১৫. যাহা বলিব সত্য বলিব

পনেরো

যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না।

—আপনার নাম?

—রমিতা চৌধুরী।

—স্বামীর নাম?

—পলাশ চৌধুরী।

—ঠিকানা?

—তেইশের বি গলফ্ ক্লাব অ্যাভিনিউ।

—গত তেরোই মে রাত দশটায় টালিগঞ্জ থানায় আপনি একটা এফ আই আর লজ করেছিলেন। ঠিক?

—ঠিক।

—ওইদিনই রাত নটা নাগাদ টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের চাতালে চারজন যুবক আপনার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিল, এই ছিল আপনার এফ আই আরের মূল বয়ান। ঠিক?

কোর্টরুমে থিকথিক করছে মানুষ। কেসের থেকেও সুন্দরী রমিতা চৌধুরীকে দেখার উৎসাহই বেশি সকলের। তাদের দৃষ্টি বিঁধছে রমিতাকে। রমিতা মাথা নামিয়ে নিল। আকাশী নীল পিওর সিল্কের আঁচল আরও ভাল করে জড়িয়ে নিল গায়ে।

—বলুন, সংকোচ করবেন না। শ্লীলতাহানি হয়েছিল?

—হুঁ।

—যারা আপনার সঙ্গে সেদিন অশ্লীল আচরণ করেছিল, আপনি নিশ্চয়ই তাদের দেখলে চিনতে পারবেন?

রমিতা চুপ।

—দেখুন তো, ওই কাঠগড়ায় যারা দাঁড়িয়ে আছে তারাই সেই যুবকেরা কিনা?

রমিতার মাথা বুকে মিশে গেল। দূর থেকেও বোঝা যায়, সে অসম্ভব কাঁপছে। রবীন দত্ত গলা আরও কোমল করল,—ভয় পাবেন না। দেখুন।

রমিতা একঝলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। চারটে মুখ ছুঁয়ে গেল তাকে। মুহূর্তের জন্য শরীরে ক্রোধের আলোড়ন। পরমুহূর্তে দেহ অবশ। কাঠগড়া দুলছে। অতলে ডুবে যাচ্ছে রমিতা। রমিতা চোখ বুজল। যখন আমি মৃত্যুছায়ার উপত্যকা দিয়া গমন করিব তখনও অমঙ্গলের ভয় করিব না। কেননা সদা প্রভু আমার সঙ্গে সঙ্গে আছেন। যখন আমি মৃত্যুচ্ছায়ার উপত্যকা দিয়া…। দু হাতে কাঠগড়া আঁকড়ে ধরেছে রমিতা,—আমি চিনতে পারছি না।

—ঘাবড়াবেন না মিসেস চৌধুরী। আরও ভাল করে দেখুন। লুক স্ট্রেট। চিনতে পারছেন?

রমিতা মুখ তুলল না। নতমস্তকে শ্বশুরমশাইয়ের উকিলবন্ধুর শেখানো বুলি তোতাপাখির মত আউড়ে যাচ্ছে,—ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। আলো কম ছিল। কারুর মুখই ভাল করে দেখতে পাইনি।

রমিতার গলা গহীন খাদে নেমে গেছে। কাঁপছে। গর্ভের শিশুটা কি নড়ে উঠল! সে কি অন্য কিছু শুনতে চায়,!

সরকারি উকিল উত্তেজিত। বিপক্ষ মিটিমিটি হাসছে। কোর্টরুমে মৃদু গুঞ্জন। কোর্টঘর ছাপিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে গেল বাইরেও। প্রাঙ্গণের প্রাচীন বটগাছের পাতারা আরও আরও অনেকবারের মত এবারও লজ্জায় মাথা নামিয়েছে। ভিতু কুকুরটা গাছের গোড়ায় কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে পড়ল। ভিজবে আজীবন।

ঝিনুক আদালতকক্ষের সামনে ভিড়-ঠাসা ছোট্ট করিডরে দাঁড়িয়েছিল। সঙ্গে মানস আর ছোটন। তাদের খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। পলাশ বেশ সচেতনভাবেই অন্যমনস্ক। তার সুনিয়ন্ত্রিত চোখকে সে কিছুতেই ঝিনুকের চোখে পড়তে দিচ্ছে না।

ঝিনুকেরও পলাশে আগ্রহ নেই। কাল রাত থেকে তার বুকে একটানা টাইফুন বয়ে যাচ্ছে। তূণীরের ভালবাসা টিকিয়ে রাখতে গেলে অলিখিত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে ঝিনুককে! ব্যক্তিগত সঙ্কটের সন্ধিক্ষণে পৌঁছে প্রতিটি পুরুষই হয়ে যাবে দুঃশাসন বা রামচন্দ্র! কেউ প্রকাশ্যে নারীকে বিবস্ত্র করতে চাইবে! অথবা প্রেমিকের ছদ্মবেশে আগুনে ঝাঁপ দিতে বলবে প্রিয়তমা নারীকে! যেন নারী শুধুই তার অধিকারের পণ্যসামগ্রী : প্রিয়তমা থাকতে হলে নারীকে অর্পণ করতে হবে নমনীয় দাস্য! তবেই অটুট থাকবে নারী-পুরুষের প্রেমের বন্ধন! প্রেমও এত নিষ্ঠুর!

—এই দিদি, শরীর খারাপ লাগছে নাকি? জল খাবি?

একটি নিদ্রাহীন রাত ঝিনুকের চোখের কোলে ঘন কালি লেপে দিয়েছে। ভাইকে তার জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হল, কতটা জল খেলে হৃদয় শীতল হয় রে? নির্জীব ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল,—দরকার নেই।

মানস বলল,—এই ঝিনুক, কোর্টে তোর নাম ডাকছে। চল।

কোর্টঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকেছে ঝিনুক। রমিতা দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে। তীব্র যন্ত্রণায় তার ফসা মুখ কালচে নীল। করুণ অসহায় দৃষ্টি ঝিনুকের ওপর নিবদ্ধ।

ঝিনুকের শিথিল স্নায়ু সঙ্গে সঙ্গে টান টান। নিজেকে ফিরে পাচ্ছে।

দৃঢ় পায়ে কাঠগড়ায় উঠল ঝিনুক। তার চোখ মুখ বেশ উদ্দীপিত। কণ্ঠে জড়তা নেই। তাকে দেখে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, কয়েক মিনিট আগে এই মেয়ের বুকের ভিতর উথালপাথাল ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। সরকারি উকিলের প্রশ্নের জবাবে নিখুঁতভাবে বর্ণনা করে গেল সেদিনের দৃশ্য। বিভিন্ন ক্রিয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রতিটি ছেলেকে আলাদা-আলাদাভাবে শনাক্ত করল। রবীন দত্ত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বসার পর উঠে দাঁড়িয়েছে ডিফেন্স লইয়ার। ভদ্রলোক মানসের সমবয়সী প্রায়। বড়ই হবে, ছোট নয়। থলথলে চর্বিওয়ালা মুখ। মুখে মধুর হাসি লেগে আছে। চোখে স্নিগ্ধ প্রশান্তি।

স্নেহমাখা কণ্ঠে কথা শুরু করল ভদ্রলোক,—আচ্ছা মা, ঠিক কটার সময় ঘটনাটা ঘটেছিল বললেন?

ঝিনুক আবার সময়টা বলল,—রাত নটা নাগাদ।

—আপনি কি মা তক্ষুনি ওখানে পৌঁছেছিলেন? না আগে থেকেই দাঁড়িয়েছিলেন?

—ট্রেন থেকে নেমে ঝড়বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিলাম।

—তার মানে ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হওয়ার আগে ট্রেন থেকে নামেননি?

—না।

—আপনি নিশ্চয়ই একাই ছিলেন?

—একা না থাকলে আরও কেউ তো আমার সঙ্গে থানায় যেতই।

—এককথায় উত্তর দিন মা। একা ছিলেন তো?

—একাই ছিলাম।

—আপনি কি প্রায়শই একা একা রাত করে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনে নামেন?

রবীন দত্ত ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে,—অবজেকশান ইওর অনার। এ প্রশ্নের সঙ্গে কেসের কোনও সম্পর্ক নেই।

—অবজেকশান সাসটেনড। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন মিস্টার মল্লিক।

ভদ্রলোকের মুখে অমায়িক হাসি,—ঠিক আছে স্যার।…আচ্ছা মা, আপনি শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি কি রাস্তাঘাটে একা একাই ঘোরাফেরা করেন?

—একাও থাকি। কখনও কখনও বন্ধুরা থাকে। আত্মীয়স্বজনও থাকে।

—বন্ধু মানে শুধুই মেয়ে বন্ধু? না আপনার পুরুষবন্ধুও আছে?

—আমার সব রকম বন্ধুই আছে।

—পুরুষবন্ধু বেশি? না মেয়েবন্ধু বেশি?

—গুনিনি।

—কাইন্ডলি নোট ডাউন ইওর অনার, শ্রীমতী সরকার তাঁর পুরুষবন্ধুর সংখ্যা ঠিক গুনে উঠতে পারেন না।

রবীন দত্ত আবার দাঁড়াল,—স্যার আমি বুঝে উঠতে পারছি না, বর্তমান কেসের সঙ্গে এসব প্রশ্নেরই বা কি সম্পর্ক আছে!

ডিফেন্স লইয়ার চাপাগলায় বলল,—বুঝবে। এক্ষুনি বুঝবে। বলেই ঝিনুকের দিকে ঘুরেছে,—আচ্ছা মা, আপনি তো রাস্তাঘাটে একাই ঘোরেন, আপনার সঙ্গে কেউ নিশ্চয়ই এ ধরনের কুকাজ করার চেষ্টা করেনি?

ঝিনুকের ভুরু জড়ো হল,—করলে তো আপনার সঙ্গে আগেই কোর্টে দেখা হত।

ঘর জুড়ে মৃদু হাস্যরোল। ডিফেন্স লইয়ারও মজা পেয়ে হাসছে,—বাহ, বেশ বুদ্ধিমতীর মত উত্তর। আচ্ছা মা, আপনি বললেন টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন দিয়ে আপনি মাঝে মাঝেই ফেরেন। ওখানে আপনি কখনও অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়েছেন?

—না।

—একা থাকলে?

—না।

—রাত বেশি হয়ে গেলে?

—না।

—চত্বরে ঘোরাফেরা করতে হলে?

—বলছি তো না। আপনি একই প্রশ্ন বারবার করছেন কেন? আমি ওখানে আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি, কোনও দিন কিছু হয়নি।

ঝিনুকের ধৈর্যচ্যুতিতে ডিফেন্স লইয়ার বেশ প্রসন্ন,—স্যার নোট করবেন, উনি মাঝে মাঝেই টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনে একা একা ঘোরাফেরা করেন। রাতেও। আধ ঘণ্টা ধরেও ঘুরতে হয় কখনও কখনও

—আমি আপত্তি জানাচ্ছি স্যার। ডিফেন্স আমার সাক্ষীর সম্পর্কে অশোভন ইঙ্গিত করছেন।

—অশোভন ইঙ্গিত কোথায় করলাম? উনি যা বললেন সেটাই স্যারকে নোট করতে বললাম।

—অবজেকশান ওভাররুলড়। প্লিজ কনটিনিউ।

—তা মা, ঠিক কটার সময় ঘটনাটা ঘটেছে বললেন যেন?

—বললাম তো রাত নটা নাগাদ।

—আপনার হাতে ঘড়ি ছিল না?

—ছিল। তবে ঘটনাটার সময়ে আমি ঘড়ি দেখিনি।

—তার মানে টাইমটা আন্দাজে বলছেন, তাই তো?

—আন্দাজ কেন হবে? আমরা ওখান থেকে থানায় গেছি কড়ি-পঁচিশ মিনিট পর। তখন প্রায় পৌনে দশটা।

—প্রায় কেন? তখনও ঘড়ি দেখেননি?

—দেখেছিলাম। ঠিক টাইম মনে নেই। এফ আই আর-এ সময় লেখা আছে।

—গুড। তা আপনি অত রাত্তিরে মেট্রো করে কোথা থেকে ফিরছিলেন?

—এগেন অবজেকশান ইওর অনার। উনি বার বার অত রাত্তির বলছেন কেন? কলকাতা শহরে রাত নটা এমন কিছু রাত নয়। বিশেষ করে গরমকালে।

—স্যার, আমার লার্নেড পাবলিক প্রসেকিউটর যদি এভাবে প্রতিটি কথায় বাধা দেন, তবে তো প্রশ্নই করা যায় না। রাত্তিরকে রাত্তির বলা যাবে না, এতো অদ্ভুত কথা! ঠিক আছে, অত রাত্তির কথাটা বাদ দিলাম। আপনি বলুন আপনি রাত নটার সময় কোথা থেকে ফিরছিলেন?

—ভবানীপুরের এক বন্ধুর বাড়ি থেকে।

—বন্ধু? না বান্ধবী?

—বান্ধবী।

—তা মা, আপনার বান্ধবীর বাড়ি থেকে মেট্রো স্টেশন কাছে, না বাসস্টপ কাছে?

—দুটোই।

—বেশ। আপনার বাড়ি তো বললেন চণ্ডীতলায়, ওখান অবধি তো ভবানীপুর থেকে বাস যায়?

—যায়।

—মেট্রোতে গেলে, আপনাকে ওখান থেকে কিভাবে ফিরতে হয়?

—টালিগঞ্জে নেমে সাধারণত রিকশা ধরে নিই। মাঝে মাঝে হাঁটি।

—তা হলে দেখা যাচ্ছে, বাসে গেলে আপনি সোজাসুজি চণ্ডীতলায় পৌঁছতে পারেন। মেট্রোতে গেলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হয়, টিকিট কাটতে হয়। আবার নিচে নামতে হয়, তারপর টালিগঞ্জে পোঁছে রিকশা। তাই তো? আচ্ছা মা, আপনি বান্ধবীর বাড়ির থেকে কটার সময় বেরিয়েছিলেন?

ঝিনুক দু-এক মুহূর্ত ভাবল। আটটা কুড়ি? সাড়ে আটটা? কটা বলবে? মুখ থেকে বেরিয়ে গেল,—সাড়ে আটটাই হবে।

—এটাও আন্দাজ? ভাল। আপনি দেখছি সবই আন্দাজে আন্দাজে বলেন। আচ্ছা, এটা ঠিক করে বলুন তো, ওই সময় বাসে ভিড় থাকে কিনা।

—তেমন থাকে না।

—বাসে ফিরতে আপনার সুবিধা বেশি, খরচও কম। তবু আপনি অত কষ্ট করে মেট্রোতে ফিরে ঠিক নটায় ওই চত্বরে হাজির রইলেন! এটা কি আপনার একটু কাকতালীয় মনে হয় না, মা?

ঝিনুক প্রশ্নটার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝে উঠতে পারল না। উত্তর কী দেবে সেটাও।

ডিফেন্স লইয়ার বলল,—উত্তরটা ঠিক খুঁজে পাচ্ছেন না তো? আমিই বলে দিচ্ছি। আপনার সেদিন ওখানে উপস্থিত থাকাটা মোটেই কাকতালীয় নয়। এই কেসে অভিযুক্তদের বিপদে ফেলার উদ্দেশ্যেই ও রকম একটা সাজানো ঘটনার আপনার দরকার ছিল। আমি কি ভুল বলছি, মা?

ঝিনুক সজোরে মাথা নাড়ল,—একদম বাজে কথা। আমি ওদের চিনি না, জানি না, কেন মিছিমিছি ওদের বিপদে ফেলতে যাব?

—চেনেন না, জানেন না, অথচ নিখুঁতভাবে শনাক্ত করে ফেললেন? একবার দেখেই?

—আমি ওদের খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম।

—কত কাছ থেকে? ভিক্টিম যত কাছ থেকে দেখেছিলেন, তার থেকেও?

—অতটা না হলেও…একদমই কাছে ছিলাম।

—আচ্ছা মা, ওই জায়গায় রাত্রিবেলা আলো কিরকম থাকে?

—ভালই থাকে।

—যখন ভয়ানক ঝড়বৃষ্টি চলে, তখনও কি যথেষ্ট আলোকিত থাকে?

—থাকে।

—কিন্তু আপনি যাঁর শ্লীলতা রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তিনি বা তাঁর স্বামী, যিনি সে সময় স্ত্রীর সঙ্গে অকুস্থলে ছিলেন, তাঁরা বলছেন, ঝড়বৃষ্টিতে জায়গাটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। ওঁরা কি মিথ্যে বলছেন?

—ওঁরা সত্যি বলতে ভয় পাচ্ছেন।

—আপনাকে ওঁরা বলেছেন নাকি ওঁরা ভয় পাচ্ছেন?

—আমি অনুমান করছি।

—বাহ্, আপনি দেখছি শুধু সাহসীই নন, আপনার অনুমানশক্তিও অত্যন্ত প্রখর। অনুমান! আন্দাজ! প্রায়! নাগাদ! স্যার কাইন্ডলি নোট করুন, উনি কোন কিছুই স্পেসিফিক বলতে পারেন না। শুধু অনুমানশক্তির ওপর ভর করেই উনি সাক্ষ্য দিতে এসেছেন।…আচ্ছা মা, এই যে চার যুবক এখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, যাদের আপনি একবার দেখেই অনুমান-ক্ষমতা দিয়ে শনাক্ত করে ফেললেন, ঘটনার দিন এদের পোশাকআশাক কেমন ছিল আপনার মনে আছে?

—একজন কালো টি-শার্ট পরা ছিল, একজন ব্যাগিশার্ট…

—কোন জন কালো টি-শার্ট পরা ছিল?

ঝিনুক বিভ্রান্ত বোধ ছিল। কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। রোগাটাই তো কালো টি-শার্ট পরে ছিল? নাকি ফর্সাটা? নিজেকে ঝিনুক শক্ত করল আপ্রাণ। নাভাস ভাবটা কাটাতে চাইল,—ওদের আমি মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখেছিলাম। উত্তেজনার মাথায় কে কী পোশাক পরে ছিল, সঠিক মনে রাখা সম্ভব নয়।

—এই তো মা আপনার অনুমানশক্তি কমেছে কিছুটা! আচ্ছা, এদের তো নয় কয়েক মিনিটের জন্য দেখেছিলেন, শ্ৰীমতী রমিতা চৌধুরী পলাশ চৌধুরীকে তো অনেকক্ষণ ধরে দেখেছিলেন, তাঁরা কী পোশাক পরেছিলেন মনে আছে?

—পলাশবাবু প্যান্ট শার্ট। রমিতা চৌধুরী শাড়ি।

—কী রঙের শাড়ি?

—সম্ভবত সাউথ ইন্ডিয়ান শাড়ি। টিয়া রঙের।

—আবার সম্ভব? আর পলাশবাবু?

—মনে নেই।

—আশ্চর্য! অতক্ষণ ওদের সঙ্গে রইলেন, উদ্যোগী হয়ে থানায় নিয়ে গেলেন, পলাশবাবুর শার্টের রঙ খেয়াল রইল না, অথচ ওদের একজনের টি-শার্টের রঙ কালো ছিল, সেটা আপনার মনে রয়ে গেল?

—সেটাই তো স্বাভাবিক।

—যদি পূর্বে ঘনিষ্ঠ পরিচয় থেকে থাকে, তবে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক। কোন ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্য চারটে নিরপরাধ ছেলেকে অভিযুক্ত করতে চাইলে আরও বেশি স্বাভাবিক।

—কখখনো না। ওরা রমিতা চৌধুরীকে টানাটানি করছিল, অসভ্য আচরণ করছিল, মোটর সাইকেলে পর্যন্ত তুলতে যাচ্ছিল…

—আপনি মিছিমিছি উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন, মা। আমি তো একবারও বলিনি, রমিতা চৌধুরীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়নি। তবে তারা এরা নয়। হলে ভিক্টিম নিশ্চয়ই চিনতে পারতেন। আপনার আগেই।

—ভিক্টিম কী বলেছে আমি জানি না। আমি যা দেখেছি, তাই কোর্টকে জানাতে এসেছি। এদের একজনের মোটরসাইকেলও ওখানে পাওয়া গেছে।

—বৃষ্টির সময় তো আরও অনেক মোটরসাইকেল স্কুটার ওখানে ছিল। ছিল না?

—এই ছেলেটি যে মোটর সাইকেলটা ফেলে পালিয়েছিল, তার নম্বর আমি পুলিশকে দিয়েছিলাম।

—বা বলা যায় আপনি একটা মোটরসাইকেলের নম্বর দিয়েছিলেন, ঘটনাচক্রে দেখা গেছে সেটার মালিক ওই ছেলেটি। এতে কিছু প্রমাণ হয় না। হয়তো ছেলেটি ওখানে মোটরসাইকেল ফেলে রেখে গেছিল। হয়তো আপনিও ওই মোটরসাইকেলেই এসেছিলেন…হয়তো আপনার সঙ্গে ঝগড়া করেই ছেলেটি চলে গেছে…না না মা, চোখ মুখ লাল করবেন না, আপনার যেমন অনুমান, আমারও তেমন অনুমান।…আচ্ছা, আপনিও তো একজন যুবতী নারী, ওইখানে ওই পরিস্থিতিতে যারা রমিতা চৌধুরীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিল, তারা আপনাকে কিছু করেনি?

—ওরা আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল, চোয়ালে ঘুষি মেরেছিল, হাত মুচড়ে ধরেছিল…

—আর কিছু?

—খারাপ গালাগাল দিচ্ছিল।

—আর কিছু? কোনও গোপন অঙ্গে হাত ফাত দেওয়া…মানে আপনিও তো নারী…

—না।

—আপনার ওপর যে আক্রমণ হয়েছিল, সেটার জন্য আলাদা ডায়েরি করেছিলেন?

—না।

—আপনার ওপর হামলা হল, তাই নিয়ে আপনি ডায়েরি করলেন না, অথচ অন্যের শ্লীলতাহানি নিয়ে ডায়েরি করাতে উদ্যোগী হয়ে পড়লেন!

—কোনও মেয়ের ওপর শারীরিক আক্রমণ আর কোনও মেয়ের ওপর…মানে তাকে অপমান করা…মানে তাকে…ঝিনুক কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছিল না। কান মাথা ঝাঁঝাঁ করতে শুরু করেছে তার।

রবীন দত্ত ঝিনুককে সাহায্য করতে উঠে দাঁড়াল,—স্যার উনি বলতে চাইছেন, মেয়েদের ওপর ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট আর সেক্সচুয়াল অ্যাসল্ট এক নয়। সেক্সচুয়াল অ্যাসল্ট ইজ মোর অফেনসিভ…

—বুঝেছি। বুঝেছি। আপনাকে লিড করতে হবে না। ডিফেন্স লইয়ার এতক্ষণে সামান্য গলা উঠিয়েছে,—তা ফিজিকাল অ্যাসল্টটা কি চার্জশিটে রাখা হয়েছে? আর সেকশান থ্রি ফিফটিফাইভ?

—নো।

—ব্যাস। আমার যা জানার, জানা হয়ে গেছে। শুধু একটা শেষ প্রশ্ন মা, তেরোই মে রাত নটার সময় মেট্রো রেল চত্বরে শুধু কি আপনারা তিনজনই ছিলেন? আপনি, রমিতা চৌধুরী আর পলাশ চৌধুরী?

—না, আরও অনেক লোক ছিল।

—কিন্তু আমি তো সরকারপক্ষের আর কোন সাক্ষী দেখছি না! আর কেউ থানায় গেল না, শুধু আপনিই গেলেন?

—হ্যাঁ, আর সকলে মজা দেখছিল। ভিতুর মত পালিয়ে গিয়েছিল।

—এগুলোও আপনার অনুমান। ব্যাস, আমার কাজ শেষ। ভদ্রলোক ঝিনুকের সামনে থেকে সরে এজলাসের দিকে এগোল,—স্যার, আমি মাননীয় আদালতকে কয়েকটা পয়েন্ট নোট করে নিতে বলছি। এক, সাক্ষীর সব তথ্য অনুমানভিত্তিক। একটি প্রশ্নের উত্তরও তিনি সঠিক নিশ্চয়তার সঙ্গে দিতে পারেননি। দুই, এঁর অসংখ্য পুরুষবন্ধু আছে। মেট্রো রেল চত্বরেও এঁর একা একা ঘোরাফেরা করার অভ্যাস আছে। অতএব এঁর সাক্ষী নথিবদ্ধ করার সময় এঁর চরিত্র সম্পর্কেও চিন্তাভাবনার অবকাশ থেকে যায়। তিন, ভিক্টিম বা ভিক্টিমের স্বামী পরিষ্কারভাবে বলে গেছেন অত কাছ থেকে দেখেও, কাঠগড়ায় যারা আছে, তাদের সঙ্গে সেদিনের অপরাধীদের তাঁরা মেলাতে পারছেন না। চার, ওঁর ওপর যে আক্রমণ হয়েছিল, সে সম্পর্কে আলাদাভাবে কোনও ডায়েরি বা মেডিকেল রিপোর্ট নেই। পাঁচ, ভিড়ের মাঝে ঘটে যাওয়া তথাকথিত শ্লীলতাহানির ঘটনায় একজন মাত্র অনুমানপ্রবণ সাক্ষী ছাড়া দ্বিতীয় সাক্ষী নেই। সেই সাক্ষীও এমন, যিনি বাসে করে সরাসরি বাড়ি না ফিরে, অনেক বেশি কাঠখড় পুড়িয়ে মেট্রোস্টেশন চত্বরে দাঁড়িয়ে রইলেন এই ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্যই।

ম্যাজিস্ট্রেট কলম বন্ধ করেছেন,—এ সব যা বলার আরগুমেন্টস-এর সময়ে বলবেন। এই সাক্ষীকে আরও কি আপনার ক্রস করার প্রয়োজন আছে?

—আপাতত নেই। বাট আই রিজার্ভ দা রাইট স্যার টু ক্রস হার এগেন।

ম্যাজিস্ট্রেট রবীনবাবুর দিকে ফিরলেন,—আপনি কি আগের দুজন সাক্ষীকে হসটাইল ডিক্লেয়ার করতে চান?

—অবশ্যই স্যার। রবীন দত্ত হতাশ,—তবে আমার মনে হয় ওদের ফারদার ক্রস করে কোনও লাভ হবে না।

ঝিনুক কাঠগড়া থেকে নেমে এল। কেসের তারিখ আবার সামনের সপ্তাহে। নিজের জবানবন্দীর নিচে স্বাক্ষর করে ঝিনুক যখন আদালত থেকে বেরিয়ে এল, তখন সে রীতিমত টলছে। ছোটন কোথা থেকে একটা অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে জল এনে ধরল তার সামনে। এক নিশ্বাসে জল শেষ।

মানস বিধ্বস্ত মেয়ের কাঁধে হাত রাখল। ছোটনকে বলল,—তুই এগিয়ে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ধর। আমরা আস্তে আস্তে আসছি।

আকাশে আজ আবার ঘন মেঘের আবরণ। বেশ কয়েকদিন পর বৃষ্টির সংকেত পেয়ে চিলেরা চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসছে নিচে। পৃথিবীর দিকে।

ছোটন কোর্টপ্রাঙ্গণে ট্যাক্সি পেয়ে গেছে,—বাবা এই দিকে, এই দিকে।

এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক সহসা ঝিনুকের পথ রোধ করে দাঁড়াল,—আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব বলে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি আমাকে চেনো না। আমি রমিতার বাবা।

ঝিনুক ফ্যালফ্যাল করে তাকাল।

মানস বলল,—ওর শরীরটা আজ ভাল নেই। আপনি যদি পরে…

ঝিনুক বাবাকে থামাল,—আপনি বলুন কী বলবেন। আমি ঠিক আছি।

গ্রিক ভাস্কর্যের মত শরীর নুয়ে পড়েছে,—আমার মেয়েটা পারল না। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, ও সত্যি কথাই বলতে চেয়েছিল। এই ক’মাস ধরে নিজের সঙ্গে লড়াইও করেছে খুব।

ঝিনুক শান্ত স্বরে বলল,—ইচ্ছে থাকলে না বলতে পারার তো কোনও কারণ নেই!

—হয় না মা। এত দায়। এত বন্ধন। একবার ভেবেছিলাম, মেয়েটাকে চিরকালের মত ও বাড়ি থেকে নিয়ে চলে আসব। স্বামী শ্বশুরবাড়ি সব চুলোয় যাক। পারলাম না। মেয়েটার পেটে বাচ্চা এসে গেছে। মেয়ে হয়ে জন্মে…ও যে তোমাকে কী চোখে দ্যাখে…! একটু মনে বল আনার জন্য, একটু তোমার গলা শোনার জন্য কতবার যে তোমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে টেলিফোন করেছে! একটি বারও কথা বলতে পারেনি। কত বার বুঝিয়েছি, কথা বল। তোর প্রবলেমটা খুলে বল।

মানস বিমূঢ়,—আপনার মেয়ে! টেলিফোনটা আপনার মেয়ে করত! কথা না বলে কেটে দিত কেন!

—সংকোচে। আত্মধিক্কারে। তপনের গলা ভেঙে এল,—এত ভিতু আমার মেয়েটা! হয়তো আমারই দোষ। ছোট থেকে সেভাবে গড়তে পারিনি। তা ছাড়া মা, সবাই তো সব পারেও না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য যে চারিত্রিক দৃঢ়তা দরকার, তা তোমারই আছে। আমার মেয়ের নেই। প্রার্থনা করি আমার মেয়ে যেন কোর্টে মিথ্যেবাদী প্রমাণিত হয়। আমার মেয়ে হারুক। তুমি অন্তত জয়ী হও।

এ কি আশীবাদ? না অভিশাপ? ঝিনুক চাতকীর মত আকাশের দিকে তাকাল। চিলেদের বৃত্ত ক্রমশ ছোট হচ্ছে। আরও ছোট। এখনও বৃষ্টি নামল না কেন?

.

ষোলো

মৃণালিনী বুঝি ঝিনুকের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। শান্তিপারাবারের পশ্চিম বারান্দায়। কেমন যেন অবসন্ন দেখাচ্ছিল তাঁকে। লোলিত শরীর ইজিচেয়ারে শয়ান। মুখের প্রতিটি বলিরেখা বড় বেশি প্রকট। ঝিনুককে একবার দেখে নিয়েই দু চোখ আবার নিমীলিত। স্খলিত স্বরে ডাকলেন,—আয়।

ঝিনুক নিঃশব্দে তাঁর পায়ের কাছে বসল।

মৃণালিনী চোখ বুজেই বললেন,—নিচে কেন? পাশে উঠে বোস।

ঝিনুক নড়ল না। আলতো হাতে মৃণালিনীর হাঁটু ছুঁয়ে আছে। এই স্পর্শটুকুর জন্যই না বার বার ছুটে আসা! এই পশ্চিমের বারান্দায়!

শেষ দুপুরের বাতাসে নবীন হেমন্তের ঘ্রাণ। আজ ষষ্ঠী। দেবীর বোধন। পুজো এ বার দেরিতে এসেছে। নির্মেঘ আকাশ তকতকে নীল। চূড়ান্ত পরাজয়ের পর বষা পালিয়েছে শেষ পর্যন্ত। মেঘের পল্টন নিয়ে। এই মাত্র কদিন আগে। হা হা করে গলা ফাটিয়ে জয়ের হাসি হাসছে হলুদ রোদ্দুর। পুজোমণ্ডপের ঢাকে ঢাকে সেই হাসির প্রতিধ্বনি।

ঝিনুকও হেরে গেল। মামলা কফিনে ঢুকে পড়েছে। ছুটির পর ম্যাজিস্ট্রেট শেষ পেরেকটা মারবেন।

মৃণালিনী নাতনির মাথায় হাত রাখলেন, —বচ্ছরকার দিনে এমন মুখ গোমড়া করে আছিস কেন? তোর জন্য ক্ষীরের চপ আনিয়ে রেখেছি। চল, ঘরে চল।

—না, মিষ্টি খাব না। মুখে একদম স্বাদ নেই।

—জ্বর তো কবে ছেড়েছে! এখনও রুচি ফিরল না?

ঝিনুক লম্বা শ্বাস ফেলল। রুচি কি শুধু জিভেই থাকে!

—ঝালঝাল কিছু খাবি? সিঙাড়া আনাব?

—থাক, ভাল্লাগছে না। বাবলগামও খাচ্ছি না কদিন।

সত্যিই জ্বরটা একেবারে দুরমুশ করে দিয়ে গেছে ঝিনুককে। শেষ দিন সাক্ষ্য দিয়ে ফেরার পর থেকেই হাই টেম্পারেচার। আগের দিন জেরার সময়ই শরীরের ক্ষয়টা সিগনাল দিতে শুরু করেছিল। তৃতীয় দিন মাথা উঁচু করে কাঠগড়া থেকে নামতেই তপ্ত বিদ্রোহ। সাত দিন ধরে শরীর জুড়ে ভাইরাসের তুমুল দাপাদাপি। রাত বাড়লেই চড়চড় করে একশো তিন, একশো চার, একশো পাঁচ। দিনের বেলা অসহ্য ব্যথায় মস্তিষ্ক, বিবশ। সর্বক্ষণ শুধু মড়ার মতো পড়ে থাকা। মহালয়ার আগের দিন জ্বর ছাড়লেও আছাড় খেয়ে পড়েছে ঝিনুক। এখনও কাহিল বড়। জিভও সযুত হল না পুরোপুরি।

যে জন্য আসা, সেই কথাটা তুলল ঝিনুক,—তুমি তা হলে সত্যিই রামরামপুরে চললে?

—তুই কি চাস না আমি যাই? অকম্মার ঢেঁকি হয়ে এই কয়েদখানায় পড়ে থাকি বাকি জীবনটা?

ঝিনুকের চাওয়াতে কার কী এসে যায় এই ভূমণ্ডলে? অন্তর দিয়ে চাইলেও বা ঝিনুক পাবে কেন? চাওয়া শব্দটাই যে বড় স্বার্থপর। বিভ্রান্তিকর। ঝিনুকের বুক আরও ভারী হয়ে গেল,—মন স্থির যখন করেই ফেলেছ, আমার চাওয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন? একটা কথা শুধু বলতে পারি, এ কয়েদখানা তুমি নিজেই বেছে নিয়েছিলে।

—দুর বোকা মেয়ে, আমাদের তো সবটাই কয়েদখানা। শুধু জেলার-টা বদলে যায়। কখনও বাবা। কখনও বর। কখনও ছেলে। কখনও বা এই পাঁচিলঘেরা বাড়ি। সংসারকয়েদে শেকলের গায়ে স্নেহ প্রেম ভালবাসার একটা মোড়ক থাকে। মোড়কটা খসে পড়লে এই গারখানার থেকে ওই গারখানা আরও ভয়ংকর। দেখি না, নতুন জায়গায় গিয়ে বুক ভরে খানিক বাতাস নিতে পারি কিনা।

—কবে রওনা দিচ্ছ? বাবা বলছিল পুজোর পর পরই নাকি চলে যাওয়ার প্ল্যান করেছ?

—প্রথমে সে রকমই ভেবেছিলাম। ব্যাংকের কিছু কাজ রয়ে গেছে। এখানকার ফিক্সড ডিপোজিটটাও তুলতে হবে। নোটিস দিলেই তো আর সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যাবে না। ও দিকে একা হাতে সব সামাল দিতে গিয়ে শরৎটার যা ল্যাজেগোবরে অবস্থা!

ঝিনুক সব বুঝেও অবুঝ হয়ে যাচ্ছিল। তার একমাত্র শান্তির আশ্রয়টাকে কেড়ে নিচ্ছে শরৎ ঘোষাল। রাগ রাগ মুখে বলল,—ঠেলা বুঝুক। আশ্রম প্রতিষ্ঠান গড়বে, একটুও নাজেহাল হবে না, সে কি হয়?

মৃণালিনী নাতনির বিরাগটা ঠিক ধরতে পারলেন না। বললেন,—তা তো বটেই। সেইজন্যই তো এখনই ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো দরকার। শুনেছিস তো, এর মধ্যেই দুটো বরে খেদানো বউ আর একটা অনাথ বাচ্চা জুটে গেছে?

—শুনেছি। ঝিনুক উদাস উত্তর দিল,—শরৎবাবু বাড়িতে এসেছিলেন।

মৃণালিনী বললেন,—তুই তো বলেছিলি ওকে-সাহায্য করবি। যা, না, এর মধ্যে একদিন ঘুরে আয় না রামরামপুর থেকে। ভাল লাগবে।

ঝিনুক রা কাড়ল না। তার ভাল লাগা মন্দ লাগার অনুভূতিগুলো কেমন ভোঁতা মেরে গেছে।

—কিরে যাবি? যদি বলিস তো শরৎকে বলে দিই। তোকে বাড়ির থেকে নিয়ে যাবে। লক্ষ্মীপুজোর আগেই ঘুরে আয়। এরপর তো হাজার কাজে আটকা পড়ে যাবি। বিয়ের বাজার বলে কথা। শাড়ি কেনা আছে, গয়না গড়াননা আছে…

—বাবলির বিয়ে তো মাঘের শেষে? এত তাড়াতাড়ি বাজার করে কি হবে? পিসিমণিও তো আসছে ডিসেম্বর জানুয়ারিতে?

—বাবলির বিয়ে কেন! তোর মা যে বলে গেল তোর বিয়ে!

—আমার বিয়ে! এক্ষুনি সূর্য আকাশ থেকে খসে শান্তিপারাবারের বারান্দায় গড়াগড়ি খেলেও এত চমকাত না ঝিনুক। স্তম্ভিত স্বর ছিটকে ছিটকে গেল,—কবে বিয়ে! কার সঙ্গে বিয়ে!

—তোর বাবা মা তো বলে গেল, দিনও ঠিক হয়ে গেছে! আঠেরোই অঘ্রান! তোর পিসিদেরও সেই মতো আসতে লিখে দিয়েছে! মৃণালিনী নিরীক্ষণ করছেন ঝিনুককে,—কেন তুই জানিস না! নাকি আমার সঙ্গে হেঁয়ালি হচ্ছে!

ঝিনুকের স্নায়ুতন্ত্র ছিলে-পরানো ধনুকের মতো টান টান। মাথার ঠিক মাঝখানে একটা শিরা দপদপ লাফাতে শুরু করেছে। নিশিত চোখ মৃণালিনীর দিকে অপলক,—আমি তোমার সঙ্গে কোনদিন হেঁয়ালি করিনি ঠাম্মা। কখনও না। তুমি একটু ঝেড়ে কাশো তো, শুনি, কী নতুন ষড়যন্ত্র তৈরি হয়েছে আমার এগেনস্টে?

—সত্যিই তুই জানিস না!

—বলছি তো না। না। না। না। না। না।

মৃণালিনী উঠে বারান্দার দূর প্রান্তে চলে গেলেন। তাঁর আশঙ্কাটাই তবে সত্যি হতে চলেছে! এই জন্যই সুজাতা তাঁর হাত ধরে এত কাকুতি মিনতি করে গেল! মা আপনি যখন যাবেনই ঠিক করেছেন, মেয়েটার বিয়ে অবধি অন্তত থেকে যান! ঝিনুককে যদি কিছু বোঝানোর দরকার হয়… আপনি ছাড়া…ও আপনাকেই যা মানে…!

শান্তিপারাবার আজ ফাঁকা ফাঁকা। পুজোর দিনে কোন কোন দয়ালু সন্তান ঘরে নিয়ে গেছে মা মাসিকে। প্রভাঠাম্মা নতুন থান পরে নিশ্চুপ তাকিয়ে আছেন পথের দিকে। ঝাঁকড়া আমগাছের আড়ালে বসে কুবো পাখি ডেকে চলেছে একটানা। এক জোড়া সেপাই-বুলবুল নাচছে পিড়িক পিড়িক। সামনের পিচরাস্তা কাঁপিয়ে দুর্দম গতিময় দুটো ট্রাক পর পর ছুটে গেল। জলস্থল কাঁপানো যান্ত্রিক গর্জনে হারিয়ে গেছে পাখির ডাক। দু-এক মিনিট পর ডাকটা ফিরল। কুব কুব কুব কুব।

মৃণালিনী অস্থির পায়ে ঝিনুকের কাছে ফিরলেন,—ছেলেটা নাকি খুব ভেঙে পড়েছে। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। যে চাকরিটা করত, সেটা শুনলাম ছেড়ে দিয়েছে। তোর জন্য। নতুন কোথায় ইন্টারভিউ দিয়েছে, নভেম্বর থেকে বোধহয় জয়েন করবে। তূণীরের দিদি-জামাইবাবুই নাকি বলে গেছে এ সব কথা।

ঝিনুক স্বগতোক্তি করল,—কবে হল এ সব?

মৃণালিনী বললেন,—অত দিনক্ষণ বলতে পারব না। তোর জ্বরের সময়ই বোধহয়। মন্টু সুজাতাও তো গিয়েছিল ছেলেটার বাড়িতে!

ঝিনুক মাটিতে থেবডে বসে পড়ল। কবে এসেছিল তনিমাদি-বিজনদা? মনে পড়ছে না। অসুখের সাতটা দিন এখনও কেমন ঝাপসা ঘোরে ডুবে আছে। মাঝনিশীথের তারার মতো এক-একটা দিন যদি বা এক মুহূর্ত দেখা দেয় তো পর মুহূর্তে হারিয়ে যায় ঘন তমিস্রায়। স্কুল ঝেঁটিয়ে অনেকে এসেছিল মনে আছে। মাধুরীদি গীতালিআন্টি দীপিকাদি লেখাদি। মাধুরীদি তার ছুটির দরখাস্ত নিয়ে গেল। মাধুরীদি নিল, না গীতালিআন্টি? গুলিয়ে যাচ্ছে। বিশাখা মৈনাক আর সুলগ্নাও তো একদিন…স্মৃতির গলি হাতড়াচ্ছে ঝিনুক। কাকামনি কাকিমা এসেছিল। রুমকি। মামা মামিরা। আর কে এসেছিল? ঠাম্মা। শরৎ ঘোষাল। বাবুয়া। হ্যাঁ হ্যাঁ তনিমাদিও তো মাথার কাছে একদিন বসেছিল অনেকক্ষণ। বিজনদা দাঁড়িয়ে ছিল দরজায়। সেদিনই কি…?

পাঁচ মাসের ম্যারাথন দৌড় সাঙ্গ করে মুখ থুবড়ে বিছানায় পড়ে আছে ঝিনুক। শেষ ফিতেটা ছুঁয়ে। প্রশস্ত রাজপথ থেকে তাকে বার বার ঠেলে দেওয়া হয়েছে কাঁটাগুল্ম ঝোপঝাড় আর বিষাক্ত লতায় আকীর্ণ দুরূহ পথে। ফুসফুসের বায়ু নিঃশেষ। স্টেডিয়ামে একটি লোকও হাততালি দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে নেই। সম্পূর্ণ শূন্য মস্তিষ্কে জ্বরে ছটফট করছে ঝিনুক। আর ঠিক তখনই তার পাশের ঘরে মিটিং চলেছে! ঝিনুকের সোনালি ভবিষ্যৎ নিয়ে!

শরীর ভেঙে আসছে ঝিনুকে। টাটকা ক্ষত থেকে গলগল। পুঁজরক্ত বেরিয়ে এল। মাগো কী যন্ত্রণা!

মৃণালিনী নাতনির মাথায় হাত রেখেছেন,—শান্ত হ দিদি, শান্ত হ। আমার মন বলছে, ছেলেটা তোকে সত্যিই ভালবাসে।

—মিথ্যে কথা। ভালবাসলে কেউ ওভাবে অপমান করতে পারে!

—যে আচরণটাকে তুই অপমান ভাবছিস, ছেলেরা তাকে অপমান বলে মনেই করে না। মেয়েদের কিসে অপমান হয়, সে বোধ কোথায় ওদের! ওরা ওদের মতো করে ভালবাসে। নিজেদের দাপট ষোল আনা বজায় রেখে।

মৃণালিনী ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। দীর্ঘ জীবন ধরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ অভিমান অপমান তাঁর জীর্ণ হাড়ের খাঁচাটাকে ঝাঁকিয়ে চলেছে। কত কথা শোনাবেন তিনি তাঁর আদরের নাতনিকে? এক সন্ধ্যায় সব কথা শেষ হবে কি?

মৃণালিনীর গলা কাঁপছে,—অন্যদের কথা আর কী বলব, আমার কথাই শোন। তোর দাদু বিয়ের সময় এক কাঁড়ি টাকা নিয়েছিল আমার বাবার কাছ থেকে। আমাকে বিয়ে করার জন্য! দাবী! তার জন্য সারা জীবনে তার একবারও কি মনে হয়েছে, সে আমাকে অপমান করেছিল! কত বড় অপমান! লেখাপড়ায় আমি খারাপ ছিলাম না, বাবা তবু ম্যাট্রিক পরীক্ষার ঠিক মুখে মুখে আমার বিয়ে দিয়ে দিল। শ্বশুরবাড়িতে এসে তোর দাদুকে ধরলাম, আমি পড়তে চাই। তোর দাদু তখনকার আধুনিক মানুষ। পড়তে দিল। প্রাইভেটে ম্যাট্রিক দিলাম। আই এ-ও পাশ করলাম। কিন্তু বি এ পড়ার সময় তোর দাদু বেঁকে বসল। বলল, সংসারের ক্ষতি হচ্ছে। ছেলের যত্ন হচ্ছে না। কত কান্নাকাটি করলাম, তোর দাদু গলল না। অথচ তোর দাদুর সংসারের দোহাইটা সত্যি ছিল না। সংসারের সব কাজ সেরে মন্টুকে কোলে নিয়ে বসে পড়াশুনো করতাম। অথবা সবাই ঘুমোলে। মাঝরাতে। তবু বাধা দিল কেন? না, তার ভয় ছিল বি এ পাশ করে আমি যদি তার সমান সমান হয়ে যাই! বলা যায় না, আমার রেজাল্ট তার থেকেও ভাল হয়ে গেলে সে মুখ দেখাবে কি করে! সেই যে আকাঙক্ষাটাকে মেরে ফেলা হল, সেটা অপমান নয়? তা বলে তোর দাদু কি আমাকে ভালবাসত না? বাসত। আমাকে ছেড়ে একদিনও থাকতে পারত না। তারপর দ্যাখ, ছেলেমেয়েদের জন্ম দিলাম আমি। তোর শুনতে খারাপ লাগবে তবু তোকে বলি, আমি যদি বলতাম, তোর দাদু তোর বাবা কাকা পিসির বাবা নয়, তবে চন্দ্র সূর্য তারা কেউ এসে অপ্রমাণ করতে পারত না সে কথা। আমরা মেয়েরা তা বলি না। সংসারগুলো তাই টিকে থাকে। মোদ্দা কথা ছেলেমেয়েদের মা’টাই খাঁটি, অথচ তাদের মানুষ করার ব্যাপারে মার দাবিটা বড় নয়, বাবার দাবিই আগে। তোর দাদুও ছেলেমেয়েদের মানুষ করার ব্যাপারে আমার কোনও কথা গ্রাহ্য করেনি কোনদিন। সে যা ভাববে, সেটাই ঠিক। ধ্রুব। আমি ছেলেমেয়েকে কিভাবে গড়তে চাই তার কোন মূল্যই নেই। এটা অপমান নয়?

এক ঝোঁকে অনেক কথা বলে হাঁপাচ্ছেন মৃণালিনী। আবার দম নিয়ে বললেন, —আমি কিন্তু তবুও তোর দাদুকে ভালবাসতাম। ভালবাসা এমনই জিনিস….

—তুমি কি তূণীরের হয়ে ওকালতি করতে চাইছ? ঝিনুক সোজা হল,—নাকি নিজে হেরেছ বলে আমাকেও হারতে বলছ? নিজে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারোনি, তাই এখনকার একটা মেয়ে লড়াই করে জিতে যাবে, এটা মনে হয় তুমি…

—সে তুই যা ভাবিস। মৃণালিনী ঝিনুকের কথা কেড়ে নিলেন, আমাদের সময়ে তোদের সময়ে কতটা কি তফাত হয়েছে বুঝি না বাপু। হ্যাঁ, তোরা এখন অনেক বেশি স্বাধীন, মিলিটারিতে যাচ্ছিস, হিমালয়ে উঠছিস, ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লেখাপড়া শিখছিস, চাকরি করছিস! তবু বুকে হাত দিয়ে বল তো, সত্যি কতটা ছাড় পেয়েছিস তোরা? এটা বুঝিস না, ছেলেরা যতটা ছাড়বে ঠিক ততটাই জমি পাবি তোরা? তার বেশি এক চুল নয়। ছেলেরা সংসারের ভেতরে আটকে থাকা জবুথবু মেয়ে আর পছন্দ করছিল না, তাই তোদের পড়াশুনো করতে দিয়েছে। ছেলেরা একা সংসার চালাতে পারছিল না কিংবা বলা যায়, সংসারের প্রয়োজন হল, তাই তোরা চাকরি করতে বেরোলি। বেশি দূর যেতে হবে না, তুই তোর মা মাসিদের দ্যাখ, তাদের ওপরে ঠাকুমা দিদিমাদের দ্যাখ, তা হলেই বুঝতে পারবি কিভাবে একটু একটু করে ছাড় দেওয়া হয়েছে তোদের। এখন ছেলেরা তোদের আরও খোলামেলা দেখতে চায়। তাই টিভিতে সিনেমায় বিজ্ঞাপনে তোদের খোলামেলা হয়ে নেচে বেড়াতে হচ্ছে। ছেলেদের মন খুশি রাখার জন্য। আর সেটাকেই তোরা স্বাধীনতা ভেবে ছাগলছানার মতো লাফাচ্ছিস। এটা স্বাধীনতা নয় রে দিদি, স্বাধীনতার মরীচিকা। স্বাধীনতা হল মনের অনুভূতি। তোদের সেই মনের স্বাধীনতাটাকে ছেলেরা কখনই মানবে না। মানবেই বা কেন? আমরা সভ্য হলেও পৃথিবীতে এখনও আদ্যিকালের নিয়মটাই চলে। যার শক্তি বেশি, তার কথাই আইন। জোরটাও তার। রমিতা চৌধুরীকে দেখে বুঝিসনি?

পরিচিত ঠাম্মা যেন এক অচেনা রাগী যুবতী। তিল তিল বারুদের কণা স্তূপীকৃত হয়ে এক অতিকায় মারণাস্ত্র। আক্রমণের পর আক্রমণ হানছেন মৃণালিণী,—আজকের মেয়েদেরই শুধু নয়, মন মাথা মেয়েদের চিরকালই আছে। প্রতিবাদ করার সাহসও। আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল একজনই। এক নারী। গান্ধারী। দ্রৌপদীর অপমানের বিরুদ্ধেও একমাত্র সেই রুখে দাঁড়িয়েছিল। সে তার স্বামী ছেলেদেরও অভিশাপ দিতে ছাড়েনি। চোখ বাঁধা অবস্থাতেও চোখ খোলা লোকদের থেকে সে বেশি দেখতে পেয়েছিল। যদিও তাতে যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। তার মানে কি গান্ধারী হেরে গিয়েছিল? তার প্রতিবাদটার মূল্য নেই?

ঝিনুক ম্লান হাসল—না গো ঠাম্মা, প্রতিবাদের দাম কোথাওই নেই। দেখলে তো, আমিও কেমন হেরে ভূত হয়ে গেলাম। ডিফেন্সের উকিল গাদা গাদা সাক্ষী এনে প্রমাণ করে দিল, বজ্জাতরা তখন নাকি ওই তল্লাটেই ছিল না। যার মোটরসাইকেল পড়ে ছিল, সেও নাকি তখন চা খাচ্ছিল আধমাইল দূরে। রেষ্টুরেন্টে বসে। রেষ্টুরেন্টের মালিকও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গীতা-কোরাণবাইবেল ছুঁয়ে দিব্যি বলে গেল সে কথা। আর উকিলটা সারাক্ষণ আমার দিকে আঙুল তুলে বলে গেল, এই দেখুন ইওর অনার, এই একটা মিথ্যেবাদী মেয়ে। এই দেখুন ইওর অনার, এই একটা নষ্ট মেয়ে। ভদ্র ঘরে জন্মেও খদ্দের ধরার জন্য রাতবিরেতে মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে। যাদের ধরতে পারে না তাদের ওপর এইভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে। দিনকে পুরো রাত করে দিল! অভিমানে গলা ভিজে গেল ঝিনুকের,—এরপরও তুমি বলবে প্রতিবাদের মূল্য আছে?

—হাজার বার বলব। জিত তোরই হয়েছে। ক’টা মেয়ে তোর মতো শেষ পর্যন্ত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে রে?

ঝিনুকের বলতে ইচ্ছে হল, আমি দাঁড়িয়ে থাকিনি ঠাম্মা। দাঁড়িয়েছিল আমার স্বপ্নে দেখা মিনারের মতো খাড়া সেই নারকেল গাছ। যে গাছের কাণ্ড কুরে কুরে খেয়ে ফোঁপরা করে দিয়েছে একজন। সেই একজন, যে ছিল ঝিনুকের পরম বিশ্বাসের আধার। যার সঙ্গে লক্ষ যোজন পথ একসঙ্গে হাঁটবে ভেবেছিল ঝিনুক। যুদ্ধের মাঝখানে লুকিয়ে শক্রশিবিরে চলে গিয়েছিল যে। মুখে বলল,—তুমিও শরৎবাবুর মতো আমাকে সান্ত্বনা দিতে চাইছ, ঠাম্মা? মামলাতে তো হারজিত আছেই! ভিক্টিম হস্টাইল! ফলস্ সাক্ষী! তা বলে তো ঘটনাটা মিথ্যে হয়ে গেল না ম্যাডাম!… না ঠাম্মা না। তোমরা আমাকে ভোলানোর চেষ্টা কোরো না।

বিকেল শেষ। চাঁদকে গোলাপি আকাশ ছেড়ে দিচ্ছে শক্তিমান সূর্য। রাতটুকুর জন্য। দূরের ঢাকের শব্দ আর মাইকের গান অনুপ্রবেশকারীর মতো ঢুকে পড়ছে নিস্তরঙ্গ বাড়িটায়।

মৃণালিনী উঠে বারান্দার আলো জ্বাললেন। দোতলায় পড়ে থাকা কয়েকটা নির্জীব শরীর ঘর থেকে বেরিয়ে একে একে নেমে যাচ্ছে একতলায়। টিভির সামনে বসে গৃহবাসের উত্তাপ নিতে। মৃণালিনী ঘরের বাতিটাও জ্বেলে এসে আবার নাতনির পাশে বসেছেন,—আমার গা ছুঁয়ে একটা সত্যি কথা বলবি দিদি?

—বলো।

—তুই তোর তূণীরকে তো ভালবাসিস। বাসিস না?

—হুঁ।

—ওর জন্য একদিনও তোর মনটা আনচান করেনি? এর মধ্যে একবারও দেখতে ইচ্ছে করেনি ছেলেটাকে?

ঝিনুক নয়, ঝিনুকের হয়ে অন্য কেউ বলে ফেলল,—করেছে।

—একবারও মনে পড়েনি, কত সুন্দর সময় তোরা একসঙ্গে কাটিয়েছিস?

অন্য ঝিনুক চুপ। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

—তা হলে কেন তুই তূণীরকে বিয়ে করবি না?

—দ্যাখো ঠাম্মা, আমি কাকে বিয়ে করব না-করব, সেটা আমার ব্যাপার। সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোমরা নাক গলাবার কে? তুমি? মা? বাবা? তূণীরের দিদি জামাইবাবু? বাড়ির লোক? তূণীরকে আমি পছন্দ করেছিলাম! ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটাও আমারই ছিল!

—তোর বলিস না, বল তোদের। তাদের দুজনের।. তূণীর তোকে এখনও চায়।

নিঃসীম বেদনায় দুমড়ে যাচ্ছে ঝিনুকের হৃৎপিণ্ড। রাগ নয়, অভিমান নয়, প্রেম নয়, ঘৃণা নয়, এ যন্ত্রণার উৎস আরও অতলে। আরও গভীরে কোথাও। ঝিনুক হিমশীতল প্রশ্ন রাখল,—আচ্ছা। ঠাম্মা, একটা কথার উত্তর দাও তো। আমি যদি তূণীরকে অপমান করে চলে আসতাম, তার বিশ্বাস নষ্ট করে দিতাম, তারপরও কি আমি বায়না করলে তূণীর আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যেত? পুতুল চাই বলে?

নাতনির কথার ভঙ্গিতে মৃণালিনী হেসে ফেললেন।

—হেসো না। ধরো আমি যদি কেসটা, জিতে যেতাম, তা হলেও কি তূণীর আমার কাছে আসত? তার ইগো ঝেড়ে ফেলে? আমি হেরেছি বলেই নিজের ইগোর সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে ওর সুবিধে হয়েছে। ঝিনুক হাত মুঠো করল। প্রাণপণে মুঠি চাপছে, —আর একটা কথাও কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না ঠাম্মা। আমাকে না জানিয়ে আমারই বিয়ে ঠিক করা হয় কি করে? আমাকে একবার জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন নেই কারুর? তূণীর আমার জায়গায় হলে তূণীরের অনুমতি ছাড়া তার বিয়ে ঠিক করতে পারত কেউ?

মৃণালিনী উত্তর দিতে পারলেন না। উত্তর কী আছে?

ঝিনুক বলল,—চুপ করে থেকে না। তুমিও কি আমাকে মাথা হেঁট করে জীবন কাটাতে বলছ? সব মেনে নিয়ে? রমিতা চৌধুরীর মতো?

মৃণালিনী নড়ে বসলেন। নাতনিকে তিনি কী করে বলেন এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতে সত্তর বছর বয়স হয়ে গেল তাঁর। নিচু গলায় বললেন,—জীবন ব্যাপারটাই বড় অদ্ভুত রে দিদি। তোক একটা গল্প বলি শোন। ছোটবেলায় বাবা খুব বলতেন গল্পটা। এই বয়সে এসে খুব বেশি মনে পড়ে। এক ব্রাহ্মণ জঙ্গলের লতাপাতায় পা জড়িয়ে কুয়োতে পড়ে গেছে। কুয়োর মুখে একটা পাগলা হাতি দাঁড়িয়ে। নিচে এক বিষধর সাপ। ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে সাপটা। ব্রাহ্মণের পা ওপরে মাথা নিচে। ঝুলছে। যে লতা জড়িয়ে ঝুলছে সে লতার গোড়াটাও ঘষঘষ করে কাটছে একটা ইঁদুর। লতায় অজস্র ফুল। ফুলভরা শাখায় মৌচাক। সেখানে ঝাঁক ঝাঁক মৌমাছি উড়ছে। ওই ভয়ঙ্কর দশাতেও লোকটার মুখে মৌচাক থেকে ফোঁটা ফোঁটা মধু ঝরে পড়ছে। কী আশ্চর্য, এক্ষুনি মরবে তবু লোকটার তৃষ্ণার শেষ নেই! এক ফোঁটা মধু পড়ে মুখে, তৃষ্ণা আরও বাড়ে। জীবন হল ওইরকমই। ফোঁটা ফোঁটা মধুর লোভেই আমাদের বেঁচে থাকা। কিরে, বুঝলি কিছু?

ঝিনুক বুঝেছে। কিন্তু শুধু বুঝলেই যদি উপশম হত যন্ত্রণার! অজস্র দুঃখ অপমানের গল্প শুনলেই যদি ফিরে আসত অপার শান্তি! হায় রে। লক্ষ খরগোশ জোড়া দিয়ে কি নির্মাণ করা যায় সূর্যের সপ্তম ঘোড়া! থাক, ঠাম্মাকে বলে লাভ নেই। ঠাম্মা বুঝতেই পারবে না সম্পর্ক ছেঁড়ার যন্ত্রণা কী গভীর। হয়ত বলে দেবে, কোর্টের উকিল ‘নষ্ট মেয়ে’ বলেছে বলে ব্যথা পেও না ঝিনুক। প্রাচীন ভারতে নষ্ট মেয়েদের ‘স্বতন্ত্রা’ বলা হত। তুমিও তো স্বতন্ত্রাই।

ঝিনুক হাঁটুতে মুখ গুজল। চারদিকের মরুভূমির মাঝে তার একটাই মরূদ্যান ছিল, তার জলের উৎসও কি স্তিমিত হয়ে এল! নাকি ধিকিধিকি তুষের আগুনে শুকিয়ে যাচ্ছে এই প্রাচীন অন্তঃসলিলা!

ক্লিষ্ট স্বরে ঝিনুক বলল,—আমি তোমাকেও হিসেবে মেলাতে পারছি না ঠাম্মা।

—এই তো তোদের দোষ। সব কিছুই তোরা বড় হিসেবে মেলাতে চাস। আরে বাবা, মানুষের মন হল হিসেবের বাইরের জিনিস। গোঁজামিল ছাড়া মিলতেই চায় না। ওই দ্যাখ না শরৎ যে শরৎ যে, অত হিসেব মিলিয়ে মানুষকে ছকে আনতে চায়, সে নিজের বউটাকেই হিসেবে মেলাতে পারেনি।

ঝিনুক বরফ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,—তুমি ওঁর বউ-এর কথা জানো?

মৃণালিনী মাথা দোলালেন,—শরৎটা ভেবেছিল বউ লজ্জা অপমানের মুখে পড়বে, থানা পুলিশ কোর্ট বেশি না করাই ভাল। এদিকে ঠুঁটো স্বামীকে ধিক্কার দিতে দিতে গায়ে আগুন লাগিয়ে মরে গেল বউটা। কিসে মেয়েদের লজ্জা বাঁচে তাই বুঝে উঠতে পারেনি শরৎ। এখন বাকি জীবনটা অনুতাপে পুড়ছে।

পলকের জন্য ঝিনুকের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। প্রায়শ্চিত্ত! বিদ্যুৎঝলকের মতো কোর্টের সেই বউটার মুখ মনে পড়ে গেল। কোল থেকে বাচ্চা ঝুলছে। বউটার জন্য শরৎ লড়েছিল, জিতিয়ে দিয়ে বউটারই গালাগাল খেয়েছে। আহা বেচারা। লোকটার কোন হিসাবই মেলে না। তবু হিসাব মেলানোর চেষ্টা করে চলেছে নিরন্তর।

মৃণালিনী ঝিনুকের কাঁধ ছুঁলেন,—কি ভাবছিস?

—কিছু না।

—আমি তোকে জোর করব না দিদি। শুধু বলছি, একটু মাথা ঠাণ্ডা করে ভাব।

ঝিনুক উঠে দাঁড়াল,—আমি তোমার গল্পের বামুনের মত হেঁটমুণ্ড ঊর্দ্ধপদ হয়ে মধু চাটতে রাজী নই ঠাম্মা। ওটা জীবন নয়। জীবনের ছল।

মৃণালিনী ঝিনুকের হাত টেনে ধরলেন,—ছেলেটাকে তুই নয় ক্ষমাই করে দে দিদি। তাতে তোর কষ্টটাও কমবে।

সহসা ঝিনুকের বুকে মেঘের গর্জন,—আমি পারব না। পারব না।

—কেন পারবি না? মেয়েরা ক্ষমা করে আসছে বলেই না টিকে আছে সমাজ সংসার। ক্ষমা যারা করে, তারাই তো প্রকৃত শক্তিমান।

ঝিনুক কাটা গাছের মত আছড়ে পড়ল মৃণালিনীর কোলে,—জাহান্নমে যাক তূণীর। আমি ওর মুখ দেখতে চাই না কোনওদিন। চাই না। চাই না। চাই না।

হেমন্তের সন্ধ্যায় আবার বর্ষা নেমেছে। মুষল ধারায়। ঝিনুকের চোখে।

.

সতেরো

একটু একটু করে ফুটে উঠছিল দিনটা। হিমেল কুয়াশা ছিঁড়ে ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে সকাল। প্রশান্ত। নির্জন। শীতল। সূর্য পুরোপুরি উঠে যাওয়ার পর নীরক্ত আকাশে রঙ ধরেছে। গাঢ় তুঁতে রঙ। কাঁচা রোদুর নরম করে হেসে উঠল। পশ্চিম আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রাচীর আলোয় ঝলমল। তুষারকিরীট প্রথম সূর্যকিরণে এক বিমূর্ত ছবি।

গ্যাংটকের পাহাড়ি রাস্তা ধরে অনেকটা ওপরে উঠে গিয়েছিল ঝিনুক। অপলক চোখে পাহাড়ের রঙ বদল দেখছিল। কালো থেকে ধোঁয়াটে নীল। তারপর ধোঁয়াটে সবুজ। ধোঁয়াটে ভাব মুছে শেষে সবুজ, বাদামি, হলুদ অজস্র রঙের মিছিল। দেখতে দেখতে কান্না পাচ্ছিল ঝিনুকের। পৃথিবী এত সুন্দর! এত মায়াময়!

ঝিনুক মন্থর পায়ে নামতে শুরু করল এ বার। ফিরছে। জিনসের প্যান্ট, মোটা চামড়ার জ্যাকেট, গলাবন্ধ ফারের টুপি আর জুতোমোজায় নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে মুড়েও নিস্তার নেই, ডিসেম্বরের ধারালো ঠাণ্ডা বাতাস নখ ফোটাচ্ছে সর্বাঙ্গে। গ্লাভস পরা হাত পকেটে ঢুকিয়ে নিল ঝিনুক। এই কনকনে শীতের সকালেও এক দল পাহাড়ী শিশু টুকটুকে লাল ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাচ্ছে। ক্ষণিক কলরোল তুলে দুরন্ত ঝরনার মতো নেমে গেল উতরাই বেয়ে। ঝিনুকের একটু মন কেমন করে উঠল। বিক্রমশীলা মহাবিহারেও কি এখন বেল বাজছে? দুই লেপচা যুবতী মাথায় বুনো ঘাসের বোঝা নিয়ে চড়াই ভাঙছে। সুবেশা ঝিনুককে ঘুরে ঘুরে দেখছে তারা। ঝিনুক তাদের পেরিয়ে হাঁটছে আবার। দুলে দুলে। একা।

হোটেলে পৌঁছে ঝিনুক দম নিল একটু। রিসেপশন কাউন্টারে একটা নেপালী ছেলে বসে বসে ঢুলছে। রাতের খোঁয়াড়ি তার পুরোপুরি কাটেনি এখনও। ঝিনুকের ডাকে বেশ কয়েক সেকেন্ড পর সাড়া দিল সে।

ঝিনুক বলল,—চা। রুম নাম্বার দুশো তিন।

কার্পেট বিছানো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল ঝিনুক। ঘরে ঢুকে টুপি খুলে ফেলল। চামড়ার জ্যাকেটটাও। চতুর্দিক বন্ধ ঘরে বাইরের হাড়কাঁপানো শীত ঢুকেও ঢুকতে পারছে না। সারা রাত জ্বলে ফায়ারপ্লেস নিভু নিভু, তবু তার উত্তাপের রেশ গোটা ঘরে ছড়িয়ে। ডানলোপিলোয় মোড়া ডবলবেড খাটে। ড্রেসিংটেবিলে। ওয়ার্ড্রোবে। টেবিল চেয়ারে।

ডবলবেড খাটের ঠিক মধ্যিখানে অঘোরে ঘুমিয়ে আছে তূণীর। কুণ্ডলী পাকিয়ে। দুটো মোটা লেপে তার আপাদমস্তক ঢাকা। সবে মাত্র কাল বিকেলে এখানে পৌঁছেছে তারা। ফুলশয্যার পরদিনই বেরিয়ে পড়েছে বলে এখনও যেন বিয়ের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি তূণীর।

ঝিনুক শব্দ করে জানলার ভারী পর্দা সরাল। কাচের শার্শির ওপারে আবারও শ্বেতশুভ্র পাহাড়চূড়া। এত বিশাল পাহাড় এত কাছে! ঠিক যেন পিছনের ব্যালকনির ওপারেই! ঝিনুকের কেমন গা ছমছম করে উঠল। একছুটে গিয়ে ঠেলছে তূণীরকে, অ্যাই, অ্যাই, কী ঘুমোচ্ছিস এখনও! ওঠ। কী দারুণ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে দ্যাখ! এক্কেবারে হাতের কাছে!

তূণীর একবার মাথা বার করেই আবার লেপের ভিতর ঢুকে গেল, —উমমম্।

—কী আলসেমি হচ্ছে! ওঠ। এমন সুন্দর দৃশ্যটা মিস করিস না।

লেপ থেকে একটা হাত বেরিয়ে হ্যাঁচকা টান মারল ঝিনুককে,—এই ঠাণ্ডায় তুই বেরোলি কি করে?

—একবার বেরিয়ে পড়লে একটুও ঠাণ্ডা লাগে না। তোকে তো কত করে ডাকলাম, উঠলিই না।

—চা কোথায়? বলেছিস?

—বলেছি বাবুসাহেব, বলেছি। চল, চা খেয়ে বেরোব। বেড়াতে এসে কেউ এত বেলা পর্যন্ত লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোয়?

—আমি তো বেড়াতে আসিনি। বলতে বলতে তূণীর ঝিনুককেও জোর করে টেনে নিল লেপের ভিতর। তার হাত বেষ্টন করে ফেলেছে ঝিনুককে।

ঝিনুক মিনমিন করে বলতে গেল,—এক্ষুনি চা দেবে.

—সো হোয়াট? এটা হানিমুন স্যুইট। কোন ডিসটার্বেন্স চলবে না।

ঝিনুকের মুখ গলা ঘাড় বুক আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে তূণীর। এক এক করে খুলে গেল সমস্ত আবরণ। সদ্যচেনা নারী-শরীর নিয়ে মাতাল হয়েছে পুরুষ। শালফুলের গন্ধ মুছে তার নাকে এখন আদিম মানবীর সুবাস।

—তোকে না পেলে আমি মরে যেতাম রে। ঠিক মরে যেতাম।

ঝিনুকও বুক ভরে শুষে নিচ্ছে তার প্রিয় পুরুষের ঘ্রাণ,—তাই বুঝি?

—আমি দিদিকে বলে দিয়েছিলাম তোকে আমার চাইই। না পেলে আমি সুইসাইড করব।

ঝিনুক উত্তর দিল না। নিঃশব্দে তূণীরের শরীরের ওম উপভোগ করছে।

তূণীরের গলা জড়িয়ে এসেছে কামনায়,—খামোক একটা ঝামেলা বাধিয়ে আমার টেনশান কেন বাড়িয়ে দিয়েছিলে তুমি?

ঝিনুক তূণীরের ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিল। একটা চিনচিনে ব্যথা সঞ্চারিত হচ্ছে বুকে। শত শত মাইল দূরের শহরটাকে এই মুহূর্তেও কি ভুলে থাকা যাবে না?

তূণীর ঝিনুকের গালে গাল ঘষছে,—সত্যিই আমরা কী বোকা, তাই না? কোথাকার কে রমিতা পলাশ, কোথাকার কোন গুণ্ডা…তাদের জন্য মাঝখান থেকে আমরা ঝগড়া করে মরছিলাম।

লেপের অন্ধকারে স্বপ্নের নারকেল গাছটা দুলে উঠল। দুলছে। দুলতে দুলতে মিলিয়ে গেল। আসবে। আবার ফিরে আসবে। আমৃত্যু।

প্রিয়তম পুরুষ এত কাছে, তবু মুহূর্তের জন্য অবসন্ন ঝিনুক। জানলার ওপারের কাঞ্চনজঙ্ঘা হঠাৎই তার বুকে চেপে বসেছে। ফুসফুস আললাড়িত করে লক্ষ মণ ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এল। তূণীরের মুখে আছড়ে পড়েছে সেই নিশ্বাস। ঘন। তপ্ত। আরও প্রবল আশ্লেষে তূণীর ডুবছে ঝিনুকের শরীরে।

ওই দীর্ঘশ্বাস চেনে না পুরুষ। জানে না কত অভিমান অপমান আর যন্ত্রণা গোপন করে নারী ভালবেসেছে তাকে। যুগযুগান্ত ধরে।

পলাশ জানে না। তূণীরও জানবে না কোনদিন।

.

[এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *