০৫. দরজায় একটা শব্দ

পাঁচ

দরজায় একটা শব্দ হতেই শিউরে উঠল রমিতা। হাতের ম্যাগাজিন খসে পড়ে গেছে, সাংঘাতিক গতিতে চলতে শুরু করেছে হৃৎপিণ্ড। আজকাল যে কোন সামান্য শব্দেও এরকম চমকে ওঠে রমিতা, কনকনে এক শীতল অনুভূতি তার মেরুদণ্ড কাঁপিয়ে দেয়, দাঁতে দাঁত লাগতে চায়। বোবায় ধরে রমিতাকে। হঠাৎ কখনও কখনও রাত্রে ঘুম ছিঁড়ে গেলে নিজের বুকের লাবডুবে নিজেই কাঠ রমিতা। মুখ থেকে কণ্ঠা, কণ্ঠা থেকে বুক পেট কোমর পা বেয়ে তখন ওঠানামা করতে থাকে শতসহস্র অদৃশ্য মাকড়সা। রমিতা মরিয়া হয়ে ঘুমন্ত পলাশকে ডাকার চেষ্টা করে, একটা শব্দও আসে না গলায়, ঘুমও আসে না আর। ডাক্তারের দেওয়া কড়া ঘুমের ওষুধেও না। সারা রাত তখন শুধু নিষ্পন্দ জেগে থাকা।

লীনা ঘরে ঢুকে বলল,— এত মন দিয়ে কী ম্যাগাজিন পড়ছিস রে?

রমিতার কানে বড় জা’র প্রশ্নটা ঠিক ঢুকল না। লীনা যেন তীক্ষ্ণ চোখে বড় বেশি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাকে। আজকাল এমন করেই তাকে দেখে সব্বাই। যেন কোন দাগ ধরেছে রমিতার গায়ে। তার ভেলভেটের মতো সুখী জীবনে এ কী বিড়ম্বনা এল! রমিতা জোর করে বিছানায় উঠে বসল,— তুলতুল ঘুমিয়েছে?

—মনে তো হল ঘুমিয়েছে। মটকা মেরে পড়ে আছে কিনা কে জানে! মহা জ্বালাতন করে সারা দুপুর।

রমিতার নিজের জ্বালা এখন এত বেশি, অন্যের জ্বালাযন্ত্রণার কথা তার মাথাতেই ঢোকে না।

লীনা খাটে বসল। রমিতার চোখে চোখ রেখেছে,— শুনেছিস আজ সকালে কী হয়েছে?

রমিতার চোখের পাতা কেঁপে উঠল,— কী হয়েছে?

—ওমা জানিস না, পলাশ বেরোনর আগে থানা থেকে ফোন এসেছিল! লীনার গলা খাদে নামল,— ছেলেগুলো নাকি ধরা পড়েছে। আইডেন্টিফাই করতে যেতে হবে।

এত বড় খবরটা রমিতা জানতে পারেনি! এ বাড়ির কেউ তাকে কিছু জানাচ্ছে না! রমিতার নিজেকে কেমন অপমানিত মনে হল। অন্য দিন অফিস যাওয়ার আগে পলাশ একটু একান্তে ডাকে রমিতাকে, কিছুই না, এক চিলতে হাসি আর প্রায় রুটিন করে একটু গালে ঠোঁট ছোঁওয়াননা, আজ কিছু না বলেই বেরিয়ে গেছে পলাশ। দুপুরে খাওয়ার সময় শাশুড়িও তো কত এতালবেতাল কথা বলছিল, একবারও রমিতাকে কোনও আভাস দিল না! অশোক মাঝে মাঝে হাসি-তামাশা করে রমিতার সঙ্গে। ছোট ভাই-এর বউকে নিজের বোনের মতোই স্নেহ করে সে। ঠাট্টা করতে করতেই সংসারের ছোটখাটো গোপন ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয় হাটের মাঝে, সেও দিব্যি খেয়েদেয়ে বাবার সঙ্গে কারখানায় বেরিয়ে গেল! বাড়ির সবাই সব জানে, শুধু রমিতাই কিছু জানতে পারল না!

রমিতার গলা থমথম করে উঠল,— কবে ধরা পড়েছে ছেলেগুলো?

—কাল রাত্রে।

—সে খবরটা আমাকে জানালে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?

লীনা খাটে পা ছড়িয়ে বসল। যেন তার দু বছরের মেয়ে তুলতুলকে ভোলাচ্ছে এমন গলায় বলল,— জানিসই তো এ বাড়ির ব্যাপার স্যাপার। সব কিছুতেই হাশহাশ চুপচুপ। তোর ভাসুর বলেছিল তোকে আগে জানানোর কথা, পলাশ বলল তোর মেন্টাল ডিপ্রেশান চলছে, শুনলে আরও আপসেট হয়ে পড়তে পারিস। তাই শুনে বাবা বললেন, তাহলে আর তোকে জানিয়ে কাজ নেই, পলাশ একাই থানায় গিয়ে ঝামেলাটা মিটিয়ে আসুক।

রমিতার অপমানবোধটা মিইয়ে এল ধীরে ধীরে। তাহলে বোধহয় এরা ঠিকই করেছে। সত্যি তো, সে রাতে এমন বিশ্রী কান্নাকাটি করেছিল সে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না থেকে হঠাৎ হঠাৎ আর্তনাদ। গোঙানি। ঘুমের ঘোরেও নাকি সারাক্ষণ বিড়বিড় করে গেছে, অ্যাই ছুঁয়ো না আমাকে। ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও বলছি। প্রথম দু-তিনটে রাত সে তো পলাশের স্পর্শও সহ্য করতে পারেনি। সেই তাকেই যদি আবার দাঁড়াতে হয় ওই শয়তানদের মুখোমুখি! নাহ্ রমিতা ভাবতে পারছে না।

ছেলেগুলোর মুখ এক পলকের জন্যও মনে আনতে চায় না রমিতা। মনে পড়লেই প্রাণপণে অন্য কথা ভাবার চেষ্টা করে। যত সুন্দর সুন্দর দৃশ্য তার হৃদয়ে জন্ম থেকে জমা আছে, সবগুলোকে পর পর সাজিয়ে ভেবে যেতে শুরু করে সে। বাবা। মা। অফুরন্ত আদর। দিদি। খুনসুটি। শৈশব। কৈশোর। স্কুল-কলেজের বুক জুড়োনো দিন। বন্ধুবান্ধব। ছোটবেলাতে একবার পেনসিল ছুলতে গিয়ে আঙুল কেটে গেছে, ছোট্ট রমিতার কান্না থামাতে তিনটে বড় বড় মিল্ক চকোলেট হাজির করেছে বাবা। স্কুল থেকে মাদার টেরিজার হোমে বাচ্চাদের জন্য উপহার নিয়ে গেছে রমিতারা। জামাকাপড় ব্যাগ রঙ-পেনসিল পুরনো খেলনা সোয়েটার। মাদার সামনে এসে দাঁড়ালেন। রমিতা প্রণাম করতেই তার মাথায় হাত রেখেছেন মা। কী অপূর্ব স্বর্গীয় অনুভূতি। সব সব দৃশ্য ছিন্নভিন্ন করে ছেলে চারটের মুখই কেন যে দুলে দুলে ওঠে! তাড়া করে রমিতাকে! জোরে চোখ টিপে রমিতা স্কুলে শেখা প্রার্থনা আউড়ে যেতে থাকে…যখন আমি মৃত্যুচ্ছায়ার উপত্যকা দিয়া গমন করিব তখনও অমঙ্গলের ভয় করিব না। কেন না সদা প্রভু আমার সঙ্গে সঙ্গে আছেন। যখন আমি মৃত্যুচ্ছায়ার উপত্যকা দিয়া…। যখন আমি…। যখন আমি… বার বার। কোন লাভ হয় না। ভয় অপমান তীব্র বিবমিষা হয়ে আলোড়িত করে চলে রমিতার শরীর। অপরূপ এক সুন্দর শরীর নোংরা হাতে ছুঁয়েছে কয়েকটা বুনো হায়না। বড় হওয়ার পর কখনও কোন পুরুষ যে তাকে স্পর্শ করেনি এমন নয়, তাদের বারাসতের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে তার মাসতুতো দাদা তাকে প্রথম চুমু খেয়েছিল। কলেজে পড়ার সময়ে কৌশিক বেশ কয়েক বার নিভৃতে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। অসংখ্য পুরুষ মহার্ঘ আপেল ভেবে বহু বার তাকে চোখ দিয়ে লেহন করেছে।

কিন্তু সে সব ছিল ভিন্ন অনুভূতি। যেন পুরুষদেরই এই জগতে পুরুষের আয়নায় নিজের মূল্য যাচাই করা। লোভ থাকলেও সে লোভে বন্দনা মিশে থাকে। আর এ তো শুধুই পাশবিকতা। রাস্তাঘাটে হাওয়ায় ভাসানো অশ্লীল মন্তব্যের চেয়ে লক্ষগুণ কুৎসিত। ট্রাম বাসের ভিড়ে অভব্য পুরুষের নোংরা ছোঁয়ার থেকে কোটি গুণ নির্মম।

লীনা বলল,— কী এত ভাবিস বল তো দিনরাত? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। তোর তো আর কোন ক্ষতি করতে পারেনি ওরা।

রমিতা নিজের মনে বলে উঠল,— ক্ষতি করতে পারেনি বলছ?

—পারেনিই তো। ভুলে যা ওসব কথা। লীনা রমিতার কাঁধে হাত রাখল,— বেঁচে গেছিস তো। যদি তুলে নিয়ে চলে যেত…।

—কিছু যখন হয়ইনি, তবে কেন মা খালি বলছেন মেয়েমানুষের গায়ে একটা দাগ পড়লেই মৃত্যু পর্যন্ত সে খুঁতো হয়ে যায়!

—বনেদি বাড়ির ব্যাপার তো, এদের কথার ধারাই এরকম।

—কেন! মা তো বেশ মডার্ন! চলনে বলনে! পোশাক আশাকে!

—জানি না রে ভাই মর্ডান কাকে বলে। লীনা ঠোঁট ওল্টালো,— বিয়ে হয়ে ইস্তক চার বছর ধরে তো দেখছি। ওসব মডার্ন ফর্ডানের পলেস্তারা বাইরে থেকে একটা টোকা পড়লেই ঝুরঝুর করে খসে পড়ে। তখন শুধু কথায় কথায় শোনাবে কবে এ বংশের কোন কর্তা কত সামান্য কারণে বউকে সদর দরজা দেখিয়ে দিয়েছিল। তোকে শোনায়নি গল্পটা?

—না তো।

—শোনাবে। শোনাবে। এবার ঠিক শোনাবে। শ্বশুরমশাই-এর ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা না কে যেন একদিন বৈঠকখানায় বসে ইয়ারবকশি নিয়ে আড্ডা মারছিলেন, ভেতর মহলে তখন তাঁর ছেলের সান্নিপাতিকে যায় যায় অবস্থা। ছেলের মা বার বার খবর পাঠাচ্ছেন কর্তাকে, তিনি শুধু গড়গড়ায় টান মেরে বলেন, যাআই। শেষমেশ গিন্নী মরিয়া হয়ে নিজেই বৈঠকখানায় চলে এসেছেন। উত্তেজনায় মাথার ঘোমটা যে খসে গেছে সে খেয়ালটাও নেই। কর্তা তো রেগে কাঁই। ছেলে মরছে বলে বাড়ির বউ মাথার কাপড় খসিয়ে বাইরের লোকের সামনে আসবে! এ স্পর্ধা কি মার্জনা করা যায়! ব্যাস, সেই দণ্ডেই বউ গেটআউট। এক বস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হল গিন্নীকে। শুধু মাথার কাপড় খসে যাওয়ার অপরাধে।

রমিতা হাসার চেষ্টা করল,— যাহ, বাবা মোটেই ওরকম নন।

—আমি কি বলেছি বাবা ওরকম? এ বাড়ির কোন ছেলেই ওরকম নয়। নয় যে, সেটাই তো সুযোগ বুঝে মা শুনিয়ে দেন। আমাদের শাশুড়ি ঠাকুরুনটি একটি চিড়িয়া বুঝলি। বিউটিপালারেও যাচ্ছেন আবার পেডিগ্রি নিয়েও মটমট করছেন। ভড়ং।

রমিতা চুপ করে রইল। লীনা সুযোগ পেলেই শাশুড়ির একটু নিন্দা করে নেয় বটে, আবার রমিতা কিছু বেফাঁস বললে বেমালুম শাশুড়িকে লাগিয়েও দেয় সেটা। এ বাড়িতে এসে প্রথম প্রথম শাশুড়ির দু-একটা অভ্যাস দৃষ্টিকটু লেগেছিল রমিতার। বিশেষত বড় ছেলের বউকে একটু যেন ঠেস দেওয়ার মনোভাব। লীনার বাপের বাড়ি নাকি হাঘরে, ছেলে কী দেখে যে মজেছিল লীনাতে—এইসব। শাশুড়ির সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের সময় অবলীলায় রমিতার মতামত সে জানিয়ে দিয়েছিল শাশুড়িকে। রমিতা অপ্রস্তুতের একশেষ। তারপর থেকে সাবধান হয়ে গেছে সে।

লীনা আবারও কি একটা বলতে যাচ্ছিল, পাশের ঘরে মেয়ের কান্নার আওয়াজ পেয়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়েছে,— ওই শ্যামের বাঁশী বাজল। দাঁড়া, একটু চাপড়ে দিয়ে আসি।

রমিতা জানলার বাইরে তাকাল। নিদাঘবেলার সূর্য রাগী দস্যুর মতো গনগনে চোখে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দূরে উঠে যাওয়া আকাশ প্রায় ফ্যাকাশে। বর্ণহীন। জানলার দিকে ঝুঁকে আসা কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলোর একটা পাপড়িও কাঁপছে না। নিঃশব্দে পুড়ছে বাইরের পৃথিবীটা। সেদিনের ঝড়বৃষ্টির পর আবার কেমন একই রকম নিরাসক্ত চতুর্দিক। নির্লজ্জের মতো দুপুরের মনে দুপুর গড়িয়ে চলেছে। কোথায় গলফ্ ক্লাব অ্যাভিনিউ-এ কে এক রমিতা দত্ত থুড়ি রমিতা চৌধুরী কী এক অজানা আংশকায় ছটফট করছে তাতে কীই বা আসে যায় এই উদাসীন দুনিয়ার!

পলাশ ফিরল সন্ধের পর। বাতাসহীন উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করছিল রমিতা। অন্য দিনের মতো পলাশ আজ আগে দোতলায় এল না, সোজা বাবার বৈঠকখানা ঘরে ঢুকেছে। সঙ্গে শাশুড়িও। জোর আলোচনা চলছে নিচে। কেউ রমিতার খোঁজও করল না।

রমিতা দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সমরেন্দ্র বেশ কয়েক বছর আগে হাওড়ার শরিকি বাড়ির অংশ বেচে নতুন বাড়ি করেছে এখানে। এদিকটায় এখনও তেমন বাড়িঘরের জঙ্গল গজিয়ে ওঠেনি। সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা মাঠ। বিকেলে ছেলেরা ফুটবল ক্রিকেট খেলে। সন্ধের পর দু-চার জোড়া কপোত-কপোতী এসে বসে কোন কোন সময়। সামনের রাস্তার উজ্জ্বল নিওন পেরিয়ে রমিতার চোখ দূরে অন্ধকারে ঘন হয়ে থাকা শিশু গাছগুলোর দিকে ভেসে গেল। হঠাৎ ওদিকে তাকালে মনে হয় দিগন্তে যেন ভৌতিক ছায়া। রমিতার ভাসন্ত চোখ সেই ছায়ায় ডুবে যাচ্ছিল। হঠাৎ পিছনে শব্দ হতে চমকে তাকিয়েছে। পলাশ।

পলাশ বারান্দার বেতের চেয়ারে বসেছে। আলো আধাঁরে তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না রমিতা। দূরের শিশুগাছগুলোর মতো সেখানেও যেন এক অপ্রাকৃত ছায়া। রমিতার বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। সাহস করে প্রশ্ন করে ফেলেছে,— তুমি থানায় গেছিলে?

—তোমাকে কে বলল থানার কথা? মা? বৌদি?

—তা জেনে কি হবে। রমিতা আরেকটা বেতের চেয়ার টেনে পলাশের পাশে বসল,—বলো না গো কী হল? ওই ছেলেগুলোই কি সেই …?

হুঁ। পলাশ চেয়ারে পিঠ রাখল,— সব কটাই ধরা পড়েছে।

—হাজতে ছিল সারা রাত?

—তাই তো থাকার কথা।

—তুমি কি গরাদের এপাশ থেকে আইডেন্টিফাই করলে?

—হুঁ।

—অফিস যাওয়ার সময় গেছিলে? না ফেরার সময়?

পলাশের গলায় বিরক্তি,— তুমিও তো পুলিশের মত জেরা শুরু করলে দেখছি।

রমিতা নীরব হল। সারাদিন খাটাখাটুনি করে ফিরেছে, তার সঙ্গে থানার হ্যাপা, এ সময়ে পুরুষমানুষকে জিরোতে দিতে হয়। বাবা বাড়ি ফিরলে দিদির নামে নালিশ জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত কিশোরী রমিতা, মা তখন প্রায়ই এ কথাটা বলত। রমিতা অনেক সময় ধৈর্য হারাত, কেন বলব না শুনি? দিদি সারাদিন আমাকে চুলের মুঠি ধরে মারবে, আমার খেলনাবাটি লুকিয়ে রাখবে, আমি বলব না বাবাকে?

আজ এই আলো আঁধারে রমিতার মনে হচ্ছে মা’ই ঠিক। তবুও ভিতরের অস্থিরতা সংযত রাখতে পারছিল না রমিতা। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলল,— আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? রাগ করবে না?

পলাশ মুখ ফেরাল।

—শ্রবণাদিকে থানায় ডেকেছিল?

—শ্রবণা সরকার আবার তোমার দিদি হল কবে থেকে?

—তা না। রমিতা ঢোঁক গিলল, —আফটার অল আমার থেকে বয়সে বড় তো।

—বড় না আরও কিছু। বিশ্বপাকা।

—কেন? কি করেছে?

—থানায় মেয়েদের আইডেন্টিফিকেশানের জন্য যাওয়ারই প্রয়োজন হয় না, উনি ওস্তাদি মারতে গিয়েছিলেন। পলাশ ঝাঁঝিয়ে উঠল,— যত সব চালবাজি কথাবার্তা! বারফাট্টাই। কেন আপনারা রিপোটরিদের মিট করলেন না! ওসব সিলি বজ্জাতদের ভয় পাওয়ার কোন মানেই হয় না! হ্যাহ্। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিল।

—আসতে বলেছ?

—কোন আসার দরকার নেই। যা ফায়দা লোটার তা তো লুটেই নিয়েছে।

—তুমি আসতে মানা করে দিলে?

—সোজাসুজি বলিনি। কায়দা করে বলেছি। যা বোঝার তাতেই বুঝে যাওয়া উচিত।

—কী বললে?

—বললাম আপনি আমার বউকে উদ্ধার করেছেন, তার জন্য উই আর এভার গ্রেটফুল টু ইউ। আমরা চাই না বাড়ির বউ এই নোংরা ঘটনায় ফার্দর জড়িয়ে পড়ুক। পলাশের গলা দুমড়ে মুচড়ে গেল,— খুব খবরের কাগজের হিরোইন হয়েছেন এখন। অ্যাট দা কস্ট অফ ইওর স্ক্যান্ডাল।

—স্ক্যান্ডাল! কিসের স্ক্যান্ডাল!

—একটা রগরগে অ্যাক্সিডেন্টকে নিয়ে বেশি কচলালে, কাগজে কাগজে স্টোরি ফাঁদলে, মাতামাতি হৈ হৈ করলে সেটা স্ক্যান্ডালেই পরিণত হয়, বুঝেছ? পাবলিকও সেটা চাটতে ভালবাসে।

রগরগে শব্দটা বুকে বাজল রমিতার। শব্দটা কী বিকৃত করে উচ্চারণ করল পলাশ! যেন নোংরা নর্দমা থেকে বুড়বুড়ি কেটে উঠল।

—ওভাবে বলছো কেন?

—বলতে বাধ্য হচ্ছি। তোমার কী? তুমি তো বাড়িতে শুয়ে শুয়ে আর কেঁদে কেঁদেই খালাস। কথা তো শুনতে হচ্ছে আমাকেই। বাড়ি, আত্মীয়স্বজনদের কথা বাদই দাও, হোয়াট অ্যাবাউট মাই অফিস? বন্ধুবান্ধব? প্রত্যেকে সিমপ্যাথিতে চুকুচক করছে। অ্যান্ড আসকিং ডার্টি কোয়েশ্চেনস্।

রমিতার স্বর নড়ে গেল,— কী জিজ্ঞেস করছে?

—জিজ্ঞেস করছে শ্লীলতাহানি মানেটা ঠিক কী। রেপ আর মলেস্টেশানে তফাত কতটা। পলাশ দাঁতে দাঁত ঘসল, —কিসব ভাষা নিউজপেপারের! মলেস্টেশান! আউটরেজ অফ মডেস্টি! আমাদের ডেপুটি চিফ তো কায়দা করে জানতে চাইছিল এটাকে রেপ বলা যায় কি না। অ্যাজ ইফ্ রেপের খবরটা চেপে আমিই মলেস্টেশান লিখিয়েছি।

—তুমি কড়া করে শুনিয়ে দিতে পারলে না?

—না, পারলাম না। বউকে রেপ করেছে, না মলেস্ট করেছে, করলে কতখানি করেছে তাই নিয়ে অফিসে ঝগড়া করা যায় না। কোন সেন্সিবল্ হাজব্যান্ড্ তা করতে পারে না।

রমিতার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। সাত দিন ধরে মনে এত উন্মা পুষে রেখেছে পলাশ! অথচ সর্বক্ষণ প্রায় শান্ত কোমল ব্যবহার করে গেছে রমিতার সঙ্গে! দায়িত্বশীল স্বামীর মত বটগাছ হয়ে ছায়া দিতে চেয়েছে তাকে! একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়েও রমিতা পলাশের বুকের গরগর আওয়াজটা শুনতে পায়নি!

অপরাধী না হয়েও একটা অপরাধবোধ ছুঁয়ে যাচ্ছে রমিতাকে। এই প্রথম। ঘটনার সাত দিন পর।

পলাশ কোন কথা বলছে না। দু হাতে চুল খামচাচ্ছে নিজের।

রমিতা পলাশের হাতে হাত রাখল, —প্লিজ তুমি মনটাকে ছোট কোরো না।

—মনটা কি ময়দার তাল যে ইচ্ছে মত মাপে কেটে নেব? পলাশ টানটান, —লোকে আরও কি বলছে শুনবে? জিজ্ঞেস করছে, ছেলেগুলোর সঙ্গে তোমার আগে পরিচয় ছিল কি না।

খর গ্রীষ্মেও কুয়াশা নামল রমিতার চোখে, —তার মানে!

—মানে তোমার সঙ্গে বিয়ের আগে ওই ছেলেগুলোর অ্যাফেয়ার ট্যাফেয়ার ছিল কি না। আরও তো অনেক মেয়ে ছিল ওখানে, তোমাকেই কেন টার্গেট করল ওরা? ওই শ্রবণাটাকে কেন টার্গেট করেনি?

দীর্ঘ সময় পরে একটা এলোমেলো বাতাস উঠেছে। বাতাসটা বেশ কিছুক্ষণ বারান্দায় খেলা করে শান্ত হল। রমিতার গলা ঘড়ঘড় করে উঠল, —তোমারও কি ধারণা, ওদের সঙ্গে আমার আগে পরিচয় ছিল?

—কি করে বলব? তোমার বিয়ের আগের কথা আমি কতটুকু জানি?

পরিপাটি বিছানায় শুতে গিয়েও থমকাল রমিতা। ড্রয়িংহলে স্টার টিভি চলছে। শ্বশুর শাশুড়ি ভাসুর জা সকলে এখন ওখানে। হয়তো বা পলাশও। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর একসঙ্গে টি ভি দেখা এ বাড়ির রেওয়াজ।

রমিতা ফিরে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়াল। কারুকাজ করা বেতের ফ্রেমে ডিম্বাকৃতি আরশি। ঘরের টিউব আলোতে প্রতিফলিত এ কার মুখ আরশিতে! এটা কি রমিতা! পল্লবিত চোখের নিচে কালির পোঁচ, কাশ্মীরি আপেলের মত রঙে কালচে ছায়া, শঙ্খমসৃণ ত্বক শুকনো ফ্যাকাশে। ভীষণ অন্যমনস্ক রমিতা ত্বক পরিশোধক ক্রিমের শিশি আর তুলো হাতে তুলে নিল। বাড়ি থেকে কদিন এক পাও বেরোয়নি, তবু রোমকূপে এত ময়লা! সাদা তুলো দেখতে দেখতে কালো।

মুখ পরিষ্কার করে রমিতা আবার বিছানায় ফিরল। বিয়েতে পাওয়া লো ইংলিশ খাটের মাথার কাছে ছোট্ট বক্স। বক্স খুলে একটা কাগজ বার করল সন্তর্পণে। কয়েক দিন আগের পুরনো খবরের কাগজ। প্রথম পাতার নিচের দিকে শ্রবণা সরকারের ঝকঝকে হাসিমুখ। ছবির মুখটাকে চোখের খুব কাছে এনে দেখছিল রমিতা। সময় পেলেই দেখে। তেমন রূপসী না হলেও মেয়েটা যথেষ্ট লাবণ্যময়ী। নরম সরম। এই মেয়ে কি করে সেদিন লড়ে গেল গুণ্ডাদের সঙ্গে! চোটও তো যা কিছু লাগবার লেগেছে মেয়েটারই!

রমিতা ছবিটাতে হাত বোলাতে গিয়ে সচকিত হল। দ্রুত কাগজটা পুরে দিল বক্সে। পলাশ আসছে।

পলাশ ঘরের দরজা বন্ধ করে সিগারেট ধরাল একটা। আড়চোখে রমিতাকে দেখল। রমিতা কোন কথা বলল না। বালিশ দেওয়ালের দিকে টেনে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। নিজেরই বকের ধকধক শব্দে কেঁপে উঠছে সে। না তাকিয়েও টের পাচ্ছে পলাশ পুরো সিগারেট খেল না। দু-এক টানের পর নিবিয়ে দিয়ে বিছানায় বসেছে। হঠাৎই ঝুঁকে পড়ে পিছন থেকে রমিতাকে জড়িয়ে ধরল, —আয়াম সরি রুমু। আমি কিছু মিন করে কথাটা বলিনি তখন। রাগের মাথায় হঠাৎ বেরিয়ে গেছে।

রমিতা শরীর শক্ত করে ফেলল। দুরন্ত অভিমানে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছে নিচের ঠোঁট।

পলাশ এক টানে তাকে কাছে টেনে নিল।

রমিতার চোখ ভিজে গেল। ঝাঁপিয়ে পড়ে পলাশের বুকে মুখ গুঁজেছে সে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, —তোমরা সকলে মিলে আমাকে দায়ী করছ কেন? আমি কী জানি? আমি কী জানি?

পলাশ বেডসুইচ টিপে ঘরের উজ্জ্বল আলোটাকে নেবাল। কয়েক পল অন্ধকারের পর নাইটল্যাম্পের মৃদু নীলচে আলোয় সুরভিত গোটা ঘর। পলাশ রমিতার ঘন চুলে আঙুল ডোবাল, —কি করব বলো। মা ভট্ করে বলে বসল, আমরা তো জামাকাপড় সিনেমা থিয়েটার শপিং কোন ব্যাপারেই রমিতার স্বাধীনতায় হাত দিই না, সেই মেয়ের কি উচিৎ ছিল না থানায় রিপোর্ট লেখাতে যাওয়ার আগে একবার আমাদের কথা ভাবা? আমি কত করে মাকে বোঝালাম, ওই মেয়েটাই জোর করে আমাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল। মা বিশ্বাসই করে না। মা’ও হেল্পলেস্…। ঘাড়ের ওপর মহিলা সমিতির পাণ্ডারা এসে নিশ্বাস ফেলছে…. একবার গ্রিন সিগনাল পেলেই সব হাল্লা মাচাতে শুরু করে দেবে…. থানার সামনে গিয়ে গাঁক গাঁক করে চেঁচাবে… জঘন্য জঘন্য পোস্টারিং করবে…. নিউজওয়ালারাও আবার জুস্ পেয়ে যাবে। অসহ্য। ….মা অবশ্য মেজমাসিকে দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলেছে সমিতিওয়ালিদের। ওদের নয় চেপে দেওয়া গেল, বাকিরা? এই তো ফুল কাকিমা এসে সেদিন চান্স পেয়ে তোমার পিঠকাটা চোলির কথাও শুনিয়ে দিয়ে গেল। বাবা আরও খেপে আগুন হয়েছে কেন জানো? তোমার ছেঁড়া ব্লাউজটাকে থানায় ডিপোজিট করে আসার জন্য।

—আমি কী করব? ওরা তো বলল সেটাই নিয়ম।

পলাশ রমিতাকে ছেড়ে দু হাতের চেটোয় মাথা রেখেছে। চোখ বন্ধ করে শুল, —বলল আর তুমিও ওমনি সুড়ুত করে ওসির কোয়ার্টারে গিয়ে তার মেয়ের ব্লাউজ পরে চলে এলে? বাড়ির বউ-এর একটা প্রেসটিজ জ্ঞান থাকবে না?

রমিতা চোখ মুছল, —তুমি তো ছিলে, তুমি বারণ করলে না কেন?

—আমার তখন মাথার ঠিক ছিল না। তাছাড়া ওই পজিশানে একটা অচেনা মেয়ের সামনে আমি তোমার ব্লাউজ নিয়ে কথা বলব?

—আড়ালে ডেকে বলতে পারতে।

—কাকে বলব? তুমি তখন সেন্সে ছিলে? সারাক্ষণ ওই মেয়েটার গায়ে এঁটুলির মতো….। এবার কোর্টে উকিলরা ওই ব্লাউজ নিয়ে নাড়াবে। বুঝেছ? এগ্জিবিট নাম্বার ওয়ান….

রমিতা দমে গেল। খোলা জানলা দিয়ে একটা তরল অন্ধকার গুড়ি মেরে ঢুকছে ভিতরে। পলাশ কনুই-এ ভর রেখে রমিতার দিকে ফিরল, —আজ থানায় যা ইনসাল্টেড্ হয়েছি, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। যে চারটে ছেলে ধরা পড়েছে তার মধ্যে একটাই গুণ্ডা ক্লাসের। বাকি তিনজন ভদ্র বাড়ির। ওয়েল অফ ফ্যামিলির। তাদের বাড়ির লোকেরাও থানায় এসে বসেছিল। তাদের সামনে আইডেন্টিফাই করা… পিওর বস্তি ক্লাশের গুণ্ডা বদমাশ হলে তাও কুকুর বেড়াল ভেবে উপেক্ষা করা যায়… এ যেন নিজেরাই নিজেদের চেনাচ্ছি।

কপালে ঘাড়ে গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল রমিতার। মাথার ওপর পাখাটা যেন তেমন জোরে ঘুরছে না। রমিতা অস্ফুটে বলল, —তুমি কি বলছ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

পলাশ নিজেকে শান্ত রাখতে চেয়েও উত্তেজিত বার বার, —অনেক কথাই তুমি বুঝতে পার না রুমু। বুঝতে পার না তোমার নার্ভস ব্রেকডাউন দেখলে তোমার বাড়ির লোেক কিভাবে রিঅ্যাক্ট করতে পারে। তোমাকে দেখতে এসে তোমার বাবা যেভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন… অ্যাজ্ ইফ আমি তাঁর মেয়েকে প্রোটেকশান দেওয়ার যোগ্য নই।

রমিতা ক্ষীণ আপত্তি জানাল, —মোটেই বাবা-মা তোমাকে কিছু বলেনি। তাদের মনের অবস্থা….

পলাশ উল্টো দিকে ফিরল, —সব কথা বলতে হয় না। চোখ মুখ দেখেও অনেক কথা পড়ে নেওয়া যায়।

রমিতার রাগটা ফিরে আসছিল, —এই সাত দিনে তুমি একবারও তো এসব কথা বলোনি! আজ এত কথা উঠছে কেন! নতুন করে থানায় যেতে হল বলে?

—ধরো তাই। ভদ্রলোকের ছেলেদের রোজ রোজ থানায় যেতে ভাল লাগে না। পুলিশের কাছে বার বার স্টেট্মেন্ট দিতেও না।

—কারণ থাকলেও নয়?

পলাশ হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট টানল। রমিতা ছোট্ট করে হুল ফোটাল, —নাকি থানায় গিয়ে শ্রবণা সরকারের সামনে আনইজি লাগছিল? ভাবতে আঁতে লাগছিল, ওই মেয়েটাই তোমার বউকে রক্ষা করেছে? তুমি যা পারোনি?

বারুদে সজোরে কাঠি ঠুকে দেশলাই জ্বালাল পলাশ, —বাহ, তোমারও দেখছি এখন অনেক বুলি ফুটেছে। সারাক্ষণ ওই ঝাঁসি রানির ছবি দেখে দেখে? হুঁহ, বীরাঙ্গনা! মিনিমাম ফেমিনিন ডিগনিটিটাও নেই। থানায় আবার পুলিশকে উপদেশ দিচ্ছিল কিডন্যাপিং চার্জটাকে ভালভাবে স্ট্রেস্ দেওয়ার জন্য!

ফেমিনিন ডিগনিটিটা কী জিনিস? নারীর মর্যাদা? না নারীত্বের মর্যাদা? চোখের সামনে শ্রবণাকে দেখতে পাচ্ছে রমিতা। উদ্ভ্রান্তের মত ভারী ব্যাগ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মারছে একপাল জন্তুকে।

রমিতা আচমকাই ফণা তুলল, —ভুল কি রলেছে? কিডন্যাপিংই তো করতে চেয়েছিল ওরা। মোটরসাইকেলে তুলতে যায়নি?

পলাশের চোখও সহসা কুটিল, —কিডন্যাপিং কেস দিলে তোমার খুব মজা লাগে, না? পুরনো আশিকরা তুলে নিয়ে যাচ্ছে….

—তোমার মুখ দেখতে আমার ঘেন্না করছে। ছি ছি। রমিতার গলা আর্তনাদের মত শোনাল।

—করছে বুঝি? পলাশ ঘষে ঘষে অ্যাশট্রেতে সিগারেট নেবাচ্ছে। রমিতার দু কাঁধ খামচে ধরল, —কী ভাল লাগছে? ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে?

—ছোঁবে না। একদম ছোঁবে না তুমি আমাকে ছাড়ো বলছি। ছেড়ে দাও।

—এখনও বুঝি ছেলেগুলোর ছোঁয়া ভুলতে পারোনি? পলাশের কণ্ঠ ঘাতকের মত নির্দয়। মত্ত হস্তীর দাপটে চূর্ণ করছে রমিতার প্রতিরোধ। রমিতা ক্রমে নিস্তেজ হয়ে এল। পোড়া কাঠের মতো পড়ে থাকা তার শরীরটার ওপর পৌরুষ বর্ষণ করে চলেছে পলাশ। উন্মাদের মত বিড়বিড় করে চলেছ, —দেখি কোন্ শ্রবণা সরকার বাঁচাতে পারে তোমাকে। দেখি। দেখি।

আকাশে চাঁদ নেই! রাস্তার নিওন বাতিগুলো নিবে গেছে কখন। অমাবস্যার অন্ধকার গিলে ফেলেছে পৃথিবীকে। নিদালির মায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে বিশ্বচরাচর। নিজের দাপটে বিধ্বস্ত পুরুষও তলিয়ে গেছে নিদ্রায়। শুধু রমিতার চোখে ঘুম নেই।

হঠাৎই নিকষ অন্ধকার ছিঁড়ে একটা মাতালের হুঙ্কার কাঁপিয়ে দিয়েছে দশ দিক, —অ্যাই স্স্সালা অন্ধকার, আমাকে তুই ভয় দেখাচ্ছিস? আমি কি ডরপুক আছি? হঠ যা। হঠ যা বলছি সামনে থেকে। হঠ্। হঠ্।

রমিতা নিঃসাড়ে মাথার কাছের বক্সটার দিকে হাত বাড়াল।

.

ছয়

সরকার পক্ষের উকিল মেল ট্রেনের গতিতে কেস ডায়েরি পড়ে যাচ্ছে। একঘেয়ে সুরে। মাথামুণ্ডু কিছুই তার বুঝতে পারছিল না ঝিনুক। তার চোখ ঘুরে ফিরে কাঠগড়ার দিকে। চার মূর্তি! উসকো খুশকো চুল। গালে বেশ কদিনের না কামানো দাড়ি। দু সপ্তাহ পুলিশ হাজতে থাকার পর আজ আবার চার বাবু উঠেছেন কাঠগড়ায়। জামিনের আশায়। তিন ওস্তাদের মাথা নিচু। শুধু একজনের চোখ গোটা কোর্টরুমে চক্কর মারছে। ঝিনুকের মুখে এসে থমকাল চোখ দুটো। থমকেই আছে। ঠাণ্ডা খুনির দৃষ্টি। ঝিনুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। বাড়িতে কাউকে বলে আসা হয়নি। এখানে আজ না এলেই বোধহয় ভাল হত।

ঝিনুকের ঠিক সামনের বেঞ্চে তিন সুট-প্যান্ট-টাই পাথরের স্ট্যাচুর মতো বসে। পাশের একজন প্রথম বেঞ্চের টাকমাথা বয়স্ক উকিলের সঙ্গে ফিসফিস করছে। পরিবেশটাই কেমন রহস্যময়। ব্রিটিশ আমলে ঘোড়ার আস্তাবল হিসাবে তৈরি ঘর। উঁচু উঁচু সিলিং-এ ঝুলন্ত সিমেন্টের চাবড়া। যে কোন সময়ে ছাদ ভেঙে পড়বে মাথায়। পলেস্তারা ওঠা দেওয়াল। স্বাধীনতার পর আর কলি ফেরানো হয়েছে বলে মনে হয় না। বিবর্ণ দেওয়াল নোংরা বালব্গুলোর আলো শুষে নিচ্ছে। ক্রমান্বয়ে আর্তনাদ করে চলেছে একটা লম্বাডাঁটি সিলিং ফ্যান। ঘরময় ছড়িয়ে দিচ্ছে উৎকট ভ্যাপসা গন্ধ। লাল শালুতে মোড়া এজলাস। কাঠের পাটাতন, চেয়ার টেবিল কাঠগড়া সবেতেই পাতলা ধুলোর আস্তরণ। অল্প উঁচুতে অপেক্ষাকৃত কম নোংরা আসনে বসে আছেন মহকুমা বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট। পুলিশের একজন অফিসার ছাড়া দুটো খেঁকুরে চেহারার কন্স্টেবল হুকুমবরদার হয়ে দরজায় খাড়া। তাদের টপকে বাইরের হট্টগোল জুত করে ঢুকতে পারছে না ভিতরে। মেলে না। সিনেমা টিভির কোর্টরুমের সঙ্গে এক বিন্দু মিল নেই ঘরটার।

হঠাৎ একটা গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজে সচেতন হল ঝিনুক। ফার্স্ট বেঞ্চের টাকমাথা বয়স্ক ল’ইয়ার উঠে দাঁড়িয়েছে, —ইওর অনার, এই কেস ডায়েরি আর আমার লার্নেড পাবলিক প্রসেকিউটরের বক্তব্যই স্বীকার করে নিচ্ছে অভিযুক্তরা মোটামুটি সম্রান্ত বাড়ির সন্তান। ফার্স্ট অ্যাকিউজড্ পার্থ শিকদার অ্যালিয়াস গুলু প্রখ্যাত চিকিৎসক ডক্টর নীহার শিকদারের একমাত্র সন্তান। সেকেন্ড অ্যাকিউজড্ সুমন হালদারের বাবা বিদেশ হালদার এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। রাকেশ গুপ্তা অ্যালিয়াস রিকির পিতা রাধেশ্যাম গুপ্তা রিনাউনড্ কনস্ট্রাকশান মার্চেন্ট।

—কনস্ট্রাকশান মার্চেন্ট! প্রোমোটার বলতে বাধে নাকি!

ঝিনুক শরতের কথায় কান দিল না। কচকচ করে বাবল্গাম চিবোচ্ছে। তার কান উকিলের চড়া গলার প্রতিটি শব্দে নিমগ্ন।

—চতুর্থ অভিযুক্ত বাদল চ্যাটার্জি ওরফে ল্যাটা এক দরিদ্র ঘরের অনাথ সন্তান। ফার্স্ট সেকেন্ড অ্যান্ড থার্ড অ্যাকিউজড্ কলকাতার এক বিখ্যাত কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। চতুর্থ জন এদেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাদল চ্যাটার্জির বাবা লেট বঙ্কিম চ্যাটার্জি ছিলেন রামরতন হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক। এই সব মানী বাড়ির ছেলেরা স্যার কখনই এ ধরনের অশালীন কাজ করতে পারে না। মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে পুলিশ এদের পরিবারের শান্তি এবং সামাজিক প্রতিপত্তি ক্ষুন্ন করতে চাইছে।

—অ্যাকিউজড্দের থানায় আইডেন্টিফাই করা হয়েছে স্যার। আর ওই বাদল চ্যাটার্জির এগেন্স্টে ক্রিমিনাল রেকর্ডও আছে।

টাকমাথা হেসে উঠল, —লার্নেড প্রসেকিউটর কয়েকটা কথা মনে হয় ভুলে গেছেন স্যার। প্রথমত থানায় আইডেন্টিফিকেশানের কোন লিগাল ভ্যালিডিটি নেই। দ্বিতীয়ত এফ আই আর- এ এদের কারুরই নাম ছিল না। অতএব ফারদার ইনভেস্টিগেশানই বা আর কী থাকতে পারে! তৃতীয়ত ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের তিনশ চুয়ান্ন, তিনশ তেষট্টি আর পাঁচশ নয় ধারা এদের ওপর প্রযুক্ত হতে পারে কিনা তা বিচারসাপেক্ষ। ফোর্থলি বাদল চ্যাটার্জির বিরুদ্ধেও কোন প্রুভেন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। প্লিজ নোট ইওর অনার। প্রুভেন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। ফাইনালি যদি এদের সাসপেক্ট বলে ভাবাও হয়, এদের স্ট্রং সোশাল ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা মনে রেখে মহামান্য কোর্ট এদের বেল্ মঞ্জুর করতে পারেন।

এতক্ষণে সরকারি উকিলেরও গলা চড়েছে, —না স্যার। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে বলেই আমি এদের জামিনের আবেদনের তীব্র বিরোধিতা করছি। যাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা বেশি, সামাজিক দায়িত্ববোধও তাদের বেশি থাকা উচিত। যে অপরাধে এদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটা শুধু একজন মহিলার অপমান নয়, গোটা সমাজের অপমান। সভ্যতার অপমান।

ঝিনুকও এতক্ষণে সামান্য উদ্দীপ্ত হল। আত্মগতভাবে বলে ফেলেছে, —যাক, আজও জামিন পাচ্ছে না তবে।

শরৎ ঝিনুকের দিকে ঝুঁকল, —নাহ্, পেয়ে যাবে। শুনলেন না পুলিশ রিপোর্টটা?

—না, মানে ঠিক, এমন তাড়াতাড়ি পড়লেন ভদ্রলোক…

—পুলিশই বলছে প্রাইমা ফেসি তদন্ত কমপ্লিট। আর পুলিশ কাস্টডির প্রয়োজন নেই। কোর্ট চাইলে এবার জেল কাস্টডিতে দিতে পারে। এর পর কি আর বেল্ আটকাবে?

শরৎ ঘোষালের কথাই সত্যি হল। ব্যক্তিগত জামিনে ছাড়া পেয়ে গেল চারজনই। সঙ্গে আদালতের আদেশ নব্বই দিনের মধ্যে পুলিশ যেন অবশ্যই চার্জশিট ফ্রেম করে। আর কেস্ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তরা যেন আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে এই শহর ছেড়ে না যায়।

ঝিনুক খুবই বিষন্ন বোধ করছিল। তার চোখের সামনে দিয়ে মূর্তিমানরা এক্ষুনি বেরিয়ে চলে যাবে। প্রকাশ্য রাস্তায় আবার বুক ফুলিয়ে ঘুরবে অন্য সব শহরবাসীর মতো। কে খেয়াল করবে, এই ছেলেরাই একটা জঘন্য অপরাধ করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে আবার! ধুস। কোর্টে না এলেই ভাল হত আজ।

বাইরের বটগাছের তলায় এসে ঝিনুক ক্ষোভটা উগরে দিল, —পুলিশের জন্য। পুলিশের জন্যই জামিন পেল ওরা।

শরৎ হা হা করে হেসে উঠল, —আরে না না। জামিন ওরা এমনিই পেত। পুলিশ তো নিমিত্ত।

—মোটেই না। ডায়েরি করার দিন থেকেই দেখছি কিডন্যাপিং ব্যাপারটাকে পুলিশ পাত্তা দিতে চাইছে না।

—তা কেন? রিপোর্টে সেকশানটা তো রয়েছে। চার্জশিটে কী থাকবে সেটা অবশ্য পরের কথা। থাকলেও প্রমাণ করতে রবীনদার জান নিকলে যাবে।

—কেন? মোটিভ তো ক্লিয়ার?

—ইনফ্লুয়েন্সের জোরে মোটিভ কোথায় ভেসে যাবে ম্যাডাম। ওই নীহার শিকদারের ক্ষমতা জানেন? তিন-চারটে মিনিস্টার ওর পেশেন্ট। নেহাত কাগজে লেখালেখি হয়েছে, নইলে ওকে থোড়াই ধরা হত।

আকাশে মেঘ জমেছে, রোদ নেই, তবু ইঁট কাঠ মাটি উজাড় করে দিচ্ছে উত্তাপ। বেশ খানিকটা দূরে দুটো মারুতি আর একটা অ্যাম্বাসাডর। সেখানে দাঁড়িয়ে কোর্টরুমের তিন সুট-প্যান্ট-টাই। তিন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি! ঝিনুক সেদিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল।

শরৎ ঘোষাল বলল, —চলুন। চা খাবেন?

শরতের সঙ্গে ঝিনুকের পরিচয় সামান্যই। ঠাম্মাদের শান্তিপারাবারে বার কয়েক দেখা হয়েছে মাত্র। এক দিন মৃণালিণীর ঘরে অবশ্য অনেকক্ষণ আড্ডাও মেরেছিল একসঙ্গে। এটুকু পরিচয়ে একটা লোকের সঙ্গে বসে চা খাওয়া যায়!

ঝিনুক বলল, —আজ থাক। একটু আলিপুর ক্যাম্পাসের দিকে যাব ভাবছিলাম।

—তা কী করে হয়? মৃণাল-মা যদি শোনেন তাঁর নাতনিকে আমাদের বাড়ি থেকে আদর আপ্যায়ন না করে ছেড়ে দিয়েছি, আমাকে আস্ত রাখবেন?

—মোটেই আমার ঠাম্মা অত রাগী না।

—রাগী না? ওরে বাবা! মুখে চোখে বিচিত্র ভঙ্গি করল শরৎ, —মৃণালমা যা চেঁচিয়ে তাকান!

—সেটা কী জিনিস?

—মানে ওঁর তাকানোর মধ্যে কেমন গর্জন ফুটে ওঠে। শুধু তাকানো নয়… একটা… একটা… মানে… আপনি মহিষাসুরমর্দিনীর চোখ দেখেছেন?

ঝিনুকের ভীষণ ভাল লেগে গেল উপমাটা। মৃণালিনীর জন্য যথার্থ বিশেষণ। তবে ওই মুখে কোথায় যেন বিষাদও লুকিয়ে থাকে। গর্জন তেল মাখা বিসর্জনের প্রতিমার মত।

টালির ছাদের নিচে চতুর্দিক খোলা মেঠো চা মিষ্টির দোকান। দুনিয়ার সব রকমের মানুষজন সেখানে আহার আলাপে ব্যস্ত। প্রত্যেকের ভঙ্গিতে অদ্ভুত রহস্যময় গোপনীয়তা।

ঝিনুক শরতের সঙ্গে একটা সরু টানা বেঞ্চিতে বসল।

—আপনি কিন্তু আমাকে চমকে দিয়েছিলেন।

—কেন? এখানে রুটির ধান্দায় আসি বলে?

—ওল্ড-হোমের হোমিওপ্যাথ ডাক্তার আলিপুর পুলিশ কোর্টের সরকারী উকিল, এ কথা কেউ ভাবতে পারবে?

পুরু ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল শরৎ, —হোমিওপ্যাথিটা আমার নেশা। আর এটা পেশা। যদিও নিষিদ্ধ পেশা কিছু নয়, তবু আড়ম্বর করে বলে বেড়ানোর কোন দরকার আছে?

ঝিনুক মাথা নাড়ল, —উফফ্, আপনার সঙ্গে আজ দেখা হয়ে আমি যা বেঁচেছি! এর আগে কখনও কোর্টে আসিনি, কিছুই থই পাচ্ছি না, যেদিকে তাকাই শুধু টাইপরাইটার, কালো কোট আর মানুষের মাথা। আর সবাই শুধু দৌড়চ্ছে। ঠিক সিনেমার কুইক মোশানের মতো।

—হুঁ হুঁ। এ বড় আজব জায়গা। প্রত্যেকে বিজি। ম্যার্ন অফ বিজনেস।

—ল’ইয়ারদেরও বিজনেসম্যান বলছেন?

—ইন্টেলিজেন্ট্ প্রশ্ন। বিজনেস সেন্টারই বটে। মানি মেকিং। মক্কেল ধরো আর আইনের বই দিয়ে পিষে দাও। তবে এখানে যত লোক দেখছেন, তাদের ফিফটি পারসেন্টেরই কোন কাজ নেই। এমন কি, যত পেঙ্গুইন ঘুরতে দেখছেন, তাদেরও অনেকের এই দশা।

এই গরমেও শরৎ ঘোষাল সাদা ফুলহাতা শার্ট পরে আছে। শার্টের বোতাম গলা অব্দি আটকানো। গলার বোতাম খুলে ঘাড় স্বচ্ছন্দ করল শরৎ, —কেউ কেউ তো আবার কৌতূহলে কৌতূহলেও ঘুরছে। আপনার মতো।

—আসলে আমার আজ একটা কাজ ছিল। ইউনিভার্সিটির আলিপুর ক্যাম্পাসে। ভাবলাম এত দূর এসেছি… ছেলেগুলোকে যখন তুলছে, একটু দেখেই যাই।

—ভালই করেছেন। শরৎ কব্জি উল্টে হাতা ফাঁক করে ঘড়ি দেখল, —আপনার অনারে আমারও চার মক্কেলকে দেখা হয়ে গেল। আগের দিন নিউজ পেপারের দৌলতে যা ভিড় হয়েছিল! বাপস!

—আজ তো একদম ভিড় নেই?

—এ শহর কিছু মনে রাখে না ম্যাডাম। আজ যা নিয়ে নাচে, কাল সেটা বেমালুম ভুলে মেরে দেয়। এই আপনিই হয়তো তিন মাস পরে কেসটার কথা মনে রাখতে পারবেন না।

—কেসটা তার মানে তিন মাসের আগে আর উঠবেই না?

—উঁহু। নাকে তেল দিয়ে ঘুমোতে পারেন। পুলিশ আরও উইটনেস খুঁজবে, তাদের স্টেটমেন্ট রেকর্ড করবে, তারপর তো কেস সাজানো। হাজার প্রসেডিওর আছে।

টেবিলে চা মিষ্টি হাজির। ঝিনুক হতাশ মুখে কাপ হাতে তুলল, —তার মানে আপাতত ধামাচাপা?

—ধামাচাপা পড়বে না। ম্যাজিস্ট্রেটটা খুব কড়া আছে। চার্জশিট নব্বই দিনের মধ্যেই জমা পড়ে যাবে। তারপরই তো আসল খেলা শুরু। আজ এই সাক্ষী আসবে না, কাল ওই সাক্ষী আসবে না, কোনদিন ওদের উকিল ডেট নেবে। তারপর এখানে কন্ভিকশন হলে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট আছে, হাইকোর্ট আছে, সবার শেষে সুপ্রিম কোর্ট আছে।

—মেয়েটার যে চূড়ান্ত অপমান হল, তার প্রতিকার এভাবে… ঝিনুক চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল, —কেউ অপমানটার কথা ভাববেই না?

—আইনের চোখ কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকে ম্যাডাম। ইমোশান নেই। অর্চনা গুহর কেসটাই দেখুন না। পনেরো বছর তো হয়ে গেল, কারুর পানিশমেন্ট হয়েছে? আপনার কেসে যদি কনভিক্শান হয়, ভাবছেন শিকদার মশাই গুপ্তাজীরা ছেড়ে দেবে? দেখবেন হয়তো এই কেস টানতে টানতে ভিক্টিম দিদিমা হয়ে যাবে। যদি অবশ্য কেসটা ততদূর এগোয়।

ঝিনুক চোখে অন্ধকার দেখল। তার এত বড় একটা প্রতিবাদ হাস্যকর রকমের মূল্যহীন! সমস্ত বীরত্ব আর সাহসিকতার যোগফল শূন্য! এ বিগ জিরো! অশ্বডিম্ব!

শরৎ যেন ঝিনুকের মন বুঝতে পেরেছে। হাসতে হাসতে বলল, —আপসেট লাগছে? এ তো গেল শুধু ট্রায়াল প্রসেডিওর। এ ছাড়াও আরেকটা দিক আছে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, কেসটা নিয়ে আপনি খুব মেন্টালি ইনভলভড্। কিন্তু আপনি কি গ্যারান্টি করতে পারেন ভিক্টিম হারসেলফ্ আপনার মতো করেই ভাবছেন?

ঝিনুক ধন্দে পড়ল। রমিতার শাশুড়ি কী অভদ্রের মতো কথা বলেছিল তার সঙ্গে! পলাশও তাকে থানাতে দেখে কেমন শামুকের মতো খোলের মধ্যে গুটিয়ে নিচ্ছিল নিজেকে! কেমন যেন অসহিষ্ণু! বিরক্ত!

ঝিনুক মিনমিন করে বলল, —মেয়েটা নিজের মানসম্মানের কথা ভাববে না?

—ভাবলেই ভাল। শরৎ কসরৎ করে প্যান্টের পকেট থেকে নস্যির ডিবে বার করল। কৌটোতে তর্জনী ঠুকতে ঠুকতে বলল, —আপনার মুখচোখের যা হাল দেখছি, আপনারও শেষ পর্যন্ত ধৈর্য থাকবে তো?

ঝিনুক আরক্ত হল। লোকটা কী ভাবছে তাকে? এত অল্পেই নিরুৎসাহ হয়ে যাবে সে? শরৎ ঘোষাল জানে না ঝিনুক অত সহজে হেরে যাওয়ার মেয়ে নয়। সে যা শুরু করে, তার শেষ না দেখে ছাড়ে না। কলেজে ঢোকার সময় স্টুডেন্ট ইউনিয়নে চাঁদা দিতে রাজি হয়নি ঝিনুক। মুখের ওপর বলে দিয়েছিল তোমাদের সঙ্গে আমার মতে মেলে না, আমি তোমাদের মেম্বার হব কেন? একটা ছেলে বিশ্রী ভাষায় অপমান করেছিল ঝিনুককে। ঝিনুক ছেলেটাকে ছাড়েনি। ইউনিয়ন অফিসে ছেলেটার নামে কমপ্লেন করেছিল, তারা পাত্তা দেয়নি, বলেছে প্রিন্সিপালের কাছে যাও। প্রিন্সিপাল হাত উল্টে বলেছেন, ওরে বাবা, ওসব পার্টির ব্যাপারে আমি নেই। ওসব মাইনর ব্যাপার গা থেকে ধুলোর মতো ঝেড়ে ফেলাই ভাল। ঝিনুক লোকাল পার্টি অফিসে গেছে, লাভ হয়নি। ডিস্ট্রিক্ট অফিসে গেছে, তারা মনোযোগ দিয়ে শুনে ‘দেখছি’ বলে চেপে গেছে। ঝিনুক সোজা স্টেট কমিটির অফিসে হাজির। ডু সামথিং। নইলে আমি নিউজপেপারে ফ্ল্যাশ করব। শেষ পর্যন্ত ছেলেটাকে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল ঝিনুকের কাছে। তূণীর এখনও তাই নিয়ে কম ঠাট্টা করে! তূণীরের ঠাট্টাটাই শরতকে শোনাল ঝিনুক, —বন্ধুরা আমাকে কী বলে জানেন? বলে শ্রবণার ধরা মানে কচ্ছপের কামড়।

শরৎ চোখ কুঁচকে তাকাল, —আর যদি সেই কচ্ছপকে চিত করে দেওয়া হয়? তখন কচ্ছপ কিভাবে হাত পা ছোঁড়ে দেখেছেন তো? হাত নেড়ে কচ্ছপের অসহায় ভঙ্গিটা দেখাচ্ছে শরৎ, —ই ই ই ই….

ঝিনুক রাগ রাগ চোখে দেখল শরতকে, —দেখবেন টেনাসিটি থাকে, কি থাকে না।

মোটা বাদামি ফ্রেমের চশমা খুলে শরৎ রুমালে মুছছে, —আমার কথা সিরিয়াসলি নেবেন না। জাস্ট মনে হল, বলে দিলাম। আমরা আসলে অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষকে মেলাতে চেষ্টা করি তো। অনেককেই প্রথম প্রথম অন্যরকম লাগে। কিছু দূর গিয়ে দেখা যায়, সকলেই কোথাও না কোথাও একই। বাঁধাধরা ছকের বাইরে মানুষ কি সহজে বেরোতে পারে? বড় কোন ধাক্কা না খেলে?

শরতের স্বর এত আন্তরিক যে, ঝিনুকের ভিতরের ঝাঁঝটা মরে আসছিল। মৃণালিনীর ঘরে বসে এরকমই কি একটা কথা বলেছিল না লোকটা? রাগ দ্বেষ আনন্দ শোকে যতই বিহ্বল হয়ে পড়ুক না কেন, মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি নাকি কিছুতেই বদলায় না? শুধু তিন-চারটে নিয়ম জানলেই সবাইকে নাকি পুরোপুরি শনাক্তকরণ সম্ভব?

ঝিনুক হালকা গলায় বলল, —আপনার সেই পুরোন থিয়োরি তো? সত্ত্ব? রজঃ? তম?

শরৎ আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠল, —হল না। হল না। বাত। কফ। পিত্ত। এর বাইরে মানুষ নেই। হের হ্যানিম্যান তাই বলেছেন।

—তবে যে সেদিন অন্য কথা বলছিলেন?

—সেটাও যা এটাও তাই। টাকার দুটো পিঠ তো আলাদা। তা বলে কি পিঠ উল্টোলে টাকাটা বদলে যায়? আমার স্বভাব হল উল্টো জায়গায় উল্টো কথা বলা। রুগী দেখার সময় দেখি রুগীর স্বভাবচরিত্র আর কোর্টে দেখি মক্কেলের শরীরের ধাত। ব্যস্। তাতেই আমার অর্ধেক কাজ ওভার।

ঝিনুক ছদ্ম কোপে নাক কোঁচকাল, —অ। তাই শান্তিপারাবারের ঠাম্মাদের অসুখ সারে না!

—আপনি আমাকে সত্যিকারের ডাক্তার ভেবেছেন নাকি! সর্বনাশ! আমি তো শান্তিপারাবারে রোগ সারাতে যাই না! নির্ভেজাল আড্ডা মারতে যাই। আর সত্যি কথা বলতে কি…. শরৎ গলা নামিয়ে যেন মিলিটারির গোপন তথ্য ফাঁস করছে, —ওঁদের তো একটাই অসুখ। সে অসুখ সারে না।

—কী অসুখ? বাতিকগ্রস্ত সব, তাই তো?

—না নিঃসঙ্গতা। টোটাল লোনলিনেস্।

ঝিনুকের হৃৎপিণ্ড নাড়া খেয়ে গেল। শরৎ ঘোষালকে যত দেখছে, অবাক হচ্ছে সে। যাদুকরের মতো কথার জালে মানুষকে আটকে ফেলতে পারে লোকটা। সাধে কি আর শান্তিপারাবারের বুড়িরা শরৎ ডাক্তার বলতে অজ্ঞান!

ঝিনুক হঠাৎই লক্ষ করল লোকটার চোখের মণিদুটো কুচকুচে কালো। এত কালো চোখের মণি সাধারণত দেখা যায় না।

শরৎ আবার ঘড়ি দেখছে।

ঝিনুক অপ্রস্তুত বোধ করল, —আপনার বোধহয় দেরি করিয়ে দিচ্ছি।

—না। সেকেন্ড হাফে কেস। দুটোয়।

—কোর্টের চাকরি আপনার ভাল লাগে? একটা ডাক্তারির চেম্বার ফেম্বার তো খুলে বসতে পারেন?

—এখানকার থ্রিলটাই আলাদা ম্যাডাম। শারীরিক দিক দিয়ে শক্তসমর্থ একটা মানুষ অসহায়ের মতো ছটফট করছে, তাকে আবার সাহস জোগানো …. এই আমার আজকের কেসটাই কি কম ইন্টারেস্টিং? একটা মেয়ে তার আগের স্বামীর কাছে খোরপোষ চাইতে গিয়েছিল, তা সেই স্বামী মহাত্মা বেধড়ক পিটিয়েছে বউটাকে। লোকজনের সামনে বউ-এর শাড়ি খুলে দিয়েছে।

ঝিনুকের গা শিরশির করে উঠল, —তারপর?

—তার আর পর নেই। মহাপ্রভু এখন বেলে ছাড়া আছেন। আর মেয়েটা রোজ আমার হাতে পায়ে ধরছে ফৌজদারি মামলাটা তুলে নেওয়ার জন্য। তাতে যদি লোকটা দয়া করে কিছু টাকাপয়সা দেয়।

—মেয়েটা অপমান ভুলে গেল?

—আগে পেট না আগে অপমান? শরৎ ঈষৎ বিরক্ত, —আমাদের মধ্যবিত্তদের এই দোষ। আগেই মেয়েটার সম্মান, শরীর এসব নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করে দিই। আরে বাবা, ছেলেরা নিজেদের দরকারে মেয়েদের শরীরের সম্মান বাড়ায়। নিজেদের দরকারেই আবার তাকে বিবস্ত্র করতে ছাড়ে না।

ঝিনুক গোঁজ হয়ে তাকাল, —আপনি বলতে চান, মেয়েদের শারীরিক শুচিতার কোন মূল্য নেই?

—আমরা ছেলেরা চাই বলে মূল্য আছে। আমরা না চাইলেই নেই। চেস্টিটিটা কী জানেন ম্যাডাম? আমার যে ছেলেটা জন্মাচ্ছে সেটা যে আমারই, মানে আমিই যে তার বাবা, সেটা নিশ্চিত করে রাখার একটা অস্ত্র। ও অস্ত্রটা আমরাই চালাই। আমি যে সম্পত্তি বানাব, টাকা জমাব, সেটা একটা কোকিলের ছানা এসে ভোগ করবে এতো হতে পারে না!

—তার মানে আপনি বলতে চাইছেন ব্যক্তিমালিকানা থাকলেই সতীত্ব-ফতীত্বর প্রশ্ন আসে? নইলে নয়?

—ওরে বাস্। অত শত দর্শনের কথা আমি জানি না। শুধু জানি সতীত্ব আর সততা একই শব্দের রকমফের। ওই টাকার দুটো পিঠের মতো। নিজের কাছে সৎ থাকাই সতীত্ব। সে ছেলেদের ক্ষেত্রেই হোক বা মেয়েদের ক্ষেত্রে।

ঝিনুকের ধারণার সঙ্গে ঠিক মিলতে চাইছে না কথাগুলো, তবু সম্মোহিতের মতো শুনছিল ঝিনুক। তর্ক করার ভঙ্গিতে বলল, —তাহলে কি রমিতা চৌধুরীর অপমানটাকে আপনি অপমান বলবেন না?

—অপমান তো বটেই। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকে মানসিক ভাবে বা শারীরিক ভাবে আঘাত করাটাই অপমান। তার শাস্তিও হওয়া উচিত। রাস্তায় পাগলা কুকুর কামড়ালে আমরা কি কুকুরটাকে ক্ষমা করি?

ঝিনুক মনে মনে বলে ফেলল, —আপনি মশাই একটা আস্ত পান্থপাদপ। আঙুল ফোটালেই রস বেরিয়ে আসে। মুখে বলল, —আর নয়। আর দেরি করলে ক্যাম্পাসে স্যারেদের রুমে তালা পড়ে যাবে।

ঝিনুক চায়ের দোকান থেকে বেরোতে গিয়ে আবার তাকাল শরতের দিকে। একটা বছর তিরিশেকের বউ জড়সড় হয়ে কথা বলছে শরতের সঙ্গে। মেয়েটার সঙ্গে দুটো বাচ্চা। একটা কোলে ঝুলছে। শরৎ ঘোষাল চোখ বুজে কিসব বলছে বউটাকে। বউটার সিঁথি সিঁদুরে মাখামাখি। কপালেও সিঁদুরের চাকা টিপ। হাতভর্তি শাঁখা পলা।

এই মেয়েটাকেই কি স্বামী পিটিয়েছিল? খোরপোষ দেয় না? এই মেয়েটাকেই কি? …. এই মেয়েটাকেই কি? …. হায় রে মেয়ে!

রমিতা চৌধুরী এই মেয়েটার মতো হবে না তো!

.

সাত

ছোট্ট একটা ঝড় উঠেছিল বিকেলে। আনসান ধুলোর সঙ্গে কয়েকটা বড় বড় দানার বৃষ্টি। তখন থেকেই মধ্য জৈষ্ঠ্যের দাপট অনেক মোলায়েম।

ঝিনুক ফুটপাথ থেকে শুকনো একটা ডাল কুড়িয়ে আলগা মারল তূণীরের পিঠে, —তোর কথা ফলে গেছে বলে খুব মজা লাগছে, না?

লেকের ধার ঘেঁষে এই রাস্তাটা বেশ মনোরম। দু পাশে সার সার বৃক্ষরাজি। কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গুলমোহর শিমূল শিরিষ। মাঝে প্রশস্ত বুলেভার্ড। সবুজের মোহ মাখা। বাঁয়ে লেক। গরমের বিকেলে লেকের পাড় গমগম। তুলনায় ফুটপাথে পথচারী কম। অন্ধকার ঘন হওয়ার আগেই।

তূণীর মিটিমিটি হাসছিল, —মজা লাগবে না? আমি শুধু কোর্টের সিনটা ভিসুয়ালাইজ করছি। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছোঁড়া চারটে তোকে প্যাট প্যাট করে দেখছে। দেখছে আর ভেতরে ভেতরে মরমে মরে যাচ্ছে। একটা পাঁচ ফুটি মেয়ের হাতে মার খেয়ে কী ক্যাডাভ্যারাস অবস্থা!

—মোটেই আমি পাঁচ নই। পাঁচ এক।

—দ্যাট মেকস নো ডিফারেন্স।

গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে রাস্তার আলো ছিটিয়ে পড়ছে চতুর্দিকে। রাস্তা বেয়ে গাড়িঘোড়ার শব্দহীন স্রোত। রাধাচূড়া ফুলেরা অন্ধকারে হাসল।

তূণীর বলল, —অ্যাই, মা তোকে একবার যেতে বলেছে।

—কেন?

—লজেন্স ফজেন্স দেবে বোধ হয়। মেয়েতে মেয়েতে এসব ব্যাপারে খুব ইউনিটি থাকে তো। একটা মেয়ে বীরত্ব দেখিয়ে ফেললে অন্য মেয়েরা গর্বে ফুলে ওঠে। দিদি তো রোজ একবার করে মৌলালি থেকে ঢাকুরিয়ায় এসে তোর কীর্তন গেয়ে যাচ্ছে। তোর আর ভাবনা নেই রে তুনাই। বিয়ের পর ঝিনুকই তোকে প্রোটেক্ট করবে। রাস্তায় কেউ কিছু বললে তুই তোর ঝিনুককে খবর দিয়ে দিবি। ব্যস, তারপর ঝিনুকই সামলে নেবে।

—তনিমাদির কথা তোর গাঁয়ে ফুটছে বুঝি? হিংসে?

—একটুও না। মেয়েরা তো জেনেটিকালি ভিতুই। তার মধ্যে একটা-আধটা মেয়ে কোন সাহসের কাজ করে ফেললে….সেই জাহাজের গল্পটা জানিস না? জাহাজ থেকে একটা লোক মাঝসমুদ্রে পড়ে গেছে। ডেকে দাঁড়িয়ে সবাই হায় হায় করছে, কিন্তু কেউ লোকটাকে বাঁচাতে নামে না। হঠাৎ এক সাহেব শিপ থেকে ডাইভ মেরেছে। তারপর কোনরকমে হাঁচোড়পাচোড় করতে করতে দুজনে জাহাজে উঠল। ক্যাপ্টেন ক্রু প্যাসেঞ্জার সব্বাই সাহেবকে ধন্য ধন্য করছে। সাহেব তখন রেগে টং। সে খালি চোখ লাল করে সকলের দিকে তাকায়। শেষে থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠেছে, ওসব ভ্যাজারং ভ্যাজারং ছাড়। শুধু বলো, আমাকে পেছন থেকে ঠেলেছিল কে?

—পুওর জোক। ঠোঙা হয়ে গেছে।

—গল্পটার শেষটা তো জানিস না। ওটা সাহেব ছিল না। ছিল মেমসাহেব। পরে সেটা আবিষ্কার করা গেছিল। তোকে কে ঠেলে সামনে এগিয়ে দিয়েছিল দেখতে পেয়েছিলি?

—ভাল হবে না বলছি। মনে আছে কিরকম পিটিয়েছিলাম তোকে? আবার পেটাব সেরকম? বলতে গিয়ে ঝিনুক ফিক করে হেসে ফেলেছে।

…থার্ড ইয়ার কমার্সের তূণীর মজুমদার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ফার্স্ট ইয়ার পল সায়েন্সের ক্লাসে ঢুকেছে। ফ্রেশার্স ওয়েলকামের আগে রুটিন র‍্যাগিং। ঝিনুকের সামনে এসে দাঁড়াল—তুই নাকি ঢুকেই ইউনিয়নের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিস? খুব গাটস? বাহ্। আমাকে পছন্দ হয়?

—মন্দ কি। চলেব্ল্। মুহূর্তের অসাবধানে ঝিনুক ওভারস্মার্ট।

—মনে কর আমি বচ্চন। তুই রেখা। প্রেম কর আমার সঙ্গে। ঝিনুক পাথর। এ কি র‍্যাগিং? না নোংরামি?

—শুরু কর। শুরু কর। মেদহীন তামাটে তূণীর সামনে দাঁড়িয়ে জগিং করে চলেছে।

ঝিনুক অবাধ্য ঘোড়ার মত দাঁড়িয়ে, —আমি পারব না।

—পারবি না মানে? দলের একটা মেয়ে হেঁকে উঠল।

—পারব না মানে পারব না।

—তবে কী পারবে তুমি খুকি?

—ফাইটিং পারবে?

বিশাখা কানের কাছে গুনগুন করল, —এই বোকা, যা হোক কিছু করে দে। নইলে এরা তোকে ছাড়বে না।

রাগে অপমানে ঝিনুক তখন জুলন্ত চুল্লি। চোখ গনগন, যা ইচ্ছে করতে পারি তো? এই অমিতাভ বচ্চনটাকে? বলেই ধাঁ করে এক ঘুঁষি তূণীরের পেটে। হেঁচকা টান মারল ছেলেটার চুল ধরে। তারপর বুকে পিঠে দমাদ্দম কিলচড়।

—অ্যাই কি করছিস! কি করছিস! আরে মেয়েটা কি পাগল নাকি!

আট-দশটা হাত ছাড়াতে চাইছে ঝিনুককে। ঝিনুকও নেহি ছোড়ুঙ্গি। ক্রমাগত পিস্টনের মতো হাত চালিয়ে যাচ্ছে। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির তূণীর প্রায় ফ্ল্যাট। দম নিতে পেট চেপে বসে পড়েছে। ঠোঁটে তবু হাসি ঝকঝক।…

ঝিনুক উন্মন। এক সময় এই তূণীরকে দেখলে মাথায় রক্ত চড়ে যেত ঝিনুকের। এক জণ্ডিসে পিকচার পুরো উল্টো। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার আগেই। গরমের ছুটিতে। তূণীর তখন পার্ট টু দিয়ে এক্স স্টুডেন্ট। হঠাৎ এক কাঠফাটা দুপুরে গরু চোরের মুখে শয্যাশায়ী ঝিনুকের বাড়িতে হাজির। কথা নেই বার্তা নেই, হাতে এক প্রকাণ্ড বাতাবি লেবু। জণ্ডিসে নাকি খেতে হয়। দ্বিতীয় দিন কাঁধে ইয়া লম্বা আখ। জণ্ডিসে নাকি আখের রস ভাল। তৃতীয় দিন পকেটে এক আপাং কাঠির মালা। জণ্ডিসে নাকি গলায় পরতে হয়। ঝিনুকের আগে সুজাতাই গলে গেল। চতুর্থ দিন সুজাতা ঠায় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, কখন ছেলেটা আসবে। তূণীর বেল বাজাতে মাসাইদের ঢাক ঝিনুকের বুকেও। আজ না জানি কী নিয়ে আসে ছেলেটা!

এনেছিল। হাসি। পাথর নিংড়ে জল বার করা হাসি। সে হাসিতে গোবি সাহারাও শ্যামল বনানীতে ছেয়ে যায়, ঝিনুক তো কোন ছার।

সেই শুরু। ছ বছর ধরে ফোঁটা ফোঁটা তূণীর ছড়িয়ে পড়েছে ঝিনুকের অস্থিমজ্জায়। শিরায়। ধমনীতে।

ঝিনুকের গলা কোন কারণ ছাড়াই কেন যে ধরে এল!

—অ্যাই, তোর মনে আছে?

—কি?

—সেই সব দিন?

তূণীর মুখে কিছু বলল না, ঝিনুকের হাত আঁকড়ে ধরল শুধু। কোন কোন সময়ে নৈঃশব্দ্যও এত বাঙ্ময়! এসব নীরব মুহূর্তে কেজো তূণীর কেমন মায়াবী নিষাদ হয়ে ওঠে। এ সময়ে কোন অতীত নেই। ভবিষ্যৎ নেই। আছে শুধু এই পাশাপাশি নির্বাক হেঁটে চলা। শুধু এক অনাদি অনন্ত বর্তমান।

—আমার ভীষণ মন খারাপ লাগে রে আজকাল।

তূণীর ঝিনুকের হাতে চাপ দিল—কেন?

—জানি না রে। ঘাই হরিণীর শিহরন ঝিনুকের শরীরে—একা থাকলেই ভীষণ ভীঈঈষণ মন খারাপ হয়ে যায়। দুপুরবেলা যদি কোন দিন ঘুমিয়ে পড়ি, ঘুম ভাঙলেই কী যে চাপ চাপ কষ্ট! কেন কষ্ট কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না। কিছু ভাল লাগে না তখন। কিছু না। কথা বলতে না। শব্দ শুনতে না। টিভি না। বন্ধুবান্ধব না। কিচ্ছু না।

—আমাকেও না?

ঝিনুক নিশ্বাস চাপল। তুই তখন কোথায়! তখন তো তুই অফিসে কম্পিউটার হয়ে বসে আছিস!

তূণীর আলগা টান দিল ঝিনুককে, আগে বলিসনি তো! এ তো খুব মারাত্মক ডিজিজ! দুপুরাইটিস।

—কিইই?

—দুপুরাইটিস। খুব সিরিয়াস টাইপের অ্যালার্জি। লাভেরিয়ার ভাইরাস শরীরে থেকে গেলে…।

ঝিনুক চিমটি কাটল তূণীরের হাতে, ইয়ার্কি মারিস না।

—ইয়ার্কি নয়। এই অ্যালার্জির একটাই ওষুধ। বিয়ে। একটাই পথ্য। হানিমুন। ওষুধের অনুপানও আছে। নির্জন পাহাড় চাই। কাচের বাংলো চাই। সঙ্গে সারাদিন ঝিরঝির বরফ। দুপুরবেলাও ঘরের মধ্যে ফায়ার প্লেস। ঘরে তুই আর আমি। আমি আর তুই। এরকম সাতটা দুপুর। সব অ্যালার্জি ফক্কা।

ঝিনুক আবার চিমটি কাটল। এবার বেশ জোরে।

—নারে, আমি সিরিয়াস। অফিসের সান্যালও জুলাই-এ বিয়ে করে ফেলছে। আমার থেকে এক বছরের জুনিয়ার, সেও কিনা সিনিয়ার হয়ে যাবে?

—কে তোকে জুনিয়ার হতে মাথার দিব্যি দিয়েছে? মা তো কবে থেকে বলছে, তুই পিছিয়ে যাচ্ছিস। তনিমাদিও তো সেদিন এসে বলে গেল…

—শখ করে কি আর পিছোচ্ছি? ল্যাডারটা ঠিক না ধরে বিয়ে করাটা ওয়াইজ হবে না। তার ওপর বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে এখনও টাগ অব ওয়ার চলছে।

—তুই যে বললি কম্পিউটার-ট্রেন্ড লোক পাঠাবে? তোদের কুরুভিলার তো কম্পিউটার ট্রেনিং নেই?

—নেই কথাটা হাফ ট্রুথ রে। বল ছিল না। একটা আমেরিকান সফটওয়্যার ইনস্টিটিউটে ক্র্যাশ কোর্স করছে। বাইশ হাজার টাকা খরচা করে। ক্যান ইউ ইম্যাজিন? বাইশ হাজার টাকা! টুয়েন্টি টু থাউজেন্ড বাকস্!

—সো হোয়াট? তোর পরিশ্রম, তোর সিনসিয়ারিটির মূল্য দেবে না কম্পানি?

—পরিশ্রম করাটা বড় কথা নয়। পরিশ্রম করছি দেখানোটাই বড় কথা। কুরুভিলা সে ব্যাপারে এক্সপার্ট। তূণীরের ঠোঁটে বিদ্রূপ, ও কর্তাদের সুইচটা চেনে।

বুলেভার্ডের ওপারে সার সার সুরম্য অট্টালিকা। প্রায় প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে আলোকরশ্মি ঠিকরে আসছে। মাঝে এক-একটা তলায় রহস্যজনক অন্ধকার।

ঝিনুক সান্ত্বনা দিল, তোর ক্যালিবার আছে, তেমন হলে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবি।

—অত সহজে হাল ছাড়বার ছেলে তূণীর মজুমদার নয়। বলল বটে, কিন্তু তেমন আস্থা ফুটল না তূণীরের গলায়। পলকা ঠাট্টা ছুঁড়ল, ম্যানস ওয়ার্ল্ডে তো ঢুকলি না, কী টাফ যুদ্ধ যদি বুঝতিস!

—তোদের নীলম বুঝছে, না রে?

তূণীর ঝিনুকের হাত ছেড়ে দিল।

নীলম পাঞ্জাবি মেয়ে। তূণীরদের অফিসে তূণীরদের পোস্টেই সম্প্রতি জয়েন করেছে, একই কিউবিকল শেয়ার করে দুজনে। নীলমের চার্টার্ড-এর রেজাল্ট তূণীরের চেয়েও ভাল। সদ্য বিয়ে করে মালহোত্রা থেকে দাশগুপ্ত বনেছে নীলম।

—কিরে, চুপ মেরে গেলি যে?

তূণীর গম্ভীর,—আজও নীলম স্টেটমেন্টে তিনটে ভুল করেছে। আমি না দেখিয়ে দিলে আজ ফিনান্স ডিরেক্টর ওর খবর নিত। নেহাত মেয়ে বলেই ছাড় পেয়ে যায়।

ঝিনুক কৌতুক বোধ করল। নীলমের কথা উঠলেই তূণীর নীলমের অযোগ্যতার লিস্ট তৈরি করতে শুরু করে। করবেই।

সাফারি পার্কের সামনে বেশ কিছু লোকের জমায়েত। সার সার পার্ক করা গাড়ির আশেপাশে ফুচকা ভেলপুরি ঝালমুড়ির সান্ধ্য আসর। একটা বাচ্চা ছেলে ভ্রাম্যমাণ উনুনে চায়ের কলসি বসিয়ে সামনে দিয়ে যাচ্ছে। তাকে দাঁড় করিয়ে দু ভাঁড় চা নিল তূণীর।

ঝিনুক বলল, ছোটন আজ তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল, তুই নাকি ওকে প্রন ককটেল খাওয়াবি বলেছিস?

—সামনের মাসে। বাবুয়াটাও ফিরুক। শুধু ওরা কেন, মাসিমাকেও নিয়ে যাব।

ঝিনুক আবার তূণীরকে চিমটি কাটল। তূণীরের মেজাজটাকে ছন্দে ফেরাতে চাইছে, অ্যাই, বিয়ের পরেও তুই আমার মাকে মাসিমা বলবি নাকি? আমার সঙ্গেও তুইতোকারি করে যাবি?

—সে তো তুইও করিস।

—আমি এক দিনে অভ্যেস চেঞ্জ করে ফেলব।

—মেয়েরা পারে। মেয়েদের পারতে হয়। আমি ওভারনাইট চেঞ্জ করতে পারব না। তূণীরের চোখে হাসি, মুখে গাম্ভীর্য, হানিমুন শেষ হওয়ার আগে তো কথাই ওঠে না।

ঝিনুক আবার একটা প্রচণ্ড জোর চিমটি কাটল। এত জোরে যে উঁউঁউঁ করে চেঁচিয়ে উঠেছে তূণীর। সামনের ভিড় থেকে সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকটা চোখ তাদের দিকে। ঝিনুক লজ্জা পেয়ে ফুটপাথ ধরে এগিয়ে গেল।

—হ্যাঁ রে, তোকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, সেই কাপলটা কোর্টে গিয়েছিল? তূণীর দ্রুত হেঁটে ধরে ফেলেছে ঝিনুককে।

—নাহ্।

—ছেলেটাও আসেনি?

—উঁহু।

—তবেই দ্যাখ, যার বিয়ে হয় তার হুঁশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই! যার বউ লুট হয়ে যাচ্ছিল, সে ব্যাটা ঠ্যাং-এর ওপর ঠ্যাং তুলে বসে আছে, তুই ফালতু ফালতু সারাদিন কোর্টে গিয়ে বসে রইলি। ঝাড়ও খেলি মাসিমা মেসোমশাইয়ের কাছে।

ঝিনুক একটু ম্লান হয়ে গেল। বাবা মা এমন অবুঝ হয়ে যায় মাঝে মাঝে! এত আতঙ্ক এত সংশয় নিয়ে বেঁচে থাকা যায়! ছোটনটাও হয়েছে তেমনি! বাবা মার তালে তাল দেওয়া স্বভাব!

ঝিনুক তূণীরের পাশে সরে এল, এই তোকে একটা কথা বলাই হয়নি! হঠাৎ মনে পড়ে গেল। কোর্টে না একটা দারুণ মজার লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। শরৎ ডাক্তার। শরৎ উকিলও বলতে পারিস। ঠাম্মাদের ওল্ডহোমে হোমিওপ্যাথি করে। আবার এদিকে আলিপুর কোর্টে গভর্নমেন্ট প্লিডার। মানুষকে নিয়ে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত থিয়োরি দেয় লোকটা! যা কথা বলে না…শুনলে তুই মোহিত হয়ে যাবি।

—উকিলদের ব্যবসাই তো কথা বেচে খাওয়া। তূণীর বিশেষ পাত্তা দিল না।

—নারে, তুই দেখলে বুঝতে পারতিস। আমার মনের জেদটাকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে লোকটা। আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে একটা চ্যালেঞ্জ লড়েছি। শেষ অবধি কেসটা নিয়ে আমার ধৈর্য থাকবে, কি থাকবে না।

তূণীরের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল, খিটকেল বুড়ো উকিল বুঝি?

ঝিনুক মনে মনে হাসল। তূণীর কায়দা করে ভদ্রলোকের বয়স জানতে চাইছে। ছেলেরা প্রিয় নারীর মুখ থেকে অন্য পুরুষের প্রশংসা শুনতে ভালবাসে না।

ঝিনুক খেলিয়ে উত্তর দিল, —বুড়ো বোধহয় ঠিক বলা যাবে না। চল্লিশ হতে পারে। পঁয়তাল্লিশ হতে পারে। পঞ্চাশ হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিছু মানুষ আছে না, যাদের শরীর বয়সটাকে বলতে গিয়েও বলতে পারে না, ঠিক সেরকম। মনই বয়সকে ইচ্ছেমত ঘোরায় ফেরায়। হযবরল’র হিজবিজবিজের মত। কখনও বাড়তি, তো কখনও কমতি।

—তার মানে গিঁটমারা চেহারা।

—তাও নয়। ছোটখাটো। রোগাসোগা। গায়ের রঙও বেশ কালো তবে খুব ব্রাইট। লোকটার সব থেকে যেটা টানে সেটা হল চোখ। হিরে যদি কুচকুচে কালো হত….

—বুঝেছি। দাঁড়কাক টাইপ। তূণীর উদাস ঠাট্টা ছুঁড়ল, —দেখিস, মাঝবয়সী লোকদের আবার একটু ইয়ের দোষ থাকে।

একটা মোড়ে এসে বাঁ দিকে ঘুরল দুজনে। এ রাস্তায় অপেক্ষাকৃত আলো বেশি। আলোতে তূণীরের মুখের অর্ধাংশ স্পষ্ট। সে মুখ ঝিনুকের দিকে ঘুরল অকস্মাৎ—ঝিনুক, তুই কিন্তু ব্র্যাভাডোর নেশাতে পড়ে যাচ্ছিস। মাথায় রাখিস ওরা ছাড়া পেয়ে গেছে।

—তো?

—ওরা তোকে মার্ক করে রেখেছে।

—তাতে আমার কাঁচকলা। দু সপ্তাহ ধরে পুলিশ যা দিয়েছে তাই চাঁদুরা সামলে উঠুক।

—কিছুই জানিস্ না। পুলিশ সহজে বড় ঘরের ছেলেদের গায়ে হাত দেয় না। লকআপে ওরা পুলিশকে ম্যানেজ করে নেয়। রিজার্ভ ব্যাংকের কড়কড়ে সার্টিফিকেট নাকের সামনে নাড়ালে জেলখানাই ফাইভস্টার হোটেল হয়ে যায়।

—অত সহজ নয়। ও. সিটা বেশ টাইট আছে। আমি নিজে কথা বলে দেখেছি। ঝিনুক শক্ত গলায় প্রতিবাদ করল, —তা নাহলে তো ধরাই পড়ত না।

—ওভাবে কিছু বলা যায় না। হয়তো পুলিশের সঙ্গে দরে বনেনি। কিম্বা নিউজওয়ালাদের চেল্লামিল্লিতে স্টেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। তূণীরের চশমায় পথের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে, —ওই সব ইনফ্লুয়েনশিয়াল বাড়ির ছেলেরা সহজে অপমান হজম করবে ভেবেছিস? কে বলতে পারে, হয়তো এখনই তোকে ফলো করছে!

কথাটা শুনেই কেন যে বাঁ পাশে চোখ চলে গেল ঝিনুকের! সঙ্গে সঙ্গে বুকে আচমকা ধাক্কা। সত্যিই খানিকটা তফাতে এক দাড়িওয়ালা লোক হাঁটছে! তাদের সঙ্গে! সমান তালে! লেকের অন্ধকার ধরে! এদিকেই তাকাচ্ছে কি!

ঝিনুকে পা আটকে গেল। দমাদম কেউ হাতুড়ি পিটছে বুকে। অবচেতনে চুয়িংগাম বার করে মুখে পুরল। খামচে ধরেছে তূণীরকে। দেখাদেখি যেন লোকটাও নিশ্চল। এবার এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে।

কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুয়িংগাম চিবোতেও ভুলে গেল ঝিনুক। তারপরই ভুল ভেঙেছে। এক গাঁট্টাগোট্টা দাড়িওয়ালা প্রৌঢ় ধীর পায়ে তাদের অতিক্রম করে চলে গেল। ফিরেও তাকাল না।

তূণীর হাসিতে ফেটে পড়ল, —জেনেটিক ফ্যাক্টরটা তাহলে ভুল বলিনি বল্? তোর মত বীরাঙ্গানাও কেমন কাঁপছে?

ঝিনুকও প্রাণ খুলে হাসতে চাইছিল। পারল না।

তূণীরের হাত ঝিনুকের কাঁধে, —এত নার্ভাস হচ্ছিস কেন? আমি তো সঙ্গে রয়েছি। দ্যাখ্, আমার দিকে তাকা।

জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে ঝিনুকের। নিজের অজান্তেই কখন তার দু কান গরম। আগুন ছুটছে।

.

আট

ঝিনুক চিঠিগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিল। সংবাদপত্রের অফিস থেকে রিডাইরেক্ট করা চিঠি। কদিন ধরে মাঝেমধ্যেই আসছে। দুটো। তিনটে। পাঁচটা। কাকদ্বীপ থেকে দেবিকা কয়াল। রায়গঞ্জ থেকে মানশ্রী বস। কাঁথি থেকে স্কুলশিক্ষিকা অমিতা ভট্টাচার্য। সব চিঠিরই বয়ান মোটামুটি এক। আমরা পথেঘাটে ট্রেনে-বাসে প্রতিদিন যে অস্বস্তির সম্মুখীন হই, আপনি আমাদের একক প্রতিনিধি হয়ে সেই সমস্ত লজ্জাকর পরিস্থিতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। আপনার দুরন্ত সাহস আমাদের প্রেরণা। ….পুরুষের চিঠিও আছে কয়েকটা। অভিনন্দন। অজস্র অভিনন্দন আপনাকে। …. দু একটা চিঠির সুর অন্যরকম। আপনার মতো দুঃসাহসী নারীর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে ইচ্ছুক। আশা করি, স্বাধীনচেতা শ্রবণা সরকার আমার আমন্ত্রণে সাড়া দেবেন। ….

শেষের চিঠিগুলো কুচি কুচি করে ছিড়ল ঝিঁনুক। জানলার বাইরে উড়িয়ে দিল। কাগজের টুকরো হাওয়ায় ভেসে উড়ে যাচ্ছে বদ্ধ ডোবার দিকে। দু-চারটে টুকরো মাটি অবধি পৌঁছল না, তার আগেই আটকে গেছে আগাছায়।

ঝিনুক অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। ভোররাতের স্বপ্নটা ফিরে ফিরে আসছে। গত সাতদিনে তিনবার স্বপ্নটা দেখল ঝিনুক। এক স্বপ্ন। এক বাড়ি। একই উঠোন। এক কুয়ো। গাছপালা। গান। নারকেল গাছ।

বাড়িটা অনেকটা ঝিনুকদের চারু মার্কেটের পুরনো বাড়ির মতো। দু পাশে টানা বারান্দা, মাঝখানে ঠাম্মা দাদুর ঘর, ঝিনুকদের ঘর, কাকামণি কাকিমার ঘর। কিন্তু সে বাড়িতে তো এত বড় উঠোন ছিল না! এত ঝোপঝাড়! বড় বড় গাছপালা! অত বড় এক বিশাল কুয়ো! কুয়োতলার পিছনে কাঠের বাথরুম! কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলো কালচে ছায়া মেখে গুটিসুটি মেরে বসে আছে সেখানে। হুট করে দরজা খুলে সেই ভূতুড়ে আলোছায়ায় বেরিয়ে এল এক দশ বছরের মেয়ে। হাড়কাঁপানো শীতের রাত আষ্টেপৃষ্ঠে সাপটে ধরেছে মেয়েটাকে। মেয়েটা হি হি কাঁপছে। যত না শীতে, তার থেকে বেশি ভয়ে। নির্জন রাতের অন্ধকারে এত ভয় ছড়িয়ে থাকে! ভূতের ভয়। রাক্ষস খোক্ষসের ভয়। সাপ-ব্যাঙের ভয়। লাল লাল চোখ চোর ডাকাতের ভয়। সব থেকে বেশি ভয় বুঝি অজানা অন্ধকারটাকেই। দশ বছরের মেয়ে ভয়ে শীতে মাখামাখি হয়ে বাথরুমের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যেই না পা বাড়ায় অমনি উঠোন বাথরুম হুশ করে সরে যায় দূরে। গাছপালা সব দৌড়ে আসে সামনে। এক্কেবারে গায়ের ওপর। ছুট্টে চৌকাঠে ফিরে এলেই আবার যে কে সেই। আবার এগোয় গুটিগুটি, আবার গাছপালা পড়িমরি করে সামনে। উফ্, কি করে যে বাথরুমে যাবে মেয়েটা? যেতেই হবে। মেয়েটা এবার চোখ কান বুজে লাফিয়ে নামল। নামতেই কোথায় গাছপালা! কোথায় ঝোপঝাড়! চতুর্দিক ধুধু। প্রকাণ্ড কুয়োটা শুধু হাঁ হাঁ করছে মাঝ উঠোনে। মেয়েটা ঝুঁকে কুয়োর ভিতরটা দেখল ভয়ে ভয়ে। অতলস্পর্শী গহ্বরে অন্ধকারও নেই, জলও নেই এক বিন্দু। চকচকে গভীর খাদে এক সিংহ শুধু কেশর ফুলিয়ে গর্জন করে চলেছে। কোখেকে গান বেজে উঠল, আজ না ছোড়ুঙ্গা তুঝে দমদমাদম। সুলগ্না চেঁচিয়ে উঠল, খলনায়কের গানটা চালিয়ে দে না। বিশাখা আর মৈনাকের গলা শোনা গেল, জানিস না গানগুলোকে তো টাডায় অ্যারেস্ট করা হয়েছে। মেয়েটা কুয়ো থেকে মুখ তুলতেই উঠোন বাড়ি রাত্রি সব ভোঁভো। ঠা ঠা রোদে খাড়া দাঁড়িয়ে এক নারকেল গাছ। ঠিক ঝিনুকের চোখের সামনে ডোবার ধারে এখন যে গাছটা দাঁড়িয়ে, হুবহু সেই গাছটাই।

কী অর্থ হতে পারে এই স্বপ্নের? মেয়েটার চেহারা দশ বছরের কিন্তু মুখটা এখনকার ঝিনুকের। মনটাও। কুয়ো উঠোন গাছপালাদেরও নির্ভুল ভাবে চেনা যায়। শিমুলতলার। কিন্তু শিমুলতলায় তো দশ বছর বয়সে যায়নি ঝিনুক! কতদিন আগে গেছে? বড় জোর বছর তিনেক। ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে। অনিন্দিতাদের বাগানবাড়িতে। সে বাড়ির ইঁদারায় ছোটবেলার গল্পের সিংহটা এল কি করে! ওই নারকেল গাছটাই বা কেন! ঘুম ভাঙলে স্বপ্নের রেশ মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে। শুধু চোখের সামনে রয়ে যায় ওই নারকেল গাছ। মিনারের মতো দীঘল। কিন্তু কেন? এ স্বপ্নের মানে কি?

তূণীরকে কাল বিকেলে স্বপ্নটার কথা বলবে ভেবেছিল ঝিনুক। পারেনি। কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকেছে। মনে হয়েছে তূণীর বুঝি জেনে যাবে তার ভিতরের ভয়টাকে। আচ্ছা, এও তো হতে পারে কদিন ধরে মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত আছে বলেই এরকম স্বপ্ন দেখছে ঝিনুক? সত্যি তো দু দুবার ভয় পেয়েছে সে। কাঠগড়ার সেই হিংস্র খুনি চোখ। আর লেকের অন্ধকারে দাড়িওয়ালা মুখ। সেই ভয়ই কি স্বপ্ন হয়ে বার বার…? তবে কি ভয়ের বীজ লুকিয়েই থাকে অবচেতনায়? কাল্পনিক জুজু হয়ে? তাই যদি হয় তাহলে ভয়কে মেরে ফেলার বীজই বা কেন থাকবে না মানুষের মনে?

রান্নাঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। ঝিনুকের চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। গোবিন্দর মার সঙ্গে আবার লেগেছে মা’র।

সুজাতা চিল-চিৎকার করে উঠল, দশ দিনে বাড়িতে গুঁড়ো সাবান শেষ! পনেরো দিনে বাসনমাজার পাউডার! আমার হিসেব করা মশলাপাতি মাস শেষ হওয়ার আগে ফুরোয় কি করে!

নাইটির ওপর হাউসকোট জড়িয়ে ঝিনুক দরজায় এসে দাঁড়াল। ছোটন কী একটা ফুট কেটেছে, মার গলা স্কেল ছাড়িয়ে গেল, হাজারবার বলব। কুড়ি দিনও চলবে না গ্যাস? যা খুশি তাই করবে? ভেবেছেটা কি? কাল রাত্তিরে দশটা রুটি বেঁচেছিল, দশটাই সকালে গিলে বসে আছে!

গোবিন্দর মা’রও স্বর সপ্তমে—মোটেই দশটা খাইনি। নটা খেয়েছি। তুমিই তো বলেছ রাতে যা রুটি বাঁচবে সকালে খেয়ে নিও।

—তা বলে খাওয়ার একটা সীমা-পরিসীমা থাকবে না? এই সকালে অতগুলো রুটি…! ফ্রিজ থেকে কে তোমাকে তরকারি নিতে বলেছে?

—সাত সকালে খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিওনি। খিদের তাড়নায় খাটতে আসা। গতর খাটিয়ে খাই। এক বাড়ি গেলে আমার দশ বাড়ি আছে।

ঝিনুকও গোবিন্দর মাকে বিশেষ পছন্দ করে না। মাঝে মাঝেই তার কাছ থেকে দশ বিশ টাকা নেয়, ফেরত দেয় না। গত মাসেও ছেলের অসুখ বলে কুড়ি টাকা নিয়েছে। তা বলে রুটি নিয়ে চেঁচামেচি!

ঝিনুক দরজা থেকে গলা চড়াল, গোবিন্দর মা, তুমি চুপ করো তো। আর মা, তোমার যদি গোবিন্দর মাকে না পোষায়, অন্য লোক দেখো। রোজ রোজ খেঁচামেচি ভাল লাগে না।

সুজাতার আর গোবিন্দর মা-তে মন নেই, তার চোখ রান্নাঘর থেকে এবার ঘুরে গেছে ড্রয়িং স্পেসের ক্যাবিনেটে রাখা ভি সি পি-তে। ফুটকির মতো লাল আলো জ্বলছে। ছোটন কাল অনেক রাত অবধি এ ঘরে বসে ক্যাসেট দেখেছে। উইক এন্ডে হোস্টেল থেকে এলে খুব বেশি সিনেমা দেখা হয় না, তাই গরমের ছুটিতে সমস্ত না দেখা সিনেমা গোগ্রাসে গিলছে সে। আর প্রায়শই ভি সি পি বন্ধ না-করে শুয়ে পড়ছে।

সুজাতা দুপদাপ গিয়ে সুইচ অফ করে এল। ছোটনের বিকার নেই। খাবার টেবিলে বসে মন দিয়ে সে খেলার পাতা পড়ে চলেছে। ঝিনুক ভাই-এর সামনে এল—রোজ কী এত সিনেমা দেখিস রে? সবই তো এক নাচ, এক গান, এক ফাইট, একই গল্প! দুই ভাই ছোটবেলায় বিছড়ে গেল! একজন বড় হয়ে পুলিশ হল! অন্যজন গুণ্ডা! আর তার সঙ্গে নিরেট কিছু বোকা ভিলেনের দল!

—তোর মধ্যে বড় বেশি দিদিমণি দিদিমণি ভাব এসে গেছে রে দিদি। ছোটন হাই মাইনাস পাওয়ারের চশমা নাকের ওপর নামাল, তবে তোর হার্টটা একদম সোনা দিয়ে মোড়া।

ঝিনুক হেসে ফেলল, মস্কা মারিস না। কাজের কথা বল। মাল্লু চাই বুঝি?

—তুই কি থটরিডিং করছিস নাকি?

—কত লাগবে?

—যা পারিস। একশ দুশ তিনশ।

—অত টাকা দিয়ে কি করবি?

—ওই যে বললাম দার্জিলিং ট্যুর। নেক্সট সানডে।

—সে তো তুই বাবাকে জপিয়ে ফেলেছিস?

—বাবার একটু টান যাচ্ছে। তোদের ইউনিভার্সিটির সব এগজাম চলছে তো, নেক্সট ব্যাচ ধরতে ধরতে বাবার গরমের ছুটি কাবার হয়ে যাবে। তাও হাজার দেবে বলেছে। স্টিল, হাতে দু-চারশ টাকা এক্সট্রা না থাকলে চলে?

—ছ দিনের ট্যুরে হাজার টাকা উড়িয়ে দিবি, আবার আমার কাছে চাইছিস?

—ফালতু জ্ঞান ছাড়। দিবি কি দিবি না বল।

—দেব না। বাবার গাদা গাদা টাকা ধ্বংস করছিস…

—ধ্বংস নয়। বল ইনভেস্টমেন্ট। ছোটন তুড়ি মেরে ঝিনুকের কথা উড়িয়ে দিল, এক্সপেনডিচার তো তুই। স্রেফ বাজে খরচা।

—কি বললি তুই? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা?

ঝিনুকের গলা উচ্চ গ্রামে উঠে গিয়েছিল, সুজাতা ছুটে এসেছে, —তোরাও সাতসকালে শুরু করে দিলি? তোকেও বলি ঝিনুক, দুদিনের জন্য ভাইটা আসে…

—দুদিনের জন্য আসে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? যা ভাষা হয়েছে তোমার ছেলের!

ছোটন হি হি করে হাসছে, অ্যাই দিদি, বেশি রাগিস না, পারমানেন্ট ভাঁজ পড়ে যাবে কপালে। মুখের শেপ চেঞ্জ হয়ে যাবে। তূণীরদা ওই মুখ দেখলে ফেন্ট আঁআঁআঁআঁ।

—গেলে যাবে। ঝিনুক রাগের সঙ্গে বলতে গিয়েও ভাই-এর মুখচোখের ভঙ্গিতে হাসছে ফিকফিক।

সুজাতা বলল, তোমার দিদি তো এমনিতেই ভিরমি খাওয়াচ্ছে ছেলেটাকে। হুটহাট এমন তর্ক জুড়ে দেয়…

—ভুল বললে তর্ক জুড়ব না? ঝিনুক প্রতিবাদ জানাল, তূণীরের কথা কি বেদবাক্য নাকি?

—বেদবাক্য কিনা জানি না, তবে তোমার থেকে তূণীরের প্র্যাকটিক্যাল সেন্স অনেক বেশি। কিসে কি হয় ও অনেক ভাল বোঝে।

—ঘোড়ার মাথা বোঝে। আমিও চাকরিবাকরি করি। রাস্তায় ঘাটে চরকি মারি। আমাকেও চোখ কান খোলা রেখে চলতে হয়।

—হঁহ্। কোথায় তূণীর আর কোথায় তুই? ও কতরকম মানুষ দেখে, কত রেসপন্সিবল পোস্টে রয়েছে, কত অভিজ্ঞতা…তার কাছে তোর ওই লিলিপুটদের পড়ানোর চাকরি!

ঝিনুক তর্ক বাড়াল না। মা বরাবরই হবু জামাই-এ আপ্লুত হয়ে থাকে। ছেলে চারটের জামিন পাওয়ার অবধারিত ঘটনাটা আগেভাগেই বলে ফেলে ইদানীং সে মা’র আরও গভীর বিশ্বাসের পাত্র। তার সামান্যতম সমালোচনা করাও এখন বাতুলতা। মাকে কি করে ঝিনুক বোঝায়, ওই লিলিপুটদের মধ্যেই বিশ্বদর্শন হয়ে যায় তার? প্রতিটি শিশুই পৃথক পৃথক পরিবারের প্রতিচ্ছবি। বাবা, মা, একটাই ছেলে অথবা একটাই মেয়ে। বড় জোর দুটো ছেলেমেয়ে। নিউক্লিয়াস ফ্যামিলি। বেশিরভাগ পরমাণুর নিউক্লিয়াসে অবশ্য এর থেকে বেশি প্রোটন নিউট্রন থাকে। এই নিউক্লিয়াস ‘হাম দো হামারা দো’-তেই শেষ। যে কোন বাচ্চার সঙ্গে দু মিনিট কথা বললেই জানা যায় তার বাবা কিরকম রোজগার করে, মা চাকরি করে কিনা, মা বাবার সম্পর্ক কেমন, তারা টিভিতে কি কি সিরিয়াল দেখতে ভালবাসে, বাবা মদ খায় কিনা, মার সঙ্গে বাবার কি নিয়ে ঝগড়া হয়, বাবা মাকে কখন আদর করে, কোন সময় দুজনেই ভাল মেজাজে থাকে। কত সামান্য আয়াসে চাঁদও কিনে আনতে পারে বাবা-মা। ঠার্কুদা ঠাকুমা বাড়িতে এলে কি ধরনের আচরণ করে মা। অথবা দাদু-দিদাকে দেখলে বাবা। একজন তো একবার বিজ্ঞের মতো বলেছিল, বাবা-মার একদম অ্যাডজাস্টমেন্ট হচ্ছে না আন্টি, বিয়েটা বোধহয় ভেঙেই গেল।

ঝিনুকরাও কি এই বৃত্তের বাইরে? ঝিনুক নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার চেষ্টা করল। উঁহু। তবু যেন ঝিনুকদের ছেলেবেলায় বাবা মার সঙ্গে একটা মসলিনের পর্দার ব্যবধান ছিল। সময় সেই পর্দাটাকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। বাবা মার জগত এখন ছেলেমেয়েদের ছোট্ট দুনিয়ার সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে একাকার। বাবা মা নির্দ্বিধায় ছেলেমেয়ের সামনে সমস্ত রকম কথা আলোচনা করে, ছেলেমেয়েদের সামনেই অবাধ আধুনিক ফুর্তির আসর জমায়। ফোঁটা ফোঁটা বিষের মতো বড়দের নিষিদ্ধ পৃথিবী ঢুকে পড়ছে শিশুদের ধমনীতে। ছেলেমেয়েদের নিয়েই এখন বাবা মার একান্ত আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপন।

মানস বাজার থেকে ফিরেছে। তার রোগাটে লম্বা শরীর, নাক মুখ চোখ ঘামে জবজব। গ্রীষ্মের ছুটি চলছে বলে তার এখন অবসর একটু বেশি। কোচিং টিউশনি কম। পরীক্ষার গার্ড না দিতে হলে কলেজে যেতে হয় না বড় একটা। এখন বাজারে গেলে সে কমপক্ষে দেড় দু-ঘণ্টা কাটিয়ে আসে।

সুজাতা বাজার নিয়ে রান্নাঘরে গেল। মানস পাঞ্জাবি খুলে ডাইনিং টেবিলে চশমা রেখেছে। পাখার নিচে বসে হাত-পা ছড়াল, ঝিনুক, এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খাওয়া তো।

জল খেয়ে মানস থিতু হল, ইলিশ মাছ আছে। দই সর্ষে দিয়ে ভাল করে রেঁধো তো।

ঝিনুক বলল, —কত করে নিল?

—একশ কুড়ি। ভাল সাইজ। সওয়া কেজি আছে।

সুজাতার কান সর্বদা ফ্ল্যাটে ঘোরাফেরা করে। রান্নাঘর থেকে বলে উঠল, এত দাম দিয়ে আনতে গেলে কেন?

—বচ্ছরকার মাছ, ছোটনটাও ভালবাসে, একদিন নয় বেশি দাম দিয়েই কিনলাম।

সুজাতা বলল, ইলিশ মাছ ছোটনের থেকে বাবুয়া বেশি ভালবাসে। ছুটির পর ওর হোস্টেল খুললে ওকেও একদিন ভাল করে খাওয়াতে হবে।

ঝিনুক সুজাতাকে দেখছিল। মা এরকমই। কখনও নিষ্ঠুর স্বার্থপর, কখনও এত স্নেহশীল!

মানস ভয়ে ভয়ে সুজাতার দিকে তাকাল, এক কাপ চা হলে…

—এই গরম থেকে এসেই চা খেতে হবে না। পরোটা ভাজা হয়ে গেছে, আগে জলখাবার খেয়ে নাও।

মানস ঝিনুকের দিকে ফিরল, আজ কাগজ দেখেছিস?

—দেখব কি করে? দশটার আগে ছোটনের কাগজ গেলা শেষ হয়?

—ফার্স্ট পেজটা দ্যাখ।

ঝিনুক ছোটনের হাত থেকে কাগজ টেনে হেডিং-এ পাখির দৃষ্টি বোলালো। বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত আরও একজন গ্রেফতার। হর্ষদ মেহেতা কেসে যুগ্ম সংসদীয় কমিটির আর এক দফা জিজ্ঞাসাবাদ শেষ। কলকাতাকে আরও মোহময়ী করে তুলতে মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বান। মসজিদ চত্বরে মন্দির বানিয়ে রামরাজ্য গড়ার উদাত্ত ঘোষণা। বসনিয়ার বন্দীশিবিরে একশ তিরাশি জন মহিলা ধর্ষিতা।

ঝিনুক জিজ্ঞাসা করল, বসনিয়ার খবরটা বলছ?

—আরে না, যুদ্ধর সময়ে ওসব হয়েই থাকে। নিচে বাঁদিকে দ্যাখ। নন্দীপুর থানার লকআপে….

ঝিনুক খবরটা পড়ল। ছোট্ট করে ছাপা হয়েছে। জনৈকা নারী বন্দিনীকে লক আপেই ধর্ষণ করেছে পুলিশ।

মানস সিগারেট ধরাল, এই পুলিশের ভরসায় তুই কেস লড়তে চাইছিস! রক্ষকই যেখানে ভক্ষক!

ঝিনুক বলল, খবরটা নো ডাউট সাঙ্ঘাতিক। তবে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকে গোটা পুলিশ সিস্টেমটাকে তো তুমি জাজ করতে পারো না বাবা।

—জাজ করা যায় না, আবার যায়ও। এটুকু হলফ করে বলা যায় সাধারণ সিটিজেন কোন বিপদে পড়লে এই পুলিশ বুড়ো আঙুল দেখাবে। তোকে কোর্টে যাওয়া নিয়ে বোঝাতে গেলাম, তুই মুখ ভার করে বসে রইলি। এটা একবার ফিল করলি না ছেলেগুলো তোকে দেখে এক্সাইটেড হতে পারে। এই তো দিনকালের অবস্থা! কোথা থেকে কী হয়ে যায়! হয়তো রাস্তায় অ্যাসিড বাল্ব্ই ছুঁড়ে মারল!

সুজাতা বলল, তোমার না আবার বেশি বেশি। যত সব অলুক্ষুণে কথাবার্তা!

—আমি ঠিকই বলছি। এটাই হার্ড রিয়ালিটি। আমি চাই আমার মেয়ে সেটা বুঝুক। আমাদের ফিলজফির সুরেনবাবু বলছিলেন ওদের পাড়ার একটা মেয়ে রাস্তার একটা বখাটে ছোঁড়ার এগেন্স্টে পুলিশে কমপ্লেন করেছিল। মেয়েটাকে সেই ছেলে অ্যাসিড বাল্ব্ মেরেছে। মেয়েটির কপাল ভাল, মুখে না লেগে হাতে লেগেছিল, তাতেই পুড়ে ঝুড়ে নাকি টেরিবল অবস্থা। এই তো গত হপ্তায়।

ঝিনুক অবাক, কই কাগজে তত বেরোয়নি?

—সব খবর কি কাগজে বেরোয়? মেয়ের বাবার খুব হোল্ড। চেপে দিয়েছে খবরটা।

—মেয়ের বাবা চেপে দিয়েছে? কেন?

—এটাও কি তোমাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে? মানসের ভুরু জড়ো, মেয়ের নামে কেলেঙ্কারি রটার ভয়ে।

—কেলেঙ্কারি?

সুজাতা বলল, বিশ্বসংসারের সব কিছু জেনে দিগ্গজ হয়েছ, মেয়েদের গায়ে কেন কালি লাগে সেটা বোঝ না?

—স্ট্রেঞ্জ! এতো খুনের চেষ্টা! বাড়ির লোক স্টেপ নেবে না! মেয়েটা তো মরেও যেতে পারত!

—মেয়েমানুষ মরল তো বেঁচেই গেল। সুজাতা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, দাগী হয়ে বেঁচে থাকা মরে যাওয়ার থেকে বেশি যন্ত্রণার।

কোন পুরুষবাহিত অনভিপ্রেত ঘটনায় কেন শুধু মেয়েদের গায়েই কালি লাগে? মেয়েরা কী? মনবিহীন মস্তিষ্কবিহীন শুধুই একটা শরীর? একটা জঠর? গর্ভাশয়?

ঝিনুক বলল, ওসব দিন আর নেই মা। ছেলেরা বজ্জাতি করলে মেয়েরা প্রোটেস্ট করবেই।

—সে তো তুমি করেছই। অনেক হয়েছে। এবার থামো। মেয়ে বড় হয়ে গেলে বাবা-মার তাকে নিয়ে কী যে চিন্তা, তা তুমি কি বুঝবে?

মানস বলল, তোর সেদিন কোর্টে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল, আমাদের বলতে পারতিস? কেউ একটা সঙ্গে যেত।

ছোটন উঠে গিয়ে সোফায় বসেছিল। তার চোখের সামনে উৎকট বিদেশি নাচ চলছে। এম টিভি। প্রায় নগ্ন নারী দেহ কম্পিউটারের জাদুতে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে রঙিন পর্দায়। সেখান থেকে তড়াক করে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ছোটন, আমায় বলতে পারতিস। জাস্ট ইম্যাজিন আর্নল্ড শোয়্যারজেনিগার তোকে পাহারা দিয়ে কোর্টে নিয়ে যাচ্ছে। কারুর বুকের পাটা হবে তোর দিকে তাকানোর?

—থাক। ওই তো বাইশ ইঞ্চি বুকের খাঁচা! তাই নিয়ে উনি আমাকে প্রোটেক্ট করবেন!

শর্টস পরা টিঙটিঙে ছোটনের দিকে তাকাল সুজাতা। ছেলের হাতে পায়ে বুকে বেশ ঘন লোম বেরিয়েছে। পুত্রগর্বে আলোকিত সুজাতার মুখ, ঠাট্টা করছিস কেন? বুকের খাঁচা যাই হোক, পুরুষ মানুষ তো বটে।

—তাতে আর সন্দেহ কি! টি শার্টে আবার বড় বড় করে লেখা আছে, আই অ্যাম এ ম্যান। ভাগ্যিস লেখা রয়েছে। নাহলে তো মানুষ বলেই চেনা যেত না!

ছোটন শব্দ করে হেসে উঠল, কী মনে হত রে তাহলে? সুপারম্যান?

—বনমানুষ। তোর গলাতে ওটা কী ঝুলিয়েছিস রে? কদিন ধরেই লক্ষ করছি?

—দেখতেই তো পাচ্ছিস। লকেট।

—দাঁড়া। দাঁড়া। হঠাৎ লকেট কেন?

—এমনিই। ছোটন এড়াতে চাইছে।

সুজাতা বলল, পরীক্ষা খারাপ হয়েছে, তাই এক বন্ধু পরতে দিয়েছে ওকে।

—লকেট খুললেই নিশ্চয়ই কোন বাবার ছবি বেরোবে?

—ওভাবে বলছিস কেন? মানস বলল, ও যদি ওটা পরে একটু মেন্টাল কনফিডেন্স পায়, দোষের কী আছে?

—না, দোষের কী আছে? একটা বাবাতে সন্তুষ্ট না হয়ে কেউ যদি কুড়িটা বাবা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আমার কি!

ছোটন সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করল, জানিস এই ফুয়াবাবার কী পাওয়ার! এ স্পিরিচুয়্যাল ম্যান। মনে রাখিস এই বিশাল গ্যালাক্সি চালানোর পেছনে একটা স্পিরিট আছে। সেই স্পিরিটে অনেকেই বিশ্বাস করতেন। আইনস্টাইনও।

—ওই নামটা মুখে নাহয় নাই আনলি। তোর ফুয়াবাবার শক্তি বোঝাতে তাঁকে কেন অপমান করছিস? স্বীকার কর, তুই নিজের ভরসায় পৃথিবীতে চলতে পারিস না। স্পিরিট আছে কি নেই সেটা বড় কথা নয়, তুই নিজে একজন রক্ষাকর্তা ছাড়া হেল্পলেস ফিল করিস। আমাকে তুই রক্ষা করতে যাবি কি করে?

—রক্ষা করা সত্যিই খুব কঠিন রে। মানসের মুখচোখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট, বিশেষ করে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষদের। আমরা যারা রাজনীতি করি না, যাদের খুব বেশি টাকাপয়সা নেই, কানেকশন নেই, তারাই আজ সব থেকে বেশি অসহায়। তুই যাদের সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়েছিস, তাদের পাওয়ারের কথা ভাব। টাকার জোর বাদই দে। ধর যে গভর্নমেন্টের চাঁইটা রয়েছে তার কি পুলিশের ওপর মহলে যোগাযোগ নেই? আর প্রোমোটাররা তো পলিটিক্যাল লিডারদের কাঁধ জড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়। তুই-তোকারির সম্পর্ক। কদিন আগে বিরাটিতে যে গণধর্ষণ হয়ে গেল, কেউ কেশাগ্রও ছুঁতে পারল প্রকৃত দোষীদের? নাম কা ওয়াস্তে যাদের ধরেছে, তাদের কলা হবে। পার্টির মহিলা সমিতি পর্যন্ত অবলীলায় বলে দিল ওই মেয়েগুলোরই নাকি চরিত্র খারাপ!

ঝিনুক স্থির চোখে মানসকে দেখছিল। কথাগুলো যে তার বাবার কথা নয়, অন্য কারুর আলোচনা থেকে সংগ্রহ করা পরিষ্কার বুঝতে পারছে। স্থির দৃষ্টিতেই প্রশ্ন করল, আমাকে একটা উত্তর দেবে বাবা? তুমি যে এত কথা বলছ, ধরো ছেলেগুলো যদি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল বাড়ির না হত, যদি আমাদের মতো কোন ফ্যামিলি বা তার থেকেও কোন গরিব বাড়ির হত, তাহলে কি তুমি আমার কোর্টে যাওয়া সমর্থন করতে?

সাধারণত মানস খুব একটা বেশি কথা বলে না, কিন্তু একবার কথা শুরু করলে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের কমে থামার অভ্যাস নেই তার। একটু অসহিষ্ণু মুখেই বলল, এসব তো কাল্পনিক প্রশ্ন। কি হলে কি হত, সে কি আগে থেকে বলা যায়?

ঝিনুক মনে মনে হাসল। তখনও বাবা মা নিশ্চয়ই এভাবেই বাধা দিত। সম্মান! মেয়েদের সম্মান এরকমই ঠুনকো। রাস্তায় অতি সাধারণ ছেলেও অশালীন অঙ্গভঙ্গি করলে মেয়েদেরই বলা হয়, সামলে চলো। আশ্চর্য! যুক্তি দিয়ে বাবা কোন কিছুই বিচার করবে না! করবে না, না করতে চায় না? হয় টেনশানে ভোগে নয়ত নিরুপায়ের মত পারিপার্শ্বিকের কাছে নীরবে আত্মসমর্পণ করে।

ঝিনুক বাবার উদ্বেগ কমাতে চাইল, আমার কোর্টে যাওয়া নিয়ে বেশি ভেবো না বাবা। শরৎবাবু বলছিলেন, ওরা যদি আমাকে পথেঘাটে সামান্যতম ভয় দেখানোরও চেষ্টা করে, ওরা আবার অ্যারেস্ট হবে। তখন কোন ক্ষমতাই ওদের জামিনে ছাড়াতে পারবে না।

সুজাতা মানসকে খাবার দিয়ে গেছে। মানস পরোটা ছিঁড়ছিল, —কে শরৎ?

—শরৎ ঘোষাল। তুমি বোধহয় ওঁকে দেখেছ। ঠাম্মাদের ওল্ডহোমে।

মানস চট করে মনে করতে পারল না।

ঝিনুক আবার বলল, শান্তি পারাবারের হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। কালোমতন। বেঁটেখাটো। কাঁচাপাকা গোঁফ।

ছোটন নতুন করে টিভির সামনে গিয়ে বসেছিল, সেখান থেকেই নাক গলিয়েছে, সে কোর্টে কী করছিল? রুগী মেরে ধরা পড়েছে?

—না। উনি আলিপুর কোর্টের গভর্নমেন্ট ল’ইয়ার।

—হোমিওপ্যাথ ল’ইয়ার? ছোটন যেন একটু আগের বিদ্রূপ ফিরিয়ে দিচ্ছে।

—টিজ করছিস কেন? কোর্টকাছারি করে কি হোমিওপ্যাথি করা যায় না?

—সরকারি উকিল হলে লক্ষ বার করা যায়। আসি যাই মাইনে পাই, কাজ করলে উপরি চাই। খবর নিয়ে দ্যাখ নির্ঘাৎ প্র্যাক্টিস ভাল ছিল না, লাইন করে গভর্নমেন্টের প্যানেলে ঢুকেছে। ওল্ডহোমের লাইনেও টু পাইস ঝাড়ছে।

সুজাতা ব্যালকনিতে টবের পরিচর্যা করছিল। সেখান থেকে চোখ বড় করেছে, ওল্ডহোম থেকে আবার কী রোজগার রে?

ছোটন হাতের মুদ্রায় অদৃশ্য মাছি তাড়াল, সব কি আর ওপর থেকে বোঝা যায়, মা? শেষ বয়সের বুড়িদের সেবা শুশ্রূষা করে…ওখানে অনেক বুড়িরই তো মালকড়ি আছে…

ছোটনের ইঙ্গিতে ঝিনুক খেপে গেল, ওখানে যাঁরা থাকেন, তাঁদের হাল জানিস? তুই তো সাত জন্মে ঠাম্মার কাছে যাস না। দেখেছিস, কী অসহায় অবস্থায় সব পড়ে আছেন?

—আরে যা, ঠাম্মার নিজের কম মালকড়ি আছে? দাদুর লাখ খানেক টাকার ফিক্সড ডিপোজিট, উইডো পেনশান….ঠাম্মার কিছু জুয়েলারিও আছে, তাই না মা? লোকটা হয়ত মালদার বুড়িদের কাছ থেকে টুকটাক হাতায়। আশায় আছে ঠাম্মারা হয়ত উইলে কেউ কিছু লিখে দিয়ে যাবে।

মৃণালিনীর ঘরে চারু ঠাম্মার তোশকের নিচে সার সার কয়েন দেখেছিল ঝিনুক। নাতির জন্য সাজানো। ওই নাতিই নাকি একমাত্র দেখতে আসে ঠাকুমাকে। তোশকের নিচে রাখা কয়েনগুলোর লোভে। ঠাকুমা অন্যমনস্ক হলেই ঝটপট চুরি করে কয়েন সব পকেটে পোরে। চারু ঠাম্মা দেখেও না দেখার ভান করেন। নাতি আসার আগে নিজেই সাজিয়ে রাখেন আধুলি সিকি টাকা। নাতির আসা বজায় রাখতে।

সেই অশিক্ষিত নাতির লোভী মনটার সঙ্গে ছোটনের তফাত কোথায়? ঝিনুকের মনটা তেতো হয়ে গেল।

ঘরে ফিরে আবারও চিঠিগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল ঝিনুক। চিঠিগুলোকে স্পর্শ করলেই মনের সব মালিন্য উধাও হয়ে যায় ঝিনুকের। এক-একটা কাগজের টুকরো আর কয়েক লাইন লেখা কেমন যেন পাকে পাকে বেঁধে ফেলে তাকে। এই বন্ধনে কোন অধিকারের দাবি নেই, কোন আইনের শৃঙ্খল নেই। এ বন্ধন যেন ঠিক বন্ধনও নয়। এ এক সীমাহীন মুক্তির আকাশ। যে আকাশে শঙ্খচিলের মত সোনালি ডানা মেলে উড়ে যায় ঝিনুক। উঁচুতে। অনেক উঁচুতে।

শরৎ ডাক্তার বলেছিল ঝিনুকের কি শেষ পর্যন্ত ধৈর্য থাকবে? শরৎ ডাক্তার বোকা। সে জানে না ঝিনুকের থেমে যাওয়ার ক্ষমতা আর ঝিনুকের হাতে নেই।

পরদিন দুপুরে ঝিনুক বিছানায় শুয়েছিল, ছোটন আড্ডা মারতে বেরিয়েছে, হঠাৎ নীলাঞ্জনা এসে উপস্থিত। ঘরে ঢুকেই প্রশ্নবাণ, কি করছিস রে আজ দুপুরে?

ঝিনুক আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল, ঠিক নেই। স্কুলের মাধুরীদির সঙ্গে সন্ধেবেলা নাটক দেখতে যেতে পারি। অ্যাকাডেমিতে।

—আমি খুব বিপদে পড়েছি রে। অরুণাংশুর সঙ্গে আজ দেখা করতে হবে। ভীষণ নার্ভাস লাগছে। তুই যাবি আমার সঙ্গে?

ঝিনুকের বুঝতে সামান্য সময় লাগল। অরুণাংশু মানে সেই বোস্টন? তিনি তাহলে কলকাতায় ল্যান্ড করেছেন? ঝিনুক গিয়ে কী করবে?

নীলাঞ্জনার মুখে খুশিমাখা লজ্জার ছটা, চল না প্লিজ। চিনি না, জানি না…ভাল করে গুছিয়ে কথাও বলতে পারি না …তুই থাকলে বস্ একটু ভরসা পাই।

—তার মানে তোদের দু বাড়ির কথাবার্তা প্রায় পাকা? এখন শুধু লাস্ট হার্ডল?

—হার্ডল ফার্ডল নেই। ডেট ফিক্সড। শ্রাবণে। নীলাঞ্জনা চোখ টিপল, বিয়ের আগে অরুণাংশু একটু ফরমাল কোর্টশিপ করতে চায়। প্রথমদিন বলেই তোকে বলছিলাম।

ঝিনুক মজা পেল। বাহ, আধুনিকতার হওয়ার সঙ্গে রক্ষণশীলতার মিশেল! চোখ ঘুরিয়ে বলল, আমি কেন কাবাব মে হাড়িড় হব রে?

নীলাঞ্জনার স্বরে তবু অনুনয়, চল না, অরুণাংশু দারুণ উইটি। ব্রাইট। তোর ওকে একদম খারাপ লাগবে না।

নীলাঞ্জনার মুখে বার বার অরুণাংশু ডাক শুনতে অস্বস্তি লাগছিল ঝিনুকের। লেখাপড়ায় এত ভাল হয়েও এই কাঙালপনা কি নীলাঞ্জনাকে শোভা পায়?

ঝিনুক হাই তুলল, নারে, আমাকে ছাড়। মাধুরীদির সঙ্গে প্রোগ্রাম হয়ে আছে। আমার জন্য ওয়েট করবে। তা ছাড়া….

ঝিনুকের কথার মাঝে সুজাতা শরবত নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। দুই বান্ধবীর সঙ্গোপনে কথা বলা দেখে সেও কৌতূহলী— কি ব্যাপার রে?

ঝিনুক চোখ নাচাল, বিয়ে। শ্রাবণে। বিয়ের পর শোঁওওও। দুজনেই স্টেটস।

সুজাতা ফস করে বলে উঠল, সে তো তূণীরও যাবে সামনের বছর।

—তুমি না মা। ঝিনুক মাথা ঝাঁকাল, —কোথায় অফিসে কথা হয়েছে কি হয়নি, তুমিও ধরে নিলে ও যাচ্ছে।

সুজাতা বিরস মুখে বলল, তোমার তো সবেতেই ঠোঁট ওল্টানো স্বভাব। হ্যাঁ রে নীলাঞ্জনা, তোরা একটু ঝিনুককে ধমকাতে পারিস না? এত ডেঁপো হয়ে উঠছে দিন দিন!

নীলাঞ্জনা অবাক হয়ে দুজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

সুজাতা বলল—সেদিন কী করেছে জানিস? ওই গুণ্ডাদের দেখতে উনি কোর্টে চলে গেছিলেন। একাই। কাউকে কিছু না বলে।

ঝিনুক দপ করে জ্বলে উঠল, জনে জনে এত বলার কী আছে? মামার বাড়িতে গিয়ে বলছ! কাকামণিকে বলে এসেছ! চুরি ডাকাতি করেছি নাকি?

—তুই বল নীলাঞ্জনা, বাহাদুরি দেখানো হয়ে গেছে, কাগজে নাম বেরিয়েছে, সবাই ধন্যি ধন্যি করেছে, ব্যস। মেয়েদের কি এর বেশি যাওয়াটা ঠিক?

—ও কী বলবে? ওর নিজের কোন মত আছে নাকি?

নীলাঞ্জনা গা বাঁচাতে চাইল, বাবা মা যখন চাইছেন না…গুণ্ডা বদমাইশও বাড়ছে দিন দিন….

ঝিনুক বান্ধবীর দিকে কটমট করে তাকাল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, নীলু, এটা তোর সাবজেক্ট না। যা বাড়ি গিয়ে এক মনে বোস্টনের ধ্যান কর। আখেরে লাভ হবে।

নীলাঞ্জনাকে এগিয়ে দিয়ে হনহন করে ঝিনুক মানসের ঘরে ঢুকেছে। পিছন পিছন সুজাতাও।

—বাবা, পরিষ্কার করে বলো তো তোমরা কী চাও?

মানসের সামনে রাশিকৃত পরীক্ষার খাতা। সে এখন তার কর্মঘোরে। আদরের মেয়ের দিকে চশমা খুলে তাকাল, কি চাই আমরা?

—তোমরা কি সত্যিই চাও না আমি একটা কজের জন্য লড়ি?

মানস অন্যমনস্কভাবে বলল, —নিশ্চয়ই চাই।

—তাহলে আমাকে সবাই মিলে আটকাতে চাইছ কেন?

মানস খাতার গোছ পাশে সরিয়ে রাখল, রেগে যাচ্ছিস কেন? আমরা মা বাবা, আমাদের তো দুশ্চিন্তা হবেই। তোর বিপদ আপদের কথা ভাবব না?

—আমার জায়গায় ছোটন হলে ছোটনকেও বাধা দিতে?

—দিতাম। মানস গম্ভীর, তবে ছোটনের জন্য ভয়টা একরকম। তোমার জন্য ভয় আর এক রকম। আফটার অল তুমি মেয়ে।

—ছোটবেলা থেকে তো এ কথা বলোনি? বলেছ ছেলেও যা, মেয়েও তাই। আজ অন্য কথা উঠছে কেন?

মানসের আগে এবার সুজাতা ঝাঁঝিয়ে উঠেছে, লেখাপড়া শেখানো হয়েছে, চাকরি করতে দেওয়া হয়েছে, তাতেই কি তুমি পুরুষমানুষের সমান হয়ে গেলে নাকি?

ঝিনুকের গলার কাছে একটা কান্না দলা পাকাচ্ছিল। কে বলেছে সে পুরুষমানুষের সমান হতে চায়? কখখনো না। সে একটা মানুষ হতে চায়।

পুরো মানুষ।

.

নয়

মাত্র কুড়ি দিনের জন্য এবার দেশে এসেছে প্রমিতা। সিঙ্গাপুর ব্যাংককে মিহিরের কয়েকটা কাজ আছে, কাজ সেরে সেও কলকাতায় দু-চার দিনের জন্য আসবে। তারপর বউ-বাচ্চা নিয়ে অগাস্টের প্রথমে আবার মন্ট্রিল। মিহিরদের নিজস্ব বাড়ি মানিকতলায়। বড় বাড়ি। বড় সংসার। কদিনের জন্য দেশে এসে শ্বশুরবাড়িতে প্রমিতা কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে। বারাসতে বাবা মা-র কাছেই সে বেশি স্বচ্ছন্দ। মানিকতলায় গিয়ে থেকে আসে এক-আধ দিন। এবারে জোর করে রমিতাকেও বারাসতে ধরে এনেছে। দীর্ঘ আট মাস পর দুই মেয়েকে একসঙ্গে পেয়ে দীপ্তি তপন ভুলে গেছে উদ্বেগের দিনগুলো। দুজনেই খুশিতে আত্মহারা। তপন অফিস ছুটি নিয়ে বসে আছে। একদিন সকলে মিলে নবদ্বীপ মায়াপুর ঘুরে এল, পরদিনই ছুটেছে ইছামতীর দিকে। প্রমিতা বাপের বাড়ি এলে চঞ্চলা কিশোরী হয়ে যায়। রমিতার মনেও পলকের জন্য মেঘ জমার অবকাশ নেই এ বাড়িতে। দুদিন ধরে বর্ষার আকাশটাও এমন হাসিখুশি ছিল যেন সেও এ বাড়ির আনন্দের অংশীদার।

যশোহর রোডের দিকে, একটু ছিমছাম পরিবেশে তপনের ছোট্ট একতলা বাড়ি। ব্যাঙ্ক অফিসার হওয়ার সুবাদে অফিস থেকে অল্প সুদে ঋণ নিয়ে তৈরি করা। বাড়িটা ঘিরে বেশ কিছুটা ফাঁকা জমি। দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর দীপ্তি-তপনকে বাগান করার নেশায় পেয়েছে। নানারকম সবজি আর ফুলে ফুলে মনোরম হয়ে উঠেছে জায়গাটা। পূবে পাঁচিলের ধারে বড় একটা কাঁঠালগাছ। বাড়িতে ঘর বেশি নেই, গোটা দক্ষিণ দিক জুড়ে বিশাল এক গোলবারান্দা। তাদের শ্যামবাজারের দমচাপা ভাড়াবাড়ির তুলনায় এ বাড়িতে আলো-বাতাস অনেক অনেক বেশি।

রমিতা বারান্দায় একলা বসে তার প্রিয় কুকুরের গা থেকে পোকা বাছছিল। তিন বছরের ছোট্ট জার্মান স্পিৎজ। ধবধবে সাদা। রমিতাই আদর করে নাম রেখেছিল ভক্তপ্রসাদ। তার বিয়ের পর ভক্তপ্রসাদ বেশ রোগা হয়ে গেছে। নোংরাও। ঘন লোমের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কালো পোকা সহজে বার করা যায় না। দু আঙুলের নখে টিপে টেনে বার করতে হয়। একটু অন্যমনস্ক হলেই পোকারা পালিয়ে যায় শ্বেত অরণ্যে।

প্রমিতা হুমহুম করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তার কাঁধ অব্দি কোঁকড়ানো চুল ফুলে ফেঁপে আলুথালু। নাইটির ওপরের দুটো বোতাম খোলা। পিঠ বেয়ে ঝুলছে তার মেয়ে টুকি। সে আদিবাসী রমণীর মত সারাক্ষণ পিঠে মেয়ে নিয়ে ঘোরে। ওইটুকুনি এক বছরের মেয়ের ওজন এত বেশি যে তাকে কোলে নিয়ে ঘোরার জন্য রীতিমত শক্তির দরকার।

রমিতার সামনে এসে ধপ করে মাটিতে বসল প্রমিতা,—আজকেই কেন যাচ্ছিস রে? আর দু-একদিন থাক না।

রমিতা মুখ তুলে দিদির দিকে তাকাল। সে এখন প্রায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তার চোখের কোণে আর কালি নেই, কথায় কথায় বুকে আর বাজ পড়ে না। পুরনো রূপের দীপ্তি ছাপিয়ে সে এখন আরও বেশি আকর্ষণীয়। লেসের কাজ-করা হাল্কা নীল নাইটিতে সে উর্বশীকেও হার মানায়। ভক্তপ্রসাদকে আদর করে মুখে ছদ্ম করুণ ভাব ফোটাল রমিতা,—যেতেই হবে রে। জরুরি কাজ আছে।

—মারব এক থাপ্পড়। দুদিন পলাশকে না দেখেই প্রাণ আইঢাই করছে, না? আমি বলে দিচ্ছি রুমু, বর নিয়ে বেশি আদিখ্যেতা করিস না, ওরা তার যোগ্য নয়। এক নম্বরের বেইমান সব।

—কেন রে, মিহিরদা তোকে লুকিয়ে ডেটিং-ফেটিং করছে নাকি?

—ধুর। পাল পাল বিকিনি-পরা মেয়ে দেখতে হবে বলে ভয়ে সি-সাইডেই যেতে চায় না। যত হুজ্জুতি বউ-এর ওপর। বাড়িতে থাকলে সিগারেটের ছাইটা পর্যন্ত নিজে উঠে ফেলে না, শুধু হাঁকাহাকি, মিতু অ্যাশট্রেটা নিয়ে এসো তো। বলতে বলতে প্রমিতা আচমকা জড়িয়ে ধরল বোনকে,—সুন্টুমুন্টু, তুই আজ যাস না প্লিজ।

রমিতার বুকে একটা চাপা উত্তেজনা গুড়গুড় করছিল। আজই রিপোর্টটা নিয়ে আসবে পলাশ। হে ভগবান, সন্দেহটা যেন মিথ্যে হয়। রমিতা একবার ভাবল কথাটা বলে ফেলে দিদিকে, পরক্ষণে মন বদলেছে,—নারে দিদি, আজ যেতেই হবে। সত্যিই কাজ আছে।

টুকি হাত বাড়িয়ে ভক্তপ্রসাদের নোম ধরে টানছে। থপথপ দু পা এগিয়ে একেবারে মুখে হাত ঢুকিয়ে দিল। মুহূর্তে দুই বোন সেদিকে মনোযোগী। রমিতা টুকিকে কোলে টেনে নিতেই গরগর করে উঠেছে ভক্তপ্রসাদ।

প্রমিতা হেসে লুটিয়ে পড়ল,—ওমা, কী হিংসুটে রে!

রমিতা টুকির গালে চুমু খেল,—মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে মানুষের মতই অভ্যেস হচ্ছে আর কি।

প্রমিতার মাথায় সব সময়েই কোনও না কোনও পরিকল্পনা চলছে। এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তায় যেতে তার সময় লাগল না,—তুই তো বিকেলে চলে যাবি, চল না এখনই পার্লার থেকে ঘুরে আসি। সুপার মার্কেটে নতুন একটা বিউটি পার্লার খুলেছে শুনলাম? ফেসিয়াল করে আসি চল। আমার চুলটাও একটু ট্রিম করাতে হবে।

—বারাসতে! ইসস, তোর কী টেস্ট হয়েছে রে দিদি! আমি এখানে মরে গেলেও করব না।

—উম্ম্, আট মাসে অনেক বদল হয়েছে দেখছি। ছিলি তো স্যামবাজারের সসীকলা। বালিগঞ্জে গিয়েই ওমনি বালিগঞ্জের বিবি!

—বালিগঞ্জ নয়, টালিগঞ্জ। আর আমি বিউটি পার্লারে যাই ভবানীপুরে। শাশুড়ির বান্ধবীর পার্লারে। দারুণ থার্মোহার্ব করে। বলিস তো তোকেও এক দিন নিয়ে যেতে পারি। আমার শাশুড়ি জা-রাও সব ওখানে যায়।

—অদ্দূর! আচ্ছা ওদিকে কি একটা বড় মার্কেট হয়েছে না! ডিফারেন্ট স্টেটের দোকানপাট আছে! ভাল শাড়ি পাওয়া যায়…! তৃষ্ণা লাস্ট বার এসে ওখান থেকে দুর্দান্ত দুটো বোমকাই আর নারায়ণপেট কিনে নিয়ে গেছে।

কোলে টুকিকে নিয়ে রমিতা ঝকঝকে সবুজ মোজাইকের মেঝেতে পা ছড়িয়ে দিল। সকালে লুচি খেয়ে এখনও কেমন গা-টা গুলোচ্ছে। একটা ছোট্ট ঢেকুর তুলে রমিতা বলল,—তুই কি দক্ষিণাপণের কথা বলছিস?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, ওইরকমই কি একটা নাম। ওটা ভবানীপুরে না?

দিদির অজ্ঞতায় মজা পেল রমিতা। তার দিদিটা মিহিরদার সঙ্গে তিনটে মহাদেশের অনেকটাই ঘুরে ফেলেছে। কিন্তু কলকাতাটা মোটেই ভাল করে চেনে না। হাসতে হাসতে বলল,—ভবানীপুরে নয়। ঢাকুরিয়ায়।

প্রমিতা সঙ্গে সঙ্গে ছক কষতে শুরু করে দিয়েছে,—ওখান থেকে তোর শাশুড়ির বিউটি পার্লার কত দূর?

—তেমন দূর নয়।

—তা হলে চল খেয়ে উঠে বেরিয়ে পড়ি। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা আগে তোর দক্ষিণা বনে যাই চল। কয়েকটা ভাল শাড়ি কিনতে হবে।

রমিতা সংশোধন করে দিল,—বন নয়, পণ। দক্ষিণ আপণ, দক্ষিণাপণ।

—ওই হল। প্রমিতা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল,—চল। আজ নাহয় মানিকতলাতে থেকে যাব।

রমিতা আমতা আমতা করল,—কিন্তু আমার যে বাবার সঙ্গে যাওয়ার কথা?

—বাবা আর গিয়ে কী কররে? বিউটি পার্লারের বাইরে বসে থাকবে? কোনও দরকার নেই। তুই ভবানীপুর থেকে একা শ্বশুরবাড়ি ফিরতে পারবি না?

প্রমিতা জেটপ্লেনের গতিতে পরিকল্পনা ভাঁজতে পারে, রকেটের গতিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, আলোর গতিতে একাই হিল্লিদিল্লি করে বেড়াতে পারে। বারাসত থেকে ঢাকুরিয়া, ঢাকুরিয়া থেকে ভবানীপুর, ভবানীপুর থেকে মানিকতলা। কিন্তু রমিতা তো প্রমিতা নয়। দু মাস আগে হলেও না হয় কথা ছিল, এখন প্রশ্নই আসে না। পলাশের সঙ্গে সম্পর্ক আবার বেশ সহজ হয়ে এসেছে, সে হয়তো কিছু মনে করবে না, কিন্তু পলাশের বাবা মা? রমিতার বুক ধুকপুক করে উঠল। সন্দেহটা আবার খচখচ করে উঠেছে। হে ভগবান যেন মিথ্যে হয়। যেন মিথ্যে হয়।

প্রমিতা প্রখর বুদ্ধিমতী। বোনের মুখ দেখেই সে দ্বিধাটা অনুমান করে নিয়েছে। মমতামাখা গলায় বলল,—ভাবিস না, আমি তোকে তোর শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব।

বেলা বাড়ছে ক্রমশ। কাঁঠালপাতার ফাঁক দিয়ে শ্রাবণের লাজুক সূর্য আলোর সংকেত পাঠাচ্ছে। তপন হুইলছিপ নিয়ে কাকভোরে বেরিয়ে গেছে, এখনও তার দেখা নেই। কাল রাত্রে দুই মেয়ের সঙ্গে বাজি হয়েছে, মেয়েদের নিজের হাতে ধরা মাছ খাওয়াতে না পারলে সে বুঝি এ বেলা আর ফিরবেই না। টুকি রমিতাকে ছেড়ে টলমল পায়ে কখন ভিতরে চলে গিয়েছিল, দীপ্তি নাতনির হাত ধরে বেরিয়ে এসেছে। তার চিন্তিত চোখ ঘুরেফিরে গেটের দিকে।

প্রমিতা মাকে বলল,—আমি দুপুরে রুমুর সঙ্গে বেরোব ভাবছি। কিছু মার্কেটিং সেরে রুমুকে ওর শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আজ মানিকতলায় থেকে যাব। তুমি এক রাত্তির টুকিকে সামলাতে পারবে না?

টুকির তেমন বিশেষ বায়নাক্কা নেই। দাদু দিদার সঙ্গে ভাল ভাব হয়ে গেছে, মাকে ছেড়ে দিব্যি থাকতে পারবে। তাকে নিয়ে ভাবছিল না দীপ্তি। অন্য ভাবনায় তার কপালে ভাঁজ পড়েছে,—তোর রুমুকে পৌঁছতে যাওয়া কি ঠিক হবে?

—তোমরা কী মা! সব সময় এমন ভাব করে আছ যেন রুমি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে!

দীপ্তি ভয়ে ভয়ে বড় মেয়ের দিকে তাকাল। তার গায়ের রঙ অসম্ভব ফর্সা, গড়ন ছোটখাটো, রোগাটে। বড় বড় টানা চোখে তার সর্বদাই ত্রাস লেগে থাকে।

প্রমিতা উত্তেজিত মুখে বলল,—হয়েছেটা কি শুনি? কী এমন হয়েছে? কয়েকটা হুলিগান রাস্তায় রুমুর সঙ্গে অসভ্যতা করেছিল, তাই তো? নোংরামি তো তারা করেছে। ধরাও পড়েছে। অ্যান্ড দে উইল বি পানিশড্। ওভার। এতে এত ভেঙে পড়ার কী আছে?

দীপ্তির দীর্ঘশ্বাস পড়ল,—এতো আর তোমার কানাডা আমেরিকা নয়, এ হল ভারতবর্ষ। এ দেশে মেয়েদের যে কত যন্ত্রণা!

—রাবিশ। ও দেশেও মেয়েরা এমন কিছু সুখে নেই। রেপ মলেস্টেশান তো ওখানে মুড়ি-মুড়কি। যে দেশ যত অ্যাডভানসড, মেয়েদের অবস্থা সেখানে তত বেশি খারাপ। জানো, ইউ এস এ-তে ঘটা করে রেপ ক্লক লাগানো হয়েছে? কি, না সারা দেশে যত রেপ হবে ঘড়ি তার হিসেব দিতে থাকবে। কী ঘেন্না!

—তা হোক, ও দেশে কেউ এ সব নিয়ে তেমন মাথাও ঘামায় না, কাদাও ছেটায় না।

—সব দেশই এক মা। রেপড্ মেয়েদের ওখানেও কিছু দেবী জ্ঞান করে না। তফাত এটুকুই, ও দেশের মেয়েদের সাহস একটু বেশি, তাই একটু বেশি প্রোটেস্ট করে, এই যা। এখানেও দরকার হলে রুমু কোর্টে গিয়ে ছেলেগুলোর মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে আসবে। কিরে রুম, পারবি না?

রমিতার রক্তপ্রবাহ দ্রুত হল। চোখের সামনে শ্রবণা সরকার উন্মত্তের মত একটা ভারী ব্যাগ ঘুরিয়ে চলেছে। আঘাত হানছে।

দীপ্তির মুখে ছায়া ঘনাল,—ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যেতে দিলে তো। যা ওদের টনটনে বংশগরিমা!

—ওরা পিকচারে আসছে কোখেকে! এটা এনটায়ারলি রুমুর প্রবলেম। বড়জোর বলা যায় রুমু আর পলাশের প্রবলেম। তেমন ট্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করলে পলাশ ও বাড়ি ছেড়ে দিক। ইঞ্জিনিয়ার ছেলে, ভাল রোজগার করে, দিব্যি থাকবে দুজনে।

রমিতার এতক্ষণে হাসি পেল। পলাশ বাবা মা-র মুখের ওপর কথা বলবে! নিজেকেই কি শাসন করার ক্ষমতা আছে পলাশের?

টুকি গ্রিলের ধারে গিয়ে তা-তা-তা-তা করে চিৎকার করছে। তপনকে দেখেই তার এই উল্লাস। তপনের এক হাতে দড়িতে ঝোলানো বড় রুইমাছ, অন্য হাতে হুইল ছিপ। বিকট হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে আসছে সে, —তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয়…

প্রমিতা দৌড়ে গিয়ে বাবার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল মাছটা। মাছটার গায়ে হাত বুলিয়েই চিৎকার করে উঠল,—তুমি হেরে গেছ। তুমি হেরে গেছ। এটা বরফের মাছ।

তপন বেশ লম্বা-চওড়া। নাক চোখ মুখ গ্রিক ভাস্কর্যের মতো কাটা কাটা। এক সময়ে সে ময়দান কাঁপিয়ে ফুটবল খেলেছে, স্টেট ট্রায়ালেও ডাক পেয়েছিল, ব্যাঙ্কের চাকরিটাও তার খেলার দৌলতেই। শক্তসমর্থ পেটানো শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠল তপন,—ধরে ফেললি! এখনও ঠাণ্ডা ভাবটা যায়নি, নারে? দুলালকে কত করে বললাম মাছটা আরেকটু জলে ভিজিয়ে রাখ!

—তুমি এতক্ষণ বসে থেকেও মাছ ধরতে পারলে না? রমিতা জলতরঙ্গের মতো হাসছে,—নিশ্চয়ই পুকুরপাড়ে বসে গান গাইছিলে, এসো এসো আমার চারে এসো…

—মাছেরাও চালু হয়ে গেছে রে। আজকাল আর স্ট্যান্ডার্ড চার খেতে চায় না। এবার থেকে চাউমিন আর রোলের কুচি দিতে হবে। হা হা।

দীপ্তি মাছ নিয়ে ভিতরে চলে গেল। তপন নাতনিকে শূন্যে ছুঁড়ে দু হাতে লুফে নিচ্ছে। টুকি বেজায় খুশি। এ ধরনের খেলাই তার বেশি প্রিয়। সে অনবরত বলে চলেছে, তা-তা-তা-তা…

বারকয়েক লোফালুফি করার পর তপন ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল,—দাঁড়ারে বিটি, একটু জিরিয়ে নিই। কী খাওয়াস রে মিতু টুকটুকিকে? যা সলিড হয়েছে…!

প্রমিতা বলল,—ও দেশে সিরিয়াল খুব ভাল। খাবারে ওরা ভেজাল দেয় না।

—সে জন্যই তো মিহিরকে বলি, এ দেশে ফেরার আর নাম কোরো না।

—না বাবা, তুমি একদম ওকে উসকিও না। আমি বলে দেশে পালিয়ে আসতে পারলে বাঁচি।

রমিতা বাবার পাশে চুপটি করে বসেছিল। এখনও বাবার পাশে বসে থাকলে এমন একটা প্রশান্তি আসে! সে ঠোঁট ওল্টালো,—বিদেশে থাকলে ওরকম সবারই একটু দেশের জন্য প্রাণ কাঁদে। একবার ওখানে থাকা অভ্যেস হয়ে গেলে এখানে এসে টিকতে পারবি? যা হরিবল্ অবস্থা এখানকার!

—যে অবস্থাই হোক, মেয়ের বয়স দশ বছর হলে আমি আর ও দেশে নেই। চোখের সামনে দুধের মেয়ে নাচতে নাচতে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ডেটিং করতে বেরিয়ে যাবে, আর আমি সেই মেয়েকে পিল গিলিয়ে যাব! অসম্ভব।

রমিতা ভুরু নাচাল,—মিহিরদা যদি না আসতে চায়?

—ওর ঘাড়ে কটা মাথা আছে আমাকে ছেড়ে থাকবে?

মিহিরদাটা কী ভাল! রমিতার বুক চিনচিন করে উঠল। পলাশ আরও বেশি হেরে যাচ্ছে মিহিরদার কাছে।

তপনের ভাবনাও রমিতার মত ঘন ঘন বদলায়। সে বলল,—সেই ভাল। বিদেশ-বিভুঁয়ে কেন পড়ে থাকবি? এবারেই আমি মিহিরকে খোঁচাতে শুরু করছি।

জোলো হাওয়া শুরু হল। দু দিন অবসরের পর বর্ষার সৈনিকরা উর্দি পরে সার সার জড়ো হচ্ছে আকাশে। প্রমিতা ঝামর চুল পাকিয়ে বড়িখোঁপা করে ফেলল। বড্ড উড়ছে। বোনকে বলল,—যা না, বাবার জন্য একটু কফি করে আন না। আমার জন্যও আনিস।

রমিতা উঠে যেতে প্রমিতা তার বাবার কাছ ঘেঁষে বসল। তপনকে সবিস্তারে শোনাচ্ছে আজকের কর্মসূচি।

তপন চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবল একটু, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়েছে, —তুই রুমুকে নিয়ে যাবি বলছিস? যা। বলিস তো আমিও সঙ্গে যেতে পারি।

—আচ্ছা বাবা, ব্যাপারটা কী বলো তো? মা বলছিল, পলাশ নাকি চায় না রুমু কোর্টে সাক্ষী দিতে যাক?

তপন হতাশভাবে হাত ওল্টালো।

—কোর্ট সমন পাঠালে না গিয়ে পার পাবে?

—কোর্টের হুকুমে ঘোড়া ঝরনার ধার অব্দি যেতে পারে, কিন্তু জল খাবে কি না সেটা তো ঘোড়ার ব্যাপার। জোরে কথা বলা তপনের মজ্জাগত অভ্যাস। ভিতরের দিকটা একবার দেখে নিয়ে সে প্রাণপণ চেষ্টায় গলা নামাল, —পলাশকে নাকি কারা ভয় দেখিয়েছে। কোর্টে গিয়ে রুম যেন বলে কাউকে চিনতে পারছে না। কে জানে বাবা সত্যি না মিথ্যে। আমার ধারণা পলাশ ডজ্ করছে। ভয় দেখানোটা ফলস। নিজেই আর এগোতে চায় না। প্রেস্টিজ!

—এ কিরকম কথা! প্রমিতা ভীষণ বিরক্ত হল,—রুমু জানে?

—বোধহয় না। আমাকে তো কিছু বলেনি রুমু।

—বাহ, রুমুর মানসম্মান পলাশের মানসম্মান নয়? রুমু কি আমাদের ফ্যালনা? তেমন হলে চলে আসুক, ওখানে থাকতে হবে না। দেখি বাছাধন তারপর কি করে!

তপনের গলা ভারী হল,—তুই এসেছিস বলে তাও দু দিন মেয়েটার একটু হাসিমুখ দেখতে পেলাম। অত জলি মেয়ে সব সময় সাজত গুজত…বেড়াত ঘুরত…এটা কিনছে সেটা কিনছে…এক দিনে সেই মেয়ে…

—এটা আবার রুমুর বেশি বাড়াবাড়ি। তোর কি রে? তুই তো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবি! তোমরাও ওকে বড় ফুলটুসি করে মানুষ করেছ বাবা। শ্রবণা সরকারকেই দ্যাখো না। সেও তো আমাদের মতো ঘরেরই মেয়ে!

—আমার যদি রক্তের জোর থাকত, আমিই ওই ছেলেগুলোকে দেখে নিতাম। তপন গলা চড়াতে গিয়েও সামলে নিল,—এখানে তোর মার কাছে এসেও অনেকে আহা উহু করে গেছে, আমাকে ঘাঁটাতে সাহস পায়নি। ভেবেছিলাম একবার ওই শ্রবণা মেয়েটার বাড়ি যাব, রুমুর কথা মনে করেই নিজেকে আটকালাম। ওর শ্বশুরবাড়ি যখন চায় না…! যদি ওর কোনও ক্ষতি হয়ে যায়!

—রুমুও শ্রবণার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি?

রমিতা দু হাতে কফিমগ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। তার চোখ বিস্ফারিত। লালচে মুখে একবিন্দু রক্ত নেই। হা ভগবান, এখানেও তাকে নিয়ে ফিসফাস!

পার্লার থেকে বেরিয়ে এবারও আফসোস হল রমিতার। কিছুতেই মুখ ফুটে গাছপালার নির্যাসে তৈরি তার ‘মুখটাকে’ চাইতে পারল না। মুখ? না মুখোশ? যাই হোক, তারই তো মুখের ছাপ। কী চমৎকার কায়দা করে মুখে লেপে দেয় লেইটা। শুকিয়ে গেলে নিপুণ কৌশলে চড়চড় করে উঠে আসে শুকনো ভেষজ মুখোশ। ওই মুখোশে লেগে থাকে রোমকূপের প্রতিটি ময়লার কণা। মুখ হয়ে ওঠে আরও চকচকে। মসৃণ। একটা ছোট্ট নিশ্বাস জমাট বাঁধল রমিতার বুকে। জীবনটাও যদি এরকম হত! লেপে দেওয়া কলঙ্ক শুকিয়ে যাওয়ার পর চড়চড় করে টেনে তুলে নিত কোনও নিপুণ যাদুকর! জীবন ফিরে আসত আরও গাঢ় উজ্জ্বলতায়!

প্রমিতা বোনের শাশুড়ির বান্ধবীর সঙ্গে হাত মুখ নেড়ে কথা বলছে। তিনিও কানাডা প্রবাসী খদ্দের পেয়ে আহ্লাদে ডগমগ। তার পরিচর্যা করা প্রৌঢ়া মুখে খেলে বেড়াচ্ছে লাস্য। নিখুঁত প্লাক করা ভরুতে, আইলাইনার-রঞ্জিত চোখে ব্রীড়ার আভাস। ববকাট চুলে হিল্লোল তুলে সে বলল,—আবার এসো কিন্তু।

মহিলার কচি কচি হাবভাব দেখে দুই বোন বাইরে এসে হেসে কুটিপাটি। রাস্তার লোকজন তাদের ঘুরে ঘুরে দেখছে, প্রমিতার ভূক্ষেপ নেই। সে আজ মন ভরে বাজার করেছে। বেশ কিছু শাড়ি আর ড্রেস মেটিরিয়াল। টুকিটাকি বাহারী ঘর সাজানোর জিনিস। দিলদরিয়া মেজাজে বোনের জন্য একটা দামী পছমপল্লী শাড়ি। মা আর শাশুড়ির জন্য তাঁত সিল্ক। গাদাখানেক প্লাস্টিক ব্যাগের ভারে সে একবার ডানদিকে হেলে পড়ছে, একবার বাঁদিকে। অনেকটা চিলড্রেনস পার্কের ঢেঁকুচকুচের মত।

দুপুর থেকে বেশ কয়েক দফা ঝমঝম বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনও বারিকণা পরাগরেণু হয়ে উড়ছে বাতাসে। ভিজে পিচের ওপর হিরের কুচির মতো রাস্তার আলোর বিচ্ছুরণ। সন্ধ্যা ঘন।

এত ঘোরাঘুরি করেও প্রমিতার ক্লান্তি নেই, হাজরার মোড়ে এসে সে বলল,—এই, মেট্রোতে যাবি? কলকাতার মেট্রো রেল এত সুন্দর…

রমিতা সজোরে মাথা ঝাঁকাল দুদিকে,—না না না না। ট্যাক্সিতে চল। ট্যাক্সিওয়ালা প্রমিতার সঙ্গে সুবিধা করতে পারল না। সে উত্তরেও যাবে, দক্ষিণেও যাবে।

ট্যাক্সিতে বসে পাহাড়ী স্রোতস্বিনীর মতো অবিরল কলকল করে চলেছে প্রমিতা। তার স্বামী কত উদাসীন। বউ-এর জন্য একটা পারফিউম পর্যন্ত কিনে আনে না। শ্বশুর শাশুড়ি আবার কানাডা যাওয়ার বায়না ধরেছে। প্রমিতার ইচ্ছে, এবার নিজের মা বাবাকে নিয়ে যাওয়ার। কলকাতা আসার সঙ্গে সঙ্গে জা ননদরা কিভাবে কসমেটিকসগুলো খতিয়ে নিল। দেশে আসার আগে তারা আলাস্কা বেড়াতে গিয়েছিল। কী ঠাণ্ডা! কী ঠাণ্ডা! বরফের মরুভূমি! মিহিরের খুব ইচ্ছে টুকিকে এখনই সাঁতার শেখাবে। প্রমিতা রাজি নয়। ইত্যাদি। ইত্যাদি। অজস্র শব্দমালা জলপ্রপাতের উচ্ছ্বাস নিয়ে রমিতার কানে আছড়ে পড়েই ছেতরে যাচ্ছিল। দু-চারটে হুঁ হাঁ ছাড়া রমিতা শব্দহীন। দিদিটা কী সুখী! দিদিটা কী সুখী!

রাসবিহারী মোড়ে ট্যাক্সি আটকে রয়েছে অনেকক্ষণ। ট্রাফিক জ্যাম। প্রমিতার ছটফটে চোখ ট্যাক্সির বাইরে,—ওফ কলকাতায় কী মানুষ বেড়ে গেছে রে!

রমিতা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিল। ডানদিকের ফুটপাথ ধরে ওটা কে হাঁটছে! শ্রবণা সরকার না! ঘন নীলের ওপর সাদা টিপ টিপ কামিজ! সাদা সালোয়ার! সাদা ওড়না! হ্যাঁ শ্রবণাই তো। সঙ্গে একটা লম্বা ছেলে। দুজনে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছে রমিতাদের ট্যাক্সির দিকেই। রাস্তা পার হওয়ার সময় চোখ দুটো কি রমিতাকে ছুঁয়ে গেল! রমিতার চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করল, শ্রবণাদি, আমি রমিতা। শ্রবণাদি, আমি এদিকে। শ্রবণাদিইই…। কণ্ঠে কোনও স্বরই ফুটবল না। গলা শুকিয়ে কাঠ। নাড়ির গতি অস্বাভাবিক চঞ্চল। শ্রবণা হারিয়ে গেল জনারণ্যে। রমিতা ট্যাক্সির সিটে মাথা রাখল। হাঁপাচ্ছে অকারণে। প্রমিতা খেয়ালই করল না বোনকে। ট্যাক্সি স্টার্ট নিতে সেও হেলান দিয়েছে সিটে,—বাব্বাহ, বাঁচলাম।

গলফ্ ক্লাব অ্যাভিনিউ এগিয়ে আসছে। প্রমিতা বলল,—অনেক রাত হয়ে গেছে রে। আটটা বাজে। আমি কিন্তু নামছি না।

রমিতা শিথিল চোখে দিদির দিকে তাকাল। সেও ঠিক চাইছিল না প্রমিতা নামুক। দিদির সঙ্গে এত রাতে ফেরাটা কি মনে নেবে সবাই কে জানে! মুখে তবু বলল,—একবার অন্তত নাম। মুখ দেখিয়ে চলে যাবি।

প্রমিতা থমকাল,—আমি না নামলে তোর অসুবিধে হবে?

—না না, তা কেন! ওরা এমনিতে মোটেই তেমন খারাপ লোক না। রমিতা সামান্য অপ্রস্তুত হল,—তোকে দেখলে শাশুড়ি খুশিই হবে।

—আজ থাক। যাওয়ার আগে একদিন দেখা করে যাব। ডেফিনিট। তুই একটু বুঝিয়ে বলে দিস।

রমিতাকে ছেড়ে দিয়ে ব্যাক করে বেরিয়ে গেল ট্যাক্সিটা। শাড়ির প্যাকেট হাতে রমিতা দোতলায় উঠল। সহসা হাঁটুতে যেন জোর পাচ্ছে না সে। কদিন ধরে জমে থাকা সংশয় চরকি খেতে শুরু করেছে আবার। আঙুলের প্রবালটা ছুঁয়ে আশ্বাস পেতে চাইল রমিতা, হে ভগবান, সন্দেহটা যেন মিথ্যে হয়।

পলাশ মা-র সঙ্গে বসে টি ভি দেখছিল। বাড়িটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। মনে হয় লীনা-অশোক নেই।

রমিতার পায়ের শব্দে দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়েছে। রমিতা শাশুড়ির সামনে এসে দাঁড়াল,—দিদি নামিয়ে দিয়ে গেল। দেখুন, কী সুন্দর একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে আমাকে!

বাক্স খুলে শাশুড়ি উল্টেপাল্টে দেখল শাড়িটা। নরম গোলাপি জমির ওপর চকোলেট রঙের নক্সা,—বাহ, কত নিল?

—চোদ্দশ। ডিসকাউন্ট দিয়ে বারো শ টাকা।

—খুউব সুন্দর হয়েছে। তা দিদি উঠল না কেন?

—মানিকতলায় ফিরবে তো। আসবে এর মধ্যে একদিন।

—তুমি আরও দু-একদিন ওখানে থেকে এলেই পারতে। কতদূর থেকে দিদি এসেছে। শাশুড়ি খুব মিষ্টি করে হাসল।

পলাশের চোখে চোখ পড়ে গেল রমিতার। দ্রুত সন্দেহটার উত্তর খুঁজল পলাশের মুখে। বুঝতে পারল না।

স্টার টি ভি-তে বিদেশী চিত্রতারকাদের বিচিত্র জীবনযাপনের দৃশ্য দেখাচ্ছে। শাশুড়ির চোখ আবার সেই ঐশ্বর্যের অপরূপ প্রদর্শনীতে মগ্ন। দু-এক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে রমিতা নিজের ঘরে এল।

পলাশও পিছন পিছন এসেছে। রমিতা কোনও প্রশ্ন করার আগেই তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল শূন্যে। বনবন করে দু পাক ঘুরে যুগ্ম শরীর গড়িয়ে পড়েছে বিছানায়। রমিতা কোনওরকমে নিজেকে মুক্ত করল, —কি করছটা কি! দরজা খোলা রয়েছে না! মা বসে আছেন…!

পলাশ তাড়াতাড়ি উঠে দরজা ভেজিয়ে আবার বিছানায় এসে বসল,—উফ, যা ঘাবড়ে দিয়েছিলে! কতক্ষণ থেকে তোমার জন্য বসে আছি। আজ তুমি না ফিরলে…সারা রাত আমি বারান্দায় বসে থাকতাম।

রমিতা পাশ ফিরে আধশোওয়া হল। দ্রিম্দ্রিম্ দ্রিম্দ্রিম্!

—রিপোর্ট এনেছ?

—কি মনে হয়? রমিতার আফোটা রজনীগন্ধার মত আঙুল নিয়ে খেলা করছে পলাশ,—এনেছি গো, এনেছি।

দ্রিম্দ্রিম্ দ্রিম্দ্রিম্ দ্রিম্দ্রিম্ দ্রিম্দ্রিম্, —কি বলছে রিপোর্টে!

পলাশ রমিতার চোখে গাঢ় দৃষ্টি রাখল,—এখনও উত্তর পাওনি?

রমিতার শরীরটা শিথিল হয়ে গেল।

পলাশ আদরে আদরে অস্থির করছে তাকে,—কী হবে গো? ছেলে? না মেয়ে?

সন্দেহটাই সত্যি হল! হা ভগবান।

—এনি বডি ইজ ওয়েলকাম। পলাশ তরলভাবে বলে চলেছে,—তবে মেয়ে হলে আমার বেশি ভাল লাগবে।

রমিতা চোখ বুজে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে ভবিতব্যটাকে। পলাশ ভাবছে তার আদর উপভোগ করছে রমিতা।

—কি গো, কথা বলছ না যে? তোমার কী চাই?

মেয়ে হলে কি আবার রমিতা? নাকি শ্রবণা সরকার? রমিতার ঠোঁট অল্প ফাঁক হল,—ছেলে হওয়াই তো ভাল।

—এহ, তোমার ছেলে ভাল লাগে?

—মন্দ কি। বেশ ডানপিটে হবে। হাতে পায়ে দস্যি। গুণ্ডা গুণ্ডা।

—তুমি খুব গুণ্ডা ভালবাস, না? পলাশ ফিকফিক হাসছে।

রমিতা মুহূর্তের জন্য নিথর। পলাশ বুঝল কথাটা বলা ঠিক হয়নি। বউকে সহজ করার জন্য ঠোঁটে পলকা চুমু খেল, —ঠাট্টাও বোঝ না? আজকাল ছেলে-মেয়ে সবই সমান। চাও তো টেস্ট করিয়েও নিতে পারো। আগে থেকেই জেনে যাবে ছেলে হবে, না মেয়ে হবে।

রমিতার চোখ পলাশকে ভেদ করে জানলার দিকে চলে যাচ্ছে। হিসাবটা আরেকবার মেলাতে চাইছে রমিতা। নড়বড়ে স্বর প্রশ্ন করল, —এক্সপেক্টেড ডেট কিছু দিয়েছে ডাক্তার?

পলাশ রমিতাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল,—বলল তো এইটথ উইক চলছে।

রমিতা মনে মনে বলল, জানি। জানি।

—এক্সপেক্টেড ডেটও তো দিল একটা। কত তারিখ যেন? পার্স থেকে একগোছা কাগজ বার করে প্রেসক্রিপশান খুঁজছে পলাশ।

সময়ের উল্টো স্রোতে চলতে শুরু করল রমিতার মন। তার হিসাবটাই ঠিক। এইটথ উইক! তার মানে টালিগঞ্জের ঘটনার সাত-দশ দিন পরে!

পলাশ কাগজটা দেখে নিয়ে টেবিলে রাখল,—এন্ড অফ ফেব্রুয়ারি। সাতাশ।

রমিতা শুনতে পেল না। ওই সময় একদিন! একদিনই তো শুধু…! অপমানের রাতটা ঝাঁকাচ্ছে নতুন করে। রমিতার চোখ জানলা পেরিয়ে বহু দূরে ভেসে গেল। এই সব নিমগ্ন ক্ষণে রমিতার সৌন্দর্য কেমন অপার্থিব হয়ে যায়। সে তখন আর মানবী থাকে না, হয়ে ওঠে এক অচিন পাখি। তার দিকে তখন শুধু নিৰ্ণিমেষে তাকিয়ে থাকা যায়, ছোঁয়া যায় না, যেন স্পর্শ করলেই মিলিয়ে যাবে স্বপ্নের মত। পলাশ আর তার হদিশ পাবে না কোনও দিন।

পলাশ সম্মোহিতের মত এগিয়ে এসে ঝুঁকেছে,—কী ভাবছ? অ্যাই? অ্যাই…? যে আসছে তার কথা? আমাদের ভালবাসার সন্তানের কথা?

রমিতার হৃদয়ে সরোদের তার ছিঁড়ে গেল। সে রাত্রে কি ভালবাসার অস্তিত্ব ছিল কোথাও? সন্তান আসছে নেহাতই জৈবিক নিয়মে। রমিতার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভাললাগার তোয়াক্কা না করে। কী নিষ্করুণ সৃষ্টির এই নিয়ম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *