রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি। সকালে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল। দেখি সবাই রেডিওর সামনে মুখ কাল করে বসে আছে। রেডিওতে প্রথম ইয়াহিয়া খান বক্তৃতা দিল। ইংরেজিতে বক্তৃত। কিছু বুঝতে পারলাম না। আব্বা যেভাবে একটু পরে পরে মাথা নাড়তে লাগলেন মনে হল খুব খারাপ জিনিস বলছে। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, কি বুলছে গো?
বলছে সব দোষ শেখ মুজিবের। দেশটাকে ধ্বংস করতে যাচ্ছিল, কোন মতে রক্ষা হয়েছে। তাকে এখন কঠিন শাস্তি দেবে।
শেখ মুজিব এখন কোথায় আছেন?
বলেছে তো এরোস্ট করেছে। সত্যি-মিথ্যা কে জানে।
আম্মা শুকনো মুখে বসে রইলেন। ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতার পর রেডিওতে একজন ঘোষণা দেয়া শুরু করল। শহরে কারফিউ, বাইরে বের হলেই গুলী করা হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। রেডিওতে যারা কথা বলে তারা সব সময়ে খুব সুন্দর করে কথা বলে, কিন্তু এই লোকটাকে মনে হল কোন জঙ্গল থেকে ধরে এনেছে, উচ্চারণ এত খারাপ যে শুনলে বমি এসে যায়। আব্বা বিরক্ত হয়ে বললেন, বন্ধ করা তো রেডিওটা। বন্ধ করা।
আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে রেডিওটা বন্ধ করে দিলাম।
বাইরে এসে দেখি রাস্তায় লোকজন খুব বেশি নেই। যারা আছে তারা সবাই এখানে সেখানে রেডিও নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বি. বি. সি. রেডিও অস্ট্রেলিয়া শোনার চেষ্টা করছে। আমি ইংরেজি বুঝি না, তাই খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম। একটু পর দেখলাম একটা মিছিল এল, অন্যদিন মিছিল যে রকম হেঁটে হেঁটে যায় আজ সে রকম নয়, একেবারে ছুটে ছুটে যাচ্ছে। এটাকে বোধ হয় বলে জঙ্গী মিছিল। মিছিলের শেষের দিকে কমবয়সী ছেলেরা, তাদের হাতে রাইফেল, কোমরে গুলীর বেল্ট। এত তাড়াতাড়ি এই ছেলেগুলি বন্দুক রাইফেল কোথায় পেলা? সত্যি সত্যি তাহলে যুদ্ধ শুরু হবে এখন, যেটাকে গৃহযুদ্ধ বলে? উত্তেজনায় আমার বুক কাপতে থাকে।
সারাটা দিন কেমন করে কাটল টেরই পেলাম না। শুধু গুজব আর গুজব। কি হচ্ছে কেউ জানে না, একেক জন একেকটা গুজব নিয়ে আসে। একবার শুনি প্রচণ্ড যুদ্ধ, পাকিস্তানীরা প্রায় সারেন্ডার করে করে অবস্থা। আরেকবার শুনি ঢাকা শহর পাকিস্তানীরা দখল করে ফেলেছে, শহরে এখন লক্ষ লক্ষ মৃতদেহ। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা বোঝার কোন উপায় নেই। রেডিওতে কিছু বলে না, আকাশবাণী কোলকাতা থেকে শুধু ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বাজিয়ে যাচ্ছে আর সব অনুষ্ঠান বন্ধ। মনে হয় বাইরের পৃথিবীও কিছু জানে না।
এভাবে কোন রকমে দিনটা কেটে গেল। রাতে আবার কিছু কিছু গুজব এল। কিছু ভাল কিছু খারাপ। কোনটা বিশ্বাস করা যায় বোঝা যাচ্ছিল না। রাত্রে বি. বি. সি. থেকে একজন বলল ঢাকায় নাকি খুব খারাপ অবস্থা। ছাত্র শিক্ষক সাধারণ মানুষ যাকে পেয়েছে মেরে শেষ করেছে। সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারে না, কিন্তু ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
পরদিন বিকেলবেলা অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার ঘটে গেল। বিকেলের দিকে হঠাৎ চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন থেকে মেজর জিয়াউর রহমান নামে একজন বলল, বঙ্গবন্ধু ভাল আছেন। তঁাকে নেতা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। এখন স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে। আর কোন ভয় নেই।
শোনামাত্র সবাই আনন্দো চিৎকার করে উঠল। তার মানে পাকিস্তানীরা এক তরফ মারছে না। আমাদের সৈন্যরাও যুদ্ধ করছে। আমরা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকি। কে জিতবে যুদ্ধে? কে?
মেজর জিয়াউর রহমান নামের মানুষটার জন্য গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠল। বারবার সে বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছে। তাহলে পাকিস্তানীরা নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুকে এরেস্ট করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয় সবাইকে বলেছে কেমন করে যুদ্ধ করতে হয়। আর ভয় কি আমাদের!
একদিন দুই দিন করে এক সপ্তাহ কেটে গেল। আস্তে আস্তে সব খবর এসে পৌছাতে শুরু করেছে। প্রথম খবরটি সবচেয়ে খারাপ খবর, পাকিস্তানীরা আসলেই বঙ্গবন্ধুকে এরোস্ট করে নিয়ে গেছে। অন্য খবরগুলিও ভাল না। ঢাকায় পঁচিশে মার্চের রাতে নাকি হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলেছে। যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেটা কমে এসেছে। ইয়াহিয়া খান আর ভুট্রো যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ-আলোচনার ভান করছিল আসলে তখন হাজার হাজার পাকিস্তানী সৈন্যকে নিয়ে এসেছে। তারপর খুব ভাবনা-চিন্তা করে ঠাণ্ডা মাথায় আক্রমণ করেছে। বাঙালী সৈন্যদের কাছে অস্ত্র রাখতে দেয়নি, তাই ঢাকায় সবচেয়ে বড় যুদ্ধ করেছে পুলিশেরা, রাজারবাগে। লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে ইণ্ডিয়াতে। পৃথিবীর সব দেশ পুরো ব্যাপারটা বেশ কৌতূহল নিয়ে লক্ষ্য করছে, কিন্তু কেউ পাকিস্তানীদের থামাতে এগিয়ে আসছে না। পাকিস্তানীরা চোখ বন্ধ করে দুই হাতে শুধু মানুষকে মেরে যাচ্ছে।
প্রথম দিকে আমাদের এই ছোট শহরটায় যে রকম টগবগে একটা উত্তেজনা ছিল এখন সেরকম উত্তেজনা নেই, তার বদলে সবার ভিতরে কেমন একটা ভয় এসে জায়গা নিচ্ছে। স্কুলে মুক্তি বাহিনীর একটা ট্রনিং সেন্টার খোলা হয়েছিল, ছেলেরা সেখানে ট্রেনিং নিত। ট্রেনিং সেন্টার উঠে গেল। যাঁরা নেতা ছিলেন, গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তাদেরকেও দেখা যাচ্ছে না। সবাই নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড চলে গেছেন। শহরে কোন পুলিশ নেই। একদিন দিনদুপুরে একটা মস্ত ডাকাতি হয়ে গেল। আমরা বাসায় বসে শুনতে পেলাম প্রচণ্ড গোলাগুলী হচ্ছে। সব মিলিয়ে পুরো শহরটায় কেমন যেন একটা আতংক আতংক স্বভাব।
বড় বড় শহরগুলি পাকিস্তানী সৈন্যরা এসে দখল করে নিয়েছে। আমাদের এই ছোট শহরটাতেও এসে যাবে যে কোন দিন। সবাই শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যেতে শুরু করেছে। আম্মা একদিন আব্বাকে বললেন, শুনেছি, সবাই যে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে?
আব্বা কিছু বললেন না।
আমরাও কি যাব?
আব্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কোথায় যাব আমরা?
দেশের বাড়ি?
আব্বা দুর্বলভাবে হেসে বললেন, এখন কি রাস্তাঘাট কিছু আছে, নাকি যাওয়ার কোন উপায় আছে? দেশের কি অবস্থা শুনিছ না?
একদিন অনেক রাতে দিলীপের বাবা আমাদের বাসায় এলেন। দিলীপের বাবা আব্বার সাথে একই কলেজে পড়ান, আমরা কাকু বলে ডাকি। দিলীপের বাবা এমনিতে দেখতে খুব সুন্দর, একবার যখন নাটক হয়েছিল। সিরাজদ্দৌলার অভিনয় করেছিলেন, দেখে মনে হচ্ছিল। সত্যিই বুঝি একজন রাজা! এখন অবিশ্যি তঁাকে দেখতে কেমন জানি লাগছে। চুল উশকো-খুশকো। মুখে খোচা খোচা দাড়ি, চোখ লাল, মনে হয় কতদিন ঘুমাননি। বাবাকে বললেন, আজীজ, কাল চলে যাচ্ছি।
আব্বা বললেন, সত্যি?
হ্যাঁ, যা খবর পাচ্ছি। আর থাকা যায় না।
আব্বা মাথা নাড়লেন। কাকু বললেন, কারো জীবনের আর কোন গ্যারান্টি নেই। কিন্তু হিন্দু কিংবা আওয়ামী লীগের কেউ হলে তার আর কোন রক্ষা নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে কেমন করে এত বড় বিপদের ঝুকি নেই?
আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে যাবে?
এখান থেকে বাসে করে নদীর ঘাট পর্যন্ত যাব। সেখান থেকে নদী পার হয়ে বাকি পথ হেঁটে।
বর্ডার পর্যন্ত পৌছাতে কতদিন লাগবে?
ঠিক জানি না। এক সপ্তাহ থেকে দশ দিন।
দশ দিন?
কাকু শুকনো মুখে বললেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে কি যে হবে ভগবানই জানেন!
আব্বা বললেন, তুমি যাও, কে জানে তোমাদের পিছু পিছু হয়তো আমাদেরও আসতে হবে।
কাকু গলা নামিয়ে বললেন, কাউকে বলে যাচ্ছি না। শুধু তোমাকে বললাম। তুমি যদি পার বাড়িঘরের দিকে একটু চোখ রেখো।
কাকু আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, আমি চোখ রাখব? একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, ধরে রাখলাম সব গেছে। প্রাণে বেঁচে থাকলেই আমি খুশি।
কাকু আব্বাকে কি সব কাগজপত্র দিয়ে যাবার সময় বাবাকে জড়িয়ে ধরে একেবারে কীদো কঁদো হয়ে গেলেন। ভাঙা গলায় বললেন, আমার ছেলেমেয়ের জন্যে একটু প্রার্থনা কর।
করব। তুমি খোদার উপর ভরসা রেখো। খোদা এত বড় অবিচার সহ্য করবে না।
কাকু ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সময় আব্বা আবার জিজ্ঞেস করলেন, কাল কখন রওনা দেবে?
ভোরে। খুব ভোরে।
ভেবেছিলাম খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠিব। কিন্তু তবু দেরি হয়ে গেল— লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। দিলীপরা কি চলে গেছে। এর মধ্যে? আমি বিছানা থেকে নেমে হাত-মুখ না ধুয়েই জুটুলাম ওদের বাসার দিকে। যাবার আগে একবার দেখাও যদি না হয় তাহলে কেমন করে হবে?
গিয়ে দেখি ওরা এখনো চলে যায়নি। তবে সবাই বের হয়েছে, সাবার সামনে দুইটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে, এক্ষুনি চলে যাবে। আমাকে দেখে দিলীপ ছুটে এল, তার চোখ লাল, শার্টের হাতা দিয়ে নাক-মুখ আর চোখ মুছে, বলল, আমরা বাস্তুহারা হয়ে যাচ্ছি।
বাস্তুহারা?
হ্যাঁ, যাদের ঘরবাড়ি নেই তাদের বাস্তুহারা বলে।
এই তো তোদের ঘরবাড়ি।
একটু পরে আর থাকবে না। রাস্তায় ঘুমাতে হবে। চিড়া খেয়ে থাকতে হবে।
চিড়া?
হ্যাঁ। শুধু চিড়া। দিলীপকে কেমন হতচ্ছড়িার মত দেখাচ্ছে। হঠাৎ ফ্যাসফ্যাস করে আবার কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আমি যেতে চাই না। আমি ইণ্ডিয়া যেতে চাই না।
আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না, আমার চোখেও হঠাৎ পানি এসে গেল। দিলীপ কোন মতে কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল, যারা হিন্দু তাদের সবাইকে মিলিটারীরা মেরে ফেলছে। আমরা এখন কোথায় থাকব?
আমি বললাম, দেশ যখন স্বাধীন হবে তখন আর কোন হিন্দু-মুসলমান থাকবে না।
ততদিনে আমরা মরে ভূত হয়ে যাব।
কেন মরবি? আমরা যে হিন্দু! রাস্তায় যদি আমাদের ধরে তাহলে বলব, আমরা মুসলমান। বাবা আমাদের সবার একটা করে নাম ঠিক করে দিয়েছে। মুসলমান নাম। আমারটা আমি নিজে ঠিক করেছি।
কি নাম?
রকিবুল হাসান।
আমি দিলীপের দিকে তাকলাম। রকিবুল হাসান আমার ভাল নাম। সবাই ইবু বলে ডাকে, তাই ভাল নামর্টার কথা মনেই থাকে না, দিলীপের মনে আছে।
দিলীপ হঠাৎ এসে আমাকে ধরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার মরতে ইচ্ছা করে না। একেবারে মরতে ইচ্ছা করে না।
মরবি কেন? ছিঃ!
আমি জানি আমরা সবাই মরে যাব। সবাই। সবাইকে মেরে ফেলবে মিলিটারী। আমাদের সবাইকে মেরে তোদেরকেও মেরে ফেলবে। আমার মেশোমশাইকে মেরে ফেলেছে। সঞ্জয়দা ছিল তাকেও মেরে ফেলেছে। আমি জানি আমাদেরকেও মেরে ফেলবে।
দিলীপ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। দিলীপের বাবা এসে দিলীপের হাত ধরে নিয়ে গেলেন। কাকীমা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তাকে দেখতে একটু অন্যরকম লাগছে। বুঝতে পারছি না কেন। দিলীপের বোন শিপ্রাদি আজ একটা শাড়ি পরেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলেন। তারপর কেউ কোন কথা না বলে রিকশায় উঠলেন। তাদের হাতে বেশি কোন জিনিস নেই, ছোটখাট কয়েকটা ব্যাগ। পানির একটা বোতল। দিলীপ একটা বই শক্ত করে ধরে রেখেছে। কি বই এটা?
রাস্তা দিয়ে রিকশাটা চলে যাবার পর হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম কাকীমাকে দেখতে অন্যরকম লাগছে কেন। কাকীমার কপালে কোন সিঁদুর নেই। দেখে যেন কেউ বুঝতে না পারে তারা হিন্দু।
আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদব না। কাঁদব না করেও কাঁদতে শুরু করলাম। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে কিন্তু আমার ঠিক দুঃখ লাগছিল না। আমার কেমন জানি রাগ উঠছিল, ভয়ংকর রাগ। ভয়ংকর ভয়ংকর রাগ।