ে গর্ভধারণ করে পুত্রের জন্য বিলাপ করছে–এটা ঠিক নয় জেনেও কুন্তী তার মাতৃ-হৃদয়ের ক্রন্দন রুদ্ধ করতে পারেননি। ভীষণ ভীষণ কেঁদেছেন তিনি, কেঁদেছেন পুত্রস্নেহে–পুত্রস্নেহেন রাজেন্দ্র করুণং পর্যদেবয়ৎ।
হ্যাঁ, পুত্রকে তিনি ভাসিয়েই দিয়েছেন অশ্বনদীর জলে। সাধারণে বলতেই পারেন–কেন, এতই যদি পুত্রস্নেহ তবে কেন সব অপমান লজ্জা ঠেলে দিয়ে, কেন তিনি ঘোষণা করলেন না–কুমারীর লজ্জার থেকেও পুত্রস্নেহ আমার কাছে বড়। আমি বলব-সমালোচনার প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলা যায় অনেক কিছু, কিন্তু কেউ কি কুন্তীর মনস্তত্ত্বের ধার দিয়ে গেছেন? মনে রাখা দরকার–যে রমণী নিজেই নিজের কাছে করুণার পাত্র, তার করুণার পরিমাপ করতে চাইছি আমরা।
আমি আগেই বলেছি–শৈশবে আপন পিতা-মাতার স্নেহরসে বঞ্চিত হয়ে যে রমণী অন্যের ঘরে প্রতিপালিত হল, যাঁকে যে কোনও বিপন্ন মুহূর্তে তার পালক পিতা বলেন– তুমি আর্য শূরের মেয়ে, ভুলে যেয়ো না তুমি মহামতি বসুদেবের বোন–সেই রমণীর কাছে। মর্মান্তিক পুত্রস্নেহের থেকেও কুমারীত্ব বড়। যাঁরা দত্তক নেন, তাদের মনস্তত্ত্ব কি কখনও বিচার করে দেখেছেন? যে পিতা-মাতা দত্তক নিলেন, সেই ছেলে বা মেয়ে যদি ভবিষ্যতে সুপুত্র বা গুণবতী রমণী হয়, তবে সমস্তটাই সেই পালক পিতা বা মাতার পালনের গুণ, কিন্তু দৈববশে সেই ছেলে বা মেয়ে যদি কুপুত্র বা দুশ্চরিত্রা হয়, তবে সব দোষটাই গিয়ে পড়বে বীজী পিতার অথবা গর্ভধারিণী মায়ের ওপর। পালক পিতা-মাতার অন্তর্দাহ আড়ালে বলতে চাইবে–অমন বাপ-মায়ের মেয়ে, বংশের দোষ যাবে কোথায়?
বরিষ্ঠ বংশের মেয়ে অন্য বাড়িতে প্রতিপালিত হয়ে কুন্তী পিতা-মাতার নাম ডোবাতে চাননি। তাই কুমারীত্ব এবং কন্যাপুত্রের দ্বৈরথে কুমারীর সুনাম তার কাছে বড় হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে যে পুত্র কঠিন কাব্যময়তায় বলে উঠবে–যে ফিরালো মাতৃস্নেহপাশ/তাহারে দিতেছ মাতঃ, রাজ্যের আশ্বাস–সে পুত্র কি জানে–শৈশবে তার মা কতটুকু মাতৃস্নেহ লাভ করেছে! কঠিন মনস্তত্ত্বের শিকার হয়েই কুন্তী কুন্তিভোজের বাড়িতে এসেছেন, এখন তিনি আরও কঠিনতর মনস্তত্ত্বের শিকার হয়ে যাবেন, যখন সদ্য-জননীর গর্ভ-হেঁচা পুত্রটিকে ভাসিয়ে দিতে হল অশ্বনদীর জলে।
কতই না কল্পনা ছিল। সে যেন আপনারই মতো দেখতে হয়। আপনার মতো চেহারা, আপনার মতো শক্তি, আপনার মতো তেজ, আর আপনারই মতো সত্ত্বগুণ-ত্ব বীর্যরূপসত্ত্বৌজা ধর্মযুক্তো ভবেৎ স চ কুন্তী শুধু এই চেয়েছিলেন। কিন্তু আজকে ভাগ্যের তাড়নায় কুমারীত্বের প্রাধান্যে প্রথম-জাত পুত্রকে ভাসিয়ে দিতে হল জলে। জননীর আর্দ্রতায় কুন্তীর বুক ভেঙে কান্না এল। নির্জন নদী তীরে আকাশ-বাতাসের উদ্দেশে জানাতে হল জননীর উদ্বেগ-বাছা আমার! দুলোক-ভূলোকে যত প্রাণী আছে, তারা যেন তোমাকে বাঁচিয়ে রাখে–স্বস্তি তেহস্তু অন্তরীক্ষেভ্য পার্থিবেভ্যশ্চ পুত্ৰক। যে জলে তোমায় ঠেলে দিয়েছি, সেই জলচর প্রাণীরা যেন ক্ষতি না করে তোমার। তোমার যাবার পথে মঙ্গল হোক তোমার।
বাছা! জলের রাজা বরুণ তোমায় রক্ষা করুন জলে, আকাশে রক্ষা করুন সর্বত্রগামী বায়ু।
বাছা! যিনি দিব্য-বিধানে আমার কোলে দিয়েছিলেন তোমাকে, তোমার সেই তেজস্বী পিতা তোমায় সর্বত্র রক্ষা করুন–পিতা ত্বাং পাতু সর্বত্র তপনস্তপতাং বরঃ।
সমস্ত দেবতার আশীর্বাদ যাচনা করেও কুন্তী জননীর যন্ত্রণা এড়াতে পারলেন না একটুও। কবচ-কুণ্ডলের সুরক্ষায় কর্ণের যে মৃত্যু হবে না, সেটা তিনি জানতেন। কিন্তু এমন সুন্দর শিশুপুত্রটিকে কোলে চেপে না ধরে, তাকে যে বিসর্জন দিতে হচ্ছে,–এই ব্যথার থেকেও আরও কঠিন এক ঈর্ষাকাতর অনুভূতি তাকে পীড়িত করতে লাগল। পুত্র-স্নেহের আরও এক অন্যতর রূপ এই ঈর্ষা। কুন্তী তখনও কাঁদছেন, আর ধরে আছেন তার পরান-পুতলির পেটিকাটি। মুখে বলছেন–বাছা! বিদেশ-বিভুয়ে যেখানেই বেঁচে থাকো তুমি, তোমার এই সহজাত বর্ম দেখে তোমায় ঠিক চিনতে পারব আমি। ধন্য তোমার পিতা, যিনি সহস্র কিরণ-চক্ষুতে নদীর মধ্যেও তোমাকে দেখতে পাবেন। বাছা! ধন্য সেই মা যিনি তোমাকে পুত্র-কল্পনায় কোলে তুলে নেবেন, তোমার মুখে দেবেন স্নেহত স্তন্যপান। এই শিশু বয়সেই এমন তেজস্বী চেহারা, এই দিব্য বর্ম, এই কুণ্ডল, এই পদ্মপাতার মতো চোখ, এই চাঁচর কেশ–যে মা তোমাকে পাবেন, তিনি কি কোনওদিন কোনও সুখস্বপ্নেও এমন একটি পুত্রের মুখচ্ছবি কল্পনা করতে পেরেছিলেন? বাছা! তুমি যখন মাটিতে হামাগুড়ি দেবে, ধুলায় ধূসর হবে তোমার শিশু-শরীর, তুমি কথা বলবে কলকল করে, আধো আধো ভাষায়–অব্যক্ত কল-বাক্যানি বদন্তং রেণুগুণ্ঠিত–সেদিন তোমায় আমি দেখতে পাব না, দেখবেন পুণ্যবতী অন্য কোনও মা। বাছা! বাছা! যখন তুমি বড় হবে, বন্য সিংহের তেজ আসবে তোমার শরীরে সেদিনও আমি তোমায় দেখতে পাব না। দেখবেন অন্য কোনও জননী।
কুন্তী অনেক কাদলেন। প্রথম জাত পুত্রের ভবিষ্যৎ মুখচ্ছবি যতই স্পষ্ট হতে থাকল তার মনে, তার কষ্টও তত বাড়তে লাগল। মা হওয়ার পর প্রথম সন্তানের বিয়োগ-দুঃখ একজন মাকে যতখানি যন্ত্রণা দিতে পারে, কুন্তী ঠিক সেই যন্ত্রণাই পেলেন। তবু তাঁকে ভাসিয়ে দিতে হল তার শিশুপুত্রটিকে। হাজারও কান্নাকাটির পর রাতও যখন অর্ধেক হয়ে গেল, তখন কঠিন বাস্তব তাকে ফিরিয়ে আনল ঘরে। এত রাত হয়ে গেছে, তবু মেয়ে ঘরে নেই–একথা যদি কোনওভাবে পিতা কুন্তিভোজের কানে যায়, তবে বহুতর অনর্থ ঘটতে পারে। কুন্তী ফিরে এলেন কাঁদতে কাঁদতে। মনে রইল পুত্র-শোকার্তা জননীর কামনা– আবার কবে দেখতে পাব আমার প্রথম সন্তানকে–পুত্ৰদৰ্শনলালসা। কুন্তী জানেন–কর্ণের মৃত্যু অসম্ভব; কিন্তু ছেলে বেঁচে আছে, অথচ তার জন্য জননীর স্নেহ-কর্তব্যগুলি করা হল না, তাকে কোনওদিন বলা যাবে না–ওরে তুই আমারই ছেলে–এই স্বাধিকারহীনতার গ্লানি কুন্তীকে কেবলই কষ্ট দিতে থাকল।
আসলে আমরা কেউই পুত্রের জন্য পুত্রকে ভালবাসি না, নিজেকে ভালবাসার কারণেই আমরা পুত্রকে ভালবাসি। উপনিষদ তাই বলেন বা আরে গার্গি পুত্রস্য কামায় পুত্রঃ প্রিয়ো ভবতি আত্মনস্তু কামায় পুত্রঃ প্রিয়ো ভবতি।
পুত্রকে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার অভিযোগে কুন্তীকে যাঁরা দোষী সাব্যস্ত করতে চান, তাদের আমি কয়েকটি কথা হয়তো কষ্টেসৃষ্টে বোঝাতে পেরেছি। এক, শৈশবে পুতুল খেলার সময় যে বালিকাকে ‘সানন্দে’ দত্তক দেওয়া হয়েছিল কুন্তিভোজের কাছে, সেই বালিকা পালক পিতার মধ্যে সাধারণ্যে পরিচিত স্নেহময় পিতাকে খুঁজে পাননি। শৈশবে মায়ের স্নেহ, যা একটি শিশুর মনোভূমি তৈরি করে অনন্ত সরসতায়, সঠিক সাবলীলতায়, সেই স্নেহ কুন্তী জন্মদাতা পিতার গৃহে তো পেলেনই না, কুন্তিভোজের গৃহেও পাননি।
দুই। ভোজগৃহের অন্যতর পরিবেশে বালিকা নিজেকে খাপ খাওয়াতে খাওয়াতে যেদিন যৌবনবতী হয়ে উঠলেন, সেই যৌবনের মধ্যে বিকার এনে দিল দুর্বাসার মন্ত্র। যৌবনের প্রথম শিহরণে কুমারীর দূরত্বে থেকে পুরুষকে একটু দেখা, একটু ছোঁয়া, আধেক পাওয়া, আধেক না-পাওয়ার রহস্য উপভোগ করা তার হল না। তিনি পুরুষ বশীকরণের কাম-মন্ত্র শিখে হঠাৎই দেব-পুরুষকে ডেকে বসলেন সদ্যোযুবতীর কৌতুকে; কিন্তু সেই কৌতুকের শাস্তি হল প্রৌঢ়া রমণীর স্থূলতায়, ভাষায়, সঙ্গমে।
তিন। একটি সন্তান জন্মাল। তাকেও জলে ভাসিয়ে দিতে হল পিতা, পরিবার এবং সমাজের মুখ চেয়ে। জন্মদাতা পিতার সানন্দ দত্তক-দানে তিনি কাঁদতে পারেননি, আজ প্রথম জাত পুত্রকে ভাসিয়ে দিয়েও তিনি সোচ্চারে কাঁদতে পারলেন না, নিজের মনোকষ্ট কোনও প্রিয়জনের কাছে বলতে পারলেন না। শৈশব এবং প্রথম যৌবনের দুই ধরনের অবরুদ্ধ শোক কুন্তীর মনোজগৎ তৈরি করেছিল এমনই এক গভীরতর মিশ্রক্রিয়ায়, যাতে মহাকাব্যের কবি তাকে আরও বহুতর কষ্টের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। কুন্তীকে যদি বুঝতেই হয়, তবে শৈশবে তার পিতা-মাতার স্নেহ বঞ্চনা এবং নবযৌবনের আরম্ভেই তাঁর অনীপ্সিত কৌতুক-সঙ্গমে তথা সন্তান-ত্যাগের নিরুদ্ধ বেদনা–এই তিনের বিচিত্র বিষমান্বয়ের নিরিখেই তাকে দেখতে হবে, নচেৎ তার চরিত্র-বিশ্লেষণে ভুল হবে, তার চরিত্রে আসবে অনর্থক আরোপ, যা মহাকাব্যের কবির হৃদয় না বোঝার সামিল।
.
০৬.
কুন্তীর রূপগুণের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই রূপগুণের ঔজ্জ্বল্য আরও বেড়ে গিয়েছিল তার ধর্মাচরণ এবং ব্রতপালনের মাধ্যমে–সত্বরূপগুণোপে ধৰ্মারামা মহাব্রতা। ধর্ম এবং ব্রতকে এই যৌবনবতী সুন্দরী কেন আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন, তার কারণ আমরা অনুমান করতে পারি। কন্যাবস্থায় সূর্য-সঙ্গম, পুত্রলাভ এবং পুত্রত্যাগ– এইসব কিছুই তার যুবতী-হৃদয়ে এমন এক অনুশোচনা তৈরি করেছিল, যার প্রলেপ হিসাবে ধর্ম এবং ব্রতচারণের মধ্যেই তিনি আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু এই ধর্ম-ব্রত নতুন এক শুদ্ধতার তেজে কুন্তীর যৌবন এবং রূপ আরও বেশি উজ্জ্বল করে তুলল এবং সেই উজ্জ্বলতা লোক-সমাজে ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না।
তেজস্বিনী যৌবনবতীর মধ্যে লজ্জা এবং মৃদুতার মতো স্ত্রী-সুলভ গুণগুলি কুন্তীকে করে তুলল প্রার্থনীয়তরা। রাজারা অনেকেই আলাদা আলাদা করে প্রস্তাব দিলেন কুন্তীকে বিয়ে করার ব্যাবৃঞ্চন পার্থিবা কেচি অতীব স্ত্রীগুণৈর্যতাম। হয়তো কুন্তীও চাইছিলেন। বিয়ে করতে। সময় বুঝে মহারাজ কুন্তিভোজ স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করলেন। ওদিকে কুন্তীর রূপ-গুণ এবং ব্রত-কর্মের কথা যেহেতু অনেক জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল তাই কৌরবগৃহেও একটা প্রাথমিক কথাবার্তা তাঁকে নিয়ে হয়ে গেছে। স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম বিদুরের কাছে প্রস্তাব করেছেন–শুনেছি যাদবদের একটি সুন্দরী মেয়ে আছে, কুলে-মানে তারা আমাদের পালটি ঘর–ক্ৰয়তে যাদবী কন্যা স্বানুরূপা কুলস্য নঃ।
‘যাদবী কন্যা’ কথাটা লক্ষ করার মতো। বোঝা যাচ্ছে কুন্তিভোজ যতই দত্তক নিন, কুন্তীর পরিচিতি ছিল যাদবদের মেয়ে হিসেবেই। কুন্তিভোজ যদি ভোজবংশের কেউ হন, তবে তাদের মধ্যেও যাদবদের রক্ত আছে এবং সে অর্থে কৃষ্ণের মামা কংসের মধ্যেও যাদবদের রক্ত আছে, কিন্তু তিনিও প্রধানত ভোজবাড়ির লোক ছিলেন। কংসকে বলা হত ভোজবংশের কুলাঙ্গার–ভোজানাং কুলপাংসনঃ। কিন্তু বংশে বংশে মামাতো পিসতুতো সম্পর্ক হলেও যাদব আর ভোজদের জ্ঞাতিশত্রুতা ছিল। বিশেষত যাদব বলে যাঁরা গর্ব করতেন, তাদের মর্যাদা কিছু বেশিও ছিল। কৃষ্ণপিতা বসুদেব অথবা কুন্তীর পিতা আর্যক শূর ছিলেন যাদবদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তি। কংসের নিজের স্বজন ভোজেরাও তার অত্যাচারে সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং যাদব বসুদেব তথা যাদব কৃষ্ণ সবসময়েই চেষ্টা করেছেন কংসের নিজের স্বজনদের মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে তাদের নিজেদের দলে টানতে। হয়তো কুন্তিভোজের হাতে নিজের মেয়েকে দত্তক দেওয়ার মধ্যেও যাদবদের এই রাজনীতি কিছু থাকতে পারে।
মহাভারতের সভাপর্বে কৃষ্ণ নিজেই যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন যে, তোজজাতির বৃদ্ধ পুরুষদের অনুরোধেই তিনি কংসকে বধ করেছেন। অন্যদিকে হরিবংশে দেখছি–কংস নিজেই বলছেন যে, বৃষ্টি, অন্ধক, ভোজ–এইসব জাতির শক্তিমান পুরুষেরা কংসের স্বজন হওয়া সত্ত্বেও যাদব কৃষ্ণের পক্ষ নিয়েছেন–শেষাশ্চ মে পরিত্যক্তা যাদবাঃ কৃষ্ণপক্ষিণঃ। আমার ধারণাকুন্তীকে ‘সানন্দে’ একটি ভোজবাড়িতে দত্তক দেওয়ার মধ্যে কুন্তীর পিতা আর্যক শূরের কিছু রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করে থাকতে পারে এবং একটি রমণীকে কেন্দ্র করে এই রাজনীতিক স্বার্থ-চেষ্টা কুন্তীর হয়তো একটুও ভাল লাগেনি৷ লাগেনি বলেই নিজের বংশের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক অধস্তন কৃষ্ণের কাছে কুন্তী নিজের পিতা আর্যক শূর সম্বন্ধে তিক্ত কথা বলেছেন। অন্যদিকে যাদবদের মান-মর্যাদা অন্য জ্ঞাতিদের থেকে বেশি থাকায় কুন্তিভোজের পক্ষে কুন্তীকে দত্তক নিয়েও তাকে আত্মীকরণ করা সম্ভব হয়নি। কুন্তী তাই বিয়ের সময়েও ‘যাদবী কন্যাই রয়ে গেছেন এবং যাদবী’ বলেই হয়তো পিতামহ ভীষ্ম তাকে নিজের কুলের উপযুক্তা বধূ হিসেবে কল্পনা করেছেন–শ্রয়তে যাদবী কন্যা স্বানুরূপা কুলস্য নঃ।
যাক এসব কথা। কুন্তিভোজ স্বয়ম্বর সভা ডাকলেন কুন্তীর বিয়ের জন্য। দেশ-বিদেশ থেকে রাজা-রাজড়ারা এলেন ভোজবাড়িতে এলেন পাণ্ডুও। হয়তো ভীষ্মের নির্দেশমতো। মহাভারতের কবি লিখেছেন–রাজসভায় মধ্যস্থানে বসা ভরতবংশের রাজা পাণ্ডুকে দেখতে পেলেন বুদ্ধিমতী কুন্তী, মনস্বিনী কুন্তী। পাণ্ডুকে দেখে তিনি মনে মনে আকুল হলেন–হৃদয়েনাকুলাভবৎ। তার শরীরে দেখা দিল কামনার রোমাঞ্চ। তিনি সখীদের সঙ্গে সলজ্জে পাণ্ডুর কাছে উপস্থিত হয়ে বরমাল্য পরিয়ে দিলেন তার গলায়।
মহাকাব্যের নিয়মে এই বিবাহ-সভার বর্ণনাগুলি প্রায়ই ‘স্টক-ডেসক্রিপশন’। অর্থাৎ যার গলায় মালা দেওয়া হচ্ছে, তিনি তার ব্যক্তিত্ব এবং শারীরিক সৌন্দর্য্যে অন্য রাজাদের অবশ্যই লজ্জা দিচ্ছেন। অপিচ নবীনতম পুরুষকে প্রথমবার চোখে দেখেই স্বয়ম্বর বধূটি তাকে পাবার জন্য ‘কাম-পরীতাঙ্গী’ হয়ে উঠছেন–এই বর্ণনা আমি আরও উদ্ধার করতে পারি।
এখানে খেয়াল করার মতো বিশেষণ আছে একটিই। তা হল বুদ্ধিমতী কুন্তী, মনস্বিনী কুন্তী। আমার ব্যক্তিগত ধারণাকুন্তীর বিয়ের মধ্যেও কিছু রাজনীতি ছিল। তখনকার দিনের রাজনৈতিক চিত্রে মগধরাজ জরাসন্ধ ছিলেন ধুরন্ধর পুরুষ। মথুরার কংস ছিলেন তার জামাই এবং এজেন্ট। যাদবরা কংসের অত্যাচারে পর্যুদস্ত হয়ে রাজনৈতিক বন্ধু বাড়াবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন একভাবে। এসব কথা আমি অন্যত্র লিখেছি। কুন্তিভোজের কাছে কুন্তীকে দত্তক দিয়ে একদিকে যেমন কংসপক্ষীয় ভোজদের হাত করার চেষ্টা করেছিলেন আর্যক শূর, তেমনই অন্যদিকে ভরতবংশের সঙ্গে একটা বৈবাহিক যোগাযোগ গড়ে তোলাটাও তাদের দিক থেকে কাম্য ছিল।
ভরতবংশের কুলপুরুষ মহামতি ভীষ্ম কুন্তিভোজের বাড়িতে থাকা যাদবী কন্যার কথাটা কোত্থেকে শুনেছিলেন–সেটা মহাভারতে বলা না থাকলেও আমার ধারণা–এ খবর এসেছিল যাদবদের কাছ থেকেই, হয়তো খোদ কৃষ্ণপিতা বসুদেবের কাছ থেকেই। এরপর কুন্তীর বিয়ের জন্য যখন স্বয়ম্বরসভা ডাকা হল, সেখানে কুন্তীর দিক থেকে সবাইকে ফেলে পাণ্ডুকে বরণ করাটা ছিল কন্যাপক্ষের ঈপ্সিত। যাঁকে কুলমর্যাদা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সময় কুন্তিভোজকে বলতে হয়–মনে রেখো তুমি আর্যক শূরের কন্যা, মহামতি বসুদেবের তুমি ভগিনী-বসুদেবস্য ভগিনী… শূরস্য দয়িতা সুতা–তিনি যে বিয়ের সময় শূর অথবা বসুদেবের ইচ্ছাটি বুঝবেন না, তা আমি মনে করি না। এইজন্যই বরমাল্য দেওয়ার সময় ঠিক পাণ্ডুকেই চিনে নেওয়ার মধ্যে কুন্তীর মনস্বিতা বা বুদ্ধিমত্তা দেখতে পেয়েছেন মহাভারতের কবি।
বরপক্ষ এবং কন্যাপক্ষ-দুইয়েরই ঈপ্সিত ব্যক্তিটির গলায় স্বয়ম্বরবধূর মালাটি পড়ায় স্বয়ম্বরসভার অবস্থা হল এখনকার দিনের পূর্বনির্ধারিত ব্যক্তির চাকুরি পাওয়ার মতো। বিশেষ এইটুকু যে, তার কোয়ালিফিকেশন’ যথেষ্ট আছে। ইন্টারভিউতে আসা গাদা গাদা কর্মপ্রার্থী ব্যক্তি যখন বুঝতে পারে লোক ঠিক করাই আছে, তখন তারা যেমন নিষ্প্রভ নিস্তরঙ্গতায় নিজেদের মধ্যে গজগজ করতে করতে ফিরে যায়, তেমনই কুন্তী পাণ্ডুকে বরণ করেছেন দেখেই রাজারা সব যেমন এসেছিলেন, তেমনই হাতি, ঘোড়া, রথের মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন–যথাগতং সমাজগুৰ্গজৈরশ্বৈ রথৈস্তথা।
কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডুর বিয়ে হল, যেন শচীর সঙ্গে মিলন হল ইন্দ্রের। পাণ্ডু বউ নিয়ে, কুন্তিভোজের বাড়ি থেকে অনেক সম্মান-উপহার নিয়ে মহর্ষি আর ব্রাহ্মণদের জয়ঘোষের মধ্যে রাজধানীতে ফিরলেন। কুন্তীর নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল- কন্যাবস্থায় সেই আকালিক দুর্ঘটনার পর এবার তিনি সুখে সংসার করবেন। কিন্তু সুখ তার ভাগ্যে ছিল না। কুন্তী কৃষ্ণের কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন বাপের বাড়িতেও আমি সুখ পাইনি, শ্বশুরবাড়িতেও নয়। শব্দটা ছিল ‘নিকৃতা’ অর্থাৎ ওখানেও লাঞ্ছনা পেয়েছি, শ্বশুররাও আমাকে লাঞ্ছনা দিয়েছেন। শ্বশুর বা শ্বশুরস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম হলেন ভীষ্ম। কারণ পাণ্ডুর নামমাত্র বাবা বিচিত্রবীর্য বেঁচে নেই এবং পাণ্ডুর জন্মদাতা ব্যাসদেব কোনওভাবেই কুরুবাড়ির সংসারে প্রবেশ করেননি। কাজেই কুন্তীর শ্বশুরের প্রথম সম্বন্ধটা ভীষ্মের সঙ্গেই।
বিয়ের পর কিছুদিন কাটতেই মহামতি ভীষ্ম পাণ্ডুর আরও একটি বিবাহ দেবার জন্য ব্যস্ত হলেন। মদ্রদেশের মেয়ে শুল্যের বোন মাদ্রীর কথা তার জানাই ছিল। তাকে বাড়ির বউ করে আনার জন্য তিনি নিজেই সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ছুটলেন সে দেশে। হয়তো পাণ্ডুর এই বিয়েতে বড় বেশি আসক্তি ছিল না। প্রথমা মহিষী কুন্তীর সঙ্গে বিয়ে হবার পর তিনি খুব উচ্চবাচ্যও করেননি। কিন্তু ভীষ্ম নিজেই আগ্রহ দেখালেন পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিবাহের জন্য।
ভীষ্মের আগ্রহটা কেন, তার কারণ আমরা বুঝি। নিজে তো বিয়ে করেননি। কিন্তু পিতা শান্তনুর দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্য মারা যেতে ভরতবংশের সিংহাসন খালি হয়ে গিয়েছিল। ভীষ্ম নিজে রাজা হবেন না অথচ রাজবংশের ভাবনাটা ছিল তারই। এই অবস্থায় রাজমাতা সত্যবতী এবং তার নিজের মতৈক্যে ব্যাসদেবকে স্মরণ করতে হয়। কুরুকুলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ড এবং বিদুরের জন্মের মাধ্যমে। কুরুকুলে বংশ পরম্পরা রক্ষার একটা সমস্যা ছিল এবং ভীষ্ম সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুদের বিয়ের আগে বিদুরকে তিনি বলেছিলেন–তোমরা তিনজনেই এই প্রসিদ্ধ ভরত বংশের অক্রূর। যে কুল প্রায় লুপ্ত হতে বসেছিল–আমি, সত্যবতী আর ব্যাসদেব মিলে এখন তোমাদের মধ্যেই সেই বংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছি–সমবস্থাপিতং ভূয়ো যুম্মাসু কুলতন্তুষু। ভীষ্ম বলেছিলেন–তোমাদের চেষ্টা করা উচিত, যাতে সমুদ্রের মতো এই বংশ বৃদ্ধিলাভ করেকুলং সাগরব যথা।
এই নিরিখে–আমার ধারণা, এই নিরিখে ভীষ্ম আগে থেকেই নানা বংশের মেয়ে খোঁজ ভাঁজ করছিলেন এবং সেই খোঁজের মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের মুখে গান্ধারীর কাহিনী শুনেছিলেন। শুনেছিলেন গান্ধারী মহাদেবকে তুষ্ট করে শতপুত্রের জননী হবার আশীর্বাদ পেয়েছেন। যিনি ভরতবংশের ‘সাগরবৎ’ বৃদ্ধি চান, তিনি যে গান্ধারীর মতো মেয়েকেই কুলবধূ করে আনবেন তাতে আশ্চর্য কী। মহাভারতের কবি লিখেছেন গান্ধারীর শত পুত্রের জননী হবার আশীর্বাদ-সংবাদ ভীষ্ম পেলেন ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে অথ শুশ্রাব বিপ্ৰেভ্যঃ। কারণ ব্রাহ্মণরাই এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়াতেন এবং এ রাজ্যের সঙ্গে ও রাজ্যের সংবাদের সূত্র ছিলেন তারাই।
তো, ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের কাছে গান্ধারীর খবর পেলেন আর কুন্তীর খবর পেলেন না? বিশেষত দুর্বাসা মুনি কারও উপকার করলে সেই উপকার কাউকে না বলে থাকবেন–এটা তার অভ্যাসের মধ্যে ছিল না। নানা পুরাণকাহিনীতে দুর্বাসার চরিত্র লক্ষ করে চৈতন্য পার্ষদ রূপ গোস্বামী এই উক্তিটি করেছেন। কাজেই দেব-পুরুষ আহ্বান করে কুন্তীর সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতার কথাও ভীষ্ম জানতেন বলেই মনে হয়। জানতেন যে, তার একটা প্রমাণ দাখিল করতে পারি মহাভারত থেকেই।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম যখন শরশয্যায় শুয়ে আছেন, রাজারা সবাই যখন একে একে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে গেছেন, তখন কর্ণ এসে উপস্থিত হলেন ভীষ্মের কাছে–একা, নতশির, অপরাধীর মতো চেহারা। এসেই বললেন–আমি রাধার ছেলে কর্ণ এসেছি– রাধেয়োহহং কুরুশ্রেষ্ঠ। ভীষ্ম বললেন–এসো, এসো কর্ণ। তুমি যে রাধার ছেলে নও, কুন্তীর ছেলে–সে আমি জানতাম। সূর্যের তেজে কুন্তীর গর্ভে তুমি জন্ম নিয়েছ–এসব কথা আমি নারদের মুখে শুনেছি। শুনেছি মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের কাছেও–সূর্যজং মহাবাহো বিদিততা নারদায়া। কৃষ্ণদ্বৈপায়নাচ্চৈব তচ্চ সত্যং ন সংশয়ঃ।
ভীষ্ম যেখানে কুন্তীর কানীন পুত্রটির কথাও জানতেন সেখানে তিনি তাঁর পুত্রলাভের ব্যাপারে দুর্বাসার আশীর্বাদের কথা জানতেন না–এটা ভাবা আমার পক্ষে মুশকিল। কাজেই গান্ধারীর কথা তিনি যেভাবে ব্রাহ্মণদের মুখে শুনেছিলেন, তেমনই কুন্তীর দৈবশক্তির কথাও তিনি জানতে পেরেছিলেন ব্রাহ্মণদের কাছ থেকেই ইতি শ্রুশাব বিপ্ৰেভ্যঃ।
কুরুকুলের সন্তান-সমস্যা সমাধানের জন্য তথা এই কুল যাতে সন্তান-সন্ততিতে ‘সাগরবৎ’ ভরে ওঠে, সেজন্যেও যদি তিনি সুবল-সুতা গান্ধারী এবং যাদবী কুন্তীকে বধূ করে এনে থাকেন, তা হলে ভীষ্মের যুক্তিও সেখানে বোঝা যায়। কিন্তু দ্বিতীয়বার তিনি কেন পাণ্ডুর সঙ্গে মাদ্রীর বিয়ে দেওয়ার জন্য এত তৎপর হয়ে উঠলেন–তার মধ্যে একটা হেঁয়ালি থেকে যায়। প্রমাণ এখানে দেওয়া যাবে না, তবে প্রায় অখণ্ডনীয় একটা অনুমান এখানে করা যেতে পারে। বস্তুত মহাভারতের পক্তির মতো শব্দ-প্রমাণ আমাদের হাতে নেই বলেই এমন একটা অনুমান আমাদের করতে হচ্ছে।
পাণ্ডুর পুত্র উৎপাদন করার ক্ষমতা ছিল না বলেই মহাভারতের কবিকে হয়তো কিম মুনির অভিশাপের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। কিন্তু সে কথা বলবার আগেই আমাদের অনুমান খণ্ডের প্রথম প্রস্তাবটা করে নিই। মহামতি ভীষ্ম কি পাণ্ডুর এই অক্ষমতার কথা জানতেন? তিনি বলেছিলেন–নারদ এবং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের কাছে তিনি কুন্তীর খবর পেয়েছেন, কিন্তু পাণ্ডুর পুত্রোৎপত্তির অক্ষমতার কথাও তিনি ব্যাসের কাছেই শোনেননি তো?
আমরা একবারের জন্য পেছন ফিরে তাকাব হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির সেই ঘরটির মধ্যে যেখানে ‘অশেষ-যোগ-সংসিদ্ধ’ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস মায়ের আদেশ মেনে নিয়ে বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর ক্ষেত্রে পুত্র উৎপাদন করছিলেন। আপনারা জানেন রাজবধূর বিদগ্ধ রুচিতে অম্বিকা এবং অম্বালিকা–কেউই ব্যাসের সঙ্গে মিলনের ঘটনাটা পছন্দ করেননি। কিন্তু তারা হলেন নিরুপায়, কারণ সে যুগে এই নিয়োগ প্রথা ছিল সমাজ-সচল। তার মধ্যে রাজমাতা সত্যবতী নিজেই হস্তিনাপুরের অরাজক সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর জন্য দুই বধূকে ব্যাসের সঙ্গে মিলিত হতে উপরোধ করেছিলেন।
সত্যবতীর ইচ্ছায় এই দুই রাজবধূর কোনও সম্মতি ছিল না। কিন্তু তাদের জন্য কুরুবংশের লোপ হয়ে যাবে–শুধু এই কারণে তাদের কোনও মতে রাজি করাতে পেরেছিলেন সত্যবতী। সত্যবতী বলেছিলেন–কিছুই নয়, তোমাদের ভাশুর আসবেন নিশীথ রাতে, তোমরা দুয়োর খুলে অপেক্ষা কোরো। কিন্তু রাজবধূর বিদগ্ধ-রুচিতে এই নিশীথ-মিলন পরাণ-সখার সঙ্গে অভিসারে পর্যবসিত হয়নি। এ মিলন বস্তুত তাঁদের কাছে ছিল ধর্ষণের মতো।
স্বয়ং ব্যাসও এটা জানতেন। সত্যবতীকেও তিনি বারবার সাবধান করেছেন। বলেছেন– আমার বিকৃত রূপ তাদের সহ্য করতে হবে–সে-কথা মনে রেখো–বিরূপতাং মে সহতাং তয়োরেত পরং ব্রত। কিন্তু বলে-কয়েও কোনও শরীর মিলনে কি রুচি নির্মাণ করা যায়? শত-শত প্রজ্জ্বলিত দীপের আলোয় ব্যাসকে দেখেই অম্বিকা তিক্ত ঔষধ সেবনের মানসিকতায় সেই যে চোখ বুজেছিলেন, আর চোখ খোলেননি। তার পুত্র শত হস্তীর শক্তি সত্ত্বেও অন্ধ হবে–ব্যাসই সে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এই দুর্ঘটনার ফলে দ্বিতীয়া রানি অম্বালিকার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল, কারণ অন্ধ ব্যক্তি কুরুবংশের রাজা হতে পারে না, অতএব তার চক্ষু মুদে থাকা চলবে না।
চক্ষু মুদে যে অনীন্সিত সঙ্গমে বড় রানি কোনওরকমে পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন, অম্বালিকাকে সেই সঙ্গম চোখ খুলে দেখতেই হল বলেই তার কাছে এই সঙ্গম সম্পূর্ণ ধর্ষণের বিকারে ধরা দিল। মহর্ষির লালচে কটা দাড়ি, মাথাভর্তি জটা, তপোদীপ্ত চক্ষু এবং গায়ের উৎকট গন্ধ–সব কিছু টান টান চোখে দেখে দ্বিতীয়া রানির শরীর ভয়ে ফ্যাকাসে হলুদ হয়ে গেল। সত্যবতী পুনরায় জিজ্ঞাসা করলে ব্যাস বললেন–এই রানির ছেলে। পাণ্ডুবর্ণ হবে।
ওপরের কথা এইটুকুই। কোনও ছেলের গায়ের রং যদি ফ্যাকাসে-হলুদ হয়, তাতে এমন কিছু আসে যায় না। বরঞ্চ এই গাত্রবর্ণে পাণ্ডুকে যে যথেষ্ট সুন্দর লাগত তার বর্ণনা আমরা মহাভারতে বহু জায়গায় পেয়েছি। কালিদাসের যক্ষবধূর মুখে এই পাতা ছিল বলে আমরা তাকে বেশি পছন্দ করেছি। কিন্তু সঙ্গম-লগ্নে রাজরানির এই পাতার আড়ালে আরও কিছু ছিল, যা ব্যাস স্বকণ্ঠে সোচ্চারে বলেননি। বৈদ্যশাস্ত্রের নিয়মমতো রমণীর কাছে পুরুষের সঙ্গম যদি ধর্ষণের বিকারে ধরা দেয়, তবে সেটা এতই ‘শকিং’ হতে পারে যাতে বিকৃতাঙ্গ সন্তানের জন্ম দিতে পারে। এর ফলেই ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, আর অম্বালিকাকে যেহেতু জোর করে এই ধর্ষণ চোখ মেলে সহ্য করতে হয়েছিল, তাই পাণ্ডু পুত্রোৎপত্তির অক্ষমতা নিয়েই জন্মেছিলেন। নইলে গাত্রবর্ণের পাণ্ডুত্ব এমন কোনও রোগ নয় যে, সত্যবতী পুনরায় ব্যাসকে আরও একটি সন্তানের জন্য উপরোধ করবেন।
সত্যবতী এই ইঙ্গিত বুঝেছিলেন হয়তো, সেই কারণেই আরও একটি পুত্রও তিনি প্রার্থনা করে থাকবেন। কিন্তু কুরুবংশের পরবর্তী বৃদ্ধির জন্য আর বেশি কিছু তার বলার ছিল না, কেননা মহর্ষি রানিদের গর্ভাধান করার সঙ্গে সঙ্গেই বলে দিয়েছিলেন-”ধৃতরাষ্ট্র শত পুত্রের পিতা হবেন এবং পাণ্ডুও পাঁচ সন্তানের পিতা হবেন। কেমন করে হবে, কীভাবে হবে– সে-কথা তখন অপ্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু আমার যা বক্তব্য ছিল–পাণ্ডুর জন্মদাতা পিতা এবং কালজ্ঞ ঋষি হিসাবে ব্যাস হয়তো জানতেন পাণ্ডুর পুত্রোৎপত্তির ক্ষমতা ছিল না। এই অক্ষমতার কথা মহামতি ভীষ্মকে তিনি জানিয়ে থাকবেন। কুরুবংশের এই সন্তানটির ওপর জন্মদাতা হিসেবে ঋষির যে মমতা ছিল, সেই মমতাতেই হয়তো ভীষ্মকে তিনি কুন্তীর খবর দিয়েছিলেন, আর সেই মমতাই মহাভারতের কবির হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়ে তাকে কিম মুনির অভিশাপের গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। আপন ঔরসজাত প্রিয় পুত্রের প্রজনন শক্তির অভাব তিনি কিমের অভিশাপের প্রলেপ দিয়ে সকারণ করতে চেয়েছেন।
এখনও প্রশ্ন রইল মাদ্রীর বিবাহ তবে কেন? দেখুন, স্বামীর ব্যক্তিত্ব-বীজ ছাড়াই যে রমণীর পুত্র-উৎপাদনের শক্তি করায়ত্ত–সে যেভাবেই হোক, দৈববলে অথবা নিয়োগপ্রথায়, পুত্ৰমুখ সে দেখবেই। সে রমণীকে স্বামী অসাধারণী ভাবতেই পারেন, কিন্তু নিজের তীব্র স্বাধিকারবোধ তাতে পদে পদে মার খায়। মাদ্রীকে ভীষ্ম প্রায় উপযাচকের মতো মদ্র নগরী থেকে নিয়ে এসেছিলেন, তাও আবার কন্যাপণ দিয়ে। নিয়ে এসেছিলেন শুধু পাণ্ডুর স্বামীজনোচিত স্বাধিকার তৃপ্ত করার জন্য নয়, নিয়ে এসেছিলেন হয়তো কুন্তীকে ‘ব্যালান্স’ করার জন্য। ভাবটা এই–শুধু পুত্র-ধারণের শক্তি থাকলেই হবে না গো মেয়ে, স্বামীর ভালবাসাটাও পাওয়া চাই। অর্থাৎ স্বামীর দৈহিক অক্ষমতায় তোমার নিজের অহংকার যদি বেড়ে যায়, তবে অন্তত স্বামীর প্রণয়ের জন্য তোমার প্রতিযোগিনী রইলেন একজন। হয়তো মাদ্রীকে ভীষ্ম এই কারণেই কুরুবাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। কারণ তিনি বোধহয় পাণ্ডুর অক্ষমতার কথাও জানতেন আবার কুন্তীর দৈবী ক্ষমতার কথাও জানতেন।
মূল প্রস্তাবে ফিরে এসে বলি–বিবাহের কয়দিনের মধ্যে, হয়তো বর-বধূর উন্মত্ত অন্তরঙ্গতা তখনও ভাল করে আরম্ভই হয়নি–তার মধ্যেই এই যে দ্বিতীয়া আরও একটি রমণীকে সযত্নে জুটিয়ে আনলেন ভীষ্ম, সে রমণী যতখানি পাণ্ডুর বউ হয়ে এলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কুন্তীর সতীন হয়ে এলেন। মনে মনে কুন্তী শ্বশুরকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন, দুঃখও পেয়েছেন মনে মনে।
হয়তো দুঃখের কারণ আরও বেশি ছিল এই কারণে যে, পুত্রোৎপত্তিতে অক্ষম জানা সত্ত্বেও পাণ্ডুর সঙ্গে যে তার বিয়ে হল–তার মধ্যে ভীষ্মের অলক্ষ হাত ছিল, কারণ এই যাদবী কন্যাটিকে আগে থেকেই তিনি পাণ্ডুর জন্য মনোনীত করে রেখেছিলেন। লক্ষ করে দেখুন, দু-দুটি নববধূকে বাড়িতে রেখে বিবাহের এক মাসের মধ্যে পাণ্ডু রাজধানী থেকে দিগ্বিজয় করতে বেরিয়েছেন। এই এক মাস কুন্তী এবং মাদ্রীর সঙ্গে তিনি বিহার করেছেন যখন তার ইচ্ছা হয়েছে অথবা যখন মনে হয়েছে বিহারে তার সুখ হবে–যথাকাম যথাসুখম্। ভাষাটা খেয়াল করার মতো।
বুঝলাম, এটাও না হয় বুঝলাম। কিন্তু প্রসিদ্ধ ভরতবংশের কোন প্রসিদ্ধ রাজা বিয়ের এক মাসের মধ্যে দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছেন? ভরতবংশে রাজকার্য বা প্রজার কার্য বোঝার মতো রাজা কম ছিলেন না। সম্বরণ, শান্তনুর মতো প্রেমিক অথবা পাণ্ডুর পিতৃপ্রতিম বিচিত্রবীর্যের মতো ভোগী রাজার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, দুষ্মন্ত, ভরত, কুরু এমনকী পরবর্তীকালে যুধিষ্ঠির-অর্জুনও যে বিয়ের এক মাসের মধ্যে কোথাও নড়েননি! পাণ্ডু কি এতই বড় রাজা? ভোগের ইচ্ছে যে তার কম ছিল না–সে-কথাও পরে জানাব।
আসলে স্ত্রীদের কাছে আপন অক্ষমতা লুকিয়ে রাখার জন্য, অথবা ক্ষমতার ধ্বজাটুকু জিইয়ে রাখার জন্যই পাণ্ডুকে দিগ্বিজয়ে বেরতে হল বিয়ের পর তিরিশ রাত্তিরের অক্ষম বিহার সেরেই–বিহৃত্য ত্রিদশা নিশাঃ। অন্তঃপুরের অন্তরমহলে পড়ে রইলেন কুন্তী– পাণ্ডুকে বরণ করার সময়ে যাঁর অতুল দৈহিক দীপ্তিতে মনে হয়েছিল যেন সূর্যের দীপ্তিতে ম্লান হয়ে গেছে অন্য রাজাদের মুখমণ্ডল–আদিত্যমিব সর্বেষাং রাজ্ঞং প্রচ্ছদ্য বৈ প্রভাঃ। যাকে দেখে কুন্তী তার হৃদয়ের ভাব গোপন রাখতে পারেননি, শরীরে জেগেছিল রোমাঞ্চ, সেই পাণ্ডু তিরিশটি বিহার-নিশি দুই রমণীর মধ্যে তারই ইচ্ছামতো ভাগ করে দিয়ে এখন রাজ্য জয় করতে বেরলেন।
রাজ্য-জয়েও অনেকদিন গেল। কম কথা তো নয়। ফিরে আসার পর দান-ধ্যান, সত্যবতী ভীষ্ম-ধৃতরাষ্ট্রকে রাশি রাশি ধনরত্ন উপহার, ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা–অনেক কিছু করে পাণ্ডু বললেন–আমি বনে যাব, বনেই কিছুদিন কাটাব। তা রাজা-রাজড়াদের এই ধরনের বিলাস হতেই পারে। রাজমহল আর রাজার সুখবিলাস ছেড়ে পাণ্ডু দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনে গেলেন। পাণ্ডু ভেবেছিলেন বুঝি, রাজমহলে যা হচ্ছে না, বনে গিয়ে তাতে সুবিধে হবে। মাঝে মাঝে তাঁকে দুটি হস্তিনীর মধ্যগত ঐরাবতের মতো লাগছিল বটে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই দুই রানিকে ছেড়ে পাণ্ডু মৃগয়ায় মত্ত থাকতেন–অরণ্যনিত্যঃ সততং বভূব মৃগয়াপরঃ।
বনে আসা, আবার বনে এসেও মৃগয়ায় ডুবে থাকা–এই সবকিছুর মধ্যেই পাণ্ডুর দুর্বার হৃদয়-যন্ত্রণা ছিল, কিছু আত্ম-বঞ্চনা ছিল, যার চরম মুহূর্তে মহাভারতের কবি কিম মুনির অভিশাপ বর্ণনা করেছেন। পাণ্ডু নাকি মৈথুনরত দুটি হরিণ-হরিণীকে মেরে ফেলবার পরেই দেখতে পেলেন হরিণটি ছিল এক ঋষিকুমার। মনুষ্যবসতির মধ্যে মৈথুন চরিতার্থ করার মধ্যে যে লজ্জা আছে, সেই লজ্জা থেকে বাঁচবার জন্যই ঋষিকুমার হরিণের আচ্ছাদন গ্রহণ করেছিলেন। ঋষি পাণ্ডুকে বলেছিলেন–স্ত্রীসম্ভোগের সুখ আপনি জানেন, অথচ সেই অবস্থায় আমাকে মেরে আপনি কী নারকীয় কাজটাই না করলেন! ঋষিকুমার বলেছিলেন–আমি পুত্রের জন্য মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম, আপনি সেই আশা বিফল করে দিলেন–পুরুষার্থফলং কতুং তৎ ত্বয়া বিফলীকৃত।
পাণ্ডু ঋষিকুমারের সঙ্গে নিজের সপক্ষে মৃগবধের কারণ উপস্থিত করে অনেক তর্ক করলেন বটে, কিন্তু মৈথুনরত অবস্থায় প্রাণিবধ মৃগয়ার বিধিতেও সত্যিই লেখে না। পুরাণ ইতিহাসে এমন গল্পও আছে যাতে দেখা যাচ্ছে–মৈথুন-চর পশু পক্ষীকে রাজপুরুষেরা ছেড়ে দিচ্ছেন। রামায়ণের মতো মহাকাব্যে যেখানে ক্রৌঞ্চমিথুনের একতরের মৃত্যুতে কবির শোক শ্লোকে পরিণত হয়েছিল, সেখানে মৈথুনরত প্রাণীকে হত্যা করার মধ্যে পাণুর যে অন্য কোনও আক্রোশ ছিল আমরা হলফ করে বলতে পারি। বস্তুত স্ত্রী-পুরুষের মিলনের মধ্যে পুত্রলাভের যে সুখ-সম্ভাবনা থেকে যায় সেই সম্ভাবনা তার বারংবার প্রতিহত হচ্ছিল বলেই তিনি তাঁর অন্তরের আক্রোশ মিটিয়েছেন মৈথুনরত একটি মৃগকে হত্যা করে, নইলে মুনি যেমন বলেছেন–সম্ভোগ সুখের মর্মও তিনি জানতেন, শাস্ত্র এবং ধর্মের মর্মকথাও তিনি জানতেন–স্ত্রীভোগানাং বিশেষজ্ঞঃ শাস্ত্রধর্মার্থতত্ত্ববিৎ।
যাই হোক মুনি শাপ দিলেন–মৈথুনে প্রবৃত্ত হলেই পাণ্ডু মারা যাবেন এবং আমাদের কাছেও পাণ্ডুর পুত্রোৎপত্তির অক্ষমতা এই মুহূর্তে থেকেই যতই সকারণ হয়ে উঠুক, আমরা বেশ জানি–মনস্বিনী কুন্তী তার শত দুঃখ সত্ত্বেও তাকে এই বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করেননি। কবি লিখেছেন–ঋষির অভিশাপ শুনে পাণ্ডুর মনে এত আঘাত লেগেছিল যে, দুই স্ত্রীকে ছেড়ে তিনি কঠোর ব্রত-নিয়ম আশ্রয় করে তপস্যা করবেন বলেই ঠিক করলেন। আমরা জানি–এও সেই আক্রোশ। বারংবার পুত্র-লাভের সম্ভাবনা ব্যাহত হওয়ায় নিজের ওপরে তার যে আক্রোশ হয়েছিল, সেই আক্রোশই তিনি চরিতার্থ করতে চেয়েছিলেন গৃহস্থধর্মের ওপরে রাগ করে। এই অবস্থায় কুন্তী এবং মাদ্রী–দু’জনেই তাকে অন্তত পত্নীত্যাগে বিরত করতে পেরেছিলেন। তারা বরঞ্চ নিজেরাও স্বামীর অনুধর্মের কঠোর নিয়ম-আচার পালন করতে রাজি হয়েছিলেন।
এইভাবেই দিন কাটছিল। দিনরাত যজ্ঞ-হোম, তপঃ-স্বাধ্যায়, ঋষিদের সঙ্গ আর ফলমূল আহার–দুই স্ত্রীর সঙ্গে সহধর্মচারী পাণ্ডুর দিন কাটছিল এইভাবেই। কিন্তু গভীর ক্ষত মিলিয়ে গেলেও যেমন তার দাগ থাকে, তেমনই এই শত ব্রত-নিয়ম-আচারের মধ্যেও পুত্রহীনতার যন্ত্রণা তাকে পীড়া দিতে লাগল। প্রাথমিকভাবে পাণ্ড নিয়োগপ্রথারও পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি স্বয়ং বিচিত্রবীর্যের পুত্র নন, তার স্ত্রীর গর্ভে তিনি ব্যাসের ঔরসে জন্মেছিলেন। নিজের জন্ম-প্রক্রিয়ার এই অকৌলীন্যে হয়তো প্রাথমিকভাবে তিনি নিয়োগের বিরোধী ছিলেন। কারণটা পরিষ্কার। বাবা বিচিত্রবীর্য বেঁচে ছিলেন না, তার অনধিকৃত ক্ষেত্রে কেউ সন্তান দান করলেন–সে এক কথা। আর পা বেঁচে আছেন, অথচ তার চোখের সামনে বা আড়ালে অন্য কেউ তারই প্রিয়া পত্নীতে উপগত হবে–এমন একটা অনধিকারচর্চা তাকে হয়তো ঈর্ষাকাতর করে তুলেছিল।
প্রিয়তমা দুই পত্নীর মুখের দিকে চেয়ে কাতর দীর্ঘশ্বাসে তিনি বলেছিলেন–সন্ন্যাসী হয়ে যাব আমি। আমার সন্তান উৎপাদন করার শক্তি নেই, কী দরকার আমার ঘর-গেরস্তির– নাহং… স্বধর্মাৎ সততাপেতে চরেয়ং বীর্যবর্জিতঃ। এই অবস্থায় অবশ্যই প্রশ্ন আসে এবং বলা যায়–পাণ্ডু তুমি কোনও ব্রাহ্মণের সাহায্য নিয়ে নিয়োগ-প্রথায় পুত্রলাভ করো। এইরকম আশঙ্কার আগেই পাণ্ডু তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন–কুন্তী-মাদ্রী দু’জনের কাছেই। পাণ্ডু বলেছিলেন–আমি কি কুত্তা নাকি যে, অন্যের কাছে ছেলে দাও, ছেলে দাও করে কাতর চোখে ভিক্ষে করব; যে ব্যাটা এমন করে, সে কুত্তা–উপৈতি বৃত্তিং কামাত্মা স শুনাং বর্ততে পথি।
কিন্তু হায়! যিনি এত বাগাড়ম্বর করেছিলেন, তাঁর চিন্তা-ভাবনা অন্যরকম হয়ে গেল। যজ্ঞ-হোম, তপশ্চরণ অনেক অনেক করেও আবারও সেই কথাই মনে হল–একটি ছেলে থাকলে বেশ হত। আসলে একটা বয়সে বাৎসল্য মানুষকে কাঙাল করে। পাণ্ডুও তাই কাঙাল হলেন। যেমন করে তোক একটি ছেলে চাই।
এ কাজ সহজ নয়, স্ত্রীদের অভিপ্রেত নাও হতে পারে। কিন্তু পাণ্ডু, পুত্রচিন্তায় পাগল পাণ্ডু একদিন নির্জনে ডাকলেন কুন্তীকে। বললেন–তুমি আমার বিপদটা জানো, কুন্তী! আমার প্রজননী শক্তি নেই–নষ্টং মে জননং-এই বিপদে তুমি আমাকে পুত্রলাভের ব্যাপারে সাহায্য করো কুন্তী। পাণ্ডু আরও বললেন–দেখো! এই এত বড় হস্তিনাপুর রাজ্যের কোনও উত্তরাধিকারী রইল না। শাস্ত্রে বলে–অন্তত ছ’রকমের ছেলে বাপের সম্পত্তি পায়–নিজের ঔরসজাত পুত্ৰ, অন্যের অনুগ্রহে নিজের স্ত্রীর গর্ভে জাত ক্ষেত্ৰজ–এইরকম করে পাণ্ডু কানীন পুত্রের কথাও বললেন। অর্থাৎ কন্যা অবস্থায় কুন্তীর যদি কোনও ছেলে থেকে থাকে তবে তার পিতৃত্ব স্বীকার করে নিতে পাণ্ডুর কোনও দ্বিধা নেই।
কিন্তু কুন্তী! কুন্তী একবারের তরেও স্বীকার করলেন না তাঁর সূর্য-সম্ভব পুত্রটির কথা। স্বীকার করলেন না, কারণ সে পুত্রের জন্মের মধ্যে জননীর ঈপ্সা ছিল না। ছিল কৌতুক। ছিল লজ্জা। ছিল গ্লানি, সবচেয়ে বেশি ছিল অনিচ্ছা। মনের গভীরে যাকে ইচ্ছের মতো লালন করেন জননী, সেই ইচ্ছে কর্ণের জন্মে ছিল না। আর ছিল না বলেই সে পর্ব তিনি ভুলতে চেয়েছিলেন। ধর্ম-ব্রতে নিজেকে শুদ্ধ করে ভালবেসেছিলেন হস্তিনাপুরের রাজাকে। নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। আজ স্বামীর এই বিপন্ন মুহূর্তে–যখন একটি কানীন পুত্রের জন্যও তিনি লালায়িত–তখনও তিনি তার পূর্বের অভিজ্ঞতা বলতে পারেননি। পাণ্ডুকে তিনি ভালবাসতে চেয়েছিলেন, তাকে ঠকাতে চাননি। তাই আজ পাণ্ডুর মুখে যখন আস্তে আস্তে সেই প্রস্তাবেরই সূচনা হচ্ছে, তখনও কুন্তী কুণ্ঠিত, লজ্জিত।
পাণ্ডু একটা গল্প বললেন কুন্তীকে। বললেন–কেমন করে এক বীর রমণী স্বামীর আদেশ মতো এক যোগসিদ্ধ ব্রাহ্মণকে আশ্রয় করে পুত্রলাভ করেছিলেন। গল্প বলার শেষে পাণ্ডুর অনুরোধ–কুন্তী! আমি মত দিচ্ছি। তুমি কোনও বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের ঔরসে পুত্রলাভের চেষ্টা করো।
কুন্তী পাণ্ডুর ইচ্ছে-অনিচ্ছে জানতেন। প্রজননের শক্তি না থাকায় পাণ্ডুর গ্লানি, তার ঈর্ষা, তাঁর কষ্ট তিনি অনুমান করতে পারেন। সবকিছুর ওপর অন্য পুরুষের নিয়োগে পুত্র লাভ করার ব্যাপারে পাণ্ডুর পূর্ব মনোভাব–অর্থাৎ সেই আমি কি কুকুর নাকি? –সেই মনোভাবও কুন্তী জানেন। নিজের জীবনে দুর্নিবার কৌতুক-খেলায় যা ঘটার একবার ঘটে গেছে। নিজের স্বামীর ঔরসজাত পুত্রটি আপন কুক্ষিতে ধারণ করে পূর্বের সমস্ত গ্লানি তিনি ধুয়ে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে বুঝি আর হল না।
তবু কুন্তী বললেন–মহারাজ! তুমি ধর্মের রীতি-নীতি সব জানো। আমিও তোমার ধর্মপত্নী মাত্র নই, তোমাকে আমি ভালবাসি–ধর্মপত্নী অভিরতাং ত্বয়ি রাজীবলোচন। ধর্ম অনুসারে তুমি আমার গর্ভে বীর পুত্রের জন্ম দেবে। সেই বীর পুত্রের জন্য শুধু তোমার সঙ্গেই মিলন হবে আমার। তুমি ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে আমার শারীরিক মিলন হচ্ছে–সে যে আমি মনে মনেও ভাবতে পারি না–ন হ্যহং মনসাপ্যন্যং গচ্ছেয়ং ত্বতে নরম। সত্যি কথা বলতে কি–তোমার চেয়ে উৎকৃষ্ট অন্য কোনও পুরুষ আমার কাছে আর কেউ নেই।
পাণ্ডু গল্প বলেছিলেন। তার উত্তরে কুন্তীও এবার গল্প বললেন পাণ্ডুকে। বললেন, পাণ্ডুরই ঊর্ধ্বতন এক বিরাট পুরুষ ব্যুষিতাশ্বের গল্প। ব্যুষিতা বহুতর যজ্ঞ এবং ধর্মকার্য করে দেবতাদের তুষ্ট করেছিলেন বটে, তবে নিজের স্ত্রী ভদ্রার প্রতি তার অতিরিক্ত আসক্তি এবং সম্ভোগের ফলে তার শরীর হল ক্ষীণ এবং তিনি অপুত্রক অবস্থাতেই মারা গেলেন। মারা যাবার পর মৃত স্বামীকে জড়িয়ে ধরে অশেষে-বিশেষে বিলাপ করলেন ভদ্রা। সেই বিলাপের সুরকুন্তী যেমন শুনিয়েছেন–সে সুর কালিদাসের রতি-বিলাপ সংগীতের প্রায় পূর্বকল্প বলা যেতে পারে। যাই হোক বিলাপে অস্থির ব্যুষিতাশ্বের প্রেতাত্মা অন্তরীক্ষ লোক থেকেই জবাব দিল–তুমি ওঠো, সরে যাও, চতুর্দশী আর অষ্টমী তিথিতে তোমার শয্যায় ফিরে আসব আমি। আমারই সন্তান হবে তোমার গর্ভে-জনয়িষ্যাম্যপত্যানি ত্বয্যহং চারুহাসিনি।
কুন্তী পাণ্ডুকে বললেন–যদি শব-শরীর থেকে তার পুত্র হতে পারে–সা তেন সুষুবে দেবী শবেন ভরতভ-তা হলে মহারাজ! তোমার তো যোগ-তপস্যার শক্তি কিছু কম নয়, তুমিই আমাকে পুত্র দেবে–শক্তো জনয়িতুং পুত্রা। পাণ্ডু এসব কথার ধার দিয়েও গেলেন না। নিজের যোগশক্তি বা তপস্যার শক্তিতে খুব যে একটা আস্থা দেখালেন তাও নয়। বরঞ্চ পুরাণে ইতিহাসে কবে কে নিয়োগ-প্রথায় আপন স্ত্রীর গর্ভে অন্যের ঔরসে পুত্র লাভ করেছে, সেইসব উদাহরণ একটা একটা করে কুন্তীকে শোনাতে লাগলেন। পাণ্ডু মানসিকভাবে কুন্তীকে অন্য একটি পুরুষের ক্ষণিক-মিলনের জন্য প্রস্তুত করতে চাইছেন। শেষ কথায় পাণ্ডু বললেন–আমাদের জন্মও যে এই নিয়োগের ফলেই সম্ভব হয়েছে, তাও তো তুমি জানো–অস্মাকমপি তে জন্ম বিদিতং কমলেক্ষণে।
পাণ্ডু নিজের কথা বলে, নানা গল্প-কাহিনী শুনিয়ে কুন্তীকে শেষে অনেক অনেক অনুনয় করে বললেন–আমার কথা তুমি শোনো কুন্তী, আমি নিজেই তোমাকে বলছি। শুধু একটি ছেলে, চিরটাকাল আমি ভেবেছি সেই ছেলের কথা। এইবারে একেবারে সত্যি কথাটা প্রকাশ হয়ে গেল। পাণ্ডুর হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হল এতকালের তথ্য-বচন– আমার প্রজনন শক্তি নেই বলেই সন্তানের আকর্ষণ আমার চিরকালের বেশি–বিশেষতঃ পুত্ৰগৃদ্ধী হীনঃ প্রজননাৎ স্বয়ম্। পাণ্ডু অনেক আদর করে কুন্তীকে সম্পূর্ণ স্বমতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্বামীর সোহাগের সঙ্গে যেন আচার্যের গম্ভীরতা মিশিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বললেন–এই আমি তোমার মাথায় আমার দুই হাত রাখছি, আমি পুত্র চাই কুন্তী, আমাকে পুত্র দাও।
কুন্তীর জীবনে স্বামীর ভালবাসার এই বুঝি চরম মুহূর্ত। পাণ্ডুর আবেগ-মধুর অনুনয়ে কুন্তী বিগলিত হলেন। আস্তে আস্তে শোনাতে আরম্ভ করলেন কুন্তিভোজের বাড়িতে সেই অতিথি-পরিচর্যার কাহিনী। বললেন তার পরম তুষ্টির কথা এবং অবশ্যই বশীকরণ মন্ত্রের কথা। এই বিষণ্ণ গম্ভীর মুহূর্তে, যখন তিনি স্বামী থাকতেও স্বামীর ইচ্ছাতেই অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতে চলেছেন, এই মুহূর্তে তার পক্ষে সেই কৌতুক-সঙ্গমের কথা উল্লেখ করা সম্ভব হল না। স্বামী যা চাইছেন ঠিক সেইরকম অর্থাৎ তার অতি-অভিলষিত একটি খবর দেওয়ার সময় তার পক্ষে স্থূলভাবে বলা সম্ভব হল না–মহারাজ! আমার একটি ছেলে আছে। কুন্তী এখানে নিজের স্বাতন্ত্র সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছেন। তিনি দেবতা আহ্বানের মন্ত্র জানেন, সেটা তিনি করবেন। কিন্তু কোন দেবতাকে আহ্বান করবেন, কখন করবেন–এই সমস্ত ভার তিনি পাণ্ডুর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। স্বামীর সম্মতি, স্বামীর চাওয়া–এই পরম অধীনতার মধ্যেই তিনি যেন পাণ্ডুর পুত্র পেতে চাইছেন, দেবতার আহ্বান তার কাছে। যান্ত্রিকতামাত্র।
কুন্তী বললেন–তুমি অনুমতি দাও। দেবতা, ব্রাহ্মণ–যাকে তুমি বলবে–যং ত্বং বক্ষ্যসি ধর্মজ্ঞ দেবং ব্রাহ্মণেব চ–তাকে আমি ডাকতে পারি। তবে কোন দেবতাকে ডাকব, কখন ডাকব–এই সমস্ত ব্যাপারে আমি তোমার আদেশের অপেক্ষা করব, আমি কিছু জানি না। তোমার ঈঙ্গিত কর্মে তোমারই আদেশ নেমে আসুক আমার ওপর ত্বত্ত আজ্ঞাং প্রতীক্ষন্তীং বিদ্ধ্যস্মিন কর্মণীপ্সিতে।
পাণ্ডুর কাছে কুন্তীর এই চরম আত্মনিবেদন এবং শরণাগতি একদিকে যেমন তার প্রথম যৌবনের গ্লানিটুকু ধুয়ে মুছে দেয়, অন্যদিকে তেমনই দেবতা-পুরুষকে নিজে নির্বাচন করার স্বাধিকার ত্যাগ করে সমস্ত ভার পাণ্ডুর ওপর দিয়ে স্বামীর প্রতি একান্ত নিষ্ঠাও তিনি দেখাতে পেরেছেন। নিজের অনীতি সন্তানটির কথাও যে তিনি বলেননি–তাও পাণ্ডুর প্রতি নিষ্ঠাবশতই। পাণ্ডু যদি দুঃখ পান। স্বামীর সম্মতি বা সাহায্য ছাড়া একাই তিনি উৎকৃষ্ট সন্তানের জননী হতে পারেন–এই স্বাধিকার যদি পাণ্ডুকে আহত করে–তাই কন্যাবস্থায় তাঁর পুত্রজন্মের কথাও উল্লেখ করেননি এবং এখনও তিনি নিজের ইচ্ছায় কাজ করছেন না, করছেন পাণ্ডুর ইচ্ছায়, তারই নির্বাচনে।
কিন্তু পাণ্ডু কী করলেন? কন্যাবস্থায় কুন্তীর কৌতুক-সঙ্গম যেমন হঠাৎই হয়ে গিয়েছিল, তেমনই এখনও কোনও মানসিক প্রস্তুতির সময় দেননি পাণ্ডু। কুন্তীর প্রস্তাবের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি কেবল একবার–আমি ধন্য হলাম, অনুগৃহীত হলাম, তুমি আমার বংশের ধারা রক্ষা করে বাঁচালে আমাকে–কেবল এই একবার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে বসেছেন–আজই, আর দেরি নয়, আজই তুমি আহ্বান করো ধর্মরাজকে।
প্রথম যৌবনে মন্ত্র পরীক্ষার জন্য যে কৌতূহল কুন্তীর মনে জেগেছিল, হয়তো পাণ্ডুও সেই মন্ত্র পরীক্ষার কৌতূহলেই কুন্তীকে বলেছিলেন–দেরি নয়, আজই ডাকো ধর্মরাজকে, তা হলে আমাদের পুত্রলাভ কোনওভাবেই অধর্মের সঙ্গে যুক্ত হবে না–অধর্মেণ ন ননা ধর্মঃ সংযুজ্যেত কথঞ্চন। আসলে ধর্মকে প্রথম আহ্বান জানানোর মধ্যে পাণ্ডুর দুটি যুক্তি থাকতে পারে। প্রথমত এতদিন পাণ্ডু ধর্ম-আচার নিয়েই জীবন কাটাচ্ছিলেন, অতএব তার একটা প্রতিফলন ঘটে থাকবে তার প্রস্তাবে। দ্বিতীয়ত, এইভাবে অন্য পুরুষের দ্বারা, হোক না সে দেবতা, তবুও অন্য একজন পুরুষের দ্বারা নিজের স্ত্রীর গর্ভে পুত্র উৎপাদনের ব্যাপারে তার কিছু লজ্জা থেকে থাকবে। কিন্তু সেই পুত্রের জন্মদাতা যদি হন স্বয়ং ধর্মরাজ, তবে তার মধ্যে অধর্মের লজ্জা কিছু থাকে না। অতএব ধর্মকেই তিনি প্রথমে ডাকতে বললেন কুন্তীকে।
কুন্তী সংযত চিত্তে ধর্মের পূজা করে দুর্বাসার মন্ত্রে ধর্মকে আহ্বান জানালেন মিলনের জন্য। ধর্ম এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন–কী চাই তোমার কুন্তী। কুন্তী বললেন–পুত্র চাই। পুত্র দিন। তারপর শতশৃঙ্গ পর্বতের বনের ভিতর একান্তে ধর্মের সঙ্গে মিলন হল কুন্তীর শয্যাং জগ্রাহ সুশ্রোণী সহ ধর্মেণ সুব্রতা।
জ্যৈষ্ঠ মাসের এক পূর্ণিমা তিথিতে কুন্তীর প্রথম ছেলের জন্ম হল। নাম হল যুধিষ্ঠির। প্রথম পাণ্ডব। ধর্মের দান প্রথম পুত্রটি লাভ করেই পাণ্ডুর এবার ক্ষত্রিয় জাতির শৌর্য বীর্যের কথা স্মরণ হল। কুন্তীকে বললেন–লোকে বলে ক্ষত্রিয় জাতির শক্তি-বলই হল সব। তুমি মহাশক্তিধর একটি পুত্রের কথা চিন্তা করো। পাণ্ডুর ইচ্ছা জেনে কুন্তী নিজেই এবার বায়ুদেবতাকে স্মরণ করলেন। কারণ দেবতার মধ্যে তিনি মহাশক্তিধর। বায়ু এলেন। কুন্তীর দ্বিতীয় পুত্র লাভ হল–ভীমসেন।
যুধিষ্ঠির এবং ভীম জন্মানোর পর পাণ্ডু যেন নতুন করে আবিষ্কার করলেন নিজেকে। শাস্ত্রে শুনেছেন–উপযুক্ত পুত্রের জন্য মাতা-পিতাকে তপস্যা করতে হয়। যুধিষ্ঠির এবং ভীমের জন্মের মধ্যে পাণ্ডুর কৌতূহল ছিল, ফলে পুত্রজন্মের মধ্যে আকস্মিকতার প্রাধান্য ছিল বেশি। কুন্তীর শক্তিতে এখন তিনি সম্পূর্ণ বিশ্বাসী অতএব জেনে বুঝে রীতিমতো পরিকল্পনা করে একটি অসামান্য পুত্রের পিতা হতে চান তিনি। এমন একটি পুত্র চান যাঁর মধ্যে দেব-মুখ্য ইন্দ্রের তেজ থাকবে। থাকবে দেবরাজের সর্বদমন শক্তি এবং উৎসাহ। এমন একটি বীরপুত্রের জন্য তিনি নিজে তপস্যায় বসলেন আর ঋষি-মুনির পরামর্শে কুন্তীকে নিযুক্ত করলেন সাংবৎসরিক ব্রতে। স্বামী-স্ত্রীর যুগল-তপস্যায় সন্তুষ্ট হলেন দেবরাজ। স্বীকার করলেন কুন্তীর গর্ভে অলোকসামান্য পুত্রের জন্য দেবেন তিনি। পাণ্ডুর ইচ্ছায় কুন্তী এবার দেবরাজকে স্মরণ করলেন সঙ্গম-শয্যায়। জন্মালেন মহাবীর অর্জুন।
অর্জুনের জন্মের পর বহুতর দৈববাণী হল। তার ভবিষ্যৎ পরাক্রম, চরিত্র এবং যশ বারংবার ঘোষিত হল স্বর্গের দেবতা আর ঋষি-মুনিদের মুখে। কুন্তীর এই পুত্রটি যে কুরুবংশের সমস্ত মর্যাদা পুনরুদ্ধার করে কুরুকুলের রাজলক্ষ্মীকে শ্রীময়ী করে তুলবে–সে কথা অর্জুনের জন্মলগ্নেই শোনা গেল বারবার। দেবতা, সিদ্ধ-গন্ধর্ব-চারণেরা, মুনি-ঋষিরা ভিড় করে অর্জুনকে দেখতে লাগলেন। এই অসাধারণ মুহূর্তে মহারাজ পাণ্ডুর কোনও প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাই না। যা দেখি তাতে আমাদের শ্রদ্ধা আহত হয়।
নন্দনের সংবাদ বয়ে আনা এই বীর পুত্রটির সম্বন্ধে শতশৃঙ্গবাসী ঋষিমুনিদের বিস্ময় এবং জয়কার তখনও শেষ হয়নি, তারই মধ্যে পাণ্ডু কুন্তীর কাছে আরও একটি পুত্রের জন্য বায়না ধরলেন। কুন্তী আর থাকতে পারলেন না। প্রজননশক্তিহীন এক অসহায় স্বামীর পুত্রকামনা মেটানোর জন্য তিনি তাঁর ইচ্ছেতে অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছেন। তাও একবার নয়, তিনবার। এখন স্বামী আবারও বলছেন চতুর্থ এক পরপুরুষের সংসর্গে পুনরায় পুত্রবতী হওয়ার জন্য। কুন্তী আর থাকতে পারলেন না। বললেন–মহারাজ! বংশকর পুত্র না থাকায় আমাদের আপৎকাল উপস্থিত হয়েছিল–এ-কথা ঠিক। সেইরকম আপৎকালে স্বামীর সম্মতিতে দেব-পুরুষের সংসর্গে আমাদের পুত্রলাভ হয়েছে–তাতেও দোষ নেই। কিন্তু বিপকালেও তিন তিনবার পরপুরুষের সহবাসে পুত্রোৎপত্তির পর চতুর্থ পুত্রের জন্ম দেওয়া–সাধুদের আচার সম্মত নয়। কুন্তীর বক্তব্য–তোমার যতই অনুমতি থাকুক, এই বিপকালেও চতুর্থ পুরুষের সংসর্গে আমার উপাধি জুটবে স্বৈরিণীর, আবার যদি যা মতিগতি দেখছি তোমার–পঞ্চম পুরুষের সহবাস জোটে আমার কপালে তা হলে লোকে আমায় বেশ্যা বলবে–অতঃ পরং স্বৈরিণী স্যাৎ পঞ্চমে বন্ধকী ভবেৎ।
আমরা যে সাহসিকা রমণীর আক্ষেপের কথা আরম্ভ করেছিলাম, অথবা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উল্লিখিত যে গৃহস্থ-পত্নী কুন্তীর উদাহরণে নিজের ব্যভিচার-দোষ সমর্থন করতে চেয়েছিল অথবা নীতি-যুক্তির নিয়মে এখনকার কালেও যাঁরা কুন্তীর মধ্যে অন্য কোনও ইঙ্গিত খুঁজে পান–তাদের আমি কুন্তীর ওই শেষ বক্তব্যটুকু স্মরণ করতে বলি। কন্যাবস্থায় কৌতুক-সঙ্গমের আকস্মিকতা ছাড়া সচেতনভাবে কুন্তী অন্য কোনও পুরুষকে সকাম অভ্যর্থনা জানাননি। এমনকী দেবতা-পুরুষদের আহ্বান করার মধ্যেও স্বামীর ইচ্ছে এবং নিজের দিক থেকে পুত্রোৎপত্তির যান্ত্রিকতা থাকায়, তার দিক থেকে কোনও সকাম ভাব আমরা লক্ষ করিনি।
বস্তুত যিনি রসিকতা করে শ্লোক বেঁধে বলেছিলেন–কপালের জোর লোকে কুন্তীকে সতী বলে, তাকেও শব্দ-চয়ন নিয়ে ভাবতে হয়েছে। তাকে শ্লোক বাঁধতে হয়েছে কর্মবাচ্যে– অর্থাৎ পাঁচটি পুরুষের দ্বারা কুন্তী কামিতা হয়েছিলেন–পঞ্চভিঃ কামিতা কুন্তী। কর্তৃবাচ্যে এই বাক্যের রূপ দাঁড়াবে–সূর্য, পাণ্ডু, ধর্মরাজ, বায়ু এবং ইন্দ্র–এই পাঁচজন কুন্তীকে কামনা করেছিলেন। এই শ্লোকের মধ্যে কুন্তীর সম্বন্ধে সকৌতুক কটু ভাবনা আছে বটে। কিন্তু তবু কামনার ক্ষেত্রে কুন্তীর কর্তৃত্ব নেই। অর্থাৎ রসিকতা করেও তার সম্বন্ধে এ-কথা বলা যাচ্ছে না যে, তিনি স্বেচ্ছায় এবং সজ্ঞানে আপন রতিসুখ চরিতার্থ করার জন্য কোনও পুরুষকে কোনওদিন কামনা করেছেন। তিনটি পর-পুরুষ সংসর্গ সত্ত্বেও পাণ্ডুর প্রতি নিষ্ঠা এবং অনুরাগটুকু মিলিয়ে নিতে হবে কুন্তীর আপন বক্তব্য অনুযায়ী–আর নয় মহারাজ! তোমার যত ইচ্ছেই হোক শুধু পুরুষান্তরের সংখ্যাই এরপর আমাকে স্বৈরিণী বা বেশ্যা করে তুলবে–অতঃ পরং স্বৈরিণী স্যাৎ পঞ্চমে বন্ধকী ভবেৎ।
কুন্তী এইটুকু বলেই পাণ্ডুকে ছেড়ে দেননি। তাঁকে শাসন করে বলেছেন-ধর্মের নিয়ম নীতি তুমি যথেষ্টই জানো। কিন্তু জেনেশুনেও যেন কিছুই তোমার খেয়াল নেই এমনিভাবে সমস্ত ধর্ম-নিয়ম অতিক্রম করে আমাকে আবারও পুত্রের জন্য বলছ কেন–অপত্যার্থং সমুক্রম্য প্রমাদাদিব ভাষসে।
আসলে এও এক বিকার। প্রজনন-শক্তিহীন অবস্থায় পাণ্ডুর এক ধরনের বিকার ছিল। কিন্তু অন্য পুরুষের সংসর্গে নিজের তিনটি পুত্র লাভ করেও পাণ্ডু যে এখনও পুনরায় স্ত্রীকে পুরুষান্তরে নিয়োগ করতে চাইছেন–এর মধ্যে বোধহয় আরও বড় কোনও বিকার আছে। জানি না, মনস্তাত্ত্বিকেরা এ বিষয়ে কী ভাববেন, তবে পাণ্ডুর অবদমিত শৃঙ্গারবৃত্তিই যে তার কুলবধূকে একরকম দুর্গতির দিকে ঠেলে দিয়েছে, সে-কথা স্বীকার না করে উপায় নেই।
যাই হোক পাণ্ডুকে থামতে হল। পুত্রহীনকে পুত্র দান করে কুন্তী আপাতত চালকের আসনে বসে আছেন। আরও একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলতে হবে। নিজের বিয়ের কয়দিনের মধ্যে পাণ্ডুকে দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে দেখে তিনি নিশ্চয়ই পুলকিত হননি। মাদ্রীর প্রতি স্বামীর দেহজ আকর্ষণ হয়তো বা কিছু বেশিই ছিল, যার জন্য তিনি পীড়িত বোধ করে থাকবেন। কিন্তু মুখে কখনওই কিছু বলেননি। আজ পুত্রলাভের জন্য পাণ্ডুকে কুন্তীরই মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে–এতে যদি তার অহংকার কিছু নাও হয়ে থাকে, আত্মতৃপ্তি কিছু ঘটেইছে। চোখের সামনে কুন্তীর এই বাড়-বাড়ন্ত দেখে মাদ্ৰীও খুশি হননি। যে কোনও কারণেই হোক স্বামী-দেবতাটি তার হাতের মুঠোয়ই ছিল, অতএব মাদ্রী কুন্তীর কাছে কোনও দীনতা দেখাননি। তার অভীষ্টপূরণ করতে চেয়েছেন স্বামীর মাধ্যমেই।
মাদ্রী পাণ্ডুকে একদিন বলেই ফেললেন–মহারাজ! তোমার পুত্র জন্মাবার শক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে–তাতেও আমার দুঃখ হয়নি। কিন্তু আমিও রাজার মেয়ে এবং পুত্র প্রসবের শক্তি আমারও ছিল। মাদ্রী বললেন–দেখো, গান্ধারীর একশোটি ছেলে হয়েছে–তাতেও আমার দুঃখ নেই। কিন্তু মহারাজ, আমি কুন্তীর চাইতে খাটো কীসে? তার ছেলে হল অথচ আমার ছেলে হল না–এ দুঃখ আমি রাখব কোথায়–ইদন্তু মে মহদ দুঃখং তুল্যতায়া অপুত্রতা। মাদ্রী নিজের দুঃখ জানিয়ে এবার আসল প্রস্তাব পেশ করলেন পাণ্ডুর কাছে। বললেন–কুন্তী আমার সতীন বটে। তাঁর কাছে আমি হ্যাংলার মতো ছেলে হওয়ার মন্ত্র শিখতে যাব না–সংরম্ভো মে সপত্নীত্বাৎ বক্তৃং কুন্তিসুতাং প্রতি। যদি তোমার ইচ্ছে হয়, যদি তোমার ভাল লাগে, তবে কুন্তীকে তুমি বলে রাজি করাও।
ছোট বউ বলে কথা। মাদ্রী যা বললেন, পাণ্ডু তা নিজেই ভেবেছিলেন। স্বামীর গাম্ভীর্য বজায় রেখেও কুন্তীর কাছে কিছু কাকুতি-মিনতি করতেই হল পাকে। কুন্তী রাজি হলেন। ভাবলেন–বেচারা! শেষে এইভাবে বলতে হল! স্বামীর আদরিণী ধনিকে করুণা করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। বললেন–ঠিক আছে। এইটুকু দয়া আমি তাকে করব– তস্মাদনুগ্রহং তস্যাঃ করোমি কুরুনন্দন। কুন্তী মাদ্রীকে মন্ত্র দিলেন বটে, কিন্তু সাবধান করে বললেন–একবার, শুধু একবারের জন্য যে কোনও দেবতাকে ডাকতে পারো তুমি।
মাদ্রী একবারে যমজ দেবতা অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আহ্বান করে কুন্তীর বুদ্ধির ওপর টেক্কা দিলেন। কুন্তীর মনে মনে রাগ হল বটে কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। এরপর পাণ্ডু আবার মাদ্রীকে মন্ত্র শেখানোর জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন কুন্তীকে। একেই কুন্তী মাদ্রীকে সহ্য করতে পারেন না, তার মধ্যে তার চোরা-বুদ্ধিতে মনে মনে আরও রেগে রয়েছেন কুন্তী। স্বামীর এই দুর্বার পুত্রেচ্ছাও তার আর ভাল লাগছে না। বস্তুত পুত্রের জন্য বারংবার এই প্রয়াসে পাণ্ডুরও কোনও সুপ্ত অভিলাষ থেকে থাকবে। আমার ধারণা–জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র শত-পুত্রের পিতা হয়েছেন–এই ঈর্ষা হয়তো তার অন্তরের অন্তরে কাজ করে থাকবে। পাণ্ডু জানতেন–কুন্তীকে বলে আর কোনও সুবিধে হবে না, এখন যদি মাদ্রীকে দিয়ে তার অভীষ্ট পূরণ হয়–তাতে ক্ষতি কী?
কুন্তী বুঝে গেছেন তার স্বামীকে। মাদ্রীকেও তার চেনা হয়ে গেছে। অতএব পাণ্ডুকে প্রায় তিরস্কারের ভাষাতেই কথাগুলি বলে গেলেন কুন্তী। মাদ্রীর সম্বন্ধে তার চিরকালীন মনোভাব যা ছিল, বিশেষত স্বামীর ব্যাপারে তার সপত্নীর অভিমানও বড় পরিষ্কার হয়ে গেল তার কথার ভাষাতেই। কুন্তী বললেন–দেখো, মাদ্রীকে একবার একটি দেব-পুরুষকে ডাকবার কথা বলেছিলাম। সেখানে সে এক মওকায় যমজ-দেবতা ডেকে দুটি ছেলে পেয়েছে। এ তো চরম বঞ্চনা, আমাকে তো বোকা বানানো হয়েছে–তেনাস্মি বঞ্চিতা। এরপরেও আমি যদি তাকে আবার মন্ত্র শিক্ষা দিই, তবে তো সন্তান-সৌভাগ্যে সে আমাকেও টেক্কা দেবে, অন্তত সংখ্যায়। তুমি আর বোলো না, খারাপ মেয়েছেলেদের কেতাকানুনই এইরকম– বিভেমস্যা হ্যভিভবাৎ কুন্ত্ৰীণাং গতিরীদৃশী। আমি বোকা কিনা, তাই বুঝিনি যে, যুগল পুরুষের আহ্বানে ফলও দুটোই হয়। না, তুমি আর আমাকে অনুরোধ কোরো না, আমি খুব বুঝেছি, এবার আমাকে দয়া করো–তস্মান্নাহং নিযযাক্তব্যা ত্বয়ৈযোহস্তু বরো মম। পাণ্ডু কুন্তীকে আর ঘটাতে সাহস করেননি।
.
০৭.
কুন্তী স্বামীকে ভালবাসার চেষ্টা করেছিলেন অনেক। কিন্তু স্বামীসুখ তার কপালে ছিল না। দুর্বাসার কাছে স্বেচ্ছা-বিহারের মন্ত্র শেখা সত্ত্বেও তার মনে ছিল অসাধারণ সংযম এবং তার চেয়েও বেশি ব্যক্তিত্ব। ইচ্ছে করলেই কামুকের স্থূলতায় তাকে ভালবাসা যায় না। তাকে ভালবাসতে হলে পুরুষের দিক থেকে যে ব্যক্তিত্ব, যে সংযম থাকা দরকার, সেই ব্যক্তিত্ব বা সেই সংযম পাণ্ডুর ছিল না। কুন্তীর অন্তর বুঝতে হলে স্বামী নামক পুরুষটির যে পরিশীলিত চিত্তবৃত্তি বা যে মার্জিত রুচিবোধ থাকা দরকার পাণ্ডুর তা ছিল না। ছিল না বলেই চতুর্থবার তিনি কুন্তীকে দেব-পুরুষ ভজনার কথা বলতে পেরেছিলেন। ছিল না বলেই মাদ্রীর মাধ্যমে তিনি নিজের বিকার চরিতার্থ করার চেষ্টা করেছিলেন। কুন্তী তাকে অপমানও করেননি, কিন্তু তার কথা শোনেনওনি। বস্তুত সেখানে তিনি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যেখানে পাণ্ডু রুচির সীমা অতিক্রম করেছেন অথবা যেখানে রুচি কামুকতার স্কুলচিহ্নে চিহ্নিত হয়েছে।
স্বামীসুখ কুন্তীর কপালে ছিল না। তার কারণ পাণ্ডু নিজেই। আরও এক কারণ তার সতীন মাদ্রী। পুত্ৰ উৎপাদনের শক্তি না থাকলেও পাণ্ডুর কামুকতা ছিল যথেষ্ট। যদি কিম মুনির অভিশাপের গল্পটি বিশ্বাস করতে হয়, তবে বলব–পাণ্ডু যে মৈথুনরত অবস্থায় মৃগ-মুনিকে হত্যা করেছিলেন, তার পিছনে পাণ্ডুর ক্ষত্রিয়ের যুক্তি যাই থাক, আসলে তিনি নিজের কাম-পীড়ন সহ্য করতে পারেননি বলেই মৃগের মৈথুনও সহ্য করতে পারেননি। পরে অভিশাপগ্ৰক্ত হয়ে তিনি স্ত্রীদের কাছে সানুতাপে নিজের সম্বন্ধেই বলেছেন–ভদ্র বংশে জন্মেও সংযমের লাগামছাড়া কামমুগ্ধ লোকেরা নিজের দোষেই এমন বাজে কাজ করে যে তার দুর্গতির সীমা থাকে না–প্রাপ্তব্যকৃতাত্মানঃ কামজালবিমোহিতাঃ।
মৃগ-মৈথুনের মধ্যে কোনও ইন্দ্রিয়পীড়ন অনুভব না করলে পাণ্ডু নিজের সম্বন্ধে এই কথাটা বলতেন না। এই মুহূর্তে স্মরণে আনতেন না পিতা বিচিত্রবীর্যের কথা, যিনি অতিরিক্ত স্ত্রীসম্ভোগে শরীরে যক্ষ্মা ধরিয়ে ফেলেছিলেন। পাণ্ডুর অবস্থাও প্রায় একইরকম। তবে তার এই সম্ভোগ-প্রবৃত্তির ইন্ধন হিসেবে কুন্তীকে ব্যবহার করাটা পাণ্ডুর পক্ষে কঠিন ছিল। কারণ সেই সংযম, সেই ব্যক্তিত্ব। কিন্তু মদ্ররাজকন্যা এ বিষয়ে পাণ্ডুর মনোমতো ছিলেন এবং তাঁর অনিয়ত শৃঙ্গার-বৃত্তিতে প্রধান ইন্ধন ছিলেন তিনিই। যথেষ্ট শৃঙ্গারে সাহায্য করার কারণেই স্বামীর প্রণয় ছিল তার বাড়তি পাওনা। বস্তুত কুন্তী এর কোনওটাই পছন্দ করতে পারেননি। স্বামীর প্রণয়ের জন্য অসংযত রুচিহীনতাকে তিনি প্রশ্রয় দিতে পারেননি, নিজেকেও বল্পহীনভাবে ভোগে ভাসিয়ে দিতে পারেননি।
মৃগ-মুনির অভিশাপের পর পাণ্ডু যে হঠাৎ বড় ধার্মিক হয়ে উঠলেন জপ-যজ্ঞ-হোমে দিন কাটাতে লাগলেন–তার পিছনে তার ধর্মীয় সংযম যত বড় কারণ, শাপের ভয় তার চেয়ে অনেক বড় কারণ। মৃগ মুনির অভিশাপ ছিল-মৈথুনে প্রবৃত্ত হলেই তোমার মরণ ঘটবে।
এই অভিশাপের পর কুন্তী স্বামীর ব্যাপারে আরও কড়া হয়ে গিয়েছিলেন। কোনওভাবেই যাতে তার প্রবৃত্তির রাশ আলগা হয়ে না যায়, সেদিকে তিনি দৃষ্টি রাখতেন সতত। বস্তুত স্বামীর ব্রত-ধর্ম পালনে তিনি বরং খুশিই ছিলেন। সাময়িকভাবে পাণ্ডুও শান্ত হয়ে ছিলেন বটে, তবে পুরুষান্তরের সংসর্গে নিজের স্ত্রীর গর্ভে বারংবার পুত্র-প্রার্থনার মধ্যে তার আপন কাম-বিকারই শান্ত হচ্ছিল। কিন্তু যেই তাঁর পুত্রলাভ সম্পন্ন হয়েছে, বলা ভাল–কুন্তীর ব্যক্তিত্বে পুরুষান্তরে তার শৃঙ্গার-নিয়োগ যেই বন্ধ হয়ে গেছে, অমনই পাণ্ডুর ধর্ম-কর্ম চুকে গেছে, এমনকী শাপের ভয়, মৃত্যুর ভয়–সব তিনি অতিক্রম করতে পেরেছেন আপন শৃঙ্গার-লালসায়।
অবশ্য সময়টাও ভাল ছিল না। ছেলেরা বড় হচ্ছিল। এদিকে চৈত্র এবং বৈশাখের সন্ধিতে বসন্তের হাওয়ায় পলাশ-চম্পকের মাতন শুরু হয়েছিল শতশৃঙ্গ পর্বতের বনে বনান্তে। এই উতলা হাওয়ায় পাণ্ডুর মনে মাঝে মাঝেই বাসনার শিখা জ্বলে উঠছিল। দূরে তার ধর্ম-বালকরা খেলা করছিল, কুন্তী তাদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু মাদ্রী রাজাকে একা উতাল-চিত্তে ঘুরতে দেখে তার পিছু নিলেন এবং তাও একাকিনী।
তিনি দুটি বালকের হাত ধরে রাজার সঙ্গে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। মহাভারতের কবি পর্যন্ত তাঁর এই ভঙ্গি নাপছন্দ করে লিখেছেন–মাদ্রী তার পিছন পিছন গেছেন একাতং মাদ্রী অনুজগামৈকা। তাও যদি বা তিনি সাবগুণ্ঠনে জননীর প্রৌঢ়তায় অনুগমন করতেন স্বামীর। না, তিনি তা করেননি। একটি শাড়ি পরেছেন যেমন সুন্দর তেমনই সূক্ষ্ম। তাও পুরো পরেননি অর্ধেকটাই কোমরে জড়ানো। সূক্ষ্ম শাড়ির অনবগুণ্ঠনে গায়ের অনেক অংশই বড় চোখে পড়ছিল। মাদ্রীকে তরুণীর মতো দেখাচ্ছিল। পাণ্ডু দেখছিলেন, কেবলই দেখছিলেন–সমীক্ষমাণঃ স তু তাং বয়স্থাং তনুবাসস।
পাণ্ডুর হৃদয়ে দাবানল ছড়িয়ে পড়ল। তিনি জড়িয়ে ধরলেন মাদ্রীকে। মাদ্রী শুধু স্বামীর মৃত্যু-ভয়ে তাকে খানিক বাধা দিলেন বটে, কিন্তু সূক্ষ্ম বস্ত্রের পরিধানে আগুন লাগিয়ে দিয়ে নিজেকে রক্ষা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মৈথুন-লিপ্সায় পাণ্ডুর তখন এমন অবস্থা যে, অত বড় একটা অভিশাপের কথাও তার মনে ছিল না। যদিবা মাদ্রীর কথায় তার মনে হয়েও থাকে তবু–ধুর শাপ-শাপজং ভয়মুৎসৃজ্য–এইরকম একটা ভঙ্গিতে তিনি মৃত্যুর জন্যই যেন কামনার অধীন হলেন-জীবিতান্তায় কৌরব্যো মন্মথস্য বংশগতঃ। সঙ্গম-মুহূর্তেই পাণ্ডু মারা গেলেন। মাদ্রীর উচ্চকিত আর্তনাদ শোনা গেল। পাঁচটি কিশোর-বালককে সঙ্গে নিয়ে কুন্তী ছুটে এলেন পাণ্ডুর কাছে।
মাদ্রী এবং পাণ্ডু এমন অবস্থায় ছিলেন যে সেখানে কিশোর পুত্রদের কাছাকাছি যাওয়াটা বাঞ্ছনীয় ছিল না। কাজেই দূর থেকে কুন্তীকে দেখেই মাদ্রী চেঁচিয়ে বললেন–ছেলে পিলেদের নিয়ে এখানে যেন এসো না দিদি। তুমি ওদের ওখানেই রেখে, একা এসো– একৈব বৃমিহাগচ্ছ তিষ্ঠত্রৈব দারকাঃ। কুন্তী এলেন এবং দেখলেন–জীবনে যাঁকে তিনি একান্তই আপনার করে পেতে চেয়েছিলেন, তিনি মারা গেছেন।
কুন্তী আর থাকতে পারলেন না। বললেন রাজা যথেষ্ট বুঝেশুনেই চলছিলেন। আমি তাকে সবসময় এসব ব্যাপার থেকে আটকে রেখেছি–রক্ষ্যমাণো ময়া নিত্যং বনে সততম আত্মবান। সেই লোক তোমাকে হঠাৎ আক্রমণ করার সুযোগ পেলেন কী করে? এই দুর্ঘটনার জন্য কুন্তী মাদ্রীকে দোষারোপ করতে ছাড়লেন না। বললেন–মাদ্রী! তোমারই উচিত ছিল রাজাকে সামলে রাখা। এই নির্জন জায়গায় এসে তুমি রাজাকে প্রলুব্ধ করেছ– সা কথং লোভিতবতী বিজনে ত্বং নরাধিপম। আমি সবসময় যে রাজাকে অভিশাপের কথা মনে করে বিষণ্ণ থাকতে দেখেছি–এখানে এই নির্জনে সে তোমাকে পেয়েই তো অতিরিক্ত সরস হয়ে উঠলাম আসাদ্য রহোগং … প্রহষঃ সমজায়ত?
মাদ্রীর ওপরে যতই রাগারাগি করুন, তার স্বামীটিও যে সমান দোষে দোষী–এ-কথা কুন্তী মনে মনে অনুভব করছিলেন। নিজের সম্বন্ধে সচেতনতাও তার কম ছিল না। শাস্ত্রের নিয়মে তিনি জানেন যে, প্রথমা স্ত্রী হলেন ধর্মপত্নী। আর মাদ্রী যতই প্রলুব্ধ করুক তাঁর স্বামীকে, তার বিয়ের মধ্যেই কামনার মন্ত্রণা মেশানো আছে। দ্বিতীয় বিবাহটাই যে কামজ। এত কামনা যে স্বামীর মধ্যে দেখেছেন এবং যাঁর মৃত্যুও হল কামনার যন্ত্রণায়–তাকে আর যাই হোক শ্রদ্ধা করা যায় না, ভালবাসা যায় না। মাত্রীকে গালাগালি করার পরমুহূর্তেই কুন্তী তাই শুষ্ক কর্তব্যের জগতে প্রবেশ করেছেন। বলেছেন–মাত্ৰী! আমি জ্যেষ্ঠা কুলবধূ এবং তার ধর্মপত্নী, কাজেই রাজার সহমরণে যেতে আমাকে বাধা দিয়ো না মাদ্রী। তুমি ওঠো। এই ছেলেগুলিকে তুমি পালন করো।
জীবনের এই চরম এবং অন্তিম মুহূর্তে মাদ্রী কুন্তীর কাছে কতগুলি অকপট স্বীকারোক্তি করে বসলেন। সেকালের পারলৌকিক বিশ্বাস অনুযায়ী মাদ্রী বলে চললেন–স্বামীর সঙ্গে আমিই সহমরণে যাব দিদি। এই সামান্য জীবনে সীমিত স্বামীসুখে এবং সীমিত শারীরিক কামোপভোগে আমার তৃপ্তি হয়নি–নহি তৃপ্তাস্মি কামানা। আর রাজার কথা ভাবো। আমার প্রতি শারীরিক লালসাতেই তার মৃত্যু হল। এই অবস্থায় আমি মৃত্যুলোকে গিয়েও তাঁর সম্ভোগ-তৃষ্ণা মেটাব না কেন–তমুচ্ছিন্দ্যামস্য কামং কথং ন যমসাদনে?
কুন্তী আবার এসব কথা বেশিক্ষণ শুনতে পারেন না। রুচিতে বাধে। হয়তো বা মনে হল–এইরকম একটি স্বামীর জন্য সহমরণের মতো এত বড় আত্মবলি কি বড় বেশি ত্যাগ নয়? কিন্তু এখনও তার শোনার বাকি ছিল। দুটি সন্তানের জন্ম দিয়েও মাদ্রী যতখানি মা হতে পেরেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি নায়িকা। ফলত স্বামীকে চিরকাল সম্ভোগের প্রশ্রয়ে তিনি শুধু কুক্ষিগতই করেননি, সন্তানের স্নেহের থেকেও সম্ভোগ-তৃষ্ণা ছিল তার কাছে বড়। আর কুন্তী যে সেই কন্যা অবস্থাতেই সন্তানকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে মায়ের স্নেহ-যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছেন, সেই স্নেহ ব্যাপ্ত হয়েছিল তার পরিবারের সর্বত্র। এমনকী অভিশপ্ত স্বামীকেও যে তিনি সমস্ত মৈথুন-চেষ্টা থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখতেন, সেও বুঝি একরকম পুত্রস্নেহে–মানুষটা বেঁচে থাকুক–আর কীসের প্রয়োজন–রক্ষ্যমাণো ময়া নিত্য। কিন্তু স্বামী যে এত ভোগী, তা তিনি তত বোঝেননি।
মাদ্রীর এই অসফল সম্ভোগ-বাঞ্ছা ছাড়াও মাদ্রী এবার যা বললেন, তাতে তো কুন্তীর কোনওভাবেই আর মৃত্যুর পথে নিজেকে ঠেলে দেওয়া চলে না। সেটাও যে এক ধরনের স্বার্থপরতা হবে। শুষ্ক কর্তব্যের জন্য, সম্ভোগ-রসিক স্বামীর অনুগমনের জন্য নিজের সন্তানদের বলি দেওয়া সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। মাদ্রী বলেছিলেন–শুধু অসফল কাম তৃষ্ণাই নয়, আমি তোমার ছেলেদের সঙ্গে আমার নিজের ছেলেদের এক করে দেখতে পারব না–ন চাপ্যহং বর্তয়ন্তী নির্বিশেষং সুতেষু তে। এই কথা শোনার পর কুন্তী আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করেননি, সহমরণের কথাও আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করেননি। নিষ্কম্প দৃষ্টিতে, সুগভীর ব্যক্তিত্বে তিনি সন্তান-পালনের দায়িত্বটাই বেশি বড় মনে করেছেন। স্বামী আর সতীনকে তাঁদের অভিলাষ-পূরণের অবসর দিয়েছেন আপন মূল্যে–ইহজন্মেও পরজন্মেও।
.
০৮.
পাঁচটি অনাথ পিতৃহীন বালক পুত্রের হাত ধরে কুন্তী স্বামীর রাজ্যের রাজধানীতে এসে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে আছেন ঋষিরা। তাঁরাই এখন একমাত্র আশ্রয় এবং প্রমাণ। এই পাঁচটি ছেলে যে পাণ্ডুরই স্বীকৃত সন্তান, তার জন্য ঋষিদের সাক্ষ্য ছাড়া কুন্তীর দ্বিতীয় গতি নেই। পাণ্ডু এবং মাদ্রীর মৃতদেহ ঋষিরাই হস্তিনাপুরে বয়ে নিয়ে এসেছেন বটে, কিন্তু মৃত স্বামীর রাজ্যপাট অথবা সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতে হলে ‘সাকসেশন সার্টিফিকেট’টা যে আর্যবাক্যেই প্রথম পেশ করতে হবে–এ-কথা কুন্তীর ভালই জানা ছিল।
পুরনো আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আবার কতকাল পরে দেখা হবে–এই অধীরতায় কুন্তী খুব দ্রুত হেঁটেছিলেন। পাঁচ ছেলে, রাজার শব আর ঋষিদের সঙ্গে কুন্তী যখন হস্তিনার দ্বারে এসে পৌঁছলেন তখন সকাল হয়েছে সবে। এর মধ্যেই রটে গেল কুন্তী এসেছেন, রাজা মারা গেছেন, পাঁচটা ছেলে আছে কুন্তীর সঙ্গে। পুরবাসী জনেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল হস্তিনার রাজসভার কাছে। মনস্বিনী সত্যবতী, রাজমাতা অম্বালিকা, গান্ধারী–সবাই কুন্তীকে নিয়ে রাজসভায় এলেন। ঋষিরা পাণ্ডুর পুত্র-পরিচয় করিয়ে দিলেন কুরুসভার মান্যগণ্য ব্যক্তিদের কাছে, মন্ত্রীদের কাছে এবং অবশ্যই প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্রের কাছে।
পাঁচটি পিতৃহীন পুত্রের হাত ধরে কুন্তী যখন কুরুসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা দামি কাপড় পরে, সর্বাঙ্গে সোনার অলংকার পরে রাজপুত্রের চালে জ্ঞাতি ভাইদের দেখতে এসেছিল। কুন্তীর কাছে এই দৃশ্য কেমন লেগেছিল? বনবাসী তপস্বীরা কুন্তীর পাঁচটি ছেলের সামগ্রিক পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন-মহারাজ! পাণ্ডু আর মাদ্রীর দুটি শব-শরীর এই এখানে রইল। আর তার প্রথমা স্ত্রীর সঙ্গে তার পাঁচটি অসাধারণ ছেলে দিয়ে গেলাম আপনারই হেফাজতে। আপনি মায়ের সঙ্গে এই ছেলেদের দেখভাল করুন অনুগ্রহ করে। তার স্বামীই রাজা, ধৃতরাষ্ট্র তারই রাজত্বের কাজ চালাচ্ছিলেন মাত্র। কিন্তু আজকে শুধুমাত্র রাজধানীতে মৃত্যু না হওয়ার কারণে আসল রাজপুত্রদেরই প্রার্থীর ভূমিকায় প্রতিপালনের অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে হচ্ছে।
ধৃতরাষ্ট্র খুব ঘটা করে পাণ্ডুর শ্রাদ্ধ করলেন বটে, কিন্তু কুন্তী বা তার ছেলেদের রাজকীয় মর্যাদা তিনি দেননি। রাজবাড়িতে তাঁদের আশ্রয় জুটেছিল বটে, কিন্তু থাকতে হচ্ছিল বড় দীনভাবে, বড় হীনভাবে। ভীমকে যেদিন বিষ খাইয়ে গঙ্গায় ফেলে দিলেন দুর্যোধন, সেদিন ওই অত বড় ছেলেকে হারানোর ঘটনার পরেও ধৃতরাষ্ট্রকে কিছু বলতে পারেননি কুন্তী। সমস্ত কুরুবাড়ির মান্যগণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে কুন্তীর একমাত্র বিশ্বাসের ব্যক্তি ছিলেন তাঁর দেওর বিদুর। দুই-একজন অতিপক্ক বুদ্ধিজীবী কুন্তী আর বিদুরের সম্পর্ক নিয়ে কণ্বঞ্চিৎ সরসও হয়ে পড়েন দেখেছি। তবে তাদের কথাবার্তার মধ্যে মহাভারতীয় যুক্তি-তর্কের থেকে আত্ম-হৃদয়ের প্রতিফলনই বেশি। এই একই ধরনের প্রতিফলন দেখেছি আরও কতগুলি বুদ্ধিজীবীর নব নব উন্মেষশালিনী প্রজ্ঞার মধ্যেও। তাঁরা আবার কুন্তীর ছেলেগুলিকে ধর্ম বায়ু বা ইন্দ্রের ঔরসজাত না ভেবে দুর্বাসার ঔরসজাত ভাবেন। আমি বলি–ওরে! সেকালে নিয়োগ প্রথা সমাজ-সচল প্রথা ছিল। পাণ্ডুর ছেলে ছিল না বলে কবি যেখানে ধর্ম, ইন্দ্র বা বায়ুকে কুন্তীর সঙ্গে শোয়াতে লজ্জা পাননি, সেখানে দুর্বাসার সঙ্গে শোয়াতেও কবির লজ্জা হত না–যদি আদতে ঘটনাটা তাই হত।
থাক এসব কথা। ভীমকে বিষ খাওয়ানোর পর কুন্তী একান্তে বিদুরকে ডেকে এনেছেন নিজের ঘরে। সুস্পষ্ট এবং সত্য সন্দেহ প্রকাশ করেছেন রাজ্যলোভী দুর্যোধন সম্পর্কে। কিন্তু কোনওভাবেই নিজের সন্দেহের কথা ধৃতরাষ্ট্রকে জানাতে পারেননি। কারণ তিনি বুঝে গিয়েছিলেন–চক্ষুর অন্ধতার থেকেও ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহান্ধতা বেশি। ভীম যখন নাগলোক থেকে ফিরে এসে দুর্যোধনের চক্রান্তের কথা সমস্ত একে একে জানিয়েছেন, তখনও আমরা কুন্তীকে কোনও কথা বলতে দেখিনি। মহামতি যুধিষ্ঠির এই নিদারুণ ঘটনার প্রচার চাননি। পাছে আরও কোনও ক্ষতি হয়। কুন্তীকে আমরা এইসময় থেকে যুধিষ্ঠিরের মত মেনে নিতে দেখছি, যদিও বুদ্ধিদাতা হিসেবে বিদুরের মতামতই এখানে যুধিষ্ঠিরের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে।
আসলে কুন্তী যা চেয়েছিলেন, মহাভারতের কবি তা স্বকণ্ঠে না বললেও বোঝা যায়, অন্য সমস্ত বিধবা মায়ের মতোই তিনি তাঁর সন্তানদের ক্ষত্রিয়োচিত সুশিক্ষা চেয়েছেন। চেয়েছেন তাদের মৃত পিতার রাজ্যের সামান্য উত্তরাধিকার ছেলেরা পাক। তার জন্য তিনি হঠাৎ করে কিছু করে বসেননি, এতদিন পরে ফিরে এসে হঠাৎ করে ছেলেদের জন্য রাজ্যের উত্তরাধিকার চাননি। তিনি সময় দিয়ে যাচ্ছেন, ছেলেদের সম্পূর্ণ উপযুক্ত হওয়ার অপেক্ষাও করছেন।
ভীষ্মের ইচ্ছায় দ্রোণাচার্যের তত্ত্বাবধানে কৌরব-পাণ্ডবদের একসঙ্গেই অস্ত্রশিক্ষা আরম্ভ হল। আর এই অস্ত্রশিক্ষার সূত্র ধরেই তার কনিষ্ঠপুত্র অর্জুন সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হিসেবে বেরিয়ে এলেন। কুন্তী এই দিনটিরই অপেক্ষায় ছিলেন। যেদিন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সামনে দ্রোণাচার্যের অস্ত্রপরীক্ষার আসর বসল, সেদিন অর্জুনের ধনুকের প্রথম টংকার-শব্দে ধৃতরাষ্ট্র চমকে উঠেছিলেন। বিদুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন–ভাই! কে এল এই রঙ্গস্থলে? সমুদ্রের গর্জনের মতো এই শব্দ কীসের? বিদুর বললেন–তৃতীয় পাণ্ডব এসেছে রঙ্গস্থলে, তাই এই শব্দ। ধৃতরাষ্ট্র সগৌরবে বললেন, যজ্ঞের সময় শমীবৃক্ষের কাঠ ঘষে ঘষে যেমন আগুন জ্বালাতে হয়, আমাদের কুন্তী হলেন সেই আগুন-জন্মানো শমীকাঠের মতো। কুন্তীর গর্ভজাত এই তিনটি পাণ্ডব-আগুনে আজ আমি নিজেকে সবদিক থেকে সুরক্ষিত মনে করছি–ধন্যোহস্মি অনুগৃহীতোহস্মি রক্ষিতোহস্মি মহামতে।
কুন্তী এই দিনটিরই অপেক্ষা করেছেন। বিধবা মা যেমন করে অপেক্ষা করেন–ছেলে পড়াশুনো করে পাঁচজনের একজন হয়ে মায়ের দুঃখ ঘোচাবে, কুন্তীও তেমনই এতদিন ধরে এই দিনটিরই অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু পোড়া-কপালির কপালের মধ্যে বিধাতা এত সুখের মধ্যেও কোথায় এক কোণে দুঃখ লিখে রেখেছিলেন। কুন্তীর কনিষ্ঠ পুত্র অর্জুন যখন নিজের অস্ত্রশিক্ষার গুণে সমস্ত রঙ্গস্থল প্রায় মোহিত করে ফেলেছেন, সেই সময়েই সু-উচ্চ রঙ্গমঞ্চ থেকে কুন্তী দেখতে পেলেন–বিশাল শব্দ করে আরও এক অসাধারণ ধনুর্ধর তার তৃতীয় পুত্রটিকে যেন ব্যঙ্গ করতে করতে ঢুকে পড়ল রঙ্গস্থলে।
কুন্তীর বুক কেঁপে উঠল–সেই চেহারা, সেই মুখ। সেই ভঙ্গি। বুকে সেই বর্ম আঁটা। কানে সেই সোনার দুল–মুখখানি যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে–কুণ্ডল-দ্যোতিতাননঃ। কুন্তী দেখলেন–কত শক্তিমান, আর কত লম্বা হয়ে গেছে তাঁর ছেলে। হেঁটে আসছে যেন মনে হচ্ছে সোনার তালগাছ হেঁটে আসছে, যেন কঠিন এক পাহাড় পা বাড়িয়েছে রঙ্গস্থলের দিকে–প্রাংশুকনকতালাভঃ… পদচারীব পর্বতঃ। কুন্তীর মনের গভীরে কী প্রতিক্রিয়া হল, মহাভারতের কবি তা লেখেননি। তবে নিরপেক্ষ একটি মন্তব্য করেই যখন কবি রঙ্গস্থলের খুঁটিনাটিতে মন দিয়েছেন, তখন ওই একটি মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় কুন্তীর মনে কী চলছিল। কবি বললেন–সূর্যপুত্র কর্ণ অর্জুনের ভাই হয়েও তাকে ভাই বলে বুঝলেন না– ভ্রাতা ভ্রাতরমজ্ঞাতং সাবিত্রঃ পাকশাসনি।
যাঁকে অমর জীবনের আশীর্বাদ দিয়ে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, সে যে এইভাবে কোনওদিন ফিরে আসবে, তা কুন্তীর কল্পনাতেও ছিল না। যাঁকে জননীর প্রথম বাৎসল্যে কোলে তুলে নিতে পারেননি, সেই তার জ্যেষ্ঠ সন্তান আজ ফিরে এল তার কনিষ্ঠ পুত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে, প্রায় যুদ্ধোদ্যত অবস্থায়। প্রকৃতির প্রতিশোধ কি এমনতর হয়! এখন এই মুহূর্তে পাঁচটি প্রায় যুবক ছেলের সামনে এই বিধবা রমণীর পক্ষে তার কন্যা অবস্থার জননীত্ব স্বীকার করা সম্ভব ছিল না। বলতে পারেন, স্বীকার করলে কীই বা এমন হত? কী হত তা কুন্তীই জানেন। তবে নিজের স্বামীর প্রচণ্ড উপরোধেও যিনি লজ্জা আর রুচির মাথা খেয়ে যে কলঙ্কের কথা স্বীকার করতে পারেননি, আজ বিধবা অবস্থায় বড় বড় ছেলেদের সামনে সে-কথা কি স্বীকার করা সম্ভব ছিল? তা ছাড়া রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে কুন্তীর মনে যে দুশ্চিন্তা ছিল, কর্ণের পুত্রত্ব প্রতিষ্ঠায় সেই উত্তরাধিকারে নতুন কোনও ঝামেলা তৈরি হত কি না সেটাই বা কতটা নিশ্চিত ছিল। কুন্তীকে যে কুরুকুলের কলঙ্কিনী বধূ হিসেবে নতুন বিপত্তির মুখ দেখতে হত না, তারই বা কী স্থিরতা ছিল?
অতএব নিজের মান, মর্যাদা এবং রুচির নিরিখে যাঁর বাৎসল্য-বন্ধন জন্মলগ্নেই তিনি ত্যাগ করেছেন, আজ আর তাঁকে আগ বাড়িয়ে সোহাগ দেখাতে চাননি কুন্তী। বরঞ্চ যে মুহূর্তে তিনি দেখেছেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র তাঁর কনিষ্ঠটিকে যুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছে, সেই মুহূর্তে মূৰ্ছাই ছিল তার একমাত্র গতি। তিনি তাই অজ্ঞান হয়ে বেঁচেছেন। কিন্তু অজ্ঞান হয়েও কি বাঁচবার উপায় আছে। মহামতি বিদুর তার অবস্থা দেখে দাসীদের দিয়ে কুন্তীর চোখে-মুখে চন্দন-জলের ছিটে দেওয়ালেন। জ্ঞান ফিরে দেখলেন বড়-ছোট–দুই ছেলেই মারামারি করার জন্য ঠোঁট কামড়াচ্ছে। কুন্তী কষ্টে লজ্জায় কী করবেন ভেবে পেলেন না–পুত্রৌ দৃষ্ট্ৰা সুসংভ্রান্তা নান্থপদ্যত কিঞ্চন।
বাঁচালেন কৃপাচার্য। কৃপাচার্য কর্ণকে তার বংশ-পরিচয় জিজ্ঞাসা করে সবার সামনে চরম অপমানের মধ্যে ফেলে দিলেন বটে, কিন্তু কুন্তীর কাছে এও বুঝি ছিল বাঁচোয়া। বংশ পরিচয়ের কথায় কর্ণের পদ্ম-মুখে বর্ষার ছোঁয়া লাগল, তার কান্না পেল–বর্ষাম্বুবিক্লিন্নং পদ্মামাগলিতং যথা–তবু কর্ণের এই অপমানেও শুধুমাত্র দুই ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হল দেখে কুন্তী স্বস্তি পেলেন। এর পরেও কর্ণকে নিয়ে মুখর ভীমসেন আর দুর্যোধনের মধ্যে বিশাল বাগযুদ্ধ, অপমান পালটা অপমান চলল বটে, তবু এরই মধ্যে প্রতিপক্ষ দুর্যোধন যখন কর্ণের মাথায় অঙ্গরাজ্যের রাজার মুকুট পরিয়ে দিলেন, সেই সময়ে দুর্যোধনের ওপর কুন্তীর চেয়ে বেশি খুশি বোধহয় কেউ হননি।
বাৎসল্যের শান্তি কুন্তীর ওইটুকুই। চাপা আনন্দে তার বুক ভরে গেল–পুত্রম্ অঙ্গেশ্বরং জ্ঞাত্ব ছন্না প্রীতি-রজায়ত। কেউ বুঝুক আর না বুঝুক কুন্তী বুঝলেন–তার বড় ছেলেই প্রথম রাজ্য পেল এবং সবার কাছে সে হীন হয়ে যায়নি। এও এক আনুষ্ঠানিক তৃপ্তি, যার ব্যাখ্যা দেওয়া সহজ নয়। কুন্তী যেটা বুঝলেন না, সেটা হল–এই যুদ্ধের রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে তার জ্যেষ্ঠ এবং কনিষ্ঠ পুত্র–দু’জনেই জন্মের মতো শক্ত হয়ে গেল। এখন যদিও যুদ্ধ কিছু হল না, তবু দুই সমান মাপের বীর দু’জনের প্রতিস্পর্ধী হয়ে রইলেন–এ-কথাটা কুন্তী বোধহয় মায়ের মন নিয়ে তেমন করে বুঝতে পারলেন না। কিন্তু বুঝতে না পারলেও জননীর প্রথম সন্তান হিসাবে কর্ণ যে বেঁচে আছেন, তিনি যে সুষ্ঠু প্রতিপালন লাভ করে এত বড় ধনুর্ধর পুরুষটি হয়ে উঠেছেন–এই তৃপ্তি তাঁকে জননীর দায় থেকে খানিকটা মুক্ত করল অবশ্যই।
যাই হোক, দ্রোণাচার্যের সামনে এই অস্ত্র-প্রদর্শনীর পর এক বছর কেটে গেছে। কুন্তীর দুটি পুত্র, ভীম এবং অর্জুনের অসামান্য শক্তি এবং অস্ত্ৰনৈপুণ্যের নিরিখেই–অন্তত আমার তাই মনে হয়–মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের যুবরাজ করতে বাধ্য হলেন। পাণ্ডবজ্যেষ্ঠের এই যৌবরাজ্য লাভের পর ভীম আর অর্জুনের প্রতাপ আরও বেড়ে গেল। তারা এমনভাবে সব রাজ্য জয় করে ধনরত্ন আনতে আরম্ভ করলেন এবং তাদের খ্যাতি এত বেড়ে গেল যে, ধৃতরাষ্ট্রের মন খুব তাড়াতাড়িই বিষিয়ে গেল–দূষিতঃ সহসা ভাবো ধৃতরাষ্ট্রস্য পাণ্ডুষু। তার মধ্যে ইন্ধন যোগালেন রাজ্যলোভী দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি বোঝালেন–যেভাবে হোক, পাণ্ডবদের একেবারে মায়ের সঙ্গে নির্বাসন দিতে হবে–সহ মাত্রা প্রবাসয়।
ধৃতরাষ্ট্রের মনেও ওই একই ইচ্ছে ছিল, তিনি শুধু বলতে পারছিলেন না, এই যা। পাণ্ডবভাইদের সঙ্গে তাদের মাকেও যে বারণাবতের প্রবাসে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন দুর্যোধন, তার কারণ একটাই–কুন্তীর বুদ্ধি এবং ব্যক্তিত্ব। পাণ্ডবরা গিয়ে যদি শুধু কুন্তী রাজবাড়িতে থাকতেন, তা হলে বারণাবতের লাক্ষাগৃহে আগুন লাগানোর ‘প্ল্যান ভেস্তে যেতে পারে–এই দুশ্চিন্তাতেই দুর্যোধন কুন্তীকেও পাণ্ডবদের সঙ্গে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। তিনি বোঝেননি যে, কুন্তীর বা পাণ্ডবদের ভাল চাওয়ার মতো লোক কুরুবাড়িতে আরও ছিল। মহামতি বিদুরের বুদ্ধিতে কুন্তী এবং পাণ্ডবভাইরা সবাই বারণাবতের আগুন-ঘর থেকে বেঁচে গেলেন।
কুন্তীকে এই সময় ছেলেদের সঙ্গে বনে বনে ঘুরতে হয়েছে বটে, তবে তিনি খারাপ কিছু ছিলেন না। ছেলেরা এখন লায়েক হয়ে উঠেছে। বিশেষত ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, তাঁর স্থিরতা, ব্যক্তিত্ব এবং নীতিবোধ এতই প্রখর যে, তার ওপরে নির্ভর না করে কুন্তীর উপায় ছিল না। যে কোনও বিপন্ন মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরের কথা মেনে তিনি চলতেন এবং যুধিষ্ঠিরের কথার মর্যাদা তার কাছে ছিল প্রায় স্বামীর কাছাকাছি। মেজ ছেলে ভীমের ওপরে তাঁর স্নেহটা একটু অন্য ধরনের। তিনি জানেন–এ এক অবোধ, পাগল, একগুঁয়ে ছেলে। ভীমের গায়ের জোর সাংঘাতিক। কাজেই বনের পথে ভীমের কাঁধে চেপে যেতেও তাঁর লজ্জা করে না। সব ছেলের সমান পরিশ্রমের পর, অথবা ভীমের যদি অন্য ছেলেদের চেয়ে বেশি পরিশ্রমও হয়ে যায় তবু যেন তাকেই ইঙ্গিত করে কুন্তী একটা কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে পারেন–পাঁচ ছেলের মা হয়ে, আজ এই বনের মধ্যে তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছে আমার। মায়ের এসব কথার প্রথম প্রতিক্রিয়া ভীমের মনেই হবে। তিনি জল আনতে যাবেন এবং কুন্তীও তা জানেন।
এই গর্ব তার অর্জুনের বিষয়েও ছিল। তবে অর্জুনের থেকেই কিন্তু কুন্তীর মাতৃস্নেহে প্রশ্রয়ের শিথিলতা এসেছে। হাজার হোক, ছোট ছেলে। মায়ের কনিষ্ঠ পুত্রটি অসাধারণ লেখা-পড়া শিখে অসম্ভব কৃতী পুরুষ হয়ে উঠলে মায়ের মনে যে শ্রদ্ধামিশ্রিত নিরুচ্চার প্রশ্রয় তৈরি হয়, অর্জুনের ব্যাপারে কুন্তীরও সেই প্রশ্রয় ছিল। যদিও এই প্রশ্রয়ের মধ্যে মায়ের দাবিও ছিল অনেক। সে দাবি মুখে সচরাচর প্রকাশ পেত না, কিন্তু সে দাবির চাপ কিছু ছিলই। অর্জুনও তা বুঝতেন। সে কথা পরে আসবে।
প্রশ্রয় বলতে যেখানে একেবারে বাধা-বন্ধহীন অকৃত্রিম প্রশ্রয় বোঝায়, যার মধ্যে ফিরে পাওয়ার কোনও তাগিদ নেই, যা শুধুই নিম্নগামী স্নেহের মতো, দাদু-দিদিমা বা ঠাকুরমা-ঠাকুরদার অন্তর-বিলাস–কুন্তীর সেই প্রশ্রয় ছিল নকুল এবং সহদেবের ওপর, বিশেষত সহদেবের ওপর। মাদ্রী যে কুন্তীকে বলেছিলেন–তোমার ছেলেদের সঙ্গে আমার ছেলেদের আমি এক করে দেখতে পারব না–এই কথাটাই কুন্তীকে আরও বিপরীতভাবে স্নেহপ্রবণ করে তুলেছিল নকুল এবং সহদেবের প্রতি। পিতৃ-মাতৃহীন এই বালক দুটিকে কুন্তী নিজের ছেলেদের চেয়ে বেশি স্নেহ করতেন। আবার এদের মধ্যেও কনিষ্ঠ সহদেবের প্রতি তার স্নেহ এমন লাগামছাড়া গোছের ছিল যে, তাকে বোধহয় তিনি বুড়ো বয়সে পর্যন্ত খাইয়ে দিতেন অথবা ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। পাণ্ডবরা যখন বনে গিয়েছিলেন, তার আগে কুন্তী সহদেবের সম্বন্ধে দুনিয়ার মাতৃস্নেহ উজাড় করে দিয়ে দ্রৌপদীকে বলেছিলেন–বনের মধ্যে তুমি বাপু আমার সহদেবকে একটু দেখে রেখো–সহদেবশ্চ মে পুত্রঃ সহাবেক্ষ্যা বনে বস। দেখো ওর যেন কোনও কষ্ট না হয়। কুন্তীর মানসিকতায় দ্রৌপদীকেও তার এই কনিষ্ঠ স্বামীটির প্রতি বাৎসল্য বিতরণ করতে হয়েছে।
যাই হোক, প্রশ্রয় আর লালনের মাধ্যমে যে ছেলেদের কুন্তী বড় করে তুলেছিলেন, দেওর বিদুরের বুদ্ধিতে সেই পাঁচ ছেলেই তার বেঁচে গেল। এখন তাদের সঙ্গেই তিনি বনের পথে চলতে চলতে একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। মেজো ছেলে ভীম মায়ের কষ্ট দেখে জল আনতে গেল। আর এরই মধ্যে পথের পরিশ্রমে ঘুম এসে গেল সবার। যে বনের মধ্যে এই ঘুমের আমেজ ঘনিয়ে এল সবার চোখে সেই বন ছিল হিড়িম্ব রাক্ষসের অধিকারে। সে তার বোন হিড়িম্বাকে পাঠিয়ে দিল ঘুমন্ত মানুষগুলিকে মেরে আনতে।
ততক্ষণে ভীমের জল আনা হয়ে গেছে। তিনি মা-ভাইদের পাহারা দিচ্ছিলেন। হিড়িম্বা ভীমকে দেখে তার প্রেমে পড়ে গেল। সে ভীমের কাছে হিড়িম্ব রাক্ষসের নরমাংসভোজনের পরিকল্পনা ফাঁস করে দিয়ে সবাইকে বাঁচাতে চাইল। ভীমের এই করুণা পছন্দ হয়নি। অদূরেই হিড়িম্ব রাক্ষসের সঙ্গে তার যুদ্ধ লাগল এবং এদিকে কুন্তী পাণ্ডবভাইদের সঙ্গে জেগে উঠলেন। হিড়িম্বা মনুষ্যরমণীর ছাঁদে যেমনটি সেজে এসেছিল, তাতে কুন্তীর ভারী পছন্দ হয়ে গেল তাকে। সরলা হিড়িম্বা কুন্তীর কাছে তার পছন্দের কথাও গোপন করল না। সে পরিষ্কার জানাল ভীমকে সে বিয়ে করতে চায়।
ওদিকে ভীমের হাতে হিড়িম্ব মারা গেল এবং কুন্তী ছেলেদের প্রস্তাব-মতো পা বাড়ালেন এগিয়ে যাওয়ার জন্য। কারও অনুমোদনের অপেক্ষা না করেই অনাকাঙিক্ষতের মতো হিড়িম্বা কুন্তী এবং তার ছেলেদের পিছন পিছন চলতে লাগল। হিড়িম্বের ওপর তখনও ভীমের রাগ যায়নি। সেই রাগেই বোধহয় তিনি হিড়িম্বাকেও মেরে ফেলতে চাইলেন। অবধারিতভাবে বাধা এল যুধিষ্ঠিরের দিক থেকে। কিন্তু এই মুহূর্তে কুন্তীর কাছে হিড়িম্বার আত্মনিবেদন বুঝি ভোলার নয়।
হিড়িম্বা কুন্তীকে তার স্বভাবসুলভ সরলতায় জানাল–মা! ভালবাসার কত কষ্ট, সে তুমি অন্তত বোঝো। তোমার ছেলের জন্য আমি এখন সেই কষ্ট পাচ্ছি। তুমি আর তোমার এই ছেলে দু’জনেই যদি আমাকে এখন প্রত্যাখ্যান করো–বীরেণাহং তথানেন ত্বয়া চাপি যশস্বিনি–তা হলে আমি আর প্রাণে বাঁচব না।
হিড়িম্বা এবার আসল লোকটিকে ধরেছে। সে জানে, এই মায়ের কথা ফেলার সাধ্য কারও মধ্যে নেই। হিড়িম্বা সমস্ত লোকলজ্জা ত্যাগ করে কুন্তীর কাছে অনুনয় করে বলল– তুমি আমাকে দয়া করো মা। তোমার ছেলের সঙ্গে মিলিয়ে দাও আমাকে। আমি এই ক’দিনের জন্য তাঁকে নিয়ে যাব, আর যখনই তুমি বলবে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব তোমার ছেলেকে, তুমি বিশ্বাস করো।
যুধিষ্ঠির বুঝলেন–মা একেবারে গলে গেছেন। মায়ের মতোই যুধিষ্ঠির ভীমকে ছেড়ে দিয়েছেন হিড়িম্বার সঙ্গে এবং তাদের পুত্র-জন্ম পর্যন্ত সময় দিয়েছেন বাইরে থাকার। যথা সময়ে ভীম এবং হিড়িম্বার ছেলে জন্মাল এবং দু’জনেই এলেন কুন্তীর কাছে। কুন্তী এই সময়ে রাক্ষসীর গর্ভজাত এই পুত্রটিকে যে মর্যাদা দিয়েছিলেন, তাতে শাশুড়ি হিসেবে তার ঔদার্য প্রকাশ পেয়েছে অনেক আধুনিকা শাশুড়ির চেয়ে বেশি।
আজকের দিনে, তথাকথিত এই চরম আধুনিতার দিনেও নিজের ছেলের সঙ্গে তথাকথিত নিম্নবর্ণের কোনও মেয়ের বিয়ে হলে শাশুড়িরা আধুনিকতার খাতিরে যথেষ্ট সপ্রতিভ ভাব দেখালেও কখনও বা মনে মনে কষ্ট পান, আবার কখনও বা পুত্রবধূ বা তার বাপের বাড়ির লোকের সামনে সোচ্চারে অথবা নিরুচ্চারে নিজের সম্বন্ধে তুলনামূলকভাবে উচ্ছিত বোধ করেন। কিন্তু সেই মহাভারতের যুগেও কুন্তীর মতো এক মনস্বিনী রাজমাতা নিজের ছেলেকে শুধু রাক্ষসীর সঙ্গে একান্ত বিহারে পাঠিয়েও তৃপ্ত হননি, রাক্ষসীর বিকট চেহারার ছেলের বিলোম মস্তকে হাত বুলিয়ে তিনি অসীম মমতায় বলে উঠেছেন–বাছা! প্রসিদ্ধ কুরুবংশে তোমার জন্ম, আমার কাছে তুমি ভীমের সমানই শুধু নয়, এই পঞ্চপাণ্ডবের তুমি প্রথম পুত্র, সবসময় আমরা যেন তোমার সাহায্য পাই–জ্যেষ্ঠ পুত্রোহসি পঞ্চানাং সাহায্যং কুরু পুত্রক।
এমন অসীম মর্যাদায় একটি রাক্ষসীর পুত্রকে যে মনস্বিনী কুরুবংশের মাহাত্মে আত্মসাৎ করেন, শাশুড়ি হিসেবে সেই মনস্বিনীর ধীরতা এবং বুদ্ধিকে আমাদের লোক-দেখানো আধুনিকতার গৌরবে চিহ্নিত না করাই ভাল। শাশুড়ি হিসেবে কুন্তীর বিচক্ষণতা এবং মমত্ব এর পরেও আমরা দেখতে পাব। কিন্তু এই মমত্ব কোনওভাবেই বাংলাদেশের জল-ভাত আর নদী-নীরের মতো নম্র কোনও মমত্ব নয়। এই মমত্বের মধ্যে জননীর সরসতা যতটুকু, ক্ষত্রিয় জননীর বীরতাও ততটুকুই। বরঞ্চ বীরতাই বেশি। ক্ষত্রিয় জননীর স্নেহের সঙ্গে বীরতা এমনভাবেই মিশে যায় যে এর জন্য আলাদা করে তার ভাবার সময় থাকে না। এই বীরতা আগে তিনি নিজের ছেলের ব্যাপারে প্রমাণ করেছেন, তারপর তা প্রমাণ করেছেন শাশুড়ি হিসেবেও। সে-কথা পরে হবে। আসলে ভীমের অমানুষিক শক্তি এবং লোকোত্তর ক্ষমতার ওপরে কুন্তীর এত বিশ্বাস ছিল যে, এরজন্য তিনি অনেক ঝুঁকি নিতেও পিছপা হতেন না। জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে উঠে পাণ্ডবরা বনের পথে ঘুরতে ঘুরতে একচক্রা নগরীতে এলেন। সেখানে বামুনের ছদ্মবেশে এক বামুন বাড়িতেই আশ্রয় নিয়ে বাস করতে আরম্ভ করলেন। এখানেই দুরন্ত বক রাক্ষস থাকত। রাক্ষস মানে, সে যে মানুষ ছাড়া অন্য কোনও বৃহত্তর প্রাণী তা আমার মনে হয় না। তবে আর্য-সমাজের বাইরে এরা এমন কোনও প্রজাতি যাদের নরমাংসে অরুচি ছিল না। একচক্রা নগরের রাজা বক রাক্ষসের সুরক্ষা ভোগ করতেন। বদলে বক রাক্ষসের নিয়ম ছিল–নগরের এক একটি বাড়ি থেকে তার খাবার জোগান দিতে হবে এবং যে ব্যক্তি ওই খাবার-দাবার নিয়ে বক রাক্ষসের অপেক্ষায় বসে থাকবেন, তিনিও বক রাক্ষসের খাদ্যতালিকায় একটি খাদ্য বলেই গণ্য হবেন। কুন্তীরা একচক্রাতে যে ব্রাহ্মণ বাড়িতে ছিলেন, কোনও একসময় সেই বাড়ির পালা এল বক রাক্ষসের খাবার জোগাড় করার। বামুন বাড়িতে কান্নার রোল উঠল। বাড়ির বদান্য গৃহকর্তা যদি বলেন–আমি খাবার নিয়ে যাব, ব্রাহ্মণী তাতে বাধা দিয়ে বলেননা আমি। ছেলে বলে–আমি যাব তো মেয়ে বলে–আমি।
বামুনবাড়িতে যখন এই আত্মদানের অহংপূর্বিকা এবং অবশ্যই কান্নাকাটি যুগপৎ চলছে, তখন কুন্তী ভীমকে জানিয়ে সেই বামুনবাড়িতে ঢুকলেন। কুন্তীর মাতৃহৃদয় তথা স্নেহ-মমতা এই ঘটনায় কতটা উদ্বেলিত হয়েছিল–সেটা বোঝানোর জন্য মহাভারতের কবি বেশি কথা খরচ করেননি। কিন্তু এমন একখানি জান্তব উপমা দিয়েছেন ব্যাস, যাতে কুন্তীর স্নিগ্ধ হৃদয়খানি পাঠকের কাছে একেবারে সামগ্রিকভাবে ধরা পড়েছে। কবি লিখেছেন ঘরের মধ্যে বাছুর বাঁধা থাকলে তার ডাক শুনে গোরু যেমন ধেয়ে গোয়ালের মধ্যে ঢোকে, সেইরকম করে কুন্তী ঢুকলেন সেই বামুনবাড়িতে–বিবেশ ত্বরিতা কুন্তী বদ্ধবৎসেব সৌরভী।
কুন্তী সব শুনলেন। বামুনের সব কথা ধৈর্য ধরে শুনলেন। শুনে বললেন–আমার পাঁচ ছেলে। তাদের একজন যাবে বক রাক্ষসের উপহার নিয়ে। কুন্তী অবশ্যই ভীমের কথা মনে করেই তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বামুন তো অনেক না-না করলেন, কিন্তু কুন্তী বললেন–আমার ছেলেকে আপনি চেনেন না। সে বড় সাংঘাতিক। অনেক রাক্ষস-ফাক্ষস জীবনে সে মেরেছে। সে রাক্ষসকে মেরে নিজেকেও বাঁচিয়ে ফিরবে। স্বয়ং যুধিষ্ঠির পর্যন্ত কুন্তীর এই পুত্র-বিতরণের উদারতায় খুশি হননি। ভয়ও দেখিয়েছেন অনেক। কিন্তু বীরমাতা তার ছেলেকে চিনতেন। বিশেষত হিড়িম্ব-বধের পর ভীমের উপর তাঁর প্রত্যয় অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এই প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিল ক্ষত্রিয়-জননীর উপকারবৃত্তি। সিংহ-জননী যেমন শিশুসিংহকে শিকার ধরার জন্য বেছে বেছে নরম শিকার ধরতে পাঠায় না, শিকারের উন্মুক্ত ক্ষেত্রে তাকে যেমন ছেড়ে দেয়, কুন্তীও তেমনই ব্রাহ্মণের প্রত্যুপকারবৃত্তির সঙ্গে তার ক্ষত্রিয়-জননীর গর্বটুকু মিশিয়ে দিয়েছেন ভীমকে রাক্ষসের সামনে ফেলে দিয়ে।
একচক্রায় সেই বামুনবাড়িতেই ছিলেন কুন্তী আর পাণ্ডবরা। এরই মধ্যে এক পর্যটক ব্রাহ্মণ এসে পাঞ্চাল-রাজ্যে দ্রুপদের ঘরে ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত গল্প করে বলে গেলেন। কুন্তীর মনে বোধহয় দীপ্তিময়ী দ্রৌপদী সম্বন্ধে পুত্রবধূর কল্পনা ছিল। কিন্তু মনে মনে থাকলেও সে-কথা একটুও প্রকাশ করলেন না। বরঞ্চ বেশ কাব্যি করে ছেলেদের বললেন–এখানে এই ব্রাহ্মণের ঘরে অনেক কাল থাকলাম আমরা চিররাত্রোষিতা স্মেহ ব্রাহ্মণস্য নিবেশনে। এখানকার বন-বাগান–যা দেখবার আছে অনেকবার সেগুলি দেখেছি। বহুকাল এক জায়গায় থাকার ফলে ভিক্ষাও তেমন মিলছে না। তার চেয়ে চলো বরং আমরা পাঞ্চালে যাই–তে বয়ং সাধু পাঞ্চালান গচ্ছামো যদি মনসে।
বলাবাহুল্য, পাণ্ডবরা জতুগৃহের ঘটনার পর দুর্যোধনের চোখে ধূলো দেবার জন্য ব্রহ্মচারী মানুষের বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। মায়ের কথায় পাঁচ ভাই পাণ্ডবেরা সবাই পাঞ্চালে যাবার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। এই উপক্রমের মধ্যেই একচক্রার সেই বামুন বাড়িতে উপস্থিত হলেন ব্যাসদেব। যত বড় নিরপেক্ষ মুনিই তিন হন না কেন, কুরুবংশের প্রতি এই ঋষির অন্য এক মমতা ছিল। বিশেষত পাণ্ডু ছিলেন তারই ঔরসজাত সন্তান। তিনি মারা গেছেন, তবুও তার স্ত্রী এবং ছেলেরা আপন জ্যাঠতুতো ভাইদের চক্রান্তে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে– এই অন্যায় তার সহ্য হয়নি। একচক্রার যে বামুন বাড়িতে কুন্তী আর পাণ্ডবরা ছিলেন, সে বাড়িতে তাদের বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং বেদব্যাস–এবমুক্কা নিবেশ্যৈতা ব্রাহ্মণস্য নিবেশনে। কুন্তীকে আশীর্বাদ করে বলে গিয়েছিলেন–তোমার ছেলেরা ধার্মিক। রাজা হবে তারাই। পুত্রবধূ কুন্তীকে অনেক আশ্বস্ত করে সেদিন তিনি চলে গিয়েছিলেন কুন্তীমায় প্রভুঃ–আজ যখন কুন্তী নিজেই আবার পাঞ্চালে যাবার প্রস্তাব করেছেন, তখন সেই বেদব্যাস আবার এসে কুন্তীকে তার সমর্থন জানিয়েছেন এবং পাঞ্চালী দ্রৌপদীর কথাটাও বলেছেন এমন করে যাতে পাঁচ ভাইয়ের এক বউ হবেন দ্রৌপদী।
স্বয়ং পাণ্ডবভাইরাও ব্যাসের মর্মকথাটা তেমন করে বোঝেননি যেমন করে বুঝেছিলেন কুন্তী। পাঞ্চালে এসে কুন্তী আর পাণ্ডবভাইরা কুমোরপাড়ার একটি বাড়িতে বাসা বাঁধলেন। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে যাবার দিনও তারা ভিক্ষা করতেই বেরিয়েছিলেন। কিন্তু পথে ব্রাহ্মণদের মুখে স্বয়ম্বরের আয়োজন এবং ঘটা শুনে তারাও গিয়ে উপস্থিত হলেন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায়। এর পরের ঘটনা সবার জানা। অর্জুন লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীর বরমাল্য লাভ করলেন–অপিচ দ্রৌপদীর পাণিপ্রার্থী অন্যান্য রাজাদের সঙ্গেও তাকে এবং ভীমকে অনেক লড়তে হল। অবশ্য তারা জিতেই ফিরলেন।
মহাভারতের জবান অনুযায়ী ভীম ও অর্জুনের সঙ্গে প্রতিপক্ষ রাজাদের লড়াই লাগবার সঙ্গে সঙ্গেই যুধিষ্ঠির, নকুল এবং সহদেব–এই তিনজন স্বয়ম্বর সভার বাইরে চলে এসেছেন, কিন্তু কোনওভাবেই মায়ের কাছে ফিরে আসেননি। ভীম আর অর্জুন নববিবাহিতা বধূটিকে মায়ের কাছে নিয়ে এসে বলেছিলেন–মা, ভিক্ষা এনেছি। কুন্তী উত্তরে বলেছিলেন–যা এনেছ, তা সবাই মিলে ভোগ করো। এই কথার পর দ্রৌপদীকে দেখে কুন্তীর ভুল ভাঙে এবং তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে মীমাংসা চান, যাতে করে তার কথাও থাকে, আবার পাঞ্চালী দ্রৌপদীও যাতে ধর্ম-সংকটে না পড়েন।
একটা মীমাংসার জন্য এই যে কুন্তী যুধিষ্ঠিরের কাছে ছুটে গেলেন, এইখানে মহাভারতের পাঠক-পণ্ডিতেরা কিছু কিছু অনুমান করেন। তারা বলেন–কুন্তীর কথাটা কোনও হঠোক্তি নয়। কুন্তী বলেছিলেন–যা এনেছ, তা সবাই মিলে ভোগ করো। অনেকের ধারণা–স্বয়ম্বর সভার ফল-নিষ্পত্তি, যা দ্রৌপদীকে লাভ করার ফলে অর্জুনের সপক্ষেই ঘটেছিল–সে ঘটনাটা কুন্তীর জানা ছিল। এবং জানা ছিল বলেই ভাইদের মধ্যে যাতে এই নিয়ে কোনও বিভেদ না হয়, তাই তিনি ইচ্ছে করেই অমন কথাটা বলেছিলেন–যা এনেছ সবাই মিলে ভোগ করো।
মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ এই কথাটা প্রথম এইভাবে বলার চেষ্টা করেন। যুধিষ্ঠিরের কাছে কুন্তী মীমাংসার জন্য গেলেন, আর সিদ্ধান্তবাগীশ লিখলেন–বোঝ যাচ্ছে, যুদ্ধ শেষ হয়েছে শুনেই যুধিষ্ঠির, নকুল আর সহদেব (যাঁরা যুদ্ধের আরম্ভেই বাইরে এসেছিলেন) চলে আসেন কুম্ভকারগৃহে মায়ের কাছে। অর্থাৎ তারাই বলে দেন–দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন অর্জুন। তারপর যখন ভীম-অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে এলেন, তখন কুন্তী জেনে বুঝে অমন একটা হঠোক্তি করলেন–যা এনেছ সবাই মিলে ভোগ করো।
ঠিক এইখানে সিদ্ধান্তবাগীশের এই মত অথবা যে পণ্ডিতেরা এই মত পোষণ করেন তাঁদের সঙ্গে আমার মত-পার্থক্য হবার ভয় করি। কারণ মহাভারতে দেখছি–স্বয়ম্বর সভার জের টেনে যুদ্ধ-বিগ্রহ শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য দিন ছেলেরা যে সারাদিনের ভিক্ষা সেরে কুন্তীর কাছে ফিরে আসতোরও একটা মোটামুটি সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু কোনওদিনই এমন দেরি হত না যাতে কুন্তী দুশ্চিন্তায় পড়তেন। কিন্তু এখানে দেখছি–তিনি মহা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন–ছেলেরা ফিরছে না, ভিক্ষা নিয়ে আসার সময়টাও পেরিয়ে গেছে–অনাগচ্ছৎসু পুত্ৰেষু ভ্যৈকালেহভিগচ্ছতি। কুন্তী এতটা ভাবছেন যে, ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা হয়তো তাদের চিনে মেরে ফেলেছে। অথবা মায়াবী রাক্ষসেরা ধরে নিয়ে গেছে ছেলেদের।
দেখা যাচ্ছে, ছেলেরা বাড়ি ফেরেনি এবং ছেলেরা বাড়ি না ফিরলে মায়েদের যে দুশ্চিন্তা হয়, তাই কুন্তীর হচ্ছে। তার মানে যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব স্বয়ম্বর সভা থেকে বেরলেও বাড়ি ফেরেননি। সিদ্ধান্তবাগীশ পরে যা লিখেছেন (যা আমরা আগে বলেছি) তার একান্ত স্ববিরোধ এইখানে কুন্তীর দুশ্চিন্তার টীকা রচনা করে বলেছেন–যুধিষ্ঠির, নকুল আর সহদেব বাড়ি ফেরেননি। তারা স্বয়ম্বরের যুদ্ধরঙ্গ থেকে বেরিয়ে গিয়ে কুম্ভকারগৃহে আসবার পথে কোথাও অপেক্ষা করছিলেন। যদি এই যুদ্ধ বিগ্রহ দূরে তাদের বাড়ি পর্যন্ত ছড়ায়, যদি মায়ের কোনও বিপদ হয়, তাই রাস্তাতেই তারা গার্ড দিচ্ছিলেন–যুধিষ্ঠির-নকুল-সহদেবাঃ মাতৃরক্ষার্থং রঙ্গান্নিক্রম্য তৎকুম্ভকারভবনাক্রমণপথে প্রতীক্ষন্তে স্ম ইতি প্রতীয়তে। দেখা যাচ্ছে সিদ্ধান্তবাগীশ আগে একরকম বলেছেন, পরে আরেক রকম বলেছেন।
বস্তুত আমরাও এই অনুমানটাই মানি। হয়তো বাড়তি এইটুকু বলি যে, মায়ের বিপদ হবে–এই ভয়ে নয়, তারা অপেক্ষা করছিলেন ভীম আর অর্জুনের আশঙ্কাতেই। যুধিষ্ঠির, নকুল-সহদেব–যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে যত ল্যাপ্যাঙাই হন না কেন, তারা পালিয়ে যাবার মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তারা অপেক্ষা করছিলেন যদি বাইরে থেকেও কোনও আক্রমণ হানতে হয়। ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধনীতিতে পাঁচজন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কেউ যুদ্ধ করে। ভীম অর্জুন যুদ্ধ করছেন, সেখানে দরকার হলে বাইরে থেকে আক্রমণ শানানোর সুবিধে বেশি। হয়তো সেই কারণেই তারা রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন। এবং ভীম-অর্জুন যুদ্ধ জিতে দ্রৌপদীকে নিয়ে রাস্তায় নামামাত্রই তারা এসেছেন একই সঙ্গে। যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব–কেউই ভীম-অর্জুন ফেরার আগে বাড়ি ফিরেছিলেন–কুন্তীর দুশ্চিন্তার নিরিখে সে-কথা বিশ্বাস হয় না। সিদ্ধান্তবাগীশ একবার রাস্তায় অপেক্ষা করার কথা বলে পরে নিজেকে বাঁচানোর জন্য লিখেছেন–যুদ্ধের শেষ খবর শুনেই তারা বাড়ি ফিরেছেন। আমি বলি–যুদ্ধ শেষ হলে তার প্রতিক্রিয়া হবে ভাইদের সঙ্গে মিলিত হওয়া। প্রায় এক বয়সের ভাইয়েরা আগে নিজেরা একসঙ্গে মিলবে, তারপর হই হই করে মায়ের কাছে যাবে। এইরকম হয়।
অবিশ্বাসী পণ্ডিতেরা বলেন–অন্য ভাইরা যদি আগে না ফিরেই থাকেন, তবে ভীম আর অর্জুনকেই শুধু মায়ের কাছে গিয়ে ভিক্ষা এনেছি বলে দাঁড়াতে দেখলাম কেন? আমি বলব লজ্জা, এর কারণ, লজ্জা। যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব যুদ্ধ-টুদ্ধ করেননি, অথচ নতুন বউকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের সামনে গিয়ে বেশ দালালি করে একটা কথা বলবেন–এটা তাদের ক্ষত্রিয়বুদ্ধিতে লজ্জা দিয়েছে। তা ছাড়া নতুন বউটিই বা কী ভাববে? তিনি স্বয়ম্বরের রঙ্গস্থলে অর্জুনকেও দেখেছেন, ভীমকেও দেখেছেন। অতএব তারা যে কথাটা বলতে পারেন, যুধিষ্ঠির, নকুল বা সহদেবের সে-কথা বলা মানায় না। তাই তারা কিছু বলেননি এবং মায়ের সঙ্গে বউ-পরিচয়ের চরম লগ্নে তারা একটু আড়ালেই থেকেছেন।
কিন্তু যে মুহূর্তে ভুল ভেঙেছে, যে মুহূর্তে তিনি বুঝেছেন–ফস করে নতুন বউয়ের সামনে অমন কথাটা বলা ভুল হয়ে গেছে, অমনই কুন্তী তার বড় ছেলের কাছে দৌড়ে গেছেন। নবপরিণীতা দ্রৌপদীকেও দেখাতে চেয়েছেন ক্ষত্রিয় বাড়িতে যুদ্ধ জিতে বউ নিয়ে আসাটা যেমন বড় কিছু কথা নয়, তেমনই যুধিষ্ঠির যুদ্ধ না করলেও তার মতের মূল্য কিছু কম নয়। কারণ ক্ষত্রিয়ের কাছে যুদ্ধবৃত্তি যত বড়, ধর্মবুদ্ধি তার থেকেও বড়। তিনি একটা কথা ভুল করে বলে ফেলেছেন, তার মীমাংসার ভার তিনি দিয়েছেন বড় ছেলে যুধিষ্ঠিরের হাতে। দেখাতে চেয়েছেন–ভীম-অর্জুন যত বড় যুদ্ধবীরই হোক, আমার অন্য ছেলেগুলিও কিছু ফেলনা নয়। সঙ্গে নতুন বউটির সুকুমার মনোবৃত্তির কথাটাও কুন্তী ভুলে যাননি। যুধিষ্ঠিরকে তিনি বলেছেন–এমন একটা মীমাংসা করো, যাতে আমার কথাটাও মিথ্যে হয়ে না যায়, আর কৃষ্ণা পাঞ্চালীরও যেন কোনও বিভ্রান্তি না হয়–ন চ বিভ্রমেচ্চ।
যুধিষ্ঠির সিদ্ধান্ত দেবার আগে অর্জুনকে যাচিয়ে নিয়েছেন। বলেছেন–তুমিই দ্রৌপদীকে জয় করেছ। তুমিই তাকে বিবাহ করো। অর্জুন সলজ্জ বলেছেন–না দাদা, আগে তোমার বিয়ে হোক, ভীমের বিয়ে হোক, তারপর তো আমি। মনে রাখবেন কথাটা অর্জুনকে বলা হয়েছে, অর্জুনই তার উত্তর দিয়েছেন। কুন্তীর এখানে কোনও পার্ট নেই। রসজ্ঞ মানুষেরা বলতে পারেন–কুন্তীর এ বড় অবিচার। কই হিড়িম্বা যখন ভীমকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, তখন তো কুন্তী বলেননি–আগে আমার বড় ছেলে যুধিষ্ঠির বিয়ে করবে, তারপর ভীম।
আমি বলি-ভীমের জন্য হিড়িম্বা লজ্জা ত্যাগ করে যেসব কথা বলেছিলেন, সেসব কথা যদি বিদগ্ধা রাজনন্দিনীর মুখ দিয়ে বেরোত, তা হলে যুধিষ্ঠির-কুন্তী নিশ্চয়ই অন্যভাবে ভাবতেন। তা ছাড়া ভীম স্বয়ং তো একবারও বলেননি যে, দাদা! এই রাক্ষসী-সুন্দরীকে আগে তুমি বিয়ে করো, তারপর তো আমার বিয়ের কথা আসবে। ভীম সরল লোক। দেখলেন–হিড়িম্বাও জোরজার করছে, মা-ও বলছেন। তিনি নির্দ্বিধায় হিড়িম্বাকে নিয়ে চলে গেছেন অন্য জায়গায়। কিন্তু অর্জুন যে মহাভারতের নায়ক। যুধিষ্ঠির প্রস্তাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মায়ের বিপাকের কথা ভেবেছেন, দ্রৌপদী সম্বন্ধে ব্যাসদেবের ভবিষ্যৎ বাণী স্মরণ করেছেন এবং নবপরিণীতা বধূর সামনে নিজের চারদিকে নায়কোচিত দূরত্বের আড়াল ঘনিয়ে নিয়ে বলেছেন–দাদা, আগে তোমার বিয়ে হোক, তারপর ভীমের বিয়ে হোক, তারপর তো আমি। আমাকে দিয়ে অধর্ম করিয়ো না।
কুন্তী এখানে কী করবেন? এখানে তার কৃত্য কিছু নেই। বিদগ্ধা দ্রৌপদীও কিছু বলেননি। অতএব সমস্ত সিদ্ধান্তটাই চলে গেছে যুধিষ্ঠিরের হাতে। বলতে পারেন–যুধিষ্ঠির যখন– ‘দ্রৌপদী আমাদের সবারই মহিষী হবেন বলে সিদ্ধান্ত দিলেন, সেটাতে কুন্তী আপত্তি করেননি কেন? করেননি, কেননা এতে তার হঠোক্তির দায়টাও চলে গেছে, আর পাঁচজনের এক স্ত্রী হলে ভাইদের মধ্যে ভেদ-বিভেদ হবে না–এই সুন্দর যুক্তিটা তার পরম ঈপ্সিত ছিল। কিন্তু এটা তিনি জেনে বুঝে করেছেন তা মনে হয় না। তা ছাড়া এই বিয়ে নিয়ে পরেও কম লড়তে হয়নি। মহামতি দ্রুপদের সঙ্গে, ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে, সবার সঙ্গে এই মায়ের বচন নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে তর্ক করতে হয়েছে। আর কুন্তী যে জেনে-বুঝে পাঁচ ছেলের সঙ্গে এক রূপসীর বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্যই ফস করে একটা মিথ্যার মতো সত্য কথা বলেছেন, তা মনে করি না। আরও মনে করি না এই কারণে যে, দ্রুপদের সভায় অত বড় ঋষি-শশুর স্বয়ং ব্যাসদেবের কাছে কুন্তী অত্যন্ত বিপন্নভাবে আর্জি জানিয়েছেন–ছেলেপিলেদের কাছে আমার কথাটা একেবারে মিথ্যে হয়ে যাবে বলে আমি বড় ভয় পাচ্ছি, আমি কী করে এই মিথ্যা থেকে মুক্তি পাব বলুন–অনৃন্মে ভয়ং তীব্রং মুচ্যেহম্ অমৃতাৎ কণ্ব? আর যাই হোক, বেদব্যাসের সঙ্গে কুন্তী চালাকি করবেন না।
শেষমেষ যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্তে এবং ব্যাসদেবের অনুমোদনে কুন্তীর হঠাৎ বলা কথাটাই পাঁচ ছেলের একত্রে বিবাহের মঙ্গলে সমাপ্ত হল। বিয়ে হলে স্বামীহারা কুন্তী নববধূ দ্রৌপদীকে স্বামীদের কাছে আদরিণী হবার আশীর্বাদ করলেন প্রথমে। তারপরই প্রবাসিনী রাজমাতা ছেলেদের রাজ-সৌভাগ্যের সম্ভাবনায় কল্যাণী বধূকে বললেন–কুরুদের রাজ্যে তুমি স্বামীর সঙ্গে রাজ-সিংহাসনে অভিষিক্ত হও। ভাষাটাও ছিল–তুমিই তোমার আপন ধর্ম-সৌভাগ্যে স্বামীকে বসাবে রাজার আসনে–অনু ত্বম অভিষিচ্যস্ব নৃপতিং ধর্মবৎসলা। কুন্তীর তৃতীয় আশীর্বাদ ছিল কুরুবংশের গর্ভধারিণী জননীর একাত্মতায়। তিনি বলেছিলেন–আজকে যেমন বিবাহের পট্টবস্ত্র পরিহিত অবস্থায় তোমাকে অভিনন্দিত করছি, তেমনই তোমার ছেলে হবার পর পুত্র-সৌভাগ্যবতী তোমাকে আবারও অভিনন্দিত করব।
এই তিনটি আশীর্বাদের মাধ্যমে কুন্তী একদিকে যেমন নববধূ দ্রৌপদীকে কুলবধূর স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনই তার মধ্যে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন প্রসিদ্ধ ভরতবংশের পরম্পরার মর্যাদা দ্রৌপদীর সৌভাগ্যেই হোক অথবা পাণ্ডবদের ধৈর্য এবং বীর্যে, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্য দিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। রাজমাতা হওয়া সত্ত্বেও যে অপমান এবং বঞ্চনার গ্লানি নিয়ে কুন্তীকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল, কুন্তী সেই ঘরে ছেলে এবং ছেলের বউ নিয়ে ফিরে এলেন সগৌরবে। যুধিষ্ঠির রাজ্য পেলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। ঘটা করে রাজসূয় যজ্ঞ করলেন। আর কুন্তী! নববধূ দ্রৌপদীর হাতে সমস্ত গৌরবের সম্ভাবনা ছেড়ে দিয়ে নিজে সরে রইলেন রাজমাতার দূরত্বে। ভাবটা এই স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা মাতা হিসেবে ছেলেদের আমি রাজত্বে প্রতিষ্ঠিত দেখলাম। এইবার তোমরা সুখে থাকো। আমি দায়মুক্ত।
.
০৯.
মুক্ত হতে চাইলেই কি আর মুক্ত হওয়া যায়? কুন্তী বলেছিলেন-বাপের বাড়ির লোকের কাছেও আমি সুখ পাইনি, শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছেও নয়। স্বামী চলে গেলেন অকালে। ভাশুর আপন পুত্রস্নেহে অন্ধ। বারণাবতের আগুন থেকে বেঁচে মহামতি দ্রুপদের আত্মীয়তার সান্নিধ্যে সগৌরবে হস্তিনায় ফিরলেন বটে, কিন্তু পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্যের প্রতিপত্তিও ধৃতরাষ্ট্রের সহ্য হয়নি। মতলববাজ শ্যালক এবং রাজ্যলোভী পুত্র তাকে যা বুঝিয়েছে, তিনি হয়তো তাই বুঝেছেন। কুন্তীর ছেলেদের বাড়বাড়ন্ত দুর্যোধনের যেমন সহ্য হয়নি ধৃতরাষ্ট্রেরও নয়। ফল পাশাখেলা, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, পাণ্ডবদের বনবাস।
এইসময় থেকে আমরা অন্য এক কুন্তীকে দেখতে পাব। রাজমাতা হিসেবে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসুখ-তা কতটুকুই বা ভোগ করলেন তিনি? সারাজীবন কষ্ট করে এসে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যসুখ তাকে বড় বেশি উৎফুল্ল করতে পারেনি। তিনি ছিলেনও একান্তে। কিন্তু তার মধ্যে এ কী হল? ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা শকুনির ক্রীড়া কুশলতায় প্রথমে তার ছেলেদের সর্বস্ব জিতে নিত, তাও তর সইত। পাশার পণে ছেলেদের বারো বছর বনবাস হত তাও তার সইত। কিন্তু উন্মুক্ত সভাস্থলের মধ্যে শ্বশুর ভাশুর গুরুজনদের সামনে কুলবধূর লজ্জাবস্ত্র খুলে দেবার চেষ্টা করল দুঃশাসন-দুর্যোধনেরা–এ তিনি সইবেন কী করে?
ঠিক এই জায়গায় কুন্তী দ্রৌপদীর সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। একাত্ম হয়েছেন কুরুকুলের বধূর মর্যাদায়। তার নিশ্চয়ই মনে হয়েছে–পাণ্ডুর স্ত্রী হিসেবে কুরুবাড়িতে যে মর্যাদা তার প্রাপ্য ছিল, সে মর্যাদা তিনি যেমন পাননি, তেমনই তার ছেলের বউও পেল না। তার শ্বশুরকুল তাঁর সঙ্গে যে বঞ্চনা করেছে, সেই বঞ্চনা চলল বধূ-পরম্পরায়। পাশাখেলায় পাণ্ডবরা হেরে গিয়ে যখন বনবাসের জন্য তৈরি হচ্ছেন, তখন কুন্তী তার আবাঙমুখ ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেননি, কথা বলেছিলেন শুধু পুত্রবধূ দ্রৌপদীর সঙ্গে।
পরিস্থিতিটা বলি। যুধিষ্ঠির দ্রোপদী আর ভাইদের নিয়ে বিদায় চাইলেন সবার কছে। কুন্তীও বুঝি ছেলেদের সঙ্গে বনে যাবার জন্যই প্রস্তুত হয়েছিলেন, কারণ পাণ্ডুর বংশধর পুত্রদের যেখানে ঠাই হল না, সেই শত্ৰুপুরীতে তার স্থান কোথায়? কাজেই তিনিও বনে। যাবার জন্যই প্রস্তুত হয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মাত্মা বিদুর যিনি ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রীও বটেন, তিনি পাণ্ডবদের ডেকে বললেন–রাজপুত্ৰী আর্যা পৃথা বৃদ্ধা হয়েছেন, বেশি কষ্টও তার সইবে না, তিনি আর বনে যাবেন না, তিনি আমারই বাড়িতে থাকবেন আমারই সমাদরে–ইহ বৎস্যতি কল্যাণি সংকৃতা মম বেশ্মনি। কথাটা বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে শোনালেন– অর্থাৎ রাজবাড়ির আনুকূল্য ছাড়াও বিদুরের অধিকারে তিনি বিদুরের ঘরে থাকবেন।
যুধিষ্ঠির নিশ্চিন্ত হয়ে কাকা বিদুরের মত মেনে নিয়েছেন, সম্মত হয়েছেন কুন্তীও। ঠিক এই সময়ে বিদগ্ধা দ্রৌপদী উপস্থিত হয়েছেন মনস্বিনী কুন্তীর কাছে। কুন্তী আর চোখের জল রাখতে পারেননি। সেইকালের শাশুড়ি হয়েও ছেলের বউকে যে কত সম্মান দেওয়া যেতে পারে তার একটা উদাহরণ হতে পারে এই কথোপকথন। সাধারণ শাশুড়িরা সবসময় ছেলের ওপর অধিকার ফলাতে গিয়ে পুত্রবধূর সঙ্গে কোঁদল করেন। পরিবর্তে শাশুড়িরা যদি ছেলের বউদের সম্মান সম্বন্ধে সচেতন হন, তা হলে যে ছেলেরা আপনিই অধিকারে আসে সেটা বোধহয় কুন্তীর মতো কেউ জানতেন না। অবশ্য দ্রৌপদীও বিদগ্ধা বটে, শাশুড়িকে তিনি বুঝেছেন ভালমতো।
কুন্তী বলেছেন বাছা! এই বিরাট বিপদের মুহূর্তে কোনও কষ্ট মনে রেখো না তুমি। মেয়েদের কী করা উচিত তা তুমি জানো এবং স্বামীদের সঙ্গে কীভাবে তোমায় চলতে হবে–তাও তোমায় বলে দিতে হবে না। তোমার পিতৃকুল এবং শ্বশুরকুল–দুই কুলেরই তুমি অলংকার। এই কুরুকুলের ভাগ্যি মানি আমি, যে তারা তোমার ক্রোধের আগুনে ভস্ম হয়ে যায়নি এখনও। তোমার মধ্যে স্বামীদের জন্য ভাবনা যতখানি আছে, তেমনি আছে। মায়ের গুণ–বাৎসল্য। শীগগিরই ভাল দিন আসবে তোমার।
এইসব শুভকামনার পরে কুন্তী শুধু তার আদরের সহদেবকে বনের মধ্যে ভাল করে দেখে রাখতে বলেছেন দ্রৌপদীকে, এবং সে-কথা আমি আগে বলেছি। বিদগ্ধা দ্রৌপদী রওনা দিলেন, কুন্তীর কান্না দ্বিগুণতর হল। ছেলেদের জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলেন তিনি, অনেক ধিক্কার দিলেন নিজেকে। বললেন–চিরকাল ধরে ন্যায়-নীতি আর সমস্ত উদারতার মধ্যেই ছেলেরা আমার মানুষ হয়েছে, কিন্তু কেউ নিশ্চয়ই ভীষণভাবে খারাপ চেয়েছে আমার-স্যাপধ্যানজঞ্চেদং–যার ফলে দুর্দৈব উপস্থিত হল। অথবা এ আমারই ভাগ্যের দোষ–আমি তোমাদের জন্ম দিয়েছিলাম; নইলে এত গুণের ছেলে হয়েও এইভাবে দুর্ভোগ পোয়াতে হবে কেন তোমাদের?
কুন্তী এবারে স্মরণ করলেন তার সারাজীবনের কষ্টের কথা, তার স্বামীর কথা, সপত্নী মাদ্রীর কথা, যাঁরা পুত্র-জন্মের সুখে-সুখেই স্বর্গত হয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পরেও ছেলেদের নিয়ে তিনি যে আশায় বুক বেঁধেছিলেন, স্বার্থপর ভাশুরের আগ্রাসনে সে আশা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তিনি বলেছেন–আগে যদি জানতাম ছেলেদের সেই বনবাসই জুটবে আবার কপালে, তা হলে পাণ্ডুর মৃত্যুর পর সেই শতশৃঙ্গ থেকে আর হস্তিনায় ফিরে আসতাম না–শতশৃঙ্গান্মাতে পাণ্ডেী নাগামিষ্যং গজাহুয়ম। স্বামী-সতীনের মরণ দেখেও জীবনে বুঝি আমার বড় লোভ ছিল, তাই হয়তো এই কষ্ট–জীবিতপ্রিয়তাং মহং ধিঙ মাং সংক্লেশভাগিনী৷
কুন্তীর করুণ বিলাপে সেদিন পাণ্ডবদের বনবাস-দুঃখ আরও গাঢ়তর হয়েছিল। কোনওদিন কুন্তীকে এত আলুলায়িত ভেঙেপড়া অবস্থায় আমরা দেখিনি। একবার তিনি ছেলেদের আটকে দিয়ে বলেন–ছাড় আমাকে, আমিও বনে যাব তোদের সঙ্গে, একবার নিজের বেঁচে থাকায় ধিক্কার দেন, আরেকবার সহদেবকে চেপে ধরে বলেন–সবাই যাক বাবা, তুই অন্তত আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য থাক এখানে, তাতে কী এমন অধর্ম হবে– মৎপরিত্রাণজং ধর্ম ইহৈব ত্বমবাপ্নহি। অত বিলাপের পর শেষে আর কুন্তী শ্বশুর-ভাশুরের উদ্দেশে দুটো কথা না বলে পারেননি। বলেছেন–ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ এঁরা নাকি ধর্মের নীতি নিয়ম সব জানেন, এঁরাই নাকি এই বংশের রক্ষক, তা এঁরা থাকতেও আমার এই দুর্দশা হল কেমন করে–স্থিতেষু কুলনাথেষু কণ্বমাপদুপাগতা?
পাণ্ডবভাইরা ঠোঁট চেপে শরীর শক্ত করে পা বাড়ালেন বনের পথে। মহামতি বিদুর বহু কষ্টে দুর্দৈবের যুক্তিতে শান্ত করার চেষ্টা করলেন কুন্তীকে। বিবাহিত পুত্রদের শোকে আকুল এক মাকে তিনি নিজের ঘরে স্থান দিলেন সসম্মানে। শোকে দুঃখে কুন্তী পাথর হয়ে গেলেন। প্রায় তেরো বছর অর্থাৎ যতদিন পাণ্ডবরা বনবাসে আর অজ্ঞাতবাসে দিন কাটিয়েছেন ততদিন মহাভারতের কবি আমাদের কুন্তীর খবর দেননি। হয়তো পুত্রশোকাতুর মাতার দুঃখ কবির মরমী ভাষাতে প্রকাশ করলেও সে বুঝি যথেষ্ট হত না, অথবা সে দুঃখ শুনে শুনে অভিনব-ঘটনা-পিপাসু পাঠকের মনে যদি কুন্তীর দুঃখকষ্টের প্রতি তুচ্ছতা জন্মায়, অতএব মহাভারতের কবি প্রায় তেরো বছর কুন্তীর খবর দেননি আমাদের। বনের মধ্যে পাণ্ডবদের অরণ্য-জীবনের নব নবতর ঘটনা-বিন্যাস করে পাঠকদের তিনি অন্যভাবে আকৃষ্ট এবং নিবিষ্ট রেখেছেন।
এই তেরো বছর যে মহাভারতের কবি কুন্তীকে পাঠক-চক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখলেন, তার আরও একটা উদ্দেশ্য আছে। মনে রাখা দরকার, কুন্তী ক্ষত্রিয়-রমণী। প্রিয় পুত্রদের বনবাসের কারণে সাময়িকভাবে তার যত কষ্টই হোক, ক্ষত্রিয়-রমণীর হৃদয় বাংলাদেশের নদী-জল আর দুধ-ভাতে গড়া নয়। ক্ষত্রিয়-রমণীর কাছে পুত্রজন্ম সাময়িক রতি-মুক্তির ফল নয়, পুত্রের মাধ্যমে সে জগতের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। এই যে তেরো বছর কেটে গেল–আমরা বেশ জানি–ছেলেদের বিবাসনের দিনটি থেকেই কুন্তীর মনের মধ্যে গড়ে উঠেছে প্রতিরোধ। স্বামীর গুরুজন তার শ্বশুর-ভাশুরের প্রতি শ্রদ্ধা তার কম ছিল না, কিন্তু তাবলে তারা যাই করেছেন, তাই ঠিক, এমন ভাবনা নিয়ে তিনি বিদুরের ঘরে বসে বসে চোখের জল ফেলে যাচ্ছেন–এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। তিনি কুরুবাড়িতে আছেন–নিজের ইচ্ছেয় নয়, বিদুরের ইচ্ছেয়, কিন্তু নিজের স্বাতন্ত্রে। সেই বিদুরের বাড়িতেই শোকাহত পাথর-প্রতিমা প্রতিরোধের আগুনে সজীব হয়ে উঠল। শ্বশুরবাড়ির মধ্যে বিদুরের দুর্গে বসেই তিনি অন্যায়কারী ভাশুরের বিরুদ্ধে মন শক্ত করে ফেলেছেন।
নিজের ছেলেদের প্রত্যেকের চরিত্র তিনি জলের মতো পড়তে পারেন। অতএব তেরো বছরের মাথায় পিতৃরাজ্যের উত্তরাধিকারের জন্য আবার যখন সময় আসবে, তখন যাতে ছেলেরা তার মিইয়ে না যায়–তার জন্য প্রত্যেক ছেলের মতো করেই উত্তেজনার ভাষা তৈরি করে রেখেছেন কুন্তী। তার বুকে বিঁধে আছে প্রিয় পুত্রবধূটির অপমানের যন্ত্রণা, যে যন্ত্রণার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে তিনি একাত্ম অনুভব করেন। পুত্রবধূর মনোকষ্ট এবং অপমান তার কাছে পাণ্ডুর কুলবধূদের পরম্পরায় সাধারণীকৃত। তিনি মনে করেন, পাণ্ডুর ঘরের বউরা-কুন্তীই হোন অথবা দ্রৌপদী-তারা কেউ তাদের প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। অতএব আর তিনি অপেক্ষা করবেন না।
সময় এল। তেরো বছরের শেষে পাণ্ডব-কৌরবের শান্তি-বিনিময়ের চেষ্টা ব্যর্থ হল। পুরুষোত্তম কৃষ্ণ নিজে এসেছেন কুরুদের বাড়িতে পাণ্ডবদের হক বুঝে নেবার জন্য। শান্তি তিনিও চান, কিন্তু পাণ্ডবদের ভাগ তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে–এই মনোভাবটা তার ছিল। ফলে কুন্তীর পক্ষে নিজের শাণিত বক্তব্যগুলি পেশ করাটা খুব কষ্টকর হয়নি। তা ছাড়া বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই ভাইপোটির ওপর তার নির্ভরতা ছিল একান্ত। ভাইপোটিও সেইরকম। কুরুদের সভায় যাবার আগে কৃষ্ণ একবার কুন্তীর সঙ্গে দেখা করেন। তেরো বছর ছেলেদের মুখ না দেখার ফলে কুন্তীর প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল অনর্গল কুশল প্রশ্নে। তারই সঙ্গে ছেলেদের কর্তব্য সম্বন্ধেও তিনি একইভাবে মুখর। বছরর পর বছর যে অন্যায় তাদের সইতে হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিক্রিয় হয়ে ওঠা উচিত, সে ব্যাপারে এখন তিনি নিজেই উপদেশ দিয়েছেন কৃষ্ণকে৷ কৃষ্ণ এখানে নিজে বেশি কথা বলেননি। কিন্তু কুরুদের সভায় কৃষ্ণের শান্তি-সফর যখন ব্যর্থ হয়ে গেল, তখন কিন্তু কৃষ্ণ নিজেই জিজ্ঞাসা করেছেন মনস্বিনী কুন্তীকে–তোমার ছেলেদের কী বলব বলে দাও, পিসি। অর্থাৎ এবার উত্তেজনাটা নিজেই চাইছেন।
প্রথমবার যখন কৃষ্ণ এলেন কুন্তীর কাছে, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। বিদুরের ঘরে খাওয়া-দাওয়া, আলাপ-আলোচনা সেরে কৃষ্ণ পিসির সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ছেলের বয়সি ভাইপোকে দেখে কুন্তী আর থাকতে পারলেন না। কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলেন কুন্তী। বললেন–পাঁচ ভাই, ছোটবেলা থেকে এক-মত, এক-প্রাণ, অন্যায়ভাবে তাদের পাঠানো হল বনে। বাপ নেই, তাদের আমি কত কষ্ট করে মানুষ করেছি-বালা বিহীনাঃ পিত্রা তে ময়া সততলালিতাঃ। সমস্ত রাজ-সুখ ত্যাগ করে দুঃখিনী মাকে রেখে তারা চলে গেল বনে।
ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যসুখের প্রতিতুলনায় পাণ্ডবভাইরা কত কষ্টে বনে বাস করলেন কৃষ্ণের সামনে তার একটা চিত্র তুলে ধরলেন কুন্তী। কুন্তী বললেন–হয় শঙ্খ-দুন্দুভির শব্দ, নয়তো হাতি-ঘোড়ার ডাকে ছেলেরা আমার সকালবেলায় জেগে উঠত। ব্রাহ্মণেরা পুণ্যাহ ঘোষণা করতেন, বাঁশিতে ভৈরবীর সুর চড়ানো হত, বাছারা আমার সেই শব্দ শুনে জেগে উঠত। আর এখন বিশাল বিশাল বনের মধ্যে জন্তুর জ্বর-কর্কশ শব্দে ছেলেরা আমার বোধহয় ঘুমোয়নি এতকাল।
কুন্তী ছেলেদের কথাই বলে চলেছেন-এই যে আমার বড় ছেলে যুধিষ্ঠির। যে নাকি অম্বরীষ-মান্ধাতা অথবা যযাতি-নহুষের মতো বিরাট এক রাজার রাজা হবার উপযুক্ত, সেই যুধিষ্ঠির বনের মধ্যে কেমন ছিল, কৃষ্ণ? আর যার গায়ে হাজার হাতির শক্তি হিড়িম্ব, বক আর কীচকের মতো লোককে যে শায়েস্তা করেছে, সেই আমার ভীষণ রাগী ছেলে ভীম কেমন করে দিন কাটাল বনে বনে? অর্জুন, আমার অর্জুন। যার ওপর সমস্ত পাণ্ডবভাইরা ভরসা করে থাকে, একেক ক্ষেপে যে একশোটা বাণ ছুঁড়তে পারে, সামনাসামনি যুদ্ধ করে কেউ পারবে না যার সঙ্গে-সেই অর্জুন আমার কেমন আছে কৃষ্ণ? এইভাবে নকুল সহদেব–পিতৃমাতৃহারা যে ভাই দুটিকে চোখে হারাতেন কুন্তী, জননীর সমস্ত প্রশ্রয়ে যাদের তিনি মানুষ করেছেন, সেই নকুল-সহদেবকে ছাড়া কেমন করে দিন কেটেছে কুন্তীর–তাও তিনি জানালেন কৃষ্ণের কাছে।
সবার শেষে এল কুলবধু কৃষ্ণার কথা। কুলবধূর সমস্ত মর্যাদা একত্র জড়ো করে শাশুড়ি কুন্তী এবার পুত্রবধূর কথা জিজ্ঞাসা করলেন কৃষ্ণকে। দোষ ধরলে তো কত কিছুই ধরতে পারতেন কুন্তী। পাঁচ ছেলের এক বউ। একে যত্নে করো না, ওকে খেতে দাও না, স্বামীদের সঙ্গে তর্ক করো, পিসতুতো দেওর কৃষ্ণের সঙ্গে অত কীসের বন্ধুত্ব তোমার, অর্জুনের ব্যাপারে তোমার রস বেশি, নকুল-সহদেবকে একটু দেখে রাখতে পারো না, স্বামীদের সঙ্গে একই তালে ঘুরে বেড়াও–এরকম শত দোষ আবিষ্কার করা কিছুই কঠিন ছিল না শাশুড়ি কুন্তীর পক্ষে। কিন্তু কুন্তী তাঁকে দেখেছেন কুরুবাড়ির বধূ-পরম্পরায়। তিনি নিজে কুরুবাড়ির বউ, সেই বউ হিসেবেই তিনি দ্রৌপদীর মর্যাদা রক্ষা করেছেন। বউ হিসেবে কুরুবাড়িতে কষ্ট পেয়েছি, অতএব শাশুড়ি হিসেবে সেটা পুষিয়ে নেব–এই দৃষ্টিতে নয়, দ্রৌপদীর মান-অপমানের কথা কুন্তীর বিলক্ষণ স্মরণে আছে।
তাই সবার কথা শেষ করে কুন্তী এবার আলাদা করে আসছেন দ্রৌপদীর প্রসঙ্গে। বললেন–আমার সবগুলি ছেলের থেকেও অনেক বেশি আমার কাছে আমার পুত্রবধূ দ্রৌপদী–সর্বৈঃ পুত্রৈঃ প্রিয়তরা দ্রৌপদী মে জনার্দন। যেমন তার রূপ, তেমনই তার গুণ। নিজের কচি ছেলেগুলিকে বাড়িতে রেখে সে স্বামীর কষ্টের ভাগ নিতে গেছে বনে। আভিজাত্য, ঐশ্বর্য, কৌলীন্য–কিছুই তো কম ছিল না তার, তবু স্বামীদের জন্যই সে বনে গেছে। দ্রৌপদীর জন্য কুন্তী এবার চিরাচরিত ভারতীয় ধর্মদর্শনেও সন্দেহ প্রকাশ করছেন। ধর্মের কর্তা বক্তা এবং অভিরক্ষিতার মতো এক ব্যক্তির নামই হল কৃষ্ণ। তার কাছেই কুন্তী বলছেন–পুণ্য কর্ম করলেই মানুষ সুখ পায়–এমন নিশ্চয়ই নয় কৃষ্ণ, কারণ তা যদি হত তা হলে আমার দ্রৌপদীর সারাজীবন ধরে অক্ষয় সুখ পাওয়ার কথা।
আসলে কুন্তী এবার যেসব মেজাজি কথাগুলি বলবেন তার অন্তঃসূত্র হলেন দ্রৌপদী। ছেলেদের এই চুপ করে বসে থাকা আর তার ভাল লাগছে না। ধর্ম-ধর্ম করে যুধিষ্ঠিরের শুভবুদ্ধি আর তৃপ্ত করছে না এই ক্ষত্রিয় রমণীর মন। কুন্তী বলছেন-দেখ কৃষ্ণ! যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন অথবা নকুল-সহদেব–কেউ আমার কাছে কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর থেকে প্রিয় নয়। অমন একটা মেয়েকে রাজসভার মধ্যে এনে অপমানের চূড়ান্ত করা হল, আর এরা কেউ কিচ্ছুটি করল না–এর থেকে দুঃখের ঘটনা আমার জীবনে কখনও ঘটেনিন মে দুখঃতরং কিঞ্চিদ ভূতপূর্বং ততোধিক। রজস্বলা অবস্থায় দ্রৌপদীকে শ্বশুর-ভাশুরের সামনে জোর করে নিয়ে আসা হল, আর ব্রহ্মলগ্ন নির্বিগ্ন পুরুষের মতো সেটা বসে বসে দেখলেন ধৃতরাষ্ট্র এবং অন্যান্য কৌরবো।
কুন্তী এই প্রসঙ্গে বিদুরের অনেক প্রশংসা করলেন কৃষ্ণের কাছে, কেননা তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দ্রৌপদীকে সভাস্থলে নিয়ে আসার নিন্দা করেছিলেন। কুন্তী কিছুই বাদ দিচ্ছেন না, কুরুবাড়ির সমস্ত বঞ্চনা তিনি একটি একটি করে বলতে থাকলেন। তিনি ভাবছিলেন–মানুষটি কৃষ্ণ বলেই তিনি হয়তো শান্তির প্রস্তাব গ্রহণ করাতে সমর্থ হবেন কুরুসভায়। জুটবে আরও এক রাশ বঞ্চনা। বারবার অসহ্য নিপীড়ন আর মাঝে মাঝে দুই-চার মুদ্রা ভিক্ষা দেওয়ার মতো কিছু সান্ত্বনা পেতে পেতে কুন্তী এখন ক্লান্ত। শান্তিকামী কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে তিনি তাই ঠাণ্ডা মাথায় নিজের জীবনের বঞ্চনাগুলি একটি একটি উপস্থিত করে তার আসল প্রস্তাবের পথ পরিষ্কার করছেন।
আমরা এখন সেই জায়গায় উপস্থিত, যেখান থেকে আমরা কুন্তীর জীবনের কথা আরম্ভ করেছিলাম। জীবনের যে উপলব্ধি থেকে কুন্তী নিজেকে অবহেলিত এবং বঞ্চিত বলে মনে করেছেন, আমরা এখন সেই মুহূর্তে উপনীত। কঠিন এবং জটিল এক মনস্তত্ত্বের শিকার হয়ে কুন্তী যখন নিজের ভাইপোকে বলেছিলেন–বাপের বাড়িতেও বঞ্চনা লাভ করেছি, শ্বশুরবাড়িতেও তাই আমরা এখন সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।
কুন্তী বলেছিলেন–জীবনে দুঃখ আমি কিছু কম পাইনি, কৃষ্ণ–নানাবিধানাং দুঃখানা অভিজ্ঞাস্মি জনার্দন। ছেলেদের এই অজ্ঞাতবাস এবং তারপরে এখনও যে তাদের রাজ্য দেওয়া হচ্ছে না–সবই সহ্য করা যেত যদি আমি ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকতাম। বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি সব জায়গাতেই আমি অবিচার পেয়েছি। তবু আমার এই বিধবার জীবন, ইন্দ্রপ্রস্থের সম্পদ-নাশ এবং কৌরবদের এই শত্রুতা–এও আমাকে তত কষ্ট দেয়, যতটা দেয় ছেলেদের সঙ্গে আমার থাকতে না-পারাটা-তথা শোকায় দহতি যথা পুত্রৈর্বিনাভবঃ। এই যে আমি প্রায় চোদ্দোটা বছর ধরে আমার অর্জুন, যুধিষ্ঠির, ভীম অথবা নকুল-সহদেব–কাউকে চোখে দেখতে পাচ্ছি না, এর পরেও কি কারও শান্তি থাকতে পারে? আসলে কী জানো কৃষ্ণ, মানুষ মারা গেলে তবেই লোকে তার শ্রাদ্ধ করে, আমার কাছে আমার ছেলেরা কার্যত মৃত, আমিও মৃত তাদের কাছে–অর্থতস্তে মম মৃতাস্তেষাং চাহং জনার্দন।
মহাভারতের কবির ব্যঞ্জনাটা এখানে ধরতে পারলেন কি না জানি না। সংস্কৃতে ‘শ্রাদ্ধ’ শব্দটি যে ধাতু থেকে আসছে ‘শ্রদ্ধা’ শব্দটিও সেই ধাতু থেকেই আসছে। পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ-তর্পণ মানে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন। সামগ্রিকভাবে এখানে কুন্তীর ভাবটা হল আমার ছেলেরা আমার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর মতো কিছু করেনি এবং আমিও তাদের মধ্যে শ্রদ্ধা করার মতো কিছু পাইনি। তারা শুধুই আমার কাছে মৃত, আমিও তাদের কাছে তাই; কিন্তু মানুষের মৃত্যু হলে যে শ্রাদ্ধ-তর্পণটুকু করে, অন্তত সেইটুকু তাদের কাছে আশা করা গিয়েছিল। তারা তাও করেনি–জীবনাশং প্রণষ্টানাং শ্রাদ্ধং কুন্তি মানা।
এখানে কুন্তীর শ্রাদ্ধ-তর্পণ বলতে যেন আবার আক্ষরিক অর্থে শ্রাদ্ধ বুঝবেন না। এখানে শ্রাদ্ধের মধ্যে কুন্তী তার সন্তানদের তরফে কৌরবদের বিরুদ্ধে যথোচিত প্রতিক্রিয়া আশা করছেন। কুন্তী এর পরেই কৃষ্ণের মাধ্যমে যুধিষ্ঠিরকে জানাচ্ছেন–কৃষ্ণ! সেই রাজা যুধিষ্ঠিরকে বোলো (কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, এককালে তিনি রাজা ছিলেন), সেই ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরকে বোলো–তুমি যে এত ধর্ম-ধর্ম করো, সেই ধর্মও যে একেবারে ক্ষীণ হয়ে গেল বাছা! ধিক সেই ধর্মপুত্রের জননীকে, যাকে বেঁচে থাকতে হয় পরের ওপর নির্ভর করে–পরাশ্রয়া বাসুদেব যা জীবতি ধিগস্তু তাম্। আর আমার নাম করে সেই ভীম আর অর্জুনকে একবার বোলো। বোলো যে, ক্ষত্রিয়-জননীরা যে সময়ের কথা ভেবে সন্তান প্রসব করে, এখন অন্তত সেই সময়টা এসে গেছে–যর্থং ক্ষত্রিয়া সূতে তস্য কালোয়মাগতঃ। এই সময়ও যদি বয়ে যায়, তবে এরপর মিথ্যাই সত্যের জায়গাটা অধিকার করে নেবে–মিথ্যা চাতিক্রমিষ্যতি।
যে ছেলের যা। ধর্মপ্রাণ যুধিষ্ঠিরকে ধর্মের শাসনে, আর ভীম-অর্জুনকে ক্ষাত্রবীর্যের মহিমায় উদ্বুদ্ধ করে কুন্তী বলেছেন– সময় যদি সেরকম আসে, তবে জীবনটাও খুব বড় কথা নয়। দরকার হলে জীবন দিতে হবে–কালে হি সমনুপ্রাপ্তে ত্যক্তব্যমপি জীবিত। আমরা ভাবি চিরাচরিত ক্ষাত্ৰ-নীতি-সিদ্ধির জন্য কোন জননী এমন করে ছেলেদের বলতে পারেন? কুন্তীর বক্তব্য–ভীম-অর্জুনের মতো বীর, যারা নাকি যুদ্ধকালে দেবতাদেরও অন্ত ঘটাতে পারেন, সেই তারা যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সভাস্থলে উপস্থিত দ্রৌপদীর অপমান দেখলেন এটা তাদের লজ্জা–তয়োশ্চৈ অবজ্ঞানং যত্তাং কৃষ্ণাং সভাং গতাম। দুঃশাসন-দুর্যোধনের সঙ্গে তার প্রথমজাত সন্তান কর্ণও দ্রৌপদীর সঙ্গে জঘন্য ব্যবহারটি করেছিলেন–কুন্তী তা ক্ষমার যোগ্য মনে করেন না। বরঞ্চ তাদের শত অপমান এবং কটুক্তির উত্তরে হঠাৎ-ক্রোধী ভীমসেন যে ক্ষেপে উঠেছিলেন–সেই ক্ষিপ্ততাই অনুমোদন করেন কুন্তী। নিজের ছেলেকে তিনি চেনেন। তার ধারণা–দুর্যোধন ভীমের সঙ্গে যে অপব্যবহার করেছে–তার ফল বুঝবে সে–তস্য দ্রক্ষ্যতি যৎ ফল।
এই চরম মুহূর্তে যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন যেখানে অসাধারণ ধৈর্য নিয়ে ঘটনার গতির দিকে নজর রাখছেন, সেখানে তাঁর ওই অধীর হঠাৎ-ক্রোধী পুত্রটিই যে প্রধান ভরসা। সে যা করেছে, সে ঠিক করেছে যেন। কৃষ্ণকে কুন্তী বলেছেন–কৌরবদের এই চরম শত্রুতার মুখে আমার ভীম অন্তত চুপটি করে বসে থাকবে না। ভীম সারাজীবন শত্রুতা পুষে রাখে। এবং শত্রুর শেষ না করে সে ছাড়বে না। দ্রৌপদীর অপমানে ভীম একান্তভাবে প্রতিক্রিয় হয়েছিলেন বলেই কুন্তীর আবার মনে পড়ল লজ্জারুণা দ্রৌপদীর কথা। কুন্তী বলেছেন ছেলেরা পাশা খেলায় হেরেছে, দুঃখ নেই আমার, রাজ্য হারিয়েছে তাতেও দুঃখ পাই না, বনবাসে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে–তাও আমি গণ্য করি না। কিন্তু রজস্বলা অবস্থায় কুলবধূকে সভার মধ্যে এসে যে অশালীন কথাগুলি শুনতে হল–সে দুঃখের থেকে বড় দুঃখ আমার কাছে কিছু নেই কৃষ্ণ। কিছু নেই–কিনু দুঃখতরং ততঃ।
দ্রৌপদীর অপমান আজ কুন্তীর কাছে সমগ্র নারী জাতির একাত্মতায় ধরা দিয়েছে, যে নারী জাতির মধ্যে তিনিও একতমা। বারবার তার মনে পড়ে–অমন অসভ্য পরিস্থিতিতে দ্রৌপদী কাউকে সহায় পায়নি, স্বামীদেরও নয়। আজ কৃষ্ণের শান্তি-প্রস্তাবের প্রাক্কালে দ্রৌপদীর একাত্মতায় কুন্তী তাই নিজের লাঞ্ছনা ব্যক্ত করছেন কৃষ্ণের কাছে। বলেছেন– ছেলেপিলেদের সঙ্গে আমার সহায় একমাত্র তুমি কৃষ্ণ! তুমি আছ, বলরাম আছে, তোমার বীরপুত্র প্রদ্যুম্ন আছে। আর আমি! তোমরা থাকতেও, ভীম-অর্জুনের মতো ছেলে থাকতেও আমাকে এইসব লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হল–সোহহম এবংবিধং দুঃখং সহেয়ং পুরুষোত্তম।
এই ‘পুরুষোত্তম’ শব্দটির মধ্যে যেন একটা খোঁচা আছে। অর্থাৎ লোকে তোমায় যে ‘পুরুষোত্তম’ বলে ডাকে, আমার এই সারাজীবনের লাঞ্ছনা গঞ্জনার নিরিখে ওই নামে বুঝি কলঙ্ক লেগেছে। কৃষ্ণ কুন্তীকে আশ্বাস দিলেন কুন্তীর পিতৃকুলের বিশ্বস্ততায়। বললেন– পিসি! তুমি মহারাজ আর্যক শূরের মেয়ে। এক হ্রদ থেকে আরেক হ্রদে এসে আশ্রয় নেওয়ার মতো বিবাহসূত্রে তুমি এসে পড়েছ কৌরবকুলে। তুমি বীরপুত্রদের জননী বলেই এই আশা আমি রাখি যে, তোমার মতো প্রাজ্ঞ রমণীরাই সাধারণ সুখ-দুঃখের ওপর উঠতে পারবে সুখদুঃখে মহাপ্রাজ্ঞে ত্বাদৃশী সোঢ়মৰ্হতি। বস্তুত তোমার ছেলেরাও বনবাসের পরিসরে এই সাধারণ সুখ-দুঃখ ক্রোধহর্ষের ওপরে উঠে ধৈর্য অবলম্বন করেছে। বড় মানুষেরা এইরকমই করেন। সাময়িক সুখের থেকে পরিণত কালের অবিচল সুখই তাদের বেশি কাম্য। কৃষ্ণ বললেন–আমার বিশ্বাস–আর খুব বেশি দেরি নেই। শীগগিরই তোমার ছেলেরা তোমার পুত্রবধূ–সবাই এসে নিজেদের কুশল জানিয়ে অভিবাদন জানাবে তোমাকে।
কৃষ্ণের কথায় কুন্তী সাময়িকভাবে শান্ত হয়ে কৃষ্ণের ওপর আস্থা জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু কুরুসভায় দুর্যোধন যখন কৃষ্ণের শান্তির প্রস্তাব নস্যাৎ করে দিলেন, সেই সময়ে সুখ দুঃখ অথবা ক্রোধ-হর্ষের ঊর্ধ্বতার দার্শনিক মাহাত্ম তার কাছে আর তত সত্য ছিল না। তিনি বুঝেছিলেন ধৈর্যের দিন এবারে শেষ। এখন শাস্তি দেবার সময় এসেছে। হস্তিনাপুর ছাড়বার আগে তিনি আবার এসেছেন মনস্বিনী কুন্তীর কাছে। কুন্তীর উত্তেজনা পাণ্ডবদের মধ্যে সংক্রমিত করার জন্য কৃষ্ণই নিজে বলছেন–বলো পিসি কী বলতে হবে পাণ্ডবদের, তোমার নাম করে যা বলতে হবে এইবার তা বলোকিং বাচ্যা পাণ্ডবেয়াস্তে ভবত্যা বচনান্ময়া।
কৃষ্ণ এখন শুনতে চাইছেন। কৃষ্ণের মতো অত বড় বীরপুরুষ এবং বাকপটু মানুষ! নিজের ওপর যার অনেক আস্থা ছিল–ভেবেছিলেন–ঠিক পারব, কৌরব-সভায় সবার মধ্যে দুর্যোধনকে ঠিক রাজি করাতে পারব। কিন্তু পারলেন না। দুর্যোধন এবং তার সাকরেদদের ভাব-ভাবনা আগে থেকে জানতেন বলেই কুন্তী কৃষ্ণের মাধ্যমে ছেলেদের যা বলার তা আগেই বলেছেন। এখন কৃষ্ণ নিজেই এসেছেন কুন্তীর কাছে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। কুন্তীকে বলেছেন–যুক্তি তর্ক দিয়ে অনেক বলেছি। আমি বলেছি, পণ্ডিত ঋষিরা বলেছেন, একটা কথাও যদি শোনে-ন চাসৌ তদ্ গৃহীতবা। কৃষ্ণ বলেছেন–এখন তুমি বলো, তোমার কথা এখন আমি শুনতে চাই–শুষে বচনং তব।
এই যে একটা সময়ের তফাত হল, তাতে কুন্তীও তাঁর বক্তব্য আরও শাণিত করার সুযোগ পেলেন। আগে যে ব্যক্তি শান্তিকামী হয়ে নিতান্ত পাঁচখানি গ্রামের বদলেই শান্তি বজায় রাখতে উদ্যত ছিলেন, সেই লোকের অর্থাৎ আমাদের কৃষ্ণের সমস্ত ‘মিশন’ এখন ব্যর্থ হয়ে গেছে। কৃষ্ণের এই ব্যর্থতার সুযোগ, কুন্তীর কাছে এক বড় সুযোগ। বস্তুত কৃষ্ণ যে শান্তিকামী হয়ে কৌরব-সভায় পাণ্ডবদের জন্য পাঁচখানি গ্রাম পর্যন্ত প্রার্থনা করেছিলেন– এই প্রার্থনা কুন্তীর মনোমত হয়নি। এখন কৃষ্ণ ব্যর্থ হওয়ার ফলে তিনি সেই কথাগুলি বলতে পারছেন, যা আগে তিনি বলতে পারেননি। কুন্তী বলছেন–তার নিজস্ব রাজনৈতিক বুদ্ধি, মনস্বিতা এবং মাতৃত্বের গ্লানি একত্রিত করে। পাঠক! অবহিত হয়ে শুনুন!
.
১০.
এই মুহূর্তে আমার সহৃদয় পাঠকদের কাছে আমিও যে সকরুণ প্রার্থনা জানাচ্ছি, তার কিছু কারণ আছে। আসলে সাধারণ পাঠক গল্প চান, ঘটনার পর ঘটনার বিন্যাস চান। উপন্যাসের চরিত্র যদি একসঙ্গে বেশি কথা বলে, তার বক্তব্য যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। কুন্তীর চরিত্র বিশ্লেষণের পথে আমরা এখন এমন একটা জায়গায় উপস্থিত হয়েছি, যখন পাঠকের ধৈর্যের ওপরেই আমাদের আস্থা রাখতে হবে। আমার ভরসা একটাই–আমার পাঠক কোনও সাধারণ মামুলি পাঠক নন। মহাভারতের মতো বিশাল এক মহাকাব্যের ততোধিক বিশাল এক নারী চরিত্রের বিশ্লেষণ শোনবার জন্য তিনি পূর্বাহেই প্রস্তুত। এই প্রস্তুতি থাকার জন্যই পাঠক তার উদারতায় কুন্তীর এই বিপন্ন মুহূর্তে তাঁর পাশে থাকবেন, তার কথা মন দিয়ে শুনবেন বলে আশা করি।
ভারতবর্ষের প্রাচীন রাজনীতি-শাস্ত্রের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তারা উত্থান-শক্তি সম্পন্ন রাজার কথা শুনে থাকবেন। উত্থান-শক্তি বলতে সাধারণত আমরা উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাই বুঝি, রাজনীতির পরিভাষাতে ব্যাপারটা প্রায় একই বটে, তবে যে রাজা শত্রুর মোকাবিলা করতে সতত উদ্যোগ নেন, শত্রুর দ্বারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েও যিনি আপন প্রাপ্তির কথা ভুলে যান না, সুযোগ এলেই আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর ওপর, প্রাচীন রাজনীতির পরিভাষায় তিনিই উদ্যমী রাজা, উত্থান-শক্তির অধিকারীও তিনিই। তেরোটা বছর ধরে ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির যেভাবে নিশ্চেষ্ট অবস্থায় কষ্ট ভোগ করে চলেছেন কুন্তী তাতে সুখও পাচ্ছেন না শান্তিও পাচ্ছেন না। পাশাখেলার পণ হিসেবে বনবাসে যাওয়াটা ধর্মের নীতি নিয়মে যুক্তিসিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু রাজ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যুধিষ্ঠিরের ধীর চেতনা এই ওজস্বিনী ক্ষত্রিয়া রমণীকে পীড়া দিচ্ছে।
কুরু-পাণ্ডবের রাজনীতির মধ্যে কুন্তী হয়তো প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নেই, কিন্তু এই রাজনীতিটা তিনি হাড়ে হাড়ে বোঝেন। আর বোঝেন বলেই রাজনীতির মধ্যে যুধিষ্ঠিরের নিরন্তর ধর্মেষণা আর তিনি সহ্য করতে পারছেন না। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরকে তিনি তাই খবর পাঠাচ্ছেন–বাবা! তুমি যেমন ধর্ম-ধর্ম করে যাচ্ছ, সেটাই ধর্ম নয়, তোমার ধর্ম প্রজাপালন, সেই ধর্ম তো নষ্টই হয়ে গেল বাবা-ভূয়াংস্তে হীয়তে ধর্মো মা পুত্ৰক বৃথা কৃথাঃ। কুন্তীর কাছে যুধিষ্ঠিরের হেয়তা এইখানেই। ছেলেকে তিনি লজ্জা দিয়ে বলেন–তোমার বুদ্ধিটা প্রায় গোঁ-গোঁ করে বই মুখস্থ করা ছাত্রের মতো। যারা বেদের অর্থ কিছুই বোঝে না অথচ দিন-রাত বেদ মুখস্থ করে ভাবে যে খুব ধর্ম হচ্ছে, তোমার বুদ্ধিও সেইরকম। ধর্মকার্যের আনুষ্ঠানিক কিছু তৃপ্তিতেই তুমি এমন ঝুঁদ হয়ে আছ যে ভাবছ খুব ধর্ম হচ্ছে–অনুবাকহতা বুদ্ধিঃ ধর্মম্ এবৈকমীক্ষতে।
যুধিষ্ঠির পূর্বে রাজা ছিলেন, এখন তিনি রাজ্যহারা, বনবাসী। ব্রাহ্মণোচিত উদার শান্ত ধর্মবুদ্ধির থেকেও তার কাছে এখন রাজ্যোদ্ধারের পরিকল্পনা বড় হওয়া উচিত ছিল। অথচ এই যে কৃষ্ণ কুরুসভায় এলেন শান্তির দূত হয়ে, সেখানে শুধু যুধিষ্ঠির কেন, অর্জুন এমনকী ভীমের মতো লোকের কাছ থেকেও পুরাতন রাজ্যপাটের চেয়ে শান্তির কাম্যতা বেশি দেখা গিয়েছিল। এ জিনিস পঞ্চস্বামিগর্বিতা দ্রৌপদীর যেমন সহ্য হয়নি, পঞ্চপুত্ৰগর্বিতা এই ক্ষত্রিয়া রমণীরও তা সহ্য হয়নি। যুধিষ্ঠিরের প্রার্থনা ছিল–সম্পূর্ণ রাজ্যপাট নাই পেলাম, অন্তত পাঁচ গ্রামের পরিবর্তেও যদি যুদ্ধ এড়িয়ে চলেন দুর্যোধন, তবু সেই কলহ-মুক্তিতে বুঝি ধর্ম আছে, শান্তি তো আছেই।
কুন্তীর কাছে অসহ্য এইসব যুক্তি। পূর্বতন রাজাদের উদাহরণে কুন্তী প্রকারান্তরে ধিক্কার দিচ্ছেন যুধিষ্ঠিরকে। বলেছেন–কৃষ্ণ! যেটা ধর্ম, অন্তত যুধিষ্ঠিরের কাছে যেটা ধর্ম হওয়া উচিত, সেই ধর্ম সে আপন বুদ্ধিতে নির্মাণ করতে পারে না। জন্মলগ্নেই তার ধর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন স্বয়ং বিধাতা। ক্ষত্রিয় পুরুষেরা জীবন ধারণ করে বাহুশক্তির ওপর নির্ভর করে। কারণ পরম পুরুষের বাহু থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই ক্ষত্রিয় জাতি। নৃশংস কাজ করতে হলেও তার চরম অভীপ্সিত কাজ হল প্রজাপালন। তার সেই ধর্ম আজ কোথায়! কুন্তী বলেই চললেন। বললেন-বুড়ো মানুষদের মুখে শুনেছি–কুবের নাকি মুচুকুন্দ রাজাকে খুশি হয়ে এই সমস্ত পৃথিবীর রাজত্ব উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জানো কৃষ্ণ! মুচুকুন্দ এই দান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন–আমি চাই, আমার নিজের শক্তিতে আমি আমার প্রার্থিত রাজ্য অধিকার করে নেব, আপনার দান চাই না আমি–বাহুবীৰ্যার্জিতং রাজ্যম্ অশ্নীয়ামিতি কাময়ে।
আসলে কুন্তীও আর এই দান চান না। যিনি রাজরানি ছিলেন তার ছেলেরা বনবাসের দীন প্রকোষ্ঠ থেকে পাঁচখানি গ্রাম ভিক্ষা করবেন আর দুর্যোধন সেই দান করবেন– দুর্যোধনের এই মর্যাদার ভূমিকা কুন্তী সহ্য করতে পারছেন না। কুন্তী মনে করেন–ভাল কথা বলে, রাজ্যের অল্পাংশমাত্র গ্রহণের প্রস্তাব করে দুর্যোধনকে কিছুই বোঝানো যাবে না। পাণ্ডবদের দিক থেকে তার ওপরে চরম দণ্ড নেমে না আসলে ধর্মেরই অবমাননা ঘটবে। কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন–তুমি যে পূর্বে রাজা হয়েও ঋষিদের মতো পরম ত্যাগের মাহাত্ম্যে নিজেকে বেশ রাজর্ষির কল্পনায় স্থাপন করেছ, তুমি জেনে রাখো এটা রাজর্ষির ব্যবহার নয়–নৈত রাজর্ষিবৃত্তং হি যত্র ত্বং স্থাতুমিচ্ছসি। তুমি যদি ভেবে থাকো যে, কোনওরকম নৃশংসতা না করে নিষ্কর্মার মতো বসে বসেই প্রজাপালনের ফল পাওয়া যাবে, তা হতে পারে না। স্বর্গ থেকে তোমার বাপ-ঠাকুরদারা তোমার এই বুদ্ধি-ব্যবহার দেখে পুলকিত হয়ে আশীর্বাদ করে যাচ্ছেন–এটা ভেবো না, এমনকী মা হিসেবে আমারও কোনও আশীর্বাদ নেই এ ব্যাপারে–ন হেতাম আশিষং পাণ্ডুর্ন চাহং ন পিতামহঃ।
পাঁচ-পাঁচটি বীর পুত্র থাকতেও তিনি নিজে অসহায়ভাবে শত্ৰুপুরীতে বসে আছেন। ছেলেদের শুভদিনের জন্য আর কতই বা অপেক্ষা করতে পারেন কুন্তী। এর থেকে দুঃখের আর কীই বা আছে যে রাজরানি এবং রাজমাতা হয়েও তাকে জ্ঞাতিশত্রুর বাড়িতে বসে পরের দেওয়া ভাতের গ্রাস মুখে দিতে হচ্ছে। তার বক্তব্য–বাপ-ঠাকুরদার মান আর ডুবিও না যুধিষ্ঠির, তুমি রাজা ছিলে, অতএব রাজার মতো শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াই তোমার একান্ত ধর্ম–যুধ্যস্ব রাজধর্মেণ মা মজ্জয় পিতামহান।
কৃষ্ণের মাধ্যমে যুধিষ্ঠিরের প্রতি অনন্ত উত্তেজনায় সংবাদ পাঠিয়ে কুন্তী এবার কৃষ্ণকে একটা গল্প বলছেন। বলছেন–এই গল্প শুনে ভালটা কী হওয়া উচিত, করণীয়ই বা কী– সেটা তুমি যুধিষ্ঠিরকে বলতে পারবে। এই গল্পটির মধ্যে একটা বিশেষত্ব আছে। কুন্তীর গল্পে চরিত্র দুটি–মা বিদুলা আর তার ছেলে সঞ্জয়, যে সিন্ধুদেশের রাজার কাছে যুদ্ধে হেরে নিরাশ হয়ে শুয়ে ছিল। এখানে বিদুলা ছেলেকে যা বলেছেন, কুন্তীও ঠিক তাই বলতে চান। বিদুলার গল্পে তার ছেলের যে অবস্থা হয়েছে, কুন্তী মনে করেন–তার ছেলেদেরও সেই একই অবস্থা হয়েছে, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের। বস্তুত কড়া কড়া যেসব কথা বিদুলা তার ছেলেকে বলেছেন, সেগুলি বোধহয় মা হিসেবে সোজাসুজি বলা যায় না বলেই কুন্তী বিদুলার জবানে বলছেন যুধিষ্ঠিরকে। এখানে বিদুলার সঙ্গে কুন্তীর এক চুলও তফাত নেই, এমনকী কোনও একপদীভাবে কুন্তীকে বিদুলা-কুন্তী বললেও দোষ হয় না। দোষ হয় না বিদুলার ছেলে সঞ্জয়কেও যুধিষ্ঠির ভেবে নিলে।
বিদুলার গল্পের প্রথম প্রস্তাবে কুন্তী বিদুলার ওরফে নিজেরই পরিচয় দিচ্ছেন। কুন্তী বলছেন–জানো কৃষ্ণ! এই বিদুলা ছিলেন রাজচিহ্নে চিহ্নিতা এক ক্ষত্রিয়া রমণী। যেমন বড় বংশ, তেমনই তার নিজের খ্যাতি। অবিনয়ী মোটেই নয়, কিন্তু ব্যক্তিত্বময়ী, রাগী মহিলাও বটে। রাজার সংসদে দাঁড়িয়ে তার কথা বলার ক্ষমতা ছিল, অন্যদিকে তিনি চরম দীর্ঘদর্শিনী, ভবিষ্যতের করণীয় এবং তার ফল সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন।
সন্দেহ নেই, বিদুলার ব্যক্তিত্ব এবং কর্তৃত্ব খ্যাপন করে কুন্তী জানাতে চাইলেন–বংশ, মর্যাদা এবং দীর্ঘদর্শিতার ব্যাপারে বিদুলার সঙ্গে তার পার্থক্য নেই কোনও৷ অতএব বিদুলার। কথা, তারই কথা। কুন্তী বলেছেন–জানো কৃষ্ণ! সিন্ধুরাজের কাছে হেরে গিয়ে বিদুলার ছেলে হতাশায় শুয়ে ছিল নিজের মনে। বিদুলা সেই পেটের ছেলেকে কী বলেছিলেন জানো? বলেছিলেন- কোথাকার এক কুপুত্তুর এসে জন্মেছে আমার পেটে। যে ছেলে শত্তুরের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে সেই ছেলে হলি তুই। আমার মতো মা তার জন্ম দেয়নি, তোর বাপও তোর জন্ম দেয়নি, তুই কোত্থেকে এসে জুটেছিস আমার কপালেন ময়া ত্বং ন পিত্রা চ জাতঃ কাভ্যাগতো হাসি।
একটু আগে যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে কুন্তী বলেছিলেন, তিনি বাপ-ঠাকুরদার নাম ডোবাচ্ছেন– মা মজ্জয় পিতামহান। এখন বিদুলার মুখ দিয়ে কুন্তী যা বলছেন তাও যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশেই। অতএব এরপর থেকে আমরা আর ‘বিদুলা বললেন’–এমন করে বলব না, বরঞ্চ বিদুলার একাত্মতায় আমরা বলব–বিদুলা-কুন্তী বললেন। যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে বিদুলা-কুন্তীর বক্তব্য–ক্রোধলেশহীন ক্লীব পুরুষকে কেউ গণনার মধ্যে আনে না। এমন করে নিজেকে ছোট কোরো না, এত অল্পে সন্তুষ্ট হয়ো না–মাত্মানং অবমন্যস্ব মৈনমপ্পেন বীভরঃ।
কুন্তী এখানে সেই ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যপাটের পরিবর্তে যুধিষ্ঠিরের চাওয়া পাঁচখানি গ্রামের দিকে অঙ্গুলি সংকেত করছেন। বিদুলারূপী কুন্তী বলছেন–কাপুরুষ ছেলে কোথাকার, দয়া করে একবার গা তোলো, দুর্যোধনের বুদ্ধিতে পরাজিত হয়ে আর নিষ্কর্মার মতো শুয়ে থেকো না, একবার গা তোলো–উত্তিষ্ঠ হে কাপুরুষ মা শেধৈবং পরাজিতঃ। বনবাস থেকেই লোক পাঠিয়ে পাঁচটি মাত্র গ্রাম ভিক্ষে করছ তুমি। আরে মজা নদী যেমন অল্প জলেই ভরে দেওয়া যায়, ইঁদুরের প্রার্থিত অঞ্জলি পূরণ করতে যেমন সামান্যই জিনিস লাগে, তেমনই তোমার মতো সন্তুষ্ট কাপুরুষ অল্পেই সন্তুষ্ট হবে।
পঞ্চ গ্রামের প্রার্থনাতেই কুন্তী বুঝি রেগে গেছেন। ভাবটা এই–বনে বসে বসে শান্তির খবর ছড়াচ্ছ, কেন বাপু তুমি এখনও শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে পারোনি শত্রুর ওপর! গাব গাছের কাঠ যেমন সহজে জ্বলে ওঠে, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ফুলিঙ্গের কণা, তেমনি করে একবারও যদি মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠতে তুমি? তা তো নয়, শুধু তুষের আগুনের মতো গুমিয়ে গুমিয়ে জ্বলছ আর ধোঁয়া ছাড়ছ। ওই ধোঁয়াটাই যুধিষ্ঠিরের শান্তির বাণী। আরে, সারাজীবন ওমনি করে গুমিয়ে গুমিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার থেকে একবার, অন্তত একবার, মুহূর্তের জন্য জ্বলে ওঠাও অনেক ভাল-মুহূর্তং জ্বলিতং শ্রেয়ো ন তু ধূমায়িতং চিরম্।
ভীমকে বিষ খাওয়ানো হল, তবু যুধিষ্ঠির সবাইকে চুপ করে থাকতে বলেছিলেন, কুন্তীও মেনে নিয়েছেন সে-কথা। কিন্তু বারণাবতে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা, রাজ্যের অর্ধেক দিয়ে পাশা খেলার পণে সেটা জিতে নেওয়া, কুলবধূকে রাজসভায় বিবস্ত্র করার চেষ্টা, বারো বছরের বনবাস, এক বছরের অজ্ঞাতবাস, তাও এখন আবার শান্তি কামনা– এইভাবে গুমিয়ে গুমিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বেঁচে থাকা–এটা কুন্তীর সহ্যের বাইরে। তার মত হল–তুমি ক্লীব, তোমার রাজ্যপাট সব গেছে, যশ-খ্যাতি সব গেছে, ভোগ-সুখ সব গেছে, এখন শুধু ধর্মের ধ্বজাটা সামনে রেখে বেঁচে থেকে লাভ কী রে ব্যাটা–ধর্মং পুত্ৰাগতঃ কৃত্বা কিং নিমিত্তং হি জীবসি। হয় তুমি নিজের বীরত্ব দেখাও, নয় মরো উদ্ভাবয়স্ক বীর্যং বা তাং বা গচ্ছ ধ্রুবাং গতিম্। আরে সেরকম সেরকম লোক আছে, যারা রণক্ষেত্রে আসন্ন মৃত্যুর সময়ে মাটিতে পড়তে পড়তেও শত্রুর কোমর জড়িয়ে ধরে পড়ে অর্থাৎ সেই অবস্থাতেও তার উদ্যম নষ্ট হয় না। তো সেইরকম একটা পুরুষকার আত্মস্থ করো তুমি, নইলে সেরকম কাজ যদি কিছুই না করতে পারো তবে তো তুমি পুরুষ নও স্ত্রীও নও, তোমার জন্ম হয়েছে শুধু জনসংখ্যা বাড়াবার জন্য রাশিবর্ধনমাত্রং স নৈব স্ত্রী ন পুনঃ পুমা।
নিজের পেটের ছেলে যুধিষ্ঠির। এই তেরো বছর ধরে শত্রুর ছিদ্র অন্বেষণ করা তার উচিত ছিল। উচিত ছিল দুর্যোধনের ওপর বিরাগগ্রস্ত মন্ত্রী-প্রজাদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা। তারপর এই বনবাসের শেষে একেবারে বাঘের মতো দুর্যোধনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। অথচ যুধিষ্ঠির এসব কিছুই করেননি। কুন্তীর ধৈর্য তাই শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে– হয় মারো, নয় মরো। মায়ের কাছ থেকে এই সমস্ত কঠিন কথার উত্তরে বনবাসক্লিষ্ট যুধিষ্ঠির বিদুলার পুত্রের মতো তো বলতেই পারেন যে, মা! আজ যদি আমরা মরে যাই, তা হলে এই রাজ্য-পাট, ভোগ-সুখ অথবা তোমার নিজের জীবনেরই বা কী মূল্য থাকবে- কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা?
কুন্তী জানেন যুধিষ্ঠিরের মতো নিরুপদ্রব শান্তিকামী ব্যক্তির কাছ থেকে এইরকম একটা মর্মবিদারী মমতা-মাখা প্রতিপ্রশ্ন হতেই পারে। তিনি বলতেই পারেন–বুঝি বা আকরিক লোহা সব এক জায়গায় করে মা তোমার হৃদয়ে গড়ে দিয়েছেন বিধাতা–কৃষ্ণায়সস্যেব চ তে সংহত্য হৃদয়ং কৃতম! নইলে, নিজের ছেলেকে পরের মায়ের মতো এমন করে যুদ্ধে নিয়োগ করো তুমি?
কুন্তী এসব আবেগ-ক্লিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানেন। তিনি জানেন যে, হ্যাঁ, যুদ্ধে গিয়ে ছেলেগুলি আমার মারাও যেতে পারে। কিন্তু তবু এইভাবে দিন দিন হীনবল হয়ে অতি অদ্ভুত এক পর্যায়মরণ বরণ করা ক্ষত্রিয় রমণীর পক্ষে যেমন উপযুক্ত নয়, তেমনই উপযুক্ত নয় ক্ষত্রিয় পুত্রদের পক্ষেও। উৎসাহহীন, নির্বীর্য কতগুলি পুত্ৰ আপন কুক্ষিতে ধারণ করার জন্য কুন্তী লজ্জা বোধ করেন। দিনের পর দিন পরের ওপর নির্ভর করার মধ্যে যে দরিদ্রতা আছে, সেই দরিদ্রতা স্বামী-পুত্রের মৃত্যুর চেয়েও তার কাছে কষ্টকর বেশি–পতিপুত্রবধাদেতৎ পরমং দুঃখমব্রবীৎ। কেন না, সমস্ত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এই পরান্নজীবিতার মধ্যে যে। লজ্জা, সেই লজ্জা ক্ষত্রিয়া বীর রমণীর সয় না। বিদুলার মতো কুন্তী বলতেই পারেন–আমি ছিলাম বিরাট বৃষ্ণিবংশের মেয়ে, বিয়ে হয়েছিল কুরুদের রাজবাড়িতে, স্বামী আমাকে সমস্ত সুখে রেখেছিলেন, স্বামীর রাজ্যে আমি ছিলাম সবকিছুর ওপর–ঈশ্বরী সর্বকল্যাণী ভর্তা পরমপূজিতা। কুন্তী বলতে পারেন–দাস-দাসী, ব্রাহ্মণ-ঋত্বিক, আচার্য-পুরোহিত–আমরা ছিলাম এঁদের আশ্রয়। আর আজ! কেউ আমাদের ভরসা করে না, আমিই অন্যের আশ্রয়ে বেঁচে আছি, এর চাইতে আমার মরণও ছিল ভাল–সান্যমাশ্ৰিত্য জীবন্তী পরিত্যক্ষ্যামি জীবিতম।
পুত্রস্নেহের থেকে কুন্তীর কাছে আজ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অনেক বড়। কারণ যুদ্ধের জন্যই পুত্রের জন্ম, যুদ্ধ-জয়ের মধ্যেই তার চরম সার্থকতা। যুদ্ধে জয় হোক বা মৃত্যু হোক। নিজের, তবু যুদ্ধের মাধ্যমেই ক্ষত্রিয়-পুরুষ হয়ে ওঠে ইন্দ্রের মতো–জয়ন্ বা বধ্যমানো বা প্রাপ্নোতীন্দ্ৰসলোকতাম। বিদুলার মতো এক ক্ষত্রিয়-রমণীর জবানে কথা বলতে বলতে কুন্তী দেখছি আর যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে তার বক্তব্য বিস্তার করছেন না। রাজনীতির মূল উপদেশের সঙ্গে যখন বীরত্ব আর উত্তেজনার সংবাদ পাঠাতে হল পুত্রদের কাছে, তখন এই শেষ মুহূর্তে কুন্তী আর যুধিষ্ঠিরের কথা মনে আনলেন না। বিদুলার গল্প শেষ করেই কুন্তী কৃষ্ণকে বলেছেন-”আমার কথায় তুমি অর্জুনকে একটা খবর শুধু মনে করিয়ে দেবে কৃষ্ণ। সেই ছোট্টবেলার কথা, অর্জুনের তখন কেবলই জন্ম হয়েছে। আমি ছেলে কোলে নিয়ে মেয়েদের মধ্যে বসেছিলাম। সেই সময়ে আকাশবাণী হয়েছিল–এই ছেলে তোমার সমস্ত শত্ৰু হত্যা করে পৃথিবী জয় করবে ভবিষ্যতে, এই ছেলের যশ হবে আকাশ-ছোঁয়া– পুত্ৰস্তে পৃথিবীং জেতা যশশ্চাস্য দিবং স্পৃশেৎ} ভীমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে নাকি বাপের সম্পত্তি উদ্ধার করবে।
কুন্তী বললেন–সেই অর্জুনকে জানিয়ে কৃষ্ণ! যে আশায় ক্ষত্রিয় রমণীরা ছেলে ধরে পেটে, সেই সময় এখন এসে গেছে, ভীমকেও জানিয়ে ওই একই কথা–এত ধনঞ্জয়ো বাচ্যো নিত্যোদযুক্তো বৃকোদরঃ। কুন্তী আবারও তুললেন দ্রৌপদীর সেই অপমানের কথা। বললেন–সেই অপমানের থেকে আর কোনও বড় অপমানের কথা তিনি ভাবতে পারেন না এবং অর্জুনও যেন এই দ্রৌপদীর কথাটা খেয়ালে রাখেন–তং বৈ ক্ৰহি মহাবাহো দ্রৌপদ্যাঃ পদবীং চর।
পাণ্ডব-সহায় কৃষ্ণ পিসি কুন্তীর সমস্ত উত্তেজনার আগুন পোয়াতে পোয়াতে রওনা দিলেন বিরাটনগরের উদ্দেশে, পাণ্ডবরা সেইখানেই রয়েছেন এখন। কৃষ্ণ চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই কৌরবসভায় ‘রিপোর্ট’ চলে এসেছে কুন্তীর বক্তব্য নিয়ে। ভীষ্ম এবং দ্ৰোণ লাগামছাড়া দুর্যোধনকে শাসন করার চেষ্টা করেছেন মনস্বিনী কুন্তীর চরম যুক্তিগুলি স্মরণ করিয়ে দিয়ে। তারা বলেছেন–কুন্তীর কথার মধ্যে উগ্রতা থাকতে পারে, কিন্তু সে কথাগুলি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং ধর্মসম্মত–বাক্যমর্থবদত্যুমুক্তং ধর্মমনুত্তমম্। ভীষ্ম-দ্রোণ দুর্যোধনকে জানালেন যে, মায়ের কথা এবার অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে তার ছেলেরা। কৃষ্ণও সেইভাবে তাদের বোঝাবেন।
এতদিন পাণ্ডবরা যা করেননি, এখন তা করবেনই– এই স্পষ্টতা হঠাৎ করে আসেনি। যে ভাষায়, যে যুক্তিতে কুন্তী আজ পাণ্ডবদের যুদ্ধের জন্য উদ্যোগী হতে বলেছেন, তা একদিনের উত্তেজনা নয়। দিনের পর দিন সহ্য করতে করতে শশুর-কুলের বৃদ্ধ-জনের কাছ থেকে আর যখন কোনও সুবিচারের আশা রইল না, কুন্তী যখন বুঝলেন যে, পাণ্ডবদের জন্য তার ভাশুরের অনুভব মমতাহীন মৌখিকমাত্ৰ, সেইদিন কুন্তী তার সমস্ত সৌজন্য ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চরম দিনের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। নইলে, এতদিন তিনি এত কঠিনভাবে কোনও কথা উচ্চারণ করেননি। কুন্তীর সমস্ত ধৈর্য অত্যন্ত সযৌক্তিকভাবে অতিক্রান্ত হয়েছে বলেই যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়ানোর মধ্যেও এখন ধর্মের সম্মতি এসেছে–উক্তং ধৰ্মমনুত্তমম্।
.
১১.
কৃষ্ণ যখন কৌরব-সভায় শান্তির দূত হয়ে এলেন, তখন তিনি সভায় যাবার আগে একবার কুন্তীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, আবার সভা ব্যর্থ হবার পরেও একবার দেখা করেছিলেন। প্রথমবার যখন কুন্তীর সঙ্গে কৃষ্ণের দেখা হয়, তখন কুন্তী একবার বলেছিলেন–আমার ভাশুরের ছেলেদের এবং আমার ছেলেদের কোনওদিনই আমি আলাদা চোখে দেখিনিন মে বিশেষো জাতু আসী ধার্তরাষ্ট্রে পাণ্ডবৈঃ। এই কথার মধ্যে হয়তো সত্য কিছু নিশ্চয়ই আছে, নইলে দিনের পর দিন বঞ্চনা সহ্য করে কুন্তী এত ধৈর্য ধরলেন কী করে! কিন্তু এই সত্যের চেয়েও আরও গভীর এক বিষণ্ণ সত্য আছে, যার জন্য দুর্যোধনের ব্যাপারে ধৈর্য ধরেছেন কুন্তী। সেই সত্য হয়তো কর্ণ, যাঁকে দুর্যোধন পালনে-পোষণে এবং মন্ত্রণায় এমনই এক পৃথক মর্যাদা দিয়েছেন যা কুন্তীর অপরাধী মনে অন্যতর ধৈর্যের জন্ম দিয়েছে।
দিনের পর দিন অস্থির অহংকারী দুর্যোধনের সঙ্গে পড়ে নিজের একান্ত-জাত সন্তানকে একেবারে অন্যরকম হয়ে যেতে দেখলেন কুন্তী। অস্ত্রশিক্ষার আসরে দুর্যোধন যখন তাকে অঙ্গরাজ্য দান করে রাজার পদবীতে স্থাপন করেছিলেন, তখন দুর্যোধনের ওপর কুন্তীর চেয়ে বেশি খুশি বোধহয় কেউ ছিলেন না। কিন্তু কুন্তীর সেই খুশি একটু একটু করে ভেঙে যেতে থাকল। তিনি দেখলেন, দুর্যোধনের সঙ্গে মিশে মিশে, তার সমস্ত অন্যায়ের অংশভাগী হয়ে কেমন করে তার কন্যাগর্ভের পুত্রটি একেবারে বয়ে গেল। কর্ণ যেদিন উন্মুক্ত রাজসভার মধ্যে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করার আদেশ দিয়েছিলেন দুঃশাসনকে–সে খবর কি কুন্তীর কানে যায়নি? গিয়েছিল। দুর্যোধনের ওপর খুশি থাকার এই বুঝি শেষ দিন, আপন কুক্ষিজাত পুত্রকে ক্ষমা করার পক্ষেও বোধহয় সেই দিনটি ছিল চরম দিন। কৃষ্ণের কাছে কথা বলতে গিয়ে বারংবার যখন দ্রৌপদীর প্রতি কৌরবদের অন্যায়ের প্রসঙ্গ আসছিল, তখন কর্ণকেও কুন্তী সমানভাবে দায়ী করেছেন–দুঃশাসনশ্চ কর্ণশ্চ পুরুষাণ্যভ্যভাষতাম্। পুত্র বলে তার অন্যায় অনুক্ত রাখেননি কুন্তী।
কিন্তু আজ কী হবে? দুর্যোধন শান্তির প্রস্তাব উড়িয়ে দিলেন এক ফুয়ে। যুদ্ধের উদ্যম শুরু হয়ে গেল সশব্দে, সোচ্চারে। বিদুর এসে কুন্তীকে বললেন-তুমি তো জানো, ঝগড়া-ঝাটি এড়িয়ে শান্তি বজায় রাখার ব্যাপারটা আমি কীরকম পছন্দ করি। কিন্তু এত চাঁচাচ্ছি, তবু দুর্যোধন কিছুই শোনে না। ওদিকে ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির, তাঁর ভীমার্জুন, কৃষ্ণ এবং অন্যান্য সহায় শক্তি থাকা সত্ত্বেও দুর্বলের মতো শান্তি-শান্তি করে যাচ্ছেন–কাঙক্ষতে জ্ঞাতি-সৌহার্দা বলবান দুর্বলো যথা। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, তিনি বুড়ো হয়ে গেলেন, তবু তিনি থামবেন না– বয়োবৃদ্ধো ন শাম্যতি। ছেলের কথায় মত্ত হয়ে অন্যায়ের রাস্তা ধরেছেন তিনি, আর এই জ্ঞাতিভেদ সৃষ্টির কাজে বুদ্ধি জুগিয়ে যাচ্ছে জয়দ্ৰথ, কর্ণ, দুঃশাসন আর শকুনিরা।
এই যুদ্ধোদ্যোগের মুহূর্তে বিদুর যখন সমস্ত রাজনীতিটার পারসপেকটিভ বুঝিয়ে দিচ্ছেন কুন্তীকে, ঠিক সেই মুহূর্তে আবারও কর্ণের নাম কুন্তীকে বুঝি শেষবারের মতো উচ্চকিত করে তুলল। বিদুর, ধর্মময় বিদুর বলেছিলেন–যদি ধার্মিক সুজনের প্রতি এত অধর্ম করবে, তবে কোন মানুষটা বিষিয়ে না যাবে–কোন সংজ্জরেৎ? কৃষ্ণের শান্তির কথাতেও যেখানে কাজ হল না, সেখানে কৌরবদের অন্যায়-অধর্মে যে বহু বীরপুরুষই মারা পড়বে, তাতে সন্দেহ কী? এইসব ভেবে ভেবে দিনে রাতে দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হয় না।
বিদুরের যেমন ঘুম হয় না, তেমনই কুন্তীরও ঘুম হয় না। বিদুরের রাজনৈতিক ভাষ্যে কর্ণ যুদ্ধ লাগবার অন্যতম কারণ, আর সে যুদ্ধ যদি লাগে তবে অনেক বীরপুরুষই মারা যাবে–সে ভীমও হতে পারে, অর্জুনও হতে পারে, কর্ণও হতে পারে। এই একটু আগে কৃষ্ণের মাধ্যমে বীর পুত্রদের যিনি যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করেছেন, তিনি ওই ভবিষ্যৎ বীরনাশে এত উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন কেন? হ্যাঁ এই যুদ্ধের দোষ অনেক, কিন্তু যুদ্ধ না করলে সেই চিরকালীন নির্ধনতা, অপমান আর বঞ্চনা। একদিকে নির্ধনতার যন্ত্রণা অন্যদিকে জ্ঞাতিক্ষয়ের মাধ্যমে জয়লাভ–দুইই তার কাছে সমান সমান–অধনস্য মৃতং শ্রেয়ঃ ন হি জ্ঞাতিক্ষয়ো জয়ঃ কুন্তী এসব বোঝেন, এমনকী পাণ্ডব-কৌরবদের এই জ্ঞাতিযুদ্ধে প্রত্যেক সমরনায়কের রাজনৈতিক অবস্থিতিটাও তিনি ভালভাবেই জানেন।
কুন্তীর মতে এই যুদ্ধে ভয়ের কারণ তিন জন পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ এবং কর্ণ। তিনজনই দুর্যোধনের জন্য লড়াই করবেন। তবু এর মধ্যে তার সান্ত্বনা এবং স্থির বিশ্বাস যে, আচার্য দ্রোণ প্রিয় শিষ্যদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাইবেন না। আর পিতামহ ভীষ্মই বা কী করে পাণ্ডবদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্নেহমুক্ত হবেন? আর বাকি রইলেন শুধু কর্ণ। হায়! কুন্তী কীভাবে বোঝাবেন নিজেকে। কৌরব পক্ষে এই কর্ণই হলেন একমাত্র ব্যক্তি, কুন্তীর মতে যার ভবিষ্যতের দৃষ্টি নেই কোনও। দুর্যোধনের পাল্লায় পড়ে মোহের বশে কেবলই সে কতগুলি অন্যায় করে যাচ্ছে, পাণ্ডবদের তো সে চোখেই দেখতে পারে না–মোহানুবর্তী সততং পাপো দ্বেষ্টি চ পাণ্ডবান্।
মুশকিল হল, যত অনর্থই ঘটাক এই কর্ণ, তার শক্তি এবং ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কুন্তী ভাবেন–ওই অসামান্য শক্তি নিয়ে কর্ণ যে শুধু তার অন্য ছেলেগুলির বিপদ ঘটাতেই ব্যস্ত রইল–এই মর্মান্তিক বাস্তব তাঁকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিল–তন্মে দহতি সম্প্রতি। আজ যখন এই মুহূর্তে কৌরব আর পাণ্ডবদের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল, তখন দুর্ভাবনায় হতাশায় হঠাই ঠিক করে বসলেন–যাব আমি। ঠিক যাব। কন্যা-জননীর লজ্জা ত্যাগ করে আমার জ্যেষ্ঠপুত্রের কাছে গিয়ে জানাব যথাযথ সব কথা। জানাব–কেমন করে দুর্বাসার কাছে মন্ত্র পেয়ে কুন্তিভোজের ঘরে বসেই আহ্বান করেছিলাম তার পিতাকে। জানাব–একই সঙ্গে আমার কন্যাত্ব এবং স্ত্রীত্ব–এই পরস্পরবিরোধী আবেগ কীরকম ব্যাকুল করে তুলেছিল আমাকে স্ত্রীভাবাদ বালবাচ্চ চিন্তয়ন্তী পুনঃ পুনঃ। একদিকে পিতার মর্যাদা রক্ষা অন্যদিকে কৌতূহল আর অজ্ঞানতার বশে সূর্যের আহ্বান–কুন্তী ঠিক করলেন–এক এক করে সব কর্ণকে জানাব আমি। কন্যাবস্থায় হলেও সে আমার ছেলে, আমার ভাল কথাটা কি সে শুনবে না, ভাইদের ভালটা কি সে বুঝবে না–কস্মান্ন কুর্যা বচনং পশ্যন্ ভ্রাতৃহিতং তথা। কুন্তী ঠিক করলেন–আজ আমি কর্ণের কাছে গিয়ে সব কথা বলব, তারপর চেষ্টা করব তার মন যাতে পাণ্ডবদের দিকে ফিরে আসে–আশংসে ত্বদ্য কর্ণস্য মনোহহং পাণ্ডবান্ প্রতি।
কুন্তী রওনা দিলেন। তিনি জানেন এই সময়ে কর্ণ গঙ্গার তীরে পূর্বমুখ হয়ে বসে থাকেন। জপ করেন বেদমন্ত্র। দ্বিপ্রহর কাল অতিক্রান্ত বটে, কিন্তু সূর্যের তাপ প্রচণ্ড রোদে কুন্তীর শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে। সূর্য কি শাস্তির মতো কোনও কিরণ বিকিরণ করছেন আজ। ভাগীরথীর তীরে এসে কুন্তী দেখলেন–পুব দিকে মুখ করে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তপস্যায় বসে আছেন কর্ণ। তার মুখ দিয়ে উদগীর্ণ হচ্ছে বেদমন্ত্রের নিস্বন–গঙ্গাতীরে পৃথাশ্ৰেীষীদ বেদাধ্যয়ন-নিস্বন। পশ্চিম দিক থেকে অলসগমনে আসা তাপাতা কুন্তীকে কর্ণ দেখতে পাননি। পুত্রের জপ-ধ্যান-বেদমন্ত্র–কিছুর মধ্যেই মায়ের সহজ ভাব নিয়ে নিজেকে ঘোষণা করতে পারলেন না কুন্তী। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। সূর্যাতপে তপ্ত হয়ে নিজের চারদিকে ঘনিয়ে নিলেন আপন উত্তরীয়ের ছায়া, হয়তো প্রথম স্বামীর কাছে লজ্জায়। দেখে মনে হল পদ্মের মালা যেন শুকিয়ে যাচ্ছে–পদ্মমালেব শুষ্যতী।
কর্ণের জপ-ধ্যান শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে গেল। পুব দিক থেকে কর্ণ এবার দৃষ্টি সরিয়ে আনবেন পশ্চিম আকাশে। বিদায় দেবেন প্রায় অস্তগামী সূর্যকে। এই দিক বদলের মুহূর্তেই চোখে পড়ে গেলেন কুন্তী। এই নির্জন নদীতীরে হঠাৎ এই প্রৌঢ়া মহিলাকে একলা দেখেই হাত জোড় করে এগিয়ে এলেন কর্ণ। কতবার তিনি এঁকে দেখেছেন দূর থেকে। অভিমানী বীর কর্ণ সৌজন্যে আনম্র হয়ে সস্মিত ভাষে নিজের পরিচয় দিলেন–আমি কর্ণ, ‘অধিরথসূতপুত্র রাধাগর্ভজাত’–রাধেয়োহহ আধিরথিঃ কর্ণমভিবাদয়ে।
কুন্তীর মুশকিল হল–তিনি জানতেন না যে, কর্ণ সব ব্যাপারটাই জানেন। যে পুত্রের জন্মের বৃত্তান্তে কালিমা থাকে, সে নিজের গবেষণাতেই প্রথমত নিজের পরিচয় জানবার চেষ্টা করে। লোকের কথায় আরওই সে জেনে যায় কে সে, কোথা থেকে এসেছে, বিশেষত এখানে এই খানিক আগেই স্বয়ং কৃষ্ণ কর্ণকে একা রথে উঠিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন অন্যত্র। কৃষ্ণ তাকে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন–দেখো ভাই, তুমি কুন্তীর ছেলে, অতএব চলে এসো পাণ্ডবের দিকে, ঝামেলা মিটে যাবে, দুর্যোধন ট্যাফো করতে পারবে না। কর্ণ রাজি হননি–সে অন্য কথা, কিন্তু ভাইপো কৃষ্ণ যেখানে পিসি কুন্তীর কন্যাগর্ভের কথা জানে, সেখানে কর্ণ সেটা জানতেন না, তা আমরা ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না। তা ছাড়া যদি আগে নাও জেনে থাকেন, তা হলেও অন্তত কুন্তী যখন তার কাছে এসেছেন, তার আগে তো তিনি কৃষ্ণের মুখেই সব শুনে নিয়েছেন।
এই নিরিখে দেখতে গেলে বলতেই হবে যে, কর্ণের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে কুন্তীর যে সলজ্জ সংশয় ছিল, কর্ণের দিক থেকে তা ছিল না। ফলত প্রথম অভিবাদনের মুখেই কর্ণ তার সারা জীবনের কলঙ্ক-অভিমান, একত্রিত করে দাঁত শক্ত করে নিজের পরিচয় দিয়েছেন–আমি ‘অধিরথসূতপুত্র রাধাগর্ভজাত’–রাধেয়োহহম আধিরথিঃ।
সেকালের অভিবাদনে এইরকমই নিয়ম ছিল। অভিবাদনের সময় নিজের নাম বলতে হত, অপরিচিত হলে কখনও বা পরিচয়ও দিতে হত। অপর পক্ষ সম্মানে বা বয়সে বড় হলে অভিবাদিত ব্যক্তি নাম ধরেই আশীর্বাদ করতেন। কিন্তু কর্ণ, হয়তো ইচ্ছে করেই কুন্তীর মনে জ্বালা ধরানোর জন্য নিজের নাম বলার আগে নিজের পিতৃ-মাতৃ পরিচয় বিন্যাস করে সগর্বে নিজের নাম বলেছেন–আমি অধিরথসূতপুত্র রাধাগর্ভজাত।
‘গর্ভ’ কথাটা শুনেই কুন্তীর মনে অন্য এক প্রতিক্রিয়া হল। সেই যেদিন পুত্রকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে কুন্তী বলেছিলেন–যিনি তোমায় পালন করবেন সেই ভাগ্যবতী রমণী অন্য কেউ–সেই রমণী আজ শুধু পুত্র পালনের গুণে কর্ণের কাছে গর্ভধারণের অধিকার লাভ করছে। আমি রাধেয়’–কথাটা শোনামাত্রই কুন্তীর মুখে তাই তীব্র প্রতিবাদ ঝরে পড়েছে–না না, বাছা তুমি মোটেই রাধার ছেলে নও। তুমি আমার ছেলে, তুমি কুন্তীর ছেলে, সূত অধিরথ মোটেই তোমার পিতা নন-কৌন্তেয় ত্বং ন রাধেয়ো ন তবাধিরথঃ পিতা। সারথির ঘরে তোমার জন্ম নয়। আমি যখন বাপের বাড়িতেই ছিলাম তখন কন্যা অবস্থায় আমারই পেটে জন্মেছিলে তুমি। তুমি আমার ছেলে, তুমি পার্থ। স্বয়ং স্বপ্রকাশ সূর্যদেব তোমার বাবা।
মহাভারতের সামান্য সংলাপকে কেন্দ্র করে যে কবি কর্ণের সারা জীবনের অভিমান এবং কুন্তীর সারা জীবনের পুত্রস্নেহ একত্র মন্থন করে ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ রচনা করেছিলেন, তাঁর পক্ষে মনস্তত্ত্বের অপূর্ব প্রসার ঘটিয়ে কর্ণকে সত্য, নিষ্ঠা এবং নীতিপরায়ণতার একান্ত ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করাটা অসম্ভব ছিল না। অসম্ভব ছিল না কর্ণকে বঞ্চনা এবং হতাশার তিলক পরিয়ে তাকে মহান করে দিতে। বিংশ শতাব্দীতে বসে মহাকাব্যের এক অন্যতম প্রতিনায়ককে জীবন-যন্ত্রণার চরমে পৌঁছে দেওয়া এবং তাকে মর্যাদার তত্ত্বে বিভূষিত করাটা নিঃসন্দেহে অন্য এক মাত্রা দিয়েছে। তবে মহাকাব্যের কবির এই দায় ছিল না। বিশাল মহাকাব্যের পরিসরে যে মানুষ নিজেই নিজের কাছে করুণার পাত্র, সেই কুন্তীকে দিয়ে তিনি আর কীই বা করাতে পারতেন এই মুহূর্তে? পুত্রের মনোযন্ত্রণার মূল্যে তিনি জননীর মনোযন্ত্রণা লঘু করে দেখেননি। বিংশ শতাব্দীতে কর্ণের মনস্তত্ত্বের জটিল আবর্ত তাকে শেষ পর্যন্ত মহান করে তুললেও মহাকাব্যের কবির কাছে সরলতার দায় ছিল বেশি।
কুন্তী বলেছিলেন–আমি কর্ণকে সব খুলে বলব। বলব–আমার নিজের চরিত্রের কথা ছেড়েই দাও, আমার পালক পিতার চরিত্র রক্ষার জন্য আমাকে এই কাজ করতে হয়েছে– দোষং পরিহরী চ পিতুশ্চরিত্ররক্ষিণী। যে রমণী বালিকা অবস্থায় আপন পিতার স্নেহে বঞ্চিত হয়ে পালক পিতার ইচ্ছা অনুসারে মানুষ হয়েছেন, পালক পিতার সুনাম রক্ষার জন্য যাঁকে নিজের সন্তান ভাসিয়ে দিতে হয়েছে জলে, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে যাকে প্রজনন শক্তি-রহিত একটি পতি বরণ করতে হয়েছে, উপরন্তু শ্বশুরবাড়িতে যাঁর নিজের স্থিতিই অত্যন্ত শঙ্কাজনক, সেই অভাগা রমণী নিজেই নিজের কাছে এত বড় করুণার পাত্র যে, তার পক্ষে আপন কন্যাবস্থার পুত্র নিয়ে জীবনে টিকে থাকা কঠিন ছিল।
আজ সেই কন্যাবস্থার পুত্রের সঙ্গে সংলাপী কুন্তী প্রথমেই ধাক্কা খেলেন। যে গর্ভ ধারণের জন্য এতকালের এত মানসিক চাপ–সেই গর্ভ ধারণের যন্ত্রণাটাই অস্বীকার করছে তার পুত্র। হ্যাঁ, বালিকার প্রগৰ্ভতায় পুত্রের প্রতি সুবিচার তিনি করেননি ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ছেলে তার গর্ভধারিণীর ভূমিকাটাই অস্বীকার করবে? জননীর মুখের ওপর ছেলে বলবে–না তুমি জননী নও! নিজের গর্ভধারিণীর ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করার জন্য অপ্রস্তুতের মতো আগে বলতে হয়েছে–না-না তুমি রাধার ছেলে নও, তুমি আমার সবার বড় ছেলে, তুমি রাধেয় নও, তুমি পার্থ!
সব গুলিয়ে গেল। ভেবেছিলেন–গুছিয়ে গুছিয়ে দুর্বাসার কথা বলব, সূর্যদেবের কথা বলব, নিজের সমস্যার কথা বলব–কিছুই সেভাবে বলা হল না কুন্তীর, সব গুলিয়ে গেল। এই অবস্থায় নিজেকে সপ্রতিভ দেখানোর জন্য কুন্তীকে নিজের বিশাল জীবনসমস্যার কথা খুব তাড়াতাড়ি বলে ফেলতে হল। কুন্তী বললেন–আলোকদাতা সূর্যদেব আমারই কুক্ষিতে তোমার জন্ম দিয়েছিলেন। এইরকমই সোনার বর্ম, কানের দুল তোমার জন্ম থেকে। আমার বাবা কুন্তিভোজের অন্দর মহলে তোমার জন্ম দিয়েছিলাম আমি।
কুন্তী খুব তাড়াতাড়ি-কর্ণের দিক থেকে কোনও প্রতিবাদ, কোনও বিরূপতার আগেই বলে ফেললেন–সেই তুমি আমার ছেলে হয়েও নিজের মায়ের পেটের ভাইদের চিনতে পারছ না। উলটে কোন এক অজানা মোহে ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের তুমি সেবা করে যাচ্ছ। এই কি ধর্ম বাছা? যে পৃথিবী, যে ধন-সম্পদ অর্জুন জিতে এনেছিল অসাধু লোকেরা সেসব লুটেপুটে নিল, এখন তুমি বাছা আবার সেসব জুটিয়ে এনে নিজেই সব ভোগ করো। লোকে দেখুক–কর্ণ আর অর্জুন এক জায়গায় জুটলে কী হয়, কেমন মাথা নুয়ে যায় সবার সন্নমস্তামসাধবঃ। কুন্তী ভবিষ্যতের এক অসম্ভবের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে সোৎসাহে বলে উঠলেন–কর্ণ আর অর্জুন এক জায়গায় হলে, ব্যাপারটা দাঁড়াবে ঠিক বলরাম আর কৃষ্ণের মতো। তোমাদের দুজনের সংহত শক্তি রুখবে, এমন বুকের পাটা কার বাছা? পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তোমার শোভা হবে যেন দেবতাদের মধ্যে ব্রহ্মা। তুমি বাপু আর সারথির ছেলে কথাটা মুখেই এনো নাসূতপুত্রেতি মা শব্দঃ পার্থত্বমসি বীর্যবান–তুমি আমার ছেলে, তুমি পার্থ।
প্রায় প্রগলভ জননীর ভাষণে কর্ণ একটুও টললেন না। তুমি কুন্তী অর্জুনজননী’– এত সব কবিতার পরিণত শ্লেষ মহাভারতে নেই। তবে উতোর-চাপান এখানেও কিছু কম ছিল না। কর্ণ কুন্তীকে সম্বোধন করলেন মায়ের ডাকে নয়, বললেন–’ক্ষত্রিয়ে’। কথাটার মধ্যে সাংঘাতিক সত্য আছে, পরে আসব সে-কথায়। কর্ণ বললেন–আমাকে জন্মকালেই বিসর্জন দিয়ে যে অন্যায়টি আপনি করেছেন তাতে আর অন্য কোন শত্রু আপনার চেয়ে আমার বেশি অপকার করবে–ত্বৎকৃতে কিনু পাপীয়ঃ শত্ৰুঃ কুর্যান্ মমাহিতম। যে অবস্থায় আমি ক্ষত্রিয়ের সংস্কার লাভ করে মেজাজে থাকতে পারতাম, সেই অবস্থায় আপনি মায়ের কাজ এতটুকু করেননি, এখন নিজের স্বার্থে আপনি আমাকে খুব ছেলে-ছেলে করছেন–সা মাং সংবোধয়সদ্য কেবলাত্মহিতৈষিণী।
কুন্তী এই গালাগালি হজম করে যাচ্ছেন, একটি কথাও তিনি বলছেন না। আর কথাগুলি তো ঠিকই। কর্ণ বললেন–আজ যদি আমি সব ছেড়ে পাণ্ডবদের পক্ষে যাই, লোকে আমাকে ভিতু বলবে না? কোনওদিন আমার ভাই বলে কেউ ছিল না, আজ যদি এই যুদ্ধকালে হঠাৎ পাণ্ডবদের আমি ভাই বলে আবিষ্কার করি, তবে ক্ষত্রিয়জনেরা আমাকে কী বলবে–অভ্রাতা বিদিতঃ পূর্বং যুদ্ধকালে প্রকাশিতঃ। কর্ণ দুর্যোধনের অনেক গুণ-গান করলেন। কত সম্মান তিনি দিয়েছেন, কত ভোগসুখ–সবই একে একে বললেন। আর বলতেই বা হবে কেন কুন্তী সেসব জানেন, তিনি তাতে সুখীও ছিলেন। পুত্রের প্রতি মাতার কর্তব্য করা হয়নি বলেই, কর্ণের প্রতি দুর্যোধনের প্রশ্রয়-গৌরবে তিনি সুখীই ছিলেন। কিন্তু আজ কী হবে? যুদ্ধ যে লাগবেই, তিনি তা চানও।
ক্ষত্রিয়া রমণীর এই কঠিন হৃদয় কর্ণ জানেন। তিনি বলেছেন–যুধিষ্ঠিরের বাহিনীর মধ্যে অন্য চার ভাইয়ের সঙ্গে আমার যুদ্ধ হবে না, আমার যুদ্ধ শুধু অর্জুনের সঙ্গে। হয় সে মরবে আমার হাতে, নয় আমি তার হাতে। তবে আপনার তাতে ক্ষতি নেই কোনও। আপনি পঞ্চপুত্রের জননী, তাই থাকবেন আপনি, আপনি নিরর্জুনা হলে কর্ণ আপনার থাকবে, আর আপনি অকর্ণা হলে অর্জুন আপনার থাকবে নিরর্জুনা সকর্ণা বা সার্জুনা বা হতে ময়ি।
কুন্তী শুনলেন, কর্ণের সব কথা শুনলেন, অন্যায়-ধিক্কার সব শুনে জননীর দায় প্রত্যাখ্যান–তাও শুনলেন। ক্ষত্রিয় পুত্রদের জননী হিসেবে কুন্তী বুঝলেন কর্ণকে তার শেষ বক্তব্য থেকে নড়ানো যাবে না। ভবিষ্যতের পুত্রশোক তার হৃদয় গ্রাস করল। তিনি আস্তে আস্তে কর্ণের কাছে এলেন। কর্তব্যে স্থির অটল, অনড় কর্ণকে তিনি সারাজীবনের প্রৌঢ় বাসনায় আলিঙ্গন করলেন–উবাচ পুত্রমাশ্লিষ্য কর্ণং ধৈর্যাদকম্পন। হয়তো আর হবে না। সেই বালিকা বয়সে পুত্রের জন্মলগ্নে জননীর যে স্নেহ প্রথম ক্ষরিত হয়েছিল, নিরুপায়তার কারণে জলে ভাসিয়ে দিতে হয়েছিল বলে যে শিশুপুত্রটিকে তিনি সজোরে কোলে চেপে ধরেছিলেন, আজ এতদিন পরে সেই ছেলেকে আবারও জড়িয়ে ধরলেন কুন্তী। বুঝলেন–জীবনের ধারায় জননীর কর্তব্য-বন্ধন মুক্ত করে একবার পুত্রকে ভাসতে দিলে সে ভেসেই চলে, সারাজীবন আর তাকে ধরা যায় না, ধরতে চাইলেও, না। কুন্তী তাই জড়িয়ে ধরলেন কর্ণকে। আর দেখতে পাই কি না পাই। হয় অর্জুন, নয় কর্ণ–একজন তো যাবেই, যদি কর্ণ যায় তবে সামনা-সামনি একতম পুত্রের সঙ্গে এই শেষ দেখা। কুন্তী কর্ণকে জড়িয়ে ধরলেন দ্বিতীয়বার।
ক্ষত্রিয় পুত্র যেমন তার সত্য থেকে চ্যুত হল না, ক্ষত্রিয়া রমণীও তেমনই তার ভবিষ্যৎ ভাবনা থেকে সরলেন না। কর্ণকে বললেন–কৌরবদের বিনাশ যাতে হয়, তুমি সেই খেয়ালটা রেখো, বাছা। আমি এত করে তোমায় বোঝালাম, কিন্তু কিছুই হল না। কপালে যা আছে হবে–দৈবন্তু বলবত্তরম্। অর্জুন ছাড়া তার অন্য চার ছেলের দুর্বলতা কুন্তী জানেন, অতএব যুদ্ধকালে এই চারজনের যাতে ক্ষতি না হয়, সে-কথা তিনি আবারও মনে করিয়ে দিলেন কর্ণকে; কেন না, কর্ণও কথা দিয়েছিলেন তিনি অর্জুন ছাড়া আর কারও ক্ষতি করবেন না। মহাভারতের কর্ণ-কুন্তী সংবাদ শেষ হল অদ্ভুত সৌজন্য-বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। কুন্তী বললেন–মঙ্গল হোক তোমার বাছা, সুস্থ থাকুক তোমার শরীর। উত্তরে কর্ণও বললেন একই কথা। যে আবেগ সারাজীবন ধরে কুন্তী জমা করে রেখেছিলেন কর্ণের জন্য, তা উপযুক্তভাবে মুক্ত হল না পাত্রের কাঠিন্যে। কুন্তী যখন জড়িয়ে ধরলেন কর্ণকে তখন ব্যাস তাঁর বিশেষণ দিয়েছেন ‘অকম্পন। হয়তো কর্ণের এই বিশেষণ তাঁর অনড় অকম্প স্বভাবের জন্যই।
.
১২.
একটা কথা করজোড়ে নিবেদন করি। আমি আগে বারংবার বলেছি কুন্তী তার শৈশব থেকেই এক কঠিন মনস্তত্ত্বের শিকার। তার মধ্যে কন্যা অবস্থায় এক শিশুপুত্রকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে এবং উপযুপরি স্বামীর কাছে, পুত্রদের কাছে সেই পুত্রের জন্মকথা চেপে গিয়ে কুন্তীর মনের মধ্যে এমন এক জটিল আবর্ত তৈরি হয়েছিল যা তাঁর মনকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলেছে। স্ত্রীলোকের জীবন-আরম্ভ যাকে বলে, সেই আরম্ভের পূর্বেও কুন্তীর এই যে বিধিবহির্ভূত পুত্রলাভ, সেই পুত্র তার জীবনের প্রথম ভাগ, মধ্যভাগ এবং শেষ ভাগেও অন্তর্দাহ তৈরি করে গেছে।
আমরা কর্ণকুন্তীর সংলাপে এখনই যে পর্যায়টুকু শেষ করলাম, এটাকে মধ্যভাগের শেষ পর্যায় বলা যায়। বলতে পারেন-কর্ণের কথা স্বামীকে তিনি বলেননি, কিন্তু বশংবদ পুত্রদের তিনি বলতেই পারতেন। আমরা বলি–কুন্তী এটাকে নিজের কলঙ্ক বলে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ফলে স্বামীকে তিনি বলেননি আর স্বামীর মৃত্যুর পরেও এমন কিছু ঘটেনি যাতে করে লজ্জা ত্যাগ করে ছেলেদের সে-কথা বলা যায়। এমন কিছু বলতে আপনারা কুন্তীর দিদিশাশুড়ি সত্যবতীর কথা স্মরণ করতে পারেন। কন্যা অবস্থায় তাঁর পুত্র হলেন স্বয়ং মহামুনি ব্যাস। কিন্তু মৎস্যগন্ধা সত্যবতী শান্তনুকে ব্যাসের কথা কিছুই বলেননি, ছেলেদেরও বলেননি। কিন্তু কুরুবংশ যখন লোপ হয়ে যেতে বসল, তখনই কেবল সত্যবতী পুত্ৰকল্প ভীষ্মের কাছে ব্যাসের কথা প্রস্তাব করেন কুরুবংশের রক্ষাকল্পে। তাই বলছি, তেমন কিছু হয়নি যে, কুন্তীকে বলতে হবে। বিশেষত এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিটাই হল চেপে যাওয়া।
বলা যেতে পারে, এখন এই বিশাল ভারত-যুদ্ধের প্রাক মুহূর্তে কুন্তী ছেলেদের কাছে কর্ণের কথা বলতে পারতেন; পাণ্ডব-কৌরবদের যুদ্ধটাই তা হলে লাগত না, হত না অজস্র লোকয়। কারণ পরের ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারব যে, মহামতি যুধিষ্ঠির মায়ের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন–আগে যদি জানতাম কর্ণ আমাদের বড় ভাই, তা হলে লোকক্ষয়ী যুদ্ধ হত না।–আলবত জানি, যুধিষ্ঠির যা চাইতেন কুন্তী তা চাইতেন না। এখানে সেই ক্ষত্রিয়া রমণীর বিচারটুকু মাথায় রাখতে হবে।
মনে রাখা দরকার, রবীন্দ্রনাথের কর্ণ-কুন্তী সংবাদ বাঙালির স্নেহ, মায়া এবং মমতার মৃদুতায় তৈরি। এই চিত্র-কবিতায় কর্ণ যতবার কুন্তীকে মা-মা করে ডেকেছেন, মূল মহাভারতে তা একবারও ডাকেননি। কর্ণ কুন্তীকে চিনতেন বলেই তাকে প্রথম সম্বোধন করেছেন–”ক্ষত্রিয়া বলে। অন্যত্র আরও কৃত্রিমভাবে–”যশস্বিনী’ বলে, “আপনি’ বলে। বস্তুত ক্ষত্রিয়া রমণীর হৃদয় বাংলার শ্যাম-শীতল নদী আর অন্নের মৃদুতা দিয়ে গড়া নয়। যতদিন কর্ণ দুর্যোধনের ভোগচ্ছায়ায় সুখী ছিলেন, কুন্তীরও ততদিন কিছু বলার ছিল না, কেন না ছেলের এই সুখ তার অভিপ্রেত ছিল। কিন্তু যেদিন থেকে তিনি বুঝলেন তারই ছেলের শক্তিকে উপজীব্য করে দুর্যোধনেরা তার অন্য ছেলেদের বঞ্চিত করছে, সেদিন থেকেই তার হৃদয়ে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। বিশেষত কুরুসভায় দ্রৌপদীর চরম অপমানের পর কর্ণকে নামত দায়ী করতেও কুন্তীর বাধেনি। ক্ষত্রিয়া রমণী নিজ পুত্রের অন্যায় সহ্য করেনা।
শেষ কথাটা হল–শ্বশুরকুলের বৃদ্ধ-জনেরা তার প্রতি সুবিচার করেননি। পাণ্ডু মারা যাবার পর রাজরানির সম্মান তার দূরে থাক, কুরুবাড়িতে তাকে থাকতে হয়েছে ভিখারির মতো। উত্তরাধিকার সূত্রে পুত্রদের প্রাপ্য ভাগও তিনি পাননি। উপরন্তু জুটেছে অপমান। নিজের অপমান, পুত্রবধূর অপমান। এরপরে বিদুলার জবানিতে, পুত্রদের যুদ্ধে উত্তেজিত করেছেন কুন্তী। যে রমণী সারা জীবনের অপমানের শোধ নেওয়ার জন্য প্রিয় পুত্রদের যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতে পারেন, তিনি এখন হঠাৎ কর্ণকে জ্যেষ্ঠ পুত্র বলে ঘোষণা করে যুদ্ধের আগুনে ছাই চাপা দেবেন, এমন মৃদুলা রমণী কুন্তী নন। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন– কর্ণকে বড় ভাই জানলে যুদ্ধ করতাম না। আর কুন্তী বলেছিলেন–বাবা তুমিও পাণ্ডবপক্ষে এসো, কৌরবদের বিনাশ করো, যুদ্ধ করো।
অর্থাৎ যুদ্ধ করতেই হবে, ক্ষত্রিয়া রমণীর এই কাঠিন্যের মধ্যে যথাসম্ভব করুণার মতো যেটা কর্ণের জন্য করা সম্ভব, কুন্তী তাই করেছেন। আসলে তার ঈর্ষা হচ্ছিল–আরে আমারই ছেলে ওটা, তার কাঁধে বন্দুক রেখে তোরা যুদ্ধ করবি? কর্ণ নিজেই কুন্তীকে বলেছেন–আমাকে নৌকোর মতো আশ্রয় করে কৌরবরা এই যুদ্ধসাগর পার হবেন–ময়া প্লবেন সংগ্রামং তিতীর্ষন্তি দুরত্যয়। কুন্তীর ঈর্ষা–তোরা যুদ্ধ করবি, কর না, কিন্তু আমার ছেলেটাকে নৌকো ঠাউরেছিস কেন? তুই বাবা চলে আয় তো এই ধারে, দেখি কার ঘাড়ে ক’টা মাথা, দেখুক চেয়ে চেয়ে কৌরব-ঠাকুরেরা–অদ্য পশ্যন্তু কুরবঃ কর্ণার্জুনসমাগম।
ঠিক এই বুদ্ধি নিয়েই কুন্তী গিয়েছিলেন কর্ণের কাছে। অন্তরের এই মুখ্য ধারার তলায় তলায় ছিল সারাজীবনের পাপবোধ, পুত্রের প্রতি মায়ের কর্তব্য পালন করার দায় এবং অন্য মানসিক জটিলতা। কিন্তু যে মুহূর্তে কর্ণ তাঁকে হাঁকিয়ে দিয়েছেন, সেই মুহূর্তেই তিনি পুনরায় কঠিন সেই ক্ষত্রিয়া রমণী। অন্তরের স্নেহধারা বয়ে চলল অন্তরের পথেই। সম্পূর্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকাল ধরে একবারের তরেও কুন্তীর দিকে নেত্রপাত করেননি মহাভারতের কবি। শুধু যুদ্ধ, যুদ্ধ এবং যুদ্ধ। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য–সব রথী-মহারথীরা যুদ্ধভূমিতে শয্যা গ্রহণ করছেন। কুন্তীর সম্বন্ধে কথাটি নেই কবির মুখে। হয়তো অন্তরালে বসে বসে এই বিভ্রান্ত জননী নক্ষত্রের আলোকে ঘোর যুদ্ধফল পাঠ করছিলেন–একজন তো যাবেই, হয় কর্ণ, নয় অর্জুন। মহাভারতের কবি যে মুহূর্তে আবারও তার চিত্রপটে কুন্তীর ছবি আঁকলেন, সেই কুন্তীর সঙ্গে যুদ্ধপূর্ব কুন্তীর কোথায় যেন এক গভীর যোগসূত্র আছে।
যুদ্ধের আগে প্রথম পুত্র কর্ণকে ফিরিয়ে নিতে এসেছিলেন কুন্তী। কর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আর যুদ্ধের পরে আবারও যখন আমরা কুন্তীর দেখা পেলাম, তখন কর্ণ মারা গেছেন। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলেছিল মাত্র আঠারো দিন। কুন্তী যখন কর্ণের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখন যুদ্ধের উদ্যোগ চলছে। অর্থাৎ আঠারো দিন নাই হোক, মাত্র কুড়ি-বাইশ দিন আগে যে পুত্রের সঙ্গে দেখা করে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরেছিলেন কুন্তী, এখন সে মারা গেছে। কুন্তীকে আমরা যুদ্ধজয়ী পাণ্ডবপক্ষের পুত্ৰগর্বিণী রাজমাতার মতো দেখতে পেলাম না। দেখলাম বিজিত কৌরবপক্ষের স্বামীহারা, পুত্রহারা হাজারো রমণীদের সঙ্গে একাকার, বিষণ্ণা, হাহাকারে সমদুঃখিত।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যতখানি রোমাঞ্চকর ছিল, যুদ্ধোত্তর কুরুক্ষেত্র ছিল ততখানিই করুণ। এমন কেউ ছিল না, যার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব একজনও মারা যায়নি। যুদ্ধ জয় করে পঞ্চপাণ্ডব বেঁচেছিলেন বটে, তবে তারাও পুত্র হারিয়েছেন, আত্মীয়-কুটুম্ব অনেককেই হারিয়েছেন। আরও যা হারিয়েছেন তা তখনও জানতেন না। যুদ্ধশেষের পর যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে প্রথম গান্ধারীর কাছে গেছেন, কারণ তাঁর একটি সন্তানও বেঁচে নেই। তা ছাড়া দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে’–সেই নিয়মে ভবিষ্যতের রাজা যুধিষ্ঠির আপন কর্তব্য পালন করে তারপর এসেছেন মায়ের কাছে। দ্রৌপদীও রয়েছেন সেখানেই।
ছেলেরা পাঁচ পাণ্ডবভাইরা মায়ের কাছে এলেন–শুধু এইটুকু বলেই মহাভারতের কবি তুষ্ট হলেন না, বললেন–মাতরং বীরমাতরম–শুধু মায়ের কাছেই নয়, বীরমাতার কাছে। মনে পড়ে কুন্তীর উত্তেজনা–যে সময়ের জন্য ক্ষত্রিয় কামিনীরা সন্তান পেটে ধরে, অর্জুন–সেই সময় এখন এসে গেছে। ব্যাসকে তাই লিখতে হল–সংগ্রামজয়ী বীরপুত্রের জননীর কাছে ফিরে এল তার পুত্রেরা–মাতরং বীরমাতরম। কতক্ষণ ধরে কুন্তী চেয়ে থাকলেন পুত্রদের মুখের দিকে, কতক্ষণ? নিশ্চয়ই মনে হল–আরও একজন যদি থাকত। প্রিয়পুত্রেরা যুদ্ধ করতে গিয়ে কত কষ্ট পেয়েছে, এই যন্ত্রণা যুদ্ধ জয়ের থেকেও এখন পীড়া। দিতে থাকল কুন্তীকে। যুদ্ধজয়ের অন্তিম মুহূর্তে কঠিনা ক্ষত্রিয়া রমণী পরিণত হয়েছেন সাধারণী জননীতে।
আনন্দের পরিবর্তে কুন্তীর চোখ ভরে জল এল। এক ছেলে মারা গেছে–সে দুঃখ কেঁদে জানাবারও উপায় নেই তার। কাপড়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন কুন্তী–বাষ্পমাহারয়দ্দেবী বস্ত্ৰেণাবৃত্য বৈ মুখ। প্রিয় পুত্রদের প্রত্যেকের ক্ষতস্থানে বারবার হাত দিয়ে জননীর স্নেহ-প্রলেপ বুলিয়ে দিলেন তিনি। জ্যেষ্ঠ-পুত্রের শোক ভুলতে চাইলেন জীবিতদের গায়ে হাত বুলিয়ে। স্বামীদের দেখে দ্রৌপদীর দুঃখ তীব্রতর হল। কেঁদে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তিনি বললেন–মা! সুভদ্রার ছেলে অভিমন্যু, আপনার অন্য নাতিরা সব কোথায় গেল? কই, আজকে তারা তো কেউ এল না আপনার কাছে। আমার ছেলেরা কেউ বেঁচে রইল না, আর আমি এই রাজ্য দিয়ে কী করব–কিং নু রাজ্যেন বৈ কাৰ্যং বিহীনায়াঃ সুতৈমম।
কুন্তী আবারও একাত্ম হলেন দ্রৌপদীর সঙ্গে। দ্রৌপদী তো আর জানেন না যে, তার মতো কুন্তীও আজ পুত্রহারা। সমদুঃখের মর্যাদায় কুন্তী পুত্রবধূকে মাটি থেকে ওঠালেন। তাকে সান্ত্বনা দিলেন মায়ের স্নেহে, সন্তানহারার একাত্মতায়। সবাইকে নিয়ে তিনি চললেন দীর্ঘদর্শিনী গান্ধারীর কাছে। বুঝলেন–যে জননী তার একশোটি পুত্র হারিয়েছে, তার যন্ত্রণা সকলের কষ্ট লঘু করে দেবে। গান্ধারীর দুঃখে কুন্তী নিজে সান্ত্বনা পেতে চেষ্টা করলেন।
কুরুরমণীদের সবাইকে নিয়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র উপস্থিত হয়েছেন গঙ্গার ঘাটে। আছেন গান্ধারী, আছেন কুন্তী। পাণ্ডবরা এসেছেন জননীর সঙ্গে। কুরুবাড়ির পুত্রবধূরা জলে নেমে তর্পণ করছেন। এমন সময় মনে মনে বিপর্যস্ত কুন্তী চোখের জলে আপ্লুত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেদের উদ্দেশে বললেন–যে মহাবীরকে সকলে সারথির ছেলে বলে ভাবত, সবাই যাকে জানত রাধার ছেলে, সেই কর্ণ তোমাদের সবার বড় ভাই। সৈন্যদলের মধ্যে যাকে দেখতে লাগত সূর্যের মতো, দুর্যোধনের সৈন্যবাহিনীর যে ছিল নেতা, যার মতো বীর এই তিন ভুবনে আর দ্বিতীয়টি নেই–যস্য নাস্তি সমো বীর্যে পৃথিব্যামপি কশ্চন–সেই কর্ণ তোমাদের বড় ভাই। এই বিরাট যুদ্ধে সে অর্জুনের হাতে মারা গেছে, তার জন্য এক অঞ্জলি জল দিয়ে গঙ্গায় তর্পণ করিস তোরা। সে তোদের বড় ভাই, সূর্যের ঔরসে আমারই গর্ভে তার জন্ম হয়েছিল তোদেরও অনেক আগে–স হি বঃ পূর্বজো ভ্রাতা ভাস্করাময্যজায়ত।
পাণ্ডবরা হঠাৎ করে প্রায় অসম্ভব এই নতুন খবর শুনে একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। কর্ণের জন্য তাদের দুঃখ ভ্রাতৃসম্বন্ধের নৈকট্যে তীব্রতর এবং আন্তরিক হয়ে উঠল। যে যুধিষ্ঠির যুদ্ধে পর্যন্ত স্থির থাকেন, তিনি রাগে সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে মায়ের কাছে। তার প্রথম পুত্রজন্মের সত্যতা সম্বন্ধে দ্বিরুক্তি শুনতে চাইলেন। মায়ের সঙ্গে যুধিষ্ঠির কখনও এই ব্যবহার করেননি। কিন্তু কুন্তী ওই একবারই যা বলেছেন, তিনি বারবার এক কথা বলেন না। যুধিষ্ঠির মনে আকুল, মুখেও গজর গজর করতে থাকলেন। বারবার বলতে থাকলেন–এ কী আক্কেল তোমার, সব কথা চেপে থাকার জন্য আজ তোমার জন্য আমরা মরলাম–অহো ভবতা মন্ত্রস্য গ্রহণেন বয়ং হতাঃ। আগে বললে এই লোকক্ষয়ী যুদ্ধ হত না, কর্ণ পাশে থাকলে এই পৃথিবীতে কী আমাদের অপ্রাপ্য ছিল–এইরকম নানা সম্ভাবিত সৌভাগ্যের কথা বলে ধর্মরাজ দূষতে লাগলেন কুন্তীকে। কুন্তী এ-কথারও জবাব দিলেন না। ভাবটা এই–আমার ছেলে মারা যেতে আমার যে কষ্ট হয়েছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট তোমাদের ভাইদের হতে পারে না বাছা। যুধিষ্ঠির সাময়িক শ্রাদ্ধ-তর্পণ সেরে চলে এলেন বটে। কিন্তু এর কাছে তার কাছে মায়ের এই রহস্য-গোপনের কথা এবং ভ্রাতৃহত্যার শোক বারংবার বলেই চললেন। তবু কুন্তী কিছু বললেন না।
যুধিষ্ঠির কর্ণের নানা খবর পেলেন মহর্ষি নারদের কাছে। গভীর দুঃখে দুঃখিত হয়ে থাকলেন অন্তরে। কুন্তী এবার প্রয়োজন বোধ করলেন যুধিষ্ঠিরকে কিছু বলার। বোঝাতে চাইলেন–তোমার দুঃখের চাইতে আমার দুঃখ কিছু কম নয় বাছা। বললেন–কেঁদো না, মন দিয়ে শোন আমার কথা–জহি শোকং মহাপ্রাজ্ঞ শৃণু চেদং বচো মম। আমি চেষ্টা করেছিলাম অনেক। তোমরা যে তার ভাই–এ-কথা আমি অনেক করে বলেছিলাম তাকে। আর শুধু আমি কেন, তার জন্মদাতা পিতা সূর্যদেবও তাকে আমারই মতো করে বুঝিয়েছেন। ভগবান সূর্যদেব এবং আমি অনেক যত্নে, অনেক অনুনয় করে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু তাকে না পেরেছি বোঝাতে, না পেরেছি তোমাদের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দিতে। মেলা তো দূরের কথা, সে আমাদের ব্যাপারে আরও প্রতিকূল হয়ে উঠল। আমিও দেখলাম–যাকে বুঝিয়ে শাম্য করা যাবে না, তাকে উপেক্ষা করাই ভাল। আমি তাই করেছি–প্রতীপকারী যুস্মাক ইতি চোপেক্ষিতে ময়া।
কুন্তীর এই স্বীকারোক্তির পরেও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তাকে ছাড়েননি। কেন তিনি আগে বলেননি কর্ণের গোপন জন্ম-কথা–এই কারণে অনেক গালাগাল অনেক শাপ-শাপান্ত যুধিষ্ঠিরের কাছে শুনতে হল কুন্তীকে। যুধিষ্ঠির বুঝলেন না–প্রথম পুত্রের মৃত্যুতে অন্য পুত্রদের যুদ্ধ-জয় কুন্তীর কাছে তিক্ত হয়ে গেছে। তার নিশ্চয়ই মনে পড়ে আপন পুত্রবধূর সেই স্মরণীয় বিলাপের ভাষা–আমার ছেলেরা বেঁচে নেই, এই রাজ্য দিয়ে আমি কী করব–কিং নু রাজ্যেন বৈ কার্যং বিহীনায়াঃ সুর্মৈম। কুন্তী এখন নির্বিঘ্ন, নিরাসক্ত এক বিশাল বৈরাগ্যের জন্য অপেক্ষমাণ।
দেখা যাচ্ছে–যুদ্ধ কুন্তীও চেয়েছিলেন, দ্রৌপদীও চেয়েছিলেন। যুদ্ধের জন্য উত্তেজনা তৈরি করার ব্যাপারে দ্রৌপদী যতখানি মুখরা ছিলেন, কুন্তীও ঠিক ততটাই। যুদ্ধ লাগলে আত্মীয়, পরিজন, এমনকী প্রিয় পুত্রদেরও কারও না কারও মৃত্যু হতে পারে–এই সত্য তাদের জানা ছিল। তবু শাশুড়ি এবং পুত্রবধূ দু’জনেই যুদ্ধ চেয়েছেন অন্যায়কারী কৌরবদের শাস্তির জন্য। দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের ধীরে চলার নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে বলেছিলেন–এত অপমানের পরেও যদি তোমরা চুপ করে বসে থাকো, তবে থাক, যুদ্ধ করবে আমার বাপ ভাই, যুদ্ধ করবে আমার ছেলেরা, আর তাদের নেতা হবে অভিমন্যু। আর কুন্তী কৌরবদের শাস্তির জন্য ছেলেদের বিদুলার উপাখ্যান শুনিয়েছিলেন, যে উপাখ্যানের বিষয়বস্তু ক্ষত্রিয়ের ছেলেরা যুদ্ধ অথবা মৃত্যুভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকে না। তারা হয় মরে, নয়তো প্রতিশোধ নেয়। কুন্তী-বিদুলার প্রসঙ্গ পরে আরও একবার স্মরণ করতে হবে আমাদের।
শাশুড়ি এবং পুত্রবধূ-দু’জনেরই এই উত্তেজনার পর তাদের এই পুত্রশোক মহাভারতের পাঠকদের কেমন যেন সংশয়িত করে তোলে, তাদের চরিত্র সম্বন্ধে একটা সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেবার পথ যেন রুদ্ধ করে দেয়। বস্তুত এইখানেই ক্ষত্রিয়া রমণী এবং জননীর বিচার। কুন্তীর শ্বশুরকুল, বিশেষত কুরুজ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র তার ভ্রাতৃবধূ এবং পুত্রবধূর ওপর যে অন্যায় চালিয়ে গেছেন, তার প্রতিবিধান করাটা কুন্তী এবং দ্রৌপদীর কাছে অনিবার্য ছিল, কারণ স্ত্রীলোক এবং শ্বশুর-ভাশুরের রক্ষণীয়া হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে তারা যে অপমান সয়েছেন, সে অপমান বোধহয় পাণ্ডবরাও সননি। কাজেই ক্ষত্রিয়া রমণী হিসেবে একজন পুত্রদের, অন্যদের স্বামীদের যুদ্ধের প্ররোচনা দিয়েছেন। সেই প্ররোচনা যেমন সত্য, আবার এখন পুত্রদের মৃত্যুতে এই দু’জনের কষ্টও ততটাই সত্য। জ্ঞাতি-বান্ধব এবং অতি প্রিয়জনের মৃত্যুর পর দ্রৌপদী রাজরানি হয়ে তবু যতটুকু সুখী হয়েছেন, কুন্তীর মনে কিন্তু রাজমাতা হওয়ার সুখ একটুও নেই। কারণ কুন্তীর বয়স হয়েছে, তিনি সংসারে নির্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।
লক্ষণীয় বিষয় হল–শ্বশুর-ভাশুর ধৃতরাষ্ট্রের ওপর যে কুন্তীর এত রাগ ছিল, পুত্রদের যুদ্ধজয়ের পর সেই কুন্তী ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী গান্ধারীর সেবায় একান্তভাবে আত্মনিয়োগ করলেন। তার ছেলেরা নিযুক্ত হল ধৃতরাষ্ট্রের সেবায়। আরেকভাবে বলা যায় কুন্তী ধৃতরাষ্ট্রের সুখকামনাতেই আত্মনিয়োগ করলেন। পাণ্ডবরা, বিশেষত মহারাজ যুধিষ্ঠির যা কিছু করতেন ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়েই করতেন, আর এদিকে কুন্তী ধৃতরাষ্ট্রের আত্ম প্রতিনিধি গান্ধারীর কাজে এমনভাবে নিজেকে নিয়োগ করলেন, যাতে মনে হবে তিনি যেন পুত্রবধূ, স্বামীর পরিজনদের সেবায় নিমগ্ন।
স্বর্গত মহামহোপাধ্যায় যোগেন্দ্রনাথ বাগচী মশাই কুন্তীর এই ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই মুখ্যত কুন্তী-চরিত্রের মাহাত্ম্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ তার মতে কুন্তী-চরিত্রের এইটাই ‘ফোকাল পয়েন্ট। কুন্তীর মৃত্যু পর্যন্ত এই ব্যবহারের ব্যাপ্তি। তার মতে কুন্তী স্বামীর ঘর বেশিদিন করতে পারেননি, স্বামী-সেবা যাকে বলে এবং যা নাকি সেকালে স্ত্রীলোকের অন্যতম ধর্ম ছিল, নানা কারণে সেই সেবা-সৌভাগ্যও কুন্তীর কপালে জোটেনি। এখন পুত্রহীন এই বৃদ্ধদম্পতির সেবায় আত্মনিয়োগ করে কুন্তী তার জীবনের সার্থকতা খুঁজে নিয়েছেন। তাঁর সতীত্ব এখানেই, এইখানেই তার সার্থকতা এবং হয়তো বা এই কারণেই পুণ্যবতী প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চকন্যার মধ্যে কুন্তীর নাম–অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা!
মহামহোপাধ্যায়ের বক্তব্য আমার মাথায় রেখে সবিনয়ে জানাই কুন্তীর সতীত্ব নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তিত নই। এমনকী চিন্তিত নই বৈষ্ণবরা যে কারণে কুন্তী সহ ওইসব রমণীকে সতী-পাকনাশিনী বলেছেন, তাই নিয়েও। বৈষ্ণবরা বলেন, এই পঞ্চকন্যাই ভগবানকে স্বশরীরে–কেউ রাম-রূপে, কেউ কৃষ্ণ-রূপে দর্শন করেছিলেন বলেই তারা পাতকনাশিনী সতী। বললাম তো যেভাবেই হোক এই মাহাত্ম্য নিয়েও আমি চিন্তিত নই। কথাটা হল–কুন্তী ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীর সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন প্রায় পুত্রবধূর অভিমানে–কুন্তিভোজসুতা চৈব গান্ধারীমন্ববর্তত। কেন?
এবার একটা ফালতু কথা বলি। গুণিজনে আমার অপরাধ নেবেন না। ভিড় বাসে একটি সিট খালি হয়েছে। সেই খালি আসনের সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তির দাঁড়াবার কায়দা, তাৎক্ষণিক শারীরিক সংস্থান এবং তৎপরতার কারণে আসনটি কারও কাছে প্রাপ্য হয়, এবং অন্য কারও কাছে প্রাপ্য হয় না। কিন্তু আসনটি অপ্রাপ্য হলেও ক্কচিৎ কেউ শারীরিক নিপুণতা, তৎপরতা এবং বলিষ্ঠতায় সেইখানে বসে পড়ে। তখন ঝগড়া লাগে। আসনটি যার প্রাপ্য স্বাভাবিক কারণেই সে অন্যান্য যুক্তিবাদীদের সমর্থনে এবং ন্যায়তই তর্কে জিতে যায়। অন্যায়ী অনধিকারী তখন আসন ছেড়ে উঠতে চায় এবং অধিকারী ব্যক্তি তখন বদান্য হয়ে বলেন–আরে ছি ছি, বসুন, আপনিই বসুন, একবার শুধু বললেই হত, এই তো দু মিনিটের মামলা, সবাই তো নেমে যাব। অপ্রস্তুত অনধিকারী তখন সেই আসনে বসতে বাধ্য হন, এবং যতক্ষণ বসে থাকেন ততক্ষণ আপন অপ্রাপ্য অধিকারে মানসিকভাবে ছিন্ন-ভিন্ন হতে থাকেন।
এখানেও তাই। পাণ্ডু ছিলেন রাজ্যের নির্বাচিত অধিকারী। ধৃতরাষ্ট্র তার রাজ্যে বসে পড়েছিলেন। যুদ্ধ হল। যুদ্ধে পাণ্ডুর প্রতিনিধিরা জিতলেন। জিতে বললেন–জ্যাঠামশাই! আপনিই রাজা। আপনি যা বলবেন, আমরা তাই করব–ধৃতরাষ্ট্রং পুরস্কৃত্য পৃথিবীং পর্যপালয়ন। ভিড় বাসে সেই অধিকারীর বদান্যতায় অনধিকারী যেমন শারীরিকভাবে উঠতেও পারে না, আবার মানসিকভাবে বসতেও পারে না, ধৃতরাষ্ট্রও সেইভাবেই পনেরো বছরে কাটালেন। আর কুন্তী! যে ধৃতরাষ্ট্রের অন্যায় আচরণে তাঁর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল, তিনি যে এত এখন ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর অনুগতা হয়ে পড়লেন, তার কারণ নৈতিকভাবে তার জয় হয়ে গেছে। বিজয়িনীর নম্রতার মধ্যে কোনও লজ্জা নেই, বরং মাহাত্ম আছে। অধিকন্তু একশত পুত্রের মৃত্যুতে যে জনকজননী শোক-ক্লিষ্ট হয়ে আছেন, তাদের গৌরবে প্রতিষ্ঠা করে নিজে নত হওয়ার মধ্যেও বিজয়িনীর মাহাত্ম্য আছে। ধৃতরাষ্ট্রের প্রিয়া মহিষীর অসংখ্য সেবা করে, বশংবদ হয়ে কুন্তী যেমন একদিকে তাদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করেছেন, তেমনই অন্যদিকে ছিল তার স্বাধিকারের বদান্যতা–তুমি আমার অধিকার স্বীকার করেছ, বাস, ঠিক আছে, তুমিই বসে থাকো রাজার আসনে, আমি নির্বিন্ন, আমি সিদ্ধকাম।
এই সিদ্ধকাম অবস্থাতেই কুন্তীর বৈরাগ্য এসেছে। তা ছাড়া পনেরো বছর ধরে এই অন্ধ ভাশুর এবং তার পুত্রহীনা পত্নীর সঙ্গে থেকে থেকে কুন্তীও ভোগসুখে নির্লিপ্ত হয়ে গেছেন। যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রকে যথাসম্ভবের থেকেও বেশি সম্মান দিয়ে চলতেন। বিলাস, ভোগ-সুখ এবং মর্যাদা কোনওটাই ধৃতরাষ্ট্র কম পাননি যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে। তবে এইসব কিছুর মধ্যে ক্ষুদ্র কণ্টকের মতো একটি মাত্র বস্তুই ধৃতরাষ্ট্রকে বিদ্ধ করত। সবাইকে লুকিয়ে মধ্যম পাণ্ডব ভীম মাঝে মাঝে গঞ্জনা দিতেন ধৃতরাষ্ট্রকে। এ ঘটনা যুধিষ্ঠির, অর্জুন অথবা দ্রৌপদী কুন্তী কেউই জানতেন না। ধৃতরাষ্ট্রও কাউকে বলেননি।
পনেরো বছর যুধিষ্ঠিরের রাজত্বে সুখবাস করে ধৃতরাষ্ট্র এবার বনে যাবার জন্য তৈরি হলেন। বানপ্রস্থের সময় ধরলে ধৃতরাষ্ট্রের একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, তিনি যুধিষ্ঠিরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সস্ত্রীক বানপ্রস্থে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। ইচ্ছে বাকি জীবন সাধন, তপস্যায় কাটিয়ে দেওয়া। যেদিন গান্ধারীকে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র রওনা দিলেন বনের উদ্দেশে, সেদিন রাজ্যের যত নর-নারী রাস্তায় ভেঙে পড়ল তাদের দেখতে। বৃদ্ধ রাজা বনে যাচ্ছেন, গান্ধারী বনে যাচ্ছেন, পাণ্ডবরা সবাই তাদের পেছন পেছন চলেছেন। কুন্তীও চলেছেন চোখ-বাঁধা গান্ধারীর হাত ধরে। হস্তিনাপুরের সিংহদ্বার ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে এসেছেন তারা। পুরবাসীরা ফিরে গেছে অনেক আগেই। এবার যুধিষ্ঠিরও ফিরবেন। আর কত দূরই বা যাবেন তিনি। ধৃতরাষ্ট্রও বারবার বলছেন–এবার ফিরে যাও বাছা, আর কত দূর যাবে তুমি, যাও যাও।
গান্ধারীর হাত-ধরা কুন্তীকেও যুধিষ্ঠির এবার বললেন–আপনি এবার ফিরে যান মা, আমি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে আরও খানিকটা এগিয়ে দিই–অহং রাজানমন্বিষ্যে ভবতী বিনিবৰ্ততা। যুধিষ্ঠির বললেন–ঘরের বউরাও সব রয়ে গেছে, আপনি এবার তাদের নিয়ে ফিরে যান। আমি আরও কিছু দূর যাই মহারাজের সঙ্গে। যুধিষ্ঠিরের এই কথার পর গান্ধারীর হাতটি আরও শক্ত করে ধরলেন কুন্তী। চোখে তার জল এল। তবু একেবারে আকস্মিকভাবে, যুধিষ্ঠিরের একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে কুন্তী বললেন–আমার সহদেবকে যেন কখনও বকাঝকা কোরো না বাছা। সে বড় ভাল ছেলে, যেমন আমায় ভালবাসে, তেমনই তোমাকেও। তাকে সবসময় দেখে রেখো।
যুধিষ্ঠির কিছু বুঝতেও পারেননি। ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীকে পৌঁছতে নয়, কুন্তীও যে তাদের সঙ্গে চলেছেন সব ছেড়ে, কিচ্ছুটি না বলে–সে-কথা যুধিষ্ঠির কিছু বুঝতেই পারেননি। কুন্তী এবার বললেন–আর তোমাদের বড় ভাই কর্ণকে সবসময় স্মরণে রেখো বাবা। আমারই দুর্বুদ্ধিতে তাকে একদিন আমি প্রতিপক্ষে থেকে যুদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছিলাম। আর দেখো, আমার হৃদয় নিশ্চয়ই লোহা দিয়ে তৈরি। নইলে কর্ণকে না দেখেও এখনও যে সে হৃদয় আমার খান খান হয়ে যায়নি, তাতে বুঝি এ একেবারে লোহা। ব্যাপারগুলো এমনই হয়েছিল, আমার পক্ষে আরও ভাল করে কী-ই বা করা সম্ভব ছিল, বাছা। তবু সব দোষ আমারই, কেন না আমি কর্ণের সব কথা তোমাদের কাছে খুলে বলিনি–মম দোষোহয়মত্যর্থং খ্যাপিতো যন্ন সূর্যজঃ।
মনে রাখবেন–এই কথাগুলি কুন্তীর সাফাই গাওয়া নয় অথবা বনে যাবার শেষ মুহূর্তের স্বীকারোক্তিও নয় কিছু। কথাগুলি গভীর অর্থবহ। এই কথাগুলির পরে কুন্তী বলেছিলেন–আমার বাকি জীবন আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর সেবায় কাটিয়ে দিতে চাই-শ্বশ্র-শ্বশুরয়োঃ পাদা শুশ্রুষন্তী সদা বনে। আগেই বলেছি, মহামহোপাধ্যায় যোগেন্দ্রনাথ বাগচী কুন্তীর এই শ্বশুর-শাশুড়ি শুশ্রূষার মধ্যেই কুন্তীর চরিত্র-মাহাত্ম খ্যাপন করতে চেয়েছেন।
মহাজনের এই পদাঙ্কিত পথে আমি যে তেমন করে পা বাড়াতে পারছি না, তার একমাত্র কারণ কর্ণ। আমি আগেই বলেছি যে, শৈশবে আপন পিতৃ-মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত কুন্তীর মধ্যে এমনই এক মানসিক জটিলতা তৈরি হয়েছিল। সে জটিলতা আরও বাড়ে কন্যা অবস্থায় তথাকথিত এক অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়ে। বাবা-মার কাছে একথা বলতে পারেননি, স্বামীর কাছে বলতে পারেননি, ছেলেদের কাছে তো বলতেই পারেননি। এদিকে শ্বশুরকুল তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছে না, অথচ প্রধানত যার ভরসায় তার শ্বশুরকুল তারই প্রতিপক্ষভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে, তিনিও তার ছেলে, কর্ণ। তিনি এমনই সত্যসন্ধ যে, তাঁকে বলে কয়েও কিছু করা যায়নি। প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছে তার অন্য ছেলেরা এবং কুন্তী পূর্বাহ্নেই জানতে পারছেন কর্ণ মারা যাবেন।
যে গভীর জটিলতার সূত্রপাত হয়েছিল যৌবনে, যার বৃদ্ধি ঘটেছিল বিধবার সমস্ত জীবনের অন্তর-গুপ্তিতে, সেই জটিলতা কর্ণের মৃত্যুতেও শান্ত হয়নি, বরং তা বেড়েছে। যে যুধিষ্ঠির জীবনে মায়ের মুখের ওপর গলা উঁচু করে কোনওদিন কথা বলেননি, সেই যুধিষ্ঠির রাগে সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে জননীকে বলেছেন–তোমার স্বভাব-গুপ্তির জন্য আজ আঘাত পেলাম আমি–ভবত্যা গূঢ়মন্ত্ৰত্বাৎ পীড়িতোহস্মীত্যুবাচ তাম্। যুধিষ্ঠির জননীকে উদ্দেশ করে সমগ্র নারীজাতিকে শাপ দিয়েছিলেন–মেয়েদের পেটে কোনও কথা থাকবে না–সর্বলোকেষু ঘোষিতঃ ন গুহ্যং ধারয়িষ্যন্তি।
কুন্তী যুধিষ্ঠিরের কথার উত্তর দেননি, প্রতিবাদ করেননি, আপন মনে বকবকও করেননি। যুধিষ্ঠির কুন্তীকে বুঝি তখনও চেনেননি। আমি হলফ করে বলতে পারি–মেয়েদের পেটে কথা না থাকার অভিশাপ শত কোটি প্রগলভা রমণীর অন্তরে যতই ক্রিয়া করুক, মনস্বিনী কুন্তীর তাতে কিছুই হয়নি। এই যে রাজ্য-পাওয়া বড় ছেলে গলা উঁচু করে কর্ণের ব্যাপার নিয়ে অত বড় কথাটা বলল, তার প্রতিক্রিয়া কুন্তী মনের মধ্যে চেপেই ছিলেন। যুধিষ্ঠির রাজ্য পাওয়া মাত্রই তিনি রাজমাতার যোগ্য বিলাস ছেড়ে মন দিয়েছিলেন শ্বশুরকল্প ধৃতরাষ্ট্রের সেবায়। যুধিষ্ঠির বুঝতেও পারেননি নিস্তরঙ্গভাবে পুত্রদের দেওয়া ভোগ-সুখ থেকে অবসর নিলেন কুন্তী। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে দিনের পর দিন অন্তরে বৈরাগ্য সাধন করার ফলেই এত সহজে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বনে যাওয়ার ব্যাপারে। জলপান বা ভাত খাওয়ার মতো অতি সহজেই তিনি বলতে পারছেন–আমিও গান্ধারীর সঙ্গেই বনে থাকব বলে ঠিক করেছি।
লক্ষণীয় বিষয় হল–এই সহজ প্রস্থানের পথে তিনি আবারও সেই কর্ণের প্রসঙ্গ তুলছেন যুধিষ্ঠিরের কাছে, এমন একটা প্রসঙ্গ যা নিয়ে পুত্রের কাছে তিনি উচ্চৈঃস্বরে অভিযুক্ত হয়েছিলেন একদা পনেরো বছর আগে। কুন্তী সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেননি, ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে কাশী কিংবা বনে যাননি। কিন্তু পনেরো বছর তিনি যুধিষ্ঠিরের কথা মনে রেখেছেন, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া চেপে রেখেছেন নিপুণভাবে। যাবার আগে শুধু জবাবদিহির মতো করে কথাটা আবারও তুলছেন কুন্তী। বলেছেন–আমার হৃদয়টা লোহার মতো বাবা, নইলে কর্ণের মরণ সয়েও বেঁচে রইলাম কী করে? তবে ঘটনার প্রবাহ ছিল এমনই যে, আমি কী বা করতে পারতাম সেখানে–এবং গতে তু কিং শক্যং ময়া কতুম্ অরিন্দম।
কথাটার মধ্যে পনেরো বছরের অন্তর্দাহ আছে, অভিমান আছে, জবাবদিহিও আছে। যুধিষ্ঠিরের কথাটা যে তিনি সেদিন মেনে নিতে পারেননি, তারই উত্তর দিচ্ছেন আজ পনেরো বছর পরে, বানপ্রস্থে যাবার পথে। অথচ বলার মধ্যে সহজ ভাবটা দেখবার মতো–সবই আমার দোষ, বাছা। তুমি ভাইদের নিয়ে তোমার বড় ভাই কর্ণের কথা সবসময় স্মরণে রেখো। তার মৃত্যু উপলক্ষ করে দান-ধ্যান কোরো।
কুন্তীর যাত্রা এবং বক্তব্যের আকস্মিকতায় যুধিষ্ঠির হতচকিত হয়ে গেছেন। তিনি কথাই বলতে পারছেন না–ন চ কিঞ্চিদুবাচ হ। পনেরো বছর আগে বলা কথার জবাবটা যে এইভাবে মায়ের বনবাস-যাত্রার মুখে এমন হঠাৎ করে ফিরে আসবে–এ তিনি ধারণাই করতে পারছেন না। কথা আরম্ভ করার জন্য তাকে ভাবতে হল এক মিনিট মুহূর্তমিব তু ধ্যাত্বা। দুশ্চিন্তায় আকুল হয়ে তিনি উত্তর দিলেন–এ তুমি কী বলছ মা! এ তুমি নিজে নিজে কী ঠিক করেছ? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার ওপর রাগ কোরো না তুমিন স্বামভ্যনুজানামি প্রসাদং কর্তুমর্হসি।
মুহূর্তের মধ্যে যুধিষ্ঠির গুছিয়ে নিলেন নিজেকে। বললেন–মা! তুমিই না একসময়ে আমাদের যুদ্ধে উত্তেজিত করেছিলে? বিদুলার গল্প বলে তুমিই যেখানে আমাদের এত উৎসাহ দিয়েছিলে, সেই তুমি কিছুতেই আমাদের ছেড়ে যেতে পারবে না–বিদুলায়া বচোভিত্ত্বৎ নাস্মন্ সন্ত্যকুমহসি। কৃষ্ণের কাছে তোমারই বুদ্ধি পেয়ে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, রাজ্যও পেয়েছি তোমারই বুদ্ধিতে। সে বুদ্ধি এখন কোথায় গেল মা? আমাদের এত ক্ষত্রিয়ের ধর্ম উপদেশ দিয়ে এখন তুমি নিজেই তো সেই ধর্মের চ্যুতি ঘটাচ্ছ। আমাদের ছেড়ে, এই রাজ্য ছেড়ে, তোমার পুত্রবধূকে ছেড়ে কোথায় তুমি বনের মধ্যে গিয়ে থাকবে?
ছেলের কান্না-মাখা কথা শুনে কুন্তীর চোখে জল এল। তবু তিনি চলতে লাগলেন গান্ধারীর সঙ্গে। কুন্তীও কোনও কথার উত্তর দিলেন না দেখে ভীম ভাবলেন–মা বুঝি একটু নরম হয়েছেন। ভীম বললেন–তোমার ছেলেরা যখন রাজ্য পেল, যখন সময় এল একটু ভোগ-বিলাসে থাকার, তখনই তোমার এই অদ্ভুত বুদ্ধি হল কেন, মা-তদিয়ং তে কুতো মতিঃ! আর যদি এই বুদ্ধিই হবে তবে আমাদের দিয়ে যুদ্ধে এত লোকক্ষয় করালে কেন? বনেই যদি যাবে তবে সেই বালক-বয়সে আমাদের শতশৃঙ্গ পর্বতের বন থেকে কেন টেনে এনেছিলে এখানে? বারবার বলছি মা, কথা শোনো, বনে যাবার কল্পনা বাদ দাও, ছেলেদের উপায়-করা রাজলক্ষ্মী ভোগ করো তুমি, ফিরে চলো ঘরে।
কুন্তী ভীমের কথাও শুনলেন, কিন্তু বাড়ি ফিরবার লক্ষণ একটুও দেখা গেল না তার মধ্যে। দ্রৌপদী-সুভদ্রা কত বোঝালেন কুন্তীকে, ছেলেরা সবাই কত করে বললেন ফিরে যেতে, কুন্তী বারবার তাদের দিকে ফিরে তাকান–যেন এই শেষ দেখা, আর চলতে থাকেন। সামুখে পুত্রদের দিকে বারবার তাকানোর মধ্যে কুন্তীর স্নেহানুরক্তি অবশ্যই ছিল–সা পুত্ৰান্ রুদতঃ সর্বান্ মুহুর্মুহুরবেক্ষতী। কিন্তু তার চলার মধ্যে নিশ্চিত সিদ্ধান্তের শক্তি লুকানো ছিল। তিনি তাই থামছিলেন না। বস্তুত ওই শক্তিতে কুন্তী এবার চোখের জল মুছলেন, রুদ্ধ করলেন বাষ্পেদ্ভিন্ন স্নেহধারার পথ। কুন্তী নিজেকে শক্ত করে দাঁড়ালেন। বনপথের মাঝখানে। প্রিয় পুত্রেরা তাকে যুক্তির জালে আবদ্ধ করেছে। প্রশ্ন করেছে কেন তুমি পূর্বে আমাদের যুদ্ধে উৎসাহিত করে এখন বনে পালাচ্ছ। ছেলেদের এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাবেন তিনি। কুন্তী দাঁড়ালেন। মুখে তার সেই তেজ, সেই দীপ্তি।
কুন্তী বললেন–প্রশ্নটা তোমাদের মোটেই অন্যায় নয় যুধিষ্ঠির! সত্যিই তো, আমি তোমাদের চেতিয়ে দিয়েছিলাম। সেই সময়ে, যখন শত্রুর ওপর আঘাত হানায় তোমরা ছিলে কম্পমান–কৃতমুদ্ধর্ষণং পূর্বং ময়া বঃ সীতাং নৃপ৷ কেন অমনি করছিলাম জান? জ্ঞাতিরা পাশাখেলায় তোমাদের সর্বস্ব হরণ করে নিয়েছে, সুখ বলে যখন কোনও কিছুই অবশিষ্ট ছিল না তোমাদের, তখনই আমি তোমাদের উত্তেজিত করেছি–কৃতমুদ্ধৰ্ষণং ময়া। আমি তোমাদের উত্তেজিত করেছি এই কারণে, আমার স্বামী পাণ্ডুর ছেলেরা যাতে পৃথিবী থেকে মুছে না যায়, যাতে তার বীর পুত্রদের যশোহানি না হয়।
এই কথাটার মধ্যে ভীমের প্রশ্নের জবাবও আছে। ভীম বলেছিলেন–বনেই যদি যাবে তবে পাণ্ডুর মৃত্যুর পর কেন আমাদের বন থেকে টেনে এনেছিলে এখানে–বনাচ্চাপি কিমানীতা ভবত্যা বালকা বয়ম? কুন্তী জবাব দিয়েছেন স্বামীর ইতিকর্তব্যর কথা মনে রেখে। বস্তুত পাণ্ডু অকালে মারা যাবার পর কুন্তী যখন বিধবা হলেন তখন অন্য ব্যক্তিত্বময়ী বিধবা রমণীদের মতো তারও একমাত্র ধ্যান ছিল-কেমন করে তার নাবালক ছেলেগুলিকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া যায়। এর জন্য মুনি-ঋষিদের ধরে পাণ্ডুর মৃতদেহ নিয়ে নাবালকদের হাত ধরে তিনি উপস্থিত হয়েছেন শ্বশুরবাড়িতে। ভূতপূর্ব রাজরানির প্রাপ্য সম্মান তিনি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাননি, পেয়েছেন শুধুই আশ্রয়। সেই আশ্রয়ও নিরাপদ ছিল না। ভীমকে বিষ খাওয়ানো, বারণাবতে সবাইকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা–সবকিছু কুন্তী সয়েছেন এবং অপেক্ষা করেছেন সুদিনের। ছেলেরা ততদিনে মহাশক্তিশালী বীরের মর্যাদা পেয়েছে। রাজনীতিতে সমর্থন এসে গেছে কুন্তীর আসল বাপের বাড়ি বৃষ্ণি যাদবদের কাছ। থেকে এবং বিবাহসূত্রে পাঞ্চাল দ্রুপদের কাছ থেকেও।
ধৃতরাষ্ট্র এই বিধবা মহিলার উচ্চাশা চেপে রাখতে পারেননি। চেষ্টা তিনি কম করেননি। কুন্তীকে যদি একটুও ভয় না পেতেন ধৃতরাষ্ট্র, তা হলে অন্তত বারণাবতে কুন্তী সহ পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করতেন না। যাই হোক, পাঞ্চালদের সঙ্গে বৈবাহিক যোগাযোগের পর এবং বারণাবতের ঘটনায় নিজের রাজ্যে নিজেরই মান বাঁচাতে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্য দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তার অবাধ্য ছেলেদের ধৃতরাষ্ট্র রুখতে পারেননি। তাদের প্ররোচনায় পাশাখেলার ছলে পাণ্ডবদের সর্বস্ব নিয়ে বনবাসে পাঠান ধৃতরাষ্ট্র।
কুন্তী এই অন্যায় সইতে পারেননি। বাপের সম্পত্তির ভাগ তারা কিছুই পেল না, উলটে তার প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের পাঠিয়ে দেওয়া হল বনে, কুন্তী এই অন্যায় সইতে পারেননি। স্বামীর অবর্তমানে নিজের কষ্টে প্রতিষ্ঠিত রোজগেরে ছেলেদের দেখে বিধবা মা যে সুখ পান, ঠিক সেই সুখই কুন্তী নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন, যখন যুধিষ্ঠির রাজা হয়েছিলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। কিন্তু দুর্যোধন-ভাইদের জ্ঞাতি চক্রান্তে ছেলেদের যে রাজ্যনাশ হয়ে গেল, তখনও কুন্তী হাল ছাড়েননি। তিনি একা বসেছিলেন শ্বশুরবাড়িতে। বিদুরের কথায় যে তিনি শেষ পর্যন্ত ছেলেদের সঙ্গে বনে যাওয়া বন্ধ করে কুরুবাড়িতেই রয়ে গেলেন, তার কারণ বিদুরের মর্যাদারক্ষা যতখানি, তার চেয়েও বেশি তার অধিকারবোধ-আমার শ্বশুরবাড়ি, আমার স্বামীর ঘর, আমার হক আছে থাকার, আমি রইলাম শুধু পাণ্ডুর উত্তরাধিকারিতার অধিকারে। রাজা পাণ্ডুর বংশ এবং উত্তরাধিকার যাতে মুছে না যায় কুরুবাড়ি থেকে–যথা পাণ্ডোর্ন নশ্যেত সন্ততিঃ পুরুষর্ষভাঃ–সেইজন্যই তিনি কুরুবাড়িতে একা জেগে বসেছিলেন এবং সময়কালে ছেলেদের উত্তেজিত করেছেন চরম আঘাত হানার জন্য ইতি চোদ্ধৰ্ষণং কৃতম্।
কুন্তী বললেন–তোমাদের শক্তি কিছু কম ছিল না। দেবতাদের মতো তোমাদের পরাক্রম। সেই তোমরা চোখ বড় করে চেয়ে চেয়ে জ্ঞাতিভাইদের সুখ দেখবে আর নিজেরা বনে বসে বসে আঙুল চুষবে–সে আমি সইতে পারিনি বলেই তোমাদের যুদ্ধে উত্তেজিত করেছি–মা পরেষাং সুখপ্রেক্ষাঃ স্থাতব্যং তৎ কৃতং ময়া। যুধিষ্ঠির! মর্যাদায় তুমি দেবরাজ ইন্দ্রের মতো হয়েও তুমি কেন বনে বাস করবে, সেইজন্যই আমার উত্তেজনা। একশো হাতির বল শরীরে নিয়েও ভীম কেন কষ্ট পাবে, সেইজন্যই আমার উত্তেজনা। ইন্দ্রের সমান যুদ্ধবীর হয়েও অর্জুন কেন নিচু হয়ে থাকবে–সেইজন্যই আমার উত্তেজনা। আর তোমরা এত বড় বড় ভাইরা থাকতে নকুল-সহদেব আমার বনের মধ্যে খিদেয় কষ্ট পাবে– এইজন্যই আমার উত্তেজনা।
কুন্তী এবার শেষ প্রশ্ন তুললেন সমগ্র রাজনীতির সারমর্মিতায়। বললেন–এই যে এই মেয়েটা, পাণ্ডবদের সুন্দরী কুলবধূ দ্রৌপদী। একে যখন সভার মধ্যে নিয়ে এসে অপমান করল সবাই, সকলে চুপটি করে বসে থাকল। পঞ্চস্বামীগর্বিতা হয়েও সাহায্যের আশায়। যাকে কাঁদতে হল অনাথের মতো, আমার শ্বশুরকুলের বড় মানুষেরা ব্যথিত হয়েও চুপ করে বসে থাকলেন। দুঃশাসন এসে তার চুলের মুঠি ধরল–এখনও ভাবলে আমার মনে হয় আমি অজ্ঞান হয়ে যাব–এরকম অসভ্যতা দেখেই আমি তোমাদের যুদ্ধে উত্তেজিত করেছি, শুনিয়েছি বিদুলার উদ্দীপক সংলাপ।
কুন্তী বলতে চান–পাণ্ডবদের যুদ্ধে উত্তেজিত করার মধ্যে তার নিজের স্বার্থ কমই। ছেলেরা রাজ্য জিতে ভোগ-বিলাস এনে দেবে তার কাছে আর তিনি বিলাস-ব্যসনে মজে থাকবেন, বসে বসে সুখ ভোগ করবেন–এই আশায় তিনি যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়াননি ছেলেদের মধ্যে। কুন্তীর বক্তব্য-যুদ্ধের উত্তেজনার বিষয় এবং কারণ তার ছেলেদের মধ্যেই ছিল, অর্থাৎ ঘটনা পরম্পরা যা চলছিল–যে অন্যায় যে অবিচার, তাতে বহু পূর্বে তার ছেলেদেরই উত্তেজিত হওয়া উচিত ছিল। তাদের দিক থেকে অত্যন্ত উচিত এই প্রতিক্রিয়া যখন কুন্তী লক্ষ করলেন না, তখনই তাকে কঠিন কথা বলতে হয়েছে, বিদুলার মরণান্তিক কঠিন সংলাপ শোনাতে হয়েছে ছেলেদের। এর মধ্যে জননী হিসেবে তার পাওয়ার কিছু নেই, যা প্রাপ্য তা তার ছেলেদের, ঠিক যেমন যুদ্ধে উত্তেজিত হওয়ার কারণগুলিও ছিল তাদেরই একান্ত।
যুধিষ্ঠির এবং ভীমের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের উত্তরে কুন্তী তার উত্তেজনা চেপে রাখতে পারেননি। যে প্রশ্ন করতে ছেলেদের লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল, সেই প্রশ্ন যখন তারা কঠিনভাবেই করল, তখন উত্তর এসেছে অবধারিত কঠিনভাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কুন্তী ছেলেদের রেখে বনের পথে পা বাড়িয়েছেন জীবনের মতো। কাজেই অভিযোগের উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে নেমে আসছে প্রশান্তি, বনযাত্রার বৈরাগ্য।
কুন্তী বললেন–তোমাদের যে এত করে যুদ্ধ করতে বলেছিলাম, তার আসল কারণ কী জানো? তোমাদের বাবা ছিলেন রাজা। তোমরা রাজার ছেলে। আমারই গর্ভজাত সন্তানদের হাতে পড়ে সেই মহাত্মা পাণ্ডুর রাজবংশ উচ্ছিন্ন না হয়ে যায়, সেই কারণেই আমি তোমাদের উৎসাহিত করেছি। জেনে রেখো, তোমরা নিজেরাই যদি নিরালম্ব অবস্থায় থাকো, তবে তোমাদের ছেলেরা, তোমাদের নাতিরা কোনওদিনই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না–ন তস্য পুত্রাঃ পৌত্রা বা ক্ষতবংশস্য পার্থিব। কাজেই যা কিছু উৎসাহ-উদ্দীপনা তা তোমাদেরই কারণে, আমার নিজের ভোগসুখের জন্য কিছু নয়। ভাবতে পারেন কি–একটি সমৃদ্ধিশালী, সুপ্রতিষ্ঠিত বংশধারার জন্য কুন্তী কত আধুনিকভাবে লালায়িত!
ভীম বলেছিলেন–তোমার ছেলেরা এখন রাজ্য জিতেছে, সেই রাজসুখ এখন তোমার ভোগ করার কথা–যদা রাজ্যমিদং কুন্তি ভোক্তব্যং পুত্রনির্জিতম–রাজমাতার প্রাপ্য সুখ যখন তোমার কাছে আমাদেরই পৌঁছনোর কথা, ঠিক তখনই তোমার এই বানপ্রস্থের ইচ্ছে হল? কুন্তী এই প্রশ্ন এবং পুত্র-নির্জিত রাজ্য-সুখের ভোক্তব্যতা নিয়ে যে অসাধারণ উক্তিটি করেছেন তা এই অতি বড় আধুনিক সমাজেও আমি অত্যন্ত সযৌক্তিক মনে করি।
কুন্তীর বক্তব্যের আগে আমি দুটো সামান্য কথা নিবেদন করে নিই। আমার সহৃদয় পাঠককুল আমাকে কুন্তীর বক্তব্যের সারবত্তা বোঝানোর সময় দিন একটু। আজকের দিনের অনেক কৃতী ছেলে বলে–পাশ্চাত্য সমাজ বড় ভাল। ওখানে যার যার, তার তার। ছেলে বড় হল, চাকরি করছে, বউ নিয়ে আলাদা আছে। বাপ-মাও আলাদা আছে। শাশুড়ি-বউতে দিন-রাত কথা কাটাকাটি নেই, ভ্যাজর-ভ্যাজর নেই। ভারী সুন্দর ব্যবস্থা।
এই ‘সুন্দর’ ব্যবস্থার মধ্যে আমি কিছু নিন্দনীয় দেখি না। ভারতবর্ষেও আজকাল তাই হচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবারগুলি একে একে ভেঙে যাচ্ছে। বস্তুত এতেও আমি কিছু নিন্দনীয় দেখছি না। কারণ এমনটি হবেই। কিন্তু কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পটভূমিকার দিকে তাকালে অনেক কিছু সহজে বোঝা যাবে। আমাদের অব্যবহিত পূর্বকালে যা দেখেছি, তাতে জমি সম্পত্তি এবং বসতবাড়ির একটা বিশাল ভূমিকা ছিল সমাজে। ছেলেরা বাপের সম্পত্তি পেত। বাবা যদি সম্পত্তির অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতেন, তা হলে শাশুড়ি দাপট দেখাতেন, পুত্র-পুত্রবধূ নিগৃহীত বোধ করতেন। জমি-সম্পত্তির যুগ অতীত হয়ে যাবার পর যখন বাপ চাকরি করে, ছেলেও চাকরি করে সেই অবস্থায় শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়ার অনুপাত বোধহয় সবচেয়ে বেশি। এই কাঠামোতে বাপ মারা গেলে মায়ের অবস্থা বড় করুণ। এই অবস্থায় পুত্রবধূ দাপট দেখায়, শাশুড়ি নিগৃহীতা বোধ করেন।
এখন দেখছি সমাজ অতি দ্রুত এই পারিবারিক ঝগড়াঝাটির নিষ্পত্তি ঘটিয়ে ফেলেছে। এখন বাপ চাকরি করতে করতেই ছেলের পড়াশুনো, তার ব্যবহারিক প্রতিষ্ঠার দিকে যেমন নজর রাখেন, তেমনই তার অবর্তমানে তার স্ত্রীর যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তার ব্যবস্থাও করেন। অথবা বাপ যদি বেঁচেও থাকেন, তা হলে অবসরকালীন জীবনে বুড়োবুড়ি পুত্র-পুত্রবধূকে বাদ দিয়েও কীভাবে জীবন কাটাবেন, তার একটা অঙ্ক কষে নেন আগে থেকেই। অর্থাৎ তারা পুত্রের উপার্জিত ধনে ভাগ বসাতে চান না। ভাবটা এই–আমরা বেঁচে থাকি, তোমরাও সুখে থাকো, ঝগড়াঝাটি যেন না হয়, বাছা। আমরা প্রায় পাশ্চাত্য সমাজ-ব্যবস্থার কাছাকাছি চলে আসছি।
এতে ভাল হচ্ছে, কি মন্দ হচ্ছে–তা জানি না, তবে এ ব্যবস্থা আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারগুলির মধ্যেই চলতে পারে, অন্যত্র নয়। অন্যত্র সেই একই হাল–রোজগেরে ছেলে, পুত্রবধূর দাপট, বাবা-মা নাজেহাল। এর মধ্যে যদি আবার একজন স্বর্গত হন, তখন অন্যজনের অবস্থা হয়ে ওঠে আরও করুণ। তিনি মনে মনে কষ্ট পান, একান্তে বসে কাঁদেন। পুত্রবধূর তবু মায়া হয় না, অথচ এই অসহায় শাশুড়ি নামের ভদ্রমহিলাটি কারণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্বশুরই আগে স্বর্গত হন–নিজের ছেলেটিকে রেখে অন্যত্রও চলে যেতে পারেন না। কারণ মায়া-মোহ তো আছেই, সহায়-সম্বলহীনতাও আছে।
ঠিক এইরকম একটা পটভূমিকায় আমি কুন্তীর বক্তব্য পেশ করতে চাই। যদিও এখানে শাশুড়ি-বউয়ের কোনও ব্যাপারই নেই। যা আছে, তার নাম সংসার-চক্র। তবে মনে রাখা দরকার কুন্তীর বক্তব্যের একটা পটভূমিকা আছে। শাস্ত্র, কাব্য এমনকী সাধারণ মানুষের শেষ কথাটির মধ্যেও আমরা বুঝতে পারি যে, ভারতবর্ষ কোনওকালেই ভোগ-বিলাসের প্রশস্তি গায় না, তার প্রশস্তি বৈরাগ্যেই। এখানে অতি ভোগী মানুষেরও একসময় মনে হয়–চাওয়ার আগুনে ইন্ধন জোগালে তার কোনও শেষ নেই, অতএব একটা কোথাও শেষ করতে হবে। এই দর্শন থেকেই ভারতবর্ষে আশ্রম-ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল। এই আশ্রম কিন্তু ঋষির আশ্রম নয়, আশ্রম-ব্যবস্থা।
চতুর্বর্ণের বিষম ব্যবস্থায় শত দোষ থাকতে পারে, তার অনেকটাই আমরা বুঝে নিয়েছি। এমনকী ব্রহ্মচর্য আশ্রমে ছেলেপিলেদের লেখাপড়ার সময়টা কেমন কাটানো উচিত, সে সম্বন্ধেও মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু এই সেদিনও কবি-ঋষি শান্তিনিকেতনে ছেলেপিলেদের লেখাপড়ার যে আয়োজন করেছিলেন, তার মধ্যে দোষ থাকলেও আনন্দের ভাগটা অন্যরকম। গার্হস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েও আমার কোনও বক্তব্য নেই। কিন্তু মানুষ কতকাল গৃহস্থ অবস্থায় রতি-সুখ, সন্তান-সুখ ভোগ করবে, তার একটা সীমা ছিল। এই সীমার শেষ থেকেই বানপ্রস্থের আরম্ভ।
সাধারণ মতে সময়-সীমাটা পঞ্চাশ, কথায় বলে পঞ্চাশোর্ধ্বে বনং ব্রজেৎ। অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত দাম্পত্য এবং বাৎসল্য রস উপভোগ করে বেরিয়ে পড়ো ঘর থেকে। কথাটা বলা সহজ, কিন্তু কাজে খুব কঠিন। কারণ ততদিনে পঞ্চাশোর্ধ্ব বুড়ো-বুড়ির মধ্যে অন্যতর এবং আরও গাঢ়তর এক ঘনিষ্ঠতা জন্মে যায়; দিন যত যায় বাৎসল্যরসও ঘনীভূত হয় ততই। এই অবস্থায় ঘর ছেড়ে বেরনো বড় কঠিন। সেকালেও এটা কঠিন ছিল। স্বয়ং মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রই বেরোতে পারেননি এবং পারেননি বলেই নিজের বংশনাশ তাঁকে বড় কাছ থেকে দেখে যেতে হয়েছে। কিন্তু বেরনোর নিয়মটা “থিওরেটিক্যালি’ ছিলই। কবিশ্রেষ্ঠ কালিদাস বড় গৌরব করে রঘুবংশীয় নৃপতিদের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, যৌবনকালে তারা বিষয় সুখ চাইতেন বটে, কিন্তু বুড়ো বয়স হলেই তারা বনে চলে যেতেন–বার্ধকে মুনিবৃত্তীনাং যোগেনান্তে তনুত্যজা।
দেখুন, কবিরও মমতা ছিল। তিনিও পঞ্চাশোধেঁ বনে যেতে বলেননি; বলেছেন বুড়ো বয়সে বার্ধকে মুনিবৃত্তীনা। এইটাই কথা–ঘর থেকে বেরতে হবে। তা একটু বয়স বেশিই হোক, কিন্তু বেরতে হবে। আসলে পুত্র এবং পুত্রবধূকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত দেখেই বেরনো ভাল, তাতে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে মধুর, মনটা থাকে অসূয়াহীন– ভালয় ভালয় বিদায় দে মা আলোয় আলোয় চলে যাই। তা অনেকে পুত্রকে প্রতিষ্ঠিত দেখা মাত্রই বেরতে পারেন না, কারণ নাতি-নাতনির জন্য নিম্নগামিনী স্নেহধারায় আরও কিছু কাল কাটে। বাস্তববাদী কবি-ঋষিরা তাতেও আপত্তি করেননি। ভাবটা এই–যতদিন সম্মান নিয়ে আছ, ততদিন থাকো, কিন্তু সম্মানের অসম্ভাবনা মাত্রেই বেরিয়ে পড়। দুঃখের বিষয়–আজ আর কেউ বনে যায় না। গেলে, অনেক পারিবারিক অশান্তির নিরসন হয়ে যেত।
আপনারা স্বয়ং ব্যাসদেবের কথাটাই স্মরণ করুণ। তাঁর মা সত্যবতী কুরুবংশের ধারা রক্ষার জন্য অত্যন্ত বিব্রত ছিলেন। মহারাজ শান্তনুর ঔরসে আপন গর্ভজাত পুত্র দুটির মৃত্যু তাকে দেখতে হয়েছে। তারপর অতিকষ্টে পূর্বজাত পুত্র ব্যাসকে বুঝিয়ে দুই পুত্রবধূ অম্বিকা এবং অম্বালিকার গর্ভে দুটি নিয়োগজাত সন্তান পেয়েছিলেন। কুরুবংশের দুই অক্রূর– ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু। অন্ধত্বের জন্য ধৃতরাষ্ট্র রাজা হতে পারলেন না। রাজা হলেন পাণ্ডু। কিন্তু সিংহাসনস্থ পাণ্ডুর মৃত্যুও সত্যবতী দেখতে বাধ্য হলেন। আর কত?
হস্তিনাপুরে যেদিন পাণ্ডুর শ্রাদ্ধ হয়ে গেল, সেদিন ত্রিকালদর্শী ব্যাস জননী সত্যবতীকে সাবধান করে দিয়ে বললেন–সুখের দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে মা, যে সময় আসছে তোমার পক্ষে তা মোটেই ভাল নয়–অতিক্রান্তসুখাঃ কালাঃ। ব্যাস আরও বললেন মা! পৃথিবী তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছে, সামনের সমস্ত দিনই পাপে আর কষ্টে ভরা–শঃ শ্বঃ পাপিষ্ঠ-দিবসঃ পৃথিবী গতযৌবনা।
‘পৃথিবী গতযৌবনা’–মহাকবির ব্যঞ্জনা যাঁরা বোঝেন না, তাদের কী করে বোঝাব– এটা কত বড় কথা। আসলে প্রত্যেক মানুষের জীবনে যতদিন যৌবনকাল, যতদিন কর্মক্ষমতা, এই পৃথিবীও তার কাছে ততদিন যুবতী। কিন্তু মানুষের প্রৌঢ়ত্বের সঙ্গে পৃথিবীও প্রৌঢ়া হয়ে যায়, মানুষের বৃদ্ধত্বে পৃথিবীও বৃদ্ধা। অর্থাৎ ততদিনে সেই পৃথিবী আমার সন্তান বা সন্তানকল্পদের কাছে যুবতী রূপে ধরা দেয়। এঁরা বলেন, “জেনারেশন গ্যাপ’ আমরা বলি–তুমি যত বুড়ো হবে, তোমার পৃথিবীও তোমার সঙ্গে বুড়ি হবে, তুমি আর মেলাতে পারবে না। তোমার যুবক সন্তানের যুবতী পৃথিবীর সঙ্গে, তোমার বুড়ো বয়সের বুড়ি পৃথিবী মিলবে না। ব্যাস তাই বললেন–পৃথিবী গতযৌবনা। চলো মা এবার বনে গিয়ে মনের সুখে ঈশ্বরচিন্তা করবে।
কুন্তীর মনে আছে এসব কথা। মনে আছে বৃদ্ধা দিদি-শাশুড়ি তার দুই শাশুড়ি অম্বিকা এবং অম্বালিকার হাত ধরে বনে চলে গিয়েছিলেন। যুবতী পৃথিবী রয়ে গেল অন্ধ যুবক ধৃতরাষ্ট্রের হাতে। তারপর কুরুক্ষেত্রবাহিনী গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। কুন্তী তার শ্বশুরের শিক্ষায় নিজেই চলে যাচ্ছেন বনে। যুবতী পৃথিবী রইল তার যুবক পুত্রদের হাতে। তার তো আর কিছু করার নেই। ভীম বলেছিলেন–ছেলেরা তোমার রাজ্য পেয়েছে, সেই রাজ্য তুমি মনের সুখে ভোগ কর। কুন্তী সদর্পে উত্তর দিয়েছেন–রাজসুখ! রাজসুখ আমি অনেক ভোগ করেছি, পুত্র! আমার স্বামীর যখন সুখের দিন ছিল, তখন তার রাজত্বে রাজরানি হয়ে রাজ্যসুখ আমি অনেক ভোগ করেছি ভুক্তং রাজ্যফলং পুত্র ভর্তুর্মে বিপুলং পুরা। টাকা-পয়সা খরচা করার অজস্র স্বাধীনতা তিনি আমায় দিয়েছিলেন, অনেক অনেক দান করেছি আমি, তিনি কোনওদিন বাধা দেননি। আর আনন্দ! স্বামীর সঙ্গে একত্রে বসে সোমরস পান করেছি পীতঃ সোমো যথাবিধি। আর কী চাই?
কুন্তীর কথাগুলির মধ্যে যেমন এক বিশাল ব্যক্তিত্ব আছে, তেমন অধিকার-বোধের মর্যাদা। বস্তুত কুন্তীর মতো একজন বিদগ্ধা রমণী যে জীবনবোধের কথা বলেছেন, সে জীবনবোধ যদি আমাদের থাকত তা হলে সংসারের অনেক বিপন্নতা এবং অসহায়তা থেকেই আমরা মুক্তি পেতাম। এ-কথাটা আপনারা মানবেন কিনা জানি না, আমি অন্তত মানি যে, স্বামীর অধিকারে স্ত্রীর যত মর্যাদা, পুত্রের অধিকারে তত নয়। পুত্র যদি অনেক গুণে গুণীও হন, তবুও নয়। বৈষ্ণব কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বলা শৃঙ্গার রস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন–”দোহার যে সমরস ভরতমুনি জানে। অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য রসটা হল সমরস, দু’জনেই সে রসের সমান অংশীদার। এই মমতার সূত্রেই স্বামীর জীবিতকালে স্ত্রী যে অধিকার বোধ করেন, স্বেচ্ছায় যা দান-বিতরণ করতে পারেন, স্বামীর অবর্তমানে পুত্রের জমানায় সে অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে না। সমরস নয় বলেই তখন ব্যবহারে সংকোচ আসে। তা ছাড়া ততদিনে পুত্রের জীবনেও যেহেতু অন্যতরা এক সমরসিকার আবির্ভাব হয়, তাই জননীকে পূর্বতন স্মৃতি নিয়েই কাটাতে হয়। আর কুন্তীর মতো ব্যক্তিত্বময়ী রমণী হলে সেই পূর্বতন স্মৃতি নিয়েই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন– তাতে মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে।
সেকালের ক্ষত্রিয়া রাজমহিষীদের মদ্যপানে বাধা ছিল না। এখানে কুন্তী পাণ্ডুর সঙ্গে একসঙ্গে বসে মদ্যপান করতেন–অথবা সোমকে যদি মদ্য নাই বলেন, তবে একসঙ্গে বসে সোমসুধা পান করতেন–এই কথাটা এখানে খুব বড় কথা নয়। এখানে সোমপানের ব্যঞ্জনাটা হল–তারা একত্রে জীবনের চূড়ান্ত আনন্দও ভাগ করে নিতেন। কুন্তীর আনন্দের ভাণ্ডার সেদিনই পূর্ণ হয়ে গেছে। আজ স্বামীর অবর্তমানে পুত্রনির্ভর আনন্দে কুন্তীর তত ভরসা নেই, বরঞ্চ সংকোচ আছে, কেন না তাঁর কাছে এখন তার পৃথিবী গতযৌবনা। বরঞ্চ ক্ষত্রিয়া বন্ধু এবং রাজরমণীদের মর্যাদায় বিদুলার কথা বলে তিনি যে স্বামীর অবর্তমানেও পুত্রদের স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, এইটুকুই ক্ষত্রিয় বিধবার পক্ষে যথেষ্ট। পুত্রদের দেওয়া রাজ্যসুখে আজ আর তার কোনও আকাঙ্ক্ষাই নেই–নাহং রাজ্যফলং পুত্ৰা কাময়ে পুত্র-নির্জিত। রাজ্যসুখ তিনি স্বামীর আমলেই যথেষ্ট ভোগ করেছেন, এখন কোনও অগৌরবের ছোঁয়ায় সেই পূর্বতন গৌরব যাতে কলুষিত না হয়, সেইজন্যই আজ কুন্তীর এই অপ্রত্যাশিত বানপ্রস্থ।
স্বামীর মৃত্যুর পর কতগুলি অসহায় বালককে নিয়ে তিনি হস্তিনায় এসেছিলেন। সেইদিন থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কুন্তী তার ভাশুরঠাকুর ধৃতরাষ্ট্রের কাছে করুণা পাননি। আজ যখন বৃদ্ধ অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র, সহায়সম্বল সব গেছে, তখন কুন্তী অসীম করুণায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শাশুড়ি-কল্প গান্ধারীর অসহায় হাতে। তিনি আজ এই দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে নিয়ে চলেছেন হাত ধরে বনের পথে। স্বামীকে তিনি বেশিদিন ইহলোকে পাননি, তাঁর অবর্তমানে স্বামীর রক্ত-মাংস যাঁর দেহে-কোষে আছে, সেই ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করে তিনি খানিকটা স্বামীসেবার সান্ত্বনা পেতে চান। ছেলেদের বলেছেন দৃঢ় সংকল্পে–ফিরে যাও বাছারা–নিবর্তস্ব কুরুশ্রেষ্ঠ। জীবনের যে কটা দিন বাকি আছে, ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর মতো শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে আমি আমার পতিলোকে যাত্রা করতে চাই।
কুন্তী চলে গেলেন। সদর্পে মাথা উঁচু করে চলে গেলেন। যুধিষ্ঠির ভীম–এঁরা যেন একটু লজ্জাই পেলেন–ব্রীড়িতা সন্ন্যবর্তন্ত। ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী অবশ্য কুন্তীকে ফিরে যাওয়ার জন্য অনেক বোঝালেন, কিন্তু কুন্তী ফিরলেন না। ফিরলেন না, কারণ, আমার ধারণা, সেই শ্বশুর ব্যাসদেবের কথা কুন্তীর মনে আছে–পৃথিবী গতযৌবনা। ফিরলেন না, কারণ কুমার যুধিষ্ঠির পুত্রশোকার্তা ক্ষত্রিয়া জননীকে কর্ণের কথা বলে একবার হলেও অতিক্রম করেছে। এই অতিক্রম যে বারবার ঘটবে না তার কী মানে আছে–পৃথিবী গতযৌবনা। তার সময় চলে গেছে। কুন্তী যে দৃঢ়তা নিয়ে পুত্রদের যুদ্ধে উত্তেজিত করেছিলেন, সেই দৃঢ়তা নিয়েই আজ বনে চলে গেলেন।
অগত্যা যুধিষ্ঠির তার ভাইদের নিয়ে কৃষ্ণা-পাঞ্চালীকে নিয়ে ফিরে এলেন হস্তিনায়। মা চলে গেছেন, রাজকার্যে তাদের মন বসে না। কিছুদিন যাবার পরেই যুধিষ্ঠির লোক-লস্কর সঙ্গে নিয়ে ভাই, বউ আত্মীয় পরিজন সঙ্গে নিয়ে চললেন বনের পথে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। কুন্তীরা তখন সবাই শতযুপ মুনির অরণ্য আশ্রমে থাকেন। পাণ্ডবরা লোকমুখে খবর নিতে নিতে শতযুপের আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। তপস্বী বালকেরা বনের মধ্যে রাজপুরুষ, পাইক-বরকন্দাজ দেখে অবাক হয়ে গেল। যুধিষ্ঠির তপস্বী বালকদের শুধোলেন–আমরা যে শুনেছিলাম এখানেই আছেন তারা। কাউকেই তো দেখছি না। বালকেরা বলল–এই তো যমুনায় গেছেন জল আনতে, পুজোর জন্য ফুল তুলতে।
পাঁচ ভাই পাণ্ডব সঙ্গে সঙ্গে চললেন যমুনার দিকে। দেখলেন–বৃদ্ধা কুন্তী এবং গান্ধারী কলসী কাখে জল নিয়ে ফিরছেন যমুনা থেকে। সঙ্গে সুস্নাত ধৃতরাষ্ট্র। মাদ্রীপুত্র কনিষ্ঠ সহদেব তো শিশুর মতো ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন কুন্তীকে–সহদেবস্তু বেগেন প্রাধাবদ যত্র সা পৃথা। আমি আগেই বলেছি–কুন্তী এই সপত্নী পুত্রটিকে কত ভালবাসতেন। সহদেব কুন্তীকে জড়িয়ে ধরে যত কাঁদেন, কুন্তীও ততই কাঁদেন। সাকণ্ঠে সানন্দে আর কোনও বীরপুত্রের কথা না বলে গান্ধারীকে তিনি খবর দেন–আমার সহদেব এসেছে, দিদি, সহদেব এসেছে। পাণ্ডবরা একে একে সবাই কুন্তীর কাছে এলেন, তাঁদের কাখের কলসী তুলে নিলেন নিজের মাথায়। সবাই ফিরে এলেন শতযুপের আশ্রমে।
মহামতি ব্যাসের আজ অন্যরূপ। নিজেরই পুত্র-প্রপৌত্র, পুত্রবধূরা সব এক জায়গায়। ধৃতরাষ্ট্র-কুন্তী-গান্ধারীকে তপস্যার কুশল জিজ্ঞাসা করে বললেন–কী চাও তোমরা বলো। আজ আমি আমার যোগসিদ্ধির ঐশ্বর্য দেখাব। বলো কী চাও? ব্যাস বুঝতে পারছিলেন– ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী এই নির্জন বনে এসে যত তপস্যাই করুন, তাঁদের মনে এখনও কাটার মতো ফুটে আছে শত-পুত্রের শোক। ব্যাসের কথা শুনেই ধৃতরাষ্ট্র কেঁদে ফেললেন। গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের মনের কথা কেড়ে নিয়ে দ্রৌপদী, সুভদ্রা, সবার মন বুঝে বললেন– এতই যদি আপনার দয়া, তবে আমার মতো অভাগা রমণীদের, যাদের পুত্র গেছে, স্বামী গেছে কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে, তাঁদের স্বামী-পুত্রদের একবার দেখান না দয়া করে।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কুন্তীর মনের মধ্যে বিদ্যুৎশিখার মতো ভেসে এল কর্ণের প্রতিচ্ছবি, চিরকালের লুকিয়ে রাখা সূর্য-সম্ভবা দীপ্তি-কর্ণ, সেও কি লুকিয়ে রাখা যায়? একবার কি কুন্তী অসাড়ে অস্পষ্টভাবে উচ্চারণও করে ফেলেছিলেন কর্ণের নাম? কেন ব্যাসের বিশেষণ দেখছি–দূরশ্রবণদর্শনঃ–যিনি দূরের কথা শুনতে পান, মনের ছবি দেখতে পান। ব্যাস কুন্তীকে দেখলেন বড় মনমরা। স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করলেন–কুন্তী। বলো তুমি। তোমার মনে কীসের কষ্ট; খুলে বলো আমায়।
এই মুহূর্তে কুন্তীকে আমরা দেখছি আত্মনিবেদনের পরম পরিসরে। কুন্তী বললেন–আপনি আমার সাক্ষাৎ শ্বশুর। দেবতার দেবতা। আমার এই চরম সত্যের স্বীকারোক্তি আমার দেবতাদের দেবতাকে আমি শোনাতে চাই–স মে দেবাতিদেবং শৃণু সত্যাং গিরো মম।
আমার সহৃদয় পাঠককুল। আমি আগেই আপনাদের জানাই–কুন্তী কর্ণের কথা বলবেন। মনে রাখবেন–এখানে তার পুত্র যুধিষ্ঠির বসে আছেন, যে যুধিষ্ঠির মাকে মৃদু অভিশাপ দিয়েছিলেন কর্ণের কারণে। মনে রাখবেন, এখানে তার স্বামীজ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র আছেন, গান্ধারী আছেন, আছেন কুলবধূরা–যাঁরা শাশুড়ির কীর্তি শুনে ছ্যা-ছ্যা করতে পারেন। কুন্তী আজ সবার সামনে, বিশেষত দেবকল্প শ্বশুর ব্যাসের সামনে নিজের চরম স্বীকারোক্তি করছেন। প্রথমজন্মা সূর্যসম্ভব যে পুত্রটি তার সারাজীবনের পুলক-দীপ্তি হয়ে থাকতে পারত, তাকে সারাজীবন লুকিয়ে রাখার যন্ত্রণা তাকে পাপের মতো পুড়িয়ে মারে। যে সারা জীবন পাপের মতো করে অন্তরে লুকিয়ে ছিল, তাকেই আজকে কুন্তী দেখতে চান এবং দেখাতে চান সবার সামনে, প্রাণ ভরে, প্রথম পুত্রের সম্পূর্ণ মর্যাদায়।
এই ঘটনাটা আমি কুন্তীর জীবনে অসীম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। জীবনের আরম্ভে প্রথম যৌবনের রোমাঞ্চের দিনে যাঁকে দিয়ে কুন্তী প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন, সারাজীবন তাকে মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে আজ তিনি তাকে সর্বসমক্ষে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। পাঁচ ভাই পাণ্ডবকে স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠা করা তাঁর কাছে যতখানি ছিল, এ তার থেকেও বেশি–আপন মাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা, প্রথমজন্মা পুত্রের প্রতিষ্ঠা। কুন্তী যাঁকে দিয়ে জীবন আরম্ভ করেছিলেন আজ শেষের দিনে তাকেই দেখতে চাইছেন। পরম প্রিয় স্বামী নয়, পুত্রদাতা দেবতাদের নয়, যাকে দিয়ে কুন্তী নিজের গর্ভের মধ্যে দ্বিতীয় সত্তার আনন্দ পেয়েছিলেন প্রথম, কুন্তী তাকেই শেষের দিনে দেখতে চাইছেন, দেখতে চাইছেন কর্ণকে। হয়তো এইজন্যই, এই মাতৃত্বের প্রতিষ্ঠার জন্যই কুন্তী পঞ্চ পুণ্যবতী রমণীর মধ্যে একতমা–অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা। এর পরেও কে তাকে কুলঙ্কষা বলে তিরস্কার করবে?
কুন্তী বললেন–আপনি তো জানেন, সেই ঋষি দুর্বাসা কেমন করে ছিলেন আমার ঘরে। কেমন করে আমি তার সেবা করেছি। সেই যুবতী বয়সে তার ওপরে রাগের কারণ অনেক ছিল আমার, কিন্তু আমি ক্রুদ্ধ হইনি। আমি যে তার কাছে বর নিয়েছি, তাও তার শাপের ভয়ে, আমি নিজে কোনও বর চাইনি। তিনি দেবতার আহ্বান আর সঙ্গমের মন্ত্র দিলেন আমার কানে। তখন আমার কী বা বয়স, যৌবনের স্পষ্টাস্পষ্ট রহস্য জানতে গিয়ে আমি সেদিন আহ্বান করে বসলাম দেব দিবাকরকে। আমার মূঢ় হৃদয়ের কৌতূহলী আহ্বান সত্য করে দিয়ে হঠাৎ তিনি এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। বিশ্বাস করুন–আমি তখন কঁপছিলাম। কত কেঁদে পায়ে ধরে বলেছিলাম–তুমি চলে যাও এখান থেকে গম্যতামিতি। কিন্তু গেলেন না, শাপের ভয়, ধ্বংসের ভয় দেখিয়ে নিজের দীপ্ত তেজে আমাকে আকুল করে আমাতে আবিষ্ট হলেন তিনি–ততো মাং তেজসাবিশ্য মোহয়িত্বা চ ভানুমা। হায়! তারপর সেই গূঢ় জাত প্ৰথমজন্মা পুত্রকে আমার জলে ভাসিয়ে দিতে হল। সূর্যের প্রসন্নতায় আমি যেমন অনূঢ়া কন্যাটির মতো ছিলাম, তাই হলাম আবার।
তবু, কিন্তু তবু, সেদিন আমার সেই ছেলেটিকে–যাকে আমি আমার ছেলে বলে জেনেও অবহেলা করলাম, ভাসিয়ে দিলাম জলে, তার জন্য আমার শরীর মন সবসময় জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। আপনি বোঝেনও সে কথা–তন্মাং দহতি বিপ্রর্ষে যথা সুবিদিতং তব। এতক্ষণ সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করে কুন্তী এবার তার কৃতকর্মের ন্যায়-অন্যায় যাচাই করতে চাইছেন। কুন্তী জানালেন–সব আপনাকে বললাম। আমার পাপ হয়েছে, না হয়নি, আমি তার কিচ্ছু জানি না। আমি শুধু আমার সেই ছেলেকে একবার দেখতে চাই–তং দুষ্টুমিচ্ছামি ভগব–আপনিই তাকে দেখাতে পারেন।
অসামান্য দীর্ঘদর্শিতার কারণে ব্যাস জানেন যে, কন্যা অবস্থায় পুত্রজন্মের জন্য কুন্তীর চরিত্রে পাপের স্পর্শ লেগেছিল কি না–এই প্রশ্ন কুন্তীকে যেমন সারাজীবন কুরে কুরে খেয়েছে, তেমনি এই প্রশ্ন অন্যদের মনেও আছে। কুন্তীর কথার উত্তরে ব্যাস প্রথমে বললেন–তোমার কোনও দোষ ছিল না কুন্তী–অপরাধশ্চ তে নাস্তি। আর দোষ ছিল না বলেই পুত্রের জন্মের পরেও তুমি দেবতার আশীর্বাদে পূর্বের সেই কন্যাভাব আবারও লাভ করেছ। আসলে কী জান–দেবতারা ওইরকমই। তাদের অলৌকিক সিদ্ধি আছে, অতএব ওইভাবেই তারা মনুষ্যশরীরে আবিষ্ট হন। তাদের এই অলৌকিক দেহ-সংক্রমণ সত্ত্বেও তুমি যেহেতু অন্য মানুষের মতোই মনুষ্যধর্মেই বর্তমান, সেই হেতু তোমার কোনও দোষ এখানে নেই। ভাবটা এই–যদি দোষ থাকে তবে সেই দেবতার। তবে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাস তার এই ভাব-ব্যঞ্জনা শুদ্ধ করে দিয়ে বলেছেন–আসলে কারওই দোষ নয় কুন্তী–অসামান্য দৈব তেজে বলীয়ান ব্যক্তির দোষ সাধারণের মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না, বড় মানুষের সবই ভাল, সবই শুদ্ধ। আর তোমার কী দোষ, তুমি আগেও যা ছিলে, দেবসঙ্গমের পরেও তাই ছিলে–সেই লজ্জারুণা কন্যাটি কন্যাভাবং গতা হ্যসি।
প্রশ্নের মীমাংসা হল। মীমাংসা করলেন মহাভারতের হৃদয়-জানা কবি, মীমাংসা করলেন ঋষি-সমাজের মূর্ধণ্য-ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত কন্যা-সত্যবতীর জাতক পারাশর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। ব্যাস উত্তর দিলেন মানে, প্রশ্নের সমাধান সবারই হয়ে গেছে। এইবার মৃতজনদের সামনে নিয়ে আসার জন্য আপন যোগেশ্বর্য প্রকট করবেন ব্যাস। তিনি ভাগীরথীতে স্নান করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মৃত প্রিয়জনদের আহ্বান করলেন আবাহান মন্ত্রে। ভাগীরথীর তীরে তুমুল কোলাহল শোনা গেল–কর্ণ, দুর্যোধন, অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে, দুঃশাসন, শকুনি, ঘটোৎকচ সবাই সশরীরে দেখা দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা– সকলে আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়লেন।
লক্ষণীয় বিষয় হল–এই যে মৃত ব্যক্তিরা সব ব্যাসের তপঃসাধনে ভাগীরথী তীরে সশরীরে উপস্থিত হলেন, এঁদের কারও মনে কোনও গ্লানি নেই, ক্রোধ নেই, অসূয়া নেই, ঈর্ষা নেই–নির্বৈরা নিরহংকারা বিগতক্ৰোধমৎসরাঃ। অত্যন্ত স্বাভাবিক রাজকীয় মর্যাদায় তাদের দেখা যাচ্ছে। যেমন তাদের বেশ-ভূষা, তেমনই ভাস্বর তাদের শরীর-সংস্থান। জীবিত অবস্থায় যে মহাবীরের যেমন বেশ ছিল, যেমন ছিল তাদের রথ, বাহন, ঠিক তেমনই রথে চড়ে, ঘোড়ায় চড়ে রাজপুতুর সব উপস্থিত হলেন মায়ের সামনে, পিতার সামনে, প্রিয়তমা পত্নীর সামনে।
এমন করে কুন্তী কর্ণকে কোনওদিন দেখেননি। এমনভাবে, এমন সহানুভূতির মহিমায় কোনওদিন কুন্তী কর্ণকে এমন দেখেননি। পুনর্জীবিত অবস্থায় কর্ণকে কুন্তী দেখলেন অন্য এক মূর্তিতে। ভাগীরথীর তীরে কর্ণকে দেখামাত্রই পাঁচভাই পাণ্ডবরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ধেয়ে গেলেন তার দিকে সম্প্রহর্ষাৎ সমাজগ্মঃ। পরস্পরকে স্বাভাবিক ভ্রাতৃস্থানে পেয়ে ভারী খুশি হলেন তারা–ততস্তে প্ৰীয়মানা বৈ কর্ণেন সহ পাণ্ডবাঃ।
ঠিক এইরকম একটা দৃশ্যই তো কুন্তী সারাটা জীবন ধরে পরম কামনায় দেখতে চেয়েছেন। পাঁচ ভাই নয়, ছয় ভাই যেন এই অনন্ত সৌহার্দ্যে বাধা পড়ে–এই তো কুন্তীর চিরকালের বাসনা। শ্বশুর ব্যাসের করুণায়–চিত্রং পটগতং যথা–এই পরম ঈপ্সিত ছয় ভাইয়ের মিলন দেখে কুন্তীর সব আশা পূরণ হয়ে গেল। টীকাকার নীলকণ্ঠ লিখেছেন–এই দৃশ্যকে স্বপ্ন বলা যাবে না, কেননা তা হলে বলতে হবে ব্যাস ‘ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। মোহ বা ভ্রান্তিও বলা যাবে না কারণ ঋষি-চূড়ামণি ব্যাস আপন বিদ্যায় এবং তপস্যার মাহাত্ম্যে এই নিষ্পাপ প্রত্যক্ষ মনুষ্য-রূপ দেখাচ্ছেন। বস্তুত কুন্তী যে ব্যাসের বিদ্যায় পুত্রকে স্বরূপে দেখতে চেয়েছিলেন, তা শুধু এই অসামান্য দৃশ্যটির জন্য। মহাভারতের কবি এ-কথা লেখেননি যে, কর্ণকে দেখামাত্র কুন্তী ছুটে গেছেন তাঁর কাছে। লিখেছেন–ভাইরা সানন্দে ছুটে গেছেন তার কাছে। কুন্তী তো এইটাই দেখতে চেয়েছেন সারা জীবন ধরে। তার কন্যা অবস্থার প্রচ্ছন্নজাত পুত্রটি স্নেহের সরণিতে কোনওমতেই যে বিধিসম্মত পুত্রদের থেকে আলাদা নয়, সেই প্রতিষ্ঠাই তার জীবনের প্রতিষ্ঠা।
বস্তুত এই অসম্ভব এবং অসামান্য এক চিত্রকল্পের পর আমার দিক থেকে কুন্তীর জীবনের আর কোনও ঘটনা জানানোর ইচ্ছে নেই। মহাভারতকে পৌরাণিকেরা ‘ইতিহাস’ বলেন। কুরু-পাণ্ডব বংশের সার্থক ঐতিহাসিক হিসেবে এরপর ব্যাসকে লিখতে হয়েছে পাণ্ডবদের হস্তিনায় ফিরে যাওয়ার কথা। লিখতে হয়েছে–কেমন করে যাবার সময় পাণ্ডব-কনিষ্ঠ সহদেব কুন্তীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিলেন-মা! এই অরণ্য আশ্রমে তোমায় ফেলে রেখে কিছুতেই আমি হস্তিনায় ফিরে যাব না। লিখতে হয়েছে নির্জন বৈরাগ্য সাধনের জন্য কীভাবে কুন্তী সহদেবকে সাশ্রু বিদায় দিয়েছেন। এমনকী লিখতে হয়েছে প্রজ্জ্বলিত দাবানলে তপোনিষ্ঠ কুন্তীর মৃত্যুর কথাও।
কিন্তু কেন জানি না–ওই ভাগীরথী-তীরে কর্ণকে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে মিলিত দেখার ঘটনাই আমার কাছে কুন্তীর জীবনের শেষ দৃশ্য বলে মনে হয়। পরেরটুকু মহাকাব্য নয়, ইতিহাস, সমস্ত মহাভারতের মধ্যে প্রায় কোনও অবস্থাতেই কুন্তীকে আমরা নিশ্চিন্ত এবং আনন্দিত দেখিনি। সেই কন্যা অবস্থায় রাজপ্রাসাদের অলিন্দে রক্তিম সূর্যকে দেখে কুন্তীকে আমরা সানন্দ-কুতুহলে যৌবনের আহ্বান জানাতে দেখেছিলাম। আর আজ এই ভাগীরথীতীরে তার প্রথমজন্মা পুত্রের প্রত্যক্ষ প্রতিষ্ঠায় কুন্তীকে আমরা সানন্দমনে তপস্যার পথে পা বাড়াতে দেখলাম। ব্যাসকে তিনি বলেছিলে–পাপ হোক পুণ্য হোক আমি আমার সেই ছেলেকে একবার দেখতে চাই। কিন্তু কর্ণের ওই ভ্রাতৃমিলনের পর কুন্তীকে এখন আমরা অনন্ত বৈরাগ্যময় এক বিশাল বিশ্রামের মধ্যে পরিতৃপ্ত দেখতে পাচ্ছি, যে দুধের ছেলেটিকে কুন্তী জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, সেই জল বাহ্যত অশ্বনদীর হলেও কুন্তীর অন্তরবাহিনী ফল্গু নদীতে কর্ণ চিরকাল ভেসে চলেছেন। আজ ব্যাসের ইচ্ছায় সেই অন্তর ফল্লুর বালি খুঁড়ে কুন্তী কর্ণকে তুলে আনলেন সবার সামনে। এর পরে আর তার পাবার কিছু নেই। যাঁকে প্রথম দিনে পেয়েছিলেন অসীম কৌতুকে ছলনায়, আজ শেষের দিনে তাকেই পেলেন আন্তর প্রতিষ্ঠায়, পরম প্রশান্তিতে। এখন তার কোনও পাপবোধ নেই, জবাবদিহি নেই, শান্ত সুস্থভাবে এখন তিনি ছেলেদের বলতে পারেন–তোমরা প্রকৃতিস্থ হও বাছারা–স্বস্থা ভবত পুত্রকাঃ। তোমরা ফিরে যাও, আমাদের আয়ু আর বেশি নেই– তস্মাৎ পুত্ৰক গচ্ছ ত্বং শিষ্টমল্পং চ নঃ প্রভো।
তোমরা প্রকৃতিস্থ হও, ফিরে যাও এবার–এ-কথাটা কুন্তীকে বলতে হয়েছে সর্বশেষের মায়া কাটিয়ে। ব্যাসের যোগজ পুণ্যবলে কুন্তী তার মৃত পুত্রকে দেখে খুশি হয়েই ছিলেন, আর কোনও আক্ষেপও ছিল না তার। কিন্তু যুধিষ্ঠির তার ভাই এবং ভার্যাদের নিয়ে তখনও ধৃতরাষ্ট্রের অরণ্য আবাসে আছেন এবং তাতে প্রত্যেকেরই মায়া বাড়ছে বই কমছে না। দুই পক্ষেই কোনও ভাবান্তর না দেখে বৈরাগ্যবিদ্য ব্যাসই শেষে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, যুধিষ্ঠির তো এবার দেশে ফিরে যেতে চাইছে, রাজ্যপালন তো আর সোজা কথা নয়। ওর যাওয়া দরকার। তুমি বিদায় দাও ওকে। ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বিদায় দিয়ে বললেন, তোমার মাধ্যমেই আমি পুত্রলাভের ফল পেয়েছি, তুমি এই অরণ্য-আবাসে এসেও আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছ, তুমি ফিরে যাও এবার। ধৃতরাষ্ট্র এবার মায়ার কথাটা বলেই ফেললেন। বললেন, দেখো বাছা! এখানে আমরা ত্যাগ বৈরাগ্যের ব্রত নিয়ে আছি, তুমি এখানে থাকলে পরে স্নেহ-মায়ায় সেই তপস্যার ক্ষতি হয়। অতএব তুমি ফিরে যাও এবার– ভবন্তঞ্চে সম্প্রেক্ষ্য তপো মে পরিহীয়তে।
তার নিজের কথাটা যে কুন্তীর ব্যাপারেও খাটে, সেটা বুঝেই ধৃতরাষ্ট্র বললেন, তোমার দুই মা, গান্ধারী এবং কুন্তী শুকনো পাতা খেয়ে আমারই মতো নিয়ম পালন করে চলেছেন– মাতরৌ তে তথৈবেমে জীর্ণপর্ণাকৃতাশনে খুব বেশিদিন এঁরা বাঁচবেনও না। তা ছাড়া জীবনে যা পাবার ছিল পেয়েছি, এখন কঠিন তপস্যাই করতে চাই, তুমি ফিরে যাও। ধৃতরাষ্ট্রের কথা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, আমাকে এইভাবে আপনি বিদায় দেবেন না। আমার ভাইরা বরং সবাই ফিরে যাক হস্তিনায়, এখানে আমি আপনার এবং আমার দুই জননীর সেবা করে দিন কাটাতে চাই সংযত হয়ে। এটা বোঝাই যায় যে, ছেলেদের নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী যত যন্ত্রণা পেয়েছেন, এখন তাতে এই বৈরাগ্যের সাধন তাদের প্রায়শ্চিত্তের মতো, কিন্তু কুন্তীর এই কঠিন তপশ্চরণ যুধিষ্ঠির মেনে নিতে পারছেন না। আমাদের ধারণা, সেই কারণেই যুধিষ্ঠির একাকিনী মায়ের জন্য তিনজনের সেবাই অঙ্গীকার করতে চাইছেন।
আমাদের তর্কানুমান যে সত্যি, তা যুধিষ্ঠিরের পরবর্তী কথা থেকেই প্রমাণ হয়ে যায়। ধৃতরাষ্ট্রের মতো গান্ধারীও যখন যুধিষ্ঠিরের আবেদন-নিবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন, তখন স্নেহশীলা জননী কুন্তীর চোখে কিন্তু জল এসে গেছে, যুধিষ্ঠির গান্ধারীর প্রত্যাখ্যাত অশ্রুজল মুছে নিয়ে রোদনপরা কুন্তীকে নিজের মানসিক অবস্থার কথাটা সবিস্তারেই জানালেন– স্নেহবাষ্পকুলে নেত্রে প্রমৃজ্য রুদতীং বচঃ। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘মা! যশস্বিনী গান্ধারী তো আমাকে বিদায় দিয়ে দিলেন, কিন্তু তুমি আমার গর্ভধারিণী মা, তোমার ওপর থেকে মন উঠিয়ে নিলে আমার যে দুঃখ হবে, সেই দুঃক বুকে নিয়ে আমি ফিরে যাই কী করে– ভবত্যাং বদ্ধচিত্তস্তু কথং যাস্যামি দুঃখিতঃ?
সত্যি বলতে কী, জাগতিক জীবনের অনন্ত জটিলতা এবং এক বিরাট যুদ্ধের অবক্ষয় দেখে যুধিষ্ঠিরের মনেও এক ধরনের নির্বেদ উপস্থিত হয়েছে। হস্তিনায় রাজ্যাভিষেকের প্রাক্-মুহূর্তে তার অনীহা আমরা দেখেছি, এখন বোধ করি কুন্তীকে দেখে তিনি আরও অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। কুন্তী তো তার পুত্রদের সদ্যোলব্ধ সমৃদ্ধ রাজৈশ্বর্য ছেড়ে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর অনুগামিতায় বনবাসী হয়েছেন। অনেক থাকা সত্ত্বেও সেই ধনৈশ্বর্য ত্যাগ করে আসার মধ্যেই ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে যুধিষ্ঠির এই তত্ত্বটা তার মায়ের উদাহরণেই সবচেয়ে ভাল বোঝেন বলে আজ এই অরণ্য-আবাসের মধ্যে বৈরাগ্যের সাধনই তার কাছে শ্রেয় এবং প্রেয় বলে মনে হচ্ছে। তিনি কুন্তীকে বললেন, ধর্মচারিণী মা আমার! আমি তোমার তপস্যায় কোনও বাধা দিতে চাই না, কেননা তপস্যার ওপরে মঙ্গল-লাভের আর কোনও উপায় নেই। কিন্তু এটাও জেনো, আমারও আর আগের মতো রাজ্য-শাসনে নিযুক্ত থাকতে ইচ্ছে করে নামমাপি ন তথা রাজ্ঞি রাজ্যে বুদ্ধিৰ্যথা পুরা। আমারও তাই তপস্যার দিকেই মন তৈরি হয়েছে।
মহাভারতের পূর্বাংশ থেকে আমরা জানি যে, রাজ্যশাসন এবং প্রজাপিলনের ক্ষাত্রবৃত্তি যুধিষ্ঠিরের কোনও কালেই পছন্দ ছিল না, এমনকী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধোত্তর কালে দ্বিতীয়বার তিনি রাজ্য গ্রহণই করতে চাননি। বিশেষত, আপনজনদের মৃত্যুর অনুতাপ যুধিষ্ঠির এখনও ভুলতেই পারেননি। ফলত তার প্রতিক্রিয়াটা এই বানপ্রস্থের পরিসরে অন্যদের চেয়ে আলাদা। কুন্তীকে তিনি বলেছেন– রাজ্যশাসন করতে আর আমার ভাল লাগে না, মা! এই পৃথিবী শূন্য হয়ে গেছে, আত্মীয়-বন্ধুরা কেউই প্রায় বেঁচে নেই, ফলে মিত্রহীন অবস্থায় আমার শক্তিও তো আর আগের মতো নেই– বান্ধবা নঃ পরিক্ষীণা বলং নো ন যথা পুরা। আমাদের বড় সহায় এবং বৈবাহিক কুটুম্ব ছিলেন পাঞ্চালরা, তারা এখন মানুষের কথায় এবং স্মরণ-কর্মে অবশিষ্ট আছেন মাত্র, শেষমেশ অশ্বত্থামা তাদের এমনই সর্বনাশ করেছে যে, তাদের বংশধর কাউকে খুঁজে পাই না আমি। তারা শেষ হয়ে গেছেন– পাঞ্চালাঃ সুভূশং ক্ষীণা কথামাত্রাবশেষিতাঃ। শিশুপালের মৃত্যুর পর চেদিবংশীয়রা এবং অজ্ঞাতবাসের সুবাদে মৎস্যদেশীয়রা আমাদের বন্ধু হয়েছিলেন। এই যুদ্ধে শেষ হয়ে গেছেন তারাও। শুধু বৃষ্ণিবংশীয়রা বেঁচে আছে এবং সেই বংশেও শুধু কৃষ্ণ আছেন বলে এখনও আমি রাজধর্ম পালন করে যাচ্ছি।
যুধিষ্ঠির নিজের নিরানন্দের বার্তা দিয়ে কুন্তীকে বলতে চাইছেন– আমি আর ঘরে ফিরতে চাই না। এরপর ধৃতরাষ্ট্রও কঠিন তপস্যায় নিমগ্ন হবেন, তোমার দেখভালের জন্য একজন পুরুষও অবশিষ্ট থাকবে না। অতএব আমি এখানে থেকে যেতে চাই। যুধিষ্ঠিরের এই বৈরাগ্যযোগে প্রথম যিনি বাধা হয়ে দঁড়ালেন, তিনি পাণ্ডব-কনিষ্ঠ সহদেব। মাদ্রীর এই ছেলেটির জন্য কুন্তীর স্নেহের অন্ত ছিল না। পাণ্ডবদের বনবাস-যাত্রার সময় নিজের গর্ভজাত কোনও ছেলের জন্য পুত্রবধূ দ্রৌপদীকে তিনি অনুনয় করেননি, কিন্তু সহদেবের জন্য পুত্রবধূর কাছেও অনুরোধ করেছিলেন কুন্তী। বস্তুত তার জন্য কুন্তীর এই মায়ার কথা সহদেবও জানেন, আর সেইজন্যই যুধিষ্ঠিরকে বাধা দিয়ে সহদেব বললেন, আমি থাকব এখানে। পিতৃকল্প ধৃতরাষ্ট্র এবং দুই মায়ের সেবা করে আমি শরীর শুষ্ক করতে চাই এখানে। আমি কুন্তী-মাকে ছেড়ে কোথাও যাব না, দাদা! তুমি হস্তিনায় ফিরে যাও– নোৎসহেহহং পরিত্যক্তৃং মাতরং ভরতভ।
কুন্তী স্নেহের আবেগে জড়িয়ে ধরলেন সহদেবকে। সেই কোন শিশুকালে স্বামী সহমরণে যাবার আগে মাত্রী তাকে বলে গিয়েছিলেন– আমার এই ছেলে দুটিকে দেখে রেখো। কিন্তু দেখতে দেখতে এই কনিষ্ঠতমটির ওপরে কুন্তীর এতই স্নেহ জন্মেছিল যে, সহদেব কিছু বললে কুন্তীর পক্ষে তাকে প্রত্যাখ্যান করা প্রায় অসম্ভব হয়। তবুও কুন্তী দীর্ঘ বনবাসের স্থিতবুদ্ধিতে এবং পরম নিষ্কামতায় সহদেবকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, সহদেব। এমন করে তুই বলিস না বাছা! আমার কথা শোন, তোমরা সবাই হস্তিনায় ফিরে যাও– গম্যতাং পুত্র মৈবং ত্বং বোচঃ কুরু বচো মম। তোমরা এখানে এসেছিলে খুব ভাল হয়েছে, তোমরা ভাল থাকো সকলে, কিন্তু এটাও তো বুঝবে বাছারা যে, তোমাদের স্নেহমায়ায় যদি আবদ্ধ হয়ে পড়ি, তা হলে আর এই বৈরাগ্যের তপস্যা করব কী করে? তোমরা যে কেউ এখানে থাকলে তোমাদের মায়ায় তপস্যার পথ থেকে ভ্রষ্ট হব আমরা। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের আর আয়ু বেশি নেই, অতএব ফিরে যাও, বাছা! কুন্তী সহদেবকে উদ্দেশ করেই শেষ কথাটা বললেন– তস্মাৎ পুত্ৰক গচ্ছ ত্বং শিষ্টমল্পঞ্চ নঃ প্রভো৷
কুন্তীর কথায় সহদেবেরও আর উপায় থাকল না, যুধিষ্ঠিরেরও আর উপায় থাকল না থেকে যাবার। পাণ্ডবরা গান্ধারী এবং কুন্তীর চরণ ধরে যাবার অনুমতি চাইলেন সাকণ্ঠে। ব্যাস লিখেছেন, গোবৎসকে জননীর দুগ্ধপান থেকে নিবারিত করলে সে যেমন গাভী মায়ের দিকে বারবার চায়, আর চরম অনিচ্ছায় যেতে বাধ্য হয়, পাণ্ডবরা তেমনই কুন্তীর দিকে বারবার তাকাতে তাকাতে হস্তিনায় ফিরে যাবার পথ ধরলেন অনিচ্ছায়– পুনঃ পুনঃ নিরীক্ষন্তঃ প্রচক্রুস্তে প্রদক্ষিণম্।
হস্তিনায় ফিরে আসার পর দুই বৎসর কেটে গেছে। পাণ্ডবরা কুন্তীর কোনও খবর পাননি। আর তিনি যেভাবে বলেছিলেন, তোমরা কেউ এখানে থাকলে আমাদের তপস্যার বিঘ্ন হয়– উপরোধো ভবেদেবম্ অস্মাকং তপসঃ কৃতে– তাতে যুধিষ্ঠিরদের কারও আর সাহসও হয়নি আবার গিয়ে তার খবর নেবার। বস্তুত পাণ্ডব-ভাইরা সবাই কুন্তীকে চেনেন, তার ‘অথরিটি, তার গম্ভীরতা এবং সবার ওপরে তাঁর কথার মূল্য। যে জননী বনবাসী পুত্রদের উদ্দেশে মৃত্যুপণে যুদ্ধের পরামর্শ দিয়েছিলেন, যিনি সুদুস্ত্যজা রাজলক্ষ্মীকে হেলায় ফিরিয়ে দিয়ে পুত্রহীনা গান্ধারী এবং অন্ধ ভাশুরের সেবার জন্য বানপ্রস্থে গেছেন, তাঁর বারণ সত্ত্বেও সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করাটা পাণ্ডবদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। যুধিষ্ঠির তাই সেদিকে পা বাড়াননি, কিন্তু খবরটা পেতে যেন একটু দেরিই হয়ে গেল।
অন্তত দু-বছর পর দেবর্ষি নারদ ঘুরতে ঘুরতে হস্তিনায় এসে পৌঁছোলেন। যুধিষ্ঠির তার কাছে খবর চাইলে নারদ বললেন, আমি এখন ধৃতরাষ্ট্রের তপোবন থেকেই আসছি। যুধিষ্ঠির আকুল হয়ে ধৃতরাষ্ট্র, সঞ্জয়, গান্ধারী এবং কুন্তীর খবর জিজ্ঞাসা করলেন। নারদ বললেন, সে অনেক কথা। তোমরা সেই তপোবন থেকে হস্তিনায় চলে এলে তোমার জ্যাঠা ধৃতরাষ্ট্র কুরুক্ষেত্রের প্রান্ত ছেড়ে গঙ্গাদ্বারে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন গান্ধারী, কুন্তী এবং সঞ্জয়। ধৃতরাষ্ট্র যথেষ্ট কৃচ্ছসাধন করে তপস্যা করছিলেন, তার সঙ্গে গান্ধারীও। গান্ধারী যদি বা জলটুকু খাচ্ছিলেন, কুন্তী তাও নয়। তিনি এক মাস ধরে উপোস করে চলেছেন– গান্ধারী তু জলাহারী কুন্তী মাসোেপবাসিনী। বনের মধ্যে থাকলেও ধৃতরাষ্ট্র এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেন না। সমস্যা ছিল, যেখানেই তিনি যেতেন, গান্ধারী অন্ধ স্বামীকে একা ছেড়ে দিতেন না কখনও, আবার এই দুই অন্ধজনকে পথ দেখিয়ে নেবার জন্য কুন্তীকেও যেতে হত তাদের সঙ্গে। সূত সঞ্জয় প্রধানত ধৃতরাষ্ট্রকে সাহায্য করতেন উচ্চাবচ পথ চলতে, আর কুন্তী হয়ে উঠতেন গান্ধারীর চক্ষু– গান্ধাৰ্য্যাশ্চ পৃথা চৈব চক্ষুরাসীদনিন্দিতা।
বানপ্রস্থের এই কালে কুন্তীর জীবন অনেকটাই ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর সেবাব্রতে কাটছে, তিনি কুন্তী যে ধরনের উপবাসাদি কৃচ্ছুতায় কাল কাটাচ্ছিলেন, তাতে খুব স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি শরীর-শোষণের মাধ্যমে নিজের আয়ু ক্ষয় করে দিতে চাইছেন। ইউথানাশিয়া, ‘মার্সি কিলিং’, ‘অনার কিলিং’ এইসব নিয়ে যাঁরা আজকাল মাথা ঘামান, তাদের প্রশ্নে আমি অনেকবারই এই উত্তর দিয়েছি যে, আত্মহত্যা মহাপাপ হলেও আমাদের দেশে কিন্তু ইচ্ছামৃত্যুর কিছু কিছু পরিসর ছিল। পৌরাণিক-স্মার্তরাও অতিবৃদ্ধ জরাগ্রস্ত অবস্থায়, দুরারোগ্য মহাব্যাধির দ্বারা পীড়িত অবস্থায় নিজেদের মৃত্যু ত্বরান্বিত করার বিধান দিয়েছেন কতগুলি বিশিষ্ট উপায়ের মাধ্যমে। তার মধ্যে প্রায়োপবেশন, অগ্নিপ্রবেশ, জলে ডুবে মৃত্যুবরণ, অথবা উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে মৃত্যু ঘটানো– এগুলি আছে। এখানে বানপ্রস্থী ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী এবং সঞ্জয়কে যেভাবে উপবাসের মাধ্যমে দিন-দিন কৃশ থেকে কৃশতর হতে দেখছি, তাতে দেখছি তপস্যা-ব্রত-উপবাসের মাধ্যমে নিজেকে শেষ করে ফেলার একটা উপায় তারা গ্রহণ করেই ফেলেছেন। কিন্তু দিন-দিন জীর্ণ হয়ে বেঁচে থাকারও একটা কষ্ট আছে। অবশেষে একটা চরম ইচ্ছা হয়ই জীবনটাকে পূর্ণভাবে শেষ করে দেবার।
দেবর্ষি নারদ জানিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে। সেদিন হঠাই হাওয়া উঠেছিল বনের মধ্যে, আর দাবানল যেটা লেগেছিল আগে থেকেই, সেই দাবানল জ্বলে উঠল বনের চারিদিক ব্যাপ্ত করে। বনের হরিণ, বরাহ, সাপ নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকলেও অনেক পশুই মরতে থাকল। এই দাবানল বাড়তে থাকল, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের তথা গান্ধারী-কুন্তীর শারীরিক সমস্যা এতটাই ছিল যে, তাদের পক্ষে আর নড়াচড়া করাই সম্ভব হচ্ছিল না। উপবাসে-অনাহারে কুন্তীর শরীর এতটাই কৃশ হয়ে গেছে যে, উদ্যত দাবানল এড়িয়ে তিনি দ্রুত যে কোথাও সরে যাবেন, সেটা সম্ভবই ছিল না এবং সম্ভব ছিল না এই বিপন্ন মুহূর্তে ভ্রাতৃশ্বশুর ধৃতরাষ্ট্র এবং শাশুড়ি-প্রতিমা গান্ধারীকে সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র যাবার। নারদ বলেছেন, তাঁরা এতই দুর্বল–অসমর্থোহপসরণে সুকৃশে মাতরৌ চ তে। ধৃতরাষ্ট্র উপায়ান্তর না দেখে সঞ্জয়কে আপন প্রাণ বাঁচানোর জন্য সরে যেতে বললেন কোথাও, কিন্তু নিজের এবং গান্ধারী-কুন্তীর দায়িত্ব নিয়ে বললেন, আমরা এখানেই থাকছি এবং এই অগ্নিতে দগ্ধ হয়েই আমরা পরম গতি লাভ করব বয়মত্ৰাগিনা যুক্তা গমিষ্যামঃ পরাং গতিম্।
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, কুন্তীর কতটা সমর্পণ ছিল ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। পূর্বে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের সম্বন্ধে যথেষ্টই বিরূপ ছিলেন, কিন্তু যে মুহূর্তে এই পুত্রহারা বৃদ্ধ সর্বত্যাগী হয়ে বানপ্রস্থী হয়েছেন, সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি এই অন্ধ-বৃদ্ধের অনুগামী শুধু নন, এতটাই তিনি তার অনুগত যে, ধৃতরাষ্ট্র কুন্তীর সম্বন্ধেও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তার মধ্যে এ তো এমন এক সময়, যখন জীবনেও তারা আসক্তিহীন হয়ে পড়েছেন সর্বাঙ্গীণভাবে। ফলে ধৃতরাষ্ট্র যখন নিজেদের সম্বন্ধে সার্বিক সিদ্ধান্ত জানালেন, তখন সঞ্জয়ের পক্ষে উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। সঞ্জয় বলেছিলেন- মহারাজ! আপনি বোধহয় কোনও মন্ত্রপূত মেধ্য অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন করছেন না। কিন্তু কী করবেন ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী। কুন্তীই বা কী করবেন? তাদের এমন শারীরিক শক্তিই নেই যাতে তারা দ্রুত অন্যত্র সরে যেতে পারেন। অতএব ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে গান্ধারী এবং কুন্তীও একেবারেই নিরুপায় ছিলেন পরিস্থিতি মেনে নিতে। আর সঞ্জয় যে মন্ত্রপূতহীন বৃথাগ্নির কথা বলেছিলেন, সেটাকে পরিস্থিতির প্রয়োজনের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র বলেছিলেন, জল, অগ্নি, বায়ু অথবা নিজেই নিজের প্রাণ আকর্ষণ করাটাকে তপস্বীরা ভালই বলে থাকেন– জলমগ্নিস্তথা বায়ুরথবাপি বিকর্ষণম্। অতএব ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে সরে যেতে বললেন এবং তিনি নিজে ইষ্টদেবতার প্রতি মনঃসংযোগ করে গান্ধারী এবং কুন্তীকেও বললেন পূর্বমুখ হয়ে তপস্যার আসনে বসতে। ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর মতোই কুন্তীও সমস্ত ইন্দ্রিয় নিরুদ্ধ করে এমনভাবেই যোগাসনে বসলেন যে, তাকে দেখে মনে হল শুকনো এক নিশ্চল কাঠ পড়ে আছে যেন সন্নিরুধ্যেন্দ্রিয়গ্রাম আসীৎ কাষ্ঠোপমস্তদা।
সেকালে বারবারই এই ধরনের যোগজ মৃত্যুর কথা এসেছে। এসেছে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবার স্বাধীনতার কথাও। ধৃতরাষ্ট্র যেভাবে নিজেই নিজের প্রাণ আকর্ষণ করার কথায় তপস্বীদের উল্লেখ করেছেন, সেটা প্রাচীন পৌরাণিক এবং স্মার্ত তথ্যের সঙ্গে মেলে। বস্তুত হঠাৎ করে কামনা-ক্রোধের বশীভূত হয়ে আত্মঘাতী হওয়াটা আমাদের দেশ কোনওভাবে মানবে না। তপস্বীর প্রসঙ্গটা সংসার-বিরাগের সঙ্গে ইষ্টদেবতার ওপর মনঃসংযোগের প্রশ্ন আসায় যে ‘ডিটাচমেন্ট তৈরি হয়, তাতে আত্মঘাতে পাপের প্রসঙ্গ থাকে না। এখানে শুধু ধৃতরাষ্ট্র নয়, কুন্তী এবং গান্ধারীর ক্ষেত্রেও সেই একই যোগাভ্যাসের কথাও বলা হল- সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্ত গতি স্তব্ধ করে ইষ্টে মনঃসমাধির মাধ্যমে মরণও অনেক অনায়াস হয়ে ওঠে। উপবাসাদি শরীর-শোষণের প্রক্রিয়ায় আগেই যে শরীর স্তিমিত হয়ে আসছিল, সেটাকে চরম যৌগিক প্রক্রিয়ায় স্তব্ধ করে দেওয়াটাই আমাদের দেশের ইচ্ছামৃত্যুর নিদান। কুন্তী ঠিক তাই করেছেন ধৃতরাষ্ট্রর গান্ধারীর অনুগামিতায় এবং তাঁর এই মনঃসমাধির মধ্যে দাবাগ্নি তাদের সকলের দেহ গ্রাস করেছে, কুন্তী মারা গেছেন গান্ধারীর সঙ্গে একত্রে–গান্ধারী চ মহাভাগা জননী চ পৃথা তব।
নারদ যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, আমি ঘুরতে ঘুরতে ওইদিকেই গিয়েছিলাম এবং আমি তোমার জননী তথা ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর দগ্ধ শরীরগুলি দেখেছি তয়োশ্চ দেবব্যারুভয়োঃ … ময়া রাজ্ঞঃ কলেবরম্ আর তপস্বীদের কাছ থেকে শুনেছি যে, কীভাবে তারা দাবানলে দগ্ধ হয়েছেন। তারা সবাই স্বর্গে গেছেন, মহারাজ! আপনি কষ্ট পাবেন না।
মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে যুধিষ্ঠির এবং অন্যান্য পাণ্ডব ভাইরা শোকে-দুঃখে কুন্তীর কথাই স্মরণ করতে লাগলেন। কুন্তীর অসামান্য গুণের কথা তাদের মনে উদয় হতে থাকল ক্ষণে ক্ষণে। তাদের রোদন-ধ্বনিতে উচ্চকিত হল রাজগৃহের সমস্ত জায়গা– রুরুদু-দুঃখসন্তপ্তা বর্ণয়ন্তঃ পৃথাং তদা। যুধিষ্ঠির অবশ্য নিজের ধৈর্যগুণে কাদা বন্ধ করে নারদের কাছে দুঃখ করতে লাগলেন, বিশেষত কুন্তীর জন্য। তিনি বললেন– গান্ধারীর জন্য আমি শোক করি না, তিনি ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে একত্র মরণ বরণ করে পতিব্রতার ধর্ম পালন করেছেন। কিন্তু আমার মা কুন্তীর জন্য আমি শোক সংবরণ করতে পারছি না, তিনি কেন তার পুত্রদের সমৃদ্ধিমান পুত্ৰৈশ্বর্য ত্যাগ করে বনবাস বেছে নিলেন স্বেচ্ছায়– উৎসৃজ্য সুমহদ্দীপ্তং বনবাসমরোচয়ৎ।
যুধিষ্ঠির তার আপন আন্তরিকতায় মায়ের এই ব্যবহার মেনে নিতে পারেননি বটে, কিন্তু আমরা কুন্তীকে বুঝতে পারি। লক্ষ করে দেখবেন পাণ্ডবদের পূর্বজীবনে কুন্তী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই শতশৃঙ্গ পর্বত থেকে কুন্তী যেদিন পাঁচ পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের গৃহে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, সেদিন থেকে রাজগৃহের একান্তে থেকে বিদুরের পরামর্শমতো ছেলেদের চালিত করেছেন, জতুগৃহের আগুনে পুত্রদের সঙ্গে তারও গতি হয়েছিল এবং অবশেষে পঞ্চাল রাজ্যে গিয়ে বসবাসের পরিকল্পনাও ছিল তারই। কিন্তু যেদিন থেকে দ্রৌপদীর সঙ্গে পাঁচ পাণ্ডবের বিয়ে হয়ে গেল, সেদিন থেকেই তাকে আমরা অনেক সংবৃত দেখেছি। দ্রৌপদীর সঙ্গে কোনওদিন তার কোনও বিরোধ দেখিনি এবং তিনি নিজের আধিপত্য কিংবা মতামত দ্রৌপদী কিংবা পুত্রদের উপরেও খাটাননি কখনও। অর্থাৎ পুত্রদের বিবাহোত্তরকালে নিজের সমস্ত অহংগ্ৰাহিতা তিনি দ্রৌপদীর মধ্যে সংক্রমিত করেছেন পুত্রবধূকে উপযুক্ত স্থান ছেড়ে দিয়ে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধোত্তরকালে পুত্রদের রাজৈশ্বর্য লাভের পরে তিনি রাজমাতা হয়ে বসবাস করতেই পারতেন হস্তিনায়। তাতে যে অসম্মানিত হয়ে থাকতেন না, সেটা পাঁচ পাণ্ডব-ভাই এবং দ্রৌপদীর সঙ্গে তার সুসম্পর্কের নিরিখে জোর দিয়েই বলা যায়। কিন্তু তিনি কোনও অবসর রাখেননি। একে তো প্রথমজন্মা কর্ণের মৃত্যুর জন্য তার হৃদয় আকুল-মথিত ছিল, তাতে এটাই তার ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে বড় গরিমা যে, তিনি সবসময় সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতেন নিজেকে অবগুণ্ঠিত রেখে। দৈবাৎ এমন প্রশ্ন যদি কখনও আসে যে, ঐশ্বর্যপুষ্ট পুত্রেরা অথবা রাজরানি দ্রৌপদী তাকে অতিক্রম করছেন কোনও ঘটনায়, তবে সেটা তার পক্ষে মর্মান্তিক হতে পারে বলেই, তার এই সংবরণ। বিশেষত রাজা পাণ্ডুর রাজত্ব-সময়ে তিনি যে রাজরানির গরিমা ভোগ করেছেন, তার সঙ্গে প্রতিতুলনায় যদি রাজমাতার গরিমা লঘু অনুভূত হয়, সেটাও কোনও অবসাদ জাগাতে পারে। অতএব অনেক ভাল পুত্রবধূকে তার নিজস্ব গরিমায় স্থিত হতে দেওয়া। কুন্তী ঠিক তাই করেছেন, পুত্রদের বিবাহোত্তর কাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি পুত্রবধূকেই আপন সম্মানে স্থিত হতে দিয়েছেন পূর্ণ স্বাধিকারে।
কুন্তীর এই অসম্ভব বাস্তব-বোধ যুধিষ্ঠির বোধহয় বুঝেও বুঝতে চাইছেন না মায়ের প্রতি মমতায়। যুধিষ্ঠির বলেছেন– আমার মায়ের এইরকম একটা মরণ হল, অথচ আমি মৃতের মতো বেঁচে আছি, ধিক্ এই রাজ্যকে, ধিক্ আমাদের বলবীর্য আর ক্ষত্রিয়ধর্মকে। আমি শুধু ভাবি– যিনি যুধিষ্ঠিরের জননী, যিনি নাকি ভীম-অর্জুনের মতো বীরের জননী তিনি কিনা অনাথের মতে দগ্ধ হলেন বনে– অনাথবৎ কথং দগ্ধা ইতি মুহ্যামি চিন্তায়। যুধিষ্ঠির আরও দুঃখ পেলেন এই ভেবে যে, কুন্তী-জননী এবং ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীও এমন বৃথা-অগ্নির দাবানলে দগ্ধ হলেন। এমন যদি হত যে, মন্ত্রপূত হোমের আগুনে তিন জনে পরপর আত্মাহুতি দিয়েছেন, তা হলেও হত; কিন্তু কোথায় এক দাবানল প্রজ্বলিত হল, আর সকলে পুড়ে মরলেন সেখানে, এ কেমন মৃত্যুবৃথাগিনা সমাযোগো যদভূত পৃথিবীপতে। কণ্বমেবংবিধো মৃত্যুঃ…?
তৎকালীন দিনের সাংস্কারিক বুদ্ধিতে যুধিষ্ঠির ভাবছেন, মন্ত্রপূতহীন বৃথাগ্নিতে তার মায়ের এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্রের বুঝি অসদগতি হল। অপিচ যুধিষ্ঠির সেই ভয়ংকর আগুনের মধ্যে শিরা-উপশিরায় ব্যাপ্ত মায়ের কৃশ শরীর কল্পনা করে ভাবতে থাকলেন– সেই সময় নিশ্চয়ই মা আমায় ভয়ার্ত কণ্ঠে ডেকেছিলেন– কোথায় বাছা, যুধিষ্ঠির, কোথায় তুই– হা তাত ধর্মরাজেতি মামক্রন্দন্মহাভয়ে নিশ্চয়ই বলবান ভীমের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলেছিলেন তিনি আমাকে বাঁচাও, ভীম! আমাকে বাঁচাও। আর ঠিক সেই দীপ্ত দাবানল গ্রাস করে নিল তাঁকে। এই সহদেব যে তার এত প্রিয় ছিল, সেও তো শুনতে পেল না মায়ের ডাক, মাকে সেও বাঁচাতে পারল না। যুধিষ্ঠিরের মর্মস্পর্শী বিলাপ শুনে সমস্ত পাণ্ডবরা পরস্পর জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন– তত্বা রুরুদুঃ সর্বে সমালিঙ্গ্য পরস্পরম।
যুধিষ্ঠির সহ সমস্ত পাণ্ডবরা মায়ের জন্য এমন বিলাপ করতে আরম্ভ করলে দেবর্ষি নারদ বললেন, মহারাজ! বৃথা-অগ্নি ধৃতরাষ্ট্রকেও গ্রাস করেনি, তোমার জননী কুন্তীকেও নয় এবং গান্ধারীকেও নয়– নাসৌ বৃথাগিনা দগ্ধো যথা তত্র শ্রুতং ময়া– কেননা সঞ্জয় যা ভেবেছিলেন তা বোধহয় ঠিক নয়, আর সেই সময় আতঙ্কিত সঞ্জয় হয়তো সব ব্যাপার খেয়ালও করতে পারেননি। নারদ বলেছেন– আমি সেই গঙ্গাতীরবাসী মুনিদের কাছে শুনেছি যে, ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-কুন্তীরা নিজের হোমাগ্নিতেই নিজেরা দগ্ধ হয়েছেন। ঘটনাটা এইরকম ঘটেছিল– উপবাসী ধৃতরাষ্ট্র বনে ঢোকবার সময়ে যাজকদের দিয়ে যজ্ঞ করিয়ে সেই যজ্ঞাগ্নি অবশিষ্ট রেখেই বনে প্রবেশ করেছিলেন। যাজকেরা সেই অবশিষ্ট আগুন বনের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন জায়গা ছেড়ে। সেই যজ্ঞাগ্নিতেই বনের মধ্যে গাছে গাছে আগুন ধরিয়ে দাবানল তৈরি করে দিল–স বিবৃদ্ধস্তদা বহ্নিৰ্বনে তস্মিন্নভূৎ কিল। সেই দাবানলেই মারা গিয়েছেন তোমার মা এবং ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী। অতএব তুমি তাদের জন্য কষ্ট পেয়ো না, তারা নিজস্ব যজ্ঞাগ্নির মেধ্য আগুনেই মারা গিয়েছেন। আর তোমার মায়ের কথা বলি, তিনি ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীকে গুরুর মতো সেবা করে যেভাবে শ্বশুরকৃত্য করেছেন তাতে মহতী সিদ্ধি লাভ করেছেন তিনি গুরু শুশ্রুষয়া চৈব জননী তে জনাধিপ। প্রাপ্তা সুমহতীং সিদ্ধিম। তোমরা আর দুঃখ পেয়ো না, ভাইদের নিয়ে তোমরা প্রয়াত জননীর শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করো।
পাণ্ডব-ভাইরা অনেক কাঁদলেন মায়ের জন্য, অনেক বিলাপ করলেন ফেলে আসা জননীর সংপৃক্ত জীবন নিয়ে। তারপর নিয়ম মেনে গঙ্গায় জলক্রিয়া, বারো দিন গেলে তেরো দিনের দিন শ্রাদ্ধ-দক্ষিণা শেষ করে পুরবাসীদের পান-ভোজন করালেন। একটা বিরাট যুগ শেষ হয়ে গেল চোখের সামনে। কিন্তু কুন্তীর চরিত্ৰশংসা শেষ হবার নয়। আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেন কুন্তীকে আপনি এত বহুমান করেন কেন? আমি বলে থাকি মহাভারতীয় নারীচরিত্রের মধ্যে কুন্তীর মতো এত ‘অথরিটি’ আমি কারও মধ্যে দেখিনি, কারও মধ্যে দেখিনি এত নিষ্কাম অথচ কর্মাসক্তি– ‘অ্যাটাচমেন্ট উইথ অল ডিটাচমেন্ট’, ‘ইমোশন উইথ অল সেলফলেনেস্। এটাও কিন্তু এক্কেবারে ঠিক নয় যে, পাণ্ডুর মৃত্যুর পর কুন্তী শতশৃঙ্গ পর্বত থেকে নেমে এসে নিজের জন্য এবং ছেলেদের জন্য সব গুছিয়ে নিতে এসেছিলেন এবং রাজ্যের ভাগটা চেয়েছিলেন স্বার্থ-সাধনের আশায়। আমরা বলব– তা হলে সবার আগে কুন্তী পুত্রদের নবলব্ধ সমৃদ্ধ রাজ্যে থেকে যেতেন। বনগমনে উন্মুখ ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত কুন্তীকে বলেছিলেন–ছেলেরা তো সব সত্যি কথাই বলছে। কুন্তী কেন এই বিশাল পুত্ৰৈশ্বর্য ত্যাগ করে বোকার মতো আমার পিছন পিছন বনে যাবে– কানুগচ্ছে বনং দুর্গং পুত্রানুসৃজ্য মূঢ়বৎ।
বস্তুত পুত্রদের জন্য কুন্তীর রাজ্যকামনার মধ্যে তৎকালীন দিনের মহাকাব্যিক তাড়না ছিল এবং সে তাড়নার মধ্যে তৎকালীন দিনের রাজনৈতিক দর্শন আছে। কুন্তী বলেছিলেন, আমার স্বামী পাণ্ডুর বংশ যাতে লোপ না পায় এবং কোনওভাবে তার বীর সন্তানদের যশ যাতে নষ্ট না হয়, সেইজন্যই আমি তোমাদের যুদ্ধ করার উপদেশ দিয়ে উদ্ধার করেছি– জ্ঞাতিভিঃ পরিভূতানাং কৃতমুদ্ধরণং ময়া।
বস্তুত হস্তিনায় পাণ্ডুর বংশ প্রতিষ্ঠিত হোক, এই মহাকাব্যিক রাজনৈতিকতা এতটাই কাজ করেছে কুন্তীর মনে যে, তিনি পাণ্ডুর নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও নিজের কানীন পুত্র কর্ণের কথা বলতে পারেননি স্বামীর কাছে। অথচ এই প্রথমজন্মা পুত্রের কথা সারাজীবন তিনি মনে রেখেছেন কিন্তু মতাদর্শের কারণেই সেখানে তিনি অনাসক্তভাবে পাণ্ডুর ঈপ্সিত পুত্রদের জন্য অবিরাম উদ্যোগ নিয়ে গেছেন। হস্তিনায় আসা অবধি তিনি কোনও রাজকীয় মর্যাদা দাবি করেননি। অপার কৃচ্ছ্রসাধনের পর পুত্রেরা ইন্দ্রপ্রস্থে রাজ্য পেলেন বটে, তবে তারপরেই তো বনবাসের কৃচ্ছতা। কুন্তী হস্তিনায় থেকেছেন দীন-হীনভাবে, কিন্তু আত্মজ পুত্রদেরও তিনি যুদ্ধে উৎসাহিত করেছেন বিদুলার ভাষায়, তার নিজের ভোগস্বার্থ অথবা আসক্তি সেখানে কাজ করেনি। পুত্রেরা রাজ্য পাবার পরেই তিনি ধৃতরাষ্ট্রের অনুব্রতী হয়ে রাজ্য ছেড়েছেন রাজকীয় অনাসক্তিতে। আর সারাজীবন প্রথমজন্মা পুত্রটির জন্য যে কষ্ট পেয়ে গেছেন, তা জানিয়ে গেছেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। যাবার আগে কুন্তী বলেছিলেন, তুমি সব সময় যুদ্ধে অপলায়ী কর্ণের কথা মনে রেখো। আমি আমার দুর্বুদ্ধিতে তাকে ত্যাগ করেছিলাম। আমার হৃদয় নিশ্চয়ই লোহার মতো, নইলে আমার নিজের গর্ভজাত সূর্যসমান পুত্রকে ত্যাগ করে আমি বেঁচে আছি কী করে!
কুন্তীর হৃদয়-গহনে এই আন্তরিকতা যেমন কর্ণের জন্য আছে, তেমনি অন্য ছেলেদের জন্যও তার এই আন্তরিকতা আছে। কিন্তু সবার ওপরে আছে সেই রাজকীয় আত্মমর্যাদা যার জন্য সংশয়িত মৃত্যুর কথা জেনেও তিনি পুত্রদের যুদ্ধে উৎসাহিত করেন এবং যার জন্য বনবাসের তপঃসাধনও তার কাছে সর্বতোভদ্র মনে হয়। আসলে যখন তিনি সম্পূর্ণ জিতে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত, সেই অবস্থায় ঐশ্বর্যভাগ থেকে সরে গিয়ে লৌকিক মর্যাদার চরম বিন্দুতে পৌঁছেছেন কুন্তী। এই অনাসক্তিতে তিনি মহাভারতের ঋষিতমা রমণী।