১৭. পাঁচটার দিকে আমি

পাঁচটার দিকে আমি বাসা থেকে বের হলাম। হাতে কয়েকটা গল্পের বই, কোন বইয়ে আমার নাম লেখা নেই। আজগুবি একটা নাম লিখে রেখেছি। বাসা থেকে বের হয়ে ফজলুর বাসায় গেলাম। ফজলুকে নিয়ে আশরাফের বাসায়। আশরাফ একটা বল হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল। আমার আর ফজলুর খালি পা আশরাফের পায়ে এক জোড়া টেনিশ শু। খালি পায়েই আমরা ভাল দৌড়াদৌড়ি করতে পারি, টেনিস শু, না পরলে আশরাফ নাকি ভাল ছুটতে পাবে না। আমরা সবাই দুটি করে শার্ট পরেছি একটা উপরে আরেকটা নিচে, দুইটা দুই রকম। উপরের শটটা খুললেই ভিতর থেকে অন্য শার্ট বের হয়ে যাবে। বেশ গরম আজকে, দুইটা সার্ট মনে হচ্ছে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। সার্ট ছাড়া আরো একটা জিনিস আছে, পকেট, একটা করে রুমাল। দুই মাথা গিট মেরে একটা টিউবের মত রাখা আছে মাথা দিয়ে গলিয়ে মুখোসের মত পরে নেয়া যাবে। চোখের জায়গা কেটে গত করে রেখেছি, পরার পর দেখতে যেন অসুবিধে না হয়। বাসায় আয়নার সামনে পরে দেখেছি, বিদঘুটে লাগে দেখতে, কেউ আর আমাদের চেহারা দেখতে পারবে না।

হাসপাতালের কাছাকাছি এসে আমরা একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম।

আমি আশরাফ আর ফজলুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার মত ভঙ্গি করলাম, হাসিটা খুব ভাল কাজ করল বলে মনে হল না। রাশেদ আমাদের সাথে নেই, সে স্টেনগান নিয়ে আসবে, সোজাসুজি হাসপাতালে আমাদের সাথে দেখা করার কথা। আশরাফ বলল, এখন তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাই?

হ্যাঁ।

আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। পেটের ভিতরে কেমন জানি করছে— ফাইনাল পরীক্ষার আগে ঠিক যখন প্রশ্ন দেয় তার আগে যেমন লাগে। ফজলু শুকনো মুখে বলল, একটু ভয় ভয় লাগছে।

আমি বললাম, লাগতেই তো পারে।

কি মনে হয়? ঠিক ঠিক হবে তো সব কিছু?

একশবার হবে : আশরাফ বুকে থাবা দিয়ে বলল, দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে এসেছি আজ।

আমি আশরাফকে বললাম, দে তোর বলটা।

আশরাফ আমাকে বলটা দেয়। আমি বললাম, দেখা হবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে।

ফজলু দাঁত বের করে একটু হাসার চেষ্টা করল, আশরাফ কিছু বলল না।

আমি আমার গল্পের বই এবং আশরাফের বলটা নিয়ে হাসপাতালের রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকি। হাসপাতালের ঠিক সামনে দিয়ে বড় রাস্তােটা গিয়েছে, রাস্তার অন্য পাশে একটা পুকুর। পুকুরের পাশে একটা গোরস্থান। হাসপাতালের এত কাছে একটা গোরস্থান রাখা মনে হয় ভাল কাজ হয় নাই। রোগীদের মন দুর্বল হয়ে থাকবে সারাক্ষণ, কিন্তু আমাদের প্ল্যানটা কাজে লাগাতে খুব সুবিধে হয়েছে। গোরস্থানটা অনেক পুরোনো, দেয়াল জায়গায় জায়গায় ভেঙে গিয়েছে ভিতরে গাছ পালায় ঢাকা, দিনের বেলাতেই গা ছমছম করে। গােরস্থানের অন্য পাশে বস্তির মত, কিছু দিনমজুর ছোট ছোট ঝুপটির মত ঘরে থাকে। তার অন্য পাশ দিয়ে আরেকটা রাস্তা নদীর ঘাটের দিকে গিয়েছে। আমি গোরস্থানের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে যখন দেখলাম। কেউ নেই এবং কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে না। আমার হয়তের বল এবং বইগুলি ভিতরে ফেলে দিলাম। এটা আমাদের প্ল্যানের একটা অংশ।

গোরস্থানে কাজ শেষ করে আমি হাসপাতালে ফিরে এলাম। বেশি আগে এসে লাভ নেই তাই একটু ঘুরাঘুরি করে সময় কাটিয়ে ছয়টা বাজার ঠিক দশ মিনিট আগে হাসপাতালে এসেছি। একা একা না। ঢুকে কিছু মানুষের সাথে ঢুকে গেলাম। ভাবখানা তাদের সাথে এসেছি। ভিতরে ঢুকে হাসপাতালের বড় একটা ওয়াড়ে নিজীব দেখে একজন রোগী বের করে তার বিছানার কাছে বসে রইলাম। ভাবখানা তার সাথে দেখা করতে এসেছি। বসে থাকতেই ডাক্তার সাহেবকে দেখলাম, রোগীদের দেখে দেখে যাচ্ছেন। আমাকে দেখলেন, দেখে চিনতে পারলেন বলে মনে হয় না। খানিকক্ষণ পর ফজলুকে দেখলাম আরো কোণায়, আরো কয়জন মানুষের পিছনে পিছনে এসে ঢুকছে। আশরাফকে দেখলাম, করিডোর ধরে হেঁটে গেল, নিশ্চয়ই নিচে কোথাও অপেক্ষা করবে। রাশেদকে দেখলাম না। তার কাছেই ষ্টেনগান, সেই সবচেয়ে জরুরী। যদি কোন কারণে না আসতে পারে আমাদের পুরো প্ল্যানটাই ভঙুল হয়ে যাবে। আমি বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। লোকজন যাচ্ছে, আসছে। কেউ আমাকে বা ফজলুকে লক্ষ্য করছে না। একটু পরে যখন প্রলয় কাণ্ড শুরু হবে তখন সবাই দেখবে চোখ বড় বড় করে!

শেষ মুহূর্তে রাশেদকে দেখলাম ভিতরে এসে ঢুকল। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ কয়েকটা ক’লা উঁকি দিচ্ছে ভিতর থেকে। নিচে নিশ্চয়ই স্টেনগান আছে। রাশেদ একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে হেঁটে গেল, আমাদের চিনছে সেরকম ভান করল f

আমি রুদ্ধশ্বাসে বসে থাকি। আর কয়েক মিনিট, তারপর এসে যাবে সেই ভয়ঙ্কর মুহুর্ত। কি হবে তখন? সত্যি কি আমরা পারব শফিক ভাইকে বাঁচাতে? সত্যি কি সব কিছু হবে পরিকল্পনা মৃত? গােলাগুলী কি হবে? কেউ কি মারা যাবে আজ? আমাদের? রাজাকারদের? এখন আর ভেবে লাভ নেই। যা হবার হবে, আমরা শুধু করে যাব যেটা করার কথা।

আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে দিম আটকে যাবে হঠাৎ কান খাড়া করে বসে আছি, আর ঠিক তখন ঢং ঢেং করে ছয়টা বাজিল পেটা ঘড়িতে।

আমি সাবধানে উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম ফজলুও উঠে দাঁড়াল। আশরাফ আর রাশেদ কোথায় আছে জানি না, কিন্তু যেখানে থাকুক এখন নিশ্চয়ই তারাও উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে মনে বললাম, হে খোদা তুমি সব কিছু ভালয় ভালয় শেষ করিয়ে দিও।

আমি খুব শান্ত ভঙ্গিতে বাইরে এলাম। করিডোর ধরে হেঁটে এখন দশ সেকেন্ডের মাঝে আমাদের শফিক ভাইয়ের সামনে যাবার কথা। তাড়াহুড়া করার কোন প্রয়োজন নেই। দশ সেকেন্দ্র অনেক সময়। আমি মনে মনে গুণতে থাকি এক হাজার এক, এক হাজার দুই, এক হাজার তিন…

আমি না তাকিয়ে বুঝতে পারলাম ফজলু আমার পাশে-পাশে হাঁটছে। করিডোর ধরে ঘুরে যেতেই আমরা শফিক ভাইয়ের ঘরটা দেখলাম। ঘরের সামনে রাজাকারটি আমাদের দিকে পিছনে ফিরে বসে আছে। সাথে আর কেউ নেই, এই সময়টাতে পুলিশ দুইজন চলে যায় ফিরে আসে আরেকটু রাতে। সে কারণেই এই সময়টা বেছে নেয়া হয়েছে। রাজাকারটি আমাদের দিকে পিছন ফিরে বসেছে, তার মানে আগে আমার আর ফজলুর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমার বুকের ভিতর হঠাৎ রক্ত ছলাৎ করে উঠে।

সামনে হঠাৎ করে রাশেদ আর আশরাফকে দেখলাম। রাশেদের হাত বাজারে ব্যাগের মাঝে, তার মানে নিশ্চয়ই স্টেনগানটা ধরেছে। হাতে দিয়ে।

আমি আর ফজলু আরেকটু এগিয়ে গেলাম। রাশেদ আর আশরাফ আরেকটু এগিয়ে এল। আমি ফজলুর দিকে তাকলাম, ফজলু আমার দিকে তাকাল তারপর দুজন এক ছুটে রাজাকারটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড ধাক্কায় রাজাকারটি চেয়ার থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ল। হাতে তখনো রাইফেলটা ধরে রেখেছে, এক হ্যাচকে টানে রাইফেটা সরিয়ে নিল ফজলু। আমি গায়ের জোরে একটা লাথি মারলাম লোকটার মাথায়, আরেকটা মারার আগেই রাশেদের হাতে স্টেনগান বের হয়ে এসেছে, হিংস্র। গলায় বলল, শুওরের বাচ্চা চোখ বন্ধ করা।

রাজাকারটি চোখ বন্ধ করল।

ঘরের ভিতর ঢোক— খবরদার মাটি থেকে উঠবি না। একটু উল্টা পাল্টা কিছু করলে গুলী।

রাশেদকে দেখে মনে হল দরকার হলে সত্যি সে গুলী করে দেবে। রাজাকারটি চোখ বন্ধ করে বুকে হেঁটে শফিক ভাইয়ের ঘরে ঢুকতে থাকে। দেখলাম ভয়ে কঁপিছে সে থারথার করে।

রাশেদ তার মুখের মুখোসটা পরে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ায়, তারপর জানালার কাঁচে কয়েকটা গুলী করে বসে। ঝনঝনি করে কােচ ভেঙে পড়ে, গুলীর শব্দ আর ধোয়ায় হঠাৎ জায়গাটা কেমন জানি ভয়ংকর হয়ে উঠে। রাশেদ চিৎকার করে বলল, এটা একটা কমান্ডো এটাক, কেউ এগিয়ে আসবেন না। এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা আছে এখানে, রাজাকারগুলিকে শেষ করে আহত একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে যেতে এসেছে। কেউ এদিকে আসবে না।

লোকজন হাসপাতালের নানা অংশ থেকে উঁকি মারে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। পাশের ওয়ার্ডে মনে হল কয়েকজন ছুটে কোথাও লুকিয়ে যাচ্ছে, আমরা জানতাম। এই হাসপাতালে কয়েকজন গুলী-খাওয়া রাজাকারও আছে।

আমাদের কাজ ভাগ করা ছিল, এখন দ্রুত কাজে লেগে পড়ি। ফজলু রাজাকারটির দুই হাত পিছনে শক্ত করে বাঁধতে থাকে। একটা রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে ঘাড়ের উপর রাইফেলটা চেপে রাখে। আশরাফ রুমাল দিয়ে তৈরি মুখোশটা পরে বের হয়ে যায় স্ট্রেচার অন্মানতে, রাশেদ স্টেনগান হাতে পাহারা দেয় সবাইকে।

আমি মুখোসটা পরে নিতে নিতে শফিক ভাইয়ের বিছানার কাছে ছুটে গেলাম, তার মুখে লম্বা লম্বা দাড়ি, লম্বা লম্ববা চুল, দেখে কেমন যেন অম্প বয়স্ক রবীন্দ্রনাথের মত দেখাচ্ছে। শফিক ভাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন তার মুখে অবিশ্বাস। আমি গলা মোটা করে বললাম, কমরেড শফিক। মুক্তিযোদ্ধার একটা স্পেশাল কমান্ডো দল আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছে।

আমাকে?

হ্যাঁ। বাইরে দুইটা মোটর সাইকেল অপেক্ষা করছে, নদীতে একটা স্পীড বেড়ি— আমি হঠাৎ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললাম, পরে বলব সব কিছু এখন চলেন।

আশরাফ স্ট্রেচার নিয়ে আসতে সেখানে শফিক ভাইকে শুইয়ে আমরা একটা চাদর দিয়ে ঢেকে চারজন চারদিকে ধরে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। শফিক ভাই কখনো মােটা সোটা মানুষ ছিলেন না এখন মনে হয় আরো শুকিয়েছেন।

হাসপাতালের রোগী, নার্স এবং ডাক্তার এগিয়ে আসছিল। মিলিটারী হলে ভয় পেত। কিন্তু মুক্তিবাহিনী তো নিজেদের লোক, তাও ভয় পাবে কেন? রাশেদ একটা হুংকার দিয়ে বলল, খবরদার কেউ কাছে আসবেন না। আমাদের এক্ষুনি দুই নম্বর দলের কাছে যেতে হবে।

লোকজন তবু কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। কৌতূহল বড় সাংঘাতিক জিনিস।

আমরা ছুটে যেতে থাকি। সামনে একটা ছোট করিডোর সেখানে এসে আমরা স্ট্রেচার নামালাম। রাশেদ ছুটে গেল সামনে, লোকজন তখনো ভীড় করে আসছে। শফিক ভাইকে সব কিছু বলার জন্যে আমাদের খানিকক্ষণ সময় দরকার এত ভীড় হলে তো ঝামেলা হয়ে যাবে। রাশেদ ভয়ঙ্কর চিৎকার করে সামনে লাফিয়ে পড়ে স্টেনগানটি উপরে তুলে গুলী করতে শুরু করল। ঝনঝনি করে কি যেন ভেঙে পড়ে, ধোঁয়া, গুলী, লোকজনের হুটোপুটি সব মিলিয়ে মুহুর্তে একটা ভয়ঙ্কর পরিবেশ হয়ে যায়। কৌতূহলী লোকজন। এবারে ভয় পেয়ে সরে যায়, সাথে সাথে আমরা আমাদের কাজ শুরু করে দিলাম। কেউ দেখার আগে শফিক ভাইকে তুলে টেনে একটা ছোট ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম, ময়লা জঞ্জালের একটা ঘর, আগে থেকে আমরা এটা ঠিক করে রেখেছিলাম। তার হাতে একটা শার্ট আর ছোট একটা প্যাকেট দিয়ে ফিসফিস করে। বললাম, এই শটটা পরে নেন। প্যাকেটে একটা কাঁচি আছে দাড়ি কেটে নিয়ে বড় ওয়ার্ডের তিন নম্বর বিছানায় গিয়ে শুবেন। বিছানাটা আপনার জন্য খালি করা আছে। শফিক ভাই কিছু বুঝতে পারছিলেন না, অবাক হয়ে বললেন, আমাকে না উদ্ধার করে নেবে–

সবাই জানাবে আপনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি আসলে এখানেই থাকবেন। আপনি হচ্ছেন আহত রাজাকার সালামত আলী! আপনার পকেটে গ্রামের মানুষের চিঠি আছে। সময় পেলে হাতে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে নেবেন, যেন আপনার হাতে গুলী লেগেছে।

শফিক ভাইয়ের মুখে হঠাৎ একটা হাসি ফুটে উঠে। তিনি আমার ঘাড়ে একটা থাবা দিয়ে বললেন, পাজী ছেলের দল!

আমি দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মুখোসে মুখ ঢাকা শফিক ভাই সেটা দেখতে পারলেন না। তা ছাড়া আমার উত্তেজনায় আমার বুকের মাঝে ঢাকের মত শব্দ হচ্ছে, যতক্ষণ না স্ট্রেচারটা চাদর ঢেকে নিয়ে এখান থেকে সরে যেতে না পারছি আমরা বা শফিক ভাই কেউই নিরাপদ না। আমি ছোট ঘরটা থেকে বের হয়ে আসতেই ফজলু বলল, সামনে থেকে দেখে এসেছি। সব ঠিক আছে।

চল তাহলে।

আমরা চাদরে ঢাকা স্ট্রেচারটা নিয়ে ছুটতে থাকি। শফিক ভাইয়ের একটা বালিশ অ্যর রাজাকারের রাইফেলটা এখানে আছে। ভাল করে লক্ষ্য করলে হয়তো বোঝা যাবে এখানে কোন মানুষ নেই, কিন্তু আমাদের কেউ ভাল করে লক্ষ্য করার সুযোগ পাবে না। বাইরে এতক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমরা তার মাঝে ছুটে গিয়ে গোরস্থানে লুকিয়ে যাব।

হাসপাতালের বাইরে এসে সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকি; রাস্তায় নেমে পিছনে ফিরে তোকালাম, তারপর আবার ছুটতে থাকলাম। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে স্ট্রেচারটা একবার নিচে রেখে সবাই হাত বদল করে নিলাম। কিছু লোক আমাদের খুব কাছাকাছি চলে আসছিল, রাশেদ তাই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে আকাশে এক পশিলা গুলী করে দেয়। লোকজন পিছিয়ে যায় সাথে সাথে। কেউ আর কাছে আসতে সাহস পায় না, দূরে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের লক্ষ্য করতে থাকে।

আমরা প্ৰাণপণে ছুটতে থাকি। আর অস্প কিছুদূর তারপরেই গোরস্থান।

হঠাৎ করে কানের কাছে দিয়ে শীষের মত একটা শব্দ হল সাথে সাথে একটা গুলীর শব্দ শুনতে পেলাম।

গুলী করছে আমাদের!

থামবি না। থামবি না কেউ।

আমরা প্ৰাণপণে ছুটে যেতে থাকি। আর কয়েক পা তারপরই ঢুকে যাব গোরস্থানে। শীষের মত শব্দ করে আরো কয়েকটা গুলী ছুটে গেল আশে-পাশে দিয়ে আমরা তার মাঝে ছুটতে ছুটতে গোরস্থানে ঢুকে গেলাম। স্ট্রেচারটা মাটিতে রেখে রাশেদ হাপাতে হাপাতে বলল, সবাই ঠিক আছিস?

হ্যাঁ।

ভেরী গুড, কাপড় পাল্টে সবাই পালাবার জন্যে রেডী হ। আমরা মুখোস খুলে নেই। উপরের শার্টটা খুলে ভিতরের অন্যরকম শার্টটা বের করে নিলাম। তারপর আগে ফেলে রাখা বইগুলি আর বলটা তুলে ভাগাভাগি করে নিয়ে গোরস্থানের অন্য পাশে ছুরতে থাকি। ছমছমে অন্ধকার গোরস্থান কিন্তু এই প্রথমবার আমাদের কারো ভূতের ভয় হল না।

গোরস্থানের অন্যপাশে একটা বৃস্তির মত। অন্ধকারে আমাদের বের হতে দেখে কয়েকজন মানুষ এগিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার?

আমরা আলাদা আলাদা বের হচ্ছিলাম। আমার সাথে আশরাফ, কি বলব ভেবে না। পেয়ে প্রায় সত্যি কথাটা বলে ফেললাম। মিথ্যে সব সময় সত্যির কাছাকাছি করে বলতে হয়। আমি বললাম, মুক্তিবাহিনী!

মুক্তি বাহিনী?

হ্যাঁ, দেখে ভয় লেগে গেছে! এত সব অস্ত্র।

লোকগুলি একজন আরেকজনকে বলল, মুক্তি ফৌজ এসেছে নাকি! একজন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মুক্তিবাহিনীকে কোন ভয় নেই। মুক্তিবাহিনী হচ্ছে নিজের মানুষ! ভয় হচ্ছে মিলিটারীকে।

অন্য মানুষগুলিও মাথা নাড়ে, বলে, হ্যাঁ। মিলিটারী আর রাজাকার।

আশরাফ বলল, যুদ্ধ শুরু হয় যদি? আমার অনেক ভয় করে।

ভয়ের কিছু নাই। মাথা নিচু করে শুয়ে থাকতে হয়।

আমি বললাম, চল বাসায় যাই। লোকগুলি মাথা মাড়ল, হ্যাঁ, বাসায় যাও। রাত্ৰিবোলা বাইরে থাকা ঠিক না।

আমি আর আশরাফ তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলাম। যারা গুলী করছে তারা যখন খোঁজাখুজি শুরু করবে। তখন আশেপাশে থাকা ঠিক নয়।

 

আমরা দশ মিনিটের মাঝে বাসায় পৌঁছে গেলাম। রিক্সা করে যখন যাচ্ছি। তখন দেখি আরেকটা রিক্সায় করে ফজলু আর রাশেদ বের হয়ে গেল, মুশকো জোয়ান একজন রিক্সাওয়ালা রিক্সাটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার মানে আমরা সবাই ভালয় ভ্যালয় ফিরে এসেছি। তার মানে শফিক ভাই বেঁচে গেলেন। হাসপাতালে মিলিটারী রাজাকারের নাকের ডগায় শফিক ভাই এখন সুস্থ দেহে ঘুরে বেড়াবেন।

 

রাত্রিবেলা খাবার টেবিলে আব্বা আম্মাকে বললেন, মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আরেকটা অপারেশান করছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

অবিশ্বাস্য ব্যাপার। হাসপাতালে নাকি রাজাকার মিলিটারী পুলিশের ভীড়, তার মাঝে মুক্তিবাহিনীর একটা কমান্ডো দল এসে হাজির।

সত্যি?

হ্যাঁ। প্রচণ্ড গোলাগুলী যুদ্ধ। ছয় সাতটা মিলিটারী নাকি শেষ। তারপরে কি করেছে জান?

কি?

আব্বা চোখ বড় বড় করে বললেন, শফিককে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে!

সত্যি?

আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনেছিস ইবু? তোর শফিক ভাইকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে।

আমি অবাক এবং খুশি হওয়ার ভান করতে থাকি। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে নিল? কোথায় নিল?

আব্বা মাথা নেড়ে বলল, সেটা কেউ জানে না। একেবারে নাকি ম্যাজিকের মত অদৃশ্য হয়ে গেছে।

আম্মা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, ইশা! কি সাহস ছেলেগুলির। আব্ব গম্ভীর হয়ে বললেন, খুব অগানাইজড। ওদের দলে নাকি ছোট ছোট ছেলেরাও আছে? এই ইবুর সাইজের।

সত্যি?

হ্যাঁ। প্রথমে তারা নাকি ছুটে এসে গ্রেনেড ছুঁড়ে চলে গেছে! দাঁত দিয়ে পিন খুলে এই রকম করে খুঁড়ে দেয়— আব্বা হাত দিয়ে গ্রেনেড ছোড়া দেখালেন।

আম্মা আবার মাথা নেড়ে বললেন, ইশ! কি সাহস!

আব্বা বললেন, এখন সরে যেতে পারলে হয়। মিলিটারীর বিরাট একটা দল বের হয়েছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। হাজার হলেও একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। দোয়া কর যেন ছেলেগুলি সময় মত সরে যেতে পারে।

দোয়া তো করিই। সব সময় করি।

আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুই জানিস নাকি কিছু?

আমি খেতে খেতে বিষম খেলাম, বললাম, নাহ।

তোর বন্ধু রাশেদ নিশ্চয়ই জানবে। সে হচ্ছে ভ্ৰাম্যমান খবরের কাগজ- আব্বা হো হো করে হাসলেন, তার মনটা আজ খুব ভাল।

আমি মাথা নাড়লাম, কাল যখন আসবে জিজ্ঞেস করে দেখব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *