বিদ্যাধর ও বিদ্যাধরীদের আচরণ
এদেশের লোক অতি প্ৰাচীন কাল হতেই বিদ্যাধরীতে বিশ্বাস করে এসেছে। বিদ্যাধরী কারা ? অভিধান খুলে দেখি, বিদ্যাধরীরা দেবযোনি বিশেষ। তবে অন্য সূত্র থেকে জানতে পারা যায়, এরা পৃথিবী ও আকাশের মধ্যস্থলে বাস করে। সাধারণতঃ এরা মঙ্গলকামী অনুচর হলেও এদের নিজেদের রাজা ছিল । এরা মনুষ্য জাতির সঙ্গে বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপন করত । এদের কামরূপী বলা হত, কারণ এরা ইচ্ছা মত নিজের চেহারা পরিবর্তন করতে সক্ষম হত । ভারতীয় ভাস্কর্যে উড়ন্ত বিদ্যাধর ও বিদ্যাধরীদের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।
যাঁরা বঙ্কিমের ‘ইন্দিরা’ পড়েছেন, তঁরা জানেন যে ইন্দিরা উপেন্দ্রের কাছে আত্মপ্ৰকাশ না করে বলেছিল– ‘আমি মায়াবিনী । কামরূপে আমার অধিষ্ঠান । আমি আদ্যাশক্তির মহামন্দিরে তাহার পার্শ্বে থাকি । লোকে আমাদিগকে ডাকিনী বলে কিন্তু আমরা বিদ্যাধরী। আমি মহামায়ার নিকট কোন অপরাধ করেছিলাম, সেই জন্য অভিশাপগ্ৰস্ত হইয়া এই মানবীরূপ ধারণ করিয়াছি। পাচিকাবৃত্তি ও কুলটা বৃত্তি ভগবতীর শাপের ভিতর । তাই এই সকল অদৃষ্ট ঘটিয়াছে।’ যদি তৎকালীন পাঠকসমাজ বিদ্যাধরীদের আজগুবী বা ঐ জাতীয় কিছু বলে মনে করত তা হলে বিদ্যাধরীর অনুপ্ৰবেশ ঘটিয়ে বঙ্কিম কখনই তার উপন্যাসখানিকে অবাস্তবতার রূপ দিতেন না ।
বিদ্যাধর ও বিদ্যাধরীদের সম্বন্ধে বহু কাহিনী নিবন্ধ আছে কাশ্মীরী কবি সোমদেবের ‘কথাসরিৎসাগর’-এ । ‘কথাসরিৎসাগর’-এর রচনাকাল আনুমানিক ১০৬৩-৮১ খ্ৰীষ্টাব্দে । সোমদেব তার গ্রন্থের মধ্যে গ্ৰন্থরচনার যে ইতিহাস দিয়েছেন, তা থেকে জানতে পারা যায় যে জলন্ধর-রাজকন্যা কাশ্মীররাজ অনন্তের মহিষী সূর্যমতীর চিত্তবিনোদনের জন্য গুণাঢ্য রচিত পৈশাচী ভাষায় লিখিত ‘বৃহৎকথা” অবলম্বনে সোমদেব তাঁর গ্ৰন্থ রচনা করেছিলেন । ‘কথাসরিৎসাগর’-এর প্রথম তরঙ্গ থেকে জানতে পারা যায় যে, সিদ্ধ বিদ্যাধর ও প্রমথগণ কৈলাসচলে মহাদেব ও পার্বতীর অনুচর হয়ে তাঁদের সেবা করে থাকেন ।
‘কথাসরিৎসাগর’-এর ষষ্ঠ লম্বকে চতুস্ত্রিংশৎ তরঙ্গে মদনমঙুকার উপাখ্যানে আমরা দেখি কিভাবে বিদ্যাধর-রাজ বৎস রাজার রূপ ধারণ করে বৎসরাজার প্রণয়িণী কলিঙ্গসেনার পানিগ্ৰহণ করেছিল । সেখানে আমরা বঙ্কিমের প্রতিধ্বনিও দেখি –‘পূর্বে তুমি অপ্সরা ছিলে, এখন দেবরাজ ইন্দ্রের অভিশাপে মানুষী যোনি প্ৰাপ্ত হইয়াছ । তুমি সতী হইয়াও কর্মফলে অসতী আখ্যা প্ৰাপ্ত হইয়াছ ।’
‘কথাসরিৎসাগর’-এর রত্ন প্রভা নামক সপ্তম লম্বকের চতুশ্চত্বারিংশ তরঙ্গে কোন বিদ্যাধর অন্তরীক্ষ হতে ভূতলে নেমে বৎসরাজকে বলে–‘রাজন ! হিমালয়ের অন্তবর্তী বজ্রকুট নগরে আমার বাস এবং আমার নাম বজ্রপ্রভ । ভগবান ভবানীপতি আমার তপস্যায় তুষ্ট হইয়া আমাকে শত্রুর অজেয় করিয়াছেন । আজ আমি ভগবানকে প্ৰণাম করিয়া আসিতে আসিতে নিজ বিদ্যা প্রভাবে জানিতে পারি রাজকুমার নরবাহনদত্ত দেব উমাপতির একজন পরম ভক্ত, এবং কামদেব অংশম্ভূত, সেই ভগবানের কৃপায় তিনি স্বৰ্গ-মর্ত্য উভয়লোকে রাজত্ব করিবেন। পুরাকালে রাজা সূর্যপ্ৰভ মহাদেবকে প্ৰসন্ন করিয়া বিদ্যাধর সিংহাসনের দক্ষিনার্ধ শ্রুতশৰ্মা নামক রাজা উত্তরাধিকান্ন সূত্ৰে প্ৰাপ্ত হন ।’
শ্রুতশৰ্মা ও সূর্যপ্রভের উল্লেখ আমরা পাই পঞ্চচত্বারিংশ তরঙ্গে । সেখানে আছে– ‘অনন্তর একদিন দেবর্ষি নারদ রাজসভায় আসেন ও রাজদত্ত অৰ্ঘ্য গ্ৰহণ করিয়া উপবিষ্ট হইয়া বলিলেন, রাজন ! দেবরাজ ইন্দ্ৰ আপনাকে এই বলিবার নিমিত্ত আমাকে পাঠাইয়াছেন। আপনার যে মহাদেবের আদেশে ময়দানবের সাহায্যে মর্ত্যবাসী সূর্যপ্ৰভকে বিদ্যাধর পদে প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত কৃতসঙ্কল্প হইয়াছেন তাহা আতিশয় অযোগ্য। যেহেতু আমরা শ্রুতিশর্মাকে এই পদ প্ৰদান করিয়াছি, সেই পদ।। তাহার কুলক্ৰমাগত ভোগে থাকিবে, এইরূপ নির্ধারিত আছে। তবে যদি আপনারা আমাদিগের প্রতিকুল কাৰ্য করিতে চেষ্টা করেন, তাহা কেবল আপনাদিগের আত্মবিশ্বাস হেতু জানিবেন। আপনাকে রুদ্রযজ্ঞ করিতে উদ্যত দেখিয়া তাহার পরিবর্তে অশ্বমেধ যজ্ঞ করিতে আদেশ করা হয়, আপনি তাহাও করেন নি এই প্ৰকার সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করতঃ একমাত্র মহাদেবের আরাধনা করিলে কখনই আপনাদিগের মঙ্গল হইবে না ।’
বিদ্যাধর রাজ্যের অধিপতির পদ নিয়ে শ্রুতবর্ম ও সূর্যপ্রভের মধ্যে প্ৰতিদ্বন্দ্বিতার কথা আমরা “কথাসরিৎসাগর’-এর অষ্টম লম্বকের ‘সংগ্রাম সমাপন” নামক অষ্টচত্বারিংশ তরঙ্গেও পাই ।
এসব থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে বিদ্যাধর চক্রবর্তীর পদ নিয়ে এক সময় আর্য ও অনাৰ্য সমাজের মধ্যে সংঘাত হয়েছিল । কেননা, মহাদেব ছিলেন.অনার্য দেবতা । আর দেবরাজ ইন্দ্র হচ্ছেন আৰ্যদের দেবতা এবং অশ্বমেধও আর্যীয় অনুষ্ঠান। ‘কথাসরিৎসাগর’-এ যে সব কাহিনী আছে, তা থেকে বুঝতে পারা যায় যে বিদ্যাধরীরা অনার্য চিন্তার অবদান, এবং তারা অনাৰ্য ঐন্দ্ৰজালিক ক্রিয়াপ্রক্রিয়াদিতে দক্ষ ছিল।