নয়
মিনুর কাকিমা শরৎকে প্রায়ই বেরুতে দেন না৷ আজ তিনি যাবেন মিছরিপোখরায় তাঁর বন্ধুর বাড়ি, শরৎকে বাড়ি আগলে বসে থাকতে হবে, কাল তিনি লকসাতে মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, শরৎ ছেলেমেয়ে সামলে বাড়ি বসে থাকবে৷
একদিন মিনুর কাকিমা বললে, পটলের বউয়ের ওখানে অত ঘন ঘন যাও কেন?
—কেন?
—আমি পছন্দ করি নে৷ ওরা গরিব লোক, আমাদের ভাড়াটে, অত মাখামাখি করা ভালো না৷
—আমি মিশি, আমিও তো গরিব লোক৷ এতে আর দোষ কি বলুন?
—তুমি বড় মুখে মুখে তর্ক করতে শুরু করেছ দেখছি৷ পটলের বউ মেয়ে ভালো নয়—তুমি জানো কিছু?
শরৎ এতদিন মিনুর কাকিমার কোনো কথার প্রতিবাদ না করে নীরবে সব কাজ করে এসেছে, কিন্তু অন্ধ রেণুকার নামে কটু কথা সে সহ্য করতে পারলে না৷ বললে—আমি যতদূর দেখেছি কোনো বেচাল তো দেখি নি৷ আমি যদি যাই, আপনাকে তাতে কেউ কিছু বলবে না তো!
—না, আমি চাই আমার বাড়ির চাকরবাকর আমার কথা শুনবে—যাও, রান্নাঘরের দিকে দ্যাখো গে—
শরৎ মাথা নামিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল৷ সেখানে গিয়েই সে ক্ষুণ্ণ অভিমানে কেঁদে ফেললে৷ আজ সে এ কথার জবাব দিত মিনুর কাকিমার, একবার ভেবেছিল দিয়েই দেবে উত্তর, যা থাকে ভাগ্যে৷
তবে মুখে জবাব না দিলেও কাজে সে দেখালে, মিনুর কাকিমার অসঙ্গত হুকুম সে মানতে রাজি নয়৷ রেণুকার বাড়ি সেই দিনই বিকেলের দিকে সে আবার গেল৷
রেণুকা ওকে পেয়ে সত্যিই বড় খুশি হয়৷ বললে—ভাই, আজ চলো আমরা নতুন কোনো জায়গায় যাই৷
—কোথায় যাবে?
—আমি রাস্তাঘাট চিনি নে, তুমি বাঙালীটোলায় আমার এক বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে?
—কেন পারব না, চলো৷
—ছ’ নম্বর ধ্রুবেশ্বরের গলি—জিজ্ঞেস করে চলো যাওয়া যাক৷
একে ওকে জিজ্ঞেস করে ওরা ধ্রুবেশ্বরের গলিতে নির্দিষ্ট বাসায় পৌঁছলো৷ তারাও খুব বড়লোক নয়, ছোট দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে স্বামী-স্ত্রী, চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে৷ বাড়ি অনেক দিন আগে ছিল ঢাকা জেলায় কি এক পাড়াগাঁয়ে, বাড়ির কর্তা বেনারস মিউনিসিপ্যালিটির কেরানি, সেই উপলক্ষে এখানে বাস৷
বাড়ির গিন্নির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি৷ তিনি ওদের যত্ন করে বসালেন, চা করে খেতে দিলেন৷
তাদের বাড়িতে একটি চার-পাঁচ বছরের খোকা আছে, নাম কালো৷ দেখতে কি চমৎকার, যেমন গায়ের রং, তেমনি মুখশ্রী, সোনালি চুল, চাঁচাছোলা গড়ন৷
শরৎ বললে, এমন সুন্দর ছেলের নাম কালো রাখলেন কেন?
গিন্নি হেসে বললেন, আমার শ্বশুরের দেওয়া নাম৷ তাঁর প্রথম ছেলে মারা যায়, নাম ছিল ওই৷ তিনিই জোর করে কালো নাম রেখেছেন৷
প্রথম দর্শনেই খোকাকে শরৎ ভালোবেসে ফেললে৷
বললে, এসো খোকা, আসবে?
খোকা অমনি বিনা দ্বিধায় শরতের কাছে এসে বসলো৷
শরৎ বললে, আমি কে হই বলো তো খোকন?
খোকা হেসে শরতের মুখের দিকে চোখ তুলে চুপ করে রইল৷
খোকার মা বললেন, মাসিমা হন, মাসিমা বলে ডাকবে—
খোকা বললে, ও মাসিমা—
—এই যে বাবা, উঠে এসে কোলে বসো—
খোকার মা বললেন, সেই ছড়াটা শুনিয়ে দাও তোমার মাসিমাকে খোকন!
খোকা অমনি দাঁড়িয়ে উঠে বলতে আরম্ভ করলে—
এই যে গঙ্গা পুণ্য ঢারা
বিমল মুরটি পাগলপারা
বিশ্বনাটের চরণটলে বইছে কুটুহলে—
খোকা ‘ত’ এর জায়গায় ‘ট’ বলে, ‘ধ’ এর জায়গায় ‘ঢ’ বলে—শরতের মনে হল খোকার মুখে অমৃত বর্ষণ হচ্ছে যেন৷ অভাগিনী শরৎ সন্তানস্নেহ কখনো জানে নি, কিন্তু এই খোকাকে দেখে তার সুপ্ত মাতৃহৃদয় যেন হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল৷ কত ছেলে তো দেখলে এ পর্যন্ত, মিনুর কাকিমারই তো এ বয়সের ছেলে রয়েছে, তাদের প্রতি স্নেহ তো দূরের কথা—শরৎ নিতান্তই বিরক্ত৷ এ ছেলেটির ওপর এমন ভাবের কারণ কি সে খুঁজে পায় না৷ কিন্তু মনে হল এ খোকা তার কত দিনের আপনার, একে দেখে, একে কোলে করে বসে ওর নারীজীবন যেন সার্থক হল৷
শরৎ সেদিন সেখান থেকে চলে এল বটে, কিন্তু মন রেখে এল খোকার কাছে৷ কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার মন হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়৷
গড়বাড়ির জঙ্গলে তাদের পুরনো কোঠা৷
বাবা বাড়ি নেই৷
—ও খোকন, ও কালো—
—কি মা?
—বেরিও না এই রোদ্দুরে হটর হটর করে—ঘরে শোবে এসো—
খিল খিল করে দুষ্টুমির হাসি হেসে খোকা ছুটে পালায়৷
হাঁড়ি-হেঁসেলের অবসরে নতুন আলাপী খোকনকে ঘিরে তার মাতৃহৃদয়ের সে কত অলস স্বপ্ন৷ যে সাধ আশা কোনোকালে পূর্ণ হবার নয়, ইহজীবনে নয়, মন তাকেই হঠাৎ যেন সবলে আঁকড়ে ধরে৷
দিন দুই পরে সে রেণুকাকে বলে—চল ভাই, কালোকে দেখে আসি গে—
কিন্তু সেদিন রেণুকার যাবার সময় হয় না৷ স্বামী দুজন বন্ধুকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছেন, রান্নাবান্নার হাঙ্গামা আছে৷
আরও দিনকয়েক পরে আবার শরতের অবসর মিলল—এবার রেণুকাকে বলেকয়ে নিয়ে গেল ধ্রুবেশ্বরের গলি৷ দূর থেকে বাড়িটা দেখে ওর বুকের মধ্যে যেন সমুদ্রের ঢেউ উথলে উঠল—বড় বড় পর্বতপ্রমাণ ঢেউ যেন উদ্দাম গতিতে দূর থেকে ছুটে এসে কঠিন পাষাণময় বেলাভূমির গায়ে আছড়ে পড়ছে৷
খোকা দেখতে পেয়েছে, সে তাদের বাড়ির দোরে খেলা করছিল৷ সঙ্গে আরও পাড়ার কয়েকটি খোকাখুকি৷
শরতের বুক ঢিপ ঢিপ করে উঠল—খোকা যদি ওকে না চিনতে পারে!
কিন্তু খোকা তাকে দেখেই খেলা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুধে-দাঁত বার করে একগাল হেসে ফেললে৷
শরতের অদৃষ্টাকাশের কোন সূর্য যেন রাশিচক্রের মধ্যে দিয়ে পিছু হঠতে হঠতে মীনরাশিতে প্রবিষ্ট হলেন, যার অধিপতি সর্বপ্রকার স্নেহপ্রেমের দেবতা শুক্র!
—চিনতে পারিস খোকা? আয়—
শরৎ হাত বাড়িয়ে দিলে ওকে কোলে নেবার জন্য৷ খোকা বিনা দ্বিধায় ওর কোলে এসে উঠল, বললে—মাছিমা—
—তাহলে তুই দেখছি ভুলিস নি খোকা—
খোকার মা ছুটে এসে বললেন, যাক, এসেছ ভাই? ও কেবল মাসিমা মাসিমা করে, একদিন ভেবেছিলাম রেণুকাদের বাড়ি নিয়েই যাই—দাঁড়াও ভাই, পাশের বকসীদের বাড়ির বড় বউ তোমাকে দেখতে চেয়েছে, ডেকে আনি—
বকসীদের বাড়ির দুই বউ একটু পরে হাজির৷ দুজনেই বেশ সুন্দরী, গায়ে গহনাও মন্দ নেই দুজনের৷ বড় বউ প্রণাম করে বললে—ভাই, আপনার কথা সেদিন দিদি বলছিলেন, তাই দেখতে এলুম—
—আমার কথা কি বলবার আছে বলুন?
—দেখে মনে হচ্ছে, বলবার সত্যিই আছে৷ যা নয় তা কখনো রটে ভাই? রটেছে আপনার নামে—
শরতের মুখ শুকিয়ে গেল৷ কি রটেছে তার নামে? এরা কি কেউ গিরীন প্রভাসের কথা জানে নাকি? সে বললে, আমার নামে কি শুনেছেন?
বড় বউ হেসে বললে, না, তা আর বলব না৷
শরতের আরও ভয় হল৷ বললে, বলুনই না?
—আপনার চেহারার বড় প্রশংসা করছিলেন দিদি৷ আমায় বললেন, ভাই রেণুকাদের বাড়িও’লাদের বাড়িতে তিনি এসেছেন রান্না করতে, কিন্তু অনেক বড় ঘরে অমন রূপ নেই৷ সে যে সামান্য বংশের মেয়ে নয়, তা দেখলে আর বুঝতে বাকি থাকে না৷ তাই তো ছুটে এলাম, বলি দেখে আসি তো—
শরৎ বড় লজ্জা পায় রূপের প্রশংসা শুনলে৷ এ পর্যন্ত তা সে অনেক শুনেছে—রূপের প্রশংসাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল জীবনে, আজ এই দশা কেন হবে নইলে? কিন্তু সে-সব কথা বলা যায় না কারো কাছে, সুতরাং সে চুপ করেই রইল৷
কালোর মা বললেন, খোকা তো মাসিমা বলতে অজ্ঞান! তবু একদিনের দেখা! কি গুণ তোমার মধ্যে আছে ভাই, তুমিই জানো—
বকসীদের বড় বউ বললে, একটু আমাদের বাড়ি পায়ের ধুলো দিতে হবে ভাই—
—এখন কি করে যাব বলুন, ছুটি যে ফুরিয়ে এল—
—তা শুনব না, নিয়ে যাব বলেই এসেছি—দিদিও চলুন, রেণুকা ভাই তুমিও এসো—খোকাকে কোলে নিয়ে শরৎ ওদের বাড়ি চলল সকলের সঙ্গে৷
বড় বউ বললে, ভাই তোমার কোলে কালোকে মানিয়েছে বড় চমৎকার৷ ও যেমন সুন্দর, তুমিও তেমন৷ মা আর ছেলে দেখতে মানানসই একেই বলে—
ওদের বাড়ি যে জলযোগের জন্যেই নিয়ে যাওয়া একথা সবাই বুঝেছিল৷ হলও তাই, শরতের জন্যে ফলমূল ও সন্দেশ—বাকি দুজনের জন্যে সিঙাড়া-কচুরির আমদানিও ছিল৷ বউ দুটির অমায়িক ব্যবহারে শরৎ মুগ্ধ হয়ে গেল৷ খানিকক্ষণ বসে গল্পগুজবের পর শরৎ বিদায় চাইলে৷
বড় বউ বললে, আবার কিন্তু আসবেন ভাই, এখন যখন খোকার মাসিমা হয়ে গেলেন, তখন খোকাকে দেখতে আসতেই হবে মাঝে মাঝে—
—নিশ্চয়ই আসব ভাই—
খোকা কিন্তু অত সহজে তার মাসিমাকে যেতে দিতে রাজি হল না৷ সে শরতের আঁচল ধরে টেনে বসে রইল, বললে—এখন টুমি যেয়ো না মাছিমা—
—যেতে দিবি নে?
—না৷
—আবার কাল আসব৷ তোর জন্যে একটা ঘোড়া আনব—
—না, টুমি যেয়ো না৷
শরৎ মুগ্ধ হয় শিশু কত সহজে তাকে আপন বলে গ্রহণ করেছে তাই দেখে৷ যেন ওর কতদিনের জোর, কতদিনের ন্যায্য অধিকার৷ সব শিশু যে এমন হয় না, তা শরতের জানতে বাকি নেই৷
খোকা ওর ছোট্ট মুঠি দিয়ে শরতের আঁচলে কয়েক পাক জড়িয়েছে৷ সে পাক খুলবার সাধ্য নেই শরতের, জোর করে তা সে খুলতে পারবে না, চাকরি থাকে চাই যায়৷ শরতের হৃদয়ে অসীম শক্তি এসেছে কোথা থেকে, সে ত্রিভুবনকে যেন তুচ্ছ করতে পারে এই নবার্জিত শক্তির বলে, জীবনের নতুন অর্থ যে তার চোখের সামনে খুলে গিয়েছে৷ যখন অবশেষে সে বাড়ি চলে এল, তখন সন্ধ্যার বেশি দেরি নেই৷ মিনুর কাকিমা মুখ ভার করে বললেন, রোজ রোজ তোমার বেড়াতে যাওয়া আর এই রাত্তিরে ফেরা! উনুনে আঁচ পড়ল না এখনও, ছেলেমেয়েদের আজ আর খাওয়া হবে না দেখছি৷ আটটার মধ্যেই ওরা ঘুমিয়ে পড়বে—
—কিছু হবে না, আমি ওদের খাইয়ে দিলেই তো হল—
—তোমার কেবল মুখে মুখে জবাব! এ বাড়িতে তোমার সুবিধে দেখে কাজ হবে না—আমার সুবিধে দেখে কাজ হবে, তা বলে দিচ্ছি৷ কাল থেকে কোথাও বেরুতে পারবে না৷
মুখোমুখি তর্ক করা শরতের অভ্যেস নেই৷ সে এমন একটা অদ্ভুত ধরনের নির্বিকার, স্বাধীন ভঙ্গীতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল, একটা কথাও না বলে—যাতে মিনুর কাকিমা নিজে যেন হঠাৎ ছোট হয়ে গেল এই অদ্ভুত মেয়েটির ধীর, গম্ভীর, দর্পিত ব্যক্তিত্বের নিকট৷
মিনুর কাকিমা কিন্তু দমবার মেয়ে নয়, শরতের সঙ্গে রান্নাঘর পর্যন্ত গিয়ে ঝাঁজালো এবং অপমানজনক সুরে বললে, কথার উত্তর দিলে না যে বড়? আমার কথা কানে যায় না নাকি?
শরৎ রান্নাঘরের কাজ করতে করতে শান্তভাবে বললে, শুনলাম তো যা বললেন—
—শুনলে তো বুঝলাম৷ সেই রকম কাজ করতে হবে৷ আর একটা কথা বলি, তোমার বেয়াদবি এখানে চলবে না জেনে রেখো৷ আমি কথা বললাম আর তুমি এমনি নাক ঘুরিয়ে চলে গেলে, ও-সব মেজাজ দেখিও অন্য জায়গায়৷ এখানে থাকতে হলে—ও কি, কোথায় চললে?
—আসছি, পাথরের বাটিটা নিয়ে আসি ওঘর থেকে—
মিনুর কাকিমার মুখে কে যেন এক চড় বসিয়ে দিলে৷ সে অবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল৷ এ কি অদ্ভুত মেয়ে, কথা বলে না৷ প্রতিবাদ করে না৷ রাগঝালও দেখায় না—অথচ কেমন শান্ত, নির্বিকার, আত্মস্থ ভাবে তুচ্ছ করে দিতে পারে মানুষকে! মিনুর কাকিমা জীবনে কখনো এমন অপমানিতা বোধ করে নি নিজেকে৷
শরৎ ফিরে এলে তাই সে ঝাল ঝাড়বার জন্যে বললে, কাল থেকে দুপুরের পর বসে বসে ডালগুলো বেছে হাঁড়িতে তুলবে৷ কোথাও বেরুবে না৷
মিনুর কাকা তাঁর স্ত্রীর চিৎকার শুনে ডেকে বললেন, আঃ কি দুবেলা চেঁচামেচি করো রাঁধুনীর সঙ্গে? অমন করলে বাড়িতে চাকরবাকর টিকতে পারে?
—কেন গো, রাঁধুনীর উপর যে বড্ড দরদ দেখতে পাই—
—আঃ, কি সব বাজে কথা বল! শুনতে পাবে—
—শুনতে পেলে তো পেলে—তাতে ওর মান যাবে না৷ ওরা কি ধরনের মানুষ তা জানতে বাকি নেই—আজ এসেছে এখানে সাধু সেজে তীর্থ করতে৷
—লোককে অপ্রিয় কথাগুলো তুমি বড্ড কটকট করে বলো৷ ও ভালো না—
মিনুর কাকিমা ঝাঁজের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললে, আমায় তোমার পাদ্রি সাহেবের মতো মর্মজ্ঞান শিখিয়ে দিতে হবে না—থাক—
মিনুর কাকাটিকে শরৎ দূর থেকে দেখেছে৷ সামনে এ পর্যন্ত একদিনও বার হয় নি৷ লোকটি বেশ নাদুস-নুদুস চেহারার লোক, মাথায় ঈষৎ টাক দেখা দিয়েছে, সাহেবের মতো পোশাক পরে আপিসে বেরিয়ে যায়, বাড়িতে কখনো চেঁচামেচি হাঁকডাক করে না, চাকর-বাকরদের বলাবলি করতে শুনেছে যে লোকটা মদ খায়৷ মাতালকে শরৎ বড় ভয় করে, কাজেই ইচ্ছে করেই কখনো সে লোকটির ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না৷
সেদিন আবার তার মন উতলা হয়ে উঠল খোকাকে দেখবার জন্যে৷ খোকাকে একটা ঘোড়া দেবে বলে এসেছিল, হাতে পয়সা নেই, এদের কাছে মুখ ফুটে চাইতে সে পারবে না, অথচ কি করা যায়?
কিন্তু শেষ পর্যন্ত খোকাকে খেলনা দেবার টানই বড় হল৷ সে মিনুর কাকিমাকে বললে—আমায় কিছু পয়সা দেবেন আজ?
মিনুর কাকিমা একটু আশ্চর্য হল৷ শরৎ এ পর্যন্ত কখনো কিছু চায় নি৷
বললে—কত?
—এই—পাঁচ আনা—
মিনুর কাকিমা মনে মনে হিসেব করে দেখলে শরৎ পাঁচ মাস হল এখানে রাঁধুনীর কাজ করছে, এ পর্যন্ত তাকে মাইনে বলে কিছু দেওয়া হয় নি, সেও চায় নি৷ আজ এতদিন পরে মোটে পাঁচ আনা চাওয়াতে সে সত্যিই আশ্চর্য হল৷
আঁচল থেকে চাবি নিয়ে বাক্স খুলে বললে, ভাঙানো তো নেই দেখছি, টাকা রয়েছে৷ ও বেলা নিয়ো—
শরৎ ঠিক করেছিল আজ দুপুরের পরে কাজকর্ম সেরে সে খোকার কাছে যাবে৷ মুখ ফুটে সে বললে, টাকা ভাঙিয়ে আনলে হয় না? আমার বিকেলে দরকার ছিল৷
—কি দরকার?
—ও আছে একটা দরকার—
—বলোই না—
—একজনের জন্যে একটা জিনিস কিনব৷
—কে?
শরৎ ইতস্তত করে বললে রেণুকা জানে—পটলের বউ—
মিনুর কাকিমা মুখ টিপে হেসে বললে, আপত্তি থাকে বলবার দরকার নেই, থাক গে৷ নিও এখন—
.
শরৎ রেণুকাকে নিয়ে বিশ্বনাথের গলিতে ঘোড়া কিনতে গেল৷ এক জায়গায় লোকের ভিড় ও কান্নার শব্দ শুনে ও রেণুকাকে দাঁড় করিয়ে রেখে দেখতে গেল৷ একটি আঠারো-উনিশ বছরের বাঙালির মেয়ে হাউহাউ করে কাঁদছে, আর তাকে ঘিরে কতকগুলো হিন্দুস্থানী মেয়েপুরুষ খেপাচ্ছে ও হাসাহাসি করছে৷
মেয়েটি বলছে, আমার গামছা ফেরত দে—ও মুখপোড়া, যম তোমাদের নেয় না, মণিকর্ণিকা ভুলে আছে তোদের? শালারা, পাজি ছুঁচোরা—গামছা দে—
শরৎকে দেখে ভিড় সসম্ভ্রমে একটু ফাঁক হয়ে গেল৷ কে একজন হেসে বললে, পাগলি, মাইজী—আপলোক হঠ যাইয়ে—
মেয়েটি বললে, তোর বাবা মা গিয়ে পাগল হোক হারামজাদারা—মণিকর্ণিকায় নিয়ে যা ঠ্যাং-এ দড়ি বেঁধে, পুড়ুতে কাঠ না জুটুক—দে আমার গামছা—দে—
যে ওকে পাগলি বলেছিল সে তার পুণ্যশ্লোক পিতামাতার উদ্দেশে গালাগালি সহ্য করতে না পেরে চোখ রাঙিয়ে বললে, এইয়ো—মু সামহালকে বাত বোলো—নেই তো মু মে ইটা ঘুষা দেগা—
মেয়েটির পরনে চমৎকার ফুলনপাড় মিলের শাড়ি, বর্তমানে অতি মলিন—খুব একমাথা চুল তেল ও সংস্কার অভাবে রুক্ষ ও অগোছালো অবস্থায় মুখের সামনে, চোখের সামনে, কানের পাশে পড়েছে, হাতে কাঁচের চুড়ি, গায়ের রং ফর্সা, মুখশ্রী একসময়ে ভালো ছিল, বর্তমানে রাগে, হিংসায়, গালাগালির নেশায় সর্বপ্রকার কোমলতা-বর্জিত, চোখের চাউনি কঠিন, কিন্তু তার মধ্যেই যেন ঈষৎ দিশাহারা ও অসহায়৷
শরতের বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল৷ রাজলক্ষ্মী? গড়শিবপুরের সেই রাজলক্ষ্মী? এর চেয়ে সে হয়তো দু-তিন বছরের ছোট—কিন্তু সেই পল্লীবালা রাজলক্ষ্মীই যেন৷ বাঙালীর মেয়ে হিন্দুস্থানীদের হাতে এভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, সে দাঁড়িয়ে দেখতে পারবে এই বিশ্বনাথের মন্দিরের পবিত্র প্রবেশপথে?
শরৎ সোজাসুজি গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে বললে, তুমি বেরিয়ে এসো ভাই—আমার সঙ্গে—
মেয়েটি আগের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললে, আমার গামছা নিয়েছে ওরা কেড়ে—আমি রাস্তায় বেরুলেই ওরা এমনি করে রোজ রোজ—তার পরেই ভিড়ের দিকে রুখে দাঁড়িয়ে বললে, দে আমার গামছা, ওঃ মুখপোড়ারা, তোদের মড়া বাঁধা ওতে হবে না—দে আমার গামছা—
ভিড় তখন শরতের অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে কিছু অবাক হয়ে ছত্রভঙ্গ হবার উপক্রম হয়েছে৷ দু একজন হি হি করে মজা দেখবার তৃপ্তিতে হেসে উঠল৷ শরৎ মেয়েটির হাত ধরে গলির বাইরে যত টেনে আনতে যায়, মেয়েটি ততই বার বার পিছনে ফিরে ভিড়ের উদ্দেশে রুদ্রমূর্তিতে নানা অশ্লীল ও ইতর গালাগালি বর্ষণ করে৷
অবশেষে শরৎ তাকে টানতে টানতে গলির মুখে বড় রাস্তার ধারে নিয়ে এল, যেখানে মনোহারী দোকানের সামনে সে রেণুকাকে দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিল৷
রেণুকা চোখে না দেখতে পেলেও গোলমাল ও গালাগালি শুনেছে; এখনও শুনছে মেয়েটির মুখে—সে ভয়ের সুরে বললে, কি, কি ভাই? কি হয়েছে? ও সঙ্গে কে?
—সে কথা পরে হবে৷ এখন চলো ভাই ওদিকে—
মেয়েটি গালাগালি বর্ষণের পরে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যেন৷ সে কাঁদো কাঁদো সুরে বলতে লাগল—আমার গামছাখানা নিয়ে গেল মুখপোড়ারা—এমন গামছাখানা—
শরৎ বললে, ভাই রেণুকা, দোকান থেকে গামছা একখানা কিনে দিই ওকে—চল তো—
মেয়েটি গালাগালি ভুলে ওর মুখের দিকে চাইলে৷ রেণুকা জিজ্ঞেস করলে, তোমার নাম কি? থাকো কোথায়?
মেয়েটি কোনো জবাব দিলে না৷
গামছা কিনতে গিয়ে দোকানি বললে, একে পেলেন কোথায় মা?
শরৎ বললে, একে চেন?
—প্রায়ই দেখি মা৷ গণেশমহল্লার পাগলি, গণেশমহল্লায় থাকে—ও লোককে বড় গালাগালি দেয় খামকা—
পাগলি রেগে বললে, দেয়? তোর পিণ্ডি চটকায়, তোকে মণিকর্ণিকার ঘাটে শুইয়ে মুখে নুড়ো জ্বেলে দেয় হারামজাদা—
দোকানি চোখ রাঙিয়ে বললে, এই চুপ! খবরদার—ওই দেখুন মা—
শরৎ ছেলেমানুষকে যেমন ভুলোয় তেমনি সুরে বললে, ওকি, অমন করে না ছিঃ—লোককে গালাগালি দিতে নেই৷
পাগলি ধমক খেয়ে চুপ করে রইল৷
—গামছা কত?
—চোদ্দ পয়সা মা—আমার দোকানে জিনিসপত্তর নেবেন৷ এই রাস্তায় বাঙালি বলতে এই আমিই আছি৷ দশ বছরের দোকান আমার৷ হুগলী জেলায় বাড়ি, ম্যালেরিয়ার ভয়ে দেশে যাই নে, এই দোকানটুকু করে বাবা বিশ্বনাথের ছিচরণে পড়ে আছি—আমার নাম রামগতি নাথ৷ এক দামে জিনিস পাবেন মা আমার দোকানে—দরদস্তুর নেই৷ মেড়োদের দোকানে যাবেন না, ওরা ছুরি শানিয়ে বসে আছে বাঙালি দেখলেই গলায় বসিয়ে দেবে৷ এই গামছাখানা মোড়ের দোকানে কিনতে যান—চার আনার কম নেবে না৷
দোকানির দীর্ঘ বক্তৃতা শরৎ গামছা হাতে দাঁড়িয়ে একমনে শুনলে, যেন না শুনলে দোকানির প্রতি নিষ্ঠুরতা ও অসৌজন্য দেখানো হবে৷ তার পর আবার রাস্তায় উঠে পাগলকে বললে, এই নেও বাছা গামছা—পছন্দ হয়েছে?
পাগলি সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে বললে, খিদে পেয়েছে—
শরৎ বললে, কি করি রেণু, ছ’টা পয়সা সম্বল, তাতেই যা হয় কিনে খাক গে—
রেণুকা বললে, আমার হাঁড়িতে বোধ হয় ভাত আছে৷
—তাই দেখি গে চলো,—
পাগলিকে ভাত দেওয়া হল, কতক ভাত সে ছড়ালে, কতক ভাত ইচ্ছে করে ধুলোতে মাটিতে ফেলে তাই আবার তুলে খেতে লাগল, অর্ধেক খেলে ভাত, অর্ধেক খেলে ধুলোমাটি৷
শরতের চোখে জল এসে পড়ে৷ মনে ভাবলে—আহা অল্প বয়েস, কি পোড়া কপাল দেখো একবার! মুখের ভাত দুটো খেলেও না—
বললে, ভাত ফেলছিস কেন? থালায় তুলে নে মা—অমন করে না—
ঠিক সেই সময় রাজপথে সম্ভবত কোনো বিবাহের শোভাযাত্রা বাজনা বাজিয়ে ও কলরব করতে করতে চলেছে শোনা গেল৷ শরৎ তাড়াতাড়ি সদর দরজার কাছে ছুটে এসে দেখতে গেল, এসব বিষয়ে তার কৌতূহল এখনও পল্লীবালিকার মতোই সজীব৷
সঙ্গে সঙ্গে পাগলিও ভাতের থালা ফেলে উঠে ছুটে গেল শরৎকে ঠেলে একেবারে সদর রাস্তায়—শরৎ ফিরে এসে বললে, ওমা, একি কাণ্ড, ভাত তো খেলেই না, গামছাখানা পর্যন্ত ফেলে গেল! অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও পাগলির আর দেখা পাওয়া গেল না৷
দশ
পরদিন শরৎ আবার খোকাদের বাড়ি ধ্রুবেশ্বরের গলিতে গিয়ে হাজির, সঙ্গে পটলের বউ৷
খোকার মা বললেন, দু-দিন আস নি ভাই, খোকা ‘মাসিমা মাসিমা’ বলে গেল৷
খোকার জন্যে আজ সে এসেছে শুধু হাতে, কারণ পাগলিকে পয়সা দেবার পরে ওর হাতে আর পয়সা নেই৷ মিনুর কাকিমার কাছে বার বার চাইতে লজ্জা করে৷
খোকা শরতের কোল ছাড়তে চায় না৷
শরৎ যখন এদের বাড়ি আসে, যেন কোনো নূতন জীবনের আলো, আনন্দের আলোর মধ্যে ডুবে যায়৷ আবার যখন মিনুর কাকিমাদের বাড়ি যায়, তখন জীবনের কোন আলো-আনন্দহীন অন্ধকার রন্ধ্রপথে ঢুকে যায়, দূর দিকচক্রবালে উদার আলোকোজ্জ্বল প্রসার সেখান থেকে চোখে পড়ে না৷
খোকা বলে, এসো মাছিমা—খেলা করি—
খোকার আছে দুটো রবাবের বল, একটা কাঠের ভাঙা বাক্স, তার মধ্যে ‘মেকানো’ খেলার সাজ-সরঞ্জাম৷ শেষোক্ত জিনিসটা ছিল খোকার দাদার, এখন সে বড় হয়ে তার ত্যক্ত সম্পত্তি ছোট ভাইকে দিয়ে দিয়েছে৷
খোকা বলে, সাজিয়ে দাও মাছিমা৷
শরৎ জীবনে ‘মেকানো’র বাক্স দেখে নি, কল্পনাও করে নি৷ সে সাজাতে পারে না৷ খোকাও কিছু জানে না, দুজনে মিলে হেলাগোছা করে একটা অদ্ভুত কিছু তৈরি করলে৷
খোকার মা শরতের জন্যে খাবার করে খেতে ডাকলেন৷
শরৎ বললে, আমি কিছু খাব না দিদি—
—তা বললে হয় না ভাই, খোকার মাসিমা যখন হয়েছ, কিছু মুখে না দিয়ে—
—রোজ রোজ এলে যদি খাওয়ান তা হলে আসি কি করে?
—খোকনকে তুমি বড় হলে খাইও ভাই৷ শোধ দিয়ো তখন না হয়—
বকসীদের বড় বউ খবর পেয়ে এসে শরতের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলে৷
সে বললে, কি ভালো লেগেছে ভাই তোমাকে, তুমি এসেছ শুনে ছুটে এলাম—একটা কথা বলবে?
—কি, বলুন?
—তোমার বাপের বাড়ি কোথায় ভাই?
—গড়শিবপুর, যশোর জেলায়৷
—শ্বশুরবাড়ি?
—বাপের বাড়ির কাছেই—
—বাবা-মা আছেন?
শরৎ চুপ করে রইল৷ দু চোখ বেয়ে টস-টস করে জল গড়িয়ে পড়ল বাবার কথা মনে পড়াতে৷ সে তাড়াতাড়ি চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে বললে, ওসব কথা জিজ্ঞেস করবেন না দিদি—
বকসীদের বউ বুদ্ধিমতী, এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না তখন৷ কিছুক্ষণ অন্য কথার পরে শরৎ যখন ওদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসছে, তখন ওকে আড়ালে ডেকে বললে, আমি তোমাকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে চাই নে ভাই—কিন্তু আমার দ্বারা যদি তোমার কোনো উপকার হয়, জানিও—তা যে করে হয় করব৷ তোমাকে যে কি চোখে দেখেছি!
শরৎ অশ্রুভারনত চোখে বললে, আমার ভালো কেউ করতে পারবে না দিদি৷ যদি এখন বাবা বিশ্বনাথ তাঁর চরণে স্থান দেন, তবে সব জ্বালা জুড়িয়ে যায়৷
—তুমি সাধারণ ঘরের মেয়ে নও কিন্তু—
—খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে দিদি৷ ভালোবাসেন তাই অন্যরকম ভাবেন৷ আচ্ছা এখন আসি৷
—আবার এসো খুব শীগগির—
শরৎ ও পটলের বৌ পথ দিয়ে চলে আসতে আসতে সেদিনকার সেই পাগলির সঙ্গে দেখা৷ সে রাস্তার ধারে একখানা ছেঁড়া কাপড় পেতে বসেছে জাঁকিয়ে—আর যে পথ দিয়ে যাচ্ছে তাকেই বলছে—একটা পয়সা দিয়ে যাও না?
শরৎ বললে, আহা, সেদিন ওর কিছু খাওয়া হয় নি, পয়সা আছে কাছে ভাই?
পটলের বউ বললে, পাঁচটা পয়সা আছে—
—ওকে কিছু খাবার কিনে দিই—এসো৷
নিকটবর্তী একটা দোকান থেকে ওরা কিছু খাবার কিনে নিয়ে ঠোঙাটা পাগলির সামনে রেখে দিয়ে বললে, এই নাও খাও—
পাগলি ওদের মুখের দিকে চেয়ে কোনো কথা না বলে খাবারগুলো গোগ্রাসে খেয়ে বললে—আরও দাও—
শরৎ বললে, আজ আর নেই—কাল এখানে বসে থেকো বিকেলে এমনি সময়, কাল দেব৷
পটলের বৌ বললে, ভাই, আমাদের বাড়ি থেকে দুটো রেঁধে নিয়ে এসে দেব কাল?
—বেশ এনো৷ আমি একটু তরকারি এনে দেব৷ আমার যে ভাই কোনো কিছু করবার যো নেই—তা হলে আমার ইচ্ছে করে ওকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে ভালো করে পেটভরে খাওয়াই৷ দুঃখ-কষ্টের মর্ম নিজে না বুঝলে অপরের দুঃখ বোঝা যায় না৷ বাঙালির মেয়ে কত দুঃখে পড়ে আজ ওর এ দশা—তা এক ভগবান ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না৷ আমিও কোনোদিন ওই রকম না হই ভাই—
—বালাই ষাট, তুমি কেন অমন হতে যাবে ভাই?…. ধরো, আমার হাত ধরো, ভাই, বড্ড উঁচু-নীচু—
এই অন্ধ পটলের বউ—এর ওপরও এমন মায়া হয় শরতের! কে আছে এর জগতে, কেউ নেই পটল ছাড়া৷ আজ যদি, ভগবান না করুন, পটলের কোনো ভালোমন্দ হয়, তবে কাল এই নিঃসহায় অন্ধ মেয়েটি দাঁড়ায় কোথায়?
আবার ওই রাস্তার ধারের পাগলির কথা মনে পড়ে৷
জগতে যে এত দুঃখ, ব্যথা কষ্ট আছে, শরৎ সেসবের কিছু খবর রাখত না৷ গড়শিবপুরের নিভৃত বনবিতান শ্যামল আবরণের সংকীর্ণ গণ্ডী টেনে ওকে স্নেহে যত্নে মানুষ করেছিল—বহির্জগতের সংবাদ সেখানে গিয়ে কোনোদিনও পৌঁছায় নি৷
শরৎ জগৎটাকে যে রকম ভাবত, আসলে এটা সে রকম নয়৷ এখন তার চোখ ফুটেছে, জীবনে এত মর্মান্তিক দুঃখের মধ্যে দিয়েই তবে যে উদার দৃষ্টি লাভ হয়েছে তার—এক একদিন গঙ্গার ঘাটে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে শরতের মনে ওঠে এসব কথা৷
আগেকার গড়শিবপুরের সে শরৎ আর সে নেই— সেটা খুব ভালো করেই বোঝে৷ সে শরৎ ছিল মনেপ্রাণে বালিকা মাত্র৷ বয়স হয়েছিল যদিও তার ছাব্বিশ—দৃষ্টি ছিল রাজলক্ষ্মীর মতোই, সংসারের কিছু বুঝত না, জানত না৷ সব লোককে ভাবত ভালো, সব লোককে ভাবত তাদের হিতৈষী৷
সেই বালিকা শরতের কথা ভাবলে এ শরতের এখন হাসি পায়৷
শরৎ মনে এখন যথেষ্ট বল পেয়েছে৷ কলকাতা থেকে আজ এসেছে প্রায় দেড় বছর, যে ধরনের উদভ্রান্ত ভীরু মন নিয়ে দিশেহারা অবস্থায় পালিয়ে এসেছিল কলকাতা থেকে—এখন সে মন যথেষ্ট বল সঞ্চয় করেছে৷ দুনিয়াটা যে এত বড়, বিস্তৃত—সেখানে যে এত ধরনের লোক বাস করে, তার চেয়েও কত বেশি দুঃখী অসহায়, নিরাবলম্ব লোক যে তার মধ্যে রয়েছে, এই সব জ্ঞানই তাকে বল দিয়েছে৷
সে আর কি বিপদে পড়েছে, তার চেয়েও শতগুণে দুঃখিনী ওই গণেশ-মহল্লার পাগলি, এই অন্ধ পটলের বউ৷ এই কাশীতে সেদিন সে এক বুড়িকে দেখেছে দশাশ্বমেধ ঘাটে, বয়স তার প্রায় সত্তর-বাহাত্তর, মাজা ভেঙে গিয়েছে, বাংলা দেশে বাড়ি ছিল, হাওড়া জেলার কোনো এক পাড়াগাঁয়ে৷ কেউ নেই বুড়ির, অনেকদিন থেকে কাশীতে আছে, ছত্রে ছত্রে খেয়ে বেড়ায়৷
সেদিন শরৎকে বললে, মা, তুমি থাকো কোথায় গো?
—কাছেই৷ কেন বলুন তো?
—তোমরা?
—ব্রাহ্মণ৷
—আমায় দুটো ভাত দেবে একদিন?
—আমার সে সুবিধে নেই মা৷ আমি পরের বাড়ি থাকি৷ আপনার মতো অবস্থা৷ কেন, আপনি খান কোথায়?
—পুঁটের ছত্তরে খেতাম, সে অনেকদূর৷ অত দূর আর হাঁটতে পারি নে—আজকাল আবার নিয়ম করেছে একদিন অন্তর মাদ্রাজীদের ছত্তরে ডালভাত দেয়৷ তা সে-সব তরকারি নারকোল তেলে রান্না মা, আমাদের মুখে ভালো লাগে না৷ আজ এক জায়গায় ভোজ দেবে, সেখানে যাব—ওই পাঁড়েদের ধর্মশালায়—চলো না, যাবে মা?
—কতদূর?
—বেশি দূর নয়৷ এক হিন্দুস্থানী বড়লোক কাশীতে তীর্থধর্ম করতে এসেছে মা৷ লোকজন খাওয়াবে—আমাদের সব নেমন্তন্ন করেছে৷ চলো না?
—না মা, আমি যাব না৷
—এতে কোনো লজ্জা নেই, অবস্থা খারাপ হলে মা সব রকম করতে হয়৷ আমারও দেশে গোলাপালা ছেল, দুই ছেলে হাতির মতো৷ তারা থাকলে আজ আমার বের্দ্ধ বয়েসে কি এ দশা হয়?
বুড়ির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল৷
শরৎ ভাবলে, দেখেই আসি, খাব না তো—যা জিনিস দেবে, নিয়ে এসে পাগলিকে কি পটলের বউকে দিয়ে দেব৷
তাই সেদিন সে মনোমোহন পাঁড়ের ধর্মশালায় গেল বুড়ীর সঙ্গে৷ ধর্মশালার বিস্তৃত প্রাঙ্গণে অনেক বৃদ্ধ বাঙালি ও হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণ জড়ো হয়েছে—মেয়েমানুষও সেখানে এসেছে, তবে সংখ্যা খুব বেশি নয়৷
যাঁরা ভোজ দিচ্ছে তারা বাংলা জানে না—হিন্দীতে কথাবার্তা কি বলে, শরৎ ভালো বুঝতে পারে না৷ তারা খুব বড়লোক, দেখেই মনে হল৷ শরৎকে দেখে আলাদা ডেকে তাদের একটি বউ বললে, তুমি কি আলাদা বসে খাবে, মাইজি?
—না মা—আমি নিয়ে যাব৷
—বাড়িতে লেড়কালেড়কি আছে বুঝি?
শরৎ মৃদু হেসে বললে, না৷
—আচ্ছা বেশ নিয়ে যাও—এখানে থাকো কোথায়?
—একজনদের বাড়ি৷ রান্না করি৷
—বাঙালি রান্না করো?
—হ্যাঁ মা৷
একটু পরে ভোজের বন্দোবস্ত হল৷ অন্য কিছু নয়, শুধু হালুয়া, তিল তেলে রান্না৷ প্রকাণ্ড চাদরের কড়াইয়ে প্রায় দশ সের সুজি, দশ সের চিনি—আর ছোট টিনের একটিন তিল তেল ঢেলে হালুয়া তৈরি হচ্ছে, শরৎকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হিন্দুস্থানী বৌটি সব দেখালে৷ অভ্যাগত দরিদ্র নরনারীদের বসিয়ে পেটভরে সেই হালুয়া খাওয়ানো হল—যাবার সময় দু-আনা করে মাথাপিছু ভোজনদক্ষিণাও দেওয়া হল৷ শরৎকে কিন্তু একটা পুঁটুলিতে হালুয়া ছাড়া পুরী ও লাড্ডু অনেক করে দিলে ওরা৷
খাবারগুলো পুঁটলি বেঁধে নিয়ে এসে শরৎ পটলের বউকে দিয়ে দিলে৷ বললে, আজ আর পাগলির দেখা নেই! আজ খেতে পেত, আজই নিরুদ্দেশ!
পটলের বউ বললে, পাগলির জন্যে রেখে দেব দিদি?
—কেন মিথ্যে বাসি করে খাবে? কাল যে আসবে তারই বা মানে কি আছে? খাও তোমরা৷
—তুমি খাবে না?
—আমি খাব না, সে তুমি জানো৷ ওরা কি জাত তার ঠিক নেই, ওদের হাতে রান্না—
—কাশীতে আবার জাতের বিচার—
—কেন, কাশী তো জগন্নাথ ক্ষেত্তর না, সেখানে নাকি জাতের বিচার নেই—
এমন সময় ওপর থেকে ঝি এসে বললে—ওগো বামুনঠাকরুণ, মা ডাকছেন—ওপরে যেতেই মিনুর কাকিমা এক তুমুল কাণ্ড বাধিয়ে দিল৷ মোগলসরাই থেকে তার ভাইপোরা এসেছে, রাত আটটার গাড়িতে চলে যাবে, অথচ বামনীর দেখা নেই, মাইনে যাকে দিতে হচ্ছে সে সব সময় বাড়ি থাকবে! বিধবা মানুষের আবার এত শখের বেড়ানো কিসের, এতদিন কোনো কৈফিয়ৎ চাওয়া হয় নি শরতের গতিবিধির, কিন্তু ব্যাপার ক্রমশ যে-রকম দাঁড়াচ্ছে, তাতে কৈফিয়ৎ না নিলে চলে না!
শরৎ বললে, আমি তো জানতাম না ওঁরা আসবেন৷ আমি আটটার অনেক আগে খাইয়ে দিচ্ছি—
—তুমি রোজ রোজ যাও কোথায়?
—পটলের বউয়ের সঙ্গে তো যাই—
—কোথায় যাও?
—৬ নম্বর ধ্রুবেশ্বরের গলি৷ হরিবাবু বলে এক ভদ্রলোকের বাড়ি—
—সেখানে কেন?
—পটলের বউ বেড়াতে নিয়ে যায়৷ ওদের জানাশুনো৷
—আজ কোথায় গিয়েছিলে?
—একটা ধর্মশালা দেখতে৷
—ওসব চলবে না বলে দিচ্ছি—কোথাও বেরুতে পারবে না কাল থেকে৷ ডুবে ডুবে জল খাও, আমি সব টের পাই৷ একশো বার করে কর্তাকে বললাম পটলদের তাড়াও নীচের ঘর থেকে—এগারো টাকার জায়গায় এখুনি পনেরো টাকা ভাড়া পাওয়া যায়! তা কর্তার কোনো কথা কানে যাবে না—পটলের বউয়ের স্বভাবচরিত্র আমার ভালো ঠেকে না—
বেচারি অন্ধ পটলের বউ, তার নামে মিথ্যে অপবাদ শরতের সহ্য হল না৷ সে বললে, আমার নামে যা হয় বলুন, সে বেচারি অন্ধ, তাকে কেন বলেন? আমায় না রাখেন, কাল সকালেই আমি চলে যাব—
—বেশ যাও৷ কাল সকালেই চলে যাবে—
শরৎ নির্বিকার-চিত্তে রান্নাবান্না করে গেল৷ লোকজনকে খাইয়ে দিলে৷ রাত ন’টার পরে মিনুর কাকিমা বললে, তোমার কি থাকবার ইচ্ছে নেই নাকি?
—আপনিই তো থাকতে দিচ্ছেন না৷ পটলের বউয়ের নামে অমন বললেন কেন? আমি মিশি বলে সে বেচারিও খারাপ হয়ে গেল?
—তোমার বড্ড তেজ—কাশী শহরে কেউ জায়গা দেবে না৷ সে কথা ভুলে যাও—
—আমার কারো আশ্রয়ে যাওয়ার দরকার নেই৷ বিশ্বেশ্বর স্থান দেবেন৷ আমি আপনাদের বাড়ি থাকতে পারব না, সকালে উঠেই চলে যাব, যদি বলেন তো রেঁধে দিয়ে যাব, নয়তো খোকাদের খাওয়ার কষ্ট হবে৷
রাত্রে বাড়ি ফিরে মিনুর কাকা সব শুনলেন৷ সেই রাত্রেই তিনি শরৎকে ডেকে বললেন, তুমি কোথাও যেতে পারবে না বামুন-ঠাকরুন৷ ও যা বলেছে, কিছু মনে করো না৷
শরৎ মিনুর কাকার সামনে বেরোয় না, কথাও বলে না৷ ঝিকে দিয়ে বলালে, তিনি যদি যেতে বারণ করেন, তবে সে কোথাও যাবে না৷ কারণ গৌরী-মা তাকে তাঁর হাতে সঁপে দিয়েছিলেন—তাঁর অর্থাৎ মিনুর মা’র বিনা অনুমতিতে সে এ সংসার ছেড়ে যেতে পারবে না৷
.
আরও দিন পনের কেটে গেল৷ একদিন বিশ্বেশ্বরের গলির মুখে সেই বুড়ির সঙ্গে আবার দেখা৷ বুড়ি বললে, কি গা, যাচ্ছ কোথায়? কোন ছত্তরে?
শরৎ অবাক হয়ে বললে, আমি ছত্তরে খাই নে তো? আমি লোকের বাড়ি থাকি যে৷
—চলো, আজ কুচবিহারে কালীবাড়িতে খুব কাণ্ড, সেখানে যাই৷ নাটকোটার ছত্তর চেন?
—না মা, আমি কোথাও যাই নি—
—চলো আজ সব দেখিয়ে আনি—
সারা বিকেল তিন-চারটি বড় বড় ছত্রে শরৎ কাঙালিভোজন, ব্রাহ্মণভোজন দেখে বেড়াল৷ বাঙালীটোলা ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিরাট কালীবাড়ি ও ছত্র কুচবিহার মহারাজের৷ কালীমন্দিরের দেওয়ালে কত রকমের অস্ত্রশস্ত্র, কি চমৎকার বন্দোবস্ত অনাহূত রবাহূত গরিব, নিরন্ন সেবার! মেয়েদের জন্যে খাওয়ানোর আলাদা জায়গা, পুরুষদের আলাদা, ব্রাহ্মণদের আলাদা৷ এত অকুণ্ঠ অন্নদান সে কখনো কল্পনাও করতে পারে নি৷
শরৎ বললে, হ্যাঁ মা, এখানে যে আসে তাকেই খেতে দেয়?
—কুচবিহারের কালীবাড়িতে তা দেয় গো৷ তবুও আজকাল কড়াকড়ি করেছে৷ হবে না কেন, বাঙাল দেশ থেকে লোক এসে সব নষ্ট করে দিয়েছে৷
—আমি নিজে যে বাঙাল—হ্যাঁ মা—
শরৎ কথা বলেই হেসে ফেললে৷ বুড়ি কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বললে, হ্যাঁগো, বাঙাল না ছাই, তোমার কথায় বুঝি বোঝা যায় কিছু, চলো চলো—নাটকোটার ছত্তর দেখিয়ে আনি—
নাটকোটার ছত্রে যখন ওরা গেল, তখন সেখানকার খাওয়া-দাওয়া শেষ৷ বাইরের গরিব লোকেরা ভাত নিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ৷
শরৎ বললে, এ কাদের ছত্র মা?
—তৈলিঙ্গিদের ছত্তর৷ এখানে খেতে এসেছিলুম একদিন, ডালে যত বা টক, তত বা লঙ্কা৷ সে মা আমাদের পোষায় না৷ তুণ্ডুমুণ্ডুদের পোষায়, ওদের মুখে কি সোয়াদ আছে মা?
শরৎ হেসে কুটি কুটি৷ বললে, তুণ্ডুমুণ্ডু কারা মা?
—আরে ওই তৈলিঙ্গিদের কথাবার্তা শোনো নি? তুণ্ডুমুণ্ডু না কি সব বলে না?
—আমি কখনো শুনি নি৷ আমায় একদিন শোনাবেন তো!
—একদিন খাওয়া-দাওয়ার সময় নাটকোটার ছত্তরে নিয়ে আসব—দেখতে পাবে—
—আর কি ছত্তর আছে?
—এখানে রাজরাজেশ্বরী ছত্তর, পুঁটের ছত্তর, আমবেড়ে—আহিল্যেবাই—
—সব দেখব মা, আজ সব দেখে আসব—
সমস্ত ঘুরে শেষ করতে ওদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ বুড়ি বললে, কাশীতে ভাতের ভাবনা নেই, অন্নপুণ্ণো মা দু-হাতে অন্ন বিলিয়ে যাচ্ছেন—
শরৎ বাসায় ফিরে এসে ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে রইল৷ তার সকলের চেয়ে ভালো লেগেছে কাশীর এই অন্নদান৷ এমন একটা ব্যাপারের কথা সত্যিই সে জানত না৷ ডাল-ভাত উনুনে চাপিয়ে দিয়ে সে শুধু ভাবে ওই কথাটা৷ তার আর কিছু ভালো লাগে না৷ কাল সকাল সকাল এদের খাইয়ে-দাইয়ে দিয়ে সে আবার বেরুবে ছত্র দেখতে৷ ছত্রে খাওয়ানোর দৃশ্য সে মাত্র দেখলে কুচবিহারের কালীবাড়িতে৷ অন্য ছত্রে যখন গিয়েছিল তখন সেখানকার খাওয়ানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ সে দেখতে চায় দুচোখ ভরে এই বিরাট অন্নব্যয়, অকুণ্ঠ সদাব্রত—যেখানে গণেশমহল্লার পাগলির মতো, ওই অন্ধ রেণুকার মতো, তার নিজের মতো, ওই সত্তর বছরের মাজা-ভাঙা বুড়ির মতো—নিরন্ন, নিঃসহায় মানুষকে দুবেলা খেতে দিচ্ছে৷ ওই দেখতে তার খুব ভালো লাগে—খুব—খুব ভালো লাগে—ওই সব ছত্রেই বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা প্রত্যক্ষ বিরাজ করেন বুভুক্ষু অভাজনদের ভোজনের সময়—মন্দিরে তাঁদের দেখার চেয়েও সে দেখা ভালো৷ অনেক—অনেক ভালো৷
ঝি এসে বলে, ও বামুন-ঠাকরুণ, মাছের ঝোল দিয়ে বাবুকে আগে ভাত দিতে হবে৷ খেয়ে এখুনি বেরিয়ে যাবেন—
—ও ঝি, শোনো—পাঁচফোড়ন মোটে নেই, বাজার থেকে আগে এনে দাও—
ঝি চলে যায়৷ মাছের ঝোল ফোটে৷ নিভৃত রান্নাঘরের কোণে গোলমাল নেই—বসে শরৎ স্বপ্ন দেখে, সে প্রকাণ্ড ছত্র খুলেছে কেদার ছত্র, বাবার নামে৷ কত লোক এসে খাচ্ছে—অবারিত দ্বার৷ বাবার ছত্র থেকে কোনো লোক ফিরবে না, অনাহারে কেউ ফিরে যাবে না৷ সে নিজে দেখবে শুনবে—সকলকে খাওয়াবে৷ সে দু-হাতে অন্নদান করবে৷ সকলকেই—ব্রাহ্মণ-শূদ্র নেই, তুণ্ডুমুণ্ডু নেই, বাঙাল-ঘটি নেই—সকলেই হবে তার পরম সম্মানিত অতিথি৷ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে খাওয়াবে সে৷
শরতের মাথার মধ্যে কি যেন নেশা জমেছে৷….
রান্নাবান্না সেরে সে মিনুর কাকিমাকে বলল, আজ একবারটি বাইরে যাব?
—কোথায়?
শরৎ হঠাৎ সলজ্জ হেসে বললে—সে বলব এখন এসে৷
শরতের হাসি দেখে মিনুর কাকিমার মনে সন্দেহ হল৷ সে বললে, কোথায় যাচ্ছ না বললে চলে? সব জায়গায় যেতে দিতে পারি কি? রাগ করলে তো চলে না—বুঝে দেখতে হয়৷
—ছত্তর দেখতে৷ রাজরাজেশ্বরী ছত্তরে অনেক বেলায় খাওয়া-দাওয়া হয়, পুঁটের ছত্তরেও হয়—দেখে আসি একটিবার—
মিনুর কাকিমা শরতের মনের উত্তাল উদ্বেল সমুদ্রের কোনো খবর রাখে না—সেবা ও অন্নদানের যে বিরাট আকৃতি ও আগ্রহ, তার কোনো খবর রাখে না—বললে, কেন, ছত্তর দেখতে কেন? সে আবার কি?
—দেখি নি কখনো৷ যেতে দিন আজ আমায়—
শরতের কণ্ঠে সাগ্রহ মিনতির সুরে মিনুর কাকিমা ছুটি দিতে বাধ্য হল, তবে হয়তো শরতের কথা সে আদৌ বিশ্বাস করলে না৷
শরৎ এসে বললে, ও রেণু পোড়ারমুখী—কি হচ্ছে?
—ও, আজ যেন খুব ফুর্তি, তোমার কি হয়েছে শুনি?
—কি আবার হবে, তোর মুণ্ডু হবে! চল ছত্তরে যাই, খাওয়া দেখে আসি৷
রেণু অবাক হয়ে বললে, কেন?
—কেন, তোর মাথা! আমি যে কাশীতে ছত্তর খুলছি, জানিস নে?
—বেশ তো ভাই৷ আমাদের মতো গরিব লোকে তাহলে বেঁচে যায়৷ দু-বেলা ছত্তরে পেট ভরে দুটো খেয়ে আসি৷ হাঁড়ি-হেঁসেলের পাট উঠিয়ে দিই৷ কি নাম হবে, শরৎসুন্দরী ছত্র?
—না ভাই, বাবার নামে—কেদার ছত্তর৷ কেমন নাম হবে বল তো?
—যাই বলো ভাই, শরৎসুন্দরী ছত্র শুনতে যেমন, তেমনটি কিন্তু হল না৷
রাজরাজেশ্বরী ছত্রে ওরা যেতেই ছত্রের লোকে জিজ্ঞেস করলে—আপনারা আসুন, মেয়েদের জন্যে আলাদা বন্দোবস্ত আছে—
শরৎ বললে, চল ভাই রেণু, দেখি গে—
—যদি খেতে বলে?
—জোর করে খাওয়াবে না কেউ, তুমি চলো৷
মেয়েদের মধ্যে সবাই বুড়ো-হাবড়া, এক আধ জন অল্পবয়সী মেয়েও আছে—কিন্তু তারা এসেছে বুড়িদের সঙ্গে কেউ নাতনী, কেউ মেয়ে সেজে৷ বুড়িরা বড় ঝগড়াটে, পাতা আর জলের ঘটি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়েছে৷ শরৎ বললে, মা বসুন, আমি জল দিচ্ছি আপনাদের—
একজন জিজ্ঞেস করলে—তুমি কি জেতের মেয়ে গা?
—বামুনের মেয়ে, মা৷
—কাশীতে এলে সবাই বামুন হয়৷ কোথায় থাকো তুমি?
—বাঙালিটোলায় থাকি মা—কিছু ভাববেন না আপনি৷
ছত্রের পরিবেশনকারিণী একটি মধ্যবয়স্কা মেয়ে শরতকে বললে, তোমরা বসছ না বাছা?
—আমি খাব না মা৷
সে অবাক হয়ে বললে, তবে এখানে কেন এসেছ?
—দেখতে৷
রেণুকা বললে, উনি বড়লোকের মেয়ে, ছত্তর খুলবেন কাশীতে—তাই দেখতে এসেছেন কি রকম খাওয়া-দাওয়া হয়৷
এক মুহূর্তে যে-সব বুড়ি খেতে বসেছে এবং যারা পরিবেশন ও দেখাশুনো করছে, সকলেরই ধরন বদলে গেল৷ যে বুড়ি শরতের জাতি-বর্ণের প্রশ্ন তুলেছিল, সে-ই সকলের আগে একগাল হেসে বললে, সে চেহারা দেখেই আমি ধরেছি মা, চেহারা দেখেই ধরেছি৷ আগুন কি ছাইচাপা থাকে? তা দ্যাখো রানীমা, একটা দরখাস্ত দিয়ে রাখি৷ আমার এই নাতনী, অল্পবয়সে কপাল পুড়েছে, কেউ নেই আমাদের৷ আপনার ছত্তর খুললে এর দুটো বন্দোবস্ত যেন সেখানে হয়৷ ভগবান আপনার ভালো করবেন৷ কুচবেহার কালীবাড়িতেও আমাদের নাম লেখানো আছে মাসে পনেরো দিন৷ বাকি পনেরো দিন আমবেড়েয় আর এই ছত্তরে—
আর চার-পাঁচজন নিজেদের দুরবস্থা সবিস্তারে এবং নানা অলঙ্কার দিয়ে বর্ণনা করেছে, এমন সময় পায়েস এসে হাজির হল৷ একটা ছোট পিতলের গামলার এক গামলা পায়েস, খেতে বসেছে প্রায় জন ত্রিশ-বত্রিশ, বেশি করে কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়—অথচ প্রত্যেকেই নির্লজ্জভাবে অনুযোগ করতে লাগল তার পাতে পায়েস কেন অতটুকু দেওয়া হল, রোজই তো পায়েস কম পায়, তাকে আজ একটু বেশি করে দেওয়া হোক৷ কেউ কেউ ঝগড়াও আরম্ভ করলে পরিবেশনকারিণীর সঙ্গে৷
শরৎ রেণুকাকে নিয়ে বাইরে চলে এল৷ বললে, কেন ওরকম বললি? ছিঃ—ওরা সবাই গরিব, ওদের লোভ দেখাতে নেই৷
তারপর অন্যমনস্কভাবে বললে, ইচ্ছে করে ওদের খুব করে পায়েস খাওয়াই৷ আহা, খেতে পায় না, ওদের দোষ নেই—ছত্তরে বন্দোবস্ত ঠিকই আছে, একটু পায়েস দেয়, একটু ঘি দেয়—তবে ছিটেফোঁটা৷
রেণুকা বললে, বাবা, বুড়িগুলো একটু পায়েসের জন্যে কি রকম আরম্ভ করে দিয়েছে বল তো? খাচ্ছিস পরের দয়ায়—আবার ঝগড়া! ভিক্ষের চাল কাঁড়া-আঁকাড়া!
—আহা ভাই—কত দুঃখে যে ওরা এমন হয়েছে তা তুমি আমি কি জানি? মানুষে কি সহজে লজ্জাশরম খোয়ায়? ওদের বড় দুঃখ৷ সত্যি ভাই, আমার ইচ্ছে করছে, আজ যদি আমার ক্ষমতা থাকত, বাবার নামে ছত্তর দিতাম৷ আর তাতে নিজের হাতে বড় কড়ায় পায়েস রেঁধে ওদের খাওয়াতাম৷ সেদিন যেমন কড়ায় হালুয়া রেঁধে দিল সেই ছত্তরটা—তুই দেখিস নি—চাদরের মস্ত বড় কড়া৷
—নে চল আমার হাত ধর—
—ওই পাগলিকে নিজের হাতে রেঁধে একদিন পেটভরে খাওয়াব৷ তোর বাড়িতে—
—বেশ তো৷
—আমি মাইনে বলে কিছু চাইলে ওরা দেবে না?
—দেওয়া তো উচিত৷ তবে গিন্নিটি যে রকম ঝানু—তুমি তো ভাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবে না—
—মরে গেলেও না৷ তবে একবার বলে দেখতে হবে৷ বেশি লোককে না পারি, একজনকেও তো পারি৷
ওরা খানিক দূর এসেছে, ছত্রের উত্তর দিকের উঁচু রোয়াক থেকে পুরুষের দল খেয়ে নেমে আসছে, হঠাৎ তাদের মধ্যে কাকে দেখে শরৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল৷ তার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বার হল—পরক্ষণেই সে রেণুকার হাত ছেড়ে দিয়ে সেদিকে এগিয়ে চলল৷
বিস্মিতা রেণুকা বললে, কোথায় চললে ভাই? কি হল?
পুরুষের ভিড়ের মধ্যে এঁটোহাতে নেমে আসছেন সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ, তিন বৎসর আগে যিনি পদব্রজে দেশভ্রমণে বেরিয়ে গড়শিবপুরে শরৎদের বাড়ির অতিথিশালায় কয়েকদিন ছিলেন৷
শরৎ চেয়ে চেয়ে দেখলে৷ কোনো ভুল নেই—তিনিই৷ সেই গোপেশ্বর চট্টোপাধ্যায়৷
সে প্রথমটা একটু ইতস্তত করছিল—কিন্তু তখনি দ্বিধা ও সঙ্কোচ ছেড়ে কাছে গিয়ে বললে, ও জ্যাঠামশাই? চিনতে পারেন?
সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণই বটে৷ শরতের দিকে অল্পক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে তিনি আগ্রহ ও বিস্ময়ের সুরে বললেন—মা, তুমি এখানে?
—হ্যাঁ জ্যাঠামশাই, আমি এখানেই আছি—
—কতদিন এসেছ? রাজামশায় কোথায়? তোমার বাবা?
—তিনি—তিনি দেশে৷ সব কথা বলছি, আসুন আমার সঙ্গে৷ আমার সঙ্গে একটি মেয়ে আছে—ওকে ডেকে নিই৷ আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন জ্যাঠামশায়৷
পথে বেরিয়েই গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন—তারপর মা, তুমি এখানে কবে এসেছ? আছ কোথায়?
—সব বলব৷ আপনি আগে বসুন, আপনি কবে এসেছেন?
—আমি সেই তোমাদের ওখান থেকে বেরিয়ে আরও দু-এক জায়গায় বেড়িয়ে বাড়ি যাই৷ বাড়িতে বলেছি তো ছেলের বউ আর ছেলেরা—তাদের অবস্থা ভালো না৷ কিছুদিন বেশ রইলাম—তার পর এই মাঘ মাসে আবার বেরিয়ে পড়লাম—একেবারে কাশী৷
—হেঁটে?
—না মা, বুড়ো বয়সে তা কি পারি? ভিক্ষে-সিক্ষে করে কোনোমতে রেলে চেপেই এসেছি৷ ছত্তরে ছত্তরে খেয়ে বেড়াচ্ছি৷ মা অন্নপুণ্ণোর কৃপায় আমার মতো গরিব ব্রাহ্মণের দুটো ভাতের ভাবনা নেই এখানে৷ চলে যাচ্ছে এক রকমে৷ আর দেশে ফিরব না ভেবেছি মা৷
রেণুকাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে শরৎ বললে, চলুন জ্যাঠামশায়, দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে বসি৷ দুজনে গিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটের রানায় বসলো৷
গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, তারপর মা, তোমার কথা বলো৷ কার সঙ্গে এসেছ কাশীতে? ও মেয়েটি বুঝি চোখে দেখতে পায় না? ও কেউ হয় তোমাদের?
শরতের কোনো দ্বিধা হল না৷ এই পিতৃসম স্নেহশীল বৃদ্ধের কাছে সব কথা খুলে বলতে৷ অনেক দিন পরে সে এমন একজন মানুষ পেয়েছে, যার কাছে বুকের বোঝা নামিয়ে হালকা হওয়া যায়৷ কথা শেষ করে সে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল৷
বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জে সব শুনে কাঠের মতো বসে রইলেন৷
এসব কি শুনছেন তিনি? এও কি সম্ভব?
শেষে আপন মনেই যেন বললেন, তোমার বাবা রাজামশায় তা হলে দেশেই—না?
—তা জানি নে জ্যাঠামশায়, বাবা কোথায় তা ভেবেছিও কতবার—তবে মনে হয় দেশেই আছেন তিনি—যদি এতদিন বেঁচে থাকেন—
কান্নার বেগে আবার ওর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল৷
—আচ্ছা, থাক মা, কেঁদো না৷ আমিও বলছি শোনো—গোপেশ্বর চাটুজ্জে যদি অভিনন্দ ঠাকুরের বংশধর হয়, তবে এই কাশীর গঙ্গাতীরে বসে দিব্যি করছি তোমাকে তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাবই৷ তুমি তৈরি হও মা—কালই রওনা হয়ে যাব বাপে-ঝিয়ে—তুমি কোন বাড়ি থাকো—চল দেখে যাই৷ তুমি কি মেয়ে, আমার তা জানতে বাকি নেই৷ নরাধম পাষণ্ড ছাড়া তোমার চরিত্রে কেউ সন্দেহ করতে পারে না৷ আমার রোগ থেকে সেবা করে তুমি বাঁচিয়ে তুলেছিলে—তা আমি ভুলি নি—আমার আর জন্মের মা-জননী তুমি৷ তোমায় এ অবস্থায় এখানে ফেলে গেলে আমার নরকেও স্থান হবে না যে৷
এগারো
বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জেকে সঙ্গে নিয়ে শরৎ ফিরল নিজের বাসায়৷
বৃদ্ধ বললেন, এই বাড়ি? বেশ৷ কাল তুমি তৈরি হয়ে থেকো৷ তোমার এই বুড়ো ছেলের সঙ্গে কাল যেতে হবে তোমায়৷ পয়সাকড়ি না থাকে, সেজন্যে কিছু ভেবো না—ছেলের সে ক্ষমতা আছে মা-জননী৷
রেণুকা এতক্ষণ কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে গিয়েছিল, শরৎকে চুপি চুপি বললে, উনি কে ভাই?
—আমার জ্যাঠামশাই—
—তোমাকে দেশে নিয়ে যাবেন?
—তাই তো বলছেন৷
—হঠাৎ কালই চলে যাবে কেন, এ মাসটা থেকে যাও না কাশীতে৷ বলো তোমার জ্যাঠামশাইকে৷ খোকার সঙ্গে একবার দেখাও করতে হবে তো? আমাকে এত শীগগির ফেলে দিয়েই বা যাবে কোথায়?
শরৎ বৃদ্ধকে জানাল৷ কালই যাওয়া মুশকিল হবে তার৷ যেখানে কাজ করছে, যারা এতদিন আশ্রয় দিয়ে রেখেছিল তারা একটা লোক দেখে নিলে সে যাবার জন্যে তৈরি হবে৷
বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জে তাতে রাজি হলেন৷ পাঁচ দিনের সময় নিয়ে শরৎ রোজ রান্নাবান্নার পরে রেণুকাকে সঙ্গে নিয়ে খোকনদের বাড়ি যায়৷ কাশী থেকে কোন অনির্দেশ্য ভবিষ্যতের পথে সে যাত্রা শুরু করবে তা সে জানে না—কিন্তু খোকনকে ফেলে যেতে তার সব চেয়ে কষ্ট হবে তা সে এ ক’দিনে হাড়ে হাড়ে বুঝছে৷ খোকনের মা ওর যাবার কথা শুনে খুবই দুঃখিত৷
শরৎ বলে, ও খোকন বাবা, গরিব মাসিমাকে মনে রাখবি তো বাবা?
খোকন না বুঝেই ঘাড় নেড়ে বলে—হুঁ, তোমাকে একটা বল কিনে দেব মাসিমা—
—সত্যি?
—হ্যাঁ মাসিমা, ঠিক দেব৷
—আমায় কখনো ভুলে যাবি নে? বড় হলে মাসিমার বাড়ি যাবি, মুড়কি নাড়ু দেব ধামি করে, পা ছড়িয়ে বসে খাবি৷
খোকা ঘাড় নেড়ে বলে— হুঁ৷
বকসীদের বড় বউ ওর নামঠিকানা সব লিখে নিলে, খোকনের মার কাছে ওর নামঠিকানা রইল৷
ফেরবার পথে শরৎ গণেশমহল্লার পাগলির সন্ধানে ইতস্তত চাইতে লাগল, কিন্তু কোথাও তাকে দেখা গেল না৷ রেণুকাকে বললে, ওই একটা মনে বড় সাধ ছিল, পাগলিকে একদিন ভালো করে রেঁধে খাওয়াব—তা কিন্তু হল না৷ আমি মাইনে বলে কিছু চেয়ে নেব মিনুর কাকির কাছ থেকে, যদি কিছু দেয় তবে তোর কাছে রেখে যাব৷ আমার হয়ে তুই তাকে একদিন খাইয়ে দিস—
রেণুকা ধরা গলায় বলে—আর আমার উপায় কি হবে বললে না যে বড়? তোমার ছত্র কবে এসে খুলছ কাশীতে—শরৎসুন্দরী ছত্র? গরিব লোক দুটো খেয়ে বাঁচি৷
শরৎ হেসে ভঙ্গি করে ঘাড় দুলিয়ে বললে, আ তোমার মরণ! এর মধ্যে ভুলে গেলি মুখপুড়ি? শরৎসুন্দরী নয়, কেদার ছত্তর—
—ও ঠিক, ঠিক৷ জ্যাঠামশায়ের নামে ছত্র হবে যে! ভুলে যাই ছাই—
—না হলেও তুই যাবি আমাদের দেশে৷ মস্ত বড় অতিথিশালা আছে৷ রাজারাজড়ার কাণ্ড! সেখানে বারো মাস খাবি, রাজকন্যের সখী হয়ে—কি বলিস?
—উঃ, তা হলে তো বর্তে যাই দিদিভাই৷ কবে যেন যাচ্ছি তাই বলো, জোড়ে না বিজোড়ে?
—তা কি কখনো হয় রে পোড়ারমুখি? জোড়ের পায়রা জোড় ছাড়া করতে গিয়ে পাপের ভাগী হবে কে?
মিনুর কাকিমাকে শরৎ বিদায়ের কথা বলতেই সে চমকে উঠল প্রায় আর কি৷ কেন যাবে, কোথায় যাবে, কার সঙ্গে যাবে—নানা প্রশ্নে শরৎ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল৷ তার কোনো কথাই অবিশ্যি মিনুর কাকিমার বিশ্বাস হল না৷ ওসব চরিত্রের লোকের কথার মধ্যে বারো আনাই মিথ্যে৷
শরৎ বললে, আমায় কিছু দেবেন? যাবার সময় খরচপত্র আছে—
—যখন তখন হুকুম করলেই কি গেরস্তর ঘরে টাকাকড়ি থাকে? আমি এখন যদি বলি আমি দিতে পারব না?
—দেবেন না৷ আপনারা এতদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন এই ঢের৷ পয়সাকড়ির জন্যে তো ছিলাম না, গৌরী-মা বলে দিয়েছিলেন, সব ঠিক করে দিয়েছিলেন—তাই এখানে ছিলাম৷ আপনাদের উপকার জীবনে ভুলব না৷
মিনুর কাকিমা শরতের কথা শুনে একটু নরমও হল৷ বললে, তা—তা তো বটেই৷ তা আচ্ছা দেখি যা পারি দেব এখন৷
বিদায়ের দিন শরৎ মিনুর কাকিমাকে অবাক করে দিয়ে বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্যে কিছু-না-কিছু খেলনা ও খাবার জিনিস কিনে নিয়ে এল৷ রেণুকাকে তার ঘরে একখানা লালপাড় শাড়ি দিতে গিয়ে চোখের জলের মধ্যে পরস্পরের ছাড়াছাড়ি হল৷
রেণুকা বললে, এ শাড়ি আমার পরা হবে না ভাই, মাথায় করে রেখে দেব—
—তাই করিস মুখপুড়ি৷
—কেন আমার জন্যে খরচ করলে? ক’টাকা দাম নিয়েছে?
—তোর সে খোঁজে দরকার কি? দিলাম, নে—মিটে গেল৷ জানিস আমি রাজকন্যে, আমাদের হাত ঝাড়লে পর্বত?
রেণুকা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললে—তুমি আমায় ভুলে গেলে আমি মরে যাব ভাই৷
শরৎ মুখে ভেংচি কেটে বললে, মরে ভূত হবি পোড়ারমুখি! ভূত না তো, পেত্নী হবি! রাত্রে আমায় যেন ভয় দেখাতে যেয়ো না!
শরতের মুখে হাসি অথচ চোখে জল৷
.
আবার কলকাতা শহর৷….
গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, এখানে বৃন্দাবন মল্লিকের লেনে আমাদের গাঁয়ের একজন লোক বাস করে, আপিসে চাকরি করে৷ চলো সেখানে গিয়ে উঠি দুজনে৷
খুঁজতে খুঁজতে বাসা মিলল৷ বাড়ির কর্তা জাতিতে মোদক, স্বগ্রামের প্রবীণ ব্রাহ্মণ প্রতিবেশীর উপস্থিতিতে সে যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেল৷ মাথায় রাখে কি কোথায় রাখে, ভেবে যেন পায় না৷ বললে—মা-ঠাকরুণ কে?
—আমার ভাইঝি, গড়শিবপুরে বাড়ি ওদের৷ তুমি চেন না—মস্ত লোক ওর বাবা৷
—তা চাটুজ্জে মশাই, সব যোগাড় আছে ঘরে৷ দিদি ঠাকরুণ রান্নাবান্না করুন, ওরা সব যুগিয়ে দেবে এখন৷ আমার আবার আপিসের বেলা হয়ে গেল—দশটায় হাজির হতেই হবে৷ আমি তেল মাখি—কিছু মনে করবেন না৷
বাড়ির গৃহিণী শরৎকে যথেষ্ট যত্ন করলেন৷ তাকে কিছুই করতে দিলেন না৷ বাটনা বাটা, কুটনো কোটা সবই তিনি আর তাঁর বড় মেয়ে দুজনে মিলে করে শরৎকে রান্না চড়িয়ে দিতে ডাক দিলেন৷
শরতের জন্যে মিছরি ভিজের শরবৎ, দই, সন্দেশ আনিয়ে তার স্নানের পর তাকে জল খেতে দিলেন৷
আহারাদির পর শরতের বড় ইচ্ছে হল একবার কালীঘাটে গিয়ে সে গৌরী-মার সঙ্গে দেখা করে৷ বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জে শুনে বললেন, চলো না মা, আমারও ওই সঙ্গে দেবদর্শনটা হয়ে যাক৷
বিকেলের দিকে ওরা কালীঘাটে গেল৷ বাড়ির গৃহিণী তাঁর বড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ওদের সঙ্গিনী হলেন৷ মন্দিরের প্রাঙ্গণে বিস্তৃত নাটমন্দিরে দু-তিনটি নূতন সন্ন্যাসী আশ্রয় গ্রহণ করেছেন৷ গৌরী-মা তাঁর পুরনো জায়গাটিতেই ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন৷ শরৎকে দেখে তিনি প্রায় চমকে উঠলেন৷ বললেন, সরোজিনীরা কি কলকাতায় এসেছে?
শরৎ তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে সব খুলে বললে৷
গৌরী-মা বললেন, তোমার জ্যাঠামশাই? কই দেখি—
বৃদ্ধা চাটুজ্জে মহাশয় এসে গৌরী-মার কাছে বসলেন, কিন্তু প্রণাম করলেন না, বোধ হয় সন্ন্যাসিনী তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট বলে৷ বললেন—মা, আমি আপনার কথা শরতের মুখে সব শুনেছি৷ আপনি আশীর্বাদ করুন আমি ওকে যেন ওর বাবার কাছে নিয়ে যেতে পারি৷ আপনার আশীর্বাদ ছিল বলে বোধ হয় আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল কাশীতে৷
গৌরী-মা বললেন, তাঁর কৃপায় সব হয় বাবা, তিনিই সব করছেন—আপনি আমি নিমিত্ত মাত্র৷
বাসায় ফিরে আসবার পথে শরতের কেবলই মনে হচ্ছিল, যদি কমলার সঙ্গে একবারটি পথেঘাটে কোথাও দেখা হয়ে যেত, কি মজাই হত তা হলে! কলকাতার মধ্যে যদি কারো সঙ্গে দেখা করবার জন্য প্রাণ কেমন করে—তবে সে সেই হতভাগিনী বালিকার সঙ্গেই আবার সাক্ষাতের আশায়৷
কাশীতে গিয়ে এই দেড় বৎসরে সে অনেক শিখেছে, অনেক বুঝেছে৷ এখন সে হেনাদের বাড়ি আবার যেতে পারে, কমলাকে সেখান থেকে টেনে আনতে পারে, সে সাহস তার মধ্যে এসে গিয়েছে৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় সে হেনাদের বাড়ির ঠিকানা জানে না, শহর বাজারে ঘরবাড়ির ঠিকানা বা রাস্তা না জানলে বের করতে পারা যায় না, আজকাল সে বুঝেছে৷
কলকাতায় এসে আবার তার বড় ভালো লাগছে৷ কাশী তো পুণ্যস্থান, কত দেউল-দেবমন্দির ঘাট, যত ইচ্ছে স্নান কর, দান কর, পুণ্য কর—স্বয়ং বাবা বিশ্বনাথের সেখানে অধিষ্ঠান৷ কিন্তু কলকাতা যেন ওকে টানে, এখানে এত জিনিস আছে যার সে কিছুই বোঝে না—সেজন্যেই হয়তো কলকাতা তার কাছে বেশি রহস্যময়৷ এত লোকজন, গাড়িঘোড়া, এত বড় জায়গা কাশী নয়৷
শরৎ বলে, জ্যাঠামশায় আপনি কোন কোন দেশে বেড়ালেন?
—বাংলা দেশের কত জায়গা পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছি মা, বর্ধমানে গিয়েছি, বৈঁচি, শক্তিগড়, নারাণপুর গিয়েছি৷ রাঢ় দেশের কত বড় বড় মাঠ বেয়ে সন্দেবেলা সুমুখ আঁধার রাত্তিরে একা গিয়েছি৷ বড় তালগাছ ঘেরা দিঘি, জনমানব নেই কোথাও, লোকে বলে ঠ্যাঙাড়ে ডাকাতের ভয়—এমন সব দিঘের ধারে সারাদিন পথ হাঁটবার পরে বসে চাট্টি জলপান খেয়েছি৷ একদিন সে কথা গল্প করব তোমাদের বাড়ি বসে৷
—বেশ জ্যাঠামশায়৷
—বেড়াতে বড় ভালো লাগে আমার৷ আগে বাংলাদেশের মধ্যেই ঘুরতাম, এবার গয়া কাশীও দেখা হল—
—আমারও খুব ভালো লাগে৷ বাবা কোনো দেশ দেখেন নি৷ বাবাকে নিয়ে চলুন আবার আমরা বেরুবো—
—খুব ভালো কথা মা৷ চলো এবার হরিদ্বারে যাব—
—সে কতদূর? কাশীর ওদিকে?
—সে আরও অনেক দূর শুনেছি৷ তা হোক, চলো সবাই মিলে যাওয়া যাক—বৃন্দাবন হয়ে যাব—তোমার বাবাও চলুন৷
—জ্যাঠামশায়?
—কি মা?
—বাবার দেখা পাব তো?
—আমি যখন কথা দিয়েছি মা, তুমি ভেব না৷ সে বিষয়ে নিশ্চিন্দি থাকো৷
.
পরদিন গোপেশ্বর চাটুজ্জে শরৎকে কলকাতায় তাঁর স্বগ্রামবাসী কৃষ্ণচন্দ্র মোদকের বাসায় রেখে দুদিনের জন্যে গড়শিবপুরে গেলেন৷ শরৎকে আগে হঠাৎ গ্রামে না নিয়ে গিয়ে ফেলে সেখানকার ব্যাপার কি জানা দরকার৷ গড়শিবপুরে গিয়ে সন্ধান নিয়ে কিন্তু তাঁর চক্ষু স্থির হয়ে গেল, যা শুনলেন সেখানে গ্রামের লোকে বললে, কেদার রাজা বা তাঁর মেয়ে আজ প্রায় দেড়-বৎসর দু-বৎসর আগে গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে যান৷ সেখান থেকে তাঁরা কোথায় চলে গিয়েছেন তা কেউ জানে না৷ কলকাতায় তাঁরা নেই একথাও ঠিক৷ যাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন, তারাই ফিরে এসে বলেছে৷
গোপেশ্বর চাটুজ্জে গ্রামের অনেককেই জিজ্ঞেস করলেন, সকলেই ওই এক কথা বলে৷ সেবার যে সেই মুদির দোকানে কেদারের সঙ্গে বসে বসে গান-বাজনা করেছিলেন সেখানেও গেলেন৷ কেদার গাঁয়ে না থাকায় গানবাজনার চর্চা আর হয় না, মুদি খুব দুঃখ করলে৷ গোপেশ্বরকে তামাক সেজে খাওয়ালে৷ অনেকদিন কেদার বা তাঁর মেয়ের কোনো সন্ধান নেই, আর আসবেন কিনা কে জানে!
বৃদ্ধ তামাক খেয়ে উঠলেন৷
গ্রামের বাইরের পথ ধরে চিন্তিত মনে চলেছেন, শরতের বাপের যদি সন্ধান না-ই পাওয়া যায়, তবে উপস্থিত শরতের গতি কি করা যাবে? কাশী থেকে এনে ভুল করলেন না তো?
এমন সময় পেছন থেকে একজন চাষা লোক তাঁকে ডাক দিলে—বাবাঠাকুর—
গোপেশ্বর চাটুজ্জে ফিরে চেয়ে দেখে বললেন—কি বাপু?
—আপনি ক্যাদার খুড়ো ঠাকুরের খোঁজ করছিলেন ছিবাস মুদির দোকানে? আমিও সেখানে ছেলাম৷ আপনি কি তাঁর কেউ হন?
—হ্যাঁ বাপু, আমি তাঁর আত্মীয়৷ কেন, তুমি কিছু জান নাকি?
—আপনি কারো কাছে বলবেন না তো?
—না, বলতে যাব কেন? কি ব্যাপার বলো তো শুনি? আমি তাঁর বিশেষ আত্মীয়, আর আমার দরকারও খুব৷
লোকটা সুর নিচু করে বললে—তিনি হিংনাড়ার ঘোষেদের আড়তে কাজ করছেন যে! হিংনাড়া চেনেন? হলুদপুকুর থেকে তিন ক্রোশ৷ আমি পটল বেচতে যাই সেবার মাঘ মাসে, আমার সঙ্গে দেখা৷ আমায় দিব্যি দিয়ে দিয়েলেন, গ্রামের কাউকে বলতে নিষেধ করে দিলেন, তাই কাউকে বলি নি৷ আপনি সেখানে যাও, পুকুরের উত্তর পাড়ে যে ধান-সর্ষের আড়ত, সেখানেই তিনি থাকেন৷ আমার নাম করে বলবে, গেঁয়োহাটির ক্ষেত্তর সন্ধান দিয়েছে৷ আমাদের গাঁয়ের শখের যাত্রার দলে কতবার উনি গিয়ে বেয়ালা বাজিয়েছেন৷ আমায় বড্ড স্নেহ করতেন৷ মনে থাকবে— গেঁয়োহাটির ক্ষেত্তর কাপালি!
গোপেশ্বর চাটুজ্জে আশা করেন নি এভাবে কেদারের সন্ধান মিলবে৷ বললেন, বড্ড উপকার করলে বাপু৷ কি নাম বললে—ক্ষেত্র? আমি বলব এখন তাঁর কাছে—বড় ভালো লোক তুমি৷
সেই দিনই সন্ধ্যার আগে গোপেশ্বর চাটুজ্জে হিংনাড়ার বাজারে গিয়ে ঘোষেদের আড়ত খুঁজে বার করলেন৷ আড়তের লোকে জিজ্ঞেস করলে, কাকে চান মশাই? কোত্থেকে আসা হচ্ছে?
—গড়শিবপুরের কেদারবাবু এখানে থাকেন?
—হ্যাঁ আছেন, কিন্তু তিনি মালঞ্চার বাজারে আড়তের কাজে গিয়েছিলেন—এখনও আসেন নি৷ বসুন৷
রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় কে তাঁকে বললে—মুহুরি মশায় ওই যে ফিরছেন—
গোপেশ্বর চাটুজ্জে সামনে গিয়ে বললেন, রাজামশায়, নমস্কার৷ আমায় চিনতে পারেন?
গোপেশ্বরের দেখে মনে হল কেদারের বয়স যেন খানিকটা বেড়ে গিয়েছে, কিন্তু হাবভাবে সেই পুরনো আমলের কেদার রাজাই রয়ে গিয়েছেন পুরোপুরিই৷
কেদার চোখ মিটমিট করে বললেন, হ্যাঁ, চিনেছি৷ চাটুজ্জে মশায় না?
—ভালো আছেন?
—তা একরকম আছি৷
—এখানে কি চাকরি করছেন? আপনার মেয়ে কোথায়?
—আমার মেয়ে? ইয়ে—
কেদার যেন একবার ঢোঁক গিলে, তারপর অকারণে হঠাৎ উৎসাহিত সুরে বললেন, মেয়ে কলকাতায়—তার মাসিমার—
গোপেশ্বর চাটুজ্জে সুর নিচু করে বললেন, শরৎ-মাকে আমার সঙ্গে এনেছি৷ সে আমার কাছেই আছে—কোনো ভয় নেই৷
এই কথা বলার পরে কেদারের মুখের ভাবের অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল৷ নিতান্ত নিরীহ ও নির্বোধ লোক ধমক খেলে যেমন হয়, তাঁর মুখ যেন তেমনি হয়ে গেল৷ গোপেশ্বর চাটুজ্জের মনে হল এখুনি তিনি যেন হাতজোড় করে কেঁদে ফেলবেন৷
বললেন, আমার মেয়েকে—আপনি এনেছেন? কোথায় সে?
—কলকাতায় রেখে এসেছি৷ কালই আনব৷ বসুন একটু নিরিবিলি জায়গায়—সব বলছি৷ ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন, কোনো ভয় নেই রাজামশায়৷ চলুন ওদিকে—বলি সব খুলে৷
গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, আপনার মেয়ে আগুনের মতো পবিত্র—
কেদার হা-হা করে হেসে বললেন, ও কথা আমায় বলার দরকার হবে না হে গোপেশ্বর৷ আমার মেয়ে, আমাদের বংশের মেয়ে—ও আমি জানি৷
গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, রাজামশায় শেষটাতে কি এখানে চাকরি স্বীকার করলেন?
কেদার অপ্রতিভের হাসি হেসে বললেন, ভুলে থাকবার জন্যে, স্রেফ ভুলে থাকবার জন্যে দাদা৷ এরা আমার বাড়ি যে গড়শিবপুরে তা জানে না৷ বেহালা বাজাই নি আজ এই দেড় বছর— বেহালার বাজনা যদি কোথাও শুনি, মন কেমন করে ওঠে৷
—চলুন, আজই কলকাতায় যাই—
—আমার বড় ভয় করে৷ ভয়ানক জায়গা—আমি আর সেখানে যাব না হে, তুমি গিয়ে নিয়ে এস মেয়েটাকে৷ আজ রাতে এখানে থাকো—কাল রওনা হয়ে যাও সকালে৷ আমার কাছে টাকা আছে, খরচপত্র নিয়ে যাও৷ প্রায় সওয়া-শো টাকা এদের গদিতে মাইনের দরুন এই দেড় বছরে আমার পাওনা দাঁড়িয়েছে৷ আজ ঘোষ মশায়ের কাছে চেয়ে নেব৷
গোপেশ্বর চাটুজ্জে পরদিন সকালে কলকাতায় গেলেন এবং দুদিন পরে শরৎকে সঙ্গে নিয়ে স্বরূপপুর স্টেশনে নেমে নৌকাযোগে বৈকালে হিংনাড়া থেকে আধক্রোশ দূরবর্তী ছুতোরঘাটায় পৌঁছে কেদারকে খবর দিতে গেলেন৷ শরৎ নৌকাতেই রইল বসে৷
সন্ধ্যার কিছু আগে কেদার এসে বাইরে থেকে ডাক দিলেন—ও শরৎ—
শরৎ কেঁদে ছইয়ের মধ্যে থেকে বার হয়ে এল৷ সে যেন ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল বাপের কাছে৷ অকারণে বাপের ওপর তাঁর এক দুর্জয় অভিমান৷
কেদার বড় শক্ত পুরুষমানুষ—এমন সুরে মেয়ের সঙ্গে কথা বললেন, যেন আজ ওবেলাই মেয়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে, যেন রোজই দেখাসাক্ষাৎ হয়৷
—কাঁদিস নে মা, কাঁদতে নেই, ছিঃ! কেঁদো না—ভালো আছিস?
শরৎ কাঁদতে কাঁদতেই বললে, তুমি তো আর আমার সন্ধান নিলে না? বাবা তুমি এত নিষ্ঠুর! আজ যদি মা বেঁচে থাকত, তুমি এমনি করে ভুলে থাকতে পারতে?
দুজনেই জানে কারো কোনো দোষ নেই, যা হয়ে গিয়েছে তার ওপর হাত ছিল না বাবা বা মেয়ের কারো—রাগ বা অভিমান—সম্পূর্ণ অকারণ!
কেদার অনুতপ্ত কণ্ঠে বললেন, তা কিছু মনে করিস নে তুই মা৷ আমার কেমন ভয় হয়ে গেল—আমায় ভয় দেখালে পুলিস ডেকে দেবে, তোমায় ধরিয়ে দেবে, সে আরও কত কিছু৷ আমার সব মনেও নেই মা৷ যাক যা হয়ে গিয়েছে, তুমি কিছু মনে করো না৷ চলো চলো আজই গড়শিবপুরে রওনা হই—দেড় বছর বাড়ি যাই নি!
.
গড়শিবপুরের রাজবাড়ি এই দেড় বছরে অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে৷
চালের খড় গত বর্ষায় অনেক জায়গায় ধ্বসে পড়েছে৷ বাঁশের আড়া ও বাতা উইয়ে খেয়ে ফেলেছে৷ বাড়ির উঠোনে একহাঁটু বনজঙ্গল—আজ গোপেশ্বর চাটুজ্জে ও কেদার অনবরত কেটে পরিষ্কার করেও এখনও সাবেক উঠোন বের করতে পারেন নি৷
নিড়ানি ধরে সামনের উঠোনের লম্বা লম্বা মুথো ঘাস উপড়ে তুলতে তুলতে কেদার বললেন, ও মা শরৎ, আমাদের একটু তামাক দিতে পার?
গোপেশ্বর চাটুজ্জে উঠোনের ওপাশে কুকশিমা গাছের জঙ্গল দা দিয়ে কেটে জড়ো করতে করতে বলে উঠলেন—ও কি রাজামশাই, না না, মেয়েমানুষদের দিয়ে তামাক সাজানো—ওরা ঘরের লক্ষ্মী—না, ছিঃ—তামাক আমি সেজে আনছি গিয়ে—
ততক্ষণে শরৎ তামাক ধরিয়ে কলকেতে ফুঁ পাড়ছে৷ দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ছায়া ঈষৎ দীর্ঘতর হয়েছে৷ বাতাসে সদ্য কাটা বনজঙ্গলের কটুতিক্ত গন্ধ৷ ভাঙা গড়বাড়ির দেউড়ির কার্নিসে বন্য পাখির কাকলি৷
কাশীতে যখন ছিল তখন ভাবে নি আবার সে দেশে ফিরতে পারবে কখনো, আবার সে এমনিতর বৈকালে বাবাকে নিড়ান হাতে উঠোনের ঘাস পরিষ্কার করতে দেখবে, বাবার তামাক আবার সাজবার সুযোগ পাবে সে৷
তামাক দিয়ে শরৎ বললে, বাবা, হিম হয়ে বসে থেকো না—এবেলা একটা তরকারি নেই যে কুটি, ব্যবস্থা আগে করো৷
কেদার কিছুমাত্র ব্যস্ত না হয়ে বললেন, কেন, পুকুরপাড়ে ঝিঙে দেখে এলাম তো তখন!
কালোপায়রা দিঘির পাড়ে বাঁধানো ঘাটের পাশের ঝোপের মাথায় বন্য ঝিঙে ও ধুঁধুলের লতা বেড়ে উঠেছে, কেদারের কথার লক্ষ্যস্থল সেই বুনো ধুঁধুলের গাছ৷
—শুধু ঝিঙে বাবা?
—তাই নিয়ে এসে ভাতে দে—কি বল হে দাদা? হবে না?
গোপেশ্বর চাটুজ্জে বনজঙ্গল কাটতে কাটতে একটা ঝালের চারা দায়ের মুখে উপড়ে ফেলেছিলেন, সেটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে কিছুক্ষণ থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন, অন্যমনস্কভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন—খুব, খুব৷ রাজভোগ ভেসে যাবে৷
কেদার বললেন—তবে তাই করো মা শরৎ৷ তাই নিয়ে এসো৷
শরৎ কালোপায়রা দিঘির ধারে জঙ্গলে এল ঝিঙে খুঁজতে৷
আজই দুপুরবেলা ওরা গরুর গাড়ি করে এসে পৌঁছেছে এখানে৷ বাপ ও জ্যাঠামশায় সেই থেকে বনজঙ্গল পরিষ্কার নিয়েই ব্যস্ত আছেন৷ সে নিজে ঘরদোর পরিষ্কার করছিল—এইমাত্র একটু অবসর মিলেছে চোখ মেলে চারিদিকে চাইবার৷ কালোপায়রা দিঘির টলটলে জলে রাঙা কুমুদ ফুল ফুটেছে গড়বাড়ির ভগ্নস্তূপের দিকটাতে৷ এই তো বাঁধাঘাট৷ ঘাটের ধাপে শেওলা জমেছে, কুকশিমার জঙ্গল বেড়েছে খুব—কতকাল বাসন মাজে নি ঘাটটাতে বসে৷ কাল সকালে আসতে হবে আবার৷
ছাতিম বনের ছায়ার দিকে চেয়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ছাতিম বনের ওপরে ওই দেউলের গম্বুজাকৃতি চূড়োটা বনের আড়াল থেকে মাথা বার করে দাঁড়িয়ে আছে৷ ছায়া ওপার থেকে এপারে এসে পৌঁছেছে৷ চাতালের যে কোণে বসে শরৎ বাসন মাজত, এপারের বটগাছটার ডাল তার ওপরে ঝুঁকে পড়েছে৷ শরৎ যেন কতকাল পরে এসব দেখছে, জন্মান্তরের তোরণদ্বার অতিক্রম করে এ যেন নতুন বার পৃথিবীতে এসে চোখ মেলে চাওয়া বহু কালের পুরনো পরিচয়ের পৃথিবীতে৷ কালোপায়রা দিঘির ধারের এমনি একটি সুপরিচিত বৈকালের স্বপ্ন দেখে কতবার চোখের জল ফেলেছে কাশীতে পরের বাড়ি দাসত্ব করতে করতে, দশাশ্বমেধ ঘাটের রানায় সন্ধ্যাবেলা রেণুকার সঙ্গে বসে, রাজগিরিতে গৃধ্রকূট পাহাড়ের ছায়াবৃত পথে মিনুর সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে৷
সে শরৎ নেই আর৷ শরৎ নিজের অনুভূতিতে নিজেই বিস্মিত হয়ে গেল৷ নতুন দৃষ্টি, নতুন মন নিয়ে ফিরেছে শরৎ৷ পল্লীগ্রামের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা যে শরৎসুন্দরীর দৃষ্টি সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখেছিল, আজ বহির্জগতের আলো ও ছায়া, পাপ ও পুণ্যের সংস্পর্শে এসে যেন শরতের মন উদারতর, দৃষ্টি নবতর দর্শনের ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে৷
ঝিঙে তুলে রেখে শরৎ বার বার দিঘির ঘাটের ভাঙা চাতালে প্রাচীন বটতলায় নানা কারণে অকারণে ছুটে ছুটে আসতে লাগল শুধু এই নতুন ভাবানুভূতিকে বার বার আস্বাদ করবার জন্যে৷ একবার উপরে গিয়ে দেখলে গ্রামের জগন্নাথ চাটুজ্জে কার মুখে খবর পেয়ে এসে পৌঁছে গিয়েছেন৷ বাবা ও জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে বসে গল্প করছেন৷
ওকে দেখে জগন্নাথ বললেন, এই যে মা শরৎ তা কাশী গয়া অনেক জায়গা বেড়িয়ে এলে বাবার সঙ্গে আর গোপেশ্বর ভায়ার সঙ্গে? ভালো—প্রায় দেড় বছর বেড়ালে৷
বুদ্ধিমতী শরৎ বুঝল এ গল্প জ্যাঠামশায়ই রচনা করেছেন তাদের দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণ নির্দেশ করার জন্যে৷ শরৎ জগন্নাথ চাটুজ্জের পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলে৷
—এসো, এসো মা, থাক৷ চিরজীবী হও—তা কোন কোন দেশ দেখলে?
কেদার বললেন, দেড় বছর ধরে তো বেড়ানো হয় নি৷ আমি মধ্যে চাকরি করেছিলাম হিংনাড়ার বাজারে ঘোষেদের আড়তে৷ এই গোপেশ্বর দাদা সপরিবারে পশ্চিমে গেলেন, শরৎকে নিয়ে গিয়েছিলেন—
শরৎ বললে, চা খাবেন জ্যাঠামশায়, যাবেন না—বসুন৷ আমি বাসনগুলো ধুয়ে আনি পুকুরঘাট থেকে৷
আবার সে ছুটে এল কালোপায়রা দিঘির পাড়ে ছাতিমবনের দীর্ঘ, ঘন শীতল ছায়ায়৷ পুরনো দিনের মতো আবার রোদ রাঙা হয়ে উঠে গিয়েছে ছাতিম গাছের মাথায়৷ বেলা পড়ে এসেছে৷ এমন সময়ে দূর থেকে রাজলক্ষ্মীকে আসতে দেখে সে হঠাৎ লুকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷
রাজলক্ষ্মীর হাতে একটি প্রদীপ, তেলসলতে দেওয়া৷
দুজনেই দুজনকে দেখে উচ্ছ্বসিত আনন্দে আত্মহারা৷
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, মানুষ না ভূত, দিদি?
—ভূত, তোর ঘাড় মটকাব!
তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলে৷
—শুনিস নি আমরা এসেছি?
—কারো কাছে না৷ কে বলবে? আমি অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, উঠে এই আসছি—
—কোথায় চলেছিস রে এদিকে?
—তোমাদের উত্তর দেউলে পিদিম দিচ্ছি আজ এই দেড় বছর৷ বলে গিয়েছিলে, মনে নেই?
—সত্যি ভাই?
—না মিথ্যে!
—আর জন্মের বোন ছিলি তুই, এই বংশের মেয়ে ছিলি কোনো জন্মে৷
—এতদিন কোথায় ছিলে তোমরা দিদি?
—কাশীতে৷ সব বলব গল্প তোকে৷ চল—
—আজ পিদিম তুমি দেবে দিদি?
—নিশ্চয়! ভিটেয় যখন এসেছি, তখন তোকে আর পিদিম দিতে হবে না৷ তবে আমার সঙ্গে চল—