১১. রেণুকার কথায় আসা যাক

এবার রেণুকার কথায় আসা যাক। রবীন্দ্রনাথের মেয়েদের মধ্যে দীর্ঘ জীবনের অধিকারিণী শুধু মীরা বা অতসীলতা। মীরার আগে ছিলেন রেণুকা। কবির মেজো মেয়ে রাণী বা রেণুকার মৃত্যু হয়েছিল কৈশোরে, ফুল হয়ে ফুটে ওঠার আগেই। অত্যন্ত জেদী একরোখা ধরনের মেয়ে রেণুকার কথা সবচেয়ে বেশি জানা যায় মীরার স্মৃতিকথা থেকে। সব ব্যাপারেই তাঁর ছিল সুগভীর ঔদাসীন্য। সাজতে ভাল লাগত না, চুল বাঁধা তো বিরক্তিকর ব্যাপার। খানিকটা নিস্পৃহ অথচ খেয়ালী মেয়ে রেণুকার বিয়ে হয়েছিল মাত্র এগারো বছর বয়সে। বেলার বিয়ের একমাস পরেই। কবি এসে স্ত্রীকে বললেন, রাণীর বিয়ে ঠিক করে এলুম ছেলেটিকে আমার বড় ভাল লেগেছে ছোট বউ, যেমন সুন্দর দেখতে তেমনি মিষ্টি অমায়িক স্বভাব। রাণীটা যা জেদী মেয়ে, ওর বর একটু ভাল মানুষ গোছের না হলে চলবে কেন? তাই বিয়ে হয়ে গেল। রেণুকা কিন্তু এ বন্ধনটা খুব খুশি মনে মেনে নিতে পারলেন না, তার ভুরু একটু কুঁচকেই রইল। বিয়ের পরই বর বিদায় হবে শুনে একটু নিশ্চিন্ত হলেন। বিয়ের সব অনুষ্ঠানই লক্ষ্মী মেঘের মতো মেনে নিলেন। মায়ের মৃত্যু এবং স্বামী অকৃতকার্য হয়ে আমেরিকা থেকে ফিরে আসার রেণুকা খুব দুঃখিত হন। মনের। ব্যথা পরিণত হয় বুকের ব্যাধিতে। কবি তাঁকে শোনাতেন শিশুর কবিতা। মেয়ের শৈশবের কথা বলতে গিয়ে নিজের শৈশব উঁকি মেরে যেত বারবার। হাওয়া বদলের জন্যে নিয়ে গেছিলেন হিমালয়ে। কিন্তু কিছুতে কিছু যখন হল না তখন কবি কে প্রতিদিন উপনিষদের মন্ত্রের অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছেন, যাতে ছেড়ে যেতে কষ্ট না হয়! তাই হয়ত যাবার সময় রেণুকা বাবার হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, বাবা, ওঁ পিতা নোহসি বল। রেণুকার জীবনে তার বাবাই ছিলেন তার সব, তাই মৃত্যুর হাতে যখন আত্মসমর্পণ করতে হল তখন তিনি বাবার হাত ধরেই দরজাটুকু পার হতে চেয়েছিলেন।

 

নিজের দিদির কথা নিপুণভাবে বললেও মীর স্মৃতিকথায় ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির। কোন আভাস দেননি। তাতে আছে শুধু নিজের ছেলেবেলার কথা। দুঃখের দারুণ আঘাত বারবার হানা দিয়েছিল মীরার জীবনে তবু সব শোকতাপ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। তা বলে যে অন্যের দুঃখের বেদনা বুঝতে পারতেন না তা নয়, তাই তো রেণুকার কথাটুকু বললুম, কিশোরী রেণুকার কথা এত ভাল করে আর কেউ লেখেননি। এখন রেণুকার কথা থাক। মীরার কথাই বলি।

রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে কাছে থাকা সবচেয়ে নির্বাক মেয়েটি। হায়! বেলার ভাগ্যে জুটেছিল কত আদর! আর মীরা শৈশবেই হারিয়েছে মাকে, ভাইকে, দিদিকে। পিতার সান্নিধ্যই বা তেমন পেয়েছেন কোথায়? মানুষ হয়েছেন জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে। বিবাহিত জীবনেও মীর সুখী হননি। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে ভাবী জামাতা রূপে নির্বাচন করেই কবি চরম ভুল করেছিলেন। প্রিয়দর্শন তেজস্বী নগেন্দ্ৰ আদি সমাজের নিয়ম অনুযায়ী মীরাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলেন আমেরিকা যাবার শর্তে। বিয়ের সময়েই উপবীত নিয়ে বিরোধ বাধে। আদি ব্রাহ্মসমাজের মতে উপবীত ধারণ অবশ্যকর্তব্য। সাধারণ সমাজের নিয়মানুযায়ী নগেন্দ্র উপবীত ত্যাগ করেছিলেন। এরপর তার বিরোধ শুরু হয় শং-মাধুরীর সঙ্গে, কবি নীরব থেকে অবিচার করলেন শরতের ওপর। কিন্তু অদৃষ্ট! সুখ ছিল না মীরার জীবনে। নগেন্দ্র তাকে ত্যাগ করে খ্রীস্টান হয়ে চলে যান ভিন্ন পথে। মীরাও তাকে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবেননি; শুধু ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে দুটিকে নিয়ে থেকেছেন স্বতন্ত্রভাবে। স্বামীর সঙ্গে আর একবার দেখা হয়েছিল মীরার, একমাত্র ছেলে নীতীন্দ্রের মৃত্যুশয্যার পাশে জার্মানীতে। কবি ভেবেছিলেন বিরাট দুঃখ দুটি অভিমানী হৃদয়কে কাছে এনে দেবে। দেয়নি। এমনকি মীরার স্মৃতিকথাতে একবারও আসেননি নগেন্দ্র, মীরার জীবন থেকে তিনি একেবারেই মুছে গিয়েছিলেন।

আত্মপ্রকাশে বিমুখ মীরার দিন কাটত নির্জনে। নিজের হাতে গড়া। মালঞ্চে বসে। একমাত্র সান্ত্বনা ছিল দুটি সন্তান। তারাও চলে গেল। নীতীন্দ্র অত্যন্ত অকালে, সেই পুরনো কালব্যাধি যক্ষ্মায়। নন্দিতা অনেক পরে। কিন্তু কোন রকম দুঃখশোকের বহিঃপ্রকাশ দেখা যেত না। কবি বলতেন, সব লোকের সামনে নিজের গভীরতম দুঃখকে ক্ষুদ্র করতে লজ্জা করে। মীরাও লুকিয়ে রেখেছিলেন দুঃখের উপচে-ওঠা ডালি। একেবারে শেষ জীবনে স্মৃতিকথা না লিখলে তাকে নিয়ে স্বতন্ত্র করে লেখার কিছু থাকত না।

জীবনের শেষ দিকে নিজেকে ব্যক্ত করতেই বা বসলেন কেন তিনি। তার কি মনে হয়েছিল যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর তাই কি লিখে রাখতে চেয়েছিলেন? কখনই না। যার নিজের জীবনেরই সব কিছু হারানোর তহবিলে চলে গেছে সে আর কি চাইবে? তিনি স্মৃতিকথা লিখেছেন। রোগশয্যার দীর্ঘ অবসর কাঁটাবার জন্যে। তাই এর মধ্যে নেই কোন ধারাবাহিকতা, নেই নিজের জীবনের কোন ছবি। যাদের সান্নিধ্য তার অন্ধকার-মনের বুক চিরে আলোর আভাস এনে দিয়েছিল শুধু তাদের কথাই আছে। যার মনের আয়নায় তারা ধরা পড়লেন তিনিই শুধু রইলেন অধরা।

তবু মানুষ কি একেবারে নিজের কথা লুকিয়ে রাখতে পারে? তাই স্মৃতিকথার পাতাও আপনি হয়ে উঠেছে ভারি। যখন তার মনের মতো বাগানে ফুল ফুটত তখন আর কোন দুঃখ থাকত না। মন আর স্থির হয়ে আসত। মীরার ভাষা বা লেখার ভঙ্গিটিও ভারি সরল। একটু দেখলে মন্দ হয় না :

গাছ ভরে বেল জুই ফুটতে লাগল, সকালে উঠে লাল রাস্তার উপর শিশির ভেজা শিউলি ফুল বিছিয়ে আছে দেখতে পেতুম, বাতাসে দূর থেকে চামেলির গন্ধ ভেসে আসত, তখন আর আমার কোন দুঃখ রইল না। মনে হত এরা। আমাকে যথেষ্ট প্রতিদান দিয়েছে। কেননা কোন কাজে যখন আমি মন বসাতে পারছিলুম না, তখন এই বাগানের নেশা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

লেখার অনেক আগে মীরা রবীন্দ্র নির্দেশে কয়েকটি দেশী-বিদেশী। ইংরেজী প্রবন্ধের সর সংকলন করেন। আটটি ছাপা হয় প্রবাসীতে এবং তিনটি তত্ত্ববোধিনীতে। এছাড়া দীর্ঘ জীবনে মীর। শান্তিনিকেতনে বাস করলেও, বলতে গেলে কিছুই করেননি। মীরার সঙ্গে সঙ্গেই মহর্ষির নাতনীদের কথা বলার পালাও ফুল। এবার আসা যাক, এ বাড়ির নতুন-আসা বৌয়েদের কথায়। মেয়েরা যেমন ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব সংস্কৃতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন ভিন্ন পরিবারে তেমনি ভিন্ন পারিবারিক ঐশ্বর্যের গরিমা নিয়ে এসেছিলেন আরও কয়েকটি মেয়ে। তবে সকলে তো আর সমান প্রতিভার অধিকারী হতে পারেন

তাই যারা বিশেষ গুণ বতীরূপে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাদের কথাই বলব। এ সময়ে ঠাকুরবাড়িতে যারা বৌ ছয়ে এসেছিলেন এঁদের মধ্যে তিনজনের নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। এই তিনজন হচ্ছেন হেমলতা, প্রতিমা ও সংজ্ঞা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *