০৬. সারদার মৃত্যু

০৬. সারদার মৃত্যু

জ্যোতির আজ মনখারাপ। টাকাপয়সার অভাবে একটি দাঁতব্য হাসপাতালে অসহায়ভাবে মারা গেলেন মধুসূদন দত্ত। ধনী পিতার আদরের সন্তান মধু ভেবেছিলেন ইংরেজিতে কবিতা লিখলে বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাবেন আর সেজন্য হেঁদো হিন্দুধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টান হওয়া দরকার। মধুর ধর্মত্যাগ সমাজে হুলুস্থুলু ফেলে দিল। রাগে ক্ষোভে বাবা রাজনারায়ণ তাকে ত্যাগ করলেন। মায়ের স্নেহ ছেড়ে, প্রেসিডেন্সি কলেজের বন্ধুদের পেছনে ফেলে, দেশত্যাগ করে মধু বেরিয়ে পড়লেন ভাগ্যান্বেষণে। কিন্তু ভাগ্যদেবী তার সঙ্গে ছলনা করেছেন। সরস্বতীর কৃপায় কবিতায় আর নাটকে তার খাতা ভরে উঠেছে, কিন্তু লক্ষ্মী তাকে ধরা দিলেন না কোনওদিনই। মধু অবশ্য খুব শিগগিরি বুঝতে পেরেছিলেন যে লিখতে হলে ইংরেজি নয় বাংলাতেই লিখতে হবে। ইংরেজি ভাষায় অনেক প্রতিযোগিতা, কেউ তার মতো নেটিভকে ঢুকতে দিতে চায় না। কিন্তু বাংলায় বহু কিছু করার আছে। প্যারীচাঁদ মিত্র বা টেকাদ ঠাকুররা যে রকম কুলিমজুরের ভাষায় লিখছেন তা দিয়ে কালজয়ী সাহিত্য হতে পারে না। দুয়োরানি বাংলামায়ের শরীরে অলংকার পরিয়ে তিনি তাকে সুয়োরানি সাজাবেন। একটি কবিতায় বাংলাভাষার উদ্দেশে তার অন্তিম ইচ্ছের কথাও লিখে গেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত,

রেখ মা দাসেরে মনে    এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাধ    ঘটে যদি পরমাদ
মধুহীন কোরো নাকো   তব মন কোকোনদে

মধুসূদনের প্রহসনের সঙ্গেই জ্যোতির কিঞ্চিৎ জলযোগ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল একবার। তার আগে থেকেই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মধুর আসা যাওয়া।

জ্যোতি বললেন, নতুনবউ, তুমি তো তাকে দেখনি। অমন প্রতিভা শেষ হয়ে গেল লালনের অভাবে, টাকাপয়সার অভাবে। আর ওদিকে তার বিপুল পৈতৃক সম্পত্তির ওপর ছাতা পড়ছে!

কাদম্বরী জানতে চান, ওঁর বিদেশিনী স্ত্রী এখন ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কী করে দিন কাটাবেন? তার পাশে তো কেউ দাঁড়াবে না কলকাতায়?

হেনরিয়েটা খুব বিপদে পড়লেন। খাঁটি ফরাসি সুন্দরী, তার ওপর বিপন্না। অনেক ভদ্রলোকবেশী লম্পট ঘুরঘুর করবে তার পেছনে কিন্তু প্রকৃত সাহায্য পাওয়া মুশকিল। সত্যি কষ্ট হয় তার কথা ভাবলে।

আচ্ছা তুমি তাঁর পাশে দাঁড়াতে পারো না? সরল বালিকার মতো কাদম্বরী বলেন।

জ্যোতি বউয়ের থুতনি ধরে নেড়ে দিয়ে বলেন, আচ্ছা, আমাকে ওরকম রূপসি বিধবার কাছে পাঠাতে তোমার একটুও ভয় করবে না? আমি যদি তার প্রেমে পড়ে যাই?

তা হলে আমাকে বিষ খেয়ে মরতে হবে, কাদম্বরী মুখ নিচু করে বলেন।

জ্যোতি শিউরে ওঠেন বালিকাবধূর মুখে এমন কথা শুনে, আর কোনওদিন ঠাট্টা করেও এরকম কথা বলবে না নতুনবউ, তা হলে আমি ভীষণ রাগ করব।

অজানা আশঙ্কায় স্বামীর বুকে মাথা গুঁজে দেন কাদম্বরী। জ্যোতির মনে হয় যেন মহীরূহের গায়ে লবঙ্গলতিকাটি।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কচি দাম্পত্যের অন্তরঙ্গ দৃশ্যটি দেখে ফেলেন জ্ঞানদা। মনের কোনায় কোথায় যেন খচ করে বেঁধে তার।

বলেন, কী ব্যাপারটা কী, কখন রোদ উঠেছে, এখনও বিছানায় প্রেমালাপ। চলছে তোমাদের? নতুনবউয়ের তো বেশ রীতি, আর সবাই কাজে লেগে পড়েছে, তুমি বরের সোহাগের লোভে বিছানায় পড়ে আছ এখনও? জ্যোতিকেও বুঝি কাজ করতে দেবে না?

কাদম্বরী ধড়মড় করে উঠে বসেন, লজ্জায় কাঁটা হয়ে যান মেজোজায়ের বকুনি খেয়ে। কিন্তু জ্যোতি হাসিমুখেই আবাহন করেন জ্ঞানদাকে, এসো এসে বউঠান, আজ কার মুখ দেখে উঠেছি বলো তো, তোমার তোমার। মনটা ভাল ছিল না, এবার ভাল হয়ে যাবে।

কী কথা হচ্ছিল শুনি? জ্ঞানদা একটু নাক গলিয়ে ফেলেন, এই কচি বউকে নিয়ে কী এত আলাপচারি করে নতুন!

দেখো না বউঠান, কাদম্বরী ভয় দেখাচ্ছে যে আমি অন্য কোনও নারীর কাছে গেলে ও আত্মহত্যা করবে, তুমিই বিচার করো এ-কথা কি ওর বলা উচিত?

জ্যোতির কথা শুনে কাদম্বরী অবাক হয়ে বলেন, ওমা কী মিথ্যে কথা, আমি তো তোমাকে যেতে বললাম, তুমিই অন্য কথা বলছিলে তাই

জ্ঞানদা বিরক্ত হন, ওমা এইটুকু মেয়ের পেটে পেটে এত? ঠাকুরপো তোমাকে এত ভালবাসে তাও এমন ভয় দেখাচ্ছ? দেওরের কাছ ঘেঁসে রহস্য করে আবার বলেন, তুমি কি ওকে আমার সঙ্গেও মিশতে দেবে না নতুনবউ?

জ্যোতি তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, সেকী কথা মেজোবউঠান, তুমি আমার প্রথম প্রেরণা, বউ তো অনেক পরে এসেছে।

এবার কাদম্বরীর একটু অভিমান হয়, জ্ঞানদাকে বলেন, তোমার সঙ্গে মিশতে বারণ করব এমন সাহস আমার নেই মেজদি। আর সে-কথা বলবই বা কেন, উনি কার সঙ্গে মিশবেন, কীভাবে মিশবেন, সেটা ওঁর ব্যাপার। আমি ওঁর শ্রীচরণে স্থান পেয়েছি এই আমার ভাগ্য!

ওবাবা, মেয়ের তো বোল ফুটেছে। না জ্যোতি এখন আর ওকে এড়িয়ে তোমার সঙ্গে মেশা যাবে না। আমাদের সাহিত্যবাসরে ওকেও ডেকে নিয়ো এরপর, জ্ঞানদার গলায় ঈষৎ শ্লেষ। বউয়ের অধিকার ফলাতে গিয়ে সাহিত্যবাসরে এসে বসলে নতুনবউয়ের সব জারিজুরি বেরিয়ে যাবে, জ্যোতিও নিজের ভুল বুঝবে। সাহিত্যিক হতে চাইলে ওর উচিত ছিল জ্ঞানদার কথামতো শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করা। শুধু রূপসি বলেই স্বামীর কাব্যের প্রেরণা হতে পারবে কি এই পুঁচকে বালিকা।

কিন্তু জ্যোতি বউকে বলেন অন্য কথা, নিজেকে কোনওদিন কারও শ্রীচরণে নামাবে না, এমনকী স্বামীর পায়েও না। নতুনবউ, কখনও ভুলো না, তোমার স্থান আমার হৃদয়ে।

আর আমাকে কোথায় রেখেছ ঠাকুরপো? জ্ঞানদা কৌতুক করে জানতে চাইলেন।

তোমাকে মাথায় করে রেখেছি বুঝতে পার না মেজোবউঠান? জ্ঞানদার মুখের দিকে তাকিয়ে জ্যোতির হঠাৎ মনে হল কাদম্বরীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতায় মেজোবউঠান কি কোনওরকম কষ্ট পাচ্ছেন! কিন্তু তা কেন হবে? বউঠান কি আশঙ্কা করছেন যে দেওর-বউঠানের মধুর সম্পর্কে কাদম্বরী বাধা দেবে? সেরকম ভাবলে তাঁর ভুল ভাঙানো দরকার।

জ্যোতি বলেন, এখন যে কদিন জোড়াসাঁকোয় থাকবে তোমরা মেজোবউঠান, সে কদিন তোমার সাহচর্যের জাদুতেই গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে উঠতে পারে নতুনবউ।

জ্ঞানদা কথাটায় যেন খুশি হলেন না, বললেন, সে ভার তো বাবামশায়। নীপময়ীকেই দিয়েছেন, নতুনবউ তো দিব্যি কথা বলছে। বাবামশায় যখন আমার ওপর আস্থা রাখেননি, এর মধ্যে আবার আমাকে টানছ কেন নতুনঠাকুরপো? বরং তোমার নতুন লেখা পড়ে শোনাও, আমি তো সকাল সকাল কাজ সেরে তোমার শকুন্তলা কাব্য শুনব ভেবেই এসেছি।

দেওর আর বউঠান কাব্যপাঠে মজে যান। কাদম্বরীর সঙ্গে আর-একটি উৎসুক শ্রোতাও তৃষ্ণার্তের মতো সেই কাব্যসুরা পান করতে থাকেন তাঁদের অলক্ষ্যে, সে জানলার বাইরে থাকা রূপকুমারী।

.

সারদা খবর পেলেন রূপা নাকি জ্যোতির পিছু পিছু গিয়ে বৈঠকখানায় পুরুষদের আসরে বসে থাকছে আর দিব্যি জমিয়ে গল্পগাছাও করছে।

তার কাণ্ড দেখে বর্ণ একদিন এসে বললেন, মা আর তো পারা যাচ্ছে না তোমার পুষ্যিকে নিয়ে! তার জন্য যে আমাদের বাড়ির মেয়েদের সম্মান ধুলোয় লুটোচ্ছে।

কেন, আবার কী করল সে? সারদার হয়েছে জ্বালা, না পারেন গিলতে, না পারেন ফেলতে মেয়েটাকে। অবাধ্য, বেয়াড়া কিন্তু মনটা স্বচ্ছ সরোবরের মতো। ও যা করে সেটা কেন বারণ তাই সে বোঝে না।

তুমি যেন কিছু জানো না!]বর্ণ রাগ করে, তুমি ওকে যেমন মাথায় তুলছ, আমাদের তো কখনও তেমন স্বাধীনতা দাওনি। ওর বয়স তো অনেক হল মা!

সারদার মাঝে মাঝে বিষণ্ণ লাগে, এ কি তাঁরই ব্যর্থতা! আবার মনে হয় তা কেন, এতগুলো হিরের টুকরো ছেলেমেয়ে তার, রূপা যে রক্তসম্পর্কের না তাই বোধহয় শোধরাতে পারলেন না। তিনি বললেন, কেন রে, সাহিত্যের আসরে তো স্বর্ণও যায়, মেজোবউমাও যায়, রূপা গেলেই বা দোষ কী?

এবার সৌদামিনী মাকে বোঝাতে নামলেন, মা স্বর্ণ বা মেজোবউঠানের সঙ্গে কি ওর তুলনা হয়? রূপা সাহিত্যের কী বোঝে? তা ছাড়া ও তো সাহিত্যের টানে যায় না, ওর আকর্ষণ যুবক ছেলেরা। রূপা তাদের সকলের সঙ্গে কীরকম ইয়ারদোস্তের মতো মেশে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমি পরদার আড়াল থেকে দেখেছি, হ্যারি নামে একটি সাহেবের সঙ্গে সারাক্ষণ ফুসফুস করছে, হেসে গড়িয়ে পড়ছে।

মানদা দাসী কত্তামার জন্য পান সেজে রুপোর পাত্রে রাখছিল। সে আর চুপ করে থাকতে পারে না, বকুনি খাবে জেনেও বলে ওঠে, কী ঢলাঢলি, কী ঢলাঢলি মা গো! দেখলে মনে হবে বাইজিপাড়ার মেয়ে।

ছিঃ, চুপ কর মানদা। কত্তামা ধমকে ওঠেন। সব কথায় কথা বলিস না। পান দে একটা।

কথা শেষ হতে না হতেই রূপকুমারী ছুটে এসে ধুপ করে সারদার পায়ের কাছে বসে পড়ে। তাকে দেখে সবাই চুপ।

সারদা তার চুলের মুঠি ধরে জিজ্ঞেস করেন, মুখপুড়ি, তুই কি আমায় শান্তিতে থাকতে দিবি না? সারাদিন তোর নামে সবাই নালিশ করে কেন? আর সব মেয়েদের মতো লক্ষ্মীমন্ত হতে পারিস না তুই? কাল সকালে উঠে যার মুখ দেখব তার সঙ্গেই তোর বিয়ে দিয়ে দেব।

রূপা হেসে গড়িয়ে পড়ে, মা, তা হলে তো কোনও মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে হবে, বাইরে না বেরলে তুমি ছেলেদের মুখ দেখবে কোত্থেকে?

ধন্যি মেয়ে বাবা, সৌদামিনী বলেন, আমরা তোকে নিয়ে জেরবার হয়ে যাচ্ছি আর মেয়ের কোনও হুঁশ নেই? না, হাসির কথা নয়, এবার সত্যিই রূপার বর খুঁজতে হবে, বয়স তো তেরো-চোদ্দো হল।

রূপা আদুরে গলায় বলে, আমি বিয়ে করবই না।

সারদা এবার কঠোর হয়ে বলেন, না করতে চাইলে জোর করে বিয়ে দেব। তোকে বিদেয় না করে আমি মরেও শান্তি পাব না।

তা হলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব, পালাবই। স্থির সিদ্ধান্ত জানায় রূপকুমারী।

জোড়াসাঁকোর বাড়িতে হঠাৎই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সারদাসুন্দরী বেড়াতে গিয়েছিলেন পেনেটির বাগানে, সেখানেই তার হাতের ওপর ভেঙে পড়ল লোহার সিন্দুকের ভারী ডালা। তড়িঘড়ি তাকে বাড়ি আনা হল। হাতে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে শয্যাশায়ী হলেন গৃহলক্ষ্মী। প্রথমে আর্নিকা ও মলম দিয়ে সারানোর চেষ্টা ব্যর্থ হল। তারপর বাড়ির ডাক্তার ডা. নীলমাধব হালদার এবং মেডিকেল কলেজের সার্জারির অধ্যাপক ডা. প্যাট্রিজ তাকে চিকিৎসা করলেও সারাতে পারলেন না। পরপর অনেক ডাক্তার এলেন গেলেন। ভেতরে লোহার টুকরো ঢুকে গিয়েছে। একবার অস্ত্রোপচার করে লোহা বার করার পরেও ব্যথা কমল না।

ঠিক এসময়েই দেবেন ঠাকুর বাড়িতে অনুপস্থিত। রবিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বেড়াতে গেছেন ডালহৌসি পাহাড়ে। দুমাসের মধ্যেও সারদার রোগ না সারায় তাকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে। সংবাদ পেয়ে চিঠিতে, টেলিগ্রামে পরামর্শ দিতে লাগলেন উদ্বিগ্ন মহর্ষি।

শেষে মেডিকেল কলেজের পাঁচজন বিশিষ্ট সাহেব ডাক্তারের বোর্ড বসল সারদাদেবীর রোগ সারাতে। তাদের প্রত্যেকের ভিজিট বত্রিশ টাকা। তাদের পরামর্শ অনুসারে ক্ষতস্থানের মাংস কেটে বাদ দিয়ে ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে। এরকম চিকিৎসার কথা আগে বিশেষ শোনা যায়নি। সাহেবদের মাথা থেকেই এ-সব উদ্ভট চিকিৎসা বেরিয়েছে। কিন্তু কথা হল কার দেহ থেকে মাংস কেটে সারদার অঙ্গে লাগানো হবে, একমাত্র পরিবারের রক্তসম্পর্কের কেউ যদি এগিয়ে আসেন তবেই সারদা রাজি হবেন নয়তো বিনা চিকিৎসায় থাকবেন তাও ভাল।

বাবামশায় বাড়ি নেই। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে এলেন সেজো ছেলে হেমেন। সন্তানের অঙ্গ থেকে নতুন মাসমজ্জা লাগল গর্ভধারিণীর দেহে।

তবুও ব্যথা কমে না। সারদা অধীর হয়ে ওঠেন। অসুখও সারে না, কত্তামশায়ও ফেরেন না। তাকে একবার দেখতে বড় সাধ হচ্ছে। কী জানি আবার দেখা হবে কি না? তার অনুরোধে বাবামশায়কে ফিরে আসার জন্য চিঠি পাঠান হেমেন।

মহর্ষি তখন রবিকে নিয়ে ডালহৌসি পাহাড় থেকে সমতলে নেমেছেন, তাঁর ইচ্ছা এবার অমৃতসরে কিছুদিন বসবাস করে আস্তে আস্তে কলকাতার দিকে পা বাড়াবেন।

শীতের শুরুতে ব্যথা বাড়লে হাওয়া বদলের জন্য গঙ্গায় বোট ভাড়া করে মাকে সেখানেই রাখলেন হেমেন্দ্রনাথ। বাড়ির বন্ধ চার দেওয়ালে চিরদিন বাস করে এখন এই নৌকোয় যেন মুক্তির আনন্দ পাচ্ছেন সারদাসুন্দরী। এই নৌকোটি যেন তার একান্ত নিজের। এখানে তিনি আর ব্রহ্মোপাসনা করেন না, নৌকোঘরের এক কোণে লক্ষ্মীজনার্দনের নাম করে দুটি ঘট স্থাপন করেছেন। মানদা দাসীকে বলা আছে টাটকা ফুল বেল পাতা এনে দিতে, তিনি স্নান করে গঙ্গাজলসহ ওই নৈবেদ্য ঘটে নিবেদন করেন রোজ।

একদিন হেমেন এসে খবর দিলেন, মা, বাবামশায় ফিরে আসছেন শিগগিরই, টেলিগ্রাম করেছেন।

স্বস্তির শ্বাস ফেলে হাত মাথায় ঠেকান সারদা। গৃহদেবতা তার কথা শুনেছেন, কত্তার সঙ্গে দেখা না হলে যে তাঁর মরেও শান্তি নেই।

বাড়ির ডাক্তার দ্বারিকানাথ গুপ্ত রোজ বোটে এসে তাকে পরীক্ষা করেন। মেয়ে বউমারা রোজ দেখা করতে আসেন, কেউ কেউ সঙ্গে থেকেও যান। সবাইকে দেখে আনন্দ পান শুধু প্রফুল্লময়ী এলেই সারদার বড় কষ্ট হয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে। ওর জন্য কিছু করে যেতে পারলেন না তিনি। কচি বয়সে ছেলে নিয়ে বিধবা হয়েছে, সারাজীবন নিরানন্দে কাটাতে হবে মেয়েটাকে। বীরেনের মৃত্যুশোক তিনিই কাটিয়ে উঠতে পারেননি, তো ও বেচারার কী অবস্থা!

মাসখানেকের মধ্যেই দেবেন ঠাকুর জোড়াসাঁকো ফিরে এলেন। পথে কিছুদিন অবশ্য রবিকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে এসেছেন তিনি। যাওয়া-আসার পথে এভাবেই তিনি প্রকৃতি উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে জমিদারি পরিদর্শন করে নেন।

মহর্ষি ফিরে এলে সারদা বোট থেকে ঘরে ফিরলেন। তেতলার ঘরে এতদিন পরে স্বামীকে দেখে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

দেবেন্দ্রনাথ তার মাথায় হাত রাখেন, এই তো আমি এসেছি, ভয় কী সারদা? এখন তোমার কাছেই থাকব।

কত্তার হাত জড়িয়ে ধরে সুখের কান্না কাঁদতে থাকেন সারদা, এবার না এলে আর আপনার দেখা পেতাম না। আর বোধহয় বাঁচব না আমি।

দেবেন সান্ত্বনা দিলেন, কে বলেছে বাঁচবে না? তোমার এখনও পঞ্চাশ হয়নি গিন্নি, এখন কোথায় যাবে? আমি নিজে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা করাব, দেখি অসুখ সারে কি না!

সত্যি যেন প্রাণে নতুন জোয়ার এল সারদার। আগের তুলনায় তিনি এখন অনেক সুস্থ। ব্যথা আছে কিন্তু তার সহ্য করার শক্তি যেন অনেক বেড়েছে। মাঝে মাঝে সকালের রান্নার জোগাড়ের সময় বা বিকেলের চুল বাঁধার আসরেও বসতে শুরু করলেন।

হিমালয় থেকে ফিরে রবি যেন অনেক বড় হয়ে গেছেন। বড়রা তাঁকে সম্মান দিচ্ছেন, মা তাকে ডেকে ডেকে হিমালয়ের গল্প শুনতে চাইছেন প্রায়দিনই। অন্তঃপুরের বন্ধ দরজা খুলে গেছে কী এক আশ্চর্য ফুসমন্তরে। সবাই তার কাছে বেড়ানোর গল্প শুনতে চায়, বিশেষ করে নতুনবউঠান। রবি যেন একটি ভ্রমণকাহিনির খোলা পাতা।

সারদা তার তেতলার ঘরে রবিকে ডেকে পাঠিয়ে জানতে চান, হ্যাঁ রে রবি, তোরা যে এত পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলি, তোর বাবামশায় ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করতেন তো?

রবির একটু অভিমান হয়, মা কি শুধু বাবামশায়ের কথাই জানতে চান, আমার খাওয়াদাওয়ার খোঁজ নেবেন না? কিন্তু মা তো এরকমই। তবু তিনি যে ডেকে পাঠিয়ে এত কথা শুনছেন তাতেই আনন্দে বুক ভরে ওঠে রবির।

তিনি সোৎসাহে বলেন, মা রোজ সকালে বেরোনোর আগে আমরা পেট ভরে দুধরুটি খেয়ে নিতাম। তারপর ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ে বেরিয়ে পড়া। উফ! সে যে কী অপূর্ব সুন্দর, না দেখলে বোঝানো যাবে না। আমি বড় হয়ে তোমাকে নিয়ে যাব মা।

হায় রে রবি, তুই যখন বড় হবি আমি কি তখন থাকব রে? সারদা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

রবি আকুল হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেন, তুমি কোথায় যাবে মা, কোথাও যেতে দেব না। আমি শিগগির বড় হয়ে যাব।

আমার যে অসুখ করেছে রবি। আর বোধহয় বেশিদিন তোদের কাছে থাকতে পারব না। সারদা রবির মাথায় হাত রেখে বলেন, তুই এইরকম তোর বাবামশায়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকিস, তা হলেই তোর ভাল হবে। পাহাড়ের মতো বড় হবি তুই।

রবি মায়ের রুগ্‌ণ দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁকড়ে ধরে বলেন, না মা, তুমি থাকবে। ছোটবেলায় তোমার কাছে আসতে পারতাম না। এখন তুমি আমাকে ডেকে নিয়েছ, আর কোথাও যাবে না। আমি তোমাকে পালকি করে তেপান্তরের মাঠে নিয়ে যাব একদিন।

সারদা হাসেন, এই ছেলেটা এখনও ছেলেমানুষ। তুই একা একা আমাকে নিয়ে কোথায় যাবি? যদি ডাকাত ধরে?

ডাকাত? আসুক না, আমি যুদ্ধ করে তাড়িয়ে দেব। রবি একটা লাঠি হাতে নিয়ে তলোয়ারের মতো ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, দেখো মা, আমি বীরপুরুষ! ডাকাতের সঙ্গে লড়াই করতে যাচ্ছি।

সারদা মজা করে বলেন, যাস নে খোকা ওরে! আমি যে ভয় পাচ্ছি! এত লোকের সঙ্গে লড়াই কী করে করবি?

রবি অনেকক্ষণ লড়াইয়ের ভঙ্গিতে তলোয়ার ঘোরায়। ছেলের খেলার যুদ্ধ দেখতে মজা পান সারদা, নিজেও যেন তার সঙ্গী হয়ে গেছেন। ব্যথার কথাও সাময়িকভাবে ভুলে গেছেন তিনি।

রবি অনেক যুদ্ধের পর ক্লান্ত হয়ে ঘাম মুছতে মুছতে মায়ের সামনে এসে বলেন, দেখো, লড়াই গেছে থেমে। আমিই জিতেছি। আর তোমার ভয় নেই।

সারদা কষ্ট করে উঠে বসেন। রবিকে বহুদিন পরে কোলে টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে বলেন, ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল, কী দুর্দশাই হত তা না হলে!

আরও বেশ কিছুদিন ক্ষুদ্র ভ্রমণকারীটি মায়ের কাছে এবং অন্দরের ঘরে ঘরে হিমালয় বেড়ানোর গল্প বলে আদর কাড়তে লাগল। স্বাধীনতার মাত্রাও বেড়ে গেল। চাকরদের শাসন এবং ইস্কুলের বন্ধন শিথিল হয়ে এল। বাড়ির দাদা দিদিদের সঙ্গে গান ও সাহিত্যের মজলিশে ঢুকে পড়তে লাগলেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ। জ্যোতির আর কাদম্বরীর প্রেমঘন কাব্যসভায় নতুন কবিদের চর্চা হয়। নতুনবউ তখন বিহারীলালের কবিতার ভক্ত হয়ে উঠেছেন, প্রায়ই কবির সারদামঙ্গল কাব্য মুখস্থ বলছেন, আর সেই অমৃতসুধা পানের আশায় তার পিছু পিছু ঘুরতে থাকেন রবি। সমবয়সি দেওর ও বউঠানের মধ্যে খেলার সঙ্গীর মতো খুনসুটি চলতে থাকে। জ্যোতির কাছে যা যা শেখেন কাদম্বরী, তাই আবার রবিকে শেখাতে চান। জ্যোতির প্রিয়শিষ্যা তিনি আর রবি তার ছায়াশিষ্য।

ঠাকুরবাড়ির ঘরে ঘরে তখন সাহিত্যের নবজোয়ার। দ্বিজেনের স্বপ্নপ্রয়াণ কবিতাটি সকলের প্রশংসা পেয়েছে। সত্যেন ও জ্ঞানদা এলে তাঁদের ঘরেই আজকাল শহরের বিশিষ্ট কয়েকজন সাহিত্যিক আসর বসান। জ্যোতি ইতিমধ্যেই একজন প্রতিষ্ঠিত কবি ও নাট্যকার। অন্ধকারে চাঁদের উদয়ের মতো স্বর্ণকুমারীর জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ছে। এইসব উদ্ভাসে পাগল পাগল লাগে কিশোর রবির, তিনি কবিতারসে মাতাল হতে থাকেন ক্রমশ।

জ্যোতি ও দ্বিজেন ঠিক করে ফেললেন সামনের বসন্তে ঠাকুরবাড়িতে একটি বিদ্বজ্জন সমাবেশ করা হবে। দেশের সন্ধিক্ষণে ঠাকুরবাড়িকেই নিতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। সবাই মেতে উঠলেন তার প্রস্তুতিতে।

সারদার শরীর কিছুটা ভাল থাকায় দেবেন ঠাকুরও নিশ্চিন্ত হয়ে পৌষের এক সন্ধ্যায় সদলবলে ব্রাহ্মসমাজে এলেন। ছেলেদের মধ্যে দ্বিজেন ও জ্যোতি এবং জামাই বন্ধু আত্মীয়স্বজন মিলে বেশ বড় দল। তাদের যোগদানে সেদিন ব্ৰহ্মসংগীত বেশ জমে উঠল। জ্যোতি ও দ্বিজেনের উদাত্ত গলার গানে যেন নতুন জোয়ার এল ব্রাহ্মদের দলটিতে। উপাসনার সময় দেবেন আজ শুধু স্ত্রীর আরোগ্য কামনা করলেন। সারদা অসুস্থ থাকলে ঘরে মন বসে না তাঁর। গৃহকে গৃহ মনে হয় না।

কিছুদিনের মধ্যেই উচাটন কাটাতে শিলাইদহে জমিদারি দেখতে গেলেন তিনি। সারদাও ঘরবন্দি না থেকে গঙ্গাবক্ষের মনোরম বাতাসে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু স্বামীর অনুপস্থিতিতে আবার তার শরীর খারাপ হতে শুরু করল। এবার শুরু হল তুকতাক। এক হাতুড়ে আচার্যিনীর পরামর্শে তেঁতুলপোড়া বেটে ক্ষতের চারপাশে লাগানোয় ক্ষত বিষাক্ত হয়ে পেকে উঠল। এবার বোধহয় আর বাঁচবেন না। সারদা ভাবলেন, শেষ কটাদিন বাড়িতে কাটানোই ভাল।

রবির আবদারে বাড়িতে কয়েকদিন বালকদের ঘরের একপাশে বিছানা করে থাকছিলেন সারদা। অসুখ বেড়ে যেতে তেতলার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ক্রমশ বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হারালেন। বেডসোর থেকে বাঁচানোর জন্য উইলসন হোটেলের দোকান থেকে হাওয়া-বালিশ আনা হয়েছে। রোজ সেই বাতাসের বিছানা-বালিশে হাওয়া ভরার জন্য গাড়ি করে একজন লোক পাঠাতে হয়।

খবর পেয়ে বিষণ্ণ হয়ে পড়েন দেবেন্দ্রনাথ। সারদাকে কি আর ধরে রাখা যাবে না সত্যিই? গিন্নি না থাকলে বাড়ির প্রতি টানটুকু ধরে রাখাই মুশকিল হয়ে যাবে এরপর।

বাড়িতে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে। সবাই ভাবছেন কর্তামশায় শিলাইদহ থেকে ফিরে এসে দেখতে পাবেন তো কর্তামাকে?

সারদা কিন্তু নাড়ি ছেড়ে যায় যায় অবস্থাতেও বললেন, তোরা ভাবিস না, কত্তার পায়ের ধুলো না নিয়ে আমি মরব না।

ঠিক তাই হল। দেবেন ফিরে এলেন জোড়াসাঁকোয়। সোজা চলে এলেন স্ত্রীর তেতলার ঘরে। সারদা অতি কষ্টে হাত বাড়িয়ে কর্তার পা ছুঁয়ে বললেন, আমি তবে চললাম। আর জন্মে আবার দেখা হবে।

ঘরভরা ছেলেমেয়ে বউ নাতিনাতনি, দাসদাসীর সামনে স্বামীর আশীর্বাদ নিয়ে চোখ বুজলেন সারদাসুন্দরী। ব্রাহ্মঘরের কোনও এক বউ মরদেহকে প্রণাম করে যেন গোঁড়া হিন্দুদের মতো বলে উঠলেন, আহা, শাখা সিন্দুর নিয়ে চলে গেলেন সৌভাগ্যবতী।

চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছাদে চলে গেলেন দেবেন্দ্রনাথ।

শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় আবার নেমে এলেন। চিরসঙ্গিনীর দেহে নিজের হাতে ফুল চন্দন ছিটিয়ে স্বগতোক্তি করেন, ছয় বৎসরের সময় এনেছিলেম, আজ বিদায় দিলেম।

সত্যেন মাকে শেষদেখা দেখতে পাননি। খবর পেয়ে সাতদিনের মাথায় জ্ঞানদাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। জীবিত সব পুত্রকন্যাবধূর উপস্থিতিতে ব্রাহ্মমতে মহাসমারোহে তার শেষ কাজ হয়ে গেল। সারদার মৃত্যুতে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে একটি যুগের অবসান ঘটল।

.

বারবাড়িতে শুরু হল নতুন একটি যুগ। মাসখানেক পরে শোক কাটিয়ে উঠে সারদার ছেলেরা বাড়িতে বিদ্বজ্জনসমাগম ঘটিয়ে ফেললেন। সত্যেন এখানে থাকায় সভার আয়োজন হল সর্বাঙ্গসুন্দর। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বাবু রাজনারায়ণ বসু, বাবু প্যারীচরণ সরকার ইত্যাদি বহু লেখক সম্পাদক গুণীজনে গমগমে সেই সভায় দ্বিজেন তার স্বপ্নপ্রয়াণ কাব্য পাঠ করলেন আর জ্যোতি পড়লেন নিজের নাটকের একটি অঙ্ক। কিন্তু গোলমাল বাধল প্যারীমোহন কবিরত্ন যখন ইংলন্ডেশ্বরীর প্রতি নিবেদিত একটি গানে স্বদেশির সঙ্গে বিলিতি দ্রব্যের বিনিময়ে ভারতের সর্বনাশের কথা বললেন। অনেকে তার সঙ্গে একমত না হওয়ায় তর্ক শুরু হয়ে গেল। সেখানে প্রায় শখানেক বাঙালি বুদ্ধিজীবী জড়ো হয়েছেন, সবাই তো কোনও বিষয়েই একমত হবেন না।

শেষে সত্যেন সংগীত শুরু করিয়ে দিতে হট্টগোল থামল। ঠাকুরবাড়ির বালক কিশোরেরা অনেকদিন ধরে মহড়া দিয়ে প্রস্তুত হয়েছে। তর্কের অবসানে গানের চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে!

এই অনুষ্ঠানটি রবির পক্ষে খুবই আনন্দের। যাদের লেখা পড়তে শুরু করেছেন, যাঁদের কথা বারে বারে শুনেছেন, তাঁরাই সশরীরে একেবারে ঘরের মধ্যে উপস্থিত! তাদের উৎসাহ পেয়ে মনে তার খুশির বাধ ভাঙল যেন।

এই সভায় মেয়েদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎই কালো চাদরে মুখ ঢাকা দুজন নারী আসরে এসে বসলেন। সৌজন্যবশত পুরুষেরা কেউ তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করতে পারছেন না। অথচ কৌতূহল হচ্ছে।

কেউ জানতে চান, মেয়েদুটি সত্যি মেয়ে তো?

আবার আর-একজন ফিসফিস করে বলেন, মুসলমানি মেয়েরা তো, এভাবে বেরতেই পারে না? মেয়ে না কি হিজড়ে?

জ্যোতির কাছে সবাই জানতে চান। তার অবশ্য সন্দেহ হয় স্বর্ণ দুষ্টুমি করছে না তো কাউকে জুটিয়ে নিয়ে? সে আসতে চেয়েছিল কিন্তু অনুমতি দেওয়া হয়নি দু-চারজন রক্ষণশীল আপত্তি জানানোয়। নিজেদের বাড়িতে প্রথমবার সমাগম করতে গিয়ে কোনও বাধা আসুক তা জ্যোতি চাইছিলেন না। পরের বার নিশ্চয় মেয়েরাও আসবে। কিন্তু মেয়েদুটি কারা?

ঘোমটার নীচে মেয়েদুটি হাসিগল্পে মশগুল। জ্যোতিরিন্দ্র কায়দা করে ওঁদের পরিচয় জানার জন্য রবিকে পাঠালেন।

রবি ওঁদের সামনে গিয়ে জ্যোতিদাদার শেখানো কথাটাই বললেন, আপনারা যদি নিজেদের পরিচয় দিয়ে কোনও আলোচনায় অংশ নেন, আমরা খুব খুশি হব।

মেয়েরা রবিকে পাত্তা দেয় না। হাত নেড়ে চলে যেতে বলে, কিন্তু রবি নাছোড়বান্দা তাঁকে একটা গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি বারবার নানাভাবে ওদের নাম জানতে চান।

রবির জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে একটি মেয়ে বলে ওঠে, জ্যোতিদাদাকে বল আমরা সখীসমিতি।

রবি জানতে চান, দুজনেরই এই নাম?

মেয়েটি বলে, দুজনে মিলে এই নাম। বুঝলি গবেট! যা জ্যোতিদাদাকে বল আর আমাদের নিস্তার দে। সবাই হাঁ করে দেখছে।

রবির এবার চেনা চেনা লাগে গলাটা, তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, বুঝেছি, তুমি তো স্বর্ণদিদি। স্বর্ণ তাড়াতাড়ি রবির মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেন, চুপ চুপ।

তা হলে বলল, তোমার সঙ্গে উনি কে? রবি ছাড়ার পাত্র নয়। না বললে চিৎকার করব। সবাইকে বলে দেব তোমরা লুকিয়ে লুকিয়ে এসেছ।

আরে আমি রূপা। এবার চুপ করো রবিদাদা। আমরা লুকোচুরি খেলছি বিদ্বজ্জনের সঙ্গে।

সখীসমিতিকে ঘোমটার মধ্যে হেসে গড়াগড়ি খেতে দেখে এবার রবিও হাসতে থাকেন। তিনিও যেন ওদের লুকোচুরি খেলার সঙ্গী হয়ে যান।

উৎসুক দু-একজন প্রশ্ন করলে রবি বলেন, সে একটা গুহ্যকথা, সবাইকে বলা বারণ। শুধু জ্যোতিদাদাকে বলা যাবে।

উৎসবের শেষে খাওয়াদাওয়াটি অতি চমৎকার হলেও সবাই মনে একটা প্রশ্ন নিয়ে ফিরে গেলেন। রহস্যটা জানা হল না, কিন্তু জানতেই হবে মেয়েদুটি কে?

সভা যখন ভঙ্গ হল দেবেন্দ্রনাথ তখন অনেক দূরের এক পাহাড়চূড়ায় সূর্যাস্ত দেখছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *