১৪. নায়িকার প্রস্থান

চোদ্দো – নায়িকার প্রস্থান

স্টারের আর্ট থিয়েটার লিকুইডেশনে গেছে, তাই হলটা আপাতত খালি পড়ে আছে। প্রবোধচন্দ্র গুহ নিজে আলাদা করে রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটে একটা নতুন থিয়েটার খুলে নাম দিয়েছেন নাট্যনিকেতন। আবার অন্ধ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে একটা লিমিটেড কোম্পানি খুলে একটি নতুন থিয়েটার হলের প্রতিষ্ঠা করে, নাম দিয়েছেন রঙমহল। শিশিরকুমারের দৃষ্টান্তে সবাই এখন নাম রাখছেন বাংলায়।

দুটি নতুন থিয়েটার থেকেই অভিনেতা ও নির্দেশক হিসেবে শিশিরকুমারকে যোগদান করার জন্য ডাকাডাকি করা হচ্ছে। কিন্তু সে তো চাকরি। কিছুদিন কম্‌বাইনড নাইট অভিনয় করলেন শিশিরকুমার, সাময়িকভাবে রঙমহলেও যোগ দিলেন, কিন্তু অপরের অধীনে কাজ করা তাঁর ধাতে নেই।

এখন স্টার হাতে পেলে খুব ভালো হয়, কিন্তু টাকা কোথায়? হাইকোর্ট থেকে স্টারের রিসিভার হিসেবে যাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছে, তিনি শিশিরকুমারের সহপাঠী৷ পাছে অন্য কেউ স্টার দখল করে নেয়, তাই বন্ধুর সহায়তায় শিশিরকুমার প্রথমে সাত দিনের জন্য ভাড়া নিলেন স্টার। তারপর বেরুলেন অর্থ সংগ্রহে।

বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সুনীতিকুমার, শ্রীকুমার, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সাহায্য করলেন সাধ্যমতন, ডাক্তার-উকিল-ব্যারিস্টার হিসেবে যাঁরা এখন সার্থক হয়েছেন চেনাশুনোদের মধ্যে, তাঁদের কাছেও হাত পাততে হল। থিয়েটার জগতে অনেকেই মনে মনে তাঁর শত্রু, তারাও তাঁর বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়তে লাগল আড়াল থেকে।

বড় বড় জমিদার, যাদের রাজা-মহারাজা বলে, তাদের প্রত্যেকেরই একটি অন্তত প্রাসাদ আছে কলকাতা শহরে, বছরে অনেকটা সময় তাঁরা শহরেই কাটান। তাঁদের বিলাস বাহুল্যের নানান সংবাদ ছড়ায় লোকের মুখে মুখে। শিশিরকুমার তাঁদের কারও কাছে যেতে চান না। কেন যেতে চান না তার ঠিক ব্যাখ্যাও দেন না কারওকে। নিজের শরীরে জমিদারদের রক্ত আছে বলেই কি তিনি অন্য জমিদারদের কাছে কৃপাপ্রার্থী হতে নারাজ? জমিদারদের নিয়ে এক এক সময় ঠাট্টা বিদ্রুপেও মেতে ওঠেন।

ব্যারিস্টারদের কাছেই এখন বেশি টাকা। কোনও এক বন্ধুর সুপারিশে তিনি গেলেন জনৈক ব্যারিস্টার চৌধুরীর কাছে। মধ্য কলকাতায় ভদ্রলোকের বিশাল হর্ম্য, প্রতিদিন সকালে তিনি অনেক পারিষদ নিয়ে বসে থাকেন বৈঠকখানায়। শিশিরকুমারকে দেখে তিনি যথেষ্ট আপ্যায়ন করলেন, সীতা ও দিগ্বিজয়ী দেখে কেমন মোহিত হয়েছেন, তাও জানাবার পর বললেন, আপনি আবার নতুন করে দল গড়তে চান, এ তো বেশ কথা। আপনি নাট্যশালায় নব যুগ এনেছেন, আপনাকে সাহায্য করা তো আমাদের অবশ্যই কর্তব্য। কত টাকা-পত্তর লাগবে তার হিসেব করেছেন?

শিশিরকুমার বললেন, আপাতত দেড় লক্ষ টাকা হলেই কাজ শুরু করতে পারি। বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু কিছু করে নিচ্ছি, আপনার কাছ থেকে কুড়ি হাজার আশা করি।

চৌধুরীসাহেব বললেন, বেশ। এর মধ্যে কার কার কাছ থেকে পেয়েছেন?

শিশিরকুমার বললেন, পঁচাত্তর হাজারের মতন প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।

চৌধুরীসাহেব বললেন, কে কে দিয়েছেন শুনি।

এভাবে সকলের নাম আলাদা করে জানানো ঠিক প্রথাসম্মত নয় বলে শিশিরকুমার একটু চুপ করে থাকতেই চৌধুরীসাহেব আবার ব্যগ্রভাবে ওই প্রশ্নটি করলেন।

শিশিরকুমার বাধ্য হয়েই নামগুলি বললেন, শুধু তাই-ই নয়, কে কত দিচ্ছেন, তাও জানাতে হল।

তালিকার মধ্যে সর্বোচ্চ দাতা দিচ্ছেন কুড়ি হাজার, তাই শুনে ব্যারিস্টার সাহেব বললেন, ঠিক আছে, আমি আপনাকে দেব পঁচিশ। প্রতিশ্রুতি নয়, এখনই চেক কেটে দিচ্ছি।

শিশিরকুমার বললেন, দান নয়, আমি এ অর্থ চাইছি ঋণ হিসেবে।

সে কথায় কান না দিয়ে চৌধুরী সাহেব দেরাজ খুলে চেক বই বার করতে করতে বললেন, মি., ভাদুড়ী, আই হ্যাভ ওয়ান কন্ডিশন। আপনাকে মদ ছাড়তে হবে। আমি শুনেছি, আপনি অতিরিক্ত মদ্যপানে শক্তি ক্ষয় করেন।

শিশিরকুমার বললেন, সরি, আই ক্যানট অ্যাকসেপ্ট দ্যাট কনডিশন।

চৌধুরী সাহেব বললেন, সেকী! আপনি মদ খাওয়া ছাড়তে পারবেন না? মদ শুধু শরীরের ক্ষতি করে না, একসময় মস্তিষ্কও দুর্বল করে দেয়। আপনার এরকম প্রতিভা, আপনি সুস্থ থাকলে আরও অনেক কিছু সৃষ্টি করতে পারবেন। চেষ্টা করলে আপনি ঠিকই ছাড়তে পারবেন। এখানেই প্রতিজ্ঞা করে যান, আর এক ফোঁটাও ছোঁবেন না। টাকাটা আমি নাটকের উন্নতির জন্যই দিতে চাই। ধরুন, অর্ধেকটা ঋণ, বাকি অর্ধেক সাহায্য।

শিশিরকুমার বললেন, মদের কী কী দোষ, তা আমি জানি। এ নিয়ে স্টাডিও করেছি। যদি ছাড়তে হয়, নিজেই ছাড়ব। আপনার কাছে শপথ করে যাব, তারপর দু’দিন বাদে দুর্বল হয়ে পড়ে আবার খেয়ে ফেলব, সেকথা আপনার কাছ থেকে গোপন করতে হবে, সে বান্দা শিশির ভাদুড়ী নয়। কোনও শর্ত মানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

শিশিরকুমার উঠে দাঁড়াতেই, চৌধুরীসাহেব বললেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান।

শিশিরকুমার বললেন, দেশে অনেক গরিব-দুঃখী আছে, আপনার টাকাটা ইচ্ছে হলে তাদের দান করবেন। আমি ঋণ নিতে বেরিয়েছি। কারও দান গ্রহণে অক্ষম। আপনার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ।

শিশিরকুমার বাইরে বেরিয়ে আসতেই পেছন থেকে একজন ডাকলেন, ভাদুড়ীবাবু, ও ভাদুড়ীবাবু।

মুখ ফিরিয়ে শিশিরকুমার দেখলেন, ব্যারিস্টার চৌধুরীর পাশেই এক প্যান্ট-কোট করা ব্যক্তি বসে ছিল, সে বেরিয়ে আসছে। শিশিরকুমার তাকে চিনতে পারলেন না।

কাছে এসে সে বলল, নমস্কার ভাদুড়ীবাবু, নমস্কার। অধীনের নাম দিলওয়ার হোসেন। একসময় পরিচয় হয়েছিল।

নাম শুনে শিশিরকুমারের মনে পড়ল।

তিনি প্রতি-নমস্কার করে বললেন, ও হ্যাঁ, আপনিই তো এখন মিনার্ভা লিজ নিয়ে চালাচ্ছেন।

দিলওয়ার বললেন, আপনি কোথায় যাবেন? আমার কারে লিফট দিতে পারি?

শিশিরকুমার বললেন, নর্থ ক্যালকাটার দিকেই যাব, আপনি কোথায়?

দিলওয়ার বললেন, উঠুন গাড়িতে। তারপর দেখা যাবে। ভাদুড়ীবাবু, আপনার মতন একজন মানী লোক, লোকের দ্বারে দ্বারে ঋণ চেয়ে বেড়াচ্ছেন, দেখে বড় কষ্ট হল। আপনাকে আমাদের মাথায় করে রাখা উচিত।

শিশিরকুমার কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, হোসেনসাহেব, মশকরা করছেন বুঝি! তা করুন, করুন, দ-এ পড়েছি যখন।

দিলওয়ার বললেন, শিশির ভাদুড়ীকে নিয়ে আমি মশকরা করব, আমার এমন বুকের পাটা! এই মাত্তর তো দেখলাম আপনার তেজ। পঁচিশ হাজার টাকা অগ্রাহ্য করে চলে এলেন! এভাবে কি কারওর কাছ থেকে ঋণও পাবেন? ও জন্য হাত কচলাতে হয়, তোষামুদি করতে হয়, তা আপনার ধাতে নেই জানি। সম্ভব হলে আমিই আপনাকে পুরো টাকাটা দিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন আমার ব্যবসায় কিছুটা মন্দা চলছে।

শিশিরকুমার বললেন, কেন, আপনার মিনার্ভায় তো বিষবৃক্ষ ভালোই জমেছে শুনছি।

দিলওয়ার বললেন, দানীবাবু চলে গেলেন, তার জন্য খুব মার খেয়েছি। শেষের দিকে তিনিও আর টানতে পারছিলেন না। অনেক টাকা লোকসান গেছে। এখন খানিকটা চাঙ্গা হচ্ছে, ইন্দুবালাকে আনতে পেরে আমার কপাল খুলে গেছে। এই নাটকে ইন্দুর উনিশখানা গান, দর্শকরা তাতেই মাতোয়ারা! একদিন আসুন না বিষবৃক্ষ দেখতে?

শিশিরকুমার বললেন, সুবিধে মতন একদিন যাব। আপনি কি সেইজন্যই আমায় ডাকলেন?

দিলওয়ার বললেন, না। অনেক দিনের ইচ্ছা, আপনার সঙ্গে একটু আলাপ-পরিচয় করব। থিয়েটারের ব্যবসায়ে এসেছি, শিশির ভাদুড়ীকে চিনব না, এ কি হয়!

শিশিরকুমার বললেন, আপনাদের সম্প্রদায়ের লোক থিয়েটারের ব্যবসায় আসছেন, এ তো বেশ ভালো কথা। আগে দেখিনি। আপনাদের কারও কারও হাতে তো অনেক টাকা। রঙমহলে কেষ্টবাবু একজনকে পার্টনার নিয়েছে, সেও তো মুসলমান শুনেছি।

দিলওয়ার বললেন, জি, ঠিকই শুনেছেন, সে আমার ভাই।

গাড়ি সোনাগাছির কাছে একটা বাড়ির সামনে থামল। দিলওয়ার বললেন, নামুন স্যার।

শিশিরকুমার বললেন, এ কোথায়?

দিলওয়ার বললেন, এখানে ইন্দুবালা থাকে। এখানে আপনি একটু বসে যাবেন, ইন্দুর দু’-একখানা গান শুনবেন, আপনার সঙ্গে দু’পাত্তর খাব। সেই সঙ্গে অন্য কথা হবে।

দিলওয়ার বেশ দিলদরিয়া গোছের মানুষ। তাঁর সঙ্গে ঘণ্টা দুয়েক বেশ ভালোই কাটল।

পরদিন দিলওয়ার শিশিরকুমারকে একজন খুব বড় মুসলমান ব্যবসায়ীর কাছে নিয়ে গেলেন, তিনি শিশিরকুমারকে প্রয়োজনীয় পুরো টাকাটাই ঋণ দিতে রাজি। দশ হাজার টাকা করে দেবেন প্রতি মাসে। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি এত টাকার জন্য এক পয়সাও সুদ নেবেন না। তাঁদের ধর্মে সুদ নেওয়া নিষিদ্ধ। ঋণ শোধ করতে হবে এক বছর পর থেকে। আর শিশিরকুমারের থিয়েটারে শুধু ওঁর জন্য একটি বক্স রিজার্ভ রাখতে হবে। তিনি যখন ইচ্ছে সপরিবার যাবেন।

স্টারে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হল নাট্যমন্দির। তার সঙ্গে যুক্ত হল নব শব্দটি।

প্রথম নাটক কী হবে? শরৎচন্দ্রের কাহিনীই একমাত্র নিশ্চিত তুরুপের তাস।

থিয়েটারমহলে শরৎচন্দ্র সম্পর্কে সকলেরই যেমন শ্রদ্ধা আছে, তেমনই ভেতরে ভেতরে ক্ষোভও আছে অনেকের মনে। শরৎচন্দ্রের প্রত্যেকটি কাহিনীই থিয়েটারে জনপ্রিয় হয়, সে জন্য তিনি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পান, কিন্তু কিছুতেই নিজে কোনও নাটক লিখতে রাজি হন না। অর্থাৎ থিয়েটারে তাঁর বিনা পরিশ্রমে উপার্জন। আগে উপন্যাসের নাট্যরূপ দেবার একটা খসড়া অন্তত করতেন নিজের হাতে, এখন আর তাও করেন না। নতুন উপন্যাসও লিখছেন না, প্রায়ই বলেন, লিখতে ইচ্ছে করে না, মাথায় আর আইডিয়া আসে না। আর কী হবে!

তা শুনে শিশিরকুমার একদিন বলেছিলেন, এ কী বলছেন, শরৎদা! কবিগুরু তো এখনও নিত্যনতুন বিষয় নিয়ে লিখে যাচ্ছেন, আপনার থেকে বয়েসে অনেক বড়, তবু তাঁর লেখায় একটুও ভাটা পড়েনি।

শরৎচন্দ্র তা শুনে বলেছিলেন, কবিগুরু মাথায় থাকুন। তাঁর সঙ্গে কার তুলনা চলে! আমি অনেক অত্যাচার করেছি, শরীর আর বইছে না, বুঝতে পারছি, আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে।

পুরনো কাহিনীগুলির নাট্যরূপ থিয়েটারে অভিনয় করাবার ব্যাপারে শরৎচন্দ্র খুব উৎসাহী। শিশিরকুমারের কাছে তিনি প্রায়ই আসেন। রিহার্সাল দেখেন।

শিশিরকুমার শরৎচন্দ্রের বিরাজ বউ-এর নাট্যরূপ দিয়ে মহড়ায় ফেলেছেন। পুরনো অভিনেতারা অনেকেই নেই। শেখাতে হচ্ছে নতুনদের, প্রভা পর্যন্ত চলে গেছে অন্য থিয়েটারে, তার বদলে এসেছে রানিবালা নামে একটি মেয়ে। অবশ্য নায়িকার ভূমিকায় কঙ্কাবতী।

কিছুদিন আগে তার একটি পুত্রসন্তান জন্মেছে। অল্প কালের মধ্যেই আবার সে ফিটফাট হয়ে রিহার্সাল দিচ্ছে পর্ণ উদ্যমে।

রিহার্সালের সময় সুরাপান এখন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। শিশিরকুমার নিজেও ওসময় আজকাল আর খান না, কিন্তু শরৎচন্দ্র এলে খাতির করার জন্য পরিবেশন করতেই হয়। শরৎচন্দ্র নানা রকম মন্তব্য করেন, শিশিরকুমার সব যে মেনে নেন, তা নয়, তবে শোনেন শ্রদ্ধার সঙ্গে।

একদিন শরৎচন্দ্র একটা আলটপকা মন্তব্য করে ফেললেন।

কিছু কিছু সংলাপ ছেঁটে দিচ্ছেন শিশিরকুমার, শরৎচন্দ্র বললেন, শিশির, আমার একটা কথাও বাদ দিলে চলবে না। আমার সংলাপই তো আসল। আমার সংলাপ যদি একটা কুকুরের মুখেও বসানো যায়, তাও লোকেরা গভীর আগ্রহের সঙ্গে শুনবে।

শিশিরকুমার অমনি উত্তর দিলেন, না, শরৎদা। আমি শিশির ভাদুড়ী। আমার সংলাপও লাগে না। আমি যদি রাস্তায় দাড়িয়ে শুধু এ বি সি ডি-ও বলি, তাও শোনার জন্য লোকের ভিড় জমে যাবে।

শরৎচন্দ্রের গুণ এই, কেউ প্রত্যাঘাত করলে তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেন। হাসতে হাসতে বললেন, জবর বলেছ হে! আমার মুখের মতন জবাব দিয়েছ। এই তো আমার দোষ, জিভের রাশ টানতে পারি না। তবে, এই আমি মুখে কুলুপ আঁটলুম। আর কোনও টিপ্পনী কাটব না।

শিশিরকুমার বললেন, একেবারে কুলুপ আঁটবেন না। গরম গরম নিমকি এনেছে, খান!

বিরাজ বউ প্রথম দিন থেকেই সার্থক।

সমালোচকরা প্রশংসা তো করলেনই, এই প্রথম কোনও কোনও সমালোচক লিখলেন, অভিনয়ের গুণে নামভূমিকায় কঙ্কাবতী যেন শিশিরবাবুকেও ছাড়িয়ে গেছেন!

দু’-একজন বন্ধু ক্ষুব্ধ হয়ে ওই দুই সমালোচককে পেছন-পাকা বলে গালি দিলেও শিশিরকুমার খুশিই হলেন। বন্ধুদের হাসতে হাসতে বললেন, একে বলে গুরুমারা বিদ্যে!

রাত্রে বাড়ি ফিরে তিনি কঙ্কাবতীকে বললেন, এই দ্যাখো, তোমার সম্পর্কে কী লিখেছে! থিয়েটার সম্পর্কে কিছুই বোঝে না। যখন তখন তোমার নিন্দে করে, এবার বড় বেশি নিন্দে করেছে।

কাগজটা পড়তে পড়তে কঙ্কাবতীর মুখখানি আরক্ত হয়ে গেল।

সে বলল, ছি ছি, এমন কথা কেউ লেখে? আমি তোমার নখেরও যোগ্য নই।

শিশির আদর করে তার থুতনি ধরে বললেন, না রে, পাগলি, তোর সম্পর্কে একেবারে খাঁটি কথা লিখেছে। তুই এবার ফাটিয়েছিস! আমার সম্বন্ধে অবশ্য ঠিক লেখেনি। রাজা-গজার ভূমিকার চেয়ে একেবারে সরল সিধে গেঁয়ো মানুষের রোলও আমি মন্দ করিনি।

কঙ্কাবতী বলল, এতে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। আমি তো তোমারই সৃষ্টি।

শিশির বললেন, কাঁচা লোহায় তরোয়াল হয় না। তুই ইস্পাত।

কঙ্কাবতী মুচকি হেসে বলল, এতদিন মাটি চাপা পড়েছিলাম।

শিশির বললেন, না, দিন দিন তোর উন্নতি হচ্ছে। এই যে এরা এটা লিখেছে, এটা বড় কম কথা নয়। আজ অবধি কেউ আমার সঙ্গে তুলনা করে কোনও অ্যাক্‌ট্রেসকে বেশি ভালো বলেনি। বড় জোর যোড়শীতে চারুশীলাকে বলেছিল সমান সমান। তুই যে এখন মাঝে মাঝে ষোড়শী করিস, তুইও এখন চারুশীলার চেয়ে কম যাস না। চারুশীলাদের আর আমার দরকার নেই।

কঙ্কাবতী বলল, আর ‘সীতা’?

শিশির বললেন, ‘সীতা’ হিসেবে প্রভার নাম দেগে গেছে। অনেক নাইট করেছে তো। এখন প্রভা না থাকলে তোকে সীতার রোলে নামাচ্ছি, অডিয়েন্স রি-অ্যাকশন কম কিছু নয়। আমি জানি, প্রভা এখন তোকে হিংসে করতে শুরু করেছে।

কঙ্কাবতী হাত জোড় করে কৃত্রিম ত্রাসে বলল, দয়া করে তুমি আমায় আর কোনওদিন পুরুষের রোলে নামিও না। সেবার বড় নিন্দে হয়েছিল।

শিশির বলল, হ্যাঁ। সেবার ‘বিসর্জন’-এ ভুলই হয়েছিল। তুই পুরোপুরি নারী। হ্যাঁ, ভাল কথা, কঙ্কা, তোর মা-বাবা কেউ কি মোটা ছিলেন?

কঙ্কাবতী বলল, মা শেষের দিকে বেশ মোটাসোটা হয়ে গিস্লেন।

শিশির বললেন, মনে হচ্ছে তোরও সেই দিকে ধাত। এখন থেকে সাবধান হ। আমেরিকায় তো যত পেরেছিস আইসক্রিম খেয়েছিস। অবশ্য তোর আর দোষ কী, অত ভালো ভালো সব আইসক্রিম, শুনেছি স্বামী বিবেকানন্দও ওদেশে গিয়ে আইসক্রিমের লোভ সামলাতে পারতেন না।

কঙ্কাবতী বলল, এখানে আর সে রকম পাচ্ছি কোথায়?

‘বিরাজ বউ’ ভাল রকম চললেও শিশিরকুমার ঠিক তৃপ্ত নন। তাঁর মনে রয়েছে নতুন কিছু করার আকাঙ্ক্ষা। উপন্যাসের নাট্যরূপে অভিনয় কিছুতেই খুব উচ্চস্তরে ওঠে না। মনে হয় যে গল্পের কথকতা।

ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ ‘প্রতাপাদিত্য’ নামে একটা পাণ্ডুলিপি দেখালেন, সেটা শিশিরকুমারের খুব পছন্দ হয়ে গেল। তিনি ঠিক করলেন, ‘প্রতাপাদিত্য’র চরিত্র নয়, নিজে করবেন পর্তুগিজ সেনাপতি রডা-র ভূমিকা।

বিদেশি চরিত্র থাকলে তার মুখে হিন্দি-ইংরিজি মিশিয়ে এক রকম জগাখিচুড়ি সংলাপ দেওয়া হয়। ক্ষিরোদপ্রসাদও তাই দিয়েছেন। শিশিরকুমার ভাবলেন, পর্তুগিজ রডা ইংরিজি জানবে কী করে? তখন তো ইংরিজি এমন বহুল প্রচারিত ভাষা ছিল না। আর হিন্দি জানা তো তার পক্ষে আরও অসম্ভব। কারণ সমুদ্রপথে সে এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরে, সেখানে হিন্দি ভাষার একেবারেই চল নেই। রডা দিল্লিটিল্লির দিকেও যায়নি। তা হলে রডা চট্টগ্রামের স্থানীয় লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করত কী ভাবে? পর্তুগিজ ভাষাও কেউ বুঝবে না। তা হলে কি সে সর্বক্ষণ দোভাষী নিয়ে ঘুরত?

সেই সময়টা নিয়ে পড়াশুনো করার জন্য তিনি যাতায়াত শুরু করলেন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে। সঙ্গে কঙ্কাবতীকেও নিয়ে আসেন, এই লাইব্রেরিতে অনেকে তাঁর চেনা।

দু’জনে মিলেই পড়েন সেই সময়কার ইতিহাসের বই। সমসাময়িক সাক্ষ্য থেকে নিশ্চিত জানা গেল, রডা চট্টগ্রামে এসে চাটগাঁর ভাষা শিখে নিয়েছিল, সে ভাষা বাংলা সাহিত্যের ভাষা নয়, কিছু কিছু শব্দ একেবারেই আলাদা।

একদিন ধর্মতলার ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি থেকে সন্ধেবেলা বেরিয়েছেন দু’জনে, একটা ভাড়ার গাড়ি থামাবার চেষ্টা করছেন শিশিরকুমার, কঙ্কাবতী মৃদু স্বরে বলল, সেদিন আর আজ কত তফাত!

শিশির বললেন, সেদিন, মানে কোন দিন?

কঙ্কাবতী বলল, তোমার মনে নেই। সেই যেদিন তুমি আমাকে এখানে নামতে দিলে না, আমরা চলে গেলাম গঙ্গার ধারে।

শিশির বললেন, ও, সেইদিন, না, ভুলব কেন? তফাত তো হবেই, কঙ্কা।

কঙ্কাবতী বললেন, সেদিন আমরা কত কবিতা বলেছিলাম। গদ্য বলিইনি বলতে গেলে!

শিশির বললেন, কবিতা, হ্যাঁ, আমি এখনও কবিতা বলি বটে, কিন্তু জগৎটা যে গদ্যময়! সেদিন তুই ছিলি এক ছিপছিপে রোমান্টিক তরুণী, আজ বেশ ভারভাত্তিক হয়েছিস। দ্যাখ, আমারও চুলে পাক ধরেছে। আর্টের চর্চা করতে চাই, অথচ টাকাপয়সার হিসেব করতে হয় সব সময়।

কঙ্কাবতী বলল, চলো না গো, আজ আর একবার গিয়ে বসি গঙ্গার ধারে!

শিশির বললেন, ওরে, তুই আর আমি যেমন বদলে গেছি, নদীও তেমনই বদলে যায়। সেদিনের নদী আর আজকের নদী তো এক নয়। সেদিন যে জল প্রবাহিত হয়েছিল, আজ অন্য জল।

কবজি উলটে হাতঘড়ি দেখে বললেন, সাড়ে সাতটার সময় একজন অ্যাটর্নি আসবে। কী সব যেন মামলা-টামলার উপক্রম হয়েছে। আজ আর হবে না রে, ভাগ্যে যদি থাকে আর একদিন নিরিবিলিতে দু’জনে বসে নদী দেখব।

কঙ্কা বলল, যদি ভাগ্যে থাকে!

শিশিরকুমার খাঁটি ঘটি, তবু চাটগাঁর ভাষা রপ্ত করে নিলেন অনেকটা। মূল নাটকের সংলাপ বদল করে তিনি ব্যবহার করতে লাগলেন স্থানীয় ভাষা। এই, ও কে আছে?’ এর বদলে তিনি বলতে লাগলেন, ‘হেই, ইবা কন?’ ‘কোথা থেকে’র বদলে ‘কোদা তুন? করেছি’র বদলে ‘করিগ্যি’, ‘এখানে’র বদলে ‘ইন্দি’।

শুধু তাই নয়। রডা যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলে, তখন সে একটু একটু দোলে। যারা সুদীর্ঘকাল সমুদ্রের বুকে জাহাজে ভাসে, তারা স্থলভূমিতে এসেও বেশ কিছুদিন সেই দুলুনি অনুভব করে।

কিন্তু দর্শকরা এসব বুঝবে কী করে?

শিশিরকুমার যখন লাইব্রেরিতে পড়াশুনো করতে যাচ্ছিলেন, তখনই সহ-অভিনেতাদের মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। এ কি সাহেবদের ব্যাপার নাকি? বাংলা নাটক, চলবে তো বড় জোর তিরিশ-চল্লিশ নাইট, তার জন্য আবার গবেষণা করতে হবে? বাড়াবাড়ি!

মঞ্চে রডা এসে একটু দুলতে দুলতে বলছে, কোছে তুন? আসতক, আসতক ইন্দি…

দর্শকরা কেউ কেউ ভাবল, আজ বুঝি আবার শিশির ভাদুড়ী বেশি নেশা করে ফেলেছে!

দু’একজন চেঁচিয়ে উঠল, এ কী বাওয়া, রডাসাহেব আবার চাটগাঁইয়া ভাষা শিখল কবে?

সেই দৃশ্যে পরদা পড়ার পরই শিশিরকুমার আবার পরদা সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন, পেছনে পেছনে ভিখা, তার হাতে কয়েকখানা বই আর লম্বা একটা ম্যাপ।

শিশিরকুমার জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের মধ্যে কে বললেন, রডা চাটগাঁইয়া ভাষা শিখল কবে? উঠে দাঁড়ান, উঠে দাঁড়ান, আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।

কেউ উঠেও দাঁড়াল না, সাড়াশব্দও করল না।

শিশিরকুমার বললেন, রডা আসে জলপথে, ধরা পড়ে চাটগাঁয়ের দিকে। তখন সেখানে ইংরেজ সরকার ছিল না, সে দিল্লি-আগ্রাও যায়নি। পর্তুগিজরা ইংরিজি জানে না, এখানে এসে হিন্দি শেখারও সুযোগ হয়নি, তাই তাকে ওখানকার বাংলাই শিখতে হয়েছে। এটা আমার নিজের অনুমান নয়। ভিখা, ম্যাপটা খুলে দাঁড়া।

শিশিরকুমার ম্যাপ দেখিয়ে দেখিয়ে, কয়েকটা ইতিহাসের বই দেখিয়ে বিশেষ বিশেষ অংশ পড়ে শোনাতে লাগলেন। তিনি আজ মদ্যপান করেননি, বোঝাই যায়।

এবার প্রচুর দর্শক হাততালি দিয়ে উঠল।

বইটই গুটিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে শিশিরকুমার ফিরে যাচ্ছেন, একজন দর্শক টিটকিরির সুরে চেঁচিয়ে উঠল, এসব রিমার্কসগুলো ওভারলুক করেন না কেন? এটা তো ক্লাস রুম নয়। আপনার লেকচার শুনতেও আসিনি।

শিশিরকুমার দপ করে জ্বলে উঠলেন।

আবার ফিরে এসে বললেন, ওভারলুক করতে পারি না আপনাদের অজ্ঞতা ও মূর্খতা দেখে। আপনারা আসেন নাচ দেখতে। তাই আমাকে ক্লাস করতে হয়, শিক্ষা দিতে হয়। নাটক ঠিকমতন বুঝতে গেলেও যোগ্যতা থাকা দরকার। আমরা অনেক খেটেখুটে নাটক তৈরি করি, আপনারা চান কান্না কিংবা বেলেল্লাপনা।

এরপর পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে ভরে গেল প্রেক্ষাগৃহ। দর্শকরা দু’দলে ভাগ হয়ে শুরু করে দিল হল্লা।

আবার অভিনয় শুরু হল বটে, কিন্তু প্রতাপাদিত্য নাটক সম্পর্কে মুখে মুখে অন্য রকম প্রচার হয়ে গেল। টিকিট বিক্রি কমতে লাগল পরের শোগুলিতে।

অগতির গতি আবার শরৎচন্দ্র। ‘দত্তা’র নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হল ‘বিজয়া’ নাম দিয়ে। এ নাটকেও কঙ্কাবতীর অভিনয়ের প্রশংসা হল বটে, কিন্তু শিশিরকুমার সম্পর্কে সমালোচকরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। কল্লোলের দলের লেখক বুদ্ধদেব বসু বললেন, ‘বিজয়ার রাসবিহারী চরিত্রে শিশির ভাদুড়ী এক স্থুল বিদূষক হয়ে আমাদের হতাশ করেন, এ ব্যক্তি মোটেই শরৎচন্দ্রের সেই গৃধু কপট ও চক্রান্তকারী ব্রাহ্ম নয়। অবশ্য শিশিরকুমারের পুরনো ভক্তেরা বলতে লাগলেন, এটা শিশিরকুমারের নতুন ইন্টারপ্রিটেশন।

শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ টাকাপয়সা আনে ঠিকই। কিন্তু শিশিরকুমার এগুলো ঠিক পছন্দ করেন না বলে মন লাগাতে পারেন না। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনায় তিনি বলে ফেলেন, শরৎদার লেখায় কাহিনীর টান আছে, সেন্টিমেন্ট আছে, কিন্তু আমার সবসময় কেমন যেন কৃত্রিম মনে হয়। গভীর জীবনবোধ নেই। বেশ্যাদের সতীসাধ্বী করে আঁকেন, অথচ উনি ভালোই জানেন, নিজেও দেখেছেন তো, তবু ইচ্ছে করে… একদিন এই নিয়ে ওঁর সঙ্গে আমার তর্ক হয়েছিল। আমিও তো এতদিন ওই সব মেয়েদের নিয়েই… তাদের মধ্যে অনেকে ভালো হয় তো ঠিকই, কিন্তু শরৎদার ক্যারেক্টারদের মতন অমন সোফিসটিকেশন তো নেই! আবার, পল্লীসমাজের ওই যে রমা মেয়েটা। ও তো একটা মেয়ে-গোরা। মাথা-বকা!

শরৎচন্দ্রের তুলনায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি শিশিরকুমারের গভীর আকর্ষণ। প্রায়ই বলেন, কবিগুরুর গদ্যের ভাষাও উচ্চারণ করে যে আনন্দ পাই, তা আর কোনও নাটকে পাই না।

রবীন্দ্রনাথের নাটক কয়েকটি খুব নিষ্ঠার সঙ্গে মঞ্চোপযোগী করে অভিনয় করলেও সফল হতে পারেননি। এখন তাঁর মাথায় ঘুরছে, রবীন্দ্রনাথের কোনও উপন্যাসের নাট্যরূপ দিলে কেমন হয়? ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি তার খুব পছন্দ।

এর মধ্যে ‘রীতিমত’ নাটক নামে একটি নাটক নামানো হয়েছে নবনাট্যমন্দিরে। সে নাটকের নাট্যকার জলধর চট্টোপাধ্যায়, কিন্তু তিনি বলেন, এ নাটকের খোলনলচে বদলে দেবার কৃতিত্ব শিশিরবাবুর। আবার শিশিরকুমার বলেন, না, না, আমি বিশেষ কিছু করিনি।

নাটকটি মোটামুটি জমেছে। শিশিরকুমার রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানালেন।

রবীন্দ্রনাথ অন্য লোকের নাটক দেখতে সাধারণ রঙ্গালয়ে যান না। তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গীসাথীরা তাঁকে বোঝান যে, এটা তাকে মানায় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শিশিরকুমারকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছেন। তিনি আসতে রাজি হয়ে গেলেন।

সেই সময় শিশিরকুমার তাঁকে জানালেন ‘যোগাযোগ’ বিষয়ে তার পরিকল্পনার কথা।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, তা বেশ তো। নাট্যরূপ আমিই দেব। তুমি এসো শান্তিনিকেতনে, এই ধরো, বসন্ত উৎসবের পরে।

বসন্ত উৎসবের আগের দিনই শিশিরকুমার এলেন শান্তিনিকেতনে। সঙ্গে কঙ্কাবতী।

এবার অবশ্য গোরুর গাড়ি কিংবা হণ্টন নয়, মোটর গাড়ি পাঠানো হয়েছিল, এবং অতিথিভবনে ঠিক করা ছিল ব্যবস্থা।

বসন্ত উৎসবের দিন শান্তিনিকেতনে গুরুদেব খুবই ব্যস্ত, সেদিন কথা হবে না। রবীন্দ্রনাথ নাটকের খসড়া আগে থেকেই পাঠিয়ে দিলেন শিশিরকুমারকে।

বসন্ত উৎসব মানে দোল, নাচ-গান এবং হোলি খেলা। শিশিরকুমার অতিথিভবন থেকে বেরোলেনই না। পড়তে লাগলেন রবীন্দ্রনাথের নাট্যরূপ। কঙ্কাবতী বেরিয়ে সব কিছু দেখে, রং মেখে বিচিত্ররূপিণী হয়ে এল।

সে শিশিরকুমারকে বলল, তুমি গেলে না কেন গো? স্বয়ং কবিগুরুর পায়ে কত লোক ফাগ দিল, তিনি কী সুন্দর হাসিমুখে বসেছিলেন। অমন সুন্দর হাসি কি আর কোনও মানুষের হয়?

শিশির বললেন, কঙ্কা, কাল বিকেল চারটের সময় কবিগুরু আমাকে সময় দিয়েছেন, তুমিও কি তখন যাবে আমার সঙ্গে?

কঙ্কাবতী কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কী চাও, আমি যাব, কি যাব না?

শিশির বললেন, যেতেও পারো। অবশ্য ওখানে তো শুধু কাজের কথা হবে। তুমি পরে কোনও এক সময় দেখা করে আসতে পারো

কঙ্কাবতী বললেন, অর্থাৎ তুমি আমাকে সঙ্গে নিতে চাও না। বলেছিলাম না, তুমি আমাকে ঠিক জীবনসঙ্গিনী করেও নিতে পারোনি। স্ত্রীর সম্মান দেওয়া তো দূরের কথা। আমি শুধু তোমার সঙ্গিনী।

শিশির খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, না, না, তা নয়। মানে, কবিগুরু ঠিক কীভাবে নেবেন ব্যাপারটা, শুনেছি তো ব্রাহ্মদের অনেক শুচিবাই থাকে। এখানকার সব আদব-কায়দাই তো আলাদা।

কঙ্কাবতী বলল, ভয় নেই, তোমার ভয় নেই। আমি যাব না। আমি এ ঘরে লুকিয়ে থাকব।

সে চলে গেল স্নানের ঘরে।

শিশিরকুমার আবার পাণ্ডুলিপি পড়ায় মন দিলেন।

পরদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। কঙ্কাবতীর ব্যবহার বেশ স্বাভাবিক। রাগ বা অভিমানের চিহ্নমাত্র নেই। জানলার সামনে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে সে গুনগুন করে গান গায়। শিশিরের জামা-কাপড় সব গুছিয়ে দিতে লাগল যথা সময়ে, খাওয়ার পর এগিয়ে দিল মুখশুদ্ধি মশলার কৌটো।

যথা সময়ে একজন এল শিশিরকুমারকে নিয়ে যেতে। বৃষ্টি এখনও পড়ছে, কিন্তু এখানকার মাটিতে জল দাঁড়ায় না, কাদাটাদা নেই। অসময়ের বর্ষণে ডালপালাগুলো যেন খলখল করে হাসছে।।

রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন উদয়ন ভবনে। চায়ের আসরে আরও কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, দু’-তিনজন মহিলাও রয়েছেন তাঁদের মধ্যে।

প্রাথমিক কিছু কুশল সংবাদের পর রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, শিশির, তোমার সঙ্গে তোমার ঘরনী এসেছেন শুনলেম। তাঁকে এখানে আনলে না কেন?

রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত অনেক ভেবেচিন্তেই ঘরনী শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তা হলে কি তিনি সঠিক সম্পর্কের কথা জানেন?

শিশিরকুমার খানিকটা দ্বিধার সঙ্গে বললেন, সে ঠিক তৈরি ছিল না…

রবীন্দ্রনাথ কয়েক মুহূর্ত শিশিরকুমারের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সে দৃষ্টিতে কি রয়েছে ভর্ৎসনা?

এরপর যোগাযোগ বিষয়ে আলোচনা চলল দীর্ঘক্ষণ। কয়েকটি ছোটখাটো পরিবর্তনের ব্যাপারে দু’জনেই একমত, মতান্তর হল নাটকের পরিণতি নিয়ে। শেষ দৃশ্যে কুমু কী করবে?

রবীন্দ্রনাথ আবার কুমুর চরিত্রটি সবিস্তারে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, সে প্রতিবাদিনী, সে বিদ্রোহিণী, সে মধুসূদনকে ছেড়ে চলে যাবে।।

শিশিরকুমার বললেন, সে প্রতিবাদ করবে, বিদ্রোহও করবে, কিন্তু একেবারে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া কি বাঙালি মেয়েদের পক্ষে স্বাভাবিক? প্রতিবাদের সুরটাই শুধু থাক।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, অর্থাৎ? কুমুকে নিয়ে তুমি কী করতে চাও?

শিশিরকুমার বললেন, আমাকে তো দর্শকদের কথাও ভাবতে হয়। টিকিটঘর একেবারে ফাঁকা থাকলে নাটক চালাব কী করে! সধবা মেয়ে স্বামীকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, এটা বাঙালি দর্শক নেবে না।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, তুমি দর্শক তৈরি করতে পারোনি, সেটা কি আমার দোষ? দর্শকদের অনবরত তোষামোদ করে চললে কোনও উচ্চাঙ্গের শিল্প সৃষ্টি সম্ভব নয়। তুমি কুমুকে সর্বংসহা হিন্দু বাড়ির বউ বানাতে চাও?

শিশিরকুমার বললেন, তার বিদ্রোহের সুরটা ঠিকই থাকবে, কিন্তু শেষ দৃশ্যে সে মধুসূদনের ঘরে ঢুকে তাকে প্রণাম করতে যাবে।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, বেশ, তা থাক। আবার বেরিয়েও আসবে।

শিশিরকুমার বললেন, না, কবিগুরু, বেরিয়ে আসবে না। স্বামীর পায়ে সে হাত দেবে, সেখানেই আস্তে আস্তে নেমে আসবে ড্রপ সিন।

রবীন্দ্রনাথের তাতে ঘোর আপত্তি। কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি চলল।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মনে প্রাণে চান, তাঁর কুমুকে দর্শকরা দেখুক, তার কথা শুনুক। শেষপর্যন্ত তিনি শিশিরকুমারকে অনুমতি দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তোমার যা খুশি করো। থিয়েটারে তুমি যাই-ই বদল করো, আমার উপন্যাসে তো ঠিকই থাকবে। ভবিষ্যতের মানুষ আমার উপন্যাসটাই পড়বে! আমি এর পরের একটি খণ্ডও লিখব।

শিশিরকুমার খুব খুশি মনে ফিরে এলেন অতিথিশালায়।

কঙ্কাবতী জানলার পাশে একা বসে চা খাচ্ছে। শিশির তার কাঁধে হাত রেখে উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, জানো কঙ্কা, আজ কবিগুরু আমার সব কথা মেনে নিয়েছেন। শুধু একটা শর্ত। যোগাযোগ নামটা বদলানো যাবে না। শরৎদার সব উপন্যাসই তো নাটক করার সময় আমরা নাম বদলে দিই। শরৎদার উপন্যাসগুলো যে লোকেরা আগে থেকেই পড়ে ফেলে। এবার নব নাট্যমন্দিরের বড় প্রোডাকশন হবে কবিগুরুর ‘যোগাযোগ।

কঙ্কাবতী বলল, বাঃ, খুব ভালো হবে।

শিশির বললেন, এখন শরৎদার ‘অচলা’ চালু আছে। মধ্যে কয়েকটা পুরনো নাটকের রিপিট শোয়ের সময় যোগাযোগের রিহার্সাল ফেলতে চাই। বেশ কিছুদিন লাগবে। কবিগুরুর একটি শব্দও যাতে ভুল না হয়!

কঙ্কাবতী বলল, আমি কিন্তু এই নাটকে পার্ট নিচ্ছি না।

শিশির চমকে উঠে বললেন, সেকী! এখন তো দর্শকরা তোকেও দেখতে আসে। কুমুর চরিত্রটা এমনই চমৎকার, তোর জীবনে এটা… ইট উইল বি আ ক্রাউনিং গ্লোরি।

কঙ্কাবতী তবু মৃদু দৃঢ় গলায় বলল, আমি করব না। তুমি ওই রোলে অন্য কারওকে নাও!

শিশির বলল, দুর পাগলি! তোর মতন অ্যাকট্রেস আর এখন কে আছে?

কঙ্কাবতী বলল, তুমি শিল্পী, তুমি এক তাল মাটি কিংবা এক খণ্ড পাথর পেলেই প্রতিমা গড়তে পারো। যে-কোনও একজনকে নাও, রানিবালা কিংবা…

শিশির বললেন, না, ওসব কিছু শুনছি না। তোকে পার্ট করতেই হবে।

কঙ্কাবতী বলল, তা হলে বড় জোর একটা ছোটখাটো ঝিয়ের পার্ট দিয়ো! আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আমার স্টেজের জীবন ফুরিয়ে আসছে।

শিশির ধমক দিয়ে বললেন, ধ্যাৎ! যত সব মরবিড কথা! ইউ আর নাউ অ্যাট দা হাইট অফ ইয়োর কেরিয়ার। তোকে এখন ছোটখাটো ঝিয়ের পার্ট দিলে পাবলিক আমাকে মারতে আসবে।

কঙ্কাবতী বলল, কুমুর চরিত্র আমাকে মানাবে না। যোগাযোগে যখন কুমু প্রথম এল, তার বর্ণনা তোমার মনে আছে? ‘দেখতে সে সুন্দরী, লম্বা ছিপছিপে, যেন রজনীগন্ধার পুষ্পদণ্ড’..। আমি এখনও লম্বা ঠিকই, কিন্তু সুন্দরীও নই, ছিপছিপেও নই, আর… রজনীগন্ধার পুষ্পদণ্ড এই উপমা শুনলেই হাসি পাবে।

শিশির বললেন, কে বললে, তুই এখনও সুন্দরী না? খানিকটা মুটিয়েছিস বটে, কিন্তু মুখখানি আগের মতনই ঢলঢলে, তা ছাড়া চেহারায় কিছু আসে যায় না। অভিনয়ই আসল। সার্থক অভিনয়ে চেহারার ত্রুটি ভুলিয়ে দেয়।

তবু কঙ্কাবতী জেদ ধরে রইল। সে রিহার্সালেই যেতে চায় না।

অগত্যা শিশিরকুমার আর দু-তিনটি মেয়েকে কুমুর ভূমিকায় গড়ে-পিটে নেবার চেষ্টা করলেন, কারুকেই তাঁর মনঃপূত হয় না। রাবীন্দ্রিক বাচনভঙ্গিই তাদের আসে না। কঙ্কাবতী ছাড়া কুমুর ভূমিকায় অভিনয় করার যোগ্যতা বাংলা রঙ্গমঞ্চে বর্তমানে আর কারুর নেই। এর মধ্যে আর একটি ব্যাপার হয়েছে।

শিশিরকুমারের একেবারে ছোট ভাই ভবানীকিশোর, ডাক নাম পুতু, সে এ বাড়িতেই থাকে। অন্য দু’ভাই তারাকুমার ও বিশ্বনাথ অভিনয়ে যথেষ্ট যশস্বী হয়েছে, কিন্তু পুতু এখনও কলেজের ছাত্র। সে বেচারির প্রায়ই জ্বর হয়, হঠাৎ একদিন তার মুখ দিয়ে রক্ত উঠল। তার রাজরোগ হয়েছে, যক্ষ্মা।

কঙ্কাবতী এ ছেলেটিকে নিজের ভাইয়ের মতনই ভালোবাসে। সে প্রাণ ঢেলে সেবা করতে লাগল পুতুর। এ রোগের তেমন কোনও চিকিৎসা নেই, রোগীকে সঙ্গ দেওয়া, তাকে ভরসা জোগানোই বড় কথা। কঙ্কাবতী সর্বক্ষণ তার পাশে বসে থাকে, তাকে নানারকম গল্প শোনায়। অন্য দাদারা সময় দিতে পারে না তার জন্য। কিন্তু কঙ্কাবতীর এখন থিয়েটারের প্রতি একটুও আকর্ষণ নেই।

একদিন পুতু শুয়ে আছে, পাশে বসে আমেরিকার গল্প শোনাচ্ছে, কঙ্কাবতী হঠাৎ কাশতে কাশতে পুতু উঠে বসল, কাশির দমক আর থামেই না। তার ঠোঁটে দেখা গেল রক্তরেখা।

বিছানার পাশে একটা ডাবর রাখা থাকে, একজন দাসী সেটা ধুতে নিয়ে গেছে। পুতুর বুকে হাত বোলাতে বোলাতে কঙ্কাবতী চেঁচিয়ে দাসীকে ডেকে বলল, ওরে, শিগগির ডাবরটা নিয়ে আয়!

এর মধ্যেই পুতুর মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত। উপায়ান্তর না দেখে কঙ্কাবতী দু’হাত জুড়ে সেই রক্ত ধারণ করল।

ঠিক তখনই দাসীটি ডাবরটি নিয়ে ঢুকল, সেই দৃশ্য দেখে অভিভূত ভাবে বলল, দিদিমণি, তুমি যা করলে, নিজের মা-ও সে রকম সেবা করতে পারে না।

কঙ্কাবতী বলল, বাজে কথা বলিস না। ওটা রেখে শিগগির গরম জল নিয়ে আয়।

এদিকে শিশিরকুমারও মরিয়া। ‘যোগাযোগ’ মঞ্চস্থ করার কথা ঘোষিত হয়ে গেছে, এখন কঙ্কাবতীকে না পেলে চলবেই না। এক প্রকার জোর করেই তিনি কঙ্কাবতীকে নিয়ে গেলেন রিহার্সালে, পুতুর জন্য নিযুক্ত করা হল একজন নার্স। তবু কঙ্কাবতী সারাদিন রিহার্সাল দিয়েও রাত্তিরবেলা পুতুর খাটের পাশে মাটিতে বিছানা পেতে শুয়ে থাকে, পুতু জেগে উঠলে সেও জাগে।

‘যোগাযোগে’র উদ্বোধনের কয়েক দিন আগে, ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে পুতুকে পাঠিয়ে দেওয়া হল হাসপাতালে।

যোগাযোগের অভিনয় জমল বটে, কিন্তু সমালোচক ও দর্শকদের প্রতিক্রিয়া হল মিশ্র। শিশিরকুমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হেমেন্দ্রকুমার পর্যন্ত এক পত্রিকায় লিখলেন যে, প্রকৃত নাটকের বদলে উপন্যাসের নাট্যরূপ দেখে দেখে বিরক্তি এসে যাচ্ছে। প্রকৃত নাটক লেখা হবে কবে? যোগাযোগের নাট্যরূপ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ করে দিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে, কিন্তু তা যেন ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। নাট্যশাস্ত্রে রবীন্দ্রনাথের গভীর জ্ঞানের কথা আমরা জানি। মঞ্চের ‘যোগাযোগ’ যদি সত্যিই তাঁর সাহায্য পেয়ে থাকে, তা হলে বলতে হয়, এ উপন্যাসটিকে তিনি স্বেচ্ছায় নাটক করে তুলতে চাননি। কারণ, মঞ্চের যোগাযোগের একাধিক চরিত্র ফুটতে চেয়েছে অন্যান্য পাত্র-পাত্রীদের মৌখিক বর্ণনার সাহায্য নিয়ে। এটা মোটেই নাটকের রীতি নয়। আমার বারবার মনে। হয়েছে, মঞ্চের এই নাটকটি রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে তৈরি হয়নি।

হেমেন্দ্রকুমার অবশ্য শিশিরকুমার ও কঙ্কাবতীর অভিনয়ের খুবই প্রশংসা করলেন। রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব সংলাপ সেইজন্যই তাঁর শুনতে ভালো লেগেছে।

অন্যান্য দু’-একজন সমালোচক লিখলেন, এত অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে কঙ্কাবতীর অভিনয় খুবই বিস্ময়কর। যেন তিনি নিজেই জীবন্ত কুমু। এই ধরনের জটিল চরিত্রে শ্ৰীমতী কঙ্কাবতী এখন বাংলায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

রাস্তায়ঘাটে লোকেরাও বলাবলি করতে লাগল, এই প্লে-টাতে কঙ্কাবতী একেবারে জান লড়িয়ে দিয়েছে!

রবীন্দ্রনাথ নিজে ‘যোগাযোগ’ দেখতে এলেন পঞ্চম রাত্রিতে। সেদিন প্রেক্ষাগৃহ অর্ধেকও পূর্ণ নয়।

রবীন্দ্রনাথ সদলবলে এসে আগাগোড়া দেখলেন তো বটেই, শেষ যবনিকা পতনের পরও দ্রুত প্রস্থান করলেন না। শিশিরকুমার এসে প্রণাম করলেন, পেছনে ছোট বোন চন্দ্রাবতীকে নিয়ে কুণ্ঠিতভাবে দাঁড়িয়ে কঙ্কাবতী।

রবীন্দ্রনাথ তার দিকে তাকাতেই কঙ্কাবতী অপরাধীর মতন গলায় বললেন, আপনার কুমুকে আমি নষ্ট করেছি, আমার চেহারার সঙ্গে একটুও মানায়নি!

মেয়েদের প্রতি চির-শিভালরাস রবীন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়িয়ে তার কাঁধ ছুঁয়ে বললেন, না, তোমার শরীর যে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা অভিনয় গুণে একটুও মনে পড়েনি। তুমি মন ভরিয়ে দিয়েছ!

শিশিরকুমারকেও তিনি প্রশস্তি জানালেন।

সাধারণ দর্শক এই নাটকটি কেমনভাবে গ্রহণ করেছে, সে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ খুবই কৌতূহলী। সঙ্গীদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলেন, প্রতি শোতেই দর্শকদের সংখ্যা কিছু কিছু কমছে।

তিনি লিখিতভাবে জানালেন, ‘নব নাট্যমন্দিরে যোগাযোগ দেখতে আমন্ত্রিত হয়ে মনে কুণ্ঠা নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে মনে আনন্দ ও বিস্ময় নিয়ে ফিরে এসেছি।

এমন সুসম্পূর্ণকায় অভিনয় সর্বদা দেখা যায় না— তৎসত্ত্বেও যদি শ্রোতাদের মনস্তুষ্টি না হয়ে থাকে, তবে সে জন্য নাট্যাধিনায়ক শ্রীযুক্ত শিশির ভাদুড়ীকে দোষ দেওয়া যায় না।’

তবে কাকে দোষ দিতে হবে? সে প্রশ্নের উত্তর অনাবশ্যক।

আবার রবীন্দ্রনাথের নাটকে নব নাট্যমন্দিরকে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে হল। শিশিরকুমারের ব্যবসায় বুদ্ধি বারবার হার মানতে লাগল তাঁর শিল্পীসত্তার কাছে। তবু সদম্ভে তিনি বন্ধুদের কাছে বললেন, ব্যবসা করতে এসেছি ঠিকই, তা বলে জাত খোয়াতে পারব না। একবার দেউলে হয়েছি, না হয় আবার হব?

কয়েকটা পুরনো নাটক টেনে এনে আবার আসর জমাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু জমল না। ঋণের দায়ে নানারকম মামলা মকদ্দমা শুরু হয়ে গেল। সদলবলে শিশিরকুমার বিতাড়িত হলেন স্টার থেকে।

আবার উদ্বাস্তু। রঙ্গমঞ্চেই যাঁর মন প্রাণ সমর্পিত, এখন কোনও রঙ্গমঞ্চেই তাঁর স্থান নেই।

এমনতর বেকার অবস্থায় আর একটি চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য ডাক এল। এর মধ্যে এই নড়াচড়া ছবির চরিত্ররা কথা বলতে শুরু করেছে। এর নির্মাণের কৃত্রিমতা শিশিরকুমারের পছন্দ হয় না, তবু তিনি রাজি হলেন, কিছু অর্থ উপার্জন তো করতে হবে।

কাহিনী হিসেবে তিনি বেছে নিলেন চাণক্য। তিনি নামভূমিকায়, আর কঙ্কাবতী মুরা।

টালিগঞ্জে স্টুডিয়ো তৈরি হয়েছে, অধিকাংশ শুটিং সেখানেই হয়। সেট তৈরি হয়, নকল রাজপ্রাসাদ, নকল রাস্তা, এমনকী শয়নকক্ষ, যার একদিকের দেওয়ালই নেই, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে ক্যামেরা।

এত কৃত্রিমতা শিশিরকুমারের সহ্য হয় না। তিনি চান মাঝে মাঝে আউটডোর। দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, সত্যিকারের গাছপালা, পূর্ণিমার রাত্রির সত্যিকারের চাঁদ। স্টুডিয়োতে পরদায় আঁকা আকাশের চাঁদ মাঝে মাঝে হাওয়ায় দোলে।

কিন্তু আউটডোর শুটিংয়ে খরচ অনেক বেশি। প্রযোজকরা রাজি হতে চায় না। শিশিরকুমারের ধমক খেয়ে তবু তাদের মেনে নিতে হয় কিছুটা।

বেহালা ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে এক জনশূন্য উন্মুক্ত স্থানে ফিল্ম কোম্পানির তাঁবু পড়েছে। শুটিং হয় দিনেরবেলা, রোদ্দুরই ভরসা। অগাস্ট মাস, কখনও আকাশে রোদ, কখনও মেঘের খেলা। প্রতিটি দৃশ্য গ্রহণের সময় ক্যামেরা-পরিচালক চেয়ে থাকে আকাশের দিকে, একটা ছোট্ট দুষ্টু ধরনের মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দিলেই সবাই শুটিং বন্ধ করে গালে হাত দিয়ে বসে পড়ে।।

ক’দিন ধরে কঙ্কাবতীর মাথায় একটা অদ্ভুত ব্যথা হতে শুরু করেছে। প্রথমে সে শিশিরকুমারকে কিছু বলেনি, কিন্তু একদিন শুটিংয়ের সময় এমনই অসহ্য ব্যথা শুরু হল যে তার মুখের অভিব্যক্তিই বদলে গেল। শিশিরকুমারের বকুনি খাবার পর সে বলতে বাধ্য হল, আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে গো! আমি আর পারছি না!

একেই তো মেঘের জন্য শুটিং থামিয়ে দিতে হয়, তা ছাড়াও অন্য কারণে শুটিং বন্ধ করলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। শিশিরকুমার বললেন, তোর রোলটা তো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, ধৈর্য ধরে আর দুটো দিন কর, তারপরই ছুটি পেয়ে বিশ্রাম নিবি!

পরের দিন শুটিংয়ের মাঝখানেই কঙ্কাবতী অজ্ঞান হয়ে গেল।

তাকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হল কলকাতায়। এর পরের চার দিন তার কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান ফেরে, আবার অজ্ঞান। জ্ঞান ও অজ্ঞানের মধ্যে চলতে লাগল লুকোচুরি। ডাক্তাররা রোগ ধরতে পারলেন না।

চতুর্থ দিন জ্ঞান ফিরল কিছুটা বেশি সময়ের জন্য, কিন্তু চক্ষে তবু ঘোর লেগে আছে।

শয্যার পাশে কে যেন বসে আছে, কঙ্কাবতী প্রশ্ন করল, কে?

সে বলল, বউদি, আমি পুতু। হাসপাতাল থেকে চলে এসেছি।

কঙ্কাবতী তীক্ষ গলায় বলে উঠল, কে তোর বউদি? আমি কারুর বউদি না! কেন এসেছিস?

পুতু বলল, বাঃ, তোমার অসুখের খবর শুনেও আসব না?

কঙ্কাবতী খানিকটা উঁচু হয়ে উঠে বলল, ও, তুই পুতু? বউদি বলছিস কেন? জানিস তোর দাদা আমাকে বিয়ে করেননি!

পুতু বলল, তবু তুমি আমার বউদি। তুমি আমার দিদি। তুমি সব কিছু!

কঙ্কাবতী পুতুর কপালে হাত ছুঁইয়ে বলল, তুই কেমন আছিস রে, পুতু? এখনও তো গায়ে জ্বর আছে দেখছি।

পুতু বলল, ও এমন কিছু না। আমি এখন অনেক ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?

কঙ্কাবতী বলল, আমি? আমি কে রে? আমি কেমন আছি, তা আমি জানিই না! তোকে যে ভাল হয়ে উঠতে হবে, পুতু!

পুতু বলল, তোমাকে এখন একটা ওষুধ খেতে হবে। একটু আগে ডাক্তারবাবু এসেছিলেন।

কঙ্কাবতী হি হি করে অদ্ভুতভাবে হেসে উঠে বলল, ওষুধ? না রে, ওষুধের দিন শেষ হয়ে গেছে! আমি আর আমাতে নেই! কাকে ওষুধ খাওয়াবি?

বারান্দায় ময়না পাখিটা বলে উঠল, কে এল গো? কে এল?

কঙ্কাবতী জোরে ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর, হতভাগী! কেউ আসবে না। আর কেউ আসবে না!

পুতু বলল, বড়দা রোজ তোমার খবর নিচ্ছে। মুশকিল হয়েছে কী জানো, কাল থেকে মাঝে মাঝেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। শুটিংয়ের আর একটুখানি বাকি আছে। শেষ না করে আসতে পারছে না। মনে হচ্ছে, কালই শেষ হয়ে যাবে।

কঙ্কাবতী বলল, হ্যাঁ, শেষ হয়ে যাবে। সব শেষ হয়ে যাবে।

একটু চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে কোনওক্রমে সে বলল, আমার বড্ড মাথার যন্ত্রণা করছে রে পুতু। বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আমাকে একটু ঘুমের ওষুধ দিবি!

সে ওষুধ খাওয়ার পরই হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল কঙ্কাবতী। সে কান্নায় আর কোনও ভাষা নেই।

পুতু বেচারি ঘাবড়ে গিয়ে কঙ্কাবতীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল, বউদি, বউদি!

একসময় আবার হঠাৎ বেশ শান্ত হয়ে গেল কঙ্কাবতী। সহজ গলায় বলল, তুই শুতে যা পুতু। আমিও ঘুমোই। শুধু দুটো আপশোস রয়ে গেল। তোর দাদা কিছুতেই আমাকে বিয়ে করলেন না। আর আমি শত চেষ্টা করেও ওঁকে মদ খাওয়া ছাড়াতে পারলুম না।…।

বলতে বলতেই তার চক্ষু বুজে এল।

ঘুমিয়ে পড়ল কঙ্কাবতী। সে ঘুম আর ভাঙল না। মাত্র বত্রিশ বছর বয়েসে জীবনের রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে চিরপ্রস্থান করল সে।

পনেরো – রাজ্য নেই, সিংহাসন নেই

বরানগরের কাছে, বি টি রোডের ওপর একটি লালচে রঙের দোতলা বাড়ির একখানা ঘরে, সকাল থেকে চোখের সামনে বই নিয়ে একটা ইজিচেয়ারে বসে থাকেন শিশিরকুমার। হাতে চুরুট। এমনও দিন যায়, সারাদিন একজন মানুষও আসে না তাঁর কাছে।

রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র দু’জনেই চলে গেছেন। নজরুল স্মৃতি-লুপ্ত, বাক-রহিত। শিশিরকুমারের মাতৃবিয়োগ হয়ে গেছে ছ’বছর আগে, দুই ভাই বিশ্বনাথ আর পুতুও আর নেই। কঙ্কাবতীর পোষা ময়নাটাকে অনেক দিন নিজের কাছে রেখেছিলেন, সে পাখিটাও একদিন মরে কাঠ হয়ে পড়ে ছিল, তার সারা গায়ে পিঁপড়ে। আছে শুধু রাশি রাশি স্মৃতি, তাও তিনি মনে করতে চান না।

তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলে অশোক থাকে এ বাড়িতে। দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী ভিখাও চলে গেছে তার দেশে। সে যেতে চায়নি, শিশিরকুমারই জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছেন, নিজের হাতের দুটি মূল্যবান আংটি খুলে দিয়েছেন তাকে, সে বিদায় নিয়েছে চোখের জল ফেলে। এখন আছে একটি নতুন ভৃত্য।

বন্ধুরা কেউ কেউ সরে গেছেন দূরে, অনেকেই আর পৃথিবীতে নেই।

নিজস্ব মঞ্চ স্টার ছেড়ে দিতে বাধ্য হবার পর কয়েক বছর ছিলেন যাযাবর। কিন্তু মঞ্চই তো তাঁর সাম্রাজ্য, তার বাইরের জগতে তিনি পরদেশি। কয়েক বছর পর আর একটি সুযোগ এল, প্রবোধচন্দ্র গুহ’র নাট্যনিকেতন ফেল পড়ল, শিশিরকুমার তাড়াতাড়ি সেটির দখল নিয়ে মঞ্চটির নতুন নাম দিলেন শ্রীরঙ্গম।

কঙ্কাবতীকে হারিয়ে সেই শ্রীরঙ্গমেও প্রায় এক যুগ ধরে শিশিরকুমার তাঁর সেই লুপ্ত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারলেন না। সিংহাসনে ঘুণপোকা ধরে গেছে, তরবারিতে মরচে পড়েছে। পুরনো নাটকগুলি আর লোক টানে না, ‘দুঃখীর ইমান’ কিংবা ‘তখৎ-এ-তাউস’-এর মতন নতুন পরীক্ষামূলক নাটকও আর দর্শকদের মনে। ধরে না। অন্যান্য মঞ্চে তখন ‘শ্যামলী’ কিংবা ‘উল্কা’র মতন সস্তা সেন্টিমেন্টের নাটকের রমরমা। এমনকী শরৎচন্দ্রের উপন্যাস-গল্পের নাট্যরূপও আগেকার সেই মন্ত্রশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

শ্রীরঙ্গমে পুরনো সহ-অভিনেতারা প্রায় কেউই নেই, শিশিরকুমারকে কাজ চালাতে হয়েছে ঝড়তি পড়তিদের নিয়ে, হেঁড়াখোড়া সেট ও পোশাক, ভাঙা আসবাব, ম্লান আলো, টিকিট বিক্রির অঙ্ক কোনওদিনই হাজার টাকাতেও পৌঁছোয় না। তারই মধ্যে অনেক বিশ্ববিখ্যাত বিদেশি কলকাতায় এসে থিয়েটার দেখতে চাইলে শ্রীরঙ্গমেই আসছেন। রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ মঞ্চ অভিনেতা চেরকাশভ আর বিখ্যাত চিত্র পরিচালক পুডভকিন সেই ভাঙা মঞ্চে ‘ষোড়শী’র মতন বস্তাপচা নাটক দেখেও মুগ্ধ। দু’জনেই বললেন, কী নাটক তা বুঝিনি। কোন জন শিশিরকুমার তাও জানতাম নয়া , কিন্তু মঞ্চে তিনি ঢোকামাত্র বোঝা গেল, ইনি একজন অসাধারণ অভিনেতা।

চেরকাশভ শিশিরকুমারকে বলেছিলেন, আপনার মতন একজন শিল্পী এই জরাজীর্ণ নাট্যশালায়, এমন পরিবেশে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন কী করে?

শিশিরকুমার বলেছিলেন, জানো তো, আমাদের দেশটা কত গরিব। আমাদের থিয়েটারেও সেই দারিদ্রই ফুটে বেরোয়। তোমাদের দেশে রাষ্ট্র সাহায্য করে থিয়েটারকে সবরকম ভাবে। আর আমাদের দেশে সরকার থিয়েটার নিয়ে মাথাই ঘামায় না। জাতীয় নাট্যশালা বলে কিছু নেই। আমাদের এইভাবেই চালাতে হয় কোনওক্রমে।

বিদেশিরা যতই প্রশংসা করুক, তা দিয়ে তো বাড়িওয়ালার মন ভেজানো যাবেনা। শিশিরকুমার শ্রীরঙ্গমে আবার রবীন্দ্রনাথের কাহিনী নিয়ে পরীক্ষা করার কথা ভাবছিলেন, ঠিক করেছিলেন, ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দেবেন, এদিকে যে তলে তলে কত ঋণ জমে গেছে তা খেয়াল করেননি। আদালতের ডিক্রি নিয়ে একদিন বাড়িওয়ালা শ্রীরঙ্গমের দরজায় তালা লাগিয়ে দিল, শিশিরকুমারের নিজস্ব জিনিসপত্র ছুড়ে ছুড়ে ফেলা হল রাস্তায়। পথচারীরা থমকে গিয়ে অবাক চক্ষে দেখল এক পাশে নতমুখে দাঁড়িয়ে আছেন শিশিরকুমার, তাঁর পায়ের কাছে এসে পড়ছে তাঁর জামা, জুতো, বইপত্র। সাধারণ মানুষের চোখে তখনও তো তিনি সম্রাট আলমগীর কিংবা নাদির শাহ! তেমনই রূপবান ও তেজস্বী চেহারা।

এর পরেও আশা ছাড়েননি শিশিরকুমার। তিনি আশা করেছিলেন, আবার একটা নিজস্ব মঞ্চ পাবেন, আবার উঠে দাঁড়াবেন। তখনও তিনি বুঝতে পারেননি, বাঙালি দর্শকরা তাঁকে ইতিমধ্যে মনে মনে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে ফেলেছে। এবং নির্বাসিত সম্রাটরা যাতে আর হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে না পারে, তার জন্যও অনেকে তৎপর হয়ে থাকে। যেন নেপোলিয়ান।

এটা হৃদয়ঙ্গম করতে শিশিরকুমারের আরও বছর দু’-এক সময় লেগে গিয়েছিল। সেই সময়টা তিনি বরাহনগরের বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে আসতেন কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায়। ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে দেবকুমার বসুর গ্রন্থজগৎ নামে প্রকাশনালয়ের ছোট্ট ঘরটিতে এসে তিনি বসেন, তাঁকে ঘিরে থাকে একদল তরুণ। শিশিরকুমারের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে ‘নব্য বাংলা নাট্য পরিষদ’। এই ঘরটিতে তিনি প্রধানত নতুন-পুরনো নাটক পাঠ করে শোনান।

শ্রোতাদের মধ্যে থাকে গৌরকিশোর ঘোষ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, বিনয়কৃষ্ণ দত্ত, জ্যোতির্ময় রায়, পঙ্কজ দত্ত, রবি মিত্র, শমীক বন্দ্যোপাধায়, নিবেদিতা দাস প্রমুখ। শিশিরকুমার জনে জনে প্রত্যেকের পরিচয় জানতে চান, নতুন কেউ এলেও আগ্রহী হন তার সম্পর্কে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষকে তিনি বিশেষ পছন্দ করে ফেলেছেন, অদূর ভবিষ্যতে যখন তিনি আবার মঞ্চ পাবেন, তখন অভিনেতা হিসেবে এরাই হবে তাঁর সম্পদ।

একদিন পেছনের দিকে একটি বছর বাইশেক বয়েসের লাজুক ও সাধারণ চেহারার যুবককে বসে থাকতে দেখে তিনি দেবকুমারের দিকে ফিরে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওই নতুন ছেলেটি কে?

দেবুদা বললেন, ও তো আমাদের সুনীল! কী যেন পদবি, ও হ্যাঁ, গঙ্গোপাধ্যায়। কবিতা টবিতা লেখে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু, ওরা একটা কবিতার কাগজও বার করে।

শিশিরকুমার আধুনিক কবিতা সম্পর্কে মোটেই উৎসাহী নন, এমনকী রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের কবিতায়ও কোনও রস পান না বলে জানিয়েছেন একদিন, তাই তিনি যুবকটি সম্পর্কে আর কোনও আগ্রহ প্রকাশ করলেন না।

নাটক পাঠ করার সময় তিনি এমনই মগ্ন হয়ে যান যেন মনে হয়, ছোট ঘরটিতে একটি চেয়ারে বসে থাকলেও তিনি সদর্পে পদচারণা করছেন মঞ্চে, সামনে প্রেক্ষাগৃহ-ভরতি বিমুগ্ধ দর্শক।।

মাঝে মাঝে মফস্‌সলে কয়েকজন বাছাই করা তরুণকে নিয়ে যান অভিনয় করতে। বিভিন্ন শখের দলের আমন্ত্রণে। যা দক্ষিণা পান, তাই তাঁর এখন একমাত্র উপার্জন। আস্তে আস্তে তিনি বুঝতে পারলেন, আবার তাঁর নতুন করে মঞ্চ পাওয়ার আশা সুদূর পরাহত। বড় সাধ ছিল, সুদীর্ঘ কালের নাট্যসাধনায় তিনি যা পেয়েছেন, সে অভিজ্ঞতার খানিক অংশ দিয়ে যাবেন নতুন কালের ছেলেমেয়েদের। সে সাধ তাঁর আর মিটবে না। কেউ তাঁকে একটা নাট্যশালা দেবে না।

যারা তাঁকে ডাকছে, তারা কি তাঁর প্রতি দয়া দেখাবার জন্য, সাহায্য করার জন্য থিয়েটার করতে বলছে? তিনি কি ভাড়াটে কেষ্ট হয়ে যাচ্ছেন?

ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে একদিন অভিনয় করার পর উদ্যোক্তারা তাঁকে ছ’ হাজার টাকা উপহার দিতে চাইল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এত টাকা দিচ্ছ কেন!

ওদের একজন সবিনয়ে বলল, স্যার, এটা আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। আপনার চোখে ছানি পড়েছে শুনেছি। ছানি কাটাবার খরচ লাগবে।

টাকাসুদ্ধ লেফাফাটা ফেরত দিয়ে শিশিরকুমার বললেন, আমার ছানি নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তোমার যাতে ছানি না পড়ে তাড়াতাড়ি, তার যত্ন নাও!

এনাফ ইজ এনাফ!

শিশিরকুমার কিছুদিনের মধ্যেই বাইরে যাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিলেন। সামনে অপেক্ষা করে আছে নিদারুণ দারিদ্র্য, তা আসে আসুক, তবু তিনি কারুর কাছ থেকে কৃপা নিতে পারবেন না। একের পর এক ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বিক্রি করে দিচ্ছেন, শুধু বইগুলি ছাড়া।

সারা ঘর ভরতি বই। সেই বইয়ের মধ্যে তিনি ডুবে থাকেন। বয়েস বেশি হলে গল্প-উপন্যাস কিংবা রম্য সাহিত্য আর পড়তে ইচ্ছে করে না, বিজ্ঞান-দর্শন কিংবা জ্ঞানগর্ভ আলোচনাই মন টানে। অথচ দিন ফুরিয়ে এলে এইসব জ্ঞান তো কোনও কাজে লাগবে না। নতুন নতুন বিদেশি নাটক, মঞ্চ ও থিয়েটার-প্রযোজনা বিষয়েও বহু বই পড়ে যাচ্ছেন শিশিরকুমার। অথচ জেনে গেছেন, আর কোনওদিন তিনি নাটক প্রযোজনা করবেন না।

মাঝে মাঝে দু’-একজন নবীন নাট্যকার আসে তাঁকে তাদের নাটক পড়াতে। তাদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করেন না। কিন্তু বলেন যে আমি পাঠ করে মতামত দিতে পারি শুধু। আমার দ্বারা তো আর মঞ্চস্থ করার আশা নেই।

যখন একা থাকেন, তখন হঠাৎ হঠাৎ বলে ওঠেন, ইট ইজ দা কজ, ইট ইজ দা কজ মাই সোল

তারপর নিজেকেই প্রশ্ন করেন, হোয়াট ইজ দা কজ?

কোনও উত্তর নেই। শেক্‌সপিয়ারও উত্তরটা দিয়ে যাননি।

মদ খাওয়ার সঙ্গীদের আর আসবার কোনও কারণ নেই। কিছুদিন আগে শিশিরকুমার মদ্যপান পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন।

পুরনো দিনের সাঙাৎ অলীক এল একদিন। সে অনেক রোগা হয়ে গেছে, চুপসে গেছে গাল, বসত বাড়ি বিক্রি করে ভাড়াবাড়িতে থাকে, তবু চালিয়ে যাচ্ছে নেশা। সে বলল, শিশির, তুমি নাকি একেবারে মাল খাওয়া ছেড়ে দিলে? কেন?

শিশিরকুমার উদাসভাবে বললেন, কী জানি! কেন যে ধরেছিলাম, তাও তো জানিনা।

অলীক বলল, বেশিদিন বাঁচতে চাও? ঠিক আছে, কমপিটিশন হোক আমার সঙ্গে।

শিশিরকুমার বললেন, ‘ঐ মহাসিন্ধুর ওপার হতে কী সঙ্গীত ভেসে আসে’, এই গানটা তোর মনে আছে? আমি যেন প্রায়ই অন্তরীক্ষে শুনতে পাই এই গান!

অলীক বলল, আমার কী মনে পড়ে জানো? ‘যৌবন বেদনা রসে উচ্ছল আমার দিনগুলি, হে কালের অধীশ্বর, অন্য মনে গিয়েছো কি ভুলি?’

একদিন বিশ্বরূপা থেকে একজন বেয়ারা এসে তাঁকে একটা টেলিগ্রাম পৌঁছে দিয়ে গেল। একজন মঞ্চ ছেড়ে গেলে অন্য যারা সেই মঞ্চের দখল নেয়, তারা অমনি নামও বদল করে। শিশিরকুমারের ‘শ্রীরঙ্গম’ এখন অন্য মালিকানায় নতুন নাম হয়েছে। ‘বিশ্বরূপা।

টেলিগ্রামটা পড়ে শিশিরকুমার প্রথমে হাসলেন। তারপর বললেন, হারামজাদারা!

টেলিগ্রামটা পাঠিয়েছেন ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের সচিব। শিশিরকুমারকে পদ্মভূষণ খেতাব দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি অভিনন্দন জানিয়েছেন। সেদিনকার সংবাদপত্রেও খবরটি ছাপা হয়েছে।

শিশিরকুমার প্রথমে ভাবলেন, টেলিগ্রামটা দলামোচা করে ছুড়ে ফেলে দেবেন। পদ্মভূষণ না ছাই! তিনি সেটা গ্রহণ করবেন কি করবেন না, তাও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করল না, তার আগেই অভিনন্দন। ওরা কী ভাবে, পদ্মভূষণ পাওয়ার কথা শুনলেই সবাই ধেই ধেই করে নাচবে!

নাঃ, একটা উত্তর দেওয়া উচিত।

অনেকদিন পর শিশিরকুমার কাগজ-কলম নিয়ে একটা চিঠি লিখতে বসলেন। ইংরিজিতে।

এর মধ্যে টেলিফোন বেজে উঠল।

শিশিরকুমার নিজে ফোন ধরেন না। অশোক এসে ধরে, সে-ই উত্তর দিয়ে দেয়। অধিকাংশ উত্তরই নঞর্থক, অর্থাৎ বাবা ব্যস্ত আছেন, এখন কথা বলতে পারবেন না।

আজ অশোক একটু কথা বলে মাউথ পিস চেপে ধরে বলল, বাবা, স্টেটসম্যানের চিফ রিপোর্টার কথা বলতে চাইছেন। উনি পদ্মভূষণ সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য একবার আসতে চান। কখন আসবেন জানতে চাইছেন।

শিশিরকুমার বললেন, বলে দে, আমি ভারত সরকারকে প্রত্যাখ্যানপত্র পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার বাড়িতে আসার দরকার কী? আমি খবরের কাগজকে আলাদা করে কিছু বলতে চাই না!

এরপর আনন্দবাজার, বসুমতী, অমৃতবাজার, যুগান্তরকেও দেওয়া হল সেই একই উত্তর। শিশিরকুমার কারও সঙ্গেই কথা বলবেন না।

দেশ স্বাধীন হবার পরও জাতীয় নাট্যশালা গড়ার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। খণ্ডিত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে শিশিরকুমারের কথা হয়েছে কয়েকবার। বিধান রায় সাহিত্য-সংগীত-থিয়েটার সম্পর্কে তেমন কিছু বোঝেন না, আগে ছিলেন ব্যস্ত ডাক্তার, এখন এক সমস্যাসংকুল, উদ্বাস্তুভারাক্রান্ত রাজ্যের প্রধান চালক। থিয়েটার নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কোথায়? তিনি আমলাদের ওপর ভার দিয়েছেন একটা কিছু ব্যবস্থা করার। বেশির ভাগ আমলাদেরই এখনও ব্রিটিশ আমলের মতন গদাই লস্করি চাল, তারা মনে করে, যে-যতবড় মানুষই হোক, সরকারি অনুগ্রহ পেলে ধন্য হয়ে যাবে। এরা অনেকে শিগ্রিকুমারের কোনও নাটকই দেখেনি।

তাদের প্রস্তাবের সবটাই ফাঁকা আওয়াজ। সরকারি উদ্যোগে কোনও নতুন রঙ্গমঞ্চ খোলার কোনও পরিকল্পনাই এখনও নেই, পরের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দেখা যাবে। আপাতত ওরা সরকারের অধীনে একটা নাট্য উন্নয়ন বিভাগ খোলার কথা ভাবছেন। শিশিরকুমার তার ভার নিতে পারেন। তবে, তিনি হবেন সরকারি কর্মচারী!

সরকারি চাকরি? পদে পদে লালফিতের বাধা! শিশিরকুমার অবজ্ঞার সঙ্গে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে চলে এলেন। ওরা সেই পদে পেয়ে গেল অহীন্দ্র চৌধুরীকে।

এরপর দিল্লিতে সাহিত্য আকাদেমির ধাঁচে খোলা হল সংগীত-নাটক আকাদেমি। সেখান থেকে তিনি সাম্মানিক ফেলো নির্বাচিত হলেন। এটাও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন শিশিরকুমার। ফেলোশিপ কি তিনি ধুয়ে খাবেন? তাঁর একমাত্র দাবি জাতীয় নাট্যশালা। সেখানে তিনি নতুন প্রজন্মকে নাটক শেখাবেন, ইচ্ছেমতন নতুন পরীক্ষামূলক নাটক প্রযোজনা করবেন, টাকাপয়সার চিন্তা থেকে নিষ্কৃতি পাবেন। সব সভ্যদেশেই যেরকম থাকে। সুইডেনের ওই যে বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, ইন্গমার বার্গমান, তিনিও তো আসলে সে দেশের জাতীয় নাট্যশালার পরিচালক। নাটকেরই লোক।

চিঠিখানা লিখতে পদে পদে বাধা আসছে। আবার টেলিফোন।

শিশিরকুমার লেখা থেকে চোখ না তুলেই অশোককে বললেন, আর আমাকে ডিসটার্ব করিস না। সবাইকে না বলে দে।

অশোক এবার চোখ বিস্ফরিত করে বলল, বাবা, আবার তিনি ফোন করছেন আপনি একবারটি অন্তত কথা বলুন!

শিশিরকুমার ভুরু কুঁচকে বললেন, তিনি মানে কিনি! কেন আমাকে কথা বলতে হবে! বলে দে, আমি ব্যস্ত আছি!

অর্থাৎ শিশিরকুমার বুঝিয়ে দিলেন, বিধানচন্দ্র রায়, এমনকী জওহরলাল নেহরু হলেও তিনি কথা বলতে চান না। ওদের কাছ থেকে তাঁর আর কোনও প্রত্যাশা নেই।

অশোক বলল, কালও ইনি ফোন করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়।

শিশিরকুমার একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, নামটা যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কে ইনি? আজকাল অনেক কিছুই মনে থাকে না।

অশোক বলল, বিশ্ববিখ্যাত সিনেমার ডাইরেক্টর।

শিশিরকুমার বললেন, সিনেমা? বিশ্ববিখ্যাত হোন বা যাই-ই হোন, আমার সঙ্গে কী দরকার? আমি তো বলেই দিয়েছি, ওসবের সঙ্গে আমার আর কোনও সম্পর্ক নেই। শুধু শুধু কেন আসবেন? বলে দে সে কথা।

অশোক বলল, বাবা, উনি একবারটি শুধু আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। উনি বললেন, ওঁর বাবা আপনার বন্ধু ছিলেন।

শিশিরকুমার বললেন, বাবার নাম বলেনি?

অশোক বলল, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন, আপনি দেখা করতে রাজি হলে এসে বলবেন। আর যদি রাজি না হন, তা হলে বলার দরকার নেই। মানে, বাবার পরিচয়ে উনি আসতে চান না।

শিশিরকুমার বললেন, বন্ধুর ছেলে? এখন ক’টা বাজে? সাড়ে বারোটা। খেয়েদেয়ে দুপুরে একটু ঘুমোব। সন্ধেবেলা একটি ছেলে আসবে বলেছে, ওই যে, যে ছেলেটি একটি নাটক জমা দিয়ে গেছে। ঠিক আছে, ওই সত্যজিৎকে কাল সকালে ঠিক দশটার সময় আসতে বলে দে।

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আর শোন, সিনেমার লোকেরা অনেক দলবল নিয়ে ঘোরে। ওকে বল, যেন তিনজনের বেশি না আসে। একগাদা অচেনা মুখ আমার আর দেখতে ইচ্ছে করে না।

আবার তিনি চিঠি লেখায় মন দিলেন; ইট ইজ আনফরচুনেট দ্যাট আই ওয়াজ নট সাউন্ডেড অ্যাবাউট ইট বিফোর দিস, ফর দো দা অ্যাপ্রিসিয়েশন ফর হোয়াটএভার মেরিটস আই হ্যাভ ইজ নো ডাউট গ্র্যাটিফায়িং, আই ফাইন্ড ইট ইমপসিবল টু অ্যাকসেপ্‌ট অন প্রিনসিপ্‌ল…..

সন্ধেবেলা তরুণ নাট্যকারটি চলে যাবার পর শিশিরকুমার আবার মন দিলেন বই পড়ায়। একটা চোখ গণ্ডগোল করছে, রাত্তিরে পড়তে অসুবিধে হয়। আলো নিভিয়ে বসে থাকলে ভালো লাগে।

অন্ধকার ঘরে শুধু মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে চুরুটের আগুন। ইজিচেয়ারে বসে আছেন শিশিরকুমার। দুটো জানলা খোলা, কিন্তু বাইরে তেমন কোনও দৃশ্য নেই। বরং শোনা যায় মানুষজন ও গাড়ি-লরির হল্লা। একসময় উঠে তিনি জানলা বন্ধ করে দিলেন।

একেবারে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ যেন জ্বলে ওঠে পাদপ্রদীপের আলো। নতুনভাবে সাজানো মঞ্চ, সামনে অগণিত দর্শক। ঝড়ের মতন হাততালি!

ঠিক যেন একটা ম্যাজিকের মতন ব্যাপার হয়।

কখনও তিনি নিজেকে দেখতে পান নাট্যমন্দিরের প্রথম যুগে। দিগবিজয়ী। তখন তার সুঠাম শরীর একেবারে জীবনরসে ভরপুর। মঞ্চে সেই গর্বোদ্ধত পদক্ষেপ। একটি দৃশ্যে তিনি এক লাফে উইংসের পাশ থেকে পৌঁছে যাচ্ছেন মাঝখানে।

বিড়বিড় করে দিগবিজয়ীর সংলাপ বলছেন, চেহারাটা বদলে যাচ্ছে, এখন তিনি ষোড়শীর জীবানন্দ। মঞ্চটাও তো অন্য, এ যে শ্রীরঙ্গম। ছেঁড়াখোড়া, তাপ্পি দেওয়া পরদা, ব্যাক ড্রপ। কথা বলতে বলতে তিনি হাঁফাচ্ছেন, প্রভা নেই, কঙ্কা নেই…। কঙ্কাবতীর নামটা মনে পড়তেই আবার বদলে গেল দৃশ্য, এ যে ‘বিরাজ বউ’, এখানে কঙ্কাবতী অভিনয়ে টেক্কা দিয়ে যাচ্ছে তাঁকে। কঙ্কাবতীর মৃত্যুর আগে তিনি তার শয্যার পাশে উপস্থিত থাকতে পারেননি। কী একটা এলেবেলে সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বুক-ভরা অভিমান নিয়ে চলে গেল মেয়েটা।

কঙ্কাবতী তার জীবনসঙ্গিনী ছিল, তার চেয়েও বড় কথা, সে কত বড় অভিনেত্রী! ‘যোগাযোগ’-এর কুমুর ভূমিকায় সে কবিগুরুকে খুশি করেছিল। কী আশ্চর্য, এর মধ্যেই অনেকে ভুলে যাচ্ছে কঙ্কাবতীকে। এখন কথায় কথায় তার নাম উঠলে অন্যদের মনে করিয়ে দিতে হয়, ঐ যে চন্দ্রাবতী, ফিল্ম অ্যাকট্রেস, তার বোন।

সেই শ্যামপুকুরের বাড়ির ছাদে বসে কঙ্কাবতী গান শোনাত। তখন ওর চোখে-মুখে ভবিষ্যতের কত উজ্জ্বল আশা। শিশিরকুমার ভাবলেন, আমি অবিচার করেছি ওর ওপর। তাই আমার এমন ভ্রষ্ট দশা? জ্ঞানত তো অবিচার করিনি, তবে কি আমার ভালোবাসার ক্ষমতাই কম? আমার অহংবোধ…

আবার পট পরিবর্তন। শিশিরকুমার দেখলেন, তাঁর চারপাশে উড়ছে অসংখ্য টাকা। শুধু কাগজের নোট নয়, রৌপ্য মুদ্রাও উড়তে উড়তে মাটিতে পড়ছে ঝনঝন শব্দে। কত টাকা! অনেক টাকা এক এক সময় উপার্জন করেছেন জীবনে, আবার উড়িয়েও দিয়েছেন। যদি শুধু ঐতিহাসিক নাটক কিংবা শরৎচন্দ্রের সেন্টিমেন্টাল গল্পের অভিনয় চালিয়ে যেতেন, তা হলে হয়তো তাঁর কখনও টাকার অভাব হত না, নিজস্ব রঙ্গমঞ্চও ছাড়তে হত না। কিন্তু তিনি বিশুদ্ধ রুচিশীল নাটক নামাতে চেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করেছেন বারবার, প্রত্যেকবারই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তবু এখনও বলতে পারেন, বেশ করেছি!

একে একে আলো নিভে যাচ্ছে। সমস্ত রঙ্গমঞ্চ এখন মিশমিশে অন্ধকারে ভরা। তার মধ্যে শোনা যাচ্ছে একটি ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর, ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল। আমার সাজানো বাগান…’।

এ রকম কাল্পনিক দৃশ্য তিনি আর উপভোগ করতে চান না। উঠে দাঁড়িয়ে ঘোর ভেঙে পায়চারি করেন কিছুক্ষণ। অন্ধকারের মধ্যে টেবল চেয়ারে ঠোক্কর লাগে।

ইট ইজ দা কজ, ইট ইজ দা কজ, মাই সোল….

হোয়াট ইজ দা কজ?

মদ্যপান পরিত্যাগ করার পর সন্ধেগুলো অনেক সুদীর্ঘ লাগে। সারা জীবনই তিনি দিনেরবেলার চেয়ে রাত্রিগুলি বেশি উপভোগ করেছেন। এখন আর ঘুমই আসতে চায় না। হেমেন্দ্রকুমার বলতেন, শিশির, এত কম ঘুমিয়েও তোর চোখ দুটো এত উজ্জ্বল থাকে কী করে?

একসময় সব শব্দ থেমে যায়। শুধু প্রতিদিন মধ্যরাত্রির পর আকাশ কাঁপিয়ে একটা বিমান উড়ে যায়, সেই সময় শিশিরকুমার জানলা দিয়ে বিমানটির অপস্রিয়মাণ নীল-হলুদ আলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। অত বড় বিমানটি আকাশে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি দেখতে তাঁর ভালো লাগে।

পরদিন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সকাল দশটায় এসে উপস্থিত হলেন সত্যজিৎ রায়। গৃহভৃত্যটি তাঁদের নিয়ে এল দোতলার ঘরে। বাড়িতে অতিথি এলেও বিশেষ কোনও পোশাক পরেন না শিশিরকুমার, সিল্কের লুঙ্গি আর ফতুয়াই তাঁর চিরাচরিত বাড়ির পোশাক। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। মাথার চুল খানিকটা কমে গিয়ে প্রশস্ত হয়েছে কপাল, একটুও মলিন হয়নি গৌরবর্ণ, সুগঠিত শরীর।

দীর্ঘকায় সত্যজিৎ হাত জোড় করে অনেকটা ঝুঁকে তাঁকে নমস্কার করতেই শিশিরকুমার উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বাগত সম্ভাষণ জানালেন।

সঙ্গী দু’জনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন সত্যজিৎ, একজন তাঁর ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র, অন্যজন, সত্যজিৎ বললেন, আমার এক লেখক বন্ধু, তবে নিজের নামে লেখেন না। ছদ্মনাম নিবারণ চক্রবর্তী।

শিশিরকুমার বললেন, ‘শেষের কবিতা’র সেই?।

ওঁরা তিনজন শিশিরকুমারের মুখোমুখি বসবার পর তিনি সত্যজিৎকে বললেন, আজকাল আমার স্মৃতি কেমন যেন গুলিয়ে যায়, আমার ছেলে আমাকে মনে করিয়ে দিল, আমি তো আপনার একটা বাইস্কোপ দেখেছি। পথের পাঁচালী। অপূর্ব লেগেছিল। আমাদের দেশে যে এরকম হতে পারে, আমার ধারণাই ছিল না। খুবই রিয়েলিস্টিক ছবি, অথচ তার মধ্যে শিল্প আছে। এই শিল্পগুণ ছাড়া রিয়েলিজ্‌মের কোনও মূল্যই নেই। তবে, আপনার আর কোনও ফিল্ম আমার দেখা হয়নি। হলে আমার যাওয়াই হয় না, কোনও হলেই আর ঢুকতে ইচ্ছে করে না। পথের পাঁচালীর জন্য আপনাকে কংগ্রাচুলেশন জানাচ্ছি।

সত্যজিৎ বললেন, আপনি আমাকে তুমি বলবেন।

ছোটখাটো রোগা চেহারার নিবারণ চক্রবর্তী বলল, আপনার পদ্মভূষণ পাওয়ার জন্য কি আপনাকে অভিনন্দন জানাতে পারি?

সুব্রত মিত্র তাড়াতাড়ি বলল, আজকের কাগজে বেরিয়েছে, উনি রিফিউজ করছেন।

নিবারণ চক্রবর্তী বলল, জানি। তবু, ভারত সরকার ওঁকে সম্মান জানাতে চাইছে…

শিশিরকুমার বললেন, তাতে কী এমন হাতিঘোড়া হয়েছে? কিছু কিছু লোককে ওই সব খেতাব দিয়ে কি একটা প্রিভিলেজ্‌ড ক্লাস বানানো হচ্ছে? ব্রিটিশ আমলের রায় বাহাদুরদের মতন? আই ফাইন্ড ইট ডিসগাসটিং!

সত্যজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা মজার কথা শুনবে? সরকারের টেলিগ্রামটা কোথায় এসেছে জানো? আমার ঠিকানা জানে না, ওটা পাঠিয়েছে শ্রীরঙ্গম থিয়েটারের ঠিকানায়। শ্রীরঙ্গম নামে কোনও থিয়েটার এখন আছে? ওটা আমার ছিল, তিন বছর আগে দেনার দায়ে আমার কাছ থেকে নিয়ে, আমাকে রাস্তায় বার করে দিয়েছে। সরকার সে খবর জানে না। আমি এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছি, তাও জানে না। আমার হাতে এখন কোনও থিয়েটার তো নেই-ই, কলকাতা শহরেই থাকার জায়গা পাইনি। এসেছি মফস্সলে। আমি যে সারাজীবন ন্যাশনাল থিয়েটার, ন্যাশনাল থিয়েটার বলে গলা ফাটাচ্ছি, তাতেও কারুর হুঁশ নেই। এখন দিতে এসেছে একটা খেতাব। জুতো মেরে গোরু দান। আমি লিখে দিয়েছি, ওসব খেতাব ফেতাব চাই না, যদি পারো তো কলকাতা শহরে একটা জাতীয় নাট্যশালা গড়ে দাও।

নিবারণ চক্রবর্তী বলল, সত্যি, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট না দিক, স্টেট গভর্নমেন্ট কি একটা ন্যাশনাল থিয়েটার গড়তে পারে না?

শিশিরকুমার বললেন, কলকাতায় যখন ইংরিজি থিয়েটার চালু হয়, কারা সাহায্য করেছিলেন জানেন? বাঙালি বড়মানুষেরা। শাঁ সুষি থিয়েটার যখন পুড়ে যায়, তখন দ্বারকানাথ ঠাকুর নতুন থিয়েটার গড়ে দেবার জন্য টাকা দিয়েছিলেন। তাঁরা কিন্তু বাংলা থিয়েটার গড়ার জন্য কিছুই করেননি। কেন, এখনও বর্ধমান, কোচবিহার, ভাগ্যকুলের জমিদাররা কি একেবারে গরিব হয়ে গেছে? তারা কী করেছে দেশের জন্য? যাক ওসব কথা, এখন বললা তো কী কারণে এসেছ আমার কাছে?

সত্যজিৎ বিনীতভাবে বললেন, আমরা একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমার নেকস্ট ছবি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী নিয়ে ‘জলসাঘর’। ওতে জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের ভূমিকায় আপনাকে চাই। ওটাই মেন রোল।

শিশিরকুমার হেসে বললেন, বায়স্কোপ? ও সবের সঙ্গে তো আমি সব সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেছি। নাঃ, তুমি ভুল মানুষের কাছে এসেছ।

সত্যজিৎ বললেন, আপনি অন্তত চিত্রনাট্যটা পড়ে দেখুন। অথবা আপনাকে শোনাতে পারি।

শিশিরকুমার বললেন, শুনেই বা কী করব? একেবারে মনঃস্থির করে ফেলেছি, ওসবের মধ্যে আর যাব না। ফিল্ম জিনিসটা একেবারে জানি না তা তো নয়। নিজেই গোটা চার-পাঁচ ফিল্ম পরিচালনাও করেছি। ভালো হয়নি অবশ্য। টাকার জন্য করতে হয়েছে। কিন্তু ঠিক মন লাগাতে পারিনি। ওই মিডিয়ামটা আমাকে সুট করে না, নাটকই আমার ধ্যান-জ্ঞান ছিল। দুই দেবতাকে একসঙ্গে খুশি করা যায় না।

নিবারণ চক্রবর্তী বলল, জলসাঘরের এই ক্যারেক্টারটা একেবারে আপনার জন্য হুবহু বিফিটিং। আপনি এই যেমন ইজিচেয়ারে বসে আছেন, তেমনি একটা ভাঙা জমিদার বাড়ির ছাদে বসবেন, আর পার্ট তো আপনার জলভাত!

হাত নাড়তে নাড়তে শিশিরকুমার বললেন, বোলো না, বোলো না, কোনও লাভ হবে না। আমার ডিসিশন ফাইন্যাল। আমি থিয়েটার নিয়ে নতুন কিছু করতে চেয়েছিলাম, পারিনি, ব্যর্থ হয়েছি, সেই পরিচয় নিয়েই মরব। এই বয়েসে আমি আবার সিনেমায় নামলে লোকে বলবে, আমি ভেক বদলাতে চাইছি। আমার কাছ থেকে যখন স্টার কেড়ে নেয়, তখন রবীন্দ্রনাথ আমাকে ডেকে বিশ্বভারতীতে অধ্যাপক হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রাজি হইনি কেন জানো? লোকে বলত, থিয়েটার করতে এসে হেরে গিয়ে শিশির ভাদুড়ী আবার পুনর্মুষিক হয়েছে। না, আমি আর মূষিক হতে চাই না। প্রাগৈতিহাসিক আমলের প্রাণী হয়েই হারিয়ে যাব।

একটু থেমে, ঠোঁটের কোণে একটু হাসির ঝিলিক দিয়ে বললেন, আর একটা কথা শুনবে? আমি শেষ কবে বায়স্কোপে অভিনয় করেছি জানো? ভ্যারাইটি পিকচার্সের ‘পোষ্যপুত্র’। সেটার কিন্তু আমি পরিচালক ছিলাম না। সতীশ দাশগুপ্ত পরিচালক। জীবনে কখনও আমি অন্যের পরিচালনায় থিয়েটারও করিনি, আগে সিনেমাও করিনি। সতীশের অধীনে কাজ করতে করতে আমার মনে হচ্ছিল, এ আমার দ্বারা পোষাবে না। তোমার এই জলসাঘরে তুমি পরিচালনা করবে। তুমিই এক নম্বর, আমি যে কিছুতেই দু’নম্বর হতে পারি না। আমার ধাতে নেই। এটা আমার দোষ বলতে পারো। কিন্তু আমি এরকমই। এ কাঠামোতে আর নিজেকে বদলাতে পারব না!

সত্যজিৎ বললেন, আপনাকে তো বিশেষ কিছু নির্দেশ দিতেই হবে না। আপনি নিজেই…

শিশিরকুমার বললেন, না, না নির্দেশ দেবে না কেন? অবশ্যই দেবে। তুমি পরিচালক, তোমার স্বপ্ন নিয়েই তো হবে সব কিছু। কিন্তু আমি পারি না। এ বিষয়ে আর কথা বলেও লাভ নেই। আগে করেছি টাকার জন্য, এখন আমার টাকাপয়সার প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে।

অন্য তিনজন চকিতে একবার ঘরটায় চোখ বোলাল। দারিদ্র্যের চিহ্ন প্রকট, শুধু এ গৃহের অধিপতির ব্যক্তিত্বে কোনও দীনতা নেই। আরাম কেদারার বেত ছিঁড়ে গেছে, দেওয়ালের একটা ছবির কাচ ফাটা। এক পাশে একটা তক্তাপোশের ওপর পাতা চাদরটা তেলচিটচিটে।।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অশোক সব শুনছে। তার খুবই ইচ্ছে, বাবা সত্যজিৎ রায়ের ফিল্মে অভিনয় করুন, কিন্তু বাবার মুখের ওপর কোনও কথা বলার সাহস তার নেই।

অশোকের দিকে তাকিয়ে শিশিরকুমার বললেন, কী রে, এঁদের একটু চা-টা খাওয়াবি না? দ্যাখ, আমার বালিশের তলায় বোধহয় কিছু টাকা আছে।

সত্যজিৎ বললেন না, না, আমরা চা খাব না। আপনি যখন রাজি হবেনই না, তখন আর আপনার সময় নষ্ট করব না।

শিশিরকুমার বললেন, ও হ্যাঁ, তোমার বাবার নামটা তো জানা হল না। অশোক বলছিল—

সত্যজিৎ বললেন, আমার বাবার নাম সুকুমার রায়। আপনি বোধহয় তাঁকে চিনতেন।

শিশিরকুমার উৎফুল্লভাবে বললেন, তুমি সুকুমার রায়ের ছেলে! আরে বসো বসো, আর একটু বসো। চেহারার কোনও মিল নেই। হ্যাঁ, চিনতাম তো বটেই, বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। আমার আর এক বন্ধু, সুনীতি চাটুজ্যে আর আমি সুকুমারের সঙ্গে কত আড্ডা দিয়েছি। যেমন সেন্স অফ হিউমার, তেমনি শার্প মাইন্ড। বিলেত থেকে ঘুরে এল, তেমন কিছু ইমপ্রেস্ড হয়নি, আমাদের বলত, ব্লক মেকিং, প্রিন্টিং সম্পর্কে সাহেবরা আমাদের থেকে এমন কিছু বেশি জানে না। তোমার বাবা খুব ভালো গানও গাইত, তুমি জানো?

সত্যজিৎ বললেন, আমি তো খুব ছোট ছিলাম, আমার মনে নেই। আমার মায়ের কাছে শুনেছি।

শিশিরকুমার বললেন, হ্যাঁ, এত অল্প বয়েসে সুকুমার চলে গেল… ‘আবোল তাবোল বইখানা বোধহয় ছাপা অবস্থায় দেখে যেতেও পারেনি, তাই না? খুব অসুখের মধ্যেও খোঁজ নিত। কী অপূর্ব বই! কত কবিতা মুখস্থ ছিল আমার! বইখানা অনেক দিন আউট অফ প্রিন্ট ছিল, এখন পাওয়া যায়?

সত্যজিৎ বললেন, হ্যাঁ, এখন আবার পাওয়া যায়। বাবার আরও বই বেরিয়েছে, আপনাকে পাঠিয়ে দেব এক সেট।

শিশিরকুমার বললেন, হ্যাঁ, দিয়ো, দিয়ো। জিনিয়াসের ছেলে জিনিয়াস! এমনটি সচরাচর দেখা যায় না। আগামী কালগুলিতে সম্ভবত বায়োস্কোপই হবে আর্টের প্রধান মাধ্যম। তাই না? থিয়েটার হারিয়ে যাবে!

সত্যজিৎ বললেন, আজ্ঞে, তা কেন? থিয়েটার আর সিনেমা পাশাপাশিই চলতে পারে। অনেক দেশে তাই-ই চলছে। থিয়েটারের সঙ্গে সিনেমার কোনও তুলনাই চলে না।

সুব্রত বলল, আপনি সিনেমাকে বায়স্কোপ বলছেন, শুনতে বেশ লাগছে। আমাদের বাবা-কাকারাও তাই বলতেন। বায়স্কোপ বলার তবু মানে হয়, কিন্তু এখন অনেকে বলে, বই। মানিকদা তো বই শুনলেই চটে যান!

শিশিরকুমার হেসে উঠে বললেন, বই! হ্যাঁ, মঞ্চ-নাটককেও অনেকে বই বলত। আমাদের মধ্যবিত্তরা তবু বই খানিকটা চিনেছে, কিন্তু থিয়েটার, পেন্টিং, ভালো মিউজিকের পুরোপুরি রসগ্রহণ করতে এখনও শেখেনি। রবীন্দ্রনাথ আমাকে প্রায়ই বলতেন, তোমরা দর্শক তৈরি করতে পারলে না? ঠিকই তো। পারিনি। ভালো নাটকও তো পাইনি। আমি তো সারাজীবন হালুমবীর, ঘুঘুবীর আর বাঁশবেহারীই করলুম। নাটকের মতন নাটক পেলুম কই!

নিবারণ চক্রবর্তী বলল, আপনি নিজে নাটক লিখলেন না কেন?

শিশিরকুমার বললেন, হয়তো ক্ষমতা ছিল না। সবার কি সব রকম ক্ষমতা থাকে? আমাকে অনেক দিক সামলাতে হত, সবচেয়ে বেশি লেজেগোবরে হয়েছি টাকাপয়সার দিকটা সামলাতে গিয়ে। হিসেব আমার মাথায় ঢোকে না। একসময় প্রচুর টাকা এসেছে, রাখতে পারিনি। আমার সংসার সামলাত কঙ্কা, সেও টাকা জিনিসটাই যেন চিনত না!

নিবারণ চক্রবর্তী বলল, আমরা তো শুনেছি, অন্যের লেখা নাটকের আপনি আগাগোড়া পালটে দিতেন। অনেক বিখ্যাত নাটকের অনেকটাই আপনার লেখা—

শিশিরকুমার বললেন, একটা কিছু ভাল থিম পেলে, তার ওপর কারিকুরি করা যায়। আমাদের স্টেজ চালাতে গেলে অনবরত নতুন নাটক লাগে। গিরিশবাবু নাটকের অভাবে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শেষপর্যন্ত নিজেই লিখতে শুরু করলেন। চার-পাঁচ দিনে একখানা করে নাটক শেষ করে ফেলতেন। সেগুলো অধিকাংশই তো এখন জঞ্জাল! আমি লিখতে না পারি, সাহিত্যটা তো বুঝি। সেইজন্যই বারবার রবীন্দ্রনাথের লেখা সংলাপ বাঙালির কানে ঢোকাতে চেয়েছি। আর প্রত্যেকবার ডুবেছি। বাঙালির কানে অনেক ময়লা জমে আছে।

নিবারণ চক্রবর্তী বলল, বুদ্ধদেব বসু আপনার নামে অভিযোগ করেছেন, আপনি সার্থক নাট্যকার তৈরি করতেও পারেননি। কল্লোল যুগের লেখকরা আপনাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করত, তাদেরও আপনি নাটক রচনায় উৎসাহ দেননি। বরং কেউ কেউ লিখলেও… বুদ্ধদেব বসু নিজেও…

শিশিরকুমার বললেন, হ্যাঁ, বুদ্ধদেব বসু একটা নাটকের পাণ্ডুলিপি আমাকে দিয়েছিল। কী যেন নামটা! ইন্দ্রজিৎ? না, না ‘রাবণ’। ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে সে ভেবেছিল, নাটক লিখলেই বুঝি প্রচুর টাকা পাওয়া যায়। সেখানা পড়ে আমার মোটামুটি পছন্দও হয়েছিল, রিহার্সালও শুরু করেছিলাম, তারপর একসময় মনে হল, মূল থিমটার সঙ্গে মেঘনাদবধ কাব্যের বেশ মিল। তাই আর এগোইনি৷ থিয়েটারে তো এরকম হয়ই, রিহার্সাল দিয়েও অনেক নাটক শেষপর্যন্ত স্টেন্ড হয় না!

নিবারণ চক্রবর্তী বলল, বনফুলও ‘শ্রী মধুসূদন’ নামে একটা নাটক…।

শিশিরকুমার বললেন, হ্যাঁ, ওটাও মন্দ না। কিন্তু মাইকেলের মুখে উনি যে ইংরিজি সংলাপ বসিয়েছেন, তা একেবারে স্কুল বয় ইংলিশ!

নিবারণ চক্রবর্তী বলল, সে ইংরিজি আপনি বদলে দিতে পারতেন অনায়াসেই। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, আপনি ওঁদের দু’জনের নাটক নেননি। কিন্তু তার পরেই, ওই বিষয় নিয়ে ‘স্বর্ণলঙ্কা’ আর ‘মাইকেল’ নাটক হয়েছে নাট্যনিকেতনে।

শিশিরকুমার খানিকটা উষ্ণ হয়ে উঠে বললেন, শোনো, প্লে আর ড্রামা এক নয়। তা বোঝাতে গেলে লম্বা লেকচার দিতে হয়। যেসব লেখকের মঞ্চ সম্পর্কে কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, তারা বড় জোর প্লে রাইট হতে পারে… তুমি আমার নামে অভিযোগ করছ? করো। আমি তো হেরেই বসে আছি।

নিবারণ চক্রবর্তী তাড়াতাড়ি দু’কানে হাত দিয়ে বলল, ছি ছি, আপনার নামে অভিযোগ করব, এমন স্পর্ধা কী আমার! বুদ্ধদেব বসুর লেখায় যা পড়েছি… ছেলেবেলায় আপনার ‘দিগবিজয়ী’র অভিনয় আমি দেখেছি। আমাদের চোখে আপনি এখনও দিগবিজয়ী! আপনার কাছে আমাদের অনেক ঋণ!

শিশিরকুমার বললেন, তোষামোদ! ওই বস্তুটি দিয়ে আমাকে কখনও নরম করা যায়নি। আমি সেলফ অ্যাসেসমেন্ট করতে পারি। আমি জানি, আমি বাংলায় দর্শকদের রুচি উন্নত করতে পারিনি, সেখানেই আমার পরাজয়। চেয়েছিলাম, বিলিতি অনুকরণ না করে আমাদের থিয়েটারকে নিয়ে যাব আমাদের ট্রাডিশনাল যাত্রার কাছাকাছি, এখন শুনছি যাত্রাই থিয়েটারের নকল করে মঞ্চ বাঁধছে!।

সত্যজিৎ বললেন, আপনি দর্শক তৈরি করতে পারেননি, একথাটা ঠিক নয়। আপনার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। এখন গ্রুপ থিয়েটারগুলোতে অনেক সূক্ষ্ম বিষয়ের নাটক হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের রচনা, আরও নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্টাল নাটক, সবই ত দর্শক নিচ্ছে। আগেকার কালে শুনেছি, নাটক দেখতে এসে একদল লোক নাচ, নাচ বলে চ্যাঁচাত, সিটি দিত, মেয়েদের সম্পর্কে কদর্য ইঙ্গিত করত, এখনকার দর্শক একেবারে অন্যরকম। খুবই রিসেপটিভ আর ভদ্র। এর পেছনে আপনাদের অবদানের কথা কোনওদিন ভোলা যাবে না। যারা বিপ্লব শুরু করে, তারা নিজেরা বিপ্লবের ফল ভোগ করে যেতে পারে না, তা পায় পরবর্তী প্রজন্ম…

শিশিরকুমার ধীরে ধীরে বললেন, রেভোলিউশান ডিভাউর্‌স ইট্‌স ওউন চিলড্রেন! কী জানি, হবেও বা! রবীন্দ্রনাথ আমাকে দেখে ‘অর্জুন’ নামে নাটক লিখবেন বলেছিলেন, শেষপর্যন্ত লিখে উঠতে পারেননি। আমি হয়ে গেলাম কর্ণ। আমি রব নিস্ফলের হতাশের দলে।

সত্যজিৎ রায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাকে একবার প্রণাম করব?

শিশিরকুমার বললেন, কেন? যখন প্রথম ঘরে ঢুকলে তখন হাত তুলে নমস্কার করেছিলে। ব্রাহ্মরা সকলের পায়ে হাত দেয় না। সেটাই তো ভালো।

সত্যজিৎ বললেন, আমরা গুরুজনদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করি। আমার মনে হচ্ছে, একবার আপনার পা ছুঁলে আমিই ধন্য হয়ে যাব।

শিশিরকুমারও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি এমন প্রতিভাবান, তুমি বিশ্বের কাছে বাংলার মান বাড়াবে, তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ব করব। তুমি আমার বন্ধুর ছেলে, তোমার স্থান তো আমার বুকে। এসো—

হাত বাড়িয়ে তিনি আলিঙ্গন করলেন সত্যজিৎকে।

1 Comment
Collapse Comments

It is wonderful classy and very informative book.it also very
helpfull book for reserch workers.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *