হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্র হয়ে ওঠার গল্পটা বলি।
গল্প না, ঘটনা। গল্পে কল্পনা থাকে, ঘটনায় থাকে সত্যতা। ছেলেবেলায় পড়াশোনায় খুবই খারাপ ছিলেন তিনি। আসলে পড়াশোনায় তাঁর মন বসত না। একেবারেই মনোযোগী ছিলেন না লেখাপড়ায়। স্কুলের পরীক্ষাগুলোয় টেনেটুনে, কায়ক্লেশে পাসটা করতেন।
বাবার বদলির চাকরি। একেকবার একেক জেলায়। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ছেন। সে বছর পাসই করতে পারলেন না। ডাহা ফেল। ফেল করা মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন কী করে! ক্লাস টিচার বড়ুয়া স্যার। তাঁর কাছে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন। ছাত্রের কান্না দেখে বড়ুয়া স্যারের হৃদয় দ্রবীভূত হলো। তিনি বিশেষ বিবেচনায় ক্লাস সেভেনে তুলে দিলেন। ওপরের ক্লাসে উঠে যেই কে সেই! অবস্থা আগের মতোই। পড়ায় মন বসে না।
মন বসল ক্লাস এইটে ওঠার পর।
স্কুল থেকে তখন খুবই সুস্বাদু, ভালো টিফিন দেওয়া হতো। সেই টিফিনের জন্য ব্যাপক লোভ ছিল বালক হুমায়ুন আহমেদের। এখানে ব্র্যাকেটে আরেকটা কথা বলে রাখি। হুমায়ূন আহমেদের ডাকনাম বাচ্চু। কবি শামসুর রাহমানেরও ডাকনাম ছিল বাচ্চু। পরে দুজনের কেউ এই নাম কখনো ব্যবহার করেন নি। কাউকে বলতেনও না।
যা হোক, ক্লাস এইটো বৃত্তি পরীক্ষা হবে। ক্লাসের ভালো ছাত্রদের সিলেক্ট করা হয়েছে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য। যারা সিলেক্ট হয়েছে, স্কুলে তাদের মহাসমাদর। স্যাররা খাতির করছেন, ছাত্ররা খাতির করছে। তাদের যত্ন-আত্তির অভাব নেই। যেহেতু বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে, সেহেতু ফাইনাল পরীক্ষাও তাদের দিতে হবে না। আর যেটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা সেটা হলো, ভালো ছাত্রদের টিফিন দেওয়া হবে ডাবল। সাধারণ ছাত্ররা যে টিফিন পাবে, ওরা পাবে তার দ্বিগুণ।
এই টিফিনের লোভটা ঢুকল হুমায়ূন আহমেদের মাথায়। যেমন করে হোক বৃত্তি পরীক্ষা তাঁকে দিতেই হবে। বৃত্তি পরীক্ষায় সিলেক্ট হলেই ডাবল টিফিন। তিনি ক্লাস টিচারের কাছে গিয়ে, হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, ঘ্যানরঘ্যানর শুরু করলাম। রোজই স্যারকে ধরি আর করুণ মুখ করে কাঁদো কঁদো গলায় বলি, স্যার, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব।
প্রথম দিন ক্লাসের খারাপ ছাত্রগুলোর একটি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে চাইছে শুনে স্যার আকাশ থেকে পড়লেন। বলিস কী, তুই দিবি বৃত্তি পরীক্ষা!
জি স্যার।
আরে তুই তো ক্লাস সিক্সে ফেল করেছিলি। সেভেন থেকে এইটে উঠেছিস তাও দুটো না তিনটে সাবজেক্ট ফেল।
তাও আমি স্যার বৃত্তি পরীক্ষা দেব।
যা যা ভাগ।
স্যার ধমক দিয়ে বিদায় করলেন।
পরদিন আবার সেই ঘ্যানঘ্যাননি, স্যার, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব।
আজ স্যার বিরক্ত হলেন আরও বেশি। পারলে মেরে ক্লাস থেকে বের করে দেন। হুমায়ূন আহমেদের করুণ কঁদো কাদো মুখ দেখে মারলেন না। আগের দিনের মতোই ধমক দিয়ে থামালেন।
কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ থামার জিনিস না। চান্স পেলেই স্যারকে ধরছেন, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব, স্যার। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।
একই ঘ্যানঘ্যাননি রোজ শুনতে শুনতে স্যার একদিন মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, আয় আমার সঙ্গে।
নিয়ে গেলেন হেডস্যারের রুমে, স্যার, এই ছেলেটা বৃত্তি পরীক্ষা দিতে চায়।
হেডস্যার অবাক, বলেন কী!
জি স্যার।
আরে ও তো সব সাবজেক্ট পাসই করতে পারে না, ও কী বৃত্তি পরীক্ষা দেবে? স্কুলের মান-ইজ্জত থাকবে না।
সারা জীবনই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বিচিত্র সব মানুষের দেখা হয়েছে। ওই স্যারটিও কিঞ্চিৎ বিচিত্র চরিত্রেরই ছিলেন। হেডস্যারকে বললেন, তার পরও আপনি স্যার ওকে কনসিডার করেন। দেখা যাক কী হয়।
সেই শিক্ষকের নাম আমার মনে পড়ছে না। হুমায়ূন ভাই বলেছিলেন, ভু্লে গেছি। স্মৃতি আজকাল কিছুটা প্রতারণাও করছে।
তো, ক্লাস টিচারের কথা শুনে হেডস্যার হতভম্ব, এসব আপনি কী বলছেন? এটা কী করে সম্ভব? স্কুলের মান-ইজ্জত সব যাবে।
শেষ পর্যন্ত ওই স্যারের কারণেই হেডস্যার কনসিন্ডার করলেন। ক্লাস এইটের একটি খারাপ ছাত্রও বৃত্তি পরীক্ষা দেবে এমন ঘটনা চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে কখনো ঘটে নি।
হুমায়ূন আহমেদ দারুণ খুশি। আরে, কিসের বৃত্তি পরীক্ষা, টিফিন ডাবল পাওয়া যাবে এটাই হচ্ছে আসল ঘটনা।
পরদিন থেকে ভালো ছাত্রদের মতো ডাবল টিফিন পেতে লাগলেন। কিন্তু কপাল খারাপ, চার-পাঁচ দিনের মাথায় জলবসন্ত হয়ে গেল। জলবসন্ত নিয়ে স্কুলে যাওয়া যায় না, বাড়িতে শুয়ে থাকতে হয়। রাতের বেলা তো বটেই, দিনের বেলাও মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। মাথার কাছে নিমের একটা ডাল রাখা হয়েছে। ডাল ভর্তি পাতা। নিমপাতা জলবসন্তের মহৌষধ। শরীর অবিরাম চুলকায়। তখন নিমপাতা শরীরে বুলিয়ে দিলে আরাম হয়।
কিন্তু মশারির তলার জীবন লেখকের ভালো লাগে না। ভাইবোনরা কেউ তাঁর সামনে আসেই না। জলবসন্ত ছোয়াচে রোগ। কাছে এলেই বা ছুলেই হবে। বাবা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, মা সংসার নিয়ে। বালক হুমায়ূন আহমেদ মশারির তলায় একা একা ছটফট করেন। সময় আর কাটে না। ওদিকে বৃত্তি পরীক্ষার মাস দেড়-দুয়েক বাকি।
একদিন মনে হলো, আচ্ছা, ক্লাসের বইগুলো একটু পড়ে দেখি তো। কিছু হোক আর না হোক, সময়টা তো কাটবে।
জলবসন্ত ভরা শরীরে মশারির তলায় সময় কাটানোর জন্য ক্লাসের বইগুলো পড়তে শুরু করলেন, অঙ্কগুলো একা একাই করতে লাগলেন। লেখাপড়ার আশ্চর্য এক নেশা ধরে গেল। ধীরে ধীরে জলবসন্ত সারল। বৃত্তি পরীক্ষার দিন এসে গেল। পরীক্ষা দিলেন। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলেন। স্কুলের ভালো ছাত্র যারা তাঁর সঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছিল, তারা কেউ তাঁর ধারে কাছেও নেই। সবাইকে পেছনে ফেলে হুমায়ূন আহমেদ নাম্বার ওয়ান!
শুরু হলো হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্রের জীবন। এসএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন, এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেন, তুখোড় রেজাল্ট। ডক্টরেট করতে গেলেন আমেরিকার নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে। অলথ্রু এ ক্যাটাগরির স্টুডেন্ট। শিক্ষকতার জীবন শুরু করলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। অধ্যাপক হয়ে ডক্টর হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষকতা ছেড়ে দিলেন। তত দিনে সাহিত্যজগতে তিনি কিংবদন্তি হয়ে গেছেন।
কিন্তু ক্লাসের খারাপ ছাত্রটি বৃত্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করেছে, স্কুলে হৈচৈ পড়ে গেছে। সেই টিচার পারলে হুমায়ূন আহমেদকে কোলে নিয়ে হেডস্যারের রুমে চলে যান। ছাত্রের ভালো রেজাল্টের গৌরবে স্কুলে তাঁর পজিশনও হাই হয়ে গেছে।
ক্লাস নাইনে ঘটল আরেক ঘটনা।
জেনারেল ম্যাথের টিচার হুমায়ূন আহমেদের খাতা দেখতে দেখতে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেছেন, ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০ নম্বর দিয়ে দিয়েছেন।
হেডস্যার অঙ্কের টিচারকে ডেকে পাঠালেন। এটা আপনি কী করেছেন? ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০? অঙ্কের টিচার খেপে গেলেন। ছেলেটা অঙ্কে এত ভালো, আমার ইচ্ছা আমি তাকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছি। আপনার কোনো অসুবিধা আছে?
হেডস্যার হতভম্ব। এ দেখি অদ্ভূত চরিত্ৰ!
নিশ্চয় জীবনের এসব অভিজ্ঞতা থেকেই হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস-গল্প-নাটকে অদ্ভুত সব চরিত্রের সমাবেশ ঘটান। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং দেখার ভঙ্গি অন্য কারও সঙ্গে মেলে না।
এসব ঘটনা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আড্ডায় হুমায়ূন ভাই মজা করে বলেছেন। আমি আমার স্মৃতি থেকে লিখছি।
হুমায়ূন ভাইয়ের ভয় পাওয়া নিয়ে এবার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।
১৯৮৫-৮৬ সালের কথা। বিটিভিতে চলছে হুমায়ূন আহমেদের দেশ-কাঁপানো ধারাবাহিক এইসব দিনরাত্রি। প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমান। সেই নাটক নিয়ে চারদিকে চলছে তুমুল আলোচনা। নাটকের ছোট্ট মেয়ে টুনি, তার ব্লাড ক্যান্সার। দর্শক আতঙ্কে আছে টুনির মৃত্যু নিয়ে। ওই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো ধারাবাহিক নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় পোস্ট এডিটরিয়াল পর্যন্ত লেখা হলো। টুনিকে যেন মেরে ফেলা না হয়। কোনো কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকা কাভার স্টোরি করেছে।
নাটক যখন তুঙ্গে, তখন এক সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই গেছেন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে। তিনি তখন নিউমার্কেটের দক্ষিণ দিককার সরকারি কোয়াটারে থাকেন। প্রায়ই আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই তাঁর ফ্ল্যাটে যান। খাওয়াদাওয়া, গল্পআড্ডা আর নাটক নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা। আড্ডা শেষ করে হুমায়ূন ভাই ফিরে যান। তাঁর আজিমপুরের বাসায়, আমি চলে যাই গেণ্ডারিয়ায়।
ও রকম এক সন্ধ্যার ঘটনা।
সিঁড়ি ভেঙে আমরা দুজন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। সরকারি পুরনো আমলের ফ্ল্যাট। দরজাগুলো পুরনো। দরজার মাথার ওপর পুরনো আমলের কলিংবেলের সুইচ। সিঁড়িতে টিমটিম করে জুলছে অল্প পাওয়ারের একটা বাম্ব। হুমায়ূন ভাই আনমনা ভঙ্গিতে কলিংবেলের সুইচে হাত দিতে গিয়েই উরে বাবা রে বলে একলাফে সরে এলেন।
আমি কিছুই বুঝতে পারি নি। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। প্রথমে মনে হলো পুরনো কলিংবেল, তারফারে লিকটিক হয়ে আছে কি না! হুমায়ূন ভাই কি ইলেকট্রিক শক খেলেন।
খুবই নার্ভাস ভঙ্গিতে তার হাত ধরলাম। কী হলো, হুমায়ূন ভাই?
তিনি কোনোরকমে বললেন, মাকড়সা।
মাকড়সা?
হ্যাঁ।
তিনি রীতিমতো কাঁপছেন। তাকিয়ে দেখি, কলিং সুইচের ওখানে মাঝারি সাইজের একটা মাকড়সা।
মাকড়সাকে এ রকম ভয়?
সত্যি তা-ই। হুমায়ূন ভাই সবচেয়ে ভয় পান মাকড়সা। তাঁর ভাইবোনরাও কেউ কেউ মাকড়সাকে খুবই ভয় পান।
সেদিন মাকড়সার ভয়ে মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে তিনি আর স্বাভাবিক হতে পারলেন না। দ্রুত আড্ডা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম।
আমরা তখন প্রায়ই বাংলাবাজারে পাবলিশার্সদের ওখানে গিয়ে চা-বিস্কুট খাই আর আড্ডা দিই। রয়ালটির টাকা পয়সার জন্যও যাই কোনো কোনো দিন। আমার অবস্থা তখন খুবই খারাপ। হূমায়ুন ভাই ইউনিভার্সিটির টিচার। তাঁর একটা বঁধা রোজগার আছে। আমার নেই কিছুই! হুমায়ূন ভাইয়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ-একশ টাকা ধারও নিই। সেই ধার কোনোদিন শোধ করি না।
একদিন দুপুরের দিকে বাংলাবাজার থেকে রিকশায় করে যাচ্ছি। তার শহীদুল্লাহ হলের কোয়ার্টারে। বাহাদুর শাহ পার্কের ওখানে দেখি এক পাখিওয়ালা খাচায় করে মুনিয়া পাখি বিক্রি করছে। আমরা রয়ালটির কিছু টাকা পেয়েছি। খাচাসহ হুমায়ূন ভাই তিন জোড়া মুনিয়া পাখি কিনে ফেললেন।
ঢাকায় তখন ট্রাফিক জ্যাম বলতে কিছু নেই। আমরা রিকশায় করে ইউনিভার্সিটি এলাকার দিকে যাচ্ছি। যেতে যেতে দুজনে মিলে একটা বিজনেসের প্ল্যান করে ফেললাম।
আমাদের সেই ব্যবসার প্ল্যান ইত্যাদির কথা পরে বলব।