৫১.
বন্যার জল সরে গেলেও দাগ সরে না।
হাসপাতালের দেওয়ালের পলির দাগ নারকেল ছোবড়া দিয়ে ঘষে ঘষে তুলহিল অবনী। সেই সকাল থেকে কাজে লেগেছে, দম নেবারও ফুরসত পায় নি। মাঝে শুভ এসে তার জলখাবার দিয়ে গিয়েছে। কুমড়োর তরকারি আর তিনখানা রুটি। বাটিতে খবরের কাগজ ঢাকা দেওয়া। এসময় মাহি ভয়ানক উপাত করে, মোগ ছড়ায়। ডুবো ঘাস খেয়ে গোরু-ছাগলের অবস্থা খারাপ। পেট ছাড়ছে অনেকের।
খবর এসেছে দোয়েম আর চরসুজাপুরে বমি আর পাতলা বাহ্যি শুরু হয়েছে পাড়া জুড়ে। কারোর আবার গলা ফুলে ব্যামো, কারোর চুলকানি আর দাদ হাজা। সেই সঙ্গে জ্বরজালার কোনো ঘাটতি নেই। এত স্টাফ নেই যে ডাক্তারবাবু সব জায়গায় লোক পাঠাবেন। সাইকেল ঠেলে দোয়েম গিয়েছেন টিকেদারবাবু, সেই সকালে গিয়েছেন, এখনও তিনি ফেরেননি। তিনি না ফেরা পর্যন্ত রীতিমতন চিন্তায় আছেন ডাক্তারবাবু।
অবনী দেয়াল ঘষতে ঘষতে থামল, চেয়ারে বসা ডাক্তারবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে অকপটে জিজ্ঞাসা করল,বাবু, কি ভাবছেন তখন থেকে? কোয়ার্টারে চলে যান, আর মনে হয় রুগী আসবে না।
সেই সকাল থেকে আউটডোর খুলে বসে আছেন তিনি। জ্বরজ্বালার দু-দশজন যা ওষুধ নিয়েছে, এর বেশি কেউ আর আসেনি। কাদাজল ঠেলে হাসপাতালে আসা এখন ঝক্কির।
হাই তুলে ডাক্তারবাবু বললেন, বাসায় গিয়ে আর কি হবে? ওখানে গেলে হাসপাতালের চিন্তা হয়। আমাদের চাকরিটায় শুধু চিন্তা ছাড়া আর কিছু নেই।
অবনীর কণ্ঠস্বরে আনুগত্য ঝরে পড়ল, তা যা বলেছেন বাবু। আমার বাবা বলত-বড়োগাছে ঝড় বেশি লাগে। তা বাবু, আপনি হলেন বড়া গাছ। আমাদের বাপ- মা। আপনার তো চিন্তা হবেই।
চেয়ারে মাথা দিয়ে স্বস্তির সন্ধান করছিলেন ডাক্তারবাবু। দুজায়গায় কলেরার খবর তার সেই স্বস্তি-শান্তি কেড়ে নিয়েছে। আজ বিকেলে থানায় যাওয়া দরকার। ওয়ারলেসে সি. এম. ও. এইচ-কে খবর দেওয়া দরকার। ওপরওয়ালাকে না জানিয়ে রাখলে পুরো দায়টা পরে তার ঘাড়ে চলে আসবে। চাকরির নিরাপত্তার বিষয়টা সবার আগে তাকে ভাবতে হবে।
অবনী ভাবছিল ডাক্তারবাবু চলে গেলে হাত ধুয়ে এসে সে টিফিনটা আরামে খেতে পারত। ডাক্তারবাবুর সামনে তার খেতে কেমন সংকোচ হয়। হাজার হোক এই হাসপাতালের মাথা বলে কথা। তার কলমের দু খোঁচায় অবনীর বদলি অবধারিত।
এর আগে নগরউখড়ায় থাকার সময় এক পেসেন্ট পার্টির সঙ্গে তার ঝুটঝামেলা হয়েছিল। যার সাথে ঝামেলা সে দলবল জুটিয়ে অবনীকে মারার জন্য তৈরি ছিল। অবনীও ছেড়ে কথা বলত না। রাগ তার শরীরেও আছে। বিপদের আঁচ পেয়ে ডাক্তারবাবু মিটমাট করে দিলেন সেবার। হাতে হাত মিলিয়ে শান্ত হল ওরা।
সেদিনের সেই ঘটনাটা প্রায়ই মনে পড়ে অবনীর। নগরউখড়ার অনেক স্মৃতি সে এখনও মন থেকে মুছতে পারেনি। চাকরির প্রথম জীবনটা জন্মদাগের মতো, কিছুতেই মেলায় না। স্মৃতি কাতরতায় ডুবে থাকে।
ডাক্তারবাবু চলে যাওয়ার পর ঝটপট টিফিন করে নিল অবনী। এতগুলো ঘরের সাফ-সুতরো করার দায়িত্ব তার। বন্যা চলে গেছে কিন্তু পচা ভ্যাপসা গন্ধটা রেখে গেছে। আশপাশে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়েও কোনো লাভ হয়নি। মশা মাছি পচা জলের ঘ্রাণে ধেয়ে আসছে। চড়া রোদ না উঠলে এসব আর দূর হবে না।
ছ-সাতটা দিন ছাদে কাটানোর অভিজ্ঞতায় বেশ ঝানু হয়ে গিয়েছে অবনী। চোখের পর্দা সরে গিয়ে মানুষের আসল রূপ চিনতে পেরেছে সে। বিপদের দিনে কেউ কারোর নয়–এ কথাটা আর একবার তার কাছে প্রমাণ হল। একটা চাপা দুঃখ তার ভেতরে পচা পাকমাটির মতো বিছিয়ে আছে। এই দুঃখটা ধীরে ধীরে শুভর মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে। সেও ভীষণ মনমরা আর বিষয়। শুধু রঘুনাথ ছাড়া আর কেউ তার খোঁজ নেয়নি। খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি। কেন করেনি? এ প্রশ্ন কোনোদিনও শুভ মুখ ফুটিয়ে করেনি। শুধু সরস্বতী আক্ষেপ করে বলল, যাদের আপন ভাবতাম তারা চোখ সরিয়ে নিল। শুধু ভগবান ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।
অভিমানের কথায় মনের ভীষণ অসুখ করে। সেই অসুখ সারতে সময়ও লাগে। মাধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুভর এই কথাগুলোই মনে পড়ল বারবার করে। মাধুরী কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, দেখ শুভ, আমার কিছু করার ছিল না। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না।
শুভ কি বলবে? কোনো কথা বলার মতো অবস্থায় সে ছিল না। শুধু তার ঠোঁট কেঁপে উঠল, অভিমানে ভার হয়ে এল গলা, না রে, মনে করার কি আছে, যা স্বাভাবিক,যা হবার তাই হয়েছে।
-এ তোর রাগের কথা।
মাধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুভর কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল, পুরনো কথা ভুলে যা। বল কি জন্য এসেছিস?
-আমাকে বসতে বলবি নে?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ বস না। শুভ পেতে রাখা খাটটা দেখিয়ে দিল।
উশখুশিয়ে মাধুরী বলল, স্কুল খুললেই পরীক্ষা। কিছু পড়া হয়নি। কী যে করব।
-পাকা বাড়িতে ছিলিস অথচ পড়িসনি কেন?
–সত্যি কথা বলব?
–হ্যাঁ, বলতে পারিস।
-তোর কথা ভেবে আমার খুব মন খারাপ করত। অনেকবার বই নিয়ে বসেছি, কিন্তু পড়ায় মন বসাতে পারিনি। আচ্ছা, তুই কি একবারের জন্য আমার কথা ভেবেছিলিস? খুব নিচু গলায় কথাগুলো বলে তাকাল মাধুরী।
এসব কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া হল না শুভর। মৃদু হেসে সে বলল, মন থাকলে তা খারাপ করে। এ আর নতুন কি?
-বন্যার পরে মাটি নরম হয় অথচ তুই তোর মনটাকে শক্ত করলি কি ভাবে? মাধুরীর জিজ্ঞাসায় প্রচ্ছন্ন খোঁচা ছিল, তা গায়ে মেখে নিয়ে শুভ বলল, আমাকে বাজারে যেতে হবে চাল কিনতে। তুই যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেল।
–আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস? আহত চোখে তাকাল মাধুরী।
শুভ কিছুটা ঘাবড়ে গেল তার কথার স্বরে, তোকে কেন তাড়িয়ে দেব। আমি শুধু আমার দরকারের কথাটা বললাম।
-আগে তো তুই এত হিসাব করে কথা বলতিস না? মাধুরীর কথার তীক্ষ্ণতায় হকচকিয়ে গেল শুভ।
মাধুরী নিজেকে শোনানোর মতো করে বলল, ঠিক আছে, আমাকে যখন পছন্দ নয় তখন আমি চলে যাচ্ছি। আর যদি কিছু মোনানোর থাকে তাহলে ভালো করে শুনিয়ে দে। আজ আমি গায়ের চামড়া মোটা করে তোদের কোয়ার্টারে এসেছি। জানি এসব কথা আমার পাওনা। তবে একটা কথা, আমি মরে গেলে তো তুই আমাকে এসব কথা শোনাতে পারবি না?
ধ্বক করে উঠল শুভর বুকটা। হাড়-পাঁজরা সব কেঁপে উঠল শব্দের ঝাঁকুনিতে। কিছু বলতে গিয়ে মুহর্তে তার কথাগুলো বরফ হয়ে গেল। সে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল মাধুরীর মুখের দিকে।
মাধুরী ক’পা সরে এসে ক্লান্ত, বিধবস্তু চোখে তাকাল, এখন আমি যাই। তবে একটা কথা শুনে রাখ। আমি শিবনাথবাবুদের ছাদের তলায় থাকলেও তোর জন্য রোজ বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কাদতাম। এখন বৃষ্টিও নেই, জলও নেই। চোখের জলের দাগও মিলিয়ে গেছে। তুই প্রমাণ চাইলে আমি মিথ্যেবাদী হয়ে যাব। মাধুরী আর দাঁড়াল না, আগুনে পোড়া পাখির যন্ত্রণা নিয়ে ফিরে গেল।
.
ফিল্ড থেকে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল টিকেদারবাবুর। কুমোর খাদে জলপাখিদের আওয়াজ থেমে গেছে। বাতাসে জলীয় কশার অতর্কিত হামলা। আঁধার দেখলেই মশারা উড়ে আসে কলাবাগানের ভেতর থেকে। অবনী এখনও ঘরে ফেরেনি। সরস্বতী সন্ধ্যা দেখিয়ে হ্যারিকেনের পোড়া সলতে কাটতে বসে গেল। আর একটু পরেই এরফান আসবে, এসে গল্প শুরু করবে রাজ্যের। হা করে তার সেই আবোল তাবোল গল্প শুনতে হবে তাকে।
সবুজের সঙ্গে গত দু-দিনে একবারও দেখা হয়নি শুভর। হয়ত টিকেদারবাবু মানা করেছেন তার সাথে মিশতে। বড়ো মানুষদের বড়ো চিন্তা। আসলে টিকেদারবাবু চান না সবুজ তার সঙ্গে মিশুক। মেলামেশাটাও একটা ছোঁয়াচে রোগের মতন। একটা পচা আলুর কাছে একটা ভালো আলু থাকলে সেই ভালো আলুটাও নাকি পচে যায়।
টিকেদারবাবুর এই চিন্তা ভাবনা শুভকে মনমরা করে রাখে সব সময়। অথচ সবুজের সঙ্গ তার ভালো লাগে। সবুজ বুড়িগাঙের হাওয়া। তাকে আটকে রাখা যায় না। তবু কিভাবে যেন আটকে আছে সবুজের স্বাভাবিকতা। টিকেদারবাবুর কড়া শাসন পাঁচিল তুলেছে এই মেলামেশায়। অথচ সবুজের মা অন্য মানুষ। তিনি কম কথা বলেন। কিন্তু যেটুকু বলেন কাজের কথা। তার মধ্যে বিভেদ নেই। তাঁর ধর্ম জলের ধর্ম। তিনি বিশ্বাস করেন–মানুষই ভগবান, ঈশ্বর। অথচ টিকেদারবাবু ধমক দিয়ে বলেন, তুমি থামো তো। যা বোঝ না তা নিয়ে বেশি কথা বলো না। সবাই যদি এক হবে তাহলে ভালো, মন্দ কথা দুটো সৃষ্টি হত না। বাজার থেকে ফিরে শুভ হাত-পা ধোওয়ার জন্য টিউবওয়েলটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে পুরো এলাকার চেহারাটা বুঝি বদলে যায়। কালীগঞ্জ বাজারের আগের শ্রী এখনও ফেরেনি। জলকাদায় প্যাঁচপ্যাঁচ করছে চারধার। বড়ো ড্রেনগুলো ভরে আছে জলে। সেখানেও মশা-মাছির চাষ-আবাদ। সব চাইতে করুণ দশা হয়েছে বারোয়ারিতলার। ঠাকুরথানটা জল সরে যাওয়ার পর কেউ পরিষ্কার করেনি। জলের দাগ, সেই সঙ্গে পা জড়িয়ে যাওয়া পলি ছড়িয়ে আছে ইতস্তত। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ফেরার সময় মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে বই দোকানটার সামনে দেখা হল শুভর। তাকে দেখতে পেয়ে মনে খেদ চেপে রেখে মৃত্যুঞ্জয় শুধালো, কেমন আছো বাবা?
শুভ দাঁড়িয়ে পড়ল, ভালো আছি কাকা। তোমরা সব ভালো তো?
মৃত্যুঞ্জয় হাসতে গিয়েও যেন হাসতে পারছে না, এই কোনোরকমে গড়িয়ে সড়িয়ে চলে যাচ্ছে বাবা। বান-বন্যায় কি আর ভালো থাকব? ঘরে অন্ন না থাকলে মন তো হমছাড়া হবেই।
মৃত্যুয়ের দুঃখটা অন্তর দিয়ে বুঝতে পারল শুভ। কালীগঞ্জ বাজারে তার ইটপাতা সেলুন আছে। সেখানে পেছনে ইট দিয়ে চুলদাড়ি কাটে অনেকে। পয়সা আর জায়গার অভাবে বাজারে ঘরভাড়া নিতে পারেনি মৃত্যুঞ্জয়। একটা সেলুনের স্বপ্ন দেখে সে। বড় আয়নায় গ্রাহকরা মুখ দেখবে, সরু চিরুনি নিয়ে চুলের টেরি কাটবে-এ স্বপ্ন বুঝি তার পূরণ হবার নয়। মাছ ধরা ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে তাই সে এখন ভ্রাম্যমাণ শুর-কাচি নিয়ে পড়েছে। মৃত্যুঞ্জয়ের ইটালি-সেলুনে নামমাত্র মূল্যে চুলদাড়ি কাটা হয়। তবে গাঁয়ের লোকে বিবাহ-শ্রাদ্ধে তাকে কোরকর্মে নেয় না। ঠাট্টা করে বলে, জাল ফেলে যে সুর-কাচি ধরে সে আবার প্রামাণিক হল কবে থেকে? কথাটা সত্যি। এর জন্য মৃত্যুঞ্জয়ের মনে কোনো দুঃখ নেই। তার সব সুখ জুড়ে আছে তার একমাত্র ছেলে সঞ্জয়। সঞ্জয় এবার আর্টস নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবে। হালদার বংশের সে হবে একমাত্র ইলেভেনের টেস্ট দেওয়া ছেলে।
ইটালি সেলুনের শ্যাওলা পড়া ইটে বসে মৃত্যুঞ্জয় মা-মরা ছেলে সঞ্জয়ের কথা ভাবে। ছেলে বড়ো হয়ে তার স্বপ্ন পূরণ করবে। ইটালি সেলুনের ইট নিয়ে গিয়ে সে ঘর গাঁথবে। সে ঘরে মাথার উপর ঢালাই ছাদ থাকবে, দেওয়ালে থাকবে বড়ো আয়না। মৃত্যুঞ্জয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষটার স্বপ্নের কথা বহুবার শুনেছে শুভ। অবনীর সঙ্গে তার এত কেন খাতির বুঝতে পারে সে। এক অভাবী আরেক অভাবীর দুঃখ বোঝে। ওদের দুজনের দেখা হলে কথা আর শেষ হতে চায় না। মুখোমুখি বসে ওরা দুটিতে ভসভসিয়ে বিড়ি টানে। কখনও মন হলে অবনী গিয়ে মুড়ি আর চপ কিনে আনে দু ঠোঙ্গা। তেল জড়ানো ঠোঙ্গায় পৃথিবীর সব সুখ বুঝি চুঁইয়ে নামে। মৃত্যুঞ্জয় বলে, ছেলেটার একটা পাশ হয়ে গেলে বাঁচি। শিবনাথবাবুর হাতে পায়ে ধরে ইস্কুলের লেখা-পড়া কাজে লাগিয়ে দেব।
-তোমার তো হয়ে এল দাদা, আমারটা যে কি করবে কে জানে।
–শুভ তো পড়াশোনায় ভালো। অত চিন্তা করছ কেন?
চিন্তা কাউকে ছাড়ে না। মৃত্যুঞ্জয় বেজার মুখে বলল, বান চলে যাওয়ার পর এট্টা খদ্দেরও আসেনি বাবা। কি করে সংসার চলবে ভেবে পাচ্ছি নে। শিবনাথবাবু বলেছিল, মন্ত্রী আসবে। হেলিক্যাপ্টার চক্কর কাটবে। বস্তা বস্তা চাল গম চিড়া কেউ তার কিছু পেল না! এখন ঘর খরচের পয়সা জুগাতে মনে হচ্ছে বুকের হাড় বাঁধা দিতে হবে।
অভাব একটা আগুন। অভাব সব খায়। মৃত্যুঞ্জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুভর মনে হল অভাবের লেলিহান শিখায় মানুষটা বুঝি ঝলসে গেছে।
মৃত্যুঞ্জয় ঢোক গিলে নিয়ে শুভকে বলল, বানে তোমরা বড় কষ্টে ছিলে এ সংবাদ আমি লোকের মুখে শুনেছি। কিন্তু কাছে গিয়ে তোমাদের কোনো কাজে লাগতে পারিনি। বাজারের ভেতর দিয়ে যা জলের সোরত, ঘাস ফেললে নিমেষে তা দু টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। তবু সঞ্জয় বলছিল সে গিয়ে তোমাদের সাথে করে নিয়ে আসবে। আমি তাকে যেতে দিইনি বাবা। আসলে কি জানো? জলকে আমার বরাবরের ভয়। জল নিজের কথা ছাড়া কারোর কথা শোনে না।
এ প্রসঙ্গে শুভর আর কথা বলার ইচ্ছে ছিল না, সে অলসভাবে অন্য কথায় চলে গেল, · আমি এখন আসি কাকা। ঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে। লিটনদাকে বলল আমি ওর সঙ্গে পরে দেখা করে নেব।
লিটন সঞ্জয়ের ডাক নাম। ইস্কুলের সবাই ওই নামে তাকে বেশি চেনে। লিটন চরিত্রটি কারোর সঙ্গে মেলে না। তার ভেতরে একটা সবজান্তা গোছের ভাব আছে। মহাকাশ থেকে নিয়ে পাতাল অবধি তার জ্ঞানের পরিধি। কোনো বিষয়ে সে মন্তব্যহীন থাকা পছন্দ করে না। সব বিষয়ে তার জ্ঞান ফলানো চাই-ই-চাই। সেই কারণে হেডমাস্টারমশাই তার উপর ভীষণ বিরক্ত। অমলকান্তি স্যারও মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠেন লিটনের ব্যবহারে
কেউ হাঁপিয়ে উঠল কিংবা বিরক্ত হল তাতে লিটনের কোনো কিছু যায় আসে না। সে তার গলার চড়া ঘরে প্রভুত্ব করতে অভ্যস্ত। ভর টিনের এসব গুণ ভালো লাগে না, সে ভালোবাসে লিটনের প্রতিবাদী সত্তটাকে। শিবনাথবাবুর মুখের উপর গলা চড়িয়ে কথা বলার স্পর্ধা রাখে এই ইস্কুলের একমাত্র লিটন। সে নির্ধিধায় বলবে, যান, যান, আপনার মতো সেঁকা রুটি মানুষকে আমার জানা আছে। ক্ষমতার লোভে আপনারা সব করতে পারেন। যারা ভাইপোকে ছেলে সাজিয়ে ইস্কুলের সেঁকা রুটি হয় তাদের মন যে কত বড়ো হিমালয় তা আমার জানা আছে।
শিবনাথবাবু অবিবাহিত। ইস্কুলের সেক্রেটারি হতে গেলে প্রাথমিক শর্ত হল ওই ব্যক্তির ছেলে-মেয়েকে এই ইস্কুলে পড়তে হবে। ছেলে-মেয়ে না থাকলেও তিনি যে কারোর লিখিত অভিভাবক এমন সত্যতা অবশ্যই থাকতে হবে। প্রথমটা সম্ভব না হওয়ায় ক্ষমতার লোভে দ্বিতীয় পটাই অনায়াসে বেছে নিয়েছেন শিবনাথবাবু। এতে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।
মানুষকে বোকা ভাববার এত কারণ নেই। জেগে ঘুমানো মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। মৃত্যুঞ্জয় হালদারের ছেলের মতো অনেকেই ঘুম ভেঙে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে অনেক আগে থেকেই। তারা ক্ষমতার স্বচ্ছতা এবং বিকেন্দ্রিকরণ পছন্দ করে। লিটনও তাদের মধ্যে একজন। সে নিজে গরিব বলে বিদুর আর লাবণি রাজোয়ারের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। কিছু শব্দকে বিকৃত করে লিটন নিজের মতো করে বলতে ভালোবাসে। যেমন সেক্রেটারি শব্দটাকে সে সবসময় সেঁকা রুটি বলে বলতে ভালোবাসে। শব্দকে বিকৃত করতে তার মতো ওস্তাদ আর কেউ নেই। লিটনের এসব ভাষণ মৃত্যুঞ্জয়কে মোহিত করে দেয়। আগামী দিনের স্বপ্নে তার চোখ কামরাঙার মতো রঙিন হয়ে ওঠে। সত্যিই লিটন কোনো বাঁশের পলকা লাঠি নয়, সে একেবারে ইস্পাত। এই বয়সে ছেলেটা যে জ্ঞানের অধিকারী হয়েছে হালদার বংশে এর আগে কেউ তা অর্জন করতে পারেনি।
অন্ধকার নেমে এলে মন খারাপের পোকাগুলো ঝিঁঝি পোকার মতো কানের পর্দায় ভাসতে থাকে। বিরক্তিকর টানা সেই শব্দ। কদবেলতলার কাছে এসে হাঁপিয়ে উঠল শুভ। বাঁ-পাশের টালি কারখানাটা কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে ধুকছে। যত অন্ধকার সব যেন বুকের খোদলে ঢুকিয়ে নিয়েছে কারখানাটা। এক ঝলক হাওয়া আসতেই পাকা কদবেলের গন্ধটা আছড়ে পড়ল শুভর নাকের উপর। পাতার ঘোমটায় ঢাকা পড়া পুরুষ্ট কদবেলগুলো নতুন বউয়ের দৃশ্যমান ফরসা মুখের মতো।
এই কদবেল গাছটার গোড়ায় দাঁড়ালে আকাশ দেখা যায় সম্পূর্ণ। বাঁশঝাড় কারখানা পরিত্যক্ত-পোড়ে কোথায় যেন একটা শ্বেতখরিস আত্মগোপন করে আছে। অনেকেই তাকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছে।
এতদিন, এত বছর হল তবু শুভ কোনোদিন দেখতে পায়নি সাপটাকে। শুধু গল্পকথায় জীবন্ত হয়ে আছে খেতখরিসের ফণা তোলা মাথা। শুভ হাসাপাতালের গেট দিয়ে নামতে গেলে একটা চাপা মেয়েলী কণ্ঠস্বর তার কানে এসে বিধল। বাঁকা, হেলে পড়া খেজুরগাছটার আড়ালে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দুজন। মেয়েটা তার সমস্যার কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলছে। যার সারমর্মবান বন্যায় মরে আচি গো। এট্টা ছাগল ছিল, তাও বেচে দিলাম জলের দরে। ছেলেটারে নিয়ে সার আর চলতে চায় না। বানে আমার কারবার সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। এখন আর কেউ আমার কাছে মদের জন্যি আসে না। জল যতদিন না টানবে ততদিন এই দুর্ভোগ।
ছায়ামূর্তিটা মন দিয়ে কথা শুনছিল। শেষে সে বলল, আমাকে কি করতে হবে বলো?
-কি আর করবা। যদি কিছু ধার হিসাবে দিতে পার দাও। আমি শোধ দিয়ে দেব।
-টাকা আমি দিতে পারি কিন্তু তোমার কাছ থেকে ঘুরোণ নেব না। তুমি আমার কোথায় আছে তা আমি কি করে তোমাকে বোব। লোকটা ব্যাকুল হয়ে উঠল মেয়েমানুষের হাতটাকে বুকের কাছে টেনে এনে।
হাত ছাড়িয়ে নিল না মহিলা। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, আর আসে না কেন? বউদি বুঝি মানা করেছে।
–তার মানা আমি শুনব না। সে কে? সে আমাকে ভালোবাসে না। লোকটির গলায় উত্তেজনা ছেয়ে গেল।
বউটি নির্দ্ধিধায় বলল, বউদি বড়ো হিংসুটে। শুধু তাই নয়-দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। তোমার সাথে কথা বলি বলে আমাকে তো দু-চোখে দেখতে পারে না।
লোকটি সাদা জামার পকেট হাতড়ে পঁচিশ টাকা বউটির হাতে ধরিয়ে দিল।
বউটি টাকাটা স্পর্শ করে কেঁদে উঠল, আজ আমি ভিখিরি, অথচ একদিন আমার সব ছিল। আসলে কি জান, এসব হল ভগবানের মার। হরিয়া আমাকে জান দিয়ে ভালোবাসত, একদিন পুকুরে সে আমাকে ডুব দিয়ে জড়িয়ে ধরল। জলের মধ্যে আমি তাকে বাধা দিতে পারছি না। সে-ও আমাকে ছাড়বে না। দিলাম ওর হাত কামড়ে। দাঁত বসে গেল। শিরা কেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত। হরিয়া জলের উপর উঠে আমার দিকে ভ্যাল ভ্যাল করে তাকাল। ওর চোখে জল। আমাকে অভিশাপ দিল। তুই কুনোদিন সুখী হবি না। আমাকে কাদালি, তুইও কাঁদবি। হরিয়া চলে গেল। সেই থেকে আমি কাঁদছি।
-হরিয়াকে তো এখন আর দেখি না?
-সে আছে। তবে তার মাথার ঠিক নেই। আমার যেদিন বিয়ে হল সেদিনও মরতে গিয়েছিল। যমরাজ ওকে নেয়নি। আমবাগানে ফাস নিতে যাওয়ার সময় বাহ্যি করতে যাওয়া একজন মুরুব্বি তাকে দেখে ফেলে। সে-ই বাঁচায় তাকে। তারপর থেকে ও পাগল। রাত বেরাতে গান গেয়ে গেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ফেরে। জানো, ওর অভিশাপ আমার গায়ে লেগেছে। মাঝে সে আমার কাছে এসেছিল মদ খেতে। আমি ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি। মহিলাটি চোখের জল মুছে নিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল, এবার আমি যাই। ছেলেটাকে পড়শির ঘরে রেখে এসেছি। তুমি কবে আসবে। তুমি না এলে আমার মন কাঁদে।
বউটি চলে যাওয়ার পর লোকটি দেশলাই ঠুকে একটা বিড়ি ধরাল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কি সব বিড়বিড় করতে করতে কোয়ার্টারের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
প্রথমেই গলার স্বর শুনে অবনীকে চিনতে পেরেছে শুভ। বউটিও তার চেনা, দাসপাড়ার স্বামী খেদানো পদ্ম। পদ্মর সাথে তার বাবার এই অযাচিত ঘনিষ্ঠতার কোনো অর্থ বুঝতে পারে না শুভ। মার ব্যবহারে বাবা যে তিতিবিরক্ত এটা সে টের পেয়েছে। মাঝে মাঝে মাকে তার নিষ্ঠুর বা পাথরের নারী বলে মনে হয়। মানুষ এত নির্দয়, হৃদয়হীন হয় কি করে? দয়ামায়া শরীর থেকে হারিয়ে গেলে মানুষের আর কি অবশিষ্ট থাকে?
পদ্ম অবনীকে দুর্দিনে ছায়া দেয়। এই ছায়াটাই ভালোবাসা। এই ভালোবাসা একদিন আগুন হয়ে জ্বালিয়ে দেবে সুস্থির সংসার। ভুসোকালির মতো সারা গায়ে জড়িয়ে যাবে কলঙ্ক। এত জেনেও মানুষ তবুও ভালোবাসে, সে লটকান ঘুঘুপাখির মতো ছটফট করে।
আজ অবনীর সেই ছটফটানি প্রত্যক্ষ করেছে শুভ। পদ্মও বিচলিত ছিল নানা কারণে। হরিয়ার অভিশাপ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। হরিয়াকে সে আজও ভুলতে পারেনি।
হাবাগোবা অবনীকে শুভর এখন কেমন অন্যরকম লাগছে। ভালোবাসা কি তাহলে কদবেল গাছের আশেপাশে আত্মগোপনকরে থাকা বেতরিস সাপ? এই শেতবরিস সাপ কি সবার বুকের ভেতর ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে? হাসপাতালের সামনে এসে শুভর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সে দৌড়াতে দৌড়াতে হাজির হল আজারবাবুর কোয়ার্টারের সামনে। মাধুরীকে এত কঠিন কথা বলা তার উচিত হয়নি। মাধুরী দুখ পেয়েছে। সে কারোর দুঃখের কারণ হতে চায় না। তার পৃথিবীতে সামান্য হলেও মাধুরীর একটা জায়গা আছে। সেই জায়গাটাকে সে কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না। যত দিন বাঁচবে, আগলে রাখবে যেমন নদীর জলকে আগলে রাখে পাড়, মাটি, শেকড় সমেত বৃক্ষ।
শুভ অধীর হয়ে ডাকল, মাধুরী, মাধুরী, আমিই-ই-ই-ই। দরজা খোল। ঘেরা বারান্দায় ঠোঁটে হাসি ফোঁটাল বনশ্রী, আয়, ঘরে আয়।
সংকোচের সঙ্গে শুভ বলল, আজ আর ঘরে ঢুকব না। মাধুরীর সঙ্গে দেখা করে চলে যাব।
-বাপ রে, এত কিসের তাড়া?
শুভ উত্তর না দিয়ে নীরব চোখে তাকাল।
বনশ্রী বললেন, তোদের মধ্যে কি হয়েছে রে? তোদের ওখান থেকে ফিরে মাধুরী একেবারে হলো বেড়ালের মতো মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।
-কিছু হয়নি তো।
-লুকাচ্ছিস? বনশ্রী চাপা গলায় শুধালেন, তোরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড্ড বেশি নিজেদের চালাক ভাবিস–তাই না?
শুভ রীতিমতো অপ্রস্তুত, না, তা নয়। ওর সাথে আমার কিছু হয়নি। মাধুরী এত ভালো মেয়ে, ওর সাথে ঝগড়া করা যায় না।
তাই নাকি? অদ্ভুত কায়দায় চোখ নাচালেন বনশ্রী, অথচ ঘরে ও প্রতি কথায় ঝগড়া করে। আমাকে মোটে পাত্তা দেয় না। আমি ওর মা। অথচ ওকে ঠিক বুঝতে পারি না।
কাউকে চেনা কি সহজ কথা? ভাবল শুভ। অবনীকে সে কি চিনত–আজ একটু আগে যেমন চিনল। রাত্রি চেনা সহজ, মানুষ চেনা কঠিন। সব মানুষের মনে হাজারটা জানলা থাকে। তার কোনোটা দিয়ে আলো আসে তো-অন্যটা দিয়ে অন্ধকার। এর হিসাব রাখা বড়ো কঠিন।
শুভর মাথাটা কেমন গুলিয়ে যায়। বনশ্রী জিজ্ঞাসা করেন, কি ভাবছিস? শুভর কথায় সারল্য ধরা পড়ে, মনে হচ্ছে এখন না এলে ভালো হত। কষ্ট হজম করা আমার অভ্যাস আছে, কিন্তু কাউকে অকারণে কষ্ট দিতে মন চায় না।
-বাঃ, বেশ বললি তো? বাংলায় কত পেয়েছিলি? বনশ্রী তির্যক চোখে বিধলেন।
শুভ মনে মনে বিরক্ত হলেও যথাযথ ধীর-স্থির কণ্ঠে বলল, তমালবাবু এবারও আমাকে হায়েস্ট দিয়েছেন। ফিজিল-কেমিস্ত্রির চেয়েও বাংলা পড়তে আমার ভালো লাগে।
-তাহলে আর্টস নিয়ে পড়তে পারতি?
–আমার তো তাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অমলকান্তি স্যার বললেন সায়েন্স নিতে।
-কী আশ্চর্য। নিজের ভবিষ্যৎ-এর কথা নিজে ভাববি তো? অন্যের মুখে ঝাল খেলে তোর কি ঝাল খাওয়া হয়ে গেল? বনশ্রীর চোখা চোখা প্রশ্নগুলো বিদ্ধ করছিল শুভকে।
সে মাথা সোজা করে বলল, সায়েন্স নিয়ে পাশ করলে তাড়াতাড়ি চাকরি পাওয়া যায়। হেডমাস্টারমশাই প্রেয়ারের সময় বলছিলেন এখন সায়েলের বাজার।
-ওঃ, ঠিক আছে। বনশ্রী খুশি হলেন না জবাব শুনে।
শুভরও ভালো লাগছিল না, সে ঘাড় তুলে বলল, আমি এবার আসি।
–আসি মানে! তোকে ছেড়ে দিলে আজ সারারাত ও আমার সঙ্গে বাড়া করবে। তুই ওর সাথে একটু দেখা করে যা।
-আমি তো দেখা করতেই এসেছিলাম। শুভ নিঃশ্বাস ছাড়ল।
বনশ্রী কিছু বলার আগেই খাট থেকে নেমে এল মাধুরী। তার টুলটুলু চোখ। যেন ঘুম থেকে উঠে এল। চুল বাঁধা নেই, কাঁধের উপর ছড়ানো। লম্বা চুলগুলো রাত হয়ে শুয়ে আছে। বনশ্রী যাওয়ার আগে বললেন, তোরা বসে গল্প কর। আমি দুধ দিয়ে সিমাই করে আনি। শুভ কতদিন পরে এসেছে বল তো?
অন্ধকারেরও চোখ ধাঁধানো রূপ থাকে। মাধুরীর ফোলা গালে তখনও শেষ বিকেলের রোদের মতো লেপটে আছে অভিমান। সে ভারিক্কী গলায় শুধালো, তুই কেন এসেছিস?
-খুব মন খারাপ করছিল, তাই। শুভ কিছু লুকাল না।
–আমার জন্য তোর মন খারাপ করছে-হাসালি।
–এতে হাসির কি হল? কারোর জন্য কারোর বুঝি মন খারাপ করতে নেই?
মাধুরী বিস্ময়ে ঠোঁট কামড়াল, তোর মন বলে কোনো বস্তু আছে? আমার তো মনে হয়। তুই পাথর।
দ্যাখ, ঝগড়া করবি না, আমি ঝগড়া করতে আসিনি। শুভ বোঝাতে চাইল। তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল মাধুরী, আর ন্যাকা সাজিস না। তোর মনের কথা আমি জেনে গিয়েচি।
কথা শুনে চোখের তারা কেঁপে উঠল শুভর। মাধুরী কি জেনেছে? শুভ যে প্রথম থেকে মাধুরীর উপর দুর্বল–এটা ক্লাসের সবাই জানে। এই নিয়ে অনেকে আড়ালে হাসাহাসি করে। শুভ মুখ বুজে থাকে। অনেক মানুষ হাওয়া অফিসের মতো আগাম সব কিছু জেনে যায়।
শুভর চোখ চকচক করছিল হ্যারিকেনের আলোয়, তুই এত মুখ ভার করে থাকলে আমার কিছু ভালো লাগে না। আমি যাচ্ছি।
ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে শুভ পা বাড়াতে গেল। মাধুরী এগিয়ে এসে তার হাত চেপে ধরে, কপট রাগে গালে টোল ফেলে বলে, যা দেখি, তোর সাহস কত! হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে শুভকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল মাধুরী, চাপা গলায় বলল, অনেকক্ষণ ধরে তোর অত্যাচার সহ্য করছি, আর কিন্তু করব না। চুপচাপ ভালছেলের মতো চেয়ারটায় বস। তোর কি কি প্রশ্ন আছে আমাকে বল।
শুভ বলল, আমি পরীক্ষা নিতে আসিনি। আমি এসেছিলাম তোকে দেখতে।
-ভালো কথা, চোখ ভরে দেখে নে। ছাপা ফ্রকটা টেনেটুনে, ডল পুতুলের মতো হাত ছড়িয়ে দাঁড়াল মাধুরী, নে, এবার যত খুশি দেখে নে। তুই ভাবছিস আমি মরে যাব। আমি অত সহজে মরব না। তুই মিলিয়ে নিস আমার কথাটা।
–আজ তোর কি হয়েছে বল তো, সেই সকাল থেকে শুধু মরা-মরা করছিস!
শুভর কথায় ফণা তোলা সাপের মতো মাথা নামিয়ে নিল মাধুরী। শুভ ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না, কি বলতে কি বলে ফেলেছি। সেই থেকে অনুশোচনায় জুলছি। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। মাধুরী অনড় গলায় বলল, ক্ষমা তো তোর কাছে আমারই চাওয়া উচিত। আমরা স্বার্থপরের মতো তাদের ফেলে চলে গেলাম। কাজটা ভালো হয়নি। এই নিয়ে আমার আফসোসের শেষ নেই। মাধুরী এগিয়ে এল শুভর কাছে, তর্জনী দিয়ে পুতনী তুলে বলল, আমার দিকে তাকা। আমাকে কি তোর ভয়াল, ভীষণ বন্যা বলে মনে হয়?
শুভ চুপ করে থাকল।
অসহ্য লাগতে মাধুরী বলল, চুপ করে থাকবি না। উত্তর দে।
মাধুরী জোর করতেই শুভ আধভাঙা স্বরে বলল, আকাশ আছে বলে তো চাঁদ-সূর্য খেলতে পারে। আকাশ হল তারা-নাদের ঘরবাড়ি। আমার মনে হয় এক একটা ভালো মানুষ এক একটা তারা। তবে তোকে আমি তারা ভাবি না। দুই
আমি কি তাহলে? বল, তোকে বলতেই হবে। মাধুরী একরকম চেঁচিয়ে উঠল।
শুভ ঝকঝকে গলায় বলল, তুই তো আকাশের চাঁদ। তাই সবাই তোকে হা করে দেখতে থাকে।
-কেউ দেখলে আমি কি করব?
–তুই অত সাজবি না। ব্যস, মিটে গেল ঝামেলা।
-অত সহজ নয় রে। আবার ঠোঁট ওন্টাল মাধুরী, আমি এখন বড়ো হচ্ছি। মা কি বলে জানিস? স্কুল যাবার সময় আমি যেন মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটি। শুভ হাসল, তাহলে তো ঠোকুর খাবি!
মেয়েরা তো ঠোক্কর খেতে খেতে বড়ো হয়। মাধুরী কেমন নিরীহ চোখে তাকাল। বাইরে একটা নেড়িকুকুর বিশ্রি গলায় ডাকছিল। টানা সেই স্বরটা অবিকল শ্মশান কুকুরগুলোর মতো। যা শুনলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।
মাধুরী ভয় পেয়ে বলল, তোকে তো আবার কোয়ার্টারে ফিরতে হবে। যা বলার তাড়াতাড়ি বল।
বলছিলাম কি, তুই কি আমার উপর খুব রেগে আছিস? আত্মসমর্পণের চোখে তাকাল শুভ।
আলতো হেসে মাধুরী মায়াবী স্বরে বলল, শুভ এইটুকু কথা বলার জন্য রাত মাথায় নিয়ে চলে এলি? তোর কি মাথায় ছিট আছে?
কথাগুলো খারাপ শুনতে লাগলেও খুব খারাপ লাগে না শুভর। অন্য কেউ এমন ঠেস দেওয়া কথা বললে সে খুব রেগে যেত। তাকে ছেড়ে কথা বলত না। দুচারটে কথা অবশ্যই শুনিয়ে ছেড়ে দিত। তার সঙ্গে মাধুরীর হিসাবটাই অন্য যা ক্লাসের অন্য কেউ টের পায় না।
হাওয়ায় পর্দা উড়ছিল জানলার, মাধুরী জানলার দিকে মুখ করে তাকিয়ে ছিল বাইরের দিকে, চাপ বাঁধা ঘন অন্ধকারের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছিল চোখের দৃষ্টি। মাধুরী আর কারোর কাছে হারবে না। শুভ তাকে রোজ রোজ হারিয়ে দেবে এমন হয় না। গলা চড়িয়ে সে বলল, ইস্কুল কবে খুলবে বলতে পারিস? ঘরে আর মন বসছে না।
শুভ ভেবে নিল, তারপর বলল, এখনও সবাই ঘরে ফিরে যায়নি। বন্যার ঘা কি সহজে কায় বল?
-জানি না। মাধুরী মুখ ফিরিয়ে নিল।
শুভ তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, রাত হচ্ছে, এখন আমি যাই। কাল আবার তোর সাথে দেখা করে যাব।
-মা যে তোর জন্য টিফিন বানাতে রান্না ঘরে গিয়েছে।
–ওঃ, হো! আফসোস ভাসিয়ে দিল শুভ, ঠিক আছে, আর একটু অপেক্ষা করে যাই।
দুটো সাদা প্লেটে সিমাই নিয়ে ঘরে ঢুকলেন বনশ্রী। শুভর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোদের রাগ পড়েছে? দুজনেই চুপ করে থাকল, উত্তর দিল না কেউ।বড়োদের এই আদিখ্যেতা মন থেকে মেনে নেওয়া যায় না। ওদের সব কথাতে হয় উপদেশ না হয় তিরস্কারসহ খেচা। যুগটা যে পাটাচ্ছে তা ওঁরা বুঝতে চায় না। এরা সবাই বুঝি পিছিয়ে পড়া মানুষ।
মাধুরী বিরক্তি চেপে বলল, মা, তুমি যাবে?
-কেন আমি থাকলে তোদের কি অবিধে? আমি তো কারোর পাকা ধানে মই দিদিই না। গজগজ করতে করতে চলে গেলেন বনশ্রী।
দ্রুত সিমাই খেয়ে শুভ বলল, এবার আমি আসি।
-যাবি? সত্যি? নরম দৃষ্টি মেলে কাতর কবুতরের মত তাকাল মাধুরী। তারপর ঠোঁটে হাসি ভরিয়ে বলল, তোর হাতটা একটু ধরব?
-তুই কি পাগল হলি?
আহত হল মাধুরী, চেঁচিয়ে বলল, হ্যাঁ, হয়েছি। তাতে তোর কি?
-ঠিক আছে,নে। দুহাত পদ্মপাতার মতো মাধুরীর সামনে বিছিয়ে দিল শুভ। মাধুরী কি করবে বুঝতে পারল না। হাত দুটো মুঠো করে ধরে বুকের কাছে আনতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর একসময় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোদের ফেলে আমাদের এভাবে চলে যাওয়াটা উচিত হয়নি। আমার প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। শুভ, তুই বল–আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস? বিশাস কর, তোর কথা ভেবে আমি করাত যে ঘুমাই নি। আচ্ছা, আমার কেন এমন হয় বলতো।
-তোর আবেগটা বেশি।
–ধুর, আবেগ নয়রে, আমার রক্তটাই অন্য!
-আমি এসব কিছু জানি না। শুভ ঘরের দিকে পা বাড়ালে মাধুরী আবার তার হাতটা শক্তভাবে চেপে ধরে, দাঁড়া। আমি এক্ষুনি আসছি।
মাধুরী এক ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে গেল। ফিরে এল টর্চ-লাইট হাতে নিয়ে। অবশেষে কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, সাবধানে যাবি। আজ অনেক কথা বলার ছিল, বলা হল না। দেখি, চিঠি দিয়ে যদি জানাতে পারি। মাধুরীর কথাগুলো যেন উত্তরের বাতাস, কেঁপে গেল শুভ। টর্চ লাইটটা হাতে নিয়ে সে বলল, ভালো থাকিস, তুই ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকব-বুঝলি? ঘাড় নেড়ে অন্ধকারে শুকতারা হয়ে গেল মাধুরী।
.
৫২.
মনে খুশির হাজার ঢেউ। টর্চ জেলে পথ হাঁটছিল শুভ। সারাটা পথ মাধুরী তার সঙ্গে আছে। স্মৃতির জাবর কাটা আর শেষ হয় না।
ঘরে পৌঁছাতেই সরস্বতী বলল, এত দেরি করলি, আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল।
–আমি মাধুরীদের বাড়ি হয়ে এলাম।
ভালো করেছিস। মেয়েটা যাওয়ার সময় কেমন ভেজা-ভেজা মুখ করে চলে গেল। আমার ভালো লাগেনি। তখনই ভেবেছিলাম, তুই ঘরে আসলে ওর কাছে পাঠাব। সরস্বতী আশ্বস্ত চোখে তাকাল।
শুভ অবনীকে খুঁজছিল। ঘরে না দেখে তার মনে দানা বেঁধে উঠল সন্দেহ। বাবা আবার পদ্মর কাছে চলে গেল নাতো? কোনো বিশাস নেই মানুষটাকে। যে মানুষটা ভালোবাসায় অ, সে তো অন্ধকারেও পথ দেখতে পায়।
শুভ অবনীকে মন থেকে মুছে দিতে পারল না। টানা শাস নিয়ে থালো, মা, বাবা কোথায়?
-আমাকে কিছু বলে যায়নি। নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়াল সরস্বতী। কিছু সময়ের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে।
জয়কিষাণ আজই দশটার বাসে সদর থেকে ফিরেছে। দুলারী বন্যার আগে হাসপাতালে ছিল না। প্রায়ই ছুটি নিয়ে কৃষ্ণনগরে চলে যায়। এই গ্রামে তার নাকি মন বসে না।
জয়কিষাণ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বারান্দায় দাঁড়াল, চিৎকার করে বলল, শুভ বেটা, এ শুভ বেটা বাইরে আয়। তোর বাপকে সাপে কেটেছে।
সাপ শব্দটায় একটা কিলবিলান, রুদ্ধশ্বাস ভয় কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে থাকে। শুভ বাক্যহারা চোখে তাকাল। তার মুখের কথা হারিয়ে গেল, সে ভ্যালভেলিয়ে জয়কিষাণের মুখের দিকে হকচকিয়ে তাকাল। হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানি বেড়ে গেল শতগুণ।
-তোর মা কুথায়? জয়কিষাণের প্রশ্ন শেষ হল না, রান্নাঘর থেকে ঝড়ের বেগে বারান্দায় ছুটে এল সরস্বতী, দাদা, সে কোথায়? কিভাবে সাপে কাটল তাকে?
হাঁপাচ্ছিল সরস্বতী। জয়কিষাণ ঠাণ্ডা গলায় বলল, অত চিন্তা করার কিছু নেই। তোমরা আমার সাথে চল। ডাক্তারবাবু হাসপাতালে এসেছেন। দাবাই ইনজেশন সব চলছে।
তবু আশ্বস্ত হতে পারে না সরস্বতী। তার বুকের ব্যাঙ লাফানিটা বাড়ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুভর চোখের তারা কেঁপে উঠল। ব্যস্ত হয়ে সে বলল, মা, আমি যাচ্ছি। তুমি কাকুর সঙ্গে এসো। অনুমতির অপেক্ষা করল না সে। অন্ধকারে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
ইঁদুরে গর্ত করে, সাপে তা ভোগ করে। চুনারামদাদুর কথাগুলো মনে পড়ল তার। এসময় রঘুনাথ তার পাশে থাকলে মনের সাহস বাড়ত। ওদের গাঁয়ে ভালো ওঝা আছে। সুফল ওঝার নাম দশ গ্রামের মানুষ জানে। সে নাকি সাপেকাটা মানুষ ঝাড়-ফুকে সরিয়ে তোলে। এমন অনেক গল্প সে নানান মানুষের মুখে শুনেছে। শোনা কথায় বিশ্বাস কি। যেসব কথা মানুষের মুখে মুখে ঘোরে সেসব কথায় বিশ্বাসের মাটি কতটা এ নিয়ে শুভর মনে বরাবরের সংশয় আছে। ওঝা গুণিনের উপর তার একেবারে আস্থা নেই। তবু অবনী বাধ্য করায় তাকে এসব শোনার জন্য।
এখনও কারেন্ট আসেনি হাসপাতালে। কথা চলছে মাস ছয়েকের মধ্যে সুইচ টিপলে আলো জ্বলবে। মাঠে মাঠে শাল খুঁটি পুঁতছে ঠিকেদারের লোক। দিন রাত খাম্বা পোঁতার কাজ চলছে। তিনটে হ্যারিকেনের আলোতে এত বড়ো হাসপাতালের কোণে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার দূর হয় না। ম্যাড়মেড়ে অন্ধকার সাদা-কালোয় মিলেমিশে থাকা ভেড়ার লোমের মতো শুয়ে আছে আনাচে-কানাচে। শুভ হন্তদন্ত হয়ে টানা বারান্দা পেরিয়ে ও.টির ভেতর ঢুকে গেল। বন্যার পর হাসপাতালের চেহারাটা বদলে গিয়েছে অনেকটাই। এখনও জলের গন্ধ প্রায়ই নাকে এসে লাগে। মাঝে মাঝে আঁশটে গন্ধ ভেসে আসে। তখনই গা গুলিয়ে ওঠে ডলি দিদিমণির। তার যুবতী রসালুর মতো শরীর পকমোড়া দিয়ে ওঠে ঘেন্নায়।
শুভ দেখল ওটি ফাঁকা। হাই-বেঞ্চে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। লাল আলো ছড়িয়ে। শুধু ডিউটিরুমে জনা চারেক মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে। ওরা নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় কথা বলছিল। সিস্টারদের চেয়ারটায় গা হেলান দিয়ে বসে আছেন ডাক্তারবাবু। তাঁর পরনে পায়জামা, গায়ে সাদা হাফ-হাতা জামা, জামার উপরে গাঢ় নস্যি রঙের একটা হাফ-হাতা সোয়েটার।
ডলি দিদিমণি শুভকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন, আয়।
-বাবা কোথায় পিসি? শুভর কণ্ঠস্বরে ব্যাকুলতা।
ডলি দিদিমণি তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, অবনীদা বাথরুমে গিয়েছে। একা যায়নি, সঙ্গে তোর সুবীরকাকু গিয়েছে। তোদের কে খবর দিল?
–জয়কিষাণ কাকু কোয়ার্টারে গিয়েছিল। তার মুখে শুনলাম।
–তোর মা আসেনি?
–মা ঘর বন্ধ করে আসছে।
-শোন শুভ, অত চিন্তা করার কিছু নেই। তুই চুপচাপ বোস। ডলি দিদিমণি বসবার জন্য একটা কাঠের বাক্স দেখিয়ে দিলেন। শুভ বসল না, দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। মনে কত রকমের চিন্তা এসে ভিড় করছে। এই হাসপাতালে সে দেখেছিল হরিনাথপুরের একটা বউকে চোখের সামনে মরে যেতে। ঘুমন্ত অবস্থায় সাপে কামড়েছিল বউটাকে। একেবারে কাঁধের কাছে কামড়ে দেয় সাপটা। কামড়ে দিয়েই সাপটা ঢুকে যায় দেওয়ালের ফাঁকে। জ্বালাপোড়া করতেই ঘুম ভেঙে বউটা শুধু সাপের লেজটাকে দেখে। ভয়ে তার জিভ শুকিয়ে যাবার উপক্রম হয়। ঘরের লোক তাকে বাঁধন দিতে পারে না। কাঁধে কামড়ালে বাঁধন দেবে কোথায়? ফলে খাটিয়ায়। করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল তারা।
হাসপাতালে সব রকম চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না বউটাকে। শেষের দিকে কথা জড়িয়ে গিয়েছিল তার। সারা শরীর ভেঙে ঘুম ঘুম আচ্ছন্নতা। কেউ বুঝি জিভ টেনে ধরছিল ভেতরের দিকে। মুখের দুপাশে গ্যাজলা উঠিয়ে বউটা চিরকালের জন্য চোখ বুজল। এই দৃশ্য অনেক দিন আগের, তবু এখনও মনে পড়ে শুভর। সেদিনের সেই দৃশ্যটা আজ কেন মনে পড়ছে বারবার।
ডলি দিদিমণি অভয় দিয়ে বললেন, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। যতদূর মনে হচ্ছে অবনীদাকে বিষাক্ত সাপে কামড়ায়নি। পায়জোনাল সাপের দাঁত খুব ঘুচলল। ওরা কামড়ালে মাংস তুলে নেয় না। শুধু ছোট ছোট ফুটো হয়। সেটাই মারাত্মক। অবনীদার বেলায় দেখলাম সবটাই উল্টো। ক্ষতস্থানে বেশ রক্ত দেখলাম। ডাক্তারবাবু এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, অবশেষে ডলি দিদিমণির বক্তব্যকে তিনি সমর্থন করলেন, চিন্তা করিস নে। দু-তিন ঘণ্টা অবজারভেশনে রেখে ছেড়ে দেব। শুধু একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। দেখবি তোর বাবা যেন ঘুমিয়ে না যায়। চেয়ারে হাতলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, হাই তুলে বললেন, আমি এখন আসি সিস্টার। অ্যাবনরম্যাল কিছু দেখলে সুবীরকে কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেবেন। আমি দশটা অবধি জেগে থাকব।
ডাক্তারবাবু নিঃশব্দে চলে যাওয়ার পর শুভর মুখে রাত্রির যাবতীয় অন্ধকার বিছিয়ে গেল। আর তখনি চিৎকার করতে করতে আলুথালু শরীরে ডিউটিরুমে ঢুকে এল সরস্বতী। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করল, ও কোথায় গেল দিদিমণি, ভালো আছে তো?
সরস্বতীর চোখের জল হেমন্তের কুয়াশার চেয়েও ভারী হয়ে নেমে এল। ডলি দিদিমণি নিস্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বললেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই। তুমি চুপচাপ বসো তো বৌদি। ডাক্তারবাবু সব দেখেছেন। উনি নিশ্চিন্ত হয়ে কোয়ার্টারে এই মাত্র ফিরে গেলেন।
তবু মনের দিক থেকে শান্ত হতে পারছিল না সরস্বতী, নিজেকে শান্ত করারসবরকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল সে। নাড়িকাঁপানো টানটা এই মুহূর্তে উন্মুক্ত হয়ে উঠল ভেজা মাটির বুক থেকে উঁকি দেওয়া অন্ধকারের মতো। ঝগড়াঝাটি, মানসিক টানাপোড়েন ভুলে সে অবনীর আরোগ্য কামনায় অস্থির হয়ে উঠল।
টলমল পায়ে বাথরুম থেকে ফিরে এল অবনী। তার সঙ্গে সুবীর। সরস্বতী পা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন বুঝতে গো?
ভয়ের রেণুগুলো এখন অবনীর দুচোখ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে, মান হেসে সে কোনোমতে বলল, ভয়ের কোনো কারণ নেই। এক ঘণ্টা হয়ে গেল। মনে হচ্ছে ঢোঁড়া।
-ঢোঁড়া হোক আর হেলে হোক সাপ তো সাপই। সরস্বতী কটাক্ষর চোখে তাকাল।
অবনী আশাহত হল। এই সময় সে সমবেদনা আশা করেছিল। সরস্বতীর মনমেজাজ বোঝ দায়। ওর জোয়ার-ভাটা খেলা মন। বোঝা যায় না। বিরক্তিতে মুখ নামিয়ে নিল অবনী।
অবনীর দুর্বলতায় পর হয়ে ওঠে সরস্বতীর ঠোঁট, স্থান কাল পাত্র ভুলে বিরক্তির সঙ্গে সে বলল, পথ হাঁটার সময় কি চোখ কপালে তুলে হাঁটে। রাস্তাঘাট দেখে শুনে হাঁটতে হয় জানো না বুঝি? আজ যদি টোড়া না হয়ে খরিস হত তাহলে?
–চলে যেতাম। ভালো হত। কাটা ঘুড়ির মতো লাট খাওয়া গলায় বলল অবনী।
-তুমি তো চলে যেতে, আমাদের কি হত? সরস্বতী ঝাঁঝিয়ে উঠল।
আঃ, থামবে বৌদি। এটা হাসপাতাল, ঘর নয়। ডলি দিদিমণি ধমক দিয়ে উঠলেন সরস্বতীকে। ধমক খেয়ে সরস্বতী কেমন নিরীহ চোখে তাকাল, দুদণ্ড তাকিয়ে থাকার পর ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলল সে, ওর জন্য আমার জীবনটাই শেষ হয়ে গেল। ও আমার মরামুখ না দেখে শান্তি পাবে না। আপনারা জানেন না দিদি, ও কি ভয়ঙ্কর মানুষ। ওর মতো ঘরজ্বালানী পরভুলানী মানুষ খুব কম আছে।
-বৌদি, প্লিজ চুপ করো। ডলি দিদিমণির কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল উত্তেজনায়। শুভর অসহ্য লাগছিল এসব নাটক। চোয়ালে চোয়াল ঘষে সে চাপা অথচ গম্ভীরভাবে বলল, মা, চুপ করো। আর ভালো লাগছে না।
পাশের কোয়ার্টারের সুবীর জ্ঞান দিয়ে বলল, বৌদি, বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ নাও। এখন অশান্তি করলে লোক হাসবে। এমনিতে আমরা ছোট পোস্টে কাজ করি। কত লোকে কত কথা বলে তার জন্য।
একরকম চাপে পড়ে মুখে কুলুপ আঁটল সরস্বতী। অবনী আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো চেষ্টা করল না, টুলের উপর মুখ ঝুঁকিয়ে বসে থাকল চুপচাপ। ডলি দিদিমণি একবার মুখ তুলে দেওয়ালের পেণ্ডুলাম ঘড়িটার দিকে তাকালেন, সময় দেখে অবনীকে শুধোলেন, তোমার কি ঘুম ঘুম পাচ্ছে অবনীদা? ঘুম পেলে বলল। ডাক্তারবাবুকে খবর দিতে হবে তাহলে।
অবনী না-সূচক ঘাড় নাড়তেই আশ্বস্ত হলেন তিনি। তারপর আপনমনে বললেন, ভগবানকে অনেক ধন্যবাদ ফাড়াটা অল্পের উপর দিয়ে গেল।
সুবীর ওভাদি দেখিয়ে বলল, ঢোড়াসাপে কামড়ালেও বিষ হয় দিদি। শনি-মঙ্গলবারে সব সাপেরই বিষ হয়। শুনেছি ঢোড়াসাপ কামড়ালে গোবর ছোঁয়া নিষেধ।
কেন? ডলি দিদিমণি জিজ্ঞাসা করলেন কৌতূহলবশত।
সুবীর চোখ মটকে হাসল, বিষ কেন হয় জানেন না বুঝি? সেই যে অমৃত মন্থনের সময় ঢোঁড়া সাপ বিষ নিয়ে গিয়ে গোবরে লুকিয়ে রেখেছিল–সেই জন্য। পরে গিয়ে দেখে সব বিষ গোবরে মিশে গিয়েছে। আর কিছু করার নেই। সেদিন থেকে টোড়াসাপ বিষহীন বুঝলেন?
ডলি দিদিমণি হয়ত এই গল্পটা জানতেন তাই হালকা হেসে বললেন, রাতের বেলায় আর সাপের গল্প করে লাভ নেই। এবার অন্য কথা বলে।
সুবীর কথা হাতড়াচ্ছিল। শুভ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, কাকু, বাবা কখন বাড়ি যাবে?
-দশটা না বাজলে যাওয়া উচিত হবে না। সুবীর জোর দিয়ে বলল।
সরস্বতীর অসহ্য লাগছিল, সে শুভর দিকেকটমট করে তাকাল,বসে থাকলে কি গা চুলকাচ্ছে? চুপচাপ থাক। ঘরে কি হাতি ঘোড়া বাঁধা আছে যে যাবার জন্য লাফাচ্ছিস? কথা শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেলেও শুভ আহত চোখে তাকাল। মায়ের ব্যবহার দিন দিন বিলি হয়ে যাচ্ছে। সবার সামনে কিভাবে কথা বলতে হয় সেই শিক্ষাটাই বুঝি ভুলতে বসেছে। কোনোরম তর্কের মধ্যে না গিয়ে শুভ জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কাচের ওপিঠে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। এখন পৃথিবী জুড়ে শুধু তরল অন্ধকার, আঁধার সমুদ্র।
হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পথে মরা চাঁদের ক্ষীণ জ্যোৎস্না বাসি সজনে ফুলের মতো নিঃশব্দে ঝরে পড়ছিল। ঠাণ্ডা বাতাসে মন খারাপের কোনো ভাইরাস বেঁচে ছিল না। বাড়ির কাছে পৌঁছে অবনী অন্ধকারকে শুনিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল, যাক, এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।
.
৫৩.
বাঁধের ধারে একটাই পলাশগাছ। বেঁটে খাটো গাছটার গাম্ভীর্যই আলাদা। বকফুলের মতো কুডি এসেছে শাখা প্রশাখায়। শীত চলে যাবার পর রঘুনাথ এই গাছটার দিকে অবাক করা চোখে তাকায়। বালিকা থেকে কিশোরী হওয়ার সৌন্দর্য গাছটার সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে। আর কদিন পরে কনে বউয়ের মতো সেজে উঠবে পলাশরঙে। পাতা ঝরার দিন শেষ হচ্ছে দিনে দিনে।
অনেকদিন পরে বাঁশিটা চাল থেকে নিয়ে এসে রঘুনাথ বাঁধের ধারে পা ছড়িয়ে বসল। অনভ্যাসে অব্যবহারে ধুলো জমে গিয়েছে বাঁশির ছিদ্রে। অথচ এই বাঁশি তার কত সখের ছিল। চুনারাম ছাতার বাঁট কেটে শিক গরম করে বানিয়েছে এই বাঁশি। প্রতিটি ছিদ্র তৈরির সময় তার যত্নের শেষ ছিল না। পাশে বসে অবাক চোখে রঘুনাথ দেখেছিল সেসব।
যৌবনে শখের যাত্রায় নাম লিখিয়েছিল চুনারাম। ডাক আসলে ভিনগাঁয়ে যেত যাত্রা করতে নামমাত্র টাকায়। যাত্রাদলে থেকেই বাঁশিটা শিখেছিল চুনারাম। শখের যাত্রার দিন শেষ হয়ে গেল কলকাতার যাত্রার আগ্রাসী থাবায়। সব দিকে পিছিয়ে গেল গ্রামীণ যাত্রা।
মনের দুঃখে চুনারাম বাঁশি বাজাত বুড়িগাভের ধারে ধারে। তার সেই বাঁশির সুর ছাড়িয়ে যেত আখখেতে। আখখেত ছাড়িয়ে সুর ছুটে যেত কমলাবেড়িয়া, সুজাপুর, নারাণপুর। এখন আর বুড়ো গালে ফুঁ ধরে না চুনারামের।
রঘুনাথকে সে মন দিয়ে বাঁশিটা শিখিয়েছিল। বাঁশিকে ভালোবাসত ছেলেটা। সারাদিন বনবাদাড়ে টো-টো করে বাঁশি হাতে ঘুরত। কমলা মুখে হাসি ভরিয়ে বলত, তোমার বাঁশি কথা বলে গো! কত সোন্দর সুর তোমার ফুঁয়ে ফুঁয়ে।
কমলার হাসির মতো বাঁশিও মুগ্ধ করত রঘুনাথকে। দুর্গামণি সতর্ক করে বলত, দিনের বেলায় বাঁশি বাজাবিনে বাপ। অধর্ম হয়।
সুরে আবার কিসের অধর্ম? এ জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর পেত না রঘুনাথ। চুনারাম হাসত, বাঁশিকে ভালো না বাসলে সে তুরে সুর দিবে নি। সুর হল মেয়ে মানুষের মন গো! যদি সে বুঝতে পারে কেউ তারে অবহেলা করছে তাহলে সে সাতজন্মেও ধরা দিবেনি দাদুভাই।
পলাশ গাছের কুঁড়িগুলোর দিকে অকিয়ে কেমন উদাস হয়ে গেল রঘুনাথ। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সুর ভাসাল পণ্ডিত বিলের জলের দিকে। দীর্ঘ সময় ধরে একমনে বেজে চলল বাঁশি। চোয়াল আর গালের কাটা শক্ত হয়ে উঠছিল রঘুনাথের। হঠাৎ-ই বলি থেমে গেল তার। কাকার কথা মনে পড়ল হঠাৎ। এই পলাশ গাহের কাছে তুলারামকে কারা যেন পিটিয়েছিল বেধড়ক। শুধু মার নয়, হাত-পা দুটোই ভেঙে দেয় ওরা। সারারাত শীতল ছোঁয়ায় কোনোমতে বেঁচেছিল সুপারাম। সেদিন সে আত্মগোপন পর্ব শেষ করে লালগোলা থেকে বাড়ি ফিরছিল। তখন রাত অনেক। সঙ্গে টাকাপয়সা, মালপত্তর। সব কেড়ে নিল গভীর রাতের ছিনতাইবাজরা। ওদের মুখ ঢাকা ছিল গামছায় ফলে লুলারাম দলের কাউকেই চিনতে পারেনি। তাহলে কি দলটা জানত লুলারাম ফিরছে।
আশেপাশের গ্রামে স্কুলারামের শত্রর কোনো অভাব ছিল না। স্বভাবদোষে সে সবার চোখের বালি। সবাই আড়ালে ফুসত কিন্তু মুখের উপর কেউ কিছু বলত না। আসলে বলার ক্ষমতা ছিল না ওদের। অনেকেই তার ডাকাত দলের খবরাখবর রাখত। সুলারামের হিংস্রতা অনেকেই জেনে গিয়েছিল অল্পদিনে। পরকে জ্বালালে নিজের জ্বলন অনিবার্য। সেদিন লুলারাম ভেবেছিল রাতের আঁধারে চুপি চুপি সে গ্রামে ঢুকে যাবে। সকাল হলে সবাই তাকে দেখলে কোনো ক্ষতি নেই। এটা সেটা কিছু একটা বুঝিয়ে বলে দিলেই হল। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, বিধি করে আর এক।
শেষপর্যন্ত গোরুর পাল খেদাতে নিয়ে যাওয়া রাখালগুলো অচৈতন্য অবস্থায় পলাশতলায় পড়ে থাকতে দেখে পুলারামকে। তাদেরই একজন মাথায় গামছা বেঁধে পাঁচন নিয়ে দৌড়ায়। গায়ে খবর দেয়। খবর পায় রঘুনাথ। দলবল নিয়ে সে পড়ি মড়ি করে ছুটে যায় শিমূল গাছটার কাছে। তারপর ধীরে ধীরে সব খোলসা হয়। সর্বস্ব হারিয়ে লুলারাম চুল চেপে ধরে কোকাচ্ছিল। হাত-পা ভাঙা নড়াচড়ার তার ক্ষমতা নেই।
চুনারাম তার শোচনীয় অবস্থা দেখে বলল, এ ভাঙা হাড় হাড়জোড় গাছের পাতায় ভালো হবেনি। এরে ঝটপট হাসপাতালে নিয়ে যাও। নাহলে এরে বাঁচানো যাবেনি। কথা সত্যি। সদর থেকে হাত-পায়ে প্লাস্টার করে, ওজন বাড়িয়ে ফিরে এসেছে লুলারাম। এখন সে নড়তে-চড়তে পারেনা। রঘুনাথ গিয়ে মাঝেসাঝে তাকে দেখে আসে। লুলারাম তখন বিছানায় শুয়ে নাকি সুরে কাঁদে। রঘুনাথকে বলে, হরিনাথপুরের সার দোকান থিকে বিষ এনে দে বাপ, খেয়ে মরি। এ জেবন আর টানতে ভালো লাগছে না।
কখনও সে ফোঁপায়, অনুশোচনায় ডুকরে ওঠে, কাতর হয়ে বলে, দাদার কাছে লিয়ে চল। তার মতুন মানুষ হয় না। সে আগে চলে গেল। আমি এখুন বসে বসে ডাল ভানচি।
গাঁয়ের কম বেশি সবাই এসে লুলারামকে দেখে গিয়েছে। ভূষণী বুড়ি এসেছিল সবার শেষে। সে এসে দগদগে ঘায়ে আঙুল ঢুকিয়ে দিল। হাসতে হাসতে বাণ মারল, হারে বাপ, সবাই এলো, ঝারি কি এসেছিল?
বুড়িটা কি বলতে চায়? বাজিয়ে দেখছে নাকি? নাকি পরখ করতে চায় এখনও টান আছে নাকি? লুলারাম ভূষণীবুড়ির প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। ঝারি তার সুখ নিয়ে সরে গেছে। মুঠো মুঠো স্মৃতি আর দুঃখ দিয়ে গিয়েছে লুলারামকে। সেই গা-চিমটান দুঃখের কথা সে ভুলবে কিভাবে? তার অত মনের জোর নেই। তার মন তো পলকা বাঁশের ঠেক।
প্রায়ই শুরাম শুয়ে শুয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে। সে তখন খুব যত্ন সহকারে কারির মুখটা দেখতে চায়। তার পালিয়ে যাওয়ার পেছনে ঝারির অদৃশ্য চাহনি ছিল। যার উপেক্ষাই তার কাল হল। ওই অপমানের ফাঁদ ছিঁড়ে বেরতে পারল না সে।
মনে মনে জ্বলছিল। শুরু হয়েছিল নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই সব সময় ধরে। ভিকনাথকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিত যে, শুধু ঝারির জন্য পারল না। ভিকনাথ সরে গেলেও তার সমস্যার সমাধান হত না। ঝারির হয়ত শরীর পেত কিন্তু মন পেত না। সোনার মন না পেলে পচা কুমড়োর এই দেহ নিয়ে কি লাভ। সে ভালোবাসার কাঙাল। কেউ তাকে ভিকে দিল না। ভেবেছিল-ঝারি তাকে ছায়া দেবে। মিথ্যে, সব মিথ্যে। ঝারি এখন কাঁটার ঝোপে ফুটে থাকা ফুল। কাছে যাওয়া যায় না, ছুঁয়ে দেখা তো দুরের কথা।
নূপুর আর নোলকের মুখ চেয়ে আঁধার রাতে ফিরে এসেছিল লুলারাম। বুড়িগাঙের পাড়ে বসে কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। হলদিপোঁতায় কার জন্য থাকবে সে? ঢিলি ছিল, সেও আজ শূন্য। ঝারি তো থেকেও নেই। মনের দুঃখে হাঁটতে হাঁটতে লুলারাম পৌঁছে গেল দেবগ্রাম স্টেশানে। সেখান থেকে আপ লালগোলা ধরে একেবারে লালগোলায়।
কটা মাস কিভাবে যে কেটে গিয়েছে সেটা টের পায়নি লুলারাম। পেটের দায়ে তখন তার কুকুর পাগল অবস্থা। ধাবার হোটেলে থালা-বাসন ধোওয়া থেকে শুরু করে বাজারে ঝাড় দেওয়া কোনো কাজ সে বাদ রাখেনি। টাকা এল, ভাত এল কিন্তু মন থেকে গেল হলদিপোঁতায়। হলদিপোঁতাই মনটাকে ঘুড়ির মতো ওড়াল না। পারল না, হেরে গেল সে।
আঁধার নামলে পণ্ডিত বিলের জলপাখিরা নজরে পড়ে না। শুধু দুরের ঝোপঝাড়ে জোনাকির চোখ পিটপিটিয়ে জ্বলতে থাকে মায়ায় ভরা আবহ তৈরি করে। নরম আলোয় চোখ সয়ে যায় রঘুনাথের। ভালো লাগার রেশটা ঈষৎ ঠাণ্ডা হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তার শরীরে। মাথার উপর দিয়ে গোটা চারেক চামচিকি স্বজাতীয় চিৎকার করতে করতে উড়ে গেলে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রঘুনাথ। ঝিঁঝি পোকার টানা ডাক ছাপিয়ে সাইকেলে ঠুনটুন শব্দ তার কানে এসে বেঁধে।
সন্ধের পর ফাঁকা হয়ে যায় বাধ। শুধু মোকামপাড়ার কুকুরগুলো তেঁতুলতলা থেকে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে এসে চক্কর কেটে হাওয়া খেয়ে চলে যায়। ওদের গলায় কোনো শব্দ নেই, সব যেন বোবা।
ঠুনঠুনানো সাইকেলটা রঘুনাথের পেছনে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। এ সময় সুর্যাকে দেখতে পাবে ভাবেনি রঘুনাথ। দেখা মাত্র তার শরীরে আনন্দের স্রোত বয়ে গেল। কতদিন সূর্যাক্ষর সঙ্গে দেখা হয়নি তার। নীলাক্ষবাবুর প্রতি অভিমানে সূর্যাকে ভুল বুঝেছিল সে। এমন কি রুদ্রাক্ষের সঙ্গেও তার ব্যবহারটা শোভন হয় নি আদৌ। সেদিন রুদ্রাক্ষ চলে যাওয়ার পর অনুশোচনায় পুড়েছে রঘুনাথ। বাপের দোষ ত্রুটি ছেলে কেন ঘাড়ে বইবে? যার পাপ তাকেই বইতে হয়। নীলার সঙ্গে হিসাব বুঝে নেবে রঘুনাথ। দিন ফুরিয়ে যায় নি, এখনও সামনে অনেকদিন পড়ে আছে।
সুর্যাক্ষ সাইকেল থেকে নামল। তার ক্যারিয়ারের পেছনে লটবহর বাধা। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সে বলল, কালই দেবগ্রামে চলে যাব। ওখানকার হাইস্কুলে সিট পড়েছে। দ্বীপীও আমার সঙ্গে যাবে। আমরা ওখানে দিন পনের ঘরভাড়া করে থাকব। রঘুনাথ নীরবে সব শুনল। পড়াশোনা নিয়ে তার এখন আর কোনো আগ্রহ নেই। তবে সূর্যাক্ষর সব ব্যাপারে তার আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। দ্বীপীর মুখটা মনে পড়তেই মুখ ফসকে সে বলে ফেলল, হ্যাঁ রে, সুর্য-দ্বীপী কেমুন আচে রে।
তার কথা বাদ দে, সে পড়ে পড়ে পাগল। সূর্যাক্ষ হাসি-মুখ করে বলল।
–অনেকদিন তোদের গাঁয়ে যাওয়া হয়নি।
–আজই চল। কাল তো চলে যাব। আবার সেই কবে দেখা হবে। সূর্যাক্ষর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এল।
রঘুনাথ বলল, না রে, আজ আর যাওয়া হবে নি। কি করে যাব বলত? বাপ মারা যাওয়ার পর মা ঘরে একা থাকতে ভয় পায়।
-কেন তোর দাদু থাকে না?
–সে তো থেকেও না থাকার মতন।
তার মানে? সূর্যাক্ষর কৌতূহলী জিজ্ঞাসা। রঘুনাথ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, বুড়া হয়েছে, তার আর কতটুকুই বা ক্ষেমতা। বিছানা নিলে নাক ডাকা শুরু। দশ ডাকেও দায়ে-অদায়ে সাড় আসে
-ওঃ, এই কথা। সূর্যাক্ষ ঠোঁট টিপে হাসল।
কিছুটা আসার পর রঘুনাথ হাওয়ার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরাল। ধোঁয়া উগলিয়ে বলল, তোকে আর দিলাম না। বিড়ি খেলে মুখ দিয়ে বদঘেরান বেরুবে। তোর মা টের পেয়ে যাবে।
সূর্যাক্ষ রঘুনাথের ব্যবহারে ভীষণ অবাক হল, সে আর তার সেই বিস্ময়বোধ নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখতে পারল না, খোঁচা দেওয়া গলায় বলল, রঘু রে, তুই এত বদলে গেলি কিভাবে?
-কেনে, কি হয়েছে?
–কি হয়নি বল? তুই বিড়ি ধরালি অথচ আমাকে একবার যাচলি না।
–তোরা বাবুঘরের ছেলে। বিড়ি খেলে জাত যাবে।
এসব বুলি কি বিদুর কাকার কাছ থেকে শিখেছিস? সূর্যাক্ষ সহজ হতে পারছিল না, জোরে নিবাস ছেড়ে সে রঘুনাথের দিকে তাকাল। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে বলল, আমি বাবুঘরের ছেলে ঠিকই কিন্তু তুই তো আমার বন্ধু। তোর কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করিনি।
-রাগ করিস নে, ভুল হয়ে গেছে। মুখ মানুষের ভুল তো হামেশাই হয়। রঘুনাথ ডিবা থেকে বিড়ি বের করে সূর্যাকে দিল।
দেশলাই জ্বেলে বিড়ি ধরাল সুর্যা। দুটান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে রঘুনাথের দিকে তাকাল, আঃ, শান্তি। পরীক্ষার আগে বিড়ি না খেলে পড়া মনে থাকবে না। আচ্ছা বলতো, বিড়িকে ভদ্রলোকেরা কি বলে?
রঘুনাথ কথাটা জানত কিন্তু মনে করতে পারল না। সূর্যাক্ষ গলার স্বর বদলে হাসতে হাসতে বলল, বিড়ি হলে গিয়ে ইন্ডিয়ান খাকি, মাজায় দড়ি। মুখে লাল টুপি। বিড়ি হল–মেহেনতী মানুষের ঐক্যের প্রতীক। বুঝলি?
রঘুনাথ হাঁ করে শুনছিল, না বুঝতে পেরে বলল, তোর কথার মানে বোঝা যায় না। ওসব হেঁয়ালি কথা শিকেয় তুলে রাখ তো। কাল কখন যাবি? আমার কি তোর সাথে যাওয়ার দরকার আচে?
সূর্যাক্ষ ঘাড় নাড়ল, কাল বাবা আমার সঙ্গে যাবে। দ্বীপীর বাবা-মাও যাবে।
আমরা বিডিও অফিসের সামনে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি। পাঁচজনে মিলে থাকব। আমাদের মধ্যে দ্বীপই একমাত্র মেয়ে।
-ওর দিদিগুলান তো ওর সাথে যেতে পারত।
-তা পারত। কিন্তু ওদের যাওয়ার কোনো দরকার নেই। লিটনের মাসী যাচ্ছে আমাদের। সাথে। মাসী আমাদের রান্না বান্নার কাজটা করে দেবে।
-কোন লিটন। রঘুনাথ জিজ্ঞাসা করল।
সূর্যাক্ষ কপালে ভাঁজ ফেলে অবাক গলায় বলল, লিটনকে চিনিস না? ইল পাড়ায় থাকে। আরে, ওর বাবার ইটালি সেলুন আহে কালীগঞ্জ বাজারে।
-বুঝতে পেরেছি। রঘুনাথ হাসল। হাঁটতে হাঁটতে ওরা হলদিপোঁতা খাওড়ার কাছে চলে এল। অন্ধকার এর মধ্যে কালো চাদর বিছিয়ে দিয়েছে চত্বর জুড়ে। এখানটায় দাঁড়ালে মিষ্টি বাতাস এসে গায়ের উপর আছড়ে পড়ে। পাকুড়তলায় আগের মতো আর আসা হয় না রঘুনাথের। সময় হয় না, ইচ্ছেও করে না। একরাশ অবসাদ মনের ভেতর বুনো হাওয়ার মতো ছটফটাচ্ছে। চুনারাম এই বয়সে মাঠের কাজে ঘাম ঝরাতে পারে না। তবু চেষ্টার কোনো তার জুটি নেই। বনবাদাড় থেকে সে সের পাঁচেক বুনো আলু তুলে এনেছে। পন্ডিত বিলের ধারে ধারে রসকর ডাঁটিগুলো বেশ চোখে লাগার মতো হয়েছে। ওগুলো কেটে আনলে দিন তিনেকের তরকারির চিন্তা আর করতে হবে না।
সাইকেলের হ্যান্ডেলটা শক্তভাবে ধরে সূর্যাক্ষ বলল, রঘুরে, এবার আমি যাই। রাত হচ্ছে। ঘরে গিয়ে সব গোছগাছ করে পড়তে বসতে হবে। পরীক্ষা নিয়ে খুব টেনশন হচ্ছে। জানি না শেষপর্যন্ত কি হবে।
–কি আর হবে। যা হবে সব ভালোই হবে। রঘুনাথ বিজ্ঞের গলায় কথাগুলো বলে হাসল।
সূর্যাক্ষ রঘুনাথের দিকে অন্ধকারে ধার চাকুর দৃষ্টি মেলে তাকাল, তারপর অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা রঘু, একটা সত্যি কথা বলবি?
রঘুনাথ চমকে উঠল, তোর কাচে কুনোদিন সত্যি বই মিথ্যে বলিনি।
–আমার দাদা এসেছিল? সূর্যাক্ষ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল।
ক্ষণিকের জন্য ইতস্তত করে রঘুনাথ ঢোঁক গিলল, হ্যাঁ, সে একদিন এসেছিল। তখন আমার বাপ মরেচে। মাথার ঠিক নেই। সে রাতে এল। তাকে দেখে আমি মাথার কুনো ঠিক রাখতে পারিনি। মুকে যা আসল তাই বললাম। সে বেচারি মন খারাপ করে চলে গেল। আমি তারে আর বাধা দিইনি।
–দাদাকে দেখে তোর কি মনে হল? দাদা ভালো আছে তো?
রঘুনাথ পাল্টা প্রশ্ন করল, কেনে তুর দাদা ঘর যায়নি? সে আমারে বলল-মাকে দেখতে এয়েছে। তাহলে কি ঘর যাওয়ার সে সুযোগ পায়নি?
-ঘরে গিয়েছিল সে কিন্তু ঘরে গিয়ে সে জেঠুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। জেঠুকে শাসিয়ে গিয়েছে। সেই থেকে জেই ভয়ে ভয়ে আছে। এখন আর আগের মতো চোটপাট করে না। নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে। সূর্যাক্ষর কথায় রঘুনাথ বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। সে জানে–শয়তানের ছলনার অভাব হয় না। এই নাটকের কোনো প্রয়োজন আছে কি? রাগে রঘুনাথের সারা শরীর উথাল-পাতাল করে উঠল। এ প্রসঙ্গে তার আর কথা বলার কোনো ইচ্ছে হল না।
বাঁধের নিচ থেকে ভেসে আসছে ভূঁইলতা ফুলের মিষ্টি সুগন্ধ। সবুজ পাতায় ঢাকা লতানে গাছগুলো মাটিকে মায়ের মতো ভালোবেসে তার কোলেই মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। অপুর্ব গোলাপি রঙের থোকা থোকা ফুলগুলোয় সারাদিন মৌমাছির দল উড়ে বেড়ায় মধু সংগ্রহের জন্য। পাঁচ বছর আগেও এই গাছগুলোর বাড়বাড়ন্ত দশা ছিল না, বড়ো বানের পর থেকে এরা ভূমি জুড়ে বিস্তার করেছে আধিপত্য।
সূর্যাক্ষ চলে যাবার পর বিষয় ছেয়ে ধরে রঘুনাথকে। তবু ঘরে ফিরে যেতে তার ইচ্ছে করে না। কাকার কাছে গেলে নানা ধরনের গল্প শুনতে পাবে সে। এককালের গা কাঁপানো মানুষটা আজ গাঁয়ের মধ্যে অথর্ব হয়ে পড়ে আছে। এখন আর তার সেই টাকার জোর নেই। লালগোলায় গত মাসে যা কামিয়ে ছিল তার সবটাই কেড়ে নিয়েছে সেদিন গভীর রাতে। সেই থেকে মানুষটার ঝিমিয়ে আছে সংগত কারণে। টাকা না থাকলে এখন আর কিছু হয় না।
নূপুরটা কমাসেই চোখে লাগার মতো হয়ে উঠেছে। শাপলাফুলের চেয়েও সুন্দর তার গায়ের রঙ। নাক চোখ মুখ ভালো। গায়ের লাবণ্য পণ্ডিত বিলের রস কচুর পাতাগুলোর চেয়েও ঝকঝকে সুন্দর। একমাথা ঘনচুল পিঠ ছাপিয়ে কোমরের কাছে কিংকং খেলে। নূপুরের ভরন্ত শরীর খলবলানো কইমাছের মতো সুন্দর। তাকে যে দেখবে, পছন্দ তার হবেই।
দিন সাতেক আগে মাটিয়ারি থেকে তাকে দেখবার জন্য লোক এসেছিল তিনজন। চুনারাম তাদের পাকুড়তলা থেকে পথ দেখিয়ে ঘরে নিয়ে আসে। মা মরা নাতনিটার উপর তার টানও কম নেই।
অতিথির দেখাশোনার কাজটা দুর্গামণি সব এক হাতেই করল। নূপুরকে দেখে পছন্দ করে গিয়েছে মাটিয়ারির লোকেরা। ছেলে পড়াশোনা জানে। হাসপাতালের কোম্পান্ডার। ফরিদপুর-পাঁচপোতা এলাকায় ধাওড়াদের অমন শিক্ষিত ছেলে আর দুটি নেই।
পাত্রপক্ষ সুন্দরী মেয়ে খুজছিল, পেয়েও গেছে। কিন্তু চুনারাম সলজ্জ গলায় নিজেদের অসহায়ত্বের গল্পটি বলে দিল সংক্ষেপে, তা বুঝলে বাপু, আমাদেরও কুনো অসুবিধা নেই। এত করে বলচো যখন, তখুন একবার পাঁচপোতায় যাবই। তবে শুভ কাজ কবে নাগাদ হবে আগাম তা বলতে অক্ষম। আসলে হাতে এখুন নগদ পয়সা নেই। যা ছিল বানবন্যায় সব খেয়ে নিল। এখন ঠনঠনানো ফাঁকা ঘি-শিশির মতো আমরা বেঁচে আছি গো! শিশি আচে অথচ ঘি নাই। টাকা-পয়সা নিয়ে কোনো সমস্যাই হবে না ওরা বলে গেল। মানুষ হিসাবে পাত্রপক্ষের ওরা খারাপ নয়। চুনারাম-মুনিরাম দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নূপুরের বিয়ে ঘরটা ওখানেই হবে। একটু সুখ পাক মেয়েটা। অল্পবয়স থেকে দায়িত্ব নিয়ে কেমন যেন মনমরা হয়ে গিয়েছে মেয়েটা। ওর মুখে হাসি ফুটাতে চায় সবাই। রঘুনাথ জোর দিয়ে বলেছে, আমার বুনের বিয়ে মাটিয়ারিতেই হবে। আমি নিজে ফুরসত মতো ফরিদপুর-পাঁচপোতা যাব। সব দেখে-শুনে আসব। তারপর তুমরা গিয়ে পাকা কথা বলে এসো। বুনের বিয়ে বলে কথা। হড়বড়ানোর কোনো দরকার নেই। যা হবে দেখে-শুনে হবে। লাখ কথার এক কথা। চুনারাম ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিল রঘুনাথকে।
.
৫৪.
কালকাসুন্দি গাছের ছায়া মানুষের কোনো কাজে লাগে না। গাছ শুকিয়ে যাবার পর জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার হয় ওগুলো। তবু শীতের আগে যখন ওইগাছে ফুল আসে তখন ফুলগুলো দেখার জিনিস হয়ে ওঠে।
সঞ্জয় হালদার কালাকাসুন্দি গাছ নয় কিন্তু তার ওই উখান অনেকটা ওই গাছের মতন।মৃত্যুঞ্জয় সব জানে তবু ছেলেকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলে, পরীক্ষায় মোটে ভয় পাবিনে। মনে না পড়লে মা বুড়োমার নাম স্মরণ করবি, মা বুড়োমা তোকে সব মনে করিয়ে দেবে। বড়ো জাগ্রত দেবী। আমি মানত করেছি–তুই বড়ো পরীক্ষায় পাশ হয়ে গেলে ঢাক বাজিয়ে পুজো দেব।
দেবশ্রামের ভাড়া বাড়িতে হাঁ করে শুনছিল সায়। বিয়ে চোখের পাতা পড়ছিল না তার। এমনিতে সরে চেহারা ভালো, নাদুস নুদুস। খেয়াল করে দেখলে মনে হবে ফুলে রুগী। আসলে মাত্রাতিরিক্ত যাওয়ার এতাব। সয়ের সব ভালো ও খাওয়ার ওপর তার কেননা নিয়ন্ত্রণ নেই। খেতে পারলেই সে পৃথিবীর সব চাইতে খুশি মানুষ। ফি-বিয়ে বাড়িতে বাজি ধরে সে কম সে কম পঞ্চাশটা রসগোল্লা খাবেই খাবে। সের খানিক মাংস তার জন্য বাধা। পিকনিকে গেলে সে একার চাঁদা দিয়ে ডবল মিল খাবে। এ নিয়ে কেউ রাগারাগি করলে তার ভীষণ অপছন্দ।
সঞ্জয় যার ভালো নাম, ডাক নাম তার লিটন। মাথায় তার ঝাঁকড়া চুল, গা-হাত-পায়ের গড়ন শিলনোড়ার চেয়েও মজবুত। লোকে বলে, লিটনের যেমন চেহারা তেমন খ্যাটন। আর খাবে না কেন সারাদিন তো টো-টো করে ঘুরছে। ঘুরলে শরীলের ক্ষয় হয়, ইঞ্জিন ডিজেল-পেট্রল চায়। নতুন বাসাবাড়িটায় ছ-সাত জনের ভালোমতন ঠাঁই হয়ে যাবে। মৃত্যুঞ্জয় ছেলের মুখোমুখি বসে আছে বারান্দায়। সঞ্জয় ওরফে লিটন মুখ ফাঁক করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। সে যে টেস্টের নদীটা পেরতে পারবে এমন মনের জোর তার ছিল না। হেড-মাস্টারমশাই বলেছিলেন, এ বছরটা ড্রপ দে লিটন। এক বছরে পাকা হয়ে উঠবি। তারপর বোর্ডের পরীক্ষায় বসে যা। তোর ভালো হবে।
বাবার কথা ভেবে লিটন হেডমাস্টারমশাইয়ের কথা কানে তুলল না, স্বপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলল, পড়াশোনা পুরনো ঘিয়ের মতো নয়, মাস্টারমশাই। পড়াশুনো হল খরালীকালের ডিমের মতো। বেশিদিন রেখে দিলে ভেতরে-ভেতরে পচে গিয়ে বাসনা ছাড়বে।
-তোর যা ইচ্ছে তাই কর। বিরক্ত হয়ে হেডমাস্টারমশাই বলেছিলেন, আমি তোকে দেবগ্রামের সেন্টার অবধি পাঠিয়ে দেব। নদী পেরনো তোর কাজ।
ভাড়াবাড়িটার চারধারে গাছপালায় ঢাকা। সূর্যাক্ষ দ্বীপীকে নিয়ে গিয়েছিল কিছু কেনা-কাটা করতে। ফিরে এসে দেখল কপোতাক্ষ বসে আছেন। তাঁর সঙ্গে দ্বীপীর বাবা-মা। ওঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। ওদের আলোচনায় ভাড়া বাড়ির প্রসঙ্গ বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল।
অষ্টমী বেশ খুশি হয়েছে ঘর দেখে। স্কুল পাড়ায় তাদের মাটির ঘর, ঘরের উপরে খড়ের ছাউনি। পয়সার অভাবে খড় পচে ছাইবর্ণ হয়েছে, এখনও পাল্টান হয়নি।
অষ্টমীকে সবাই কম বেশি চেনে। মাঝের গাঁ, হলদিপোঁতায় যেতে গেলে এ পথ ধরে বাঁধের উপর উঠতে হবে। জগৎখালি বাঁধের গায়েই পাশাপাশি তিনটে গুয়োবাবলার গাছ। ওদের বয়সের কোনো গাছপালা নেই। প্রকাণ্ড খসখসে ছালওঠা শুড়িগুলোই বলে দিচ্ছে ওরা বয়স্ক।
অষ্টমী শাড়ি গুছিয়ে নিজেকে ভদ্রস্থ করে বলল, এ বেলায় রান্না হবে, আমি আঁচ ধরিয়েছি। আপনারা তাহলে দুটো সেদ্ধ ভাত এখান থেকে খেয়ে যাবেন। সবার প্রথমে বাধা দিলেন কপোতাক্ষ, না, না,তা হয় না। দেবগ্রামে ভালো হোটেল আছে–আমরা সেখানে খেয়ে নেব। তোমার ব্যস্ত না হলেও চলবে। অষ্টমী স্নান হাসল, ব্যস্ত নয় গো, এটা আমার কর্তব্য। ঘরে থাকলে আপনাদের কি না খাইয়ে ছাড়তাম।
এটা ঘর নয়, ভাড়াবাড়ি। দেবোত্তর বললেন, যেখানে যেরকম, সেখানে সে রকম। বুঝে-শুনে পনেরটা দিন চালিয়ে নিও। ছেলে-মেয়েগুলোকে একটু শাসনে রাখার চেষ্টা করো, অষ্টমী। ওরা যেন বায়োসকোপ দেখতে যেতে না পারে।
অষ্টমীর কঠিন ঘাড় ডানে-বাঁয়ে নড়ে উঠল। বাইরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সে বলল, আমার শাসন ভীষণ কড়া। আমি এদের রাস্তার ওদিকে যেতে দেব না। টাইমে খাবে, টাইমে ঘুমুবে, মাঝখানে শুধু পড়াশোনা।
–ঠিক বলেছো, এই তো চাই। দেবোক্স চক্রবর্তী অষ্টমীর কথাকে সমর্থন করলেন। এই সমর্থন অষ্টমীকে ডানা মেলে ওড়ার সুযোগ করে দিল। তার সাহস বেড়ে গেল হাজার গুণ। লিটনকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বলল, ভালো করে শুনে রাখ, প্রতিদিন রাত বারোটা পর্যন্ত পড়তে হবে। পড়ার সময় দুলুনী বা ঘুম কোনোটাই চলবে না। সকাল ছটার মধ্যে উঠতে হবে। আমার কথার অবাধ্য হলে আমি নালিশ ঠুকে দেব।
মুখের উপর কথা বলার স্বভাব লিটনের। অন্য জায়গায় হলে সে মাসীকে মুখের মাপে জবাব দিয়ে দিত। ভাড়াঘরে অনেকেই উপস্থিত। বিশিষ্ট লোকজনের মাঝখানে তার কোনো উত্তর দেওয়া সাজে না। সেটা বরং খারাপ দেখায়।
বাধা না পেয়ে অষ্টমী বলল, বেলা অনেক হয়েছে, এবার আপনারা যেতে পারেন। আমাকে ভালো করে ঘর দুটো গুছিয়ে নিতে হবে।
-হ্যাঁ, তা তো ঠিক। অনেকক্ষণ পরে অষ্টমীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলল মৃত্যুঞ্জয়, ভালোভাবে থেকো সব। আমি সময় পেলে আবার এসে দেখা করে যাব। কপোতাক্ষ বললেন, হ্যাঁ, বেলা অনেক হল। এবার আমরাও উঠব। এরপরে গেলে হোটেলে আর ভাত পাওয়া যাবে না। তখন দুপুরবেলায় জল-মিষ্টি খেয়ে থাকতে হবে।
চন্দ্রিকা এসব কথা শুনছিলেন না। মেয়ের পরীক্ষা নয় তো যেন তারই পরীক্ষা। কপালের ঘাম কমালে মুছে তিনি দ্বীপীকে বললেন, সাবধানে থাকবি। কোনোদিন বাইরে থাকিল নি, আমার ভয় করছে।
দ্বীপী হাসল, ভয়ের কি আছে?
-তুই মা হলে বুঝবি।
লজ্জায় এত লোকের মাঝখানে দ্বীপী যেন জল লাগা সন্দেশের মতো গলে গেল। গালে রাঙা টোল পড়ল তার। কথা শুনে সূর্যাক্ষ পিটপিটিয়ে হাসছিল। দ্বীপী তার দিকে কটমট করে তাকাল।
কয়লার আঁচে ভাত বসিয়েছিল অষ্টমী। এতক্ষণ গমগম করছিল ভাড়া ঘর। ওরা চলে যাওয়ার পর ঘরটাতে ফাঁকা হাটের নীরবতা নেমে এল। চন্দ্রিকা যাওয়ার আগে দ্বীপীকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলে দিয়েছেন–শরীর খারাপ হলে বিদেশে কীভাবে তা সামলাতে হবে।
দ্বীপী খুব বিরক্ত হচ্ছিল। কিন্তু তার কিছু করার নেই। মায়ের মুখের উপর সে একটাও কথা বলতে পারে না। তাছাড়া মা যা বলেন-তা তো ভালোর জন্যই বলেন।
চন্দ্রিকা এ-ও বললেন, ঘুমোনোর সময় মাসীর কাছে ঘুমিও। তোর ঘুম খুব খারাপ। ঘুমালে বড় এলোমেলো হয়ে যায়ে তোর জামাকাপড়। এসব কথা চন্দ্রিকা বলতেন না কিন্তু না বলেও তার কোনো উপায় নেই। সূর্যাক্ষ তাদের ঘরের ছেলের মতন। ওর কথা আলাদা। কিন্তু বাকি আরও তিনজন আছে। তারা দ্বীপীকে আর কতটুকু চেনে! ওদের মনে একটা খারাপ ধারণা জন্মালে সহজে তা মুছবে না। দ্বীপীর এখন নজরকাড়া চেহারা। চুল থেকে পায়ের নখ সবখানে উপচে পড়া যৌবন। এটেল মাটির মতো গায়ের রং যেন ফেটে পড়ছে। কথা বললে কলকল ঢেউ ওঠে জলের। শুধু ঠোঁট নয়, দিঘল চোখ দুটো কথার তালে তালে নাচে। ডাগর বুকের সে কি দুর্নিবার আকর্ষণ–দেখলেই পানকৌড়ি পাখির মতো ডুব দিয়ে হারিয়ে যেতে চাইবে যুবক সত্তা। তবু মেয়েটাকে এক সাথে না রেখে উপায় নেই। এত টাকা ঘরভাড়া তাদের একার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। পাঁচজনে মিলে দিলে ভাগে কম পড়বে। সেইজন্য এই ব্যবস্থা।
ওরা চলে যেতেই শুনশান হয়ে গেল ঘরগুলো।
সূর্যাক্ষ লোভী চোখে ঘরটার চারপাশে তাকাল। পাঁচিলঘেরা ঘর, সামনে একফালি জমিতে ফুলগাছ যেমন আছে, তেমনি আছে ইউরিয়া দেওয়া পুইগাছ। এ এলাকায় ঢোলকলমী গাছের ছড়াছড়ি। এখন হোট হোট মাইকের মতো ঈষৎ গোলাপী সাদা ফুল ফুটে আছে। গাছগুলো রোগা ডাল নিয়ে দোল খাচ্ছে হাওয়ায়।
সূর্যাক্ষ ছাদে যাওয়ার সিঁড়িটার দিকে তাকাল। তার মনে হল ওই খোলা ছাদে কত রহস্য বুঝিবা লুকিয়ে আছে। ফুরসত মতো ছাদে গিয়ে হাওয়া খেতে হবে। ছাদ থেকে চৌত্রিশ নাম্বার জাতীয় সড়ক নিজের বুকের হাড়ের মতো স্পষ্ট দেখা যায়।
অষ্টমীর রান্না শেষ। এ বেলাটা সেদ্ধ খেয়েই কাটাতে হবে। ও বেলার রান্না নিয়ে কারোর মনে কোনো সংশয় নেই। সবাই যে যার থালা নিয়ে লাইন করে বসে গেল মেঝেতে। দ্বীপী এল না। সূর্যাক্ষ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলল, মাসী, দ্বীপীরটাও বেড়ে দাও। আজ অন্তত সবাই একসাথে খাই। তুমিও আজ আমাদের সঙ্গে খেয়ে নাও।
-তা হয় না, বাবা। আমার অভ্যাস সবার শেষে খাওয়া।
-ও তো বাড়িতে করতে। এখানেও কি তাই করবে? সূর্যাক্ষর প্রশ্নে অষ্টমী বিরক্তির চোখে তাকাল।
দ্বীপী এগিয়ে এল, আমি তোদের সঙ্গে বসছি। মাসী পরে খাক। কেন না কারোর কোনো কিছু দরকার হলে এঁটো হাতে কে বেড়ে দেবে?
-তাই তো! সমস্যাটা বুঝতে পেরে সূর্যাক্ষ মাথা ঝাঁকাল।
খাওয়া-দাওয়া চুকে গেলে দ্বীপী ওর ঘরে চলে গেল। জাতীয় সড়ক কাঁপিয়ে একের পর এক ট্রাক বাস ম্যাটাডোর ছুটে যাচ্ছে। বিরামহীন তাদের চলা। এখান থেকে ট্রেনের শব্দ স্পষ্ট কানে আসে।
এত শব্দ তবু জায়গাটার একটা শান্তশ্রী ভাব আছে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই পরিশ্রমী। যুদ্ধের সময় শিকারপুর বর্ডার পেরিয়ে এরা এখানে আশ্রয় নিয়েছে। কলোনীর পরিবেশ গড়ে উঠেছে চারধারে। পাকা বাড়ির সংখ্যা খুব কম চোখে পড়লেও যে কটা পাকাবাড়ি আছে তা একেবারে নজর এড়িয়ে যাবার মতো নয়।
সবার খাওয়া শেষ, লিটন তখনও ওঠেনি। অষ্টমী তার পাতের গোড়ায় বসে আছে চুপচাপ। পাকা চুলের গোড়া কুটকুটালে সে তর্জনী দিয়ে চুলকে নিচ্ছে জায়গাটা।
কি ভেবে সূর্যাক্ষ দ্বীপীর ঘরে ঢুকে এলে তার মনে হল কাজটা উচিত হল না। এক অপ্রতিরোধ্য সংকোচ তাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখল। গ্রামে থাকতে এই জড়তা তার কোনোদিনও অনুভব হয়নি। কোনো কিছু না বলেই সে দ্বীপীর ঘরে ঢুকে যেত মুক্ত বাতাসের মতন। আজ এখানে কে যেন ভেতর থেকে বলল, যেও না। এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় সূর্যাক্ষ দ্বীপীর দিকে নীরব চোখে তাকাল।
দ্বীপী প্রশ্ন করল, এখানে কি করতে এসেছিস?
-একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সত্যি বলবি?
–ন্যাকামো করিস না। বল কি কথা?
কাকিমা তোকে আড়ালে ডেকে কি বলল রে?
মায়ের কথাগুলো মনে পড়তেই দ্বীপীর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল, মা যা বলেছে-সব কথা তোকে বলতে হবে নাকি?
–তুই তো আমার কাছে কিছু গোপন করিস না।
–দেখ সূর্য, পাগলের মতো বকছিস কেন? তোর কি কোনো কাজ নেই। যা তো
–তাড়িয়ে দিচ্ছিস?
–তাহলে কি ফুলবেলপাতা দিয়ে পুজো করব তোকে? দ্বীপী কপট রাগে চোখ পাকাল।
সুবিধা হবে না বলে সূর্যাক্ষ নরম গলায় বলল, ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। একটু আগেও তুই ঠিক ছিলিস। এখন বদলে গেলি। মেয়েরা গিরগিটির চেয়ে তাড়াতাড়ি নিজেদের বদলে নেয়। ছেলেরা অতটা পারে না।
-যা আর ঝোল টানতে হবে না। দ্বীপী চোখ বন্ধ করে বলল, তুই যা তো, আমি পড়তে বসব। কাল পরীক্ষা। ভীষণ চিন্তা হচ্ছে
–তুই তো ভালো মেয়ে, তোর আবার চিন্তা কি?
–ভালো মেয়ে হলেও পড়তে হয়।
–কাল তো বাংলা। অত পড়ার কি আছে?
-ভুলে যাস না, দুশ নাম্বারের পেপার। ম্যাকসিমাম ছেলে-মেয়ে বাংলায় ফেল করে। দ্বীপী গম্ভীর গলায় বলল।
তার কথায় দিশেহারা বা ভীত হল না সূর্যাক্ষ, এবার তোর স্টার বাঁধা।
-হায়ার সেকেন্ডারীতে স্টার মার্কস পাওয়া ছেলের হাতের মোওয়া নয়। দ্বীপী অবজ্ঞায় ঠোঁট ওটাল।
কিছুটা হলেও মনে মনে দুঃখ পেল সূর্যাক্ষ। দ্বীপীকে বাগে আনতে হবে। কথা দিয়ে ওর মন ভুলবে না। মাঝে মাঝে ও খুব গম্ভীর হয়ে যায় তখন কাউকে চেনে না যেন। ওর এই নির্দয় ব্যবহারটা সূর্যাকে বড়ো আঘাত দেয়। সব বুঝেও সে দ্বীপীকে বলল, শুনেছি, এবার খুব চোতা চলবে। সুযোগ পেলে আমিও চালিয়ে দেব। ছাড়াছাড়ি নেই।
তুই দেখছি ঝালেও আছিস, অম্বলেও আছিস। দ্বীপী কষ্ট করে হাসল। সূর্যাক্ষ এবার আর দ্বীপীকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না। লম্বা লম্বা পা ফেলে সে খপ করে দ্বীপীর হাতটা চেপে ধরল। ওর খোঁপা বাঁধা চুল ছড়িয়ে গেল পিঠে, মুখ কালো হয়ে গেল কষ্টে, ছাড়, ছাড় বলছি।
ছাড়ব না। না ছাড়লে তুই কি করবি?
দ্যাখ সূর্য, ভালো হচ্ছে না কিন্তু। কেউ যদি দেখে নেয় তো মুখ দেখাতে পারবি না। দ্বীপীর ঠোঁট কেঁপে উঠল।
-আগে আমার কাছে ক্ষমা চা। নাহলে তোর মুক্তি নেই।
–আহারে, কী আমার বীর-যোদ্ধা। মুখ বিকৃত করে ঠোঁট ওন্টাল দ্বীপী।
সূর্যাক্ষ বলল, হাত ছেড়ে দেব। আগে বল তুই ভালো ব্যবহার করবি।
-আমি খারাপ ব্যবহার করলে তোর কি আসে যায়?
-আমার মন খারাপ হয়ে যায়। পড়তে বসলে তোর মুখটা খালি ভেসে ওঠে। সূর্যাক্ষ দিশেহারা চোখে তাকাল।
খিলখিলিয়ে হেসে উঠল দ্বীপী, কষ্ট হয় না, ছাই হয়। তোর মনভুলানো কথায় আমি আর গলছি না। যা ভাগ।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্বীপী সুর্যাকে ঠেলা মারল। টাল সামলাতে না পেরে দেওয়ালে মাথা ঠুকে গেল সূর্যাক্ষর। আর সঙ্গে সঙ্গে কপালটা মার্বেল গুলির মতো ফুলে গেল।
দ্বীগী বিস্ফারিত চোখে দেখল সেই দৃশ্য! ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল তার। কান্না পেল। এ কী সর্বনাশ করল সে। কাল পরীক্ষা। ফোলাটা যদি না কমে। যদি সবাইকে ফেলার কারণটা বলে বেড়ায় সূর্যা? তাহলে সে মুখ দেখাবে কিভাবে? দ্বীপীর গা হাত পা কাঁপছিল ভয়ে। তবু সে সূর্যাক্ষর হাতটা চেপে ধরল গভীর আবেগে, তোর বুঝি খুব লেগেছে। দেখ, আমি ঠিক, ওভাবে …
–ঠিক আছে, বুঝেছি। চুপ কর। সূর্যাক্ষ ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল।
ফাঁকা ঘরে দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল দ্বীপী। আর তখনই ভেসে ওঠা শুশুকের মতো দম নিয়ে অষ্টমী বলল, এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তোমার কি ঘুম পাচ্ছে না! কী মেয়েরে বাবা…!
দ্বীপীর ডাগর চোখের তারায় বিস্ময় লুটিয়ে গেল, ঝোঁক সামলে সে বলল, মাসী, দুপুরে শোওয়ার অভ্যাস আমার নেই। দুপুরে ঘুমালে গা-হাত-পা ম্যাজম্যাজ করে। শরীরটা কেমন খারাপ লাগে।
অষ্টমী কেমন পাংশু মুখে তাকাল, আমাদের লিটনটা তো কথা শোনে না। খাওয়ার পরে ঘুম না দিলে ওর পেটের ভাত হজম হবে না। দুপুরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ছেলেটা কেমন মোটা হয়ে গিয়েছে দেখো। আমি কত মানা করি, তবু ও আমার কথা শোনে না।
এই বয়সে লিটন তার চেহারাটাকে বয়স্কদের মতন করে ফেলেছে। শরীরের ওজন বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। তবু খাওয়া-দাওয়ার উপর ওর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। খাবার দেখলে ওর ভেতরটা অস্থির হয়ে ওঠে। বয়সকালে লিটনের মা সপ্তমীর খাওয়া-দাওয়ার প্রতি আসক্তি খুব বেশি ছিল। জলঢালা ভাত খেতে সে খুব ভালোবাসত। শীতকালে বেগুনপোড়া আর জলঢালা ভাত তার কাছে ছিল অমৃতসমান। খুব তাড়াতাড়ি সপ্তমী চলে গেল। প্রসব হতে গিয়ে তার রক্তচাপ অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। মৃত্যুঞ্জয় ধার-দেনা করে সদরে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না। লাউগাছটা মরে গেল, জালি রেখে। সন্ধের মুখে সপ্তমী ইস্কুল পাড়ায় এল ছোট লরিতে চেপে, তার সারা শরীর তখন কাপড়ে মোড়ান, আর সেই কাপড় ভিজে গিয়েছে রক্তে। মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে ধরা একদিনের লিটন।
পাড়া-পড়শিরা দুঃখ করে বলল, যা হবার হয়েছে মৃত্যুন, এবার এই ছেলেটার মুখ চেয়ে বাঁচো। সপ্তমী বড়ো ভালো মেয়ে ছিল গো, কখনো মুখ তুলে কথা বলত না। যারা ভালো তারা চটজলদি ভগবানের কাছে চলে যায়। এসব শাস্ত্রের কথা, তুমি-আমি কি করতে পারি বলো।
দুধের শিশু লিটনকে মানুষ করবে কে? এই চিন্তায় কদিন ঘুমাতে পারেনি মৃত্যুঞ্জয়। শেষে ঠিক করল শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসবে ছেলেটাকে। ওখানে দশজনের হাতে-গেলে মানুষ হয়ে যাবে ছেলেটা। বছর পাঁচেকের হয়ে গেলে লিটনকে নিজের কাছে এনে রাখবে।
শাশুড়ি-মা তার প্রস্তাব শুনে বললেন, ভালো কথা। কিন্তু শুধু ছেলের কথা ভাবলে চলবে না। তোমার নিজের কথাও ভাবতে হবে। তার চেয়ে এক কাজ করো–অষ্টমীকে নিয়ে যাও। ওরও তো কপাল পুড়েছে। জলজ্যান্ত জামাইটা আমার পেটে জল জমে মরে গেল। অত বড়ো কাটোয়ার হাসপাতাল, জামাইটাকে বাঁচাতে পারল না। সবই ভাগ্য বাবা, বুঝলে! শাশুড়ির কথা মৃত্যুঞ্জয়ের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে নেমে এল।
একদিন শ্বশুরঘরে কাটিয়ে একমাত্র শালী অষ্টমীকে নিয়ে ফিরে এল সে। সেই থেকে উনিশ বছর ইস্কুল পাড়াতে কাটিয়ে দিল অষ্টমী। লিটন তাকে ছোট মা বলে ডাকে। তার এই সবোধনে কোনো খাদ নেই। অষ্টমী দু দিনের শিশুকে মায়ের মতো লালন-পালন করেছে। লিটন কাদলে নিজের ভরন্ত দুধহীন স্তনবৃন্ত ধরিয়ে দিয়েছে ছেলেটার মুখে। মা হতে না পারার যন্ত্রণাটা ভুলিয়ে দিয়েছে লিটন। অল্প বয়সে স্বামীহারা হয়ে বাঁচার অনেক জ্বালা। মৃত্যুঞ্জয় দেবতার মতো মানুষ। কোনোদিন তার প্রতি লালসার চোখে তাকায়নি। একই ঘরে শোওয়া বা খাওয়া পরা–তবুও। অথচ পাড়ার লোকে ভুল বোঝে। প্রথম প্রথম চোখ টাটাত। জ্বর ধনুক বাঁকিয়ে বলত, আগুন আর বি পাশাপাশি থাকলে গলবেই। কেনে মিহে কথা বলছো মৃত্যুনা। তোমার আর কতটা বা বয়স? এই বয়সে বউ মরলে লোকে চার-চারটা বিয়ে করতে পারে।
জিভ কেটে মুখ নামিয়ে নিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়, তা নয় গো ভাই, তা নয়। সবাই যা ভাবছে তা ভুল। ঘা শুকোতে সবার একই সময় লাগে না। কারো কারোর ঘা গভীরে থাকে, বাইরে থেকে তা চট করে দেখা যায় না। দেখা না গেলেও ঘা তো ঘা-ই।
অষ্টমী তার ক্ষুদ্র জীবনে অনেক মানুষ দেখেছে, কিন্তু জামাইবাবুর মতো অমন সজ্জন, চরিত্রবান মানুষ সে আর দুটি দেখেনি। এক একটা পুরুষমানুষের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, নারীমন কার্তিকমাসে শ্যামাপোকার মতো দন্ধে মরে। অষ্টমী উনিশটা বছর দন্ধে দন্ধে মরল, কোনোদিন মৃত্যুঞ্জয় তাকে দুর্বল সময়েও ইশারা করে ডাকল না। অথচ দেখতে শুনতে সে কখনও মন্দ ছিল না। আখের আলসের মতো গায়ের রঙ, মাথাভরা চুল ঢলঢল করে নাচত পিঠের উপর, শিরদাঁড়ার ভেতরে প্রায়সময়ই বইয়ে দিত উষ্ণস্রোত। নারীত্বের পাশাপাশি তার এই ভরাট শরীরের দীপ্তমান বক্ষশোভা যেন জাহির করে দিত গোপন যৌবনসত্তা। ঢেউ খেলান শরীরে এখন চর্বি জমলেও জ্যোৎস্নার ঘোলাটে রঙ ধুয়ে গিয়ে ফুটে উঠেছে। কামিনীকাঞ্চন। বয়সটাকে বুঝি ঢাকতে পারে যৌবন। এখনও তার ছোট্ট কপালে লাউ আঁকসির চেয়েও সুন্দর চুলগুলো দোল খায় যখন-তখন। তখন ওই হাড়ভাঙা খাটুনির মুখটাকে মনে হয় শ্রীময়ী। দুকানে বিয়েতে পাওয়া সোনার দুটি বেলকুঁড়ি আজও ফুটে আছে, ঝরে যায়নি। হাতের শাখা ভেঙেছে প্রায় বছর কুড়ি আগে, এখন শুধু সোনার কলি কব্জির নিম্নদেশে খেলা করে, আর রোদে ঝলসায়। আর সেই ঝলকানি শরীরে পড়লে তেতে ওঠে গা-গতর। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও এখন সব মানিয়ে নিয়েছে অষ্টমী। সে জেনেছে পাতলা ঠোঁটের যাদুতে সে পুরুষের হৃদয় অবশ করে দেবে, তাতে লাভের চাইতে যে ক্ষতি বেশি–এ বিষয়ে সে নিশ্চিত। তাই এই সুরভিত শরীরটাকে নিয়ে তার এখন আর কোনো গর্ব নেই, সে শুধু চায় ভালোয় ভালোয় বাকি দিনগুলো কাটিতে দিতে। লিটনের মধ্যে তার আগামী দিনের সব সুখ যেন গন্ধদানীর আতরের মতো লুকিয়ে আছে।
দ্বীপী এসব গল্পের কিছু জানে না। লিটনকে সে ইস্কুলে দেখেছে কথার পিঠে কথা বলে যেতে। ওর মুখে সর্বদা যেন খই ফোটে। হেডমাস্টারমশাই ওর ব্যবহারে তিতিবিরক্ত। দ্বীপীও একদিন রাগের মাথায় সঞ্জয়কে বলে দিয়েছিল, শুন্য কলসি বাজে বেশি। ওই জন্য সবাই তোকে লিটন না বলে নিউটন বলে।
দুপুরবেলায় জানলা টপকে রোদ এসে শুয়ে পড়েছে মেঝেয়। আলোর গোল গোল ফুটকিগুলো বড়ো বেশি ভ্রাম্যমাণ এখন। ওরা বুঝি এক জায়গায় স্থিতু হতে জানে না। দ্বীপী হাঁ-করে অষ্টমীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার মন পড়ে আছে সূর্যাক্ষর কাছে। একটু আগে সে যা ব্যবহার করেছে তা কখনও সমর্থনযোগ্য নয় তার নিজের কাছে। ইদানীং নিজেকে নিয়ে সে বেশি চিন্তিত।
দেবোত্তর চক্রবর্তী সংসারের হাল ফেরাতে গিয়ে ফুটো নৌকোর মতো টলছেন। শিবমন্দিরের পুরোহিতের ভাগ্যে আর কটাকা দক্ষিণ জোটে? পুজোর শাড়ি গামছা দোকানেও কিনতে চায় না। কত আর ওগুলো জমিয়ে রাখা যায়? বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বীপীর মন ভেঙে যায়। পাশ করে তাকে কিছু করতেই হবে। এ নিয়ে সূর্যাক্ষর সঙ্গে তার বিস্তর আলোচনা হয়েছে। দ্বীপী বলেছে, হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করে পিএসসি পরীক্ষায় বসবে।,কেরানীর চাকরি খারাপ নয়। যদি সে চাকরি যোগাড় করতে পারে তাহলে বাইরে থাকতেও তার কোনো অসুবিধা হবে না। সংসারের জন্য অর্থ চাই। সেই অর্থ তাকে শ্রমের বিনিময়ে যোগাড় করতে হবে। সে জানে পড়াশোনার রাস্তাটা দেবগ্রামের সেন্টার অবধি এসে থেমে যাবে। এর জন্য মন খারাপ হয় না তা নয়। মন খারাপ করলেও আর কোনো উপায় নেই।
সূর্য এসব শুনে তাকে অভয় দিয়ে বলেছে, তুই এত ভাবিস নে, আমি আছি, আমি তোদের সংসার চালিয়ে দেব।
-তুই চালাবি? আশ্চর্য!
–কেন, আমি বুঝি তোদের কেউ নই?
–না, না। তা নয়। তবে
–তবে কি?
–এটা বাস্তব নয়। বাস্তব বড়ো কঠিন। তুই আমাদের সংসারে টাকা দিলে সেটা তোর বাবা-মা মেনে নেবো কেন? দ্বীপী বুঝিয়ে বলল, মন তো অনেক কিছু চায়, কিন্তু বাস্তবে কি তা করা যায়?
-বাস্তবে যা করা যায় না, তা অনেক সময় করে দেখানো যায়।
–এটা তোর জেদের কথা।
-জেদ নয়, এটা আমার মনের কথা। তুই আমার পাশে থাকলে আমি অনেক কঠিন কাজ সহজে করতে পারব।
তার মানে?
–মানেটা আমি নিজেও জানি না এখনও।
সেদিনের আলোচনাটা আর বেশি দূর গড়ায়নি। দ্বীপী মনে মনে খুশি হয়েছিল সূর্যাক্ষর কথা শুনে। এমন কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যা ডুমুরের ফুলের মতো লুকানো। যা বাইরে এলে মুগ্ধতার রেশ কেটে যাবে। দ্বীপী আর দাঁড়াল না। যে ভুল সে করেছে, তার জন্য ক্ষমা চাওয়া দরকার। অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও সূর্যাকে তার একান্তে পাওয়া দরকার। ভুল বোঝাবুঝি ব্যাঙাচির লেজের মতো যত দ্রুত খসে পড়বে ততই মঙ্গল।
সন্ধেবেলায় আলো ছিল না, চৌমাথা থেকে মোমবাতি কিনে এনেছে সাক্ষ। তিনটি ঘরে এখন মোমবাতি জলছে। অষ্টমী হ্যারিকেনের কাচ মুছছিল মন দিয়ে। দ্বীপী তার পাশে দাঁড়াতেই মুখ তুলে তাকাল, কিছু বলবে মা?
-না, এমনি…দেখছি।
-হ্যারিকেনের কাচমোছা কেউ দেখে বুঝি? অষ্টমী সহজভাবে হাসল, তোমার মনটা খুব ভালো, খুব নরম।
–কি করে বুঝলে? কৌতূহলী হল দ্বীপী।
অষ্টমী বলল, বোঝা যায় মা, বোঝা যায়। নদীর দেশের মেয়েরা পলিমাটির চেয়েও নরম হয়।
কথাটায় ভালোলাগা ছিল, ভালোবাসা ছিল। দ্বীপী মুগ্ধ চোখে তাকাল, মাসী, তোমার জীবনটা বড়ো কষ্টের, তাই না?
কেন একথা বলছে? কষ্ট ভাবলে কষ্ট, না হলে কিছু নয়। অষ্টমী কোনো জটিলতায় গেল না, বিয়ের ছমাসের মধ্যে স্বামী মারা গেল। মানুষটাকে চিনতে না চিনতেই চলে গেল সে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ভাবলাম এবার হয়ত আমার পালা। দেখো, কেমন বেঁচে গেলাম এতদিন। বাপের দোরে আর হাত পোড়াতে হল না। একটা ঘর পেলাম, ছেলে পেলাম। জানো লিটনকে আমি পেটে ধরিনি ঠিকই কিন্তু লিটন আমার সব। আমি জানি এই ছেলেই আমার মুখে আগুন দেবে।
দ্বীপী আশ্চর্য হয়ে গেল কথা শুনে, গলা নামিয়ে বলল, যা মাগী, তোমার কথাই ঠিক। লিটন বড় ভালো ছেলে। ওর ভেতরে একটা প্রতিবাদী মন আছে। আমার ওই মনটাকে ভালো লাগে।
খুশী হল অষ্টমী, কাছে সরে এসে ঘনিষ্টস্বরে বলল, তোমাকে একটা কথা বলি মা। লিটনকে যেন ভুল করেও বলো না। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে দেবগ্রামের পাশটা হয়ে গেলে লিটনের বিয়ে দিয়ে দেব। তা তোমার নজরে তেমন কোনো ভালো মেয়ে আছে? থাকলে বলল। আমি যোগাযোগ করব।
-সে কী মাসী, এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেবে?
–কেন বিয়ে দিলে ক্ষতি কি?
–ওর চাকরি-বাকরি নেই, কিছু করে না। আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাও।
–চাপ না পড়লে কেউ বাপ বলে না-বুঝলে? অষ্টমী ঘন দাঁত বের করে হাসল। দ্বীপী আর এ প্রসঙ্গে কোনো কথা না বলে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া লোডশেডিং দৈত্যের আলোচনায় মেতে উঠল, দেখো তো, কী ঝামেলা। এ সময় লাইট গেলে আমরা পড়ব কখন?
অষ্টমী ক্রোধিত হয়ে বলল, সব কানা, বিবেকহীন। না হলে পরীক্ষার আগে কেউ বাতি কেটে দেয়। পুরো এলাকাটা অন্ধকারে ডুবে আছে মনে হচ্ছে। এদিক থেকে ভালো হয়েছে–আমাদের ঘরে এসব ঝামেলা নেই। হ্যারিকেন-ডিবরিতে আমাদের চোখ সয়ে গেছে।
সাড়ে আটটার পরে অন্ধকার খুন হল। সঙ্গে সঙ্গে ছাদ থেকে নেমে এল ওরা। দ্বীপী সবার পেছনে, লিটন সবার আগে। সিঁড়ির বাটা লালচে আলো ছড়িয়ে জুলছিল।
অষ্টমী ওদের আসার অপেক্ষায় সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছিল, আলো এসেছে, এবার তোরা সবাই খেয়ে নে। আবার কখন বাতি চলে যাবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। যা হাত-মুখ ধুয়ে আয় কলতলা থেকে। আমি ভাত বেড়ে রাখছি।
সূর্যাক্ষ হাত নেড়ে বলল, এত তাড়াতাড়ি খাওয়া কি ঠিক হবে মাসী, যদি ভোরের দিকে খিদে পেয়ে যায়?
খিদে পেলে খাবি। টিনে মুড়ি আছে। মুড়ি খেতে দোষ কোথায়?
এবার আর কোনো আপত্তি টিকল না কারোর। কলতলায় গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এল ওরা। নতুন টিন কেটে বানানো হয়েছে কলতলার দরজা। আলো পড়ে চকচক করছে টিন। টিন নয় যেন ধাতুর-জ্যোৎস্না।
খাওয়ার পর দুঘণ্টা টানা পড়ে নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল দ্বীপী। পাশে বসা সূর্যাক্ষকে চিমটি কেটে বলল, ঘুম পাচ্ছে, ছাদে যাবি, সূর্য?
-এত রাতে?
–আমার ভালো লাগছে না। ভীষণ মন খারাপ করছে বাড়ির জন্য।
–সে কি রে, একদিনেই এত?
–যার হয়, একদিনেই হয় না হলে জীবনভর হয় না।
সূর্যাক্ষ অবাক হয়ে শোনে দ্বীপীর কথাগুলো। নরম কথা কিন্তু নেশা ধরে যায় মনে। দ্বীপী অস্থির হয়ে বলল, যাবি তো চল। আমার আর ভালো লাগছে না।
-আমরা একা যাব?
–একা কোথায় রে, আমরা তো দুজন আছি।
–হ্যাঁ, দুজন আছি। কিন্তু আমরা দুজন মানে তো একজন।
–অঙ্কে তুই নির্ঘাত ফেল করবি। এই যদি তোর হিসাব অন হয় আমি তোকে কি বলব বল। দ্বীপী আনমনে আঙুল কামড়াতে লাগল, চল না রে সূর্য, আমার যে ছাদে যেতে মন করছে।
-যেতে পারি, কিন্তু আমি যতক্ষণ বলব ততক্ষণ তোকে ছাদে থাকতে হবে।
সূর্যাক্ষর শর্তটা উপভোগ করল দ্বীপী, এবার হাসি ফুটল তার ঠোঁটে, ঠিক আছে মেনে নিলাম। কিন্তু একটা কথা বল তো, এতক্ষণ ছাদে থেকে কি হবে?
–রকেটবাসের নাম শুনেছিস? হাইওয়ে দিয়ে বাসটা রোজ যায় গভীর রাতে। তার মাথায় থাকে সার্চ-লাইট। বাসটা রকেটের গতিতে দৌড়য়। দিনের বেলায় বাসটাকে দেখা যায় না, এ হল রাতের রানী।
সূর্যাক্ষর কথায় দ্বীপী অবাক হল, তুই এত সব জানলি কি করে?
–জানতে হয়। বিজ্ঞের মতন ঘাড় নাড়াল সূর্যাক্ষ, মোমবাতি কিনতে গিয়ে সব শুনে এসেছি। তুই যদি সঙ্গে থাকিস তাহলে আজ রাতেই রকেট বাস দেখার আশাটা পূর্ণ হয়ে যাবে।
–অত রাত অবধি থাকব, যদি ঠাণ্ডা লেগে যায়?
–তাহলে গায়ে একটার চাদর জড়িয়ে নে।
–তুই কি গায়ে দিবি?
–আমার দরকার হবে না।
–কেন?
–-তুই আছিস না। তুই থাকলে আমার শীতও লাগে না।
দ্বীপী অবাক না হয়ে পারল না। চাপা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমার সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে রঘুর চাইতে তুই আরও বড়ো চোর। প্লিজ সূর্য, অন্তত পনেরটা দিন তুই আমার সঙ্গে কথা বলবি না।
-তুই থাকতে পারবি?
–জানি না, যা। তবে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কোথায়?
.
৫৫.
সময় পেরিয়ে গেল কিন্তু রকেট বাস আর দেখা হল না দ্বীপীর। হয়ত বাসটা গিয়েছিল, দীর্ঘ অপেক্ষার ঘুম চোখে আর দেখা হয়নি।
তখন রাত্রি দুটো বা তারও বেশি হবে হঠাৎ ঘুম ভেঙে সূর্যাক্ষ দেখল তার মাথার চুল হিম পড়ে ভিজে গেছে। দ্বীপী খোলা আকাশের নীচে শুয়ে আছে তার বুকে মাথা রেখে। জড়তায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতে গেলেই সূর্যাগ টের পায় মেয়েদের মাথার চুল কচুরিপানার শেকড়ের চেয়েও ভারী।
মেয়েদের চুলে হাত দিতে নেই তবু গোপনে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল সূর্যা। ঘুমিয়ে থাকলে মেয়েদের রূপটা রাতের শাপলা ফুলের চেয়েও নজরকাড়া। সূর্যাক্ষর চোখের তারা কেঁপে গেল। দ্বীপী এত সুন্দরী, কই আগে তো তার কোনোদিন মনে হয়নি। দ্বীপীকে তার মনে হল ঘন পাতার আড়ালে ফুটে থাকা কাঁঠালীচাঁপা ফুল। সুগন্ধে ম-ম করছে রাতের বাতাস। অকাতরে ঘুমাচ্ছে
তবু তাকে জাগাতেই হবে।
-দ্বীপী, এই দ্বীপী ওঠ।
মুখের দুপাশ হাত দিয়ে ঘষে নিয়ে দ্বীপী স্বপ্নময় আচ্ছন্নতার মধ্যে উঠে বলল, আক্ষেপ বেজে উঠল তার গলায়, ইস, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রকেট বাস কি চলে গিয়েছে?
-জানি না, আমারও তো তোর মতন দশা। তবে বুকটা বড় ব্যথা করছে।
–কেন রে, কি হল আবার?
–কিছুই হয়নি, তোর মাথাটা ভীষণ ভারী।
তার মানে?
–মানেটা নাই বা বললাম। শুনলে তুই খুব অবাক হবি, নয়ত রাগ করবি।
–আমি কোনো দোষ করেছি বুঝি?
–না।
–তাহলে? তুই কি কিছু দেখেছিস?
–হ্যাঁ।
–কি দেখেছিস?
কত কি দেখেছি। সব তোকে বলতে হবে?
মুখ শুকিয়ে গেল দ্বীপীর, কথা আটকে গেল গলায়। লজ্জা এসে রাঙিয়ে দিল ওর কাঁঠালকোয়া মুখ।
সূর্যাক্ষ বলল, শুয়ে থাকলে মেয়েরা আকাশের তারা হয়ে যায়। আজ বুঝতে পারলাম কথাটা কত সত্যি।
দ্বীপী ঠোঁট ওন্টাল কিন্তু ওর দিশেহারা চোখে কোনো ভাষা ছিল না। পৃথিবী নিজস্ব পথে ঘুরছিল তখনও।
বাংলা পরীক্ষা সবারই ভালো হয়েছে, খুবই সাধারণ মানের প্রশ্নপত্র, ছাত্র-ঠকানোর কোনো দুরভিসন্ধি ছিল না। ফাস্ট পেপারটায় বড়ো বেশি লিখতে হল সূর্যাদের, তবে গুছিয়ে লিখলে আরও হয়ত একখানা সুজ সিট কম নিতে হত তাকে।
দ্বীপী রিকশা করে ফিরে এল সেন্টার থেকে। সাদা নীল পাড় শাড়িতে তাকে অপূর্ব দেখাচ্ছিল। গায়ে গাঢ় নীলরঙের ব্লাউজ, যেন কামড়ে ধরেছে শরীরের মাংস, এমন চেপে আছে শরীরে। লিটন, সূর্যানরা হেঁটে আসছিল জাতীয় সড়ক ধরে।
একটা পরীক্ষা শেষ হওয়া মানে ঘাড় থেকে এমণি বস্তা নেমে যাওয়া। সূর্যাক্ষ হাঁটতে হাঁটতে লিটনকে শুধালো, কেমন হয়েছে রে তোর পরীক্ষা?
লিটন বেশ মুডেই ছিল, ভদভদ করে বলল, এত ভালো কশ্চিন এলে কে খারাপ পরীক্ষা দেবে বল? তাছাড়া মাতৃভাষা সবার ভালো হবে। তাছাড়া তমালবাবু যেভাবে বাংলা পড়ান তাতে ক্লাসেই সবার পড়া হয়ে যায়। ওঁর মতন সবাই যদি যত্ন নিয়ে পড়াতেন তাহলে আর চিন্তা ছিল না।
লিটন যা বলল তাতে কোনো খাদ নেই। সত্যিই তমালবাবুর কোনো তুলনাই চলে না কারোর সঙ্গে। তাঁর কোনো ছেলেমেয়ে নেই অথচ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের উপর তার যে অগাধ টান, মায়া মমতা স্নেহ ভালোবাসা একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
আজ পরীক্ষার হলে তমালবাবু এসেছিলেন হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। সমস্ত ক্লাস রুম ঘুরে ঘুরে দেখলেন। এমন কি ঐশীর কাছেও গেলেন। ঐশী শুধুমাত্র তাদের স্কুলের নয়, আশেপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে সব চাইতে সুন্দরী মেয়ে। ওর দিকে তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া বড়ো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটা এত সুন্দরী তবু তার কোনো রূপের বড়াই নেই। সূর্যাক্ষর মনে হয় ঐশী মৃন্ময়ী দুর্গাঠাকুরের রক্ত-মাংসের সাক্ষাৎ রূপ।
সেই ঐশীর ঘুসঘুসে জ্বরের পর পক্ষ বেরিয়েছে সারা গায়ে, বেশ বড়ো বড়ো জলঠোসার মতো, তার এখন হাঁটতে, কথা বলতে এমন কি বেশি সময় ধরে বসে থাকতে কষ্ট হয়। সে শুয়ে শুয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে আলাদা ঘরে, ইস্কুলের বাঁ পাশে, প্রাইমারী ক্লাসরুমে তার জন্য ঘরের ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে মশারি টাঙানো সব সময়, একজন মহিলা পিওন ঘরের বাইরে টুল নিয়ে বসে আছে। ঐশী জল চাইলে তাকে জল দেবে, বাথরুমে যেতে চাইলে মহিলাটি তাকে ধরে ধরে নিয়ে যাবে।
হেডমাস্টারমশাই আর তমালবাবু ঐশীর ঘরে গেলেন, দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, তোমার এই অবস্থার জন্য খুব খারাপ লাগছে। তবে মনোবল হারিও না। সবরকম পরিস্থিতিকে যে মানিয়ে নিতে পারে সেই-ই তো আসল মানুষ। তা ঐশী, তোমার বাড়ি থেকে কে কে এসেছেন?
ঐশীদের বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো, তাদের একটা টালি কারখানা, পাটের রমরমা ব্যবসা ছাড়া চরে প্রায় দেড়শ বিঘার উপর জমি আছে আর বেশ বড় সড়ো পাকাবাড়ি। বাড়িতে ঢোকার মুখে খান তিনেক গোরুর গাড়ি, একটা লাল রঙের ট্রাক্টর দাঁড়িয়ে থাকে।
মাস্টারমশাইরা চলে যাওয়ার পর লিটন সূর্যাকে জিজ্ঞাসা করল, মেঘনাথ বধ কাব্যটা কার লেখা রে? মাইরি কিছুতেই মনে পড়ছে না, সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
লিখতে লিখতে হাসি আর চেপে রাখতে পারেনি সূর্যা। সে তখন বাপ্পাদিত্যের প্রশ্নটার উত্তর লিখছিল। লিটনের খোঁচা খেয়ে বিরক্ত হয়ে তাকাল। লিটন চাপা গলায় প্রশ্ন করল, কি রে বল, কার লেখা? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের না?
সূর্যাক্ষ ধমকে উঠল, গাধা, ওটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নয়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা। সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মাসী! যা আর জ্বালাবি নে। আমাকে লিখতে দে।
কথা শেষ হল না, একেবারে দরজার ওপ্রান্ত থেকে জাহাবাজ গলায় ভেসে এল, ডোন্ট টক। ইউ, ইউ, আমি তোমাকেই বলছি! গার্ড দেওয়া শিক্ষকটি এগিয়ে এলেন সূর্যাক্ষর সামনে, গম্ভীর গলায় বললেন, মনে রেখো এটা পরীক্ষার হল, মাছের বাজার নয়। আবার যদি কথা বলতে শুনি তাহলে অন্য জায়গায় বসিয়ে দেব।
সূর্যাক্ষ মুখ নামিয়ে নিল, ওকে সবাই দেখছে। লিটন বেশ মজা পেয়েছে ঘটনাটায়। ঘন হওয়া গোঁফে হাসি মাখিয়ে সে রগড়ের চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর এক সময় উঠে দাঁড়িয়ে সে শিক্ষকটিকে ডাকল, স্যার, এদিকে একটু…।
শিক্ষক এগিয়ে গেলেন, কি, কি বলতে চাও? আমি কিছু হেলপ করতে পারব না। আমি ফিজি পড়াই। এটা আমার সাবজেক্ট নয়। যতটুকু জান, ততটুকু লেখো। ডোন্ট সাইট।
লিটনও সহজে ছাড়ার ছেলে নয়, স্যার লাস্ট-ইয়ার গণটোকাটুকি হয়েছে। এবছর একটু ঘাড় যোরালেই আপনি চেঁচিয়ে উঠছেন, এটা কি ঠিক? আমরা তো টুকলি করছি না, একটু ডাউট ক্লিয়ার করে নিচ্ছি। এতে দোষ কোথায়? বোর্ডের পরীক্ষায় এরকম একটু আধটু হয়েই থাকে। শিক্ষক রাগলেন না, বিস্ফারিত চোখ মেলে তাকালেন, ইউ, ইউ, তোমার নাম কি? দেখি তোমার রোল নাম্বার। আই মাস্ট কমপ্লেন এগেনস্ট ইওর নেম। মাইন্ড ইউ! চুপচাপ বসো। ডিসটার্কিং এলিমেন্ট। পরিস্থিতি অনুকুল না দেখে লিটন ধপ করে বসে পড়ল।
হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবতে মন্দ লাগছিল না সূর্যাক্ষর। এ সময়টা জাতীয় সড়কের চারপাশটা বড়ো মনোরম। রোদ কমে গিয়ে গাছের স্নেহের মতো নরম হায়া নেমেছে। পশ্চিম দিগন্তে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে আলোর রঙ। পাখির ডাক সেখানে আবহসংগীতের প্রেক্ষাপট রচনা করেছে।
দ্বীপী সূর্যাক্ষদের দেখতে পেয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়ল। কোমল আলোয় ওর মুখটাতে বুঝি শান্তির আগুন জ্বলছে। লালচে হয়ে আছে ওর পুরো মুখ। সামান্য চ্যাটচেটে ঘাম ফুটে উঠেছে সেই মুখে। বেশ বোঝা যাচ্ছিল জ্বালাময়ী এক দীর্ঘস্থায়ী অশান্তি কুরে কুরে খাচ্ছে ওকে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দ্বীপী সূর্যাক্ষর কোমরের কাছে জোরে চিমটি কেটে জিজ্ঞাসা করল, বটতলায় ঐশীর সঙ্গে তোর কি কথা হচ্ছিল রে? মেয়ে দেখলে একেবারে কাদার মতো লতলতে হয়ে যাস কেন? তোর হ্যাংলামী আর যাবে না।
সূর্যাক্ষ অবাক হল না, সে জানে এটা দ্বীপীর পুরনো রোগ, তুই দেখেছিলি বুঝি?
–দেখব না, আমি কি অন্ধ? ঝাঁঝিয়ে উঠল দ্বীপী।
সূর্যাক্ষ মন খারাপ করে বলল, ওর জন্য কষ্ট হয়। আহারে অত ভালো মুখ যার তারই শেষ পর্যন্ত পক্স বেরিয়ে গেল। মুখে নিশ্চয়ই কালো কালো দাগ হয়ে যাবে। তখন কেমন দেখতে হবে ঐশী কে জানে?
–ওর চিন্তায় তোর দেখছি ঘুম আসছে না। দ্বীপী কটাক্ষ করল।
সূর্যাক্ষ সহজভাবে বলল, পসের জ্বালা তুই আর কি করে বুঝবি বল? যাকে সাপে কামড়ায়নি সে কি সাপের বিষের জ্বালা বোঝে রে। ছোটবেলায় আমার পক্ষ হয়েছিল। এক মাসের উপরে ভুগেছি। মা মাছ-মাংস কিছু খেতে দিত না। সব মনে আছে।
দ্বীপী এসব কথা গায়ে মাখল না, শুধু কটমট করে তাকাল, ঐশী তোকে কি বলল বললি না তো?
ওই রকম অবস্থায় কি কিছু বলা যায়, নাকি বলা সম্ভব?
-ও নিশ্চয়ই তোকে কিছু বলেছে। আমি ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি। ওর মতন শয়তান মেয়ে খুব কম আছে। দ্বীপীর সাদা চোখের জমিতে লালচে আভা ফুটে বেরল, তুই জানিস না সূর্য, ও দেখতে সুন্দরী বলে কত ছেলের সঙ্গে প্রেম করে বেড়ায়। ওর কেমিস্ট্রি বইতে আমি দুটো চিঠি পেয়েছিলাম। তোক দেখাতে পারি।
-না, না। আমাকে আর দেখানোর দরকার নেই।
–আমি জানি তুই দেখবি না। তুই তো—
থামলি কেন? বলে ফেল।
-হ্যাঁ, বলছি। ভাবিস না, আমি তোকে ভয় পাই। থানাপাড়ার আকাশদার সঙ্গে ওর প্রেম চলছে। দ্বীপী কথাগুলো বলে শান্ত হল।
কথাগুলো শুনে সূর্যাক্ষ বলল, প্রেম করা কি অন্যায়? সবাই কি তোর আমার মতো বোকা নাকি?
-কি বললি? একথা বলে তুই কি বোঝাতে চাইছিস?
-ই খুব ঝগড়া করার মুডে আছিস আজ। নিশ্চয়ই তোর পরীক্ষা ভীষণ ভালো হয়েছে। দ্বীপী থামল না, তোর সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না।
-একটু গুড়াখু দিয়ে দাঁত মেজে নে তাহলে মুড ফ্রেশ হয়ে যাবে।
–ওসব বদ-অভ্যাস আমি কবে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছি। আমি তোর মতো নইরে। তোর তো মাঝেমাঝে মুখ দিয়ে বিড়ির গন্ধ বেরয়।
-পুরুষ মানুষের মুখ দিয়ে বিড়ির গন্ধ বেরবে না তো ধুনোর গন্ধ বেরবে? আমাদের মধু খাওয়া মুখ নয় বুঝলি? সূর্যাক্ষর কথাগুলো দ্বীপীর গায়ে চিমটি কাটল।
দ্বীপী চুপ করে থাকার মেয়ে নয়, হাত নেড়ে নেড়ে সে বলল, মধু খাওয়ার ভাগ্য আর তোর কোথায় হল? আর খেলেও নিমফুলের মধু খেয়েছিস। সেইজন্য কথাবার্তার তোর কোনো ছিরি নেই।
সূর্যাক্ষর আর লড়াই-ঝগড়াতে মন ছিল না, সে চাইছিল সন্ধি। অনেকটাই আপোষের সঙ্গে সে বলল, আচ্ছা তুই কি চাইছিস বল তো?
-আমি যা চাই তা তো আগেই বলেছি। দ্বীপী হাঁপাচ্ছিল, তুই ঐশীর সঙ্গে মিশবি না। আর যেন কোনোদিন ওর সঙ্গে কথা বলতে না দেখি। ও ভালো মেয়ে নয়, আমাকে হিংসা করে।
সূর্যাক্ষ অনেক কিছুই বলতে পারত কিন্তু সে চুপ করে থাকল। ওদের মধ্যে মধ্যস্থতায় এগিয়ে এল লিটন, ঝামেলা মিটল তোদের? পরীক্ষা দিতে এসে এসব মান-অভিমানের পালা আর ভালো লাগছে না। আমাদের ইস্কুলটার তোরাই বদনাম করে ছাড়বি।
কথা নয় যেন অ্যাসিডের ছিটে, জ্বলে উঠল দ্বীপী, তোর সাহস তো কম নয়, এ কথা তুই বলতে পারলি? কেন বললি বল? কি দেখেছিস?
নিমেষে বেলুন চুপসান চুপসে গেল লিটন, ঢোঁক গিলে বলল, কথাটা মুখে এল তাই বলে ফেললাম। মনে কিছু করিস না।
–জুতো মেরে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করা যায়? দ্বীপীর রাগ তখনও পড়েনি।
সূর্যাক্ষ শান্ত করল তাকে, চুপ কর। ও তো ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে।
ক্ষমা চাইলেই সব হয়ে যায়? দ্বীপী কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না কথাটা। খিরিষগাছের পাশ দিয়ে রাস্তাটা নেমে গেছে বাঁ দিকে। তার কিছু দুরে পরপর দাঁড়িয়ে আছে নিরীহ কটা তালগাছ। তালগাছের হাত পাঁচেক দুরে টলটলে জলের বড়ো একটা পুকুর। হাড়মটমটি ঝোপের পাশ দিয়ে দেখা যায় দেবগ্রামের গোরুর হাট। ঘাসহীন জায়গাটায় রবিবারে গোরর ক্ষুরে ধুলো ওড়ে। গোরু-মোষের চিৎকারে, মানুষের ব্যবসা সংক্রান্ত কথাবার্তায় জায়গাটা জমজমাট থাকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত। মানিকডিহি থেকে সাইকেল চালিয়ে সূর্য আর তার বন্ধুরা হাট অবধি আসত গল্পে-গল্পে। এসব বেশি দিনের কথা নয়, সুর যেন সব পর পর মনে পড়ে যায়।
রবিবার ছাড়া হাটের দিকে তাকালে মন খারাপ হতে বাধ্য। ফাঁকা মাঠটা তখন ঘুমোয়, বিশ্রাম করে। গোরর পায়ের ক্ষুরের দাগগুলো ধুলোয় ঢাকা পড়ে যায় তখন।
সূর্য থাকতে না পেরে বলল, দ্বীপী, জানিস গোরুর হাটের কাছে একটা বরফ কল আছে। ওখানে লাল-সাদা-হলুদ রঙের আইসক্রীম পাওয়া যায়। এখন ওখানে দুধমালাইও বানাচ্ছে। আগে দুধমালাই বেলডাঙা থেকে আসত।
দ্বীপীর এসব ছেলেভুলানো কথা শোনার কোনো আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না সে চুপচাপহাঁটছিল। তার চোখ টেলিগ্রাফ তারের উপর। গোল খুঁটির উপর তারগুলোকে ধরে রেখেছে সাদা কাঁপের মতো দেখতে চীনামাটির ইনসুলেটর। টান টান তারের উপর বসে আছে পিচের চেয়েও কালো রঙের একটা ফিঙে পাখি। পাখিটার নজর উড়ে বেড়ান ঘাসফড়িংগুলোর দিকে। ডানা কাঁপিয়ে উড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে ফড়িং ধরায় বুঝি অনেক সুখ, পড়ন্ত বেলায় আহারের জন্য এই সান্ধ্য-শিকার ফিঙে পাখিদের কাছে বুঝি রীতিমতো উপভোগ্য।
দ্বীপীর ভালো লাগে না এই জবরদখল। চোখ সরিয়ে নিয়ে সে নিজেকে স্বাভাবিক করার খেলায় মেতেছে। আগামীকাল কোনো পরীক্ষা নেই। অথচ চিন্তামুক্ত হতে পারছে না সে। হোটহোট ঘটনায় বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে মনটা। আর কপা হাঁটলেই ভাড়া বাড়িটাতে পৌঁছে যাবে ওরা। দ্বীপী ভাবল আজ আর সে ছাদে যাবে না। চোখে মুখে জল দিয়ে একটু গড়িয়ে নেবে বিছানায়। সারাদিন যা ধকল গেল টনটন করছে শিরদাঁড়া। টানটান হয়ে ঘুমালে শুধু শিরদাঁড়া নয়, মনটাও তার জুড়াবে।
সন্ধের পর থেকেই গাড়ি ঘোড়ার যাতায়াত বেড়ে যায় রাস্তায়। ভারী ট্রাকের শব্দে কাঁপতে থাকে মাটি। যেন মৃদু ভূমিকম্পে নড়ে উঠছে ঘরবাড়ি।
হালকা টিফিন খাওয়ার পর থেকে যে যার মতো বই নিয়ে বসে গিয়েছে পড়তে। অষ্টমী রান্নার কাজে এদিকে আর আসার সময় পায় না। এতগুলো মানুষের রান্নাবান্না নিয়ে সে রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে।
বাথরুমে যাবার নাম করে লিটন উঠে গিয়েছে মিনিট দশেক আগে। টানা পড়ার অভ্যাস তার কোনোদিনও ছিল না। এভাবে বসে থাকলে তার মাথায় ঘুঘরোপোকা ঘোরে।
লরির শব্দটা হাইওয়ে থেকে মিলিয়ে যেতেই হঠাৎই গোঙানীর একটা শব্দ বাথরুম থেকে ভেসে এল সূর্যাক্ষর কানে। কেউ গলা টিপে ধরেছে এমন ঘড়ঘড় আওয়াজ।
সূর্য, দ্বীপী এবং অন্যান্যারা একে অপরের দিকে তাকাল, তারপর সন্দেহ হতেই দৌড়ে গেল বাথরুমের দিকে। অষ্টমীও না থাকতে পেরে তাদের পেছন পেছন গেল।
বাথরুমের কোণে হতভম্ব শরীর নিয়ে দাঁড়িয়েছিল লিটন। সারা গায়ে হরলিকসের গুড়ো। ঢাকনা খোলা নতুন শিশিটা পড়ে আছে সামনে। সেদিকে কোনো লক্ষ্য নেই লিটনের। জোরে জোরে শ্বাস টেনে সে গোভানীকে এখন নিজের বশে আনতে অক্ষম। বেশ বোঝা যাচ্ছিল তার কষ্টটা সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে।
-তোর কি হয়েছে? সবার আগে বাথরুমের ভেতরে ঢুকে গেল দ্বীপী। তার চোখে মুখে ভয়। নিজেকে সামলে নিয়ে সে লিটনের হাত শক্ত করে চেপে ধরল। লিটনের মুখের চারপাশে ঘাম আর লালায় চ্যাটচেটে হরলিকস। ঠোঁটেও তার ছোঁয়া, যেন শেতী হয়েছে।
শাসকষ্টে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আমার উপক্রম হল লিটনের। সেইসঙ্গে বাড়ছিল গোঙানীর মাত্রা। নিদারুণ কষ্টে টলটলিয়ে উঠল ওর চোখের তারা। শুধু মুখ নয়, সারা শরীরে ফুটে উঠল সেই অস্বাভাবিকতা। বুক চাপা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে স্যাঁতসেঁতে মেঝেতেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল লিটন। বেশিক্ষণ বসে থাকার ক্ষমতা ছিল না তার, একসময় শরীর এলিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল সে ভেজা বাথরুমে।
অষ্টমী এসব দেখে হাউ হাউ কান্নায় আলগা করে দিল নিজেকে। বুকের কাপড় সরে গেল তার অসাবধানে। চুল আছাড় দিয়ে পড়ল মুখের উপর। এই অবস্থায় কোনোমতে টলতে টলতে সে ছুটে গেল ঘরের দিকে। হাতপাখা আর এক জগ জল নিয়ে ফিরে এল সে দ্রুত। এখন আর শব্দ নেই, শুধু চোখ বেয়ে অনর্গল ধারা নামছিল অষ্টমীর, মা বুড়োমা, মাগো মা, একি করলে? কাঁপতে কাঁপতে নিজের তর্জনী জোর করে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল লিটনের মুখের ভেতর। বহু কষ্টে বের করে আনল লালা থুতু আর কফ মিশ্রিত হরলিকস।
সূর্যাক্ষ ঘাবড়ে গিয়েছিল, কিছুটা আন্দাজ করে সে বলল, মনে হয় শাসনালীতে হরলিকস আটকে গিয়েছে। তাড়াহুড়ো করে খেতে গেলে অনেকসময় এমন বিপদ হয়।
কথা বলো না গো, ছেলের কিছু হলে আমি যে শেষ হয়ে যাব। সুর করে ডুকরে উঠলঅষ্টমী। মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দলা পাকানো হরলিকসগুলো বহু কষ্টে বের করে আনল অষ্টমী। তার কপালে ফুটে উঠল বোদের মতো বিন্দু বিন্দু ঘামের দলা। প্রায় আধ ঘন্টা পরে অষ্টমী আর দ্বীপীর যৌথ প্রচেষ্টায় লিটনের গলার ঘড়ঘড়ানী আওয়াজটা বন্ধ হল। তখনও উঠে বসার ক্ষমতা ছিল না তার।
অষ্টমী তাকে চায়ের চামচে জল খাওয়াল। দ্বীপী তার বুক ডলে দিতে দিতে একসময় জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন মনে হচ্ছে তোর?
ভ্যালভেলিয়ে চারপাশে দৃষ্টি যোরাল লিটন, আস্তে আস্তে বলল, আগের চেয়ে একটু ভালো। আমার হাতটা ধর তো, উঠে বসি। পিঠে বড়ো ঠাণ্ডা লাগছে। অষ্টমী বুক হালকা করে শ্বাস ছেড়ে লিটনের মুখের দিকে তাকাল, হরলিকস খেতে মন চায় তো আমাকে বললি না কেন? আমি বানিয়ে দিতাম।
-ওটা তো সূর্যর হরলিকস। লিটন অপরাধীর মতো মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, বাবাকে বলেছিলাম একটা কিনে দিতে। বাবা পয়সার অভাবে পারেনি। অথচ গুঁড়ো হরলিকস খেতে আমার খুব ভালো লাগে।
-ভালো জিনিস তো খেতে ভালো লাগে, তা বলে এই ভাবে? অষ্টমী ধীরে ধীরে তেতে উঠছিল, বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে সে এবার ছেলেকে শিক্ষা দেবার জন্য ব্যস্ত, শেষপর্যন্ত তুই খাওয়ার জন্য চুরি করলি? ছিঃ। তোর বাবা কত কষ্ট করে তোকে পড়াচ্ছে। তার মূল্য তুই এভাবে দিলি?
অষ্টমী যা বলছে তা সত্যি। তবু কথাগুলো কানে লাগছে দ্বীপীর। সে চাপা গলায় সতর্ক করল অষ্টমীকে, আঃ মাসী ছাড়ো তো এসব কথা। এখন এসব কথা বলে কোনো লাভ হবে কি?
-লাভ-ক্ষতির কথা নয়, চুরি করে খেতে গিয়ে ওর যদি কিছু হয়ে যেত? কষ্টে চোখবন্ধ হয়ে এল অষ্টমীর। মনের দুঃখে কেঁদে ফেলল সে।
লিটন মেঝেতে দুহাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বুকের কাছে ব্যথাটা পুরোপুরি মেলায়নি এখনও। গলাটাও চিরে আছে, সেখানেও ব্যথা।
নীরবে লিটন হেঁটে গেল ঘরের কাছে। হাত উঠিয়ে ডাকল, এই সূর্য, শোন।
–শোনার কিছু নেই। তুই একটু রেস্ট নে।
দ্বীপী সমর্থন করল, সূর্য ঠিকই বলেছে। আর কথা বলিস না তুই। বিছানা পেতে শুয়ে পড় তো।
আমি ঠিক হয়ে গিয়েচি, আর ভয় নেই। লিটন জোর করে বলল, সূর্য, তোর কাছে আমি ঋণী হয়ে গেলাম।
বন্ধুর কাছে ঋণী হলে কিছু যায় আসে না। সূর্য হাসল। লিটন হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলল ঝরঝরিয়ে। লিটনের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল সূর্য। এমন দৃশ্যে দ্বীপী খুঁজে পেল তার হারানো মাটি।
.
ফেরার দিন কালীগঞ্জের বাসটা ভরে গিয়েছে যাত্রীতে। কেমন যেন মন খারাপ করছিল স্যার। কটা দিন বেশ আনন্দেই কাটল ওদের। শেষের দিন অমলকান্তিবাবু এসেছিলেন। তাঁর কেসটা মিটে গিয়েছে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে ফিরে এসেছেন তিনি। শিবনাথবাবু এখন লজ্জায় আর তার দিকে তাকাল না।
অমলকান্তিবাবু সূর্যাক্ষদের পরীক্ষার পরে ডাকলেন, বেশ আবেগঝরা গলায় বললেন, এবার থেকে তোমাদের আলাদা জীবন শুরু হবে। স্কুলের গণ্ডি আজ তোমাদের শেষ হল।
সূর্যাক্ষ ভাবছিল অন্যকথা। সব কি শেষ হয়ে যায় নাকি শেষ হয়ে শুরু হয় আবার।
বাসটা ছেড়ে দিতেই ধুলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল জানলার উপর। দেবগ্রাম ছাড়িয়ে বাস ছুটছিল হাটগাহার দিকে। দুপাশে ছড়ানো মাঠ। মাঠ ভরে আছে আখের পাতায়। আলসের ভেতর হাওয়া ঢুকে সুড়সুড়ি দেয়। হাওয়া মানে মুঠো মুঠো অক্সিজেন।
দূর মাঠে কে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে শুকনো পাতায়। পড়পড় করে পুড়ছে পুরনো হাল বাকল। এখন আর পাতা নয় শুধু দেখা যাচ্ছে আগুন আর আগুনের শিখা।
আগুনের আরাধনায় মানুষ হয়ে উঠবে আগুনের পদ, অবশেষে পদাবলি। যাত্রাপথের শুরুতেই সূর্যাগ টের পায় মাটি তেতে ওঠার আগেই বৃষ্টির ভীষণ প্রয়োজন।