১৪. নিবারণের নির্বাণ

পাণ্ডব গোয়েন্দা – ১৪ – চতুর্দশ অভিযাননিবারণের নির্বাণ / ষষ্টীপদ চট্টোপাধ্যায়

অনেকদিন ধরে যাব যাব করেও যাওয়াটা কিছুতেই আর হয়ে উঠছিল না। এমন সময় হঠাৎ একদিন চিনু মাসির চিঠি এল। চিঠিতে তিনি বাবলুকে একবার অতি অবশ্য দুমকাতে যেতে লিখেছেন।

পাণ্ডব গোয়েন্দাদের কাছে এই রকমের একটা আমন্ত্রণ সত্যিই লোভনীয়। বাবলু সেই চিঠির কথাটা সঙ্গে সঙ্গে বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছুকে জানিয়ে দিল। কিন্তু মুশকিল হল পঞ্চকে নিয়ে। পঞ্চুকে কীভাবে নিয়ে যাওয়া যায়? হাওড়ার দিক থেকে দুমকায় যাওয়ার পথ অনেকগুলো। তবে সচরাচর লোকে সাঁইথিয়া অথবা রামপুরহাটে ট্রেন থেকে নেমে মোটর বাসে দুমকায় যায়। সাঁইথিয়ার বাস মাসাঞ্জোরের ওপর দিয়ে পাতাবেড়ে হয়ে দুমকা যায়। আর রামপুরহাটের বাস পাহাড় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাতাবেড়ে ছুয়ে দুমকায় আসে। কিন্তু এই দুই পথেই বাসের ভিড় এত বেশি হয় যে তাতে আর যাই হোক, পঞ্চুকে নিয়ে যাওয়া যায় না। তা ছাড়া সাঁইথিয়া অথবা রামপুরহাট পর্যন্ত ট্রেনে যাওয়ার পর যদি ওখানকার বাসওয়ালারা ওদের বাসে না নিতে চায় তখন কী হবে? অথচ পঞ্চুকে বাদ দিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, সেও যেন এক কল্পনাতীত ব্যাপার।

অতএব কী করা যায় না যায়, সে নিয়ে একটা জোর আলোচনা বসল ওদের। মিত্তিরদের বাগানে ওরা গোল হয়ে বসেছে। আর পঞ্চু ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

বাবলু বলল, “এই ব্যাপারে আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।”

বিলু বলল, “কী রকম?”

“এখানে আসার সময় হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপন নজরে পড়ল। বিজ্ঞাপনটা দিয়েছে আমাদের পাড়ার ‘বোকাদা অ্যান্ড কম্পাণি।’ মাত্র পঁচিশ টাকায় বোলপুর, বক্রেশ্বর, মাসাঞ্জোর, তারাপীঠ ঘুরিযে আনবে রিজার্ভ বাসে। খাওয়া খরচ আলাদা। তা আমরাও যদি ওই বাসে যাই, তা হলে মাসাঞ্জোর পর্যন্ত গিয়ে ওখান থেকে কোনও লরি ম্যানেজ করে অথবা মোটর নিয়ে দুমকায় চলে যেতে পারব।”

ভোম্বল বলল, “দি আইডিয়া। ঠিক বলেছিস রে বাবলু।”

বাচ্চু বলল, “কিন্তু অন্যান্য যাত্রীরা যদি কেউ আপত্তি করে?”

বিচ্ছু বলল, “কেন করবে? সবাই তো আমাদের পাড়ার লোক এবং সবাই আমাদের চেনে।”

বাবলু বলল, “তা ছাড়া পঞ্চুকে আমি বাসের মাথায় উঠিয়ে দেব। কাজেই কারও কোনও অসুবিধেও হবে না, বলারও কিছু থাকবে না।”

বিলু বলল, “চমৎকার আইডিয়া। তা হলে এখন সর্বাগ্রে বোকাদার কাছেই যাই চল।”

বাবলু বলল, “চল।”

পঞ্চু আনন্দে একবার লাফিয়ে ডেকে উঠল, “ভৌ-ভৌ ভৌ।”

একটা গাধার মুখের মধ্যে যেটুকু সৌন্দর্য আছে, বাবলুদের পাড়ার বোকাদার মুখে সেটুকুও বুঝি নেই। আলকাতরা দিয়ে বার্নিশ করা রোগা পাতলা চল্লিশ বছরের কোনও মানুষের দেহে আস্ত একটা ঘোড়ার মুখ কেটে বসিয়ে দিলে যা হয় বোকাদা তাই। খাকি রঙের একটা ময়লা প্যান্টের ওপর ছক্কা-পাঞ্জা মার্কা একটা হাওয়াই শার্ট পরে বোকাদা তার ফাটা কাঁসার মতো গলায় মুখের কাছে চোঙ ধরে চেঁচাচ্ছিল, আর মাত্র একদিন। মাত্র পঁচিশ টাকায় বোলপুর, বক্রেশ্বর, মাসাঞ্জোর, তারাপীঠ। হেলায় হারাবেন না। সুবর্ণ সুযোগ। উদ্যোক্তা—“বোকাদা অ্যান্ড কোম্পানি।”

বোকাদাকে দেখলেই ভোম্বলটা ফিক করে হেসে ফেলে। বাবলু তাই আগে-ভাগেই সাবধান করে দিল ভোম্বলকে, “মুখে চাপা দিয়ে থাকবি ভোম্বল। হেসে ফেললেই মাটি। বোকাদা রেগে গেলে কিন্তু আমাদের পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যাবে।”

ভোম্বল বলল, “আমি ভাই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকব।”

বিলু বলল, “তার চেয়ে আমি বলি কী, তোরা একটু তফাতে থাকবি। বাবলু আর আমি গিয়ে ম্যানেজ করব বোকাদাকে ৷ ”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “সেই ভাল। না হলে আমরাও হেসে ফেলব কোন সময়।”

যাই হোক। বাবলু, বিলু আর পঞ্চু বোকাদার সামনে গিয়ে দাড়াতেই বোকাদা উৎসাহিত হয়ে মুখ থেকে চোঙ নামিয়ে বলল, “বাড়ির কেউ যাবে নাকি রে?”

বাবলু বলল, “না বোকাদা। বাড়ির কেউ যাবে না। আমাদেরই হঠাৎ দুমকায় যাবার দরকার হয়ে পড়েছে। তুমি যদি তোমার বাসে আমাদের মাসাঞ্জোর পর্যন্ত নিয়ে যাও, তা হলে খুবই ভাল হয়। কেন না, আমাদের সঙ্গে পঞ্চুও যাবে তো। ওকে নিয়ে অন্য বাসে যাওয়া মুশকিল।”

পঞ্চুকে দেখেই লাফিয়ে উঠল বোকাদা, “ওরে বাবা। ওসব কুকুর-টুকুর নিয়ে আমি যেতে পারব না। তা ছাড়া শুধু মাসাঞ্জোর অবদি কোনও প্যাসেঞ্জার আমি নেব না। আমার অসুবিধে আছে।”

বাবলু বলল, “কীসের অসুবিধে শুনি? আমরা পঁচিশ টাকা হিসেবে পুরো ভাড়াটাই তোমাকে দেব। এমনকী পঞ্চুর জন্যও ভাড়া পাবে। তাতেও তোমার অসুবিধে কী?”

ঘোড়া যে হাসতে পারে তা দেখতে গেলে বোকাদাকে একবার দেখতেই হবে। বোকাদার সেই ঘোড়ামুখে কী চমৎকার হাসি ফুটে উঠল তখন। বলল, “সত্যি!”

“সত্যি না তো কি মিথ্যে? আমরা পাঁচজন, পঞ্চুকে নিয়ে একজন। মোট ছ’ জন। ছটা টিকিট আমাদের দাও।”

বোকাদা সঙ্গে সঙ্গে ছটা টিকিট দিয়ে দিল বাবলুকে। বাবলু বলল, “একটু পরে বাড়িতে গিয়ে টাকাটা তুমি নিয়ে এসো। কেমন?”

বোকাদা বলল, “সে আমি সময়মতো নিয়ে নেবখন। আর মাত্র দুটো টিকিট আছে। বেচতে পারলেই ব্যস।”

বাবলুরা টিকিট পেয়ে মনের আনন্দে ঘরে গেল।

রাতের অন্ধকারে বাস ছুটে চলেছে। বাসের মাথায় দুনিয়ার মালপত্তর চাপিয়ে পঞ্চুকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে সেখানে। আর ভেতরে সিটে বসে আছে বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু এবং অন্যান্য প্রতিবেশীরা। বাবলুদের ঠিক সামনের সিটেই বসেছিল লাল ফুলপ্যান্ট ও হলুদ গেঞ্জি পরা এক সুবেশ তরুণী। মেমেদের মতো বব করা চুল আর খুব ফরসা গায়ের রং বাবলুরা তাকে কখনও দেখেনি। তরুণী একমনে একটি হিন্দি পকেটবুক পড়ে যাচ্ছিল।

বাবলু তার কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বলল, “আচ্ছা দিদি, যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

তরুণী এতক্ষণে একটু কথা বলার মতো সঙ্গী পেয়ে বলল, বেশ তো, করো।”

“আমরা অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছি, আপনি একা একা চুপচাপ বসে বই পড়ে যাচ্ছেন। কেউ আপনার সঙ্গে কথা বলছে না। আপনিও কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। আর সত্যি বলতে কী, এই বাসে যারা আছেন তারা সবাই আমাদের পরিচিত। কিন্তু আপনাকে তো কখনও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। আপনি কে বলুন তো?”

তরুণী হেসে বলল, “আমার নাম মহুয়া পাল। তোমাদের পাড়ায় যে বিল্ডিং কনট্রাক্টর মি. উপেন পাল আছেন আমি তার ভাইঝি। আমি তো এখানে থাকি না ভাই। আমি থাকি পুনেতে। এক মাসের ছুটি নিয়ে কলকাতা দেখতে এসেছিলাম, তা এই সুযোগে রিজার্ভ বাসে তারাপীঠ বক্রেশ্বরটাও একটু ঘুরে যেতে চাইছি। এই আর কী।”

বাবলু বলল, “ও। আচ্ছা আচ্ছা।”

বাস তখন পানাগড় হয়ে ইলামবাজারের পথ ধরেছে। ঘন শাল বনের ভেতর দিয়ে রূপোলি ফিতের মতো পিচঢালা পথের ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে বাস। যেতে যেতে হঠাৎ এক সময় আচমকা ব্রেক কষে থেমে গেল বাসটা। কী ব্যাপার! দেখা গেল, মোটা একটা শাল গাছের গুড়ি দিয়ে পথটা অবরোধ করা আছে।

বোকাদা বসেছিল ড্রাইভারের পাশে। দরজা খুলে তিড়িং করে লাফিয়ে নেচে চেঁচাতে লাগল, “এই! এ কার কীর্তি ? এখানে কোনও চেকপোস্ট নেই, কিছু নেই এইভাবে পথ আটকেছে কে?”

ড্রাইভার অবনীদাও তখন নেমে এসেছে। মধ্যবয়সি ভদ্রলোক। ঠোঁটে তর্জনী রেখে হিসস করে চুপ করার নির্দেশ দিল বোকাদাকে। বলল, “এই বুরবাক। চুপ কর না। গতিক সুবিধের নয়। মনে হচ্ছে বেকায়দায় পড়েছি।”

বোকাদা চোখ কপালে তুলে বলল, “তার মানে!”

অবনীদা বলল, “ওরে ঘোড়ামুখো, যদি থানা পুলিশের ভয় না থাকত তো এখানেই তোর গলাটাকে টিপে মেরে ফেলতুম আমি। এখনও বুঝতে পারছিস না?”

“না।”

“তবে ওই দ্যাখ। তোর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সবাই এসে কেমন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”

দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বিকট চিৎকার করে এড়ে বাছুরের মতো লাফাতে লাগল বোকাদা, “ওরে বাববারে। কেটে ফেললে রে। ওরে মরে গেলুম রে। ডা-কা-ত রে।”

বাস ভর্তি লোকের মুখ তখন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। মেয়েরা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।

বাবলুরাও গতিক সুবিধের নয় বুঝে নেমে পড়ল বাস থেকে। মহুয়াদিও নামল। কারও মুখে কথাটি নেই।

ওরা বাস থেকে নেমে একটু দূরত্বে অন্ধকারে সরে দাঁড়াল। দেখল জনা পাঁচেক দুর্ধর্ষ লোক বন্দুক হাতে এগিয়ে আসছে। একজন এসে বোকাদার চুলের মুঠি ধরে ঠাস করে একটা চড় মেরে বলল, “এই রাসকেল! অমন গাধার মতো চেঁচাচ্ছিস কেন? কী করেছি আমরা তোর?”

“শুধু শুধু কেটে ফেলব কেন? যার কাছে যা টাকা-কড়ি আছে, দিয়ে দিতে বল। আর মালপত্তরগুলো ওপর থেকে নামিয়ে দে। না হলে দেখছিস তো?” বলেই বন্দুক তাগ করল।

বন্দুক দেখে আবার লাফিয়ে উঠল বোকাদা। তারপর মুখ দিয়ে এক বিশ্রী রকমের শব্দ বার করে চেঁচাতে লাগল।

ডাকাতের লোকেরা বলল, “এই গাধাটাকে দিয়ে কোনও কাজই হবে না দেখছি। আমাদের হাত লাগাতে হবে।” বলে বাসের ভেতর ঢুকে পড়ল তারা।

তিনজনে ভেতরে ঢুকল। দুজন বাইরে। যারা বাইরে রইল, তাদের একজন সিটি দিতেই শালবনের ভেতর একটা লরির হেড লাইট জ্বলে উঠতে দেখা গেল। লরিটা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আলো নিভিয়ে পিচ রাস্তায় থামল ।

বাবলুরা তখন আরও একটু পিছিয়ে এসে অন্ধকারে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়েছে।

বিলু বলল, “তোর পিস্তলটা এবার কাজে লাগা বাবলু।”

বাবলু বলল, “না। এখনই ওসব করা যাবে না। ওরা পাঁচজন। তার ওপর ওদের হাতে বন্দুক আছে। লরিতেও যে আরও দুচার জন নেই তাই বা কে জানে?”

ভোম্বল বলল, “সব ব্যাপারে বেশি দুঃসাহস ভাল নয়, বুঝলি?”

বাচ্চু-বিচ্ছু কোনও কথাই বলল না।

মহুয়াদি বলল, “ওরে বাবা, এমন হবে জানলে তো আসতামই না।”

যে তিনজন ভেতরে ঢুকেছিল, তারা তখন ছিনতাই শুরু করে দিয়েছে।

বিলু বলল, “আমরা কি তা হলে এইভাবে নীরব দর্শক হয়েই থাকব?”

বাবলু বলল, “না। তাও না। তবে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। ততক্ষণে ভোম্বল এক কাজ কর, অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে লরির কাছে চলে যা। গিয়ে যে কোনও উপায়েই হোক লরিটার গায়ে একটা ক্রস চিহ্ন দিয়ে আয়।’

ভোম্বল বলল, “বেশ বুদ্ধি। কী দিয়ে চিহ্নটা দেব? চক কোথায়?”

মহুয়াদি বলল, “কেন, চিহ্ন দিয়ে কী হবে?”

“সে আপনি এখন ঠিক বুঝতে পারবেন না মহুয়াদি।”

তারপর ভোম্বলকে বলল, “ওরে বোকা, একটা মাটির ঢালা কুড়িয়ে নিয়ে যা না।”

বিলু বলল, “ও থাক। আমি যাচ্ছি।”

বিলু গেল আর এল। বলল, “লরিতে শুধু ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই।”

বাবলু বলল, “ঠিক দেখেছিস তো?”

বিলু বলল, “হ্যাঁরে বাবা, হ্যাঁ। আমি কি ভোম্বল?”

যে তিনজন বাসের ভেতরে ঢুকেছিল, তারা তখন ছিনতাই সেরে বেরিয়ে এসেছে। ওরা বেরিয়ে এলে যারা বাইরে ছিল তারা বলল, “যা, এবার তাড়াতাড়ি করে ওপরের মালগুলো নামিয়ে নিয়ে আয়।”

বলার সঙ্গে সঙ্গেই লোকগুলো বাসের মাথায় উঠে পড়ল। কিন্তু তখন তো ওরা জানত না যে সেখানে ওদের বাবার বাবা ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। তারা পরম নিশ্চিন্তে যেই না দড়ির বাঁধন খুলে একটা সুটকেসে হাত দিয়েছে, পঞ্চু অমনি অন্ধকার বিদীর্ণ করে হাউমাউ শব্দে চেঁচিয়ে উঠেই একজনের গলার টুটি কামড়ে ধরল। বাকি দুজন আচমকা ওই রকম চিৎকারে এমন চমকে উঠল যে ভয়ে টাল সামলাতে না পেরে মাথা টলে পড়ে গেল বাসের ছাদ থেকে। নীচের লোক দু’জন তখনও ব্যাপারটা কী হল বুঝে উঠতে পারেনি। অবশ্য বুঝে ওঠবার মতো অবকাশও পেল না তারা। সঙ্গীদের দুর্দশা দেখতে যেই না এগিয়েছে, অমনি দু’জনের নাকের ওপর বড় বড় দুটো পাথর এসে পড়ল। বন্দুক ওঠাবারও আর সময় পেল না বাছাধনরা। রক্তাক্ত কলেবরে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। বাবলুরা ছুটে এল তাড়াতাড়ি। এসেই ওদের হাত থেকে বন্দুক দুটাে কেড়ে নিল। আর ভোম্বল করল কী পাশেরই একটি গাছ থেকে বেশ মোটা দেখে একটি ডাল ভেঙে নিয়ে বেশটি করে পেটাতে লাগল লোকদুটোকে। মারের চোটে তারা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল। ওদিকে বাসের ছাদ থেকে যারা পড়ে গেছে, তাদের অবস্থাও শোচনীয়। এমনভাবে হাত-পা ভেঙে পড়ে আছে তারা যে আর উঠে দাঁড়াবারও শক্তি নেই। আর সেই লোকটি? বাবলু উঠে দেখল, পঞ্চু লোকটির কণ্ঠনালিটা একেবারে ছিড়ে বার করে নিয়েছে। মরেও গেছে লোকটি। মরে যখন গেছেই তখন আর অযথা মেহনত করে তাকে ধরাধরি করে নীচে নামিয়ে লাভ কী? বাবলু বাসের ছাদ থেকেই ঠেলে ফেলে দিল লাশটাকে। তারপর পঞ্চুকে নিয়ে নীচে নেমে এসে সহযাত্রীদের বলল, “আপনারা সব হাঁ করে দাড়িয়ে দেখছেন কী? এগুলোর একটা ব্যবস্থা করুন?”

বোকাদা ভয়ে চেঁচাতে লাগল, “খুন খুন। নির্ঘাত জেলে যেতে হবে এবার। তবে আমি কিন্তু এ সবের ভেতরে নেই। এখন থেকেই বলে রাখছি আমি, হ্যাঁ।”

বোকাদার চেঁচানিতে বাবলুরা তো বটেই, পঞ্চুও বিরক্ত। তাই রেগে গিয়ে হাউ হাউ করে ছুটে এল বোকাদার কাছে। বোকাদা তিড়িং করে একটা লাফ মারল।

বাবলু ড্রাইভারকে বলল, “আপনি এক কাজ করুন অবনীবাবু, পথটাকে অবরোধমুক্ত করুন।” তারপর সহযাত্রীদের বলল, “আপনারা দেরি করবেন না, সবাই এসে ধরাধরি করে এদের বাসে ওঠান। তারপর ইলামবাজারে গিয়ে এগুলোকে পুলিশের হাতে জমা দিয়ে আমাদের দায়িত্ব শেষ করব আমরা।”

সহযাত্রীরা সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল একবার। কিন্তু লোকগুলোকে বাসে ওঠানোর কোনও ব্যবস্থাই কেউ করল না। প্রথমেই তারা নিজেদের খোয়া যাওয়া টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসগুলো উদ্ধার করল। তারপর বলল, অযথা ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ কী ভাই? তার চেয়ে যে যেখানে আছে পড়ে থাক। আমরা বাস নিয়ে কেটে পড়ি।

বাবলু বলল, “সে কী! এমন অপ্রত্যাশিতভাবে লোকগুলোকে ধরে ফেললাম অথচ এদের পুলিশে দেবেন না?”

বোকাদা বলল, “থাক। যা করেছ তোমরা সে আর বলে কাজ নেই। তোমাদের জন্যে বাসসুদ্ধ লোককে হাজতে ঢুকতে হবে এবার।”

বাবলু বলল, “বাঃ। চমৎকার।”

বিলু বলল, “বেইমান।”

এমন সময় ওদের পিছন দিক থেকে হঠাৎ ঝড়ের বেগে ডাকাতদের সেই লরিটাকে পালাতে দেখা গেল। লরিটা যে অন্ধকারে আলো নিভিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা ওদের মনেই ছিল না কারও।

ড্রাইভার অবনীদা তখন পথ মুক্ত করে এসে হর্ন বাজিয়ে বলল, “কই, নিন সব তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন। আমি এবার বাস ছাড়ব।”

বাবলু বলল, “এখনও বলছি যদি ভাল চান তো এদেরকে বাসে তুলে নিন। না হলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।”

বোকাদা রেগে-মেগে বলল, “কী খারাপ হবেটা শুনি? পাকা পাকা কথা বললে মারব এক চড়।”

এবার মহুয়াদিও আর থাকতে পারল না। বলল, “সত্যই তো। এই রকম খুনে বদমাশ লোকগুলোকে হাতের মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দেবেন আপনারা? এ কী আবদার!”

সহযাত্রীরাও দেখা গেল বোকাদা ও ড্রাইভারের সঙ্গে একমত। ঝামেলায় যেতে কেউ চায় না। ডাকাতগুলোকে গাড়িতে নেওয়ার ব্যাপারে জোর আপত্তি জানাল সবাই।

বাবলু বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনাদের অসুবিধে থাকে নেবেন না। তবে আমাদের তো মাসাঞ্জোর অবদি যাবার কথা ছিল, আমরা অত দুরে যাব না। এইখানেই আমরা আমাদের যাত্রা শেষ করলাম।”

বোকাদা বলল, “এই বনের ভেতর?”

সহযাত্রীরা মহুয়াদিকে বলল, “আপনি তবে চলে আসুন। ওরা না যায় না যাবে। যা ইচ্ছে করুক, মরুক। ঢের ঢের ছেলেমেয়ে দেখেছি বাবা। এ রকম তো কোথাও দেখিনি।”

মহুয়াদি বলল, “আপনারা যখন এতই স্বার্থপর বা আপনাদের যখন এতই ভয় তখন আপনারাই যান। আমি এদের ছেড়ে এক পাও নড়ছি না।”

অবনীদা বিরক্ত হয়ে বলল, “না যায় না যাবে, এঃ।”

বলে ওদের রেখেই বাস চালিয়ে দিল। অবাক বিস্ময়ে বাবলুরা দেখল বাসটা মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। মহুয়াদি বলল, “সত্যি, মানুষ এত অকৃতজ্ঞও হয়? অথচ তোমরা বা এই কুকুরটা না থাকলে ওদের দুর্দশার অন্ত থাকত না আজ।”

বিলু বলল, “এখন তা হলে কর্তব্য?”

বাবলু বলল, “পায়ে হেঁটে ইলামবাজারের দিকে এগিয়ে যাওয়া।”

মহুয়াদি বলল, “আমি বলি কী সবাই না গিয়ে তোমাদের ভেতর থেকে যে কেউ একজন বা দু’জন যাও। আমরা পাহারা দিই এদের। ওখানে গিয়ে ওখানকার থানায় খবর দাও তোমরা। তারপর পুলিশের গাড়ি এলে ওই গাড়িতেই আমরাও ইলামবাজার পৌঁছে যাব।”

মহুয়াদির হাতে ঘড়ি ছিল। ঘড়ি দেখে বলল, “এখন তিনটে বাজে। কাজেই ভোরের আলো ফুটতেও আর খুব বেশি দেরি নেই। ইলামবাজার কত দূর এখান থেকে?”

বাবলু বলল, “তা তো জানি না।” এমন সময় হঠাৎ দূর থেকে একটা মোটরবাইকের ভটভট শব্দ ও হেডলাইটের আলো ওরা দেখতে পেল।

বাবলু বলল, “দেখা যাক। ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই। যদি কোনও সাহায্য পাই।”

ওরা কথা শেষ করার আগেই মোটরবাইকটি ওদের সামনে এসে ব্রেক কষল। একজন দীর্ঘদেহ বলিষ্ঠ চেহারার ভদ্রলোক বাইক থেকে নেমে এসে বললেন, “ব্যাপার কী ! অ্যাক্সিডেন্ট নাকি?”

বাবলু বলল, “না।” এই ডাকাতগুলো আমাদের রিজার্ভ বাসকে আক্রমণ করেছিল। আমরা এদের এই হাল করেছি। ”

ভদ্রলোক অবাক হয়ে বাবলুদের মুখের পানে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ডাকাতগুলোর অবস্থা দেখে পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “বাস কই তোমাদের?”

বাবলু বলল, “বাস অনেক আগেই চলে গেছে।”

ভদ্রলোক বললেন, “এই জঙ্গলে রাতের অন্ধকারে বাস তোমাদের ফেলে রেখে চলে গেল। অথচ—। ব্যাপারটা কী হয়েছে খুলে বলো তো আমাকে?”

বাবলু আগাগোড়া সব কথা খুলে বলল ভদ্রলোককে। ভদ্রলোক একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “ইলামবাজার এখনও অনেক দুর। তবে ঠিক আছে। তোমাদের কাউকেই আসতে হবে না। আমি ইলামবাজারেই যাচ্ছি। আমিই গিয়ে থানায় খবর দিচ্ছি। তোমরা বরং এখানেই থাক এবং এদেরকে পাহারা দাও।” বলে ভদ্রলোক বাইক নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন ইলামবাজারের দিকে।

কিছু সময়ের মধ্যেই একদল পুলিশ সমেত দুটো পুলিশের গাড়ি এসে হাজির হল সেখানে। প্রথম গাড়িটি থেকে বিশাল বপু দরোগাবাবু নেমে এসে বললেন, “কেন যে রাত-ভিত গাড়ি নিয়ে আসে সব এই পথে, খুব খারাপ জায়গা এটা। প্রায়ই তো ঘটছে এই রকম ঘটনা।”

বাবলুর ইচ্ছে হল, একবার বলে যে প্রায়ই যখন ঘটছে এইরকম ঘটনা তো আপনারা নজর রাখেন না কেন এই দিকে? কিন্তু তা আর বলল না।

দারোগাবাবু লোকগুলোকে ভ্যানে উঠিয়ে বাবলুদেরও সঙ্গে নিলেন। তারপর বললেন, “তোমাদের এই সাহস এবং কর্তব্যনিষ্ঠা দেখে খুব খুশি হয়েছি আমরা। মি. শিকদার তোমাদের অত্যন্ত প্রশংসা করেছেন। ইলামবাজারে উনি অপেক্ষা করছেন তোমাদের জন্য।”

বাবলু বলল, “কে মি. শিকদার?”

“কেন? জঙ্গলের মধ্যে যার কাছে তোমরা তোমাদের বিপদের কথা বলেছ। উনি তো এখানকার পুলিশ সুপার।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। অত্যন্ত ভাল লোক উনি।”

বাবলুরা যখন ইলামবাজারে এসে পৌঁছুল তখন সকাল হয়ে গেছে। মৃত ও বন্দি ডাকাতদের এবং সেই সঙ্গে বাবলুদের দেখার জন্য থানার বাইরে তখন দারুণ ভিড়।

মি. শিকদার বাবলুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আমি ব্যক্তিগত ভাবে তোমাদের কিছু পুরস্কার দিতে চাই ভাই বলো তোমরা কী চাও?’

বাবলু বলল, “কিছু না। শুধু আমাদের বাড়িতে একটু খবর পাঠিয়ে দিন। আর আমরা দুমকা যেতে চাই, তার একটা ব্যবস্থা করুন।”

মহুয়াদি বলল, “এবং অনুগ্রহ করে আমাকেও বাড়িতে পৌঁছে দিন।”

বাবলু বলল, “না। তা তো হবে না মহুয়াদি। আপনিও আমাদের সঙ্গে দুমকায় যাবেন এবং আমার মাসির বাড়িতে কয়েকদিন থেকে আমাদের সঙ্গে একসঙ্গেই ফিরবেন।”

তারপর মি. শিকদারকে বলল বাবলু, “আপনি এক কাজ করুন, আমাদের ওখানকার থানাতে আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা তার করে জানিয়ে দিন। ওখানকার থানাতে শুধু জানিয়ে দিন যে পাণ্ডব গোয়েন্দাদের বাড়ি। আমাদের বাড়ি থেকেই লোক গিয়ে তা হলে মহুয়াদির বাড়িতেও খবর দিয়ে আসবে।”

পাণ্ডব গোয়েন্দা নাম শুনেই চমকে উঠলেন মি. শিকদার। বললেন, “আরে! তোমরাই সেই বিখ্যাত ছেলেমেয়ে? তোমাদের নামের সঙ্গে আমি বিশেষভাবে পরিচিত। আর এই কি সেই কুকুর? যার নাম পঞ্চু?”

“হ্যাঁ। এই সেই পঞ্চু। এবারের অভিযানেও ওর অবদান অসামান্য। বরং বলা যেতে পারে ওর কৃতিত্বের জোরেই ডাকাতগুলো আজ ধরা পড়ল।

মি. শিকদার বললেন, “সাব্বাস পঞ্চু।”

পঞ্চু উত্তর দিল, “ভৌ—ভৌ-ভৌ।”

এরপর মি. শিকদার বাবলুদের তার কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন। সেখানে বেশটি করে পেট ভরে লুচি মিষ্টি খাওয়ার পর বাবলুরা দুমকার পথে পাড়ি দিল। মি. শিকদার একজনদের একটি প্রাইভেট গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। ওঃ, সে কী দারুণ মজা! সেই গাড়িতে চেপে ওরা বক্রেশ্বর সিউড়ি মাসাঞ্জোর পাতাবেড়ে হয়ে দুমকায় এসে পৌছুল।

কিন্তু এবারের যাত্রাটাই বোধহয় খারাপ। দুমকায় চিনু মাসির বাড়িতে গিয়ে ওরা দেখল বাড়িতে কেউ নেই। তালা ঝুলছে। মেসোমশাই হঠাৎ একটা জরুরি কাজে ভাগলপুর গেছেন। মাসিমাও গেছেন সঙ্গে।

বিলু বলল, “যাঃ। কী হবে তা হলে?”

বাবলু বলল, “কী আর হবে? এইভাবে চিঠিপত্তর না দিয়ে মাসিমার চিঠি পেয়েই দুম করে দুমকায় আসা আমাদের ঠিক হয়নি। কাজেই এখন কোনও একটা হোটেলে ওঠা ছাড়া আর কোনও উপায়ই নেই আমাদের।”

চিনু মাসির বাড়ির সামনেই একটা হোটেল আছে। নাম ‘আবার খাব হোটেল।’ বাবলুরা সেখানেই উঠল। হোটেলের মালিক এক হৃষ্টপুষ্ট বাঙালি ভদ্রলোক। নাম নিবারণ চক্রবর্তী। ধুতি পাঞ্জাবি পরে হোটেলের সামনেই একটি তক্তপোশে ক্যাশবাক্স নিয়ে বসে আছেন। বাবলুরা যেতেই বললেন, “ঘর চাই? পাবে। তা কোথা থেকে আসছ বাবারা?”

বাবলু সব বলল ও পরিচয় দিল। নিবারণবাবু বললেন, “ও। তোমরা তা হলে অভয়বাবুর রিলেটিভ? আরে ওরা তো সবে কাল গেছে। অবশ্য ক’দিন থাকবে তা জানি না। তবে ভয় নেই। কোনও অসুবিধে হবে না তোমাদের।” বলে চেঁচিয়ে ডাকলেন, “হোরে! এই হোরে!”

একটি অল্পবয়সি ছেলে, দোকানের কর্মচারী এগিয়ে এল, “কী বলছেন বাবু?”

“এই, এরা সব অভয়বাবুর লোক। এদের—।”

বাবলু বলল, “অভয়বাবু আমার মেসোমশাই হন।”

“ঠিক আছে। এদের দোতলার এক নম্বর ঘরে ঢুকিয়ে দে।” তারপর পঞ্চুকে দেখেই লাফিয়ে উঠলেন,
“এই মরেছে। এটাকে আবার নিয়ে এসেছ কেন? এসব কুকুর-টুকুর এখানে রাখার নিয়ম নেই।”

মহুয়াদি বাবলুদের হয়ে বলল এবার, “সে জানি। কিন্তু কী করব বলুন? ওঁরা যখন নেই, তখন ও বেচারা যায় কোথায়? ওরও একটা ব্যবস্থা করুন।”

নিবারণবাবু একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন, “সে তো বুঝলুম। কিন্তু কবে যে আসবেন ওঁরা, তাও তো জানি না। ঠিক আছে। থাক ও আপনাদের কাছে। তবে সব সময় বেঁধে রাখবেন।”

“সে আপনাকে বলতে হবে না।”

নিবারণবাবু বললেন, “তোমরা তা হলে স্নান খাওয়া করো। অনেক বেলা হয়ে গেছে।” তারপর হরেকে বললেন, “এই, এদের সব দেখিয়ে শুনিয়ে দে। আমি মন্দিরে যাচ্ছি। জয় মা চামুণ্ডা। মা—মাগো।” বলে নিবারণবাবু চলে গেলেন।

বাবলুরা হোরের সঙ্গে দোতলায় উঠল।

সাঁওতাল পরগণার এই সদর শহর দুমকা সম্বন্ধে বাবলুর যা ধারণা ছিল তা একেবারেই পালটে গেল। একদম বাজে জায়গা। বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু সবাই বলল, “এই দুমকা! এরই এত নামডাক! কী আছে এখানে? আজকের রাতটা কোনওরকমে কাটিয়ে কালই চলে যাব এখান থেকে।”

একমাত্র মহুয়াদিই বলল, “কেন, খারাপ কী? দুমকা শহরটা খুব একটা ভাল না হলেও এর আশপাশের পরিবেশ তো মন্দ নয়।”

যাই হোক, বাবলুরা বিকেলবেলা দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করতে লাগল চারদিকে। ঘুরতে ঘুরতে ওরা যখন শহর থেকে অনেকটা দূরে একটু নির্জনে চলে এসেছে, তখন দেখল একটা বেপরোয়া লরি ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে রোডের ওপর দিয়ে। কিন্তু এ কী! লরিটা ওদের দিকেই আসছে যে ! চাপা দেবে নাকি? ওরা লাফিয়ে রোড থেকে নেমে খাদের পাশে সরে গেল। লরিটা সাঁ করে বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে। কিছু দূরে গিয়েই থামল। তারপর আবার পিছিয়ে এল ওদের দিকে। লরির ভেতর থেকে সাংঘাতিক চেহারার পাকানো গোঁফ হিন্দুস্থানি ড্রাইভারটি রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে দেখল ওদের দিকে। দেখে থুঃ করে একটু থুথু ফেলে আবার লরিতে স্টার্ট দিল।

লরিটা চলে যেতেই চেঁচিয়ে উঠল বিলু, “বাবলু! সেই লরিটা।”

“সেই যে রে, কাল রাতে যার পিছনে আমি চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলাম।”

“সত্যি!”

“সত্যি।”

“তা হলে চল তো দেখি লরিটা দুমকাতেই থামে কিনা?”

ওরা আবার দুমকার দিকে ফিরে চলল। বেলা পড়ে আসছে তখন। ওরা দেখল, সেই পড়ন্ত বেলায় লরিটা টিম্বার মার্চেন্ট শ্যামসুন্দর আগরওয়ালার গোলাতে গিয়ে ঢুকেছে৷

ওরা যেন লক্ষই করেনি, এমনভাবে পেরিয়ে এল সেই জায়গাটা। তারপর দুমকার পুলিশ-ফাঁড়িতে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে আগাগোড়া সব কথা বলে বলল, “যদি আপনারা অনুগ্রহ করে একবার ইলামবাজারের মি. শিকদারের সঙ্গে আমাদের কথা বলিয়ে দেন তা হলে খুব ভাল হয়।”

জায়গাটা এস পি তে হলেও এখানকার দারোগাবাবু বাঙালি। কী সাম চ্যাটার্জি। বললেন, “তা হলে শোন বাবলু, মি. শিকদার আজই একটা বিশেষ কাজে এখানে আসছেন। আর ওই যে লরির কথা বললে বা ওই যে গোলাটি, ও সবই আমাদের নজরে আছে। ওটি নামে মাত্র গোলা। আসলে ওই শ্যামসুন্দর আগরওয়ালার একটা দল আছে। ওরা সোনা নিয়ে গোপন কারবার করে। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুতেই হাতেনাতে ধরতে পারিনি ওদের। তবে কাল রাতে ওই যে লোকগুলোকে তোমরা জখম করেছ, সে খবরও আমরা পেয়েছি। ওরাও এদের দলেরই লোক। কাঠের ব্যবসার সঙ্গে এবং সোনা পাচারের সঙ্গে লিপ্ত আছে। ওরা এখন পুলিশেরই হেফাজতে। দেখা যাক, ওদের মারধোর করে কোনও গোপন কথা কিছু আদায় করা যায় কিনা। যাই হোক, তোমরা কিন্তু সাবধানে চলাফেরা করবে এখন থেকে। আমি এখনই মি. শিকদারের সঙ্গে আলোচনা করছি।”

বাবলু বলল, “আমরা অবশ্য কাল সকালেই চলে যাব এখান থেকে।”

“না না, তোমরা যাবে কি? তোমরা এখন কোনওমতেই যেয়ো না। বরং এদিক ওদিক ঘুরে একটু ওদের নজরে রাখো, এবং দেখো, ওরা তোমাদের আর কোনও ক্ষতি করার চেষ্টা করে কিনা। আমার মনে হচ্ছে, ওদের ধরার পক্ষে তোমরাই এখন মোক্ষম টোপ।”

বাবলুরা থানা থেকে যখন বেরিয়ে আসছে তখন হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে মোটরবাইক ভটভটিয়ে মি. শিকদার এসে হাজির হলেন। বাবলুদের দেখে শিকদারবাবু বললেন, “কী ব্যাপার! তোমরা এখানে কেন?”

বাবলু সব কথা খুলে বলল। মি. শিকদার চোখ বড় বড় করে বললেন, “ঠিক বলছ! সেই লরি?” “হ্যাঁ স্যার। আমরা চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলাম।”

“না। ডালা ওলটানো ছিল।”

“চলো চলো, শিগগির চলো। ওই লরিটারই সন্ধান করছি আমি। ওটা বুঝি এখানে এসেছে?”

দুমকার দারোগা মি. চ্যাটার্জি বললেন, “আপনি হঠাৎ ওই লরিটার সন্ধান করছেন কেন শিকদারবাবু?”

“আরে সর্বনাশ হয়েছে। আমাদের কনস্টেবলগুলোও যেমন। আজ দুপুরে ডাকাতরা দু’জন বন্দিকে হত্যা করে বাকি দু’জনকে ওদের অন্যমনস্কতার সুযোগে তুলে নিয়ে গেছে। আমি সন্দেহ করছি, ওই লরিতেই আনা হয়েছে ওদের।”

“তাই নাকি! চলুন তো দেখি।”

মি. চ্যাটার্জি, মি. শিকদার, কয়েকজন পুলিশ ও পাণ্ডব গোয়েন্দারা দল বেঁধে চলল শ্যামসুন্দর আগরওয়ালার কাঠগোলার দিকে।

ওরা যেতেই শ্যামসুন্দর আগরওয়ালা তার বিশাল ভুড়ি নিয়ে এগিয়ে এলেন, “আসুন আসুন দারোগাবাবু। এই সন্ধের সময় কী মনে করে গরিবখানায় পায়ের ধুলো দিলেন?”

মি. শিকদার বললেন, “আমরা তোমার গোলা একবার সার্চ করতে চাই।”

শ্যামসুন্দরজি ফিক করে হেসে বললেন, “একবার কেন? একশো বার করুন। কিন্তু কেন মিছিমিছি তকলিফ করবেন হুজুর? এই নিয়ে তো হাজার বার এই রকম কষ্ট করলেন। কিছু পেলেন কি? শুধু শুধু নিজেদের সময় নষ্ট করে গরিবকে কেন কষ্ট দেন? হামি বেওসাদার আদমি। স্রেফ লকড়িকা বেওসা করি। ও সব সোনা-টোনার বেপারে হামি কুছু জানে না।”

শিকদারবাবু বললেন, “শ্যামসুন্দরজি, তোমার গোলা সার্চ করে কিছুই আমি পাব না জানি। কিন্তু আমি জানতে চাই তোমার লরির ড্রাইভার আজ এই ছেলেমেয়েগুলোকে চাপা দিয়ে মারতে যাচ্ছিল কেন? তোমার দলের লোকেরা চারজন বন্দির দু’জনকে হত্যা করে বাকি দু’জনকে নিয়ে পালাল কেন? তাদের তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছ? হয় বলো, না হলে তোমার ছাল আমি ছাড়িয়ে নেব আজ।”

শ্যামসুন্দরজি নাক-কান মলে লাফিয়ে উঠলেন, “আরে রাম রাম! সিয়ারাম। এসব কী বানিয়ে বানিয়ে বোলছেন?” বলেই ডাক দিলেন, “মুনিমজি! এ মুনিমজি!”

মাথায় পাগড়ি, কপালে তিলক, চোখে চশমা মুনিমজি গদিতে বসে খাতা লিখছিলেন। মনিবের ডাকে ছুটে এলেন হন্তদন্ত হয়ে, “বোলিয়ে হুজুর।”

“কিতনা রুপিয়া হ্যায় তুমহারা পাশ?”

“দশ হাজার।”

“দারোগাবাবুকে রসগুল্লা খানেকে লিয়ে দে দো ও রুপিয়া।” বলেই শিকদারবাবুকে বললেন, “হামি গরিব আদমি হুজুর। এর চেয়ে বেশি আর কী হামি করতে পারি বলুন?”
শিকদারবাবু তখন ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিয়েছেন শ্যামসুন্দরজির গালে, “ব্যাটা চোর! আবার ঘুষ দেওয়া হচ্ছে? কোথায় গেল সেই লরিটা?”

“আরে বাঃ। ক্যা তাজ্জব কী বাত! লরি কাহা বা?”

সত্যিই তো, কোথায় লরি? পুলিশ আসার অনেক আগেই লরিটা উধাও হয়ে গেছে। অগত্যা নিরুপায় হয়েই ফিরে আসতে হয় সকলকে।

রাত তখন কত তা কে জানে? বাবলুর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বহুদূর থেকে একটা ঠকঠক শব্দ ওর কানে আসছে। বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছুও শুনল শব্দটা।

মহুয়াদি বলল, “ওটা কীসের শব্দ কিছু বুঝতে পারছ?”

বাবলু বলল, “না। মনে হচ্ছে কোথাও কাজ হচ্ছে।”

মহুয়াদি বলল, “এই রাত্তিরে এই রকম পরিবেশে কী কাজই বা হওয়া সম্ভব!”

“কে জানে?”

“শব্দটা মনে হচ্ছে জঙ্গলের দিক থেকে আসছে।”

বাবলু বলল, “আমারও তাই মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে তো। চল সব।”

মহুয়াদি বলল, “এই রাত্তিরেই যাবে?”

বাবলু বলল, “আমাদের আবার রাত্ৰি-দিন। ঘুম যখন আসবে না তখন অন্ধকারেই একটু নৈশ অভিযান করা যাক।”

এই বলে ওরা চুপিচুপি নীচে নামল। নিবারণবাবু কোন ঘরে কে জানে? হোরেটা ঘরের মেঝেয় একপাশে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওরা এসে দরজা টেনেই দেখল, বাইরে থেকে তালা দেওয়া। কী ব্যাপার! তালা দিল কে? তবে কি নিবারণবাবু হোটেলের দরজায় তালা লাগিয়ে নিজে অন্যত্র থাকেন? কিন্তু তাই বা কী করে হয়? যাই হোক, ওরা বাধ্য হয়েই আবার ওপরে উঠে এল।

বাবলু বলল, “নাঃ। যেমন করেই হোক, এই বাড়ির বাইরে একবার যেতেই হবে।”

বিলু বলল, “বাবলু, এক কাজ করি আয় বারান্দার রেলিংয়ে দড়ি বেঁধে আমরা বাইরে যাই চল। তারপর তালা ভেঙে– ”

বাবলু বলল, “না। তালা ভাঙার দরকার নেই। সকলের যাবারও দরকার নেই। শুধু তুই আমি আর পঞ্চু যাব।”

মহুয়াদি বলল, “না বাবলু, ওভাবে যেয়ো না। তোমাদের কোনও বিপদ হলে কিছুই জানতে পারব না আমরা। ”

বিলু বলল, “আমাদের কোনও বিপদ হলে এই পঞ্চুই এসে সে খবর জানিয়ে যাবে আপনাকে। অতএব আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মহুয়াদি।”

এই কথা বলে তরতরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল বিলু। সিঁড়ির পাশে কুয়ো থেকে জল তোলার যে দড়ি-বালতিটা ছিল, সেই দড়ি-বালতির দড়িটা খুলে এনে রেলিংয়ে বাঁধল। তারপর দড়ি বেয়ে ঝুলে পড়ল বাইরে। বিলু নামলে বাবলুও পঞ্চুকে নিয়ে নামল। ওরা দু’জনেই নেমে গেলে ঝুলন্ত দড়িটা ওপরে গুটিয়ে নিল মহুয়াদি।

রাতের অন্ধকারে সেই ঠকঠাক শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেছে বাবলুরা। অনেক দূর যাওয়ার পর এক সময় ওরা দেখল, শালবনের ভেতর কতকগুলো লোক মশাল জ্বেলে কী সব যেন করছে। কতকগুলো লোক বড় বড় শালবল্লীগুলোর গায়ে হাতুড়ি আর বাটালি ঠুকে গর্ত করছে। কয়েকজন সেই গর্তের ভেতর মূল্যবান কিছু যেন ঢুকিয়ে দিয়ে প্লাস্টার করে দিচ্ছে। প্লাস্টার হয়ে গেলে একজন লোক লম্বালম্বিভাবে তার ওপর আলকাতরার দাগ টেনে দিচ্ছে। লোকগুলোর মুখ দূর থেকে চেনা যাচ্ছে না। একজন শুধু টর্চ হাতে ওদের কাজের তদারক করছে। বাবলুরা সাহস করে আরও একটু এগিয়ে গেল। কিন্তু গিয়ে যা দেখল, তাতে ওদের চোখকেও ওরা বিশ্বাস করতে পারল না। ওরা ভেবেছিল, শ্যামসুন্দরজিকেই হয়তো এইসব কারবারের সঙ্গে লিপ্ত অবস্থায় ওরা দেখতে পাবে। কিন্তু তার জায়গায় দেখল স্বয়ং নিবারণবাবুকে। নিবারণবাবুর মতো লোক যে এই রকম একটা রহস্যের সঙ্গে জড়িত থাকবে তা যেন ভাবাও যায় না।

বাবলুরা আর রইল না। যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেল। মহুয়াদি, ভোম্বল ও বাচ্চু-বিচ্ছুরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল ওদের জন্য। ওরা যেতেই দড়ি নামিয়ে দিল। বাবলু-বিলুপঞ্চুসহ উঠে এল ওপরে।

পরদিন সকালে বাবলুরা ঘুম থেকে উঠতেই নিবারণবাবু বললেন, “কী, তোমাদের কোনও অসুবিধে হয়নি তো?”

বাবলু বলল, “না না। কী যে বলেন? খুব আরামেই আছি আমরা।”

নিবারণবাবু বললেন, “কাল বিকেলে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। তিনি তোমার মেসোমশাইয়ের বন্ধু। তার মুখে শুনলাম, ওঁরা দুদিনের জন্য গেছেন। আজ সন্ধের দিকেই এসে পড়বেন হয়তো।”

বাবলু বলল, “তা হলে তো ভালই হয়।”

নিবারণবাবু বললেন, “যাক। তবুও বলে রাখি, কোনও অসুবিধা হলে বলবে আমাকে, কেমন?” বলে হোরেকে ডাকলেন, “হোরে! এই হোরে!”

হোরে এগিয়ে এল, “কী?”

“এই বেলা যা, বাজারটা করে নিয়ে আয়। আর এদের জিজ্ঞেস কর কী খাবে এরা, মাছ না মাংস? দেখিস যেন কোনও অসুবিধে না হয়।”

বাবলুরা চা-জল খেয়ে শ্যামসুন্দর আগরওয়ালার কাঠগোলার দিকে চলল। বিলু বলল, “আবার এই পথে কেন?”

বাবলু বলল, “যেমন করেই হোক, শ্যামসুন্দরজির সঙ্গে আমাদের আলাপ জমিয়ে নিতে হবে। কাল রাতে যা দেখলাম, ওইরকম শালবল্লী এই গোলাতে আছে কিনা সেটাও তো আমাদের একবার জানা দরকার। তারপর যা ব্যবস্থা করার পুলিশ করবে।”

সবাই বলল, “ঠিক।”

মহুয়াদি বলল, “সত্যি, তোমাদের সঙ্গে এসে আমার এত ভাল লাগছে যে কী বলব! মনে হচ্ছে, তোমাদের ছেড়ে কখনও কোথাও যেন না যাই।”

ওরা যখন গোলার কাছে এসেছে তখন হঠাৎ অযাচিতভাবে শ্যামসুন্দরজিই এগিয়ে এলেন, “আরে খোকাবাবুলোক! তুম সব ইধার কাহা যা রহে?”

বাবলু এসে বলল, “এই একটু বেড়াচ্ছি।”

“তো ঠিক আছে। হামারা গরিবখানামে আইয়ে। এক কাপ করকে চা পি লিজিয়ে।”

বাবলু বলল, “বেশ তো, আপনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয়ই যাব।” এই বলে ওরা শ্যামসুন্দরজির কাঠগোলায় ঢুকল।

শ্যামসুন্দরজি বলল, “কাল বুটমুট তুম সব ঝামেলা লাগা দিয়া। আরে ও ট্রাকবালা নেশে মে থা। ইসি লিয়ে কুছ গড়বড় হো গিয়া। নেহি তো তুমহারা মাফিক মাসুম লেড়কা লেড়কি কো মারনে সে ফায়দা ক্যা?”

বাবলু বলল, “না শ্যামসুন্দরজি, আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। তা ছাড়া ও ট্রাক যে আপনার, তা তো জানতাম না। আমাদের রাগ হয়েছিল ড্রাইভারের ওপর।”

শ্যামসুন্দরজি ওদেরকে গোলায় নিয়ে গিয়ে চা-বিস্কুট খাওয়ালেন। তারপর বললেন, “কাল ক্যা হুয়া? তুম সব তিন-চার ডাকুকো পাকড়কে পুলিশ নে ভেজ দিয়া শুনা?”

বাবলু বলল, “ও কিছু নয়। সামান্য ব্যাপার। ব্যাটারা চুরি করতে এসেছিল। ধরা পড়ে গেছে।”

“দেখিয়ে তো, দারোগাবাবু বুটমুট হামকো বোলা ও হামারা আদমি। এ পোলিশবালা বহুত বদমাশ হ্যায়। আরে হাম তো বেওসাদার আদমি। হামারা বিজনেস লকড়ি কা। ডাকুক কাম কাহে কো করেঙ্গে হাম?”

বাবলু মনে মনে বলল, তুমি ব্যাটা গভীর জলের মাছ। তবু যদি না ওই লরিতে আমরা চিহ্ন দিয়ে রাখতাম। মুখে বলল, “আরে ছাডুন না ওসব কথা। আমরা দু’দিনের জন্য বেড়াতে এসেছি। কাল পরশু করে চলে যাব ৷ ”

“আরে হিয়া কাহা ঘুমো গে? ঘুমনা হো তো চলা যাও পরেশনাথ, গিরিডি, দেওঘর।”

“তাই যাব। এখানে তো কিছুই দেখার নেই দেখছি।”

“কুছ নেই। ইয়ে বিজনেস কী সেন্টার হ্যায়। তব তুম এক কাম করো। ইধার সে থোড়ি দূর চলা যাও। ও যো জঙ্গল হ্যায় না, হুয়া পর এক চামুণ্ডা মন্দির হ্যায়। ও দেখো, আউর কাল সবেরে দেওঘর চলা যাও।”

বাবলুরা তখন শ্যামসুন্দরজির সঙ্গে কথা বলতে বলতে গোলার চারদিক ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। এখানকার সব কাঠেই দেখা গেল ওইরকম একটা করে লম্বা দাগ টানা। বাবলুরা এবার খুব সহজভাবেই বলল, “আচ্ছা, আপনার এইসব কাঠে এমন দাগ দেওয়া কেন?” বলে সেগুলো আরও ভাল করে পরীক্ষা করার জন্য এগিয়ে গেল।

শ্যামসুন্দরজি হা হা করে উঠলেন, “আরে—আরে উসমে হাত মাত লাগাও, খোকাবাবু! রং লাগ জায়গা। ইয়ে হামারা কোম্পানিকা মার্কিং হ্যায়। তুম সব মন্দিরমে যাও। ভগবানজিকো দর্শন করো। ভাগো হিঁয়াসে।”

বাবলুরা আর দেরি না করে মন্দিরের দিকেই চলল। ওরা চলে গেলে শ্যামসুন্দরজি মুনিমজির কানে কানে ফিসফিস করে কী যেন বলতেই মুনিমজি ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে গদি ফেলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

বাবলুরা মেইন রোড ফেলে জঙ্গলের পথ ধরল। মন্দিরের চূড়া লক্ষ্য করে যেতে যেতে বাবলু বলল, “কাল নিবারণবাবুও এই মন্দিরের নাম করছিলেন মনে আছে?”

বিলু বলল, “সে আবার মনে নেই? আমার মনে হচ্ছে এই মন্দিরটাই ওদের ঘাটি।”

ওরা পায়ে পায়ে সেই জঙ্গলের ভেতর ঢুকে মন্দিরের কাছাকাছি চলে এল। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। কেউ কোথাও নেই সেখানে। মন্দিরে প্রবেশ করতেই এক ভয়ংকরী চামুণ্ডা মূর্তি ওদের চোখে পড়ল। সেই মূর্তির সামনেকার মেঝেয় একটা কাঠের ডালা ওলটানো রয়েছে। ওরা দেখল, সেই ডালার নীচে ধাপে ধাপে কয়েকটা সিড়ি নেমে গেছে।

বাবলু বলল, “বুঝেছি। নিশ্চয়ই এর ভেতরে রয়েছে কোনও গুপ্ত কক্ষ।”

বিলু বলল, “নেমে দেখবি?”

“সে তো দেখবই। তবে তার আগে দেখি কেউ এখানে আসে কিনা?”

মন্দিরে একটা বড় ঘণ্টা ছিল। বাবলু সেই ঘণ্টার দড়ি ধরে ঢং-ঢং করে বাজাতে লাগল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, “এই যে, কে আছেন? আমরা মন্দিরে পুজো দিতে এসেছি, একবার আসুন না?”

কিন্তু কে আসবে? কেউই এল না। বাবলু তখন পঞ্চুকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার ইশারা করল। বাবলুর ইঙ্গিত পেয়েই পঞ্চু নেমে গেল নীচে।

মহুয়াদি বলল, “বাবলু, বেশি সাহসে কাজ নেই। চলো, আগে থানায় গিয়ে সব কিছু পুলিশকে জানাই। তারপর ওরা যা করতে পারে করুক।”

বাবলু বলল, “সে তো যাবই। তার আগে দেখিই না এর ভেতরেও তেমন কোনও রহস্য আছে কিনা?”

বাবলুর নির্দেশে পঞ্চু সিঁড়ির শেষ দেখে এসেই বাবলুকে নীচে নামার জন্য কুইকুই করে ডাকতে লাগল। বাবলু বলল, “মহুয়াদি, আপনি বাচ্চু আর বিচ্ছুকে নিয়ে ওপরে থাকুন। আমি বিলু ভোম্বলকে নিয়ে নীচেটা দেখে আসছি। কোনও বিপদ বুঝলে চেঁচিয়ে ডাকবেন আমাদের।” এই বলে ওরা নীচে নেমে গেল।

ওরা নামার সঙ্গে সঙ্গেই চামুণ্ড মূর্তির পিছন থেকে এক কাপালিকের মতো সাধু আত্মপ্রকাশ করে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল মহুয়াদির ওপর। মহুয়াদি চেঁচিয়ে উঠতেই সাধু কঠিন হাতে মুখ চেপে ধরল তার। মন্দিরের বাইরে গাছের ডাল থেকেও তখন দুতিনজন লোক নেমে এসে বাচ্চু-বিচ্ছুকে টিপে ধরল।

মহুয়াদির চিৎকার বাবলুদের কানে গেল। কিন্তু তারা কিছু করতে যাবার আগেই পঞ্চু ঘেউঘেউ করে ছুটে এল ওপরে। পঞ্চু উঠতেই কাপালিক এক লাথি মেরে দরজার বাইরে ফেলে দিল পঞ্চুকে ছিটকে পড়ে পঞ্চু আবার লাফিয়ে ওঠার আগেই দরজা বন্ধ করে দিল ওরা। বাইরে থেকেই পঞ্চুু আকাশ ফাটানো চিৎকার করতে লাগল। তারপর গতিক সুবিধে নয় বুঝে তিরবেগে ছুটল থানার দিকে।

এদিকে কাপালিক ও সেই লোকগুলো মহুয়াদি ও বাচ্চু বিচ্ছুকে জোর করে সিঁড়ির নীচে নামিয়ে কাঠের ডালাটা চাপা দিল। তারপর ডালাটার ওপর দেওয়ালের কোণ থেকে একটা বাঘছাল এনে পেতে ফেলল। কাপালিক সেই বাঘছালের ওপর বসে রুদ্রাক্ষর মালা ঘুরিয়ে জপ করতে করতে বলল, “জয় মা—মাগো, সবই তোমারই ইচ্ছা।”

অন্য লোকগুলো দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল।

মহুয়াদি ও বাচ্চু-বিচ্ছু সিঁড়ির নীচে নামতেই বাবলুদের দেখা পেল। বাবলুরা ওদের সাহায্য করার জন্য আসছিল। বাবলু বলল, “কী হল? নীচে এলেন যে?”

মহুয়াদি বলল, “সর্বনাশ হয়েছে বাবলু। এখান থেকে বেরোবার কোনও পথই আর নেই। আমাদের জোর করে সিঁড়ির নীচে নামিয়ে ওপরের ডালাটা ওরা বন্ধ করে দিয়েছে।”

বাবলু বলল, “ওঃ আমাদের ধরার জন্য কী চমৎকার টোপই না ওরা ফেলেছিল মহুয়াদি। আমরা একদম বুঝতে পারিনি।”

“এখন তা হলে কী করবে?”

“সামনের দিকে এগিয়ে যাব।”

ওরা ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোতে লাগল, চারদিক কী অন্ধকার। একটু যাওয়ার পরই ওরা দেখল, সেই অন্ধকারে এগোবার বা পিছোবার কোনও পথই আর নেই। ঘরঘর শব্দে ওদের পেছনে ফেরার পথটা হঠাৎ রুদ্ধ হয়ে গেছে এক লৌহকপাটের অবরোধে। অনেকক্ষণ আটক থাকার পর হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। এবং দেওয়ালের গা থেকে লাউড স্পিকারে কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “তোমাদের বলছি।”

কণ্ঠস্বর যেন পরিচিত বলে মনে হল ওদের। বিলু ভেংচে বলল, “বলুন।”

“তোমরা অযথা পালাবার চেষ্টা কোরো না। একটু পরেই সামনের পথ খুলে যাবে। ওই পথে তোমরা আমার সামনে এসে দাঁড়াও।”

বলার সঙ্গে সঙ্গেই সামনের দিকের দেওয়ালটা সরে গেল। এবং সেই পথে ওরা একটি প্রশস্ত চাতালে এসে দাঁড়াল। সেখানে বেশ কিছু লোকজনকে দেখা গেল। তাদের ভেতর ইলামবাজারের শালবনে ধৃত দুটি লোকও আছে। তাদের মাথায় ব্যান্ডেজ। চাতালঘরের মাঝখানে প্রচুর সোনার বাট। হিরে প্রভৃতি রয়েছে। ঘরের শেষ প্রান্তে একটু উঁচ্চস্থানে ডায়াসের ওপর এক অতিকায় চামুণ্ডা মূর্তিও রয়েছে। সেই মূর্তির মুখে একটি লাউড ম্পিকার বসানো আছে। সেখান থেকে কথা ভেসে এল—“তোমরা অত্যন্ত ডেঞ্জারাস ছেলেমেয়ে। কিন্তু তোমরা কি জান, আমরা কেন তোমাদের আটক করেছি?”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ, জানি। আপনারা আমাদের রাবড়ি, প্যাড়া, রাজভোগ, রসগোল্লা খাওয়াবার জন্য আটক করেছেন।”

“বেশি ফাজলামি কোরো না হে ছোকরা, বুঝেছ? এখুনি রস তোমাদের গুটিয়ে দিচ্ছি।”

বিলু বলল, “আমার খুব মাংস পোলাও খেতে ইচ্ছে করছে। খাওয়াবেন?”

ভোম্বল বলল, “আমি আবার খুব লেডিকিনি খেতে ভালবাসি।”

একজন লোক এগিয়ে এসে ঠাস করে ভোম্বলের গালে একটা চড় মেরে বলল, “এই নে খা। আর একটা খাবি? ডেপো ছোকরা কোথাকার?”

ভোম্বল রেগে তার অস্থানে সজোরে একটা ঘুষি চালিয়ে বলল, “তুই খা না ব্যাটা।”

লোকটা যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে বলল, “ওরে বাপ রে। কী সাংঘাতিক ছেলে রে। তোরা মর না এখনই।”

ভোম্বল বলল, “তুই মর না। পুলিশের গুলি খেয়ে।”

লাউড স্পিকার থেকে কঠিন গলার ধমক শোনা গেল এবার, “তোমাদের এত সাহস কী করে হল? ভয় করছে না তোমাদের? আর একটু পরেই তো আমরা তোমাদের গুলি করে মারব।”

“না, ভয় করছে না।”

“কেন?”

“সেটা আপনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে চাই।”

“তোমরা তো আমার মুখোমুখিই আছ?”

“না। এরকম নয়। একেবারে ফেস-টু-ফেস। কেন না, আপনার কণ্ঠস্বর আমাদের চেনা চেনা লাগছে। তাই মুখটা একবার দেখতে চাই।”

“বেশ। তোমরা এই ডায়াসের বাঁদিক দিয়ে ওপরে উঠে এসো।”

বাবলুরা ডায়াসে উঠে বঁদিকে যেতেই একটা কাঠের সিঁড়ি দেখতে পেল। তাই বেয়ে ওপরে উঠেই দেখল, একটা ঘোরানো চেয়ারে ওদের দিকে পিছন হয়ে বসে আছেন এক বলিষ্ঠ পুরুষ। পরনে প্যান্ট, শার্ট ও মাথায় নেভি ক্যাপ। হাতে ঝকঝক করছে একটি অটোমেটিক রিভলভার।

বাবলুরা ওপরে উঠে বলল, “এসেছি।”

ভদ্রলোক ওদের দিকে ঘুরে বসলেন।

তাকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমক উঠল বাবলুরা। সবিস্ময়ে বলল, “এ কী! আপনি!”

“হ্যাঁ, আমি। আমি তোমাদের সাহসের প্রশংসা করি। বীরত্বকে স্বাগত জানাই। তবুও আমাদের দলের স্বার্থে আমি তোমাদের প্রত্যেককে মারব।”

“কিন্তু তাতেও আমরা ভীত নই নিবারণবাবু।”

“কেন নও?”

“আপনার হয়তো ধারণা যে আমাদের মেরে ফেললেই আপনারা নিষ্কণ্টক হবেন। কিন্তু সে ধারণা ভুল। আপনারা জানেন না এতক্ষণে পুলিশ আপনাদের দুয়ারে এসে উপস্থিত হয়েছে।”

“পুলিশের বাবারও ক্ষমতা নেই যে এখানে আসে। চারদিকে আমাদের অতন্দ্র প্রহরী।”

“তাই নাকি! তা হলে জেনে রাখুন। আমাদের ট্রেনিং দেওয়া কুকুর পঞ্চুই পুলিশকে ডেকে আনতে গেছে। এমন সময় হঠাৎ সেখানে শ্যামসুন্দরজিকে হস্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেল, “আরে ভেইয়ো! অন্দর মে যো কোই হ্যায়, সব জলদি তৈয়ার হো যাও। বাহার মে বহৎ পুলিশ আ গিয়া।”

নিবারণবাবু চমকে উঠে বললেন, “কিন্তু পুলিশ এই ঘাঁটির সন্ধান পেল কী করে?”

“আরে ক্যা বর্তীউ। এ বদমাশ লেড়কা-লেড়কি কো সাথ যো কুত্তা থা ও পুলিশ লেকে আয়া।”

বাবলু দেখল এই সুযোগ। আচমকা জুতোসুদ্ধ পায়ে নিবারণবাবুর হাতে মারল এক লাথি। রিভলভারটা হাত থেকে ছিটকে খানিকটা অন্তরে গিয়ে পড়ল। তারপর চমকের ঘোর কাটিয়ে ওঠার আগেই বাবলু, বিলু আর ভোম্বল একসঙ্গে ধাঁপিয়ে পড়ল নিবারণবাবুর ওপর। কিন্তু কী অমানুষিক শক্তি ভদ্রলোকের গায়ে। এক এক ঝটকায় ওদের তিনজনকে তিন দিকে ফেলে দিয়ে ওপর থেকে লাফিয়ে নীচে নামলেন। দলের লোকদের বললেন, “চলো সব। তাড়াতাড়ি চলো। একটি পুলিশও যেন ভেতরে ঢুকতে না পারে। গুলির জবাবে গুলি চাই।”

কিন্তু ততক্ষণে পুলিশ ঢুকেই পড়েছে। সেই কাপালিক এবং কয়েকজন প্রাণের দায়ে ছুটে আসছে এদিকে। ওদের পিছু পিছু হাউ হাউ করে ছুটে আসছে পঞ্চু। তারও পিছনে আসছেন মি. শিকদার, মি. চ্যাটার্জি ও একদল পুলিশ।

পঞ্চু এসেই শ্যামসুন্দরজিকে সামনে পেয়ে, যেন ছোট ছেলে কতদিন বাপের কোলে ওঠেনি, এমন ভান দেখিয়ে লাফিয়ে শ্যামসুন্দরজির কোলে উঠে পড়ল। তারপর দু হাতে গলা জড়িয়ে মুখের দিকে চেয়ে গ্যাগ্যা’ শব্দ করতে লাগল। আর শ্যামসুন্দরজি? তার তখন সেই বিশাল ভূড়ি নিয়ে প্রাণের দায়ে সে কী দারুণ ড্যান্স। টিকিট কেটে দেখবার মতো।

মি. শিকদার এসেই নিবারণবাবুর দিকে রিভলভার তাগ করে বললেন, “হ্যান্ডস আপ।” নিবারণবাবু মুহুর্তের মধ্যে ভল্ট খেয়ে লাফিয়ে পড়লেন মি. শিকদারের ওপর। মি. শিকদারের হাত থেকে রিভলভারটা পড়ল দূরে। নিবারণবাবু দু হাতে শিকদারকে জড়িয়ে ধরে মেঝের ওপর শুইয়ে গলা টিপে ধরলেন।

মি. চ্যাটার্জি তখন সামলাচ্ছেন অন্যদের। দড়াদুম গুলির ঘায়ে দু-তিনটিকে ইতিমধ্যেই শুইয়ে দিয়েছেন তখন।

এদিকে মি. শিকদারও দু’পা জোড় করে প্রবল বেগে মারলেন নিবারণবাবুর পেটে এক লাথি। নিবারণবাবু ছিটকে গিয়ে পড়লেন যেখানে, মি. শিকদারের রিভলভারটা পড়েছিল সেইখানে। চকিতে সেটিকে কুড়িয়ে নিয়েই তিনি এক লাফে চলে এলেন চামুণ্ডা মূর্তির পিছনে। তারপর সেখান থেকে যেই না গুলি করতে যাবেন মহুয়াদি অমনি পিছন দিক থেকে সজোরে একটা ধাক্কা দিলেন নিবারণবাবুকে নিবারণবাবু টলে গেলেন এবং গুলি লাগল গিয়ে কাপালিকের বুকে।

মি. শিকদার ওরই মধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তখনও তিনি নিরস্ত্র। গতিক সুবিধের নয় বুঝে বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিবারণবাবুর ওপর। নিবারণবাবু আবার ওদের ছিটকে ফেলে দিতে লাগলেন এবং মি. শিকদারকে লক্ষ্য করে গুলি চালালেন। গুলিটা বুকে না লেগে লাগল কাঁধে। মি. শিকদার আর্তনাদ করে এক হাতে কাঁধ চেপে বসে পড়লেন। আর সেই মুহুর্তেই ক্রোধান্ধ বাবলুর হাতে নিজের পিস্তলটা উঠে এল। নিবারণবাবু পরবর্তী গুলি চালাবার আগেই বাবলুর পিস্তল গর্জে উঠল—‘গুডুম’। তাড়াতাড়িতে লক্ষ্যস্থান ফসকে গিয়ে গুলি লাগল নিবারণবাবুর মাথায়। মাথাটা চুরমার হয়ে গেল। নিবারণবাবু রক্তাক্ত কলেবরে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।

যুদ্ধ থামল। এখন আর বাধা দেওয়ার কেউ নেই। ভেতরে যারা ছিল, তারা সবাই অ্যারেস্ট হয়েছে। কয়েকজন মরেছে। ওরা শ্রান্ত ক্লান্ত ভাবে বাইরে বেরিয়ে এল। পুলিশের লোকেরা নীচের মূল্যবান ধনরত্বগুলো উদ্ধার করলে লাগল। মি. চ্যাটার্জি ও মি. শিকদার বাবলুদের সঙ্গে বাইরে এলেন।

বাইরেও অনেকে গ্রেফতার হয়েছে। বাবলু, মি. শিকদার ও মি. চ্যাটার্জিকে কাল রাতের ঘটনার কথা বলল, কী ভাবে ওরা শালবল্লীর ভেতরে গর্ত করে মূল্যবান জিনিসগুলো রেখে প্লাস্টার করে দিচ্ছে এবং তার ওপর কালো আলকাতরার দাগ টেনে পুলিশের চোখে ধুলো দিচ্ছে, সব বলল। মালগুলো যে শ্যামসুন্দরজির গোলায় গাদা হচ্ছে এবং সেখান থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে তাও বলতে ভুলল না।

মি. চ্যাটার্জি উৎসাহিত হয়ে বললেন—“তাই নাকি! কই চলো তো দেখি?”

এই বলে ওরা সদলে শ্যামসুন্দরজির কাঠগোলায় গিয়ে হাজির হল। এবং সেখানে গিয়ে শালবল্লীগুলো পরীক্ষা করতেই সোনার বাট, হিরে প্রভৃতি মূল্যবান রত্ন বেরিয়ে পড়তে লাগল এক এক করে।

মি. চ্যাটার্জি বাবলুকে ধন্যবাদ জানিয়ে মি. শিকদারকে বললেন, “আপনি এদের নিয়ে চলে যান মি. শিকদার, আমি সব দেখছি। আপনি তাড়াতাড়ি গিয়ে কাঁধ থেকে গুলিটা বার করার ব্যবস্থা করুন। আর দেরি করবেন না | ”

মি. শিকদার বললেন, “হ্যাঁ, যাই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।” এই বলে বাবলুদের নিয়ে চলে গেলেন তিনি। থানায় গিয়ে বাবলুরা দেখল ওর মাসিমা-মেসোমশাই ফিরে এসেছেন এবং অপেক্ষা করছেন ওদের জন্য। বাবলুকে দেখেই আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন তারা। বাবলু মহুয়াদির সঙ্গে ওর মাসিমা-মেসোমশাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিল।

বিলু বলল, “সত্যি, পঞ্চু এ যাত্রায় আমাদের যে উপকার করল তা সকল অভিযানকেই ছাপিয়ে গেছে।”

বাবলু বলল, “পঞ্চুর ঋণ আমরা কোনও দিনও শোধ করতে পারব না।”

ওরা যখন থানা থেকে বেরিয়ে মাসিমার বাড়িতে যাচ্ছে তখন দেখল, হাতে হাত কড়া ও কোমরে দড়ি জড়িয়ে শ্যামসুন্দরজিকে পুলিশের লোকেরা টানতে টানতে থানায় নিয়ে আসছে।

বাবলুরা দূর থেকে শ্যামসুন্দরজিকে ডেকে হাত নেড়ে বলল, “টা-টা।”

শ্যামসুন্দরজি ক্রুদ্ধ চোখে একবার তাকালেন ওদের দিকে। পঞ্চু গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠল, “ভৌ। ভৌ-ভৌ।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *