ভোরের আলো আকাশের সীমা ছাড়িয়ে সবে নেমে এসে পড়েছে বাড়ির ছাদে, অন্ধকারের আবছা ওড়নাটা তখনও একেবারে সরে যায়নি, এমন সময় শিশিরভেজা ঘাস মাড়িয়ে রুক্ষ পথের বুকে এসে নামে দুটো আরবী ঘোড়া। সদর। ছাড়িয়ে জোর কদমে এগিয়ে চলে গড়ের মাঠের দিকে। দারোয়ান কাজ ভুলে যায়। প্রতিবেশীরা হতভম্ব। রাজপথের লোকেরা অবাক। এ কী কাণ্ড? বিস্ময়ে গালে হাত দিয়ে তাকালে একে অপরের দিকে। সবাই চেয়ে আছে। কিন্তু সেদিকে তাকাবার সময় কই আরোহীদের। না, ভুল বলা হল বুঝি। দুজন আরোহী কোথায়? একজন যে অরোহিণী! আরোহিণী? চোখের ভুল নয়ত? কলকাতার রাস্তায় ঘোড়ায় চড়া মেয়ে? তাও মেমসাহেব নয়, বাঙালী। পথিকরা থমকে দাঁড়ায়। চোখ কপালে ওঠে পড়শিনীর। না, আর কোন ভুল নেই। ঐ তো আঁটসাঁট পোশাকে দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘোড়ার পিঠে বসে আছেন কাদম্বরী, ঠাকুরবাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে চলেছেন স্বামীর সঙ্গে, ময়দানের দিকে।
আজও মনে হয়, যেন গল্প শুনছি। তবু গল্প নয়, একেবারে সত্যি ঘটনা। চার দেওয়ালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সব কিছুতে বড়-হয়ে-ওঠা এক আশ্চর্য মায়াপুরীর কথা। জোড়াসাঁকোর কর্কশ হৈ-হট্টগোলের মাঝখানে প্রায় হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট একটা গলির শেষে যে সেকেলে মস্ত বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, বাইরে থেকে তাকে বিশেষত্বহীন মনে হলেও বাংলার নবযুগের বিকাশ হয়েছিল এই ঠাকুরবাড়িতেই। ঝিমিয়ে-পড়া সমাজের বুকে একটার পর একটা আঘাত হেনে যারা তার জড়তা ঘোচাতে চেষ্টা করেছিলেন, তাদের অনেকেরই স্থায়ী ঠিকানা ছিল সেদিনকার জোড়াসাঁকো-ঠাকুরবাড়ি। পুরনো দিনের দু-চারটে পুথি-পত্র, পাঁচালী-কবিগান আর বিকৃত বাবু-কালচারের সংকীর্ণ খাতে দেশের শিল্প-সাহিত্য যখন কোনরকমে নিজেদের টিকিয়ে রেখে চলছে সেই সময়কার কথা। পশ্চিম দিগন্তের একটুখানি আলো এসে পড়ল পুবের আকাশে। সেই নবজাগরণ। লজ্জার মতো গোলাপী আভাটাই শেষে আগুন হয়ে উঠল একদিন। তার আকস্মিক উত্তেজনায় যখন অনেকে দিগভ্রান্ত, কেউ বা পথচ্যুত কিংবা বিদ্রোহী, তখন প্রথম ঊষার সবটুকু লালিমা নিজের গায়ে মেখে এই ঠাকুরবাড়িই সারা দেশের ঘুম ভাঙাবার ভার নিয়েছিল। তারই সামান্যতম নজির ওপরের ঐ গল্পের মতো ঘটনাটা।
কাগজপত্রের খুঁটিনাটি বিবরণের মধ্যে না গিয়ে রেনেসাঁসের সমসাময়িক ঘটনাগুলোর ওপর হালকা নজর বুলিয়ে নিলে দেখা যাবে তখনও তেমন কোন সমবেত চেষ্টা শুরু হয়নি। সর্বত্র শুধু তামসী রাতের গাঢ় ছায়া। তারই মধ্যে এখানে সেখানে দু-একটি প্রদীপ সবে জ্বলেছে, কোথাও বা সলতে পাকাবার আয়োজন চলছে। কিন্তু একটার সঙ্গে আরেকটার কোন যোগ নেই। নবজাগরণের পটভূমি থেকে ঠাকুরবাড়িকে সরিয়ে নিলে এই হবে সেকালের বাংলাদেশের খাটি ছবি। এইরকম দু-একটা প্রদীপের আলো সম্বল করে আমাদের জীবনে নব্য রেনেস কি আজকের রূপ নিয়ে আসত, না ষোড়শ শতকের চৈতন্য রেনেসাঁসের মতো স্মৃতি হয়ে থাকত কে জানে? সেইসব দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে মাথাব্যথা করে লাভ নেই। আমরা শুধু বলতে চাই যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য ভাবসংঘাতের যুগে ঠাকুরবাড়িতেই প্রথম একটা সহিষ্ণু সমবায়িতার ক্ষেত্র গড়ে ওঠে। তাই সহজেই এ বাড়ির প্রতিটি মানুষের কল্পনায় ঢেউ তুলেছে পশ্চিমের সমুদ্র, ভাবনা ছুয়েছে হিমালয়ের শিখর। আধুনিক বাংলার সুরুচি ও সৌন্দর্যবোধের প্রায় সবটাই তো ঠাকুরবাড়ির দান। ছোট্ট একটা প্রশ্ন এসে পড়েই—ঠাকুরবাড়ির এই স্পর্শমণিটি কি রবীন্দ্রনাথ? স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে তার কথা। শুধু ঠাকুরবাড়িকে কেন, সারা বাংলাদেশকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে যিনি একাই যথেষ্ট। তবু একথাও তো সত্যি, ঠাকুরবাড়ি কোনদিনই আর পাঁচটা সাধারণ বাড়ির মধ্যে আটপৌরে ধরনের ছিল না। অনেকদিন, সম্ভবতঃ দ্বারকানাথের আমল থেকেই এ বাড়িতে জীবনযাত্রার নিজস্ব একটা সংস্কার গড়ে উঠেছিল। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের কোন অনুভূতি, কোন চিন্তাই সেখানে বাধা পায়নি। তাই একই পরিবারে ব্রহ্মবিদ মর্যর সঙ্গে সিভিলিয়ান অফিসারের সহাবস্থান যেমন বেমানান হয়নি তেমনি কবি-সঙ্গীতজ্ঞ-নাট্যকার-শিল্পরসিক-দার্শনিক-চিন্তাবিদের একত্র সমাবেশও সম্ভব হয়েছিল।
এই সোনালি-সফল পর্বে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা আবছা পর্দার আড়ালে অস্পষ্ট আভাস হয়ে থাকেননি। নবযুগের ভিত গড়বার কাজে হাত লাগিয়েছিলেন। কখনও প্রত্যক্ষভাবে আবার কখনও পরোক্ষে—পুরুষের প্রতিভার প্রদীপে তেলসলতে যোগানোর দায়িত্ব নিয়ে। অবশ্য যত সহজে লেখা গেল ঘটনাটা তত সহজে ঘটেনি। মনুর বিধান এবং মুসলমানী আবরু রক্ষার তাগিদ অনেকদিন থেকেই মেয়েদের একেবারে ঘরের আসবাবপত্রে পরিণত করেছিল। ঠাকুরবাড়িতেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। অন্দরমহলে নিঃসম্পর্কিত পুরুষ প্রবেশ করতেন না, বাইরে বেরোতে হলে মেয়েরা চাপতেন ঘেরাটোপ-ঢাকা পালকি। হাতে সোনার কাঁকন, কানে মোটা মাকড়ি, গায়ে লাল রঙের হাতকাঁটা মেরজাই-পরা বেহারার দল কাঁধে করে নিয়ে যেত। সঙ্গে সঙ্গে ছুটত দারোয়ান, হাতে লাঠি নিয়ে। ঘেরাটোপের রঙ দেখে শুধু বোঝা যেত কোন্ বাড়ির পালকি যাচ্ছে। জোড়াসাঁকো-ঠাকুরবাড়ির পালকির ঘেরাটোপ ছিল টকটকে লাল আর পাড়টা গাঢ় হলুদ। পাথুরেঘাটা-ঠাকুরবাড়িরটা ঘোর নীল আর ধবধবে সাদা পাড়। আর পাঁচটা বনেদি বাড়িরও এ রকম পালকি ছিল।
যাক সে কথা, মেয়েরা পালকি তো চাপতেন কিন্তু যেতেন কোথায়? কালেভদ্রে গঙ্গাস্নানে যাবার অনুমতি পেলে বেহারারা তো একেবারে পালকিশুদ্ধ, জলে চুবিয়ে অনত। এটাই ছিল সেকেলে দস্তুর। এছাড়া তারা মাঝে মাঝে যেতেন আত্মীয়-কুটুম্বের বাড়িতে বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন-শ্রাদ্ধের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে। তখন পালকি একেবারে উঠোনে গিয়ে দাঁড়াত। জোভান্সাকোর পাঁচ নম্বর এবং ছ নম্বর বাড়ির মধ্যে দূরত্ব আর কতটুকু, তবু সেখানেও এবাড়ি-বাড়ি যেতে হলে মেয়েদের পালকি চাপতে হত। সুতরাং অসংখ্য বাধা-নিষেধের গণ্ডি পার হয়েই মেয়েদের এমনকি ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের আত্মপ্রকাশ করতে হয়েছিল। সহজে হয়নি। প্রথমদিকে এ বাড়ির মেয়ে এবং বৌয়েদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন সাহিত্য ও শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ শক্তির পরিচয় রেখে গিয়েছেন, কিন্তু যাদের নাম বিশেষ ছড়িয়ে পড়েনি, পড়বার কারণও নেই, তাদের ভূমিকাও নেহাত কম ছিল না। চলবার বাধা-পথ তারা পাননি, পথ তাদের তৈরি করে নিতে হয়েছিল। খুব সোজা পথও প্রথম পথিকের কাছে দুর্গম। পরেও সেই ধারাটিকে নিরন্তর রসপুষ্ট করে বাঁচিয়ে রাখা কম কৃতিত্বের কথা নয়। সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা যে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে পুরুষের পাশে এসে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস অর্জন করেছিলেন, সেটাই পরম গৌরবের কথা। স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা হারিয়ে-যাওয়া সেই মেয়েদের নিয়েই তো এ প্রসঙ্গের অবতারণা।
অবশ্য নবজাগরণের অনুকূল হওয়ায় পাল তুলে এগিয়েছিলেন অনেকেই। প্রীশিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার ও আরো অনেকে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও তার পুত্রদের উৎসাহও কম ছিল না। সত্যেন্দ্রনাথ বিলেতে বসে বাড়ির সমস্ত কাঠের ঝরকা ভেঙে মেয়েদের স্বাধীনতা দেবার স্বপ্ন দেখতেন। হেমেন্দ্রনাথ বাড়ির মেয়ে-বৌদের নিয়ম করে লেখাপড়া শেখাতেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শোনাতেন দেশবিদেশের ভাল ভাল গল্প। শেখবার। তাগিদ ছিল মেয়েদেরও, নতুন কিছু করার সাহস এবং শক্তিও তাঁদের কম ছিল না।
তবু কেন এই একটি পরিবারের মেয়েরাই এতখানি স্বাধীনতা পেয়েছিলেন? পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার করে মনে হয়, হিন্দুসমাজের বাধানিষেধ ও তার কড়াকড়ি ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের খুব বেশি অসুবিধেয় ফেলতে পারেনি। কারণ। তৎকালীন হিন্দু ব্রাহ্মণদের চোখে ঠাকুরবাড়ি ছিল পিরালী—খানিকটা একঘরের মতো স্বতন্ত্র। তার ওপর দেবেন্দ্রনাথ ব্ৰাহ্মধর্ম গ্রহণ করলে শাসনের গিট আপনিই শিথিল হয়ে এসেছিল। আমাদের অনুমানের কারণ, প্রায়ই দেখা গেছে পিরালী ব্রাহ্মণের মেয়েকে বিয়ে করার পরে কোন ছেলে আর স্বগৃহে সসম্মানে ফিরে যেতে পারেননি। সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর বাবা অভয়াচরণ মুখোপাধ্যায় রাগ করে বাড়ি থেকে চলে এসে ঘটনাচক্রে যশোরের পিরালী রায় বংশের মেয়েকে বিয়ে করেন। তার বাবা বিবাগী সন্তানের খোঁজ করতে করতে এসে যেই শুনলেন তার ছেলের সঙ্গে পিরালী বামুনের মেয়ের বিয়ে হয়েছে অমনি রাগে-দুঃখে ভেঙে পড়ে পৈতে ছিঁড়ে অভিশাপ দিয়ে গেলেন অভয়চরণ নির্বংশ হোক বলে। এমন উদাহরণ আরো আছে। মহর্ষির পঁচি জামাইয়ের মধ্যে চার জন ছিলেন ঘরজামাই। সবাই কুলীনের ছেলে। কিন্তু পিরালী ঘরে বিয়ে করে আর নিজেদের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারেননি। জ্ঞানদানন্দিনী শুনেছিলেন, একজনের বাপ গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ছেলেকে শাপ দিয়েছিলেন। আর যিনি ঘরজামাই হননি অর্থাৎ স্বর্ণকুমারীর স্বামী জানকীনাথ। ঘোষাল, তিনিও পিরালী দেবেন্দ্রনাথের কন্যাকে বিবাহ করে পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার হারিয়েছিলেন সাময়িকভাবে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ের সময়ও দেখা যাবে মহর্ষি লিখছেন, জ্যোতির বিবাহের জন্য একটি কন্যা পাওয়া গিয়াছে এইই ভাগ্য। কেন? না একে ত পিরালী বলিয়া ভিন্ন শ্রেণীর লোকেরা আমাদের সঙ্গে বিবাহেতে যোগ দেয় না তাহাতে আবার ব্রাহ্মধর্ম-অনুষ্ঠান জন্য পিরালীরা আমাদিগকে ভয় করে। অথচ জ্যোতিরিন্দ্রর বিয়ের সময় ধনে মানে শিক্ষায় যোগ্যতায় ঠাকুরবাড়ির সমতুল্য বাড়ি কলকাতায় কটাই-বা ছিল? তাই বলছিলুম, সমাজের অন্যান্য বাধা এ বাড়িতে শেকলের বাঁধন হয়ে ওঠেনি বরং তারই মধ্যে একটু ফাঁক রেখে গেছে। শৈথিল্যের অবকাশে গড়ে উঠেছিল ঠাকুরবাড়ির একেবারে নিজস্ব সংস্কৃতি, সকলের দেখে নকল করা নয়, নিজেরা নতুন কিছু করা।
সাহিত্য, সঙ্গীত বা শিল্পের দিক থেকে নতুন কিছু পাবার আগে প্রকৃতপক্ষে বাঙালী মেয়েরা ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের কাছে পেল আত্মবিশ্বাসের শক্তি আর এগিয়ে যাবার একটি প্রশস্ত পথ। তাই তাদের ময়দানে ঘোড়া ছোটানো, কালাপানি পেরিয়ে বিলেত যাওয়া, লাট ভবনের নিমন্ত্রণ রাখা, আমেরিকায় বক্তৃতা দেওয়া, স্কুলে পড়া, ছবি আঁকা, গান গাওয়া, অভিনয় করা, বই লেখা, স্বদেশসেবা, সমিতি-প্রতিষ্ঠা সবই অর্থবহ হয়ে উঠেছে। সমাজের ধীর-স্থির বুকে নানা আকারের আন্দোলন তুলে বাঙালী মেয়েদের লজ্জাভীরু মনে সাহস জোগাবার জন্যেও এর দরকার ছিল। শুধু তাই নয়, কিশোর রবীন্দ্রনাথের জন্যে বাড়ির মধ্যে একটা সাহিত্যিক আবহাওয়া গড়ে তুলতেও তার দিদি-বৌদিদিরা দাদাদের চেয়ে কোন অংশে কম সাহায্য করেননি। আবার পরিণত বয়সে নৃত্য-গীত-অভিনয়সংক্রান্ত নিজস্ব ভাবনাকে রূপায়িত করবার সময়েও তিনি বারবার ডাক দিয়েছেন বাড়ির মেয়েদের। শুধু এই জন্যেও ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের, কখনো কখনো সামান্য ভূমিকা থাকলেও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এ প্রসঙ্গে একটা আশ্চর্য ঘটনা চোখে পড়ে, প্রায় কাকতালীয়ের মতোই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের পূর্ণ আত্মবিকাশের ক্ষেত্রটা যেন সমস্ত রবীন্দ্রজীবনের সঙ্গে গাঁথা হয়ে গেছে। অথচ রবীন্দ্রনাথ সর্বত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছেন তা নয়। স্বর্ণকুমারী-জ্ঞানদানন্দিনীর অভ্যুত্থান পর্বে রবীন্দ্রনাথ কিশোর আর এখনও যারা জাকম্পিত হাতে নিবুনিবু ঐতিহ্য প্রদীপের শিখাটিকে জ্বেলে রেখেছেন তারা পেয়েছেন অস্ত-রবির শেষ আশীর্বাদ!
একটু আগেই বলেছি যে, ঠাকুরবাড়িতে সমাজের প্রত্যক্ষ বাধা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু কী সেই বাধা, যা এবাড়ির মেয়েদের অচল করে তোলেনি? সেকালে মেয়েদের জীবন কেমন করেই-বা কাটত? তখনকার দিনে মেয়েদের জীবন বিশেষ সুখে কাটত না। কয়েকশো বছরের পুথিপ্রমাণ আর দলিল দস্তাবেজের বস্তাপচা পুরনো সাক্ষীসাবুদ জড়ো না করেও এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, আমাদের সমাজে নারীসম্পর্কিত মূল্যবোধের প্রচণ্ড অবনতি হয়েছিল। পুরুষের কাছে সেদিন নারী ছিল জীবন্ত সম্পত্তি, শুধু ভাত-কাপড় দিয়ে পোষা বিনা মাইনের দাসীমাত্র। ইচ্ছের হাড়িকাঠে তাদের যতবার খুশি বলি দেওয়া চলত। সমাজের সমস্ত নিয়ম-শৃংখলা নারীর অঙ্গে পাকে পাকে জড়ানো শৃংখল হয়ে উঠেছিল খুব সহজে, কারণ সকল অনর্থের মূল অর্থ এবং অর্থোপার্জনের যাবতীয় উপায় ছিল পুরুষের হাতে। পিতার ধনে বা পতির ধনেও নারীর অধিকার স্বীকৃত হয়নি। মেয়েদের এই নিরুপায়তায় সুযোগ নিয়েই পুরুষেরা অধিকারের নামে অবাধে স্বেচ্ছাচার করে গেছেন। তাই দেখা যাবে উনিশ শতকে সমাজ সংস্কারের প্রধান কথাই ছিল নারীমুক্তি—আধুনিক অর্থে নয়, তখন নারীশিক্ষা, নারীর অধিকার এবং নারী প্রগতির দিকেই মনীষীদের দৃষ্টি পড়েছিল!
আসলে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অসমবিবাহ, সতীদাহ প্রভৃতি গোটা কতক বড় বড় সামাজিক অত্যাচার ছাড়াও ছোটখাট অগুণতি বাধা মেয়েদের পায়ে বেড়ির মতো চেপে বসে ছিল। তার মধ্যে লেখাপড়া শেখা, জাম জুতো পরা, বাইরে বেরোনো, গান গাওয়া, গাড়ি চড়া, অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে কথা বলা সবই পড়ে। আজ মনে হয় মেয়েরা তাহলে সারাদিন কী করত? ঘর-সংসার? সে তো এখনও করে। তবে? রাধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাধা নিয়েই কি জীবন কেটে যেত? বইয়ের পাতায় উদাহরণ খুঁজলে দেখা যাবে নিখাদ-নিনাদে একটা কথাই বাজছে, না-না-না। দীনবন্ধুর নীলদর্পণ নাটকের সরলতা বলেছিল, রমণীর মন কাতর হইলে বিনোদনের কিছুমাত্র উপায় নাই কেননা পাঁচজন সঙ্গিনী নিয়ে বাগানে যাওয়া, শহরে বেড়াতে যাওয়া মেয়েদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের জন্যে কলেজ নেই, কাছারি নেই, সভাসমিতি নেই, ব্রাহ্মসমাজ নেই—বলতে গেলে কিছুই নেই। একেবারে নেই-রাজ্যের বাসিন্দাদের দিনগুলো কাটত কেমন করে? খুব যে কষ্ট হত তা নয়, সয়ে গিয়েছিল সবই। হঠাৎ ঠাকুরবাড়ি থেকে বয়ে আসা এক বালক সঞ্জীবনী হাওয়া এসে তাদের দুলিয়ে না দিলে হয়ত আরো অনেকদিন এমনি করেই কাটত, শুধু অবকাশ পেলে মাঝে মাঝে গুমরে উঠত ফাঁকা মন।
তবু খুব নিশ্চিত হতে না পারলেও মনে হয়, মেয়েরা সর্বত্র সমানভাবে নিশ্চেষ্ট জীবন যাপন করছিল না; তা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়, হলে একটিমাত্র বাড়ির মেয়েদের প্রভাবে সার্বিক জাগরণ কিছুতেই সম্ভব হত না। সলতে পাকাবার আয়োজন চলছিল, ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এনে দিলেন নবজাগরণের প্রদীপশিখাটিকে। একটু আগে যে অগুণতি বাধার কথা বললুম তার অনেক গুলোই ঠাকুরবাড়িতে মেনে চলা হত, তবে লেখাপড়া শেখার ব্যাপারে এ বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা প্রথম থেকেই উদার ছিলেন। মেয়েদের লেখাপড়া শেখায় কোন বাধা তো দেনইনি বরং উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন। দ্বারকানাথের পিতার আমল থেকেই এ বাড়ির মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে শুরু করে বৈষ্ণবীর কাছে। এর সুফল পাওয়া গেল অচিরেই। এ বাড়ির পুরুষদের মতো মেয়েরাও বাংলাদেশের সমস্ত মেয়ের কাছে আদর্শ হয়ে রইলেন। চিরকালের জন্যে।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের পূর্বকথা আজ আর কারুর অজানা নেই। রূপকথার মায়াপুরীর মত রহস্যঘেরা বাড়িটি তো বহুদিন ধরেই সমস্ত বাঙালীর কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। পাজি-পুঁথি খুলে হয়ত আজ অনেকেই বলে দিতে পারবেন, সেই কবে পুরুষোত্তমের বংশধর পঞ্চানন এসেছিলেন কলকাতায় ভাগ্য ফেরাতে কিংবা তার নাতি নীলমণি কোন্ শুভক্ষণে কলকাতার এক প্রান্তে বসবাস শুরু করলেন। আমাদের প্রধান লক্ষ্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি। গৃহবিবাদ আর মন-কষাকষির ফলে মৃল কুশারী বা ঠাকুর পরিবার ক্রমেই নানা শরিকে ভাগ হয়ে যেতে শুরু করেছিল বেশ কিছুদিন ধরে। পাকাপোক্তভাব পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে ১৭৮৪ সালের জুন মাস নাগাদ নীলমণি সপরিবারে চলে আসেন জোড়াসাঁকোতে। তখন এ অঞ্চল মেছুয়াবাজার নামে পরিচিত। নীলমণির ভাই দর্পনারায়ণ থেকে গেলেন পাথুরেঘাটায় সাবেকী বাড়িতেই। অবশ্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করে আরো কয়েক বছর পরে, প্রিন্স দ্বারকানাথের আমলে। ঠাকুরবাড়ির ঐশ্বর্য-প্রতিপত্তি-আড়ম্বর-শিল্পরুচি সব কিছুর মূলেই তিনি। অপরিমিত ধনসঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন পুব-পশ্চিমের মিলন ঘটাতে; সফল হয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই, না হলে অন্য ধনীদের সম্বন্ধে যেমন বলবীর কিছু। থাকে না, তার সম্বন্ধেও সেইরকম কিছু বলার থাকত না। কিন্তু তার কথা থাক, আমরা অন্দরমহলের কথায় ফিরে আসি।
সেযুগে ঠাকুরবাড়ির মতো ধনী এবং অভিজাত বাড়ি বা পরিবার আরো অনেক ছিল। খুব কম করেও আমরা আরো ত্রিশটি পরিবারের উল্লেখ করতে পারি যারা ধনে-মানে ঠাকুরবংশের চেয়ে কোন অংশে হীন তো ছিলেনই না বরং আরো খ্যাতি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীকালে এইসব পরিবারও নানাভাবে শিল্পরুচি কিংবা প্রতিপত্তির পরিচয় দিয়েছেন। তবু এতগুলি বাড়ির মধ্যে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বেছে নেবার প্রধান কারণ প্রথম পর্বে এই বাড়িই ছিল সবার পুনরাবর্তিনী। অবশ্য পাথুরেঘাটা-ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বৌরাও যে ছিলেন তা নয় কিন্তু তারা স্থায়ী প্রভাব রেখে যেতে পারেননি।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী ও জ্ঞানদানন্দিনীর নাম সকলেই জানে। তবু ইতিহাসেরও ইতিহাস থাকে, তাই তাদের পিতামহী দিগম্বরীকেও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। সূর্যোদয়ের অনেক আগে যেমন উষার আলো ফুটে ওঠে, দিগম্বরীর ধর্মনিষ্ঠা এবং নির্ভীক তেজস্বিতার মধ্যেও তেমনি ঠাকুরবাড়ির নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার ছাপটুকু চোখে পড়ে। যে যুগে মেয়েদের স্বামী বই গতি ছিল না সেই সময়ে দিগম্বরী কুলধর্মত্যাগী স্বামীকে ত্যাগ করা উচিত কি উচিত নয় জানতে চেয়েছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সমাজের কাছে। সেই পুরুষশাসিত সমাজে তার একক প্রতিবাদ—তবু তিনি নিন্দায় জর্জরিত হননি। বরং হিন্দুসমাজ তাকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিল।
কিন্তু তিনিই বা হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞদের কাছে এমন একটা বিধান জানতে চেয়েছিলেন কেন? তিনি কি মুক্তি চেয়েছিলেন সাত-পাকে-বাঁধা বিবাহ বন্ধন থেকে, না, স্বামীর অবহেলা তার তীব্র অভিমানকে বড় বেশি আঘাত করেছিল? এই কেনর উত্তর খুঁজতে হলে বাস্তবে-অবাস্তবে মেশা দিগম্বরীর অলৌকিক জীবনের কথা জানতে হয়।
লোকে বলে, অপরূপ লাবণ্যময়ী দিগম্বরী এসেছিলেন ঠাকুরবাড়ির লক্ষ্মী হয়ে। যশোরের নরেন্দ্রপুরে তার জন্ম। মাত্র ছ বছর বয়সে দ্বারকানাথের ধর্মপত্নী হয়ে তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসে পা দিলে ঠাকুরবাড়ির শ্রীবৃদ্ধি হতে শুরু করে। দিগম্বরীর রূপ এখন প্রবাদে পরিণত হয়েছে। বোধহয় তখন থেকেই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের রূপের খ্যাতি। শোনা যায়, দিগম্বরীর মুখের আদলেই ঠাকুরবাড়ির জগদ্ধাত্রী প্রতিমা গড়া হত। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে বলতেন, সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী। বলবে নাই বা কেন? দুধে-আলতা মেশা গায়ের উজ্জ্বল রঙ, পিঠে একটাল কোঁকড়া কালো চুল, চাপাকলির মতো হাতের আঙুল, দেবী প্রতিমার পায়ের মতো দুখানি পা—মৃত্যুর পরে তাকে শ্মশানে নিয়ে যাবার সময় অনেকে তার পা দুটি থেকে এক অপূর্ব জ্যোতি বেরোতে দেখেছিল। অতুলনীয় রূপের সঙ্গে দিগম্বরীর ছিল প্রচণ্ড তেজ। শাশুড়ী অলকাসুন্দরীও এই ব্যক্তিত্বময়ী বৌটিকে সমীহ করে চলতেন।
আর দ্বারকানাথ?
স্ত্রীকে তিনি সত্যিই ভালবাসতেন। কিন্তু এ তো গল্প। গল্পই তো। গল্পই তো জীবন। তারই টানাপোড়েনে বোনা হয়েছে অন্দরমহলের বালুচরী আঁচলার নকশা, গৌরবময় নারীজাগরণের ইতিহাস।
তখনকার দিনে এঁরা ছিলেন গোঁড়া বৈষ্ণব। পাথুরেঘাটার ঠাকুররা ব্যঙ্গ করে বলতেন মেছুয়াবাজারের গোঁড়া। পেঁয়াজ ঢুকত না বাড়িতে। মাছ-মাংসের তো কথাই নেই। পাছে কুটনো-কোটা বললে হিংস্র মনোভাব জেগে ওঠে তাই বলা হত তরকারি বানানো। গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনের নিত্যসেবা নিজের হাতে করতেন দ্বারকানাথ। পুজোর উপকরণ হয়ত যুগিয়ে দিতেন দিগম্বরী। নীলাম্বরী শাড়ির আঁচল-ঘেরা দুধে-আলতা মেশা সুন্দর মুখে ভক্তির আবেশ মাখা —যে দেখত শ্রদ্ধায় আপনিই নুয়ে পড়ত। না, সেদিন কোথাও বিরোধের কালো মেঘ বাষ্প হয়েও দেখা দেয়নি।
হঠাৎ ঝড় উঠল, কেঁপে উঠল যুগলের সংসার। ফাটল ধরল সনাতন হিন্দুয়ানীর ভিতে। মা লক্ষ্মীর পদ্মের অনেকগুলো পাপড়ি উড়ে এসে পড়ল দ্বারকানাথের ঘরে। আর ব্যবসায়িক সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে বিলাসিতা ও বাবুয়ানীর ছদ্মবেশ পরে নবযুগের ভাবনা বাসা বাঁধলে দ্বারকানাথের মনে। হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বিধর্মীর সংস্পর্শে এলে দেহ অপবিত্র হয়। সেই নিয়ম অনুযায়ী দ্বারকানাথ যখন সাহেববোর সঙ্গে মেলামেশা শুরু করলেন তখন থেকে তাঁকে নিজের হাতে পুজো-করা ছাড়তে হল। নিত্য পূজা ও অন্যান্য ক্রিয়াকর্মের জন্যে তিনি আঠারজন শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণকে মাইনে দিয়ে সেই কাজে নিযুক্ত করলেন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজে এর পরে ব্যবসায়িক কাজকর্মের প্রয়োজনে মাংস এবং শেরি খাওয়া অভ্যাস করলেন। দিগম্বরী ও দ্বারকানাথ বয়ে চললেন ভিন্ন খাতে।
প্রথম প্রথম দ্বারকানাথ বেপরোয়া খুশির প্রমোদে গা ঢেলে দেননি। যদিও উ এটি ছিল সেযুগের বিলাসী বাবুদের মতোই দিলদরিয়া। সেই সঙ্গে ছিল শিল্পরুচি। তাঁর বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে ছিল নানারকম প্রমোদের আয়োজন। এক প্রহরের আমোদে কত যে ঐশ্বর্য নষ্ট হয়েছে তার সীমা নেই। নিজের মনের মতো জীবন-যাপন করবার জন্যে বাগানবাড়িটি তৈরি করেছিলেন দ্বারকানাথ। কী তার কারুকাজ। ফোয়ারা, সেতু, রঙিন টালি-ঘেরা বাগান, ঝাড়লণ্ঠন, বিলিতি আসবাবে নিজের রুচিমতো সাজালেন। তাঁর নতুন গৃহসঞ্চার-এর কথা ঘটাপটা করে ছাপাও হল সেদিনকার কাগজে। প্রকাণ্ড ভোজ, নাচ-গান, বিলিতি ব্যাণ্ডের সঙ্গে ভাঁড়ের সং-এরও আয়োজন হয়েছিল, আর মধ্যে একজন গোবেশ ধারণপূর্বক ঘাস চর্বণাদি করিল। সুতরাং দ্বারকানাথের বিলাসিতায় সেযুগের বাবুয়ানীর ছাপ পুরোমাত্রায় বজায় ছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
এই বাড়িটি তৈরি হয় ১৮২৩ সালে। এসময় দ্বারকানাথ গভর্নমেন্টের দেওয়ান, পরে আরো উন্নতি হয়। প্রথমদিকে দিগম্বরীর চোখে এত পরিবর্তন ধরা পড়েনি। নিজের জপ-তপ ঠাকুরসেবা নিয়ে তিনি সদাব্যস্ত। ভরা সংসার। বড় ছেলে দেবেন্দ্রর সবে বিয়ে হয়েছে। ছেলের বৌ সারদাও এসেছেন যশোর থেকে। এখানে যে পিরালীবংশের অনেকেই থাকেন। ছ বছরের মেয়ে সারদা এসেছেন দক্ষিণডিহি থেকে। অন্য দিকে তাকাবার সময় কই? ভোর চারটে থেকে দিগম্বরীর পূজা শুরু হত। লক্ষ হরিনামের মালা জপ ছাড়াও তিনি নিয়মিতভাবে পড়তেন ভাগবত-রাসপাধ্যায়ের বাংলা পুঁথি। দয়া বৈষ্ণবী পড়ে শোনাতেন নানারকম ধর্মগ্রন্থ। পরাণ ঠাকুর তাঁর পুজোর উপচার ও রান্নার উপকরণ গুছিয়ে রাখত। দিগম্বরী স্বপাকে আহার করতেন। একাদশীতে খেতেন সামান্য ফলমূল।
মাঝে মাঝে শোনেন অনেক কথা। অনেকে অনেক কিছু বলে। কিছু শোনেন, কিছু মনে থাকে না, মালা জপতে জপতে ভুলে যান। মন বলে, এ সবই অহেতুক রটনা। কৃতী পুরুষের গায়ে কালি ছিটোবার সুযোগ কে না। খোঁজে? কিন্তু খুব বেশি দিন নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকা সম্ভব হল না। ওদিকে বাগানবাড়িতে পানভোজন হাসিহল্লা চলে নিয়মিত। ঘরগুলো আলোতে, আরশীতে, মির্জাপুরের কার্পেটে, লাল জাজিমে, সবুজ রেশমে, ফুলের তোড়ায় ঝলমল করে। গুজব ছড়ায়। শেষে সবই শুনলেন দিগম্বরী, শুনলেন দ্বারকানাথের। ভোজসভায় নাকি মদের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। শোনেন ছড়ার গান বাঁধা হয়েছে :
বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরিকাঁটার ঝনঝনি,
খানা খাওয়ার কত মজা আমরা তার কি জানি?
জানেন ঠাকুর কোম্পানী।
বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষী অরো শোনালেন :
কি মজা আছে রে লাল জলে
জানেন ঠাকুর কোম্পানী।
মদের গুণাগুণ আমরা কি জানি।
জানেন ঠাকুর কোম্পানী।
প্রথমে বিশ্বাস হয়নি তবু নিঃসংশয় হবার জন্যে দিগম্বরী স্থির করলেন, তিনি স্বয়ং যাবেন সেই ম্লেচ্ছ ভোজসভায়। স্বচক্ষে দেখে আসবেন কোষ্টা সত্যি আর কোন্টা মিথ্যে। পতিব্রতা দিগম্বরীর এই অতর্কিত অভিযান চিরস্মরণীয়। বিপথগামী স্বামীকে ফেরাবার জন্যে তিনি নিজেই গেলেন, সঙ্গে রইল ভীতত্ৰন্তা তরুণী সারদা ও আরো কয়েকজন আত্মীয়। মনে ক্ষীণ আশা, যা শুনেছেন তা ভুল। এতদিনের চেনা মানুষ কি এভাবে বদলে যেতে পারে?
অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে প্রবেশ করতে গিয়ে কুলবধূ দিগম্বরী কেঁপে উঠেছিলেন কিনা কে জানে। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটিকে কেউ কোনভাবে ধরে রাখেনি। সত্যিই কি তিনি সেখানে যেতে পেরেছিলেন, পারিপার্শ্বিক ঘটনা তো তাই বলে চোখের সামনে দেখলেন, অলো-ঝলমলে ঘরে সাহেব-বিবিদের সঙ্গে একাসনে পানাহারে মত্ত তার স্বামী। এ কি দুঃস্বপ্ন! তাহলে যা শুনেছেন সব সত্যি! বুকটা যেন ভেঙে গুড়িয়ে গেল। তবু কর্তব্য ভোলেননি; বিপথগামী স্বামীকে ফিরিয়ে আনার জন্যে অনেক চেষ্টা অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলেন। কর্ণপাত করেননি দ্বারকানাথ।
অন্য মেয়ে হলে এ সময় কী করতেন? হয় কেঁদে-কেঁদে নিঃশেষে হারিয়ে যেতেন, নয়ত থাকতেন আপনমনে। যেমন থাকত সেকালের অধিকাংশ ধনী গৃহিণীরা। দিগম্বরী এর কোনটাই বেছে নিলেন না। তার মতে তেজস্বিনী নারীর কাছে ধর্ম আর কর্তব্য সবার আগে। তাই মনের দুঃখ মনে চেপে তিনি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মতামত চেয়ে পাঠালেন। কী করবেন তিনি? স্বামীকে ত্যাগ করে কুলধর্ম বজায় রাখবেন, না স্বামীর সহধর্মিণী হয়ে কুলধর্ম ত্যাগ করবেন? দ্বারকানাথ অবশ্য ধর্মত্যাগী নন। কিন্তু ম্লেচ্ছদের সঙ্গে যে। একত্রে খানা খায় তার আর ধর্মত্যাগের বাকী কী আছে? পণ্ডিতেরা ভাল করেই বিচার করলেন। বহু বিতর্কের পর উত্তর এল, স্বামীকে ভক্তি ও তাহার সেবা করা অবশ্য কর্তব্য তবে তাহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য অকর্তব্য।
পণ্ডিতদের রায় শুনে দিগম্বরী নিজের কর্তব্য স্থির করে নিলেন। শুধু সেবা। ছাড়া আর সব ব্যাপারে তিনি স্বামীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। অবশ্য বাইরের কেউ কিছু জানতে পারল না। কারণ তাঁর স্বামীভক্তি ছিল প্রবল। তিনি প্রতিদিন দ্বারকানাথের শয্যার কাছে গিয়ে মাটিতে একটি প্রণাম রেখে আসতেন। দ্বারকানাথ সম্পূর্ণ নির্বিকার। বৈষয়িক ব্যাপারে কিংবা অন্য কারুর প্রয়োজনে দিগম্বরী যখনই স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হতেন তারপরই সাত ঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করে নিজেকে শুদ্ধ করে নিতেন। দিনরাতের বিচার ছিল না। দুঃসহ অত্যাচারের ফলে কয়েকদিনের জ্বরবিকারে নিবে গেল দিগম্বরীর জীবনদীপ। তার জ্যোতির্ময়ী মূর্তিটি শুধু অম্লান হয়ে রইল মহর্ষিপুত্রের আধ্যাত্মিক ধ্যান-স্মৃতিতে। দ্বারকানাথেরও কি মনে পড়েনি তেজস্বিনী দিগম্বরীকে? স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তিনি বারবার অনুভব করেছেন গৃহলক্ষ্মীর অভাব; তাই তো যেদিন কার-টেগোর কোম্পানীর একটি মূল্যবান জাহাজ অকুল সাগরে ডুবে গেল সেদিন দ্বারকানাথের বুকভাঙা নিঃশ্বাসের সঙ্গে শুধু বেরিয়ে এল দুটি কথা, লক্ষ্মী চলিয়া গিয়াছেন, অলক্ষ্মীকে এখন আটকাইবে কে?
সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে দিগম্বরী যে সাহস দেখিয়ে গিয়েছিলেন তার ছেলের বৌয়েদের মধ্যে সেই তেজ, সেই শক্তি দেখা যায়নি। দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদার সমস্ত কাজকর্মই ছিল স্বামীকেন্দ্রিক। বরং গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগমায়ার মধ্যে শাশুড়ির সনাতন ধর্মনিষ্ঠার অনেকটাই লক্ষ্য করা গেছে। দেবেন্দ্রনাথের ছোট ভাই নগেন্দ্রনাথের স্ত্রী ত্রিপুরা সুন্দরী, তিনি এসেছিলেন অনেক পরে।
সারদা এবং যোগমায়ার প্রসঙ্গে আরো একটা কথা বলা চলে যে তারা কিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন। মনে হয়, তখনও ধনী সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা নিয়মিত লেখাপড়া শিখতেন। মাইনে-করা বৈষ্ণবী এসে শিশুবোধক, চাণক্যশ্লোক, রামায়ণ, মহাভারত পড়াত। আর কলাপাতায় চিঠি লৈখা মকস করাত। এ নিয়ম যে শুধু ঠাকুরবাড়িতে ছিল তা নয়, অনেক বাড়িতে ছিল। সারদা এবং যোগমায়াও পড়তে পারতেন, শুধু তারা নন, বাড়ির অন্যান্য মেয়েরাও লেখাপড়া জানতেন। বই পড়লে বিধবা হবার ভয় কোনদিনই তাদের ছিল না। সম্ভবতঃ গ্রামাঞ্চলে এই জাতীয় বিধিনেষেধ চলত।
সারদা অবসর সময়ে প্রায়ই একটা না একটা বই খুলে বসতেন। সংস্কৃত রামায়ণ, মহাভারত পড়ে শোনাবার জন্যে মাঝে মাঝে ডাক পড়ত ছেলেদের। হাতের কাছে অন্য কোন বই না থাকলে অভিধানখানাইখুলে বসতেন। যোগমায়াও নানারকম বই পড়তেন। মালিনী আসত বটতলা থেকে ছাপা বইয়ের পসরা নিয়ে। সেখান থেকে বেছে বেছে বই কিনতেন মেয়েরা। নরনারী, লয়লা-মজনু, হাতিমতাই, আরব্য রজনী, লাম্বল টেল, পাল ও বর্জিনিয়া—সবই জোগাড় করেছিলেন যোগমায়। তার স্বামীর লেখা কাব্যোপন্যাস কামিনীকুমারও থাকত মালিনীর পসরায়। আর থাকত মানভঞ্জন, প্রভাস-মিলন, কোকিল দূত, অন্নদামঙ্গল, রতিবিলাপ, বস্ত্রহরণ, গীতগোবিন্দ, গোলেবকাওলী, বাসবদত্তার মতো কিছু বই। যোগমায়া বেশ ভালই বাংলা জানতেন। সত্যেন্দ্রনাথের ভাষায় তিনি ছিলেন আমাদের একপ্রকার শিক্ষয়িত্ৰী।
সারদা এবং যোগমায়া দুজনের কথাই জানতে ইচ্ছে করে কিন্তু জানার খুব সুবিধে নেই। ধর্মশীলা বৌদুটির জীবন বয়েছিল দুটি খাতে। সরলপ্রাণ। কামদয়া সারদা মহর্ষি স্বামীর সহধর্মিণী হবারই চেষ্টা করেছিলেন যদিও এ পর্মের প্রতি তার কোন আকর্ষণ বা আসক্তি ছিল বলে মনে হয় না। আমরা
কে যে রূপে দেখি সেটি সতী-সাধ্বী পতিব্রতার সনাতন রূপ। দেবেন্দ্রনাথের জন্যে তার ভাবনার সীমা ছিল না। একবার শ্রাবণ মাসের ভরা বর্ষায় তিনি গঙ্গাভ্রমণে বেরোলে কঁদতে কাঁদতে সারদাও ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে স্বামীর সঙ্গী হয়েছিলেন, আমাকে ছাড়িয়া কোথায় যাইবে? যদি যাইতেই হয়, তবে আমাকে সঙ্গে করিয়া নাও। হিমালয়ে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে চিঠি লেখানোর ঘটনাটি তো সবাই জানে। স্বামীর মঙ্গলের জন্যে ব্রহ্মোপাসনা এবং হিন্দুমতে পূজার্চন কোনটিতেই তার কিছুমাত্র আপত্তি ছিল না।
জ্ঞানদানন্দিনীর পুরাতনী কথা পড়ে আরো জানা যায় সারদা বেশি নড়াচড়া করতে পারতেন না। সংসারের নিত্যকাজ দেখাশোনা করবার প্রয়োজনও হত না। একখানি তক্তপোষের ওপর তিনি বসে থাকতেন আর দাসীরা ছেলের বৌয়েদের রূপটান মাখাত তার সামনে বসে। শুধু দেবেন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরলে সারদা নিজে রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাকতেন। জ্ঞানদানন্দিনী বলেছেন, আমার। মনে পড়ে বাবামশায় যখন বাড়ি থাকতেন আমার শাশুড়িকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন, ছেলেরা সব শুতে গেলে। আর মা একখানি পোয়া সুতি শাড়ি পরতেন, তারপর একটু আতর মাখতেন। এই ছিল তার রাত্রের সাজ।
সত্যি কথা বলতে কি, ঠাকুরবাড়িতে সারদার ছবিটি খুব স্পষ্ট নয় কিন্তু বড় স্নিগ্ধ। ভাবতে ভাল লাগে, তিন তলায় পঙ্খের কাজ-কর একটি ঘরে, মেঝেতে কার্পেট পাতা, সেই ঘরে বসে আছেন সারদা বালুচর শাড়ি পরে। ঘরের কোণে জ্বলছে একটি প্রদীপ, সেই আলোয় জ্বলজ্বল করছে সাদা চুলের মাঝে টকটকে লাল সিঁদুর। কত লোক আসছে যাচ্ছে, প্রশংসা করছে তাঁর জ্ঞানী গুণী ছেলেমেয়েদের, মায়ের লজ্জারুণ মুখে গভীর সুখের আবেশ—কিন্তু পাছে কেউ দেখে, দেখে ভাবে গরবিণী, তাই ছেলেমেয়েদের প্রশংসা শুনলেই মাথাটি নীচু করে নিচ্ছেন কুণ্ঠাভরে।
যোগময়ার ছবিটিও কম সুন্দর নয়। তাঁকে আমরা শুধু পুরনো কথার মধ্য দিয়ে পেয়েছি। তার গায়ের রঙ ছিল সোনার মতো আর পাশ দিয়ে। চলে গেলে গা দিয়ে যেন পদ্ম গন্ধ ছড়াত। দেবেন্দ্রনাথ ব্ৰাহ্মধর্ম গ্রহণ করার পরে বাড়িতে লক্ষ্মীজনার্দনের নিত্য পূজা বন্ধ করতে উদ্যত হলে যোগমায়া চাইলেন গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনকে। তাই হল। যোগমায়া দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে উঠে গেলেন দ্বারকানাথের বৈঠকখানাবাড়িতে। সেই থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দুটি বাড়িতে পরিণত হয়; তবে দুই বাড়ির পুরুষদের মধ্যে মতের অমিল বা মনের অমিল কখনো হয়নি। এই ঘটনার পর দুই পরিবারের মেয়েদের গতিবিধি অবশ্য স্বাভাবিক রইল না, শুধু পলাপার্বণে দেখাসাক্ষাৎ ঘটত।