০৩. কাদম্বরীর প্রবেশ

০৩. কাদম্বরীর প্রবেশ

মনে পড়ে সেইদিন,   নাটকের ‘হিরোইন’
সম্মুখে আয়না ধরি
গবেশ করিতে বন্দী,   পাতিছেন নানা ফন্দী
পান খেয়ে ঠোঁট লাল করি।
মরি মরি মরি।।

জ্যোতির উৎসাহে জোড়াসাঁকোয় দুবাড়ির ছেলেরা মেতে উঠেছে স্টেজ বেঁধে নবনাটক অভিনয় করতে। মেয়েদের রোলে পুরুষেরাই অভিনেতা। চন্দ্রলেখার নারীভূমিকায় পুরুষ অমৃতলালের অভিনয় দেখে মজা করে ছড়া বেঁধেছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। বলাই বাহুল্য তা নিয়ে নাটকের কলাকুশলীরাই হেসে অস্থির। বহুবিবাহপ্রথার দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে লোকশিক্ষায় এই নাটকটি লিখেছেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। ও-বাড়ির গণেন্দ্র ও এ-বাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রর উদ্যোগে বাড়ির ছেলেরা অভিনয় করতে নেমেছে, মেয়েরা চাইলেও তাদের নাটকে অংশ নিতে দেওয়ার সাহস পাননি জ্যোতিরা। অভিজাত বাড়ির আঙিনায় পরিবারের ছেলেরা নাটক করছে– এটাই যথেষ্ট দুঃসাহসের কাজ। এখনও ইতরশ্রেণির যাত্রার সঙ্গে থিয়েটারকে গুলিয়ে ফেলা হয় বাঙালি সমাজে। বাবামশাই ব্যাপারটা কীভাবে নেবেন, কে জানে।

 দেবেন্দ্রনাথ অবশ্য খবর পেয়ে খুশি হয়ে ভাইপো গণেনকে চিঠিতে লিখেছেন, তোমাদের নাট্যশালার দ্বার উদঘাটিত হইয়াছে– সমবেত বাদ্য দ্বারা অনেকের হৃদয় নৃত্য করিয়াছে– কবিত্ব রসের আস্বাদনে অনেকে পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছে। নির্দোষ আমোদ আমাদের দেশের যে একটি অভাব, তাহা এই প্রকারে ক্রমে ক্রমে দূরীভূত হইবে।… কিন্তু আমি স্নেহপূৰ্ব্বক তোমাকে সাবধান করিতেছি যে, এ প্রকার আমোদ যেন দোষে পরিণত না হয়।

জ্যোতিরিন্দ্র শিল্পসাহিত্যে খুব উৎসাহী, কিছুদিন আর্ট স্কুলে আঁকা শিখেছেন। কবিতা ও নাটক লেখেন। সুপুরুষ জ্যোতি এই নাটকে সুন্দরী নটীর রোল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। তাঁর মেয়েলি হাবভাব। দেখে লোকে হেসে লুটিয়ে পড়ে।

বাড়ির এক জামাইনীলকমলনট সেজেছেন, আর এক জামাই শরৎকুমারীর বর যদুনাথ সেজেছেন চিত্ততোষ। এই যদুনাথকে নিয়ে দেবেন ঠাকুর খুব ভুগছেন। প্রায়ই তিনি ইয়ারবন্ধুদের বাড়িতে জুটিয়ে এনে মাতলামি করেন। যা কাজের ভার দেওয়া হয় তা কিছুই করেন না, কিন্তু তিনি রসিক এবং নাটুকে ব্যক্তি। তার হালকা স্বভাবের জন্য স্ত্রী শরৎকুমারী প্রথম দিকে স্বামী নামক ব্যক্তিটির গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। নাম ধরে যদু যদু বলে ডেকে ফেলে মাঝেমাঝেই সারদাদেবীর কাছে ধমক খেতে হয়েছে তাকে।

গবেশ নামক চরিত্রের দুই স্ত্রী, বড় গিন্নির রোলে সৌদামিনীর বর সারদাপ্রসাদ আর ছোটগিন্নি সাজলেন সরকারমশায়ের ছেলে অমৃতলাল। নারীচরিত্রে এঁদের দেখে দর্শকেরা যে কতদূর আমোদিত হচ্ছিলেন দ্বিজেনের কৌতুক ছড়াটি তারই প্রমাণ।

কিছুদিন পরেই যে এই অমৃতলালের বোন কাদম্বরী কর্মচারী পরিবার থেকে জ্যোতির গৃহলক্ষ্মী হয়ে আসবেন সে-কথা তখনও ভাবা হয়নি। জ্যোতির বিয়ের কথা তখন ওঠেনি। তিনি ব্যস্ত ছিলেন গান, কবিতা, নাটকচর্চা নিয়েই। সত্যেন ও জ্ঞানদাও তাকে উৎসাহ দেন এ ব্যাপারে।

একদিন জোড়াসাঁকোর দালানে হইহই করে মুড়ি তেলেভাজা সহযোগে নাটকের মহড়া চলছে, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে একটি কাগজ হাতে জ্যোতি এসে উপস্থিত হলেন, দেখো দেখো, সোমপ্রকাশ আমাদের নাটকের রিভিউতে লিখেছে, শনিবার আমরা জোড়াসাঁকো নাট্যশালায় নবনাটকের অভিনয় দর্শন করিতে গিয়াছিলাম। এখানে নাটক অভিনয়ের যে প্রণালী দর্শন করিলাম, তাহা যদি সৰ্ব্বত্র প্রচলিত হয়, আমাদিগের বিশুদ্ধ আমোদ ভোগের একটি উৎকৃষ্ট উপায় হইয়া উঠে। নাট্য শালা প্রকৃত রীতিতে নির্মিত ও দ্রষ্টব্যর্থগুলি সুন্দর বিশেষতঃ সূৰ্যাস্ত ও সন্ধ্যার সময় অতিমনোহর হইয়াছিল। অধিকতর আহ্লাদের বিষয় এ সমুদায়গুলি এতদ্দেশীয় শিল্পজাত। দর্শকদের উপবেশন প্রণালী অদ্যাপিও উৎকৃষ্ট হয় নাই… এককালে দ্বার উদঘাটিত হওয়াতে যাবতীয় দর্শক প্রবেশ করিয়া সকলেই সমুখের আসন গ্রহণ করিবার চেষ্টা করেন, তাহাতে গোলযোগ, গাত্রঘর্ষণ ও আসনভঙ্গ ইহার ফল হইয়া উঠে।… সকলেরই বেশ প্রায় উত্তম হইয়াছিল, কিন্তু সাবিত্রী না স্ত্রীলোক না হিজড়ে রূপ ধারণ করে।… কোন কোন অংশে কিছু কিছু ত্রুটি থাকুক সাকল্যে বিবেচনা করিলে গ্রন্থ ও অভিনয় উভয়ই উত্তম হইয়াছে।

সোমপ্রকাশ অতি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। অনুকূল রিভিউ পেয়ে সকলেই আনন্দে মেতে ওঠেন। ন্যাশনাল পেপারেও ভাল রিভিউ বেরিয়েছে। সমর্থন পেয়ে উৎসাহিত কলাকুশলীরা জোড়াসাঁকো রঙ্গমঞ্চে ঘন ঘন প্রায় নবার নবনাটক মঞ্চস্থ করলেন।

ফাল্গুনমাস নাগাদ সত্যেন তার কর্মস্থল আমেদাবাদে ফিরে যাওয়ার সময় জ্যোতিকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন। জ্যোতি না থাকায় কলাকুশলীদের উৎসাহ কমে গেল, নবনাটকও বন্ধ হয়ে গেল।

জ্যোতি এই প্রথম ঠাকুরবাড়ির অভিজাত বনেদিয়ানার বাইরে বেরিয়ে জ্ঞানদার গৃহস্থালির মাঝখানে বিশ্বপৃথিবীর আর একটি সংসার খুঁজে পেলেন। সত্যেন কাজে বেরিয়ে গেলে দুজনের অখণ্ড অবসর, দুজনেই অসীম আগ্রহে নতুন নতুন বই পড়েন, গান শোনেন। শেকসপিয়রের নাটক পড়ে উত্তেজিত আলোচনা করেন। সিমবেলাইন নাটকটি জ্যোতিকে এত নাড়া দিল যে তিনি শুরু করে দিলেন বাংলা তর্জমা। কিছুটা এগিয়ে জ্যোতির মনে হল মাছি মারা কেরানির মতো অনুবাদ না করে তিনি এর বঙ্গীকরণ করবেন। জ্ঞানদাকে পড়ে শোনাতে শোনাতে জ্যোতি বললেন, নাটকটির নাম কী দেওয়া যায় মেজোবউঠান?

জ্ঞানদা বললেন, আচ্ছা তোমার নাটকে নায়িকার নাম তো সুশীলা, তার নামেই নাম দাও না। নায়িকার বাবার নামে এখানে নাটক জমবে না।

জ্যোতি ভাবতে থাকেন, সুশীলা নামটি মন্দ নয়, কিন্তু আরও ভাল কী নাম হতে পারে? শেকসপিয়রের নাটকে রাজা সিমবেলাইনের মেয়ে ইমোজেন বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে পসথুমাস নামে এক নিচুশ্রেণির ছেলেকে বিয়ে করে। বাবার পছন্দের পাত্র ক্লোটন নানাভাবে ওদের জুটি ভেঙে ইমোজেনের মন জয় করার চেষ্টা করে। অনেক ষড়যন্ত্র, বিচ্ছেদ, সংকটের মধ্য দিয়ে শেষে ইমোজেন ও পসথুমাসের মিলন হয়, সিমবেলাইন তার ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু শেকসপিয়র তাঁর নাটকের নাম ইমোজেন না রেখে সিমবেলাইন কেন রাখলেন?

তাই বলে তুমিও কি নায়িকার বাবার নামে নাম দেবে। বরং নায়কের নামে হোক, জ্ঞানদা বলে ওঠেন। তোতামার তো সহজে কোনও কিছু পছন্দ হয় না নতুন ঠাকুরপো।

আচ্ছা মেজোবউঠান, সুশীলা-বীরসিংহ নাটক নামটা কীরকম হবে? জ্যোতি জিজ্ঞেস করেন।

হ্যাঁ, এবার বেশ বীরত্ব আর লালিত্যের মিলমিশ হয়েছে, এটাই ভাল নাম। নাটকের জন্য লোকের আগ্রহ বাড়বে।

আমেদাবাদে থাকতে থাকতেই তরতর করে নাটক এগিয়ে চলে। মার্চ মাস নাগাদ বই হয়েও বেরিয়ে যায়। সুশীলা-বীরসিংহ নাটকের পরতে পরতে মেজোবউঠানের ছোঁয়া অনুভব করেন জ্যোতি, তার উৎসাহ তরুণ নাট্যকারটিকে শস্যশ্যামলা করে তোলে। অবশ্য সত্যেন এই দুই স্বপ্নাতুর নাট্যমোদীকে প্রশ্রয় না দিলে কিছুই এগোত না। আমেদাবাদে সরকারি কাজকর্মের ফাঁকে সত্যেন নিয়মিত চিঠি লিখছিলেন জোড়াসাঁকোর গণেন্দ্রকে, অনেক কিছুর সঙ্গে জ্যোতির নাটকের বই প্রকাশ করার সমস্ত ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় নিয়েছিলেন। এক অর্থে ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে প্রগতিশীল পুরুষ সত্যেন্দ্রনাথ। স্ত্রীর শিক্ষা ও স্বাধীনতার বিষয়ে যেমন, ভাইদের প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রেও তিনিই ছিলেন অগ্রণী।

আমেদাবাদে এসে জ্যোতির বিকাশে যাতে বাধা না পড়ে সে ব্যাপারেও সত্যেন সতর্ক। তার মনে হল জ্যোতির মনে আনন্দ আনার জন্য সেতার শেখানো যেতে পারে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আবার কিছুদিন জ্যোতি ও জ্ঞানদার জন্য মাস্টার রেখে ফরাসি শেখানোর বন্দোবস্ত হল। আমেদাবাদে থাকতে দু-একটি পারসি ও মরাঠি পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছেন ওঁরা। বোম্বাইতে সত্যেনের পুরনো বন্ধু আত্মারাম পাণ্ডুরঙের বাড়িতে দল বেঁধে যাওয়া হল একবার।

পাণ্ডুরঙের মেয়ে আন্না তড়খড়ের জন্মদিন উপলক্ষে সেদিন তাঁদের। বাড়িতে বিরাট পার্টি। জ্যোতিকে সেই পার্টিতে ছেড়ে দিয়ে মজা দেখছিলেন জ্ঞানদা। সাহেবমেমরা তো আছেনই, তার সঙ্গে আছেন কিছু অভিজাত ভারতীয় পরিবার। পারসি ও মরাঠি সে-সব মেয়েরা কী ঝকঝকে, সপ্রতিভ। বাঙালি নারীসুলভ লজ্জায় জড়সড় নয় একেবারেই। যার জন্মদিন সেই আন্নার রূপে ও স্মার্টনেসে সবাই মুগ্ধ। চটপটে চৌখস মেধাবিনী মেয়েটি বয়সে বালিকা কিন্তু হাবভাবে সাজসজ্জায় যেন রাইকিশোরী। আশেপাশে অনেক প্রীতিপ্রার্থী কিশোর ঘুরঘুর করলেও নবাগত জ্যোতিকেই তাঁর পছন্দ হল।

আন্না এগিয়ে এসে জ্যোতির দিকে হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে হাত বাড়িতে দিলেন। তুমি মি. ঠাকুর জুনিয়র? আমার নাম আন্না।

জ্যোতি হাত মেলালেও আন্নার সহজ হাবভাবে একটু অবাক হন। তার সপ্রতিভ আচরণে মুগ্ধ হলেও মনে মনে বাঙালি মেয়েদের সঙ্গে তুলনা করতে থাকেন। জ্যোতির তরুণ হৃদয় যেন লাজুক বাঙালি কন্যাদের দিকেই ঝুঁকে আছে।

জ্যোতি আন্নার হাতের লাল পানীয়র গ্লাসের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, তুমি কী পানীয় নিয়েছ?

আন্না কটাক্ষ করে বলেন, কেন, রেড ওয়াইন। তুমি চেনো না? তোমার হাত খালি কেন, চলো একটা ড্রিঙ্ক নাও।

ঠাকুরবংশে সবরকম নেশাই চলে কিন্তু দেবেন ঠাকুরের ছেলেরা শুদ্ধ জীবনযাপনে বিশ্বাসী, মদে নয় তারা কাব্যপাঠের নেশায় মাতাল। জ্যোতির দ্বিধা দুর থেকে লক্ষ করে এগিয়ে আসেন জ্ঞানদা, জ্যোতির হাত ধরে বলেন, সত্যি তো পার্টিতে এসে ড্রিঙ্ক নিচ্ছ না কেন নতুন, আন্না তো ঠিকই বলছে, চলো। তাঁকে টেনে সেলারের দিকে নিয়ে যান জ্ঞানদা।

আন্নাও সঙ্গে সঙ্গে আসেন। স্কচ নেবে, না ওয়াইন? জিজ্ঞেস করেন জ্যোতিকে। জ্ঞানদার দিকে প্রশ্নাকুল চোখে তাকান জ্যোতিরিন্দ্র, তুমি বলো মেজোবউঠান কী নেব?

স্কচ, জ্ঞানদা বলেন।

আন্না তাকে বাধা দিয়ে বলেন, মি. ঠাকুর জুনিয়র, তুমি প্রথমবার খাচ্ছ তো রেড ওয়াইন টেস্ট করো। আমার মতো।

এই সময় ড্রিঙ্ক নিতে এলেন মি. জন ম্যাকগ্রেগর, সত্যেনের বন্ধু। জ্ঞানদার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বলেন, ওঃ লুক! হাউ বিউটিফুল ইউ আর লুকিং টুনাইট!

লজ্জায় লাল হয়ে জ্ঞানদা বলেন, মি. ম্যাকগ্রেগর, প্লিজ ডোন্ট মেক মি এমব্যারাসড। দেয়ার আর সো মেনি বিউটিজ অ্যারাউন্ড।

মিসেস টেগোর, টুমি সবার থেকে সুন্দর। টোমার ড্রেস সুন্দর, টোমার বডি সুন্দর, টোমার কথা সুন্দর। ইউ আর দি এপিটোম অফ ইন্ডিয়ান বিউটি। চলো ডান্স করি। টুমি আমার পার্টনার হবে প্লিইইইইজ। ম্যাক কাতর অনুনয় করেন জ্ঞানদার হাত ধরে।

জ্যোতি প্রথমে অবাক হচ্ছিলেন পরে তার রাগ হতে থাকে। ঠাকুরবাড়ির বউয়ের হাত ধরে একজন উটকো সাহেব কেন টানাটানি করবে? মেজদাদা দূর থেকে দেখলেও যেন দেখছেন না। হাসছেন, যেন খুব মজার কিছু ঘটছে। তিনি জোর করে জ্ঞানদার হাতে ধরা ম্যাকের হাত ছাড়িয়ে দেন। রাগতস্বরে বলেন, ডোন্ট ডিসটার্ব হার, লিভ হার অ্যালোন।

হাউ ডেয়ার ইউ? ম্যাক জ্যোতিকে চেনেন না, তেড়ে যান তার দিকে। জ্ঞানদার দিকে তাকিয়ে বলেন, লুক লেডি, ইফ ইউ ডোন্ট লাইক মি প্লিজ টেল মি ডিরেক্টলি, বাট কনট্রোল ইয়োর বডিগার্ড।

পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সত্যেন এগিয়ে আসেন, জ্যোতিকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ম্যাক, হোয়াই আর ইউ সো টেনস? মাই ইয়াং ব্রাদার ইজ আ বিট পজেসিভ আবাউট হিজ বৌঠান। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।

উত্তেজিত জ্যোতিকে টেনে সরিয়ে এনে সত্যেন বললেন, ম্যাক যদি জ্ঞানদার সঙ্গে ডান্স করতে চায় তাতে কী মহাভারত অশুদ্ধ হল? নারীপুরুষ একসঙ্গে নাচা তো বিলিতি কালচারের পার্ট, জ্ঞানদা এখনও সহজ হতে পারছে না কিন্তু হয়ে যাবে। তোকেও শিখতে হবে। এজন্যই তো এ-সব পার্টিতে আসা। তুই কেন কুয়োর ব্যাঙের মতো আচরণ করছিস?

জ্যোতি ক্ষুব্ধ মনে অন্যদিকে সরে যান। বিলিতি কালচারের সবকিছুই আমাদের নকল করতে হবে কেন? মেজোবউঠানের ইচ্ছে না হলেও ওই সাহেবটার সঙ্গে নাচতে বাধ্য করবেন মেজদাদা?

গৃহস্বামী পাণ্ডুরং ম্যাকগ্রেগরের সঙ্গে রঙ্গতামাশা করে হালকা করে দিতে চান ব্যাপারটা। হলঘরের কোনায় রাখা সোফায় আন্না, জ্ঞানদা ও ম্যাকগ্রেগরকে নিয়ে আড্ডা দিতে বসেন। শ্ৰীমতী পাণ্ডুরং অচিরেই তাদের দলে যোগ দিলেন। আজ তিনি কী সুন্দর পাথর বসানো কাশ্মীরি সিল্ক পরেছেন, গলায় সাতনরি মুক্তোর হার। প্রতিবারের মতো এদিনও তাকে দেখে চমৎকৃত হন জ্ঞানদা। রুচি ও সম্পদের কী আশ্চর্য মিলন।

প্রথমবার বোম্বাই এসে এঁদের আতিথ্যেই ছিলেন জ্ঞানদা। এই মরাঠি পরিবারের মেয়েদের সাজগোজ, শাড়ি পরার ধরন জ্ঞানদাকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল। এখানেই তার আধুনিকতার পাঠশালা। পারঙের স্ত্রী শিক্ষিত কেতাদুরস্ত মহিলা, সাহেবমেম নারীপুরুষ সবার সঙ্গেই মেলামেশায় স্বচ্ছন্দ। ওঁদের তিন মেয়ে আন্না দুর্গা ও মানিক, ইংরেজি কেতায় বড় হচ্ছে। বোম্বাই অঞ্চলে সমাজ সংস্কারের ব্যাপারে এই পরিবার খুবই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। শ্রীমতী পাণ্ডুরঙের বাড়িতে দুঃসাহসী সমাজ সংস্কারক পণ্ডিতা রমাবাইয়েরও নিয়মিত যাতায়াত।

এঁদের সান্নিধ্যে জ্ঞানদা সবসময়েই উজ্জীবিত হন। কিন্তু এখন ওঁদের সঙ্গে কথাবার্তার মধ্যেও তার দুর্ভাবনা হচ্ছে। জ্যোতিটা বোকা, কেন যে এত মাথা গরম করে ফেলল! সত্যেন পরে নিশ্চয় জ্ঞানদাকেই বকবেন।

এভাবেই ঠাকুরবাড়ির বৃহৎ সংসারের বাইরে শিল্প সংস্কৃতি আত্মীয়তার একটি অন্তরঙ্গ ত্রিকোণ রচিত হচ্ছে সতেরো বছরের জ্ঞানদা, আঠারোর জ্যোতিরিন্দ্র আর তাদের অভিভাবক সত্যেনের মধ্যে। আমেদাবাদে আরও কিছুদিন ইংরেজি সাহিত্য চর্চার পর জ্ঞানদার আগ্রহ জাগল সংস্কৃত কাব্যের প্রতি। ঠাকুরবাড়ির পাঠশালায় বাংলা ইংরেজি অনেক পড়া হলেও জ্যোতির সংস্কৃত পড়া হয়নি। জ্ঞানদার উৎসাহেই সংস্কৃত কাব্য ও নাটকপাঠ শুরু করলেন জ্যোতি। প্রতিদিন সন্ধেবেলা সত্যেন ঘরে ফিরলে শুরু হয় তিনজনের আসর। কখনও জ্যোতি কখনও সত্যেন অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ পাঠ করেন। পড়তে পড়তে শকুন্তলার অনুবাদ করতে ইচ্ছে হয় জ্যোতির।

এ-সবের মধ্যেই বাতের ব্যথায় একটু অসুস্থ হয়ে পড়লেন সত্যেন। একদিন বললেন, ব্যথাটা বাড়ছে, ভাবছি চিকিৎসার জন্য ছুটি নিয়ে কলকাতায় যাই একবার।

জ্ঞানদা উদ্বিগ্ন হন, পায়ের ব্যথা নিয়ে পনেরোদিন স্টিমারে থাকতে পারবে, কষ্ট হবে না?

সত্যেন হাসতে থাকেন, শোনো এবার আর অনেকদিন ধরে স্টিমারে যেতে হবে না। ১১ই অক্টোবর ১৮৬৭ বোম্বাই-কলকাতা রেলপথ খুলে গেছে। মাত্র পাঁচদিনেই পৌঁছে যাওয়া যাবে বোম্বাই থেকে কলকাতা।

রেল চালু হওয়ায় চারিদিকে মহা উৎসাহ হইচই। জ্ঞানদা আর জ্যোতিও উত্তেজিত নতুন অভিজ্ঞতার সম্ভাবনায়। তাদের উৎসাহের জোয়ারে ভেসে দু-এক দিনের মধ্যেই তিনটে রেলের টিকিট বুক করে ফেললেন সত্যেন। জ্ঞানদা ও জ্যোতিরিন্দ্রকে নিয়ে ফিরে এলেন জোড়াসাঁকোয়।

জোড়াসাঁকো কি পালটে গেল? নাকি ইতিমধ্যে স্বাধীনভাবে থাকতে অভ্যস্ত জ্ঞানদারই এ-বাড়িতে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হচ্ছে! তার স্বাধীন চলাফেরায় যেন প্রতিমুহূর্তে বেড়ি পরিয়ে দিতে চাইছে নানা অনুশাসন। সারদার সঙ্গেও খটাখটি লাগছে বারবার। তার ফলে সত্যেনের চিকিৎসাও ব্যাহত হচ্ছে, ঠিকমতো বিশ্রাম হচ্ছে না।

দেবেন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়ে এক মাসের জন্য আলাদা বাগান বাড়ি ভাড়া করে স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন সত্যেন। নিজের চিকিৎসার জন্যও এই নিরিবিলি পছন্দ হল তার। জ্যোতিও তাদের সঙ্গে এসে জড়ো হলেন। আমেদাবাদ ছাড়ার পর তিনজনের সাহিত্যবাসর যেখানে থেমে গেছিল আবার সেখান থেকেই যেন শুরু হয়ে গেল।

ঠাকুরবাড়িতেও সংস্কৃতি চর্চা থেমে নেই। নীপময়ী গান ও পড়াশোনার পাশাপাশি বাঁয়া তবলা, খোলকরতাল বাজানো শেখা শুরু করেছেন বেণীমাধববাবুর কাছে। হেমেন তাকে নিয়ম করে মিলটনের মহাকাব্য প্যারাডাইস লস্ট পড়াচ্ছেন। এর আগে পড়িয়েছেন কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম কাব্য। এমনকী দেশি ও বিদেশি শিক্ষকের কাছে ছবি আঁকাতেও হাত পাকাতে চেষ্টা করছেন হেমেনের আদরের পত্নী।

ওদিকে মেয়ে-বউদের পড়ানোর জন্য মেমশিক্ষিকারা আসছেন অন্তঃপুরে। কন্যা সৌদামিনীকে বেথুন স্কুলে পাঠিয়েছিলেন মহর্ষি, কিন্তু তারপরে আর কোনও মেয়ে-বউ স্কুলে যাননি। বাড়িতেই তাদের পড়াশোনার ওপর খুবই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জ্ঞানদা নিজেও সবুরান বিবির কাছে দীর্ঘদিন ইংরেজি শিখেছেন। শরৎকুমারীর অবশ্য রূপচর্চা ও রান্নার দিকে আগ্রহ বেশি। প্রতিদিন যত্ন করে ঘষে ঘষে সর-ময়দার রূপটান মেখে স্নান করেন তিনি। মাঝে মাঝে গায়ে মালিশ করেন স্বামীর বিলিতি মদের সঙ্গে ইতালিয়ান অলিভ অয়েলের মিশ্রণ। তার স্বামী যদুনাথের কাছে একবার ইয়ারবন্ধুরা ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের গায়ের রং জানতে চাইলে যদু রহস্য করে বলেছিলেন, সে রং দুধে আর মদে। পড়াশোনার পাশাপাশি চলত অন্যান্য শিক্ষা। রান্না, সেলাই, সেবা, শিশুপালন সবই নিয়মিত অনুশীলনের বিষয় বলে মানতেন অন্তঃপুরিকারা।

এই সুগৃহিণীপনার পাঠশালায় একেবারেই অনুপস্থিত থাকেন একমাত্র স্বর্ণকুমারী। তার এ-সব ভাল লাগে না। বিয়ের আগেও যেমন, পরেও তিনি ঘর বন্ধ করে সাহিত্যচর্চায় ব্যস্ত রেখেছেন নিজেকে। মগ্ন হয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস পড়েন আর স্বপ্ন দেখেন তিনিই হবেন বাংলার প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক। মাঝে মাঝে মালিনী এসে তার স্বপ্নকে উসকে দিয়ে যায় ইদানীং।

ইতিমধ্যে ঠাকুরবাড়িতে আরেকটি বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। নীপময়ীর বোন প্রফুল্লময়ী এসেছিল দিদির সঙ্গে দেখা করতে। তাকে দেখে খুব পছন্দ হয়ে গেল শরৎকুমারী ও স্বর্ণকুমারীর। তারা ভাই বীরেনের সঙ্গে বিয়ের উদ্যোগ নিলেন। বালিকাকে সাজিয়ে গুজিয়ে বীরেনের সামনে টেনে আনতে গেলে সে লজ্জায় পালিয়ে গেল। বন্ধু হরদেবের আর একটি মেয়ের সঙ্গে তার আর একটি ছেলের বিবাহ প্রস্তাব, দেবেন ঠাকুর খুশি হয়েই সম্মতি দিলেন। গা ভরতি গয়না ঝমঝমিয়ে বালিকাবধূ ঢুকলেন ঠাকুরদের প্রাসাদে। কিন্তু তাঁর বর বীরেন্দ্রর হাবভাবে একটু পাগলামির ছাপ। মহর্ষি ভেবেছিলেন বিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

এরপরেই ঠাকুরবাড়িতে শুরু হল জ্যোতির বিয়ের তোড়জোড়। কিন্তু সত্যেন ও জ্ঞানদার তাতে মত নেই। সত্যেন দেবেন্দ্রনাথকে বললেন, বাবামশায়, এত তাড়াতাড়ি জ্যোতির বিয়ের কথা কেন ভাবছেন? ওর বয়স এখনও উনিশ হয়নি। আমার ভাইদের মধ্যে ও সবচেয়ে প্রতিভাধর। ওকে যে আমি বিলেত পাঠিয়ে উচ্চশিক্ষা দিয়ে মেজেঘষে আনব ভাবছিলাম।

দেবেন ঠাকুর কিন্তু এখনই জ্যোতির বিবাহ দিতে চান। কতদিন আর মেজদা মেজোবউঠানের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াবে সে! বিবাহ না দিলে ছেলেরা দায়িত্বশীল হয় না। পরিবারে আশ্রিত কর্মচারী শ্যাম গাঙ্গুলির সেজোমেয়ের সঙ্গে জ্যোতির বিয়ের কথা উঠেছে। আট বছরের বালিকা মেয়েটি নিরক্ষর হলেও সুন্দরী। চেনাশোনার মধ্যেই এমন মেয়ে যখন পাওয়া গেছে, বিয়ে লাগিয়ে দিলেই হয়।

জ্ঞানদার একেবারেই পছন্দ নয় এই বয়সে দেবরের বিয়ের প্রস্তাব। এখন তার তৈরি হওয়ার সময়। জ্যোতি লিখবেন একের পর এক নাটক কবিতা প্রবন্ধ, জ্ঞানদা হবেন তার প্রেরণাদাত্রী আর পৃষ্ঠপোষক সত্যেন। এমন একটা জীবনের পরিকল্পনাই তো তাঁরা আমেদাবাদে বসে করেছিলেন। আর বিয়ে যদি করতেই হয়, জ্যোতির বউ হবে ইংরেজি শিক্ষিত, বিলেত ফেরত, কেতাদুরস্ত। জ্ঞানদা এমনই এক পাত্রী দেখে রেখেছেন জ্যোতির জন্য। সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তীর বিলেত ফেরত মেয়ে, ইংরেজি শিক্ষিত, শ্যামলা রং কিন্তু মুখশ্রী সুন্দর। মেয়েটি সেসময় কলকাতায় এসেছিল। তাকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একদিন নেমন্তন্ন করে আনালেন জ্ঞানদা। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ এই সম্বন্ধে সম্মতি দিলেন না। সত্যেনের বউ শিক্ষিত কেতাদুরস্ত হয়ে ইস্তক বড্ড স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছে, বাড়ির অন্যান্যদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে চায় না। এজন্য দেবেন্দ্র কিছুটা বিরক্ত। তিনি জ্ঞানদার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে শ্যাম গাঙ্গুলির মেয়ের সঙ্গেই কথা পাকা করতে নির্দেশ দিলেন।

সত্যেন আহমেদনগর থেকে জ্ঞানদাকে লিখলেন, আমি যদি নতুন হইতাম, তবে কখনই এ বিবাহে সম্মত হইত… [হইতাম] না। কোন্ হিসাবে যে এ কন্যা নতুনের উপযুক্ত হইয়াছে জানি না।

‘..আমি বলি নতুন যদি ইংলণ্ডে যাইবার সঙ্কল্প করেন তবে বিবাহ না করিয়া যাওয়াই ভাল।… আমার ভাগ্যে এমন স্ত্রী হইয়াছে, আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে এমন স্ত্রীরত্ন দুর্লভ।… জ্যোতি না দেখিয়া শুনিয়া একজনকে বিবাহ করিয়া ইংলণ্ডে ৪৫ বৎসরের জন্য চলিয়া যাক– সেখানকার সমাজে সঞ্চরণ করিয়া ও সুশিক্ষিত হইয়া ফিরিয়া আসিয়া এক অপরিচিত, হয়ত অশিক্ষিত স্ত্রী কি তাঁহার মনোনীত হইবে? দেখ যতজন বিলাতে গিয়াছে প্রায় সকলেরই ওই প্রকার দুর্দশা ঘটিয়াছে… আমাদের কথা স্বতন্ত্র’।

মহর্ষি অবশ্য সত্যেনের আশঙ্কাকে গুরুত্ব দিলেন না। সত্যেনের স্ত্রীকে যশোরের কোন অজগ্রাম থেকে আনা হয়েছিল? ঠাকুর পরিবারের বেশিরভাগ বউকেই প্রত্যন্ত পাড়াগাঁ থেকে বেছে আনা হয়েছে, তারপর মেজে ঘষে শিক্ষায় সংস্কৃতিতে তারাই হয়ে উঠেছেন বাংলার আদর্শ নারী। শ্যাম গাঙ্গুলির মেয়েটিকে তিনি কয়েকবার দেখেছেন, বেশ সুলক্ষণা। সত্যেনকে তিনি চিঠি লিখে জানিয়ে দিলেন, জ্যোতির বিবাহের জন্য একটি কন্যা পাওয়া গিয়াছে এইই ভাগ্য। একেত পিরালী বলিয়া ভিন্ন শ্রেণীর লোকেরা আমাদের সঙ্গে বিবাহেতে যোগ দিতে চাহে না, তাহাতে আবার ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান জন্য পিরালীরা আমাদিগকে ভয় করে। ভবিষ্যৎ তোমাদের হস্তে তোমাদের সময় এ সঙ্কীর্ণতা থাকিবে না।

হতাশ সত্যেন্দ্র স্ত্রীকে লিখে পাঠালেন, তবে নতুনের বিবাহের ধূম লাগিয়া গিয়াছে। হিতেন্দ্র ও নীতিন্দ্রের ভাত, তোমরা বেশ আমোদে আছ। নতুনের বিবাহ দেখিবার তোমার যে এত সাধ ছিল, তাহা পূর্ণ হইল। শ্যামবাবুর মেয়ে মনে করিয়া আমার কখনই মনে হয় না যে ভাল মেয়ে হইবে– কোন অংশেই জ্যোতির উপযুক্ত তাহাকে মনে হয় না। জ্যোতি এই বিবাহে কেমন করিয়া সম্মত হইল, এই আমার আশ্চর্য্য মনে হইতেছে। কিন্তু সত্যেন জ্ঞানদার অপছন্দে বিয়ে আটকে থাকল না।

২৩ আষাঢ়ের শুভলগ্নে সিঁদুরে রঙের চেলি ও গা-ভরতি জড়োয়া গয়না পরে কাদম্বরী ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করলেন। সাজের কী বাহার! গলায় চিক ও ঝিলদানা হার, হাতে চুড়ি, জড়োয়া কঙ্কণ ও বাজুবন্দ, কানে বীরবৌলি ও কানবালা, পায়ে নূপুর ও চুটকি, কোমরে চাবি ও গোট, মাথায় জড়োয়া সিঁথি ও টিকলি। এ-বাড়ির রীতি অনুযায়ী অধিকাংশ গয়নাই দেবেন্দ্র যৌতুক হিসেবে দিয়েছেন। জ্যোতির বয়স উনিশ, কাদম্বরীর নয় বছর। জ্ঞানদার আশঙ্কা ছিল অশিক্ষিত বালিকাকে পছন্দ হবে না জ্যোতির। সে ভয় মিথ্যে করে নববধূকে দেখে জ্যোতিরিন্দ্রর রোমান্টিক মন দুলে উঠল। এই শ্যামল বালিকাকে তিনি নিজের মতো করে গড়েপিটে নেবেন। মেজোবউঠান যশোর থেকে এসে যদি আভিজাত্যের শিরোমণি হতে পারেন, নতুনবউও নিশ্চয় পারবে। আর নববধূকে দেখে তার চেয়ে দুবছরের ছোট দেওর রবির মনে হল রূপকথার রাজকন্যে এসেছেন বাড়িতে। কী যেন অজানা পুলকে শিউরে ওঠে বালকের মন।

বিয়ের সময় দেবেন্দ্র হিমালয়ে ছিলেন বলে সব দায়দায়িত্ব দিয়েছেন ভাইপো গণেন্দ্রকে। সত্যেন বা হেমেনকে এই দায়িত্ব না দেওয়ার একটা কারণ নিশ্চয় এ-বিয়ে সম্বন্ধে তাদের বিরূপ মনোভাব। বালক বালিকাদের জন্য নতুন জামাকাপড়, ঘটক বিদায়, কুলীন বিদায়, অধ্যাপক বিদায় সবকিছু সামলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন গণেন্দ্র। বিলিতি দোকানের জুতো কেনা হল। বিয়েতে গরিবদের জন্য ঢালাও ভোজের ব্যবস্থা নির্দেশ করলেন মহর্ষি। এবার অবশ্য ব্রাহ্মবিয়েতে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের উপস্থিতি দেখা গেল। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় সে-খবরটি বিশেষভাবে উল্লেখ করার নির্দেশ দিলেন দেবেন্দ্রনাথ।

আনন্দর পাশাপাশি একটি বেদনার সূত্রপাত হচ্ছিলঠাকুরবাড়িতে। বীরেনের মাথার দোষ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছল। তাকে পারিবারিক আয়ব্যয়ের হিসেব রাখার ভার দিয়েছিলেন বাবামশায়, কিন্তু সে-কাজে গাফিলতি হতে থাকল। ক্রমে তিনি খাওয়া ছেড়ে দিলেন। তার নিরাময়ের আশায় বোলপুরে নিয়ে গেলেন স্ত্রী প্রফুল্লময়ী। নীপময়ী, ব্রজসুন্দরী, কাদম্বরীরাও তাদের সঙ্গী হলেন। কিন্তু সেখানে গিয়েও তার খাওয়াদাওয়ার কোনও উন্নতি হল না। এক চামচ ভাত আর একটি পটলপোড়া খেয়েই থালা সরিয়ে দিতেন এক-একদিন। কলকাতা ফিরে এসে সাহেব ডাক্তার দেখিয়েও অসুখ সারল না।

এইসময় থেকেই রবির কবিতা নিয়ে আঁকিবুকি শুরু। সুযোগ পেলে পাঠ্যবইয়ের কবিতা মুখস্থ শুনিয়ে মাকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করতে লাগলেন বালক। ভেতরমহলে ছলছুতোয় মায়ের কাছে গেলে কিশোরী নতুনবউঠানের সঙ্গেও মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যায় সমবয়সি দেওরটির। চোখে চোখে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে যেন। বুক কেঁপে ওঠে অজানা রোমাঞ্চে আর রবির গোপন খাতা ভরে ওঠে কবিতায় কবিতায়। নতুনবউঠানের ঘরের কাঁচের আলমারিতে বিচিত্র চিনেমাটির খেলনার ঝলক চোখে পড়ে। ওই রহস্যময়ীর সঙ্গে গল্প করতে বড় ইচ্ছে করে রবির। কিন্তু কথা বলতে গেলেই বর্ণদিদি কেন যে তেড়ে আসে! মেয়েদের সৌভাগ্যকে একটু ঈর্ষাও হয়, আজকাল একসঙ্গে গুরুমশায়ের কাছে পাঠ নিতে বসেন তাঁরা। কিন্তু পড়া শেষ হলে রবি, সোম ও সত্যকে যখন ইস্কুলের কয়েদখানায় পাঠানো হয়, বর্ণ বেণী দুলিয়ে এবং নতুনবউঠান ঘোমটা টেনে অন্দরের স্বর্গরাজ্যে চলে যান। এই মনের দুঃখ কাকেই বা জানাবেন রবি!

নতুনবউকে মেজেঘষে ভোলার দায়িত্ব পেলেন নীপময়ী। তাঁর বাপের বাড়ির নাম মাতঙ্গিনী পালটে দিয়ে বিয়ের পরে ডাকা হচ্ছে কাদম্বরী বলে। নীপময়ী এবার তার জন্য বর্ণপরিচয় ও ধারাপাত কিনে আনালেন। পড়াশোনায় বেশ মেধার পরিচয় দিচ্ছেন নতুনবউ। আবার ঘরের কাজের শিক্ষাও চলছে পুরোদমে।

রবি, সোম ও সত্যের উপনয়নে কাদম্বরী ওদের অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়লেন। এই তিন বালকের বড় হওয়ার সময় হল। ব্রাহ্ম হলেও পইতে ধারণের সময় মাথা ন্যাড়া করে, কানে সোনার বীরবৌলি পরে, হাতে বিদণ্ড নিয়ে গায়ত্রীমন্ত্রে দীক্ষা নিলেন তাঁরা। ভিক্ষাপাত্র নিয়ে মা, বাবামশায় ও গুরুজনদের কাছে ভিক্ষা নিয়ে আচার্য আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশকে দান করা হল। সারাদিন উপোস করে সন্ধ্যায় গায়ত্ৰীমন্ত্র জপের পর যখন নতুনবউঠানের বেঁধে দেওয়া হবিষ্যান্ন মুখে দিলেন, রবির মনে হল অমৃত খাচ্ছেন। প্রথমবার বাড়ির অন্তঃপুরিকার হাতের রান্না খেয়ে স্বাদেগন্ধে মুগ্ধ বালকদের মন কাদম্বরীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। সমবয়সি কাদম্বরীকে যেন বালকদের চেয়ে অনেক পরিণত মনে হয়। অন্তঃপুরের শিক্ষায় এবং সপ্রতিভতায় তিনি। শুধু বালকদেরই নয়, ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরিকাদেরও মন জয় করে নিচ্ছেন। নবীন ব্রহ্মচারীদের তিনদিনের হবিষ্যি রান্নার ভার কাঁধে তুলে নিলেন তিনি।

রূপা এখন সারদার খুব নেওটা হয়েছে। রোজ দুপুরে এসে হাত-পা টিপে দেয়, পাকা চুল তুলে দেয় আর পুটুর পুটুর করে আবোল-তাবোল বকে যায়। ওর নরম আঙুলের ছোঁয়ায় বেশ ঘুম জড়িয়ে আসে সারদার চোখে।

একদিন বললেন, রূপা, তুই কি এমন মুখ হয়ে থাকবি? দাঁড়া তোকে লেখাপড়া শিখতে পাঠাব বৈঠকখানায়। বর্ণদিদি, রবিদাদা, নতুন বউঠানের সঙ্গে বসে বসে পড়া শিখবি মাস্টারমশায়ের কাছে।

রূপা আনন্দে নেচে ওঠে কত্তামায়ের কথা শুনে। তার পায়ে হাত দিয়ে বলে, তোমাকে কত্তামা ডাকতে আমার ভাল লাগে না। বন্নোদিদির মতো মা বলে ডাকলে তুমি কি রাগ করবে?

এই অনাথা বালিকার সঙ্গে কী এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন সারদা, ভাবলে নিজেরই আশ্চর্য লাগে। রূপা তার যত কাছে এসে গেছে, নিজের গর্ভের সন্তানদের কোনওদিন তত কাছে ঘেঁষতে দেননি। ছোট থেকে বুকের দুধ না-দেওয়ায় বাচ্চাদের সঙ্গে কোনও শরীরী বন্ধন গড়ে ওঠেনি। এই মেয়েটি যখন গায়ে হাত দিয়ে সেবা করে, তা ঠিক যেন দাসীর মতো নয়, বরং কন্যার মতো। আবার মুশকিল হচ্ছে এর হাবভাবে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের ঘষামাজা নেই, গ্রাম্যটানের বুলিতে বারবার মনে করিয়ে দেয় ও আলাদা। সারদা ঠিক করলেন ওর গায়ে ঠাকুরবাড়ির আলোর ছোঁয়া লাগিয়ে দেখবেন কী হয়।

শোন, আজ থেকে তোর নাম দিলাম রূপকুমারী। আমার সুকুমারী, শরৎকুমারী, স্বর্ণকুমারী, বর্ণকুমারীদের পাশে বেশ মানাবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে এই নাম বলবি, মাস্টারমশায়কেও।

কিন্তু সবাই যে রূপা বলেই ডাকবে? বালিকা খুশিতে অধীর হয়ে জানতে চায়।

সে ডাকুক না, রূপকুমারীর ডাকনাম তো রূপা হতেই পারে। সারদা আশ্বস্ত করলেন পুষ্যিকন্যাকে। স্বর্ণ বর্ণ তো ওকে এখনই মজা করে মায়ের পুষ্যি বলে।

কিন্তু তোর দস্যিপনা আর চলবে না। আমার পুয্যি হয়ে থাকতে হলে আমার মেয়েদের মতো ভদ্রসভ্য শিক্ষিত হতে হবে। ঘরের কাজ, রান্নাবান্না শিখতে হবে, উড়ে উড়ে বেড়ানো বন্ধ।

রূপাকে স্নেহ করলেও সারদা জানেন ওর মধ্যে একটা অবাধ্য ঘোড়ার মতো বুনো স্বভাব আছে, আদর নেবে কিন্তু সহজে পোষ মানবে না। ছোট থেকে কুটুম মহলে থেকে থেকে সংসারের কল্যাণকর নিয়মগুলো কিছুই শেখেনি।

রূপার ঝুঁটি ধরে নেড়ে আবার বলেন সারদা, বুঝেছিস, তোকে ভাল মেয়ে হতে হবে!

ভাল মেয়েরা কী করে মা? রূপার প্রশ্নটি সারল্য না দুষ্টুমি ঠিক বুঝতে পারেন না সারদাসুন্দরী। এ মেয়েটা একটু অন্যরকম, মনে মনে তারও জেদ চাপে, বেতো ঘোড়াকে সোজা করবেনই, তবে তার নাম সারদাসুন্দরী।

ভাল মেয়েরা স্বর্ণ বৰ্ণর মতো, নতুন বউয়ের মতো মায়ের কথা শুনে চলে। সব কাজ ধীরে ধীরে করে। সবাইকে সেবা যত্ন করতে শেখে আবার লেখাপড়াও শেখে। যাকে বলে, রূপে লক্ষ্মী আর গুণে সরস্বতী। শুনিসনি, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে?

রূপার বয়স একটু বেড়েছে, সারদার প্রশ্রয়ে সাহসও বেড়েছে। সে বলে, তা কেন হবে মা। মেয়েরাই শুধু খেটে মরবে কেন? কেন ঘরে বন্দি হয়ে থাকবে? আমার তো ইচ্ছে করে ডানা মেলে পাখির মতো উড়ে যাই। বেটাছেলেদের গায়ে যেন ডানা লাগানো আছে আর আমরা বিটিরা সব ডানাছেঁড়া।

সারদা ভাবেন, তার পেটের মেয়ে হলে এ-কথা বলত না কখনও। বলেন, দাঁড়া, তোকে কী করে শিক্ষে দিতে হয় আমি দেখছি।

পরের দিন থেকেই পুরোদমে শুরু হয়ে গেল রূপা থেকে রূপকুমারী হয়ে ওঠার ক্লাস, শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি তৈরি করেই ছাড়বেন সারদা।

বর্ণকুমারী কিন্তু সহজে মেনে নিতে পারেন না মায়ের পুষ্যিটিকে। সে বেশ মায়ের পাশ ঘেঁষে ঘেঁষে বসছে রোজ দুপুরে, আবার পাঠশালায় একসঙ্গে পড়া শিখতে আসছে। বিরক্ত বর্ণ ফিসফিস করে রবিকে বলেন, দেখ মেয়েটা কেমন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।

রবির এ-সব নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই। তাঁর দুশ্চিন্তা যে পড়া শেষ হলেই ইস্কুলে যেতে হবে। ও জায়গাটা তাঁর মোটেই পছন্দ নয়। বর্ণদিদির আর চিন্তা কী? তিনি তো পড়ার পর অন্দরমহলের আরামে ঢুকে পড়বেন। নতুনবউঠানের সঙ্গে গল্পের লোভে রবি দু-একদিন ওদের পিছু পিছু ঢুকতে চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু নিষ্ঠুর বর্ণদিদির তাড়নায় ফিরে আসতে হয়েছে চাকরমহলে। সুতরাং রবি ঠিক করে নেন, তিনি কিছুতেই বর্ণদিদির পক্ষ নেবেন না। বরং রূপার সঙ্গে বন্ধু পাতানো যায় কারণ সে মায়ের কোলঘেঁষা। আহা রূপার মতো ভাগ্যও যদি তার হত!

রবি বললেন, ও তো পড়া শিখতে এসেছে, তুমি অমন করছ কেন? মা পাঠিয়েছেন বলেই তো এসেছে। আর তুমি পারলে সবাই পড়তে পারে।

রূপা বোঝে তাকে সহজে কেউ জায়গা ছেড়ে দেবে না, লড়ে জায়গা নিতে হবে। তবে এরা সব আলালের ঘরের দুলাল, তার সঙ্গে লড়াই করে জিততে পারবে না।

বর্ণকুমারী তাকে ঠেলা দিলে সেও পালটি ঠেলা মারে। বর্ণ চোখ পাকিয়ে তাকায়, সেও তাকায়। রবি ফিকফিক করে হাসতে থাকেন মজা পেয়ে।

মাস্টারমশায় এলে কাদম্বরীও ছাত্রদলে যোগ দিলেন। আজকের পাঠ মেঘনাদবধ কাব্য। সেই কঠিন পাঠ্য মাস্টারমশায়ের ততোধিক কঠিন পাঠে ছাত্রদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগল।

কাদম্বরীর হাতে রবি একটি চিরকুট গুঁজে দিলেন, তাতে লেখা– কী বুঝিতেছ?

তৎক্ষণাৎ চিরকুটের উত্তরও পেয়ে গেলেন রবি, বুঝিলাম তুমি রাবণ আর আমি অশোকবনে বন্দিনী সীতা। রামচন্দ্র কবে উদ্ধার করিবেন সেই অপেক্ষায় আছি।

কিশোর রবির মনে দাগা লাগে, নতুনবউঠান কেন তাকেই রাবণ ভাবলেন? রবির মধ্যে রামচন্দ্র হওয়ার কোনও যোগ্যতাই কি তাঁর চোখে পড়ল না!

অভিমানী রবি পাঠে মন দিয়ে কাদম্বরীকে উপেক্ষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু রহস্যময়ীর ঠোঁটের মৃদু হাস্য সেই মনঃসংযোগে বিলক্ষণ বিঘ্ন ঘটাতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *