হুমায়ূন ভাই আর আমি যে একবার বিজনেস প্ল্যান করেছিলাম, সেই ঘটনা বলি।
১৯৮৫ সালের কথা। হুমায়ূন ভাই থাকতেন আজিমপুর কবরস্থানের পশ্চিমউত্তর দিককার গলির ভেতর তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে। আমি গেণ্ডারিয়ায়। হুমায়ূন ভাইয়ের তো ঢাকা ইউনিভার্সিটির চাকরি আছে, তখন তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। আমি একেবারেই বেকার। বাড়ি থেকে বিতাড়িত। থাকি কলুটোলার একটি বাসায়। চারদিকে ইটের দেয়াল, মাথার ওপর টিনের চাল। আমার স্ত্রী লজ্জায় ওই বাসায় আসেন না। তিনি থাকেন কাছেই তাদের তিনতলা বাড়িতে।
বিতাড়িত হওয়ার পর শাশুড়ি আমাকেও তাদের বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। ব্যৰ্থ লোকদের অহংকার তীব্ৰ হয়। আমার পকেট দশটা টাকাও নেই। তবু শ্বশুরবাড়িতে না থেকে বারো শ না পনেরো শ টাকা দিয়ে যেন ওই টিনশেড ভাড়া নিয়েছি। শ্বশুরবাড়ির কাছেই।
এই বাসায় আমাকে একদিন দেখতে এসেছিলেন কবি রফিক আজাদ। আমার শোচনীয় অবস্থা দেখে নানা ধরনের জ্ঞান দিয়ে চলে গেলেন। লেখকদের জীবন এ রকমই হয়… ইত্যাদি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাহরণও দিলেন।
আমার কি আর ওসব কথায় মন ভালো হয়!
মন ভালো করার জন্য দু-একদিন পরপরই হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে যাই। দুপুরে তাঁর ফ্ল্যাটে খাই, বিকেলে আড্ডা দিতে যাই ইউনিভার্সিটি ক্লাবে। দু-একদিন হুমায়ুন আজাদের বাসায়। শামসুর রাহমান, সালেহ চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ আর এই অধম, আমরা ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসির এক ভদ্রলোকের ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটেও আড্ডা দিতে যাই কোনো কোনো সন্ধ্যায়। অর্থাৎ আমার খুবই এলোমেলো জীবন।
এর আগে ও পরে আমি বেশ কয়েকবার ছোটখাটো নানা রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেষ্টা করেছি। শুরু করার পর সেইসব ব্যবসায় লালবাতি জুলে যেতে একদম সময় লাগে নি। আমার ধারণা, আমার মতো ব্যৰ্থ ব্যবসায়ী এই পৃথিবীতে আর একজনও নেই। যদি কখনো আত্মজীবনী লিখি তাহলে একটা চ্যাপ্টারের শিরোনাম হবে আমার ব্যৰ্থ ব্যবসায়ী জীবন।
যা হোক, ওই টিনশেডের বাসায় এক গরমের দুপুরে বসে ঘামে ভিজতে ভিজতে সিদ্ধান্ত নিলাম, লিখেই রুজি-রোজগারের চেষ্টা করব। এ ছাড়া আমি অন্য কোনো কাজ জানি না। ৭৭ সালের শেষদিকে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় ঢুকেছিলাম জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে। পুলিশ নিয়ে রিপোর্ট লেখার কারণে চাকরি চলে গিয়েছিল।
এসব কথা আগেও কোথাও কোথাও লিখেছি।
কিন্তু লিখে জীবনধারণের সিদ্ধান্তটা তখন ছিল প্রায় আত্মঘাতী। পত্রপত্রিকা বলতে গেলে হাতে গোনা দু-চারটা। একটা গল্প লিখলে পাওয়া যায় বড়জোর ২০ টাকা। তাও সে টাকা তুলতে বাসভাড়া, রিকশাভাড়া চলে যায় অর্ধেকের বেশি।
বিটিভি একমাত্র টিভি চ্যানেল। তিন মাসে ছয় মাসে একটা নাটক লেখার সুযোগ মেলে। তাও নানা প্রকার ধরাধরি, তদবির। শেষ পর্যন্ত নাটক প্রচারিত হলে টাকা পাওয়া যায় শ চারেক।
পাবলিশাররা বই ছাপলে সেই বই কায়ক্লেশে পাঁচ-সাত শ-এক হাজার বিক্রি হয় বছরে। রয়্যালিটি যেটুকু পাওয়া যায় তাতে মাসখানেক চলা মুশকিল।
এ অবস্থায় ও-রকম সিদ্ধান্ত।
তবে সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ আমি শুরু করলাম। আজানের সময় ঘুম থেকে উঠে লিখতে বসি। টানা ১১টা ১২টা পর্যন্ত লিখি। এক ফাঁকে গরিব মানুষের দিনদরিদ্র নাশতাটা সেরে নিই। তারপর যাই বাংলাবাজারে, প্ৰকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরি। কোথাও কোথাও বসে আড্ডা দিই। দুপুরে কেউ কেউ খাওয়ায়। যেদিন ও রকম হয় সেদিন আর বাড়ি ফিরি না। একবারে আড্ডা-ফাডা দিয়ে রাতে ফিরি।
হুমায়ূন ভাইও তখন দু-একদিন পরপরই বাংলাবাজারে আসেন। বিউটি বুক হাউস, স্টুডেন্ট ওয়েজ আর নওরোজ কিতাবিস্তানে বসে আড্ডা দিই, চা-সিগ্রেট খাই।
ও রকম একদিনের ঘটনা।
আমরা দুজনই এক প্রকাশকের কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়েছি। দুপুরের দিকে হুমায়ূন ভাই বললেন, চলে আমার বাসায়।
আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। চলুন।
বাংলাবাজার থেকে রিকশা নিলাম। যাব আজিমপুর। তখনো বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ আধুনিক হয় নি। আমাদের বইপত্র তৈরি হয়। হ্যান্ড কম্পোজে, প্রচ্ছদ তৈরি হয়। হাতে তৈরি ব্লকে। অফিসেটে প্রচ্ছদ ছাপার কথা তখনো ভাবতে পারেন না অনেক প্ৰকাশক।
আমার প্রথম বই ভালোবাসার গল্প ছিল ১২ ফর্মার। দাম ছিল ৭ টাকা। আমি রয়্যালটি পেয়েছিলাম ৪০০ টাকা। হুমায়ূন ভাইয়ের নন্দিত নরকের দাম ছিল সাড়ে তিন টাকা।
তখন বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা হলে বাংলাবাজার এলাকার কোনো গলির ভেতর একটা রুম ভাড়া নিয়ে কম্পোজ সেকশন করা যেত। সিসা দিয়ে তৈরি টাইপ সাজানো থাকে একধরনের কাঠের ছোট ছোট খোপওয়ালা পাত্রে। সামনে টুল নিয়ে বসে একটা একটা করে টাইপ তুলে পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী লাইনগুলো তৈরি করে কম্পোজিটর, পৃষ্ঠা তৈরি করে। একেক খোপে একেক অক্ষরের টাইপ। ১৬ পৃষ্ঠা তৈরি হলে এক ফর্মা। ভারী একটা তক্তার ওপর ওই টাইপের দুটো করে পৃষ্ঠা। মোট আটটি ও-রকম কাঠের তক্তা চলে যায় মেশিনে। অর্থাৎ একটা ফর্মা।
এভাবে ছাপা হয় বই।
যারা বই ছাপার কাজ করে, ও-রকম প্রেসগুলোরও অনেকেরই থাকে কম্পোজ সেকশন। ওসব ক্ষেত্রে ইনভেস্টমেন্টটা বেশি। আর মেশিন ছাড়া শুধু কম্পোজ সেকশন ছোটখাটোভাবে করেও অল্প পুঁজিতে ব্যবসা করে কেউ কেউ।
ও রকম কম্পোজ সেকশনের একটা সমস্যা হলো কম্পোজিটরীরা অনেকেই সিসায় তৈরি টাইপ চুরি করে নিয়ে সের দরে বিক্রি করে ফেলে। পার্টনারশিপে যারা কম্পোজ সেকশন করে তারা নিজেরাও এক পাটনার আরেক পার্টনারের অজান্তে টাইপ চুরি করে। বিক্রি করলেই তো ক্যাশ টাকা।
একটা বিজনেস করি।
হুমায়ূন ভাই সিগ্রেট টান দিয়ে বললেন, কী বিজনেস?
একটা কম্পোজ সেকশন করি।
হ্যাঁ। করা যায়। ভালো আইডিয়া।
কত টাকা লাগবে?
একেকজনে দশ-পনেরো হাজার করে দিলে হয়ে যাবে।
সেটা দেওয়া যাবে।
তাহলে চলেন শুরু করি।
তোমার টাকা রেডি আছে?
আরে না। দশ টাকাও নেই।
তাহলে?
ধার করতে হবে।
সেটা না হয় করলে, তবে আমার একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত?
হুমায়ূন ভাই আমার মুখের দিকে তাকালেন। চুরি করে টাইপ বিক্রির অধিকার সমান থাকতে হবে।
আমি হাসতে হাসতে রিকশা থেকে প্রায় ছিটকে পড়ি।
আমাদের ব্যবসার ওখানেই যবনিকাপাত।