হিন্দুদের কা/মশাস্ত্ৰ
যৌ*মিলন নিয়ে অনুশীলন ভারতে অতি প্ৰাচীনকাল থেকে অনুসৃত হয়েছে। এরূপ অনুশীলনমূলক গ্রন্থগুলিকে কা/মশাস্ত্র বলা হত । রতিসম্ভোগের প্রয়োজনীয়তার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৭৯ সুক্তে ! তবে কা/মশাস্ত্ৰ সম্বন্ধে অনুশীলনেরও উল্লেখ পাওয়া যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৬।২৷১২-১৩ ; ৬।৪।২-২৮ )। সেখানে খোলাখুলিভাবে বলা হয়েছে যে রমণের সময় যদি নারীর কামোদ্রেক করাতে চাও, তা হলে যোনির ওষ্ঠপৃষ্ঠ জিহবা দ্বারা লেহন করবে । (৬।৪।৯) । পরবর্তীকালে বাৎসায়নের কা*সূত্রই প্রসিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু বাৎসায়নের উক্তি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে বাৎসায়নের পূর্বে বহু আচাৰ্যই এ সম্বন্ধে অনুশীলন করেছিলেন। বাৎসায়ন বলেছেন– ‘প্রজাপতি প্ৰজা সৃষ্টি করবার পর, তাদের রক্ষার জন্য ত্ৰিবর্গ (ধর্ম, অর্থ, কা/ম ) সাধনের জন্য লক্ষ অধ্যায়ে এক শাস্ত্র উপদেশ দেন । তারই একাংশ অবলম্বন করে স্বায়ম্ভুব মনু ধর্মশাস্ত্র রচনা করেন । আর এক অংশ অবলম্বন করে বৃহস্পতি অর্থশাস্ত্র রচনা করেন । অন্য এক অংশ অবলম্বন করে মহাদেবের অনুচর নন্দী এক হাজার অধ্যায়ে কা/মশাস্ত্র রচনা করেন। পরে উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতু তাকে ৫০০ অধ্যায়ে সংক্ষেপিত করেন । তারপর পাঞ্চালাদেশীয় আচাৰ্য বাভ্রব্য আরও সংক্ষিপ্ত একটা গ্রন্থ রচনা করেন । এতে সাতটা অধিকরণ ও ১৫৯ অধ্যায় ছিল । পরে এক একটা অধিকরণ নিয়ে এক একজন আচাৰ্য বিভিন্ন বিষয়ে কা/মশাস্ত্র রচনা করেন । যথা, দত্তকাচাৰ্য পাটলিপুত্রের বারযোষিতদের নিয়ে বৈশিক অধিকরণ রচনা করেন, গোর্নদীয় ভাৰ্যাধিকারিক, গোনিকাপুত্র পারদারিক, সুবৰ্ণাভ সাম্প্রোয়াগিক, ও কুচুমার ঔপনিষদিক অধিকরণ সম্পর্কে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন।’ বাৎসায়ন তারপর বলছেন ‘বহু আচাৰ্য কর্তৃক কা/মশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয় সন্মন্ধে বহু খণ্ড খণ্ড গ্ৰন্থ রচনার ফলে, সমগ্ৰ কা/মশাস্ত্ৰ নষ্ট হবার উপক্রম হয়েছিল। দত্তকাচাৰ্য, গোর্নদীয়, গোনিকাপুত্র, সুবৰ্ণাভ, কুচুমার প্রভৃতি আচার্যগণ কর্তৃক রচিত গ্রন্থগুলি কা/মশাস্ত্রের এক এক বিশেষ বিষয় সম্পর্কে রচিত হয়েছিল, আর বাভ্রব্য রচিত গ্ৰন্থখানি আকারে বিশাল বলে সাধারণের পক্ষে তা পাঠ করা দুঃসাধ্য ছিল। সেজন্য পূর্বসূরীদের এই সকল গ্ৰন্থ অবলম্বন করে স্বল্প আয়তনের মধ্যে ‘কা*সূত্র’ রচিত হল ।’ এই হচ্ছে বাৎসায়নের কা*সূত্র রচনার ইতিহাস। বাৎসায়নের ‘কা*সূত্র’ খানি ঠিক কবে রচিত হয়েছিল, তা আমাদের জানা নেই। তবে পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে এখানা খৃষ্টজন্মের এদিক-ওদিকে দুই-এক শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল। উপরে উদ্ধৃত বাৎসায়নের উক্তি থেকে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে বাৎসায়নের সময় পর্যন্ত বাভ্রব্য রচিত বৃহৎ গ্ৰন্থখানিই কা/মশাস্ত্ৰ সম্বন্ধে একমাত্র প্রামাণিক গ্ৰন্থ ছিল । বাৎসায়নই বাভ্রব্যের লুপ্তপ্রায় গ্ৰন্থখানির সার সংগ্রহ করে সূত্রকারে ‘কা*সূত্র’ রচনা করেন । বাৎসায়নের প্রকৃত নাম ছিল মল্লনাগ । পরবর্তীকালে বাৎসায়নের গ্ৰন্থখানাই প্ৰাচীন ভারতের কা/মশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্ৰন্থ বলে স্বীকৃতি লাভ করে। এখানা ৩৬টি অধ্যায়ে, ৬৪ প্রকরণে ও সাত অধিকরণে বিন্যস্ত । সমগ্র বইখানির শ্লোক সংখ্যা হচ্ছে ১১২৫ ৷৷ বাৎসায়ন রচিত গ্রন্থের অনেকগুলি টীকা রচিত হয়েছিল। তন্মধ্যে যশোধরের ‘জয়মঙ্গলা” টীকাই প্ৰসিদ্ধ।
বাৎসায়নের ‘কা*সূত্র’ই অবশ্য যৌ*সম্ভোগ সম্পর্কিত শেষ গ্রন্থ নয়। তবে বাৎসায়নের কা*সূত্রেই আছে শেষ কথা । কেননা, বাৎসায়নের পরে যাঁরা কা*শাস্ত্ৰ সম্বন্ধে বই লিখেছিলেন, তাঁরা সবাই বাৎসায়নের ‘কা*সূত্রে’র ওপরই নিজেদের রচনাসমূহ ভিত্তি করেছিলেন । যদিও বাৎসায়নের পরবর্তী লেখকগণ বাৎসায়নের উপরই নির্ভর করেছেন, তা হলেও তাঁরা মৈথুন-ভঙ্গীর (coital postures ) অনেক কাল্পনিক বিবরণ দিয়েছেন । গণনা করে দেখা গিয়েছে যে এ সকল ভঙ্গীর মোট সংখ্যা হচ্ছে ৭২৯ ।
কা*শাস্ত্ৰ সম্বন্ধে পরবর্তীকালে যে অগণিত গ্ৰন্থ লেখা হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখের দাবী রাখে (১) খ্ৰীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষে বা নবম শতাব্দীর গোড়াতে কাশ্মীররাজ জয়াপীড়ের মন্ত্রী দামোদর গুপ্তের ‘কুট্টনীমত‘, (২) খ্ৰীষ্টীয় দশম বা একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধভিক্ষু পদ্মশ্ৰীজ্ঞান রচিত ‘নাগরসর্বস্ব‘, ( ৩) একাদশ শতাব্দীতে রচিত মহাকবি ক্ষেমেন্দ্রের বাৎসায়ন কা*সূত্রের পদ্য অনুবাদ ও ‘সময়মাতৃকা’ নামে বে*শ্যাদের সম্পর্কে একখানা বই, (৪) দ্বাদশ শতাব্দীতে কোক্কোক রচিত ‘রতিরহস্য’, এর অন্যূন চারখানা টীকা আছে, তার মধ্যে কাঞ্চীনাথের টীকাই প্ৰসিদ্ধ, (৫) চতুৰ্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মিথিলার জ্যোতিরীশ্বর কবিশেখর রচিত ‘পঞ্চ সায়ক’, (৬) পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে বা ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জৌনপুরের কল্যাণমল্লর ‘অনঙ্গরঙ্গ’, এখানা ফার্সী, উর্দু, ইংরাজী, ফরাসী ও জার্মান ভাষায় অনুদিত হয়েছে ; (৭) ষোড়শ শতাব্দীতে বিজয়নগরের রাজা ইম্মাদি প্ৰৌঢ়দেবরায়ের ‘রতিরত্নদীপিকা’, (৮) সপ্তদশ শতাব্দীতে বিকানীরের রাজা অনুপসিংহের সভাকবি ব্যাসজনার্দনের ‘কা/মাগ্রাবোধ’ । এ ছাড়া, এ সময় আরও রচিত হয়েছিল অনন্তের ‘কা/মসমূহ’, রুদ্রের ‘স্মরদীপিকা’ হরিহরের ‘শৃঙ্গারদীপিকা’ ও জনৈক জয়দেবের ‘রতিমঞ্জরী’ । অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাপণ্ডিত ভারতচন্দ্ৰ ‘রাসমঞ্জুরী’ নামে একখানা কা/মশাস্ত্ৰ বিষয়ক গ্ৰন্থ বাংলা পদ্যে রচনা করেন ।
বাৎসায়নের ‘কা*সূত্ৰ’ নাগরিক সমাজের জন্য লিখিত হয়েছিল । নাগরিক সমাজের লোকেরা কিভাবে তাদের যৌ*জীবনকে সুখময় করে তুলত তারই পরিচয় বইখানাতে পাওয়া যায়। যত রকম পদ্ধতিতে (coital postures ) মানুষ রতিক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হতে পারে তার পরিচয় বাৎসায়নের বইয়ে আছে । বাৎসায়ন একটা বিশেষ রকম পদ্ধতিতে রমণের নাম দিয়েছেন ‘ইন্দ্ৰানিক রতি’ । সেখানে বলা হয়েছে যে ইন্দ্ৰানী শচী এই বিশেষ পদ্ধতিতে রতিক্রিয়া করতে ভালবাসতেন । সেজন্যই এর নাম ‘ইন্দ্রানিক রতি’ ।