সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
০১.
সেটা ১৮৮৩ খৃস্টাব্দের শীতকাল। আবার প্রশ্ন উঠবে, শীত তো খ্রিস্টবর্ষের প্রথমেও থাকে, শেষেও; অর্থাৎ তখন নভেম্বর-ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি? আমার ধারণা নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়টাই যুক্তিযুক্ত হবে। শীতকালে প্রকৃতিতে সবুজ কমে,বাদামী, হলুদ, সোনালি বাড়ে। এতক্ষণ তো রেলপথের দু পারেই মাঠগুলোতে, কৃষকদের বাড়িগুলোতে অনেক গাছের পাতায় সেই বাদামী, হলুদ, লাল এবং সোনালি। তখন গাড়িটা বেশ দ্রুত গতিতে চলেছিলো, কিন্তু দিনের আলো ছিলো; এখন ধীরে চললেও দিনের আলোও তো কমে আসছে। ফলে তখন জানলার বাইরে রোদ-মাখানো দৃশ্যগুলোই আকর্ষণ করছিলো। তখন রেল রোড এত নতুন যে কামরার জানলায় এরকম দৃশ্য-পরিবর্তন বিশেষ আনন্দজনক। কারো কাছেই একঘেয়ে লাগার মতো হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে কামরার ভিতরে আনতে হয়। বাতাসটাও ঠাণ্ডা। সার রাজচন্দ্র পরপর দুটো জানলার শার্সি ফেলে দিয়ে কামরার ভিতরের দিকে দৃষ্টি দিলো। প্রথম শ্রেণীর কামরা। এখন যেমন তখনো তেমন কিছুটা বৈশিষ্ট্য তো ছিলোই অন্য শ্রেণী থেকে। এই কামরাটার আর একটু বৈশিষ্ট্য বলে নেওয়া যায়। লোহালক্কড়, রিবেট, ক্রু সব সোনালি রঙের পিতলের হবে, সিলিং-এর আলোটা তো পিতলেরই, আর বসবার গদিগুলো প্রকৃতপক্ষে উজ্জ্বল পালিশদার চামড়ার। এটা বলা সম্ভব নয়, এই গাড়িটাতে এরকম কামরা বরাবর থাকতো কিনা। সেদিন ছিলো, কয়েকখানাই ছিলো। বরং সাধারণের জন্য কামরাই কম। এই কামরায় আপাতত তিনজন যাত্রী। সার রাজচন্দ্র নামে এই দশাসই পুরুষ। তার পায়ের ভারি পুরু সোলের বিলিতি জুতো ওস্টেড ট্রাউজার্স ও জুতার মধ্যে দৃশ্যমান খয়েরিতে সাদার ফুল তোলা উলের মোজা, গায়ের চেক টুইড কোট থেকে বোঝা যায়, তার চল্লিশোর্ধ্ব শরীরটা এখন বেশ ভারি, যদিও মজবুত। মাথার পিছন দিকের চুলগুলো ঈষৎ লাল। কলপ? মুখটায় একটা লালচে ভাব আছে যাকে সানট্যান বলা যায়। তার উপরে বেশ বড়ো মাপের খয়েরি বাদামি গোঁফ। দুটো বাঙ্ক। এপারের বাঙ্কে সার রাজচন্দ্র। ওপারেরটিতে দুজন। একজন মহিলা, অন্যজন পুরুষ। মহিলাটির পরনে দুধ-গরদ, কিন্তু পাড় নেই। সাদা কারো কারো পছন্দের হয়। সেজন্য গলায় এক লহরের একটা মুক্তার হার, হাতে দুগাছা মুক্তার বালা।
স্নানের সুবিধা কোথায়? তাহলেও কিছুক্ষণ আগে, বিকেলের অভ্যাস অনুসারেই, পাশের ক্লোজেটে গিয়ে শাড়ি পালটে ফিরেছে। এক দুধ-গরদ থেকে অন্য দুধ-গরদ, তখনই চুলগুলো ব্রাশে উজ্জ্বল করে পিঠে ছড়ানো হয়েছে। ফলে মাথা ঝাঁকালে মৃদু সৌরভ উঠছে। সেই বাঙ্কের পুরুষযাত্রীটি বয়সে তরুণ। তাকে এরকম বললে বা তার বয়স একুশ-বাইশ বললেই তারুণ্যটাকে বোঝা যায় না। কারো কারো চোখে মুখেও বিষয়টা সুখের আকারে জড়ানো থাকে। মনে হয় যেন পৃথিবীর চূড়ায় বসে। খুবই গৌরবর্ণ রং। চুলগুলো কালো এবং কপাল-ঢাকা অবাধ্য। চোখ দুটো ডাগর, চঞ্চলা কোনো মেয়ের যেন। ঠোঁট লাল, তার উপরে সরু গোঁফের রেখা। কারো কারো এসব পুরুষালি চিহ্ন পরে প্রকাশ পায়। এই তরুণটিকে এখন কিছুটা সলজ্জ দেখাচ্ছে, আর তা বেড়েছে সার রাজচন্দ্র শার্সি নামিয়ে কামরার ভিতরে চোখ রাখাতে। কারণ তরুণটির ট্রাউজার্সের হাঁটুর উপরে একটা সুদৃশ্য তোয়ালে, তার উপরে অনেক রকমের অনেক মিষ্টিযুক্ত রূপার একটি থালা। তরুণটি বুঝতে পারছে না মহিলাটিতে ঝাজ কিংবা মিষ্টি বেশি। মিষ্টি সাজিয়ে দিয়ে হাতের উপরে থালা রেখে বলেছিলো, হাত দিয়েই খাও, লজ্জা কী? প্রায় একশো মাইল দক্ষিণে একটা স্টেশনে সে তার সুটকেসটা হাতে গাড়ির কামরায় কামরায় ঢু মেরে বেড়াচ্ছিলো। এই কামরার হাতলে হাত দিয়ে এটাকেও রিজার্ভড় দেখে সে ফিরে যাচ্ছিলো। এই সময়ে মহিলাটির সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়েছিলো। মহিলা বলেছিলো, কোথায় যাওয়া হবে? তরুণের গন্তব্য শুনে বলেছিলো, আসুন। আমরাও তাই। তরুণ উঠে এসে ইংরেজিতে ধন্যবাদ দিলে মহিলাটিও যথোপযুক্ত উত্তর দিয়েছিলো সেই ভাষাতেই। কিন্তু সেই অত্যন্ত রাজকীয় মহিলার আর একটি দিক টিজ করা, খোঁচানো, খেপানো। প্রথম পাঁচ মিনিটেই এইরকম কথা হয়েছিলো।
তরুণ–সবগুলো ফার্স্টক্লাস রিজার্ভড়। সবগুলোতে লালমুখো বাঁদর।
সার রাজচন্দ্র-হতেই পারে। এটাকে স্পেশাল ট্রেন বলা যায়।
মহিলা-কারো ল্যাজ টানোনি তো?
তারপর এক ঘণ্টার মধ্যে তরুণের নাম কুমারনারায়ণ জেনে তাকে কুমার বলে যাচ্ছে। এই মহিলা। একবার তরুণ বলেছিলো দুটো শব্দ মিলে একটা নাম। মহিলাটি বলেছিলো, আমরা কুমার বলতে অভ্যস্ত। অসুবিধা হচ্ছে না। সার রাজচন্দ্র গাড়ির ভিতরের দিকে মুখ ফেরালে তরুণটি ভাবলো, এই সার লোকটি? চটপটে তো বটেই, যদিও চোখে দেখে অন্য রকম মনে হতে পারে। নৃশংস? নাকি কিছু ভেবে কাজ করে না? এর আগের স্টেশন ছাড়ার কয়েক মিনিট পরেই ট্রেনটাকে চেন টেনে থামিয়ে রাইফেল নিয়ে নেমেছিলো। যে হরিণটাকে ছুটন্ত ট্রেনের সব যাত্রী দু-তিন মিনিট ধরে দেখে অবাক হচ্ছিলো, সেটাকে গুলি করে মারলো। যাই হোক, গাড়িটার সেখানে, সেই মাঠের মধ্যে, আধঘণ্টা দেরি হয়ে গিয়েছে। আর এখন তো ধিকিধিকি চলেছে। নতুন লাইন, মাত্র দুমাস আগে শেষ হয়েছে। এখন ট্রেন এই লাইনের বর্তমান শেষ স্টেশন তারাবাড়ির উদ্দেশ্যে চলেছে।
আর কয়েক মাইল পরেই সেই তারাবাড়ি স্টেশন। এখানে এখনো প্রধান যোগাযোগ তো স্টিমারেই ছিলো। তার স্টেশনের নাম তারাবাড়ি-ঘাট। এখন এই রেল-স্টেশন হওয়ার পরে হয়তো স্টিমার-স্টেশনটার মর্যাদা কমে যাবে। আজ সেই তারাবাড়ি রেল-স্টেশনে, তার নতুন বাড়িতে, নতুন-করা প্ল্যাটফর্মে, যাতে এখানে ওখানে রাখা টবের গাছ, নিশ্চয় এতক্ষণে অনেক আলো জ্বালানো হয়েছে। নতুন স্টেশনমাস্টার তার স্টাফ নিয়ে এই প্রথম ট্রেনের অপেক্ষায় ঘর বার করছে। আমাদের ভাবাই অভ্যাস। এই তারাবাড়ি নাম নিয়ে ভাবাটা অবশ্য কিছু পুরনো, কারণ তারাবাড়ি ঘাট তো বছর পনেরোই হয়েছে। ধর্মের দেশে ধর্মের কথাই আগে মনে আসে। কিন্তু তারাবাড়িতে সার রাজচন্দ্রের প্রকাণ্ড বাড়িটার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে যে একমাত্র মন্দিরটা দেখতে পাও, সেটা বিশেষ সুন্দরই, যদিও রক্ষণাবেক্ষণে কিছু ত্রুটি চোখে পড়ে, সেটা কিন্তু শিবের, আর মন্দির বলতে এখানে ওই একটিই। পুরোহিতকে এরকম বলায় সে নাকি বলেছিলো, তা তারা গৌরী একই তো; গৌরীপাটেই তো তারারও অধিষ্ঠান ধরা যায়। তাছাড়া শিবের অন্তরে কি তারা নেই?
মহিলা বললো–তোমাকে স্যান্ডউইচ দু-একটা?
সার রাজচন্দ্র প্রথমে বললো, না; পরে বললো, একটু পোর্ট দাও।
মহিলা উঠে বেত কাঠ পিতলের সমন্বয়ে তৈরী সুদৃশ্য কাঁপ খুলে প্লেট ইত্যাদি বার করে, একটা প্লেটে একটা স্যান্ডউইচ সার রাজচন্দ্রর বাঙ্কে তার পাশে রাখলো। দুটো ওয়াইন কাপ বার করে আর একটা তেমন প্লেটে রাখলো। একটা গাঢ় ব্রাউন রঙের বোতল বার করে রাখলো তার উপরে। তরুণ নিষেধ করলেও খান-দুয়েক স্যান্ডউইচ তার প্লেটে তুলে দিলো মহিলা। বললো, মাটন ওনলি। সার রাজচন্দ্র বোতল খুললো, নিজের ওয়াইন কাপটাকে পুরো ভরে নিয়ে দ্বিতীয় কাপটাকে আধাআধি ভরে মহিলাকে নাও বলে তুলে দিলো।
একবার মহিলা বললো–এতগুলো গেস্ট নিয়ে চলেছো, অথচ গাড়ি তো যেন শামুক। ডিনার শেষ হতে মাঝরাত না হয়। ঘরগুলোর বা কী ব্যবস্থা হয়েছে, কে জানে!
সার রাজচন্দ্র বললো–তুমি তো তাদের টেলিগ্রাম করেই জানিয়েছে গেস্টের কথা; কেন মিছে উদ্বেগ?
তরুণ কুমারনারায়ণ ভাবলো, সম্বন্ধটা স্বামী-স্ত্রীর মতো মনে হয়; বোধ হয় হিন্দু নয়। সিঁদুর তো নেই-ই, শাড়ি সাদা। আর এখন দ্যাখো। ওয়াইন কাপটা অবলীলায়! সার রাজচন্দ্র তবু তো স্যান্ডউইচ চিবোচ্ছেন, এঁর দ্যাখো, নিছক ওয়াইন।
ট্রেনটা জোরে কটা হুইসিল দিলো, তাহলে তারাবাড়ি নামে সেই নতুন স্টেশনের আলো চোখে পড়েছে। তরুণ জানলার কাঁচ দিয়ে একবার চাইলো। দূরে যে আলোকবিন্দু তা কোথায় কত দূরে কত অন্ধকারের গভীরে বোঝা যায় না। তাহলেও গন্তব্যের আর বেশি দেরি নেই। সে তার লাগেজ বলতে একমাত্র বড়ো সুটকেসটার উপরে চোখ বুলিয়ে নিলো। বোঝাটা বড় নয়, আসল ব্যাপারটা অন্ধকার। ট্রেনটার শিডিউল স্টপ বিকেল পাঁচটায়, এখন সাতটা বাজতে চলেছে। ওই আলোকবিন্দুই প্রমাণ করে তার চারিদিকে কী রকম অন্ধকার হবে গ্রামের পথে। লোককে জিজ্ঞাসা করেই যেতে হবে, হয়তো পথে লোকও থাকবে না। উপরন্তু যে রকম হদিশ পাত্তা নিয়ে সে রওনা হয়েছিলো, এখন ব্যাপারটা তার কিছু অন্য রকম দেখছে। সে শুনেছিলো, মরেলগঞ্জে রেলওয়ে স্টেশন নেই। কিন্তু সেটা রাজনগরের মাইল দুয়েক উত্তরে। নামে যে স্টেশনটা তারা পার হয়ে এসেছে তা নাকি মরেলগঞ্জ থেকে ক্রোশ পাঁচ-ছয় দূরে। আসছে শুনে সে নামার জন্য প্রস্তুত হতে। গেলে মহিলা জিজ্ঞাসা করেছিলো–তুমি রাজনগরে নামবে বলেছিলে না?
-এটাই তো?
মহিলা বলেছিলো–স্টেশনে, না রাজনগরে? এটা নয়, আসলে এটাকে কায়েতবাড়ি বলে। রাজা থাকতেন এখানেই বলে স্টেশনের নাম রাজনগর। আসল তারাবাড়ি নামে নতুন স্টেশনের দিকে, বরং তাকেও ছাড়িয়ে দু ক্রোশ। তোমার তারাবাড়িতে নামা ভালো। তারাবাড়িও আসল নাম নয়। আসল নাম ফরাসডাঙাই এখনো চলে।
তরুণের সম্ভবত রাজা সম্বন্ধে কৌতূহল ছিলো অন্য অনেকের মতো। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাজার কথা তুলেছিলো। তখন মহিলা বলেছিলো, রাজার নাম ছিলো মহারাজা কর্নেল সার মুকুন্দবিলাস স্মৃতি খাঁ, কে. সি. বি.। কিন্তু বছর দুয়েক হলো তিনি গত হয়েছেন। মহারানী পুত্রকন্যাদের নিয়ে বিলেতেই থাকেন প্রায়।
পোর্টের বোকেটা বিশেষ ভালো। কামরাটা ভরে উঠেছে গন্ধে। সার রাজচন্দ্র সিগার ধরালো। টান দিয়ে কাশতে শুরু করলে মহিলা বললো–পাহাড় থেকে নামা সাত দিন হয়ে গেলো। কাশিটা রয়ে গেলো। কিছুতে শুনলে না ডাক্তার দেখানোর কথা, কলকাতায় থেকেও
সার রাজচন্দ্র কথাটাকে কিংবা মুখের সামনের ধোঁয়াটাকে মৃদু হাত নেড়ে সরিয়ে দিলো। তার আঙুলগুলো লম্বা, শরীরের গড়নের তুলনায় বরং সরু আর হালকা। সে হেসে বললো, তার চাইতে মজার কথাটা ভাবো হৈমী, রানীমারই লোকসান হয়েছিলো। তার বান্দা আর গজা গিয়েছিলো; ওদের তো একটা পাইক।
হৈমী বললো, মনোহর সিং-এর ব্যাপারটা?
–সেটা একটা ভড় ছিলো না?
সার রাজচন্দ্র, ধোঁয়া লাগলে যেমন, চোখ দুটোকে স্তিমিত করে একটু ভাবলো।
হৈমী বললো, মশাল নাকি?
রাজচন্দ্র কাঁচের উপরে পিছলে যাওয়া ধোঁয়াটে লাল আলোটাকে দেখে নিয়ে বললো, লাইন ক্লিয়ারেন্স। তাহলে তোমার তারাবাড়ি আর এক ফারলং। সে সিগারেটকে কামরার অ্যাশট্রেতে রেখে নিজের ওয়াইন-কাপটা আবার ভরে নিলো, হৈমীর ওয়াইন কাপটাতেও ঢেলে দিলো প্রায় পুরো কাপ।
কুমারনারায়ণ নামে সেই তরুণের একটা বিচিত্র অনুভূতি হলো। এক ফারলং যেতে কতটুকুই বা সময়, কিন্তু দ্যাখো, নামার আগে যে গোছগাছ করা হয় তার কোনো চেষ্টা নেই। বাম্পারটার ডালা খোলা হয়েছিলো, তেমন ভোলা। এদিকে-ওদিকে অনেক মালপত্র ছড়ানো। দু-দুটো রাইফেল, পাহাড়ে বেড়ানোর দু-একটা লাঠি, শহরে বেড়ানোর লাঠি, শাল, কোট, রাগ, এখানে-ওখানে রাখা; তাছাড়া স্তুপাকার ট্রাঙ্ক, সুটকেস। সে মনে মনে হেসে ভাবলো, ওয়াইন-কাপ হাতেই নামবে? হয়তো বোতলটা, ক্লাসগুলোও ছড়ানো থাকবে কামরায়। হয়তো ভৃত্যরা এসে গুছিয়ে নামাবে সবকিছু।
.
ওয়াইন-কাপটা তুলে ঠোঁটের কাছে এনে হৈমী সলজ্জভাবে হাসলো। এই প্রথম তার মাৰ্বল সাদা গালে কিছু অন্য রং দেখা দিলো। লজ্জা বোধ হলো তার। তার মনে পড়লো, লজ্জায় পড়েছিলো সে। বিশ বছর আগেকার সে লজ্জা অবশ্যই পালাতে বলে না। গল্পের মতো মনে পড়ে।
হ্যাঁ, বেশ লজ্জাই। যা কেউ ভাবতে পারে না তেমন করে নিজের মহল থেকে রাজকুমারের মহল পর্যন্ত সমস্তটা পথ দাসদাসী, আত্মীয়স্বজন, কর্মচারীদের ভীত সন্ত্রস্ত করে রানী নিজে রাজকুমারের শোবার ঘরে এসে দাঁড়ালেন। বলতে বলতে ঢুকলেন, কী আক্কেল তোমার, রাজু? স্নানের সময় হয়। ওরা গন্ধ নিয়ে, কত রকমের জল নিয়ে বসে-কিন্তু কথা শেষ করার আগে রাজকুমারের বিছানার দিকে চোখ পড়েছিলো। বিছানার উপরে রাজকুমার, তার হাতে ওয়াইন-গ্লাসে ভরা হুইস্কি তখন। এক হাত দূরে হৈমী, তার হাতেও তেমন। মনে হয়েছিলো, রানীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেউ রং ঢেলে দিলো। যেন ফিরে যাবেন, দৌড়ে পালাবেন। কিন্তু লোহার মতো শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন, বললেন–হৈমী!
হৈমী উঠে দাঁড়ালো। হুইস্কি চলকে পড়লো, কিন্তু যা সে বুঝতে পারেনি, ততটা হুইস্কি, অনেকবার অল্প অল্প করে হলেও, তার ভিতরে তখন। পা টলে উঠলে সে খাটের থাম ধরে দাঁড়িয়েছিলো।
রানী ছিঃ ছিঃ বলতে গেলেন, কিন্তু দৃঢ়স্বরে বললেন
এটা স্বীকার করতেই হবে, হৈমী ভাবলো, তখন কম বয়সের তুলনাতেও, বোকা ছিলাম। নতুবা কেউ একজন অনুরোধ করতে থাকলেই প্রায় এক দেড় ঘণ্টা ধরে, কারো সঙ্গী হওয়ার জন্যই, একটু একটু করে অতটা হুইস্কি কেন খেয়ে ফেলবো যাতে পা টলে যায়, সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে? রাজকুমার বেএক্তিয়ারই ছিলেন। তা না হলে কেউ কি বলে, যেমন বলছিলেন, এত লোক, বাড়ি-ভরা এত মানুষ, এর মধ্যে কি নয়নতারা নেই? নয়ন আসেনি বলছো? এত উৎসব, এত আয়োজন, তবু নয়নতারা ফেরেনি–এ কি বিশ্বাস করতে বলো? অথচ দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর থেকে রাজকুমার একেবারে স্তব্ধ ছিলেন। সেই পাঁচ ছয় মাসে কারো সঙ্গেই কি কথা বলেছেন? রাজবাড়ির সংসার তেমনই চলছিলো যেমন চলে, বরং সেই উৎসবের আয়োজনগুলো ধীরে ধীরে। এটা কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপারই যে রাজবাড়ির বোটটা থেকে কেউ তেমন পড়ে যেতে পারে, শুধু দুই নদী কেমন মিলছে দেখতে গিয়ে! হোক তা ভাদ্রের গঙ্গা। সংবাদ পেয়ে স্বয়ং হরদয়াল গিয়েছিলো তদন্তে, কিন্তু এলাহাবাদের কাছে গঙ্গায় জাল ফেলে কি কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়? রূপচাঁদ তো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জলে লাফিয়ে পড়েছিলো; সেও তলিয়ে গিয়েছিলো মাত্র। কারো কারো জীবন দুর্ঘটনাবহুল হয়।
রানী দৃঢ়স্বরে বললেন–হৈমী, রাজকুমারকে বাথে নিয়ে যাও স্নান করাতে, রূপচাঁদকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। খবরটা যেন বাইরে না যায়। রাজু, আজ তোমার বিবাহের দিন তা জানতে, অথচ
রাজচন্দ্র উঠে দাঁড়ালো। তার মুখ কথা বলার আবেগে লাল হয়ে উঠলো। সে যে দু পায়ের উপরে টলছে তা বোঝা গেলো। কথা তৈরি করার চেষ্টায় ডান হাতে বাড়িয়ে যেন শূন্যে অক্ষর আঁকতে লাগলো। কিন্তু কথা এসেও গেলো-বিয়ে? কার বিয়ে? কী যে বলে তুমি, মা!
হঠাৎ রাজকুমার যেন রানীমাকে এতক্ষণে দেখতে পেলো, নিজের মুখের উপরে হাত রাখলো, বেশ স্পষ্ট করে ভেবে নিলো, বললো–ও, তুমি আমার বিবাহের কথা বলছো? তা সব লোককে বিবাহ করতে হবে কেন? নাঃ, আমি বিবাহ করবো না।
রানীমা কী বুঝলেন কে জানে? ধমক দিতে গেলেন, কিন্তু গলা নামিয়ে বললেন–রাজু, এখন আর তা বলা যায় না। কন্যাপক্ষ উপস্থিত। কন্যার অধিবাস হয়ে গিয়েছে। তার মুখ চেয়েও। কথাটা শেষ হলো না।
শেষ করা যায় না। সকলেই জেনেছিলো, হৈমীর তত বেশি জানার কথাই। গুণাঢ্য মহাশয় সপরিবারে সবান্ধবে তখন রাজনগরে। একটা গোলমাল চলেছিলো বটে। তা কিন্তু বিবাহ হবে না এমন কথা নয়। রানী নাকি বিবাহের আগের বিকেলে আবদার তুলেছিলেন শালগ্রামশিলা সাক্ষী রাখা হোক, মন্ত্রগুলো সংস্কৃতে পাঠ করা হোক, আমার একইমাত্র ছেলে। এটা কি তাৎক্ষণিক আবেগ? অথবা অনেকদিনের পরিকল্পনা? ব্রাহ্ম মেয়েকে পুত্রবধূ করছি অথচ বিবাহটা হবে হিন্দুমতে? গুণাঢ্য মহাশয়ের সঙ্গে তার পরিবার ছাড়াও সমাজের অনেক প্রধান স্থানীয় ব্যক্তি। তারা বলে পাঠালেন, এমন অপমানজনক প্রস্তাবে রাজী হওয়ার চাইতে তাঁরা বরং কন্যাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তখন রানীর সেটা আর অনুরোধে রইলো না। সন্ধ্যার কিছু পরে গুণাঢ্য আর তার কন্যাকে তাদের আপত্তি সত্ত্বেও রাজবাড়িতে এনে রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট কন্যাত্রী তখন? আমোদ-আহ্লাদ, খাওয়া-দাওয়া, বিভুগুণগান সব চলতে পারে, বিবাহ-কর্ম সমাধা না-হওয়া পর্যন্ত কেউ সেই বাড়ির বাইরে যাবে না। রানীমার হুকুম। অন্তত ত্রিশজন বরকন্দাজ যেন তাদের সম্মানের জন্য বাড়িটাকে চারদিক ঘিরে পাহারা দিচ্ছিলো।
কিন্তু রানীর সেটা পরাজয়ের দিন ছিলো। পরাজয়কে জয়ে পরিণত করার কৌশলগুলো কি একটাও খাটলো? কবিরাজ রাজচন্দ্রকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলো। সন্ধ্যার কিছু আগে রাজচন্দ্র ঘুম থেকে উঠেছিলো। ইতিমধ্যে দাসীরাও হৈমীকে ঘুম থেকে তুলে বলেছিলো, রানী বলেছেন রাজকুমারকে স্নান করিয়ে সাজিয়ে দিতে। হৈমী এসে দেখেছিলো, রাজকুমার তার রাইডিং কোট পরছে। আর তখন রানী দ্বিতীয়বার এসেছিলেন রাজচন্দ্রর শোবার ঘরে। কথা কি আর বেশি হলো? দুজন তো দুজনকে চেনেনই।
রানীকে তখন বরং শান্ত দেখাচ্ছিলো। তার ঠোঁট কাপছিলো মনে হলেও, কথাগুলি নিচু স্বরের হলেও, তা সব খুব স্পষ্ট ছিলো। তিনি বললেন, তুমি কি বাইরে যাচ্ছো, পিয়েত্রোর বাংলোয় ফিরে যাচ্ছো?
-হ্যাঁ, মা। সেটাই ভালো লাগবে মনে হচ্ছে।
রানী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বললেন–তোমার বিবাহের ব্যাপারে ইতিমধ্যে আমি কেলেঙ্কারি করেছি।
–বিবাহ আমি করছি না।
–এইসব মানুষেরা অপমানিত হয়ে ফিরে যাবে? সেই নির্দোষ কন্যাটির কথাও ভাবো।
–আমি নিরুপায়। কিছু টাকা দিয়ে দাও।
রানী গলাটাকে আরো নামালেন–শোনো, রাজু, তোমাদের সম্পত্তির চার আনা অংশ আমার, তা জানো? আমি আজ সেই চার আনা অংশ আমার ভাবী পুত্রবধূর নামে লিখে দিয়েছি। গুণাঢ্যমশায় নিজে তার একজন সাক্ষী। আমি সে দস্তখত ফেরত নিতে পারবো না। তার অর্থ কী হয় জানো?
রাজু বললো–ওটাই তো যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ হয়েছে।
–এটা হাসির কথা নয়, রাজু। মুকুন্দ এখন সাবালক, তাকেও তার ছ আনা দিয়ে দিতে হবে। তোমার তাহলে কী রইলো?
রাজু বললো–আমাকে কি তোমার পা ছুঁয়ে বলতে হবে বাকি ছ আনাতেও আমার লোভ নেই?
রানী অদ্ভুতভাবে হাসলেন। বললেন–যেন রসিকতাই, অবশ্য তোমার ফরাসডাঙা থাকে।
বিবাহ হয়েছিলো, আর তা গুণাঢ্যর সমাজকে খুশি করেই, ব্রাহ্মমতে। গুণাঢ্যকে ধাক্কাটা সামলে নিতে সময় দিয়ে সকন্যা তাকে কন্যা-নিবাসে ফেরত পাঠিয়েছিলেন রানী। কায়েত কুমার মুকুন্দ তো এই উৎসবের জন্যই ফারলো নিয়ে চীন থেকে এসেছিলো, আর মায়ের সঙ্গে রাজবাড়িতেই উপস্থিত ছিলো। সেই রাত্রিতেই গুণাঢ্যর কন্যার সঙ্গে বিবাহ হয়েছিলো তার। ঘুমের ঘোরে কন্যা কি টের পেয়েছিলো যে বর বদলে গেলো?
সে দিনই জানা গিয়েছিলো, কায়েত বাড়ির কুমারও এ বাড়িরই রাজকুমার, বরং সেই জ্যেষ্ঠ এবং তার নামটা অত বড়-মুকুন্দবিলাসস্মৃতি।
অবশ্য বলা যায়, হৈমী সার রাজচন্দ্রকে একবার দেখে নিলো, সম্পত্তির ছ-আনা অংশের সঙ্গে ফরাসডাঙা আর নানা শেয়ার ও স্টক যোগ হলে কম হয় না, যদিও রাজনগরের রাজবাড়িটাও রানীমার চারআনি অংশের মধ্যে পড়ে বলে তা হাতছাড়া হয়; আর তখনকার দিনে গুণাঢ্যর সহায়তা না পেলে ফরাসডাঙাকে নিয়ে অত কেলেঙ্কারির পরে কারো আর রাজা উপাধি পাওয়া সম্ভব ছিলো না।
.
০২.
সেই রাত্রির সেই ব্যাপারে মৃত রাজার সম্পত্তির ট্রাস্টি হিসাবে রানী একটা দীর্ঘদিনের ভুলকে শুধরে নিলেন কিনা বলা যায় না। কিন্তু গাড়িটা থামলো। যেমন ছিলো তেমন অবস্থাতেই সার রাজচন্দ্র প্রথমে, পরে হৈমী নামলো গাড়ি থেকে। ভৃত্যরা, কর্মচারীরা তো প্রস্তুত ছিলোই। তারা মালপত্র গুছিয়ে নিতে গাড়িতে উঠলো। কুমারনারায়ণেরই বরং তাদের ভিড় এড়িয়ে নামতে অসুবিধা হলো। ততক্ষণে পাশাপাশি আর সব কামরা থেকে কুমারনারায়ণের সেই লালমুখোরা নামছে। সার রাজচন্দ্র একজন কর্মচারীকে তাদের দেখিয়ে দিলো। তারা অবশ্যই শুধু লালমুখোনয়। রেলের বড়ো অফিসার, জেলার কালেক্টর, ছোটোলাটের প্রাইভেট সেক্রেটারি ইত্যাদি।
তারা সকলেই কর্মচারীদের যার যার মালপত্র দেখিয়ে দিতে ব্যস্ত, তাছাড়া তার পরেও তো তাদের স্টেশন পরিদর্শন নামে কর্তব্য আছে। নতুন স্টেশনে সেই সন্ধ্যাতেই তো প্রথম। গাড়ি এসেছে। স্টেশনটাকেও সেজন্যই সুসজ্জিত করা।
তারা সকলেই আবার সে রাত্রির জন্য রাজচন্দ্রর গেস্ট। রাজচন্দ্র এবং হৈমী স্টেশনের টিকেট-গেটের পাশে আলোর নিচে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। কুমারনারায়ণ তার সুটকেসটাকে টানতে টানতে, স্টেশনের আলো আর সেই আলোর বাইরে অন্ধকার, যাকে সূচীভেদ্য বলা যায়, দেখতে দেখতে গেটের কাছেই এসে পৌঁছলো। হৈমী তাকে আগে দেখতে পেলো। সে নিজে তো অন্ধকার দেখেই চিন্তাকুল।
হৈমী বললো–এই যে কুমার, জার্নিস এন্ড?
কুমারনারায়ণ হেসে বললো–আপনাদের কর্মচারীর ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম, অসংখ্য ধন্যবাদ।
নট অ্যাট অল। এখন কোথায় যাবে মনস্থ করেছো? তোমার গাড়ি এসেছে?
কুমার জানালো-সে মরেলগঞ্জে যাবে, তার গাড়ি আসার কোনো কথা নেই।
-মরেলগঞ্জ। সেখানে? সেখানে অন্ধকারে কী করে যাবে? আগে কখনো গিয়েছে?
কুমার বললো–অন্ধকার দেখে এখন আশঙ্কা বটে। পথপ্রদর্শক–অন্তত একটা হারিকেন পেলেও হতো।
-তা তোমাকে দেওয়া যায়, হৈমী হাসলো, কিন্তু এমন সোফিস্টিকেটেড মানুষ, সেই অজপাড়াগাঁয়ে এত রাতে কোথায় যাবে?
-মরেলগঞ্জে আমার মামার বাড়ি।
-তাহলে তোক ঠিক করে দেবো? আমি অবশ্য মরেলগঞ্জের কাউকে চিনি না। শুনছো, এই যুবক মরেলগঞ্জে যেতে চাইছে।
সার রাজচন্দ্র ছিলো। সে হৈমীর কথা শুনে আপাদমস্তক ইউরোপীয় পোশাক-পরা কুমারকে দেখে নিলো, সে তত গাড়িতে অনেকক্ষণ ধরেই তার ইউরোপীয় ম্যানার্স লক্ষ্যও করেছে, সে অন্যমনস্কর মতোই বললো, কিন্তু নীলকুঠি তো বছর বিশেক আগে থেকেই উঠে গিয়েছে। সেখানে একমাত্র তাদেরই বাসযোগ্য বাংলো ছিলো। হ্যাঁ, বিশ বছর তো হলোই। খোঁড়া ডানকান ফিরেছিলো বটে, কিন্তু তারপর তারা সকলেই তো আমাদের চা বাগানে। তারা তখনই বুঝেছিলো নীলের চাইতে চায়ে লাভ বেশি। বাংলো-টাংলোও সম্পত্তিসমেত মহারাজার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলো। বোধ হয় বছর দশেক আগে একটি ট্যাস মেয়ে থাকতো বটে সেই ভাঙাচোরা বাংলোয়।
সার রাজচন্দ্র কর্তব্য শেষ করে শিস দেওয়ার জন্য ঠোঁট গোল করলো। বোঝা যাচ্ছে, নিজের বাড়িতে ফিরে বেশ সুখী।
হৈমীকুমারকে এবার বেশ বিব্রত দেখতে পেলো। বললো–তাহলে? কাল দিনের বেলা বরং মামাকে খুঁজো। আজ বরং আমাদের কাছে থাকবে? এখানে সম্ভবত ওয়েটিংরুম হয়নি এখনো ।
-কিন্তু এমনিই তো আপনাদের অনেক গেস্ট শুনলাম।
হৈমী বললো–শুনছো, এই ছেলেটি বলছে তোমার অনেক গেস্ট সেজন্য তাকে রাত করে মরেলগঞ্জ যেতে হচ্ছে।
রাজচন্দ্র সবার উপর দিয়ে সেই লালমুখোদের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখছিলো, বললো–সিলি! গলা তুলে একটু উঁচু করে বললো, ও, বিলি, আইম্ ওয়েটিং।
বিলি সম্ভবত ছোটোলাটের সেক্রেটারি, কাঁধে হাতে ভঙ্গি করে বললো–দিজ রেলওয়ে মে!
সুতরাং অন্যান্য গেস্টরা দু-তিনটে হ্যাঁমে ভাগ করে উঠলে, জোড়া ঘোড়ার ল্যাভোটাতে হৈমী ও সার রাজচন্দ্রের সঙ্গে কুমারকে উঠতে হলো।
.
সাতজন গেস্ট তো ছিলোই; টেলিগ্রাম পেয়ে অল্প সময়ে ভৃত্যরা একতলার সাতটা শোবার ঘর প্রস্তুত রেখেছিলো। দোতলায় ওঠার স্টেয়ারকেসের বাঁ দিকে আরো দু-তিনখানা ঘর। পুরো শীতটা সেগুলো তালাবন্ধ ছিলোলন পার হয়ে গাড়িবারান্দার দুপাশের ঘরগুলোতে দিস ইয়োর্স বলে এক-একজন গেস্টকে দেখিয়ে দিয়ে এবং ড্রিংকস্ পাঠাচ্ছি, কিন্তু বোধ হয় আধঘণ্টায় ডিনার গং বলে সিঁড়ির গোড়ায় তখন সার রাজচন্দ্র এবং হৈমী। তখন কুমারনারায়ণ তাদের পিছনে। তাকে দেখে ভৃত্যরা একটু মুশকিলে পড়লো। বন্ধ ঘরের তালা খুলবে কিনা এই দ্বিধা করতে লাগলো। তখন রাজচন্দ্র বললো––ও ঘর তো ঠাণ্ডা হবে, তুমি বরং ওপরে এসো, মিস্টার কুমারনারায়ণ।
দোতলায় রাজচন্দ্র বললো–তুমি এই ড্রয়িংরুমে আপাতত বসো। এটার সঙ্গে বাথ আছে। এখানে তুমি তৈরী হয়ে নাও। ইনফরম্যাল ডিনার, পোশাক না-পাল্টালেও চলবে। আমি তোমার শোবার ঘর ঠিক করে দেবো। তোমার ড্রিংকস্?
কুমার শুধু চা বললে, রাজচন্দ্র বললো–বেশ, বেশ, হৈমী এসে ততক্ষণ গল্প করবে। আমি একটু গেস্টদের ড্রিংকসের ব্যবস্থা দেখে আসছি।
সুতরাং কিছু রিফ্রেশড় হয়ে কুমার বসতে না বসতেই ভৃত্য তার চা নিয়ে এলো এবং কিছুপরেই হৈমীরও হাসিমুখ দেখা দিলো। ইতিমধ্যে সে আবার পোশাক পালটেছে। শাড়ি তেমন সাদাই বটে, মুক্তোর বদলে কানে হাতে গলায় লোখরাজ। গল্পটা কোনদিকে গড়ায়, সূচনায় যাই থাক, তা সম্ভবত যে গল্প করছে তার মনের নিকটতর বিষয়গুলোর দিকে গড়িয়ে যায়। সুতরাং কুমার যখন সেই ড্রয়িংরুমের কোণে রাখা পাহাড়ে চলা লাঠির দিকে লক্ষ্য করে বললো, আপনারা দুজনেই পাহাড়ে গিয়েছিলেন? অনেক দূর উঠেছিলেন নাকি? হৈমী এক কথায় হাঁ-নানা বলে বললো, এই তত দিন সাতেক আগে পাহাড় থেকে নামা হলো। আমি অবশ্য আলমোড়ার চাইতে বেশি ওপরে উঠিনি। সার রাজচন্দ্র অনেক দূরই গিয়েছিলেন। তুমি কি ওদিকের পাহাড়ে কখনো গিয়েছো? সার রাজচন্দ্ররও এবার এই প্রথম। কিন্তু আসকোট, বালুয়াকোট, সাংখোলা, গারবিয়ং, লিপুধুরা পর্যন্ত এবার গিয়েছিলেন।
কুমার বললো–এসব তো বিখ্যাত জায়গা নয়। তাহলে জানতাম বোধ হয়। আমি আলমোড়ার এক প্রাইভেট স্কুলে কিছুদিন পড়েছি। আলমোড়াই সবচাইতে বড় জায়গা ওদিকে, কিন্তু সেটাও তো বন, আর পাহাড়, চীর বন, আর বড়জোর ঝর্না।
হৈমী বললো–না, বড়ো জায়গা নয়। আসলে সার রাজচন্দ্র একজনকে সি-অফ করতে গিয়েছিলেন। হৈমী একটু ভাবলো, সার রাজচন্দ্র ফিরে এসে যে পথের কষ্টের কথা বলেছে, অনেক জায়গাতেই যে বরফ ছিলো, আবহাওয়ার তাপমান যে হিমাঙ্কের নিচে, সব পথটাই প্রাণ হাতে করে চলা, তা তার অনুভূতিতে ফিরলো। বললো, হ্যাঁ, এটা সার রাজচন্দ্রর খুবই দৃঢ়তা আর সহনশীলতার পরিচয়। তুমি নিশ্চয় মানস-সরোবরের নাম শুনেছো।
হ্যাঁ, তা তো তিব্বতে।
–নিশ্চিয়। লিপুধুরাতে পৌঁছেতেই হাত পা অবশ হয়ে যায়। প্রচুর শীতবস্ত্র না থাকলে মৃত্যু হওয়া অসম্ভব নয় এই শীতে। আর পথ তো পাথরে পাথরে পা রেখে চলা, ভালো গাইড না থাকলে আর তারা সাহায্য না করলে আমাদের মতো মানুষেরা এক পাও বাড়াতে পারবে না। আর মানস-সরোবর সে তো শুনেছি বরফে চলা আর প্রতি মুহূর্তে পড়ে প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নয় শুধু, ডাকাতের হাতে পড়ার আশঙ্কা।
আগ্রহ বোধ করে কুমার বললো–আপনি সি-অফ করার কথা বলছিলেন, ও পথে সি অফ মানে? ওটা কোথাকার পথ?
হৈমী ভাবলো কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা, কিন্তু পরে সেই গল্পটার আবেগই যেন নিজে থেকে তার মনে আত্মপ্রকাশের চাপ দিলো। সে বললো–তিনি একজন বৃদ্ধা, না না, প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন বৃদ্ধা রানী। তিনি মানস-সরোবরের উদ্দেশে গেলেন কিনা। বয়স প্রায় ষাট হয়েছে। সঙ্গে দু-একজন মাত্র লোক। তা সেই ভৃত্যটিও বৃদ্ধ। গাইডটা অবশ্য মাঝবয়সী। পাহাড়ী ঘোড়ায় হয়তো এখনো চলেছেন। এই দারুণ শীতে আর সেই নিঃসঙ্গ বরফ-ঢাকা পাহাড়ে দিনে তিন-চার মাইলের বেশি কি আর চলা সম্ভব? আর রোজ কি চলতেও পারবেন? হৈমী তার সাদা শালটাকে টেনে হাত দুটোকে ঢেকে নিলো।
কুমার বললো, বাপরে! তিনি খুব ধর্মপ্রাণা? এ যে মহাপ্রস্থানের মতো! এ রকম গেলে তো আর ফেরার সম্ভাবনাই থাকে না। আশ্চর্য কিন্তু, নয়?
.
কিন্তু ডিনারের ড্রেসিং গং বেজে উঠলো। সার রাজচন্দ্র, গেস্টদের ঘরে যখন ভৃত্যরা ড্রিংকসের ট্রে নিয়ে ঢুকছে, প্রত্যেক দরজার সামনে একবার করে হাসিমুখ দেখিয়ে হ্যালো জো, হেল্প ইয়োরসেলফ বিলি ইত্যাদি বলে দোতলায় ফিরে বাথে ঢুকেছিলো। গরম বাথটাকে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে ল্যাভেন্ডার ঘ্রাণটাকে উপভোগ করছিলো। ড্রেসিং গং-এর শব্দে বাথটাব থেকে উঠে পড়লো। এতগুলো গেস্ট! কিন্তু সেই গরম থেকে উঠেই স্বগতোক্তি করলো, কী ঠাণ্ডা, কী শীত! সে তাড়া তাড়ি শরীর ঘষতে লাগলো টাওয়েলে। মনে মনে বললো, বাব্বা, এ যে লিপুধুরা! গায়ে জামা চাপিয়ে তার মনে হলো, তা অবশ্য নয়। লিপধুরায় সেদিন তুষার পড়ছিলো। সাদা ছাড়া কোনো রংই ছিলো না চারিদিকে। সে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরতে লাগলো। তার মুখটা উদাসীন নিস্পৃহ, কিন্তু চোখ দুটো যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন কিংবা সজল। ঠাণ্ডা লাগলে যেমন হয়। তার চোখ দুটোয় কালো গ্লাসে ঢাকবার আগের কয়েক মিনিটেই, সেই সাদা দেখে, ঠাণ্ডা লেগে কষ্ট দিচ্ছিলো।
কিন্তু লিপুধুরায় পৌঁছে সে কাউকেই দেখতে পায়নি। তার গাইড অনেক চেষ্টায় বরফে বারো আনা ঢাকা ছোট গোয্যায় একজন লামাকে পেয়েছিলো। সেই লামাই বলেছিলো, এখন তো সব লোকই আসকোটের দিকে নেমে গিয়েছে। তবে সকালে একটিমাত্র দল তিনটি ঘোড়া নিয়ে লিপুধুরা ছেড়ে তাকলাখারের দিকে রওনা হয়েছে, নিষেধ শোনেনি। যদি বরফ পড়ার আগে পুরাং-এর জং-এ আশ্রয় পায়। সার রাজচন্দ্রর কঠিন মুখে গগল্স-ঢাকা চোখ থেকে জলের ধারা নেমেছিলো।
সারা পথটাই এমন হয়েছে। কখনো একবেলা আগে, কখনো একদিন আগে, রানীমার এগিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিলো। স্থানীয় দুঃসাহসী লোকেরা অতি প্রয়োজনে যাওয়া-আসা করছিলো, নতুবা সাধারণ গ্রামবাসীদের অধিকাংশ তখন নিচে নেমে গিয়েছে। উপায়হীন শীতে বন্দী যারা ছিলো তারাও একটা তিনজনের দলকে ক্রমশ উপরের দিকে চলতে দেখেছে। বালুয়াকোটের প্রধানের অতিথিশালায় পৌঁছে সে আর বাগচী সেই শেঠানীর কাছে শুনেছিলো, আগের দিন রানী রওনা হয়ে গিয়েছেন। লিপুধুরায় তবু তো সময়টা কমে একবেলার তফাতে দাঁড়িয়েছিলো। শেঠানী বাগচীর মারফত জানিয়েছিলো রাজচন্দ্রর ফিরে যাওয়া উচিত হবে। কারণ তার ধারণা কারো সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা থাকলে সেই দলটা থেকে যেতো সেদিনও। সেই রকম কথাই হয়েছিলো রাতে। সকালে উঠে সেই রানী যখন রওনা হওয়ার জেদ করলেন, তখন শেঠানী ঘোড়া তিনটে বদলে দিয়েছে আর এখানকার সবচাইতে ভালো গাইডটাকেই দিয়েছে।
রাজচন্দ্রর ইচ্ছা ছিলো, শেঠানীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে, কিন্তু বাদামী সিল্কের অবগুণ্ঠনে ঢাকা সেই ধনী শেঠানী পর্দার আড়ালেই ছিলো। বাগচীর রোগী বলে তার সঙ্গে কথা বলে, অন্যের সঙ্গে কথা বলবে কেন? রাজচন্দ্র পর্দার নিচে তার পা দুখানা দেখেছিলো আর পর্দা একবার একটু সরে গেলে একটামাত্র চোখ।
লিপুধুরার সেই লামা বলেছিলো, বরফ আরো বেশি পড়লে কালাপানি দিয়ে নামা যাবে । আপনারা নেমে যান এখনই। শেঠানীও তেমন বলেছিলো, আপনারা আর উঠবার চেষ্টা করে নেমে যান।
বালুয়াকোটে রাত্রিতে খেতে বসেছিলো, সে আর বাগচী। বাগচী বলেছিলো, আলমোড়ায় সংবাদ পেয়েই টেলিগ্রাম করেছিলাম। আমার ধারণা হয়েছিলো রানীমা মানস যাওয়ার আগে আপনাকে একবার দেখতে চান। আপনিও তো ঠিক এসেই পড়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম হলো। এ যেন মহাপ্রস্থান। কয়েক বছর থেকেই হিমালয়ের এদিক ওদিক ঘুরছিলেন। বছরে দু-একবার করে আলমোড়ায় নামতেন। কিন্তু এখন অন্যরকম মনে হচ্ছে।
রাজচন্দ্র বলেছিলো, আপনি আলমোড়ায় ফিরে যান, আপনার প্রাইভেট স্কুলের ছাত্ররা আছে, রোগীরা আছে। শেঠানীকে অনুরোধ করুন যাতে আমি দুটো ভালো ঘোড়া ও একজন গাইড পাই। যা টাকা লাগে দেবো।
পরের দিন সকালেও রাজচন্দ্রকে বাগচী নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলো। রাজচন্দ্র একটু শক্ত হয়ে বলেছিলো, কাল রাতে আপনি শেঠানীর সঙ্গে আলাপ করছিলেন আমি শুনেছি। এই মহাপ্রস্থানকে আমার সুইসাইডাল মনে হয়।
তখন শেঠানীর সেই মৃদু গলা আবার শোনা গিয়েছিলো-রাজাসাহেবের ইংরেজিটা আমি বুঝলাম না। কিন্তু মহাপ্রস্থান আগেও হয়েছে।
-সে তো কাব্যে, রাজচন্দ্র বলেছিলো।
পর্দার ওপার থেকে শেঠানী সেই একবার তাকে সরাসরি কিছু বলে ফেলেছিলো। রাজাসাহেব, কাব্য কি মিথ্যা? কাব্যে যা সম্ভব কোনো কোনো মানুষ নিজের জীবনে তেমন কিছু করতে চাইবে। সেই সময়েই পর্দার নিচে বাদামী সিল্কে ঘেরা পা দুখানা আর তার মলদুটো আবার চোখে পড়েছিলো রাজচন্দ্রর।
আর সে কথাটা বোধহয় বাগচী বলেছিলো আলমোড়ায় ফিরে যেতে। রাজচন্দ্র নেমে এসে বাগচীকে বালুয়াকোটেই পেয়েছিলো। বলেছিলো, শেঠানী নামতে দেয়নি। বাগচী বলেছিলো, মনে আছে রাজকুমার, সেই চতুর্দশীয় সৌরভ? আমরা ভুলে যাই সেই চতুর্দশীর মনেও ব্যূঢ়োরস্ক, বয়োবৃদ্ধ, জ্ঞানবৃদ্ধ এক স্বপ্ন থাকতে পারে। এই পাহাড়ে বিশ বছর কাটিয়ে আমার মনে হয়, এই হিমালয়কে, হাজার হাজার বছর ধরে, তেমন একজন পুরুষ বলে কল্পনা করা হয়েছে। তারপর একটু হেসে বলেছিলো, জাঁ পিয়েত্রোর ছবি আপনার যা মনে আছে। তাও কি এক বৃদ্ধের নয়?
টাইটা বাঁধলো রাজচন্দ্র নিখুঁত করে। গলাটা উঁচু করে আয়নায় বাঁধনটাকে লক্ষ্য করতে করতে রাজচন্দ্র ভাবলো, আলমোড়া থেকে সে অবশ্য বাগচীর টেলিগ্রাম পেয়ে অবাক হয়নি।
-ও না, তা সে ভাবছিলো না। রানীমা যে অবিরত পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতেন ইদানীং, তার ব্যাখ্যা কি বাগচীর ও কথায় হয়?
.
০৩.
ডিনারের পরে গেস্টরা শুতে গেলো। সার রাজচন্দ্রর মনে হলো এখনো তার অষ্টম গেস্ট সেই কুমারনারায়ণের শোবার ঘর ঠিক করে দেওয়া হয়নি। হৈমী সে ব্যবস্থা করবে ভেবে সময় কাটানোর জন্য সার রাজচন্দ্র তাকে নিয়ে নিজের শোবার ঘরে গেলো। বললো–বোসো, গল্প করি। তুমি খেতে বসে যে বলছিলে ইংরেজ তোমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, তা কি অন্তর থেকে বলেছিলে?
কুমারনারায়ণ হেসে বললো–ডিমোক্র্যাসি, লিবার্যালিজম,ন্যাশনালিজম,এগুলো তো শিখেছি। তাছাড়া বোধ হয় আন্দোলন করতেও।
রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো–এটা কী রকম কথা হলো?
কুমার হেসে বললো–দু রকমে। প্রথমত, ওদের দেশের আন্দোলনের ঐতিহ্যটার পরিচয় দিয়ে; দ্বিতীয়ত, ভালো আদর্শ তুলে ধরে সেই আদর্শ নিজেরাই ভেঙে দিয়ে বরং দমনমূলক এবং পক্ষপাতমূলক আইন তৈরী করে। ভিকটোরিয়ার ডিক্লারেশনের আদর্শ নিজেরা মানেনি। একটা উদাহরণ দেখুন, তার ফলেই ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে আন্দোলন, লালমোহন ঘোষের লন্ডনে যাওয়া। আর্মস অ্যাক্ট এবং ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট নিয়ে আন্দোলন তত দমনমূলক ও পক্ষপাতমূলক আইনের বিরুদ্ধেতা কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক চেতনাকে বাড়িয়েছে। এখন তো ইলবার্ট বিলের ব্যাপারটা দেখতেই পাচ্ছেন।
সার রাজচন্দ্র আবার হেসে বললো–তুমি খেতে বসে ওদের বলছিলে বটে ইংরেজদের ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলনের জন্য তুমি সুখী। তোমার এ মন্তব্য আমার গেস্টদের আনন্দিত করেছে।
কুমার হেসে বললো–আপনি বলছেন, ছলনা করা উচিত নয়। কিন্তু আমি সত্যি সুখী। ওদের আন্দোলনের জয় না হলে সুরেন্দ্র ব্যানার্জির অল ইন্ডিয়া ন্যাশন্যাল ফান্ড তৈরী হতো না। সারা ভারতবর্ষ থেকে প্রতিনিধি নিয়ে যে ইন্ডিয়ান ন্যাশন্যাল কনফারেন্স হতে চলেছে, তাও হতো না। এই অল ইন্ডিয়া, সারা ভারতবর্ষ সর্বভারতীয় শব্দগুলোই সবচাইতে মূল্যবান।
রাজচন্দ্র বললো–তুমি, মনে হচ্ছে, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির পক্ষপাত। এইসব ব্যাপারেই কি কলকাতা এসেছিলে?
কুমার একটু দ্বিধা করে বললো, কিছুটা তা বলতে পারেন। আবার হেসে বললো, আপনাদের জেনারেশনে কিন্তু এই সর্বভারতের বোধটা ছিলো না। সে হাসলো। বললো–সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে, তখন আপনাদের বয়স সম্ভবত আমার এখনকার বয়সের মতো ছিলো, আপনারা কিছু করতে পারেননি, কারণ তখন মারাঠা, শিখ, বাঙালি, হায়দ্রাবাদী, দিল্লীওয়ালা এইসব স্বার্থ পৃথক ছিলো। কলকাতা আসার অন্য কারণ, কিছুদিনের মধ্যে বিলেতে যাবো। বাঙালি হয়েও এর আগে বাঙলা দেশে আসিনি, তাই ঘুরে যাওয়া।
রাজচন্দ্র বললো–তোমার হাই উঠছে, মিস্টার কুমার। আচ্ছা, না হয় তুমি এই ঘরেই শোও। এ ঘর কি তোমার পছন্দ হচ্ছে?
কুমার চারিদিকে চেয়ে বললো–আমার মনে হচ্ছে, প্রিন্সলি। বোধহয় এটাই রাজকীয় বাড়িতে সব চাইতে রাজকীয়। বরং সঙ্কোচ হচ্ছে, হয়তো এটা আপনার নিজের ব্যবহারের।
-সে কিছু নয়। কাল তোমার মামাবাড়ির গল্প শুনবো। মরেলগঞ্জে একাধিক পুকুর থাকার কথা। নীলের জন্য জল লাগে। রাজচন্দ্র হাসলো। বললো–মামাবাড়ি খুঁজে পেতে পুকুর মেপে বেড়াতে না হয়! তার চাইতে এক কাজ করো। আমি লোক পাঠিয়ে বাড়িটা খুঁজে বার করতে পারি তোমার জন্য। তোমার কম্পানি বেশ লাগছে। …আরে দ্যাখো, সেই থেকে তোমাকে মিস্টার কুমার বলছি। কুমার তত তোমাদের উপাধি নয়, নিশ্চয়? নাকি রাজনৈতিক কারণে ইকগনিটো?
কুমারের মুখটা মুহূর্তের জন্য লাল হলো। কিন্তু তখনই সে বিড়ম্বনাটা পার হলো। হেসে বললো, আধুনিক কালে পূর্বপুরুষের নাম সবক্ষেত্রে না করাই ভালো। মনে করুন কেউ যদি রাজার ছেলেই হয়ে থাকে, তবে সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে সেই রাজা কী করেছিলো তাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। হয় সেই রাজা বিদ্রোহে প্রাণ দিয়েছে, ফলে রানীকে আত্মগোপন করতে হচ্ছে। অথবা সেই সময়ে সেই রাজা এমন কিছু করেছে যে তার পুত্রদের লজ্জায় থাকতে হয়, সেই রাজা বেঁচে থাকলেও এখন হয়তো এমন একজন প্রৌঢ় যার মধ্যে রাজাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমাদের উপাধি রায়। আসলে এমন কি হয় না যে আজ আমাকে যেমন দেখে আমার কম্প্যানি ভালো লাগছে, এখন থেকে বিশ বছর পরে আবার যদি দেখা হয় আমাকে আপনার তেমন না লাগতেও পারে। তাহলেও যেহেতু মরেলঞ্জের সঙ্গে আমার মায়ের যোগ, সুতরাং আমারও যোগ, আমি কিন্তু আপনার এস্টেটের ব্যারিস্টার হওয়ার ইচ্ছা এখনই প্রকাশ করছি। সার রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো–বিউটিফুল! আচ্ছা, এবার বিছানায় যাও। কাল দিনের আলোয় মামাবাড়ির খোঁজ কোরো।
সার রাজচন্দ্র বারান্দায় এলো। সারাদিন ট্রেনে চলার পরে এখন বিছানার কথা মনে হচ্ছে বটে। বারান্দা দিয়ে চলতে চলতে কুমারনারায়ণের কথা বলার ভঙ্গিটাকেই আবার ভাবলো। কেউ কি এমন করে ঘুরিয়ে বলে কথা আর হাসির আড়ালে চিরকাল লুকিয়ে থাকতো? হতে পারে, এই ছেলেটির জননী প্রবাসী বাঙালি পরিবারের মেয়ে। সে তো আমাদের রানীমাও ছিলেন। হয়তো সিপাহী বিদ্রোহের সমসাময়িক কালে ওসব দেশের কোনো রাজপুত্র অথবা সামন্তপুত্রকে ভালোবেসেছিলো। তারপর ছাড়াছাড়ি। এরকম হয়। পাশাপা। দুটো আলোকোজ্জ্বল ঘর থেকে পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। দুইটি আলোর চিত্রের মাঝখানে কোমল অন্ধকারটায় সার রাজচন্দ্র থেমে দাঁড়ালো। তারপর আলোকোজ্জ্বল ড্রয়িংরুম পার হয়ে তার পাশের ঘরটায় ঢুকলো।
সেটা শোবার ঘর। কিন্তু শয্যা থেকে অদূরে বসবার বন্দোবস্ত। টিপয়ের উপরে আলোয় হীরার মতো ঝকঝকে দুটি হুইস্কির গ্লাস। পাশে একটি হুইস্কির বোতল। প্ল্যাটিনাম ব্লোন্ড হৈমী টিপয়টার সম্মুখে বসে। সার রাজচন্দ্রকে ঢুকতে দেখে সে বললো–ঘুমোতে হবে, না কী?
রাজচন্দ্র টিপয়টা অন্যদিকে বসলো। গ্লাস দুটোকে হুইস্কিতে পূর্ণ করলো। একবার ভাবলো, কুমারনারায়ণ রায়ের কথা বলবে। কিন্তু বললো, আচ্ছ হৈমী, হিন্দুরা কি সচরাচর সোনার মল পরে? কী একটা সংস্কার আছে না?
সোনা পায়ে পরা লক্ষ্মীকে অপমান? হৈমী জিজ্ঞাসা করলো, তাই বলছো? এত রাতে?
এমন হতে পারে, হৈমী, তা সত্ত্বেও কোনো শেঠানী যদি তা পারে, তাহলে কি এই প্রমাণ হয় সে খুব দাম্ভিকা? খুবই দাম্ভিকা? শুধু ধনের দম্ভ নয়–
ঘুমোবে না আজ? আমার ঘুম পায়, বাপু।
হুইস্কির গ্লাসটাকে এক চুমুকে প্রায় শেষ করলো রাজচন্দ্র। বললো–নিশ্চয় নিশ্চয়। চলো, এবার আমরা ইউরোপ ঘুরে আসি। যাবে? তুমিও তো ঘুরতেই ভালোবাসো। বেশ এটাই কথা রইলো।