দিদির মতো সুনয়নীও ঘর–সংসার, ঠাকুর–দেবতা নিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। তারই ফাঁকে ফাঁকে তিনি আঁকতেন রাধাকৃষ্ণ, হরপার্বতী, বালগোপাল, ননীচোরা, কৃষ্ণশোদার ছবি। কি করে ছবি আঁকতে হয় সুনয়নী শেখেননি। দুই দাদাকে নিবিষ্ট মনে দক্ষিণের বারান্দায় বসে ছবি আঁকতে দেখে-দেখে একটু বেশি বয়সে আপন মনেই ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন। ছবি আঁকা তো নয়, আঁকা-আঁকা খেলা। আগে থেকে কিছু না ভেবে, তুলি বুলিয়ে জলে ডুবিয়ে ডুবিয়ে ধোয়া—তারই মধ্যে কখনো আভাস এল নাদুসনুদুস বালগোপাল কেষ্টঠাকুরের, কখনো লাজুকলতা কনে বৌয়ের হেসে ওঠা চোখ দুটির—আগে থেকে কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু শিল্পী দাদাদের কোন প্রভাব সুনয়নীর ছবিতে নেই। আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার নব উদ্বোধনের যুগে তিন ভাইবোন বেছে নিলেন তিনটি পথ। অবনীন্দ্র গ্রহণ করলেন পারশিয়ান ও মোগল টেকনিক! গগনেন্দ্র নিলেন জাপানী ও কিউবিষ্টিক ধারা আর সুনয়নী একেবারে জনসাধারণের আট অর্থাৎ পটশিল্পের ভিত্তির ওপর আঁকলেন তার একান্ত নিজস্ব ছবি। পটের ছবির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ টানা-টানা দীঘল দুটি কালো চোখের গহিন ছায়ায়। সুনয়নীর ছবিতেও স্বভাবশিল্পী পটুয়াদের আঁকা চোখদুটি চোখে পড়ে। এ ধরনের চোখ আঁকার ব্যাপারে সুনয়নী যামিনী রায়েরও পূর্ববর্তিনী।
সুনয়নী ছবি আঁকতেন আপন খেয়ালে। তিনিই বাঙালী মহিলা চিত্রশিল্পীদের পথিকৃৎ। তখনকার দিনে যে মেয়ের ছবি আঁকত না তা নয়। বিশেষ করে যারা পশ্চিমের ফ্যাশান দুরস্ত ছিলেন তাদের তো কথাই নেই। ঘোড়ায় চড়া, ইংরেজীতে কথা বলা, পিয়ানো বাজানোর মতোই ছবি আঁকাঁটাও ছিল তাদের গুণের নিদর্শন। ঠাকুরবাড়ির ট্রাডিশন ভেঙে হেমেন্দ্রনাথও তার স্ত্রী ও মেয়েদের ছবি আঁকা শিখিয়েছিলেন। প্রতিভার আঁকা দু-একটা ছবি ছাপা হয়েছিল পুণ্যে। প্রজ্ঞার আঁকা দু-তিনটে পোট্রেট বেশ ভাল হয়েছিল। সুতরাং ছবি আঁকার চেষ্টা যে সুনয়নীর পক্ষে খুব নতুন তা নয়। নতুন তার দৃষ্টিভঙ্গির নতুনত্বে। এতদিন যারা ছবি এঁকেছেন তাঁর আঁকার চেয়ে বেশি ওপরে ওঠেননি। মানুষ বা প্রতিকৃতি যাই হোক না কেন তারই অনুকরণ করেছেন তারা। নীপময়ী, প্রতিভা, প্রজ্ঞা সম্বন্ধেও একথাই খাটে। কিন্তু সুনয়নী যা দেখলেন তাই আঁকলেন না। ছবির সঙ্গে মিশে রইল এক অধরা সৌন্দর্য। তাই তার ছবিতেই প্রথম দেখা দিল স্বকীয়তা। প্রথম প্রথম তিনি ছবি নিয়ে দেখাতে যেতেন দাদাদের।
দেখ তো দাদা কেমন হয়েছে।
দাদার উৎসাহ দেন। কখনো বলেন ভাল। কখনো বলেন বা। কখনো বলেন এঁকে যা, তোর হবে। সুনয়নী এঁকে চলেন। ঘর ভরে ওঠে ছবিতে। এর মধ্যে একটা ছবি অর্ধনারীশ্বর। দেখে খুশি হয়ে উঠলেন গগনেন্দ্র। অবনীন্দ্র তখন সরকারী আট কলেজের সঙ্গে যুক্ত। তাকে বললেন, ওকে একটা সাটিফিকেট লিখে দাও।
অবনীন্দ্র অনেকদিন থেকেই লক্ষ্য করছিলেন সুনয়নীর ছবি। এবার বললেন, ও যে ধারায় ছবি আঁকছে তার জন্যে আমায় আর সাটিফিকেট লিখে দিতে হবে না। পরে দেশের লোকের কাছ থেকে ও নিজেই সাটিফিকেট আদায় করে নেবে।
সত্যিই তাই নিয়েছিলেন সুনয়নী। দেশের সম্মান, বিদেশের সম্মান সবই পেয়েছিলেন। তবু তার জীবন ছিল সহজ ও অনাড়ম্বর।
সুনয়নী কি কোন বাধা পেয়েছিলেন? মনে তো হয় না। একলা ঘরে গিন্নী ছিলেন তিনি। বিয়ে হয়েছিল সেই বিখ্যাত চাটুজ্যে পরিবারে, যেখানে দুই বৌ হয়ে গিয়েছিলেন সরোজা ও ঊষা। সুনয়নীর স্বামী রজনীমোহন অবশ্য পাঁচ নম্বর বাড়িতেই থাকতেন। বাপের বাড়িতেই শ্বশুরবাড়ি হওয়ায় সুনয়নী অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে পিয়ানোয় সুর তুলতেন, ডিক্সনারী দেখে ইংরেজী শিখতেন আর ছবি আঁকতেন। আরেকটা কাজেও সুনয়নীর উৎসাহ ছিল। তিনি মেয়েদের দিয়ে নাটকাভিনয় করাতেন। মহর্ষি ভবনের মতো এ বাড়িতে স্ত্রীপুরুষ সবাই মিলে নাটক করতেন না। বরং মেয়েদের নাটকে মেয়েরাই সাজতেন পুরুষ। একবার জ্ঞানদানন্দিনীর উৎসাহে রত্নাবলী নাটকের অভিনয় হল। রাজা সাজলেন বিনয়িনী। রাণী গগনেন্দ্রের স্ত্রী প্রমোদকুমারী, মন্ত্রী সমরেন্দ্রের স্ত্রী নিশিবালা, বাসবদত্তা সুনয়নী ও চুতলতিকা অবনীন্দ্রের স্ত্রী সুহাসিনী। ছোট মেয়েদের নিয়েও সুনয়নী করাতেন আলিবাবা, মৃণালিনী বা অন্য কিছু। রবীন্দ্রনাথ বা জ্যেতিরিন্দ্রনাথের নাটক নিয়ে এঁরা এক্সপেরিমেন্ট করেননি, এমনকি অবনীন্দ্রনাথের লেখাও না। তাই বোঝা যায় এবাড়ির অন্দরমহলের সুরটি বাঁধা ছিল সাবেক কালের সঙ্গে।
সুনয়নীকে ছবি আঁকায় কেউ বাধা দেয়নি। সমাজ এখন উদার হয়েছে। আর সুনয়নীর বি ও তো ঠাকুর দেবতার ছবি। তারই মধ্যে দেখা দিল তার নিজস্ব ধারা। সুনয়নীর ছবি বিদেশীদের চোখে পড়েছিল। সর্বপ্রথম এ ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন স্টেলা ক্ৰামরিশ। তিনি ছবির আলোচনা করলে সেই লেখা পড়ে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন শ্ৰীমতী ককশীটার। লণ্ডনের উইমেন আর্ট ক্লাব থেকে তিনি সুনয়নীর ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করলেন ১৯২৭ সালে। বিদেশীরাও মুগ্ধ হল। তুলির টানে কোন দুর্বলতা নেই, নেই সংশয়ের অবকাশ। সবচেয়ে সুন্দর দুটি চোখ। দীঘল, মায়াময়, স্বপ্ন ঙিন। এ চোখ বুঝি পাশ্চাত্ত্য প্রথাসিদ্ধ নয়, তবুও ভীষণ রকম বাস্তব। সম্পূর্ণ বিদেশী প্রভাবমুক্ত সুনয়নী যেন নতুন শিল্পরীতির প্রবর্তন করলেন। ফ্রান্স এবং জার্মানী থেকেও আহ্বান এসেছিল। তবে সুনয়নী এত প্রদর্শনীর কথা ভাবছেন না। ভাল লাগত, মনের খেয়ালে আঁকতেন, বিলিয়ে দিতেন প্রিয়জনদের। এত খ্যাতি, এত সম্মান কিন্তু তাতে সুনয়নীর চিত্রভাষা বদলাল না। সেই রূপকথা, কথকতা, পাঁচালী, পুরাণ, মহাকাব্য, আলপনা, নকশী কাথা, বাউল, বোস্টম, আরব্য-রজনীর গল্পই জুড়ে রইল তাঁর ছবির জগৎ। শিব, কৃষ্ণ, লক্ষ্মীর ছবির সংখ্যাই বেশি। হরপার্বতী, অনারীশ্বর এবং রাধাকৃষ্ণেরও একাধিক ছবি আছে। অসংখ্য ছবি, কিন্তু সবার মধ্যেই যেন লৌকিক সারল্যের স্পর্শ মাখানো রয়েছে। ভাস্কর মীর মুখোপাধ্যায়ের মতে, সুনয়নীর ছবিতে কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই; দক্ষ হাতের খেলা নেই, কোন রঙের আড়ম্বর নেই—আছে একটি সহজ সোজা মন ও চোখের দৃষ্টি। একথা আরো মনে হয় সুনয়নীর কবিতা পড়লে। ঠাকুরবাড়ির অধিকাংশ মেয়েদের মতো তিনিও গান জানতেন, কবিতা লিখতেন। প্রকাশ্যে নয়। গোপনে। তাই বিনয়িনীর আত্মকাহিনীর মতোই সেগুলো আত্মগোপন করে আছে খাতার পাতায়। আমরা তার পুত্রবধূ মণিমালা দেবীর সৌজন্যে দুটো কবিতা দেখেছি। একটা তুলে দিচ্ছি। দুটিতেই রয়েছে এক অনাবিল সারল্য। সেকেলে শিশুপাঠ্য কবিতার সঙ্গে সুনয়নীর কবিতার মিল আছে। অথচ তিনি রবীন্দ্র-কাবের সঙ্গে ভালমতোই পরিচিত ছিলেন। অন্যদের কবিতাও পড়েছেন। কিন্তু তার নিজের কবিতা আশ্চর্যভাবে সরলীকৃত। মাটি ঘেঁষা। প্রাণবন্ত। শৈশবচেতনায় মগ্ন। এবার কবিতা :
সারাদিন বসি গগনের মাঝে
আলোকের খেলা করিয়া শেষ
সাঁঝের বেলায় চলে দিনমণি
ক্লান্ত শরীরে আপন দেশ।
গ্রামের পথটি আঁধারে ঢাকিল
ছেলেরা চলিল আপন ঘর প্র
দীপ জ্বলিয়া কে রেখে দিয়েছে
আলপনা দিয়ে দুয়ার পর
বধুটি চলেছে ঘোমটায় ঢাকি
কলসী ভরিয়া লইয়া জল
সোপান বাহিয়া চলে ধীরে ধীরে
চরণে তাহার বাজিছে মল।
গগন সাজিল নতুন শোভায়
পরণে নীল শাড়ি হীরার ফুল।
জ্বলিল গগনে হীরক প্রদীপ
আর নাহি হবে পথের ভুল।
খেয়া তরীখানি বাহিয়া এখনি
আসিবে যে নেয়ে করিতে পার
বলিবে কে যাবি আয় ত্বরা করি
নাহি কোন ভয় ভাবনা আর।
সুনয়নীর কবিতাও যেন ছবিতে ভরা। এই প্রকৃতি, এই ছেলের দল, আলপনা আঁকা-প্রদীপ জ্বালা ঘর, ঘোমটা-টানা বন্ধুর মল বাজিয়ে জল আনা, খেয়া তরীর মাঝির আহ্বান—এ সবই তো ছবির উপাদান। বাংলার নিজস্ব। এই সুর, এই ভঙ্গি, এই কল্পনা, কালিঘাটের পোটোর মতো এই তুলির টানও সুনয়নীর একান্ত নিজস্ব।