আমি যে লেখক নই এবং এই লেখাটার উপর যে আমার বিন্দুমাত্র হাত নেই, সেটা নিশ্চয় আপনারা এতক্ষণে বুঝে গেছেন। এবং অনেক আগেই হয়তো লেখাটা পড়াই বন্ধ করে দিয়েছেন।
আবার অনেকে হয়তো আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে কিংবা রবি ঠাকুর আর আমার ব্যক্তিগত জীবনের হাঁড়ি এই যে এইভাবে হাটে ভাঙছি আমি, সেই কারণেই লেখাটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি।
যাঁরা এখনও আমার সঙ্গে আছেন, তা সে যে কারণেই হোক, তাঁদের জিগ্যেস করছি, মনে আছে কি আপনাদের এই লেখাতেই বেশ কিছু আগে আমি বলেছি, রবি ঠাকুর আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি!
প্রশ্নটা খুবই সহজ—কেন রবি ঠাকুর, কেন তুমি বিয়ে করলে আমাকে?
সেই ‘কেন’র উত্তর আমার বর আমাকে দেয়নি।
দিতে পারেনি।
আমি লিখেছিলুম, সেই ‘কেন’-র উত্তর উঁকিঝুঁকি মারছিল ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের টিপ্পনিতে, আড়চোখের চাউনিতে, নানারকম বাঁকা কথার চোরাস্রোতে।
ডুবুরি যেমন খুঁজে পায় সমুদ্রের অনেক নীচের মণিমুক্তো, তেমনি করে আমি পেয়েছি আমার সেই ‘কেন’-র উত্তর।
এই ‘কেন’-র উত্তর লুকিয়ে আছে রবি ঠাকুরের জীবনের একান্ত গোপন এক কাহিনির মধ্যে।
সেই গল্প আমি একটু একটু করে জোগাড় করেছি।
এই গল্পের মধ্যেই আমার বর রবি ঠাকুরের আর এক পরিচয়। চাঁদের উলটো পিঠ। একটা কথা, আমি কিন্তু এ-গল্প আমার স্বামীর নিন্দে করার জন্যে লিখছি না।
যা ঘটেছে তা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।
কোনও অন্যায় নেই এই কাহিনির মধ্যে।
আর আমরা তিনজনেই এই ঘটনার শিকার—আমার বর, তার নতুন বউঠান আর আমি।
১৮৭৮ সালে আমার বরকে বিলেত যেতে হল। তখন তার বয়েস সতেরো।
উনিশ বছরের নতুন বউঠান পড়ে থাকলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে—অবহেলার মধ্যে।
কেউ তাঁর বন্ধু ছিল না এ-বাড়িতে। একমাত্র বন্ধু তাঁর দু-বছরের ছোট দেওর রবি ঠাকুর।
তাঁদের সম্পর্কটা কিন্তু শুধুমাত্র বউদি-দেওরের সম্পর্ক ছিল না। সতেরো বছরের রবি ঠাকুর, উনিশ বছরের কাদম্বরী, একজন কবি আর অন্যজন অসম্ভব একলা এক মেয়ে, যাঁকে কেউ ভালোবাসে না, সবাই যাঁকে বাজার সরকারের মেয়ে বলে নীচু চোখে দেখে আর যাঁর সঙ্গে স্বামী জ্যেতিরিন্দ্রনাথের সম্পর্কে তেমন কোনও মনের আঁট তৈরি হয়নি বলে আমার ধারণা।
সব মেয়েরই বুকের মধ্যে ভালোবাসার জন্যে একটা তীব্র তেষ্টা থাকে। আমার তেষ্টা থেকেই সেকথা আমি বুঝতে পেরেছি।
নতুন বউঠানের তো কোনও বাচ্চা হয়নি। মেয়েরা মা হলে অনেক অভাব পূর্ণ হয়ে যায়।
নতুন বউঠানের মনের ভিতরটা খাঁ-খাঁ করত। খুব দুঃখী ছিলেন তিনি। রবি ঠাকুরের ভালোবাসা নতুন বউঠানের মনের কষ্ট অনেকটাই জুড়িয়ে দিয়েছিল।
হঠাৎ যখন তাঁর অনেক ভালোবাসার দেওরটি বিলেতে চলে গেল, কী ভাবে দিন কেটেছিল তাঁর?
একবারও কি কেউ ভেবে দেখেছে সেকথা?
এমনকী সতেরো বছরের রবি ঠাকুরের কি সেকথা ভাববার সময় ছিল?
না, ছিল না। কিন্তু রবি ঠাকুরের কথায় পরে আসছি।
প্রথমে নতুন বউঠানের কথা।
১৮৬৮ সালে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বউ হয়ে এ-বাড়িতে আসেন। আর ১৮৭৮-এ, অর্থাৎ দশ বছর পরে তাঁর পরম বন্ধু, প্রিয়তম মানুষটি তাঁকে ছেড়ে চলে গেল সাতসমুদ্র পেরিয়ে এক অজানা দেশে। কবে সে ফিরবে, কেমন হয়ে ফিরবে, ফিরে আর নতুন বউঠানকে মনে ধরবে কি না, কিছুই তাঁর জানা নেই।
বাড়ির লোকজন সবাই তাঁকে হেয় করে। কেউ তাঁকে ভালোবাসে না। নতুন বউঠানের বুকের ভিতরটা কতখানি হু-হু করত সারাক্ষণ তাঁর প্রিয় মানুষটির জন্যে, তা আন্দাজ করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। একা ঘরে কত নিঃসঙ্গ কান্নাই না তিনি কেঁদেছেন তখন।
এই যে দশ বছর তিনি ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে দিনরাত অবহেলা আর চাপা অপমান সহ্য করেছেন, তার মধ্যে একমাত্র তাঁর ঠাকুরপোর মমতাই যেন নতুন বউঠানকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
প্রথম ক’বছর তো খেলার সাথি। তারপর প্রিয় রবি যখন মাতৃহারা হল, সেই মাতৃহারা বালকটিকে স্নেহে-মায়ায়-মমতায় যে মেয়েটি ঘিরে থাকল, মায়ের অভাব বুঝতে দিল না, সেও তো বালিকাই তখন। কিন্তু তবু যেন রাতারাতি কত বড় হয়ে উঠল সেই মেয়ে—রবি ঠাকুরের নতুন বউঠান।
রবি ঠাকুরের বয়েস তখন বছর বারো। আর নতুন বউঠান চোদ্দো বছরের। বালিকা বলব? না কিশোরী?
আমার যে তাঁকে কিশোরী বলতেই ইচ্ছে হচ্ছে। রাধিকা তো ওই বয়েসেই রাইকিশোরী হয়ে উঠেছিল। আর আমি তো সে-বয়েসে মা হয়ে গেছি।
বারো বছরের রবি ঠাকুরের পৈতে হল। তার জন্যে কে বেঁধে দিল হবিষ্যি?
কে আবার, চোদ্দো বছরের সেই রাইকিশোরী।
আমার বর সেই হবিষ্যির স্বাদ এখনও ভুলতে পারেনি। যা সে বলেছে আমাকে, তার মতো করে তো আমি বলতে পারিনে—তার কথাগুলোই যতদূর মনে পড়ছে হুবহু লিখে দিলুম—
মনে পড়ে, বউঠাকরুণ হবিষ্যান্ন বেঁধে দিত, তাতে দিত সামান্য গাওয়া ঘি। ওই তিনদিন তার স্বাদে-গন্ধে মুগ্ধ হয়েছিলুম লোভীর মতো।।
আর একদিন আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে বললেন, বুঝলে ছোটবউ, ছেলেবেলায় আমি পান্তাভাত খেতে ভালোবাসতুম।
আর সেই পান্তার স্বাদে যেদিন যুক্ত হত নতুন বউঠানের আঙুলের স্পর্শ, অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না।
শুধু কিন্তু হবিষ্যি আর পান্তার মধ্যেই আমার বরের মুগ্ধতা বন্দি হয়ে থাকল না।
তার মনের মধ্যে অন্য ঢেউ উঠল। একদিন আমার বর আর আমি একলা বেড়াতে বেরিয়েছি পদ্মার চরে।
বিকেলবেলা। আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। সেদিকে তাকিয়ে আপনাদের রবি ঠাকুর বললেন, নতুন বউঠানের চোখ দুটো এমনভাবে আমার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে আছে যে জ্বলজ্বল করতে থাকে, কিছুতেই ভুলতে পারি নে। যদি আঁকতে পারতুম তো বারবার তার চোখ দুটিকে আঁকতুম।
আসলে আমার বর তার নতুন বউঠানকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল খুব কাঁচা বয়েসে।
আর নতুন বউঠান?
বলতেই হবে সেকথা?
না, আমি বলতে চাইনে। আমি যদি লেখক হতুম বলতে পারতুম। যা বলা যায় না, বলতে নেই, তাও লেখকরা কেমন সুন্দর করে বলতে পারেন।
শুধু একটা কথা না বলে পারছি না—রবি ঠাকুর যখন সতেরো বছর বয়েসে হঠাৎ বিলেত চলে গেল, উনিশ বছরের নতুন বউঠান তখন কত যে কষ্ট পেয়েছিল, তা লিখে বোঝাতে পারব না।
আপনাদের রবি ঠাকুর কিন্তু অত কষ্ট পাননি। একথা আগেও বলেছিনা?
তিনি তো নতুন দেশে কত নতুন অভিজ্ঞতা আর মজার মধ্যে গেলেন। কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে কমবেশি ভালোবাসাও তো হল। তখন কি নতুন বউঠানের কথা তাঁর মনে পড়েছিল? কী করছে, কেমন করে দিন কাটছে নতুন বউঠানের জোড়াসাঁকোর অবহেলায় অপমানে?
আমাকে নতুন বউঠান সম্পর্কে কত সময়ে কত কথাই তো বলেছেন আপনাদের রবি ঠাকুর। কিন্তু কোনও কোনও কথা আবার বলেননি। বেশ বুঝতে পারতুম বলতে চাইছেন না।
তিনি যা বলেছেন আমাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি বলেননি। কতটা বলতে হয় আর কোথায় দাঁড়ি টানতে হয় তাঁর মতো আর কে জানে?
একদিন জিগ্যেস করেছিলুম—একদিনই শুধু—তুমি নতুন বউঠানকে বিলেত থেকে নিশ্চয় অনেক চিঠি লিখেছিলে। আর তিনি তো আমার মতো মুখ ছিলেন না যে তোমাকে চিঠি লিখতে ভয় পেতেন। একদিন দেখাবে তুমি আমাকে ওঁর লেখা একটা চিঠি?
আমার এ-প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর দিলেন না উনি। শুধু ওঁর ফরসা মুখটা আরও লাল হয়ে উঠল। কী জানি, হয়তো রেগে গেলেন আমি আলটপকা এভাবে কথা বলে ফেলেছি বলে। স্ত্রীর অধিকার তিনি আমাকে নিশ্চিত দিয়েছেন। কিন্তু এতটা নয়।।
দু-তিনদিন পরে উনি আমাকে বললেন, একটু মজা করেই বললেন বলে মনে হল, আসলে ওঁর মনের কথা যে ঠিক কী তা বুঝতে পারতুম না সব সময়ে, ওঁর মনের উপর অনেক ঢাকনা যে-কথা বলছিলুম, উনি বললেন, নতুন বউঠাকরুণকে লেখা আমার অনেক চিঠি ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। যাকে লিখছি সে ঠিকই বুঝত, তাকেই এসব চিঠিতে আভাসে ইঙ্গিতে অনেক কথা বলছি—আর কেউ বুঝত না।
এখানে একটু যেন কী ভাবলেন আপনাদের রবি ঠাকুর। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, নতুন বউঠানকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলুম বিলেতের মেয়েদের কথা—সবার নাম জানাতাম, মিস ভিভিয়ান, মিস লং, মিস মুল আর অবশ্যই মিস লুসি স্কট। এইসব বিলিতি বিবিরা যে আমার আকর্ষণে সাড়া দিয়েছিল সেকথা নতুন বউঠানকে গর্বভরে জানাতে দ্বিধা করিনি। তবে নতুন বউঠান নিশ্চয়ই ভাবত, আমি যেরকম লাজুক আর মুখচোরা, বিলেতের তরুণীমহলে আমি কিছুতেই ভিড়তে পারব না। সেটা অবিশ্যি বউঠাকরুণের ধারণা। বিলেতের সব মেয়েদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা একরকম নয় ছোটবউ। মেয়েরা এমন বিচিত্র বলেই তো তাদের আকর্ষণের এতরকম রং। লুসিকে ভালোলাগত তার চাপল্যের মাধুর্যের জন্যে। ভিভিয়ান ছিল অস্পষ্ট, কেমন যেন ইশারাময়। মিস লং চাইত আমার সঙ্গে অরণ্যের নির্জনতায় যেতে। আর মিস মুল ভালোবাসত নাচতে-গাইতে। একটা কথা বলতে পারি, এদের সান্নিধ্যে আমার লজ্জা ভাঙল, দ্বিধা ঘুচল। একটি চিঠিতে মনে পড়ে, এসব কথা লিখেও ছিলুম নতুন বউঠাকরুণকে।
বিলেতের তরুণীমহলে যখন আমার বরের প্রতিষ্ঠার কানাঘুষো এসে পৌঁছোচ্ছে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে, তখন সেই বাড়িতেই কেমন ছিলেন নতুন বউঠান? কী নিয়ে কীভাবে কাটছিল তাঁর দিনরাত?
নতুন বউঠানের বয়েস তখন কুড়ি ছুঁইছুঁই। তাঁর প্রাণের মানুষটি বিলেত চলে যাবার পর তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে একলা মানুষ। এবং এই অপবাদের অপমান তাঁকে বয়ে চলতে হচ্ছিল যে তিনি বাঁজা। তাঁর কোনওদিন বাচ্চা হবে না। ঠাকুরবাড়ির মহিলামহলে তিনি ছিলেন সবচেয়ে অপমানিত। একে বাজার সরকারের মেয়ে, তায় সন্তান ধারণে অক্ষম, তায় আবার গায়ের রং কালো কোথায় লেখাপড়া জানা মাজাঘষা ঝকঝকে জ্ঞানদানন্দিনী যিনিও তখন বিলেতে, আর কোথায় ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকারের মেয়ে—এ-মেয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী! বিয়েটাকেই তো অনেকে অচল বলে ধরে নিয়েছিলেন। মাথা নিচু করে এই অচল বিয়ের অপবাদ মেনে নেওয়া ছাড়া নতুন বউঠানের কোনও উপায় ছিল না।
তিনি একটি জিনিস মনেপ্রাণে চাইছিলেন—কেউ তাঁকেও ভালোবাসুক। সেই ভালোবাসা তিনি পেলেন ছোট্ট ঊর্মিলার কাছ থেকে।
কে এই ছোট্ট মেয়ে যাকে বুকে করে বেঁচে থাকতে চাইলেন নতুন বউঠান?
উর্মিলা হল আমার বরের ন’দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে।
নিঃসন্তান নতুন বউঠান বুকে টেনে নিলেন এই মেয়েটিকে।
ঊর্মিলার কাছ থেকে তিনি পেলেন একটি শিশুর নিখাদ ভালোবাসা। নতুন বউঠানই এই শিশুকে দেখতেন শুনতেন খাওয়াতেন পরাতেন। নতুন বউঠানের ঘর ছিল বাইরে, তেতলার ছাদে। বাড়ির অন্দরমহলের বাইরে থাকতেই হয়তো তিনি আরাম পেয়েছিলেন।
শুনেছি ওই ছাদের ঘরে একাই থাকতেন তিনি উর্মিলাকে নিয়ে। যেন তাঁরই মেয়ে ঊর্মিলা।
বাড়ির অন্দরমহলের সঙ্গে মা-মেয়ের তেমন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এই সুখ সইল না নতুন বউঠানের ভাগ্যে।
তেতলার ছাদের ওই ঘরের পাশেই ছিল নীচে যাওয়ার লোহার সিঁড়ি।
নতুন বউঠানের চোখের আড়ালে ছোট্ট উর্মিলা একাই নামতে গেল সেই সিঁড়ি দিয়ে।
শীতের সন্ধে। জায়গাটা অন্ধকার।
উর্মিলার পা গেল ফস্কে। লোহার সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে সে পড়ে গেল নীচে।
মাথায় আঘাত লেগে অজ্ঞান হয়ে গেল।
আর জ্ঞান ফিরল না উর্মিলার।
এই ঘটনার পরে যা হওয়ার তাই হল। একে বাঁজা তায় অপয়া, অলক্ষ্মী—ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে একঘরে হয়ে গেলেন নতুন বউঠান। তার মুখ দেখলেও অকল্যাণ হয়—এমন রটনাও শোনা গেল ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে।
একদিন শান্তিনিকেতনে আপনাদের রবি ঠাকুরের মুখেই শুনেছিলুম এই ঘটনার পরে নতুন বউঠান কেমন ছিলেন, সেই কথা।
কী গভীর গম্ভীরভাবে বলেছিলেন তিনি কথাগুলি। ওঁর মুখের কথা, যতটুকু মনে আছে, এইখানে লিখে দিলুম—এই ঘটনার পর নতুন বউঠান আরও নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। কারও সঙ্গে আর তেমন মিশত না। বিলেত থেকে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই এক নতুন ভাবে বউঠাকরুণকে আবিষ্কার করলেম।।
এই মেয়ে যেন তার সমস্ত ঘরকন্না, সমস্ত কর্তব্যের তলায় একটা সুড়ঙ্গ কেটে সেই নিস্তব্ধ অন্ধকারের মধ্যে একটি গোপন শোকের মন্দির তৈরি করে তারই মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে— সেখানে তার স্বামী বা কারও কোনও অধিকার নেই।
উনি দেড় বছর পর বিলেত থেকে ফিরলেন।
যে নতুন বউঠানকে উনি ফেলে গিয়েছিলেন আর যাঁর কাছে ফিরে এলেন উনি, তাঁরা কি একই মানুষ?
তা কি হতে পারে?
দেড় বছর যে অনেক সময়।
আমার তো মনে হয় অনেক ব্যথা, অভিমান, অপমান, একাকিত্ব আর ভালোবাসা নিয়ে নতুন বউঠান পথ চেয়ে বসেছিলেন ওঁরই জন্য। নতুন বউঠান যে নিজের মধ্যে আরও ঢুকে গেছেন, তাঁর ভেতরটা যে এখন নির্জন শোকের মন্দির—একথা ঠাকুরবাড়ির আর কেউ না বুঝুক, উনি বিলেত থেকে ফিরেই বুঝতে পেরেছিলেন। কী করে নতুন বউঠানকে বের করে আনা যায় সেই শোকের মন্দির থেকে? তাঁর মনের অন্দরমহলে, যেখানে তাঁর স্বামীরও অধিকার নেই, কেমন করে প্রবেশ করা যায় সেখানে? পারবেন কি আপনাদের উনিশ বছরের রবি ঠাকুর তাঁর একুশ বছরের নতুন বউঠানের মনের গোপন অন্ধকারে অধিকারের আসনটি পাততে?
নতুন বউঠান তাঁর রবির সঙ্গে পুনর্মিলনের অপেক্ষাতেই তো দিন গুনছিলেন। বিলেত যাওয়ার আগে তাঁর কাছে বসেই তো রবি লিখত, পড়ত।
বিলেতের বিবিরা তাকে বদলে দেয়নি তো?
নতুন বউঠানকে আর কি সে আগের মতো ভালোবাসবে?
এই ভয়, অনিশ্চয়তা তো নতুন বউঠানের মনে ছিলই। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন বউঠানের মনের মেঘ কেটে গেল।
বিলেত থেকে ফিরেই নতুন বউঠানের তেতলার ছাদের ঘরের সামনে বাগান করতে শুরু করলেন তাঁর প্রিয় ঠাকুরপো।
সেই বাগান তৈরির গল্প উনি একদিন আমাকে শুনিয়েছিলেন শিলাইদহে।
সে এক বর্ষার সন্ধে।
তোড়ে নামল বৃষ্টি। উনি বসেছিলেন শোবার ঘরে জানলার পাশটিতে। কুঠিবাড়ির সামনে ধু-ধু পদ্মার চর।
জানলার পাশটিতে বসে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পাশে পাথরের টেবিলে জ্বলছে একটি শামাদান।
সেই আলোয় ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে ওঁকে।
আমি সেইদিকে তাকিয়ে বসে আছি কাছেই খাটের উপর।
উনি বললেন, বিলেত থেকে ফিরে নতুন বউঠানের সঙ্গে বাগান করতে শুরু করলেন।
এই কাজটি করতে বউঠাকরুণ খুব উৎসাহ পেল। নিজের মধ্যে যে শোকের মন্দিরটি সে তৈরি করে তারই ভিতর নিঃসঙ্গ নির্বাসনে দিন কাটাচ্ছিল, সেখান থেকে আমার সঙ্গে বাগান তৈরির কাজ তাকে বের করে আনল। লতা-পাতা-ফুল-ফল-পাখির ডাক ছাড়া এই কাজটি সম্ভব হত না।
আমি ওঁর কথা শুনে হঠাৎ বলে ফেললুম ওসব ডাকের কোনও মানেই হত না তোমার ভালোবাসার ডাক না থাকলে।
উনি খুব ধীরে-ধীরে বললেন, খুব ভালোবাসতেম নতুন বউঠানকে, বউঠাকরুণও আমাকে খুব ভালোবাসত।
তারপর আরও কথা বললেন উনি—ওই একবারই—আর কখনও বলেননি।
বললেন, সেইসব দিনগুলির কথা খুব মনে পড়ছে। সেই সুন্দর দিনগুলোকে যদি সোনার খাঁচায় বন্দি করে রাখতে পারতেম! বিলেত থেকে ফিরেই নতুন বউঠানের চোখের দিকে তাকিয়ে একটি কথা আমি বুঝতে পেরেছিলেম—নতুন বউঠান কোনওদিন মুখ ফুটে বলেনি, আমি কিন্তু অনুভব করেছিলেম বউঠান এক অসহায় একাকিত্ব এবং ঠাকুরবাড়ির নানা তির্যক অপমান থেকে একটা মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। আর তার ভিতরটা ছটফট করছে।
ছোটবউ, আমি ছাড়া ঠাকুরবাড়িতে আর কেউ ছিল না যে নতুন বউঠানের মনের খোঁজ রাখত। এই কথাটা আমি বিলেত থেকে ফেরার পরেই প্রথম সঠিকভাবে উপলব্ধি করলেম।
নতুন বউঠান আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাগান তৈরি করল।
আমি বললেম, বউঠান বাগান তো ফুলে-ফলে-লতায়-পাতায় ভরে উঠেছে। এবার তুমি বাগানের একটা নাম দাও।
নতুন বউঠান একটুও না ভেবে বলল, ঠাকুরপো, তুমি থাকতে আমি দেব নাম?
আমিও একটুও না ভেবে বললাম, নন্দনকানন।
বউঠানের নামটি ভারি পছন্দ হল। আমরা তখন শরৎকালের এক বিকেলবেলায় বাগানের মাঝখানটিতে দাঁড়িয়ে।
বউঠান মুখে কিছু বলল না। শুধু একবার তাকাল আমার চোখের পানে।
সেই দৃষ্টি মনে থাকবে চিরকাল। আর…
আর কী? প্রশ্ন করে ফেললুম ওঁর কথার মাঝখানে।
উনি বললেন, কী আর? বললেম বউঠান, আমাদের এই বাগানে রূপকথার রাজকন্যার মতো তোমাকে নিজের হাতে গাছে জল দিতে হবে।
নতুন বউঠান আমার হাতে হাত রেখে বলল, ওই পশ্চিমের কোণটাতে একটা কুঁড়ে তৈরি করে দিও, হরিণের বাচ্চা থাকবে।
আমি বললেম, আর একটি প্রস্তাব আছে বউঠান।
বউঠান প্রশ্ন না করে একটু হাসল।
আমি বললেম, যেন সেই হাসির উত্তরে, আর একটি ছোটখাটো ঝিল থাকবে, তাতে দু-চারটি হাঁস চরবে।
বউঠানের সে কী উৎসাহ, বললে শুধু ঝিল আর হাঁস হলে চলবে না ঠাকুরপো। ঝিলের মধ্যে তুমি-আমি দুজনে ফুটিয়ে তুলব নীলপদ্ম। আমার অনেক দিন থেকে নীলপদ্ম দেখবার সাধ আছে।
আমি বললেম, বেশ তো বউঠান, সেই নীলপদ্মের ঝিলের উপর একটি সাঁকো বেঁধে দেওয়া যাবে আর ঘাটে থাকবে ছোট্ট একটি ডিঙি। আমার কথা শোনামাত্র বউঠান বললে, ঘাট অবশ্য সাদা মার্বেলের হবে।
গল্পটা এই পর্যন্ত বলে আপনাদের রবি ঠাকুর অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
বাইরে বৃষ্টিও তখন প্রায় ধরে এসেছে।
আমি ভাবলুম, এই একান্ত ব্যক্তিগত কাহিনি উনি আর বেশিদূর আমাকে বলতে চান না।
আমি খাট থেকে নেমে টেবিলে শেজের আলোটা একটু উস্কে দিলুম। আর উনি তখুনি বললেন, কোনও একদিন একটা গল্প লিখব যেখানে বউঠান আর আমার এই বাগান করার ব্যাপারটা থাকবে।
–কী নাম দেবে সেই গল্পের?
–নষ্টনীড়।
–নষ্টনীড়? বাগান নিয়ে গল্প, তার নাম নষ্টনীড়? আমি তো অবাক।
—সে তুমি বুঝবে না ছোটবউ। গল্পটা তো বাগান নিয়ে হবে না। বাগানটা থাকবে, কিন্তু গল্পটা হবে এক নারীর গল্প, যে-নারী চারদিক থেকে আক্রান্ত। তার জন্যে এ-পৃথিবীতে এমন স্থান নেই যেখানে সমস্ত হৃদয় উদঘাটিত করে দিয়ে সে হাহাকার করে উঠতে পারে—বাগানটা তার হৃদয়ের মধ্যেই একটু-একটু করে মরে গেল।
—সেই মেয়েটির স্বামী—তিনিও কি বোঝেন না মেয়েটির মনের কষ্ট?
—তার স্বামীর মনের কথা দিয়েই শেষ হবে আমার সেই গল্প।
–কী তার স্বামীর মনের কথা? আমি প্রশ্ন না করে পারলুম না। কেন জানি না আমার সারা বুক জুড়ে তখন ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র এক যন্ত্রণা। আর ভয় করছে। কীসের ভয়!
রবি ঠাকুর বললেন, ধরো আমার সেই গল্পের একেবারে শেষে নিঃশব্দে স্বামীটি ভাবছে— আমি কোথায় পালাব? যে স্ত্রী হৃদয়ের মধ্যে নিয়ত অন্যকে ধ্যান করে, নির্জন বন্ধুহীন প্রবাসে তাকে সঙ্গদান করব কী করে? যে-স্ত্রীর অন্তরের মধ্যে অন্য পুরুষের ভাবনা, তাকে বুকের কাছে ধরে রাখার যন্ত্রণা কতদিন সহ্য করতে পারব? যে-আশ্রয় চূর্ণ হয়ে গেছে তার ভাঙা ইটকাঠগুলো আমাকেই বাকি জীবন কাঁধে করে বয়ে বেড়াতে হবে?
রবি ঠাকুর আবার চুপ করলেন।
আমি হঠাৎ বুঝলাম, পায়ের তলায় কোনও মাটি নেই আমার। আমার বুক ঘামে ভিজে যাচ্ছে।
জানলার ধারে চুপ করে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বিলেত থেকে আমার বর ফিরে এল। নতুন বউঠান তার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। এ যেন ছেলেবেলার বন্ধু, খেলার সাথীকে নতুন করে পাওয়া।
গল্পটা কিন্তু আরও অনেক দূর গড়াল।
আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে সবটা বলেননি। যা বলেছেন তার মধ্যেও অনেক আড়াল আছে।
আমি একটু একটু করে সেই আড়াল সরাবার চেষ্টা করেছি।
কেন করেছি?
হয়তো আরও ব্যথা পেতে ভালোলেগেছে, তাই।
স্বামীর জীবনে তার জায়গা ঠিক কোথায়, সেইটুকু অন্তত জানতে কোন স্ত্রীর না ইচ্ছে করে?
আড়াল সরিয়ে আমি সত্যিটা জানতে চেয়েছি সেই কারণেও।
আর একটা কারণ আছে।
রবি ঠাকুর কেন আমাকে বিয়ে করলেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতেও আমার এই আড়াল সরিয়ে-সরিয়ে সন্ধান। একটা কথা বলি, যত আমি এগিয়েছি সত্যের দিকে, ততই আমি আমার স্বামীকে আমার মতো করে ভালোবেসেছি, আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছি। তাঁকে ভালোবেসেছি আমার জীবনে দুঃখদানের দেবতা হিসেবে। আর বেদনাও পেয়েছি ততই বেশি।
আমার ভিতরটা বরফ হয়ে গেছে। আমার বরের বয়েস তখন একুশ। নতুন বউঠান তেইশ। শোনা কথা, গুজব, উড়ো গল্প থেকে আমি বুঝতে পাচ্ছিলুম আস্তে আস্তে যে আমার বর আর তার নতুন বউঠানের সম্পর্কটা হয়ে উঠল খুব গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক।
আমি আপনাদের রবি ঠাকুরের সঙ্গে এত বছর ঘর করলুম, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের (না কি ছয় বলব?) মা হলুম,—তাঁকে আমি যতটুকু বুঝেছি, তিনি আর কোনও মেয়েকে নতুন বউঠানের মতো ভালোবাসেননি। আমার বর বিলেত থেকে ফিরে আসার পর ঠিক কী হয়েছিল?
এক কথায়, ঠাকুরবাড়িতে নতুন প্রাণের জোয়ার এসেছিল।
রবি ঠাকুর কবিতায়, গানে, সাহিত্যচর্চায় ভরিয়ে দিলেন, ভাসিয়ে দিলেন।
সেই জোয়ার নতুন বউঠানকে ভাসিয়ে নিয়ে এল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির একেবারে মাঝখানে।
আর যিনি ছিলেন মাঝখানে, জ্ঞানদানন্দিনী, তিনি ভেসে চলে গেলেন দূরে।
সব আলো এসে পড়ল কাদম্বরীদেবীর মুখে।
আমার বর গান লেখে, সুর দেয়, কবিতা লেখে—সবই তারই জন্যে। আর নতুন বউঠান টিপ্পনি কেটে বলেন, যতই লেখো না কেন, বিহারীলালের মতো লেখা তোমার দ্বারা সম্ভব হবে না। আমার বর তখন তার নতুন বউঠানের মন পাওয়ার জন্যে বিহারীলালের অনুকরণ করেও লিখেছে।
তার কাছ থেকে জেনেছি সেই গল্প—
বউঠাকরুণের ব্যবহার ছিল উলটো। আমি যে সত্যি-সত্যি কোনওকালে কিঞ্চিৎ লিখতে টিখতে সক্ষম হব এ সে কিছুতেই যেন মানতে পারত না। কেবল খোঁটা দিত আর বলত, ঠাকুরপো, বিহারী চক্রবর্তীর মতো লেখার চেষ্টা করছ, বটে, কিন্তু সে তুমি পারবে না। একথা বলবার পরেই নতুন বউঠান আড়চোখে হাসত। ভারি দুষ্টুমিভরা সেই হাসি।
আমার বর বোধহয় ক্রমেই বুঝতে পেরেছিল, এইভাবেই তার নতুন বউঠান তাকে আরও ভালো লেখার উৎসাহ দিচ্ছেন।
নতুন বউঠানই ছিলেন তাঁর লেখার প্রধান প্রেরণা। প্রিয় ঠাকুরপোটি দুপুরবেলা নতুন বউঠানের পাশে শুয়ে তার লেখা পড়ে শোনাত। আর হাতপাখা নেড়ে বাতাস করতেন নতুন। বউঠান।
সে-গল্প যে কতবার শুনেছি আমার বরের মুখে।
এই গল্প শোনাতে তার ভালোলাগে, নতুন বউঠানকে যেন চোখের সামনে দেখতে পায়। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ছোটবউ, দুপুরবেলা জ্যোতিদাদা নীচের তলায় কাছারিতে চলে গেল।
বউঠাকরুণ ফলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে-কেটে যত্ন করে রুপোর রেকাবিতে সাজিয়ে দিচ্ছে। নিজের হাতে তৈরি মিষ্টি—তাও সে কিছু দিয়ে দিচ্ছে সঙ্গে। কী সুন্দর করে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে নতুন বউঠান। সঙ্গে পাঠাচ্ছে ডাবের জল কিংবা বরফে ঠান্ডা করা তালশাঁস। সমস্তটার উপর রেশমের রুমাল বিছিয়ে মোরাদাবাদি খুনচেতে করে জলখাবার পাঠিয়ে দিত নতুন বউঠান রোজ দুপুরবেলা জ্যোতিদাদার জন্যে। তার মনটা ভালোবাসায় ভরা ছিল। সেই সহজ সরল ভালোবাসাকে ভালোবাসার মতো মানুষ নতুন বউঠান পায়নি। এইটে ছিল নতুন বউঠানের সবচেয়ে ব্যথার জায়গা ছোটবউ।
একটা কথা এখানে না বলে পারছিনা।
আমার তো মনে হয় ওঁর নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ক্রমে বুঝতে পারছিলেন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে প্রিয় দেওরটি প্রেমে পড়েছে। আর স্ত্রীও যে ভালোবাসার মতো একটি মানুষ পেয়েছেন এই সংসারে, সে-বিষয়েও আমার মনে হয় কোনও সন্দেহ ছিল না জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনে।
এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি হয়তো ভিতরে ভিতরে কষ্ট পেয়েছেন, তবু আমার বর আর ওঁর স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কটা আরও গভীর, আরও ঘনিষ্ঠ করে দেওয়ার পিছনেও তিনি।
তিনি সব দেখছিলেন, সব বুঝছিলেন। তবু এমন নাটক লিখলেন যাতে উর্বশীর ভূমিকার অভিনয় করলেন নতুন বউঠান আর মদনের ভূমিকায় আপনাদের রবি ঠাকুর। এ তো আগুনে ঘি ঢালা।
এখানেই থেমে থাকেননি এই অদ্ভুত মানুষটি। তিনি লিখলেন আর এক নাটক ‘অলীকবাবু।’ সেই নাটকের নায়ক আমার বর, নায়িকা নতুন বউঠান। দুপুরবেলা খাটে শুয়ে-শুয়ে এই নাটকের মহড়া দিতেন নতুন বউঠান তাঁর ঠাকুরপোর সঙ্গে।
অলীকবাবু আমি পড়েছি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে এই কথাগুলো তাঁর প্রিয় ঠাকুরপোকে বলিয়েছেন—আমি জগতের সমক্ষে, চন্দ্রসূর্যকে সাক্ষী করে মুক্তকণ্ঠে বলব, লক্ষবার বলব, তুমিই আমার স্বামী, শতবার বলব, সহস্রবার বলব, লক্ষবার বলব, আমিই তোমার স্ত্রী।
আমি যতবার পড়েছি লাইনগুলো আমার বুক কেঁপে উঠেছে। ভাগ্যিস আমার বিয়ের অনেক আগে এই অভিনয় হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে।
আমার সামনে হলে আমি সহ্য করতে পারতুম না।
খুব কষ্ট হত আমার। তবে এখন আর হয় না। এখন মনে মরচে পড়ে গেছে।
আমি তো লাইনগুলো শুধু পড়েছি।
তবু মনে হয়েছে, এসব নতুন বউঠানের মনের কথা। আমার বরেরও নিশ্চয় ভালোলেগেছিল তার সবচেয়ে ভালোবাসার মেয়েটির মুখে এই কথাগুলি। হতে পারে অভিনয়। সে তো শুধু আপাতভাবে।
এ তো একেবারে ভেতরের কথা।
যে বলছে, তার কাছে।
যাকে বলছে, তার কাছেও।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সব জেনেও কী করে ঘটালেন এমন ঘটনা?
তিনি কি ভালোবাসতে পারেননি তাঁর স্ত্রীকে? এতটুকুও? তাই তিনি চাইছিলেন অন্য কেউ তাঁকে ভালোবাসুক?
এ-প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না কোনওদিন।
শুধু এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত, আমার স্বামীর জীবনে যদি নতুন বউঠানের মতো কেউ না আসতেন, তাহলে তিনি আজ যা হয়েছেন এবং পরে হয়তো যা হতে চলেছেন, তা তিনি হতে পারতেন না।
রবি ঠাকুরের জীবনে আমি তাঁর স্ত্রী, তাঁর ছেলেমেয়ের মা, তাঁর সংসারে কাজের লোক।
নতুন বউঠান তো তাঁর ভালোবাসার মানুষ। তাঁর প্রেরণা। এইটুকু বুঝে মেনে নিতে অসুবিধে কোথায়?