৭০০ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ৮১ হিজরী সন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স তখন মাত্র সতের বছর। সিন্ধু অঞ্চলে দাহির নামের এক কট্টর হিন্দু রাজা মসনদে আসীন হলো। তখন সিন্ধু অববাহিকা ছিল দুটি রাজ্যে বিভক্ত। এক অংশের রাজধানী ছিল আরুঢ় অনেকে বলত আলোড়। আর অপর অংশের রাজধানী ছিল ব্রাহ্মণাবাদ। ব্রাহ্মণাবাদের রাজার নামই ছিল রাজ। ক্ষমতা দখলের এক বছরের মাথায় সে মারা গেল। রাজের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণাবাদের মসনদ অপর অংশের রাজা দাহিরের এক জ্ঞাতি ভাই দখল করে নেয়। এতে রাজা দাহির খুব খুশী হয় এই ভেবে যে, তারই এক জ্ঞাতি ভাই সিন্ধু অঞ্চলের অপর অংশের ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। রাজা দাহির মসনদ দখল করার তিন চার বছর পরের ঘটনা। রাজা দাহিরের রাণী মায়ারাণী হরিণ শিকার করতে গেল। তখন সিন্ধু অববাহিকা যেমন ছিল ঘন জঙ্গলাপূর্ণ; দ্রুপ জংলী পশু পাখিতে ছিল ভরা। তখনকার রাজা-রাণীদের হরিণ শিকার ছিল একটি আভিজাত্যের প্রতীক। ছুটন্ত হরিণের পিছে তাজি ঘোড়া হাঁকিয়ে বিষাক্ত তীর ছুড়ে হরিণকে ঘায়েল করা ছিল শাসকদের একটি অন্যতম খেলা। এ কাজে বেশীর ভাগ পুরুষরা অংশ নিলেও কোন কোন রাজ বংশের সাহসী মেয়েরাও রীতিমতো বন্যপ্রাণী শিকার করত। তাদের শিকার কাজে সহযোগিতা করতে অনুগত ভৃত্য ও দেহরক্ষী সৈন্যসান্ত্রী।
মাত্র এক বছর হলো বিয়ে হয়েছে রাণীর। বয়স উনিশ কিংবা বিশের বেশী নয়। মায়ারাণী ছিল খুবই সুন্দরী, সেই সাথে শিকার প্রেমী। বংশগতভাবে মায়ারাণী রাজবংশের মেয়ে হওয়ায় অশ্বারোহণ ও তীর নিক্ষেপে পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। সেদিন সে দুটি ঘোড়া ও দু’চাকার রথ নিয়ে শিকার করতে বের হলো। রথচালক ছিল শাহী নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য। সে
যুদ্ধক্ষেত্রে রাজাকে বহনকারী ঘোড়ার গাড়ি চালাতো। যদ্দরুন ঘোড়ার গাড়ি চালনায় তার পারদর্শিতা ছিল কিংবদন্তিতুল্য।
শিকারের জায়গায় পৌছেই চার পাঁচটি হরিণ চোখে পড়লো রাণীর। মায়ার নির্দেশে রথচালক ঘোড়া দৌড়িয়ে দিলো। শিকারীর তাড়া খেয়ে হরিণ উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে লাগল। পলায়নরত হরিণের পিছনে ঘোড়ার গাড়িও ছুটতে লাগলো তীরবেগে। কিছুদূর গিয়ে হরিণগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এদের একটির পিছনে ছুটতে লাগলো মায়ারাণী। শাহী আস্তাবলের প্রশিক্ষিত ঘোড়াও দৌড়াতে লাগলো হরিণের পিছু পিছু। দৌড়াতে দৌড়াতে এমন জায়গায় এসে গেল যে, জমিন কোথাও পাথুরে টিলাময় আবার কোথাও বালুময়। হরিণ জীবন বাঁচাতে এমন জোরে জোরে লম্ফ দিচ্ছিল যে, এক একটি লাফে ত্রিশ চল্লিশ হাত দূরত্ব অতিক্রম করত। এমতাবস্থায় মায়ারাণী চার-পাঁচটি তীর নিক্ষেপ করেছিল কিন্তু কোনটিই লক্ষভেদ করতে পারেনি। হরিণের ডানে বামে গিয়ে পড়েছে মায়ারাণীর ছোড়া তীর। এমন সময় হরিণ দৌড়ে পৌছে যায় টিলা ও জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায়। নাগালের বাইরে চলে যায় হরিণ। তবুও দ্রুত হাঁকাতে শুরু করলো রথচালক ঘোড়ার গাড়ি। উঁচু নীচু জমিনে আঘাত লেগে ঘোড়ার গাড়ি উল্টে যাওয়ার উপক্রম। কয়েকবার এমন হয়েছে যে, পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়েছে মায়া।
হরিণ টিলার ফাঁকে ফাঁকে নীচু দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল। আর আঁকাবাঁকা পথে এগুচ্ছিল। রাণী এরপরও হরিণের পিছু ছাড়লো না। হরিণ যেদিকে মোড় নিতো মায়ার ঘোড়ার গাড়িও সেদিকে ঘুরতে গিয়ে মাঝে মধ্যে উল্টে যাওয়ার উপক্রম হত। এমতাবস্থায় আবারো তিনটি তীর নিক্ষেপ করলো মায়া। কিন্তু কোনটিই হরিণকে স্পর্শ করল না। এ সময় সামনে ঘন টিলাময় জায়গা এসে গেল। হঠাৎ একটি টিলার ওপাশ থেকে এক অশ্বারোহী বেরিয়ে এলো। আরোহীর হাতে বর্শা। আরোহী তার ঘোড়া ধাবমান হরিণের পিছনে ছুটালো। মায়ারাণীর গাড়িও ততক্ষণে খোলা জায়গায় এসে গেছে। মায়ারাণীর রথচালক হরিণের পিছু ধাবমান অশ্বারোহীকে চিৎকার করে বলল, সামনে থেকে সরে যাও! এটা মহারাণীর শিকার। কিন্তু অশ্বারোহীর কানে রথচালকের চিঙ্কার প্রবেশ করেছে বলে মনে হলো না। সে যথারীতি হরিণের পিছনে ছুটতে লাগল।
“মহারাণী! তীর ধনুক আমার হাতে দিন! হরিণের আগে আমি এই বেকুবকেই খতম করে ফেলব।” বলল রথচালক।
“মনে হচ্ছে, অশ্বারোহী আমাদের দেশের নয়।” বলল মায়ারাণী।
এমন সময় হরিণ একটু ঘুরে দৌড়াতে লাগলো, অশ্বারোহীও ঘুরে গেল সেদিকে। এখন স্পষ্টই অশ্বারোহীর চেহারা দেখা গেল।
“দেখে মনে হচ্ছে এ কোন আরব।” বলল রথচালক। বুঝতে পারছি না, এদিকে আসার সাহস ও কিভাবে পেল! রথ তখনো আগের মতোই এগুচ্ছিল। মায়ারাণী আবারো কয়েকটি তীর ছুড়ল কিন্তু পূর্ববৎ এগুলোও লক্ষ্যভেদ করতে পারল না। এমন সময় অশ্বারোহী পদানীর ওপর দাঁড়িয়ে তার হাতের বর্শাটি হরিণের দিকে নিক্ষেপ করলে নিক্ষিপ্ত বর্শা গিয়ে পড়ল হরিণের কাঁধে। বর্শা বিদ্ধ হওয়ায় হরিণটি লাফ দিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। অশ্বারোহী লুটিয়ে পড়া হরিণের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এদিকে ধাবমান মায়ার ঘোড়ার গাড়িও ততোক্ষণে পড়ে থাকা হরিণের পাশে গিয়ে থেমে গেল। অশ্বারোহী মায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল। রথচালক অশ্বারোহীর প্রতি রাগে ফুঁসতে ফুসতে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
“তুমি সেইসব আরবদের কেউ যাদেরকে মহারাজা আশ্রয় দিয়েছেন? স্বদেশী ভাষায়ই জিজ্ঞেস করল রথচালক। তুমি কি জানো না, কি অপরাধ করেছছ? মহারাণী ইচ্ছে করলেই তোমাকে আমার গাড়ির পিছনে বেঁধে ঘোড়া দৌড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। তুমি আরব হয়েও এভোটা বেকুব ও বেআদব হলে কি করে?”
“না, আমি মহারাজের আশ্রিত আরবদের কেউ নই। তাছাড়া আমি কোন বেআদবীও করিনি, বেকুবও নই।”
“আরে! তুমি আমাদের ভাষাও জানো! আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলল রথচালক।
“মায়ারাণীর রাগান্বিত হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সে রাগান্বিত হলো না। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে মায়া গিয়ে দাঁড়াল অশ্বারোহীর সামনে। গভীরভাবে তাকালো আরোহীর চোখের দিকে। অজ্ঞাত আরব অশ্বারোহীর বয়স ছিল ত্রিশের কোঠায়। উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রং, একহারা শরীরের গড়ন। শক্ত গাঁথুনী শরীরের। গাঢ় কালো চোখের তারায় হাসির ঝিলিক। চেহারার মধ্যে এক ধরনের মায়া মায়া ভাব। প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বর ছাপ আরোহীর চেহারায়। মায়া যুবকের দিকে তাকিয়ে তার
সম্মোহনীতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। আরব যুবকের মুচকি হাসি মায়ারাণীর প্রতি যেন এক ধরনের বিদ্রুপ করছিল।
এমন সময় অশ্বখুরের আওয়াজ শোনা গেল। মুহূর্তের মধ্যে সেদিকে দৌড়ে এলো ছয়জন অশ্বারোহী। এরা ছিল মায়ারাণীর নিরাপত্তারক্ষী।
“সগ্রাম, নিরাপত্তা রক্ষীদের আমার কাছে আসতে দিয়ো না। ওদেরকে দূরেই থামিয়ে দাও। আর তুমিও রথ নিয়ে যাও। এর ভাগ্যের ফায়সালা আমি একাকীই করব।” চালক রথ নিয়ে চলে গেল এবং নিরাপত্তা রক্ষীদের দূরেই থামিয়ে দিলো।
“এখানে কেন এসেছ?” আরোহীকে জিজ্ঞেস করল মায়ারাণী। হরিণ শিকারের জন্যে এসেছিলে? আমার অনুমতি ছাড়া তো তুমি হরিণ নিয়ে যেতে পারবে না।”
“এটা যদি আমি নিজের জন্যে শিকার করতাম, তাহলে মরে যাওয়ার আগেই আমি সেটিকে জবাই করতাম। আমি এটিকে তোমাদের জন্যই শিকার করেছি। আমি জানি তোমরা মরা জীবজন্তু খেয়ে থাকো।” “আমাদের জন্য তুমি কেন শিকার করলে? তুমি কি আমাকে নারী মনে করে ভেবেছিলে আমি এটিকে শিকার করতে পারবো না?” জিজ্ঞেস করল মায়া। তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করেছ? না আমাকে এর পিছনে আসতে দেখোনি?”
“আমি তোমাকে নারী হিসেবে দেখেছি ঠিক, কিন্তু শিকারের ব্যাপারে তোমাকে আমি আনাড়ী মনে করিনি। আমি এ টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি যখন থেকে হরিণের পিছু নিয়েছ, তখন থেকেই আমি তোমাকে দেখছি বারবার তুমি হরিণের দিকে তীর নিক্ষেপ করছ, কিন্তু রথ এদিক সেদিক হওয়ার কারণে তোমার ছোড়া তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এদিকে হরিণটিও বাঁচার জন্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। এদিকের মাটি অসমতল হওয়ার কারণে তোমার রথ যেভাবে হেলে যাচ্ছিল এবং হোচট খাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছিল রথ না আবার উল্টে যায়। এজন্য আমি ভাবলাম তোমার জন্য হরিণটি শিকার করে দেবো, যাতে তোমার ঝুঁকির আশঙ্কায় পড়তে না হয়।”
সুদর্শন আরব যুবক বলে যাচ্ছিল স্মিত হাস্যে।
মায়ারাণী মন্ত্রমুগ্ধের মতো যুবকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন যুবক তাকে যাদু করে ফেলেছে। তার মুখ থেকে কোন কথাই আর বের করতে পারল না।
“তুমি কি জানতে আমি কে?” ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রাণী।”
“না আমি জানতাম না যে তুমি রাজা দাহিরের স্ত্রী। তোমার ঘোড়ার গাড়ি ও পিছনের নিরাপত্তা রক্ষীদের দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি শাহী খান্দানের কেউ হবে।”
“এখনতো জানলে? এখন কি আমাকে তোমার ভয় হচ্ছে না?”
“না, ভয় করছি না। তোমাদের এখানে ভয় করার অর্থ এক রকম, আর আমাদের দেশে ভয় এর অর্থ অন্যরকম।
আমরা শুধু আল্লাহকেই ভয় করি। আমরা মুসলমান। আমাদের দেশে কোন রাজা মহারাজা নেই। সেখানে কেউ রাজা-বাদশাহ হয় না।”
“তুমি এখানে কেন এসেছিলে?” যুবককে জিজ্ঞেস করলো মায়ারাণী।
“আমি একটি অপরাধ করে এসেছি। এখন যদি সেই অপরাধের কথা তোমাকে বলি, সেটি হবে আরেকটি অপরাধ। অবশ্য তোমাকে একথা বলতে পারি, আমি এখানে কোন অপরাধ করতে আসিনি। আশ্রয় নিতে এসেছি।”
মায়ারাণী রথচালককে ইশারায় আহবান করলো। রথচালক দৌড়ে এলো। রথচালক এলে মায়া বললো, হরিণের গা থেকে বর্শাটা খুলে এখানেই রেখে দাও, আর হরিণটি গাড়িতে করে নিয়ে যাও। রথচালক রাণীর নির্দেশ পালন করে যখন যেতে লাগল, তখন আবার ডাকলো মায়ারাণী। রাণী এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, কোন আশঙ্কা নেই সংগ্রাম। আমি এর কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করছি। এ লোক আমাদের কাজে আসতে পারে। তোমরা একটু দূরে চলে যাও।”
“মহারাণী! আপনার যে জ্ঞান আছে তাতে আমার কিছু বলার নেই। আমি শুধু আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, মুসলমানদের বিশ্বাস করা যায় না। একটু সতর্ক থাকবেন।”
“তোমার কোন চিন্তা করতে হবে না। যাও। এ লোক আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।”
চলে গেল রথচালক। রাণীর নিরাপত্তা রক্ষীরাও আরো দূরে সরে গেল। রাণী পুনর্বার আরব যুবকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“তুমি কি নিজের সম্পর্কে আমাকে আর কিছু বলবে না?” আরব যুবককে জিজ্ঞেস করলো মায়া।
“নিজের সম্পর্কে আর কিছু বলার আগে আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।”
“ঠিক আছে, যা জিজ্ঞেস করার তা করো।”
“আমি তোমাদের দেশ সম্পর্কে জানি। এদেশের রাজা বা রাণী সাধারণ মানুষের সাথে এভাবে কথা বলে না, যেভাবে তুমি আমার সাথে বলছ। তোমাদের এখানে তো মানুষ মানুষের দেবতায় পরিণত হয়েছে।”
“আমি তোমাকে সাধারণ কোন ব্যক্তি মনে করছি না।” বলল মায়ারাণী। আমার মনে হয় তুমি কোন শাহী খান্দানের লোক। আচ্ছা, তুমি আমাদের ভাষা শিখলে কোত্থেকে?” তুমি কি আমাদের দেশ সম্পর্কে আরো বিশেষ কিছু জানো?”
রাণী কিছুক্ষণ নীরব থেকে আরব যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সাথে আমার কঠোর স্বরে কথা বলার কোন দরকার নেই, কারণ আমি তোমাকে জানাতে চাই যে, এ মুহূর্তে তুমি আমার নিরাপত্তা রক্ষীদের বেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে। আমি তোমাকে আরব গোয়েন্দা বলে সন্দেহ করছি। তুমি কি আমার সন্দেহ নিরসন করতে পারবে?”
“না, তোমার এ সন্দেহ নিরসন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি তোমাকে সন্দেহাতীতভাবে জানিয়ে দিচ্ছি আমি কারো গোয়েন্দা নই। আমার নাম বেলাল বিন উসমান। আমি আমার খেলাফতের বিদ্রোহী। আমি জানতে পেরেছিলাম এখানে আরবের অনেক লোক আশ্রয় নিয়েছে, এদের সবাই ছিল বিদ্রোহী।”
“যা, তোমার কথা ঠিক।” বলল মায়ারাণী। আমরা হাজার হাজার বিদ্রোহী আরবকে আশ্রয় দিয়েছি। তুমি ওদের কাছে যাওনি কেন?”
“আমার কাছে তাদের কোন ঠিকানা নেই। তাছাড়া আমি একা নই, আমার সাথে আরো চারজন রয়েছে। আমরা চার পাঁচ দিন যাবত এখানে লুকিয়ে রয়েছি। আমরা বুঝতে পারছি না, কিভাবে রাজা পর্যন্ত আশ্রয়ের জন্যে যাওয়া যাবে। তুমি জানতে চেয়েছিলে তোমাদের ভাষা আমি কি করে শিখেছি। ছোট্ট বেলায় আমি আমার পিতার সাথে এদেশে এসেছিলাম এবং ছিলাম প্রায় পাঁচ ছয় বছর। তখনই আমি তোমাদের দেশের ভাষা শিখেছি।”
“তুমি কি তখন সিন্ধু অঞ্চলে থাকতে?”
“না, আমি প্রথমে গিয়েছিলাম সন্দ্বীপে। তুমি কি জানো, ওখানে অনেক আগে থেকেই মুসলমানরা বসবাস করে?” “হ্যাঁ, একথা আমি জানি। আমি জানি অনেকদিন আগে থেকেই আরব বণিকরা যাতায়াত করত। এদের অনেকেই সেখানে বসতি গড়ে তোলে। আমি একথাও জানি যে, মালাবারে যেসব মুসলমানরা বসবাস করে, তারা ইসলামও প্রচার করে। তারা এ অঞ্চলের অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে মুসলমানও বানিয়েছে।” “আমার পিতাও একজন ধর্মপ্রচারক। অবশ্য তিনি ব্যবসাও করতেন। আমি সেই সুবাদে পিতার সাথে এদেশে এসেছিলাম। আব্বার সাথে আমি হিন্দুস্তানের বহু জায়গায় গিয়েছি। তখনই আমি এদেশের ভাষা শিখেছি। আমার পিতা আমাকে একজন ধর্ম প্রচারক হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার আগ্রহ ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার। আবু তখন আমার আগ্রহের কথা বিবেচনা করে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য অভিজ্ঞ উস্তাদের কাছে পাঠান। আমি বড় হওয়ার পর তিনি আমাকে আরব দেশে পাঠিয়ে দেন। আমি খলিফার সেনাবাহিনীতে যোগ দিলাম কিন্তু কিছুদিন পর সেনাবাহিনী ও খেলাফতের মধ্যে দেখা দিল বিরোধ। যেসব সেনা সদস্য ও নাগরিক তৎকালীন খলিফার বিরোধী ছিল তারা খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল। কিন্তু খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে গেল এবং বিদ্রোহীরা গ্রেফতার ও মৃত্যুর সম্মুখীন হতে লাগল। এখানকার রাজা যাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তারা সেই খলিফা বিদ্রোহী আরব। আমি যেহেতু বিদ্রোহীরই সন্তান, তাই আমাকেও পালাতে হলো।”
“আরব বিদ্রোহীরা এদেশে এসেছিল সে তো অনেক আগের কথা, কিন্তু এতোদিন পরে তোমাকে কেন আসতে হলো?” জিজ্ঞেস করল মায়া।
“আমি আসলে ওইসব বিদ্রোহীদের কেউ নই, যাদের বিরুদ্ধে প্রথম ধরপাকড় হয়েছিল- বলল বেলাল। বিদ্রোহের সময় আমিও বিদ্রোহীদের সাথে ছিলাম, কিন্তু কিছুদিন পরে আমি ভাবলাম, পরস্পর যুদ্ধ করা মোটেও ঠিক নয়। এই বোধ থেকে আমি তৎকালীন খেলাফতের বিশ্বস্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সংখ্যা এখনো সেদেশে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বিদ্রোহীদের পক্ষ ত্যাগ করার কারণে আমি ওদের শত্রুতে পরিণত হই, খেলাফতের পক্ষে চলে যাওয়ার কারণে বিদ্রোহীরা আমাকে হত্যার হুমকি দেয়। এদিকে বিদ্রোহীদের সঙ্গ দেয়ার জন্যে খেলাফতের মধ্যে
অনেকেই আমাকে অবিশ্বাস ও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। ঘরে বাইরে আমি শত্রুবেষ্টিত হয়ে পড়ি, সেখানে আমার বেঁচে থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। এ কারণে চার সাথীকে নিয়ে আমি দেশ ত্যাগ করে চলে আসি।
এখনও আমি সন্দেহ সংশয়ের মধ্যে রয়েছি। আমি কোন পক্ষ অবলম্বন করবো স্থির সিদ্ধান্তে পৌছতে পারছি না। কখনও মনে হয় বিদ্রোহীদের পক্ষাবলম্বন করাই হবে আমার কর্তব্য।”
বেলালের কথা শুনতে শুনতে মায়ারাণীর চেহারার রং বদলে যেতে লাগলো। কোন কিশোরী প্রেমে পড়লে প্রেমিকের সংস্পর্শে গেলে চেহারার যে অবস্থা হয় মায়ারাণীর চেহারাও তদ্রুপ। প্রেমিকা যেমন প্রত্যাশ্যা করে প্রেমিক সারা জীবন তার সামনে বসে থাকুক, আর কথা বলুক, মায়ার অবস্থাও হলো তাই।
“তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?” রাণীকে জিজ্ঞেস করল বেলাল। তোমাদের দুর্গে আমার কোন একটা চাকুরী হলেই হলো। এ মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন একটা নিরাপদ আশ্রয়। একটা নিশ্চিন্ত ঠিকানা পেলে আমি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারতাম আমি ভুল পথে আছি কি-না?”
“আমি তোমাদের জন্য একটা কিছু করবো।” বলল রাণী।
তুমি কি আমার ওপর আস্থা রাখতে পারবে? জিজ্ঞেস করল মায়া। আমার মনে হয় আমাদের মধ্যে আর একবার দেখা হওয়া উচিত।”
“তুমি যেখানকার কথা বলবে, আমি সেখানেই চলে আসব।” বলল বেলাল। মায়ারাণী বেলালকে রাজা দাহিরের দুর্গের পার্শ্ববর্তী একটি জায়গার কথা বলল। আগামীকাল অমুক সময় তুমি সেখানে থাকবে, আমি তোমার কাছে আসব।” এই বলে মায়া চলে গেল। “বেলাল মায়ার কাছ থেকে বিদায় হয়ে একটি উঁচু টিলার ওপর তার চার সঙ্গীর কাছে চলে গেল। বেলাল সঙ্গীদের কাছে গিয়ে বলল, রাজা দাহিরের কাছে পৌছানোর জন্যে ক’দিন যাবত যে চেষ্টা করছিলাম, ঘটনাক্রমে আজ সে ব্যবস্থা আল্লাহ করে দিয়েছেন। বেলালের জন্য এভাবে মায়ার মুখোমুখি হওয়া যদিও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তবুও ঝুঁকি নিয়েছিল বেলাল। কিন্তু মায়ারাণী তার কথায় এতোটা প্রভাবিত হয়ে যাবে তা ছিল আশাতীত।
সিন্ধু অঞ্চলে দেশ ত্যাগী পাচ আরব মুসলমানের উপস্থিতি কোন আশ্চর্য ঘটনা ছিল না। কারণ মুহাম্মদ বিন কাসিমের জন্মের বহু পূর্বেই আরবের বহু মুসলমান ভারত ভূখণ্ডে পৌঁছে গিয়েছিলেন। অনেকেই ভারতের ভুখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সর্বপ্রথম মুসলমানরা মালাবার অঞ্চলে আসেন। অবশ্য ইসলামের আগে থেকেই আরব বণিকদের এ অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ছিল। যেসব মুসলমান মালাবার অঞ্চলে এসেছিলেন, তারা ছিলেন মূলত নৌচালক ও বণিক। মুসলমানরা এখানে আসার সময় ভারতে বৌদ্ধ, হিন্দু, খৃস্টান ও ইহুদি এই চার ধর্মের অস্তিত্ব ছিল। অবশ্য অধিকাংশ মানুষ ছিল পৌত্তলিক ধর্মে বিশ্বাসী হিন্দু।
ইতিহাস সাক্ষী দেয় রাসূল সাঃ-এর জীবদ্দশায়ই ইসলাম ভারতের মালাবার অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিল। হেরা গুহার অন্ধকারে যে আলোক রশ্মি উদিত হয়েছিল, তা আরব বণিকদের মাধ্যমে উপমহাদেশের মালাবার অঞ্চলে রাসূলে আরাবী সাঃ-এর জীবদ্দশাতেই পৌঁছে গিয়েছিল। আরব বণিকদের হাতে বহু ভারতীয় ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন।
মালাবারের অদূরেই ছিল সরন্দ্বীপ যা বর্তমানে শ্রীলঙ্কা নামে পরিচিত। মুসলমান বণিকরা যখন জাহাজে করে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এ অঞ্চলে আসতো, তারা শুধু পণ্যই নিয়ে আসত না, সাথে নিয়ে আসত ইসলামের পবিত্র আলো। মুসলমান বণিকদের সাথে যখন শ্রীলংকা ও মালাবারের লোকদের সখ্যতা গড়ে উঠলো, তখন তারা মুসলমানদের উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সততায় আকৃষ্ট হলো। পরে যখন তারা ইসলামের তাবলীগ শুরু করলেন, তখন তাদের উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সততায় মুগ্ধ হয়ে বহু লোক ইসলামে দীক্ষা নিল।
ভারতের লোকজন যখন দেখল ইসলামে কোন রাজা প্রজার বিভেদ নেই, মানুষ হিসাবে সবাই সমান। সবাই এক আল্লাহর বান্দা। আরব মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে তৎকালীন শ্রীলঙ্কার উপকূল ও মালাবারের রাজাও ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। এমন কি মালাবারের রাজা যামুরান ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর রাসূল সাঃ-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য হিজাযে রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু আরব উপকূলে সামুদ্রিক ঝড়ে জাহাজ ডুবে তার মৃত্যু ঘটে। মৃত যামুরানকে ইয়েমেনের তীরে দাফন করা হয়।
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর খেলাফতের সময় সেনাপতি উসমান বিন আবু আস বোম্বাই এর নিকটবর্তী থানা বন্দর আক্রমণ করেছিলেন। তার আক্রমণের
উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশে যেসব আরব বণিকের জাহাজ যাতায়াত করে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি বন্দর কব্জায় রাখা।
এটিই ছিল ভারতে মুসলমানদের প্রথম অভিযান। অভিযান সফল হয়। কিন্তু এ অভিযানে আমীরুল মুমেনীনের অনুমোদন ছিল না বলে বন্দরের কব্জা বহাল রাখা হয়নি। ঐতিহাসিক বালাযুরী লিখেছেন-সেনাপতি উসমান বিন আবু আস যখন মালে গনীমতের অংশ মদিনায় প্রেরণ করেন তখন ভারত অভিযানের সংবাদে হযরত ওমর সেনাপতি বরাবর অনুমতি ছাড়া অভিযান পরিচালনার জন্যে কঠোর পয়গাম পাঠান।
হযরত ওমর লিখেন— “ভাই উসমান! তোমার এ অভিযান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তুমি যে পরিমাণ সৈন্যবল নিয়ে অভিযান পরিচালনা করলে, এরা তো একটি কীটের চেয়ে বেশী ছিল না, যে কীটকে তুমি একটি কাষ্ঠখণ্ডে বসিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিলে। তুমি এতোদূরে গিয়ে অভিযান পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে যদি বিপদে ফেঁসে যেতে, তাহলে আমার পক্ষে তোমাকে কোন সহযোগিতা করার উপায় ছিল না। আর যদি সেখানে সৈন্য ক্ষয় করে আসতে, তাহলে আল্লাহর কসম! আমি তোমার কবিলা থেকে এতো সংখ্যক লোক সেনাবাহিনীতে নিয়ে নিতাম।” এর কিছুদিন পর আমীরুল মুমিনীনের অনুমতিক্রমে উসমান বিন আবু আস সিন্ধু অঞ্চলে আরেকটি অভিযান পরিচালনা করেন। সেই অভিযানে তিনি তার সেনাবাহিনীকে দু’ভাগে ভাগ করেন। এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন সেনাপতি উসমান নিজে, আর অপর অংশের নেতৃত্ব তার ভাই মুগীরাকে দেন। উসমানের এ বাহিনী সামুদ্রিক জাহাজে করে ডাভেল অঞ্চলের সমুদ্র উপকুলে অভিযান চালায়।
সে সময় ডাভেলের রাজা ছিল চচন্দ। ডাভেলে সামা নামের এক বীর পুরুষ ছিল রাজা চন্দ এর সেনাপতি। সে দুর্গের বাইরে সেনাবাহিনীকে নিয়ে এসে মুগীরার বিপরীতে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবুও মুগীরা শত্রু পক্ষের পেটে ঢুকে সামাকে হুমকি দিলেন। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের সেনাপতিদ্বয় মুখোমুখি হয়ে গেল। মুগীরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তকবীর দিয়ে সামার ওপর হামলে পড়লেন। সামা আহত হলো, কিন্তু সে প্রতিপক্ষকে এমন আঘাত করল যে, মুগীরার পক্ষে সেই আঘাত সামলানো সম্ভব হলো না। মারাত্মক আহতাবস্থায় শাহাদাত বরণ করলেন মুগীরা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু।
অবশেষে বিজয়ী হলো মুসলিম বাহিনী। কিন্তু সেই বিজয়ে মূল্য দিতে হয়েছিল খুব বেশী। শেষ পর্যন্ত নানা কারণে সেখানে আর মুসলমানরা কব্জা বহাল রাখেনি। এ ঘটনার ছয় বছর পর সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন আমের বিন রবিয়া ইরান জয় করেন। ইরান জয়ের পর তিনি সিস্তান আক্রমণ করেন। সিস্তানের শাসক মিরখান হাতিয়ার ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করেন। সিস্তান দখল হওয়ার পর সেনাপতি আব্দুল্লাহ সেনাপতি তামিম তাগলিবীকে মাকরান অভিযানে প্রেরণ করেন। তখন মাকরানের শাসক ছিল রাজা রাসেল। রাসেল সিন্ধের রাজা চচন্দের সাহায্য প্রার্থনা করলে চচন্দ রাসেলের সাহায্যে বিরাট সেনাবাহিনী পাঠালো। উভয় সেনাবাহিনী একত্রিত হলে মুসলিম বাহিনীর বিপরীতে হিন্দুদের সৈন্য সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেল, তবুও মুসলমানরাই বিজয়ী হলেন। মাকরান মুসলমানদের কব্জায় নীত হলো।
অবশ্য এর আগেও একবার হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর খেলাফত কালে ইরাকের শাসক আবু মূসা আশআরী রবিয়া বিন যিয়াদ নামের একজন সেনাপতিকে মাকরান অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন মাকরান তাঁদের অধীনে এসেছিল। কিন্তু বিজয়ের পর মুসলিম সেনাবাহিনীকে কব্জা ত্যাগ করে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
সেই অভিযানে অর্জিত মালে গনীমতের অংশ ভিন্ন করে বাইতুল মাল মদিনায় প্রেরণ করলে সরকারী অংশ মদিনায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল অভিজ্ঞ সেনানায়ক শিহাব আবদীকে।
বাইতুল মালের অংশ নিয়ে আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমরের কাছে সমর্পণ করলে তিনি বললেন
“আল্লাহ তাআলা তোমাদের বিজয়কে মোবারক করুন।” তোমাদের ওপর আল্লাহ্ তাআলা রহম করুন। আচ্ছা শিহাব! আমাকে বলো তো মাকরানের অবস্থান কিরূপ? ওখানকার ভৌগোলিক অবস্থা কেমন?”
“আমীরুল মুমিনীন! বলল শিহাব। মাকরানের জমিন খুবই শুষ্ক। সেখানে কোন ফল ফুল জন্মে না। দু’চারটি ফলজ বৃক্ষে যা ফল পাওয়া যায়, সেগুলো খাওয়ার অযোগ্য। ওখানকার অধিবাসীরা লুটতরাজে অভ্যস্ত। একজন অপরজনকে লুট করেই এরা জীবিকা নির্বাহ করে। এরা বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই অপরজনকে খুন করে। আমরা যদি সেখানে অল্পসংখ্যক সেনাবাহিনী মোতায়েন করি, তাহলে তাদের ওরা লুটতরাজ করে নিঃশেষ
করে দেবে, আর যদি বেশী পরিমাণে সৈন্য মোতায়েন করা হয়, তাহলে খাদ্যাভাবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
“আল্লাহ্ তোমার ওপর রহম করুন।” শিহাব আবদীর কথার প্রেক্ষিতে বললেন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। তুমি তো কাব্য করছ, ওখানকার প্রকৃত অবস্থা আমাকে বলো।”
“আমীরুল মুমিনীন! আমি যা দেখেছি, হুবহু তাই আপনার কাছে ব্যক্ত করলাম। আল্লাহর কসম! আমি কেন; যেই সেখানে যাবে সে একথাই বলবে। সত্যকে ও বাস্তবতাকে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না আমীরুল মুমিনীন!”
“না, শিহাব আবদী। তোমার ধারণা ঠিক নয়।” বললেন ওমর। ইসলামের সৈনিকদেরকে ক্ষুৎপিপাসা কখনো মেরে ফেলতে পারে না। কায়সার ও কিসরাকে অস্ত্রসমর্পণে বাধ্যকারী মুজাহিদদের বেলায় একথা বলা যায় না যে, তারা ঘুমিয়ে থাকবে আর ডাকাতেরা সহায় সম্পদ লুটে নিয়ে যাবে। তাদের বেলায় একথাও বলা হবে অপমানকর যে, তারা ক্ষুধা পিপাসায় ধুকে ধুকে মারা যাবে।”
একথা বলার পর আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমাকরান থেকে মুসলিম সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। অতঃপর মাকানের কিছু অংশ কব্জায় রেখে বাকী অংশ ত্যাগ করে মুসলিম বাহিনী সেখান থেকে ফিরে আসে।
মহাভারতে মুসলমানদের অভিযান শুধু মাকরানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ওমর ফারুকের শাহাদাতের পর হযরত উসমানের সময়ও মহাভারতের পশ্চিমাঞ্চলে মুসলমানদের বিজয়াভিযান অব্যাহত ছিল। হযরত উসমানের শাহাদাতের পর হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর খেলাফত কালেও যথারীতি তা অব্যাহত থাকে। তখন মুসলমানরা কিলাত পর্যন্ত অগ্রাভিযান চালিয়েছিলেন। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর শাহাদাতের পর খেলাফত বনী উমাইয়াদের হাতে চলে যায়। বনী উমাইয়ার শাসনামলেও মহাভারতের পশ্চিমাঞ্চল মুসলমানদের শাসনাধীনে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ইসলামের কেন্দ্রভূমিতেই দেখা দেয় গোযোগ। ক্ষমতার লোভ খেলাফতের মধ্যে সৃষ্টি করে অস্থিরতা। সত্য আর মিথ্যা, হক ও বাতিলের মধ্যে অনিবার্য হয়ে ওঠে সংঘাত। যারা ছিলেন হক এর পক্ষে তাদের বলা হয় বিদ্রোহী। এতে করে খেলাফত দু’ভাগে বিভক্ত
হয়ে পড়ে। দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় বিজয়ী সেনাবাহিনী। জুলুম ও অত্যাচারের যুগ শুরু হয়ে যায়। শাসকদের মধ্যে জুলুম অত্যাচারে সবচেয়ে বেশী খ্যাতি লাভ করেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। ক্ষমতালোভীরা ইসলামের পতাকা ও তাকবীরকে দ্বীনের পরিবর্তে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
উমাইয়া শাসক আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের শাসনামলে তিনি কঠোর হস্তে সকল ধরনের বিদ্রোহ দমন করেন এবং উমাইয়া শাসনকে পাকাপোক্ত করেন। সেই বিদ্রোহের সময় অন্তত পাঁচশ প্রথম শ্রেণির যোদ্ধা আরবভূমি ত্যাগ করে মহাভারতের এক অংশের পৌত্তলিক শাসক রাজা দাহিরের আশ্রয় গ্রহণ করে। রাজা দাহির দেশত্যাগী এসব মুসলমানদেরকে মাকরান অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেয়। দাহিরের আশ্রয় প্রার্থীদের অধিকাংশই ছিলেন আলাফী বংশের। এ গোত্র যুদ্ধবাজ হিসাবে ছিল বিখ্যাত। বিলাল বিন উসমানও বিদ্রোহজনিত কারণে চারজন সঙ্গী নিয়ে দাহিরের কাছে আশ্রয়ের আশায় ভারতের মাটিতে পৌছে। কিন্তু এলাকা অপরিচিত থাকা এবং রাজা পর্যন্ত পৌঁছানোর কোন মাধ্যম না পাওয়ার কারণে তারা ঠিকানাহীন ঘুরে ফিরছিল। বিলাল এ কথাও জানতো যে, বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিয়ে রাজা দাহির খেলাফতের সাথে শত্রুতা তৈরী করেছে। তাছাড়া দাহিরের পিতা মাকরান অভিযানে মুলমানদের প্রতিপক্ষ রাজা চন্দকে সামরিক সহযোগিতা করাও ছিল শত্রুতার অন্য কারণ। এজন্য বেলাল ভয় করছিল রাজা দাহির তাদের গ্রেফতার করে কয়েদখানায় বন্দি করতে পারে।
দুর্গ থেকে কিছুটা দূরের একটি জায়গায় পরদিন মায়ারাণী বেলালকে সাক্ষাত করতে বলেছিল। পরদিন বেলাল যখন মায়ারাণীর সাথে সাক্ষাত করতে যাবে, তখন তার সঙ্গীরা তাকে বাধা দিলো। রাতে এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিস্তর কথাবার্তা হলো। বেলালের সঙ্গীরা তাকে বুঝাতে চেষ্টা করল, মায়া তোমাকে ধোকা দিতে পারে, তোমাকে গ্রেফতার করতে পারে। বেলালের মনেও এ আশঙ্কা ছিল। কারণ মায়া তাকে বলেছিল, তোমাকে আমার গোয়েন্দা মনে হয়। বেলাল সাথীদের এ কথা বলার পর সাথীরা তাকে মায়ারাণীর সাথে সাক্ষাত করার ব্যাপারে জোরালো বাঁধা দেয়। কিন্তু বেলালের মনে দৃঢ় আস্থা জন্মে মায়া তাকে গ্রেফতার করবে না, তার সাথে প্রতারণা করবে না।
“তোমরা কি করবে? সবাইকে আমার সাথে দেখলে মায়া আমার সাথে সাক্ষাত করবে না। তা ছাড়া ওর মনে যদি কোন দূরভিসন্ধি থাকে তাহলে একসাথে গেলে সবারই গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরচেয়ে বরং এটাই ভালো হবে, তোমরা এখানে থাকো, আমাকে ঝুঁকি নিতে দাও। তাতে গ্রেফতার হলে আমি একাই হবো। যদি সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি ফিরে না আসি, তাহলে বুঝবে আমি কোন বিপদে পড়ে গেছি, তোমরা তখন এখান থেকে পালিয়ে যাবে।” বেলালের পরামর্শ সঙ্গীরা মানতে পারল না। শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নিলো সবাই যাবে। তবে বেলাল যাবে অশ্বারোহণ করে, যাতে কোন বিপদের আশঙ্কা দেখলে পালাতে পারে। আর তার সাথীরা বেলাল ও মায়ার সাক্ষাত স্থল থেকে দূরে লুকিয়ে থাকবে। কোন বিপদ দেখলে তারা বেলালের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। নিজের ঘোড়ায় আরোহণ করে হাতে বর্শা নিয়ে রওয়ানা হলো বেলাল। মায়ারাণী যে জায়গায় তাকে সাক্ষাত করতে বলেছিল, জায়গাটি তাদের অবস্থান স্থল থেকে দুই আড়াই মাইল দূরে। কিভাবে যাবে কখন যাবে সবই মায়া বেলালকে বলে দিয়েছিল।
টিলা, পাহাড়ী উপত্যকা ও গিরিখাদ পেরিয়ে বেলাল যখন ভোলা জায়গায় পৌছলো, তখন বেলালের চোখে পড়লো ঘন সবুজ একটি ময়দান। ঘন উঁচু ঘাসে ভরা জায়গাটি, মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়। মাঝে মধ্যে কিছু গাছও রয়েছে। গাছগুলো খুবই তরতাজা, সবুজ পত্রপল্লব ও ফলফুলে ভরা। বেলাল এই ঘন ঘাসপূর্ণ মাঠ পেরিয়ে যখন সামনে অগ্রসর হলো, তখন দেখতে পেল একজন অশ্বারোহী দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে এদিকে আসছে। কালো বর্ণের ঘোড়াটিকে দূর থেকে দেখেই বোঝা যায় শাহী আস্তাবলের বিশেষ ঘোড়া সেটি।
দূর থেকেই বেলালের বুঝতে অসুবিধা হলো না, অশ্বারোহী কোন পুরুষ নয়, নারী। কিন্তু বেলাল সেদিকে ভ্রক্ষেপ করল না। বেলাল পাকা যোদ্ধা। মায়ারাণীর দেহ সৌন্দর্যে নিজেকে মোটেও আকৃষ্ট করেনি বেলাল। সে জানে নারী সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে হিন্দুস্তানের হিন্দুরা নারীকে শত্রুদের ঘায়েল করতে ব্যবহার করে এ ব্যাপারটি সে পূর্বেই অবগত ছিল। সে তার ঘোড়াকে চাবুক দিয়ে আঘাত করলো, উড়ে চললো ঘোড়া। কিন্তু মায়ার দিকে
নয়। মায়া যে জায়গার কথা বলেছিল বেলাল চললো সেদিকে। রাণী পৌছার আগেই নির্দিষ্ট জায়গায় বেলাল পৌছে গেল। জায়গাটি খুবই সুন্দর। চতুর্দিকে ছোট বড় গাছপালা। থোকা থোকা লতাগুল্মে জংলী ফুলের সমারোহ। বিশাল ময়দানের মাঝখানে একটি ছোট ঝিলের মতো। স্বচ্ছ স্ফটিক পানির মধ্যে শাপলা, পদ্মফুল ফুটে একটা মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। গাছে গাছে অসংখ্য নাম না জানা পাখির কলকাকলী। অসংখ্য ঝোপ ঝাড়ের পিছনে দু’দশজন মানুষ লুকিয়ে থাকা কোন ব্যাপারই নয়। বেলাল ঘোড়া দৌড়িয়ে পুরো এলাকাটি একটু দেখে নিল। সে বুঝতে চাইলো রাণীর কোন লোক কোথাও লুকিয়ে রয়েছে কি-না। কিন্তু অশ্বশুরের শব্দে পাক পাখালীর ছুটাছুটি ছাড়া কোথাও কোন জনমানুষের চিহ্ন সে খুঁজে পেল না। গোটা এলাকাটি পর্যবেক্ষণ শেষ করে বেলাল ঝিলের পাড়ে পৌছলে মায়ারাণীকেও আসতে দেখা গেল। মায়া বেলালকে দেখেই এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে বেলালের প্রতি একটা মুচকি হাসি দিল। বেলালও ঘোড়া থেকে নেমে ধীরে ধীরে নির্মোহভাবেই মায়ার দিকে অগ্রসর হলো।
বেলাল কাছে পৌছলেই হঠাৎ করে মায়া বেলালের একটি হাত তার দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু দিল এবং বেলালের হাতটি তার কাঁধে নিয়ে বেলালের শরীরের সাথে নিজের শরীর মিশিয়ে দিল। বেলালের পাঁজর তার পাঁজরকে স্পর্শ করছে। বেলাল নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে মায়ার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল। নিজেকে সরিয়ে নিলে কেন? আমাকে কি তোমার ভালো লাগেনি?” বেলালকে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল মায়া। তুমি কি আমাকে এদেশের রাণী ভেবে ভয় পাচ্ছ? না, কোন ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আমি ভালো করেই বুঝতে পেরেছি, তুমি আরবের কোন বেদুঈন নও, তুমি কোন না কোন বাহাদুর সর্দারের ছেলে। আমি জানি, আরব দেশ থেকে পালিয়ে যারা এসেছে তারা সাধারণ নাগরিক নয়, সবাই ওখানকার নেতৃস্থানীয় লোক, নয়ত নেতৃস্থানীয় লোকজনের সন্তান। তুমি তাদের মতোই একজন।” “আমি তোমাকে ভয় পাচ্ছি না রাণী। আমি এটা দেখে অবাক হচ্ছি যে, তুমি এদেশের রাণী হয়েও একাকী দুর্গের বাইরে এতোদূর এসেছে? না-কি তোমার দেহরক্ষীরা তোমার পিছনে পিছনে আসছে?”
“না, এখানে আমার কোন দেহরক্ষী আসবে না। আমি অন্য দশজন রাণীর মতো নই। অন্যসব রাণী তো প্রজাদের মধ্যে সমীহ সৃষ্টি করার জন্য বিশাল নিরাপত্তা প্রহরী বেষ্টিত হয়ে প্রাসাদের বাইরে বের হয়।”
“রাজা একাকী তোমাকে দুর্গের বাইরে বের হতে বাধা দেয়নি?”
“না। তুমি জেনে আশ্চার্যান্বিত হবে যে, মহা ভারতের কোন রাণী সাধারণত দুর্গের বাইরে যায় না, কিন্তু আমার ব্যাপারটি ভিন্ন।”
“এটা আবার কেমন ব্যাপার?”
“এটা পরে বলব। আমি আগে বুঝতে চাই, তোমার হৃদয়ে আমার প্রতি কোন ভালোবাসার উদ্রেক হয়েছে কি-না। তোমার প্রতি ভালোবাসা-ই আমাকে একাকী এখানে টেনে এনেছে। আচ্ছা! তুমি কি আমাকে ভালোবাসার যোগ্য মনে করো না?”
“অবশ্যই যোগ্য মনে করি। কিন্তু সেই সাথে আরো অনেক কিছুই মনে করছি আমি। আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার জন্য একটি মায়াবী ফাদ তৈরী করছ!”
“আমি জানতাম, আরবের লোকেরা না-কি আমাদের দেশের লোকদের চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী হয়। কিন্তু তোমার মধ্যে তো কোন বুদ্ধি বিবেক দেখছি না। তুমি এটা কি করে ভাবতে পারলে যে, আমাদের সেনাবাহিনী তোমাদের মতো পাঁচজন ভবঘুরেকে গ্রেফতার করতেও অক্ষম। তোমাকে যদি গ্রেফতার করারই ইচ্ছা থাকত, তাহলে রাতে কয়েকজন সেনা পাঠিয়ে দিলেই তো তোমাদের ধরে নিয়ে যেতে পারত।”
“তুমি আমার মধ্যে ভালোবাসার কি দেখলে রাণী?” এদেশে কি আমার চেয়ে কোন ভালো মানুষ তুমি পাওনি?”
“বেলাল। আমি এদেশের রাণী। এটা তো খুবই সম্ভব যে, তোমার চেয়েও আরো সুশ্রী সুন্দর টগবগে যুবক আমাকে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। কিন্তু ভালোবাসার কথা মুখে উচ্চারণ করার দুঃসাহস পাচ্ছে না। কারণ দেশের রাণীকে সাধারণ প্রজারা দেবীতুল্য মনে করে। রাণীকে সাধারণ প্রজারা পূজা করে…। কিন্তু তোমার সৌভাগ্য বেলাল! এদেশের রাণী আজ তোমার মতো এক অজ্ঞাত বিদেশী যুবকের কাছে প্রেম নিবেদন করছে, ভালোবাসার ভিখারী সেজে একটু মমতা ভিক্ষা করছে। বেলাল! আমার দৃঢ় বিশ্বাস পূর্বজন্মে অবশ্যই আমরা একসাথে ছিলাম।”
“মৃত্যুর পর মানুষ আবার দুনিয়ায় পুনর্জন্ম লাভ করে, এ বিশ্বাস আমার ধর্মে নেই।”
“ভালোবাসার মধ্যে ধর্ম বিশ্বাস টেনে এনে দেয়াল সৃষ্টি করোনা বেলাল। একটু সময় আমার পাশে বসো, আমার হৃদয় ভেঙে দিয়ে তুমি চলে যেয়ো না।”
“নিজের একান্ত পাশে বেলালকে বসালো রাণী। বেলাল ছিল একজন সুদর্শন সাহসী যোদ্ধা। প্রখর মেধাবী ও তীক্ষবুদ্ধি সম্পন্ন সুদর্শন যুবক। হিন্দুস্তানের যে কোন রাণীই এই যুবককে দেখলে আকৃষ্ট হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য মায়ারাণীও ছিল রূপবতী, সুন্দরী। যে কোন যুবকের পক্ষে মায়ার রূপ লাবণ্য ও সৌন্দর্য এড়িয়ে যাওয়ার মতো ছিল না। তাছাড়া মায়ার তীক্ষ্ণ ধী, প্রখর দৃষ্টি ও বাচনভঙ্গী যে কোন সুপুরুষকেই মায়ার বাঁধনে জড়ানোর জন্য যথেষ্ট। যে কোন যুবককেই প্রেমের বাঁধনে নিজের গোলামে পরিণত করার মতো গুণের অধিকারী ছিল মায়া।
দীর্ঘ সময় একান্তে কাটিয়ে বেলাল ও রাণী যখন সবুজ শ্যামল নৈসর্গিক বেলাভূমি থেকে বেরিয়ে এলো, তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। জঙ্গলের বৃক্ষগুলো বিকেলের আলোয় দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে। বেলালের সঙ্গীরা দরের একটি উঁচু জায়গায় বসে এদিকে দৃষ্টি রাখছিল। তারা ভাবছিল অবশ্যই দুর্গ থেকে সেনাবাহিনী এসে জায়গাটিকে ঘিরে ফেলবে এবং বেলালকে ধরে হত্যা করবে নয়তো গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে গেলেও এমন কোন দৃশ্য তাদের চোখে পড়ল না। অনেকক্ষণ পর বেলাল যখন তার সঙ্গীদের কাছে এলো তখন সে নেশাগ্রস্তের মতো। সে এসে সঙ্গীদের সাথে এমনভাবে কথা বলছিল, দেখে তাকে নেশাগ্রস্তের মতো মনে হচ্ছিল। তার সঙ্গীরা তাকে যা জিজ্ঞেস করছিল সে জবাব দিচ্ছিল তার উল্টো। সে শুধু রাণীর প্রশংসা করছিল। সঙ্গীরা ওকে গালমন্দ করার পর চৈতন্যোদয় হলো।
“আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সবার জন্যই ঠিকানার ব্যবস্থা করতে পারবো।” বলল বেলাল। রাণী আমাদেরকে মর্যাদার সাথেই তার দুর্গে রাখবে। আগামীকাল আবার আসবে রাণী।
পরদিন আগের জায়গায় আবার রাণীর সাথে দেখা করতে গেল বেলাল। রাণী ও বেলাল পাশাপাশি এভাবে বসল যে, একজন অপরজনের মধ্যে হারিয়ে যাবে। রাণী ও বেলাল বৃক্ষশাখায় লীলারত কপোত কপোতির মতো একজন অপরজনের প্রেমে হারিয়ে যাচ্ছিল। “এখনও কি তুমি আমাকে সন্দেহ কর?” বেলালকে জিজ্ঞেস করল রাণী। নিজের বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করো, এখনও কি তোমার মনে হয় আমি তোমাকে ধরিয়ে দেব?”
“এ সন্দেহ এখন আর আমার নেই। তবে আমি এ প্রশ্নের কোন জবাব পাচ্ছি না। তুমি এভাবে আমার সাথে প্রেম করে তোমার স্বামীকে কেন ধোকা দিচ্ছ? কেন তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করছ?” সে এতো বিশাল রাজ্যের রাজা। তাছাড়া যতটুকু শুনেছি, সে একজন সুস্থ সবল মানুষ। দেখতেও বিশ্রী নয়। বয়স্কও নয়। তারপরও তুমি তাকে ভালোবাসার অযোগ্য মনে করছ কেন?”
“তাকে আমি ভালোবাসি না একথা ঠিক নয়। এতোটাই আমি তাকে ভালোবাসি যে, তার জন্য আমি আমার জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। তার শরীরে একটা কাঁটা বিদ্ধ হোক তাও আমি সহ্য করতে পারি না” বলে নীরব হয়ে গেল রাণী। দীর্ঘক্ষণ নীরব থেকে রাণী বেলালের উদ্দেশ্যে বলল, তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না বেলাল। আমি তোমাকে এমন কথা শোনাব যা কখনো তুমি শোননি।
“বেলাল! রাজা দাহির আমার স্বামী বটে; কিন্তু আমি তার সহোদর বোন।” একথা শুনে আঁৎকে উঠলো বেলাল। “বলল কি? এমনটি কি করে সম্ভব?”
“তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো, আমি যা বলছি তাই সত্য। আমি রাজা দাহিরের সহোদর বোন, তবুও সে আমার স্বামী। অন্য দশটি হিন্দু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা যেভাবে হয়ে থাকে সে ধরনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়েই আমাদের বিয়ে হয়েছে। মন্দিরের বড় পণ্ডিতই আমাদের বিয়ের মন্ত্র পড়িয়েছে। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বামী স্ত্রী কিন্তু শারীরিকভাবে ভাই-বোন। আমাদের কোন সন্তান হবে না। রাজা দাহির নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে আমাকেও জীবন্ত তার চিতায় মৃত্যুবরণ করতে হবে।” “এ বিয়ে কিভাবে সম্ভব হলো?” জিজ্ঞেস করল বেলাল। কেন তোমাদেরকে এমন বিয়ে করতে হলো?”
“তাহলে শোন বলছি, বলে মায়ারাণী রাজা দাহিরের সাথে তার বিয়ের কারণ সবিস্তারে জানাল।
মায়া বেলালকে বিয়ের যে কাহিনী শোনালো তা ভারতের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। পুরনো ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে এই বিয়ের সত্যতা পাওয়া যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দাহির সিন্ধু অঞ্চলে রাজা হওয়ার পর সারা দেশের প্রজাদের অবস্থা ঘুরে ঘুরে দেখে। সেই সাথে নিজ দেশের সীমান্ত এলাকা সম্পর্কেও সে প্রত্যক্ষ ধারণা লাভ করে। কয়েক
মাসের পর্যবেক্ষণ শেষে রাজা দাহির যখন রাজধানী আরুরে ফিরে এলো তখন রাজধানীর প্রজারা তার গমন পথে ফুল বিছিয়ে দিলো এবং তার ওপর ছিটিয়ে দিলো ফুলের পাপড়ী। রাস্তার দু’পাশে নারী পুরুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রাজাকে রাজধানীতে স্বাগত জানাল।
রাজা দাহির রাজধানীবাসীর আনুগত্যে মুগ্ধ হয়ে সেদিনই বিকেলে রাজপ্রাসাদে সাধারণ সভা আহবান করল। তাতে রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় নাগরিকদেরকে পুরস্কারে ভূষিত করল এবং অভ্যাগত সবাইকে ভূরিভোজনে আপ্যায়িত করল। সভা ভেঙ্গে যাওয়ার পর শহরের বড় দুই পণ্ডিত তার কাছে গিয়ে তার খুবই প্রশংসা করল এবং রাজাকে দেবতার আসনে সমাসীন করল।
“আমরা মহারাজ ও মহারাজের বোন মায়াদেবীর ভাগ্য গণনা করিয়েছিজ্যোতিষীদের হয়ে বলল এক ঋষি। মহারাজের ভবিষ্যত আমরা যা দেখেছি তাতে কোন অসুবিধা নেই, সব ঠিকই আছে তবে একটু…। মায়ার ভাগ্য গণনা করতে গিয়ে আমরা পেয়েছি, যে ব্যক্তির সাথে মায়ার বিয়ে হবে সেই সিন্ধু অঞ্চলের রাজা হবে।”
“নিশ্চয়ই তা হবে আমার মৃত্যুর পর?” জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল রাজা দাহির।
“না, মহারাজ! এবার এগিয়ে এসে বলল জ্যোতিষী। মহারাজের জীবদ্দশাতেই সে রাজা হবে।”
“কে হবে সেই রাজা? কোথেকে আসবে সে?” জিজ্ঞেস করল দাহির।
“এ বিষয়টি অস্পষ্ট মহারাজ! বলল জ্যোতিষী। ভাগ্য যেক্ষেত্রে অস্পষ্ট থাকে, সেক্ষেত্রে জ্যোতিষী ও গণকরাও অক্ষম। তারাও কিছু বলতে পারে না।”
“অবশ্য এটা পরিষ্কার বোঝা যায় মহারাজ, মায়ার স্বামী বাইরে থেকে আসবে না, সে হবে স্থানীয়।” বলল অপর এক গণক। “এমন তো নয়, যে আমার বোনের স্বামী হবে সেই আমাকে হত্যা করবে?” জানতে চাইলো রাজা।
“এ ব্যাপারটিও পরিষ্কার নয় মহারাজ! বলল প্রধান গণক। এটা পরিষ্কার যে-ই হবে মায়ার স্বামী সেই হবে সিন্ধু অঞ্চলের রাজা।” “আমরা এটা কর্তব্য মনে করেছি মহারাজ। মহারাজের যে কোন সমস্যা। সংকট সম্পর্কে আগে ভাগেই আপনাকে অবগত করান।” বলল প্রধান ঋষি। যাতে মহারাজ বিপদ আসার আগেই প্রতিকার ব্যবস্থা নিতে পারেন।”
রাজা দাহির পণ্ডিত ও গণকদের পেট থেকে একথা বের করার সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করল, বোনের বিয়ের পর তার ভাগ্যে কি ঘটবে। কিন্তু পণ্ডিত ও গণকরা এ ব্যাপারে তাকে স্পষ্ট কিছুই বলল না। পূর্বে দেয়া বক্তব্যের বাইরে আর কোন কথাই বলল না পণ্ডিত ও গণকদল। রাজা দাহির পণ্ডিত ও গণকদের কথা শতভাগ সত্য বলে বিশ্বাস করত। তাই চিন্তায় পড়ে গেল রাজা। রাজা দাহির ছিল কট্টর ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান। গণক ও পণ্ডিতদের কথার বাইরে কোনকিছু চিন্তা তার দেমাগে মোটেও প্রবেশ করেনি।”
রাজাকে চিন্তার সাগরে ভাসিয়ে বিদায় নিল পণ্ডিত ও গণকদল। পণ্ডিত ও গণকদল চলে যাওয়ার সাথে সাথে রাজার স্বস্তি ও সুখ বিদায় নিল। আকাশ পাতাল চিন্তা করে রাতে একরতিও ঘুমাতে পারল না রাজা। অগত্যায় সে তলব করল তার প্রধান উজির বুদ্ধিমানকে। “প্রধান উজির শুধু নামেই বুদ্ধিমান ছিল না। তার জ্ঞান বুদ্ধির ওপর রাজা দাহিরের ছিল অগাধ আস্থা। প্রকৃত পক্ষেও যে কোন উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে বুদ্ধিমানের কোন জুড়ি ছিল না। রাজার নির্দেশ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলো উজির। রাজার শয়নকক্ষে প্রবেশ করে নমস্কার ও কর্নিশ করে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বলল, এতো রাতে কেন অধমকে তলব করেছেন মহারাজ?” রাজা দাহির উজির বুদ্ধিমানকে পণ্ডিত ও গণকদের সবকথা জানাল এবং বলল, “উজির! ব্যাপারটি তুমি গভীরভাবে চিন্তা করো তারপর আমাকে বলো, আমি কি করতে পারি?” অচিরেই আমার বোনের বিয়ে হচ্ছে। তাহলে কি আমি নিজে থেকেই এই রাজ্যপাট ভগ্নিপতিকে দিয়ে দেব? এতে অন্তত আমি বেঁচে থাকতে পারব—তাছাড়া আর কি করার আছে আমার?”
“মহারাজ! দেশের প্রজা, সেনাবাহিনী ও দেশের শাসনক্ষমতা থেকে স্বেচ্ছায় রাজার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মোটেও ঠিক হবে না। জগতের পাচটি জিনিস এমন রয়েছে যেগুলো পাঁচটি জিনিস থেকে বিচ্ছিন্ন হলে পরিণতি ভালো হয় না। রাজা রাজ্য ত্যাগ করলে, উজির উজারতি ছেড়ে দিলে, পীর মুরীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে, শিশু মায়ের কোল থেকে বিচ্ছিন্ন হলে, আর দাঁত মুখের পাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কোনটারই কোন মূল্য থাকে না।
আপনি একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন মহারাজ! আমি আপনাকে রাজ্যপাট ত্যাগ করার কথা কোন্ মুখে বলব!”
“আমি তোমার কাছে কোন ব্যাখ্যা চাচ্ছি না। আমি তোমার কাছে জানতে চাই এখন আমাকে কি করতে হবে?”
মহারাজ! এমনটিই আপনাকে করতে হবে যেমনটি কোনদিন কেউ করেনি।” বলল উজির। মায়াকেই আপনি বিয়ে করে নিন এবং তাকে রাণী করে ফেলুন। তবে বিয়ে হলেও তার সাথে আপনার ভাই-বোনের সম্পর্কই অক্ষুন্ন রাখতে হবে, নয়তো তা হবে মহাপাপ। এতে রাজত্বে কোন ঝুঁকি থাকবে না।
“বুদ্ধিমান! তোমাকে ধন্যবাদ। বড় দামী পরামর্শ দিয়েছ তুমি, বলল রাজা। এ ছাড়া আমার আর কোন পথ নেই। কিন্তু এতে যে লোকজন খুবই সমালোচনা করবে। মানুষ আমার বদনাম করবে এবং নানা কল্পকাহিনী তৈরী করবে।”
“মহারাজ। বদনাম ও লোকজনের সমালোচনার ব্যাপারটি বেশীদিন থাকবে না। কারণ কোন ব্যাপারেই লোকজনের আগ্রহ বেশীদিন থাকে না। কিছুদিন আগের ঘটনা। একলোক তার একটি ভেড়ার পশমের ওপর কিছু মাটি ঢেলে দিয়ে মাটিতে পানি ঢেলে ভিজিয়ে দিল। পানিতে ভিজে মাটি ভেড়ার গায়ে লেপ্টে যায়। মালিক এতে কিছু কলাই বীজ ছিটিয়ে দিয়ে পানি দিতে থাকে। কিছুদিন পর কলাই অংকুরোদগম হয়ে ভেড়ার গায়ে কলাই গাছ জন্ম নেয়। অতঃপর মালিক সেটিকে বাজারে নিয়ে গেলে ভেড়াটি দেখার জন্য লোকজনের ভীড় লেগে যায়। এ ভীড় থাকে কয়েকদিন। সপ্তাহান্তে দেখা গেল আর কেউ ভেড়া দেখার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এর সপ্তাহখানিক পর ভেড়ার পাশ দিয়ে হেটে গেলেও ভেড়ার দিকে কেউ তাকিয়েও দেখেনি…। মহারাজকেও এ বিষয়টি বুঝতে হবে যে, মানুষ কিছু দিন এ নিয়ে কানাঘুষা করবে ঠিক, তবে তা বেশী দিন নয়। তাছাড়া মহারাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা করার দুঃসাহস কার আছে?”
রাজা দাহিরের মাথায় ক্ষমতার মোহ চেপে বসল। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য উজির বুদ্ধিমানের দেয়া পরামর্শেই আপন বোনকে বিয়ে করল রাজা। অবশ্য বিয়ের আগেই উজির বুদ্ধিমানকে বলল, রাজার কাজকর্ম দেশের প্রজারা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে এবং সেটি নীতিতে পরিণত হয়। রাজা দাহির ছিল প্রজা বৎসল। এ কারণে সে দেশের নেতৃস্থানীয় পাঁচশ প্রজাকে রাজপ্রাসাদে দাওয়াত করে এনে গণকদের গণনা ও উজিরের পরামর্শ সম্পর্কে
জানিয়ে তাদের মতামত চাইল। হঠাৎ এক কোণ থেকে মৃদু কণ্ঠে শোনা গেল, “না মহারাজ! এমনটি হতে পারে না।” এরপর অপর একজন, তারপর আরো কয়েকজন রাজার এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলে শুরু হয়ে গেল তুমুল প্রতিবাদ। সবাই একবাক্যে এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মুখরিত হয়ে উঠল।
“শোন! তোমরা সমর্থন না করলেও আমি মায়াকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।” গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করল রাজা। তোমরা কি চাও, আমি রাজ্যপাট ত্যাগ করে জঙ্গলে চলে যাব, বাকী জীবন বনবাসে কাটিয়ে দেব? তোমরা যদি আমার রাজত্বে কোন কষ্ট করে থাকো, আমি যদি তোমাদের কষ্ট দিয়ে থাকি, তাহলে বলো আমি কাকে কি কষ্ট দিয়েছি।”
সভা নীরব হয়ে গেল। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে রাজা বলল, “আমার শাসনকালে আমি কি কারো ওপর কোন জুলুম করেছি? করে থাকলে বলো।”
সবাই মাথা নীচু করে ফেলল।
“আমি মায়ার সাথে শুধু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাই পালন করব, কখনো আমাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হবে না।” বলল রাজা।
“তাহলে কোন অসুবিধা নেই মহারাজ! আওয়াজ এলো এক কোণ। থেকে। দেখাদেখি সবাই এ কথায় সায় দিল।”
এ ঘটনার তিনদিন পর রাজা দাহির সহোদর বোন মায়ারাণীকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করল। নেতৃস্থানীয় প্রজা ও সভাসদদের উপস্থিতিতে আবেগ উত্তেজনা ও আমোদ প্রমোদহীন অনাড়ম্বর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো রাজা দাহিরের সাথে মায়ারাণীর বিয়ের পর্ব। লোকজন এই বিয়ের কথা শুনে নাক ছিটকালো, কানে আঙুল দিল। কিন্তু রাজার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস কারো ছিল না।
এভাবে ঘটে গেল আমার বিয়ে অনুষ্ঠান। বেলালকে বলল রাণী। আপন ভাইয়ের জন্য আমি নিজ আগ্রহেই এ ত্যাগ স্বীকার করেছি। কারণ সিংহাসন থেকে ভাইকে বঞ্চিত করতে চাই না আমি। তাছাড়া আমার কানে যখন একথাগুলো এলো যে, আমার হবু স্বামী আমার ভাইকে খুন করে মসনদ দখল করবে, তখন আর বিয়ের প্রতি আমার কোন আগ্রহ থাকেনি।
“তোমার হয়তো জানাই ছিল না, কার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে?” বেলাল জানতে চাইলো।
“জানা ছিল।” সেও রাজা ছিল। ভাটি’ নামের এক রাজ্যের রাজা ছিল সে। তার নাম ছিল সোহান রায়। আমি তখন ব্রাহ্মণাবাদে আমার অপর ভাই মিহির সেনের এখানে। সেই ভাই আমাকে রাজা দাহিরের কাছে এ পয়গাম দিয়ে পাঠাল যে, আমাকে যেন অতি তাড়াতাড়ি রাজা সোহান রায়ের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। আমার ভাই মিহির সেন আমার বিয়ের যৌতুক হিসাবে পাঁচশ ঘোড়া ও পাঁচশ মটকি ভর্তি মাল-সামানও দিয়েছিল। তাছাড়া একটি দুর্গও দিয়েছিল যৌতুক হিসাবে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা দাহিরের অপর ভাই মিহির সেন যখন জানতে পারে রাজা দাহির বোন মায়াকেই বিয়ে করেছে তখন সে দাহিরের প্রতি রেগে আগুন হয়ে গেল। জরুরী পয়গাম পাঠাল। পয়গাম পাওয়া মাত্র মায়াকে সোহান রায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু রাজা দাহির তার বিয়ে করার কারণ, গণকদের গণনা ও উজিরের পরামর্শ এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার সমস্যা জানিয়ে ফেরত পয়গাম পাঠাল কিন্তু তাতে মিহির সেনের ক্ষোভ প্রশমিত হলো না। সে রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে সেনাভিযান করল। অবরোধ করল রাজা দাহিরের দুর্গ। কয়েকদিন অবরোধের মধ্য থেকে রাজা দাহির তার সৈন্যদের অবরোধ ভাঙার নির্দেশ দিল। রাজার হুকুম পেয়ে দাহিরের সেনারা অবরোধ ভাঙতে যখন দুর্গের বাইরে বেরিয়ে এলো তখন মিহির সেন বুঝতে পারল দাহিরের সৈন্য সংখ্যা অনেক বেশী তাই মোকাবেলায় প্রবৃত্ত না হয়ে রাজা দাহিরের কাছে পয়গাম পাঠাল, তুমি দুর্গের বাইরে এসে আমার সাথে সাক্ষাত করো। তোমার ও আমার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কথা হবে।
রাজা দাহির উল্টো খবর পাঠাল আমার তো যাবার প্রয়োজন নেই। তুমিই তো আসতে পারো, আমি তোমাকে স্বাগত জানাব। অবশেষে মিহির সেন নিজেই হাতি সাজিয়ে তাতে আরোহণ করে দাহিরের প্রাসাদে উপস্থিত হয়ে বলল, দুর্গের বাইরে চলো, তোমার সাথে আমার একান্ত কথা আছে। ভাই মিহির সেনের প্ররোচনায় দুর্গের বাইরে যেতে রাজি হয়ে গেল রাজা দাহির। দাহির সেনের হাতিতে সাজানো হলো হাওদা। দাহির বসল হাওদায় আর মিহির বসল হাতির সামনে মাথার কাছে। রাজা দাহিরের উজির বুদ্ধিমান : ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে রাজার হাতির পিছু পিছু যেতে লাগল। হাতি যখন দুর্গ ফটকের কাছাকাছি পৌছলো তখন উজিরের কানে কানে কে যেন এসে ফিস ফিস করে কি কথা বলল আর অমনি উজির রাজাকে ইশারা করে বুঝাল,
আপনি দুর্গের বাইরে যাবেন না বিপদ আছে। অনন্যোপায় হয়ে দুর্গের প্রধান ফটক দিয়ে হাতি বের হওয়ার সময় রাজা দাহির হাওদায় দাঁড়িয়ে গেটের নীচে ঝুলে থাকা গাছের ডালে ঝুলে পড়ল। হাতি প্রধান ফটক পেরিয়ে গেলে সৈন্যসামন্ত এসে রাজাকে নামাল। দুর্গফটক পেরিয়ে রাজা মিহির সেন পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখল রাজা দাহির হাওদাতে নেই। হতাশ সে। তার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেল। রাজা দাহির অনিবার্য বিপদ থেকে রক্ষা পেল।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, প্রাসাদে ফিরে গিয়ে রাজা উজিরকে জিজ্ঞেস করল, উজির! তুমি আমাকে ফেরালে কেন? উজির বলল মহারাজ! আমার গোয়েন্দারা একেবারে শেষ মুহূর্তে আমাকে খবর দেয়, আপনার ভাই আলোচনার নামে চক্রান্ত করে দুর্গের বাইরে নিয়ে আপনাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাজা মিহির সেন রাজা দাহিরকে হত্যা করার জন্যই দুর্গের বাইরে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু যখন দেখল দাহির তার হাত ছাড়া হয়ে গেছে আর তার সৈন্যবাহিনীও দাহিরের বিপুল সৈন্য সংখ্যার সাথে মোকাবেলায় পেরে উঠতে পারবে না, তখন অবরোধ তুলে নিয়ে স্বরাজ্যে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু অত্যধিক মনোকষ্ট ও গরমে রাজা সেন জ্বরে আক্রান্ত হলো। গরমে সারা শরীরে ফুস্কা পড়ে গেল। কয়েকদিন জ্বরে ভুগে দাহিরের দুর্গের বাইরেই সে মারা গেল। ৬৭২ খৃস্টাব্দের ঘটনা সেটি। তখন রাজা মিহির সেনের বয়স ছিল মাত্র বত্রিশ বছর।
বিয়ের ঘটনা সবিস্তারে বলার পর মায়ারাণী বেলালের উদ্দেশ্যে বলল, কি ভাবছ বেলাল? মনে রেখো, রাজা দাহির আমার জীবনে কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারবে না। সে আমাকে বিয়ে করেছে সত্য কিন্তু আমাদের মধ্যে কোন দাম্পত্য সম্পর্ক হয়নি। আমরা সেই ভাই-বোনের পবিত্রতা বজায় রেখেছি। তবে রাজা দাহির জানে আমি যুবতী। এ সময়ে আমার স্বামীর ঘরে থাকার কথা ছিল। সে আলবৎ জানে, যৌবনের চাহিদা কি? যুবতীর মন কিসে তৃপ্তি পায়। যে তার মসনদ রক্ষা করতে গিয়ে আমার জীবন যৌবনকে গলা টিপে হত্যা করেছে।
“আমি শুনেছি, তোমাদের দেশে নাকি তরুণী-মেয়েদেরকে দেবতার নামে জবাই করে দেয়া হয়?”
“তুমি ঠিকই শুনেছ। কেবল পণ্ডিত বা গণক যদি একবার বলে দেয় যে, বিপদ আসন্ন। কোন কুমারীকে দেবতার নামে বলি দিলে এই মুসীবত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে তাহলে রাজার তত্ত্বাবধানেই কুমারী বলি দেয়া হয়। বিশেষ অনুষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পালন করা হয় পণ্ডিতদের নির্দেশ।” “আমাদের দৃষ্টিতে এসব কর্মকাণ্ড হারাম এবং এক আল্লাহর সাথে শরীক করার পর্যায়ে পড়ে। অথচ তোমাদের প্রভু নিজের বান্দাদের প্রাণ হরণ করে আনন্দিত হয়?”
“বেলাল! আমি তোমাকে আগেই অনুরোধ করেছি, আমার সাথে ধর্ম সম্পর্কে কথা বলবে না। আমি যখন তোমার কাছে আসি তখন আমি নিজেকে হিন্দু ধর্মের অনুসারী মনে করি না, আর তোমাকেও মুসলমান বলে ভাবি না। আমি নারী আর তুমি পুরুষ আমার কাছে এ সত্যটাই সবচেয়ে বেশী মূল্যবান। নারী সেই পুরুষকেই মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে যে পুরুষ তার চোখে ভালো লাগে। দেখো, আমি এ দেশের ঘোষিত রাণী। ইচ্ছা করলে আমি তোমাকে শিকলে বেঁধে আমার গোলাম বানিয়ে রাখতে পারি। কিন্তু তা না করে তোমার প্রেমে পড়ে আমি নিজেকে তোমার বাদীতে পরিণত করেছি। আমি কি তোমার সেই সংশয় ও প্রশ্নের জবাব দিতে পেরেছি, কেন আমি আমার স্বামীকে ধোকা দিচ্ছি এবং কেন তাকে আমি প্রেমিক হিসাবে নিজের জীবন যৌবন উৎসর্গ করতে পারছি না?”
“আমার ভাই রাজা দাহির জানে, সে আমার যৌবনের রঙ্গীন স্বপ্নগুলোকে মরুভূমিতে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। এতে আমি জীবন তৃষ্ণায় ছটফট করতে করতে ধুকে ধুকে মরছি। আমার সারা অস্তিত্বে আমার স্বপ্নগুলো সারাক্ষণ জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলছে। সে পুরুষ। দেশের রাজা। রাজমহলে রয়েছে অসংখ্য সেবিকা দাসী। সে যে কোনভাবে তার দৈহিক প্রয়োজন মিটিয়ে নিতে পারে। বিশেষ কোন নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কোন বাধ্যবাধকতা তার নেই। কিন্তু আমি রাণী। আমার জন্য এ ব্যবস্থা নেই। এ জন্য সে আমাকে স্বাধীন ছেড়ে দিয়েছে। তবুও আমি আমার মর্যাদাকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারি না। কিন্তু এমনটিও সম্ভব নয় যে, আমি স্বামী হিসাবে কাউকে ভালোবাসবো, তার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকব। স্বামীর চরনে নিজের ভালোবাসার অর্থ দেব।” “আমি তোমার অবস্থা বুঝেছি রাণী। কিন্তু আমি তো বিদেশ বিভূয়ে এক পলাতক। তোমার দেশে আমি পরবাসী। এখানে আমার কোন ঠিকানা নেই।
নেই ঘরবাড়ি। তুমি কতদিন এভাবে চুপি চুপি আমার সাথে মিলিত হবে? তুমি মায়াজালে আবদ্ধ করে ফেলেছ।” “চুপি চুপি মিলব কেন? আমি তোমাকে আমার সাথেই রাখব।” বলল মায়া। “রাণী! রাণীকে নিজের বুকে টেনে বলল বেলাল। আমি যদি এখানে পরবাসী না হতাম, তাহলে তোমাকে মুসলমান বানিয়ে আমার বিবি করে নিতাম।” “তুমি আবার ধর্মের কথা বলছ। উন্মা মাখা কণ্ঠে বলল রাণী। আমি নিজেও ধর্মান্তরিত হতে চাই না, তোমাকেও আমার ধর্মে টেনে আনতে চাই না। আমরা একজন অপরজনের ভালোবাসায় সিক্ত হতে চাই, আজীবন ভালোবেসে যেতে চাই। বলো বেলাল! তুমি কি আজীবন আমাকে ভালোবেসে যাবে?”
এ ঘটনার ছয় বছর পর রমলের রাজা রাজা দাহিরের রাজ্য আক্রমণ করে কিছু এলাকা দখল করে নিল এবং আরো সামনে অগ্রসর হতে লাগল। রমলের রাজা ছিল হস্তিবাহিনী সজ্জিত। তার প্রায় সব হাতিই ছিল মাদা হাতি। হাতিগুলো ছিল খুবই তাজা তাগড়া আর অস্বাভাবিক শক্তির অধিকারী ও ভয়ংকর। তদুপরি রমল বাহিনী যুদ্ধের সময় এসব হাতিকে মদ খাইয়ে নেশাগ্রস্ত করে ফেলত, তখন এগুলোর ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলার সামনে কারো
দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকত না। এছাড়া রমলের সৈন্যসংখ্যাও ছিল বিপুল। রমলের আগ্রাসী ক্ষমতার বর্ণনা শুনে ভড়কে গেল রাজা দাহির। সে উজির বুদ্ধিমানকে ডেকে ভীত শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই অবস্থায় কি করা যায় উজির?”
“মোকাবেলা ছাড়া আর কি করার আছে মহারাজ! বলল উজির বুদ্ধিমান। সৈন্যবাহিনী কম তাতে কি হয়েছে? খাজাঞ্চীখানার দরজা খুলে দিন। প্রজাদের বলুন, যারা বাহাদুরের মতো লড়াই করবে, তাদের দেয়া হবে এসব ধনরত্ন।”
“সাধারণ প্রজাদের তো লড়াই করার ট্রেনিং নেই, তারা কিভাবে একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করবে?”
“তাহলে শত্রুদের সাথে সন্ধিচুক্তি করে নিন।” বলল উজির।
“সন্ধি করার মানে হলো পরাজয় বরণ করা। এরচেয়ে তো মৃত্যুও ভালো। জানা নেই, শত্রু পক্ষ সন্ধি প্রস্তাব দিলে কি পরিমাণ টাকার বিনিময়ে সন্ধি করার শর্ত দেয়। আমি সন্ধি প্রস্তাব করতে চাই না, পরাজয়ও বরণ করতে চাইনা।” বলল রাজা দাহির।
“তাহলে একটাই পথ আছে মহারাজ! আপনি যেসব আরবদেরকে এখানে আশ্রয় দিয়েছেন এদেরকে আপনার দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। করতে রাজি করুন।”
“কিন্তু এরাও তো সংখ্যায় বেশী নয়। মাত্র পাঁচশ বা এর কিছু বেশী হবে। এতো অল্প মানুষ কিভাবে বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করবে?” বলল রাজা।
“মহারাজ! আপনি কি জানেন না, এরা সেই জাতি যারা রোম ও পারস্যের বিশাল সমরশক্তিকে গুড়িয়ে দিয়ে বিজয় অর্জন করেছে। এরা লড়াকু জাতি। হাতে গোনা সৈন্য নিয়ে বিশাল বাহিনীর মোকাবেলায় বিজয় অর্জনের অভিজ্ঞতা এদের আছে।” বলল উজির।
তারিখে মাসুমীতে বর্ণিত হয়েছে “রাজা দাহির তার দেশ রক্ষার জন্য তার আশ্রিত আরবদের কাছে নিজে গিয়ে শত্রুদের মোকাবেলার অনুরোধ করল।” আশ্রিত মুসলমানের সংখ্যা ছিল পাঁচশ। এদের অধিকাংশই ছিল প্রথম সারির যোদ্ধা ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সন্তান। আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের শাসনামলে সাঈদ বিন আসলাম নামের মাকরানের গভর্নরকে এরা হত্যা করে বিদ্রোহ করেছিল। এই অপরাধে খলিফার রোষের শিকার হয়ে এরা সিন্ধুতে এসে রাজা দাহিরের কাছে আশ্রয় নেয়। আশ্রিতরা সবাই মিলে হারেস বিন আলাফীকে তাদের নেতা ঘোষণা করে।
রাজার আগমন সংবাদ শুনে আশ্রিত আরবদের সর্দার হারেস আলাফী রাজাকে স্বাগত জানিয়ে বলল— “মহারাজ! আজ আপনাকে অন্যদিনের মতো দেখাচ্ছে না। এমন ব্যতিক্রম দেখছি কেন মহারাজ!”
“আমার মর্যাদা এখন প্রশ্নের মুখোমুখি। তোমাদের তরবারীই পারে আমার সম্মান মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে। আমি তোমাদের উপকারের প্রতিদান নিতে আসিনি, উপকারের ডঙ্কা বাজাতে আসিনি। আমি বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এসেছি।” হারেস আলাফী তাকে বসিয়ে আরব আশ্রিতদের আরো কয়েকজন ( নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে ডেকে পাঠাল।
“মহারাজ! বলুন, আমাদের তরবারীর এমন কি প্রয়োজন পড়েছে আপনার? আমরা অবশ্যই আপনার বন্ধুত্বের হক আদায় করতে প্রস্তুত।”
“রাজা দাহির আশ্রিত আরব সর্দার হারেসকে জানাল, তার বিরুদ্ধে বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে এক শক্তিশালী বাহিনী আক্রমণ করতে আসছে। রাজধানী থেকে মাত্র দশ মাইল দূরে তাঁবু গেড়েছে শত্রুবাহিনী।
“একথা শুনে হারেস আলাফী বলল, “আল্লাহর কসম! মুসলমানরা বন্ধুত্বের দাবী আদায়ে কখনো পিছপা হয় না। আমরা অবশ্যই আপনার বন্ধুত্বের হক আদায় করব। প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করব না।”
“তাহলে এখনই কোন পরিকল্পনা তৈরী করে নাও, দয়া করে শত্রুদের হাত থেকে আমার দেশকে রক্ষা করো। রাজা দাহির হতাশ ও পরাজিতের স্বরে বলল। শুনেছি শত্রুদের হাতে পাগলা হাতি রয়েছে। হস্তিবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞকে কোন বাহিনীই রুখতে পারে না, ওদের চিৎকারেই সৈন্যরা ভয় পেয়ে যায়। তোমরা কি এসব হাতির মোকাবেলা করার ব্যবস্থা করতে পারবে?”
“মহারাজ। কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, এক আরব বৃদ্ধ। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের ঘটনা স্মরণ করো। তখন তুমি খুবই ছোট ছিলে। পারস্যের অগ্নি পূজারীরা আমাদের কাছে পরাজিত হয়ে কাদেসিয়ার যুদ্ধে এত বিপুল সংখ্যক সৈন্য সমাবেশ ঘটাল যে, এর আগে কোন যুদ্ধে এতো অধিক পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ কোথাও ঘটেনি। অগ্নি পূজারীরা মনে করেছিল, এটাই হবে ওদের সাথে আমাদের শেষ লড়াই, এরপর আমাদের আর কোন অস্তিত্বই থাকবে না। ওরা বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে এলো। আমরা অনেকে জীবনেও হাতি দেখিনি। হাতি ছিল আমাদের জন্যে বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। আমি তখন যুবক। সে লড়াইয়ে ছিলাম আমি। হে রাজা! তুমি হয়তো জেনে থাকবে, পারস্য ম্রাটকে জঙ্গী হাতি সরবরাহ করেছিল তৎকালীন সিন্ধু অঞ্চলের রাজা….। আজ চল্লিশ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও সেইসব হাতির চিৎকার আমার কানে বাজে। এসব হাতি আমাদের ভয়ানক ক্ষতি করেছিল। তবে আমরা হাতির সুড় কেটে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলাম। কি মনে করো রাজা! কাজটি খুব সহজ ছিল?”
“অবশ্যই নয়, দোস্ত!” বলল রাজা দাহির। হ্যাঁ, আমি বড় হয়ে শুনেছি। কাদেসিয়ার যুদ্ধে হস্তিবাহিনী মুসলমানদের প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও মুসলমানরা যখন হাতিগুলোর সুড় কাটতে শুরু করে তখন আহত হাতিগুলোই
পারসিকদের জন্য হয়ে ওঠে বিপদ। হাতির পায়ে পিষ্ট হয়েই মারা পড়ে বহু পারসিক সৈন্য। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদেরকেই পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।”
৬৩৫ খৃস্টাব্দে কাদেসিয়া যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তখন পারস্যের রাজা ছিলেন ইয়াজদগিদ। তিনি পূর্বাঞ্চলের সকল অমুসলিম রাজাদের কাছ থেকে এই বলে সাহায্য নিয়েছিলেন যে, যদি মুসলমানদের এখনই প্রতিরোধ না
করা যায়, তাহলে দুনিয়াতে কোন ধর্মই আর থাকবে না। মুসলমানরা সবাইকে গোলাম বাদীতে পরিণত করবে। পারস্যের রাজা ইয়াজদেগিদ সিন্ধু রাজার কাছেও সাহায্যের আবেদন করেছিল। সিন্ধু রাজা তার কিছু সৈন্যসহ এই ভয়ানক জঙ্গী হাতি উপহার দেয়। কতগুলো হাতি সিন্ধু রাজা পারস্য ম্রাটকে দিয়েছিল তা আমরা জানতে পারিনি। তবে এতটুকু জানতে পেরেছিলাম যে, সম্রাটের জন্য রাজা নিজের ব্যবহৃত সাদা কালো মিশ্রিত কাজলা রঙের হাতিটিও দিয়েছিল। কাদেসিয়া যুদ্ধে সেই হাতিতে সওয়ার ছিল পারস্যের বিখ্যাত সেনাপতি রুস্তম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি রুস্তমের। কাদেসিয়া যুদ্ধেই আমাদের সৈন্যদের হাতে রুস্তম নিহত হয়।”
“এ জন্যই তো আমি তোমাদের কাছে এসেছি। হস্তিবাহিনীর মোকাবেলা করা তোমাদের পক্ষেই সম্ভব। আমি তোমাদের উপকার করেছি, আশা করি এই বিপদে তোমরাও আমার উপকার করবে।”
“যাও রাজা! আমরা ইনশাআল্লাহ তোমার সাহায্যের জন্য পৌছে যাবো। দেখবে হাতি ময়দানেই আসবে না। আমাদের মধ্যে লড়াই করার মতো যতজন রয়েছে সবাই যুদ্ধ করবে। তুমি আমাদেরকে কিছু সংখ্যক সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করো। আর বাকী সৈন্যদেরকে তুমি শত্রুবাহিনীর দিকে পাঠিয়ে দাও। ওদের থেকে মাইল খানিক দূরে তাঁবু ফেলে ওদের বলে প্রতিরক্ষা খাল খনন করতে। তুমি আমাকে পাঁচশ সৈন্য আমার অধীনে পাঠিয়ে দিও। আর বাকীদের তোমার সাথে রাখে। এরপর যা ঘটবে তা তোমার শত্রুবাহিনী যেমন টের পাবে তুমিও নিজের চোখেই দেখতে পাবে।” বলল আরব সর্দার আলাফী। অতঃপর যা ঘটলো, তা আরব মুসলমান যোদ্ধাদের ইতিহাসের স্বাভাবিক ঘটনা। অবশ্য তাদের বাহাদুরী শুধু সিন্ধু রাজা দাহির আর তার শত্রুরাই দেখেনি। আজো ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে সেই আরব সর্দার হারেস আলাফীর সাথীদের শৌর্য বীর্যের কাহিনী কথা বলে। ইতিহাসের পাতায় সারা জগতের মানুষ সেই কাহিনী দেখে নিতে পারে।
“হারেসের কথা মতো রাজা দাহির পাঁচশ অশ্বারোহী তার অধীনে পাঠিয়ে দিল। অপরদিকে রাজা দাহিরের সেনাবাহিনী রাজধানী ত্যাগ করে রমলের রাজার অবস্থানের তিন মাইল দূরে তাঁবু ফেলে দ্রুত প্রতিরক্ষা খাল খনন করে ফেলল। এর মধ্যে আলাফী বেশ বদল করে রাজা দাহিরের শত্রুবাহিনীর মধ্যে ঢুকে ওদের সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখে বুঝতে পারল— এই বাহিনীর মোকাবেলায় রাজা দাহিরের অস্ত্র সমর্পণের কোন বিকল্প নেই। বিশাল সেই বাহিনী আর বিপুলশক্তির অধিকারী। শত্রুদের শর্ত মেনে সন্ধিচুক্তি করে প্রাণ রক্ষা ছাড়া রাজা দাহিরের বাঁচার কোন পথ নেই।
রমলের রাজা দাহিরের সেনাবাহিনীর তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করছিল এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রমলের রাজা খোজ নিয়ে জানতে পারল রাজা দাহিরের বাহিনী তার বাহিনীর মোকাবেলায় একেবারেই নগণ্য। তাই সে চিন্তামুক্ত হয়ে গেল। ভাবল, বিজয় তার অবশ্যম্ভাবী। সে ভাবতেই পারল না নগণ্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে রাজা দাহিরের বাহিনী তার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। দু’দিন পরের ঘটনা। রমলের বাহিনী রাতের দ্বিপ্রহরের সময় গভীর ঘুমে অচেতন। এমন সময় আরব সর্দার হারেস তার আরব সাথী ও রাজার দেয়া পাঁচশ অশ্বারোহী নিয়ে রমলের বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালালো। সে রমলের শিবিরে ঢুকে তাঁবুগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল। সারা শিবির জুড়ে ভয় আতঙ্কে সেনারা পালাতে শুরু করল। জীবন নিয়ে পালানো ছাড়া প্রতিরোধের কোন চিন্তাই করতে পারল না। কিন্তু আলাফীর গুপ্ত হামলা এতোটাই তীব্র ছিল যে, রমলের বাহিনী পালানোর অবকাশও পেল না। প্রায় হাজারের ওপরে সৈন্য মারা গেল। বন্দি হলো বহু সেনা। আলাফীর যোদ্ধারা পঞ্চাশটি হাতি ধরে নিয়ে এলো। এতে রমল রাজার কোমর ভেঙে গেল।
অভাবিত এ সাফল্যে রাজা দাহির আরবদের অপরিমেয় পুরস্কারে ভূষিত করল। তাছাড়াও মাকরান অঞ্চলে বিশাল এলাকা তাদেরকে বসতি স্থাপনের জন্য লা-খিরাজী দান করল। এখানেই পরবর্তীতে এই আরব আশ্রয় প্রার্থীরা বসতি স্থাপন করে। রাজা দাহিরের আশ্রিত আরবরা যখন রমলের রাজার আক্রমণ থেকে রক্ষা করল দাহিরের রাজত্ব, তখন বেলাল ও তার সাথীরা রাণী মায়ার একান্ত কর্মচারী হিসাবে রাজ প্রাসাদে নিরাপদ জীবন যাপন করছে। রাণী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাহিরের বিবাহিতা হলেও বেলালকেই সে মনে প্রাণে প্রাণ
পুরুষ হিসাবে স্থান দিয়ে রেখেছে এবং তার চার সাথীকে একান্ত নিরাপত্তারক্ষীর মর্যাদা দিয়ে রাজ মহলেই বিশেষ মর্যাদায় রেখেছে। রাণী বাইরে গেলে এরাই থাকে তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী। ঘরে বাইরে সবখানে বেলাল ও তার সাথীরাই মায়ারাণীর সেবক, কর্মচারী, পাহারাদার, নিরাপত্তারক্ষী সেই সাথে জীবন ও প্রাণের আত্মীয়। এক পর্যায়ে রাজা দাহিরের সেই দুরবস্থা আর থাকল না। রাজা দাহির তার দুর্বলতা কাটিয়ে রাজত্বকে মজবুত করতে সক্ষম হলো। দেখতে দেখতে রাজা দাহিরের রাজ্য মুলতান পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। উত্তরে সীস্তান ও মাকরানের কিছু অঞ্চলও রাজা দাহিরের দখলে চলে এলো। দক্ষিণে গুজরাট ও মাললা পর্যন্ত বিস্তৃত হলো রাজা দাহিরের রাজত্ব।
এতো দিনে মায়ারাণীর শরীরেও ভাটার টান দেখা দিয়েছে। আর যোদ্ধা বেলালও পৌঢ়ত্বের সিড়িতে পা দিয়েছে। এরা একজন অপরজনকে দেখে ও কথা বলেই জীবন কাটাত। রাজা দাহিরের রাজত্বের সীমানা বৃদ্ধি পেল ঠিক, তবে শেষ পর্যায়ে এসে দাহিরের মধ্যে দেখা দিল রূঢ়তা। সে প্রজাদের ওপর শুরু করল অত্যাচার উৎপীড়ন। দাহিরের রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোক ছিল বেশী। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের অধিকাংশই ছিল জাট। রাজা দাহির বৌদ্ধদের জীবনকে সংকীর্ণ করে ফেলল, তাদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্রবোধকে নস্যাৎ করে দিতে গুড়িয়ে দিলো তাদের উপাসনালয়।
আরব দেশের সাথেও দাহির শত্রুতা সৃষ্টি করল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইরাকের শাসক থাকাকালে রাজা দাহিরের আক্রমণাত্মক ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশী। তখন যেসব বিদ্রোহী আরব হাজ্জাজ ও আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের অত্যাচারের ভয়ে দেশত্যাগ করেছিল, রাজা দাহির তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে আরব শাসকদের বিরুদ্ধে উস্কানী দিচ্ছিল। এসব খবর হাজ্জাজের কানে পৌছলে হাজ্জাজ এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। সে সময় হাজ্জাজ ছিলেন অর্ধেক আরবের শাসক। অত্যাচার, উৎপীড়ন ও যুদ্ধবাজ হিসাবে তার জুড়ি ছিল না। হাজ্জাজের অত্যাচারের ভয়েও কিছু সংখ্যক বিদ্রোহী দেশত্যাগ করে রাজা দাহিরের রাজ্য সিন্ধুতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। রাজা দাহির এসব বিদ্রোহী মুসলমানকে আরব শাসকদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ চালানোর জন্য নানাভাবে প্ররোচনা দিচ্ছিল।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আপন ভাতিজা ও হাতে গড়া সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন পারস্যের গভর্নর, তখন পারস্যের রাজধানী ছিল সিরাজ শহরে। সে সময় মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স মাত্র সতেরো বছর। কিন্তু বয়স কম হলে কি হবে, মেধা মনন ও অভিজ্ঞতায় সে যেকোন পৌঢ় ব্যক্তির চেয়েও ছিল বেশী দক্ষ। মুহাম্মদ বিন কাসিমের এই অসাধারণ প্রজ্ঞা ও শক্তি ছিল তার মা ও চাচা হাজ্জাজের দেয়া প্রশিক্ষণের ফসল। সামরিক রণকৌশলে সে ছিল একজন অভিজ্ঞ সেনাপতি। পারস্যের কুর্দিরা ছিল বিদ্রোহী ও লড়াকু। পারস্যের সম্রাট ও কুর্দিদের বিদ্রোহ এবং চক্রান্তে অসহায় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিম তার অস্বাভাবিক মেধা ও প্রজ্ঞার দ্বারা কুর্দিদের এমনভাবে আয়ত্বে এনেছিলেন যে, তাঁর আঙুলের ইশারায় কুর্দিরা উঠত বসত।
মুহাম্মদ বিন কাসিম গভর্নরের দায়িত্ব নেয়ার আগে সিরাজের তেমন গুরুত্ব ছিল না। বিন কাসিম সিরাজের আশে পাশের আরো কিছু পারসিক অঞ্চল জয় করে মুসলিম সালতানাতে অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই সাথে কুর্দিদের বিদ্রোহ ও চক্রান্ত দমন করতে সক্ষম হন। তিনিই সিরাজকে রাজধানী ঘোষণা করে এখানে একটি আধুনিক শহরের গোড়াপত্তন করেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই সিরাজ নগরীর খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
আশৈশব এতীম ও ক্ষুদে এই শাসক ও সেনাপতির তখনও প্রৌজ্জ্বল তারকা খ্যাতি অর্জিত হয়নি। অবশ্য মুহাম্মদ বিন কাসিমের উত্থান সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল, যেদিন তিনি খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের ভাই সুলায়মানকে বাৎসরিক সামরিক প্রদর্শনীতে পরাজিত করেছিলেন। সুলায়মান ভেবেছিল তার ভাই হয়তো এটাকে নিছক একটা খেলার জয় পরাজয় হিসাবেই মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু খলিফা সেইদিনের খেলার মধ্যেই মুহাম্মদ বিন কাসিম যে অন্য দশজনের চেয়ে ভিন্ন, তা বুঝতে পেরেছিলেন।
খলিফা সেদিন রাতেই মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ডেকে এনে তার সাথে কথা বলেন। এতোটুকু তরুণের মধ্যে অস্বাভাবিক মেধা ও প্রজ্ঞা দেখে তিনি বিস্মিত হন। সেই বয়সেই মুহাম্মদ বিন কাসিম দক্ষ সেনাপতিদের মতো সামরিক বিষয় বিশ্লেষণ করতে পারতেন এবং যে কোন বিষয়ে তার মন্তব্য হতো অত্যন্ত বাস্তব সম্মত এবং দূরদৃষ্টির পরিচায়ক। ইবনে ইউসুফ! হাজ্জাজের উদ্দেশ্যে বললেন, খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক। এই ছেলে একজন প্রতিভাধর সেনাপতি হবে একথা আমি
হলফ করে বলতে পারি। দেখবে আগামী প্রজন্ম অনেক ক্ষেত্রে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলবে। এই ছেলে আরব জাতির জন্য আল্লাহ তাআলার বড় নিয়ামত। একে ব্যারাকে নিয়ে যান ইবনে ইউসুফ! তাঁকে সেনাপতির পদমর্যাদা দিয়ে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিন।” ঐতিহাসিকরা তৎকালীন লেখকদের কথা উদ্ধৃত করে লেখেন, মুহাম্মদ বিন কাসিমের গায়ের রং ছিল গোলাপী, চোখ দুটো ছিল বড় বড়, কপাল চওড়া, হাত দুটো শক্ত, সুডৌল ও দীর্ঘ। শরীর ছিল পুষ্ট এবং আওয়াজ ছিল ভারী। চেহারা ছিল চমকানো। মুখের ভাষা ছিল খুবই মিষ্ট, বলার ভঙ্গি ধীর ও সরল। পুরো অবয়বে মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন একজন মূর্তিমান সম্মোহনী ক্ষমতার অধিকারী। যে তাকে দেখত মুগ্ধ ও প্রভাবিত না হয়ে পারত না। তার ঠোটে কথা বলার সময় ঈষৎ হাসি লেগে থাকত। মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত কিন্তু নির্দ্বিধায় প্রয়োজনের কথা বলতে পারত। তিনি সবার সাথে খুব সহজে কথা বলতেন এবং শুনতেন। কিন্তু প্রশাসনিক কাজে ছিলেন খুবই নীতিবান। কেউ তার কোন নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে এমনটি কল্পনাও করতে পারতো না। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর ও আপসহীন।
একদিন মুহাম্মদ বিন কাসিম তার চাচার রাজধানী বসরায় এলেন।
“মুহাম্মদ! মৃত্যুর আগে আমি একটি অপূর্ণ আশা পূরণ করে যেতে চাই!” বললেন হাজ্জাজ।
“কি সেই অপূর্ণ আশা চাচাজান?”
“এটা এমন একটা আশা যা পূর্ণ করাটা এখন আমার কর্তব্য হয়ে পড়েছে। আমি সিন্ধু রাজ্যের প্রতিটি ইমারতের ইট খুলে ফেলতে চাই। আমার মনে হয়, তুমি আমার এই প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারবে এবং সিন্ধু রাজ্যকে ইসলামী সালতানাতের সঙ্গে যুক্ত করতে পারবে।”
“এজন্য তো আমীরুল মুমেনীনের অনুমতির প্রয়োজন হবে। আপনি অনুমোদন এনে দিন। আমি আপনার প্রত্যাশা পূরণ করে দেবো। ইনশাআল্লাহ।”
“এটা একটা সমস্যা বটে। আমীরুল মুমেনীন এখনো অনুমতি দিচ্ছেন না। আমি এমন একটা অজুহাতের চেষ্টা করছি, যাতে তিনি অনুমতি দিতে বাধ্য হন। সিন্ধু দেশ ও হিন্দুস্তান থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে বড় ধরনের
চক্রান্তের পায়তারা চলছে। তোমার দস্তাবিজ রক্ষক হয়তো তোমাকে বলে থাকবে কাদেসিয়ার যুদ্ধে সিন্ধু রাজা বহু জঙ্গী হাতি দিয়ে পারস্য সম্রাটকে সহযোগিতা করেছিল। ওরা পারসিকদেরকে সেনাবাহিনী দিয়েও আমাদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করেছে।” “হ্যাঁ, চাচাজান! আমি একথাও শুনেছি যে, কাদেসিয়া যুদ্ধের দু’বছর আগে জঙ্গে সালাসিলে হিন্দু মারাঠা ও জাটরা অংশগ্রহণ করেছিল এবং তারা নিজেদেরকে শিকলে বেঁধে নিয়েছিল।”
পারসিকদেরকে যখন খালিদ বিন ওয়ালিদ একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত করে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন সেনাপতি হরমুজ তৎকালীন সিন্ধু রাজার কাছে সাহায্যের আবেদন করে এবং সিন্ধু রাজার সাথে মৈত্রী চুক্তি করে। অপরদিকে যেসব হিন্দু জাট তাদের দেশে গোলামী ও মানবেতর জীবন যাপন করছিল, তাদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে মোটা অংকের ভাতা বরাদ্দ দিয়ে তার সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। হিন্দু জাটা ছিল জাতিগতভাবে লড়াকু ও সাহসী। হরমুজের হাতে বন্দি জাটদের অধিকাংশই ছিল অভিজ্ঞ যোদ্ধা ও প্রথম শ্রেণির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য। হরমুজ এদেরকে নিজ দেশের সেনাদের মতো সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে সেনাবাহিনীতে পদায়ন করে নেয়। সেই সাথে এদের মধ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা ঢুকিয়ে দেয়।
এসব জাট (অনেকে এদেরকেই গোখা বলেন) সৈন্যরাই পাঁচ, সাতজনের একেকটি ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদেরকে শিকলে বেঁধে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল। এতে করে কেউ পালিয়ে যেতে চাইলেও পালাতে পারতো না এবং প্রতিপক্ষ অগ্রসর হতে চাইলে শিকলে পেঁচিয়ে বাধাগ্রস্ত হতো।
এসব আমি আমার উস্তাদের কাছে শুনেছি চাচাজান। উস্তাদের কাছ থেকে আমি যা শুনেছি, সবই আমি হৃদয়ে গেঁথে নিয়েছি। শিকলে বেঁধে যুদ্ধ করেছিল বলেই এই যুদ্ধকে “জঙ্গে সালাসিল” বলা হয়। পারসিক সেনাপতি হরমুজ খালিদ বিন ওয়ালিদের মুখোমুখি যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। এরপর পারসিকদেরকে মুসলমানরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে।
“আমার গোয়েন্দা সিন্ধু দেশের খবরাখবর আমাকে নিয়মিত পাঠাচ্ছে। আমার গোয়েন্দারাও বিদ্রোহীদের বেশ ধারণ করে ওদের সাথে রয়েছে। রাজা দাহির এতোটাই বদমাশ হয়ে পড়েছে যে, সমুদ্রের ডাকাতদেরও সে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এসব ডাকাত দল সন্দ্বীপ ও মালাবার অঞ্চল থেকে যেসব মুসলমান হজ্জ্ব করতে আসে এবং যেসব আরব মুসলমান ব্যবসায়িক
মালপত্র নিয়ে ওদের সমুদ্রকূল দিয়ে যাতায়াত করে, এসব ডাকাতেরা তাদের সবকিছু লুটে নেয়। এরই মধ্যে কয়েকটি মুসলিম জাহাজ এরা লুট করেছে।
“আমাদেরকে অবশ্যই মুসলমানদের যাতায়াত ব্যবস্থা এবং জাহাজ চলাচলের নিরাপদ ব্যবস্থা করতে হবে।” বললেন মুহাম্মদ বিন কাসিম।”
“আমি ব্যবস্থা বলতে একটাই বুঝি, সিন্ধু অঞ্চল আমরা দখল করতে না পারলেও অন্তত সিন্ধু অববাহিকার সমুদ্র অঞ্চল ও উপকূলের নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই আমাদের কব্জায় আনতে হবে।” বললেন হাজ্জাজ। সিন্ধু অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বন্দর হলো ডাভেল। এটিকে দখলে নিতে পারলেই সমুদ্র পথ আমাদের নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে।” “আমীরুল মুমেনীন থেকে যুদ্ধের অনুমতি নিয়ে দিন। পরে একটু সময় দিন আমি ডাভেল বন্দরের নিয়ন্ত্রণ আপনার অধীনে এনে দেবো।” বললেন মুহাম্মদ। “খলিফার অনুমতি নেয়ার চেষ্টা আমি অনেকদিন থেকেই করছি।” বললেন হাজ্জাজ। কিন্তু তিনি অনুমতি দিচ্ছেন না। হয়তো অনুমতি তিনি দেবেনই না। রাজা দাহির। নিজের বোনের স্বামী। আমি ওর দেহকে আরবদের ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হতে দেখতে চাই, ওকে আমি তুলা ধোনা করতে চাই…।” “পরদিন মুহাম্মদ বিন কাসিম চাচা হাজ্জাজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিরাজ নগরে চলে গেলেন।
এর প্রায় দু’মাস পরের ঘটনা। বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দুপুরের আহারের পর আরাম করছিলেন। এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন তার নিরাপত্তারক্ষী কাউকে ভিতরে প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে, আর লোকটি ভিতরে প্রবেশে দ্বাররক্ষীর বাধা মানতে চাচ্ছে না। এ নিয়ে দ্বাররক্ষী ও আগন্তুকের মধ্যে বাদানুবাদ হচ্ছে। এরই মধ্যে কারো কণ্ঠে শোনা গেল “হে হাজ্জাজ সাহায্য করো! হে হাজ্জাজ সাহায্য করো! হাজ্জাজ আমাদের সাহায্য করো।”
হাজ্জাজ দ্বাররক্ষীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাইরে কি হচ্ছে?”
“বাইরে এক ক্লান্ত-শ্রান্ত লোক এসেছে। সে সন্দ্বীপ থেকে এসেছে বলে দাবী করছে। বলছে তাদের জাহাজ ডাকাতরা লুটে নিয়েছে এবং আরোহী সবাইকে ডাকাত দল বন্দি করে নিয়ে গেছে…।”
“তাকে এক্ষুণি ভিতরে নিয়ে এসো। জলদি যাও! আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকো না।”
“হাজ্জাজ দ্বাররক্ষীকে বিদায় করে সাহায্যপ্রার্থীকে নিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি নিজেই দ্বাররক্ষীর পিছনে পিছনে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। তিনি বাইরে এসে দেখতে পেলেন, একজন অশ্বারোহী ঘোড়ার পিঠে ঝুঁকে রয়েছে, আর ঘোড়াটি অত্যধিক খাটুনীর কারণে ঘেমে নেয়ে গেছে এবং হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ধুকছে ঘোড়াটি। আরোহীর মাথা বুকের সাথে মিশে গেছে। লোকটি হাজ্জাজের আগমন টের পেয়ে মাথা উঁচু করলে হাজ্জাজ দেখতে পেলেন, তার মুখ ব্যাদান হয়ে রয়েছে এবং চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ঠোট দুটো সাদা হয়ে শুকিয়ে গেছে। শরীরে ধুলোবালির আস্তরণ পড়ে গেছে। লোকটি হাজ্জাজকে দেখে বলে উঠলো, “হে হাজ্জাজ! আমাদের জাহাজ হিন্দুস্তানের ডাকাতরা লুট করেছে এবং আরোহী সবাইকে ধরে রাজা দাহিরের রাজমহলে নিয়ে গেছে।”
“তাড়াতাড়ি আরোহীকে পানি পান করানো হলো। হাজ্জাজের নির্দেশে তাকে মেহমানখানায় নিয়ে যেতে চাইলে লোকটি বলল, আগে আমার কথা শুনে নাও। পরে শোনার কথা বললে আরোহী বলল, এক্ষুণি আমার কথা শুনে নাও। আমার প্রাণ বায়ু ফুরিয়ে যাচ্ছে। হায়াত আমাকে বেশী সময় দেবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি এক নির্যাতিতা আরব কন্যার ফরিয়াদ বার্তা নিয়ে এসেছি।”
আগন্তুক বলল, সন্দীপে বসবাসকারী মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি। পাচ্ছিল। মুসলমানদের জীবনযাত্রা ও তাদের উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সেখানকার শাসক মুসলমানদের সাথে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন।
তিনি মুসলিম খলিফার কাছে বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ আটটি জাহাজ বোঝাই করে উপহার উপঢৌকন পাঠালেন। এসব উপহার উপঢৌকনের মধ্যে দামী তৈজসপত্র ছাড়াও ছিল কিছু হিন্দুস্থানী উন্নত ঘোড়া অন্যান্য গৃহপালিত ও বন্য পশু, কিছু সংখ্যক হাবশী দাস দাসী।
এসব উপহার সন্দ্বীপের রাজা পাঠিয়েছিলেন সন্দীপে বসবাসকারী মুসলমানদের দিয়ে। তাদের জাহাজে ছিল কিছু সংখ্যক আরব ব্যবসায়ী যারা আরব ও হিন্দুস্তানে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে যাতায়াত করতেন। তাছাড়া কিছু
সংখ্যক মুসলমান পরিবার আরব ভূখণ্ডে তাদের আপনজনদের সাথে সাক্ষাতের জন্যেও রওয়ানা হয়েছিল। এই কাফেলায় আরো ছিলেন কিছু সংখ্যক উমরার উদ্দেশ্যে সফরকারী মুসলমান। এদের সাথে এমন কিছু তরুণ-তরুণী ছিল যারা হিন্দুস্তানের অধিবাসী আরব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে। তাদের পিতা-মাতার মূল জন্মভূমি আরব দেশ দেখতে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে রওয়ানা হয়েছিল আরব ভূ-খণ্ডে। সন্দ্বীপ ও মালাবার থেকে যেসব মুসলমান আরব দেশে সফর করতো, তাদেরকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, তারা যেন সিন্ধু এলাকা থেকে অনেক দূর দিয়ে যাতায়াত করে। যাতে তারা সিন্ধু এলাকার নৌ-ডাকাতদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে পারে। কিন্তু এই আটটি জাহাজ সিন্ধু উপকূলে পৌছার আগেই সাগরের আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেল। বইতে শুরু করল উল্টো বাতাস। মাল্লারা জাহাজকে আটকাতে বহু চেষ্টা করলো কিন্তু ঝড়ো বাতাসের কারণে আটকানো সম্ভব হলো না। বাতাসের ধাক্কায় জাহাজ সিন্ধু উপকূলে চলে গেল।
এমতাবস্থায় সামুদ্রিক তুফানের চেয়ে আরো ভয়ংকর মনুষ্য তুফানে আক্রান্ত হলো জাহাজ। আরব মুসাফিরদের জাহাজে হানা দিলো সিন্ধু অঞ্চলের নৌ-ডাকাতেরা। এরা অনেকগুলো নৌকা নিয়ে চতুর্দিক থেকে আরব জাহাজগুলোকে ঘিরে ফেলল এবং তীরবৃষ্টি বর্ষণ করতে শুরু করল। এক পর্যায়ে লম্বা রশি ফেলে আরবদের জাহাজে চড়তে শুরু করল। এদিকে আরব বনিকদের অধিকাংশেরই কোন অস্ত্র চালনার ট্রেনিং ছিল না। জনাকয়েক যুবকের হাতে মামুলী অস্ত্র ছিল, প্রতিরোধ করতে গিয়ে তারা সবাই ডাকাতের হাতে নিহত হয়েছে।
জাহাজের সব ধন-দৌলত ডাকাতরা লুট করে, আরোহীদেরকে বন্দি করে নারী-পুরুষ, শিশুসহ সবাইকে ডাভেলের কারাগারে আটকে রেখেছে। হাজ্জাজকে জাহাজ লুটের বিস্তারিত ঘটনা শোনাতে শোনাতে মুসাফিরের আওয়াজ রুদ্ধ হয়ে এলো। কণ্ঠ হয়ে এলো অস্পষ্ট। হাজ্জাজ তার সামনে খাবার ও পানীয় এগিয়ে দিলেন; কিন্তু মুসাফির এই বলে খেতে অস্বীকার জানালো যে, আমি এক আরব কন্যার ফরিয়াদ শোনানো পর্যন্ত বেঁচে থাকবো, এরপর আমার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। ক্ষীণ কণ্ঠে খুবই কষ্টে মুসাফির বলল, ডাকাতরা আমাদেরকে যখন ডাভেলের উপকূলে নামালো, তখন ওরা সবাইকে নির্বিচারে চাবুক মারতে
শুরু করে। ওরা আমাদেরকে চাবুক মেরে মেরে তাড়িয়ে নিচ্ছিলো। কিন্তু বনী রাবিয়ার এক তরুণী ডাকাতদের এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পশ্চিম দিকে মুখ করে হাত তুলে চিৎকার করে বলল, হে হাজ্জাজ! আমাদের সাহায্য করো, হে হাজ্জাজ! আমাদের সাহায্য করো।”
“হাজ্জাজ মৃত্যু পথযাত্রী আগন্তুকের কথা শুনে আবেগতাড়িত হয়ে বলে ওঠেন “লাব্বাইক ইয়া বিনতি! লাব্বাইক ইয়া বিনতি! হে কন্যা আমি আসছি! হে আত্মজা, আমি অচিরেই তোমার পাশে উপস্থিত হচ্ছি।” আগন্তুক আরো জানালো, গভর্নর! আপনি জেনে রাখুন, ওখান থেকে কোন বন্দির বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ডাকাতরা যখন দল বেঁধে তাড়িয়ে নিচ্ছিল, বেলাভূমিতে পথিমধ্যে অসংখ্য পুরনো নৌকা ছিল। আমি ছিলাম পিছনের সারিতে। হঠাৎ একলোক আমাকে আরবী ভাষায় ইঙ্গিত করে বলল, এদিকে এসো, লুকিয়ে পড়ো এ ভাঙা নৌকার আড়ালে। আমি এক সাথীর হাত ধরে টেনে নিয়ে একটি বড় নৌকার আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। ডাকাত দল অন্যদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল। সেই আরব লোকটি মধ্যবয়সী ছিল। ডাকাত দল যখন অনেক দূরে চলে গেল, তখন আরব লোকটি আমাকে জানালো, “আমার নাম বেলাল বিন উসমান। বিদ্রোহী হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আমি স্বেচ্ছায় এ দেশে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমি ডাভেলে থাকি
আমি থাকি এখান থেকে অনেক দূরে রাজা দাহিরের রাজ্যে। আমি রাজা দাহিরের স্ত্রী রাণীর একান্ত প্রহরী। সমুদ্র সফরের জন্য রাণী এখানে এসেছে। আমি যখন দেখলাম, ডাকাতরা আমার দেশের লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাই আমি এদিকে এসেছিলাম। আমি বেশীক্ষণ এখানে থাকতে পারবো না। আমি তোমাদেরকে দুটো ঘোড়া দিচ্ছি। এতে সওয়ার হয়ে সোজা বসরার শাসকের কাছে পৌছে যাবে। হাজ্জাজকে গিয়ে বলবে, এসব ডাকাত রাজা দাহিরের লোক। রাজা দাহির যাকে ডাভেলের শাসক নিযুক্ত করেছে, সে নিজেই ডাকাতদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। ডাকাতদের আস্তানা থেকে কোন বন্দির মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। বেলাল দুটি ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে সন্ধ্যার আগেই আমাদেরকে ডাভেল থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
আমার সঙ্গীর ঘোড়া বিরামহীনভাবে দৌড়ে ক্ষুৎপিপাসায় রাস্তায় পড়ে যায়। আমি পিছনে ফিরে দেখলাম, আমার সাথী ঘোড়ার নীচে পড়ে গেছে, আর ঘোড়াটি হাঁপাতে হাঁপাতে মরে গেল। কিন্তু আমার থেমে গিয়ে ওকে সাহায্য করার সুযোগ ছিল না। আমি আমার ঘোড়াকে চাবুক মারলাম। যখন
আমার ঘোড়াটিও ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে এলো তখন আমি একটি সৈন্য শিবির দেখে ওখানে ঘোড়া বদল করলাম। এরপর পথের আরেকটি সেনা ছাউনী থেকে এ ঘোড়াটিও বদল করে নিলাম। রাস্তায় আমি এক ঢোক পানি পানের জন্যেও থামিনি…। একথা বলেই আগন্তুকের যবান বন্ধ হয়ে গেল এবং থেমে গেল ঠোটের নড়াচড়া। চোখ দুটো বুজে এলো। দেখতে দেখতে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। . অবস্থা দৃষ্টে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মধ্যে এমনই অস্থিরতা সৃষ্টি হলো যে, তিনি অস্থিরভাবে পায়চারী করতে লাগলেন এবং রাগে ক্ষোভে দাঁতে দাঁত পিষতে শুরু লাগলেন।
তখন আরব সাগরের কুলে অবস্থিত মাকরান ইসলামী শাসনের অধীনস্থ ছিল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ বিন হারুন নাসিরীকে মাকরানের উপশাসক নিযুক্ত করেছিলেন। রাজা দাহিরের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় খলিফার জন্য প্রেরিত উপহার উপঢৌকন জলদস্যুদের দ্বারা লুষ্ঠিত ও আরব বংশোদ্ভূত মুসলমান নারী শিশুসহ জাহাজের সকল মুসলমান আরোহীকে জলদস্যুরা রাজা দাহিরের রাজ্যে বন্দি করে রাখার সংবাদ এবং একজন আরব কন্যার ফরিয়াদ ও উদ্ধার অভিযানের আহবানের দাস্তান হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জাতিত্ববোধ প্রচণ্ডভাবে নাড়িয়ে দেয়, চরম প্রতিশোধের আক্রোশে তার দেমাগে আগুন ধরে যায়। তিনি তখনি রাজা দাহিরের নামে একটি চরমপত্র লিখে দূতের মাধ্যমে দাহিরের কাছে পাঠিয়ে দেন। হাজ্জাজ লেখেন, রাজা দাহির! তুমি তোমার রাজ্যে যেসব আরব মুসলমানকে বন্দি করে রেখেছ, তাদেরকে এই পত্র পৌছামাত্র সসম্মানে তাদের জাহাজে সওয়ার করে আরবে ফেরত পাঠাবে। সেই সাথে লুষ্ঠিত মালপত্র, ধন-দৌলত সব একটি জাহাজে দিয়ে দেবে। তাছাড়া যাদের বন্দি করে ক্ষতি করেছে এর ভর্তুকিও দিতে ভুল করবে না।” হাজ্জাজ তার লিখিত পত্রে খলিফার সীল না লাগিয়ে নিজের সীলমোহর লাগিয়ে পত্রটি দূতের মাধ্যমে রাজা দাহিরের কাছে না পাঠিয়ে মাকরানের শাসক মুহাম্মদ বিন হারুনের কাছে পাঠিয়ে তাকে লিখে দিলেন, তুমি তোমার কোন উর্ধ্বতন অফিসারকে দূতের সাথে পাঠাবে এবং সিন্ধু রাজা দাহিরকে বন্দীদের মুক্তির জন্য আবেদন করবে না, বরং বলবে, আমার পত্র পাওয়া মাত্রই কথা মতো কাজ করলেই তার জন্য ভালো হবে। হাজ্জাজ একথাও মাকরানের শাসককে লিখে দিলেন, তিনি যেন মাকরানে গোয়েন্দা ব্যবস্থা আরো তীব্রতর করেন এবং আরো দক্ষ গোয়েন্দা নিয়োগ করেন।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দীর্ঘদিন ধরে রাজা দাহিরের ওপর বজ্র হয়ে আঘাত হানার জন্য একটা উপায় তালাশ করছিলেন। মুসলমানদের জাহাজ লুণ্ঠন হাজ্জাজের হাতে সেই সুযোগ এনে দিলো। জাহাজ লুটের ঘটনা শোনার পর থেকে হাজ্জাজের নাওয়া-খাওয়া, আরাম-আয়েশ নিঃশেষ হয়ে গেল। প্রতিশোধের অগ্নিস্পৃহা তার হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দিলো। তিনি রাজা দাহিরের জবাবের অপেক্ষা না করেই সিন্ধু রাজ্যে আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন।
অল্পদিনের মধ্যেই রাজা দাহিরের জবাব পৌছে গেল হাজ্জাজের কাছে। দূত জানালো, সে মাকরানের শাসকের দেয়া একজন অফিসারকে নিয়ে রাজা দাহিরের রাজধানী ব্রাহ্মণবাদে গিয়ে রাজা দাহিরের সাথে সাক্ষাত করে হাজ্জাজের দেয়া পয়গাম পৌছায়। রাজা দাহিরের এক দোভাষী তাকে আরবী পয়গাম ভাষান্তরিত করে শোনাচ্ছিল। পয়গাম শোনার সময় রাজা দাহিরকে দেখে মেনে হচ্ছিল, সে হাজ্জাজের দেয়া কোন পয়গাম নয় তার কোন বিপন্ন প্রজার আবেদন শুনছে মাত্র। রাজা দাহির পয়গাম শুনে দূতের দিকে তাকিয়ে বলল, আরবদের জাহাজ রাজার লোকেরা লুট করেনি।
লুট করেছে জলদস্যুরা, এদের ওপর সিন্ধু রাজার শাসন চলে না। বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক আবুল কাসিম ফারিতা লিখেছেন, রাজা দাহির হাজ্জাজের পয়গামের জবাবে লিখেছিল, “তোমাদের জাহাজ যারা লুট করেছে এবং লোকজনকে কয়েদ করেছে এরা খুবই লড়াকু দুর্ধর্ষ। তোমরা এদের কাছ থেকে তোমাদের বন্দি ও মালপত্র ফেরত নিতে পারবে এমনটি কল্পনাও করা যায় না।” ফারিশতা লিখেন, রাজা দাহির প্রকারান্তরে এ কথাই বলল যে, তোমাদের জাহাজ আসলে আমাদের লোকেরাই লুট করেছে। কিন্তু তোমরা এ জন্য আমাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না।
তখনও পর্যন্ত হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিককে জাহাজ লুট ও নাগরিকদের বন্দি করার ঘটনা অবহিত করেন নি। কিন্তু রাজা দাহিরের জবাব আসার পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের কাছে দীর্ঘ পয়গাম পাঠালেন, সেই পয়গামে রাজা দাহিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাবও গেথে দিলেন। তা ছাড়া তিনি সিন্ধু রাজ্যে আক্রমণের জন্য খলিফার অনুমতি চাইলেন।
খলিফার দরবার থেকে সিন্ধু আক্রমণের অনুমতি দেয়া হলো না। কেন সিন্ধু আক্রমণ করা যাবে না এর পক্ষে কোন কারণ উল্লেখ করেন নি খলিফা।
খলিফার নেতিবাচক জবাব পেয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ অনুমতির প্রত্যাশায় খলিফার কাছে দীর্ঘ একটি পত্র লিখলেন। এ পত্রে তিনি খলিফাকে উজ্জীবিত এবং তার মধ্যে ইসলামী জাতীয়তাবোধ ও জাত্যভিমান জাগিয়ে তোলার জন্য জাহাজে পাঠানো উপহার উপঢৌকন এবং আরোহীদের মধ্যে থাকা নারী শিশু ও হজব্রত পালনের উদ্দেশে সফরকারীদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন। শেষ পর্যায়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা ওয়ালীদকে লিখলেন “আমীরুল মুমিনীন! আপনি হয়তো ভাবছেন, দূরবর্তী এলাকায় নতুন একটি যুদ্ধ শুরু করার কারণে বিরাট ব্যয়ভার বহন করতে হবে। আমি আপনাকে এ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, এ যুদ্ধ শুরুর আগে ও পরে যতো ব্যয় হবে আমি এরচেয়ে দ্বিগুণ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেবো।” হাজ্জাজের পীড়াপীড়িতে অবশেষে খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক যুদ্ধের অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন।
খলিফার অনুমতি পাওয়ার পর হাজ্জাজ তাৎক্ষণিকভাবে সিন্ধুরাজ্যের দিকে অভিযানের নির্দেশ দিলেন পূর্ব থেকেই প্রস্তুত রাখা সেনা ইউনিটকে। এ অভিযানে সেনাপতির দায়িত্ব দিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে নাবহানকে। আব্দুল্লাহ ইবনে নাবহান সেনাদের নিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে ধারণাতীত কম সময়ের মধ্যে ডাভেল পৌছে গেলেন।
এ অভিযানে হাজ্জাজ একটি মারাত্মক ভুল করলেন। গোয়েন্দারা তাকে রাজা দাহিরের সমরশক্তি ও সেনাদের যুদ্ধ ক্ষমতার সঠিক তথ্য চিত্র দিয়েছিল কিন্তু অত্যধিক ক্ষুব্ধ থাকার কারণে হাজ্জাজ রাজা দাহিরের বাহিনীর সমর শক্তি পর্যালোচনা করেন নি। তিনি তার সেনাদের লড়াই ক্ষমতার ওপর বেশী আশ্বস্ত ছিলেন। ভেবেছিলেন ডাভেলের পৌত্তলিক সেনারা এদের মোকাবেলায় দাঁড়ানোরই সাহস পাবে না। কিন্তু ঘটনা হাজ্জাজের ধারণার বিপরীত ঘটে গেল। রাজা দাহির অসতর্ক ছিল না। সে বুঝতে পেরেছিল তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ পত্রের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আরবরা যে কোন মূল্যে কয়েদীদের মুক্ত করতে তার দেশে আক্রমণ চালাবে। এজন্য সে সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত রেখেছিল। মুসলিম বাহিনী পৌছার খবর পেয়ে সে সকল সেনাদেরকে দুর্গ বন্দি করে
তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলল। দাহিরের সেনাদের মধ্যে বিচক্ষণ কমান্ডারের অভাব ছিল না। এরা দুর্গের বাইরে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলায় যুদ্ধ করতে রাজাকে রাজী করালো এবং তুমুল যুদ্ধ শুরু করল। শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ল মুসলিম বাহিনী। সেনাপতি আব্দুল্লাহ ইবনে নাবহান প্রথম দিনের যুদ্ধেই আচমকা এক আঘাতে নিহত হলেন ফলে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো।
সেনাপতির অবর্তমানে সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। আব্দুল্লাহ ইবনে নাবহান শত্রুদের মোকাবেলায় কোন ত্রুটি করেননি কিন্তু তার মৃত্যুটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। সেনাপতির মৃত্যুর ফলশ্রুতিতে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে যখন হতাশা ছড়িয়ে পড়লো এর পূর্ণ সুযোগ নিলো দাহিরের বাহিনী। তারা আরো প্রবল বিক্রমে আঘাত হানলো। সেনাপতি হারা বাহিনী আঘাতের তীব্রতা সামলাতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হলো। এই অনাকাক্ষিত পরাজয় হাজ্জাজের জন্য বয়ে আনলো মারাত্মক বিপর্যয়।