পাণ্ডব গোয়েন্দা – ৭ – সপ্তম অভিযান – আগুনমুখী দানব রহস্য / ষষ্টীপদ চট্টোপাধ্যায়
বাবলুর ঘুমটা আচমকা ভেঙে গেল। এমন আকস্মিকভাবে ওর ঘুম সহসা ভাঙে না। ওর মনে হল কোথা থেকে যেন একটা চাপা গোঙানি ভেসে আসছে। বাবলু বালিশের তলা থেকে টৰ্চটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর জানলা খুলে বাইরে তাকাতেই ভয়ে ওর বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। টর্চটা পড়ে গেল হাত থেকে। আর সেই মুহুর্তে সে দেখল এক ভয়ংকর অগ্নিদানব অন্ধকার বিদীর্ণ করে উধাও হয়ে যাচ্ছে। উঃ, সে কী দৃশ্য! সারা গায়ে তার আগুনের ঝলকানি। এত আলো যে সেদিকে তাকানো যায় না। সেটা যে কী, বাবলুর তা কল্পনাতেই এল না। জীবজগতে এরকম কোনও ভয়ংকর প্রাণী থাকতে পারে বলে জানাই ছিল না তার।
পঞ্চু শুয়েছিল বাইরের রকে। বাবলু তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখল থরথর করে কাঁপছে পঞ্চু। ভয়ে তার গলা দিয়ে অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসছে। বাবলু গিয়ে পঞ্চুর গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। পঞ্চু বাবলুকে দেখে একবার একটু কুই কুই করে উঠল। তারপর সাহস ফিরে পেয়েই চিৎকার—ভৌ। ভৌ ভৌ। ভৌ—উ—উ।
পরদিন সকালে উঠে সেই ভয়ংকর দৃশ্যটার কথা সকলকে বলল বাবলু। কিন্তু কেউই বিশ্বাস করল না। সবাই বলল, নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছে বাবলু।
বাবলু তখন ওদের দলের প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুপুরবেলা জমায়েত হতে বলল। সবাই এল দুপুরবেলা। সেই ভাঙা বাড়ির ভাঙা ঘরে। বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চুু, বিচ্ছু এবং পঞ্চু সবাই জড়ো হল।
বাবলু ঘটনাটা সবাইকে খুলে বলতেই বিলু বলল, “কিন্তু ওই রকম একটা ভয়ংকর জীব বা দানব, অথচ সেটা একমাত্র তোরই চোখে পড়ল আর কারও নয়?”
“এইটাই তো রহস্য রে ভাই।”
ভোম্বল বলল, “আমার মনে হয় এ ব্যাপারটা একবার পুলিশকে জানালে ভাল হয়।”
বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “পুলিশকে বলেই বা কী হবে? পুলিশও তো সেই রকম। হেসে উড়িয়ে দেবে।”
বাবলু বলল, “আমার মনে হয় তবু ব্যাপারটা একবার পুলিশকে জানানো দরকার। ওরা আমাদের কথা অবিশ্বাস করবে না এবং সকলকে সাবধানও করে দিতে পারবে। সে যে কী বিরাট চেহারা! সত্যি বলছি, তোরা না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবি না! এখনও আমার হাত-পা ভয়ে হিম হয়ে আসছে।”
বাবলুর কথা এরা কেউই অবিশ্বাস করল না। আলোচনা শেষ করে সবাই পায়চারি করতে করতে সেই ভাঙা বাড়ির পিছন দিকে গেল। পিছন দিকে বেশ কয়েক বিঘা জায়গা জুড়ে জলা আর জঙ্গল। সেদিকে যেতে যেতে হঠাৎ বিচ্ছু চেঁচিয়ে উঠল, “ওই দেখ। ওই—।”
ওরা সবিস্ময়ে দেখল, ধুলোর ওপর কয়েকটা অতিকায় পায়ের ছাপ। মানুষ নয়। কোনও জন্তুর। এমন সময় আরও একটা আশ্চর্য দৃশ্য চোখে পড়ল। একটা প্রকাণ্ড গুলঞ্চ গাছের মোটা ডাল কে যেন মটকে ভেঙে দিয়ে গেছে।
বাবলুরা থমকে দাঁড়াল।
বিলু বলল,“রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।”
বাবলু বলল, “চল, ফেরা যাক। কাল রাতের সেই ভয়ংকর জন্তুটার কাজ নিশ্চয়ই। আমি নার্ভাস হয়ে পড়ছি ভাই। আর না এগিয়ে ফিরে যাওয়াই ভাল। উঃ! এখনও মনে পড়লে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।”
ওরা পায়ে পায়ে ফিরে এসে একেবারে থানায় গিয়ে ঢুকল। সি তখন সবে একটা কেসের ফাইলে মনোনিবেশ করছিলেন। এমন সময় বাবলুরা গিয়ে হাজির হল।
ওসি হেসে বললেন, “কী খবর পঞ্চপাণ্ডব?”
বাবলু বলল, “খুব সাংঘাতিক খবর স্যার।”
বাবলুর ভয় পাওয়া মুখে দিকে তাকিয়ে ওসি তাড়াতাড়ি একটা চেয়ারে বসতে বললেন বাবলুকে। বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছুও বসল একটা বেঞ্চে। পঞ্চু বসল একেবারে টেবিলের ওপর।
ওসি বললেন, “কোকোকোলা আনতে দেব?”
“না স্যার। মনটা ভাল নেই। কাল রাতে একটা আশ্চর্য জিনিস দেখেছি। কেউ বিশ্বাস করছে না। সবাই স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কী ভয়ংকর। ভাবলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।”
সি ফাইল মুড়ে রেখে বললেন, “হাউ ষ্ট্রেঞ্জ! কোথায় দেখেছ তাকে?”
বাবলু তখন সব বলল।
শুনে ওসি বললেন, “ঠিক বলছ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।”
“ওই ভয়ংকর দৃশ্য তোমার মতন আরও একজন দেখেছে। লোকটা গাঁজা খায় বলে আমরা কেউ তার কথা বিশ্বাস করিনি। কাল রাত্রে সেও দেখেছে। দেখেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আজ একটা কাজে আমি ওদিকে গিয়েছিলাম, গিয়ে শুনলাম। এখন তো দেখছি কথাটা ঠিক।”
বাবলু বলল, “আজ বিকেলে আমরা তার পায়ের ছাপও দেখেছি। শুধু পায়ের ছাপই নয়, মোটা একটা গুলঞ্চ গাছের ডালও সে ভেঙে রেখে গেছে। প্রচণ্ড শক্তিমান সে। কিন্তু সেটা যে কী তা আমার মাথাতেই আসছে না। তার গায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে আলোর ঝলকানিতে চোখে ধাঁধা লেগে যাবে। আপনি নিজে গিয়ে দেখে আসতে পারেন তার পায়ের ছাপ।”
ওসি বললেন, “আমি এখনই যাচ্ছি। এই কে আছিস?”
একজন কনস্টেবল এসে সেলাম করে দাঁড়াল।
“গাড়ি বার করতে বল।”
ওরা সকলে পুলিশের গাড়িতে চেপে সেই ভাঙা বাড়ির দিকে চলল। যেতে যেতে ওসি বললেন, “তুমি রাইফেল ট্রেনিং নেবে বাবলু ?”
“আমি পিস্তল চালাতে পারি। আমার মামার কাছে শিখেছিলাম।”
“ওতেই হবে। তোমার কাছে পিস্তল আছে?”
“না।”
“আমি আজই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সবসময় ওটা তোমার কাছে রেখে দেবে। কেমন? তবে একটা কথা, আত্মরক্ষার জন্যই হোক বা পলাতক দুষ্কৃতকারীকে ধরবার জন্য হোক, গুলি চালালে পায়ের দিক লক্ষ্য করে চালাবে। কেমন? তবে অতর্কিত অন্য কোথাও লেগে যায় সে আলাদা কথা।”
দেখতে দেখতে ঘটনাস্থলে পৌছে গেল ওরা। বাবলু ভাল করে ওসি-কে সেই পায়ের ছাপ আর ভাঙা ডালটা দেখিয়ে দিল।
ওসি সব দেখে গম্ভীর মুখে বললেন, “ঠিক আছে। আমি কড়া পাহারার ব্যবস্থা করছি। এখন থেকে তোমরা এখানে আসা বন্ধ করে দাও। বিশেষ করে জঙ্গলে যেন একদম ঢুকো না। বুঝেছ?”
বাবলু বলল, “আচ্ছা।”
ওরা চলে এল।
সে রাতে বাবলু ভাল করে ঘুমোতে পারল না। পঞ্চুকেও ওর ঘরে তক্তপোশের তলায় শুইয়ে রাখল। সবে তন্দ্রাটি এসেছে, এমন সময় হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল পঞ্চু, “ভৌ ভোঁ।”
বাবলু ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠেই দেখল সেই ভয়ংকর যমের মতো অগ্নিদানব ওর জানলার কাছে মুখ এনে ঘরের ভেতর তাকিয়ে আছে। বাবলু উঠে বসতেই অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
ওর বুকের ভেতর একটা হিম স্রোত বয়ে গেল যেন। তারপর ঘোর কাটিয়ে উঠতেই দেখল ওর বিছানার উপর একটা খামে ভরা চিঠি পড়ে আছে। বাবলু আলো জ্বেলে চিঠিটা খুলে পড়ে দেখল। কিছুই না। সংক্ষেপে শুধু কয়েকটা কথা লেখা আছে বাড়াবাড়ি কোরো না! আমার নজর সর্বত্র। ভাঙা বাড়িতে যেও না।’
চিঠিটা পড়া সবে শেষ করেছে বাবলু, এমন সময় বহু দূরে গুলির শব্দ শোনা গেল।
বাবলু আর মুহুর্তমাত্র দেরি না করে শর্ট প্যান্ট আর টাইট গেঞ্জিটা গায়ে দিয়ে সদ্য পাওয়া পিস্তল আর ছুরিটা কোমরে গুজে টর্চটা নিয়ে পঞ্চুকে সঙ্গে করে বাগানবাড়ির দিকে চলল।
দ্রুত চলার জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই পৌছে গেল মিত্তিরদের বাগানে।
দুজন পুলিশের ডিউটি দেবার কথা ছিল সেখানে। কিন্তু কোথায় কে? তবুও টর্চের আলোয় এদিক সেদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখতে পেল বিহারের ছাপরা জেলার রামবচন কনস্টেবল বন্দুকটা বুকে নিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আর একজন নিখোঁজ। হয় গুম, না হয় কেটে পড়েছে।
রাগে ও উত্তেজনায় বাবলুর শিরাগুলো ফুলে উঠেছে তখন। এ রহস্যের যবনিকা ঘটাতেই হবে। ওই চিঠিটা না পেলে এত সাহস হত না বাবলুর। ওই চিঠিটাতেই সে বুঝতে পেরেছে, ব্যাপারটা অলৌকিক বা জান্তব মোটেই নয়। এর পিছনে শয়তানের বুদ্ধি খেলা করছে না হলে এই চিঠি লেখার উদ্দেশ্যটাই বা কী? শয়তানের ঘাঁটিটা নিশ্চয়ই ওই জঙ্গলের মধ্যে। না হলে চিঠি দিয়ে এখানে আসতে ওদের বারণই বা করবে কেন?
বাবলু মনে সাহস এনে টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে জঙ্গলের দিকে এগোল। সেই ভয়ংকর প্রাণী যে পথে গেছে সে পথ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। তাই পথ চিনতে তার অসুবিধে হল না। বাবলু আর পঞ্চু জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
কী ঘন বন! দিনের বেলাতেই অন্ধকার থাকে, তার ওপর রাত্রে তো কথাই নেই। পোকার কিরকিরে ডাক। জোনাকির আলো আর কাঁটার খোঁচা খেতে খেতে পথ চলতে লাগল বাবলু। বেশ কিছুদূর যাবার পর একটা জলার ধারে এসে পৌছল বাবলু। একটা মস্ত ইদারাও রয়েছে সেখানে। সাবেক কালের ইদারা। কী গভীর! হঠাৎ চিৎকার করে উঠল পঞ্চ, “ভৌ। ভৌ। ভৌ। ভৌ—উ—উ।”
বাবলু ঘুরে তাকাবার আগেই বুঝতে পারল একটা বলিষ্ঠ বাহু তাকে শক্ত করে ধরে তার নাকে রুমাল চেপে ধরেছে।
পরদিন সকালে বাবলুর অন্তর্ধান সংবাদ জেনে গেল সকলে। চারদিকে খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। পঞ্চু ভোম্বলদের বাড়ি গিয়ে ভোম্বলের প্যান্ট ধরে টানাটানি করতে লাগল। ভোম্বল চালাক ছেলে। সে অনুমান করল পঞ্চু নিশ্চয়ই জানে কিছু। তাই এরকম করছে। সে তখন বাচ্চু-বিচ্ছু আর বিলুকে নিয়ে পঞ্চুর পিছু নিল।
আগে চলল পঞ্চু। পিছনে বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু আর বিচ্ছু বিলু আর ভোম্বল আসবার সময় সঙ্গে একটা করে ছুরিও নিয়ে এসেছে। বাচ্চু-বিচ্ছু সঙ্গেই রয়েছে।
পঞ্চুর সঙ্গে প্রথমেই ওরা গেল সেই বাগানবাড়িতে। সেখানে তখন অনেক পুলিশ। কাল রাতে দু’জন কনস্টেবলের পাহারা ছিল। তাদের একজন পালিয়ে যায় আর একজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। তার ওপর বাবলুর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে এক জটিল পরিস্থিতি।
ওসি ঘটনাস্থলেই ছিলেন। ভোম্বল বলল, “আপনি যখন রয়েছেন তখন আমাদের আর কোনও ভয় নেই। আপনি আমাদের সঙ্গেই আসুন স্যার। এই কুকুরটা হয়তো কোনও হদিস দিতে পারবে।”
ওসি বললেন, “বেশ তো, চলো।”
সকলে পঞ্চুর সঙ্গেই চলতে লাগল। কিছুদূর যাবার পর জঙ্গল পার হয়ে ওরা সেই বিস্তীর্ণ জলাভূমির দিকে এগিয়ে চলল। সেখানে কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখতে পেল ওরা। সেই ভয়ংকর প্রাণীর এবং মানুষের।
পঞ্চু বার বার সেই ইদারার কাছে গিয়ে চিৎকার করতে লাগল। সবাই এসে বুকে পড়ল ইদারার কাছে। ইদারা তো নয়, যেন একটা মরণকূপ। এত গভীর যে তার কথা নেই। অনেক—অনেক নীচে জল। পুলিশের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গে দড়িতে ইট বেঁধে জলের গভীরতা মাপতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্য! ইট নামছে তো নামছেই। অবশেষে তল পাওয়া গেল। কিন্তু হদিস পাওয়া গেল না কোনও কিছুরই।
ওসি ফায়ার ব্রিগেডে ফোন করালেন। অনেক পরে ফায়ার ব্রিগেডের লোক এল। গাড়ি তো ঢোকে না। তাই দূরে গাড়ি রেখে লোকেরা এল। ইদারার গায়ে লাগানো লোহার বালা ধরে ধরে নীচে নামল একজন। তারপর উঠে এসে বলল—না স্যার। ডুবুরি নামান। যদি ছেলেটাকে পাথর বা বালির বস্তা বেঁধে ফেলে দিয়ে থাকে। –
এক সময় ডুবুরিও এল। কিন্তু কোথায় কী? খোঁজাখুঁজি সার হল। বাবলুর মা-বাবা কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। কী যে হল? কোথায় যে গেল বাবলু তা টেরও পেলেন না কেউ।
বাবলুর অভাবে বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তাদের দলেরই যে কেউ একজন গুম হয়ে যাবে, এরকমটা ওরা আশাও করেনি।
এদিকে পুলিশেরও কড়া আদেশ, সেই ভয়ংকর প্রাণীকে দেখা মাত্রই যেন গুলি করা হয়।
বিলু বলল, “গুলির প্রস্তাবটা আমার কিন্তু ভাল ঠেকছে না।”
ভোম্বল বলল, “আমারও। ওই ভয়ংকর প্রাণীই বাবলুকে অপহরণ করেছে এতে কোনও সন্দেহ নেই। যেমন করেই হোক ওই ভয়ংকরের পিছু নিয়ে আমাদের বাবলুকে উদ্ধার করতেই হবে।”
বাচ্চু-বিছু বলল, “হ্যাঁ। তাই ঠিক। তবে খুব গোপনে। বাড়িতে সবাই নজর রেখেছে আমাদের ওপর। সাবধানে থাকতে বলছে।”
“যাব পঞ্চুকে সঙ্গে নিয়ে।”
“বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “কোথায় যাবে?”
“আপাতত সেই ইদারার কাছে।”
“কিন্তু সেই ভয়ংকর প্রাণীটা যদি আমাদের তাড়া করে?”
“সে ব্যবস্থাও করব। আমরা চারজনে চারটে মশাল নিয়ে একটা বড় গাছের ডালে উঠে বসে থাকব। যদি সে আমাদের তাড়া করে তখন মশাল জ্বেলে আমরাও আক্রমণ করব তাকে। যত ভয়ংকরই হোক না কেন সে, আগুনের কাছে সব ব্যাটাই ঠান্ডা।”
বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “বাঃ, চমৎকার আইডিয়া তো!”
ওরা অধীর হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল রাত্রির জন্য।
রাত্রিবেলা একে একে সবাই জড়ো হল। তারপরই হল মশাল নিয়ে যাত্রা শুরু। বিলু প্রতিরক্ষা বাহিনীর ছেলেদের কাছ থেকে একটা বল্লমও নিয়ে রেখেছিল। সেই নিয়ে মশাল না জ্বেলে টর্চের আলোয় পথ দেখে সেই বনের ভেতর দিয়ে চলতে লাগল তারা।
আজ আর কোনও পাহারাই নেই। না থাক। ওরা এগিয়ে চলল।
তারপর একটা বড় গাছ দেখে উঠে পড়ল সবাই। বিচ্ছু ছোট বলে ভোম্বল ওকে পিঠে নিয়ে উঠল।
কিন্তু আশ্চর্য! ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা সত্ত্বেও দেখা পাওয়া গেল না সেই ভয়ংকরের। তারপর ওরা যখন নামব নামব করছে তখনই হঠাৎ দেখতে পেল সেই ভয়ংকর অগ্নিদানব এগিয়ে আসছে। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল ওদের।
দানবটা এসে ইদারার কাছে থমকে দাঁড়াল একবার। তারপর ধীরে ধীরে নেমে গেল ইদারার ভেতরে।
ওরা তো মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল যে যার। বিলু বলল, “এই তাল। আর এক মুহুর্ত নয়। এখনই ধরতে হবে ব্যাটাকে। আর ভয় নেই। নির্ঘাত জল খেতে নেমেছে। উঠলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব ব্যাটাকে। ওর আস্তানা নির্ঘাত এই জলার কাছে। আর এ যদি সত্যিই বাবলুকে নিয়ে গিয়ে থাকে, তবে বাবলু আর বেঁচে নেই। অতএব ব্যাটাকে নট ছাড়নছোড়ন।”
কথা শেষ করেই তরতর করে নেমে পড়ল ওরা।
সবার আগে বিলু। তারপর বিচ্ছুকে নিয়ে ভোম্বল। সব শেষে বাচ্চু। পঞ্চু তো নীচেই ছিল। টু শব্দ করেনি সে। ওরা নামতেই কুই কুঁই করতে করতে সেও ছুটল ওদের সঙ্গে। তারপর সবাই মিলে ইদারার কাছে গিয়ে বুকে পড়ে নীচে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। দেখল, কোথায় কে? কেউই নেই। ইদারার ভেতরে না মানুষ, না জন্তু।
বিলু বলল, “পেয়েছি। এই তা হলে আসল জায়গা।”
ভোম্বল বলল, “এ যে একেবারে ভৌতিক ব্যাপার রে ভাই!”
বিলু বলল, “মারো গোলি। ভৌতিক কি অন্য কিছু তার এখনই ফয়সালা হয়ে যাবে। বাবলু যদি বেঁচে থাকে তবে উদ্ধার তাকে করবই।”
“আমার মনে হয় এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও সুড়ঙ্গ আছে। অথবা অন্য কিছু, যেখানে আত্মগোপন করা যায়।”
“কিন্তু তা হলে ফায়ার ব্রিগেডের লোকদের কি নজরে পড়ত না?”
বিলু বলল, “যাক। আর বাক্যব্যয় নয়। ইদারার গায়ে আটা বালাগুলো ধরে আমি নেমে পড়ি আগে। তারপর নীচে থেকে সংকেত দিলেই তোরাও নামবি একে একে।”
“আর পঞ্চু?”
“ও বাইরে থাকবে।” বলেই টর্চের আলো ফেলে নীচে নামতে লাগল বিলু। চারদিকে সন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নামতে লাগল। কিছুটা নামার পর হঠাৎ স্থির হয়ে গেল বিলু। দেখল ইদারার গায়ে এক জায়গায় ছোট্ট একটি হুকে একটা গোল চাকতির মতো কী যেন লাগানো। বিলু সেটা সরাতেই দেখল মস্ত এক গহুর। ঢাকনাটা বন্ধ করে বিলু আলোটা ওপর দিকে নেড়ে সংকেত জানাল।
ওপর থেকেও সংকেত এল তখনই। তারপর একে একে নামতে লাগল সব। সবাই নেমে এসে একে একে হামাগুড়ি দিয়ে সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করল। গুটি গুটি করে এগিয়ে চলল ভিতর দিকে। ওঃ, সে কী ভীষণ অন্ধকার! কিছুটা পথ যাবার পরই ওরা দেখতে পেল সুড়ঙ্গটা ক্রমশ শেষ হয়ে প্রশস্ত হয়ে আসছে। মৃদু একটু আলোর রেখাও চোখে পড়ল। এবার আর হামাগুড়ি নয়। সোজা হয়েই চলতে লাগল সবাই।
যেতে যেতে একটা ছোট্ট ঘরের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ওরা। মাটির নীচে যে এইভাবে আন্ডারগ্রাউন্ড ঘর তৈরি হতে পারে তা ওদের কল্পনার বাইরে ছিল। জানলাটা খোলাই ছিল। জানলার ফাঁক দিয়ে ওরা উঁকি মেরে ভিতর দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল। দেখল সারি সারি কঙ্কাল জড়ো করা আছে ঘরের ভেতর। আর একজন বলিষ্ঠ চেহারার লোক কী যেন লিখে চলেছে নিজের মনে।
বিলু একবার এদিক ওদিক তাকাল। তারপর আস্তে আস্তে দরজার কাছে গেল। বাইরে তারের আলনায় একটা গামছা শুকোচ্ছিল। সেটা হাতে নিয়ে চুপি চুপি ভোম্বলকে বলল, “ছুরিটা হাতে নিয়ে তৈরি থাক।”
ভোম্বলও এগিয়ে এল চটপট। তারপর খুব সন্তৰ্পণে দরজাটা খুলে ফেলল ওরা। লোকটা টেরও পেল না। নিজের মনে খসখস করে লিখেই চলল। বিলু অতর্কিতে পিছন দিক থেকে লোকটার মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলল।
লোকটা লাফিয়ে উঠল তখনই। কিন্তু লাফালে কী হবে? সামনেই তার আর এক যম। উদ্যত তীক্ষ্ণ ছুরির ফলাটা উঁচিয়ে ভোম্বল বলল, “চেঁচিয়েছ কী মরেছ! বসে চুপ করে।”
ততক্ষণে ওরা লোকটাকে ঘরের ভেতর পড়ে থাকা মোটা কাছি দিয়ে চেয়ারের সঙ্গে বেশ আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে রেখে বেরিয়ে এসে শিকল তুলে দিল। তারপর আবার এগিয়ে চলল ধীরে ধীরে। ঘরের পিছন দিকে যেতেই অবাক হয়ে গেল ওরা। দেখল, একটা দালান মতো জায়গায় মোটা থামের সঙ্গে বাঁধা আছে বাবলু। ওর হাত-পা পিছমোড়া করে বাঁধা।
বিচ্ছু আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, “ওই তো বাবলুদা।”
ভোম্বল তাড়াতাড়ি হিসস করে মুখ চেপে ধরল বিচ্ছুর। বিলু এক লাফে বাবলুর কাছে গিয়ে ছুরি দিয়ে ওর বাঁধন কাটতে লেগে গেল। কিন্তু ততক্ষণে দু-দু’জন গোর্খা ছুটে এসেছে ওদের কাছে। ভোম্বল ছাড়বার ছেলে নয়। মশালটা বাগিয়ে ধরে রুখে দাড়াল। তারপর মশাল জ্বেলে সেই জ্বলন্ত মশাল নিয়ে ছুটে গেল গোর্খাদুটোর কাছে।
সে-দুটো ভাবতেও পারেনি এমন সর্বনাশা ব্যাপার ঘটে যাবে বলে। ভোম্বল মশালের আগুনটা সরাসরি একজনের মুখে গুজে দিল। আর বাচ্চুও তালের মাথায় আর একটা মশাল জ্বেলে ধরিয়ে দিল অপরজনের জামাতে।
দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন দু’জনে পরিত্রাহি চিৎকার শুরু করে দিল। ততক্ষণে বাবলুও মুক্তি পেয়ে গেছে। সে এক লাফে উঠোনের এক কোণে লাফিয়ে পড়ে একটা মরচে ধরা লোহার চেন তুলে নিয়ে ঝপাঝপ করে পিটতে লাগল দু’জনকে বেশি নয়। দু-চার ঘা দিতেই একেবারে চুপ। বাবলু চকিতে সেই প্রথম ঘরখানার কাছে এগিয়ে গিয়ে ভেতরটা দেখেই অবাক হয়ে গেল, “আরে! একে এমন চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখল কে?”
বিলু বলল,“আমরা, আবার কে।”
বাবলু বিলুর পিঠ চাপড়ে বলল, “সাবাস! এই ব্যাটাই এখানে নিয়ে এসেছে আমাকে।”
“বলিস কী রে?”
“হ্যাঁ। সায়েন্স কলেজের একজন নামকরা প্রোফেসর ছিল লোকটা। কোনও একসময় একটা মার্ডার কেসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে চালান যায়। তারপর একসময় জেল পলাতক হয়ে এখানে এসে ঘাঁটি করে। একেবারে শয়তানের ঘাঁটি যাকে বলে। কবর খুঁড়ে মড়া নিয়ে এসে তাদের হাড়গোড় বিক্রি করে। তা ছাড়া জীবন্ত লোককেও তাল পেলে নিয়ে আসে এখানে। এসে গা থেকে একটু একটু করে রক্ত টেনে নিয়ে বিক্রি করে।”
“কিন্তু এর ভেতর এই সব ঘরবাড়ি?”
“এ কিছুই নয়। ইতিহাসের যুগে আন্দুল মৌড়ি থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গপথ ছিল। বৰ্গীর হাঙ্গামার সময় লোকে প্রাণ বাঁচাবার জন্য এই সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিল। সেই সন্ধান নিয়েই ওই শয়তানরা এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছে কী ভাবে। এরকম আরও অনেক সুড়ঙ্গর ফ্যাঁকড়া আছে এর ভেতর।”
“আর সেই ভয়ংকর জন্তুটা?”
বাবলু হেসে উঠল এবার, বলল, “ওটা আসলে জস্তুই নয়।”
সবাই উৎসাহিত হয়ে বলল, “তবে?”
বাবলু বলল, “আয় দেখবি আয়।” বলে দালান পেরিয়ে সুড়ঙ্গ পথে আরও কিছুদূর গিয়ে একটা ঘরের কাছে পৌছল ওরা। ঘরটা চাবি দেয়া। চাবিটা দরজার গায়ে একটা পেরেকে লাগানো ছিল। সেটা দিয়ে তালাটা খুলতেই দেখতে পেল সারি সারি সোনার বাট সাজানো একটা ঘরে প্রকাণ্ড একটা জন্তু দাঁড়িয়ে আছে।
বিলু সভয়ে পিছিয়ে এল।
বাবলু বলল, “ভয় নেই। ওটা একটা অতিকায় ভালুকের ছাল।”
“কিন্তু ওই আলো!”
“ও কিছুই নয়। ওই ছালটার সারা গায়ে ফসফরাস মাখানো, যা রাতের অন্ধকারে আগুনের মতো জ্বলে। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এই ছালটা পরে শয়তানটা রাতের অন্ধকারে আতঙ্ক সৃষ্টি করবার জন্য বাইরে বেরোয়। আর একটি বীভৎস ছালের মুখোশও পরে। জুতোর সোলেও রবারের কৃত্রিম জন্তুর পায়ের থাবার মতো একরকম জিনিস আটা থাকে ওর। যাতে লোকে এসব মানুষের কীর্তি বলে বুঝতে না পারে।”
“কিন্তু আমাদের ওপর ওদের এই আক্রোশ কেন?”
“তার কারণ, এই বাগানের ভেতর ভাঙা বাড়িতে আমরা ঘন ঘন যাতায়াত করি তো। যদি কখনও এদিকে এসে ওদের ঘাঁটিটা জানতে পেরে যাই তাই। ইতিমধ্যে আমাদের পরিচয় তো খবরের কাগজের মাধ্যমে, আর গল্পে জানতেই পেরে গেছে ওরা। তাই ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল দলের লিড়ার হিসাবে আমাকে সরানো। তা ছাড়া কবর খুঁড়ে মড়া উধাও করার ব্যাপারে পুলিশ বেশ সতর্ক ছিল। তাই কাজটা যে মানুষের নয়, জন্তুর এটা প্রমাণ করবার জন্যই ওই জন্তুর পোশাক পরে লোকালয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করছিল।”
বিছু বলল, “তা হলে গুলঞ্চ গাছের অত বড় ডালটা মানুষ হয়ে ও কী করে ভাঙল গো?”
বাবলু বলল, “আরে ওটাও তো একটা ধোঁকা। ওই ডালটা কুডুলে কেটে তারপর দড়ি দিয়ে টেনে মচকে ভাঙা হয়েছে চোখে ধুলো দেবার জন্যে। এরা হল ঘোড়েল শয়তান। যাক! এখন আর সময় নষ্ট নয়। তাড়াতাড়ি এদের লিডারটাকে ধরতে হবে। ওই ব্যাটাই আসল কালপ্রিট। সে ওই জন্তুর পোশাক পরে লোকালয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।”
বিলু বলল, “কিন্তু তুই এত সব জানলি কী করে?”
“সে এক মজার ব্যাপার। সেদিন রাত্রে যখন আমি ইদারার কাছে এলাম পঞ্চুর সঙ্গে, তখন হঠাৎ কে যেন আমার নাকে রুমাল চেপে ধরল। আমি বুঝলাম শয়তানের হাতে পড়েছি। তাই বুঝতে পারলাম এই রুমালে নিশ্চয়ই ক্লোরোফর্ম আছে। আর আমাকে অজ্ঞান করবার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেই জন্যে আমি ইচ্ছে করে নিশ্বাস বন্ধ করে একটু ছটফট করেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ভান করলাম। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে থাকায় ক্লোরোফর্মে আমার কিছুই হল না। অথচ শয়তানটা ভাবল আমি অজ্ঞান হয়ে গেছি। এই মনে করে এই সুড়ঙ্গ পথে সে আমাকে নিয়ে এল। তারপর এদের গোপন কথাবার্তা সব শুনলাম। আর ওই যে জন্তুর রহস্য? ওটা আমার কাছে ফাঁস করে দেয় এখানকারই একজন লোক। তার বাড়ি ওড়িশায়। তাকে এরা এখানে ধরে নিয়ে এসে কাজ করাচ্ছে। খুব ভাল লোক সে। এদের সব খবরাখবর সে আমাকে দেয়। এরা হল রক্তশোষার দল। তা ছাড়া বড় বড় ডাকাতিতে এদের জুড়ি নেই। দেখলি না ওই ঘরের ভেতর সোনার বাটগুলো কীভাবে জড়ো করা আছে। তা ছাড়া আরও কত ধনসম্পদ যে রয়েছে এর ভেতর তার হিসেবনিকেশ নেই।
বিলু বলল, “এদের দলে কতজন লোক আছে বলে মনে হয়?”
“খুব বেশি নয়। জনা দশেক। যাক গে, আর কথা নয়। এখন আসল শয়তানটাকে যাতে ধরতে পারি সেই চেষ্টা করি আয়।”
বিলু বলল, “সেই ভাল।”
বাবলু হঠাৎ হিসস করে উঠল।
কে যেন আসছে।
ওরা চকিতে দেওয়ালের কোণে সরে দাঁড়াল। ওরা দেখল একজন ভয়ংকর চেহারার লোক এগিয়ে আসছে এদিকে। দেওয়ালের দিকটা অন্ধকার। ওরা সেই অন্ধকারে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল দেওয়ালের গা ঘেঁষে।
বিলু চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে?”
“এই তো সেই লোক।”
লোকটা আসতে আসতে থেমে পড়ল হঠাৎ কী বিরাট চেহারা, যেন একটা দৈত্য। বলল, “কে? কে ওখানে?”
এমন সময় একজন বামনাকৃতি লোক বিপরীত দিক থেকে ছুটতে ছুটতে এল, “কেলেংকারি হয়েছে সর্দার।”
“কী ব্যাপার ?”
“সেই ছেলেটা ভেগেছে। তার চেয়েও কেলেংকারি হয়েছে কী জানেন? প্রোফেসর তার ঘরের ভেতর বন্দি হয়ে পড়ে আছে।”
“সে কী! খুলে দাও তাকে।”
“দিয়েছি। প্রোফেসর মুক্তি পেয়েই ঘাঁটির বাইরে পাহারা দিতে চলে গেছে। প্রোফেসরের মুখে শুনলাম, সেই বদ ছেলেমেয়েগুলো নাকি এখানে এসে জুটেছে সব।”
“পুলিশ খবর পায়নি তো?”
“জানি না।”
“তুমি এক কাজ করো। এখনই সমস্ত মাল-পত্তর বারো নম্বর ঘরে পৌছে দিয়ে এক নম্বর ঘরের সামনেটা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দাও। ওর ওপরটাই জলা। ওখানটা ধসে গেলে এদিকে আসার পথ একেবারে বন্ধ। পুলিশও হদিস পাবে না আমাদের। আমি ওদিকে একবার দেখে আসি। গোর্খাদুটোকে দেখেছ?”
“আরে ওদের চিৎকারেই তো আমি এখানে এলাম। এসে দেখি দু ব্যাটা রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে আছে। কী করে যেন জামা-কাপড়েও আগুন লেগে গেছে ওদের।”
“আগুন!”
“হ্যা।”
শোনা মাত্রই সর্দার বিপদ জ্ঞাপক ঘণ্টি বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে হইহই করে ছুটে এল অনেকে।
সর্দার বলল, “সবাই এসো আমার সঙ্গে।”
ওরা এগিয়ে গেল।
বামনটা তাড়াতাড়ি পাশের ঘর থেকে ডিনামাইট এনে ফিট করতে বসে গেল তখন।
বাবলু ইশারা করল বিলুকে। বিলু ভোম্বলকে ইশারা করেই অন্ধকারে উঠে দাঁড়িয়ে বাবলু ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার ওপর। তারপর তিনজনে মিলে চেপে ধরল তাকে।
বাবলু বলল, “এদিকে আয় ব্যাটা। এখান দিয়ে পালাবার আর কোনও রাস্তা আছে কিনা বল?”
বামনটা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর বলল, “বলছি। বলছি। একটু জল।”
বিলু তাড়াতাড়ি পা থেকে জুটোটা খুলে ওর মুখে গুজে দিয়ে বলল, “এই নে খা। বল আগে বেরোবার রাস্তা কোন দিকে? না বললে শেষ করে দেব। আর চেঁচিয়েছিস যদি”—বলেই ওর বুকের কাছে ছুরিটা উঁচিয়ে ধরল বিলু
অগত্যা নিরুপায় হয়ে বেরোবার রাস্তা বলে দিল বামনটা। বাবলু তাড়াতাড়ি সেই পথে বাচ্চু-বিচ্ছুকে পাচার করে দিল। তারপর সকলে মিলে বেশটি করে হাত-পা বেঁধে একটা ঘরের মধ্যে শিকল দিয়ে রাখল বামনটাকে।
বাচ্চু-বিচ্ছু সুড়ঙ্গের বাইরে বেরিয়েই ছুটল পুলিশে খবর দিতে। আর বামনটাকে কায়দা করে শিকল বন্দি করার পরই ওরা দেখল সশস্ত্র একটা লোক দূর থেকে ছুটে আসছে সেই দিকে। বোধহয় এদিককার সুড়ঙ্গ-মুখে পাহারা দিতে। লোকটাকে দেখেই ওরা সতর্ক হয়ে দেওয়ালের গায়ে সরে দাঁড়াল। তারপর যেই না লোকটা কাছাকাছি এসেছে ভোম্বল অমনি চেনটা ঘুরিয়ে ছুড়ে দিল তার পা দুটো লক্ষ্য করে।
অব্যৰ্থ লক্ষ্যভেদ। লোকটা আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। পড়া মাত্রই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। তারপর হাতের অস্ত্রটা কেড়ে নিয়ে পা ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে এল সেই ঘরে, যে ঘরে একটু আগেই রেখে গেছে সেই বামনটাকে। এ লোকটাও এমন মোক্ষমভাবে পড়েছে যে আর নড়নচড়নেরও ক্ষমতা নেই ওর। বাবলুরা শিকল খুলে গাদার মড়ার মতো লোকটাকে ঘরে ঢুকিয়ে আবার শিকল তুলে দিল। তারপর খুব সন্তৰ্পণে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
যেতে যেতে দেখল সেই প্রোফেসর ভদ্রলোক রক্তাক্ত কলেবরে এগিয়ে আসছে এদিকে। সঙ্গে সেই ভয়ংকর লোকটা। দলের সর্দার।
প্রোফেসর বলছে, “উঃ। কী সাংঘাতিক কুকুর। ইদারা থেকে আমাকে উঠতেই দিল না। আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দিল একেবারে। অবশেষে পালিয়ে এলাম। হতভাগা কুকুর সমানে চেঁচাচ্ছে। ওর চেঁচানির চোটে না পুলিশ এসে পড়ে শেষকালে।”
“কিন্তু সেই ছেলেমেয়েগুলো কোথায় গেল?”
“তারা বোধহয় এতক্ষণে খবর দিয়ে দিয়েছে পুলিশে।”
“হয়তো দিয়েছে। তবে আমার মনে হয় তাদের কেউ না কেউ এখনও আছে এর মধ্যে। আমাদের গতিবিধি লক্ষ করছে।”
বাবলুরা তৈরি ছিল। একখানা ইট নিয়ে ওদের দু’জনের ঠিক পিছন দিকে মেঝের ওপর ছুড়ে দিল। যেই না দেওয়া, ওরা অমনি ওদের দিকে পিছন হয়ে উলটো দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “কে?”
আর কে? বাবলু তখন চেনটা ঘুরিয়ে ঝপাৎ করে মারল এক ঝাপটা লোকটার ঘাড়ের ওপর। আর বিলু করল কী তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে প্রোফেসরের টেংরি লক্ষ্য করে কষে লাগাল জোরসে লাথি।
প্রোফেসর পা মচকে ধুপ করে বসে পড়ল মাটিতে। একবার শুধু ‘বাবারে করে উঠল। তবে জান বটে সর্দারের। অমন চেনের ঝাপটা খেয়েও চোখের পলকে ছিটকে বেরিয়ে গেল ইদারার সঙ্গে যুক্ত সুড়ঙ্গ মুখের দিকে। তারপর চোখের পলকে একটার পর একটা ডিনামাইট চার্জ করে ওলটপালট করতে লাগল সব।
বাবলু বলল, “কুইক। আর এক মুহুর্ত এখানে নয়। লোকটা এখনই বোমা ছুড়তে শুরু করবে এদিকে লক্ষ্য করে। পালা।” বলেই ছুটতে আরম্ভ করল বিপরীত দিকে।
যাবার মুখে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল একজনের সঙ্গে। সে হল সেই ওড়িয়া চাকর দুঃশাসন। যে বাবলুকে এখানকার সব কথা বলে দিত।
বাবলু বলল, “শিগগির আমাদের সঙ্গে পালিয়ে এসো দুঃশাসন, যদি বাঁচতে চাও।”
দুঃশাসন তখন থরথর করে কাঁপছে। বলল, “কিন্তু আমি যে এদিককার পথ জানি না।”
“আমি জানি। তুমি চলে এসো আমাদের সঙ্গে।”
এমন সময় হঠাৎ একটা বোমা বাবলুর পায়ের পাশ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে সশব্দে ফেটে পড়ল কিছুটা দূরে। বাবলু এক ধাক্কায় দুঃশাসনকে ঠেলে দিয়ে নিজেও সরে গেল একপাশে। বিলু ভোম্বল আগেই বেরিয়ে পড়েছিল। এবার বাবলু আর দুঃশাসনও বেরিয়ে এল।
নীচে তখন দুম দাম করে বোমা ফাটার শব্দ। ভোম্বল বলল, “ওই তো পুলিশের গাড়ি আসছে। আর ভয় নেই।” গাড়িটা জলা থেকে কিছু দূরে থামিয়ে একদল পুলিশ হইহই করে বন্দুক উঁচিয়ে ছুটে এল। দারোগীবাবুও এলেন। বাচ্চু-বিচ্ছু সঙ্গেই ছিল।
পুলিশের লোকেরা সুড়ঙ্গে যেই না ঢুকতে যাবে অমনি বাঁধা দিল বাবলু, “খবরদার, অমন কাজটি করবেন না। সবাই মারা যাবেন প্রাণে।”
বাবলু বলল, “ওই দেখুন।”
সবাই দেখল জলাটা ঘাস-মাটি-জল সমেত ক্রমশ নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। বাবলু বলল, “ডিনামাইট চার্জ করে আন্ডারগ্রাউন্ডের সব কিছু ধ্বংস করে নিজেরাও মৃত্যুবরণ করছে ওরা। মিছিমিছি আমরা কেন মরি?”
জলার ওপার থেকে পঞ্চুর একটানা ডাক তখনও শোনা যাচ্ছে—ভৌ-ভৌ-ভৌ-ভৌ। বাবলু এপার থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “থ্রি চিয়ার্স ফর পঞ্চু।”
কেউ কিছু বলার আগে পঞ্চুই উত্তর দিল “ভৌ। ভৌ ভোঁ।”