আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে দেবদর্শনও দাঁড়িয়ে গেলেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—কী হল ঠাকুরমশাই? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে?
বুঝলাম নীল আলোটা উনি দেখতে পাচ্ছেন না। না পাওয়ারই কথা।
বললাম—কিছু না। আজ শুক্লপক্ষের একাদশী পড়ে গিয়েছে, চাঁদের আলো সামান্য হলেও থাকা উচিত ছিল। এত অন্ধকার হল কীভাবে?
দেবদর্শন বললেন-চাঁদ আকাশে আছে ঠাকুরমশাই। পশ্চিমে হেলে পড়েছে কিনা, আমবাগানের আড়ালে বলে দেখতে পাচ্ছেন না—
–বড় অন্ধকার, তাই না?
—যা বলেছেন। নিজের বাড়িটাই দেখতে পাচ্ছি না—
এই জিনিসটা বরাবর আমাকে অবাক করেছে। স্পষ্ট, সুন্দর নীল আলোয় উদ্ভাসিত। হয়ে আছে মুখুজ্যেবাড়ি। কিন্তু আমি ছাড়া কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না। আমার মানসিক শক্তি খানিকটা দেবদর্শনের মধ্যে সঞ্চারিত করে ওঁকে আলোটা দেখাতে পারতাম, কিন্তু এ ধরণের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মুখখামুখি হওয়ার জন্য কিছুটা পূর্বপ্রস্তুতি দরকার। নইলে উনি ভয় পেয়ে যেতেন।
বৈঠকখানায় বসে দেবদর্শন বললেন—সারারাত তো জেগে, তাছাড়া কয়েকদিন ধরে আপনার পরিশ্রমও কম যাচ্ছে না। একটু ঘুমিয়ে নেবেন নাকি?
তখন ব্রাহ্মমুহূর্ত। পূব আকাশে প্রাক্-ঊষার হালকা আভাস। বৈঠকখানার পাশে একটা বড় জগডুমুর গাছের ডালে ভোরের প্রথম দোয়েলপাখি ডাকতে শুরু করেছে। রাত্তিরে না ঘুমোলেও ঠিক এইসময়টায় আর কোনো জড়তা থাকে না, ঈশ্বরের আশীর্বাদ। হয়ে মনের ভেতর পবিত্রতা জেগে ওঠে, সকালের আলো ফুটে ওঠে। বললাম—না মুখুজ্যেমশাই, এখন আর শোব না—
–বসুন তাহলে, গল্প করা যাক। আমিও শোবো না। রঘু, তামাক দিয়ে যা–
দুপুরে খাওয়ার পর দেবদর্শন বললেন—মাছ ধরার নেশা আছে?
—খুব। আমার গ্রামে আমি ছোটবেলা থেকে মেছো তারানাথ বলে বিখ্যাত। কেন বলুন তো?
—চলুন, কাল তাহলে রাণীদীঘিতে মাছ ধরা যাক। আমার শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন আত্মীয়েরও আসার কথা আছে, সবাইকে কাল রাত্তিরে লুচি আর মাছের কালিয়া খাওয়াবো–
বললাম–রাণীদীঘি কোথায়?
—বেশীদূর নয়। ওই আমবাগানটার পেছনে। বেশ গাছপালার ছায়ায় ঢাকা সুন্দর পরিবেশ। মনের মত পরিবেশ না হলে মাছ ধরে সুখ নেই, বলুন ঠাকুরমশাই?।
এই শেষের দফায় আমি দেবদর্শনকে একজন পাকা মেছুড়ে বলে চিনতে পারলাম। অনেক মাছ ধরাটা বড় কথা নয়, পরিবেশ এবং মাছ ধরার উদ্যোগটাই বড় কথা।
বললাম–ঠিক বলেছেন। দীঘিতে ভাল মাছ আছে? টোপে ঠোকরায়?
দেবদর্শন হাসলেন, বললেন—প্রচুর মাছ আছে। ও দীঘি জমিদারবাড়ির নিজস্ব সম্পত্তি, বাইরের কেউ ব্যবহার করে না। পালে-পার্বণে জাল ফেলা হয়, প্রয়োজনমত সামান্য মাছ রেখে বাকি আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। এমন অনেক মাছ আছে যাদের ওজন বিশ-ত্রিশ সের, গায়ে শ্যাওলা গজিয়ে গিয়েছে। তবে টোপে ঠোকরাবে কিনা সে তো অনেকটা কপালের ব্যাপার–
—জাল ফেলে দরকারমত মাছ ধরে নিতে পারেন তো? ছিপে যদি না আসে?
–না, আত্মীয়দের বলেছি নিজে মাছ ধরব। এখন জাল ফেলাটা—
বুঝলাম এখন কিছু মাছ অন্তত নিজে না ধরলে শ্বশুরবাড়ির মানুষদের কাছে তাঁর সম্মান থাকবে না। একটু ভাবনাও হল। শরৎকালের এই সময়টায় চারে মাছ আসবে কি? এটা ঠিক মাছ ধরার সময় নয়। দেবদর্শন মানুষটি বড় ভাল, নিজে মাছ ধরে আত্মীয়দের খাওয়াবেন—এই সামান্য সাধটুকু পূর্ণ না হলে মনে ভারি দুঃখ পাবেন। কী করা যায়?
বিকেলের ছায়া গাঢ় হয়ে এলে গ্রামের পথে একটু বেড়াতে বের হলাম। শরৎসন্ধ্যার একটা আলাদা স্নিগ্ধ রূপ আছে। ঝোপঝাড় থেকে কেমন সুন্দর মিষ্টি গন্ধ বের হয়, মাথার ওপর দিয়ে পাখিরা বাসার দিকে উড়ে যায়। মাঠে-প্রান্তরে হাল্কা কুয়াশা জমে, ঈষৎ হিমের ছোঁয়া আর বেলাশেষের আলো হঠাৎই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়িয়ে দেয়। একটা জিনিস কখনও লক্ষ্য করেছ? সন্ধ্যের সময় যত পাখি আকাশে ওড়ে তারা সব পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায়, উল্টোদিকে খুব একটা কাউকে যেতে দেখবে না। অর্থাৎ কোনও অজ্ঞাত কারণে পাখিরা দিনের বেলা নিজেদের বাসার পূর্বদিকে ঘোরাফেরা করে। কী করে তারা দিক চিনতে পারে কে জানে!
পথের বাঁকে একজায়গায় একটা বড় আকন্দগাছ প্রায় আমার মাথা ছাড়িয়ে লম্বা। বড় বড় চ্যাটালো, ফ্যাকাসে সবুজ পাতায় ভরপুর প্রাণশক্তি প্রকাশিত হয়েছে। সে গাছ থেকে বুড়ো আঙুলের মত মোটা আর কড়ে আঙুলের মত লম্বা কিছুটা ডাল ভেঙে নিয়ে কোমরে গুঁজে রাখলাম। যাক, কাজ অন্তত কিছু এগিয়ে রইল।
সন্ধ্যে গাঢ় হতে মুখুজ্যেবাড়ি ফিরে এলাম। দেউড়িতে বসে বাতির কঁচ পরিষ্কার করছিল রঘু, তাকে বললাম—হাতের কাজটা শেষ করে আমাকে একটা নরুণ এনে দিতে পার?
—আজ্ঞে, নরুণ? নখ কাটবেন বুঝি? কাল সকালে নলিন পরামাণিককে পাঠিয়ে দেব?
—কারুকে পাঠাতে হবে না। তুমি একটা নরুণ আমাকে দিয়ে যাও—
কিছুক্ষণ পরে রঘু অতিথিশালার ঘরে এসে একটা চকচকে নরুণ দিয়ে গেল।
রাত্তিরে খাওয়ার পরে বসে বসে নরুণ দিয়ে আকন্দগাছের ডাল থেকে একটা ছোট্ট গণেশমূর্তি কুঁদে বের করলাম। আকন্দকাঠ নরম, তাই অসুবিধে হল না। দেখতে বেশ ভালই হল। গণেশমূর্তি বানানোর একটা সুবিধে আছে, নাদা পেট আর সামনে শুড় দুলিয়ে দিলেই গণেশ। খুব বড় শিল্পী হওয়ার দরকার পড়ে না। মোটামুটি আদল আনতে পারলেই জিনিসটা কী তা বোঝা যায়।
পূজো উপলক্ষ্যে কাছারি এখন বন্ধ। নায়েবমশাইকে বলেছিলাম একটা নীলের বড়ি আমাকে জোগাড় করে দিতে। উনি কাছারির দরজা খুলে লেখার কালি বানাবার একখানা বড়ি এনে দিয়েছিলেন বিকেলে। মাটির ভাঁড়ে কুঁজো থেকে জল ঢেলে তাতে বড়ি গুলে গাঢ় নীল কালি বানিয়ে তাতে গণেশমূর্তি ভিজিয়ে রাখলাম কিছুক্ষণ। যখন তুললাম তখন সাদা আকন্দকাঠ রঙ টেনে কটকটে নীল হয়ে গিয়েছে।
তারানাথ সিগারেট ধরাবার জন্য থামল। জিজ্ঞাসা করলাম—নীল গণেশ দিয়ে কী হয়?
—নীল গণেশ খুব শুভকারী দেবতা। সঠিক আরাধনা করতে পারলে ওকে দিয়ে করানো যায় না এমন কাজ নেই। তোমাদের আগেও নীল গণেশের কথা বলেছি, তোমাদের মনে নেই।
যাই হোক, পরদিন সকালে জলখাবার খাওয়ার পর মুখুজ্যেমশাইয়ের ডাক এল। সরঞ্জাম তৈরি, এবার মাছ ধরতে যাওয়া হবে। কাছারিবাড়ির সামনে দেখি দেবদর্শন ব্যস্ত হয়ে কর্মচারীকে কী করতে হবে বোঝাচ্ছেন। একজন ভৃত্য পাঁচ-ছ’গাছা ছিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে, মাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে নানামাপের কৌটো আর ভঁড়। তা থেকে মনোমুগ্ধকর। সব গন্ধ বের হচ্ছে। হঠাৎ সম্মিলিত গলার কোলাহল শুনে দেখি কয়েকজন ভদ্রলোক নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এদিকে আসছেন। বুঝলাম এঁরাই দেবদর্শনের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়, এঁদের সামনেই তিনি মাছ ধরে দেখাতে চান।
রাণীদীঘি সত্যিই একটা বিশাল জলাশয়। এপার থেকে ওপারে দাঁড়ানো মানুষকে ভাল চেনা যায় না। যেখানে মাছ ধরতে বসা হবে সেখানে বাড়ির মেয়েদের স্নান করার জন্য বাঁধানো ঘাট, কয়েকখানা প্রাচীন আমকাঠালের ছায়ায় স্নিগ্ধ হয়ে আছে। দু-চারটে কলাপাতা পেতে দেবদর্শন মাছ ধরতে বসে গেলেন। একটু উঁচুতে পৈঠার ওপর শতরঞ্জি ভাঁজ করে বসলেন অতিথিরা। সকাল-বিকেলে সামান্য হিমের ভাব থাকলেও বেলা হবার সঙ্গে সঙ্গে রোদ্র বেশ চড়বড় করে বেড়ে ওঠে। কিন্তু এখানে সারাদিনই ছায়া থাকবে মনে হয়।
চুপ চুপ শব্দ করে জলে চার ছড়াচ্ছেন দেবদর্শন, গন্ধে চারদিক মম করছে। পুরুষ্টু কেঁচো দিয়ে টোপ গাঁথা হল, শক্ত মুঠোয় ছিপ ধরে তীক্ষ্ণ চোখ করে বসলেন বটে, কিন্তু জমিদারমশাই আজ কতটা সফল হবেন সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রইল। গত কুড়ি বছর ধরে মাছ ধরে আসছি, শরতের সকালে টোপে মাছ ঠোকরাতে খুব একটা দেখিনি।
দেবদর্শন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-ঠাকুরমশাইও একটা ছিপ নিয়ে বসে যান না, শুধু দেখবেন কেন?
–না, আজ আপনিই ধরুন! আজ আর হাত লাগাতে ইচ্ছে করছে না।
মাছ ধরতে ইচ্ছে করছিল না এমন নয়, কিন্তু ভাগ্যবশে ওঁর বদলে আমার ছিপে মাছ উঠলে উনি দুঃখ পেতেন। আর সত্যিকারের মেছুড়ে মাছ ধরা দেখতেও ভালবাসে। উনি বিশেষ পীড়াপীড়ি করলেন না। আমিও দেবদর্শনের পেছনে একখানা কলাপাতা পেতে বসে পড়লাম।
যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই ঘটতে চলল। দুপুরে খাওয়ার সময় পর্যন্ত একটা মাছও চারে এল না। একসময় ছিপ গুটিয়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে দেবদর্শন বললেন—চলুন, খেয়ে আসা যাক। তারপর আবার বসা যাবে। ততক্ষণ চার আর একটু জমুক–
আত্মীয়ের দলটিও একটু উসখুস করছিল, তারাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে নিচু স্বরে বললাম—চিন্তা নেই। খেয়ে এসে বসুন, মাছ পাবেন–
দেবদর্শন চমকে আমার দিকে তাকালেন, মুখে কিছু বললেন না, আমি একটু হাসলাম।
প্রথম হেমন্তের বেলা চট করে পড়ে আসে। খাওয়ার পরেই আর দেরি না করে। আবার রাণীদীঘির পাড়ে ফিরে আসা হল। ছিপ মুঠো করে বসে গেলেন দেবদর্শন।
আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম জমিদারমশাইয়ের সব আত্মীয়েরা এখনও এসে পৌঁছোয় নি। যারা এসেছেন তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছেন, এদিকে কারো তেমন মনোযোগ নেই। আমি ধুতির ভাঁজে লুকিয়ে রাখা নীল গণেশের মূর্তিটা বের করে দেবদর্শনের মাথার ওপর দিয়ে দীঘির জলে ছুঁড়ে দিয়ে বললাম-শ্বেতর্ক নির্মিতং গণনাথং পঞ্চান্তকং ওঁ অন্তরীক্ষায় স্বাহা।
দেবদর্শন চমকে উঠে ফিরে তাকালেন, তাঁর চোখে বিমূঢ় দৃষ্টি। বললেন—কে কী ফেলল জলে? এঃ, মাছ পালিয়ে যাবে যে! এতক্ষণে হয়ত চার একটু জমে আসছিল–
—ভাবনা নেই। ও আমি একটা জিনিস ফেলেছি—
–আপনি! সে কি! কী জিনিস?
উত্তরে বললাম—ঘুরে বসুন মুখুজ্যেমশাই। বাঁদিকের ছিপের ফাতনা কাঁপছে।
বড় মাছ। দু-তিনবার কেঁপে ফাতনা একেবারে নিতলি হয়ে গেল।
হর্ষধ্বনি করে আত্মীয়ের দল উঠে দাঁড়াল। ধনুকের মত বেঁকে গিয়েছে ছিপ, মাছ ছুটেছে দীঘির উত্তর-পশ্চিম কোণ লক্ষ্য করে। কিরকির আওয়াজ করে ঘুরে যাচ্ছে হুইল। গতকাল তামাক খেতে খেতে তার মাছ ধরার সরঞ্জাম দেখিয়েছিলেন দেবদর্শন। কলকাতায় তোক পাঠিয়ে অনেক খরচ করে কিনে আনা মূল্যবান বর্মী বাঁশের ছিপ, বিলিতি হুইল আর বঁড়শি—খাঁটি ইস্পাতের তৈরি। শক্ত মুগার সূতো, মথুরা থেকে আনানো ময়ূরের পাখার ফাতনা—যত বড় মাছই হোক, একবার গাঁথলে আর সহসা ছাড়া পাবার উপায় নেই।
প্রায় পৌনে একঘণ্টা খেলাবার পর হুইল গুটিয়ে ঘাটের কাছে মাছটা টেনে আনলেন দেবদর্শন। তাঁর গা বেয়ে ঘাম ঝরছে। কিন্তু মুখ উজ্জ্বল। বড় মাছ গেঁথেছে এ খবর রটে যাওয়ায় রাণীদীঘির পাড়ে ভিড় জমে গিয়েছে। অনেকক্ষণ লড়ে যদিও মাছটা নির্জীব হয়ে পড়েছে, তবু জলের ভেতর ও জিনিস বাঘের মত শক্তি ধরে। রঘু এবং আরও তিনজন লোক জলে নেমে পাঁজাকোলা করে জাপটে মাছটা ওপরে তুলে এনে ঘাটের পৈঠায় শুইয়ে দিল। অস্ফুট শব্দে ভিড় ঝুঁকে পড়ল সামনে।
চোদ্দ-পনেরো সের ওজনের বিশাল লালচে রুই। একটা বাছুরের মত বড়।
সবাই নানারকম প্রশংসাসূচক কথা বলছে, কেউ ফিতে এনে মাছটা মাপার কথা বলছে। আমি তাকিয়েছিলাম দেবদর্শনের দিকে। তিনি ভারি খুশি হয়েছেন। মানুষটির মনের মধ্যে কোনো ঘোরপ্যাচ নেই, এইটুকু কৃতিত্বতেই ভদ্রলোক তৃপ্ত।
বললাম—এতে হবে তো? না আর একখানা ধরবেন?
দেবদর্শন বললেন—না, না, এতেই খুব হয়ে যাবে। আজ তো কেবল বাড়ির লোক আর এই এঁরা, সবমিলিয়ে ধরুন তিরিশজন। মুড়ো আর আঁশ-টাশ বাদ দিয়ে যদি দশ কী এগারো সের মাছও পাই, তাহলেও ভেসে যাবে। আর ধরা উচিত হবে না, কোনো কিছুর অপচয় করতে নেই।
তারপর বললেন–সুন্দর মাছটা, বলুন? এর মুড়োটা কিন্তু আজ আপনাকে খেতে হবে–
—সে কী! আমি কেন? নিয়ম জানেন না? মাছ যে ধরেছে মুড়ো তাকেই খেতে হয়?
স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে দেবদর্শন বললেন—সেইজন্যই তো মুছোটা আপনি খাবেন। নিয়ম জানি বলেই তো এ কথা বলছি–
আমরা দুজন কয়েকমুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর আমি হেসে বললাম—বেশ তো, মুড়ো খেতে হয় খাব। কিন্তু মাছটা আপনিই ধরেছেন।
সবকিছু বাদ দিয়ে মোট সাড়ে বারোসের মাছ পাওয়া গেল। পেটভরে মাছ খেয়ে সবাই ভারি খুশি। কেবল খেতে খেতে দেবদর্শন হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন।
পরের দুটো দিন ভালই কাটল। খাই-দাই আর গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়াই। সত্যি বলতে কী, এ ক’দিন আরামে থেকে থেকে আমার অভ্যেসটাই খারাপ হয়ে গেল। আর বড় জোর দুদিন, তারপর আবার বেরিয়ে পড়তে হবে পথে।
বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে যে পথটা বেঁকে নদীর দিকে চলে গেল, সেই পথে সন্ধ্যের দিকে রোজ হাঁটতাম। দুদিন পরে পূর্ণিমা, রাঙা চাদটা পূব দিগন্তের একটু ওপরে ভেসে থাকে দেবতাদের দেওয়া আকাশপ্রদীপের মত। আমবাগানের ওপারে ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে শেয়ালের দল একসঙ্গে ডেকে ওঠে। বর্ষা চলে যাবার পর জোনাকির ঝক বিদায় নিয়েছে, তবু দেরি করে রয়ে যাওয়া দু-দশটা গাছ-গাছালির ফাঁকে ফাঁকে জুলেনেভে। বাংলার পল্লী অঞ্চলের এই পরিবেশ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, শহুরে চালচলন আর ভাবধারা ঢুকে পড়েছে গ্রামে। তোমরা যারা দেখেছ তারা জানো, তোমাদের সন্তানেরা হয়ত এ জিনিস আর পাবে না।
লক্ষ্মীপূজোর দিন খুব ভোরে উঠে শিশিরভেজা ঘাসের পথে হেঁটে নদীতে স্নান করতে গেলাম। হেমন্তের সকালে অবগাহন স্নান ভারি আরামের, একটা পবিত্রতার বোধ এনে দেয়।
স্নান করে ফিরতে রঘু এসে বলল—ঠাকুরমশাই, কর্তাবাবু বৈঠকখানায় এসে বসেছেন। আপনাকে ডাকছেন। আপনি আজ ওখানেই জলখাবার খাবেন।
বৈঠকখানায় তাকিয়া হেলান দিয়ে আলবোলার নলে টান দিচ্ছেন দেবদর্শন। এই সকালেই তাঁরও মান হয়ে গিয়েছে। আমাকে দেখে বললেন—বসুন। ওরে রঘু, ঠাকুরমশাইকে তামাক দিয়ে যা।
তামাক এল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জলখাবার। খাঁটি ঘিয়ে ভাজা খাস্তা পরোটা, বেগুনভাজা এবং একথাবা সর—তার ওপরে মোটা করে চিনি ছড়ানো। বললাম—একি! আমার একার জন্য কেন? আপনার কই?
—আমি এখন খাব না। কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমায় আমি সারাদিন নির্জলা উপোস করি। রাত্তিরে একেবারে পূজোর পর অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ নেব। আপনি সঙ্কোচ বোধ করবেন না, শুরু করুন।
তারপর তামাকের নলে গোটাদুই লম্বা টান দিয়ে বললেন—আজ আপনাকে একটা মজার জিনিস খাওয়াব
—আপনার সঙ্গে আলাপ হবার পর থেকে কেবলই তো নানারকম খাবার খাচ্ছি। আজ আবার কী?
—আজকেরটা ঠিক খাবার বলা যায় না, বরং পানীয় বলতে পারেন–
একটু অবাক হয়ে বললাম—পানীয়! তার মানে–কিন্তু আপনি তো-ইয়ে, কী পানীয়ের কথা বলছেন?
দেবদর্শন হাসলেন, বললেন—ভয় নেই, কড়া কোনও পানীয় নয়। আপনাকে গড়গড়ির জল খাওয়াব–
—গড়গড়ির জল! সে আবার কী?
মুখ থেকে নল নামিয়ে দেবদর্শন বললেন—একমাত্র শীতকাল ছাড়া আমাদের দেশে তেমন ঠাণ্ডা খাবার জল পাওয়া যায় না। গরমকালে মাটির জালায় রাখা হলে কিছুটা ঠাণ্ডা হয় ঠিক, কিন্তু একেবারে বরফজলের মত তো আর হয় না। আমাদের এই পাড়াগাঁয়ে বরফ পাওয়াও যায় না, তাই কোনো ঘরোয়া উৎসবে অতিথিদের দাঁত শিরশির করা কনকনে জল খাওয়াবার ইচ্ছে হলে আমি গড়গড়ির জলের ব্যবস্থা করি।
—সে তো বুঝলুম, কিন্তু জিনিসটা কী?
—মোগল আমলে সম্রাটেরা এই পদ্ধতিতে জল ঠাণ্ডা করতেন। একটা বড় পেতলের হাঁড়ির মধ্যে অর্ধেক ভর্তি করে জল ঢেলে তাতে বেশ কিছুটা সোরা মিশিয়ে দেওয়া হয়। কালীপূজো আসছে, গ্রামের ছেলেপুলেরা অনেকেই আতসবাজি তৈরি করে, তাই এ সময়টায় সারের দোকানে সোরা পাওয়া যায়। একটা কাঠের ডাণ্ডা দিয়ে ভাল করে খুঁটে দিলে জলটা বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এবার একটা জলভর্তি সরু গলা ধাতুর পাত্র ওই হাঁড়ির মধ্যে বসিয়ে দিলে আধঘণ্টার ভেতর সে জলও কনকনে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ভরপেট খাবার পর ঠাণ্ডা জল ভারি তৃপ্তিদায়ক, বলুন?
বলবার আর বিশেষ কী ছিল, দুপুরে আহারাদির পর গড়গড়ির জল খেয়ে হাতেনাতে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। দেবদর্শনের সব অতিথিরাই সে জল খেয়ে অবাক।
দুপুরের পর থেকে মেয়েরা বসে গেলেন পূজোদালানের মেঝেতে চালবাটা দিয়ে আলপনা দিতে। এই জিনিসটা আমাকে চিরকাল মুগ্ধ আর বিস্মিত করে। বাঙালীর জীবনে যতই বারো মাসে তেরো পার্বণ হোক, মাসে পনেরোদিন তো আর মেয়েদের আলপনা দেবার জন্য বসতে হয় না। তাহলে নিয়মিত অভ্যাস ছাড়া তারা এত সুন্দর আর নিখুঁত আলপনা দেন কী করে? পরিষ্কার মেঝেতে যেন জাদুবনে ফুটে উঠছে ছোট ছোট কুটির, তার দুপাশে কলাগাছ, সামনে সরু পথ—সে পথে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আঁকা। তাছাড়া ধানের গোলা, ধানের ছড়া। পাশেই বসে রয়েছে গম্ভীরমুখ পাচা। বড় বড় কানওয়ালা সে পাচারা আসল প্যাঁচার চাইতেও দেখতে অনেক ভাল।
সূর্য অস্ত গেল। পুরোপুরি অন্ধকার নামবার আগেই পূবদিগন্ত বেয়ে উঠে এল সোনালি রঙের পূর্ণিমার চাঁদ। আমাকে বৈঠকখানায় বসিয়ে রেখে দেবদর্শন স্নান করতে গিয়েছিলেন। এবার স্নান সেরে গরদের ধূতি আর চাদর পরে এসে তিনি বললেন—চলুন ঠাকুরমশাই, পূজোর সময় হয়েছে—
আমি উঠে দাঁড়াবার আগেই হঠাৎ বাইরে কীসের একটা হই-চই শোনা গেল। ঘরে এসে ঢুকল রঘু, নায়েবমশাই এবং আরও কয়েকজন লোক। তারা সবাই খুব উত্তেজিত, সবাই একসঙ্গে কী একটা বলতে চাইছে। দেবদর্শন অবাক হয়ে বললেন—কী হয়েছে? কী ব্যাপার?
তারা কিছু বলবার আগেই ভিড়ের পেছন থেকে এগিয়ে এল একজন মানুষ। সেও উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে।
লোকটি ভূষণ রায়।
দেবদর্শন বললেন—একি ভূষণ! কী হয়েছে? গোলমাল কীসের?