১৪. লুসি ও বিনোদিনী
রবিকে ইংলন্ডে আনা হয়েছে ব্যারিস্টারি বা আই সি এস পরীক্ষার জন্য। কিন্তু মেজোবউঠানের স্নেহচ্ছায়ায়, ঘরের আরামে রবির ভগ্নহৃদয় কাব্যটি এগিয়ে চললেও পড়াশোনা যে খুব বেশি এগোচ্ছে না সেটা কিছুদিনের মধ্যেই লক্ষ করলেন সত্যেন। সুতরাং বন্ধু তারকনাথ পালিতের উদ্যোগে তাকে লন্ডনে পাঠানো হল। প্রথমে কিছুদিন রিজেন্ট পার্কের সামনে একটি ভাড়া বাড়িতে একা থাকার প্র্যাকটিস করতে হল তাকে। লোকজন কেউ দেখা করতে এলে রবির মনে হয় তাদের জোর করে ধরে রাখবেন, এই শীতে নির্জন ঘরে তার প্রাণ যেন হাঁপিয়ে ওঠে।
মাঝে মাঝেই সত্যেন আসেন। কোনওদিন সত্যেন, তারক ও রবি হয়তো দল বেঁধে যোগ দিলেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভায়। আবার কোনওদিন ব্রিটিশ গণতন্ত্রের কাঠামোকে কাছ থেকে দেখার জন্য তারা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গ্রীষ্ম অধিবেশন দেখতে গেলেন। পরপর কদিন গিয়ে কিন্তু হতাশ হলেন রবি।
ঘরে ফিরে সত্যেন ও তারককে বলেই ফেললেন তার নিরাশার কথা, পার্লামেন্টের অভ্রভেদী চূড়া, প্রকাণ্ড বাড়ি, হাঁ করা ঘরগুলো দেখলে খুব তাক লেগে যায়; কিন্তু ভেতরে গেলে তেমন ভক্তি হয় না। ইংরেজদের গণতন্ত্র ও বিচক্ষণতা সম্বন্ধে আমার যতটা উঁচু ধারণা ছিল, ততই এরা হতাশ করল।
সত্যেন নিজেও বেশ হতাশ, ইংরেজরা যে এমন অসভ্যের মতো চেঁচামেচি করবে এ আমার দুঃস্বপ্নের অতীত ছিল।
রবি যোগ করলেন, এরা তো অন্য কাউকে কথা বলতেই দিচ্ছে না,বক্তাকে কতভাবে যে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে তা ভাবা যায় না, কেউ হাততালি দিচ্ছে, কেউ হিসস হিসস শব্দ করে, এত অসংযত!
তারক একটু লঘু করার চেষ্টা করেন, আসলে তোমরা বুঝতে পারছ না, এটাই রাজনীতির আসল চেহারা, কেউ কাউকে বলতে দেব না, কেউ কাউকে বিনা যুদ্ধে একচুল জমি ছাড়ব না।
তা হলে ভদ্রতা, সৌজন্যের বড় বড় কথাগুলো সব ইংরেজদের ভণ্ডামি, রবি তবু ফুঁসে ওঠেন। সেদিন যে আইরিশ মেম্বার ভারতের প্রেস অ্যাক্ট এর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছিলেন, কেউ তার কথা মন দিয়ে শুনলই না! অথচ ভারতবাসীর করের টাকাতেই ওদের এত রমরমা। ভারতের কোনও রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে নাই বা কেন?
রবি যা খেপেছে এবার না রাজদ্রোহী হয়ে ওঠে। তারক বলেন, তার চেয়ে তাড়াতাড়ি ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে এ-সব তর্ক তোলার চেষ্টা করো।
তবে হ্যাঁ, রবি বলেন, কিছু যে শেখার মতো পাইনি তা বলব না, গ্ল্যাডস্টোনের বাগ্মিতায় আমি অভিভূত। তিনি মঞ্চে ওঠামাত্রেই সমস্ত ঘর একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল, গলার স্বর শুনতে পেয়ে বাইরে ঘুরে বেড়ানো মেম্বারেরা এসে বসতে লাগলেন, দুদিকের বেঞ্চি ভরতি হয়ে গেল, তখন যেন পূর্ণ উৎসের মতো গ্ল্যাডস্টোনের ভাষণ উৎসারিত হতে লাগল। তিনি তেজের সঙ্গে বলেন কিন্তু চিৎকার করেন না, যা বলেন আন্তরিক বিশ্বাস থেকে বলেন। আর অন্যদিকে, আইরিশ মেলোডির সুরে মজে থাকার পাশাপাশি উপেক্ষিত আইরিশ মেম্বারদের প্রতি আমার টান রোজই বাড়ছে।
ওঁরা সেদিন তারক পালিতের বাড়িতে উঠেছেন। হঠাৎ বালা এসে রবির হাত ধরে টানতে থাকেন পিয়ানোর দিকে।
পেছন থেকে সতু বলে ওঠেন, অনেক রাজনীতি হয়েছে, এবার তোমার একটা আইরিশ মেলোডি শোনাও রবি। আমার বিলেতি বান্ধবীরাও তোমার গলার খুব প্রশংসা করেছে।
সেই ভাল, স্কচের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে তারক বললেন, রবির গান শোনা যাক এবার, বালা সতুর ইংরেজ বান্ধবীরাও যখন ভাল বলছে!
রবির গান শেষ হতেই বালা যোগ করেন, রবির গলার এই টেনর ইংরেজ মেয়েদের মুগ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, রবি, তোমার চেহারার প্রশংসাতেও পঞ্চমুখ তারা।
সতু বলেন, রবি তো লজ্জায় মেয়েদের মুখের দিকে তাকাতেই পারে না। এখানে পার্টি হলে সবাই একটু আধটু ফ্লার্ট করে, তুমি কেন করতে পারছ না রবি! তোমাকে মেয়েরা এত পছন্দ করে!
রবি লাজুক হেসে বললেন, আমার চোখ সেই যে বাঙালি মেয়ের কালোহরিণ চোখে বাঁধা পড়েছে, তার থেকে আর মুক্তি পেলাম না। বিলিতি নীলনয়নাদের দেখে আমার পুষিবেড়াল পুষিবেড়াল মনে হয়।
.
কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য দুজন নীলনয়না পুষিবেড়ালের সঙ্গে সরস বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়লেন রবি। মাঝখানে কিছুদিন বার্কারদের বাড়িতে কাটিয়ে তাদের দাম্পত্য ঝগড়ায় বিপর্যস্ত রবি আশ্রয় নিলেন লুসি স্কটদের পরিবারে। বিলেতের এই পরিবারটি হয়ে উঠল তার আপনজনের মতো। বিশেষত মাতৃস্নেহবঞ্চিত রবিকে মিসেস স্কট তার অসীম স্নেহের বন্ধনে বেঁধে ফেললেন।
রবি কাদম্বরীকে চিঠিতে লিখতে থাকেন, এখন আমি ক-র পরিবারের মধ্যে বাস করি। তিনি, তাঁর স্ত্রী, তাদের চার মেয়ে, দুই ছেলে, তিন দাসী, আমি ও টেবি বলে এক কুকুর নিয়ে এই বাড়ির জনসংখ্যা। মিস্টার ক একজন ডাক্তার। তার মাথার চুল ও দাড়ি প্রায় সমস্ত পাকা। বেশ বলিষ্ঠ সুশ্রী দেখতে। অমায়িক স্বভাব, অমায়িক মুখশ্রী। মিসেস ক আমাকে আন্তরিক যত্ন করেন। শীতের সময় আমি গরম কাপড় না পরলে তার কাছে ভর্ৎসনা খাই। খাবার সময় যদি তার মনে হয় আমি কম খেয়েছি, তা হলে যতক্ষণ না তাঁর মনের মতো খাই ততক্ষণ পীড়াপীড়ি করেন। বিলেতে লোকে কাশিকে ভয় করে; দৈবাৎ যদি আমি দিনের মধ্যে দুবার কেশেছি তা হলেই তিনি জোর করে আমার স্নান বন্ধ করান, আমাকে দশরকম ওষুধ গেলান, শুতে যাবার আগে আমার পায়ে খানিকটা গরম জল ঢালবার বন্দোবস্ত করেন, তবে ছাড়েন।
রবিকে গরম জলের সেক দিতে এসে লুসি ও জেসি নানারকম খুনসুটি শুরু করে দেয়, তাদের চঞ্চলতায় রবির সংকোচ কেটে যাচ্ছে। তিনিও বেশ ওদের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে ওঠেন।
লুসি হেসে হেসে বলে, জানো রবি, একজন ইন্ডিয়ান অতিথি আসবে শুনে আমরা ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে মাসির কাছে চলে গিয়েছিলাম!
কেন, রবিও মজা পেয়ে জানতে চান, আমি কি ভূত না রাক্ষস?
না না, জেসি এবার বলে, আমরা ভেবেছিলাম কোথাকার কোন জংলি আসছে, বড় বড় নখ, গায়ে গন্ধ।
আমি তো ভেবেছিলাম, তোমার গায়ে উলকি আঁকা থাকবে আর নাকে কানে গলায় ভারী ভারী সব গয়না, হাসতে হাসতে লুসি বলল।
ও তোমরা ইন্ডিয়ান বলতে রেড ইন্ডিয়ান ভেবেছিলে, রবি লুসি-জেসির কথা শুনে মজা করে বলেন, দাঁড়াও না, একদিন ওরকম সেজে দেখাব তোমাদের। আবার মাসির বাড়ি পালাতে হবে।
ইসস, ভয় দেখাবে! লুসি বলে, দেখি কে কাকে ভয় দেখায়! পায়ে সেক দিয়ে দিচ্ছি, আরাম করে শুয়ে আছেন বাবু, আবার ভয় দেখাবেন!
রবি বলেন, তখন তো পালিয়ে গিয়েছিলে, এখন কী মনে হচ্ছে দেখে?
লুসি বলে, বলব না। বুঝে নাও।
.
রাতে খুব সুন্দর সুন্দর সব স্বপ্ন দেখলেন রবি। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। বাইরের ঘরের সোফায় এসে বসেছিলেন। এ বাড়ির সকালটা কীভাবে শুরু হয়, কে জানে। সব চুপচাপ। সবাই ঘুমোচ্ছে।
একটু পরে বড়মেয়েটি নেমে এল নীচে। ফায়ারপ্লেসের আগুন উসকে দিয়ে সে বলে, গুড মর্নিং রবি। ঘুম ঠিক হয়েছিল?
এটাই কথাবার্তা শুরু করার দস্তুর, রবিও তাকে বলেন গুড মর্নিং।
মেয়েটি দ্রুতপায়ে রান্নাঘরে গিয়ে রাঁধুনিকে ব্রেকফাস্টের ব্যাপারে কিছু নির্দেশ দেয়। আবার ফিরে এসে অগ্নিকুণ্ডে দু-চারটে কয়লা গুঁজে দিয়ে সোফায় বসে।
এমন সময় সিঁড়িতে দুদ্দাড় শব্দ। শীতে হি হি করে কঁপতে কাঁপতে মিস্টার স্কট। নামলেন। ফায়ারপ্লেসের কাছে গিয়ে হাত পা সেকতে সেকতেই গুড মর্নিং-এর পাট সেরে ফেললেন। তারপর খবরের কাগজ নিয়ে বসলেন খাবার টেবিলে।
রবিকে দু-একটা খবর পড়ে শোনাতে শোনাতে কফিপর্ব শুরু হয়ে যায়। লুসি ও জেসি নেমে এসে বাবার গালে চুমু দিয়ে সকাল শুরু করে।
মিস্টার স্কট বললেন, এই যে লুসি জেসি, আজ আবার ফাইন হল তোমাদের। আমার পরে ঘুম থেকে উঠেছ, দাও, দাও চার আনা ফাইন।
দেব, বাবা, দেব। ঠিক দিয়ে দেব। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে লুসি বলে। জেসিও বাবাকে একটু আদর করে যায়।
স্কট রবিকে সাক্ষী মেনে বলেন, দেখো রবি, এরা কথা রাখছে না। এদের সঙ্গে আমার চুক্তি আছে, ওরা আমার আগে উঠলে আমি পাঁচ সিকে পুরস্কার দেব আর আমি আগে উঠলে ওরা দেবে চার আনা ফাইন। ওদের কাছে আমার অনেক পাওনা হয়েছে, এরকম ডেট অব অনার ফাঁকি দেওয়া কি ভদ্রতা?
সব শেষে ব্রেকফাস্ট টেবিলে যোগ দিলেন মিসেস স্কট। সাড়ে নটার মধ্যে জলখাবার পর্ব শেষ। একটু হাসিঠাট্টার পরেই মেয়েদের তাগাদা দেন স্কট আন্টি। সবাই কাজে লেগে পড়ো। হাতে দস্তানা পরে আন্টি নিজে দাসীদের নিয়ে একতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত ঝাড়মোছ করান। রান্নাঘরে গিয়ে রুটিওলা, তরকারিওলা, মাংসওলার বিল দেখে পাওনা মেটান। কর্তার সঙ্গে পরামর্শ করেন। রান্নার তদারক করেন। বড় মেয়েটিও তার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে।
মেজোমেয়ে জেসির কাজ হল দাসীরা ঘর ঝাঁট দেওয়ার পর একটা ঝাড়ন নিয়ে ড্রয়িংরুমের ধুলো সাফ করা। লুসি তখন সেলাই নিয়ে বসে। বালিশের ওয়াড় বা মোজা রিপু করা, চিঠিপত্র লেখা এ-সব তার কাজ। লুসি কিন্তু গানবাজনাও করে, বাড়িতে সে একমাত্র গাইয়ে-বাজিয়ে। গানের আসরে আজকাল রবিও সোৎসাহে যোগ দিচ্ছেন।
.
লুসির খেয়ালে হঠাৎ একটি নতুন খেলা শুরু হল কিছুদিন। প্ল্যানচেট-চর্চা। এক-একদিন সন্ধ্যায় টেবিল চালা হত। কয়েকজন মিলে চেয়ারে বসে একটা টিপাইতে হাতে হাত লাগিয়ে রাখতেন আর টিপাই উন্মত্তের মতো সারাঘরে ঘুরে বেড়াত। শেষে যাতে হাত দেন তাই নড়তে শুরু করে। একবার খেলাচ্ছলে ওরা মিস্টার স্কটের টুপির দিকে হাত বাড়াতেই স্কট আন্টি ছুটে এসে টুপি সরিয়ে নিলেন, স্কটসাহেবের কোনও জিনিসে শয়তানের স্পর্শ লাগুক সেটা তিনি হতে দেবেন না কিছুতেই।
এরমধ্যে রবি ভরতি হয়েছেন লন্ডনে ইউনিভার্সিটি কলেজে ইংলিশ পড়ার জন্য। এখানে রবির সহপাঠী তারকের ছেলে লোকেন। বয়স কম হলেও অদ্ভুতভাবে তেরো বছরের লোকেনের সঙ্গে আঠারো বছরের রবির বন্ধুত্ব খুব জমে উঠল অচিরেই। লুসিকে বাংলা শেখাতে গিয়ে রবি যখন শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন, তখনও তার সাহায্যকারী লোকেন পালিত।
রবির সন্দেহ হয় শুধু লুসি নয়, জেসিও যেন তার প্রতি একটু বেশিই মনোযোগী। বাগানের গাছের ফাঁকে, ছাদের দক্ষিণমুখো ঘরে, পিয়ানোর রিডের ওঠা-নামায়, প্ল্যানচেটের আঙুল ছোঁয়ায় কী যে মধুর রহস্য পল্লবিত হয়ে ওঠে, রবি সবটা যেন বুঝতে পারেন না।
ইংলিশ ক্লাসের ফাঁকে রবি তার সমস্যার কথা বলেন লোকেনকে। লুসি যেন কী একটা কথা বলতে চায়, কিন্তু কী বলতে চায় রবি বোঝেন না। আবার জেসিও কত রহস্য করে লুসিকে লুকিয়ে।
লোকেন তাকে বলে, বুঝতে পারছ না, ওরা দুজনেই তোমার প্রেমে পড়েছে।
রবি বলেন, কী জানি, আমি তো বিশ্বাস করার মতো মরাল কারেজ পাচ্ছি না। কী যে করি!
কী আবার করবে, লোকেন অনেক পরিণত, প্রেম করো। ফ্লার্ট করো। ওরা তোমার সুরের ভক্ত, চেহারায় মুগ্ধ।
রবি সাহস পান না। তার মনে পড়ে যায় ঘরের কোনার একটি রহস্যময় কালো চোখ। কালো আর নীল চোখের টানাপোড়েনে হাবুডুবু খান তরুণ রবি।
স্কটকন্যাদের সঙ্গে রবির মাখামাখি বন্ধুত্বের কাহিনি কিছুটা পল্লবিত হয়ে ক্রমে দেবেন ঠাকুরের কানেও এসে পৌঁছল। তার ওপর ইংরেজ মেয়েদের স্বাধীন রূপ নিয়ে রবির মুগ্ধতা যেভাবে ভারতীতে য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র নামে প্রকাশিত হচ্ছিল, তাতে দেশে বেশ শোরগোল পড়ে গেল। কয়েকজন তো জোর তর্ক বাঁধিয়ে দিলেন এ নিয়ে।
মহর্ষি রবিকে নির্দেশ দিলেন দেশে ফিরতে। কিছুদিন এলোমেলো বিলেত ভ্রমণের পরে সবে যখন ইংলিশ ক্লাসের শিক্ষক মি. মরলির পড়ানোয় আকর্ষিত হয়েছেন রবি, তখনই তার দেশে ফেরার ডাক এল।
স্কট আন্টি রবির হাত ধরে কেঁদে ফেললেন বিদায়কালে। রবির মনেও শেষ কদিন চলল অসহ্য টানাটানি। মালতীপুঁথির খাতা নানারকম আঁকিবুকি করতে করতে রবি লিখলেন তার বেদনার ভাষ্য,
‘ফুরালো দুদিন।কেহ নাহি জানে এই দুইটি দিবসে–
কি বিপ্লব বাধিয়াছে একটি হৃদয়ে।
দুইটি দিবস/চিরজীবনের স্রোত দিয়াছে ফিরায়ে–
এই দুই দিবসের পদচিহ্নগুলি/শত বরষের শিরে রহিবে অঙ্কিত।
যত অশ্রু বরষেছি এই দুই দিন/যত হাসি হাসিয়াছি এই দুই দিন
এই দুই দিবসের হাসি অশ্রু মিলি।
হৃদয়ে স্থাপিবে চির
হাসি অশ্রু।
বসন্ত বরষা।
নিজের বেদনা চেপে রেখে, ব্যারিস্টার বা আই সি এস হওয়ার চেষ্টায় জলাঞ্জলি দিয়ে, দুই নীলনয়নার হৃদয়ে দাগা দিয়ে ১৮৮০ সালের বসন্তকালে দেশে ফিরে এলেন রবি। পথে ফ্রান্স ভ্রমণ করে একইসঙ্গে বাচ্চাদের নিয়ে ঘরে ফিরলেন সত্যেন জ্ঞানদাও।
.
বাবু কলকাতার এক আশ্চর্য নক্ষত্র বিনোদিনী। বারাঙ্গনার মেয়ে পুঁটি কী এক অসাধারণ জাদুমন্ত্রে নিজেকে পালটে নিয়েছে। তার রেয়াজি কণ্ঠের গানে, চমকদার রূপে আর অভিনয়ের মুনশিয়ানায় রাতের পর রাত জমে ওঠে আলোকিত নগরমঞ্চ। শহরের অভিজাত পুরুষেরা তার পায়ে লুটোপুটি খায়। অভিনয় শেষে কেউ ফুল নিয়ে আসে তো কেউ টাকার তোড়া, কেউ হিরের নেকলেস উপহার দেয় তো কারও হাত প্রণামের ছলে হাঁটু বেয়ে তার উরু ছুঁতে আসে।
বিনোদিনী অবশ্য সবাইকে পাত্তা দেন না। বাছা বাছা বাবুরাই তার প্রসাদ পায়। ধনীঘরের এক যুবক এখন তার প্রেমিক, যদিও সে ছেলেটির বাড়ি থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
কিন্তু সবার ওপরে গিরিশচন্দ্র। তিনিই বিনোদিনীর ঈশ্বর। বিনোদিনীর বাড়িতে আজকাল প্রায়ই জমাটি আসর বসাচ্ছেন গিরিশ। অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্রেরাও আসেন। কোনওদিন গিরিশ কিটসের কবিতা পাঠ করে শোনন তো আর-একদিন শেকসপিয়রের নাটক, কোনওদিন কাব্যালোচনা তো কোনওদিন আবার বিলেতের অভিনেত্রীদের কথা। মিসেস সিডেনস-এর লেডি ম্যাকবেথ চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের কথা প্রায়ই বলেন গিরিশ। বিনোদিনী চাতকের মতো শুষে সব রসগ্রহণ করেন। নিজেকে গিরিশের মনোমতো করে তুলতে তার চেষ্টার অন্ত নেই।
মলমলের নকশাকাটা উড়ানি উড়িয়ে, বিলিতি আতরের খুশবু ছড়িয়ে হঠাৎই এদিন সেখানে উপস্থিত হলেন জ্যোতি।
গিরিশ বলে ওঠেন, এ কাকে টেনে এনেছিস বিনোদ? এই খারাপ পাড়ায় নটীর ঘরে জ্যোতিঠাকুরের উদয় হল, লোকে যে আমাকেই দুষবে!
কেন গিরিশবাবু, আপনি এলে আমারই বা আসতে দোষ কোথায়? জ্যোতি বলেন। নটীর কাছে নাট্যকারকে তো আসতেই হবে।
জ্যোতি, তুমি বড়ঘরের ছেলে, গিরিশ তবু বললেন, তুমি এখানে এলে সমাজে অনেক কথা হবে। আমার কথা আলাদা, আমি সারাদিন নেশা করি, থিয়েটারের নেশায় যা খুশি করি, আমাকে নিয়ে কেউ কিছু বলে না, বললেও যায় আসে না।
আমি আপনাকে আমার নতুন নাটক শোনাতে চাই, জ্যোতি গিরিশকে বলেন, আপনি অনুমতি না দিলে বিনোদিনী তো তাতে অভিনয় করতে পারবে না।
বিনোদিনীর হিরের নাকচাবি ঠিকরে ওঠে। এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন তিনি, এখন বলে ওঠেন, আমি তো এখন ন্যাশনালে ছাড়া অন্য কোথাও থিয়েটার করব না, সরোজিনী করেছিলাম। জ্যোতিঠাকুরবাবু, এখন আপনার নাটক কী করে করি বলুন তো?
জ্যোতির হৃদয় সে মুহূর্তে যেন থেমে গেল, পৃথিবী দুলে উঠল। সরোজিনী! সরোজিনী! উঃ কী নিষ্ঠুর তুমি! বিনোদিনীর গা থেকে ভেসে আসা আতরের যে গন্ধ জ্যোতিকে পাগল করে সেই গন্ধে এখন তার দম বন্ধ হয়ে আসে।
গিরিশ কেঠো গলায় শ্লেষের সঙ্গে জ্যোতিকে বললেন, ও, আসল কথা এটাই, আমাকে নাটক শোনাতে চাওয়াটা একটা বাহানা, আসলে তুমি চাও বিনোদিনীকে!
উপস্থিত দু-একজন হেসে হেসে বলেন, বিনোদিনীকে কে না চায় মশায়, ঠাকুর একা আর কী দোষ করলেন?
এ-সব হেঁজিপেঁজি লোকের ফোড়ন কাটায় জ্যোতির মানে লাগে, অথচ সত্যিই তো বিনোদিনীর টানে চুম্বকের মতো ছুটে এসেছেন তিনি। ওর হাসি, ওর গন্ধ, ওর নাকচাবির ইশারা ওঁকে পাগল করে দেয় যে উন্মাদনা কোনও ঘরনির কাছেই পাওয়া সম্ভব না, যা এমনকী কাদম্বরীও দিতে পারে না।
একটু বিরক্ত হয়েই জ্যোতি বললেন, দেখুন গিরিশবাবু, এতে দোষ কীসের? বিনোদিনী ভাল অভিনেত্রী, আমি যদি তাকে আমার নাটকের হিরোইন করতে চাই, আপনার গায়ে লাগবে কেন?
গিরিশের এক ফচকে চেলা বলে ওঠে, রোজ সন্ধ্যায় জ্যোতিঠাকুর ন্যাশনালে আসেন বিনোদিনীকে দেখতে! রোজ!
তাতে কী হল? জ্যোতি ফুঁসে ওঠেন।
আহা রাগ করছেন কেন, বিনোদিনী জ্যোতির হাত ধরে অনুনয় করেন, ঠান্ডা হয়ে একটু বসুন দেখি!
জ্যোতি তার দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমার কাছে আসতে এত পাথরে ঠোক্কর খেতে হয় কেন সরোজিনী?
আহা, ওটা কি আমার নাম নাকি? বিনোদিনী লজ্জা পান। আমি তো কত চরিত্র করেছি, যখন যে পার্ট করি সেটাই আমাকে সারাক্ষণ খেলার সঙ্গীর মতো ঘিরে রাখে, তখন আর অন্য পার্ট মনে থাকে না।
আমার কাছে তুমি চিরদিনই সরোজিনী হয়ে থাকবে, জ্যোতি বলেন, যতদিন-না আমার নতুন নাটকের হিরোইন হবে। ওই জ্বল জ্বল চিতা গানের সঙ্গে আগুনের দৃশ্যে তোমার রূপ যে দেখেছে সে কোনওদিন ভুলতে পারবে না।
সরোজিনী নিয়ে দর্শকেরা পাগল হয়ে গেছিল ঠিকই, বিনোদিনী বলেন, কিন্তু ঠাকুর, আগেও অমন হয়েছে। আমরা যখন গ্রেট ন্যাশনাল থেকে সারা ভারত ঘুরে ঘুরে নীলদর্পণ করছিলাম, কী হয়েছিল জানো! ক্রমে সেই দৃশ্যটা এল, রোগসাহেব ক্ষেত্ৰমণিকে পীড়ন করছে আর ক্ষেত্ৰমণি নিজের ধর্মরক্ষার জন্য চিৎকার করে বলছে, ও সাহেব, তুমি মোর বাবা, মুই তোর মেয়ে। ছেড়ে দে, আমায় ছেড়ে দে। তারপর তোরাপ এসে সাহেবের গলা টিপে ধরে হাঁটুর গুঁতো কিল চড় মারছে, অমনি সাহেব দর্শকরা হইচই শুরু করে দিল। কতগুলো লালমুখো গোরা তরোয়াল খুলে স্টেজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেকী হুড়োহুড়ি চিৎকার!
জ্যোতি বলেন, জানি বিনোদ, সেই অভিনয় দেখেই তো আমি তোমাকে সরোজিনীর পার্ট দেব ঠিক করলাম। কিন্তু সরোজিনীর উন্মাদনা আরও বেশি ছিল। অন্যদের দিকে তাকিয়ে আবার বলেন, আপনারা দেখেননি, সরোজিনী এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে ওই নাটকটি গ্রামেগঞ্জে যাত্রাপালা হয়েও ছড়িয়ে পড়েছে।
গিরিশের একটু গায়ে লাগে, বলেন, আপনি সরোজিনী ভুলতে পারছেন না, মেঘনাদ বধের সাতটি চরিত্রে ওকে দেখেননি? বিষবৃক্ষের কুন্দনন্দিনীতে? মৃণালিনীতে ওর অভিনয় দেখে বঙ্কিম বলেছেন, আমি মনোরমার ছবি লিখেছিলাম, কখনও প্রত্যক্ষ চলেফিরে বেড়াতে দেখব আশা করিনি। এখন বিনোদিনীর অভিনয়ে যেন জ্যান্ত মনোরমাকে দেখছি।
চেলা বলে, আর সধবার একাদশীর কাঞ্চন?
আরেক চেলা বলে, ব্রিটানিয়া, পলাশীর যুদ্ধে?
অমৃতলাল বসু বললেন, সরোজিনীতে খুব ভাল পার্ট করেছিল বিনোদিনী সত্যি, কিন্তু গিরিশ যখন নায়ক সাজে, তার উলটোদিকে নায়িকা বিনোদিনীকে যেমন মানায়, তেমনটা আর কিছুতে না।
জ্যোতির বিমর্ষ লাগে, এখানে যেন গিরিশের রাজ্যপাট। গিরিশের কবল থেকে না ছাড়াতে পারলে এভাবে বিনোদিনীকে রাজি করানো যাবে না।
জ্যোতি ঘুরেফিরে আসেন বিনোদিনীর কাছে। বিনোদিনীও খুশি হন তাকে দেখলে, নিজের লেখা কবিতার খসড়া শোনান। জ্যোতিঠাকুর প্রশংসা করলে তাঁর শরীরে খুশির হিল্লোল বয়ে যায়। জ্যোতি আসতেই নিজের লেখায় সুর বসিয়ে বিনোদিনী গান গেয়ে ওঠেন,
চাই না চাই না চাই নারে তোর ওজন করা ভালবাসা
সিন্ধুসম ভালবাসা বিন্দুতে কি যায় পিপাসা
ভালবাসা পাকা সোনা, ভালবাসায় খাদ মেশে না
ভালবাসা বেচাকেনা ভরাডুবি করে আশা।
জ্যোতি আকুল হয়ে বলে ওঠেন, এমন গান তুমি কাকে নিয়ে বেঁধেছ সরোজিনী? কে তোমাকে এমন দাগা দিল? আমাকে বলল, আমি তোমার সব কষ্ট বুক পেতে নেব বলেই তো বারবার ছুটে আসি।
বিনোদ রহস্যময় হাসি হেসে আর-একটা গান ধরেন।
জ্যোতি যখন তাঁকে নিজের লেখা গান বা নাটক শোনান, বিনোদিনী তখন মুগ্ধ শ্রোতা। কিন্তু তার মনের কোণের নিভৃত জায়গাটায় কিছুতেই যেন পৌঁছতে পারেন না জ্যোতি। সেখানে বিনোদ তাকে ঢুকতে দেয় না কেন? কে বসে আছে সেখানে? গিরিশ না অন্য কেউ? নিজের কন্দর্পকান্তি রূপ এবং আশ্চর্য প্রতিভাকে ব্যর্থ মনে হয় জ্যোতির। ভগ্নহৃদয় নিয়ে বারবার বিনোদিনীর কাছ থেকে ফিরে আসেন তিনি।
ফিরে আসেন কাদম্বরীর কাছে। কিন্তু ফিরে এসেও সুখ কোথায়? কাদম্বরী তো বারবার জ্যোতিকেই কাঠগড়ায় তোলে। কেঁদেকেটে অস্থির করে তোলে বিনোদিনীর সঙ্গে কল্পিত প্রণয়ের অভিযোগে।
কাদম্বরীকে নিয়ে একদিন স্টিমারে ভেসে পড়লেন জ্যোতি, সঙ্গে অক্ষয় ও দু-একটি বন্ধুবান্ধব। সেদিন ওঁদের গানবাজনার মুড, জ্যোতি পাগলের মতো সুর তৈরি করছেন আর অক্ষয় কথা বসাচ্ছেন। বন্ধুরা বাহবা দিচ্ছেন সুরে সুর মিলিয়ে।
কাদম্বরী আজ আসরের মধ্যমণি। জ্যোতি সুর দিচ্ছেন তার দিকে তাকিয়ে, অক্ষয় গান গাইছেন তাকে ঘিরে। আকাশের পাখি, নদীর জল তাঁকে ঘিরে উৎসবে মেতেছে। কাদম্বরীর বড় ভাল লাগে। বহুদিন পরে আবার এমন আসর, গত বসন্তের স্মৃতির মতো, বেলকুঁড়ি-গন্ধমাখা তেতলার ছাদের সন্ধ্যার মতো। আজ আবার যেন তিনি ত্রিমুণ্ডী হেকেটি।
আকাশ কালো করে ঝড় এল, বৃষ্টি এল, পালের মতো উড়তে লাগল কাদম্বরীর শাড়ি, তবু কারও ভ্রূক্ষেপ নেই। নীল মেঘডম্বরু শাড়ির ঘোমটায় মাথা ঢেকে নিলেন হেকেটি আর দুই ঘোরলাগা পুরুষ গান তৈরি করে চললেন।
বাহ্যজ্ঞানহীন তুরীয় অবস্থায় জ্যোতি ও অক্ষয় একের পর এক কত গান যে তৈরি করলেন সেদিন! গানগুলি ইন্দ্র, শচী ও দেবদেবীদের নিয়ে নানারকম প্রেমের, রাগ অনুরাগের গান। চন্দননগরে পৌঁছে সেগুলি নিয়ে বসলেন দুই বন্ধু, ঘষামাজা করে তৈরি হল মানময়ী নামে একটি গীতিনাট্য।
নাটক তৈরি হতেই জ্যোতির আর-একরকম ছটফটানি, এবার থিয়েটার নামাতে হবে। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এই গীতিনাট্যের তোড়জোড়ের মধ্যেই ফিরে এলেন রবি, সত্যেন ও জ্ঞানদা। বাড়ির গানবাজনার এই চিরপরিচিত স্রোতে ফিরতে পেরে রবির মন নেচে ওঠে। গুনগুন করে মানময়ীর গানের সুর ভাঁজতে ভাজতেই রবি লিখে ফেললেন একটি নতুন গান।
রবির গলা শুনে কাদম্বরী বলেন, রবি কেমন পালটে গেছ, তোমার গলাও কেমন বিলিতি বিলিতি ঠেকছে।
আহা, এ-কথা শোনার জন্য কি ফিরে এলাম বউঠান, রবি মজা করে বলেন, সেখানে তোমার কথা ভেবে ভেবে রাতে ঘুম হত না, কত বিলিতি বালিকার ফুলশর অগ্রাহ্য করে তোমার কাছে ফিরে এলাম, আর তুমি এমন পরপর ভাব করছ!
অ্যাই রবি, একদম বাজে কথা, কাদম্বরী ঠোঁট ফুলিয়ে বলেন, আমার কথা তোমার মনেই ছিল না। কত বালিকাকে ফুলশরে বধ করেছ তুমিই জানো, তবে আন্না যে এখানে এসে তোমার জন্য চোখের জল ফেলেছে, সে তো আমি নিজের চোখেই দেখেছি।
রবি কাদম্বরীর হাত ধরে একপাক ঘুরে যান নাচের ভঙ্গিতে, গেয়ে ওঠেন, আয় তবে সহচরী
জ্যোতি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, বাঃ বেশ তো গানটা, নতুন লিখলি রবি? লাগিয়ে দে আমাদের নাটকে।
এবার স্বর্ণকুমারীও বলে উঠলেন, না রবি, তোর গলা একটু পালটেছে ঠিকই, নতুনবউঠান ভুল কিছু বলেননি। কেমন যেন বিদেশি বিদেশি লাগছে, ভালই লাগছে।
অক্ষয় বললেন, বিলিতি সুরের প্রভাবে গলা একটু পালটেছে ঠিক, তার ওপর ওর এখন বয়ঃসন্ধি পেরোনো কণ্ঠ। রবির গলায় আইরিশ মেলোডির ছোঁয়া লেগেছে।
রবি আপাদমস্তক শিউরে ওঠেন কী এক অজানা ভাললাগায়, একদিন ছিল যখন অক্ষয়ের কণ্ঠে আইরিশ মেলোডির ওইসব কবিতার আবৃত্তি শুনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন। বিলেতে গিয়ে সুরগুলি শিখে এসে অক্ষয়কে কবে শোনাবেন, তাই ভাবতেন কিশোর রবি। শিখেছেনও, কিন্তু সব সুর যে ভাল লেগেছে তা নয়। কিছু সুর মিষ্টি, সরল, করুণ। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের প্রাচীন কবিসভার বীণ ছোটবেলায় যেভাবে বেজে উঠত, বিলেতে যেন তেমনভাবে বাজল না। বরং তিনি অন্য অনেক সুর শিখেছেন। লুসির সঙ্গে সুরের খেলায় মেতেছিলেন এই সেদিন, এখন যেন পিয়ানোর ছেঁড়া তার। বেজে ওঠে বুকে। চোখের জল লুকোতে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ান তিনি।
জ্ঞানদা অন্য কথা বলেন, প্রথমে নিজেদের মধ্যেই মানময়ীর অভিনয় হোক না। কে কী পার্ট করবে সব ঠিক করা যাক।
আমি সুরাটে গিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার আগেই তা হলে অভিনয় হোক, সত্যেন বললেন। এতদিন দূরে ছিলাম, একটু গানবাজনা অভিনয়ের স্বাদ নিয়ে কাজে ফিরতে চাই।
ঘরে বসেই ঠিক হয়ে গেল, জ্যোতি করবেন ইন্দ্রের পার্ট, রবি মদন।
আর শচী সাজবেন কে? কাদম্বরী পরম উৎসাহে জানতে চান।
বহুদিন বিদেশে থেকে জ্ঞানদার মন থেকে নতুনবউয়ের ওপর অসন্তোষ কিছুটা কমেছে। মেয়েটা কেমন শীর্ণ হয়ে গেছে, চোখের তলায় জমে আছে বর্ষার মেঘ।
তুমিই তো শচী সাজতে পারো নতুনবউ, জ্ঞানদা বললেন, সাজলে গুজলে নতুনের সঙ্গে তোমায় বেশ মানাবে।
এমনিতে বুঝি মানায় না? কাদম্বরী সঙ্গে সঙ্গে ধরে নেন জ্ঞানদার গোপন ইশারাটি। ঠিক কীরকম হলে মানাবে বলো তো?
আহা, মেজোবউঠান ওভাবে কিছু বলেননি, জ্যোতি তাড়াতাড়ি বলেন, তোমরা আবার শুরু করে দিয়ো না, দোহাই নতুনবউ।
অভিমানিনী কাদম্বরী রবির কাছে জানলায় গিয়ে দাঁড়ান। রবি তার হাতে হাত রাখে। কানে ফিসফিস করে উচ্চারণ করে নিজের লেখা একটি কবিতা,
হয়তো জান না, দেবি, অদৃশ্য বাঁধন দিয়া
নিয়মিত পথে এক ফিরাইছ মোর হিয়া।
গেছি দূরে গেছি কাছে, সেই আকর্ষণ আছে
পথভ্রষ্ট হই নাক তাহারি অটল বলে।
বৈশাখে বাড়ির আঙিনায় মহা ধুমধাম করে মানময়ীর অভিনয় হল। কাদম্বরী সর্বস্ব পণ করে অভিনয় করলেন, মানময়ী শচীর চোখের জলে মিশিয়ে দিলেন নিজের চেপে রাখা অশ্রুজলরাশি।
সবাই নাটকের অভিনয়ের প্রশংসায় মাতোয়ারা, বিশেষত কাদম্বরীর অভিনয় সবাইকে অবাক করেছে। সকলে যখন ধন্য ধন্য করছে তখন জ্যোতিকে আড়ালে টেনে নিয়ে তার আঙরাখার সোনার বোম ধরে নাড়াচাড়া করতে করতে কাদম্বরী জানতে চান, তোমার বিনোদিনী কি আমার চেয়েও ভাল অভিনয় করে?
উঃ, নতুনবউ, তোমার মাথার ঠিক নেই! জ্যোতি ছিটকে যান, যে অধরা আগুনকে ভুলে থাকতে চাইছেন তিনি আবার তাকেই কেন টেনে আনে কাদম্বরী!
নাটকের মানময়ীর মানভঞ্জন হয়, কিন্তু বাস্তবের মানময়ী নিজের পরম সাফল্যের দিনেও চোখভরা অশ্রু নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন চিত্রার্পিত।