১০. ঘরের মধ্যে একটা উৎকণ্ঠিত নীরবতা

ঘরের মধ্যে একটা উৎকণ্ঠিত নীরবতা। কিন্তু দেবদর্শনের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম ভূষণ রায় কিছু বলার আগেই উনি উত্তরটা জেনে গিয়েছেন।

ভূষণ রায় বললেন–রাজাবাবু! আপনি বিলিতি ডার্বির সেকেন্ড প্রাইজ পেয়েছেন! আশি হাজার টাকা। এই একটু আগে টেলিগ্রামে খবর এসেছে।

বলতে বলতে ভূষণ রায় উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়ে দুইহাতে নিজের মাথা ধরে রইলেন। হঠাৎ দেখলে মনে হবে তিনি এক্ষুণি একটা ভয়ানক খারাপ খবর পেয়েছেন। আসলে চরম শোক আর চরম উল্লাসের প্রকাশ অনেকটা একই রকম।

বাইরে একটা সম্মিলিত গলার কোলাহল শুরু হল। এসব খবর বাতাসের মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যারা পূজো দেখতে আর প্রসাদ পেতে এসেছে তারা সবাই চেঁচাচ্ছে—জয় রাজাবাবু! জয় মা লক্ষ্মী! যারা দেরী করছিল তারাও খবর পেয়ে দলে দলে এসে ভিড় বাড়াচ্ছে। মানে ভূষণ রায় আসবার পথে খবরটা ছড়াতে ছড়াতে এসেছেন।

দেবদর্শন আমার হাতদুটো একবার চেপে ধরলেন। তার চোখে বিস্মিত কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি। তারপর বললেন—একটু বসুন। আমি একবার ভেতর থেকে আসছি। বাইরে গোলমাল শুনে ওঁরা হয়ত ভয় পাচ্ছেন।

একটা বাদেই বাড়ির ভেতর থেকে উলুধ্বনি আর শাঁখের আওয়াজ ভেসে এল। বুঝলাম দেবতার কাছে পারিবারিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আরম্ভ হয়েছে।

ভূষণ রায় এখনও মাটিতেই বসে আছেন। মানুষটি এমনিতে নম্র আর নিরীহ হলেও বেশ বুদ্ধিমান। কথা বিক্রি করে যাদের খেতে হয় তাদের বোকা হলে চলে না। কিন্তু বাস্তব ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি বর্তমানে কেমন যেন থতিয়ে গিয়ে প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে বিগলিত অর্থহীন হাসি হাসছেন। জিজ্ঞাসা করলাম—আপনার বিক্রি করা টিকিটে এর আগে কখনও প্রাইজ উঠেছে?

মাথা নেড়ে ভূষণ রায় বললেন—নাঃ। কক্ষণো না। এই প্রথম–

—ছোটখাট প্রাইজও ওঠেনি কখনও? দু-পাঁচশো কিম্বা অমনি কিছু?

—না ঠাকুরমশাই। প্রাইজের টাকার কমিশন কখনও চোখে দেখিনি, কেবল টিকিট বিক্রি করলে টাকায় ছ-পয়সা করে পাই। তাতে কি সংসার চলে? আমার ছাতা আর জামা-জুতোর তালি দেখুন, বাড়ি গিয়ে ডিগডিগে ছেলেপুলেগুলোকে দেখে আসুন এবার পুজোয় কারও জামাকাপড় হয়নি ঠাকুরমশাই।

—এই টাকা থেকে আপনি কত পাবেন?

–কোম্পানী থেকে বেশি নয়। বেশির ভাগটাই নিয়ে নেবে কলকাতার যে আসল এজেন্ট, সে। আমাকে হাজার দুয়েক দেবে বোধহয়। কী আর করব? যা দেয় তাই অনেক। তবে রাজাবাবু মানুষ খুব ভাল, উনি কি আর কিছু দেবেন না? নিশ্চয় দেবেন—উনি আমাকে ভালবাসেন–

দেবদর্শন ভেতর থেকে ফিরে এলেন। তক্তাপোষে তাকিয়া হেলান দিয়ে বসে প্রথমেই বললেন—ভূষণ, এর থেকে পাঁচ হাজার টাকা আমি তোমাকে দেব। তোমার জন্যই তো প্রাইজটা পেলাম—

ভূষণ রায় তার দিকে তাকিয়ে বললেন-আমার জন্য নয়, এই যে এই ঠাকুরমশাইয়ের জন্য। আমার টিকিটে কিছুই পেতেন না, ইনি বেছে দিয়েছিলেন বলেই–

—সে কথা ঠিক, সে কথা ঠিক। যাক, তোমরা এখন সবাই পুজোর মণ্ডপে যাও। আমিও আসছি–

উপস্থিত লোকেরা টিকিট পছন্দ এবং বদলানোর ব্যাপারটা কিছুই জানে না। তারা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ভূষণ রায় বললেন—চল, চল হে। পুজোর জায়গায় চল। রাজাবাবু বিশ্রাম করে আসছেন—

ভূষণ রায় গপ্পে লোক, বুঝলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই টিকিট বদল করে দেবার ঘটনাটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এও বুঝলাম যে, হয় কাল, নয় পরশু সকালে আমাকে এ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। ভূষণ রায়ের গল্প শুনলেই মানুষের স্রোত শুরু হবে—কারও সন্তান হয়ে বাঁচে না, কারও অম্লশূলের ব্যথা, কারও ভাই মামলা করেছে, কেউ বা আবার হঠযোগ শিখতে চায়। পালানো ছাড়া গতি নেই।

কিশোরী বলল-পালাবেন কেন? আপনি কি এসবের প্রতিবিধান করতে পারেন না?

একটু চুপ করে থেকে তারানাথ বলল-হয়ত পারি। বিশ্বের যাবতীয় দুঃখকষ্ট দূর করার ক্ষমতা যদি আমার থাকত তাহলে আমি অন্য সব কিছু ছেড়ে সেই কাজে লেগে পড়তাম। তা নয়। আসলে মধুসুন্দরী দেবী আর বীরভূমের শ্মশানের মাতু পাগলী আমাকে কিছু সাধারণ ক্ষমতা দিয়েছিলেন, খুব মাঝারি সিদ্ধাই গোছের জিনিস। তা দিয়ে চটজলদি ভেলকি দেখানো যায়, কিন্তু তার চেয়ে বড় মাপের কিছু হয় না। এককালে টাকা উপার্জন করার জন্য তাও করেছি। সে সময়টা তোমাদের সঙ্গে আলাপ হয়নি। আমার বাড়ির সামনে মাড়োয়ারীদের মোটরগাড়ির ভিড় লেগে থাকত। বেশি ব্যবহারে আর। অপব্যবহারে সে শক্তি চলে গেল, তারপর থেকেই এই খারাপ সময় যাচ্ছে–

খারাপ সময় যে যাচ্ছে তাতে আর সন্দেহ কী? প্রথম যেদিন আমরা আলাপ করতে এসেছিলাম, সেদিন আমাদের পাওনাদার ভেবে তারানাথ প্রথমে বাইরে আসেনি। তার ছেলে এসে আমাদের কী প্রয়োজন জেনে ভেতরে গিয়ে খবর দিতে তারপর তারানাথ। বেরিয়েছিল। মানুষ হিসেবে তার চরিত্র আদর্শ বা প্রশংসনীয় হয়ত নয়, কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের একটা আশ্চর্য আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। তার গল্প বিশ্বাস হোক বা না-ই হোক, শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠে আসার উপায় থাকে না।

তারানাথ আবার বলতে শুরু করল।

উজ্জ্বলমুখে বাড়ির ভেতর থেকে ফিরে এলেন দেবদর্শন। বললাম-কী, কেমন লাগছে?

মানুষটি অত্যন্ত সংযমী! যে খবর তিনি একটু আগে শুনেছেন অন্য কেউ সে সংবাদ পেলে কী যে করত তার ঠিক নেই। কিন্তু দেবদর্শন বাইরে কোনও উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে সবাইকে বললেন–যাও, তোমরা পুজোর জায়গায় যাও। আমি আসছি—

তাপোষের একপাশে বসে তাকিয়ায় কনুই রেখে হেলান দিয়ে দেবদর্শন, তারপর বললেন—ঠাকুরমশাই, টাকাটা তাহলে পাইয়েই দিলেন?

হেসে বললাম—আমি কেন? টিকিট বিক্রি করেছে ভূষণ রায়, কিনেছেন আপনি। ঘোড়া দৌড়েছে বিলেতে, খবর এসেছে ডাকবিভাগের টেলিগ্রামে—আমি কী করলাম?

দেবদর্শন মিষ্টি করে হাসলেন। তার ব্যক্তিত্বের স্বরূপটাই মিষ্টি।

—ওসব কথা থাক, আপনি কী করেছেন আমি তা জানি। কেবল কয়েকটা জিনিস ঠিক বুঝতে পারছি না–

—যেমন? কী জিনিস?

—আবছা আবছা বুঝতে পারছি অমরজীবনের ছড়ার সঙ্গে টিকিটের নম্বরের একটা কিছু যোগ আছে। নইলে ভূষণ রায়ের পছন্দ করে দেওয়া টিকিট আপনি বদলাতে বলবেন কেন? ছড়াটার মানেই বা কী?

বললাম—মুখুজ্যেমশাই, অমরজীবন ছড়ার মধ্যে যে সংকেত ব্যবহার করেছিল সেটা একটা পুরনো ধাঁধা। আমাদের ছোটবেলায় দেশে ঘরে খুব প্রচলিত ছিল। নানারকম চেহারায় এই ধাঁধা বাসরঘরে কিংবা বাড়িতে জামাই এলে তাকে ঠকানোর জন্য ফিরে ফিরে দেখা দিতো। ছোটবেলায় ধারাপাত পড়েছেন তো? ধারাপাতের প্রথম দিকে একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ’ কবিতাটা মনে পড়ছে কি? অমরজীবনের ছড়ার মূল সংকেতও ওই ধারাপাতের কবিতা।

দেবদর্শন বললেন—ঠিক বুঝতে পারছি না ঠাকুরমশাই। আর একটু খুলে বলবেন?

বললাম—কবিতাটা মনে করুন। দিকে দিকে সাগরেতে ভাই, চোখে চোখে চাদ খুঁজে পাই। দিক কখানা? চারটে তো? পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ। তাহলে দুবার ‘দিক’—অর্থাৎ ৪-৪, ঠিক আছে? পরের কথা সাগরেতে। সাগর কটা? না, সপ্তসমুদ্র। তাহলে এ পর্যন্ত কী হল? দিক, দিক, সাগর—৪-৪-৭। পরের লাইনে ছড়ায় বলেছে—চোখে চোখে চাদ খুঁজে পাই। তিনে নেত্র, অর্থাৎ পরপর দুটো তিন হবে। আর চাদ তো একটা। কাজেই পুরো সংখ্যাটা দাঁড়ালো ৪ ৪ ৭ ৩ ৩ ১। আপনি এর চারখানা আগের নম্বরের টিকিট নিচ্ছিলেন। নিলে একটুর জন্য প্রাইজটা হাতছাড়া হয়ে যেত। আমি কেউ না, মুখুজ্যে মশাই। পুরস্কারটা আপনার ভাগ্যই পাইয়ে দিয়েছে—অমরজীবনের মাধ্যমে।

কিছুক্ষণ একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন দেবদর্শন। তারপর বললেন—অমরজীবন কে?

বললাম-আমি জানি না মুখুজ্যেমশাই। এ প্রশ্ন আপনি আগেও করেছেন, উত্তর জানা থাকলে আমারও আনন্দ হতো। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই থাক না। তাতে জীবন সরস থাকে, জীবনে বিশ্বাস থাকে, আনন্দ থাকে। সব জেনে ফেলতে নেই। চলুন, পুজোর সময় হলো, আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে–

দেবদর্শনকে পুজোমণ্ডপে আসতে দেখে সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠে দাঁড়াল। সেদিনকার পুজোর পরিবেশই আলাদা। অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া কোনও অলৌকিক ঘটনা, অন্তত আমরা সঠিক ব্যাখ্যার অভাবে যাকে অলৌকিক বলে মনে করি, তা মানুষের মনে বিশ্বাস আর ভক্তির জোয়ার এনে দেয়। সেদিনও তাই হয়েছিল–

বললাম—তাতে আর অন্যায় কী? রোজকার জীবনে যা ঘটে না, তেমন অদ্ভুত কিছু চোখের সামনে ঘটতে দেখলে মানুষ তো আপ্লুত হবেই, তাই না? এ একটা পাসিং শো ধরিয়ে তারানাথ বলল—সাধারণভাবে কথাটা ঠিক, কিন্তু ওই বিশ্বাস আর আবেগের প্রকৃত কোনও মূল্য নেই–

কিশোরী বলল—কেন, একথা বলছেন কেন? হয়ত আশ্চর্য বা অলৌকিক কিছু দেখে। বিশ্বাস বা ভক্তির ভাব জেগে উঠেছে, কিন্তু তাতে ওই বিশ্বাস কি মিথ্যে হয়ে যাবে? এ যুক্তি আমার ঠিক বলে মনে হচ্ছে না—

যা তারানাথ বলল—মিথ্যে হয়ে যাবে এমন কথা বলছি না, কিন্তু সরল বিশ্বাসের মূল্য। তার সারল্যেই। কিছু পাব বলে আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে ভাল লাগে বলেই তা করি। যদি কেউ অন্যরকম করে, তবে তা দোকানদারি। বাবার সম্পত্তি পাব, তাই বাবাকে ভালবাসি—এ কেমন কথা?

কিশোরী বলল—সে আশা কি মনের কোণে একটু থাকে না?

–থাকলে সে কেমন ভালবাসা তুমিই ভেবে দেখ। জানি, যে কোনও ভালবাসাই শেষ পর্যন্ত স্বার্থের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে থাকে—মাও যে শিশুকে ভালবাসেন, তা ওই ভালবাসার পরিবর্তে বাৎসল্যের রসঘন তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি হয় বলেই। তবু নিছক বৈষয়িক স্বার্থের চেয়ে কি তা ভাল নয়? কোন না কোন আসক্তি যদি জীবনে থাকতেই হয়, তাহলে ঈশ্বরে নিষ্কাম আসক্তি থাকুক–

আলোচনার গতি দেখে ভেতরে ভেতরে ক্রমাগত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলাম। কিশোরীটা চিরকালের বুদ্ধিহীন কুতার্কিক, বেশ জমাট গল্পের স্রোত বয়ে চলেছে, হঠাৎ এর মধ্যে নৈয়ায়িক আচার্যের সদসৎ বিচার না আনলেই কি চলত না? এখন তর্ক জমে উঠলেই গল্প ডুবে যাবে। বললাম—সে তো ঠিকই, খুব ন্যায্য কথা। যাই হোক, অমরজীবন-রহস্য কি শেষ পর্যন্ত ভেদ হয়েছিল?

তারানাথ বলল—না। অমরজীবনের কাহিনী এখনও চলছে।

একটু বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালাম। তারানাথ ও-প্রসঙ্গে আর কিছু বলল না বটে, কিন্তু কেমন করে যেন স্পষ্ট বুঝতে পারলাম সে কী বলতে চায়। মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে বোধ করি অমরজীবনের গল্পটা মিশে রয়েছে, হঠাৎ কোথাও তো তা শেষ হবার নয়।

বললাম—এ গল্পের তাহলে এখনও অনেক বাকি?

—অনেক। আজকে তো শেষ হবেই না, যতদিন বাঁচব একটু একটু করে বলে গেলেও শেষ হবে না। তা সে যাই হোক, আপাতত দেবদর্শন মুখুজ্জের অংশটুকু বলে শেষ করি। তারপর আবার আর একদিন হবে। তোমরা পানিফল তো খেয়েছ নিশ্চয়, পুকুরে পানিফলের ঝাক দেখেছ কখনও?

হঠাৎ হঠাৎ তারানাথ এরকম কথার গতি পরিবর্তন করে থাকে। হেসে বললামদেখেছি। আমারও তো গ্রামেই বাড়ি। কেন?

–পানিফলের ঝক অর্ধেক পুকুর ছেয়ে থাকে, কিন্তু যে কোন একটা জায়গা ধরে টান দিলে সবটা একসঙ্গে নড়ে ওঠে। আমাদের বেঁচে থাকাও ঠিক তাই। আলাদা ঘটনা বলে কিছু হয় না। সবকিছু সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি তুমি দেবদর্শন অমরজীবন জীবন মৃত্যু হাসি কান্না—সব। তোমাদের এখনও বয়েস অল্প, পরে নিজেরাই সব বুঝবে।

ছাইদানি হিসেবে ব্যবহৃত নারকেলের মালায় সিগারেটের দগ্ধাবশিষ্টটুকু গুঁজে দিয়ে তারানাথ শুরু করল।

–পূর্ণিমার আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। তেমন জ্যোৎস্না তোমরা শহরে কখনও দেখবে না। পাখিরা সকাল হয়ে গিয়েছে মনে করে ডাকতে আরম্ভ করে। ঈষৎ শীত-শীত। ভাব পরিবেশে, অথচ পুরো ঠাণ্ডা পড়েনি। এখানে ওখানে কাশের গুচ্ছ চাঁদের আলোয় দেখাচ্ছে যেন রূপোর মেঘ। পুজোমণ্ডপে বড্ড ভিড়, তাছাড়া আজ দেবদর্শনের প্রাইজ পাওয়ার ব্যাপারটা সর্বত্র উত্তেজনা তৈরি করেছে। ভূষণ রায় আর আমাকে দেখলেই লোকে কথা বলবার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ছে। তার চেয়ে ভিড় থেকে দূরে আপনমনে থাকাই ভাল।

মুখুজ্জেবাড়ির বাঁদিকে নদীতে যাবার পথের মুখে একটা পুরনো ভাঙা মন্দির। জ্যোৎস্নায় দেখাচ্ছে যেন হালকা জলরঙে আঁকা ছবি। সেদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মাথার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে ডানা মেলে একটা বেশ বড় সাদা লক্ষ্মীপ্যাচা উড়ে গিয়ে মন্দিরের চূড়ায় বসল। মন্দিরটা মুখুজ্জে-পরিবারের পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত, বর্তমানে আর্থিক কারণে কিছুটা ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হলেও একজন পুরোহিত সেখানে নিত্যপূজা করে আসেন, সন্ধেবেলা আরতি হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠিতা দেবী বিশালাক্ষী। কালো পাথরের মূর্তি, ভারি প্রশান্ত মুখ। ঠিক আজকের দিনেই বংশের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর মন্দিরের ওপর লক্ষ্মীপ্যাঁচার উড়ে বসাটা একটা সুলক্ষণ।

মৃদু পায়ের আওয়াজ শুনে পাশে তাকিয়ে দেখি কখন দেবদর্শন এসে দাঁড়িয়েছেন, হাতজোড় করে প্রণাম করছেন মন্দিরের দিকে মুখ করে। তাঁর মুখ উদ্ভাসিত।

বললাম-প্রণামটা কি প্যাচাকে?।

দেবদর্শন হেসে বললেন—না, দেবীকে। তবে ঈশ্বরের প্রকাশ সর্বজীবেই, প্যাচাকে প্রণাম করলে অন্যায় কী?

–অন্যায় আর কী! যে স্তরে উঠলে ওই উপলব্ধি হয়, সেখানে পেঁছলে সবাই সমান। আর পাচা প্রাণীটিও বেশ সুন্দর।

দেবদর্শন কেবলমাত্র উঁদে বৈষয়িক জমিদার নন সেকথা তো আগেই বলেছি। মানুষটার ভেতর কবিত্ব আর সৌন্দর্য মিশে গিয়ে চমৎকার একটি স্নিগ্ধ রসায়ন তৈরি করেছে। তিনি বললেন—পুজোমণ্ডপে বেজায় ভিড় জমেছে। আপনাকেও দেখতে পেলাম না। ঠিক। বুঝেছি আপনি এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। তাই আমিও চলে এলাম। কী অপূর্ব জ্যোৎস্না ফুটেছে দেখছেন! এই দেখ, ইনি আবার একা চললেন কোথায়?

জমিদারবাড়ি থেকে বেরিয়ে এক ঘোমটা দেওয়া বৌ মানুষ পায়ে চলা সঁড়ি পথটা দিয়ে বিশালাক্ষী মন্দিরের দিকে চলেছেন। বোধহয় মুখুজ্জেগিন্নী, মন্দিরে প্রণাম করে তারপর পুজোর জায়গায় যাবেন। বললাম—বৌঠান না?

দেবদর্শন বললেন—হ্যাঁ। কিন্তু একা যাচ্ছেন কেন? বাড়ির বাকি মেয়েরা কই? পেছনে সব আসছে বোধহয়—

দেবদর্শনের স্ত্রী কিন্তু মন্দিরের পৈঠায় বা চালাতে দাঁড়িয়ে প্রণাম সারলেন না, সিঁড়ি বেয়ে উঠে মন্দিরে ঢুকে গেলেন। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বেরুবার সময় উনি আমাদের দেখতে পাবেন, ওঁর অস্বস্তি হতে পারে সেকথা ভেবে আমি বললাম—চলুন মুখুজ্জেমশাই, নদীর দিক থেকে একটু ঘুরে আসি

আবার বলছি, সে-সব দিনের কথা ভাবলে এখনও বুকের মধ্যেটা কেমন করে ওঠে। জ্যোৎস্না এত সাদা ধপধপে যে, নদীর ধারের সাদা বালির চরে দাঁড়িয়ে সময়টা দিনের বেলা বলে ভুল হয়। খুব হাল্কা বাতাসে চরে গজিয়ে ওঠা কাশগুচ্ছ দুলছে, কট কটু করে ডাকছে কী একটা নিশাচর পোকা। বয়েস অল্প, পৃথিবী বিশাল, শরীর নীরোগ, প্রকৃতি সুন্দর, ঈশ্বর তার সিংহাসনে আসীন—এবং দুনিয়ার সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। তখন অমর ছিলাম, পৃথিবীতে কোনও গ্লানি ছিল না, কালো রঙ ছিল না, বুকভরা অকারণ আনন্দ ছিল, মৃত্যু ছিল আবছা জনশ্রুতি। সে বাংলাও আর নেই—আমার এই কথাকে জীবনের পেছনদিকে ফিরে তাকিয়ে প্রৌঢ়ের স্বাভাবিক হাহাকার মনে কোরো না—তখন দিনকাল সত্যিই অন্যরকম ছিল। মনের ভেতরের সেই আনন্দ মিশিয়ে শরৎরাত্রি অপরূপ হয়ে উঠত।

যুগ যুগ ধরে শারদ পূর্ণিমার রাত্রির সঙ্গে উৎসবের একটা সম্পর্ক আছে বলেই কিনা জানি না, এই রাত্তিরটার একটা মায়াময় রূপ আছে। দেবদর্শনের বড় গুণ, তিনি অকারণে কথা বলে পরিবেশের গাম্ভীর্য নষ্ট করেন না। কাশফুলে ঢাকা জ্যোৎস্নামাখা সাদা বালির চরে দুজনে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম, কিন্তু দেবদর্শন কথা বলে পরিবেশের মাধুর্য নষ্ট করলেন না। কিছুক্ষণ পরে আমিই বললাম—চলুন, এবার ফিরে যাই। পুজো এতক্ষণ শেষ হয়ে এলো।

ফেরবার সময় আমাদের ডানদিকে বাঁশঝাড়ের পাশে বিশালাক্ষী মন্দিরটা পড়লো, তার ওধারে মুখুজ্জেবাড়ি। আর বাঁদিকে পথ থেকে একটু ভেতরে পুজোমণ্ডপ। পুজোর জায়গায় ঢোকবার মুখে দেবদর্শন থমকে দাঁড়িয়ে নিজের বাড়ি থেকে আসার পথের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক গলায় বললেন—এ কী! এদের আজ হল কী! বারবার কোথায় যাওয়া-আসা করছে?

তাকিয়ে দেখলাম মুখুজ্জেগিন্নী বাড়ির অন্য মেয়ে-বৌদের সঙ্গে চলেছেন পুজোমণ্ডপে। মানে তিনি বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন, এখন আবার সবাইকে নিয়ে পুজো দেখতে যাচ্ছেন।

পুজো শেষ হয়ে গেল, পুরোহিত শান্তিজল আর চরণামৃত দিলেন সবাইকে। ওদিকে কয়েকজন কর্মচারী প্রসাদ বিতরণ শুরু করেছে। ছোট ছোট চেরা কলাপাতার টুকরোয় বাতাসা আখের টিকলি শসা পানিফল বাতাবিলেবু আর ভেজা আতপচাল কলা দিয়ে চটকে মাখা। খিচুড়ি-ভোগ একটু বেশি রাত্তিরে শুরু হবে। বাচ্চারা সামিয়ানার নিচে ছোটাছুটি করছে, বয়স্করা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে ব্যস্ত। আমরাও বৈঠকখানায় ফিরে এলাম। কোনও কারণে দেবদর্শনের দ্ৰ কুঁচকে রয়েছে, কিছু একটা ভাবছেন ভদ্রলোক।

রঘু তামাক দিয়ে গেল। তামাক টানতে টানতে এটা-সেটা গল্প করছি, কিন্তু দেবদর্শনের মুখের গম্ভীর ভাবটা যাচ্ছে না। হঠাৎ উনি বললেন—ঠাকুরমশাই, আমার স্ত্রী যখন প্রথমবার এক বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করতে যাচ্ছিলেন, তখন তার হাতে কিছু ছিল কি?

অকস্মাৎ এই প্রশ্নে একটু অবাক হয়ে বললাম—হাতে? আমি তো ঠিক—দাঁড়ান, একখানা উঁটাওয়ালা পদ্ম ছিল বোধহয়, তাই না?

দেবদর্শন বললেন—আর দ্বিতীয়বার?

—যখন বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে আসছিলেন?

—হ্যাঁ।

—তখন তো হাতে পুজোর ডালা ছিল। কেন, এ প্রশ্ন করছেন কেন?

দেবদর্শন যেন কিছুটা আপনমনেই বললেন—তাহলে পদ্মটা উনি কোথায় রেখে এলেন? পরে তো হাতে ছিল না—

এই সামান্য ব্যাপারে দেবদর্শন ব্যস্ত হচ্ছেন কেন বুঝতে পারলাম না। বললাম—ডালাতেই রাখা ছিল হয়ত, পাশ থেকে দেখা যায়নি–

-তাই? তা হবে হয়ত, অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। নইলে আর যাবে কোথায়?

মানুষের একটা না একটা বাতিক থাকেই, ভেবে মজা লাগল। দেবদর্শনের মত বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান লোক এই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এতক্ষণ মাথা ঘামাচ্ছেন!

নিমন্ত্রিতদের খাওয়া মিটতে মিটতে অনেক রাত্তির হয়ে গেল। এ পরিবারের নিয়ম, বাইরের কারও খাওয়া বাকি থাকতে বাড়ির কেউ খেতে বসবেন না। আমরা বৈঠকখানাতে বসেই তামাক খাচ্ছিলাম, রাত একটা কী দেড়টা নাগাদ রঘু এসে দেবদর্শনকে বলল—চলুন কর্তামশাই, খাবার জায়গা হয়েছে—

ভেতরবাড়ির বারান্দায় খেতে বসলাম দুজনে। কলাপাতায় করে খাওয়া, মুখুজ্জেবাড়ির রীতি অনুযায়ী পুজোর প্রসাদ ধাতুপাত্রে পরিবেশন করা হয় না। খিচুড়ি, পাঁচভাজা, পাঁচমিশেলি একটা ঘণ্ট—তার মধ্যে আলু কচু বেগুন থােড় পালংপাতা চালকুমড়ো সবই আছে, তারপর লুচি আর পায়েস। একটা জিনিস বরাবর দেখেছি, পুজোর ভোগ হিসেবে যে খিচুড়ি রান্না হয় তার স্বাদ অদ্ভুতভাবে আলাদা। বর্ষার দিনে গরম খিচুড়ি আর ডিমভাজা খাবার ইচ্ছে হয়েছে? বেশ তো, বেঁধে খাও। চড়ইভাতি কিম্বা পোষলায় খিচুড়ি রান্না হয়েছে? বেশ তো, পেট ভরে খাও। রান্না নিশ্চয় ভাল হবে, কিন্তু সে অন্যরকমের ভাল, পুজোর ভোগের স্বাদ তাতে পাবে না।

কিশোরী বলল—তার কারণ আমাদের মনের ধর্মভাব। বৃষ্টির দিনে বা পৌষলায় রান্না করা হয় মনে একটা আড্ডা বা হুল্লোড়ের ভাব নিয়ে, আর পুজোর ভোগ রাঁধবার সময় মনে পবিত্র ধর্মীয় সচেতনতা জেগে থাকে—তাই পার্থক্য। নইলে একই চাল-ডালমশলায় তৈরি খাবারে অন্যরকম স্বাদ হবে কেন?

তারানাথ বলল—তাই হবে হয়ত। যাক, গল্পটা শোন।

মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছি, বুঝতে পারছি রান্নাঘরের দরজার পাশে মুখুজ্জেগিন্নী দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অতিথির খাওয়ার সময় গৃহকত্রীর উপস্থিত থাকা বনেদি বাড়ির নিয়ম। হয়ত তিনি কথা বলবেন না, কোন ছোট মেয়ে বা কর্মচারীর মাধ্যমে কী লাগবে তা জিজ্ঞাসা করে নেবেন, কিন্তু নিজে আড়ালে দাঁড়িয়ে সমস্ত সময়টা তদারক করবেন। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য পরিস্থিতি একটু অন্যরকম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরপর দুবার কিছুদিনের ভেতর এসে অতিথি হওয়ায়, মুখুজ্জেগিন্নীর সহজ মাতৃত্বপূর্ণ চরিত্রের জন্য, আর লটারির প্রাইজ পাবার টিকিটটা যে আমিই বেছে দিয়েছি সে খবরটা রাষ্ট্র হয়ে পড়ায় বাড়ির সকলেই আমাকে একান্ত আপনজন বলে ভাবতে শুরু করেছে।

খেতে খেতে দেবদর্শন বললেন—বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করে আবার ফিরে গিয়েছিলে কেন? সবাইকে নিয়ে একবারেই তো গেলে পারতে–

দরজার আড়ালে একটুখানি বিস্মিত নীরবতা। তারপর মুখুজ্জেগিন্নী একটু অবাক গলায় বললেন—বিশালাক্ষী মন্দিরে? সেখানে আমি যাইনি তো!

খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলে তাকালেন দেবদর্শন।

–যাওনি! কী বলছ তুমি!

—ঠিকই বলছি। বাড়ির মেয়েরা মিলে যখন পুজোর জায়গায় যাচ্ছি তখন তো তোমার সঙ্গে দেখাই হল, তুমি আর ঠাকুরমশাই মিলে নদীর ধারের পথ দিয়ে ফিরছিলে। আমাদের দেখে বাঁশঝাড়ের তলায় দাঁড়িয়ে ওঁকে কী যেন বললে। তার আগে আবার কোথায় গেলাম?

—তার একটু আগে তুমি একা যাওনি বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করতে?

-না তো! আমি, রাজুর মা, বিরাজপিসি আর ছেলেপুলেরা মিলে একবারই বেরিয়েছিলাম। কেন জিজ্ঞাসা করছ বল তো? কিছু হয়েছে নাকি?

পাত থেকে হাত তুলে ফেলেছেন দেবদর্শন।

–না, হয়নি কিছু। কিন্তু আমি যে স্পষ্ট—মানে তোমার হাতে একটা—

আমি একটু কেশে বললাম—ওটা বোধহয় ভুল দেখেছেন মুখুজ্জেমশাই।

দেবদর্শন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—সে কী! আপনিও তো–

আমি জোর দিয়ে বললাম—সে-সব কথা পরে হবে এখন। চাঁদের আলোয় অত ভাল করে কিছু দেখা যায় না, কাকে দেখতে কাকে দেখেছেন–

দেবদর্শন কেমন হকচকিয়ে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ আগেই ওঁর সঙ্গে এ নিয়ে আমার কথা হয়েছে, ওঁর মত আমিও যে বউঠাকরুণকে বিশালাক্ষী মন্দিরে ঢুকতে দেখেছি তা বলেছি—কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার এই উল্টো কথা বলায় উনি খুবই বিস্মিত হয়েছেন সন্দেহ নেই।

দেবদর্শন বললেন—কিন্তু আপনিই যে—

ফের খেতে শুরু করে নিচু গলায় বললাম—খেয়ে নিন, পরে কথা হবে।

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো বেশিরভাগ পূর্ববঙ্গেই পালিত হয়। দেবদর্শনের জমিদারি ঠিক পূর্ববঙ্গে নয়, বরং বেশ খানিকটা দূরেই বলতে হবে। কিন্তু উৎসব আর আনন্দ করার আকাঙ্ক্ষা মানুষের এত প্রবল যে তা কোন প্রথা কিংবা দেশকালের সীমা মানে না। উৎসব করার সুযোগ পেলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে আঁকড়ে ধরে। মুখুজ্জেবাড়ি ছাড়াও এই অঞ্চলে অনেক জায়গাতেই কোজাগরী লক্ষ্মীপূজো হতে দেখলাম।

এই লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে ঘুমোতে নেই, সারারাত জেগে তাস-পাশা খেলে, গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দিতে হয়। কোনও কোনও পরিবারে আবার নিজেদের মধ্যে জুয়াখেলারও রীতি আছে। মুখুজ্জে-পরিবারে জুয়াখেলাটা হয় না, কিন্তু আড্ডা দিয়ে রাত জাগা হয়। সেই উদ্দেশ্যে কয়েকজন গ্রামবৃদ্ধ দেবদর্শনের বৈঠকখানায় এসে জড়ো হয়েছেন দেখলাম। আগেই বলেছি, রঘু জমিদারের কেতাদুরস্ত কর্মচারী, সে অতিথিদের তামাক দিয়ে গেল। তাকিয়া হেলান দিয়ে তারা জমিয়ে বসলেন। দেবদর্শনও বসতে যাচ্ছিলেন, আমি বললাম—চলুন না, বাইরে একটু ঘুরে আসি, কী চমৎকার চাদের আলো ফুটেছে। তাছাড়া দেরি করে খাওয়া হল তো-হাঁটাচলা করলে হজম হবে।

দেবদর্শন আমার কাণ্ডে অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কোনও দ্বিধা না করে বললেন—চলুন।

তারপর অভ্যাগতদের দিকে তাকিয়ে বললেন—আপনার বসুন, তামাক খান। আমি এই এক্ষুণি আসছি—

রাত তখন প্রায় আড়াইটে। রূপোর চাকার মত চাঁদ পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে বিশাল পাকুড়গাছের পেছনে। মৃদু হিমের ছোঁয়া বাতাসে, কী যেন কী কত কথা মনে পড়ে যায়। স্বার্থ হিংসা আর হানাহানির মধ্যেও মনে হয় আকাশ মধু, বাতাস মধু। মনে হয় মৃত্যু আর অন্ধকার সত্য, কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য মুক্ত জীবনের আনন্দ।

দেবদর্শন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

বললাম–মুখুজ্জেমশাই, কেবল লটারির টাকা পাওয়া নয়, আপনার পরিবারের ইতিহাসে আজ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে–

—কী ঘটেছে ঠাকুরমশাই?

—আসুন আমার সঙ্গে। দেখাচ্ছি—

দেবদর্শনকে নিয়ে বিশালাক্ষী মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *