মৈথুনের মল্লবীর
অভিধানে ‘দক্ষ’ শব্দের অর্থ দেওয়া আছে ‘নিপুণ, পটু ৷’ সেই অর্থে ‘মৈথুনধর্মে দক্ষ’ মানে মৈথুন কর্মে পটু। বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চদশ অধ্যায়ে এই অভীধা মাত্র একজনকেই দেওয়া হয়েছে। তিনি হচ্ছেন কণ্ডু মুনি । আমরা একবার উল্লেখ করেছি যে একবার অপ্সরা প্রম্লোচ্চাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল কণ্ডু মুনির তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্য। এর বিশদ বিবরণ বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চদশ অধ্যায়ে আছে। সেই বিবরণ অনুযায়ী পূর্বকালে বেদবিদগণের শ্ৰেষ্ঠ কণ্ডু নামে এক মুনি গোমতীতীরে পরম তপস্যায় রত ছিলেন। ইন্দ্ৰ কণ্ডুর চিত্তবিকার উৎপাদনের জন্য প্রম্লোচ্চা নামী এক সুন্দরী অপ্সরাকে পাঠিয়ে দেন। প্রম্লোচ্চা কণ্ডুর চিত্তবিকার ঘটায় ৷ কণ্ডু তার সঙ্গে মন্দার পর্বতের এক দ্রোণীতে ( দুটি শৈলের সন্ধিস্থলে ) বাস করে একশত বৎসর তার সঙ্গে সঙ্গমে রত হন । একশত বর্ষ উত্তীর্ণ হলে প্রম্লোচ্চা কণ্ডুকে বলে– ‘হে ব্ৰাহ্মনী! আমি স্বগে যাইতে ইচ্ছা করি। প্ৰসন্ন হইয়া অনুজ্ঞা দাও।’ কিন্তু কণ্ডু। তৎপ্ৰতি আসক্ত হয়ে বলেন- ‘ভদ্রে । আরও কিছু দিন থাক।’ কৃশাঙ্গী প্রম্লোচ্চা আবার তার সঙ্গে এক শত বৎসর সহবাস করল । একশত বৎসর পরে প্রম্লোচ্চা আবার কণ্ডুকে বলল– ‘হে ভগবান ! অনুজ্ঞা দাও, আমি স্বর্গে যাই।’ পুনশ্চ একশত বৎসর গত হইলে শুভাননা ওই অপ্সরা প্রণয়ের মৃদুহাস্যসহ মধুর বাক্যে বলল– ‘ব্রহ্মণ ! আমি স্বর্গে যাই।’ কিন্তু কণ্ডু তাকে আলিঙ্গন করে বলল– ‘সুভ্রু ! ক্ষণকাল থাক, চিরকালের নিমিত্ত যাইবে ।’ তখন তাঁর শাপের ভয়ে ভীত হয়ে অন্সরী আরও দুশো বছর ওই ঋষির কাছে রইল । তারপর বার বার স্বৰ্গে ফিরে যেতে চাহিলে মুনি কেবল তাকে ‘থাক’ ‘থাক’ বলতে লাগলেন। প্রম্লোচ্চা শাপভায়ে মুনিকে পরিত্যাগ করল না । “তয়া চ রমতস্তস্য মহর্ষেস্তদহর্নিশম । নবং নবমভূৎ প্ৰেম মন্মথাবিষ্টচিতসঃ।।” তার মানে মন্মথাবিষ্টচিত্ত মহর্ষি তার সঙ্গে অহৰ্নিশি ( দিবা রাত্ৰি ) রমন করতে থাকলে, নব নব প্রেমের উদ্রেক হতে লাগল। এইভাবে মুনি প্রম্লোচ্চার সঙ্গে ৯৮৭ বৎসর ছয়মাস তিন দিন আনন্দ উপভোগ করল । এজন্যই কণ্ডুকে মৈথুন দক্ষ বলা হয়। এই সংসর্গের ফলে কণ্ডুর ঔরসে ও প্রশ্নোচ্চার গর্ভে মারিষা নামে এক কন্যা হয়। বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী মারিষার গর্ভে প্রজাপতি দক্ষ জন্ম গ্রহণ করে ।
।। দুই ।।
যদিও পুরাণে একমাত্র কণ্ডুকেই ‘মৈথুন দক্ষ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল তা হলেও প্ৰাচীনকালে আরও অনেকেই এই অভীধার দাবী রাখতেন। আমরা আগেই দেখেছি যে অগস্ত্য মুনি যখন লোপামুদ্রাকে স্ত্রীরূপে গ্ৰহণ করেছিলেন, তখন তিনি লোপামুদ্রাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন “প্রিয়ে! তোমার অভিলাষ আমাকে বল, তুমি আমার দ্বারা কতগুলি সন্তানের জননী হতে চাও, একটি, না একশত, না এক সহস্ৰ ?” আমরা আবার দেখছি পুরু যখন পিতা যযাতির জরা গ্ৰহণ করে পিতাকে যৌবন দিয়েছিল তখন যযাতি এক হাজার বৎসর ইন্দ্ৰীয় সম্ভোগের পর পুনরায় পুত্র পুরুকে তার যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছিল।
শ্ৰীকৃষ্ণের ষোল হাজার স্ত্রীর কথাও তো শুনেছেন ? তবে যা শুনেছেন, তার মধ্যে একটু ভুল আছে। সংখ্যাটা ষোল হাজার নয়। পুরাণ অনুযায়ী ষোল হাজার একশত। এ সম্মন্ধে লোকের আরও একটা ভুল বিশ্বাস আছে। লোকের ধারণা এরা সব গোপবালা ছিল। তা নয় । সকলেই নানাদেশ থেকে অপহৃত (abducted ) মেয়ে ছিল। (‘তাঃ কন্যা নরকেণাসন সর্বতে যা সমাহৃতাঃ”, বিষ্ণুপুরাণ ৫।৩১৷১৪ ) । পুরাণে লিখিত আছে যে একই সময়ে পৃথক পৃথক ভাবে গোবিন্দ সেই সকল কন্যার ধর্মানুসারে বিধি অনুযায়ী পাণিগ্রহণ করেছিলেন, যাতে সেই সকল কন্যাগণ প্ৰত্যেকে মনে করেছিল যে শ্ৰীকৃষ্ণ মাত্র তাকেই বিবাহ করলেন । তা ছাড়া, প্ৰতিরাত্রেই তিনি তাঁদের প্রত্যেকের ঘরে গমনপূর্বক বাস করতেন । ( “নিশাসু চ জগৎস্রষ্টা তাসাং গেহেষু কেশবঃ” )
।। তিন ।।
প্ৰাচীনকালের এ সকল ব্যক্তির কথা পড়লে মনে হবে যে তারা সব যৌন শক্তিধর বা Sexual athlete ছিলেন। মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল । কেননা মনু ও শতরূপা যখন ব্ৰহ্মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল–“পিতঃ কোন কর্মের দ্বারা আমরা আপনার যথোচিত সেবা করব ?” ব্ৰহ্মা বলেছিলেন—“তোমরা মৈথুন কর্মদ্বারা প্ৰজা উৎপাদন কর। তাতেই আমার তুষ্টি।” পরবর্তীকালে এটাই “পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা”–এই বচনে প্ৰকাশ পেয়েছিল। এটাই বায়োলজির পরম সত্য ।