ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
০১.
রানীমার জন্মোৎসব নিশ্চয়ই বড়ো ঘটনা। তখন সেই রঙিন মেঘে সকলের আকাশই ঢাকা। কিন্তু উল্লেখযোগ্য আর কিছুই কী নেই? সেটাও তো রানীমারই উৎসব–শিবমন্দিরের বিগ্রহের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি, সেটা হবে তো। জন্মোৎসবের দিনবিশেক আগে রানীমা নয়নতারাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। নয়নতারা রাজবাড়ি আসতে গিয়ে নতুন জোগাড় করা একখানা পুঁথি এনেছিলো।
এটা কৌতূহলের ব্যাপার। নয়নতারার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে রানীমার কি এত বই পড়ায় ঝোঁক ছিলো? অথবা নয়নতারাই কি মহাভারত ও অন্যান্য পুঁথিতে এত মনোনিবেশ করতে অভ্যস্ত ছিলো? পাঠকের মনে পড়বে, রানী যখন নয়নতারাকে রাজবাড়িতে ডেকেছিলেন, তখন অন্য উদ্দেশ্য ছিলো। এখন সে রাজবাড়িতে এলে বারানসী অক্ষরে লেখা মহাভারতের কোনো-না-কোনো পর্ব তার হাতে থাকে। ব্যাকরণ ভাষ্য টীকা সহকারে তা পাঠ হয়। এ থেকে কি কোনো সাধারণ সূত্রে পৌঁছনো যায়? –মানুষ কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যে-কাজ আরম্ভ করে, একসময়ে উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে সেই কাজটাই নতুন উদ্দেশ্য সৃষ্টি করতে পারে।
নয়নতারা আসতেই রানীমা বলেছিলেন, তোমাকে একদিন শিবমন্দিরটা দেখতে যেতে হয়। শিবচতুর্দশীর আগে শেষ হওয়া দরকার। তাছাড়া সেই রাতে মেয়েরা কোথায় থাকবে, কোথায় স্নান করবে? পড়ো দেখি কী এনেছে আজ।
কিন্তু পড়া শুরু করার আগেই রানী হাসলেন। বললেন–হা,নয়ন, সেদিন বেনেরা ইচ্ছা তৈরি করে বলে খুব বলে খুব ঠকালে। কিন্তু আর-একরকম ইচ্ছাও কি নেই? এমনকী হতে পারে যাকে আমরা বুদ্ধির সাহায্যে ক্ষুধা নাম দিয়েছি, সেটাও আসলে একটা প্রবল ইচ্ছা? সেটা আছে বলেই বুদ্ধি তার নাম দিয়েছে।
-আপনি কি বলবেন তা বুদ্ধির চাইতে পুরনো?
বাহ্, যে-শিশুর কথা ফোটেনি তারও ক্ষুধা আছে, যে-প্রাণীর চেতনা নেই বলি, তারও ক্ষুধা আছে। দ্যাখো, ক্ষুধা নামে ওই ইচ্ছাগুলো আমাদের চালাতে থাকে, বুদ্ধিনা না করলেও থামা নেই।
–এ তো বড়ো ভয়ঙ্কর কথা যে আমরা বুদ্ধিতে চলি না! নয়নতারা হাসলো।
রানী বললেন–সেদিন হৈমী বাইবেলের গল্প করছিলো। ওদের ভগবান নিষেধ। করেছিলো তা সত্ত্বেও আদম না কে একজন ফল খেলোই। বুদ্ধি চালালে ভগবানের অত কাছের মানুষ কি বোকার মতো সেই ফল খায়, হলোই বা মেয়েমানুষের পরামর্শ? চৌদ্দপুরুষ ধরে অভিশপ্ত হয়?
রানী হাসলেন। নয়নতারা জিজ্ঞাসা করলো–হৈমী বাইবেল পড়ে নাকি?
রানী নয়নতারাকে ভালো করে দেখলেন, ভাবলেন, হয়তো পরে একদিন জানবেনই; তাহলেও এখনই কেন? যেন হালকা কিছু এমনভাবে হেসে বললেন, কিন্তু কপালের প্রান্তে যেন বিষণ্ণতাও। বললেন–তো, তোমার এই ইচ্ছা যার নাম ক্ষুধা সে কি বেনেদের চাইতে পুরনো নয়? অন্যদিকে গাছেরও আত্মপুষ্টির ফুল ফুটানোর ক্ষুধা থাকে। সে কি জানে ফলে তার কী লাভ?
আলাপটা এগোতে পারলো না। নায়েব উৎসবের ব্যাপারে দেখা করতে চাইছে জেনে রানী উঠে গেলেন। নায়েব নিবেদন করলো : শিশাওয়াল ফেলিসিটার কাল বিকেলের দিকে এসে পৌঁছবে আশা করা যাচ্ছে। আজ চিঠি পেলাম। নায়েব হাসলো। বললো– আবার, লিখেছে আলো দিয়ে সম্পূর্ণ রাজবাড়ি সাজানোর ভার এবার সে নিতে চায়। সেই ব্যবস্থা করে আসছে। আমরা কি অপেক্ষা করবো?
রানীমা বয়স্ক কর্মচারীর এই কমবয়সী আনন্দ দেখে হাসলেন, বললেন–বেশ তো, তোমরা যা ভালো বোঝে। নায়েব উঠে দাঁড়ালো। বললো–ফেলিসিটার লিখেছে তার নৌকোয় কায়েতবাড়ির কুমার আসছেন। রানী একটু ভাবলেন। বললেন এক মুহূর্তেই, তাহলে দুপুরের পর থেকেই হাওদা রাখতে হয় বোধ হয় কুতঘাটে।
নায়েব চলে গেলে রানী নিজের ঘরের দিকে ফিরতে ফিরতে ভাবলেন। তার কল্পনায় বিশেষ আলোকোজ্জ্বল রাজবাড়িটা ধরা দিলো। অন্যান্যবার কিছু কম আলো থাকে না, এবার তা বিশেষ হবে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলার নিজের ঘরের দিকে চলতে চিন্তা করলেন, এসবই কেমনভাবে ঘটতে থাকে না? ডানকানই আর তার সেই তশীলদারের কথা ভাবে? চন্দ্রকান্ত বোধ হয় নাম ছিলো। কিন্তু রোহিণী নামে সেই স্ত্রীলোকটি? রাজকুমার হয়তো বয়সের ধর্মে ভুলে যেতে পারে। তার মনে হলো, আচ্ছা, রাজুকে কি উদাস দেখায়? নাকি ছেলেরা বড়ো হলে তেমন মনে হয়?
অলিন্দ দিয়ে চলতে চলতে সেই দুপুরের বসার ঘরের দরজার মুখোমুখি অলিন্দ যেখানে ঝুলবারান্দায় বেড়েছে তার কাছে দাঁড়ালেন। নয়নতারা তখনও বই-এর সামনে দরজার পাশেই। মুখটা নিচু কিন্তু তার কোণে যেন কৌতুক।
পায়ের শব্দে নয়নতারা মুখ তুললে রানী বললেন, কী করছোনয়ন? বইটা কি ভালো নয়, নাকি টীকায় সন্দেহ আছে?
নয়নতারা বললো–কত বড়ো পণ্ডিতের লেখা; সন্দেহ কোথায়?
–মুখের চেহারায় রানী হাসলেন।
নয়নতারা অবাক হলো। অসময়ের এই কালীপূজা যা রানীমার জন্মোৎসবের অঙ্গ সে বিষয়ে তার তো কিছু সন্দেহ আছেই। তাই কি ধরা পড়েছে তার মুখে? সে হেসে বললো, আমার ভ্রূর গঠনে কিছু দোষ আছে, রানীমা।
–হুঁ। তুমি তো কম নও।
নয়নতারার মুখটা একটু বিবর্ণ হলো। কথাটা সুপ্রয়োগ হয়নি।
কিন্তু রানী হাসতে হাসতে বললেন, এবার কিন্তু তুমি দুষ্টু হয়ে ফিরেছে। রানীকে তেমন মানছে না। কিন্তু যেন চেঞ্জো থেকে ফিরে আরো ভালো দেখায় তোমাকে।
কথার আড়ালে সরে রানীমা ভাবলেন, ছেলেরা বড়ো হলে….কিন্তু কালীপূজার ব্যাপারটাকে নানাভাবেই প্রশ্ন করা যায়। রাজবাড়ির জন্মদিনের উৎসবগুলোতে সাধারণত গৃহদেবতা রাধাগোবিন্দর পূজা হয়। ছেলেরা বড়ো হলে তাদের মনের এক শরিক হতে পারে যে মা নয়। হঠাৎ একটা ধাক্কা লাগলো মনে। নয়নতারা কি জানে? রাজু কি তাকে বলেছে? এসব কত দিনে তামাদি হয়?
রানীর অন্তর চঞ্চল হলো। একটু যেন ঝুঁকে নিচের উঠানটাকে দেখলেন। একটু যেন আবার শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। ভাবছিলেন তো। ঘরের দিকে ফিরে বললেন–দ্যাখো নয়ন, ভুলে গিয়েছি। তুমি কাউকে দিয়ে এখনই একবার হরদয়ালকে আসতে বলে দাও।
রানীর স্বরটা দ্রুত। নয়নতারা তাড়াতাড়ি উঠে ভৃত্যদের খোঁজে গেলো।
রানী চারিদিকে চাইলেন, কিন্তু সেখানেই বা বিষণ্ণতা কোথায়? দিনশেষের বেলা তো নয়, দুপুরের দিকে চলেছে দিন যার উজ্জ্বলতা চকমিলানো দেয়ালগুলোর মধ্যে রোদে কবোষ্ণ জলাশয়ের মতো অগাধ স্থির। তখন কিছু কি উদাস? রানী মনে করতে পারলেন না রাজুর চোখ দুটিকে শেষ কবে ভালো করে দেখেছেন। বরং অনেক পিছিয়ে মনে হলো রাজুর ধাই-দাসী বলছে, এ মা, একেবারে হরিণচোখ, মেয়ে নাকি, রানীমা! এখন রাজু অনেক বেড়েছে। নায়েবমশাই, হরদয়াল দুজনেই দীঘল চেহারার মানুষ, রাজুকে তাদের চাইতে দীঘল দেখায়। হাসি হাসি দেখালো রানীমার মুখ, কিন্তু সে হাসি দেখলে দৃঢ়তার কথাও মনে হতে পারে কারো। আসলে ছেলেরা বড়ো হলে পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত হবে। পরিচয়ে সত্য থাকবে। পারো কি আড়াল করতে?
ইতিমধ্যে নয়নতারা ফিরেছিলো। রানী বললেন, শিশুর চোখ দুটি মায়ের চোখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে; তার বাইরে কিছু দেখতে চায় না। বড়ো হলে, তুমি দেখবে, তা স্বাভাবিক নয়। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী মায়ের মুখের চাইতে বিচিত্র, তাই নয় কি নয়ন?
নয়নতারা প্রস্তুত ছিলো না। সে কথাটা ভালো করে বুঝে উত্তর দেবার আগেই অলিন্দর। শেষ প্রান্তে পায়ের শব্দ হলো।
হরদয়ালই এসেছে। নয়নতারা অন্যত্র গেলো।
কিন্তু তখন কি আলোচনার সময়? বরং স্নানাহারের উদ্যোগ করতে হয়। রানীকী নির্দেশ দেবেন যা জরুরি? তিনি অলিন্দেই দাঁড়িয়ে রইলেন, সুতরাং হরদয়ালকেও সেখানে দাঁড়াতে হলো। রানী যেন গায়ে রোদ লাগাচ্ছেন, যেন বা কথা বলার জন্যই কথা বলা, থেমে থেমে কথা বলছেন। রানী বললেন, হরদয়াল, কলকাতার বাড়ি সম্বন্ধে আর কিছু ভেবেছো?
আহিরিটোলার বাড়িটা কেনা যায়, আর কালীঘাটের দক্ষিণে গিয়ে হেস্টিংয়ের বাড়ি ছাড়িয়ে সেই জমিটা দেখতে বলেন
-উৎসবের পরেই তাহলে কলকাতায় যাও। এদিকে নরেনের তৈরি বাড়ির সামনে বসানোর গাড়িবারান্দার নক্সা কি দেখলে? সব ইংরেজি বাড়িতেই নাকি তা থাকে। ভালো হবে? খৃস্টমাসে এবার রাজুর কলকাতায় যাওয়ার কথা কী ভাবলে?
নক্সাটা আর-একটু দেখে আপনাকে জানাবো। খৃস্টমাসের জন্য আপাতত আহিরিটোলার বাড়িটা ভাড়া নেওয়া যায়।
রানী দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। হরদয়াল চিন্তা করলো, এসব কথা কি এমন জরুরি? এ কি রানীর মনের কোনো চঞ্চলতাকে ঢাকার চেষ্টা? কিছু কি ঘটেছে? কথা শুনতে সে মুখ তুলেছিলো, নিজে থেকেই মুখ নামালো।
রানী বললেন–আচ্ছা, হরদয়াল, তুমি কি ভেবেছো আমাদের নায়েবমশাই বুড়ো হয়েছেন, হয়তো চার-পাঁচ বছরে বিশ্রাম নিতে চাইবেন। তার জায়গায় তখন কাজের মানুষই লাগবে। আমাদের ধরন বোঝে, তাকে ভালো লাগে এমন একজন দরকার হবে না? (রানী এই জায়গায় হাসলেন)। তাছাড়া এমন দুএকটা গোপন ব্যাপার থাকে যা গোপন রেখে চলতে হয়। আজকালকার ব্যাপার তো, নতুন লোককে ইংরেজিতে দক্ষ হতে হবে।
-এখনই খোঁজ করা দরকার?
-ভাবছিলাম এখন থেকেই রাজবাড়িতে অভ্যস্ত হোক, রাজুকে চিনুক, সম্ভবপক্ষে ভালোবাসতে শিখুক। আচ্ছা, আজকাল নাকি প্রাইভেট সেক্রেটারি রাখা হয়। সব লাটেদের ছোটো হোক, বো হোক–থাকে একজন।
হরদয়াল হাসিমুখে বললো–সে রকম লোক যদি পাওয়া যায় পরিকল্পনাটা বিশেষ ভালো।
রানী ঈষৎ হেসে বললেন জন্মোৎসবের পর নতুন কিছু করার রেওয়াজ হলো দেখছি। ভেবেছি, আমলাদের বেতন বাড়ানোর সঙ্গে এই পদটার জন্যও বড়জেটে ধরা হোক। কলকাতা থেকে কাউকে আনিয়ে নেবে? আচ্ছা, তোমার বাগচীমাস্টার ভালো ইংরেজি জানেন শুনি, রাজুর সঙ্গে ভাবও।
এবার রাজু ফিরবার পর থেকে প্রায় সন্ধ্যাতেই বোঠোকখানায় বসেন। দুজনে খুব কথা হয়। ইংরেজ রাজাদের গল্প। শিক্ষক তো, গল্প বলতে জানেন। ইতিমধ্যে হৈমীকে দিয়ে বিলেতি পিঠে, কেক না কী, তৈরি করিয়ে নিয়েছিলো। আচ্ছা, পাঞ্চো কী? এ কী বিষয়?
একটু ভেবে ইংরেজি শব্দ দুটোকে ধরলো হরদয়াল, কিন্তু পাঞ্চো যে ইংরেজি পাঞ্চ, ব্রান্ডিতে লেবু-গরমজল-চিনি ইত্যাদির এক বিশেষ মিশ্রণ, একরকমের মদকে যে এ বলে, ইংরেজিতে কেকস্ অ্যান্ড এ বলে যে এক প্রবাদ চালু আছে–এসব কি রানীকে বলা যায়!
কিন্তু রানী হাসলেন, বললেন–আচ্ছা, এই সন্ধ্যাগুলোর জন্য বাগচীকে কি কিছু বেতন দেওয়া উচিত? হরদয়াল ভাবলো, এতক্ষণে কথাটাকে সে ধরতে পেরেছে। বললো, আপনি কি মিস্টার বাগচীকে আপাতত প্রাইভেট সেক্রেটারি নিয়োগের কথা ভাবছেন?
–ভেবে দ্যাখো, ওদিকে তোমারে স্কুলও আছে।
হরদয়াল রানীর মনের গতি বুঝতে তার মুখের দিকে চোখ তুলো আবার, কিন্তু রানী ততক্ষণে আবার সুরেন-নরেশের বিষয়ে ফিরে গেলেন, বললেন–সিংদরজা থেকে পাকা পথটা আপাতত শিবমন্দির পর্যন্ত থাক। বসন্তে তো প্রাণপ্রতিষ্ঠা। তারপর সড়কটা ফরাসডাঙার আড়াআড়ি না-নিয়ে কায়েতবাড়ি থেকেও ওদিকে ফরাসডাঙার সীমা পর্যন্ত আনলে হয়। তুমি কি শুনেছো কায়েতবাড়ির ছেলেটি কালই আসছে এখানে?
হরদয়াল পথের কথায় বললো–আপনার হুকুম হলে তা হবে।
কিন্তু কায়েতবাড়ির কারো আসা যাওয়া সম্বন্ধে সে কী বলবে?
রানী ঝিকমিক করে হাসলেন, বললেন, ঝিলটায় এখন জল নেই বললেই চলে, ফরাসডাঙার সীমা পার হতে যা পেরোতে হবে। আগে হাঁস আসতো। ওটাকে বুজিয়োনা। ওর ওপারেই ছিলো ফরাসীদের ডিয়ার পার্ক। এখন একটা হরিণও বোধ হয় নেই। ওটা পিয়েত্রো এক তাসের বাজিতে তোমাদের রাজার কাছে জিতেছিলো। তারও আগে অবশ্য আমার শ্বশুর পিয়েত্রোর বাবাকে বাধ্য করেছিলেন জমিটুকুকে তাঁর কাছে ইস্তফা দিতে।
হরদয়াল কী বলবে খুঁজে পেলোনা। অনেকগুলো কথা হয়েছে, কোনোটাই অকার্যকরী নয়, কিন্তু কোনটা প্রধান? সবগুলো কাজ হলে ভিতরে বাইরে এক পরিবর্তনের ছাপ পড়বে অবশ্যই।
রানী নিজেই বললেন–আচ্ছা, হরদয়াল, তুমি সবদিকে চিন্তা করে জানিও।
রানী নিজের ঘরে গেলেন। সেখানে নয়নতারা তখন অপেক্ষায়। রানী বসলেন। গায়ের চাদরটাকে রাখলেন। কিন্তু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বললেন, চলো, নয়ন, স্নানে! তুমি কি বাড়ি যাবে ভাবছিলে? আজ দীঘিতে স্নান। ওদিকের ওই আলমারিটা খোলো; ওতেই বোধ হয় নতুন কাপড়। তোমার-আমার জন্য শাড়ি বেছে নাও।
এগুলো প্রাত্যাহিক আলাপের মতোই। যদিও এ কি এক পরীক্ষা–এই শাড়ি বাছার ব্যাপার? সেখানে তো নানা রং নানা ঢং নানা জাতের শাড়ি।
.
০২.
হরদয়াল সিঁড়ি দিয়ে নামলো। এখন তারও কাজের চাপ নেই। রানী কেন ডেকেছিলেন? অন্তত আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে কথা বললেন। বাগচীমশায়কে নিয়োগের কথা বলতে? রানী যেমন চাইছেন বাগচী তেমন একজনই বটে।
ইংরেজি ভাষার দখলে যে কোনো ইংরেজের সমকক্ষ। পরবর্তীকালে স্টেটের দেওয়ান, নায়েব ম্যানেজার যা হয় একটা হবেন। কিন্তু এখন কী কাজ হবে তার? প্রাইভেট সেক্রেটারিদের কী কাজ থাকে? মনিবদের চিঠিপত্র আদানপ্রদান কিংবা দেখাসাক্ষাতের ব্যাপারে মনিব এবং বাইরের জগতের মাঝখানে বাফার? কিন্তু আসল কাজ কি মনিবের চিন্তার প্রতিফলক হওয়া? চিন্তার প্রতিফলক! বেশ কথাটা, আয়না যেমন ব্যক্তির–যেমন–যেমন সে নিজেই বুঝি বা রানীর চিন্তার প্রতিফলক হয়ে পড়ছে। হরদয়াল কিছুটা কৌতুক বোধ করলো। কিন্তু এ তো বোঝাই যাচ্ছে, রানীর সবগুলো প্রস্তাবের মধ্যে যেন সবলতর হয়ে ওঠার ভাব ছিলো। তাহলে কোনো কারণে কি দুর্বল বোধ করছিলেন?
নিজের কুঠির কাছাকাছি এসে কেকস্ অ্যান্ড এল এই বাক্যাংশে যেন আবার শুনতে পেলো। ও দুটোর সমন্বয় তার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে। কিন্তু কে আনলো কেক রাজবাড়িতে?
কোন ময়রা মিষ্টান্ন পাঠায়, অন্দরে কোথায় কী মিষ্টান্ন তৈরী তা কাছারিতে জানার কথা নয়। সে জন্য রাজবাড়ির গোমস্তা-সরকার আছে। কিন্তু বিজাতীয় এই কেক যা বাগচী বাড়িরও নয়? কে হৈমী যে বিজাতীয় কেক তৈরী করতে পারে রাজবাড়ির ভিতরে? কে কোন পালকিতে ঢুকে রাজবাড়ির অন্দরে থেকে গিয়েছে তাও তোমার জানার কথা নয়, তাহলেও এটা বিস্ময়ের যে তেমন একজন কী করে কোথা থেকে এই গ্রামেই বা এসেছে? ওটাও দ্যাখো বিস্ময়ের যে, বাগচীমশায় ইদানীং অনেক সন্ধ্যায় রাজকুমারের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন। বলবে, বাগচী স্কুলের শিক্ষক, তাকে তুমিই এই গ্রামে এনেছো? হরদয়াল হাসলো। অবশ্য বাগচী তার এমন অধীন থাকতে পারে না যে তিন বছর বাদেও গ্রামের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সে নিজের সম্বন্ধ স্থাপন করবে না। তাহলেও আশ্চর্য লাগে যে সে এ বিষয়েও জানতো না!
আসল কথা, হরদয়াল ভাবলো, তাহলে কি এই যে জীবনের স্রোত তাকে পাশ কাটিয়ে তার লাইব্রেরি-ঘরের বাইরে দিয়ে বয়ে চলে গেলো? সে ভাবলো, দেওয়ানকুঠি রাজবাড়ির এত কাছে যে রাজকুমারের পিয়ানো ঘরে বসে শুনতে পারো, তাই বলে রাজবাড়ির অন্দরে কী ঘটছে তা কি জানতে পারো যদি রানী না-জানান? এটাই বোধ হয় সেই ব্যাপার যে রানী এবং তার সংসার এবং যারা সেই সংসারের হিসাব রেখে চলে তার মধ্যে একটা অদৃশ্য। পর্দা আছে বলে অনুভূত হয়। সেজন্য ওপারের সবই বিস্ময়ের আর কৌতূহলের। কী বলবে? রানীর মতোই? নাকি একটা হীরার মতো? আলো দেখে মনে হয় ভিতরটা ছুঁতে পারা যায়, কিন্তু কে কবে হীরার ভিতরে ঢুকেছে?
প্রমাণ তো আছেই। মনে হয় রাজবাড়ির সঙ্গে বাইরের যে যোগাযোগ তাকাছারির মধ্যে দিয়ে চলে। কিন্তু ইদানীং রানীর মুখে মরেলগঞ্জের সংবাদ শুনে মনে হয় না যে তার নিজের লোক আছে সেসব খবর রাখতে? ইদানীং বা কেন? দেওয়ান হিসাবে তুমি জানতে সাহবাদ পরগনায় ছ-আনি তরফ আছে যাকে কায়েতবাড়ি বলে; জানতে, সেখানে এক কুমার আছে; জানতে, নামে তা ছ-আনি তরফ হলেও রাজার সম্পত্তি ভাগ হয়নি; জানতে, এক ট্রাস্ট ডিডের বলে রানীই সব সম্পত্তির ট্রাস্টি। জানতে, বছরের শেষে সম্পত্তির লাভ থেকে যে কোম্পানির কাগজ নিয়মিত কেনা হয় তা যেমন রাজকুমারের নামে তেমন সেই কায়েতবাড়ির ছেলেটির নামেও। জানতে, চার-পাঁচ বছর আগে থেকে সেই কুমার কলকাতায়। কিন্তু জানে না সেই কায়েতবাড়ির সঙ্গে এই রাজবাড়ির ঠিক সম্পর্কটা কী। রানী বলেননি। কর্মচারীরা, গ্রামের লোকেরা কি জানে, আন্দাজ করে? কিন্তু দেওয়ান না জানতে চাইলে কে নিজে তা বলতে চাইবে? সেই ট্রাস্টি-ডিড সে কখনো দেখেনি। এটা এখানকার নিয়ম রানী কাকে কী করতে বলেছে তা নিয়ে আলোচনা হবে না।
তাহলেও, হরদয়ালের অনুভব হল, আগে হলে বাগচীর এইসব আসরের কথা সে জানতো এই ঘটনাটা সেই কথাই মনে করিয়ে দেয় সে দেওয়ান নয় আর, আর রাজকুমারের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই।
আসল কৌতুকটা অন্যত্র। রানী কী চাইছেন? সেক্রেটারি না টিউটর? নাকি বয়স্য চাইছেন যে বাগচীর মতো স্থিতধী এবং সৎচরিত্র, মদ খায় কিন্তু মদ্যপ নয়। সে নিজে এসেছিল রাজকুমারের সেই পাঁচ বছর বয়সে টিউটর হয়ে। টিউটর এবং রাজকুমারের দিনমানের সঙ্গী। তারপর ক্রমশ বদলে গেল। রাজকুমার তখন তেরো-চোদ্দো হবে। ক্রমশ পিয়েত্রো বুজরুক তার দিনের বেশির ভাগ নিতে লাগলো। সে নিজে অবশ্য তখন কাছারিতে বহাল। বুজরুক মাঝে-মাঝেই আসতো রাজকুমারকে নিয়ে যেতে। সেসব কি রানীর ইচ্ছাতে? এখন পিয়েত্রো বুজরুক নেই। সে জন্যই কিনতুনতর সঙ্গী হিসাবে বাগচী? তাহলে কিন্তু অবাক হতে হয়। ভাবলো হরদয়াল, সবটার পিছনেই কি পরিকল্পনা ছিল রানীর? কলকাতার শিক্ষা দিতে তাকে নিযুক্ত করে পরে পিয়েত্রো বুজরুক উপযুক্ততর মনে হয়েছিলো? আর এখন পিয়েত্রো বুজরুকের কাল চলে গিয়েছে বলে বাগচী?
হরদয়াল নিজের উত্তেজনায় হাসলো। নিজের উপমাকে মনে ফিরিয়ে আনলো। মনে মনে বললো, নিজেই বলছো, হীরার ভিতরে ঢোকা যায় না। কিন্তু রানীমাতা, এটা আপনার হাতড়ে হাতড়ে চলা হতে পারে, যেমন আমরা চলি। নতুবা বলতে হয় পুরুষদের মধ্যে দয়াল, পিয়েত্রো, বাগচী যেমন ক্রমে ক্রমে, স্ত্রীদের মধ্যে তেমন নয়নতারা, কেট, বর্তমানে হৈমী।
.
০৩.
স্নানে চলেছেন রানী, সঙ্গে নয়ন। পিছনে কিছু দাসী কাপড় ইত্যাদি নিয়ে।
অন্দরমহলে চতুষ্কোণ পার হয়ে প্রাচীরের মধ্যেই এই আর-এক মহল। মন্দির, নাটমন্দির, তাদের পিছনে শালবন, শালবনের পাশে দীঘি। বন অর্থে ঝোপঝাড় নয়, আগাছাও নয়। বরং গাছগুলোর তলা যেন নিকানো এমন পরিষ্কার। গাছের ফাঁকে ফাঁকে পথ। সেই বনের সামনে সোনালী গম্বুজওয়ালা লাল নাটমন্দিরসমেত সাদা মন্দির।
এখানে কারো কৌতূহল জাগতে পারে মন্দিরটা ঠিক এখানে এমনভাবে কেন?
মন্দিরের চেহারা নাটমন্দিরের চেহারা দেখে মনে হয় যথেষ্ট যত্ন আছে। কিন্তু এই রাজবাড়িরই যেখানে জাঁকজমকেরানীর জন্মতিথির কালীপূজা হয়, সে তত কাছারির দিকে, সদরে, প্রাসাদের এক অংশে। এই মন্দিরটিকে যেন কেমন লুকানো মনে হয়। শালবনের জন্য এই ধারণাটায় জোর পড়ে। আলো যখন ম্লান তখন হঠাৎ কারো মনে হতে পারে এই মন্দির পরিত্যক্ত।
বিষয়টি আসলে কিন্তু পার্থক্য। কাছারির কাছে সদরের আচার-আয়োজনের সঙ্গে এই মন্দিরের সেগুলির কিছু প্রভেদ দেখা যায়। সেখানে উৎসবের অঙ্গ হিসাবে দশটা ঢাকে কাঠি পড়ে, তেড়ে তেড়ে কাড়ানাকাড়া বাজে, বিদ্যাসুন্দরের পালাগান হয়, এবার তো শোনা যাচ্ছে নাকি ঠিয়াটারই হবে। এখানেও বাজনা বাজে, তা কিন্তু মৃদু বাঁশি আর ঢোল, কদাচিৎ জগঝম্পর একটানা ঝরঝমর। এখানে নাটমন্দিরে কখনো কীর্তন হয়, মুষ্টিমেয় শ্রোতার সামনে কীর্তনীয়া পদাবলীর সঙ্গে আখর জোগায়, কচিৎ কখনো কথকতা।
এই পার্থক্যগুলির কারণ সম্বন্ধে নানা গল্প আছে। এক গল্প বলে : এই বংশের বৃন্দাবনী গুরু, গুরু-পরম্পরায় যিনি নাকি শ্রীজীবের বংশধর, তিনি এখানে প্রায় পাঁচ বছর ছিলেন। এবং সাধনা করতেন। এবং তাঁর প্রত্যাদেশেই এই রাধামাধব বিগ্রহ। এই শালগাছগুলি তখনকার। যদি দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে মেহগ্নিও আছে তবে বুঝতে হবে সেগুলিই পরে লাগানো। সাধনার জন্য নিভৃত স্থানই প্রশস্ত।
এখনো (সাধনাটা বোধ হয় নেই। কিন্তু নিভৃতিটা আছে। পূর্ণিমা কিংবা তার আগের কয়েকটি রাত্রিতে শালবনে যখন জালিকাটা আলো তখন এই মন্দিরের কাছে, কারো তেমন। চেষ্টা থাকলে, সে নিভৃতিকে খুঁজে পেতে পারে।
অন্য গল্প এই যে, কাছারিতে নানা ধর্মমতের লোক আসে। আরো আগে তো ভিন্ন। ধর্মমতের এমন কেউ কেউ আসতো যাদের মুখ থেকে কথা খসলে দু-চারটে মন্দির চূর্ণ হয়ে প্রমাণ করতে পারতো প্রকৃতপক্ষে সেসব মন্দিরের বিগ্রহরা সবইঠুটো জগন্নাথ, ভক্তকে। রক্ষা করা দূরে থাক আত্মরক্ষাও করতে পারে না। অথচ তখন এমন অবস্থা যে রাজবাড়ির। কর্তাব্যক্তিদের ওঠাবসা কাজকর্ম সবই সেই ক্ষমতাবান ভিন্ন ধর্মমতের মানুষের সঙ্গে। তারা। এলে, কাছারিতে, এমনকী প্রাসাদের কোনো কোনো ঘরেই, ওঠাবসা এমনকী আহার না হোক একত্রে মদ্যপান তো চলতোই। কর্তাব্যক্তিরা তখন শিলোয়ারচুস্ত, চোগা চাপকান পরতেন। সে পোশাক নিয়ে কি রাধামাধবের সামনে দাঁড়ানোও যায়!
গল্প যাই হোক, এই নিভৃতির অর্থ পরিত্যক্তনয় তা এখনই বোঝা যাচ্ছে। দূর থেকেই মন্দিরের বারান্দায় কাজের লোকদের দেখা গেলো। শীতের ছোটো দিন। হয়তো অন্নভোগের আয়োজন শেষ করে দিয়ে এখনই শীতলের আয়োজন করছে।
শিরোমণি একবার যেমন বলেছিলো, রজোগুণটার প্রকাশ তবু চোখে দেখা যায়। সত্ত্ব যেন ফুলের গন্ধর চাইতেও হাল্কা আর অদৃশ্য, যেন লুকিয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, রাধামাধব বলল মদনমোহন বলল সত্ত্বগুণের উপাসনা। এ নিয়েও এক গল্প আছে। একজন মদনকে পুড়িয়ে ছাই করেছিলেন। অন্যজন মদনকে মোহিত করেছিলেন। মদন পায়ের কাছে লুটিয়ে স্বীকার করেছিলো হার। নারূপে না-গভীরতায় সেই একজনের প্রেমের কাছে প্রেমের রাজা মদন কিছু নয় তা স্বীকার করেছিলো। তারপরে মদন কী করেছিলো? সে সম্বন্ধে এখনো কবিতা লেখা হয়নি।
কিন্তু মানুষ কি পারে–কামের চাইতেও মনোমোহন কোনো অন্তহীন অতল ভালোবাসায় পৌঁছতে, তেমন কোনোরসকে আস্বাদন কতে, আহা, যা পরকীয়া প্রেমের চাইতেও মধুর? চরম সাত্ত্বিকতার সেই চরম মাধুর্য কৌপীনবন্ত কারো ভাগ্যে জুটেছে কিনা জানি না, কিন্তু মানুষের পক্ষে? বিনা দহনে আলোয় ঝলমল করা!
আর তার প্রমাণও আছে। রানী নিজেই জানেন। (তার মুখে হাসির মতো কিছু! তার কি এই কথাগুলোই মনে আসছে)?
কাদম্বিনী খুবই ভালো গাইতে পারতো। বৃন্দাবনের সেই মন্দির ছাপিয়ে, শুধু বৃন্দাবনের পথেই নয়, তার যশ তখনকার খাস দিল্লীর দিকে চলেছিলো। পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেকার দিল্লী। দিল্লীতে তখনো বাদশা। সুতরাং আমীর উজীর মনসবদার। উপরন্তু কাদম্বিনী তার শ্যামবর্ণ সত্ত্বেও টিকলো নাকে, টানা চোখে, শরীরের গঠনে, সুন্দরী ছিলো অসামান্যই, তার সেই পঁচিশ বছর বয়সে। ফলে কাদম্বিনী বৃন্দাবন থেকে কাশী এসেছিলো, বাঈজী না হয়ে মাথা কামিয়ে গৈরিক পরে সেই কায়স্থের বিধবা নিজের চারিদিকে এক কঠিন ছদ্মবেশ তৈরী করেছিলো। কিন্তু একসময়ে সে রানীর সহচরী হয়েছিলো। এবং ক্রমশ সেই ছদ্মবেশ থেকে বেরিয়ে এসেছিলো একনতুন সৌন্দর্যের ভিমিত পূর্ণতা নিয়ে। তখন অবশ্য রানীরানীহননি, কাদম্বিনীর পঁচিশ, রানীর বারো হবে। পরে কাদম্বিনী এই রাজবাড়িতেও এসেছিলো, রানীর সহচরীরূপেই। দাসী বা পরিচারিকা নিশ্চয়ই নয়, বরং সঙ্গিনী, যেন বা নতুন পরিস্থিতিতে মন্ত্ৰিণী। আর তার প্রমাণ তার বেশভূষাতেও ধরা পড়তো। সে আপত্তি করলেও রানী সোনার কাজ করা বেনারসী পরলে তাকে রূপোর কাজকরা বেনারসী পরতে হত, নিদেন ঢাকাই জামদানি।
সেই কাদম্বিনী এখানে গান করতো। সেই বৃন্দাবনের গানই। বৈষ্ণব মহাজনদের পদাবলি। রানীর ধারণা তা প্রাণহীন ছিল না। কারণ কাদম্বিনী বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের জ্ঞানে যে কোনো পণ্ডিতের সমকক্ষ ছিলো। এই গান এবং এই জ্ঞানই রাজাকে আকর্ষণ করেছিল। নতুবা এটা বলার বিষয়ই হয় না। রানীরা ছাড়াও অন্তঃপুরে সবসময়েই সুন্দরী স্ত্রীলোক থাকে। তাদের কেউ কেউ রাজশয্যায় কখনো স্থান পেলে দর্পিতাই হয়; ধর্ম গেলো এবং ভক্ষিতও হলাম এরকম মনে করে না।
কাদম্বিনী একদিন চোখের জলে ডুবে রানীকে বলেছিলো, আমি এখন কী করি বলো? সব শুনে রানী বলেছিলেন, তুমি আমার চাইতে বয়সে বড়ো, ধর্ম-অধর্ম বেশি বোঝা। তুমি যা হতে চলেছে সে সম্বন্ধেও আমি বা কী জানি?
রানী ভাবলেন। একটা কৌতুক বোধ সেই ভাবনার খুব কাছে থাকায় তার ঠোঁটদুটিতেহাসি জড়ানো। আসলে সূর্যও কি পারে বিনা দহনে শুধু আলো দিতে! আর আমরা মানুষেরা তো সূর্যেরই সৃষ্টি।
কাদম্বিনী বলেছিলো–আমি কায়স্থ, আমি বিধবা, আমি রাজার বিবাহিতা স্ত্রী নই। সেদিন রানীর মুখ লজ্জায়, ব্যথায় লাল হয়ে উঠেছিলো হয়তো। (এখন তা রানীর মনে পড়ে না। সেই তো প্রথম জানা গেলো নিঃসন্তান রাজার সন্তান হতে চলেছে। সপ্তদশী রানী তখন নিজের শরীরের অবস্থাকে কিছু সন্দেহ করছে মাত্র, আর এদিকে কাদম্বিনী নিজের অভ্যন্তরে সত্তাটাকেই উপলব্ধি করছে)। রানী বলেছিলেন, এ নিয়ে তুমি খুব লজ্জিত বা অপমানিত বোধ করছো এরকম অন্তত রাজার কানে ওঠা ভালো হবেনা। বিবাহিত না হলেও রাজবাড়িতে থাকাই তোমার পক্ষে ভালো হবে। সামান্য কিছু মাসোয়ারা নিয়ে অন্য কোথাও থাকলে কোথায় নেমে যাও তা বুঝে দ্যাখো। গান্ধর্ব মতটাকে যখন মেনেছে তার উপরে বিশ্বাস রাখো।
এখনো কাদম্বিনী তার টিকলো নাকে তেমন সরু করে তিলক কাটে। কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করে। কায়েতবাড়িতেও তার মহলটাই আলাদা। আসল ব্যাপারটা এই যে মানুষের পক্ষে সেই প্রেমোত্তর প্রেমের সাধনা খুবই কঠিন। কিন্তু তাহলেও প্রত্যয়টাও মিথ্যা নয়। সুগন্ধির ঝাঁপি যদি ঠাসা ভরতি না হয় তবে সুগন্ধি বস্তুগুলোর উপরে যে অন্তরীক্ষ, সেই আঁপিতে তা অদৃশ্য সুগন্ধে ম-ম করে। যেমন রাজবাড়ির পিছনে এই শালবাগান। হয়তো বাদশাহী ফারমানের যে রাজা পাটনা অযোধ্যা হয়ে দিল্লী তক্ যাতায়াত করতো তার মনে মধ্যেও কোথাও এমন একটা অসাধারণের প্রতি আকাঙ্ক্ষা ছিলো যা সার্থক হলে রূপ সনাতনের বৈরাগ্য হয়।
রানীর মুখ অন্তর্লীন হাসিতে উজ্জ্বল দেখালো। পায়ের তলায় শুকনোশালপাতা বিছানো পথ।
নয়নতারা বললো–বনমর্মর বলে নাকি একে?
নয়নতারার দুষ্টুমিতে আবার হাসলেন রানী।
এটাও কিন্তু কম কৌতুকের নয় যে রানী আজ খিড়কির দীঘিতে স্নানে চলেছেন। স্নানের জন্যই তো দীঘি এবং সেখানকার বাঁধানো ঘাট এমনকী পুরনারীদের জন্য স্নানের ঘর আছে, জলের উপরে-তা সত্ত্বেও। এবং এখানে চলতে গিয়ে এ পুরনো কথাগুলো যেন তার মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঠিক ভাবছেন এমন নয়, যেন মনে ঢুকতে দিচ্ছেন। কৌতুকটা এই যে এভাবে এ পথে স্নানে এসেই কি এমন হলো, অথবা মনে আসছিলো বলেই তিনি এ পথে এসেছে আজ?
রানী সংবাদ পেয়েছেন কাদম্বিনীপুত্র, অন্য কথায় কায়েতবাড়ির ছেলে, রাজবাড়িতে আসছে। রাজুর জন্মের পর এই প্রথম। রাজুর মনে কি ধাক্কা লাগবে? যখন তাদের সাক্ষাৎ হবে?
পরে না হয় ভবিষ্যতের কথা ভাববেন, কিন্তু অতীত? অতীত আর ভবিষ্যতে এই তফাত যে অতীত নিজের মনেরই এক অংশ যেন।
কাদম্বিনীকে এরপরে অন্যত্র থাকতে হয়। গম্ভীর খাদের গলা ছিলো রাজার।
-তা তো বটেই। (কী বা বুদ্ধি তখন সেই সপ্তদশী রানীর!)–আপনি কি বাগানবাড়ির মতো কিছু ভাবছেন?
–সে রকম কিছু। যদি বলো কলকেতার দিকে যেমন হচ্ছে তেমন একটা দূরে শাহাবাদ পরগনায়।
তাই হোক। কিন্তু তা রাজবাড়িই হোক। নতুবা কাদম্বিনী ছোটো হয়ে যায় না? আর সে ছোটো হলে আমারও সম্মান থাকে না।
তাই হয়েছিলো। শাবাদ পরগনার আয়েও একটা রাজবাড়ি চলে বৈকি। আর সেখানে কায়েতের মেয়ে কাদম্বিনী একা নয়, যেন এটা নীচ কিছু নয় এরকম বোঝতে, এ বাড়ির অনেক আশ্রিত সে বাড়ির আশ্রয়ে গিয়েছিলো, অথবা তাদের তেমন রাখা হয়েছিলো। আর আশ্রিত মানুষরা যদিও তারা রাজার আত্মীয় এবং কায়েতও নয়, কাদম্বিনীর সম্বন্ধে উন্নাসিক হবে এমন হয় না।
শাবাদ পরগনার কাছারি অবশ্য অন্যান্য পরগনার কাছারির মতোই নায়েব-ই রিয়াসতের অধীন। আর আয় ব্যয়ের শেষ হিসাব সুমারনবিশ দেখে থাকে।
রাণি বললেন, আচ্ছা, নয়নতারা, তুমি কি কখনো কায়েতবাড়ি গ্রামে গিয়েছে? নাম শুনেছো নিশ্চয়?
-হ্যাঁ, সদরে যেতে পড়ে। সেখানে এক জমিদারবাড়ি আছে, যারা নাকি কায়স্থ।
–সেখানে একজন কুমার আছে যার বয়স রাজুর কাছাকাছি, জানো?
–শুনিনি তো।
–সে আমাদের রাজবাড়িতে আসবে লিখেছে।
–আমাদের রাজকুমারের সঙ্গে পরিচয় বুঝি?
না। রাজু কবে কায়েতবাড়ি গেলো? তাছাড়া সেই কায়েত-কুমার তো পাঁচ-ছ বছর বয়স থেকেই বেশির ভাগ কলকাতায়।
রানী আলাপটাকে অন্য দিকে নিলেন। বললেন–তোমার সঙ্গে হৈমীর আলাপ হলো নয়ন? মেয়েটি ভালো নয়! বেশ সুন্দরী, কি বলল?
নয়নতারা বললে–বেশ কম বলা হয়।
রানী হাসলেন। বললেন–ভাগ্যে মেমসাহেব বলোনি। রাজুর একরকম মামাতো বোন, ওদের শাখাটার রং ওরকমই। কিন্তু দুঃখের ছায়া পড়লো রানীর মুখে। বললেন, তুমি ওর কথা জিজ্ঞাসা করছিলে না? কিন্তু কী কপাল! তোমাদের বয়স হবে, এর মধ্যে দুবার কপাল পুড়িয়েছে। জানো, ওর বাবা পাটনায় কমিসেরিয়টে ছিলেন। বালবিধবা মেয়েকে সব আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। পাটনার কুঠির পার্টিতে যেতো। সেখানে শেষ পর্যন্ত এক ইংরেজ না কী আইরিশ ক্যাপটেনের সঙ্গে প্রণয় পরিণয় হয়। কিন্তু দুমাস পরেই দানাপুরের কাছে কানোয়ার সিংকে রুখতে গিয়ে আর ফিরলো না।
নয়নতারা কী বলবে খুঁজে পেলো না। অবশেষে এই সাদা প্রশ্নটা করলো, উনি কি খৃস্টান?
রানী বললেন–বিবাহটা চার্চে হয়ে থাকবে। কিন্তু তাই বলে কি ধর্ম বদলেছে? মনে হয় না। জিজ্ঞাসা করিনি। ওর বাবা অনেক সাহস করেছিলো, কিন্তু এখন ফিরিয়ে নিতে সাহস পাচ্ছে না। দোষ দেওয়া যায় না, তার ছোটো বাড়িতে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যায়।
দূর থেকে যাদের দেখা গিয়েছিলো মন্দিরের বারান্দায় এখন তারা স্পষ্ট। তারা সকলেই ব্যস্ত। তারা কেউ ক্ষীরছানায় মিষ্টি গড়ছে, কেউ লুচির ময়দা নিয়ে ব্যস্ত। তারাও রানীকে দেখেছে। আজ কেউ কাজে ফাঁকি দিচ্ছে না, সুতরাং কর্মরত অবস্থায় রানীর দৃষ্টিতে পড়তে পেরে তারা বরং খুশি হলো।
রানী ওদের থেকে কিছু দূরে বারান্দায় বসলেন। রানীর পা নিচের সিঁড়িতে। রানীজুতো পরেন না, পায়ে আলতাও দেন না। তিনি তেমন করে সিঁড়িতে পা রেখে বসেছেন বলে জানা গেলো, পায়ে গুফের নিচে সরু পাটিহারের মতো পায়জোর। ঘুণ্টি নেই, তাই নিঃশব্দ; অযত্নে রূপোটা কি কিছু ম্লান?
এখন কি রানী এখানে গল্প করবেন? যেহেতু প্রাচীনাগণ পরিচারিকা শ্রেণীর নয়, বরং দূরের হলেও আত্মীয়াই, এখানে গল্প চলতে পারে।
আজ ভোগের আয়োজন কী হয়েছে, শীতলের আয়োজন কীকী হবে এসবই আলাপে এলো কারণ এসবই তো সেই একজনের যিনি রাজার রাজা। আজ শীতল-প্ৰসাদ কার বাড়িতে যাবে তা আলোচনার পর যখন জানা গেলো, আজ তা লিস্টি অনুযায়ী শিরোমণিমশায়ের বাড়িতে যাচ্ছে, তখন সেই সূত্রে যেন আলাপটা কেঁপে উঠতে পারলো। এটা একটা প্রথা, শীতলের প্রসাদ গ্রামের ভদ্র গৃহস্থদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। একশো জনের নাম আছে তালিকায়, ঘুরে ঘুরে সেই তালিকা অনুযায়ী বাড়িতে যায় প্রসাদ। গ্রামের একশত ভদ্র পরিবার বলা বাহুল্য তারা কিছু পরিমাণে অর্থবান, এবং এমন যে অনাহূত ভাবে রাজবাড়ির মন্দিরে প্রসাদ পেতে আসবে না।
শিরোমণির নামের সূত্রেই একজন বললো–অনেকদিনকথকতা হয় না। সামনে পূর্ণিমা। বললে হয় শিরোমণিকে।
রানী বললেন–কেউ কেউ বলে শিরোমণির কথকতা কাঠকাঠ।
সংস্কৃত বেশি থাকে। কিন্তু অমন ব্যাখ্যাও সহজে কেউ দিতে পারে না। গতবারে মানভঞ্জনের ব্যাখ্যা যা করেছিলো তা এখনো যেন কানে লেগে আছে। আমরা কি জানতাম যিনি তাঁর হাদিনী শক্তি, যিনি প্রায় অভেদ তার থেকে, তারও এমন অভিমান উচিত নয় যে তিনিই ঈশ্বরকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসেন, ঈশ্বর তারই একমাত্র। ঈশ্বর চন্দ্রাকেও কৃপা করবেন। সেজন্য মান করা শোভা পায় না। আমি সবচেয়ে বড় ঈশ্বরভক্ত এটাও তো সাধনার বিঘ্ন।
হেসে রানী বললেন–তোমার ব্যাখ্যাও কম যায় না, সুরধুনি। বেশ তত, শিরোমণির বাড়িতে যে যাবে শীতল নিয়ে তাকেই বলে দিও শিরোমণিকে কথকতার নিমন্ত্রণ দিতে।
আমার তো মনে হয় বিরুদ্ধপক্ষীয় নেতা হওয়া মানুষের স্বভাবেই থাকে। সেই আসরেও একজন ছিলো। ক্ষণকালের আসর, রানী এখনই উঠবেন স্নানে, কিন্তু মনের মধ্যে বিরোধপ্রবণতা নিজেকে নিয়েই একশো।
তেমন একজন বললেনয়ননাকি এবার ফিরেই শিরোমণিদের ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ দিয়েছিলে?
–শিরোমণিদের নয়, শুধু তাকেই। নয়নতারার মুখটা যেন একটু লাল হলো।
–তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন, আর তারপর বলতে পারোনি কাউকে আর?
যেন নয়নতারাকে প্রত্যাখ্যান করায় শিরোমণির রাজবাড়িতেও অনাদৃত হওয়া উচিত। আর একজন বললো–আমাদের রাজবাড়িতে তো ব্রাহ্মণ কর্মচারীর অভাব নেই।
অপরা বললো–তারা অন্তত বাধ্য হয়েই আসতো।
নয়নতারা মুখ নামিয়ে নিজের পায়ের দিকে চেয়ে রইলো।
কিন্তু রটালো কে এই প্রত্যাখ্যান? এই শেষ প্রশ্নটাই বা কে করলো? তা কি রানীর দৃষ্টি?
রানী যখন কথা বললেন, তার গলাটা গম্ভীর শোনালো। তাকেও কথা বলতে সময় নিতে হয়েছে। বললেন তিনি–তোমার কি ব্রাহ্মণভোজনের দিন পার হয়ে গিয়েছে? ওরা যেমন। বলছিলো তাও করতে পারো, নয়ন।
নয়নতারা রানীর দিকে চাইলো। তার চোখের পাতা দুটো কি কপলো? সে ধীরে ধীরে বললো–তাতে কি শিরোমণিকে অপমান করা হবে না?
রানী হাসলেন। এ হাসির নানা অর্থ করা যায়। একটা অর্থ এই হতে পারে, তোমার বুদ্ধিকে বিশেষ পছন্দ করলাম। কিন্তু যে শুরু করেছিলো আলাপটা তার মুখ ততক্ষণে কালো হয়ে গিয়েছে। বিশ্রী এই শব্দটাই যেন অন্যান্যদের মুখ থেকে বেরুবে। শিরোমণির প্রত্যাখ্যানটা যে রাজু এবং নয়নতারার সম্বন্ধ নিয়ে নানা কল্পনা থেকে ঘটছে তাতে সন্দেহ। নেই। রানীর মনে আলোচনাটাকুৎসিত, এই কথাটাই এলো। যেন কেউ ক্রুদ্ধও করে তুলেছে তাকে। কে সেই ক্রোধের পাত্র? যারা শিরোমণির কথা তুলেছিলো? তারা তো বিবর্ণমুখ, যন্ত্রের মতো হাত চলছে শুধু। অথবা ক্রোধের পাত্র কি শিরোমণি? কিংবা নয়নতারা? ক্রোধের পাত্র খুঁজে না-পেয়ে কি তিনি নিদারুণ রকমে হেরে যাবেন? তার একবার মনে হলো এরকম আকস্মিকভাবে কথাটা উঠে পড়লো কেন? সে জন্যই বিষয়টাকে আয়ত্তে রাখতে পারছে না! অথবা প্রকাশ আকস্মিক হলেও একদিন এ তত আলোচনার বিষয় হতোই। অতীতের সেইসব তো ছেলেমানুষি মোহ ছিলো রাজুর। এখন?
হঠাৎ যেন তার মনে কাদম্বিনী ফিরে এলো। কাদম্বিনী আর নয়নতারার পার্থক্য কি সেকাল আর আধুনিকতায়? কিংবা কাদম্বিনী নিজেকে রাজবাড়ির বাইরের সমাজে কখনো নিয়ে যায়নি যেমন নয়নতারা শিরোমণিকে আহ্বান করতে গিয়ে করেছে? কিংবা কথাটা আধুনিকতাই হয়তো। বাদশাহী ফারমানে যে রাজা তাকে যা মানায় রাজুকে তা মানায় না।
কিন্তু রানী গলা তুলে বললেন–এই দ্যাখো, মনে পড়ে গেলো, নয়ন, তুমি আর রাজু যে সেদিন অত গভীর রাত করে ফিরলে শিকার থেকে সে গল্পই আমার শোনা হয়নি। স্নান করতে করতে শুনবো।
নয়নতারা বললো–তাহলে চলুন, রানীমা, বেলা হচ্ছে।
রানী চলতে শুরু করলেন। তার মুখে ক্লান্তির পাশে স্নিগ্ধতা ফুটবে এবার মনে হলো। কিন্তু তাও কি সহজে! পাশে এখনো নয়নতারা রয়েছে তো! তিনি যেন নিজেকে তিরস্তার করবেন এরকম এক মনোভঙ্গির কাছে গেলেন একবার। যেন বা নিজেকে বলবেন এমন করে সমস্যাটা থেকে দূরে থেকেছে বলেই এমন বিস্ফোরণ হলো তোমার নিজেরই অন্দরমহলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজের ব্যক্তিত্বকে, যেমন অন্য সকলে, শ্রদ্ধা করেন। তাকে হীন করলে কি তিনি কিছু করতে পারবেন আর? নয়নতারা এবং রাজুর ব্যাপারটা ওদেরই নিজস্ব। সেটা কি আদৌ কিছু ব্যাপার? নয়নতারাকে হীন করলে ব্যাপারটা মলিন হয়ে যায়।
তিনি বললেন–নয়ন, তোমার সঙ্গে বিদ্যেসাগরের মত মিলছে না মহাভারতে, শিরোমণির সঙ্গে মিলছে না ব্রাহ্মণভোজনে। আমার মনে পড়ছে আগে এরকম কথা ছিলো গ্রামে তোমার দাদা ন্যায়রত্নের মত মেলে না কারো সঙ্গেই।
নয়নতারা বললো–ন্যায়রত্ন বলতেন মহাভারত বৃক্ষ।
–সেই যার মূল ধৃতরাষ্ট্র মহারাজা? সে তো সাধারণ মতই।
–ঠিক নয়। বলতেন বৃক্ষ জমি অনুসারে বৃদ্ধি পায়। মন অনুসারে মহাভারতের বৃদ্ধি।
কথাটা ভেবে দেখার মতো।
রানী স্থির করলেন তাকে এবার থেকে ভাবতে হবে। কিন্তু এখন নয়, অন্তত নয়নতারার পাশে থেকে নয়, যেমন নয় বিবর্ণমুখ তার সেই বর্ষীয়সী আত্মীয়াদের কাছে বসে। বিষয়টাকে নিজের আয়ত্তে এনে চিন্তা করতে হবে।
রানী বললেন–আ, নয়ন, ফরাসডাঙার ব্যাপারটা ভাবতে হয়। ওরা কি করছে? এবার শিবচতুর্দশীতেই কি সেখানে পুজো হবে? কেউ সেদিকটাকে দেখছে না যেন। ওদিকটার ভার নেবে? প্রকৃতপক্ষে রাজবাড়ির পুজোটুজোর ব্যাপারে বিশেষভাবে যাকে দায়িত্ব দেওয়া যায় এমন একজন কেউ নেই। নেবে সে ভার?
আপনার প্রয়োজন হলে তা করবো।
একবার রানী ভাবলেন নয়নতারার পাশে কি সত্যি তিনি ক্ষুদ্রকায়া ও মলিন হয়ে গেলেন? তা অবশ্যই নয়। নয়নতারা এখনো প্রাপ্তবয়স্ক রাজুকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে। এটা ভাবতে গিয়ে তেমন বোকামির কথা মনে এসে থাকবে? আসলে তিনি যা অনুভব করছেন তাকে কথায় আনলে এরকম হয়? আর দ্যাখো এই গরবিনীর রূপ, এই রূপসীর তেজ। চোখ দুটোকে দেখেছো?
স্নানের ঘাটে বসলেন রানী।