১০. ভারতনারী

দশ – ভারতনারী

সারা কলকাতা গুজবে ম ম করছে যে স্টারের আর্ট থিয়েটার দলের এক নতুন অভিনেত্রীকে লুঠ করে নিয়ে গেছে নাট্যমন্দির। সেই যে সেবারে স্টার শিশির ভাদুড়ীর কাছ থেকে সীতা হরণ করেছিল, এবার শিশির ভাদুড়ী তার প্রতিশোধ নিল। তবে, এবারে আর নাটক নয়, জলজ্যান্ত এক মেয়ে, সে একেবারে রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। বি এ পাস!

গুজব ক্রমশ বিস্তৃত হতে হতে মাত্ৰাজ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

সেই তরুণী যেন এক অন্ধকার চোর-কুঠুরিতে বন্দিনী, কাকপক্ষীও তার মুখ দেখতে পায় না। পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজেও হদিশ পায়নি তার। কেঁদে কেঁদে এর মধ্যে আধখানা হয়ে গেছে তার শরীর ইত্যাদি।

আসল ঘটনা এই, শিশিরকুমারের সঙ্গে যেদিন গঙ্গার ঘাটে দু’জনের আবেগ এক বিন্দুতে মিশেছিল, তার পরেও কয়েকবার কঙ্কাবতীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে। হঠাৎ একদিন কঙ্কাবতী স্বয়মাগতা হয়ে উপস্থিত হল কর্নওয়ালিশ থিয়েটারে শিশিরকুমারের নিজস্ব কক্ষে। তার এক হাতে একটি জামাকাপড়ের ব্যাগ, অন্য হাতে একটা খাঁচা, তার মধ্যে একটা ময়না পাখি।

খবর পাওয়ামাত্র স্টার উঠেপড়ে লেগেছিল। প্রথমে পুলিশ কেস, নারী হরণের অভিযোগ। তাতে কিছু সুবিধে হল না, পুলিশ আসার পর কঙ্কাবতী পরিষ্কার জানিয়ে দিল, আমার বয়েস তেইশ বছর, আমি স্বাবলম্বী, আমার কোনও অভিভাবক নেই, আমি এখানে স্বেচ্ছায় এসেছি, কেউ আমার ওপর জোর করেনি। আমার ব্যাপারে নাক গলানোর কোনও অধিকার পুলিশের নেই।

তারপর আদালতে চুক্তিভঙ্গের মামলা।

প্রতিদিন সেই মামলার শুনানিই চাঞ্চল্যকর সংবাদ। রঙ্গমঞ্চ ছাড়া এ শহরে প্রমোদ উপকরণ আর বিশেষ কিছু নেই। তাই নতুন নতুন নাটক ও নট-নটীদের নতুন নতুন খবরই মুখরোচক আলোচ্য বিষয়। বায়োস্কোপ নামে মানুষের নড়াচড়া ছবিও চালু হয়েছে কয়েক বছর ধরে, এখন তাতে কাহিনীও থাকে, কিন্তু নির্বাক। মানুষগুলোকে মনে হয় পুতুলের মতন, তাই এখনও তা বেশি দর্শক টানে না।

দুই পক্ষেই জবরদস্ত উকিল লাগানো হয়েছে, তবু মামলায় নাট্যমন্দিরের হার হল।

স্টারের আর্ট থিয়েটারের চুক্তি একেবারে অকাট্য। তিন বছরের জন্য কঙ্কাবতীকে একেবারে বেঁধে ফেলা হয়েছে। সাহেব বিচারপতি রায় দিলেন, এই চুক্তি অনুযায়ী কঙ্কাবতী নামে অভিনেত্রীকে শুধু স্টারেই অভিনয় করতে হবে, নাট্যমন্দির বা অন্য আর কোনও দলেই তিনি যোগদান করতে পারবেন না। তবে, স্টারেও তাঁকে দিয়ে জোর করে অভিনয় করানো যাবে না, কারণ অভিনয় একটা শিল্প, কোনও অনিচ্ছুক মানুষকে দিয়ে শিল্পসৃষ্টি সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে কঙ্কাবতী এই তিন বছর চুপ করে বসে থাকতে পারেন, কিন্তু অন্য কোনও দলে যোগদানের অধিকার তাঁর থাকবে না। আর তাঁর বাসস্থান সম্পর্কেও কোনও নির্দেশ জারি করা হবে না, তিনি তাঁর যথা ইচ্ছা, তথায় থাকতে পারেন।

শেষ দিন দু’পক্ষের সমর্থকরাই সমবেত হয়েছে আদালত প্রাঙ্গণে, রায় শুনে স্টারের দল উল্লাসে জয়ধ্বনি করতে লাগল। নাট্যমন্দিরের দলের মুখ চুন। এ মামলায় স্টারের বিশেষ কিছু লাভ হল না বটে, কিন্তু শিশির সম্প্রদায়ের তো দর্পচূর্ণ হল! বিচারপতি স্বয়ং শিশিরকুমারকে আইনভঙ্গ না করার জন্য সাবধানবাণী শুনিয়েছেন।

গর্বিত মুখে বেরিয়ে আসছেন স্টারের ম্যানেজার প্রবোধচন্দ্র গুহ, শান্তিপুরী কোঁচানো ধুতি ও সিল্কের বেনিয়ান পরা, পায়ে মোজা ও পাম্পশু, হাতে ছড়ি। জুতো মশমশিয়ে আসতে আসতে তিনি দেখলেন বাইরের প্রাঙ্গণে একটি গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছেন শিশিরকুমার, তাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই শিশিরকুমার মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

প্রবোধচন্দ্র শিশিরকুমারের চেয়ে বয়েসে কিছুটা বড়। তিনি সহাস্যে বললেন, আরে। শিশিরবাবু, শোনো, শোনো, আমাদের থিয়েটার লাইনে আকছা-আকছি, রেষারেষি তো লেগেই আছে, দল ভাঙাভাঙিও তো চলছেই সবসময়। যে খেলার যে নিয়ম, তা নিয়ে রাগারাগি করতে আছে? তুমি কত বড় অভিনেতা, আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে শ্রদ্ধা করি। আমার কাছে ভাল চুরুট আছে, একটা নেবে নাকি?

শিশিরকুমার বললেন, আপনি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে এসেছেন?

মুখের হাসিটা বিস্তৃত করে প্রবোধচন্দ্র বললেন, আরে না, না। তুমি তো হারবেই আমি জানতাম। এরপর তুমি কী করবে? যদি বলতে আপত্তি না থাকে।

শিশিরকুমার বললেন, কোনও আপত্তি নেই। আপিল করব।

আপিলেও যদি হারো?

হাইকোর্টে যাব। সেখানেও হারলে সুপ্রিম কোর্টে।

সে তো অনেকদিন লাগবে। কতদিন চালাবে?

যতদিন না ওই মেয়েটি বুড়ি থুথ্থুড়ি হয়ে যায়।

জলের মতন পয়সা খরচ হবে।

তা হোক। এ জন্য আমি সর্বস্বান্ত হতেও রাজি আছি।

তা তুমি পারো, শিশিরবাবু, তুমি বড় মাপের মানুষ, রেকলেস, জীবন নিয়ে তুমি ছিনিমিনি খেলতে পারো। কিন্তু আমরা ছাপোষা সংসারী লোক, আমরা জেদের বশে কিছু করতে পারি না। সবসময় দেখতে হয় আখেরে কিছু লাভ হবে কিনা?

জেব থেকে একটা চামড়ার কেস বার করে তার থেকে একটা হাভানা চুরুট বার করে জোর করেই সেটা দিলেন শিশিরকুমারের হাতে।

তারপর বললেন, আমি মেয়েটাকে ছেড়ে দিচ্ছি, তুমি নাও!

শিশিরকুমারের ভুরু কুঁচকে গেল।

প্রবোধচন্দ্র বললেন, আমরা আর মামলা চালাব না। এর মধ্যেই অনেক পয়সা গলে গেছে। তা ছাড়া মেয়েটা অভিনয় করতে পারবে কিনা, তাও তো জানি না। একটু বেশি লম্বা, সব হিরোদের সঙ্গে মানাবে না। দেখো, তুমি কতদূর কী করতে পারো। তুমি বরং আমাদের কিছু টাকা দিয়ে দাও। খুব বেশি না, হাজার তিনেক।

শিশিরকুমার বললেন, এ কি গোরু-হাটার মতন মেয়ে কেনাবেচা হচ্ছে নাকি? টাকা দিয়ে ওকে কিনতে হবে?

জিভ কেটে প্রবোধচন্দ্র বললেন, আরে ছি ছি, ওভাবে নিচ্ছ কেন? ক্ষতিপূরণ। আমাদের তো এর মধ্যেই অনেক খরচা হয়ে গেছে!

শিশিরকুমার বললেন, আপনারা যখন কারচুপি করে ‘সীতা’র রাইট নিয়ে নিয়েছিলেন তখন সেটটেটের জন্য আমিও তো অনেক খরচা করে ফেলেছিলাম, তখন ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন?

প্রবোধচন্দ্র বললেন, সেসব সেট তোমার পরে কাজে লেগে গিয়েছিল। সীতাই তো তোমার এখন লক্ষ্মী। যতবার রিপিট শো হয়, ততবার হাউজ ফুল! ভায়া, তোমার জনপ্রিয়তা দেখলে আমার হিংসে হয় ঠিকই, আবার বাংলায় থিয়েটারকে তুমি এতখানি জাতে তুলেছ বলে তোমার সম্পর্কে গর্বও বোধ করি।

এতক্ষণে শিশির একটু নরম হয়ে বললেন, থ্যাঙ্কস!

প্রবোধচন্দ্র শিশিরকুমারের কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, শুধু থিয়েটারের জন্য নয়, ও মেয়েটিকে যে তুমি অন্য জায়গায় আসন দিয়েছ, তা কি আমি জানি না? তাতে ব্যাগড়া দিয়ে কি আমি মহাপাতকী হব? সি ইজ ইয়োরস। নো হার্ড ফিলিংস!

মামলার রায় সবাই জানে, প্রবোধচন্দ্র এইমাত্র শিশিরকুমারকে যা বললেন, তা কেউ এখনও জানে না, শিশিরকুমার জানাতে চাইলেনও না। সোজা চলে এলেন বাড়িতে।

থিয়েটার হলের কাছেই একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন, সেখানে নতুন সংসার পেতেছেন কঙ্কাবতী।

শিশির ফিরে এসে দেখলেন, পোষা ময়নাকে ছোলা খাওয়াচ্ছে কঙ্কাবতী। রঙ্গ করার জন্য মুখে বিমর্ষভাব এনে বললেন, কঙ্কা, খবর শুনেছ তো? আমরা গো-হারান হেরে গেছি!

কঙ্কাবতী মুখ তুলে বলল, একটু আগে বিশু এসেছিল। সব শুনেছি আমি। আমরা মোটেই হারিনি৷

শিশির বললেন, হারিনি মানে? জজ সাহেব আদেশ দিয়েছেন, তিন বছরের মধ্যে তুমি কোনওক্রমেই নাট্যমন্দিরে যোগ দিতে পারবে না।

কঙ্কাবতী উজ্জ্বল মুখে বলল, আপনার কাছ থেকে সরিয়ে নেবার তো আদেশ দেননি। আমাকে আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আপনিই তো বলেছিলেন! অভিনয় করা না হয় নাই বা হল! আপনাকে পেয়েছি, তাই আমার যথেষ্ট।

শিশির বললেন, তুমি আমারই থাকবে। তোমাকে আমি গড়ে তুলব নাট্য জগতের সম্রাজ্ঞী।

ময়নাটি অবিকল মানুষের মতন গলায় ডেকে উঠল, কে এল গো? কে এল?

শিশির হেসে বললেন, ওটা যখন তখন এটাই বলে কেন? ওকে তুমি কৃষ্ণনাম শেখাওনি!

কঙ্কাবতী বললেন, ওকে যা শেখাতে চাওয়া হবে, তা কিছুতেই শিখবে না। হতচ্ছাড়ি মুখপুড়িটা এটা যে কী করে শিখল!

শিশির খাঁচাটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বললেন, ও ময়না, বল তো, এসেছে ভারতনারী! ভারতনারী!

একে তো গ্র্যাজুয়েট, তার ওপরে মঞ্চে এক লাইনও পার্ট বলার আগেই একজন ভাবী অভিনেত্রীকে নিয়ে খবরের কাগজে এত লেখালেখি, এত গুজব ও গুঞ্জন আগে কখনও ঘটেনি। কঙ্কাবতী সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। এই কৌতূহল ও ঔৎসুক্য বজায় থাকতে থাকতেই কঙ্কাবতীর মঞ্চাবতরণ সম্ভব করতে হবে।

নাট্যমন্দিরে এ সময় খুব বড় আকারে ও সাড়ম্বরে ‘দিগ্বিজয়ী’ নাটকের প্রস্তুতি চলছে। যোগেশচন্দ্র চৌধুরী রচিত ঐতিহাসিক নাটকটির চরিত্রগুলি যেমন গাঢ় রঙে আঁকা, তেমনি কাহিনীও জমজমাট। রিহার্সাল দেখেই বোঝা গেছে, নাদির শাহের ভূমিকায় শিশিরকুমারের শিরোভূষণে আর একটি গৌরবের পালক যুক্ত হবে।

কিন্তু এই নাটকে কঙ্কাবতীর স্থান কোথায়?

প্রধান দুই নারীচরিত্র সিরাজি বেগম আর সুলতানা বেগমের ভূমিকায় যথাক্রমে রয়েছে চারুশীলা আর হরিসুন্দরী ব্ল্যাকি। এদের সরাবার প্রশ্ন ওঠে না। বিশেষত ষোড়শীতে অনবদ্য অভিনয় করার জন্য চারুশীলার খুবই সুনাম হয়েছে। প্রভার পরেই চারুশীলা এখন নাট্যমন্দিরের অ্যাসেট। প্রভা মাঝে মাঝেই অসুস্থ থাকে। আর হরিসুন্দরী ব্ল্যাকি পুরনো আমলের অভিনেত্রী, যে-কোনও ভূমিকায় জমিয়ে দিতে পারে।

থিয়েটারের মেয়েরা সবাই প্রথমে সখীর দলে সংলাপহীন ভূমিকা দিয়ে শুরু করে, তারপর আস্তে আস্তে, গুণপনা দেখিয়ে বড় পার্ট পায়। বাইরে থেকে প্রথমেই এসে নায়িকা হওয়া প্রায় অসম্ভব ঘটনা। অন্য মেয়েরা তা সহ্য করবে কেন? ভদ্রঘরের বিদূষী মেয়ে, তার সঙ্গে অন্য অভিনেত্রীরা সহজভাবে মিশতেও চায় না। আবার বড়বাবুর পেয়ারের মেয়ে বলে তার সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করতেও সাহস পায় না।

অনেক ভেবেচিন্তে শিশিরকুমার অন্যদের অদলবদল না করে একটি নতুন চরিত্র ঢুকিয়ে দিলেন। যোগেশ চৌধুরীর প্রায় সব নাটকই শিশিরকুমারের অর্ধেক রচনা। কোথাও নিজের নাম দেন না। কিন্তু দৃশ্য বিভাজন, অনেক সংলাপ পর্যন্ত তৈরি করে দেন। এই নারীচরিত্রটির নাম ভারতনারী। নাটকের বাকি সব চরিত্রই মুসলমান, শুধু এর কোনও নাম নেই। এই নারী যেন ভারতের আত্মা। সে গান গেয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। শিশিরকুমার এর কণ্ঠে দিলেন রবীন্দ্রনাথের গান।

যথারীতি কঙ্কাবতীর নামও বিজ্ঞাপনে জুড়ে দেওয়া হল। খুব আঁকজমকের সঙ্গে উদ্বোধন হল দিগ্বিজয়ী নাট্য অনুষ্ঠান। সব টিকিট আগেই শেষ।

কয়েকটি দৃশ্যের পর, ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’ গাইতে গাইতে জীবনে প্রথম মঞ্চে প্রবেশ করল কঙ্কাবতী। গানখানি শেষ হবার পরই প্রবল করতালিতে ফেটে পড়ল প্রেক্ষাগৃহ। কঙ্কাবতী অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেল।

এ নাটকে শিশিরকুমার এমন প্রবল প্রতাপের সঙ্গে অভিনয় করলেন যে তাঁর পাশে অন্য কেউ দাঁড়াতেই পারল না। নাদির শাহ-রূপী শিশিরকুমার যেন ছাড়িয়ে গেলেন তাঁরই আগেকার কৃতিত্ব। তবু এর মধ্যেই দর্শকদের মনে ছাপ রেখে গেলেন কঙ্কাবতী।

অল্প বয়সে শিশিরকুমার যেমন দেখতে যেতেন গিরিশ ঘোষের অভিনয়, তেমনই তাঁর এই নাটকের দর্শকদের মধ্যে একাধিক দিন বসেছিল একটি পনেরো-ষোলো বছরের কিশোর। তার নাম শম্ভু মিত্র, মুগ্ধ বিস্ময়ে সে দেখছিল নাদির শাহের বীরত্বপূর্ণ পদচারণা, শুনছিল অসাধারণ কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামা।

এগারো – আবার রবীন্দ্রনাথ

পরপর কয়েকটি নাটকের সাফল্যের পর নাট্যমন্দিরের তহবিলে বেশ কিছু অর্থ জমেছে। এমন সচরাচর ঘটে না।

এর মধ্যে নতুন রূপ দেওয়া গীতিনাট্য বসন্তলীলায় আবার গান গেয়ে মাতিয়েছে কঙ্কাবতী। তারপর বিসর্জন, বুদ্ধদেব চরিত, শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজের নাট্যরূপ রমা ইত্যাদিতে সে অভিনয়ও করেছে ভালো। শুধু বিসর্জনে জেদের বশে কঙ্কাবতীকে ভুল ভূমিকা দিয়েছিলেন শিশিরকুমার, তার জন্য সমালোচকদের তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে।

বসন্তলীলায় কঙ্কাবতী সেজেছিল কৃষ্ণ, সংলাপ নেই। সবই গান, তাই মানিয়ে গিয়েছিল। বিসর্জনে কঙ্কাবতীকে দেওয়া হল জয়সিংহের ভূমিকা। আগেকার দিনে নারী চরিত্রে পুরুষরা অভিনয় করত। তা বলে পুরুষের ভূমিকায় নারী? দর্শকরা সহ্য করল না।

কঙ্কাবতী এ অপবাদ ঘুচিয়ে দিল অন্য নাটকগুলিতে। নতুন নাটকের মাঝে মাঝেই পরীক্ষিত সফল কয়েকটি পুরনো নাটকেরও শো হয়, যেমন সীতা, আলমগীর, প্রফুল্ল, সধবার একাদশী। সেসব নাটকের আগেকার খ্যাতিময়ী যে নায়িকা যখন অনুপস্থিত থাকে, কঙ্কাবতী সেসব ভূমিকায় কাজ চালিয়ে দেয়। শিশিরকুমারের নির্দেশে প্রচুর খাটতে হয় তাকে, সব নাটক তার মুখস্থ। প্রভা কিংবা চারুশীলা মাঝে মাঝে কঙ্কাবতীকে প্যাঁচে ফেলার জন্য পুরনো নাটকের নাম ঘোষিত হবার পরেও ইচ্ছে করে অসুস্থতার ভান করে অনুপস্থিত থাকে।

ক্রুদ্ধ শিশিরকুমার তখন কঙ্কাবতীকে ডেকে বলেন, তুমি সীতার ভূমিকায় আজ নামতে পারবে?

কঙ্কাবতী সঙ্গে সঙ্গে রাজি। যে-সীতার সঙ্গে প্রভার নাম অঙ্গাঙ্গী জড়িত, সেই সীতা রূপেও কঙ্কাবতী দর্শকদের কাছ থেকে বাহবা আদায় করে নেয়। শিশিরকুমারের জন্য সে সব কিছু করতে পারে।

অবস্থা কিছুটা সচ্ছল হয়েছে বলে শিশিরকুমার ঠিক করলেন, এবার আর একটি রবীন্দ্র নাটক মঞ্চস্থ করবেন। তপতী।

তপতী? বন্ধুবান্ধবদের ভুরু কপালে উঠে গেল। সে যে অতি কঠিন নাটক, বাংলার দর্শক ও নাটক বুঝবে না।

শিশিরকুমার বললেন, কেন, কবিগুরু নিজেই তো কিছুদিন আগে ‘তপতী’ মঞ্চস্থ করলেন? তার পর থেকেই আমার ইচ্ছে, আমি এ নাটকের অন্যরকম একটা ইন্টারপ্রিটেশন দেব!

সৌরীন্দ্রমোহন বললেন, কবিগুরু তো নাটক করলেন জোড়াসাঁকোয় নিজেদের বাড়িতে। টিকিট ফিকিট কিছু ছিল না। বাছা বাছা লোকদের নেমন্তন্ন করেছিলেন, সেখানে জমবে না কেন?

হেমেন্দ্রকুমার বললেন, গ্যালারি না ভরলে থিয়েটার চলে না। সেই গ্যালারির দর্শক তপতীর কী মর্ম বুঝবে? যারা তোমার কাছ থেকে ফ্রি পাস পায়, তারাই শুধু আসবে।

অলীক বলল, স্টারে ‘মন্ত্রশক্তি’ খুব জমিয়েছে। কথায় কথায় দর্শক একেবারে কেঁদে ভাসায়। ওদের সঙ্গে কমপিটিশান করতে হলে এখন একটা সেন্টিমেন্টাল নাটক নামানো দরকার।

শিশিরকুমার রেগে উঠে বললেন, ব্যবসা করতে নেমেছি ঠিকই, তা বলে নিছক গতানুগতিক ভাবে গ্যালারি মাতানো, তা আমি পারব না! ভালো নাটক করার জন্যই তো এসেছিলাম এ লাইনে। এক একটা নাটক জমে বটে, পয়সাও আসে, আমার মন কিন্তু সায় দেয় না। এই যে শরৎদার পল্লীসমাজের রমা, ওটা আবার নাটক নাকি? পয়সার জন্য রামের পার্টে এখনও গলা ফাটানো, এক এক সময় অসহ্য মনে হয়। তপতী আমি নামাবই, তাতে লোকসান যায় যাক! দর্শক নেবে না মানে কী, দর্শক তৈরি করতে হবে। আমরা চেষ্টা না করলে আর কে করবে? স্টার?

হেমেন্দ্রকুমার বললেন, শিশির, নাট্যমন্দির এখন লিমিটেড কোম্পানি। এরকম গ্যামব্‌ল করতে গেলে তোমার অন্য পার্টনাররা আপত্তি জানাতে পারে।

শিশিরকুমার বললেন, নাটকের সিলেকশনের ব্যাপারে আমার পার্টনাররা কোনও কথা বলতে পারবে না, এটা আমি আগেই শর্ত করে নিয়েছি।

বাড়ি এসে তিনি কঙ্কাবতীকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তপতী পড়েছ?

কঙ্কাবতী বলল, হ্যাঁ, ওটাই তো আগে ছিল রাজা ও রানি। সেদিন ঠাকুরবাড়িতেও দেখতে গেলাম।

শিশির বললেন, ওই তপতী আমরা করতে পারি না?

উৎসাহে প্রায় নেচে উঠে কঙ্কাবতী বলল, হ্যাঁ, করুন, করুন। আমি বেশ বিপাশার রোলটা করব।

শিশির বললেন, হ্যাঁ, বিপাশাই তোমাকে মানাবে। রানী সুমিত্রার পার্ট অনেক বড়, নাটকীয়তা আছে। কিন্তু তার তো গান নেই। সেটা প্রভা চালিয়ে নেবে। বিপাশার অনেকগুলো গান।

কঙ্কাবতী বলল, কবিগুরু নিজে রাজা বিক্রম করেছিলেন, অনেক বয়েস হয়ে গেছে, বেশি মুভমেন্ট ছিল না।

শিশির বললেন, তবু তো এই বয়েসেও পেরে যাচ্ছেন। সেদিন আমি কবিগুরুকে বললাম, এবার আপনি একবার ‘রক্তকরবী’ করুন। উনি বললেন, ওটা আর পারব না হে। ওটা তো রক্তকরবী নয়, শক্তকরবী। তুমি পারলে পারতে পারো। তুমি করো। তোমাকে আমি রাইট দিলাম। সত্যি, আমার ইচ্ছে আছে, তপতীতে যদি সাকসেসফুল হই, তা হলে পরে রক্তকরবী নামাব।

কঙ্কাবতী বলল, ‘মুক্তধারাও’ কেউ করেনি।

শিশির বললেন, তুমি বিপাশার গানগুলো তুলতে শুরু করো। দিনুবাবু কিংবা শান্তিনিকেতনের কারওকে ডাকব গান শেখাতে!

কঙ্কাবতী বলল, দু’খানা গান তো আমি আগেই জানি।

শিশির ব্যগ্রভাবে বললেন, গাও তো, একখানা শোনাও তো, মুডটা তৈরি করি।

কঙ্কাবতী বলল, শোনাব? এখানে নয়, বরং ছাদে চলুন।

বারান্দার খাঁচায় ময়নাটা চেঁচিয়ে উঠল, কে এল গো? কে এল?

শিশির বললেন, কী রে, এখনও চিনলি না আমাকে?

কঙ্কাবতী বলল, বল মুখপুড়ি, এসো, এসো, প্রাণসখা।

পাশেই একটি ইস্কুলবাড়ি, সেটি এখন অন্ধকার। পথের উলটোদিকে মিত্তিরদের বিরাট উদ্যান ও প্রাসাদ, সেই উদ্যানে ফোয়ারার চার পাশে চাপা আলো। এত বড় প্রাসাদে মানুষজন বড়ই কম।

আকাশে আজ পূর্ণশশী।

মিত্তিরদের বাগান থেকে ভেসে আসছে বকুল ফুলের মৃদু গন্ধ। একজন ফেরিওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে, মালাই বরফ! মালাই বরফ।

পাঁচিলে হেলান দিয়ে কঙ্কাবতী গাইতে লাগল।

তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর, পূর্ণ করো—

ওই-যে দেখি বসুন্ধরা কাঁপল থরোথরো ৷।

বাজল তূর্য আকাশপথে—সূর্য আসেন অগ্নিরথে,

এই প্রভাতে দখিন হাতে বিজয়ড়্গ ধরো।…

গানটি শেষ হবার পর শিশির বললেন, দাঁড়াও, গেলাস আর বোতল আনাই। বাকিটাও শুনব।

কঙ্কাবতী বলল, আজ আবার খাবেন? কালও তো খেয়েছেন।

শিশির হেসে বললেন, কাল খেয়েছি বলে আজ খাব না? কাল তো ভাতও খেয়েছি, জল খেয়েছি, চুরুট খেয়েছি। তাও তো তোমাকে পাবার পর থেকে কত কম খাচ্ছি। একদিনও পাগলামি করিনি। বন্ধুরা ঠাট্টা করে, ওরা বলে, শিশির, ওই মেয়েটা জাদু করে তোকে ভেড়া বানিয়ে দিয়েছে। নইলে শিশির ভাদুড়ী কিনা রাত ন’টা বাজতে না বাজতেই বাড়ির দিকে দৌড়োয়!

কঙ্কাবতী বলল, ওরা কেন বাড়ি যায় না?

শিশির কঙ্কাবতীর থুতনি ধরে বললেন, ওদের বাড়িতে তো এমন রূপসি সংগীতপটিয়সী কেউ নেই!

তিনি সিঁড়ির কাছে গিয়ে হাঁক দিতেই ভিখা বোতল, গেলাস, জল দিয়ে গেল।

গেলাসে হুইস্কি ঢেলে এক চুমুক দেবার পর শিশির বললেন, তুমি তো এসব একবারও চেখে দেখলে না। থিয়েটারের অন্য মেয়েরা অনেকেই খায়। আর বিড়ি সিগারেট ফোঁকে তো সব ক’টাই। ওটা আমার খারাপ লাগে। বকে বকেও ওই অভ্যেসটা ছাড়াতে পারি না। বাইরের লোক দেখে ফেললে কী ভাবে বলো তো! নাটকের রানি উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে!

কঙ্কাবতী মাথাটা দুলিয়ে দুলিয়ে বলল, এই যে জ্যোৎস্না আমার গায়ে-মাথায় লাগছে, আমার আর কিছু লাগে না। এতেই নেশা হয়।

শিশির বললেন, এবার অন্য গানটা ধরো

কঙ্কাবতী গাইল:

জাগো জাগো অলসশয়নবিলগ্ন।

জাগো জাগো তামসগহননিমগ্ন ॥

ধৌত করুক করুণারুণবৃষ্টি সুপ্তিজড়িত যত আবিল দৃষ্টি,

জাগো জাগো দুঃখভারনত উদ্যমভগ্ন ॥

জ্যোতিঃসম্পদ ভরি দিক চিত্ত ধনপ্রলোভননাশন বিত্ত,

জাগো জাগো, পুণ্যবসন পর লজ্জিত নগ্ন ॥

শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে রইলেন শিশির। একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আপন মনে বললেন, অলসশয়নবিলগ্ন। কী অপূর্ব ভাষা!

গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার বললেন, শোনো কঙ্কা, অলসশয়নবিলগ্ন কিন্তু এক কথা। অলস শয়ন বিলগ্ন নয়, কেটে কেটে বললে মানে বদলে যাবে। সেই রকমই তামসগহননিমগ্ন। লাইন দুটো আর একবার গাও তো!

সেই শুরু হল শিক্ষা।

কঙ্কাবতীর জন্য ততটা প্রয়োজন হল না, কিন্তু অন্য কুশীলবদের প্রত্যেকটি বাক্য ধরে ধরে শেখাতে লাগলেন। যোগেশচন্দ্র বা ক্ষীরোদপ্রসাদের ভাষা আর রবীন্দ্রনাথের ভাষার তফাত কোথায়, তা বুঝিয়ে, উচ্চারণ করাতে লাগলেন বারবার। শব্দগুলিতে ঝংকার থাকবে, কিন্তু সুর করে টেনে টেনে বলা চলবে না, বেশি হাত-পা নাড়া বন্ধ।

এ নাটকের মহড়ায় অসুরের মতন খাটতে লাগলেন শিশিরকুমার। আপাতত অন্য সব কিছু স্থগিত, সবাইকে এক মনে প্রস্তুত হতে হবে তপতীর জন্য।

সেটের জন্য পশ্চাৎপটে রাজবাটি কিংবা মন্দিরের ছবি আঁকাটাকা বাদ। প্রথমে ভেবেছিলেন শুধু সাদা স্ক্রিন রাখবেন। তারপর তিনি নিজে মহড়ার সময় অডিটোরিয়ামে বসে দেখলেন, বড় নেড়া দেখাচ্ছে। তখন এক শিল্পীকে দিয়ে বড় একটা কোনারকের সূর্যমূর্তি আঁকিয়ে নিলেন, রাজশক্তির প্রতীক হিসেবে। পোশাকেরও আমূল পরিবর্তন হল। রাজা, রানি, সেনাপতি মানেই কতকগুলো বাঁধাধরা ঝকমকে পোশাক থাকে, সে সবই বাতিল। বিভিন্ন ধরনের কাপড় কিনে এনে দর্জি ডাকিয়ে প্রত্যেকের মাপ নিয়ে তৈরি হল পোশাক। এ নাটকের রানি যেহেতু প্রতিবাদিনী, তাই তার অঙ্গে থাকবে না কোনও অলংকার। শেষ দৃশ্যে আগুন জ্বলবে, তা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলারও চেষ্টার ত্রুটি নেই।

যেমন প্রচুর পরিশ্রম, তেমন প্রচুর অর্থ ব্যয় করলেন শিশিরকুমার। নাট্যমন্দিরের অন্য কয়েকজন নাম কা ওয়াস্তে পার্টনার শেষ পর্যন্ত বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল পদে পদে, শিশিরকুমার গ্রাহ্য করেননি। অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কেউই শিশিরকুমারের উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের বারবার সংশোধন করে নিতে কসুর করেননি।

বড় করে কয়েকটি বিজ্ঞাপন দিয়ে উদ্বোধন হল তপতীর মঞ্চাভিনয়।

প্রথম রজনীতে অবশ্য অর্ধেকেরও বেশি দর্শক আমন্ত্রিত। তাঁরা সবাই গণ্যমান্য ব্যক্তি। গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ সমেত একটা বড় দল এলেন ঠাকুরবাড়ি থেকে। শান্তিনিকেতন থেকেও এলেন অনেকে, এবং ভারতী ও কল্লোল গোষ্ঠীর প্রায় সকলে। রবীন্দ্রনাথ এখন বিদেশে।

মঙ্গলশঙ্খধ্বনির পর উত্তোলিত হল যবনিকা। প্রথমেই দর্শকদের মধ্যে একটা বিস্ময়ধ্বনি শোনা গেল। এমন রুচিশীল মঞ্চসজ্জা পেশাদারি থিয়েটারে আগে কেউ কখনও দেখেনি।

ইংরেজি কেতায় এইসব থিয়েটারের সার্থকতার নিদর্শন হচ্ছে ক্ল্যাপ, হাততালি। ঘনঘন হাততালিতেই বোঝা গেল, এ নাটক জমে গেছে, এর আর মার নেই। যারা রাজা বিক্রমের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন, তাঁরাও শিশিরকুমারকে দেখে মনে মনে অনুভব করলেন, এই বিক্রম একেবারে স্বতন্ত্র। কঙ্কাবতীর প্রতিটি গানে অ্যাপ্লজ। এই তো খাঁটি রবীন্দ্র-গান। মর্মস্পর্শী অভিনয়ের জন্য শ্রীমতী প্রভাও হাততালি পেলেন বারবার।

অভিনয়ের শেষে একটি বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। আগুনের দৃশ্যের পর শেষবার পরদা পড়ে গেল, তবু বেশ কিছু দর্শক বসেই রইল আসনে। তাদের ধারণা, নাটক তখনও শেষ হয়নি, রানি আগুনে প্রবেশ করেছেন, এই প্রতীকী দৃশ্য তাদের ঠিক মর্মে ঢোকেনি, তারা প্রতীক্ষা করছে, আবার পট উঠবে, কান্নাকাটি হবে।

শেষপর্যন্ত শিশিরকুমারকে পরদা সরিয়ে মুখ বার করে বলতে হল, নাটক শেষ।

পরের কয়েক দিনের পত্রপত্রিকার সবগুলিই তপতীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যেমন সুধীজনের মন্তব্য, তেমনই সমালোচকদের মতামত। অনেকেই বললেন, তপতীর নাট্যপ্রয়োগ বাংলা নাট্যজগতের একটি মাইলস্টোন। শিশিরকুমারের অন্য নাটকগুলির প্রযোজনা এক ধরনের সার্থক, আর তপতীর সার্থকতা একেবারে আলাদা ধরনের। এই প্রযোজনা নিয়ে আমাদের নাট্যজগত বহুকাল গর্ব করবে।

কিন্তু আসল সমালোচনা সাধারণ দর্শকদের মুখে মুখে ছড়ায়।

তৃতীয় রাত্রি থেকেই দর্শকদের সংখ্যা হুহু করে কমে যেতে লাগল। পঞ্চম রাতে টিকিট বিক্রি হল পঁচানব্বইটি, ষষ্ঠ রাতে মাত্র কুড়িটি। তাও তৃতীয় দৃশ্যের পর অনেকে উঠে চলে গেল। জনা সাতেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইল এদিক-ওদিক। ওপর থেকে দেখলে প্রেক্ষাগৃহ একেবারে শূন্যই মনে হয়।

প্রথম উইংসের পাশ থেকে উঁকি মেরে দেখে প্রভা কাঁদোকাঁদো ভাবে বলল, বাবা, সব চেয়ার যে খালি। কার জন্য অভিনয় করব?

পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে চুরুট টানছেন শিশিরকুমার। তিনি সবই জানেন।

তিনি বললেন, ওই খালি চেয়ারগুলোর দিকে চেয়েই চুটিয়ে অভিনয় করে যা। দেখি তোর কত এলেম!

কঙ্কাবতী প্রভাকে জড়িয়ে ধরে বলল, দিদি, আমাদের তো অভিনয় করার কথা, আমরা তো দর্শকদের কথা সে সময় ভাবি না, সে সময় আমাদের অভিনয় দেখেন অন্তর্যামী!

শিশিরকুমার একবার ভাবলেন, সাজঘরে গিয়ে মদের বোতলে দুটো চুমুক দিয়ে আসবেন, কিন্তু দিলেন না, গেলেন না সেদিকে। মঞ্চে প্রবেশ করে খালি চেয়ারগুলির সামনে তিনি করলেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়।

একেবারে শেষ হবার পর দূরের একটি আসন থেকে হাততালি দিতে দিতে এগিয়ে এলেন হেমেন্দ্রকুমার।

তিনি চেঁচিয়ে বললেন, সুপার্ব! ব্রাভো! শিশির, আমি প্রত্যেক রাতেই এসেছি, কিন্তু আজকের রাতের মতন এমন অপূর্ব অভিনয় আর কোনওদিন দেখিনি। তপতী যে কোনও দেশের তুলনায় অতি উচ্চাঙ্গের প্রোডাকশন। রবীন্দ্রনাথ দেখলে নিশ্চিত খুব খুশি হতেন। অবনবাবুরা খুব সুখ্যাতি করে গেছেন। কিন্তু শিশির, আজ শেষপর্যন্ত যে সাতজনে ঠেকেছে। সেসব দর্শকই তোমার বন্ধুবান্ধব, ফ্রি পাসের খদ্দের। এর পর তুমি এ নাটক চালাবে কী করে? তুমি দর্শকদের রুচি উন্নত করবে ভেবেছিলে, এ পোড়া দেশটা এত দিনের পরাধীনতায় পরাধীনতায় একেবারে পচে গেছে। কান্নাকাটি আর ভাঁড়ামি ছাড়া এরা কিছু বোঝে না। শিশির, আই ফিল ভেরি স্যাড টুডে। তোমার এত পরিশ্রম, এত উদ্যোগ, সব বৃথা গেল!

মাথা থেকে রাজার মুকুটটা খুলে হাতে নিয়ে শিশিরকুমার বললেন, হোয়াই শুড ইউ ফিল স্যাড, হেমেন? তুমি বললে, আমার সাতজন বন্ধু আছে। সাতজন বন্ধু পাওয়াই বা ক’জনের ভাগ্যে ঘটে? হেমেন, ওপরে উঠে এসো। আজ আমরা সেলিব্রেট করব।

ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি পেছনে তাকিয়ে আবার সহাস্যে বললেন, অলীক, কোথায় গেলি রে! গেলাসপত্তর সব সাজা।

শিশিরকুমারের এই আপাতশান্ত ভাব যে পরবর্তী এক দারুণ ঝড়ের লক্ষণ, তা বন্ধুরা সবাই জানে।

হলও ঠিক তাই। শিশিরকুমার অনেকদিন বাদে আবার পাগলের মতন মদ্যপান শুরু করে দিলেন। কঙ্কাবতী বা অন্য কেউ অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারল না তাঁকে।

এই পর্ব চলল টানা কয়েকদিন।

তারপর তিনি যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন এক ভগ্নস্তূপে।

হাতে আর কোনও তৈরি নাটক নেই। পুরনো নাটকগুলি বহুব্যবহৃত। যে-কোনও থিয়েটারে একটা পালা ফ্লপ করলে পরবর্তীটা জমতেও অনেক সময় লেগে যায়। এর মধ্যে নিয়মিত কিছু খরচ তো থাকেই। যেটুকু সঞ্চয় ছিল তা নিঃশেষ হয়ে গিয়ে এখন চলছে ঋণের পালা। বেগতিক দেখে ঝানু অভিনেতা-অভিনেত্রী কয়েকজন নাট্যমন্দির ছেড়ে অন্য থিয়েটারে যোগ দিয়েছে, চারুশীলা প্রথম থেকেই কঙ্কাবতীর প্রাধান্য সহ্য করতে পারেনি। এবার সে অন্য দলে চলে গেল তো বটেই, বকেয়া বেতনের দাবিতে একটা মামলাও ঠুকে দিল।

ভালো করে সুস্থ হয়ে ওঠার পর শিশিরকুমার চোখের সামনে যাদের দেখতে পেলেন, তারা কেউ বন্ধু নয়। সব পাওনাদার। থিয়েটারের মালিকরাও তাড়া দিচ্ছে। বেশ কয়েকদিন পর আবার প্রেক্ষাগৃহে আলো জ্বলল। পুরনো নাটকগুলিই নামাতে লাগলেন একটার পর একটা। তাতেও আর তেমন দর্শক আসে না। তারপর একই টিকিট-মূল্যে এক একদিনে দুটি নাটক, যুগ্ম-অভিনয়। এরকম ঘুষ দিয়েও আকৃষ্ট করা গেল না খুব বেশি দর্শকদের। শিশিরকুমার বুঝতে পারলেন, এ ফুটো জাহাজ আর বেশি দূর চালানো যাবে না।

সীতা আর ষোড়শী, শিশিরকুমারের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি নাটক। অভিনয় হবে একসঙ্গে এক শনিবার। আজ মোটামুটি ভালই দর্শক এসেছে, সীতা সাঙ্গ হল, পরদা পড়ে যাবার পরেও পরদা সরিয়ে একেবারে মঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ালেন রামবেশী শিশিরকুমার।

হাত জোড় করে বললেন, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, পরবর্তী অনুষ্ঠানের আগে আমি দু’-চারটি কথা নিবেদন করতে চাই। অনুগ্রহ করে শুনবেন।

আজকের অভিনয় আমাদের এখানে শেষ অভিনয়, আর আমরা এখানে অভিনয় করব না। তা বলে কেউ যেন না মনে করেন, নাট্যমন্দির উঠে গেল! নাট্যমন্দির রইল ঠিকই, মাত্র আমরা এই স্টেজটা ছেড়ে দিচ্ছি। যতদিন না সুযোগ-সুবিধে হয়, ততদিন পর্যন্ত কলকাতায় অভিনয় করা আর আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। ভবিতব্য জানেন, আবার কবে আমরা আপনাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করব।

এই স্থানটি ছেড়ে দিতে হচ্ছে কেন, তাও আপনাদের খোলাখুলি জানানো দরকার। কলকাতায় Landlordism বলে বস্তুটি প্রবল হয়ে উঠেছে। আমাদের এই বাড়িটির জন্য মাসে মাসে তিন হাজার দুশো পঞ্চাশটি করে টাকা গুনতে হয়। এত বাড়িভাড়ার সঙ্গে অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ মেটানো দুষ্কর হয়ে পড়ছে আমাদের পক্ষে। যে হারে টিকিটের দাম করা আছে, তাই আমাদের মতন গরিব দেশের পক্ষে যথেষ্ট বেশি। আর বাড়ানো যায় না।

থিয়েটার জিনিসটা exotic, এই যে সেট-সিন, এই যে আলোর প্যাঁচ—এ হচ্ছে। কতকটা বিলিতির অনুকরণ। আমাদের জাতি যদি বেঁচে থাকত, তার মধ্যে যদি জীবনীশক্তি থাকত, তা হলে আমাদের নিজস্ব যে যাত্রাভিনয়, তাই আজ এমন জায়গায় পৌঁছোতে পারত যাকে জগতের সামনে তুলে ধরা যেত। তার জন্য যে ধরনের নাটক লেখা হত, তাই-ই হত আমাদের— বাঙালির জাতীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নাটক। যেমন আমাদের বাংলার কীর্তন, বাউল, কালীঘাটের পট ইত্যাদি। জাপানের লোক যে নাট্যাভিনয় করে, সে তাদের নিজের মতন, আমাদের তেমন জিনিস নেই।

নানা রকম কল্পনা মাথায় নিয়ে নাট্যমন্দির খোলা হয়। নাট্যমন্দির একা শিশির ভাদুড়ী গড়েনি, অনেক বন্ধুবান্ধব মিলে এটির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সুলেখক, স্বর্গীয় মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। এরকম আরও অনেকে আছেন। আমাদের বাসনার এক অংশও পূর্ণ হয়নি। বিলাতির অনুকরণের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে নানা রকম এক্সপেরিমেন্টের দরকার। তার জন্য টাকা চাই, কিন্তু তা আমরা পাইনি। নাট্যমন্দির লিমিটেড করা হল, অথচ শেয়ার বিক্রি হল মাত্র সাতাশ হাজার টাকা।… এই অবস্থায় থিয়েটার চালাতে গেলে যা হয় তাই হয়েছে, ঋণ জমে গেছে। সেই ঋণের সুদ আর বছরে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা হল ভাড়া দিতে প্রাণ বেরুচ্ছে, অথচ লাভ—অর্থাৎ নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হচ্ছে না একটুও। তাই দেনার অঙ্ক আর বাড়াতে পারছি না।… আমাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছিল চার্লস ডিকেনসের নভেলের সেই ঘোড়াটার মতন, The horse is going to go, but not going.

আমি থিয়েটার করতে শিখেছি, ব্যবসা করতে শিখিনি।

যা হোক, আমি এখনও হতাশ হয়ে পড়িনি। আমার অন্তরে নাট্যভারতীর যে মূর্তি সাধনার দ্বারা গড়ে তুলেছি, তাকে আমি দেখবই দেখব। আমার যথেষ্ট আশা আছে, আমার দেহপাতের আগে, আপনাদের সন্তুষ্টির জন্য কিছু একটা করে যেতে পারব। যাঁরা আমাদের থিয়েটার দেখেন, টিকিট কেনেন, অনুগ্রহ করেন, ভালোবাসেন, তাঁদের সকলকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।

এই প্রথম শিশিরকুমারের সুদীর্ঘ একক সংলাপের পর কেউ হাততালি দিল না। বরং শোনা গেল অনেক দীর্ঘশ্বাস। তারপর উৎকট স্তব্ধতা।

সাজঘরে এসে শিশিরকুমার পরবর্তী নাটকের জন্য মেকআপ নিচ্ছেন, একটু পরে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রবোধচন্দ্র গুহ। হাতে সেই ছড়ি।

গলা খাঁকারি দিয়ে তিনি বললেন, শিশিরবাবু, তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারি?

শিশিরকুমার ঘাড় ঘুরিয়ে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন।

প্রবোধচন্দ্র ভেতরে ঢুকে একটা টুল টেনে নিয়ে শিশিরকুমারের একেবারে গা ঘেঁষে বসে পড়ে বললেন, তুমি আজই এই হল ছেড়ে দেবে। সে খবর আমরা আগেই পেয়েছি। এর পর তুমি কী করবে?

শিশিরকুমার শ্লেষের সঙ্গে বললেন, বিবাগী হয়ে যাব না বোধহয়।

প্রবোধচন্দ্র বললেন, তা তুমি পারবে না জানি। তুমি রজোগুণী মানুষ। আমার একটা প্রস্তাব আছে। তুমি স্টারে যোগ দাও।

শিশিরকুমার অনেকখানি ভুরু তুলে বললেন, স্টারে?

প্রবোধচন্দ্র সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, চিরশত্রু স্টার, তাই না? ভায়া, আমরা কেউ কারও শত্রু নই, মিত্র নই। থিয়েটারে আমরা সবাই একই পথের পথিক। কেউ খানিকটা এগিয়ে, কেউ কিছুটা পিছিয়ে। প্রতিযোগিতা তো থাকবেই। কিন্তু তোমার মতন একজন গ্রেট থিয়েটার পার্সন মঞ্চ-হারা হয়ে বাইরে বসে থাকবে, এটা কি আমরা মেনে নিতে পারি! তার মানে তো আমরা থিয়েটারকেই ভালোবাসি না। তোমাকে আমরা সসম্মানে স্টারের অধিনায়ক হবার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি।

শিশিরকুমার বললেন, কিন্তু আপনাদের তো অহীন্দ্রবাবু আছেন। তিনিই হিরো। সেখানে গিয়ে আমি কী করব? জানেন না, এক জঙ্গলে বাঘ আর সিংহ একসঙ্গে থাকে না?

প্রবোধচন্দ্র বললেন, তা জানব না কেন? অহিন চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের ইদানীং বনিবনা হচ্ছে না। তার খাঁই বাড়ছে দিন দিন। সে মিনার্ভায় যোগ দিচ্ছে। স্টারে তুমি একাই সিংহ হয়ে থাকবে।

শিশিরকুমার বললেন, কিন্তু, কিন্তু, এটা কি আপনার একলার অভিমত? আপনাদের তো মাথার ওপরে আছেন অপরেশ মুখুজ্যে, তিনিও কি আমাকে চান?

প্রবোধচন্দ্র বললেন, অপরেশবাবুর মতামত না নিয়ে কি আমি এসেছি? তাঁরও বিশেষ ইচ্ছে, তিনি নাট্যকার, তাঁর নাটকও ভালো চলে, তোমার মতন একজন অ্যাক্টরকে পেতে কোন নাট্যকারের না সাধ হবে? তিনি অনেকবার আমাকে বলেছেন, অহীন্দ্র খুব ভাল অ্যাক্টর নিঃসন্দেহে, কিন্তু শিশিরের সঙ্গে কারও তুলনাই হয় না। হি ইজ এ ক্লাস বাই হিমসেলফ। আমরা তোমার সঙ্গে যতই রেষারেষি করি, মনে মনে তো জানি, তুমি এ যুগের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা।

শিশিরকুমার বললেন, ও কথা বলবেন না। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ।

প্রবোধচন্দ্র বললেন, ওঁর কথা বাদ দাও। কোনও ব্যাপারেই কি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কারও তুলনা চলে? শোনো, অপরেশবাবু নিজে আসতে চেয়েছিলেন, তোমাকে অনুরোধ জানাতে। কিন্তু তাঁর পক্ষে এখানে আসাটা ভালো দেখায় না, তাই ওঁকে নিরস্ত করেছি! তুমি রাজি হয়ে যাও শিশির। তোমার হাতে এখন পয়সা নেই জানি, আমরা কালই কিছু টাকা অ্যাডভান্স পাঠিয়ে দেব।

শিশিরকুমার বললেন, আপনারা আমাকে একা চাইছেন? আমার একটা দল আছে, তারাও কাল থেকে বেকার হয়ে পড়বে। তাদের ছেড়ে আমি যাব কী করে? সেটা হবে ট্রেচারি।

প্রবোধচন্দ্র বললেন, না, না, একা কেন? সদলবলে যাবে, যোগেশ, জীবন গাঙ্গুলি, রবি রায়… প্রভা, কঙ্কাবতী… তোমার যাকে যাকে ইচ্ছে হয় নেবে। কঙ্কাবতী, তার তো স্টারে থাকারই কথা ছিল, তুমি তাকে কেড়ে নিলে, সেই কঙ্কাবতী এবার স্টার বোর্ডে নামবে। এটা আমাদের একটা সুইট রিভেঞ্জ, কী বলো, হা-হা-হা-হা, সুইট রিভেঞ্জ!

বারো

নিউ ইয়র্ক, ২৭ অক্টোবর, ১৯৩০

আচমকাই ভোরবেলা থেকে তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। এ বছর শীত আসছে তাড়াতাড়ি।

নিউ ইয়র্ক শহর চব্বিশ ঘণ্টাই জেগে থাকে। সারা রাত শোনা গেছে গাড়িঘোড়ার শব্দ। এখন চলন্ত মোটর গাড়িগুলির ওপর এমন থোকা থোকা বরফ জমে আছে, যেন মনে হয় ফুল দিয়ে সাজানো বরযাত্রীর গাড়ি।

এগারোতলা ঘরের এক জানালা দিয়ে এ শহরের দৃশ্য দেখছে কঙ্কাবতী। শাড়ির ওপর সোয়েটার, শাল জড়িয়েও শীত যাচ্ছে না। শীতের জন্য কেউই সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। ঘরের মধ্যেই ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে সর্বক্ষণ, তার একেবারে কাছ ঘেঁষে বসে থাকলেই হাত-পা একটু গরম হয়, দূরে সরে গেলেই শরীরে কাঁপুনি ধরে।

প্রথম রাতেই শীত সম্পর্কে অভিযোগ করায় এরিক এলিয়ট মৃদু ভর্ৎসনা করে বলেছে, এ শহরের সব লোকই ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে কম্বল গায় দিয়ে ঘুমোয়। তোমাদের দেখছি বেশি বেশি শীতবোধ!

তা তো ঠিকই, গরম দেশ থেকে এলে শীত বেশি লাগে। সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে যখন কলকাতা ছাড়া হয়, তখনও সেখানে চিটপিটে গরম ছিল। ট্রেনে সরাসরি করাচি, সেখানেও বেশ গরম। তারপর জাহাজ যখন ভারত মহাসাগরে ভেসেছে, তখন গরম এমন বেড়েছিল যে টেঁকাই যাচ্ছিল না। একমাত্র আটলান্টিক মহাসাগরে আসার পরেই হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করেছিল।

এত বড় বড় বাড়িও এরা কেউ কখনও দেখেনি। এগারোতলা! পাশের বাড়িটা আরও উঁচু, কুড়িতলা নাকি। মানুষের তৈরি এক একটি পাহাড়।

বাথরুম থেকে স্নান সেরে বেরিয়ে এলেন শিশিরকুমার। অঙ্গে ডোরাকাটা ড্রেসিং গাউন। তাঁকে দেখলে মনে হয়, তাঁর শীত কম লাগে।

কঙ্কাবতী মুখ ফিরিয়ে বলল, তুমি কী করে এর মধ্যে চান করলে গো? আমি যে ঠান্ডায় মরছি!

শিশিরকুমার বললেন, গরম জল আছে। তুমিও স্নান করে নিলে পারো। ঠান্ডা কম লাগবে।

কঙ্কাবতী বলল, বাবাঃ, আমি আজ আর চান করছি না!

শিশিরকুমার বললেন, মোজা পরো, মোজা পরো! পায়েই তো বেশি ঠান্ডা লাগে।

কঙ্কাবতী বলল, প্রভাদিদি তো বিছানা ছেড়ে উঠছেই না। একটু আগে দেখে এলুম। বললে যে বিছানা থেকে নামলেই গা একেবারে কালিয়ে যাচ্ছে।

শিশিরকুমার বলল, তা বললে তো চলবে না! উঠে রেডি হতে হবে সবাইকে। শোনো, বিছানা থেকে উঠে কয়েক পাক নেচে নিতে হয়। নাচলে শরীর গরম হয়। এইভাবে নাচবে!

শিশিরকুমার দু’হাত তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচতে লাগলেন। তা দেখে হাসিতে ভেঙে পড়ে কঙ্কাবতী দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। দৃঢ় আলিঙ্গন!

কঙ্কাবতী শিশিরকুমারের গালে গাল ঠেকিয়ে বলল, এইভাবে থাকলে শীত চলে যায়।

শিশিরকুমার বললেন, প্রিয়ে, তোমার সঙ্গে জড়াজড়ি করে তো সারাদিন কাটাতে পারব না! ছাড়ো! আজ ড্রেস রিহার্সাল, মনে নেই?

সঙ্গে সঙ্গে বাহুবন্ধন থেকে শিশিরকুমারকে মুক্তি দিয়ে, একটু দূরে গিয়ে ভয়-পাওয়া গলায় কঙ্কাবতী বলল, কী হবে? এত তাড়াতাড়ি, এসে পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই—

শিশিরকুমার বললেন, যত দেরি হবে, তত টাকা খরচ। হল বুক হয়ে গেছে শুনেছ। তো, এক সপ্তাহের জন্য হাউস ফুল। সবচেয়ে কমদামি টিকিট বারো ডলার। তার মানে আমাদের হিসেবে ছত্রিশ টাকা। এরা এত টাকা দিয়ে থিয়েটার দেখে! আমাদের সবচেয়ে দামি টিকিটই তো পাঁচ টাকার।

কঙ্কাবতী তবুও বলল, আমরা পারব তো?

শিশিরকুমারের মনেও সে সংশয় আছে।

এখানে জাহাজ থেকে নামার সময় যে-সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে, তা অভূতপূর্ব।

বন্দরে জাহাজ এসে পৌঁছেছিল রাত্তিরবেলা। সকালবেলাতেই শহরে মেয়র স্বয়ং এলেন দলবল নিয়ে, সঙ্গে রাশিয়ার গ্র্যান্ড ডাচেস অব মারি আর রাজকুমারী রসপিগলিয়োসি, আরও সব হোমরাচোমরা। ধুতি ও শাড়ি পরা ভারতীয় দলটি নেমে আসতেই তাদের প্রত্যেককে দেওয়া হল ফুলের তোড়া। তারপর ছ’খানা রোলস রয়েস গাড়িতে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হল ব্রডওয়ে রাস্তা ধরে। সামনে পেছনে পুলিশের গাড়ি। রাস্তার দু’ধারে লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে।

সতু সেন নামে এক যুবক নিউ ইয়র্কে ভালো চাকরি করে। সেও গিয়েছিল জাহাজঘাটে। গাড়িতে শিশিরের পাশে বসে সে বলেছিল, দাদা, আপনাদের যে গ্র্যান্ড রিসেপশন দেওয়া হল এরকম আমি আগে কখনও দেখিনি। জানেন তো রবীন্দ্রনাথ এখন এখানে আছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন আসেন, তাঁকেও এরকমভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয় না।

শিশিরকুমার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তা হলে আমাদের এত খাতির করা হল কেন? আমরা একটা নাটুকে দল বই তো আর কিছু না।

সতু সেন বলেছিল, আপনারা… আপনারা মানে এক অভিনব বস্তু। এখানকার সাধারণ মানুষ তো ভারতীয় প্রায় দেখেই না। এদের ধারণা, ভারতে মেয়েদের সব ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা হয় কিংবা সতীদাহ হয়, বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের গঙ্গার জলে ছুড়ে দিলে কুমিরে খায়, রাস্তায় রাস্তায় সাধু, যোগী আর বাঘ, সাপ ঘুরে বেড়ায়। আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংগীত সম্পর্কে এদের কোনও ধারণাই নেই। একটা কাগজে ক’দিন আগে কী লিখেছে জানেন! আপনি হচ্ছেন একজন রাজা, আর বিয়ে করেছেন এক রাজস্থানি মেয়েকে। রাজা, রাজস্থান কথাগুলো এরা নতুন শিখেছে। আর আপনি এখানে নাচতে আসছেন, একদল নাচুনে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। এদের ভাষায় নচ গার্ল।

শিশিরকুমার খুব হেসেছিলেন এসব শুনে।

কী রকম যেন কার্য-কারণের যোগাযোগে আমেরিকায় আসার ব্যবস্থা হয়ে গেল।

প্রথম চেষ্টা করেছিল এই সতু সেনই।

নিউ ইয়র্কের ব্রডওয়ের অনেকগুলি রঙ্গমঞ্চে নিয়মিত নাটকের অভিনয় হয়। আমেরিকার থিয়েটার ছাড়াও নানান দেশের নাট্যসম্প্রদায় কিছুদিনের জন্য এসে প্রদর্শন করে যায় তাদের নাটক। ইয়োরোপীয় দেশগুলি থেকেই বেশি আসে, একবার একটি জাপানি দল এসে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ইমপ্রেশারিওরা সেই দলগুলি আনাবার ব্যবস্থা করে, লাভ-লোকসানের দায়িত্বও তাদের।

সতু সেন এদেশে এসে কিছুদিন থাকতে থাকতে ভেবেছিল, ভারত থেকেও কেন একটি দল আসবে না? ভারতেরও বিরাট নাট্য-ঐতিহ্য আছে। শিশির ভাদুড়ী বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতাদের চেয়ে কম কীসে? সতু সেন এসেছিল বিখ্যাত নাট্যবিশেষজ্ঞ বলিস্লাভস্কির কাছে স্টেজ পরিচালনা শেখার জন্য। এখন সে নিউ ইয়র্ক লেবরেটরি থিয়েটারের টেকনিক্যাল ডিরেক্টার। নাটকের জগতের অনেকের সঙ্গে চেনাশুনো আছে।

সে যোগাযোগ করেছিল নাম করা ইমপ্রেশারিও মিস এলিজাবেথ মারবেরির সঙ্গে। শ্রীমতী মারবেরি প্রথমে কিছুটা আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু শিশির ভাদুড়ীর দলের অভিনয়ের মান কতটা উঁচু সেটা নিজেদের কেউ না দেখে মনঃস্থির করতে পারল না। প্রাথমিক দু’-একখানা চিঠি লিখেও থেমে গেল।

এর কয়েক মাস পরে ইংলন্ডের এক ভ্রাম্যমাণ নাটকের দল অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার পথে কলকাতা নামে। তাদের প্রধান অভিনেতা এরিক এলিয়ট কলকাতার থিয়েটার দেখতে চাইল, কলকাতায় ইংরেজি থিয়েটারও হয় সাহেব পাড়ায়, কিন্তু এরিক চায় স্থানীয় ভাষার খাঁটি জিনিস দেখতে। ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার এক রিপোর্টার তাকে পরামর্শ দিল, তা হলে যাও শিশির ভাদুড়ীর নাট্যমন্দিরে।

নাট্যমন্দিরে তখন চলছিল ‘রঘুবীর’। বাংলা নাটক, তবু এরিক এলিয়ট তা দেখে মুগ্ধ। শো-এর শেষে শিশিরকুমারকে অভিনন্দন জানাতে এসে সে বলল, I realise I am in the presence of a very great artist. শিশিরকুমার যে ইংরেজি নাটক বিষয়েও বহু কিছু জানেন, তা দেখেও এরিক এলিয়ট তাজ্জব বনে গেল।

বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই এরিক এলিয়ট আবার এল কলকাতায়। এবার সে পর পর দেখল সীতা, আলমগীর, ষোড়শী, দিগ্বিজয়ী। তার যেন নেশা ধরে গেছে, একটু একটু বাংলা আর হিন্দিও বলতে শিখেছে।

এরিক এরপর তার দল নিয়ে গেল নিউ ইয়র্কে, তার ইমপ্রেশারিও ওই পূর্বোক্ত মিস মারবেরি। কথায় কথায় একদিন ভারতীয় নাটক এবং শিশির সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ আসতেই মিস মারবেরির মনে পড়ে গেল এ নাম তার চেনা। একজন শ্বেতাঙ্গ অভিনেতা যখন ইন্ডিয়ার একজন নেটিভ অভিনেতার এত প্রশংসা করছে, তখন নিশ্চিত সেই লোকটির মধ্যে কিছু বস্তু আছে।

আবার চিঠি গেল শিশিরকুমারের কাছে। মিস মারবেরির সহকারী কার্ল রিড ব্যবস্থা করে ফেলল, রুজভেল্ট কোম্পানি শিশির সম্প্রদায়ের সমস্ত খরচটা দেবে, শুধু ‘সীতা’ নাটকের কয়েকটি শো করতে হবে, তবে এই দলের মধ্যে অন্তত সাত-আটটি নাচের মেয়ে অবশ্যই চাই।

প্রস্তাবটি পেয়ে শিশিরকুমার প্রথমটা বেশ দ্বিধার মধ্যে পড়েছিলেন। এত বড় দল নিয়ে অত দূরের দেশে পাড়ি দেওয়া সহজ কথা নয়। দলের কেউই আগে বিদেশে যায়নি, অনেকে বাংলার বাইরেই যায়নি। অর্ধেকের বেশি অভিনেতা-অভিনেত্রী এক অক্ষরও ইংরেজি জানে না।

সে সময় শিশিরকুমারের নিজস্ব থিয়েটার হল নেই, স্টারের আর্ট থিয়েটারের অধীনে চাকরি করতে হচ্ছে, নাটক জমছে বটে, কিন্তু শিশিরকুমারের মন বসে না। স্টারের যে ‘মন্ত্রশক্তি’ নাটকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ‘তপতী’র শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল, এখন শিশিরকুমার সেই ‘মন্ত্রশক্তি’-তেই অভিনয় করে দ্বিগুণ দর্শক টানছেন, এ যেন এক নিষ্ঠুর পরিহাস।

তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, স্টারে তিনি বেশিদিন টিঁকতে পারবেন না, তাই আমেরিকা সফরের প্রস্তাব গ্রহণ করে ফেললেন। কঙ্কাবতী এটা চাইছিল প্রথম থেকেই।

কিন্তু দল গড়তে গিয়ে শিশিরকুমার পড়লেন মহা ফাঁপরে।

তাঁর নিজের হাতে গড়া শিল্পীরা অনেকেই যেতে রাজি নয়। উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবে, তা জেনেও। আমেরিকা সোনার দেশ, তার ঐশ্বর্য সম্পর্কে কত কাহিনী আছে, সেই দেশ দেখতে যাবার মতন অ্যাডভেঞ্চারস্পৃহাও তাদের নেই। কেউ কেউ বলল, ওরে বাবা, ওখানে দারুণ শীত, যখন-তখন বরফ পড়ে, ওখানে গিয়ে কি সান্নিপাতিকে মরব নাকি? কেউ কেউ বলল, ওখানে ভাত পাওয়া যায় না, আমি বাবা দু’বেলা ভাত না খেয়ে বাঁচতে পারি না। কেউ বলল, আমেরিকানরা সব গোরুখোর, অন্য মাংস কিংবা মাছ মেলে না, শেষে কি গোরু খেয়ে জাত খোয়াব? একজন বলল, রাস্তায় কালো লোক দেখলেই ওরা ঢিল মারে, আমার গায়ের রং যে ছাতার মতন!

অপর পক্ষে কিছু কিছু লোক এগিয়ে এসে শুধু দেশ ভ্রমণের লোভেই যেতে আগ্রহ দেখাল। তারা পারিশ্রমিকও চায় না। কিন্তু তারা কেউ কখনও রঙ্গমঞ্চে পা দেয়নি। অগত্যা শিশিরকুমার সে রকম কয়েকজনকে নিতে রাজি হলেন, খানিকটা শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন, এই ভেবে।

সবচেয়ে মুশকিল হল মেয়েদের নিয়ে। নামকরা অভিনেত্রীদের মধ্যে কেউই যেতে রাজি নয়, কঙ্কাবতী ও প্রভা ছাড়া, তারা তো ঘরেরই মেয়ে। অথচ আট-দশটি মেয়ে তো চাই-ই। কঙ্কাবতীকে বিদেশিদের চোখেও সুন্দরী মনে হবে। কারণ সে দীর্ঘাঙ্গিনী এবং স্বাস্থ্যবতী, কোমর ও বুকের গড়নে সৌষ্ঠব আছে। প্রভা রোগা-পাতলা হলেও চলনসই। আর বাকিদের কোথায় পাওয়া যাবে! আক্ষরিক অর্থেই খেঁদি-পেঁচি কয়েকজনকে তুলে আনা হল সোনাগাছি থেকে। তাদের নাম উমা (পটল), সরলা (বেঁকি), পরিমল (পাঁচি), বেলারানি, কালিদাসী, কমলা (হাঁদু), হেনা (নিমকি), যদু (ছোট রাখালি)। ভালো নামগুলো ওরা নিজেরাই আগে শোনেনি, এবং মাত্র দু’জন ছাড়া কেউ নাচ জানে না।

শিশিরকুমার ভেবেছিলেন, নিউ ইয়র্কে পৌঁছে অন্তত দিন দশেক সময় পাওয়া যাবে, তার মধ্যে কয়েকটা রিহার্সাল দিয়ে ভালোভাবে তৈরি হয়ে নেবেন। আগে থেকেই যে প্রথম অভিনয়ের তারিখ ঠিক হয়ে আছে আর বিক্রি হয়ে গেছে সব টিকিট, তা তিনি কিছুই জানতেন না। রিহার্সালের কথা বলতেই কার্ল রিড বলল, সেকী, তোমরা তো শুনেছি ‘সীতা’ নাটক তিনশো রাত অভিনয় করছ, তা হলে আর। রিহার্সাল লাগবে কেন?

কলকাতায় যত রাতই হোক, এখানে নতুন দেশে এসে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার একটা ব্যাপার আছে। জাহাজে অনেকেই সামুদ্রিক পীড়ায় ভুগেছে, এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি, ঠান্ডাটাও সইয়ে নিতে হবে। এখানকার রাস্তায় এত অজস্র গাড়িঘোড়া যে একখানা সাবান কেনার জন্যও কেউ একা হোটেলের বাইরে যেতে সাহস পায় না।

পৌঁছোবার তিনদিন পরেই ড্রেস রিহার্সাল, পর দিন প্রথম শো। এরিক বলে দিয়েছে, এ দেশের ড্রেস রিহার্সাল মানে একেবারে পূর্ণাঙ্গ অভিনয়ের মতন, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টানা, মাঝখানে অন্য কথা বলার উপায় নেই, কেউ কোনও নির্দেশও দিতে পারবে না।

ব্রডওয়ের সুখ্যাত বিল্টমোর থিয়েটারে ড্রেস রিহার্সাল। কোনও রঙ্গমঞ্চের এত বড় প্রবেশপথ এই বাঙালিরা আগে দেখেনি। বাইরের দেওয়ালে ছ’ ইঞ্চি অক্ষরে লেখা আছে

The wizard of the Indian Stage with a band of nauch girls at Broadway.

ধনুর্বাণ হাতে একজন রাজা আর একদল লম্বা চুলের নর্তকীর বিশাল ছবি, যাদের কারওকেই ভারতীয়দের মতন দেখতে নয়। মেয়েদের ঊরু পর্যন্ত নগ্ন।

ভেতরে একটা মস্ত বড় ডোম, তার ওপরের দিকে নানান কারুকার্য করা ছবি আঁকা। দুটি উড়ন্ত পরির মূর্তি ঝুলছে, দেখে মনে হয় নিখাদ সোনার।

বাইরে খুব জাঁকজমক, কিন্তু ভেতরের প্রেক্ষাগৃহটি তেমন বড় নয়। পাঁচ-ছ’শো দর্শক আসন, অবশ্য পেছন দিকে দু’তলায়, তিনতলায় গ্যালারি, এবং দু’দিকে কয়েকটি বক্স।

গাঁয়ের লোক শহরে এসে যেমন সব কিছু বিহ্বলভাবে দেখে, এখানেও বাংলা থিয়েটারের দলটির প্রায় সেই অবস্থা। কেউ কোনও কথা বলছে না।

অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য শিশিরকুমার যোগেশচন্দ্রের কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, জানো তো যোগেশদা, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অ্যাব্রাহাম লিঙ্কনকে খুন করে একজন অভিনেতা। তার নাম বুথ। লিঙ্কন এইরকম একটা বক্সে বসে থিয়েটার দেখছিলেন, অভিনয় করতে করতে বুথ লাফিয়ে সেই বক্সে উঠে যায়, তারপর খুব কাছ থেকে প্রেসিডেন্টকে গুলি করে।

ঘাড় উঁচু করে যোগেশচন্দ্র বললেন, ওরে বাপ! অত উঁচুতে লাফিয়ে উঠল কী করে?

শিশিরকুমার বললেন, দড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতে।

পাশ থেকে শ্রীশ চাটুজ্যে নামে একজন নতুন লোক বলল, বড়বাবু, এদের এত সব সাজানো গোছানো ব্যাপার। এখানে কি পেচ্ছাপখানা থাকতে পারে?

শিশিরকুমার বললেন, কেন, সাহেবরা কি পেচ্ছাপ-বাহ্যে করে না নাকি? নিশ্চয়ই থাকবে।

শ্ৰীশ কাঁচুমাচুভাবে বলল, আমাকে একবার যে যেতে হবে। কোথায় যাব!

শিশিরকুমার ধমক দিয়ে বললেন, যাও নিজে খুঁজে দেখো। আমি তোমার জন্য পেচ্ছাপখানা খুঁজব নাকি?

বেচা চন্দ্র নামে আর একজন জিজ্ঞেস করল, বড়বাবু, এখানে কি খাবার জল পাওয়া যাবে? নাকি এরা শুধু বিয়ার খায়?

শিশিরকুমার বললেন, কেন, বিয়ারে তোমার আপত্তি কীসের? জাহাজে আসার সময় তো দেখলাম, দিব্যি বোতলের পর বোতল বিয়ার ওড়ালে!

বেচা বলল, না, মানে, বিয়ার খেলে তো আর জলের তেষ্টা মেটে না। আমার গলা শুকিয়ে আসছে।

শিশিরকুমার বললেন, চোখ নেই? ভেতরে ঢোকার মুখে দেখলে না, দেওয়ালে জলের কল। আর পাশে কাগজের গেলাস রাখা আছে? যাও, এসব সামান্য কথা নিয়ে আমায় বিরক্ত করবে না।

কাস্টম্স থেকে মাত্র আজ সকালেই সব জিনিসপত্র ছাড়িয়ে আনতে পারা গেছে। তাড়াহুড়োতে সব মিলিয়ে দেখা হয়নি। সিনগুলো কোনওরকমে টাঙানো হয়েছে। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম নেই, সিঁড়ি নেই। পেছনের পরদা নেই। এগুলো এখানেই বানিয়ে দেবার কথা ছিল, তা হয়নি। একেবারে ফ্ল্যাট মঞ্চে কীভাবে অভিনয় হবে?

আলোকসম্পাত হবে কীভাবে? প্রচুর আলোর ব্যবস্থা আছে, গাঁট্টাগোঁট্টা কয়েকজন ইলেকট্রিশিয়ানও বসে আছে গালে হাত দিয়ে। দৃশ্যের পর দৃশ্যে কোথায় ফোকাস হবে, কোথায় ডিম লাইট, কখন অন্ধকার, তা তাদের কে বোঝাবে? নাটকের কপিতে দাগ দিয়ে দিয়ে এসব বোঝাতে দু’-তিন দিন লাগে। তাও আবার এ নাটকের পাণ্ডুলিপি বাংলায় লেখা, এরা এক বর্ণ বুঝবে না।

পাশে দাঁড়িয়ে কেউ কি ওদের আলোকসম্পাতের সময় বুঝিয়ে দেবে? দলের যে ক’জন ইংরিজি জানে, তাদেরও উচ্চারণ বোঝে না সাহেবরা। আমেরিকানরা আবার নাকি নাকি সুরে কথা বলে, তাদের কথা বোঝাও দুষ্কর। একমাত্র শিশিরকুমারই ওদের সঙ্গে সব কথাবার্তা বলছেন। এখন তিনি কি নিজের ভূমিকায় অভিনয় করবেন, না ইলেকট্রিশিয়ানদের পাশে দাঁড়িয়ে আলোর নির্দেশ দেবেন! কোনওরকমে দৃশ্য বিভাজন বুঝিয়ে দিলেন। সেকেন্ড বেল বেজে গেছে। এখানে সব কিছু চলে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায়।

মঞ্চে প্রবেশের আগে প্রভা আর কঙ্কাবতীকে দু’পাশে দাঁড় করিয়ে শিশিরকুমার বললেন, শোনো, আমেরিকায় এই প্রথম কোনও ভারতীয় নাটকের অভিনয় হচ্ছে। আমরা বাংলা থেকে এসেছি, আমাদের মান রাখতেই হবে। আমরা জান লড়িয়ে অ্যাক্টিং করব। এরা ভাষা না বুঝুক, একটা স্পেল তৈরি করতে হবে।

কিন্তু শুধু দু’-তিনজনের উচ্চ স্তরের অভিনয়েই নাটক সার্থক করা যায় না। কয়েকটি ছোটখাটো ক্রটিতেই রসভঙ্গ হয়ে যেতে পারে। থিয়েটার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল, এমনকী মঞ্চের নেপথ্যে যারা থাকে, যাদের নামও দর্শকরা জানতে পারে না, তাদেরও প্রত্যেকের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নাটকের প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান, একটু ভুল হয়ে গেলে আর সংশোধনের উপায় নেই। আবেগঘন মুহূর্তেও যদি নেপথ্যে কিছু ত্রুটি হয়ে যায়, নায়কের মুখে ‘ওই শোনো মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি’ উচ্চারিত হবার পরেও যদি ঘণ্টাধ্বনি না শোনা যায়, দর্শকরা হাসতে শুরু করে।

কলকাতায় নাটক চলে চার ঘণ্টা, সাড়ে চার ঘণ্টা, নইলে দর্শকদের পয়সা উশুল হয় না। সারারাত ধরে থিয়েটার চললেও তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এখানে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার বেশি দর্শকদের ধৈর্য থাকে না। তাই অতি দ্রুত ‘সীতা-কে কাট-ছাঁট করতে হয়েছে, বাদ দিতে হয়েছে দু’-চারটে গোটা দৃশ্য। তাতে নাটকের গতি ছন্দ হারিয়েছে কিছুটা।

প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের আসনে বসেছে মিস মারবেরি, তার পাশে এরিক এলিয়ট, কার্ল রিড এবং কয়েকজন নির্বাচিত অতিথি ও পত্রিকা সম্পাদক।

প্রথম দৃশ্য শুরু হবার আগে বাঁশি বাজে, এখানে বাঁশি বাজাবার কেউ নেই। একটি হারমোরিয়াম আনা হয়েছে। কিন্তু তার আওয়াজ শুনেই মিস মারবেরি বলে দিয়েছে, ও যন্ত্র এ দেশে চলবে না, অতি কর্কশ, দরকার হলে পেছন থেকে অরগ্যান বাজিয়ে দেওয়া হবে। পেশাদার তবলচিও সঙ্গে আসেনি। মেক-আপ ম্যান শীতলকে দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে, সে শুধু নাচের সময় ধাঁই ধপাধপ বাজাতে পারে।

প্রথম দৃশ্যেই বিপত্তি।

শ্রীশকে দেওয়া হয়েছে দুর্মুখের ভূমিকা। দেশভ্রমণে উৎসাহী শ্ৰীশ নিজের যোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে বলেছিল, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বারোয়ারি কালীপুজোয় সে অ্যামেচার থিয়েটার করেছে, তাও ছোটখাটো রোলে নয়, ‘বঙ্গে বর্গী’ আর ‘গৈরিক পতাকা’ দুটোতেই নামভূমিকায়।

তখন সবাই হেসেছিল এবং মানুষটি সরল বলে তাকে দলে নেওয়া হয়েছিল।

আসবার পথে জাহাজে যতটা সময় পাওয়া গেছে, শিশিরকুমার এদের কয়েকজনকে পাখি পড়ানোর মতন পার্ট শিখিয়েছেন। কিন্তু একী কাণ্ড! এখানে প্রথম সংলাপ থেকেই শ্ৰীশ ‘ইয়ে, মানে…’ করতে লাগল। সব পার্ট ভুলে মেরে দিয়েছে।

শিশিরকুমার নিজের পার্ট বলছেন, আর শ্রীশেরও সংলাপের কিউ ধরিয়ে দিচ্ছেন নিচু গলায়। এখানকার অ্যাকাউস্টিক্স অনেক ভালো, শিশিরকুমারের নিচু গলার কথাও শোনা যাচ্ছে হলের মধ্যে, সেখান থেকে ভেসে আসছে মৃদু হাস্যরোল।

শুধু তাই নয়, কার্ল রিড চেঁচিয়ে বলল, My God! The man does not know his role. And I hear the play has run there three hundred nights.

লজ্জা পেলে চলবে না। থামলে চলবে না।

কোনওরকমে প্রথম অঙ্ক শেষ হল।

মিস মারবেরি একজনকে দিয়ে শিশিরকুমারকে খবর পাঠালেন, নাচের দৃশ্যটা কোথায় গেল? সেটা এখনই দিতে হবে।

শিশিরকুমার এরিক এলিয়টকে আগের দিনই অনুরোধ করেছিলেন, নাচের দৃশ্যটা বাদ দেবার জন্য। এখানকার দর্শক যে রকম নাচ দেখতে চায়, তাঁর দলের মেয়েরা সে রকম নাচতেও জানে না। দেখতেও সুন্দর নয়। তারা ঊরু দেখাতে রাজিও হবে না। সে সব ঊরু দেখার মতনও নয়।

এরিক বলেছিল, নাচ বাদ দেওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই।

এখানকার কাগজে লেখালেখি হয়েছে যে, যে-সব নাচের মেয়েরা আসছে, তারা সবাই ভারতের এক একটি পবিত্র মন্দিরের দেবদাসী। তারা শুধু দু’বেলা দেবতার মূর্তির সামনে নাচ দেখায়, অন্য কোনও লোকচক্ষুর সামনে আসে না। এরা অপূর্ব রূপসি এবং কুমারী। শিশির ভাদুড়ী নামে ব্যক্তিটি অত্যন্ত প্রভাব খাটিয়ে তাদের আমেরিকায় আনাচ্ছে। এদের দেখতে পাওয়াই বিরল অভিজ্ঞতা।

জাহাজে কঙ্কাবতী সঙ্গের মেয়েদের কিছুটা নাচ শেখাবার চেষ্টা করেছে। অনেকেরই হাত-পায়ের আড় ভাঙতে চায় না। কোনওক্রমে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে জাতীয় খানিকটা নাচ শিখেছে।

শিশিরকুমার চেয়েছিলেন, কঙ্কাবতীও এই নাচের দলে যোগ দিক, তা হলে অন্তত একজনের দিকে চোখ ভরে তাকানো যাবে। কঙ্কাবতী তাতে রাজি হয়নি।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিশিরকুমার দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথমেই নাচের দলটাকে মঞ্চে পাঠিয়ে দিলেন। আড়াল থেকে গান হতে লাগল, ‘মঞ্জুল মঞ্জরী নব সাজে’।

একে তো একজনের সঙ্গে অন্যজনের পা মেলে না। তার ওপর কেউ বেঢপ মোটা, কেউ একেবারে সিড়িঙ্গে, কয়েকজন কুচকুচে কালো মুখে মেখেছে একগাদা পাউডার, সব মিলিয়ে একেবারে বীভৎস দৃশ্য। সেই সঙ্গে ধাঁই ধপাধপ তবলা।

মিস মারবেরি প্রথমে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এই মেয়েরা রূপসি দেবদাসী, আর এই তাদের নাচ? এই নাচই প্রধান আকর্ষণ হবার কথা।

এবার রাগে জ্বলে উঠল মারবেরি। সে চেঁচিয়ে বলল, এরিক, এরিক, হু আর দিজ লেডিজ?

পাশ থেকে কার্ল রিড বলল, সিম্স লাইক আ বানচ্ অফ গোস্টস!

এরিক কাঁচুমাচুভাবে বলল, মি. ভাদুড়ী ঠিক মেয়েদের জোগাড় করতে পারেনি। এদের বদলাতেই হবে। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। আজই বিকেলে গোটা কতক মেক্সিকান মেয়ে জোগাড় করব। ওদের গায়ের রং ওরিয়েন্টালদের মতন হয়, চুলও রাখে লম্বা লম্বা। আর একটু মেক-আপ দিলেই আর বোঝা যাবে না।

মিস মারবেরি বলল, মেক্সিকান মেয়ে? সমালোচকদের ফাঁকি দিতে পারবে?

এর মধ্যে নাচের দল সরে গিয়ে দ্বিতীয় অঙ্কে তপোবনের দৃশ্য। লব কুশকে নিয়ে বাল্মীকির প্রবেশ। শম্বুক বধের দৃশ্য বাদ পড়েছে। মাঝখানে যে আঠেরো বছর কেটে গেল, তা কী করে বোঝা যাবে? সংলাপ তো কেউ বুঝছেই না। দৃশ্যপরম্পরাও বোঝা যাচ্ছে না।

ভারতে শিশুরাও রামায়ণের গল্প জানে। যে-কোনও দৃশ্য দেখলেই সকলে বুঝে যায়, কখন কোনটা ঘটছে। এখানে এরা ধরতে পারবে কী করে! সবাই ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করছে, হু ইজ দিস ওল্ড ম্যান? হুজ চিলড্রেন আর দিজ টু কিডস?

এর মধ্যে ঢুকে পড়ল শত্রুঘ্নরূপী বেচা চন্দ্র। সে এমনই ঘাবড়ে গেছে যে হাঁটছে কাঠের পুতুলের মতন, ফ্যালফ্যাল করছে চোখ।

মিস মারবেরি বলে উঠল, লুক অ্যাট দ্যাট ম্যান, হ্যাজ হি এভার বিন অন দা স্টেজ?

মারবেরির অভিজ্ঞ চোখ ঠিকই ধরে ফেলেছে। বেচারি বেচা চন্দ্র তো শত্রুঘর পার্ট দূরের কথা, জীবনে কোনও পার্টই করেনি।

শ্ৰীশ এসে আবার পার্ট ভুলে গেল, শিশিরকুমার তার দিকে রাগ রাগ চোখে তাকাতেই সে কাঁপতে কাঁপতে ধড়াস করে পড়ে গেল অজ্ঞান হয়ে। তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হল ভেতরে।

এর ফলে হল কী, একটু পরে শিশিরকুমারের মূর্ছা যাওয়ার কথা, মাঠে মারা গেল সেই দৃশ্যটা। তিনি আবেগকম্পিত কণ্ঠে বললেন, লক্ষ্মণ, ভরত, ফিরাও বালকে!

তখনই আলো নিভে যাওয়ার কথা। মঞ্চ অন্ধকার হল না। ফটফটে আলোর মধ্যে শিশিরকুমারকে সজ্ঞানে মূর্ছা যেতে হল।

মিস মারবেরি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্টপ ইট, স্টপ ইট! ক্যানসেল দা শো! ক্যানসেল দ্যা কনট্রাক্ট! ডিসগাস্টিং!

অন্য আমন্ত্রিতরাও মিটিমিটি হাসছে। কার্ল রিড এরিক এলিয়টকে বলল, ইউ চিটেড আস!

এরিক পালাবার পথ পায় না। তবু সে শিশিরকুমার ও তার দলকে চরম অপমান ও বিপদের মধ্যে ফেলে পালিয়ে গেল।

পরদিন ‘নিউ ইয়র্ক সান’ নামে সংবাদপত্রে লেখা হল, কলকাতা থেকে একটি বোগাস থিয়েটার কোম্পানি এসেছে।

হোটেলে থাকার খরচ কে দেবে, তাই দু’দিন পরেই সতু সেনের উদ্যোগে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল পুরো দলটির জন্য। এর পর কী হবে, তা কেউ জানে না। সত্যিই কি মিস মারবেরি ও তার সঙ্গীরা চুক্তি বাতিল করে দিল, তাদের তো আর পাত্তাই নেই। কিন্তু ফেরার ব্যবস্থা তো তাদেরই করে দিতে হবে!

এরকম অবস্থায় শিশিরকুমারের মদ্যপানের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবার কথা। কিন্তু কঙ্কাবতী এবার শক্ত হাতে হাল ধরল, কিছুতেই সে শিশিরকুমারকে তিন পেগের বেশি খেতে দেবে না। বোতল কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে। পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে। বিদেশবিভূঁইয়ের ব্যাপার, বেশি পান করলে শিশিরকুমারের মেজাজের ঠিক-ঠিকানা থাকে না। কখন বাইরে বেরিয়ে যাবেন, কখন কাকে কী রূঢ় কথা বলে ফেলবেন, তাতে আবার কী বিপদ হবে কে জানে!

দলের অনেকেই ভয়ে প্রায় কাঁপছে বলা যায়, গলার আওয়াজ খনখনে হয়ে গেছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যত, শেষে কি এই বিদেশ-বিভুঁয়ে প্রাণ দিতে হবে? নাটক অভিনয়ের আর কোনও আশা নেই, কী করে ফেরার ব্যবস্থা হবে তাও কেউ জানে না। পাউরুটি আর মাখন ছাড়া আর কোনও খাদ্য নেই। এই সামান্য খাদ্যেরও খরচ ক’দিন জোগানো যাবে?

অচেনা জায়গা, রাস্তা দিয়ে এত গাড়ি-ঘোড়া চলে যে কেউই বাইরে বেরুবার সাহস করে না। সবাই মিলে ভাড়াবাড়ির একতলায় বসে সর্বক্ষণ এই একই বিপদের কথা আলোচনা করে। এরই মধ্যে একজনের সঙ্গে অন্য জনের কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত—গড়িয়ে যায় ঝগড়া। কে যে কার ওপর কেন দোষারোপ শুরু করে তার কারণ বোঝা যায় না, অনেকেরই মুখের কোনো লাগাম নেই। যে বেচা চন্দ্র স্টেজ রিহার্সালের সময় একটা কথাও বলতে পারেনি, এখন তার মুখ দিয়ে কুকথার তুবড়ি ছোটে।

একমাত্র শিশিরকুমারই যে শুধু মদ্যপান করেন তা নয়, অন্য আরও বেশ কয়েকজনের সে নেশা আছে। কয়েকজন অভিনেত্রীরও। এদিকে সুখাদ্য জুটছে না। তবু কোন্ মন্ত্রবলে মদের বোতল এসে যায় কে জানে। খানিকটা মদ্যপানের পর কেউ অন্য একজনের গলা জড়িয়ে কাঁদে, কেউ প্রকাশ্যেই অন্যের পোশাক খোলার জন্য টানাটানি করে কাঁদে। এক এক সময় ঝগড়া-বিবাদ ও নেশার হল্লায় নারকীয় দৃশ্য রচিত হয়।

এই সময় কোনও একজনের অন্তত সুস্থির থাকা দরকার।

কঙ্কাবতী অ্যালকোহল স্পর্শ করে না, তার মাথা ঠান্ডা এবং ভয়-ডর কম। শুধু শিশিরকুমারকেই নয়, পুরো দলটিকেই সামলাবার দায়িত্ব নিল সে। ওপরের দুটি ঘরের অন্যটিতে থাকে তারাকুমার আর প্রভা, বাকি সবাই নীচের তলায়। সর্বক্ষণ ওপর-নীচ করে কঙ্কাবতী, কখনও সে শিশিরকুমারের কাছ থেকে বোতল কেড়ে নেয়, কখনও একতলায় এসে অন্যদের ঝগড়া মেটায়।

তার ব্যক্তিত্ব যেন নতুনভাবে বিকশিত হয়েছে এখানে। কেউ আর তাকে অমান্য করার সাহস পায় না।

ভবিষ্যত সম্পর্কে ভয় আর অনিশ্চয়তা থেকেই আসে তিক্ততা, আর সেই তিক্ততা কাটিয়ে ওঠার একমাত্র উপায় অন্যদিকে মন ফেরানো।

কঙ্কাবতী সকাল-বিকেলে সবাইকে নিয়ে গান শুরু করে। নিজের গানে উদ্বুদ্ধ করে অন্যদের। একে একে প্রত্যেকেই গলা মেলায়। গানের সময় কয়েকজনের চক্ষু দিয়ে নামে অশ্রুধারা।

আহত সিংহের মতন গজরান শিশিরকুমার। দেশে থাকলে তাঁকে কেউ এরকম অপমানের দশায় ফেলে পার পেত না। এখানে তিনি অসহায়। যারা তাঁদের নিয়ে এসেছে, তাদের আর দেখাই যাচ্ছে না, তারা সব দায়িত্ব থেকে হাত ধুয়ে ফেলল? একমাত্র সতু সেনের ভরসায় আর কতদিন থাকা যাবে?

শিশিরকুমার একদিন সতু সেনকে বললেন, চুক্তির কাগজপত্র সব তো আমার কাছে আছে। ওদের নামে মামলা করা যায় না?

সতু সেন বলল, হ্যাঁ যাবে না কেন। মামলা করলে আমরা জিতব অবশ্যই, ভালো ক্ষতিপূরণও পেতে পারি। কিন্তু ওরা কী করবে জানেন? যতদূর সম্ভব এই মামলা টেনে নিয়ে যাবে, শুনানি শেষ হতে তিন বছরও লেগে যেতে পারে। ততদিন এখানে থাকবেন কী করে? বাড়িভাড়া কে দেবে? খাওয়া-পরার খরচই বা চলবে কী করে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিশিরকুমার বললেন, তা হলে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে কৃপাপ্রার্থী হয়ে বসে থাকব? সবাই দেশে ফেরার জন্য উতলা হয়ে গেছে। দিনের পর দিন পাউরুটি আর বিস্কুট খাওয়া কারও সহ্য হচ্ছে না।

সতু সেন বলল, আর ক’টা দিন সবুর করুন। একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। বিদেশ থেকে একটা দল এনে তারপর তাদের শো না করিয়েই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া, এটা কোনও নামজাদা ইমপ্রেশারিওর পক্ষেও ভালো নয়। তাতে সুনামের হানি হয়। আগের ডেট ক্যানসেল হয়ে গেছে, কোনও ভালো থিয়েটার হলে নতুন ডেট পাওয়া খুবই শক্ত। কার্ল রিডের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল, ওরা সম্ভবত নভেম্বর মাসে শো করাবার কথা ভাবছে। আপনাদের খরচপত্রের কিছু টাকাও পাঠাবে দু’-একদিনের মধ্যে।

শিশিরকুমার বললেন, আমি তো বলেইছি, অন্তত তিন দিন রিহার্সালের ব্যবস্থা করলেই আমি নাটকটাকে ভালোভাবে দাঁড় করিয়ে দিতে পারব!

সতু সেন এবার হেসে ফেলে বলল, কিন্তু নাচের মেয়েদের তো সুন্দরী করে তুলতে পারবেন না। নাচের দৃশ্য এদের চাই-ই চাই। ব্যালে নাচে এখানকার যে-সব মেয়েরা তাদেরই গায়ে খয়েরি রং মাখিয়ে নামাতে হবে।

কঙ্কাবতী ওপর থেকে নেমে এসে বলল, সতুবাবু, সবাই যে ভাত না খেয়ে প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। চাল-ডাল জোগাড় করে দিতে পারেন না? তা হলে নিজেরাই এখানে খিচুড়ি ফুটিয়ে নিতে পারি।

সতু সেন বলল, কয়েক জায়গায় খোঁজ করেছি। পাইনি। ডাল নামে বস্তুটার তো এরা নামই শোনেনি। রাইস এরা জানে বটে, কালো লোকেরা খায়। সাহেবদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে আলু। আপনারা আলু খেতে পারেন না?

কঙ্কাবতী ঠোঁট উলটে বলল, শুধু শুধু রোজ আলু সেদ্ধ খাওয়া যায়? বমি আসে।

সতু সেন বলল, আমি তো রান্নাবান্নার ধার ধারি না। হট ডগ আর স্যান্ডুইচ খেয়েই দিব্যি কাটিয়ে দিই!

কঙ্কাবতী ফিকফিক করে হেসে বলল, হট ডগ! প্রভাদির ধারণা, ওতে কুকুরের মাংস থাকে। চোখ কপালে তুলে বলেছিল, এমা, এরা কুকুরের মাংস খায়?

সতু সেন বললেন, না, না।

শিশিরকুমার বললেন, কুকুর না হলেও ওর মধ্যে গোরু-শুয়োরের মাংস থাকে। ওদের বলে দিয়ো, না জেনেশুনে যেন কিছু না খায়। শেষে আমার নামে জাত খোওয়ানোর অপবাদ দেবে। এমনিতেই তো অভিযোগের অন্ত নেই।

কঙ্কাবতী বলল, এ বাড়ির সামনে একজন ঠেলা গাড়িতে হট ডগ, হট ডগ বলে চেঁচিয়ে বিক্রি করছিল। আমি একটা খেয়ে দেখেছি। সর্ষে বাটা দিয়ে খেতে দারুণ লাগে। আমার কোনও সংস্কার ফংস্কার নেই। আচ্ছা, এখানে আমাদের দিশি লোকদের মুদিখানা নেই!

সতু সেন বললেন, উঁহুঃ! দেখিনি কোথাও। আমাদের দেশের লোক এত দূরে ব্যবসা করতে আসবে? সে রকম বুকের পাটা কার আছে? তবে, চিনেম্যানদের দোকান আছে কয়েকটা। চিনেম্যানরা অপ্রতিরোধ্য, পৃথিবীর কোথায় না ওরা যায়!

শিশিরকুমার বললেন, এরকম থিয়োরি আছে, কলম্বাস বা আমেরিগো ভেস্পুচিরও আগে একদল চিনেম্যান এদেশের প্যাসিফিক উপকূলে পৌঁছে গিয়েছিল। আমেরিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব চিনেদেরই দেওয়া উচিত।

সতু সেন বলল, চিনেরা যদি আগে এসেও থাকে, ওরা তো সঙ্গে বন্দুক, পিস্তল আনেনি, এদেশের আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের ধরে ধরে পেটায়নি। প্যাসিফিক কোস্ট, মানে এখনকার ক্যালিফোর্নিয়ার ওদিকটা ছিল তখন জনমানবশূন্য।

কঙ্কাবতী বলল, আমাকে একটা গ্রসারি স্টোরে নিয়ে চলুন না। দেখি কী কী পাওয়া যায়। দিনের পর দিন বাড়ির মধ্যে বসে আছি। কিছুই তো দেখা হল না।

সতু সেন বলল, ঠিক আছে চলুন। চার পাঁচ ব্লক দূরেই একটা ছোট শপিং কমপ্লেক্‌স আছে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল তিনজনে।

প্রথম দু’দিন তুষারপাতের পর হঠাৎ শীতের প্রকোপ অনেকটা কমে গেছে। ঝলমলে রোদ। কনকনে বাতাসও বন্ধ।

হাঁটতে হাঁটতে কঙ্কাবতী বলল, এদেশে এসে প্রথম কোন জিনিসটা চোখে পড়ে বলুন তো! রাস্তায় মেয়ে হাঁটছে। একা একা। আমাদের দেশে এরকমটা ভাবাই যায় না। এরা বুঝি কাজ করতে যায়! দেখুন, দেখুন, পুরুষ আর মেয়ে প্রায় সমান সমান।

সতু সেন বলল, হ্যাঁ, এটা আমেরিকার বিশেষত্ব। ইউরোপেও এমন দেখতে পাবেন না। এখানে মেয়েরা সমান অধিকার আদায় করে নিয়েছে। একমাত্র আর্মি ছাড়া আর সব জায়গায় মেয়েরা কাজ করে। কিছু কিছু বড়লোকের বিধবার দারুণ প্রতাপ।

কঙ্কাবতী বলল, আমার এ দেশটা বেশ ভালো লেগেছে। এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করে। নিজের দেশে মেয়েদের কোনও সম্মান নেই।

শিশিরকুমার গম্ভীরভাবে বললেন, তা হলে তোমাকে একাই থাকতে হবে।

সতু সেন বলল, আপনি উচ্চশিক্ষিত মানুষ, আপনি ইচ্ছে করলেই এখানে কাজ পেয়ে যেতে পারেন। এই প্রাচুর্যের দেশে আপনার থাকতে ইচ্ছে করে না?

শিশিরকুমার জোর দিয়ে বললেন, না। লক্ষ ডলার পেলেও থাকব না। এখানে আমাকে কে চিনবে? কলকাতায় আমি শিশির ভাদুড়ী। রাস্তা দিয়ে এরকম হাঁটলে কত লোক এসে নমস্কার করত।

সতু সেন বলল, একটা মজার কথা শুনবেন? বছর তিনেক আগের কথা, আমি তখন কলকাতায় মানিকতলার দিকে হাঁটছি, মোড়ের মাথায় একজন লোক আর একজনকে ধমকে ধমকে কী যেন বলছে। পাশ দিয়ে একজন লোক বলে উঠল, ইস, লোকটা যেন শিশির ভাদুড়ী! আপনি মিথ হয়ে গেছেন।

শিশিরকুমার অট্টহাস্য করে উঠে বললেন, সেই শিশির ভাদুড়ীর এ দেশে কী অবস্থা! যেন বন্দি সিসিফাস!

আরও এক ব্লক যাবার পর কঙ্কাবতী হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

দু’বার জোরে নিশ্বাস টেনে বলল, ভাতের গন্ধ পাচ্ছি যেন! হ্যাঁ, ঠিক ভাতের গন্ধ?

শিশিরকুমার একটু একটু মাথা নেড়ে বললেন, হতে পারে, হতে পারে।

পাশেই একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁ। সেটা দেখতে পেয়ে সতু সেন বলল, এটা বোধহয় নতুন খুলেছে। আগে তো ম্যানহাটনে চাইনিজ দোকান ছিল না।

সব রেস্তোরাঁতেই দরজার বাইরের দেওয়ালে খাবারের মেনু টাঙানো থাকে। সতু সেন কাছে গিয়ে দেখে এসে বলল, কঙ্কাদেবী, আপনার তো দারুণ নাক। সত্যি এখানে দু’রকম ভাত পাওয়া যায়, প্লেন রাইস, আর মিক্সড ফ্রায়েড রাইস।

কঙ্কাবতী প্রায় নেচে উঠে বলল, চলো চলো! খেয়ে আসি। ভাতের গন্ধেই মনটা আনচান করছে।

শিশিরকুমার রাজি হয়েও রেস্তোরাঁর গেটের কাছে থেমে গেলেন।

তিনি বললেন, দ্যাখো, আমাদের দলের অন্য সবাই তো ভাতের জন্য কাতর হয়ে আছে। ওদের না জানিয়ে আমরা ক’জন ভাত খেয়ে ফেলব, দ্যাট্‌স নট রাইট। নট প্রপার।

কঙ্কাবতী বলল, ওমা তাই তো! সবাই আমাদের হ্যাংলা বলত।

সতু সেন বলল, ঠিক আছে। দু’-একদিনের মধ্যেই ওরা টাকা পাঠাবে বলেছে, তা যদি দেরিও করে, সোমবার আমি মাইনে পাব, দলের সবাইকে এখানে খাওয়াব। এই দোকানদারের কাছেই জানা যাবে, ওরা কোথা থেকে চাল কেনে।

কঙ্কাবতী বলল, আজ খাই বা না খাই, ভালো করে গন্ধ শুঁকে তো যাই অন্তত! আঃ!

এর পরেও কেটে গেল তিন সপ্তাহ৷ ভাত সমস্যার সুরাহা হয়েছে বটে, কিন্তু আসল ব্যাপারে জানা যাচ্ছে না কিছুই। সতু সেন মাঝে মাঝে এসে আশার কথা শুনিয়ে যায়। সে আর একজন ইমপ্রেশারিওর সঙ্গে যোগাযোগ করছে, সে লোকটি ইহুদি, সে খানিকটা উৎসাহও দেখিয়েছে। তবে ব্রডওয়েতে আর অদূর ভবিষ্যতে শো করার উপায় নেই, ক্রিসমাস এসে যাচ্ছে, এখন সব বুক্ড। বাইরের কোথাও হতে পারে।

শিশিরকুমার এখন আর রাগারাগিও করতে পারেন না। ভবিতব্যের ওপর ভরসা করা ছাড়া গতি নেই।

শুয়ে শুয়ে তিনি বহুক্ষণ ধরে সংবাদপত্র পড়েন।

ভারত সম্পর্কে প্রায় দিনই কোনও খবরই থাকে না, যেন অত বড় দেশটার কোনও অস্তিত্ব নেই! যেদিন খবর থাকে, তা শুধু খারাপ খবর। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, নারী-নির্যাতন। ভারতীয় সাধু-সন্ন্যাসীদের ওপর কাগজওয়ালাদের খুব রাগ। সেই যে স্বামী বিবেকানন্দ বার দুয়েক এসে অনেকের মন জয় করে গেছেন, লেকচার টুর দিয়ে অনেক অর্থ উপার্জন করেছেন, তারপর থেকে লোভে লোভে বহু সাধু-সন্ন্যাসী, আসল বা মেকি, প্রতি বছর এ দেশে আসে। নানারকম সাজপোশাক করে, ভেলকি দেখায়, ভারতীয় দর্শনের ত্যাগ ও তিতিক্ষা বিষয়ে গালভরা বাণী শোনায়। মূল উদ্দেশ্য, টাকার থলি নিয়ে দেশে ফেরা। যাবার সময় তারা সংবাদপত্রে যে সব সাক্ষাৎকার দেয়, তাতে আমেরিকাকে মেটেরিয়ালিজ্ম-এর জন্য গাল পেড়ে যায়।

‘ভ্যারাইটি ফেয়ার’ নামে একটি পত্রিকা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও খুব খারাপ কথা বলেছে। রবীন্দ্রনাথকেও উক্ত সাধুদের দলে ফেলে লিখেছে, স্যার রবীন্দ্রনাথ টেগোরের সব কিছুই ফাঁকা আওয়াজ। তাঁর তথাকথিত মিস্টিক্যাল কবিতাগুলি শুধু-আধা-বুদ্ধিজীবীরাই তারিফ করে। নিজের ছবিতে তিনি নিজেকে যথা সম্ভব ধর্মগুরু বা সন্ত হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করেন, কারণ ওই যে সব মহাত্মা ও ‘স্বোয়ামি’রা ঝাঁকে ঝাঁকে প্রতি বছর এসে গোটা আমেরিকা ছেয়ে ফেলে টাকা রোজগারের জন্য, রবীন্দ্রনাথ তো তাদের মধ্যেই প্রধান।

এসব পড়ে শিশির খুব কষ্ট পান। তাঁর মনে হয়, অর্থোপার্জনের আশায় এরকম অগোছালোভাবে এ দেশে দল নিয়ে আসাটা তাঁর খুবই ভুল হয়েছে। কেন আর এদের দয়ার ওপর নির্ভর করে এখানে পড়ে থাকা! কিন্তু নিজে থেকে ফেরারও তো উপায় নেই।

বারবার তাঁর মনে হচ্ছে, ভারতসভ্যতা বিদেশে প্রচার করতে হলে সম্রাট অশোকের মতন রাজশক্তি দরকার।

অবশেষে ১২ জানুয়ারি ‘ভ্যান্ডারবিল্ট’ থিয়েটার ‘সীতা’র অভিনয়ের ব্যবস্থা হল। সেই পাকা খবর জেনে শিশিরকুমার বাড়ির মধ্যেই রিহার্সালের ব্যবস্থা করলেন কয়েক দিন। একদিন স্টেজ রিহার্সালেরও সুযোগ পাওয়া গেল।

শিশিরকুমার সবাইকে বোঝালেন, সবাইকে মন-প্রাণ ঢেলে অভিনয় করতে হবে। এরা বুঝুক বা না বুঝুক। সেই ‘তপতী’র কথা মনে আছে? সব চেয়ার ছিল ফাঁকা, কিন্তু আমরা অভিনয়ে কোনও ত্রুটি রাখিনি। কেউ ক্ল্যাপ দিক বা না দিক, আমরা নিজেদের কাছে খাঁটি থাকব।

নাচের দলের মেয়েদের বাদ দিতেই হল। কিছু ভাড়া-করা মেক্সিকান মেয়েকে এনে শেখানো হল ওরিয়েন্টাল ডান্স। ওরিয়েন্টাল ডান্স মানে হাত-পা তুলে ধেই ধেই নৃত্য। মেয়েগুলি লম্বা লম্বা, গায়ের রং অনেকটা তামাটে, তার ওপরেও লাগানো হল কিছুটা খয়েরি রঙের পোঁচ। এদের সকলেরই পিঠ-ছাওয়া চুল, অনেকটা উত্তর ভারতীয় মেয়েদেরই মতন দেখায়, কিন্তু শাড়ি সামলাতে পারে না কিছুতেই। আর ঊরু-প্রদর্শন না করে এরা নাচের কথা ভাবতে পারে না কিছুতেই। কঙ্কাবতী যত্ন করে সব কটি মেয়েকেই শাড়ি পরিয়ে দিল বটে, কিন্তু নাচের সময় ঘাগড়া বা স্কার্ট ঘোরানোর ভঙ্গিতে শাড়ি ঠিক ঊরুতে উঠে যায়।

এই ভাড়া করা নাচিয়েদের আনার শর্ত মেনে নিতেই হল শিশিরকুমারকে। তিনি ভাবলেন, কলকাতাতেও দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য কারণে-অকারণে অনেক নাটকেই একটা নাচের দৃশ্য জুড়ে দিতে হয়। এখানকার দর্শকরাও নাচ চায়, অর্থাৎ দর্শক শ্রেণী একই। তফাত শুধু এই, কলকাতার দর্শকরা মঞ্চের ওপর কয়েকটি মেয়ের শরীর দোলানো দেখেই সন্তুষ্ট, তার বেশি কিছু আশা করে না, আর এই উন্নত দেশের দর্শকদের নর্তকীদের শরীরের অনেকখানি না দেখতে পেলে আশ মেটে না।

অভিনয়ের আগের দিন থেকেই একটুও মদ্যপান করলেন না শিশিরকুমার। ধীর, স্থির রইলেন, স্নান করলেন দু’বার। মঞ্চে প্রবেশ করেই তিনি ভাবলেন, আমেরিকান দর্শক নয়, সামনে রয়েছেন সুনীতিকুমার হেমেন্দ্রকুমারের মতন তাঁর বন্ধুরা, এবং শরৎচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ। এঁদের মনোরঞ্জন করাই আসল কথা।

এবারে অন্য সকলেও কোনও ভুল-ভ্রান্তি না করে মান রক্ষা করলে বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারের। শেষ দৃশ্যে করতালি ধ্বনিও সারা প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে। পত্রপত্রিকায় সুখ্যাতিও বের হল খুব, কিন্তু অর্থোপার্জন হল না। যা পাওয়া গেল, তাও প্রায় নিঃশেষ হল আগেকার খরচ মেটাতে।

ফেরার পথে দিল্লির বড়লাটের সামনে অভিনয় করতে হল এক রাত্রি।

তেরো – পুরী কোনারক, সমুদ্রতীরে।

রাত আড়াইটে, সরকারি ডাকবাংলোর বারান্দায় বসে আছেন শিশিরকুমার।

চতুর্দিক অন্ধকার, তবু সমুদ্রের দিকে তাকালে অস্পষ্ট একটা আলোর রেখা দেখা যায়। শোনা যাচ্ছে অবিশ্রান্ত ঢেউয়ের শব্দ। এখানকার বাতাসের কোনও নির্দিষ্ট দিক নেই, এলোমেলোভাবে ঘোরে। সামনের বালিতে একটা কাগজের ঠোঙা পড়ে আছে, সেটা একবার এদিক, আর একবার ওদিকে ওড়াউড়ি করছে।

বোতল শেষ হয়ে এসেছে, গেলাসে একটু একটু চুমুক দিচ্ছেন শিশিরকুমার। চুরুট পুড়ছে একটা পর একটা।

একবার হাঁক দিলেন, কঙ্কা, কঙ্কা, এবার ওঠো। এরপর দেরি হয়ে যাবে!

খাটের ওপর পাশ ফিরে শুয়ে আছে কঙ্কাবতী, বিকেলে বাইরে যাবার উপযোগী যেমন সাজগোজ করেছিল, এখনও সেই শাড়িই শরীরে, রাতপোশাক আর পরা হয়নি। ঘুমের মধ্যেও তার মুখে লেগে আছে অভিমান।

শিশিরকুমার নিশাচর, রাতের পর রাত না ঘুমোলেও তাঁর কিছু এসে যায় না, দিনের বেলা পুষিয়ে নেন। কিন্তু মেয়েরা বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে পারে না, সেটা যেন শোভন নয়।

শিশিরকুমারকে বেলা এগারোটাতেও কেউ ডাকতে এসে যদি শোনে, তিনি এখনও ঘুমোচ্ছেন, সে অবাক হয় না। কিন্তু বাড়ির বউ বেলা এগারোটায় ঘুমন্ত? সে যে সংসারের অলক্ষ্মী!

কঙ্কাবতীকে প্রায়ই রাত জাগতে হয় একটা-দেড়টা পর্যন্ত, আবার সকালবেলা ছ’টা-সাড়ে ছটা বাজতেই উঠে পড়তে হয়। তখন সারা সংসার জাগে, দাস-দাসীরা যে-কোনও কাজের ব্যাপারে গৃহকর্ত্রীর নির্দেশ চায়। জলখাবার, দুপুরের রান্নার জন্য বাজার, বহিরাগতদের সঙ্গে কথা বলা, এসব সামলাতে হয় কঙ্কাবতীকে। এসব তার অভ্যেস হয়ে গেছে।

আজও রাতে কঙ্কাবতী ঘুমোতে গেছে মাত্র ঘণ্টা দেড়েক আগে, রাত আড়াইটের সময় ডাকাডাকি শুরু করেছেন শিশিরকুমার।

কয়েকবার ডাক শোনার পর কঙ্কাবতী চোখ মেলে বললেন, কেন বিরক্ত করছ আমাকে বলেছি তো আমি আজ যাব না!

শিশিরকুমার বললেন, কেন যাবে না? সব ঠিক হয়ে আছে। এক্ষুনি গাড়ি এসে পড়বে।

কঙ্কাবতী আবার বললেন, আসুক গাড়ি, বলেছি তো আমি যাব না।

শিশিরকুমার বারান্দা ছেড়ে উঠে এলেন ঘরের মধ্যে। খাটের এক পাশে বসে কঙ্কাবতীর গায়ে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বললেন, ওঠো লক্ষ্মীটি। গেলে তোমার ভালো লাগবে।

কঙ্কাবতী ঝট করে শিশিরকুমারের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, প্লিজ ডোন্‌ট টাচ মি! অ্যাটলিস্ট টুনাইট!

শিশিরকুমার অপরাধীর মতন হাত গুটিয়ে নিলেন।

কঙ্কাবতী উপুড় হয়ে শুল, তার শরীরটা দুলে দুলে উঠছে, কাঁদছে নিঃশব্দে।

একটু বাদে শিশিরকুমার আবার অনুনয় করে বললেন, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন উঠে মুখ টুখ ধুয়ে নাও, ওখানে গেলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।

কঙ্কাবতী বলল, না।

বারান্দায় ফিরে এসে শিশিরকুমার অবশিষ্ট পানীয়টুকুতে চুমুক দিলেন।

আজ সন্ধ্যায় একটা বড় ভুল হয়ে গেছে। কঙ্কাবতী মনে খুব আঘাত পেয়েছে।

অথচ ব্যাপারটা যে এমন গুরুতর, তা তিনি তখন বুঝতে পারেননি।

আমেরিকা থেকে ফিরেছেন প্রায় রিক্ত অবস্থায়। নাট্যমন্দির ভেঙে গেছে, স্টারের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন। একেবারে বেকার অবস্থা। গাড়িটাও বিক্রি করে দিতে হয়েছে।

কলকাতায় থাকলে যার সঙ্গে দেখা হয়, সে-ই জিজ্ঞেস করে, এবার কী করছেন? এরপর কী করবেন? কাগজওয়ালাদেরও ওই একই প্রশ্ন। যেন তাদের খুব মাথাব্যথা!

এসব প্রশ্নের উত্তর শিশিরকুমার নিজেই জানেন না।

ওদের এড়াবার জন্যই বাইরে কোথাও ঘুরে আসতে মন চাইছিল। সব ব্যবস্থা করে দিল অলীক। তার এক দাদা এখানকার কালেক্টরের বন্ধু, তাঁর মারফত বুক করা হয়েছে পুরীর বাংলো। তাঁরই লোকজন কটক স্টেশন থেকে অভ্যর্থনা জানিয়ে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছে এখানে। তিনি নিজে এসেও দেখা করে গেছেন।

পুরীতে বাঙালিদের সংখ্যা কম নয়। তাদের একটি নিজস্ব ক্লাবও আছে সংগীত সম্মিলনী নামে। শিশিরকুমারের আগমনবার্তা ঠিকই রটে যায়। দলে দলে বাঙালি দেখা করতে আসে, অনেকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে চায় বাড়িতে।

আজ সন্ধেবেলা সংগীত সম্মিলনীতে শিশিরকুমারের একটা সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় গাড়ি আসবে। কঙ্কাবতীও সেজেগুজে তৈরি হয়ে বসে ছিল। যথা সময়ে দু’জন যুবক এল নিয়ে যেতে।

কঙ্কাবতীকে দেখে তারা যেন কেমন অস্বস্তিবোধ করল। এর আগের দু’দিন তারা কঙ্কাবতীকে ‘বউদি’ ‘বউদি’ বলে ডেকে কত খাতির করেছে, আজ কথাই বলতে চায় না।

একসময় শিশিরকুমারকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে তারা বলল, স্যার, ওনাকে নিয়ে যাওয়ার একটু অসুবিধে আছে। কালই আমাদের ক্লাবের একজন মেম্বার জানিয়েছে, উনি আপনার ম্যারেড ওয়াইফ নন। তারপরই ক্লাবের মিটিং ডেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আপনাকে একাই সংবর্ধনা দেওয়া হবে। মানে, ওখানে অনেক ভদ্র ঘরের মেয়ে-বউ তো আসবে।

শিশিরকুমার বললেন, উনিও তো ভদ্রঘরের মেয়ে। লেখাপড়া জানেন।

ওরা বলল, না মানে, বিবাহিত তো নন। বোঝেনই তো স্যার, এখানকার বাঙালিরা খুব কনজারভেটিভ, আমরা দু’-একজন এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করেছিলাম, কিন্তু ক্লাবের যা সিদ্ধান্ত… মানে ওখানে অনেক ছোট ছেলেমেয়েও তো থাকবে, তারা যদি কিছু জিজ্ঞেস করে… বেশিক্ষণ তো নয়, বড় জোর ঘণ্টা দেড়েক পরেই আপনি ফিরে আসবেন।

এই সময় শিশিরকুমারের দৃঢ় প্রতিবাদ করা উচিত ছিল না? তিনি বলতে পারতেন না যে, তা হলে আমিও যাব না?

কিন্তু তিনি ভাবলেন, তাতে আরও গোলমাল হবে, লোকে আড়ালে বলাবলি করবে অনেক কথা। তার চেয়ে কঙ্কাবতীকে পরে বুঝিয়ে বললেই হবে।

তিনি বললেন, কঙ্কা, আমি ঘুরে আসছি, তুমি ততক্ষণে বইটই পড়ো।

কঙ্কাবতীর চোখ দুটি প্রথমে বিস্ফারিত হয়ে গেল, তারপর মুখখানা ছেয়ে গেল অপমানের কালিমায়। এ কি সত্য হতে পারে? শিশিরকুমার নিজেই তাকে তৈরি হয়ে নেবার জন্য কয়েকবার তাড়া দিয়েছিলেন, এখন তিনিই তাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন?

দেড় ঘণ্টার বদলে আড়াই ঘণ্টা হয়ে গেল ফিরতে। লোকজনের কথা আর থামেই না। আমেরিকার গল্প শুনতে চায়। শিশিরকুমারকে দু’খানা কবিতাও আবৃত্তি করতে হল৷

প্রচুর ফুল, জগন্নাথ দেবের প্রসাদ, একটি মানপত্র ও একটি রুপোর থালা নিয়ে বাংলোয় ফিরেই তিনি এ ঘরে ও ঘরে খুঁজলেন কঙ্কাবতীকে। কোথাও সে নেই।

শিশিরকুমার হাঁক দিলেন, ভিখা, ভিখা!

নাট্যমন্দির দলের অনেকেই ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু চিরবিশ্বস্ত ভিখা রয়ে গেছে এখনও। সে ছায়ার মতন শিশিরকুমারের সঙ্গে সঙ্গে ফেরে।

সে আসতেই শিশিরকুমার জিজ্ঞেস করলেন, কঙ্কা কোথায় রে? বাইরে গেছে কারুর সঙ্গে?

ভিখা বলল, না তো। দিদিমুনি সেই বিকেল থেকেই ওদিক পানে বসে আছে। অন্ধকার হয়ি গেল, কতবার ডেকিছি।

‘ওদিক পানে’ মানে বাংলোর বাইরের দেওয়ালের এক পাশে বসে আছে কঙ্কাবতী। বালি দিয়ে সে একটা বাড়ি তৈরি করেছে, বেশ বড় বাড়ি, তার তিন দিকে অলিন্দ।

শিশির হাঁটুগেড়ে সেখানে বসে পড়ে বললেন, এই নাও, আমি তোমার জন্য ফুল এনেছি।

কঙ্কাবতীর হাতে ফুলের গুচ্ছ দেবার চেষ্টা করতেই সে সেগুলো ছুড়ে ফেলে দিল দূরে।

শিশির স্তোকবাক্যের মতন বললেন, ওখানে বিশেষ কিছু হয়নি। আমার তেমন ভালোও লাগেনি। ওদের আমি বলেছি, তোমার শরীর খারাপ, তাই তুমি যাওনি।

কঙ্কাবতী ঝংকার দিয়ে বলল, মোটেও তা নয়। আমি জানি, ওরাই বলেছে, আমি তোমার বউ নই, আমি বাজারের মেয়েছেলে, আমাকে ভদ্রসমাজে নিয়ে যাওয়া চলে না।

কঙ্কাবতীর বাহু ছুঁয়ে শিশির দুর্বলভাবে বললেন, না, না, তা নয়—

কঙ্কাবতী খানিকটা সরে গিয়ে বললেন, আমাকে ছুঁয়ো না তুমি। আমি অস্পৃশ্য, আমি ঘৃণ্য।

শিশির বললেন, ছি ছি, এ কী বলছ তুমি? আমি তোমাকে কখনও তেমন ভেবেছি?

কঙ্কাবতী বলল, বেডরুমে তা মনে করো না। বাইরে, প্রকাশ্যে সেই ভাব দেখাও।

শিশির বললেন, না কখনও না।

কঙ্কাবতী বলল, আমার আর বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না। …ভেবেছিলাম সমুদ্রে গিয়ে ঝাঁপ দেব। কিন্তু সাঁতার জানি, তাতে বোধহয় মরণ হবে না। আমি, আমি তোমাকে নিষ্কৃতি দিয়ে যাব।

তারপর শুরু হল কান্না। এতক্ষণ এই কান্না অবরুদ্ধ ছিল।

কাঁদতে কাঁদতে বালির প্রাসাদটা চূর্ণ চূর্ণ করে দিয়ে কঙ্কাবতী দৌড়ে ঘরের মধ্যে চলে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।

এরপর ঘণ্টাখানেক বারান্দায় চুপ করে বসেছিলেন শিশির। মানভঞ্জনের আর বেশি কিছু সংলাপ তাঁর জানা নেই। তা ছাড়া, তাঁর মনের মধ্যে রয়েছে অপরাধবোধ। আজ বিকেলবেলা তাঁর সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হয়েছে।

কিন্তু কতক্ষণ আর চুপচাপ একা বসে থাকবেন? একসময় তো শরীর ছটফট করবেই তৃষ্ণায়। ওই বন্ধ ঘরটাতেই রয়েছে মদের বোতল।

তা ছাড়া, শিশিরের মনে হল, অনেকক্ষণ সাড়াশব্দ নেই। রাগের মাথায় মেয়েটা সাঙ্ঘাতিক কিছু করে বসবে না তো? যদি গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ে? এমন টেম্পেরামেন্টাল মেয়ে, তেমন করে ফেলতেও পারে।

তিনি ভিখাকে ডেকে বললেন, দেখ তো তোর দিদিমণি কী করছে! রাত্তিরে খেতে টেতে হবে না? ডাক।।

ভিখা অনেকক্ষণ দরজায় ধাক্কাধাক্কি করার পর কঙ্কাবতী খুলে দিল দরজা। ভিখাকে বলল, আমি আজ রাত্তিরে কিছু খাব না।

তারপর অনেকক্ষণ ধরে চলল ঝগড়া আর কান্নাকাটি। একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে কঙ্কাবতী।।

শিশিরও রাত্তিরে কিছু খাননি। একটা বোতল শেষ করলেও আজ আর নেশা জমেনি। মেজাজ বিগড়ে গেলে কি আর নেশা হয়? দোষ করল এখানকার বাঙালিরা, সেই ঝঞ্ঝাট সহ্য করতে হচ্ছে তাঁকে।

মিনিট দশেকের মধ্যে হেড লাইট জ্বেলে এসে পড়ল একটা গাড়ি। গাড়ি থেকে একটি যুবক নেমে ডাকতে লাগল, স্যার, স্যার।

এই সুদর্শন যুবকটির নাম জিতেন। এখানকার মুখার্জিদের বাড়ির এই ছেলেটি লেখাপড়ায় খুব ভালো। কিন্তু সে ঠিক করেছে কারুর অধীনে চাকরি করবে না। কিছুদিন গাড়ির ব্যবসা শুরু করেছিল, এখন আইন পড়ছে।

যুবকটি নাটকও খুব ভালোবাসে। নিজে নাটক লিখে অভিনয়ও করিয়েছে স্থানীয় বাঙালিদের নিয়ে। তার পক্ষে শিশির ভাদুড়ীকে সামনাসামনি দেখা আর কথা বলার সুযোগ পাওয়া একেবারে হাতে স্বর্গ পাওয়ার মতন। গত তিন দিন ধরে প্রায় সর্বক্ষণ এঁদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছে।

কোনারক দর্শনের ব্যবস্থাপনা তারই।

বারান্দায় উঠে এসে জিতেন বলল, স্যার, রেডি? দিদি কোথায়?

শিশিরকুমার লক্ষ করলেন, আজ সকালেও এই ছেলেটি কঙ্কাবতীকে বউদি সম্বোধন করেছিল, এখন বলছে দিদি। ভিখাও তো বউদিদি বলে না, বলে দিদিমুনি। তিনি আগে খেয়াল করেননি।

শিশিরকুমার বললেন, জিতেন, তোমার বউদি যেতে চাইছেন না। শরীর ভালো নেই।

জিতেন বলল, না না, আজ আকাশে মেঘ নেই, ওখানে দুর্দান্ত সানরাইজ দেখা যাবে। এমন সুযোগ আর পাবেন না। বাইরে বেরুলেই শরীর ভালো লাগবে। আমার মা বলেন, ভোরের হাওয়া লাগলে গায়, সকল অসুখ দূরে যায়।

জিতেন হাঁকডাক করতে করতে ভেতরে ঢুকে গেল। কঙ্কাবতীর কোনও ওজর আপত্তিই শুনলে না সে।

এই ছেলেটির আন্তরিক ব্যবহারে এঁরা দুজনেই বেশ সানন্দ বোধ করেছেন। কঙ্কাবতীকে উঠে চটপট তৈরি হয়ে নিতেই হল।

শিশিরকুমারের নির্দেশে ভিখা গাড়িতে তুলে দিল টিফিন কেরিয়ার, জলের কুঁজো, স্টোভ, আরও কী সব৷ শিশিরকুমারের ইচ্ছে কোনারকের সমুদ্রের ধারে বসে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে চা ও ব্রেকফাস্ট খাওয়া হবে। ওখানে তো কিছু পাওয়া যায় না।

সামনের সিটে ড্রাইভার, ভিখা আর জিতেন, পেছনে শিশিরকুমার আর কঙ্কাবতী। জিতেন মাঝে মাঝে কৌতূহলের সঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে ওঁদের দেখছে।

জিতেন এখনও বিয়ে করেনি। সদ্য একটি প্রেমে পড়ে কিছুটা চোট খেয়েছে। সে আজ জানতে পেরেছে এই দু’জন স্বামী-স্ত্রী নন। কিন্তু একসঙ্গে থাকেন যখন, প্রেমিক-প্রেমিকা নিশ্চয়ই।

প্রেমিক-প্রেমিকারা এরকম চুপ করে গোমড়া মুখে বসে থাকে?

কোনারকের দূরত্ব প্রায় পঁচাত্তর মাইল, গাড়ি ছুটছে খুব জোরে, আলো ফোটার আগে পৌঁছোতে হবে।

হঠাৎ একসময় খুঁক খুঁক শব্দ শুনে চমকে উঠল জিতেন। কেউ কাঁদছে নাকি! ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, আঁচল দিয়ে মুখ মুছছে কঙ্কাবতী। শিশিরকুমার অন্যদিকে চেয়ে সিগার টেনে যাচ্ছেন।

কোনারক মন্দিরের একেবারে কাছে পৌঁছোনোর পথ নেই। প্রায় আধ মাইল দূরে গাড়ি থামিয়ে হেঁটে যেতে হয়।

আকাশে শুধু জ্বলজ্বল করছে শুকতারা। দূরে বালুকারাশির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেই বিশাল মন্দির, তার অনেকটা ধ্বংস হয়ে গেছে, দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে। এখানে আর কোনও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।

দেখতে দেখতে চাপা নীল রঙের আলোয় ভরে গেল আকাশ।

জিতেন বলল, ওই দিকটায় তাকিয়ে থাকুন, ওই দিকে সমুদ্র, সূর্য কিন্তু হঠাৎ উঠবে।

শিশিরকুমার বললেন, হাওয়াটা ভারী মিঠে। মাথা জুড়িয়ে যাচ্ছে।

পূর্ব আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখা গেল যেন সমুদ্র থেকে লাফিয়ে উঠে এল একটি সোনার গোলক।

তারপরই আকাশের নীল আলো হয়ে গেল স্বর্ণময়।

শিশিরকুমার বললেন, সত্যি, অপূর্ব দৃশ্য। কঙ্কা, দেখলে, দেখলে?

কঙ্কাবতী চুপ।

জিতেন গদগদভাবে আবৃত্তি করল, ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম…।

শিশিরকুমার বললেন, জবাকুসুম। ঋষিরা কী সুন্দর কল্পনা করেছেন। এখন আমরা জানি, সূর্যের পেটের মধ্যে উত্তাপ ১৩ লক্ষ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। ফুলই বটে!

জিতেন এই মন্দিরের ইতিহাস শোনাতে যাচ্ছিল, শিশিরকুমার খানিকটা শুনে বললেন, ভারতীয় শিল্পীরা ল্যাটিচিউডের হিসেব কষে মন্দিরের পজিশন ঠিক করেছে। ইন্ডিয়ান জ্যোতিষশাস্ত্র কোথা থেকে এসেছে জানো? ব্যাবিলন থেকে। হিন্দু, গ্রিক, আরব-পারস্যের লোকেরা ওদের কাছ থেকেই শিখেছে।

মন্দিরের কাছে এসে শিশিরকুমারের মধ্যে যেন পুরনো অধ্যাপকের ভাব জেগে উঠল, বিভিন্ন মূর্তি দেখিয়ে দেখিয়ে তিনি লেকচার দিতে লাগলেন। কোন দাড়ির আকৃতি সেমেটিক, কোনটি ইন্ডো-ইয়োরোপিয়ান নরডিক এরিয়ান…।

জিতেন কঙ্কাবতীর দিকে এক একবার তাকাচ্ছে আর ভাবছে, এই মহিলাটি কি ডাম্ নাকি? অথচ নাম করা অভিনেত্রী, লেখাপড়াও যথেষ্ট জানেন বলে শোনা যায়। কিন্তু এখানে এত বিখ্যাত একটা মন্দির মন দিয়ে দেখার কোনও আগ্রহই নেই। শিশিরকুমারের কথা কিছুই শুনছেন না। ঘুরছেন এদিক-ওদিক।

শিশিরকুমার খানিকটা দেখার পর জিজ্ঞেস করলেন, জিতেন, এখানে সাত ঘোড়ায় টানা সূর্যদেবের একটা মূর্তি ছিল না? হ্যাভেল সাহেবের বইতে দেখেছি।

ধীরেন বলল, সেটা বোধহয় মিউজিয়ামে আছে। অনেক মূর্তি চুরিও হয়ে গেছে, জানেন তো!

শিশিরকুমার বললেন, মিউজিয়ামে গিয়ে একবার দেখতে হবে তো! ছবি দেখে সেই সূর্যদেবকে আঁকিয়ে আমি ‘তপতী’ নাটকের ব্যাকড্রপে ব্যবহার করেছিলাম। অবন ঠাকুরের খুব ভালো লেগেছিল। কঙ্কা, তোমার মনে আছে?

কঙ্কাবতী অনেকটা দূরে। শুনতেও পেল না।

এবার দেখা হবে সমুদ্র। রাস্তা নেই। বালি ঠেলে ঠেলে যাওয়া। গাছপালাও নেই। শুধু মাঝে মাঝে দু-একটা ফনিমনসার ঝোপ।

সমুদ্রের কাছে এসে বুক ভরে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে, কপালে হাত ছুঁইয়ে শিশিরকুমার বলে উঠলেন,

হে সুন্দরী বসুন্ধরে, তোমা-পানে চেয়ে
কত বার প্রাণ মোর উঠিয়াছে গেয়ে
প্রকাণ্ড উল্লাসভরে—ইচ্ছা করিয়াছে;
সবলে আঁকড়ি ধরি এ বক্ষের কাছে
সমুদ্রমেখলা-পরা তব কটিদেশ;
প্রভাত-রৌদ্রের মতো অনন্ত অশেষ
ব্যাপ্ত হয়ে দিকে দিকে, অরণ্যে ভূধরে
কম্পমান পল্লবের হিল্লোলের ’পরে
করি নৃত্য সারাবেলা করিয়া চুম্বন
প্রত্যেক কুসুমকলি, করি’ আলিঙ্গন
সঘন কোমল শ্যাম তৃণক্ষেত্রগুলি,
প্রত্যেক তরঙ্গ-’পরে সারাদিন দুলি’
আনন্দ দোলায় …

তিনি থামতেই জিতেন জিজ্ঞেস করল, এটা কোন নাটকের?

শিশিরকুমার বললেন, এটা কি স্টেজ? নাটক কেন হবে, এটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘বসুন্ধরা’। কঙ্কার অনেক বেশি মুখস্থ আছে।… কঙ্কা গেল কোথায়?

জিতেন বলল, এসেছিলেন তো আমাদের সঙ্গেই।

শিশিরকুমার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি পড়েছ রবীন্দ্রনাথের কবিতা?

জিতেন বলল, কিছু কিছু অবশ্যই পড়েছি। আপনার গলায় শুনে অপূর্ব লাগল। আর একটু শোনাবেন?

শিশিরকুমার বললেন, তা হলে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ থেকে একটু শোনাই।

আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে

হে সুন্দরী?
বলো, কোন্ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী।
যখনি শুধাই, ওগো বিদেশিনী,
তুমি হাসসা শুধু, মধুরহাসিনী—
বুঝিতে না পারি, কী জানি কী আছে
তোমার মনে।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি,
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন
গগনকোণে।
কী আছে হোথায়, চলেছি
কিসের অন্বেষণে?

একটু থেমে, শিশিরকুমার আবার বললেন, কী আছে হোথায়, চলেছি কিসের অন্বেষণে?

জিতেন বলল, আমার এবার ফিরাও মোরে কবিতাটা মুখস্থ আছে। বলব?

শিশিরকুমার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কঙ্কা কোথায় গেল?

জিতেন বলল, মনে হচ্ছে, ওনার আজ মুড নেই।

শিশিরকুমার বললেন, হু। কিন্তু গেল কোথায়?

সবেমাত্র কয়েকটা জেলে ডিঙি জলে নামতে শুরু করেছে। কয়েকটি নেংটি পরা বালক ছোটাছুটি করছে বেলাভূমিতে। আর তো কারুকে দেখা যাচ্ছে না। অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টিতে কোনও বাধা পড়ে না। শুধু বালি৷

জিতেন তবু ছুটে গেল জেলেদের কাছে। না, তারা কোনও রমণীকে জলের কাছে আসতে দেখেনি। তবে কি কঙ্কাবতী ফিরে গেছে গাড়িতে? কিছু না বলে?

ফিরতে শুরু করে শিশিরকুমার চিৎকার করলেন, কঙ্কা! কঙ্কা!

জিতেনও ডাকল, দিদি! দিদি!

কোনও সাড়া নেই।

খানিকটা এসে এত বালুকারাশির মধ্যে দিকভ্রম হয়ে গেল। গাড়িটাই বা কোন দিকে? উলটো দিকে যাচ্ছেন তাঁরা।

থেমে গিয়ে শিশিরকুমার বললেন, ওই যে কোনারক মন্দির, আমরা যখন গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে প্রথম সূর্যোদয় দেখি, তখন সোজাসুজি তাকিয়ে…তা হলে

খানিক বাদে গাড়ির কাছে পৌঁছোনো গেল, সেখানে ভিখা আর ড্রাইভার বসে আছে। তারাও দেখেনি কঙ্কাবতীকে।

আবার খোঁজাখুঁজি, ডাকাডাকি। মন্দিরের চারপাশ ঘুরেও দেখা গেল কোথাও সে নেই।

শেষপর্যন্ত তাকে পাওয়া গেল একটা বড় ফনিমনসা গাছের তলায়। বসে আছে হাঁটু গেড়ে। যেন এক ধ্যানস্তব্ধ স্থির মূর্তি।

বকাবকি করার বদলে শিশিরকুমার শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কঙ্কা, এখানে কী করছ?

কঙ্কাবতী তাঁর দিকে না তাকিয়ে বলল, এমনি বসে আছি।

শিশিরকুমার কণ্ঠস্বর আরও নরম করে বললেন, এবার ওঠো।

কঙ্কাবতী বলল, তোমরা যাও। আমি এখানেই থাকব।

শিশিরকুমার বললেন, এখানে থাকবে মানে? একা থাকবে?

কঙ্কাবতী বলল, হ্যাঁ

এবার শিশিরকুমারের ধৈর্য শেষ হয়ে গেল। প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, কী পাগলামি হচ্ছে? সব কিছুরই একটা সীমা আছে। উঠে এসো!

পেছন ফিরে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, জিতেন, তোমার দিদি এমনি আসতে না চায়, জোর করে টেনে নিয়ে এসো।

জিতেনকে তা করতে হল না। কঙ্কাবতী উঠে দৌড় লাগাল। সোজা গাড়ির দরজা খুলে বসে পড়ল ভেতরে।

ভিখা স্পিরিট ল্যাম্প নামিয়ে ধরাবার উদ্যোগ করছে। প্রভুকে দেখে জিজ্ঞেস করল, চা বানাই? ডিম ছাড়াব?

শিশিরকুমার তাকেও এক ধমক দিয়ে বললেন, নাঃ, কিছু চাই না। এক্ষুনি বাংলোয় ফিরে যাব। তোল, সব তোল!

ফেরার পথে কেউ একটি কথাও বলল না।

জিতেন বেচারি খুব আড়ষ্ট হয়ে গেছে।

বাংলোর দরজায় ওদের পৌঁছে দেবার পর সে বলল, আমি তা হলে আসি?

শিশিরকুমার বললেন, আচ্ছা।

তারপর গাড়ি থেকে নেমে বললেন, না, না, তুমি আমাদের জন্য এত কষ্ট করলে, তোমাকে একটু চা-ও খাওয়াব না, তা কি হয়? একটু বসে যাও।

ভেতরে গিয়ে পোশাক বদলে দ্রুত লুঙ্গি পরে এলেন শিশিরকুমার।

স্টোভে চায়ের জল ফুটছে। তিনি ভিখাকে বললেন, তুই ডিমগুলো ছাড়িয়ে ফেল।

তিনি নিজে পাউরুটিতে মাখন লাগাতে লাগলেন।

কঙ্কাবতীকে আর দেখা গেল না।

জিতেনের কাছে সব কিছুই অন্যরকম লাগছে। এঁরা প্রেমিক-প্রেমিকা না নকল স্বামী-স্ত্রী? তার ধারণা, বাড়িতে অতিথি থাকলে স্ত্রী-ই চা-জলখাবার বানাবার দায়িত্ব নেয়। নকল হলে বুঝি অন্যরকম? প্রেমের চেয়েও বিয়েই কি বড়?

সীতা নাটকের বিখ্যাত রাম এখন তার জন্য চায়ের কাপে চিনি মেশাবার জন্য চামচ নাড়ছেন!

একে তো শিশির-সান্নিধ্যের লোভ, তার ওপর নকল-দম্পতির কাণ্ডকারখানা দেখার অদম্য কৌতূহলে বিকেলবেলাই ফিরে এল জিতেন।

আজ এক ধনাঢ্য বাঙালির বাড়িতে নেমন্তন্নে যাবার কথা, শিশিরকুমার একটু আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি যাবেন না। তখন কঙ্কাবতীই বলেছিল, যাও না, তুমি ঘুরে এসো। আমি একা থাকতে পারব।

শিশিরকুমার তবু বলে দিলেন, না, যাব না!

জিতেন এসে দেখল, দু’জনে বারান্দায় দু’টি চেয়ারে খানিকটা দূরত্ব রেখে বই পড়ছে।

শিশিরকুমার বললেন, এসো জিতেন।

জিতেন বলল, সকালে সূর্যোদয় দেখলেন। এ বেলা সূর্যাস্ত দেখবেন না? সূর্যাস্তটা পুরীতেই ভালো দেখা যায়।

শিশিরকুমার উদাসীনভাবে বললেন, থাক, একটা দেখাই তো যথেষ্ট!

জিতেন বলল, চলুন না। বেশিক্ষণ তো লাগবে না।

শিশিরকুমার আঙুল তুলে ইঙ্গিত করে বললেন, ওকে জিজ্ঞেস করো।

জিতেন জিজ্ঞেস করতেই কঙ্কাবতী বলল, হ্যাঁ, যেতে পারি।

ডাকবাংলো থেকে সমুদ্র খুব কাছে নয়। ভাটার সময় জলরেখা অনেকটা দূরে চলে যায়। হাঁটতে হয় বালির ওপর দিয়ে।

খানিকটা যাবার পরই একটা পাথরের বেঞ্চি দেখে শিশিরকুমার বললেন, আমি এখানে বসছি। তোমরা এগোতে চাও তো এগোও।

কঙ্কাবতী মৃদুস্বরে বলল, তুমি জল ছোঁবে না?

শিশিরকুমার বললেন, ওসব আমার পোষায় না। তুমি যাও না। জিতেনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে যাও।

কঙ্কাবতী সমুদ্রের দিকে এগোতে লাগল।

জিতেন পাশে যেতে যেতে বলল, সকালে যেমন দেখলেন, সূর্য যেন লাফিয়ে উঠে এল, এখন দেখবেন সূর্য দিগন্তে নামতে নামতে একসময় হঠাৎ মিলিয়ে যাবে।

কঙ্কাবতীর পায়ে এসে লাগল ঢেউয়ের প্রথম ছোঁয়া।

পশ্চিম আকাশে চলেছে খুনখারাবির খেলা। যেন কোনও পাগল শিল্পীর এলোমেলো লাল রঙের পোঁচ। অদূরে স্থির হয়ে আছে একটি জাহাজ। মনে হয় যেন জাহাজটি রহস্যময়। কোনও জনমনুষ্য নেই ওর অভ্যন্তরে, কোথা থেকে এমনিই ভাসতে ভাসতে এসেছে।

কঙ্কাবতী শাড়ির প্রান্ত একটু উঁচু করে আরও এগোলেন সামনে।

জিতেন বলল, আর যাবেন না কিন্তু। হঠাৎ বড় ঢেউ এসে গেলে ভিজে যাবেন।

কঙ্কাবতী সে কথা না শুনে এগোতেই লাগল, শাড়িটাকে ছেড়ে দিয়ে ভিজতে দিল। এখন সে কোমর জলে।

জিতেন চেঁচিয়ে কী যে বলছে, আর শোনা যাচ্ছে না। সমুদ্র যখন ঢেউয়ের ভাষায় কথা বলে, তখন অন্য কারুর কথা শুনতে দেয় না।

একটা অতিকায় ঢেউ আসছে, অন্য যে দু’-একজন জলে নেমেছে, তারা পিছিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সেই ঢেউ গ্রাস করে নিল কঙ্কাবতীকে।

একটুক্ষণের জন্য তাকে আর দেখাই গেল না।

তারপর সে সাবলীলভাবে সাঁতার কেটে ফিরে এল তীরের দিকে।

জিতেন বলল, উঃ, ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

কঙ্কাবতী বলল, সমুদ্রে এসে অবগাহন না করলে কি ভালো লাগে?

সর্বাঙ্গ ভিজে কাপড়ে লেপটে সে ওপরে উঠে এল হেমেন মজুমদারের ছবি হয়ে। তার ঠিক পেছন দিকের পটভূমিকায় সূর্যদেব, তিনি দেখছেন। এবার তাঁর ডুব দেবার সময় হল।

জিতেন তার গাড়িতে ওঁদের তান্য কয়েক জায়গায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলেও ওঁরা দু’জনে আর রাজি হলেন না।

কথাবার্তাও আর জমে না দেখে সে বিদায় নিল একসময়। আবার কাল সকালে দেখা হবে।

রাত্রি নামতে-না-নামতেই বোতল খুলে বসলেন শিশিরকুমার।

কঙ্কাবতী কিছুক্ষণ গুনগুন করে গান গাইল ভেতরের ঘরে।

এখন সে যেন অনেক স্বাভাবিক। একসময় রাত্রির রান্নাবান্নার নির্দেশও দিল ভিখাকে।

শিশিরকুমারের বারান্দার আসনই পছন্দ। সামনে খোলা আকাশ, মিটিমিটি করে জ্বলছে কয়েকটা তারা। মদ্যপানের দু’-একটি সঙ্গী থাকলে ভাল লাগে, আবার একাকিত্বও তার অভ্যেস হয়ে গেছে।

অনেক চেষ্টা করেও কঙ্কাবতীকে মদ ধরানো যায়নি। তাঁর মদ্যপানের সময় সে ধারেকাছেই থাকতে চায় না। মদের গন্ধই সহ্য করতে পারে না সে!

একবার কঙ্কাবতী বারান্দায় আসতেই শিশিরকুমার বললেন, একটু বসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

কঙ্কাবতী চেয়ার টেনে বসল একটু দূরে।

শিশিরকুমার বললেন, কাল সকালবেলা আমাদের ভুবনেশ্বর যাবার কথা। ওখানে দেখবার জিনিস অনেক। ভোরেই বেরুতে হবে, তখন আবার আজকের মতন পাগলামি করবে না তো?

কঙ্কাবতী বলল, ও, এই কথা? আমি ভেবেছিলাম… নাঃ, আমি কাল যাব না। আর আমার কিছু দেখার শখ নেই।।

শোনো, এসব জায়গায় তো বারবার আসা হয় না। তুচ্ছ কারণে, নিছক মান-অভিমান করে সব কিছু না দেখাটা বোকামি।

তুচ্ছ কারণ? আমি ভেবেছিলাম, আমরা দু’জনে বসে…অনেক কবিতা পড়ব। আমি তোমাকে গান শোনাব।

গান গাও না। কে বারণ করেছে?

কে বারণ করেছে? হা-হা-হা, না, কেউ না। কেউ বারণ করেনি। তুমি এর মধ্যে অতটা খেয়ে ফেলেছ, একটু পরেই তো মাতলামি করবে।

নো। আই অ্যাম ফাইন! গান গাও, গান গাও!

তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করব? তুমি সত্যি উত্তর দেবে? তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারো না কেন?

তা হলে, আগে আমিও একটা প্রশ্ন করি। তুমিও সত্যি উত্তর দাও। তোমার বাবার সঙ্গে কি তোমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল?

একটুখানি চুপ করে থেকে কঙ্কাবতী বলল, সত্যি কথা বলব না কেন? তুমি আগে কখনও জিজ্ঞেস করোনি। সেই জন্যই কিছু বলিনি। ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের আর একজন মা ছিল। আমরা মনে করতাম, তিনি সৎ মা। এমন তো অনেকেরই থাকে। তার ছেলেমেয়েদের আমরা দুই বোনও নিজেদের ভাইবোনের মতনই মনে করতাম। পরে বড় হয়ে জেনেছি, অন্যজনই আমার বাবার একমাত্র স্ত্রী, আমার মা তাঁর বাঙালি রক্ষিতা। কিন্তু যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন মায়ের কোনও অযত্ন হয়নি। স্ত্রীর মতনই…

শিশিরকুমার বললেন, বেশ, তোমার মা যা মেনে নিয়েছিলেন, তুমি তা মেনে নিতে পারছ না কেন?

কঙ্কাবতী বললেন, আমার বাবা এম এ পাশ অধ্যাপক ছিলেন না। দেশ বিদেশের সাহিত্য পড়েননি। তিনি ছিলেন পুরনো আমলের লোক। যুগ বুঝি বদলায়নি?

শিশিরকুমার চুরুটটা বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, আমি বিয়েটিয়ে পছন্দ করি না। ওসব মন্ত্রটন্ত্র পড়া, ওর কোনও মূল্যই নেই আমার কাছে। আমি তোমায় জীবনসঙ্গিনী করে নেব বলেছিলাম।

কঙ্কাবতী বলল, তা তো করোনি। হ্যাঁ, সঙ্গিনী ঠিকই, কিন্তু তোমার জীবনে আমার কী স্থান আছে? আমার বদলে চারুশীলা, আশ্চর্যময়ী, নীরদা… এরা যে-কেউ হতে পারত। নাট্যমন্দির ভেঙে গেছে, তোমার হাতে কোনও থিয়েটার হল নেই, এখন যে-কোনও দিন তুমি আমায় ছুড়ে ফেলে দিতে পারো।

শিশিরকুমার এবার গর্জে উঠে বললেন, কী? কী বললে? আমি কি মরে গেছি! শেষ হয়ে গেছি? আবার আমি হল ভাড়া নেব, নতুন করে দল গড়ব, আবার আমি বাংলাদেশ কাপাব। তখন তুমি থাকবে আমার পাশে।

কঙ্কাবতী গলা একটুও না তুলে বলল, আমার প্রশ্নটার উত্তর তুমি এখনও দাওনি। আমাকে বিয়ে করতে চাও না… তোমার মনে কি কোনও সংস্কার আছে? আমার বংশ পরিচয়ের জন্য… মন্ত্র না পড়েও তো বিয়ে করা যায়।

শিশিরকুমার বললেন, সংস্কার? কী জানি, হয়তো থাকতেও পারে। তুমি হয়তো জানো না, আমার স্ত্রী ছিল, ঊষা, সে আত্মহত্যা করেছিল, অভিমান করে, এখনও তাকে পুরোপুরি ভুলতে পারিনি। তার জায়গায় আর কারওকে বসাতে মন চায় না। আমার মনে অপরাধবোধ আছে।

কঙ্কাবতী বলল, আমি জানি সে কথা। বিশু বলেছে। কিন্তু সে তো পনেরো-ষোলো বছর আগের কথা। তারপর অনেক মানুষ আবার বিয়ে করে না? পুরনো কথা ভুলে যাওয়াই তো স্বাভাবিক।

শিশিরকুমার অভিনয় করার মতন বললেন, অনেক মানুষ আর শিশির ভাদুড়ী এক নয়। আমার আরও একটা বাধা আছে। আমার মা। দ্যাট ওল্‌ড লেডি, আমি ওঁকে ডিজওবে করতে পারি না। আমি জানি, মা এরকম বিয়েতে মত দেবেন না।

কঙ্কাবতী এবার মোক্ষম তির মারার ভঙ্গিতে বলল, তুমি যে এত মদ খাও, সেটাও কি তোমার মায়ের অনুমতি নিয়ে?

শিশিরকুমার জ্বলে উঠে বললেন, নাও, কঙ্কা, ইউ আর ক্রসিং ইয়োর লিমিট! আমার মদ খাওয়া নিয়ে খোঁচা মারা আমি পছন্দ করি না। তুমি জানো?

কঙ্কাবতী বললেন, জানি, তুমি এবার রেগে যাবে। আর তোমার সঙ্গে কথা বলা যাবে না। তুমি ইনটেলেকচুয়াল, তুমি যুক্তিবাদী, তুমি কোনও ধর্মীয় সংস্কার মানো না। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে তুমি আমার সেন্টিমেন্টের কোনও মূল্যই দিতে চাও না।

শিশিরকুমার বিরক্তির সঙ্গে বললেন, এসব বাজে সেন্টিমেন্টকে তুমিই বা এত মূল্য দিচ্ছ কেন? বিয়ে? হুঁ!

কঙ্কাবতী ঠিক করেছিল, এখন সে কাঁদবে না। সমানে সমানে কথা বলবে। কিন্তু চোখ জ্বালা করছে, সে উঠে পড়ল।

ভেতরে যাবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করল, যদি আমার পেটে তোমার সন্তান আসে?

শিশিরকুমার ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে বললেন, অ্যাঁ? এসেছে নাকি?

কঙ্কাবতী বলল, কী জানি! হতেও পারে।

শিশিরকুমার খানিকটা মেজাজ সামলে নিয়ে বললেন, যদি আসে, ওয়েলকাম। ছেলে বা মেয়ে যে-ই আসুক, তাকে আমি, তোমার বাবার মতন, আমার পদবি ধার দেব। আমার আগে একটা ছেলে আছে—

কঙ্কাবতী বলল, তোমার একটা ছেলেই থাক। আমার সন্তান হলে, তাদের আর ভাদুড়ী হবার দরকার নেই। তারা হবে দাস। তারা হবে পরমেশ্বরের সন্তান।

শিশিরকুমার এবার কৌতুক বোধ করে বললেন, তোমার পরমেশ্বর যদি তোমার ছেলেমেয়ের বাপ হতে চায় ওয়েল, আই ডোন্‌ট মাইন্ড! গো অ্যাহেড!

শিশিরকুমার আবার একা একা গেলাসে চুমুক দিতে লাগলেন। মাঝে মাঝে আপন মনেই আওড়াতে লাগলেন মাইকেল আর শেকসপিয়ার।

কঙ্কাবতী যে কখন তাঁর প্রায় সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেল বাইরে, তা তিনি খেয়ালও করলেন না।

কঙ্কাবতী বালির ওপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে যেতে লাগল সমুদ্রের দিকে। আজ চন্দ্রলুপ্ত আকাশ। আলো নেই। সমুদ্রের বুকে ঢেউয়ের মাথায় দেখা যাচ্ছে ফসফরাসের রেখা। যেন একটা অস্পষ্ট আলোর মালা।

কঙ্কাবতী বসে পড়ল একেবারে বেলাভূমির কিনারায়।

ঢেউ এসে লাগছে তার পায়ে। এখন জোয়ার শুরু হয়েছে সবেমাত্র। ক্রমশ এগিয়ে আসছে ঢেউ। সমুদ্র যেন লোভী জিভ দিয়ে, এক প্রবল পুরুষের মতন, চাটছে কঙ্কাবতীর শরীর। হাঁটু ছাড়িয়ে পৌঁছে গেল ঊরুর কাছে।

কঙ্কাবতী গান শোনাতে লাগল সমুদ্রকে।

আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *