পাণ্ডব গোয়েন্দা : দ্বিতীয় অভিযান – জিপসি রহস্য
এরপর একদিন বিকেলবেলা মিত্তিরদের বাগানে খেলা করছে পাণ্ডব গোয়েন্দারা, এমন সময় হঠাৎ গুলঞ্চ গাছের ডাল থেকে কে যেন বলে উঠল, “চোর চোর।”
সেই না শুনেই চেঁচিয়ে উঠল পঞ্চু, “ভৌ- ভৌ-ভৌ।”
বাবলু বলল, “কী ব্যাপার বল তো?”
বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “আরে, কী চমৎকার একটা কাকাতুয়া পাখি রে। বাবলুদা শিগগির ধরে পাখিটাকে।”
বাবলু অবাক হয়ে বলল, “এই বনে কাকাতুয়ার বাসা আছে নাকি? জানতুম না তো।”
বিলু বলল, “অসম্ভব। কাকাতুয়া পাখি এখন তো বিরল হয়ে এসেছে। যাও-বা পাওয়া যায় তারও দাম বাজারে অনেক।”
বাবলু বলল, “এ নিশ্চয়ই কারও পোষা-পাখি।”
ভোম্বল বলল, “যারই হোক। ধরতেই হবে পাখিটাকে।”
পঞ্চুু তখনও সমানে চেঁচিয়ে চলেছে, “ভৌ-ভৌ-ভৌ-ভৌ-ভৌ।”
ভোম্বল বলল, “তুই পঞ্চুকে ধরে থাক বাবলু। আমি পাখিটাকে কায়দা করি। না হলে ওর চেঁচানিতেই উড়ে যাবে পাখিটা।”
বলতে বলতেই উড়ে গেল পাখিটা। বেশি দূরে অবশ্য যেতে পারল না। খানিক গিয়েই একটা ঝোপের ওপর ছোট্ট একটি ডালে বসে পড়ল।
ভোম্বল বলল, “তোরা যেন আসবি না কেউ। আমি পিছু নিচ্ছি পাখিটার। ওটাকে ধরতে না পারলে আমার মনে শান্তি আসবে না।” এই বলে পাখিটাকে ধরবার জন্য ঝোপের দিকে ছুটল ভোম্বল।
পাখিটা আবার উড়ে পড়ল। উড়ে আর একটু দূরে গিয়ে বসল। ছোট্ট একটা টগর ফুলের গাছ ছিল, তার ডালে।
ভোম্বল সেখানেও যেই গেল পাখিটা সেখান থেকেও উড়ে গেল। এইভাবে পাখিটার পিছু নিতে নিতে ভোম্বল একেবারে বাগানের শেষ-প্রান্তে গিয়ে পৌছুল। এইখানে একটা মস্ত কঁঠাল গাছ ছিল। সেই কাঁঠাল গাছের ঘন ডালপালার আড়ালে গিয়ে লুকল পাখিটা।
ভোম্বল তখন অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তবুও সে পাখিটার লোভে একটু একটু করে ডাল বেয়ে সেই গাছের মগডালে উঠতে লাগল। ওই তো দেখা যাচ্ছে পাখিটাকে। কেমন নিশ্চিন্তে বসে আছে বাছাধন। ধূর্ত বেড়ালের মতো চুপিসারে ভোম্বল পকেট থেকে রুমালটা বার করে যেই না ধরতে যাবে, দুষ্ট পাখিটা আমনি ক্যাঁ-ক্যাঁ করেই ফুডুত। বাগান পেরিয়ে একেবারে প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির দোতলার বারান্দায় গিয়ে বসল পাখিটা। আর সেদিকে যেই না তাকানো, অমনি চক্ষুস্থির হয়ে গেল ভোম্বলের দেখল এক বিজাতীয় চেহারার লাল মুখ বারান্দার থামের আড়াল থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছে ওকে। সে দেখা এমনই দেখা যে ভোম্বলের বুকের একদম ভেতরের জায়গাটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। এ মুখাবয়ব অমানুষিক। ভৌতিক ছাড়া আর কিছুই নয়। যেই না এ কথা মনে হওয়া অমনি সুড় সুড় করে গাছ থেকে নেমেই একেবারে তীরবেগে ছুটে চলল ভোম্বল সেই পোড়ো বাড়ির দিকে, যেখানে আর সকলে ওর জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
পরদিন সকালবেলা প্রত্যেকটি খবরের কাগজে এক চাঞ্চল্যকর খবর ছাপা হল। প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির মালিকের স্ত্রীকে কে বা কারা যেন নৃশংসভাবে হত্যা করেছে এবং তার সমস্ত গয়না চুরি করে নিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে নিয়ে গেছে একটি পোষা কাকাতুয়া পাখি। পাখিটা অবিকল মানুষের মতো কথা বলতে পারত। পুলিশ এই খুনের বিষয়টি নিয়ে খুবই চিন্তায় পড়ে গেছে। কেন না, আততায়ীর পায়ের ছাপ ঘরের ভেতরে পাওয়া গেলেও ঘরের বাইরে উঠোনে মাঠে সিঁড়িতে কোনওখানেই তার এতটুকু পদচিহ্ন নেই।
খবরটা পড়েই লাফিয়ে উঠল ভোম্বল। যাকে দেখে সে ভূত ভেবে ভয় পেয়েছিল আসলে সেই লোকটাই যে খুনি তাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না তার। ভাগ্যে পাখিটা উড়ে এসে ‘চোর চোর’ বলে ডেকেছিল, তাই তো পাখিটাকে ধরতে গিয়ে আসল ঘুঘুকে দেখে ফেলেছে সে। দৃশ্যটা মনে পড়তেই শিউরে উঠল ভোম্বল। উঃ, কী সাংঘাতিক সেই মুখ!
ভোম্বল আর একটুও দেরি না করে বাচ্চু-বিচ্ছু আর বিলুকে নিয়ে বাবলুদের বাড়িতে গেল। তারপর সবাই জড়ো হল বাবলুদের ছাদে।
কালকের ঘটনাটা কালই ওদের বলেছিল ভোম্বল। শুনে সবাই হেসেছিল। কিন্তু আজকের কাগজে খবরটা পড়ার পর কেউ আর হাসতেও সাহস করল না।
ভোম্বল বলল, “এই কেসটা কি আমাদের হাতে নেওয়া যেতে পারে।”
বাবলু বলল, “নিশ্চয়ই খুনিকে যখন দেখেছিস তুই, তখন আর তাকে চিনে ফেলতে খুব একটা দেরি হবে না আমাদের। ওকে আমরা ধরবই ধরব।”
বিলু বলল, “দরকার হলে এ ব্যাপারে আমরা পুলিশেরও সাহায্য নেব। পুলিশ তো চিনেই গেছে আমাদের।”
বাবলু বলল, “ঠিক। কালকের ঘটনার কথা এখনই আমরা গিয়ে পুলিশকে বলি চল। তাতে করে খুনিকে ধরতে ওদেরও একটু সুবিধে হবে।”
সবাই তখন দল বেঁধে থানায় চলল খুনির বর্ণনা দিতে। পঞ্চুও অবশ্য ওদের সঙ্গে যেতে বাদ পড়ল না।
থানায় গিয়ে ভোম্বল সব কথা খুলে বলতেই ওসি অবাক হয়ে বললেন, “আশ্চর্য ব্যাপার।” তারপর বললেন, “ঠিক কী রকম সময়ে দেখেছ বল তো?”
“আজ্ঞে, সন্ধের মুখে। আর লোকটার মুখ কী রকম যেন। আমাদের সাধারণ লোকের মুখের মতো নয়।”
ওসি গম্ভীরমুখে সব কথা শুনে যা যা নোট করবার সব নোট করে নিলেন। তারপর বললেন, “আমরা এ ব্যাপারে জোর তদন্ত চালাচ্ছি। যদি প্রয়োজন হয় তোমাদের ডাকব। তোমরা এখন থেকে চেষ্টা করবে সেই মুখ আর কখনও দেখতে পাও কিনা। যেই পাবে অমনি জানাবে আমাকে। যদি দূরে কোথাও দেখতে পাও, তা হলে তাড়াতাড়ি ফোন করে সেই জায়গাটার নাম বলে জানাবে। সঙ্গে সঙ্গে ধরব ব্যাটাকে। আর সেই সঙ্গে খবরের কাগজেও নাম ছাপিয়ে দেব তোমাদের। পাণ্ডব গোয়েন্দা নামটা দেখবে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবে।”
ওরা থানা থাকে বেরিয়ে এক জায়গায় হঠাৎ একটা ডুগডুগ বাজনা শুনে থমকে দাঁড়াল। আরও অনেকেই দাঁড়িয়েছে সেখানে। ওরাও দাঁড়াল।
বাঁশ আর দড়ি দিয়ে একটা অংশকে ঘিরে খেলা দেখাচ্ছে একজন ইরানি যাযাবর ও এক জিপসি মেয়ে। মেয়েটি ঘাগরা উড়িয়ে এক অদ্ভুত কায়দায় অপূর্বভাবে নেচে চলেছে। আর ইরানিটা সেই নাচের তালে তালে ঢোল বাজিয়ে কসরত দেখাচ্ছে পাশেই একটি ছোট্ট তাবু সেই তাবুর আশেপাশে কতকগুলো মুরগি ঘোরাঘুরি করছিল। বেশ নধর চেহারা মুরগিগুলোর একটা ছাগল এবং একটা কুকুরও বাঁধা ছিল সেখানে। পঞ্চু হঠাৎ সেই মুরগিগুলোর দিকে ভৌ-ভৌ করে তেড়ে গেল। যেই-না-যাওয়া ইরানিদের কুকুরটাও অমনি দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে তার প্রতিবাদ করে উঠল। নেহাত বাঁধা ছিল তাই রক্ষে। না হলে যা তেজি কুকুর, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত বোধ হয়। ,
ইরানিটা ঢোল থামিয়ে একটা লাঠি হাতে তেড়ে এল পঞ্চুকে। যেই-না-আসা অমনি খুব কাছ থেকে লোকটার মুখ দেখেই চমকে উঠল ভোম্বল। তারপর চুপি চুপি বাবলুর কানের কাছে মুখ এনে বলল, “বাবলু! এই মুখই কাল আমি দেখেছি। এই সেই লোক।”
তাড়া খেয়ে পঞ্চু তখন পালিয়ে এসেছে। আর ভোম্বল বাবলুর পিছনে এমনভাবে এসে দাঁড়িয়েছে যে ইরানিটা যেন ওকে দেখে না ফেলে। পঞ্চুকে তাড়িয়ে লোকটা আবার ঢোল পিটতে লাগল। আবার শুরু হল জিপসির নাচ। পাণ্ডব গোয়েন্দারা চলে এল সেখান থেকে। খানিকটা তফাতে এসে বাবলু বলল, “তুই ঠিক বলছিস ভোম্বল? এই সেই লোক?”
“আমার এতটা ভুল হবে না বাবলু। এই সেই লোক। শুধু লোকটা এতক্ষণ পিছন ফিরে ঢোল বাজাচ্ছিল বলে ওর মুখটা আমি দেখিনি ভাল করে।”
বিলু বলল, “এই লোকটাই তা হলে খুনি বলতে চাস?”
ভোম্বল বলল, “খুনি কিনা তা বলতে পারি না। তবে কাল প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির বারান্দায় এই মুখই আমি দেখেছি। এ মুখ আমি জীবনে ভুলব না।”
বাবলু বলল, “তা যদি হয় তবে এই লোকটাই হত্যাকারী।”
বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “তা হলে কি একবার থানায় গিয়ে জানিয়ে আসব?”
বাবলু বলল, “না। এখনই তার কোনও প্রয়োজন নেই। যেমন করেই হোক চোরাই মাল আমাদের উদ্ধার করতেই হবে। আজ বিকেলবেলা আবার আসব আমরা এইখানে এবং দুপুরবেলা একবার আমরা স্পটে যাব।”
ভোম্বল বলল, “বেশ, তাই হবে।”
ওরা সবাই চলে এল যে যার ঘরে।
দুপুরবেলা প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির মেইন গেটের কাছে এসে ওরা দেখল গেট বন্ধ। ফ্যাক্টরিও বন্ধ আজকে। কালকের ওই ব্যাপারের পর আজ কখনও খোলা থাকতে পারে না। সে যাই হোক, এখন মুশকিল হল ভেতরে ঢোকা যায় কী করে?
বাবলু বলল, “এর ভেতরে ঢোকবার একটিমাত্র উপায় আছে।”
বিলু বলল, “কী উপায় বল?”
“মিত্তিরদের বাগানের পিছন দিক দিয়ে ভেতরে ঢোকা।”
ভোম্বল বলল, “কিন্তু সেখানে তো কোনও ফাঁক নেই।”
“একটু বুদ্ধি খরচা করলেই ভেতরে ঢোকা যায়।”
“যে গাছে ভোম্বল উঠেছিল সেই গাছের ডালে একটা বেশ শক্ত মোটা লম্বা দড়ি বেঁধে সেই দড়ি বেয়ে নীচে নামা যায়।”
“দি আইডিয়া।”
ভোম্বল বলল—“ঠিক আছে, তোরা যা! তারপর আমি যাচ্ছি। আমি এখনই নিয়ে আসছি আমাদের কুয়োর জল তোলা লম্বা নাইলনের দড়িটা।” এই বলে ভোম্বল চলে গেল।
বাবলুরা সবাই তখন বাগানের শেষ প্রান্তে সেই গাছের ওপর উঠেছে। এখান থেকে ফ্যাক্টরির বারান্দা খুব ভালভাবে দেখা যাচ্ছে। জায়গাটাও অনেকখানি। চারদিক ঘেরা। নীচে ফ্যাক্টরি। ওপরে মালিক থাকেন। কাজেই মেশিনের ঘরঘর শব্দে ওপরের চিৎকারও কানে যাবার নয়। কিন্তু কী সাহস ব্যাটার। অমন ভর সন্ধেবেলা দিব্যি এসে খুন করে গেল।
একটু পরেই ভোম্বল এসে পড়ল দড়ি নিয়ে।
দড়ি ধরে পাঁচিল টপকে সর্বাগ্রে বাবলু নামল ভেতরে। তারপর পঞ্চুুকে বেঁধে নামানো হল। পঞ্চুুর পরে বাচ্চুু-বিচ্ছু। সবশেষে বিলু আর ভোম্বল।
সবাই নেমে পড়ার পর প্রথমে চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল কোথাও খুনি তার সুকৌশল খুনের কোনওরকম চিহ্ন রেখে গেছে কিনা তা দেখবার জন্য। কিন্তু না। কোনও চিহ্ন কোথাও নেই। কী অদ্ভুত ও রহস্যময় হত্যাকাণ্ড। একটা মানুষ খুন হল, আততায়ীর পদচিহ্ন পাওয়া গেল অথচ সেটা ঘরের ভেতর। ঘরের বাইরে কোথাও নয়। আততায়ী কি ম্যাজিক জানে?
এমন সময় হঠাৎ পঞ্চুু ভৌ-ভৌ করে একটা ঝোপের দিকে ছুটে গেল।
পঞ্চুকে ছুটতে দেখে পঞ্চুর পিছু পিছু সর্বপ্রথম ছুটে গেল বিলু। বিলু গিয়ে দেখল এক জায়গায় পঞ্চুু একমনে কী যেন শুকছে। তাই দেখেই সে উৎসাহিত হয়ে বলল, “এই দেখ বাবলু, এখানে কীসের যেন দাগ | ”
বাবলু অনেকক্ষণ ধরে গবেষকের মতো দাগগুলোর আশপাশ লক্ষ করে রায় দিল, “এটা আততায়ীর কোনও চিহ্ন নয়।”
“এখানে পুলিশ এসেছিল। চারদিকে বুটের ছাপ আছে। এ দাগ পুলিশের লাঠি ঠোকার। চলে আয়। একবার বারান্দার ওপরে উঠতে হবে আমাদের।”
বিচ্ছু বলল, “কী করে উঠবে? চারদিকে তা তালা দেওয়া।”
“পাইপ বেয়ে ওপরে উঠব। তোরা একটু গেটের দিকে নজর রাখবি, যাতে কেউ এসে না পড়ে।”
বিলু বলল, “এসে পড়বার ভয় নেই। কেন না মর্গ থেকে লাশ নিয়ে দাহ করে আসবে তো সব। কাজেই দেরি হবে।”
বাবলু নিশ্চিন্ত মনে পাইপ বেয়ে ওপরে উঠল। উঠেই দেখতে পেল বারান্দায় পুলিশের পায়ের ছাপ এবং এক কোণে অন্য একটি পায়ের ছাপ রয়েছে। ঘর বন্ধ। ও আস্তে আস্তে ছাদের সিঁড়ির কাছে গেল। তারপর দরজার খিল খুলে ছাদে উঠে চারদিক দেখতে লাগল খুনি ছাদ দিয়ে নেমেছে বা পালিয়েছে কি না। কিন্তু না সেখানে আততায়ীর কোনও চিহ্নই সে দেখতে পেল না। হঠাৎ চিলেকোঠার সিঁড়িতে একজোড়া পায়ের ছাপ সে লক্ষ করল। বেশ বড় বড় জুতোহীন পায়ের ছাপ। কেউ যেন এই সিঁড়িতে বেশ কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিয়েছে।
বাবলু একটা ঝাঁটাকাঠি কুড়িয়ে সেই ছাপটার মাপ নিয়ে তাড়াতাড়ি বারান্দায় এসে অপর ছাপটার মাপ মিলিয়ে দেখল। হুবহু একই ছাপ। একই মাপ। কাঠিটা নিয়ে আবার পাইপ বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে এল সে। তারপর বলল, “আমাদের প্রাথমিক তদন্ত শেষ। এবার চল, স্বস্থানে প্রস্থান করি।” এই বলে ওরা সেই ঝুলনো দড়ির কাছে গেল। কিন্তু এ কী? দড়ি কোথায়? ওরা ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল গাছের ডালের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা দড়িটা কে যেন খুলে নিয়ে গেছে। কে নিল? কে? কে সে?
বিলু বলল, “আশ্চর্য ব্যাপার তো?”
বাবলু বলল, “কিছুই আশ্চর্য নয়। যে খুন করেছে সে নিজেই এসে খুলে নিয়ে গেছে ওটা।”
ভোম্বল বলল, “এ অসম্ভব।”
“এটাই সম্ভব। খুনিরা চিরকাল এই ভুলটাই করে থাকে। খুনের পর ঘটনাস্থলের আশপাশেই ঘুরে বেড়ায় তারা। কেবল দেখে তার কোনও চিহ্ন কোথাও পড়ে আছে কিনা অথবা তাকে কেউ সন্দেহ করছে কি না।”
বিলু বলল, “তা হলে উপায়? এখন আমরা বেরোব কী করে এর ভেতর থেকে?” বাবলু বলল, “কোনও উপায় নেই। যতক্ষণ না ওরা ফিরে আসে ততক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”
বিলু বলল, “আশ্চর্য ব্যাপার। এরা সবাই না হয় লাশ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু দারোয়ান ব্যাটা? সে ব্যাটা গেল কোথায়?”
ভোম্বল বলল, “দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।” বলতে বলতেই দেখা গেল গেট খুলে যাচ্ছে। ওরা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়ল একটা ঝোপের আড়ালে। গেট খুলে কয়েকজন লোক ভেতরে ঢুকল। তাদের একজন হলেন এই ফ্যাক্টরি এবং বাড়ির মালিক। বাকিরা তার বন্ধুবান্ধব। ওঁরা সবাই ভেতরে এলেন। গেটটা ভেজিয়ে দিয়ে বাড়ির তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন। সেই অবসরে ওরাও সকলে বেরিয়ে পড়ল গেট দিয়ে।
বাবলুরা বাইরে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল তখন। বাবলু বলল, “এখন একবার ময়দানের দিকে আমাদের যাওয়া উচিত।”
ভোম্বল বলল, “আমি একটু তফাতে থাকব, কেমন? না হলে ব্যাটা আমাকে চিনে ফেলতে পারে।”
বাবলু বলল, “সেটার আর প্রয়োজন নেই। তার কারণ গাছ থেকে দড়ি যখন খুলেছে তখন আমাদেরকে সে নিশ্চয়ই লক্ষ করেছে।”
বিলু বলল, “তারই বা কী মানে আছে? হয়তো সে আমাদের দেখেনি। শুধু দড়িটাই ঝুলতে দেখেছে। তাই খুলে নিয়ে পালিয়েছে সে।”
বাবলু বলল, “যা হোক একটা কিছু হয়েছে। তবে আমরা সবাই একসঙ্গেই থাকব।” এই বলে কথা বলতে বলতে ওরা ময়দানের দিকে গেল। কিন্তু কোথায় কে? কোথায় সেই ইরানি যাযাবর আর কোথায় বা সেই জিপসি মেয়ে? ছাগল, বাদর, কুকুর, তাবু সবই উধাও।
তাই দেখে হতবাক হয়ে গেল ওরা। ভোম্বল বলল, “ওঃ! সকালে যদি একবার থানায় গিয়ে খবরটা দিতাম। কী ভুলই না করলাম আমরা। অথচ এখন আর মুখই নেই আমাদের।”
বাবলু বলল, “এত ভেঙে পড়বার কিছু নেই। একটা বেলার মধ্যে যাবে কোথায় বাছাধনরা। ওদের খুঁজে বার আমরা করবই করব।”
ভোম্বলের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
আর পঞ্চ অকারণেই শুকে বেড়াতে লাগল মাঠের মাটিটাকে এবং নিজের মনেই রাগে গরগর করতে লাগল।
পরদিন সকালের কাগজে আবার এক চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হল। তুলসী মিত্তির গার্ডেন লেনের এক বাড়িতে গভীর রাতে রহস্যজনকভাবে চুরি হয়েছে। টাকাকড়ি এবং সোনার গয়না মিলিয়ে প্রায় বিশ হাজার টাকার মতো চুরি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, এ ক্ষেত্রেও চোরের পদচিহ্ন শুধুমাত্র ঘরে, বারান্দায় এবং ছাদের ওপর পাওয়া গেছে। এর বাইরে আর কোথাও নয়। প্রথম খুনির পায়ের ছাপের সঙ্গে এই পায়ের ছাপ হুবহু মিলে যাচ্ছে।
খবরটা দেখেই পাণ্ডব গোয়েন্দারা দলবদ্ধভাবে ছুটল ঘটনাস্থলে। গলির মুখে একটা ছোটখাটো ভিড় হয়ে আছে। সেখানে বাবলুর চেনা জানা একজন ছিল।
বাবলু তাকে জিজ্ঞেস করল, “কাদের বাড়ি চুরি হয়েছে?” সে একজন বেঁটে কালো লোককে দেখিয়ে দিল। বাবলু চিনল লোকটাকে। রেলের ক্যান্টিনে কাজ করে। অনেকদিন আগে যখন ওদের পাড়ায় ভাড়া থাকত লোকটা তখন একবার ক্যান্টিন থেকে আনা চপ কাটলেট ওদের খাইয়েছিল। বাবলু ভেবে পেল না লোকটা এর মধ্যে এত টাকা কী করে করল। যাই হোক, এ রকম চুরি সত্যিই অভাবিত।
ওরা অনেকক্ষণ ধরে আশপাশে ঘোরাঘুরি করল। কিন্তু কে-ই বা ওদের পাত্তা দেবে? ওরা নিজের মনেই আর একটু এগিয়ে গেল। হঠাৎ এক জায়গায় ডুগ ডুগ ডুগ ডুগ আওয়াজ।
ডুগডুগির আওয়াজ শুনে এগিয়ে গেল ওরা। দেখল যে মাঠে শীতলা পুজো হয় সেই মাঠের ওপর খেলা দেখাচ্ছে সেই ইরানি যাযাবর আর সেই জিপসি মেয়েটা। অপূর্ব সুন্দরী। ইরানিটাও যেন লালমুখো একটা দানব। একসঙ্গে কুড়িটা সোডার বোতল সে একটা ছুড়ছে একটা লুফছে। কী অপূর্ব ব্যালান্স। বোতলগুলো যেন শূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ সে একের পর এক ডান হাতে বা হাতে লুফেই ছুড়ে দিচ্ছে। সে দৃশ্য দেখবার মতো। সেই কুকুর, ছাগল, বাদর সবই আছে। জিপসি মেয়েটা ডুগডুগি বাজিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে চারিদিকে।
পাণ্ডব গোয়েন্দারা প্রথমটা মহাবিস্ময়ে সেই খেলা দেখতে লাগল। বিলু, ভোম্বল, বাচ্চ, বিচ্ছু অবাক হয়ে বোতলের ম্যাজিক দেখছে। আর বাবলু একদৃষ্টে চেয়ে আছে ইরানিটার পায়ের দিকে। পায়ের প্রতিটি ছাপ ধুলোর মাঠে অাঁকা হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি পদক্ষেপ।
বাবলু বিলুর গায়ের কাছে ঘেঁষে দাড়িয়ে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চুপি চুপি বলল, “কালকের রহস্যজনক চুরিও এই ব্যাটাই করেছে।”
“সে তো জানা কথা।”
“আমি একে ফলো করব। তোরা এক কাজ কর, এখানে আর থাকিস না। ঘরে গিয়ে স্নান খাওয়া করে তৈরি হয়ে নে। ভোম্বল, তুই বরং খেয়েদেয়েই চট করে চলে আয়। তুই এলে তারপর আমি যাব। বিলু, বাচ্চু আর বিচ্ছু মিত্তিরদের বাগানে থাকবি। পঞ্চও থাকবে তোদের সঙ্গে। আমি খবর দিলেই চলে আ সবি। কেমন?”
“বেশ তাই।” এই বলে ওরা চলে যেতেই বাবলু দর্শকদের ভেতর মিশে খেলা ও খেলোয়াড়কে তীক্ষুচোখে দেখতে লাগল।
বোতলের খেলা শেষ হতেই একটার পর একটা পয়সা পড়তে লাগল মাঠের ওপর। দশ, পাঁচ, সিকি।
ইরানি যাযাবরটা তখন ঘৰ্মাক্ত কলেবরে একটা গাছতলায় বসে বিশ্রাম নিতে লাগল। বাবলুও নিজের মনে এটা সেটা দেখার ছলে লক্ষ করতে লাগল চারদিকে। ইরানিটা হঠাৎ বাজখাই গলায় বলল, “এই, কী চাই তোমার?”
বাবলু বলল, “কিছু না। তোমার বোতলের খেলা আমার খুব ভাল লেগেছে।”
“বিকেলে আবার হবে। দেখতে এসো। এখন যাও। আমরা এবার রান্না করে খাওয়া-দাওয়া করব। বিকেলে তোমাদের আরও সব বন্ধুবান্ধব থাকে তো ডেকে আনবে, বুঝলে?”
বাবলু হ্যাঁ বলে ওর সামনে থেকে চলে এল। তবে দূরে একটা মোড়ের মাথায় বসে রইল চুপচাপ। ভোম্বল না আসা পর্যন্ত ওইভাবেই থাকবে ও তারপর ভোম্বলকে পাহারায় রেখে খেতে যাবে।
ভোম্বল এল প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পরে। নিজের জায়গায় ভোম্বলকে বসিয়ে বাবলু ঘরে চলে গেল। বাবলুর মনে জোর প্রতিজ্ঞা, খুনি-তস্কর ইরানিটাকে আজই বামাল সমেত ও ধরাবেই ধরাবে।
বিলু, বাচ্চু আর পঞ্চ অপেক্ষা করছিল মিত্তিরদের বাগানে। বাবলু গিয়ে ওদের ডাকল। ওরা সকলেই খেয়েদেয়ে একদম তৈরি।
“ভাল। আজ বিকেলে বোতলের খেলা আবার হবে। সেই খেলা দেখার ভেতরেই আমাদেরকে আমাদের কাজ করে ফেলতে হবে। ”
“কী করে কী করবি?”
“কিছুই ঠিক করিনি। ঘটনা যেভাবে ঘটবে বা সুযোগ যখন যেমন পাব তেমনি কাজে লাগাব।” বলতে বলতে ওরা সেই মাঠটার কাছে গেল।
কিন্তু এ কী! কোথায় বা ভোম্বল, আর কোথায় সেই ইরানি যাযাবর ও জিপসি মেয়ে। তাদের তাবুরও কোনও চিহ্ন নেই।
বাবলু বলল, “ওরা নিশ্চয়ই পাততাড়ি গুটিয়েছে। এবং ভোম্বল ওদের পিছু নিয়েছে। কিন্তু কোন দিকে যে গেল ওরা তা কী করে জানা যায়?”
বিলু বলল, “ভোম্বল না ফেরা পর্যন্ত কিছুই জানা যাবে না।” বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “তার মানে আজ আর কিছুই হচ্ছে না।”
বাবলু বলল, “তবে একটা কাজ হবে।”
বিলু বলল, “কী কাজ ?”
“খুনির পায়ের ছাপ এবং এই ইরানির পায়ের ছাপ মিলছে কিনা জানা যাবে।” বলেই বাবলু সেই কাঠিটা দিয়ে মেপে দেখল পায়ের ছাপ। আর মেপে দেখেই সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, “হুরররে। মিলেছে, ছাপ হুবহু মিলে গেছে।”
বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “তা হলে এখনই পুলিশকে জানাই চলো। আর দেরি করা কোনওমতেই ঠিক হবে না।”
“এখনই নয়। আমাদের কাজ আরও একটু এগিয়ে গেলে তারপর ডাকব পুলিশ।”
এমন সময় হঠাৎ রাস্তার ওপর কী যেন দেখে চেঁচিয়ে উঠল বিলু, “বাবলু শিগগির আয়।”
বাবলু যাবার আগেই বাচ্চু-বিচ্ছু ঝুঁকে পড়েছে। বাবলুও গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখল রাস্তার তেমাথার মোড়ে ছোট ইটের টুকরো ঘষে কে যেন একটা তীরচিহ্ন একে পথ-সংকেত করে রেখেছে।
বিলু বলল, “এ নিশ্চয় ভোম্বলের কাজ।”
বাবলু বলল, “অবধারিত। এই চিহ্ন যদি রাস্তার প্রত্যেক মোড়ে থাকে, তা হলে জানব ভোম্বল ছাড়া এ কাজ আর অন্য কারও নয়।”
ওদের অনুমানই ঠিক। সেই চিহ্ন ধরে যেতে যেতেই পরপর কয়েকটি মোড়ে পথ-সংকেত দেখতে পেল। সেই চিহ্ন শেষ হল চ্যাটার্জিহাটের কাছে। একটা বড় মাঠে দেখা গেল ইরানি যাযাবর তার তাবু ফেলছে। জিপসি মেয়েটা কেমন এক সুন্দর ভঙ্গিতে বসে বসে কাঠালপাতা খাওয়াচ্ছে ছাগলটাকে। আর এই ছাগলটাকে লক্ষ করতে গিয়েই বাচ্চু বলে উঠল, “বাবলুদা, ওই দেখ, আমাদের সেই দড়িটা। সেই দড়িটাকেই কেটে ছোট করে ছাগল বেঁধেছে।
বাবলু বলল, “আরে তাই তো। কিন্তু ভোম্বল কোথায়? ভোম্বলকে দেখছি না কেন ?”
বিছু বলল, “সে বোধহয় আমাদের খোঁজেই গেছে।”
বাবলু বলল, “হয়তো।”
বিলু বলল, “চোরাই মালগুলো সব এদের তাবুর ভেতরেই আছে। একবার কোনওরকমে ঢুকে দেখতে পারলে হত।”
কিন্তু কী করে যে ঢুকবে তা ওরা ভেবেও পেল না। তাবুর মুখেই বাঁধা আছে অ্যালসেশিয়ানটা। পঞ্চুকে দেখে সে লেজ নাড়ছে। পঞ্চুও লেজ নাড়ছে তাকে দেখে।
ওরা দূর থেকে ওদের লক্ষ করতে লাগল। আরও অনেক ছেলেমেয়ে ও দু-চারজন বড় লোকের ভিড়ও জমতে শুরু করেছে সেখানে। এমন সময় হঠাৎ ভোম্বল হাঁফাতে হাঁফাতে এসে হাজির হল সেখানে।
বাবলু বলল, “কী রে, কোথায় গেছলি? আমাদের ডাকতে?”
“দুর। তোদের ডাকতে যাব কেন? তোদের জন্যে তো পথ-নির্দেশ করেই রেখেছিলাম। আমি গিয়েছিলাম অন্য কাজে।”
“কী কাজে ?”
“যে কাজে গিয়েছিলাম তাতে সাকসেসফুল হয়ে এসেছি। ব্যাটা ইরানির ষষ্ঠীপুজো করব আজ। আজই ধরব ব্যাটাকে। একটু রাত্রি হোক।”
“কী করে কী করবি? ওই অ্যালসেশিয়ানটাকে বাগাতেই তো হিমসিম খেয়ে যেতে হবে।”
“আরে আমার নাম ভোম্বল। জনিদের রকে পল্টন বসেছিল। ওকে বলতেই ও গিয়ে ঠাকুর ফার্মেসি থেকে এক শিশি ক্লোরোফর্ম জাতীয় কড়া ওষুধ ম্যানেজ করে এনেছে।”
বাবলু যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না, এইভাবে বলল, “সত্যি! তা যদি হয় তবে এটা ছেড়া ন্যাকড়ায় ঢেলে সেটা কুকুরটার দিকে ছুড়ে দিলেই তো ও ব্যাটা শুকবে আর তার পরেই হবে কেল্লা ফতে। ”
বিলু বলল, “শুধু তাই নয়। ওই ন্যাকড়া ইরানিটা এবং ওই জিপসি মেয়েটাকে শোকানো হবে। তা হলেই সুবিধে হবে আমাদের।”
পাণ্ডব গোয়েন্দারা জয়ের গৌরবটা মনে মনে কল্পনা করেই আনন্দে অধীর হয়ে উঠল প্রথমে। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল কতক্ষণে সেই শুভক্ষণটি আসে তার জন্য।
দেখতে দেখতে সন্ধে হল। তারপর অন্ধকারের কালো যবনিকায় ঢেকে গেল চারদিক। যাযাবর তাবুতে আলো জ্বলে উঠল। জিপসি মেয়েটা নিশ্চয়ই ইরানিটার বউ। সে আলো জ্বেলে তাবুর সামনে বসে ছুঁচ-সুতো বার করে তার একটা পুরনো ঘাগরা সেলাই করতে বসল।
আর ইরানিটা শুয়ে রইল বাইরে ঘাসের ওপর। পোষা বাদরটা ইরানিটার বুকে পিঠে, কখনও বা ছাগলটার পিঠে বসতে লাগল। আবার মাঝে মাঝে কুকুরটারও লেজ টেনে দিয়ে পালিয়ে এসে কুকুরটাকে রাগিয়ে দিতে লাগল। তার মানে যত রকমের বাদরামো আছে তাই করতে লাগল বসে বসে।
বাবলু বলল, “আর যে ধৈর্য ধরতে পারছি না। কী করি বল তো?”
বিলু বলল, “সাড়ে সাতটা হয়ে গেছে। মাস্টারমশাইয়েরও আসবার সময় হয়ে গেছে।”
ভোম্বল বলল, “আজ আর ও-আক্ষেপ করে লাভ নেই।”
এমন সময় দেখা গেল ইরানিটা উঠে দাঁড়াল। তারপর কী যেন বলল জিপসি মেয়েটাকে। বলে বাঁদরটাকে কাঁধে বসিয়ে রাস্তায় এল। ওর কোমরে জড়ানো একটা নাইলনের মোটা দড়ি।
বিলু বলল, “এই তাল। জিপসিটা তাবুতে ঢুকলেই—।”
বাবলু বলল, “না। আগে এই ব্যাটার পিছু নিই। দেখি ব্যাটা কোথা যায়। তারপর ফিরে এসে তাবুতে ঢুকে শুলে গভীর রাতে কাজ করব। বাচ্চু-বিচ্ছু বরং বাড়ি চলে যাক।”
বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “কখনওই না। যা করব সবাই একসঙ্গে করব। এর জন্যে বাড়িতে বকুনি খেতে হয় খাব।”
পাণ্ডব গোয়েন্দারা সত্যিকারের গোয়েন্দাদের মতো পিছু নিল ইরানিটার। ইরানিটা রাতের অন্ধকারে এ-পথ সে-পথ করে একটা গলির ভেতর ঢুকল। ওরাও দেওয়াল ঘেঁষে গিয়ে অনুসরণ করতে লাগল তাকে। একেবারে অন্ধকারে মিশে এমনভাবে রইল যাতে ও দেখতে না পায়।
ইরানিটা থমকে দাড়িয়ে এদিক ওদিক করে তাকিয়ে দেখল দু-একবার। তারপর সেই নাইলনের দড়িটা বাঁদরটার হাতে দিয়ে ছেড়ে দিল। পরক্ষণেই দেখা গেল বাদরটা ওপর থেকে ঝুলিয়ে দিল দড়ি। ইরানিটা তাই ধরে উঠে গেল বাড়ির ছাদে এবং বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ঝোলায় করে কী সব যেন
নিয়ে নেমে এল। এসে দড়িটা ধরে নাড়া দিতেই বাদরটা ওপর থেকে দড়ি খুলে দিল। তারপর আবার ফিরে চলল যে পথে এসেছিল সেই পথে।
বাবলু বলল, “এইবার বুঝেছি ঘুঘু তুমি কী করে ধান খাও।”
বিলু বলল, “এ যে ম্যাজিকের পর ম্যাজিক রে ভাই।”
বাবলু বলল, “এই জন্যেই ঘরের ভেতরে বা ছাদে পায়ের ছাপ পাওয়া যায় কিন্তু অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। ফ্যাক্টরির খুনের ব্যাপারটাও ঠিক এইভাবেই ঘটেছে। বাগানের দিক থেকে বাঁদরটা দোতলার ছাদে বা বারান্দায় হুক আটা দড়িটা আটকে দিয়েছে। আর তাই ধরে ও ব্যাটা ওপরে উঠেছে। তারপর চুরি করতে গিয়ে হয় বেগতিক দেখে ও ব্যাটা খুন করেছে না হয় খুন করেই চুরি করেছে। নীচে মেশিনের শব্দে খুন হওয়ার চিৎকার কানেও যায়নি কারও। তারপর বাদরটাও ওই দড়ি হুক সমেত আবার লাফিয়ে এসে গাছের ডালে আটকে অথবা বেঁধে দিলে সেই দড়ি ধরে বারান্দা থেকেই ব্যাটা এধারে আসে। কাজেই ছাদ বা বারান্দায় ছাড়া আর অন্য কোথাও পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি ওর।
ইরানিটার পিছু পিছু আবার ওরা সেই মাঠের কাছে এল। যেখানে ওরা তাবু খাটিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। জিপসি মেয়েটা তখন কাঠকুটো জ্বেলে রান্না চাপিয়েছিল। একটু পরেই রান্না শেষ করে কুকুরটাকে ছেড়ে দিয়ে তাবুর ভেতরে ঢুকে পরদা নামিয়ে দিল।
ভোম্বল তখন মুখে নাকে রুমাল জড়িয়ে ন্যাকড়ায় ক্লোরোফর্ম ঢেলে ছুড়ে দিল কুকুরটার দিকে। যেই না দেওয়া কুকুরটা আমনি ছুটে এসে শুকতে লাগল সেটা। তারপর বার বার সেটা নিয়ে কামড়া কামড়ি করতে করতে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
পাণ্ডব গোয়েন্দারা নিশ্চিন্ত হয়ে মাঠে ঢুকল এবার। তাবুর ভেতর আলো জ্বলছে। এর মধ্যেই ওরা ঘুমিয়ে পড়েনি নিশ্চয়ই। বাবলু চুপি চুপি উকি মেরে ভেতরটা দেখল। বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিছু দেখল।
একটা আয়নার সামনে দাড়িয়ে জিপসি মেয়েটা কী যেন দেখছে। আর সেই ইরানিটা একটা ঢোলের ভেতর অনেক কিছু লুকিয়ে রাখছে। রেখে আবার ছাউনি পরিয়ে দিল এমনভাবে যে ওর ভেতরে যে কিছু থাকতে পারে তা কেউ ধারণাও করতে পারবে না।
বিলু হঠাৎই বলল, “জিপসি মেয়েটার গলায় একটা হিরের নেকলেশ রয়েছে মনে হচ্ছে না?”
“এই নেকলেশ কাউকে খুন করে নিয়ে এসেছে।”
ভোম্বল বলল, “এবার তা হলে পুলিশে খবর দিই?”
বাবলু বলল, “আর একটু পরে।”
জিপসি মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে নেকলেশটা পরে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগল। তারপর সেটা খুলে রেখে মাথায় বালিশের নীচে চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ল।
ইরানিটাও ঢোলটা টাঙিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল একপাশে। ছোট্ট লণ্ঠনটা সমানে জ্বলতে লাগল। দু-পাঁচ মিনিট বিরতি। তারপরই ভয়ংকর নাক ডাকার শব্দ। ভোম্বল আবার একটু ন্যাকড়াতে ওষুধ ঢেলে সেটা চেপে ধরল ইরানিটার নাকে। দেখতে দেখতে নাক ডাকা থেমে গেল। তারপর যেই না সেটা জিপসি মেয়েটার দিকে নিয়ে যাবে আমনি সে লাফিয়ে চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল। ওর এক হাতে লকলক করছে একটা ধারালো ছোরা। মেয়েটার চোখদুটোও যেন ইস্পাতের ফলার মতো বেঁকে গেল। সে হাত উঁচিয়ে ছোরাটা যেই না বাবলুকে মারতে যাবে পঞ্চ অমনি এক লাফে মেয়েটার হাত শক্ত করে কামড়ে ধরল।
পঞ্চুর কামড়ে হাত বেঁকে গেল মেয়েটার। বাবলু কেড়ে নিল ছোরাটা। তারপর সেই ছোরাই ওর বুকের কাছে ঠেকিয়ে ভোম্বলকে বলল, “ভোম্বল পুলিশ।”
ভোম্বলকে থানা পর্যন্ত যেতে হল না। পথেই পুলিশের ভ্যান দেখতে পেয়ে সব কথা খুলে বলল। হাওড়া থানার দারোগাবাবু ওকে ভালই চিনতেন। এটা শিবপুর থানার এলাকা। ফোনে কথা হয়ে যেতেই ভ্যান বোঝাই পুলিশ সব হইহই করে এসে হাজির হল। সেইসঙ্গে এলাকার অনেক লোক।
পঞ্চ তখনও জিপসি মেয়েটার হাত কামড়ে ধরে বসে আছে। আর বাবলু সেই ছোরা ঠেকিয়ে রেখেছে ওর বুকে।
বিলু, বাচ্চু আর বিচ্ছু পাহারা দিচ্ছে ঘুমন্ত ইরানিটাকে।
পুলিশ এসেই হাতে হাতকড়া লাগাল দু’জনের। তারপর সমস্ত মালপত্তর উদ্ধার করে পাণ্ডব গোয়েন্দাদের বুদ্ধির প্রশংসা করে ওদের প্রত্যেককে গাড়িতে তুলে নিল।
সবাই অবাক হয়ে গেল এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখে। কয়েকটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যে এইসব কাণ্ডকারখানা করে এত বড় একটা খুনি ও চোরকে ধরিয়ে দেবে তা কেউ ভাবতেও পারেনি।
গাড়িতে উঠে বাবলু আনন্দে বলে উঠল—“থ্রি চিয়ার্স ফর পাণ্ডব গোয়েন্দা।”
অন্যরা বলল—“হিপ হিপ হুরর রে।”
পঞ্চু ডেকে উঠল—“ভৌ ভোঁ ভৌ।”