বারো
কালোপায়রা দিঘির ওপারের ছাতিমবন নিবিড় হয়েছে, তার ছায়ায় ছায়ায় উত্তর দেউলের যাবার পথে বাদুরনখী গাছের জঙ্গল তেমনি ঘন, যেমন শরৎ চিরকাল দেখে এসেছে, তবে এখনো গাছ শুকিয়ে যায় নি— সবে বেগুন রঙের ফুল ধরেছে বড় বড় সবুজ পাতার আড়ালে৷ শরৎ আগে আগে প্রদীপ হাতে রাজলক্ষ্মী পেছনে৷ কত পরিচিত পুরনো পথ, সারা জীবনই যেন অতীব শান্ত ও নিরুপদ্রব আরামে ওই বাদুড়নখী গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছে সে, তার পিতৃগৃহের পুণ্য আবেষ্টনী তার জীবনের পাথেয় যুগিয়ে এসেছে— যে জীবনের না আছে রাত্রি, না আছে অরুণোদয়—শুধু এমনি চাপা গোধূলি, হৈচৈহীন কর্মকোলাহলহীন!
প্রদীপ দিয়ে ওরা আবার ফিরল৷ পথের দুপাশে পুষ্পশ্রীর লীলায়িত চেতনা ওর আগমনে যেন আনন্দিত৷ কতকাল পরে রাজকন্যা বাড়ি ফিরেছে!
রাজলক্ষ্মী বলে, এঃ দিদি, এ ঘরে বসে রাঁধবে কি করে? জল পড়ে মেজে যে একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে!
—পিঁড়ি পেতে নেব এখন৷ তুই আমার বাপের ভিটের নিন্দে করিস নি বলে দিচ্ছি—
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, সেই ছেলেমানুষি স্বভাব এখনও যায় নি শরৎদি—
—চা খাবি?
—তা খাচ্ছি—এখন বলো এতকাল কোথায় ছিলে তোমরা?
—রাজারাজড়ার কাণ্ড, একটু হিল্লিদিল্লি বেড়িয়ে আসা গেল!
—সে তো বুঝতেই পারছি৷
—আজ রাত্তিরে এখানে খাবি রাজলক্ষ্মী৷ কিন্তু কিছু নেই বলছি, শুধু ধুঁধুলভাতে, ধুঁধুলভাজা৷ ভাঙা ঘরে এই দুই তরুণীতে বসে বহুকাল পরে আবার আসর জমালে—ওদিকে দুই বৃদ্ধ উঠোনে দুই কাঁঠালকাঠের পিঁড়ি পেতে বসে অনেক রকম রাজা-উজির বধের গল্প করছিলেন৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে ইতিমধ্যে চলে গিয়েছেন৷
—ভাই, জ্যাঠামশায় আর বাবাকে চাটুকু দিয়ে আয় তো—
রাজলক্ষ্মী চা দিতে গেলে কেদার বললেন, আরে আমার মা-লক্ষ্মী যে! আয় আয়—কতকাল পরে দেখলাম, ভালো ছিলি?
গোপেশ্বর চাটুজ্জেও বললেন, হ্যাঁ, এ খুকিকে তো দেখেছি বটে এখানে—কি নাম যেন তোমার মা?
রাজলক্ষ্মী দুজনের পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে রান্নাঘরে চলে গেল৷
কেদার বললেন, দাদা, এবার এখানে কিছুদিন থেকে যাও৷ একসঙ্গে দিনকতক কাটানো যাক—
—শরৎ-মা বলছিল—তীর্থভ্রমণে একবার চলুন, বেরুনো যাক রাজামশাই—
কেদার নিশ্চিন্ত আরামে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বললেন, আর কোথাও বেরুতে ইচ্ছে করে না দাদা৷ বিদেশে বড় গোলমাল—শুনলে তো সবই! আমাদের এই জায়গাটাই ভালো—বাইরে নানারকম ভয়৷ কেন এখানে ওখানে বেরুনো—আমার হাতে এখনো যা টাকা আছে, এ বছরটা হেসে খেলে চলে যাবে৷ খাজনাপত্তর কেউ দেয় নি দুটি বছর—কাল থেকে আবার তাগাদা শুরু করি৷
শরৎ নিজে তামাক সেজে আনতেই গোপেশ্বর চাটুজ্জে হাঁ হাঁ করে উঠলেন৷ —তুমি কেন মা—তুমি কেন? আমাকে বললেই তো হত—এসব আমি পছন্দ করি নে, মেয়েদের দিয়ে তামাক সাজানো! রাজামশায়ের তামাক আমি সাজব৷
কেদার বললেন, তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় দাদা৷ আর যে উপকার তুমি করেছ, তার ঋণ আমি বা আমার মেয়ে কেউ শুধতে পারব না৷ আমার এ বাড়িতে যতদিন ইচ্ছে থাকো, তোমার বাড়ি তোমার ঘর-দোর৷ আমার মেয়ে তোমার আমার তামাক সাজবে এ আর বেশি কথা কি দাদা?
গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, আচ্ছা রাজামশাই, এই কালোপায়রা দিঘি৷ ওপারের বন কেটে বেশ আলু হয়—কিছু বীজ এনে—
—না দাদা, ওসব আমাদের বংশে নেই৷ চাষকাজ করে চাষা লোকেরা৷ আমার দরকার হয় গড়ের জঙ্গল থেকে মেটে আলু তুলে আনব৷ সোজা মেটে আলুটা হয় গড়ের জঙ্গলে৷ সে বছর উত্তর দেউলের গায়ের বন থেকে আলু তুলেছিলাম এক একটা আধমণ ত্রিশ সের৷ আলুর অভাব কি আমার?
হঠাৎ জগন্নাথ চাটুজ্জেকে পুনরায় আসতে দেখে উচ্চকণ্ঠে বললেন, ও শরৎ, জগন্নাথ খুড়ো আসছেন—আর একটু চা পাঠিয়ে—
জগন্নাথ চাটুজ্জে আসতে আসতে বললেন, তুমি বাড়ি এসেছ শুনে অনেকে দেখা করতে আসছে কেদার রাজা৷ আমি গিয়ে সাতকড়ির চণ্ডীমণ্ডপে খবরটা দিয়ে এলাম—সেই জন্যেই গিয়েছিলাম৷ ওঃ, একটু তেল আনতে বলো তো শরৎকে! বিছুটি যা লেগেছে গায়ে—বড্ড বিছুটির জঙ্গল বেড়েছে গড়ের খালের পথটাতে৷ ছিলে না অনেকদিন, চারিধারে বনজঙ্গল হয়ে—
গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, কাল আমি সব কেটে সাফ করে দেব—দেবেন তো দেখিয়ে জায়গাটা!
জগন্নাথ চাটুজ্জে এসেছেন এদের সব খবর সংগ্রহ করতে৷ একটু পরেই তিনি বড় বেশি আগ্রহ দেখাতে লাগলেন, একা এতদিন কোথায় ছিলেন, কি ভাবে কাটল সে-সব খবর জানতে৷ জগন্নাথ বললেন, তুমি কি বরাবর হিংনাড়ায় ছিলে এই দেড় বছর—না আর কোথাও—
—না, আমি—গিয়ে হিংনাড়াতেই—
—কাদের আড়তে বললে—
—ঘোষেদের আড়তে৷ বিপিন ঘোষ বিনোদ ঘোষ দুই ভাই—ওদেরই—
—মাটসের বিনোদ ঘোষ?
—মাটসে তো ওদের বাড়ি নয়, শত্রুঘ্নপুর—
—সে আবার কোন দিকে? নাম তো শুনি নি—
—শত্রুঘ্নপুর বাজিতপুর—রামনগর থানা৷
কেদার ক্রমশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন জগন্নাথ চাটুজ্জের জেরায়৷ এত খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করবার কি দরকার তিনি বুঝতে পারলেন না৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে পরের ছিদ্র অনুসন্ধান করে জীবন কাটিয়ে দিলেন কিনা, তাই ভয় হয়৷
গোপেশ্বরকে দেখিয়ে জগন্নাথ বললেন, ইনি সেই একবার তোমার এখানে এসেছিলেন না? চমৎকার হাত তবলার৷ একদিন শুনতে হবে আবার৷
—হ্যাঁ৷
—শরৎ বুঝি এঁর পরিবারের সঙ্গে তীর্থ করে এল?
—হ্যাঁ৷
—বেশ বেশ৷
জগন্নাথ চাটুজ্জে হঠাৎ বললেন, ভালো কথা কেদার ভায়া, শুনেছ বোধ হয়, প্রভাসের বাবা হারান বিশ্বেস মারা গিয়েছে আজ বছরখানেক হল৷ প্রভাসদের কলকাতার বাড়িতে তোমরা তো প্রথম যাও—না?
কেদারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে কতটা জানে বা না জানে আন্দাজ করা শক্ত৷ কি ভেবে ও কি কথা বলছে, তাই বা কে জানে? হঠাৎ প্রভাসের কথা তোলার মানে কি?
তবুও সত্য কথার মার নেই ভেবে তিনি বললেন, প্রভাসদের বাড়িতে তো ছিলাম না আমরা৷ একটা বাগানবাড়িতে আমাদের থাকবার জায়গা করে দিয়েছিল৷
—কতদিন সেখানে ছিলে তোমরা?
—বেশি দিন নয়—দিন পনেরো৷
—তার পর কোথায় গেলে?
এইবার জবাব দিলেন গোপেশ্বর চাটুজ্জে৷ বললেন, তার পর একদিন আমার সঙ্গে হঠাৎ দেখা৷ আমি ওঁদের সঙ্গে দেখা করলাম বাগানবাড়িতে গিয়ে তার পরদিন সকালে৷ আমার বাড়ির সকলে তীর্থ করতে বেরিয়েছিল—সেই সঙ্গে শরৎকে নিয়ে গেলাম৷ রাজামশাই দেশে চলে আসছেন, হিংনাড়ার বাজারে ঘোষেদের আড়তের একজন কর্মচারীর সঙ্গে ওঁর চেনা ছিল—সে নিয়ে গিয়ে চাকরি জুটিয়ে দিলে৷ এই হল মোট ব্যাপার৷ কেমন, এই তো রাজামশাই?
—হ্যাঁ, ওই বৈকি৷
.
দুপুরবেলা৷ কেউ কোথায় নেই৷ গোপেশ্বর কালোপায়রার দিঘিতে মাছের চার করতে গিয়েছেন, আহারাদির পর কেদারকে নিয়ে মাছ ধরতে যাবেন৷
শরৎ বাবাকে একা পেয়ে বললে, আচ্ছা বাবা, আমার খোঁজ করলে না কেন?
কেদার এ কথার কি উত্তর দেবেন? এ সব ব্যাপারকে তিনি এড়িয়ে চলতে চান—জীবনের সব চেয়ে বড় ধাক্কাকে তিনি ভুলে যেতে চেষ্টা করে আসছেন—তাঁর সব চেয়ে ভয় মেয়ে পাছে আবার ওইসব কথা তোলে৷
আমতা আমতা করে বললেন, তা—খোঁজ করি কোথায়? আমার—
—তোমাকে ওরা বলেছিল আমি ইচ্ছে করেই তোমার সঙ্গে দেখা করি নি—না? বলো বাবা, তা যদি বিশ্বাস করে থাকো আমি তোমার সামনেই দিঘির জলে ডুবে মরব৷
এবার কেদার যেন একটু বিচলিত হলেন, তাঁর অনড় আত্মস্বাচ্ছন্দ্য-বোধ এইবার একটু ধাক্কা খেলে৷ মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে তিরস্কারের সুরে বললেন, তাই তুই বিশ্বাস করিস যে আমি ওসব ভাবতে পারি? দে—একটু তেল দে মাখবার— দেখি আবার গোপেশ্বর ভায়া মাছের চারের কতদূর কি করলে! তোর রান্না হল?
—বেশ বাবা, কি নিশ্চিন্দিই থাকতে পার তুমি, তাই শুধু আমি ভাবি৷ ঘরে আগুন লাগলেও বোধ হয় তোমার সাড়া জাগে না—মানুষে যে কি করে তোমার মতো—আচ্ছা আর একটা কথা জিজ্ঞেস করি—উত্তর দেবে?
কেদার বিষণ্ণ মুখে বললেন, কি?
—প্রভাসের নামে তোমাকে কেউ কিছু বলেছিল তো? সেই মুখপোড়া গিরীনই বলে থাকবে৷ তুমি পুলিসে খবর দিলে না কেন?
—তারাই বললে পুলিসে খবর দেবে তোর নামে৷ তাতেই তো আমি পালিয়ে এলাম৷
পুলিসের কাছে নালিশে কে আসামী কে ফরিয়াদি হয় এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই শরতের—ওসব বড় গোলমেলে ব্যাপার৷ সে চুপ করে রইল৷
কেদার বললেন, কষ্ট পেয়েছিস না মা?
—যাও, তোমাকে আর—
—না মা, ছিঃ, রাগ করতে নেই৷ কি রাঁধছিস? বেগুন এনে দেব এখন ওবেলা৷ গেঁয়োহাটি যাব তাগাদা করতে, ব্যাটারা আজ দু-বছর খাজনার নামটি করে নি৷
—করবে কি? তুমি ছিলে এ চুলোয়? মেয়েকে ভাসিয়ে দিয়ে নিজেও ভেসে পড়েছিলে৷ কি নির্বিকার পুরুষমানুষ তুমি তাই শুধু ভাবি বাবা৷
শরতের এ মেজাজকে কেদারের চিনতে বাকি নেই৷ এ সময় ওর সামনে থাকতে যাওয়া মানে বিপদ টেনে আনা৷ কেদার তেল মেখে সরে পড়লেন৷ বাবাকে যতক্ষণ দেখা গেল শরৎ চেয়ে চেয়ে দেখলে, তারপর তিনি কালোপায়রা দিঘির পাড়ের বন-ধুঁধুলের লতাজালের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলে শরৎ দুই হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল৷ তার বাবা, তাদের বনজঙ্গলে ঘেরা এত বড় গড়বাড়ি, কত পুরনো ভাঙা মন্দির, উত্তর দেউল, বারাহী দেবীর ভগ্ন পাষাণমূর্তি, ওই ছায়ানিবিড় ছাতিমবন—এসব ফেলে তাকে কোথায় চলে যেতে হয়েছিল ভাগ্যের বিপাকে! আর যদি সে না ফিরত, আর যদি বাবাকে না দেখতো, গড়বাড়ির মাটির পুণ্যস্পর্শলাভের সৌভাগ্য যদি আর না ঘটত তার?
কার পায়ের শব্দে সে মুখ তুলে দেখলে রাজলক্ষ্মী একটা বাটি হাতে রান্নাঘরের দাওয়ায় উঠছে৷ এই আর একটি মানুষ—যাকে দেখে শরৎ এত আনন্দ পায়! দেড় বছরের মধ্যে কত জায়গা সে বেড়াল, কত নতুন নতুন মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল—কিন্তু এমন কি একটা দিনও গিয়েছে যেদিন সে এই গরিব ঘরের মেয়েটার কথা ভাবে নি৷
—কি রে ওতে?
—তোমাদের জন্যে একটু সুত্তু�নি—মা বললেন জ্যাঠামশায়কে দিয়ে আয়—
—খাওয়া হয়েছে?
—পাগল! এখুনি খাওয়া হবে? তোমাদের এখান থেকে গিয়ে নাইব—তার পর—
—আর বাড়ি যায় না, এখানেই খা—
—না, না শরৎদি—
—খেতেই হবে৷ আচ্ছা, কেন অমন করিস বল তো? কতকাল দুই বোনে বসে একসঙ্গে খাই নি তা তোর মনে পড়ে? মোটে কাল আর আজ যদি হয়—সত্যি ভাই, বিশ্বাস এখনও যেন হচ্ছে না যে, আমি আবার গড়শিবপুরের ভিটেতে বসে আছি৷ একযুগ পরে আবার এ মাটিতে—
রাজলক্ষ্মীকে শরৎ এখনও সব কথা খুলে বলে নি৷ রাজলক্ষ্মীও ওকে খুঁটিনাটি কিছুই জিজ্ঞেস করে নি প্রথম আনন্দের উত্তেজনায়৷ শরৎ মনে মনে ঠিক করে রেখেছে রাজলক্ষ্মীকে সে অবসর সময়ে সব খুলে বলবে৷ বন্ধুত্বের মধ্যে দেওয়াল তুলে রাখা তার পছন্দ হয় না৷
শরৎ বললে, এই দেড় বছরের গাঁয়ের খবর বল—কিছুই তো জানি নে৷
—চিন্তে বুড়ি মরে গিয়েছে, জানো?
—আহা, তাই নাকি? কবে মোলো?
—ফাল্গুন মাসে৷ গুরুপদ জেলের সেই হাবা ছেলেটা মরে গিয়েছে আষাঢ় মাসে৷ ম্যালেরিয়া জ্বরে৷
—আহা!
—পাঁচী গয়লানীর বাড়ি চোর ঢুকে সব বাসন নিয়ে গিয়েছিল৷ থানার দারোগা এল, এর নাম লিখলে, ওর নাম লিখলে—কিছুই হল না শেষটা৷
—ভালো কথা, ওপাড়ার সেজখুড়িমার ছেলেপিলে হবে দেখে গিয়েছিলাম—
—একটা ছেলে হয়েছে—বেশ ছেলেটি৷ দেখতে যাবে কাল?
—বেশ তো, চল না৷ সাতকড়ি চৌধুরীর মেয়ের বিয়ে হয়েছে?
—কেন হবে না? হাতে পয়সা আছে—মেয়ের বিয়ে বাকি থাকে?
শরৎ হেসে বললে, কেন রে, তোর বুঝি বড় দুঃখু বিয়ে না হওয়ায়?
—কার না হয় শরৎদি, যদি সত্যি কথা বলা যায়! যেমনি মা হিম হয়ে বসে আছে, তেমনি মেজখুড়িমা হিম হয়ে বসে আছে—আমার এদিকে আঠারো পেরুলো, লোকের কাছে বলে বেড়ান পনেরোতে নাকি পা দিইছি৷ এমন রাগ ধরে!
শরৎ হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি৷
—ওমা, তুই হাসালি রাজলক্ষ্মী৷ আজকালকার মেয়ে সব হল কি? সত্যি রে, তোর মনে কষ্ট হয়?
—ওই যে বললাম দিদি, সত্যি কথা বললে হাসবে সবাই৷ তুমি বললে, তাই বললাম৷
—আমি দেখব রে তোর সম্বন্ধ?
—না, হাসি না শরৎদি৷ এতদিন তুমি ছিলে না—আমার মন পাগল-পাগল হয়ে উঠত৷ এই গাঁয়ে একঘেয়ে থাকলে মানুষ পাগল হয়ে যায় না তুমিই বলো? তার চেয়ে মনে হয়—যা হয় একটা দেখে-শুনে দে, একঘেয়েমির হাত থেকে নিস্তার পাই৷ জন্মালাম গড়শিবপুর, তো রয়েই গেলাম সেই গড়শিবপুরে৷ এই যে তুমি কত দেশ বেড়িয়ে এলে শরৎদি, কেন বেড়িয়ে এলে? নতুন জিনিস দেখবার জন্যে তো?
শরৎ গম্ভীর সুরে বললে, আমার কপাল দেখে হিংসে করিস নে ভাই৷ তোকে সব খুলে বলব সময় পেলে৷
রাজলক্ষ্মী বিস্ময়ের সুরে বলল, কেন শরৎদি?
—সে কথা এখন না ভাই—বাবা আসছেন, সরে আয়—
কেদার গামছায় মাথা মুছতে মুছতে বললেন, কে ও? রাজলক্ষ্মী? বেশ মা বেশ৷ হ্যাঁ ভালো কথা শরৎ—মনে পড়ল নাইতে নাইতে—তোর মায়ের সেই কড়িগুলো কোথায় আছে মা?
শরৎ হেসে বললে, কোনো ভয় নেই বাবা, লক্ষ্মীর হাঁড়িতেই আছে৷ প্রথম দিন এসেই আমি আগে দেখে নিয়েছি৷ ঠিক আছে৷
—ও, তা বেশ৷ আর—ইয়ে—তোর মার সেই ভাঙা চিরুনিখানা?
—ওই গোল তোরঙ্গের মধ্যে রেখে গিয়েছিলাম, সেইখানেই আছে, সেও দেখে নিয়েছি সেদিন৷
—ইয়ে, ডাকি তবে গোপেশ্বর দাদাকে? রান্না হয়েছে তো?
কেদার আবার গেলেন পুকুরপাড়ে গোপেশ্বর চাটুজ্জেকে ডাকতে৷ শরৎ মৃদু হেসে রাজলক্ষ্মীকে বললে, দুটি নিষ্কর্মা আর নিশ্চিন্দি লোক এক জায়গায় জুটেছে, জ্যাঠামশায় আর বাবা—দুই-ই সমান৷ দুটিতে জুড়ি মিলেছে ভালো৷
কেদার বলতে বলতে আসছিলেন, বেহালা বাজাই নি আজ দেড় বছর দাদা৷ তারগুলো সব ছিঁড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ আজ ওবেলা ছিবাসের ওখানে আসর করা যাক গিয়ে৷ তোমার তবলাও অনেক দিন শোনা হয় নি৷
তেরো
দিন দশ-পনেরো কেটে গেল৷
এ দিনগুলো কেদার ও গোপেশ্বরের কাটলো খুব ভালোই৷ ছিবাস মুদির দোকানে প্রায়ই সন্ধ্যার পর ছেঁড়া মাদুর আর চট পেতে আসর জমে, কেদার এসেছেন শুনে তাঁর পুরনো কৃষ্ণযাত্রা দলের দোহার, জুড়ি, এখানে গায়কেরা কেউ জাল রেখে, কেউ লাঙল ফেলে ছুটে আসে৷
—রাজামশাই! ভালো ছেলেন তো? এট্টু পায়ের ধুলো দ্যান—
—বাবাঠাকুর, এ্যাদ্দিন ছেলেন কনে? মোদের দল যে একেবারে কানা পড়ে গেল আপনার জন্যি!
গেঁয়োহাটি কাপালি পাড়ার মধু কাপালি, নেত্য কাপালি এসে পীড়াপীড়ি—গেঁয়োহাটিতে একবার না গেলে চলবে না৷ সবাই রাজামশাইকে একবার দেখতে চায়৷ এদের ওপর কেদারের যথেষ্ট আধিপত্য, অন্য সময় যে কেদার নিতান্ত নিরীহ—এদের দলের দলপতি হিসাবে তিনি রীতিমতো কড়া ও উগ্র মেজাজের শাসক৷
মধুকে ডেকে বললেন, তোর যে সেই ভাইপো দোয়ার দিত সে কোথায়?
—আজ্ঞে সে পাট কাটছে মাঠে—
কেদার মুখ খিঁচিয়ে বলেন, পাট তো কাটছে বুঝতে পারছি, চাষার ছেলে পাট কাটবে না তো কি বড় গাইয়ে হবে? কাল একবার ছিবাসের ওখানে পাঠিয়ে দিয়ো তো, বুঝলে?
—যে আজ্ঞে রাজামশাই—
—আর শশীকে খবর দিয়ো, দু-বছরের খাজনা বাকি৷ খাজনা দিতে হবে না? নিষ্কর জমি ভোগ করতে লাগল যে একেবারে—
নেত্য কাপালি এগিয়ে এসে বললে, বাবাঠাকুর, আপনি যদি বাড়ি থাকতেন, তবে, সবই হত৷ তারা খাজনা নিয়ে এসে ফিরে গিয়েল—
কেদার ধমক দিয়ে বললেন, তুই চুপ কর—তোকে ফোপর-দালালি করতে বলেছে কে?
কেদারের নামে বহু লোক জড়ো হয় ছিবাসের দোকানে—কেদারের বেহালার সঙ্গে মিশেছে ওস্তাদ গোপেশ্বরের তবলা৷ পাড়াগাঁয়ে নিঃসঙ্গ দিনেরাত্রে সময় কাটাবার এতটুকু সূত্রও যারা নিতান্ত আগ্রহে আঁকড়ে ধরে—তাদের কাছে এ ধরনের গুণী-সম্মেলনের মূল্য অনেক বেশি৷ দু-তিনখানা গ্রাম থেকে লোকে লণ্ঠন হাতে লাঠি হাতে জুতো বগলে করে এসে জোটে৷ সেই পুরনো দিনের মতো অনেক রাত্রে দুজনেই অপরাধীর মতো বাড়ি ফেরেন৷
শরৎ বলে, এলে? ভাত জুড়িয়ে জল হয়ে গিয়েছে—
গোপেশ্বর আমতা আমতা করে বলেন—আমি গিয়ে বললাম মা রাজামশায়কে—যে শরৎ বসে থাকবে হাঁড়ি নিয়ে—তা হয়েছে কি, উনি সত্যিকার গুণী লোক, ছড়ে ঘা পড়লে আর স্থির থাকতে পারেন না৷ জ্ঞান থাকে না মা—
কেদার গোপেশ্বরের পেছনে দাঁড়িয়ে মনে মনে কৈফিয়ৎ তৈরি করেন৷
শরৎ ঝাঁঝের সঙ্গে বলে, আপনি জানেন না জ্যাঠামশায়, বাবার চিরকাল একরকম গেল আর যাবেও৷ আজ বলে না, কোন কালে ওঁর ছিল জ্ঞান, ওঁকেই জিজ্ঞেস করুন না?
গোপেশ্বর মিটমাটের সুরে বলেন, না না, কাল থেকে রাজামশাই আর দেরি করা হবে না৷ শরতের বড্ড কষ্ট হয়, কাল থেকে আমি সকাল সকাল নিয়ে আসব মা, রাত করতে দেব না—
এই দুই বৃদ্ধের ওপর শাসনদণ্ড পরিচালনা করে শরৎ মনে মনে খুব আমোদ পায় এবং এঁদের সঙ্কোচজড়িত কৈফিয়তের সুরে যথেষ্ট কৌতুক অনুভব করে—কিন্তু কোনো তর্জনগর্জনেই বিশেষ ফল হয় না, প্রতি রাত্রেই যা তাই—সেই রাত একটা৷ নির্জন গড়বাড়ির জঙ্গলে ঝিঁঝি পোকার গভীর আওয়াজের সঙ্গে মিশে শরতের শাসনবাক্য বৃথাই প্রতি রাত্রে নিশীথের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে৷
শরৎ বলে—আজ কিছু নেই বাবা, কি দিয়ে ভাত দেব তোমাদের পাতে? হাট না, বাজার না, একটা তরকারি নেই ঘরে, আমি মেয়েমানুষ যাব তরকারি যোগাড় করতে? ওল তুলেছিলাম কালোপায়রার পাড় থেকে একগলা জঙ্গলের মধ্যে—তাই ভাতে আর ভাত খাও—এত রাত্তিরে কি করব আমি?
কেদার সঙ্কুচিত ভাবে বললেন, ওতেই হবে—ওতেই হবে—
—তুমি না হয় বললে ওতেই হবে, জ্যাঠামশায় বাড়িতে রয়েছেন, ওঁর পাতে শুধু ওল ভাতে দিয়ে কি করে—
গোপেশ্বর তাড়াতাড়ি বলেন, যথেষ্ট, মা যথেষ্ট৷ তুমি দাও দিকি৷ ভেসে যাবে—কাঁচালঙ্কা দিয়ে ওল ভাতে মেখে এক পাথর ভাত খাওয়া যায় মা—
—তবে খান৷ আমার আপত্তি কি?
—কাল গেঁয়োহাটির হাট থেকে আমি ঝিঙে পটল আনব দুটো—মনে করে দিয়ো তো?
শরতের কি আমোদই লাগে! কতদিন পরে আবার পুরাতন জীবনের পুনরাবৃত্তি চলছে—আবার যে প্রতি নিশীথে গড়বাড়ির জঙ্গলের মধ্যে তাদের ভাঙা বাড়িতে সে একা শুয়ে থাকবে, বাবা এসে অপ্রতিভ কণ্ঠে বলবেন—ও মা শরৎ, দোর খুলে দাও মা,—এসব কখনো হবে বলে তার বিশ্বাস ছিল?
সেই সব পুরনো দিন আবার ঠিক সেই ভাবেই ফিরে এসেছে….
—জ্যাঠামশাইয়ের জন্যে একটু দুধ রেখেছি—ভাত কটা ফেলবেন না জ্যাঠামশায়—
গোপেশ্বর ব্যস্তভাবে বললেন, কেন, আমি কেন—রাজামশায়ের দুধ কই?
—বাবার হবে না৷ দু-হাতা দুধ মোটে—
—না না, সে কি হয় মা? রাজামশায়ের দুধ ও থেকেই—
কেদার ধীরভাবে বললেন, আমার দুধের দরকার নেই৷ আমরা রাজারাজড়া লোক, খাই তো আড়াইসের মেরে একসের করে খাব৷ ও দু-এক হাতা দুধে আমাদের—
কথা শেষ না করেই হা-হা করে প্রাণখোলা উচ্চ হাসির রবে কেদার রান্নাঘর ফাটিয়ে তুললেন৷
এইরকম রাত্রে একদিন গোপেশ্বর ভয় পেলেন কালোপায়রা দিঘির পাড়ের জঙ্গলে৷ বেশি রাত্রে তিনি কি জন্যে দিঘির পাড়ের দিকে গিয়েছিলেন—সেদিন আকাশে একটু মেঘ ছিল, ঘুম ভেঙে তিনি রাত কত তা ঠিক আন্দাজ করতে পারলেন না৷ দিঘির জঙ্গলের দিকে একাই গেলেন৷ কিন্তু কিছুক্ষণ পরে কোথায় যেন পদক্ষেপের শব্দ তাঁর কানে গেল—গুরুগম্ভীর পদক্ষেপের শব্দ৷ উৎকর্ণ হয়ে কিছুক্ষণ ধীরে ধীরে পা ফেলে চলেছে—তাঁর দিকেই ক্রমশ এগিয়ে আসছে নাকি? চোর-টোর হবে কি তা হলে? না কোনো ছাড়া গরু বা ষাঁড়—
কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে হল এ পায়ের শব্দ মানুষের নয়—গরু বা ষাঁড়েরও নয়৷ পদশব্দের সঙ্গে কোনো কঠিন জিনিসের যোগ আছে—খুব ভারি ও কঠিন কোনো জিনিস৷
এক-একবার শব্দটি থেকে যায়—হয়তো এক মিনিট….তার পরেই আবার….
হঠাৎ গোপেশ্বরের মনে হল শব্দটি যেন—তাঁকেই লক্ষ্য করে হোক বা নাই হোক—মোটের ওপর খুব কাছে এসে গিয়েছে৷ তিনি আর কালবিলম্ব না করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে নিজের ঘরে ঢুকতেই পাশের বিছানা থেকে কেদার জেগে উঠে বললেন কি, কি—অমন করছ কেন দাদা?
—ইয়ে, একবার বাইরে গিয়েছিলাম—কিসের শব্দ—তাই ছুটে চলে এলাম—কেমন যেন গা ছম-ছম—
—শব্দ? ও শেয়াল-টেয়াল হবে—
—না দাদা, মানুষের পায়ের শব্দের মতো, ভারি পায়ের শব্দ—যেন ইট পড়ার মতো—
কেদার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, হুঁ, আজ কি তিথি?
—তা কি জানি, তিথি-টিথির কোনো খোঁজ রাখি নে তো—
—হুঁ৷ নাও শুয়ে পড় দাদা…একটা কথা বলি অমন একা রাত্তির বেলা যেখানে-সেখানে যেয়ো না—দরকার হয় ডাক দিয়ো!
.
রাজলক্ষ্মী দুপুরবেলা হাসিমুখে একখানা চিঠি হাতে করে এসে বললে, ও শরৎদি, তোমার নামে কে চিঠি দিয়েছে দ্যাখো—
শরৎ সবিস্ময়ে বললে, আমার নামে! কে আনলে?
—দাদার সঙ্গে পিওনের দেখা হয়েছিল বাজারে—তাই দিয়েছে—
—দেখি দে—
—কোথাকার ভাবের মানুষ চিঠি দিয়েছে দ্যাখো খুলে—
বলে রাজলক্ষ্মী দুষ্টুমির হাসি হাসলে!
শরৎ ভ্রূকুটি করে বললে, মারব খ্যাংরা মুখে যদি ওরকম বলবি—তোর ভাবের মানুষেরা তোকে চিঠি দিক গিয়ে—জন্মজন্ম দিক গিয়ে—
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক শরৎদি, তাই বলো—তাই যেন হয়৷
—ওমা, অবাক করলি যে রে রাজি! সত্যি তাই তোর ইচ্ছে নাকি?
—যদি বলি তাই?
—ওমা, আমার কি হবে!
—অমন বোলো না শরৎদি৷ তুমি এক ধরনের মানুষ, তোমার কথা বাদ দিই—কিন্তু মেয়েমানুষ তো, ভেবে দ্যাখো৷ আমার বয়েস কত হয়েছে হিসেব রাখো?
শরৎ সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বললে, কেউ আটকে রাখতে পারবে না যেদিন ফুল ফুটবে, বুঝলি রাজি? কাকাবাবুর হাতে পয়সা থাকলে কি আর এতদিন—ফুল যেদিন ফুটবে—
—ফুল ফুটবে ছাতিমতলার শ্বশান-সই হলে—নাও, তুমি যেমন! খোলো চিঠিখানা দেখি—শরৎ চিঠি খুলে পড়ে বললে, কাশী থেকে রেণুকা চিঠি দিয়েছে—বাঃ—
—সে কে শরৎদি?
—সে একটা অন্ধ মেয়ে৷ বিয়ে হয়েছে অবিশ্যি৷ গরিব গেরস্ত, এ চিঠি তার বরের হাতে লেখা, সে তো আর লিখতে—
—কাশীতে থাকে? কি করে ওর বর?
—চাকরি করে কোথায় যেন—
—দেখতে কেমন?
—কে দেখতে কেমন? মেয়েটা না তার বর?
—দুই-ই৷
— রেণুকা দেখতে মন্দ নয়, বর তার চেয়েও ভালো—ছোকরা বয়েস, লোক ভালোই ওরা৷ দ্যাখ না চিঠি পড়ে!
—অন্ধ মেয়েরও বিয়ে আটকে থাকে না, যদি কপাল ভালো হয়—
—হ্যাঁ রে হ্যাঁ৷ তোর আর বকামি করতে হবে না—পড় চিঠি—
রেণুকা অনেক দুঃখ করে চিঠি লিখেছে৷ শরৎ চলে গিয়ে পর্যন্ত সে একা পড়েচে, আর কে তার ওপর দয়া করবে, কে তার হাত ধরে বেড়াতে নিয়ে যাবে? ওঁর মোটে সময় হয় না৷ তার মন আকুল হয়েচে শরৎকে দেখবার জন্য, রাজকন্যা কবে এসে কাশীতে ‘কেদার ছত্র’ খুলছে? এলে যে রেণুকা বাঁচে—ইত্যাদি৷
চিঠি পড়ে শরৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল৷ অসহায়া অভাগী রেণুকা! ছোট বোনটির মতো কত যত্নে শরৎ তাকে নিয়ে বেড়াত—কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাট, জলে ভাসমান নৌকো ও বজরার ভিড়, বিশ্বেশ্বরের মন্দিরে সান্ধ্য-আরতির ঘণ্টা ও নানা বাদ্যধ্বনি৷…রেণুকার করুণ মুখখানি৷ এখানে বসে সব স্বপ্নের মতো মনে হয়৷ খোকা—খোকনমণি! রেণুকা খোকনের কথা কিছু লেখে নি কেন? কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল রেণুকাকে কে বকসীদের বাড়ি নিয়ে যাবে হাত ধরে অত দূরে? তাই লিখতে পারে নি৷
রাজলক্ষ্মী কৌতূহলের সঙ্গে নানা প্রশ্ন করতে লাগল কাশী ও সেখানকার মানুষ-জন সম্বন্ধে, বহির্জগৎ সম্বন্ধে৷ শরৎ বিরাট অন্নসত্রগুলোর গল্প করল, রাজরাজেশ্বরী, আমবেড়ে, কুচবিহারের কালীবাড়ি৷
হেসে বললে, জানিস এক বুড়ি তৈলঙ্গিদের ছত্তরদের বলত তুণ্ডুমুণ্ডুদের ছত্তর!
—তৈলঙ্গি কারা?
—সে আমিও জানি নে—তবে তাদের দেখেছি বটে৷
রাজলক্ষ্মী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে৷ বাইরের জগৎ মস্ত একটা স্বপ্ন৷ জীবনে কিছুই দেখা হল না, একেবারে বৃথা গেল জীবনটা৷ শরৎদির ওপর হিংসে না হয়ে পারে?
চৌদ্দ
কেদার ও গোপেশ্বর দুজনে মিলে খেটে বাড়ির উঠানটা অনেকটা পরিষ্কার করে তুলেছেন৷ কেদার তত নন, বলতে গেলে গোপেশ্বরই খেটেছেন বেশি৷ শরৎকাল পড়েছে, পূজার দেরি নেই, গোপেশ্বর একদিন উঠানের এক ধার খুঁড়ে কতকগুলো কচুর চারা পুঁতছেন, কেদার মহাব্যস্ত হয়ে এসে বললেন, দাদা, এসো—ওসব ফেলে রাখো—
—কি রাজামশায়?
—আরে একটা নতুন রাগিণীর সন্ধান পেয়েছি একজনের কাছে৷ মুখুজ্জে-বাড়িতে জামাই এসেছে—ভালো গায়ক৷ দেওগান্ধার ওর কাছে আদায় করতে হবে৷ থাকবে এখন কিছুদিন এখানে, চলো দুজনে যাই—
—দেবে কি রাজামশাই? ওসব লোক বড় কষ্ট দেয়৷ আমি কাশীতে এক ওস্তাদের কাছে বড় আশা করে যাই৷ একখানা ভীমপলশ্রীর আস্তাই দিলে অতি কষ্টে তো মাসাবধি অন্তরা আর দেয় না৷ কত খোশামোদ, কেবল অন্তরা এক মিনিটে নাকি হয়ে যাবে! হায়রান হয়ে গেলাম হাঁটাহাঁটি করে৷
—পেলে?
—কোথায় পেলাম? আদায় করা গেল না শেষ পর্যন্ত৷ সেই থেকে নাকে-কানে খৎ—ওস্তাদের কাছে আর যাব না৷
—যা হোক চলো দাদা৷ এ আমাদের গাঁয়ের জামাই—ওকে নিয়ে একদিন মজলিশ করা যাক—অনেকদিন থেকে দেওগান্ধারের খোঁজ করছি৷ ধরা যাক চলো—ওখানে কি হচ্ছে?
—মানকচুর চারা লাগিয়ে রাখলাম গোটাকতক৷ সামনের বছরে এক একটা কচু হবে দেখবেন কত বড় বড়! আপনার ভিটের এ জমিতে একটা মানকচু—
—জানি দাদা৷ ও এখন রাখো, হবে পরে৷ ও শরৎ—
শরৎ রান্নাঘর থেকে বার হয়ে এসে বললে, কি বাবা?
—আমাদের দুজনকে একটু তেল দ্যাও মা৷ রান্নার কতদূর?
—ওলের ডালনা চড়েছে—নামিয়ে ভাত চড়াব৷ তা হলেই হয়ে গেল—
—হ্যাঁ মা, রাজলক্ষ্মী এসেছে?
—না, আজ আসে নি এখনো৷ কেন?
—না বলছিলাম, মুখুজ্জে-বাড়ি জামাই এসেছে, ভদ্রেশ্বরে বাড়ি, কেমন লোক তাই তাকে জিজ্ঞেস করতাম৷
—সে খোঁজে তোমার কি দরকার? সে ভালো হোক মন্দ হোক—
—তুই তা বুঝবি নে বুঝবি নে৷ অন্য কাজ আছে তার কাছে৷ যদি এর মধ্যে রাজলক্ষ্মী আসে—
—মুখুজ্জে-বাড়ির কোন জামাই বাবা? আশাদিদির বর? আশাদিদির শ্বশুরবাড়ি তো ভদ্রেশ্বর—
—তাই হবে৷
—সে তো বুড়ো মানুষ৷ আশাদিদিকে বিয়ে করেছে দোজপক্ষে—
—তোর সে-সব কথায় দরকার কি বাপু? বুড়ো হয়, আরও ভালো!
—বলো না, কেন বাবা—
—নাঃ, সে শুনে কি করবি?
—না আমি শুনব—
—শুনবি? রাগিনী ভূপালী, বাদী গান্ধার বিবাদী মধ্যম আর নিখাদ—সম্বাদী ধৈবত—আরও শুনবি? রাগিনী আশারবী—বাদী—
—থাক, আর শুনে দরকার নেই—নেয়ে এসে ভাত খেয়ে আমায় খোলসা করে দিয়ে যত ইচ্ছে রাগিনী শেখো—
.
বেলা পড়ে গেল৷ ঘরের তালকাঠের আড়াতে কলাবাদুড় ঝুলছে, যেমন শরৎ আবাল্য দেখে এসেছে৷ কেদার ও গোপেশ্বর আহারাদি সেরে অন্তর্হিত হয়েছেন, মধ্যরাত্রে যদি ফেরেন তবে শরতের সৌভাগ্য৷ রাজলক্ষ্মীর জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকে সে৷ তবুও দুজনে গল্প করে সময় কাটে৷ রোজ রোজ বাবার এই কাণ্ড! ভালো লাগে!
এমন সময় কে বাইরে থেকে ডাকল—ও শরৎ, শরৎ—
শরৎ বাড়ির দাওয়ায় উঁকি মেরে দেখে বললে—কে? ও বটুক-দা, ভালো আছেন? আসুন৷
বটুককে শরৎ কোনো কালেই ভালো চোখে দেখত না৷ সেই বটুক, যে এক সময় শরতের প্রতি অনেক অসম্মানজনক ব্যবহার করেছিল, রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে যে বটুকের সম্বন্ধে সেযুগে কলকাতায় যাবার পূর্বে শরৎ আলোচনা করেছিল একবার৷
বটুক একটু ইতস্তত করে বললে, শুনলাম তোমরা এসেছ—কাকা এসেছেন, তাই একবার দেখা করতে—
শরৎ আগেকার মতো নেই—জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে অনেক সাহসী ও সহিষ্ণু করে দিয়েছে৷ আগেকার দিন হলে শরৎ বটুকের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথাও বলত না, এ নিশ্চয়ই৷ আজ শরৎ দাওয়ায় একখানা পিঁড়ি পেতে বটুককে বসতে বললে৷
বটুক একটু আশ্চর্য হয়ে গেল৷ শরতের কাছ থেকে এ আদর সে আশা করে নি এখানে৷ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে বসলো৷ শরৎ তাকে চা করে খাওয়ালে৷ বললে, দুটি মুড়ি খাবে বটুকদা? আর তো কিছু নেই ঘরে৷ তুমি এলে এতদিন পরে—
—থাক, থাক, সে জন্যে কিছু নয়! আমি দেখতে এলাম, বলি দেখা হয় নি কত দিন৷ আচ্ছা শুনলাম নাকি কত দেশ-বিদেশে বেড়িয়ে এলে?
—তা বেড়ালাম বৈকি৷ রাজগীর, কাশী৷
—কাকা নিয়ে গিয়েছিলেন বুঝি?
—জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম—ওই যিনি আমাদের এখানে আছেন—
—তা বেশ বেশ৷
এই সময় দূরে রাজলক্ষ্মীকে আসতে দেখে বটুক তাড়াতাড়ি উঠে বিদায় নিলে৷ শরৎ বললে—আর একদিন এসো, বাবার সঙ্গে তো দেখা হল না! বাবা থাকতে এসো একদিন—
রাজলক্ষ্মী চেয়ে বললে—ও এখানে কি জন্যে এসেছিল? বটুকদা তো লোক ভালো না—
—কি মতলব নিয়ে এসেছিল কি করে বলব বল? এলো—বসতে দিলাম, চা করে দিলাম—
—না না শরৎদি, জানো তো—ওসব লোকের সঙ্গে কোনো মেলামেশা না করাই ভালো৷ তুমি কানে আঙুল দেবে৷ অতি বদ লোক৷ কি মতলব নিয়ে এসেছিল কে জানে?
—তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমার বাড়ি এলো, আমি কি বলে না বসাই! তা তো হয় না, আমায় আমার কাজ করতেই হবে৷
—সেই যে প্রভাস কামার তোমাদের মোটরে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল, সে লোকটাও ভালো না, পরে শুনলাম৷ বটুকদা প্রভাসের খুব বন্ধু ছিল আগে—তবে এখন অনেকদিন আর তাকে এ গাঁয়ে দেখি নি৷ তোমরা চলে গেলে একবার এসেছিল যেন—
শরতের মুখ হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল, সে তাড়াতাড়ি অন্য কথা পাড়লে একথা চাপা দিয়ে৷ বললে—চল৷ দিঘির পাড় থেকে গোটাকতক ধুঁধুল পেড়ে আনি—কিছু তরকারি নেই, বাবাকে বলা না বলা দুই সমান—
রাজলক্ষ্মী বললে, আর কোথাও যেয়ো না শরৎদি, দুটি বোন এই গাঁয়ে কাটিয়ে দিই জীবনটা৷ আমারও যা হবে, সে বেশ দেখতেই পাচ্ছি৷ তুমি থাকলে বেশ লাগে৷
—খারাপ কি বল না! আমি কত জায়গায় গেলাম, কিন্তু তোকে ছেড়ে—কালোপায়রার দিঘি ছেড়ে—
—যা বলেছ শরৎদি৷ তুমি এসেছ আমি আর কোথাও যেতে চাই নে, স্বর্গেও না৷ দুজনে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করি—
—আর চাল-ছোলা ভাজা খাই—না রে? ভাজি দুটো চাল-ছোলা?
—না না, শরৎদি৷ ওই তোমার পাগলামি—
—পাগলামি নিয়েই জীবন৷ আয় আমার সঙ্গে রান্নাঘরে, তার পর আবার দুজনে এসে বসব৷
রাজলক্ষ্মী আজকাল সর্বদা শরতের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসে৷ সন্ধ্যার আগে একাই বাড়ি চলে যায়, শরৎ দিদির মুখে বাইরের জগতের কথা শুনতে ওর বড় আগ্রহ৷ যে একঘেয়ে জীবন আবাল্য সে কাটাচ্ছে গড়শিবপুরে, যার জন্যে তার মনে হয় এ একঘেয়েমির চেয়ে যে কোনো জীবন বাঞ্ছনীয়, যে কোনো ধরনের—শরৎ দিদি আজ কিছু দিন হল বিদেশ থেকে ফিরে সেই একঘেয়ে আবেষ্টনীর মধ্যে যেন আগ্রহ ও নতুনত্বের সঞ্চার করেছে৷ তা ছাড়া জীবনে শরৎ দিদিই তার একমাত্র ভালোবাসার লোক, ও দূরে চলে যাওয়াতে রাজলক্ষ্মীর জীবন শূন্য হয়ে পড়েছিল, এখন আবার গড়বাড়িতে এসে, ওর সঙ্গে বসে গল্প করে, ওর সামান্য কাজকর্মে সাহায্য করে রাজলক্ষ্মীর অবসর-ক্ষণ ভরে ওঠে৷
শরৎ বললে, রেণুকার চিঠির জবাব দিলাম অনেকদিন, উত্তর তো এল না?
—আসবে৷ অত ব্যস্ত কেন? দিন দশেক হল মোটে জবাব গিয়েছে৷ ঠিকানা লেখা ঠিক হয়েছিল তো?
—ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন জ্যাঠামশায়৷ উনি কি আর ভুল করবেন? আমার বড় মন কেমন করে খোকনমণির জন্যে৷ সে যদি চিঠি লিখতে পারত আমায় নিজের হাতে—
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, একেই বলে মায়া! কোথাকার কে তার ঠিক নেই—
শরৎ ব্যথা-কাতর কণ্ঠে বললে, অমন বলিস নে রাজি৷ তুই জানিস নে, সে আমার কি! কেন তাকে ভুলতে পারি নে তাই ভাবি৷ কখনো অমন হয় নি আমার, কাশীতে থাকবার শেষ একটা মাস যা হয়েছিল৷ খোকাকে না দেখলে পাগলের মতো হয়ে যেতাম বুঝলি? কষ্টও যা গিয়েছে! আচ্ছা বল তো, সত্যিই সে আমার কে? অথচ মনে হত কত জন্মের আপনার লোক সে, তার মুখ দিনান্তে একবার না দেখলে—ভালোই হয়েছে রাজি, সেখানে বেশিদিন থাকলে মায়ায় বড্ড জড়িয়ে পড়তাম৷ আর তেমনি ছিল মিনুর মা!
—সে কে শরৎদি?
—যাদের বাড়ি ছিলাম সে বাড়ির গিন্নি৷ বলব তোকে সব কথা একদিন৷ এখন না—
—কাশীর কথা শুনতে বড্ড ভালো লাগে তোমার মুখে—কখনো কিছু দেখি নি—যেন মনে হয় এখানে বসে দেখছি সব৷ আজ একটু ঠাণ্ডা পড়েছে, না শরৎদি?
—তা হেমন্তকাল এসে পড়েছে, একটু শীত পড়বার কথা৷ একটা নারকোল কুরতে হবে—দা খানা খুঁজে দ্যাখ ততক্ষণ—আমি ছোলাগুলো ততক্ষণ ভেজে ফেলি—
—কেন এত হাঙ্গামা করছ শরৎদি? দাঁড়াও আমি নারকোল কুরে দিই—
শরৎ বললে, দুজনে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করব আর চালভাজা—কি বলিস?
ছেলেমানুষের মতো উৎসাহ ও আগ্রহভরা কণ্ঠস্বর তার৷ এই জন্যই শরৎ দিদিকে রাজলক্ষ্মীর এত ভালো লাগে৷ এই পাড়াগাঁয়ে সব লোক যেন ঘুমুচ্ছে, তাদের না আছে কোনো বিষয়ে আগ্রহ, না শোনা যায় তাদের মুখে একটা ভালো কথা৷ অল্প বয়সে বুড়িয়ে যেতে হয় ওদের মধ্যে থাকলে৷ শরৎ দিদি এসে বাঁচিয়েছে৷
রাজলক্ষ্মী হঠাৎ মনে পড়বার সুরে বললে, ভালো কথা, বলতে মনে নেই শরৎদি, টুঙিমাজদে থেকে তোমার নামে একখানা চিঠি এসেছিল একবার—
শরৎ চমকে উঠে বললে—টুঙি-মাজদে! কই সে চিঠি?
—আছে বোধ হয় বাড়িতে, খুঁজে দেখব৷ তোমরা তখন এখানে ছিলে না—আমি রেখে দিয়েছিলাম—
—কতদিন আগে?
—তা ছ-সাত মাস কি তার বেশিও হবে৷ গত বোশেখ মাসে বোধ হয়৷ আচ্ছা শরৎদি ওখানে তোমার শ্বশুরবাড়ি—নয়?
শরৎ অন্যমনস্কভাবে বললে, হাঁ৷
একটুখানি চুপ করে কি ভেবে বললে, কে দিয়েছিল, জানিস?
—খামের চিঠি৷ আমি খুলে দেখি নি—কে আছে তোমার সেখানে?
শরৎ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে, নিয়ে আসিস চিঠিখানা, দেখব৷
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ৷ তারপর রাজলক্ষ্মী বললে, খাও শরৎদি, সন্দে হয়ে আসছে—
—হুঁ—
—নারকোল কেটে দেব আর একটু?
—না, তুই খেয়ে নে৷ উত্তর দেউলে সন্দে দেখিয়ে আসতে হবে—
—এখন রোদ রয়েছে গাছের ডগায়, অনেক দেরি এখনো, খেয়ে নাও না—
—আমি আর খাব না এখন৷
—তুমি না খেলে আমার এই রইল—
—না, না, আচ্ছা খাচ্ছি আমি—নে তুই৷ কাঁচালঙ্কা একটা নিয়ে আসি—
উত্তর দেউল থেকে সন্ধ্যা-প্রদীপ দিয়ে কিছুক্ষণ পরে ওরা ফিরছিল, কালোপায়রা দিঘির ওপাড়ের ঘন জঙ্গলে যেখানে ছাতিম ফুল ফুটে হেমন্তসন্ধ্যার বাতাস সুবাসিত করে তুলেছে৷ শ্যামলতার লম্বা কালো ডাঁটায় কুচো কুচো সুগন্ধ ফুল প্রত্যেক বর্ষাপুষ্ট ঝোপের মাথায়৷ পায়ে চলার পথ গত বর্ষায় ঘাসে ঢেকে আছে, ভাঙা ইটের স্তূপে শেওলা জমেছে, গড়ের জঙ্গল ঘন কালো দেখাচ্ছে আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে৷ রাজলক্ষ্মীকে বাড়ি ফিরতে হবে বলে ওরা সন্ধ্যা-প্রদীপ দেখানোর কাজ বেলা থাকতে সেরে এল৷
শরৎ বললে, অনেক মেটে আলু হয়ে আছে বনে, আজ দু-বছর এদিকে আসি নি—
—তুলবে একদিন শরৎদি? আমিও আসব—
বাড়ি গিয়ে শরৎ বললে, চল তোকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি—গড়ের খাল পর্যন্ত যাই৷ জল নেই তো খালে?
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, কোথায়! বর্ষায় সামান্য জল হয়েছিল, শুকিয়ে গেছে৷
—থাক না আজ রাতটা! একা থাকব?
—বাড়িতে বলে আসি নি যে শরৎদি—নইলে আর কি৷ আচ্ছা কাল রাত্রে বরং থাকব৷ বাড়িতে বলে আসতে হবে কিনা!
রাজলক্ষ্মীকে এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসবার পথে শরৎ একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসলো৷ হেমন্তের সান্ধ্য-বাতাস কত কি বন্য পুষ্প, বিশেষত বনমরচে ও শ্যামলতার পুষ্পের সুবাসে ভারাক্রান্ত৷ দেউড়ির ভাঙা ইটের ঢিবির সর্বত্র-এ সময় বনমরচে লতায় ছেয়ে গিয়েছে, পুরনো রাজবাড়ি, লক্ষ্মীছাড়া দৈন্য তাদের শ্যামশোভায় আবৃত করে রেখেছে৷ রাজকন্যার সম্মান রেখেছে ওরা সেভাবে৷
কি হবে এখুনি ঘরে ফিরে৷ বেশ লাগে বাইরের বাতাস৷ ভয় নেই ওর মনে, যা ছিল তাও চলে গিয়েছে৷ তা ছাড়া ভয় কিসের? সবাই বলে ভূত আছে, অপদেবতা আছে—তার পূর্বপুরুষের অভ্যুদয়ের দিনের শত পুণ্য অনুষ্ঠানে এ বাড়ির মাটি পবিত্র, এ বাড়ির সে মেয়ে, আবাল্য সে এ-সব এইখানেই দেখে এসেছে—তার ভয় কিসের?
উত্তর দেউলের দেবী বারাহী তাদের মঙ্গল করবেন৷
সে ঘরে ফিরে ডুমুরের চচ্চড়ি রান্না করবে বাবা আর জ্যাঠামশায়ের জন্যে৷ জ্যাঠামশায় অনেক ডুমুর পেড়ে এনেছেন আজ কোথা থেকে৷ জ্যাঠামশায় বেশ লোক৷ ওঁকে সে আর কোথাও যেতে দেবে না৷ উনি না থাকলে কে তাকে আনতো কাশী থেকে? বাবার সঙ্গে কে আবার দেখা করিয়ে দিত? যতদিন উনি বাঁচেন, সে ওঁর সেবা-যত্ন করবে মেয়ের মতো৷
শরতের হঠাৎ মনে পড়ল, রাজলক্ষ্মীকে তার শ্বশুরবাড়ির সে পুরনো চিঠিখানা আনবার জন্যে মনে করিয়ে দেওয়া হয় নি আর একবার৷ টুঙি-মাজদিয়া! কত দিন সেখানে যাওয়া হয় নি! কে-ই বা আছে আর সেখানে? চিঠি লিখেছেন বোধ হয় খুড়শাশুড়ি৷ তাই হবে—তা ছাড়া আর কে? সেখানকার সব কিছু যখন শেষ হয়ে গিয়েছে, তখন ভালো জ্ঞানই হয় নি শরতের৷ এক উৎসব-রজনীর চাঁপাফুলের সুগন্ধ আজও যেন নাকে লেগে আছে৷ কতকাল আগে বিস্মৃত মুহূর্তগুলির আবেদন—আজও তাদের ক্ষীণ বাণী অস্পষ্ট হয়ে যায় নি তো! বিস্মৃতির উপলেপন দিয়ে রেখেছে চলমান কাল, সেই মুহূর্তগুলির ওপর৷ তবে সে ভালোবাসে নি, ভালোবাসলে কেউ ভোলে না৷ তখনও বোঝবার, জানবার বয়স হয় নি তার৷
টুঙি-মাজদে তার শ্বশুরবাড়ি৷ ওখানকার ভাদুড়ীরা তার শ্বশুরবংশ—একসময়ে নাকি ভাদুড়ীদের অবস্থা খুব ভালো ছিল৷ এখন তাদেরই মতো৷
টুঙি-মাজদে! নামটা সে ভুলেই গিয়েছিল, রাজলক্ষ্মী আবার মনে করিয়ে দিলে৷
বনের মধ্যে কোথায় গম্ভীর স্বরে হুতুমপ্যাঁচা ডাকছে, শুনলে ভয় করে—যেন রাত্রিচর কোনো অপদেবতার কুস্বর! শরৎ অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে ঘরে গিয়ে রান্নাঘরে খিল দিয়ে রান্না চড়িয়ে দিলে৷
অনেক রাত্রে কেদার এসে ডাকাডাকি করেন—ও মা শরৎ, দোর খোলো—ওঠো—
.
দিন দশেক পরে একদিন রাজলক্ষ্মী এসে বললে, চললাম শরৎদি—
শরৎ বিস্ময়ের সুরে বললে, কি রে? কোথায় চললি?
—সব ঠিক৷ আমার বিয়ে হচ্ছে সতেরোই অঘ্রাণ—জানো না?
—তোর? সত্যি?
—সত্যি না তো মিথ্যে?
—বল শুনি—সত্যি? কোথায়?
রাজলক্ষ্মী বেশি কিছু জানে না বোঝা গেল৷ এখান থেকে মাইল দশেক দূরে দশঘরা বলে অজ এক পাড়াগাঁয়ে যার সঙ্গে সম্বন্ধ হয়েছে, তার বয়েস নাকি তত বেশি নয়, বিশেষ কিছু করে না, বাড়িতেই থাকে৷
শরৎ বললে, তোর পছন্দ হয়েছে?
—পছন্দ হলেও হয়েছে, না হলেও হয়েছে—
—তার মানে?
—তার মানে বাবার যখন পয়সা নেই, আমি যদি বলি আমার বর হাকিম হোক, হুকুম হোক, দারোগা হোক, তা হলে তো হবে না! যা জোটে তাই সই!
—এখন যা হয় হলে বাঁচি, না কি?
—তোমার মুণ্ডু৷
তার পর ওরা বনের মধ্যে মেটে আলু তুলতে গিয়ে অনেক বেলা পর্যন্ত রইল৷ বনের মধ্যে এক জায়গায় একটা পাথরের থামের ভাঙা মুণ্ডুটা মাটিতে অর্ধেক পুঁতে আছে৷ রাজলক্ষ্মী সেটার ওপরে গিয়ে বসল৷ পাথরের গায়ে সামুদ্রিক কড়ির মতো বিট কাটা, মাঝে মাঝে পদ্মফুল এবং একটা দাঁড়ি৷ আবার কড়ি, পদ্ম ও দাঁড়ি—মালার আকারে সারা থামটা ঘুরে এসেছে৷ নীচের দিকে একরাশ কেঁচোর মাটি বাকি অংশটুকু ঢেকে রেখেছে৷
রাজলক্ষ্মী চেয়ে চেয়ে বললে, এই নক্সাটা কেমন চমৎকার শরৎদি! বুনলে ভালো হয়—দেখে নাও—
শরৎ বললে, এর চেয়েও ভালো নক্সা আছে ওই অশ্বত্থ গাছটার তলায়—একটা খিলেন ভেঙে পড়ে আছে, তার ইঁটের গায়ে৷ কিন্তু বড্ড বন ওখানে আর কাঁটা গাছ—
—তোমাদেরই সব তো—একদিন শুনেছি গড়বাড়ির চেহারা অন্যরকম ছিল, না?
—কি জানি ভাই, ও-সবের খবর আমি রাখি নে৷ আজকাল যা দেখছি, তাই দেখছি৷ তেল জোটে তো নুন জোটে না, নুন জোটে তো চাল জোটে না৷
তার পর শরৎ কি ভেবে আনন্দপূর্ণ কণ্ঠে বললে, সত্যি রাজি, খুব খুশি হয়েছি তোর বিয়ের কথা শুনে৷ কত যে ভেবেছি, কাশীতে থাকতে কতবার ভাবতাম, ভালো সম্বন্ধ পাই তো রাজির জন্যে দেখি৷ একবার দশাশ্বমেধ ঘাটে একটা চমৎকার ছেলে দেখে ভাবলাম, এর সঙ্গে যদি রাজির বিয়ে দিতে পারতাম, তবে—
রাজলক্ষ্মী চুপ করে রইল৷ সে যেন কি ভাবছে৷
শরৎ বললে, প্রভাসদার দেওয়া সেই মখমলের বাক্সটা আছে রে?
—হুঁ৷ স্নোটা সব খরচ হয়ে গেছে—আর সব আছে৷ দ্যাখো শরৎদি, সত্যি সত্যি একটা কথা বলি, আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না তোমায় ছেড়ে—আমি একবার বলেছি, আবার বলছি, মনের কথা আমার—
তার পর রাজলক্ষ্মী উঠে ধীরে ধীরে শরতের গলা জড়িয়ে ধরে বললে, শরৎদি, তুমি আমায় ভালোবাস?
শরৎ তাকে ঠেলে দিয়ে হেসে বললে, যাঃ—
রাজলক্ষ্মীর চোখ দিয়ে হঠাৎ ঝরঝর করে জল পড়ল৷ সে অশ্রুসিক্ত স্বরে বললে, তুমি ভালোবাস বলেই বেঁচে আছি শরৎদি৷ তুমি গরিব হতে পারো, আমার কাছে তুমি গড়বাড়ির রাজার মেয়ে, এই দেউল, মন্দির, দিঘি, গড়, ঠাকুর-দেবতার মূর্তি সব তোমাদের, আমি তোমাদের প্রজার মেয়ে, একপাশে পড়ে থাকি—তুমি সুনজরে দ্যাখো বলে বার বার আসি—
শরৎ কৌতুকের সুরে বললে, খেপলি নাকি, রাজি? কী হয়েছে আজ তোর?
.
রাজলক্ষ্মী চলে যাবার কিছু পরে বটুক এসে ডাকলে, ও শরৎ—বাড়ি আছ?
শরৎ তখন স্নান করতে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে, বটুককে দেখে একটু বিব্রত হয়ে পড়ল৷
মুখে বললে, এসো বটুকদা—
—হ্যাঁ, এলাম, তুমি বুঝি—
—নাইতে বেরিয়েছি বটুকদা৷ রাজির সঙ্গে বন থেকে মেটে আলু তুলতে গিয়েছিলাম কিনা! না ডুব দিয়ে ঘরে-দোরে ঢুকব না—
—ও, তা আমি না হয় অন্য সময়—
—কোনো কথা ছিল?
—হ্যাঁ, না—কথা—তা একটু ছিল—তা—
বটুকের অবস্থা দেখে শরতের হাসি পেল৷ মনে মনে বললে, কি বলবি বল না—বলে চলে যা—কাণ্ড দ্যাখো একবার!
মুখে বললে, কি বটুকদা? কি কথা?
বটুক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ইতস্তত করে তার পর মরীয়ার সুরে বললে, প্রভাস এসেছিল কাল কলকাতা থেকে—
বলে সে শরতের মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল৷
শরতের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল এক মুহূর্তে৷ তার সমস্ত শরীর কেমন ঝিম-ঝিম করে উঠল৷ কিন্তু তখনি সামলে নিয়ে বললে, তা আমায় এ কথা কেন? আমি কি করব?
বটুক মাথা চুলকে বললে, না—তা—এমন কিছু নয়, এমন কিছু নয়৷ প্রভাসের সঙ্গে গিরীনবাবু বলে এক ভদ্রলোক ছিল৷ এই গিয়ে তারা বলছিল—
এই পর্যন্ত বলে বটুক একবার চারিদিকে চেয়ে দেখলে৷
শরৎ দাওয়ার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে নিজেকে যেন টলে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে বললে, কি বলছিল?
—বলছিল যে—
—বলো না কি বলছিল?
—মানে, ওরা—তোমার সঙ্গে একবার লুকিয়ে দেখা করতে চায়৷ নইলে গাঁয়ে সব কথা নাকি প্রকাশ করে দেবে!
—হুঁ—তোমাকে তারা চর করে পাঠিয়েছে বুঝি?
শরতের অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বটুক ভয় খেয়ে গেল৷ সুর নরম করে বললে—আমার ওপরে অনর্থক রাগ করছ তুমি৷ আমায় তারা বললে, তোমাকে কথাটা বলতে—কেউ টের পাবে না, গড়ের জঙ্গলের ওদিকে হোক কি রানীদিঘির পাড়ে হোক—কি তারা বলবে তোমায়৷ আমায় বললে, বলে এসো৷ তারা কলকাতায় চলে গিয়েছে, আবার আসবে৷ নয়তো কলকাতায় কি হয়েছিল না হয়েছিল, সব গাঁয়ে প্রকাশ করে দিয়ে যাবে—
শরৎ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ৷ কোনো কথা নেই তার মুখে৷ তার মূর্তি দেখে বটুকের ভয় হল৷ সে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় শরৎ স্থিরগলায় বললে, বটুকদা, তোমার বন্ধুদের বোলো আমি লুকিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা কোনোদিন করব না৷ তাদের সাহস থাকে বাবা আর জ্যাঠামশায়ের সামনে এসে যেন দেখা করে৷ আমরা গরিব আছি, তাই কি—আমাদেরও মান আছে৷ না হয় তারা বড়লোকই আছে৷
বটুক বললে, না—এর মধ্যে আর গরিব বড়লোকের কথা কি?
—আর একটা কথা বটুকদা! তুমি না গাঁয়ের ছেলে? তোমার উচিত কলকাতায় সেই সব বখাটে বদমাইশদের তরফ থেকে আমায় এ-সব কথা বলা? আমি না তোমার ছোট বোনের মতো? তোমায় না দাদা বলে ডাকি? তুমি এসেছ চর সেজে?
বটুক আমতা আমতা করে বললে, আমি কি করব, আমি কি করব—তোমার ভালোর জন্যেই—
শরৎ পূর্ববৎ স্থিরকণ্ঠেই বললে, আমার বাড়ি তুমি এসেছ—আমার বলতে বাধে, তবুও আমি বলছি—আমার এখানে তুমি এসো না—আমার ভালো তোমায় করতে হবে না৷
বটুক ততক্ষণে ভগ্ন দেউড়ির পথে অদৃশ্য হয়েছে৷
পনেরো
শরৎ কাঠের পুতুলের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কতক্ষণ৷ এখন সে কি করবে? গড়শিবপুরের রাজবংশে সে কি অভিশাপ বহন করে এনেছে, তার বংশের নাম বাবার নাম ডুবতে বসেছে আজ তার জন্যে!
মানুষ এত খারাপও হয়!
এই পল্লীগ্রামের বনে বনে হেমন্তকালের কত বনকুসুম, লম্বা লতার মাথায় থোবা থোবা মুকুল ধরেছে বন্য মাখম-সিম ফুলের শিউলির তলায় খই-ছড়ানো শুভ্র পুষ্পের সমারোহ, সুমুখ জ্যোৎস্নারাতের প্রথম প্রহরে ছাতিমবনের নিবিড়তায় চাঁদের আলোর জাল-বুনুনি, ছাতিম ফুলের সুবাস—এ সবের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রভাসের মতো, বটুকের মতো ভয়ানক প্রকৃতির লোক, যাদের অসাধ্য কাজ নেই, যাদের ধর্মাধর্ম জ্ঞান নেই! এত কষ্ট দিয়েও ওদের মনোবাঞ্ছা মিটল না? এতদিন পরে আবার এখানেও এসে জুটল তার জীবনে আগুন জ্বালাতে?
আচ্ছা সে কি করেছে যার জন্যে তার এত শাস্তি?
সে কি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কিছু করেছে? সে কি স্বেচ্ছায় কমলাদের পাপপুরীর মধ্যে ঢুকেছিল? হতে পারে সে নির্বোধ, কিছু বুঝতে পারে নি, অত খারাপ কাউকে ভাবতে পারে নি বলেই তার মনে কোনো সন্দেহ জাগে নি৷ সন্দেহ সত্যই জাগলো, তখন ওরা তো তাকে বেরুতে দিল না৷ অথচ সে যদি সব কথা খুলে বলে গ্রামে, কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না৷
প্রভাসের ও গিরীনের বদমাইশির কথা শুনে ওদের কেউ শাস্তি দেবে না? ভগবান সত্যের দিকে দাঁড়াবেন না?
না হয় সে কালোপায়রা দিঘির জলে ডুবে মরে বাবার ও বংশের মুখ রক্ষা করবে৷ তা সে এখুনি করতে পারে—এই দণ্ডে!
শুধু পারে না বাবার মুখের দিকে চেয়ে৷
আচ্ছা সে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে দু’দিনের জন্যে? টুঙি-মাজদে গ্রামে খুড়শাশুড়ির আশ্রয়ে এখন থাকবে গিয়ে কিছুদিন? কার সঙ্গে পরামর্শ করা যায়? জ্যাঠামশায় বা বাবাকে এসব কথা বলতে বাধে৷
তার চেয়ে জলে ডুবে মরা সহজ৷
সকলে মিলে অমনভাবে তাকে যদি জ্বালাতন করে, বনের মেটে আলু, বুনো সিম-ভাতে-ভাত এক বেলা খেয়েও যদি শান্তিতে থাকতে না দেয়, তবে মায়ের মুখে শোনা তারই বংশের কোন পুরনো আমলের রানীর মতো—তারই কোন অতি-বৃদ্ধ প্রপিতামহীর মতো নিজের মান বাঁচাবার জন্যে কালোপায়রা দিঘির শীতল জলের তলায় আশ্রয় নিয়ে সব জ্বালা জুড়ুতে হবে, যদি তাতে হতভাগারা শান্তিতে থাকতে দেয়৷….চোখের জলে শরতের গালের দু-পাশ ভেসে গেল৷
কতক্ষণ পরে তার যেন হুঁশ হল—কত বেলা হয়েছে! রান্না চড়ানো হয় নি—বাবা জ্যাঠামশায় এসে ভাত চাইবেন এখুনি!
উঠে সে স্নান করে এল—তেল আগেই মেখে বসে ছিল, বটুক আসবার আগেই৷
রান্না চড়িয়ে দিয়ে আবার সে ভাবতে বসল৷ সব সময়েই ভাবছে, বটুক চলে যাবার পর থেকে৷ কতবার চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে, কতবার অঁচল দিয়ে মুছেছে—কি সে করে এখন?
তার কি কেউ নেই সংসারে?
কেউ তার দিকে দাঁড়িয়ে, তার হয়ে দুটো কথা বলবে না? প্রভাস ও গিরীন যদি তার নামে কুৎসা রটিয়ে দেয় গ্রামে, তবে তাদের কথাই সবাই সত্য বলে মেনে নেবে? তার কথা কেউ শুনবে না?
এমন সময় কেদার ও গোপেশ্বর এসে পৌঁছে গেলেন৷
তাঁরা মুখুজ্জে-বাড়ির জামাই সোমেশ্বরের কাছে নতুন রাগিণীর সন্ধানে গিয়েছিলেন, বোধ হয় খানিকটা কৃতকার্যও হয়েছেন, তাঁদের মুখ দেখলে সেটা বোঝা যায়৷
গোপেশ্বর খেতে খেতে বললেন—গলাটা ভালো লোকটার৷
—বেশ৷ ভৈরবীখানা গাইলে বড় চমৎকার—অবরোহীতে একবার যেন ধৈবৎ ছুঁয়ে নামল—
—না না, আমার কানে তো শুনলাম না৷ কোমল ধৈবৎ তো লাগবেই অবরোহীতে—
—সেটা আমার খুব ভালো জানা আছে—শুনবে? এই শোন না—আচ্ছা খেয়ে উঠি৷ অবরোহীতে কোমল নিখাদ, তার পরেই কোমল ধৈবৎ আসছে৷ যেমন—
শরৎ বললে, বাবা খেয়ে নাও দিকি! এর পর ওর অনেক সময় পাবে—
—এটা কিসের চচ্চড়ি মা?
—মেটে আলু৷ রাজলক্ষ্মী আর আমি তুলে এনেছিলাম আজ ওই বনের দিক থেকে—
—রাজলক্ষ্মী এসেছিল নাকি?
—কতক্ষণ ছিল৷ এই তো খানিকটা আগে গেল—
—ওর বিয়ের কথা শুনে এলাম কিনা—তাই বলছি—
—আমার সঙ্গে অত ভাব, ও চলে গেলে গাঁয়ের আর কেউ এদিকে মাড়াবে না৷ ওকে একটা কিছু দিতে হবে বাবা—
—কি দিবি?
—তুমি বলো বাবা—
—আমি ওসব বুঝি নে৷ যা বলবি, কিনে এনে দেব—ওসব মেয়েলি কাণ্ডকারখানার আমি কোনো খবর রাখি নে—
.
আহারান্তে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে দুজনে হাটে চলে গেলেন, আজ পাশের গ্রামে হাট৷ পূর্বে হাট ছিল না, দুই জমিদারে বাদাবাদির ফলে আজ বছরখানেক নতুন হাট বসেছে৷ হাটের খাজনা লাগে না বলে কাপালিরা তরিতরকারি নিয়ে জমা হয়—সস্তায় বিক্রি করে৷
অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষ হয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহ পড়েছে, অথচ এবার শীত এখনও তেমন পড়ে নি৷ বাবা ও জ্যাঠামশায় চলে গেলে শরৎ রোদে পিঠ দিয়ে বসে আবার সেই একই কথা ভাবতে লাগল৷
গড়ের খাল পার হয়ে দেখা গেল রাজলক্ষ্মী আসছে৷ ওর জীবনে যদি কেউ সত্যিকার বন্ধু থাকে তবে সে রাজলক্ষ্মী, ও এলে যেন বাঁচা যায়, দিন কাটে ভালো৷
রাজলক্ষ্মী আসতে আসতে বললে, আজ একটু শীত পড়েছে শরৎদি—না?
—আয় আয়, তোর কথাই ভাবছি—
—কেন—
—তুই চলে গেলে যেন ফাঁকা হয়ে যায়, আয় বোস—
শরৎ ভাবছিল বটুকের কথাটা বলা উচিত হবে কিনা৷ কিন্তু তা হলে অনেক কথাই ওকে এখন বলতে হয়—রাজলক্ষ্মী তাতে কিছু যদি মনে করে সব শুনে? শরৎ তাহলে মরে যাবে—জীবনের মধ্যে দুটিমাত্র বন্ধু সে পেয়েছে—অন্ধ রেণুকা আর এই রাজলক্ষ্মী৷ এদের কাউকে সে হারাতে প্রস্তুত নয়৷
আর একটি মেয়ের কথা মনে হয়—হতভাগিনী কমলার কথা—কে জানে সেই পাপপুরীর মধ্যে কি ভাবে সে দিন কাটাচ্ছে?
সরলা শরৎ জানত না—পাপে যারা পাকা হয়ে গিয়েছে, তারা পাপপুণ্য বলে জ্ঞান অল্প দিনেই হারিয়ে ফেলে, পাপে ও বিলাসে মত্ত হয়ে বিবেক বিসর্জন দেয়৷ কোনো অসুবিধাতে আছে বলে নিজেকে মনে করে না৷ পুণ্যের পথই কণ্টকসঙ্কুল, মহাদুঃখময়—পাপের পথে গ্যাসের আলো জ্বলে, বেলফুলের গড়েমালা বিক্রি হয়, গোলাপজলের ও এসেন্সের সুগন্ধ মন মাতিয়ে তোলে৷ এতটুকু ধুলোকাদা থাকে না পথে৷ ফুলের পাপড়ির মতো কোঁচা পকেটে গুঁজে দিব্যি চলে যাও৷
রাজলক্ষ্মী বললে, দিন ঘনিয়ে এল, তাই তো তোমায় ছাড়তে পারি নে—
—হুঁ—
—কি ভাবছ শরৎদি?
শরৎ চমক ভেঙে উঠে বললে—কই না—কিছু না৷ হ্যাঁরে, তুই আশাদিদির বরের গান শুনেছিস? খুব নাকি ভালো গায়? বাবা আর জ্যাঠামশায় সেখানে ধন্না দিয়ে পড়ে আছেন আজ ক’দিন থেকে৷ দিন দশেক থেকে দেখছি—
—ও, তাই শরৎদি—মুখুজ্জে-বাড়ির দিকে যেতে দেখেছি বটে ওঁদের আজ সকালে—
—রোজ সেখানে পড়ে আছেন দুজনে—কি সকাল, কি বিকেল—কেমন গান গায় রে লোকটা?
—হিন্দী-মিন্দি গায়—কি হা-হা করে, হাত-পা নাড়ে, আমার ও ভালো লাগে না৷
দুজনে সন্ধার পূর্ব পর্যন্ত গল্প করলে, সন্ধার আগে প্রতিদিনের মতো রাজলক্ষ্মী চলে গেল, শরৎ এগিয়ে দিতে গেল৷ অল্প অল্প অন্ধকার হয়েছে, ভারি নির্জন গড়বাড়ির জঙ্গল৷ শরৎ ভয় পায় না একটুও, বরং এতকাল পরে তার বড় ভালো লাগে৷ এসব জিনিস তার হারিয়ে গিয়েছিল, আবার সে ফিরে পেয়েছে৷ চিরদিনের গড়বাড়ির জঙ্গল তার পল্লব-প্রচ্ছায় বীথিপথে কত কি বনপুষ্পের সুবাস ও বনবিহঙ্গের কলকাকলি নিয়ে বসে আছে, পিতৃপিতামহের পায়ের দাগ আজও যেন আঁকা আছে সে পথের ধুলোয়, মায়ের স্নিগ্ধ স্নেহদৃষ্টি কোন কোণে সেখানে যেন লুকিয়ে আছে আজও—তাই তো মনে হয় তার যদি কোনো পাপ হয়ে থাকে নিজের অজ্ঞাতে—সব কেটে গিয়েছে এখানে এসে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে৷
.
রাজলক্ষ্মীর বিবাহে বেশি ধুমধাম হবে না, গ্রামের সকলকে ওরা বিবাহ-রাত্রে নিমন্ত্রণ করতে পারবে না বলে বেছে বেছে নিমন্ত্রণ করছে৷ কেদার ও গোপেশ্বর দুজনেই অবিশ্যি নিমন্ত্রিত—এসব খবর কেদারই আনলেন৷
শরৎ বললে, বাবা, ওর বিয়েতে কি একটা দেওয়া যায় বলো না—
—তুই যা বলবি, এনে দেব৷
—তুমি যা ভালো ভাব, এনো৷
—আমি তো তোকে বললাম, ওসব মেয়েলি ব্যাপারে আমি নেই—
—টাকা আছে?
—আড়তে চাকরি করার দরুন টাকা তো খরচ হয় নি৷ সেগুলো আছে একজনের কাছে জমা৷ কত চাই বলে দে—
—আইবুড়ো ভাতের একখানা ভালো শাড়ি দাও আর একজোড়া দুল—ও আমায় বড় ভালোবাসে, আমার ছোট বোনের মতো৷ আমার বড় সাধ—
—তা দেব মা৷ কখনো তোর কাউকে কিছু হাতে করে দেওয়া হয় না—তুই হাতে করে দিয়ে আসিস—হরি সেকরাকে আজই দুলের কথা বলে দিই—
বিবাহের দু-তিন দিন আগে কেদার শাড়ি ও দুল এনে দিলেন৷ শরৎ কাপড়ের পাড় পছন্দ না করাতে দুবার তাঁকে ও গোপেশ্বরকে ভাজনঘাটের বাজারে ছুটোছুটি করতে হল৷ শরৎ নিজে ওদের বাড়ি গিয়ে রাজলক্ষ্মীকে আইবুড়ো ভাতের নিমন্ত্রণ করে এল৷ সকাল থেকে শাক, সুত্তুনি, ডালনা ঘণ্ট অনেক কিছু রান্না করলে৷ গোপেশ্বর চাটুজ্জে এসব ব্যাপারে শরৎকে কুটনো কোটা, ফাইফরমাশ—নানা রকম সাহায্য করলেন৷
শরৎ বললে, জ্যাঠামশায়কে বড় খাটিয়ে নিচ্ছি—
—তা নেও মা৷ আমি ইচ্ছে করে খাটি৷ আমার বড় ভালো লাগে—এ বাড়ি হয়ে গিয়েছে নিজের বাড়ির মতো৷ নিজে যা খুশি করি—
ইতিমধ্যে দুবার গোপেশ্বর চাটুজ্জে চলে যাবার ঝোঁক ধরেছিলেন, দুবার শরৎ মহা আপত্তি তুলে সে প্রস্তাব না-মঞ্জুর করে৷
শরৎ বললে, সেই জন্যেই তো বলি জ্যাঠামশায়, যতদিন বাঁচবেন, থাকুন এখানে৷ এখান থেকে যেতে দেব না৷
—সেই মায়াতেই তো যেতে পারি নে—সত্যি কথা বলতে গেলে যেতে ভালোও লাগে না৷ সেখানে বৌমারা আছেন বটে, কিন্তু আমার দিকে তাকাবার লোক নেই মা—তার চেয়ে আমার পর ভালো—তুমি আমার কে মা, কিন্তু তুমি আমার যে সেবা যে যত্ন করো তা কখনো নিজের লোকের কাছ থেকে পাই নি—বা রাজামশায় আমায় যে চোখে দেখেন—
শরৎ ধমকের সুরে বললে, ওসব কথা কেন জ্যাঠামশায়? ওতে পর করে দেওয়া হয়—সত্যিই তো আপনি পর নন?
রাজলক্ষ্মী খেতে এল৷
শরৎ বললে, দাঁড়া, কাপড় ছাড়তে হবে—
রাজলক্ষ্মী বিস্ময়ের সুরে বললে, কেন শরৎদি?
—কারণ আছে৷ ঘরের মধ্যে চল—
পরে কাগজের ভাঁজ খুলে শাড়ি দেখিয়ে বললে—পর এখানা—পছন্দ হয়েছে? তোর কান মলে দেব—কান নিয়ে আয় এদিকে—দেখি—
—দুল? এসব কি করেছ শরৎদি?
—কি করলাম! ছোট বোনকে দেব না? সাধ হয় না?
রাজলক্ষ্মী গরিবের মেয়ে, তাকে এমন জিনিস কেউ কোনো দিন দেয় নি৷ সে অবাক হয়ে বললে, এই সব জিনিস আমায় দিলে শরৎদি! সোনার দুল—
শরৎ ধমক দিয়ে বললে, চুপ৷ বলিনি আমাদের রাজারাজড়ার কাণ্ড, হাত ঝাড়লে পর্বত—
রাজলক্ষ্মীর চোখের জল গড়িয়ে পড়ল৷ নীরবে সে শরতের পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় দিলে৷ বললে, তা আজ দিলে কেন? বুঝেছি শরৎদি—তুমি যাবে না বিয়ের রাতে!
—যাব না কেন—তা যাব—তবে পাড়াগাঁ জায়গা, বুঝিস তো—
—তোমার মতো মানুষ আমার বিয়েতে গিয়ে দাঁড়ালে আমার অকল্যাণ হবে না শরৎদি৷ এ তোমায় ভালো করেই জানিয়ে দিচ্ছি, তুমি না গেলে আমার মনে বড্ড কষ্ট হবে৷ আর তুমি গেলে যদি অকল্যাণ হয়, তবে অকল্যাণই সই—
—ছিঃ ছিঃ—ওসব কথা বলতে নেই মুখে—আয়, চল রান্নাঘরে—কেমন গোটা দিয়ে সুত্তুনি রেঁধেছি খেয়ে বলবি চল—
.
বিকেলের দিকে শরৎ পুকুর থেকে গা ধুয়ে বাড়ি গিয়ে দেখলে রান্নাঘরের দাওয়ায় ইটচাপা একখানা কাগজের কোণ বেরিয়ে রয়েছে৷ একটু অবাক হয়ে কাগজটা টেনে নিয়ে দেখলে, তাতে লেখা আছে—
‘‘আজ সন্ধ্যার পরে রানীদিঘির পাড়ে ডুমুরতলায় আমাদের সঙ্গে দেখা করিবা৷ নতুবা কলিকাতায় কি হইয়াছিল প্রকাশ করিয়া দিব৷ হেনা বিবি আমাদের সঙ্গে আছে ভাজনঘাটের কুঠির বাংলায়৷ সেই তোমার সঙ্গে দেখা করিতে চায়৷ দেখা করিলে তোমার ভালো হইবে৷ এ চিঠির কথা কাহাকেও বলিও না৷ বলিলে যাহা হইবে দেখিতেই পাইবে৷ সাবধান৷’’
শরৎ টলে পড়ে যেতে যেতে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলে৷ মাথাটা যেন ঘুরে উঠল৷ আবার সেই হেনা বিবি, সেই পাপপুরীর কথা—যা মনে করলে শরতের গা ঘিনঘিন করে! এ চিঠিখানা ছুঁয়েছে, তাতেই তাকে নাইতে হবে এই অবেলায়৷
এরা তাকে রেহাই দেবে না? তাদের গড়বাড়িতে কলকাতার লোকের জোর কিসের?
সব সমস্যার সে সমাধান করে দিতে পারে এখুনি, এই মুহূর্তেই কালোপায়রা দিঘির অতল জলতলে—
কিন্তু বাবার মুখের অসহায় ভাব মনে এসে তাকে দুর্বল করে দেয়৷ নইলে সে প্রভাসেরও ধার ধারত না, গিরীনেরও না৷ নিজের পথ করে নিত নিজেই৷ তাদেরই বংশের কোন রানী ওই দিঘির জলে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন মান বাঁচাতে৷ সেও ওই বংশেরই মেয়ে৷ তার ঠাকুরমারা যা করেছিলেন সে তা পারে৷
বাবাকে এ চিঠি দেখাবে না৷ বাবার ওপর মায়া হয়, দিব্যি গানবাজনা নিয়ে আছেন, ব্যস্ত হয়ে উঠবেন এখুনি৷ গোপেশ্বর জ্যাঠামশায়কে দেখাতে লজ্জা করে৷ থাক গে, আজ সে এখুনি রাজলক্ষ্মীদের বাড়ি গিয়ে কাটিয়ে আসবে অনেক রাত পর্যন্ত৷ উত্তর দেউলে পিদিম আজ সকাল সকাল দেখাবে৷
রাজলক্ষ্মীর মা ওকে দেখে বললেন, এসো এসো মা শরৎ, আচ্ছা পাগলি, মেয়ে, অত পয়সাকড়ি খরচ করে রাজিকে দুল আর শাড়ি না দিলে চলত না?
রাজলক্ষ্মীর কাকিমা বললেন, গরিবের ওপর ওদের চিরকাল দয়া অমনি—কত বড় বংশ দেখতে হবে তো? বংশের নজর যাবে কোথায় দিদি?
শরৎ সলজ্জ সুরে বললে, ওসব কথা কেন খুড়িমা? কি এমন জিনিস দিয়েছি—কিছু না—ভারি তো জিনিস—রাজি কোথায়?
রাজলক্ষ্মীর মা বললেন, এই এতক্ষণ তোমার কথাই বলছিল, তোমার দেওয়া কাপড় আর দুল দেখতে চেয়েছেন গাঙ্গুলীদের বড় বউ, তাই নিয়ে গিয়েছে দেখাতে৷ শরৎদি বলতে মেয়ে অজ্ঞান, তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ বলে, মা—শরৎদিকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে সুখ পাব না৷ বসো, এল বলে—
একটু পরে গাঙ্গুলী-বউকে সঙ্গে নিয়ে রাজলক্ষ্মী ফিরল, সঙ্গে জগন্নাথ চাটুজ্জের পুত্রবধূ নীরদা৷ নীরদা শরতের চেয়ে ছোট, শ্যামবর্ণ, একহারা গড়নের মেয়ে, খুব শান্তপ্রকৃতির বউ বলে গাঁয়ে তার সুখ্যাতি আছে৷
গাঙ্গুলী বউ বললেন, এই যে মা শরৎ, তোমার কথাই হচ্ছিল৷ তুমি যে শাড়ি দিয়েছ, দেখতে নিয়েছিলাম—ক’টাকা নিলে? ভাজনঘাটের বাজার থেকে আনানো? বটঠাকুর কিনেছেন বুঝি?
শরৎ বললে, দাম জানি নে খুড়ীমা, বাবা ভাজনঘাট থেকেই এনেছেন৷ দুবার ফিরিয়ে দিয়ে তবে ওই পাড় পছন্দ—
নীরদা বললে, দিদির পছন্দ আছে৷ চলুন দিদি, ও ঘরে একটু তাস খেলি আপনি আমি রাজলক্ষ্মী আর ছোট খুড়িমা—
রাজলক্ষ্মীর মা শরৎকে পাশের ঘরে নিয়ে বললেন, মা, কাল তুমি আসতে পারো আর না পারো, আজ সন্দের পর এখান থেকে দুখানা লুচি খেয়ে যেয়ো—রাজলক্ষ্মী আমায় বার বার করে বলেছে—
সবাই মিলে আমোদ-স্ফূর্তিতে অনেকক্ষণ কাটাল—বেলা পড়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ বিয়েবাড়ির ভিড়, গ্রামের অনেক ঝি-বউ সেজেগুজে বিকেলের দিকে বেড়িয়ে দেখতে এল৷ মুখুজ্জে বাড়ির মেজ বউ পেতলের রেকাবে ছিরি গড়িয়ে নিয়ে এলেন৷ রাজলক্ষ্মীর মা বললেন, বরণ-পিঁড়ির আলপনাখানা তুমি দিয়ে দ্যাও দিদি—তুমি ভিন্ন এসব কাজ হবে না—এক হৈমদিদি আর তুমি—তারকের মা তো স্বর্গে গেছেন—আলপনা দেবার মানুষ আর নেই পাড়ায়—তারকের মা কি আলপনাই দিতেন!
শরৎ বললে, বাবাকে একটু খবর দিন খুড়িমা, কালীকান্ত কাকার চণ্ডীমণ্ডপে গানের আড্ডায় আছেন৷ যাবার সময় আমাকে যেন সঙ্গে নিয়ে যান এখান থেকে৷ অন্ধকার রাত, ভয় করে একা থাকতে৷
.
পরদিন সকাল আটটার সময় শরৎকে আবার রাজলক্ষ্মীদের বাড়ি থেকে ডাকতে এল৷ নিরামিষ দিকের রান্না তাকে রাঁধতে হবে৷ গাঙ্গুলীদের বড় বউয়ের জ্বর কাল রাত্রি থেকে৷ তিনিই রান্না করে থাকেন পাড়ার ক্রিয়াকর্মে৷
রাজলক্ষ্মী প্রায়ই রান্নাঘরে এসে শরতের কাছে বসে রইল৷
শরৎ ধমক দিয়ে বলে—যা রাজি, দধিমঙ্গলের পরে হটর হটর ক’রে বেড়ায় না৷ এখানে ধোঁয়া লাগবে চোখেমুখে—অন্য ঘরে বসগে যা—
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, কারো ধমকে আর ভয় খাই নে৷ এই বসলাম পিঁড়ি পেতে—দেখি তুমি কি করো?
নীরদা এসে বললে, শরৎদি একটা অর্থ বলে দাও তো?
আকাশ গম গম পাথর ঘাটা
সাতশো ডালে দুটি পাতা—
শরৎ তাকে খুন্তি উঁচিয়ে মারতে গিয়ে বললে, ননদের কাছে চালাকি—না? দশ বছরের খুকিদের ওসব জিজ্ঞেস করগে যা ছুঁড়ি—
গরিবের বিয়ে বাড়ি, ধুমধাম নেই, হাঙ্গামা আছে৷ সব পাড়ার বউ-ঝি ভেঙে পড়ল সেজেগুজে৷ প্রথম প্রহরের প্রথম লগ্নে বিবাহ৷ শরৎ সারাদিন খাটুনির পরে বিকেলের দিকে নীরদাকে বললে, গা হাত পা ধুয়ে আসব এখন৷ বাড়ি যাই—কাউকে বলিস নে—
বাড়ি ফিরে সে সন্ধ্যাপ্রদীপ দেখাতে গেল৷ শীতের বেলা অনেকক্ষণ পড়ে গিয়েছে, রাঙা রোদ উঠে গিয়েছে ছাতিমবনের মাথায়, ঈষৎ নীলাভ সাদা রঙের পুঞ্জ পুঞ্জ ছোট এড়াঞ্চির ফুল শীতের দিনে এই সব বনঝোপকে এক নির্জন, ছন্নছাড়া মূর্তি দান করেছে৷ শুকনো বাদুড়নখী ফল তাদের বাঁকানো নখ দিয়ে কাপড় টেনে ধরে৷ থমথমে কৃষ্ণা চতুর্দশীর অন্ধকার রাত্রি৷
এক জায়গায় গিয়ে হঠাৎ সে ভয়ে ও বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল৷ একটি লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে উত্তর দেউলের পথ থেকে সামান্য দূরে বাদুড়নখী জঙ্গলের মধ্যে৷ শরৎ কাছে দেখতে গিয়ে চমকে উঠল—কলকাতার সেই গিরীনবাবু!
মরে কাঠ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ৷ ওর ঘাড়টা যেন শক্ত হাতে কে মুচড়ে দিয়েছে পিঠের দিকে, সেই মুণ্ডুটা ধড়ের সঙ্গে এক অস্বাভাবিক কোণের সৃষ্টি করেছে৷ গিরীনের দেহটা যেখানে পড়ে, তার পাশেই মাটিতে ভারী ভারী গোল গোল কিসের দাগ, হাতির পায়ের দাগের মতো৷….শরতের মাথা ঘুরে উঠল, সে চিৎকার করে মূর্ছিতা হয়ে পড়ে গেল৷ হাত থেকে সন্ধ্যাপ্রদীপ ছিটকে পড়ল বাদুড়নখীর জঙ্গলে৷
* * * *
এই অবস্থায় অনেক রাত্রে কেদার ও গোপেশ্বর তাকে বিয়েবাড়ি থেকে ডাকতে এসে দেখতে পেলেন৷ ধরাধরি করে তাকে নিয়ে বাড়ি যাওয়া হল৷
লোকজনের হৈ-হৈ হল পরদিন৷ পুলিশ এল, রানীদিঘির জঙ্গলে এক চালকবিহীন মোটরগাড়ি পাওয়া গেল৷ কি ব্যাপার কেউ বুঝতে পারলে না৷ সবাই বললে গড়বাড়ির সবাই সারারাত বিয়েবাড়িতে ছিল৷ মৃতদেহের ঘাড়ে শক্ত, কঠিন পাঁচটা আঙুলের দাগ যেন লোহার আঙুলের দাগের মতো, ঘাড়ের মাংস কেটে বসে গিয়েছে৷ গোল গোল হাতির পায়ের মতো দাগগুলোই বা কিসের কেউ বুঝতে পারলে না!
* * * *
গড়ের জঙ্গলে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে৷ সন্ধ্যাবেলা৷ কেদার ঘোর নাস্তিক, কি মনে করে তিনি হস্তপদভগ্ন বারাহী দেবীর পাষাণ মূর্তির কাছে মাথা নিচু করে দণ্ডবৎ করে বললেন, গড়ের রাজবাড়ি যখন সত্যিকার রাজবাড়ি ছিল, তখন শুনেছি তুমি আমাদের বংশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিলে৷ আমাদের অবস্থা পড়ে গিয়েছে, অনেক অপরাধ করেছি তোমার কাছে, কিন্তু তুমি আমাদের ভোলো নি৷ এমনি পায়ে রেখো চিরকাল মা—অনেক পুজো আগে খেয়েছ সে কথা ভুলে যেয়ো না যেন৷
এ যে কী অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না!