০১. সেই ছেলেটি

হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন
জে. কে. রাওলিং

প্রকাশকের কথা

এক বিস্ময়কর সৃষ্টির নাম হ্যারি পটার। যে শিশু আজ ভুবন বিখ্যাত, যে শিশু মাতিয়ে তুলেছে পৃখিবীর তাবৎ শিশু-কিশোরকে তার নাম হ্যারি পটার। বাবা মা হারা ১০ বছরের এই অনাথ শিশুটিই ব্রিটিশ লেখিকা জে. কে. রাওলিংয়ের কলমে হয়ে ওঠে অনন্য সাধারণ। হ্যারি পটার সিরিজে জে কে রাওলিং এ পর্যন্ত ৭টি বই লিখেছেন। হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন এই সিরিজের প্রথম বই।

বইয়ের কাহিনী শুরু এক ভাগ্যবিড়ম্বিত শিশুকে নিয়ে। নাম হ্যারি পটার। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর হ্যাগ্রিড নামে এক জাদুকর তাকে দিয়ে যান, ৪ নাম্বার প্রিভেট ড্রাইভে। সেটা ছিল তার আঙ্কল ও আন্টের বাসা। অদ্ভুত স্বভাবের এই দম্পতি হ্যারিকে গ্রহণ করলেও আদর যত্ন করতেন না। হ্যারির ঘুমানোর জন্য কোন ঘর ছিল না। সে থাকতো সিঁড়ির নিচে একটা কাবার্ডে। তাকে নতুন কোন পোশাক দেয়া হতো না। ডাডলির পরিত্যক্ত, পুরনো কাপড় পরেই তাকে থাকতে হতো। তদুপরি সুযোগ পেলেই খালাত ভাই ডাডলি তাকে মারধর করত। সেখানে হ্যারির জীবন ছিল দুর্বিষহ। কিন্তু কিছুই করার নেই। এরই মধ্যে হোগার্টস নামের এক জাদুবিদ্যার স্কুল থেকে চিঠি আসতে থাকে। কিন্তু তার আঙ্কল ও আন্ট কেউই তাকে সেসব চিঠি দেন না। এরপর একদিন হ্যাগ্রিড সত্যি সত্যিই তাকে স্কুলে নিয়ে যান এবং তার কাছে তার বাবা-মার মৃত্যুর ঘটনা এবং ডার্সলি দম্পতির অপকীর্তি ফাঁস করে দেন।

এরপর হোগার্টস জাদুর স্কুলে গিয়ে হ্যারি মজার সব কাণ্ড করতে থাকে। প্রতিপক্ষ কোন খেলায়ই তাকে হারাতে পারে না, ষড়যন্ত্র করলেও সফল হয় না। এই স্কুলেই হ্যারি পেয়ে যায় তার বন্ধু রন ও হারমিওনকে। এই দুই সাথীকে নিয়ে হ্যারি প্রতিটি খেলায় জয়ী হয়। সর্বত্র তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

এ বইয়ে রাওলিং শিশু-কিশোরদের অন্তর্জগতে যে সব অসম্ভব ও অবাস্তব কল্পনার সৃষ্টি হয় তার কথা যেমন বলেছেন তেমনি সেই কল্পনার ওপর ভর করে তাদের নিয়ে গেছেন জাদু বাস্তবতার আশ্চর্য জগতে। শিশু-কিশোররা রূপকথা শুনতে ভালবাসে। রাওলিং তাদের সেই রূপকথা শুনিয়েছেন। তার এ রূপকথার মধ্যে জীবন বাস্তবতার নির্মম নিষ্ঠুর চিত্র আছে, আছে মাতৃহৃদয়ের চিরন্তন স্নেহশীলতা ও মমত্ববোধ।

জে. কে. রাওলিং নিজের বই সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন: সত্যিই আমি ভাগ্যবান মানুষ নই। আমার প্রথম জীবনটা কেটেছে নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে। রাওলিংয়ের আক্ষেপ, তার পরম আনন্দের খবরটি তার মা শুনে যেতে পারলেন না। ১৯৯৩ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মেয়ের লেখালেখি সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। তবে রাওলিংয়ের মা ছিলেন একজন সত্যিকার বই প্রেমিক। তিনি যদি দেখে যেতেন তার মেয়ের লেখা বই মাত্র তিন কপি বিক্রি হয়েছে তাহলেও খুশি হতেন। না, রাওলিংয়ের বই তিন কপি চলেনি, চলেছে ২০ কোটি কপিরও বেশি।

হ্যারি পটার নিয়ে বিশ্বজুড়ে মাতামাতি হলেও বাংলা ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ এটাই প্রথম। এর আগে কলকাতা থেকে নকল হ্যারি পটার প্রকাশের উদ্যোগ নিলেও আইনবলে তা বন্ধ হয়ে গেছে। লেখক জে. কে. রাওলিংয়ের লিটারারি এজেন্ট-এর সঙ্গে দীর্ঘ দুবছর যোগাযোগ করে আমরা এ গ্রন্থ বাংলায় ভাষান্তর করার অনুমতি পেয়েছি। বিদেশে বাংলাদেশের দুর্নাম আছে, এখানকার প্রকাশকরা বিনা অনুমতিতে বিদেশী বই প্রকাশ করছে। আমরা এই দুর্নাম ঘুচাতে চাই। আমরা চাই প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিয়েই বিদেশী বইয়ের ভাষান্তর এখানে প্রকাশিত হোক। আবার বাংলাদেশের বইও আইনানুগভাবে বিদেশে ভাষান্তর হোক। এ ব্যাপারে দেশের সহযোগী প্রকাশক ও লেখকদেরও সহযোগিতা কাম্য।

এই বইটি অনুবাদ করেছেন সোহরাব হাসান ও শেহাবউদ্দিন আহমদ। অনুবাদ কাজে সার্বিকভাবে সহায়তা করেছেন গ্রন্থ বিশেষজ্ঞ মোশাররফ হোসেন। তাদের সবার প্রতি জানাই কৃতজ্ঞ।

মেসবাহউদ্দীন আহমেদ

পরিচিতি

হ্যারি পটার : এই বইয়ের প্রধান চরিত্র। জাদুকর লিলি ও জেমস পটারের ছেলে।

ডাডলি : হ্যারি পটারের খালাতো ভাই।

ডার্সলি : ভার্নন ডার্সলি, হ্যারি পটারের খালা পেতুনিয়ার স্বামী ও ডাডলির বাবা। বইতে হ্যারির আঙ্কল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

পেতুনিয়া : পেতুনিয়া ডার্সলি, হ্যারি পটারের খালা। ডাডলির মা। বইতে আন্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভোলডেমর্ট : হ্যারির বাবা-মার হত্যাকারী। ইউ নো হু নামে পরিচিত।

আলবাস ডাম্বলডোর : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ।

ম্যাকগোনাগল : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের উপ-অধ্যক্ষ।

হ্যাগ্রিড : হোগার্টসের চাবির রক্ষক ও গেমকিপার, হ্যারির সুহৃদ।

মাগল : জাদুবিদ্যায় অবিশ্বাসী সাধারণ মানুষ।

কিডিচ : ফুটবলের মত এক প্রকার জাদুনির্ভর খেলা।

স্নেইপ : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

কুইরেল : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

স্প্রাউট : জাদু বিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিষয়ক অধ্যাপক।

হেডউইগ : হ্যারির পেঁচা, চিঠিপত্রের বাহক।

গ্রিফিল্ডর : হোগার্টস জাদু বিদ্যালয়ের গ্রিফিল্ডর হাউজ। ছাত্রাবাস।

স্ক্যাবাস : রনের ইঁদুর।

রন উইসলি : হ্যারির বন্ধু হোগার্টসের ছাত্র।

হারমিওন গ্রেঞ্জার : হ্যারির বান্ধবী হোগার্টসের ছাত্র।

নেভিল লংবটম : হ্যারির বন্ধু হোগার্টসের ছাত্র।

ম্যালফয় : হ্যারির সহপাঠী, প্রথম বর্ষের ছাত্র স্লিদারিন হাউজের আবাসিক ছাত্র ও হ্যারির প্রতিদ্বন্দ্বী।

ক্রেব : ম্যালফয়ের বন্ধু।

গ্রিংগটস : জাদুকরদের ব্যাংক।

ইউ-নো–হু : ভোলডেমর্ট, হ্যারির মা–বাবার হত্যাকারী।

ফ্লাফি : পরশমণির পাহারাদার তিনমাথা বিশিষ্ট কুকুর

ফ্লামেল, নিকোলাস : পরশমণির স্রষ্টা।

পিভস : জাদু বিদ্যালয় পালিত ভূত।

ফিলচ : হোগার্টসের কেয়ারটেকার।

ডেইলী প্রফেট : জাদুকরদের সংবাদপত্র।

ডায়াগন এলি : জাদুকরদের বিশেষ বাজার, যেখানে জাদুর উপকরণ পাওয়া যায়।

নিষিদ্ধ বন : হোগার্টের চারপাশের বন। ইউনিকর্ন ও রহস্যময় জন্তুদের বাস। হোগার্টের সীমার বাইরে।

গ্যালিওন্‌স : জাদুকরদের টাকা। পটার তার অভিভাবকদের কাছ থেকে এক পাত্র গ্যালিওনস পেয়েছিল।

গ্রিফিল্ডর, হাফলপাফ, র‍্যাভেন ক্ল, স্লিদারিন : হোগার্টের চারটি ছাত্রাবাস। যা, চার প্রতিষ্ঠাতার নামে নামকরণ করা হয়েছে।

হোগার্ট স্কুল অফ উইচক্রাফট এন্ড উইজারি : জাদুবিদ্যার আবাসিক স্কুল, যেখানে হ্যারি ও তার বন্ধুরা বিভিন্ন জাদু শিখেছে। স্কুলের মূলমন্ত্র হলো, কখনও ঘুমন্ত ড্রাগনকে কাতুকুতু দিও না।

অদৃশ্য পোশাক : রূপালী ছাই রঙের পোশাক, যা পড়লে অদৃশ্য হওয়া যায়।

জাদু মন্ত্রণালয় : জাদুকরদের বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জাদুকর আর জাদুকরীদের বিষয় গোপন রাখার দায়িত্ব এই মন্ত্রণালয়ের।

এরিসেডের আয়না : এই আয়নায় মানুষের সব চাইতে বড় ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়।

নিম্বাস ২০০০ : জোরে উড়ে যাওয়া এবং সাংঘাতিক জাদুর ঝাড়ু, যা হ্যারিকে কিডিচে সোনার বল খোঁজায় দারুন পারদর্শী করেছিল।

প্লাটফর্ম পৌনে-দশ : লন্ডনের কিংস ক্রস জাদুর প্লাটফর্ম (যা, সাধারণের কাছে অদৃশ্য), যেখান থেকে হোগার্টের ছাত্রছাত্রীরা হোগার্ট এক্সপ্রেসে চড়ে।

বাছাই টুপি : জাদুকরদের লম্বা-চ্যাপ্টা টুপি। যা, ছাত্ররা কোন্ ছাত্রাবাসে থাকবে তা চিহ্নিত করে। টুপিগুলো গান করতে পারে আর তাদের অনুভূতিও আছে।

০১. প্রথম অধ্যায় : সেই ছেলেটি

জায়গার নাম প্রিভেট ড্রাইভ। বাড়ি নম্বর চার। সেখানে বসবাস করেন ডার্সলি দম্পতি। এ দম্পতি গর্ব করে বলেন যে তারা খুবই স্বাভাবিক মানুষ। তারা কোনো অলৌকিক ঘটনা বা ভূত–প্রেত জাতীয় কিছুতে বিশ্বাস করেন না। এগুলো তাদের কাছে অর্থহীন। মি. ডার্সলি হলেন গ্রুনিংস নামের একটি ড্রিল কোম্পানির পরিচালক। তিনি দেখতে বেশ লম্বা এবং মোটা। তার বিশাল গোঁফ। তবে তার ঘাড় নেই বললেই চলে। অপরদিকে তার স্ত্রী মিসেস ডার্সলি একটু হালকা–পাতলা। চুল বাদামি। তাঁর ঘাড়টা অস্বাভাবিক লম্বা। এটি তার খুব কাজে লাগে। তিনি লম্বা ঘাড় বাঁকিয়ে বাগানের খোঁজ–খবর করেন। পাড়া প্রতিবেশীরা কে কী করছে তা জানতে গোয়েন্দাগিরি করেন। ডার্সলি দম্পতির একমাত্র ছেলে। নাম ডাডলি। তাঁরা বলেন-এমন ছেলে হাজারে একটা মেলে।

ডার্সলি পরিবার যা চান তার সবই পান। কি তাদের একটি গোপন বিষয় আছে। তারা চান না এই বিষয়টা কেউ জানুক। তারা প্রতি মুহূর্তেই ভয়ে ভয়ে থাকেন তাদের ওই গোপন বিষয়টা বুঝি কেউ জেনে ফেলল।

পটার পরিবারের ব্যাপারে তারা বরাবরই অত্যন্ত স্পর্শকাতর। মিসেস পটার হচ্ছেন মিসেস ডার্সলির বোন। তবে দীর্ঘদিন তাদের দেখা–সাক্ষাৎ ছিল না। মিসেস ডার্সলি এমন ভাব দেখাতেন যেন তার কোন বোনই নেই। কারণ তাঁর বোন এবং তার নিষ্কর্মা স্বামীর সাথে মিসেস ডার্সলি বা তার স্বামীর বিন্দুমাত্র মিল ছিল না। পটার পরিবারের কেউ যদি তাদের বাড়িতে এসে পড়ে তাহলে পাড়া–প্রতিবেশী কী বলবে-এ নিয়ে মিসেস ডার্সলি ভয়ে ভয়েই থাকতেন।

ডার্সলি পরিবার জানতেন যে পটার দম্পতির একটা ছোট্ট ছেলে আছে। তারা কখনোই এই ছেলেটাকে দেখেননি। এই ছোট ছেলেটির কারণে ডার্সলি পরিবার নিজেদেরকে পটার পরিবার থেকে দূরে রাখতেন। তারা চান নি যে তাঁদের ছেলে ডাডলি পটার পরিবারের ছেলেটির সাথে মেলামেশা করে।

আমাদের গল্পের সূচনা মঙ্গলবারে। দিনটি ছিল মেঘলা। এই মেঘলা দিনে কখনোই মনে হয়নি ওইদিনই কিছুক্ষণ পর দেশে অদ্ভুত বা রহস্যজনক কিছু ঘটবে। মি. ডার্সলি গুন গুন করছিলেন এবং কাজে যাওয়ার জন্য তাঁর বিরক্তিকর কাজ টাইটা বাঁধছিলেন। তাঁদের পুত্র ডাডলি ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করছিল। মিসেস ডার্সলি গল্প থামিয়ে বেশ কসরৎ করে চিৎকাররত ডাডলিকে একটি উঁচু চেয়ারে বসালেন।

সে সময় তারা কেউই লক্ষ্য করেননি যে একটি বাদামী রঙের পেঁচা তার পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে তাদের ঘরের জানালায় এসে বসেছে।

সকাল সাড়ে আটটায় মিস্টার ডার্সলি অফিসে যাওয়ার আগে তাঁর ব্রিফকেস হাতে নিয়ে মিসেস ডার্সলির চিবুকে চুমো দিলেন। একই সঙ্গে পুত্র ডাডলিকে তিনি বিদায়ী চুমো দিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। ডাডলি তখন খাচ্ছিল আর এদিক সেদিকে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মারছিল। পুত্রকে হাই বলেই মি. ডার্সলি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। এরপর গাড়িতে চড়ে সোজা অফিসের দিকে রওনা হলেন।

মি. ডার্সলির কাছে আজ সব কিছু যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে। তিনি গাড়ি থেকে দেখতে পেলেন রাস্তায় একটি বিড়াল মানচিত্র পড়ছে। ডার্সলি বুঝতে পারলেন না তিনি সত্যিই কী দেখছেন। তিনি তার মাথা বাঁকালেন; কিন্তু একই দৃশ্য। প্রিভেট ড্রাইভের কোণায় আরও একটি বিড়াল দাঁড়িয়ে আছে। এবার কোন মানচিত্র নেই। ডার্সলি বুঝতে পারলেন না, ঠিক কী ঘটছে।

এটা কী ভোজবাজি। ডার্সলি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি চোখ কচলিয়ে বিড়ালটার দিকে তাকালেন। বিড়ালটাও তার দিকে তাকাল। ডার্সলির গাড়ি তখন সামনে এগুচ্ছে। তিনি যখনই গাড়ির আয়নায় চোখ রাখছেন তখনই বিড়ালটাকে দেখছেন। বিড়ালটা রাস্তার ফলক দেখছে, প্রিভেট ড্রাইভ নং–। কিন্তু বিড়ালের তো পড়ার কথা নয়, মানচিত্র দেখার ও কথা নয়। কোন ঘোরের মধ্যে আছেন কিনা তা বোঝার জন্য মি. ডার্সলি শরীরকে ঝাঁকুনি দিয়ে বিড়াল বিষয়টাকে মাথা থেকে তাড়ালেন। তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা। ড্রিলের বড় অর্ডাটা আজ আর পাওয়ার কথা।

মি. ডার্সলির মগজ থেকে আবার ড্রিলের চিন্তুা উধাও। তিনি গাড়ি থেকে রাস্তায় দেখলেন লোকজন অদ্ভুত ঢোলা পোশাক পরে পায়চারি করছে। চারদিকে সকালের যানজট। কাউকে অদ্ভুত পোশাক পরতে দেখলে ডার্সলি খুব বিরক্ত হন। গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে তিনি বাইরে অদ্ভুত পোশাক পরা লোকজনদের দেখতে লাগলেন। লক্ষ্য করলেন, তাদের মধ্যে কেউই বয়সে তরুণ নয়। এতে তিনি আরও ক্ষেপে গেলেন। কিছুক্ষণ পর সড়ক যানজট মুক্ত হল। অবশেষে অফিসে পৌঁছলেন, অফিসে পৌঁছা মাত্রই তার মাথায় ড্রিলের চিন্তা ফিরে এল।

মি. ডার্সলি সব সময় জানালার দিকে পেছন ফিরে বসেন। তার অফিস দশ তলায়। যদি তিনি সেখানে না বসতেন তাহলে ড্রিলের প্রতি মনোযোগ দেয়া আরও কঠিন হতো। তিনি যদিও কোন পেঁচা দেখতে পেলেন না; কিন্তু পথের লোকজন দিনের আলোয় পেঁচা দেখছিল। তারা হা করে উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের অনেকেই হয়তো জীবনে কখনো রাতের বেলায়ও পেঁচা দেখেনি। অথচ ডার্সলি নিজে খাঁটি পেঁচামুক্ত একটি সকাল কাটালেন। অফিসে একে একে পাঁচজনকে বকা–ঝকা করলেন।

এরপর ডার্সলি কয়েকটা জরুরি ফোন করলেন। আরও খানিকক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করলেন। মধ্যাহ্নভোজের আগ পর্যন্ত তার মনমেজাজ খুবই ফুরফুরে ছিল। তিনি ভাবলেন, হাত–পা ছড়াবার জন্য একটু হেঁটে আসা দরকার। তিনি বেকারি থেকে মিষ্টি রুটি কেনার জন্য পথে নামলেন। অদ্ভুত পোশাকের লোকদের কথা তিনি তখন ভুলে গেলেন। বেকারির সামনে কয়েকজনকে অদ্ভুত পোশাকে দেখে তার আবার তাদের কথা মনে পড়ল। তিনি কড়া দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালেন। তাঁর রাগের কারণ তিনি বুঝতে পারলেন না, তবে তাদের দেখে বিরক্ত হলেন। লোকগুলো উত্তেজিত স্বরে কানাকানি করছিল। মনে হল তারা পটারের কথা বলছে।

মিস্টার ডার্সলির কানে ভেসে এলো–পটাররা, হ্যাঁ ঠিক…, এটাই আমি শুনেছি।

হ্যাঁ, তাদের ছেলে, হ্যারি–

এসব কথা শুনে মিস্টার ডার্সলি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ভয় তাকে গ্রাস করল। যারা ফিস ফিস করছিল তিনি তাদের দিকে তাকালেন। একবার ভাবলেন কিছু জিজ্ঞেস করবেন। পরে ভাবলেন, জিজ্ঞেস না করাই ভাল।

মিস্টার ডার্সলি রাস্তা পার হলেন এবং দ্রুতবেগে অফিসের দিকে ছুটলেন। অফিসে ঢুকেই সচিবকে বললেন তাকে কেউ যেন বিরক্ত না করে।

তিনি টেলিফোন হাতে নিয়ে বাসায় ফোন করার জন্য ডায়াল ঘোরালেন। পরমুহূর্তেই মত পালটে রিসিভার রেখে দিলেন। এরপর গোঁফে তা দিতে দিতে ভাবলেন এসব চিন্তা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। পটার তো বিশেষ কোন নাম নয়। অনেক লোকের নামই পার হতে পারে এবং হ্যারি নামে তাদের ছেলে থাকতে পারে। তার নাম পটার না হয়ে হার্ভে বা হ্যারল্ডও হতে পারত। কিন্তু ছেলেটিকে তিনি এখন পর্যন্ত দেখেননি। এসব কথা জানিয়ে মিসেস ডার্সলিকে ভয় পাইয়ে দেবার কোন কারণ নেই। তার বোনের নাম উচ্চারণ করলেই মিসেস ডার্সলি ঘাবড়ে যান। এজন্য তিনি স্ত্রীকে দোষ দিচ্ছেন না, তার জায়গায় হলে হয়তো তিনিও তাই করতেন।

বিকেলে তিনি কাজে আর মনোযোগ দিতে পারলেন না। পাঁচটায় যখন অফিস থেকে বের হলেন তখনও চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। অফিস থেকে বেরোবার সময় দরজার বাইরে একটা লোকের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগল। লোকটা প্রায় মাটিতেই পড়ে যাচ্ছিল। তার দিকে তাকিয়ে মিস্টার ডার্সলি বললেন—দুঃখিত।

কয়েক সেকেন্ড পর মিস্টার ডার্সলি খেয়াল করলেন যে লোকটা বেগুনি রঙের আলখেল্লা পরেছে। মাটিতে প্রায় পড়ে গেলেও লোকটাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হলো না। বরং তার মুখে স্মিত হাসির রেখা। বলল–স্যার, দুঃখিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কোন কিছুই আজ আমাকে বিচলিত করতে পারবে না। আনন্দ করুন। ফুর্তি করুন। অবশেষে ইউ-নো-হু বিদায় নিয়েছে। আপনার মতো জাদুতে অবিশ্বাসী মাগলদেরও আজ আনন্দ করা উচিত, এই শুভদিনে। শুভদিন।

বৃদ্ধ লোকটা রাস্তার মাঝখানে মিস্টার ডার্সলিকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। পরে ছেড়ে দিয়ে আবার হাঁটতে থাকল।

মিস্টার ডার্সলি অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। এক অদ্ভুত লোক তাঁকে রাস্তায় বুকে জড়িয়ে ধরেছে। লোকটা তাকে আবার মাগলও বলেছে। সবকিছু তার কাছে ধাঁধার মতো মনে হচ্ছে। তিনি দ্রুতবেগে গাড়িতে উঠে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। ভাবলেন হয়তো এই সবকিছুই কল্পনা। তবে তাই বা হয় কি করে! তিনি তো এসব আজগুবি কল্পনায় বিশ্বাস করেন না। গাড়ি নিয়ে চার নম্বর বাড়িতে প্রবেশ করতে প্রথমেই বিড়ালটা তার নজরে পড়ল। বিড়ালটা ছিল বাগানের দেয়ালের ওপর বসা। ডার্সলি নিশ্চিত যে এটাকেই তিনি সকালে দেখেছিলেন। এর চোখের চারদিকে একই চিহ্ন। বিড়ালটা দেখেও তার কোন ভাবান্তর হলো না।

হিস–বিড়ালটার উদ্দেশে তিনি জোরে শব্দ করলেন। নড়ল না।

বরং তার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল। তিনি ভাবলেন এটা তো বিড়ালের স্বাভাবিক আচরণ নয়। আবার ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার সময়ও ডার্সলি ভাবলেন এতক্ষণ যা কিছু ঘটেছে তার কিছুই স্ত্রীকে বলবেন না।

সুন্দর স্বাভাবিকভাবেই মিসেস ডার্সলির দিনটা কাটল। রাতে খাবার সময় তিনি স্বামীকে প্রতিবেশিনী ও তার কন্যার ঝগড়ার আদ্যপান্ত বললেন। ডার্সলি যে একটা নতুন শব্দ শিখেছে তাও তিনি উল্লেখ করলেন। মিস্টার ডার্সলি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেন। ডাডলি যখন ঘুমিয়ে পড়ল সন্ধ্যার শেষ খবর শোনার জন্য তখন তিনি বসার ঘরে গেলেন।

খবরে শোনা গেল–পাখি বিশারদগণ লক্ষ্য করেছেন যে পেঁচা আজ অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। পেঁচা রাতের পাখি। দিনের আলোয় একে খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু আজ সকালেই অনেক পেঁচা উড়তে দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা পেঁচার আচরণের আকস্মিক পরিবর্তনের কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। সংবাদ পাঠক হাসতে হাসতে পেঁচককূলের এ আচরণকে গভীর রহস্যময় বলে উল্লেখ করলেন–আবহাওয়াবিদরা জানালেন, আমরা এ সম্পর্কে কিছু জানি না। কিন্তু আজ পেঁচা এখানেই শুধু অস্বাভাবিক আচরণ করেছে তাই নয়, কেন্ট, ইয়র্কশায়ার ও ডান্ডি থেকেও দর্শকরা ফোন করে একই খবর জানিয়েছেন।

আবহাওয়ার খবরে বলা হলো–আজ অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। দূরদূরান্ত থেকে ফোনে শ্রোতারা আমাদের জানিয়েছেন যে, গতকাল বৃষ্টির পরিবর্তে তারকা গোলাবর্ষণের শব্দ শোনা গেছে। লোকজন আতশবাজি পুড়িয়ে আনন্দ করেছে। অবশ্য আজকের রাতেও বৃষ্টি হবে। মিস্টার ডার্সলি তার আরাম কেদারায় শক্ত হয়ে বসলেন এবং ভাবলেন সারা ব্রিটেনেই তারকা গোলা বর্ষিত হচ্ছে। রাতের পেঁচা কেন দিনে উড়ে বেড়াচ্ছে? সর্বত্রই কি অদ্ভুত আলখেল্লা পরা রহস্যময় লোক? পটারকে নিয়ে ফিসফিসানি…?

দু কাপ চা নিয়ে মিসেস ডার্সলি বসার ঘরে প্রবেশ করলেন। চায়ে মোটেই স্বাদ হয়নি। মিস্টার ডার্সলি ভাবলেন স্ত্রীকে কিছু বলা দরকার।

তিনি তার গলা পরিষ্কার করে সংকোচের সাথে শুরু করলেন—

পেতুনিয়া–প্রিয়তমা–তুমি কি ইদানিং তোমার বোনের কোন খবর টবর পেয়েছে।

তিনি যেমনটা ভেবেছিলেন ঠিক তেমনি তার স্ত্রী ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ চোখে তাকালেন। ডার্সলি দম্পতি বোঝাতে চাইতেন, মিসেস ডার্সলির কোন বোন নেই। তারা কখনো এ বিষয়ে আলোচনা করতেন না।

না, হঠাৎ এ কথা কেন? মিসেস ডার্সলি রাগতস্বরে প্রশ্ন করলেন।

মিস্টার ডার্সলি আমতা আমতা করে বললেন–আজকাল খুব আজগুবি খবর শোনা যাচ্ছে।–পেঁচা–তারকা–গোলাগুলি এবং আজ শহরে অদ্ভুত পোশাক পরা লোককে দেখলাম।

কথার মাঝখানে থামিয়ে মিসেস ডার্সলি বললেন, তা-ই!

মিসেস ডার্সলি নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। মিস্টার ডার্সলি ভাবলেন, পটার সম্পর্কে যেসব কথা আজকে শুনেছেন তা স্ত্রীকে বলবেন কিনা, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এ ব্যাপারে কথা না বলাই ভালো। তারপর খুবই হালকাভাবে বললেন তাদের ছেলেটা ডাডলির বয়সি হবে না?

মিসেস ডার্সলি শুকনো কণ্ঠে জবাব দিলেন, আমার মনে হয় তা-ই।

তার নাম কি? হাওয়ার্ড না কি যেন?

তুমি যদি আমাকে জিজ্ঞেস কর, তাহলে বলব নাম, হ্যারি। অনেকেই এ নাম রাখে।

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। মিস্টার ডার্সলি উত্তর দিলেন। তার বুক কাঁপছিলো, এই নামটিই তো তিনি শুনেছেন। আমি তোমার সাথে একমত।

ওপরের তলায় ওঠার সময় মিস্টার ডার্সলি এ বিষয়ে আর কোন কথা বললেন না। মিসেস ডার্সলি যখন স্নানের ঘরে, মিস্টার ডার্সলি তখন শোবার ঘরের জানালা দিয়ে বাড়ির সামনের বাগানের দিকে তাকালেন। বিড়ালটা তখনও সেখানে আছে। বিড়ালটা প্রিভেট ড্রাইভের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যে মনে হচ্ছে বিড়ালটা কোন কিছুর প্রতীক্ষা করছে। এসব কি তার কল্পনা? নাকি এর সাথে পটারদের কোন যোগসূত্র আছে?

সত্যি যদি যোগসূত্র থাকে তার ঝামেলাটা কিভাবে মোকাবিলা করবে সে কথা তিনি ভাবতেও পারছেন না।

ডার্সলি দম্পতি ঘুমুতে গেলেন। মিসেস ডার্সলি শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু মিস্টার ডার্সলির সহজে ঘুম এলো না। না ঘুমিয়ে তিনি আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলেন। তিনি নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন এবং ভাবলেন যে, আজকের অদ্ভুত ঘটনাগুলোর সঙ্গে পটারদের যদি কোন যোগসূত্র থেকেও থাকে তাহলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের কিছুতেই তাঁর কাছে বা তার স্ত্রীর কাছে আসার কোন কারণ নেই। তিনি এবং তার স্ত্রী পটারদের সম্পর্কে কী ধারণা রাখেন তা তাদের জানা আছে। পটাররা তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

কিন্তু তার ধারণা সঠিক ছিল না।

মিস্টার ডার্সলি ক্রমশঃ অস্বস্তিকর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেও বাইরে দেয়ালের ওপর বিড়ালটার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম ছিল না। বিড়ালটা মূর্তির মত বসেছিল। তার নিষ্পলক দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল প্রিভেট ড্রাইভের কোণায়। পরের রাস্তায় গাড়ির দরজায় সজোরে শব্দ হওয়া কিংবা দুটো পেঁচা এসে না বসা পর্যন্ত সে নড়ল না। প্রকৃতপক্ষে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত বিড়ালটা দেয়ালের ওপর বসেছিল।

বিড়ালটা যেখানে বসেছিল তার কাছাকাছি হঠাৎ একজন লোককে দেখা গেল। লোকটা এমনভাবে উদয় হলো যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। বিড়ালটা লেজ নাড়াল এবং তার চোখ ছোট হয়ে এল।

প্রিভেট ড্রাইভে এ ধরনের লোক এর আগে কখনো দেখা যায়নি। লোকটা দেখতে লম্বা ও পাতলা। রূপোলি চুল ও দাঁড়ি দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে লোকটা বৃদ্ধ। তার লম্বা চুল ও দাঁড়ি তার কোমর পর্যন্ত ঠেকেছে। লোকটা লম্বা ও ঢোলা পোশাক পরেছেন। তার গোলাপি রঙের পোশাক এত লম্বা যে মাটি স্পর্শ করছিল। তার চোখ ছিল হালকা ও উজ্জ্বল। চশমার ভেতর দিয়ে আলো ঠিকরে পড়ছে। তার নাক বেশ লম্বা, আর একটু খাদা ধরনের। তার নাক দেখে মনে হয় এটা অন্তুতঃ দুবার ভেঙেছে। এই লোকটির নাম আলবাস ডাম্বলডোর। তিনি তার আলখেল্লার বিভিন্ন পকেটে আতিপাতি করে কি যেন খুঁজছিলেন।

মনে হয় ডাম্বলডোর বুঝতে পারেন নি, তিনি যে সড়কে এসেছেন সেখানে তার নাম থেকে শুরু করে জুতা পর্যন্ত প্রতিটা জিনিসই অবাঞ্ছিত।

তিনি বুঝতে পারলেন যে কেউ তাকে লক্ষ্য করছে। হঠাৎ বিড়ালটার দিকে তার দৃষ্টি পড়ে, বিড়ালটা সড়কের অপরদিক থেকে তাঁর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিড়ালটাকে দেখে তিনি খুব মজা পেলেন। তিনি মনে মনে হাসলেনও, বিড়বিড় করে বললেন–আমার জানা উচিত ছিল।

ডাম্বলডোর তার জামার পকেটে যা খুঁজছিলেন এবার হাত দিয়ে তা পেলেন, একটা রূপোর সিগারেট লাইটার। তিনি লাইটারে মৃদু চাপ দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার কাছের বাতিটা নিভে গেল। এভাবে তিনি মোট বারো বার লাইটারে চাপ দিলেন। রাস্তার সব বাতি নিভে গেল। অবশিষ্ট আলো বলতে ছিল বিড়ালটার দুটি চোখ। গোল কুতকুতে চোখের মিসেস ডার্সলি বা অন্য কেউ যদি তখন বাইরে তাকাতেন তাহলেও নিচের ফুটপাথে অন্ধকারে কি ঘটছে তা তারা দেখতে পেতেন না। লাইটারটা পকেটে ভরে এরপর ডাম্বলডোর রাস্তার শেষপ্রান্তে চার নম্বরে এসে বিড়ালটার পাশে দেয়ালের ওপর বসলেন।

বিড়ালটার দিকে না তাকিয়ে ডাম্বলডোর বললেন–অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, অবাক কাণ্ড আপনি এখানে?

এরপর তিনি বিড়ালটার দিকে স্মিত হাস্যে তাকালেন। কিন্তু এ কি? বিড়ালের কোন নাম নিশানা নেই। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রাশভারি এক মহিলা। তার চোখে চারকোণা চশমা। এমন চৌকো চারকোণা চিহ্ন বিড়ালের চোখের চারপাশেও ছিল। তার গায়ে সবুজ পান্না রঙের আলখেল্লা। তার কালো চুল ঝুটি বাঁধা। চেহারায় একটু বিধ্বস্ত ভাব।

মহিলা প্রশ্ন করলেন–আমি এখানে আছি-এটা আপনি কী করে জানলেন?

ডিয়ার প্রফেসর, আমি কখনো কোন বিড়ালকে এত শক্তভাবে বসে থাকতে দেখিনি।

ম্যাকগোনাগল বললেন, আপনিও যদি সারাদিন ইটের দেয়ালের ওপরে বসে থাকতেন তাহলে আপনাকেও এতটা শক্ত থাকতে হত।

সারাদিন? তাহলে আপনি কখন আনন্দ করলেন? আমি এখানে আসার পথে এক ডজন ভোজ ও পার্টি দেখে এসেছি।

প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ঘৃণাসূচক নাক সিঁটকালেন। হ্যাঁ, সবাই উৎসবই তো করবে। অধৈর্য কণ্ঠে তিনি বললেন। আপনি বলেছিলেন তাদের আরও সতর্ক থাকা উচিত। কিন্তু তারা সতর্ক হলো না। হ্যাঁ, এমন কিছু যে ঘটছে মাগলরাও তা বুঝতে পেরেছে। এটা তাদের নজরে এসেছে।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ডার্সলি পরিবারের অন্ধকার শোবার ঘরের জানালার দিকে তাকালেন। তারপর তিনি মন্তব্য করলেন–পেঁচার ঝাঁক, তারকা গোলা… এগুলো আমি শুনেছি। তারা একেবারে বোকা নয়, তাদের চোখে কিছু না কিছু ধরা পড়বেই। তারকা গোলা গিয়ে পড়ল কেন্টে। আমি বাজি ধরতে পারি এগুলি ডিডালুস ডিগলের কাজ। কখনো তার বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল না।

তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ডাম্বলডোর নম্রস্বরে বললেন গত এগারো বছরে উৎসব করার মতো কোন সুযোগ আমরা পাইনি।

আমি সেটা জানি। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল খানিকটা রেগেই জবাব দিলেন। তবে এটা মাথা গরম করার কোন বিষয় নয়। সবাই একেবারেই অসতর্ক ছিল, এমনকি প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় বের হওয়া, তাও মাগলদের পোশাক না পরে, গুজব ছড়ানো।

তিনি ডাম্বলডোরের দিকে তীব্র তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালেন। তার ধারণা ছিল ডাম্বলডোর তাকে কিছু বলবেন, কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। তাই ম্যাকগোনাগল বলে চললেন–খুবই ভালো হত যদি ওইদিন ইউ-নো-হু অদৃশ্য হয়ে যেত। মাগলরা আমাদের সম্পর্কে সব জেনে গেছে। আমার মনে হয় ডাম্বলডোর, সে সত্যি সত্যিই চলে গেছে।

আমারও তা-ই মনে হয় সে চলে গেছে– ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। সে জন্য তাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। তারপর একটু থেমে বললেন আপনাকে কি শরবতি লেবু দেব?

কী? ম্যাকগোনাগল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

শরবতি লেবু। এটা মাগলদের প্রিয়। আমিও খুব পছন্দ করি।

না, ধন্যবাদ–ম্যাকগোনাগল শীতল কণ্ঠে জবাব দিলেন। তিনি মনে করেন না এটা শরবতি লেবু খাওয়ার সময়। একটু থেমে বললেন–আমি যেমন বলি, যদি ইউ-নো-হু চলে গিয়েও থাকে।

প্রিয় অধ্যাপক, আপনার মত বিচক্ষণ ব্যক্তির উচিত তাকে নাম ধরে ডাকা। ইউ-নো-হু কি কোন নাম হলো। আমি গত এগারো বছর ধরে সবাইকে এটা বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে তাকে তার আসল নাম ধরেই ডাকা উচিত। তার আসল নাম ভোলডেমর্ট। ডাম্বলডোর বললেন।

অধ্যাপক, ম্যাকগোনাগল কুণ্ঠিত হলেন। ডাম্বলডোর দুটি শরবতি লেবুর খোসা ছাড়িয়ে খেলেও ম্যাকগোনাগল সে দিকে তাকালেন না। আপনি যদি ইউ–নো–হু বলতে থাকেন তাহলে সবকিছুতে বিভ্রান্তি দেখা দেবে। আমি ভলডেমর্ট-এর নাম বলতে ভয় পাওয়ার কোন কারণ দেখি না।

কিন্তু এতে কোন কাজ হয়নি। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন কিছুটা ক্লান্তি আর কিছুটা বিস্ময় নিয়ে আপনি অন্যদের থেকে ভিন্ন। সবাই জানে একমাত্র আপনিই জানেন। ইউ–নো–সরি–ভলডেমর্ট ভয় পেয়েছিলেন।

আপনি আমার সম্পর্কে বাড়িয়ে বলছেন। ডাম্বলডোর শান্তভাবে জবাব দিলেন ভলডেমর্টের এমন ক্ষমতা ছিল যা আমার কোনদিনই হবে না।

কারণ আপনি খুব ভাল… এত মহৎ যে সে ক্ষমতা আপনি ব্যবহার করেন না।

এটা ভাগ্যের কথা যে-এখন সব অন্ধকার। খুবই লজ্জা পাচ্ছি আপনার কথায়, মাদাম পমফ্রে আমার কান ঢাকা টুপির প্রশংসা করার পর এত লজ্জা আমি আর কখনো পাইনি।

ম্যাকগোনাগল ডাম্বলডোরের দিকে শানিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন গুজব যেভাবে ছড়াচ্ছে তার সামনে পেঁচারা কিছুই নয়। আপনি কি জানেন–সবাই কী বলাবলি করছে? তারা বলছে–সে কোথায় গেছে? গেছে কোথায়?

মনে হল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল এখন ডাম্বলডোরকে বলতে চান কেন তিনি সারাদিন বিড়ালের ছদ্মবেশে কনকনে শীতের মধ্যে দেয়ালের ওপর বসেছিলেন। সবাই যা বলাবলি করছিল তিনি তা বিশ্বাস করবেন না। যতক্ষণ না ডাম্বলডোর সেটাকে সত্য বলেন। ডাম্বলডোর কিন্তু কোন কথা না বলে আরেকটা শরবতি লেবু মুখে তুললেন।

তারা বলছিল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন, গতরাতে ভোলডেমর্ট গডরিকস হলোতে গিয়েছিলেন পটারদের সন্ধানে। গুজব ছড়ানো হয়েছে যে লিলি এবং জেমস পটার মৃত।

ডাম্বলডোর তার মাথা নত করলেন এবং অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

লিলি আর জেমস মারা গেছে-একথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই না …ওহ! আলবাস

ডাম্বলডোর কাছে গিয়ে তাঁর কাঁধ মৃদু স্পর্শ করে ভারি কণ্ঠে বললেন আমি জানি, আমি জানি। আপনার কাছে খবরটা কত বেদনাদায়ক।

কম্পিত কণ্ঠে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন-এটাই শেষ নয়। তারা বলছিল যে, সে পটারের ছেলে হ্যারি পটারকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার সে চেষ্টা সফল হয়নি। কেন হয়নি তা কেউ বলতে পারছে না। যখন হ্যারি পটারকে হত্যা করা গেল না তখনই ভোলডেমর্টের ক্ষমতা কিছুটা হলেও হ্রাস পেল। এই কারণেই সে চলে গেছে।

ডাম্বলডোর গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন।

এটা-এটা কি সত্য? ম্যাকগোনাগল দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললেন। সে তো সবাইকে হত্যা করেছে। কেবল এই ছোট্ট ছেলেটাকে হত্যা করতে পারেনি? এটা সত্যিই বিস্ময়কর। হ্যারি যে বেঁচে গেল-এটা সত্যিই অভাবনীয়।

আমরা কেবল অনুমান করতে পারি। ম্যাকগোনাগল বললেন হয়তো সত্যটা কখনোই জানতে পারবো না।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল একটা রুমাল বের করে তার চশমার ভেতর দিয়ে চোখ মুছলেন। ডাম্বলডোর পকেট থেকে সোনালী ঘড়ি বের করে মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। ঘড়িটা আবার পকেটে রেখে বললেন–হ্যাগ্রিড দেরি করছে। সে নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছিল যে আমি এখানে থাকব।

হ্যাঁ ম্যাকগোনাল জবাব দিলেন–আমি জানি, আপনি আমাকে বলবেন না–আপনি এখানে কেন এসেছেন।

আমি হ্যারিকে তার আঙ্কল ও আন্টের কাছে দিয়ে যাবার জন্য এখানে এসেছি। হ্যারির আত্নীয়ের মধ্যে এখন তো মাত্র তারাই আছেন।

যারা এখানে থাকে আপনি নিশ্চয়ই তাদের কথা বলছেন না? চার নাম্বার বাড়ি দেখিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–ডাম্বলডোর, আপনি যা ভাবছেন তা করা ঠিক হবে না। আমি সারাদিন ধরে তাদের লক্ষ্য করছি। ওরা দুজন আমাদের মত নয়। ওদের একটা ছেলে আছে। সে তো আজকে সারা পথ ওর মাকে লাথি মেরেছে আর চিৎকার করেছে মিষ্টির জন্য। হ্যারি পটার এখানে আসবে এবং থাকবে ভাবাও যায় না।

এটাই তার জন্য উপযুক্ত স্থান। ডাম্বলডোর বললেন যখন হ্যারি বড় হবে তখন তার আঙ্কল–আন্ট তাকে সব ব্যাখ্যা করে বলতে পারবেন। আমি তাদেরকে একটা চিঠি দিয়েছি।

চিঠি? ম্যাকগোনাগল অবাক হয়ে জানতে চাইলেন আপনি কি সত্যিই মনে করেন একটা চিঠিই সবকিছু ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট? এই লোকগুলো কোনদিনই হ্যারি পটারকে বুঝতে পারবে না। তবে একদিন সে কিংবদন্তী হবেই।

আজকের দিনটাকেই যদি হ্যারি পটারের দিন বলে ঘোষণা করা হয় আমি বিন্দুমাত্র অবাক হব না। ভবিষ্যতে হ্যারিকে নিয়ে যে বই লেখা হবে তা পৃথিবীর প্রতিটি শিশু পড়বে।

আপনি ঠিকই বলেছেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল। ডাম্বলডোর বললেন। একটা ছেলে হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না, কিন্তু বিখ্যাত হয়েছে-একটা ছোট ছেলেকে মাথা খারাপ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ছেলেটাকে এখানে কীভাবে আনবেন? তারপর তিনি ডাম্বলডোরের আলখেল্লার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে, মনে হল তিনি হ্যারিকে তার পোশাকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছেন।

হ্যাগ্রিড তাকে নিয়ে আসছে। ডাম্বলডোর জবাব দিলেন।

এমন একটা কঠিন বিষয়ে হ্যাগ্রিডের ওপর আস্থা রাখা কি ঠিক হবে? অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল জানতে চাইলেন।

হ্যাগ্রিডের ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। ডাম্বলডোর জবাব দিলেন।

আমি তাকে অবিশ্বাস করি না– অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন। তবে সে তো ভুলও করতে পারে।

কিছু সময় নীরবে কাটল। তারপর বাইরে মোটর বাইকের শব্দ শোনা গেল। মোটর বাইক থেকে হ্যাগ্রিড নামলেন। মোটর বাইকটা অনেক বড় হলেও হ্যাগ্রিডের জন্য এটা নস্যি মাত্র। হ্যাগ্রিড এমনিতে যথেষ্ট লম্বা। সাধারণ লোকের তুলনায় পাঁচগুণ মোটা। কালো ঝাকড়া চুল। দাঁড়িতে তার সারা মুখ ঢেকে গেছে। তার হাত ডাস্টবিনের ঢাকনির মত চওড়া। বুটপরা অবস্থায় তার পা দেখলে মনে হবে শিশু ডলফিন। তার বাহু দেখলে মনে হবে কয়েকটা কম্বলের বাণ্ডিল।

অবশেষে তুমি এসেছো! আশ্বস্ত হয়ে ডাম্বলডোর হ্যাগ্রিডের কাছে জানতে চাইলেন–যাক! তুমি এই মোটর বাইক কোথায় পেলে?

অধ্যাপক ডাম্বলডোর, আমি এটা ধার করেছি। হ্যাগ্রিড বাইক থেকে নামতে নামতে জবাব দিলেন–ইয়াং সিরিয়াস ব্ল্যাক এটা আমাকে ধার দিয়েছে।

কোন অসুবিধে হয়নি তো? ডাম্বলডোর জানতে চাইলেন।

না, কোন অসুবিধে হয়নি। হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন–বাড়িটা ধ্বংস হয়ে গেছে। মাগলদের কিছু করার সুযোগ না দিয়েই আমি ছেলেটাকে বের করে নিয়ে এসেছি। ব্রিস্টলে এসে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

ডাম্বলডোর এবং অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল কাছে এসে ঝুঁকে কম্বলের পুঁটলিটাকে দেখলেন। কম্বলটা সরাতেই দেখা গেল–ভেতরে একটা শিশু ঘুমিয়ে আছে। কালো চুল। কপালের ওপর বিদ্যুৎ চমকানোর মতো আঁকাবাঁকা একটা কাটা দাগ।

এটাই কি সেই দাগ?–ম্যাকগোনাগল প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ–ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। সারাজীবন তাকে এই দাগ বয়ে বেড়াতে হবে।

এ ব্যাপারে আপনি কি কিছু করতে পারেন না ডাম্বলডোর? অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল জানতে চাইলেন।

পারলেও আমি কিছু করব না–ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। কারণ এই দাগগুলো ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। আমারও বাঁ পায়ের হাঁটুতে কাটা দাগ আছে, যা দেখতে অবিকল লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডের ম্যাপের মতো। হ্যাগ্রিড, বাচ্চাটাকে দাও। এখন আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো।

হ্যারিকে কোলে নিয়ে ডাম্বলডোর ডার্সলিদের বাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন।

আমি কি এখন বিদায় নিতে পারি? হ্যাগ্রিড জানতে চাইলেন।

হ্যাগ্রিড তার দাঁড়িভরা মুখ নিয়ে হ্যারিকে চুমো খেলেন। তারপর বিকট শব্দ করে আহত কুকুরের মত দ্রুতগতিতে সরে গেলেন।

ম্যাকগোনাগল তাকে হুঁশিয়ার করলেন—শ্‌শ্‌। চুপ। মাগলরা জেগে যাবে।

হ্যাগ্রিড একটা বড় রুমাল বের করে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–লিলি আর জেমস জীবিত নেই, এ সত্যটাই আমি মানতে পারছি না। হ্যারি মাগলদের সাথে কিভাবে থাকবে–সেটা ভেবেই আমি চিন্তিত।

আসলেই এটা খুব দুঃখজনক। ম্যাকগোনাগল বললেন–হ্যাগ্রিড আপনি শক্ত হোন। নতুবা অন্যরা আমাদের দেখে ফেলবে।

ডাম্বলডোর বাগানের দেয়াল টপকে বাড়ির সামনের দরোজার দিকে অগ্রসর হলেন। নিজের আলখেল্লার ভেতর থেকে একটি চিঠি বের করে তিনি হ্যারির গায়ে জড়ানো কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। হ্যারিকে কম্বলসহ দরোজার সামনে রেখে ডাম্বলডোর ফিরে এলেন আগের জায়গায়, সঙ্গী দুজনের কাছে।

পুরো এক মিনিট তারা তিনজন দাঁড়িয়ে কম্বলের পুটলির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হ্যাগ্রিডের কাধ নড়ে উঠল, অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল তার চোখের পাতা পিট পিট করলেন আর ডাম্বলডোরের চোখে যে জ্যোতি সব সময় দেখা যেত, তা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

ডাম্বলডোর বললেন-এখানে দাঁড়িয়ে থাকার তো কোন মানে হয় না। আমরা ফিরে গিয়ে উৎসবে যোগ দিতে পারি।

ঠিক বলেছেন, হ্যাগ্রিভ কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন আমি বরং বাইক নিয়ে বিদায় হই। শুভরাত্রি অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, শুভ রাত্রি অধ্যাপক ডাম্বলডোর।

চোখ মুছতে মুছতে হ্যাগ্রিড তার মোটরবাইকে উঠলেন। আর বিকট আওয়াজ করে বাইক ছুটে চলল।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, আবার দেখা হবে আশা করি–ডাম্বলডোর বললেন।

জবাবে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল নাক দিয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন। ডাম্বলডোর রাস্তার দিকে রওনা হলেন। লাইটারের সাহায্যে রাস্তার আলোগুলো আবার জ্বেলে দিলেন। বারটা বাতিই জ্বলে উঠলো, কমলা রঙের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো সড়ক, এমন পরিস্কার সব কিছু দেখা যাচ্ছিল যে কোন বিড়ালের বাচ্চাও যদি সড়কের শেষপ্রান্তে দৌড়ে যেত পরিষ্কার তা দেখা যেত। দূর থেকে তারা দেখতে পেল চার নাম্বার বাড়ির সিঁড়িতে কম্বলের পুটলিটা। তারপর গুডলাক হ্যারি বলে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলেন।

প্রিভেট ড্রাইভের ঝোঁপঝাড়ু তখন বাতাসে দুলছে। আকাশের দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল শিগগিরই আশ্চর্যজনক কিছু ঘটনা ঘটবে।

কম্বলের ভেতর হ্যারি পটার নড়ছে, কিন্তু তার ঘুম ভাঙেনি।

হ্যারির একটা হাত সেই চিঠির ওপর ছিল, যেটা ডাম্বলডোর তার কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। হ্যারি জানতেও পারল না যে, সে অসাধারণ, সে বিখ্যাত এবং কিছুক্ষণ পর মিসেস ডার্সলি তাকে ঘুম থেকে জাগাবেন।

ভোরবেলা দরোজা খুলেই মিসেস ডার্সলি চিৎকার করে উঠলেন। দুধের বোতল নেয়ার জন্য তিনি দরোজা খুলেছিলেন। কম্বল জড়ানো শিশুটাকে তিনি দুহাতে কোলে তুলে নিলেন। তার পুত্র ডাডলির সাথে হ্যারি আশ্রয় পেল। তিনি জানতেও পারলেন না দেশের সর্বত্র লোকজন মিলিত হয়ে গোপন সভায় হাতের গ্লাস উঁচু করে ফিসফিসে গলায় বলছে হ্যারি পটারের উদ্দেশ্যে, যে ছেলেটা বেঁচে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *