সুন্দরী তরুণীদের ভোগ করতে রাজা বাদশারাও হিংস্র হয়ে ওঠে।
বিন কাসিমের সেই হাসিতে ইসলামের নূর ছিল, তার ঈমানী আভায় সেদিন চমকে ওঠেছিল সিন্ধু অঞ্চলের বালুকারাশি, যে উরুঢ় ছিল ইসলামের চরম শত্রু রাজা দাহিরের ক্ষমতার দাপট, জুলুম অত্যাচারের কেন্দ্র বিন্দু সেটি এখন বিন কাসিমের পদানত। রাজা দাহিরের মৃত্যুর পরও উরুঢ় ছিল হিন্দুদের মর্যাদার কেন্দ্রবিন্দু। তাই এটিকে শত্রুমুক্ত করা ছিল অতি জরুরী।
এদিকে মুসলিম সৈন্যদের দুর্গে প্রবেশের খবর শুনে দুর্গবাসীদের মধ্যে দৌড়ঝাপ শুরু হয়ে গেল। মুসলিম সৈন্যরা যখন দুর্গে প্রবেশ করল তখন শহরের লোকদেরকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল তাদের ওপর কোন ধরনের জুলুম অত্যাচার করা হবে না। কিন্তু ভীত বিহ্বল জনতা তারপরও নিজেদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটাছুটি করতে শুরু করে এবং দুর্গ থেকে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে দুর্গফটকে মুসলিম সৈন্যরা প্রহরা বসিয়েছে দেখে আতঙ্কিত লোকজন নিজেদের ঘরে দরজা বন্ধ করেও স্বস্থিবোধ করতে পারছিলনা। অনেকেই দিকবিদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে।
বিন কাসিম নির্দেশ দিলেন, শহর জুড়ে ঘোষণা করে দাও, শহরের ছেলে বুড়ো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো। সবার জীবন সম্পদের নিরাপত্তা দেয়া হলো কারো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সবাই নিরাপদে নিজ নিজ ঘরবাড়িতে নিশ্চিন্তে অবস্থান করতে পারে। শহরের কোন নারীর ওপর বিজয়ী সৈন্যরা জুলুমতো দূরে থাক তাকিয়েও দেখবে না। তবে যেসব সৈন্য মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে কেউ ঘরে আশ্রয় দিতে পারবে না। কারো ঘরে যদি লুকিয়ে থাকা সৈন্যকে খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে সেই ঘরের নারী শিশু ছাড়া সবাইকে হত্যা করা হবে।
বেলা ডুবা পর্যন্ত শহরময় এই ঘোষণা করা হলো, যাতে সকল দুর্গবাসীর কাছেই বিজয়ী বাহিনীর বার্তা পৌঁছে যায়। ফাতহুল বুলদান’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে, বিন কাসিম নির্দেশ দিলেন, যেসব সৈন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিল তাদেরকে হত্যা করা হোক।’ মন্দির প্রদর্শন এবং শহরের নাগরিকদেরকে নিরাপত্তার ঘোষণা এবং শত্রুসেনাদের হত্যার নির্দেশ দিয়ে বিন কাসিম ধীরে সুস্থে রাজমহলের দিকে অগ্রসর হলেন। তিনি ভেবেছিলেন, তার নির্দেশ মতো কাজ হবে। কারণ তার নির্দেশের ব্যতিক্রম করে মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে নির্দেশের খেলাপ করার কোন দৃষ্টান্তই অতীতে ছিলনা।
নির্দেশ করা মাত্রই উরুঢ়ের যুদ্ধবাজ সৈন্যদের ধরপাকড় শুরু হয়ে গেল। বিদ্রোহী সৈন্যদের পাকড়াও করতে গিয়ে কয়েকজন মুসলিম সৈনিক নিহত হলো।
বিন কাসিম অশ্বারোহণ করে চতুর্দিক দেখে শুনে রাজমহলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তার সাথে সাথেই অগ্রসর হচ্ছিল একান্ত নিরাপত্তারক্ষী ও চারজন সংবাদ বাহক। এক দুভাষীও তার সাথে ছিল। যে দুভাষী আরবী ও সিন্ধিভাষা অনর্গল বলতে পারতো। এমন সময় এক বিচিত্র পোষাক পরিহিতা বৃদ্ধা বিন কাসিমের নজর কাড়ল। বৃদ্ধা মাথায় একটি লাল কাপড়ের রুমাল বেঁধে রেখেছে এবং সাদা চুল রুমালের বাইরে ঝুলে রয়েছে। বৃদ্ধার গলায় হাজার দানার একটি মালা ঝুলছে। তার পরনে কাধ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত লম্বা চৌগা! তার পায়ে কোন জুতা ছিল না। তার পা কাপড়ে প্যাচানো। বৃদ্ধা বিন কাসিমের বিপরীত দিক থেকে আসছিল। এক নিরাপত্তারক্ষী তার ঘোড়াকে আগে বাড়িয়ে বৃদ্ধাকে রাস্তা থেকে সরে যেতে বলল। কিন্তু বৃদ্ধা নিরাপত্তারক্ষীর ঘোড়াকে পাশে ফেলে এগিয়ে চলল। তার এক হাতে একটি তাজা গাছের ডাল। আর অপর হাতে কাচের মতো দানার মালা। তার চেহারা মলিন কিন্তু চেহারার দীপ্তি ও দৃষ্টি খুবই তীক্ষ্ণ ও গভীর। দেখে যে কারো মনে হবে বৃদ্ধা পাগলী অপ্রকৃতস্থ। বৃদ্ধার গতিরোধ করার জন্য অপর একজন নিরাপত্তারক্ষী তার ঘোড়াকে বৃদ্ধার সামনে দাঁড় করিয়ে বৃদ্ধা ও বিন কাসিমের মধ্যে আড়াল সৃষ্টি করল।
এমতাবস্থায় বৃদ্ধা দৃঢ় কণ্ঠে সৈনিকের উদ্দেশ্যে বলল, “বিজয়ের গর্বে এতোটা ফুলে যেয়ো না হে অশ্বারোহী!” বিন কাসিমের দু’ভাষী আরবীতে
বৃদ্ধার কথা তাকে জানাল। বৃদ্ধার কথা বুঝে নিয়ে বিন কাসিম নিরাপত্তারক্ষীকে বললেন, সরে যাও ওর সামনে থেকে। নিরাপত্তারক্ষী সামনে থেকে সরে গেলে বৃদ্ধা একেবারে বিন কাসিমের সামনে এসে পড়ল। এমন সময় এক অশ্বারোহী উর্ধশ্বাসে ঘোড়া হাঁকিয়ে বিন কাসিমের পাশে এসে ঘোড়া থামালেন। এই আগন্তুক আর কেউ নন গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফী। গোয়েন্দা প্রধান বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে বললেন, সম্মানিত সেনাপতি! আপনি কি জানেন এই বৃদ্ধা কে?
আমি ওর ব্যাপারে কিছুই জানি না।
এতো মস্তবড় যাদুবুড়ি। স্থানীয় লোকজন আমাকে জানিয়েছে, এই যাদুবুড়ি নাকি গোপীকে গণনা শুনে বলেছে, রাজা দাহির মারা গেছে। এই বুড়ি নাকি তার যাদু দিয়ে জানতে পেরেছে, রাজা দাহির মারা গেছে।
হে যাদুবুড়ি! তোমার যাদু দিয়ে কি তুমি দূরের জীবিত মানুষজনকেও দেখতে পারো? বুড়ির উদ্দেশ্যে বললেন বিন কাসিম।
তুমি আমার হাতে এই গোল মরিচের তাজা ডাল দেখতে পাচ্ছে না? এই গাছ সিন্দু অঞ্চলের কোথাও জন্মে না। তুমি কি বলতে পারো যে এটা আমি কোথেকে এনেছি।
আমি কি করে বলবো’ বললেন বিন কাসিম।
হা’ তুমি বলতে পারবে না, তোমার দৃষ্টি শুধু দুর্গ আর সৈন্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তুমি শুধু জয় আর পরাজয় বোঝে। তুমি জানোনা, আগামী কাল তোমার জীবনে কি ঘটবে। তোমার জীবন বেলাতো উদিত হওয়ার সাথে সাথেই ডুবে যাচ্ছে।
আমি শুধু জানি, আল্লাহ আমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন এই দায়িত্ব পালনে আমার দিনটি কিভাবে কাটল, যাতে আল্লাহর কাছে গেলে আমি বলতে পারি স্বীয় কর্তব্য পালনে আমি কোন ত্রুটি করিনি’ বুড়ির উদ্দেশ্যে বললেন বিন কাসিম।
বিন কাসিম যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে কথিত যাদুবুড়ির সাথে কথা বললেন, কারণ তার কাছে মনে হলো এই বৃদ্ধার কথাবার্তা যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। কোন মতেই তাকে পাগল বা অপ্রকৃতস্থ বলা যায় না।
তুমি কি ঘোড়া থেকে নামবে না? বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে বলল যাদুবুড়ি। তুমি অবশ্যই ঘোড়া থেকে নামবে। তোমার চোখমুখ চেহারা ছবি বলছে, তুমি
অপরাপর রাজা বাদশাদের মতো নও, যারা আমার মতো বৃদ্ধাকে অশ্বখুরে পিষ্ট হওয়ার যোগ্য মনে করে।
বিন কাসিম ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এলে যাদুবুড়ি তার মাথায় এভাবে হাত রাখলো যে তার হাতের শাহাদত আঙুল বিন কাসিমের নাক বরাবর ছিল। যাদুবুড়ি এরপর বিন কাসিমের চোখের দিকে উঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে দুকদম পিছিয়ে গেল। রাজা দাহির মরে গেছে, অথচ সবাই বলে সে নাকি জীবিত। আর তুমি……না আর সামনে শুনতে চেয়োও না। একথা বলে সে নীরব হয়ে গেল এবং এক পাশ দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো। বিন কাসিম হাত প্রসারিত করে তার গতি রোধ করলেন।
তুমি বলতে না চাইলেও আমি তা শুনবো। বুঝেছি তুমি আমার মৃত্যুর খবর আমাকে শুনাতে চাও না। তুমি হয়তো জানো না, আমরা মৃত্যুকে মেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছি। প্রতি মুহূর্তকেই আমরা জীবনের শেষক্ষণ মনে করি। মৃত্যুকে আমরা ভয় করি না। শত্রুর কামান থেকে নিক্ষিপ্ত যে কোন একটা তীরে আমাদের মৃত্যু হতে পারে। তুমি আমাকে মৃত্যুর খবর শোনালেও তাতে আমার মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে না, বললেন বিন কাসিম। রণাঙ্গনে যুদ্ধ ময়দানে তোমার মৃত্যু হবে না, বলল যাদুবুড়ি। তোমার জীবন খুবই সংকীর্ণ। তোমার ভাগ্যতারা খুব দ্রুত ওপরে উঠে গেছে, তাই এটি দ্রুত ভেঙে পড়বে।
কখন তা হবে? জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম। এ বছরই তা হতে পারে। তবে তোমার জীবনের দ্যুতি কখনো শেষ হবে না। লোকেরা তোমাকে যুগযুগ স্মরণ করবে। বুড়ির কথা শুনে বিন কাসিম হেসে ফেললেন। মৃত্যুর কথায় তার মধ্যে কোন ভাবান্তর ঘটল না।
সব রাজা বাদশারা চায়, তারা যেন অমরত্ব লাভ করে। বহু দিন বেঁচে থাকতে চায়। রাজা বাদশারা মনে করে জগতের সব প্রজাদের হায়াত যদি তারা পেয়ে যেতো। কিন্তু মৃত্যু তাদের জীবনে একদিন হানা দেয় এবং প্রজাদের চোখের সামনেই তাদের জীবনের অবসান ঘটে। প্রজারাই তাকে মাটির নীচে দাফন কিংবা চিতায় পুড়িয়ে দেয়। বিড় বিড় করে বলল যাদুবুড়ি। বিন কাসিম স্মীত হেসে তার পথ ছেড়ে দিলেন। এবার আর যাদুবুড়িকে আটকানোর কোন চেষ্টা করলেন না।
কিছুক্ষণ পর বিন কাসিম রাজ প্রাসাদের সীমানায় প্রবেশ করলেন। উষ্ণ মরুময় এলাকায় সাজানো রং বেরঙের বাহারী বৃক্ষলতা ফুল সজ্জিত দৃশ্য দেখে তিনি অভিভূত হলেন। ঘোড়া থেকে নেমে চতুর্দিকে চোখ বুলালেন বিন কাসিম। তার ঠোটের কোণে যে স্মিত হাসি ছিল তা মিলিয়ে গেল। অনুচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, এই প্রাসাদে সেই রাজা থাকতো যে মনে করতো তার কোন দিন মৃত্যু হবে না। মৃত্যুকে তারা ভৃত্য ভাবতো। বিন কাসিম যখন রাজা দাহিরের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলেন তখন রাজ পরিবারের কেউই সেখানে ছিল না। গোপী তার পরিবার পরিজন ও একান্ত ভৃত্যদের নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বিন কাসিমের সাথে আসা একমাত্র রাণী প্রিয়সীই ছিল রাজপরিবারের সদস্য। বিন কাসিম রাণী প্রিয়সীকে প্রাসাদে প্রবেশের নির্দেশ দিয়ে বললেন, তুমি নিশ্চিন্তে প্রাসাদে থাকতে পারো। বিন কাসিম যখন রাজ প্রাসাদের দরবার কক্ষে প্রবেশ করলেন তখন রাণী প্রিয়সী এসে তার সামনে দাঁড়াল।
আপনার বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছিল আপনি কি তাদের সবাইকে হত্যার হুকুম দিয়েছেন, মহামান্য সেনাপতি? হ্যাঁ, দিয়েছি। আমাদের যুদ্ধনীতি মোতাবেক আমরা শুধু তারই জীবন ভিক্ষা দেই, যে শত্রুযোদ্ধা আমাদের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করে। নিঃসন্দেহে বিজয়ী বাদশাহের এটাই নীতি হয়ে থাকে। কিন্তু আপনার মতো মানব দরদী বিজয়ী সেনাপতির নীতি এমনটি হওয়া উচিত নয়। কারণ আপনি নিজেকে মানব দরদী বলে থাকেন; বলল রাণী প্রিয়সী। তুমি যদি আমার একান্ত যুদ্ধ কৌশলের ব্যাপারে দখলান্দাজি না কর তাহলে আমি খুশি হবো, প্রিয়সীর উদ্দেশ্যে বললেন বিন কাসিম। তুমি যাদের প্রাণ বাঁচাতে চাচ্ছো, তারা তো তোমার কথাও শুনেনি। তারা তো তোমাকেও গালমন্দ করেছে এবং তোমার ওপর চারিত্রিক অপবাদ পর্যন্ত দিয়েছে।
আপনার এই ধারণা ঠিক নয়। আপনার যুদ্ধ কৌশলে কোন ধরনের দখলদারী করার ইচ্ছা আমার নেই। তা ছাড়া আমি আমাদের কোন লোককেও বাঁচাতে বলছি না। ওরা মনে করেছিল, আপনার সেনারা শহরে প্রবেশ করলে লুটতরাজ ও খুনোখুনিতে মেতে ওঠবে এবং কারো জীবন সম্পদ ইজ্জত আব্রু রক্ষা পাবে না। এই ভয়েই তারা হাতিয়ার সমর্পণ করেনি।
আমরা যুদ্ধরত শত্রু সেনাদের হত্যা করি, কারণ এদের মুক্ত করে দিলে এরা আবার এক জায়গায় জড়ো হয়ে শক্তিসঞ্চয় করে আমাদের ওপর আক্রমণ করে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো শত্রু বাহিনীর শক্তিকে দুর্বল করা।
গণহত্যার ব্যাপারটি থেকে বিরত থাকতে আমি অন্য কারণে আপনাকে অনুরোধ করছি’ বলল রাণী প্রিয়সী। আপনি নিশ্চয়ই আমার চেয়ে ভালো বুঝেন। আপনার বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতাই আপনাকে আরব থেকে এই উরুঢ়ের দুর্গে নিয়ে এসেছে। পাহাড়সম দুর্গগুলো আপনি একের পর এক জয় করে এসেছেন। আমি সবিনয়ে আপনাকে বলতে চাই, বিবেক অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হতে পারে। আপনি উরুঢ়ের লোকদের সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত নন। এই শহর শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে ভারত বিখ্যাত। এখানকার অধিকাংশ লোক এমনকি সৈন্যরা পর্যন্ত অবসর সময়ে ক্ষেত খামারে চাষাবাদ ও বিভিন্ন কারিগরি কাজ করে।
এই শহরের প্রায় সব লোক হয় কারিগর নয়তো চাষী নয়তো ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে একটি অংশ যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরির কারিগরও রয়েছে। এই শহরে এমন ব্যবসায়ীও রয়েছে যারা সারা হিন্দুস্তান জুড়ে ব্যবসা করে। অবশ্য একথা অস্বীকার করার মতো নয় যে, এসব লোকও সৈন্যদের সাথে আপনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং তারা তাদের ব্যক্তিগত কর্মচারীদের পর্যন্ত যুদ্ধে শরীক করেছিল। তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল, লড়াই করেই তারা দুর্গ তাদের কব্জায় রাখবে। ফলে বিজয়ী সামরিক নীতিতে এরা আপনার হাতে নিহত হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু আপনি হত্যাকাণ্ড কার্যকর করার আগে একথাও চিন্তা করুন, এদের দেয়া কর ও জিজিয়া দিয়েই তো আপনাকে প্রশাসনের চাকা সচল রাখতে হবে। এরা নিহত হলে আপনাকে শুধু বিপুল অংকের জিজিয়াই হারাতে হবে না, গোটা শহরের সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে। তখন আপনাকে ঐসব বেকার লোকদের ওপর করের বোঝা চাপাতে হবে, যাদের আসলে একমুঠো শষ্যও কর দেয়ার সামর্থ নেই। তখন তো আপনার সরকারি কোষাগার শুন্য হয়ে পড়বে। একজন হিন্দু রমণীর কথায় বিন কাসিম যুদ্ধবন্দি শত্রুসেনাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবেন, এমনটি ধারণা করার কোনই অবকাশ ছিল না। তবে রাণী প্রিয়সীর কথাকে তিনি গুরুত্বের সাথে নিয়ে তাঁর সেনাপতি, সামরিক উপদেষ্টা বিশেষ করে গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীর সাথে পরামর্শ করে যুদ্ধ বন্দীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
যুদ্ধবন্দীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্ত রাজা দাহিরের দরবার হলে অনুষ্ঠিত হয়। পরামর্শ বৈঠক শেষে সবাই প্রাসাদ থেকে চলে গেলে বিন কাসিমের সাথে এক বয়স্ক লোক সাক্ষাত করতে এসে আরবী ভাষায় কথা বলে।
আগন্তুকের কথা শুনে বিন কাসিম বললেন, আল্লাহর কসম, তোমার কণ্ঠে তো আরব্য মরুর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তুমি তো আরব থেকে আসোনি, এবং আমাদের সেনাদলেরও কেউ নও।
আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন! ইবনে কাসিম! বলল আগন্তুক। আমি সেই সব লোকদের একজন যাদেরকে বিদ্রোহের অভিযোগে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। আমার নাম হামদ। হামদ বিন জাবের। আমি রাজপ্রাসাদে কর্মরত ছিলাম। বর্তমান আরব শাসকদের সাথে আমার শত্রুতা থাকতে পারে কিন্তু আমার দেশ, আমার ধর্ম ও আমার স্বজাতির সেনা নায়কদের সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। আমার বিশ্বাস, বনি উমাইয়া যাদেরকে শত্রু ভেবে দেশছাড়া করেছে, পর্দার আড়ালে তুমি এদেশে আসার পর থেকেই তারা তোমাকে অব্যাহত সহযোগিতা করেছে। ইবনে জাবের! দেশ ও ধর্মের স্বার্থে তোমরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং ইসলামের আলো হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে দিতে তোমরা যে সহযোগিতা করেছ, আল্লাহ তোমাদেরকে এর উত্তম প্রতিদান দেবেন। তুমি হয়তো জানো, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আমাকে এই অঞ্চল নতুন বাদশাহীতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে পাঠাননি। আমাদের সিন্ধু অভিযানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তোমরা জানো। আমি সিন্ধুতে পা দিয়ে দেখি, এখানকার লোকজন মাটি পাথরের তৈরি মূর্তিকে পূজা করে।
আমি সবার অলক্ষে এক মূর্তির হাত থেকে স্বর্ণ ও মুক্তা খচিত বাজুবন্ধ খুলে ফেলি। সেই মূর্তির কব্জা থেকে আমরা দুর্গ দখল করে নেই কিন্তু আজো পর্যন্ত এখানকার মানুষ মাটি পাথরের তৈরি মূর্তিকেই পূজা করে চলছে। আমি যদি তাদের একথা বুঝাতে চেষ্টা না করি যে, জয় পরাজয়ের একমাত্র মালিক আল্লাহ এবং ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহ, তাহলে কি আল্লাহর কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হবো না? কেননা, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই আমি ঘর থেকে বেরিয়েছি।
আমি একটি জরুরী কথা বলতে এসেছি বিন কাসিমা তুমি কি উরুঢ়ের যুদ্ধবন্দীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছ?
হ্যাঁ, আমি কি তা ঠিক করিনি?
সম্পূর্ণ সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছে বিন কাসিম। আমি তোমাকে একথা বলার জন্যই এসেছি। কিন্তু এই জাতির ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। এদেরকে শারীরিকভাবে হত্যা করা যাবে না। কিন্তু তাদেরকে মানসিকভাবে নিবীর্য করে ফেলতে হবে। তাদের মনে মূর্তির যে ভূত সওয়ার হয়ে আছে, তাকে হত্যা করে ফেলতে হবে এবং তাতে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। তাদেরকে কোমল কঠোর শাসন করতে হবে। এগুলো কালো সাপ তারা যেন বুঝতে না পারে তাদেরকে মুক্ত ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
বিন কাসিম গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীকে বললেন, শহর জুড়ে গোয়েন্দা ছড়িয়ে দিন। শহরের প্রতিটি ঘরের ভিতরের অবস্থা জানার চেষ্টা করুন। গোয়েন্দা প্রধান শহরের অধিবাসীদের অভ্যন্তরীণ খবর জানার জন্য বিপুলসংখ্যক স্থানীয় গোয়েন্দা নিয়োগ করলেন। শহরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা তাদের মতো করে পুনর্বহাল করলেন বিন কাসিম। রাওয়া বিন আসাদকে বিন কাসিম শহরের প্রশাসক নিযুক্ত করলেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ফলে উঢ়ের মানুষের মধ্যে যে কৃতজ্ঞতা ও স্বস্তি বিরাজ করছিল, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে ভিন্নভাবে একজনকে ধর্মীয় প্রশাসক নিযুক্ত করা হলো। মূসা বিন ইয়াকুব ছাকাফীকে একই সাথে ধর্মীয় প্রশাসক এবং প্রধান বিচারকের দায়িত্বে নিয়োগ করা হলো।
ইবনে ইয়াকুবের উদ্দেশ্যে বিন কাসিম বললেন, ইবনে ইয়াকুব! সাকীফ গোত্রের অধিবাসীরা আপনাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। আপনি যেমন একজন তেজস্বী যোদ্ধা, সেই সাথে একজন বিচক্ষণ আলেম। আমরা এই কাফেরদের দেশে এসে প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছি, তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে বিচার ও ইনসাফ কি জিনিস। তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে মুসলমানদের বিচার ব্যবস্থা আল্লাহর কাছে জবাবদেহিমূলক। ইসলামের বিচার ব্যবস্থায় শাসক শাসিত, ধনী-গরীব সবাই সমান। আল্লাহর আইন পার্থিব কোন পদ পদবী আর যশ খ্যাতিকে বিবেচনা করে না। সব অপরাধীকে সমান দৃষ্টিতে দেখে এবং সবাইকে কৃত অপরাধের জন্য উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হয়। ইতিহাসে লেখা হয়েছে, বিন কাসিম মূসা বিন ইয়াকুবকে বললেন, আল্লাহর কালাম, তারা ভালো কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে’ এই আয়াতের ভিত্তিতে আপনি ব্যবস্থা নেবেন।
বিন কাসিমের আরো সামনে অগ্রসর হওয়ার তাকিদ ছিল। কিন্তু উরুঢ়ের প্রশাসন কতটুকু কার্যকর ও সফল ভূমিকা রাখতে পারে এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাঁকে এখানে কিছুদিন অবস্থান করার প্রয়োজন ছিল। তা ছাড়া এখানকার অধিবাসীরা তাদের ওপর ধার্যকৃত জিযিয়া দিতে পারছে কি-না, শহরের অধিবাসীরা সাধারণ ক্ষমার সুযোগে গোপনে নতুন কোন চক্রান্ত ষড়যন্ত্র করছে কি-না এ ব্যাপারটিও নিশ্চিত হওয়া জরুরী ছিল। শাবান ছাকাফীর নিযুক্ত গোয়েন্দারা খবর সংগ্রহ করছিল। তাদের খবর ছিল আশাব্যাঞ্জক। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়ীক কাজকর্ম শুরু করে। শহরের অধিবাসীদের মধ্যে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসে। বিন কাসিম শহরের নাগরিকদের ওপর ইসলাম গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেননি, সেই সাথে হিন্দুদের মন্দিরে গমনেও কোন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেননি। ফলে হিন্দুদের মধ্যে পূর্ণস্বস্তি বিরাজ করছিল। কারণ তাদের কারো ইজ্জত সম্ভ্রমের ওপর আক্রমণ হয়নি, তাদের ধনসম্পদ ছিল সম্পূর্ণ নিরাপদ। স্থানীয় অধিবাসীরা দেখেছে, তাদের দেশের সেনারা অধিকাংশ সময় তরি-তরকারীসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য বিনামূল্যে কিংবা নাম মাত্র মূল্যে নিয়ে নিতো। কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা পূর্ণমূল্য দিয়ে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন পণ্য সংগ্রহ করে। বিজয়ী বাহিনীর পক্ষ থেকে এ ধরনের ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ পাওয়াটা ছিল উরুঢ়ের অধিবাসীদের কাছে অভাবণীয়। অবশ্য তারা ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছিল বিজয়ী মুসলমানরা বিজিত এলাকার অধিবাসীদের ওপর কোন ধরণের জুলুম অত্যাচার করে না।
মুসলমানদের সতব্যবহার এবং প্রজাহিতৈষীর ফলে উরুঢ়ের সাধারণ হিন্দুরা মনেপ্রাণে মুসলমানদের আনুগত্য মেনে নিল। এদিকে মূসা বিন ইয়াকুব ইসলামের তাবলীগ শুরু করে দিয়েছিলেন। তার দাওয়াতে কিছু পরিবার ইসলামে দীক্ষা নেয়। এমতাবস্থায়ও বিন কাসিম কোন ধরনের ঝুকি নিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি সার্বিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য রাতে রাণী প্রিয়সীকে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠালেন।
রাণী প্রিয়সী ছিল যথার্থ অর্থেই যুবতী ও সুন্দরী। নিজের রূপ সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সে রাজা দাহিরের মনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু রাণী প্রিয়সীকে রাজা দাহির যখন রাণী হিসাবে গ্রহণ করে তখন দাহিরের যৌবন নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু রাণী ছিল তরুণী। আর এই মুহূর্তে রাজা দাহিরের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে। নিজ বুদ্ধিমত্তায় রাণী
প্রিয়সী বিন কাসিমের আস্থা অর্জন করেছিল। দ্রুপ নিজে বিন কাসিমের প্রতি আস্থাবান ছিল। উরুটে বিজয়ী বাহিনী প্রবেশ করার পর সেই যে রাণীকে রাজ প্রাসাদে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়, আর বিজয়ী বাহিনীর পক্ষ থেকে তাকে কোন ধরনের নজরদারীতে রাখা হয়নি। এ কয়দিন স্বাধীনভাবেই রাণী প্রিয়সী দাহিরের রাজপ্রাসাদে কাটায়। কিন্তু হঠাৎ করে বিন কাসিমের পক্ষ থেকে রাতের বেলায় সাক্ষাতের আহবানে সে অন্য অর্থ করল। রাণী প্রিয়সীর কাছে বিন কাসিমের এই তলব ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
রাণী প্রিয়সী রাতের বেলায় যখন বিন কাসিমের কক্ষে প্রবেশ করল, তখন বিন কাসিম রাণীকে দেখে অভিভূত হলেন। কারণ যুবতী এই হিন্দু নারীকে তিনি সাধারণ পোশাকে দেখেছিলেন। রাণী যতদিন তার নজরদারীতে অবস্থান করেছিল খুব সাদামাটা পোশাকেই অবস্থান করেছিল। কিন্তু আজ রাতে সেই সাদামাটা রমণীর অবস্থা আর আগের মতো ছিল না। পূর্ণ জৌলুস আর রাজকীয় সাজসজ্জায় কামোদীপ্ত এক রমণীয় পোশাক পরে রাণী এলো বিন কাসিমের কক্ষে। যে রাণীর চেহারা ছবি ছিল যথেষ্ট গম্ভীর আজ সেই রাণীর ঠোটে ইঙ্গিতপূর্ণ মুচকী হাসি, হাটায় চলায় উদ্দীপনাময় ভাবভঙ্গি।
আমি জানতাম, কোন না কোন এক রাতে আপনি আমাকে ডাকবেন। কক্ষে প্রবেশ করেই বিন কাসিমের উদ্দেশ্য চপল চাহনী ও আকর্ষণীয় ভঙিতে বলল, রাণী প্রিয়সী। আপনার যৌবন শেষ পর্যন্ত আমাকে তলব করতে বাধ্য করেছে।
হাসলেন বিন কাসিম।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, বাধ্য হয়েই তোমাকে ডেকেছি। কিন্তু তুমি যদি এভাবে সেজেগুজে না এসে স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে তাহলে আমি খুশি হতাম, রাণীর উদ্দেশ্যে বললেন বিন কাসিম।
আমি একটি সৌন্দর্য ও কৃতজ্ঞতার উপঢৌকন হয়ে এসেছি। আপনি এরই মধ্যে আমাকে যে ইজ্জত সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন, এই সাজসজ্জা ছাড়া এসে এর প্রতিদান দেয়া যায় না। আমি তো আপনার হাতে বন্দি ছিলাম? কিন্তু আপনি আমাকে কখনো বন্দি থাকার বিষয়টি অনুভব করতে দেননি। আপনাকে সকল উরুবাসীকে সাধারন ক্ষমা করার অনুরোধ করলাম, আপনি আমার সেই অনুরোধও রক্ষা করেছেন। এখন যদি আমি এদেশের রাণী থাকতাম, তাহলে রাজসিংহাসনে আপনাকে আমার পাশে আসন দিতাম। কিন্তু আজ আমার কিছুই
নেই। আছে শুধু আমার অস্তিত্ব। এজন্য আমার হৃদয়ের মণিকোঠা আর আমার চোখের মণিতেই দিয়েছি আপনার আসন। আর এই দেহটাকে সোপর্দ করছি। আপনার সেবায়।
হ্যাঁ, প্রতিদান আমার চাই রাণী। কিন্তু প্রতিদানে আমি তোমাকে গ্রহণ করতে রাজী নই। আমি তোমার কাছে শুধু এতটুকু প্রতিদান চাই, তুমি সত্যিকার অর্থে আমাকে সহযোগিতা করো এবং এখানকার বাস্তব পরিস্থিতি কি সে খবর আমাকে জানাও এবং করণীয় সম্পর্কে আমাকে পরামর্শ দাও। আমি যদি তোমাকেই চাইতাম, তাহলে আর আমার এসব লোক কক্ষে থাকত না।
যারা তোমার আর আমার কথা আমাদের নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে আমাদের কাছে পেশ করছে। তুমি যে নেশা ও আশা নিয়ে সেজেগুজে এসেছ এই নেশা ও প্রত্যাশা আমার মধ্যে থাকলে তোমার আমার কথোপকথনের জন্য কোন দুভাষীর প্রয়োজন হতো না। কারণ দেহ জ্বালার এই ভাষা জগৎ জুড়ে একই। এক্ষেত্রে কোন দুভাষীর প্রয়োজন হয় না।
বিন কাসিম রাণীকে কাছে বসতে না দিয়ে কিছুটা দূরত্বে একটি কুরসীতে বসতে দিয়ে বললেন, আমি জরুরী কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করার জন্য তোমাকে ডেকেছি। আমার পরবর্তী গন্তব্য ভাথিয়া। ভাথিয়ার ভৌগলিক অবস্থান দুর্গের অবস্থা এবং শাসক ও অধিবাসীদের সম্পর্কে আমি খবর নিয়েছি। কাকসা ওখানকার দুর্গশাসক। আমি জেনেছি, রাজা কাকসা দাহিরের চাচাতো ভাই। আমি তোমার কাছে জানতে চাই, তুমি কি জানো, কাকসাও কি দাহিরের মতো উগ্র মেজাজের লোক? না, সে রাজা দাহিরের মতো উগ্র নয়। সে খুবই বুদ্ধিমান লোক, সবকিছুই বুদ্ধিমত্তার সাথে বিবেচনা করে।
সে যেমন বুদ্ধিমান তেমনি বীরযোদ্ধা। মুখোমুখি যুদ্ধে তাকে কেউ হারাতে পারে না। আপনি হয়তো জানেন না, কাকসা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। রাজা দাহিরের সাথে সেও যুদ্ধে শরীক ছিল। কিন্তু রাজা দাহির নিহত হওয়ার পর সে উরুঢ় ফিরে আসে। কাকসা যখন জানতে পারে, আপনার সেনাবাহিনী উঢ়ের দিকে এগিয়ে আসছে তখন সে ভাথিয়া চলে আসে।
সে কি যুদ্ধ না করে দুর্গ আমাদের হাতে তুলে দেবে? রাণী প্রিয়সীকে প্রশ্ন করলেন বিন কাসিম। আমার যোদ্ধারা তার কাছ থেকে নিঃসন্দেহে দুর্গ ছিনিয়ে নেবে, তবে তাতে প্রচুর রক্তক্ষয় হবে। আমি চাই সে যেন যুদ্ধ ছাড়াই দুর্গ আমাদের হাতে তুলে দেয়।
আপনি অনুমতি দিলে আমি কাকসার কাছে চলে যেতে পারি, বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে বলল রাণী প্রিয়সী। আমি তাকে বলব, অবশেষে যদি তাকে পরাজয়ই বরণ করতে হয় তাহলে জনগণের রক্তপাত এড়াতে কেন আগেই আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। না প্রিয়সী! তুমি এমনটি করবে না। এমনটি করলে সে ভাববে, আরব বাহিনীর সেনাপতি একজন কাপুরুষ। সে একজন অবলা নারীকে তার বিজয়ের মাধ্যম বানিয়েছে। আমি শুধু জানতে চাই, তার মধ্যে বিবেক বুদ্ধি কেমন?
সে তো প্রকৃতপক্ষে উরুঢ়েরই অধিবাসী ছিল। আপনি দেখেছেন উরুঢ়ের অধিবাসীরা বুদ্ধিমান। শুধু তাই নয়, এখানকার অধিবাসীরা বিশ্বস্ত ও বন্ধুবৎসল। কাকসা যে কোন সাধারণ লোকের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। সে যুদ্ধ করা না করার সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নেবে। প্রয়োজন হলে আমি তার কাছে চলে যাব। রাণী প্রিয়সী যখন বিন কাসিমের কক্ষ থেকে বের হলো, তখন তার চেহারায় ফুটে উঠল গাঢ় হতাশা। কারণ সে ভিন্ন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বিন কাসিমের ডাকে সাড়া দিয়েছিল কিন্তু বিন কাসিম তার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করলেন। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাণী প্রিয়সী ছিল বুদ্ধিমতি বিচক্ষণ সুন্দরী যুবতী। রাণী সেই রাতে নানা ভাবে নানা কথা ও অঙ্গ ভঙিতে বিন কাসিমকে কামোদ্দীপ্ত করতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে অনুভব করেছে, আসলে বিন কাসিম টগবগে যুবক হলেও সে রক্ত-মাংসে গড়া সাধারণ কোন যুবক নয়, তার গোটা দেহটাই একটা পবিত্র মোড়কে মোড়ানো। যেখানে সামান্যতম মানবিক ত্রুটির চিহ্ন নেই। আগাগোড়া বিন কাসিম একজন পূত পবিত্র মানব মূর্তি। সেখানে এতটুকু খাদ নেই।
রাণী প্রিয়সী বিন কাসিমের কক্ষ থেকে বের হয়ে অল্পক্ষণ পরে আবার কক্ষে প্রবেশ করে বলল, ক্ষমা করে দিন সিপাহসালার! আজ আমি কুমতলব নিয়ে আপনাকে অপবিত্র করার বাসনা নিয়ে এসেছিলাম। তুমি কি আমার ওপর তোমার রূপের যাদু চালিয়ে আমার ক্ষতি করার ইচ্ছা করেছিলে? জানতে চাইলেন বিন কাসিম। তুমি কি মনে করেছিলে, তোমার রূপের দ্যুতি ও জৌলুস ছড়িয়ে আমাকে কাবু করে ফেলবে? না” না’ এমনটি নয়। আমি আপনাকেও রক্তমাংসের গড়া মানুষ ভেবেছিলাম। সুন্দরী রূপসী তরুণীদের সঙ্গলাভের জন্য তো প্রবল প্রতাপশালী রাজা বাদশারাও তাদের আত্মমর্যাদা ভুলে নীচে নেমে আসে।
আমি আপনাকেও তেমনই একজন প্রতাপশালী রাজা বাদশার প্রতিকৃতি ভেবেছিলাম। এজন্য রাজপরিবারের একজন মর্যাদাবান রাণীর উচ্চাসন ভুলে তুমিও নীচে নেমে এসেছিলে? বললেন বিন কাসিম। না, আপনি যেমনটি ভেবেছেন তা নয়। আমি রাজ পরিবারের কেউ নই। আমার দেহে রাজপরিবারের রক্ত নেই। আমিতো সাধারণ একজন ব্যবসায়ীর মেয়ে। রাজা দাহির আমাকে দেখে পছন্দ করে রাজ প্রাসাদে উঠিয়েছে। রাজ পরিবারের লোক নই বলেই আমার মনে সাধারণ মানুষের প্রতি প্রবল মায়ামমতা। সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যই তো আমি উরুঢ়ের দুর্গপ্রাচীরের কাছে এসে দুর্গের যুদ্ধরত সৈনিকদেরকে বলেছিলাম, রাজা দাহিরের মৃত্যু হয়েছে, তারা যেন আপনার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই আমি আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম, দুর্গের সামরিক বেসামরিক সবাইকে ক্ষমা করে দিতে। আজ আমি আপনাকে একথাও বলে দিতে পারি, কাকসা কোন রক্তক্ষয় না করেই আপনার বশ্যতা স্বীকার করে নেবে, একথা বলে রাণী প্রিয়সী কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
কয়েকদিন পর সকল সেনাদের নিয়ে ভাথিয়া দুর্গের কাছে শিবির স্থাপন করলেন বিন কাসিম। ভাথিয়া দুর্গের অবস্থান ছিল বিয়াস নদীর পূর্ব পাড়ে। সুলতান মাহমুদের অভিযানের সময়ও এই জনবসতির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু আজ আর সেই জনবসতির ধ্বংসাবশেষও অবশিষ্ট নেই। বিন কাসিমের সৈন্যদের সাথেই রাণী প্রিয়সী ভাথিয়া দুর্গে গিয়েছিল। রাণী প্রিয়সী মুসলিম সৈন্যদের সাথে আসা তাদের স্ত্রী-কন্যাদের সাথে অবস্থান করছিল। বিন কাসিম তাকে সাথে নিয়েছিলেন এ জন্য যে, যুদ্ধের কোন পরিস্থিতিতে রাণী প্রিয়সীর প্রয়োজন হতে পারে ভেবে। বিন কাসিমের সৈন্যরা তখনো তাঁবু তৈরিতে ব্যস্ত। বিন কাসিমের তাবু তৈরি শেষে তিনি তাতে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন ঠিক এমন সময় সংবাদবাহক খবর নিয়ে এলো, দুর্গের দিক থেকে সাতজন অশ্বারোহী এবং তাদের পিছনে তিনটি উট আসছে। খবর শুনে বিন কাসিম তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ পর তারও নজরে পড়ল কয়েকটি অশ্বারোহী ও তিনটি উট তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসার দৃশ্য। তিনি নির্দেশ দিলেন, অশ্বারোহীরা যদি তার সাথে সাক্ষাত করতে চায়, তবে তাদেরকে না আটকিয়ে সরাসরি এখানে নিয়ে আসা হোক।
অশ্বারোহীরা তাঁবুর দিকেই আসছিল। কিন্তু তবু এলাকায় প্রবেশের আগেই তাদের পথরোধ করা হলো। কারণ গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী কঠোর নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, তাকে অবহিত না করে যেন কিছুতেই কাউকে প্রধান সেনাপতির কাছে যেতে না দেয়া হয়। গোয়েন্দা প্রধান আগন্তুক অশ্বারোহীদের যাছাই করে তাদের সাথে থাকা অস্ত্র নিজের কাছে রেখে দেন। তিনি আগন্তুকদের কোমর ও দেহ তল্লাশী করে তাদের সাথে গোপনে কোন খঞ্জর রয়েছে কিনা তাও পরীক্ষা করেন। নিশ্চিত হওয়ার পর তাদেরকে বিন কাসিমের কাছে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনিও তাদের সাথেই রওয়ানা হন।
আগত প্রতিনিধি দলের দলনেতা রাজা কাকসার একজন শাসক, বিন কাসিমকে জানালেন গোয়েন্দা প্রধান। এরা রাজা কাকসার উপঢৌকন নিয়ে এসেছে।
বিন কাসিম আগন্তুক প্রতিনিধি দলের সাথে সহাস্যে মিলিত হলেন এবং তাদেরকে সসম্মানে তাঁবুতে বসিয়ে মেহমানদারীর নির্দেশ দিলেন। আমরা কিছুতেই আপনাকে হত্যা করতে এভাবে আসিনি, আপনার এই কর্মকর্তা আমাদের কাছ থেকে তরবারীগুলো ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের অসম্মান করেছে। আমরা ময়দানের লড়াইয়ে অভ্যস্ত। রণাঙ্গনেই আমরা মরতে ও মারতে পছন্দ করি। কাউকে গোপনে হত্যায় আমরা বিশ্বাস করি না। এটা কাপুরুষের কাজ। আমরা কাপুরুষ নই, বলল দল নেতা। বিন কাসিমের নির্দেশে আগন্তুক প্রতিনিধি দলের তরবারী নিয়ে আসা হলো। বিন কাসিম তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া তরবারীগুলো সসম্মানে ফিরিয়ে দিলেন। প্রতিনিধি দল তাদের সাথে নিয়ে আসা উপঢৌকন পেশ করল। বিন কাসিম বললেন, এসব উপহার উপঢৌকন দেয়ার অর্থ কি? এর অর্থ কি আমি কাকসার দুর্গের দিকে না তাকিয়ে এটি এড়িয়ে সামনে চলে যাব? না এটি তোমাদের রাজা কাকসা আমার আনুগত্য স্বীকার করে নেয়ার প্রতীক?
আপনি যদি আমাদেরকে আমাদের অবস্থায় ছেড়ে সামনে এগিয়ে যান, তাহলে আমরা আপনার সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় সব তরিতরকারী আহার সামগ্রী দেবো। শুধু তাই নয়, আমরা আপনার সেনাবাহিনীর ঘোড়া ও উটের খাবারও সংগ্রহ করে দেবো।
আমরা এখানে কোন ভিক্ষা করতে আসিনি, বললেন বিন কাসিম। আমার সেনাদের খাবার দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই এবং আমার বাহিনীর আনা
ঘোড়া ও উটের খাবারও আমরা সাথে নিয়ে এসেছি। আমাদের দরকার দুর্গ। এ প্রশ্নে আমরা কোন ধরনের বেচা কেনা করব না। তোমাদের রাজা কাকসা কি আত্মসমর্পন করবে না? আত্মসমর্পণ করবেন তিনি। তিনি আমাদের বলে দিয়েছেন আপনি যদি আমাদের প্রথম প্রস্তাব মানতে সম্মত না হন, তাহলে আমরা যাতে আত্মসমর্পনের শর্তাদি নিয়ে কথা বলি। আমরা যাতে এ ব্যাপারেও কথা বলি আত্মসমর্পণ করলে রাজা কাকসার মর্যাদা কি হবে?….. আমি আপনাকে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারি, রাজা কাকসা রাজা দাহিরের মতো এতোটা গোঁয়ার নন। তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা তাকে বলেছিল একজন সেনা সদস্য জীবিত থাকাবস্থায়ও দুর্গ যেন আপনার হাতে তুলে দেয়া না হয়। কিন্তু তিনি যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা সবাইকে হতবাক করেছে।
‘তোমরাও কি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলে? জানতে চাইলেন বিন কাসিম। আপনি একটি লড়াকু জাতির লড়াক সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। নিজের মাতভূমি নিজের দুর্গ রক্ষার জন্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করাকে নিশ্চয়ই আপনি অপরাধ বলে গণ্য করবেন না, জবাব দিল দলনেতা। তাছাড়া একথাও একটু ভেবে দেখুন, রাজা দাহিরের নিমক আমরা খেয়েছি। রাজা দাহির আমাদের দিয়েছেন ইজ্জত, সম্মান, মর্যাদা ও প্রতিপত্তি। তাই কেন আমরা তার রেখে যাওয়া রাজ্যের সুরক্ষার জন্য লড়াই করব না? আপনি কি আপনার অধীনস্থ লড়াইবিমূখ কর্মকর্তাদের পছন্দ করবেন?
ঠিক বলেছ। নিঃসন্দেহে তোমরা বিশ্বস্ত এবং সত্যবাদী। কিন্তু রাজা কাকসা তোমাদের লড়াই থেকে নিবৃত্ত করল কেন? প্রশ্ন করলেন বিন কাসিম। তিনি একজন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী লোক, বলল দলনেতা। তিনি বলেছেন, মুসলমানদের লড়াই আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি রাজা দাহিরের পরাজয় ও মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছি। সৈন্য দলের হাতিগুলোকে আমি মুসলমানদের হাতে রক্তাক্ত হয়ে রণাঙ্গন থেকে পালাতে দেখেছি। মুসলমানরা ডাবেল, নিরূন, সিস্তান, ব্রাহ্মণবাদের পর রাজধানী উরুঢ়ও কব্জা করে ফেলেছে। ভাথিয়াকেও তারা কব্জা করে নেবে তাতে সন্দেহ নেই। যেহেতু অবশেষে আমাদেরকে পরাজয় বরণ করতেই হবে, নয়তো ওদের হাতে নিহত হতে হবে, এমনটি জানার পরও যেসব সৈন্যকে আমরা এতোদিন লালন-পালন করেছি এবং এরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত কিন্তু এজন্য
ওদেরকে যুদ্ধে ঠেলে দিয়ে মেরে ফেলা কোন বিবেকবান মানুষের কাজ হতে পারে না। এটা অন্যায়। তাছাড়া বিজয়ী সেনাবাহিনী যখন শহরে প্রবেশ করবে তখন শহরের নিরীহ নাগরিকদের কাছ থেকে তারা যুদ্ধের যাবতীয় ব্যয় ও ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেবে। একজন বিজয়ী সেনার মৃত্যুর বদলে বিজিত রাজ্যের বিশজন নাগরিকের জীবন নেবে। শহরের তরুণী যুবতী মেয়েদেরকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদে পরিণত করবে। প্রতিটি নাগরিকের জীবন সম্পদ ও ইজ্জত আব্রুর নিরাপত্তা বিধান করা রাজার কর্তব্য। রাজা যখন দেখছে, সে তার রাজ্যকে শত্রু বাহিনীর হাতে তুলে দিলে প্রজাদের জীবন সম্পদ রক্ষা পাবে, তখন রাজার রাজত্বের মায়া ত্যাগ করাই উচিত। তিনি বলেছেন, শত্রুকে পরাজিত ও বিতাড়িত করার উদ্দেশে যখন আমাদের লড়াই করার প্রয়োজন ছিল আমরা তা করেছি কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই অবস্থায় লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া হবে আত্মঘাতি।
আমি তোমার রাজাকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি, সত্যিই সে বিবেকবান লোক। যে শাসক তার নিজের জীবন সম্পদ ক্ষমতা ও মর্যাদার জন্য প্রজাদের জীবন সম্পদ মানসম্ভম ধ্বংস না করে নিজের মর্যাদা ও ক্ষমতা কুরবানী করে ইসলামে এমন লোকের মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে। তবে এটা কি ভালো হয় না যে, তোমাদের রাজা নিজে এসেই আমাদের স্বাগত জানাবে? সে এলে তাকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হবে, বললেন বিন কাসিম।
ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, বিন কাসিম রাজা কাকসার প্রেরিত প্রতিনিধি দলকে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান দিয়ে বিদায় করেন। তিনি এদের আগমনকে আত্মসমর্পনের গ্লানীকর অনুষ্ঠানে পরিণত করেননি।
পরদিন সকালেই বিন কাসিমকে খবর দেয়া হলো, রাজা কাকসা তার সাথে সাক্ষাত করতে আসছেন। খবর শুনে বিন কাসিম তাঁবু থেকে বেরিয়ে ঘোড়ায় আরোহণ করে তাঁবুর সীমানা ছাড়িয়ে রাজা কাকসাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এগিয়ে গেলেন। শাবান ছাকাফী তব বিশেষ নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে তার অনুসরণ করলেন। বিন কাসিমকে দেখে রাজা। কাকসা ঘোড়া থেকে নেমে গেলেন। রাজাকে সম্মান দেখানোর জন্য বিন কাসিমও তার ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন এবং এগিয়ে গিয়ে কাকসার সাথে হাত মেলালেন। বিন কাসিমের সাথে ছিল তার একান্ত দুভাষী।
আপনার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই; রাজা কাকসাকে বললেন বিন কাসিম। কাকসাকে তাঁবুতে বসিয়ে বললেন, আপনি কি রাজা দাহিরের চাচাতো ভাই?
“আমি রাজা দাহিরের চাচাতো ভাই, এ নিয়ে গর্ব করার মতো কিছু নেই”, বললেন রাজা কাকসা। কিন্তু আমি রাজা দাহিরের মতো নই এজন্য অবশ্যই আমি গর্ব করতে পারি। এর অর্থ এই নয় যে, রাজা দাহির ছিল দুঃসাহসী ও জাত্যাভিমানী আর আমি ভীতু কাপুরুষ। আমি রাজা দাহিরের মতো যুদ্ধ না করেই দুর্গ আপনার হাতে তুলে দিয়েছি। রাজা কাকসার সাথে বিন কাসিম আলাপ করার পর বুঝতে পারলেন, কাকসা যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী। রাজা কাকসা ভাথিয়া দুর্গের সকল অধিবাসীর জীবন সম্পদের নিরাপত্তা ও দুর্গে স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম, ব্যবসা বাণিজ্য করার অধিকারের শর্তে বিন কাসিমের আনুগত্য কবুল করে নিলো। বিন কাসিম কাকসার বুদ্ধিমত্তা ও বোধ বিবেচনা দেখে এতোটাই মুগ্ধ হলেন যে, তিনি কাকসাকে তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্বে বরণ করে নিলেন। কারণ সেই এলাকায় এমন কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল যেগুলোর সুষ্ঠু সমাধান বের করার জন্য কোন স্থানীয় দূরদর্শী ব্যক্তির পরামর্শ জরুরী ছিল। সেই সাথে পরামর্শ দাতাকে স্থানীয় লোকদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য ও প্রভাবশালী হওয়াটাও ছিল জরুরী। এ ক্ষেত্রে কাকসার চেয়ে বেশিযোগ্য কেউ ছিল না।
বিন কাসিম কাকসার হাতে স্থানীয় ট্রেজারীর দায়িত্বও অর্পণ করেন এবং তাকে মুশীরমোবারক অভিধায় অভিষিক্ত করেন। এরপর ভাথিয়া দুর্গকে বিন কাসিম তার শক্তিশালী সেনা শিবিরে রূপান্তরিত করে পরবর্তী লক্ষবস্তুর ব্যাপারে মনোনিবেশ করলেন। ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণে কাকসার দেয়া পরামর্শ বিন কাসিমের জন্য খুবই সহায়ক প্রমাণিত হলো। কাকসার পরামর্শে পরবর্তী লক্ষবস্তু নির্ধারণ করা হলো আসকালান্দ। এর মধ্যে একদিন রাণী প্রিয়সী বিন কাসিমের সাথে সাক্ষাত করে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার পর বিন কাসিম দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন। ভাথিয়া দুর্গে প্রবেশের পর এই সাক্ষাতের আগে বিন কাসিমের আর রাণী প্রিয়সীর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি, প্রয়োজনও পড়েনি। রাণী প্রিয়সী বিন কাসিমের সাথে দেখা করে বলল, আমি আপনাকে বলেছিলাম না, কাকসা বুদ্ধিমান লোক, সে কোন রক্তক্ষয় না করেই দুর্গ আপনার হাতে তুলে দেবে। কারণ আমি জানতাম, পরিস্থিতি বুঝে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো বিবেক বুদ্ধি তার রয়েছে। সে যদি লড়াই করার মতো বোকামী করতো, তাহলে তাকে কঠিন মূল্য দিতে হতো, বললেন বিন কাসিম।
কাকসা দুর্গ রক্ষার জন্য লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলেও আমি তাকে লড়াই থেকে নিবৃত্ত করতে পারতাম। কারণ তার ওপর আমার এতোটা প্রভাব রয়েছে যে, তাকে আমি আমার কথা মানতে বাধ্য করতে পারতাম, বলল রাণী প্রিয়সী। আল্লাহর যা ইচ্ছা ছিল তা হয়ে গেছে। তুমিতো দেখেছ, আমি তার বিবেক বুদ্ধির সম্মান ও মর্যাদা কিভাবে দিয়েছি, বললেন বিন কাসিম। তুমি কি কাকসার সাথে কথা বলেছ?
না, আমি তার সাথে দেখা করিনি। আপনার অনুমতি ছাড়া আমি আমার পরিচিত কোন লোকের সাথে সাক্ষাত করি না।
তুমি তার সাথে সাক্ষাত করতে পার, বললেন বিন কাসিম।
এই অনুমতির জন্যই আমি এসেছি। আমি শুধু তার সাথে দেখা করতে নয়, তার সাথেই বসবাস করতে চাই, বলল প্রিয়সী। রাণী প্রিয়সীর একথা শুনে বিন কাসিম নীরব হয়ে গেলেন। তিনি চিহ্নিত দুই প্রভাবশালী পূর্ব শত্রুর মিলিত অবস্থানের বিষয়টিতে ভবিষ্যতে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের সম্ভাবনা রয়েছে মনে করে শঙ্কাবোধ করলেন। বিন কাসিমকে দীর্ঘসময় নীরব থাকতে দেখে রাণী প্রিয়সী বলল, আপনি নীরব হয়ে গেলেন কেন? আপনার চেহারা বলছে, আপনি আমাদের একত্রিত অবস্থানকে পছন্দ করছেন না। আপনি চাচ্ছেন না আমরা একত্রে বসবাস করি। আপনার মনে যদি আমার ব্যাপারে কোন ধরনের সংশয় সন্দেহ থেকে থাকে তাহলে মন থেকে তা ঝেড়ে ফেলুন। কারণ কাকসার সাথে তার পরিবারের সব মহিলারাই রয়েছে, আমি শুধু তাদের সান্নিধ্যে থাকতে চেয়েছি মাত্র। আপনি যদি আমাকে বন্দি করে রাখতে চান, তবে আমার কিছুই বলার নেই। তবে আমি আপনাকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, আমি কাকসার সাথে থাকলে আপনার উপকার বৈ-ক্ষতি হবে না। ঠিক আছে প্রিয়সী! তুমি যাও, আমি তোমাকে কাকসার পরিবারে থাকার অনুমতি দিচ্ছি। রাণী প্রিয়সী সে দিন থেকেই কাকসার পরিবার পরিজনের সাথে বসবাস করার জন্য চলে গেল। সে দিন বিকেলে গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী বিন কাসিমের সাথে সাক্ষাত করতে এলেন।
সম্মানিত সিপাহসালার! এই মহিলাকে কাকসার পরিবারে থাকতে দিয়ে আপনি মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করেছেন, বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে বললেন গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী। আপনাকে শুধু আমার কর্তা এবং সিন্ধের আমীরই মনে করি না, বয়োকনিষ্ঠ হওয়ার কারণে আপনাকে আমি নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আপনি নিঃসন্দেহে একজন অনন্য সেনানায়ক এবং শাসক। কিন্তু আপনার যৌবন অনেক ক্ষেত্রে আপনার মধ্যে বিচক্ষণতার চেয়ে আবেগকে প্রবল করে দেয়। আমি আপনার রণকৌশলে কখনো দখলান্দাজি করিনি, দ্রুপ আপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে কখনো আপনাকে কর্তৃত্ব করার সুযোগ দেইনি। কারণ আপনার নিরাপত্তার বিষয়টি আমার ওপর ন্যস্ত।
আপনি কি কোন ঝকির আশঙ্কা করছেন? শাবান ছাকাফীর উদ্দেশ্যে বললেন বিন কাসিম, এরা আমাদের চিহ্নিত শত্রু ছিল ক’দিন আগেও। পরাজিত হওয়ার পর প্রকাশ্য আনুগত্য করলেও এই দুই দিকপাল একত্রে মিলে কোন ঝুকি সৃষ্টি করার ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আপনি কি মনে করেন, আমার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা উচিত?
সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা আপনার মর্যাদা ও আভিজাত্যের পরিপন্থী হবে। এটার ব্যবস্থা আমার কাছে আছে। আমি আজই এদের পিছনে আমার বিশ্বস্ত স্থানীয় দু’জন গোয়েন্দা লাগিয়ে দিয়েছি। যারা এদের ভিতরের খবর সংগ্রহ করবে।
এতো দিনে বিন কাসিম ভাথিয়ার প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের কাজ সমাপ্ত করে ফেলেছিলেন। তাঁর সেনা বাহিনী তখন আসকালন্দের দিকে অভিযানের জন্যে প্রস্তুত। আসকালন্দ অভিযানের আগেও রীতি অনুযায়ী অগ্রবর্তী বাহিনী নির্বাচন করা হলো। আসকালন্দ শহরের কোন অস্তিত্ব এখন আর নেই। শুধু এতটুকু জানা যায়, আসকালন্দ ছিল আবয়াস নদীর পূর্বতীরে। আসকালন্দ অভিযানের অগ্রবর্তী দলের কমান্ড বিন কাসিম কাকসার ওপর ন্যস্ত করলেন। কারণ এলাকাটি সম্পূর্ণ নতুন হওয়ায় একজন স্থানীয় লোকের প্রয়োজন ছিল। কাকসাকে অগ্রবর্তী দলের কমান্ডার নিযুক্ত করলেও শাবান ছাকাফীর পরামর্শে একজন আরব সেনাপতিকেও তার সহযোগী হিসাবে নিযুক্ত করা
হলো। তার নাম ছিল জায়েদ বিন আলতাই। এখানে বলে রাখা ভালো, কাকসা নিজেই অগ্রবর্তী দলের কমান্ডার হওয়ার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন।
পরবর্তীতে কাকসা তার দায়িত্বে পূর্ণ বিশ্বস্ততার স্বাক্ষর রাখলেন। বিয়াস নদী পারাপারের সময় সে স্থানীয় মাছ শিকারীর কাছ থেকে নৌকা নিয়ে নিতে সক্ষম হলো। ফলে সহজেই বিন কাসিম তাঁর দলবল নিয়ে নদী পেরিয়ে গেলেন। বিন কাসিমের সৈন্যরা যখন নদী পার হচ্ছিল তখন দুর্গে খবর পৌছে যায় মুসলিম বাহিনী এসে গেছে। এ খবর মুহূর্তের মধ্যে সারা দুর্গে ছড়িয়ে পড়লে অধিবাসীদের মধ্যে দৌড়ঝাপ শুরু হয়ে যায়। লোকজন বলাবলি করতে শুরু করে, মুসলিম বাহিনী তুফানের মতো ধেয়ে আসছে। এই তুফানে দুর্গের সবকিছু খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে। দুর্গশাসক সিহরা ছিল খুবই বেয়াড়া ও গোয়ার লোক। সে মুসলিম বাহিনীর আগমনে দুর্গের লোকদের ভীত সন্ত্রস্ত হতে দেয়নি।
মুসলিম বাহিনীর আগমন সংবাদ শুনে দুর্গের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় নাগরিক সিহরার দফতরে গিয়ে জানাল, তারা দুর্গপ্রাচীরে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর আগমন দেখেছে। মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা বিপুল।
তোমরা কি চাও? আগন্তুকদের উদ্দেশ্যে বলল সিহরা। তোমরা ভয়ে মরে যাচ্ছো কেন?
আমরা আমাদের স্ত্রী সন্তান মা বোনদের জীবন সম্ভ্রমের নিরাপত্তা চাই, বলল এক আগন্তক। আপনি যদি মনে করেন, আমাদের সেনাবাহিনী দুর্গ রক্ষা করতে পারবে না, তাহলে মুসলিম সৈন্যদের জন্য দুর্গফটক খুলে দিন। আমরা শুনেছি, মুসলিম বাহিনী কোন নাগরিককে হয়রানী করে না। জিযিয়া ছাড়া আর কিছুই নেয় না এবং শহরে লুটতরাজও করে না।
আরব বাহিনী অনেক বড় বাহিনী মহারাজ! বলল অপর একজন। তারা শহরে পাথর ও আগুনেতীর নিক্ষেপ করে। তারা ডাভেল ও উরুঢ়ের মতো দুর্গ দখল করে নিয়েছে, আমরা তাদের প্রতিরোধ করতে পারবো না। তোমরা এমন কাপুরুষ হয়ে যাচ্ছো কেন? ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল দুর্গশাসক সিহরা। তোমরা আমার কথা শোনো। মুসলিম বাহিনীকে আমরা বুঝে শুনেই আসার সুযোগ দিয়েছি। পরপর কয়েকটি বিজয়ে আরব সেনাকমান্ডারদের মাথা বিগড়ে গেছে। তারা ভাবছে, তাদের কেউ মোকাবেলা করার ক্ষমতা রাখে না। রাজা দাহির বলেছিলেন, মুসলিম সৈন্যরা যখন সিন্দু অঞ্চলের
ভিতরে চলে আসবে, তখন ওদের জনবল কমে যাবে, যখন তাদের খাবার মতো কিছুই থাকবে না তখন আমরা তাদের ওপর আক্রমণ করব। সে সময় তাদের পালাবার কোন পথ থাকবে না। আমরা আরব বাহিনীর সিপাহসালার ও সৈন্যদেরকে জীবিত পাকড়াও করবো আর আমাদের প্রতিটি ঘরে একজন করে আরব গোলাম থাকবে। ওদের ঘোড়া ও উটগুলো হবে আমাদের সম্পদ। রাজা দাহির যে স্থানে এদের নিয়ে আসতে চাচ্ছিলেন, তারা এখন সেখানেই এসে গেছে, এখন আমাদের কর্তব্য হলো ওদেরকে পিছু হটার সুযোগ না দেয়া। আমরা ওদেরকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য নদীর তীর পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগও দেবো না।
আপনি তাদের নিক্ষিপ্ত পাথর ও অগ্নিবাহী তীর কিভাবে রোধ করবেন? সিহরাকে প্রশ্ন করল আরেকজন।
আমাদের তীরন্দাজরা কি মরে গেছে? আমাদের অশ্বারোহী সৈন্যরা কি বেকার হয়ে গেছে? আমাদের সৈন্যরা দুর্গ থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাদের ওপর এমন আক্রমণ করবে যে, তারা পাথর অগ্নিবাহী তীর নিক্ষেপের সুযোগই পাবে না।
বলল দুর্গশাসক সিহরা। তোমরা কাপুরুষ হয়ে যেয়ো না। বুকে সাহস রাখো, শহরের যেসব লোক তীর তরবারী বল্লম চালাতে জানে তাদেরকে সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়ে দাও, তারা দুর্গপ্রাচীরের ওপরে উঠে সৈন্যদের সহযোগিতা করুক। আর যারা অশ্বারোহণ, ও তরবারী চালাতে সক্ষম তাদেরকে অশ্বারোহী সৈন্যদের সাথে শামিল হওয়ার কথা বলো।
শুনেছি, রাজা দাহির মারা গেছেন? বলল আগন্তুকদের একজন।
মিথ্যা, সম্পূর্ণ মিথ্যা, গলা চড়িয়ে বলল সিহরা। রাজা দাহির বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে হিন্দুস্তানের সৈন্যদের জমায়েত করছেন। দেখবে তিনি সময় মতো ঠিকই এসে যাবেন।
দুর্গশাসক সিহরা শহরের লোকদেরকে এভাবে উত্তেজিত করল যে, শহরের অধিবাসীরাও সৈন্যদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার জন্য মৃত্যুপণ করল। শহরের মন্দিরের পুরোহিতরা লড়াই না করলে দেবদেবীদের অভিশাপ পড়ার কথা বলে অধিবাসীদের ভয় দেখালো। একপর্যায়ে শহরের সব অধিবাসী ও সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য একজোট হয়ে গেল। তাদের কাছে বিজয় অবশ্যম্ভাবী মনে হতে লাগল।
নদী পারাপারের পর কাকসার পরামর্শে নৌকার মালিকদেরকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক উপহার দেয়া হলো। সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত শস্যভাণ্ডার থেকে তাদেরকে তরিতরকারী দেয়ার নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম।
দুর্গের চতুর্পাশে অবরোধ আরোপের সময় দুর্গপ্রাচীর থেকে অবরোধ আরোপকারী মুসলিম সৈন্যদের প্রতি বৃষ্টির মতো তীর বর্ষণ করল হিন্দু সৈন্যরা। কাকসা একটি ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে দুর্গের প্রধান ফটকের ওপর দাঁড়ানো দুর্গশাসক সিহরার কাছাকাছি গিয়ে সিহরার উদ্দেশ্যে বললেন
সিহরা! আমাকে চিনতে চেষ্টা করো, আমি রাজা দাহিরের চাচাতো ভাই। কাকসা!
আরে কাকসা’ এই লুটেরাদের সঙ্গী হয়ে তুমি কি নিতে এসেছো? তুমিও কি বাপদাদার ধর্ম বিক্রি করে দিয়েছো?
প্রধান ফটক খুলে দাও! ভিতরে এসেই বলব, কেন আমি এদের সাথে এসেছি।
এই ফটক শুধু রাজা দাহিরের জন্যেই খোলা হবে। রাজা দাহিরের আর আসা হবে না। সে নিহত হয়েছে, তার খণ্ডিত মাথা আরবদেশে চলে গেছে। রাজার কনিষ্ঠা স্ত্রী রাণী প্রিয়সী আমার সাথেই রয়েছে।
রাণী প্রিয়সী ছিল অনেকটা পিছনে। কাকসার ইঙ্গিতে সে একটি ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে কাকসার পাশে এসে দাঁড়াল। রাণী তার চেহারা কাপড়ে ঢেকে রেখেছিল।
চেহারার আবরণ ফেলে দিয়ে রাণী প্রিয়সী বলল, আমার দিকে তাকাও সিহরা! তুমি তো আমাকে চেনো। রাজা দাহির জীবিত থাকলে আমি মুসলমানদের সাথে আসতাম না। সময় নষ্ট না করে দুর্গের ফটক খুলে দাও, তাতে কাকসার মতো তুমিও সম্মানিত হবে, তুমিই থাকবে দুর্গের শাসক। শহরের অলিগলি নিজের সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের রক্তে রঞ্জিত করোনা সিহরা! সিহরার উদ্দেশ্যে বললেন কাকসা। নিজের ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনো না। মনে রাখবে, আমি এখন মুসলিম বাহিনীর একজন উপদেষ্টা।
সত্যিই যদি রাজা দাহির এই আরবদের দ্বারা নিহত হয়ে থাকেন, তাহলে আমি তার রক্তের প্রতিশোধ নেবো। এসো না! সাহস থাকলে এগিয়ে এসে
দুর্গের দরজা খুলতে চেষ্টা করে দেখো। তুমি মান মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে আরবদের কর্মকর্তা সেজেছ…। তোমার চোখে বিষাক্ত তীরবিদ্ধ হওয়ার আগেই জীবন বাঁচাতে চাইলে এখান থেকে চলে যাও।
উরুঢ় দুর্গ অবরোধ করার পর রাণী প্রিয়সী দুর্গফটকের কাছে গিয়ে যখন রাজা দাহিরের মৃত্যু সংবাদের খবর বলেছিল তখন ঠিক এমনই এক বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল রাণী প্রিয়সী, যা আজ রাজা কাকসার হতে হলো। রাজা কাকসা ও রাণী প্রিয়সীর সাথেও আসকালন্দ দুর্গের অধিবাসীরাও তাই করল। তাদেরকে অপমান ও ভৎসনা করে তাড়িয়ে দিলো।
“রাজা দাহিরকে হত্যা করার মতো কোন মানুষ পৃথিবীতে নেই। সে যদি নিহত হয়েই থাকে তাহলে তোমরাই তাকে হত্যা করিয়েছ,” দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে কাকসা ও প্রিয়সীর উদ্দেশ্যে বলল সিহরা। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমরা রাজা হত্যার প্রতিশোধ নেবো।
বিন কাসিম তার দুভাষীকে ডেকে বললেন, কাকসা ও প্রিয়সীকে ফিরে আসতে বলে। এদের ভাগ্য খুবই খারাপ। দুর্ভাগ্য ও ধ্বংসই ওদের বিধিলিপি। এদের উপকার করার চেষ্টা অর্থহীন।
বিন কাসিমের নির্দেশে তারা ফিরে এলো।
কাকসা ও রাণী প্রিয়সীর সমঝোতা চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর বিন কাসিম দুর্গ অবরোধ করার নির্দেশ দিলেন। সৈন্যরা যখন দুর্গের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল ঠিক সেই সময় দুর্গের এক কোণের একটি দরজা খুলে গেল। দুর্গের ভিতর থেকে জয়ধ্বনী দিয়ে অসংখ্য অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য প্লাবনের মতো বেরিয়ে এলো এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে সারিদ্ধভাবে না দাঁড়িয়ে ঘেরাও রত মুসলিম বাহিনীর ওপর হামলে পড়ল। মুসলমানরা কোন ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই যে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই প্রতিরোধে লিপ্ত হলো। লড়াই ছিল এলোপাতাড়ি ফলে এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি।
উভয় পক্ষের বিক্ষিপ্ত লড়াইয়ে নিহত ও আহতের সংখ্যা বেড়েই চলছিল। মুসলিম সেনাপতিরা তাদের যোদ্ধাদের একটা শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছিলেন কিন্তু প্রতিপক্ষের প্রবল আক্রমণের মুখে সৈন্যদের শৃঙ্খলায় নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছিল না। বিন কাসিমের বেশি সময় লাগল না সিহরার যুদ্ধ কৌশল অনুধাবন করতে। তিনি হিন্দু সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ উন্মাদনাও দেখতে পেলেন।
বিন কাসিম চিৎকার করে তাঁর যোদ্ধাদেরকে পিছিয়ে আসার আহবান করলেন। তিনি চাচ্ছিলেন, হিন্দু সৈন্যরা যাতে মুসলমানদের তাড়া করতে করতে দুর্গের পাশ থেকে দূরে সরে আসে কিন্তু সিহরা যখন দেখতে পেল মুসলিম সৈন্যরা পিছনে সরে যাচ্ছে তখন সে তার সৈন্যদেরকেও পিছনে সরিয়ে নিল এবং খুব দ্রুত প্রধান ফটক পেরিয়ে দুর্গের ভিতরে চলে গেল। হিন্দু সৈন্যদের বিদ্যুৎ গতিতে দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসা এবং প্রবেশ করা থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল, তাদেরকে এভাবেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং তারা এ ধরনের আক্রমণের জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের বহুসংখ্যক যোদ্ধা নিহত ও আহত হলো। হিন্দুরা তাদের নিহত ও আহত যোদ্ধাদের তুলে নেয়ার কোন চেষ্টা না করেই দুর্গের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিলো। আহত হিন্দুযোদ্ধারা উঠে দুর্গের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল দুর্গফটক বন্ধ হতে দেখে মুসলিম তীরন্দাজরা অতি সহজেই ওদেরকে তীরবিদ্ধ করে হত্যা করতে শুরু করল। ফলে কোন আহত হিন্দু যোদ্ধার পক্ষেই জীবন নিয়ে দুর্গে ফেরা সম্ভব হলো না। হিন্দুরা তাদের নিহত সহযোদ্ধাদের মরদেহ তুলে নেয়ার কোন চেষ্টাই করল না এবং আহতদের জীবন রক্ষারও পরোয়া করল না।
দুর্গফটক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নির্বিঘ্নে মুসলিম যোদ্ধারা তাদের নিহত ও আহত সহযোদ্ধারদেরকে তুলে আনতে শুরু করল। এদিকে মুসলিম শিবিরে থাকা মহিলারা বেরিয়ে এসে আহতদের ক্ষতস্থানে পট্টিবেধে তাদের ওষুধ খাইয়ে পানি ঢেলে সুস্থ করার কাজে লেগে গেল।
সেদিন যুদ্ধ শেষে বিন কাসিম তার বাহিনীর সকল সেনাপতি ও কমান্ডারদের নিয়ে বৈঠক করলেন। শত্রুদের যুদ্ধ কৌশল নিয়ে পর্যালোচনার পর তারা বুঝতে পারলেন আজকের মতো হঠাৎ দুর্গ থেকে বেরিয়ে হামলে পড়াই হবে শত্রুদের যুদ্ধকৌশল। সেই সাথে অবরোধ সম্পন্ন করার পাশাপাশি শত্রু আক্রমণ প্রতিরোধে কিছুসংখ্যক রিজার্ভ সৈন্য রাখার সিদ্ধান্ত হলো। কিছু যোদ্ধাকে রাখা হলো বিচরণশীল। যারা যে কোন দিকে আক্রমণ হলে আক্রান্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে যাবে।
পরদিন মুসলিম সৈন্যরা দুর্গের চতুর্দিকে অবরোধ আরোপ করেছিল। বিন কাসিম দুর্গের চতুর্দিক ঘুরে দুর্গপ্রাচীর কোন দিক দিয়ে ডিঙানো যায় কিনা কিংবা দুর্গপ্রাচীর ভাঙা যায় কি-না তা নিরীক্ষণ করছিলেন। যোহরের নামাযের সময় মুসলিম সৈন্যরা ময়দানেই জামাতে নামায আদায়
করছিল। নামায শেষে অনেকেই ছিল মোনাজাত রত ঠিক এমন সময় দুর্গের পূর্বপাশের একটি ফটক খুলে বন্যার পানির মতো হিন্দু সৈন্যরা বেরিয়ে এসে হামলে পড়ল মুসলিম সৈন্যদের ওপর। মুসলমান সৈন্যরা ঘটনার আকস্মিকতায় পরিকল্পিত প্রতিরোধের অবকাশ পেলনা। অধিকাংশ মুসলিম সৈনিকের পক্ষে নামায থেকে উঠে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে আরোহণের সুযোগ হলো না। হাতের কাছের তরবারী নিয়ে অশ্বারোহীরাও পদাতিকের মতোই হামলে পড়া শত্রুদের প্রতিরোধে লিপ্ত হলো।
আক্রমণ হয়েছিল অবরোধের এক কোণে। বিন কাসিম আক্রমণ হতে দেখেই রিজার্ভ ও চলমান সৈন্যদেরকে আক্রান্তদের সহযোগিতার জন্য দৌড়ালেন। উভয় পক্ষের মধ্যে শুরু হলো তীব্র লড়াই। অপ্রস্তুত থাকার পরও দ্রুত সহযোগীদের পৌছে যাওয়ায় মুসলিম সৈন্যরা আক্রমণ সামলে নিল কিন্তু এই আক্রমণে হিন্দুদের বিরাট মূল্য দিতে হলো। হিন্দুরা বেরিয়ে আসা অর্ধেক যোদ্ধাকে আহত ও নিহত অবস্থায় ময়দানে ফেলে রেখে দুর্গে ফিরে গেল। এই ক্ষয়ক্ষতির পর আর সিহরার কোন সৈন্যদল দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে আক্রমণ করল না। তারা দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে তীর ও পাথর নিক্ষেপ করে মুসলমানদের ক্ষয়ক্ষতি করার চেষ্টায় লেগে গেল।
সিহরার সৈন্যরা আরব সৈন্যদের নৌকা থেকে চুরি করে আনা মিনজানিকের আদলে ছোই মিনজানিক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এসব মিনজনিক দিয়ে মুসলিম সৈন্যদের প্রতি ছোট্ট পাথর নিক্ষেপ করছিল সিহরার বাহিনী। নিক্ষিপ্ত এক দেড় কেজি ওজনের পাথরের দ্বারা মুসলিম শিবিরের তেমন কোন ক্ষতিসাধন সম্ভব হলো না। কারণ নিক্ষিপ্ত পাথরের গতি বুঝে নিয়ে মুসলমানরা তাদের তাবু সরিয়ে নিয়েছিল কিন্তু হিন্দুদের অব্যাহত ও তীব্র পাথর নিক্ষেপের কারণে দুর্গপ্রাচীরে ভাঙন সৃষ্টিকারী আরব যোদ্ধাদের পক্ষে প্রাচীরের ধারে কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এভাবে এক সপ্তাহ পর্যন্ত চেষ্টা করার পরও দুর্গপ্রাচীর ডিঙানোর কৌশল ফলপ্রসূ না হওয়ায় অবশেষে বিন কাসিম শেষ পন্থা অবলম্বন করলেন। তিনি মুসলিম সৈন্যদের নিয়ে আসা বড় বড় মিনজানিক থেকে দুর্গের ভিতরে বড় বড় পাথর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন সেই সাথে অগ্নিতীর ছোড়ারও অনুমতি দিয়ে দিলেন।
মুসলমানদের নিক্ষিপ্ত পাথর ও অগ্নিবাহী তীরে শহরের অনেক জায়গায় আগুন ধরে গেল এবং পাথরের আঘাতে ঘরবাড়ি ধ্বংস হতে শুরু করল। আতঙ্কিত শহরবাসীর মধ্যে শুরু হলো আর্তচিকার হুড়োহুড়ি দৌড়-ঝাপ।
সন্ধ্যার সামান্য আগে দুর্গের একটি ফটক খুলে দুর্গের ভিতর থেকে অন্য দুদিনের মতো হিন্দু সৈন্যরা বেরিয়ে এসে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করল। হিন্দু সৈন্যদের সংখ্যা ও আক্রমণের ধরণ দেখে মনে হচ্ছিল দুর্গের সকল সৈন্যই বেরিয়ে এসেছে এবং তারা আখেরী ও চূড়ান্ত আঘাত হেনেছে। হিন্দুদের আখেরী আক্রমণ প্রতিহত করতে বিন কাসিম অবরোধ ভেঙে দিয়ে সৈন্যদেরকে প্রতিরোধ আক্রমণকে নির্মূল আঘাতে পরিণত করার চেষ্টা করলেন। সন্ধ্যার সামান্য আগের এই আক্রমণ প্রতি আক্রমণ বেশি সময় স্থায়ী হলো না। সন্ধ্যা নেমে আসায় বিপুল সাথীকে ময়দানে ফেলে রেখেই অবশিষ্ট হিন্দু সৈন্যরা দুর্গে ফিরে গেল। রাতের বেলায় গোটা ময়দান আহত সৈন্যদের আর্তচিৎকার ও কান্নাকাটিতে কাটল। এদিকে দুর্গের ভিতরেও রাতভর শোনা গেল শহরবাসীর মধ্যে হট্টগোল। সকাল বেলায় দেখা গেল দুর্গের কয়েকটি জায়গায় উঁচু বাঁশের মাথায় সাদা পতাকা বেঁধে দেয়া হয়েছে। সাদা পতাকা সাধারণত শান্তি ও আত্মসমর্পণের আহবান বোঝায় কিন্তু সিহরার কার্যক্রমের কারণে বিন কাসিম এটাকে প্রতারণতার একটি কৌশল মনে করলেন। বেলা কিছুটা বাড়ার পর দুর্গের প্রধান ফটক খুলে কয়েকজন লোককে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। তাদের একজন উচ্চ আওয়াজে মুসলমানদের উদ্দেশ্য বলল, তারা মুসলিম প্রধান সেনাপতির সাথে দেখা করতে চায়। তাদেরকে অগ্রসর হতে বলা হলো। তারা এগিয়ে এলে তাদের কাছ থেকে তরবারী ও হাতিয়ার ছিনিয়ে নিয়ে গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফীর হাতে সোর্পদ করা হলো। গোয়েন্দা প্রধান তাদেরকে বিন কাসিমের কাছে নিয়ে গেলেন।
আমরা আপনার কাছে নিরাপত্তা চাইতে এসেছি, আমরা আপনার কাছে আমাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার আবেদন করছি’, বলল আগন্তুকদের একজন।
তোমাদের শাসকের কি সাহস হলো না এখানে আসার? আগন্তুকদের জিজ্ঞেস করলন বিন কাসিম। দুর্গশাসক নিজে না এসে তোমাদের পাঠাল কেন? আত্মসমর্পণের রীতি তো এটা নয়। সে নিজে না আসার অর্থ হলো, তার এখনো যুদ্ধ করার সাধ মিটেনি।
মহামান্য আরব সেনাপতি। সে দুর্গে থাকলে তো আসবে? বলল প্রতিনিধি, দলের মুখপাত্র। আমরা আসার অর্থই হলো সে নেই। দুর্গশাসক পালিয়ে গেছে।
কখন পালালো? কোন দিক দিয়ে পালালো?
পালানোর সুযোগ সে করে নিয়েছিল। গতকাল আপনার সেনাবাহিনীর নিক্ষিপ্ত পাথরে যখন শহরের অধিবাসী ও সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং অগ্নিবাহী তীরে কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরে যায়, ভীতসন্ত্রস্ত নারী ও শিশুদের আর্তনাদে আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয় তখন শহরের অধিবাসীদের মধ্য থেকে আমরা আত্মসমর্পণের জন্য সিহরাকে বলি। আমরা তাকে বললাম, আরব সৈন্যদের আক্রমণ থেকে আমরা দুর্গ রক্ষা করতে পারবো না, তাই আরবরা দুর্গ জ্বালিয়ে ভস্ম করার আগেই আত্মসমর্পণ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। না হয় আরবরা দুর্গ দখল করবে। আমাদের সকল যুবক-যুবতী নারী ও শিশু আরবদের গোলামবাদী হবে এবং তুমি সহ সেনাবাহিনীর সকলকেই হত্যা করা হবে। তার চেয়ে কি ভালো নয় আরবদের কাছে আত্মসমর্পণ করে সবার জানমাল ইজ্জত আব্রু রক্ষা করা। এটা করলে শহরও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পাবে।
আমাদের প্রস্তাবে সিহরা গভীর ভাবনায় ডুবে গেল। অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর নীরবতা ভেঙে বলল, ইতিমধ্যে আমরা বহু আরব সৈন্যকে হত্যা করেছি এবং বিপুলসংখ্যক আরব সৈন্যকে আহত করেছি। আরব সেনাপতি তাদের এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির জন্যে আমাদের কিছুতেই ক্ষমা করবে না। এখন যদি আমরা আত্মসমর্পণ করি, তাহলে তারা আমাদের কাছ থেকে জিযিয়াও নেবে যুদ্ধের যাবতীয় ক্ষয়ক্ষতির জন্য মোটা অংকের ভর্তুকি উসূল করবে। শুধু এর ওপরই তারা খুশি হবে না, এরা আমাদের স্ত্রী কন্যা বোন ও সোনাদানা সবই কুক্ষিগত করবে। আর আমাদের সবাইকে দাসদাসী বানিয়ে আরব দেশে পাঠিয়ে দেবে।
এরপর দুর্গশাসক সিহরা শহরের প্রধান মন্দির থেকে দুজন পুরোহিতকে ডেকে পাঠালো আমাদের বুঝানোর জন্য। পুরোহিতরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমাদের উৎসাহিত করল। তারা লড়াই না করে আত্মসমর্পণ করলে দুনিয়াতে আমাদের যে নির্মম লজ্জাকর পরিণতি বরণ করতে হবে সেই সম্পর্কে সতর্ক করল এবং পরপারে আমাদের আরো কঠিন শাস্তির কথা বলল। পুরোহিতরা সতর্ক করল এই বলে যে, লড়াই না করলে মৃত্যুর পর তোমাদেরকে শূকর কুকুরের বেশে পূর্ণজন্ম দেয়া হবে।
তোমরা বোঝাতে চাচ্ছো, সিহরী ও পুরোহিতরা তোমাদেরকে লড়াই। করতে বাধ্য করেছে।
হ্যাঁ, আমরা আপনাকে আমাদের প্রকৃত অবস্থা বুঝানোর জন্যই বিস্তারিত বলছি। আমরা আপনার কাছে যাতে আমাদের অপরাধের ক্ষমা পেতে পারি এজন্য আমরা প্রকৃত ঘটনা আপনাকে অবহিত করছি। সিহরা ও পুরোহিতরা আমাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করার পর বলল, আজ দিনের শেষ ভাগে আমরা মুসলমানদের ওপর এমন আক্রমণ চালাবো যে, মুসলমানরা পালানোর পথ পাবে না। এরপর সরকারি সৈন্যরা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। শহরে যত যুবক ও সামর্থবান পুরুষ ছিল সবাইকে নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ে শরীক হওয়ার আহবান জানালো। তারা বলল, আজ বিকেলে মুসলিম বাহিনীকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উদ্দেশে আখেরী হামলা চালানো হবে। এসো সবাই নিধনযজ্ঞে শামিল হও। একথা শুনে শহরের সকল সক্ষমপুরুষই নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে সৈন্যদের সাথে মুসলিম নিধনযজ্ঞে শামিল হলো। সন্ধ্যার সামান্য আগে সৈন্য ও শহরের লোকেরা মিলে আপনাদের ওপর আক্রমণ চালালো।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে অক্ষত সৈন্য ও বেঁচে যাওয়া লোকজন দুর্গে ফিরে গেল। আমরা রাতে সিহরার প্রাসাদে গিয়ে দেখি সে নেই। প্রাসাদের এক রক্ষী বলল, সকল সৈন্যও লোকেরা যখন যুদ্ধে লিপ্ত তখন সিহরা তার প্রাসাদে রক্ষিত সকল সোনাদানা মনিমুক্তা দামী আসবাবপত্র জড়ো করল। পূর্ব থেকেই প্রাসাদের সামনে কয়েকটি ঘোড়া প্রস্তুত ছিল। এমনসময় এক সৈনিক দৌড়ে এসে সিহরাকে কানে কানে কি যেন বলে সব মালপত্র একটি ঘোড়ার পিঠে তুলে অন্য ঘোড়ার পিঠে সিহরার পরিবার-পরিজনকে তুলে অদৃশ্য হয়ে গেল। সাথে সাথে সিহরাও গায়েব হয়ে গেল। জানা নেই তারা কোন দিক দিয়ে দুর্গ ছেড়ে গেছে। বিন কাসিম প্রতিনিধি দলের আবেদন মঞ্জুর করলেন এবং জিযিয়া ছাড়া তাদের ওপর কোন জরিমানা ধার্য করেননি। তিনি প্রতিনিধি দলকে আশ্বাস দিলেন, তোমরা আগে যেসব নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে সেসব সুবিধার সবগুলোই তোমাদের বহাল থাকবে।
দুর্গে প্রবেশ করার পর গোয়েন্দা প্রধান বিভিন্ন লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে চেষ্টা করলেন, সিহরা কোন দিক দিয়ে পালিয়ে গেছে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধানের পর তিনি জানতে পারলেন, পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই করে রেখেছিল সিহরা কিন্তু অবরোধের কারণে তার পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে সে শহরের সকল লোকও
সৈন্যদের দিয়ে অবরোধের একপাশে এমন জোরদার আক্রমণ করল যে, সকল মুসলিম সৈন্য প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে বাধ্য হলো। এই হামলাও করল সন্ধ্যার ঠিক আগমুহূর্তে। দু’পক্ষের আক্রমণ প্রতি আক্রমণের মধ্যেই সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলো আর এই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে খালি জায়গা দিয়ে সিহরা তার পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে গেল। এদিকে যে দুই পুরোহিত যুদ্ধের জন্য লোকজনকে প্ররোচিত করেছিল তারাও গায়েব। রাতের বেলায় যুদ্ধ ফেরত লোকজন যখন দেখল তাদের শাসক ও ধর্মগুরু কেউই নেই, তখন শহরের লোকেরা সবাই মিলে পরামর্শ করে তাদের জীবনও সম্পদ রক্ষার আবেদন জানানোর জন্য বিন কাসিমের কাছে এই প্রতিনিধিদলকে পাঠাল। অত:পর বিজয়ী বেশে বিন কাসিম আসকালন্দ দুর্গে প্রবেশ করলেন। এবং উতবা বিন সালামা তামিমীকে আসকালন্দ দুর্গের শাসক নিযুক্ত করলেন। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, প্রায় বারো হাজারের মতো হিন্দু সেদিন আসকালন্দ দুর্গের বাইরে নিহত হয়েছিল এবং হাজারেরও বেশী আহত হয়েছিল।
বর্তমানে যে সিন্ধু প্রদেশ রয়েছে এর পুরো এলাকাটিই তখন বিন কাসিমের দখলে চলে আসে। অবশ্য রাজা দাহিরের রাজত্বের পরিধি মুলতান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিন কাসিমের পরবর্তী গন্তব্য ছিল মুলতান। বিন কাসিম মুলতানের নকশা মেলে অভিযানের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। স্থানীয় উপদেষ্টাগণ বিন কাসিমকে জানালেন, মুলতানের আগে সিককা নামে একটি দুর্গ রয়েছে সেটিকে অবশ্যই জয় করতে হবে। ইতিহাসে বর্ণিত সিককা নগরীর কোন চিহ্ন বিদ্যমান নেই। জানা যায় সিককা শহরের অবস্থান ছিল চুন্নাব নদীর পূর্বতীরে মুলতান শহরের অপর পাশে। সিককা শহর ও মুলতানের মাঝে যদি নদী না থাকত তাহলে উভয় শহর একই শহরে রূপান্তরিত হতো। সিককা নগরের শাসক ছিল রাজা দাহিরের ভাতিজা বিজয়রায়ের সহোদর বজরা এবং মুলতানের শাসক ছিল রাজা দাহিরের ভাই চন্দ্রের ছেলে কুরসিয়া। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, মুলতানের শাসকের নাম ছিল গৌরাঙ্গ। কাকসা বিন কাসিমকে জানালেন, কুরসিয়াও এভাবেই লড়াই করবে। তাই ওর সৈন্যদেরকে দুর্গের বাইরেই দুর্বল করে ফেলতে হবে। বিন কাসিম কাকসার পরামর্শকে পছন্দ করলেন, তিনি পাথর নিক্ষেপ ও অগ্নিবাহী তীর
নিক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করতেন। কারণ তাতে দুর্গের অধিবাসীদের মধ্যে আতঙ্কই শুধু ছড়িয়ে পড়তো না, দুর্গের লোকজনের ব্যাপক ধনসম্পদ ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হতো। বিন কাসিম বিজিত এলাকার লোকজনের কাছ থেকে কর ও জিযিয়া আদায় করতেন। কিন্তু পাথর ও আগুনে ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেলে জিযিয়া আদায় করা অসম্ভব হয়ে যেত। লোজন বলত, আমাদের সব কিছুই তো ধ্বংস হয়ে গেছে, আমাদের জীবন ব্যয় মিটানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় জিযিয়া কিভাবে পরিশোধ করব? অথচ যুদ্ধের ব্যাপক ব্যয় নির্বাহে জিযিয়া প্রাপ্তির বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরদিন ভোরের সূর্য যখন চতুর্দিকে আলো ছড়ালো, তখন মুসলিম সৈন্যরা যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে সিককার সৈন্যদের মুখোমুখি দাঁড়ানো। বেলা কিছুটা ওপরে উঠার পর বিন কাসিম ইসলামী যুদ্ধরীতি অনুযায়ী মধ্যভাগের সৈন্যদেরকে সামনে অগ্রসর হয়ে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। অপর দিকেরও মধ্যভাগের সৈন্যরা অগ্রসর হয়ে লড়াইয়ে লিপ্ত হলো। দুপক্ষের মধ্যে শুরু হলো তীব্র লড়াই। এক পর্যায়ে আরব সৈন্যরা তাদের রীতি অনুয়ায়ী পিছনে সরে আসতে শুরু করলো। মধ্যভাগের সৈন্যদের পিছনে সরিয়ে এনে বিন কাসিম দুই প্রান্তের সৈন্যদের ঘেরাও আরো প্রলম্বিত করে শত্রুসেনাদের ঘেরাও করতে চাইলেন কিন্তু শত্রুবাহিনী মুসলমানদের ইচ্ছা বুঝতে পেরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিলো। ফলে বিন কাসিমের এই কৌশল কোন কাজে এলো না। এভাবে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর সন্ধ্যা নেমে এলে বজরা তার সৈন্যদেরকে দুর্গে ফিরিয়ে নিল। বিন কাসিম দুর্গ অবরোধের কোন চেষ্টাই করলেন না। অবরোধ না করে তিনি কিছু সৈনিককে দুর্গের বিপরীত পাশে পাঠিয়ে দিলেন। তাদের নির্দেশ দিলেন, দুর্গ থেকে যাতে কোন লোক বাইরে যেতে না পারে এবং বাইরের কোন লোকও যাতে দুর্গে প্রবেশ করতে না পারে। বাইরের দুনিয়া থেকে দুর্গকে বিচ্ছিন্ন করা ছিল এই নির্দেশের উদ্দেশ্য।
এ ভাবে চার পাঁচ দিন চলে গেল। দুর্গ থেকে বেরিয়ে হিন্দু সৈন্যরা যুদ্ধ করতো, আবার দিন শেষে দুর্গে ফিরে যেত। তাতে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল বটে কিন্তু ক্ষতি থেকে মুসলমানরাও মুক্ত ছিল না।
কিন্তু চার পাঁচ দিন যুদ্ধের পরও সিককার সৈন্যদের যুদ্ধ উন্মাদনায় কোন ঘাটতি দেখা গেল না। বিন কাসিম সেনাপতি ও কমান্ডারদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেনো মুসলিম সৈন্যদেরকে বিরতি দিয়ে লড়াই
করায় এবং দুই বাহুর সৈন্যরা যাতে ওদেরকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে না দেয়। ওদেরকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ক্লান্ত করে ফেলে এবং তীরন্দাজরা তীরের চেয়ে বর্শার ব্যবহার বেশি করে। এভাবেও তিন চার দিন যুদ্ধ হলো। এই কৌশলে মুসলমান সৈন্যরা ছিল খুবই পারদর্শী। পারদর্শিতার সাথেই তারা এই চাল প্রয়োগ করল। তাতে শত্রুবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো বটে কিন্তু তাদের আবেগ ও উচ্ছাসে ভাটা পড়ল না।
শেষ দিন গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী বিন কাসিমকে জানালেন, দুর্গপ্রাচীরের ওপরে যেসব লোক রয়েছে এদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। সৈন্যরা সবাই দুর্গের বাইরে এসে যুদ্ধ করে। কিন্তু যুদ্ধে আহত সৈন্যদেরকে ওরা কখনই উঠিয়ে নেয়ার চেষ্টা করত না। এরা ময়দানেই মরণযন্ত্রণায় ভুগে এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। শাবান ছাকাফী প্রতি দিনই ময়দান থেকে দু’একজন আহত শত্রু সৈন্যকে তুলে এনে ওদের চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রুষা করে তাদের প্রাণভিক্ষা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ওদের কাছ থেকে ভিতরের তথ্য বের করে নিতেন। তুলে আনা শত্রুসৈন্যরা প্রাণে বাঁচার আশায় দুর্গের অভ্যন্তরের সব খবর শাবান ছাকাফীকে জানিয়ে দিতো। আহত হিন্দু সৈন্যরা তাকে জানিয়েছে, দুর্গপ্রাচীরের ওপরে কোন নিয়মিত সৈনিক নেই, সবাই শহরের বেসামরিক নাগরিক। তারাই তীরবর্শা দিয়ে প্রতিরোধ করছে। এটাও জানালো, শহরের সকল নাগরিক মন্দিরে গিয়ে জীবন দিয়ে হলেও শহর রক্ষার শপথ নিয়েছে। সর্বশেষ তুলে আনা আহত সৈন্যরা শাবান ছাকাফীকে জানালো, দুর্গে সৈন্যসংখ্যা মারাত্মক কমে গেছে এবং খাবারও ফুরিয়ে এসেছে। মুলতান থেকে সাপ্লাই আসতে পারছে না।
এরপর বিন কাসিম দুর্গের চতুর্দিকে বলিষ্ঠ কণ্ঠধারী ঘোষক দিয়ে ঘোষণা করালেন, শহরের সাধারণ নাগরিকরা যদি সৈন্যদের সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তাদের সবাইকে ক্ষমা করা হবে, অন্যথায় তাদের কঠিন মূল্য দিতে হবে। তাদের আরো বলা হলো, সৈন্যদের অবস্থা দেখো, ওরা বেশি দিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না, শেষ পর্যন্ত জয় আমাদের হবেই। অতএব, আমাদেরকে মোকাবেলায় সময় নষ্ট না করে স্বাগত জানানোর মধেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত।
উচ্চকণ্ঠের অধিকারী স্থানীয় ঘোষক দিয়ে বিন কাসিম দুর্গের চতুর্দিকে বার বার এই ঘোষণা দেয়ালেন। কিন্তু এই ঘোষণার জবাবে দুর্গপ্রাচীরে থেকে অধিবাসীরা মুসলমানদের বিদ্রুপ করতে লাগল। তাদেরকে মন্দিরের পুরোহিতরা বলেছিল, শেষ পর্যন্ত বিজয় হিন্দুদেরই হবে, মুসলিম বাহিনী পরাজিত ও ধ্বংস হয়ে যাবে।
পুরোহিতদের ভবিষ্যদ্বাণীতে হিন্দু অধিবাসীরা এতোটাই আশ্বস্ত ছিল যে, তারা চোখের সামনে সৈন্যদের শক্তি হ্রাস পাওয়া এবং দুর্গের ভিতরকার খাবার সামগ্রী শেষ হওয়ার ব্যাপারটি আমলেই নিলো না। তারা মুসলমানদের প্রতি নানা বিদ্রুপাত্মক অঙ্গভঙ্গি ও গালিগালাজ করছিল। ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করছিল। এক পর্যায়ে দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে আওয়াজ এলো, হে মুসলমানেরা! আমরা মন্দিরে দেবদেবীর সামনে শপথ নিয়েছি, হয় তোমাদের ধ্বংস করবো নয় তো আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। এ কথা বিন কাসিমও নিজের কানে শুনতে পেলেন। প্রলম্বিত এ যুদ্ধে। ইতোমধ্যে মুসলিম বাহিনীর তিন সেনাপতি ও সতেরো জন কমান্ডার নিহত হয়েছিলেন। দুর্গপ্রাচীরের এই দম্ভোক্তি বিন কাসিমের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিলো, তিনি হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতি ও কমান্ডারদের মৃত্যুতে এমনিতেই তিনি ছিলেন ব্যথিত মর্মাহত। এ পর্যায়ে হিন্দুদের দম্ভোক্তি তাকে উত্তেজিত করে তুলল। তিনি বলে উঠলেন-আল্লাহর কসম! আমি এই শহর নিশ্চিহ্ন করে দেব। অবশেষে টানা সতেরো দিন যুদ্ধের পর আঠারোতম দিনে যখন দুর্গের ফটক খুলে হিন্দু সৈন্যরা সামনে অগ্রসর হলো বিন কাসিম ওদের আক্রমণের নির্দেশ দিলেন, তখন হিন্দুযোদ্ধাদের একাংশ দুর্গের ভিতরে ঢুকে পড়ল। তিনি আরো লক্ষ্য করলেন, শত্রুসেনাদের মধ্যে আগের মতো আর আবেগ উচ্ছাস নেই। তিনি বুঝে নিলেন, নিশ্চয় ওদের কোথাও দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে, তিনি জোরদার আক্রমণের নির্দেশ দিলেন।
মুসলিম যোদ্ধারা শৃঙ্খলা বজায় রেখেই জোরদার আক্রমণ চালালো। মুসলমানদের আক্রমণে হিন্দুরা ফটকের দিকে পালাতে শুরু করল। বিন কাসিম তীরন্দাজদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন দুর্গপ্রাচীরের ওপরে তীব্র আক্রমণ অব্যাহত রাখে। দুর্গের সৈন্যরা দুর্গপ্রাচীর ও মুসলমানদের আক্রমণের মাঝে আটকে গেল। যারাই সুযোগ পাচ্ছিল ফটক গলিয়ে দুর্গের ভিতরে পালিয়ে যাচ্ছিল। ওদের পশ্চাদ্ধাবন করে মুসলিম সৈন্যরা দুর্গে ঢুকে
পড়ছিল। এভাবে একপর্যায়ে কয়েকটি মুসলিম ইউনিট দুর্গের ভিতরে ঢুকে পড়ে। মুসলমান সৈন্যদের দুর্গের ভিতরে দেখে যেসব হিন্দু দুর্গপ্রাচীরের ওপরে বসে তীর নিক্ষেপ করছিল এরা পালিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ দুর্গের ভিতরেও লড়াই চলল। কিন্তু মুসলমানদের তীব্র আক্রমণে টিকতে না পেরে হিন্দু সৈন্যরা হাতিয়ার ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করল। এরপর দুর্গের হিন্দু শাসকদের তল্লাশী চালিয়ে জানা গেল, দুর্গশাসক বজরা রাতের অন্ধকারে পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে গেছে। সকাল বেলায় সেনা কর্মকর্তারা সতেরো দিনের যুদ্ধে অর্ধেকের চেয়ে কম বেঁচে থাকা সৈন্যদেরকে দুর্গের বাইরে যুদ্ধের জন্য নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ করার মতো সাহস শক্তি ও মনোবল ছিল না। বিন কাসিমকে এ যুদ্ধে দু’শ পনেরো জন সৈনিক সতেরো জন কমান্ডারও তিন জন সেনাপতিকে হারাতে হয়েছিল।
বিন কাসিম নির্দেশ দিলেন, শহরের সকল সামরিক বেসামরিক লোককে গ্রেফতার করা হোক।
তাৎক্ষণিক নির্দেশ পালিত হলো। সেখান থেকে বৃদ্ধ নারী ও শিশুদের আলাদা করা হলো। এরপর বিন কাসিম নির্দেশ দিলেন, এই শহর ও শহরের প্রতিরক্ষা ব্যুহকে ধ্বংস করে দেয়া হোক। তাই হলো। শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো।
সিককা শহর ধ্বংসের খবরে হিন্দুস্তানের রাজা মহারাজের মধ্যে দেখা দিলো আতঙ্ক। সারা হিন্দুস্তান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল সিককা শহর ধ্বংসের খবর। রাজা দাহির জীবিত থাকাবস্থায় তার আশেপাশের রাজ রাজড়াদেরকে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চলিয়েছিলেন। তার পরিবার, উজীর, পরামর্শদাতা ও সেনাবাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা জানতো, রাজা দাহির আরবদের বিরুদ্ধে হিন্দুস্তানের রাজা মহারাজাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য চেষ্টা করছেন। এর ফলে রাজা দাহিরের নিহত হওয়ার পরও তার ছেলেসহ অন্যান্য লোকেরা মনে করেছিল, যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দাহির হিন্দুস্তানের অন্যান্য রাজ্যে সৈন্য সাহায্যের জন্যে চলে গেছে। কিন্তু বিন কাসিমের কৌশল ও অব্যাহত দুর্গ দখলের ফলে অল্পদিনের মধ্যে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, রাজা দাহির আসলে বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে তার রাজধানীর পতন এবং পার্শ্ববর্তী দুর্গগুলোর একের পর এক পতনে তিনি নীরব থাকতে পারতেন না।