ছয়
রাত্রে শরতের ভালো ঘুম হল না, অচেনা জায়গা, ভালো ঘুম হবার কথা নয়, দেশের বাড়ি ছেড়ে এসে পর্যন্তই তার ঘুম তেমন হয় না৷ কিন্তু কাল রাত্রে কি জানি কেমন হল, বাবার কথা মনে হয়েই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক—শরৎ প্রথম দিকে তো চোখের পাতা একটুও বোজাতে পারে নি৷
প্রভাসের বৌদিদি তার পাশে শুয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল৷ এত শব্দ এত আওয়াজের মধ্যে মানুষ পারে ঘুমুতে? মোটরগাড়ি যাচ্ছে, লোকজনের কথাবার্তা চলেছে—ভালো রকম অন্ধকার হয় না, জানলা দিয়ে কোথা থেকে আলো এসে পড়েছে দেওয়ালের গায়ে—আর সারারাতই কি লোক-চলাচল করবে আর গান-বাজনা চলবে? এখানে এতও গানবাজনা হয়! ডুগি-তবলার শব্দ, হারমোনিয়মের আওয়াজ, মেয়ে-গলার গান চলেছে আশেপাশের সব বাড়ি থেকে৷ দমদমার বাগানবাড়িতে থাকতে সে বুঝতে পারে নি আসল কলকাতা শহর কি৷ এখন দেখা যাচ্ছে এখানকার তুলনায় দমদমার বাগানবাড়ি তাদের গড়শিবপুরের জঙ্গলের সমান৷
ভোরে উঠে সে গঙ্গাস্নান করে আসবে—এখান থেকে গঙ্গা কতদূর কে জানে? প্রভাসদাকে বললে মোটরে নিয়ে যাবে এখন৷ সকালে প্রভাসের বৌদিদির ডাকে তার ঘুম ভাঙল৷ জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে বিছানায়৷ অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে নাকি তবে? ওর মুখে কেমন ধরনের ভয় ও উৎকণ্ঠার চিহ্ন প্রভাসের বৌদিদির চোখ এড়ালো না৷
সে বললে, ভাবনা কি দিদি, দেরিতে উঠেছ, তাই কি—তোমার উঠে আপিস করতে হচ্ছে না তো আর৷ মুখ ধুয়ে নাও, চা হয়ে গিয়েছে—
শরৎ লজ্জিত মুখে জানালে এত সকালে সে চা খায় না৷ তার চা খাওয়ায় কতকগুলো বাধা আছে—স্নান করতে হবে, কাপড় ছাড়তে হবে—সে-সব হাঙ্গামায় এখন কোনো দরকার নেই, থাকগে৷ গঙ্গা এখান থেকে কতদূর? একবার গঙ্গায় নাইতে যাবার বড় ইচ্ছে তার৷ প্রভাসদা কখন আসবে?
প্রভাসের বৌদি বললে, গঙ্গা নাইবে? চল না আমাদের—আচ্ছা, দেখি বোসো৷ ওরা আসুক সব—
—কখন আসবে? আসতে বেশি দেরি করবে না তো প্রভাসদা?
—কি জানি ভাই! তবে দেরি হওয়ার কথা নয় তো, এখুনি আসবে—
—গঙ্গা নেয়ে এসে আমি বাবার কাছে যাব—আমায় রেখে আসুক—
—সে কি ভাই? এ-বেলাটা থাকবে না এখানে? থেকে খাওয়াদাওয়া করে ওবেলা—
শরৎ চিন্তিত মুখে বললে, কাল রাতে গেলাম না, বাবা কত ভেবেছেন৷ আমার কি থাকবার জো আছে যে থাকব?
প্রভাসের বৌদিদি বললে, ওবেলা চলো ভাই সিনেমা দেখে দুজনে—
—কি দেখে?
—সিনেমা—মানে বায়োস্কোপ টকি—
—ও—
—দেখে চলো আমরা যশোর রোড দিয়ে মোটরে বেড়িয়ে আসব৷ চাঁদের আলো আছে—
শরৎ হেসে বললে, মোটে একাদশী গেল বুধবারে, এরই মধ্যে চাঁদের আলো কোথায় পাবেন? আপনারা কলকাতার লোক, আপনাদের সে খবরে কোনো দরকার নেই—ওখানে সারারাতই গ্যাসের আলো—ইলেকট্রিক আলো—
ঈষৎ অপ্রতিভের সুরে প্রভাসের বৌদিদি বললে, তা বটে ভাই, যা বলেছ৷ ওসব খেয়াল থাকে না৷
এমন সময় পাশে কমলাদের ঘর থেকে জড়িত স্বরে কে বলে উঠল—আরে ও হেনা বিবি, এদিকে এসো না চাঁদ, আলোর সুইচটা যে খুঁজে পাচ্ছি নে—ও হেনা বিবি—
প্রভাসের বৌদিদি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বললে, আ মরণ, বেলা সাড়ে সাতটা বাজে—উনি আলোর সুইচ খুঁজে বেড়াচ্ছেন এখন—
শরৎ বললে, কি হয়েছে, কে উনি?
—কে জানে কে? মাতালের মরণ যত—পাশের বাড়ির এক বুড়ো৷ রোজ ভাই অমনি করে—
শরৎও হেসে ফেললে মাতাল বুড়োটার কথা ভেবে৷ বললে, ডাকছে কাকে? ও যেন পাশের ঘর থেকে কথা বললে বলে মনে হল—না?
—ওই পাশের বাড়ি, দোতলার জানলাটা খোলা রয়েছে দেখছ তো, ওই ঘর৷ দাঁড়াও আসছি—
শরৎ শুনলে বুড়ো মাতালটা হঠাৎ ‘এই যে হেনা বিবি, বলিহারি যাই! বলি সার্সি জানলা বন্ধ করে’—এই পর্যন্ত চেঁচিয়ে বলে উঠেই চুপ করে গেল৷ কে যেন তার মুখে থাবা দিয়ে চুপ করিয়ে দিলে৷ কিছুক্ষণ পরে কমলাও ঘরে ঢুকল৷ শরৎ হাসিমুখে বলে উঠল—এসো ভাই গঙ্গাজল এসো—তোমাকেই খুঁজছি—গঙ্গা নাইতে চলো না কেন যাই সবাই মিলে?
কমলা সত্যিই সুন্দরী মেয়ে৷ ঘুম ভেঙে সদ্য উঠে এসেছে, আলুথালু চুলের রাশ খোঁপার বাঁধন ভেঙে ঘাড়ে পিঠে এলিয়ে পড়েছে, বড় বড় চোখে অলস দৃষ্টি, মুখের ভাবেও জড়তা কাটে নি—বেশ ফর্সা নিটোল হাত দুটি কেমন চমৎকার ভঙ্গিতে ঘাড়ের পেছনে তুলে ধরে এলোচুল বাঁধবার চেষ্টা করছে৷ আসলে বাঁধার ছলে একটা কায়দা মাত্র, চুল বাঁধবার চেয়ে ওই ভঙ্গিটা দেখাবার আগ্রহটাই ওখানে বেশি৷ শরতের হাসি পায়—ছেলেমানুষ কমলা!
শরৎ এসব বোঝে৷ সেও এক সময়ে সুন্দরী কিশোরী ছিল, ওই কমলার মতো বয়সে, সে জানে নিজেকে ভালো দেখানো কত খুঁটিনাটি আগ্রহ অকারণে মেয়েদের মনে জাগে৷ তারও জাগত৷ এসব শিখিয়ে দিতে হয় না, বলে দিতে হয় না মেয়েদের৷ আপনিই জাগে৷ শরতের কেমন স্নেহ হয় কমলার ওপর৷ স্নেহের সুরেই বলে—ভাই, চমৎকার দেখাচ্ছে তোমায় গঙ্গাজল—
—সত্যি?
—সত্যি বলছি৷
কমলার মুখে লজ্জার আভাস নেই, সে যে পথে পা দিয়েছে, সে পথের পথচারিণীরা লজ্জাবতী লতা নয়, বনচাঁড়ালের পাতা—টুসি দিলে নাচে৷ কমলা হেসে বললে, আপনার ভালো লাগে?
—খুব ভাই—খুব—
—তবে তো আমার ভবিষ্যতের পক্ষে ভালো—এদিকে আবার গঙ্গাজল পাতিয়েছি—
কমলার কথার নির্লজ্জ সুর শরতের কানে বাজল৷ সে মনে মনে ভাবলে, মেয়েটি ভালো, কিন্তু অল্পবয়সে একটু বেশি ফাজিল হয়ে পড়েছে৷ আমি ওর চেয়ে কত বড়, মা না হলেও কাকি-খুড়ির বয়িসী—আমার সঙ্গে কেমন ধরনের কথা বলছে দ্যাখো—
কমলা বললে, আপনি চা খেয়েছেন?
শরৎ হেসে বললে, না ভাই, আমি বিধবা মানুষ, নাই নি, ধুই নি—এখুনি চা খাব কি করে? চা খাওয়ার কোনো তাড়াতাড়ি নেই আমার৷ এখন গঙ্গা নাইবার কি ব্যবস্থা হয় বলো তো?
—চলুন না হেঁটে গিয়ে নেয়ে আসি৷ এই তো আহিরীটোলা দিয়ে গেলে সামনেই গঙ্গা—
প্রভাসের বৌদিদি ওদের ঘরের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে পেছন থেকে গিরীন ডাকলে—ও হেনা বিবি—
হেনা দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ফিরে বললে, কখন এলে? কি ব্যাপার? ওদিকে—
গিরীন চোখ টিপে বললে, আস্তে৷
হেনা এবার গলার সুর নিচু করে বললে, কি হল?
—এখনো হয় নি কিছু৷ আমরা এখনো বুড়োর কাছে যাই নি৷ বেশি বেলা হলে যাব৷ এদিকের খবর কি?
হেনা রাগের সুরে বললে, তোমরা আমায় মজাবে দেখছি৷ এখনও সে কিছু খায় নি, এ বাড়ি এসে পর্যন্ত দাঁতে কুটো কাটে নি৷ না খেয়ে ও কতক্ষণ থাকবে, ও আপদ যেখানে পারো বাপু তোমরা নিয়ে যাও৷ আমার টাকা আমায় চুকিয়ে দাও, মিটে গেল গোলমাল৷ না খেয়ে মরবে নাকি শেষটা—তার পর এদিকে হরি সা যা কাণ্ড বাধিয়েছিল! হেনা বিবি বলে ডাকাডাকি! সারারাত কমলির ঘরে বসে মদ খেয়েছে—এই একটু আগে কি চেঁচামেচি৷ মেয়েটা যাই একটু সরল গোছের, কোনোরকমে তাকে বুঝিয়ে দিলাম, পাশের বাড়িতে একটা মাতাল আছে তারই কাণ্ড, বিশ্বাস করেছে কিনা কে জানে—
গিরীন হাসিমুখে বললে, ভয় কি তোমার হেনা বিবি, রাত যখন এখানে কাটিয়েছে তখন ওর পরকাল ঝরঝরে হয়ে গিয়েছে৷ ওর সমাজ গিয়েছে, ধর্ম গিয়েছে৷ ওর বাবার কাছে সেই কথাই বলতে যাচ্ছি—
—কি বলবে?
—সে-সব বুদ্ধি কি তোমাদের আছে? গিরীনের কাছ থেকে বুদ্ধি ধার করে চলতে হয় সব ব্যাটাকে৷
—গালাগাল দিয়ো না বলছি—
—গালাগাল তোমাকে তো দিই নি হেনা বিবি, চটো কেন? তার পর শোনো৷ সন্দে অবধি রেখে দাও৷ সন্দের আগে আবার আমরা আসব৷
—টাকা নিয়ে এসো যেন৷
—অত অবিশ্বাস কিসের হেনা বিবি? নতুন খদ্দেরের কাছে তাগাদা করো, আমাদের কাছে নয়৷
—আচ্ছা, কথায় দরকার নেই—যাও এখন৷ আমি দেখি গে, কমলিটা ছেলেমানুষ—কি বলতে কি বলে বসে—ওকে সামলে নিয়ে চলতে হচ্ছে আবার—
হেনা ঘরে ঢুকে দেখলে শরৎ ও কমলা চুল খুলে তেল মাখতে বসেছে৷ বললে—ও কি? নাইতে যাবে নাকি ভাই?
কমলা বললে, গঙ্গাজলকে নিয়ে নেয়ে আসি—
হেনা প্রশংসার দৃষ্টিতে শরতের সুদীর্ঘ কালো কেশপাশের দিকে চেয়ে বললে, কি সুন্দর চুল ভাই তোমার মাথায়! এমন চুল যদি আমাদের মাথায় থাকত—
কমলা বললে, আমিও তাই বলছিলাম গঙ্গাজলকে—
শরৎ সলজ্জ স্বরে বললে, যান, কি যে সব বলেন! গঙ্গাজলের মাথায় চুল কি কম সুন্দর? দেখুন দিকি তাকিয়ে? তা ছাড়া আমার লম্বা চুলের কি দরকার আছে ভাই? বাবা কিছু পাছে মনে করেন তাই—নইলে ও চুল আমি এতদিন বঁটি দিয়ে কেটে ফেলতাম৷ শুধু বাবার মুখের দিকে চেয়ে পারি নে৷ তাঁর চোখ দিয়ে যাতে জল পড়ে, তাতে আমার ধর্ম নেই৷
হেনা এ পথের পুরাতন পথিক, তার মন কোমল হৃদয়-বৃত্তির ধার ধারে না অনেক দিন থেকে—যা কিছু ছিল তাও পাষাণ হয়ে গিয়েচে চর্চার অভাবে, শরতের কথায় তার মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত হল না—কিন্তু কমলা মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল৷
হেনা বললে, কমলা, এঁকে গঙ্গায় নিয়ে যাবি? কেন, বাড়িতে চান করে না? বেলা হয়ে যাবে!
শরতের দিকে চেয়ে বললে, সে তুমি যেয়ো না ভাই, ও ছেলেমানুষ, পথ চেনে না—কোথায় যেতে কোথায় নিয়ে যাবে!
কমলা বললে, বা রে, আমি বুঝি আর—সেবার তো আমি—
হেনা কমলাকে চোখ টিপে বললে, থাম বাপু তুই৷ তুই ভারি জানিস রাস্তা-ঘাট৷ তার পর দিদিকে নিয়ে যেতে একটা বিপদ হোক রাস্তায়! যে গুণ্ডা আর বদমাইশের ভিড়—
শরৎ বললে, সত্যি নাকি ভাই, বলুন না?
—আমি কি আর মিথ্যে কথা বলছি—ও ছেলেমানুষ, কি জানে?
এইবার কমলা বললে, না—তা—হ্যাঁ আছে বটে৷
—কি আছে ভাই গঙ্গাজল?
কমলাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বললে, কি নেই কলকাতা শহরে বলতে পারো? সব আছে৷ আজকাল আবার সোলজারগুলো ঘুরে বেড়ায় সর্ব জায়গায়৷
—সে আবার কি?
—সোলজার মানে গোরা সৈন্য৷ এরা যে অঞ্চলে আছে, তার ত্রিসীমানায় মেয়েমানুষের যাওয়া উচিত নয়৷ না, তুমি যেয়ো না ভাই৷ আমি তোমায় যেতে দিতে পারি নে৷ তোমার ভালো-মন্দর জন্যে আমি দায়ী যখন৷ প্রভাস-ঠাকুরপো আমার হাতে তোমায় যখন সঁপে দিয়ে গিয়েছে৷
কমলা বললে, আমরা তেল মাখলাম যে!
—তেল মেখে বাড়ির বাথরুমে ওঁকে নিয়ে চান করো৷ মিছিমিছি কেন ওঁকে বিপদের মধ্যে নিয়ে যাওয়া?
আড়ালে নিয়ে গিয়ে কমলাকে হেনা খুব বকলে৷ প্রভাসের কাছ থেকে সেও টাকা নেবে যখন, তখন এতটুকু বুদ্ধি নিয়ে কাজ করলে কি চলে না? বাড়ির মধ্যেই ওকে ধরে রাখা যাচ্ছে না, একবার বাইরের রাস্তায় পা দিলে আর সামলানো যাবে না ওকে৷ এত কম বুদ্ধি কেন কমলার! হরি সা লোকটাকে কাল রাত্রে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলে কি কোম্পানির রাজ্য অচল হত? সামলে না নিলে সব কথা ফাঁস হয়ে যেত যে আর একটু হলে! ঘটে বুদ্ধি হবে কবে তার?…ইত্যাদি৷
কমলা গুরুজন-কর্তৃক-তিরস্কৃতা-বালিকার ন্যায় চুপ করে রইল৷
হেনা বললে, তুমি আর ওঘরে যেয়ো না৷ আমি করছি যা করবার—তুমি যাও৷ হরি সা যেন এখন আর না ঢোকে—
হেনা ঘরে ঢুকে শরৎকে বললে, গঙ্গায় যাওয়া হবে না ভাই৷ পথে আজকাল বড় গোলমাল, তুমি বাথরুমে নেয়ে নাও, আমি সব যোগাড় করে রেখে এলাম—
স্নান করে আসবার কিছু পরে হেনা শরৎকে বললে, তোমার খাওয়ার কি করব ভাই? আমাদের রান্না চলবে না তো?
—আমার খাওয়ার জন্যে কি ভাই! দুটো আলোচাল আনুন, ফুটিয়ে নেব৷
—মাছমাংস চলে না—না? গাঁ থেকে এসেছ, এখন চলুক না, কে আর দেখতে আসছে ভাই?
প্রভাসের বৌদিদির এ কথায় শরৎ বিস্মিত হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল৷ ব্রাহ্মণের ঘরের মেয়ে নয় বটে, কিন্তু হিন্দু তো—সে একজন ব্রাহ্মণের বিধবাকে একথা বলতে পারলে কি করে? অন্য জায়গায় এ ধরনের কথা বললে শরৎ নিজেকে অপমানিতা বিবেচনা করত, তবে এরা কলকাতার লোক, এদের কথা স্বতন্ত্র৷
হেনা মনে মনে বললে, বাপ রে, দেমাক দ্যাখো আবার! কথা বলেছি তো ওঁর গায়ে ফোস্কা পড়েছে! তোমার দেমাক আমি ভাঙব, যদি দিন পাই—কত দেখলাম ওরকম, শেষ পর্যন্ত টিকল না কোনোটা!
শরৎ বিকেল থেকে কেবল দমদমায় ফেরবার জন্যে তাগাদা করতে লাগল৷ হেনা ক্রমাগত বুঝিয়ে রাখে, ওরা এখনো আসছে না, এলেই পাঠিয়ে দেবে৷ শরৎ তো জলে পড়ে নেই—এর জন্যে ব্যস্ত কি?
কমলার দেখা নেই অনেকক্ষণ ধরে৷ শরৎ বললে, গঙ্গাজল কই, তাকে দেখছি নে—
হেনা কমলাকে সরিয়ে দিয়েছিল, কাঁচা লোক, কখন কি বলে বসবে, করে বসবে,—সব মাটি হবে৷ তা ছাড়া কমলার ঘরে এমন সব জিনিসপত্র আছে, যা দেখলে শরতের মনে সন্দেহ হতে পারে৷ হরি সা’র একটা বিছানা, আলমারিতে তার দাড়ি কামানোর আসবাব, বড় নল লাগানো গড়্গড়া ইত্যাদি৷ মদের বোতলগুলো না হয় পাড়াগাঁয়ের মেয়ে না বুঝতে পারলে—কিন্তু পুরুষের বাসের এসব চিহ্নের জবাবদিহি দিয়ে মরতে হবে হেনাকে!
বিকেলের দিকে হেনা বললে, চলো ভাই, টকি দেখে আসি—
—সে কোথায়?
—চৌরঙ্গীতে চলো, শ্যামবাজারে চলো—
—বাবার কাছে কখন যাবে? ওরা কখন আসবে?
—চলো, টকি দেখে দমদমায় তোমায় রেখে আসব—
শরৎ তখুনি রাজি হয়ে গেল৷ টকি দেখবার লোভ যে তার না হয়েছিল তা নয়৷ বিশেষ করে টকি দেখেই যখন বাবার কাছে যাওয়া হচ্ছে তখন আর গোলমাল নেই এর ভেতর৷
কিন্তু হেনার আসল উদ্দেশ্য কোনো রকমে ওকে ভুলিয়ে রাখা৷ টকি দেখবার জন্যে গাড়ি ডাকতে গিয়েছে বলে দেরি করিয়ে সে প্রায় সন্ধ্যা করে ফেললে৷ শরৎ ব্যস্ত হয়ে কেবলই তাগাদা দিতে লাগল—কখন গাড়ি আসবে, কখন যাওয়া হবে৷ হেনাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল, এদের কারো দেখা নেই—পোড়ারমুখো গিরীনটা লম্বা লম্বা কথা বলে, তারও তো চুলের টিকি দেখা যাচ্ছে না, গিয়েছে সেই সকাল বেলা! যা করবি করগে বাপু, টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে এ আপদ তোরা যেখানে পারিস নিয়ে যা, তার এত ঝঞ্ঝাটে দরকার কি? এদিকে একে আর বুঝিয়ে রাখা যায় না৷
.
সন্ধ্যার পরে গিরীন এসে নীচের তলায় হেনাকে ডেকে পাঠালে৷
হেনা তাড়াতাড়ি নেমে এসে বললে, কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করি তোমাদের? আমার ঘাড়ে যে চাপিয়ে দিয়ে গেলে এখন আমি করি কি? ও যে থাকতে চাইছে না মোটে৷ কোথায় নেবে নিয়ে যাও না, আমি কতকাল ভুলিয়ে রাখব? আমার থিয়েটার আছে কাল৷ কাল ওকে কার কাছে রাখব? ওদিকে কদ্দূর করলে?
গিরীন তুড়ি দিয়ে গর্বের সুরে বললে, সব ঠিক৷
—কি হল?
—বুড়োকে ভাগিয়েছি৷ সে বলব এখন পরে৷ সে পুঁটুলি নিয়ে বুঝলে—হি-হি-হি—
—কি বলো না?
—পুঁটুলি নিয়ে ভেগেছে, হি-হি—ঝি চিঁড়ে আনতে গিয়েছে আর সেই ফাঁকে হি-হি—পুলিসের এ্যায়সা ভয় দেখিয়ে দিইছি, বুড়োটা আর এমুখো হবে না!
—বেশ, এখন নিয়ে যাও—
—দ্যাখো, ওকে একটু ভুলোও-টুলোও৷ পাড়াগাঁয়ে গরিব ঘরে থাকত, সুখ আমোদ-আহ্লাদের মুখ দেখে নি৷ গয়নাগাঁটি কাপড়-চোপড়ের লোভ দেখাবে—
—ওরে বাপ রে, বলেছি তো ও মেয়ে তেমন না৷ একটুখানি মাছমাংস খাওয়ার কথা বলেছিলাম তো অমনি ফোঁস করে উঠল—আর কেবল হা বাবা যো বাবা—
—তবে আর তোমার কাছে দিয়েছি কেন হেনা বিবি? পাকা লোকের কাছে রেখেছি, আজ রাতটা রেখে দাও, রেখে যা পারো করো৷ আজ আর নিয়ে যাই কোথায়? এখনো কিছু ঠিক করি নি৷ প্রভাসের বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, প্রভাস বাড়ি থেকে বেরুতে পারছে না৷ অরুণ আজ নাইট-ডিউটি করবে আপিসে৷ আমি একা—
—কেন, তুমি একাই একশো বলে যে বড্ড গোমর করো! লম্বা লম্বা কথা বলবার সময় হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা—এখন কাজের সময়ে হেনা বিবি তুমি করো৷ আরও টাকা চাই তা বলে দিচ্ছি—
—যাহোক, যা বললাম আজকার রাতটা তো রাখো—
—ও টকি দেখতে যাবে বলছিল, নিয়ে যাব?
—দরকার নেই৷ বাড়ির বার করবার হ্যাঙ্গামা অনেক৷ ভুলিয়ে রাখো৷
—কাল সকালে এসো বাপু৷ কাল আমার থিয়েটার, আমার দ্বারা কাল কোনো কাজ হবে না বলে দিচ্ছি—
হেনা মুখ চুন করে শরতের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললে, বড় মুশকিল! প্রভাস-ঠাকুরপোর বাবার বড় অসুখ, এখন যান তখন যান! হঠাৎ অসুখ হয়ে পড়েছে—এই মাত্তর খবর দিয়ে পাঠিয়েছে৷
শরৎ উদ্বেগের সুরে বললে, অসুখ! তা বয়সও তো হয়েছে—বাবা বলেন তাঁর চেয়ে দশ-বারো বছরের বড়!
—তা তো বুঝলুম৷ এদিকে এখন উপায়!
—আজ কি দমদমা যাওয়া হবে না?
—কি করে আর যাওয়া হচ্ছে বলো ভাই৷ প্রভাস-ঠাকুরপোর গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না তো—
—কেন ভাড়াটে গাড়ি?
—কে নিয়ে যাবে? তুমি আমি দুই মেয়েমানুষ, ভাড়াটে গাড়িতে ভরসা করে যাওয়া চলবে না৷ কাল সকালেই যা হয় ব্যবস্থা হবে৷
শরৎ অগত্যা রাজি হল৷ না হয়ে উপায় যখন নেই৷
.
সন্ধ্যার পরে শরৎকে সঙ্গে নিয়ে হেনা গিয়ে ছাদে উঠল৷ চারদিকে আলোর কুরকুট্টি, নিচের রাস্তা দিয়ে সারবন্দী গাড়ি ঘোড়া, মোটর, কর্মব্যস্ত জনস্রোত, ফিরিওয়ালারা কত কি হেঁকে যাচ্ছে, বেলফুলের মালাওয়ালা ‘চাই বেলফুলের গোড়ে’ বলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাঁকছে, শরৎ মুগ্ধ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখলে৷
বললে, সত্যি শহর বটে কোলকাতা! জায়গার মতো জায়গা একথা ঠিক! কি লোকজন, কি আলোর বাহার! আমাদের গাঁ এতক্ষণ অন্ধকার হয়ে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে জঙ্গলে৷
হেনা অবসর বুঝে অমনি বললে, আমিও তো তাই বলি, এখানেই কেন থেকে যাও না? সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি, সুখে থাকবে, খাও-দাও, আমোদ-আহ্লাদ করে বেড়াও—
শরৎ হেসে বললে, তা তো বুঝলাম৷ আমার ইচ্ছে করে না যে তা নয়, কিন্তু চলবে কি করে? বাবা গরিব মানুষ—
হেনা উৎসাহের সুরে বললে, সব বন্দোবস্ত হয়ে যাবে এখন৷ তুমি রাজি হয়ে যাও ভাই—
—কি বন্দোবস্ত হবে? বাবার চাকরি করে দিতে পারা যায় যদি, তবে সব হয়৷ গড়শিবপুরের জঙ্গলে থেকে আমার প্রাণও হাঁপিয়ে উঠেছে—দুদিন এখানে থেকে বাঁচি—
—বেশ কথা তো! কলকাতার মতো জায়গা আছে ভাই—এখানে নিত্য আমোদ, লোকজন—ইচ্ছে হল আজ শিবপুরে কোম্পানির বাগানে বেড়াতে গেলাম—ইচ্ছে হল আজ জু’তে গেলাম—
—সে আবার কি?
—মানে চিড়িয়াখানা৷ যখন যেখানে যেতে চাও গেলে, যা খাবার ইচ্ছে হয় খেলে, এই তোমার বয়েস, হেসে খেলে যদি এখন না বেড়ালে তবে কবে আর কি করবে? মানব-জীবনে এই সবই তো আসল৷ জঙ্গলে থাকলাম আর আলোচাল খেলাম—এজন্যে কি আসা জগতে?
—কি করব বলুন! অল্প বয়সে কপাল পুড়েছে যখন, তখন কি আর উপায় আছে—ব্রাহ্মণের ঘরের মেয়ের? বাবাও টাকার মানুষ নন যে কলকাতায় বাসা করে রাখবেন৷
—তুমি ইচ্ছে করলেই সব হয়৷ কলকাতায় থাকতে চাও, বাসা কেন—খুব ভালো ভাবে থাকতে পারবে এখন—স্টাইলে থাকবে৷ রেডিয়ো রাখবে এখন বাড়িতে—
—সে কি?
—বেতার৷ ওই শোনো বাজছে—ওই যে দোকানের সামনে লোক জমেছে? গান গাইছে না? তার পর গ্রামোফোন মানে কলের গান—
—জানি৷
—সে কলের গান রাখো—মোটর পর্যন্ত হয়ে যাবে৷ আজ এখানে বেড়াও, কাল ওখানে বেড়াও ইচ্ছে হল আজ কাশী বেড়াতে যাবে, কাল এলাহাবাদ কি দার্জিলিং বেড়াতে যাবে—
শরৎ হি-হি করে হেসে উঠে বললে, আপনি যে রূপকথার গল্প আরম্ভ করে দিলেন দেখছি! আমি মুখে বললেই সব হবে—এ যেন সেই আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের—যাক গে, সত্যি হোক না হোক—ভেবে তো নিলাম—বেশ লোক কিন্তু আপনি!
—আমি মোটেই গল্পকথা বলি নি ভাই৷ আপনি ইচ্ছে করলেই হয়—
—আমি কি আর ইচ্ছে করলে বাবার চাকরি করে দিতে পারি? অবিশ্যি আমিও বুঝতে পারি, বাবার যদি থিয়েটারে চাকরি হয় তবে সব হয়৷ বাবা যে কি চমৎকার বেহালা বাজান, সে আপনি শোনেন নি—কলকাতার থিয়েটারে সে-রকম পেলে লুফে নেয়৷ যেমনি বাজান, তেমনি গাইতে পারেন৷
হেনার হাসি পাচ্ছিল৷ পাড়াগেঁয়ে একটা বুড়ো এমন বেহালা বাজায় যে তাকে কলকাতার বড় থিয়েটারে লুফে নিয়ে এত টাকা মাইনে দেবে যে তাতে ওদের বাড়ি, গাড়ি, জুড়ি, ঢাক, ঢোল সব হয়ে যাবে! শোনো কথা! বাঙাল কি আর গাছে ফলে?
হেনা চুপ করে ভাবলে৷ আর বেশি বলা কি উচিত হবে একদিনে? অনেকদূর সে এগিয়েছে—অনেক কথা বলে ফেলেছে৷ মাগী কি সত্যিই বোঝে না—না ঢং করছে? কিন্তু যদি সত্যি ও বুঝতে পেরে থাকে তার কথার মর্ম—তবে আর না বলাই ভালো৷ ভয় করে বাবা, এখনি ফোস করে উঠে একটা কাণ্ড বাধিয়ে তুলতে পারে! বাঙালনীকে বিশ্বাস নেই৷
শরৎ বললে, কই বললেন না, আমি ইচ্ছে করলে কি করতে পারি?
এ কথার জবাবে হেনা খপ করে বলে ফেললে, তুমি বুঝতে পারছ না ভাই, সত্যিই আমি কি বলছি?
এই পর্যন্ত বলেই হেনার হঠাৎ বড় ভয় হল৷ চোখ বুঝে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার দরকার নেই—আপাতত সাহসও নেই তার৷ কথা সামলে নেবার জন্যে সঙ্গে সঙ্গে একই নিশ্বাসে সে কণ্ঠস্বরকে লঘু ও হাস্য-তরল করে এনে বললে, বুঝলে এবার? একটু ঠাট্টা করছি তোমায়৷ তাই কি কখনো হয়? তুমি আমি বললে কি হবে বলো—এমনি বলছিলাম৷ চলো নীচে যাই—রাত্রে কি খাবে?
—কিছু না৷ আমি কিছু খাইনে রাত্রে৷
—বেশ, একটু দুধ একটু মিষ্টি খেতে আপত্তি আছে?
—আমি কিছুই খাব না, আপনি ব্যস্ত হবেন না৷
হেনা মনে মনে বললে, তুমি না খেয়ে মরো না, আমার কি? এমন একগুঁয়ে বালাই যদি আর কখনো দেখে থাকি! যা বলবে তাই, ‘না’ বললে ‘হাঁ’ করাবার জো নেই!
এই সময় নীচের তলায় খুব একটা চেঁচামেচি শোনা গেল৷ কে জড়িত স্বরে চিৎকার করছে, কে গালাগালি করছে৷
শরৎ ভীতমুখে বললে, ওকি ভাই? কে চেঁচাচ্ছে? আমাদের বাড়িতে না?
হেনা পাংশুমুখে বললে, না, ও আমাদের বাড়ি নয়৷
হরি সা মদ খেয়ে কমলার ঘরে ঢুকে নিত্যকার মতো উপদ্রব শুরু করেছে৷ সর্বনাশ!
এই সময় নীচে মারধরের শব্দ শোনা গেল৷ এও নতুন নয়, হরি সা মদ খেয়ে এসে কমলাকে ঠেঙায় মাঝে মাঝে—পয়সার খাতিরে গায়ের কালশিরে ঢেকে আবার হাসতে হয় কমলাকে৷ কিন্তু—
শরৎ ব্যস্ত হয়ে বললে, না, দেখুন, আমাদের বাড়িতে নীচের ঘরেই৷ কমলার ঘরের দিকে মনে হচ্ছে৷ যান যান, আপনি শীগগির যান—দেখুন—চলুন যাই আমরা৷ কে হয়তো বদমাইশ ঘরে ঢুকেছে—
চেঁচামেচি বাড়ল৷ আর রক্ষা হল না৷ হরি সা গর্দভের মতো চেঁচানি জুড়েছে৷ হরি সা যে একদিন মাটি করে দেবে সব, হেনা তা জানত৷ সেই লম্বা কথাওয়ালা গিরীন এই সময় আসুক না দেখা যাক৷
কমলার গলার কান্না মেশানো আর্ত সুর শোনা গেল—ও দিদি, তোমরা এসো, আজ আমায় মেরে ফেললে মুখপোড়া—আর পারি নে দিদি—উঃ, আর রক্ষা হয় না৷
তবুও অ্যাকট্রেস হেনা মরীয়া হয়ে শেষ চাল চাললে৷ মুখে দিব্যি শান্ত হাসি এনে বললে, ও আমাদের বাড়ি না, পাশের বাড়ির সেই বুড়ো মাতালটা৷ ছাদ থেকে মনে হয় যেন আমাদের বাড়ি৷ রোজই শুনছি৷ যাবেন না নীচে—জানলা দিয়ে ওদের ঘরটা দেখা যায় কিনা, আমাদের দেখলে আবার গালাগালি করবে৷ আমি তো এ সময় সিঁড়ি দিয়ে নামি নে—
সাত
ওদিকে কমলার চিৎকার তখনও শোনা যাচ্ছে৷
শরৎ বললে, ও তো পষ্ট গঙ্গাজলের গলা—আপনি কি বলছেন?
তার পরে সে নিজে এগিয়ে গিয়ে কমলার ঘরে ঢুকল৷ গিয়ে যা দেখলে তাতে সে অবাক হয়ে গেল৷ কমলা মেঝেতে পড়ে কাঁদছে, একটা কালো মোটা-মতো লোক তক্তপোশের ওপর বসে, তার হাতে একখানা পাখা৷ পাখার বাঁটের দিকটা উঁচিয়ে বোধ হয় কিছুক্ষণ আগে সে কমলাকে মেরেছে, কারণ পাখাখানা উল্টো করে ধরা রয়েছে লোকটার হাতে৷
শরৎকে দেখে কমলা দিশাহারা ভাবে বললে, আমায় মারছে গঙ্গাজল—আমায় বাঁচাও—
শরৎ কমলার হাত ধরে বললে, তুমি চলে এসো আমার সঙ্গে—
মোটামতো লোকটা গর্জন করে বলে উঠল, ও কোথায় যাবে?
পরক্ষণেই সে শরতের দিকে ভালো করে চেয়ে, সুর নরম করে ইতরের মতো রসিকতার সুরে বললে, তুমি আবার কে চাঁদ?
শরৎ সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে কমলার হাত ধরে তাকে ঘরের বাইরে আনতে গেল৷
বুড়ো লোকটা বললে, ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ চাঁদ? ওকে আমার দরকার আছে—তুমিও এখানে বসো না একটু—কোন ঘরে থাকো?
পরে কমলার দিকে চেয়ে কড়া সুরে বললে, এই, যাবি নে৷ বোস বলছি৷
শরৎ বললে, আপনি একে মারছেন কেন?
—আমার ইচ্ছে—তুমি কে হে আমার কাজের কৈফিয়ৎ নিতে এসো? আমার নাম হরি সা৷ বৌবাজারে আমার দোকানে ছাপ্পান্ন হাজার টাকার জল বিক্রি হয় মাসে—শুধু জল, বুঝলে চাঁদ! বোতলভরা জল—
শরৎ ততক্ষণে কমলার হাত ধরে ঘরের বাইরে এনেছে৷ কমলার পিঠের কাপড় তুলে দেখলে, পিঠেও অনেক জায়গায় লম্বা লম্বা মারের দাগ৷ হেনা কখন এসে নিঃশব্দে ওদের পেছনে দাঁড়িয়েছে৷ শরৎ তার দিকে চেয়ে বললে, দেখুন ওই কে একজন লোক কি রকম মার মেরেছে—কে ভাই উনি তোমার?
কমলা চুপ করে রইল, তখন সে নিঃশব্দে কাঁদছে৷
এ কথার উত্তর দিলে স্বয়ং হরি সা৷ কমলার পিছনে পিছনেই সে ঘরের বাইরে এসে বললে—আমি কে ওর? শুধু ওকে জিজ্ঞেস করো ওর পেছনে কত টাকা খরচ করেছি আমি! হাড়কাটা গলির দোকানখানাই উড়িয়ে দিয়েছি ওর পেছনে—আমার—আচ্ছা আমি বসছি গিয়ে ঘরের মধ্যে৷ ও পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘরে আসুক—
শরৎ এতক্ষণও খুব খারাপ কোনো সন্দেহ করে নি৷ কমলার কোনো গুরুজন হবে এতক্ষণ ভেবেছিল—যদিয়ো লোকটার কথাবার্তার ধরনে সে রাগ করেছিল খুব৷ কিন্তু এবার তার বুকের মধ্যেটা হঠাৎ ধক করে উঠল, এ কোন সমাজে সে এসে পড়েছে যেখানে দাদামশায়ের বয়সী বৃদ্ধ নাতনীর বয়সী মেয়ের সম্বন্ধে এ ধরনের কথাবার্তা বলে! সে কোথায় এসে পড়েছে? বুড়ো লোকটার সঙ্গে কমলার সম্পর্ক কি?
প্রভাসের বৌদিদিই বা তাকে এত মিথ্যে বলতে গেল কেন?
সে হেনার দিকে তীব্রদৃষ্টিতে চেয়ে বললে, আপনি জেনেশুনে আমায় কি সব কথা বলছিলেন এতক্ষণ? আমায় আপনারা কোথায় এনেছেন? এ সব কি কাণ্ড!
হেনা ঠোঁট উল্টে বললে, ন্যাও ন্যাও গো রাইমণি! অমন সতীপনা অনেককে করতে দেখেছি—প্রথম প্রথম যারা আসে, সবাই অমনি সতী থাকে! কত দেখলুম, কত হল আমাদের এ চক্ষের সামনে—
শরৎ রাগের সুরে বললে, তার মানে? কি বলছেন আপনি?
—যা বলছি তা বলছি, ভেবে দ্যাখো৷ আর ঢং দেখাতে হবে না তোমাকে৷ বেরিয়ে এসেছ তো প্রভাসের আর গিরীনের সঙ্গে—কোথায় এসে পড়েছ বুঝতে পারছ না? তোমার একূল ওকূল দুকূল গিয়েছে৷ এখন যেখানে এসে উঠেছ সেখানেই থাকো—সুখে থাকবে৷ তোমার বাবা এখানে নেই—চলে গিয়েছে কাল৷ তুমি এখানে ওদের সঙ্গে পালিয়ে এসে উঠেছ শুনে—
শরতের মুখ থেকে হঠাৎ সব রক্ত চলে গিয়ে সমস্ত মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেল৷ সে হাঁ করে হেনার মুখের দিকে চেয়ে রইল৷ মুখ দিয়ে কোনো কথা বার হল না, শুধু তার ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল৷
ওর অবস্থা দেখে হেনার ভয় হল৷
বাঙালনীর ঢং দ্যাখো আবার! ফিট-টিট হবে নাকি রে বাবা! আঃ, কি ঝঞ্ঝাটেই তাকে ফেলে গেল ওই কথার ঝুড়ি গিরীনটা! এসে সামলাক এখন তাল!
সে কাছে এসে বললে, তা ভাই তুমি তো আর জলে নেই? ভয় কিসের? আমি তো বলছিলাম তোমার সব হবে৷ থাকো না এখানে আমাদের এই বাড়িতে৷ তোমায় মাথায় করে রেখে দেবে এখন ওরা৷ মোটর বলো, কালই মোটর হবে৷ রেডিও হবে, কলের গান হবে—যা আমি বলেছি৷ আপাদমস্তক জড়োয়া দিয়ে মুড়ে দেবে—ভয় কিসের তোমার? চাকর-চাকরানীর মাথায় পা দিয়ে বেড়াও, মুখের কথা খসাও, কাল থেকে সব ঠিক করে দেব—কি হবে সেই ধাবধাড়া গোবিন্দপুরের জঙ্গলে—
শরৎ এতক্ষণে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল৷ বললে, এমন লোক আপনারা—তা আমি ভাবি নি৷ মাথার ওপর ভগবান আছেন, আমি জানতাম না, সরল বিশ্বাস করেছিলাম প্রভাস দাদার ওপর৷ ভাইয়ের মতো দেখতাম৷ আপনাদের ভেবেছিলাম ভদ্রঘরের মেয়ে৷ আমার বোকামির শাস্তি যথেষ্ট হয়েছে—
কান্নায় তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল৷
হেনার মন যে পথকে আশ্রয় করে পোক্ত হয়েছে, সেই পথেরই সংকীর্ণ দৃষ্টি ওর মনুষ্যত্বকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে৷ পাপের পথে যে মনে মনে ঝানু হয়ে পড়ে, পুণ্যের আলো প্রবেশ করবার বাতায়ন-পথ তার নিজের অজ্ঞাতসারে ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয়ে যায়৷
হেনার মন গলবার নয়৷
সে বললে, কেন কান্নাকাটি করছ ভাই? প্রথম প্রথম অবিশ্যি একটু কষ্ট হয়—কিন্তু জগতে এসে সুখের মুখ যদি না দেখলে তবে করলে কি? এখানে দিব্যি সুখে থাকো—পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে খাও—সব সয়ে যাবে৷
শরৎ বললে, আপনি দয়া করে আর কিছু বলবেন না৷ আমি গরিব লোকের মেয়ে, বাসন মেজে ভাত রেঁধে কাঠ চ্যালা করে সংসার করে এসেছি এতকাল, এক দিনের জন্যেও ভাবি নি যে কষ্টে আছি৷ আপনাদের সুখ নিয়ে থাকুন আপনারা—
এই সময় অপ্রত্যাশিত ভাবে দুপ দুপ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল গিরীন৷
তাকে দেখে হেনা যেন অকূলে কূল পেয়ে গেল৷ তার দিকে ফিরে বললে, এই যে! বাপরে বাপ! এত ঝক্কি পোয়াবার জন্যে আমি রাজি হই নি, তা বলে দিচ্ছি৷ ওই নাও, সব খুলে বলেছি—যা বোঝো করো৷
গিরীন বললে, কি, ও বলে কি?
—জিজ্ঞেস করো, তোমার সামনেই তো বিরাজ করছে সশরীরে—
গিরীন শরতের দিকে ফিরে বললে, কি? বলছ কি তুমি? তোমার বাবা তোমার কথা সব শুনে পালিয়েছে৷ এখানে থাকো, পরম সুখে থাকবে—
শরৎ বললে, আপনি আমায় কোনো কথা বলবেন না৷ আমায় ছেড়ে দিন দয়া করে—আমি গাঁয়ে চলে যাব বাবার কাছে—
গিরীন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললে, সে গুড়ে বালি! এতক্ষণ গাঁয়ে রটে গিয়েছে সব৷ কোথায় দু-দিন দু-রাত কাটিয়েছ গাঁয়ের সবাই জেনে গিয়েছে৷ আর ঘরে জায়গা নেই তোমার—এখন যা বলছি তাতে রাজি হও চাঁদ—
শরৎ হঠাৎ তীব্র পরুষকণ্ঠে বলে উঠল, খবরদার, আমাকে যা তা বলবার কোনো এক্তার নেই আপনার জানবেন—সাবধানে কথা বলুন—
গিরীন কৃত্রিম ভয়ের ভান করে হেনার পেছনে লুকোবার অভিনয় করলে৷ বললে—ও বাবা, শূলে দেবার না ফাঁসিতে লটকাবার হুকুম হয়ে গেল বুঝি! তাল সামলাও হেনা বিবি—
শরৎ বললে, সে দিন নেই, আজ আমার বাবা গরিব, আমরা গরিব—নইলে আপনাদের মতো ছোটলোককে শূলে ফাঁসে দেওয়া খুব বেশি কথা ছিল না গড়শিবপুরে—যাক, আমায় যেতে দিন, আমি চলে যাব—
গিরীন বললে, কোথায় যাবে চাঁদ? সে পথ বন্ধ—আমি তো—
শরৎ বলে উঠল, আবার ওই ইতরের মতো কথা! আমি কোনো কথা শুনবার আগে আপনি আমার সামনে থেকে চলে যান—ভদ্রলোক বলে ভুল করে ঠকেছি—
শরতের কথাবার্তার ভঙ্গির মধ্যে ও কণ্ঠস্বরে এমন কি একটা জিনিস ছিল যাতে গিরীন কুণ্ডু যেন সাময়িক ভাবে ভয় পেয়ে চুপ করল৷
হেনা ওকে আড়ালে চুপি চুপি বললে, কেন ও বাঙালনীকে রাগাচ্ছ৷ রাগিয়ে কাজ পাবে না ওর কাছে!
—বাপরে, কেবলই যে ফোঁস ফোঁস করে! আজ ওকে এখানে রাখো—
—আমি পারব না, আমার থিয়েটার আজ—
—তুমি নিয়ে যাও কমলাকে৷ হরি সা কে আমি নিয়ে ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে যাচ্ছি৷ থাকুক এখানে চাবি দেওয়া আটকানো—
হেনা ফিরে গিয়ে বললে, তোমার কথা হল৷ বাড়ি যাবে কোথায়? সেখানে সব রটে গিয়েছে—গাঁয়ে যাবে কোন মুখে? এখানে সুখে থাকবে৷
—সে ভাবনা আপনি ভাববেন না৷ আমার যে দিকে দু-চক্ষু যায় চলে যাব৷ মা-গঙ্গা তো আছেন শেষ পর্যন্ত৷ এমন কি করেছি আমি যাতে মা আমায় কোলে স্থান দেবেন না?
শরতের গলা আবার কান্নার বেগে আটকে গেল৷ বললে—লোককে বিশ্বাস করে আজ আমার এই দশা—কি করে জানব যে মানুষের পেটে এত থাকে!
হেনা বললে, আচ্ছা, তাই হবে৷ না হয় মোটরে করে তোমাকে ইস্টিশানে রেখে আসুক—দেখে আসি নীচে—
—সে চলে গেল৷ কমলাকে গিরীন কি বলতে নিয়ে গেল পাশে৷ শরৎ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হেনার ওপরে উঠে আসবার অপেক্ষা করলে৷ তার পর তার দেরি হচ্ছে দেখে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখলে বাইরের দরজা বন্ধ৷ বাইরে থেকে ওরা তালা দিয়েছে৷
শরৎ এসে চুপ করে ওপরে অনেকক্ষণ বসে রইল৷
বাড়ি নির্জন, নিস্তব্ধ৷ জলতেষ্টা পেয়েছে বড়, জল আছেও কিন্তু এ বাড়িতে সে জলস্পর্শ করবে না, জলতেষ্টায় মরে গেলেও না৷ প্রভাসদার বাবার কি সত্যিই অসুখ? হয়তো সব মিথ্যে কথা ওদের৷ কথাতে কথাতে বিশ্বাস করেই আজ তার এই দশা৷ প্রভাসও লোক ভালো নয় নিশ্চয়ই৷
অনেকক্ষণ কেটে গেল৷ কেউ আসে না৷ শরৎ জানলা দিয়ে পাশের বাড়িতে উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করলে৷ কোনো লোক দেখা গেল না৷ দু ঘণ্টা তিন ঘণ্টা কেটে গেল, শরৎ বসে বসে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল৷ সম্পূর্ণ অসহায়, কেউ তাকে জানে না, কেউ চেনে না৷ কি সে এখন করে?
শেষ পর্যন্ত সে ভাবলে, এও ভালো, দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়ালও ভালো৷ ওরা না আসুক, সে এখানে না খেয়ে মরবে—মরতে তার ভয় নেই৷ একবার আশা ছিল বাবার সঙ্গে দেখা করে সব কথা খুলে বলে—কিন্তু বাবার দর্শনলাভ অদৃষ্টে বোধ হয় নেই৷
বিকেল হয়ে আসছে৷ পাশের বাড়ির গায়ে লম্বা ছায়া পড়েছে৷ শরৎ বসে বসে একটা উপায় ঠিক করলে৷ সে যেই দেখবে পাশের বাড়ির জানলায় লোক, তাকে সে নিজের অবস্থার কথা জানাবে৷ তার কথা শুনে দয়া হবে না কি ওদের? বাড়ির চাবিটা খুলিয়ে দেবে না তারা?
হঠাৎ সে দেখলে পাশের বাড়ির জানলায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে৷
সে চেঁচিয়ে বললে, শুনুন, এই যে এদিকে—
মেয়েটি ওর দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চেয়ে বললে, আমায় বলছ—কি ভাই?
—আমায় এ বাড়িতে আটকে রেখেছে৷ আমি পাড়াগাঁ থেকে এসেছি—আমায় দোরটা খুলে দিন—দয়া করুন আমার ওপর৷
—এ তো হেনা দিদির বাড়ি, হেনা নেই?
—হেনা কে জানি নে৷ তবে কেউ এখন এ-বাড়িতে নেই৷ আমায় তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখে চলে গিয়েছে—
—তোমার বাড়ি কোথায়?
—অনেক দূরে৷ গড়শিবপুর বলে একটা গাঁ—যশোর জেলা—
—এখানে কার সঙ্গে এসেছ?
—প্রভাস আর অরুণ বলে দুজন লোক—আমাদের গাঁয়ের—
মেয়েটি মুচকি হেসে বললে, তার পর ঝগড়া হয়েছে বুঝি? থাকো ভাই, থাকো৷ এসেছ যখন, তখন যাবে কোথায়?
শরৎ ব্যগ্রস্বরে বললে, না না—আপনি বুঝতে পারছেন না৷ ওরা আমায় ঠকিয়ে এনেছে, আমি ভদ্রলোকের মেয়ে৷ আমায় দোর খুলে দিন কাউকে বলে দয়া করে—আমায় বাঁচান—আমার সব কথা শুনুন—
মেয়েটি ঠোঁট উল্টে বললে, সবাই বলে ঠকিয়ে এনেছে৷ তবে এসেছিলে কেন? ওসব আমি কিছু করতে পারব না—কে হ্যাঙ্গামা পোয়াতে যাবে বাপু তোমার জন্যে? যারা এনেছে, তাদের কাছে বোঝাপড়া করো গে—
কথা শেষ করে মেয়েটি জানলা থেকে সরে গেল৷ শরৎ জানত না যে এ পাড়ায় আশপাশের বাড়িতে যেসব স্ত্রীলোক বাস করে, তারা কেউ ভদ্রঘরের নয়, মানে, চরিত্রে, পেশায় তারা হেনারই সগোত্র৷ এদের কাছ থেকে সাহায্য ভিক্ষা নিষ্ফল৷
কিছুক্ষণ কেটে গেল৷ বিকেল বেশ ঘনিয়ে এসেছে, এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে শরৎ তাড়াতাড়ি ছুটে বাইরের বারান্দায় এসে দেখতে গেল৷ সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে একা কমলা৷ ওর পেছনে কেউ নেই৷ ওকে দেখে কমলা হাসিমুখে বললে—কি ভাই গঙ্গাজল?
তার পর তাড়াতাড়ি দু-তিনটে সিঁড়ি একলাফে ডিঙিয়ে এসে শরতের গলা জড়িয়ে ধরে বললে, গঙ্গাজল—কি কষ্ট ওরা তোমাকে দিলে! কোনো ভয় নেই ভাই, আমি যখন এসে গিয়েছি৷ তুমি পালাও—আমি লুকিয়ে দেখতে এসেছিলাম তোমার কি দশা হচ্ছে—হয়তো এতক্ষণে একটা উপায় হয়েছে ভেবেছিলাম৷ তুমি চলে যাও—আমার কাছে এ বাড়ির একটা চাবি থাকে তাই রক্ষে৷
এতক্ষণ শরৎ কথা বলবার অবকাশ পায় নি, এত তাড়াতাড়ি সব ব্যাপারটা ঘটল!
সে এইবার বললে, ভগবান আছেন গঙ্গাজল, তাই তোমায় পাঠিয়ে দিয়েছেন ভাই—
—আমার তো আর কেউ ছিল না—
কমলা বললে, তুমি ভাই তাড়াতাড়ি নেমে চলো, জিনিসপত্র কিছু এনেছিলে—সুটকেস কি পুঁটুলি নেই? এসো নেমে গিরীনরা এসে পড়তে পারে৷ আমায় দেখলে গোলমাল করবে৷ হেনাদি থিয়েটারে গিয়েছে—সে আজ এখুনি আসবে না৷
শরৎ ওর সঙ্গে ফুটপাথে এসে দাঁড়াল৷
কমলা বললে, ভাই, তুমি এখন কোথায় যাবে?
—যেদিকে দু চোখ যায়—ভগবান আমার হাত ধরে যে পথে নিয়ে যাবেন৷ আমাদের গড়ের ভাঙা দেউলে সন্দে পিদিম দিয়েছি জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত—তিনি পথ দেখিয়ে দেবেন আমায়৷ পথ না হয়, মা-গঙ্গা আর কোল থেকে ঠেলে ফেলবে না৷
কমলার চোখ জলে ভরে উঠল৷ সে বললে, আমরা নরকের কীট ভাই, তোমার মতো মেয়ের পায়ের ধুলো পড়ে আমাদের পাপের বাসা পবিত্র হয়ে গেল৷ একটু সাবধানে থেকো, তোমার রূপ যে কি তুমি নিজে জানো না৷ আমাদের মাথা ঘুরে যায়—পুরুষের দোষ কি দেব? তার পর সে আঁচল খুলে পাঁচটা টাকা নিয়ে শরতের হাতে দিয়ে বললে—এই টাকা কটা সঙ্গে রাখো দিদি৷ দরকার হবে, ছোট বোনের কাছ থেকে নিতে লজ্জা নেই৷ সুসময় আসে, অনেক রকমে শোধ দিতে পারবে৷
শরৎ বললে, তুমিও কেন চলো না আমার সঙ্গে? এই কষ্ট সহ্য করে মার খেয়ে কেন এখানে পড়ে থাকো? চলো দুই বোনে পথে বেরুই ভগবানের নাম করে৷ তিনি নিরুপায়ের উপায়, একটা কিছু করে দেবেনই তিনি—
কমলা বিষণ্ণ মুখে বলল—না দিদি, আমার তা হবার নয়৷ আমার মা এখানে—মার বয়েস হয়েছে—তাঁকে ফেলে যেতে পারব না৷ তা ছাড়া আরও অনেক কাল এই পথের পথিক—এক পুরুষে নয়, অনেক পুরুষে৷ আমাদের উদ্ধার নেই—আমি যাব বললেই যাওয়া হবে না৷ বাঁচি মরি এখানে থাকতে হবে৷ গোবরের গাদাতে জন্মেছি, গোবরের গাদাতেই মরতে হবে৷
শরৎ কমলার চিবুক ধরে আদর করে বললে, না ভাই, গোবরের গাদায় তুমি পদ্মফুল—
কমলা অশ্রুসজল চোখে মাথা নিচু করে বললে, একটু পায়ের ধুলো দাও দিদি৷ ছোট বোন বলে মনে রেখো যেখানে থাকো—আমার আর দেরি করবার জো নেই—
কমলা বিদায় নিয়ে দ্রুতপদে চলে গেল৷
.
কমলা চলে গেলে শরৎ বড় একা মনে করল নিজেকে৷ এতক্ষণ তবুও একটা অবলম্বন ছিল, তাও গেল৷ এখন থেকে সে সম্পূর্ণ একা, নিঃসহায়৷ কখনো এমন অবস্থায় পড়ে নি জীবনে৷ কোথায় সে এখন যায়? বেলা পড়ে এসেছে—এই বিশাল অপরিচিত শহর সামনে৷ সুনির্দিষ্ট পথে চিন্তাধারাকে চালিত করবার শিক্ষা ওর নেই—যারা এ বিষয়ে আনাড়ি, তাদের চিন্তা যেমন খাপছাড়া ধরনের, ওর বেলাতে তার ব্যতিক্রম হল না৷ শরৎ ভাবলে—কালীঘাট গিয়ে গঙ্গাস্নান করে শুদ্ধ হই—যা কিছু পাপ, যদি ঘটে থাকে কিছু, গঙ্গায় ডুব দিয়ে কেটে যাবে এখন—
একটা ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছিল পাশ দিয়ে৷ গাড়োয়ান এ পাড়াতেই থাকে, এ পাড়ার স্ত্রীলোকদের সে চেনে—সওয়াড়ি খুঁজবার চেষ্টায় বললে, গাড়ি চাই?
শরৎ যেন অকূলে কূল পেলে৷ গাড়ি ডেকে নিজে চড়তে পারতো না—কি করে গাড়ি ডাকতে হয়, কি বলতে হয়, এসবে সে অনভ্যস্ত৷ সে বললে, আমায় কালীঘাটে নিয়ে যাবে?
—কেন যাব না বিবিজান? চলো—
—কত ভাড়া দিতে হবে?
—তিন টাকা দিয়ো, তোমাদের এ পাড়ার ভাড়া তো বাঁধাই আছে৷ ওই খেঁদি বিবি যায়, বড় পারুল বিবি সেদিন গেল—তিন টাকা দিলে৷ আমি যাস্তি লেবো না৷
শরৎ দরদস্তুর করতে জানে না৷ দু টাকার জায়গায় তিন টাকা ভাড়ায় সওয়ারি পেয়ে গাড়োয়ান মনের আনন্দে গাড়ি ছুটিয়ে দিলে৷ গড়ের মাঠ দিয়ে যখন গাড়ি চলেছে, তখন শরতের মনে হল একটা বিশাল জনস্রোতের মধ্যে সেও একজন৷ প্রকাণ্ড মাঠটার মধ্যে দিয়ে কত রাস্তা, কত গাড়ি ঘোড়া, ট্রাম গাড়ি, লোকজন ছুটেছে, চলেছে—দূরে গঙ্গাবক্ষে বড় বড় জাহাজের মাস্তুল দেখা যাচ্ছে৷ সকলের ওপর উপুড় হওয়া নীল আকাশের কতটা দেখা যাচ্ছে, মুচুকুন্দ চাঁপাগাছের সারির নিচে সাহেবদের ছেলেমেয়েদের ঠেলে নিয়ে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট ঠ্যালাগাড়িতে—জীবনটা ছোট নয়, সংকীর্ণ নয়—এত বড় জগতে যদি সবাই বেঁচে থাকে নিজের নিজের পথে—সেও থাকবে৷ ভগবান তাকে পথ দেখিয়ে দেবেন৷
গাড়িতে বসে গতির বেগে মন যখন পুলকিত, তখন অনেক কথা এমন অল্প সময়ের জন্যে মাথায় আসে, শরীরের জড়তার সুদীর্ঘ অবসরে নিষ্প্রভ ও অলস মন যা কখনো কল্পনা করতে পারে না৷
এই অল্প সময়টুকুর মধ্যেই শরৎ অনেক কথা ভেবে ঠিক করলে৷ সে আর গড়শিবপুরে ফিরবে না৷
বাবা সেখানে গিয়ে আছেন, হয়তো তিনি গিয়ে বলেছেন মেয়ে তাঁর মারা গিয়েছে৷ সে গেলেই গ্রামে কলঙ্ক রটবে৷ সে কলঙ্কের হাত থেকে বাবাকে সে রক্ষা করবে৷
কোথায় সে যাবে? তা সে জানে না আজ, যদি কখনো কারো অনিষ্ট চিন্তা না করে থাকে জীবনে, কখনো অন্যায় না করে থাকে—তবে সে-সবের জোর নেই জীবনে?
কালীঘাটে পৌঁছে সে গঙ্গায় ডুব দিলে, তার পর আর কোথাও যাওয়া নিরাপদ নয় ভেবে সে কালী-মন্দিরের সামনে চুপ করে বসে রইল৷
সন্ধ্যার আরতি আরম্ভ হল৷ কত মেয়ে সাজগোজ করে আরতি দেখতে এল৷ তার মধ্যে ও চুপ করে বসে বসে সকলের দিকে চেয়ে দেখলে৷ কত বৃদ্ধা এসে দোরের কাছে ওর পাশে বসল৷ রাত্রি বেশি হল৷ ও ভাবলে কোথায় যাবে এখন৷ কোনো জায়গা নেই যাবার৷ এত বড় বিশাল শহরে অসহায় তরুণী নারীর পক্ষে নিরাপদ স্থান কোথায় এই দেবমন্দির ছাড়া৷ সুতরাং সে বসেই রইল৷ বসে বসে মনে পড়ল বাবার কথা৷ গড়শিবপুরের জঙ্গল-ঘেরা বাড়িতে বাবাকে একা হয়তো এতক্ষণ হাত পুড়িয়ে রেঁধে খেতে হচ্ছে৷ আনাড়ি মানুষ, কোনো দিন জীবনে কুটোটা ভেঙে দুখানা করার অভ্যেস নেই, বেহালা বাজিয়ে আর গান গেয়েই নিশ্চিন্তে দিনগুলো কাটিয়ে এসেছেন বাবা—শরৎ তাঁর গায়ে আঁচটুকুও লাগতে দেয় নি৷ আজ সে থেকেও নেই৷ বাবার কি কষ্টই হচ্ছে! তার কথা মনে ভেবে বাবার কি শান্তি আছে?
শরতের চোখে জল এল৷ বাবার কথা মনে পড়লে মন হু-হু করে৷ সে কিছুতেই চুপ করতে পারে না, ইচ্ছে হয় সে এখুনি ছুটে চলে যায় সেই গড়শিবপুরের ভাঙা বাড়িতে, বড় কাঁঠালকাঠের পিঁড়িখানা বাবাকে পেতে দেয় রান্নাঘরের কোণে—একটা চটা-ওঠা কলাইকরা পেয়ালায় বাবাকে চা করে দিয়ে ছোট্ট খুকির মতো বাবার মুখের দিকে চেয়ে বসে বসে গল্প শোনে৷
মন্দিরের সামনে নাটমন্দিরে একজন সন্ন্যাসিনী ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছে—ওর নজরে পড়ল৷ তার চারিপাশ ঘিরে অনেক মেয়েছেলে জড়ো হয়ে কেউ হাত দেখাচ্ছে, কেউ ওষুধ নিচ্ছে, কেউ শুধু বা কথা শুনছে৷ শরৎ সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে এই দেবমন্দিরের পবিত্রতা অনুভব করতে চাইছিল—যে ঘরে সে আজ দুদিন কাটিয়ে এসেছে তার সমস্ত গ্লানি, অপবিত্রতা, পাপ—এই দেবায়তনের ধূপধুনার সৌরভে, শঙ্খঘন্টার ধ্বনিতে, সমবেত ভক্তমণ্ডলীর প্রাণের নিবিড় আগ্রহে যেন ধুয়ে যায়, মুছে যায়, শুভ্র হয়ে ওঠে, নির্মল হয়ে ওঠে৷ কালীঘাটের মন্দিরের সেবকদের লোভ যেখানে উগ্র, পূজার্থীদের অর্থ শোষণ করবার হীন আকাঙ্ক্ষা সব ছাপিয়ে যেখানে প্রবল হয়ে উঠেছে—পূজার মধ্যে ব্যবসা এসে ঢুকেছে, বৈষয়িকতা এসে ঢুকেছে—সে সব দিক পল্লীবাসিনী শরতের জানা নেই৷ তার মুগ্ধ মনের ভক্তি ওর চোখে যে অঞ্জন মাখিয়েছে, তার সাহায্যে প্রাচীন ভারতের সংস্কারপূত বাহান্ন পীঠের এক মহাপীঠস্থান জাগ্রত হয়ে উঠেছে ওর মনে, বুদ্ধদেবের সেই অমর বাণী ‘মনই জগৎকে সৃষ্টি করে’—শরতের মনে মহারুদ্রের চক্রছিন্ন দক্ষকন্যা সতীর দেহাংশ সতী নারীর তেজ ও পাতিব্রত্যের প্রতীক স্বরূপ এখানকার মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে৷ এই মাটি তার মনে তেজ ও বল দিক৷ সন্ন্যাসিনীর সামনে বসে সারারাত কাটিয়ে দিলে সে৷ কিছু কিছু কথাও হল সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে৷ সামান্য কিছু ফলমূল কিনে ক্ষুন্নিবৃত্তি করলে৷
সন্ন্যাসিনী বললে, বাড়ি কোথায় তোমার?
—গড়শিবপুরে৷
—এখানে কোথায় থাকো?
—কোথাও না মা৷ মন্দিরেই আছি এখন৷ আশ্রয় নেই কোথাও৷
—তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি বড়ঘরের মেয়ে৷ কে আছে তোমার? কি করে এখানে এলে মা? একটা কথা জিজ্ঞেস করি কিছু মনে কোরো না—মানে কেউ ভুলিয়ে নিয়ে এসেছিল?
কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গেই শরতের সরল, তেজোদৃপ্ত মুখের সুকুমার রেখার দিকে, তার ডাগর, কালো নিষ্পাপ চোখ দুটির দিকে চেয়ে সন্ন্যাসিনী এ প্রশ্ন করার জন্যে নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়ল৷
শরৎ মুখ নিচু করে বললে, না মা, ও সব নয়৷ তবে সব তো বোঝেন, মেয়েমানুষের অনেক শক্র—বিশেষ করে মা, যে সকলকে বিশ্বাস করে তার শত্রু এখন দেখছি চারিদিকেই৷ ভুলিয়েই এনেছিল বটে মা—তবে আমি ভুলে আসি নি, বুঝলেন মা?
—তোমার বয়েস কত মা?
—সাতাশ বছর৷
—কিন্তু তোমার রূপ এই বয়েসে যা আছে, তা কুড়ি বছরের যুবতীরও থাকে না— তোমার বড় বিপদ এই কলকাতা শহরে৷ আমার এখানে থাকো—কোথাও গেলে তোমার বিপদ ঘটতে দেরি হবে না মা৷
শরতের চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল৷ এই তো মা সতীরানী তাকে আশ্রয় দিয়েছেন৷ ঠাকুর-দেবতার মাহাত্ম্য কলিকালে তবে নাকি নেই? বাবা তো নাস্তিক, সন্দে-আহ্নিকটা পর্যন্ত করবেন না৷ সে কত বকুনির পর জোর করে আসন পেতে বাবাকে আহ্নিকে বসাত৷ বাবার কথা মনে পড়তে শরতের চোখের জল আর থামে না৷ বাবা কি আর সন্দে-আহ্নিক করছেন? উত্তর দেউলে এই সন্ধ্যায় বাদুড়নখীর জঙ্গল ঠেলে কে সন্দে-পিদিম দিচ্ছে আজকাল? কেউ না৷
বহুদূর থেকে সে দেখতে পায়, দেবীমূর্তির পায়ের চিহ্ন বনে-জঙ্গলে নির্দেশহীন কালো নিশীথ রাত্রে এখনও অমনি পড়ে যাচ্ছে, ভয়ে শিউরে উঠে কুটিরের ঘরে অর্গলবদ্ধ করবার জন্যে সে আর সেখানে নেই৷ রাজলক্ষ্মী? সে কি আছে—সে আর এখানে আসে না৷ কেনই বা আসবে?
শরৎ সেখানেই রইল সেদিনটা৷ সন্ধ্যার পরে অনেকগুলি মেয়ে আসে—রোজ শাস্ত্রকথা হয়৷ শরৎ বড় ভালোবাসে শাস্ত্রকথা শুনতে, একদিন নকুলেশ্বরের মন্দিরে কথকতা হল৷ আরও কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে সেখানে শরৎ গেল৷ কথকতার পর প্রসাদ বিতরণের পালা৷ সকলের সঙ্গে শরৎও শালপাতা পেতে বাতাসা, শসা, ছোলা ভিজে, ফলমূল নিয়ে এল৷ সন্ন্যাসিনী ব্রাহ্মণের মেয়ে—তিনি স্বপাক ভিন্ন খান না, নিজে রান্না করেন, শরৎকে শালপাতে ভাত বেড়ে দেন৷ সারাদিন খাওয়া হয় না—সন্ধ্যার পর রান্না চড়ে৷
তিন-চার দিন পরে একটি বড়লোকের গৃহিণী এলেন সন্ন্যাসিনীর কাছে৷ স্নানের ঘাটে যেতে শরৎকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন দুপুরে৷ বোধ হয় সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে তাঁর কিছু কথা হয়ে থাকবে শরতের সম্বন্ধে৷ বললেন—তোমাকে দেখে আমার বড় ভালো লেগেছে৷ তোমার নাম কি?
—শরৎসুন্দরী৷
—কতদিন সন্ন্যাসিনীর কাছে আছ?
—বেশি দিন না৷
—আমাদের সঙ্গে যাবে?
—কোথায় মা?
—আমরা বেরিয়েছি কাশী, গয়া করব বলে৷ মুখে বলতে নেই—এখন হবে কিনা তা জানি নে৷ ইচ্ছে তো আছে আমার বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে লক্ষ্ণৌ৷ সেখানে গিয়ে একবার মেয়ের সঙ্গে দেখা করব৷ আমি যাচ্ছি আর আমার দুই মেয়ে, ছোট ছেলে আর কর্তা৷ একটা লোক আমাদের দরকার৷ বয়েস হয়েছে—একা ভরসা করি নে সব ঝক্কি নিতে বিদেশে৷ তুমি চলো না কেন আমার সঙ্গে? মাইনে-টাইনে সব ঠিক করে দেব এখন—কোনো অসুবিধে হবে না৷ গৌরী-মা বলেছিলেন তোমার কথা৷ কথা কি জানো, যে সে মেয়ে নিতে ভরসা হয় না৷ স্বভাব-চরিত্তির কার কি রকম না জেনে বাপু নেওয়া তো যায় না৷ গৌরী-মা তোমার সম্বন্ধে বললেন—তখন আমার নিতে কোনো আপত্তি নেই৷
মহিলাটির প্রস্তাব ভালোই—তবুও শরৎ বলল, ভেবে দেখি মা—আপনাকে আমি বলব এখন সন্দেবেলা৷ গৌরী-মার কথকতা আপনি আসবেন তো শুনতে সন্দেবেলা?
তার পর মন্দিরে ফিরে এল ওরা স্নান সেরে৷
গিন্নি বললেন, আমি এখন যাচ্ছি মনোহরপুকুর রোডে আমার মেজ জামাইয়ের বাড়ি৷ নাতির অসুখ, তাকে গৌরী-মার কাছে নিয়ে এসে মাদুলি ধারণ করাবো৷ জামাই খ্রীষ্টান মানুষ, ওসব মানে না৷ মেয়েকে বলে রেখেছি জামাই আপিসে বেরুলে নাতিকে মোটরে নিয়ে আসব৷ যাবে আমার সঙ্গে?
শরতের যাবার কৌতূহল হল৷ ভাড়াটে গাড়ি করে ওরা অনেক রাস্তা গলি পার হয়ে একটা ছোট দোতলা বাড়ির সামনে এসে নামলে৷ শরৎ আশ্চর্য হয়ে ভাবলে, কলকাতার বড় লোক, দেখি ওদের বাড়ি-ঘর কি রকম—
প্রথমে এগারো বারো বছরের একটি মেয়ে নেমে এসে দোর খুলেই চেঁচিয়ে বলে উঠল—ও মা, কে এসেছে দ্যাখো—
একটি সুন্দরী মেয়ে ওপর থেকে নেমে এসে গিন্নির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, মা কবে এলে? কখন এলে? চিঠি তো লিখলে না আজ আসছো? এ কে মা?
ওকে নিয়ে এলাম৷ আমাদের সঙ্গে যাবে৷ গৌরী-মার কাছে এসেছে—সেখানে থাকে৷ পাড়াগাঁয়ে বাড়ি—কোন জায়গায় গো?
শরৎ বলল—যশোর জেলায় গড়শিবপুরে৷
মেয়েটি বলল, এসো ওপরে এসো৷
ওপরের ঘর বেশ চমৎকার সাজানো৷ শরৎ চেয়ে চেয়ে দেখলে৷ বড় বড় গদি-আঁটা চেয়ার, মেঝের উপর বড় বড় শতরঞ্জির মতো আসন পাতা৷ তার ওপর দিয়ে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে সবাই, তবে আসন পাতা কেন? এক কোণে একটি ছোট পাথরের মূর্তি, মেয়েটি বলল, তার শ্বশুরের চেহারা৷ বড় ডাক্তার ছিলেন, আজ ছ-বছর মারা গিয়েছেন৷ ফুলদানিতে বড় বড় রজনীগন্ধার ঝাড়৷ রান্নাঘরের মধ্যে কল, রান্না করতে করতে টিপলেই জল, ভারি সুবিধে৷ ছ-সাতটা বড় কাঠের আলমারি-ভর্তি মোটা বই৷ সেগুলো দেখিয়ে মেয়েটি বলল, শ্বশুর ডাক্তার ছিলেন বড়, নাম করতে পারি নে৷ তাঁর ডাক্তারি বই এগুলো—আরও সাত আলমারি বোঝাই বই আছে, নীচের ঘরে—শ্বশুরের শোবার ঘরে৷
মেয়েটি শরৎকে কিছু মিষ্টি ও ফল খেতে দিলে৷
তার পর গিন্নি মেয়ে ও নাতির সঙ্গে তাদের বড় মোটরে আবার এলেন কালীমন্দিরে৷ বেলা প্রায় তিনটে৷ শরৎ বলল, মা, আমি গঙ্গায় একটা ডুব দিয়ে আসি, বড্ড গরম—
আসল কথা গরম নয়৷ গঙ্গাহীন দেশের মেয়ে শরৎ, গঙ্গাকে কাছে পেয়ে সর্বদা ডুব দিয়ে পুণ্য সঞ্চয়ের লোভ দমন করতে পারে না৷ কিন্তু স্নান করে উঠে আসবার সময় শরৎ মহা বিপদের সামনে পড়ে গেল৷ স্নান করে উঠে কৃষ্ণকালী লেনের মুখে এসেছে, বাঁ দিকেই মনসাতলা ও কৃষ্ণকালীর মন্দিরে একবার দর্শন করে আসবে—হঠাৎ দেখলে তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে গিরীন, প্রভাস ও আরও দুটো অজানা লোক৷ তারা চারিদিকে কি যেন খুঁজছে৷
ওর সঙ্গে গিরীনের একেবারে চোখাচোখি হয়ে গেল৷ গিরীন আঙুল দিয়ে তার সঙ্গীদের ওর দিকে দেখিয়ে বলল—এই যে! তার পর সবাই মিলে এসে ওকে ঘিরে ধরল৷ গিরীন বলল, তার পর? রাগ করে ঝগড়া করে পালিয়ে এসে এখানে আছ? চলো বাড়ি চলো—
সঙ্গীদের দিকে চেয়ে বলল, কেমন বলেছি কি না যে ঠিক কালীঘাটে খুঁজলেই পাওয়া যাবে৷ আজীর গাড়োয়ান দেখ ঠিক সন্ধান দিয়েছিল৷ বাবা, এ সব ডিটেকটিভগিরি কি তোমাদের কম্মো?
প্রভাস বলল, চলো শরৎ দিদি, ফিরে চলো—রাগ কেন? আর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়?
ওদের কথাবার্তার সুরে এমন একটা সহজ ভাব নিয়ে এসে ফেলেছে যেন শরৎ ওদের বহুদিনের ন্যায্য অভিভাবকত্ব থেকে বঞ্চিত করে নিজের একগুঁয়েমি এবং বদমেজাজের দরুন নিজে চলে এসেছে৷ ওরা যথেষ্ট উদারতা দেখিয়ে আবার ফিরিয়ে নিতে এসেছে৷ গিরীন বলল, নাও হয়েছে, কোথায় বাসা নিয়েছ চল দেখি—জিনিষপত্র কিছু আছে-টাছে? প্রভাস একখানা গাড়ি ডেকে আনো—এসো—
শরৎ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, এতক্ষণে যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, আপনি আবার এসেছেন এখান পর্যন্ত? কেন এসেছেন, আমি আপনাদের সঙ্গে যাবই বা কেন? আপনাদের সাহস তো খুব৷
প্রভাসের দিকে চেয়ে বলল, আর প্রভাসদা, আপনাকে মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো জ্ঞান করতাম—তার সাজা খুব দিয়েছেন! এত খাবাপ হয় লোকে তা আমি বুঝি নি! বাবা কোথায়? বাবার খবর কিছু আছে?
গিরীন ওদের দিকে সাট করে চোখ টিপে বলল—আরে আছেই তো৷ তিনি তো কাল থেকে এসে আমাদের ওখানে প্রভাসদের বাড়ি বসে৷ সেই জন্যেই নিতে আসা—চলো৷
শরৎ বলল, মিথ্যে কথা৷ বাবা কখনো আসেন নি৷ হ্যাঁ প্রভাসদা সত্যি? বাবা এসেছেন সত্যি বলুন—
প্রভাস বলল, মিথ্যে বলে লাভ? এসো দেখবে চলো৷ গাড়ি আনি৷
—গাড়ি আনতে হবে না প্রভাসদা৷ বাবা কখনো আসেন নি৷ এলে আপনাদের সঙ্গে এখানে আসতেন৷
—আমাদের কথা বিশ্বাস হল না? যাবে কিনা তাই বলো?
কলকাতা শহরের রাস্তা—একটি তরুণী মেয়েকে ঘিরে তিন-চারজন লোককে কথা-কাটাকাটি করতে দেখে দু-একজন লোক জমতে শুরু করল৷ একজন ছোকরা এগিয়ে এসে বলল, কি হয়েছে মশাই?
গিরীন কুণ্ডু ঈষৎ সলজ্জ সুরে বলল, ও আমাদের ঘরোয়া ব্যাপার মশাই৷ আপনারা যান৷
আর একজন বলল, ইনি কে? কি বলছেন? আপনারা নিয়ে যেতে চাইছেন কোথায়?
প্রভাস বলল, উনি আমাদের লোক—
গিরীন বলল, মশাই আপনারা ভদ্দরলোক, চলে যান৷ আমাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে—সে-সব কথা শুনে আপনাদের লাভ কি? আমাদের মেয়েমানুষ ঝগড়া হয়ে রাগ করে চলে এসেছে, তাই নিয়ে যেতে এসেছি৷
কে একজন বাইরে থেকে বলে উঠল—ওহে চলে এসো না—ওসবের মধ্যে থাকবার দরকার নেই, ও বুঝতে পেরেছি৷ এসব জায়গায় ওরকম কত কাণ্ড নিত্যি ঘটছে—
শরৎ অবাক, স্তম্ভিত৷ এমন সহজ ভাবে এমন নির্লজ্জ মিথ্যে কথা কেউ যে বলতে পারে তা তার ধারণার বাইরে৷ সে এর প্রতিবাদ করতেও পারলে না৷ প্রকাশ্য রাজপথে অপরিচিত পুরুষ-বেষ্টিতা অবস্থায় কথা-কাটাকাটি করা, চিৎকার করে ঝগড়া করা তার ঘটে লেখা নেই, তার স্বভাবজ শোভনতা-বোধ মুখে যেন হাত চাপা দেয়৷ সে মরে যাবে তবুও পথে দাঁড়িয়ে ইতরের মতো ঝগড়া করতে পারবে না৷
লোকজন চলে যেতে শুরু করলে৷ শরৎ এগিয়ে যেতে চাইল, গিরীন কুণ্ডু এসে পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, নাও চলো—খুব ঢলান ঢলালে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, এতগুলো ভদ্দরলোক জুটিয়ে ফেললে চারিদিকে—এখন ফিরে চলো আমাদের সঙ্গে—রাগ অভিমান করে কি পালিয়ে এলে চলে চাঁদ?
গিরীন যেন রাস্তার লোককে শুনিয়ে শুনিয়ে এ কথাগুলো চেঁচিয়েই বলল৷
শরতের হঠাৎ বড় রাগ হল, গিরীনের মিথ্যা কথায়, ধূর্তামি ও শেষের কথার ইতর সম্বোধনে৷
সে বলল, আবার ওই কথা মুখে? আপনার সাধ্য নেই এখান থেকে আমায় নিয়ে যান! আমি এখানে চলে এলাম—এখানেও আপনারা এলেন? পথ ছেড়ে দিন বলছি—
শরৎ তখনই মনে ভেবে দেখলে ওই দল যদি তার সঙ্গে যায় বা যে মহিলাটির আশ্রয় সে পেয়েছে তারা যদি এখন এখানে এসে পড়ে, তবে এদের সাজানো মিথ্যে কথায় তাদের মনে সন্দেহ জাগবে এবং তারা তাকে কুচরিত্রা ভেবে তখনই পরিত্যাগ করে চলে যাবে৷ তা হলে সে একেবারে অসহায়—এই সব শুনলে গৌরী-মা কি তাকে জায়গা দেবেন আর?
যাক, যদি কেউ আশ্রয় না দেয়, গঙ্গা তো কেউ কেড়ে নেবে না?
গিরীন আবার বলল, দাঁড়াও এখানে গাড়ি ডাকি—মিছে রাগ করে কি হবে বলো!
সুর নীচু ও নরম করে বলল, চলো—কেন মিথ্যে পথে পথে ঘুরে কষ্ট পাও! এখানে আছ কোথায় বলো তো? খুব সুখে থাকবে৷ আমাদের সব ঠিক হয়ে গিয়েছে৷ প্রভাস মাসে পঞ্চাশ টাকা দেবে—আমি আর অরুণ পঞ্চাশ৷ আলাদা বাড়িভাড়া করে থাকতে চাও পাবে, হেনার বাড়িতেও থাকতে পার৷ নেকলেস আর চুড়ি সামনের হপ্তাতেই পাবে৷ ঘর সাজিয়ে দেব দুশো টাকা খরচ করে৷ কলের গান কিনে দেব৷ পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থাকবে, যা যখন হুকুম করো ইচ্ছামত—
শরৎ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, আবার ওই সব কথা? চলে যান আপনারা! আপনাদের দেখলেও পাপ হয়৷ আমি এই পথে বসে থাকব, মা কালী আমায় আশ্রয় দেবেন—
গিরীন জানত রাস্তার ওপর কোনো জোর করতে গেলেই লোক ছুটে হৈ-চৈ বাঁধিয়ে দেবে, পুলিস আসবে—সব পণ্ড হবে৷ মিষ্টি কথায় কাজ হাসিল হল না দেখে সে ভয় দেখাতে আরম্ভ করল৷ চোখ রাঙিয়ে বললে, সহজে না যাও—জানো আমি কি করতে পারি? আমার নাম গিরীন কুণ্ডু—থানায় এজাহার করব তুমি হেনা বিবির হার চুরি করে এনেছ! এক্ষুনি চালান দিয়ে দেব, জানো? হেনা সাক্ষী দেবে—আজ রাতেই হাজতে বাস করতে হবে৷ ও বাঙালির বাঙালগিরি কি করে ঘোচাতে হয়, সে আমি জানি—তুমি এখানে আছ কোথায় শুনি?
শরৎ বলল, বেশ তাই করুন৷ ভগবান জানেন আমি কোনো অপরাধ করি নি৷ এখনও চন্দ্র সূর্যি উঠছে—আমি জীবনে পরের কুটোগাছটাতে কখনো হাত দিই নি৷ তিনি কখনো আমায় মিছিমিছি শাস্তি—
হঠাৎ নিজের অসহায় অবস্থা কল্পনা করে এবং ভগবানের উপর নির্ভরতার অনুভূতিতে শরতের চোখে জল এসে পড়ল—সে কেঁদে ফেললো৷
ক্রন্দনরতা মেয়ে পথের ওপর, তখনই কৌতূহলী জনতা জমতে আরম্ভ করল আবার৷
একজন ষণ্ডা গোছের তোয়ালে-কাঁধে লোক এগিয়ে এসে বললে, কি হয়েছে? কে আপনি? উনি কাঁদছেন কেন মশাই?
ভিড়েরই একজন বলল, তা কি জানি? আপনার সঙ্গে কে আছেন মা, হয়েছে কি?
আর একজন বলল, আপনি কোথায় যাবেন? কি হয়েছে আপনার বলুন তো মা?
এরা গিরীনের দলকে ঠাওর করতে পারে নি—সুতরাং তাদের সঙ্গে জনতার কথা বিনিময় হল না৷ জনতার সুর ক্রমশ উত্তেজিত ও কৌতূহলী হয়ে উঠতে দেখে গিরীন বুঝলে এখানে কথা বলতে যাওয়া মানেই বিপদ টেনে আনা৷ এরা কোনো কথা শুনবে না, সকলেরই সহানুভূতি ক্রন্দনরতা নারীর দিকে৷ মার খেতে হবে বেশি কথা বললে৷ বাতাসের মোড় হঠাৎ এমন ভাবে ঘুরে যাবে, তা ওরা ভাবে নি৷
গিরীন কুণ্ডু আর যাই হোক, নির্বোধ নয়৷ বেগতিক বুঝে সে দলবল নিয়ে মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেল৷
শরৎ যখন নাটমন্দিরে ফিরে এল, তখন বেলা পাঁচটা৷
গৌরী-মা বললেন, এত দেরি হল যে মা? এসে একটু প্রসাদ খেয়ে নাও৷ ওরাই পুজো দিয়ে গেল৷ কাল যাবে তো ওদের সঙ্গে?
শরৎ ইতিমধ্যে পথে আসতেই ঠিক করে ফেলেছে সে ওদের সঙ্গে যাবে৷ এখানে থাকলে তার সমূহ বিপদ৷ আজ উদ্ধার পেয়েছে, কিন্তু যদি গিরীন তোড়জোড় করে আর একদিন আসে—আসবেই সে, তখন হয়তো জোর করেই নিয়ে যাবে৷ সন্ধ্যাবেলা গৌরী-মার কথকতা শুনতে গিন্নি এলেন, সব ঠিক হয়ে গেল—কাল বেলা তিনটার সময় শরৎ তৈরি থাকবে৷ কালই রওনা হতে হবে ওদের সঙ্গে৷
রাত্রিটা নিতান্ত ভয়ে ভয়ে কেটে গেল৷ সকালে উঠে শরৎ গৌরী-মার সঙ্গে গঙ্গাস্নান করে এল৷ তাও তার বুক ঢিপ ঢিপ করছিল, কোনো দিক থেকে ওরা এসে পড়ে নাকি! ভগবান কাল বড় বাঁচিয়ে দিয়েছেন! মানুষ এত খল হতে পারে, এমন নয়-কে-ছয় করতে পারে, হাসিমুখে নির্জলা মিথ্যে বলতে পারে—গ্রাম্য মেয়ে শরতের তা জানা ছিল না৷ বিশেষ করে সে যে বাপের মেয়ে! কেদারের মেয়ে তাঁরই মতো সরল৷
গৌরী-মা বললেন, নকুলেশ্বর তলায় গিয়ে একটু প্রসাদী বেলপাতা নিয়ে এসো৷ তোমার যাত্রার দিন, ওদের যাত্রার দিন৷ মায়ের ফুল বেলপাতা আমি মন্দির থেকে এনে দেব৷
যাবার সময় গৌরী-মার চোখে জল এল, বললেন—তিনদিনের মায়া, তাতেই তোমায় ছেড়ে দিতে মন কেমন করছে৷ আবার এসো, দেশে ফেরবার সময় এখান দিয়েই হয়ে যাবে সরলারা৷
শরৎ চোখের জলে ভেসে গৌরী-মার পায়ের ধুলো নিলে, বলল—অনেকদিন মাকে হারিয়েছি, আবার সেই মায়ের কথা আপনাকে দিয়ে মনে পড়ল৷ আশীর্বাদ করুন মা৷
.
হাওড়া স্টেশন৷ মস্তবড় জায়গা৷ লোকজন গমগম করছে৷ লম্বা লম্বা রেলগাড়ি ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াচ্ছে৷ আলোয় আলো চারিদিক৷ ঘরের মধ্যে এসে রেলগাড়ি দাঁড়ায় কেমন করে!
সে সত্যিই চলল তবে? কোথায় চলল?
বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে না৷ কোথায় পড়ে রইল তার আবাল্য-পরিচিত গড়শিবপুর! যেখানকার গড়ের জঙ্গলে, তাদের কালো পায়রার দিঘির জলে, চৈত্র মাসে তুলোওড়া বড় শিমুল গাছটার ছায়ায়, উত্তর দেউলের নির্জন পথে বাদুড়নখীর শুকনো খোলের ঝুমঝুমির শব্দে তার যে জীবনের শুরু সেই মাটিতেই—সেখানকার জ্যোৎস্নার মধ্যে, বর্ষার দিনের মেঘের ছায়ায় যে জীবন সুখে দুঃখে আপন পথ ধরে চলে এসেছিল এতদিন— সে জীবনের সঙ্গে আজ চিরদিনের মতো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল৷
শরৎ জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে দিল৷ চোখের জলে দ্রুত পলায়নপর টেলিগ্রাফের তারের খুঁটি, গাছপালা, ঘরবাড়ি সব ঝাপসা৷ কামরার মধ্যে শরৎ চেয়ে দেখলে অবাক হয়ে৷ কাদের সঙ্গে সে আজ দেশ ছেড়ে যাচ্ছে? কারা এরা? ওই মাটিতে ফর্সা রঙের গিন্নি, এই চৌদ্দ বছরের মেয়ে ওই তিন-চারটি ছোট বড় খুকি, কর্তা আছেন পুরুষগাড়িতে—এদের তো সে চেনে না!
বাবা গান গাইতেন—‘দিয়ে মায়াবেড়ি পথে ফেলেচ বিপদে৷’
কত যে তার সাধ ছিল দেশবিদেশে বেড়াতে৷ গড়শিবপুরের জঙ্গল ভালো লাগে না৷ রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে সে কত গল্প! আজ তো সে-সব সফল হতেই চলল—কিন্তু এ ভাবে সর্বস্ব ছেড়ে, বাবাকে ছেড়ে গড়শিবপুর জন্মের মতো ছেড়ে যেতে হবে, জন্মজন্মান্তরের গভীর চেতনা দিয়ে যে গড়শিবপুর তার মন আঁকড়ে ধরে ছিল, তা সে কি কোনোদিন ভাবত?
আর সে ফিরবে না৷ বাবাকে সে কলঙ্কের হাত থেকে—লোকের টিটকিরি থেকে মুক্ত রাখবে৷ তার ভাগ্যে পরের বাড়ির দাসী হয়ে চিরকাল বিদেশে নির্বাসন—যা ঘটে ঘটুক—বুড়ো বয়সে বাবার মুখ হাসাতে পারবে না৷ বাবা হয়তো দেশে গিয়ে বলেছেন, মেয়ে মরে গিয়েছে৷ খুব ভালো৷ আর সে দেখা দেবে না৷ দেশের কাছে মৃত হয়েই থাকবে যতদিন বাঁচবে সে৷ রাতের অন্ধকারে বাংলা মুছে গেল৷ কামরাটা ছোট—ধামা, লণ্ঠন, পেঁটরা, বিছানা, জলের কুঁজোতে একটা দিক ঠাসা, অন্য দিকে শরৎ গৃহিণীর জন্য বিছানা পেতে দিলে বেঞ্চিতে৷ তার স্বাভাবিক সেবা-প্রবৃত্তি এখানেও সজাগ আছে৷
গিন্নি বললেন, কোন ইস্টিশান রে মিনু?
তেরো-চোদ্দ বছরের মেয়েটি মুখ বাড়িয়ে বললে, ব্যান্ডেল জংশন—
—সব শুয়ে পড় তোরা৷ শরৎ ওদের বিছানা করে দাও—
মিনু তাড়াতাড়ি বলল, আমি বিছানা পেতে নিচ্ছি মা—আমার পাতাই আছে৷
শরৎ অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে চাইল৷ বাঃ, বেশ মেয়েটি৷ এতক্ষণ চুপ করে লাজুকের মতো আপনমনে বসে ছিল৷
পথে তার পর মেয়েটির সঙ্গে ওর বড় ভাব হয়ে গেল৷ ওর ভালো নাম মৃণাল, মৃদু স্বভাব, হৃদয়বতী৷ ও শরৎকে কি চোখে দেখে ফেলেছে, দিদি বলে ডাকে, লুকিয়ে হাতের কাজ কেড়ে নেয়৷
জামালপুরে বদল করে ওরা গেল প্রথমে মুঙ্গেরে৷ সেখানে গিন্নির ছোট ঠাকুরপো চাকরি করে৷ গঙ্গার ধারে বেশ ভালো বাসা৷ তিন দিন ধরে কাটাল সেখানে, শরৎ মিনুকে সঙ্গে নিয়ে কষ্টহারিণীর ঘাটে রোজ স্নান করে আসে৷ গৃহিণীর বাতের ধাত, তিনি বাথরুমে স্নান করেন৷
কষ্টহারিণীর ঘাটে প্রথমে যে দিন গিয়ে দাঁড়াল, শরতের মন অভিভূত হয়ে পড়ল—গঙ্গার রূপ দেখে৷ একদিকে জামালপুরের মাবক পাহাড়ের লম্বা টানা সুনীল রেখা, সামনে প্রশস্ত পুণ্যতোয়া জাহ্নবী, দু-একখানা পালতোলা নৌকা নদীবক্ষে, কত স্নানার্থীর যাতায়াত৷
পৃথিবীতে এমন সুন্দর জায়গাও আছে?
আবার চোখে জল আসে, শরৎ দেখে নি কখনো এসব৷
মিনু বললে, দিদি চেয়ে দ্যাখো—এই যে ভাঙা পাঁচিল না—এখানে মীরকাসিমের দুর্গ ছিল৷ ওই যে ফটক দিয়ে এলাম—দেখলে তো?
—তোর দিদি মুখ্যু মেয়ে, তোরা এ কালের ইস্কুলে পড়া মেয়ে—দিদিকে একটু শিখিয়ে নে৷ মীরকাসিমের দুর্গ বললে তো—কে ছিল সে?
—আহা দিদি, তুমি কিচ্ছু জান না৷ শোনো বলি—
তার পর মিনু বিজ্ঞভাবে স্কুলে সদ্য-অধীত ইতিহাসের বিদ্যা সবিস্তারে জাহির করে৷
শরৎ চোখ বড় বড় করে বলল—ও!
.
দিন বেশ কেটে যায়৷ একদিন সবাই মিলে চণ্ডীর মন্দিরে পুজো দিতে গেল, আর একদিন গেল সীতাকুণ্ড৷ মুঙ্গের থেকে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে গমের ক্ষেত, ছোলার ক্ষেতের পাশের পথ দিয়ে গিয়ে, কত ছোট বড় বস্তি ছাড়িয়ে কতখানি বেড়িয়ে এল সবাই মিলে৷
পাহাড় জিনিসটা শরতের কাছে একটা বিস্ময়ের বস্তু৷
প্রথম যেদিন মিনু ওকে দেখালে ওই দ্যাখো দিদি জামালপুরের পাহাড়—শরৎ অপলক চোখে চেয়ে রইল সেদিকে৷ তারপর ভালো করে দেখলে যেদিন মুঙ্গের থেকে ওরা বখতিয়ারপুর রওনা হল৷ কাজরা স্টেশনের কাছে এবং স্টেশন ছাড়িয়ে বাঁদিকে সে কি লম্বা উঁচু পাথরের পাহাড়, এত বড় বড় পাথর যে আবার হয়, তার এত বড় স্তূপ হয়—এ কথা কে আবার কবে ভেবেছিল?
কিউলের কাছাকাছি এসে দূরে কত নীল পাহাড়—শরৎ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে৷ দেখে মনে আনন্দ হয়, দুঃখও হয়—কেবলই মনে হয় বাবাকে এসব সে যদি আজ দেখাতে পারত৷
রেলে যেতে যেতে একটা চমৎকার জায়গা দেখেছে, মনের মধ্যে গেঁথে গেল জায়গাটা৷ কাজরা পাহাড়ের একটা কি সুবৃহৎ গাছের ছায়ায় অনেকটা যেন পাথরের সানবাঁধানো রোয়াক, চারিধারে শুধু পাহাড়, নিকটেই একটা ঝর্ণা ঝিরঝির করে পাহাড় থেকে বয়ে নেমে এসেছে৷ কি শান্তি পাহাড়ের ওপর সান-বাঁধানো রোয়াকের মতো পাথরটাতে! কি ছায়া!
ট্রেনের এককোণে সে বসে বসে ভাবে বাবাকে নিয়ে সে ওইখানে একটা ছোট ঘর বাঁধবে৷ মাঝে মাঝে গড়শিবপুর থেকে বাবা আর সে ওখানে এসে বাস করবে দু-মাস, তিনমাস৷ জ্যোৎস্নারাতে এদিকের সেই যে পাথরখানা, বাবা ওটার ওপর বসে বেহালা বাজাবেন, তাঁর সেই প্রিয় গান গাইবেন—
‘‘তারা কোন অপরাধে, এ দীর্ঘ মেয়াদে, সংসার গারদে থাকিব বল’’—
ভাবতে বেশ লাগে৷ যদিও সে জানে, এসব ভাবনা আকাশকুসুম, কোথায় বা বাবা, কোথায় কে? এত দূর দূর সব জায়গা আছে তা হলে? গড়শিবপুর থেকে, কলকাতা থেকে? সত্যি পৃথিবীটা কত বড়—না মিনু?
মিনু হেসে খিল খিল করে গড়িয়ে পড়ে বলল—দিদি, তুমি বড় ছেলেমানুষ! কিচ্ছু জানো না৷
—মুখ্যু যে তোর দিদি—তোরা আজকাল কত পড়িস বোন কত জানিস—
—দিদি, তোমাদের বাড়ির যে বড় গড়টা আর সেই ভাঙা কি কি পাথরের মূর্তি সেই বলেছিলে?
—বারাহী দেবীর মূর্তি৷
—সেই অন্ধকারে চলে বেড়ায় জঙ্গলের মধ্যে—না?
—হ্যাঁ ভাই মিনু৷
—সামনে যে পড়ে তাকে মেরে ফেলেন বুঝি?
—এই রকম সবাই বলে৷ গড়ের জঙ্গলে সেই তিথিতে কেউ যায় না প্রাণের ভয়ে৷
—সব দিন বুঝি নয়?
—তিথির দিনে৷
—আচ্ছা দিদি—কখনো এরকম হতে দেখেছ তুমি? তোমাদেরই তো গড়—
শরৎ গড়শিবপুরের জঙ্গল থেকে বহুদূরে থেকেও যেন ভয়ে শিউরে উঠে বললে—না দিদি, আমি কিছু দেখি নি চোখে৷ তবে পায়ের দাগ দেখেছে অনেকে—আমিও দেখেছি ছোটবেলায়—
—কিসের পায়ের দাগ?
—বারাহী দেবীর পাথরের পায়ের ছাপ—
—সত্যি?
—সত্যি ভাই মিনু? তোর গা ছুঁয়ে বলছি—
শরৎ যুবতী হলে কি হবে, ছেলেপুলে হয় নি, একা নির্জন গ্রাম্য সংসারে চিরদিন কাটিয়েছে, বালিকা-স্বভাব তার যায় নি৷ যায় নি বলেই সে বালিকাদের সঙ্গে নিজেকে যত মিশ খাওয়াতে পারে, বড়দের দলে তেমন পারে না৷ মিনুর সঙ্গে তাই মিলছিল ভালোই—যেমন গাঁয়ে থাকতে মিলেছিল রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে৷
বখতিয়ারপুর থেকে ওরা গেল রাজগীর৷ কর্তার শরীর ভালো নয়, গিন্নির বাতের ধাত—রাজগীরের উষ্ণ-কুণ্ডে স্নান করে বাত ভালো করতে চান৷ মিনু ও শরৎ বাসা থেকে বেরিয়ে রাজগীরের বৌদ্ধমঠ পার হয়ে বাজার ও উষ্ণ-কুণ্ডকে ডাইনে রেখে বেণুবন ও বৈভার পর্বতের ছায়ায় ছায়ায় সোন ভাণ্ডার গুহা পর্যন্ত বেরিয়ে আসে সরস্বতী নদীর ধারের পথ বেয়ে৷ ওদের ডাইনেই থাকে সেই গৃধ্রকূট পর্বত ও সেই সুপবিত্র বেণুবন, বুদ্ধদেব যেখানে শিষ্য আনন্দকে উপদেশ দিয়েছিলেন! হাজার বছর ধরে পার্বত্য সরস্বতী নদীর বাতাসে বুদ্ধদেবের পদচিহ্নপূত করণ্ড ও বেণুবন ধ্বনিত হয়, হাজার হাজার বছরের জ্যোৎস্নালোকে বৈভার পর্বতের শিখরদেশ উদ্ভাসিত হয়—ছেলেমানুষ মিনু ও অশিক্ষিতা গ্রাম্য মেয়ে শরৎ, লোকে তার কিছুই খবর রাখে না৷ তবুও মিনু তার স্কুলপাঠ্য ইতিহাসের জ্ঞানকে আশ্রয় করে বলল—এই যে রাজগীর দেখছ দিদি, এর নাম রাজগৃহ৷ মগধের রাজধানী ছিল রাজগৃহ—জরাসন্ধের নাম জানো তো দিদি? এখানে জরাসন্ধের রাজধানী ছিল—
মগধের খবর রাখে না শরৎ, কিন্তু কাশীরাম দাসের মহাভারত ও গ্রাম্য যাত্রার কল্যাণে জরাসন্ধের নাম তার অপরিচিত নয়৷
শরতের চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়৷ জরাসন্ধের রাজ্যে এসে গিয়েছে তারা—পুরাণের সেই জরাসন্ধ? কতদূরে এসে পড়েছে আজ…কত দূর বিদেশে?
এখানে প্রতিদিন ওরা উষ্ণ-কুণ্ডে স্নান করে, গিন্নিকে ধরে এনে রোজ স্নান করাতে হয়, শরৎ অত্যন্ত যত্নে নিয়ে আসে, অত্যন্ত যত্নে নিয়ে যায়৷ গিন্নি শরতের ওপর খুব সন্তুষ্ট—সেবাপরায়ণা শরৎ প্রাণ দিয়ে আশ্রয়দাত্রীর সেবা করে৷ সে সেবার মধ্যে এতটুকু ফাঁকি নেই৷
রাজগীর থাকতেই গিন্নির এক জা কোন জায়গা থেকে ছেলেপুলে নিয়ে ওদের ওখানে হাওয়া বদলাতে এলেন৷ ইনি নাকি বেশ বড়লোকের মেয়ে, স্বামী পশ্চিমের কোন শহরে ইনজিনিয়ার, মোটা পয়সা রোজগার করে৷ সঙ্গে দুটি ছেলেমেয়ে, একজন আয়া এসেছে৷ সর্বাঙ্গে সোনার গহনা—গুমোরে মাটিতে পা পড়ে না৷ দোহারা গড়ন, রং খুব ফর্সাও নয়, খুব কালো নয়৷ দাম্ভিক মুখশ্রী৷
প্রথম দিন থেকেই মিনুর কাকিমা শরতের ওপর ভালো ব্যবহার করত না৷ যেদিন গাড়ি থেকে নামল—সেই দিনই বিকেলে মিনু ও শরৎ রাজগীরের বাজার ছাড়িয়ে সরস্বতী নদীর ধারে বেড়িয়ে সন্ধ্যার কিছু আগে ফিরল৷ মিনুর কাকি অমনি শরৎকে বলে উঠল, ছেলে দুটোকে একটু কোথায় ধরবে, না কোথা থেকে এখন বেড়িয়ে ফিরল—বামনী, ও বামনী খোকাদের কাপড় ছাড়িয়ে গা-হাত ধুইয়ে দাও—
তার পর থেকে প্রত্যেক সময় সে শরৎকে ডাকে ‘বামনী’ বলে৷ শরৎ নিজের হাতেই দুবেলার রান্নার ভার নিয়েছিল৷ বাড়ির পাচিকাকে যে চোখে দেখা উচিত, মিনুর কাকি সেই চোখেই দেখত ওকে৷
একদিন মিনুকে ডেকে বলল, হ্যাঁরে, বামনীকে নিয়ে রোজ রোজ যাস কোথায়?
—কে? দিদি? দিদির সঙ্গে বেড়াতে যাই—
—দ্যাখ, তোকে বলে দিই মিনু! চাকর-বাকরের সঙ্গে বেশি মেশামেশি করা ভালো নয়৷ সেবার তো দেখি নি, ওকে কোথা থেকে আনলি?
—মা কলকাতা থেকে এনেছে এবার৷
—ক’টাকা মাইনে ঠিক হয়েছে জানিস?
—আমি জানি নে কাকিমা৷ তবে আমার মার যিনি গুরু-মা, কালীঘাটে থাকেন, তিনিই দিয়েছেন৷
যাকগে, ওদের সঙ্গে এত মেশামেশি ভালো নয় বাপু৷ ওদের নাই দিলেই মাথায় চড়ে বসবে, চাকর-বাকরকে কখনো নাই দিতে নেই৷ অমনি একদিন বলে বসবে দু-টাকা মাইনে বাড়িয়ে দাও—ওসব করিস নে৷
—উনি কিন্তু তেমন নয় কাকিমা—বড় ভালো, কি কথাবার্তা, ওঁদের দেশে মস্ত বড় বাড়ি ছিল, এখন পড়ে গিয়েছে—গড় ছিল বাড়িতে—কেমন দেখতে দেখছ তো? বড় বংশের মেয়ে—
মিনুর কাকিমা হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি! একটু সামলে নিয়ে বললে, তোকে এইসব গল্প করে বুঝি? কলকাতা থেকে এসেছে, ওই বয়েস—যাই হোক ওরা লোক ভালো হয় না৷ সে-সব তোর শোনার দরকারও নেই—মোট কথা তুই ছেলেমানুষ, ওর সঙ্গে অত মেলামেশা করো না—বারণ করলুম৷
তার পর থেকে মিনুর সত্যিই শরতের সঙ্গে বেড়ানো বন্ধ হয়ে গেল, কাকিমার হুকুমে৷
একদিন মিনুর কাকিমা শরৎকে ডেকে বললে, ওগো বামনী শোনো এদিকে৷ আগে কোথায় কাজ করতে?
শরৎ এই বৌটির পাশ কাটিয়ে চলত—এ পর্যন্ত সামনেই এসেছে কম, উত্তর দিলে—কাজ বলছেন? কাজ—কলকাতাতেই—
—কোথায় বলো তো? আমরা কলকাতার লোক৷ সব চিনি৷ কোথায় ছিলে?
—কালীঘাটে গৌরী-মার কাছে৷
—না না, আমি বলছি কাজ করতে কোথায়?
—কাজ করি নি কোথাও৷
—তবে যে খানিক আগে বললে কাজ করতে! বাড়ি কোথায় তোমার?
—যশোর জেলার গড়শিবপুর—
—আচ্ছা, তোমার নাম কি বলো৷ কি পোস্টাফিস তোমার গাঁয়ের, আমরা চিঠি লিখব৷ তোমাকে সেখানে কেউ চেনে কিনা দেখা দরকার৷ অজানা লোককে রাখা ঠিক নয় কিনা৷ তোমার কেউ আছে, সেই কি নাম বললে, সেই গাঁয়ের?
শরতের মুখ শুকিয়ে গেল৷ সে সত্য কথা বলে বিপদে পড়ে যাবে এমন তো ভাবে নি৷ কথা বানিয়ে বলা তার অভ্যাস নেই—তার বাবাও যেমন চিরকাল সোজা সরল কথা বলে এসেছেন, সেও তাই শিখেছে৷ এখন কি করা যায়, দেশে চিঠি লিখলে তো সব ফাঁস হয়ে যাবে৷
কিন্তু এর মধ্যে একটা সত্য বলবার ছিল৷ ডাকঘরের নাম তার জানা নেই৷ আগে ডাকঘর ছিল কুলবেড়ে৷ সে ডাকঘর উঠে গিয়েছে, বাবার কাছে সে শুনেছিল—তাদের কস্মিনকালে চিঠিপত্র আসে না, কেই-বা দেবে, ডাকঘর যে কোথায় হয়েছে৷
সে বললে—ডাকঘর কোথায় জানি নে—
—ওমা, সে কি কথা—ডাকঘর জানো না কোথায়—কে আছে তোমার?
—কেউ নেই মা—
কথাটা বলবার সময়ে শরতের গলা ধরে গেল, মিনুর কাকিমা সেটা লক্ষ্য করলে৷ গিন্নিকে গিয়ে বললে—দিদি লোক দেখে রাখতে হয়৷ বামনীর বাড়িঘর আজ জিজ্ঞেস করলুম, তা বলতে চায় না৷ আমি তো ভালো বুঝছি নে, ওকে তাড়াও—
গিন্নি বললেন, গৌরী-মা ওকে দিয়েছেন, তাঁর কাছে থাকত৷ ভালো মেয়ে বড্ড—কোনো বদচাল তো দেখি নি৷ ওর আর কেউ নেই, তখনি জানি৷ ওকে তাড়াতে পারব না৷
আট
মিনুর কাকিমার এ খুঁটিনাটি জেরার পরদিন থেকে শরৎ ভয়ে আর সামনে বেরুতে চায় না সহজে৷ সে জানত না, গিন্নির কাছে তার সম্বন্ধে লাগানোর কথা৷ কিন্তু আবার কোনোদিন বাপের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে হয়তো বসবে বৌটি—হয়তো যে আশ্রয়টুকু আছে, তাও যাবে৷ তার চেয়ে সামনে না যাওয়া নিরাপদ৷
কিন্তু শরৎ এড়িয়ে যেতে চাইলেও মিনুর কাকিমা অত সহজে শরৎকে রেহাই দিতে রাজি নয় দেখা গেল৷ শরৎকে সে পছন্দও করে না—অথচ পছন্দ না করার মধ্যেই শরৎ সম্বন্ধে ওর কেমন এক ধরনের উগ্র কৌতূহল৷
একদিন শরৎকে ডেকে বললে, ও বামনী—শোনো—
শরৎ কাছে গিয়ে বললে, কি বলছেন?
—তোমার হাতের রান্না বেশ ভালো৷ কোন জেলায় বাপের বাড়ি বললে সেদিন যেন—
শরতের মুখ শুকিয়ে গেল৷ এই বুঝি আবার—
সে বললে—যশোর জেলা৷
—যশোর জেলা৷ বাঙাল দেশের নিরিমিষ্যি রান্না বাপু তোমাদের ভালোই৷ তোমার বয়েস কত?
—সাতাশ বছর৷
—না, তার চেয়ে বয়েস বেশি৷ বত্রিশ-তেত্রিশের কম না৷ তোমাদের হিসেব থাকে না৷
শরৎ চুপ করে রইল৷ এর কোনো উত্তর নেই৷
—তোমার বিয়ে হয়েছিল কোথায়?
—আমাদের গাঁয়ের কাছেই৷
—কতদিন বিধবা হয়েছ?
এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে শরতের মনে বড় কষ্ট হয়৷ যা ভুলে গিয়েছে, যা চুকেবুকে গিয়েছে কতদিন আগে, সে-সব দিনের কথা, সে-সব পুরনো কাসুন্দি—এখন আর ঘেঁটে লাভ কি?
—তবু সে বললে, অনেকদিন আগে৷ আমার তখন আঠার বছর বয়েস৷
—সেই থেকে বুঝি কলকাতায়—মানে, চাকরি করছ?
—না, দেশেই ছিলাম৷
শরৎ খুব সতর্ক ও সাবধান হল৷ তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল৷
—কলকাতায় কতদিন আগে এসেছিলে?
—বেশিদিন না৷
—গাঁ থেকে কার সঙ্গে—মানে কলকাতায় আনলে কে?
শরতের জিব ক্রমশ শুকিয়ে আসছে৷ তার মুখে কথা আর যোগাচ্ছে না৷ কাঁহাতক বানিয়ে বানিয়ে কথা বলবে সে?
—কালীঘাট এসেছিলাম মা—গৌরী-মার কাছে সেই থেকে ছিলাম৷
সেদিন মিনু এসে পড়াতে তার কাকিমার জেরা বন্ধ হল৷ শরৎ মুক্তি পেয়ে সামনে থেকে সরে গেল৷
পরদিন বাসার সকলে মিলে উষ্ণকুণ্ডে স্নান করতে গেল৷ শরৎ ছেলেমেয়েদের সামলে নিয়ে পেছনে পেছনে চলল৷ মিনুর মা সেদিন যান নি৷ মিনুর কাকিমার সঙ্গে যে আয়া এসেছিল, সে যেন এখানে এসে ছুটি পেয়েছে—খাটুনি যত কিছু শরতের ঘাড়ে৷ কাকিমার দুটি ছেলেমেয়ে যেমন দুষ্ট তেমনি চঞ্চল—তাদের সামলাতে সামলাতে শরৎ হয়রান হয়ে পড়ে৷
মিনুর কাকিমা বলে, ও বামনী, ওই মিন্টুকে চার পয়সার গরম জিলিপি কিনে এনে দাও তো বাজার থেকে—
বাজারে সকলের সামনে দোকান থেকে জিনিস কেনা শরতের অভ্যেস নেই৷ চুপি চুপি মিনুকে বললে, মিনু দিদি, যাবি আমার সঙ্গে?
মিনু সব সময়েই তার দিদিকে সাহায্য করতে রাজি৷
বললে, চলো দিদি—
জিলিপি কিনে ফিরে আসতেই মিনুর কাকিমা বললে, চলো কুণ্ডীতে কাপড়গুলো নিয়ে—সাবানের বাক্স নেও৷ নেয়ে আসি—
মিনু পেছন থেকে এসে সাবানের বাক্স নিজেই নিয়ে চলল৷
স্নান শেষ হয়ে গেল৷ সিক্ত বসনে সবাই উঠে এসে মেয়েদের কাপড় ছাড়বার ঘেরা জায়গার মধ্যে ঢুকল৷ শরৎও স্নান করে এল৷ সে লক্ষ করল, মিনুর কাকিমা ওর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে৷ পশ্চিমের জলহাওয়ার গুণে হয়তো শরতের স্বাস্থ্য আরও কিছু ভালো হয়ে থাকবে, তার গৌর তনুর জলুস আরও খুলে থাকবে, সিক্তবসনা দীর্ঘদেহা সে তরুণীর মূর্তি এমন মহিমময়ী দেখাচ্ছিল যে রাস্তার কত লোক তার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল৷
মিনু অপলক চোখে চেয়ে চেয়ে ভাবলে—দিদি যে বলে তাদের রাজার বংশ, মিথ্যে নয় কথাটা৷ ওই তো কাকিমা অত সেজেগুজে এসেছেন, দিদির পাশে দাঁড়াতে পারেন না—
মিনুর কাকিমাও বোধ হয় শরতের অদ্ভুত রূপে কিছুক্ষণের জন্যে মুগ্ধ না হয়ে পারলে না—কারণ সেও খানিকটা শরতের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখলে৷
সঙ্গে সঙ্গে তার কেমন এক ধরনের ভাব হল মনে—সেই পুরাতন মনোভাব, সুন্দরী নারীর প্রতি সাধারণ নারীর ঈর্ষা৷
সে ধমকের সুরে বললে, একটু হাত চালিয়ে কাপড়টাপড়গুলো কেচে-টেচে নাও না বাপু, তোমার সব কাজেই ন্যাড়া-ব্যাড়া—
যেন শরতকে খাটো করে অপমান করে ওর নিজের মর্যাদা আভিজাত্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করলে৷
ফিরবার পথে মিনুর কাকিমা বললে, তুমি একটু আগে হেঁটে যাও বাপু, আমরা আস্তে আস্তে যাচ্ছি—তোমাকে আবার গিয়ে দিদির গরমজল চড়াতে হবে—কাপড়গুলো নিয়ে গিয়ে রোদে দাও গে—
বড় এক বোঝা ভিজে কাপড় শরতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কাকিমা মিনুকে ও নিজের ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে পিছিয়ে পড়ল৷ মিনু বলল, দিদিকে আজ চমৎকার দেখাচ্ছিল নেয়ে উঠে, না কাকিমা?
কেন মিনু হঠাৎ একথা বললে? মিনুর কাকিমাও বোধ হয় ওই ধরনের কোনো কথাই ভাবছিল৷ হঠাৎ যেন চমকে উঠে মিনুর দিকে চেয়ে রইল অল্প একটু সময়ের জন্যে৷ পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে, পরের ঘি-দুধ খেলে এমন সবারই হয় বাপু—তুই চল, নে—
বিকেলে আবার বৌটি ডাকলে শরতকে৷ বৌ নিজে স্টোভ ধরিয়ে চা করে এক পেয়ালা মুখে তুলে চুমুক দিচ্ছে, আর একটা ধূমায়মান পেয়ালা সামনে বসানো মেঝের ওপর৷ শরতকে বললে, ও বামনী, দিদিকে চা-টা দিয়ে এসো তো?
তার পরের কথাতে শরৎ বড় চমৎকৃত হয়ে গেল কিন্তু৷
বৌটি বললে, তোমার জন্যেও এক পেয়ালা আছে, ওটা দিদিকে দিয়ে এসো—এসে তুমি খাও—
শরৎ অগত্যা ফিরে এসে কলাই করা পেয়ালাটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে, বৌটি বললে, এখানে বসে খাও না গো, তাড়াতাড়ির কি আছে?
শরৎ বসে চা খেতে লাগল কিন্তু কোনো কথা বললে না৷
মিনুর কাকিমা আবার বললে, তোমাকে একটা কথা বলব ভাবছি৷ দিদির কাছ থেকে তোমায় যদি আমি নিয়ে যাই, তুমি মাইনে নেবে কত?
শরৎ আরও অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে—আমাকে?
—হ্যাঁ গো—তোমাকে৷ বলো না মাইনে কত নেবে?
—গিন্নিমা যেতে দেবেন না আমায়৷
মিনুর কাকিমা মুখ নেড়ে বললে, সে ভাবনা তোমার না আমার? আমি যদি বলেকয়ে নিতে পারি! মানে আর কিছু না, যেখানে থাকি খোট্টা বামুনে রাঁধে, বাঙালীর মুখে সে রান্না একেবারে অখাদ্য৷ আমার নিজের ওসব অভ্যেস নেই—হাঁড়িহেঁসেল কখনো করি নি, বাপের বাড়িতেও না, শ্বশুরবাড়িতে এসে তো নয়ই৷ তোমাদের বাঙাল দেশের রান্না ভালো—তাই বলছিলাম—বুঝলে?
শরতের মুখ চুন হয়ে গেল৷
এমন একটা আশ্রয় পেয়ে সে যে কোথাও যেতে রাজি নয়, এদের ছেড়ে মিনুকে ছেড়ে৷ কিন্তু সে এখনও পরের দয়ার পাত্রী, তার কোনো ইচ্ছে বা দয়া এসব স্থলে খাটবে না, সে ভালোই বোঝে৷
সে চুপ করে রইল৷
মিনুর কাকিমা ভুল বুঝে বললে, আচ্ছা তাই তবে ঠিক রইল৷ মাইনের কথা একটা কিন্তু ঠিক করে ফেলা ভালো—তা বলছি৷ তখন যে বলবে—
শরৎ মিনুকে নিরিবিলি পেয়ে বললে, মিনু বেড়াতে যাবি?
—চলো দিদি—কোন দিকে যাবে?
—সোন ভাণ্ডারের গুহার দিকে চল—
নদীর ধারে ধারে বনাবৃত পথ গৃধ্রকূট শৈলের ছায়ায় ছায়ায় সোন ভাণ্ডার ছাড়িয়ে রাজগীরের প্রাচীনতর অঞ্চলে জরাসন্ধের মল্লভূমির দিকে বিস্তৃত৷ ওরা সেই পথে চলল৷ কত পাথরের নুড়ি পড়ে আছে পাহাড়ের তলায়, নদীর পাড়ে৷ সমতলবাসিনী শরৎ এখনও এই সব রঙচঙে নুড়ির মোহ কাটিয়ে ওঠে নি, দেখতে পেলেই কুড়িয়ে আঁচলে সঞ্চয় করে৷
মিনু বললে, তুমি একটা পাগল দিদি! কি হবে ওসব?
—বেশ না এগুলো? দ্যাখ এটা কেমন—
—কি করবে?
—ইচ্ছে কি করে জানিস! ওসব দিয়ে ঘর সাজাই—কিন্তু ঘর কোথায়?
—জড়ো করেছ তো একরাশ৷—তাতেই সাজিও—
—জানিস মিনু, তোর কাকিমা কি বলেছে?
—কি দিদি?
—আমায় নিয়ে যেতে চায় ওদের বাড়ি৷
—তোমার যাওয়া হবে না, আমি মাকে টিপে দেব!
—আমি তোদের ফেলে কোথাও যেতে চাই নে মিনু৷ যখন আশ্রয় পেয়েছি, যতদিন বাঁচি এখানেই থাকব৷
.
কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতেই হল মিনুর কাকিমার সঙ্গে৷ মিনুর মা বললেন—যাও মা, ওরা কাশীতে যাচ্ছে, তোমার তীর্থ করা হবে এখন৷ আমি এর পরে তোমায় কাছে নিয়ে আসব৷
মিনুর কাকিমা সগর্বে অন্যান্য বোঁচকা, ট্রাঙ্ক, আয়া ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শরৎকেও নিয়ে গিয়ে কাশী নামল দিন-দশেক পরে৷ মাঝারি গোছের তেতলা বাড়ি, ছোট্ট সংসার, স্বামী-স্ত্রী আর এক দেওর৷ দেওর লাহোর মেডিকেল ইস্কুলে পড়ে, এবার পাশ দেবে৷ নীচে একঘর গরিব লোক থাকে ওদের ভাড়াটে৷
শরৎ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে নি, কিন্তু নতুন জায়গায় এসে তার এত খারাপ লাগছিল! একটা কথা বলবার লোকও নেই৷ মিনুর কাকিমা চাকর-বাকরকে আমল দেয় না, ছেলেমেয়েদেরও তার ভালো লাগে না৷ যেমন দুষ্ট, তেমনি একগুঁয়ে এগুলো৷ যা ধরবে তাই৷
একদিন মিনুর কাকিমা বললে—ও বামনী, এই ডালটুকু ওই নীচের তলার পটলের মাকে দিয়ে এসো—চেয়েছিল আমার কাছে, গরিব লোক—
শরৎ ডাল দিতে গিয়ে দেখল একটি বৌ রান্নাঘরে বসে ওর দিকে পিছন ফিরে রান্না করছে৷ ওর কথায় বৌটি ওর দিকে ফিরতেই শরৎ বললে, উনি ডাল পাঠিয়ে দিয়েছেন—রাখুন—
তার পরেই বৌয়ের চোখ দুটোর দিকে চেয়ে শরতের মনে কেমন খটকা লাগল৷
বৌটি হেসে বললে, তোমার গলা নতুন শুনছি৷ তুমি বুঝি ওদের এখানে নতুন ভর্তি হয়েছ? বলছিলেন কাল দিদি৷ বসো ভাই৷ আমি চোখে দেখতে পাইনে—বাটিটা রাখ এই সিঁড়ির কাছে৷
ও, তাই অমন চোখের চাউনি!
শরতের বুকের মধ্যে যেন কোথায় ধাক্কা লাগল৷
বৌটি আবার বললে, তোমার নাম কি ভাই? তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছে বয়েস বেশি নয়৷
—আমার নাম শরৎ৷ বয়েস আপনার চেয়ে বেশিই হবে বোধ হয়—
—না ভাই, আমার বয়েস কম নয়৷ তা আমাকে তুমি আপনি আজ্ঞে কোরো না৷ আমি একা থাকি এই ঘরে—উনি তো বাইরের কাজেই ঘোরেন৷ তুমি এসো, দুজনে গল্প করব৷
—বেশ ভাই৷ তাহলে তো বেঁচে যাই—
শরতের মনের মধ্যে কাশী আসবার কথা শুনে একটু আগ্রহ না হয়েছিল এমন নয়৷ মিনুর মার কাছে এজন্যে সে না আসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নি৷ কাশী গয়া কজন বেড়াতে পারে? তাদের গাঁয়ের নীলমণি চাটুজ্জের মা শরতের ছেলেবেলায় কাশীতে এসে তীর্থ করে যান—সে গল্প বুড়ির এখনো ফুরলো না৷ আর বছরও সে গল্প বুড়ির মুখে শরৎ শুনেছে৷ সেই কাশীতে যদি এখন যাওয়া হয়—হোক!
কাশী এসে কিন্তু মিনুর কাকিমার ফরমাশ আর হুকুমের চোটে এতটুকু সময় পায় না শরৎ৷ সকালে উঠে হেঁসেলের কাজ শুরু৷ একদফা ছোটদের দুধবার্লি, একদফা বড়দের চা খাবার, বাজল বেলা আটটা৷ তার পরে রান্নার পালা শুরু হল এবং খাওয়ানো-দাওয়ানোর কাজ মিটতে বেলা দেড়টা৷ ওবেলা তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে আবার চা-খাবারের পালা৷ সন্ধ্যার সময় বাবুর বন্ধুরা বৈঠকখানায় এসে বসে, রাত নটা পর্যন্ত বিশ পেয়ালা চা-ই হবে৷
দুপুরবেলায় কাজকর্ম চুকিয়ে ফাঁক পেলে শরৎ এসে বসে একতলায় অন্ধ বৌটির কাছে৷ শরৎ তার পরিচয় নিয়েছে—ওর নাম রেণুকা, ওর বাবা কাশীতেই স্কুল-মাস্টারি করতেন৷ মা নেই, ভাই নেই, আজ কয়েক বছর আগে ওর বিয়ে দিয়েই বাবা মারা যান৷ ওরা ব্রাহ্মণ, স্বামী সামান্য মাইনেতে কি একটা চাকরি করে৷ সন্ধ্যার সময় ভিন্ন বাড়ি আসতে পারে না—সারাদিন রেণুকাকে একা থাকতে হয় বাসাতে৷
শরৎ বলে, তুমি বাংলা দেশে যাও নি কখনো?
—না ভাই, এখানেই জন্ম, বিশ্বনাথের চরণ ছেড়ে আর কোথাও যাবার ইচ্ছা নেই৷
—দেশ ছিল কোথায় বাবার মুখে শোনো নি?
—হালিশহর বলদেঘাটা৷ এখনো আমার কাকারা সেখানে আছেন শুনেছি৷
দুজনে বসে সুখদুঃখের কথা বলে৷ রেণুকার অনেক কাজ শরৎ করে দেয়৷ বড় ভালো লাগে এই অন্ধ মেয়েটিকে৷ মন বড় সরল, অল্পেই সস্তুষ্ট, জীবন ওকে বেশি কিছু দেয় নি, যা দিয়েছে তাই নিয়েই খুশি আছে৷
রেণুকা বলে, একদিন আমার বাড়ি কিছু খাও ভাই—
—বেশ, আমি কি খাব না বলছি?
—রান্না তো খেতে পারবে না৷ নিরিমিষের হাঁড়ি নেই—সব একাকার৷ রান্না করে খাবে আলাদা?
—না ভাই, সে হাঙ্গামাতে দরকার নেই—তুমি ফল খাইও বরং—
রেণুকার স্বামী ছানা ফলমূল মিষ্টি কিনে রেখে গিয়েছিল৷ একদিন বিকেলে রেকাবি সাজিয়ে রেণুকা ওকে খেতে দিলে৷ চোখে দেখতে পায় না বটে—কিন্তু কাজকর্ম সবই করে হাতড়ে হাতড়ে৷
শরৎ একদিন মিনুর কাকিমাকে বলেকয়ে বিশ্বনাথ দর্শনের ছুটি নিলে৷ ওদের আয়া সঙ্গে গেল মন্দিরের পথ দেখানোর জন্য৷ শরৎ রেণুকাকে হাত ধরে নিয়ে গেল৷
বিশ্বনাথের গলির মধ্যে কি লোকের ভিড়! কত বৌ-ঝি, কত লোকজন! শরৎ অবাক হয়ে চেয়ে দেখলে, তার কাছে সব কিছু নতুন, সবই আশ্চর্য৷ মন্দির থেকে বার হয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে বসলো বিকেলবেলা৷ নিত্য উৎসব লেগেই আছে সেখানে৷ নৌকো আর বজরাতে কত লোক সাজগোজ করে বেড়াতে বেরিয়েছে৷
রেণুকা বললে, আমি এসব জায়গা দেখেছি ছেলেবেলায়৷ চৌদ্দ বছর বয়েস থেকে অসুখে চোখ হারিয়েছি৷ এখনো সেইরকম আছে, কানে শুনে বুঝতে পারি৷
—ভারি ভালো জায়গা ভাই৷ কলকাতা শহর দেখে ভালো লেগেছিল বটে—কিন্তু সেখানে শান্তি পাই নি এমন৷ এখানে মন জুড়িয়ে গেল৷
—একদিন গঙ্গায় নাইতে এসো—
—সময় পাই নে, আসি কখন? কাল একবার বলব—
শরৎ আর রেণুকা একটু তফাৎ হয়ে বসে৷ চারিদিকের জন-কোলাহল ও সম্মুখে পুণ্যতোয়া জাহ্নবীর দিকে চেয়ে শরতের নতুন চোখ ফোটে৷ সত্যই সে বড় শান্তি পেয়েছে মনে৷
আয়া বললে, একদিন তোমাকে কেদার ঘাটে নিয়ে যাব—
শরৎ চমকে উঠে বললে, কি ঘাট?
—কেদার ঘাট৷ ওই দিকে—আমার সঙ্গে যেয়ো—
শরতের মন স্বপ্নঘোরে একমুহূর্তে কোন পথে চলে গেল পাহাড় পর্বত বনবনানীর ব্যবধান ঘুচিয়ে৷ গরিব বাবা কত কষ্টে চাল যোগাড় করে, নুন তেল যোগাড় করে এনে বলতেন ভালো করে রাঁধো, বাবা যে ছেলেমানুষের মতো, ঘরে কিছু নেই, তা বুঝবেন না—ভালো খাওয়াটি হওয়া চাই—নইলে অবুঝের মতো রাগ করবেন, অভিমান করবেন৷ এতটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারেন না বাবা৷ কোথায় গেলেন বাবা! জানবার জন্যে বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে, তিনি এখন কোথায় কি ভাবে আছেন! এমন জায়গা কাশী, সেই কতকাল আগের গল্প শোনা বিশ্বনাথের মন্দির, দশাশ্বমেধ ঘাট সব দেখা হল—কিন্তু মনের মধ্যে সব সময় একথা আসে কেন, বাবা যে এসব কিছু দেখলেন না, বাবা বুড়ো হয়েছেন, তাঁর এখন তীর্থধর্ম করবার সময়, অথচ বাবার অদৃষ্টে জুটল না কিছু! তিনি গোয়ালপাড়া বাগদিপাড়ায় বেহালা বাজিয়ে, গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন, ফিরে এসে অবেলায় হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাচ্ছেন কিম্বা তাও খাচ্ছেন না, কে তাঁকে দেখছে, কে মুখের দিকে চাইবার আছে তাঁর!
কাশী গয়া সব তুচ্ছ—কিছু ভালো লাগে না৷
শরৎ বলে, আচ্ছা রেণুকা, কাশীতে দুজন লোকের কত হলে চলে?
রেণুকা ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে, তা কুড়ি টাকার কম তো কোনো মাস যেতে দেখলাম না৷ আমরা তো দুটো মানুষ থাকি৷ কেন ভাই?
শরৎ কি ভেবে কি কথা বলছে সে নিজেই জানে না৷ রেণুকা ভাবে, শরৎ হঠাৎ কিরকম অন্যমনস্ক হয়ে গেল, না কি—আর ভালো করে কথা বলছে না কেন?
বাড়ি ফিরে মিনুর কাকিমার ফাইফরমাশ ও হুকুমের মধ্যে রান্নাঘরে রাঁধতে বসে সে ভাবে তার কোন জীবনটা সত্যি, গড়শিবপুরের ভাঙা গড়বাড়ির বনের সেই জীবন, না পরের বাড়ির হাঁড়ি-হেঁসেলের এ জীবন?