উনি বলেছেন, ওঁর বিয়ের কোনও গল্প নেই।
ওঁর বিয়ের গল্প থাকবেই বা কী করে?
আমার মতো অতি সাধারণ অল্প শিক্ষিত একটি গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে বিয়ের গল্প তো না থাকাই স্বাভাবিক।
কিন্তু আমার বিয়ের মস্ত বড় গল্প।
রবি ঠাকুরের সঙ্গে বিয়ে—গল্প থাকবে না?
আমার সমস্ত জীবনটাই তো আমার বিয়ের গল্প। আমার বিয়ে হল প্রায় দশ বছর বয়সে।
রবি ঠাকুরের স্ত্রী হয়ে থাকলুম প্রায় উনিশ বছর।
আর তো কিছু নেই আমার জীবনে—তাঁর একের পর এক সন্তানের মা হওয়া এবং তাদের বড় করা এবং ক্রমশ একা আর অসুস্থ হয়ে যাওয়া ছাড়া।
না, আরও আছে। সেই কথাটাই বড় কথা।
আছে আমার পরিচয়ের গৌরব, মহিমা।
আমি ক্রমেই বুঝতে পারছি, তেমন কিছুই না করেও আমি অমরত্বে উত্তীর্ণ হতে চলেছি।
ওঁর আলোই আমার আলো।
ওঁর দীর্ঘ যাত্রা আর হয়ে ওঠার ইতিহাসে আমার আসন চিরস্থায়ী।
আমার মতো এত কাছ থেকে ওঁকে তো আর কেউ দেখেনি।
সেই সৌভাগ্য তো শুধু আমার।
আমার উপর ঈশ্বরের করুণার শেষ নেই।
সব দিক থেকে কত সাধারণ, তুচ্ছ আমি।
তবু আমিই দেখতে পেলুম চাঁদের উলটো পিঠ। এ তো ঈশ্বরের আশীর্বাদ!
সেই রবি ঠাকুরকে ক’জন জেনেছেন, চিনেছেন, আমি যাঁকে চিনি, জানি।
আগেই বলেছি আমি লিখতে জানি না। উনি কী সুন্দর সাজিয়ে-গুছিয়ে মনের কথা বলেন।
আমি কিছুতেই পারিনে।
ওঁর সঙ্গে ঘর করলুম–যদি একে ঘর করা বলে—যা হোক, কাটালুম তো এতগুলি বছর একসঙ্গে কিন্তু কিছুতেই লেখার ব্যাপারটা রপ্ত করতে পারলুম না।
কিন্তু তবু, যত শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, যতই আর সংসারের ভার বহন করতে পারছিনে, যতই খুব একা লাগছে, ততই মনে হচ্ছে কিছু একটা লিখে সময় কাটাই।
দেখেছি, লিখলে বেশ সময় কেটে যায়। কিন্তু কী লিখি?
কেন, নিজের কথা।
আমি তো লেখক নই ওঁর মতে, যে বানিয়ে বানিয়ে লিখব।
নিজের কথা লিখি তো। বানাতে হয় না। একেবারে রেডি মেড গপ্পো।
নিজের কথা লিখি কীভাবে?
আমার দিক থেকে আমি আমার জীবনটাকে যেভাবে দেখেছি, সেইভাবে। সেইটেই লিখে ফেলি।
সেই দেখাটা আপনাদের রবি ঠাকুরের মতো নাও হতে পারে। তানা হওয়াই তো স্বাভাবিক।
উনি যদি লেখেন কোনওদিন আমাদের কথা, আমাদের নিয়ে ওঁর জীবনের কথা লিখবেন কি কোনওদিন? সে-লেখা তো ছাপার অক্ষরে বেরোবে, সবাই পড়বে। একেবারে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, লেখার মতো লেখা। রবি ঠাকুরের লেখা বলে কথা। আমাদের চেয়ে লেখাটাই তখন বড় হয়ে উঠবে! আমি তো আর ছাপাবার জন্যে লিখছি না। লুকিয়ে রাখার জন্যে লিখছি।
যেমন ওঁকে লেখা আমার চিঠি—সেসব চিঠি আমি তো জানি, আমার সঙ্গে চিতায় উঠবে। কেউ কোনওদিন খুঁজে পাবে না তাদের। এই লেখাটার ভাগ্যে কী আছে কে জানে!
আমার বিয়ের বেশ ক’বছর পরে। উনি শিলাইদহে জমিদারির দেখাশোনা নিয়ে ব্যস্ত।
কত কী লিখছেন। গল্প, কবিতা, গান।
ওঁর কাজ আর খ্যাতি ক্রমশই বাড়ছে। আমি তো তেমন কিছু বুঝি না। দূর থেকে শুধু ওঁর মঙ্গল চাই। উনি দূরে আছেন। মন কেমন করে। কতদিন দেখা হয় না। কিন্তু এও ভাবি, দূরে আছেন বলেই ভালো আছেন।
আপন মনে কাজ করতে পারছেন।
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বিশেষ করে মেয়েমহলে কূটনীতির শেষ নেই।
শুধু সাংসারিক মারপ্যাঁচ।
যে যার নিজের স্বার্থ নিয়ে আছে।
সেই খেয়োখেয়ির মধ্যে আমি পচছি।
যতখানি পারি মানিয়ে চলার চেষ্টা করি।
মাঝেমধ্যে মনে হয় সংসারের, ছেলেমেয়েদের সব দায়িত্ব কি শুধুই আমার?
ওঁকে কি কখনও পাশে পাব না?
বলতে গেলে আমিই এখন বাড়ির গিন্নি, যদিও আমি কিন্তু এ-বাড়ির ছোটবউ।
ওঁকে সুবিধে-অসুবিধে জানাবার উপায় নেই।
উনি দিনরাত ভেসে চলেছেন পূর্ববাংলার নদীপথে।
পদ্মার চরে, কোনও অজানা প্রান্তরের পাশে উনি বোটের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন।
কখনও ইছামতীতে। কখনও দীঘাপতিয়ার জলপথে। কখনও সুদূর নোয়ালঙ্গে একা।
তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের কোনও উপায় নেই।
কখনও হয়তো তাঁর চিঠি এল কালিগ্রাম থেকে।
তারপর খবর আসে তিনি নাটোরে, তিনি পতিসরে, তিনি কুষ্টিয়ায়! আমি যখন নিজের কথা ভাবি তখন দেখি পনেরো বছর ধরে আমি আসলে জোড়াসাঁকোর বাড়ির কাজের লোক হয়ে গিয়েছি।
না হয়ে উপায় বা কী?
বাড়ির বড়বউ সর্বসুন্দরী বহুকাল হল মরে বেঁচেছেন।
বড়বউ মানে আমার বড়ভার দ্বিজেন্দ্রনাথের স্ত্রী।
আমার মেজোজা জ্ঞানদানন্দিনী, মানে সত্যেন্দ্রনাথের বউ, তিনি তো বিলেত ফেরত মেমসাহেব, প্রথম ভারতীয় আইসিএস-এর স্ত্রী বলে কথা, তিনি জোড়াসাঁকোর সংসার ছেড়ে থাকেন সায়েবপাড়া পার্কস্ট্রিটে। এলাহি ব্যাপার। বাবামশায় আজকাল কলকাতায় এলে ওখানেই থাকেন। মেজোজায়ের এক ছেলে এক মেয়ে।
সুরেন আর ইন্দিরা।
আর একটি ছেলে হয়েছিল। ভারি মিষ্টি দেখতে। নাম দেওয়া হয়েছিল কবীন্দ্র। তবে সবাই ডাকত চোবি বলে। সে বিলেতে মারা গেল দু-বছর বয়েসে। বোধহয় বিলেতের ঠান্ডা সহ্য করতে পারেনি।
এবার আসি আমার সেজোজানীপময়ীর কথায়।
আমার সেজোভাশুর হেমেন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন চল্লিশ বছর বয়সে।
এগারোটি ছেলেপুলে নিয়ে নীপময়ী বিধবা। এবং বিধবা হওয়ার পর থেকে তিনি সংসারের কুটোটি নাড়েন না। ধম্মকম্ম নিয়ে আলগোছা হয়ে থাকেন একপাশে।
আমার আরও এক জা আছে। ইনি আমার শ্বশুরমশায়ের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রফুল্লময়ী। প্রফুল্লময়ী নীপময়ীর ছোটবোন। নীপময়ীর তো বিয়ে হয়েছে। হেমেন্দ্রনাথের সঙ্গে। পরের ভাই বিয়ে করলেন নীপময়ীর ছোটবোন প্রফুল্লময়ীকে। তার কারণ, এঁদের বাবা হরদেব চাটুজ্জ্যে আমার শ্বশুরমশায়ের খুব ভক্ত ছিলেন। অতএব ভক্তের দুই কন্যাকে দুই ছেলের বউ করে নিয়ে এলেন বাবামশায়। ভাগ্যে সুখ সইল না। হঠাৎ পাগল হয়ে গেলেন প্রফুল্লময়ীর স্বামী বীরেন্দ্রনাথ।
আপনাদের রবি ঠাকুর একদিন আমাকে হেসে বললেন, আমার দাদা পূর্ণ উন্মাদ। আর আমি অর্ধেক।
আমি বললুম, বালাইষাট, তুমি পাগল হতে যাবে কেন?
উনি বললেন, কবি মাত্রেই অর্ধোন্মাদ।
আমার ভাশুর যখন উন্মাদরোগে আক্রান্ত সেই অবস্থায় ওঁর একমাত্র পুত্র বলেন্দ্রনাথের জন্ম হল।
এবং বলেন্দ্র মারা গেল মাত্র ঊনতিরিশ বছর বয়েসে।
বলু আমাকে সংস্কৃত, ইংরেজি এইসব শিখিয়েছিল। ও ছিল আমার খুব বন্ধু। ওর মৃত্যুর পরে আমি আরও একা হলুম।
বলুর কথায় পরে আসছি। যতটুকু বলা যায়, ততটুকুই বলব বলুর আর আমার বন্ধুত্বের কথা। তবে এখন তো জোড়াসাঁকোর বাড়ির জটিল পরিবেশের কথা বলছি যার মধ্যে আমি একা বছরের পর বছর কাটিয়েছি। এবং বলা যেতে পারে, শেষ হয়ে গেছি।
ওঁকে পাশে পাইনি বলেই বড্ড একা থাকতে হল সারাজীবন। বলু মারা যাওয়ার পর বাবামশায় বেশ একটা নিষ্ঠুর কাণ্ড করলেন। আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু উনি বাবামশায়কে সমর্থন করেছিলেন। আমার মনের কষ্টটা বোঝেননি।
বলুর মৃত্যুর পরে বাবামশায় তাঁর শেষ উইলে পাগল ছেলে বীরেন্দ্রকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলেন। কারণ দেখালেন, বলুর মৃত্যুর পরে বীরেন্দ্রর তো আর কোনও উত্তরাধিকারী নেই। তিনি নিজেও উন্মাদ। তা-ই তাঁকে সম্পত্তির ভাগ দেওয়া উচিত হবে না। তাঁর বিধবা স্ত্রী প্রফুল্লময়ীর কথা বাবামশায় একবারও ভাবলেন না। প্রফুল্লময়ীর জন্যে নির্দিষ্ট হল একশো টাকা মাসোয়ারা। প্রফুল্লময়ী অর্থচিন্তায় ভেঙে পড়লেন। জোড়াসাঁকোর পারিবারিক পরিবেশ কেমন যেন অন্ধকার আর ঘোরালো হয়ে উঠল।
উনি দূর থেকে তাঁর কতটুকু আঁচ করতে পেরেছিলেন, জানি না। আমার মনে হয়েছিল বাবামশায় প্রফুল্লময়ীর উপর অবিচার করলেন। আপনাদের রবি ঠাকুর কিন্তু বাবামশায়ের সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করে আমাকে একটি চিঠিতে জানালেন, ন’বউঠানের এক ছেলে, সংসারের একমাত্র বন্ধন নষ্ট হয়েছে, তবু তিনি টাকাকড়ি, কোম্পানির কাগজ কেনাবেচা নিয়ে দিনরাত্তির যেরকম লেগে রয়েছেন তা দেখে সকলেই আশ্চর্য এবং বিরক্ত। চিঠি পড়ে আমার মনে হল অন্তত আমার স্বামীটি বেশ রেগেই রয়েছে। তবে আপনাদের রবি ঠাকুর এটাও জানালেন তিনি মনুষ্যচরিত্রের বৈচিত্র্য বিবেচনা করে ন’বউঠানের কাজকম্ম শান্তভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করছেন। আমার স্বামীর চিঠি পেয়ে এই প্রথম তাঁকে চিঠি লেখার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। এবং সেই চিঠিতে তাঁকে একটি প্রশ্ন করতে চেয়েছিলুম।
কিন্তু চিঠি লিখিনি, প্রশ্নও করিনি।
সাহসে কুলোয়নি।
আমার এই অগোছালো কিন্তু একেবারে খাঁটি আত্মজীবনীতে সেই প্রশ্নটি আপনাদের রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে লিখে রেখে গেলুম—তুমি কি ভুলে গিয়েছিলে যে তোমার পাগল দাদার একমাত্র ছেলে বলু যখন মারা গেল, সে রেখে গেল তার পনেরো বছরের বিধবা বউ সাহানাকে?
তার ভরণপোষণের দায়িত্ব কি ন’বউঠানের উপর এসে পড়ল না?
বাবামশায় সেকথা ভুলে গেলেন কী করে?
আর তুমিও টু শব্দটি পর্যন্ত করলে না!
তোমার এই ব্যবহারে আমি যতটা না অবাক হয়েছিলুম, তার থেকে লজ্জা পেয়েছিলুম অনেক বেশি।
আরও একটা ঘটনা ঘটল আমার চোখের সামনে।
সাহানা অভিমান করেই চলে গেল এলাহাবাদে তার বাপের বাড়িতে। সাহানার বাপ মেজর ফকির চাটুজ্যে জাঁদরেল মানুষ ছিলেন। তিনি পনেরো বছরের বিধবা মেয়েটির আবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন।
সাহানা বারো বছর বয়েসে বলুর বউ হয়ে আসে।
তিন বছরে তার কোনও বাচ্চা হয়নি। এই একটা সুবিধে ছিল। যেই না বাবামশায়ের কানে পৌঁছোল সাহানার বিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে অমনি উনি যেন দপ করে জ্বলে উঠলেন।
উনি বিধবাবিবাহের একান্ত বিরোধী।
এছাড়া উনি মনে করলেন, ঠাকুরবাড়ির কোনও বিধবার অন্যত্র বিয়ে হলে তাঁর এবং বংশের মর্যাদাহানি হবে।
বাবামশায় তোমাকেই পাঠালেন এলাহাবাদে তাঁর দূত হিসেবে। তোমার একমাত্র কাজ এই বিয়ে বন্ধ করে পনেরো বছরের সাহানাকে জোড়াসাঁকোর বাড়ির জেলখানায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
আমার মনে হয়, তোমার মেজোদাদাকে যদি বাবামশায় এই কাজটি করতে বলতেন, তিনি প্রতিবাদ করতেন।
একমাত্র তাঁরই মধ্যে আমি বাবামশায়ের সঙ্গে স্পষ্ট কথা বলার সাহস দেখেছি। তোমার ভাইদের মধ্যে এ-ব্যাপারে তিনি একা। তার অবিশ্যি একটা বড় কারণ হল, তিনি প্রথম ভারতীয় আইসিএস, তাঁর মাসে অনেক টাকা বেতন, তিনি বাবামশায়ের তহবিল থেকে পাওয়া হাতখরচের উপর নির্ভর করেন না।
বাবামশায় যেই তোমাকে এলাহাবাদ যেতে বললেন অমনি তুমি শুড়শুড় করে এলাহাবাদ ছুটলে।
ঠিক যেমনি বাবামশায়ের কথায় আমাকে শুড়শুড় করে বিয়ে করলে। আমাকে বিয়ে করাটা তো স্রেফ পিতৃআজ্ঞা পালন। তাই না?
কেন বিয়েটা করেছিলে বলো তো?
তুমিও কষ্ট পাচ্ছ। আর আমি? সেকথা ছাড়ো। অন্তত আপাতত। পরে তো আসতেই হবে সেকথায়। এখন যে কথা বলছিলুম—তুমি চলে গেলে এলাহাবাদে। কী জন্যে এলাহাবাদে যাচ্ছ, ঠিক করে আমাকেও জানাওনি।
আমি জিগ্যেস করেছিলুম।
তুমি বললে, একবার সাহানাদের বাড়িতে যেতে হচ্ছে।
—সাহানার বাপের বাড়ি! সে তো এলাহাবাদে। তার ওখানে যাওয়ার কী দরকার পড়ল?
–বাবামশায়ের আদেশ।
–মেয়েটা এ-বাড়িতে ভালো ছিল না। খুব একলা হয়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ কাঁদত।
—প্রথম প্রথম তো কাঁদবেই। এত কম বয়েসে বিধবা হল। কিন্তু কী জানো ছোটবউ, ক্রমশই অভ্যস্ত হয়ে যেত। এ-বাড়িতে এত লোকজন। ওর এখন মানুষজনের সঙ্গ প্রয়োজন।
—ওকে কি ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছ?
–দ্যাখা যাক।
—বাপের বাড়িতে গিয়ে যদি মেয়েটা একটু শান্তিতে থাকে, থাকুক না। এখুনি ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে?
—তুমি বুঝবে না ছোটবউ। সাহানা ঠাকুরবাড়ির বউ। এই বাড়িই ওর জায়গা। ওর অন্য কোথাও মন বসলে সেটা ওর ভবিষ্যতের পক্ষে ভালো হবে না।।
আমি অন্যের মুখে শুনলাম, সাহানাকে এত তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন কেন হয়েছিল!
বিধবাবিবাহের বিরোধিতা করেছেন বাবামশায় আজীবন। কিন্তু তোমার নিজস্ব কোনও মত ছিল না?
তুমি তো আমাকে কতবার বলেছ, তুমি বিধবাবিবাহের পক্ষে। অথচ বাবামশায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে একটি কথাও বলার সাহস হল না তোমার।
আমি তোমাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি।
খুব ভালোবাসি।
তাই তুমি যখন সাহানাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্যে এলাহাবাদে গেলে আমি বড় কষ্ট পেয়েছিলুম। লজ্জাও হয়েছিল।
তবে আমি জানতুম সাহানার বাপের বাড়ি তোমার কথায় মজে যাবে। আর সাহানা তো একরত্তি মেয়ে—ওর আবার মতামত আছে নাকি। আমার মনে এতটুকু সন্দেহ ছিল না, তুমি যখন ওকে আনতে যাচ্ছ, ও ঠিকই চলে আসবে। আর ওর বাকি জীবন বিধবা হয়েই কাটবে। তোমার সঙ্গে কথায়, যুক্তিতে, বোঝনোর ক্ষমতায় কে এঁটে উঠবে?
তুমি তো ভাষার ভগবান।
তোমার কথায় কী জাদু, তার কত প্রমাণ তো পেলাম সারাজীবন।
একটা জরুরি কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। আমি অকৃতজ্ঞ নই। কথাটা বলতেই হবে। কথাটা হল, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আমি যখন খুব একা, সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি, তখন আমার বড়ননদ সৌদামিনী কিছুদিন আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাল ধরেছিলেন। এবং কিছুদিনের মধ্যেই নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, কাজটি বড় সুবিধের নয়। বেশিদিন পারলেনও না।
মনে হল, আড়াল থেকে আঙুল নাড়লেন বাবামশায়। মেজোবউদিদি জ্ঞানদানন্দিনীরও যে ইশারা ছিল না এমনও তো ভাবতে পারিনে।
বাবামশায় এখন কলকাতায় থাকলে মেজোভাশুরের পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতেই ওঠেন। জোড়াসাঁকোতে আর আসেন না।
আমার বড় ননদ বাবামশায়ের সেবা করার জন্যে পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতেই চলে গেলেন।
বাবামশায় নিজেও চেয়েছিলেন সেটাই—তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাটি তাঁর কাছেই থাকুক।
সুতরাং আমার ঘাড়ে জোড়াসাঁকোর সকল ভার চাপিয়ে বড় ননদ পিতৃআজ্ঞা পালন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করলেন না।
তখন তো পার্ক স্ট্রিটের বাড়ি জমজমাট। যে-ভাশুটি রূপেগুণে আমার রূপবান গুণবান। স্বামীটির চেয়ে বিন্দুমাত্র কম নন, সেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথও সেখানে।
তবে স্ত্রী কাদম্বরীর আত্মহত্যার পরে তিনি ক্রমশ কেমন যেন হয়ে গেলেন।
মেজোবউঠানের খুব কাছের মানুষ হয়ে রইলেন। কিন্তু তোমার আমার কাছ থেকে ক্রমশই যেন দূরে সরে গেলেন। এর কারণ আমি ধীরে-ধীরে জানতে পেরেছি। তুমি কিন্তু আমাকে কিছু বলোনি।
এত বছর হয়ে গেল তোমার আমার। তবু তোমার সেই আড়াল গেল না।
তুমি এত বোঝে।
এইটুকু বোঝো না?
তোমার এক এবং অদ্বিতীয় জ্যোতিদাদার কথা যখন উঠলই, তখন তো তোমার নতুন বউঠানের কথা উঠতে বাধ্য।
কিন্তু আমি বলতে চাই না সেই বিষয়ে বিশেষ কিছু। তুমি যখন আড়াল করে রেখেছ, আড়ালেই থাক।
তবে একেবারে যে আমাকে কিছুই বলেনি, তাও তো নয়।
তুমি বলেছ তোমার মতো করে হয়তো সব কথাই।
একমাত্র তুমিই পারো এভাবে সমস্ত বলতে সেই সমস্তর মধ্যে আড়াল থেকেই যায়।
তুমি আমাকে বলেছিলে, তুমি নতুন বউঠানকে খুব ভালোবাসতে। আর বলেছিলে, নতুন বউঠানও তোমাকে খুব ভালোবাসতেন। সেই নতুন বউঠান কেন তোমার আমার বিয়ের ক’মাসের মধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন?
কী এমন দুঃখ হল তাঁর?
যখন তিনি আত্মহত্যা করলেন, আমার বয়স তখন দশ।
কিছুই বুঝিনি।
একটা দৃশ্য মনে আছে।
তুমি আর তোমার জ্যোতিদাদা, দুজনে নতুন বউঠানকে ধরে তাঁকে দক্ষিণের বারান্দায় হাঁটাবার চেষ্টা করছ।
তিনি সামনের দিকে ঝুলে পড়ে ঘুমিয়ে পড়ছেন।
আর তোমরা দুজনে তাঁকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছ।
কিন্তু কিছুতেই জাগিয়ে রাখতে পারলে না।
আমার মনে আছে তাঁকে।
ঠাকুরবাড়ির সব বউদের চেয়ে তাঁর গায়ের রং ময়লা।
আমার থেকেও।
কিন্তু সব থেকে সুন্দর তিনিই। তাঁর সঙ্গে আমার বেশি দেখা হয়নি। তিনি তো ঘর থেকে বেরোতেনই না। আমাকেও তুমি কোনওদিন নিয়ে যেতে না ওঁর ঘরে।
তুমি যেতে মাঝেমধ্যে। অনেকক্ষণ থাকতে। যখন ফিরে আসতে আমার কাছে, তোমার মন থাকত অন্য কোথাও।
আমি যে ঘরে আছি খেয়ালই থাকত না তোমার।
দু-একদিন সাহস করে জিগ্যেস করেছিলুম, কী কথা হল গো?
তুমি কোনও উত্তর দাওনি।
জিগ্যেস করেছিলুম, আমার একা যেতে ভয় করে, তুমি একদিন নিয়ে যাবে ওঁর ঘরে?
তুমি বললে, ওঁকে একা থাকতে দাও। ওঁকে তুমি বুঝবে না। যখন নতুন বউঠান আত্মহত্যার চেষ্টা করেও দুদিন বেঁচে থাকলেন, বউঠানের খুব অসুখ, জানতে চাইলুম কী হয়েছে? তুমি বললে, ডাক্তার তো দেখছে। শক্ত ব্যামো।
তারপর এ-বাড়িতে থাকতে-থাকতে, নানা গল্প, কানাঘুষো, উড়োকথা শুনতে-শুনতে এইটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছি, নতুন বউঠান বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, ওঁর কোনও ব্যামো হয়নি।
একটা জলজ্যান্ত মানুষ, কী কম বয়েস, আত্মহত্যা করল!
কেন? সব চুপ! কেউ কিছু জানে না।
আমি বাতাসে কান পেতে জানতে পারছিলুম খুব আস্তে আস্তে আমার রবি ঠাকুর আর তাঁর নতুন বউঠানের বয়েস ছিল খুব কাছাকাছি।
নতুন বউঠান ছিলেন মাত্র দু-বছরের বড়। আর এ-বাড়িতে আমার স্বামী ছাড়া তাঁর কোনও বন্ধু ছিল না।
ওঁদের মনের মিল হয়েছিল।
ওঁদের সম্পর্কটা আমি খুব ধীরে-ধীরে অনুভব করেছিলুম—যেমন একটু-একটু করে আলো ফুটে ভোর হয়, সেইভাবে।
যেদিন তাঁর নতুন বউঠান চলে গেলেন, সেদিন অনেক রাত্তির পর্যন্ত উনি ঘরে এলেন না।
কোথায় উনি?
আমি চুপিচুপি ছাদে গিয়ে দেখি, উনি পায়চারি করছেন আর মাঝে-মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছেন, কোথায় তুমি নতুন বউঠান, তুমি ফিরে এসো। আমি তোমাকে ছেড়ে বাঁচব কী করে?
আমি আর কখনও ওঁকে এমন উদভ্রান্ত দেখিনি। আমি কাঁদতে কাঁদতে একা ঘরে ফিরে এলুম।
শুরু করেছিলুম বিয়ের কয়েক বছর পরে শিলাইদহে একটি ঘটনার কথা মনে করে।
কিন্তু সেই ঘটনা চুলোয় গেল, কথায়-কথায় কোথায় চলে এসেছি—একেবারে আমার বিয়ের মাস তিনেকের মধ্যে!
লেখক না হলে এই হয়। খালি খেই হারিয়ে যায়। তা হোক। এই লেখা তো কেউ কোনওদিন ছাপবে না।
শুধু সময় কাটানোর জন্যে লিখছি।
মনের মধ্যে কথা জমিয়ে রেখে কোনও লাভ নেই।
মনের কথা লিখে ফেললে মন অনেক হালকা হয়ে যায়। আর মনের কষ্টও কমে যায়।
সেদিন হঠাৎ বৃষ্টি এল। আষাঢ় মাসের বৃষ্টি। উনি লেখা বন্ধ করে জানলার কাছে গিয়ে বসলেন।
বরাবর দেখেছি, বৃষ্টির সঙ্গে ওঁর খুব গভীর একটা সম্পর্ক। বৃষ্টি আর উনি যেন পরস্পরের মনের কথা বোঝেন।
আর কারো সঙ্গে বৃষ্টির এমন বন্ধুত্ব দেখিনি।
কতবার দেখেছি; শান্তিনিকেতনে দেখেছি, শিলাইদহে দেখেছি, সাজাদপুরে দেখেছি, বৃষ্টি এসেছে, উনি তাকিয়ে আছেন মেঘের দিকে, আকাশের মধ্যে যেন হারিয়ে গিয়েছেন, সেই সময়ে উনি একেবারে অন্য মানুষ, সংসারের বাইরের মানুষ।
গান লেখার সময়েও ওইরকম। অন্য কিছু লেখার সময় হয়তো তবু কথা বলা যায়।
কিন্তু বৃষ্টি আর গানের সঙ্গে উনি একাকার হয়ে থাকেন। তখন উনি আমাদের কেউ নন।
আমার কী সৌভাগ্য—এই দুই ভাবের মধ্যেই আমি ওঁকে কতবার কত কাছ থেকে দেখেছি।
আমি ওঁর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। উনি ডুবে আছেন। টের পাননি। টেবিলের উপর ওঁর লেখার কাগজ। কলম। কী লিখছিলেন উনি? লেখা বন্ধ করে উঠে গিয়েছেন জানলার কাছে চেয়ারটিতে।
টেবিলের কাছে গিয়ে দেখি মুক্তোর মতো হাতের লেখায় ইন্দিরাকে একটি চিঠি লিখছেন।
কোথাও একটি কাটাকুটি নেই। কী এক তোড়ে বেরিয়ে এসেছে তাঁর মনের কথা! আমার সব চিঠিটা মনে নেই। কিন্তু তার ভিতরের কথাটা মনে আছে।
উনি লিখেছেন, যারা খুব অল্প অনুভব করে, অল্প চিন্তা করে, অল্পই কাজ করে, তাদের সংসর্গে মনের কোনও সুখ নেই। ঠিক এই ভাষায় লেখেননি, কিন্তু মোদ্দা কথাটা তাই।
চিঠির শেষে লিখছেন, আমাদের সমস্ত জীবনের সফলতাটা যে জায়গায় সেইখানে একটা প্রেমের স্পর্শ, একটা মনুষ্য-সঙ্গের উত্তাপ সর্বদা পাওয়া আবশ্যকনইলে তার ফুলে-ফলে যথেষ্ট বর্ণ গন্ধ এবং রস সঞ্চারিত হয় না। কথাগুলি আমার এমনভাবে মনে ধরল যে মুখস্থ হয়ে গেল!
উনি তো কখনও আমাকে এই ভাষায় এমন ভাবের চিঠি লেখেননি! কেনই বা লিখবেন?
আমি কি এমন চিঠির, এমন ভাব আর ভাষার যোগ্য? আমি কি দিতে পারব জীবনের সফলতার জায়গায় প্রেমের স্পর্শ? আমার সঙ্গের উত্তাপ?
আর দিতে যদি পারিও, আমার মতো অতি সাধারণ একটি মেয়ের প্রেমের কী দাম?
একবার ইচ্ছে হল, ওঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াই, ঢুকে পড়ি ওঁর ভাবের ঘরে আর স্পষ্ট কণ্ঠে ওঁকে প্রশ্ন করি, সত্যি করে বলো, আমাকে বিয়ে করেছিলে কেন?
জিগ্যেস করতে পারিনি। পারলে তো আমি অন্য মেয়ে হতুম। বলা যায় না, এমন প্রশ্ন করতে পারলে হয়তো উনি আমাকে ওঁর প্রেমের যোগ্য ভাবতেন কোনওদিন।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম নিঃশব্দে।
কেন তুমি আমাকে বিয়ে করতে গেলে?
আমার প্রিয় রবীন্দ্রনাথ, কেনই বা তোমাকে আমি এ-প্রশ্ন করতে চেয়েছিলুম? এ-প্রশ্নের উত্তর, সঠিক উত্তর, তুমি কিছুতেই দিতে পারতে না।
সেই স্বীকারোক্তি তোমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।
আমি কিন্তু জানি কেন তুমি বিয়ে করেছিলে আমাকে, তোমাদের বাড়ির এক গরিব কর্মচারীর অতি সাধারণ দশ বছরের কন্যাকে।
তোমার তখন বয়েস প্রায় তেইশ।
নতুন বউঠান তোমার জীবনে তখন একমাত্র ভালোবাসার মেয়ে, তোমার ধ্রুবতারা—তার বয়েস পঁচিশ, তাঁকে ছাড়তে বাধ্য হলে তুমি। আর বিয়ে করতে বাধ্য হলে ন’বছর ন’মাসের আমাকে!
কী দিতে পারতুম আমি?
কী-ই বা তোমার পাওয়ার ছিল আমার কাছে?
কেন তুমি বিয়ে করতে বাধ্য হলে, সে-গল্প আমি একটু-একটু করে বুঝতে পেরেছি।
কত মুখে কত কথা শুনতে-শুনতে বুঝেছি, তোমার জীবনে আমার জায়গাটা কোথায়।
তোমার সঙ্গে তোমার নতুন বউঠানের বন্ধুত্ব বলো, সম্পর্ক বলো, মনের দেয়ানেয়া বলল, ভালোবাসা বলল, তা যে কত গভীরে গিয়ে পৌঁছেছিল, সেকথাও আমি ক্রমশ বুঝতে পেরেছিলুম।
তোমার যখন দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়ার কথা হল—এবার বিলেত যাবে তুমি ব্যারিস্টার হতে—সেই খবর পেয়ে নতুন বউঠান আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি।
কেন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলেন তিনি?
কারণ, ঠাকুরবাড়িতে তিনি কারও সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেননি।
আমার মতো তিনিও ছিলেন এ-বাড়ির কাজের লোকের মেয়ে। তাঁর সঙ্গেও তাঁর স্বামীর বয়েসের অনেক তফাত।
তাঁকে তোমার নতুন দাদার যোগ্য স্ত্রী বলে কেউ মনে করতেন না। এমনকী তোমার নতুন দাদাও নন।
একমাত্র তুমি ছিলে তাঁর বন্ধু।
তাঁর একটিমাত্র মনের মানুষ।
একমাত্র তোমারই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তাঁর ভারি মধুর এক সম্পর্ক। তুমি যখন প্রথমবার বিলেত গেলে, তোমার বয়স সতেরো। তোমার নতুন বউঠান কুড়ি। তুমি তাঁকে দেড় বছরের জন্যে ফেলে রেখে গিয়েছিলে এমন এক পৃথিবীতে যেখানে প্রতি মুহূর্তে তিনি তোমার অভাব বোধ করেছেন এবং কষ্ট পেয়েছেন।
নতুন দেশে, নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে তুমি কিন্তু অতটা কষ্ট পাওনি রবি ঠাকুর।
আমি অনেক ভেবেছি। এবং ভাবতে ভাবতে কিছু সত্যের সন্ধান পেয়েছি। আস্তে-আস্তে আমার চোখের সামনে থেকে পরদাটা সরে গিয়েছে।
আমি অনেকগুলি সিঁড়ি পেরিয়ে ধাপে-ধাপে তোমার আমার সম্পর্কের আসল জায়গাটায় পৌঁছোতে পেরেছি।
সেটা হল সত্যের তলানি।
যে-কথা বলছিলুম। তুমি বিলেত যাওয়ার আগে আমেদাবাদে গেলে তোমার মেজোদাদার কাছে। তিনি চাইলেন বিলেত যাবার জন্যে তোমাকে তৈরি করতে।
কেমন ভাবে তৈরি করা?
বিদেশকে যারা দেশের রস দিতে পারে সেইরকম মেয়েদের সঙ্গে তোমাকে মিলিয়ে দিয়ে তৈরি করা।
তোমাকে পাঠিয়ে দিলেন বম্বেতে বন্ধু ডাঃ আত্মারাম পাণ্ডুরঙের বাড়িতে থাকার জন্যে।
সেই বাড়িতে থাকে আত্মারামের সদ্য বিলেত ফেরত সুন্দরী কন্যা। এই মারাঠি মেয়ে শেখাবে তোমাকে বিলিতি বুলি আর আদবকায়দা।
কিন্তু সে তো তোমার প্রেমে পড়ল গো রবি ঠাকুর। তোমার প্রেমে কে না পড়বে বলো?
তুমিও পড়লে তার প্রেমে—সেটাই তো খবর।
সেই মেয়ের মারাঠি নাম ছিল আন্না।
তুমি ভালোবেসে তার নাম রাখলে ‘নলিনী’।
তুমি তাকে নিয়েই লিখলে তোমার কাব্য ‘কবিকাহিনি’।
তোমার বড়দাদা আমার বিয়ের পরে আমার আইবুড়ো নাম ভবতারিণী বদলে নতুন নাম রাখলেন ‘মৃণালিনী।’
কেন মৃণালিনী অনেক পরে জেনেছিলুম।
নলিনী-ই কি মৃণালিনী নয়? আমার নাম শুনলেই যাতে তোমার জীবনের প্রথম প্রেমিকার কথা তোমার মনে আসে, তাই আমার নাম হল ‘মৃণালিনী।’ আমি অন্য এক মেয়ের ছায়া হয়ে এলুম তোমার জীবনে।
প্রথম থেকেই আমার নিজের বলতে কিছুরইল না। মুছে দিলে তোমরাই।
নলিনীকে অবিশ্যি ভুলতে তোমার বেশি সময় লাগেনি।
তোমার মুখেই আমি নলিনীর গল্প শুনেছি।
সেই মেয়ে যে চাঁদনি রাতে তোমার খাটে একা এসে বলেছিল, আমার হাত ধরে টানো তো, দেখি টাগ-অফ-ওয়া’র কে জেতে—সেই মেয়ে যে তোমাকে বলেছিল, রাখলাম আমার হাতের দস্তানা তোমার সামনে, এবার আমি ঘুমিয়ে পড়ছি, এই সুযোগে যদি দস্তানাটা চুরি করতে পারো, তাহলে তুমি পাবে আমাকে চুমু খাবার অধিকার কী সাহসী মেয়ে গো! পারব কখনও অচেনা পুরুষকে এসব কথা বলতে?
তুমি তো তার প্রেমে পড়বেই। কিন্তু বিলেতে মেমসায়েব দেখে নলিনীকে গেলে ভুলে ক’দিনের মধ্যেই। অথচ ‘কবিকাহিনী,’ ‘ভগ্নহৃদয়’ তাকে নিয়েই লেখা।
নলিনীকে ভুললে কার প্রেমে পড়ে?
লুসি স্কটের প্রেমে পড়ে।
লন্ডনে যাঁদের বাড়িতে গিয়ে উঠলে তুমি সেই ভদ্রলোকের চার মেয়ে।
লুসিই ছোট মেয়ে।
তার সঙ্গে শুরু করে দিলে গানবাজনা-প্রেম। শুধু কি লুসি? তোমার মুখেই তো শুনেছি আরও অনেক নাম—মিস লং, মিস ভিভিয়ান, মিস মুল।
তুমি তো নতুন বউঠানকে জানিয়েও ছিলে, বিলেতে অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে নাচতে তোমার মন্দ লাগে না। জানিয়েছিলে, যেদিকে পা বাড়াও সেদিকেই বিবিদের গাউন। জানিয়েছিলে, যেদিকে চোখ ফেরাও চোখ ঝলসে যায় মেয়েদের রূপে। জানিয়েছিলে, সকলের মুখে হাসি আর হাসতে হাসতেই এইসব বিলিতি মেয়েরা পুরুষের মন অধিকার করার যত প্রকার গোলাগুলি আছে, সব তারা অকাতরে নির্দয়ভাবে বর্ষণ করছে। জানিয়েছিলে, বিলেতে যে-ঘর যত পিছল সে-ঘর তত নাচার উপযুক্ত। জানিয়েছিলে, এই পিছল ঘরে পা কোনও বাধা পায় না, আপনাআপনি পিছলে আসে।
আমি কী করে জানলুম, তোমার নতুন বউঠানকে তুমি লিখেছিলে এইসব কথা?
এসব কথা তো ছাপার অক্ষরেই লেখা আছে। আর আমি তো বুঝতে পেরেছি, এসব লেখা তোমার নতুন বউঠানকেই লেখা চিঠি।
তুমিই লিখেছ নতুন বউঠানকে, এইসব মেয়েদের কেউ তোমাকে ডেকেছে ইশারায়, কেউ চাপল্যের মাধুর্যে। কারও কাছে পেয়েছ রোম্যান্টিক উষ্ণতা। কারও সঙ্গে একা বেড়াতে গেছ বনের পথে। কারও সঙ্গে নেচ্ছে। কারও সঙ্গে গেয়েছ। কেউ দিয়েছে স্পর্শসুখ। কেউ মনের তৃপ্তি।
তুমি তো নিজেই লিখেছ রবি ঠাকুর, তোমার চেহারাটা যে নেহাত মন্দ নয় একথা তুমি প্রথম টের পেলে বিলেতে।।
তুমি তো স্বীকার করেছ, তোমার বয়স হয়েছিল একটু দেরিতেই। ইঙ্গিতে বলেছ, বিলেতের মেয়েরাই তোমাকে প্রাপ্তবয়স্ক করল—তাই তো?
আমি তখন তোমার জীবন থেকে অনেক দূরে।
আমি তখন ফুলতুলি গ্রামে বছর পাঁচেকের শিশু। আরও বছর পাঁচেক পরে তোমারই সঙ্গে আমার বিয়ে হবে!
ভাবো একবার! কী এক অসম্ভব অবাস্তব ঘটনা ঘটল বলো তো?
একদিকে তোমার জীবনে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছেন নতুন বউঠান কাদম্বরীদেবী।
অন্যদিকে তুমি শরীরে-মনে বড় হয়ে উঠছ বিলেতে, বিলিতি মেয়েদের সঙ্গসুখ পাচ্ছ, আন্নার মতো মারাঠি মেয়েও এসেছে তোমার জীবনে, কেউ তোমাকে বলছে আমার দস্তানা চুরি করলে আমাকে চুমু খাবার অধিকার পাবে তুমি, আর কেউ তোমার উপর অকাতরে বর্ষণ করছে মন অধিকারের গোলাগুলি—সেই সব ছেড়ে, কিংবা ছাড়তে বাধ্য হয়ে তুমি বিয়ে করলে আমাকে!
কেন, রবি ঠাকুর, কেন?
সেই ‘কেন’-র উত্তর আমাকে তুমি দাওনি। দিতে পারোনি।
অন্য কেউও দেয়নি।
তবে সেই ‘কেন’-র উত্তর ছড়িয়েছিল ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের নানা টিপ্পনিতে, আড়চোখের চাউনিতে, বিদ্রূপে, নানা কথাবার্তার চোরাস্রোতে।
যেমন করে ডুবুরি ডুব সাঁতার দিয়ে আহরণ করে সাগরতলার মণিমুক্তো, তেমনি করে আমিও পেয়েছি আমার গভীর ব্যথার নীলকান্তমণি—আমার সেই ‘কেন’র উত্তর।