০৫. সীতার অগ্নিপরীক্ষা ও ঊষা

পাঁচ – সীতার অগ্নিপরীক্ষা ও ঊষা

সাড়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে অভিনয়ের উত্তেজনা ও পরিশ্রমের পর কয়েকজন নট-নটী মিলে কিছুক্ষণ আমোদ-ফুর্তি করা সব রঙ্গালয়েরই স্বাভাবিক প্রথা। কখনও কখনও কোনও অভিনেত্রীর বাড়িতেও যাওয়া হয়, সেখানে কেউ কেউ বে-এক্তিয়ার হলে গেলেও তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। গিরিশবাবুর আমল থেকেই এ ব্যাপার চলে আসছে। অমৃতলালই তো পদ্য করে লিখে গেছেন, ‘আমি আর গুরুদেব (অর্থাৎ গিরিশচন্দ্র) যুগল ইয়ার/ বিনির (অর্থাৎ বিনোদিনীর) বাড়িতে যাই খাইতে বিয়ার/ …বিয়ার খাইয়া মোর লাগিয়াছে ঠাণ্ডি/ ঝট করে নিয়ে আয় বি-হাইভ ব্র্যান্ডি/ …তখন হুইস্কি ছিল ঘোড়ার ঔষধ/ পায় নাই আজিকার রাজপেয় পদ…।

শিশির দু’-চারজন অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া আর কারও সঙ্গে মদ্যপান করেন না। কোনও অভিনেত্রীর বাড়িতেও যান না। থিয়েটারের মেয়েদের শিক্ষা দেবার জন্য তিনি অনেক সময় ব্যয় করেন, কিন্তু কারও সঙ্গেই তাঁর অন্তরঙ্গতা হয় না। রমণীদের সম্পর্কে তাঁর যেন কিছুটা বিতৃষ্ণার ভাব আছে।

সারাদিন নিজেকে সংযত রেখেছেন, এখন গপগপ করে গেলাসে ঢাললেন অনেকখানি হুইস্কি। জলটল না মিশিয়ে এক চুমুকে সবটা শেষ করে চুরুট ধরালেন।

তারপর ওই ছোট ঘরটিতেই পায়চারি করতে লাগলেন খাঁচায়-ভরা সিংহের মতন। বুক-ভরা প্রচণ্ড অভিমানের বাষ্প। মনে মনে অনবরত বলছেন, রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়নি। তার মানে, আমি পারিনি। সব ছেড়েছুড়ে থিয়েটারের জগতে এলুম কেন, কিছু পাঁচপেঁচি লোকের হাততালি কুড়োবার জন্য? বন্ধুরা তোল্লাই দেয় ভালোবেসে, আসল কষ্টিপাথরে যাচাই হয়নি এতদিন।

বোতল যখন প্রায় খালি, তখন শিশিরকুমারের সব তেজ, অহংকার অন্তর্হিত হয়ে গেছে। তিনি যেন একজন সম্পূর্ণ ব্যর্থ, পরাজিত মানুষ। দু’-চোখে টলটল করছে অশ্রু।

তিনি ধরা গলায় বললেন, ঊষা, তুমি আমায় এমন শাস্তি দিয়ে গেলে!

ঊষা।

এই নাটকের শেষে রাম যখন বারবার সীতা বলতে বলতে বুক-ফাটা আর্তনাদ করেন, যে-দৃশ্যটার জন্য এত প্রশংসা, সেখানে শিশিরকুমার মুখে সীতা সীতা বললেও, মনে মনে বলেন ঊষা, ঊষা! দেখতে পান এক নারীমূর্তিকে, যার সর্বাঙ্গে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।

কেউ একথা জানে না। একমাত্র সুনীতিকুমার ছাড়া।

আট বছর হয়ে গেল, তবু ঊষার সেই জ্বলন্ত মূর্তি ফিরে ফিরে আসে।

বাবা আর মা, দু’জনেরই প্রবল ব্যক্তিত্ব, তাঁরা জোর করে বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। পাত্রী আগ্রার এক ডাক্তারের মেয়ে, দেখতে শুনতে ভালোই, কিন্তু অতি সাধারণ, কাব্য-সাহিত্য কিছুই বোঝে না। তাও শিশিরকুমার ভেবেছিলেন, স্ত্রীকে লেখাপড়া শেখাবেন। নিজের মতন করে গড়ে নেবেন। কিন্তু পুরনো বনেদি পরিবার, সংস্কার-আচ্ছন্ন, অভিভাবকদের মতে বাড়ির বউ থাকবে অন্দরমহলে, পরদানশীন, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী-দেওর-ঠাকুরঝিদের সেবা করাই তার প্রধান কর্তব্য। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও গ্রামের অশিক্ষিত কিশোরী মেয়েদের বধূ করে আনা হয়েছে অত বৃহৎ পরিবারে, তারপর তাদের গড়েপিটে, সুশিক্ষা দিয়ে, শিল্প-সাহিত্য-সংগীতে রুচি তৈরি করে দিয়ে আধুনিক জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই পরিবারেই গ্রাম্য কন্যারা হয়েছেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, কাদম্বরী দেবীর মতন বিশিষ্ট রমণী।

কিন্তু ভাদুড়ী পরিবারে সে আধুনিকতার হাওয়া আসেনি। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের কোনও প্রভাব পড়েনি এই সমস্ত সংসারে। বউকে সঙ্গে নিয়ে কোনও বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি ছিল না শিশিরকুমারের, বন্ধুদের নিজের বাড়িতে ডেকে এনে স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার পর্যন্ত উপায় ছিল না। সুনীতিকুমার, শ্রীকুমারের মতন অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ঊষাকে কখনও চোখেই দেখেননি!

ছেলে যে উচ্চশিক্ষিত, তার একটা বাইরের জগৎ আছে, তার স্ত্রীকেও যে যোগ্য সঙ্গিনী করে তোলা দরকার, তা মানতে চাইলেন না শিশিরকুমারের বাবা আর মা। শুধু রাত্তিরবেলায় শয্যাসঙ্গিনী ছাড়া স্ত্রীর আর কোনও পরিচয় নেই। প্রথম দু’-তিন বছর একটা জৈব আকর্ষণ থাকে, ভালোবাসা হল না, মনের মিল হল না, তবু শারীরিক সম্পর্ক হয়। তার ফলে একটি ছেলেও জন্মাল। স্ত্রীকে কিছুটা শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন স্বামী, যাতে তার সঙ্গে নিছক সাংসারিক বিষয় ছাড়াও অন্য কথা বলা যায়, কিন্তু স্ত্রী সে তাল সামলাতে পারে না। হাল ছেড়ে দিয়ে শিশিরকুমার বারমুখী হয়ে গেলেন। অল্পবয়েস থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে সাহিত্য-নাটক নিয়ে আড্ডা দেবার খুব ঝোঁক শিশিরকুমারের, বন্ধুদের যখন নিজের বাড়িতে ডাকা যায় না, তখন তিনিই বন্ধুদের বাড়িতেই সময় কাটাতে লাগলেন। দিনেরবেলা তো বটেই, তা ছাড়া শিশিরকুমার স্বভাবে খানিকটা নিশাচর, না ঘুমিয়ে সারা রাতও আড্ডা দিয়ে কাটাতে পারেন। মাঝে মাঝে রাতেও বাড়ি ফেরা হয় না।

সরল, সাদাসিধে তরুণী ঊষা, কয়েক বছরের মধ্যেই সে খুব অসহায় হয়ে পড়ল। শ্বশুরের মৃত্যুর পর শাশুড়ি সংসারের হাল ধরেছেন। তিনি পদে পদে ঊষার কাজে ও ব্যবহারে খুঁত দেখতে পান। অনেক সময় অযৌক্তিকভাবেও বকাবকি করেন, যেন বিষের হুল বিঁধিয়ে দেন ঊষার শরীরে। ঊষা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে, সে সান্ত্বনা খুঁজবে কার কাছে? বাপের বাড়ি থেকে এত দূরে, এ বাড়িতে তার স্বামীই তো একমাত্র আপনজন। কিন্তু স্বামীর তো দেখাই পাওয়া যায় না। যদিও বা কখনও সখনও দেখা হয়, শাশুড়ির নামে কিছু বলতে গেলে পাত্তাই দেন না শিশিরকুমার।

ক্রমে ঊষার ধারণা হল, তার স্বামী অন্য রমণীর প্রতি অনুরক্ত। যে মানুষ রাত্তিরেও বাড়ি ফেরে না, সে নিশ্চয়ই অন্য কোনও মেয়ের কাছে থাকে, এটাই তার সোজাসুজি ধারণা।

এই নিয়ে প্রশ্ন করতে গেলে শিশিরকুমার আরও বিরক্ত হন। মাঝে মাঝে কথা বন্ধ করে দেন!

দু’-তিন দিন কথা বন্ধ থাকলে ঊষার যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। তারপর সে-ই উপযাচিকার মতন স্বামীর কাছে দয়া-ভিক্ষা করতে যায়। তখন হয়তো সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়। আবার কয়েকদিন পর দাম্পত্যকলহ, তা পর্যবসিত হয় তিক্ততায়। রাগের সময় শিশিরকুমার কথা বলতে শুরু করেন ইংরিজিতে, ঊষা তার এক বর্ণও বোঝে না। তখন সে স্বামীর পায়ে পড়ে বলে, ওগো, আমায় ক্ষমা করো, আমার যে আর কেউ নেই!

শিশিরকুমার গর্জন করে বলেছিলেন, আমি অন্য কোনও মেয়ের কাছে গিয়ে রাত কাটাই না। এই আমার শেষ কথা। এ নিয়ে আমাকে আর কোনওদিন জ্বালাতন করবে না!

তবু অবলা নারীর মন। একবার সন্দেহ ঢুকলে যেতে চায় না। শাশুড়ির নিপীড়নে মন বিষিয়ে গেলে সে তার স্বামীর কাছে আশ্রয় খোঁজে, স্বামী যদি তখনও উদাসীন থাকে তা হলে সে স্বামীকেই দংশন করে। দুঃখে হতাশায় সে বলে ফেলে, জানি তো, তুমি অন্য মেয়ের কাছে…

এবারে কথা বন্ধ হয়ে যাবার পর কয়েকদিন বাদে ঊষা আবার ক্ষমা চেয়ে বারবার কাকুতি-মিনতি করতে এল, কিন্তু শিশিরকুমারের মন গলল না। তিনি বললেন, তোমার যা ইচ্ছে করো, তুমি আমার সঙ্গে আর কথা বলতে এসো না!

ঊষা মিনমিন করে বলল, আমার ঘাট হয়েছে। আর ও কথা বলব না। এবারকার মতন আমায় ক্ষমা করো।

শিশিরকুমার এবার খুবই ক্রুদ্ধ হয়েছেন। ঝাঁঝালো স্বরে বললেন, বললুম পড়াশুনো করতে, তাতেও তোমার মন নেই। খালি আমার মায়ের নামে চুকলি কাটা ছাড়া আর তো কিছু জানো না! যাও!

আবার বললেন, দাঁড়িয়ে রইলে কেন, যাও! তোমার মুখের দিকে তাকাতেও আমার ঘেন্না করে!

কয়েক পলক বোবার মতন তাকিয়ে থেকে ঊষা চলে গেল ভেতরে।

একটু পরে মায়ের সঙ্গে বসে কথা বলছেন শিশিরকুমার, ভেতরে কী যেন একটা কাচ ভাঙার শব্দ হল।

উৎকর্ণ হয়ে কমলেকামিনী বললেন, কীসের আওয়াজ হল রে। কে যেন একটা বোতল ফেললে?

শিশিরকুমার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, কী আবার হবে! নিশ্চয়ই তোমার গুণবতী বউ একটা বোতল ভেঙেছে।

সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া গেল কেরোসিনের উগ্র গন্ধ। আর সিঁড়িতে ওপরে উঠে যাবার দুপদাপ শব্দ!

কিছু একটা সন্দেহ হল শিশিরকুমারের। উদ্বিগ্নভাবে তিনিও ভেতরে গিয়ে দেখলেন, সিঁড়িতে ফোঁটা ফোঁটা কেরোসিন। তেতলার ছাদে আর্ত চিৎকার।

শিশিরকুমার ছাদে এসে দেখলেন, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে ঊষার সারা শরীরে। শুধু দেখা যাচ্ছে মুখখানা। ঠিক যেন ছবিতে অগ্নিপরীক্ষায় সীতা। কিন্তু বাস্তবে আগুনের কোনও দয়া নেই।

ঊষা বিষম চিৎকার করে বলতে লাগল, ওগো, আমাকে বাঁচাও! আমি মরতে চাই না। ভুল করেছি। আমায় বাঁচাও!

শিশিরকুমার ছুটে গিয়ে দু’হাত দিয়ে চাপড়ে চাপড়ে আগুন নেভাবার চেষ্টা করতে লাগলেন, আর ডাকতে লাগলেন, মা, মা, শিগগির এসো। তারু, বিশু, আয়। সর্বনাশ হয়ে গেছে।

শিশিরকুমারের দু’হাত ঝলসে গেছে, কিন্তু তাতে কেরোসিনের আগুন নিভবে কেন? ছাদের ওপর একটা ছেঁড়া মাদুর পড়েছিল, বিশ্বনাথ এসে বুদ্ধি করে সেই মাদুরটা জড়িয়ে দিল বউদির গায়ে।

শিশিরকুমারদের বাড়ি মানিকতলার কাছে যুগিপাড়া লেনে। কাছেই সুকিয়া স্ট্রিটে থাকেন তাঁর বন্ধু সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, দুপুরবেলা তাঁর বাড়িতে একটি ছেলে দৌড়োতে দৌড়োতে এসে বলল, আপনি কোনও অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটকে চেনেন? তাকে সঙ্গে নিয়ে এক্ষুনি যেতে হবে, দাদা পাঠালেন। আমাদের বাড়িতে একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে।

পাড়ার এক অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে দ্রুত চলে এলেন সুনীতিকুমার। ও বাড়ির সামনে তখন ভিড় জমে গেছে। ততক্ষণে দোতলায় নামিয়ে আনা হয়েছে ঊষাকে। ওদের আত্মীয় এক ডাক্তার তাকে দেখছেন। শাড়ির ভগ্নাংশ সেঁটে গেছে ঊষার গায়ের পোড়া চামড়ার সঙ্গে। টেনে খোলা যাচ্ছে না। মুখখানাও দগদগে। এই প্রথম সুনীতিকুমার তাঁর বন্ধুর স্ত্রীর মুখ দেখলেন! সে তখন যন্ত্রণায় হাঁপাচ্ছে আর চিৎকার করছে।

ঘরের এক কোণে পাথরের মূর্তির মতন বসে আছেন শিশিরকুমার। তাঁর দু’হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। সুনীতিকুমার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই শিশিরকুমার অদ্ভুত এক ফাঁকা গলায় বললেন, এসেছিস? শোন, মেয়েদের সম্বন্ধে কখনও উদাসীন হবি না!

করোনারি ম্যাজিস্ট্রেট ঊষার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এমন কাজ করলে কেন মা?

ঊষা কোনওরকমে থেমে থেমে বলতে লাগল, আমি ভুল করেছি, ছেলেমানুষি সন্দেহ, ওগো আমায় রক্ষা করো। আমার কি পাপ হবে? কেউ দায়ী নয়। আমি নিজেই, ওঃ ওঃ, বড্ড কষ্ট।

ম্যাজিস্ট্রেট রিপোর্ট লিখছেন, ঊষা হঠাৎ চিৎকার থামিয়ে শান্ত গলায় বলল, উনি কোথায়?

শিশিরকুমার সঙ্গে সঙ্গে খাটের পাশে এসে দাঁড়ালেন শিয়রের কাছে।

মুখ ঘুরিয়ে স্বামীকে দেখে ঊষা বিহ্বলভাবে জিজ্ঞেস করল, আমি যে ভুল করেছি, তার জন্য কি আমার সাজা হবে?

শিশিরকুমার বললেন, না, না। সাজা কীসের! কেউ কিছু বলবে না।

ঊষা আবার জিজ্ঞেস করল, আমি কি বেঁচে উঠব? সত্যি বাঁচব আবার?

শিশিরকুমার বললেন, নিশ্চয়ই বাঁচবে। এই তো ডাক্তার বলছেন।

এবার অন্যদিকে মুখ ফেরাল ঊষা। আপন মনে বলল, যদি বেঁচে উঠি… সমস্ত শরীরটা পোড়ার দাগে … মুখখানাও পুড়েছে… সবাই আমাকে দেখে ভয় পাবে… তুমি তো তখন আমার দিকে আরও তাকাবে না, না… না, না। চলে যাই…

সেটাই তার শেষ কথা। আর জ্ঞান ফেরেনি, পাঁচ মিনিটের মধ্যে থেমে গেল হৃৎস্পন্দন।

জীবিত অবস্থায় নিজের প্রতি তার স্বামীর মনোযোগ ফেরাতে পারেনি ঊষা, কিন্তু মৃত্যু তাকে অনেকখানি গুরুত্ব দিয়ে গেল। অতি সাধারণ মানুষও কোনও কোনও সময় অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে। অত ক্ষোভ, অভিমান, তবু স্বামীকে ক্ষমা করে গেছে ঊষা। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেও স্বামীকে বিন্দুমাত্র দায়ী করেনি।

আগে দিনের পর দিন ঊষার সঙ্গে একটা কথাও হত না শিশিরকুমারের, এখন প্রায় প্রতিদিনই তার কথা মনে পড়ে। চোখের জল বেরিয়ে আসে পরিতাপে।

বোতল প্রায় শেষ। আজ বাড়িতে আর কিছুতেই ঘুম আসবে না। এই সময় একা থাকতেও তাঁর নিদারুণ কষ্ট হয়। ঈষৎ স্খলিত পায়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। অতি বিশ্বস্ত ভিখা বসে আছে দরজার বাইরে।

শিশিরকুমার বললেন, দরজা বন্ধ করে দে। তুই এবার শুতে যা।

এখন পথ একেবারে শুনশান। কোনও গাড়িঘোড়া নেই। গ্যাসের বাতি জ্বলছে, তাতে পুরো রাস্তা আলোকিত হয় না, আলো-আঁধারিতে দিনের বেলায় চেনা রাস্তা ও বাড়িগুলি কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়।

শিশিরকুমার হাঁটছেন রাস্তার মাঝখান দিয়ে। হঠাৎ তাঁর সামনে দু’জন পুলিশের সেপাই এসে দাঁড়াল। এখন রাত প্রায় আড়াইটে-তিনটে। এত রাতে কলকাতা শহরে একা কোনও মানুষের পথ চলার নিষেধ আছে। বিশেষ কোনও কারণ থাকলে তার প্রমাণ দাখিল করতে হয়। নইলে চোর বলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।

পাহারাওয়ালা দু’জন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শিশিরকুমার অসীম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, সরো, সরো, পথ ছাড়ো।

সেই কণ্ঠস্বরের দাপট শুনেই ওরা বুঝল, এ ব্যক্তি মাতাল হতে পারে, বড় জাতের মাতাল। চোর-ছ্যাঁচোড় নয়।

তারা বিনা বাক্যব্যয়ে পথ ছেড়ে দিল।

আরও কিছুক্ষণ পথ চলার পর শিশিরকুমার একটা দোতলা বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়ালেন। অন্ধকার, সব দরজা-জানালা বন্ধ।

শিশিরকুমার চিৎকার করে ডাকলেন, সুনীতি! সুনীতি!

কয়েকবার ডাকার পর পাশের একটি বাড়ির জানালা খুলে গেল। একজন ব্যক্তি কর্কশ গলায় বলল, এই, এত রাত্রে কে চ্যাঁচাচ্ছে? চুপ করো!

শিশিরকুমার বললেন, চোপ! আমি সুনীতিকে ডাকছি!

তক্ষুনি সামনের বাড়ির সদর দরজা খুলে, লুঙ্গি পরা, খালি গায়ে বেরিয়ে এলেন সুনীতিকুমার। মোটেই অবাক বা উদ্বিগ্ন নন।

তিনি সহাস্যে বললেন, কী রে, তুই কি মানুষকে ঘুমোতে দিবি না?

অবুঝের মতন মাথা নেড়ে শিশিরকুমার বললেন, আমার ঘুম পাচ্ছে না, এখন অন্য লোকে কেন ঘুমোবে?

সুনীতিকুমার বললেন, আমার তো গাঢ় ঘুম। সহজে ভাঙতেই চায় না। আমার স্ত্রী ঠেলা মেরে জাগিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার সেই পাগল বন্ধুটা এসেছে। দা গ্রেট জিনিয়াস!

শিশিরকুমার বললেন, ঠাট্টা করছিস!

সুনীতিকুমার বললেন, না রে! মনে নেই, তোর সঙ্গে আমার স্ত্রীর আলাপ করিয়ে দেবার সময় বলেছিলুম, আমার এই বন্ধুটি একই সঙ্গে পাগল আর জিনিয়াস! চল, ভেতরে চল।

শিশিরকুমার বললেন, আজ আমার মনটা খুব খারাপ লাগছে রে!

সুনীতিকুমার বললেন, কেন, বিশেষ কোনও কারণ ঘটেছে? আজ আমি যাইনি। আজকের শো-তে কোনও গোলমাল হয়েছে নাকি?

শিশিরকুমার ধরা গলায় বললেন, রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগেনি। উনি একটাও কথা বলেননি আমার সঙ্গে।

সুনীতিকুমার কয়েক পলক স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন, সেইজন্য তুই এত রাতে ছুটে এসেছিস আমার কাছে? গুরুদেব সম্ভবত অত ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াতে চাননি। আমি পরে ওঁর মতামত জেনে নেব। কতটা খেয়েছিস?

শিশিরকুমার ধরা-পড়া শিশুর মতন বললেন, অনেকটা। বোতল শেষ।

সুনীতিকুমার বললেন, বেশি খেলেই তুই এমন উতলা হয়ে উঠিস। আমি তো জানিই। শিশির, তুই আর একটা বিয়ে কর। তুই একজন এত বড় শিল্পী। কোনও শিল্পীর জীবনে নারী না থাকলে কি চলে? মাধুর্য হারিয়ে যায়।

শিশিরকুমার বললেন, কিন্তু…

সুনীতিকুমার বললেন, কিন্তু আবার কী! ঊষা তোকে ক্ষমা করে গেছে।

শিশিরকুমার ভাঙা গলায় বললেন, ঊষা আমায় ক্ষমা করে গেছে, কিন্তু আমি যে নিজেকে এখনও ক্ষমা করতে পারি না!

ছয় – প্রথম বার, শান্তিনিকেতন

গোরুর গাড়িতে যেতে হবে?

বোলপুর স্টেশনের বাইরে এসে অন্য কোনও ধরনের যানবাহন তো দেখা গেল না।

যোগেশ চৌধুরী আর বিশ্বনাথকে সঙ্গে এনেছেন শিশিরকুমার। সদ্য ভোর হয়েছে, ট্রেনেই কেটে গেছে সারারাত। অল্প কিছু যাত্রী, তাদের মধ্যে কয়েকজন চেপে বসল অপেক্ষমাণ গোরুর গাড়িতে, কয়েকজন হাঁটা শুরু করেছে।

বাসি মুখেই চুরুট ধরালেন শিশিরকুমার, ঈষৎ বিরক্তভাবে ছোটভাইকে বললেন, ওরে বিশে, দ্যাখ না আর কোনও গাড়িটাড়ি পাওয়া যায় কিনা। ওসব গোরুর গাড়ি মাড়িতে আমি চাপতে পারব না।

যোগেশ একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ মশাই, শান্তিনিকেতনের আশ্রম কত দূর?

লোকটি বলল, তা হবে ক্রোশ দেড়-দুই।

যোগেশ আবার জিজ্ঞেস করল, ওখানে যে একজন গুরুদেব আছেন, তিনি যখন যাওয়া-আসা করেন, কীসে যান?

লোকটি বলল, ঠাকুরবাবু? ওনার বাপের আমলে তো মোটরগাড়ি ছিল না। তেনারা গোরুর গাড়িতেই যেতেন। এখন এক সাহেব একখানি মোটরগাড়ি এনেছেন। ঠাকুরবাবু চড়েন, আর কলকেতা থেকে ভারী ভারী মানুষ কেউ এলে সেই মোটরগাড়ি পাঠানো হয়।

যোগেশ মনে মনে হাসল। শিশির ভাদুড়ীর তুলনায় কলকাতায় ভারী ভারী মানুষ আর ক’জন আছে? অবশ্য, এখানে কোনও খবর দিয়ে আসা হয়নি।

বিশ্বনাথ গাড়োয়ানদের সঙ্গে কথা বলে এসে জানাল, বড়দা, গোরুর গাড়ির ভেতরে খড় দিয়ে গদি পাতা আছে, তোমার অসুবিধে হবে না।

শিশিরকুমার সবেগে দু’দিকে মাথা নাড়লেন।

যোগেশ বলল, বড়বাবু, বলছে তো তিন-চার মাইলের পথ। চলুন না বেড়াতে বেড়াতে হাঁটতে হাঁটতেই চলে যাই। বাতাস বেশ মোলায়েম আছে।

শিশিরকুমার তাতেই রাজি হলেন। স্টেশন ছাড়াবার পর দুটো-একটা পাকা বাড়ি, কয়েকখানা খড়ের চালের দোকান, তারপর দু’পাশে ধুধু মাঠ। লাল মাটির কাঁচা রাস্তা। দূরে দূরে দেখা যায় কয়েকটা তাল গাছ।

এক দোকানে ভাজা হচ্ছে গরম গরম জিলিপি। বিশ্বনাথ কিনে ফেলল ডজন খানেক, শিশিরকুমার তার একটাও ছুঁয়ে দেখলেন না। সকালবেলা তাঁর কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। মিষ্টদ্রব্য পছন্দও করেন না। যোগেশ বেশ ভোজনরসিক।

এঁদের তিনজনেরই ধুতির নীচের অংশ লাল ধুলোয় ধূসরিত হয়ে গেল।

এক স্থানে, পথের ধারে কুয়ো থেকে জল তুলছে কয়েকটি সাঁওতাল রমণী, শিশিরকুমার দাঁড়ালেন সেখানে। গত রাত্রির নেশার কিছুটা রেশ রয়ে গেছে মাথার মধ্যে, চোখ দুটিও আঠা আঠা। তিনি একটু জল প্রার্থনা করতেই এক নারী তার মাটির হাঁড়ি থেকে জল ঢেলে দিল। শিশিরকুমার অঞ্জলি পেতে সেই জলে চোখমুখ প্রক্ষালন করলেন, খেয়েও ফেললেন অনেকটা।

এবার তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, আঃ, জল বেশ ঠান্ডা আর স্বাদু।

যোগেশও জল নিতে নিতে বলল, শুনেছি, এখানকার জলে ক্ষুধা বৃদ্ধি হয়!

শিশিরকুমার বললেন, ঠাকুরবাড়ির আতিথ্য খুব বিখ্যাত। ভালোই খাওয়াবে।

যোগেশ বলল, কবিগুরু আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন তো?

শিশিরকুমার ভুরু তুলে বললেন, কেন, দেখা করবেন না কেন?

যোগেশ বলল, না, মানে, ঠিক আগে থেকে চিঠি লিখে আসা হয়নিকো। ওয়ার্লড ফেমাস পোয়েট, সারা ওয়ার্লডের লোক আসে ওনার কাছে। যদি আমাদের মতন ভেতো বাঙালিদের এখন চিনতে না পারেন?

বিশ্বনাথ বলল, তা বলে কি উনি বাঙালিত্ব ভুলে গেছেন নাকি? কোনও সভায়-টভায় তো ওঁকে কোট-প্যান্টালুন পরতে দেখি না।

শিশিরকুমার গম্ভীরভাবে বললেন, কবিগুরু কত দেশ-বিদেশ ঘুরে আসেন! কখনো অন্য দেশ নিয়ে কিছু লেখেন না। তাঁর মন সবসময় পড়ে থাকে এই বাংলায়। আজ দেখা না পাই, দু’দিন আমরা অপেক্ষা করব।

বললেন বটে এ কথা, কিন্তু যোগেশের কথা শুনে তাঁর মনেও একটা খটকা লেগে গেল।

ওঁরা বনেদি বাড়ির মানুষ, কারুর মুখের ওপর অপ্রিয় কথা বলেন না। ‘সীতা’ নাটকের অভিনয় যদি ওঁর খুবই অপছন্দ হয়ে থাকে, তা হলে হয়তো দেখা না করে কোনও ছুতোয় এড়িয়ে যাবেন।

আবার হাঁটা শুরু করে তিনি আপন মনে বললেন, উই শ্যাল ক্ৰম দা ব্রিজ হোয়েন। উই কাম টু ইট।

চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের সঙ্গে শিশিরকুমারের ভালো পরিচয় আছে। প্রথমে তাঁর খোঁজ করা হল, চারুবাবু এঁদের থাকার বন্দোবস্ত করে দিলেন অতিথিভবনে।

বললেন, এ বেলাটা বিশ্রাম নিন। বিকেলে সাহিত্যবাসর হবে। সেখানে গুরুদেব নতুন লেখা পড়ে শোনাবেন। তখন নিয়ে যাব।

অতিথিভবনটি একটি ছোট্ট দোতলা বাড়ি। সব মিলিয়ে চার-পাঁচখানা ঘর। ওপরতলায় রয়েছে দু’জন বিদেশি। এখানে ঠাকুরবাড়ির আতিথ্যের প্রশ্ন নেই। দুপুরে খেতে যেতে হয় ক্যান্টিনে। অতি সাধারণ নিরামিষ আহার। যোগেশ-বিশ্বনাথরা খুব নিরাশ।

ফেরার পথে যোগেশ বলল, ব্রাহ্মরা কি সবাই নিরামিষ খায়? আগে তো শুনিনি। শুধু ডাল-ভাত আর আলুর ঘ্যাঁট খেয়ে এরা দিনের পর দিন কাটায় কী করে?

শিশিরকুমার বললেন, এই শান্তিনিকেতনের ইস্কুলটার নাম ব্রহ্মচর্য আশ্রম। তাই এখানে নিরামিষ। শোনো, তোমাদের একটা মজার গল্প বলি। আমার বন্ধু সুকুমার রায়ের কাছ থেকে শুনেছি। সুকুমার মহা রসিক। কবিগুরুর কাছেও যাতায়াত আছে, গান গায়ও ভালো। প্রথমবার এখানে এসে ক্যান্টিনে খেতে বসেন। ভাত-ডাল আর কী একটা ভাজা দিয়েছে, মাছ মাংসের নামগন্ধ নেই, তারপর দেখল, দূরে গোল গোল কী যেন পরিবেশন করা হচ্ছে। সুকুমার ভাবল, নিশ্চয়ই ডিমের ঝোল। কাছে আসবার পর দেখা গেল, ও হরি, ডিম তো নয়, বড় বড় আস্ত আলু। তক্ষুনি ও কবির একটা গানকে প্যারোডি করে গেয়ে উঠল, এই তো ভালো লেগেছিল, আলুর নাচন হাতায় হাতায়…। কোন গানটা, বুঝলে?

চারুচন্দ্র ডাকতে এলেন ঠিক সাড়ে চারটের সময়। এর মধ্যে শিশিরকুমার খানিকটা ঘুমিয়ে নিয়েছেন। শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে। সাহিত্যসভা বসেছে এই অতিথিভবনেরই ছাদে।

রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন একটি মখমল দিয়ে ঢাকা চেয়ারে, সামনের শতরঞ্জিতে উপবিষ্ট কয়েকজন অধ্যাপক ও ছাত্র-ছাত্রী। বসবার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়েও আছে কয়েকজন। রবীন্দ্রনাথের ঠিক পিছনেই আকাশ একেবারে দিগন্তবিস্তৃত, মেঘের ফাঁকে ফাঁকে খেলা করছেন সূর্য।

চারুচন্দ্র নিশ্চিত আগে সব বলে রেখেছিলেন, তাই রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই বিনা ভূমিকায় বলে উঠলেন, আরে শিশির, এসো এসো। কোন কাগজে মিথ্যে করে লিখেছে, আমি নাকি তোমার সীতা নাটক পছন্দ করিনি! মোটেও তা নয়।

শিশিরকুমার বিনীতভাবে বললেন, আপনি প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। তাই আমার প্রতিপক্ষ ধরেই নিয়েছে আপনার ভালো লাগেনি। তারা খুব খুশি।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, ওরা ঠিক বলেনি। সেদিন আমার তাড়া ছিল। আমি তো মণিলালকে বলে দিয়েছি, সেদিনের অভিনয় আমি উপভোগ করেছি। তোমাকে সে জানায়নি?

শিশিরকুমার বললেন, আজ্ঞে, মণিলাল আমার বন্ধু, সে বলেছে, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, সে আমাকে স্তোকবাক্য শুনিয়েছে। আমি আপনার মুখ থেকে শোনার জন্য এতদূর ছুটে এসেছি।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, এসো, আমার কাছে এসে বসো।

সঙ্গীদের নিয়ে শিশিরকুমার এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলেন কবির পা ছুঁয়ে। বসার আর জায়গা নেই। কয়েকজন উঠে গিয়ে ওঁদের স্থান করে দিল।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, সেই সন্ধ্যায় আমি তোমার অভিনয়প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছি। প্রয়োগনৈপুণ্যও বিস্ময়কর। কিন্তু সীতা নাটকটি একেবারেই নিরেস, খুবই দুর্বল!

শিশিরকুমার আড়ষ্টভাবে আড়চোখে যোগেশ চৌধুরীর দিকে তাকালেন। তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে কবির পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। এখন আর সে প্রশ্ন ওঠে না, কবি তা হলে লজ্জা পেয়ে যাবেন। বেচারি যোগেশের মুখখানি আঁধার হয়ে গেছে।

রবীন্দ্রনাথ আবার বললেন, অত দুর্বল নাটককেও কীভাবে মঞ্চে সফল করে তোলা যায়, তুমি তার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছ। রামচন্দ্রের ভূমিকায় তোমাকে দেখতে দেখতে আমার কী মনে হচ্ছিল জানো! আমি অজুৰ্নকে নিয়ে একটা নাটক রচনা করব, আর তুমিই হবে সার্থক অর্জুন।

শিশিরকুমার বললেন, আপনি নাটক লিখে দিলে সে হবে আমার পরম প্রাপ্তি। আমাদের বাংলা মঞ্চে ভালো নাটকের অভাব আমি পদে পদে বোধ করছি। আপনার নাটক ছাড়া আর কারও নাটক পাঠযোগ্যই নয়। আমার খুব সাধ ছিল, চিরকুমার সভা নামাই। কিন্তু অক্ষয়ের ভূমিকা কে করবে? আমার গলায় একটুও সুর নেই। তারপর ‘বিসর্জন’-এর কথাও ভেবেছিলাম।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, হ্যাঁ। বিসর্জন তো করতেই পারো। তোমাকে রঘুপতি উত্তম মানাবে, গান গাইতেও হবে না। জয়সিংহও করতে পারো।

শিশিরকুমার বললেন, বির্সজন আপনি স্বয়ং প্রোডাকশন করেছেন। অসাধারণ আপনার অভিনয় অনেকেরই স্মৃতিতে আছে। এখন আমি ওই অভিনয় করতে গেলে তারা আমাকে দুয়ো দেবে।

রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, না, না দুয়ো দেবে কেন? তোমার অভিব্যক্তি হবে অন্য রকম। তা ছাড়া আমার বয়েস হয়েছে না? বিশ্বভারতীর অর্থ সংগ্রহের জন্য এখনও রং মেখে স্টেজে নামি, সে আর কতদিন! তোমার এখন পূর্ণ যৌবন। যৌবনের বর্ণচ্ছটাই আলাদা। জানো, শিশির, অনেকদিন পর আবার আমার নাটক রচনার নতুন করে উৎসাহ লেগেছে। ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করছি। আজ আমার এখানে একটা নাটক পাঠ করে শোনাবার কথা। তোমরা শুনবে?

শিশিরকুমার বললেন, অবশ্যই। আপনার নিজের কণ্ঠে নতুন নাটকের প্রথম পাঠ শুনতে পাব, এতবড় সৌভাগ্য আশাই করিনি।

পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাগুলি গুছিয়ে নিতে লাগলেন রবীন্দ্রনাথ।

সবাই অধীর আগ্রহে স্তব্ধ।

পাঠ শুরু করার আগে কবি মুখ তুলে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাই বলো বাপু, তোমাদের স্টেজে পশ্চাৎপটে যে একটা ছবি আঁকা থাকে, ওটা আমার মোটেই পছন্দ নয়। ওটা ইউরোপীয় নাট্যমঞ্চের প্রসাধন, আমাদের মঞ্চে উপদ্রব হিসেবে প্রবেশ করেছে। ওটা ছেলেমানুষি। লোকের চোখ ভোলাবার চেষ্টা। সাহিত্য ও নাট্যকলার মাঝখানে ওটা গায়ের জোরে প্রক্ষিপ্ত।

শিশিরকুমার বললেন, কবিগুরু, আমি আপনার সঙ্গে একশো ভাগ একমত। ব্যাক ড্রপে ছবি আঁকা থাকলে, সে ছবি তো আর নড়েচড়ে না, অথচ নাটক এগিয়ে যায়। স্টেজ যখন খালি থাকে, তখন মনে হয় একটা পিকচার ফ্রেম! নাটকের জন্য একেবারে অপ্রয়োজনীয়।

কবি বললেন, তা হলে ব্যবহার করো কেন? কালিদাস মেঘদূত লিখে গেছেন, ওই কাব্যটিই তো একটি ছন্দোময় কাব্যের চিত্রমালা, ওর পাশে পাশে কেউ যদি ইলাস্ট্রেশনের মতন ছবি এঁকে দেয়, তা হলে কবির প্রতি যেমন অবিচার, পাঠকের প্রতিও তেমনি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়। নিজের কবিত্বই কবির পক্ষে যথেষ্ট, বাইরের সাহায্য তার পক্ষে সাহায্যই নয়, বরং ব্যাঘাত। অনেক সময় মনে হবে সে যেন স্পর্ধা! যেমন ধরো, শকুন্তলার তপোবনের একটা ভাব, একটা চিত্র, সে তো কাব্যকলার মধ্যেই আছে। মঞ্চে অভিনয়ের সময় পেছনে সেই তপোবনের ছবি এঁকে দিতে হবে কেন? এসব পূর্বে ছিল না।

শিশিরকুমার বললেন, আমরা সাহেবদের স্টেজের অনুকরণ করে আসছি। ওরা দর্শকদের কল্পনার সুযোগ দিতে চায় না, কিংবা ভরসা পায় না। হ্যামলেটের অভিনয় করতে গেলে ব্যাকড্রপে একটা রাজবাড়ির ছবি এঁকে রাখে। আমাদের যাত্রার যে ট্র্যাডিশন, তা কিন্তু অনেক উন্নত ছিল, সবদিক খোলা, ছবিটবির বালাই নেই, শ্রোতা দর্শকরা ইচ্ছে মতন কল্পনা করে নিতে পারে। কিন্তু সে ট্র্যাডিশন আমরা ধরে…।

শিশিরকুমারের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কবি আবার বললেন, তোমাদের স্টেজে পেছনে একটা ছবির পট ঝুলিয়ে রেখে মানুষের মনকে, মানুষের কল্পনাকে বিদায় দেওয়ার একটা যান্ত্রিক নিয়ম প্রচলিত হয়েছে! যাত্রাপালায় মানুষের ভিড়ে খুব ঠাসাঠাসি হয় বটে, কিন্তু পটের ঔদ্ধত্যে মানুষের মনকে সীমাবদ্ধ রাখা হয় না। আমি যখন অভিনয়ের ব্যবস্থা করি, সেটের বালাই থাকে না, মাঝে মাঝে দৃশ্যপট ওঠানো-নামানোর ছেলেমানুষিকেও আমি প্রশ্রয় দিইনে। তোমরাও এটা ভেবে দেখো।

এবার শুরু হল পাঠ। নাটকটির নাম গোড়ায় গলদ।

মেঘের প্রাবল্যে বিকেল ফুরোবার আগেই অন্ধকার হয়ে আসছে আকাশ। দুটি হ্যাজাক বাতি জ্বালানো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ পাঠ করতে লাগলেন প্রত্যেকটি পাত্র-পাত্রীর আলাদা বাচনভঙ্গিতে। যেন অভিনয়ের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। শেষ করলেন একবারও না থেমে।

সবাই বলে উঠলেন, সাধু সাধু। যোগেশ আর বিশ্বনাথ ভুল করে হাততালি দিতে গিয়েও থেমে গেল।

শ্রোতাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলতে লাগল নানান প্রশংসাবাক্য। শিশিরকুমার চুপ।

একসময় রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, কী হে, শিশির, তুমি কিছু বলছ না যে? অন্যরা সবাই শ্রোতা, আর তুমি প্রয়োগকর্তা। তোমার মতামতের মূল্য আলাদা।

শিশিরকুমার বললেন, শ্রোতা হিসেবে আমি মুগ্ধ, বিমোহিত। আপনার ভাষার তো তুলনা হয় না। তবে প্রয়োগকর্তা হিসেবে, আমার যা মনে হয়েছে, যদি অনুমতি দেন তো সত্যি কথা বলব?

কবি বললেন, অবশ্যই, অবশ্যই। সত্য বই মিথ্যা বলিবে না।

শিশিরকুমার তবু খানিকটা দ্বিধার সঙ্গে বললেন, এই নাটক যদি আমি মঞ্চস্থ করি, আপনি আমাকে কোন ভূমিকাটা নিতে বলবেন!

কবি বললেন, কেন, চন্দ্র। তোমার চন্দ্রকে পছন্দ হয়নি?

শিশিরকুমার বললেন, পছন্দ হবে না কেন? কিন্তু আপনি ওকে মাঝপথে বিদায় করে দিলেন, তাতে আমি এ নাটক জমাতে পারব না।

কবি বললেন, বটে? আর কী কী ক্রটি দেখলে?

শিশিরকুমার বললেন, ক্রটি বলতে পারি না। তবে, মানে, মাঝে মাঝে নাটকের গতি শ্লথ হয়ে গেছে।

যোগেশচন্দ্র, এই সুযোগে, যেহেতু কবি তার নাটককে মন্দ বলেছেন, তাই একটু খোঁচা মারার জন্য ফুট কাটল, এক এক স্থানে ডায়ালগগুলো বড্ড লম্বা লম্বা, বলতে গেলে আটকে যাবে।

শিশিরকুমার বললেন, আর একটু গতি আনতে গেলে

কবি তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, স্পষ্ট করে বলো তো, এ নাটক মঞ্চ-উপযোগী হয়নি?

শিশিরকুমার বললেন, আপনি নিশ্চয়ই পারবেন। আপনি অসাধ্যসাধন করতে পারেন। কিন্তু আমি ঠিক ভরসা পাব না। আমি তো দর্শকদের মর্জি বুঝি। আমি বরং ‘বিসর্জন’-ই…।

কবির মুখ খানিকটা রক্তিম হয়ে উঠেছে। উষ্মার সঙ্গে বললেন, মোট কথা, তুমি বলছ, এই গোড়ায় গলদ নাটকটা অপদার্থ হয়েছে!

এরপর কবি একটি অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। ফ্যাঁস ফাঁস করে ছিঁড়তে লাগলেন নাটকের পাণ্ডুলিপি। অনেকের চোখ কপালে উঠে গেল।

ছিন্ন অংশগুলি মাটিতে ফেলে দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চারু, দেখো অতিথিদের যেন অযত্ন না হয়। ওঁদের আর একদিন থেকে যেতে বলো!

তিনি দ্রুতপায়ে নেমে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে।

শ্রোতাদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল বিস্ময়ের গুঞ্জন। কয়েকজন বক্রভাবে তাকাতে লাগলেন শিশিরকুমারের দিকে।

শিশিরকুমারের একেবারে মরমে মরে যাবার মতন অবস্থা। এ কী হল? কবিগুরু কখনও প্রকাশ্যে রাগ করেন, এমন তো কখনও শোনা যায়নি। তিনি তো অতিভদ্রতার প্রতিমূর্তি।

চারুচন্দ্রকে এক পাশে ডেকে নিয়ে শিশিরকুমার বললেন, চারুবাবু, কিছু দোষ করলাম? কবিই তো অভয় দিলেন, সত্যি কথাটা বলার জন্য।

চারুচন্দ্র বললেন, আপনিও যেমন! সত্যি কথাই কি সব জায়গায় বলা যায়? কবি আসলে সমালোচনা একেবারে সহ্য করতে পারেন না। নিজের ভুল-ক্রটি নিজেই বুঝতে পারেন একসময়। দেখেন না, নিজের নাটকগুলো কাটাকুটি করেন কতবার! কিন্তু অন্যের মুখ থেকে কিছু শুনতে নারাজ। আর একটা ব্যাপার খুব আশ্চর্য লাগছে। নিজের হাতের লেখার ওপর খুব মায়া, কখনও একটা পাতাও ফেলে দেন না। আজ গোটা পাণ্ডুলিপিটা ছিঁড়ে ফেললেন!

শিশিরকুমার বললেন, উনি এত রেগে চলে গেলেন, এখন গিয়ে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব? আমি যে ওঁর কত ভক্ত, তা উনি জানেন না।

চারুচন্দ্র বললেন, না মশাই, এখন ক্ষমাটমা চাইতে যাবেন না। একসময় ওঁর রাগ পড়ে যাবে। আপনাদের আর একদিন থাকতে বললেন। থাকুন, ঘুরেটুরে বেড়ান। এখানে আছে দিগন্তবিস্তৃত খোয়াই, এমন আর অন্য কোথাও দেখবেন না।

নিজের ঘরে এসে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন শিশিরকুমার। পুড়তে লাগল একটা-পর-একটা চুরুট।

বিশ্বনাথ আর যোগেশচন্দ্রও কথা বলেনি আর একটাও। জানে বড়বাবুর মেজাজ। কিছু বলতে গেলেই হঠাৎ ফেটে পড়তে পারেন। যত রাগ ঝাড়বেন এই দু’জনের ওপর।

কিছুতেই এখানে লুকিয়ে চুরিয়েও মদ্যপান করবেন না বলে শিশিরকুমার বোতল টোতল কিছু সঙ্গে আনেননি। কিন্তু গলা শুকিয়ে আসছে।

একসময় তিনি জানালার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, দ্যাখ তো বিশে, এখানে কফিটফি কিছু পাওয়া যায় কিনা!

যোগেশচন্দ্র এবার সভয়ে বলল, বড়বাবু, আপনি তো কিছু দোষ করেননি। কবির সব লেখারই ভাষা অনবদ্য। কিন্তু আমরা প্রফেশনাল থিয়েটারের লোক, আমাদের বোর্ডে যে এ নাটক চালানো যাবে না, তা তো বলতেই হবে!

শিশিরকুমার শান্ত গলায় বললেন, ঠিক। কবি যে সমালোচনা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, তা আমি জানব কী করে? অনেক শিল্পীরই অবশ্য এই দুর্বলতা থাকে। বার্নার্ড শ সামান্য সমালোচনা শুনলে খেঁকিয়ে ওঠেন। তবে, কবি ‘বিসর্জন’ স্টেজ করার পারমিশন দিয়েছেন আমাদের। যাবার আগে সেটা ফাইনাল করে যাব।

যোগেশ বলল, ঠিক বলেছেন, ‘বিসর্জন’ আমরা জমিয়ে দেব। আপনি কোন রোলটা করবেন?

শিশিরকুমার বললেন, ভাবছি, প্রথমে রঘুপতিই ট্রাই করব। ওর ডায়ালগে খুব জোর আছে।

যোগেশ বলল, কিন্তু জয়সিংহ ট্রাজিক ক্যারেক্টার, অডিয়েন্সের সহানুভূতি তার দিকে থাকবে। কবিগুরু তো বুড়ো বয়েসেও জয়সিংহ করেছেন এইজন্য।

শিশিরকুমার বললেন, তা ঠিক। দেখি। তুমি কোন রোলটা চাও!

যোগেশ বলল, আপনি যেটা দেবেন!

বিশ্বনাথ কফি নিয়ে আসার পর শিশিরকুমার তাতে চুমুক দিয়ে বললেন, কবি কিন্তু একটা কথা ঠিকই বলেছেন। আমাদের দেশীয় যাত্রাই আমাদের নাটকের সঠিক আর্ট ফর্ম। সেই যাত্রাকে পরিত্যাগ করে আমরা এই পিকচার ফ্রেমের মঞ্চে থিয়েটার করে ভুলই করে বসেছি।

বিশ্বনাথ বলল, কিন্তু দাদা, আগেকার দিনে যাত্রা হত জমিদারদের বদান্যতায়। জমিদাররা কিংবা বড় মানুষরা নিজেরা টাকা দিয়ে যাত্রাদল ভাড়া করে আনতেন। পাবলিকের তো আর টিকিট কাটতে হত না। এখন লোকে টিকিট কেটে হলে আসে নাটক দেখতে। এই পাবলিক আমাদের লক্ষ্মী। এখানে তুমি চারদিক খোলা রাখবে কী করে?

শিশিরকুমার মাথা নেড়ে বললেন, তোর কথাও ঠিক। তবু এই বিলিতি স্টেজের সঙ্গে যাত্রার টেকনিক মেশানো যায় কি না ভেবে দেখতে হবে। শুধু সাহেবদের নকল করলে কি আমাদের আত্মসম্মান বজায় থাকবে!

পরদিন সকালে এসে ওঁদের ঘুম ভাঙালেন চারুচন্দ্র।

রহস্যকাহিনী শোনাবার মতন মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বললেন, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন। গুরুদেব ঠিক ন’টার সময় আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। রথীর কাছে শুনলাম গুরুদেব কাল সারারাত জেগে ছিলেন।

রথী কে?

গুরুদেবের ছেলে, রথীন্দ্রনাথ।

সর্বনাশ, কী পাপ করলাম কাল! কবির ঘুম নষ্ট হল।

দেখুন, আজ তার প্রায়শ্চিত্ত হয় কিনা।

প্রাতঃকৃত্য সেরে, সেজেগুজে বসে রইলেন তিনজন, কেউ উৎকণ্ঠা গোপন করতে পারছেন না। আজ কবিকে কী মেজাজে দেখবেন কে জানে! এই বয়েসে সারারাত্রি জাগরণ কি সোজা কথা?

যোগেশচন্দ্র ভয়ে ভয়ে বললেন, আমি আজ না গেলাম। ঘরেই থাকি!

একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে চিন্তা করে শিশিরকুমার বললেন, নাঃ, যাবে না কেন? অত ভয় কীসের? আমরা তো অন্যায় কিছু করিনি।

ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ন’টা বাজতে পাঁচ মিনিট আগে চারুচন্দ্র ওঁদের ডাকতে এলেন। একটুখানি হেঁটে যেতে হল কবির বাসগৃহে৷ নানান গাছতলায় ছেলেরা বসে গেছে ক্লাসে, মাস্টারমশাইদের হাতে বেতের বদলে কাঁধে উত্তরীয়।

অভ্যর্থনাকক্ষটি নানান ছবি দিয়ে সাজানো। চেয়ারের বদলে নিচু নিচু টুল। কোথাও বিলাসিতার চিহ্ন নেই, আছে সূক্ষ্ণ রুচি।

টেবিলটি খুব বড়। তাতে কত যে পদের খাদ্যদ্রব্য সাজানো তার ইয়ত্তা নেই। প্লেটের পর প্লেট নানা প্রকার ফলমূল, তারপর লুচি, মোহনভোগ, তারপর বহু রকমের মিষ্টদ্রব্য। এই ঠাকুরবাড়ির আতিথেয়তা।

শিশিরকুমার যোগেশচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন।

কবি এখনও আসেননি, লাল-পাড় শাড়ি পরা একজন তরুণী, আঁচলে ঘোমটা দেবার বদলে সেটি কাঁধে জড়িয়ে রেখেছেন। কতকগুলি রুপোর রেকাবি সাজিয়ে রাখছেন।

চারুচন্দ্র ইঙ্গিতে ও নিম্নস্বরে জানাল, ইনি কবির পুত্রবধূ প্রতিমা।

তারপর তিনি প্রতিমার সঙ্গে অতিথিদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।

প্রতিমা সুমিষ্টস্বরে বললেন, আপনারা শুরু করুন না! বাবামশাই আসছেন।

চারুচন্দ্রই বললেন, না, না, গুরুদেব নামুন। তারপর হবে।

বাইরের অতিথিদের সামনে এসেছেন এত বড় এক পরিবারের পুত্রবধূ, এত সাবলীল ব্যবহার, এমন স্বাভাবিক সাজপোশাক, শিশিরকুমারদের চোখে লাগবেই। কলকাতায় এমনটি দেখা যায় না তাঁদের বাড়ির পরিবেশে। শিশিরকুমারের ক্ষণিকের জন্য মনে পড়ল, ঊষা এমন পরিবেশ পায়নি। ব্রাহ্ম হোক বা হিন্দু হোক, বা মুসলমান, তবু মানুষ কেন স্বাভাবিক হতে পারে না? কেন মেয়েদের ঠেলে রাখা হয় অন্তঃপুরে। তা হলে থিয়েটারের মেয়েরাই ভালো। তারা প্রকাশ্যে মঞ্চে এসে নাচে, গায়, হাসে, কাঁদে।

অবিলম্বে এসে পড়লেন কবি। আজ তাঁর পরনে আজানুলম্বিত আলখাল্লা। স্নান সেরে এসেছেন। ঘরে যেই ঢুকলেন, এ যেন সেই অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত কথিত আবির্ভাব। দেবদুর্লভ রূপ, আজ তাঁর মুখে প্রসন্নতার দ্যুতি।

তিনি বললেন, বসো, বসো, সবাই বসো। শিশির, তোমার সঙ্গে দু’জন এসেছেন, তাঁদের তো পরিচয় দাওনি।

শিশিরকুমার ঈষৎ চালাকি করে বললেন, এই আমার ভাই বিশ্বনাথ, আর এ আমার ভ্রাতৃপ্রতিম যোগেশ, দু’জনেই আমার দলে আছে, নানা রকম সাহয্য করে।

যোগেশের পুরো নাম শুনলেন না বলে সেই যে সীতার নাট্যকার তা কবি খেয়াল করলেন না।

তিনি সস্নেহে বললেন, তোমাদের কোনও অসুবিধে হয়নি তো? খাও, সামনে খাবার ফেলে রাখতে নেই।

শিশিরকুমার ঈষৎ অনুতপ্ত স্বরে বললেন, আপনার কাল রাত্তিরে ঘুম হয়নি শুনলাম। যদি আমাদের জন্য

কবি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এক রাত্তির ঘুম না হওয়া কী এমন অস্বাভাবিক ব্যাপার? অনেকেই ঘুমোয় না। বলো তো, কোন প্রজাতি সারারাত্রি জাগ্রত থেকেও খুশি হয়? চোর-ডাকাতদের কথা বোলো না যেন। ওদের বাদ দাও।

শিশিরকুমার উত্তর না দিয়ে উৎসুকভাবে চেয়ে রইলেন।

কবি হেসে বললেন, লেখক নামে এক অদ্ভুত প্রজাতি। সারারাত জেগে যদি কিছু লিখতে পারে তা হলে রাত্রি-জাগরণের কথা তাদের মনেই পড়ে না। কাল তোমরা আমার নাটকটি পছন্দ করোনি। তাই তো আমি জেদ করে রাত জেগে নাটকটি আবার নতুন করে লিখে ফেললাম।

পাশ ফিরে তিনি বললেন, রথী, কোথায় রে! তোর পড়া শেষ হল? পাণ্ডুলিপিটা আন।

রথী এসে বলল, এ নাটক তো একেবারে নতুন হয়ে গেছে।

কবি পাণ্ডুলিপিটা শিশিরকুমারের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই নাও। এটার আগে গোড়ায় গলদ ছিল, এখন শেষ রক্ষা হল!

সাত – প্রথম স্বপ্নভঙ্গ

দুপুর বারোটা থেকে রিহার্সাল চলে সন্ধে ছ’টা, সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত। একই সঙ্গে তিনটি নাটকের।

ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট সেন্ট্রাল এভিনিউ নামে নতুন রাস্তা বানাবার জন্য এ দিককার অনেক বাড়ি ও বস্তি ভেঙে দেবে বলে শোনা যাচ্ছে, তার মধ্যে এই মনোমোহন থিয়েটারহলও জলাঞ্জলি যাবে, তখন নাট্যমন্দিরকে আবার ঠাঁই-নাড়া হতে হবে, সেই চিন্তাও আসে।

মহড়া শেষ হবার পর শিশিরকুমার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে নিয়ে আড্ডায় বসেন। সাহিত্য, শিল্প, থিয়েটার, রাজনীতি, এমনকী ভাষাতত্ত্ব পর্যন্ত কোনও প্রসঙ্গই বাদ যায় না। প্রায়ই নবীনচন্দ্র সেনের ভাষায়, ‘সুরা দেবী আবির্ভূতা হন’ এঁদের মাঝখানে।

শিশিরকুমারের মদ্যপানের অভ্যেসটা অন্যদের থেকে আলাদা। পাকা মদ্যপায়ীরা প্রতিদিনই দ্বিপ্রহর থেকে বা সন্ধ্যায় কিছুটা পান করবেনই, কেউ বা মাত্রা রেখে, কারুর বা পা টলমল করলেই সুখ। শিশিরকুমার যেদিন ধরেন, সেদিন আর থামতে চান না। পরপর কয়েকদিন ঠিক একই রকম চলে, একেবারে বেএক্তিয়ার না হলে থামেন না। আবার হঠাৎ একদিন কী মনে হয়, একেবারে স্পর্শই করেন না, সেই অনাসক্তিও চলে পরপর কয়েকদিন। তখন অন্যদের শত অনুরোধেও ধরেন না গেলাস। শিশিরকুমারের এক বন্ধু বলেন, শিশিরের স্বভাবে এ যেন অমাবস্যে আর পুন্যিমে!

এক সপ্তাহ ধরে শিশিরকুমারের সুরাহীন পর্ব চলছে। ইদানীং শরৎচন্দ্র আসেন প্রায়ই। তাঁর অভ্যর্থনার জন্য ভালো জাতের মদ্য দিতে হয়।

অলীক নামে বাল্যবন্ধুটি প্রায়ই দামি দামি বোতল নিয়ে আসে, তার একটি-দুটি শিশিরকুমার শরৎচন্দ্রের জন্য জমিয়ে রাখেন। শিশিরকুমার তখন শরৎচন্দ্রকে সঙ্গ দেন।

রবীন্দ্রনাথের সামনে যেমন কিছুতেই আড়ষ্টতা কাটানো যায় না, সমীহের চোটে গলা পর্যন্ত আধো আধো হয়ে যায়, সেই তুলনায় শরৎচন্দ্র অনেক খোলামেলা। সমান সমান হয়ে রঙ্গ-রসিকতা করা চলে, এমনকী একটু-আধটু বেয়াদপি করলেও প্রশ্রয় দেন তিনি।

গতকালই এসেছিলেন শরৎচন্দ্র। তাঁর জন্য বোতল-গেলাস সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শিশিরকুমার নিজের গেলাস নেননি। শরৎচন্দ্র অবাক হয়ে বলেছিলেন, তোমার হল কী হে শিশির, ব্রত ট্রত নিয়েছ নাকি? শিশিরকুমার বলেছিলেন, না, শরৎদা, এখন আমার মাথায় অন্য চিন্তা।

শরৎচন্দ্রকে অনায়াসে দাদা বলা যায়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রদা, রবীন্দ্ৰকাকা, রবীন্দ্রজ্যাঠা এমন কোনও সম্বোধন অসম্ভব। তিনি শুধু রবীন্দ্রনাথ অথবা কবিগুরু, শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের গুরুদেব।

‘বিসর্জনে’র নতুনভাবে প্রয়োগের চিন্তা তো আছেই, তার ওপর এখন মাথায় চেপেছে নতুন হল খোঁজার দুশ্চিন্তা। যে-কোনও জায়গায় তো থিয়েটার করা যায় না। চেনা জায়গা ছাড়া যেতে চায় না দর্শকরা। এখন তো চালু মাত্র চারটি রঙ্গমঞ্চ, তাও হ্যারিসন রোডের আলফ্রেড মঞ্চ দর্শক টানে না।

রঙ্গমঞ্চ নয়, অলীক একটি অন্য বাড়ির সন্ধান এনেছে। সে এক পড়ন্ত বয়সের জমিদার মানুষ, এখন আর জমিদারির আয় নেই। চলেছে বেচার পালা। সম্পত্তি, বাগানবাড়ি, দুর্লভ ফার্নিচার ও হিরে-জহরত বিক্রি করে জোগাড় হচ্ছে ফুর্তির সরঞ্জাম। সে মৃতদার এবং নিঃসন্তান, ঠিকই করেছে মৃত্যুর আগে সব কিছু উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে যাবে। বন্ধুদের প্রতি সে খুব উদার, তাদের জন্য সে খরচ করে জলের মতন। শুধু বন্ধু নয়, বিভিন্ন রাত্রিতে বিভিন্ন সঙ্গিনীর জন্যও তার কম ব্যয় হয় না। শিশিরকে সে তার নৈশঅভিযানে সঙ্গী হবার জন্য অনেকবার প্ররোচিত করেছে, শিশির রাজি হয়নি। হাত ধরে টানাটানি করে পর্যন্ত বলেছে, আরে চল না ভাই, ওসব জায়গায় না গেলে জীবনটাকে বড় করে চিনবি কী করে? দিনের পর দিন কাটাচ্ছিস এই ছোট গণ্ডির মধ্যে।

অলীক যে-বাড়িটির সন্ধান এনেছে, সেটি রাজবল্লভ পাড়ায়, তার মামার সম্পত্তি, তিনি সেটা ঋণের দায়ে বেচে দিচ্ছেন প্রায় জলের দরে। বেশ বড় অট্টালিকা, ভেতরে একটা নাচঘর আছে, সেটাই প্রায় একটি থিয়েটারহলের মতন।

শিশির বললেন, প্রথম কথা, এক্ষুনি ও বাড়ি কেনার মতন অর্থ সামর্থ্য আমার নেই। দ্বিতীয়ত, আগে কয়েকবার চেষ্টা করে দেখা হয়েছে, ভদ্র পাড়া, ঘন বসতির মধ্যে থিয়েটার হল চালানো যায় না। পাড়ার লোকই আপত্তি করে। বড় রাস্তা চাই, কাছাকাছি দোকান-বাজার থাকা চাই। অনেক ফিটন-ল্যান্ডো এসে থামবে, তার জায়গা চাই।

একটু ভেবে শিশির আবার বললেন, তবে, বাড়িটা আমি একবার দেখতে যাব। যদি অন্য কাজে লাগানো যায়। আমার মাথায় আর একটা পরিকল্পনা আছে।

অলীক বলল, ন্যাশনাল থিয়েটার?

শিশির দু’বার মাথা ঝোঁকালেন।

অলীক বলল, সে স্বপ্ন তো তোর অনেক দিনের। টাকা জোগাবে কে? তেমন গৌরী সেন আর কোথায় পাবি?

দেশবন্ধু জোগাড় করে দেবেন বলেছেন। উনি শত কাজে ব্যস্ত থাকেন, একথা কি ওঁর মনে থাকবে? একবার বলেছিলেন বটে!

এই তো সেদিন আবার বললেন। আমার হাত ধরে বললেন, শিশির, রঙ্গমঞ্চের উন্নতির জন্য, ভালো থিয়েটারের জন্য, তোমাকে আমরা একটা জাতীয় নাট্যশালা গড়ে দিতে পারব না? এ আমাদের লজ্জা। তুমি নতুন ছেলেমেয়েদের নাটক শেখাবে, ভালো নাটক প্রোডিউস করবে, টাকাপয়সা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। আমি কিছুদিনের মধ্যেই বাইরে থেকে ঘুরে আসছি, তারপর এক মাসের মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি সুভাষকেও বলেছি।

দেশবন্ধুর কথার দাম নেই?

তা আছে নিশ্চয়ই। ততদিনে মামার ওই বাড়িটা থাকলে হয়! না হয়, অন্য বাড়ি পাওয়া যাবে।

হঠাৎ প্রসঙ্গ বদল করে অলীক বলল, তোর প্রতিটি প্লে-তে প্রভা নামের মেয়েটির অ্যাকটিং যতই দেখছি, ততই মোহিত হয়ে যাচ্ছি। ও মেয়ে কি কারুর কাছে রক্ষিতা আছে?

শিশির বললেন, বেশ তো ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে যাওয়া-আসা করিস। আবার আমার থিয়েটারের মেয়েদের দিকে মন কেন?

অলীক বলল, বরাবরই তো থিয়েটারের অ্যাক্ট্রেসদের আমার মতন বড়লোকের বখাটে ছেলেরাই প্রতিপালন করে। আমার কথায় তো দোষের কিছু নেই। তোরা আর ক’টা টাকাই বা দিস ওদের! তবে অন্য কেউ যদি নিয়ে থাকে… আমি হাত বাড়াব না। মেয়েটিকে আমার বড় মনে ধরেছে।

শিশির বললেন, কোনও বড়লোকের বখাটে ছেলের দিকে আমি প্রভার কখনও মন দেখিনি। থিয়েটারই ওর মন-প্রাণ জুড়ে আছে।

অলীক বলল, তবে কি তোর চরণেই নিজেকে নিবেদন করতে চায়?

শিশির বললেন, না। ওসব না, ওসব না। খবরদার, ওর দিকে নজর দিবি না। কিছুদিন ধরে দেখছি, আমার মেজোভাই তারাকুমারের সঙ্গে প্রভার বেশ অন্তরঙ্গতা। পারহ্যাপ্‌স দে আর ইন লাভ। আমার আপত্তি করার কোনও প্রশ্ন নেই। বরং একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি। প্রভা হুট করে আমার দল ছেড়ে যাবে না। এক একটা মেয়েকে নিচুতলা থেকে টেনে এনে শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করি, তাদের মুখে যখন বোল ফোটে, অমনি অন্য থিয়েটার থেকে তাদের লোভ দেখিয়ে ভাঙিয়ে নিয়ে যায়। প্রভা নাট্যমন্দিরে অচলা থাক!

অলীক বলল, এই দ্যাখ, নাক মুলছি, কান মুলছি। এবার থেকে প্রভারানির দিকে শুধু ভগিনী জ্ঞানে তাকাব। তুই আজ বাড়ি যাবি না?

শিশির বললেন, হ্যাঁ, কয়েক রাত যাওয়া হয়নি, আজ বাড়িই যাব ভাবছি। মুখে গন্ধ নেই। মায়ের সঙ্গেও কথা বলা যাবে।

তোর মা কতবার ‘সীতা’ দেখলেন রে?

মায়ের এই এক শখ। মাঝে মাঝেই এসে পড়েন, আমাকে কিছু বলেনও না, লোকজনরাই ওপরের বক্স খুলে দেয়। বারো-চোদ্দোবার দেখলেন বোধহয়।

সীতা দেখতে আসেন, না নিজের ছেলেকে দেখতে আসেন?

ওই কিছু একটা হবে।

তারাকুমার আর প্রভার অ্যাফেয়ার কি তোর মা মেনে নেবেন?

দ্যাট ইজ নান অফ মাই বিজনেস! সে তারা বুঝবে। অলীক, তুই কি আরও খাবি?

ভাবছি, আর এক পাত্তর, সরু করে, নেশাটা ঠিক জমেনি। শালা, একা একা খেলে কি নেশা জমে? তোর যে মাঝে মাঝে মাথায় কী চাপে! আর একটু বোস, অমি শেষ করে নিই—

একটু পরে বাইরে গলার আওয়াজ শোনা গেল। একজন কেউ বলছে, ভিখা, ঘরে তো আলো জ্বলছে, তোর বাবু আছেন নাকি রে?

শিশির উৎকর্ণ ও বিস্মিত হয়ে বললেন, হেমেন? এত রাত্রে—

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হেমেন্দ্রকুমার রায় বিহ্বল গলায় ডাকলেন, শিশির।

শিশির তাকিয়ে রইলেন, আর কিছু বললেন না হেমেন্দ্রকুমার।

একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে বললেন, অলীক, আমার জন্য একটু ঢাল, গলাটা শুকিয়ে গেছে।

শিশির বললেন, কী ব্যাপার রে হেমেন? কোনও দুঃসংবাদ আছে? নাচঘর আর বেরুবে না!

হেমেন্দ্র বললেন, তোকে একটা খবর দিতে এসেছি, কিন্তু কীভাবে যে বলব… শিশির, তুই জাতীয় নাট্যশালা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলি, আজ যেন চোখের সামনে দেখলাম, সেই নাট্যশালাটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল। একেবারে ধূলিস্যাৎ।

শিশির বললেন, কী হেঁয়ালি করছিস? নাট্যশালা গড়াই হল না, তার আগেই তুই ভেঙে পড়ার খোয়াব দেখছিস! দিস ইজ নট ফানি।

শিশিরের দিকে সোজাসুজি চোখ রেখে হেমেন্দ্রকুমার বললেন, দেশবন্ধু আজ মারা গেছেন। ইদানীং শরীর ভালো যাচ্ছিল না। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য দার্জিলিং গিয়েছিলেন জানিস তো! ওখানে ওঁর ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ নামে একটা বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে হার্ট ফেল করেছেন।

শিশিরের ফরসা মুখখানি কালিবর্ণ হয়ে গেল। অলীক অস্ফুটভাবে বলল, এ যে মহাগুরু নিপাতের মতন! ইন্ডিয়ান পলিটিকসে আমাদের বাঙালিদের মধ্যে আর কে রইল!

হেমেন্দ্রকুমার বললেন, আমাদের একেবারে অনাথ করে দিয়ে গেলেন। আমি গেসলাম অমৃতবাজার পত্রিকা অফিসে, সেখানেই শুনলাম খবরটা। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল শিশিরের কথা। কাল ডেডবডি নিয়ে আসবে, আমরা সবাই যাব। শুনলাম, সুভাষবাবু খুব ভেঙে পড়েছেন।

শিশিরের মুখে একটুও শব্দ নেই। দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল।

অলীক একটা গেলাসে অনেকখানি হুইস্কি ঢেলে ধরিয়ে দিল শিশিরের হাতে।

শিশির একবার সে দিকে তাকালেন, তারপর মরুভূমিতে তৃষ্ণায় প্রায় মুমূর্ষু পথিকের মতন এক চুমুকে সবটা শেষ করে ফেললেন, জল না মিশিয়ে। গেলাস নামিয়ে বললেন, আবার দে!

হেমেন্দ্রকুমার বললেন, এত বড় একটা আঘাত… অপূরণীয় ক্ষতি, এই ধাক্কা সামলানো… নে। আর একটু খেয়ে নে!

এরপর কিছুক্ষণ দেশবন্ধুর স্মৃতিচারণ করার পর হেমেন্দ্রকুমার বললেন, এবার আমি উঠি। তোরা বাড়ি যাবি না?

শিশির বললেন, না তুই যা।

অলীকের আনা বোতল শেষ হয়ে গেছে। শিশির বললেন, দ্যাখ, ওই আলমারির মধ্যে আর একটা আছে। বার কর।

অলীক বলল, আমাকেও আর আধঘণ্টা পরে উঠতে হবে। এক জায়গায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

কোথায়?

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে।

তুই এখন কার কাছে যাচ্ছিস? স্টেডি কেউ আছে?

ইয়েস।, মাসখানেক ধরে… একটি ফ্রেঞ্চ মেয়ে, যেমন অ্যাট্রাকটিভ, তেমন সিডাকটিভ। ফ্রেঞ্চ মেয়েদের কাছে লাভ মেকিং ইজ অ্যান আর্ট।

হুঁ। বেশ। তোর সঙ্গে আর কেউ যেতে পারে? ইজ দ্যাট অ্যালাউড?

তুই যেতে চাস? চল, চল, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।

না, থাক।

কেন, চল না। গল্প করবি, ভালো লাগবে। তুই আশ্চর্য হয়ে যাবি, পেশায় ফুল-টাইম হোর, কিন্তু বেশ লেখাপড়া জানে, একদিন ওদের দেশের একজন রাইটারের কী একটা নাটক সম্পর্কে বলছিল, আমি সে রাইটারের নামই শুনিনি। বোধহয় ভিকতর য়ুগো।

আমি তার সঙ্গে কী করে কথা বলব? আমি তো ফ্রেঞ্চ জানি না। জ্য ন পার্ল পা ফ্রাঁসে।

তুই ওইটুকু বললি, আমি তো তাও জানি না। ও মেয়ে খুব ভালো ইংলিশ জানে। আরে, অত দূর দেশ থেকে এখানে শিকার করতে এসেছে, ইংলিশ জানবে না! ওঠ, ওঠ। আজ তোর একা থাকা ঠিক নয়।

অলীক হাত ধরে টেনে তুলল বন্ধুকে।

অল্প সময়ের মধ্যে অনেকখানি কাঁচা হুইস্কি পেটে পড়ায় শিশিরের নেশা ধরে গেছে। টলটল করছে মাথা। বাইরে পা বাড়াবার আগে তিনি টেবিল থেকে তুলে নিলেন অর্ধসমাপ্ত দ্বিতীয় বোতলটি।

অলীকের নিজস্ব ফিটন আছে। দুই বন্ধু ওঠার পর সহিসকে কোনও নির্দেশ দিতে হল না, সেটা চলতে শুরু করল।

রাত বেশি হলে উত্তর কলকাতার অনেক পল্লি নিস্তব্ধ হয়ে এলেও চিৎপুরের দিকটা জমজমাট। সেখানে বেল ফুল ও মালাই বরফ বিক্রেতারা হেঁকে হেঁকে যায়, অনেক বাড়িতে আলো জ্বলে, শোনা যায় নারীকণ্ঠে হাসির হররা আর মাতালদের চিৎকার।

চৌরঙ্গির দিকে সাহেব পাড়াও আলোয় ঝলমল করে। রাস্তায় ইংরেজ ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের চলাচলই বেশি। ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে মোটর গাড়ির জটলা বেঁধে যায়। সবচেয়ে সরগরম থাকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট।

নবাবি আমলের শেষ দিক থেকে ইংরেজ শাসিত কলকাতা শহরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা এসে আস্তানা গাড়তে থাকে। ইয়োরোপ থেকেও আসে অনেকে, ব্যবসায়ী ছাড়াও পণ্ডিত, গবেষক, ভাগ্যানুসন্ধানী এবং দেহপসারিণীরা। ফরাসি রমণীরা প্রথমে আসে চন্দননগরে, সেখান থেকে বৃহত্তর বাজারের টানে কলকাতায়।

গাড়িতে যেতে যেতেও বোতলে চুমুক দিতে লাগলেন শিশির। জানালা দিয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাস। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করছেন, আর কত দূর রে, অলীক?

অলীক বলল, এই তো এসে গেলুম আর কী!

শিশির বললেন, দেশবন্ধু আর নেই, সত্যি?

ফরাসি মেয়েটির কক্ষে যখন উপস্থিত হলেন দু’জনে, তখন অলীক অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও শিশিরের পা, চোখ আর গলার আওয়াজ কোনওটাই স্বাভাবিক নেই।

মেয়েটির নাম হেলেন। ফরাসিরা এইচ উচ্চারণ করতে পারে না, তাই সে নিজেকে বলে এলেন। ছিপছিপে তরুণী, ব্লন্ড, শরীর নয়, যেন দেহবল্লরী। তার পাতলা ঠোঁটে সবসময় লেগে থাকে মিষ্টি হাসি, কণ্ঠস্বর সুরেলা, দু’চোখে ঝিলিক, শিশিরকে অভ্যর্থনা করল এমন আন্তরিকভাবে যেন বহুদিনের চেনা। সব কিছুই তার কৃত্রিম, একেবারে নিখুঁত অভিনয়। শিশিরের অভিজ্ঞ চোখে তা এড়াল না।

অলীক পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, এ আমার বন্ধু, খুব ফেমাস অ্যাক্টর, প্রত্যেক বাঙালি ওর নাম জানে, অলসো আ ভেরি এরুডাইট পার্সন!

শিশির প্রথমেই তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়াং লেডি, তুমি কখনও স্টেজে অ্যাক্টিং করেছ?

এলেন ফুরফুরিয়ে হেসে বলল, চেষ্টা করেছি, চান্স পাইনি। আমাদের দেশে চান্স পাওয়া খুব শক্ত। ভাগ্যের জোর লাগে।

শিশির বললেন, তুমি যদি বাংলা জানতে, তোমার মতন একটি মেয়েকে যদি আমার দলে পেতাম! আজ পর্যন্ত একটাও লেখাপড়া জানা অ্যাকট্রেস পেলাম না। আগে আমাদের গেলাস দাও।

বোতলটা তুলে দেখিয়ে বললেন, তুমি খাবে?

অলীক বলল, না, না, ও খায় না।

এলেন বলল, ইংরেজদের ওই ক্রুড জিনিসটা আমরা ছুঁয়েও দেখি না। আমি শুধু রেড ওয়াইন পান করি।

দু’টি গেলাসে ঢালতে যেতেই অলীক বলল, আমি আর খাব না রে শিশির!

শিশির নিজে একটা বড় চুমুক দিয়ে বললেন, তুমি আমার বন্ধুকে ভিকতর য়ুগো সম্পর্কে কী বলেছ? আমি ফরাসি সাহিত্য বিশেষ পড়িনি, মলিয়ের পড়ার জন্য ভাষাটা শেখা উচিত ছিল। ভিকতর য়ুগো তো লে মিজেরাবল নামে উপন্যাস লিখেছেন। তিনি কি নাটকও লিখেছেন নাকি?

এলেন বলল, অবশ্যই। কবিতা লিখেছেন, নাটক লিখেছেন। নাটকের জন্যই তো বেশি বিখ্যাত। তোমার এই বন্ধুটি প্রায়ই আমাকে বেঙ্গলি স্টেজের কথা বলে, তাই আমি ওকে য়ুগো সম্পর্কে একটা ঘটনা বলছিলাম।

শিশির বললেন, কী ঘটনা, শুনি, শুনি! এই হারামজাদা অলীক, তুই আর খাবি না কেন রে?

এলেন বলল, তোমরা আমাদের বিখ্যাত অ্যাকট্রেস মিড্ল মার্স-এর নাম শুনেছ?

শিশির বললেন, শুনিনি। মিড্ল মার্স নামটা কি ফরাসি?

এলেন বলল, উনি ওই নামেই বিখ্যাত। দারুণ দাপট ছিল। নাট্যকার, পরিচালকদেরও ওঁর খামখেয়ালিপনা মেনে চলতে হত। ভিকতর য়ুগো তখন একজন তরুণ লেখক, নাটক নিয়ে থিয়েটারের দরজায় দরজায় ঘোরেন, কেউ পাত্তা দেয় না। এদিকে চরম দারিদ্র্য, থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার পয়সা নেই, পরে যিনি হয়েছিলেন আমাদের সাহিত্য জগতের সম্রাট, সেই সময় তাঁর পকেটে থাকত মাত্র পঞ্চাশ ফ্রাঁ, যাতে এক সপ্তাহ মোটে চলতে পারে…

শিশির জড়ানো গলায় বললেন, দেশবন্ধু, দেশবন্ধু

এলেন বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কী?

অলীক বলল, ও কিছু না। তুমি বলো—

এলেন বলল, শেষপর্যন্ত কমেডি ফ্রাঁসেইজ-এ ওঁর একটা নাটক মনোনীত হল। সেটার নাম ইরমানি, তোমরা এইচ দিয়ে বলবে, হিরমানি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সে নাটকের রিহার্সালের সময় নায়িকার সঙ্গে গোলমাল লেগে গেল। এক জায়গায় সংলাপে আছে, মঁ লিয়ঁ, অর্থাৎ মাই লায়ন, এটা কোনও রাজাকে উদ্দেশ করে বলা যায়, কিন্তু নাটকের নায়ক একজন ডাকাত, তাকে ওই সম্বোধন করতে মিড্ল মার্স রাজি নয়। শুরু হল কথা কাটাকাটি… একদিন রিহার্সালের সময় উপস্থিত ছিলেন আলেকজান্দার দুমা, তোমরা তাঁর নাম শুনেছ নিশ্চয়ই?

অলীক বলল, হ্যাঁ, পড়েছি তো ওঁর লেখা থ্রি মাসকেটিয়ার্স!

শিশির বলল, দুমা, দুম দুমা, দুম দুম দুমা।

গেলাসটা পড়ে গেল হাত থেকে, ঘাড়টা হেলে গেল, আর জ্ঞান নেই।

কাচভাঙা আওয়াজেরই মতন হেসে উঠল বারবনিতাটি।

অলীকের গায়ে একটা চাপড় মেরে বলল, তোমার বন্ধু কিছু শোনেনি। দেখো ঘুমোচ্ছে! চলো, আমরা অন্য ঘরে যাই।

কী করে, কখন ফিরলেন, তা শিশিরের মনে নেই। ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়, বাড়িতে নয়, রঙ্গালয়ে নিজের ঘরটিতে।

প্রথম চোখ মেলার পর নিজের ঘরটাও চিনতে পারলেন না। তারপর ভাবলেন, এটা দিন, না রাত?

জানালার বাইরে রোদ্দুর দেখে বুঝলেন, দিন। তা হলে গত রাতে কী হয়েছিল? অলীকের সঙ্গে ফিটন গাড়ি চেপে কোথাও গিয়েছিলেন। তারপর, তারপর? একটি অচেনা মেয়ে, রক্তচন্দনের মতন গায়ের রং, কী যেন বলছিল? আর হাসছিল খুব। অত হাসির কী আছে, অ্যাঁ? আমি শিশির ভাদুড়ী, আমার সামনে বিনা পারমিশনে অত হাসা যায় না, জানিস না? মেয়েটা কে? আ হারলট! স্ট্রামকেট! অত কী বলছিল সে? ওর বন্ধু ভিক্‌তর হুগো? হুগো নয়, য়ুগো!

শিশিরকুমার উঠে বসে চোখ ঘষলেন।

কোথায় ওই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল? অথচ এখন নিজের থিয়েটারের ঘরে। তবে কি পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্ন? অলীক হারামজাদা গেল কোথায়?

হাঁক দিলেন, ভিখা! ভিখা!

সঙ্গে সঙ্গে ভিখা দরজার কাছে দাঁড়াল এসে।

শিশির জিজ্ঞেস করলেন, এখন ক’টা বাজে রে?

ভিখা বলল, একটা বাজি গেছে।

শিশির উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন, রিহার্সালের জন্য কেউ এসেছে?

ভিখা জানাল যে, আজ রিহার্সাল বন্ধ।

শিশির ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন? আজ কি শো আছে?

ভিখা জানাল যে, আজ শো হবার কথাও নেই। কোনও একজন বড় মানুষ মারা গেছে।

শিশির গুম হয়ে বসে রইলেন খানিকক্ষণ।

সাধারণ বাড়ির তুলনায় নির্জন রঙ্গালয়ের নৈঃশব্দ্য অনেক বেশি। এখান থেকে শহরের অস্তিত্বও টের পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে যেন শোনা যায় বিগত কালের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ফিসফিসানি।

একটু পরে শিশির বললেন, দে ভিখা, কফি দে! আজ দুপুরে কী খাওয়াবি?

স্নানটান সেরে আজ দুপুরে বেশ ভালো করেই খেলেন কষা মাংস ও পরোটা। জল পান করলেন কয়েক গেলাস। বেশি মদ্যপানের পরের দিন শরীর খুব জল টানে।

আবার শুয়ে পড়লেন ইবসেনের একটি নাট্যসংগ্রহ হাতে নিয়ে।

কাল রাতে তিনি একটি বিদেশিনী মেয়ের কাছে গিয়েছিলেন অলীকের সঙ্গে। একটু একটু মনে পড়ছে। মেয়েটি কী যেন বলছিল নাটক বিষয়ে? ভালো মনে পড়ছে না।

একটু পরে দু’জন অভিনেতা এল, তারা শিশিরকে দেশবন্ধুর মরদেহের মিছিলে নিয়ে যেতে চায়। শিশির যেতে রাজি হলেন না। বাহ্যিক শোক প্রকাশের আড়ম্বর ভালো লাগে না তাঁর।

তারপর আর কারও দেখা নেই। এর মধ্যে শিশির আরও খানিকটা ঘুমিয়ে নিলেন। বিকেল পেরিয়ে সন্ধে হয়ে গেল, তবু এল না কেউ? আজ কেউ আসবে না, এমনকী অলীকেরও কী হল? সে-ও কি দেশবন্ধুর জন্য শোকে আজ সব বন্ধ রেখেছে?

কেউ না এলেও ক্ষতি নেই। শিশির নিজেকে নিয়েই দিব্যি সময় কাটাতে পারেন। বোতল আনালেন, হুইস্কি পানের সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল গ্রন্থপাঠ ও আবৃত্তি। তারই মধ্যে বারবার মনে পড়তে লাগল, অলীক এল না? অলীক কোথায়?

রাত্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নেশাও যখন চড়ল, তখন তাঁর মনে হল, অলীক নিশ্চয়ই সেই মেয়েটির ঘরে চলে গেছে। অলীকের সঙ্গে একবার দেখা করার বিশেষ দরকার।

ভিখাকে দিয়ে একটা ছ্যাকরা গাড়ি ডাকিয়ে এনে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে হুইস্কির বোতলটি নিতে ভুললেন না।

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ঘরে সেই মেয়েটি আছে, কিন্তু অলীক নেই।

এলেন বলল, তার তো আজ আসবার কথা নয়। তার সঙ্গে আমার পরবর্তী অ্যাপয়েন্টমেন্ট আবার শনিবার।

শিশির একটু ইতস্তত করে বললেন, তোমার কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে বুঝি আসা যায় না?

এলেন বলল, সেটাই আমি পছন্দ করি। তবে, তুমি যদি ভেতরে এসে কিছুক্ষণ বসতে চাও বসতে পারো।

শিশির ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে বললেন, গেলাস দেবে?

এলেন বলল, তুমি তো অলরেডি অনেকটা পান করেছ বোঝা যাচ্ছে। আর সহ্য করতে পারবে? কাল ঘুমিয়ে পড়েছিলে।

শিশির বললেন, না, না, আজ ঘুমোব না। তুমি কাল নাট্যকার মলিয়ের সম্পর্কে কী যেন বলছিলে, আমার বাকিটা শোনার আগ্রহ হচ্ছে।

এলেন অবাক হয়ে বলল, মলিয়ের? আমি তো মলিয়ের সম্পর্কে কিছু বলিনি!

শিশির বললেন, মলিয়ের নামে তোমাদের ভাষার একজন নাট্যকার আর অভিনেতা ছিলেন না?

এলেন বলল, তা ছিলেন, কিন্তু আমি তো শোনাচ্ছিলাম ভিকতর য়ুগোর একটা নাটকের কথা।

শিশির এবার কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললেন, য়ুগো? তিনি নাটকও লিখেছেন নাকি?

এলেন বললেন, মাই ডিয়ার গ্রেট অ্যাক্টর, তোমার দেখছি কিছুই মনে নেই!

শিশির বললেন, না, না, কিছুটা মনে আছে, এখন মনে পড়েছে। ওঁর নাটক নিয়ে কী যেন গণ্ডগোল হয়েছিল। ছাপাখানা না কোথায় যেন?

এলেন বলল, এ তো দেখছি আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। তার আগে বলো তো ডারলিং, তুমি কি আমার কাছে শুধু গল্প শোনার জন্য এসেছ?

শিশির তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, নো নো নো। আমি শুধু শুধু তোমার টাইম ওয়েস্ট করতে আসিনি। আই উড লাইক টু হ্যাভ ফান উইথ ইউ। আই হ্যাভ মানি! আই হ্যাভ মানি!

এলেন পরে আছে একটা হলদে-কালো ডোরাকাটা গাউন, দেখাচ্ছে চিতা বাঘিনীর মতন। একটুখানি হাঁটলেই গাউনটায় ঘূর্ণি লাগে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আজ তার হাতে রেড ওয়াইনের গ্লাস৷ সে ঘরের এক কোণে গিয়ে বলল, মনে করো, আমি হিরোইন মিড্ল মার্স, আর তুমি পুয়োর ইয়াং প্লে রাইট মস্যিয়ো য়ুগো। একটা ডায়ালগ নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার মতভেদ হয়েছে।

শিশির বললেন, হিরোইনের সঙ্গে? হেঃ! আমাদের হিরোইনরা অনেক ডায়ালগের মানেই বোঝে না। সব তো খেঁদি পেঁচি, আসে ওই পাড়া থেকে। তোমার মতন লেখাপড়া জানে? তুমি বেঙ্গলি স্টেজে জয়েন করবে?

এলেন বলল, ডোন্ট বি সিলি! তারপর শোনো, য়ুগোর নাটকটা অতি কষ্টে সিলেক্টেড হয়েছে, এখন মিড্ল মার্স যদি আপত্তি করে, তা হলেই সেটা রিজেক্টেড হয়ে যাবে।

শিশির চেঁচিয়ে বলল, কোন হিরোইনের এত সাহস হবে? আমি যা বলব, আমার মুখের ওপর কথা…নাটক সিলেক্ট করব আমি! ডায়ালগ বদলাতে হয় আমি বদলাব।

এলেন বলল, তোমাদের স্টেজের কথা আমি জানি না। এটা পারির কমেডি ফ্রাঁসেইজ, খুব বিখ্যাত থিয়েটার। একদিন রিহার্সালের সময় আলেকজান্দার দুমা উপস্থিত ছিলেন, তিনি ভিকতর য়ুগোকে বললেন, মেনে নাও, ওইটুকু চেঞ্জ।

শিশিরের শরীরটা দুলতে শুরু করেছে।

একটা হেঁচকি তুলে বললেন, আলেকজান্ডার দুমা কেন ওই কথা বললেন? হোয়াট রাইট হি হ্যাড? আমি রিহার্সালের সময় অন্য কারুর কমেন্ট অ্যালাউ করি না।

এলেনের মুখে একটুও বিরক্তির ভাব ফুটল না। তার পেশা তাকে এই সহবত শিখিয়েছে। মিষ্টি করে হেসে বলল, এসো, আমরা অন্য গল্প করি। তোমার কথা বলো।

শিশির বললেন, না, না, আমি এটা আগে শুনব। প্লে-টা কি শেষপর্যন্ত স্টেজড হল? কার যেন লেখা নাটকটা বললে? মলিয়ের, না ভিকতর য়ুগো?

এলেন বলল, ফরগেট ইট।

শিশির বড় এক চুমুক দিয়ে বললেন, নো, আই ওন্‌ট ফরগেট ইট। মাই মেমারি ইজ ভেরি শার্প…

শিশির এবার উঠে দাঁড়াতে গিয়েই পা দুমড়ে পড়ে গেলেন মেঝেতে। দু’বার নড়াচড়া করেই স্থির।

এলেন কাছে এসে তার লীলায়িত আঙুল দিয়ে শিশিরের গালে আস্তে আস্তে চাপড় দিতে দিতে বলল, ওঠো ওঠো, ওগো আমার প্রেমিক, মজা করবে না?

যখন সে বুঝল, এ ব্যক্তির আর অবিলম্বে জ্ঞান ফেরার কোনও আশা নেই, তখন সে তার নরম পায়ে শিশিরের পিঠে একটা লাথি কল।

এরপর আর শিশির আসেনি এই ফরাসি মেয়েটির কাছে। এমনকী অলীকের শত অনুরোধেও না।

অলীক বলেছিল, একদিন একটু কম মদ খেয়ে চল না! দেখবি, ইন্টেলেকচুয়াল আর ফিজিক্যাল দু’রকমই স্টিমুলেশন হবে।

শিশির উত্তর দিয়েছিলেন, ওই তো মুশকিল। কম মদ খেলে ওসব জায়গায় যেতেই ইচ্ছে করে না। আর বেশি ড্রিঙ্ক করলে তবেই যাওয়া যায়, কিন্তু আউট হয়ে গিয়ে আসল মজাটাই আর হয় না।

তবু, দিন কুড়ি-একুশ বাদে, ভবানীপুরের এক জমিদার বাড়ি থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে ফেরার পথে শিশিরের মনে হল, একবার ফ্রি স্কুলে থেমে গেলে কেমন হয়? আজও মদ্যপান হয়েছে বটে, তবে তুমুল নয়, চক্ষু লাল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জিভ জড়ায়নি, দু’পায়ের ওপরেও কর্তৃত্ব আছে।

ঊষার স্মৃতির হানা থেকে মন ফেরাবার জন্য ইদানীং শিশির একটি-দুটি নারীর সাহচর্যে সময় কাটাতে শুরু করেছেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে তো কথা বলা যায় না, কেউ একটু উচ্চস্তরের কথাই বোঝে না। শুধু শরীর দিতে জানে।

এলেনের কাছে শিশিরের যেতে ইচ্ছে হল শুধু শরীরের টানে নয়, সে যে-কাহিনীটি বলতে শুরু করেছিল, তার অনেকটাই মনে আছে তাঁর। এক নাট্যকারের সঙ্গে একজন নায়িকার মতভেদ শুধুমাত্র একটি সংলাপ নিয়ে। এখানে তো এরকম ব্যাপার ভাবাই যায় না। এখানে সে রকম নায়িকাই বা কোথায়? কতটা সূক্ষ্ম ওদের বোধ! বাকি অংশটা শোনার জন্য একটা কৌতূহল রয়ে গেছে, একটা অতৃপ্তি।

জমিদারমশাই একটা জুড়ি গাড়ি দিয়েছেন, শিশির সে গাড়িটা নিয়ে যেতে বললেন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। বাড়ি চিনে পৌঁছে গেলেন ঠিক। রাত বেশি হয়নি, সাড়ে দশটা। এ রাস্তা এখন কলকোলাহলময়।

দোতলায় এসে বেল দিলেন শিশির। নেশা হয়নি ভেবেছিলেন, কিন্তু এখন একটু একটু পা কাঁপছে।

দরজা খুলল এলেন, আজ তার অঙ্গে একটা কুচকুচে কালো ভেলভেটের পোশাক। তার ব্লন্ড চুলের সঙ্গে বেশ মানিয়েছে, গলায় দু’ছড়া মুক্তোর মালা।

পুরো দরজা খুলল না সে। হালকাভাবে হেসে বলল, অ্যালো, মনামি। হোয়াট উইন্ড ব্রিংগ্স ইউ হিয়ার? আজ তো তোমার সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। একটু বাদেই আমার একজন গেস্ট আসবে।

শিশির বললেন, আমি তোমার বেশি সময় নেব না। একটু শুধু কথা বলব। অফ কোর্স আই উইল কমপেনসেট।

এলেন দু’দিকে মাথা নাড়ল।

শিশির তার হাত ধরার জন্য এগিয়ে এসে বললেন, প্লিজ, প্লিজ।

এলেন বলল, স্যরি, নো৷ ডারলিং, হোয়েন এভার ইউ কাম, ইউ কাম ড্রাঙ্ক…ইউ আর আ ওয়েস্টার, ইউ আর আ ওয়েস্টার। নাও, গেট লস্ট! তুত সুইত!

দড়াম করে সে দরজা বন্ধ করে দিল শিশিরের মুখের ওপর।

এরকম ব্যবহারের অর্থ স্পষ্ট। আর কোনওদিন এসো না। তোমার জন্য এ দরজা আর কখনও খোলা হবে না। এখানে মাতলামি সহ্য করা হয় না।

তা হলে কি সেই কাহিনীটি অসমাপ্তই থেকে যাবে?

শিশিরের দলের কেউ তেমন ফরাসি ভাষা জানে না। সুনীতিকুমার জানেন, তাঁর সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়নি।

একদিন দেখা হতেই শিশির তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ফরাসি লেখক ভিকতর য়ুগো, তিনি নাটকও লিখেছেন। তার একটা নাটক নিয়ে—না, শুধু একটা ডায়ালগ। নিয়ে একজন বিখ্যাত অ্যাকট্রেসের ঝগড়া হয়েছিল, তারপর কী হল, তুই জানিস?

সুনীতিকুমার বললেন, আমি তো ভাই ফরাসি সাহিত্য কিংবা স্টেজের অত খবর রাখি না। তবে, নীতীশ, নীতীশই তো আছে, সে প্রমথ চৌধুরীর চ্যালা, ফরাসি সাহিত্য গুলে খেয়েছে। তাকে একদিন ডাকব’খন। নীতীশকে মনে আছে তো, আমাদের চেয়ে এক ক্লাস নীচে পড়ত, এখন ফিলজফি পড়ায়।

নীতিশ দাশগুপ্ত এলেন কয়েকদিনের মধ্যে।

প্রসঙ্গটা শুনেই তিনি বললেন, এটা তো খুব বিখ্যাত ঘটনা। মিড্ল মার্স-এর সঙ্গে ভিকতর য়ুগোর একটি সংলাপ নিয়ে মতান্তর। সংলাপটা হচ্ছে ভুজেৎ মঁ লিয়ঁ, ইউ আর মাই লায়ন। আলেকজান্দার দুমা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি লিখে গেছেন। মিড্ল মার্স বারবার বদলাতে বলছেন, য়ুগো মানছেন না। শেষপর্যন্ত অনেকের ধরাধরিতে মিড্ল মার্সকে রাজি করানো হল। কেউ কেউ ধরে নিল, মিড্ল মার্স ওই সংলাপটা শেষপর্যন্ত উচ্চারণ না করে বাদ দিয়ে দেবেন অভিনয়ের সময়। আরও কারুর কারুর আশঙ্কা হল, নায়িকা ইচ্ছে করলে এ নাটকের দফারফাও করে দিতে পারে, একটু নিষ্প্রান অভিনয় করলেই দর্শকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, ব্যস, তা হলেই নতুন নাট্যকারের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

শিশির জিজ্ঞেস করলেন, কেন, সেখানে বুঝি নায়কের দাপট নেই?

নীতীশ বললেন, আমাদের বাংলা স্টেজ বরাবরই নায়কপ্রধান। গিরিশচন্দ্র, অর্ধেন্দুশেখর, অমৃতলাল, দানীবাবু আর এখনকার এই আপনি, আপনাদের নিয়েই তো দর্শকরা মাতামাতি করে, কোনও অভিনেত্রী কি কখনও সে পর্যায়ে উঠেছে? বিনোদিনী ছাড়া? ফ্রান্সে আবার অভিনেত্রীদের প্রতি আকর্ষণই বেশি। নাট্যকাররা তাই তাদের চাটুকার হয়। ইরমানি নাটকের উদ্বোধন রজনীতে বহু গুণী, জ্ঞানী, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও সমালোচকরা এসেছেন। নাট্যকার মঁসিয়ো য়ুগো দুরুদুরু বক্ষে বসে আছেন উইংসের ধারে। আশ্চর্য ব্যাপার, কয়েক মিনিটের মধ্যে নাটক জমে গেল। সংলাপগুলো এমনই নতুন ধরনের, দর্শকরা হাততালি দিতে লাগল ঘনঘন। নায়িকা নিজেও খুব অবাক। তবে বুদ্ধিমতী তো, মিড্ল মার্স একটু বাদেই বুঝে গেলেন এই ডোনা সলের ভূমিকাটা তাঁর অন্যতম কেরিয়ার বেস্ট হতে চলেছে। তখন তিনি মন-প্রাণ ঢেলে অভিনয় করতে লাগলেন আর সেই সংলাপটাও বাদ দিলেন না। সেই সংলাপও দর্শকরা খুব খেয়ে গেল।

শিশির বললেন, নাট্যকারেরই জয় হল।

নীতীশ বললেন, শুনুন না। আরও মজা আছে। নাটকটা পাঁচ অঙ্কের। চতুথ অঙ্ক শেষ হয়েছে, কয়েক মিনিটের বিরতি, মেম নামে একজন প্রকাশক ভিকতর য়ুগোকে কফি খাওয়ার জন্য টেনে নিয়ে গেল।

শিশির জিজ্ঞেস করলেন, প্রকাশক পুরুষ? তার নাম মেম?

নীতীশ বললেন, আরে দাদা, ম্যাডামকে আমরা মেম করে নিয়েছি, ও শব্দটা তো সাহেবরা জানে না। এ লোকটির নাম এম ই এম ই। ঠিক মেম নয়, ম্যম। যাই হোক, প্রকাশক বললেন, ভিকতর, তোমার এই নাটকটা আমরা ছাপব, চুক্তিপত্রে সই করো, আর এই নাও পাঁচ হাজার ফ্রাঁ।

ভিকতর তো হতবাক। নাটকের পাণ্ডুলিপি নিয়ে তিনি প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন, কুকুরের মতন সবাই দূর দূর করে দিয়েছে। বেশ কয়েকটি থিয়েটার কোম্পানি তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে অপমান করে। আর এখন একেবারে ছাপার আগেই পাঁচ হাজার ফ্রাঁ!

ভিকতর তখন বললেন, নাটক তো এখনও শেষ হয়নি, এত তাড়াহুড়ো কীসের। কাল সকালে আলোচনা করা যাবে।

প্রকাশকটি বললেন, না, না, এ নাটক শেষ হওয়ামাত্র হুলুস্থুলু পড়ে যাবে বুঝেছি। অন্য অনেক প্রকাশক এসে তোমাকে ধরবে। দর অনেক বেড়ে যেতে পারে। ঠিক আছে, তোমাকে পাঁচের বদলে ছ’হাজার ফ্রাঁ দিচ্ছি, নাও, সই করো!

শিশির বললেন, গুড স্টোরি! ওদেশে প্রকাশকরা নাটকের জন্য এত টাকা দেয়? তাই ভালো ভালো লেখকরা নাটক লেখে। আমাদের দেশে তো নাটক বিক্রিই হয় না বই হিসেবে। নভেলিস্টরা তাই নাটক লেখেন না। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ বিক্রির পরোয়া করেন না।

নীতীশ বলল, বিক্রি টিক্রি নয়, এটা একটা কালচারের ব্যাপার। আমাদের এখানে সেই কালচারটাই গড়ে ওঠেনি। শুনুন দাদা, এই অ্যানেকডোটটার আর একটুখানি বাকি আছে। ইরমানি নাটকটি খুবই সফল হয়েছিল, একবার একটানা একশো রাত্রির পর বন্ধ হলেও আবার পুনরভিনয় হত মাঝে মাঝেই। আট বছর পর সেই তেয়াত্‌র-এ, মানে থিয়েটারে, আবার সেই নাটকের অভিনয় হচ্ছে। দু’জন দর্শক, যারা প্রথম দিনের অভিনয় দেখেছিল, আট বছর পরে আবার দেখল। শোয়ের শেষে বেরিয়ে আসতে আসতে একজন অপরজনকে বলল, আগে যা দেখেছিলাম, তার চেয়ে আজ যেন আরও অনেক বেশি ভালো লাগল, অডিয়েন্স রি-অ্যাকশনও অনেক বেশি৷ নাটকটা অনেকখানি পালটানো হয়েছে, তাই না? অন্য জন বলল, না, নাট্যকার নাটকটা পালটাননি। দর্শকদের রুচি পালটে দিয়েছেন এই আট বছরে। দাদা, ভালো নাটকের সার্থকতাই তো সেখানে!

আট – মঞ্চ এবং মঞ্চের বাইরে

বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের দোতলার একটি ছোট ঘরে থাকেন মুজফ্ফর আহমেদ। তাঁর বেশ জ্বর এসেছে, কাশছেন অনবরত। তাঁর রুমমেট নজরুল ইসলাম হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের সুর ভঁজছেন বিকেল থেকে, ইদানীং কবিতা লেখার চেয়েও গান তাঁকে বেশি পেয়ে বসেছে। নজরুল অবশ্য এখন সস্ত্রীক বসবাস করেন কৃষ্ণনগরে, কলকাতায় এলে ওঠেন এখানে।

সুর তোলার সঙ্গে সঙ্গে কথাও বসাচ্ছেন নজরুল। ‘আমরা শক্তি, আমরা বল, আমরা ছাত্রদল…’। মার্চিং সংয়ের মতন শোনাচ্ছে। কৃষ্ণনগরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য হয়েছেন নজরুল, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা ও তাদের কুচকাওয়াজ শেখাবার দায়িত্বও তাঁর ওপর, তিনি যে হাবিলদার কবি।

কাছেই পটুয়াটোলায় ‘কল্লোল’ পত্রিকার অফিস। সেখানকার তরুণ লেখকরা নজরুলকে প্রায়ই ডেকে নিয়ে যায়, কখনও তিনি নিজেও গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হুংকার দেন, দে গোরুর গা ধুইয়ে! সেই ‘প্রাণ ঠাসা এক মুঠো ঘর’ তাঁর গান ও উচ্চহাস্যে সরগরম হয়ে যায়।

গানটির রচনা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এই সময় রাস্তা থেকে কে যেন ডাকল, কাজীদা, কাজীদা!

হারমোনিয়াম সরিয়ে নজরুল জানালা দিয়ে উঁকি মারলেন। ডাকছে অচিন্ত্যকুমার, তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রেমেন্দ্র।

নজরুল হাত নেড়ে ওদের অপেক্ষা করতে বলে, জিভ কেটে বললেন, এই রে!

মুজফ্ফর জিজ্ঞেস করলেন, কী হল? ডাকছে কে?

নজরুল বললেন, কল্লোলের দুই কল্লোলী। আজ ওদের সঙ্গে আমার থিয়েটার দেখতে যাবার কথা ছিল। কিন্তু যাই কী করে?

কেন যাবে না কেন?

তোমার অসুখ, তোমাকে ফেলে যাব না।

অসুখটা আবার কোথায়? সামান্য জ্বর হয়েছে। এমন অনেক মানুষেরই হয়।

তুমি তো ডাক্তারের কাছেও যেতে চাইলে না।

জ্বর হলেই ডাক্তার দেখাতে হবে, ওসব বড়লোকি ব্যাপার। সর্দিজ্বর নিজে নিজে সেরে যায়।

তোমাকে একা রেখে যেতে আমার মন চাইছে না।

আমি কি পোলাপান নাকি! যাও, যাও। কী নাটক?

শিশির ভাদুড়ী আজ নতুন নাটক নামাচ্ছেন। কবিগুরুর ‘শেষরক্ষা’।

মুজফ্ফর আহমেদ উঠে বসে বললেন, কবিগুরুর নাটক, তার ওপর আবার শিশির ভাদুড়ী, এই চান্স কেউ মিস করে? আমার শরীরে জুত থাকলে আমি নিজেই যেতাম, এই অবস্থায় গিয়ে খকর খকর করে কাশলে লোকেদের ডিসটার্ব করা হবে। কল্লোলের পোয়েটরা সবাই যাচ্ছে?

নজরুল বললেন, হ্যাঁ, শিশিরবাবু নিজে এসে ওদের ইনভাইট করেছেন। আমাকেও বলেছেন বিশেষ করে। আজ কবিগুরু নিজেও আসবেন দেখতে!

মুজফ্ফর আহমেদ দারুণ আফশোসের সঙ্গে বললেন, ইস, এমন চান্স মিস করব! কবিগুরুকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ…কবিগুরু তোমায় যে টেলিগ্রামখানা পাঠিয়েছিলেন, সেখানা আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।

নজরুল বললেন, ও, সেখানা তোমার কাছে? আমি খুঁজেও পাই না। আমাকে দিয়ে দিয়ো। মাঝে মাঝে ওটা দেখতে ইচ্ছে করে।

মুজাফ্ফর বললেন, তোমাকে দিলেই তুমি হারাবে। তোমার যা লক্ষ্মীছাড়া স্বভাব! নাও, নাও, আর দেরি কোরো না।

নজরুল কোথাও যাবার আগে সাজগোজ করতে ভালোবাসেন। তাঁর সঙ্গে একটি বটুয়ায় থাকে প্রসাধনদ্রব্য। মুখে স্নো ঘষলেন, পাউডার মাখলেন, চুল আঁচড়ালেন পরিপাটি করে।

মুজফ্ফর একটা টিনের সুটকেস খুলে টেলিগ্রামটি দেখালেন নজরুলকে।

নজরুল যখন ‘ধূমকেতু’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন, তখন আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেই পত্রিকায় নজরুল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দাবি করেন পূর্ণ স্বাধীনতা। তারপরেই রাজদ্রোহের অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন। এক বছর কারাদণ্ড। হুগলি জেলে রাজনৈতিক বন্দিদের মর্যাদা না দিয়ে তাঁকে রাখা হয় সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে, তার প্রতিবাদে অন্য অনেকের সঙ্গে নজরুল শুরু করেছিলেন অনশন। ঊনচল্লিশ দিন ধরে চলেছিল অনশন, নজরুলের প্রাণসংশয় হবার মতন অবস্থা। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন। Give up hunger strike, our literature claims you. কারারুদ্ধ থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তাঁর ‘বসন্ত’ নাটিকাটা উৎসর্গ করেছিলেন। একজন অনুজ কবির প্রতি একজন সর্বজনমান্য কবির এই স্বীকৃতির দৃষ্টান্ত খুবই বিরল।

নজরুল নীচে নেমে এসে দেখলেন, অচিন্ত্য-প্রেমেন্দ্রর সঙ্গে আর একটি যুবকও রয়েছে। এর যেমন ছোটখাটো চেহারা, তেমনি হাতে রয়েছে মেপোল নামে বেশ ছোট আকারের সিগারেট। কল্লোলের দলে নতুন যোগ দিয়েছে ঢাকা থেকে এসে, এর নাম বুদ্ধদেব বসু।

ট্রামে চেপে ওঁরা সবাই চলে এলেন হাতিবাগানে। কাছেই কর্নওয়ালিশ মঞ্চে এখন নাট্যমন্দির। ‘সীতা’র যুগ থেকে শিশিরকুমার এখন অনেকটা এগিয়ে এসেছেন, এর মধ্যে তিনি আলমগীর, প্রফুল্ল, সধবার একাদশী ইত্যাদি জনপ্রিয় নাটকে এমন সব ভূমিকায় অভিনয় করলেন, যে সব ভূমিকায় গিরিশচন্দ্র, অর্ধেন্দুশেখর, দানীবাবুর প্রভূত সুনাম ছিল। কিন্তু শিশিরকুমার সকলকেই যেন ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি শুধু অভিনয় করেন না, এক একটি চরিত্রের নতুন ইন্টারপ্রিটেশন দেন। যে-সব প্রবীণ মানুষ গিরিশ যুগের নাটকও দেখেছেন, তাঁরাও স্বীকার করলেন, শিশিরকুমার রঙ্গমঞ্চে যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছেন, তা অভূতপূর্ব। শিশিরকুমারের খ্যাতি এখন গগনচুম্বী।

এর মধ্যে তাঁর সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে। শরৎচন্দ্রের দু’-একটি উপন্যাসের নাট্যরূপ অন্য রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয়েছে, তা তেমন জমেনি। একদিন তিনি ছাতা ও একটি পাণ্ডুলিপি বগলদাবা করে নাট্যমন্দিরে এসে বললেন, শিশির, ওরা শুধু বোঁদে তৈরি করতে জানে। সন্দেশের মর্ম বোঝে না। তুমিই হচ্ছ সন্দেশের শ্রেষ্ঠ কারিগর।

পাণ্ডুলিপিটি শরৎচন্দ্রের দেনা-পাওনা উপন্যাসের নাট্যরূপ, নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ষোড়শী। এ উপন্যাসের নাট্যরূপ দেওয়ার কথা প্রথম মাথায় এসেছিল শিবরাম চক্রবর্তী নামে এক তরুণ লেখকের। সে একটি পত্রিকায় সে নাট্যরূপ ছাপিয়েও দিয়েছিল, কিন্তু শরৎচন্দ্রের তেমন পছন্দ হয়নি। তিনি সেই নাট্যরূপের ওপর খানিকটা কলম চালিয়ে এনেছেন। শিশিরকুমার সেই নাটকটির ভালো সম্ভাবনা আছে বুঝতে পেরে নিজেও কাটাকুটি করলেন অনেকখানি।

প্রথমদিন থেকেই ‘ষোড়শী’র সার্থকতা হল আশাতীত। এর নায়ক জীবানন্দ মাতাল, দুশ্চরিত্র এবং নিষ্ঠুর প্রকৃতির জমিদার। এমন নায়ককে দর্শকরা গ্রহণ করবে কি না সন্দেহ ছিল। কিন্তু শিশিরকুমার সেই চরিত্রটিতে যেমনভাবে ফুটিয়ে তুললেন এক দ্বৈতসত্তা, তার অভিমানী হৃদয়, তার বিবেকবোধ ও অগ্নিশুদ্ধ চেতনা, তা সব মানুষকে বিস্ময়ে অভিভূত করে রাখল। সঙ্গে সঙ্গে উঁচু পর্যায়ের অভিনয় করল ষোড়শীর ভূমিকায় চারুশীলা, সেও তো শিশিরেরই শিক্ষাগুণে, সেও প্রায় শিশিরেরই সৃষ্টি।

শুধু খ্যাতি নয়, প্রচুর অর্থও এনে দিল ‘ষোড়শী’। জনপ্রিয়তায় ‘সীতা’র সমান না হলেও ছাড়িয়ে গেল অন্য অনেক নাটক। বাংলার জ্ঞানী-গুণী মনীষীদের মধ্যে যাঁরা অনেকে পেশাদারি বারাঙ্গনা অধ্যুষিত রঙ্গমঞ্চের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতেন, তাঁরা সবাই এখন আসতে লাগলেন নাট্যমন্দিরে। সর্ব স্তরে এই ধারণা ছড়িয়ে পড়ল যে, শিশিরকুমার বাংলার সংস্কৃতির সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছেন।

পরপর এরকম কয়েকটি নাটকের জনপ্রিয়তার পরেও শিশিরকুমারের মনে এখনও এই ধারণা বদ্ধমূল যে, মঞ্চ বেঁধে, পেছনে ছবি আঁকা দৃশ্যপট টাঙিয়ে, সেই ছবির ফ্রেমের মতন স্টেজ করে বিলিতি অনুকরণে বাংলা নাটকের অভিনয় মোটেই স্বাভাবিক নয়। যাত্রাই আমাদের ঐতিহ্য, যাত্রাই আমাদের সঠিক রীতি। আমাদের মতন গরিব মানুষদের দেশে রঙ্গমঞ্চগুলি না চললেও ক্ষতি ছিল না।

কিন্তু পেশাদারি দল গড়েছেন। এখন রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে খোলা মাঠে যাত্রা করতে নামা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মনে মনে তিনি আকাঙক্ষা পুষে রেখেছেন, বাঁধা রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে তিনি যাত্রার রীতি কিছুটা মিশিয়ে দেবেন।

‘শেষরক্ষা’য় তার প্রথম পরীক্ষা।

প্রথম রজনীতে আমন্ত্রিত অতিথিদের সংখ্যাই বেশি থাকে। প্রচারপত্রটিও একটি নিমন্ত্রণপত্রের মতন, যেন সবাইকে আহ্বান জানানো হচ্ছে এক বিবাহবাসরে।

একে একে সংস্কৃতি জগতের রথী মহারথী এবং নতুন তারকারাও আসন গ্রহণ করছেন। একেবারে সামনের সারির ঠিক মাঝখানে বিশেষ সোফায় বসলেন আকাশের রাজার মতন রবীন্দ্রনাথ। সবাই এসে এসে প্রণাম করে যাচ্ছে তাঁকে।

অভিনয় শুরু হবার আগে সকলেই লক্ষ করলেন, রঙ্গমঞ্চের মাঝখান দিয়ে একটা কাঠের সিঁড়ি নেমে এসেছে প্রেক্ষাগৃহে, সেটি লাল সালু দিয়ে মোড়া। এটা আগে ছিল না। সেখান থেকে প্রেক্ষাগৃহের মাঝ বরাবরও লাল সালু পেতে তৈরি করা হয়েছে একটি পথ।

এ নাটকে নতুন গান জুড়ে দেওয়া হয়েছে অনেকগুলি। সেসব গান শিখিয়েছেন কবির নিজের গানের ভাণ্ডারী স্বয়ং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

প্রথম দৃশ্যে শুধু মেয়েরা, ক্ষান্তমণি, ইন্দুমতী, কমলমুখী। লঘু হাস্যপরিহাস ও গানে বেশ জমে উঠেছে। দ্বিতীয় দৃশ্যের প্রথমেই চন্দ্রকান্তর ভূমিকায় শিশিরকুমারের আবির্ভাব। হাস্যরস ফোটাতে যে তিনি সমান দক্ষ তা বুঝতে দেরি হল না।

মাঝে মাঝেই প্রবল হাততালির মধ্যে নাটক চলল এগিয়ে।

রবীন্দ্রনাথের ঠিক পেছনের সারিতেই বসেছে কল্লোলের তরুণ লেখকরা, তারা শুধু নাটক দেখছে না, মাঝে মাঝেই লক্ষ করছে রবীন্দ্রনাথের মুখের দিকে। হাসির মুহূর্তে কবির মুখেও হাসি ফুটছে তো?

একেবারে শেষ দৃশ্যে গদাইয়ের বিবাহবাসর সাজানো হচ্ছে। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে চন্দরদা রূপী শিশিরকুমার কাঠের সিঁড়িটা দিয়ে নেমে এলেন প্রেক্ষাগৃহে। তাঁর হাতে একগাদা কাগজ। বিয়েবাড়িতে পদ্য ছাপা হয় যে-রকম রঙিন পাতলা কাগজে, সেরকম কাগজ। বরকর্তার মতন দর্শকদের নমস্কার ও আপ্যায়ন করতে করতে এগিয়ে গেলেন শিশিরকুমার, বিলি করতে লাগলেন সেই পদ্যের কাগজ। তাতে ছাপা আছে একটি গান:

যার অদৃষ্টে যেমনি জুটেছে

সেই আমাদের ভালো

আমাদের এই আঁধার ঘরে

সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালো …

রঙ্গমঞ্চের নট-নটীরা গেয়ে উঠল গানটি। প্রথম লাইন দু’বার গাইবার পরেই দর্শকদের মধ্য থেকেও বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকজন সেই গানে সুর মেলাল। রবীন্দ্রনাথ কৌতুক বোধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।

ব্যাপারটা যে একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত, তা অবশ্য নয়। আগে থেকেই নলিনীকান্ত সরকার ও পাঁচ-ছ’জন গায়ককে ওই গানটি শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল দর্শকদের মধ্যে। তবে, গান শুরু হবার পর দেখা গেল, অন্য দর্শকদের মধ্যেও অনেকে গলা মেলাচ্ছে।

মঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহ হয়ে গেল একাকার। শুধু তাই নয়, শিশিরকুমার কয়েকজন দর্শককেও আহ্বান জানালেন মঞ্চে উঠে আসতে। অভিনেতা ও দর্শকরা মিলে মিশে গেল। দারুণ আনন্দ-উৎসবের মতন শেষ হল নাটক।

যবনিকা পতনের পর শিশিরকুমার এসে হাত জোড় করে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথের সামনে।

তিনি সহাস্য মুখে, স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, বেশ উপভোগ করেছি। কাল সকালে এসো জোড়াসাঁকোয়। আরও কথা হবে।

কল্লোলের লেখকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরাও এসো।

তারপর তিনি নজরুলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন।

কল্লোলের দল রাস্তায় এসে তেলেভাজা আলুর চপ ও চা খেতে খেতে জটলা করল খানিকক্ষণ।

সবাই অভিভূত। শুধু শিশিরকুমার নয়, অন্যরাও জমিয়ে দিয়েছে। মেয়েরা প্রত্যেকে মানানসই। প্রশংসা আর শেষ হয় না।

শুধু বুদ্ধদেব কোনও কথা না বলে সিগারেট টেনে যাচ্ছে আপন মনে।

অচিন্ত্যকুমার একসময় তাকে জিজ্ঞেস করল, কী হে, তুমি চুপচাপ যে? তোমার ভালো লাগেনি?

বুদ্ধদেব সংক্ষেপে বলল, একটুও না।

এবার সকলের দৃষ্টি বুদ্ধদেবের দিকে। এ আবার কী? বুদ্ধদেব তো বেরসিক নয়। প্রাণ খুলে হাসতে জানে।

বুদ্ধদেব বলল, এটা মোটেই রবীন্দ্রনাথের নাটক হয়নি! হ্যাঁ, স্বীকার করছি, ‘সধবার একাদশী’তে নিমচাঁদের ভূমিকায় শিশিরবাবু অপূর্ব। তুলনাহীন। আর ‘ষোড়শী’তে জীবানন্দও তাঁর ব্যক্তিত্বের গুণে যেন নিজেরই জীবনকথা। অসাধারণ অভিনয়। কিন্তু এটা কী হয়েছে? এটা একটা প্রহসন, শিশিরবাবু যেন কিছুতেই ভুলতে পারছেন না যে তিনি শিশির ভাদুড়ী! চন্দ্রবাবুকে পেলাম কোথায়? আর এক একজন এমনভাবে সংলাপ বলছে, যেন ঠিকঠাক মানেই বোঝেনি। রবীন্দ্রনাথের নাটক এভাবে হয় না। দিস ইজ ডিসগ্রেসফুল!

প্রেমেন্দ্র এগিয়ে এসে বুদ্ধদেবের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? একটু হাসো তো! স্মাইল, স্মাইল!

নয় – নায়িকার আবির্ভাব

কিছুদিন হল, নাট্যমন্দিরের পক্ষ থেকে শিশিরকুমারের জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কালো রঙের বুইক গাড়ি, চালক সাদা উর্দি পরা, মাথায় পাগড়ি। মাঝে মাঝে শিশিরকুমার কোনও কোনও বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বিকেলের দিকে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যান।

দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর শিশিরকুমার কিছুদিন প্রচণ্ড খ্যাপামি করেছিলেন। একটানা এত বেশি মদ্যপান যে প্রাণসংশয়ের মতন অবস্থা। শিশিরকুমারের শোক প্রকাশের ধরনই এই। নিজেকে কষ্ট দেওয়া।

কয়েকদিন আগে অকস্মাৎ মৃত্যুর দেশে চলে গেছেন শিশিরকুমারের অন্তরঙ্গ বন্ধু মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। মণিলালের উৎসাহ, পরামর্শ এবং স্বার্থহীন সহযোগিতা ছাড়া শিশিরকুমার নাট্যজগতে এমন প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারতেন কিনা তাতে সন্দেহ আছে। আজ তিনি জনগণের আরাধ্য নটসম্রাট, আজ যিনি সবচেয়ে খুশি হতেন, সেই মণিলালই নেই।

এবারও শিশিরকুমার খুব ভেঙে পড়ে শুরু করেছিলেন নিজের ওপর অত্যাচার। এবার বাধা দিয়েছেন অন্য বন্ধুরা। এখন শিশিরকুমারের অনেক দায়িত্ব, সমস্ত সংবাদপত্র, দেশীয়গুলি ছাড়াও সাহেবদের পত্রপত্রিকাও তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ করে। তাঁর নাট্যকৃতিত্বের প্রশংসায় যেমন তাঁকে তুঙ্গে তোলা হয়, তেমনই তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতি নির্দেশ করতেও দ্বিধা করে না। এর মধ্যে একদিন ‘ষোড়শী’তে মাতাল জীবানন্দের ভূমিকায় অভিনয় করার সময় তিনি যে সত্যিকারের মাতাল ছিলেন, জিভ আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সে জন্য অন্তত দুটি সংবাদপত্রে তাঁকে ধিক্কার জানানো হয়েছে।

তা ছাড়া স্টারের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কথাও সর্বক্ষণ মনে রাখতে হয়। নানা রসের নাটক অনবরত বদল করে করে স্টার অনেক সময়ই নাট্যমন্দিরের চেয়ে বেশি দর্শক টানে। স্টারের প্রধান অভিনেতা অহীন্দ্র চৌধুরী খুবই সুদক্ষ অভিনেতা ঠিকই, তবে আবেগ-সম্বল, আর শিশিরের মতন তিনি শিল্পী, সাহিত্যিক এবং শিক্ষিত সমাজের প্রিয় হতে পারেননি। অভিনেতার পোশাক ছাড়াও অন্য সময়ে ব্যক্তিত্বের গুণে ও বৈদগ্ধ্যে শিশিরকুমার সমাজের একজন বিশিষ্ট পুরুষ।

নাট্যমন্দির ও শিশিরকুমারের ক্ষতি করার জন্য স্টার নানান রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেই ‘সীতা’ হরণের পর থেকেই। স্টার নিয়োজিত কিছু ব্যক্তি টিকিট কেটে শিশিরকুমারের খুব সার্থক কোনও নাটক দেখতে আসে, মাঝপথে তারা অকারণে হেসে ওঠে, কিংবা লাউডার লাউডার প্লিজ বলে চেঁচিয়ে অভিনয় ভন্ডুল করার চেষ্টা করে। এর মধ্যে অন্য দর্শকরাই খেপে উঠে তাদের চুপ করায়। একদিন তো অন্য দর্শকরা সেইসব দুষ্কৃতিকারীদের চড়-চাপড় মারতেও শুরু করেছিল।

আরও সন্দেহ করা হচ্ছে যে স্টার-প্রেরিত দু’-একজন ব্যক্তি শিশিরকুমারের বন্ধু সেজে তাঁকে অতিরিক্ত মদ্যপানে প্ররোচিত করতে আসে, বিশেষত শিশিরকুমারের দুঃখ-শোকের সময়ে। তারাই অফুরন্ত বোতল আনে। তা বুঝতে পেরে শিশিরকুমারের খাঁটি বন্ধুরা সতর্ক হয়ে উঠেছেন, তাঁরা যাদের চেনেন না, তাদের আর শিশিরকুমারের কাছে ঘেঁষতে দেন না। সেই বন্ধুরা কেউ-না-কেউ সবসময় শিশিরকুমারকে সঙ্গ দিচ্ছেন মণিলালের মৃত্যুর পর থেকে।

আজ গাড়িতে শিশিরকুমারের সঙ্গে আছেন নরেন্দ্র দেব। দীর্ঘকায়, সদাহাস্যময় পুরুষ, তাঁর মুখের মধ্যে পুরুষ্টু গোঁফটি বিশেষ দ্রষ্টব্য। রাধারানী নামে সম্ভ্রান্ত বংশীয়া এক বিধবা যুবতীকে বিয়ে করেছেন, স্বামী ও স্ত্রী দু’জনেই কবি। সবাই বলে কবি দম্পতি।

নরেন্দ্র একটি সংগীতবহুল অপেরাধর্মী নাটক রচনার কথা ভাবছেন। সে বিষয়েই আলোচনা করছিলেন শিশিরকুমারের সঙ্গে।

একসময় তিনি বললেন, জানো শিশির, যখনই ভাবি, পেশাদারি মঞ্চে দর্শক আসবে কি আসবে না, টিকিট বিক্রি হবে কি হবে না, তার ওপরই নির্ভর করে নাটকের সার্থকতা, তখনই মনটা কেমন সিঁটিয়ে যায়, প্রাণ খুলে আর লেখা যায় না। সবসময় দর্শকদের কথা মাথায় রাখলে কি সার্থক কিছু সৃষ্টি করা যায়? বরং নাট্যকার নতুন কিছু সৃষ্টি করবেন, দর্শকরা আস্তে আস্তে সেটা গ্রহণ করতে শিখবে!

শিশিরকুমার বললেন, আস্তে আস্তে, মানে কত আস্তে আস্তে! দু’-একটা অন্যরকম কিছু করার তো চেষ্টা আমি করেছি। একটু নতুন কিছু হলেই দর্শক আর আসে না। দেখলে তো, শেষরক্ষা জমল না। দর্শক না এলেই ভাঁড়ে মা ভবানী! মাস গেলে এতগুলো টাকা তো মেটাতে হবে! সেইজন্যই দু’এক মাস অন্তর অন্তর আমাকে পুরনো নাটকগুলো টেনে আনতে হয়, আমাকে রাজা-বাদশা কিংবা রামের মতন সুপার হিরো হিসেবেই দেখতে চায় মানুষ।

নরেন্দ্র বললেন, দেশবন্ধু চলে গেলেন, তিনি থাকলে একটা কিছু হতই। এখন আমরা নিজেরাই জাতীয় নাট্যশালা গড়ে তুলতে পারি না? যাতে সবসময় টাকাপয়সার কথা চিন্তা করতে না হয়!

শিশিরকুমার এ কথায় খুব গুরুত্ব না দিয়ে, আলগাভাবে বললেন, কী করে?

নরেন্দ্র বললেন, দেশের সরকারকে অনুরোধ জানাতে হবে। যেমন সরকার নানান জায়গায় ইস্কুল খুলছে, পার্ক বানাচ্ছে, হাসপাতাল, মহামারি রোগের টিকা দেবার জন্যও দপ্তর খুলে বহু টাকা ব্যয় হচ্ছে। সেরকম দেশের মানুষের ভালো জাতের আমোদের জন্য একটা নাট্যশালা তৈরি করে দেওয়া উচিত নয়?

শিশির বাঁকাভাবে বললেন, নরেন্দ্র, তুমি কি ভুলে যাচ্ছ, আমরা পরাধীন জাতি? বিদেশি সরকারের কী উচিত বা উচিত নয়, তা কে বোঝাবে? ভিক্ষে চাইতে হবে?

তা হলে করপোরেশনকে বলা যেতে পারে। করপোরেশন জমি দিক, আমরা চাঁদা তুলে সেখানে হল বানাব। আর করপোরেশন যদি মাসে বিশ হাজার টাকা করে দেয়, তা হলেই সব খরচ চলে যাবে। টিকিট বিক্রি থেকেও কিছু তো উঠবে, তা নতুন নতুন নাটক তৈরিতে কাজে লেগে যাবে!

আকাশকুসুম! নরু, তোমাকেই দেখছি করপোরেশনের মেয়র বানিয়ে দেওয়া দরকার। অবশ্য তুমি মেয়র হয়ে গেলে তখন কি আর মাসে কুড়ি হাজার টাকা দিতে রাজি হবে?

কেন, আকাশকুসুম কেন? মাসে কুড়ি হাজার মানে, বছরে দু’লাখ চল্লিশ হাজার। কলকাতা শহরের জনসংখ্যা এখন ষোলো লাখ। আমরা তো প্রতি তিন মাসে করপোরেশনকে ট্যাক্স দিই! যদি অন্তত দশ লাখ লোকও তিন মাসে মাত্র চার পয়সা প্রমোদকর দেয়, তা হলে বছরে কত হয়, হিসেব করো তো! একটা জাতীয় নাট্যশালা হলে আমরা দেশ-বিদেশের বিখ্যাত সব গায়ক-বাদক, অভিনেত্রী ও নর্তক-নর্তকীদের নেমন্তন্ন করে আনতে পারব, এ শহরের কত সুনাম হবে! এত বড় একটা শহর কলকাতা, ব্রিটিশ রাজত্বে লন্ডনের পরেই এর স্থান, অথচ এখানে মাত্র চারটে থিয়েটার হল, তাও আলফ্রেড ধুঁকছে, মিনার্ভার অবস্থাও খারাপ!

তবু তো কলকাতা শহরে কয়েকটা স্টেজে নিয়মিত নাটক হয় সারা বছর। ইন্ডিয়ার আর কোনও শহরে পার্মানেন্ট স্টেজ আছে? নেই?

এ আর বেশি কথা কী! আর্ট-কালচারে বাঙালিরা এদেশে সবচেয়ে এগিয়ে, এ তো সবাই জানে!

বেঙ্গলি শভিনিস্ট! নরু, এমন কথা তুমি অন্য জায়গায় গিয়ে বোলো না! ধোলাই খাবে!

শিশির, আমি ইয়োরোপ দেখেছি! প্রাগ একটা ছোট শহর, মোটে সাড়ে সাত লাখ লোকের বাস। সেখানে ক’টা থিয়েটার তুমি জানো? চোদ্দোটা! ওখানকার ন্যাশনাল থিয়েটারটা বানিয়ে দিয়েছে বোহেমিয়া রাজ্য, আর করপোরেশনেরও একটা নিজস্ব থিয়েটার আছে।

ওদের ওই সাড়ে সাত লাখ লোকের মধ্যে কতজন লেখাপড়া জানে? আর আমাদের এই কলকাতা শহরে? যে-বাঙালিদের নিয়ে তুমি এত গর্ব করো, তার দর্শক…

হঠাৎ কথা থামিয়ে শিশিরকুমার সোজা হয়ে বসলেন। ড্রাইভারকে বললেন, এই থামাও তো, রোককে! রোককে!

ময়দান থেকে গাড়িটা ডালহাউসি স্কোয়ার ঘুরে লালবাজারের পাশ দিয়ে এসে পড়েছে বউবাজারের রাস্তায়, এক বাড়ির গায়ে সাঁটা একটা মস্ত বড় পোস্টারের দিকে চোখ পড়েছে শিশিরের।

পোস্টারটি এই রকম:

সুসংবাদ, সুসংবাদ!

বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে এই প্রথম এক

শিক্ষিতা নায়িকার আবির্ভাব

শ্ৰীমতী কঙ্কাবতী সাহু, বি.এ

আগামীতে নিয়মিত অভিনয় করিবেন

আপনাদিগের প্রিয় থিয়েটারে

স্টার

(আর্ট থিয়েটার)

গাড়ি থেকে নেমে শিশিরকুমার পোস্টারটি কয়েকবার পাঠ করে ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ব্যাপার, নরু, এটা কি স্টারের নতুন স্টান্ট নাকি?

নরেন্দ্র বললেন, যার মাথা থেকেই আসুক, কেরামতি আছে বলতে হবে। একেবারে জবর চমক। বি.এ. পাশ মেয়ে আসছে পেশাদারি থিয়েটারে। ভূ-ভারতে এরকম কখনও হয়নি!

শিশিরকুমার বললেন, তার ওপর এর আবার পদবি আছে!

নরেন্দ্র বললেন, পদবি? ওঃ হো, বুঝেছি। সেই বিনোদিনী থেকে এখনকার আঙুরবালা, ইন্দুবালা, প্রভা, আশ্চর্যময়ী, এদের কারওই তো পদবি নেই।

শিশিরকুমার বললেন, থাকবে কী করে? সবাই তো আসে ও পাড়া থেকে। তারা সব জন্মেছে ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে। তাই গোত্রের ঠিক নেই। কিন্তু স্টার কি সত্যিই ভদ্রঘরের এক মেয়েকে পেয়েছে, না কুমোরটুলি থেকে মাটির প্রতিমা গড়িয়ে এনেছে।

তাড়াতাড়ি আবার গাড়িতে উঠে শিশিরকুমার চালককে বললেন, চালাও, চালাও, জোরে চলো।

এরপর শহরের বহু বাড়ির দেওয়ালে, মেডিক্যাল কলেজে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মিউনিসিপ্যাল বাজারে দেখা গেল সেই পোস্টার। কোনও কোনও বাড়ি একেবারে পোস্টার দিয়ে মোড়া। কর্নওয়ালিস থিয়েটারে পৌঁছে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই শিশিরকুমার হাঁক দিতে লাগলেন, বিশে, তারা, যোগেশদা, সব কোথায় গেলে?

সপ্তাহের মাঝখানের দিনগুলোয় অভিনয় বা রিহার্সাল থাকুক বা না থাকুক, অনেকেই রঙ্গমঞ্চে গুলতানি করতে আসে। আজও এসেছে, সবাই শিশিরকুমারের ডাক শুনে কাছে এসে জড়ো হল।

মঞ্চের ঠিক মাঝখানে একটা চেয়ারে বসে শিশিরকুমার জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা স্টারের পোস্টার দেখেছ?

প্রায় সারা শহর আজই ওই পোস্টারে ছয়লাপ হয়ে গেছে, না দেখার উপায় কী? সবাই দেখেছে!

শিশিরকুমার চুরুট ধরিয়ে বললেন, এটা কি সত্যি, না স্টার ভাঁওতা মেরেছে।

সবাই নিরুত্তর, শুধু মদের গেলাস হাতে নিয়ে মিটিমিটি হাসছে অলীক।

শিশিরকুমার তার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী রে, অলীক, তুই তো সব মেয়েমানুষের খবর রাখিস, তুই জানিস না?

অলীক বলল, জানব না কেন? পোস্টারটি দেখার পরই আমি খবর নিয়েছি।

শিশির বললেন, সত্যিই একটা এই নামের মেয়ে আছে? সে বি. এ পাশ!

অলীক বলল, কোন্ সত্যিটা জানতে চাও?

শিশির বললেন, দুটোই।

অলীক বলল, তা হলে দুটোই সত্যি। কঙ্কাবতী সাউ নামে একটি দেখতে শুনতে ভালো মেয়ে এম এ ক্লাসের ছাত্রী, তার অভিনয় করার শখ হয়েছে, সে খবর পেয়েই স্টার তাকে গপ করে গিলে ফেলেছে!

এবার শিশিরকুমার গলা চড়িয়ে বললেন, একটা বি এ পাশ মেয়ে থিয়েটার করতে চায়। সে শিশির ভাদুড়ীর কাছে না এসে স্টারে যাবে কেন? তোমরা কেউ কিছু করতে পারলে না? যত সব অপদার্থের দল! যেমন করে পারো, মেয়েটাকে ধরে নিয়ে এসো!

অলীক বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও শিশির, মাথা গরম কোরো না! স্টার-এর আর্ট থিয়েটারের এমন রমরমা কেন জানো? অহীন চৌধুরী কিংবা নির্মলেন্দু লাহিড়ীর জন্য নয়। ওদের আছে একজন দুঁদে ম্যানেজার। ক্ষুরধার বুদ্ধি। সে সবসময় বাজার বুঝে খেলতে নামে। তোমার নাট্যমন্দিরেরও যে ওইরকম একজন ম্যানেজার দরকার, তা কতবার বলেছি।

তোকেই তো ম্যানেজার হতে বলেছিলুম!

আমি? আমি ভাই শেকল-ছেঁড়া চিড়িয়া। কোনও দায়িত্ব-ফায়িত্বের মধ্যে নেই। তা ছাড়া তোমার আন্ডারে কাজ করতে গিয়ে সবসময় ধমক খেয়ে মরি আর কী? সব সময় তুমিই তো সর্বেসর্বা। যাই হোক, স্টারের ম্যানেজার প্রবোধ গুহ কী রকম পাকা কাজ করেছেন শোনো। পাছে তুমি ওই মেয়েটার ওপর থাবা বসাও, তাই তিনি আগেই ওকে চুক্তিতে বেঁধে ফেলেছেন। তিন বছরের জন্য।

তিন বছর?

হ্যাঁ। প্রথম তিন মাস অ্যাপ্রেন্টিস। তারপর প্রথম এক বছর তিনশো টাকা মাস মাইনে। দ্বিতীয় বছর চারশো করে। তৃতীয় বছর পাঁচশো। স্ট্যাম্প পেপারে সই হয়ে গেছে। এখন তুমি যতই হাত কামড়াও।

ওসব চুক্তি-ফুক্তি আমি গ্রাহ্য করি না। মেয়েটাকে জোর করে ধরে আনতে হবে এখানে।

এটা ছেলেমানুষির মতন কথা।

হোক ছেলেমানুষি! আমি মেয়েটাকে দেখতে চাই। যেমন করে পারো তাকে এখানে ধরে আনো। অলীক, আমি তোর ওপরেই এ ভার দিতে চাই।

পাগল নাকি! শেষে মেয়ে-অ্যাবডাকশনের চার্জে পড়ব! আমি ওসবের মধ্যে নেই।

এবার যোগেশ চৌধুরী বললেন, ধরে আনতে হবে কেন? শিশির ভাদুড়ী দেখা করতে চাইলে বাংলার এমন কোন মেয়ে আছে, যে দেখা করতে চাইবে না? যদি না নিতান্ত পরদানশীন ঘরের বউ হয়! আমরা নিজেরাই প্রস্তাব নিয়ে যেতে পারি।

শিশির বললেন, ঠিক আছে, দ্যাখো চেষ্টা করে। স্টারের লোকজন ওকে ঘিরে রাখতে পারে।

যোগেশের উদ্যোগে দু’দিন পরেই এল সেই মেয়েটি। জোর করার প্রশ্নই নেই। শিশিরকুমারের নাম শুনেই সে রাজি হয়েছে।

কঙ্কাবতী একা আসেনি। সঙ্গে তার ছোট বোন চন্দ্রাবতী আর একজন মামাতো ভাই।

কঙ্কাবতী-চন্দ্রাবতীর বাবার নাম গঙ্গাধর সাহু, ওড়িশার মানুষ হলেও ছোটখাটো একটা জমিদারি কিনেছিলেন বিহারের মজঃফরপুরে। এবং সেখানকার অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটও বটে। মানুষটি যেমন বিলাসী, তেমনই গানবাজনার সমঝদার। অনেক ব্যাপারে সংস্কার মুক্ত। দুই মেয়েকে তিনি অল্প বয়েস থেকেই লেখাপড়া ও সংগীত শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন, মফস্সল ছেড়ে পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়।

এর মধ্যেই আরও খবর জানা গেছে যে বড় মেয়েটির গানের গলা খুব ভালো, রবীন্দ্রনাথের গানই বেশি গায়। কঙ্কাবতী রবীন্দ্রনাথকেও গান শুনিয়ে এসেছে।

কঙ্কাবতীর বয়েস বাইশ-তেইশ, বাঙালি মেয়েদের তুলনায় সে বেশ লম্বা। শরীরের গড়নটি বড়সড়। অনেকটা দুর্গা প্রতিমার মতন। সে রকমই টানা টানা চোখ, পিঠের ওপর ঢালের মতন চুল। তুলনায় ছোট বোনটি ছোট্টখাট্টো, তবে তারও মুখ চোখ খুব তীক্ষ্ণ।

যেন বিচারসভা। এক দিকের চেয়ারে বসেছেন শিশিরকুমার, অন্য দিকে তিনটি চেয়ারে ওরা তিনজন, অন্যরা দাঁড়িয়ে আছে দু’পাশে।

মেয়ে দুটি শিশিরকুমারের পা ছোঁয়নি, হাত তুলে নমস্কার করেছে। ব্রাহ্মদের মতন। ছোট বোনটির সিঁথিতে সিঁদুরের রেখা, কঙ্কাবতীর তা নেই।

শিশিরকুমার প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, তুমি থিয়েটারে অভিনয় করতে চাও? আগে আমার কাছে আসোনি কেন?

কঙ্কাবতী পরিষ্কার গলায় বলল, আমাকে তো কেউ বলেনি। আমি একটা বাড়িতে গান গাইছিলাম, এক ভদ্রলোক এসে বললেন, তুমি স্টারে অভিনয় করবে? আমি বললাম, সে তো আমার সৌভাগ্য। পরের দিনই এগ্রিমেন্টে সই হয়ে গেল।

একটু থেমে, পাতলাভাবে হেসে সে আবার বলল, তা ছাড়া আপনি তো অনেক দূরের মানুষ, আমার সাহস কী!

মামাতো ভাইটি বলল, কঙ্কা আমাদের কিছু জিজ্ঞেস না করেই চুক্তিতে সই করে ফেলেছে।

শিশিরকুমার সে কথা গ্রাহ্য না করে কঙ্কাবতীর দিকেই তাকিয়ে আবার বললেন, তুমি কবিগুরুকে কী শুনিয়েছ? কী গান গেয়েছিলে? আমাদের শোনাবে?

কঙ্কাবতী মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপর সুর ভাঁজল একটু। মুখ তুলে বলল, কবিগুরুর সামনে গান গাইতে ভয় লাগেনি। কিন্তু আপনার সামনে ভয় পাচ্ছি।

শিশিরকুমার কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে বললেন, আমাকে ভয়? কেন?

কঙ্কাবতী বলল, শুনেছি আপনি খুব রাগী!

শিশিরকুমার বললেন, সেকী? আমার এ দুর্নাম কে রটালে?

তিনি অন্যদের দিকে তাকালেন। তারা হাসি লুকোবার জন্য মুখ ফিরিয়ে রয়েছে, শিশিরকুমারের মুখের ওপর এমন কথা কেউ বলেনি আগে।

শিশিরকুমার বললেন কোনও ভয় নেই, তুমি গাও!

কঙ্কাবতী খোলা গলায় গাইল:

এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর

পুণ্য হলো অঙ্গ মম, ধন্য হলো অন্তর…

শিশিরকুমার পুরো গানটি মন দিয়ে শুনলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বাঃ! আমার নাট্যমন্দিরের অ্যাকট্রেসরা অনেকেই গান গাইতে পারে। কিন্তু কবিগুরুর গানের ঠিক ভাব তাদের গলায় ঠিক ফোটে না। এখানে বসে এই যেন প্রথম শুনলাম ঠিক ঠিক গান। তুমি ভালো গাইতে পারো। কিন্তু অভিনয় করার শখ হল কেন?

কঙ্কাবতী বলল, কলেজ সোশ্যালে কয়েকবার থিয়েটারে পার্ট করেছি। অভিনয় আমার ভালো লাগে।

শিশিরকুমার বললেন, কলেজ সোশ্যাল, সে তো আলাদা, কিন্তু প্রফেশনাল বোর্ডে, জানো না বোধহয়। এখানকার মেয়েরা সবাই আসে খারাপ পাড়া থেকে। লোকে নিছক বদনাম দেয়। তুমি ভদ্র ঘরের মেয়ে। তোমার বাবা-মা আপত্তি করবেন না?

কঙ্কাবতী বলল, আমার মা অনেক দিনই নেই, আর বাবা… না, বাবাও কিছুদিন আগে…. তবে তিনি বেঁচে থাকলেও বোধহয় আপত্তি করতেন না।

শিশিরকুমার জিজ্ঞেস করলেন, আর তোমার ছোট বোনটি? সেও থিয়েটার করতে চায়?

কঙ্কাবতী বললেন, না, না। ও এর মধ্যেই বিয়ে করে ফেলেছে। ওর স্বামী চায় না।

মামাতো ভাইটি বলল, চন্দ্রাকে সিনেমার লোকরা নেবার জন্য খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। স্টেজের তুলনায় সিনেমায় খাটুনি কম।

শিশিরকুমার কঙ্কাবতীকে এবার সরাসরি প্রশ্ন করলেন, তুমি আমার দলে জয়েন করবে?

কঙ্কাবতী দু’দিকে মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে বলল, না। পারব না। স্টারের ম্যানেজারবাবু আমায় বলে দিয়েছেন। এই চুক্তি ভাঙলে আমার জেল হবে!

শিশিরকুমার বললেন, সে সব চুক্তিটুক্তি আমি বুঝব—

মামাতো ভাইটি বললেন, না, স্যার, ও কথা বলবেন না। আপনি ডেকেছেন, তাই দেখা করতে এসেছে। কোনও ঝামেলায় আমরা জড়াতে চাই না।

আর বিশেষ কথা হল না। এর মধ্যেই এসে পড়লেন হেমেন্দ্রকুমার ও সৌরীন্দ্রমোহন। চা-মিষ্টি খাওয়াবার পর কঙ্কাবতীদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে বিদায় দিলেন শিশিরকুমার।

ফিরে আসার পর তাঁকে হেমেন্দ্রকুমার বললেন, শিশির, তুমি খুব নিরাশ হয়েছ মনে হচ্ছে? মেয়েটির মধ্যে এমন আহামরি কী আছে! না হয় লেখাপড়া জানে। বি. এ. পাশ। কিন্তু লেখাপড়া জানলেই যে ভালো অভিনয় করতে পারবে, তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? বরং তলা থেকে যারা উঠে এসেছে, তারা অনেক সিনসিয়ার।

শিশির বললেন, তুমি তো মেয়েটির কথা বলার ধরনটা দেখোনি। চাপা গাম্ভীর্য আছে। এমনটি আগে দেখিনি। তুমি ওর গানও শোনোনি। আমাদের ‘শেষরক্ষা’ জমল না কেন? আমাদের মেয়েরা যতই চেষ্টা করুক, রবিবাবুর গানের সুর আর ভাব যে ফোটে না, তা আমি বুঝি। এর গান অনেক আলাদা। আমার তো এখনও রবীন্দ্রনাথের নাটক নামাবার ইচ্ছে আছে, তখন এরকম মেয়েই চাই।

সৌরীন্দ্রমোহন বললেন, কিন্তু এসব ভদ্র ঘরের শিক্ষিতা মেয়ে, দু’দিন বাদেই যে ফুড়ুত করে উড়ে যাবে না, তার কী গ্যারান্টি আছে?

শিশিরকুমার বললেন, তা অবশ্য ঠিক।

অন্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে প্রভা।

সে একটু এগিয়ে এসে নম্র স্বরে জিজ্ঞেস করলে, বড় বাবু একটা কথা বলব? যদি নির্ভয় দেন

অন্য সব মেয়েই বলে নিভ্ভয়, শুধু প্রভার উচ্চারণ সঠিক।

শিশিরকুমার একটু অন্যমনস্কভাবে বললেন, হাঁ, বল না, ভয়ের কী আছে?

প্রভা মৃদু কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল, এই যে ভদ্রঘরের পড়াশোনা জানা মেয়েটি এয়েছিল, তার বয়েস তো নেহাত কম নাকো। তেইশ-চব্বিশ তো হবেই। ওর মাথায় সিঁদুর নেই কেন?

শিশিরকুমার এবার সচকিত ও বিস্মিত হয়ে বললেন, সিঁদুর নেই? কেন, তা আমি কী করে জানব? বিয়ে হয়নি বোধহয়।

প্রভা বলল, হিন্দু ঘরের মেয়ে, ষোলোতে অরক্ষণীয়া। এত বয়েসেও বিয়ে না হলে তো ওর বাপ-মা পতিত হয়ে যাবে। ওর বাপ-মা না হয় নেই, কিন্তু আত্মীয়স্বজন তো থাকবে। তেনারা ওকে থিয়েটারে পাঠাতে রাজি হল? এখন কখনও শুনিনি।

শিশিরকুমার ঈষৎ ধমকের সুরে বললেন, দ্যাখ প্রভা, ওসব ব্যাপার নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি। ওরা ব্রাহ্ম হতে পারে, ক্রিশ্চিয়ান হতে পারে। হিন্দু মেয়েরাও কি বিয়ে না করে স্বাধীন থাকতে পারে না? কী জানি, এত সব আমি জানি না।

প্রভা এবার ঈষৎ পাশ ফিরে অভিমানের বাষ্প জড়ানো কণ্ঠে বলল, বড়বাবু, আপনি বিদ্যের জাহাজ। আমরা হতভাগিনী, বাপের নাম জানি না। লেখাপড়া শিখিনি, তাই আপনি সব সময় আমাদের খোঁটা দেন। ভগবান আমাদের এমনি করেই এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, সে কি আমাদের দোষ?

শিশিরকুমার কণ্ঠস্বর নরম করে ফেলে বললেন, খোঁটা দিই? না, তা নয়, তোদের ধমকাই, যাতে উচ্চারণ সঠিক হয়। অনেকের মধ্যে তুই খুবই উন্নতি করেছিস। মহাভারতের কর্ণ যেমন বলেছিলেন, মানুষের জন্ম দৈবের অধীন, কিন্তু তার গুণ তাকে নিজে আয়ত্ত করতে হয়। প্রথম তোকে যেমন দেখেছি, সেই তুলনায় আজ তুই মহারানি থেকে চাকরানি সব রোলে যেমন অভিনয় করতে পারিস, তাতে বহুৎ আচ্ছা আচ্ছা লেখাপড়া মেয়েরও তোর পা ধোওয়া জল খাবে।

এরপর সবাই মগ্ন হলেন অন্য আলোচনায়। শিশিরকুমার আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।

দু’দিন পর শিশিরকুমার কারওকে কিছু না জানিয়ে একা বেরিয়ে পড়লেন মোটর গাড়ি নিয়ে। মাঝে মাঝেই চিত্ত বড় উতলা হয়ে উঠছে, ঠিক করলেন গঙ্গার ধারের হাওয়া খেয়ে আসবেন।

চওড়া নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে, নাম সেন্ট্রাল এভিনিউ, সেই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে, কলুটোলার মুখটায় এসে ড্রাইভারকে হঠাৎ বললেন, গাড়ি ঘোরাও তো বাঁ দিকে।

মির্জাপুর স্ট্রিটে এসে তিনি একটি ফার্মেসি খুঁজতে লাগলেন। একটু বাদে পেয়ে গেলেন। তার পাশে একটি দোতলা হলুদ রঙের বাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে সেই বাড়ির দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। তাঁর বুক কাঁপছে।

কেন এসেছেন এখানে? তিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অযাচিতভবে কখনও কারও বাড়িতে যান না। সেই যে একবার একটি ফরাসি মেয়ে তাঁকে অপমান করেছিল, তারপর থেকেই শিক্ষা হয়ে গেছে। তবু আজ এসেছেন, তাও কোনও বিশেষ পল্লিতে নয়, যেখানে পয়সার জোর থাকলেই যে-কোনও ঘরে যাওয়া যায়। এখানে কী রকম ব্যবহার পাবেন তা জানেন না। তাঁর এত অহমিকা, তবু তাঁর বুক কাঁপছে, এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।

তিনি দরজার কড়া নাড়লেন।

দরজা খুলে দিল কোনও গৃহভৃত্য নয়, এক যুবতী। কঙ্কাবতী স্বয়ং।

কঙ্কাবতী বিস্মিতভাবে বলল, একী, আপনি?

শিশিরকুমার কাচুমাচুভাবে বললেন, তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলতে এলাম। তোমার ব্যাঘাত হল কি?

কঙ্কাবতী বলল, আমি তো এক্ষুনি বেরুচ্ছিলাম। আর এক মিনিট পরে এলে আমার সঙ্গে দেখা হত না।

শিশিরকুমার বললেন, ও, তোমাকে বাইরে যেতে হবে? তা হলে… তা হলে তো তোমার সময় নষ্ট করা ঠিক নয়, আমি তবে

কঙ্কাবতী বলল, না, না, তেমন ব্যস্ততার কিছু নেই। একটু পরে গেলেও চলবে। আমি লাইব্রেরি থেকে বই আনতে যাচ্ছিলাম। বসুন, বসুন। চা-কফি কী খাবেন বলুন?

শিশিরকুমার বললেন, কিছু না, শুধু মিনিট পাঁচেক কথা বলব।

কঙ্কাবতী বললেন, আর যা-ই বলুন, আমাকে স্টার থিয়েটার ছেড়ে আসতে বলবেন না। উকিলবাবু নিষেধ করেছেন।

শিশিরকুমার বললেন, না, সে কথা বলতে আসিনি।

বসবার ঘরটি অনেকটা নিরাভরণভাবে সাজানো। কয়েকটি সোফা, একটি লম্বাটে সেন্টার টেবিল, দেওয়ালে দুটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি।

কঙ্কাবতী পরে আছে একটা ডুরে শাড়ি, তেমন দামি কিছু নয়, দু’হাতে চুড়ি-বালা কিছু নেই, শুধু একটি সাদা ব্যান্ডের রিস্টওয়াচ, দু’কানে দুটো হিরের দুল।

মুখোমুখি দুটি সোফায় বসবার পর কঙ্কাবতী সহজভাবে বলল, বলুন!

শিশিরকুমার মিনমিন করে বললেন, ঠিক কী বলব, তাও তো ভেবে আসিনি। এমনিই এলাম।

কঙ্কাবতী হেসে ফেলে বলল, গ্রেট শিশির ভাদুড়ী আমার মতন একটি সামান্য মেয়ের কাছে এমনি এমনি এসেছেন, তাও কি বিশ্বাস করতে হবে?

শিশিরকুমার বললেন, বরং আজ উঠে পড়া যাক। তোমার তাড়া আছে।

কঙ্কাবতী বলল, বেশ!

দু’জনে উঠে দাঁড়াবার পর শিশিরকুমার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন লাইব্রেরিতে যাও?

কঙ্কাবতী বলল, ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি।

সেখানে তুমি রোজ যাও?

না, রোজ না, সপ্তাহে দু’-তিন দিন।

এখান থেকে খুব তো কাছে নয়। ধর্মতলায়। কী করে যাও?

ট্রামগাড়ি যায় এদিক দিয়ে।

আমার মোটর গাড়িতে যদি আজ তোমাকে পৌঁছে দিতে চাই, সেটা কি গর্হিত হবে?

একটুক্ষণ চিন্তা করে কঙ্কাবতী বলল, গর্হিত কেন হবে, আমারই সুবিধে হল।

ভদ্রবাড়ির কোনও মেয়েকে এরকম একা একা বেরুতে আগে কখনও দেখেননি শিশির। কারওকে কিছু বললও না, শুধু টেনে বন্ধ করে দিল সদর দরজাটা। হাতে দু’খানি বই।

গাড়িতে ওঠার পর কঙ্কাবতী জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ওইদিক পানেই যাচ্ছিলেন? কিংবা যাচ্ছেন আমার জন্য।

শিশির বললেন, আমার কোনও দিকেই যাবার কথা নেই। কোথাও গেলেই হল।

কঙ্কাবতী বলল, বেশ তো মজা। আপনার কোনও দিকেই যাবার কথা নেই। আমার বাড়িতে এলেন, কিন্তু বলার কিছু নেই। আজ কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা?

শিশির বললেন, যদি তাই পারতাম। মনে মনে নয়, সত্যিকারের। এক একদিন মনে হয়, ধরাচুড়ো পরে, মুখে রং মেখে, স্টেজে এই যে সঙ সাজি, তার কী প্রয়োজনীয়তা আছে! সব কিছু ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে পড়লেই তো হয়।

কঙ্কাবতী বলল, সবাই যে চতুর্দিকে আপনাকে বাহবা দিচ্ছে, সবাই ধন্য ধন্য করছে, এসব আপনার ভালো লাগে না? এ এক ধরনের নেশা নয়!

শিশির বললেন, হ্যাঁ। ভালোও লাগে, আবার এক-এক সময় তিতিবিরক্তও লাগে। তুমি কী বই পড়ছ? দেখি।

হাত বাড়িয়ে বই দুটি নিলেন।

একখানি ডস্টয়েভ্স্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, অন্যটি বঙ্কিমচন্দ্রের তিনখানি উপন্যাস একত্রে বাঁধানো।

দ্বিতীয়টির পাতা ওলটাতে ওলটাতে শিশির জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কবিতা পড়োনা?

কঙ্কাবতী বলল, কবিতার বই কি লাইব্রেরি থেকে এনে পড়বার? বাড়িতে রাখতে হয়। আমাদের বাড়িতে কবিগুরুর সব বই আছে।

শিশির আপন মনে বলে উঠলেন:

একথা জানিতে তুমি, ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান

কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান।

শুধু তব অন্তরবেদনা

চিরন্তন হয়ে থাক, সম্রাটের ছিল এ সাধনা।

রাজশক্তি বজ্রসুকঠিন

সন্ধ্যারক্তরাগ সম তন্দ্রাতলে হয় তোক লীন,

কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস

নিত্য-উচ্ছ্বসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ …

থেমে গিয়ে শিশির প্রশ্ন করলেন, এটা জানো?

কঙ্কাবতী বলল, হ্যাঁ, জানব না কেন? এই তব মনে ছিল আশ … এটা ‘বলাকার’ কবিতা। ও বইতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে এটা:

হে প্রিয়, আজি এ প্রাতে

নিজ হাতে

কী তোমারে দিব দান?

প্রভাতের গান?

প্রভাত যে ক্লান্ত হয় তপ্ত রবি করে

আপনার বৃন্তটির ’পরে।

অবসন্ন গান

হয় অবসান।

কঙ্কাবতী একটু থামতেই শিশির ধরে ফেললেন,

হে বন্ধু, কী চাও তুমি দিবসের শেষে

মোর দ্বারে এসে?

কী তোমারে দিব আনি?

সন্ধ্যাদীপখানি?

এ দীপের আলো এ যে নিরালা কোণের

স্তব্ধ ভবনের।

তোমার চলার পথে এরে নিতে চাও জনতায়?

এ যে, হায়,

পথের বাতাসে নিবে যায় …

কঙ্কাবতী বিস্ময় কটাক্ষে বলল, আপনি এসবও জানেন? সবার ধারণা, রাজা-বাদশা হিসেবেই আপনাকে মানায়।

শিশির বললেন, রাজা-বাদশাও কখনও কখনও কারও কাছে দীন-ভিখারির মতন হাঁটু গেড়ে বসতে পারে। তুমি এটা জানো:

আমারে যে ডাক দেবে, এ জীবনে তারে বারংবার

ফিরেছি ডাকিয়া।

যে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার

থাকিয়া থাকিয়া।

দীপখানি তুলে ধরে, মুখে চেয়ে, ক্ষণকাল থামি

চিনেছে আমারে।

তারি সেই চাওয়া, সেই চেনার আলোক দিয়ে আমি

চিনি আপনারে।

সহস্রের বন্যাস্রোতে জন্ম হতে মৃত্যুর আঁধারে

চলে যাই ভেসে।

নিজেরে হারায়ে ফেলি অস্পষ্টের প্রচ্ছন্ন পাথারে

কোন্ নিরুদ্দেশে।

নামহীন দীপ্তিহীন তৃপ্তিহীন আত্মবিস্মৃতির

তমসার মাঝে

কোথা হতে অকস্মাৎ কর মোরে খুঁজিয়া বাহির

তাহা বুঝি না যে। …

কঙ্কাবতী বলল, এর পরে আমি একটু বলি?

তব কণ্ঠে মোর নাম যেই শুনি গান গেয়ে উঠি

‘আছি’, ‘আমি আছি।’

সেই আপনার গানে লুপ্তির কুয়াশা ফেলে টুটি

বাঁচি, আমি বাঁচি

তুমি মোরে চাও যবে অব্যক্তের অখ্যাত আবাসে

আলো উঠে জ্বলে …

সব পথের নিয়মই এই, তা একসময় ফুরিয়ে যায়। কখনও কখনও খুব তাড়াতাড়ি।

পূর্ব নির্দেশমতন ড্রাইভার গাড়িটি থামাল ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির সামনে। বিকেল শেষ হয়ে গেছে, তবু এখনও লোক চলাচল যথেষ্ট। এই অঞ্চলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে ইংরেজ পুলিশ।

কঙ্কাবতী বলল, আমি নামি।

শিশির সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়েও বললেন, একদিন লাইব্রেরিতে না গেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

কঙ্কাবতী ঠোঁট টিপে হেসে বলল, মহাভারতের শুদ্ধতা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। নামব না? কোথায় যাব?

শিশির বললেন, আর একটু সামনের দিকে। যতক্ষণ না অন্ধকার নামে।

কঙ্কাবতী বলল, ঠিক আছে। চলুন। আকাশের দিকে দেখুন, মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে। আমি অবশ্য ঝড়কে ভয় পাই না। ঝড়কে নিজের সঙ্গী করে নিতে পারি।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করার পর শিশির বললেন, কোনও কিছু খবর না দিয়ে, না জানিয়ে তোমার বাড়িতে গেলাম, দরজায় করাঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে তুমিই দরজা খুলে দিলে, এমন চমকে উঠেছিলাম, বুক কেঁপে উঠেছিল। আমি অনেক পোড় খাওয়া মানুষ, বয়েসও কম হল না। এখনও যে আমার বুক অমনভাবে কাঁপতে পারে, সেটাও জানা ছিল এ যেন সেই, ‘যে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার’।

কঙ্কাবতী আগেরই মতন হেসে বলল, আমার বিচিত্র বেশ কোথায় দেখলেন? আমিও কি কম অবাক হয়েছি? দরজায় শব্দ শুনে ভেবেছি বুঝি দুধওয়ালা বা কোনও ফেরিওয়ালা। ও মা! ‘দুয়ার খুলে দেখি এ যে স্বয়ং মহারাজ!’

শিশির বললেন, তোমার মুখ দেখে কিছু বোঝা যায়নি।

কঙ্কাবতী বলল, আপনাকে বুঝতে দিইনি। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে পড়েছিল, আমি স্টারের কাছে বাঁধা পড়ে গেছি।

শিশির বললেন, তোমার কাছে মাঝে মাঝে যদি শুধু কথা বলতে আসি? তুমি রাগ করবে? অনেকদিন এমন প্রাণ খুলে কারও সঙ্গে কথা বলিনি।

আমার বাড়িতে বসে তো আপনি কিছুই বললেন না।

হ্যাঁ, সেও বড় আশ্চর্যের। আমাকে অনেকে বাক্যবাগীশ বলে জানে। অন্যদের কথা বলতে দিই না। অথচ তোমার সামনে গিয়ে হঠাৎ যেন বাক্যহারা হয়ে গেলাম।

শুধু কথার চেয়ে কবিতায় অনেক বেশি কিছু বলা যায়।

আজই যেন বুঝলাম, এক একসময় কথারও দরকার হয় না। নীরবতাও অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়।

Only themselves understand themselves

and the like of themselves,

As souls only understand souls.

এটা কার কবিতা?

ওয়ল্ট হুইটমান। ‘লিভ্‌স অফ গ্রাস’।

আমি পড়িনি। শেক্‌সপিয়ার পড়েছি একটু আধটু। ক’দিন আগে শেক্‌সপিয়ার সম্পর্কে একটা খবর পড়ে বেশ মজা লাগল। উনি তো শুধু নাটক লিখতেন না, অভিনয়ও করতেন।

হ্যাঁ, আগে ছিলেন স্টেবল বয়, তারপর ছোটখাটো পার্ট, শেষপর্যন্ত থিয়েটারের মালিক আর প্রধান নাট্যকার।

হ্যামলেটে উনি কোন পার্টটা করতেন বলুন তো?

সেটা ঠিক জানি না।

ভূতের পার্ট। হ্যামলেটের বাবা! শেক্‌সপিয়ার সাজতেন ভূত!

কঙ্কাবতী কুলকুল করে হাসতে লাগল।

গাড়ি এসে থামল গঙ্গার ঘাটে।

গঙ্গার বুকে অসংখ্য নৌকো আর স্টিম বোট। যেন রাজপথের চেয়েও নদীতে যানবাহন বেশি। এই সময় বহু লোকই ওদিক থেকে এদিকে আসে, কিংবা এদিক থেকে ওদিকে যায়। সেতু নেই, ফেরিই সম্বল।

আকাশে কালি বর্ণ মেঘ, তারই ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে শেষ সূর্যের রক্তিম রশ্মি। উড়ে যাচ্ছে বকের পাঁতি।

নদীর ধার ঘেঁষে হাঁটছে সাহেব-মেমেরা। এদের অনেকেই এখানে বৈকালিক ভ্রমণে নিয়মিত আসে, মেয়েরা আসে গাউন পরে সুসজ্জিতা হয়ে, পুরুষদের মাথায় টপ হ্যাট। হাতে হাত ধরে থাকে হাঁটার সময়। যেন টেম্স নদীর পার্শ্বস্থ পথের স্মৃতি ধরে রাখতে চায়।

এখানে নেটিভদের চলাচল নিষেধ। যদিও কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ বলা নেই, তবে ধরেই নেওয়া হয়, নেটিভদের স্থান পোস্তাবাজারের পর থেকে। এই অঞ্চল রাজার জাতের জন্য সংরক্ষিত। এখানে দিশি লোক কেউ এসে পড়লে পাহারাওয়ালা তাকে ধরবে না বটে, কিন্তু সাদা চামড়ার ভ্রমণকারীরা দৃষ্টিতে ঘৃণা ছুড়ে দেবে আর সন্ধের পর একটু অন্ধকার হলেই কেল্লার মাতাল গোরা সৈন্যরা আচমকা মাথায় ডান্ডা মেরে যাবে।

শিশিররা গাড়ি থেকে নামলেন না।

একটু মেঘ সরে গিয়ে সাপের মতন অস্তসূর্যের লকলকে লাল শিখা এসে পড়েছে। নদীর জলে। কঙ্কাবতী আপন মনে বলে উঠল,

হে বিরাট নদী

অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল

অবিচ্ছিন্ন অবিরল

চলে নিরবধি।

শিশির বললেন, এটা আমার মনে নেই। আরও একটু বলো।

কঙ্কাবতী বলতে লাগলেন।

স্পন্দনে শিহরে শূন্য তব রুদ্র কায়াহীন বেগে;

বস্তুহীন প্রবাহের প্রচণ্ড আঘাত লেগে

পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুফেনা উঠে জেগে;

ক্রন্দসী কাঁদিয়া ওঠে বহ্নিভরা মেঘে।

আলোকের তীব্রচ্ছটা বিচ্ছুরিয়া উঠে বর্ণস্রোতে

ধাবমান অন্ধকার হতে,

ঘূর্ণাচক্রে ঘুরে ঘুরে মরে

স্তরে স্তরে

সূর্য চন্দ্র তারা যত

বুদ্বুদের মতো…

শিশির বললেন, কী সুন্দর, নিখুঁত উচ্চারণ। সুরেলা কণ্ঠ। কঙ্কাবতী, তুমি এই শহরে এতদিন ছিলে, মানে রয়েছ, তবু তোমাকে আমি আগে দেখিনি কেন?

কঙ্কাবতী বলল, আমি এত সামান্যা মেয়ে, আপনার চোখে পড়বার মতো নয়।

শিশির এবার আবেগের বশে কঙ্কাবতীর একটি হাত চেপে ধরে বললেন, তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। থিয়েটার হোক বা না হোক, আমরা দু’জনে—

কঙ্কাবতীর শরীরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল থরথর করে। দুই চোখ দিয়ে নেমে এল জলের ধারা।

শিশির দারুণ অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, এ কী, আমি কি অসমীচীন কাজ করে ফেলেছি? তোমাকে স্পর্শ করে… তুমি মনে আঘাত পেয়েছ?

কঙ্কাবতী নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল।

শিশির অনুতপ্ত কণ্ঠে বললেন, আমি তোমাকে অসম্মান করতে চাইনি, আমাকে ক্ষমা করো, আমি কিছুই না ভেবে…

কঙ্কাবতী এবার ধরা গলায় বলল, আপনি জানেন না, আপনি আমার মতন কত মেয়ের বাচ্চা বয়েস থেকে হিরো? আমার মনে আছে, অনেক বছর আগে, তখন আমার বেশ কম বয়েস, ইডেনের বাগানে একটা বিরাট মেলা হয়েছিল, আপনি সেখানে মঞ্চ বেঁধে ‘সীতা’ থিয়েটার করেছিলেন। আমি দেখতে গিয়েছিলাম বাবার হাত ধরে। আপনি হয়েছিলেন রাম। সে কী বিস্ময়! আমার মনে হয়েছিল, আপনি মানুষ নন, আকাশের দেবতা। তারপর কতদিন মনে মনে আপনাকে পুজো করেছি। চোখের জল ফেলতে ফেলতে ভেবেছি, কোনওদিন কি সেই দেবতার একটু কাছে যেতে পারব? একটা কথা বলে ধন্য করতে পারব জীবন! সেই আপনি, এত কাছে বসে আছেন, আমাকে স্পর্শ করলেন, এ কি স্বপ্ন, না সত্য? এমন সৌভাগ্য কি আমার প্রাপ্য ছিল?

শিশির শুকনো গলায় বললেন, আমি দেবতা নই। আমি দোষে-গুণে ভরা মানুষ। আমার কামনা-বাসনা আছে। তবে একটা অতি সত্য কথা বলছি, শপথ করেও বলতে পারি, তোমার মতন আর কোনও নারীকে দেখে আমি এমন দুর্বল হয়ে পড়িনি। এর মধ্যে লোভ নেই, কিছু এমন একটা তীব্র আকর্ষণ, তার কারণ আমি নিজেই জানি না। এতক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলে আমি যে নির্মল আনন্দ পেয়েছি, তা আগে আর কোনও নারী আমাকে দিতে পারেনি।

চোখের জল মুছে কঙ্কাবতী নতমুখে বসে রইল।

শিশির আবার বললেন, সত্যি, তোমাকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। কঙ্কাবতী, যদি তোমাকে আজই আমি জোর করে ধরে নিয়ে যাই?

কঙ্কাবতী বলল, কোথায় নিয়ে যাবেন? কোথায় স্থান দেবেন আমাকে?

শিশির বললেন, কবিত্ব করে বলা যায়, তোমাকে স্থান দেব আমার হৃদয়ে। কিন্তু সেটা আমার মুখে মানাবে না। আমি আসলে তো গদ্যময় মানুষ। তুমি থাকবে আমার পাশে পাশে, আমার জীবনসঙ্গিনী হয়ে।

কঙ্কাবতী বললেন, যদি ওরা আমায় কেড়ে নিতে আসে?

শিশির বললেন, পারবে না। কোনও শক্তি তোমাকে কেড়ে নিতে পারবে না। আমি তোমাকে আগলে আগলে রাখব ভালবাসা দিয়ে। সারাজীবন।

কঙ্কাবতী বলল, যদি আমি পুরনো হয়ে যাই?

শিশির বললেন, তুমি পুরনো হবে না, বরং আমিই তোমার কাছে পুরনো হয়ে যেতে পারি। আমার বয়েস অনেক বেশি। আমার মাথার চুল বেশি দিন থাকবে না, আমার চামড়া…সত্যি সত্যি আমি এখনই তোমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাব না, তুমি ভেবে দেখো, যদি মনে হয়

এবার কঙ্কাবতী নিজেই একটু ঝুঁকে, একটা হাত বাড়িয়ে শিশিরের বুকের ওপর রাখল।

তারপরই ঝড় উঠল বাইরে। তুমুল রবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *