১২. উপসংহার
মৃণালিনীদেবীকে কলকাতায় চিকিৎসার জন্যে দিয়ে আসা হয় ১৯০২-এর ১২ সেপ্টেম্বর। ১৩০৯-এর ২৭ ভাদ্র।
তাঁকে জোড়াসাঁকোতে রবীন্দ্রনাথের লালবাড়ির দোতলায় একটি ঘরে রাখা হয়। সেই বাড়িতে কোনও বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না।
দেখা যাচ্ছে এই লালবাড়ির ওই ঘরেই তিনি তাঁর আত্মজীবনীটি লেখা শেষ করেন কলকাতায় আসার পরের দিনই—১৩ সেপ্টেম্বর। মৃত্যুর দু-মাস আগে। আচ্ছন্ন অবস্থায় মৃণালিনী বারবার বলতেন, আমাকে উনি বলেন ঘুমাও, ঘুমাও। শমীকে রেখে এলেন শান্তিনিকেতনে, ওইটুকু ছেলেকে ছেড়ে আমি কি ঘুমাতে পারি? বোঝেন না সেটা?
মৃণালিনীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হল ১৭ নভেম্বর। মৃত্যুর আগের দিন বড় ছেলে রথীকে শেষ দেখা দেখলেন মৃণালিনী।
সেই কথা এইভাবে আছে রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায়—
‘মৃত্যুর আগের দিন বাবা আমাকে মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শয্যাপার্শ্বে তাঁর কাছে বসতে বললেন। তখন তাঁর বাকরোধ হয়েছে। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে শুধু নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল। মায়ের সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা।’
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মৃণালিনীদেবীর জীবনাবসান হল ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর। দু-মাস এগারোদিন তিনি কলকাতায় মৃত্যুশয্যার যন্ত্রণা পেয়েছেন।
রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন মায়ের মৃত্যুদিনটির কথা—
‘আমাদের ভাইবোনদের সকলকে সে রাত্রে বাবা পুরোনো বাড়ির তেতলায় শুতে পাঠিয়ে দিলেন। একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কার মধ্যে আমাদের সারারাত জেগে কাটল। ভোরবেলার অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ, নিঝুম, কোনও সাড়াশব্দ নেই সেখানে। আমরা তখনি বুঝতে পারলুম, আমাদের মা আর নেই। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
মৃণালিনীর দেহ সেই রাত্রেই শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল।
ছেলেমেয়েরা কেউ জানতেই পারেনি কখন।
শমীকে শেষবারের মতো দেখে যেতে পারেননি মৃণালিনী।
পুত্র রথীন্দ্রনাথকে শ্মশানে যেতে, মুখাগ্নি করতে দেননি রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও শ্মশানে যাননি।
নিতান্ত নম নম করে সারা হয় মৃণালিনীর অন্ত্যেষ্টি। খরচ ২৮ টাকা ২ পয়সা।
সেই দিনই সকালে রথীকে ডেকে পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ, মৃণালিনীর ব্যবহৃত চটি জোড়াটি তাকে দিয়ে বললেন, রেখে দিস, তোকে দিলুম।
ঠিক পরের দিন থেকে রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন স্ত্রীর উদ্দেশে তাঁর ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি লিখতে—প্রতিদিন দু-একটি করে।
সাতাশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হল ‘স্মরণ’ পরের বছর, মোহিতচন্দ্র সেনের সম্পাদনায়, রবীন্দ্র কাব্যগ্রন্থের ষষ্ঠভাগে।
স্বতন্ত্র কাব্যগ্রন্থ রূপে ‘স্মরণ’-এর প্রকাশ ১৯১৪-র ২৫শে মে, মৃণালিনীর মৃত্যুর বারো বছর পরে।
উৎসর্গ পত্রে কোনও নাম নেই।
শুধু একটি তারিখ।
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩০৯।
মৃণালিনীর প্রয়াণদিবস।