১৫. রানীর পক্ষে সংবাদ পাওয়া

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

০১.

রানীর পক্ষে সংবাদ পাওয়া কঠিন নয়। কাছারির লোক ছাড়াও তাঁর নিজেরও তো সংবাদ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিলো। বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যেত বলেই তো তার কাছে পৌঁছানো সংবাদকে নির্ভুল মনে করা হতো। সিদ্ধান্ত নিতেই যেন দেরী হচ্ছে। তিনি জানেন অ্যালবেট্রসের লোকেরা চড়ুইভাতি করতে নামেনি। তিনি জানেন সেই সাহেবের দলে মরেলগঞ্জের নীলকররা ছিলো; কালেক্টর, যার নাম ম্যাকফার্লান ছিলো; কলকাতা থেকে আসা এক সাহেব ছিলো, যার নাম সিবাস্টিয়ান, বলে, সে নাকি পাদরি। তারা ডিয়ার পার্কের টিলার উপরের দিকের কয়েকটা মেহগ্নি গাছ ইতিমধ্যে কেটেছে। তারা সেদিন জরিপ করছিলো। ওখানে একটা চার্চ বসাবে। তারা জায়গাটাকে খুব পছন্দের মনে করেছে। এমন ঢেউ খেলানো জমি আর এদিকে কোথায়? অন্যদিকে প্রজাও নেই, পিয়েত্রোর খাসে ছিলো। কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও নেই। চার্চ আর মিশনারি সাহেবদের বাংলোর পক্ষে এমন জায়গা আর হয় না। সামনের গুড ফ্রাইডে, পবিত্র দিন, সেদিনই চার্চের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে। চার্চের নামও নাকি হবে চার্চ অব দা হোলি অ্যাসেনশন।

শেষ পর্যন্ত সেদিন সকালে রানী তার মহলের অলিন্দ দিয়ে চলতে চলতে বললেন, রূপসী, রূপচাঁদকে ডাক। রূপচাঁদ উঠতে উঠতে তাকে সিঁড়ি দিয়ে দরবার হলের দিকে নামতে দেখলো। রানী রূপচাঁদকে বললেন–নায়েবমশায়কে দরবার হলে আসতে বলল।

রানী দরবারের ঘরে বসতেই রূপসী জানাতে এলো রূপচাঁদকে সে খবর দিয়েছে। রানী মিষ্টি করে হেসে বললেন–রূপী, একবার রাজকুমারের মহলে যাও। রাজকুমারের সময় থাকলে জানিও, আমি কথা বলবো।

যদি বলা হয় নায়েবমশায় কিংবা হরদয়াল তখন জানতো না চার্চের কথা, তবে বলতে হয় দুজনেই বয়সের ভারে শ্লথ হয়ে পড়েছিলো। নায়েব শুনে নিজেকে বলেছিলো, তাতে তোমার কীরে বাপু? যে খবর এনেছিলো তাকে বলেছিলো, দূরে দূরে থাকো গা। হরদয়ালকে খবরটা দিয়েছিলো বাগচী নিজে। আবার রলের চিঠি পেয়েছিলো বাগচী। সে এই ভাবতে চেষ্টা করেছিলো, রলে হয়তো মরেলগঞ্জের এবং ইন্ডিগো কমিশনের কথা জানে না। সে ভাবছে, হয়তো এখনো সব আগের মতোই আছে। কিন্তু সংবাদটা হরদয়ালকে জানানো দরকার যদিও রলের চিঠির প্রস্তাব মতো হরদয়ালকে অনুকূলে আনার চেষ্টা সে আর করতে পারে না।

হরদয়াল ও নায়েব, প্রায় একইসঙ্গে এসেছে তারা, বসলে রানী বললেন–ফরাসডাঙায় চার্চ হচ্ছে?

–আজ্ঞা, হাঁ।

–শুনেছো কালেক্টর নিজে নাকি উদ্যোগের পিছনে।

নায়েব বললো–অতটা শুনিনি।

রানী একটু ভেবে বললেন, এবার লাটের দিন এখন আসেনি। গত সনের ফরাসডাঙার লাট নাকি পিয়েত্রোর উকিল দয়ালকৃষ্ণ দিয়েছে।

হরদয়াল বললো–এরকম কিছু অসম্ভব নয়। নতুবা গত সনে ডাকে উঠত।

নায়েবমশায় বললো–গৌরী খবরাখবর নেয়। সে বলেছিলো, পিয়েত্রো মৃত্যুর আগে দয়ালকৃষ্ণকে এই মর্মে আমমোক্তারনামা দিয়েছে যে ৬১ সন তক সে আদায় করবে এবং লাট দিতে থাকবে।

হরদয়াল ভেবে বললে–এটা একটা আইনের ব্যাপার দাঁড়াচ্ছে, উকিল তো ওয়ারিশ নয়।

রানী বললেন–ওয়ারিশ নেই বলে, লাট দেওয়া সত্ত্বেও কালেক্টর কি ওটাকে খাস করে নিচ্ছে মনে করো?

হরদয়াল বললো–খাস এখনো করেনি, চার্চের সাহেবদের অনুমতি দিয়েছে, পরে খাস হবে স্থির করেছে হয়তো। চৈত্র শেষ হতে আর কদিন?

রানী যেন খুব লজ্জিত হয়ে পড়লেন। বললেন–অথচ, দ্যাখো, ভেবেছিলাম ওই টিলাটায় একটা সুন্দর বাড়ি হয়। আবার হয়তো ডিয়ার পার্ক হয়ে ওঠে।

হরদয়াল বিমর্ষ বোধ করলো, কারণ উত্তরটা সুখের হয় না। নায়েব ভাবলো, রানী কি ভেবেছিলেন যেমন শিবমন্দিরের বেলায় তেমন এই প্রাসাদের ব্যাপারে জবরদখল করে বেওয়ারিশ পিয়েত্রোর খাসজমি রাজবাড়ির সম্পত্তি করে নেবেন?

নায়েব বললো, রায়মশায় ঠিকই বলেছেন। ওটা আইনের প্রশ্নই দাঁড়াচ্ছে। মৃতের আমমোক্তারনামাও অচল। যদিবা লাট জমা পড়ে থাকে তা কিন্তু পিয়েত্রো জীবিতই এরকম বিশ্বাসে।

রানী ভাবতে লাগলেন। একবার তার মুখ রাঙা হয়ে উঠলো, একবার তার সুন্দর ছোটো কপালটা যেন ছায়া পড়ে বিবর্ণ হলো। তিনি হঠাৎ বেশ জোর দিয়ে বললেন না, তা হয় না। ফরাসডাঙার কিছুই খাস করতে দিতে পারি না।

এই সময় রাজকুমার বাগচীকে নিয়ে দরবারে এসে বসলো।

রানী তা দেখে বললেন রাজু, পিয়েত্রোর ফরাসডাঙা সরকার খাস করার মতলব নিয়েছে বোধ হয়।

রাজকুমার একটু ভেবে বললো–আপনার মন্দিরটাকেও দখলে নেবে নাকি?

রানী বললেন–তুমি এখন বড়ো হয়েছে, রাজু। একটু থেমে বললেন, শুনুন নায়েবমশায়, শোনো হরদয়াল। ওটা আমার চাই।

নায়েব বেশ বিচলিত হলো। হরদয়াল বললো, কী করে তা পারা যাবে যদি ওটা লাটের নিলামে ডাকার সুবিধা না হয়? আমরা জানি না কালেক্টর কলকাতায় পিয়েত্রো সম্বন্ধে কিছু লিখেছে কিনা, সেখান থেকে খাস করার মতো আনিয়েছে কিনা রেভেনু বোর্ডের।

রানীর ঠোঁটের কোণ দুটি শক্ত হলো। বললেন, তাহলে রেভেনু বোর্ডের সঙ্গে লড়তে তৈরী হও।

নায়েব বললো, তার আগে কিন্তু কালেক্টর চার্চ তোলার অনুমতি দিয়ে বসেছে। চার্চ উঠে যাবে।

রানী বললেন, এমন কি কেউ নেই যে টিলাটাকে আমার দখলে এনে দিতে পারে? আমি নতুন বন্দোবস্তে তাকেই ফরাসডাঙার পত্তনিস্বত্ব দেবো।

হরদয়াল বললো, দখল করে নেওয়ার ঝুঁকি আছে এক্ষেত্রে। তাছাড়া, রেভেনু বোর্ডের সঙ্গে মামলা লড়ে যাওয়ার জন্যই এমন কিছু দখল নেওয়া যায় না।

রানী বললেন, আমরা বিলেতে প্রিভি কাউন্সিলেও যেতে পারি তো?

হরদয়াল মৃদু হেসে বললো, রানীমা, মামলায় তো অন্তত কিছুটা যুক্তি থাকবে। বেওয়ারিশ একজন ফরাসীর সম্পত্তির ব্যাপারে কালেক্টরের আদেশকে অগ্রাহ্য করার পক্ষে অন্তত কিছু স্বত্বের জোর থাকা দরকার।

রানীমুখ নিচু করে নিজের হাত দেখছিলেন। মুখ তুলে বললেন, মুখ তার থমথম করছে, ও ফরাসডাঙার সবই রাজুর, রাজুর মাতুল-সম্পত্তি। রাজু ব্যতীত পিয়েত্রোর আর কোনো । ওয়ারিশ নেই। যেন লজ্জায় শিউরে-রানী উঠে দাঁড়ালেন।

বাগচী হঠাৎ বলে উঠলো, আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি, রানীমা সঠিক যুক্তি দিয়েছেন। আমি মঁসিয়ে পিয়েত্রোর কাছে শুনেছিলাম, তাঁর মাতুলকন্যা, তিনি ব্রাহ্মণ কন্যাও বটেন, কোথাও রানী। এখন বুঝতে পারছি, তিনিই আমাদের রানীমাতা।

হরদয়াল ও নায়েবরানীর উঠেদাঁড়ানো দেখে বুঝতে পেরেছিলো দরবার শেষ হয়েছে। নায়েব আজকাল আগের মতো তাড়াতাড়ি নড়াচড়া করে না। সে চিন্তাকুলও বটেইতিমধ্যে। সে ধীরে ধীরে উঠে রানীমাকে নমস্কার করতে গিয়ে দেখলো রানী চলে গিয়েছেন। নায়েব চলে গেলেও হরদয়াল দু-এক মিনিট তেমনি বসে রইলো। তার বিস্ময় যেন কাটতে চাইছে না।

রাজকুমার আর বাগচীও উঠে দাঁড়ালো। রাজকুমার যেন কৌতুক দেখেছে এমনভাবে বাগচীর দিকে চেয়ে হাসলো।

তখন কাছারি পুরোদমে চলেছে। নায়েব তার খাসকামরায় ঢুকে দু-চার মিনিট চুপ করে বসে রইলো। তামাক দিতে বললো। ল-মোহরার আসবার অনুমতি চাইলে বললো, বিকেলে। জমানবিশ নিজে এলে বললো, তোমাকে ডাকিনি, আমিনকে। জমানবিশ চলে গেলে তার খাসবরদারকে বললো, রাজবাড়ির নতুন রসুইওয়ালা বান্দাকে চেনো? তাকে বলবে ডেকেছি। আমিন এলে বললো, বিল মহলের গজাকে চেনো? কাল ভোরে তাকে চাই। বেরিয়ে পড়ো, মুখের এত্তেলা নয়। নায়েব গড়াগড়ার নল রেখে বারান্দায় এলো। বরকন্দাজদের একজনকে দেখে আঙুলের ইশারায় ডাকলো। সে এলে বললো, বুনোদের রেমো আর পেল্লাদকে চেনো? সন্ধে নাগাদ কাছারিতে আসে যেন। সে আবার তার খাস কামরায় ঢুকলো, ল-মোহরারকেই ডাকলো এবার। খাওয়া-দাওয়া করে সদরে যাও তো। ইদিক-উদিকে খবর করো, গুড ফ্রাইডে নাকী আছে তোমাদের, সেই ছুটি কাটাতে কালেক্টর কোন দিকে যাচ্ছে?

হরদয়ালও চিন্তা করতে করতেই তার কুঠির দিকে চলেছিলো। এটা কিন্তু খুব বিস্ময়ের হবে যদি প্রমাণ হয় যে জাঁ পিয়েত্রো রানীর আপন পিসিমার ছেলে। আর এখন তো তা প্রমাণ হলোই। সে ভাবলো, তাহলে কি রানীর খৃস্টান ধর্ম ও ইউরোপীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে অনেক মনোভঙ্গির বিশ্লেষণ হয়? তার মনে পড়ে গেলো, রাজকুমার বালকত্ব পার হয়ে কৈশোরের দিকে যেতে তার শিক্ষাদীক্ষার ভারই যেন পিয়েত্রো বুজরুকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। অন্তত দিনের অনেকসময়েই ফরাসডাঙায় কাটাতো রাজকুমার। একটা পক্ষপাতই ছিলো যেন রানীর রাজকুমারের বেড়ে ওঠার ব্যাপারে।

সে যখন তার কুঠিতে ঢুকেছে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। সিঁড়ির উপরে যেন রাজবাড়ির দিকে ফিরে কিছু দেখবে। সে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো, এখন তাহলে কি ব্যাপারটা বোঝ যাচ্ছে? এমন কী হতে পারে, সেই বিশেষ এক রাতে যখন রাজকুমারকে বুজরুকের সহায়তা করতে সে বাধা দিয়েছিলো তখনই রানী ক্রুদ্ধা হয়েছিলেন? সেজন্যই কি তাকে পদচ্যুত করা হয়েছে? বুজরুকের পরিকল্পনা যে পিয়েত্রোরও পরিকল্পনা তা তো সহজেই জানা যায়। কিন্তু এ কি সম্ভব, রানী ভেবেছিলেন এই রাজবাড়ি, বিশেষ রাজকুমার, সেই ৫৭-এর ব্যাপারে জড়ায়? কী হতো? কী লাভ হয়েছে কার? কিংবা রানী নিজেও কি বুঝেছিলেন পরিকল্পনা ব্যর্থ হবেই? তা সত্ত্বেও পিয়েত্রোর কাছ থেকে রাজকুমারকে সরিয়ে আনাও সহ্য করতে পারছিলেন না? তার পদচ্যুতি কি এক দুঃসহ নিরুপায় ক্রোধের প্রকাশমাত্র? তাতে কিন্তু প্রমাণ হয়, পিয়েত্রো রানীর কত কাছের মানুষ ছিলেন। কিন্তু কোনোদিনই কি কেউ পিয়েত্রোর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে তাঁকে?

.

সেদিন গুড ফ্রাইডে।

বাগচী দু-তিন দিন আগেই বলেছিলো, রাজকুমার, ছুটি চাই। একটা বই লিখে শেষ করতে হবে। আর তিনদিন সময়মাত্র হাতে। রাজকুমার বলেছিলো, ছুটি নয়, বই লেখার জন্য অবসর। বাগচী সেই সন্ধ্যার পর থেকে আসছে না।

কারো কথা ভাবতে গেলে মন অনেকসময়ে তাকে যেখানে শেষ দেখেছিলো সেখানে ফিরে যেতে পারে। বাগচী না আসায় তার সন্ধ্যাগুলো ফাঁকা যাচ্ছে এই অনুভূতি থেকে তার মন যেন বাগচীকে অনুসরণ করে তার কুঠিতে গেলো। তার মনে পড়লো, সেদিন বেশ হাসাহাসি হয়েছিলো কিন্তু নয়নতারার দীঘির জমি দেখার কথা নিয়ে। আর বোধ হয় পিয়েত্রোর তরোয়াল নিয়েও। আর সেই সময়ে, তার মনে পড়লো, পিয়ানোর ডালায় সেই রূপার ফলকে, পিয়েত্রোর পিয়ানোই তো সেটা, লেখা সেই বাইচেনাম। ও, সেই চতুর্দশীর সুঘ্রাণ! সেই বাইচে যে নাকি পিয়েত্রোর আদরের মামাতো বোন।

রূপচাঁদ এসে জিজ্ঞাসা করলো, রাজকুমার তখনই বাইরে যাবেন কিনা?

রাজচন্দ্র বললো, তা দিয়ে তোমার কী হবে? তুমি দুলকিকে আনতে বলল।

কিন্তু রূপচাঁদ যাওয়ার আগে রাজচন্দ্র তাকে থামিয়ে বললো, হারে রূপচাঁদ, তোর সঙ্গে কাঠের মিস্ত্রির জানাশোনা আছে? তুই কি গাছের উপরে সেই দুখানা ঘরের বাড়ির দেখেছিস? আমি জানতে চাইছি, সেই গাছের আর একটু নিচের দিকে আর খানদুয়েক ঘর হয় কিনা? মিস্ত্রিরা পারে কিনা? কাঠের সিঁড়িও করে দিতে হবে এঘরে ওঘরে যোগ করে। সব মিলিয়ে একটা বাড়ির মতো। খোঁজ নিয়ে জানাস তো আজ সন্ধ্যায়। আর একটা কাজ করিস। পিয়ানোটাকে ভালো করে মেপে নিবি। গাছের উপরে যে ঘর দুটো তার কোনটিতে সেটাকে বসানো যায় কিনা দেখে আসিস একসময়ে।

রূপচাঁদ বললো, আজ্ঞে আচ্ছা। কিন্তু সেখানে কি রাজকুমার একা থাকবেন?

-তুই বুঝি যেতে চাস?

–আজ্ঞে না, সে আমার বেশ ভয় করবে। আপনারও খুব একা লাগবে?

 –আচ্ছা বাঁদর হয়েছিস। যা, সহিসকে ঘোড়া আনতে বল।

রূপচাঁদ চলে গেলে রাজচন্দ্র ভাবলো, কী যেন সে ভাবছিলো? হৈমীর কথা? না, হৈমী কাল রাতে বলছিলো মুকুন্দর চিঠি এসেছে চীন থেকে। আর তা নিয়ে কাদম্বিনীই এসেছে কায়েতবাড়ি থেকে। হৈমীর কথাতেও বোঝা যাচ্ছিলো মুকুন্দ প্রকৃতপক্ষে এই রাজবাড়িরই কুমার বটে। এসব ভাবতে কিন্তু অবাক লাগে। আগেকার মানুষগুলোকে একটু স্পষ্ট করে চেনা যায় যেন।

সহিস রাজচন্দ্রের কথা মতো অর্থাৎ তার খয়েরি রঙের প্রিয় ঘোটকীটাকেই এনেছে।

রাজচন্দ্র ঘণ্টাখানেক চলে গাছ-ঘরের কাছে পৌঁছে গেলো। ঘোড়াটাকে ঘরে উঠবার মই-সিঁড়ির রেলিং-এ বেঁধে দিয়ে সে বরং আতপ্ত ঘাসের উপরে বসলো।

রাজচন্দ্র ভাবলো : একসময়ে সে কিন্তু ভাবতো, পিয়েত্রোর গল্প শোনার পর, যদি পিয়েত্রোর আত্মীয়া সেই রানী তাদের বাড়িরই হতো তবে ভালোই হতো। এরকম হয় না, হলে ভালো হতো, এরকম অনুভব করেই সে মায়ের কাছে প্রস্তাব করেছিলো অসুস্থ পিয়েত্রোকে রাজবাড়িতে এনে রাখতে। রানী বলেছিলেন, মানুষ বয়স্ক হলেই একা হয়ে যায়, তিনি নিজের কথা, পিয়েত্রোর কথা তুলে যেন একা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝিয়েছিলেন। তখন পিয়েত্রো তার আত্মীয় জানলে সে কি আর রানীর কথা শুনত? শেষে কিন্তু পিয়েত্রোর মৃত্যুর মুহূর্তে দয়াশীলা রানী পিয়েত্রোর নিভে আসা চোখের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন একবার।

এই সময়েই হঠাৎ যেন রাজচন্দ্র এতদিনে নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক মনে করলো। ওটা তো ভালোবাসার গল্পই। বিচিত্র সুঘ্রাণের ভালোবাসা। সে মনে মনে হাসলো, যেন মনে মনেই বললো, তাহলে কিন্তু রানীমা মা থাকে না। আমাদের মতো মানুষ হয়ে যাও, যার নিজের সুখ-দুঃখ আছে।

সে অনুভব করলো, এতদিন কি সে মায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলো, আর এখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে মায়ের থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে?

প্রথমে পায়ের শব্দ, তারপর দেখতে পেলো রূপচাঁদকে। সে ভাবলো, তাহলে কিছু না করে, কিছু না ভেবে পুরো দিনটা কাটিয়ে দিয়েছে নাকি? হয়তো বনের বাইরে সূর্য ঢলে পড়ছে। কিন্তু রূপচাঁদ হাঁপাচ্ছে, ছুটে এসেছে সন্দেহ কী?

রূপচাঁদ বললো, হুজুর আপনি এখানে?

–এখানে কী দোষ করেছে?

রূপচাঁদ বললো, ওদিকে যে সর্বনাশ! শিগগির চলুন। আপনাকে নিয়ে যেতে না পারলে হৈমীদিদি আমাকে সদরদরজার সামনেই গুলি করে মারবে বলেছেন। নিজেও সেখানে দু তিনজন বরকন্দাজ নিয়ে পথ আগলাচ্ছেন।

রাজচন্দ্ৰ কপট আশঙ্কায় বললো, সে কী রে, হাতে কি বন্দুকও নাকি?

রূপচাঁদ বললো, আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর, আপনার রাইফেলই একটা আর তাতে গুলিও ভরা।

এবার রাজচন্দ্রকে উঠে বসতে হলো। সে কারো তার রাইফেল ছোঁয়া পছন্দ করে না। সে বিরক্ত হয়ে বললো, এসব কেন?

রূপচাঁদ বললো, হুজুর, বান্দাকে মেরে ফেলেছে।

বান্দাকে? কে? কেন?

বান্দা মরেলগঞ্জের নতুন জমিতে পুকুর কাটাতে গিয়েছিলো একশো কোদাল নিয়ে। জুড়ান পাইক সড়কি চালালে বান্দা তাকে দুফালা করে ফেলেছিলো। তখন কীবল এসে দূর থেকে বান্দাকে গুলি করে মেরেছে। হুজুর, শিগগির চলুন। ওদিকে আরো। ফরাসডাঙায় গিয়েছে গজা মণ্ডলের দল। সাহেবদের ভিতের পাথর গাড়ার কাজ ভেঙে উড়িয়ে দিতে।

সেখানে শুনি কালেক্টর, তার ফৌজ, ডানকান আর কে কে সব সাহেব!কটার বা প্রাণ গেল। সেখানে! আপনাকে কোথাও না পেয়ে আপনি ফরাসডাঙায় ভেবেমাসি পাল্কি করে সেদিকে। গেলেন। কী যে বিপদ! আমাকে বললেন, রূপচাঁদ, রাজকুমারের হাতে যে বন্দুকটা। সবচাইতে ভাল চলে সেটা দাও পাল্কিতে। গুলি আর বন্দুক তুলে নিয়ে বেহারাদের বললেন, উড়ে চলো, বকশিশ দেবো। রূপচাঁদ কেঁদে ফেলো, হুজুর, আমারই ভুল। আমি বলেছিলাম, রাজকুমার খালি হাতে বেরিয়েছেন।

রাজচন্দ্রের ঘোড়া ততক্ষণে ধাপে ছুটতে শুরু করেছে।

.

০২.

বাগচী ভাবছিলো আজ সারাদিন সারারাত লিখেই কী শেষ করতে পারবে–এই শেষ দুটি ওষুধের কথা? ইতিমধ্যে বেলা দুটো হয়ে গেল। চরণের হাতে এ দুটি ওষুধ কত যন্ত্রণা কত হতাশাকেই না দূর করতে পারবে! কত রকমেরই তো দুঃখ, যন্ত্রণা, অপমান, হীনতা! তাদের পক্ষে অনেকগুলিই দূর করা সম্ভব নয়। আত্মার যন্ত্রণা, মনের যন্ত্রণার কিছুই কি করতে পারে তারা। কিন্তু দেহের যন্ত্রণার কিছু লাঘব করতে চেষ্টা করা সম্ভব। রোগগ্রস্ততাও তো একরকমের হীনতা, অপমানও বটে। সে স্থির করলো এই রকম পাইপ টানার জন্য যে সময় ব্যয় হবে তাছাড়া অন্য সময়টুকু সে লিখে যাবে। সে অবশ্যই এ পর্যন্ত ক্রাইস্টের কাছে ঈশ্বরজ্ঞানে কিছু চায়নি। কিন্তু তার হাতের স্পর্শে যে নিরাময়গুলি সম্ভব হয়েছিলো তেমন নিরাময়কেই সে প্রার্থনা করছে এখন।

অস্বাভাবিক শব্দে বাগচী তার স্টাডি থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। কেট অবশ্যই এখন কিচেনে, তার কুঠিতে এরকম সব শব্দ কেন হয়? সে দেখতে পেলো, এক উন্মাদিনী বিলাপ করতে করতে তার কুঠিতে ঢুকে পড়েছে। খোলা চুল পিঠের উপরে। হয়তো ছুটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে থাকবে, ফলে বিস্বস্ত শাড়ি ঘেঁড়াও বটে। তার প্রথমেই মনে হলো সে কি কেটকে কিছু পোষাক আনতে বলবে? তার এরকমও মনে হলো, হায়, এ কি মরেলগঞ্জের কোনো উৎপীড়িতা? সেই উন্মাদিনী হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, সে চরণের বউ। চরণকে কাল সন্ধ্যার সময় কালেক্টরের পেয়াদা ধরে নিয়ে গিয়েছে। এখনো ফেরেনি। আর কী ফিরবে? এই কাগজ দেখুন।

চরণের স্ত্রীর বনদুর্গা বোধ হয় তার শক্তির শেষ সীমায় এসেছিলো, সে হাহাকার করে কেঁদে বসে পড়লো। কাগজটাকে পড়ে বাগচী পকেটে পুরলো। সে বলতে গেলে, চরণের বউ, তুমি কেঁদো না। আমি এখনই এই মুহূর্তে যাচ্ছি, দেখবো কেমন কালেক্টর, আর কেমন তার বিচার! কিন্তু হঠাৎ তার প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেলো। পার্লারের কোণে তার নানারকম ওয়াকিং স্টিক। সে সবচাইতে মোটা আর বড়ো মালাক্কা বেতের লাঠিটাকে বেছে নিয়ে সেটাকে মেঝেতে ঠুকতে ঠুকতে বললো, তুমি কিছু ভেবোনা, কিছু ভেবোনা, চরণের বউ। সীমা আছে অত্যাচারের। ভারি ইংরেজ হয়েছে! ভেবেছে আমার গায়ের রং কালো বলে ওরা আমার চাইতে বড় ইংরেজ! আমি টাইমসে লিখবো, আমি পার্লামেন্টে কোশ্চেন তুলবো। আমি, আমি-আমি চরণকে না নিয়ে ফিরবো না।

এইসব সোরগোলে কেট ছুটে এসেছিলো। বাগচী কেটের সঙ্গে একটাও কথা না বলে লাঠি হাতে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেলো।

.

ঘোটকী তখন তীরবেগেই ছুটছে। রাজচন্দ্র বিরক্ত মুখে ভাবলো, এসব কি নায়েবমশায়ের হুকুম? কে বলেছিলো এখনই তাকে দীঘি কাটাতে? কী লাভ? শুধু কয়েকটা মানুষের প্রাণ যায়! কী হয় ফরাসডাঙার পরগনাটাকে রাজনগরের সঙ্গে যোগ করলে! অকারণে কিছু নরহত্যা। মনে করো ডানকানের কুঠিকে নিশ্চিহ্ন করা হলো, তা কি হাস্যকর প্রস্তাব নয়? বান্দার কথা মনে পড়লো তার। ও, সেই ফেনসিং-বিশারদ কীবল! রাজচন্দ্রর মনে হলো, কাপুরুষ। বান্দার তরোয়াল যে খেলার নয় তা বুঝে দূর থেকে গুলি করে মেরেছে! একটা দুঃসহ ক্রোধ উঠে পড়ছে, ছুটন্ত ঘোটকীর উপরে সেটাকে সে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। ওদিকে আবার হৈমী কী বোকামি করে বসেছে! রাজকুমারের হাতে তার সবচাইতে শক্তিশালী রাইফেলটা তুলে দিতে পারলেই কি কিছু হয়? এতক্ষণে কি সে ফরাসডাঙায় পৌঁছে গেলো?

সেই খয়েরি ঘোটকী মুখে ফেনা নিয়ে রূপার বিট কামড়ে ধরে যেন চারখানা পায়ে একটামাত্র শব্দ তুলে রাজবাড়ির সদর দরজা পার হয়ে গেলো।

বাঁ হাতের দিকে তখন গাছের মাথাগুলোর উপর দিয়ে পাক খাওয়া সাদা কালো ধোঁয়া, দুপুরের রোদের আকাশকেও লাল করে আগুনের আভা। উভয় পক্ষেই গোপন করার চেষ্টা ছিলো, ফলে সেই গুড ফ্রাইডেতে ঠিক কী ঘটেছিলো তার বিবরণ উদ্ধার করা সহজসাধ্য নয়। দীঘি কাটার সেই জমিটাতে অকরুণ নিচে রৌদ্রদগ্ধ মাটির উপরে দুটি শব পড়ে ছিলো সন্ধ্যা পর্যন্ত। একশো জন কোদালি না হলেও, তখনো কিছু কোদাল যন্ত্রের মতো মাটি কেটে চলেছে।

মরেলগঞ্জের দেওয়ান মনোহর সিং-এর সেই প্রকাণ্ড আটচালাসমেত গোটা বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছে। গজা মণ্ডল, যার আসল নাম মেন্ডোজা ছিলো একসময়ে, যার কাঁধের মাপ এক গজ বলে নতুন নাম মানিয়ে যায়, সে জানতে পেরেছিলো চরণকে শেষ দেখা গিয়েছিলো মনোহর সিং-এর আটচালাতেই। কিন্তু তন্ন তন্ন করে প্রত্যেকটি ঘর খুঁজেও তাকে না পেয়ে, দড়িতে বাঁধা মনোহরকে লাঠিতে খুঁচিয়েও যখন চরণের সম্বন্ধে জানা যাচ্ছে না, তখন তার সঙ্গের লোকেরা আগুনের ভয় দেখাতে গিয়েই নাকি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। চৈত্র-বৈশাখের দিনে সে আগুন কি থামানো যায়? নতুবা গজার ইচ্ছে ছিলো না মানুষকে পুড়িয়ে মারার।

এসবই অনেকপরে গজার বিচারের সময়ে জানা গিয়েছিলো। গজারই শাস্তি হয়েছিলো। নায়েবমশায় দণ্ড কমাতে চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু বোকা রোকনুদ্দিন, কাজটা খুবই ভুল করেছিলো। মনোহর সিং-এর চতুর্থ স্ত্রী, যাকে গজার বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলো রোকনুদ্দিন, সে গজাকে সনাক্ত করেছিলো।

গজাকে যখন সেই ঘোষজা ডেপুটি ধরে নিয়ে যায় তার আগে সেই ডেপুটির লোকেরা বিলমহলে কবর খুঁড়ে রহিম আর রমজানের শবও বার করেছিলো। তাদের গায়ে তখনো ঘায়ের চিহ্ন ছিলো, কিন্তু সে বিশ্বাস করেনি তা বসন্তের। বরং আগুনের পোড়া হওয়াই সম্ভব এই মত ছিলো তার।

কিন্তু তখন দেওয়ান মনোহর সিং-এর কুঠি দাউদাউ করে জ্বলছে, যদিও দিন শেষ হয়ে আসছে। বিলমহলের থেকে যারা এসেছিলো তারা তখন ফরাসডাঙায় পিছিয়ে এসেছে আর সেই পিছিয়ে যাওয়ার টানে ডিয়ার পার্কের টিলার উপরে চার্চ অব হোলি অ্যাসেনশানের যে ভিত্তি গাঁথা হয়েছিলো তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

.

০৩.

বিলমহলের সেই ভিড় দুপুর থেকেই ফরাসডাঙার পথে ছড়িয়ে পিয়েত্রোর বাংলোর এপাশে-ওপাশে অনেকটা সময় ছিলো, তারপরে সন্ধ্যার অন্ধকারে ক্রমশ মিলিয়ে গিয়েছিলো। এরকম প্রমাণ আছে তারা ততক্ষণই ছিলো ফরাসডাঙায় যতক্ষণ রাজকুমার পিয়েত্রোর বাংলোয় ছিলো সেদিন।

 পিয়েত্রোর বাংলোয় একই সময়ে কালেক্টর, ডানকান, বাগচী এবং রাজকুমার ছিলো। কী হয়েছিলো সেখানে সেটাই তো আসল গোপন করার বিষয়।

তখন বেশ রাত হয়েছে। দেওয়ানকুঠির বসবার ঘরে হরদয়াল আর ম্যাকফার্লান। মুখোমুখি। হরদয়াল বললো, বসো ম্যাকফার্লান, তোমার সঙ্গে এই প্রথম আলাপ আমার। একটু ওয়াইন আনি?

ম্যাকফার্লানের এই কালো রঙের দেওয়ানটির কথা বলার ভঙ্গিটা ভালো লাগছিলো না। সার তা বলছেই না, নামের আগে মিস্টারও বলছে না। তার এরকমও মনে হলো, আজ সারাদিন যা ঘটেছে তারপরে তিনজনমাত্ৰ সিপাহীর ভরসায় রাজবাড়ির ভিতরে ঢোকা ভালো হয়েছে কি?

হরদয়াল ওয়াইন নিয়ে ফিরলো। গ্লাসে ভরে দিলো। বললো, আমি বার্গান্ডিতে সোড়া খাই না, জলও না। তুমি? তারপরই হেসে বললো, আমি কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না তুমি আর হোয়াইট কী করে তখন পিয়েত্রোর বাংলোয় ঢুকলে।

ম্যাকফার্লান বললো, ইংল্যান্ড আশা করে তার ছেলেরা তাদের কর্তব্য করবে।

-আহা, তুমি উত্তেজিত হচ্ছো কেন? ওটা তো নেলসন না কে বলেছিলো, আর তা যুদ্ধের সময়ে। এটা তো সামান্য জমি নিয়ে হাঙ্গামা। তুমি কালেক্টর, নিশ্চয় জানো, রাজকুমারের খরিদকরা জমিতে রাজকুমারের দীঘি কাটানোর এক্তিয়ার আছে। জুড়ান পাইক এবং কীবল ছোকরা ট্রেসপাস করেছিলো। তুমি কি কীবলকে ইতিমধ্যে অ্যারেস্ট করেছো? ট্রেসপাস এবং খুন।

কথা ইংরেজিতে হচ্ছিলো। ম্যাকফার্লান বললো, তুমি আমার ডিউটি আমাকে শিখিয়ে * না। তুমি বলছো মরেলগঞ্জের মধ্যে সেটা রাজকুমারের জমি?

-প্রমাণ চাও? যাকগে, সেটা কলকাতার কোর্ট বুঝবে। তুমি নিজে ট্রেসপাস করেছিলে কেন ফরাসডাঙার কুঠিতে? না কি সেটাও কর্তব্য ছিলো? বলবে, রাজকুমার কিংবা মিস্টার । বাগচীকে অ্যারেস্ট করতে? হরদয়াল হাসলো। বললো– আবার, তুমিই বলছিলে, বাগচী প্রথমে, পরে রাজকুমার তোমাদের পরে সেখানে গিয়েছিলো। আর তখন তো কেউ কোনো অপরাধই করেনি।

ম্যাকফার্লান বললো, ট্রেসপাস! সেটাও কি তোমাদের রাজকুমারের বাড়ি নাকি?

হরদয়াল নিশব্দে হাসলো। বললো, এতদিন তো তাই জানতাম, যদিও ওটা রাজকুমারের বাসের উপযুক্ত নয়। তুমি বোধ হয় জানতে না? সেজন্যই আজ সকালে ফরাসডাঙার টিলার কী একটা ভিত গাড়ার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছো, প্রতিবাদ করোনি? ভেবে দ্যাখোনি, রাজকুমারের কলকাতার গেস্টরা ওই বাংলোতেই ছিলো?

–সিলি!

–কোনটা? ডানকানের মত লোকের গুড ফ্রাইডেতে চার্চ করার ব্যাপারে উৎসাহ?

অন্যমনস্কের মতো ওয়াইনকাপের স্টেমে আঙুল রেখেছিলো ম্যাকফার্লান। সে নিজেকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো, বললো, তুমি রাজকুমারকে এখানে আসতে বলবে? অথবা আমি কি তাকে অ্যারেস্ট করতে রাজবাড়িতে ঢুকবো?

হরদয়াল বললো, ওয়াইনের বোকেটা কিন্তু আকর্ষণ করে, তাই না? কিন্তু রাজকুমারের অপরাধ কী তাই ভালো করে জানি না। তুমি বলছে, রাজকুমার ডানকান হোয়াইটকে ঘোড়ার ক্রপ-চাবুক দিয়ে চাবকেছে। সে তো শুনেছি ডানকান রাজকুমারকে গাল দেওয়ায়। রাজকুমার যদি তাকে লাথি মেরে থাকে সে তো ডানকান রেভরেন্ড বাগচীর সহধর্মিণীকে বীচ এবং প্রটিচুট বলার রাগে। আর রেভরেন্ড বাগচী যা করেছিলো সে তো সেলফ-ডিফেন্স। ডানকানের রিভলবারটা কার দিকে লক্ষ্য করা ছিলো তা কি বোঝা যায়? তা যে রাজকুমারকে মারতেই তা সে কী করে বুঝবে? ভেবেছিলো হয়তো সে নিজেই তার শিকার। সেলফ-ডিফেন্সে সে ডানকানের কোমরে লাঠি মেরেছে। এমন তো হতে পারে তার জন্য ডানকানের বাতই দায়ী। তাড়াতাড়ি সরে যেতে পারেনি বলেই, বাগচী তাকে চেয়ার তুলেও, মেরেছিলো। কিন্তু ও কাজটা কি তোমার ভালো হয়েছে? তুমি বাগচীকে অত ক্লোজ রেঞ্জে গুলি করলে! হয়তো তার পাটাকে বাদ দিতে হবে, যদি হেমারেজে মৃত্যু না হয়!

ম্যাকফার্লান বললো, তাকেও অ্যারেস্ট করবো। আর তা আজ রাতেই।

-তা কী করে পারবে? আমি তো তাকে আর তার স্ত্রীকে সন্ধ্যাতেই কলকাতায় পাঠিয়েছি। আগে তো বলেনি। এতক্ষণে তারা বিশ-পঁচিশ ক্রোশ চলে গিয়েছে। আশা করছি কাল দুপুরে নাগাদ মেজর চীবসের সাহায্য পাবে। হরদয়াল যেন একটু ভাবলো। বললো– আবার, তা, জয়নাল বুড়ো হয়েছে বটে। কিন্তু প্রায় সাড়ে ন ফুট উঁচু, আর পাগলার মতো ছোটে এখনো; আশা করছি কোল্যান্স না করা পর্যন্ত সে ঘণ্টায় পনেরো-বিশ মাইল ছুটবে, শিকারী হাতি তো।

ম্যাকফার্লানের সন্দেহ হলো, লোকটি কি কথা বলে বলে সময় নিচ্ছে? রাজকুমারকে পালাতে সাহায্য করছে। ইতিমধ্যে নায়েবকে পাওয়া যাচ্ছে না, গা-ঢাকা দিয়েছে সে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তুমি রাজকুমারকে আনবে? না, আমি রাজবাড়িতে ঢুকবো? স্ত্রীলোকদের সরে যেতে বলবে?

হরদয়াল বললো, বসো, কালেক্টরসাহেব। রাজকুমারকে আনি।

হরদয়াল ভ্রূকুটি করে প্রাসাদে ঢুকলো। রানীর কাছেই দরকার। সে দেখলো রানী তার বসবার ঘরে। রানীর সামনে একটি শেজ। শেজের গোড়ায় রূপার ট্রেতে যা মৃদু আলোয় ঝকঝক করছে তাকে পৃথক পৃথক করে চেনা শক্ত, কিন্তু তা যে নানা দামী পাথর আর সোনার একটা ছোটো স্তূপ তা বোঝা যাচ্ছে। রানী কী ভাবছেন বোঝা শক্ত। অনুশোচনা নাকি তার? কিন্তু একেবারে স্থির। হরদয়াল কথা বলতে গেলো। কী করে যেন, কোথা থেকে যেন হরদয়ালের চোখের কোণ দুটি ভিজে উঠলো।

সে বললো, অতটা নয়। আমি ভাবছি হাজার দশেক পাউন্ড মোহরে। তোষাখানা কি খোলা আছে? চাবিটা? রাজকুমারকে পোশাক পরতে বলুন।

হরদয়াল তোষাখানার চাবি নিয়ে সেখান থেকে একটা থলি সংগ্রহ করে তার বসবার ঘরে ফিরতে মিনিট বিশেক সময় নিলো। টেবিলের ওয়াইনের পাশে একটা জিংলিং শব্দ করে সেই সিল্কের থলিটাকে নামালো। তাকে তখন কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বললো, রাজকুমার পোশাক পরছেন।

ম্যাকফার্লান বললো, নো ফানি বিজনেস। তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।

হরদয়াল তার স্কার্লেটে সাদায় আঙুরলতার নকসা নাইট-গাউনের জেব থেকে একটা কাগজ বার করলো। আলোর সামনে ধরে পড়লো। সেটাকে পকেটে রেখে সিগার ধরালো। তুমি খাবে, কালেক্টর? রিয়্যাল টার্কিশ। অবশ্য তোমার পার্মিশন নিচ্ছি। সে গলা সাফ করলো। আলতো করে গলা নামিয়ে বললো, চরণদাস বলে একজনের কথা জানো?

ম্যাকফার্লান বললো, আমি কী জানি!

হরদয়াল তার জেব থেকে কাগজটাকে বার করলো, বললো, এই কাগজটায় কিন্তু তোমার দস্তখত এবং মোহরও। তুমি কি জানো, ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে যাকে সামন্ করা হয় তাকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব থাকে ম্যাজিস্ট্রেটের? হরদয়ালের এই প্রথম যেন রাগ প্রকাশ পেলো। তার শান্ত মুখে দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠলো একবার। আমি যদি বলি তুমি এখানে আসার কিছু আগেই চরণদাসের কাঁচা কবর খুঁড়েছে আমার লোকেরা। তার বিকৃত শরীরটাও পাওয়া গিয়েছে। তোমার সামনে মনোহর তাকে চাবকাচ্ছিলো। হুকুমটা কি তোমার?

ম্যাকফার্লানের মুখটা কিছু বিবর্ণ হলো।

হরদয়াল বললো– হেসে, আমি বলি কি এখানে এই থলিতে দশ হাজার পাউন্ড সভরেন আছে।

দু-তিন মিনিট ছটফট করলো ম্যাকফার্লান। গলা নামিয়ে বললো, তুমি বলছো–কিন্তু।

এসব ব্যাপারে মনস্থির করতে সময় নেয়। অন্যপক্ষের ধীর শান্ত কোমল প্ররোচনা দরকার। আধঘণ্টা সময় লাগলো। অবশেষে বার্গান্ডি স্পর্শ করলো ম্যাকফার্লান। হরদয়াল ফিসফিস করে বললো, একটা রসিদ সই করে দাও, দুই দিক থেকেই সুবিধা। একটা আই ও ইউ তো। অসুবিধা হলে তুমি বলবে ধার নিয়েছে। আমারও একটা দলিল থাকে।

ম্যাকফার্লান অবশেষে বললো, কিন্তু রাজকুমারকে অ্যারেস্ট তো করতে হবে। কলকাতা আছে।

–অবশ্যই, অবশ্যই।

অবশেষে এই স্থির হয়েছিল, রাজকুমার দু-তিন মাস পিয়েত্রোর বাংলোর নজরবন্দী রূপে থাকবেন। একজন ঝি, একজন চাকর থাকতে পারবে। দুজন সিপাহী বাংলোর বাইরে থাকবে বটে। কিন্তু ওয়ার্ড অব অনার রাজকুমার পালাতে চেষ্টা করবেন না। তারপরে তদন্ত শেষ হবে।

হরদয়াল অতিশয় গম্ভীর মুখে বলেছিলো, ওয়ার্ড অব অনার।

তখন মাঝরাতের কাছে সময়। একটা ধোঁয়ানো মশাল। তার পিছনে একটা ঘোড়া। ঘোড়াটার গলা যেন বৃত্তাকারে মাটিতে ঝুঁকেছে। ঘোড়ার পিঠে স্থির রাজকুমার পিয়েত্রোর বাংলোর দিকে এগিয়ে চলেছিলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *