০৯. মর্লক

৯। মর্লক

দুদিন পর আমার নতুন-পাওয়া সূত্র ধরে কাজ শুরু করলাম। স্যাঁতসেঁতে জীবগুলো দেখলেই কেমন জানি গা শির শির করে উঠত আমার। মিউজিয়ামের স্পিরিটে-ডোবানো ম্যাটমেটে সাদা রঙের পোকামাকড়ের মতো দেখতে ওগুলোকে। চুলেও গা ঘিন ঘিন করে। আমার এই গা ঘিঘিনে ভাবটা খুব সম্ভব ইলয়দের কাছ থেকে পেয়েছিলাম। ফুটফুটে জাতটার ওপর আমার বেশ সহানুভূতি এসে গিয়েছিল। তা ছাড়া ওরা যে মর্লকদের মোটেই পছন্দ করে না, তা একটু একটু করে পরে বুঝেছিলাম।

পরের রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারলাম না। শরীরটাও ভালো যাচ্ছিল না। উদ্বেগ আর সংশয়ে বেশ দমে গিয়েছিলাম। বেজায় ভয় পেয়ে বার দুয়েক শিউরে উঠলাম, কী কারণে তা অবশ্য বুঝিনি। রাত হয়ে যেতে নিঃশব্দে হলঘরে এসে ঢুকলাম আমি। খুদে মানুষরা দল বেঁধে ঘুমাচ্ছিল টুকরো টুকরো চাঁদের আলোয় গা এলিয়ে দিয়ে। বুঝলাম, আর দিনকয়েকের মধ্যে অমাবস্যার পথে আরও গড়িয়ে যাবে চাঁদ, আঁধারও একটু একটু করে বাড়তে থাকবে। আর নিচের জগতের কৃমিকীটের মতো জঘন্য সাদা লিমারগুলো পালে পালে উঠে আসবে ওপরে। টাইম মেশিন উদ্ধার করতে হলে যে আগে নিচুতলার রহস্য সমাধান করা দরকার, তা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম। কিন্তু একলা এগবার মতো দুঃসাহস আমার ছিল না। একজন সঙ্গীও যদি পেতাম, কাউকে ডরাতাম না। কুয়োর অন্ধকারে তাকালেই গা ছমছম করে উঠত আমার।

মনের এই অশান্তির হাত থেকে সাময়িকভাবে রেহাই পাওয়ার জন্যে এদিকে-সেদিকে অভিযান শুরু করলাম আমি। সেদিন দক্ষিণ-পশ্চিমে এখনকার কম্বেউডের দিকে গিয়েছিলাম। দেখলাম, অনেক দূরে ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যানস্টিডের দিকে সবুজ রঙের বিরাট একটা ইমারত–এ জাতীয় ইমারত এর আগে আর কোথাও দেখিনি আমি। ও যুগে যত ভেঙেপড়া প্রাসাদ দেখেছিলাম, সেসবের চাইতে অনেক বড় সে ইমারত। গঠনভঙ্গি অনেকটা প্রাচ্য রীতির অনুকরণে। সামনের দিকটা ফিকে সবুজ কি নীলাভ সবুজ রঙের জ্বলজ্বলে চীনে পোর্সেলিনের মতো জিনিস দিয়ে তৈরি। তখুনি ইমারতটার দিকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সন্ধে হয়ে আসছিল, কাজেই পরের দিনের জন্যে মুলতুবি রাখলাম অ্যাডভেঞ্চারটা। কিন্তু পরের দিন সকালে উঠে ভাবলাম সবুজ পোর্সেলিনের প্রাসাদে যাওয়ার ইচ্ছেটা আসলে মনকে ছলনা করা। কুয়োর ভেতরে নামার দুঃসাহস আমার নেই, তাই ও পথ না মাড়িয়ে যেতে চাই অন্য কোথাও। ঠিক করলাম, আর দেরি নয়, কুয়োতে এবার নামবই। তখুনি বেরিয়ে পড়লাম ভাঙা স্কুপের কুয়োটার দিকে।

ছোট্ট উইনা ছুটতে ছুটতে এল আমার সঙ্গে। কুয়োর ধারে মহাখুশিতে নাচ জুড়ে দিল সে। কিন্তু যেই দেখলে কুয়োর মধ্যে ঝুঁকে রয়েছি আমি, অমনি ওর মুখ শুকিয়ে গেল। তারপর যখন ভেতরের পা রাখার হুকগুলোর ওপর পা দিলাম, ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিল ও। বাধা পেতে আরও গোঁ চেপে গেল আমার। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নেমে চললাম নিচের দিকে, আর আতঙ্কে নীল মুখ নিয়ে ওপরে ঝুঁকে রইল উইনা।

প্রায় দুশো গজ নিচে থামতে হয়েছিল আমাকে। কুয়োর দেওয়ালে গাঁথা ধাতুর শিকগুলো আমার চাইতে হালকা প্রাণীর উপযুক্ত, তাই সাবধানে নামতে নামতে হাতে পায়ে খিল ধরার উপক্রম হল। তারপরেই হঠাৎ একটা হুক উপড়ে এল হাতে, পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে এক হাতে ঝুলতে লাগলাম শূন্যে। সে যাত্রা কোনওরকমে বেঁচে গিয়ে আরও সাবধানে নামতে লাগলাম আমি। ওপরে তাকিয়ে দেখি, বহু উঁচুতে গোলাকার নীল আকাশের পটে উইনার ছোট্ট মাথাটা ঝুঁকে রয়েছে। মেশিনের ধুম ধুম শব্দ আরও তীব্র হয়ে উঠল। আবার যখন ওপরে তাকালাম, উইনাকে আর দেখলাম না।

আরও কিছুক্ষণ নামার পর ডানদিকে ফুটখানেকের মধ্যে দেওয়ালের গায়ে সরু একটা ফাঁক দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ভেতরে ঢুকে দেখি সংকীর্ণ একটা সুড়ঙ্গের মুখ সেটা হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে খানিকটা জিরিয়ে নেওয়া যায়। শিরদাঁড়া আর হাত দুটো তখন খসে পড়ার উপক্রম। ভয়ে-উত্তেজনায় ঘেমেও উঠেছিলাম বেশ। আশপাশের মিশমিশে কাজল অন্ধকারের মাঝে শুধু শুনলাম যন্ত্রপাতির ঘটাং ঘটাং শব্দ। আর অনুভব করলাম, পাম্পের টানে অবিরাম বাতাসের স্রোত বয়ে আসছে ওপর থেকে নিচে।

কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ মুখের ওপর একট নরম হাত এসে পড়ায় ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম আমি। ঝটিতি দেশলাই বার করে ফস করে একটা কাঠি জ্বালিয়ে ফেললাম। আর দেখলাম, আলোর সামনে তিনটে প্রাণী অন্ধের মতো পায়ে পায়ে পিছিয়ে যাচ্ছে–যে প্রাণী ওপরে স্কুপের মধ্যে দেখেছিলাম, হুবহু তার মতোই দেখতে এদের। গভীর জলের মাছের চোখের তারা যেমন বিরাট আর খুব অনুভূতি-সচেতন হয়, আলো পড়লে ঠিকরে যায় বহুদিন মাটির নিচে বাস করার ফলে এদের চোখও তেমনি। অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে উঠেছে। আলো ছাড়া আমাকে ওরা ভয় করে বলে মনেই হল না। আলো জ্বালামাত্র চটপট তিনজন সেঁধিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে, সুড়ঙ্গ আর গলিঘুজির ভেতর থেকে অদ্ভুতভাবে শুধু দপদপ করে জ্বলতে লাগল চোখগুলো।

ওদের ডাকলাম আমি। কিন্তু উধ্বজগতের বাসিন্দাদের ভাষা আর এদের ভাষা তো এক নয়। কাজেই সে চেষ্টা আর না করে সুড়ঙ্গের মধ্যেই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম খানিকটা। যন্ত্রপাতির শব্দ আরও জোর হয়ে উঠল। একটু পরেই সুড়ঙ্গের দুপাশের দেওয়ালের আর নাগাল পেলাম না। আর-একটা কাঠি জ্বালাতেই দেখি, বিশাল খিলান-দেওয়া মস্ত এক গহ্বরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি আমি। আলোর সংকীর্ণ পরিধির ওপাশে নিঃসীম অন্ধকারের মাঝে কত দূর পর্যন্ত যে গহ্বরটা গেছে, তা আর দেখতে পেলাম না।

কী যে দেখেছিলাম, ভালো মনে নেই। আলো-আঁধারির মাঝে বিপুলাকার মেশিনগুলোর দানবের মতো কিম্ভুতকিমাকার কালো ছায়া, আর সেই ছায়ার সঙ্গে মিশিয়ে মকদের অস্পষ্ট প্রেতচ্ছায়া আর জ্বলন্ত চোখ। গুমট বাতাসে যেন দম আটকে আসছিল আমার। তাজা রক্তের অদ্ভুত গন্ধে গা গুলিয়ে উঠতে একটু দূরে চোখ পড়ল। দেখলাম, সাদা ধাতুর তৈরি একটা টেবিলের ওপর মাংসের একটা স্তূপ। মর্লকরা তাহলে মাংসাশী। কিন্তু লাল হাড়টা যে কোন প্রাণীর তা ভেবে পেলাম না। অদ্ভুত গন্ধ, বড় বড় অর্থহীন ছায়া, ছায়ার মধ্যে ওত পেতে থাকা কুৎসিত প্রেতচ্ছায়া–এই সবকিছুর একটা ভাসা ভাসা স্মৃতি ছাড়া আর কিছু মনে নেই আমার। তারপরেই কাঠিটা শেষ অবধি পুড়ে আঙুল স্পর্শ করল। চকিতে রাশি রাশি অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর।

কোনওরকম হাতিয়ার না নিয়ে টাইম মেশিনে চড়াটা যে আহাম্মকি হয়েছে, তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম সেদিন। ওই নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘেমে উঠলাম– অস্ত্রের মধ্যে শুধু আমার চার হাত-পা, দাঁত আর পকেটের শেষ সম্বল চারটি দেশলাইয়ের কাঠি।

দেশলাইয়ের কাঠি যে মাত্র চারটিতে এসে ঠেকেছে, তা শেষবার কাঠি জ্বালতে গিয়েই দেখেছিলাম। ইলয়দের নিয়ে মজা করার জন্যে দেদার কাঠি জ্বালাতাম আমি–তখন বুঝিনি, ওই সামান্য কাঠিই এত কাজে লাগতে পারে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভাবছি, আর কাঠি অপচয় করা উচিত হবে কি না, এমন সময়ে একটা হাত এসে পড়ল আমার হাতে, তারপরেই সরু আঙুলের ছোঁয়া লাগল আমার মুখে, আর কীরকম বোটকা একটা গন্ধ ভেসে এল নাকে। চারপাশে ভয়াবহ জীবগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনলাম, বহুজনে ঘিরে ধরেছে আমাকে। অনুভব করলাম, খুব সন্তর্পণে দেশলাইয়ের বাক্সটা আমার হাত থেকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে কয়েকজন, আর কয়েকটা হাত টানাটানি করছে আমার পোশাক। সারা দেহে এদের ছোঁয়া অনুভব করে আমি এত অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম যে বলার নয়। আচম্বিতে ভাবলাম, এরা কেন এভাবে পরীক্ষা করছে আমায়? কী চায় ওরা? কী ওদের মতলব? ভয়ে শিউরে উঠলাম। হঠাৎ বিকট হুংকার দিয়ে উঠলাম। চমকে পিছিয়ে গেল ওরা, তারপরেই শুনলাম, আবার এগিয়ে আসছে। এবার আরও জোরে চেপে ধরল আমায়, আর অদ্ভুত ফিসফিস স্বরে কথা বলতে লাগল নিজেদের মধ্যে। সর্বাঙ্গ কেপে উঠল আমার। আবার বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠলাম। এবার কিন্তু ওরা আর ভয় পেল না, বরং রক্ত হিম করা হাসির শব্দ ভেসে এল আমার কানে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। কোনওরকমে একটা কাঠি বার করে জ্বালালাম। তারপর পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে দেশলাইয়ের শিখায় তা জ্বালিয়ে নিয়ে পিছু হটে যেতে লাগলাম সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু একটু যেতে-না-যেতেই নিবে গেল আগুন, অন্ধকারের মধ্যে শুনলাম, খসখস শব্দে মর্লকরা দৌড়ে আসছে আমার দিকে।

মুহূর্তের মধ্যে কতকগুলো হাত আঁকড়ে ধরল আমায়। ওরা যে আমাকে ভেতরে টেনে নিয়ে যেতে চায়, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ রইল না। আর-একটা কাঠি জ্বালিয়ে ওদের মুখের ওপর নেড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিলাম। ওদের চেহারা যে কী কদাকার আর অমানুষিক, তা আপনারা কল্পনা করতে পারবেন না। রক্তহীন, চিবুকহীন মুখ আর বড় বড় গোলাকার লালাভ ধূসর দুই চোখ। চোখের পাতা না থাকায় আলোর জেল্লায় ওরা প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই সুযোগে ওদের ভালো করে দেখে আমার গা বমি-বমি করে উঠল। বেশি দেরি করলাম না, ওই অবস্থাতেই পিছু হটে চললাম। দ্বিতীয় কাঠি ফুরাতে জ্বালোম তৃতীয় কাঠি। এটা ফুরাতে ফুরাতেই পৌঁছালাম সুড়ঙ্গের মুখে। কুয়োর নিচে বিরাট পাম্পের গুরুগম্ভীর শব্দে মাথা ঘুরে যাওয়ায় কিনারায় শুয়ে পড়লাম আমি। তারপরেই পাশে হাত বাড়ালাম হুকগুলোর দিকে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ওরা আমার দুপা ধরে দারুণ হ্যাঁচকা টান মারলে পেছনে। শেষ কাঠিটা জ্বালোম আমি… কিন্তু তখুনি নিবে গেল কাঠিটা। ততক্ষণে আমার হাত গিয়ে পড়েছে মইয়ের ওপর। কাজেই প্রচণ্ড কয়েকটা লাথিতে মকদের ছিটকে ফেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠতে লাগলাম ওপরে। ওদের মধ্যে একজন অবশ্য কিছু দূর পর্যন্ত উঠে আমার বুটটা ধরেছিল, কিন্তু পদাঘাত ছাড়া তার বরাতে সেদিন আর কিছুই জোটেনি।

ওপরে ওঠা যেন আর ফুরাতেই চায় না। শেষ বিশ-তিরিশ ফুট ওঠার সময়ে দারুণ গা গুলিয়ে উঠল আমার। অতিকষ্টে আঁকড়ে রইলাম হুকগুলো। জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হল শেষ কয়েক গজ ওঠার সময়ে, প্রাণপণে নিজেকে সামলে রাখলাম। কয়েকবার তো মাথা ঘুরে গেল। একবার মনে হল, পড়ে যাচ্ছি। শেষকালে কোনওরকমে উঠে এলাম কুয়োর মুখের কাছে, টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম রোদ্দুরভরা ভাঙা স্কুপের মাঝে। উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। মাটির গন্ধ যে কত মিষ্টি, তা বুঝেছিলাম সেদিন। তারপর কানে ভেসে এল উইনা আর কজন ইলয়ের মিষ্টি স্বর। এরপরেই জ্ঞান হারালাম কিছুক্ষণের জন্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *