০১. উত্তাল সমুদ্রের মত ঢেউ

দহন – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

.

এক

উত্তাল সমুদ্রের মত ঢেউ ভাঙছিল দুটো শরীর। ঢেউয়ের বুকে ঢেউ। ঢেউয়ের পিঠে ঢেউ। অবিরাম ঢেউয়ের অভিঘাতে চলকে চলকে উঠছে আদিম রিপু। সুদর্শন ছেলেটা গানের কথা আর সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পিঠ বুক উদর নিতম্ব কোমর সর্বাঙ্গ দিয়ে ঘাঁটছে রূপসী মেয়েটাকে। মেয়েটার শরীরের চার ভাগের তিন ভাগ উন্মুক্ত। চোলি আর ঘাগরার মাঝে আটলান্টিক মহাসাগরের ব্যবধান। তার মোমে মাজা মসৃণ ত্বক, উদ্ধত যৌবন আর অলৌকিক সুষমা মাখা দেহের প্রতিটি খাঁজ থেকে বিকীর্ণ হচ্ছে তেজস্ক্রিয় কামনা।

ঝিনুক মুখ ঘুরিয়ে নিল। আজকাল যে বাড়িতেই যাও, যখনই যাও, শুধু টিভি টিভি টিভি। ফার্স্ট চ্যানেল সেকেন্ড চ্যানেল, কেব্ল, স্টার, এম, জি। সর্বত্রই একই দৃশ্যের রকমফের। পাঁচ সাত বছর আগেও এ ধরনের দৃশ্য ঘরে বসে দেখতে নিষিদ্ধ রোমাঞ্চ জাগত। এখন সব জলভাত। সময় এখন আলোর গতিতে দৌড়চ্ছে। সব কিছুই এখন অনেক বেশি মুক্ত। মুক্ত দুনিয়া। মুক্ত অর্থনীতি। মুক্ত আমোদ প্রমোদ। রঙদার বিজ্ঞাপনে জীবন এখন অনেক বেশি মোহময়। খোলামেলা।

বিশাখার বাবা হঠাৎ ঘরে ঢুকে টিভিটা বন্ধ করে দিল,—কী তোমরা দিনরাত এই নাচগান দ্যাখো বলো তো? ইয়াং ব্লাড! সামনে খাবার পড়ে আছে। খাওদাও। আড্ডা মারো। হইচই করো। তা না, সব ঘাড় সোজা করে…

—ঠিক আছে ঠিক আছে। তুমি যাও তো। বিশাখার মা বেশ অপ্রসন্ন হয়েছে,— এ প্রোগ্রামটা সবাই দেখতে ভালবাসে। তোমার মত রসকষহীন লোক ছাড়া। এটা শেষ হলেই উঠে যাব।

—কোন দরকার নেই শেষ হওয়ার। ওই নেত্য না দেখলে জীবন বিফলে যাবে না। আমাকে খেতে দেবে চলো।

বিশাখার বোন সদ্য হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে। খুড়তুতো ভাই ক্লাস ফাইভে। এই সব নাচাগানা দুম করে বন্ধ হয়ে গেলে মাথা গরম হয়ে যায় তাদের। দিদির বন্ধুদের সামনে সেই রাগ প্রকাশ করতে না পেরে দু’জনে মার্চ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

টিভি বন্ধ হতে ঝিনুক মনে মনে খুশিই হয়েছে। ওই বাক্সটা তাকে যে কখনও টানে না এমন নয়। তবে সে শুধু নিজের বাড়িতেই। দৃশ্যগুলোও তখন অন্যরকম। দেখতে দেখতে কখনও কখনও এক ধরনের অলীক মায়াও জাগে। যেন ঝিনুকের সকালের স্কুল সত্যি নয়, যেন প্রায় দুপুরেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্লান্ত হওয়া সত্যি নয়, যেন বিকেলে একই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মুখহীন একই মানুষজনের দিকে তাকিয়ে দেখা সত্যি নয়, সত্যি শুধু ওই বাক্সে মেলে ধরা জগতটাই। ঝিনুকদের চণ্ডীতলার সাড়ে সাতশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট, দক্ষিণের ছয় বাই তিন ব্যালকনি, টবে সাজানো পাতাবাহার গাছ—সবই তখন মুছে গিয়ে বিশাল বর্ণময় বিলাসময় প্রাসাদ হয়ে যায়। রক্তের কণিকায় অমোঘ বাসনার মতো ঢুকে পড়ে ওই ম্যাজিক-বাক্স। ওই বাক্সের ভিতরেই গাঢ় অরণ্যের শুঁড়িপথে তূণীরের সঙ্গে হাঁটে ঝিনুক। বরফের ওপর দৌড়য়। কাকচক্ষু ঝরনায় উন্মত্ত স্নান করে দু’জনে। তূণীর যে সে মুহূর্তে পাশে নেই, প্রায়শই থাকে না, সে কথা ঝিনুক সম্পূর্ণ ভুলে যায় যেন। তা বলে ওই বিদঘুটে নাচাগানা! ছিঃ।

বিশাখার বাবা মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে সুলগ্না ফিসফিস করে বিশাখাকে বলল,— সাউন্ড অফ্ করে একটু চালিয়ে দে না। আজ খলনায়কের গান দিতে পারে।

মৈনাক বলল,— দেবে না। এখন সঞ্জয়ের মুখ টিভিতে ব্যান্ড্। আগে তো হিরো টাডা থেকে ছাড়া পাক।

সুলগ্নার মুখ কাঁদ-কাঁদ হয়ে গেল। পিঁপড়ে থেকে ঐরাবত, কারুর কোন কষ্ট তার সহ্য হয় না। বন্ধুমহলে তার নাম নাজুকদিল্। সে বলল,— এটা কিন্তু ভারি অন্যায়। একটা বাচ্চা ছেলে ভুল করে একটা কাজ করে ফেলেছে, তার জন্য সবাই মিলে তাকে এরকম করা…কী নিষ্ঠুর!

—উউউহ্, কচি খোকা আমার। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলবে বলে ফরেন আর্মস্ কাছে রেখেছিল, না?

—ইশ্শ্, সঞ্জয়ের যেন সব দোষ, না? আর অন্যরা সব কী? তোদের পলিটিকাল লিডাররা বুঝি সব খসে পড়া দেবতা? এই তোর রশিদের কেসেই দ্যাখ না সব কেমন ফাঁসে!

—তোরা থামবি? সারাক্ষণ শুধু এক বোরিং টপিক। শুভাশিস রুখে দিল বাজার চলতি আলোচনাটাকে, আয়, আমরা এখন মুরগির ঠ্যাং তুলে বিশাখার চাকরি পাওয়াটা সেলিব্রেট করি।

হইচই করে প্লেট থেকে মুরগির তুলে ধরল সকলে। যন্ত্রচালিতের মতো ঝিনুকও। তূণীর এখনও আসছে না কেন!

ঝিনুকের আনমনা মুখ, দরজার দিকে বার বার ফিরে ফিরে তাকানো নজরে পড়েছে মৈনাকের,— কিরে শ্রবণা, তোর তূণীর আজকাল অফিসের তালা লাগানোর কাজটাও করছে নাকি?

ঝিনুক অনেকক্ষণ ধরে একটা বাবল্গাম চিবোচ্ছিল। যে কোন উত্তেজনার সময়ে সে কচকচ করে বাবল্গাম চিবোয়। শিশুকালের অভ্যাস। সুজাতা অনেক চেষ্টা করেও মেয়ের এই বদ অভ্যাস ছাড়াতে পারেনি। মুখ নাড়তে নাড়তে সে গম্ভীর উত্তর দিল,— তাই হবে।

তূণীরের অফিস অফিস বাতিক ইদার্নীং খুব বেড়েছে। ঝিনুকের সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলতে গেলেও তিন বার কুরুভিলা, দু’বার রজত রায়, ছ’বার ফিনান্স ডিরেক্টর, তূণীরের কথায় ঘুরে ফিরে আসবেই। সাতটা সাড়ে সাতটার আগে বেশির ভাগ দিন অফিস থেকে বেরোয় না, ছুটির দিনেও যে কোন অজুহাতে তার অফিস দৌড়নো চাই-ই।

অথচ চাকরিটা পাওয়ার আগেও তূণীর ছিল অন্যরকম। তখন তার শয়নে স্বপ্নে নিদ্রায় জাগরণে ঝিনুক ঝিনুক ঝিনুক।…. তুই তি-ই-ন দিনের জন্য মুর্শিদাবাদ বেড়াতে যাবি? আমি বাঁচব না।… পরশু সন্ধেয় বিয়েবাড়ি আছে তোর? আমি উল্টো ফুটের ল্যাম্পপোস্টের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। …কাকার শ্রাদ্ধে আমাকে নবদ্বীপ যেতে হবে? চান্স নেই। গেলে আমি সেদিন ফিরতে পারব? তখন আমার শ্রাদ্ধ করে কে? রোজ ঝিনুকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তবু সাতচল্লিশ পাতার প্রেমপত্র, সাতান্ন পাতার প্রেমপত্র, তিয়াত্তর পাতার প্রেমপত্র।

তূণীর এরকমই। সব কাজই তার মাত্রাছাড়া। আবার এই মাত্রাছাড়া ব্যাপারটাও কেমন যেন গোলমেলে। ঝিনুক মাঝে মাঝে থৈ পায় না। কতটা মাত্রা ছাড়াবে তারও এক জটিল হিসাব যেন নিরন্তর চলছে তুণীরের মস্তিষ্কে। চার্টার্ড ইন্টার পরীক্ষার আগে তিন মাসে মোট সাতশ পঁয়ষট্টি ঘণ্টা পড়বে বলে স্থির করেছিল তূণীর। একত্রিশ ঘণ্টা কম পড়া হয়েছে বলে পরীক্ষাতেই বসল না প্রথম বার। এক বার এক মাসে একশ পঁয়ত্রিশ ঘণ্টা ঝিনুকের সঙ্গে কাটাবে বলে ঠিক করেছিল। নিজের হিসাব পূর্ণ করতে মাসের শেষ ক’দিন ঝিনুকদের বাড়িতে এসে বসে আছে তো বসেই আছে। রাত ন’টা বাজে ভ্রূক্ষেপ নেই, দশটা বেজে গেল হিল্দোল নেই, তিন দিন সাড়ে দশটার পরে তূণীরকে প্রায় ঠেলেঠুলে বাড়ির থেকে বার করেছিল ঝিনুক। শেষ দিন তো ঝিনুককে দরজাতেই আটকে রাখল আরও কুড়ি মিনিট। বাড়িতে কৈফিয়ৎ দিতে দিতে ঝিনুকের জান কয়লা। মা তো আছেই, মার এমনিতেই কৌতূহলের অন্ত নেই, বাবা যে বাবা যে ঘরের পর্দা বদলানো হলেও তিন মাসের আগে বুঝতে পারে না, সেই বাবা পর্যন্ত ভুরু কুঁচকোতে বাধ্য হয়েছিল সেরার।

অফিস নিয়েও কি ওরকম কোন ছক কষেছে তূণীর? এক বছরে আড়াই হাজার ঘণ্টা অফিসে কাটাবে! অথবা তিন হাজার! স্টেটস্ যাওয়ার জন্য যেরকম খেপেছে!

ঝিনুক জানলার ধারে গিয়ে মুখের বাবল্গাম ফেলে এল। দিনের প্রখর তাপ ঝিমিয়ে এলেও বাইরের বাতাস এখনও বেশ গরম। পাখার তলা থেকে একটু সরলেই চোখে মুখে ঘাম জমে যায়। গুমোট ভাবটাও আজ বড় বেশি। বিশাখাদের বাড়িটা যদবাবুর বাজারের গায়ে বলে গুমোটটা কি এখানে বেশি তীব্র?

ঝিনুক খাবারের প্লেট হাতে তুলল।

বিশাখা বলল,— আরেকটু মাংস নিবি তোরা? নে না। তূণীর আসে কিনা ঠিক নেই অনিন্দিতা অনিন্দিতার বর তো ঝুলিয়েই দিল।

নীলাঞ্জনা জিজ্ঞাসা করল,— হ্যাঁ রে, অনিন্দিতার নাকি বাচ্চা হবে?

শুভাশিস যত্ন করে পরোটা ছিঁড়ছিল, আড়চোখে বিশাখার দিকে তাকাল,— তার মানে আরেকটা খাওয়া পাওনা হচ্ছে?

নীলাঞ্জনা চোখ পাকাল,— লজ্জা করে না বলতে? নিজে চাকরি পেয়ে এখনও খাওয়ালি না, বসে বসে বিশাখারটা গিলছিল, সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা খাওয়ার ধান্দা?

—খেপছিস কেন? তুই তো খাওয়াবি না, খাওয়াবে অনিন্দিতার বর।

—তোকে থোড়াই খাওয়াবে। পয়সা অত সস্তা না।

—হাসালে বস্। অনিন্দিতার বরের পয়সার অভাব? ছুরিকাঁচি হাতে ধরলেই পয়সা। যেমন…যেমন…এই শ্রবণা, বল্ না যেমন?

—যেমন পকেটমারদের ব্লেড ধরলেই পয়সা। ঝিনুক ঠোঁট টিপে হাসল।

—যেমন ট্রাফিক পুলিসদের লরি ধরলেই পয়সা।

সুলগ্না খিলখিল হাসছে,— তোরা ভীষণ অসভ্য আছিস। মোটেই অনুর বর চশমখোর ডাক্তার নয়। পাড়ার পুওর ক্লিনিকেও বসে, জানিস? কত গরিব লোকদের কম পয়সায় অপারেশন করে দেয়…

ঝিনুক ব্যাজার মুখে বলল,— অনুটা আজ না এসে আমাকেও ফাঁসিয়ে দিল। ওর বই দুটো ফেরত দেব বলে নিয়ে এসেছিলাম, অনেক দিন ধরে আমার কাছে পড়ে আছে, আবার এই ভারী বোঝা টেনে টেনে ফেরা, মানে হয়! এই মৈনাক, তই তো ওর শ্বশুরবাড়ির কাছে থাকিস্ তুই একটু পৌঁছে দিবি?

মৈনাক বিশাখার দিকে টুক করে তাকিয়ে নিল। বিশাখার সঙ্গে তার গভীর প্রেম। কলেজে পড়ার সময় অনিন্দিতার আবার সামান্য দুর্বলতা ছিল মৈনাকের প্রতি। বিশাখা সে কথা জানে। বিশাখার সামনে অনিন্দিতার কথা উঠলে মৈনাক তাই একটু কাঁটা হয়ে যায়। সে উদাস মুখে বলল,— বইগুলো হজম করে গ্যাঁট হয়ে বাড়িতে বসে থাক। ও ঠিক সুড়সুড় করে তোর কাছে যাবে। ও না গেলে ওর বর যাবে। যেতেই হবে।

—কেন?

—ওর হবু বাচ্চার জন্য এ বছর থেকেই স্কুলে স্কুলে লাইন লাগাতে হবে না? অবশ্য তোর ব্যাকিং-এ তোদের স্কুলে লাস্ট টাইমেও অ্যাডমিশান পেতে পারে।

ঝিনুক হেসে ফেলল,— আমার বাবা কোন হাতফাত নেই, আমাদের স্কুলে টিচারদের কোন কোটা থাকে না।

নীলাঞ্জনা ফস করে বলে উঠল,— তোর কোটা নেই, তোর হেডমিস্ট্রেসের তো আছে! নিজে সেই কোটায় চাকরিতে ঢুকে গেলি!

স্কুলের চাকরিটা পাওয়ার পর থেকে এ ধরনের ছোটখাটো টীকাটিপ্পনী ঝিনুককে অনেক শুনতে হয়েছে। তার নিজেরই স্কুলের প্রাইমারি সেকশানের ইন্চার্জ গীতালি বসুর কাছ থেকে খবর পেয়ে ঝিনুক সোজা গিয়ে ধরেছিল তাদের হেডমিস্ট্রেসকে। এম এ পরীক্ষা দিয়ে ঝিনুক তখন কাঠবেকার। সুনীতা সেনগুপ্ত জিজ্ঞাসা করেছিল,— সত্যিই তুই পড়াবি? সিরিয়াস? না শখ?

—চাকরি আবার শখের হয় নাকি আন্টি?

—হুট করে ছেড়ে পালাবি না তো?

—বেটার চান্স না পেলে প্রশ্নই আসে না।

—তাহলে আপাতত লিভ ভেকেন্সিতেই কর। স্বপ্না মেটারনিটি লিভে যাচ্ছে, তার জায়গায় তুই নার্সারির একটা সেকশান নে।

—উনি ফিরে এলে?

—তখন দেখা যাবে। প্রতি বছর গাদা গাদা স্টুডেন্ট বাড়ছে। এবার মাধ্যমিকে দুটো স্ট্যান্ড করেছে। চোদ্দটা স্টার। বলতে বলতে সুনীতার চোখ চকচক,— মনে হয় নার্সারিতে আরও এক-আধটা সেকশান বাড়াতে হবে। মিস্টার সেনগুপ্তও চান এক্স স্টুডেন্টরাই আমাদের স্কুলের টিচার হয়ে আসুক।

নিলয় সেনগুপ্ত সুনীতার স্বামী। মিনি ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। স্কুলের মালিকও। বেজায় ব্যস্ত মানুষ। স্কুল নিয়ে ভাবার তার আদৌ সময় নেই। তবু সুনীতা তার স্কুল সংক্রান্ত নিজস্ব সিদ্ধান্তে সেনগুপ্তর নাম ছুঁইয়ে রাখবেই। সিঁথির হালকা সিঁদুরের মতো।

ঝিনুক আলগা শ্বাস ফেলল,— তোরা শুধু আমার চাকরি পাওয়াটাই দেখলি, পরিশ্রমটা তো আর দেখলি না!

—নার্সারিতে পড়ানোয় আবার পরিশ্রম কিরে? খালি তো আম আর আপেল আঁকা শেখানো। সঙ্গে এ বি সি ডি ওয়ান টু। বড় জোর সুর করে করে দুলে দুলে হাম্পটি ডাম্পটি স্যাট্ অন এ ওয়াল…

নীলাঞ্জনার ক্ষোভটা কোথায় ঝিনুক জানে। তাদের ইয়ারে এম এতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েও নীলাঞ্জনা তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি। শ্যামবাজারের কাছে একটা কলেজে পার্টটাইম পড়ায়। সপ্তাহে ছ’টা করে ক্লাস। দক্ষিণা মাসে একশ পঁচিশ। দরজায় দরজায় ধুপকাঠি ফিরি করলেও এর থেকে বেশি রোজগার হয়। সেখানে বরাতজোরে জুটে যাওয়া ঝিনুকের চাকরিতে মাস গেলে বারোশো। এই বারোশো টাকার বিনিময়ে তাকে কম খাটায় তার স্কুল! সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে গোটা চল্লিশেক বাচ্চার খিদমদগারি। সম্মানজনক বেবিসিটিং। আন্টি হিসি করব। আন্টি পটি হয়ে গেল। একেকটা তো আবার তিলে বিচ্ছু। কালীঘাটে পুঁতলে কোডাইকানালে কাঁটাগাছ হয়ে বেরোবে। যেমন মুখ চলে তেমন হাত পা। ক্লাসে ঢুকেই কাঁধের ব্যাগ ঢাল হয়ে গেল, স্কেল তলোয়ার। সব্বাই তখন টেলিভিশনের টিপু সুলতান। হা রে রে রে রে রে। আ ক্র ম অ অ ণ। সঙ্গে খিমচাননা কামড়ানো তো চলছেই। এখন আবার নতুন ব্যাচ এসেছে। তিন বছরের একদল শিশু। গা থেকে এখনও দুধের গন্ধ যায়নি। অবিরাম প্যাঁ পোঁ সানাই বাজিয়ে চলেছে তো চলেছেই। একটা মেয়ে তো আজও ঝাড়া তিন ঘণ্টা মিহি সুরে ললিত শুনিয়ে গেল, ম্যাঁ-অ্যার ক্যাঁছে যাঁবো… ম্যাঁর ক্যাঁছে এঁ এঁ এঁ এঁ এঁ….। দূর দূর, কী লাভ হল এই চাকরি পেয়ে! এক বছর পার হয়ে গেল এখনও সেই নার্সারিতেই ঘষটে যাচ্ছে! বড়দের সেকশানে নিয়ে যাওয়ার নাম গন্ধও করছে না সুনীতা আন্টি। মাঝখান থেকে লোভে লোভে কুঁড়েমি করে এবারও বি এড-এর ফর্ম আনা হল না। ডব্লিউ বি সি এসে বসল, অঙ্ক পেপারে গাব্বু। এক সরল করতেই দেড় ঘণ্টা জলে চলে গেল। নাহ্, এবার থেকে দুপুরে আর ঘুম নয়, পাটিগণিত প্র্যাকটিস্ করতে হবে।

ঝিনুক ডিভানে আধশোওয়া হল। নিজের ব্যথার কাহিনী নীলাঞ্জনাকে শুনিয়ে লাভ নেই। এখন তাদের সকলেরই নিজস্ব জীবন শুরু করার সময়। চাকরি-বাকরি ঘরসংসার ভূত ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার সময়। এই সময়ে কলেজ ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া বন্ধুর থেকে পিছিয়ে পড়তে ভাল লাগে কারুর! প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নীলাঞ্জনার চোরা ঈর্ষায় খুশির প্রলেপ দিতে চাইল ঝিনুক,— হ্যাঁরে নীলু, তোর বিয়ের আরেকটা কথাবার্তা চলছিল না? কদুর?

বিয়ের কথা উঠলেই নীলাঞ্জনার মুখ চোখ আলোকিত হয়ে ওঠে, হাসতে হাসতে বলল,— ছেলে আসছে বোস্টন থেকে। গত রোববার মা আর দিদিটা এসেছিল, সঙ্গে একটা মাসতুতো না পিসতুতো ভাই।

—ইন্টারভিউ নিল? আগেরটার মতো হাতের লেখা দেখতে চেয়েছে?

—উহুঁ। ছবি দেখে নাকি ছেলের খুব একটা অপছন্দ হয়নি। জাস্ট টুকটাক কয়েকটা খেজুরে প্রশ্ন করছিল। আমার রিসার্চ করার ইচ্ছে আছে কিনা। কি কি রাঁধতে পারি। ড্রাইভিং জানি, কি জানি না। ঘরদোর সাজানো সম্পর্কে কিরকম আইডিয়া। ও দেশে তো কাজের লোকের খুব প্রবলেম, এবার এসে পাঁচ সাতটা দেখে, চুজ করে, একেবারে বিয়ে করে ফিরবে।

ঝিনুক চোখ ঘোরাল,— তুই কিন্তু এবার ছাড়বি না। কড়া ইন্টারভিউ নিবি বোস্টনের। সোজা জিজ্ঞেস করবি, ঘরদোর ঝাড়াঝুড়ি করতে পারে কিনা, ভাতের ফ্যান্ কিভাবে গালবে, বাচ্চার ন্যাপি কিভাবে পাল্টাতে হয়…

শুভাশিস জানলার ধারে গিয়ে গ্লাসের জলে হাত ধুচ্ছিল, চেঁচিয়ে বলল,— হ্যাঁ হ্যাঁ আগে থেকে খবর দিস্, কোয়েশ্চেনিয়ার তৈরি করে দেব।

—সুলগ্না হেসে গড়িয়ে পড়ল,— দৃশ্যটা একবার ভাব্। বোস্টন মেয়েদের মতো হাঁটু মুড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে আর নীলু অদৃশ্য গোঁফ পাকিয়ে ঝাঁক ঝাঁক প্রশ্ন ছুঁড়ছে, হ্যাঁ তারপর বলো তো তোমার গায়ের রঙ কি সত্যিই এরকম লাল? না আমেরিকান ক্রিম মেখে…তুলো আর স্পিরিট দিয়ে ঘসে দেখব নাকি?

ঘরে নতুন করে হাসির বাতাবরণ। ঝিনুকের মোটেই হাসি পাচ্ছিল না। মেয়েরা এখনও ওভাবে বসলে যখন হাসি পায় না, ছেলেদের বেলায় হাসি আসবে কেন?

মৈনাক বলল,— সে তোমরা যতই ঠাট্টা করো, মার্কেট এখন এন আর আই-দের। হ্যাঁরে, বোস্টন গ্রিন কার্ড পেয়েছে?

গর্বিত মোরগের মতো ঘাড় নাড়ল নীলাঞ্জনা,— নিশ্চয়ই পেয়েছে। এতদিন ধরে যখন আছে। ওর মা তো কাঁদ-কাঁদ গলায় বলছিল ছেলে বোধহয় আর ফিরবে না!

—বুদ্ধিমান হলে তাই করা উচিত। কিসের ভরসায় ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা এ দেশে পড়ে থাকবে? অ্যাই শ্রবণা, তোর ভাই-এর প্ল্যান কিরে? ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পর জি আর ই দেবে তো?

—কে জানে! ঝিনুক ঠোঁটি ওল্টালো,— সবে তো থার্ড ইয়ারে উঠছে, এখনই কি কিছু বলা যায় নাকি?

—না নাহ, লাইফের প্ল্যানিংটা অনেক আগে থেকে সেরে ফেলা উচিত। শুভাশিস ভীষণ সিরিয়াস,— তোর ভাইকে তো দেখেছি, এত ব্রাইট ছেলে! ওরকম ব্রিলিয়ান্ট ছেলের এখনই যদি ক্লিয়ার অ্যাম্বিশান না থাকে…

ছোটন কি সত্যিই খুব ব্রিলিয়ান্ট! মেধা কাকে বলে! ঝিনুকের চোখের সামনে আচমকা একটা পুরনো দৃশ্য ভেসে উঠল। এক পাশ থেকে মা নলেন গুড়ে সন্দেশ আর ছানার পায়েস খাওয়াচ্ছে ছোটনকে, অন্য পাশ থেকে গুনগুন করে সাইন-থিটা কস্-থিটা আউড়ে যাচ্ছে মহার্ঘ টিউটর। বাবা মা দু’জনেই তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করছে প্রতিটি শব্দ আর খাবারের শা একসঙ্গে ছেলের শরীরে ঢুকছে কিনা। ওয়ান থেকে এক কাঁড়ি খরচা করে মাস্টার রেখে দক্ষিণ শহরতলির নামী বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে ছোটনকে, তবু প্রতি মুহূর্তে ভয় ছোটন বোধহয় অঙ্কে একটু কাঁচা রয়ে গেছে এখনও! সেই ছোটন মাধ্যমিকে স্টার পাবে, উচ্চ মাধ্যমিকে এইট্টি পারসেন্ট্, খগপুর আই আই টি-তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ, এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে! বাহবাটা কার প্রাপ্য? সাফল্যটা কার? ছোটনের? না ছোটনের পাওয়া সুযোগের? না সুযোগ পাওয়ার ক্ষমতার?

ধস্, এ সব ভাবলেই মনটা এমন খারাপ হয়ে যায়! ঝিনুক দু’দিকে মাথা ঝাঁকাল। তূণীরটাও বোধহয় আজ আর এল না। আসবেই না যখন, কথা দেওয়ার কি দরকার ছিল? থাকুক ফেভিকলের মতো বসের সঙ্গে সেঁটে। যতক্ষণ খুশি।

ঝিনুক বিশাখাদের বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে একটু জল ছিটোল। গরমে গা হাত পা চিটপিট করছে। বাড়ি ফিরে আবার একবার স্নান করতে হবে। যমগোদা ব্যাগটা থেকে চিরুনি বার করে চুলের সামনেটা অল্প আঁচড়াল। সে কখনও খুব একটা বেশি সাজে না। তার কমনীয় মুখে চিকন ত্বকে এমনিই একটা আলগা লাবণ্য আছে। ধনুকের মতো ভুরুর নিচে তার চোখ দুটো অসম্ভব গভীর। কালো। সেই গাঢ় চোখের কোণে সরু করে কাজল, কপালে ছোট্ট টিপ, হালকা একটু লিপস্টিক, ব্যাস। এতেই তাকে বড় স্নিগ্ধ দেখায়।

ফ্লেয়ারকাট গুজরাটি কামিজের ওপর স্বচ্ছ ওড়না সুন্দর করে সাজিয়ে বাথরুম থেকে বেরোল ঝিনুক। বেরোতেই বিশাখার মা।

—হাঁরে শ্রবণা, তোর শুনলাম খুব শিগ্গিরই বিয়ে?

ঝিনুক লজ্জা পেল,— না মাসিমা, মানে এখনও ডেট কিছু ফাইনাল হয়নি। হয়ত…

—অনিন্দিতা মা হতে চলল, তোর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, নীলাঞ্জনারও এবার হয়ে যাবে। আর তোদের বন্ধু? তার কোন হুঁশ আছে?

ঝিনুক বুঝতে পারছিল বিশাখার মা কথাটা কোন্ দিকে নিয়ে যেতে চায়। মৈনাক এখনও চাকরি পায়নি, মৈনাকের ওপর তেমন আস্থাও নেই বিশাখার মা’র। এই নিয়ে মাঝে মাঝে অনুযোগও শুনতে হয় তাদের।

ঝিনুক পাশ কাটাতে চাইল,— এই তো বিশাখা চাকরি পেয়ে গেল, এবার….

—থাম্ তো, ওর চাকরি পাওয়ার জন্য কি বিয়ে আটকে আছে নাকি? কত ভাল ভাল সম্বন্ধ আসছে জানিস? বিশাখার মা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল,— তোরা তো বন্ধু, তোরা একটু বুঝিয়ে বল না, ওই ট্যাঙটেঙে ছেলেটার কথা না ভেবে যেন একটু আমাদের কথা শোনে।

বিশাখা মৈনাকের বিষয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ঝিনুক জানে। তা ছাড়া ওদের ব্যক্তিগত সমস্যায় ঝিনুক নাক গলাবেই বা কেন। কোন রকমে ভদ্রমহিলাকে কাটিয়ে ড্রয়িংরুমে ফিরল ঝিনুক।

সুলগ্না ঝিনুককে জিজ্ঞাসা করল,— কিরে, বেরোবি তো? নাকি তূণীরের জন্য আরেকটু ওয়েট করবি?

ঝিনুক ব্যাগ থেকে আরেকটা বাবল্গাম বার করে মুখে পুরল। আট’টা দশ। এবার ধরে নেওয়াই যায় তূণীর আর আসছে না। ধ্যাৎ, এর চেয়ে আজ বিকেলে ঠাম্মার কাছে গেলেই ভাল হত। আজ নিয়ে পর পর দুটো বুধবার ওল্ডহোমে যাওয়া হল না।

ঝিনুক বলল,— চল্ বেরিয়েই পড়ি।

—দাঁড়া দাঁড়া, আরেকটু দেখে যা। তূণীর এখন শিওর অফিসের চেয়ার থেকে উঠে পড়েছে। শুভাশিস চোখ বন্ধ করে যেন অনেক দূরের ছবি দেখতে পাচ্ছে এমন ভাব ফোটাল মুখে,— এই, এইমাত্র টয়লেট থেকে নাক ঝেড়ে এল… এবার ওদের রিসেপশনিস্টের পেছনে রাখা গণপতি বাপ্পার মূর্তির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। … এই এখন সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল সিদ্ধিদাতাকে। এবার পকেট থেকে চাবির গোছা বার করে একের পর এক ঘরে তালা লাগাচ্ছে….

নীলাঞ্জনা খিলখিল করে হেসে উঠল,— যাহ, তূণীরদের অফিসে মোটেই গণপতি বাপ্পার মূর্তি থাকে না। ওটা বিলিতি অফিস।

ভিতরের চাপা রাগটাকে কয়েক সেকেন্ড কচকচ করে চিবিয়ে নিল ঝিনুক,— তোদের তো বলেই ছিলাম তূণীর ভীষণ অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে।

—খুব চটেছিস মনে হচ্ছে?

—চটতে আমার বয়ে গেছে।

—রাগছিস কেন? সুলগ্না ঝিনুকের কাঁধে হাত রাখল,— এটাই তো কেরিয়ার তৈরির সময়। অনিন্দিতা বলে শুনিস না, ওর বর চেম্বার নার্সিংহোম হাসপাতাল সেরে সাড়ে দশটা-এগারোটার আগে কোন দিনই ফেরে না? হাত পা ছড়িয়ে সুখ করে থাকতে গেলে খাটতে হবে না?

ঝিনুকের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হল, কার সুখ? যাকে ভোর রাত্তিরে কাজে বেরিয়ে গভীর রাতে ঘরে ফিরতে হয়, তার জন্য ‘হাত পা ছড়িয়ে থাকা’ কথাটা কি নিষ্ঠুর ঠাট্টা নয়! সুখের সংজ্ঞাটাই বা কী? যার জীবনে কাঠবিড়ালির ঘাসের নিচে বাদাম লুকনোর মনোরম দৃশ্য দেখার অবসর নেই সে কিসের সুখী! যে মানুষ দুপুরে গঙ্গার বুকে কোনদিন কোটি তারার ঝলকানি দেখার অবকাশ পায় না, তার কোথায় সুখ! উর্ধ্বশ্বাসে ছোটাতেই? এই যে তার বাবা, শ্রীযুক্ত মানস সরকার, নিরীহ নিপাট এক ভালমানুষ ভদ্রলোক, কলেজ টিউশনি কোচিং ক্লাস নোটবই লেখা পাবলিশার এত কিছুর গোলকধাঁধাঁয় অবিশ্রান্ত ঘুরপাক খেয়ে চলেছে, সেই মানুষটা কি খুব সুখী? দিনরাত এভাবে রোজগারের ধান্দায় ঘুরতে বাবারও কি ভাল লাগে? ঝিনুকের বুকের গভীরে একটা উষ্ণ বাতাস বয়ে গেল। ভাল লাগে না। নিশ্চয়ই বাবারও ভাল লাগে না। উপায়ই বা কি? যেভাবে দিন দিন সংসারের চাহিদা বেড়ে চলেছে! ঝিনুকের নিজস্ব ওয়ার্ডরোবের শখ, ওয়ার্ডরোব এল। মার কালার টিভি চাই, বিশেষ মডেলের কালার টিভি এল। ছোটনের বায়না ভি সি পি, তাও এল। এর সঙ্গে ফ্ল্যাট কেনার দেনা মেটানো আছে, ছোটন আই আই টি-তে পড়ছে, তার একটা বড় খরচা আছে। এ ছাড়া মাকে লুকিয়ে কাকার সংসারে দু’-পাঁচশো টাকা সাহায্য করাও আছে। তাও ভাগ্যিস ঠাম্মা ওল্ডহোমে থাকার কোন খরচ ছেলেদের কাছ থেকে নেয় না!

তূণীরও কি কালে কালে ওইরকম কেজো লোক হয়ে যাবে?

মৈনাক শুভাশিসের নড়বার কোন লক্ষণ নেই। নীলাঞ্জনারও বাড়ি কাছে, সে আরেকটু গল্প-সল্প চালাবে। ঝিনুক আর সুলগ্না উঠল।

রাস্তায় বেরোতেই একটা গরম হল্কা। বদ্ধ ঘরের চেয়েও বাইরে গুমোট আরও ঘন। বাতাস একেবারে থম মেরে আছে। বৈশাখ শেষের আকাশে বারুদের গন্ধ।

সুলগ্না ঝিনুককে টানল,— ঝড় আসছে। চল্ তাড়াতাড়ি মেট্রোতে চলে যাই।

ঝিনুক দ্বিধায় পড়ল, —বাসে গেলে ভাল হত রে। একদম টানা বাড়ি অব্দি….

—ওই বাসে তুই উঠবি এখন? বাস তো এখন ফার্নেস! চল্ চল, আমি রবীন্দ্র সরোবরে নেমে যাব, তুই টালিগঞ্জ থেকে রিক্শা ধরে নিস্।

ঝিনুক আবার আকাশ দেখল। কালবৈশাখী আসছে। আসছেই।

.

দুই

নিউমার্কেটে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল রমিতা। পলাশ কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল, রমিতা পাশে নেই দেখে ঘুরে তাকিয়েছে। রমিতা হাত নেড়ে ডাকল পলাশকে,— এই দেখে যাও, জিনসের এই স্কার্টটা কী দারুণ!

সন্ধ্যার সাজে নিউমার্কেট এখন বর্ণাঢ্য আরও। সার সার চমকদার আলোয় চোখ টানছে রকমারি লোভনীয় পশরা। অসংখ্য আলোর সঙ্গে মানুষের নিশ্বাস মিশে বৈশাখী উত্তাপ গাঢ় থেকে গাঢ়তর।

পলাশ রমিতার পাশে এসে সিগারেট ধরাল। শোকেসের গায়ে ক্লিপ দিয়ে টান টান ফ্যাকাশে নীল জিন্সের স্কার্ট এমন ভাবে টাঙানো যেন এক অদৃশ্য নারীদেহ পরে আছে পোশাকটা।

রমিতা উচ্ছাসে ঝলমল করে উঠল,—কী এক্সকুইজিট! তাই না!

পলাশ অবশ্য স্কার্টটাতে বিশেষ কোন সৌন্দর্য খুঁজে পেল না, সিগারেটে টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,— স্পেশালিটিটা কী?

—কাটটা কী অসাধারণ। উফ্, এই শেডের জিনস আমার এত ভাল লাগে!

পলাশ মুখে আগ্রহের ভঙ্গি ফোটাল, তবে ভঙ্গিটা যে কৃত্রিম, সেটা নজর এড়াল না রমিতার। রমিতা একটু মুখ ফুলিয়ে শোকেসের সামনে থেকে সরে এল।

পলাশ নীচু গলায় বলল,— কিনবে ওটা?

—থাক্, অত সুন্দর জিনিসটা অ্যাপ্রিসিয়েট করতে পারলে না। ইঞ্জিনিয়ারিং-ই পাশ করেছ, কোন রুচি গড়ে ওঠেনি।

রাগলে রমিতার নাকের পাটা ফুলে যায়, রক্তের আভা ছড়িয়ে পড়ে মুখে। সেদিকে তাকিয়ে পলাশ হেসে ফেলল,— আহা রেগে যাচ্ছো কেন? কিনেই ফ্যালো না।

রমিতা আরেকবার পিছন ফিরে তাকাল। স্কার্টটা ভীষণভাবে টানছে তাকে। দুর্বল হয়েও নিজেকে সামলে নিল,— না থাক্, তোমার মা আবার কী ভাববে!

—মা যেন তোমার স্কার্ট পরা ছবি দেখেনি! মানালির অর্ধেক ছবিতেই তো তুমি স্কার্ট নয় প্যান্ট পরা, মা কিছু বলেছে দেখে?

রমিতা প্রতিবাদ করতে পারল না। হানিমুনে রমিতার নানা রকম ড্রেস পরা ছবি দেখে পলাশের মা মুখ টিপে হেসেছে শুধু। এদিক দিয়ে ভদ্রমহিলা যথেষ্ট আধুনিক। পলাশের বাবাই যা একটু…।

রমিতার মাঝে মাঝে নিজেরই কেমন অবাক লাগে। এই যে পুরুষটা তার সঙ্গে হাঁটছে, এই আলোময় সুদৃশ্য বাজারের মাঝখান দিয়ে, একে তো সে চিনতও না ছ’ মাস আগে। পলাশের মা বাবা দাদা বৌদিদের সঙ্গে যে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, তার সম্ভাবনাও মনের কোণে উঁকি দেয়নি কখনও। কোথা থেকে কোথায় যে চলে যায় মেয়েদের জীবন! দু একটা ছোটখাটো যোগাযোগ, একটা সামাজিক অনুষ্ঠান, মাত্র কয়েক মাস একত্রে বাস করার অভ্যাস, তাতেই কত চিন্তাভাবনার বদল ঘটে যায়! পলাশের ভাল লাগা মন্দ লাগা, পলাশের পরিবারের প্রত্যেকের পছন্দ অপছন্দ অনিবার্য ভাবে প্রতি মুহূর্তে স্মরণে আসে আজকাল। এই কি বন্ধন!

নিউমার্কেটের বাইরে এসে রমিতা বুক ভরে শ্বাস টানল। বাজারের অসহ্য গুমোট থেকে মুক্তি। কিন্তু না, বাইরেও উত্তাপ কম নয়, বড় বিশ্রী ভ্যাপসা ভাব। বাতাসও সম্পূর্ণ স্থির। নিউমার্কেটের দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করেছে। দক্ষিণ গেটের সামনে দু তিনটে অল্পবয়সী ছেলে অবিরাম সাবানের বুদ্বুদ্ ভাসিয়ে যাচ্ছে শূন্যে। আলোর প্রতিফলনে জলবিম্ব ক্রমশ রঙিন। রঙিন গোলক ভাসছে। ভাসছে। ভাসতে ভাসতেই ফেটে যাচ্ছে পথচারীদের গায়ে ধাক্কা খেয়ে।

রমিতা মুগ্ধ চোখে ভাসন্ত বুদ্বুদ্ দেখছিল, পলাশ আচমকা ছুটেছে,— অ্যাই ট্যাক্সি, ট্যাক্সিইই….

কলকাতা শহরে প্রয়োজনের সময় ট্যাক্সি পাওয়া লটারি পাওয়ার শামিল। অন্ধকার নেমে গেলে তো কথাই নেই, ট্যাক্সি তখন চালকের মেজাজ নির্ভর।

উৎফুল্ল পলাশ ফাঁকা ট্যাক্সির জানলা দিয়ে মুখ গলাল।

ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞাসা করল,— কোন্ দিক?

—সাউথ। টালিগঞ্জ।

—আমি নর্থ। দার্শনিকের হাসি ট্যাক্সি চালকের ঠোঁটে। হাসতে হাসতেই অ্যাক্সিলেটারে চাপ দিয়েছে। হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও পলাশ কোন রকমে ঝুঁকে টাল সামলালো।

পর পর কয়েকটা ট্যাক্সির সঙ্গে গন্তব্য নিয়ে লুকোচুরি খেলায় শেষ পর্যন্ত হেরে গেল পলাশ। অসহায় ক্ষোভে ডান হাতের মুঠো ঠুকছে বাঁ হাতের চেটোয়। বিড়বিড় করে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে চলেছে শহরের তাবৎ ট্যাক্সিওয়ালাদের। টকটকে ফর্সা রঙ, একটু মেয়েলি মুখ, পলাশকে এসব সময়ে এমন ছেলেমানুষ লাগে! রমিতা হেসে ফেলল,— ছাড়ো তো, এসপ্ল্যানেডে গিয়ে মেট্রো ধরি চলো।

পলাশ নিমপাতা খাওয়া মুখে বলল,— তোমার উচিত ছিল আজ বাড়ির গাড়িটা আনা।

—ওই গাড়ি! রমিতা চোখ টিপল,— আচ্ছা, ওই থুরথুরে মরিস মাইনরটা বেচে একটা বাইসাইকেল কিনে নেওয়া যায় না? তুমিও চালিয়ে অফিস যেতে পারো।

—ফাজলামি হচ্ছে! গাড়িটার সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু জানো? দাদুর প্রাণ ছিল ওই গাড়ি। সেকেন্ড ওয়াইফ। জ্যাঠারা বেচে দিতে চেয়েছিল, বাবা সম্পত্তি ভাগের সময় যেচে ওটা নিয়েছে। গাঁক গাঁক করে তেল খায়, তাও। পলাশও খেপাল, রমিতাকে,— দাঁড়াও বাবাকে আজ গিয়ে বলছি, তুমি তোমার দিদিশাশুড়িকে নিয়ে ঠাট্টা করছ।

—না না বোলো না প্লিজ।

—বলেও অবশ্য লাভ নেই। বাবা তোমাকে কিস্যু বলবে না।

—কেন? নতুন বউ বলে?

—উঁহু, সুন্দরী বউ বলে।

কান্টাষ্ট্র পাড় সবুজ সাউথ ইন্ডিয়ান শাড়িতে স্তুতিটা আলতো করে মেখে নিল রমিতা। লিন্ডসে্ স্ট্রিট ধরে হাঁটছে দু’জনে। হঠাৎ একটা মারুতি সামনে এসে পড়ায় পলাশ জোরে টেনেছে রমিতার হাত, এত জোরে যে পলা আর মুনস্টোন পরা রমিতার আঙুল টনটন করে উঠল।

রমিতা হাত ছাড়িয়ে কয়েক বার মুঠো বন্ধ করল, খুলল,— উফ, তোমাদের, লিওদের হাত এমন চাষাড়ে হয়!

পলাশ হো হো করে হেসে উঠল,— আর তোমাদের, জেমিনিদের হাত বড় বেশি ডেলিকেট্।

রমিতা জিভ কাটল,— এম্মা একদম মনে নেই, শ্ৰীযোগী তোমাকে একটা গোমেদ ধারণ করাতে বলেছিলেন। দু রতির।

—মাকে বলেছ? মার একটা ভাল দোকান চেনা আছে। ঠকায় না।

—একদম ভুলে গেছি। এই, তোমার মা’র কী রাশি গো?

—বোধহয় টরাস।

—আমার মনে হয় লিব্রা। তোমার বাবার টরাস হলেও হতে পারে। টরাসরা একটু কন্জারভেটিভ্ হয়।

—কেন? আমার বাবার মধ্যে সেকেলেপনার কি দেখলে!

—সেদিন তোমার মাসতুতো বোনের বিয়েতে লাহেঙ্গা চোলি পরে গিয়েছিলাম, তাই নিয়ে মা’র কাছে বাবা গজগজ করছিলেন, আমি নিজের কানে শুনেছি। মা যত বলেন এটাই ফ্যাশান, বাবা কিছুতেই বুঝতে চান না। খালি বলছেন কাসুন্দের চৌধুরী বাড়ির একটা ইজ্জৎ নেই! বনেদী বাড়ির বউ ওরকম একটা পিঠখোলা পোশাক পরে বিয়েবাড়ি যাবে!

—বাবা ওইরকমই। একটু খুঁতখুঁতে। কাসুন্দে ছেড়ে গলফ্ ক্লাবে এসেও সাবেকি মেজাজ যায়নি। আফটার অল আগের জেনারেশান তো।

—তুমিই বলো ড্রেসটা কি খারাপ ছিল?

—খারাপ নয়। ডেয়ারিং। পলাশ মুখে চোখে বিচিত্র মুদ্রা করল, —এনি বডি কুড হ্যাভ ফলেন ফর ইউ।

রমিতা আলগোছে ধাক্কা দিল পলাশকে। এখন খুব কথা ফুটেছে পলাশের। মানালিতে হানিমুনে গিয়েও এত লাজুক ছিল প্রথম প্রথম। সন্ধ্যাবেলা উচ্ছল বিপাশার ধারে, হোটেলের বারান্দায়, দীর্ঘ সময় স্থির বসে থাকত তার পাশে। রমিতাকেই কত বার গায়ে পড়ে পলাশের ধ্যান ভাঙাতে হয়েছে, হ্যাঁ গো মশাই, তুমি নাকি ইংলিশ মিডিয়াম কো-এড স্কুলে পড়েছিলে!

—পড়েছি তো।

—তারপর নাকি চার বছর ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেলে ছিলে!

—ছিলাম। সো?

—ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেলেই থাকতে তো! নাকি কোন মনেস্ট্রিতে।

পলাশ ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকত রমিতার মুখের দিকে। অনেকক্ষণ এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে এক সময় চোখ নামিয়ে নিত। রমিতার হাত ছুঁয়ে বলত,— আমাকে কি তোমার মংক্ মনে হয়?

—তাহলে সারাক্ষণ এত চুপচাপ কেন?

—সুন্দরের সামনে চুপ করে থাকাই তো নিয়ম।

—কোন্টা সুন্দর? বিপাশা? বরফমাখা পাহাড়? পাইন বন? জলের শব্দ?

—তুমি।

কী আশ্চর্য নরম স্বরে শব্দটা উচ্চারণ করেছিল পলাশ। তুমি। যেন শব্দ নয় পাইন বনের ফাঁকে ফাঁকে মানালির মিহি বাতাসের স্পন্দন। এখনও শব্দটা রিন রিন করে অনুক্ষণ বাজে রমিতার বুকে। সে যে সুন্দর, অসাধারণ সুন্দর, এ কথা জন্ম থেকে কয়েক লক্ষ বার শুনেছে সে। তার ত্বক শঙ্খের মত মসৃণ, বাঁশপাতার মত পাতলা তার ঠোঁট, পল্লবিত আঁখি, দ্যুতিময় মুখমণ্ডল, কাশ্মীরি আপেলের মত গায়ের রঙ। নিজের সম্পর্কে এ সব বিশেষণ মুখস্থ আছে রমিতার। একটু বেশি রকমই আছে। তবু ওই ‘তুমি’ শব্দটা যেন অনেক অনেক বেশি মায়াময়। অদৃষ্টে গভীর বিশ্বাস রমিতার। সেই অদৃষ্টই বোধহয় পলাশকে নির্দ্দিষ্ট করে রেখেছিল রমিতার জন্য।

রমিতা একটা খাবার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল,— এই, ভেলপুরি খাবে?

—রাস্তায় দাঁড়িয়ে! হ্যাহ্। এখন চারদিকে খুব আন্ত্রিক হচ্ছে। কাগজে দেখছ না?

—যাদের হচ্ছে তাদের হচ্ছে। বাইরে খেলেই আন্ত্রিক হয় না। রমিতা গলা নামাল,— ওই দ্যাখো না সামনের মহিলাকে। এই খেয়েও কেমন স্বাস্থ্য রেখেছে!

পলাশ বিশালকায় মহিলাকে এক ঝলক দেখে নিল। কী নিপুণ কায়দায় একটার পর একটা ফুচকা ঢুকে যাচ্ছে মহিলার মুখগহ্বরে! ফিসফিস করে বলল,— স্বাস্থ্য নয়, বলো বপু। সার্কাসের জলহস্তীকে ফুলকপি খেতে দেখেছ কখনও? অবিকল সেই হাঁ। ওই খেলে তোমারও ওরকম স্বাস্থ্য হবে।

—হবে হবে, আমার হবে। বলো নাগো দুটো ভেলপুরি। ভাল করে সস্ দিয়ে মেখে।

খেতে খেতে মুখ দিয়ে নানা রকম তৃপ্তির শব্দ করছিল রমিতা। পলাশ বলল,— বাবা যদি এখন দেখে, বাড়ির বউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে…..

—কিছুই হবে না। পাশে দাঁড়িয়ে আরেকটা দিতে বলবেন। বাবা খুব খেতে ভালবাসেন, আমি জানি।

—কই আর তেমন খেতে পারে আজকাল! ডাক্তার তো অর্ধেক খাওয়াই মেরে দিয়েছে। নুন বন্ধ। মিষ্টি বন্ধ। পলাশের কপালে ভাঁজ পড়ল,— বাবাকে নিয়ে বড় চিন্তা হয়, জানো। একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে….। এবারও ইয়ার এন্ডিং-এ খুব স্ট্রেইন গেল। বিজনেস নিয়ে যা টেন্শান সারাক্ষণ। ফ্রেশ ও ডি-র জন্য ছুটোছুটি করতে হচ্ছে।

হাওড়াতে পলাশদের পুরনো আমলের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তৈরির ব্যবসা। এত দিন স্কুল কলেজে ওই যন্ত্রপাতির চাহিদা ছিল, ইদানীং সে চাহিদায় ভাঁটার টান। কারখানার নিজের অংশটাকে তাই আধুনিক করে গড়ে তুলতে চাইছে পলাশের বাবা। সুবিধা হচ্ছে না। ব্যাংক এখন সহজে লোন দিতে চায় না। এক হর্ষদ মেহেতাই যা টলমলে অবস্থা করে দিয়েছে ব্যাংকগুলোর!

রমিতা বলল,— বাবাকে ক’দিন নার্সিংহোমে রেখে একটা থরো চেকআপ্ করিয়ে নিলে হয় না?

—দাদাও সে কথা বলছিল। আমি ভাবছি আগে একটা ভাল কার্ডিওলজিস্ট দেখিয়ে নিই। সিন্হদা ডক্টর সুমিত কেশানের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেও দিয়েছেন। শুক্রবার সঙ্গে সাতটায়।

—আশ্চর্য! শুক্রবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলে! ও দিন না তোমার আমার সঙ্গে মা-বাবার ওখানে যাওয়ার কথা!

—ও নো। পলাশ চোখ বুজে দুদিকে মাথা দোলালো,— একদম খেয়াল ছিল না। তোমাদের বাড়ি পরের দিন গেলে হয় না? রাত্রে নয় থেকে আসব।

রমিতা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। পই পই করে পলাশকে ওই দিনটার কথা বলে রেখেছে, তবু পলাশ কি করে ভুলে গেল! সেদিন ও বাড়িতে মেজ মাসি আসবে, বিয়ের সময় জব্বলপুর থেকে আসতে পারেনি, শুক্রবার সারা দিন থাকবে ওখানে। বার বার করে রমিতা-পলাশকে ওই দিন জোড়ে আসতে বলে দিয়েছে বাবা মা। পলাশের কী দরকার ছিল বাবার দায়িত্ব নিজের ঘাড়েই নেওয়ার! পলাশের দাদা দশটা-পাঁচটা বাবার ফ্যাক্টরিতে বসেই খালাস, বৌদি বাড়ির কুটো নেড়ে দুটো করে না, তারা এ দায়িত্ব নিতে পারত না! রমিতার ভীষণ ইচ্ছে সেদিন মাসতুতো বোন মহাশ্বেতার সঙ্গে প্রাণ খুলে আড্ডা মারার, গল্প করার, খুনসুটি করার। কত দিন পর যে দেখা হবে! দেড় বছর? না দু বছর? শুধু বিয়ের পর থেকেই কত কথা যে জমে গেছে রমিতার! পলাশকে না নিয়ে সেদিন কি করে যাবে বারাসতের বাড়িতে! রমিতার নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো কী বিশ্রী ভাবেই না জড়িয়ে গেছে এই সদ্য-পরিচিত যুবকের সঙ্গে! এদের পরিবারের সঙ্গে!

একটা লম্বা নিশ্বাস গড়িয়ে এল রমিতার বুক থেকে। এও কি বন্ধন!

পলাশ নিজের মনে বলে উঠল,— ক’দিন চেঞ্জে গেলে বাবা বোধহয় একটু ফ্রেশ হতে পারে। যদি গুরুদেবের ওখান থেকেও ক’দিন ঘুরে আসে….

রমিতা নিস্পৃহ মুখে শুনল কথাটা, কিছু বলল না।

এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনে ক্লোজ সার্কিট টিভি’র সামনে থোকা থোকা জটলা। ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটের ভারত বনাম সাউথ আফ্রিকার ভিডিও টেপ চলছে। পলাশ টিকিট কেটে কয়েক সেকেন্ডের জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, রমিতা পলাশের হাত ধরে টানল,— একদম নয়। আমি যখন সঙ্গে থাকব, তখন শুধু আমি আর কিছু না।

অফিসযাত্রীদের ভিড় কমে গেছে। তবু বেশ কিছু লোক খানিক পর পর লাইন করে দাঁড়িয়ে। পাতালযানের অপেক্ষায়। রমিতা ট্রেনে উঠে বসার সিটও গেয়ে গেল। এক বৃদ্ধ মানুষ বসতে গিয়েও রমিতাকে দেখে সসম্রমে জায়গা ছেড়ে দিল। এ সব ব্যাপারেও রমিতা খুব একটা আশ্চর্য হয় না। সুন্দরী মেয়েদের এটুকু সুবিধা প্রাপ্য। রমিতা জানে।

পলাশ মাথার ওপরের রড় ধরে রমিতার দিকে ঝুঁকল,— তোমার দিদি আমাদের চিঠির উত্তর দিল না তো!

—দেবে। ওরা যা ব্যস্ত থাকে। এ তো আর আমাদের দেশের গভর্নমেন্টের চাকরি নয়।

—ঠিকই তো। ওদেশে সবাইকেই খেটে খেতে হয়। পলাশ ব্যঙ্গটা ফিরিয়ে দিল,—চলো না, আমরাও কানাডায় চলে যাই। তোমার জামাইবাবুকে একটা জব ভাউচার পাঠাতে বলো।

রমিতার বুকে সূক্ষ্ম কাঁটা ফুটল। তার থেকে কম সুন্দরী হয়েও কেমন এন আর আই পাত্র জুটে গেছে দিদির। পলাশরা যতই বনেদী হোক, দিদির শ্বশুর বাড়ির তুলনায় কোথায় যেন খামতি আছে এদের। পলাশও কি আর মিহিরদার মতো অত উঁচুতে উঠতে পারবে! সরকারি অফিসের ইঞ্জিনিয়াররা কতই বা আর ওপরে ওঠে! মিহিরদাদের তিন তিনটে মহাদেশ জোড়া কম্পানি, কানাডাতেই বছরে আট মাসের বেশি থাকতে পারে না মিহিরদা। অথচ সেও তো পলাশের মতোই এ দেশ থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার। রূপ বেশি থেকেও রমিতা যেন বিয়ের বাজারে সামান্য ঠকে গেছে। আচমকা রুক্ষ হল রমিতা— ইচ্ছে থাকলে নিজেই চেষ্টা করো। অন্যকে বলব কেন?

রমিতার আকস্মিক ঝাঁঝে পলাশ থতমত।

আলো আঁধারের আবছায়া বেয়ে প্রচণ্ড গতিতে সুড়ঙ্গ পথ ধরে ছুটছে ট্রেন। যান্ত্রিক কণ্ঠ পার করে দিচ্ছে একের পর এক স্টেশন। পার্ক স্ট্রিট, ময়দান, রবীন্দ্রসদন …। ভবানীপুর থেকে টানা কামরাগুলোতে ভিড় অল্প বেড়েছে। রমিতার পাশের সিট খালি হতে পলাশ সেখানে বসল,— কি হল, চুপ মেরে গেলে কেন? রাগ হয়েছে?

রমিতা পলাশের অপ্রস্তুত মুখ দেখে হেসে ফেলল,— মনে রাখবে শনিবার নয়, শুক্রবার।

—কী শুক্রবার! কী শনিবার!

—আমাদের বাড়ি শুক্রবার। তোমার বাবার ডাক্তার শনিবার। নইলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।

ভূগর্ভ ছেড়ে মর্ত্যে উঠছে পাতালযান। মাটিতে উঠতেই প্রচণ্ড ঝড়ের ঝাপটা অনুভব করল রমিতা। এসপ্ল্যানেডের গোমড়া আকাশ টালিগঞ্জে কালবৈশাখী হয়ে দাপাদাপি করছে। উন্মত্ত বৃষ্টির দাপটে চতুর্দিক ধোঁয়া ধোঁয়া। ঝাপসা।

বাইরের চাতালে বেশ ভিড় জমেছে। বৃষ্টির ফলা থেকে নিজেদের বাঁচাতে হুড়মুড়িয়ে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে লোকজন, ঠিক ততটাই ভিতরে, যেখান থেকে ছুটে গিয়ে প্রথম বাস বা রিকশায় উঠে পড়া যায়। বৃষ্টি থামলেই।

পলাশ ভিড় ঠেলে রমিতাকে নিয়ে সামনের দিকে এসে দাঁড়াল। খোলা আকাশের নিচে পাঁচ-সাতটা মোটরসাইকেল স্কুটার অনর্গল বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে। রাস্তার আলো বৃষ্টির ঝরোখার আড়ালে স্নান।

পলাশ পলকা রসিকতা জুড়ল,—টু হুইলারগুলোর যাতনা দ্যাখো। অবোধ মোষের মত ভিজছে। সাধে কি আর কিনতে চাই না! কিনলে ফোর হুইলার।

আকাশচেরা বিদ্যুতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভ্রূভঙ্গি করল রমিতা,— কথাই সার। দু মাস ধরে তো শুধু প্ল্যানই ভাঁজতে শুনছি।

—আজ্ঞে না। সিটি ব্যাংকে কথা বলে এসেছি। থার্টি পারসেন্ট ডাউন পেমেন্ট। বাকিটা পাঁচ বছরের মান্থলি ইনস্টলমেন্ট।

হঠাৎ একটা জোর ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল রমিতাকে। রমিতা নিজেকে আড়াল করার সময়ও পেল না। ঠিক তখনই পিঠের খোলা জায়গাতেও এক অচেনা হাতের স্পর্শ। চমকে তাকাতেই হাতের মালিকের চোখে চোখ। বছর কুড়ি একুশের এক রূপবান তরুণ। গলায় সোনার সরু চেন, গায়ে জমকালো ব্যাগি শার্ট, চোখমুখ ঠিক প্রকৃতিস্থ নয়।

ছেলেটা ঢুলুঢুলু চোখে হাসল। কুৎসিত অশ্লীল চাহনি। রমিতা পলাশের দিকে ঘেঁষে এল। আঁচল টেনে শরীরের অনাবৃত অংশগুলো ঢেকে নিল ভাল করে। পিঠ। কোমর। নাভিদেশ।

আবারও একটা নোংরা হাত স্পর্শ করছে শরীর। রমিতা আরও সরল পলাশের দিকে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিচ্ছে ছেলেটা একা নয়। আরও কয়েকজন আছে। সামনে। পিছনে। পাশে।

পিছন থেকে একজন বেশ জোরে চিমটি কাটল রমিতার নিতম্বে। রমিতা কুঁকড়ে গেল। পাশ থেকে দাড়িওয়ালা বেশ বড়সড় চেহারার এক যুবক কোন কারণ ছাড়াই মৃদু ধাক্কা দিল পলাশকে। পলাশ কিছু বুঝতে না পেরে ঘুরে তাকিয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা খেঁকিয়ে উঠল,— সোজা হয়ে দাঁড়ান। গায়ে পড়ছেন কেন?

—আমি কী করলাম! আপনিই তো আমায় ধাক্কা মারলেন।

—একদম ফালতু কথা বলবেন না। বলেই ছেঁলেটা আবার ধাক্কা দিল। এবার বেশ জোরে।

পাশ থেকে নীল জিনসের জ্যাকেট পরা একজন বলে উঠল,— হুই, সোজা হয়ে দাঁড়া।

—তুই তোকারি করছেন কেন? নিজেরা ইচ্ছে করে গায়ে পড়ছেন…

—অ্যাই, মুখ সামলে। কে তোর গায়ে পড়েছে?

—ইউ স্কাউড্রেল!

—খিস্তি দিচ্ছিস কাকে বে? ব্যাগি শার্ট হ্যাঁচকা টান মেরে রমিতাকে সরিয়ে দিল পলাশের পাশ থেকে,— মেয়েছেলে সঙ্গে থাকলে রোয়াব বেড়ে যায়, অ্যাঁ?

পলাশ রাগে ভাষা হারাল। রমিতা পলাশের হাত ধরে টানল,— সরে এসো তো। যত সব রাফিয়ানের দল।

একটা ছেলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল। পরিস্কার বোঝা যায় ছেলেগুলো রীতিমত পরিকল্পনা করে একটা অঘটন ঘটাতে চাইছে। হাসতে হাসতেই কালো টিশার্ট পরা ছেলেটা রমিতার থুতনি ধরল,— হোয়াট আ সুইট ভয়েস।

এবার পলাশ জ্ঞান হারাল। ঝাঁপিয়ে পড়ে কলার চেপেছে কালো টি শার্টের। উপস্থিত জনতার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত ভাবে চেঁচাচ্ছে,— দেখেছেন! দেখেছেন এদের কাণ্ডটা! আমাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে এখন আমার স্ত্রীর গায়ে পড়ছে!

—অ্যাই চোপ। দেব এক ঝাপড়। পেন্টু খুলে নাঙ্গা করে দেব।

জনতা নীরব।

পলাশ পাগলের মত চিৎকার করে উঠল,— কে ঝাপ্পড় মারবে? কোন্ শুয়োরের বাচ্চার সাহস আছে দেখি?

দাড়িওয়ালা বলশালী ছেলেটার ঠেলা খেয়ে পলাশ নিমেষে মুখ থুবড়ে পড়েছে খোলা চাতালে। ব্যাগি জামা আর কালো টি শার্ট দু দিক থেকে চেপে ধরল রমিতার হাত।

জনতার মুখে রা নেই। যেন রুদ্ধশ্বাস কোন ফিলমের শুটিং দেখছে সবাই।

পলাশ উঠে খেপা ষাঁড়ের মত ছুটে আসছিল। দাড়িওয়ালা মাঝপথে রুখে দিয়েছে তাকে। ধস্তাধস্তিতে ভিড় প্রায় ছত্রখান। হতচকিত ভিড়ের মানুষ যে যেদিকে পারে সরে সরে যাচ্ছে।

রমিতা আর্তনাদ করে উঠল,— কী অসভ্যতা আরম্ভ করেছেন! ছাড়ুন আমাকে। ছাড়ুন বলছি।

ব্যাগি শার্ট সুর করে গেয়ে উঠল, — আজ না ছোড়ুঙ্গা তুঝে দমদমাদম…

কালো টি শার্ট নাচের ভঙ্গিতে কোমর দিয়ে ধাক্কা মারল রমিতার কোমরে। তাদের কারুর মুখে এতটুকু ক্রোধের চিহ্নও নেই। হুবহু ফিল্মি নায়কদের ভাবভঙ্গি তাদের শরীরে, দিলমে হ্যাঁয় তুফান বড়া দমদমাদম…

—নাচ মেরি জান জরা দমদমাদম…

পলাশ প্রাণপণে বলশালী ছেলেটার হাত থেকে ছাড়াতে চাইছিল নিজেকে,— ইউ ডার্টি বাস্টার্ডস! আই উইল কিক ইত্তর…

দাড়িওয়ালা সশব্দে চড় কষাল তাকে,— কিপ কোয়ায়েট ইউ সান অফ আ বিচ।

রমিতা অসহায় ভাবে ভিড়ের মানুষের সাহায্য চাইল, — আপনারা কিছু করুন। প্লিজ কিছু করুন।

এতক্ষণে ভিড় থেকে গুঞ্জন উঠেছে। টুকরো টুকরো মন্তব্য ফুলঝুরির মত জ্বলে উঠেই নিবে যাচ্ছে।

—কি হচ্ছেটা কি! ছেড়ে দিন না দাদা।

—মেয়েছেলে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এত মাথা গরম করলে চলে?

—ওকে তো প্রোডোক করল মশাই।

—নিজেরা মারপিট করুন না। মেয়েছেলেটাকে টানছেন কেন?

—এদের দরকার ঝাড়। বুঝলেন? ঝাড়? হাত পায়ের আঙুলগুলো থেঁতলে দিলে…

শেষ কথা বলা মাঝবয়সী লোকটা হঠাৎই ককিয়ে উঠেছে নীল জিনসের লাথিতে। পলকে গুঞ্জন স্তব্ধ। জনতা আবার বোবা। শুধু বৃষ্টির হাহাকার ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই কোথাও। প্রতিপক্ষহীন মানুষের জঙ্গলে নির্ভীক বীরের দল এবার রমিতাকে নিয়ে উল্লাসে মেতেছে। ঝটকা টানে রমিতার আঁচল লুটিয়ে পড়ল। কালো টি শার্ট রমিতাকে দু হাতে জাপটে ধরে গেয়ে উঠল— চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়…

এক অদ্ভুত অসহায় ক্ষোভের সঙ্গে চূড়ান্ত অপমান মিশে রমিতার মস্তিষ্কের সমস্ত কোষ অচল হয়ে গেল। কি হচ্ছে, কি ঘটছে, কোন কিছুই বুঝবার ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে গেছে তার। দাড়িওয়ালা পলাশকে ঠেলে নিয়ে গেছে দেওয়ালের দিকে। পলাশেরও আর প্রতিরোধের শক্তি নেই।

ভিড়ের একেবারে পিছনে, অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল ঝিনুক। বৃষ্টি দেখে সে প্ল্যাটফর্ম থেকেই বেরোয়নি। গণ্ডগোল যখন চরমে, আচমকা ভিড় ঠেলে দৌড়ে এসেছে সে। নায়কদের কীর্তিকলাপ দেখে প্রথমটা তারও মস্তিষ্ক অচল। চোখের সামনে এ কোন্ দৃশ্য! এ কি বাস্তব! না কল্পনা!

মুহূর্তে কী যেন হয়ে গেল ঝিনুকের! কাঁধের ব্যাগ দুহাতে চেপে দৌড়ে এসেছে দৃশ্যের মাঝখানে।

—অ্যাই জানোয়ার, ছাড়, ছাড়, বলছি। চেহারাপত্র সব ভদ্রলোকের মত…।

নীল জিনসের জ্যাকেট কাছে এগোতেই হাতের ভারী ব্যাগ প্রচণ্ড শক্তিতে চালিয়েছে ঝিনুক। উদভ্রান্তের মতো এলোপাথাড়ি ব্যাগ ঘুরিয়ে যাচ্ছে। কালো টি শার্টকে পিছন থেকে জোর টান মারায় রমিতা মুক্ত হয়েছে অনেকটা। লুটনো আঁচল কোনওক্রমে গায়ে জড়াতে জড়াতে সে দেখল কালো টি শার্ট এগিয়ে যাচ্ছে তার রক্ষাকর্ত্রীর দিকে।

তীব্র ঘৃণায় ঝিনুক চেঁচিয়ে উঠল,— আপনারা এতগুলো লোক হাঁ করে দেখছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে! সকলের চোখের সামনে একটা মেয়েকে এভাবে…

কালো টি শার্ট হাত মুচড়ে ধরল ঝিনুকের। অন্য হাতের চেটোর উল্টো পিঠ দিয়ে আঘাত হেনেছে তার চোয়ালে। পরক্ষণে তাকে প্রায় ছুঁড়ে দিয়েছে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিচক্রযানগুলোর দিকে।

ঝিনুক উঠে ঠোঁট মুছতে মুছতে আবার দৌড়ে এল। ততক্ষণে ব্যাগি জামা আর কালো টিশার্ট রমিতাকে নামিয়ে নিয়েছে বৃষ্টিতে। ব্যাগি জামা একটা মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিচ্ছে। কালো টি শার্ট রমিতাকে টেনে হিচড়ে বসাতে চাইছে তার আর ব্যাগি জামার মাঝখানে। দাড়িওয়ালা পলাশকে ছেড়ে আরেকটা মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিতে ছুটল। জিনসের জ্যাকেট আরেকটায়। ঝিনুক ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণপণ শক্তিতে দু হাতে টানল রমিতাকে। টানাটানিতে রমিতা ঝিনুক দুজনেই গড়িয়ে পড়ল জলকাদায়।

অবশেষে জনতার চৈতন্য এসেছে। হয়তো বা ঝিনুককে দেখেই! ব্যাগি জামা আর কালো টি শার্টের দিকে রে রে করে তেড়ে গেল কয়েকজন। দু-চারজন পলাশের সঙ্গে দৌড়েছে অন্য দুটো মোটর সাইকেলের দিকে। বিকট গজন তুলে দুটো মোটর সাইকেল পলকে বেরিয়ে গেল। নীল জিনস তৃতীয় বাহনটাকে চালু করার জন্য দমাদ্দম লাথি মারছে। সিক্ত টু হুইলার গোঁয়ারের মত অনড়। আবার লাথি মারল। আবারও। বলশালী যুবক কিছুটা এগিয়েও ফিরে এসেছে বন্ধুকে উদ্ধার করতে। এলোমেলো মোটর সাইকেল ছুটিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে,— কাম অন সুমন। লিভ দ্যাট ব্লাডি জাংক।

নীল জিনসের জ্যাকেট উল্টোপাল্টা হাত চালিয়ে জনতার হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে গেল। মরিয়া লাফে উঠে পড়ল বলশালী যুবকের বাহনে। সেকেন্ডের মধ্যে দুজনে উধাও।

রমিতা কাদায় বসে ঠকঠক করে কাঁপছিল, পলাশ তাকে উঠিয়েছে। হাঁপাচ্ছে হাপরের মত,— নোংরা নোংরা। নোংরা ডাস্টবিন হয়ে গেছে শহরটা।

ঝিনুকের ওড়না বৃষ্টি জল কাদায় গড়াচ্ছিল। ওড়নাটা তুলে ঠোঁটের নিচে চাপল ঝিনুক। কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। কাঁধের ব্যাগ ছিঁড়ে পড়েছে পায়ের কাছে। শুধু বাবলগামটাই এখনও মুখে রয়ে গেছে তার। সেটাকে অশান্তভাবে চিবোতে চিবোতে সে গনগনে চোখে ভিড়ের দিকে তাকাল,— শহর নোংরা হয় না। শহরের মানুষরা নোংরা হয়। এতগুলো নপুংসক এক জায়গায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকলে… থুঃ থুঃ।

রমিতা পলাশকে ছেড়ে ঝিনুঞ্জে হাত জড়িয়ে ধরল। লোকজনের ভিড় ক্রমশ ঘিরে ফেলেছে তিনজনকে। অজস্র অস্ফুট ধ্বনি থেকে একটি শব্দও পৃথক করা যায় না। অবয়বহীন সেই ভিড়টাকে হিংস্র চোখে দেখছিল ঝিনুক,— চুপচাপ দাঁড়িয়ে অনেক তো মজা দেখলেন, এবার অন্তত থানায় চলুন। বলতে বলতে পলাশের দিকে ঘুরেছে,— ইমিডিয়েটলি ডায়েরি করা দরকার। বৃষ্টি থামলেই আমরা কিন্তু থানায় যাব।

পলাশ রোবটের মতো মাথা নাড়ল।

রমিতার বুকের ভিতর জমাট অপমান এতক্ষণে কান্না হয়ে ঝরে পড়তে চাইছে। পেট গুলিয়ে বমি এসে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলাতে গিয়ে ঝিনুককে আঁকড়ে ধরে ডুকরে উঠল রমিতা।

কালবৈশাখীর বৃষ্টি আসতে যতক্ষণ, মিলিয়ে যেতেও ততক্ষণ। বৃষ্টি থামতে চাতাল থেকে রাস্তায় এল তিনজন।

ঝিনুক বলল,—দাঁড়ান, মোটর সাইকেলটার নম্বর নিয়ে নিই।

পলাশ আর ঝিনুক পরিত্যক্ত যানটার দিকে এগিয়েছে। রমিতা ছেঁড়া ব্লাউজ ঢাকতে আষ্টেপৃষ্টে গায়ে জড়াল শাড়িটাকে। চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে ভিড়টাকে খুঁজল। ভিড়ের মানুষ যে যার মতো ছুটেছে আপন কোটরের দিকে।

তাদের সঙ্গে একটি লোকও নেই।

.

তিন

—আন্টি ফুল। মা তোমাকে দিতে বলেছে।

ফুটফুটে একরত্তি মেয়েটার ছোট্ট ছোট্ট হাতে গোলাপের তোড়া। তাকে ঘিরে এক ঝাঁক প্রজাপতি।

—আন্টি, তুমি বুঝি গুণ্ডাদের খুব মেরেছ?

—তুমি বুঝি ক্যারেটে জানো আন্টি? কুংফু?

—তোমার কাছে স্টেনগান ছিল না? এ কে ফিফটি সিক্স?

—ভিলেনদের গুলি করে মেরে দিতে হয়। ঢ্যা ঢ্যা ঢ্যা ঢ্যা ঢ্যা।

—কিচ্ছু ভেবো না আন্টি। বড় হলে পাজি লোকেদের আমি বটি বটি কেটে ফেলব।

খুশিতে ঝিনুকের চোখে জল এসে যাচ্ছিল প্রায়, কোন রকমে ধরা ধরা গলায় বলল,— থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ। এবার তোমরা যে যার জায়গায় গিয়ে বোসো।

তাজা সকালের নতুন রোদুর জানলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ক্লাসরুমে। নবীন আলোর উত্তাপে দীপ্ত চতুর্দিক। ঝিনুকের মধ্যেও নতুন করে উত্তাপ সঞ্চারিত হচ্ছিল। গত দুদিন ধরে এই উত্তাপে বার বার সম্পৃক্ত হয়েছে সে। এক সন্ধ্যার সাহসী প্রতিবাদ, থানার উত্তেজিত কিছু মুহূর্ত, পর দিন কাগজে কাগজে ছোট্ট খবর। বিক্রমশীলা মহাবিহারের তরুণী শিক্ষিকা শ্রবণা সরকার জীবন বিপন্ন করেও সম্মান রক্ষা করলেন রমিতা চৌধুরী নামের জনৈকা গৃহবধূর। সেই দুপুরেই বাড়িতে সংবাদপত্রের রিপোর্টার, গতকাল কাগজে কাগজে ছবি সহ তার বীরত্বের রোমহর্ষক বিব্রণ, সম্পাদকীয়তে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের অজস্র অভিনন্দন। পর পর এত সব দ্রুত ঘটে-যাওয়া ঘটনা ঝিনুককে এক আত্মতৃপ্তির ঘোরে ডুবিয়ে দিচ্ছে বার বার। শ্রবণা সরকার এখন রাতারাতি একটা নাম। একটা তারকা। একটা আদর্শ। এত খুশি যে কোথায় রাখে ঝিনুক!

অথচ এত কিছু যে হয়ে যাবে, ঝিনুক কি ভুলেও ভাবতে পেরেছিল! দিনটা তো ছিল অন্য যে কোন দিনের মতোই। নির্দিষ্ট একটা তারে বাঁধা। সকালে স্কুল। স্কুল থেকে ফেরা। দুপুরে একটু ঘুম। ছোটখাটো কাজ। বিকেল সন্ধেয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। ক্ষণিক বিষাদ। ক্ষণিক ভাললাগা। সবই তো অভ্যস্ত দিন-যাপনের ছকের ভিতর মাপে মাপে কাটা। চকিত কালবৈশাখীতে সেই ছক ওলোটপালোট।

আজকাল খবরের কাগজ খুললে প্রায়ই এ ধরনের খবর চোখে পড়ে। গৃহবধূ হত্যা। গণধর্ষণ। নারী নির্যাতন। শ্লীলতাহানি। তবে সে সব তো শুধু খবরই। সকালে চা খেতে খেতে লোকে এসব কাহিনী গপাগপ গেলে, ট্রেনে বাসে অফিসে বাড়িতে দুদিন আলোচনা করে উত্তেজনার আগুন পোহায়, তারপর স্বাভাবিক নিয়মে ভুলেও যায়। ওই খবর যে কখনও নিজের জীবনেও বাস্তব হয়ে উঠতে পারে, এ কথা কি কেউ কল্পনাও করে সে সময়! ঝিনুকও কি জানত ওরকম একটা ঘটনা তার চোখের সামনে ঘটবে! সেখানে সে দাঁড়িয়ে থাকবে! মুহূর্তের উত্তেজনায় ঘটনাটার শরিক পর্যন্ত হয়ে যাবে! শুধু শরিক নয়, এক নম্বর নায়িকাও। এত দিনে ঝিনুক বড় কিছু একটা করতে পেরেছে। নাম হয়েছে ঝিনুকের।

টিফিনে স্টাফরুমে বসেও গোলাপগুলোকে শুঁকছিল ঝিনুক। তেমন একটা গন্ধ নেই, বেশ শুকিয়ে এসেছে, তবু যেন প্রাণবন্ত।

দীপিকা বলল,— তোর ঠোঁটের কাছটা তো এখনও বেশ ফুলে আছে রে শ্রবণা! আর কোথাও চোট লেগেছে নাকি?

মাধুরী স্কুলে ঝিনুকের প্রিয়তম সখী। বয়সে ঝিনুকের থেকে কিছুটা বড় হলেও। ঝিনুকের আগে সে বলে উঠল,— তাও তো কাল-পরশু চেহারাটা দেখিসনি! গাল-টাল ফুলে যা অবস্থা ছিল! হ্যাঁরে, তোর হাতের ব্যথাটা কমেছে? এক্সরে করেছিলি?

ছোটখাটো স্টাফরুম। বড় একটা টেবিল ঘিরে গোটা কতক চেয়ার, দুটো স্টিলের আলমারি, লম্বাটে কাঠের র্যাক। মাথার ওপর পেল্লাই সাইজের ফ্যান। ধীরে ঘুরছে।

ঝিনুক কোণের চেয়ার ছেড়ে ফ্যানের ঠিক নিচে এসে বসল,— জোর চোট লেগেছিল গো। আরও দুদিন রেস্ট নিলে ভাল হত। মা বাবা তো বেরোতেই দিচ্ছিল না। নেহাত আজ গরমের ছুটি পড়ে যাচ্ছে, তাই জোর করে চলে এলাম।

রমা টেবিলের এক ধারে বসে বাচ্চাদের জন্য ছুটির লেসন প্ল্যান তৈরি করছিল। গীতালির মতো সেও এক সময় ঝিনুককে ছোট ক্লাসে পড়িয়েছে। মমতা-মাখা গলায় সে বলে উঠল,— ভগবান রক্ষা করেছেন। অতগুলো গুণ্ডার সঙ্গে একা লড়াই করা কি চাট্টিখানি কথা!

গীতালি জিজ্ঞাসা করল,— কি রকম দেখতে রে ছেলেগুলো! মুশকো মুশকো গুণ্ডা! হাতে আর্মস ছিল!

—সেরকম কিছু তো চোখে পড়েনি। তবে মনে হয় ড্রিঙ্ক করে ছিল। চোখগুলো ঢুলুঢুলু। লম্পট লম্পট। তবে ঠিক প্রফেশনাল গুণ্ডা-মস্তানদের মতো নয়। ঝিনুক চেয়ারে হেলান দিল,— এখন এক ধরনের ক্লাস তৈরি হয়েছে না, দামি দামি জামাকাপড় পরে, দেদার টাকা ওড়ায়, টকাটক ইংরিজি বলে, মোটর সাইকেল মারুতি নিয়ে ফুর্তি মেরে বেড়াচ্ছে… রাস্তাঘাটে এরকম ছেলে আজকাল প্রচুর দেখতে পাবেন।

মিতা টিফিন বাক্স খুলতে খুলতে ফুট কাটল,— তার মানে পয়সাওয়ালা বাড়ির ছেলে বলছিস্?

—পয়সাওয়ালা না হাতি। গীতালি মুখ বেঁকাল,— যত সব দু নম্বরি পয়সা। ঘুষের টাকা। ব্ল্যাক মার্কেট আর শেয়ার মার্কেটের টাকা।

রমা খাতার গোছা পাশে সরিয়ে রাখল,— বউটার ড্রেস কী রকম ছিল রে? সভ্য ভব্য, না প্রোভোকেটিং?

—শাড়ি ব্লাউজ। ঝিনুক হাত ওল্টালো,— ব্লাউজটার বুক পিঠ একটু বেশি কাটা ছিল ঠিকই, তা আমার তো তেমন বেখাপ্পা লাগেনি।

—তাই বল। এ কথা তো কাগজের লোকদের বলিসনি। লেখা এক টুকরো আপেল মুখে পুরল,— ঝড়বৃষ্টির রাত, ওরকম একটা ফাটাফাটি সুন্দরী, তার আবার ব্লাউজ লো কাট! মুনিঋষিদেরই মতিভ্রম হতে পারে…।

—এ তুমি কী বললে লেখাদি? দীপিকা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠেছে,— তাহলে তো সমুদ্রের ধারে বিকিনি পরা মেয়ে দেখলে সব পুরুষকেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। শিক্ষা সভ্যতার আর দরকার কী! জঙ্গলে থাকলেই হয়।

—পুরুষদের শিক্ষা সভ্যতার কথা আর বলিস না রে ভাই। লেখা গলা চড়াল। এক বছরও হয়নি লেখার ডিভোর্স হয়েছে। তার ছেচল্লিশ বছরের বর চোদ্দ বছর তাঁর সঙ্গে ঘর করেও এদিক ওদিক মেয়েদের সঙ্গে খুচরো প্রেম করে বেড়াত। তাই নিয়েই মারপিট, চেঁচামেচি, ঝগড়া। শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ। ছোট ছোট দুটো মেয়ে নিয়ে লেখা এখন একা। উঁচু গলায় সে বলল,— পুরুষমানুষ হল হামলাননা টাইপ। ওদের ঢিট করার জন্য শ্রবণাদের মতো মেয়েই দরকার।

লেখার থেকে মিতা আরও কট্টর পুরুষবিদ্বেষী। তার গায়ের রঙ মিশমিশে কালো, দেখতেও সে খুব সুশ্রী নয়, বহু বার পাত্রপক্ষের সামনে নাজেহাল হতে হয়েছে তাকে, দেখতে দেখতে বয়সও বেড়েছে, বিয়ের সম্ভাবনা তার আর নেই বললেই চলে। সে হিসহিসিয়ে উঠল,— পুরুষমানুষ হল কুত্তার জাত। তফাত শুধু এইটুকুই, ওদের বারো মাসই ভাদ্র মাস।

সকলে হেসে উঠতে যাচ্ছিল, গীতালি চাপা ধমক দিল,— কত দিন বলেছি, স্টাফরুমে বসে কেউ খারাপ কথা বলবে না। ভুলে যেও না, তোমরা এখানে সবাই টিচার।

দীপিকা তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে নিল,— তা হ্যাঁরে শ্রবণা, ছেলেগুলো ধরা পড়েছে?

মাধুরী বলল,— ধরা পড়লে তো কাগজেই বেরোত।

—কাগজের কথা বাদ দে। ওরা সব রসাল খবর ছাপে বিক্রি বাড়ানোর জন্য। দেখিস না, একদিন-দুদিন গপ্পো ফেঁদেই কেমন চুপ মেরে যায়।

—কাগজে বেরোলে লাভও আছে। ওদের না? ধরে পুলিশের এখন উপায়ও নেই। চাইলেও কেস চাপতে পারবে না। তাই না রে শ্রবণা?

—হুঁ, আমারও কাজ বাড়বে। ঝিনুক কাঁধ ঝাঁকাল,— আমাকেও হয়তো থানায় গিয়ে আইডেন্টিফাই করতে হবে।

রমা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,— তোর ভয় করবে না? আবার ওই গুণ্ডাবদমাশদের সামনে যাবি?

ঝিনুক হাতে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল,— না না আন্টি, ওরা আর কিস্যু করতে পারবে না। ধরলে পুলিশ ওদের এমন মাখন করে দেবে…।

মাধুরী বলল,— দ্যাখ্ পুলিশ কবে ধরে। সেদিন যে ডায়েরি নিয়েছে এই কত ভাগ্যি।

—না রে মাধুরীদি, ও সিটা লোক ভাল। আমাদের দেখেই সঙ্গে সঙ্গে বসতে বলে সব কথা মন দিয়ে শুনল। মিজেই বলল, ভাববেন, না, একটা মোটর সাইকেল যখন পড়ে আছে, ও বাছাধনদের আর ট্যাঁ ফোঁ করতে হবে না। আমি এক্ষুনি লোক পাঠাচ্ছি, মোটর সাইকেল থানায় নিয়ে চলে আসবে। আমার কলেজের এক বন্ধু আছে সুলগ্না, ওর মামা লালবাজারে আছে, ও বলছিল লালবাজারেও নাকি সাড়া পড়ে গেছে। পুলিশ কমিশনার নিজে থানায় খবর নিচ্ছেন।

—খবর নেওয়াই সার। দু দিন তো কেটে গেল, মূর্তিমানরা কোথায়?

—আমার মনে হয় ডিউটি অফিসারটা কিছু প্যাঁচ কষছে। সেদিনই এমন বাঁকা বাঁকা প্রশ্ন করছিল!

রঞ্জনার জুলাইতে বিয়ে। সে এতক্ষণ দূরে বসে শুনছিল আলোচনাটা। হঠাৎ সে কৌতূহলী হয়ে উঠল,— কি রকম? কি রকম প্রশ্ন?

ঝিনুক একবার আড়চোখে গীতালিকে দেখে নিয়ে নিচু গলায় বলল,— সত্যিই শ্লীলতাহানি হয়েছে, না শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছে? কোন চিহ্নটিহ্ন আছে? বলতে বলতে আরও নামাল গলাটা,— কোথায় কোথায় হাত দিয়েছিল? তেমন কোন জায়গায় ইনজুরি হয়ে থাকলে এখনই মেডিকেল টেস্ট করাতে হবে।

মিতা বলল,— জানি। পুলিশরা ওইরকম অসভ্য হয়। সব সময়ই ওদের জিভ লকলক করে। পারলে ওরা কথা দিয়েই ধর্ষণ করে নেবে। আর কাজের বেলায় সব নেহারবানু। গুণ্ডাই হোক আর পুলিশই হোক, আসলে বেটাছেলে তো।

সব সময়ই মিতার এই ধরনের কথা ঝিনুকের ভাল লাগে না। প্রশ্নগুলো ভাল ছিল না ঠিকই কিন্তু কী করা যাবে? কিছু রুটিন প্রশ্ন পুলিশকে তো করতেই হয়। আবার মিতার কথাও পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না, নইলে অত খুঁটিয়ে সব জেনে নেওয়ার পরও এখনও ছেলেগুলো ছাড়া থাকে কী করে!

গীতালি দরজার পাশের বেসিনে টিফিন-কৌটো ধুচ্ছিল, বলল,— আমার এখনও কেমন অবাক লাগছে ভাবতে। এই আমাদের সেই শ্রবণা! ক্লাসে এসে ভিতু ভিতু মুখে বসে থাকত, চোখ পাকিয়ে তাকালেই ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না! সেই একবার কী একটা দুষ্টুমি করেছিল, প্রণতিদি আটকে রেখেছিল দারোয়ানের ঘরে, ওমা, দরজা খুলে দেখি সে কি দশা মেয়ের! চোখ জবাফুলের মতো লাল! হেঁচকি তুলছে! সেই মেয়ে এখন গুণ্ডা পেটাচ্ছে, গটগট করে থানায় যাচ্ছে, টকাটক রিপোর্টারদের কথায় জবাব দিচ্ছে!

—সত্যিই। রমা উঠে এসে থুতনি নেড়ে দিল ঝিনুকের,— আমার তো বাবা থানার নাম শুনলেই হাঁটু কাঁপতে শুরু করে।

ঝিনুকের রোঁয়া ফুলে উঠল। এক কালবৈশাখী ঝড়ে তার আত্মবিশ্বাস একশ গুণ বেড়ে গেছে। কথাবার্তা হাঁটাচলায় তার এখন রাজহংসী ভাব।

স্কুলে যে কোন বড় ছুটি পড়ার আগে সুনীতার ঘরে সমস্ত শিক্ষিকাদের নিয়ে একটা ছোট্ট মিলনোৎসব হয়। মর্নিং-এর প্রাইমারি বাড়ির আলাদা উৎসব, দুপুরের হাইস্কুলের জন্য আলাদা। এতে নাকি টিচারদের সঙ্গে স্কুলের আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়। টিচাররা অবশ্য আড়ালে ঠাট্টা করে বলে লাডু পার্টি। স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এ উৎসবে লাড়ু চানাচুর ছাড়া আর কিছু খাওয়ানো হয় না। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। শুধু নতুন সংযোজন সুনীতার ভাষণ। শ্রবণা শুধু আমাদের স্কুলের শিক্ষিকাই নয়, আমাদের প্রাক্তন ছাত্রীও বটে। আমাদেরই স্কুলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সে যে অসীম সাহসিকতার কাজ করেছে সেজন্য সমস্ত স্কুল আজ গৌরবান্বিত। মিস্টার সেনগুপ্ত বলেছেন, গরমের ছুটির পর এক বিশেষ অনুষ্ঠানে শ্রবণাকে স্কুলের পক্ষ থেকে সংবর্ধিত করা হবে। সে অনুষ্ঠানে মর্নিং, ডে দুটো সেকশানেরই ছাত্রছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকারা, উপস্থিত থাকবে। মিস্টার সেনগুপ্ত তাই চান।

অন্য দিন হলে ঝিনুক মুখ টিপে হাসত একটু। আজ অহংকার মাখা লজ্জায় বিভোর। ফিসফিস করে বলল,— দেখেছিস মাধুরীদি, আন্টির কাণ্ড!

মাধুরী ঝিনুককে চিমটি কাটল,— মানপত্রটা তুই রাখিস। উপহারটা আমায় দিস। যদি অবশ্য লাড়ু ছাড়া আর কিছু দেয়।

ঝিনুক হাওয়ায় ভাস্তে ভাসতে স্কুল থেকে বেরোল। স্কুল গেটে চার-পাঁচটা শিশু শুকনো মুখে বসে। ওর মধ্যে দু-তিনটে বাচ্চাকে ঝিনুক হাড়ে হাড়ে চেনে। ভয় ডর বলে কোন বস্তু ওদের অভিধানে নেই। একমাত্র ওই নিরীহ বুড়ো দারোয়ান জীবনদাকে একটু সমঝে চলে ওরা। হয়তো বা খাঁকি উর্দিটার জন্যই।

মাধুরী বলল,—ঘড়িটা দেখেছিস? বারোটা চল্লিশ। এখনও মায়েদের টিকি নেই।

—যতক্ষণ ওরা বাড়িতে না থাকে ততক্ষণই বাড়িতে শান্তি। বড় হলে যে কি হবে এক-একজন।

—তোর গুণ্ডাগুলোর মতো হবে বলছিস?

—হতেও পারে। বিচিত্র কি! ওই ছেলেগুলোও নিশ্চয়ই এরকমই কোন স্কুলে পড়েছে। ওরা সেদিন যে গান গাইছিল, এ বাচ্চাগুলো তো এখনই সে গান গায়। পেট থেকে পড়তে না পড়তে এদেরও যে রকম রক্তের মধ্যে রিভলবার বন্দুক ঢুকে পড়ছে! ঝিনুক অন্যমনস্ক হল,— ভাবতেই খুব ভয় করে রে মাধুরীদি। আমাদের ছেলেমেয়ে যে কী রকম হবে!

—রাম না জন্মাতেই রামায়ণ! আগে বিয়েটা তো কর্। মাধুরী শব্দ করে হেসে উঠল,— তারপর সে শমার কী খবর? তোর তূণীর? খুশিতে লাফাচ্ছে? গেয়ে গেয়ে শোনাচ্ছে তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহান?

—প্রায় তাই। ঝিনুকও হেসে ফেলল,— পর দিন সকালে কাগজ দেখেই ছুটে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে গিয়েও ঝিনুক সামান্য হোঁচট খেল। কালকের কাগজে তাকে নিয়ে স্টোরি বেরোনর পর বিকেলে তূণীরকে খুব আশা করেছিল। আসেনি। ফোনও করেনি। অফিসে কোন জরুরি কাজে আটকে গিয়েছিল কি!

ট্রামে উঠেও মাধুরী মিটিমিটি হাসছে,— কপাল করে এসেছিলি রে। তোর খোঁপায় এখন শুধু পালক গোঁজা চলছে। দু-একটা পালক খুলে পড়লে আমাকে দিস।

—কী করবি নিয়ে?

শাশুড়িকে দেখাব। যদি লাল নীল পালক দেখে মন ভেজে। প্রাণে দয়া জাগে।

—ইশশ, সেধে শাশুড়ির চামচাবাজি করিস, আবার ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না হচ্ছে!

—কি করি বল। বুড়ো মানুষের সংস্কার। মাধুরী উদাস হল,— শ্বশুরমশাই গত হওয়ার পর শুচিবাইটা হঠাৎ বেড়ে গেল। পাঁচ বছরের নাতিটাকে পর্যন্ত কাচা প্যান্ট-জামা ছাড়া ঘরে ঢুকতে দেয় না। বাড়িতে কাজের লোক যে রাখতে দেবে না, এ আর এমন কি!

—যাই বলিস ত্রিদিবদাও একটু মেনিমুখো আছে। মাকে বলতে পারে না, বউ চাকরি করে! তার একটা বাইরে পরিশ্রম আছে!

—সেধে কোন্ পুরুষমানুষ সংসারের ঝামেলায় নাক গলাতে চায় রে ভাই?

—ত্রিদিব কিন্তু অন্যায় করছে। স্কুলের খাটুনির পর বুড়ির লক্ষ ফরমাস খাটা, এই কাপড় কাচো রে, বাসন মাজো রে, হেঁশেল ঠ্যালো রে… ত্রিদিবদাও তো তোকে বাড়ির কাজে সাহায্য করতে পারে। নাকি বউ-এর কাজে হাত লাগালে মান যাবে?

—কপাল রে, সবই কপাল। মাধুরীর মুখে ফিকে হাসি,— তোর কপালে পালক আর তূণীর। আমার কপালে ওই বুড়ি আর ওই বর। তেমন কিছু তো ঘটেও না আমাদের সামনে। তোর মতো। তাহলে তবু নিজের কেরামতি দেখিয়ে বরের সামনে মাসল ফোলাতে পারতাম। একটু ওয়েট বাড়ত।

মাধুরী যথেষ্ট নাদুসনুদুস। মাঝে মাঝে ডাক্তারের কাছে গিয়ে সে ডায়েটিং-এর চার্ট করে আনে, সাতদিনের মধ্যেই সেই চার্ট ফেলে দিয়ে দ্বিগুণ খাওয়াদাওয়ায় মত্ত হয়।

ঝিনুক অপাঙ্গে মাধুরীকে জরিপ করল,— বাপস্! আরও ওয়েট চাস!

মাধুরী পায়রা ওড়ানো শব্দ করে হেসে উঠেছে। দুপুরের ট্রাম বেশ ফাঁকা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা লোকজন মাধুরীর হাসিতে ঘুরে তাকিয়েছে। সচকিত মাধুরী গলা নামাল,— একবার বিয়ের জল গায়ে পড়ুক, একটা দুটো নামা, তারপর তোর ওজনও দেখব। ইভনিং শো-এ সিনেমা যাবি?

অদ্ভুত দ্রুততার সঙ্গে প্রসঙ্গ বদলাতে পারে মাধুরী। অন্তহীন পরিশ্রমের পরও কি করে যে সিনেমা দেখার, মেলায় ছোটার উৎসাহ থাকে তার! হয়তো এটাই মাধুরীর সুপ্ত বিদ্রোহ। দম বন্ধ করা খাটুনির বিরুদ্ধে। অবিচারের বিরুদ্ধে। মরুভূমির কাঁটাগাছের মতোই অফুরন্ত তার প্রাণশক্তি।

ঝিনুক বলল,— আজ থাক। সন্ধেবেলা বাড়িতে তূণীর আসতে পারে।

টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর আগের স্টপে নেমে গেল মাধুরী। ঝিনুক সাধারণত ট্রাম ডিপোয় নিমে রিক্শা ধরে নেয়। হাঁটেও মাঝে মাঝে। ছ বছর আগে ঝিনুকরা যখন ফ্ল্যাট কিনে প্রথম এদিকে এসেছিল তখনও আশপাশে বেশ কয়েকটা পুকুর ছিল। গাছপালাও ছিল অনেক বেশি। মহানগরীর বাহু অক্টোপাসের শুঁড় হয়ে একটু একটু করে শুষে নিচ্ছে শেষ সবুজ চিহ্নগুলোকে।

ঝিনুক রাস্তা পার হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মেট্রো স্টেশনের চাতাল চড়া রোদে ঝিমোচ্ছে। কয়েকটা রাস্তার কুকুর শুধু ছায়া খুঁজে খুঁজে উদভ্রান্ত। ছায়া নেই।

কী নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে চাতালটাকে! কী নির্বিকার!

.

চার

ফ্ল্যাটে ঢুকে ঝিনুক থমকে গেল। ঠাম্মা।

বসার আর খাবার জায়গাটাকে নেটের পর্দা টাঙিয়ে পৃথক করে নিয়েছে সুজাতা। ক্রিমরঙ পর্দা সুদৃশ্য রডের দু ধারে সরানো। খাবার টেবিলের এক প্রান্তে বসে আছেন মৃণালিনী।

—ঠাম্মা! ঝিনুক লাফাতে লাফাতে পৌঁছে গেছে মৃণালিনীর কাছে। বিপুল উচ্ছ্বাসে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষল খানিকক্ষণ। শোঁ শোঁ করে নিশ্বাস টানল। সেই চেনা হালকা মিষ্টি গন্ধ। মৃণালিনীর শীতল শরীরে এই মিষ্টি গন্ধটা থাকবেই। এ গন্ধ শুধু ঝিনুকই পায়। আর কেউ না। হয়তো স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া বৃদ্ধাবাসের একাকিত্বের যন্ত্রণার সঙ্গে প্রিয়-পরিজনদের জন্য তীব্র ভালবাসা মিশে জন্ম হয়েছে এই গন্ধটার। মৃগনাভির মতো।

মৃণালিনীও নাতনির আদর চুপচাপ উপভোগ করছিলেন। ঝিনুক ধপ করে তাঁর পাশের চেয়ারে বসল,— এত চড়া রোদুরে বেরনোর কী দরকার ছিল শুনি?

—তোরও তো গরমের ছুটি পড়ে গেছে, তুই কেন বেরিয়েছিলি?

—এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ডটা রিনিউ করে এলাম। তা আমার বয়স আর তোমার বয়স? ঝিনুক আবার মৃণালিনীর গালে গাল ঠেকিয়ে গন্ধটা শুঁকল,— আমি তো আজকালের মধ্যে তোমার ওখানে যেতামই।

—না এসে কি ওঁর উপায় আছে। সুজাতার স্বরে চাপা গর্ব,— যা একখানা কাণ্ড করেছে নাতনি! সব্বাই ভেবে মরছে।

মৃণালিনী স্মিত মুখে বললেন,— বানপ্রস্থে আছি, সন্ন্যাস তো আর নিইনি বৌমা। সাংসারিক উদ্বেগ থেকে মুক্ত হতে পারলাম কই? সামনের দোকান থেকে টেলিফোন করার চেষ্টা করলাম—তা চার দিনেও বেহালা থেকে টালিগঞ্জের লাইন পাওয়া গেল না। তা হ্যাঁ রে ঝিনুক, তুই তো ঠিকই আছিস মনে হচ্ছে, খুব চোট তাহলে লাগেনি? কাগজের লোকেরা বুঝি তবে বেশি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখেছে? পড়ে এমন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম …

—চোট আবার লাগেনি? সেদিন যদি ওই বেপরোয়া মেয়ের হাল দেখতেন! ডান গাল এই বড় টোবলা হয়ে ফুলে আছে। মুখময় রক্ত। হাত নাড়তে পারছে না। ওড়না ছিঁড়ে কুটিপাটি। গা ভর্তি জ্যাবজেবে কাদা। চুল খুলে রাক্ষুসীর মতো…

—আহ্ মা, থামবে? নাগো ঠাম্মা, আই অ্যাম ফাইন নাউ। একেবারে দোকানের ফুলের মতো তাজা। ঝরঝরে।

—কচু। কাল রাত্তিরেও তো কোঁকাচ্ছিল হাতের ব্যথায়। পেইন কিলার খেয়ে ঘুমোল।

মৃণালিনী ঝিনুকের হাত দুটো হাতে তুলে নিলেন,— হুঁ, এখনও তো বাঁ হাতটা বেশ ফুলে আছে দেখছি।

ঝিনুক লজ্জা লজ্জা মুখে হাসল,— বাঁ হাতের কবজিটা এমন মুচড়ে দিয়েছিল! সেদিন তো হাত নাড়ারই ক্ষমতা ছিল না। বাবা জল গরম করে কতক্ষণ সেঁক দিয়ে দিল।

সুজাতা ঘরের জানলাগুলো বন্ধ করছিল। গ্রীষ্মের চড়া তাপ আটকাতে প্রতিদিনই দুপুরে সব আগল তুলে দেয়। তবুও দেওয়াল ফুঁড়ে, সিলিং ভেদ করে চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসতেই থাকে নির্দয় উত্তাপ। একেবারে ওপরতলার ফ্ল্যাট বলে এ উত্তাপ থাকেও বহুক্ষণ। সন্ধে নেমে আসার পরও।

মৃণালিনী বললেন,— তোর বাবার তাহলে জোর ধকল গেছে বল।

সুজাতা রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল,— ধকল বলে ধকল! ধন্যি নাতনি আপনার। যা দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল। আমি বার বার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই, নটা বাজে, সাড়ে নটা বাজে, দশটা বাজে… আপনার ছেলে সমানে হানটান করছে, একবার চারতলা থেকে একতলা যায়, আবার উঠে এসে ওর বন্ধুদের নম্বর খুঁজে খুঁজে ফোন করে, ভয়ে টেনশানে সে কী অবস্থা তার! এত বড় একটা মেয়ে… বন্ধুরা বলছে সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ির জন্য রওনা দিয়ে দিয়েছে… সেই মেয়ে যদি এগারোটা অব্দি না ফেরে… আপনার ছেলে তো… সে তো… কি বলব তার অবস্থা…!

মৃণালিনী অমলিন মুখে বললেন,— আরে বলোই না ভয়ে কাঁপছিল, তাই তো? আমার ছেলেকে আমি চিনি না? ভয় আর দুশ্চিন্তা ছাড়া আর কোন অনুভূতি আছে তার?

সুজাতা শাশুড়ির দিকে খর চোখে তাকিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

ঝিনুক বলল,— ঠিকই বলেছ। বাবার সব কিছুতে বাড়াবাড়ি। রাতে আমাকে দেখে ঠকঠক করে কাঁপছে আবার ভোরবেলা কাগজে আমার নাম দেখে হৈ চৈ। লাফালাফি।

—বাড়াবাড়ি নয় রে দিদি, ওটাই স্বাভাবিক। নিজের জগত ছোট্ট হয়ে গেলে সামান্যতেই বেশি শোক পায় মানুষ। বেশি খুশি হয়। ভয়ও পায় বেশি।

খুশির হিল্লোল এখনও বইছে ঝিনুকের শিরা উপশিরায়। মৃণালিনীর কথা তার কানে পৌঁছেও পৌঁছল না।

সুজাতা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল,— চান করে আয়। খেয়ে নিয়ে যত খুশি গল্প কর ঠাম্মার সঙ্গে।

ঝিনুক টেবিলে তবলার তাল ঠুকল,— আগে খাওয়া পরে চান। বড় ক্ষিদে। বড় ক্ষিদে। ঠাম্মা তুমিও আমার সঙ্গে বসবে তো?

—না রে সোনা, আমি খেয়ে এসেছি। মৃণালিনী উঠে দাঁড়ালেন,— তোরা খাওয়াদাওয়া কর, আমি ততক্ষণ একটু গড়িয়ে নিই। তিনটে নাগাদ বেরোতে হবে।

বছর সাতেক আগে করুণাকেতন মারা যাওয়ার ঠিক দু মাসের মাথায় নিজে জেদ করে বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেছেন মৃণালিনী, ছেলে ছেলেবউদের সমস্ত অনুরোধ উপেক্ষা করে। সেই থেকে কোন ছেলের বাড়িতে কখনও একটা রাতও কাটাননি। মাঝে মধ্যে আসেন, সন্ধে অবধি থাকেন বড় জোর। কখনও কখনও মানসের সঙ্গে দেখা করেও ফেরেন। একটু রাত করে।

ঝিনুক বলল,— এখন এই ঠাঠা রোদুরে তোমার কোথাও বেরোন চলবে না। রোদ পড়লে তবে বেরোবে।

—উপায় নেই রে। বিভুর ওখানেও যেতে হবে একবার। গত হপ্তায় বিভু আমার কাছে গেছিল। রুমকির নাকি থেকে থেকে জ্বর আসছে।

—সে কি! কাকামণি তো ফোন করেছিল। কাগজে খবরটা দেখেই। কই, তখনও তো রুমকির কথা কিছু বলল না! ঝিনুক সামান্য উদ্বিগ্ন হল,— কাকামণিকে কতবার বলেছি রুমকিকে একটা স্প্যাসটিক স্কুলে ভর্তি করে দাও। মন ভাল থাকলে, সঙ্গীসাথী পেলে ও বেচারা এত ভোগে না।

সুজাতা টেবিলে খারার সাজাচ্ছিল, বলে উঠল,— আপনার ছোট ছেলে কারুর কোন পরামর্শ শোনে কোনদিন? আপনার বড় ছেলেও তো কত বুঝিয়েছে। ঠিকমতো ট্রিটমেন্ট হলে হয়তো লেখাপড়াও কিছু শিখত মেয়েটা। বালিগঞ্জ সারকুলার রোডের দিকে কি একটা ঠিকানাও দিয়েছিল… গেলই না!

—ওর কথা বাদ দাও। আজকাল কেই বা কার পরামর্শের ধার ধারে।

—এ কথা কেন বলছেন মা? আপনার পরামর্শে নরেন্দ্রপুরের জমিটা বেচে দেয়নি আপনার বড় ছেলে? ভাল পরামর্শ হলে শুনবে কেন?

মৃণালিনী মৃদু হাসলেন,— রাগ কোরো না বৌমা, একটা কথা বলি। অন্যের পরামর্শ কেউ ভাল বলে মানে না, পরামর্শটা নিজের পছন্দসই হলে তবেই মানে। ওই সময়ে মন্টুর টাকার দরকার ছিল তাই আমার কথাটা ভাল লেগেছিল। ভাইবোনেদের টাকা অবশ্য বুঝিয়েও দিয়েছে। এসব ব্যাপারে মন্টুর কাজে ফাঁক থাকে না। তবে তার আগেও তো আমি একবার জমিটা বেচার কথা বলেছিলাম। রুমকির চিকিৎসার জন্য। তখন তোমরা রাজী হওনি।

—তখন জমির একদম দাম পাওয়া যেত না। দালালরাই বলেছিল ধরে রাখতে। সুজাতার গলা ঘন হল,— তা ছাড়া রুমকির চিকিৎসা তো তখন টাকার জন্য আটকে থাকেনি মা। আপনার বড় ছেলে কোঅপারেটিভ থেকে লোন তুলে টাকা দিয়েছে। আপনার মেয়ে-জামাই টাকা পাঠিয়েছে।

সুজাতা কথাগুলো বলছিল ঠিকই, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তেমন যেন জোর পাচ্ছিল না। বাহাত্তর বছরের এই ঋজু ব্যক্তিত্বময়ী মহিলার সঙ্গে কিছুতেই এঁটে উঠতে পারে না সুজাতা। মৃণালিনী যেন অন্তর্যামীর মতো ধরে ফেলেছেন সুজাতাদের সেই সময়কার মনের গোপন কথাটি। তখন জমি বিক্রি করলে সবার ভাগের টাকাই বিভাসকে দিয়ে দিতে হত। চক্ষুলজ্জার খাতিরে।

মৃণালিনী বুঝি সান্ত্বনা দিলেন একটু,— তোমরা সবাই আছ সেটুকুনিই যা বলভরসা। তোমরাই তো করো। বিভুটা তো উঞ্ছবৃত্তি করেই জীবন কাটিয়ে দিল। রোজগারপাতির দিকে মন নেই, সংসার নিয়ে ভাবনা নেই!

ঝিনুক চুপ করে মা ঠাকুমার কথা শুনছিল। কাকামণিটা সত্যি কেমন যেন! চাকরিবাকরি না পেয়েই টুপ করে একটা বিয়ে করে বসল! যাও বা দু-একটা চাকরি জুটেছিল, কোনদিন অফিসেই গেল না ঠিক মতন! এখন এই নেতার পিছন পিছন ঘুরছে, সেই নেতার তল্পি বইছে! বোকাসোকা লোক ধরে লাইসেন্স পাইয়ে দেব বলে ঠকানো! বাবা বকাবকি করলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, এ কাজ তোর ঘটে ঢুকবে না। এটাকে বলে রাজনৈতিক দালালি। দাঁও মারতে পারলে একবারে মোটা টাকা।… কবে যে বেঘোরে মার খেয়ে মরবে! মাঝখান থেকে কাকিমা বেচারীর কী হিমসিম অবস্থা! ঘরে বসে চব্বিশ ঘণ্টা সেলাই মেশিন চালিয়ে যাচ্ছে।

ঘরের হাওয়া সামান্য ভারী যেন। সুজাতা করুণ মুখে বলল,— রুমকিটার জন্যই কষ্ট হয় সব থেকে বেশি। বারো বছরেই কী বড়সড় চেহারা হয়ে গেছে। মনটাই বাড়ল না। দেখি, পারলে আজকালের মধ্যেই আমি ও বাড়ি ঘুরে আসব। আগে আপনার বাহাদুর নাতনির ঝামেলাটা একটু সামলে নিই।

মৃণালিনী ঝিনুক-ছোটনের ঘরের দরজা থেকে ফিরে এলেন,— বার বার ওকে বেপরোয়া বাহাদুর বলছ কেন বৌমা? কি এমন সাংঘাতিক বাহাদুরির কাজ করেছে ঝিনুক?

শেষ পাতের ভাতটুকু মাখতে গিয়ে ঝিনুকের হাত থেমে গেল। সুজাতার চোখ কপালে,— বাহাদুরি নয়! একপাল গুণ্ডার সঙ্গে মারপিট করল! থানায় গিয়ে পুলিশদের দাবড়ে এল! খবরের কাগজে কি এমনি এমনি ছবি ছাপিয়েছে!

চশমার কাচের আড়ালে মৃণালিনীর চোখ পলকে জন্য জ্বলে উঠল,— ওদিন ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে এর থেকে কম আর কী করতে পারত ঝিনুক? একটা স্বাভাবিক মানুষের যা করা উচিত, ঝিনুক তো তাই করেছে।

ঝিনুকের আঁতে লাগল কথাটা। তার কান লাল হয়ে গেছে। রক্তের খুশির কণিকাগুলো আচমকা পাথরের ঠোক্কর খেয়ে চমকিত যেন। অপ্রতিভ স্বরে সে বলার চেষ্টা করল,— বাহাদুরি নয় ঠিকই। তবে একটু গাট্স লাগে, এটা তো মানবে। একগাদা লোক তো দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ তো এগিয়ে আসেনি!

—তাতে কী প্রমাণ হয় রে দিদি? অন্যায়টা চোখের সামনে দেখাটাই স্বাভাবিক? মেরুদণ্ড না থাকাটাই স্বাভাবিক? নাকি অন্যায় করাটা স্বাভাবিক?

মৃণালিনী ঘরে ঢুকে গেলেন। সুজাতা খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। বক্ৰচোখে একবার তাকাল ঝিনুকদের ঘরের দিকে, তারপর গলা নামিয়ে বলল,— তোর ঠাম্মা একখানা চিজ বটে। কারুর কোন কিছুতে কখনও খুশি হতে দেখলাম না। তোর বাবা আহ্লাদ করে সেবার বলতে গেল, মা আমি রিডার হয়েছি, তাতেও কত টেরা টেরা কথা! রিডার হলে তোর টিউশনি বাড়বে! নামের পাশে রিডার লিখলে নোটবই বেশি বিক্রি হবে, না রে মন্টু!

ঝিনুকের কান বুজে গেছে। মার কথা শুনতে পাচ্ছে না। ভাতের শেষ দলা নামছে না গলা দিয়ে। এ কদিনের কুলকুল আনন্দের ঝরনা হঠাৎই জমাট হিমানী।

স্নান সেরে ঝিনুক ঘরে এসে দেখল মৃণালিনী ছোটনের খাটে শুয়ে। সুজাতা শাশুড়িকে ননদের চিঠি পড়ে শোনাচ্ছে। চিঠি শেষ হতে মৃণালিনী বললেন,— শুনেছিস ঝিনুক, পুজোর সময় রানু কলকাতায় আসতে পারে।

ঝিনুক বিশেষ কৌতূহল দেখাল না। অনেকক্ষণ শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থেকেও তার ক্ষোভ এতটুকু প্রশমিত হয়নি। এখনও মৃণালিনীর কথা হূলের মতো বিঁধছে। খাটের পাশে রাখা ড্রেসিং টেবিলে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আলগা মন্তব্য করল,— পিসিমণি ওরকম লেখেই, আসে না।

—এবার আসবে। বাবলির বিয়ে ঠিক হচ্ছে। তোর কাকিমার দেওয়া সেই পাত্রটার সঙ্গে।

—অ। তা ছেলে কি করে?

—ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে কাজ করে। সুজাতা বলল,— তোর কাকিমার জেঠতুতো দিদির ছেলে। ভালই হল। একসঙ্গে তোর বিয়েটাও লেগে যাবে। বাবুয়া তো আছেই। ছোটনও এসে খাটাখাটি করবে।

বুকের ভিতর ধিকিধিকি ক্ষোভ, তবু মজা লাগছিল ঝিনুকের। বাবুয়া কলকাতায় থাকে বলে মার সুবিধা হবে! কী ভাবে যে মানুষের সুবিধা অসুবিধার স্রোত প্রয়োজন মতো দিক পাল্টায়! এই বাবুয়াকেই না মা এ বাড়িতে রাখতে রাজী হয়নি! কত বাহানা! আমার এই ছোট ফ্ল্যাট! ছোটনেরই এখানে এসে পড়াশুনো করতে অসুবিধা হয়, বাবুয়ার কি সুবিধা হবে! তার ওপর আমাকে তো দেখছই। অর্ধেক দিন কোমরের ব্যথায় পড়ে থাকি। ঝিনুক তো উড়ছে নিজের মনে। নইলে বাবুয়া কি আমার পর! পিসিমণির অনুরোধকে কী কায়দা করে কাটিয়ে দিল! বাবার চেঁচামেচিকে পাত্তা দিল না। বাবুয়া বেচারাকে এখন আলিপুরদুয়ার থেকে যাদবপুরের হোস্টেলে এসে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হচ্ছে। কলকাতায় মামার বাড়ি থাকা সত্তেও। ঝিনুক কি বোঝে না, মা কেন আপত্তি করেছিল বাবুয়ার এখানে থাকায়! ঈষা। নিজের ছেলে আজীবন হোস্টেলে থাকবে আর ননদের ছেলে গৃহসুখ ভোগ করে যাবে, এটা মার সহ্যই হবে না।

মৃণালিনী কাছে ডাকলেন ঝিনুককে,— এই মেয়ে, আমার কাছে এসে একটু বোস তো।

ঝিনুক নিস্পৃহ মুখে মৃণালিনীর পাশে এসে বসল। তার বাঁ হাতের কবজিতে আলগা হাত বুলোচ্ছেন মৃণালিনী। শিরা ভরা হাতের ঠাণ্ডা ছোঁয়া লাগছে ঝিনুকের হাতে। হাত বেয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে শরীরে। বুকের ঠিক মাঝখানটাতে পৌঁছে গেল। এখানেই কি হৃদয়? এক স্নিগ্ধ অনুভূতি জাগছে ঝিনুকের। নিবিড় মধ্যাহ্নে অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে থাকার অনুভূতি।

মৃণালিনী বললেন,— তুই যে তোর তূণীরকে একদিন আমার কাছে নিয়ে আসবি বলেছিলি, তার কী হল?

ঝিনুকের ক্ষোভটা জুড়িয়ে এল,— যাব। ওর এখন অফিসে খুব কাজের চাপ যাচ্ছে।

সুজাতা উঠে পুব দিকের জানলার একটা পাট খুলে দিচ্ছিল। এদিকে গোটা কতক গাছপালা আছে। একটা ডোবাও। মাঝে মাঝেই বেশ সুন্দর বাতাস আসে। জানলার পর্দা সরিয়ে সজাতা ঝিনুকের কথার প্রতিধ্বনি করে উঠল,— সত্যি ছেলেটার বড্ড কাজের চাপ। ওকে ছাড়া তো ওদের ডিরেক্টররা চোখে অন্ধকার দেখে। এ বাড়িতেই বেশি আসতে পারে না, অন্য কোথাও যাওয়ার সময় কোথায়!

তূণীরকে নিয়েও ঠাকুমার সঙ্গে মার মৃদু রেষারেষিতে মজা পেল ঝিনুক।

মৃণালিনী ঝিনুকের কবজিতে চাপ দিলেন সামান্য। ঝিনুক আঁ আঁ করে উঠল। ঝিনুকের ভঙ্গি দেখে হাসছেন মৃণালিনী,— খুউব ব্যথা এখনও! তা হ্যাঁ রে, সেই মেয়েটির খোঁজ নিয়েছিলি?

ঝিনুক আড়ষ্ট হয়ে গেল। সত্যি তো, এ কদিনে ওই মেয়েটার কথা সেভাবে একবারও মনে পড়েনি কেন! চোখ বন্ধ করে ঝিনুক কালবৈশাখীর মুহূর্তটাকে মনে করার চেষ্টা করল। কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারছে না। মেয়েটার চূড়ান্ত অপমান, ছেলে চারটের কুৎসিত আচরণ, জমে থাকা ভিড়ের নিরুত্তাপ মনোভাব ছাপিয়ে কাগজে ছাপা নিজের মুখের ছবিটা বার বার চলে আসছে চোখের সামনে। অথবা গোলাপ হাতে শিশু। থানা। রিপোটার। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের সপ্রশংস দৃষ্টি। আশ্চর্য! রমিতা নেই!

ঝিনুক নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠল,— না, খবর নেওয়া হয়নি। কেন মনে পড়ল না খবর নেওয়ার কথা?

মৃণালিনী ঝিনুকের হাত ছেড়ে দিলেন,— খুব অন্যায়। মেয়েটার ওরকম অবস্থার পরে… শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত রইলি! তোর চোট তো কদিনেই সেরে যাবে, মেয়েটার কথা ভাব। লজ্জাঘেন্নায় মেয়েটার কী অবস্থা হয়েছে কে জানে!

মুহূর্তে ঝিনুক উঠে দাঁড়িয়েছে। কী যেন ঠিকানা ছিল মেয়েটার! …কী যেন! …কী যেন! হ্যাঁ, মনে পড়েছে তেইশের বি গলফ্ ক্লাব অ্যাভিনিউ।… মেয়েটার শ্বশুরবাড়িতে কি টেলিফোন আছে?

দ্রুত পায়ে বসার ঘরে গেল ঝিনুক। ঝড়ের গতিতে টেলিফোন ডিরেক্টরির পাতা ওল্টাচ্ছে।… চৌধুরী … চৌধুরী … চৌধুরী। … গল্ফ ক্লাব রোড… গল্ফ ক্লাব অ্যাভিনিউ… এই তো রয়েছে একটা! চৌধুরী সমরেন্দ্র নারায়ণ। তেইশের বি গলফ্ ক্লাব…। মেয়েটার শ্বশুরের নাম নাকি? হতে পারে।

ঝিনুক ডায়াল বাটন টিপে রিসিভার কানে চাপল। বাজছে। বেশ খানিকক্ষণ পর এক মহিলার কণ্ঠস্বর,— হ্যালো?

—এ বাড়িতে কি রমিতা চৌধুরী থাকে?

—হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?

মহিলার গলা একটু জড়ানো। ঘুম থেকে উঠে এসেছে মনে হয়।

ঝিনুক পরিচয় দিল,— আমি শ্রবণা সরকার। রমিতার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?

ও প্রান্ত থমকেছে। কয়েক সেকেন্ড। তারপর স্পষ্ট হল,— আমি রমিতার শাশুড়ি। রমিতার সঙ্গে কী দরকার?

—না… মানে… এর মধ্যে খবর নিতে পারিনি। রমিতা ভাল আছে তো?

—না। ভাল নেই। ডাক্তার ওকে বিছানা থেকে উঠতে বারণ করেছে।

—ডাক্তার কেন! কী হয়েছে ওর!

—বললাম তো অসুস্থ। ওর সঙ্গে এখন কথা বলা যাবে না।

—ঠিক আছে ঠিক আছে। ডাকতে হবে না, আমি বরং বিকেলে ওকে দেখতে যাব। আপনাদের বাড়ির ডিরেকশনটা যদি কাইন্ডলি বলেন…

—কোন প্রয়োজন নেই। মহিলার স্বর আচমকা রূঢ়,— তুমি এলে ওর টেনশান হতে পারে।

ফোনটা কট করে কেটে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *