প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করার যেমন অনেক আশঙ্কার দিক আছে, তেমনি আবার কিছু মজার ব্যাপারও আছে। রথের দিন আমাদের অফিসে ছুটি থাকে না। কিন্তু সে বছর হঠাৎ রথে একটা হাফ-ছুটি পাওয়া গেল। কলকাতা অফিসের বড়কর্তা বাঙালী, সকালে অফিস গিয়েই শুনলাম তিনি নোটিশ জারি করেছেন আজ দুপুর দুটোয় ছুটি। যদি কেউ ইচ্ছে করে সে মেলা দেখতে যেতে পারে। মেলা দেখার উৎসাহ থাক বা না থাক, দেওয়ালের ঘড়িতে দুটোর ঘণ্টা বাজামাত্র বেরিয়ে পড়লাম।
ছোটবেলায় সবার মুখে শুনতাম প্রতিবছর রথের দিন বৃষ্টি হবেই। আজকে সকাল থেকে আকাশ মেঘলা ছিল, এখন অফিস থেকে বেরুনো মাত্র গুঁড়ি গুড়ি ছাগল তাড়ানো বৃষ্টি শুরু হল। এই আসে এই যায়। মনের আনন্দে ছাতা খুলে শেয়ালদার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মেলাটা একবার ঢু মেরে তারপর মন্টু লেনে তারানাথের বাড়ি যাব গল্প শুনতে।
পর্বদিনে ছেলেবুড়ো সবার মনেই বোধহয় উৎসবের রঙ লাগে। দেখলাম বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে মানুষের ঢল নেমেছে মেলাতলায়। ভিড়ের চোটে গাড়িঘোড়া সব বন্ধ। কেবল হাসপাতালের গাড়ি চলাচলের জন্য ক্যাম্বেল স্কুলের সামনে একটুখানি ফাঁক। খানিকক্ষণ ধরে ফুল-ফল-নারকেলের চারা, মাটির পুতুল, রঙিন কাচের চুড়ির দোকানে অল্পবয়েসী মেয়েদের ভিড়, পি-পি বাঁশি এসব দেখে বেড়ালাম। তবু বাল্যের সেই আনন্দ আর কই? সে ছিল মিগ্ধ শ্যামছায়াচ্ছন্ন পরিচিত গ্রাম, আর এ হল ইট-কাঠ-পাথরের অচেনা শহর। ঠোঙায় করে কিছু ফুলুরি আর গরম ভাজা জিলিপি নিয়ে হাইকোর্টমুখো ট্রামে উঠে পড়লাম। মন্টু লেনের মুখে যখন নামলাম তখনও বৃষ্টি পড়ছেই। হন্ হন্ করে হেঁটে তারানাথের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে স্বয়ং তারানাথের গলা—আসছি হে, দাঁড়াও একটু–
ভেজা জুতো আর ছাতা বারান্দার কোণে রেখে আড্ডাঘরের পরিচিত চৌকিতে বসে বললাম—নিন, এতে তেলেভাজা আর জিলিপি আছে। চা বলুন একবার–
ঠোঙাটা হাতে নিয়ে তারানাথ বলল—বাঃ, এ যে দেখছি এখনো গরম! চা কিন্তু ঠিক। দশ মিনিট পরে বলব। কিশোরী এসে পড়ক, একসঙ্গে খাব—
অবাক হয়ে বললাম—কিশোরী আসছে নাকি? আপনি কী করে—
তারানাথ হাসল, বলল—এখুনি আসবে। আর সাড়ে আট মিনিট–
এক প্যাকেট পাসিং শো এনেছিলাম। প্যাকেটটা এগিয়ে দিতে তার থেকে একখানা বের করে ধরালো তারানাথ। বাড়িতে সাধারণতঃ হুঁকো খায়, কিন্তু পাসিং শো ব্র্যাণ্ডটা তার খুব প্রিয়। তার কাছে গল্প শুনতে যাবার সময় আমি আর কিশোরী মন্টু লেনের মোড় থেকে দশ পয়সা দিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে যাই। প্রতিবারই তারানাথ সস্নেহে স্বচ্ছ মোড়ওয়ালা চিমনির মত টুপিপরা ধূমপানরত সাহেবের ছবিসুদ্ধ কালচে লালরঙের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে বলে—হ্যাঁ, এই হচ্ছে সিগারেট। নেশার আসল কথা হচ্ছে মৌজ, ছবির সাহেব কেমন মৌজ করে গোল গোল রিং ছাড়ছে দেখেছ?
সাড়ে-আট মিনিট শেষ। বাইরে ঝপ করে ছাতা বন্ধ করার আওয়াজ, তারপরই কিশোরীর গলা-চক্কোত্তিমশাই আছেন নাকি? আমি কিশোরী–
তারানাথ আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর উঁচুগলায় বলল—এসো হে, ভেতরে এসো।
কিশোরী সেন ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে বিশেষ একটা অবাক হল না। আসলে হঠাৎ কোনো কারণে কাজের থেকে একটু অবসর পেলে তারানাথের বাড়ি আড্ডা দিতে আসা আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। বয়েসে অন্ততঃ কুড়ি বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও তারানাথ আমাদের সঙ্গে সমবয়েসী বন্ধুর মতই আচরণ করে। সাধু-সন্ন্যাসী এবং অদ্ভুতকর্মা মানুষ দেখার শখ আমার চিরদিনের। কয়েকবছর আগে কিশোরী সেনই আমাকে তারানাথের কাছে নিয়ে এসেছিল, বলেছিল—চল, একজন ভাল তান্ত্রিক জ্যোতিষীর সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই। মুখের দিকে তাকিয়ে ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলে দেয়।
কৌতূহলী হয়ে কিশোরীর সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমার সম্বন্ধে অদ্ভুত কিছু কথা বলে। তারানাথ আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। এমন সব কথা, যা আমি ছাড়া কারো জানবার। সম্ভাবনা নেই। আর আকর্ষণ করেছিল তার গল্প। যৌবনে সে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছে, হাটে মাঠে গাছতলায় শ্মশানে কাটিয়েছে, শবসাধনা করেছে। তার গল্প বলার ক্ষমতাও ভারি সুন্দর। এ ক্ষমতা সবার থাকে না। কেউ কেউ বলার মত গল্পও বাচনভঙ্গির দোষে নষ্ট করে ফেলে, আর তারানাথ নিতান্ত তুচ্ছ ঘটনা বলার গুণে চিত্তাকর্ষক করে তোলে। কত আশ্চর্য ঘটনা শুনেছি তার কাছে, সে-সবের সঙ্গে আমাদের ডাল-ভাত খাওয়া মধ্যবিত্তের প্রাত্যহিক শান্ত জীবনধারার কোনো সম্পর্ক নেই। বীরভূমের গ্রাম্য শ্মশানে হকিনীমন্ত্রে সিদ্ধ মাতু পাগলীর কাহিনী, বরাকর নদীর বালুকাময় তীরে শালবনের পাশে শুক্লা পঞ্চমীর স্বপ্নিল জ্যোৎস্নায় মধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাব, শ্বেতবগলার পুজো–আরো কত কী!
আমরা বলতাম—বাব্বাঃ, এতও ঘটেছে আপনার জীবনে!
তারানাথ হেসে বলত—হবে না! আমার জন্মের সময় আকাশে নীলরঙের উল্কা দেখা গিয়েছিল। আমার তদীক্ষা হয়েছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়–
কিশোরী গুছিয়ে বসতে জিজ্ঞাসা করলাম—তুমিও হঠাৎ এলে যে, কী ব্যাপার!
কিশোরী বলল—আজ দুপুরে সেকশন অফিসার ভবানীপুরের দিকে একটা কাজ দিয়ে বললেন—এটা সেরে ওখান থেকেই বাড়ি চলে যাবেন বরং, আর অফিসে ফিরতে হবে না। তা সে কাজ আধঘণ্টাতেই হয়ে গেল। ট্রামে করে ধর্মতলা এসে নামতেই তোমার অফিসের রমেশ মিত্তিরের সঙ্গে দেখা। তার কাছে শুনলাম তোমাদের আজ হাফ ছুটি হয়ে গিয়েছে। রথের দিন, মেঘলা আকাশ, তারপর আবার হাফ ছুটি—মনে হল তুমি নিশ্চয় এখানে এসে জমবে। তাই চলে এলাম। এই নিন–
পকেট থেকে একটা পাসিং শো-র প্যাকেট বের করে কিশোরী তারানাথের দিকে বাড়িয়ে ধরল। তারানাথ হেসে বলল—ভাল, ভাগ্যিস গলির মুখে তোমাদের দেখা হয়ে। যায়নি! এ আমার কাল পর্যন্ত চলবে–
বললাম—কিন্তু আপনি জানলেন কী করে যে কিশোরী আসছে?
কিশোরী আমার দিকে তাকিয়ে বলল-তাই নাকি? উনি বলেছিলেন আমি আসছি?
-হ্যাঁ, বললেন দশ মিনিটের মধ্যে তুমি আসবে, তারপর চা করতে বলবেন।
তারানাথ মিটিমিটি হেসে চলেছে, যেন কিশোরীর আগমনসংবাদ সে কী করে আগে থেকে জানতে পারল তার ব্যাখ্যা দেবার প্রয়োজন সে বোধ করে না। আমরাও জোর করলাম না, কিছু কিছু জিনিস রহস্যের আবরণে ঢাকা থাকাই ভাল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চা এল। চায়ে চুমুক দিয়ে তারানাথ বলল—তোমরা জিজ্ঞাসা করলে না বটে, কিন্তু মনে কৌতূহল নিশ্চয় হচ্ছে—তাই না? আসলে কী জানো, আমিও জানি না কী করে আমি বুঝতে পারি। কিছুটা সাধনায়, কিছুটা মধুসুন্দরী দেবীর বরে এই ক্ষমতাটা আমি পেয়েছি। হঠাৎ হঠাৎ মনে কোনো কথা ভেসে ওঠে, পরে সেগুলো মিলে যায়। যেমন কিশোরী, তোমার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে তুমি গতকাল কোথাও থেকে কিছু টাকা—এই গোটা পঞ্চাশেক-মুফতে পেয়ে গিয়েছ। ঠিক?
কিশোরীর চোখ গোলগোল হয়ে গেল। সে বলল—সত্যি, আপনাকে যত দেখছি ততই বিস্ময় বাড়ছে। গতকাল অফিসের ঠিকানায় হঠাৎ পঞ্চাশ টাকার একটা মানি অর্ডার এসে হাজির। কী ব্যাপার-না, দেশের বাড়ির আমবাগানের ইজারার টাকা থেকে আমার ভাগের অংশ জ্যাঠামশাই পাঠিয়ে দিয়েছেন। কুপনে লেখা—টাকাটা তিনি বাবাকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা নাকি বলেছেন টাকাটা কলকাতায় আমাকেই পাঠিয়ে দিতে। একা মেসে থাকি, কতরকম দরকার হতে পারে। আশ্চর্য, কত টাকা তাও তো প্রায় ঠিক বলে দিলেন! ধন্য আপনাকে! তা আজকে রথের দিনটা, এমন বাদলা করেছে, আজ একটা ভাল গল্প হবে না?
একটা ফুলুরিতে পরম তৃপ্তির সঙ্গে কামড় দিয়ে তারানাথ বলল-গল্প নয়, গল্প নয়, আমার কাছে সব সত্যি কথা। মধুসুন্দরী দেবীর কথা বলতে গিয়ে একটা ব্যাপার মনে পড়ে গেল। দেবী বলেছিলেন আমি বড়লোক হতে পারব না বটে, কিন্তু অর্থের অভাবে আমাকে কখনো নিদারুণ সঙ্কটে পড়তে হবে না। এই প্রসঙ্গেই একটা ঘটনার কথা তোমাদের বলি।
বরাকর নদীর ধারে মধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাবের পর সেখানেই শালবনের মধ্যে আস্তানা বানিয়ে বেশ কিছুদিন সাধনা করেছিলাম। সে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন গিয়েছে। নিজের দিকে কোনো খেয়াল নেই, হয়ত পাঁচ-ছদিন স্নানই করি না, দাড়ি। কামাই না-রুক্ষ চুল বাতাসে ওড়ে। কাছাকাছি গ্রামগুলোতে ভিক্ষে করে খাই, আর অপেক্ষা করে থাকি কখন রাত হবে, কখন দেবী আসবেন। নদীর ধারের বালিতে মেশানো অভ্রের কুচি সদ্যোদিত চাঁদের আলোয় চকচক করে, মৃদুমন্দ হাওয়ায় নড়ে নদীতীরের অরণ্যের শাখা-প্রশাখা। তারপর বাড়ির লোক খবর পেয়ে এসে জোর করে ধরে নিয়ে গেল, সাধনজীবনের শেষ হল না, কিন্তু ভবঘুরে জীবনের শেষ হয়ে গেল। বাড়ির লোক ধরে নিয়ে যাবার আগে শেষদিন যখন মধুসুন্দরী দেবীর সঙ্গে দেখা হয়, সেদিন দেবী ওই বর আমাকে দিয়েছিলেন।
বাড়ির লোকেরা আমাকে সংসারে বাঁধবার জন্য আর দেরি না করে ভাল মেয়ে দেখে। বিয়ে দিয়ে দিল। আমার তখন কেমন একটা বিহুল অবস্থা, যে যা বলে তাই করি, যা পাই তাই খাই, নিজের ইচ্চা বলে যেন কিছু নেই। দেবীকে হারিয়েছি, জীবনে অন্য নারীর আবির্ভাব ঘটলে তিনি আর দেখা দেবেন না। মনের সেই অবস্থায় কিছুতেই আর কিছু এসে যাবে না, কাজেই শূন্যমনে যন্ত্রচালিতের মত বিয়ে করলাম।
সময় একটু একটু করে সব দুঃখই লাঘব করে, বিয়ের পরে নববিবাহিতা স্ত্রীর সান্নিধ্য আমার একটা নতুন জীবন গড়ে তুলল। পেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না, কাজেই আমি বৌকে। নিয়ে পৈতৃক ভিটে ছেড়ে কলকাতার উপকণ্ঠে একটা আধা শহর গোছের জায়গায় বাসা নিলাম। কিন্তু যে আশায় গিয়েছিলাম তা সফল হল না। পসার জমতে সময় লাগে। হাতদেখা আর কোষ্ঠী বিচার করা জ্যোতিষী বাজারে অনেক আছে, হঠাৎ মানুষ আমার কাছে। আসবেই বা কেন? একটা পনেরো সেরী ঘিয়ের খালি টিন বাজার থেকে কিনে কাটিয়ে পিটিয়ে বোর্ড বানালাম, তার ওপর আলকাতরা দিয়ে বিজ্ঞাপন লিখে টাঙালাম। তাও কেউ আসে না। বাড়ি থেকে পুঁজি যা এনেছিলাম তাই ভেঙে ভেঙে কিছুদিন চলল।
একদিন দুপুরে একজন মক্কেল এসে হাজির। খাওয়াদাওয়া সেরে বাইরের ঘরে বসে বৃহৎ পারাশরি হোরা খুলে একটু পড়াশুনো করছিলাম, হঠাৎ উঠোন থেকে কে ডাকল—এই যে! বাড়িতে কেউ আছেন নাকি?
কিছুটা বিরক্ত হয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। যা অবস্থা চলেছে, তাতে এ যদি মক্কেল হয় তাহলে একে আমার খুবই দরকার। কিন্তু সব কিছুরই তো একটা সময় অসময় আছে। আমি চিরকালই একটু আয়েসী মানুষ। পথেঘাটে খুব ঘুরে বেড়াতে পারি, এককালে যথেষ্ট ভবঘুরেমি করেছি, কিন্তু দুপুরবেলা তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বিশ্রাম করছি, এমন সময়ে লোকজন এসে বিরক্ত করলে ভাল লাগে না। শাস্ত্রে বলে ‘ভুক্ত্বা রাজবদাচরেৎ’—অর্থাৎ আহারাদির পর হাত-পা ছড়িয়ে রাজার মত আচরণ করবে। এই শাস্ত্রবাক্যটি আমি মনোযোগ দিয়ে পালন করে থাকি। যাই হোক, দেখি লোকটা কী চায়!
বেরিয়ে যাকে দেখলাম সে একজন অদ্ভুতদর্শন মানুষ। রোগা সিড়িঙ্গে, ধুতিটা খাটো, কিন্তু পাঞ্জাবির লম্বা ঝুল হাঁটু ছাড়িয়ে নেমেছে। পাঞ্জাবির কাপড়টা ঝলঝলে সিলকের। চুপচুপে করে তেল দেওয়া কাঁধ পর্যন্ত পাট করা চুল। বিসদৃশ লম্বাটে ঘোড়ামার্কা মুখ, এদিকে থুতনি প্রায় নেই বললেই চলে, যেন স্রষ্টা মুখখানা বানাবার সময় জায়গাটা থাবড়ে-থুবড়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। গায়ের রঙ ঘোর কালো, তার ওপর কপালে তেল-সিঁদুরের দীর্ঘ তিলক। আমাকে দেখে সে একগাল হাসল, বেরিয়ে পড়ল লম্বা লম্বা একসারি হলদে দাঁত।
দুপুরে বিশ্রামের সময় এমন চেহারা দেখলে প্রীতি জন্মায় না। বললাম-কী চাই?
এই যে সাইনবোর্ড ঝুলছে, তারানাথ জ্যোতিষার্ণব, আপনিই কি সেই?
—কেন, তাতে কী?
লোকটা বলল-আপনিই যদি তিনি হন, তাহলে একটু কথা বলতাম, এই আর কী–
—আমিই সেই। বলুন কী বলবেন—
লোকটা জিভ কেটে বলল—ছি! ছি! আমাকে ‘আপনি’ বললে খুব লজ্জা পাচ্ছি। আপনি একে ইয়ে, তার ওপর ইয়ে—বলতে গেলে আমার ইয়ের মতন। একটু বসতে পাব কি?
বুঝলাম একে সহজে বিদায় করা যাবে না। দুপুরের বিশ্রামটুকু সত্যিই গেল। তবু হিন্দুর ছেলে, গৃহস্থ মানুষ, কেউ আতিথ্য চাইলে তাকে তো আর বিমুখ করতে পারি না। বিরসবদনে বললাম—এসো, ভেতরে এসো। বেশ, তুমিই বলব। তুমিও আমার ইয়ের মতন।
রসিকতাটা মাঠে মারা গেল। ধুলোমাখা চটি দরজার সামনে খুলে ঘোড়ামুখো অতিথি বৈঠকখানায় এসে জমিয়ে বসল। জিজ্ঞাসা করলাম—তোমার নামটি কী বাপু?
আবার একগাল হেসে ঘোড়ামুখো বলল—আজ্ঞে, আমার নাম হরকীর্তন সেন্নামৎ।
অবাক হয়ে বললাম—হর–?
–কীর্তন সেন্নাম। পদবীটা একটু অচেনা ঠেকছে, না? ওই আমরা কয়েকঘর মাত্র আছি সারা বাংলায়। একেবারে অধম নই আজ্ঞে, জল আচরণীয়–
-না, না, সেজন্য বলিনি। যাক, কী প্রয়োজনে এসেছ বল–
—আমি এই ও-পাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়ি এসেছিলাম। কাজ সেরে ফেরার পথে আপনার সাইনবোর্ডটা নজরে পড়ল। আমার আবার এসব দিকে একটু চর্চা করার ঝোক আছে। তাই ভাবলাম আপনার সঙ্গে একটু দেখা করেই যাই। তা আপনি কী মতে ভাগ্য গণনা করেন? ওখানা কী বই? পারাশরি হোরা? পড়ছিলেন বুঝি?
বললাম—হোরাশাস্ত্র জান নাকি? পড়েছ?
হরকীর্তন হাসল, বলল—তা পড়েছি। তবে কী জানেন, ওসব কিছুই কিছু নয়, যে পারে সে এমনিতেই পারে, আপনি-আপনি। সবাইকে ঈশ্বর সে ক্ষমতা দেন না—
বাঃ, এ তো দেখি ধুকড়ির ভেতর খাসা চাল। লোকটা একেবারে অপোগণ্ড নয়, জ্যোতিষের একেবারে মূল কথাটা অক্লেশে বলে দিয়েছে। বললাম—তা আমার কাছে সাইনবোর্ড দেখে ঢুকে পড়লে কেন? অদ্ভুত ক্ষমতা কিছু আছে কিনা যাচাই করবার জন্য?
–না, তা নয়। সে তো আপনাকে দেখেই বুঝেছি। এলাম একটু আলাপ-সালাপ করতে। গুণী মানুষের সঙ্গ করলে পুণ্য হয়—
–আমাকে দেখে কী বুঝেছ? বল দেখি শুনি–
ভেবেছিলাম লোকটা দুটো মন-রাখা কথা বলবে, বা গদগদ প্রশংসা করে কিছু কাজ গোছানোর চেষ্টা করবে। একেবারে বিনা কারণে আজকাল কি কেউ কারো কাছে বসে সময় নষ্ট করে? এইবারে মন তুষ্ট করে তারপর ঝুলি থেকে বেড়াল বের করবে। কিন্তু হরকীর্তন সেন্নামৎ তা করল না, সে মুখ তুলে আমার দিকে সামান্য কয়েকমুহূর্ত স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল—যেমন বুঝেছি আপনার জন্ম ভাদ্র মাসে, আপনি তন্ত্রমতে দীক্ষিত উচ্চশাখার ভূতডামর অবলম্বনে সাধনা করেছেন। আপনার তন্ত্ৰদীক্ষা হয়েছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়—যা খুব সৌভাগ্য না থাকলে হয় না। কিন্তু কোনো। কারণে সিদ্ধিলাভের আগেই তন্ত্রসাধনা ত্যাগ করে আপনাকে সংসারজীবনে প্রবেশ করতে হয়েছিল। ঠিক বলছি?
বললাম—বলে যাও।
—কিন্তু সাধনা সমাপ্ত না হলেও আপনার জীবনে খুব অদ্ভুত কিছু একটা ঘটেছে, অলৌকিক প্রত্যক্ষ কিম্বা তন্ত্রোক্ত দেব-দেবীদর্শন গোছের কিছু ঠিক ধরতে পারছি না—তবে ঘটেছে যে, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। একটা কথা বলি, অপরাধ নেবেন না। আপনি খুব আনন্দে জীবন কাটাবেন, অনেক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হবে আপনার, কিন্তু বৈষয়িক দিক দিয়ে যাকে কিছু করা বলে, সে আপনার হবে না—
এ আর নতুন কথা কী? বললাম—সে জানি জানি। কিন্তু তুমি কীভাবে বুঝলে?
হরকীর্তন বলল—জানি না। আপনাকে দেখে যা মনে হল তাই বললাম—
বললাম—যা বলেছ ঠিকই বলেছ। তোমার ভাগ্যবিচারের স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। দেখছি। এবার তোমাকে দেখে আমার যা মনে হচ্ছে একটু বলি?
হরকীর্তন বিনয়ে গলে গিয়ে বলল—আজ্ঞে, নিশ্চয়। বলুন আপনি–
জন্ম দিয়েই শুরু করা যাক। তোমার জন্ম চৈত্রমাসে, দিনটাও বলে দিচ্ছি— রামনবমীতে তোমার জন্ম। ভাই-বোন যমজ হয়েছিলে, জন্মের পরই বোন মারা যায়। ঠিক?
—ঠিক। তারপর?
–লেখাপড়া বেশিদূর গড়ায় নি। ইস্কুলে পড়তে পড়তে সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গ করার দিকে ঝোক যায়। অনেক ঘুরে বেড়িয়েছ, কিন্তু দীক্ষা নাও নি–
হরকীর্তন বলল—ঠিকই বলেছেন। দীক্ষা নেবার উপযুক্ত গুরু পাইনি। সব ব্যাটা ভণ্ড, কেবল লোক ঠকিয়ে খাবার ধান্দা। কেবল এই এক আপনার কাছে বসে মনটা ভারি ভক্তিতে ভরে যাচ্ছে। আপনি দেবেন আমাকে দীক্ষা?
হেসে বললাম—দূর পাগল! আমিই নিজের সাধনা ঠিকমত করে উঠতে পারিনি, তোমাকে দীক্ষা দেব কী? তাছাড়া তোমার ওসবের প্রয়োজন নেই, এমনিতেই তুমি অনেক পেয়েছ।
হরকীর্তনের চেহারা যেমনই হোক, মানুষটা সে ভাল। ঘ্যান ঘ্যান করে বিরক্ত করল। শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল-না তেমন কিছু আর পেলাম কই? যা পেলে মানুষ বড় হয় তা পাওয়া হয়নি। যাক, একটা জীবন কেটেই যাবে—
—তুমি সংসার করনি?
—না, ওসব ঝামেলায় আর নিজেকে জড়াই নি। আচ্ছা, আসি তাহলে। অসময়ে খুব বিরক্ত করে গেলাম, কিছু মনে করবেন না
—না, না, তাতে কী হয়েছে? এদিকে আবার এলে দেখা করে যেও—
তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেছিলাম, সে বাধা দিয়ে বলল—আপনাকে আর আসতে হবে না। এবার বিশ্রাম নিন বরং–
দরজার কাছে খুলে রাখা চটিজোড়া পায়ে দিয়ে সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে উঠোন পার হয়ে একবার দাঁড়াল। কঞ্চির বেড়ার দরজায় একটা হাত রেখে আমার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অদ্ভুতভাবে বলল—শুক্রবার। শুক্রবার।
হরকীর্তন কথাটা আমার দিকে তাকিয়ে বলছে বটে, কিন্তু ঠিক যেন আমাকে বলছে। তার চোখে হঠাৎই উদ্দেশ্যহীন শূন্যতা। সে এখানে আছে বটে, নেইও বটে।
আমি অবাক হয়ে বললাম—কী শুক্রবার? কীসের শুক্রবার?
আমার কথা যেন শুনতেই পেল না সে, পেছন ফিরে হেঁটে চলে যেতে লাগল।
লক্ষণ-প্রতিলক্ষণ ইত্যাদি নিয়েই জ্যোতিষ এবং তন্ত্রসাধনার চর্চা করতে হয়। আমি বুঝতে পারলাম হরকীর্তন কথাটা নিজের জ্ঞানে বলেনি, দৈবী আবেশে গ্রস্ত হয়ে বলেছে। কেন এবং কী ভেবে বলেছে তা ও নিজেও জানে না। যেভাবে এলোমেলো পা ফেলে সে হেঁটে যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় তার ঘোর এখনো কাটেনি। কী বলতে চাইল লোকটা?
আজ সোমবার, তিনদিন পরে শুক্রবার পড়ছে। কী হবে শুক্রবার?
বৈঠকখানায় ফিরে এসে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আবার একটু বিশ্রাম আর ঘুমের চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুমের রেশ একবার কেটে গেলে ফের তাকে খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। হোরাশাস্ত্র পড়তে পড়তেই বিকেল গড়িয়ে গেল।
পরের দিন সকালে কোষ্ঠী লেখবার হলুদ রঙের লম্বা কাগজের ফালি তৈরি করছি, এমনসময় স্ত্রী এসে কাছে দাঁড়ালেন। বললাম—কী হল? কিছু বলবে?
আমার স্ত্রী বরাবরই খুব মৃদুভাষিণী, তারপর তখন আবার নতুন বিয়ে হয়েছে। তিনি উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলেন। বললাম—আরে, কী ব্যাপার বলোই না–
উত্তরে তিনি যা বললেন সেটা আমারই আগে খেয়াল করা উচিত ছিল। বাড়িতে চাল নেই, ডাল নেই, আনাজ-সবজি-তেলমশলা কিছুই নেই। আগের দিন অবধি তিনি যা করে হোক চালিয়েছেন, আজ আর কোনো উপায় নেই। এ বিষয়ে আমি কী ভাবছি?
শুধু হোরাশাস্ত্র পড়ে দিন কাটালে চলে না। স্ত্রীর সঙ্কুচিত অনুযোগ আমাকে বাস্তব পৃথিবীর রৌদ্রদগ্ধ প্রান্তরে দাঁড় করিয়ে দিল। থলেহাতে বেরিয়ে পড়লাম।
জনবসতির শেষদিকে যেখানে পথটা হাটতলা হয়ে মহকুমা শহরের দিকে চলে যাচ্ছে, সেখানে হারাধন নন্দীর মুদিখানা। এখানে আসার পরে এই দোকান থেকেই মাঝে মাঝে জিনিসপত্র নিয়ে যাই। হারাধন লোকটা ভদ্র, হাসিমুখ। সওদা মেপে দিতে দিতে কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, সুখদুঃখের কথা বলে। তার দোকানেই গিয়ে দাঁড়ালাম।
সে সময়টা খদ্দের কেউ নেই, দোকান খালি। হারাধন তালপাতার পাখা উলটো করে। ধরে তার বাঁট দিয়ে পিঠ চুলকোচ্ছে। আমাকে দেখে বলল—আসুন ঠাকুরমশাই কী দেব?
তোমরা শহুরে মানুষেরা শুনলে একটু অবাক হবে, গ্রামাঞ্চলে মুদিখানায় চাল-ডাল তেল-নুন ছাড়াও আলু পিঁয়াজ কুমড়ো লাউ শাকপাতা পাওয়া যায়, অন্তত একসময় যেত। কারণ হাট বসে সপ্তাহে মাত্র দুদিন, অন্য সময়ে হঠাৎ প্রয়োজন হলে মানুষকে বিপদে পড়তে হয়। মাছ-মাংস পাওয়া অবশ্য সম্ভব নয়, তবে কিঞ্চিৎ সৌখিন খরিদ্দারদের জন্য কোনো কোনো দোকানে হাঁসের ডিম থাকে।
বললাম কিছু চাল-ডাল, তেন-নুন-মশলা আর সামান্য সবজি—
হারাধন বলল—আপনি বলে যান ঠাকুরমশাই, আমি মেপে দিই। দিন থলেটা—
এবারেই আসল কথাটা বলতে হবে। একটু কেশে বললাম—হারাধন, একটা কথা–
–কী ঠাকুরমশাই?
—ইয়ে হয়েছে মানে—দামটা কিন্তু কয়েকদিন পরে দেব, এখন বাকি থাকবে।
একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হারাধন বলল—দিন, থলেটা দিন–
তারপর একটু হেসে বলল–আমাদের সকলকেই কোনো না কোনো সময়ে ঠেকায় পড়তে হয়। অসুবিধের সময় পরস্পরকে দেখলে কি চলে? বড় বড় কথা বলছি ভেবে রাগ করবেন না ঠাকুরমশাই, আপনি পণ্ডিত ব্রাহ্মণ, মাননীয়, কিন্তু বয়েসে আমি বড়। থলেটা দিন, আর বলুন কী কী দেব–
মানুষের ভেতরেই ঈশ্বর বাস করেন। নইলে বাংলার অখ্যাত পাড়াগ্রামের এক মুদির মনে এই সহানুভূতি আর করুণার প্রকাশ কী করে সম্ভব?
কিশোরী বলল—শুধুই ঈশ্বর?
তারানাথ বলল-দানবও। ভাল আর মন্দ, আলো আর অন্ধকার সৃষ্টির মুহূর্ত থেকেই বর্তমান, বৈপরীত্য আছে বলেই সৃষ্টির সার্থকতা আছে। দানবিকতার ওপরে ঐশ্বরিকতার প্রতিষ্ঠাই মানুষের সাধনা। যাক, শোনো–
তারানাথ আবার বলতে শুরু করল।
কৃতজ্ঞচিত্তে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম বটে, কিন্তু বুঝতে পারলাম এই স্বস্তি মাত্র কয়েকদিনের। ধার করে তো আর মাসকাবারি বাজার করা যায় না, যা এনেছি তাতে বড়জোর দিন তিনেক চলতে পারে, তারপর অনটনের মেঘ আবার আকাশ ছেয়ে ফেলবে। নিকট ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা বর্তমানের আনন্দকে ম্লান করে দিল।
স্বাস্থ্যনিবাস হিসেবে খ্যাতি আছে এমন শহরে ডাক্তারের পসার জমে না। আমারও হল প্রায় তাই। যেন ভয়াবহ নাস্তিকদের দেশে বাসা বেঁধেছি, সপ্তাহে অন্তত একখানা কোষ্ঠী আর পাঁচ-ছটা হাত দেখার খদ্দের খুব দুঃসময়েও পেতাম, হঠাৎ তাও বন্ধ হয়ে গেল। একটানা খরা যাকে বলে। মাঝে মাঝে মনে হত মধুসুন্দরী দেবী বলেছিলেন আমি ধনী হতে পারব না বটে, কিন্তু অনাহারে কখনো দিন কাটাতে হবে না, মোটামুটি চলেই যাবে। দেবীর আশীর্বাদ কি শেষ পর্যন্ত মিথ্যে হতে চলেছে? অনাহার তো এসে পড়ল বলে।
কিন্তু আমার যা চিরকালের অভ্যেস, বৈষয়িক দুর্ভাবনা বেশিক্ষণ করতে পারি না। চৈত্রের প্রথম, গাছে নতুন পাতা গজাতে শুরু করেছে, ঈষৎ তপ্ত বাতাস শীতের শেষে ঝরা শুকনো পাতার রাশি অস্পষ্ট মর্মর শব্দে সরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। আমের গুটি ধরেছে। গাছে গাছে, আকাশ নির্মেঘ নীল। ঋতুর এই সব সন্ধিক্ষণে মন উদ্বেল হয়ে ওঠে, মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা, হারানো মানুষদের স্নেহভরা হাসিমুখের কথা। মনে পড়ে যায় প্রথম যৌবনে আমার দায়মুক্ত ভবঘুরে জীবনের কথা। এইসব অমূল্য উপলব্ধির সম্পদের মধ্যে কে দুর্ভাবনা করে বাড়িতে চাল-ডাল আছে কিনা তার জন্য?
কিন্তু মুশকিল হল বাস্তবকে নিয়ে। তিনদিন পরেই সকালে স্ত্রী জানিয়ে দিলেন বাড়িতে যা আছে তাতে টেনেটুনে আর একটা দিন চলবে, পরের দিন বাজার না আনলেই নয়।
বাইরের দাওয়ায় উদ্ভান্ত মনে পায়চারি করতে লাগলাম। কি করি আমি এখন? আজ শুক্রবার। হরকীর্তন বলে গিয়েছিল মনে রাখতে, শুক্রবার একটা কিছু হবে। কি হতে পারে আজ? দিন তো শুরু হয়ে গেল।
উঠোনের ওপারে রাংচিতার বেড়ার ওপর একটা কাক কোথা থেকে এসে বসেছে। ঠোট ঘষছে বেড়ার গায়ে। তার ঠোঁট থেকে কী একটা জিনিস খসে উঠোনের ভেতরদিকে। পড়ল। আমি প্রথমটা খেয়াল করিনি। একটু পড়ে দেখি আরেকটা কাক এসে আগেরটার পাশে বসল। তার পর আর একটা। এ দুটো কাকের মুখ থেতেও হালকা কী জিনিস ভাসতে ভাসতে উঠোনে পড়ল। একটু অবাক হয়ে বেড়ার দিকে এগিয়ে যেতে কাক তিনটে উড়ে পালাল। জায়গাটায় পৌঁছে আমি সবিস্ময়ে উঠোনের মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মাটিতে পড়ে রয়েছে একখানা পাঁচ টাকার এবং দুখানা দু’টাকার নোট!
আশ্চর্য! এখানে টাকা এল কোথা থেকে? কাকেরাই মুখে করে এখানে এনে ফেলে দিয়ে গেল নাকি? নিচু হয়ে টাকাগুলো কুড়িয়ে হাতে নিলাম। নোটগুলোতে শুকনো রক্ত আর মাছের আঁশ লেগে রয়েছে। ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝতে পারলাম। আজ হাটবার, মাছের আড়ত থেকে কাক তিনটে রক্তের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে নোটগুলো তুলে এনে বেড়ার ওপর বসেছিল। ঠোট ঘষবার সময় সেগুলো খসে পড়েছে।
নোট তিনটে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হরকীর্তনের ভবিষ্যৎবাণী ফলে গেল তাহলে! অদ্ভুত ক্ষমতা তো লোকটার! কাকে মুখে করে এনে টাকা ফেলে যায় এমন কখনো শুনিনি। মনে রেখো, যে সময়কার কথা বলছি তখন ন’টাকা অনেক টাকা। ছোট সংসারে একমাসের বাজার হয়ে যায়। টাকাটা না পেলে আজ সত্যি বিপদ হত, আগের টাকা শোধ না করে তো হারাধনের কাছে নতুন করে ধার নেওয়া যেত না।
বিস্ময়ের তখন যে আরও অনেক বাকি তা বুঝতে পারিনি। পরের দিন থলে নিয়ে সকালবেলা হারাধনের দোকানে গিয়ে হাজির হলাম। হারাধন বলল—আসুন ঠাকুরমশাই। আজ হাটে না গিয়ে আমার দোকানে এলেন যে বড়? হাটে নানারকম জিনিস পেতেন
বললাম হ্যাঁ, কাল আর হাটে যাওয়া হয়ে উঠল না, তাই আজ তোমার কাছেই এলাম।
হারাধন বলল—সে কী ঠাকুরমশাই! হাট তো কাল ছিল না! আপনি নতুন লোক, ভুলে গিয়েছেন হয়তো, হাট তো আজ শনিবার বসেছে। তাহলে কি হাটেই যাবেন?
মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। হাট গতকাল ছিল না, আজ বসেছে! তাহলে কাক তিনটে মাছের রক্ত আর আঁশমাখা টাকা পেল কোথা থেকে? যাই হোক, কথা না বাড়িয়ে বললাম—না হারাধন, হাটে যাবে না। যা নেবার তোমার কাছ থেকেই নিই।
সেদিন রাত্তিরে মধুসুন্দরী দেবীকে স্বপ্নে দেখলাম। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি হাসছেন। যেমন হেসেছিলেন এক পূর্ণিমার রাত্তিরে বরাকর নদীর ধারের শালবনে।