১৫. সময়-পর্যটকের প্রত্যাবর্তন

১৫৷ সময়-পর্যটকের প্রত্যাবর্তন

 আর তাই ফিরে এলাম আমি। নিশ্চয় বহুক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিলাম মেশিনের ওপর। দিনরাতের মিটমিটে জ্বলা-নেবা আবার শুরু হল, আবার সোনালি হয়ে উঠল সূর্য, আকাশ নীল। আরও সহজভাবে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম আমি। জমির ওঠানামার রেখা-তরঙ্গ কমে এল–মসৃণ হয়ে উঠল তার গতি। ডায়ালের ওপর পেছনদিকে ঘুরে চলল কাঁটাগুলো। আবার দেখতে পেলাম ক্ষয়িষ্ণু মানবজাতির নিদর্শন বড় বড় বাড়ির আবছা ছায়া। তা-ও গেল মিলিয়ে, এল অন্য দৃশ্য। দেখতে দেখতে লক্ষের কাঁটা শূন্যের ঘরে এসে দাঁড়াতে গতি কমিয়ে দিলাম। অনেকদিনের চেনা আমাদের সুন্দর বাড়িঘরদোর আবার দেখতে পেলাম, হাজারের কাঁটা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখানে এসে থেমে গেল। দিনরাতের আনাগোনা আরও কমে এল। তারপরেই ল্যাবরেটরির পুরানো দেওয়াল ফিরে এল আমার চারপাশে। খুব সাবধানে আরও কমিয়ে দিলাম মেশিনের গতি।

ছোট্ট কিন্তু বেশ মজার একটা জিনিস লক্ষ করলাম। আগেই বলেছি আপনাদের, যাত্রা শুরু করার মিনিটকয়েকের মধ্যে খুব অল্প গতিবেগের সময়ে মিসেস ওয়াচেটকে ঘরের মধ্যে দিয়ে রকেটের মতো হেঁটে যেতে দেখেছিলাম। ফেরবার সময়ে ঠিক সেই মিনিটটাও পেরিয়ে আসতে হল আমাকে। কিন্তু এখন দেখলাম, সমস্ত জিনিসটা ঘটল উলটোদিক থেকে। উলটোদিক থেকে ফিল্ম চালালে যেরকম দেখা যায়, ঠিক সেইরকমভাবে আগে নিচের দরজাটা খুলে গেল, পিঠটা সামনের দিকে রেখে যেন পিছলে ল্যাবরেটরিতে ঢুকলেন মিসেস ওয়াচেট। আর ওইভাবেই পিছু হেঁটে পেছনের যে দরজা দিয়ে আগে তিনি ঢুকেছিলেন, সেই দরজা দিয়েই বেরিয়ে গেলেন! ঠিক তার আগেই মনে হল, হিলিয়ারকেও মুহূর্তের জন্য দেখলাম, কিন্তু সে-ও বিদ্যুৎ-চমকের মতো চকিতে উধাও হয়ে গেল।

তারপরেই থামালাম মেশিনটা। চারদিকে তাকিয়ে আবার দেখতে পেলাম আমার পরিচিত ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতি আর টুকটাক সরঞ্জাম–ঠিক যেভাবে ফেলে গিয়েছিলাম, সেইভাবেই পড়ে রয়েছে এখানে-ওখানে। টলতে টলতে মেশিন থেকে নেমে পাশের বেঞ্চে বসলাম। বেশ কয়েক মিনিট কেঁপে জ্বর আসার মতো দারুণভাবে কাঁপতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর অনেকটা সামলে নিলাম। চারপাশে আগের মতোই রয়েছে আমার পুরানো কারখানা, কিছুই পালটায়নি। ভাবলাম, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই দেখিনি আমি।

কিন্তু তা তো নয়! ল্যাবরেটরির দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল টাইম মেশিন, কিন্তু শেষ হয়েছে উত্তর-পশ্চিমের দেওয়ালের ধারে–সেখানেই এখনও দেখতে পাবেন মেশিনটা। আর এই দূরত্বটুকুই ছিল ছোট লন আর সাদা স্ফিংক্স-এর বেদির মধ্যে -মর্লকরা এই পথটুকুই বয়ে নিয়ে গিয়েছিল টাইম মেশিনটা। বেশ কিছুক্ষণ অসাড় হয়ে রইল আমার মগজ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে প্যাসেজ দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলাম এদিকে। দরজার পাশেই টেবিলের ওপর পলমল গেজেটটা দেখলাম। আপনাদের টুকরো টুকরো কথা আর ছুরি-কাঁটার শব্দ শুনতে পেলাম। বড় দুর্বল লাগছিল নিজেকে, তাই একটু ইতস্তত করলাম। কিন্তু মাংসের লোভনীয় সুবাস নাকে আসতেই দরজা খুলে দেখলাম আপনাদের। তারপর কী হল তা তো জানেনই। হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে এই আশ্চর্য কাহিনি শোনাতে বসেছি আপনাদের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *