০৯. চুনকাম আর মেরামতির কাজ

৪১.

চুনকাম আর মেরামতির কাজ চলছে পাশাপাশি।

এরফানের হাতের কাজে মুগ্ধ সবাই।

অবনী বলল, এমন মানুষ লাখে একটা পাওয়া যায়। এমন সাচ্চা মানুষ আজকাল নজরে পড়ে কম।

কথাটা চুপচাপ শুনছিল সরস্বতী। আর থাকতে না পেরে বলল, হ্যাঁ-হ্যাঁ, কেমন মানুষ জানা আছে। বুড়ো বয়সে যে আবার বিয়ে করেছে তার চরিত্র যে কত ভালো তা নিয়ে আমার কাছে আর ঢাক-ঢোল পিটিও না।

কথা বলতে বলতে কেমন চুপসে গেল অবনী। মনে মনে সে ভাবল-এরফান আবার বিয়ে না করলেই পারত। একটা বউ ঘরে থাকতে আবার অন্য কারোর হাত ধরা, মোটেও এটা ভালো স্বভাবের লক্ষণ নয়। সরস্বতী যা বলছে-তাকে একেবারে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সরস্বতী বলল, মানুষকে এক ঝলক দেখেই বিচার করতে যেও না। এত ঠকছু তবু শিক্ষা হয় না।

অবনী মিইয়ে গেল কেমন, তার মেলামেশাটা সবার সঙ্গে বড়োই আন্তরিক। মানুষের দোষ তার খুব কম নজরে পড়ে। এরজন্য তাকে যে ঠকতে হয়েছে তা নয়। তার কি আছে যে মানুষে ঠকিয়ে নেবে? এরফান-এর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইল সে। সরস্বতী যা ভালোবাসে না তা নিয়ে হৈ-চৈ করতে মন সায় দেয় না। তবে এতদিনে তাদের মেলামেশাটা গাঢ় হয়েছে। এরফান সময় পেলেই চলে আসে কোয়ার্টারে। অবনীই তাকে ডাকে। বড়ো মুখ করে বলে, সময় যখন কাটে না তখন আমার বাড়িতে চলে এসো। গল্প করে সময় কেটে যাবে।

গল্পে-গল্পে একদিন বিয়ের কথাটা বলে ফেলেছে এরফান। সহজ সরল না হলে কেউ কি নিজের সবকথা এমনভাবে অন্যের কাছে বলতে পারে? সরস্বতী সব শুনেছে নিজের কানে। শোনার পর থেকে মানুষটার প্রতি তার ভক্তি-শ্রদ্ধা সব উঠে গেছে।

অবনী তাকে কত বুঝিয়েছে, যে যা করল তাতে আমাদের কী এসে যায়। আমাদের সাথে দু-দিনের সম্পর্ক, অত গভীরভাবে না ভাবলেই চলবে। তাছাড়া, এরফান এখানে আসে, দুদণ্ড গল্প করে চলে যায়। ও তো আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি। এরফান এমন স্বভাবের মানুষ–ওর দ্বারা কারোর কোনো ক্ষতি হবে না। চৌবাচ্চাটা ভেঙে গিয়েছিল অবনীর, সর্বদা জল চুয়াত, গচ্ছিত জল বেরিয়ে যেত, একদিন এরফানের নজরে পড়তেই আগ বাড়িয়ে বলল, দাঁড়াও, তোমাদের চৌবাচ্চাটা আমি আবার নতুন করে বানিয়ে দেব।

কথা রেখেছিল সে। ইট-সিমেন্ট দিয়ে নতুন একটা চৌবাচ্চা বানিয়ে দিয়েছিল সে। কাঁচা সিমেন্টের প্লাস্টারের উপর কর্নিকদিয়ে লিখে দিয়েছিল অবনী +সরস্বতী। শুধু ভাব-ভালোবাসাতেই এসব সম্ভব। নাহলে কার এত অফুরন্ত সময় আছে হাতে।

অবনী আর এরফান মুখোমুখি বসে বিড়ি খায়, বিড়বিড়িয়ে গল্প করে নিজেদের মধ্যে। কত রকমের সুখ-দুঃখের গল্প। ওরা দুটিতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বাঁধের গোড়ায়। হাঁ-করে তাকিয়ে থাকে জল সরে যাওয়া বুড়িগাঙের দিকে। অবনী আক্ষেপ করে বলে, মানুষের জীবনও মনে হয় এই বুড়িগাঙের মতো। আজ জল আছে, কাল শুকনো খটখটে।

এরফান শব্দহীন হাসে, তা যা বলেছ। এ জীবন কোথায়, কখন যে গোত্তা খায় কেউ আগাম বলতে পারে না। অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে, আপন মনে বলে চলে, নতুন বউকে সহ্য করতে পারে না বাবলু। আমি তাকে কত বুঝিয়েছি। সে কথা শোনার ছেলে নয়। ওর ধারণা নতুন বউ আসার ফলে খয়রা বিবির কদর কমে গেছে আমার কাছে। আমি তাকে দেখি না, শুনি না। জান ভাই–এসব ওর মনগড়া। আমি দু-জনকে সমান দেখার চেষ্টা করি।

অবনী বলল, তুমি ফের বিয়ে করাতে ওর একটু অভিমান হয়েছে। অভিমান হওয়া তো স্বাভাবিক। ছেলে বড়ো হয়েছে। এবার ওর বিয়ে দিয়ে দাও। দেখবে–আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

এরফান ঘাড় নেড়ে সায় দিল, হ্যাঁ, তুমি যা বলেছ ঠিক বলেছ। বিয়েটা দিয়ে দিলে ছেলের হয়ত রাগ পড়ত। কিন্তু ভালো মেয়ের সন্ধান পাচ্ছি কই। তোমার যদি নজরে পড়ে, আমাকে বলল। দু-হাত এক করে দেব।

সন্ধে লাগার আগে ওরা ফিরে আসে হাসপাতালের সীমানার মধ্যে। আইসোলেশন ওয়ার্ডের বউটা চিৎকার করে কাঁদে, জল, একটু জল।

তার গোঙানী ভরা কথাগুলোয় ভয়ের রেণু ছড়িয়ে থাকে। অবিকল ভূতের মতো লাগে তার গলা। মনে হয় পাতালপুরীর ভেতর থেকে কোন এক প্রেতাত্মা নিজেকে উদ্ধার করার জন্য মরিয়া হয়ে সাহায্য প্রার্থনা করছে। হাসপাতালের অনেকেই এখন আর ঐ ঘরটার পাশ দিয়ে যায় না। আসা-যাওয়ার রাস্তা ভয়ে অনেকে বদলে ফেলেছে এখন। রাস্তা বদলালেও ভয়ের কোনো কম বেশি হয় না। ভয় হচ্ছে অলতার মূল। যার শেকড় খুঁজে পাওয়া দায়।

অতসী দিদিমণি কেন, এই হাসপাতালের কোনো নার্স-দিদিমণি বউটাকে ওষুধ খাওয়াতে যায় না। এমন কী ডাক্তারবাবুও ভয়ে চুপচাপ। শুধু কাগজে ওষুধ লিখে নিজের দায়িত্ব সেরে দেন।

কারা যে বউটাকে এখানে রেখে পালিয়ে গেছে এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা, গবেষণা হল হাসপাতালে। মুখটা কারোরই চেনা নয়। আশেপাশের গ্রামে বাড়ি হলে কেউ না কেউ চিনত বউটাকে।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে অবনী বলল, বউটা মনে হয় বাঁচবে না। যেভাবে বসন্ত ফুটেছে ওভাবে কারোর বুঝি হয় না।

এরফান বিজ্ঞের স্বরে বলল, যার যা ভাগ্যে লেখা আছে তা তো হবেই। নসিবকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তবে তোমার মুখে শুনে আমারও ভীষণ খারাপ লাগছে। কষ্ট পাওয়ার চেয়ে চলে যাওয়া ভালো।

চুপ করে থাকল অবনী। কারোর মৃত্যু কামনা করা অশোভন। তবু মনে মনে সে চাইল–এভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। চলে যাওয়াই ভালো। সুস্থ হয়ে সে ফিরে যাবে কোথায়? যাওয়ার সব রাস্তা তার বন্ধ। যারা অসুখে ফেলে পালায় তাদের কাছে সুস্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না।

সরস্বতী সন্ধেবেলায় শুভকে নিয়ে বসেছে পড়াতে। হ্যারিকেনের আলোয় মাতাল হয়ে উড়ছে শ্যামাপোকা। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে কত কথা মনে পড়ছে তার। বিশেষ করে বালিঘাইয়ের স্মৃতি সে ভুলে থাকতে পারে না। বাবার কথা তার বারবার করে মনে পড়ে। বুকের গভীর থেকে উঠে আসে কান্না। সে কাঁদে একা একা।

অবনী যখন এরফানকে নিয়ে ঘরে এল তখনও উদাস হয়ে বসেছিল সরস্বতী। আজ সন্ধেবেলায় সে চুল আঁচড়ায়নি, সিঁদুরও পরেনি। কেমন ভার হয়ে আছে তার সুন্দর মুখটা। দেখলে মনে হয় চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে সে।

পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকাল সরস্বতী। কপালে নড়ে উঠল বিরক্তির রেখাগুলো, এই বুঝি ঘরে ফেরার সময় হল! এত বাউণ্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়ালে সংসার পাতার কি দরকার ছিল?

অবনী সরস্বতীর কথার ঝঝে বিব্রত, সামান্য সঙ্কুচিত। পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার জন্য সে বলল, সারাক্ষণ হাসপাতাল চত্বরে ঘুরঘুর করতে মন করে না। তাই একটু বাঁধের ধার দিয়ে ঘুরে এলাম। এ সময় বাঁধের ধারে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়। সেই হাওয়ায় শরীরটা জুড়োয়।

সরস্বতী এরফানকে বসতে বলে চোখ তুলে তাকাল, যেখানেই যাও, সংসারের কাজ সামলে যেও। একা আমার ঘাড়ে অত দায়িত্ব দিও না। আমারও শরীর ভালো নেই। আমিও হাঁপিয়ে উঠি।

একটা কাঠের চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছে এরফান।

শুভ হা-করে তাকিয়ে আছে মাঝবয়েসী মানুষটার দিকে। বাবলুর মুখে অনেক কথাই শুনেছে সে এরফান চাচার। সে সব অনেক কথাই এখন ভিড় করে আসে শুভর মনে।

সে কিছু বলার আগেই এরফান শুধালো, এখন তোমাদের ইস্কুল ছুটি আছে বুঝি?

ঘাড় নেড়ে সায় দিল শুভ।

এরই ফাঁকে লাল চা করে আনল সরস্বতী। একটা কাপ এরফানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, চা খান দাদা। সকাল থেকে খেটে খেটে শরীরে আর জোর পাই না। মন-মেজাজ তাই ভালো নেই।

এরফান সহজ হাসি হাসল। চায়ে চুমুক দিয়ে সে দেখছিল ঘরের চেহারাখানা। চার দেওয়ালের মাঝে এ সংসারে দেখার মতো কোনো জিনিস নেই, শুধু সরস্বতী ছাড়া।

অবনী বলল, খালি হাতে দেশ ছেড়ে এসেছিলাম। ডাক্তারবাবু না থাকলে ভেসে যেতাম, দাদা। ডাক্তারবাবুর দয়ায় আমার এই চাকরি। আজ তার দয়ায় দুটো করে খাচ্ছি।

উপকারীর উপকারের কথা ভোলেনি অবনী। কৃতজ্ঞতায় চকচক করছে তার চোখের তারা।

এরফান চা শেষ করে বিড়িতে দম দিয়ে বলল, এখনও এ সংসারে কিছু মানুষ আছে যারা আল্লার ফরিস্তা। তাদের দোয়ায় চাঁদ-সূয্যি খেলছে গো…। সরস্বতী কথা শুনছিল এক মনে। দুম করে সে বলে বসল, আমি শুনলাম তুমি বসন্ত-ঘরে বউটার কাছে যাও। বলি, তোমার কি জানে ভয়-ডর নেই?

অবনীর মুখে কোনো কথা নেই। অতসী দিদিমণি নিশ্চয়ই সব বলেছে সরস্বতীকে নাহলে হাসপাতালের ঘটনা সে জানবে কি করে?

উত্তর না পেয়ে সরস্বতী এরফানকে সাক্ষী রেখে বলল, দাদা, বলুন তো, ওর কি এত আগ বাড়িয়ে সব জায়গায় যাওয়া উচিত। ওর যে বউ ছেলে আছে এটা সে ভুলে যায়।

ডিউটিতে থাকলে না গেলে কি চলে? অবনী বোঝাতে চাইল। রোগকে ভয় পাওয়া ভালো কিন্তু রুগীকে ডরলে সে বেচারী বাঁচে কি করে?

-তোমাকে আর ভগবান সাজতে হবে না। নিমেষে উত্তেজিত হয়ে উঠল সরস্বতী, পরের জন্য ঢের করেছ। এবার নিজের জন্য ভাবো। তোমার কিছু হলে আমাদের কে দেখবে?

দুঃশ্চিন্তায় মেঘলা হয়ে গেল সরস্বতীর মুখমণ্ডল।

অবনী আপন মনে বিড়বিড়িয়ে বলল, বউটা আর বাঁচবে না। একফোঁটা জলের জন্য ও যে ভাবে কাঁদে-তা কানে শোনা যায় না। সবাই পাথর হলে আমাকে যে পাথর হতে হবে তার কোনো মানে নেই।

-তোমার কিছু হলে তোমাকে কে দেখবে?

–তোমরা তো আছ। তোমরা দেখো।

রাত্রি বাড়ছিল। এরফানের ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। এ সময় রাতের বাতাস বেশ ভারী। বাতাসে হিম মিশে থাকে।

অবনী এরফানকে এগিয়ে দেবার জন্য বাতাবী লেবুর গাছ অবধি এল। তারপর এরফানই বলল, দাদা, আর আসার দরকার নেই। এবার আমি চলে যাবো।

আর একটা বিড়ি ধরাল অবনী। এরফানকে একটা বিড়ি দিয়ে বলল, আজ মনে হচ্ছে শীতটা বাড়বে। দেখ হাওয়ায় কেমন কনকনে ভাব।

বিড়ি ধরিয়ে ঘাড় নাড়ল এরফান। তারপর অন্ধকারে মিশে গেল।

 ঘরে ফিরে এসে নাইট-ডিউটির তাড়ায় মেতে উঠল অবনী। ব্যাগ গুছিয়ে সে খেতে বসল রান্দায়। আজও গরম ভাত রাঁধেনি সরস্বতী। জল ঢালা ভাতের উপর দুপুরের কুমড়ো ঘাট আর একটা পেঁয়াজ এগিয়ে দিল সে।

খুব নিরুত্তাপ গলায় অবনী শুধোল, আজ ভাত করোনি?

-বললাম তো আমার শরীর ভালো নেই। নিস্তেজ গলায় উত্তর দিল সরস্বতী, যা আছে আজকের মতো খেয়ে নাও। কাল দেখা যাবে।

শীতকালে ভিজে ভাত খেতে মন করে? অবনী কিছুটা প্রতিবাদী হবার চেষ্টা করল, ঠাণ্ডা ভাত খেয়ে গেলে রাতে ঘুম পায়। ডিউটিতে ঘুমিয়ে গেলে দিদিমণি বকেন।

এবার মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল সরস্বতী, কত ডিউটি করো সব আমার জানা আছে। গিয়ে তো বিছানা পেতে ঘুমাও। রাতে এ হাসপাতালে ভূতই আসে না তো রোগী আসবে।

-ওরকম তোমার মনে হয়। অবনী বোঝাতে চাইল, রোগ-জ্বালা দিনরাত্রি মেনে আসে না। বলে-কয়েও আসে না।

সরস্বতী হাসল, যাও, আমাকে আর বোঝাতে এসো না। আমি সব বুঝি– খেয়ে-দেয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছিল অবনী। সরস্বতী ছুটে এসে সামনে দাঁড়াল, শোন, আজ আর ওই বউটার কাছে যাবে না। দিদিমণি বলছিল-বড়ো ছোঁয়াচে রোগ। আমার খু-উ-ব ভয় করে। যদি তোমার কিছু হয়ে যায়।

ভয়-মনে মনে হাসল অবনী। নিরাপত্তাহীনতা এ পৃথিবীর কেউ চায় না। সরস্বতী-ও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই জলছবি অন্ধকারে ফুটে উঠেছে তার চোখে-মুখে।

হাসপাতালমাঠের ঘাস বিক্রির টাকায় মুনিষ দিয়ে রাস্তায় মাটি ফেলেছেন ডাক্তারবাবু। পায়ের চড়া পড়া পথ এখন অনেকটা উঁচু। এত বড়ো বৃষ্টি গেল তবু জল জমেনি রাস্তায়।

অন্ধকার লেপটে শুয়ে আছে হাসপাতালের ঘরগুলো। সব মিলিয়ে কুড়ি বেডের হাসপাতাল। রবিবার বাদে আউটডোরে বসেন ডাক্তারবাবু। রুগীরা ওষুধ নিয়ে চলে যায়। খুব বড়ো ধরনের সমস্যা হলে তখন ভর্তির প্রসঙ্গ এসে যায়। রাত-বেরাতে কখন যে রুগী আসবে বলা যায় না। তাই চব্বিশ ঘণ্টা নার্স থাকেন ডিউটি রুমে।

নাইট ডিউটি থাকলে অবনী কামাই করে না একদিনও। গাঁয়ের হাসপাতালে রাতের ডিউটি আরামের ডিউটি। তেমন খারাপ কোনো রুগী না থাকলে বিছানা পেতে ঘুম দেয় অবনী। বেশি খারাপ রোগী কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন ডাক্তারবাবু।

এ হাসপাতালে একটা মাত্র অ্যাম্বুলেন্স। ফলে ড্রাইভারও একজন। চিত্রভানু একাই সেই অ্যাম্বুলেন্সের হর্তাকর্তা। এ হাসপাতাল চত্বরে তার কথার বেশ ওজন আছে। ড্রাইভার মানুষ। কেউ সহজে তাকে চটাতে চায় না।

হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে ঢেলায় হোঁচট খেল অবনী। উঃ যন্ত্রণার শব্দ ছিলা পিছলান তীরের মতো আচমকা বেরিয়ে গেল মুখ থেকে। শীত হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ছেশরীরের উপর চাবুকের মতো। তুষের চাদরটা ভালো মতন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় অবনী।

হাসপাতালের মেইন দরজার মুখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল দাসপাড়ার কানুকুড়ো। রোজই সে এই সময়টাতে বাইরে আসে। এলোমেলো কপা হেঁটেই আবার নিজের বিছানায় ফিরে যায়। সারাদিন তার শুয়ে থাকা কাজ। কাঁহাতক আর বিছানা আঁকড়ে শুয়ে থাকতে ভালো লাগে। বয়স হয়েছে। এখন ঘুম চাপড়ার বিলে চরতে আসা শীতের পাখির মতো, শরীরে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধতে জানে না, কেবলই উড়ু উড়ু স্বভাব। ঘুম না এলেও নিয়ম করে খিদে পায় তার। হাসপাতালের ভাতে তার পেট ভরে না, বুড়ি তাই দুপুরবেলায় আউস ফুটিয়ে আনে তার জন্য। কানুকুড়ো এত খায় বলে বুড়ির মনে চাপা রাগ। প্রায় শুধোয়, হ্যাঁ গো, তোমার পেট সাফ হয় তো। পেটে গ্যাস-অম্বল হয় না তো?

কানুকুড়ো ফোকলা মাড়ি দেখিয়ে হাসে, ভগবান এই হজমশক্তি ছাড়া আর কোনো কিছু আমাকে দেয় নি। সে বড়ো কৃপণ গো! তার সাথে দেখা হলে আমার হাতাহাতি হয়ে যেত।

দাসপাড়ার ঘরগুলো হাসপাতালের বারান্দা থেকে দেখা যায়। দায়ে-অদয়ে মানুষজন চিকিৎসার জন্য ছুটে আসে এখানে। এ গ্রামে হাতুড়ে ডাক্তার ছাড়া পাস করা ডাক্তার নেই। একজন হোমিওপ্যাথি পুরিয়া দেয়। তাতে কারোর রোগ সারে, কারোর আবার সারে না।

কানুকুড়ো ঠাট্টা করে বলে, নেশা-ভাং করলে ঐ গুড়ো ওষুধে কোনো কাজ হয় না। বুড়ি বলে, কাজ হয় গো, কাজ হয়। শ্রদ্ধা-ভক্তি ভরে খেতে হবে। ছটফট করলে ও ওষুধে কাজ হবে না।

কানকুড়োর কেস আলাদা।

পালবাড়ির নারকেল গাছ ঝুরতে গিয়ে সে গাছ ব্যাঙের মতো ঠিকরে পড়েছে কঠিন মাটিতে। পড়েই আর উঠতে পারে নি, যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়েছে। ওর ভাগ্য ভালো মাজায় লেগেছে কিন্তু হাড় সরেনি। ডাক্তারবাবু চিকিৎসা করেছেন নিজের হাতে। পাক্কা দেড়মাস তার বিশ্রাম। দেড়মাস পরে সে পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু সুস্থ মানুষ হাসপাতালে থাকে কোন অধিকারে? ডাক্তারবাবু প্রায় এসে বলেন, কাল তোমাকে ছুটি দিয়ে দেব, ঘরে চলে যেও।

ঘরে গিয়ে খাবে কি কানুকুড়ো? এখানে দুধ-পাঁউরুটি, চা-বিস্কুট-ভাতের কোনো অভাব নেই। ঘরে গিয়ে কি শুকিয়ে মরবে? কে খেতে দেবে তাকে? ছেলের বউ দুচোখে দেখতে পারে না। মনে মনে গালমন্দ করে, বুড়োটা মরলে বাঁচি। ঘর জুড়ে বসে বসে শুধু খাওয়া আর বাঁশবন ভরানো। ছা:, এমন কুঁড়ে মানুষের মুখ দেখাও পাপ।

পাপ-পুণ্য অনেক দূরের পথ। তার অনেক জটিল হিসাব। আপাতত খেয়ে-পরে বাঁচতে চায় কানুকুড়ো। দরকার হলে সে ডাক্তারবাবুর পা জড়িয়ে ধরবে, তবু সে হাসপাতাল ছেড়ে যাবে না।

তিন বেলা ওষুধ দিয়ে যায় নার্স দিদিমণি। সেই ওষুধ পরে খাবো বলে মুঠো করে ফেলে দেয় বাথরুমে। কারোর সাধ্যি নেই যে কানুকুভোর কেরামতি ধরে। শুধু ইনজেকশান নেওয়ার সময় তার দৃষ্টি যেন মরা মাছের ঘোলাটে চোখ। কাতর হয়ে বলে, আর ইজিসিন দেবেন না গো, ইনজিসিন নিয়ে নিয়ে হাত দুটো আমার ঝাঁঝরা হয়ে গেল। বড্ড বিদনা হয়।

সরকারি ভাত মাগনা হয় না, সুঁচের ফোঁড়াই তো খেতে হয়। এখন কোমরের ব্যথা সেরে গিয়ে হাতে তার ভীষণ ব্যথা। সোজা হয়ে দুহাত নাড়াতে পারে না। যেন সখের হাত দুটো তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলে গেছে। শুধু বসে বসে কথার জাবরকাটা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই।

সেই কানুকুড়ো অবনীকে দেখতে পেয়ে হাত গুটিয়ে নিল দাপনার কাছে।

 ব্যাপারটা নজর এড়ায়নি অবনীর, চটপট সে শুধোল, কী গো বড়দা, হাতের ব্যথা সেরে গেছে?

-ব্যথা-বিদনা কি সারে ভাই? বয়স কালের ব্যথা-বিদনা চিতায় যায়। আফশোষ ধ্বনিত হল কানুকুভোর গলায়, সেই বসন্ত হওয়া বউ মানুষটা জল-জল করে চেঁচাচ্ছিল, এখন এটু থেমেছে। কেমন চেঁচানী গো, শুনলে গায়ের লুমা চেগিয়ে ওঠে।

অবনী অসহায় গলায় বলল, মনে হয় আর বেশিদিন নেই! কেন যে ভগবান এত কষ্ট দিচ্ছে বুঝি না। কী তার লীলাখেলা বোঝা দায়।

কানুকুড়ো অন্যমনস্ক হয়ে গেল কমুহূর্ত, পরে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, ভগমান যা করে মঙ্গলের জন্য। জানো তো ভাই, কারোর পৌষমাস, কারোর সর্বনাশ। দেখ দিনে দিনে কি হয়?

এখনও ইলেকট্রিক আসে নি এ গাঁয়ে। ফলে পুরো হাসপাতাল ডুবে আছে অন্ধকারে। বাবলা গাছের মাথা থেকে উড়ে যায় কালপেঁচা। হাসপাতালের টানা লম্বা বারান্দায় দৌড়-ঝাঁপ খেলে চামচিকি। দিনের বেলায় ওরা যে কোথায় গা ঢাকা দিয়ে থাকে বোঝা যায় না। রাত হলে ওদের দাপাদাপি বাড়ে। ওদের ওড়াওড়ি কেমন ভৌতিক আর রহস্যময় মনে হয়।

ডিউটি রুমে খাতা সারছিলেন অতসী দিদিমণি। অবনীর পায়ের শব্দে তিনি মাথা তুলে তাকালেন। তারপর ঘাড় সোজা করে বড়ো দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালন। রাত সাড়ে আটটা। তার মানে আধঘণ্টা লেটে ডিউটি এসেছে অবনী। অতসী দিদিমণি এই লেট শব্দটাকে একদম সহ্য করতে পারেন না। নিজে আসেন কাঁটায় কাঁটায় আটটায়। তাকে দেখে ঘড়ি মেলানো যায়।

অবনী ব্যাগটা প্রতিদিনের মতো দরজার গোড়ায় ঠেস দিয়ে রাখল।

অতসী দিদিমণি অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, আজও আধঘণ্টা লেট করে এলে? নাইট ডিউটিতে লেট এলে আমার চিন্তা হয়। এত বড়ো হাসপাতালে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ভাবো তো–কোনো অঘটন ঘটে গেলে কি হবে?

অবনীর মুখে কোনো কথা নেই। দেরিতে এসে বড়ো মুখ করে কিছু বলা শোভা পায় না। এতে দিদিমণি আরও রেগে যাবেন। তার চাইতে চুপ করে থাকা ভালো।

দুটো হ্যারিকেন জ্বলছিল পাশাপাশি। তার একটা তুলে নিয়ে অবনী নিজেকে শুনিয়ে বলল, যাই, দরজাগুলো বন্ধ করে আসি।

হ্যারিকেনটা তুলে নিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল অবনী।

সদর দরজার কাছে এসে সে দেখল তখনও হা-করে মড়িঘরের দিকে তাকিয়ে আছে কানুকুড়ো, তার বয়স্ক চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে অন্ধকারে। অন্ধকারে মড়িঘরের দিকে তাকিয়ে কি দেখছে সে? মানুষের শেষ পরিণতিই মড়ার ঘর। দার্শনিক ভাবনায় হঠাৎ বুঝি আপ্লুত হল কানুকুড়ো। অবনী তার কাছে গিয়ে আলতো করে ঘাড়ের উপর হাত রাখল, বড়দা, চলো গো। রাত মিলা হল। আমি দরজা বন্ধ করব।

.

যেন আকাশ থেকে পড়ল কানুকুড়ো। অবনীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে নিমেষে ভেঙে পড়ল ঝাঁকুনি দেওয়া কান্নায়, মন ভালো নেই, মন ভালো নেই গোয় আমার মনের যে কী হলো! মনে হচ্ছে আমার আর বেশিদিন নেই, মরে যাবো। মন বড়ো কু গাইছে। আজ আমার কী হল গো…শুধু ওপরওলা জানে। যত কথা বলে তার শতগুণ কান্না এসে ঠোকরায় তার গলা। কিসের দুর্ভাবনায় দুলে ওঠে তার শরীর। কাঁদতে কাঁদতে নাকের জল-চেখের জলে একাকার হয়ে যায় সে, বার্ধক্যজনিত ভাঙা স্বরের কল্যাণে তাকে মোটেও চিনতে পারে না অবনী। সে শুধু গায়ে হাত রেখে সান্ত্বনার গলায় বলে, চুপ করো। মাথার উপর তিনি আছেন। সব ঠিক করে দেবেন। ভেবো না তো।

–যা ঠিক হবার নয়, তা কি করে ঠিক হবে?

বিছানায় ফিরে এসে আক্ষেপে মাথার চুল ছেড়ে কানুকুড়ো। অতসী দিদিমণি এসে বলে গিয়েছেন, জিনিসপত্তর সব গুছিয়ে রেখো। কাল তোমার ছুটি হয়ে যাবে। ডাক্তারবাবু লিখে দিয়ে গিয়েছেন।

কথাটা শোনার পর থেকে মাথাটা ঠিকঠাক কাজ করছে না কানুকুড়োর। আর একটা দিন ডাক্তারবাবুর হাতে-পায়ে ধরে থাকতে পারলে ভালো হত। যাওয়ার আগে আর একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে সে। ভাগ্যে থাকলে হবে নাহলে পগার পার হয়ে যাবে।

রাত যত বাড়ে, ভয় তত থাবা বসায় বুকের পাঁজরায়। লোহার খাটে কুঁকড়ে মুড়ে শুয়ে থাকে কানুকুড়ো। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ ঝরে পড়ে। তার ব্যথা-বেদনা সব ভালো হয়ে গেছে অনেকদিন হল। অনেকদিন আগেই তার ছুটি হয়ে যাবার কথা। কিন্তু ছুটি হলে সে মরে যাবে। খাবে কি? এখানে টাইমে খাবার। চা থেকে পাউরুটি সব টাইমে দেয়। ঘরে ছেলের বউ ফিরেও তাকায় না। মুখ ঝামটায়। চাপা গলায় বলে, মুনিষ খেটে খাও গো যাও। যদি মুনিষ খাটতে না পারো তো ভিক্ষে করে খাও। আর তা যদি না পারো তো ভাড়া দিচ্ছি দেবগ্রাম স্টেশনে চলে যাও। ওখানে কৌটো নাড়িয়ে ভিক্ষে কর। দেখবা–সারাদিনের পেটের ভাতের যোগাড় হয়ে যাবে।

জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। কানুকুড়ো আবার দার্শনিকের মতো বিড়বিড়িয়ে ওঠে। তার সুখে থাকা কেউ সহ্য করতে পারে না। সবার মাথায় যেন বজ্র পড়ে তার হাসিখুশি চেহারা দেখলে। কেন কি করেছে সে? কার পাকা ধানে মই দিয়েছে?

মনে মনে সে ভাবল-কাল যেন ডাক্তারবাবু না আসে সকালে। হে ভগবান, কাল থেকে ডাক্তারবাবুর যেন পাতলা পায়খানা হয়। ডাক্তারবাবু যেন কদিন বিছানা ছেড়ে না উঠতে পারে। ডাক্তারবাবু না এলে তাকে আর কেউ ছুটির কথা বলবে না। অন্তত আর কটা দিন সে এখানে কাটিয়ে দিতে পারবে। এরপর সে ঘরের সবাইকে মানা করে দেবে হাসপাতালে আসতে। বুড়িটা রোজ দু-বেলা আসে, এসে খোঁজখবর নিয়ে যায়। তাকে মানা করতে বুক ভেঙে যাবে তবু নিজের স্বার্থের কথা ভেবে কথাটা তার মুখের উপর বলতে হবে। বাড়ির লোকজনদের দেখলে ডাক্তারবাবুর মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে, আর অনিবার্যভাবে মনে পড়ে যাবে বুড়োর কথা। তার চেয়ে কেউ না এলেই সব দিক থেকে মঙ্গল। কোমরে চোট না লেগে যদি পুরো শিরদাঁড়াটা তার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত তাহলে বুঝি সব চাইতে খুশি হত সে নিজে। অল্প আঘাত স্বল্পদিনে সারে। আঘাত জোর হলে কে তাকে খেদাত হাসপাতাল থেকে?

অবনী দরজা লাগিয়ে ফিরে এসেছে ডিউটি রুমে। চেয়ারে থাকলে অতসী দিদিমণি তাকে বেশি পাত্তা দেন না। একটু দূরত্ব রেখে কথা বলেন। তবু অতসী দিদিমণির ব্যবহারে অখুশি নয় অবনী। জামার পকেট থেকে একটা মোড়ান পোস্টকার্ড বের করে বলে, দিদি, দেশ-গাঁয়ে একটা চিঠি লিখে দিতে হবে। অনেকদিন চিঠি দেওয়া হয়নি।

কার কাছে লিখেবে? অতসী দিদিমণি চিঠি লেখার সময় চশমাটা নাকের উপর ঝুলিয়ে নেন। চশমা পরলে তাকে হাই-ইস্কুলের দিদিমণির মতো লাগে।

-বড়দার কাছে চিঠি দিতে হবে। ধান কাটা শেষ হয়েছে। আগাম না জনিয়ে দিলে এবছরও ভাগ পাব না। অবনী টুল সরিয়ে দিদিমণির কাছে সরে এল, আপনি তো জানেন দিদি, প্রতিবছর ওরা আমাকে কত ঠাকায়। দেশে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসি আমি। ফসল ভালো হলেও বড়দা আমাকে ফসলের ভাগ দেয় না। ওদের যে এত কিসের অভাব বুঝি না।

অতসী দিদিমণি চুপচাপ শোনেন, এ ব্যাপারে তাঁর কোনো মন্তব্য করা উচিত হবে না। দাদা-ভাইয়ের ব্যাপার। রাগারাগি, মান-অভিমান থাকলেও একটা আত্মীয়তার আলো আছে এই সব সম্বন্ধের মধ্যে।

পোস্টকার্ডটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলেন তিনি, চিঠি লেখার আগে ঠিকানাটা যত্ন নিয়ে লিখলেন লাল কালির কলমে। বেশ গোটা গোটা পরিষ্কার লেখা। হ্যারিকেনের আলোয় জ্বলজ্বল করছে লাল রঙের লেখাগুলো। পোস্টকার্ডটা পুরো ভরে দিলেন তিনি। যা লিখেছেন তা পড়ে শোনালেন একবার। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক আছে তো, অবনী? আর কিছু জুড়তে হলে বলো লিখে দিচ্ছি।

-আপনার লেখার উপর কারোর কোনো কলম চলবে না দিদি, অবনী মুখ ভরিয়ে প্রসন্ন হাসল, এ তো লেখা নয় উকিলের চিঠি। দেখি এবার দাদা কি জবাব দেয়। এক মাসের মধ্যে উত্তর না পেলে আমি ছুটি নিয়ে দেশে চলে যাব। দেখি এবার কেমন করে ফসলের ভাগ না দিয়ে থাকতে পারে।

ডিউটি রুমের বাইরে পেঁচাটা ডেকে ওঠে কর্কশ স্বরে। লাঠি নিয়ে খেজুর গাছের ঠিলি পাহারা দেয় গিয়াস। তার গলার স্বর বাতাস ভেদ করে অবনীর কানে ধাক্কা মারে। গিয়াসের জন্য অবনীর মনটা বিচলিত হয়ে ওঠে। অমন ভালো মানুষটার সঙ্গে বিপথগামী নাফিজা ভালো ব্যবহার করে না। প্রায়ই কথায় কথায় দুঃখ দেয়। কোলের ছেলেটাকেও সে খেয়াল রাখে না। খেলতে খেলতে কাচের গুলি গিলে ফেলেছিল ছেলেটা। ডাক্তারবাবু বঙ্কষ্টে তা বের করেন। তবু নাফিজার ব্যবহারে কোনো অনুশোচনা নেই। সে বুঁদ হয়ে আছে মকবুলের প্রেমে। সব জেনে বুঝে ঝিম ধরে আছে গিয়াস। আল্লা ছাড়া তাকে দেখার আর কেউ নেই। গুড় জ্বাল দিতে গিয়ে পোড়ের সামনে ঝিম ধরে দুলতে থাকে গিয়াস। অবনী বহুবার তাকে মানা করেছে। সাবধান করে বলেছে, রাতজাগা শরীর নিয়ে অমন পোড়ের কাছে চুলো না। বিপদ কখন ঘটে যাবে কেউ বলতে পারে না।

–আমার কিছু হবে না, দাদা। আমি দোজকের কীট। আমাকে কেউ ছোঁবে না।

রাত পাহারার ডাকেও বুঝি এই অভিমান মিশে আছে গিয়াসের। অবনীর ঘুম আসছিল না, অস্বস্তিতে সে এপাশ ওপাশ করে। সারাটা দিন তার চিন্তাভাবনার বিরাম নেই। এরফানের সঙ্গ তার কাছে সাধুসঙ্গ মনে হয়। মানুষটাকে মনে হয় যেন ফেরেস্তা। রাজমিস্ত্রির কাজ করলেও ওর মন রাজার মতো।

টানা বারান্দায় পাশ ফিরে শুলো অবনী। মশার ডানা কাঁপানো শব্দ তার কাছে ঘুমপাড়ানীর গানের মতো মনে হয় না আর। হাসপাতালে মশার বড়ো উৎপাত। আজ মশারী আনতে ভুলে গেছে সে। তাছাড়া দিদিমণি মশারী টাঙালে রাগারাগি করেন। বলেন, কেউ এসে গেলে চাকরিটা যাবে তোমার। অন-ডিউটিতে মশারী টাঙিয়ে ঘুমাতে তোমার লজ্জা লাগবে না? রুগীরা দেখলেই বা কি জবাব দেবে?

সব বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে অবনী। পেটের দায় মহা দায়। তাকে তো অস্বীকার করা যায় না। আবার ঘুমও চাই। ঘুম না হলে শরীর ভাঙে। থানার পেটা ঘড়িটা ঢং-ঢং করে রাত বাড়ার জানান দিল। স্তব্ধতা ভেঙে খান খান হল ক মুহূর্ত। ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে বাইরে থেকে। একটা কুকুর ডাকতে-ডাকতে চলে গেল। এই হিম ঝরা রাতে সামান্য শব্দ যেন হুলু সুলু বাধিয়ে দেয় কানের ভেতর। বাথরুমে এসে চোখে-মুখে জলের ছিটে দিতে গিয়ে অবনী শুনতে পায় সেই কাতর আর্তনাদ, জল, জল। মরে গেলাম গো…!

আওয়াজটা চেনা। তবু এই মুহূর্তে মনে হয় অচেনা এই স্বর। একটা ভৌতিক আবহের পরিমণ্ডল তৈরি হয় এই স্বরে। গায়ের নোম চাগিয়ে ওঠে অবনীর। তবু সে কান পেতে শোনে, জল, একটু জল…! মরে গেলাম গো-ও-ও-ও! ভয়ে বাথরুম থেকে ছুটে সে চলে যায় ডিউটি রুমে। একটা ছায়া তার পেছন পেছন আসে। অবনী তাকিয়ে দেখে কানুকুড়ো। দাঁত বের করে খি-খি করে হাসছে। এ হাসি যেন মানুষের নয়, প্রেতাত্মার। ভয়ে গলা কেঁপে ওঠে অবনীর, তোমার আবার কি হল, খ্যাখ্যা করে হাসছো যে!

–হাসি পায়, হাসি ঠেকাতে পারি না। টেনে টেনে জবাব দেয় কানুকুড়ো।

–এত বড়ো রাত, ঘুমোও। তোমার কি ঘুম আসে না, দাদা?

–ঘুম আসে না, ভাইরে! কপালে হাত দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকে কানুকুড়ো।

তার এই ভঙ্গি দেখে আরও বিরক্ত হয় অবনী, ঘুম যখন আসছে না, তখন ঘুমের বড়ি চেয়ে নাও দিদিমণির কাছ থেকে। একটায় ঘুম না এলে দুটো খাও। তবু তুমি ঘুমোও। তোমাকে আর দেখতে ভালো লাগছে না রাতকালে।

-গরীবকে দেখতে কারোরই ভালো লাগে না, ভাই। কানুকুড়ো গলায় দুঃখ-ঝরিয়ে বলল, গরীবের মরে যাওয়া ভালো। বিশেষ করে বয়স হলে বেশিদিন বাঁচা ভালো নয়। কে তারে খেতে দেবে, পরতে দেবে?

রামায়ণ থামাও। ধমক দিয়ে ডিউটি-রুমে ঢুকে গেল অবনী।

টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন অতসী দিদিমণি। পায়ের শব্দে চোখ মেলে তাকিয়েছেন তিনি, কেমন ঘুমজড়ানো তন্দ্রামাখানো চোখ-মুখ। তিনি স্বাভাবিক হওয়ার আগেই অবনী হড়বড় করে বলল, দিদি, মনে হচ্ছে বসন্ত ওয়ার্ডের বউটার অবস্থা খুব খারাপ।

-কী করে বুঝলে? পালটা প্রশ্ন করলেন অতসী দিদিমণি, হ্যারিকেনের বাতি উসকে তিনি যেন কিছু খুঁজছিলেন।

অবনী বলল, শুনতে পাচ্ছেন না জল, জল আওয়াজ।

এবার জানলা খুলে বাতাসে কান পাতলেন অতসী দিদিমণি। হুড়মুড়িয়ে শব্দের সঙ্গে ঢুকে এল হিম। শব্দগুলো হাড় কাঁপানো। ভয়ে অতসী দিদিমণির চোখ-মুখ শুকিয়ে গেল, একবার তো ওখানে মানবিকতার খাতিরে যাওয়া দরকার। তুমি কি বলো অবনী?

হ্যাঁ। ঘাড় নাড়ল অবনী, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। যা হবার হবে–আমি ভয় পাই না। বেশি কিছু হলে সঙ্গে কানুকুড়ো বুড়োকে নিয়ে নেব।

-হ্যাঁ, তাই চলো। দিদিমনি উঠে দাঁড়ালেন।

কানুকুড়ো বুড়োকে আর ডাকতে হল না, সে নিজেই এসে হাজির। হাতজোড় করে বলল, আমি যতক্ষণ আছি ভয় পাবেন নি গো মা জননী। ভূত-প্রেত সব আমার কাছে মশা-মাছির সমান। আমি থাকতে ওদের বাপেরও সাধ্যি নেই কিছু করার।

–তুমি চুপ করবে! ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল অবনী।

অতসী দিদিমণির গা হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপছিল। মনে ভয় ঢুকেছে তাঁর। সেই ভয়ের কথা তিনি কাউকে মুখ ফুটিয়ে বলতে পারছেন না। এ এক অসহনীয় যন্ত্রণা।

হিমঝরা রাতের পৃথিবী পড়ে আছে মরা মাছের মতো। একটা নেড়ি কুকুর ঘেউঘেউ ডাকতে ডাকতে চলে গেল পালপাড়ার দিকে। মেয়েলি কণ্ঠের চিৎকারটা কাছে যেতেই তীক্ষ্ণ হয়ে কানে বিধল ওদের। এর মধ্যে কোনোমতে ওষুধ খাইয়ে ফিরে এলেই দায়িত্ব শেষ। এই কাজটুকুই কত বড় কাজ হয়ে ধরা পড়ছে এখন।

অবনী যেন দিদিমণির মনোভাব বুঝতে পারল। সে তাকে আশ্বস্ত করবার জন্য বলল, আপনাকে ভেতরে ঢুকতে হবে না দিদি। আপনি এখানে পঁড়ান। জল আর ওষুধগুলো আমার হাতে দিন। আমি ঠিক খাইয়ে দেব।

ওষুধ আর জলের গ্লাসটা অবনীর হাতে দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন অতসী দিদিমণি।

-তাড়াতাড়ি এসো। তোমার দেরী হলে আমার চিন্তা হবে। ঢোঁক গিললেন দিদিমণি। মাজা পড়া বয়স্ক কানুকুড়ো তাকে অভয় দিয়ে বলল, মোটে ভয় পাবেন নি। আমি আছি। আমি থাকতে ভয় কিসের মা জননী। বলেছি না ভূত প্রেত সব আমার তাকে গোঁজা।

অবনী ভয়হীন চিত্তে মাথা উঁচু করে ঢুকে গেল আইসোলেশন ওয়ার্ডে। হ্যারিকেন নিভে গেছে তেল নেই বলে। সেই ভৌতিক আঁধারে দেশলাই জ্বেলে হ্যারিকেনটা জ্বালাবার চেষ্টা করল সে। পারল না কোনোমতে। হ্যারিকেনটা মেঝের উপর নামিয়ে রাখল সে। লালচে আলোয় দেখতে চাইল বউটার মুখখানা। ফর্সা ধবধবে মুখখানা গুটি বসন্তের প্রকোপে বাসি লুচির মতো জড়িয়ে আছে। তার ভেতরে জ্বলজ্বল করছে শেষ যাত্রার দৃষ্টি। কী যেন বলতে চায় ওই চোখদুটো। অবনী সাত-পাঁচ ভেবে বসে পড়ল বউটার মাথার কাছে। মিহি গলায় শুধোল, কিছু বলবে? খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার?

বউটার মুখে কোনো উত্তর নেই, শুধু গড়িয়ে নামছে চোখের জল। ফুলে-ফুলে উঠছে বসন্ত খুবনো ঘেয়ো ঠোঁট দুটো।

অবনী ঝুঁকে পড়ে বলল, মুখ ফাঁক করো। আমি তোমার জন্য ওষুধ এনেছি। ভালো হয়ে যাবে। পাখির বাচ্চার মতো মুখটা ফাঁক করল বউটা। অবনী প্রথমে ওষুধ না দিয়ে এক চামচ জল দিল তার মুখে। জলটুকু ঢক করে গেলার শব্দ হল। দ্বিতীয়বার আর এক চামচ জল দিতে গেলেই জলটা মুখে নিয়ে কস বেয়ে গড়িয়ে দিল বউটা। নিমেষে ঝাঁকুনি দেওয়া তার শরীরটা বন্ধন ছিন্ন করতে চাইল মাটির। এই প্রথম অবনীর সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল ভয়ে। বিপদ বুঝতে পেরে সে পাগলের মতো ছুটে এল বাইরে।

–দিদিমণি, ভেতরে চলুন। খিচুনি উঠেছে। অবস্থা ভালো বুঝছি নে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘরের ভেতরে ব্যস্ত পায়ে ঢুকে এলেন অতসী দিদিমণি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি দেখলেন বউটার শরীর ধনুকের মতো ঠেলে উঠল উপরে, তারপর ঝড়ে ভেঙে যাওয়া কাঠটগরের ডালের মতো লুটিয়ে পড়ল মাটির বিছানায়।

চোখ ভরে জল এল অতসী দিদিমণির, অবনীকে শুনিয়ে বললেন, চলে গেল! আহা, বহু কষ্ট পেয়ে মরল বউটা। ওর আত্মার যেন সক্ষতি হয়।

অবনীর মুখে টুঁ শব্দটি নেই। সে দিদিমণির নির্দেশে ছুটল ডাক্তারবাবুকে খবরটা দিতে।

গায়ে সোয়েটার চাপিয়ে ডাক্তারবাবু এলেন পনের মিনিট পরে। সবকিছু দেখেশুনে তিনি বললেন, অবনী, এই সাদা চাদরটা দিয়ে ওর মুখটা ঢেকে দাও যাওয়ার আগে দরজার হুকটা লাগিয়ে দিও। অন্তত বাহাত্তর ঘণ্টা ডেড-বডি রাখতে হবে। এখানে বরফের কোনো অ্যারেঞ্জমেন্ট নেই। দেখি শেষ পর্যন্ত কী করতে পারি। বেওয়ারিশ লাশের এই এক ঝামেলা…।

ডাক্তারবাবু আসার সংবাদ পেয়ে ওখান থেকে সটকে গিয়েছে কানুকুড়ো। একটা খেজুরগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে জুলজুল চোখে সে খুঁজছিল বেঁচে থাকার উপায়।

.

৪২.

ধোঁয়া ওঠা আগুনের দিকে তাকিয়ে বাবলু বলল, আজ আর তোমার কাজে গিয়ে লাভ নেই, আব্বা। ড্রাইভারের হাতে মা চিঠি পাঠিয়েছে। তার কাছে কোনো পয়সা-কড়ি নেই। তুমি গিয়ে তার খায় খরচের ব্যবস্থা করে এসো। আর যদি কোনো কারণে তুমি না যেতে পারো তাহলে আমাকে দাও, আমি কেনগর গিয়ে সব ব্যবস্থা করে আসি।

আগুনের দিকে হাত বাড়িয়ে সেঁক নিচ্ছিল এরফান। কাল রাতে ছোটবিবির স্বপ্ন দেখেছে সে। কুয়োয় পড়ে গিয়েছে নুরি আর উঠতে পারছে না। অন্ধকার কুয়োয় দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। শুধু বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদ। কেউ নেই। শুধু বাবলু পাঁড়িয়ে আছে কুয়োপাড়ে। হা-হা হাসিতে বুক ভরিয়ে সে বলছে, যেমন কর্ম তেমন ফল। অন্যের সুখ কেড়ে নিলে নিজের কপালে আগুন ধরে।

বাবলুর চোখ থেকে আগুনের ফুলকি ছুটে যাচ্ছে নুরির দিকে, সেই ফুলকি খাক করে দিতে চায় নুরির সাজানো শরীর।

লাট্টুর ঠেলায় ঘুম ভেঙে যায় এরফানের, কী আবোল তাবোল বকছ গো বড়ভাই। উঠে বসে গিলাস খানিক পানি খাও। শোওয়ার পর বিড়বিড়ানী স্বভাব তোমার আর গেল না! স্বপ্ন ভেঙে গেছে কিন্তু তার রেশ ছড়িয়ে ছিল এরফানের চোখে-মুখে, আতঙ্কে সে নীল হয়ে শুধিয়েছিল, বাবলু কোথায়?

–ওই তো শুয়ে আছে।

–ওঃ। বুকে হাত দিয়ে আশ্বস্ত হয়েছিল এরফান। বাস্তবিক নুরির চিন্তায় তার ভালো ঘুম হয় না। শাদী করার পর থেকে কদিনই বা সান্নিধ্য পেয়েছে বউটার। যদি কোনো উপায় থাকত তাহলে সাথে করে আনত নুরিকে এখানে। নতুন বউ, তার যে একা থাকতে কী ভীষণ কষ্ট হবে তা একমাত্র খোদাই জানে। এরফান এখানে এসেও যেন তার উষ্ণ সান্নিধ্য পেতে চায়। এসব ভাবনা দুর্বল করে তোলে তাকে। ভালোবাসা সোহাগ মানেই দুর্বলতা। এসব কাটিয়ে ওঠা এরফানের পক্ষে সহজ কাজ নয়। তার আবেগ যে কোনো যুবকের চাইতে বেশি। মন করে বাস ধরে চলে যেতে কৃষ্ণনগরে। রাত কাটিয়ে ফিরে এলে কে আর টের পাবে।

লাট্টু আর বাবলু দুজনে যেন দুই দারোয়ান। ওদের চিল চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সস্তা নয়।

আগুন থেকে হাত সরিয়ে বাবলু বলল, হাত-চিঠিতে মা লিখেছে, তার শরীর ভালো নেই। ডাক্তার দেখাতে হবে। হাতে টাকা পয়সা নেই।

এরফানের কানে অসহ্য লাগছিল বাবলুর ঘ্যানর ঘ্যানর। বিরক্ত হয়ে সে বলল, তোরও তো মা। তুইও তো যেতে পারিস। শুধু আমার কি একার দায়িত্ব?

এবার আগুনে ঘি ঢালার মতো জ্বলে উঠল বাবলু, এখন নতুন বিবি পেয়ে পুরনা বিবির কাছে যেতে শরম লাগছে বুঝি? তোমার মতলবটা আমার আর বুঝতে বাকি নেই।

ছোট ছেলে ছোট ছেলের মতো থাক, মেলা ফড়ড় ফড়ড় করিস নে। তেতে উঠল এরফান, আমার এই দু-চোখ দুজনকে সমানভাবে দেখে। অধর্ম আমার দ্বারা হয় না।

-হ্যাঁ, তা যা বলেছ। বাবলু গালে হাত বুলিয়ে নিষ্ঠুর চোখে তাকাল, সেইজন্য আসার সময় ছোটবিবিকে দিলে আড়াইশো টাকা। আর খয়রা বিবির বেলায় মাত্র পঞ্চাশ টাকা। বলি পঞ্চাশ টাকায় কি হয় একজনের? কদিনই বা খেতে পারে? সে-কথা শুনে আঁতকে উঠল এরফান, ঢোঁক গিলে বলল, তুই যা জানিস সেটা সঠিক নয়। এসব কথা তোকে কে বলেছে?

কে আবার বলবে! যে বলেছে–সে তোমার পাশে বসে আগুন সেঁকছে। বাবলু তির্যক দৃষ্টি মেলে লাট্টুর দিকে তাকাল; বিশ্বেস না হলে পাশে বসে আছে শুধিয়ে নাও। সে তো আর মিথ্যে কথা বলবে না। সে তোমার এক মায়ের পেটের ভাই। বিপদ বুঝে চুপ করে গেল এরফান। বাবলু গলা চড়িয়ে বলল, আজই আটটার বাসে চলে যাও। বাজার হাট করে দিয়ে কাল চলে এসো। আমরা এদিকটা সামলে নেব।

-আজ কোনোমতেই যাওয়া যাবে না। এরফান জোর গলায় বলল, কাজ ফেলে আমি যাই কী করে। ঠিকেদারবাবু হঠাৎ এসে গেলে আমাকে বেইমান ভাববে। তার চোখে আমি ছোট হতে পারব না। আমি যদি যাই তো রবিবারে যাব, তার আগে কোনোভাবে সম্ভব নয়।

–ঠিক আছে তাহলে টাকা পয়সা আমাকে বুঝিয়ে দাও। আমি গিয়ে দিয়ে আসি। বাবলু বলল, রবিবারের অনেক দেরি। ততদিন কি উপোষ দেবে খয়রা বিবি?

–আমি তার কি জানি। এরফানের কথায় তেড়ে গেল বাবলু, তুমি জানবে না তো কি পাড়ার মোড়ল জানবে?

প্রায় হাতাহাতি হবার উপক্রম, লাট্টু থামিয়ে দিল ওদের, তোমরা বাপবেটায় থামবে! বিদেশ বিভূঁইয়ে মান-সম্মান না খুয়ালে দেখছি তোমাদের ভাত হজম হবে না।

দু-জনকে দুহাত দিয়ে সরিয়ে দিল লাট্টু।

হাঁপাতে হাঁপাতে এরফান বলল, কারোর চোখ রাঙানির আমি এত ধার ধারি না। যাকে জন্ম দিয়েছি তার এত গলা আমি সহ্য করব না।

–তাহলে ওকে টাকা দিয়ে দাও, ল্যাটা চুকে যাক। লাট্টু বলল।

এরফান অসহায় গলায় বলল, টাকা থাকলে তো দেব! গেল হপ্তায় জোগালদারদের হপ্তা দিতে পারিনি। ঠিকেদার বাবু যা টাকা দিয়েছিল–তা প্রায় শেষের দিকে। যতদিন তিনি না আসেন আমাকে তো দল চালাতে হবে।

বাবলু ঠোঁট কামড়ে আগুন উগলান চোখে তাকাল, তাহলে দুজনকে সমান ভাগে টাকা দিয়ে আসতে পারতে। তাহলে কারোর কিছু বলার থাকত না। তোমার একপক্ষ বিচার দেখে আমার মাথায় বিছে কামড়ে দিয়েছে।

সকালের রাগটা আবার উঠে এল দুপুরবেলায়।

পুকুরে ডুব দিয়ে এসে বাবলু দেখল তখনও ভাত ফুটছে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে। দুটোর আগে খাওয়া না হলে বাস বেরিয়ে যাবে কৃষ্ণনগরের। এরফান বলেছিল, সে যেখান থেকে হোক টাকা ধার করে এনে দেবে।

দুটোর বাস চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল। এরফান ফিরে এল শূন্য হাতে। হতাশ হয়ে বলল, ভেবেছিলাম ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে ধার এনে দেব। এতক্ষণ বসে বসে ফিরে এলাম। ডাক্তারবাবু কোথায় নেমতন্ন খেতে চলে গিয়েছে। ফিরতে অনেক দেরি হবে। ফুটন্ত ভাতের মতো ভেতরে ভেতরে ফুটছিল অস্থির বাবলু। মা তার নয়নের মণি। মায়ের অমর্যাদা সে কোনো কালে সহ্য করতে পারে না। এরফানের ব্যবহারে সে তিতিবিরক্ত। নিজের অসহিষ্ণুতা বোঝাবার জন্য সে হুঙ্কার ছেড়ে ছুটে গেল ভাতের হাঁড়ির দিকে, চিৎকার করে বলল, আমার যখন যাওয়া হল না তখন এ ভাত আমি কাউকেই খেতে দেব না।

একটা জ্বলন্ত কাঠের টুকরো উনুন থেকে বের করে সে ছুঁড়ে মারল ভাতের হাঁড়িকে লক্ষ্য করে। চোখের নিমেষে চুলা থেকে উল্টে গেল ভাতের হাঁড়ি, দাউ দাউ আগুনে লুটিয়ে পড়ল ফেন সমেত সাদা ভাত।

সেই ভাতের দিকে হাঁ-করে চেয়ে রইল এরফান। এই প্রথম সে টের পেল আগুনও রাগের কাছে নিভে যায়।

লাট্টুর চোখের সামনে সবকিছু যেন ছায়াছবির মতো ঘটে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় সে মূক, বিহ্বল। ধিকিধিকি জ্বলা মনের ক্ষোভ আগুন আজ প্রতিকুলতার হাওয়া পেয়ে দাউ দাউ জ্বলে উঠেছে–এই আগুন সহজে প্রতিরোধ করা যাবে না। এর যে শেষ কোথায় তাও জানে না সে। বাবলুকে সে অনেক বোঝনোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু কিছুতেই বুঝবে না বাবলু। নুরির নামটাকে সে সহ্য করতে পারে না। ওই একটি মেয়ে তাদের সুখের সংসারে ভাঙন ধরিয়েছে। তাই নুরিকে সে ছেড়ে কথা বলবে না, সুযোগে পেলে সে এর হিসাব সুদে-আসলে বুঝে নেবে।

অনেকক্ষণ পরে লাট্টু বলল, বাপের উপর রাগ করে ভাতের হাঁড়ি উল্টে দেওয়া তোর উচিত কাজ হয়নি।

বাবলু ফুঁসে উঠল, অমন চরিত্রহীন বাপের ভাত আমি কাউকে খেতে দেব না।

এ তোর রাগের কথা। লাট্টু বোঝাবার চেষ্টা করল, অত মাথা গরম করলে চলবে? সংসারে থাকতে গেলে সব কিছুকে মানিয়ে নিতে হবে। না হলে পদে পদে ঠকবি। রক্তের তেজ দেখিয়ে জীবনের হিসাব মেলে না-বুঝলি।

–যোগ-বিয়োগ যা করার তোমরা করো। বাবলু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল, আমি চললাম।

–কোথায় যাবি, এখন তো বাস নেই?

-বাস না থাকুক, দুটো পা তো আছে। বাবলু হারবার ছেলে নয়, আমি হেঁটেই দেবগ্রাম চলে যাব। আর আসব না।

-পাগলামী করিস নে। লাট্টু ছুটে গিয়ে তার পথ আটকে দাঁড়াল।

 হাত ছাড়িয়ে নিল বাবলু। রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে বলল, মার অসুখ। তার কাছে খরচাপাতি কিছু নেই। আমি না গেলে সে না খেয়ে শুকিয়ে মরবে। বাপ দেখল না বলে ছেলে যে মুখ ঘুরিয়ে নেবে এমন তো হয় না। আমাকে যেতেই হবে।

ঘাড়ে ঝোলানো একটা ব্যাগ নিয়ে বাবলু বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার পথের দিকে শুকনো চোখে তাকিয়ে থাকল এরফান।

রোদ পড়তেই সুফল ওঝা এল ভূত খেদাতে।

তার কাঁধের উপর দিয়ে ঝুলছিল লম্বা একটা কাপড়ের থলি। তাতে রাজ্যের শেকড়-বাকড় ভরা।

সুফল ওঝার কপালে লম্বা সিঁদুরের টিপ। ওটাকে টিপ না বলে তিলক বলা ভালো। সে হাসপাতালের গেট দিয়ে নেমে সটান চলে গেল আউটডোরের দিকে। তার হাঁটা-চলা রাজার মতো।

হাসপাতালে ভূত ঘুরছে–এই খবরটা তার কানেও গিয়েছে।

বউটা গত হবার পর থেকে লম্বা কথার গুজব হাজার ডালপালা ছড়িয়েছে লোকের মুখে মুখে। রাতকালে হাসপাতালের ভেতর জল জল করে চিল্লিয়ে ওঠে সেই বউটা। তার সেই কান্না অনেকেই শুনেছে। ভয়ে হাসপাতালের দিকে এখন আর কেউ একা যাওয়া-আসার সাহস দেখায় না। ফিমেল ওয়ার্ডের রুগীরা সব পালিয়েছে বেড ছেড়ে।

তিন দিন হয়ে গেল বউটার লাশ পড়ে আছে মড়ার ঘরে। বেওয়ারিশ লাশ, কবর না দিলে দুর্গন্ধ যাবে না। কিন্তু কবরটা দেবে কে? গাঁয়ের কোনো মানুষই সাহস করে এগিয়ে আসছে না একাজে। ফলে দুর্গন্ধে বিষিয়ে উঠেছে বাতাস। শুধু ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে এই তীব্র দুর্গন্ধ রোখা যাবে না।

বাতাস সর্বত্রগামী।

সারা হাসপাতাল চত্বরে ভয়ের একটা মেঘ ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো ভয়ংকর আকার ধারণ করছে মুখে মুখে। যে যেমন পারছে গুজবের পালক গুঁজে দিচ্ছে আতঙ্কভরা বাতাসে।

তিন দিনের পচা লাশ ছুঁতে চায় না কেউ। তবু অবনী আগ বাড়িয়ে বলল, সঙ্গে আর একজন কাউকে পেলে আমিই সত্ত্বার করে দিতাম। সকার হয়ে গেলে ভয়ের আর কোনো কারণ থাকত না।

ডাক্তারবাবু দিদিমণিরা সব শুনলেন যে যার মতো। হাসপাতালে এমন ঘটনা এই প্রথম। ভয়ের যতই আলোচনা হোক না কেন-ফুঙ্কারে সব উড়িয়ে দেন ডাক্তারবাবু। জোর গলায় তিনি বলেন, আমি ওসব ভূত-ফুত মানিনে। ভূত বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। ওসব দুর্বল মনের গল্পকথা।

দিদিমণিরা দু-দিকেই আছেন। তাদের মুখে হা-না কোনো জবাব নেই। এর মধ্যে অতসী দিদিমণি বলেন, একটা মেয়েলী গলার স্বর আমি বহুবার শুনেছি। কান্নাটা মেল-ওয়ার্ডের কাছ থেকে আসে। সারা হাসাপাতালের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। এগুলো তো মিথ্যে নয়। সব নিজের কানে শোেনা।

-সব মানলাম কিন্তু… ডাক্তারবাবু বিরক্তিতে চুপ করে গেলেন। দশ চক্রে ভগবান ভূত-এর বেশি কিছু তিনি জানেন না।

থানায় খবর পাঠিয়েছেন তিনি। থানা থেকে পুলিশ এসেছে হাসপাতালে। দু-জন পুলিশ রাতে ডিউটি দেয় এখন। তারাও শুনেছে এই আর্তনাদ। ভয়ে কাঠ হয়ে আছে তারা।

পঞ্চায়েত প্রধান হাসপাতালে ঘুরে গিয়েছেন বার তিনেক। সব শুনে তার কপালেও ভাঁজ পড়েছে চিন্তার। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে সদর থেকে জমাদার আসবে লাশ পুঁততে। তাকে সাহায্য করবে অবনী। মাটির তলায় শরীর ঢেকে গেলে ভয়ও চাপা পড়ে যাবে। এই আশায় সময় পার করছেন ডাক্তারবাবু। যত তাড়াতাড়ি এই আলোচনা বন্ধ হয়–ততই মঙ্গল।

থানার ওয়ারলেসে সদরে খবর পাঠিয়েছেন ডাক্তারবাবু। থানার ওসি তার পাশে আছেন। তিনি সাহস দিয়ে বলেছেন, আমি আপনার সঙ্গে আছি। ভয় পাবেন না। কোনোরকম চাপের কাছে মাথা নত করবেন না। কোনো কিছু হলে আমাকে খবর পাঠাবেন। আমি ঠিক পৌঁছে যাবো।

অবনীর আগে আগে হাঁটছিল সুফল ওঝা। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাকে জামাই আদরে বসাল অবনী। খবরটা কানে যেতেই বিরক্তি প্রকাশ করলেন ডাক্তারবাবু, সুফল ওঝাকে আবার কে ধরে আনল? ওকে এখান থেকে চলে যেতে বলল। ওর এখানে কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের বিপদ আমারই সামলে নিতে পারব।

রসের কলসী পাহারা দিতে গিয়ে রাতের বেলায় ভূত দেখেছে গিয়াস। একটা বউ সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে বাঁকা খেজুরগাছের গোড়ায়। তার আঁচল উড়ছে কুয়াশায়। গিয়াসের সাথে চোখাচোখি হতেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল বউটা। আর ঠিক তারপরেই জ্ঞান হারিয়ে ঘাসে লুটিয়ে পড়েছিল গিয়াস। হিমজলের স্পর্শে অনেক পরে তার জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফেরার পরে সে আর বউটাকে দেখতে পায়নি। দেখতে না পেলেও ভয়টা তার মন জুড়ে রয়ে গেছে। এখনও সেই দৃশ্য মনে করে ভয়ে সে কেঁপে ওঠে। এসব কথা ডাক্তারবাবুকে সবিস্তারে বলতেই আবার একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ল তাঁর কণ্ঠস্বরে, নিজের ভয়ের কথা নিজের বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখো। লোক এমনিতে ক্ষেপে আছে। আর লোক ক্ষেপিয়ে লাভ নেই।

গিয়াস মুখ নিচু করে চলে গেছে নিজের কাজে। ভূত দেখার প্রসঙ্গটায় ইতি টেনেছে সে। সকাল আটটার বাসে কৃষ্ণনগর থেকে এল জয়কিষাণ আর দুলারী। ওদের আসার সংবাদ পেয়ে ঘর থেকে ছুটে এল অবনী। এ কয়দিন তারও ঝামেলার শেষ নেই। নানা জনে নানা কথা শোনাচ্ছে তাকে। যেন যত দায় তার।

হাঁপিয়ে ওঠা অবনী বলল, তোমরা এসে গিয়েছ–যাক বাঁচা গেল! এবার একটা ফয়সাল্লা হয়ে যাবে। হাসপাতালের মানুষগুলো এবার ভয়ের হাত থেকে বাঁচবে।

তিন কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে জয়কিষাণ তার লম্বা গোঁফে হাত বোলাচ্ছিল আয়েস করে। চা-দোকানের কাঠের বেঞ্চিটাতে পাশাপাশি বসেছিল ওরা। দুলারী জয়কিষাণের বউ। সে তার ছায়া সঙ্গী। সেও সদর হাসপাতালের ঝাড়ুদার। প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ লেগে আছে ওদের। চুলোচুলি হলেও কেউ কারোর সঙ্গ ছাড়ে না, ওরা যেন একে অপরের জন্য এ পৃথিবীতে এসেছে।

দুলারীর মাথা ভর্তি কোঁকড়ান চুল, পেঁপে রঙের ত্বকের সাথে সেই চুলের অদ্ভুত একটা মিল খেয়ে যায়। কাজলটানা ওর চোখ দুটো কালী ঠাকুরের মতো, দূর থেকে দেখলে চোখ আটকে যাবে মেয়েলী শরীরের আঠায়। ওর হাসিটা মিছরি দানার চেয়েও মিষ্টি, মেটে রঙের ঠোঁটে তা যেন সর্বক্ষণ লেপটে আছে। ছাপা শাড়িতে দুলারী রানীর মতো বসে আছে কাঠের বেঞ্চিতে। পাশে বসে মন দিয়ে ও কথা শুনছে ওদের। হাত ভর্তি রঙ্গিন কাচের চুড়ি নড়াচড়ায় রিনঝিন শব্দ তুলছে বাতাসে। চা-দোকানী হা করে তাকিয়ে আছে দুলারীর গর্বিত বুকের দিকে। অবনী পাশে বসে মেয়েলী শরীরের সুগন্ধ নাক ভরে টেনে নেয়। কালোর মধ্যে দুলারীর নাক চোখ মুখ তীক্ষ্ণ। ও যে শালিক নয়, ময়না–এটা সে বুঝতে পারে।

সেই কোন ভোরে ঘর ছেড়েছে ওরা। অত ভোরে শুধু চা-ছাড়া আর কোনোকিছু পেটে পড়েনি ওদের। দুলারী হাই তুলে তুড়ি মেরে হাত দুটো আকাশের দিকে তুলল, নাস্তাপানি কিছু হলে ভালো হত। এ দোকানী টোস্ট হবেক তোমার দোকানে। চা-দোকানী ঘাড় নাড়তেই দুলারী বলল, গোটা, পাউরুটি হাফ করে সেঁকে তিন জায়গায় দাও। আগে কিছু পেটে যাক– তারপর চা খাব।

জয়কিষাণ গোঁফ নাচিয়ে হেসে উঠল, সেই ভালো। খালি পেটে লাশ খালাস হয় না। পেটে ডেড-বডির গ্যাস ঢুকে গেলে উলটি হবে।

দুলারী চিমটি কেটে ইশারা করল জয়কিষাণকে, সব কথা সবখানে বলা কি ঠিক?

অবনী সায় দিল তার কথায়। চা আর টোস্ট খেয়ে বিড়ি ধরাল ওরা। অবনী জয়কিষাণকে একটা বিড়ি দিতেই অভিমানে ঠোঁট ফুলাল দুলারী, আমি কি দোষ করলাম গো কর্তা? এক যাত্রায় আমি কেন বাদ যাবো?

তার কথা বুঝতে পারল না অবনী, সে বিস্ফারিত চোখে জয়কিষাণের দিকে তাকাল। জয়কিষাণ অবনীকে ঠেলা মেরে বলল, আমার বউয়ের ভাগটা দিয়ে দাও। আমরা খাবো, ও কি তাকিয়ে দেখবে নাকি?

এর অর্থ দুলারীও ধূমপান করে। মেয়েমানুষকে সে বিড়ি খেতে এর আগে দেখেনি। মেয়েরা বিড়ি খেলে কেমন দেখতে লাগবে–এই কাল্পনিক ভাবনায় সে রোমাঞ্চিত হল। ক্ষমা চেয়ে নিয়ে অবনী বিড়ি এগিয়ে দিল দুলারীর দিকে; এই নাও, ধরাও। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে গো। আমি তো জানতাম না।

দুলারীর পুরুষ্ট ঠোঁটে হাসি ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে গেল, বিড়িতে টান দিয়ে সে বলল, নোংরা কাজে নেশা-ভাং না করলে চলে না। এসব কাজে মনটাকে একটু হালকা-ফুলকা রাখতে হয়। মন চাঙ্গা না হলে অপরের দুর্গন্ধ সাফ-সুতরো করা যায় না।

তিনজনে বিড়ি টানতে টানতে হাঁটছিল।

রাস্তার লোকে হাঁ করে দেখছিল ওদের। দুলারী আর জয়কিষাণের কোনো হৃক্ষেপ নেই ওসবে। সামান্য অস্বস্তিতে পথ হাঁটছিল অবনী। চেনা-জানা কেউ দেখে ফেললে মুশকিল। হাজার-গণ্ডা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। মানুষের মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ অনেক সময় বিরক্তির কারণ হয় অন্যের।

অবনী দ্রুত পায়ে কদবেলতলার পাশ দিয়ে মড়িঘরের কাছে চলে গেল। রোদে থৈ থৈ করছে চারপাশ। পিচরাস্তার ওপাশে বাঁশ ঝাড়ে একটা ঘুঘু এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে। সেই একটানা শব্দে ক্লান্তির আভাস ফুটে ওঠে। অবনী যাবতীয় ক্লান্তি মুছে ফেলে মুক্তি প্রার্থনা করছিল এই বিপদ থেকে। মাত্র তিনদিনেই বিষিয়ে উঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ। একটা বউ ঘুম কেড়ে নিয়েছে সবার। মরার আগেও বউটাকে ভয় করত সবাই। মরার পরে সেই ভয় চারগুণ ছাপিয়ে গিয়েছে। লাশ দেখে এসে হাত-পা ছড়িয়ে চারা আমগাছতলায় বসে পড়ল জয়কিষাণ। কপালের ঘাম মুছে সে বলল, এ যে পচে-গলে খতরনাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুৎ বাস মারছে বডি থেকে। এ বাসটাই খারাপ। নাকে ঢুকলে শরীলের তাগত হারিয়ে যাবে। যা কিছু করতে হবে মুখে গামছা বেঁধে করতে হবে। তবে সবার আগে গাড্ডা খোঁড়া দরকার। আর গাঁজার জন্য কোদাল ঝুড়ি গাঁইতির দরকার। আমরা তো এখানে খালি হাতে এসেছি। তা কর্তা, তোমাকে এসব যোগাড় যন্তর করে দিতে হবে।

অবনী সঙ্গে সঙ্গে বলল, ওসব নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না।

–তাহলে তো আর কথা নেই। জয়কিষাণ নড়েচড়ে বসল, তবে এসব কাজে নামার আগে গলা ভেজানো দরকার। দারু-পানি এখানে কোথায় মিলবেক? দেশী হলেই চলবে। অবনী হাসল, সবই পাওয়া যায় এ গাঁয়ে। শুধু টাকা থাকলেই হল। টাকা থাকলে এখানে বাঘের দুধও পাওয়া যাবে।

-তাহলে সবার আগে চলো ঐ কাজটা সেরে আসি। জয়কিষাণের কথায় অবনী খুশি হল, সেই ভালো। চলো তাহলে।

পাকা রাস্তা শেষ হলে বাঁশবাগানের ছায়ায় ঘেরা পথ। মাটির পথ কুলবেড়িয়া হয়ে সোজা চলে গিয়েছে পলাশী। বেশি দূর নয়, বাজার ছাড়িয়ে ক পা গেলেই বাঁশবাগানের ভেতর মাটির হাঁড়িগুলো যত্ন করে সাজানো। ওখানে দেশী মদ বিক্রির দোকানটা লোকচক্ষুর আড়ালে। বাঁশের বাতা দিয়ে বেঞ্চি বানিয়ে সাজিয়ে রেখেছে মালিক। দোকানদার থাকে একটা গুমটি দোকানের ভেতরে। পয়সা সঠিক পেলেই মদের বোতল এগিয়ে দেয় সে। নচেৎ ঝগড়াঝাটি হাতাহাতি লেগেই আছে। প্রায়ই পুলিশ আসে এখানে। হপ্তা নিয়ে চলে যায় থানায়।

জয়কিষাণ আর দুলারী বোতল কিনে একটা পিটুলি গাছের ছায়ায় গিয়ে বসল। সেদ্ধ ছোলা এখানে চাট হিসাবে পাওয়া যায়। তা ছাড়া চানাচুর ওদের সঙ্গে ছিল।

মদের বোতল হাতে নিয়ে জয়কিষাণ উশখুশ করছিল ছিপি খোলার জন্য। অবনী আসার পরে সে আর কালবিলম্ব করল না। নেশা করাটা তার কাছে জীবনের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। এ কাজে অযথা বিলম্ব সে পছন্দ করে না।

তিনটে কাচের গ্লাসে মদ ঢালল জয়কিষাণ।

অবনী প্রথম থেকেই মানা করল, এসব আমি ছুঁয়েও দেখিনি জীবনে। তোমরা প্রাণ ভরে খাও। আমি তোমাদের পাশে বসে দেখব। ওতেই আমার নেশা হয়ে যাবে। হায়-হায় করে উঠল জয়কিষাণ, গলায় আফসোস ফুটিয়ে বলল, তা কি হয় কর্তা। এক জায়গায় দু-রকম বিচার হয় না গো! খেলে তিনজনে মিলে খাবো। নাহলে খাবো না টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেব।

অবুঝ হয়ো না। পয়সার জিনিস নষ্ট করা পাপ। অবনী বোঝাতে চাইল জয়কিষাণকে। জয়কিষাণ শোনার মানুষ নয়। সে ডানে-বাঁয়ে ঘাড় দুলিয়ে বলল, খেলে তিনজনে মিলে খাবো নাহলে খাবো না। এই নাও কর্তা, ধরো। টুকে খেলে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।

লাভ-ক্ষতির কথা নয়, অবনী ভাবছিল শুভ আর সরস্বতীর কথা। ওরা মাতাল মানুষকে একদম দু-চক্ষে দেখতে পারে না। মাতাল দেখলে ভয়ে সরস্বতীর গলা শুকিয়ে আসে। শুভ নাক কুঁচকে বলে, যারা মাতাল তারা দাঁতাল হাতির সমান। পাগলা হাতির যেমন কোনো জ্ঞানগম্যি নেই-মাতালেরও ঠিক তেমন দশা।

তবু চাপে পড়ে গ্লাস হাতে তুলে নিতে হয় অবনীকে। ওরা বাইরে থেকে এসেছে। ওদের সঙ্গ দেওয়া দরকার। গ্লাসে চুমুক দিতেই গা গুলিয়ে উঠল অবনীর। বমি ঠেলে উঠল গলার ভেতর। তবু হাজার চেষ্টা করে মাত্র এক ঢোঁক গিলল সে। তারপর গ্লাসটা নামিয়ে রাখল পাশে।

বেলা বাড়ছে, শুধু মদ খেয়ে সময় কাটালে চলবে না। ডাক্তারবাবু নিশ্চয়ই তাদের জন্য পথ দেখছেন। সময়ে না গেলে ভুল বুঝবেন। বাবুদের ভুল বুঝতে বেশি দেরী লাগে না।

পরপর দুবোতল মদ গিলে দুলারী আর জয়কিষাণের হাঁটা চলার ক্ষমতা ছিল না। নেশার ঘোরে কথাও জড়িয়ে যাচ্ছিল ওদের। এসব দেখে শুনে ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল অবনীর। আসল কাজটাই যদি না হয় তাহলে কী ভাববেন ডাক্তারবাবু। দোষ তো তাকেই দেবেন।

বহু কাকুতি-মিনতির পর মাটিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল জয়কিষাণ। অবনীর শুকনো গালটা টিপে দিয়ে বলল, অত চিন্তা করো না। মাল যখন পেটে পড়েছে, তখন কাজ না মিটিয়ে আমরা যাব না।

দুলারী খিল খিল করে হাসল, কর্তা, অত ভাবনার কী আছে! এসব কাজ মাল পেটে না পড়লে হবে না। মাল হচ্ছে টনিক। টনিক খাওয়ার পর আমার গায়ের জোর দশগুণ বেড়ে যায়। তখন আমি দশটা মরদের কাজ একা করি।

দুলারীর আঁচল খসে পড়ে লুটায় ধুলোয়। ভরা শরীর ফুলে ভরা গাছের মতো শোভা পায়। অবনী সেদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। তার শরীরে কেমন জোয়ার আসে। বুকের ভেতর ছলাৎছলাৎ ঢেউ ভাঙার শব্দ হয়। চোখ কুঁকড়ে সে ভাবে এরা জীবনটাকে ভোগ করতে জানে। এদের জীবন টবে লাগান গাছের মতো নয়। এরা জঙ্গলের ভেতর বেড়ে ওঠা আদিবৃক্ষ। অবনী হঠাৎ ধুলোয় বসে যাওয়া দুলারীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সাহায্যের জন্য। দুলারীও নিঃসংকোচে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল তার হাত। উত্তাপ বিছিয়ে দিল অবনীর পুরো শরীরে। গলায় আব্দার মিশিয়ে বলল, কর্তা, তোমার কাজ তো হয়ে যাবে। বলল, তুমি আমার একটা কাজ করে দেবে? দুলারী মোহনী চোখে তাকাল, দৃষ্টিতে লজ্জা মিশিয়ে বলল, পেটে আমার তিনমাসের ছানা। এ সময় মন করছে শুয়োরর মাংস দিয়ে ভাত খেতে। তুমি আমাকে কালো দেশী শুয়োরের মাংস খাওয়াবে কর্তা?

অবনী হাঁ-হয়ে দেখছিল দুলারীর পুরো শরীর। ওর কুঁড়ি ধরা শরীরে যৌবন-লাবণ্য কই মাছের মতো ছড়ছড় করছে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সে বলল, শুয়োরের মাংস খাবে এ আর এমন কি বড়ো কথা! যাওয়ার পথে হাঁড়িপাড়া থেকে মাংস কিনে নিয়ে যাব। তুমি মুখ ফুটিয়ে খেতে চেয়েছ, তোমাকে না খাওয়ালে আমার পাপ হবে।

সব দিন শুয়োর মারে না পাড়ায়, আর মারা হলেও খদ্দের জোটে না ঠিকমতন। শুয়োরের মাংস যারা খায় সেই সব মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বড়ো কম এ গ্রামে। অবনী জানত সে গিয়ে দাঁড়ালেই সের দুয়েক মাংস অবশ্যই পেয়ে যাবে। কাছে এত টাকা নেই, তবু টাকার জন্য আটকে যাবে না কেনাকাটি। এ পাড়ার সবাই তাকে চেনে, মান্য করে। ধার দেওয়া নিয়ে তাদের কোনো সংশয় নেই মনে।

পাকা রাস্তায় ওদের দাঁড় করিয়ে অবনী চলে গেল পাড়ার ভেতর। ফিরে এল হাসি মুখে। পাতায় জড়ানো মাংসর পুটলি দুলারীর হাতে দিয়ে সে বলল, মাংস আমি এনে দিলাম। তোমাকে এবার বেঁধে-বেড়ে খেতে হবে।

-কেন তোমার বউ?

দুলারীর প্রশ্নে স্মিত হাসল অবনী, সে শুয়োরের মাংস ছুঁয়েও দেখে না। এমনিতে খাসীর মাংস খেতেই ঘেন্না, তার উপরে শুয়োর শুনলে আমার অবস্থা দফা-রফা করে ছেড়ে দেবে। তবে কেউ খেলে তাকে সে মানা করবে না।

-তাহলে তো তোমার ঘরে যাওয়া যাবে না। দুলারী আশাহত হল, বৌদি এত শুচিবাই আমি জানতাম না। জানলে আর ওই আব্দার তোমার কাছ করতাম না। অবনী তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, সব মানুষ তো একরকম হয় না। তবে তোমার বৌদি কারোর ক্ষতি করতে জানে না। সে নিজের খেয়ালে থাকে অন্যের পেছনে লাগার স্বভাব তার নেই।

–তুমি দেখছি ভাগ্যবান। দুলারীর কণ্ঠস্বর নেমে এল খাদে।

কোপে কোপে মাটি কাটছিল জয়কিষাণ, ঝুড়িতে করে তা ফেলে আসছিল অবনী। দুলারী কাপড় গুছিয়ে নিয়েছে ধুতি পরার মতো। কাজের জন্য টগবগ করছে সে। একটুআগের নেশা উড়ে গিয়েছে কোথায়। সে এখন সুস্থ মানুষের চেয়েও স্বাভাবিক। ডাক্তারবাবু আর হাসপাতালের ড্রাইভার চিত্রভানু এসে দাঁড়িয়েছে কাজ দেখার জন্য। ওরা মাঝে মধ্যেই উৎসাহ দিচ্ছে জয়কিষাণকে। মাটি কাটার তোড়ে গা বেয়ে ঘাম নামছে। তবু তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বোঝা যাচ্ছে সে কত কাজপাগল মানুষ।

দুলারী ঘাসের উপর থেবড়ে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে টানছিল। ধোঁয়া উগলিয়ে সে অবনীকে বলল, হাঁপু লাগলে ঝুড়িটা আমাকে দিয়ে দিও। আমি তখন মাটি ফেলব। তুমি তখন বিশ্রাম নিও।

কোনো কথাই কানে ঢুকছিল না অবনীর। কাজের সময় সে একটা বুনো মানুষ। তবু মাঝে মাঝেই মনে পড়ছিল তার সরস্বতীর কথাগুলো। শুয়োরের মাংসগুলো নিজের হাতে নিল না সে, তর্জনী উঁচিয়ে বলল, ঐ চৌবাচ্চার ধারে রেখে আসো। এ মাংস আমি ঘরে ঢোকাব না। তুমি সব জেনে-শুনেও ঘরে এনেছ। তুমি দেখছি ঘরে শান্তি ফিরুক চাও না।

অবনী অপরাধীর মতো বলেছিল, সদর থেকে ওরা এসেছে, ওরা খাবে।

–আমি মাটির হাঁড়ি এনে দিচ্ছি।

এবার জ্বলে উঠেছিল সরস্বতী তুমি দেখছি ঘরটাকে হোটেল বানিয়ে ছাড়বে। তোমার মতো ঘর জ্বালানো পর ভুলানো মানুষ আমি আর জীবনে দুটি দেখিনি। অবনী স্তব্ধ হয়ে গেল কথা শুনে। সরস্বতী ফি কথায় ভুল বোঝে তাকে। মন খারাপ করে অবনী ফিরে এসেছে কাজে।

গাঁয়ের বাজারে কোনো হোটেল নেই। দুটো মানুষ খাবে কোথায়? এই চিন্তায় কাজের গতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছিল অবনীর। কোথাও কিছু না পেলে শেষপর্যন্ত হাসপাতালের কিচেন ঘরে খাওয়ার ব্যবস্থা করবে সে। জয়কিষাণ আর দুলারী এসেছে সরকারি কাজে। ওরা কিচেনে খেলে কেউ ওদের মানা করবে না। বরং খুশি হবে সবাই। ওরা সবার কাজে এসেছে। ওরা না এলে ভয়ের জীবাণু উড়ত হাসপাতালের কোণায় কোণায়।

একমানুষ মাটি কেটে হাঁপিয়ে পড়েছিল জয়কিষাণ। দুলারী চটের থলি থেকে মদের বোতলটা এগিয়ে দিল ওর দিকে। গলা ভিজিয়ে ছিপি বন্ধ করে আবার বোতলটা ফিরিয়ে দিল জয়কিষাণ। দুলারী ছিপি খুলে দুকে মেরে নিয়ে ঢেঁকুর তুলে বলল, আজ খুনোখুনি রোদ উঠেছে। আর দেরী করা ঠিক হবে না। এবার যাও মড়িঘর থেকে লাশ নিয়ে আসো। যাওয়ার আগে ভালো করে মুখে গামছা বেঁধে নিও। পচা লাসের গ্যাসটা ভেষণ খারাপ।

হাসপাতাল থেকে ব্লিচিং পাউডার আনিয়ে রেখেছে অবনী। ব্লিচিং পাউডারের ঝাঁঝাল গন্ধে মশা মাছি পোকামাকড় কাছে ঘেঁষতে পারবে না। দুর্গন্ধ থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যাবে।

মড়িঘর থেকে চ্যাং-দোলা করে লাশ বয়ে আনল জয়কিষাণ আর অবনী। সামান্য পথ তবুহাঁপিয়ে গেল ওরা। কপালের ঘাম মুছে জয়কিষাণ রসিকতা করে বলল, মরে গেলে মানুষের ওজন বুঝি বেড়ে যায়। কী ভারী লাশ! হাতের কলকজা ক্ষয়ে যাবার যোগাড়।

অবনী হা-করে দেখছিল বউটার মুখ। কী গায়ের বর্ণ-চোখ ফেরান যায় না। এ যে চড়ুই নয়, বনটিয়া। মনে মনে বিড়বিড়িয়ে উঠল সে। চেহারা দেখে অনায়াসে বোঝা যায় বড়ো ঘরের বউ। কাদের ঘরের বউ? কি দোষ করেছিল সে? রোগজ্বালা কি দোষের?

মুখে গামছা বাঁধা অবস্থায় অবনী বসে পড়ল ঘাসের উপর। সে দেখতে চায় না তবু তার চোখ বারবার করে চলে যায় বউটার মুখের উপর। বুকের খোদল থেকে কান্না গুমরে উঠছে বাধা পাওয়া বানের জলের মতো। বউটা তার কেউ হয় না তবু এই কান্নার বেগ তাকে বড়ো অসহায় করে তোলে।

দুলারীর চোখ এড়ায় না কোনো কিছু। সে অবনীর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলে, কর্তা, তোমার চোখে জল এসেছে। গামছার খুট দিয়ে মুছে নাও গো। পরের জন্য কাদা ভালো স্বভাব। তুমি যে ভালোমানুষ এ নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।

অবনী কোনো কথার উত্তর দিতে পারে না। কথা বলতে গেলেই ধরা পড়ে যাবে তার দুর্বলতা। চোখের কুল ছাপিয়ে অসহায় হয়ে পড়বে সে।

অবনী হাত এলিয়ে দিয়েছে মাটির উপর। জয়কিষাণ বলল, কর্তা, মাছি উড়ছে। দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। যা করার তাড়াতাড়ি করো। কবর দেওয়ার কাজটা তাড়াতাড়ি চুকিয়ে দিলে আয়েশ করে দু-টোক মারা যাবে।

অবনী দেখল–শবদেহ দেখার জন্য হাত দশেক দূরে ভিড় জমিয়েছে উৎসাহী মানুষের দল। তার মধ্যে সবুজ আর শুভকে দেখতে পেল সে। ভয়ে শিউরে উঠল তার শরীর। মারণব্যাধি বসন্ত ছোঁয়াচে রোগ। ওরা এখানে কেন এল এ সময়। অবনী বিরক্তিতে এগিয়ে গেল ওদের সামনে। চাপা ধমক দিয়ে বলল, এখানে এসেছিস কেন? যা পালা।

শুভ চলে যাচ্ছিল। কিছুটা গিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল। অবনীর চোখে চোখ রেখে সে বলল, মা বলেছে ঘরে খেতে। সদর থেকে যারা এসেছে তারাও আমাদের ঘরে খাবে। মা ওদের জন্য রান্না করছে। কাজ মিটে গেলে তুমি ওদের নিয়ে ঘরে যেও।

মেঘলা আকাশ সরে গিয়ে যেন রামধনু ফুটল অবনীর মনে। এটাই মনে মনে সে প্রার্থনা করেছিল। অতিথির সম্মান রক্ষা পেলেই গৃহস্বামীর মর্যাদা বাড়ে। এই বোধ এবং বিশ্বাসে তার অন্তরাত্মা পূর্ণ। সরস্বতী হয়ত তার ব্যথিত মনের আঁচ পেয়েছে। নাহলে সে যা জেদী মেয়ে পরের জন্য রান্না করতে যাবে কেন? ও বরাবরই নাক উঁচু স্বভাবের মেয়ে। এক ঝলক দেখলে লোক ভাববে-বউটা ভীষণ অহঙ্কারী।

কাজ মিটে গেল চটজলদি।

দা-দিয়ে শ্যাকুল গাছের ঝোপ কেটে আনল দুলারী। ওগুলো কবরে পুঁতে দিয়ে সে বলল, শেয়াল এসে আবার লাশ না তুলে ফেলে। কর্তা, তুমি আধলা ইট কয়েকটা খুঁজে আনো। ইট আর কাঁটা চাপা দিলে শেয়ালের বাপের ক্ষমতাও হবে না লাশ তুলে ফেলার। তাড়াতাড়ি করো কর্তা, আমাদের আবার বাস ধরে ফিরে যেতে হবে। সাঁঝের মধ্যে ঘর না ফিরলে ঝামেলা।–

-খাবে না? তোমার জন্য এত কষ্ট করে রান্না করল আমার বউ। অবনী গর্বিত দৃষ্টি মেলে তাকাল।

জয়কিষাণ বলল, নিশ্চয়ই খাবো। না খেয়ে কোথাও নড়ব না। যা ধকল গেল অনেকদিন মনে থাকবে।

পাল পুকুরে সাবান ঘষে চান করল দুলারী আর জয়কিষাণ!

অবনীও বার দশেক ডুব দিয়ে পাড়ে উঠে এসে দেখল পদ্ম দাঁত টিপে হাসছে তার ভেজা গতর দেখে। তার দৃষ্টি জোঁকের মতো লেপটে গেল শরীরে।

কেঁপে উঠল অবনী, কিছু বলবা?

–অনেকদিন আমার ওখানে আসোনি। আমার উপর বুঝি রাগ হয়েছে। রোদে ঝলসে যাওয়া পদ্মের মতো মুখ নীচু করে দাঁড়াল স্বামীখেদান বউটা।

-না, না রাগ করব কেন? অবনী বলল, সময় পাইনে। সময় পেলে ঠিক যাব।

দুলারী ভেজা শরীরে পাড়ে উঠে এল পানকৌড়ি পাখির মতো। গলায় রহস্য মাখিয়ে বলল, কর্তা, এ বউটা কে গো? এর চোখে তো পীরিতের আঠা। সাবধানে থেকো। জড়িয়ে গেলে সংসারে আগুন ধরে যাবে। তোমার যা বউ টের পেলে তোমাকে শেষ করে দেবে।

বিষণ্ণ হাসল অবনী। এড়িয়ে গেল সব কথা।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকতে বেলা গড়িয়ে গেল অনেকটা।

লাট্টু খাওয়া-দাওয়া সেরে গল্প করার জন্য এসেছে অবনীর ঘরে। এ কথা সে কথার পরে সে বলল, বাঁশতলায় কী কাজে যেন গিয়েচিলাম। ফেরার সময় দেখি জল জল বলে কে কাঁদছে। বাঁশ পাতা উড়ছে ফরফরিয়ে পাখির মতো। ভয়ে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছি। আর ভুল করেও ও দিকে যাইনি।

অবনী জোর গলায় বলল, ওসব তোমাদের মনের ভুল ধারণা। মাটির তলায় চাপা পড়ে আছে। বউটা। যা কষ্ট পেয়ে মরেছে–ও আর এ পৃথিবীতে আসবে না।

দুলারী হি-হি করে হেসে উঠল কথা শুনে। অবনীকে সমর্থন জানিয়ে গায়ে চাঁটি মেরে বলল, তুমি ঠিক বলেছ কর্তা। মেয়েমানুষ একবারই জন্মায়, একবারই মরে। বারে বারে সে কষ্ট ভোগ করতে আসে না।

দুলারীর ঘনিষ্ঠ হয়ে সরে আসা ভালো চোখে দেখল না সরস্বতী। সে চাইছিল এরা যত তাড়াতাড়ি বিদেয় হয় ততই ভালো। এত গায়ে পড়া মেয়েমানুষ তার ভালো লাগে না। ওদের চোখে পুরুষ ধরার ফাঁদ আছে। যে কেউ আটকা পড়তে পারে সেই ফাঁদে। তখন ভেসে যাবে তার সাজানো সংসার। অবনীর মতো ভালো মানুষকে ফাঁদে ফেলতে বেশি সময় লাগবে না দুলারীর মতো মেয়েদের। সরস্বতীর চোখের তারা কটকটিয়ে উঠল।

দুলারী জর্দা-পান মুখে পুরে বলল, মাসোটা বড়ো ভালো বেঁধেছ বৌদি। যদি বেঁচে থাকি তাহলে আবার আসব তোমার হাতের মান্সাে রান্না খেতে। অনেক দিন মনে থাকবে তোমাদের কথা। ছোট কাজ করেও মনটা তোমরা বড়ো রেখেছো দেখে ভালো লাগল। তোমাদের কথা আমি ওখানে গিয়ে জনে জনে গল্প করব। যাওয়ার সময় জয়কিষাণ শুভর হাতে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বলল, এই টাকাটা রাখো। তোমাদের জন্য কিছু আনতে পারিনি, খালি হাতে চলে এসেছি।

শুভ টাকাটা নেবে না। শেষে অবনী বলল, নে। জ্যাঠা দিচ্ছে। না নিলে দুঃখ পাবে।

সন্ধের বাসে ওরা ফিরে গেল সদরে। মাথা হেঁট করে পিচ রাস্তা থেকে একা ফিরে এল অবনী। এত ধকল সহ্য করার পরেও আজ তাকে নাইট ডিউটিতে আসতে হবে। তার হয়ে ডিউটি করার কেউ নেই। অতসী দিদিমণি বলেছেন, অবনী না এলে আজ ছুটি নিয়ে নেবেন।

ডাক্তারবাবু তাই সমস্যায় পড়েছেন। অবনীকে ডেকে বললেন, আমি খবর পেয়েছি সব কাজ মিটে গেছে। তুমি আজ যা করলে আমার তা মনে থাকবে। একটা অনুরোধ তোমাকে। অতসী দিদিমণি একা নাইট করতে পারবে না। অন্তত আজকের মতো তুমি নাইটটা করে দাও। কাল থেকে পরপর দু-দিন ডিউটি না করলেও চলবে।

অবনী ঘাড় নেড়ে বলল, ঠিক আছে। আমি সময়মতো ডিউটিতে চলে আসব। আপনি দিদিমণিকে বলে দেবেন।

রাত বারোটার পরে শুনশান হয়ে গেল হাসপাতাল চত্বর। চামচিকি আর বাদুড়ের দৌরাত্ম্য বাড়ে তখন। বাবলাগাছে বসে পেঁচা ডাকে একনাগাড়ে। মড়িঘরের পায়রাগুলো কাঠ হয়ে পড়ে থাকে অন্ধকারে। অত উঁচুতে বেডাল উঠতে পারে না, না হলে একে একে ধরে খেয়ে ফেলত ওরা।

ডিউটি আসার সময় সরস্বতী বাতাবীলেবু তলা অব্দি এগিয়ে দিল তাকে। ফিরে যাওয়ার সময় তোমার কিছু হয়ে গেলে আমাদের দেখার কেউ নেই। ফলে বুঝে শুনে চলবে। লোকের তালে তাল মিলিয়ে নেচো না।

সরস্বতী শুকনো মুখে ফিরে গেল। তার ভাবনা বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল অবনীকে। যত দিন যাচ্ছে সরস্বতী যেন বুঝে নিতে চাইছে তার দায়িত্ব। অবনীর এসব ভালো লাগছিল ভাবতে। একটা মেয়েমানুষ ধীরে ধীরে তার ভাবনার শরিক হয়ে উঠছে এটাই বা কম পাওয়া কিসে? তার বেশি কিছু চাওয়ার নেই। একটু সুখ পেলে সে দম ছেড়ে বাঁচে। অন্তত গর্ব করে বলতে পারে–আমাদের সংসার। এই সংসারের ভালো হোক, মঙ্গল হোক।

বিছানা পেতে এই সব আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুম এসে গিয়েছিল অবনীর তা আর মনে নেই।

জল জল আর্ত-চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল তার। ভয়ে সিঁটিয়ে গেল দেহ। চোখ খুলতে সাহস হচ্ছিল না তার। কে যেন ঘাড়ের উপর ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস ছাড়ছে। কান খাড়া করে সে আবার শুনতে পেল সেই একই স্বর। আশে পাশে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই, শুধু ভয়ের ছায়ামূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অতসী দিদিমণি। কাঁপতে কাঁপতে বলছেন, খেতে না পাই সে-ও ভালো, এই হাসপাতালে আর একদিনও ডিউটি করা নয়। অবনী চলো–আমরা ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলি। তিনি বিচক্ষণ মানুষ। তার কাছে নিশ্চয়ই সুবিচার পাব।

তাদের যাওয়ার পথ আটকে দেয় চিত্রভানু, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার।

বেশ উত্তেজিত গলায় তিনি বললেন, ভূত আমি ধরে ফেলেছি। আপনাদের আর ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। পিছন ঘুরে তিনি গলা ধাক্কা দিয়ে মেঝের উপর ফেলে দিলেন কানুকুড়োকে। পড়েই কিছুদূর হেঁচড়ে গেল বুড়োটা। তারপর নাকি সুরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ভূত-ফুত কিছু নেই গো, আমি হলাম সেই আসল ভূত। ডাক্তারবাবু হাসপাতালের খাতা থেকে আমার নাম কেটে দেবেন বলেছেন। নাম কেটে দিলে আমি ঘরে গিয়ে খাবো কী? আমার যে বড়ো খিদে পায়। খিদে পেলে আমার কোনো জ্ঞানগম্যি থাকে না। নিজেকে বাঁচাবার জন্য আমি ভূত সেজেছি গো! ছোটবেলায় পাখপাখির ডাক নকল করে ডাকতাম। কুকুর ছাগল বেড়াল সব কিছু ডাকতে পারতাম অনায়াসে। সেই ছোটবেলার হরবোলা- বিদ্যে বাঁচার জন্যি কাজে লাগাই। বউটা মারা যাওয়ার পর ওর গলাটা আমি নিজের গলায় তুলে নিলাম। এতেই কাজ হল। কটা দিন তো থাকতে পারলাম হাসপাতালে।

চিত্রভানু ডাক্তারবাবুকে ওই রাতে ডেকে আনলেন হাসপাতালে। ভূত ধরা পড়েছে–এটা কোনো সামান্য খবর নয়। চিত্রভানু সারারাত মশার কামড় খেয়ে অন্ধকারে লুকিয়েছিলেন হাসপাতালে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে লোহার খাট থেকে নেমে আসে কানুকুড়ো। অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে সে চলে যায় বাথরুমে। ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের বিজ্ঞাপনের টিনগুলোর উপর চড়ে বসে সে। তারপর গলায় হাত ঢুকিয়ে শুরু করে তার অদ্ভুতবিদ্যা। অবিকল মেয়েলী গলায় জল-জল বলে কাঁদতে থাকে সে। বার কয়েক কেঁদে-ঝাঁকিয়ে সে আবার নেমে এসে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

ঘটনাটা প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল চিত্রভানুর। অত বড়ো মেল-ওয়ার্ডে কানুকুড়ো ছাড়া আর কোনো রুগী নেই। এটাও তাঁর সন্দেহের অন্য একটা কারণ। কানুকুড়োর সঙ্গে দিনের বেলায় কথা বলেছেন তিনি। ভূত নিয়ে তার ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প বলার ধরণ মনে সন্দেহের একটা দাগ কেটে দেয়।

সেই থেকে তক্কে তক্কে ছিলেন চিত্রভানু। মওকা বুঝে বুদ্ধি খেলিয়ে ঠিক তাকে ধরে ফেলেন তিনি।

সমস্ত ঘটনা শুনে তাজ্জব হয়ে যান ডাক্তারবাবু। অবনীর মুখেও কোনো কথা সরে না। সব শুনে রাগে ফুঁসছেন অতসী দিদিমণি। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, একে কোনোমতেই ক্ষমা করা উচিত হবে না। এর জন্য আমার হার্ট-স্ট্রোক হয়ে যেত ভয়ে। ঈশ্বরের অশেষ দয়া যে বেঁচে গেছি! হাঁফ ছেড়ে অতসী দিদিমণি বললেন, এই পাপীটাকে থানায় দিন, ডাক্তারবাবু। হাসপাতালের ভাত খেয়েছে, এর এবার জেলের ভাত খাওয়া দরকার। নাহলে শিক্ষা হবে না বুড়োটার।

থানা-পুলিশের কথা শুনে ভয়ে গলা ফাড়িয়ে কেঁদে উঠল কানুকুড়ো। ছুটে গিয়ে সে জড়িয়ে ধরল ডাক্তারবাবুর পা।

-না খেয়ে মরব সে-ও ভালো, আর কোনোদিন হরবোলা সাজব না গো। আমারে ছেড়ে দিন গোগা, আমারে ছেড়ে দিন….। কান্নায় ভেঙে পড়ল কানুকুড়ো। পরের দিন ভোর হওয়ার আগে কানুকুড়োর আর কেউ দেখা পায় না। বুড়ি এসে হাসপাতালের দোরগোড়ায় কাঁদে আর কপাল ঠোকে।

.

৪৩.

রস চুরি করতে গিয়ে গিয়াসের হাতে ধরা পড়ে গেল সবুজ আর শুভ। বাঁকের ঘায়ে মাথা ফাটিয়ে দিত গিয়াস, শুভ ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে তার হাত চেপে ধরল, কাকা, মেরো না গো। যাকে তুমি মারবে সে তো টিকেদারবাবুর ছেলে সবুজ।

গিয়াসের উত্তেজনায় জলের ছিটে পড়ল তবু রাগের ঝাঁঝ কমল না, যার ছেলেই হোক চুরি করার শাস্তি পেতেই হবে। টাকা দিয়ে গাছ কিনেছি আমি। রাত জেগে ঘরদুয়ার ছেড়ে পড়ে আছি অপরের পেট ভরানোর জন্য নয়। গরম নিঃশ্বাস পড়ছিল গিয়াসের বুক টুইয়ে, হাঁপিয়ে উঠে সে বলল, কদিন থেকে আমার ঠিলিতে পেরেক পুঁতে চলে যাচ্ছে কেউ। গেল সপ্তাহ এক সেরও গুড় পাইনি। এভাবে লস হলে আমারই বা চলবে কি ভাবে? আমাকে তাহলে গলায় ফাঁস নিয়ে মরতে হবে। ঘরে-বাইরে এত বিপদ আমি আর সামাল দিতে পারছি না। বাঁকটা পাশে নামিয়ে রেখে ডুকরে উঠল গিয়াস।

গেল হপ্তায় খরচাপাতি নিয়ে ঘর গিয়েছিল সে। ভেবেছিল ছেলেটার চাঁদমুখে চুমা খেয়ে রাতটা নাফিজার সঙ্গে কাটিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু এ কী দেখল সে নিজের চোখে!

বিকেল বেলায় মকবুলকে নিয়ে শুয়েছিল নাফিজা। লুঙ্গি পরা মকবুল অসময়ে তাকে দেখে বাঘ দেখার মতো চমকে ওঠে। তক্তপোষের এক পাশ থেকে জামাটা তুলে নিয়ে সে ঘর থেকে ছিটকে গিয়েছিল রকেটগতিতে। যাওয়ার সময় সে তার সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচিস বাক্স ফেলে গেল। আর নাফিজার অবস্থা চোখে দেখা যায় না। তার ভরা শরীরের সম্পদ নুয়ে পড়া স্তন যুগলে দু-হাত চেপে অসহায় চোখে সে তাকিয়েছিল গিয়াসের দিকে। তক্তপোষে পড়ে থাকা ছাপা শাড়িটা টেনে নিয়ে সে যে বুকে চাপা দেবে তার এমন ক্ষমতা ছিল না।

হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল নাফিজা।

বাঁচার কোনো পথ না পেয়ে সে দৌড়ে এসে পা চেপে ধরেছিল গিয়াসের। চোখের জলে পা ভিজিয়ে দিয়ে বলেছিল, ইবলিশটা জোর করে আমাকে ছিঁড়ে খেল। আমি কতদিন আর বাঁধা দিয়ে ঠেকিয়ে রাখব। গেল হপ্তায় তুমি ঘর আসোনি। এ হপ্তায় ঘর আসবে কিনা কোনো খবর পাইনি। আমার তো রক্ত-মাংসের শরীল। আমি হেরে গেছি গো। আমাকে মারো ধরো যা খুশি করো। আমি আর কোনো রা কাড়বোনি।

নাফিজা সময়ের সাথে নেচে কেঁদে মান-অভিমান করে মানিয়ে নিল নিজেকে। এত বড়ো চোট সামাল দেওয়া মুখের কথা নয়। গিয়াস বোবা হয়ে গিয়েছিল ক মুহূর্ত। তারপর হুঁশ ফিরতেই সে ছুটে গিয়েছিল চোরাকুঠুরীর ঘরে। পাটে দেওয়া বিষতেল নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসেছিল নাফিজার কাছে। ছিপি খুলে মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, আমি মরলে তোর পথের কাঁটা সরে যায়। আমি মরে তোকে বাঁচিয়ে যাব। এই দেখ।

নাফিজা চিলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই বিষডিবার উপর। টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল উঠোনে। তারপর গিয়াসের বুকের উপর চড়ে বসে পাগল-চুমায় ভরিয়ে দিয়েছিল তার শরীর। বাধা দেওয়ার কোনো ক্ষমতা ছিল না গিয়াসের, নারী হাতের কোমল স্পর্শে তার শিথিল শরীরের শিরাগুলো টান টান হয়ে উঠেছিল ধনুকের ছিলার মতো। নাফিজার দক্ষ শরীরী খেলায় এক সময় হেরে গেল গিয়াস। বুক উজাড় করে নিজের সর্বস্ব দিয়ে গিয়াস মুখের ঘাম মুছে শুধু একবার তাকিয়েছিল নাফিজার সুন্দর মুখের দিকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু বলতে গেলে শঙ্খলাগা ভঙ্গিতে নাফিজা ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে যেন নামিয়ে আনে শালগাছের মতো শরীর, তারপর দুচোখে দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন এঁকে বলে, এরপরে আর কোনো প্রশ্ন করো না। খোদাকসম, আমি তোমার কোনো কথার জবাব দিতে পারব না কেননা জবাব আমার জানা নেই। আমার যা ছিল তা সব দিয়ে আমি তোমার রোজা ভাঙলাম। এবার আমাকে মারতে হলে মারো, কাটতে হলে কাটো। আমি মুখ দিয়ে টু শব্দও করব না।

নাফিজার যাদুটোনা মনের জয় হল।

হাসপাতালের ছাউনীতে ফিরে এসে বেশ খুশি-খুশি দেখাচ্ছিল গিয়াসকে। সে তো ভালোবাসার কাঙাল। নাফিজার মন থেকে মকবুলকে সে মুছে দিতে পেরেছে–এর চেয়ে বিরাট জয় আর কি হতে পারে। গিয়াসের অন্ধকার মনের বনে হাজার ছোট ছোট ফুলের আলো আর সুগন্ধে মাতোয়ারা পাগল ভ্রমর যেন সে। তার আর কোনো দুঃখ কষ্ট নেই। এবার সে রাতের পর রাত জাগতে পারবে বিনা ক্লান্তিতে।

নাফিজার এই পরিবর্তন ভালো নজরে নেয়নি মকবুল। সে নোক লাগিয়ে পেরেক দিয়ে মাটির ঠিলি ফুটো করে দিল গিয়াসের। ধরাও পড়ে গেল কিচেন ঘরের সামনের বেঁকা গাছটায়। হাতের বাঁক সেদিন ক্ষমা করেনি গিয়াসের। এক চোটেই ব্যাঙের মতো গাছ থেকে ঠিকরে পড়েছিল মকবুল। কপাল ফেটে রক্ত ঝরছিল ফিনকি দিয়ে। শেষে হাসপাতালের বেডে তার জায়গা হল। ডাক্তারবাবু পরপর সাতটা সেলাই দিলেন তার কপালে।

মকবুল এখন ফাটা কপাল নিয়ে ঘোরে।

নাফিজা গোয়ল পালানো গোরু, বনে-বাদাড়ে গিয়েও দুধ দিয়ে আসে। এর ওর মুখে খবর পায় গিয়াস। যে মেয়েমানুষের স্বভাব কুকুরের লেজের মতো তাকে কোন মন্ত্রে সিধা করবে গিয়াস–তা তার জানা নেই। তার মনে একটাই আক্ষেপ। খোদাতালা তার কপালে সুখ লিখে পাঠায়নি।

গিয়াসের কাছে রস জ্বাল দেবার কাজে লেগেছে রঘুনাথ। শুভই ঠিক করে দিয়েছে কাজটা। কথায় কথায় গিয়াস একদিন বলছিল, ভালো ছেলে পেলে বলো তো। একার দ্বারা দশ দিক দেখা যায় না। সারা রাত জাগি। দুপুরে একটু গড়িয়ে নিলে আরাম হয়। তাহলে রাতটা আবার জাগা যায়। যা চোরের উৎপাত, আর পারচি নে গো।

ফুট-রস খেতে এসে শুভর রঘুনাথের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। সে বলেছিল, কাকা, একটা ভালো ছেলে আছে। আমি তাকে খবর পাঠাব।

-দেখো, যত তাড়াতাড়ি হয়। সিজিন ফুরিয়ে গেলে কাজে লাগিয়ে আর কি লাভ হবে!

সেদিন গুয়ারামকে সাথে করে রঘুনাথ এসেছিল হাসপাতালে। ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার সময় কদবেলতলায় রঘুনাথের সঙ্গে দেখা হল শুভর। শুভ টিউশনি সেরে ঘরে ফিরছিল। রঘুনাথ তাকে দেখতে পেয়ে সাইকেল থেকে নামল। একগাল হেসে বলল, আজ আর তোদের ওখানে যাওয়া হল না। বাবার শরীর খারাপ। জ্বর ছাড়ছে না। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে ঘর ফিরছি।

গুয়ারাম ঘোলাটে চোখে দেখছিল শুভকে। ছেলের বন্ধু বলে নয়, শুভকে তার ভালো লাগে নানা কারণে। কদবেল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গুয়ারাম বলল, কিছু মনে করো না। পরে আবার কোনো একদিন আসব। আজ আর শরীলটা ভালো লাগছে না। আজ চটপট ঘরে গিয়ে আরাম করব।

রঘুনাথ দুঃখ করে বলল, হাতে আমার কাজ নেই। খুব অভাব চলচে সংসারে। কাজটা যদি হয় তো দেখ।

-তাহলে বিকেলে চলে আয়। আমি তোর সাথে যাবো কথা বলতে। শুভ বলল। বিকেলে সময় করে এসেছিল রঘুনাথ। তার হৃষ্টপুষ্ট চেহারা দেখে পছন্দ হয়েছিল গিয়াসের। খাওয়া-পরা আর মাস গেলে থোক কিছু টাকা দেবে সে। বিনিময়ে হাড়ভাঙা খাটুনী খাটতে হবে তাকে। রাতে রসের ঠিলি পাহারা দিতে হবে তাকে। গুড় জ্বাল দিতে হবে সকালে। প্রয়োজন হলে হাটে গুড় নিয়ে বসতে হবে দুবেলা। সব শর্ত মেনে নিয়েছে রঘুনাথ। পেটের দায় মহাদায়। এখানে পিছিয়ে গেলে খাদে গিয়ে পড়তে হবে।

হাসি মনে কাজটাকে মেনে নিয়েছে রঘুনাথ। শুভকে বলেছে, জিরেন কাট রস খেতে মন হলে আসিস। মালিককে বলে তোদের মন ভরে খাইয়ে দেব। জানিস তো গিয়াস- কাকা লোক হিসাবে বেশ ভালো। মনটাও উদার। কাউকে মুখের উপর না বলতে শেখেনি।

এমন একটা কাজের ছেলের খোঁজে ছিল গিয়াসে। রঘুনাথকে পেয়ে তার একটু আরাম হয়েছে। ফি-রাতে সে গাঁয়ের ঘরে চলে যায় সাইকেল চালিয়ে। এক ঘুম দিয়ে ভোর ভোর ফিরে আসে। তখন বেশ ঝরঝরে লাগে শরীর। নাফিজারও সুখ ঝরে পড়ে শরীর থেকে। রঘুনাথ সাতসকালে ভাড় নামিয়ে কড়াইয়ে চাপিয়ে দেয় রস। গুড় হয়ে গেলে ভাড় ধুয়ে খড়ের ধোঁয়া দেয় প্রতি ঠিলিতে। গিয়াস পাটালিটা বানায় নিজের হাতে। গুড়ের পাক দেখে নামানো দরকার। দানা না হলে পাটালি জমবে না। আর পাটালি না জমলে দাম পাবে না। তখন এত পরিশ্রম বৃথা যাবে।

রসের ঠিলি পাহারা দিতে গিয়ে হাবুল চোরের সাথে রঘুনাথের দেখা হল ভোর রাতে। কারোর সর্বনাশ করে ঘরে ফিরছিল সে। মাথায় কাঁসার ভর্তি-বোরা। ঠনর-ঠনর আওয়াজ হচ্ছিল হাঁটা চলায়। দূর থেকে তাকে দেখে ছুটে এসেছিল রঘুনাথ, গলা উঁচিয়ে বলেছিল, কে যায় গো? মাথায় বস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল হাবুল চোর। হাতের ইশারায় কাছে ডেকেছিল রঘুনাথকে। চাপা গলায় বলল, বোরাটা নামিয়ে দে দেখি মাথা থেকে। সেই কোথা থেকে হেঁটে আসছি। ঘাড় লেগে গেছে, যন্ত্রণা হচ্চে।

-তুমি কে? রঘুনাথের প্রশ্নে দাঁতে দাঁত ঘষে হেসেছিল হাবুল চোর, তুই আমাকে চিনবি কি করে? তোর বাপ-ঠাকুর্দা চেনে। চেনে তোর কাকা লুলারাম। আর চেনে থানা-পুলিশ-দারোগা চৌকিদার। আমাকে চেনে না এ গাঁয়ে এমন মানুষ আছে নাকি? হাবুল চোর দাঁত টিপে হাসল। রঘুনাথ খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল উত্তর শুনে। হাবুল চোর তার বিস্ফারিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমার নাম হাবুল চোর। অনেকে বলে, পাঁকাল মাছ। সিদ কাটায় এ তল্লাটে আমার মতো কেউ নেই। আমি ঘুমপাড়ানী মন্ত্র জানি। সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে আমি কাজ হাসিল করে বেরিয়ে আসি। আমি হলাম গিয়ে রেতের বনবেড়াল।

আজ কার আবার কপাল পোড়ালে? রঘুনাথের প্রশ্নে আবার এক চোট হাসল হাবুল চোর। মাথা চুলকে বলল, আজ বেশি দুর যাইনি। ঘরের কাছেই কাজ হয়ে গেল। কাঁসা-পেতল ছাড়া টাকা-পয়সা সোনাদানা কিছু পাইনি। কাঁসা-পেতলে আজকাল আর দাম পাওয়া যায় না। ঝুঁকি অনেক। এসব মাল এখানে কাটবে না। বেথুয়া নয়ত পলাশী নিয়ে যেতে হবে। নাহলে মাল কাটানো যাবে না। তার উপর ধরা পড়ে গেলে ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে গাঁয়ের মানুষ ডুগডুগি বাজাবে। ভয়ে ভয়ে জীবন কাটেরে ব্যাটা…। কী করব, পেটের দায়।

–এক বস্তা কাঁসা-পেতল কোথায় নিয়ে গিয়ে রাখবা গো? ভয়ে চোখ ছোট হয়ে আসে রঘুনাথের। হাবুল চোর ভ্রূক্ষেপহীন, ঝোপে-ঝাড়ে রাখার কি জো আছে বাপ! আগে ঝোপে-ঝাড়ে রাখতাম। এখন পুকুরে ডুবিয়ে রাখি। পুলিশের বাবাও টের পাবে না। সময়-সুযোগ মতো মাল বেচে দিই। ঝামেলা মিটে যায়। তা তোর কি একটা কাঁসার গেলাস লাগবে জল খাওয়ার জন্য? লাগে তো বল। বোরা খুলে দিয়ে দিচ্চি। ওই অত শীতে কুলকুল করে ঘামতে থাকে রঘুনাথ। গলা শুকিয়ে যায় ভয়ে।

রঘুনাথের হাতটা শক্তভাবে চেপে ধরে হাবুল চোর বলে, ছোটবেলায় তোর মতন আমার গা-গতর ছিল। বয়সে এখন ভাঙন ধরেছে। কী ভেবে সে বলল, তোর ঘর কুথায়? বাপের নাম কি? বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল হাবুল চোর। তার মনে কোনো ভয়-ডরের চিহ্ন নেই।

–আমার ঘর হলদিপোঁতা ধাওড়ায়। বাপের নাম গুয়ারাম।

রঘুনাথের জবাব শুনে হাবুল চোর জোর গলায় বলল, তোর দ্বারা হবে। তুই আমার কাছ থেকে মন্ত্র লিবি? জীবনে ভাত-কাপড়ের কুনোদিনও অভাব হবিনি। মাথা উঁচু করে বাঁচবি। কুঁইকুই করে বাঁচতে হবে না।

তার মানে? আগ্রহ প্রকাশ পেল রঘুনাথের কথায়।

হাবুল চোর বলল, এসব গুরুবিদ্যে শিখতে হয়। শিখতে গেলে গুরু ধরতে হয়। গুরু বিনা কিছু হয় না রে! তা যাকে-তাকে তো সব কিছু দেওয়া যায় না! তাহলে কচুবনে মুক্তো ছড়ানো হয়। যদি তুই রাজি থাকিস, কাল এই সময় বাঁশতলায় আসিস। কাল অমাবস্যা আচে। কাল দীক্ষা দিয়ে তোর হাতেখড়ি হয়ে যাবে। সঙ্গে পাঁচ সিকে পয়সা আর কিছু ফল আনিস। কাল থিকে আমি তোর গুরু হয়ে যাবো। তুই গুয়ারামের ব্যাটা। তোর রক্তে জোস আছে। তুই অনেক দূর যাবি, বাপ।

রঘুনাথ সারাদিন অনেক ভেবেছে। অন্যমনস্ক হয়ে গেছে কাজে। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে হাবুল চোরের। পাঁচ সিকে পয়সা আর দুটো গাঁদা ফুল নিয়ে বাঁশতলায় হাজির হয়েছে রঘুনাথ যথাসময়ে।

গাঁজার কলকে হাতে হাবুল চোর অনেক আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিল সেখানে। রঘুনাথ কাছে যেতেই সে বলল, যা পুকুর থেকে হাত-পা ধুয়ে আয়। এট্টা পাতায় করে এই গুঁড়ো সিঁদুরটা গুলে নিয়ে আসবি। তিলক কাটতে হবে। কাঁটা ফুটিয়ে রক্ত দিতে হবে মা ডাকাত কালীকে। তবেই তোর দীক্ষা নেওয়া সার্থক হবে। আজ দিনটা বড়ো ভালরে। আজ ছাই মুঠালে নির্দেশ মতো সব কিছু সোনা হয়ে যাওয়ার দিন রে। রঘুনাথ বুকের রক্ত দিয়ে বলল, যতই বিপদে পড়ি, কোনোদিন কোনো অবস্থাতে গুরুনিন্দে করব না। গুরুনিন্দে করলে আমার জিভ যেন খসে পড়ে। গুরুনিন্দে মহাপাপ। মা ডাকাতকালী, তোমার শ্রীচরণে আমাকে আশ্রয় দাও। তুমি আমাকে সন্তান ভেবে রক্ষা করো। তুমি আমাকে শেয়ালের বুদ্ধি দাও, হাঁসের মতো স্বভাব দাও। আমি যেন গুরুর মুখ রক্ষা করতে পারি। হাবুল চোরের পা ছুঁয়ে ধুলো নিল রঘুনাথ। মাথায় খড়খড়ে হাত রেখে তাকে আশীর্বাদ করল হাবুল চোর, বড়ো হঅ বাপ, বড়ো হয়। ধানমাঠের ইঁদুরের চেয়েও চালাক হজ।

কুলবেড়িয়ায় গিয়ে প্রথম কাণ্ড করে এল রঘুনাথ।

হাত কাঁপল না, মনও টলল না। একেবারে নিশ্চল গাছের মতো সে। প্রতি পদে তার বুদ্ধি তাক লাগিয়ে দিল হাবুল চোরকে। তার ক্রিয়াকর্ম দেখে বোঝা যায় না এটাই তার জীবনের প্রথম চুরির ঘটনা। পিঠ চাপড়ে দিয়ে হাবুল চোর বলল, ভাগের তিন ভাগ মাল আজ তোর। এক ভাগ নিয়ে আমি ঘর যাবো। তুইও আজ ঘরে চলে যা। ঘরে গিয়ে ঘুমো। দরকার হলে তোকে আমি ডেকে আনব। তখন যেন তোর সাড়া পাই। আর একটা কথা। এসব যেন মুখ ফুটে কারোর কাছে গল্প করবি নে। যতই চাপ আসুক মুখ যেন তোর হাঁ না হয়।

রঘুনাথ ঘর চলে যাচ্ছিল, হাবুল চোর হাতের ইশারায় তাকে ডাকল, শোন, এসব কাজে শরীরই সব। শরীরের যত্ন নিবি। শরীরই সম্পদ।

গিয়াসের কাজ ছেড়ে দিয়েছে রঘু। শুভ আর সূর্যাক্ষর সঙ্গে তার এখন খুব কম দেখা হয়। একদিন স্কুল থেকে ফিরছিল শুভ। হঠাৎ রঘুনাথের সঙ্গে দেখা হল বাঁশবাগানের ধারে।

রঘুনাথ সুস্থ ছিল না, ওর মুখ থেকে কাঁচা মদের গন্ধ বেরচ্ছিল ভুরভুরিয়ে। শুভর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই লজ্জায় পালিয়ে যেতে চাইল সে, কিন্তু শুভ তাকে সে সুযোগ দিল না। দৌড়ে গিয়ে খপ করে চেপে ধরল তার হাত, তুই মদ খেয়েছিস?

রঘুনাথ কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ নীচু করে দাঁড়াল।

 শুভ বলল, এই বয়স থেকে মদ খেলে পরে তোর কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছিস?

এবার রঘুনাথ ঘুরে দাঁড়াল, মদ না খেলে খাবো কি, ভাতে তো তাগদ আসে না। আমাদের ভালো-মন্দ খাওয়ার ভাগ্য হয় কোথায়?

–অনেকেই শাক-ভাত খেয়ে বেঁচে আছে।

–আমি তাদের মতো নই। আমি আলাদা। রঘুনাথের গলার রগ ফুলে উঠল, আমাকে কেউ খেতে না দিলে আমি তার খাবার জোর করে কেড়ে নেব। ভিখারীর মতো বাঁচতে আমি পারব না। আমার কাকা যা করেছে আমি তাই করব। বাপের মতন আমি মিউমিউ করে বাঁচব না।

-তুই কী চাস তাহলে?

–আমি বাঘের মতো বাঁচতে চাই। আমার বাপ-ঠাকুর্দা যেভাবে বেঁচেছে আমি সেভাবে বাঁচব না। রঘুনাথ হাঁপাচ্ছিল। ওর রাত জাগা গতর ওঠা-নামা করছিল যন্ত্রের মত।

-তাহলে লেখা-পড়া করলি না কেন? শুভর জিজ্ঞাসায় থমকে গেল রঘুনাথ তারপর শিশুর মতো দাঁত বের করে হাসল, সবাই কি লেখাপড়া শিখে বড়ো হয় নাকি? অনেকে গায়ের জোরে বড়ো হয়। আমি বুদ্ধির জোরে বড়ো হবে। তখন তোকেও আমি অনেক সাহায্য করব। দেখে নিস!

-তোর সাহায্যের আমার দরকার নেই। অভিমানে কণ্ঠস্বর বুজে এল শুভর, তোকে আমি খুব ভালো ছেলে বলে জানতাম। এখন দেখছি তুই পুরোপুরি পাল্টে গেছিস! হাবুল চোরের সঙ্গে তোর এখন ওঠা-বসা। তুই এখন আমাদের খোঁজ কেন নিবি?

চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো মুখ করে তাকাল রঘুনাথ, ঘাবড়ে যাওয়া গলায় বলল, হাবুল চোরকে তুই চিনিস? সে আমার গুরু হয়। সে আমার চোখে আলো জ্বেলে দিয়েছে। তার জন্যি আজ আমার জীবনটা বড়োগাঙের চেয়েও ঢেউ ভরা।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল শুভ, রঘুনাথ তার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিল, আমি আর অভাবকে ভয় পাইনে। বাবাকে সদরে নিয়ে গিয়ে বড়ো ডাক্তার দেখিয়ে এনেছি। পয়সা থাকলে ওষুধ-ডাক্তার সব হাতের মুঠোয় এসে যায়। বুঝলি?

-তুই কি লটারীর টিকিট পেয়েছিস? শুভর প্রশ্নে রঘুনাথ হা-হা করে হাসল, নেশায় চোখ কুঁচকে বলল, লটারী ছাড়া কি ভাগ্য ফেরানো যায় না? মানুষ কর্মের দ্বারা তার ভাগ্যকে বদলে দিতে পারে। আমি এখন যে কাজ করি, সেই কাজে ঝুঁকি আছে ঠিকই কিন্তু টাকাও আছে মুঠো মুঠো। যেখানে টাকা আছে, সেখানে এই রঘু আচে।

শুভ অবাক হয়ে শুনল রঘুনাথের কথাগুলো, তারপর তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুই কি কাজ করিস আমাকে বলবি কি?

-তা আমি আজ তোকে বলব না। সময় হলে একদিন বলব।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা বাজারে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়াল। রঘুনাথ পকেটে হাত দিয়ে বলল, বাড়ির জন্য মিষ্টি কিনে দিচ্ছি তুই নিয়ে যা।

-তোর মিষ্টি আমি ছোঁব না। শুভ শক্ত গলায় বলল।

রঘুনাথ হাসল, আমি তোর মিতে হই না? মিতে মানে বন্ধু। বন্ধুর সাথে কেউ অমন করে?

-মিতে যখন, তখন মদ খেলি কেন? বল, তোকে বলতেই হবে। শুভ জেদ করল।

 রঘুনাথ অসহায় চোখ করে তাকাল, মদ না খেলে শরীরে তাগদ আসে না। আমার বাপ-ঠাকুর্দা খায়। আমিও খাই। আমার গুরুও খায়।

–দাঁড়া, তোর শুরুর সাথে একবার দেখা যোক তারপর তাকেই শুধাব–মদ খাওয়ার আসল কারণটা কি? শুভ রীতিমত বিরক্ত, এত পয়সা তুই কোথায় পাস? কে তোকে মদ খাওয়ার টাকা দেয়? তোর এই হঠাৎ বদলে যাওয়া আমার খুব অবাক লাগছে।

–টাকা আবার কেউ দেয় নাকি, টাকা আয় করতে হয়। রঘুনাথ ঠোঁট টিপে হেসে উঠল। ওর কথায় আরও আশ্চর্য হল শুভ। দু-দিন আগেও যাব ভাত জুটত না, সে এখন মদের নেশায় পাগল। কী যাদুতে এমনটা সম্ভব হল শুভ বুঝতে পারল না কিছুতেই।

মিষ্টি খাবি না তো? রঘুনাথের জিজ্ঞাসায় কোনো সাড়া দিল না শুভ। অভিমানে তার ভেতরটা গুমরে গুমরে উঠছে। মনে মনে সে ভাবল রঘুর সাথে এসময় দেখা না হলে ভালো হত। রঘু তার প্রিয় বন্ধু। তার এই অধঃপতনে মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল।

শুভর ঘাড়টা ঝাঁকিয়ে দিয়ে রঘুনাথ আর দাঁড়াল না। কমলা এসময় আখের খেতে আসবে। কী সব কথা আছে। সুফল ওঝার মেয়েটা ঘাসফুলের চাইতেও নরম। ওর মুখের দিকে তাকালে রঘুর মাথাটা কেমন ঘুরে যায়, বুকের ভেতর ভরা গাঙ্গের জোয়ার আসে। একটা টান অনুভব করে সে, আর সেই টানের জন্য সে পাগলের মতো ছুটতে থাকে বাঁধ ধরে।

লাখুরিয়া হাই স্কুলের কাছে এসে দম নেয় রঘুনাথ। শুভর ব্যবহারে সে দুঃখ পেয়েছে। এমন দুঃখ তার মা-ও পায়। মদ খেলে মানুষ কেন দুঃখ পায়? দুধ খাওয়া আর মদ খাওয়া তো একই কথা। দুটোতেই পেট ভরে। একটাতে গন্ধ নেই, অন্যটায় গন্ধ আছে। দুটোই তরল।

হঠাৎ হুঁশ এল রঘুর। এ কী ভাবছে সে? এমন ভাবনার কি কোনো দরকার আছে এখন? এখন কমলার কাঁপা চোখের তারা তাকে টানছে আগুনের দিকে ধেয়ে যাওয়া পোকার মতো। রঘুর গোঁফের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে উত্তেজনায়। তার হাঁপ ধরা ভাবটা আরও বেড়ে যায়। পাগলের মতো ছুটতে গেলে পায়ে পা বেঁধে পড়ে যায় সে। হাতে পায়ের ধুলো ঝেড়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। সুফল ওঝার মেয়ের আঘো কথাগুলো একতারার সুরের মতো বাজে। জুরানপুরের মেলায় কমলার হাত ধরেছিল সে। ভিড়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়নি কমলা। ঘেমো হাতটা শরীরের শিশিরে ভিজে যাচ্ছিল হঠাৎ। সেদিন থেকে রঘুর মনে হয়েছে কমলা আর কারোর নয় তার একার। সময় সুযোগ মতো কমলাকে সে বউ সাজিয়ে ঘরে তুলবে।

আখখেতের আলো আঁধারী পরিবেশে স্বপ্নের মতো ছোট ছোট ছায়া দৌড় ঝাঁপ খেলছিল। দুপুরের নির্জনতায় একটা কাক-পক্ষীও নেই চারপাশে। ঘন জমাট বাঁধা আখখেতের ভেতর ঢুকে গিয়ে রঘুনাথ ডাকল, কমলা।

শুকনো আখ পাতা মাড়ানোর শব্দ হল, যেন কোনো ভীতু কিশোরী হরিণী সতর্ক পায়ে এগিয়ে এল সামনে। পরনে তার সবুজ রঙের ডুরে শাড়ি, পিঠের উপর আছাড় খেয়ে পড়েছে ছাড়া চুল। টানা মোটা ভুরুর নীচে চোখ দুটো তার ভীষণ চকচকে। কমলার গায়ের রঙ কাঁঠালপাতার মতো। ষোল বছরের শরীরে কেউ যেন তেলের শিশি ঢেলে দিয়েছে এমন দুত্যিময় আভা। ঘোলাটে চোখে কম্পমান সেই সুষনিপাতা দেহের দিকে হা-করে চেয়েছিল রঘুনাথ। সুফল ওঝার মেয়েকে সে তো এই প্রথম দেখছে না। যতবার দেখে ততবার মনে হয় কলাগাছের নতুন পাতা, জোর করলে ছিঁড়ে ফারফাই হয়ে যাবে। এত সাহসী রঘুনাথের বুক কেঁপে গেল ভয়ে। কী ভাবে কথা শুরু করবে বুঝে পেল না সে। কমলাও নিথর, নীরব। স্তব্ধা ঢেউহীন দিঘি।

এক সময় হঠাৎ মাটিতে ভর দিয়ে উঠে বসা কমলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রঘুনাথকে জড়িয়ে, কাল বাদে পরশু আমার বিয়ে গো। ছেলের বেথুয়াতে ভূষিমালের দোকান আছে। বড়োলোক। তুমি কি তার সাথে পারবে গো?

-চলো পালাই। রঘুনাথ কমলার হাত ধরে টানল।

-কোথায়?

–গাঙ পেরিয়ে রাঢ়ের দিকে চলে যাব। রঘুনাথ উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছিল।

কমলা সতর্ক গলায় বলল, তোমার তো ফুটো কড়িও নেই। আমাকে খাওয়াবে কি? চুপসে গেল রঘু। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, খাওয়ার চিন্তা তোমার নয়, আমার।

কমলার ভালো লাগল রঘুনাথকে। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলল, তাহলে বিয়ের রাতে এসো। বেসপতিবার আমার বিয়ে। খিড়কি দরজা খোলা থাকবে। এসো। আমি তোমার পথ চেয়ে থাকব।

উৎসাহিত রঘু পাগল হাওয়ার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল কমলার শরীরে।

.

সুখ-স্বপ্ন অলকলতার মূল। চোখ মুদে আবেশে হারিয়ে যেতে থাকে রঘু। রাঢ় কোন পথে যাবে সব ঠিক করা আছে। মাত্র তো দুটো নদী, তারপর তো রাঢ় দেশের গাঁ-গঞ্জ। সেখানে মন না ধরলে তারা বর্ধমান শহরে পালিয়ে যাবে। কমলা বুনোদের বউ হয়ে গেলে তাকে আর সুফল ওঝা ঘরে নেবে না। মেয়ে হল তো কী হল? দেশ-সমাজ আছে না। টি-টি পড়ে যাবে চতুর্দিকে। যদি থানা-পুলিশ করে? ভয়ে রক্ত চলকে ওঠে রঘুনাথের। একা একা ঘামতে থাকে সে।

রাত গাঢ় হতেই ভেসে আসে ঝিঁঝির ডাক। মরাগাঙ উগলে দেয় শীত হাওয়া। বাঁধের উপর কুকুর ডাকতে ডাকতে চলে যায় লাখুরিয়ার দিকে। তার ডাক কান্নার মতো কানে বাজে রঘুনাথের। চোখের পাতা নেচে ওঠে ভয়ে।

ঘরছাড়ার সময় হয়ে এল। ঘুমন্ত মাকে দূর থেকে দেখে নিল সে। হঠাৎ করে শুভ সূর্য আর সবুজের মুখটা মনে পড়ে গেল তার। ওরা সত্যিকারের ভালোবাসা দিয়েছে তাকে। এত ভালোবাসা যে মন ভিজে যায়। হাবুল চোর তাকে অভাবের খাদ থেকে টেনে তুলেছে। ঐ লোকটার কাছে সে কৃতজ্ঞ। হাবুল চোর তার জীবনের ধ্রুবতারা। তাকে অশ্রদ্ধা বা অমান্য করা যাবে না কোনদিন।

হাওয়া শনশনিয়ে চলে যায় গাছের পাতা কাঁপিয়ে। শুধু পাতা কাঁপে না, কেঁপে ওঠে রঘুর গায়ের রক্ত। কমলাকে উদ্ধার করতে হবে তাকে। শেষ লগ্নে মালাবদল হবে ওদের। তার আগে যাওয়া দরকার।

রঘুনাথ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। যে অন্ধকার তার প্রিয় সেই অন্ধকারকে ভীষণ ভয় পেল সে। ছমছমিয়ে উঠল গা-গতর। কাচ-টিপ্পির মতো চোখে দ্যুতি ছড়িয়ে বসে আছে কুলগাছের পেঁচাটা। রোজই বসে। আজ অন্যরকম মনে হচ্ছে রঘুর।

পা টিপে টিপে বাঁধের গোড়ায় আসতেই রঘুনাথ দেখল সাইকেল থেকে নামল হাবুল চোর। সাইকেলটা খেজুর গাছে হেলান দিয়ে হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল বাঁধের নীচে। ফিসফিসিয়ে বলল, আজ তোদের গায়ে কাজ সারতে হবে। সুফল ওঝার মেয়ের বিয়ে। আমার পুরনা শত্রু। আজ মওকা। এ সুযোগ ছাড়লে হবে না।

রঘুনাথ থমথমে চোখে তাকাল। ঠোক গিলে বলল, কমলার বিয়ে, আজ ছেড়ে দাও ওস্তাদ। মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আজকের দিনটা বাদ দাও।

-শরীরে এত দয়া-মায়া থাকলে এ বিদ্যের ধার কমে যায়। রঘুনাথকে ধমকে উঠল হাবুল। মুখ নীচু করে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে রঘুনাথ। এ কী বিপদ মাথার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার ঠোঁটের উপর চুলবুল করল কত কথা। কিন্তু হাবুল চোরের ব্যক্তিত্বের কাছে সে সব কথা পানসে হয়ে গেল নিমেষে। অন্ধকারে তার রক্তহীন মুখের ছবি দেখতে পেল না হাবুল চোর। শুধু হাত ধরে টানল, চল, রাত বাড়ছে। আর দেরী করা যাবে না। সাথে আরও তিনজন আছে। ওরা মোকামপাড়ার কাছে অপেক্ষা করছে। ওদের নিয়ে বিলের পাড় ধরে চলে যাব।

রঘুনাথের গা-হাত-পা ঝনঝনিয়ে উঠছে রাগে। তবু তার মুখে কোনো প্রতিবাদের ভাষা নেই। শুধু মনের ভেতর দলা পাকিয়ে উঠছে ভয়। কমলা যদি তাকে দেখে ফেলে হ্যাজাকের আলোয় চুরি করতে তাহলে দিনের আলোয় কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবে সে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রঘুনাথ ভাবল–মনের কথা সব খোলসা করে বলে দিতে হাবুল চোরকে। শেষ পর্যন্ত ভয়ে ঠোঁট দিয়ে কোনো শব্দ বেরল না তার। হাবুল চোরের স্বভাব সে জানে। মতের মিল না হলে সে পথের কাঁটা সরিয়ে দেয়। তার শরীরে ক্ষমা কম।

কমলাদের বাড়ির পেছনের ঝোপটাতে ওরা লুকিয়ে থাকল পাঁচজন। পুরোহিতের মন্ত্র পড়া শেষ। সিঁদুর দান মালাবদল সাতপাকে ঘোরা সব শেষ হল একে একে।

খোলা খিড়কি দরজা দিয়ে সবার আগে দা-হাতে ঢুকে এল রঘুনাথ। মুখে সে তেল-কালি মেখে নিয়েছে যাতে তোক চিনতে না পারে।

মাঝের ঘরে ঘুমে ঢুলছিল কমলা। কী সুন্দর সেজেছে সে! জ্বলজ্বল করছে সিথির সিঁদুর। লাল বেনারসীতে কমলাকে যেন চিনতেই পারে না রঘুনাথ। হাতের দা-আড়াল করে সে থামের পেছনে দাঁড়ায়। হাবুল চোর চাপা গলায় ধমকায়, হাঁ-করে মেয়েছেলে দেখলে হবে? যা হাতে টাইম নেই। যা নেবার সব কেড়ে নে। গায়ে যা দেখছিস্ সব সোনার। আমি নিজের চোখে স্যাকরা দোকান থেকে নিতে দেখেছি।

পায়ে যেন পেরেক পোঁতা, রঘুনাথ নড়তে-চড়তে পারে না। কাঁপা কাঁপা গলায় সে শুধু বলে, ওস্তাদ, আমার ভেষণ ভয় করছে। এ কাজ আমার দ্বারা হবে নি। কমলা আমারে দেখলে চিনে ফেলবে। এক গাঁয়ের মেয়ে তো! ওর চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ হবে না।

দরকার হলে বুকে দাওলি ঢুকিয়ে দিবি। হুকুম করল হাবুল চোর। তবু থাম ঘেঁষে দাঁড়াল রঘুনাথ।

হাবুল চোর আর কাল বিলম্ব না করে একটা মোক্ষম খিস্তি আউড়ে এক ছুটে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল কমলার কাছে, হাতের খাড়াটা মাথার কাছে ঠেকিয়ে বলল, বাঁচতে চাস তো সব খুলে দে। তাড়াতাড়ি কর। না হলে দু টুকরো করে চলে যাব। রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব। কারোর বাপেরও সাধ্য নেই যে বাধা দেবে।

ফ্যাট-ফ্যাট শব্দে হ্যাজকগুলো লাঠি দিয়ে ভেঙে দিচ্ছে হাবুল চোরের অন্য সাকরেদ। ভাঙা কাচ গেঁথে যাচ্ছে মাটিতে।

বুকে হাত চেপে অসহায় ভাবে মা বুড়োমাকে ডাকে রঘুনাথ।

রক্ষা করো গো, মা বুড়োমা; কমলার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। এর কিছু হলে আমি মরে যাব। আমি পাগল হয়ে যাব।

বরবেশী বেথুয়ার ছেলেটাকে থামের সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে হাবুল চোর। তার মাথায় খাঁড়ার বাঁট ঠুকে দিয়ে গলার সোনার হারটা ছিনিয়ে নিল সে। গলগল করে রক্তের ধারা নামছে মুখ বেয়ে। কিছুক্ষণ পরে সংজ্ঞা হারাল বর।

ততক্ষণে জেগে গিয়েছে পুরো পাড়া। কাজ শেষ করে ফিরে যাওয়ার সময় হাবুল চোর রঘুর হাত ধরে টানল, পালা। পাড়া জেগে গিয়েছে। পালা! ধরা পড়ে গেলে ছাল ছাড়িয়ে হাতে দেবে।

পালাতে গিয়ে রঘুনাথ মুখ থুবড়ে পড়ল পড়ে থাকা গাছের গুঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে। অন্ধকারে কাঠ-ব্যাঙের মতো ঠিকরে পড়ল সে। মাটিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সে দেখল তাকে লাঠি হাতে ঘিরে দাঁড়িয়েছে জনা দশেক আগুন চোখের মানুষ। ফাঁক গলে পালাতে গিয়ে লাঠির আঘাতে আবার হুমড়ে পড়ল সে। আর তখনই লাঠির বৃষ্টি শুরু হল তার শরীরে।

রঘুনাথের আর্ত চিৎকারে বাতাস ভরে যেতেই ছুটে এল কমলা। আঁচলে মুখ ঢেকে সে কাতর হয়ে বলল, ওকে মেরো না গো, ও নির্দোষ। ও চোর নয়। ও ধাওড়াপাড়ার রঘু। আমি ওকে চিনি গো।

কেউ তার কথা শুনল না।

লাঠির ঘায়ে মাথা ফাটিয়ে দিল রঘুনাথের। তাতেও ক্রোধ শান্ত হল না জনতার। টানতে-টানতে তাকে নিয়ে যাওয়া হল উঠোনে। রঘুনাথের পা কাঁচা ডালের মতো মড়াৎ করে ভেঙে দিল একজন। গাল দিয়ে বলল, এই বয়স থেকে চুরির করার মজা দেখ। এমন করে দিলাম-সারাজীবন মনে থাকবে তোর। আর কোনোদিন কারোর ঘরে ঢুকতে সাহস হবে না।

মুচ্ছিত, রক্তাক্ত রঘুনাথ উঠোনে শুয়ে থাকল থানা থেকে পুলিশ না আসা পর্যন্ত। তার শাস পড়ছিল ধীরে ধীরে। কোনোমতে চোখ খুলে সে দেখল কমলা শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে ভ্যান চেপে। দু-চোখ ভর্তি জল। সে যেন মমতামাখা দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে রঘুর রক্তমাখা শরীরের দিকে। অনুশোচনায় পুড়ে যাচ্ছিল কমলার হৃদয়। বারবার দোষীর কাঠগোড়ায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে সে ভাবছিল আজ তার জন্য রঘুর এই দশা হল। শুধুমাত্র তার জন্য রঘুনাথ আজ চোর সেজে ধরা পড়ে গেল! এই পাপবোধ থেকে কবে যে মুক্তি ঘটবে কমলার সে নিজেও জানে না।

দৃষ্টির বাইরে গিয়েও রঘুনাথ তার শরীর জুড়ে রয়ে গেল।

এক শীতের সকালে শুভকে দেখে গিয়াস বাঁক বোঝাই রসের ঠিলি নামিয়ে শুধাল, তোমার মিতের খবর কী গো? ছেলেটার পেটের ভেতর এত কুবুদ্ধি ছিল কে জানত। আমি তো অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। না হলে আমার কপালে যে কী ছিল কে জানত।

জিরেন-কাট রস খেতে এসে রসের মজাটাই হারিয়ে ফেলেছে শুভ। এর পরে রঘুনাথের সাথে মেলামেশা করাটা তার পক্ষে শোভনীয় হবে কী না ভেবে ভেবে অস্থির হচ্ছিল সে।

গিয়াস তাকে বড়ো গাছের আধ-ঠিলি রস দিয়ে বলল, একেবারে চিনির মতো মিঠা ঠ্যাঙা গাছের রস। খেয়ে বড়ো মজা পাবা।

শুভকে একা দেখে গিয়াস শুধোল, তুমি আজ একা এসেচ, তোমার বন্ধু কোথায়? শুভ বলল, ও ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারে নি। যা শীত পড়ছে কদিন থেকে বাইরে বেরলে কনকন করে গা হাত পা। তখনই যেন শীত এসে জড়িয়ে ধরল ওকে।

-তা যা বলেচ। গিয়াস শীতে ঠকঠক করে কাঁপছিল। এক সময় বাঁকটা কাঁধের উপর উঠিয়ে নিয়ে সে বলল, গুড়শালে যাবা নাকি? এখন চুলা ধরাব। গা-গতর গরম করে ঘর যেওক্ষণ—মজা পাবে।

চারিদিকে ছেঁড়া মশারির মতো উড়ছিল কুয়াশা। গুঁড়িগুঁড়ি কুয়াশা-দানায় বাতাস গর্ভবতী মেয়ের মতো গা-গতরে ভারী হয়ে আছে। সামান্য দূরের কোনো কিছুই দেখা যায় না স্পষ্ট। এত কুয়াশার ভেতর শীত ডিম ছেড়েছে সহস্র।

হাঁটতে হাঁটতে গিয়াস খুশিতে টগবগিয়ে বলল, যত শীত পড়বে পাটালিও জমবে ভালো। রস কাচের মতো দেখতে হলে পাটালিও বড়ো ঘরের বউয়ের মতো খোলতাই রঙ বুড়ে। শীত পড়ুক, আরো শীত পড়ুক। জমিয়ে শীত না পড়লে গাছির যে মাথায় হাত।

এ সময় গিয়াসকে বড়ো স্বার্থপর মনে হল শুভর। এত হাজার হাজার মানুষ যখন শীতে কষ্ট পাচ্ছে তখন তীব্র হাড়-কাঁপানো শীতের প্রার্থনায় গিয়াসের এই আকুলতা কানে বেঁধে বই কি! তবু নিরুত্তর শুভ গিয়াসের পাশাপাশি হাঁটছিল। রস বোরার কাজ মেহনতের কাজ। এ কাজে শরীর মাটি হয়, গাদ তোলা রসের মতো ঘোলাটে হয় চোখ। রাতের ঘুম যায়, দিনের স্বস্তি হারায়। এত কিছু ত্যাগ স্বীকার করে যে মানুষটা হাসপাতালে খেজুর-ঝোপে পড়ে আছে তাকে কোনোমতে এড়িয়ে যেতে পারে না শুভ। এই লোকটার সঙ্গে অবনীর বড় ভাব। দুপুরে সময় পেলেই অবনী চলে আসে গিয়াসের ডেরায়।

কুয়াশা ঢাকা পথ তবু হাঁটতে কোনো কষ্ট হচ্ছিল না গিয়াসের। রসের কলসী নিয়ে হাঁটতে তার কোনো কালেই কষ্ট হয় না। এ যেন খেজুরের রস নয়, তার রাতজাগা শরীরের পরিশ্রমের কষ।

বাঁক বয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল গিয়াস। হঠাৎ চাপ বাঁধা কুয়াশার ভেতর তার কানে ভেসে এল শিশুর চিৎকার। ফাঁকা মাঠেকাদের বাচ্চা কাঁদে গো?মা বুঝি জলকাজ সারতে গিয়েছে ঝোপে-ঝাড়ে, কাঁখের বাচ্চা বসিয়ে গেছে মাঠে। তাই অভিমানে গলা ফাড়িয়ে কাঁদছে দুধের শিশু। আজকালকার মা গুলো যেন সব কেমন। বড়ো বেশি দয়া-মায়াহীন। কনকনে শীত হাওয়ায় কান্নার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল ক্রমশ। থাকতে না পেরে বাঁক নামিয়ে গিয়াস চলে গেল বাচ্চাটার কাছে। ভূত দেখার মতো চমকে উঠল সে।

শিশির ভেজা ঘাসে অনাথের মতো শুয়ে আছে নাফিজার কাঁখের শিশু মেহের। মেহেরকে বুকে তুলে নিয়ে গিয়াস পাগলের মতো ডাকল, নাফিজা-আ-আ-আ। এ-না- ফিজা–আ-আ-আ। কুথা গেলি রে…।

বাঁশবাগানে প্রতিধ্বনি ফিরে এল গিয়াসের। পাগলের মতো গিয়াস মেহেরকে আঁকড়ে ধরেছে বুকে। আর ঠিক তখনই ওর ছোট্ট পকেট থেকে ঠিকরে পড়ল একটা হাত-চিঠি। তাতে লেখা আছে, বদলা নিলাম। আমার নাম মকবুল। বদলা নিতে আমার কোনোদিন ভুল হয় না। তোর সুন্দরী বউ নাফিজাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে আমি কলকাতায় চললাম। আর এ গাঁয়ে আসবো নি। তোর ছেলেটাকে তোর কাছে দিয়ে গেলাম। ও কাছে থাকলে নাফিজা কোনোদিনও আমার হত না। টা-টা বাই-বাই!

আবছা আলোয় চিঠিটা পড়ছিল শুভ। গিয়াসের মুখের টু শব্দটিও নেই। সে পাথর হয়ে গেছে পাপ-হাওয়ায়।

.

৪৪.

রসের হাঁড়ি ফেলে নাফিজার খোঁজে গ্রামে ফিরে এল গিয়াস।

পুরনো সাইকেলটা যত জোরে চালান যায় তার চেয়েও জোরে চালাচ্ছিল সে। ভাবছিল দ্রুত গেলে বুঝি নাফিজার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। আর একবার দেখা হয়ে গেলে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারবে তাকে। ভুল তো মানুষেরই হয়। মানুষই আবার ভুল শুধরে নেয়। মকবুলের দ্বিচারিতায় ফাঁদে পা দিয়েছে নাফিজা। সেই কঠিন ফাঁদ কেটে তাকে মুক্ত করে আনতে হবে। কিছুটা আসার পরে গিয়াসের মনে হল হাসপাতালে গাছ ঝুড়তে না এলে তার জীবনে বুঝি এত দুর্যোগ নেমে আসত না। মকবুল সুযোগের অপেক্ষায় ঘুরঘুর করছিল শিয়ালের মতো। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে সে। তার সাথে একবার মুখোমুখি হলে হিসাবটা বুঝে নিতে পারত সে। এক আকাশে দুটো সূর্য উঠত না, যাইহোক একটা এপার ওপার হয়ে যেত।

মেহের সাইকেলের ঝাঁকুনিতে ঝাঁকিয়ে উঠল। চিন্তার খেই হারিয়ে গেল গিয়াসের। বুক ভেঙে যাওয়া কষ্টে সে তার ছেলের মুখের দিকে তাকাল। অমনি হু-হু করে উঠল তার শূন্য হৃদয়। চোখের জল তাকে পরাস্ত করে নেমে এল চিবুক বেয়ে। মেহেরের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে গিয়াস বলল, আর একটু বস। এই তো এসে গেলাম…! কথাগুলো বলতে গিয়ে অস্বাভাবিক ভাবে কেঁপে উঠল তার ঠোঁট জোড়া। তেঁতুলতলা পেরিয়ে বাঁক নিলেই গিয়াসের মাটির ঘরখানা চোখে পড়ে। সাইকেল নিয়ে ধুলো পায়ে গিয়াস গিয়ে দাঁড়াল ঘরের সামনে। সবখানে নাফিজার স্মৃতিচিহ্ন ধুলোর রেণু হয়ে উড়ছে। কত কথা মনে পড়ছে গিয়াসের। বড়োই গরীব ঘরের মেয়ে ছিল নাফিজা। গিয়াসের আব্বা মেয়েটাকে একনজর দেখেই তার ছেলের সাথে শাদীর প্রস্তাব দেয়। নাফিজার বাবা ছিল না, মা-ই তার সর্বময় কী। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায় সে। পাকা কথা বলতে এসে গ্রামসাক্ষী খরিস সাপের ছোবলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল গিয়াসের বাবা। শোকে কাহিল হয়ে গেল সে। সেই দুঃসময়ে নাফিজাই তার পাশে ছিল।

ডুবে যাওয়া সংসারটাকে ধীরে ধীরে টেনে তুলছিল গিয়াস। নাফিজা হাসি মুখে বলত, আমি মরবনি গো, না মরা পর্যন্ত আমি তোমার পিছু ছাড়ব নি। চাম এঁটুলির মতো এটকে থাকব গায়ে। নাফিজা মিথ্যে কথা বলেছে। বনের পাখির মতো পোষ না মেনে সে উড়ে গিয়েছে। তাকে ফেরানো কি এ জীবনে সম্ভব হবে তার? শুনশান ঘরে ঢুকতে আর মন করে না গিয়াসের। বুক ঠেলে কান্না উঠে আসে। তাড়াহুড়োতে অনেক কিছুই নিতে ভুলে গিয়েছে নাফিজা। সেই সব স্মৃতিচিহ্ন আঁকড়ে গিয়াস আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। দাওয়ার খুঁটি ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।

কান্নার আবেগ থামতে সময় লাগে বেশ কিছুটা। পাশের ঘরের বউটা এসে বলল, কার জন্য কাঁদছো? সে কোনদিনও তোমার ছিল না। সে আমার কাছে কথায়-কথায় বলেছে–তুমি নাকি টোড়া সাপ। খরিস সাপের খোঁজ পেলে সে চলে যাবে।

কথাগুলো যেন গরম তেলের মতো কানে ঢেলে দিচ্ছিল বউটা। অসহ্য লাগতে সে ব্যাকুল হয়ে বলল, যা হবার তা হয়েছে। ওর কথা বলে আর আমাকে কষ্ট দিও না। ওর মনের কথা আমি কিছু বুঝতাম না। ও ছিল বুনো পাখি। আমি ওকে বশে রাখতে পারিনি সেটা আমার দুর্বলতা।

বউটি সব শুনে দুম করে বলে বসল, মেহেরকে দেখবে কে? ওর কপালটা খারাপ। একটা কথা বলি শোন। দুটো ভাত ফুটিয়ে দেবার তো মানুষ দরকার। আমার বুন্ আছে। বলো তো তার সাথে কথা পাড়ি।

–তোবা তোবা। জিভ কাটে গিয়াস, বিয়ে-শাদী মানুষের কবার হয়? যে পারে পারুক। আমি আর ওসব পারব না!

-তাহলে মেহেরকে দেখবে কে?

–ওর জন্য আল্লা আছে। অভিমানে গলা বুজে এল গিয়াসের, আমার কথা বাদ দাও। দুধের শিশুকে ফেলে কোনো মা যে এভাবে পালিয়ে যায় আমার তা জানা ছিল না।

-যে যুগের যা ধর্ম! বউটা ফ্যাকাসে হাসল। তারপর করুণ দৃষ্টিতে গিয়াসের দিকে তাকিয়ে সে চলে গেল তার নিজের ঘরে।

একটা টিপ তালা দরজার আংটায় লাগাল গিয়াস। কঁকা ঘরে থাকলে দুঃখ পাথরের মতো চেপে বসবে বুকে। এর থেকে নিস্তার পাওয়া দরকার। সে ভাবল মেহেরকে তার বোনের ঘরে রেখে কাজে ফিরে যাবে।

না খাটলে তার-ই বা পেটের ভাতের যোগাড় হবে কী ভাবে? মেহেরকে পাশের গ্রামে বোনের বাড়িতে রেখে ফিরে এল গিয়াস। ওখানে ওর কোনো কষ্ট হবে না। মায়ের যত্ন না পেলেও ফুপুর যত্ন পাবে। আর সময় তো কারোর জন্য থেমে থাকবে না। দেখতে দেখতে মেহের একদিন বড় হবে। ভুলে যাবে তার মায়ের কথা। শুধু মেহের নয়, গিয়াসের স্মৃতিও দিন বদলের সাথে সাথে ঝাপসা হয়ে আসবে। সময় কাকে কোথায় টেনে নিয়ে দাঁড় করাবে সে নিজেও জানে না।

মেহেরকে ছেড়ে আসতে নিদারুণ কষ্ট হয় গিয়াসের। ফ্যালফ্যাল করে দেখছিল মেহের। তার কোনো কিছু বোঝার শক্তি নেই। যদি বোঝার শক্তি থাকত তাহলে সে উচ্চস্বরে কাঁদত।

সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে রাস্তায় উঠে এল গিয়াস। শরীর আর চলছিল না তার। দিনভর ধকল গিয়েছে গাছ ঝোড়ায়। পরিশ্রমের কাজে ফাঁকি দেওয়া চলে না। জিরেন কাট রস পেতে গেলে খেজুরগাছের তোয়াজ দরকার। বিবিকে পোষ মানানো বুঝি সেই জিরেনকাট রস বের করার মতো। শক্ত গাছের শরীর কেটে রস বের করা কি মুখের কথা। কাঁটা বোঝাই খেজুরগাছ তার হাতের যাদুতে বশ মেনেছে অথচ নাফিজাকে সে পোষ মানাতে পারল না। কেন পারল না-এই ব্যাখ্যার উত্তর খুঁজতে গেলে তার কানের পাশটা ব্যথায় টনটনিয়ে ওঠে। বুক ভেঙে যায় সুখে-দুঃখে। তার বারবার মনে হয় মাটির ঘরে নাফিজা কি সুখী ছিল না? তার অসুখী মুখের ছায়া একদিনও দেখতে পায় নি গিয়াস। যদি দেখতে পেত তাহলে নাফিজাকে সে হাতছাড়া হতে দিত না। বুক ঠেলে উঠে আসা দুঃখ কুরেকুরে খায় তার হৃদয়, মন। ক্রমশ ভার হয়ে আসছে মাথা এবং শরীর। সকাল থেকে ঝামেলার অন্ত নেই। পঞ্চাশটা গাছের ঠিলি নামিয়ে সাতসকালে হাঁপসে উঠেছিল সে। তবু মনে একটা আশা ছিল। রসটুকু জ্বাল দিলে যা গুড় হবে তা ফুৎকারে উড়ে যাবে চড়া দামে। নলেন লাভ করেছে গিয়াস, গুড় বেচার টাকায় চার কাঠা জায়গা কিনেছে বিলের ধারে। কানপাশা গড়িয়ে দিয়েছে নাফিজাকে। বাহারী দেখে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে দেবগ্রামের হাট থেকে। সেই শাড়ি নাফিজাই পছন্দ করে কিনেছে রোববারের হাটে। সেদিনের সেই হাসিমাখা মুখখানা আজও তো মনে পড়ছে গিয়াসের। মন বুঝি সেই এঁটেল মাটির কাদার মত, হাত রাখলে তার চাপে ছাপ পড়ে যায়। দেবগ্রামের হাটে লাল মিঠা বরফ কিনে খেয়েছিল নাফিজা। এক মুখ হাসতে হাসতে বলেছিল, লাল বরফ খেতে আমার ভেষণ ভালো লাগে। জানো, ছোটবেলায় এই বরফ খাওয়ার জন্যি কত জেদ ধরতাম।

ছোটবেলার দিনগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠত নাফিজার। ছোটবেলাটা তার বেশ দুঃখেই কেটেছে। এ সব খবর জানত গিয়াস। তাই সে চেষ্টা করত নাফিজাকে সুখে রাখার। তার সেই চেষ্টা ঠুনকো কাচের গ্লাসের মতো ভেঙে গেল! এই দুঃখের কথা সে কার কাছে বলবে? যে শুনবে সে-ই তো হাসবে মনে মনে। ভাববে–বউকে সুখ দিতে পারে নি, বউ পালাবে না তো কি ঘর আগলে বসে থাকবে? এখন আর কেউ ধ্বজভঙ্গ বরের মুখ চেয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে রাজি নয়। এখন সবার এক জোড়া করে পাখনা আছে। অসুবিধা কিংবা মনের মিল না হলে তারা উড়ে পালাবে। কে তাদের আটকে রাখবে?

শীতের হাওয়ার চাবুক এসে সপাং করে লেপটে যাচ্ছে গিয়াসের দুবলা-পাতলা শরীরে। তবু কোন তেজে ঘাম ফুটে বেরয় তার গতরময়। এ ঘাম রাগের ঘাম, পরাজয়ের ঘাম। নাফিজা সত্যি তাকে হারিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে। সারা গায়ে ঢিঢি পড়েছে। পাড়ার দোকানটাতে আলোচনা হচ্ছিল, তার ছিটেফোঁটা কথা কানে এসেছে গিয়াসের। চাপা গলার কথাগুলো সাপের বিষের চেয়েও ভয়ংকর। এক হাতে তালি বাজে না। নিশ্চয়ই গিয়াসের কোনো দোষ আছে। মেয়েমানুষকে খেতে দাও কিন্তু গাদনটা নিয়ম করে দিতে হবে। শরীরের সুখ না পেলে ওরা সোনার সংসার ভেঙে পালিয়ে যাবে।

ছুটে আসা কানাকানি কথাগুলো গিয়াসের গায়ের নোম চাগিয়ে দেয়। সে যেন চোখ তুলে ধুলোর দিকে তাকাতে পারছেনা।নাফিজা যেন তার মুখ ধুলোয় ঠুসে ধরেছে।দম আটকেআসছেগিয়াসের। বিষ কথাগুলো বুঝি না শুনলে ভালো হত। কার মুখে সে আর হাত চাপা দেবে? লোক যা বলে সব সত্য নয়। গিয়াস নিজের দিকে তাকাল। তার শরীরে অক্ষমতার কোনো বীজ নেই। আর দশটা সবল সুস্থ পুরুষের মতো সে-ও। ফলে এই অপবাদ মন থেকে মেনে নিতে পারে না সে। বউটা মান-সম্মান নিয়ে গেল, সেই সঙ্গে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে গেল একটা মানুষকে। গ্রাম সমাজে এসব নিয়ে বোলান গান বাঁধা হবে। রসিয়ে-টরিয়ে গাইবে মানুষ। হাঁ-করে সব শুনতে হবে তাকে। কোনো প্রতিবাদ করা চলবে না। যারা বোলান গায় তারা যা বলবে সেটাই সত্যি।

 সাইকেলটা ঠেলতে-ঠেলতে গিয়াস একটা চারা বটগাছের নীচে গিয়ে দাঁড়াল। তার মনে হল–গাছের কোনো স্ত্রী নেই। গাছকে কেউ কথা শোনায় না।

কপাল কুঁচকে গিয়াস পকেট থেকে বিড়ির ডিবাটা বের করে আনল। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায় তবু মগজে ধোঁয়া ঢোকান দরকার। ধোঁয়ার মতো যদি হালকা ভাবতে পারে নিজেকে-এই ভেবে দেশলাই জ্বেলে বিড়ি ধরাল সে। এক বুক ধোঁয়া টেনে সে হালকা বোধ করতে চাইল নিজেকে। কিন্তু পাথর চাপা বুক ফুড়ে তো শীতল জল ওঠে না। শুধু দুঃখ বুজকুড়ি কাটে ফুসি কঁকড়ার শ্বাস নেবার মতো। এ সময় পৃথিবীতে সে একা হলে ভালো হত। তাকে কারোর কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হত না। কেউ দেখতে পেত না তার ক্ষত-জ্বালা। আঁধার নেমে এলে সেই আঁধারে ভীতু ইঁদুরের মতো নিজেকে সিঁধিয়ে নিতে পারত সে। কিন্তু মানুষ যা চায় তা কি চট করে হয়?

নুর মহম্মদ লোহালক্কড়ের ব্যবসা করে। লোহা ভাঙা, পেতল ভাঙা, সংসারের ফেলে দেওয়া জিনিস নিয়ে তার যত কারবার। সাইকেলের পেছনে বাঁশের বড়ো ঝুড়িটায় সব সময় ঘটর মটর শব্দ। বিস্কুট, খেলনা কখনও বা নাগাদ পয়সা দিয়ে ভাঙা জিনিস পত্তর কজা করে সে। এ সব জিনিস শহরে চালান হয়। গলিয়ে আবার নতুন হয়ে ফেরত আসে গাঁয়ে। ব্যবসাটা মন্দ নয়। অনেকদিন ধরে এতেই মজে আছে সে।

দূর থেকে মুখ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গিয়াসকে দেখে এগিয়ে এল সে। সাইকেলটা গাছে হলান দিয়ে সে সন্দেহঘন চোখে গিয়াসের দিকে তাকাল, তা, অবেলায় এই বটতলায় কি করছো হে! হাসল নুর মহম্মদ। আর তাতেই পিত্তি চটকে গেল গিয়াসের। কথা বলার ইচ্ছে হল না, তবু তিতকুড়ো ঢোঁক গিলে তাকে বলতে হল, গাঁয়ে এসেছিলাম। এবার কালীগঞ্জে ফিরব

–তা তো ফিরতেই হবে। নুর মহম্মদ চুরুক দাড়িতে হাত বুলিয়ে হাসল, তার পান খাওয়া দাঁত বিকশিত হল নিমেষে, চিবিয়ে-চিবিয়ে সে বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার কেউ মারা গিয়েছে! তা কিসের এত শোক গো তোমার?

গিয়াস আঁতকে উঠল কথা শুনে। শুকনো হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করল ঠোঁটের ডগায়। কিন্তু বাসি ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে গেল সেই হাসি। মুখ কাঁচুমাচু করে সে আড়াল করতে চাইল সত্য, তুমি ঠিকই ধরেচো, মন আমার ভালো নেই। গাছ ঝোড়ার কাজে ডাহা লস চলছে।

তোমার কথা মানতে পারলাম না। নুর মহম্মদ বিজ্ঞের হাসি হাসল, এ বছর তো সিজিন ভালো চলছে। যা শীত পড়েছে, তাতে লস খাবার তো কথা নয়।

গলা শুকিয়ে খড়খড়িয়ে উঠল গিয়াসের কণ্ঠস্বর, কাল ঠিলিগুলোকে ফুটা করে দিয়ে পালাল। মেলা টাকার লস হয়ে গেল গো। শুধু পয়সা নয়, রসও ঝরে গেল মাটিতে। লোক যদি শত্রুতা করে তাহলে আমার কি সাধ্য আছে তা ঠেকাব।

-তা তো ঠিক। নুর মহম্মদ হাত বাড়িয়ে দিল একটা বিড়ির জন্য।

ঝামেলা এড়াতে ডিবা খুলে একটা বিড়ি দিল গিয়াস। নুর মহম্মদ বিড়ির মুখে জোরসে ফুঁ দিয়ে আগুন ধরাল। এক মুখ ধোয়া ছেড়ে সে রহস্যময় চোখে গিয়াসের দিকে তাকাল। রসিকতা করার গলায় বলল, তোমার গাঁয়ে গেছিলাম। তোমার গাঁয়ে ব্যবসা আমার মন্দ হয় না। তা তোমার ঘরে টিপ তালা ঝুলছে দেখলাম। ঘরে বুঝি কেউ নেই?

এ প্রশ্নের কি জবাব দেবে গিয়াস। লোকটা সব জেনে-শুনে বোকা সাজতে চাইছে। গিয়াসের মুখ থেকে শুনতে চাইছে কেচ্ছা-কাহিনী। সব শোনার পরে এ-ও এক বিকৃত উন্মাদনা। ভাবনার নীল হয়ে আসে গিয়াসের মুখমণ্ডল। উদভ্রান্ত চোখে সে আকাশের দিকে তাকায়, মনে মনে সে বলে, হে আল্লা, তুমি আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করো।

নুর মহম্মদের তর সইছিল না, কী হল, কথা আটকে গেল যে! এবার সে শব্দ করে সবজান্তার হাসি হেসে উঠল, গা-হাত-পা ঝাঁকিয়ে একটা খিস্তি দিয়ে বলল, আমার কাছে গোপন করে আর কি হবে? তোমার বউ পালিয়ে যাবার খপর আমি শুনেছি। কথাগুলো বলেই চুপ করে গেল নুর মহম্মদ। তারপর লুঙ্গি উঠিয়ে দাপনা চুলকে বলল, মরদের কমজোরী হলে বউ পালাবে না তো কি ধরে বসে থাকবে? তোমার যদি অসুবিধে ছিল তাহলে হাকিমের কাছে যেতে পারতে। শেকড়-বাকড় বেঁটে এমন ওষুধ বানিয়ে দিত বা খেয়ে গায়ে হাতির বল পেয়ে যেতে।

–যা ভাবছ, তা নয়। মিনমিনে গলায় গিয়াস কিছু বলতে চাইল।

নুর মহম্মদ তার মাধে চাপড়া মেরে বলল, শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকতে যেও নি-ধরা পড়ে যাবে। নাফিজা যে পালিয়েছে তার এই একটাই কারণ। গিয়াস তবু অস্পষ্ট গলায় বলল, যে থাকার নয় সে তো পালাবেই। আমি তাকে আটকে রাখলেও সে পালাবে। সব ঠিক করা যায় কিন্তু রক্তের দোষ ঠিক করা যায় না।

নুর মহম্মদ চুরুক দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, যা হবার তা তো হয়েছে। এখন কি ভাবছ তুমি?

–ভাবার মনটাই মরে গেছে।

-অত ভেঙে পড়লে চলবে, শক্ত হও। নুর মহম্মদ চোখে চোখ ফেলে তাকাল, সে যখন ধোকা দিয়েছে তুমি তাকে গরম লোহার সেঁক দাও। সে একজনের হাত ধরে পালাল, তুমিও একজনের হাত ধরে ঘরে নিয়ে আসো। ভাত ছড়ালে কাক-পক্ষীর অভাব হবে নি। তোমার যদি ইচ্ছে থাকে আমাকে খপর দিও। আমার হাতে ভালো মেয়ে আছে।

গিয়াস ঘামছিল, গামছায় মুখ মুছে সে বলল, এবার আমাকে যেতে হবে আঁধার নামছে।

-হ্যাঁ হ্যাঁ, যাও। তবে আমার কথাটা মনে রেখো। নুর মহম্মদ জোর গলায় বলল, যে তোমাকে কঁদিয়েছে, তুমি আর তার জন্যি কেঁদো না। এ দুনিয়ায় সব সম্পর্কই খোলামকুচি। ধুলোর যা জান আছে, সম্পর্কের তা নেই গো। গিয়াস সাইকেলটা টেনে নিল নিজের কাছে। যেন সাইকেল নয়, নাফিজাকে সে যেন নিয়ে এল নিজের নিঃশ্বাসের আওতায়। বউটা পালিয়ে গিয়ে তার মুখে চুনকালি লেপে দিয়েছে যা হাজার সাবান ঘষেও উঠবে না। গ্রাম সমাজে এখন কদিন দাপিয়ে বেড়াবে এই সংবাদ। গুজবের হাজার ডালপালা। তার ঝাঁপটা খেতে খেতে গিয়াস যে কোথায় ছিটকে পড়বে–তা তার জানা নেই। এই মুহূর্তে গিয়াসের মনে হল–হ্যাঁসপাতালের মাঠটাই তার জন্য নিরাপদ জায়গা। কাজের মধ্যে ডুবে গেলে সে নিশ্চয় নাফিজাকে ভুলে থাকতে পারবে।

.

৪৫.

থানা থেকে চালান গেল রঘুনাথ।

দুর্গামণি বাস-স্ট্যান্ড অবধি এসেছিল কাঁদতে কাঁদতে। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে রঘুনাথ এমন কাজ করতে পারে। কমলার সঙ্গে ছেলেটার ঘনিষ্ঠতার খবর বানানো নয়। তারপরেও এসব কাজ করার প্রবৃত্তি হল কি করে? হিসাব ভুল হয়ে যাওয়া মানুষের মতো উদভ্রান্ত দেখাচ্ছিল তাকে।

থানার দু-জন পুলিশ রঘুনাথের মাজায় মোটা দড়ি বেঁধে বাসে ওঠাল। ওর হাতে হ্যান্ড-ক্যাপ। দূরে দাঁড়িয়ে দুর্গামণি হাপুস নয়নে দেখল। চোখের জল আটকে রাখা তার পক্ষে আর সম্ভব হল না। ফুঁপিয়ে নয়, আঁচলে মুখ ঢেকে শরীর ঝাঁকিয়ে কেঁদে উঠল সে।

ওর সঙ্গে এসেছিল নূপুর। সে বলল, কেঁদো না কাকি। চলো, বাসে উঠে দাদার সঙ্গে দেখা করে আসি।

–খবরদার, ও কথা বলবিনে। রাগে জ্বলে উঠল দুর্গামণি, চোখের জল মুছে নিয়ে সে চেষ্টা করল স্বাভাবিক হবার, কিন্তু পারল না। মন চাইল একবার গিয়ে দেখা করে আসতে কিন্তু ভেতর থেকে কে যেন বলল–যেও না। যে ছেলে পরের ঘরে চুরি করে মা হয়ে সে ছেলের মুখ না দেখাই ভালো। মনটা বিক্ষিপ্ত হতেই ভেতরটা ছটফটিয়ে উঠল তার। পৃথিবীর আর কোনো কিছু ভালো লাগছিল না তার। মুখ নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল সে। তবু চোখ দুটো বারবার চলে গেল বাসের জানলায়। একসময় ঝাপসা হয়ে এল তার দৃষ্টি।

রঘুনাথ কুলগাছের ভাঙা ডালের মতো মুখ ঝুঁকিয়ে বসেছিল। চোখ তুলে তাকাবার ক্ষমতা নেই তার। চুরি করতে যাওয়ার বিবেক দংশন বুঝি বা তাকে ঠুকরাচ্ছিল বারবার। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজটা তার করা উচিত হয়নি, ভাবল সে। হাবুল চোরকে কোনমতে বোঝাতে পারল না সে। মানুষটা তখন একটা শুকনো গাছ। তার কাছে কেঁদেকেটে কি লাভ?

থানায় লুলারাম এসেছিল দেখা করতে। সে এসে আরও তাতিয়ে দিয়ে গেল, ভয় পাবিনে, যা হবার তা হয়েছে। চোর বদনাম একবার রটলে চট করে তা যায় না। তবে যা হয়েছে, ভালো হয়েছে। এতদিন পরে তুর বুদ্ধিশুদ্ধি খুলেচে। তোর বাপকে তো এ লাইনে আনতে পারি নি। তুই এসে আমার দল ভারী হল।

লুলারামকে কী বলবে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিল না রঘুনাথ। বারবার করে তার শুধু কমলার মুখটা মনে পড়ছিল। যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে কি এভাবে কষ্ট দেওয়া যায়? অথচ কমলা তাকে বাঁচাবার জন্য কত চেষ্টাই না করল। এমনকী সুফল ওঝার পায়ে ধরে কেঁদে উঠেছিল সে। তার নতুন বর ভ্যালভ্যাল করে দেখছিল, জীবনে এমন নাটক বুঝি সে দেখেনি এমন তার হাবভাব। ঘিরে ধরা লোকজনের মধ্যে কাশীনাথকে চিনতে ভুল হয়নি তার। বদলা নেবার জন্য কাশীনাথ ফুটছিল। এই সুযোগ সে হাতছাড়া করল না। তারই নির্দেশে ডান পাটা মুচড়ে ভেঙে দিল মারমুখী মানুষগুলো। তবু বাঁচাবার শেষ চেষ্টা করেছিল কমলা। সে হেরে গেল। তার প্রেম হেরে গেল। ডুকরে ওঠা বধূবেশী কমলার অসহায় চাহনিই বলে দিচ্ছিল এসব কথা।

এখন সেই বিস্ময় মাখানো, কান্নাকাতর চাহনিটাই বড়ো অসহায় আর কোণঠাসা করে তুলছে রঘুনাথের থেতলে যাওয়া সত্তা। একটা প্রশ্ন তার মনে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে–সে কি কমলাকে ভালোবাসত না? ভালোবাসলে কি এমন নিষ্ঠুর কাজ করা যায়? বাসটা কঁকুনি দিয়ে নড়ে উঠতেই দৌড়ে এল নূপুর, দাদা, জেঠি এসেছে, তুই ওর দিকে তাকাবি না? নুপুরের কথায় আন্দোলিত হল রঘুনাথ। নিজের ভেতরে তছনছের শব্দ শুনতে পেল সে। লললুলা মাটি দিয়ে তৈরি খেলাঘরের মতো বারবার ভেঙে যেতে লাগল তার মনের জোর।

ক্রমে ক্রমে ভরে উঠছে বাসটা। একজন পুলিশের হাতে ধরা আছে মোটা দড়িটা। নূপুরের ভালো লাগছিল না দেখতে, এমনটা দেখতে সে অভ্যস্ত নয়, ফলে চোখ ঘুরিয়ে নিল সে। বাস ছেড়ে দেওয়ার আগে নূপুর বলল, তুই ভাবিস নে দাদা, বাবা আর জেঠা পরের বাসে যাচ্চে। ওরা কেসনগরে কোর্টে গিয়ে তোর সঙ্গে দেখা করবে। বাবা বলছিল–আজই তোর জামিন হয়ে যেতে পারে।

জামিন না হলেও রঘুনাথের কিছু করার নেই। কাশীনাথের নির্দেশে লাঠিয়াল মানুষগুলো ওর পাটাকে জখম করে দিয়েছে। কালীগঞ্জ হাসপাতালের ডাক্তার বলেছেন, মনে হয় পাটা ভেঙেছে। যদি ভাঙে তাহলে সারতে সময় লাগবে। যেভাবে ফুলে আছে ডান পাটা তাতে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছে না কেউ। থানার গাড়িতে চেপে রঘুনাথ হাসপাতালে গিয়েছিল মেডিকেল চেক আপ-এর জন্য। ব্যাণ্ডেজ জড়িয়ে ব্যথার ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন ডাক্তার। থানায় হাজতে কাল সারারাত ঘুমাতে পারেনি রঘুনাথ। বারবার করে মনে পড়েছে কমলার কথা। কমলার সঙ্গে তার বুঝি বিশ্বাসঘাতকতা করা হল। কোন মুখ নিয়ে সে কমলার কাছে দাঁড়াবে?

বাস ছেড়ে দিতেই মন খারাপ করে নেমে এল নূপুর। যত দূর বাসটাকে দেখা যায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় টানটান করে দেখছিল দুর্গামণি। বাসটা একসময় পালপাড়ার বাঁকে হারিয়ে গেল। দুর্গামণির মনটা ভরে গেল শূন্যতায়। যেন কোল ফাঁকা হয়ে গেল তার, সম্পর্ক ছিডে হারিয়ে গেল একটা মানুষ যে তার কলিজার টুকরা।

নূপুর পাশে এসে বলল, জেঠি গো, ইবার চলো। রোদ বাড়ছে। আবার অতটা পথ যেতে হবে।

বেলার দিকে কোনো খেয়াল ছিল না দুর্গামণির। এখন তার মাথার কোনো ঠিক নেই। গুয়ারামও ছেলের চিন্তায় অস্থির। টাকার জন্য সে রেশনবাবুর কাছে গিয়েছিল। রেশনবাবু তাকে টাকা দেয়নি, উল্টে দু-চার কথা শুনিয়ে ছেড়ে দিল। মন বেজার করে গাঁ থেকে ফিরে এসেছে গুয়ারাম।

রঘুনাথ থানায় যাওয়ার পর থেকে মন বেজার হয়ে আছে চুনারামের। মুখে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। মন নয়তো যেন নিম্নচাপের গুমোট আকাশ। প্রথমত সে ভাবতে পারছিল না রঘুর দ্বারা এমন পাপ কাজ হল কী ভাবে? তাহলে কি লুলারামের হাত-এর পেছনে লুকিয়ে আছে? বংশের একজন বিপথগামী হলে অন্যজনকে সেইপথ অনুসরণ করতে হবে–এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। তবু ঘটনাটা দুর্ভাগ্যজনক। চুনারাম মন থেকে রঘুনাথের এই অধঃপতন মেনে নিতে পারেনি। মন বারবার বললেও সে থানায় যেতে পারেনি সংকোচে। কোন মুখ নিয়ে সে থানায় যাবে? কী ভাবে রঘুনাথের মুখোমুখি দাঁড়াবে সে? এই বয়সে এত বড়ো আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা নেই তার। তাই বুকে নীরবতার পাথর রেখে সে গাছের মতো বোবা হয়ে গিয়েছে।

হাজার চেষ্টা করেও জেলবাস রোখা গেল না রঘুনাথের। কোর্ট-চত্বরে দাঁড়িয়ে লুলারাম আশাহত গলায় বলল, চল দাদা, গাঁয়ে ফিরে যাই। জেল যখন হল তখন তো আর কিছু করা যাবে না। মনকে বোঝাতে হবে। তবে আমরা মাঝে মাঝে এসে রঘুকে দেখে যাবো।

গুয়ারাম প্রতিক্রিয়াহীন গলায় বলল, তাতে আর কি লাভ হবে বল? দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটেরে!

কথাটা সত্যি হলেও লুলারাম পুরোপুরি মেনে নিতে পারে না। রঘুনাথ যা করেছে ভালোই করেছে, এতে তার পূর্ণ সমর্থন আছে। ভাই পারেনি, অন্তত ভাইয়ের ছেলে এসেছে রাস্তায়। এটাই বা কম কি। তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিলে সে-ই একদিন এ লাইনে সাবালক হয়ে উঠবে।

তিনমাস সময় দেখতে-দেখতে কেটে গেল। খড়ো নদীর জল একপ্রান্ত থেকে গড়িয়ে গেল অন্যপ্রান্তে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রঘুনাথ প্রথমে তার বাবার দিকে তাকাল। ওই মানুষটার মুখের দিকে সে তাকাতে পারছে না লজ্জায়।

ধরা পড়ার পর শুয়ারাম শুধু থানায় এসে একটা কথা বলেছিল। মুখে চুনকালি লেপার আগে মরতে পারলি না বাপ! তুই মরে গেলে আমি সব চাইতে খুশি হতাম। ভাবতাম আমার কেউ নেই, আমি দেবদারু গাছের মতো একা। আটকুঁড়া।

পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে পা কাঁপছিল রঘুনাথের। গুয়ারামকে মনে হচ্ছিল থানার বড়ো দারোগা। সময় মতো খেতে পায় না, হাতে টাকা-পয়সা নেই তবু তার তেজ খরিস সাপের চেয়েও কম নয়। ধাওড়াপাড়ায় থেকে এত সাহস কোথা থেকে পায় মানুষটা!

বাস জলঙ্গী নদীর কাছে আসতেই ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল রঘুনাথের বুকের উপর। এখন দিব্যি আরামের আবহাওয়া, রোব্দুর রঙ এবং স্বভাব বদল করে নিজেকে ভাবছে অঘোষিত রাজা। লোহার ব্রিজে পিছলে যাচ্ছে সেই রোদ, জলের উপর রোদের ক্রমাগত সোহাগ মনকে পৌঁছে দেয় অনেক দূর দেশে।

এত কিছুর পরেও কমলা একদিন ওর স্বামীকে নিয়ে জেলে এসেছিল দেখা করতে। অনেক হ্যাপা সামলে শেষ পর্যন্ত কমলা দেখা করতে পেরেছিল রঘুনাথের সঙ্গে। এক পলক দেখেই কান্নাকে আটকাতে পারেনি কমলা। সমস্ত স্মৃতি এসে গলা টিপে ধরছিল ওর। কান্না থামিয়ে কমলা বলেছিল, এত রোগা হয়ে গেছ তুমি। তোমার দিকে তাকানোই যায় না।

একথার কোনো উত্তর দেয়নি রঘুনাথ। উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা ছিল না তার। কমলা এক টুকরো কাগজ রঘুনাথকে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এখান থেকে ছাড়া পেলে আমাদের বাড়িতে যেও। ওখানে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমার ঘরের মানুষটা তোমার মতো, নিজে যা বুঝবে তাই করবে, পরের কথায় নাচে না।

ঠিকানাটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে রঘুনাথ ভাবছিল ওর সাহসের কথা। সত্যি কমলার যা সাহস আছে তা হয়ত ওর নেই। সেই সাহসে ভর করে কমলা বলল, আমি জানি–তোমার দ্বারা চুরি করার মতন কঠিন কাজ কোনোদিন হবে না। যে একটা ফড়িং মারতে পারে না, সে যাবে পরের দোরে সিঁদ কাটতে! যে বিশ্বাস করে করুক–আমি এসব বিশ্বাস করি না।

কমলার এই জোর, দৃঢ়তা বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা স্থলপদ্ম। স্থলপদ্মফুল তো দূরের কথা রঘুনাথের বুকের মধ্যে সেই ভরসার চারাগাছটা বেড়ে উঠল না আজও। রঘুনাথ সংকোচে কুঁকড়ে গেল, তুমি এত কষ্ট করে এলে কেনে, খপর পাঠালেই তো হত। আমি গিয়ে হাজির হতাম।

–আমি মেসিন নই, রক্তমাংসের মানুষ। কমলার চোখ ধকধকিয়ে উঠল উত্তেজনায়, মনে রেখো, তুমি যা পারো–একটা মেয়ে তা পারবে না। আসলে মনের সাহসটাই বড়ো কথা।

কেমন কুঁকড়ে গিয়েছিল রঘুনাথ, কমলার মুখের দিকে তাকাতে পারেনি সাহস করে। সংকোচের পাঁচিলটা বাড়ছিল ক্রমশ। সেই পাঁচিল সে ভাঙতে পারেনি, এই জড়তা রঘুনাথের জন্মগত অসুখের মতো।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সবার আগে কমলার মুখটাই মনে পড়ছিল রঘুনাথের। কোথায় যেন অপরাধবোধের সূক্ষ্ম একটা খোঁচা তার মনের ভেতর বিঁধছিল। এর থেকে কিছুতেই সে নিষ্কৃতি পাচ্ছিল না।

বাস থেকে নামতেই লুলারাম তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিল, সাবাস রঘু, তুই যা করেছিস এর জন্যি আমার মনে কুনো খিচখিচানি নেই। তুর জন্যি আমার ছাতি ফুলে যায়। তুর বাপ যা পারেনি, তুই তা পেরেচিস। বাঁচার জন্যি সব কিছু রসদ তুর আচে। ইবার শুধু বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে হবে। দেখবি তুর জীবনের গোরুর গাড়িটা হড়হড়িয়ে চলছে।

কাকার কথা শুনে মোটেই উৎসাহিত হয়নি রঘুনাথ, বরং মনে মনে সে দগ্ধে মরছিল। এ যন্ত্রণার কথা সে কাউকেই বলে বোঝাতে পারবে না। কমলা অকে ভুল বোঝেনি এই যা রক্ষে। বাঁধের উপর পাশাপাশি হাঁটছিল লুলারাম আর রঘুনাথ। কথা বলার ইচ্ছে ছিল না ওর। লুলারাম পিটুলিগাছের মাথা থেকে চোখ ফিরিয়ে বলল, মনটারে শক্ত কর।

রঘুনাথ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, এ কাজ আমার জন্যি নয় কাকা! প্রথমেই বাধা পেয়ে গেলাম, পরে কি হবে কে জানে।

–অতো ভাবিস নে, সব ঠিক হয়ে যাবে। লুলারাম মন পাওয়ার জন্য বলল, হাবুল চোরের তুকে দিয়ে এ কাজ করানো উচিত হয়নি।

কেন উচিত হয়নি-চমকে উঠল রঘুনাথ। কাকা কি কমলার ব্যাপারটা সব জেনে গেছে। দুর্বলতার কথা বেশিক্ষণ চাপা থাকে না। আর প্রেম-ভালোবাসার সংবাদ তো পাখি হয়ে ওড়ে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে রঘুনাথ অস্বস্তিভরা দৃষ্টি মেলে তাকাল, আমি মানা করেছিলাম, সে আমার কথা শোনে নি।

-ওর মতন বোকা মানুষ আমি আর দুটি দেখিনি।

–সে আমার গুরুজী হয় গো। তার কথা শুনে আমি গিয়াস ভাইয়ের রসের কাজটা ছেড়ে দিলাম।

ভালো করেছিস। ও কাজে কুনো জীবন নেই রে। লুলারাম আক্ষেপের সঙ্গে বলল, দূরের গাঁয়ের অনেকে আমাদের নেকনজরে দেখে। অনেকে ঘেন্না করে। তাদের আমি মুখের মাপে জবাব দিতে চাই। সবাই তো মুনিষ খেটে মরল। আমি ওভাবে মরব না। মরার আগে সবাইকে দেখিয়ে দিয়ে যাবো, লুলারাম রাজোয়ারও পারে মাথা সিধা করে বাঁচতে।

কাকার এই তেজ ভালো লাগে রঘুনাথের, আমি তুমার সাথে আচি। ভেবো না আমি পিছিয়ে যাব।

-সুফল ওঝার মেয়েটারে তুই বিয়ে করে নিলেই পারতিস।

লুলারামের কথায় ধকধকিয়ে উঠল রঘুনাথের মনটা। নিজেকে সামলে নিয়ে সে শান্ত চোখে তাকাল, পরের মেয়েকে কষ্ট দিয়ে কি হবে?

-কষ্টর কথা আসছে কেন?

–ওরা মানেসম্মানে সব দিক থিকে বড়ো।

–ওকথা বলিস নে। সব মানুষ সমান। আমরাই সব আলাদা-আলাদা করে দিয়েছি।

–তবু পায়ের নখ আর হাতের নখ এক হতে পারে না।

–এই ভুলই তো আমাদের কাল হয়েছে। লুলারাম মেনে নিতে পারছিল না কথাগুলো, সময়ের সাথে সাথে মানুষকেও বদলে নিতে হয়, না হলে পরে ঠকতে হয়। নিজে না শুধরালে তাকে কেউ শুধরে দিতে পারে না।

হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল রঘুনাথের, প্লাস্টার কাটার পর থেকে পাটা যেন আগের অবস্থায় ফিরে আসছে। মাঝে মাঝে ব্যথা উঠলে কাশীনাথের রাগী মুখটা মনের ভেতর শিঙ্গি মাছের মতো কাটা মারে। কাশীনাথকে সহজে ছাড়বে না–এমন একটা জেদ তার ভেতরে বেড়ে ওঠে।

বিবর্ণ পিটুলিগাছের পাতাগুলো কুঁকড়ে গিয়েছে রোদে, ধুলো জমে পাতাগুলোর মনমরা দশা। বাঁধের পাশের জামগাছটাকে এতদিন পরে নিজের বলে মনে হয় তার। এই চেনাজানা পরিবেশ আজ তাকে যেন নতুনভাবে দেখছে। এদের সবার কাছে ভীষণভাবে ছোট হয়ে গিয়েছে রঘুনাথ। নিজের দুষ্কর্মের জন্য এদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সে।

আগড় সরাতেই দুর্গামণির সঙ্গে চোখাচোখি হল রঘুনাথের। এক জাহাজ অভিমান নিয়ে পাশে সরে দাঁড়াল সে, মুখে কোনো কথা নেই, ঠোঁট কাঁপছিল থরথরিয়ে। মা বলে ডাকতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল রঘুনাথ। মায়ের এই গুমোট মনোভাবের পরিণতি সে জানে। না খেয়ে মরবে তবু এই চোরুয়া ছেলেকে ক্ষমা করবে না সে। কেন ক্ষমা করবে? যে ছেলে মায়ের মুখে চুনকালি লেপে দেয় সে আবার কেমন ছেলে। দুষ্টু গোরুর চাইতে শূন্য গোয়াল ঢের ভালো। এই নীতিতে দুর্গামণির দিন কাটে।

রঘুনাথ জড়তা কাটিয়ে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে ডেকে উঠল, মা।

 দুর্গামণি ফণা তোলা সাপের মতো ঘুরে দাঁড়াল, খবরদার, তুই আমারে মা বলে ডাকবি নে। তুই কুলাঙ্গার। তোর মুখ দেখাও পাপ।

-মা। রঘুনাথ কী যেন বিড়বিড়িয়ে বলতে চাইল, তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল দুর্গামনি, কোন মুখে তুই আমাকে মা ডাকিস, এ্যা? তুর লাজ লাগে না? আমি কুনো চোরের মা হতে পারবো নি। ছ্যাঃ! বাড়ি মেরে মাটিতে লুটিয়ে দেওয়া কচাগাছের মতো মুখ মাটির দিকে ঝুঁকে গেল রঘুনাথের, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো ভাষা তার মুখে বালিছাতুর মতো ফুটে উঠল না। উল্টে পুরো মুখটাই কালি হয়ে গেল লজ্জায়, অপমানে। কানের ভেতর থেকে একটা গরম ভাপ বেরিয়ে তার মানসিক স্নায়ুগুলোকে ঝিমিয়ে দিল।

দুর্গামণির রাগকে শান্ত করার জন্য এগিয়ে এল লুলারাম, পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার জন্য সে বলল, কেন মিচিমিচিরাগ করচো, বৌদি? ছেলে বলে কথা, এতদিন পরে ঘরে এল, এত রাগঝাল করলে চলে?

–আমার মাথা গরম করে দিও না ঠাকুরপো। চোখে আগুন উসকে তাকাল দুর্গামণি। তবু ভয় পেল না লুলারাম। ঠোঁটে বেহায়ার হাসি ঝুলিয়ে বলল, যা হবার হয়েছে, এবার এসব ছাড়ো তে। যাও, চা বসাও। এদিক-সেদিক তাকিয়ে সে বলল, দাদাকে তো দেখচি নে, কুথায় গেল সে? দাদা কি জানে না রঘু আসছে।

-তার কথা তাকে শুধাও গে। মুখ ঝামটা দিয়ে দুর্গামণি চলে যেতে চাইলে লুলারাম তাকে থামাল, শোন বৌদি, এট্টা কথা বলি তুমাকে। মন দিয়ে শোন–

-তুমার কোনো কতা আমি শুনব না। তুমি এখন ঘর যাও।

আহত গলায় লুলারাম বলল, তাড়িয়ে দিচ্চো?

 দুর্গামনি তবু নরম হল না, হা, তাই ধরে নাও। পচা আঙুল কেটে ফেলাই ভালো।

-তার মানে?

-মানেটা খুব সহজ গো! বিচিত্র হেসে দুর্গামনি কঠিন গলায় বলল, এই ছেলেকে আমি খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছি। এর ভাতও চাই না, আগুনও চাই না।

-মাথা গরম করো না, একবার ভাবো।

-তিন মাস ধরে অনেক ভেবেচি ঠাকুরপো। শুধু ভাবিনি, কেঁদেওচি। কুনো কুল কিনারা পাইনি গো! আমার বাসিভাত খাওয়া পেটে এমন অসুর কুথা থেকে এল বুঝিনে। আঁচলে মুখ ঢেকে আবার ফুঁপিয়ে উঠল দুর্গামণি, তুমি এখুন যাও ঠাকুরপো। আর কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিও না। আর এট্টা কথা–নিজের আয়নায় অন্যকে দেখতে যেও না, ঠকবে।

লুলারাম আর দাঁড়াল না, হনহনিয়ে হেঁটে গেল বেড়ার ধারে। আগড় খুলে ধুলো পথে এসে দাঁড়াল সে। সারাদিনের মেহনতটা তার মাটি হল। দুর্গামণির মন কঞ্চি নয় যে ধাপিয়ে দেবে। পাটকাঠি হলে ভেঙে যেত। এত মনের জোর এই অভাবের সংসার থেকে পেল কীভাবে–এসব ভাবতে ভাবতে নিজের উঠোনে ঢুকে এল সে।

চুনারাম ঘাস কেটে ফিরেছে মাঠ থেকে। ঘাসের বোঝাটা গোরুর পাতনার কাছে নামিয়ে সে দেখতে পেল রঘুকে। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল তার। বংশের বাতি জেল খেটে আজ ঘরে এল। এ লজ্জা কোথায় লুকাবে সে। গরীব মানুষের মান সম্মান ছাড়া হারাবার তো আর কিছু নেই। সেই অমূল্যধন ক্ষুইয়ে আজ ঘরে এসেছে রঘুনাথ। না এলেই বুঝি ভালো হত। বেশ বিব্রত আর অসহায় দেখাল চুনারামকে।

কীভাবে নাতির মুখোমুখি দাঁড়াবে সে-কী বলবে তাকে–এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল চুনারামের মাথার ভেতর। তবু দাঁড়াতে হয়, না দাঁড়ালে কি পারা যায়? অনেক দিন পরে চুনারামের মনে হল সে নিজেই যেন কোনো জঘন্য অপরাধ করে ঘরে এসেছে, তার এতদিনের জমিয়ে রাখা অহঙ্কার সব মিশে যাচ্ছে ধুলোয়।

রঘুনাথকে পাশ কাটিয়ে তক্তপোষের দিকে যেতে গেলেই একটা ডাক ভেসে আসে তার কানে, দাদু!

এবার দাঁড়িয়ে পড়ল চুনারাম। যান্ত্রিকভাবে মাথাটা বেঁকিয়ে শুধোল, কি?

-কেমুন আচো গো দাদু? রঘুনাথের গলায় আবেগ কচুপাতার জলের মতো টলমল করছিল।

চুনারাম কিছুটা নীরসভাবে বলল, না মরে বেঁচে আছি। গরীবের আর থাকা না থাকা।

অবস্থা সুবিধার নয় বুঝে রঘুনাথ বলল, বড়ো ভুল করে ফেলেচি, ইবারের মতুন মাপ। চুনারাম কিছুটা উত্তেজিত, সব কাজের কি মাপ হয় রে?

এবার কি জবাব দেবে শরীর হাতড়েও খুঁজে পেল না রঘুনাথ। এ বাড়ির সবাই এত নিষ্ঠুর হবে ভাবতে পারেনি সে। নিজের ঘর এ কমাসে পর হয়ে গেছে তার কাছে। সে ভেবেছিল অন্তত মা তাকে সব ভুলে গিয়ে আবার আগের মতো কাছে টেনে নেবে। ভুল। মার ভেতরের পাথরটাকে সে আর এ জীবনে গলিয়ে নরম করতে পারবে না। এত কাছের দাদুও তার পর হয়ে গেল। ভালোভাবে কথাও বলতে চাইছে না ওরা। এই মানুষগুলো এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল? রঘুনাথ ভাবত-এরা এলেবেলে, খড়কুটো। এরা শুধু পেটে খেয়ে বাঁচার জন্য প্রাণপাত করে। এদের কোনো আদর্শ নেই, ধর্ম নেই। এতদিন ভুল বুঝেছে রঘুনাথ। চোখের দুকোল মুছে নিয়ে বাইরে এল সে।

খাঁ-খাঁ করছে দুনিয়া। আজ যেন বুড়িগাঙও তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। বুকটা পাথর হয়ে এল তার। জমাটবাঁধা দুঃখগুলো কান্না হয়ে ঝরে পড়তে চাইল পথের ধুলোয়।

যে ঘরে তার জন্য এত ঘৃণা এত অবজ্ঞা জমে আছে–সেখানে কি তার থেকে যাওয়া উচিত হবে–একথা বারবার করে ভাবল রঘুনাথ। আকাশ আর এই ধুলোপথ ছাড়া আর কোনো কিছুকেই তার আপন বলে মনে হয় না।

টগরী কিতকিত খেলছিল, নুপূর ছককাটা ঘরের পাশে দাঁড়িতে অপেক্ষা করছিল দান পাওয়ার। ওর হুঁশিয়ার চোখ সতর্ক মাছরাঙার মতো দেখছিল টগরী দাগে পা দেয় কী না।

তখনই রঘুনাথকে ছন্নছাড়াভাবে যেতে দেখে টগরী উৎসাহ নিয়ে লাফিয়ে উঠল রঘুদা, কবে এলে গো?

খেলা থেমে গেল টগরীর। পা দুটো ফাঁক করে অদ্ভুত কায়দায় সে দাঁড়িয়ে আছে। নূপুর দৃষ্টি ঘুরিয়ে রঘুনাথকে দেখে থ। দান-দেখা ভূলে সে দৌড়ে গিয়ে রঘুনাথের মুখোমুখি দাঁড়াল, দাদা, কখন এলি রে?

রঘুনাথ কোনো কথা না বলে গম্ভীর হয়ে দাঁড়াল।

 টগরী আপন মনেই বলল, তুই চলে যাবার পর জেঠি কত কানছিল।

কথাগুলো যেন লিকলিকে চাবুক হয়ে আছড়ে পড়ল রঘুনাথের পিঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে কিছু বলতে গেলেই নূপুর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কুথায় চললি ঘর চল। আমি আর খেলব না।

রঘুনাথ এবার বাধ্য হল মুখ খুলতে, আমি ঘর যাবো না, মাঝের গাঁ যাবো।

-মাঝের গাঁ পরে যাস। এখন ঘর চল তো, কথা আছে। নূপুরের ঠোঁটে হাসি এক রহস্যময়তার গন্ধ দিল রঘুনাথকে। এসব এড়িয়ে সে টগরীর মাথার হাত রাখল স্নেহের, এখন কেমুন আছিস রে টগরী?

টগরী মুখ ফাঁক করে বলল, খু-উ-ব ভালো। কেসনগরের ডাক্তার দেখেছিলো, ওষুধ দিয়েছিলো তাতে ভালো হয়ে গিয়েচি, দাদা। এখুন আর পেটে কুনো বিদনা হয় না। এখুন আমি রোজ কিতকিত খেলি।

সূর্যের কিরণের চেয়েও ঝকমকে হাসছিল টগরী, হাসতে হাসতে সে কেমন উদাস হয়ে গেল, রঘুনাথের ডান হাতটা চেপে ধরে বলল, দাদা গো, তুমাকে যেদিন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল–সেদিন আমি কত কালাম। মা শীতলাবুড়িকে বললাম–আমার দাদাকে যেন পুলিশ না মারে। দাদা, তুমাকে কি পুলিশ মেরেছিল? কুথায় মেরেছে গো? আর কুনোদিন খারাপ কাজ করো না দাদা।

আবার দু-চোখ বর্ষার মেঘের মতো ভারী হয়ে উঠছিল রঘুনাথের, কোনো মতে টগরীর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সে বলল, তুই ভালো আছিস শুনে আমারও খুব ভালো লাগল। তোর অসুখে আমি ভীষণ ঘাবড়ে গেছিলাম।

-তুমার কি মন বলছিল আমি মরে যাব?

না রে পাগলি, তা কেনে হবে?

টগরী বিষণ্ণ হয়ে বলল, আমার কাচে লুকিয়ো না। আমি সব বুঝি গো। এ পাড়ার কেউ ভাবতে পারেনি, আমি আবার বেঁচে ফিরব। তবে দাদা, আমি জানতাম–আমি মরব না। কষ্ট পাবো, কিন্তু মরব না। হাসপাতালে রোজ শীতলাবুড়ির সাথে আমার কথা হত। আমি বেছানায় শুয়ে-শুয়ে তারে ডাকতাম যে!

টগরী আর নূপুরকে এড়িয়ে যাওয়া রঘুনাথের পক্ষে সম্ভব নয়। ওরা ফুলগাছের মতো ডালপালা দিয়ে ঘিরে ধরেছে ওকে। সুগন্ধ এড়িয়ে মানুষ কতদূর যেতে পারে?

নূপুর রঘুনাথের হাতে ইঙ্গিতপূর্ণ চিমটি কেটে হাসল, দাদা, কমলাদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অনেক কথা আছে, তুই কখন আসবি বল?

যে সম্পর্ক শুকিয়ে গিয়েছে, সেই সম্পর্কে কিভাবে ফিরে আসে বিদ্যুৎ-এর শিহরণ। রঘুনাথ শুধু চমকে উঠল না, অবাকও হল কিছুটা। নূপুরের মুখের দিকে তাকিয়ে সে কিছুসময় বাক্যহারা হয়ে রইল।

নূপুর বলল, দাদা, কমলাদি ঘরে এয়েচে। ওর বরও সাথে এয়েছে। আমাকে বলল–তুমাকে খবরটা দিয়ে দিতে।

রঘুনাথের ভেতরটা তছনছ হয়ে গেলেও সে যথাসম্ভব প্রতিক্রিয়াহীন থাকার চেষ্টা করল নুপুরের সামনে। কমলার কোনো কথাই সে রাখতে পারেনি। জন্মগত সংকোচ তাকে পা বাড়াতে দেয়নি। পদে পদে বাধা এসে আগলে দিয়েছে পথ। সাহস করে কমলার হাত সে চেপে ধরতে পারেনি–এটা তার অক্ষমতা। উল্টে হাবুল চোরের কথা শুনে সে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যার কোনো ক্ষমা নেই। এই আফসোস কবে যে শেষ হবে কে জানে।

নূপুর হাঁ-করে তাকিয়ে ছিল কিছু শোনার জন্য, রঘুনাথ এড়িয়ে যাবার জন্য বলল, ঠিক আছে, তুই এখুন যা। কমলার সঙ্গে পরে আমি দেখা করে নেব।

–দেখা করো কিন্তু। নপুর নিশ্চিত হতে চাইল।

টগরী হাসতে হাসতে বলল, দাদা, আমাদের ঘরে কবে যাবা?

রঘুনাথ হাসতেগিয়েও পারল না, কষ্ট হল, কোনোমতে বলল, বেঁচে থাকলে ঠিক যাব। তোরা এখন যা

বাঁধের গা বেয়ে ঢালু পথটা গ্রামের ভেতর ঢুকে গেছে। গাছগাছালির ছায়ায় শান্ত পথ যেন ঘুমিয়ে আছে। নুয়ে পড়া বাঁশঝাড়ের সাথে পথের কি সখ্যতা রঘুনাথ জানে না তবু তার মনে হল এই চিরন্তন সম্পর্ক বুঝি মা আর সন্তানের মতো স্নিগ্ধময়।

একা হাঁটলে নিজের সঙ্গে কথা বলে মানুষ। নিজের সঙ্গে কথা বলে এখন ক্লান্তবোধ করে রঘুনাথ। বারবার করে তার মনে ভাসছে দুর্গামণির মুখ। সুখের বদলে দীর্ঘ মন্থনে উঠে আসছে দুঃখ। মা কি তার পর হয়ে গেল? দাদু? এত ঠুনকো এসব দীর্ঘকালীন সম্পর্ক? কে জানে। মানুষ অনেক কিছুই জানে না, বোঝে না।

রঘুনাথ সূর্যাক্ষের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল, সূর্য, সূর্য।

মীনাক্ষী বাইরে এসে দেখলেন তাকে। কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে ঘরের ভিতর ঢুকে গেলেন তিনি। রঘুনাথ দূর থেকে দেখতে চাইল–ওই মুখে তার জন্য কতটুকু ঘৃণা জমেছে এতদিনে?

মন খারাপ করার আরও অনেক কিছু রসদ লুকিয়েছিল রঘুনাথের জন্য। দ্বীপীদের বাড়িতে এসে সে জানতে পারল সূর্যাক্ষ পরীক্ষা দেবার জন্য কালীগঞ্জে চলে গিয়েছে। পরীক্ষা দেবার কদিন ওরা ওখানেই থাকবে। এতে সুবিধে অনেক, যাওয়া-আসায় সময় নষ্ট হয় কম। পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা আরও সহজ হবে। ঝড়-জলের আশঙ্কা প্রায়দিনই লেগে আছে, এখানকার বর্ষাঋতু কারও ধার ধারে না।

দ্বীপীদের বাড়িতে অদ্ভুত এক মৌনতা লক্ষ্য করল রঘুনাথ। মন খুলে কেউ তার সঙ্গে কথা বলল না। ঠিক এড়িয়ে যাওয়া নয়, অথচ অপ্রত্যক্ষভাবে এড়িয়ে যাওয়াটা মর্মে বিধে গেল রঘুনাথের। অন্তর্গত পাপবোধ তাকে মাথা সোজা করে দাঁড়াতে দিল না কিছুতেই।

ঘরে বাইরের এই দংশন রঘুনাথকে খোলা আকাশের নিচে দাঁড় করিয়ে দিল। মনে মনে সে ভাবল তার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এবার সে যাবে কোথায়? শুভর কাছে গেলে ওর মা নিশ্চয়ই তাকে তাড়িয়ে দেবে না। তবু ওখানে যেতে ইচ্ছে হল না তার। বিতাড়িত হবার জ্বালা অনেক। এই জ্বালা থেকে মুক্তির উপায় কি?

রঘুনাথ হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল বড়ো গঙ্গার শ্মশানের কাছে। জায়গাটা নির্জন, জল সেই নির্জনতাকে প্রকট করেছে। এখানে এলে একটা ভেজা গন্ধ টের পায় রঘুনাথ। পা ছুঁয়ে থাকা মাটি যেন একাকীত্বের কথা বলে।

বয়ে যাওয়া গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রঘুনাথের মনে হল তার এই জীবনের কি দাম আছে? গ্রামসমাজে একবার সম্মান হারালে সহজে তা ফিরে আসে না। পুকুরের জলে হারিয়ে যাওয়া সঁচ খুঁজে পাওয়া সহজ, কিন্তু ডাঙায় হারানো সম্মান ফিরে পাওয়া আরও কঠিন। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেল রঘুনাথ। সূর্যাক্ষ, শুভ, সবুজ… সবার সঙ্গে মেশার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে সে।এ কালিলেপা মুখ নিয়ে সে কোন ভরসায় ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। এমন ভাবনায় কেঁপে গেল রঘুনাথের দুর্বল হৃদয়। সব হারিয়ে গেলে দুঃখ নেই, কিন্তু বন্ধু হারিয়ে গেলে সেই দুঃখভার সে কি বইতে পারবে?

হরনাথ দূর থেকে দেখেই চিনতে পেরেছিল রঘুনাথকে। অমন মুখ ঝুঁকিয়ে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এল সে। লাল-লাল চোখ, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল, ফোলা গোলাকার মুখ নিয়ে সামনে এসে সঁড়াল হরনাথ, খুব নিবিষ্ট চোখে রঘুনাথকে জরিপ করে বলল, কি রে কবে এলি?

মনে মনে আঁতকে উঠল রঘুনাথ, তার জেল যাওয়ার খবরটা শ্মশানের ছাইভূমিতেও এসে পড়েছে, এবার কোথায় পালাবে সে, কোথায়? মুক্তির রাস্তাগুলো কেন্নো হয়ে শুয়ে আছে জড়োসড়ো। এই গুটিয়ে থাকা জীবনের উপর তার কোনো আগ্রহ নেই।

হরনাথ সহজে ছাড়ার পাত্র নয়, রঘুনাথের পাশে বসে শুধোল, কী হয়েছে তুর? ঘর থিকে পেলিয়ে এয়েচিস বুঝি?

ঘাড় নাড়ল রঘুনাথ, পেলিয়ে আসব কেন? পেলিয়ে পেলিয়ে কদিন আর বাঁচা যাবে বলো?

-তা ঠিক। কোমরে লাল গামছাটা জড়িয়ে নিল রঘুনাথ। চোখ রগড়ে নিয়ে সে হরনাথের দিকে তাকাল, তুমি তো শ্মশানে থাকো রাতদিন, তুমার কাচে নেশার কিছু হবে নাকি?

–তুই নেশা করিস? হরনাথ জটা ধরা চুলগুলো আঙুলে জড়াতে জড়াতে প্রশ্ন করল।

সশব্দে হাসল না রঘুনাথ, শুধু ঠোঁটে হালকা হাসি মাখিয়ে বলল, নেশা না করলে এসব কুকাজ কি করা যায় গো?

–ছেড়ে দে বাপ। নেশায় কিছু নেই রে

-যারে ধরেচি, তারে ছেড়ে দিলে লোকে আমাকে বেইমান ভাববে। রঘুনাথ গোল গোল চোখ মেলে তাকাল।

কপাল কুঁচকে হরনাথ আক্ষেপের সঙ্গে বলল, তুর বাবা আমার সাথে মদ খায়।

-বাপ খায় যখন, ছেলে খেলে বুঝি দোষের হয়।

–না তা নয়। হরনাথ অবাক হয়ে শুনছিল।

 রঘুনাথ বলল, আজ আমি জেল থিকে ছাড়া পেয়েচি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ভাবলাম-যাক আমি আজ বেঁচে গেলাম। আমি যা ভেবেচি–তা ভুল গো। জেল শুধু কেসনগরে নেই, জেল গায়ে-গঞ্জে সবখানেতে আচে।

–তুর হেঁয়ালি কথা রাখ, বাপ। নেশা করতে মন চায় তো চ। হরনাথ ওর হাত ধরে টানল।

 গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল রঘুনাথ। ক্লান্তিতে নুয়ে আসছে শরীর। তবু কষ্ট করে বেশ কয়েক কদম হেঁটে এল সে। চ্যাটচেটে পরিবেশে কাঁচা মদের ঘ্রাণ ভালো লাগে তার। গন্ধটা গাঢ় কুয়াশার মতো জড়িয়ে যাচ্ছে গায়ে।

পরপর তিন গেলাস খেয়ে ঢেকুর তুলে হরনাথের দিকে তাকাল রঘুনাথ, আর এট্টু দাও। নেশাটা জমচে না।

–আর খাস নে, মরে যাবি। যা, এবার ঘর যা। হরনাথ রঘুনাথকে বোঝাতে চাইলে গলা ফাড়িয়ে হেসে উঠল সে, আমাকে বোঝাতে এসো না গো। সকাল থিকে অনেক বুঝেচি। মাথা আর নিতে পারছে না। জোর করে বোঝাতে গেলে মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে যাবে-বুঝলে?

হরনাথ বুঝল নেশাটা গাঢ় হয়েছে রঘুনাথের। হাঁটা-চলার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে সে। একসময় সাট পাট হয়ে সে শুয়ে পড়ল বালির বিছানায়। তাকে আর সহজে ওঠাতে পারল না হরনাথ।

ভোরের দিকে হাবুল চোরের ঠেলা খেয়ে ঘুম ভাঙল রঘুনাথের। জড়ানো স্বরে শুধোল, কে, কে তুমি?

–চিনতে পারছিস নে ব্যাটা? আমি তোর…

-ও বুঝেচি, বুঝেচি। রঘুনাথ বালিতে ভর দিয়ে উঠে বসল। চোখ রগড়ে নিয়ে বলল, গুরু দক্ষিণা এভাবে কেনে নিলে ওস্তাদ? তুমাকে কতো করে মানা করলাম আমি যাবো নি, তবু তুমি আমার কথা শুনলে নি। ভালোবাসা অভিশাপ দেয় গো, সে অভিশাপ বড়ো মারাত্মক।

-ঘর চল। আমি তোরে ঘরে দিয়ে আসি।

-না। ওটি করো না। তাহলে আমার আঃ-ও যাবে, ফু-ও যাবে। রঘুনাথের স্বরে ব্যাকুলতা ঝরে পড়ল। হাবুল চোর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, পুলিশে ছুঁলে বাঘের চেয়েও বিষ বেশি হয়। মাস কয়েক সমঝে চল। তারপর তোকে আমি সময় মতো ডেকে নেব।

-তুমার ডাকে আমি আর যাব না। তুমি হলে গিয়ে মরণফাঁদ।

কাকে কি বলছিস? হাবুল চোর রঘুনাথের দুকাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে দিল, তোর নেশা এখনো কাটেনি। নেশা কাটলে পেছন থাবড়াবি বলে দিচ্ছি।

–আর জ্ঞান দিও না, ঢের হয়েছে। রঘুনাথ জ্বলে উঠল, তুমার জন্যি আমার সব গেল! মা ছিল,মা-ও পর হয়ে গেল!

দূর বোকা, মা কুনোদিন পর হয় রে?

-হয় গো হয়। নাহলে আমার ঘরে গিয়ে দেখে আসো। রঘুনাথ ডুকরে উঠল, দাদুও আমার সাথে কথা বলছে না। আমাকে ঘেন্না করচে যেন আমার গায়ে কুঠ ফুটেছে।

–এতে আমার দোষ কুথায়?

–সব দোষ তুমার। তুমি আমাকে হাতে ধরে বেলাইনে নিয়ে এলে। আমি তুমার ছেলের মতো। ছেলেকে কেউ হাড়িকাঠে গলা দিতে ঠেলে দেয়। মাথার চুল মুঠো করে আর্তনাদে ভেঙে পড়ল রঘুনাথ।

হাবুল চোর আর দাঁড়াল, পেছনের ভেজা বালি ঝেড়ে বলল, গুয়ে শালিখের মতো তোর জন্ম। কত আর ভালো হবি বাপ। আমি চললাম। এবার তুই নিজের পেছন নিজে চাপড়া।

কথাগুলো শেষ না করেই হনহনিয়ে হেঁটে গেল হাবুল চোর। ভোরের আলো ফোটার আগে থানায় তাকে হাজিরা দিতে হবে। যা কড়া বড়োবাবু এসেছে হাজিরায় দেরি হলে মেরে মাজা ভেঙে ঘরে শুইয়ে রাখবে মাসের পর মাস। চুরি বিদ্যে তখন শিকেয় ভোলা ফুলের মতো শুকিয়ে ঝরঝরে হয়ে যাবে। শুকনো ফুলের এক পয়সাও দাম নেই–এটা হাবুল চোরের চাইতে ভালো করে আর কেউ জানে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *