যেসব মূর্তি নিজেদের অস্তিত্বই রক্ষা করতে পারেনা তোমরা এগুলোর পূজা কেন করো?
ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গ জয় ছিল বিন কাসিমের বিজয়গাথার আরেকটি মাইল ফলক। মুসলিম সৈন্যরা ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে সর্বত্র ইসলামী পাতাকা উড়িয়ে দিল। ব্রাহ্মণাবাদ ছিল একটি দুর্গবন্দি শহর। শহরের সাধারণ হিন্দুরা মনে করছিল বিজয়ী সেনারা তাদের ঘড়-বাড়িতে লুটতরাজ করবে। তাদের কুমারী কিশোরী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাবে। এই ভয়ে সবাই তরুণী-যুবতী মেয়েদের লুকানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। বহুসংখ্যক তরুণী বিজয়ী সেনাদের আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্যে পুরুষের পোশাক পরিধান করছিল। বহুসংখ্যক হিন্দু মন্দিরে গিয়ে লুকিয়ে ছিল।
মন্দিরে আশ্রয় প্রার্থীদের উদ্দেশ্যে প্রধান পুরোহিত ঘোষণা করল, হে ব্রাহ্মাণাবাদবাসী। তোমাদের কোন ভয় নেই। আমরা বিজয়ী সৈন্যদের কাছ থেকে তোমাদের জানমালের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি নিয়েছি। দুর্গের প্রধান ফটক বিজয়ী বাহিনীর জন্য আমরাই খুলে দিয়েছি। তোমাদের কোন ভয় নেই। সবাই নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে যাও। ঘরের দরজা খুলে ঘুমাতে পারো। কোন মুসলিম সৈন্য তোমাদের গায়ে হাত দেবে তো দূরে থাক তোমাদের দহলিজেও পা দেবে না।
এদিকে বিন কাসিম তার সৈন্যদের জন্য হুকুম জারী করলেন, আক্রমণ উদ্যত কোন লোক ছাড়া দুর্গের কোন সাধারণ নারী, শিশু আবালবৃদ্ধ বনিতার গায়ে কেউ হাত ওঠাবে না। কারো বাড়ি-ঘরে উঁকি দিয়েও দেখবে না। বিন কাসিমের এই নির্দেশ শহর জুড়ে আরবী ও সিন্ধি উভয় ভাষায় ঘোষণা করা হচ্ছিল। কারণ মুকুর স্থানীয় সৈন্যরা ছাড়াও বহুসংখ্যক স্থানীয়
নওমুসলিমও বিন কাসিমের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। যাদের অধিকাংশই আরবী ভাষা জানতো না।
বিন কাসিম আরো ঘোষণা করালেন, কোন সৈন্যকে পালানোর সুযোগ দেবে না। কারণ এরা এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্য জায়গার সৈন্যদের সাথে মিশে শক্তি সঞ্চয় করবে। বিন কাসিম! আমি কিন্তু পালিয়ে যাওয়া সৈন্যদের মধ্যে বরং-এর বিপরীতটাই দেখতে পাচ্ছি। মুচকী হেসে বললেন গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী। তিনি বললেন, হিন্দুস্তানের এসব পালিয়ে যাওয়া সৈন্যরা অন্য জায়গায় গিয়ে শক্তিবৃদ্ধির বদলে, বরং আরো ভীতিকেই প্রকট করে।…. তাই যারা পালাতে চায় ওদের পালিয়ে যেতে দেয়াই উচিত। আর যাদেরকে পালাতে দেয়া উচিত না, ওরা আমার জালের ভিতরেই আছে। ওরা আমার দৃষ্টির আড়াল হতে পারবে না।
দুর্গের রাজ মহলে হৈচৈ পড়ে গেল। ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গে একটি রাজপ্রসাদ ছিল। এখানে রাজা দাহির এসে মাঝে মধ্যে অবকাশ যাপন করত। ছেলে এবং রাণীরাও আসতো মাঝে মাঝে। রাজমহলে যখন খবর পৌছল দুর্গে মুসলিম সৈন্যপ্রবেশ করেছে, তখন প্রাসাদের অনেকেই ব্যাপারটি বিশ্বাস করে নি। প্রাসাদে অবস্থানকারী রাজা দাহিরের এক মন্ত্রী বলল, “ছয় চাঁদ চলে গেছে। মুসলিম বাহিনী দুর্গপ্রাচীরের ধারে কাছে ঘেষতে পারেনি। আর এখন। শুনছি ওরা দুর্গে ঢুকে পড়েছে। কখনোই না, এমনটা হতেই পারেনা।” একথা বলছিল বিন কাসিমের আনুগত্য স্বীকারকারী মন্ত্রী সিয়াকর। সে কিছুদিন বিন কাসিমের সাথে থেকে তাঁর অনুমতি নিয়ে ব্রাহ্মাণাবাদ এসে অবস্থান নিয়েছিল। সে বলেছিল ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গ জয়ের পর সে প্রকাশ্যে ইসলামে দীক্ষা নেবে।
আরেক সংবাদ দাতা হস্তদন্ত হয়ে এসে বলল, মহামহিম উজির। মুসলিম বাহিনী দুর্গের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। মহারাণীকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলা দরকার।
রাণী ঘুমিয়ে আছে। যে পর্যন্ত আমি নিজ চোখে মুসলিম সৈন্য না দেখব ততোক্ষণ পর্যন্ত রাণীকে জাগানোর দরকার নেই, বলল মন্ত্রী সিয়াকর।
কথিত রাণী ছিল রাজা দাহিরের প্রিয়সী। তাকে প্রিয়সী বলেই ডাকা হতো। এই রাণী ছিল রাজা দাহিরের খুবই প্রিয়। বয়সে তরুণী, অত্যধিক সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও আত্মাভিমানী। রাজার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট দখলদারিত্ব ছিল এই রাণীর। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও যুদ্ধনীতি সম্পর্কেও এই রাণীর দখল ছিল। মুসলিম বাহিনী যখন একের পর এক দুর্গ জয় করে রাজধানীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন রাণী প্রিয়সী এক দিন রাজার মুখোমুখি হলো।
অসময়ে রাণীকে তার খাস কামরায় দেখে রাজা জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার প্রিয়সী? এই সময়ে তুমি রাজদরবারে? তাছাড়া তোমার চেহারা কেমন যেন মলীন দেখাচ্ছে?
শুধু আমার চেহারায় নয়, মহারাজ! গোটা সিন্ধুর আকাশেই আজ গাঢ় মেঘের ঘনঘটা। এই মেঘ আরব থেকে এসেছে এবং মাকরানকে ডুবিয়ে দিয়ে এখন মহারাজের আত্মসম্মানকেই হুমকি দিচ্ছে। আরে আমি তো মরিনি রাণী! আমিই ওদের এতটুকু বাড়তে দিয়েছি। এসো, আমার কাছে এসো রাণী। রাজা রাণীর দিকে তার দু’হাত বাড়িয়ে দিলো।
কিন্তু রাণী পিছনে সরে গিয়ে বলল, মহারাজ! আজ থেকে আমি আপনার রাণী নই, আর আমার কোন রাজাও নেই। আপনার হৃদয়ে যদি আমার প্রতি সামান্য ভালোবাসাও থেকে থাকে তাহলে তা সিন্ধুর ভূমিকে দিয়ে দিন। আর সিন্ধুর চেয়ে যদি আমার প্রতি আপনার বেশি ভালোবাসা থেকে থাকে তাহলে বিন কাসিমের ছিন্নমস্তকটা আমার সামনে নিয়ে আসুন। যদি তা-না পারেন, তাহলে আপনার মাথাটাই বিচ্ছিন্ন করে ফেলুন। আমি এখন মুহাম্মদ বিন কাসিম না হয় আপনার ছিন্ন মস্তক দেখতে চাই! মুসলমানরা এখন রাওয়া থেকে এক হাত সামনে আসাটাকেও আমি সহ্য করতে পারছি না। মুসলিমরা রাওয়ার জল-মাটি নোংরা করে ফেলেছে। আপনি সেই দিন আমার শরীর
স্পর্শ করতে পারবেন যে দিন বিন কাসিমের ছিন্ন মস্তক আমার সামনে পড়ে থাকবে। আর ওর সৈন্যরা বানভাসী খড়খুটোর মতো সিন্ধুর জলে ভেসে সাগরে চলে যাবে। রাজা দাহির কোন কাপুরুষ শাসক ছিল না। ছিল না অনভিজ্ঞ ও মেধাহীন যে তাকে উস্কানী দিয়ে উত্তেজিত করতে হবে। রাণীর ক্ষোভ সে যথার্থই বুঝতে পারল। সিংহাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে গেল রাজা।
হ্যাঁ এমনিটিই হবে রাণী! এমনটিই হবে। তুমি ঠিকই বলেছ, আমার জীবন সিন্ধুর মাটির জন্য। তুমি ঠিকই বলেছ, কথা দিচ্ছি তোমার সামনে হয় বিন কাসিমের ছিন্ন মস্তক দেখবে নয়তো আমার মস্তক ছিন্ন হতে দেখবে। অতঃপর ঘটনা তাই ঘটল। রাণী প্রিয়সী আবেগ উচ্ছাস ও প্রেম ভালোবাসায় সিক্ত করে রাজাকে রণাঙ্গনে বিদায় জানালো। আবেগ উত্তেজনায় রাণী প্রিয়সী রাজা দাহিরের একান্ত সাদা হাতির শুঁড়ে চুমু দিলো। কিন্তু প্রিয়সী জানতো না, তার এই আবেগ ও উত্তেজনা সুফল বয়ে আনবে না।
প্রিয়সী জানতো না, সে এই শেষ বারের মতো রাজা দাহিরকে জীবিত দেখছে। বিন কাসিমের ছিন্ন মস্তক দেখার সৌভাগ্য প্রিয়সীর হয়নি, তাকে রাজা দাহিরের মস্তক ছিন্ন হওয়ার দুঃসংবাদই শুনতে হয়েছে। রাণী প্রিয়সী রাজা দাহিরকে রণাঙ্গনে বিদায় করে ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গে চলে আসে। এখানে থাকাবস্থায়ই রণাঙ্গন থেকে দলে দলে সৈন্য পালিয়ে আসার খবর পায়। সেই সাথে রাজার নিহত হওয়ার খবর আসে। একদিন পালিয়ে আসা সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে রাণী প্রিয়সী বলল, ব্ৰহ্মণবাদের সকল সৈন্যকে আমার সামনে হাজির করা হোক। সৈন্যদেরকে যখন রাণী প্রিয়সীর সামনে এনে দাঁড় করানো হলো, তখন উচ্চ আওয়াজে রাণী বলল, “তোমরা কি জীবিত থাকার যোগ্যতা রাখো, তোমরা কি এখনো তোমাদের স্ত্রীদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস রাখো? তোমাদের চেয়ে অপবিত্র সৃষ্টি এই ধরিত্রীর বুকে আর কোথাও কি আছে? যারা নিজ মাতৃভূমিকে গুটিকতক বিদেশী সৈন্যের দখলে দিয়ে দিয়েছে।
তোমাদের মহারাজা আমার সাথে ওয়াদা করেছিল, হয় সে আমার সামনে বিন কাসিমের ছিন্ন মস্তক ফেলে দেবে নয়তো নিজের মাথা ছিন্ন করাবে। খবর পেয়েছি, সে বিন কাসিমের মাথা ছিন্ন করতে পারেনি কিন্তু নিজের দেহ থেকে মাথা ছিন্ন করিয়েছে। তোমাদের লজ্জা থাকা উচিত ছিল, তোমাদের রাজার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে আর তোমাদের দেহে এখনো মাথা বহাল রয়েছে। ঠিক আছে, তোমাদের মতো কাপুরুষদের আর দরকার নেই। সবাই মাথা ন্যাড়া করে ঘরের কোণে বসে যাও; এখন থেকে এদেশের নারীরাই যুদ্ধ করবে। আজ থেকে আমি নারীদের নিয়েই সেনাবাহিনী গঠন করব। আমরা যদি মুসলমানদের কাছে হেরেও যাই তবুও মনে এতোটুকু শান্তি থাকবে আমরা একটা বাহাদুর জাতির বাদী হয়েছি।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাণী প্রিয়সীর সেই বক্তৃতা এতোটাই উত্তেজনা পূর্ণ ছিল যে, সৈন্যরা আবেগে উত্তেজিত হয়ে শ্লোগান দিচ্ছিল, আর তাদের ঘোড়াগুলো পর্যন্ত পা দিয়ে মাটি আঁচড়াচ্ছিল। সেই দিন রাণী প্রিয়সী উপস্থিত সেনাবাহিনী থেকে কিছু সংখ্যক কমান্ডারঠাকুর ও সৈন্য বাছাই করে নিজের মতো করে একটি সেনাদল গঠন করল এবং নিজে পুরুষের পোশাক পরে তাজি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে নবগঠিত সেনাদলের ট্রেনিং দিতে শুরু করল। এসব সৈন্য প্রশিক্ষিতই ছিল। তাদের সামরিক ট্রেনিংয়ের খুব একটা প্রয়োজন ছিল না কিন্তু রাণী প্রিয়সী বিভিন্নভাবে এমন মানসিকতা এদের মধ্যে সৃষ্টি করল যে, এই সেনাদল মানুষ খেকো বাহিনীতে পরিণত হলো। এই বাহিনীকে অন্যান্য সেনাদের চেয়ে অনেক বেশি বেতন ভাতা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলো। এই বাহিনীর সৈন্যদেরকে নগদ পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলো। তাছাড়া এই ঘোষণাও দেয়া হলো, লড়াইয়ে বিজয়ী হলে প্রত্যেক সৈনিককে একজন করে তরুণী উপহার দেয়া হবে।
বিন কাসিম ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গ অবরোধ করার পর যে হিন্দু সৈন্যরা দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করত এবং দুর্গে ফিরে যেত এদের অধিকাংশই ছিল রাণী প্রিয়সীর বিশেষ সৈন্য। অবরোধের শেষ দু’মাসে রাণী প্রিয়সী তার বিশেষ বাহিনীকে তার নিজের প্রাসাদের অনতি দূরে বসিয়ে দিয়েছিল। রাণী ভেবেছিল একসময় ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে মুসলিম বাহিনী অবরোধ উঠিয়ে যখন চলে যেতে চাইবে তখন পিছন দিক থেকে আক্রমণ করবে তার বিশেষ বাহিনী।
বিন কাসিমের বাহিনী যখন দুর্গে প্রবেশ করল, তখন রাণীর বিশেষ বাহিনী তাদের ব্যারাকেই অবস্থান করছিল, তারা মুসলিম সৈন্যদের দুর্গে প্রবেশের কোন সংবাদই পেল না। কিন্তু বিন কাসিমের গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফী দুর্গে প্রবেশ করার সাথে সাথেই তার একান্ত গোয়েন্দারা রাণীর বিশেষ বাহিনীর খবর দিলো। ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গে শাবান ছাকাফীর গোয়েন্দারা বহু পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিল। তারা রাণীর বিশেষ বাহিনীর অবস্থান ও গঠনের পুরোপুরি খবর রাখতো। শা’বান ছাকাফী তার গোয়েন্দাদের রিপোর্ট সম্পর্কে সাথে সাথেই বিন কাসিমকে অবহিত করলেন। তিনি বিন কাসিমের অনুমতি নিয়ে একদল সৈন্য নিয়ে রাণী প্রিয়সীর সৈন্যদের অজান্তেই ওদেরকে ঘেরাও করে ফেললেন। ওরা কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই শা’বান ছাকাফীর সৈন্যরা ওদের পাকড়াও করে
ফেলল। রাণীর বাহিনীর পক্ষে কোন ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ হলো না।
রাণীর বিশেষ বাহিনী পাকড়াও হওয়ার সাথে সাথে রাজ প্রাসাদে খবর হয়ে গেল বিন কাসিমের সৈন্যরা দুর্গে ঢুকে পড়েছে। ঠিক সেই সময়ে মন্ত্রী সিয়াকর রাণী প্রিয়সীকে ঘুম থেকে জাগালো। তখন বেলা অনেক ওপরে উঠে গেছে কিন্তু রাণী তখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল।
রাণী, আরব সৈন্যরা দুর্গে ঢুকে পড়েছে।
মুসলিম সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে শহরের বাইরে বসে আছে আর তোমরা এখনো দুর্গের ভিতরে আরামে দিন কাটাচ্ছ উজির। তোমার মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাছ থেকে এমনটাই কি প্রত্যাশিত?
রাণী, তোমার হুকুম আমার ওপর চলতে পারে কিন্তু মুসলিম বাহিনীর ওপর তোমার কোন হুকুম চলবে না, এখন পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করো। ওঠো এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করো। দৃঢ়কণ্ঠে বলল উজির সিয়াকর। আরে আমার বাঘের বাচ্চারা সব কোথায়? তুমি এসব কি বলছ? ওদের বলল, আমি ওদেরকে যে জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিলাম, সেই সময় এখন এসে গেছে।
সেই সময় আর হবে না রাণী। তোমার বাঘের বাচ্চারা সব শিয়ালের মতো মুসলিম বাহিনীর হাতে বিনা প্রতিরোধে বন্দি হয়েছে। রাণী, তুমি কি পালাতে চাও, না স্বেচ্ছায় মুসলমানদের হাতে বন্দি হতে চাও? ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল উজির সিয়াকর।
আমাকে এখান থেকে বের করার ব্যবস্থা করো। আমি এক্ষুণি পুরুষের পোশাক পরে নিচ্ছি।
রাণী প্রিয়সী তার সেবিকাদের বলল, কে আছে, তাড়াতাড়ি মহারাজের পোশাক ও তরবারী নিয়ে এসো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাণী প্রিয়সী রাজা দাহিরের পোষাক পরে হাতে তরবারী নিয়ে একটি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল।
কিন্তু রাণী প্রিয়সী রাজপ্রাসাদের আঙিনা অতিক্রম করার আগেই মুসলিম বাহিনীর পনের ষোলজন অশ্বারোহী প্রাসাদের প্রধান ফটকে প্রবেশ করল।
তাদের সাথে শাবান ছাকাফীও ছিলেন। তিনি রাণীকে দেখেই তার গতিরোধ করলেন।
“আমি তোমাদের আনুগত্য কবুল করে নিয়েছি,” শা’বান ছাকাফীর উদ্দেশ্যে কণ্ঠে পুরুষালী ভাব এনে বলল, পুরুষরূপী রাণী প্রিয়সী।
আরে নারী! বাঘ যদিও বা সিংহের রূপ ধরতে পারে, তুমিও হয়তো পুরুষের বেশ ধারণ করতে পারো। কিন্তু আমি দৃঢ়তার সাথেই বলতে পারি, তোমার মতো এতো সুন্দর পুরুষ সিন্ধুর মাটি জন্ম দিতে পারেনি। মাথা থেকে পাগড়ী খুলে ফেলল। বলল, তোমার আসল পরিচয় কি? বললেন গোয়েন্দা প্রধান। সেই সাথে তিনি সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দিলেন, প্রাসাদের সবাইকে বন্দি করে ফেলো।
কিছুসংখ্যক সৈন্য মহলের দিকে অগ্রসর হলে শা’বান ছাকাফী তার ঘোড়াকে রাণীর ঘোড়ার পাশে নিয়ে হঠাৎ রাণীর মাথার পাগড়ী একটানে খুলে ফেললেন। পাগড়ী খোলার সাথে সাথেই রাণীর দীর্ঘ কেশরাজী তার সারা কাধ ও পিঠে ছড়িয়ে পড়ল। তোমাকে কি এখনও কেউ বলেনি, আমরা নারীর ওপর কখনো আঘাত করি না? দেখেতো মনে হচ্ছে তুমি কোন সাধারণ নারী নও। রাজা দাহিরের সাথে তোমার কি সম্পর্ক ছিল?
“আমি মহারাজ দাহিরের স্ত্রী। আমি রাণী প্রিয়সী।”
কই তোমার সেই বিশেষ বাহিনী কোথায়? আমাদের পরাস্ত করতে তুমি যে বাহিনী গঠন করেছিলে? জানতে পারলাম, তোমাদের প্রতিরোধ করার সুযোগই ওদের হয়নি। ওরা যদি মোকাবেলার সুযোগ পেতো, তাহলে আর আমাকে পুরুষের পোশাক পরতে হতো না।
কিছুক্ষণ পর রাণী প্রিয়সীকে বন্দী করে বিন কাসিমের সামনে হাজির করা হলো।
“ওকে মহলেই নিয়ে যাও। তাকে কাপড় বদলাতে দাও এবং কোন ধরনের পেরেশানী না করে সসম্মানে থাকার সুযোগ দাও।” নিজ সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম।
রাণীকে প্রাসাদে পৌছে দেয়া হলো। প্রাসাদে রাজা দাহিরের প্রিয়পাত্র উজির সিয়াকরকে গ্রেফতার করে বিন কাসিমের সামনে হাজির করা হলো।
বিন কাসিম সিয়াকরকে দেখেই চিনে ফেললেন, কারণ এর আগে সিয়াকর তার সান্নিধ্যে কিছুদিন কাটিয়ে ছিল। সম্মানীত সেনাপতি! আমি আপনার কাছে জানতে চাই, আমাদের শহরের সাধারণ মানুষের সাথে আপনার আচরণ কেমন হবে? বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে বলল সিয়াকর।
যে ব্যবহার তোমার সাথে করা হচ্ছে, সবার সাথে একই আচরণ করা হবে। কাউকেই যুদ্ধবন্দি কিংবা দাসে পরিণত করা হবে না। তোমার পূর্ব মর্যাদা বহাল রাখা হবে। এজন্যই তোমাদের রাণীকে তার প্রাসাদে পৌছে দেয়া হয়েছে।
তিন চারদিন পর বিন কাসিমকে খবর দেয়া হলো, প্রায় হাজারখানিক লোক যাদের সবার দাড়ি গোঁফ সম্পূর্ণ ছাটা বিন কাসিমের সাথে সাক্ষাত করতে এসেছে। বিন কাসিম তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে দেখলেন, সুশৃঙ্খল ভাবে দাড়ানো এবং একই পোশাক পরিহিত একদল লোক তার জন্য অপেক্ষা করছে।
বিন কাসিম তার স্থানীয় দুভাষীকে বললেন, এদেরকে দেখে মনে হচ্ছে, এরা সাধারণ কোন নাগরিক নয়। এরা কোথেকে এসেছে? কি চায়? কি তাদের পরিচয়? জিজ্ঞেস করো? দুভাষী জিজ্ঞেস করলে তারা জানালো, আমরা কোন সেনাবাহিনীর সদস্য নই। আমরা সবাই ব্রাহ্মণ। আমাদের বহু লোক দুর্গ পতনের দুঃখে আত্মহত্যা করেছে। আমরা আপনাদেরকে তাদের মরদেহ দেখাতে পারি।
তাহলে তোমরা কেন আত্মহত্যা করনি? তোমাদের ধর্ম কি আত্মহত্যা সমর্থন করে? জানতে চাইলেন বিন কাসিম।
আমাদের ধর্ম আত্মহত্যা সমর্থন করে না, বলল ব্রাহ্মণদের মুখপাত্র। যারা আত্মহত্যা করেছে, তারা মৃত রাজার প্রতি বিশ্বস্ততা প্রকাশ করতে আত্মহুতি দিয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের প্রভুর প্রতি বিশ্বস্ত যিনি আমাদেরকে সমাজে উঁচু মর্যাদা দিয়েছেন। সেই সাথে আমরা তাদের প্রতিও বিশ্বস্ত থাকি, যে আমাদের সামাজিক উঁচু মর্যাদা বহাল রাখে।
তোমরা কি আমার কাছে তোমাদের উঁচু মর্যাদার স্বীকৃতি আদায় করতে এসেছ? জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।
আমরা জানতে এসেছি, এদেশের সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্রাহ্মণ শ্রেণির প্রতি আপনার মনোভাব কি?
তোমরা যদি লড়াইকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকো এবং ভবিষ্যতে কোন ধরনের আক্রমণ বা যুদ্ধ চেষ্টা না করো, তাহলে আমরা তোমাদেরকে শান্তিতে বসবাস করার অধিকার দেবো। কিন্তু অন্য লোকদের থেকে আমরা তোমাদের ভিন্ন মর্যাদায় বিশ্বাস করি না। আমাদের ধর্মে ধনী-গরীব, ছোটবড় এমন কোন শ্রেণি বৈষম্য নেই। আমি আরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি এবং বিজিত অঞ্চলের শাসক পদে আমাকে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। এই দায়িত্ব অনেকটা তোমাদের প্রধান পুরোহিতের মতো। কিন্তু আমাদের আল্লাহর কাছে আমার মর্যাদা ও আমার সওয়াব এতটুকুই যতোটুকু আমার বাহিনীর এক সাধারণ সৈনিকের। আমার নেতৃত্বে ও ইমামতিতে যারা নামায পড়ে তাদের কারো থেকে আমার বিশেষ কোন মর্যাদা নেই। এখানকার একজন সাধারণ নাগরিক যতটুকু অধিকার পাবে তার সবটুকু তোমরাও পাবে, এর বেশি নয়। তোমরা যদি সাধারণ মানুষ থেকে বেশি মর্যাদা ও অধিকার ছিনিয়ে নিতে চাও, তাহলে তা হবে আমাদের আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ যা আমাদের বিধানে শাস্তিযোগ্য।
ঠিক আছে, আমরা আপনার এই নির্দেশ মেনে চলবো, বলল ব্রাহ্মণদের মুখপাত্র। কিন্তু হে আরব সেনাপতি! আমাদের কি স্বাধীনভাবে আমাদের মন্দিরে ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে না আপনারা তরবারীর জোরে আমাদেরকে ইসলাম ধর্মগ্রহণে বাধ্য করবেন?
আমি তোমাদেরকে একথা অবশ্যই বলব, তোমরা আমাদের ধর্মের বিধিবিধান ও কর্মকাণ্ডকে গভীরভাবে অবলোকন কর, তোমরা পর্যবেক্ষণ করো, আমরা আমাদের ধর্মের শিক্ষা কতটুকু বাস্তবায়ন করি এবং ধর্মপালনে কোন ধরনের শ্রেণিভেদ করি কি-না?
আমাদের রাজা নিহত হয়েছে’ বললেন ব্রাহ্মণদের মুখপাত্র। আমরা তার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম। আমরা তার সম্মানে মাথা ন্যাড়া করেছি এবং শোকের পোশাক পরেছি। এটা আমাদের দেশের রীতি। কেউ যদি মারা যায় তার বড় ছেলে শোক প্রকাশে মাথা ন্যাড়া করে এবং সেলাই বিহীন কাপড় পরিধান করে। এখন আপনি আমাদের রাজা। আমরা আগের রাজার মতোই আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব।
ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন, ব্রাহ্মণ দলের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে রাজা দাহিরের অধস্তন বংশধরদের তথ্য জানার জন্য বিন কাসিম ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা যদি আমার আনুগত্য স্বীকার করেই
থাকো, আর আমার প্রতি বিশ্বস্ততার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে থাকো, তাহলে বলল, রাজা দাহিরের যেসব আপনজন এখনো বেঁচে আছে, তারা কে কোথায় অবস্থান করছে এবং কে কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
এই দুর্গে শুধু রাণী প্রিয়সী অবস্থান করছিল, যাকে আপনি গ্রেফতার করেছেন, বলল ব্রাহ্মণ মুখপাত্র। রাণী প্রিয়সী একদল রক্ত পিপাসু সৈন্য তৈরি করেছিল। তাদেরও আপনি গ্রেফতার করে ফেলেছেন। সে মুক্ত থাকলে আপনার জন্যে বিপদ হয়ে উঠতো। তাকে আপনি নাগিনী মনে করতে পারেন। তবে নাগিনীর বিষ দাঁত আপনি ভেঙে ফেলেছেন। তবে আরেকটি কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, রাণী প্রিয়সী খুবই সুন্দরী ও ধূর্ত। তার মুখের ভাষাও যাদুমাখা। আপনি যুবক মানুষ। আপনাকে তার মোহনীয় রূপ সৌন্দর্য আর যাদুকরী কথা যেনো পেয়ে না বসে, বলল অপর এক ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণদের কথায় বিন কাসিমের মধ্যে কোন ভাবান্তর ঘটলো না, তিনি পূর্ববৎ ভাবলেশহীন রইলেন। কোন প্রতিক্রিয়াই ব্রাহ্মণের কথায় প্রকাশ করলেন না।
আরেকজন নারী আপনার জন্যে ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারতো, সে ছিল মায়ারাণী। আপনি হয়তো শুনে থাকবেন, মহারাজা দাহিরের সাথে তার ছিল দ্বৈত সম্পর্ক। সে রাজার সহোদরা ছিল, আবার তার বিয়ে করা স্ত্রীও ছিল। এজন্য ভগবানের গজব নেমে আসে। কারণ আপন সহোদরাকে বিয়ে করা মহাপাপ।
মায়ারাণী এখন কোথায়? ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।
নিশ্চিত বলতে পারব না, তবে শুনেছি, সে সতীদাহ স্বরূপ আত্মহুতি দিয়েছে।
কোথায়?
এই শহরেই। এই শহরের একপ্রান্তে আপনি একটি পতিত বাড়ি দেখতে পাবেন। শুনেছি, সেখানে সে কাঠখড়ি জড়ো করে চিতা জ্বালিয়ে আত্মহুতি দিয়েছে।
বিন কাসিম ব্রাহ্মণদের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে তাদের বিদায় করে দিলেন।
ব্রাহ্মণরা চলে গেলে বিন কাসিম শা’বান ছাকাফীকে ডেকে মায়ারাণী সম্পর্কে দেয়া ব্রাহ্মণদের তথ্য যাচাই করার নির্দেশ দিলেন। বললেন, ব্রাহ্মণদের কথা কতটুকু বাস্তব তা যাচাই করে দেখা দরকার। ব্রাহ্মণরা খুশি মনেই বিন কাসিমের কাছ থেকে বিদায় নিল। কারণ প্রথমত: তারা তাদের জীবনের নিরাপত্তা পেল, দ্বিতীয়ত: তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের মন্দিরে ধর্মকর্ম করার সুযোগ পেল।
এদিকে কিছু দূর যেতেই শা’বান ছাকাফী ব্রাহ্মণদের পথরোধ করে তাদের কাছে জানতে চাইলেন, তারা কার কাছে শুনেছে, মায়ারাণী আত্মহুতি দিয়েছে?
ব্রাহ্মণরা তাকে সব ঘটনা বলল এবং একটি পতিত বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, সেখানে মায়ারাণী আত্মহুতি দিয়েছে। গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী তার একান্ত দু’জন যোদ্ধাকে নিয়ে পতিত অনাবাদী এলাকার কাছাকাছি বাসিন্দাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দু’জন জানালো, একরাতে তিনজন পুরোহিতকে তারা এই পতিত বাড়ির দিকে যেতে দেখেছে। তাদের একজন আরো জানালো, সেই রাতে অনেক দেরীতে তিন পুরোহিতের মধ্যে দু’জনকে সে পতিত বাড়ি থেকে ফিরে আসতে দেখেছে। শাবান ছাকাফী তাদের একজনকে সাথে নিলেন। কিছুক্ষণ অগ্রসর হলে ঘন গাছগাছালির ভিতরে একটি বাড়ি দেখতে পেলেন। শাবান ছাকাফী দেখতে পেলেন, বাড়িতে একটি মাত্র পুরনো ইটের ঘর। ঘরটির মাত্র দুটি দরজা। দরজা ধাক্কা দিলে বোঝা গেল ভিতর থেকে খিল আটকানো। কয়েকবার ধাক্কা দেয়া হলো, কিন্তু ভিতর থেকে কারো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না।
ভিতরের লোকজনকে তুমি ডাকো স্থানীয় লোকটিকে নির্দেশ দিলেন গোয়েন্দা প্রধান। তিনি আরো বললেন, ভিতরের অধিবাসীদের বলল, তাদের ওপর কোন ধরনের শাস্তি হবে না এবং তাদের কোন ধরনের হয়রানী করা হবে না।
এখানে কেউ থাকে না। যদি ভিতরে কেউ থেকেও থাকে, তবে সে এখানকার বাসিন্দা নয়, কেউ হয়তো এখানে এসে লুকিয়ে থেকে থাকবে। আপনারা দরজা ভেঙে দেখুন, বলল লোকটি। শাবান ছাকাফী ইশারা করতেই তার সাথীরা একটি দরজার খিল ভেঙে ফেলল এবং সাথে সাথে ক্ষীপ্ত গতিতে তরবারী উঁচিয়ে সবাই ভিতরে প্রবেশ করল।
ঘরের ভিতরের পরিবেশ ছিল ভীতিকর। ঘরের ভিতরে আগুনে পোড়া মানুষের দুর্গন্ধে দমবন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। সবাই দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে নাকে কাপড় দিলো। সবার চোখ জ্বলতে শুরু করল। একটি খেরকী দরজা দিয়ে অন্য কক্ষে গেলে এটির ফাঁক দিয়ে কিছুটা আলো দেখা গেল। আলো অনুসরণ করে আরেক কক্ষে গেলে দেখা গেল একটু মেঝে ও আঙিনা। আঙিনায় জ্বলন্ত কাঠের কয়লা দেখা গেল। কয়লার মধ্যে তিনটি মরদেহ দেখা গেল, যেগুেলো পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে। এগুলো এতোটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে, হাত, পা, নাক, মুখ চেহারার অবয়ব বোঝা যায় না।
হঠাৎ অপর পাশের কোথাও কোন মানুষ দৌড়ানোর শব্দ পাওয়া গেল। শব্দ অনুসরণ করে অগ্রসর হয়ে দরজার কাছে পলায়নকারী দুজনকে পাকড়াও করা হলো। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশী করে তার কাছ থেকে গলে যাওয়া কিছু স্বর্ণের টুকরো পাওয়া গেল। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানালো, তারা উভয়েই ছিল মায়ারাণীর একান্ত কর্মচারি। তারা জানতো মায়ারাণী এক পুরোহিত ও এক সেবিকাসহ স্বর্গবাসী হচ্ছে। তারা এও জানতো মায়ারাণীর শরীরে স্বর্ণের অলংকার রয়েছে, এজন্য তারা লোক চক্ষুর আড়ালে মায়ার চিতা থেকে স্বর্ণ তুলে নেয়ার জন্য এখানে এসেছিল।
কোন হিন্দু জ্বলন্ত চিতায় আত্মহুতি দিয়েছে, এ নিয়ে বিন কাসিম ও শা’বান ছাকাফীর কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। তারা শুধু নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন, সত্যিকার অর্থেই মায়রাণী আত্মহুতি দিয়েছে কি-না। শাবান ছাকাফী মন্দিরে গিয়ে সেই দুই পুরোহিতকে আলাদা করলেন। এদের একজন ছিল যথেষ্ট বয়স্ক। তাদের জিজ্ঞাসা করলে বয়স্ক পুরোহিত বলল, ‘হ্যাঁ’ মায়ারাণী এক পুরোহিত ও তার একান্ত সেবিকাকে নিয়ে আত্মহুতি দিয়েছে।
আমরা জানি, তোমাদের ধর্মে সতীদাহ প্রথা রয়েছে কিন্তু রাণী প্রিয়সী নিজেকে সতীদাহ করল না কেন? পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলেন ছাকাফী।
মায়ারাণীও আত্মহুতি দেয়ার মতো নারী ছিল না, বলল বৃদ্ধ পুরোহিত। আমি শুনেছি, সে এই ঘরে লুকিয়ে থাকার জন্য তার একান্ত চাকরাণীকে নিয়ে এসেছিল। কারণ, আপনারা দুর্গে প্রবেশ করার পর তার আর পালানোর মতো সুযোগ ছিল না। সে এই ভেবে এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে বেশ বদল করে উড়ে চলে যাবে এবং সেখানে গিয়ে সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করে আপনাদের
বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ করবে। সে বলেছিল, নিজে সে রণাঙ্গনে যাবে এবং নিজ ভাই হত্যার প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু যে ঘরে সে আশ্রয় নিয়েছিল এই ঘরটি মানুষের বসবাসের উপযোগী ছিল না। কেন, ঘরটি কি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা ছিল? জানতে চাইলেন শাবান ছাকাফী। না, ব্যাপারটি এমন নয়। এই বাড়িটি প্রেতাত্মার আখড়া। সেখানে যে কেউ দু’একদিন কাটালে প্রেতাত্মাদের প্রভাবে আত্যহত্যার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আমি নিজেই প্রেতাত্মার নারী কন্ঠের আওয়াজ শুনেছি। এই হলো তোমাদের ধর্মের একটা খারাপ দিক। তোমরা নানা আজগুবী অলৌকিকতায় বিশ্বাস করো, যার কোন বাস্তবতা নেই, বললেন গোয়েন্দা প্রধান। ব্রাহ্মণাবাদকে বিন কাসিম তাঁর শক্তিশালী একটি সেনা শিবিরে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছিলেন। এ পর্যন্ত যে কয়টি দুর্গ তিনি জয় করেছেন সবগুলোতেই প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুন্দর করেছিলেন। নাগরিকদের ওপর এমন সহজ করারোপ করেছিলেন, যা তারা অনায়াসে পরিশোধ করতে পারে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাদের প্রশাসনের ব্যাপারে তিনি পূর্বের চেয়েও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করলেন। তিনি ব্রাহ্মণবাদের অধিবাসীদের নিশ্চিন্ত করার জন্য যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তাদেরকে মুসলমানদের প্রাপ্য সব সুযোগ সুবিধা দিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, যে সব হিন্দু ও বৌদ্ধ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ না করবে তাদের ওপর ইসলাম গ্রহণের জন্য কোন চাপ সৃষ্টি করা হবে না।
কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই জিযিয়া পরিশোধ করতে হবে। তিনি বিত্তশালী, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত এই তিন ভাগে নাগরিকদের ভাগ করে পয়তাল্লিশ দিরহাম, চব্বিশ দিরহাম ও বারো দিরহাম জিযিয়া আরোপ করলেন। দুর্গের পুরোহিতদেরকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হলো। যাদের কাছে পূর্ব থেকেই সরকারি জায়গা জমি ছিল তা তাদের কব্জায়ই বহাল রাখা হলো। হিন্দু বাহিনী যেসব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জবরদস্তিমূলক মোটা অংকের টাকা উসূল করছিল কিংবা যুদ্ধের কারণে যাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাদের জন্য প্রায় এক লাখ বিশ হাজার দিরহামের নগদ সাহায্য দেয়া হলো।
শহরের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বহু উচ্চ পদে ব্রাহ্মণদের পদায়ন করা, হলো। হিন্দু প্রশাসনে যারা উচ্চপদে আসীন ছিল তাদেরকে সপদে বহাল রাখা হলো। এবং দুর্গের প্রধান ফটক রক্ষায় সেনাবাহিনীর যে অফিসার
নিযুক্ত ছিল তাকেও সেই পদে বহাল রাখা হলো। প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের পর বিন কাসিম একদিন সকল কর্মকর্তার উদ্দেশ্যে বললেন, আমরা বিজয়ী শক্তি হওয়ার পরও, তোমাদের সবাইকে নিজ নিজ পদে বহাল রেখেছি। আমরা কি ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে দাস দাসীর পর্যায়ে নামিয়ে দিতে পারতাম না? কিন্তু আমরা তোমাদেরকে দাসদাসীতে পরিণত করিনি। আমি তোমাদেরকে বলছি, শহরের সাধারণ নাগরিকদেরকে দাসদাসী মনে করবে না। তাদের কাছ থেকে আমি যা নির্ধারণ করে দিয়েছি এই পরিমাণ কর আদায় করবে। কেউ যদি কর দিতে অসুবিধা বোধ করে অথবা অক্ষম হয় তাহলে এজন্য তার ওপর অত্যাচার করবে না। এমনটি হলে আমার কাছে খবর পৌছাবে, আমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে কথা বলে তার করের বোঝা লাঘব করার ব্যবস্থা করব…।
তোমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো, শাসক ও প্রজাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও আস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করা। নাগরিকরা যাতে মনে করে প্রশাসক তাদের আপন, তাদের শুভাকাঙ্ক্ষি। কেউ যদি কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় তাহলে তাৎক্ষণিক আমাকে অবহিত করবে যাতে বিশৃঙ্খলার মূলোৎপাটন করা সম্ভব হয়। কোন মুসলমান যদি কোন অমুসলিমের ইবাদতখানা বা ধর্মালয়ের অমর্যাদা করে তাহলে সে বিজয়ী বাহিনীর লোক বলে তাকে ছেড়ে দেয়া যাবে না, তার এমন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যেমনটি যেকোন অপরাধী ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
হিন্দুদেরকে দেয়া বিন কাসিমের সুযোগ সুবিধা ছিল তাদের ধারণাতীত। তাদের বিশ্বাস ছিল, অর্থনৈতিকভাবে মুসলিম বিজয়ীরা তাদের পিঠের চামড়াও তুলে নিতে চেষ্টা করবে আর সামাজিক ভাবে অভিজাত হিন্দুদের অবস্থান হবে নীচু জাতের হিন্দুদের মতো। বিন কাসিমের এই উদার বদান্যতার ফল হলো, মন্দিরের প্রধান পুরোহিত সকল ব্রাহ্মণ ও শহরের অভিজাত হিন্দুদের ডেকে বলল, সবার কাছে আমার এই পয়গাম পৌছে দেবে। হে সিন্ধুবাসী! তোমাদের বিশ্বাস করতে হবে রাজা দাহিরের মৃত্যু হয়ে গেছে এবং তার বংশের রাজত্বও খতম হয়ে গেছে। সিন্ধুর শাসন ক্ষমতা আরব মুসলমানদের হাতে। মুসলমানদের সম্পর্কে তোমাদের জেনে রাখা উচিত, তাদের দৃষ্টিতে উঁচু নীচু, ধনী গরীব গ্রাম্য শহুরে সকল নাগরিক সমান। এটা তাদের ধর্মের শিক্ষা। তাদের এই নীতি সবার কাছে পৌছে দেয়া আমি কর্তব্য মনে করছি। বিজয়ী আরব
মুসলমানরা আমাদের সাথে আরো সুযোগ সুবিধা দেয়ার ওয়াদা করেছে কিন্তু শর্ত হলো তাদের অনুগত থাকতে হবে, কোন অবস্থাতেই বিদ্রোহমূলক কিছু করা যাবে না। তোমাদের কেউ যদি বিশ্বস্ততা বিনষ্ট করে গাদ্দারী করে, তাহলে সকল হিন্দুকেই এজন্য খেসারত দিতে হবে। এর চেয়ে আর সুবিধা কি হতে পারে একটি বিজাতীয় বিজয়ী শক্তি আমাদের ব্রাহ্মণজাতিকে সমাজে তাদের যে মর্যাদা ছিল তাই বহাল রেখেছে এবং মুসলিম শাসক তো শাসন ক্ষমতার সব উঁচু পদও ব্রাহ্মণদের হাতেই সোপর্দ করেছে। বিজয়ী বাহিনী আমাদের ওপর যে কর ধার্য করেছে, তা প্রত্যেক প্রজা খুব সহজেই উসূল করতে পারবে। তারপরও যদি কেউ এই কর দিতে অস্বীকার করে তবে তার উচিত হবে সিন্ধু এলাকা ছেড়ে হিন্দুস্তানের অন্য কোন অঞ্চলে চলে যাওয়া।
এদিকে রাজা দাহিরের বিশ্বস্ত উজির সিয়াকরও নানা পরীক্ষায় বিন কাসিমের প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রাখলো এবং তাকে বাস্তব ভিত্তিক নানা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছিল।
বিন কাসিম বিদা বিন হুমাইদ আল বাহরীকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করলেন এবং নোভা বিন দিরাসকে রাওয়া দুর্গের শাসক নিযুক্ত করে বললেন, ওখান থেকে যতসম্ভব তুমি নৌকা সরবরাহ করো এবং নদীপথে যদি কোন অপরিচিত নৌকা সামরিক সরঞ্জাম পরিবহণ করে তবে তা আটকে ফেলবে। এভাবে বিজিত প্রতিটি দুর্গের শাসক হিসাবে তিনি মুসলমানদের নিয়োগ করলেন। সালেহ নামের এক মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম বেশ কয়েকটি যুদ্ধে এমন বীরত্ব ও কুশলী যুদ্ধ পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছিল যে, দেহে অস্বাভাবিক শক্তি ও বুদ্ধি উভয়টির সমন্বয় না থাকলে কারো পক্ষে এতোটা কুশলী নৈপূণ্য প্রদর্শন সম্ভব নয়। বিন কাসিম তার পারদর্শিতা ও নৈপূণ্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে মাকরানের একটি অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে তারা মাকরানেই বিয়েশাদী করে বসতি স্থাপন করে। যাদের অধস্তন বংশধর এখনো মাকরানে বর্তমান রয়েছে। বিন কাসিমের পরবর্তী লক্ষ্যস্থল ছিল উরুঢ় যা রাজা দাহিরের রাজধানী। কিন্তু উরুঢ়ের আগে ছোট ছোট কয়েকট দুর্গ ছিল। তবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল একটি উপজাতি। স্থানীয় ভাষায় এরা ছিল জাট। খুবই দুর্ধর্ষ ও
স্বাধীনচেতা এই জাট জনগোষ্ঠী। স্থানীয় লোকজন বিন কাসিমকে জানালো, জাটা ছিল রাজা দাহিরের জন্যও চিন্তার কারণ। কেননা তারা কোন রীতিনীতির পরওয়া করে না, কারো শাসন মানতে তারা নারাজ।
বিন কাসিমের কাছে যখন জাট জনগোষ্ঠীর খবর এলো, তখন তিনি সিয়াকরকে ডেকে জাটদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। সিয়াকর বলল, এই জনগোষ্ঠী খুবই দুর্ধর্ষ ও জংলী। এরা অসভ্য এবং অপরাধ প্রবণ। সভ্যসমাজে এদের যাওয়ার কোন অনুমতি নেই এবং তাদের কারো অশ্বারোহণের অনুমতি ছিল না। এদের পরিধেয় বস্ত্র মোটা। বিন কাসিম জাট জনগোষ্ঠী সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা শুনলেন কিন্তু মন্তব্য করলেন না। এদিকে বিন কাসিম যখন উরুঢ়ের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ওদিকে উরুঢ় তখন বিন কাসিমকে প্রতিরোধ করার প্রাণান্তকর প্রস্তুতি চলছিল। উরুঢ়ের বিষ্ময়কর অবস্থা এই ছিল যে, সেখানকার অধিকাংশ অধিবাসী বিশ্বাস করতো, রাজা দাহির তখনো জীবিত রয়েছে। মন্দিরের পূজা-অর্চনাতেও রাজা দাহিরকে এভাবে স্মরণ করা হতো যে, রাজা দাহির জীবিত।
এই বিশ্বাসের কারণ ছিল রাওয়া যুদ্ধে দাহিরের অধিকাংশ সৈন্য নিহত হয়েছিল। যারা জীবন নিয়ে পালাতে পেরেছিল তাদের কেউই রাজা দাহিরের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেনি। এর মধ্যে এই বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করেছিল রাজা দাহিরের ছোট স্ত্রীর খবর। দাহিরের ছোট স্ত্রী রাণী প্রিয়সী ব্রাহ্মণবাদের সৈন্যদেরকে রাজার মৃত্যু খবর দিয়ে প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত করেছিল বটে কিন্তু সে উরুঢ়ে সংবাদ দিয়েছিল রাজা দাহির জীবিত। তাই উরুঢ়ে এই খবরই প্রচার হয়ে গিয়েছিল, দাহির হিন্দুস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈন্য সংগ্রহের জন্যে সফর করছেন।
অনেক ঐতিহাসিকও লিখেছেন, আসলে এই প্রচারণা অমূলক ছিল না, রাজার বংশের অধিকাংশ লোকের ধারণা ছিল রাজা মরেনি। সে সেনা সংগ্রহে লিপ্ত রয়েছে। উরুঢ়বাসী এ খবরও জানতো না রাণী প্রিয়সী বিন কাসিমের হাতে বন্দি হয়েছে এবং মায়ারাণী আত্মহত্যা করেছে।
বিন কাসিম ৯৪ হিজরী সনের ৩ মুহররম উরুঢ়ের দিকে রওয়ানা হলেন। বিন কাসিম ডাহতা নামক একটি ঝিলের কাছে তাবু ফেলে আশেপাশের অধিবাসীদের খবর দিলেন, তারা যেন আরব বাহিনীর আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। কেননা মুসলমানরা এখন সিন্ধুর শাসক। রাজা দাহির মারা গেছে। এলাকাটি ছিল বৌদ্ধ অধ্যুষিত। অধিকাংশ অধিবাসী ছিল ব্যবসায়ী। খবর
পাওয়া মাত্রই বৌদ্ধদের সর্দার বিন কাসিমের সাথে সাক্ষাত করতে এলো। বৌদ্ধ সর্দার এসে শুধু আনুগত্যই প্রকাশ করল না, সব ধরনের সহযোগিতা ও বিশ্বস্ততা বজায় রাখার প্রক্রিতি ব্যক্ত করল। বৌদ্ধদের মধ্যে দু’জন ছিল খুবই উঁচুমানের সর্দার। বিন কাসিম তাদের যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে তাদেরকে তার সরকারের ট্যাক্স আদায়ের দায়িত্বে নিয়োগ করলেন। বিন কাসিম বৌদ্ধ সর্দারদের বললেন, তোমাদের পাশেই জাটদের বসবাস। তাদের সাথে তোমাদের সম্পর্ক কেমন?
জাট জনগোষ্ঠির ওপর নির্ভর করা যায় না’ বলল এক বৌদ্ধ সর্দার। হিন্দু শাসকরা জাটদেরকে সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত রেখেছে। ফলে এরা সভ্য সমাজের প্রতি বিরক্ত ও ক্ষুদ্ধ। লুটতরাজ ও হিংস্রতাই এদের জীবন ও পেশা। আমরা তাদেরকে নিয়মিত কিছু চাঁদা দেই এবং তাদেরকে আমাদের উৎপন্ন ফসলের একটা অংশ দেই। এজন্য ওরা আমাদেরকে কোন রকম হয়রানী করে না। এদেরকে সামাজিক মর্যাদা শিষ্টাচারে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে হয়তো এই হিংস্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবর্তন আসত।
আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। মানবিকতা ও মানব প্রেমের বৈশিষ্ট দিয়ে আমরা ওদেরকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে আসছি। ফলে ওরা আমাদের সাহায্য সহযোগিতাকে সম্মান দেয়, বলল অপর বৌদ্ধ সর্দার।
তারিখে মাসুমীতে বর্ণিত হয়েছে, সেই দিন বিন কাসিমকে খবর দেয়া হলো, দুই জাট সর্দার তার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছে। তিনি তখনি তাদের নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। দুই জাট সর্দার যখন বিন কাসিমের কাছে এলো, তাদের দেখে কোন সর্দার ভাবার অবকাশ ছিল না। উভয়েই কাধ থেকে পা পর্যন্ত মোটা কম্বল দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছিল। তোমরা কোন্ উদ্দেশ্যে আমার কাছে এসেছো? বিন কাসিম দুই জাট সর্দারকে জিজ্ঞেস করলেন।
আমরা আপনার আনুগত্য প্রকাশ করতে এসেছি, বলল দুই জাট সর্দার। তবে আমাদের আরো গোত্র আছে, তাদের সর্দারের সাথে কথা বলে আমরা আপনাকে চূড়ান্ত আনুগত্যের কথা জানাবো। তবে এর মধ্যে আপনি আমাদের সাথে কোন ধরনের ব্যবহার করেন তাও আমরা যাচাই করব। ‘আমিও দেখবো, তোমরা আমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করো’ বললেন বিন কাসিম। আমি এটা দেখবো না, তোমরা আমার আনুগত্য করেছ কি
করনি কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের অভ্যাস পরিবর্তন না করো, তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
আমরা শুনেছি, বিজিত এলাকার লোকদের আপনি দাসদাসীতে পরিণত করেন না। তাদেরকে সবধরনের সুযোগ-সুবিধা ও স্বাধীনতা দেন এবং তাদের জীবন সম্পদ হেফাযত করেন। আপনি যদি পূর্ববতী রাজাদের মতোই আচরণ করেন, তাহলে বাধ্য হয়ে আমাদেরকে আগের পেশাতেই ফিরে যেতে হবে।
তোমরা কি এই বাহিনীকে মোকাবেলা করতে পারবে, যে বাহিনী এতোগুলো দুর্গ ও অঞ্চল জয় করেছে এবং রাজা দাহিরের মতো তুখোড় যোদ্ধাকেও হত্যা করেছে? হে আরব সর্দার! আমাদের আক্রমণ ভিন্ন প্রকৃতির। আপনি আমাদের কখনো মুখোমুখি পাবেন না। কিন্তু বিরুদ্ধে চলে গেলে আমাদের আক্রমণ থেকে কখনোই আপনার লোকজন রেহাই পাবে না। কিন্তু আমরা আপনার কাছে শত্রুতা নয় শান্তির জন্য এসেছি। আপনি আমাদের শান্তি প্রস্তাব কবুল করে নিন। বিন কাসিম তাদের শাস্তি প্রস্তাব মেনে নিলেন। কিন্তু উভয় জাট সর্দারের চেহারা ছবি ও কথাবার্তা শুনে তিনি অনুমান করলেন এরা বেশি দিন তাদের বিশ্বস্ততা বজায় রাখবে না।
‘এদের ব্যাপারে সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ করে তিনি আপাদত শান্তি প্রস্তাব মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত দিলেন। কিন্তু জাট জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে বিশদ বর্ণনা দিয়ে পয়গাম পাঠালেন। পয়গামে জাটদের ব্যাপারে কি করণীয় এ ব্যাপারে পরামর্শও চাইলেন।
বিন কাসিম কোন ধরনের ঝুকি নিতে চাচ্ছিলেন না। কারণ জাটরা হিংস্র প্রতিশোধপরায়ণ ও দুর্ধর্ষ। এরা মুসলমানদের প্রতি বিরূপ হলে দাহির পুত্রের সাথে মিশে যেতে পারে। অথবা দাহিরের পুত্র এদেরকে ইরানীদের মতো বিশেষ মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিন কাসিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও ব্যবহার করতে পারে।
কয়েক দিনের মধ্যেই হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জবাবী পত্র এসে গেল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ লিখলেন
প্রিয় বসছ’ তোমার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। তুমি জাট জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চেয়েছে। আমার মতামত
পরিষ্কার। যে জনগোষ্ঠী তোমার বিরুদ্ধে লড়াই করে অথবা যে জনগোষ্ঠী তোমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং যারা অব্যাহতভাবে তোমার বিরুদ্ধাচরণ করছে, তাদের সকল যোদ্ধা ও নেতৃস্থানীয় লোকদের পাকড়াও করে হত্যা করবে। জাট জনগোষ্ঠীকে আমুলী কোন জনগোষ্ঠী মনে করো না। তুমি নিশ্চয়ই জানো এই জনগোষ্ঠীর লোকেরাই ইরানীদের পক্ষ হয়ে খালিদ বিন ওয়ালীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। ওরা খুবই বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিল। ওদের চরিত্র বৈশিষ্ট্যের কিছু তুমি উল্লেখ করেছো। আমি আগেই ওদের সম্পর্কে জানতাম। জাট জনগোষ্ঠী তোমার মোকাবেলায় যুদ্ধ না করলেও ওরা তোমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ওরা তোমাকে নিশ্চিন্তে থাকতে দেবে না।
লুটতরাজ হিংসা খুনাখুনিই ওদের পেশা। বংশ পরস্পরায় ওরা লুটতরাজ করে আসছে।
ওদের নিয়ন্ত্রণ করতে তোমাকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ওদের মধ্যে কে কে যোদ্ধা ও খুনাখুনিতে সিদ্ধহস্ত তোমাকে তাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং এদের হত্যা করে ফেলতে হবে। এ ছাড়া ওদের নারী শিশুদেরকে ধরে এনে পণবন্দি হিসেবে তোমার কাছে রাখতে হবে। তবে ওদেরকে এমন লোকদের প্রহরাধীনে রাখতে হবে যাতে নারী শিশুদের ওপর কোন নির্যাতন না হয়। এ ছাড়া ওদের মধ্যে যেসব লোক ব্যবসায়ী কৃষিজীবী কারিগর ওদের ওপর খুবই হাল্কা কর আরোপ করবে। ওদের মধ্যে যারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করবে তাদের ওপর জিযিয়া ধার্য না করে উশর ধার্য করবে। সেই সাথে তাদেরকে ইসলামী হুকুম আহকামের সাথে পরিচিত করার ব্যবস্থা নেবে। বস্তুত তুমি অতি কাছে থেকে ওদের দেখছো, আশাকরি বাস্তবতার নিরীখে কী করণীয় সে সম্পর্কে তুমিই ভালো বুঝবে। তবে খুব সতর্কতা ও দূরদর্শীতার সাথে ওদের ব্যাপারটি সামলাতে হবে।
হাজ্জাজ কঠোর হতে বললেও বিন কাসিম জাটদের প্রতি অতোটা কঠোর হলেন না। তিনি ওদেরকে কৌশল ও মানবতার দীক্ষা দিয়ে সভ্যতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন।
কিছুদিন পর বিন কাসিম সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে জাটদের অপর একটি গোষ্ঠী সিমা কওমের আবাসস্থলের কাছে গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। সিমা কওম জাটদের ওই জনগোষ্ঠী যাদেরকে কোন শাস্তিই বাগে আনতে পারেনি। বিন কাসিমের সৈন্যরা যখন শিবির স্থাপনের জন্যে খুঁটি পুঁততে শুরু
করে তখন শোনা গেল জাট জনবসতীর দিক থেকে ঢোল ও বাদ্য বাজনার আওয়াজ। কিছুক্ষণের মধ্যে বাদ্য বাজনার আওয়াজ ও মানুষের শোরগোল আরো এগিয়ে এলো। বিন কাসিম কয়েকজনকে নির্দেশ দিলেন, দেখে এসো তো এই বাদ্য বাজনা কারা করছে এবং কারা এ দিকে বাজনা বাজিয়ে অগ্রসর হচ্ছে?
কারো যাওয়ার দরকার নেই সম্মানীত সেনাপতি। এরা জাট জনগোষ্ঠী, বলল বিন কাসিমের দলের সাথে থাকা দাহিরের সাবেক উজির সিয়াকর। এটা জাটদের রীতি। ওরা যখন কাউকে অভ্যর্থনা জানায় তখন এভাবে ঢাকঢোল বাজায়। মনে হচ্ছে, ওরা আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতেই বাদ্য বাজনা নিয়ে নেচে গেয়ে এদিকে আসছে।
আমার তো মনে হয় এরা আমাদের ওপর আক্রমণ করার মতো এতোটা বোকামী করবেনা, বললেন বিন কাসিম। তিনি একথা বলে একটি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে জাটদের আসার দিকে অগ্রসর হলেন।
বিন কাসিম ঘোড়া ছুটাতেই তাঁর একান্ত নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁর পিছনে ঘোড়া ছুটাল। জাট জনগোষ্ঠী খোলা মাথা ও খালি পায়ে নেচে গেয়ে বাদ্যের তালে তালে এদিকে অগ্রসর হচ্ছিল। বিন কাসিম উন্মাতাল নাচে লিপ্ত মিছিলের কাছে গিয়ে ঘোড় থামিয়ে এক লাফে নীচে নেমে পড়লেন। বিন কাসিমকে দেখে জাটদের বাজনা আরো চড়ে গেল এবং নাচগান আরো তীব্র আকার ধারণ করল। এরপর বাদ্য বাজনা থামলে ওদের মিছিল থেকে দু’তিন জন লোক তার দিকে এগিয়ে এসে বিন কাসিমের সাথে মুসাফাহা করল। বিন কাসিমের সাথে দুভাষী ছিল, তার মাধ্যমে তিনি ওদের সাথে কথা বললেন। জাটরা তাদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে একজন সর্দার ধরনের লোককে সামনে এগিয়ে দিল।
আমরা আপনাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এসেছি। তবে জানি না, আপনি আমাদের অভ্যর্থনা গ্রহণ করবেন কি না।
তোমরা যদি তোমাদের পেশা ত্যাগ করো তাহলে আমি শুধু তোমাদের অভ্যর্থনাই কবুল করবো না, বরং তোমাদেরকে আমাদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করবো। কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের আচরণ ও পেশা পরিবর্তন না কর তা হলে পূর্ববর্তী রাজাদের থেকে আরো কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আচ্ছা, তোমরা কি তোমাদের মধ্য থেকে এমন কোন সর্দারকে আমার কাছে পাঠাতে পারো, যার সাথে আমি সব ধরনের কথা বলতে পারি?
হ্যাঁ, নিশ্চয় পাঠাবো! বলল জাট সর্দার। আমরা আপনার কাছে আমাদের এমন সর্দারকেই পাঠাবো যার সাথে আপনি সব ধরনের আলাপ আলোচনা করতে পারবেন। অতঃপর জাট জনগোষ্ঠীর মিছিলটি পুনরায় নেচে গেয়ে বাদ্যবাজনা বাজাতে বাজাতে তাদের বসতির দিকে চলে গেল। ওদের দেখে বিন কাসিম কিছুটা স্বস্তিই বোধ করলেন। কিছুক্ষণ পরে বহুরিয়া নামে এক বৃদ্ধ জাট সর্দার আরো তিনজনকে সাথে নিয়ে বিন কাসিমের সাথে সাক্ষাত করতে এলো। বিন কাসিম তার তাবুতে সসম্মানে এদের বসালেন। তখন শা’বান ছাকাফীও আরো দু’জন সেনাপতি বিন কাসিমের তাবুতে বসা ছিলেন। হে জাট সর্দার! বলল তোমরা কি উদ্দেশে আমার এখানে এসেছ? দু’ভাষীর মাধ্যমে জাট সর্দারকে জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।
হে আরব সেনাপতি! আমার কওমের লোকেরা তোমাকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, তা থেকেই তোমার বুঝে নেয়া উচিত আমি কি উদ্দেশে এসেছি? বলল বৃদ্ধ জাট সর্দার। আমরা যাকে পছন্দ করি, যাকে সম্মান করি, তাকে এ ভাবেই অভ্যর্থনা জানাই। এটা আমাদের কওমের রীতি। আমাদের এলাকায় তোমাদের আগমনে আমরা খুশি হয়েছি।’ এখন আর এই এলাকা তোমাদের নয় সর্দার, এটা আমার এলাকা। এই এলাকা তখন তোমাদের হবে, যখন তোমরা আমার কাছে এটা প্রমাণ করবে যে, এই এলাকার কর্তৃত্ব করার যোগ্যতা তোমাদের আছে। তোমরা তো একটা বীর জাতি ছিলে এখন তোমরা এমন লুটেরা খুনি জনগোষ্ঠীতে পরিণত হলে কেন? জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।
আমাদের এই অবনতির কারণ রাজা চাচ। সে আমাদেরকে সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। রাজা চাচের ওপর যখন ইরানীরা আক্রমণ করেছিল, তখন সে আমাদেরকে দিয়ে যুদ্ধ করায়। তখন যদি আমরা জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ না করতাম তবে ইরানীরা গোটা সিন্ধু অঞ্চল কব্জা করে নিতো। রাজা চাচ ও তার ছেলে দাহিরের কোন নাম নিশানাও থাকতো না।
কিন্তু আমরা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়ে ইরানীদের মাকরান থেকে আর সামনে অগ্রসর হতে দেইনি। কিন্তু রাজা চাচ আমাদের কোন সহযোগিতাই করেনি। ফলে বহুসংখ্যক জাট ইরানীদের হাতে বন্দি হয়। জাট বন্দীদেরকে ইরানীরা পশুর মতো থাকতে বাধ্য করে। কিন্তু তোমাদের পূর্বপুরুষরা যখন ইরান আক্রমণ করে তখন ইরানীরা জাটদের দাসত্ব থেকে
মুক্তি দিয়ে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত করে। যুদ্ধে জাটরা আরবদের হাতে বন্দি হয়? আমরা যারা তাদের উত্তরসূরী ছিলাম তাদের পরাজয় ও বন্দিত্বের কারণে শাস্তি নেমে এলো আমাদের ওপর। রাজা চাচ আমাদের সব ধরনের মানবিক অধিকার কেড়ে নিলো। বাধ্য হয়েই আমরা লুটতরাজের পথ বেছে নিলাম। বৃদ্ধ জাট সর্দারের বলার ভঙ্গি এমন আবেগপূর্ণ ছিল যে, বিন কাসিম মনোযোগ দিয়ে তা শুনছিলেন। তুমি জানো না আরব সেনাপতি। আমাদের সাথে এখানকার শাসকরা কেমন আচরণ করে তা তুমি জানো না। মোটা কম্বল ছাড়া আমাদের কোন কাপড় পড়ার অধিকার নেই। আমাদের পায়ে জুতো পরার অধিকার নেই। আমরা মাথায় পাগড়ী বাঁধতে পারিনা। আমরা ছিলাম ঘোড় সওয়ার জাতি। কিন্তু রাজা চাচ আমাদের অশ্বারোহণে নিষেধাজ্ঞা জারী করে। যদিও বা কোন শাসকের অনুমতিতে আমাদের কোন সর্দারকে ঘোড়ায় সওয়ার হওয়ার অনুমতি দেয়া হয় তবে সে ঘোড়ায় জিন লাগাতে পারে না। আমাদের কয়েকটি গোষ্ঠীর নারী শিশু আবাল বৃদ্ধ সবাইকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে আমরা রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছি। যেখানেই আমরা সুবিধা পাই লুটতরাজ করি। এখন বলল, হে আরব সেনাপতি! তুমিও কি রাজার মতোই আমাদের সাথে আচরণ করবে?
এ প্রশ্নের জবাব তুমিই ভালো দিতে পারো, বললেন বিন কাসিম। তোমরা যদি আমার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি এমন আচরণই প্রত্যাশা করো এবং এমন আচরণই করো তাহলে পূর্বের রাজার দুঃশাসন থেকেও আমার আচরণ হবে আরো কঠোর। আরব থেকে আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে, যে বিশৃঙ্খলা, হাঙ্গামা ও খুনাখুনি করবে তাদেরকে হত্যা করে ফেলবে। আর যারা শান্তি ও নিরাপদ জীবন-যাপনে আগ্রহী তাদেরকে পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধা দেবে এবং তাদের ওপর সহজ ও লঘু কর আরোপ করা। আমাকে এই নির্দেশও দেয়া হয়েছে, যারা সেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করবে তাদেরকে সাধারণ মুসলমানদের মতোই সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। আমার ধর্মেরও নির্দেশ হলো, সকল মানুষ সমান। মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। তোমার ও আমার মধ্যে মানুষ হিসাবে কোন পার্থক্য নেই, পার্থক্য যতটুকু আছে তা শুধু দায়িত্ব ও কর্তব্যের। সর্দার। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছে।
তোমার সব কথাই আমি বুঝতে পারছি আরব সেনাপতি! বলল জাট সর্দার। তুমিতো এখনো দুনিয়াকে ততোটা দেখোনি। তোমার বয়সটা আমার কেটেছে ঘোড়া ও তাঁবুতে। আমি জগতটাকে অনেক দেখেছি। তুমি যদি আমাদেরকে মানুষের মর্যাদা দাও, তাহলে আমরা তোমাকে তোমার বাহিনীর সেনাদের মতোই সুসভ্য মানুষ হয়ে দেখিয়ে দেবো। এটা মনে করো না, তোমার সেনাবাহিনীর ভয়ে আমি একথা বলছি। আমি তোমাদের ধর্মের রীতি-নীতি সম্পর্কে জানি। আমি তোমাদের ধর্ম গ্রহণ করবো কি করবো না এটা পরের কথা কিন্তু আমি জানি, তোমাদের ধর্ম আমার ও রাজা দাহিরের ধর্ম থেকে ভালো। আমি শুনেছি, এ পর্যন্ত তুমি যেসব অঞ্চল জয় করেছে, সেখানকার অধিবাসীদের ওপর কোন জুলুম অত্যাচার করোনি।
তোমার গোত্রের সব লোক কি তোমার নির্দেশ মেনে চলে? জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।
আমার গোত্রের লোকেরা শুধু আমার নির্দেশই মান্য করে না, ওরা তো আমাকে রীতিমতো ভগবানের মতো সম্মান করে। তুমি বলো, কোন নির্দেশ তুমি মানাতে চাও? বলল জাট সর্দার বহুরিয়া।
আমি চাই, তোমরা মানুষের মতো জীবন-যাপন করো এবং আমাদের কাছ থেকেও মানুষের আচরণ প্রত্যাশা করো। আমার ধর্মের বিধিনিষেধকে দেখো। আমার বাহিনীর কোন সিপাহী বা কর্মকর্তা সম্পর্কে যদি কোন অপরাধের অভিযোগ করো, তাহলে তাকেও এমনই শাস্তি দেয়া হবে যেমন শাস্তি তোমাদেরকে রাজা দাহিরের পক্ষ থেকে দেয়া হতো।
তা হলে শুনে রাখো হে আরব সেনাপতি। আজ থেকে আমরা ঠিক সেই রকম মানুষ হয়ে গেলাম যেমনটি তুমি দেখতে চাও। আমরা তোমার আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছি। তুমি যা ইচ্ছা আমাদের ওপর কর ধার্য করতে পারো। আমরা খুশী মনেই তা পরিশোধ করবো। আজ থেকে তোমাদের সব ধরনের কাপড় পরার অনুমতি দেয়া হলো, বললেন বিন কাসিম। আর কাউকেই খালি পা ও খালি মাথায় থাকতে হবে না।
এখন থেকে তোমরা জিন লাগিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হতে পারবে। কিছুদিন আমি তোমাদের দেখবো, তোমরা আমাকে দেয়া প্ৰতিশ্রুিতি রক্ষা করছে কি না। তোমরা যদি আমার কথা মেনে চলো, তাহলে কিছুদিন পর তোমাদের লোকজনকে আমরা সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে নেবো।
যে জাট জনগোষ্ঠী ছিল হিংস্র লুটেরা কলহপ্রিয় ও খুনী এবং অনিয়ন্ত্রিত বিন কাসিমের দূরদর্শিতায় তারা সুসভ্য জাতিতে পরিণত হলো। বিন কাসিম জাট সর্দার বহুরিয়াকে তার সমান্তরালে বসিয়ে কথা বললেন এবং তাকে কিছু হাদিয়া তোহফা দিলেন এবং তার মাথায় পাগড়ী পরিয়ে দিয়ে পায়ে জুতা পরিয়ে দিলেন।
ইবনে কাসিম! আমাদের ওপর কৃতজ্ঞতামূলক সেজদা ওয়াজিব হয়ে গেছে, বললেন বিন কাসিমের পাশে বসা সেনাপতি বিন আমের। কারণ এই ঝুকিপূর্ণ দুর্ধর্ষ জনগোষ্ঠী খুব সহজেই আমাদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। কথাগুলো আরবীতে বললেন বিন আমের।
বিন কাসিম তার কথায় হেসে বললেন, হে ইবনে আমের! তুমি যদি সেজদা শোকর ওয়াজিব মনে করে থাকো, তাহলে এই অঞ্চলের শাসকের দায়িত্বে তোমাকেই নিয়োগ করবো।
বহুরিয়াকে বিদায় করতে তারা সবাই তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখেন বহুসংখ্যক জাট গোষ্ঠীর লোক বাইরে দাঁড়ানো। তারা মাথায় পাগড়ী ও পায়ে জুতা পরিহিত অবস্থায় তাদের সর্দার বহুরিয়াকে হাসিমুখে বেরিয়ে আসতে দেখে আনন্দে ঢোল পেটাতে লাগল এবং নাচতে গাইতে শুরু করল। ওদের নাচ ও গান বন্ধ হলে সেনাপতি ইবনে আমের তার পকেট থেকে বিশ দিরহাম বের করে তাদের হাদিয়া দিলেন।
জাটদের সমস্যা সহজে মিটে যাওয়ায় বিন কাসিমের মাথা থেকে বিরাট বোঝা অপসারিত হলো। তিনি সেখান থেকে অগ্রাভিযানের নির্দেশ দিয়ে দিলেন। এখন বিন কাসিমের সামনে এলো সবচেয়ে কঠিন মনজিল। উরুঢ় রাজা দাহিরের রাজধানী। বিন কাসিম অনেক আগেই তার গোয়েন্দা দাহিরের রাজধানীতে নিয়োগ করে রেখেছিলেন। তাদের কাছ থেকে উরুঢ় সম্পর্কে তথ্য জেনে বিন কাসিম তাঁর রণকৌশল নির্ধারণের জন্যে বসে গেলেন।
রাজা দাহিরের মৃত্যুর পর তার এক ছেলে গোপী উরুঢ়ের ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল। গোপী কিছুতেই তার বাবার মৃত্যুর খবরে বিশ্বাস করতো না।
তার কাছে রাজার মৃত্যু খবর বলার সাহসও কেউ পেতো না। বিন কাসিম উরুঢ়ের দিকে রওয়ানা করে সূর্য ডোবার আগেই উরুঢ় থেকে মাইলখানিক দূরে গিয়ে যাত্রা বিরতি করলেন। উরুঢ় অবরোধ করার
আগেই বিন কাসিম তাঁবুর এলাকায় দ্রুত একটি মসজিদ তৈরি করেন। প্রথম জুমআর দিনে এই মসজিদে তিনি জুমআর খুতবা দেন এবং জুমআর নামাযের পর উরুঢ় দুর্গ অবরোধ করেন।
মুসলমানদের অবরোধের খবর শোনামাত্রই উরুঢ় দুর্গে হৈ চৈ পড়ে গেল। মুসলমানদের ভয় ও আতঙ্কে এমনিতেই সাধারণ মানুষ ছিল আতঙ্কিত। সেনাবাহিনীর মধ্যেও ভীতি কাজ করছিল। কারণ এ পর্যন্ত মুসলমানদের কোন রণাঙ্গনে পরাজয়ের খবর তারা জানতো না। বিন কাসিমের বাহিনী একের পর এক জয়ের মধ্য দিয়ে অবশেষে উরু পর্যন্ত এসে পৌছে গেল। অবরোধ আরোপের সাথে সাথে উরুঢ়ের প্রধান মন্দিরে বিরতিহীনভাবে ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। শহরের মে
রের মধ্যে দৌড়ঝাপ শুরু হয়ে যায়। দলে দলে মানুষ মন্দিরে গিয়ে ভীড় করে। মন্দিরে বিপুল মানুষের স্থান সংকুলান না হওয়ায় অধিকাংশই মন্দিরের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে।
সমবেত লোকজনদের উদ্দেশ্যে তখন মন্দিরের পুরোহিত ঘোষণা করল, হে উরুটের অধিবাসীরা! তোমরা ভয় করো না। মহারাজ বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আসছেন। তোমরা দেখেছো, রাজকুমার গোপী যেভাবে দুর্গের বাইরে থেকে এখানে পৌছে গেছেন, মহারাজও ঠিকই পৌছে যাবেন। রাওয়াত মহারাজের মৃত্যু হয়েছে একথা বিশ্বাস করো না। মুসলমানদের মৃত্যু অত্যাসন্ন। মৃত্যুই তাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে।
মন্দিরের পুরোহিতরা রাতদিন একটানা রাজা দাহিরের সৈন্যদল নিয়ে ফিরে আসার কথা ঘোষণা করছিল এবং লড়াইয়ের জন্য লোকজনকে উৎসাহিত ও বিক্ষুব্ধ করার চেষ্টা করছিল। পুরোহিতরা বলতে লাগল, মহারাজ বিশাল সৈন্যদল নিয়ে মুসলমানদের ওপর পিছন থেকে হামলা করবেন। মুসলমানরা মহারাজ ও দুর্গের সৈন্যদের দ্বিমুখী আক্রমণের মাঝে পড়ে পিষ্ট হয়ে যাবে। এদিকে বিন কাসিম আরবদের কৌশল প্রয়োগ করে দুর্গ জয়ের চেষ্টা শুরু করে দিলেন। কয়েকবার তীরন্দাজদের সহায়তায় দেয়ালে ভাঙন সৃষ্টির চেষ্টা করা হলো। কিন্তু প্রতিবারই হিন্দু সৈন্যরা বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করে মুসলিম সৈন্যদের দুর্গপ্রাচীর থেকে চলে আসতে বাধ্য করল। এক পর্যায়ে দুর্গপ্রাচীরে দাঁড়ানো হিন্দু সৈন্যরা মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, আরে আহম্মকের দল! তোমরা কেন আরবে ফিরে যাচ্ছে না। তোমরা কি
আমাদের হাতেই প্রাণ দিতে পণ করেছ? একথা বলার পর দুর্গপ্রাচীরের সৈন্যরা একযোগে হেসে উঠল। অতঃপর তারা মুসলিম যোদ্ধাদের প্রতি নানা ব্যঙ্গ বিদ্রোপ করতে শুরু করল। বার বার হিন্দু সৈন্যরা বলতে লাগল, ‘হে। আরব বোকার দল! মৃত্যু তোমাদেরকে এখানে টেনে এনেছে। এখনো সময় আছে, দেশে ফিরে যাও।’ এক সৈন্য বলে উঠল, এখনো মহারাজ দাহির জীবিত আছেন, তার ফিরে আসার আগেই তোমরা পালিয়ে যাও।
বিন কাসিম আগেই খবর পেয়েছিলেন, শহরের লোকজনকে জানানো হয়েছে, রাজা দাহির জীবিত। তিনি সৈন্য নিয়ে আসছেন। বিন কাসিম রাতের বেলায় তাঁর সেনাপতি ও কমান্ডারদের ডেকে যুদ্ধ পরিস্থিতি ও রাজার জীবিত থাকার কথা প্রচারের বিষয়টি উত্থাপন করলেন। তিনি বললেন, যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্গের লোকজনকে এটা বিশ্বাস না করানো যাবে যে রাজা দাহির মারা গেছে, সে কোন সৈন্যবাহিনী আনতে যায়নি ততোক্ষণ পর্যন্ত ওদের মনোবল চাঙ্গা থাকবে। এ বিষয়টি নিয়ে অনেক পর্যালোচনার পর একজনের বলা একটি কৌশল বিন কাসিমের মনপূত হলো।
তিনি সেটিকে গ্রহণ করলেন। প্রস্তাবটি ছিল, রাণী প্রিয়সীকে ব্যবহার করা। রাণী প্রিয়সী বিন কাসিমের হাতে বন্দি ছিল এবং বাহিনীর সাথেই ছিল। বিন কাসিম রাণী প্রিয়সীকে ডেকে এনে বললেন, “উরুঢ় দুর্গের লোকজন আমাদের মোকাবেলা করার অপচেষ্টা করছে, দুর্গ আমাদের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছে না। ওরা ভাবছে রাজা দাহির জীবিত। উরুঢ়ের প্রতারিত লোকজনের প্রতি কি তুমি দয়া দেখাবে না? রাণী প্রিয়সীকে বিন কাসিম আরো বললেন, দেখো রাণী! অবরোধের একমাস হয়ে গেল। এখনো দুর্গের লোকেরা মনে করছে রাজা বিশাল বাহিনী নিয়ে এসে ওদের উদ্ধার করবে। কিন্তু আমি আর অপেক্ষা করতে পারি না। আমি এখন বাধ্য হয়েই দুর্গের ভিতরে মিনজানিক দিয়ে পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করবো। তুমি জানো, আমাদের হাতে আছে অগ্নিবাহী তীর। অগ্নিতীর ও পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করলে গোটা দুর্গশহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে।
“আমাকে বলো, আমি কি করতে পারি, বিন কাসিমের কাছে জানতে চাইলে রাণী প্রিয়সী! তোমরা কি আমাকে দুর্গের ভিতরে যেতে দেবে?”
না, আমরা তোমাকে দুর্গের ভিতরে যেতে দিতে পারি না। এটা হয়তো তোমার জন্য ভালো হবেনা, বললেন বিন কাসিম। কারণ ওরা ভেবে বসতে
পারে তুমি স্বেচ্ছায়ই আমাদের সাথে যোগ দিয়েছো। তুমি বরং আমার সাথে দুর্গপ্রাচীরের কাছে গিয়ে বলো, রাজা দাহির রাওয়া যুদ্ধে মারা গেছে। সে কখনো আর সৈন্য নিয়ে ফিরে আসবে না। তুমি আমাদের হাতে বন্দি। মায়ারাণী আত্মহুতি দিয়েছে। এখন দুর্গ আমাদের হাতে তুলে না দিলে দুর্গবাসীকে কি ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হতে হবে। হ্যাঁ, ঠিক আছে, আমি তাই বলবো। তোমরা আমাকে দুর্গপ্রাচীরের কাছে নিয়ে চলো। রাজা দাহিরের নিজস্ব যে হাতিটি ছিল, সেটি ছিল সর্বপরিচিত সাদা হাতি, সেটি রাওয়া যুদ্ধে মারা পড়েছিল। রাজা দাহিরের বিশেষ একটি উট ছিল। এটির রং ছিল কালো। উটটি বিন কাসিমের কব্জায় ছিল।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাণী প্রিয়সী ও রাজা দাহির মাঝে মধ্যে একই সাথে কালো উটে আরোহণ করতো। বিন কাসিম রাণী প্রিয়সীকে রাজা দাহিরের উটে সওয়ার করে নিজে একটি ঘোড়ায় সাওয়ার হলেন। অবরোধকারী মুসলিম সৈন্যদের কাছে গিয়ে বিন কাসিম থেমে গেলেন এবং রাণী প্রিয়সীকে সামনে যেতে নির্দেশ দিলেন। রাণী প্রিয়সী দুর্গের প্রধান ফটকের কাছে গিয়ে থামলো এবং চেহারা থেকে নেকাব খুলে ফেলল। দুর্গশাসক প্রাচীরের ওপরে দাঁড়ানো ছিল। দুর্গবাসীদের উদ্দেশ্যে রাণী প্রিয়সী উচ্চ আওয়াজে বলল, হে দুর্গবাসী! আমাকে তোমরা চেনো। আমি তোমাদের রাণী, তোমাদের শাসকদের ডাকো, আমি তাদের সাথে কথা বলব। কিছুক্ষণ পর দুর্গপ্রাচীরের ওপরে এসে দাঁড়াল দাহিরপুত্র গোপী। দুর্গের নিরাপত্তা কর্মকর্তাও তার সাথেই ছিল। দুর্গপ্রাচীর থেকে আওয়াজ এলো, আমরা তোমাকে চিনে ফেলেছি রাণী! বলল কি বলতে চাও।
“মহারাজ দাহির মারা গেছেন! তোমরা একথা বিশ্বাস করো,” দুর্গবাসীদের উদ্দেশ্যে বলল রাণী প্রিয়সী। তিনি জীবিত থাকলে আমাকে মুসলমানদের হাতে বন্দিত্ববরণ করতে হতো না। মহারাজের মাথা ও তার ঝাণ্ডা মুসলমানরা আরব দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, একথা বলে রাণী উচ্চ আওয়াজে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু দুর্গপ্রাচীরের ওপরে দাঁড়ানো লোকদের প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, তারা একথা মোটেও বিশ্বাস করেনি।
তুমি মিথ্যা বলছে, দুর্গপ্রাচীর থেকে রাণীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল গোপী। তুমি ওইসব লুটেরা আরব গোমাতা খোরদের জাদুর খপ্পরে পড়েছ। মহারাজ জীবিত আছেন, বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি অবশ্যই আসবেন। ওদের সাথে মিশে তুমি নিজেকে অপবিত্র করে ফেলেছো রাণী! মহারাজ ফিরে এলে তোমার আশ্রয় দাতাদের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি তোমাদেরকে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্যেই এসেছি, কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল রাণী। তুমি জানো না গোপী! মুসলমানরা গোটা শহরটাকে ধ্বংস করে ফেলবে, আমার কথা বিশ্বাস করো। আমাকে অবিশ্বাস করো না।
কিন্তু রাণীর কথায় কেউ সায় দিলো না, বরং প্রাচীরের ওপর থেকে রাণীকে গালমন্দ করতে শুরু করল দুর্গবাসিরা। অবস্থা দেখে বিন কাসিম রাণী প্রিয়সীকে ডেকে বললেন, রাণী! তুমি ফিরে এসো। ওদের কপাল খুবই মন্দ। ওদের ভাগ্যে ধ্বংসই লেখা রয়েছে। এ থেকে ওদের কেউই রক্ষা পাবেনা। রাণী অগত্যায় ফিরে এলো।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাণী প্রিয়সীর কথায় গোপী ও অন্যান্যরা বিশ্বাস করলনা বটে কিন্তু তাদের মনে সংশয় দেখা দিল। কারণ একমাসের বেশি সময় ধরে মুসলমানরা উরুঢ় দুর্গ অবরোধ করে রেখেছে, রাজা দাহির অন্তরাল হয়েছে আরো আগে কিন্তু এখনো পর্যন্ত না তার কোন খবর পাওয়া গেল, না উরু রক্ষায় কোন সেনাবাহিনী এগিয়ে এলো। সংশয় দূর করতে গোপী কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়ে দুর্গের এক বৃদ্ধা যাদুরাণীর কাছে গেল। যাদুরাণী আশ্চর্যজনকভাবে অনেক ভবিষ্যতবাণী বলে দিতে পারে বলে দুর্গের সবাই বিশ্বাস করত। যাদুরাণী গোপীকে বলল, রাজা দাহির সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসার জবাব সে আগামী কাল উন্মুক্ত ময়দানে দেবে।
গোপী অতি সংগোপনে যাদুরাণীর কাছে গিয়েছিল। কিন্তু এ খবর এক কান দু’কান হয়ে শহরময় ছড়িয়ে পড়ল, “আগামীকাল অমুক সময়ে শহরের ময়দানে যাদুগীর বৃদ্ধা মহারাজের ব্যাপারে তথ্য দেবে।
পর দিন বেলা কিছুটা চড়তেই লোকজন এক এক করে খোলা ময়দানে জমায়েত হতে লাগল। এদিকে হঠাৎ দেখা গেল বাহারী এক ধরনের পোশাক পরিধান করে যাদুবুড়ি ময়দানে হাজির হলো। তার হাতে গোল মরিচের একটি তাজা ডাল। সে এই ডালটি একহাতে উঁচিয়ে রেখেছে।
এক পর্যায়ে যাদুবুড়ি উচ্চ আওয়াজে কাপা কণ্ঠে বলল, হে লোক সকল, তোমরা কেন বিভ্রান্তিতে পড়ে আছো। আমি দুনিয়ার একপ্রান্ত থেকে ওপর
প্রান্ত ঘুরে এসেছি এবং সারা হিন্দুস্তান ঘুরে এসেছি, আমি কোথাও তোমাদের রাজাকে দেখতে পাইনি। সে বেঁচে নেই। তোমরা আর রাজার অপেক্ষা না করে নিজেদের শান্তি নিরাপত্তার কথা চিন্তা করো।
যাদুবুড়ির এই ঘোষণায় সাধারণ মানুষ খুবই হতাশ হলো, কারণ দুর্গের লোকজন মুসলমানদের মিনজানিক ও অগ্নিবাহী তীরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ শুনে এমনিতেই আতঙ্কিত ছিল। যাদুবুড়ির মুখে রাজার মৃত্যুর কথা শুনে তখনই তারা দুর্গ মুসলমানদের হাতে তুলে দেয়ার কথা বলাবলি করতে লাগল। লোকজনের এই মনোভাবে সৈন্যরাও প্রভাবিত হলো, তাদের লড়াইয়ের মনোবল ভেঙে গেল।
সৈনিকদের মধ্যে দু’চারজন উর্ধতন কর্মকর্তা মুসলমান বিজয়ীদের সতব্যবহার ও উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্টের কথা আলোচনা করতে শুরু করল।
রাতের বেলায় মুসলমানদের ঘেরাও এর এক জায়গায় এসে একটি তীর। পতিত হলো। তীরের মাথায় পাতলা চামড়ায় একটি পুটলীর মতো বাঁধা। তীরটিতে কোন বার্তা আছে মনে করে গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীর কাছে তীরটি পাঠিয়ে দেয়া হলো। তীরটিতে পয়গাম লিখা ছিল। এই পয়গাম দুর্গের ভিতর থেকে আলাফীদের এক লোক যে দুর্গের রাজপ্রাসাদে কর্মরত ছিল সে পাঠিয়েছে। জাদুবুড়ির কথা শুনে দুর্গের সাধারণ মানুষ যখন হতাশ হয়ে দুর্গ মুসলমানদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে আর সৈন্যদের মনোবলও ভেঙে পড়ে এমতাবস্থায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আশঙ্কা প্রবল হতে থাকে। এই পরিস্থিতি আন্দাজ করে দাহিরপুত্র গোপী তার পরিবার পরিজন নিয়ে রাতের আধারে দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছে।
এই পয়গাম ছিল বিন কাসিমের জন্য খুবই ফলদায়ক। তিনি সেনাবাহিনীর মনোবল দুর্বল করার জন্য তার সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, “তোমরা সমস্বরে উচ্চ আওয়াজে তকবীর ধ্বনী দিয়ে দুর্গপ্রাচীরের ওপরে তীর বর্ষণ করো আর একদল দুর্গফটকে আঘাত হানো। বিন কাসিমের নির্দেশে মুসলিম সৈন্যরা যখন সমস্বরে তকবীর ধ্বনী দিলো, দুর্গের ভিতরে অধিবাসীরা মুসলমানদের তকবীর ধ্বনী শুনে আতঙ্কবোধ করতে শুরু করল। দিনের বেলায় হঠাৎ একটি ফটক খুলে কিছু বেসামরিক লোক বেরিয়ে এলো। তারা কিছু দূর অগ্রসর হয়ে উচ্চ আওয়াজে ঘোষণা করল, দুর্গের ব্যবসায়ী ও সম্মানিত নাগরিকরা তাদেরকে পাঠিয়েছে, তারা মুসলিম
সেনাপতির সাথে কথা বলতে চায়। তাদেরকে বিন কাসিমের কাছে নিয়ে গেলে তারা জানাল “আমরা বন্ধুত্বের জন্য এসেছি। দুর্গের ব্যবসায়ী ও অভিজাত লোকেরা যুদ্ধ চায় না। এতোদিন দুর্গবাসীদের বিশ্বাস ছিল রাজা দাহির জীবিত তিনি বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে আসবেন। কিন্তু এখন আমাদের বিশ্বাস হয়েছে, রাজা মারা গেছেন। রাজকুমার গোপী ছিল দুর্গের শাসক। পরিস্থিতি অনুধাবন করে সে দুর্গবাসীকে ফেলে রেখে পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে গেছে। এখন আর আমাদের সৈন্যদের আপনার মোকাবেলা করার হিম্মত নেই, সাধারণ মানুষও যুদ্ধের বিরোধী। আমরা আপনার আনুগত্য করতে প্রস্তুত তবে আপনাকে আমাদের জীবন, সম্পদ ও ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা দিতে হবে।” বললেন দুর্গের বেসামরিক লোকেরা।
তোমরা বুদ্ধিমানের কাজ করছ, কিন্তু যে পর্যন্ত দুর্গপ্রাচীর ও দুর্গের ভিতরে সৈন্য মোতায়েন থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তোমাদের কথার ওপর আস্থা রাখতে পারি না। আমাদের আস্থা অর্জন করতে হলে তোমাদেরকে দুর্গপ্রাচীর থেকে সৈন্য অপসারণ করতে হবে এবং ভিতরের শাসকদেরকে দুর্গ থেকে বের করে দিতে হবে। দুর্গের প্রতিনিধিরা চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর মুসলিম সৈন্যরা দেখতে পেল দুর্গপ্রাচীর থেকে একেক করে সৈন্য সরে যাচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পর দুর্গের প্রধান ফটক দিয়ে বহুসংখ্যক সেনা অফিসার বের হয়ে এলো এবং তারা তরবারি অবনত করে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে বিন কাসিমের সামনে হাতিয়ার ফেলে দিলো এবং দুর্গফটকের চাবি বিন কাসিমের হাতে সোপর্দ করল। বিন কাসিম তার সৈন্যদলের অগ্রভাগে ফটক পেরিয়ে দুর্গে প্রবেশ করলেন। প্রথমেই তার দৃষ্টি পড়ল দুর্গের ভিতরকার একটি মন্দিরে। এই মন্দিরকে স্থানীয় লোকজন নৌবিহার বলে ডাকত। মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিন কাসিমের দৃষ্টি পড়ল মন্দিরের দরজার দিকে। তিনি দেখতে পেলেন বহু লোক একটি মূর্তির সামনে সেজদাবনত। বিন কাসিম ঘোড়া থেকে নেমে মন্দিরের ভিতরে গেলেন। তিনি দেখতে পেলেন, একটি পাথরের তৈরি ঘোড়ার সামনে লোকগুলো সিজদা দিচ্ছে। পাথরের ঘোড়র ওপরে একজন দেবতা সওয়ার। সওয়ারী দেবতার দুই বাহুতে চামড়ার বাজুবন্ধ বাধা। বাজুবন্ধের ওপর সোনা ও মনিমুক্তা খচিত। বিন কাসিম এগিয়ে গিয়ে মুক্তির গা থেকে একটি বাজুবন্ধ খুলে ফেললেন।
অতঃপর তিনি পূজারীদের উদ্দেশ্যে বললেন, এই মন্দিরের পুরোহিত কে? তাকে ডাকো। এক পূজারী দু’হাত প্রসারিত করে করজোড়ে এসে বিন কাসিমের সামনে দাঁড়াল।
এই মূর্তির অপর বাজুবন্ধটি কোথায়? পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম। পূজারী অজ্ঞতা প্রকাশ করল। এ খবর মূর্তিকেই জিজ্ঞেস করোনা? বললেন বিন কাসিম। এ খবর মূর্তি কি করে বলবে? সে তো নিপ্ৰাণ পাথর। তাই যদি হবে তাহলে তোমরা এর পূজা কর কেন? বললেন বিন কাসিম। তার বাজুবন্ধ কে খুলে নিয়েছে, সে যদি তাই বলতে না পারে তবে এটি তোমাদের কি উপকার করতে পারবে? পুরোহিত নীরব হয়ে গেল। বিন কাসিম স্মিত হেসে মন্দিরের বাইরে চলে এলেন।