০৫. স্বর্ণযুগ

৫৷ স্বর্ণযুগ

 পরমুহূর্তে মুখোমুখি দাঁড়ালাম আমরা–আমি আর আগামীকালের সেই বিশীর্ণ মানুষটি। সিধে আমার কাছে এসে চোখে চোখ রেখে হেসে উঠল সে। ভাবভঙ্গিতে শঙ্কার লেশমাত্র না দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। তারপরেই সে তার সঙ্গী দুজনের দিকে ফিরে অদ্ভুত কিন্তু বড় মিষ্টি আর দ্রুত উচ্চারণে কী বললে।

আরও অনেকে ছুটে আসছিল, দেখতে দেখতে বোধহয় আট-দশজন এইরকম সুন্দর খুদে মানুষ ঘিরে ধরল আমাকে। একজন আমাকে কী বললে। আর তখনই বুঝলাম তাদের তুলনায় আমার গলার স্বর কী বিশ্রী কর্কশ আর মোটা। তাই মাথা নেড়ে কানের দিকে আঙুল তুলে দেখলাম আমি। আর-এক পা এগিয়ে আসে সে, একটু ইতস্তত করে, তারপর স্পর্শ করে আমার হাত। আরও কতকগুলো নরম ছোঁয়া অনুভব করলাম ঘাড়ে পিঠে। আমি রক্তমাংসের জীব কি না, তা-ই পরখ করে নিল ওরা। ভয় পাবার মতো কিছু নেই, বরং এদের ছেলেমানুষি স্বাচ্ছন্দ্য, মিষ্টি সৌন্দর্য দেখে মনে গভীর আস্থা জেগে ওঠে। তা ছাড়া ওরা এত রোগা যে আমার তো মনে হল, ওদের ডজনখানেককে একগোছা আলপিনের মতো ছুঁড়ে দিতে পারি। ওদের টাইম মেশিনে হাত দিতে দেখে আমাকেও এবার তৎপর হয়ে উঠতে হল। এতক্ষণে এ বিপদের সম্ভাবনা মোটেই মনে আসেনি। তাড়াতাড়ি স্টার্ট দেওয়ার লিভারটা খুলে নিয়ে পকেটে রেখে দিলাম। তারপর ভাবতে লাগলাম, কী করে কথাবার্তা শুরু করা যায়।

আরও ভালো করে ওদের চেহারা দেখতে গিয়ে ফুটফুটে সৌন্দর্যের মধ্যে কতকগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলাম। ঢেউতোলা চুলগুলো গাল আর ঘাড়ের কাছে এসে সুচালো প্রান্তে শেষ হয়েছে। মুখের ওপর দাড়িগোঁফের কোনও চিহ্নই নেই। আর কান তো আশ্চর্য রকমের ছোট। ছোট্ট মুখের হাঁ, ঘন লাল পাতলা ঠোঁট, এতটুকু চিবুকটাও সরু হয়ে নেমে এসেছে নিচের দিকে। চোখগুলো কিন্তু বেশ বড় বড়, ভাসা ভাসা চাহনি সে চোখে।

আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা না করে চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে বাঁশির মতো নরম স্বরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে লাগল ওরা। বাধ্য হয়ে আমিই শুরু করলাম। টাইম মেশিন আর নিজের দিকে আঙুল তুলে দেখালাম। সময় জিনিসটা কী বোঝানোর জন্যে সূর্যের দিকে আঙুল তুললাম। তৎক্ষণাৎ লাল-সাদা চেক-কাটা পোশাক পরা একজন খুদে মানুষ এগিয়ে এসে মেঘ ডাকার শব্দ নকল করে চমকে দিলে আমায়।

থতমত খেয়ে গেলাম আমি। সত্যিই কি এরা এত বোকা? জানেন তো, চিরকাল আমি বলে এসেছি, আগামীকালের মানুষরা জ্ঞানে-শিল্পে সব দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি আগুয়ান হবে। আর, আট লক্ষ দুহাজার সাতশো এক সালের একজন আচমকা শুধাল যে, সূর্য থেকে বাজ আমায় নিয়ে এসেছে কি না। পাঁচ বছরের ছেলের চাইতে ওরা বেশি বুদ্ধি ধরে বলে আমার মনে হল না। খুব হতাশ হয়ে পড়লাম। মুহূর্তের জন্যে ভাবলাম, বৃথাই তৈরি করলাম টাইম মেশিনটা।

মাথা হেলিয়ে সায় দিয়ে সূর্যের দিকে আঙুল তুলে বাজ পড়ার এমন এক আওয়াজ ছাড়লাম যে ওরা চমকে উঠল। এবার একজন এগিয়ে এসে একেবারে নতুন ধরনের একরকম ফুলের মালা পরিয়ে দিলে আমার গলায়। দেখে সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। তারপরে প্রত্যেকেই এদিকে-সেদিকে দৌড়ে গিয়ে রাশি রাশি ফুল এনে ছুঁড়তে লাগল আমার দিকে। বেশ একটা মজাদার খেলায় মেতে উঠল সবাই। ফুলগুলো কিন্তু বিচিত্র ধরনের–কত অযুত বছরের প্রচেষ্টায় প্রকৃতি তাদের যে কত সুন্দর করে তুলেছে তা বোঝাতে পারব না। তারপর একজন প্রস্তাব করলে, খেলাটা কাছের বাড়িটায় সবাইকে দেখানো যাক। তৎক্ষণাৎ আমাকে নিয়ে চলল ওরা। সাদা মর্মরের স্ফিংক্স-এর পাশ দিয়ে ধূসর পাথর দিয়ে তৈরি প্রকাণ্ড একটা প্রাসাদের দিকে এগিয়ে চললাম। যেতে যেতে ওদের উন্নত প্রতিভা সম্বন্ধে দৃঢ়মূল ধারণা আবার ফিরে এল আমার মনে। অনাবিল আনন্দে ভরে উঠল আমার বুক।

বাড়িটার প্রবেশপথ যেমন উঁচু, তেমনি বিরাট তার আকার-আয়তন। অবাক হয়ে বিরাট তোরণের ওপাশে ছায়া ছায়া রহস্যময় পথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। খুদে মানুষদের মাথার ওপর দিয়ে দেখলাম অযত্নবর্ধিত, অবহেলিত কিন্তু আগাছাহীন বড় সুন্দর একটা বাগান। দেখলাম, অদ্ভুত সুন্দর সাদা রঙের একরকম ফুল, পাপড়িগুলো মোমের মতো মোলায়েম। ফুটখানেক লম্বা বোঁটা সমেত ফুলগুলো এলোমেলোভাবে বুনো উদ্দামতায় ঝোপেঝাড়ে ফুটে রয়েছে। তোরণের খিলানে বিচিত্র কারুকাজ। খুব খুঁটিয়ে না দেখলেও মনে হল, প্রাচীন ফিনিশিয়ান অলংকরণের সঙ্গে তার যেন কিছু মিল আছে। যদিও ভেঙেচুরে গেছে, রোদে-জলে জীর্ণ হয়ে এসেছে, তবুও সে সৌন্দর্য একবার দেখলে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। আরও অনেক খুদে মানুষ ঝকঝকে গরম পোশাক পরে তোরণের নিচে দাঁড়িয়েছিল, শুভ্র সুন্দর হাত নেড়ে জলতরঙ্গের মতো মিষ্টি কলরোল তুলে ওরা আমায় অভ্যর্থনা জানালে। আর আমি ঊনবিংশ শতাব্দীর কিম্ভুতকিমাকার ময়লা পোশাকে গলায় একরাশ ফুলের মালা ঝুলিয়ে ঢুকলাম তোরণপথে।

বিশাল তোরণপথ শেষ হয়েছে সেই অনুপাতে বিরাট একটা বাদামি হলঘরে। জানলার কিছু স্বচ্ছ আর কিছু অস্বচ্ছ কাচের মধ্য দিয়ে স্তিমিত আলো আসছিল ভেতরে। বহু উঁচুতে অন্ধকারে মিশে আছে ছাদ। বড় বড় কঠিন সাদা চারকোনা পাথরের চাঁই দিয়ে বাঁধানো মেঝে, পূর্বপুরুষদের চলাফেরার ফলে বহু স্থানে ক্ষয়ে গেছে। মেঝে থেকে ফুটখানেক উঁচু চকচকে পাথরের অসংখ্য টেবিল। ওপরে রাশি রাশি ফলের স্তূপ। কতকগুলো কমলা আর রাস্পবেরির বড় সংস্করণ বলেই মনে হল, বাকিগুলো তো চিনতেই পারলাম না।

সারি সারি টেবিলের মাঝে অনেকগুলো গদি-মোড়া আসন ছিল। ওরা তার ওপরে বসে পড়ে আমাকেও বসতে ইঙ্গিত করলে। তারপর লোক-দেখানো কোনওরকম আড়ম্বর না করে দুহাত দিয়ে ফল খেতে শুরু করে দিলে। খিদের চোটে আমিও হাত চালাতে কসুর করলাম না। খেতে খেতে আরও ভালো করে দেখতে লাগলাম ঘরটাকে।

সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল ঘরের জীর্ণ অবস্থা। জ্যামিতিক নকশায় তৈরি জানলার কাঁচগুলো অসংখ্য দাগে মলিন হয়ে উঠেছে, ভেঙেও গেছে অনেক জায়গায়। পরদাগুলোর ওপরেও পুরু হয়ে জমেছে ধুলোর স্তর। টেবিলের কোনাতেও দেখলাম চিড় ধরেছে। এসব সত্ত্বেও সবকিছু মিলিয়ে ঘরের সৌন্দর্য কিন্তু সত্যিই অপূর্ব, জমকালো ছবির মতো সাজানো চারদিকে। প্রায় শদুয়েক লোক একসঙ্গে খাচ্ছিল ঘরটাতে, প্রত্যেকেই সাগ্রহে লক্ষ করছিল আমাকে। প্রত্যেকের পরনে একই রকমের কোমল কিন্তু মজবুত রেশমের চকচকে হালকা কাপড়ের পোশাক।

দেখলাম ফলই তাদের একমাত্র খাদ্য। সুন্দর ভবিষ্যতের এই খুদে মানুষগুলো সত্যিই গোঁড়া নিরামিষাশী। বাধ্য হয়ে আমাকেও আমিষপ্রীতি ত্যাগ করতে হয়েছিল। পরে অবশ্য দেখেছিলাম, ইকথিওসরাসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গোরু, ঘোড়া, মেষ, কুকুরও লোপ পেয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে। ফলগুলো কিন্তু সুস্বাদু। বিশেষ করে তিনদিকে খোসাওয়ালা ময়দার মতো গুঁড়োয় ভরা একটা ফলের স্বাদ তো রীতিমতো লোভনীয়। সারা বছরেই পাওয়া যেত ফলটা। আমিও শেষ পর্যন্ত আমার মূল খাদ্য করেছিলাম এই ফলটিকেই। এত রাশি রাশি অদ্ভুতদর্শন ফলমূল তারা কোত্থেকে আনছে, তা না বুঝে প্রথমে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য দেখেছিলাম কোথায় এদের আমদানির উৎস।

যা-ই হোক, দূর ভবিষ্যতের ফলাহার-পর্বের কথাই বলি আপনাদের। খিদের জ্বালা একটু কমতেই ঠিক করলাম, এদের ভাষা আমাকে শিখতে হবে। একটা ফল উঁচু করে ইশারায় নাম জিজ্ঞেস করলাম। ওরা তো প্রথমে হেসেই কুটি কুটি। শেষে, বেশ সুন্দর চুলওয়ালা একজন বোধহয় কিছু বুঝল। এগিয়ে এসে একটা দুর্বোধ্য শব্দ উচ্চারণ করল সে। অনেক চেষ্টায় রপ্ত করলাম পুঁচকে শব্দটা। এইভাবে একটা একটা করে অন্তত বিশটা দ্রব্যবাচক বিশেষ্য শিখে নিলাম। তারপর সর্বনাম আর খাওয়া, এই ক্রিয়াপদটাও শেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওই একঘেয়ে প্রশ্নোত্তরে ওরা বেশ ক্লান্ত আর অনিচ্ছুক হয়ে পড়েছে দেখে ঠিক করলাম, রয়ে-সয়ে শিখে নেওয়া যাবে ওদের ইচ্ছেমতো। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম যে, এদের মতো শ্রমবিমুখ আর এত অল্পে পরিশ্রান্ত মানুষ আমি আর জীবনে দেখিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *