হুমায়ূন আহমেদের অন্যরকম সাক্ষাৎকার
মিলন : হুমায়ূন আহমেদ, আপনি কেমন আছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : বেঁচে আছি।
মিলন : বেশির ভাগ মানুষকে যদি এ প্রশ্নটা করা হয়, তারা বলেন, ভালো আছি। অথবা এই আছি আর কী। কেউ কেউ কোনো কোনো সমস্যার কথা বলেন। আর আপনি শুধু বলেন, বেঁচে আছি। এ রকম বলার কারণ কী?
হুমায়ূন আহমেদ : বাংলাদেশে আমি অনেক মৃত মানুষকে জীবিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে দেখি। এঁদের আত্মা মরে গেছে। তারা তা জানেন না। তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় কেমন আছেন, তাঁরা হাসিমুখে বলেন, ভালো আছি।
মিলন : আপনি এত বড় লেখক, বড় লেখকদের বাড়িভর্তি বই থাকবে, এমনই আমরা আশা করি। আপনার ফ্ল্যাটে তেমন বই দেখছি না কেন? আপনার এই ফ্ল্যাটের সেলফে বইয়ের সংখ্যা কত?
হুমায়ূন আহমেদ : এই মুহূর্তে আমার ফ্ল্যাটে বই আছে বারো শ তেত্রিশ। এটা আমার লেখালেখির বারান্দা। যেসব বই লেখালেখিতে প্রয়োজন সেই বই-ই শুধু এখানে আছে। আমার নিজের লেখা বই একটিও নেই। তবে ঢাকার বাইরে নুহাশপল্লীর লাইব্রেরিতে অনেক বই আছে। দশ হাজারের বেশি বই আছে আমার গ্রামের শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ স্কুলে। একটা কথা, লেখক হতে হলেই বিশাল লাইব্রেরি থাকতে হবে, তা না। প্ৰকাণ্ড লাইব্রেরির মালিকরা কেউই লেখক না।
মিলন : কয়েক বছর ধরে আপনি ছবি আঁকছেন। অনেক ছবিই এর মধ্যে এঁকেছেন। ছবি আঁকার ব্যাপারটি আপনার মধ্যে কীভাবে এল?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার সব ভাইবোনই শখের পেইন্টার। এটা বোধহয় জিনের কোনো ব্যাপার। তবে আমার বাবা-মা কাউকেই কখনো ছবি আঁকতে দেখি fà |
মিলন : ছেলেবেলায় বা বড় হয়ে ওঠার পর লেখালেখি শুরু করলেন। কিন্তু ছবি আঁকতে শুরু করলেন অনেকটা বয়সে.।
হুমায়ূন আহমেদ : Even an old dog can learn few new tricks.
মিলন : যারা ছবি আঁকেন, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছবির প্রদর্শনী করা। কখনো কখনো পত্রপত্রিকায় নিজের আঁকা ছবি ছাপাবার ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ প্রচারের একটা লক্ষ্য থাকে। আপনার সে রকম কিছুই আমাদের চোখে পড়ে নি কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি খুবই নিম্নমানের পেইন্টার। আমার আঁকা ছবি বন্ধুবান্ধবকে দেখানো যায়। এর বাইরে না। নিজের সীমাবদ্ধতা আমি জানি।
মিলন : ম্যাজিকে আপনার গভীর উৎসাহ। ম্যাজিকের বই পড়া, ম্যাজিক প্র্যাকটিস করা-এ ব্যাপারটি নিয়ে মেতে থাকতে আপনি খুব পছন্দ করেন। ম্যাজিকের প্রতি আপনার এই আকর্ষণ কীভাবে জাগল?
হুমায়ূন আহমেদ : ম্যাজিক মুন্সি লেখায় আমার ম্যাজিকের প্রতি আগ্রহের কারণ ব্যাখ্যা করেছি। আর কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। একই কথা বারবার বলা ক্লান্তিকর ব্যাপার।
মিলন : এ পর্যন্ত শ খানেক গান আপনি লিখেছেন। আপনার লেখা কোনো কোনো গান আকাশচুম্বী জনপ্রিয়। যেমন—এক যে ছিল সোনার কন্যা, ও আমার উড়াল পঙ্খী রে। আপনি সেভাবে কখনো কবিতা চর্চা করেন নি। গান লেখার ব্যাপারটিতে কেমন করে জড়ালেন?
হুমায়ূন আহমেদ : বেশির ভাগ গানই প্রয়োজনের তাগিদে লেখা। যেমন ছবির জন্য গান দরকার, অন্য কারও কাছে না গিয়ে নিজেই লিখলাম। গানে আমার ভূমিকার চেয়ে সুরকার এবং গায়ক-গায়িকার ভূমিকা প্রধান। পত্রিকার পোস্টএডিটরিয়ালেও সুন্দর সুর বসালে এবং ভালো কাউকে দিয়ে গাওয়ালে সুন্দর গান হবে।
মিলন : আপনি কয়েকটি দুর্দান্ত বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। বিজ্ঞাপন চিত্রের স্ক্রিপ্ট করেছিলেন। এ কাজগুলো এখন আর করছেন না কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞাপন তো নিজের আগ্রহে কেউ করে না। অন্যের আগ্রহে করা হয়। কেউ আমাকে এখন আর বিজ্ঞাপন বানাতে ডাকে না।
মিলন : একবার ঈদে দেশ টিভির জন্য আপনি একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করেছেন। অনুষ্ঠানটির পরিচালকও ছিলেন আপনি। পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ নন, আমরা কথা বলতে চাইছি উপস্থাপক হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। এ বিষয়ে তিনি কী বলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : নুহাশপল্লীর নিতান্ত ঘরোয়া অনুষ্ঠানে উপস্থাপনটা গৌণ। নিজের ঘরে কথা বলার মতো। তবে জীবনের প্রথম উপস্থাপনাটা কিন্তু জাপানে। বাংলাদেশ থেকে বিশাল একদল নিয়ে গিয়েছি। উপস্থাপক নিয়ে যাই নি, কাজেই বাধ্য হয়ে উপস্থাপনা।
মিলন : ভবিষ্যতে আপনি কি উপস্থাপনা করবেন? সবকিছুই তো করলেন, এটা বাদ থাকবে কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার চেহারা খারাপ, কণ্ঠস্বর খারাপ, ভাষা আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট। এইসব ক্রটি নিয়ে লেখক হওয়া যায়, উপস্থাপক হওয়া যায় না।
মিলন : আপনি কিছু অবিস্মরণীয় ভূতের গল্প লিখেছেন। আমরা মনে করি, সেইসব গল্প বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হবে। ভূত নিয়ে আপনার নিজের ভাবনাটা কী রকম? আপনি ভুতে বিশ্বাস করেন?
হুমায়ূন আহমেদ; ভূত বিশ্বাস করি না, কিন্তু ভয় নামক অনুভূতিটি বিশ্বাস করি। আমার কাজ ভয় নিয়ে, ভূত একটা উপলক্ষ মাত্র।
মিলন : আপনার লাইব্রেরি ভর্তি বিজ্ঞানের বই। বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু বলুন।
হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞান আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করত। মনের ভেতর সবসময় অতৃপ্তির হাহাকার, কবে মানুষ সব জানতে পারবে?
মিলন : ধর্ম নিয়ে আপনার ব্যাপক পড়াশোনা। নানা রকমের ধর্মীয় বই আপনি পড়ছেন। আপনার ধর্মভাবনা কী রকম?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি অত্যন্ত গোড়া মুসলিম পরিবার থেকে এসেছি। উৎসাহের শুরুটা সেখানে। আমি প্ৰচণ্ড আস্তিক, তবে… পরের উত্তর দেব না।
মিলন : আপনি একজন বৃক্ষপ্রেমী মানুষ। বৃক্ষের প্রতি আপনার আকর্ষণ এবং মমত্ববোধের কথা আমরা জানি। থা নামে আপনি একটি বইও লিখেছেন। বৃক্ষের প্রতি আপনার এই আকর্ষণ কীভাবে জাগল?
হুমায়ূন আহমেদ : লোকমান হেকিম গাছের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। আমি কথা বলতে পারি না, তবে গাছের অনুভূতি সামান্য হলেও ধরতে পারি। হয়তোবা এ কারণেই।
মিলন : আপনি খান খুব কম। কিন্তু আপনি একজন রসনাবিলাসী মানুষ। আপনার বইয়ের কোনো কোনো তাকভর্তি শুধুই রান্নার বই। রান্না বিষয়ে আপনার এত আগ্ৰহ কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : কম খেলেও ভালো খেতে পছন্দ করি। রান্না যে-কোনো জাতির সংস্কৃতির একটা বড় অংশ। বিভিন্ন দেশের রান্নার বই পড়ি ওই দেশ সম্পর্কে ভালোমতো জানার জন্য।
মিলন : আপনি একসময় বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাংলাদেশ প্রায় চষে বেড়িয়েছেন। বেড়াবার নেশাই ছিল আপনার। বিদেশেও অনেক বেড়িয়েছেন। এখনো কি সেভাবে বেড়ান?
হুমায়ূন আহমেদ : গর্তজীবী হয়ে গেছি। নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করার মধ্যেও কিন্তু আনন্দ আছে। জনতার মধ্যে যেমন আছে নির্জনতা, আবার নির্জনতার মধ্যেও আছে জনতা।
মিলন : লেখকরা সাধারণত একা থাকতে পছন্দ করেন। একাকী ঘুরে বেড়ানো বা নিজের জন্য ভাবনার সময় বের করা। কিন্তু আপনি সেভাবে একা কখনো থাকেন না। চারপাশে আড্ডা, বন্ধুবান্ধব, হইচই পছন্দ করেন। তাহলে আপনার ভাবনার সময়টা কখন?
হুমায়ূন আহমেদ : যে-কোনো মানুষ একগাদা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প করতে করতেও নিজের একান্ত ভাবনা ভাবতে পারে। আমি তা-ই করি।
মিলন : একজন মানুষ এত কাজ একা কী করে করে?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি অনেক দিন থেকেই বেকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। বেকারের হাতে থাকে অফুরন্ত সময়।
মিলন : আগামী দিনের জন্য আপনার কাজের পরিকল্পনা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি বাস করি বর্তমানে। ভবিষ্যতে না। কাজেই কোনো পরিকল্পনা নেই।
মিলন : আনন্দ-এ ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখোন?
হুমায়ূন আহমেদ : ১৯৭১ সালে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসার পর বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তই আমার জন্য আনন্দের। শাওনের সঙ্গে যখন ঝগড়া করি তখনো আনন্দ পাই। মনে হয় বেঁচে আছি বলেই তো ঝগড়া করতে পারছি। আমি যে আপনি কেমন আছেন প্রশ্নের উত্তরে বেঁচে আছি বলি, এটাও একটা কারণ। জীবন পরম করুণাময়ের অতি পবিত্র এক উপহার। এই উপহার নিয়ে নিরানন্দে থাকার কোনো উপায় নেই।