১২. এরিসেডের আয়না

এরিসেডের আয়না

বড়দিন আসছে। ডিসেম্বর ৩০,সর মাঝামাঝি কোন এক সকালে দেখা গেল যে সমগ্র হোগার্টস কয়েক ফুট বরফে ঢেকে গেছে। হ্রদের পানিও জমে বরফ হয়ে গেছে। বরফের টুকরো নিয়ে জাদু করার জন্য উইলি পরিবারের যমজ দুভাইয়ের শাস্তি হয়েছে। তারা বরফের বল তৈরি করে কুইরেলের পেছনে লাগায় এবং বলটা কুইরেলের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে তার পাগড়িতে লেগে ফিরে আসে। এই শীত উপেক্ষা করে চিঠি বিলি করার জন্য যেসব পেঁচা আসত সেগুলোকে সেবা করে সুস্থ করার দায়িত্ব হ্যাগ্রিডের ওপর।

সবাই ছুটির জন্য অধীর হয়ে গেছে। গ্রিফিল্ডর হাউজের কমন রুম ও গ্রেট হল গরম রাখার ব্যবস্থা থাকলেও করিডোর ছিল কনকনে ঠাণ্ডা। শীতল হাওয়ায় জানালায় প্রচণ্ড ঝটপটানি শোনা যায়।

সবচে খারাপ হলো অধ্যাপক স্নেইপের মাটির তলায় বন্দিশালায় ক্লাস–সেখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। আর ছাত্ররা চেষ্টা করত গরম কলড্রনের কাছাকাছি বসতে।

ওষুধ তৈরির এক ক্লাসে হঠাৎ করে ম্যালফয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল আমার তাদের জন্য দুঃখ হচ্ছে যাদেরকে বড়দিনের সময় হোগার্টসে কাটাতে হবে, কারণ তাদের নিজ বাড়িতে ঠাঁই নেই।

ম্যালফয় হ্যারির দিকে তাকিয়ে এই কথা বলল। ঐেব ও গয়েল টিটকারি দিল। হ্যারি তখন ওষুধ প্রস্তুত করছিল। সে ম্যালফয়ের কথায় গা করল না।

কিডিচ খেলায় গ্রিফিল্ডর হাউজের কাছে শিদারিন হাউজের পরাজয়ের পর হ্যারির ওপর তার ক্রোধ বহুগুণ বেড়ে গেছে।

ম্যালফয়ের এইসব শ্রেষপূর্ণ কথাবার্তায় আর কেউ যোগ দেয়নি। কিডিচ খেলায় গ্রিফিল্ডর হাউজের বিজয়ে হ্যারির বিশেষ ভূমিকা থাকায় হ্যারি এখন হোগার্টসে খুব জনপ্রিয়। হ্যারিকে কাবু করতে না পেরে ম্যালফয় এবার বলল–হ্যারির নিজস্ব কোন পরিবার নেই।

বড়দিনের ছুটিতে হ্যারি প্রিভেট ড্রাইভে যাবে না। বড়দিনের এক সপ্তাহ আগে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল এসে তালিকা তৈরি করলেন–কারা বাড়িতে যাবে, আর কারা হোগার্টসে থাকবে। বড়দিনে হোগার্টসে থাকতে হবে বলে হ্যারির কোন দুঃখ ছিল না। কারণ এবারের বড়দিনটা হ্যারির খুব আনন্দে কাটবে। রন ও ফ্রেডও হোগার্টসে থাকবে কারণ চার্লিকে দেখার জন্য তার বাবা–মা বড়দিনের ছুটিতে রুমানিয়া যাবেন।

ক্লাস শেষ করে তারা যখন বাইরে বেরুল তখন দেখল, একটি ফারগাছ তাদের গতিরোধ করছে। গাছের পেছন থেকে একটি শব্দ শোনা গেল। ওরা অবাক, কি হতে পারে, না, গাছের পেছনে হ্যাগ্রিড দাঁড়িয়ে আছেন।

গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে রন চিৎকার করে উঠল–হ্যাগ্রিড! কোন সাহায্য করতে হবে?

কোন সাহায্যের দরকার নেই। আমি ঠিকই আছি। হ্যাগ্রিড বললেন।

আপনি কি পথ ছাড়বেন? পেছন থেকে ম্যালফয়ের কণ্ঠ শোনা গেল। উইসলি, তুমি কি কিছু অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতে চাইছ। ভবিষ্যতে তুমিও কি গেমকীপার হতে চাও না–কি? তোমাদের বাড়ির তুলনায় হ্যাগ্রিডের কুঁড়ে ঘর নিশ্চয়ই একটি প্রাসাদ।

রন ম্যালফয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠিক সেই সময় স্নেইপ এসে হাজির। তিনি রনকে জিজ্ঞেস করলেন–কী ব্যাপার, কী হয়েছে? রন ম্যালফয়কে ছেড়ে দিল।

গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে হ্যাগ্রিড বললেন–প্রফেসর, ম্যালফয় রনকে খামোখা খেপিয়েছে। সে রনের পরিবার সম্পর্কে যা–তা বলেছে।

তা-হোক। মারামারি করা হোগার্টসের নিয়মের বাইরে, হ্যাগ্রিড। অধ্যাপক স্নেইপ বললেন–উইসলি, গ্রিফিল্ডর হাউজ থেকে পাঁচ পয়েন্ট কাটা গেল। তোমার ভাগ্য ভালো, তোমাকে বেশি কঠিন শাস্তি দেয়া হয়নি। তোমরা সবাই যেখানে যাচ্ছিলে যাও।

ম্যালফয়, ক্রেব ও গয়েল গাছটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে যত্রতত্র গাছের কাটা ফেলে দুষ্টামির হাসি হেসে চলে গেল।

ম্যালফয়ের পেছন থেকে রন দাঁত কিড়মিড় করে বলল আমি তাকে একহাত দেখে নেব। একবার না একবার তো সুযোগ পাব।

ম্যালফয় আর স্নেইপ, আমি দুজনকেই ঘৃণা করি। হ্যারি বলল।

হ্যাগ্রিড বললেন-এসব বাদ দাও। বড়দিন আসছে। চল আমরা গ্রেট হলে আনন্দ করি।

হ্যারি, রন, হারমিওন, হ্যাগ্রিড ও তার গাছ অনুসরণ করল। তারা গ্রেট হলে প্রবেশ করে দেখল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ও ফ্লিটউইক বড়দিনের সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত।

হ্যাগ্রিড, সবশেষে গাছটা এনেছ তুমি, এই গাছটা কোনায় শেষের দিকে রাখবে একটু।

গ্রেট হল খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের ফেস্টুন লাগানো হয়েছে। কমপক্ষে বারোটা ক্রিসমাস গাছ ঘরের ভেতর রাখা হয়েছে।

ছুটির আর কদিন বাকি? হ্যাগ্রিড জানতে চাইলেন।

মাত্র একদিন। হারমিওন জবাব দিল। আর এই কথার সাথে, আমার মনে পড়ে যাচ্ছে–মধ্যাহ্নভোজের আর মাত্র আধঘণ্টা বাকি আছে। হ্যারি ও রন, চলো এই সময়টুকু লাইব্রেরিতে কাটাই।

অধ্যাপক ফ্লিটউইক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রন বলল–হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। ফ্লিটউইক সে সময় তার জাদুদণ্ড দিয়ে সোনালী বুদবুদ তৈরি করে সেগুলো নতুন গাছের ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন।

আবার লাইব্রেরি কেন? হ্যাগ্রিড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ছুটির আগে লাইব্রেরি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে লেখাপড়ায় তোমরা খুবই মনোযোগী।

লেখাপড়া করার জন্য আমরা লাইব্রেরিতে যাচ্ছি না। হ্যারি জবাব দিল।

আপনার মুখে নিকোলাস ফ্লামেলের নাম শুনেছি। আমরা তার সম্পর্কে আরো জানতে চাই।

কী জানতে চাও? বিরক্ত কণ্ঠে হ্যাগ্রিড বললেন–আমার কথা শোন। আমি তো আগেই বলেছি এ চিন্তাটা মাথা থেকে নামাও। কুকুর কী পাহারা দিচ্ছে। এ নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই।

নিকোলাস ফ্লামেল লোকটা কে–শুধু এটাই জানতে চাই। এর বাইরে অন্য কিছু জানার আগ্রহ আমাদের নেই। হারমিওন বলল। আপনি একটু সাহায্য করলে আমরা খাটনি থেকে মুক্তি পেতে পারি। হ্যারি বলল আমরা এ পর্যন্ত শতাধিক বই পড়েছি। কিন্তু নিকোলাস ফ্লামেল সম্পর্কে কিছুই পাইনি। তবে, আমার মনে হয় কোথায় যেন তার নাম শুনেছি।

আমি এ ব্যাপারে তোমাদের কিছু বলব না। হ্যাগ্রিডের স্পষ্ট জবাব।

ঠিক আছে, আমরা নিজেরাই খুঁজে বের করব। রন বলল। বিরক্ত হয়ে তারা সবাই দ্রুত হাগ্রিডের কাছ থেকে বিদায় নিল।

লাইব্রেরিতে তারা নানা ধরনের বই খুঁজল। জাদুর ওপর সেখানে যে কটা বই ছিল সব তারা তন্ন তন্ন করে দেখল। কোথাও নিকোলাস ফ্লামেলের নাম পাওয়া গেল না। কিন্তু ফ্লামেল সম্পর্কে জানতে না পারা গেলে অধ্যাপক স্নোইপ কী চুরি করতে চেয়েছিলেন জানা যাবে না।

হারমিওন লাইব্রেরির ক্যাটালগ দেখতে লাগল। রন লাইব্রেরির বই দেখছিল আর হ্যারি চলে গেল নিয়ন্ত্রিত বইয়ের কোনায়। এখানকার বই ইস্যু করতে হলে কোন একজন শিক্ষকের লিখিত অনুমতি নিতে হবে। কালো জাদুর ওপর নিয়ন্ত্রিত কিছু বই ছিল যা হোগাৰ্টসে কখনও পড়ানো হতো না। কালো জাদুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বিষয় নিয়ে যে সমস্ত সিনিয়র ছাত্র লেখাপড়া করত কেবল তাদেরকেই এ সমস্তু বই পড়তে দেয়া হত।

তোমরা কী খুঁজছ?

কিছুই না। হ্যারি জবাব দিল।

লাইব্রেরিয়ান মাদাম পিনস–তার ধূলা ঝাড়ার পালক তাদের দিকে ভাক করে বললেন–তাহলে তোমরা এখন বাইরে যাও।

হ্যারি লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে এলো। সে, বন ও হারমিওন একমত হয়েছিল যে তারা মাদাম পিসকে ফ্লামেল সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। তিনি নিশ্চয়ই ফ্লামেল সম্পর্কে বলতে পারবেন। তবে তারা কী খুঁজছে এটা স্নেইপ জানুন সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

হ্যারি কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করে দেখে রন ও হারমিওন কোন ক্লু পেয়েছে কিনা। তবে হ্যারি তেমন আশাবাদীও ছিল না। গত পনেরো দিন ধরে তারা ফ্লামেল সম্পর্কে জানার এত চেষ্টা করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। তারা চাচ্ছিল মাদাম পিনসের অনুপস্থিতিতে লাইব্রেরিতে এটা ভালভাবে খুঁজবে।

পাঁচ মিনিট পর রন আর হারমিওন হ্যারির কাছে এলো। তারা নানা রকম চিন্তাভাবনা করে মধ্যাহ্নভোজে গেল। আমি না থাকলেও তোমরা খুঁজে দেখ। হারমিওন বলল–যদি কিছু পাও আমার কাছে একটি পাচা পাঠিয়ে দিও।

তুমি তোমার বাবা–মাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো নিকোলাস ফ্লামেল কে? রন হারমিওনের উদ্দেশ্যে বলল। তাদেরকে জিজ্ঞেস করাটাই নিরাপদ হবে।

তুমি ঠিকই বলেছ, কারণ তারা দুজনেই দন্তচিকিৎসক। হারমিওন বলল।

বড়দিনের ছুটি শুরু হলে হ্যারি আর রনের সময় খুব ভালো কাটতে লাগল। ফ্লামেল সম্পর্কে ভাবার জন্য তারা অফুরন্ত সময় হাতে পেল। ঊর্মিটরি এখন তাদের দখলে। কমনরুম আগের তুলনায় অনেক ফাঁকা। ছুটিতে সবাই বাড়ি গেছে। তারা ইচ্ছেমত ভালো ভালো আরাম কেদারা নিয়ে আগুনের পাশে বসে। তারা ইচ্ছেমত খেতেও পারে।

বন এখন হ্যারিকে জাদুর দাবা শেখাচ্ছে। খেলাটা অনেকটা মাগলদের দাবা খেলার মত। তফাৎ হলো-এখানে রাজা, মন্ত্রী, হাতী, ঘোড়া, নৌকা সবই জীবন্ত।

বড়দিনের আগের রাতে শোবার সময় হ্যারি ভাবছিল, এবার বড় দিনে অনেক মজা হবে, তবে তার জন্য কোন উপহার আসবে না। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে অবাক। বিছানায় পায়ের সামনে একগাদা প্যাকেট।

শুভ বড়দিন ঘুম জড়ানো কণ্ঠে রন হ্যারিকে অভিনন্দন জানাল। হ্যারি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে তার ড্রেসিং গাউন পরে নিল।

তোমাকেও শুভ বড়দিন। হ্যারি বললো–দেখ, আমি একটা উপহার পেয়েছি।

নিজের উপহারগুলোর দিকে তাকিয়ে রন বলল–হ্যারি তুমি কি শালগম আশা করেছিলে?

রনের অনেক উপহার।

হ্যারি তার উপহার খুলল। বাদামী কাগজে প্যাকেটটা মোড়ানো। মোড়ক খোলার পর দেখা গেল ওপরে সুন্দর করে লেখা আছে–হ্যারির জন্য, ইতি হ্যাগ্রিড। প্যাকেটটার ভেতর ছিল একটা কাঠের বাঁশি। হ্যারি বাঁশিটা বাজাল। পেঁচার ধ্বনির মত শব্দ শোনা গেল। দ্বিতীয় প্যাকেটটা ছিল খুবই ছোট। প্যাকেটের ভেতর ছিল টাকা আর একটা চিঠি।

চিঠিতে লেখা আছে–আমরা তোমার বার্তা পেয়েছি। এখানে তোমার বড়দিনের উপহার। আঙ্কল ভার্নন ও আন্ট পেতুনিয়ার উপহারের সাথে সেলো টেপ দিয়ে লাগানো ছিল ৫০ পেনসের একটা নোট।

উপহারের মধ্যে আন্তরিকতা আছে। হ্যারি বলল। হ্যারি ৫০ পেনসের নোট পাওয়াতে রন খুব অভিভূত হলো।

আশ্চর্য। রন মন্তব্য করল-একেবারে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে।

তুমি এটা রাখতে পারো। রনের উল্লাস দেখে হ্যারি রনকে বলল।

হ্যাগ্রিড এবং আমার আঙ্কল ও আন্ট এই দুটো পাঠিয়েছেন।

আর এই প্যাকেটটা?

প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে রন বলল–আমার মনে হয় আমি বলতে পারব-এটা কোত্থেকে এসেছে। আমার মা পাঠিয়েছেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে হ্যারিকে বড়দিনে কেউ উপহার পাঠাবে না। তাই তিনি তোমার জন্য একটা পশমীর সোয়েটার পাঠিয়েছেন।

হ্যারি প্যাকেটটা খুলে দেখল–ভেতরে হাতে বোনা একটি সোয়েটার। নিজের প্যাকেট খুলতে খুলতে রন বলল–আমার মা প্রতিবছর আমাদের সোয়েটার বানান। আমারটির রঙ হবে অবশ্যই মেরুন।

তিনি সত্যিই খুব ভালো মানুষ। হ্যারি বলল।

পরবর্তী প্যাকেটে ছিল হারমিওনের পাঠানো মিষ্টি ও চকোলেট ফ্রগ।

উপহারের আরেকটা প্যাকেট খোলা বাকি। ওজনে খুবই হালকা। হ্যারি খুলে দেখে ভেতরে একটা অদৃশ্য হওয়ার পোশাক। হ্যারি পোশাকটা পরল। রন বলল–দেখ পোশাক থেকে একটা চিরকুট নিচে পড়ে গেছে। হ্যারি চিরকুটটা কুড়িয়ে নিল। চিরকুটে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা আছে

মৃত্যুর আগে তোমার বাবা আমাকে এটা দিয়ে গিয়েছিলেন।
এখন সময় হয়েছে এটা তোমাকে ফেরত দেয়ার।
এটার সঠিক ব্যবহার কর।
শুভ বড়দিন।

চিঠিতে কারো স্বাক্ষর ছিল না। রন পোশাকের প্রশংসা করে হ্যারিকে চিন্তিত দেখে প্রশ্ন করল–হ্যারি, কি ব্যাপার, কি হয়েছে?

না কিছু না। হ্যারি বলল। তারপর চিন্তা করতে লাগল কে তাকে এ পোশাকটা পাঠিয়েছে। তার বাবাই কি এ পোশাকটার মালিক ছিলেন?

হ্যারি যখন চিঠির রহস্য উদঘাটনের কথা চিন্তা করছিল ঠিক তখনি দরোজা খুলে গেল।

ফ্রেড ও জর্জ ওয়েসলি ভেতরে প্রবেশ করেছে। হ্যারি পোশাকটা সাথে সাথে লুকিয়ে ফেলল। সে তার অনুভূতি কারো সাথে ভাগ করে নিতে চায় না।

শুভ বড়দিন।

তাকিয়ে দেখ হ্যারি একটা উইসলি জাম্পার পেয়েছে।

ফ্রেড আর জর্জ জাম্পার পরা ছিল। একটাতে হলদে রঙে বড় করে এফ লেখা ছিল অপরটাতে হলদে রঙে বড় করে জি লেখা ছিল।

হ্যারির জাম্পার হাতে নিয়ে ফ্রেন্ড বলল–আমাদের উপহারের তুলনায় তোমার উপহার সবচেয়ে ভাল। যেহেতু তুমি আমাদের পরিবারের সদস্য নও, সেহেতু মা তোমার জন্য আরও বেশি পরিশ্রম করে সুন্দর করে বানিয়েছে।

তুমি কেন তোমারটা পরছ না রন? জর্জ জানতে চাইল ও বলল এটা পর, কি সুন্দর এবং উষ্ণ।

মেরুন রঙ আমার পছন্দ নয়, মা প্রতিবছর এই রঙের সোয়েটার আমার জন্য বুনেন। জাম্পার খুলতে খুলতে রন বলল।

তোমারটাতে কোন অক্ষর নেই। জর্জ বলল–তার ধারণা তুমি তোমার নাম ভুলে যেতে পার না। আমরা বুদ্ধ নই। আমরা জানি আমাদেরকে ফ্লেভ এবং জর্জ বলা হয়।

কী ব্যাপার, এত হইচই কিসের? পার্সি উইসলি বিরক্ত স্বরে দরজায় মুখ বাড়িয়ে বললো। তারও উপহারের প্যাকেট খোলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। তার হাতেও একটা জাম্পার। ফ্রেন্ড তার জাম্পারটা কেড়ে নিল।

প্রিফেক্ট লিখতে পি। পার্সি এদিকে এসো। আমরা সবাই আমাদের জাম্পার পরেছি। হ্যারিও একটা পরেছে।

না, আমি পরব না। পার্সি বলল।

উইসলি যমজ দুভাই পার্সিকে চশমা পরা অবস্থায় জাম্পার পরাতে গেল। তার চশমাটা বাঁকা হয়ে গেল।

আজ তো তুমি প্রিফেক্টদের সাথে বসছ না। জর্জ বলল–বড়দিনের অনুষ্ঠান তো একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান।

***

হ্যারি তার জীবনে বড়দিনের কোন ভোজে যোগ দেয়নি। একশটি তরতাজা টার্কির রোস্ট, অফুরন্ত সেদ্ধ আলু, মাখন দেয়া মটরশুটি এবং সুস্বাদু সস। একটু পর পরই বিকট আওয়াজে বোমা ফুটছে।

এই অদ্ভুত আতশবাজির সাথে মাগলদের আতশবাজির কোন তুলনা হয় না। ডার্সলি প্লাস্টিকের খেলনা এবং পাতলা কাগজের হ্যাটের সাথে সেসব আতশবাজি ক্রয় করে থাকেন। ফ্রেডের সাথে হ্যারি জাদুকরের আতশবাজি ফোটালো। এটা শুধু শব্দ করেনি, কামানের মতো বিকট আওয়াজ করেছে। কালো ধোঁয়া তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। আর ভেতর থেকে বিস্ফোরিত হলো একটা রিয়ার এ্যাডমিরালের হ্যাট ও কয়েকটা প্রাণী, সাদা ইঁদুর। উঁচু টেবিল ডাবলডোর তার হ্যাটটা ফুলের তোড়ার ওপর রেখে ফ্লিটউইকের সাথে আনন্দ কৌতুক করছেন।

ভোজনের পর এলো পুডিং। পার্সি তার দাঁত খোয়াতে বসেছিল প্রায়। হ্যারি লক্ষ্য করে দেখল–মদ চাইতে চাইতে হ্যাগ্রিডের চেহারা ক্রমশ লাল হচ্ছে। হ্যারি অবাক হয়ে দেখল হ্যাগ্রিড অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের চিবুকে চুমো খাচ্ছেন। ম্যাকগোনাগল লজ্জায় লাল হয়ে হাসলেন। তার হ্যাটটা তেরচা হয়ে গেছে।

হ্যারি যখন সবশেষে টেবিল ত্যাগ করল তখন তার ওপর এক বোঝার ভার। অদাহ্য তারাবাতি, বেলুন ও টুকটাক জিনিস। তার জাদুর নিজস্ব দাবার সেট। সাদা ইঁদুর অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং হ্যারির মনে এক বাজে চিন্তা এল যেন তাদের দশা হবে মিসেস নরিসের বড়দিনের ভোজের মত।

হ্যারি আর উইসলি যমজ দুই ভাই মাঠে বরফ নিয়ে খেলা করে একটি সুন্দর বিকেল কাটাল। ঠাণ্ডা, ভিজে অবস্থায় হাঁপাতে হাঁপাতে তারা তিনজন শরীরকে গরম করার জন্য গ্রিফিল্ডর হাউজের কমন রুমে ফিরে এলো। হ্যারি দাবা খেলায় রনের কাছে গো–হারা হারল। হ্যারির ধারণা–পার্সি যদি রনকে এত সাহায্য না করত তাহলে খেলার ফলাফল এরূপ হতো না।

তারপর চায়ের সাথে এলো টার্কি স্যান্ডউইচ, বড়দিনের কেক ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এটাই ছিল হ্যারির জীবনে সর্বোত্তম বড়দিন পালন। বিছানায় শুয়ে সে পাশ থেকে অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা বের করার চেষ্টা করল। এটা তার বাবা ব্যবহার করেছেন। রেশমের চেয়ে কোমল। এত হালকা যে বাতাসে ওড়ে। চিরকুটে লেখা ছিল-এটার সঠিক ব্যবহার কর।

এই পোশাকটার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। তাকে এখন পোশাকটা পরতে হবে। পোশাকটা পরে সে বিছানা থেকে নামল। তার পায়ের সামনে জ্যোৎস্না খেলা করছে।

পোশাকটা পরার পর হ্যারির সমস্ত সত্তা নতুন করে জেগে উঠল। সম্পূর্ণ হোগার্টস তার সামনে উপস্থিত হলো। অন্ধকার আর নীরবতায় দাঁড়িয়ে নিজেকে মহানায়ক ভাবতে হ্যারির খুব ভালো লাগছিল। এ পোশাক পরে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সে যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারে। কেয়ারটেকার ফিলচও কিছুই জানতে পারবেন না।

রন ঘুমিয়েছিল। হ্যারি ভাবছিল তাকে জাগাবে কিনা। পরে সে ভাবল রনকে জাগানো ঠিক হবে না। তার বাবার পোশাকের সাথে কাউকে সঙ্গী করা ঠিক হবে না। সে ঠিক করল একাই পোশাকটা ব্যবহার করবে।

সে ডর্মিটরি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল। কমনরুম দিয়ে বেরিয়ে দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

ওখানে কে? মোটা মহিলাটি প্রশ্ন করল–হ্যারি কোন জবাব দিল না। সে তাড়াতাড়ি করিডোর পেরিয়ে নিচে নামল।

সে কোথায় যাবে? সে দাঁড়াল। তার বুক কাঁপছে। এখন সে সেই স্থানটিতেই আসল–লাইব্রেরির নিয়ন্ত্রিত অংশ। হ্যারি এবার জানতে পারবে, পড়তে পারবে ফ্লামেল কে ছিলেন। অদৃশ্য হওয়ার পোশাক পরে সে হাঁটতে লাগল।

লাইব্রেরির ভেতরে ছিল ভুতুড়ে অন্ধকার। হ্যারি একটা প্রদীপ জ্বাললো।

নিয়ন্ত্রিত শাখাটা ছিল লাইব্রেরির ঠিক পেছনের ডানদিকে। দড়ির ওপর দিয়ে হ্যারি সতর্কভাবে হাঁটতে লাগল। দড়িটা বইগুলোকে মূল লাইব্রেরি থেকে পৃথক করে রেখেছিল। হ্যারির খুব একটা লাভ হলো না। বইয়ের মুছে যাওয়া, মলিন হয়ে যাওয়া স্বর্ণাক্ষরের লেখা হ্যারি বুঝতে পারেনি কারণ সেগুলো ছিল ভিন্ন ভাষায়। কোনও কোনও বইয়ে নামও ছিল না। একটা বই দেখে হ্যারি শিউরে উঠল। মনে হয় রক্তমাখা। হয়ত তার মনের ভুল। কে যেন ফিসফিস করছে। হয়ত বা শোনার ভুল। হঠাৎ নিচের রকে একটা মোটা বই নজরে পড়ল। কালো চামড়ায় রূপালী লেখা। বেশ ভারী। কোলের ওপর নিয়ে হ্যারি বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগল।

আরে একি। বইটা যেন আর্তনাদ করছে। অস্ফুট চাপা আর্তনাদ। ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াতেই তার প্রদীপটা পড়ে গেল। চারদিক আবার অন্ধকার। আরও ভয় পেয়ে গেল হ্যারি। কার যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

দৌড়ে পালাতে গিয়ে হ্যারি দেখল অধ্যাপক স্নেইপ ও কেয়ারটেকার ফিল। তারা অবশ্য হ্যারিকে দেখতে পাননি। পথটা ছিল খুবই সরু। সে পথে গেলে এঁদের দুজনের সাথে ধাক্কা লাগবেই। পোশাক তাকে অদৃশ্য করতে পারলেও তার শারীরিক অবয়বকে অদৃশ্য করতে পারবে না।

হ্যারি দৌড় শুরু করল।

হ্যারি হাঁপাতে হাঁপাতে মালখানায় এসে পৌঁছল।

এতক্ষণ পালাবার সময় তার খেয়ালই ছিল না, সে কোন দিকে যাচ্ছে। চারদিক অন্ধকার থাকায় সে এটাও ঠাহর করতে পারেনি যে, সে এখন কোথায় আছে।

শুনতে পেল, প্রফেসর, আপনার কাছে সরাসরি চলে আসার জন্য আমাকে বলেছিলেন। যাতে রাতে কেউ লাইব্রেরিতে আসে কিনা সেটা দেখা যায়। মনে হয় লাইব্রেরির নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কেউ না কেউ আছে।

হ্যারির মনে হলো তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। সে যেখানেই যাবে ফিলচ তা জানতে পারবে। তার কণ্ঠস্বর খুব কাছ থেকেই শোনা যাচ্ছে। ভীত হ্যারি শুনতে পেল যে অধ্যাপক স্নেইপ কথার জবাব দিচ্ছেন।

নিয়ন্ত্রিত এলাকা? এটা তো খুব দূরে নয়। যেই আসুক তাকে আমরা ধরতে পারব।

হ্যারি দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। অধ্যাপক স্নেইপ ও কেয়ারটেকার ফিলচ তার সামনে দিয়ে গেলেও তাকে দেখতে পেল না। আহ্, খুব বাঁচা গেছে। হ্যারি মনে মনে ভাবল।

হ্যারি একটু এগোতেই তার সামনে একটা দরোজা খুলে গেল। দরোজা দিয়ে সে ভেতরে চলে ঢুকলো। অধ্যাপক স্নেইপ ও ফিলচের দৃষ্টি এড়িয়ে হ্যারি একটি কক্ষের ভেতর প্রবেশ করল। আরো একটু আগে বেড়ে যে কক্ষে প্রবেশ করল। দেখে মনে হলো সেটা একটা পরিত্যক্ত ক্লাসরুম!

ডেস্ক আর চেয়ারগুলো দেয়ালের পাশে স্তূপ করে রাখা। ওয়েস্ট পেপারের বাস্কেটগুলো উলটিয়ে রাখা হয়েছে। এরপর হ্যারি যে জিনিসটার ওপর দৃষ্টি দিল সেটা ক্লাসরুমের অংশ মনে হলো না। মনে হলো বাইরে থেকে কেউ এনে এখানে বসিয়ে দিয়েছে।

সিলিংয়ের সমান উঁচু একটি আয়না। সোনার ফ্রেমে বাঁধা। আয়নার চারদিকে খোদাই করে লেখা-এরিসেড স্ত্রা এহরু অয়েত উবে কাফ্রু অয়েত অন ওহসি।

এতক্ষণে হ্যারির ভয় কেটে গেছে। ফিলচ আর স্নেইপেরও কোন সাড়াশব্দ নেই। নিজেকে দেখার জন্য হ্যারি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কোন প্রতিবিম্ব দেখতে পেল না। সে আরও কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

ভয়ে চিৎকার বন্ধ করার জন্য হ্যারি নিজের মুখে হাত হাত চেপে ধরলো। সে যখন আয়নার দিকে তাকাল তখন সে শুধু নিজেকেই দেখল না দেখল বিশাল জনতা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ হ্যারি যে কক্ষে দাঁড়িয়েছিল সে কক্ষটি ছিল সম্পূর্ণ খালি। দ্রুত নিশ্বাস নিতে নিতে হ্যারি আবার আয়নায় তাকাল।

হ্যারি আয়নায় অন্তত আরো দশটি মানুষের প্রতিবিম্ব দেখল। সে ঘাড় নাড়িয়ে এদিক–সেদিক তাকাল। না কেউই তো নেই। তাহলে আয়নায় যাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে তারা কি সবাই অদৃশ্য।

হ্যারি আবার আয়নায় তাকাল। আয়নায় দেখা গেল একজন মহিলা ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। হ্যারি ভাবল-এই মহিলা যদি সত্যিই সত্যিই তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে তার হাতের ছোঁয়া হ্যারি তার ঘাড়ে অনুভব করবে না, তেমন কিছু ঘটল না। তাহলে তাদের অস্তিত্ব কি কেবলই আয়নার মধ্যেই।

মহিলাটি খুবই সুন্দরী। তার ঘন লাল চুল। তার চোখ দুটি হ্যারির চোখের মত। চেহারাও অনেকটা হ্যারির মতো। হ্যারি আয়নাতে দেখল

মহিলা চিৎকার করছেন আবার হাসছেন আবার কাঁদছেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন পুরুষ, ভদ্রলোকের চোখে চশমা। তিনি তার বাহু দিয়ে মহিলাকে জড়িয়ে ধরলেন। লোকের চুল ছিল একটু এলোমেলো। হ্যারি আয়নার এত কাছে এলো যে, তার নাক আয়না স্পর্শ করল।

মা হ্যারি অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল।

একটু পর আবার উচ্চারণ করল–বাবা।

তাঁরা দুজনেই স্মিতহাস্যে হ্যারির দিকে তাকালেন। হ্যারি আয়নায় অন্য এক মানুষের প্রতিবিম্বও দেখল। তাকে ভাল করে লক্ষ্য করে হ্যারি, তার মত গাঢ় সবুজ দুই চোখ, তার মত নাক, খাটো বৃদ্ধ মানুষটার হাঁটু হ্যারির মতো। হ্যারি এই প্রথমবারের মতো তার পরিবারকে দেখতে পেল।

হ্যারির বাবা–মা স্মিতহাসিতে তার দিকে তাকালেন এবং হাত নেড়ে হ্যারিকে অভিনন্দন জানালেন। হ্যারি ক্ষুধার্ত মানুষের মতো আয়নার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু বাবা–মার সাথে করমর্দন করা গেল না। চরম আনন্দ আর প্রচণ্ড ক্ষোভ হ্যারিকে একাকার করে ফেলল।

হ্যারি এখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তা সে বলতে পারবে না। একটা আচ্ছন্নতা তাকে ঘিরে ছিল। দীর্ঘসময় তার ঘোরের ভেতর কাটল। দূর থেকে শোরগোল শুনে হ্যারির চেতনা ফিরে এলো।

এখানে তো আর বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়। তাকে ডর্মিটরিতে ফিরে যেতে হবে। ইচ্ছে না হলেও এখান থেকে তাকে বেরুতে হবে। মায়ের চেহারা থেকে হ্যারি তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল। অস্ফুট কণ্ঠে হ্যারি বলল–আমি আবার আসব। এই বলে হ্যারি সেখান থেকে বিদায় নিল।

*****

তুমি তো আমাকে জাগাতে পারতে। অনুযোগের স্বরে রন হ্যারিকে বলল।

তুমি আজ রাতে যেতে পারো। আমি আজও যাব। আমি তোমাকে সেই আয়নাটা দেখাতে চাই।

আমি তোমার বাবা–মাকে দেখতে চাই। রন আগ্রহের স্বরে বলল।

আর আমি তোমার পরিবারের সবাইকে দেখতে চাই। উইলি পরিবারের সবাইকে। তুমি আমাকে তোমার অন্যান্য ভাই ও তোমার পরিবারের সবাইকে দেখাবে। হ্যারি বলল।

তুমি যখনই খুশি তাদের দেখতে পারো। রন বলল–তুমি এই গ্রীষ্মকালে আমার সাথে আমার বাড়িতে এসো। সত্যি লজ্জাজনক যে আমরা ফ্লামেলের বিষয়টা ভুলেই গেছি। জানতে পারিনি। আরো কিছু খাবার মাও। একি, তুমি খাচ্ছ না কেন?

আসলে হ্যারি খেতে পারছিল না। তার বাবা–মার চেহারা বার বার তার চোখে ভাসছে। সে ফ্লামেলের কথা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছিল। কারণ এখন ফ্লামেল তার কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিন মাথা কুকুরও এখন তার ভাবনার বিষয় নয়। আর অধ্যাপক স্নেইপ যদি কোন কিছু চুরি করেই থাকেন তাতে হ্যারির কী আসে যায়।

তুমি ঠিক আছ তো? রন তাকে জিজ্ঞেস করে। তোমাকে খুব অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।

***

হ্যারি মনে মনে ভয় পাচ্ছিল–আরেকবার গিয়ে যদি আয়নাটি না পাওয়া যায়।

রন আর হ্যারি অদৃশ্য হওয়ার পোশাক পরে তাদের অভিযানে বেরুল। লাইব্রেরি থেকে বেশ ধীরে ধীরে তারা এগুতে থাকল। তারা আগের পথ ধরেই অন্ধকারে প্রায় আধঘণ্টা কাটাল।

আমি বরফে জমে যাচ্ছি। রন বলল।

কোন কথা বলবে না। হ্যারি বলল–আমি জানি এটা এখানে কোথাও হবে।

উল্টোদিক থেকে আসা একটা ডাইনি পেত্নীকে তারা অতিক্রম করল। এছাড়া তারা কোন লোকজন দেখতে পেল না। হ্যারি অস্ত্রভাণ্ডার ঘরটা শনাক্ত করে বলল-এটা এখানে।

দরোজা ধাক্কা দিয়ে তারা দুজনে ভেতরে ঢুকলো। ঘাড় থেকে অদৃশ্য হবার পোশাকটা নামিয়ে হ্যারি আয়নার দিকে তাকাল।

তারা দুজনেই আয়নার সামনে দাঁড়াল। হ্যারির বাবা–মা উৎফুল্ল হলেন।

তাকিয়ে দেখ। নিচু হয়ে হ্যারি রনকে বলল।

রন জবাব দিল–আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

ভালো করে দেখ। এখানে সবাই আছে। হ্যারি বলল।

আমি তো কেবল তোমাকে দেখছি। রন বলল।

ভালো করে দেখ। আমি যেখানে আছি সেখানে এসে দাঁড়াও।

হ্যারি সরে দাঁড়াল।

রন আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালে সে নিজেকে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।

রন হতবুদ্ধি হয়ে তার নিজের ছায়ামূর্তি দেখছিল। হ্যারি বলল আমার দিকে তাকাও।

তুমি দেখতে পাচ্ছ তোমাদের পরিবারের সবাই তোমার চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে।

না, আমি কিছুই দেখছি না। এখানে আমি একা। আমাকে একটু বুড়ো বুড়ো দেখাচ্ছে। আমি এখন হেডবয়।

তুমি কি বললে?

বিল যে ধরনের ব্যাজ পরে আমি এখন সে ধরনের ব্যাজ পরে আছি। আমার হাতে হাউজক্যাপ আর কিডিচ ক্যাপ। আমি কিডিচ খেলায় অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছি।

এই চমৎকার দৃশ্য থেকে রন তার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল। তারপর উত্তেজিতভাবে সে হ্যারিকে বলল–তুমি কি মনে কর এই আয়না ভবিষ্যৎ বলতে পারে?

আয়না কী করে বলবে। হ্যারি জবাব দিল–

হ্যারি নিজে আয়না দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সে রনকে বলল,

আমার পরিবারের কেউ তো আর বেঁচে নেই। আমাকে আরেকবার আয়নাটি দেখতে দাও।

গত রাতে তো তুমি একাই দেখেছ। আজ তুমি আমাকে একটু বেশি সময় দাও।

তুমি তো কিডিচ কাপ হাতে ধরে নিজেকে দেখেছে। এর মধ্যে মজাটা কি? আর আমি আমার বাবা–মাকে দেখতে চাই। হ্যারি বলল।

আমাকে সরিয়ে দিও না।

বাইরের করিডোরে একটি শব্দ শুনে কথা বলা বন্ধ করলো ওরা। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি যে তারা বেশ জোরেই কথা বলছিল।

তাড়াতাড়ি পালাও।

ওরা অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা দিয়ে নিজেদের ঢেকে ফেলো। মিসেস মরিসের জ্বলজ্বলে চোখ তখন দরোজার ওপর। হ্যারি আর রন দুজনেই দাঁড়িয়ে ভাবছিল-এই অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা কি বিড়ালের ওপরও কাজ করে। তাদের মনে হলো তারা এখানে এক যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস নরিস ঘুরে দাঁড়ালেন এবং ঘর ত্যাগ করলেন।

এটা মোটেও নিরাপদ নয়। তিনি ফিলচকে বলতে পারেন, আমি বাজি ধরে বলতে পারি তিনি আমাদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছেন। এসো। রন হাত ধরে হ্যারিকে ঘরের বাইরে নিয়ে এল।

***

পরদিন সকালে তখনও বরফ ভালোভাবে গলেনি।

হ্যারি, দাবা খেলবে নাকি? রন জিজ্ঞেস করে।

না। হ্যারি বলে।

তাহলে চল হ্যাগ্রিডকে দেখে আসি। রন আবার বলল।

না, যাব না। তুমি যাও।

আমি জানি তুমি কি চিন্তা করছ। হ্যারি, আজ রাতে আর ওখানে যেও না। রন বলল।

কেন যাব না? হ্যারি প্রশ্ন করে।

রন বলল–আমি ঠিক বলতে পারবো না, কিন্তু আমি সামনে বিপদ আশঙ্কা করছি। তুমি কয়েকবারই অল্পের জন্য বেঁচে গেছ। কেয়ারটেকার ফিলচ, অধ্যাপক স্নেইপ আর মিসেস নরিস সবাই তোমার ওপর নজর রাখছেন। তারা তোমাকে দেখতে না পেলেও তোমার আশেপাশেই ছিলেন। যদি হঠাৎ তারা তোমাকে দেখে ফেলেন।

তুমি দেখি হারমিওনের মত কথা বলছ। হ্যারি হেসে বলে।

হ্যারি, আমি তোমার ভালোর জন্যই কথাটা বলছি। আজ তুমি ওখানে যেওনা।

আয়নার কাছে যাবার জন্য হ্যারি অস্থির হয়ে পড়ল। রন তাকে ফেরাতে পারল না। তৃতীয় রাতে হ্যারি আরো তাড়াতাড়ি তার গন্তব্যে পৌঁছল। সে দ্রুতগতিতে দৌড়াচ্ছিল বলে শব্দ হচ্ছিল। এত জোরে শব্দ করা ঠিক নয় জেনেও হ্যারি নিজেকে সংযুক্ত রাখতে পারেনি। তবে সে আশেপাশে কাউকেই দেখে নি।

এবারও হ্যারি আয়নায় তার বাবা–মার স্মিত হাসি দেখল। শুধু তাই নয়, তার একজন দাদাও তাকে সম্বোধন করল। হ্যারি আয়নার সামনে মেঝেতে বসে পড়ল। তার মনে হল, সে সারারাত এখানে কাটিয়ে দিতে পারে। এমন সময় পেছন থেকে শব্দ শোনা গেল–হ্যারি তুমি আবার এখানে এসেছ?

হ্যারির অন্তরাত্না বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হ্যারি পেছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখে যে, তার ঠিক পেছনেই ডেস্কে বসে আছেন অধ্যাপক ডাম্বলডোর। হাঁটার সময় তাকে অতিক্রম করলেও তাড়াহুড়ার কারণে সে তাকে লক্ষ্য করেনি।

আত্নপক্ষ সমর্থন করে হ্যারি আমতা আমতা করে বলল–স্যার, আমি আপনাকে দেখতে পাইনি।

আশ্চর্য। অদৃশ্য হতে গিয়ে তুমি যে চোখে কম দেখছো–তা বুঝতে পারনি। ডাম্বলডোর বললেন। ডাম্বলডোরকে মুচকি হাসতে দেখে হ্যারি অনেকটা আশ্বস্ত হলো। না, ভয়ের কারণ নেই।

তাহলে ডেস্ক থেকে নেমে অধ্যাপক ডাম্বলডোর হ্যারির পাশে মেঝেতে বসে বললেন–তোমার আগে বহুলোক এরিসেডের আয়নার আনন্দ উপভোগ করেছে।

স্যার আমি এটার নাম জানতাম না। হ্যারি বলল।

এটা কি কাজ করে–তা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ। অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন।

এটা–হা স্যার আমার পরিবারকে দেখিয়েছে।

এবং তোমার বন্ধু রনকে হেডবয় হিসেবে দেখিয়েছে।

কি করে জানলেন?

অদৃশ্য হবার জন্য আমার কোন পোশাক লাগে না। তুমি কি এখন বলতে পার এরিসেডের আয়না আমাদেরকে কি দেখায়।

হ্যারি মাথা নেড়ে না বলল।

অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন–ঠিক আছে। আমি বলছি। পৃথিবীতে যিনি সবচে সুখী ব্যক্তি তিনিই এ আয়নাটি স্বাভাবিক আয়না হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন। তিনি ঠিক যেমন–আয়নাতে ঠিক তেমনি দেখতে পাবেন। এতে কি কোন লাভ হয়?

হ্যারি কিছুক্ষণ চিন্তা করে আস্তে আস্তে বলল–আমরা যা চাই বা যা কিছুই চাই–তা এ আয়নায় দেখা যায়।

তুমি যা বলেছ তা সত্যি আবার সত্যিও নয়, ডাম্বলডোর বললেন আমাদের হৃদয়ের পরম ইচ্ছে এই আয়নায় দেখা যায়। এই যে তুমি, এতদিন তোমার পরিবারের কাউকে দেখতে পাওনি। এখন আয়নায় তাদের দেখতে পেয়েছ। তুমি তোমার বাবাকে দেখতে পেয়েছ। তবে কি জান, এই আয়না কোন জ্ঞান দিতে পারে না বা সত্য জানাতে পারে না। এর আগে বহুলোক এই আয়নার দিকে তাকিয়ে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে। আয়নায় যা দেখা যাচ্ছে তা বাস্তব বা সম্ভব কিনা–বিষয়টা তার ভেবে দেখেনি।

ডাম্বলডোর আরো বললেন–আগামীকালই আয়নাটি অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হবে। আবারও আয়নাটি দেখতে আমি তোমাকে বারণ করব। এরপরও যদি তুমি যাও তোমার ক্ষতি হতে পারে। এ কথাটা মনে রেখো। এই আয়না কোন স্বপ্নের কথা বলে না। এই আয়না কাউকে কিছু ভোলাতে পারে না। বুঝেছ? এখন তোমার অদৃশ্য হওয়ার পোশাক খুলে ঘুমুতে যাও।

হ্যারি উঠে দাঁড়াল।

স্যার, প্রফেসর ডাম্বলডোর, আমি কি আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে পারি?

ডাম্বলড়োর বললেন, তুমি তো এই মাত্র আমাকে প্রশ্ন করেছ। ঠিক আছে, কর।

আপনি যখন আয়নার দিকে তাকান তখন আপনি কি দেখতে পান। হ্যারি প্রশ্ন করল।

আমি দেখি আমি এক জোড়া পশশী মোজা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অধ্যাপক ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। হ্যারি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন-একজন লোকের অনেক মোজা থাকে। আরেক বড়দিন এসে চলেও গেল। এই বড়দিনেও আমি একজোড়া মোজা উপহার পাইনি। সবাই আমাকে বই উপহার দিয়েছে।

যখন হ্যারি বিছানায় ঘুমোতে গেল তার মনে হল অধ্যাপক ডাম্বলডোর তাকে পুরোপুরি সতা কথা বলেননি। হ্যারি যে প্রশ্নগুলো করেছিল তা অবশ্য ছিল তার একান্ত ব্যক্তিগত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *