১০. প্রকৃতির ধর্ম

৪৬.

পাল্টে যাওয়াই প্রকৃতির ধর্ম।

মাত্র এক বছরে অনেকটাই বদলে গিয়েছে হলদিপোঁতা। পিটুলি গাছের পাতাগুলো টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে কদিন হল। ঝারির কোল ভরেছে মাস কয়েক আগে।

ভূষণী বুড়ি ধার পাত্তিতে ওর নাড়ি কেটে বলল, তুর বেটা হয়েচে রে, বউ! নাড়ি শুকোলে আমাকে নিদেন পক্ষে সোনা দিবি। ইবার আর কাঁসা পেতলে মন ভরবে না। তুর বাঁজাগাছের ফল, শুকনা হাতে বিদেয় আমি লিবো নি।

কোঁত পাড়তে গিয়ে ঘেরা দাওয়ায় চোখে জল এসে গিয়েছিল ঝারির। প্রসব বেদনায় যে এত সুখ স্বপ্নেও ভাবেনি সে। কাঁচা খোকার মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখের তারা স্থির হয়ে গেল।

ভূষণী বুড়ি বলেছিল, আর কাঁদিস নে বউ। পেট হালকা হলে মনও হালকা হয়। হালকা মন কেঁদে কেঁদে আর ভার করিস নে। মেঘলা দিন কার আর ভাল লাগে বল?

দেখতে দেখতে চাঁদের টুকরো ছেলেটা এখন কোল ভরিয়ে হাসে। মনে হয় যেন বুড়িগাঙের জলে কোজাগরী চাঁদ খেলছে, সাঁতরে ডুব দিয়ে আবার ভেসে উঠছে। তখন বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কাঁপুনি টের পায় ঝারি। ভিকনাথ পাশে বসে ছেলের চুকচুকিয়ে দুধ খাওয়া দেখতে দেখতে বলে, দুধ দেওয়ার সময় এত কি ভাবো বলোদিনি?

ঝারির হুঁশ ফেরে, ভাবার আর সময় পাই কখুন? মায়ের দুটা সময় ভাবনা বেশি। ছেলেকে দুধ খাওয়ানোর সময় আর উকুন মারার সময়। এছাড়া ভাবার আর সময় কুথায়।

ঝারির চোখে দেওয়ালির তারাবাতির ঝিলিক। তার সারা শরীরে মাতৃত্বের রেণু দুধের সরের মতো কোমল হয়ে জড়িয়ে আছে। ভিকনাথ চোখ ফেরাতে পারে না। এ ঝারি তার চেনা নয়, একে যেন সে প্রথম দেখছে।

মা হলে যে কোনো মেয়ে আকাশের চেয়েও সুন্দর। পাকুড়গাছের নতুন পাতা গজানোর মতো তার লাবণ্য-আভা। মাতৃত্বের আলোটাই আলাদা। তবু এই অলৌকিক আলোর মধ্যে অন্ধকারের সাপটি ঘাপটি মেরে বসে থাকে। সেই সাপটাই মাঝে মধ্যে ফণা তোলে। বিষ ঢেলে দিতে চায়।

লুলারামের ব্যবহার এখন ঝারির কাছে পাগলের মতো মনে হয়। ওর আব্দার মেটাতে ঝারি অপারগ। লুলারাম তাকে দোষারোপ করে বলে, তুমার জন্যি আমার বউ মরল। এখুন আমাকে এড়িয়ে গেলে চলবে? আমার এটাও তো শরীল। আমারও তো খিদে পায়।

–অন্য পথ দেখো। ঝারি মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

–তুমি আমার ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। লুলারাম জোর করে হাসে, আজ সাঁঝবেলায় পাটের খেতে এসোক্ষণ।

-আমি আর তুমার কথা শুনব না।

-না শুনলে চলবে না। গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিলে চলবে? ধীরে ধীরে তেতে উঠছিল লুলারাম।

ঝারি ততোধিক শান্ত হয়ে বলল, এই শরীল নিয়ে আমি পাটের ভূঁইয়ে যেতে পারব নি, জানগুরু

-ও শালারে আমি খুন করব। তুমি যদি না আসো কাল শুনবা জানগুরুর কেউ টুঁটি কেটে দিয়েচে। লুলারাম চিবিয়ে চিবিয়ে হাসল।

ভয় পেয়ে মুখটা মলিন হয়ে গেল ঝারির, খবরদার ও কাজ করো না। ওই মানুষটা না থাকলি পরে আজ আমি কুথায় তলিয়ে যেতাম। তুমরাই সবাই মিলে আমাকে মেরে ফেলতে।

এ তুমার মন গড়া কথা। লুলারাম চোখে চোখে হেসে উঠল, কেউ কারোর জন্যি বাঁচে না। যে যার আয়ুর জোরে বাঁচে। তুমাকে আমি অসময়ে দেখেচি। ঘর-সনসার ফেলে তুমাকে দেখেচি। আমার অসময়ে তুমি আমাকে দেখবা না?

–আমি পোয়াতি।

-সারা গাঁ চষে বেড়াচ্ছে, শুধু পাটভুঁইয়ে গেলে দোষ? লুলারাম লোভী চোখে তাকাল, আমার সোনার হার ছড়া খুলে দাও। আমার হার পরে পরের মন ভরাবে তা হয় না।

গলায় হাত দিয়ে সোনার হার ছড়াটার ছোঁয়া পেল না ঝারি, আফসোসের সঙ্গে বলল, তুমার জিনিস আমি তুমায় ঘুরোণ দেব। ঠিক আছে পাটভুঁইয়ে এসো। ঘর থেকে নিয়ে তোমায় দিয়ে দেব।

-সেই ভালো। লুলারাম আর দাঁড়াল না।

 হালকা হবার নাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ঝারি। দূর থেকে ভিকনাথ তাকে দেখতে পেলে। মনে সন্দেহ খরানীকালের কাতলামাছের মতো ঘাই দিয়ে ওঠে। পাকা বাঁশের লাঠি নিয়ে ঘর থেকে সে বেরিয়ে যায়। আজ এসপার ওসপার করে ছাড়বে। রোজ রোজ ডালভাত আর ভালো লাগে না।

ঝারি এগিয়ে গিয়ে আবছা আঁধারে আলের উপর দাঁড়াল। লুলারাম আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিল।ঝারির হাত ধরে সে পাটখেতের দিকে টেনে নিয়ে যেতে গেলেঝারি তাকে বাধা দিল–থামো। হাত ছেড়ে দাও। তুমাকে বলেচি না আমি পোয়াতি।

-তুমার কুনো ক্ষতি হবে না।

হাত ছাড়ো বলছি। ঝারি রাগে অপমানে ফুঁসে উঠল, তুমার চোখে কি মানুষের চামড়া নেই? এই নাও তুমার হারছড়া। এবার আমাকে ছাড়ো। আমাকে যেতে দাও। সোনার হারটা মুখে পুরে লুলারাম বলল, সেই বিকেল থিকে দেঁড়িয়ে আছি, এখুন চলে গেলে হবে?

তুমার সে গুড়ে বালি। কোমর দুলিয়ে ঝারি ফিরে যেতে চাইলে লুলারাম তার খড়খড়ে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল ঝারির কোমর। বুকের কাছে টেনে এনে লেপটে নিতে চাইল শরীরে। ঝারি নুন দেওয়া জোঁকের ঢঙে নড়ে উঠল শরীরে মোচড় দিয়ে, তুমি এই সাঁঝবেলায় মদ গিলেচ?

পুরুষ মানুষ মদ খাবে নাকি দুধ খাবে? লুলারাম ক্রমশ সাহসী হয়ে উঠছিল। ঝারি দুহাত দিয়ে ঠেলে দিল তাকে। টাল সামলাতে না পেরে আলের উপর হুমড়ে পড়ল লুলারাম।

কাছিমের মতো চোখ পিটপিটিয়ে লুলারাম এক বিচিত্র ভঙ্গিতে বলল, মাগী, আমাকে ফেলে দিলি? দাঁড়া দেখাচ্চি তুর মজা! লাথ মেরে তুর পেট ধসিয়ে দেব। ভার হয়ে যাওয়া গতর নিয়ে ঝারি দেীড়াচ্ছিল বুড়িগাঙের দিকে। ওখানে পৌঁছাতে পারলে তার বিপদ কেটে যাবে। অন্তত চেঁচিয়ে ডাকলে বাঁধ থেকে যে কেউ শুনতে পাবে তার ডাক। ঝারি টলমল পায়ে ছুটছিল। তার পেছন পেছন গ্যাড়া মোষের মতো ছুটছিল কামে থরথর লুলারাম।

পুরুষের কাছে নারী অনেক সময় অসহায়। লুলারাম লালসার হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল ঝারির আঁচল। হ্যাঁচকা টান দিয়ে পড়পড় করে খুলে ফেলল তার শাড়ি। শায়া নেই, ব্লাউজ নেই। আঁধারে ঝারি মা কালী। ওর খণ্ডিত শরীরের একখণ্ড অঞ্চল জুড়ে আলোর চাষআবাদ। সেই আলোর উৎসকে সমূলে উৎখাত করতে মরিয়া লুলারাম তার দানবীয় হাত দুটোকে সাঁড়াশি বানিয়ে ঝারির কণ্ঠনালীর কাছাকাছি নিয়ে গেল। ঝারি মাগো! আর্তনাদ করে দুহাত পেটে চেপে বসে পড়ল মাটিতে। দুই হাঁটুতে ঠোকা খেল তার নিম্নাভিমুখী মাতৃত্বের আধার। অন্ধকারে চিৎকার করে কেঁপে উঠল সে।

ভিকনাথ আর ধৈর্য ধরতে পারল না। লাঠি উর্ধ্বে তুলে সজোরে কষিয়ে দিল লুলারামের মাথায়, ঘরে কি তুর মা-বুন নেই, ছাগল কুথাকার?

অন্ধকারে ভিকনাথের গলাটা চিনতে পারে লুলারাম। নিজেকে সামলে নেবার আগে আর একটি বেদম আঘাত তাকে থেতলে দেয়, মাটি নেওয়ার আগে সে শুনতে পায় ভিকনাথ গলার রগ ফুলিয়ে বলছে, এখুনো সময় আছে পালা, নাহলে মরবি। বাপ হবার আগে আমি খুনী হলে কুনো পাপ লাগবে না।

লুলারাম অন্ধকার ফুঁড়ে হাপড়ে সাপড়ে ছুটছে। তার পায়ের শব্দে রাতের পাখি সচকিত হয়। ঝারিকে বুকে টেনে নেয় ভিকনাথ, কেঁদো না চোখের জল মুছে নাও।

হাত বাড়িয়ে শাড়িটা টেনে নিয়ে গায়ে চাপা দেয় ঝারি। শীত শীত ভাবটা উড়ে এসে তার শরীর দখল নেয়। শরীর ঘিরে বাড়তে থাকে ভয়। ভয়ের আয়ু কম। তবু অজানা এক ভয় কাবু করে দেয় ঝারিকে। ফুঁপিয়ে উঠে সে বলে, ওরে আমি বিশ্বেস করি নে। সুযোগ পেলে ও আমার পেটেরটাকে খতম করে দিবে।

–অত সস্তা নয়। ভিকনাথ ঝারিকে ঝাঁকুনি দিল, চুপ করো। ঘর চলো। আলের উপর মা লক্ষ্মীর মতো ধীরে ধীরে পদচিহ্ন এঁকে ঘরের পথ ধরে ঝারি। অন্ধকার তার পিছু ছাড়ে না আলোর প্রার্থনায়।

.

বুড়িগাঙের জলে রোদ পড়লে আকাশের সহস্র তারা বুঝি ঝিলিক দিয়ে ওঠে জলের শরীরের বৈভব দেখিয়ে। মন ভালো না লাগলে পাকুড়তলায় মাচায় চুপচাপ পা ঝুলিয়ে বসে থাকে রঘুনাথ।

তিনদিন হল গা ছেড়েছে লুলারাম। তার গা ছাড়ার কারণ এখনও কেউ জানতে পারেনি। নূপুর কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসেছিল ঝারির কাছে। সব শুনে মুখে কুলুপ এঁটেছিল ঝারি। নূপুর কান্নাকাটি করতেই ঝারি তাকে বুঝিয়ে বলল, মা শীতলাবুড়িকে মন দিয়ে ডাক। তুর বাবা ঠিক ফিরে আসবে। সে মানুষ হারাবার নয়। যে মানুষটা সবাইকে হারিয়ে দেয় সে কেন লোকের কাচে হারবে?

–গাঁয়ে তার শত্রু কম নেই। বুঝিয়ে বলেছিল নূপুর। ঝারি কিছুটা নিষ্ঠুর হয়ে বলেছিল, আগুন খেলে অঙ্গার তো হাগতে হবেই। তবে তুর বাপের কথা আলাদা। গত পাঁচ মাসে সে এদিকপানে একবারও আসেনি।

কথা না বাড়িয়ে নূপুর ফিরে গিয়েছিল ঘরে। নিজের বাপকে সে ভালো চেনে। মানুষটা তড়বড়ে লাট্টুর মতন, এক জায়গায় স্থিতু হতে জানে না।

রঘুনাথ ভরসা জুগিয়ে বলল, ভাবিস নে বুন, সে ঠিক ফিরে আসবে। তার মতন চালাক চতুর মানুষ এ গাঁয়ে আর কটা আচে।

তবু মন সুস্থির করতে পারে নি নূপুর। বাপ চলে গেলে তার চারধার আঁধার। মুনিরাম থেকেও না থাকার মতো। তার কথা এখন কেউ শোনে না। মোলকও ঝিম ধরে আছে খবরটা শোনার পর থেকে। এমনিতে সে কম কথার মেয়ে। খবরটা শুনে আরও গম্ভীর হয়ে গিয়েছে সে। কিছু ভালো লাগছে না তার।

চুরি বিদ্যে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে রঘুনাথ। ওপথে হেঁটে কোনো শান্তি নেই উল্টে থানা এসে ঢুকে যায় ঘরের ভেতর। রঘুনাথ মাচায় বসে পা দোলাতে দোলাতে তার প্রথম চুরির কথাগুলো ভাবছিল। দীনু খোঁড়ার দোকানের তালা ভেঙে আঁধারে দাঁড়িয়ে সে চুরি করবে কি, থরথরিয়ে কাঁপছিল। দীনু খোঁড়ার উপর তার প্রথম থেকে রাগ। বরাবরই ওজনে কম দিত সে। দাড়িপাল্লার একদিকে চুম্বক আটকে রাখত সে। কেজিতে শ দুশ গ্রাম কম দিতে তার হাত কাঁপত না। নীলাক্ষ কতবার ধরেছেন তাকে। তবু দীনু খোঁড়ার কোনো লজ্জা শরমের বালাই ছিল না। তোক ঠকিয়ে তার খুব বড়োলোক হওয়ার ইচ্ছে। সেই ইচ্ছের গুড়ে বালি ছিটিয়ে দেবে রঘুনাথ। লজেন্সের দাম বেশি নেওয়ার হিসাব বুঝে নেবে সে। ভগবান তাকে শাস্তি দিয়েছে, তাতে তার মন ভরেনি, শিক্ষা হয়নি। পিঁপড়ের পেছন টিপে খাওয়া মানুষকে উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। পেতলের ডাবর ভর্তি খুচরো পয়সাগুলো তাকে প্রলুব্ধ করে। ডাবর সমেত খুচরো পয়সাগুলো নিজের ভেবে চটের থলিতে পুরে নেয় রঘুনাথ। এত পয়সা, নির্ঘাৎ দুশ টাকার উপরে হবে। এ বাজারে দুশ টাকার অনেক দাম। রঘুনাথের চোখ চকচকিয়ে ওঠে। পা দিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সে একদলা মিছরি মুখের ভেতর পুরে নেয়। কুড়মুড় করে চেবায়। পরের ধনকে নিজের ভাবার অনুভূতিতে চনমনিয়ে ওঠে মন। ডাল, গুড়, সাবু, মিছরি, মশলাপাতিতে থলি ভরে নিঃসাড় পায়ে বেরিয়ে আসে দোকান থেকে। আগু পিছু দেখে। অন্ধকার ছাড়া কেউ নেই। অন্ধকার ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করে রাত কটা। বড়ো জোর দশটা এগারটা। এর মধ্যে ঘুমে অসাড় গ্রামখানা। গাছপালার সব মুছিত দশা।

এই থলি নিয়ে রঘুনাথ কোনোদিন ঘরে ফিরতে পারবে না। দুর্গামণির হাজার প্রশ্নে কেঁচো হয়ে যাবে সে, কথা বলার ইচ্ছেটাই ফুরিয়ে যাবে চোখের পলকে। দুর্গামণিকে বোঝাবার ক্ষমতা তার আর কোনোদিন হবে না।

চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। ধরা পড়লে পিঠ হতে হবে কাছিমের খোল। মাটির সরা হলে পিঠ ফাটবে, ঝরবে রক্ত। বদনাম বদবু হয়ে ছুটবে চারধারে। রঘুনাথ এসব আর চায় na। সে চায় দুর্গামণির মুখে হাসি ফুটুক। আগের সেই প্রাণোচ্ছল হাবভাব ফিরে আসুক। মাকে সে আর দুঃখ দিতে চায় না। মাকে দুঃখ দেওয়ার আগে না খেয়ে শুকিয়ে মরা ঢের ভালো।

হাড়মটমটির ঝোপে ভর্তি থলিটা লুকিয়ে রেখে ঘরে ফিরে গিয়েছিল রঘুনাথ। দুর্গামণি তখনও ভাত নিয়ে বসে আছে। ওর চোখের কোণে কালি, দুঃশ্চিন্তা। কতদিন হাসেনি সে। একদিন আক্ষেপ করে বলল, রঘুরে, তুর জন্যি আমাদের মরণ হবে। আর কাদাসনে বাপ। নিজেরে সামলা।

নিজেকে সামলায়নি শুধু, পুরোপুরি বদলে ফেলেছে নিজেকে রঘুনাথ। হাবুল চোর এসেছিল তাকে কুলবেড়িয়ায় নিয়ে যাবে বলে। রঘুনাথ শরীরের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে গেছে।

হাবুল চোর তার মনোভাব বুঝতে পেরে বলেছে, তোরে বিবেকের সাপটা দংশাচ্ছে। মনে রাখিস, ও সাপের বিষ নেই। যার বিষ নেই, তার অমৃতও নেই। দুদিন পরে ঠোকা খেয়ে সেই আমার কাছে তোকে আসতে হবে। কথাটা মনে রাখিস।

হাবুল চোর চলে যাওয়ার পরেও রঘুনাথের কোনো আফসোস হয়নি। ওর সাপের গল্পটা তার বিশ্বাস হয়নি। মন যা বলে তা না করাই ভালো, বিবেক যা বলে সেটাই তো আসল আলোর পথ। সে কেন আলোর পথে হাঁটবে না? মনটাকে লোহার শিকের চাইতে শক্ত করল রঘুনাথ।

তখনই হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এল ভিকনাথ, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুর বাপরে নীলাক্ষবাবুর পেয়াদা এসে ধরে গিয়ে গিয়েছে। খপখপ চল, নাহলে তুর বাপকে ওরা মেরে ফেলবে।

কথাগুলো শুনে সারা শরীর কেঁপে উঠল রঘুনাথের। শুধু ভয় নয়, এক অন্যধরনের উত্তেজনায় টনটনিয়ে উঠল তার শিরা-উপশিরা। টান ধরল স্নায়ুতন্ত্রে। কমুহূর্ত বাকরুদ্ধ চোখে তাকাল সে।

ভিকনাথ তাড়া দিল তাকে, চল, আর দেরি করা যাবে না। আমি যাই–পাড়ার সবাইকে খপর দিয়ে আসি।

রঘুনাথের ঠোঁট বেঁকে উঠল, খপর দিয়ে কুনো কাজ হবে না। ওঁরা ইঁদুরের চেয়েও ডরপুক।

-কেউ না যাক, আমি যাব। ভিকনাথের গলার দুপাশের শিরা ফুলে উঠল, এ কি মগের মুলুক নাকি–যা খুশি তাই করবে? গুয়াদার মতো মানুষ হয় না। সে কুন দুঃখে পরের খাসি চুরি করতে যাবে? তার কি খাওয়া-পরার অভাব আছে?

অভিযোগ শুনে থ হয়ে গেল রঘুনাথ। বাঁধ ধরে ছুটতে লাগল সে। ধুলো উড়ল তার পায়ের চাপে। ঘাম নেমে এল শরীর চুঁইয়ে।

নিমতলায় ভিড় জমে গেছে শমানুষের। পাকমোড়া দিয়ে মোটা রশিতে গুয়ারামকে বেঁধে ফেলেছে নীলাক্ষবাবুর পেয়াদা। মুখ কাতর করে যীশুখ্রিস্টের মতো দাঁড়িয়ে আছে গুয়ারাম। বিড়বিড় করে সে যেন কিছু বলতে চাইলে লাঠির বাড়ি মেরে তাকে থামিয়ে দিল পেয়াদা, বল, বাবুর খাসি কুথায় রেখেছিস বল?

–আমি কিছু জানি নে বাবু।

-জানিস নে? শালা হারামীর বাচ্চা। এবার লাঠির আঘাতটা তার মাথা ফাটিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের করে ছাড়ল।

কঁকিয়ে উঠল গুয়ারাম, আর মেরো নি গো। মরে যাবো

-মর। ছুটে গিয়ে জোড়া পায়ের লাথি মারলেন নীলাক্ষবাবু। হাঁপাতে হাঁপাতে শুধালেন, আমার সখের খাসিটা কোথায় বেচেছিস বল? নাহলে আজ মেরে-মেরে তোকে কিমা বানিয়ে ছাড়ব।

রাগে ফুঁসছিলেন নীলাক্ষবাবু। গ্রাম ভেঙে মানুষের ঢল নেমেছে গুয়ারামকে দেখার জন্য। ভিড়ের মধ্যে নানা মন্তব্য কান ঝালাপালা করে দিল রঘুনাথের। বড়ো অসহায় দেখাচ্ছিল তাকে। এভাবে তার বাবাকে যে কেউ মারতে পারে এটা তার স্বপ্নে ছিল না। হাতের মুঠি পাকিয়ে ভেতরে ভেতরে সছিল সে। জ্যান্ত সাপের ছাল ছাড়িয়ে নেওয়ার কষ্ট হচ্ছিল তার। বিষ আছে অথচ ঢালতে পারছে না সে। এক অসহ্য যন্ত্রণায় আঙুল কামড়াচ্ছিল রঘুনাথ। শরীরের রক্ত ফুটে উঠছিল টগবগিয়ে। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ওরা গুয়ারামকে মারছে। এর পিছনে কোনো যুক্তি নেই, প্রমাণ নেই। অনুমানের শিকার হয়ে একটা মানুষকে এভাবে শাস্তির মুখে ঠেলে দেওয়া কি উচিত হচ্ছে বাবুদের? দাঁতে দাঁত ঘষে রঘুনাথ উপায় খুঁজছিল বাবাকে বাঁচাবার।

তামাশা দেখার ভিড়টা বাড়ছিল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। এলোমেলো হাওয়ায় উড়ছিল ধূলিকণা। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে শংকর মাছের চাবুক হাতে দাঁড়িয়েছিলেন নীলাক্ষবাবু। তার শরীরে যে অত্যাচারিতের রক্ত প্রবাহিত এবং তা বুনো হাতির জেদের চেয়ে মারাত্মক সেই সুপষ্ট আভা পরিলক্ষিত হচ্ছিল তার হাবভাবে। মাঝে মাঝে তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠছিলেন, মার হারামীটাকে মেরে শেষ করে ফেল। তারপর যা হয় আমি তা সামলাব।

তার কথাগুলো যজ্ঞের জ্বলন্ত কাঠে ঘি ঢালার চেয়েও অগ্নি উৎপন্নকারী। ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে গুয়ারাম কেঁদে উঠল বাতাস কাঁপিয়ে, ছেড়ে দাও গো, আর মেরো না। আমি কুনো দোষ করিনি গোর ছেড়ে দাও গো, তুমাদের পায়ে ধরি।

তার আর্তি, আবেদন শোনার মতো মানুষ জামতলায় কেউ ছিল না। শুধু রঘুনাথ ফুঁসছিল। ভিকনাথ পাশে দাঁড়িয়ে চাপা রাগে ফুঁসে উঠে বলল, ওদের ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না রঘু। যা করার কিছু কর। ওরা যে তুর বাপকে মেরে ফেলবে।

ভিকনাথের কথায় তীব্র ভূমিকম্পের প্রকোপে কেঁপে ওঠা কাচের ইমারতের মতো কেঁপে উঠল রঘুনাথ, হাতের পেশি ফুলিয়ে ছুটে গিয়ে সে তার বাপকে বুক দিয়ে আগলে দাঁড়াল। খবরদার কেউ এর গায়ে আর এট্টা ঘাও দেবা না। দিলে ভালো হবেনি বলে দিচ্ছি। আমার বাপ চোর নয়। আমরা কেউ চোর নই। রঘুনাথের কথার তেজে বাতাস বারুদে ভরে উঠল। আচমকা ঢেউ আর গুঞ্জন উঠল সমবেত ভিড়ে।

নীলাক্ষবাবু ধুতির কোঁচা ফুলিয়ে এগিয়ে এলেন রঘুর কাছে, ঝাঁঝাল সুরে মুখ তুলে বললেন, তোর সাহস তো কম নয়। আমার এলাকায় এসে আমাকেই শাসানো। সর, সরে যা বলছি।

সরব না। রঘুনাথ বুড়ো আঙুলে পা আঁকড়ে নিজেকে বটগাছের চেয়েও দৃঢ়ভাবে দাঁড় করাল।

নীলাক্ষবাবুর নির্দেশে দু-জন পেয়াদা এগিয়ে গিয়ে রঘুনাথের হাত চেপে ধরল প্রাণপণে। রঘুনাথও অনড়, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ঝড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভূমিলগ্ন বটগাছ সে, তাকে উপড়ে ফেলা কার সাধ্যি! ততক্ষণে ভিকনাথ এসে ওদের মাঝখানে দাঁড়াল। গর্জন করে বলল, কাজটা ভালো হচ্ছে না, বাবু। আমরা গরীবগুবরো মানুষ মানচি কিন্তু আমরা চোর নই। গুয়াদা যে খাসি চুরি করেছে তার কুনো প্রমাণ আচে? প্রমাণ ছাড়া কাউকে কি সাজা দেওয়া যায়? আমরা ধাওড়াপাড়ার মানুষরা বাবুসমাজের একচোখি রায় মানব না।

ভিকনাথের চেঁচিয়ে বলা কথাগুলোয় আগুনের ঢেলা ছিল যা আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ভাসিয়ে দিল আগুনের হলকা। ভিড় আবার পিঠে ছ্যাঁকা খাওয়া অসাড় সাপের মতো নড়ে উঠল, সত্যিই তো সাক্ষী প্রমাণ ছাড়া একটা মানুষকে এভাবে পশুর মতো জঘন্যভাবে মারা যায় না। নীলাক্ষবাবু যা করছেন, সেটা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। সভ্য সমাজ তার এই কর্মকে কখনও সমর্থন করবে না। স্পষ্টত দুটি মত মাথা চাড়া দিয়ে উঠল সেই সময়। ভিড় দেখে জামতলায় সাইকেল নিয়ে হাজির হলেন কপোতাক্ষ। কোন একটি গ্রামে মিটিং সেরে ফিরছিলেন তিনি। তাঁকে দেখে বিরক্ত নীলাক্ষ কপাল কুঁচকে এগিয়ে গেলেন সামনে, তুই এখানে দাঁড়ালি যে, বাড়ি যা।

কি হয়েছে দাদা?

–কি হয়নি বল? নীলাক্ষ উত্তেজনায় কি ভাবে শুরু করবেন কথা হাতড়ালেন, আমার বড়ো খাসিটাকে কাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। ধাওড়াপাড়ার ধারের মাঠটাতে চড়ছিল। সন্ধেবেলায় ঘর আসেনি।

-তার জন্য ওই মানুষটাকে কেন বেঁধে রেখেছো?

–ওকে আমার সন্দেহ হচ্ছে।

–কাউকে সন্দেহের জেরে ওভাবে বেঁধে রাখা যায় কি? কপোতাক্ষর কণ্ঠস্বর গুরুগম্ভীর মেঘের মতো শোনাল, স্বাধীন সভ্য দেশে তোমার এই বর্বর ব্যবহারের সাজা কি জানো?

-থাক আর জ্ঞান দিস না।

-জ্ঞান নয় দাদা, যা ঘটনা আমি তাই তোমাকে শোনাচ্ছি। নিজেকে বদলাও। তোমার এই বুর্জোয়া সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব ত্যাগ করো। না হলে সব হারাবে। দিকে দিকে মানুষ জাগছে। কপোতাক্ষর কথাগুলো বক্তৃতার মতো শোনাল।

-যা তো, মেলা ফ্যাচফ্যাচ করিস না। বিরক্তি আর চেপে রাখতে পারলেন না নীলাক্ষ, ঠেলে ওঠা গ্যাস অম্বলের মতো ছিটকে এল বাইরে, তোর মতন মানুষগুলো এসব ছোটলোকদের মাথায় উঠিয়েছে। তোদের জন্য এদের এত বাড়বাড়ন্ত। যা, নিজের কাজ কর। আমাকে বাধা দিস নে।

–ভালো চাও তো, ওর বাঁধন খুলে দাও।

–যদি না খুলি?

 তাহলে আমি নিজে গিয়ে ওর বাঁধন খুলে দেব।

-তোর এত সাহস?

-এতে সাহসের কি দেখলে? যাকে তুমি সাহস বলছ–সেটা হল সত্য। কপোতাক্ষ থামলেন, তারপর তর্জনী তুলে বললেন, ওই দেখ, প্রতিবাদ কেমন তোমার মোটা দাড়িকে আঁকড়ে ধরেছে। পেয়াদা আর লেঠেল দিয়ে সব কাজ কি হয়? কিছু কাজ মগজ খাটিয়ে করতে হয়। তুমি আমার দাদা হও–সেই জন্য তোমাকে আমি অনুরোধ করছি, অন্য কেউ হলে আমি নিজে গিয়ে বাঁধন খুলে দিতাম। কেননা আমাদের লড়াইটা এই তোমাদের মতো গোঁড়া সামন্ততান্ত্রিক মানুষগুলোর বিরুদ্ধে। ওদের চোখে প্রতিবাদের ভাষা যতদিন না আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ছে–ততদিন আমাদের এই লড়াই থামবে না।

-যা তো, পাগলের মতো বকিস না।

–আমি পাগল নই, দাদা। আমি শুধু তোমাকে সতর্ক করছি। কপোতাক্ষ কিছু সময় গম্ভীর হয়ে গেলেন, তুমি রুদ্রর কথা ভাবো। সে তো তোমার ছেলে। তোমার ওই সোনার টুকরো ছেলে আজ তোমার বিরুদ্ধে, কেন? এসব কথা একবার ভাববে না? নিজের জেদ নিয়ে থাকা ভালো কিন্তু জেদের বশে অন্ধ হয়ে যাওয়া ভালো নয়। যাও দাদা, গুয়ারামকে ছেড়ে দাও। আর ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও।

ক্ষমা! ওর মতন ছোটলোকের কাছে ক্ষমা চাইব আমি? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? গরম তেলে জলের ছিটে পড়ার মতো চড়বড়িয়ে উঠলেন নীলা।

তোমার এত কিসের অহঙ্কার, দাদা? মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শেখো নাহলে শ্রদ্ধা হারাবে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হল কপোতাক্ষর।

ধাওড়া পাড়া থেকে জগৎখালি বাঁধের মাটি কাঁপিয়ে পিলপিল করে ছুটে আসছে সশস্ত্র মানুষ। অস্ত্র হাতে মানুষগুলো যেন এক একটা যোদ্ধা। তাদের ক্রোধিত হুঙ্কার বাতাসকে ধর্ষিতা রমনীর চেয়েও অসহায় করে দেয়। চোখ কুঁকড়ে ওই স্রোতের দিকে অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন নীলাক্ষ। তার দর্পের অট্টালিকার ফাটলটা সহজে দৃষ্টিগোচর হয়।

কপোতাক্ষর ভেতর থেকে আবেগটা ধূপের গন্ধ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল, দেখলে দাদা, মানুষ যে জাগছে–আর বুঝি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। জাগরণের সময়, প্রভাতবেলায় কেউ ঘুমিয়ে থাকে না। শুধু তুমি ঘুমিয়ে আছে। তোমার এই স্বৈরাচারী মনোভাব পাড়ায় পাড়ায় দাঙ্গা লাগিয়ে দেবে। ওই দেখো দাঙ্গা আগুন ধেয়ে আসছে।

ভিকনাথ সাতগুণ উৎসাহ নিয়ে ছুটে গেল ভিড় ঠেলে। রঘুনাথকে সরিয়ে সে ব্যস্ত আর মরিয়া হাতে গিট খুলে দিল মোটা রশির। গুয়ারামের কষ আর মাথার রক্ত হাতের তালুতে জেবড়ে নিয়ে বলল, তুমার এই অক্তো জল হবেনি। তুমার ঘরের রঘু এর বদলা নিবে। কেঁদো না গুয়াদা, চোখ মুছছে। ঘর চলো। আমাদের পোকাড়ে ভাগ্য, সেই জন্যি তুমাকে এই বয়সে, এমনধারা মার খেতে হল!

.

৪৭.

মাজা ধাপিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটছিল গুয়ারাম। এই বয়সে এমন আঘাত সহ্য করার শারীরিক ক্ষমতা তার নেই। শরীর থরথর করে কাঁপছিল ভয়ে। বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়া ভয়টা পণ্ডিত বিলের পুরনো মাছের মতো শরীরের রক্তে, মাংস-কোষে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে এখনও। একে সহজে কাবু করা যাবে না। বুকের কাছ থেকে একটা চিনচিনে শুলোনী উঠে কলজের কাছে এসে থেমে যাচ্ছে। বাবুর জোড়া পায়ের লাথিটা এই হাড়ের খাঁচায় লেগেছে, পাকাটির বেড়ার মতো মড়মড়িয়ে উঠেছে খাঁচাটা। আর একটু হলে ভেঙে যেত। যে কোনো যন্ত্রণার একটা নিজস্ব বেগ আছে। গুয়ারাম সেই যন্ত্রণাকে নিজের দেহে লুকিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছিল। বারবার করে ছোট ভাইয়ের কথা তার মনে পড়ছিল। লুলারাম এতদিন যা করেছে তা বুঝি ঠিক করেছে। রঘুনাথকে ভুল বোঝা তার উচিত হয়নি। সবাই যে যার মতো বাঁচে।

পেয়াদাগুলো ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বলছিল, লুলারাম থাকলে তোকে আজ ধরতামনি। সে শালা কুথায় পেলুলো কে জানে। বড় চালাক মানুষ সে, পাঁকাল মাছের মতো কুথায় সিঁদিয়ে যায় শিবের বাপও টের পায় না। চুরি বিদ্যায় লুলারামের খ্যাতি এ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। গেরস্থরা তাকে দেখলে মনেমনে ভয় পায়। মুখ ফুটিয়ে কারোর কোনো কথা বলার ক্ষমতা নেই। লুলারামের সঙ্গে থানার যা দহরম-মহরম তা প্রত্যক্ষ করে অবাক হয়ে যায় গুয়ারাম।

রেশন-দোকানী জগতবাবুর পাঁঠাটা হারিয়ে গিয়েছিল কদিন আগে, পাঁঠার শোকে কাতর জগতবাবু বারবার আসতেন তাদের দোরে। বিমর্ষ মুখ ঝাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন আর হাঁ-করে দেখতেন গুয়ারামকে। কাকুতি-মিনতি করে বলতেন, গুয়ারে, তোরে আমি খুশ করে দেব। আমার পাঁঠাটা ঘুরোন দে। ওটা আমার জান রে। ওরে আমি রেশনের গম-চাল সব খাওয়াতাম। ওই অবলা জীবটা পোর পর থেকে আমার যত রমরমা। গুয়ারাম শত চেষ্টা করেও রেশন দোকানীকে বোঝাতে পারেনি যে পাঁঠাটা সে নেয়নি এমন কী এধার-ওধার ঘুরতেও দেখেনি। এত বলেও মানুষটার বিশ্বাস অর্জন করতে সমর্থ হয়নি সে।

মনে মনে দুঃখ পেয়েছে গুয়ারাম। দশ বছর আগেও মানুষ তাদের বিশ্বাস করত। লুলারামের কীর্তিকলাপ সেই বিশ্বাসের দেওয়ালে ফাটল ধরাল ধীরে ধীরে। রঘুনাথ সেই ফাটলের ভেতর লুকিয়ে থাকা একটা বিষধর সাপ। আজকের এই ভয়াবহ, শোচনীয় পরিস্থিতির জন্য গুয়ারাম ওদের দায়ী করে।

রেশন-দোকানীর পাঠাটা ফিরে এল তিন দিন পরে। একটা পাঠী ছাগলের সঙ্গে মুখে স্বজাতীয় কামধ্বনি তুলে পাঁঠাটা চলে গিয়েছিল তার প্রেমিকার বাড়ি। প্রেমিকার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে তিন দিন সময় তার ঘোর কাটতে লেগেছিল।

পাঁঠাটা ফিরে আসার পর হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন জগতবাবু। কিন্তু গুয়ারামকে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করেন নি তিনি। কেন খবর দেবেন? গরীবগুরবো ছোটলোকদের এত মাথায় তুলতে নেই। কুকুরকে লাই দিলে, মাথায় তুললে আঁচড়াতে আসে। মাথার চুল আর পায়ের লোমের ফারাক থাকা দরকার।

হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল গুয়ারামের তবু এসব কষ্ট যেন তার ভেতরের দুঃখটাকে শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। এই মাঝ বয়সে এমন বুনো মার শরীর যেন সইতে পারে না। থেতলে যাওয়া ঠোঁটটা চিনচিন করে জ্বলছে এখনও। হাত দিতেও ভয়। বাঁ চোখের কাছটায় ঝুলে আছে মাংস। টনটন করছে চোখের চারপাশ। মাথার রক্ত চুঁইয়ে পুরো মুখটাকে করে দিয়েছে বীভত্স। এক ঝলক কেউ দেখলেই আঁতকে উঠবে। গা গতরের ব্যথাটা নিয়ে জোরে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল গুয়ারামের। কিছুটা হেঁটে এসে সে পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে থমকে গেল। রঘুনাথ মাত্র দশ হাত দূরে। তার হাতে একটা রাঙচিতের ডাল, মাঝে মাঝে সেই সরু লিকলিকে ডালটা বাতাসে চিতেসাপের মতো হিলহিল করে নাড়ছে।

ভিকনাথ কিছুটা অবাক হয়ে বলল, গুয়াদা, পেঁড়িয়ে পড়লে যে–চলো।

-হ্যাঁ, যাবো রে ভাই। আড়মোড়া ভেঙে কেমন বিপন্ন চোখে তাকাল গুয়ারাম, বড় মেরেচে রে, হাঁটতে পারচি নে।

-জানি, সব জানি। দাঁতে দাঁত ঘষে তাকাল ভিকনাথ। তারপর উত্তেজনা চেপে রাখতে পেরে বলল, মনে দুখ লিয়ো না, সব আমাদের ফোপরা ভাগ্য গো। তবে মনে রেখো গুয়াদা, এক মাঘে শীত যাবে না। তুমার ছেলে রঘু এর বদলা নেবেই নেবে। ওর জিদ আমি জানি। মন করলে ও জলে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।

গুয়ারাম চুপ করে শুনল, তারপর যন্ত্রণা হজম করে বলল,ওর ওই জিদটাকেই তো আমি ভয় পাই। ছেলেটার যে কুথায় গতি হবে কে জানে। গায়ে থাকলে বাবুদের হাতে মার খেতে খেতে ওর জেবনটা শেষ হয়ে যাবে।

-অত মাগনা নয়। ভিকনাথ তীব্র প্রতিবাদ করল, যুগ বদলেচে গো। যুগ যে বদলেছে তা তো তুমি নিজের চোখে দেখলে। কপোবাবু নিজের মায়ের পেটের ভাইকেও ছেড়ে কথা বলল না। সত্যি মাইরি, অমন মানুষ আমি দেখিনি গো! ইবার পঞ্চাত ভোটে বাবুরে আমরা জেতাব।

গুয়ারামের ভিতর থেকে এবার কথার উজান ঠেলে উঠল, এক গাছে দু-রকম ফুল হয় কি করে বুঝে পাইনে! একজন হয়েচে অসুর, তো অন্যজন হয়েচে দেবতা। এত দুঃখের মাঝেও ভিকনাথ হালকা করে হাসল, এ তো ভবের লীলা গো! এর ব্যাখ্যা কি আমাদের ছোটমাথায় হবে?

পাটের ভুঁইয়ে লুলারামের সাথে সেই যে দেখা হয়েছিল ভিকনাথের তারপর থেকে তার আর টিকি দেখতে পায়নি ভিকনাথ। মনের দুঃখে গাঁ ছেড়েছে লুলারাম। ঝারি তার মাথাটা আরও খারাপ করে দিয়েছে। মেয়েমানুষের উপেক্ষা অনেকের বুকে তীরের মতো বেঁধে, অনেকে আবার সেই আঘাতকে ভাবে বিচুটির জ্বলন। ঘন্টাখানিক কুটকুটিয়ে সে জ্বলন থেমে যায়, আবার স্বাভাবিক হয়ে যায় জীবনযাপন। সবাই যা পারে লুলারাম তা পারেনি। মনে মনে সে দন্ধে দন্ধে মরেছে। অপমানে কালসিটে মেরে গিয়েছে তার মুখ। এ পোড়ার মুখ গ্রামসমাজে সে দেখাবে কী ভাবে? কেউ না জানলে অন্তর তো জানবে। বিবেক মিছে কথা বলে না। বিবেকের ঘা কোনো মলমে সারে না। বিশেষ করে ঝারির কাছে তার মুখ দেখানো দায়। এক সময়ের দুর্ধর্ষ ডাকাত সময়ের ফসে পড়ে সিঁদেল চোরের মতো দিন কাটাতে পারে না। এর চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালো। লুলারাম আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়নি। রাতের আঁধারে সে গা ঢাকা দিয়ে পালিয়েছে। বিবেকের দংশন না জুড়ালে সে গাঁয়ে ফিরতে পারবে না। এ ঘটনায় ভিকনাথের মনে কোনো দুঃখ বা অনুশোচনা নেই। যেমন কর্ম করবে তেমন তো ফল পাবে। বরং তার পথের কাঁটা সরে গেল বিনা বাধায়। এ তো মেঘ না চাইতে জল পাওয়ার মতন।

ভিকনাথের নুয়ানো মনটা ডগা ধাপানো বাঁশ গাছের মতো হঠাৎ সিধা হয়ে গিয়েছে। মানসিক শান্তি দুনিয়ার সব চাইতে দামী টনিক। ঝারি এখন পোষা বেড়াল হয়ে তার সংসারে ঘোরাফেরা করে। ছেলে কোলে ঝারিকে মনে হয় গেরস্থঘরের তুলতুলে বউ। তার চোখেও সকালের নরম রোদের মতো গড়িয়ে নামে সুখ।

জানগুরুর পায়ের ধুলোয় কি যাদু ছিল ভিকনাথের সংসারের সব অসুখ ব্যাধি সেরে গেল। ঝারিকে এত সুখী, এত হাসিখুশি জীবনে সে দেখেনি। এখন আর ঝারিকে মনে হয় না সে দূর আকাশের তারা। ঝারি এখন বেড়ার উপর লতিয়ে যাওয়া চালকুমড়োর ফুল। সেই ফুলের ম-ম করা গন্ধ নেই, কিন্তু সৌন্দর্য আছে। তাকে ছোঁয়া যায়, নিজের করা যায়। সে ফুলের মালা হয় না, কিন্তু মালা গাঁথলে দোষ কোথায়?

ডিভিসির ছাড়া জলে যৌবন কইমাছের মতো ছড়ছড়িয়ে উঠছে বুড়িগাঙের। কোথা থেকে উড়ে এসেছে দুটো শামখোল পাখি, ওদের সাদা ডানায় জড়িয়ে আছে শ্রাবণের বুনো মেঘ। এ বছর বর্ষার ছিচকাঁদুনী স্বভাব বদলে গিয়ে অঝোর ধারায় ঢালছে। জগৎখালির গোড়ায় ঘোলা জল ক্ষুর নিয়ে প্রতিবার চেঁচে নিয়ে যাচ্ছে মাটি।

জল দেখবে বলে নূপুর আর মোলক দৌড়ে এসেছে বাঁধ অব্দি। ওরা যে বড়ো হচ্ছে সে খেয়াল ওদের নেই। রঘুনাথ কদমগাছের গোড়ায় বিড়ি টানছিল একমনে। এখন দিনে তার দু তাড়া বিড়ি লাগে না হলে সময় কাটতে চায় না। দু বান্ডিল বিড়িতেও অনেক সময় কম পড়ে তখন চেয়ে-চিন্তে নেশা জুড়োয়।

সব ঠিকঠাক থাকলেও মনটা ঠিক নেই রঘুনাথের। মার খাওয়ার পর থেকে গুয়ারামের বুকে বড়ো ব্যথা হয়। বারো বছরের পুরনা ঘি তার বুকে ভাপ দিয়ে ডলে দেয় দুর্গামণি। তাতেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি।

চুনারাম কদবেলতলা ধাওড়া থেকে শুনে এসেছে পুরনো শুয়োরের চর্বি ডলতে পারলে বুকের ব্যথা নাকি সেরে যায়। হাঁড়িপাড়ায় গিয়ে পুরনো চর্বির খোঁজ করেছিল সে কিন্তু সেখানেও পেল না। শুয়োরের চর্বি ডালডা ঘিয়ের মতো জমে গেলে অনেকেই ওষুধ কার কাজে কিনে নিয়ে যায়। হাজরা পাড়ার বুড়োটাই বলল, অতো ভেবো না তো। শুয়োরের চর্বি তুমি বসন্তপুর ধাওড়ায় গেলি পরে পেয়ে যাবে। আমি জানি, শ্রীকান্ত রাজোয়ারের ঘরে অনেক দিনের পুরনো চর্বি আছে। আগে ওদের শুয়োরের পাল ছিল। এখন অবশ্যি শুয়োরের পাল নেই কিন্তু চর্বি রয়ে গিয়েছে শিশি ভর্তি।

ছেলের জন্য বসন্তপুর ধাওড়া কেন হেঁটে হেঁটে সে মাটিয়ারি অবধি চলে যাবে। ছেলে তার প্রাণভোমরা। ছেলের জন্য সে পারে না হেন কাজ দুনিয়াতে নেই।

কিন্তু সব শোনার পর রঘুনাথ তাকে যেতে দিল না। জোর করে বলল, তুমার পায়ে বেথা, দাদু। তুমি ঘরে থাকো। আমি যেচি, চর্বি তুমাকে এনে দেবই দেব।

শুয়োরের চর্বি নিয়ে ফিরতে বেলা চড়ে গিয়েছিল টিকলিতে। চান-খাওয়া করে একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে যত ঝামেলা। তালাই পেতে শুয়েছিল গুয়ারাম। একটু ধরে এসেছিল চোখ, আর ঠিক তখনিই শুরু হল হাড়ের গোড়ায় গোড়ায় শুলোনী ব্যথা। বাপ রে, মা-রে বলে বাতাস কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল গুয়ারাম। তার সেই চেঁচানিতে চোয়াল চাগিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল রঘুনাথ, তারপর এক ছুটে চলে গিয়েছিল গুয়ারামের কাছে, কি হল গো, অমনি ধারা করছো কেনে?

-সেই বিদনা আবার তালভুসের মতন ঠেলে উঠচে। গুয়ারামের চোখের কোণে থেতো হয়ে গেল জল।

আর সেই জেবড়ে যাওয়া চোখের জলের দিকে তাকিয়ে রঘুনাথের সারা শরীর টগবগিয়ে ফুটে উঠল রাগে। এক অসুরজেদ তাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াল। ছুটে গিয়ে জোড়া পায়ের লাথি কষিয়ে দিচ্ছেন নীলাক্ষবাবু, এই দৃশ্য বায়োস্কোপের মতন বারবার ঘুরতে থাকে তার মনের পর্দায়। ফাঁকা মাঠে তাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় বুনো মোষ। ছুটতে ছুটতে জিভ বের করে হাঁপায় রঘুনাথ। কোয়াশের দুপাশে জমে ওঠে লতলতে ফেনা। বদলা, হা বদলা তাকে নিতেই হবে। গুয়ারামের প্রতিটি চিৎকার যেন ধারালো বর্শা হয়ে তার মনের আকড়া জমিতে গেঁথে যায়।

বদলা নেওয়ার নেশায় সে পালবাড়ির গোরু চরানোর কাজটা এক কথাতে ছেড়ে দিল। ভদ্রভাবে তার আর বাঁচা চলবে না। শয়তানের সঙ্গে মালাম লড়াতে গেলে তাকেও শয়তান হতে হবে। ইটের জবাব দিতে হবে পাটকেলে।

জামতলা থেকে ফিরে এসে পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে রঘুনাথ। সে এখন কম কথা বলে, হাসেও কম। তার ভেতরে এখন লুকিয়ে আছে একটা আগুনপাহাড়। ফলে হাবুল চোরের বাড়ি গিয়ে যেচে সে সন্ধি করে এসেছে। সব শুনে খুশি হয়ে হাবুল চোর বলেছে, আমি তুর পাশে আচি। ভয় কি। মনে রাখিস, সাপের ছাল ছড়িয়ে নিলে সে সাপের তেজ কমে যায় মানুষের তো ছাল ছাড়ানো যায় না, কিন্তু দাপটে মানুষ ধরাকে সরা ভাবে সেটা আমরা বেলুন-চুপসা করে দিতে পারি। পেটের টান জব্বর টান। পেটে লাথ মার, দেখবি জোড়া পা কেন, জোড়া হাতও ছোট হয়ে গিয়েছে।

হাবুল চোরের কথাগুলো মাথায় ঘুরছিল রঘুনাথের। নীলাক্ষকে উচিত শিক্ষা না দিলে তার ঘুম আসবে না ভালোভাবে। বাপের রাত কাঁপান চিৎকার তাকে অসহায় করে তোলে। অথচ নীলাক্ষ দিব্যি মাঠে ঘাটে ঘুরছে বুক ফুলিয়ে। অর্থের অহঙ্কারে তার পায়ের ভার সইতে পারছে না মাটি।

হাবুল চোরের সাইকেলের পেছনে বসে ছোট কুলবেড়িয়ায় মণিরুলের ঘরে গিয়েছিল রঘুনাথ। মণিরুল শুধু কালীগঞ্জ থানায় নয়, আশে পাশের সাতটা থানার ত্রাস। আর হবেই বা নয় কেন? হাফিজ ডাকাতের রক্ত তার শরীরে বয়ে যাচ্ছে।

গণ ধোলাইয়ে হাফিজ ডাকাতের নৃশংস মৃত্যুটা মেনে নিতে পারেনি মণিরুল। সে তখন বছর কুড়ির যুবক! রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে গোরু-চোরের মতো অসহায় চোখ নিয়ে শুধু দেখেছে হাফিজ ডাকাতের মৃত্যু যন্ত্রণা। ওই পথ থেকেই তার মনে উঠে এসেছে ডাকাত হবার সুতীব্র বাসনা। পড়ালেখা জানা মনিরুলের দল গড়তে বেশি সময় লাগেনি। হাফিজ ডাকাতের বউ মোতিবিবি তাকে পথ দেখিয়েছে, চেনা-জানা চোর ডাকাতের নাম ঠিকানা সে সব বাতলে দিয়েছে। শুধু তাই নয়-হাফিজ ডাকাতের লুকিয়ে রাখা অস্ত্রশস্ত্র পোশাক আশাক সব দিয়ে দিয়েছে বিনা পয়সায়। মণিরুলের মধ্যে তার ঘরের মানুষটা জ্যান্ত হয়ে উঠুক এই তার বাসনা।

পুকুড়পাড়ে হেলে পড়া বাঁশের ছায়ায় মণিরুলের দেখা পেয়েছিল ওরা। মণিরুলের দেখা পাওয়া মানে পীরবাবার দেখা পাওয়া। চড়া গরমে বড়ো পুকুরের জলে গলা ডুবিয়ে পড়েছিল মণিরুল, ওর দুজন সাদা পোষাকের সাকরেদ দূর থেকে লক্ষ্য রাখছিল নিরাপত্তার দিকগুলো। গাঁয়ে এখন সাদা পোষাকের পুলিশ ঘুরছে মণিরুলকে ধরবার জন্য। সরকার ওর মাথার দাম রেখেছে পঁচিশ হাজার। হাইটেনশন লাইনের তার কেটে মণিরুল হইচই বাঁধিয়ে দিয়েছে জেলা-সদরে। দুকিলোমিটার তার কেটে নিয়ে যাওয়া মুখের কথা নয়। সঙ্গে একটা বিশাল মাপের ট্রান্সফরমার। এত মাল কোথায় সে চালান করে দিল পুলিশ তার টিকিও ধরতে পারল না। তবে পাশের জেলা মুর্শিদাবাদ-বর্ধমানে তার নিয়মিত ওঠা-বসা আছে। জেলা পেরিয়ে সীমান্তবর্তী জেলায় লুকিয়ে যাওয়া মনিরুলের কাছে এমন কোনো কঠিন কাজ নয়।

পুকুর থেকে উঠে আসার সময় মণিরুলের গা থেকে জল ঝরছিল কাল বাউশ মাছের আঁশ থেকে জল ঝরার মতো। তার পেটা, খাজ খাঁজ শরীর স্বাস্থ্য দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিল রঘুনাথ। হাবুল চোর সেলাম দিয়ে কথা শুরু করল নিজস্ব ভঙ্গিতে।

সব শুনে মণিরুল বলল, কাফেরের সাজা কায়দা করে দিতে হয়। জালিলদের বেশি বাড়তে দিতে নেই। রসে ভেসে যাওয়ার আগে রস শুকিয়ে খরার মাঠ করে দাও। দেখবা সব ঠিক হয়ে যাবে, আপসেই সাইজে এসে যাবে।

-সে ভার তুমাকে নিতে হবে মনিরুল ভাই।

-ঘর যাও। আর ভেবো নি। তাতি কিভাবে তাঁত বুনবে সেটা তার উপর ছেড়ে দাও। মনিরুল গামছা নিংড়ে গা মুছতে মুছতে তাকাল, আমার লোক যাবে, তারে সব পথ ঘাট দেখিয়ে দিও। আমি শেষবেলায় গিয়ে সব ছকে আসব। তবে তিনটে নৌকো ঘাটে বেঁধে রেখো। তেমন বুঝলে আমরা জলে-জলে কাটোয়া পেলিয়ে যাব।

হাবুল চোর ঘাড় নাড়ল, ওসব নিয়ে ভেবো নি। তুমাদের রাস্তায় না তুলে দিয়ে আমি ঘর ধরবোনি। কথা দিলাম–

অমাবস্যার রাত্রিতে মণিরুল তার দলবল নিয়ে চড়াও হয়েছিল নীলাক্ষবাবুর বাড়িতে। সব মিলিয়ে তার দলে ছিল ছাব্বিশজন। অতর্কিত হামলায় কেঁপে উঠেছিল সারা গ্রাম। নীলাক্ষবাবুকে থামে বেঁধে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক একনাগাড়ে পিটিয়ে গেল মণিরুল। সিন্দুকের চাবি দিতে অস্বীকার করায় প্রহারের মাত্রা বেড়ে হল দ্বিগুণ। মারের চোটে ভূত পালায় কথাটা সত্যি। নীলাক্ষবাবুর উঁচু মাথা মারের চোটে নেতিয়ে ভূমি নিল এক সময়। ঘর ছাড়ার আগে মণিরুলের ঝোলায় তখন পঁচিশ ভরি সোনা, দুসের রূপো, নগদ ছহাজার টাকা। গোলা ভর্তি ধান যাওয়ার আগে পুকুরের জল ঢেলে দিয়ে গেল জনা দশেক ডাকাত। সেই সঙ্গে আগুন ধরিয়ে দিল দোতলা বাড়ি সমান উঁচু খড়গাদায়। নীলাক্ষবাবুর স্ত্রী তুঙ্গভদ্রার কপাল ফাটিয়ে দিল ওরা। একমাত্র মেয়ে ক্ষমাঞ্জলিকেও এরা ক্ষমা করল না। ওর গলায় এক ভরির সোনার চেনটা খুলে দিতে দেরি হচ্ছিল বলে হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে দিল। শুধু রক্ষা পেয়ে গেল কমলাক্ষ। সেদিন সে ঘরে ছিল না, পাশের গ্রামের কুটুমঘর গিয়েছিল।

বোমা ফাটাতে ফাটাতে মণিরুলের দল চলে গেল বাঁধ ধরে। এক দল মানুষ থ হয়ে দেখল খড়পোড়া আগুন। তাদের চোখে আগুন আতঙ্কের পদাবলী।

সেই আগুন-শপথ পুরোপুরি বদলে দিল রঘুনাথকে। হাবুল চোরের পায়ের কাছে বসে নেশাগ্রস্ত রঘুনাথ প্রতিজ্ঞা করল, হাজার বিপদে পড়লেও এ পথ আমি আর ছাড়বোনি। আজ থিকে আমি হলাম রঘু চোর। তুমার যখন দরকার পড়বে আমাকে ডেকো। আমি এক ডাকে হাজির হবো। সেই থেকে রঘুনাথের বদলে যাওয়া শুরু। সে ঘরের বেড়াল থেকে হয়ে গেল বনের বাঘ। লোকে তাকে রাস্তাঘাটে দেখলে পাশ কাটিয়ে চলে যেত। তাসের আড্ডায়, বাঁশের মাচায়, মদের ঠেকে, সবখানে রঘুনাথের চর্চায় মশগুল হয়ে উঠল গ্রামের বাতাস। সেই হাওয়ায় নড়েচড়ে বসল থানা। পুলিশ থেকে চৌকিদার সবার খোঁজ ছিল রঘুনাথের। কিন্তু রঘুনাথ বুঝি রঙ বদলাতে পারে। গাছে উঠলে সে গাছের পাতা হয়ে যায়, রাতে সে আরও মিশমিশে কালো। দিনের বেলাতেও সে চোখে ধূলো দেওয়াতে মাস্টার। রঘুনাথ তখন স্থিতু হতে জানে না, তার পায়ের তলায় সর্ষে, এখন এপারে তো তখন ভিনপারে।

ছেলের কুকীর্তির কথা শুনতে শুনতে চোখের জলে ভাসে দুর্গামণি। দিনমানে রঘুনাথ গাঁয়ে ঢুকতে পারে না পুলিশের ভয়ে। রাত-বেরাতে সে যখন আসে তখন তীব্র অভিমানে দরজা খোলে না দুর্গামণি। গুয়ারাম ঘুম জড়ানো চোখে কাতর হয়ে বলে, দরজা খুলে দাও গো, ছেলেটারে আসতে দাও। লুলার সাথে আমাদের রঘুর অনেক ফারাক আচে। লুলা যদি তুষের আগুন হয়, আমার ঘরের রঘু হল গনগনে আগুনের টিপি। আমার বাপ-ঠাকুরদা যা পারেনি, রঘু তা হাসতে-হাসতে পেরেছে। ও নীলবাবুরে উচিত শেক্ষা দিয়েছে। বড়ো বাড় বেড়েছিল বাবুটার। ধরাকে সরাজ্ঞান করত। আমার ঘরের রঘু ওর সরা ফেটিয়ে দিয়েছে। রঘুনাথকে ঘরে ঢুকতে দেওয়ার পেছনে গুয়ারামের স্বার্থ ছিল। বুকের ব্যথায় মাঠে খাটতে যেতে পারে না সে। গা রোদ লাগলে চিড়বিড় করে জ্বলে। খরানীতে ঝ্যানঝেনে কাশি ওঠে। অসহ্য বেদনাটা বুকের চারপাশে কুণ্ডলী পাকানো সাপের মতো বিড়া বানিয়ে ছোবল মারার জন্য তৈরি থাকে। এই ভয় আর ব্যথা দিনরাত গিলে খাচ্ছে তাকে।

হাসপাতালের বড়ো ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়েছে সাদা কাগজে। মুখ দেখিয়ে ওষুধ আসবে না। আর ওষুধ না খেলে বাঁচবে না জান। জান বাঁচানোর জন্য রঘুনাথের কাছে হাত পাতা দরকার। ছেলে রোজগেরে হয়েছে। ছেলে দেবে তার চিকিৎসা খরচা।

দুর্গামণি গুয়ারামের এই মনোভাবকে সমর্থন করে না। সে কান্না ভেজা গলায় বলে, আমার কুনো ছেলে নেই। আমার যে ছেলে ছিল সে মরে গিয়েছে গো। তুমরা সেই মরা ছেলের কথা আমাকে আর শুনিয়ো না গো, তার কথা শুনলে আমার কলিজার হাড় মড়মড় করে ভেঙে যায়।

কান্নার বেগকে সামাল দেওয়া যায় না, দুর্গামণি কাঁদে। গুয়ারামের চোখও লেবু চিপায়। চুনারাম আক্ষেপ করে বলে, কাদিস নে গুয়া, কাঁদিস নে। আমি বেঁচে থাকতে তুর কুনো ক্ষতি হবে না। সে বামুন বাচ্চা তুরে জোড়া পায়ের লাথ মেরেছে। তার ওই সোনার বরণ পা শুকিয়ে মরা আখের মতো হয়ে যাবে। নর হচ্ছে নারায়ণ। তার গায়ে কি পা ভোলা ভালো রে! সবুর কর, তার শাস্তি সে পেয়ে যাবে। এখনও যে চাঁদ-সূয্যি ওঠে। এখনও যে আগুন তাপ দেয়।

বাঁধের গোড়ায় সড়সড় করে জল। এই জলের স্বভাব চোরের মতন। রঘুনাথ জলের দিকে তাকিয়ে সুতোর কাছাকাছি এসে যাওয়া বিড়িটা ছুঁড়ে দিল দূরে। সাত করে একটা হেরে যাওয়ার শব্দ হয়ে নিভে গেল বিড়িটা।

নূপুর এগিয়ে এল তার সামনে, দাদারে, ঘর যাবি নে?

নূপুরের কথায় ছ্যাঁকা খেল রঘুনাথ, মুখ ফেরাল সে, ঘর যেতে তো মন চায়, কিন্তু মা তো কথা বলে না।

–ও জেঠির কথা বাদ দাও। নপুর হালকা করতে চাইল প্রসঙ্গ।

রঘুনাথ সেই একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে বলল, মার কথা বাদ দিলে হয় বল? আমি বুঝতে পারিনে, মার কাছে আমি কি দোষ করেছি?

-ও তোমার বুঝে কাজ নেই। নপুর রঘুনাথের হাত ধরে টানল, নিজের ঘরে না যাও তো, আমাদের ঘরে চলো। বাবা চলে যাওয়ার পর ঘরটা কেমন কঁকা হয়ে আছে।

-তা তো হবেই! মানুষটা যে কুথায় গেল।

–আমার মনে হয় তারে কেউ মেরে ফেলেছে! নূপুর বোবার মতো তাকাল।

–কে মারবে তাকে? তার কেউ শত্রু ছিল না।

-ছিল গো, ছিল। তুমি জানো না। নুপুরের গলা একটুও কাপল না। সে দৃঢ় গলায় কথাগুলো বলে রঘুনাথের মুখের দিকে তাকাল।

রঘুনাথ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, মোটে ভাববি নে, কাকা ঠিক ফিরে আসবে। তার মতন মানুষ বেশিদিন ঘরছাড়া হয়ে থাকতে পারবে না। হলদিপোঁতা ছেড়ে সে সপ্নে গিয়েও সুখ পাবে না।

নপুর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, ঘর খরচা এট্টা টাকাও নেই আমার কাছে। কদিন খুদ ফুটিয়ে খাচ্চি। দাদু জাউভাত খেতে পারে না। প্রতিদিন খাওয়ার সময় চোখের জল ফেলে। আমার দেখতে ভালো লাগে না।

নুপুরের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল রঘুনাথের। অথচ একসময় কত মানুষ ওদের ঘরে পাত পেড়ে খেয়ে যেত। লুলারামের মন খোলা আকাশ না হলেও সে কৃপণ নয়। মানুষের বিপদে আপদে প্রায় সে দাঁড়াত। হলদিপোঁতার পুজো পরবে সে ছিল সবার আগে। রঘুনাথ ছোটবেলায় ভাবত-বড়ো হয়ে সে কাকার মতো হবে। তবে ঢিলি কাকির জন্য তার দুঃখ হত। মনটা ঝাঁকিয়ে উঠত হর সময়। ঢিলি কাকির উপর কাকার ব্যবহার মোটেও ভালো ছিল না। তার মনে হয় কাকা কোনোদিন চাইত না কাকি ভালো থাকুক।

পাপ করলে আজকাল শাস্তি হাতেনাতে পেতে হয়। এক আকাশে দুটো চাঁদ ওঠে না। ঢিলি কাকি নিজেকে সরিয়ে নিল স্বেচ্ছায়। তার মৃত্যু ওদের স্বাধীনতা দিতে পারেনি, বরং বিচ্ছেদের সাপটা ছোবল মেরেছে দু-জনকে। সেই বিষে জ্বলে পুড়ে দন্ধেছে ওরা দুজন।

নূপুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রঘুনাথ অকপটে বলল, তুই ভাবিস নে, আমি সময়মতো তোর কাছে সব কিছু পৌঁছে দেব। পকেট হাতড়ে সে কিছু টাকা নুপুরের হাতে গুঁজে দিল, এগুলো রাখ। পরে আরও দেব। মার খোঁজ নিবি। আমি রাতে এসে বাবাকে দেখে যাব। বলা যায়

-কোথায় কোন পুলিশের লোক ঘুরছে।

–পুলিশ তুমার কি করবে?

–কিছু না। ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে পুরে দেবে।

-তুমার দোষ কি যে তোমাকে হাজতে দেবে? নূপুরের সরল জিজ্ঞাসায় একটু অবাক হল রঘুনাথ, নিজেকে আড়াল করে সে বলল, আমি ধোয়া তুলসীপাতা হতে পারলাম কই? আমারও মেলা দোষ আচে।

তুমার কি দোষ তা জানি। নূপুর বিশ্লেষণী তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। রঘুনাথ হতভম্ব। পাশ কাটিয়ে বলল, জল দেখে ঘরে ফিরে যা। আমার তাড়া আছে। আমাকে পাশের গায়ে যেতে হবে। কপা এগিয়ে আবার ফিরে এল রঘুনাথ, পকেট থেকে বেশ কিছু টাকা মুঠো করে বের করে বলল, শোন নূপুর, এই টাকাগুলো লুকিয়ে বাবাকে দিয়ে দিবি। মা যেন না দেখে। মা দেখলে আমার ছোঁয়া লাগা টাকা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে উড়িয়ে দেবে।

নূপুর ঘাড় নেড়ে বাঁধের গোড়া বেয়ে নেমে গেল।

বর্ষায় বৃষ্টির দেখা নেই অথচ শরৎ ঋতুতে হড়হড়িয়ে ঢালল মেঘ। টানা সাতদিনের বৃষ্টিতে হাঁপিয়ে উঠেছিল দুর্গামণি, ঘরে চাল বাড়ন্ত অথচ খিদের জন্য গুয়ারামের বুকের ব্যথাটা আরও চাগিয়ে ওঠে। সে ভ্যালভেলিয়ে আশেপাশে তাকায়। কাউকে দেখতে না পেয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এই দুর্দিনে ছেলেটা একবার ঘরে এলে ভালো হত। ওর কি মন কাঁদে না বাপ-মার জন্য? আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতিগতি বোঝা দায়। ওরা আষাঢ়ের মেঘের চেয়েও হড়বড়ে, তড়বড়ে–এক জায়গায় তিষ্ট্রতে জানে না।

রঘুনাথের চিন্তায় গুয়ারামের রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছে, চোখে ঘুম না এলে দল বেঁধে ব্যথা আসে। ওরা খাবলায়, খুবলায়। আছড়ে-পাছড়ে ঘুম চটকে পালায়। তখন বিছানা আঁকড়ে বাকি রাতটুকু আবোল-তাবোল ভাবা। ভাবনার কি শেষ আছে? ভাবনা তো স্বর্ণলতার মূল। ওর মুড়ো খুঁজে পাওয়া ভার।

পেছল পথে লাঠি ছাড়া হাঁটতে কষ্ট হয় গুয়ারামের। বাপের আগে তাকে লাঠি ধরতে হল বলে মাঝে মাঝে তার মনে খেদ জন্মায়। খেদ থেকে সৃষ্টি হয় ঘৃণার। নীলাক্ষবাবুকে সে ক্ষমা করতে পারে না। যদি কোনোদিন আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে ওই মানুষটাকে সে ছেড়ে কথা বলবে না।

খুব সতর্কতায় লাঠি ঠুকতে ঠুকতে বাঁধের গোড়া অবধি এল গুয়ারাম। নুয়ে পড়া বাঁশগাছের ছায়ায আঁধার হয়ে আছে পথ। একদল সাতভায়া পাখি কাদার উপর খপর খপর করে হাঁটছে। ওদের শিস দেওয়া বন্ধ নেই। ঝগড়া করার মতো অনর্গল বকে যাচ্ছে ওরা। গুয়ারামের সহ্য হচ্ছিল না সেই চিৎকার। লাঠি উঁচিয়ে পাখিগুলোকে সে তাড়াতে গেলে ভারসাম্য হারিয়ে শরীরটা টলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখনই কচু শাকের বোঝা নামিয়ে ঝারি তাকে ধরে ফেলল, সাবধানে চলাফেরা করো গো, পড়ে গেলে এঁটেল কাদা গায়ে জড়িয়ে যেত যে

ওয়ারাম অনেকদিন পরে ঝারিকে দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। রূপ যেন ফেটে পড়ছে বউটার। বর্ষার মানকচু গাছ বুঝি লজ্জা পাবে তাকে দেখে। রসিকতা করার লোভটা সামলাতে পারল না গুয়ারাম, ছেলের মুখেভাত হয়ে গেল–আমার মিঠাইটা কুথায় গো বউমা?

ঝারি মজা পেয়ে হাসল, হবে, সব হবে। আগে আমার দুয়ারে তুমার পায়ের ধুলো পড়ুক-তারপর।

-দেখচো তো আমার শরীলের অবস্থা। বড়ো বিপন্ন শোনল গুয়ারামের কণ্ঠস্বর, জানি না আর কোনোদিন তুমার ছেলের মুখ দেখা হবে কি না! তবে আমার শরীলের অবস্থা ভালো নেই। পাটকাঠির বেড়ায় উই লেগেছে গো…।

-তুমার ভাইয়ের মুখে সব শুনেচি। ঝারির চোখে সমবেদনা ফুটে উঠল। গুয়ারাম বলল, শরীর পারলে একদিন তুমার দুয়ারে যাব। তবে কবে যাবো আগাম বলতে পারচি নে। তুমি একবার সময় পেলে ছেলেটারে নিয়ে এসো। আমার ছেলেটা তো আর আমার হল না!

-সে কি কথা!

-হ্যাঁ, যা সত্যি তাই বলছি। মেলা দিন হল সে ঘর আসেনি। গুয়ারাম কাছিমের মতো মুখ তুলে চারপাশটা দেখে নিল, আগে তাও রাত-বেরাতে আসত। এখন আর মুটে আসে না। জানি না সে বেঁচে আছে কি না।

–কি যা তা বলচো! ঝারি বিমূঢ় ঢঙে তাকাল, রঘুর কুনোদিন ক্ষতি হবে না। ওর মতন ছেলে হলদিপোঁতায় কটা আচে বলতো?

গুয়ারাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উপরের দিকে মুখ তুলল, ওই ওপরওয়ালাই জানে সে এখুন কুথায়। সারে বড়ো অভাব গো! সে এলে জান-মান বাঁচত।

ডিভিসি জল ছাড়ল আবার। আখের ভুই ডুবে গিয়েছে জলে। বুড়িগাঙ চওড়া হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে চরসুজাপুর কমলাবাড়ি পর্যন্ত। দিগন্ত জুড়ে শুধু ঢেউ আর ঢেউ। সেই সঙ্গে ঘোলা জলের তান্ডব। এই জলের দিকে তাকালে রঘুনাথের কথা মনে পড়ে গুয়ারামের। অথচ ঘোলা জলের সাথে কালো কুচকুচিয়া রঘুনাথের কত ফারাক।

কয়লা কালো, বেবুর কাঠ কালো। ওদের দেহে লুকিয়ে আছে আগুনের ঝোরা। আগুনের পাহাড়। বুড়িগাঙের জলে আগুনের ঢেউ উজান ঠেলে চলেছে জীবনের নতুন পদাবলী রচনার জন্য।

গুয়ারাম বাঁধে দাঁড়িয়ে লাঠিটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।

.

৪৮.

ঘেঁটকুল গাছের মসৃণ পাতায় মোটা মোটা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে চোখের নিমেষে। অ্যাশোওড়ার পাতাতেও জল দাঁড়ায় না, শুধু ওর গোড়াগুলো ডুবে আছে চেটো ডোবা জলে। টানা সাতদিন ধরে বৃষ্টি, আকাশের তবু থামবার কোনো লক্ষণ নেই। এমন সৃষ্টিছাড়া বৃষ্টিতে মিয়ানো মুড়ির মতো মন নিয়ে ঘুরছিল শুভ। অবনী তাকে দেখতে পেয়ে ডাকল, শোন, আকাশের মতিগতি ভালো বুঝছি নে। এইমাত্র পঞ্চায়েত অফিস থেকে ঘুরে এলাম। সবাই বলাবলি করছে যে কোনো সময় বাঁধ ভাঙতে পারে। বাঁধের যা দশা বেশিক্ষণ আর ঠেকা দিতে পারবে না।

শুভর চোখ থেকে নিমেষে উধাও হয়ে গেল স্বস্তি। তার বদলে একটা শিউরে ওঠা ভাব ওর চোখের সাদা জমির দখল নিল। অবনীর তর সইছিল না। চিন্তার শেষ নেই ওর। বাধ ভাঙলে ঘর সংসার নিয়ে কোথায় দাঁড়াবে সে? কোয়ার্টারের সবাই যে যার মতো গোছগাছ করে নিয়েছে। খাটের পায়ায় চারটে-ছটা ইট দিয়ে উঁচু করেছে খাট। সেই উঁচু খাটের উপর ঘরের জিনিস সাজিয়ে রেখেছে সবাই। জল যাতে ছুঁতে না পারে তার জন্য সবার মধ্যে এক অসম লড়াই।

জলের থাবা বিশাল থাবা। সেই থাবা থেকে বাঁচার ক্ষমতা নেই কারো। অবনী কপাল কুঁচকে ভাবল এ যাত্রায় পার পেয়ে গেলে ভালো। নাহলে বিপদের আর শেষ থাকবে না। বাঁধ ভেঙে গেলে হাসপাতালের মাঠ নাকি সমুদ্র হয়ে যায়, থৈ-থৈ জলে তখন সাঁতার ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

ডাক্তারবাবু তাঁর কোয়াটারের যাবতীয় জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছেন শিবনাথবাবুর বাড়িতে। চারবার ট্রিপ দিয়েছে শিবনাথবাবুর ট্রাক্টর। কালীগঞ্জ বাজারের ওদিক বেশ উঁচু। বড় বন্যার সময় জল ওঠেনি। এবছর যে জল উঠবে না একথা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। তবে জল উঠলেও ভয়ের কোনো কারণ নেই। কেননা শিবনাথবাবুর দোতলাবাড়ি, দোতলাতেই প্রায় দুখানা ঘর। ছখানা ঘরের দুখানা ঘর তিনি ছেড়ে দিয়েছেন ডাক্তারবাবুকে। একদিন আগে থেকে মাধুরীরা ভয়ে চলে গিয়েছে ওখানে। শুধু ডাক্তারবাবু নন কোয়ার্টারের আর সবাই যে যার মতন ব্যবস্থা করে নিয়েছেন মাথা গোঁজার।

সবাই যা অনায়াসে পেরেছে, অবনী তা পারেনি। এটা তার অক্ষমতা কিনা ভাবছিল সে। গালে হাত দিয়ে হাত ব্যথা হয়ে গেল তবু সে এর কোনো উত্তর পায়নি। গ্রামসমাজে ছোঁয়াছুঁয়ি রোগটা বালি ঢাকা নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। অস্পৃশ্যতা বুঝি স্বর্ণলতার মূল, যার গোড়া খুঁজে কেউ উপড়ে ফেলতে পারে না। হাসপাতালের আউটডোরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, অবনী শেষ পর্যন্ত তুমি কি ঠিক করলে? কোথায় যাচ্ছো? যদি কোথাও ঠিক না হয়ে থাকে তাহলে সময় থাকতে বড়ো ইস্কুলে চলে যাও। শুনেছি, ইস্কুলের মাঠটা উঁচু। সবাই বলছিল গেল বন্যায় ওখানে জল ওঠেনি।

এসব উপদেশ হাজারবার শুনে অবনী ঠিক করেছে বাঁধ ভাঙলেও সে আর কোথাও যাবে না। বাঁশ দিয়ে ছাদে ওঠার সিঁড়ি বানিয়ে নিয়েছে সে। একটা বড়ো মাপের ত্রিপল সংগ্রহ করেছে সে। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে ত্রিপলটাকে কাজে লাগাবে সে। আকাশ ধরলে তার আর কোনো চিন্তা নেই। কোয়ার্টারের ছাদের উপর দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারবে। লোকের বাড়িতে গেলে বউ-ছেলে নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারত সে। গাঁয়ের কেউ তাকে থাকার প্রস্তাব দেয়নি। আর এসব কথা আগ বাড়িয়ে সে কাউকে বলতে পারেনি। তার ভিতরেও সংকোচ জড়তার শেষ নেই। সবাই ছোট কাজ করে বলে ঘেন্না করে। তাদের চোখের ঘৃণা সে কি ভাবে মুছে দেবে? তার এত শক্তি কোথায়? সে শুধু শুভকে বলল, তুই খপখপ চাপড়া চলে যা। চাল আর আটা নিয়ে চলে আসবি। চাল আটা থাকলে অনেকটাই ঠেকা দিতে পারব। খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা না থাকলে তখন অন্য চিন্তা করা যাবে।

শুভর পাশের গ্রাম চাপড়ায় যাবার কোনো ইচ্ছে ছিল না। এখন কাদা পথে সাইকেল ঠেলতে হাজার সমস্যা। মাইলখানিক পথ মাঠে মাঠে যাওয়া যায়, নয়তো আমবাগানের পথটা ধরতে হবে। দাসপাড়ার পাশ দিয়ে যে রাস্তা গিয়েছে সেটা তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো। বেলে মাটিতে কাদা হয় না, আর হলেও সে কাদা কোনো সমস্যা তৈরি করে না।

ঘর থেকে দুটো থলি আর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শুভ। অন্য সময় হলে সে অজুহাত তৈরি করে এড়িয়ে যেত। সরস্বতী যাওয়ার সময় বলল, সাবধানে যাবি। মোটে দেরি করবি নে। তুই না আসা পর্যন্ত আমার খুব চিন্তা হবে।

শুভরও ভয় করছিল। বলা যায় না কখন বাঁধ ভেঙে যায়। বন্ধুদের মুখে বন্যার ভয়াবহতার কথা সে বিশদ শুনেছে।

শুভ কাছ থেকে তার বাবাকে দেখে। বাবার মুখের দুঃখী ভাবটা তার ভালো লাগে না। একটা মানুষ সব সময় গালে হাত দিয়ে কী ভাবে এত? মানুষের সমস্যার শেষ নেই। সমস্যা থাকবে তা বলে সমস্যার ভেতরে তলিয়ে যেতে হবে মানুষকে? মাথা তুলে দাঁড়াবার কোনো চেষ্টা থাকবে না মানুষের? এভাবে কথায় কথায় হেরে যাবার কোনো অর্থ হয় না। কালীগঞ্জ বাজারে বিদুর কাকার বক্তৃতা শুনেছে সে। এত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে যা শুনে গায়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। মাথা ঠিক রাখা যায় না। অথচ বিদুরকাকার দুবেলা ভাত জোটে না। শিবনাথবাবু কত হেয় করে কথা বলেন তার সঙ্গে। মাথা গরম হয়ে ওঠে শুভর। মানুষের সঙ্গে মানুষ এত খারাপ ব্যবহার করে কি ভাবে? তার মা বলে, চোখের চামড়া মোটা হলে মানুষ পশু হয়ে যায় যখন তখন। শুভর মনে হয় মায়ের কথাটা সত্যি।

শিবনাথবাবু শুধু মোটা নয়, তার চোখের চামড়াও মোটা। মনটা ভাগাড়ের চেয়েও নোংরা। শুধু সাদা ধবধবে পোশাক পরলেই মানুষের মন পরিষ্কার হয় না।

চাপড়া থেকে ফিরতে বেলা গড়িয়ে গেল। সাইকেল ঠেলে হাঁপিয়ে উঠেছিল শুভ। মেঘে ঢাকা আকাশের গোমড়া মুখ ভাসছিল কালভার্টের জলে। যে কোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়বে এমন একটা মুহূর্ত। বড়ো অসহ্য লাগছিল শুভর। এক সময় বৃষ্টি না হলে ভীষণ মন খারাপ করত তার। এখন মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কতদিন মাঠে যায় নি খেলতে। খেলবে কোথায়? মাঠ ভর্তি জল সাদা আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে পরম মমতায়। কদিন থেকে শুভ লক্ষ্য করছে টিউবওয়েলটার দৈন্য দশা। হ্যাঁন্ডেলে চাপ না দিলেও জল ঝরছে অনবরত।

সরস্বতী কপাল কুঁচকে বলল, এ লক্ষণ ভালো নয়। এমন হলে মানুষের কপাল ফাটে।

শুভ এ কথার অর্থ পরিষ্কার বুঝতে পারেনি। তবে সামনে যে খুব খারাপ সময় এটা সে অনুভব করতে পেরেছে। অবনী হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে বলল, দেখো মাঠের কেঁচো সব বারান্দায় উঠে এসেছে। এ লক্ষণ ভালো নয়। মনে হচ্ছে সামনে মহাবিপদ। আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।

প্রকৃতি ক্ষেপলে তার ক্ষেপামু চট করে দূর করা যায় না। বিধির থাবা বাঘের থাবব চাইতেও হিংস্র। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে অবনী ঠকঠক করে কঁপছিল। কথা বলার ইচ্ছে হল না তার।

–কি ভাবলে? বেজার মুখে শুধোল সরস্বতী।

অবনী নিরুপায় হয়ে বলল, কি আর ভাবব, ভাবার আর কি আছে। যা হবে দেখা যাবে।

 –জানো, আমার খুব ভয় করছে। আমি জীবনে বন্যা দেখিনি।

বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকাল অবনী, অত ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। মাথার উপর একজন আছে তো

সরস্বতীর বুকটা ভয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠল, অশুভ আশঙ্কায় দুলে উঠল মন।

–আমাদের ঘরটা যদি জলের তোড়ে ভেঙে যায় তাহলে?

-ধুর, অমন কোনোদিন হয় নাকি? অবনী জোর গলায় বলে, সাবধানে থাকতে হবে। সাবধানের মার নেই। আমি নিজেকে নিয়ে ভাবি না। শুধু শুভর কথা ভাবছি ।

সরস্বতী মুখ ফিরিয়ে বলল, গাঁয়ের মানুষগুলোর কি হবে গো? ওরা কোথায় যাবে?

-শুনেছি সবাই বাঁধের উপর থাকবে। এক বাঁধ ভেঙে গেলে বাকি বাঁধের ক্ষতি হয় না।

অবাক হয়ে শুনল সরস্বতী। বিস্ময়ও অনেক সময় রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়। কালো চাপ বাঁধা মেঘের দিকে তাকিয়ে বুক শুকিয়ে গেল তার। চারপাশ থেকে উঠে আসা জলীয়গন্ধ অসহ্য লাগল তার নাকে।

হাসপাতালের পাঁচিলের ও পিঠে কুমোরদের খাদ। বারো মাস ওখান থেকে মাটি কেটে নিয়ে যায় ওরা। গত বছর গরমে খাদে ঢুকে মাটি কাটতে গিয়ে চাপা পড়ে গিয়েছিল একজন। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও সে বাঁচল না। মাটির বিরাট চাই তার বুকটাকে জলে চুবানো স্পঞ্জের মতো নরম করে দিয়েছিল। বড়ো ডাক্তার বুকে চাপ দিতেই গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল নাক-মুখ দিয়ে। সেই ভয়াবহ দৃশ্য এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে সরস্বতীর। কুমোরখাদের দিকে তাকাতে তার ভয় করে। চোখের তারা কেঁপে ওঠে।

সবুজরা আর একটু পরে চলে যাবে। ওদের গোছগাছ প্রায় সারা। পাল বুড়ো দুটো গোরর গাড়ি পাঠিয়েছে ওদের জন্য। সবুজের মা অনেক আগে দুই মেয়েকে নিয়ে চলে গিয়েছেন। তার পায়ে ব্যথা জোরে হাঁটতে পারেন না। হঠাৎ বাঁধ ভেঙে জল এলে কোথায় যাবেন তিনি। আগাম সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। সবুজ দুরে দাঁড়িয়ে ওদের ব্যস্ততার আঁচ পাচ্ছিল। মাত্র কদিনেই সবকিছু যেন বদলে গেল। এত নিবিড় সম্পর্ক সব যেন ছানাকাটা দুধের মতো ছাড়া-ছাড়া হয়ে গেল। গত কদিনে অনেক বেশি গভীর দেখাচ্ছে সবুজকে। বাঁধের ধারে সে একদিনও যায় নি জল দেখতে। ওর বাবা ভীষণ কড়া ধাতের মানুষ। ডাক্তারবাবু বলেন, হাই প্রেসার।

রেগে গেলে সহজে আর স্বাভাবিক হতে পারেন না। তবে বেঁটে খাটো মানুষটার মন ভালো। পেয়ারা তলায় অবনীকে ডেকে বললেন, আমরা চলে যাব। তোমরাও চলে যাও। আগুনকে বাগে আনা যায় কিন্তু জলকে তো বাগে আনা যায় না। জলের মতো বেয়াদপ পৃথিবীতে আর দুটি নেই।

দাঁড়িয়ে থেকে চোখ ঝাপসা হয়ে এল শুভর। সবুজের ব্যবহার আজ তার অস্বাভাবিক ঠেকছে। সবুজ যেন তাকে চেনে না এমন মুখভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কত অজানা, অচেনা। কেন এমন অপরিচিতের মতো মুখ করে চেয়ে আছে সবুজ। ওকি কিছু বলতে চায়? তা যদি হবে তাহলে এগিয়ে আসছে না কেন? ওর সাথে তো ঝগড়া হয়নি? ওরা চলে যাবে বলেই কি বিচ্ছেদের পাচিল তুলছে ইচ্ছে করে? শুভ এক দৌড়ে ঘরের মধ্যে চলে এল। চেনা ঘরের চেহারা বদলে গিয়েছে বন্যার ভয়ে। এক মানুষ সমান উঁচু করা হয়েছে তক্তপোষ। দরকারী জিনিসপত্তর বস্তায় বেঁধে নিয়েছে অবনী। ত্রিপল দিয়ে অস্থায়ী ছাউনি বানিয়েছে ছাদের উপর। বাঁশের সিঁড়িটা যাতে বন্যার জলে ভেসে না যায় সেইজন্য সিঁড়ির দুমাথা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে শক্ত করে। ঝড়ো হাওয়ায় ত্রিপল যাতে না উড়ে যায় সেইজন্য ইটচাপা দিয়ে রেখেছে। ত্রিপলের ডগায়। মুষলধারে বৃষ্টি হলে এই অস্থায়ী ছাউনি কতটা কাজে দেবে তা ওপরওয়ালাই জানেন।

এতকিছুর পরেও মনোবল হারায়নি অবনী। সে বান-বন্যা দেশের মানুষ। ঘোলাজল তার কাছে চাষের জল। জলকে সে ভয় পায়নি কোনোদিনও। তবে স্রোতের মুখে সে বাহাদুরী দেখাতে ভয় পায়। স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব কিছু। তবু জীবনের অন্য নাম স্রোত একথা সে অস্বীকার করতে পারে না।

পাঁচিলের ধারে আইশ্যাওড়া গাছের পাতাগুলো চকচক করছে কৃষ্ণবরণ যুবতীর মুখমণ্ডলের লাবণ্যের মতো। আইশ্যাওড়ার ডাল ভেঙে দাঁত মাজলে সাদা মুলোর চেয়েও ঝকঝক করে দাঁত। ওই বেঁটে গাছের গোলাপী ফলগুলো নেশা ধরিয়ে দেয় অবনীর চোখে। মেদিনীপুরের দেশ গাঁয়ে এমন ফল তার চোখে পড়েনি। এক এক জেলার মাটিতে একেক ধরনের চাষ, গাছপালা ঝোপঝাড়ও ভিন্ন ভিন্ন। মাটি কি তাহলে রূপ বদলায় জায়গা বুঝে? অবনীর মাথাটা ঝিমঝিমিয়ে ওঠে বৃষ্টি ভেজা গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে।

তার মনের অনেকটাই খেয়ে নিয়েছে বন্যা। এই বন্যা বুঝি হাঙরের মতো এগিয়ে আসবে তাকে পুরোপুরি গিলে নিতে। টিকেদারবাবুর তিনজন মুনিষ গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে দিচ্ছে ঘরের জিনিস। তদারকির কাজ মন দিয়ে দেখছেন তিনি।

একে একে এই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাবে সবাই। ওরা জানে জলের সঙ্গে কুস্তি লড়া সহজ ব্যাপার নয়। বাঁধ ভাঙা জল বুনো হাতির চেয়েও ভয়ঙ্কর। তার পাগল হয়ে দৌড়ে বেড়ান সবাই সহজ চোখে মেনে নিতে পারবে না। বানের জল আর ঘূর্ণি হাওয়া দুজনের বড়ো ভাব। সামনে যা পাবে তাই গিলে খাবে গোগ্রাসে, রাক্ষস।

অবনী চোখ ফিরিয়ে নিয়ে উদাস হয়ে গেল নিমেষে। কুমোরখাদকে এখন আর চেনা যায় না, ভরা যৌবন ঢ্যাপফুলের চেয়েও সুন্দর। রোদের সাথে জলের খেলা সহজাত। কতদিন রোদের মুখ তারা দেখেনি–সে কথা ভাবার চেষ্টা করল অবনী। মন খারাপ হয়ে গেল তার।

পালবাড়ির উদ্দেশ্যে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে যাচ্ছে মালবোঝাই গোরুগাড়ি। পেছন পেছন হাঁটছেন টিকেদারবাবু। অবনী ভাবছিল তিনি হয়ত যাওয়ার সময় পিছু ফিরে তাকাবেন। কিন্তু তার ভাবনায় গোড়ায় গলদ। বিপদের দিনে মানুষ আগে বাঁচাবে নিজেকে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আশাহত অবনীর মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল।

ঘেঁটকুল গাছের পাতা চুঁইয়ে জল ঝরছে হরদম। এই গাছগুলোকে কেউ বুঝি দেখেও দেখে না। এর রূপ যেমন তেমনি এর বদগুণ। গিয়াস গাছি রস চুরি ঠেকাতে ঘেঁটকুল কচুর গোড়া কুঁচি কুচি করে কেটে রেখে দিত রসের ঠিলিতে। চুরি করে রস খেতে গেলে তার কুটকুটানি আর কমত না। ডাক্তার-বদ্যি না করালে নিস্তার নেই এমন জ্বলন। অবনী ঘেঁটকুল ভেজানো রস খায়নি তবু তার ভেতরটা জ্বলছে। শুভর প্রশ্নটা তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না কিছুতেই, বাবা, সবাইকে ডেকে নিয়ে গেল অথচ আমাদের কেউ ডাকল না। কেন ডাকল না বাবা?

কি উত্তর দেবে অবনী ছেলের এই প্রশ্নের। সব প্রশ্নের কি উত্তর হয়। কিছু প্রশ্ন আছে যার উত্তর জেনেও নীরব থাকতে হয়। অবনীও এ ঘটনায় কম দুঃখ পায়নি। এতগুলো বছর এক সঙ্গে বসবাস করা অথচ বিপদের সময় ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া এ কেমন বিচার বাবু ভদ্র সমাজের? চোখের চামড়া মোটা না হলে এমন কাজ কেউ কি করতে পারে?

ডাক্তারবাবুর মেয়ে মাধুরীই একমাত্র বলেছিল, আমাদের সঙ্গে শুভদেরও নিয়ে চল। বাঁধ ভেঙে গেলে ওরা কোথায় থাকবে?

মেয়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেন নি ডাক্তারবাবু। প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে মুখ কালো করে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। মেয়ের নির্বুদ্ধিতায় তিনি যে রীতিমত অপ্রস্তুত এটা তার হাবভাব চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছিল। দিনের আলোতেও আড়াল খুঁজছিলেন তিনি।

দিনের আলোতে যার মন কালো হয়ে যায় তার আড়াল বুঝি কোনোদিনও জোটে না। অবনীর ভাবনায় এই চিন্তাগুলো মিছিল করে আসছিল বারবার। ডুমুরের পাতার চেয়েও খসখসে হয়ে গেল তার মনের আস্তরণ। ব্যাধিটার কোথায় জন্ম, জন্ম থেকে জেনে গিয়েছে অবনী। বামুনবুড়ির হলে তাকে যে কাজটায় ঢুকিয়েছে সে কাজটা আদৌ তার নয়। প্রথম প্রথম সংকোচ হত হাসপাতাল ঝাড়ু দিতে। পরে সেই সংকোচ ব্যাঙাচির লেজের মতো খসে যায়। জীবনের জন্য কোনো কাজ ছোট নয়। মন ছোট হলে বুক ছোট হতে বাধ্য। বুক ছোট হলে ভাবনা হয়ে যায় সাগর থেকে ডোবা। গন্ধ ডোবার মন নিয়ে সুগন্ধ আশা করা যাবে কিভাবে।

অবনী হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এসেছিল সেদিন। মুখ আর মুখোশের মানে সেদিনই সে ভালো ভাবে জেনে গেল। নদীয়ার কালীগঞ্জ, আর মেদিনীপুরের বালিঘাই এগরার কোনো ফারাক নেই।

পঞ্চায়েত থেকে ঢেঁড়ি পিটিয়ে গিয়েছে কাল ডিভিসি আবার জল ছাড়বে। এই ছাড়া জলে শুরু হবে নতুন করে তাণ্ডব। বাঁধের কোণায় ছুঁয়ে থাকা জল উপচে যাবে এবার। ইঁদুরগর্তে ঘোলা জলের স্রোত ঢুকে তৈরি করবে ঘূর্ণি। বাঁধের ঘোঘা বড়ো হলে বাড়বে জলের ঘর-সংসার।

বাঁধ বাঁচানোর চেষ্টা চলছে সব প্রকার। সবাই এক বাক্যে দুষছে আকাশকে। আকাশের ছেরানি রোগ না সারলে সমূহ বিপদ। গোদের উপর বিষফেঁড়ার মতো ছাড়া জল আরও ভয়ঙ্কর। শুধু মাঠ ভাসবে না, ভাসবে ঘর। ভয়ে পা থেকে মাথা অবধি শিরশিরিয়ে উঠল অবনীর।

–মা শীতলাবুড়ি মুখ রেখো মা। জয় মা বুড়িমা মুখ রেখো মা। অবনী বিড়বিড়িয়ে উঠল, আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই মা। দয়া করো, আমার সংসারটা যেন না ভেসে যায়।

সরস্বতীর অসহ্য লাগছিল অবনীর হাবভাব। সে চেঁচিয়ে ডাকল তার ঘরের মানুষটাকে কৈ গো, এদিকে এসো। ঠাকুর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে? ঠাকুর নয়, মানুষের মতো দাঁড়িয়ে ছিল অবনী, কথাটা তার গায়ে লাগল। কোনোমতে ফ্যাসফেসে গলায় বলল, যাচ্ছি, তুমি সব ঘরের জিনিসগুলো বের করে দাও।

গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝরছে, ভিজে গেলে? সরস্বতীর গলায় বজবজিয়ে উঠল সংশয়জনিত সন্দেহ।

সামান্য বিরক্তি হলেও তা চেপে রাখল অবনী, তোমাকে যা বলছি তাই করো তো।

সরস্বতী ঝাঁঝিয়ে উঠতে পারত কিন্তু সে ওপথে হাঁটল না, মাথা নীচু করে সুড়সুড়িয়ে সে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। সংসারের ছড়ানো জিনিস চোখে লাগে না, গোছাতে গেলে সেটাই হয়ে ওঠে একটা মস্ত বোঝ। তবু একা কোনোমতে মালপত্তর ভর্তি বস্তাটা বহু কষ্টে টেনে আনে দোরগোড়ায়। সামান্যতেই হাঁপিয়ে যায় সে। সাহায্যের জন্য শুভর দিকে তাকাতেই শুভ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, মা ধরব।

কোনো উত্তর না দিয়ে সরস্বতী বুঝিয়ে দিল তার কি কর্তব্য। ততক্ষণে অবনী এসে হাত লাগাল বস্তায়, যাও আর একটা বস্তা আছে, সেটাও নিয়ে আসো।

–অত জিনিস ছাদের উপর রাখবা কোথায়? সরস্বতীর প্রশ্নে যথেষ্ট যুক্তি ছিল, অবনী না ভেবেই বলল, থালা-বাসন না নিয়ে গেলে মাটিতে যে খেতে হবে। এগুলো আগে ছাদে তোলা দরকার।

–দেখো রাতে যেন শোওয়ার মতো জায়গা থাকে। আমি বাপু সারাদিন খাটাখাটনির পর রাত জাগতে পারব না।

-তোমার রাত জাগার কোনো দরকার নেই। রাতটা আমি সামলে দেব। তুমি দিনটা সামলিও।

-খাওয়ার জলের কি হবে? সরস্বতীর প্রশ্নে যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠল অবনী, অনবরত জল ঝরা টিউবওয়েলটার দিকে তাকিয়ে সে বলল, এখনও সময় আছে জল ভরে নেওয়ার। বানের জল ঢুকলে কল ডুবে যাবে। তখন খাওয়ার জল আর পাওয়া যাবে না।

শুভ মা-বাবার কথা মন দিয়ে শুনছিল, অবশেষে সে বলল, জল পাওয়া যাবে তবে জল আনতে গেলে থানার কলে যেতে হবে। সবুজ বলছিল বড়ো বানের সময় সব ডুবেছে কিন্তু থানার মাঠ ডোবে নি।

কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে শ্বাস ফেলল অবনী। বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে একতলার ছাদে ওঠা কোনো কঠিন কাজ নয়। তবে বাঁধ না ভাঙলেও রাতটা ওখানে কাটাতে হবে না হলে যে কেউ ছাদে উঠে গায়েব করে দেবে মালপত্তর।

নৈঋতে মেঘ করেছে যা হারিয়ে দেবে কালো খাসীর গায়ের রঙ। এই বুনো মেঘকে ভীষণ ভয় পায় অবনী। এর হাবভাব, মতিগতি কিছুই বোঝা যায় না। এই মেঘ পদ্মর মতো সুন্দর, ঘোলা নেশার চেয়েও নেশাখোর। চাপ বাঁধা মেঘ ঢাললে চট করে থামতে চায় না। আবার পেছল হয়ে যাবে পথঘাট। মাঠের বাকি কেঁচো উঠে আসবে উঠোনে। অবনী হা-করে তাকিয়ে থাকে সেই ধুমসা মেঘের দিকে।

.

৩৭.

দুপুরের আগে বাঁধ ভেঙে গেল দুজায়গায়। মালীপাড়া আর কদবেলতলা ধাওড়ায়। ঘাসুরিডাঙার কাছে বাঁধ উপচে জল ঢুকছে গায়ে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে ভেসে যাচ্ছে বাঁধের মাটি। বালির বস্তা ফেলেও কোনো কাজের কাজ হল না। বিদুর বলল, আর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দরকার নেই। এবার যে যার ঘরে যাও।

লোকমুখে হাজার কথা কানে আসছিল অবনীর। যত শুনছিল ততই অস্থির হচ্ছিল মনটা। দেশগাঁয়ে কেলেঘাই নদীতে বান আসত। বৃষ্টির জলে কখন কেলেঘাই মাঠ পেরিয়ে ঢুকে যেত গাঁয়ের ভেতর। অতিথির মতো জলদস্যু সেজে খুন করত গরীব মানুষের স্বপ্ন। সে বান আর এ বানে কত ফারাক। এ বানের জলের শব্দ দশটা বুনো হাতির সমান। কান পাতা দায়। ভয়ে ধড়াক করে বুক। কলজেয় বুঝি কেউ ঢুকিয়ে দেয় নখ।

অবনী ধড়াস বুকে ছাদে উঠে এল সবার শেষে। সরস্বতী বলল, দেখো, আর কিছু রয়ে গেল কি না।

অবনী গা করল না, কেমন বিষণ্ণ চোখে তাকাল। হাসপাতালের মাঠে ফণা তোলা সাপের মতো জল ঢুকছে। অবনী ভ্যাদামাছের মতো ড্যামা ড্যামা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। ছাদ থেকে মালীপাড়ার বাঁধের ভাঙা চেহারাটা দেখা যায়। জলের সাথে ভেসে আসছে কান-ফাটানো আওয়াজ।

ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল সরস্বতীর, ওগো, দেখছো কেমন জল ঢুকছে।

-বাঁধ ভাঙলে জল ঢুকবেই। এ তো জলের ধর্ম—

সরস্বতী চুপ করে শুনল কথাগুলো। তারপর কেমন ঝিমিয়ে গিয়ে বলল, এত কাছে বাঁধ ভাঙল যে রাতে জলের শব্দে ঘুম আসবে না। জলের শব্দ নয়তো যেন বিসর্জনের হাজার ঢাক বাজছে।

-ধীরে ধীরে কানে সব সয়ে যাবে।

–সয়ে যাওয়ার আগে যেন কালা না হয়ে যাই।

কষ্টের মধ্যেই হাসল অবনী, কপালে যা লেখা আছে তা তো হবেই। এ কেউ খণ্ডাতে পারবে না।

কপাল ধরে বসে থাকলে কি দিন চলবে?

–দিন চলুক না চলুক কপালই সঙ্গে যাবে। অবনী জোর খাটাল কিন্তু তার কথাকে কোনো পাত্তা দিল না সরস্বতী।

শুভ অবাক চোখে দেখছিল জলের যাতায়াত। মাত্র আধঘণ্টার মধ্যেই হাঁটু ভোবা জল খলবলানো মাঠে। কত কি যে ভেসে গেল তার চোখের সামনে। ঘর গুছিয়ে যারা হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেল তার আর কোনোদিন দেখতে পাবে না এমন ভয়ংকর সুন্দর দৃশ্য!

সরস্বতী ইটের চুলা বানাচ্ছে যত্ন নিয়ে। সেদিকে অলস চোখে তাকিয়ে আছে অবনী। পেটের মতো অগ্নিকুণ্ড আর হয় না। চুলা না বানালে ভাত ফুটবে না। ভাত না ফুটলে পোটের গর্ত ভর্তি হবে কি করে? ভাগ্যিস চাল আটা আনিয়ে রেখেছে বেশি করে! কেউ তো এন না আগাম, জল কবে নামবে?

বেলা মরে এলে জলের গভীরতা আরও প্রকট হয়। ঘোলা জলের রঙ বদলে সে তখন রূপ বদলান মায়াবী। এই জলে নাকি বিষ থাকে। ছোঁয়া লাগালে কুটকুটায় গা-গর। জল বসে গেলে জ্বরজালা এড়ানো বড়ো মুশকিল।

ঝমঝমানো বৃষ্টি নয়, বুক সমান জলে তীক্ষ্ণ কাচের মতো টুকে যাচ্ছে বৃষ্টির ফলা। আর একটু পরে অন্ধকার নেমে আসবে, আকাশের গুড়গুড় শব্দ আর ঠান্ডা বাতাস জানিয়ে দিচ্ছিল তার পূর্বাভাস। ধেয়ে আসা অন্ধকারের দিকে ধেয়ে আসছিল ফেনামুখো জল। চাপড়ার বিল পেরিয়ে এই জল সটান চলে যাবে পাগলাচণ্ডীর দহে।

বানের জলে মাছ ধরতে গিয়ে তোড়ের মাথায় ভেসে গিয়েছে জটা হালদার। তার বউ আদুরী বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে গাঁয়ে ফিরছে। হাসপাতালের ভাঙা পাঁচিলের পাশ দিয়ে পাড়ায় ঢোকার পথ। পথের পাশে কামারডোবা। গোড়া মোটা তেঁতুল গাছটার শেকড় সদা ছুঁয়ে আছে ডোবার-হৃদয়। একটু এদিক হলে গলা জল থেকে ডু জলে পৌঁছে যাবে মানুষ। সাঁতার না জানলে ওখানেই একবারে সাঙ্গ হবে ভবলীলা।

আদুরীর মাথার কোনো ঠিক নেই, তাকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আরও তিনজন। ওদের সান্ত্বনা বাক্যে মন ভুলছে না আদুরীর, থেকে থেকে হিক্কা মেরে উঠছে। তার কাঁধ থেকে খসে গিয়েছে শাড়ির আঁচল। মানকচুর মতো ফর্সা শরীর বলে দিচ্ছে তার শরীর ত্রিশও পেরোয়নি। এই বয়সে স্বামী হারালে সে যে খোটা উপড়ানো গোরুর মতো চরাবে। সমাজ লোকলজ্জাকে তার খুব ভয়। দাদ হলে সারানো যায়। কিন্তু শরীরে ঘা হলে সারাবে কিসে।

পাশের মেয়েটি আদুরীর চেয়ে ছোট, লজ্জায় চোখ কুঁকড়ে সে বলল, দিদি গো, সব বেরিয়ে গেছে বুকটা ঢাকো।

জলের আড়াল কোনো আড়াল নয়। জল বড়োজোর আশ্রয়।

আদুরী কাঁদতে কাঁদতে বুক ঢাকা দিয়ে বলল, কত করে মানা করলাম তবু কথা শুনল না। মাছ ধরার নেশাই ওর কাল হল। ওকে কালে খেল, এখন আমাকে যে কে খাবে হে ভগবান বলে দাও।

সুরেলা কান্না আর্দ্র বাতাসের বুক ভার করে দেয়। পাশের মেয়েটি আদুরীর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, কেঁদো না, কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। জটাদা ভালো সাঁতার জানে। সে ভেসে গেলেও ডুবে যাবে না।

ঘূর্ণি জল ফুটরসের চেয়েও প্রাণঘাতী। ওরে বুন, আগুন জল আমার মানুষটাকে কি ছেড়ে দেবে? নাকের সকড়ি মুছে বড়ো করে শ্বাসটান দিল আদুরী। আবার বুকের শাড়ি তার খসে পড়ল নাভি ডোবা জলে। কেমন ভায়ে-চিন্তায় ছোট হয়ে গিয়েছে আদুরির বুক দুটো। জলীয় হাওয়ায় ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল তার কান্নার গতি।

বৃষ্টির তোড়ে সারারাত দু-চোখের পাতা এক হল না সরস্বতীর। ভোরের দিকে শুভ ওই স্যাঁতসেঁতে বিছানায় দেহ এলিয়ে দিল। তখনও বজ্র-বিদ্যুত এৎ খেলা চলছে আকাশে। গালে হাত দিয়ে ঠায় বসে আছে অবনী। হাওয়াতে তাবু উড়ে গেলে সে চেপে ধরবে খুঁট। সরস্বতীও সতর্ক। মাথা বাঁচানোর জন্য ছাউনিটাকে বাঁচাতে হবে। আকাশ যখন মাথা বাঁচাতে অপারগ তখন একটা মানুষ অন্য মানুষের ছায়া হয়ে বেঁচে থাকে।

সকালের আলোয় অবনী দেখল আর জল বাড়েনি। কলাগাছের কোমর ডোবা জল একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

লাল চা বানিয়ে সরস্বতী ডাকল, কই আসো। চা খাবা না?

চায়ের কথা শুনে মনে স্মৃর্তি হল অবনীর। ফি-সকালে অতলী দিদিমণি তার জন্য চা বানান। ওর জন্য আলাদা কাপ রাখা আছে দিদিমণির ঘরে। সকালবেলায় অতসী দিদিমণির ঘরে চা খাওয়াটা তার কাছে একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছে।

লাল চায়ের দিকে তাকিয়ে অবনীর মনটা হঠাৎ ভরে উঠল বিষাদে। অতসী দিদিমণি তার পাশের গাঁয়ের অথচ বিপদের দিনে তাকে ফেলে চলে লেগেন এই ক্ষোভ জ্বালার কথা সে কাকে বলবে? কিছু কথা থাকে যা গলা ফাড়িয়ে বলা যায় না? অতসী দিদিমণি ফিরে এলে সে কি আগের মতো তার সাথে মিশাতে পারবে?

সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়ে জলে হাত রেখেছে শুভ। সরস্বতী তাকে দেখতে পেয়ে সাবধান করল, অমন করিস নে বাবা, পড়ে গেলে বিপদ ঘটে যাবে।

শুভ মার কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো করে তাকাল, পড়ে গেলেই বা, আমি তো সাঁতার জানি!

সাঁতার সব সময় কাজে লাগে না। এ তো পুকুর নয় যে সাঁতার কাটবি। বানের জল বড়ো নোংরা হয়।

শুভ ত জলের কাছ থেকে নড়ল না। সরস্বতী তাকে ভোলাবার জন্য বলল, সময় নষ্ট না করে বরং ছিপ নিয়ে বস। বানের জলে ডোবা-পুকুরের মাছ থাকে।

 মাছ ধরার প্রস্তাবটা লুফে নিল শুভ। মাটি ডুবে গিয়েছে জলে। এ সময় কেঁচো পাওয়া যাবে না। মাছ ধরতে হলে আটার টোপকে কাজে লাগাতে হবে। টোপ ছাড়া কেউ আর বঁড়শির কাছে ঘেষতে চায় না।

শুভ লম্বা ছিপ ফেলে বসে আছে জলের দিকে তাকিয়ে। বেলেমাছগুলো সাঁতরে চলে যাচ্ছে পগার-পার। মাছগুলো বোকা। একবার টোপের দিকে ওদের নজর পড়লে ভাগ্য খুলে যাবে। বেলে মাছগুলো খেতে খুব সুস্বাদু।

শুধু মাছ ভাসে না, ভেসে যায় কাঠের খাট, কাঠের সিন্দুক, দরজা। খড়ের চালাঘর ভেসে যেতে দেখে শুভ চেঁচিয়ে ডাকল, মা, দেখে যাও ঘর ভেসে যাচ্ছে।

হাতের কাজ ফেলে ছুটে এল সরস্বতী। এই বান বন্যায় কত মানুষের যে কপাল পুড়ল কে জানে। স্রোতের মুখে যে পড়বে সেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে এ তো জানা কথা। জটা হালদার সব জেনেও ঝাঁপ দিয়েছে জলে। ওর দৈনন্দিন অভাব বাধ্য করেছে ওকে ঝাঁপ দিতে। বিপদে সুযোগ খোঁজে অনেকে। চরম বিপদের দিনে অনেকেই আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এসব কাজে সফলতা কম এলেও ঋকি হাজার গুণ বেশি।

জটা হালদার যদি ভেসে যাওয়া পাটের মাড় ধরতে পারত তাহলে বেশ কিছু টাকা সে পাট ছাড়িয়ে উপার্জন করে নিতে পারত। তা যখন হয় নি তার জন্য আর মনে মনে আফসোস করে লাভ নেই।

জল স্থিতু হবার পর কলার ভেলা নিয়ে হাসপাতালের দিকে গিয়েছিল অবনী। পিচ রাস্তার দিকে যতই এগোচ্ছিল ততই যেন পাক খাচ্ছিল কলার ভেলা। লগা ঠেলেও বাগে আনা যাচ্ছিল নাসেই ঘূর্ণি। তবু দক্ষ হাতে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতিকে সামাল দেয় অবনী।

পুরো হাসপাতাল চত্বর বান ঢোকার পর আর চেনা যায় না। শুধু খেজুর গাছগুলো মাজা জলে দাঁড়িয়ে আছে, ওদের ঝাঁকড়া মাথায় আশ্রয় নিয়েছে সাপ পোকামাকড়। সব চাইতে বেশি বিপদে পড়েছে পিঁপড়ের দল। ওদের বেশির ভাগই ভেসে গিয়েছে জলের স্রোতে, যারা নিজেদের কোনোমতে বাঁচিয়েছে তাদের আশ্রয় এই গাছগুলো।

ফেরার সময় অবনী শিউরে উঠেছিল খরিস সাপের ফণা তোলা মাথা দেখে। বান-বন্যায় ওরাই বা যাবে কোথায়? জলে খরিস সাপের সাঁতার কাটা এর আগে সে দেখেনি। হাসপাতালের মাঠে সেই বিরল দৃশ্য দেখতে পেয়ে মনের ভয়ে সে জড়িয়ে গেল।

খরিস সাপের গল্পটা শুভ বা সরস্বতীর কাছে করা যাবে না, ওরা তাহলে ভয়ে আর জলের দিকে তাকাবে না। বন্যার আলোচনা যেদিন থেকে শুরু হয়েছে সেদিন থেকে শুভ ভীষণ মনমরা। এই অসাম্য তার মন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। মেঘলা আকাশের মতো গুম মেরে আহে সে। বোঝা যাচ্ছে নিজের ভেতর ঝড় বইছে তার। এত দিনের সাজিয়ে রাখা স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে গিয়েছে তার।

সবুজ যাওয়ার সময় তাকে একটা কথাও বলেনি। এই হাসপাতালে শুভর সব চাইতে কাছের মানুষ অতসী পিসি। জ্ঞান পড়ার পর থেকে এই পিসিকেই সে নিজের পিসি বলে জেনে এসেছে। অথচ কোয়ার্টার ছাড়ার সময় এই পিসিও একবার মুখে জিজ্ঞেস করল না। এত দিনের আগলে রাখা সম্পর্ক এভাবে টলে উঠবে হঠাৎ ভাবতে পারেনি শুভ। মানুষ কি তাহলে এরকম স্বার্থপর হয়? কেন হয়? আত্মরক্ষার জন্য মানুষের এই বেহায়া স্বার্থপরতা মন থেকে মেনে নিতে পারে না শুভ। অথচ সবাই যে একই ছাঁচে গড়া তা নয়। নোনা আতা আর মিষ্টি আতার ফারাক নিয়ে যে যার মতো বেঁচে আছে।

শুভর মন খারাপ লক্ষ্য করে অবনী বলল, জল চিরকাল একভাবে থাকবে না। যত দিন যাবে ধীরে ধীরে জল কমবে। জল কমলে তুই বাজারের দিকে যেতে পারবি, তখন তোর এত মন খারাপ করবে না।

শুভ কিছু না বলে অবনীর মুখের দিকে তাকাল। চারদিকের জল তার মনে কোনো শাস্তি দিতে পারছিল না এটা সত্যি কথা। তবু সবুজ আর রঘুনাথের কথা মনে পড়ে তার মনটা কেমন বিষাদে ছেয়ে গেল। বিপদের দিনে ওরা যদি পাশে থাকত তাহলে মনের জোর কত বেড়ে যেত। ঢোঁক গিলে সে বলল, এত জল জীবনে আমি প্রথম দেখলাম। সবাইকে হারানো যাবে কিন্তু জলকে হারানো অত সহজ নয়।

খুশিতে ঘাড় নেড়ে অবনী বলল, ঠিক কথা। বন্যা আমি জীবনে ঢের দেখেছি। তবে এবারে বন্যা বেশ জমকাল। এবার বন্যা আঁটঘাট বেঁধে এসেছে।

-বৃষ্টি কমে গেলে বন্যার খোঁতা মুখ ভোতা হয়ে যাবে। সরস্বতী মুখ বেজার করে বলল।

অবনী তার কথায় সায় দিল, ঠিকই বলেছো। বৃষ্টি হল গোদের উপর বিষফোঁড়া। ফোঁড়া ফেটে যতক্ষণ না পুঁজ বেরচ্ছে ততক্ষণ আর রেহাই নেই।

শুভ উশখুশ করছিল কিছু বলার জন্য। সরসবতী তাকে বলল, বৃষ্টি হোক, বানবন্যা যাই হোক তবু এর মধ্যে তোক পড়তে হবে। ইস্কুল খুললে তোর পরীক্ষা। এবার আরও ভালো করে পাশ করতে হবে ।

সরস্বতীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুভ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। সব বইখাতা নিয়ে ছাদে ওঠা সম্ভব হয়নি। কাপড়ে বইগুলো বেঁধে রেখে এসেছে তক্তপোষে। জল আর না বাড়লে ওগুলোর আর কোনো ঝুঁকি নেই। মাধুরী বলেছে এবার একসাথে পড়বে। ফিজিক্স কেমিস্ট্রি আর অঙ্কটা দেখিয়ে দেবেন ডাক্তারবাবু। এছাড়া টিউশনির মাস্টার তো আছেন।

মাধুরী এত বড়ো বিপদেও তাদের কথা ভোলেনি। সবুজের চাইতে মাধুরীর মন ঢের ভালো। সে তার বাবার সঙ্গে তর্ক করে গেছে সমানে। জোর দিয়ে বলেছে, শুভদের আমাদের সঙ্গে শিবনাথবাবুর বাড়িতে নিয়ে চলো। আমরা না নিয়ে গেলে ওদের কেউ থাকার কথা বলবে না। এটা গ্রাম। আমি সব বুঝে গিয়েচি।

-তুই চুপ কর। যা হচ্ছে হতে দে।

–তার মানে? সবাই অন্যায় করছে তুমি তাকে সাপোর্ট করবে?

–যেখানকার যা কালচার। আমি কি করব বল? আমি রামমোহন হতে পারব না।

-বাবা, তোমার মুখে এমন কথা মানায় না। অভিমানে চোখ ছলছলিয়ে উঠেছিল মাধুরীর। অভিমানের দাম বেশির ভাগ সময় পাওয়া যায় না। মুখ ফুলিয়ে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল মাধুরী।বাবার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেতাই গরিয়ে গেল তার।সবাই গড়পড়তা, কেউ আর ব্যতিক্রমী হওয়ার দুঃসাহস দেখাল না। নিজের বাবাকে নিয়ে মাধুরীর গর্ব ছিল মনে। সে ভাবত তার বাবা অসাধারণ। এ গ্রামের কারোর সঙ্গে তার বাবার তুলনাই চলে না।

ভুল। তার ভাবনাটা সম্পূর্ণ ভুল। সব মানুষের ভিতরে বাঘ আর বেড়াল ঘাপটি মেরে বসে থাকে। ওরা সময় আর সুযোগ বুঝে বাইরে আসে। সচরাচর ওদের থাবায় নখ লুকানো থাকে, সাধারণ ছা-পোষা মানুষ সেই নখগুলো দেখতে পায় না।

চারদিনের মাথায় প্রায় বিশটা কলাগাছ হুমড়ে পড়ল জলে। সব চাইতে আশ্চর্য ডুমুর গাছটাও বাদ গেল না বানের জলের কামড় থেকে। গোড়ার মাটি কী ভাবে যেন আলগা হয়ে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে গাছটাকে। ডুমুরের খসখসে পাতা ছুঁয়ে বয়ে যাচ্ছে জল। উপরের জল ধরলেও মাঠের জল ঠায় দাঁড়িযে। চড়া রোদ উঠলে জল মরবে একথা বলছে মুরুব্বিরা। সবার কথা মন দিয়ে গিলছে শুভ। এই জলে ঘেরা জীবনকে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছে সে।

টানা ছদিনের পর জল কমতে লাগল বন্যার। ডুবে যাওয়া ঝোপ ঝাড়ের পাতা পচে গন্ধ ছাড়ছে চারধারে। এই গন্ধটাই ভয়ের কারণ। পরিবেশ একেবারে বিষিয়ে ছাড়ে। ডুবো ঘাস খেয়ে গলা ফুলেছে ছাগলের। গোরুগুলো ছেরানী রোগের প্রকোপে প্রায় শেষ হয়ে গেল। মাঠের ফসল হারিয়ে চাষীর মাথায় হাত।

সন্ধের আগে পাকা রাস্তায় জটা হালদারকে ভান-বিকশা থেকে নামতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল অবনী। দেশলাই আর বিড়ি কিনতে সে ব্ৰহ্মাণীতলায় গিয়েছিল। জটা হালদারকে দেখে বুকের ভেতরটা ধড়মড় করে উঠল তার। বাঁধ ভাঙার দিন মাছ ধবতে গিয়ে জলে ভেসে গেল জটা হালদার। তার বউ আদুরী কাঁদতে কাঁদতে গ্রামে ফিরেছে এ পথ দিয়ে। বউটার সেই কান্না এখনও কানে লেগে আছে অবনীর। স্বামী হাবানোর শোক সেদিন তার চোখেমুখে লক্ষ্য কবেছিল সে। মনে মনে ব্যথা পেয়েছিল সে নিজেও।

হঠাৎ কোথা থেকে ফিরে এল জটা হালদার? এই প্রশ্নটা যখন অবনীর মাথায় ঘোঁট পাকাচ্ছে তখন থুতনি চুলকাতে চুলকাতে এগিয়ে এল জটা হালদার। বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে বলল, অবনীদা ভালো আছো তো?

–হ্যাঁ ভাই সব ভালো। তা তোমার খবর কি?

–আমার কথা বাদ দাও। মা বুড়োমার দয়ার কোনোমতে আমি প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে এলাম।

–বাঁধ ভাঙার দিন ঠিক কি হয়ে ছিল তোমার? অবনী কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারল না।

কী আর বলব দাদা। কপাল মন্দ হলে যা হয়। বিমূঢ় স্বরে কথাগুলো আউড়ে আকাশের দিকে তাকাল জটা হালদার, খ্যাপলা জাল নিয়ে মাছ ধরছিলাম বাঁধের গোড়ায়। বাঁধ যে ভেঙেছে সে খবর আমার কানে এসেছে যথাসময়ে। কুমোর খাদ যেই না জাল ফেলেছি এমনি শরীরের ভারে বাঁধের কোনার মাটি খসে আমি একেবারে ঠিকরে পড়লাম জলে। বানের জল তখন বোঁ-বো করে ঘুরছে। সেই ঘূর্ণি জলে বেশ কয়েকবার পাক খেয়ে আমি তলিয়ে গেলাম। স্রোতের টানে আবার ভেসে উঠলাম দশ হাত তফাৎ-এ গিয়ে। তখন আর ডাঙায় ফেরার কোনো উপায় নেই। জল হুড়মুড়িয়ে ছুটছে চাপড়ার বিলের দিকে। প্রাণের দায়ে গা ভাসিয়ে দিলাম সেই জলে। মনে মনে ভেবে নিলাম সাঁতার জানি যখন ডুবব না। দেখি জল আমাকে ঠেলতে ঠেলতে কর নিয়ে যায়। মুখ ফাঁক করে শ্বাস নিল জটা হালদার। অবনীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে কথা হাতড়াল অনেকক্ষণ।

-তারপর? অবনীর তর সইছিল না। মনটা চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

জটা হালদার অবনীর মনের ভাব বুঝতে পেরে মুচকি হাসল, তারপর চলো চিবকে আলতো হাত বুলিয়ে বলল, দাদা গো ভাসতে-ভাসতে পড়ে গেলাম একেবার পাগলা চণ্ডীর দহে। কী কালো জল, আর কী ঠাণ্ডা! মনে হল জল নয়, কিলবিল করছে সাপ। সেই যে ভাসার শুরু তার আর শেষ নেই। শেষে কি না উঠলাম নবদ্বীপেব গঙ্গায়। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে জল ভেঙে আসছি। দেবগ্রামে ভ্যান পেলাম। এটুকু রাস্তা আর হাঁটতে হয়নি।

অবনী জটা হালদারের ভেসে যাওয়ার , শুনে বিস্মিত না হয়ে পারল না, অবশেষে বিড়বিড়িয়ে সে বলল, একে বলে রাখে হরি তো মারে কে? যাও, ঘর যাও। তোমার বউতো কেঁদে কেঁদে মুচ্ছা যাচ্ছে। তার তো পাগলের দশা।

-বউয়ের কথা না শুনলে এমন বিপদ হয় গো। আফসোস ঝরে পড়ল জটা হালদারের গলায়, যাই গো, জানি না আদুরী আমার কেমন আছে। বেচে পাড়ের মাটি যখন প্রথম ছুঁলাম, তার মুখটাই আমার মনে পড়ছিল। হাঁটুডোবা জলে জটা হালদার ছোটার মতো করে হাঁটছিল। ওর খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভর্তি মুখটা কালচে হয়ে গিয়েছে বানবন্যায়।

হাসপাতালের মাঠ অনেক নামলা। হাঁটুডোবা জল এখনও আড়াল করে বেখেছে ঘাসের সংসার। ঝোপঝাড়ের ডুবে থাকা সংসার এখন হাঁটু জলে ঝাঁকড়া মাথা তুলে শ্বাস নিতে চাইছে। কদিনের জমা জলে গাছের পাতায় ভরে গিয়েছে পলি। রোদ পড়লে বদলে যাবে পাতার বরন। পলিমাটি শুকিয়ে ঝুরঝুবে বাতাসে ঝরে পড়বে নীচে।

ফি-বছর গাঁয়ে গাছপুজো করে বুনোপাড়ার মেয়েরা। ভাইফোঁটার সময় ফোঁটা দেওয়া হয় গাছকে। এই গাছ ঝড়-দুর্যোগ থেকে বাঁচায় তাদের। প্রকৃতির ক্রোধ সহজে মেটে না। এখনকার ঝড়-বৃষ্টি বাঁধনহারা। ফি-বছর ঝড়ে কত ঘর ভাঙে, ধসে পড়ে দেওয়াল, এমন কি উড়ে যায় ঘরের চাল। বুড়িগাঙ ফুঁসতে ফুঁসতে ঢুকে যায় উঠোনে। বুড়িগাঙের পাড়ে বাস করে এসব আনুগত্য না মানলেও চলে না। ভূষণীবুড়ি এই পুজো পাঠ নিয়ে মেতে আছে। গায়ের মঙ্গল সে-ও চায়। তার ভেতরেও অসহায় দহন ছারখার করে।

শুধু গাছপুজো করেও মন ভরে না। এত বড়ো নদী, তারও তো খাতির দরকার। গঙ্গাপুজোর সাথে সাথে তারা দল বেঁধে শুরু করেছে নদীপুজো। নদীর কাছে করজোড়ে বলা, মাগো,দয়া করো। এবছর আর বানবন্যা দিও না। গেল বছর ফসল খেল, তার আগের বছর চাষ হল না, এবছর মাগো যেন উঠোনে ধানের বিড়া আসে।

শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে গাছ আর নদীর পুজো সারে ওরা। এ পুজো চলে আসছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। আগে মেয়েরা সাফ-সুতরো শাড়ি পরে নৈবেদ্য সাজিয়ে নিয়ে যেত গঙ্গার ধারে। এখন পুরনো শাড়িতে মন ভরে না, নতুন শাড়ি চাই।

এ পুজোয় কোনো পুরোহিত নেই, নিজেরাই নিজেদের বামুন ঠাকুর। ঝারি হাসতে হাসতে বলে, এ বছর আর বাঁধ ভাঙবে নি। মানুষের দশা ভেষণ শোচনীয়। ভালো করে পুজো না করলে কপালে বিপদ আচে।

অবনী পিচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাবল, শাঁখা পরা হাত, সবাই একসাথে গাছের গোড়ায় হাত দিয়ে প্রার্থনা করছে গ্রামবাসীর মঙ্গল। এত কিছুর পরেও বাঁধ ভাঙল কিভাবে, কিভাবে ভেসে গেল জটা হালদার? তাহলে প্রকৃতি কি রুষ্ট মানুষের উপর?

রাস্তার ধারে জলে ডুবে থাকা আপাংগাছের মরমর দশা। অবনী এই গাছটাকে অন্য নামে চেনে। গ্রামের প্রায় মানুষ একে বলে চচ্চড়ি গাছ। হাতে ধরে টানলে ব্যথা লাগে তালুতে। ছদিন ছরাত্রি জলে ডুবে গাছটা তবু মরেনি। হোট হয়েও সে যেভাবে বেঁচে আছে–তা বড়োর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

জল কমতে মাঝে রঘুনাথ একদিন এসেছিল। অভিমানে তার সঙ্গে কথা বলেছে শুভ। আক্ষেপ করে সে বলেছে, রঘু, তুই যে অমন বদলে যাবি–আমি স্বপ্নেও তা ভাবিনি।

রঘুনাথের সারা শরীর কেঁপে উঠেছে কথা শুনে। শুভর কাছে তার মুখ দেখাবার জো নেই। শুভই তাকে বলেছিল, প্রথম আগুন ধরানোর গল্প। গল্প করতে করতে হারিয়ে যাওয়া। আর দাসত্ব নয়, পরাধীনতার শেকল ছিঁড়ে, নতুন আলো এসে পড়ছে হাসপাতালের মাঠে। সেই আলোকরশ্মি ছুঁয়ে যাচ্ছে মেহনতী মানুষের স্বপ্ন।

রঘুনাথ খুব অবাক হয়ে শুনছিল শুভর কথাগুলো। শুভ তার চাইতে বয়সে ছোট কিন্তু কথাবার্তায় ধানিলঙ্কার ঝাঁঝ। ওর কথা শুনে রঘুনাথ ভিতরে ভিতরে তেতে ওঠে। শুভ অকপটে বলে, মারের বদলে ইকুই করে লেজ নাড়লে হবে না। যে হাত দিয়ে ওরা আঘাত করবে ওদের সেই হাত ভেঙে দিতে হবে। তবে যদি উচিত শিক্ষা হয়।

এসব কথা বলার পরে শুভ হাসপাতালের সবার ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে। তাদের ফেলে সবাই যে যার নিরাপদ স্থানে চলে গিয়েছে এই যাওয়াটাই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। শুভ। অথচ এদের নিয়ে এক সমাজে বাস করার কোনো অর্থ হয় না। তার আদর্শ বিদুর রাজোয়ার, লাবনি রাজোয়ার। ওদের কথাবার্তায় থাকে আগুনের হল। ওরা নিজেরাই যেন একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ আগুনের কুণ্ড। ওই অভাবী মানুষ দুটিকে মন থেকে শ্রদ্ধা করে শুভ। বিদুর কাকা প্রায়ই হাসপাতালে আসে রোগী নিয়ে। প্রায়ই বড় ডাক্তারবাবুর সঙ্গে তার তর্কাতর্কি হয়। ডাক্তারবাবুর মনটাও খুব যে সংস্কারমুক্ত তা নয়। তিনি বিদুরকে শুনিয়ে বলেন, ওভাবে কৌটো নাড়িয়ে বিপ্লব আসবে না। চীনের চেয়ারম্যান যেমন আমাদের চেয়ারম্যান হতে পারেন না, তেমনি ভারতবর্ষের মাটিতে আপনাদের কমিউনিস্টের পতাকা কোনোদিনও উড়বে না। কেন উড়বে না জানেন? আরে মশাই, দীঘার বালিয়াড়িতে কাজুবাদামের চাষ ভালো হয়, তা বলে সেখানে পাটচাষ করলে ভালো হবে না। মাকর্সইজিমের চাষ আবাদ করতে গেলে ভালো মাটি দরকার। সেই মাটি ভারতবর্ষের কোনো প্রান্তে পাবেন না।

বিদুর সেদিন ডাক্তারবাবুর কথা শুনে উত্তেজিত হয়নি, শান্ত নম্র ভঙ্গিতে সে প্রতিবাদ করল শুধু, সময়ই বলে দেবে চাষ-আবাদের প্রয়োজনীয়তার কথা। আপনি-আমি আগাম ভবিষ্যৎবাণী করার কে? আমাদের সেই অধিকার বা ক্ষমতা নেই। আঠারো শ শতাব্দীতেও মানুষ ক্রীতদাস প্রথার অবলুপ্তির কথা ভাবতে পারত না। কালো মানুষদের ঘৃণা করা হত। অথচ দেখুন দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থার কত পরিবর্তন ঘটল। আসলে কি জানেন ডাক্তারবাবু, পরিবর্তনটা ভূমিকম্পের মতো হুড়মুড়িয়ে আসে না, পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে। সময়ের হাত ধরে পথ চলে বিপ্লব। প্রতিবাদ তার দর্শন। আমরা এগুলো অস্বীকার করতে পারব না।

রঘুনাথ শেরপুর ধাওড়া থেকে জলপথে এসেছে। তার পরণে একটা হাঁটুকাটা খাকি প্যান্ট। পায়জামা আর সাদা গেঞ্জিটা সে বেঁধে নিয়েছে মাথায়। তাকে অনেকটাই সাহেবমাঠের পেয়াদার মতো দেখতে লাগছে। রঘুনাথ এতটা পথ হেঁটে এলেও হাঁপিয়ে ওঠেনি।

সরস্বতী ছাদের উপর বাটি ভর্তি মুড়ি দিয়ে বলল, এগুলো খেয়ে নাও। আজ এখানে সেদ্ধভাত খেয়ে যাবে। রঘুনাথ না করতেই সরস্বতী কেমন মনমরা চোখে তাকাল, আমি তোমার মা হই না, মায়ের কথা শুনতে হয়। আর একটা কথা। খাওয়ার জল ফুরিয়ে গিয়েছে। ভেলা নিয়ে থানার কল থেকে দু-ঘড়া জল এনে দিও। শুনেছি–থানার চাপাকলটা কোনো বন্যাতেও নাকি ডোবে না।

রঘুনাথ মুড়ি চিবাতে চিবাতে ঘাড় নাড়ল।

 সরস্বতী বলল, একটু সরষের তেল দেব? কাঁচা সরষে তেলের টা আমার ভালো লাগে। রঘুনাথের মতামত না নিয়েই ছোট চামচের আধ চামচ তেল মুড়ির বাটিতে পরিমাণ মতো ছড়িয়ে দিল।

কলার ভেলায় থানার পথটা দীর্ঘ নয়। কুমোর ডোবা পেরলেই পালপাড়ার ডাঙা। বাঁশঝাড়ে ভেলাটা তুলে রেখে ওইটুকু পথ অনায়াসেই পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়।

কলার ভেলা বলে বেশি ঝুঁকি নিতে চাইল না রঘুনাথ, শুভকে বলল, তুই ঘরে থাক। আমি ঘুরে আসি। থানা থেকে দুঘড়া জল আনতে আর কত সময় লাগবে?

বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর থেকে একরকম বন্দী হয়ে দিন কাটছে শুভর। ফলে এ সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চাইল না। তাছাড়া কুমোর ডোবা ভেলায় করে পেরনোর আনন্দটাই আলাদা যদি সঙ্গে রঘুনাথের মতো বন্ধু থাকে। লগা ঠেলে কুমোর ডোবার মাঝখানে আসতেই একটা মাছ ঘাই দিয়ে কাঁপিয়ে দিল জল। ঢেউগুলো ছড়িয়ে যেতে লাগল চারদিকে। শুভকে অবাক করে দিয়ে রঘুনাথ বলল, যে মাছটা ঘাই দিল সেটা কম করে সের তিনেকের তো হবেই। জানিস শুভ, এই বন্যায় পণ্ডিত বিলের মাছ সব ভেসে গিয়েছে।

-কি করে বুঝলি?

শুভর পাল্টা প্রশ্নে রঘুনাথ বলল, আখের খেতে ভিকনাথ কাকা এট্টা কাতলা মাছ ধরেছিল যার মাথাটা এট্টা বাছুরের মাথার চেয়েও বড়। আঁশগুলো এট্টা কাঁচা টাকার চেয়ে বড়ো আর মোটা। ধাওড়া পাড়ায় মাছটারে পাট মাপার কাটায় ওজন করা হল। পাক্কা সাড়ে পাঁচসের। কাকা একা খায়নি মাছটা। সবাইকে দিয়ে তারপর খেল।

শুভ বলল, এখানেও একটা ঘটনা ঘটেছে। জটা কাকা মাছ ধরতে গিয়ে ভেসে গিয়েছে। তার খবর কেউ জানে না। লোকে যে খোঁজ খবর নেবে জলের জন্য তা পারছে না। আর একটা কথা। বানের প্রথম দিনে পোদ্দারদের ফাইভে পড়া ছেলেটা বাজারের বড়ো ড্রেনটাতে পড়ে গিয়েছিল। তাকে শেষে পাওয়া গেল হাজরাপাড়ার নালাটায়। জল খেয়ে পেট ঢোল হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার। পরে সে বেঁচে যায়।

বাঁশ ঝাড়ের কাছে ভেলা থামিয়ে শুভ বলল, এই বানবন্যায় সুফল ওঝার বাজার এখুন ভাল চলছে। সাপখোপ, পোকামাকড়ের উৎপাত বেড়েছে। শুনেছি কাজের চাপে সুফল ওঝা নাকি নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়েছে। শালা ধাপ্পাবাজটা আর এটু হলে আমার গলায় শ্বশুর হয়ে এটকে যেত! অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েচি মাইরি! ঝটকা মেরে কলার ভেলা থেকে ডাঙায় লাফিয়ে পড়ল রঘুনাথ। তার দেখাদেখি শুভও ঝাঁপ দিল ডাঙায়। ভেলাটা সামান্য হেলে গিয়ে আবার ঢেউয়ের ধাক্কায় ফিরে এল ডাভায়।

রঘুনাথ হশিয়ার হয়ে বলল, ভেলাটা না বাঁধলে ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে দূরে চলে যাবে তখন আর ফেরা যাবে না। কি দিয়ে বাঁধা যায় বলদিনি?

শুভ কপালে ভাঁজ ফেলল, জলের লতা নিয়ে বাঁধবি? বলেই সে গা জড়াজড়ি কলমীলতার ঝোপটার দিকে তাকাল।

ভ্রূ কুঁচকে রঘুনাথ বলল, জলের যা শ্ৰেত কলমীলতা ছিঁড়ে যাবে।

-তাহলে কাঁচা দিয়ে বেঁধে রাখলে কেমন হয়।

–মন্দ হয় না। তবে রঘুনাথের আধভাঙা গলায় সংশয় ধরা পড়ল।

কঞ্চি যদি ঢেউয়ে-ঢেউয়ে খুলে যায়?

–তাহলে চল ওটাকে ডাঙায় তুলে দিই। শুভ নিরীহ চোখে তাকাল।

বাঁশবাগানে বুঝি আলো আঁধারের খেলা চলে সর্বদা। দুটো ঘুঘু বাঁশের ডালে বসে করুন চোখে চেয়ে আছে পরস্পরের দিকে। ওদের দৃষ্টিতে স্বাচ্ছন্দ্য বা সুখ কোনোটাই নেই। মানুষের মতো গভীর এক বিপন্নতা ওদের যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে।

অন্যসময় হলে রঘুনাথ নিদেন পক্ষে একটা ঢেলা ছুঁড়ে মারত তাক করে। আজ আর সেই মনটাকে খুঁজে পেল না সে। পরিস্থিতি এবং পরিবেশের সঙ্গে মনও বুঝি পাল্টে নেয় নিজেকে।

কলার ভেলাটা ডাঙায় তুলে ওরা দুজনে নিশ্চিন্ত হল। থানায় পথটা পালপাড়ার ভেতর দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গিয়েছে, পালপাড়ার অবস্থান বেশ উঁচুতে। দেশ গাঁ নামলা ভুঁই সব ডুবে গেলেও এখানে জল উঠবে না কোনোদিনও। তাই এখানে যারা বসবাস করে তাদের মনে মৃদু একটা গর্ব আছে।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে শুভ বলল, থানায় যেতে পোর ভয় করে না?

-ভয়? ভয় করলে কেন? কথাগুলো বললেও রঘুনাথের বুকটা ধকধকিয়ে উঠল।

লুলারামের খোঁজে থানায় দুজন পুলিশ এসেছিল পাড়ায়। পুলিশের ড্রেস পরে এলে পাড়ার মানুষের কৌতূহল বাড়ে। কেউ কেউ ভয়ও পায়। রঘুনাথ ভয় পায়নি। সে এগিয়ে গিয়ে শুধিয়েছিল, কি ব্যাপার অসময়ে এলেন যে?

-তোমার কাকা কোথায়? থানায় অনেক দিন তার হাজিরা নেই। বড়োবাবু পাঠালেন।

-ওঃ, এই কথা! তারপর রঘুনাথ সবিস্তারে লুলারামের নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা বলেছিল। কাকা চলে যাওয়ার পর তার মাথার উপর দুবোনের দায়-দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। বিশেষ করে নূপুর আর নোলকের জন্য কষ্ট হয়। ওরা যে কোনো দোষ করেনি।

নোলক পুলিশ দুটোর সামনে কথা বলতে গিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। তার সেই কান্না এত ছোঁয়াচে ছিল যে নূপুরও চোখের জল আটকে রাখতে পারল না। বাবা ছিল তাদের কাছে ছাতার মতো। সেই ছাতাটা ফুটো হয়নি, ভাঙেনি, শুধু কোথায় যেন হারিয়ে গেল ছাতাটা! মাঝে মাঝে তার মনে হয় বাবা বেঁচে নেই। যদি বেঁচে থাকত–সে কি একবার আসত না?

থানার কলে জল নেওয়ার লম্বা লাইন। শুভ গিয়ে সেই লাইনে দাঁড়াতেই একজন পুলিশ এসে খপ করে হাত চেপে ধরল রঘুনাথের, চল, বড়োবাবু তোকে ডাকছে।

-আমাকে? রঘুনাথ ভ্যালভ্যাল করে তাকাল। শুভর সামনে এমন ঘটনা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। ঝামেলার ভয়ে সামান্য বাধা দেওয়ারও চেষ্টা করল না সে। সুড়সুড় করে এগিয়ে গেল থানার পাকা ঘরটার দিকে।

বড়োবাবু রাগী মানুষ একথা রঘুনাথ অনেক আগেই শুনেছে। মাথা ঝাঁকিয়ে বড়োবাবুর সামনে দাঁড়াতেই সিগারেটের ছাই ঝেড়ে লম্বা চওড়া মানুষটি বাঘের গলায় হুঙ্কার দিয়ে বললেন, লুলারাম কোথায়?

–আজ্ঞে, জানি না বাবু।

-জানিস না মানে? আমার কাছে লুকানো হচ্ছে। এমন মার দেব পাছা দিয়ে আমরক্ত বের হবে।

-আমি কিছু জানি না বাবু, মায়ের দিব্যি।

থানায় এসেছিস কি করতে?

–আজ্ঞে জল নিতে?

–শেরপুর থেকে এসেছিস জল নিতে? আশ্চর্য।

রঘুনাথ ঘাড় নাড়ল, না বাবু, আমাদের গায়ে কল আছে। আমি জল নিতে এয়েচি মিতেমায়ের জন্যি ।

–কে তোর মিতে-মা?

–ওরা হাসপাতালে থাকে। আমার মিতেকে ডাকব?

-না, দরকার নেই। বড়োবাবু সিগারেটের পোড়া অংশটা অ্যাশট্রেতে জোর করে খুঁজে দিলেন, তোর রিপোর্ট সব আমার কাছে আছে। দু-বার বেঁচেছিস বলে তৃতীয়বার যে বাঁচবি–এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। থানায় যদি তোর নামে কোনো কমপ্লেন আসে তাহলে মাঠে দাঁড়িয়ে গুলি করে দেব।

রঘুনাথের কলিজায় বড়োবাবুর কথাগুলো বাঘনখ ঢুকিয়ে দিল। ঢোঁক গিলে কাঁপা কাঁপা চোখে সে বড়োবাবুর দিকে তাকাল। বড়োবাবু চিৎকার করে বললেন, আমার দুটো চোখ নয়, দশটা চোখ-বুঝলি? আমার চোখকে ফাঁকি দিতে গেলে তোকে আবার দশবার জন্ম নিতে হবে। যা চোখের সামনে থেকে দূর হ।

রঘুনাথ মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল থানা থেকে। মুখটা মেঘলা আকাশের চেয়েও থমথমে। থানা পুলিশ ঝুটঝামেলা তার ভালো লাগে না। অথচ ওরাই তার পিছু ছাড়ছে না। সে যে কি করবে, কোন পথে চলবে কোনো কথাই তার মাথায় এল না সেই সময়।

শুভর জল ভরা শেষ। সে ঘাড় তুলে হকচকানো গলায় জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ তোকে আবার থানায় ডাকল কেন রে?

রঘুনাথ কি উত্তর দেবে ভাবল। সত্যি কথা শুভর কাছে বলা যাবে না। ওর খুব আত্মসম্মানের ভয়। আসল ঘটনা শুনলে শুভ হয়তো আর কোনোদিন তার সঙ্গে মিশবে না। সব যদি হারিয়ে যায় যাক তবু বন্ধুত্বটা বেঁচে থাকুক। শুভর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রঘুনাথ চাপা গলায় বলল, বড়োবাবু কাকার কথা শুধোচ্ছিল।

-কেন?

কাকা ওর বন্ধু হয়।

থানার বড়োবাবু তোর কাকার বন্ধু? শুভর যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না কথাগুলো। রঘুনাথ হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ রে বাবা, আমরা গরীব বলে কি বড়োলোকের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না?

শুভ ঢোঁক গিলল, না, তা নয়। আসলে বড়োলোকরা গরীবলোককে প্রয়োজন ফুরোলে ভুলে যায়।

আমাদের বড়োবাবু অমন মানুষ নয়। রঘুনাথ জোর দিয়ে বলল, অতসীপিসি কি তোদের সাথে মেশে না বল?

শুভর মন খারাপ হয়ে গেল অতসীপিসির নাম শুনে, পিসির কথা আর বলিস না। পিসিও বোলোকদের মতো

-কেনে কি হয়েছে রে?

এড়িয়ে যেতে চাইল শুভ। রঘুনাথ ওর হাত ধরে বলল, বল, তোকে বলতেই হবে।

শুভ জড়তা ভাঙল, বাবা যে বলে–এক গাছের ছাল আরেক গাহে লাগে না–সত্যি। পিসি আমাদের ফেলে চলে গেল। যাওয়ার সময় আমাদের একবারও মুখের বলাটাও বলল না।

-ওসব কথা মনে রাখা ভুল। রঘুনাথ বিষয়টাকে হালকা করতে চাইল, ভুলে যা, সব ভুলে যা। যে কথায় বুক মোড়া মারে–সে কথা ভুলে যা।

-যে কথায় দুঃখ থাকে সে কথা কি ভোলা যায়?

–মনটাকে পাথর কর, তাহলে সব পারবি।

শুভ ঠোঁট কামড়াল। রঘুনাথের সঙ্গে সে একমত হতে পারছে না কিছুতেই। ভিতরটাতে শুরু হয়েছে তছনছ। ঝড়-বৃষ্টি রাতে ত্রিপল উড়ে যাবার ভয় ছিল। আধলা বা থান ইটের কত জোর যে হাওয়ার বিরুদ্ধে লড়বে। তবু অবনী তাকে বলল, আজ আর ঘুমানো যাবে না। ঝড়ে ত্রিপল উড়ে গেলে পুরো ভিজতে হবে।

আকাশে বিদ্যুৎ-এর সাপ ছুটে বেড়াচ্ছিল, তার সেই জ্বলন্ত রূপ দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছিল সরস্বতীর, শুভর কাছে ঘেষে সে বলেছিল, আজ রাতটা ভালোয় ভালোয় কেটে যাক। কালই ইস্কুল মাঠে চলে যাব। বড় ভয় লাগছে গো। যে ভাবে বাজ পড়ছে কিছু হয়ে গেলে শুদ্ধি মরব।

ইস্কুল মাঠে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না অবনীর। এত জিনিস নিয়ে কোথায় দাঁড়াবে সে। মোকামপাড়া আর স্কুলপাড়ার ঘরহারা মানুষগুলো সেখানে জায়গা নিয়েছে। ভিড়ে গিয়ে ভিড় বাড়িয়ে লাভ নেই। এখানে শতকষ্ট হলেও নিজের বাসা। কেউ তাড়িয়ে দেবার নেই। খেয়ে না খেয়ে এখানে মুখ বুজে পড়ে থাকা যায়। তা সত্ত্বেও চাপা অভিমানটা বুকের খোদলে চোরা হিমের মতো ঢুকে যায়। তখন কষ্ট পাওয়াটা বাড়ে, বাড়তেই থাকে।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকতে বেলা গড়ায়। রঘুনাথ ছাদের উপর থেকে মাছ ধরছিল ছিপ ফেলে। এক ঝাক বেলেমাছ ভাসতে ভাসতে চলে গেল মাঠের দিকে। গাঙতোড় মাছের লম্বা ঠোঁট জলের উপর জেগে আছে। এই মাছটাকেই রঘুনাথ বলে, কেঁকলে মাছ। এক কাঁটার মাছ এটা। বড়ো সুয়াদ। টক রাঁধলে জিভে জল এসে যাবে হড়হড়িয়ে।

এত মাছ ভেসে যায় তবু একটাও ঠোকর মেরে দেখে না। বিরক্তিতে ছিপ গুটিয়ে রঘুনাথ সরস্বতীর মুখোমুখি দাঁড়াল। অবনী মাদুরে শুয়ে কাত হয়ে বিড়ি টানছে। কথাটা কিভাবে শুরু করা যায় রঘুনাথ ভেবে নিল কিছু সময়। তারপর সহজ সরলভাবে বলল, মা, এট্টা কথা বলি। এত কষ্ট করে এখানে পড়ে থেকে কি হবে? তার চেয়ে আমার দোরে চলো। আমাদের হলদিপোঁতা উঁচু জায়গায়। ওখানে জল ওঠে না।

সরস্বতী আড়চোখে অবনীর দিকে তাকাল। আগুন মুখো বিড়িটায় টান দিয়ে অবনী বলল, যেতে পারলে ভালো হত বাবা কিন্তু যাওয়া যাবে না।

-কেনে যাওয়া যাবে না?

–পুরা হাসপাতাল খালি। বান-বন্যায় চুরি চামারি বাড়ে। হাসপাতাল ফেলে আমি কোথাও যাব না।

সবাই যে তুমাকে ফেলে চলে গেল? তখন?

–সে যারা গিয়েছে–যাক। আমি কাউকে বাধা দেব না। আমার ধর্ম আমাকেই মানতে হবে।

–ধর্ম রাখতে গিয়ে জীবন বেরিয়ে গেলে সেটা কি ভালো হবে?

-ভালো-মন্দের হিসেব রাখি নে বাবা। আমার অতো হিসেব ক্যার সময় নেই। অবনী হাল ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গিতে বলল, যে পেটের ভাতের মোগান দেয় তাকে অবহেলা করা পাপ। কিছু মনে করো না। এ হাসপাতাল ছেড়ে এখন আমি কোথাও এক পা নড়তে পারব না।

হাল ছেড়ে দিল রঘুনাথ। অবনীর এই আত্মঘাতী জেদ তার ভালো লাগল না। নিমেষে কঠিন হয়ে উঠল তার ঠোঁট। থিরথির করে কাঁপছে চোখের তারা। জলের দিকে তাকিয়ে সে ভাবল-এই ধর্মটাই গরিবের ঘোড় রোগ। এই রোগ যতদিন থাকবে ততদিন এই জাতটার মুক্তি নেই।

.

৪৯.

হলদিপোঁতায় মন খারাপ করে ফিরে এল রঘুনাথ।

দুর্গামণি তাকে দেখতে পেয়ে বলল, কুথায় ছিলিরে রঘু এতক্ষণ? তোরে খুঁজতে একজন বাবুপারা লোক এসেছিল। দেখে মনে হল আগে একে দেখেছি। রঘুনাথ স্মৃতি হাতড়ে খুঁজতে থাকে পরিচিত মুখগুলো। সব মুখ ভিড় করে এল একে একে। শত চেষ্টা করেও সেই সব মুখের মিছিল থাকে আলাদা করে কোনো একটা মুখকে সে চিহ্নিত করতে পারল না।

দুর্গামণি ছেলের মনোভাব বুঝতে পেরে বলল, অত ভাবার কি আচে। যে এসেছিল সে তোর চেনা জানা। আমি বসতে বললাম, সে বসল না। বলল–আবার আসবে।

–কখুন আসবে বলেচে? উৎসাহ নিয়ে ঝুঁকে পড়ল রঘুনাথ।

দুর্গামণির অভিব্যক্তিহীন মুখ, কখুন আসবে সেই টেইমটা আমাকে বলে যায় নি। তবে সে মাঝের গাঁয়ের দিকে চলে গেল। তুই ঘরে চ তো। মিলা কাজ আছে।

কি কাজ?

 –ভিকনাথ এসে বলে গেল দুলুর সঙ্গে তোরে দেখা করতে।

–কেনে সে আসতে পারল না?

–আমি তার কি জানি।

-তুমি জানো না কিন্তু আমি জানি। রঘুনাথ অস্থির হয়ে উঠেছিল মনে মনে, দুটা কাঁচা পয়সার মুখ দেখে ধরাকে সরা ভাবছে মানুষটা। ঠিক আছে, আমার যখন দরকার তখুন আমিই যাব দেখা করতে।

এখুন আর ঘরের বাইরে যাস না। আগে বান যাক তারপর। দুর্গামণির কথা শেষ না হতেই ঘরের ভেতর থেকে ভেসে এল কাশির খ্যাসখেসে শব্দ। ভয় পাওয়ার মতো শব্দগুলো আছড়ে পড়ছিল ঘরের দাওয়ায়। দুর্গামণি কথা থামিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘাড় তুলে তাকাল, আমি যাইরে। তুর বাবা ঘুম থিকে উঠেছে। এবার চা বসাব। মানুষটার যে ভেষণ চায়ের নেশা।

রঘুনাথ কোনো কথা না বলে নিথর হয়ে দাঁড়াল। দুর্গামণি তাকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলল, কি ভাবছিস রে?

-কিছু না।

–মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অতো সস্তা নয়।

 যেন ধরা পড়ে গেল রঘুনাথ, গলা খাদে নামিয়ে সে শুধোল, সত্যি করে বলদিনি-বাবার কাশিটা কমেছে কিনা।

দুর্গমণি-হা-করে তাকাল, এ জন্মের কাশি কি কমে রে বাপ? এ হল বুড়ো শিবের ধার। একেবারে সাথে যাবে।

–এসব কথা বলতে তুমার একবারও মুখে বাঁধিল না? রঘুনাথের মুখ বিরক্তিতে বেঁকেচুরে গেল।

দুর্গামণি চাপা গলায় আগুন ঝরিয়ে বলল, সত্যি কথা বলতে দোষ কুথায়?

-নীলুবাবুর জোড়া পায়ের লাথিটা ওর বুকের কলকজা সব নড়িয়ে দিয়েছে। আমি আর কত দেখব। এ সব দেখার আগে আমার মরণ হলে ভালো হত। আঁচলে মুখ ঢেকে গিয়ে উঠল দুর্গামণি।

রঘুনাথ মহা সংকটে পড়েছে, কাছ কেনে? চুপ করো।

-চুপ করা যায়, বল? আজ দুপুরেও তোর বাপের মুখ দিয়ে চাপ চাপ অক্ত উঠেছে। মনে হচে- দুর্গামণি পুরো কথা বলল না। থামল।

রঘুনাথ বিপদের সংকেত পেয়ে বলল, নীলুবাবুর যা সর্বনাশ করার তা আমি করে দিয়েছি। বড়োগাছ বলে ঝড়টা সামলে নিয়েছে।

–সে সামলে নিলেও তোর বাপ তা পারেনি। আজও বিড় বিড় করে নীলুবাবুকে গাল দিচ্ছিল।

–তুমি কি চাও আমি নীলুবাবুকে শেষ করে দিই?

আঁতকে উঠে মরা ভ্যাদভেদে চোখে তাকাল দুর্গামণি, মা হয়ে তুর অমঙ্গল হোক এ আমি কি করে চাই বাপ? তুই তোর মতো থাক। তোর বাপ যতদিন শ্বাস নেয় নিক। এত মার খেলে কোন মানুষটা বাঁচে বল।

রঘুনাথ চুপ করে গেলে দুর্গামণি বলল, তোর দাদুও কেমন নেসকে গিয়েছে। তারে আমি কত বুঝিয়েচি। সে কিছুতে বুঝবে না। সে ঠোঁট কামড়ে আফসোসের সঙ্গে মায়ের দিকে তাকাল। দুর্গামণি নিরাসক্তভাবে বলল, ছেলে বড়ো হলে বাপ-মা তার উপর অনেক কিছু আশা করে। আমিও তোর কাছে কিছু চাই রঘু। তোকে তা দিতে হবে।

রঘুনাথ ঢোঁক গিলল, আমার চেষ্টার কুনো খামতি থাকবে না মা।

-তাহলে তুই কথা দে তুই তোর বাপের বদলা আমি বেঁচে থাকতি নিবি। কথা দে। মানুষের চোখ যে চুলার আগুনের চেয়েও তীব্র হয় সেই প্রথম মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে টের পেল রঘুনাথ। এ কোন মাকে দেখছে সে। এতো মা নয়–আগুনের ঢিপি।

রঘুনাথ ধীরস্থির ভাবে বলল, বাবুদের সাথে মিশলেও বাবুরা আমাকে আপন করে নেয়নি। ওরা আমাকে ভাবে বুনো, রাজোয়ার। হ্যাঁ, বুনো হয়েই আমি দেখিয়ে দেব-আমিও কারোর চাইতে কম নই। আমোর শরীলেও রাগ আচে।

সন্ধে নেমে এল হলদিপোঁতার উপর। সাঁঝ নামলে কালো হয়ে যায় বুড়িগাঙের জল। ডি ভি সির ছাড়া জলে তার রূপ খোলতাই হয়েছে দশগুণ। এখন চোখ ফেরালে চেনা যায় না তাকে। যুবতীর ঠাটবাট নিয়ে সে এখন অনন্যা। রঘুননাথ হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল পাকুড়তলায়। সেখানে গামছা গায়ে জড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল দুলাল। বেশ কদিন হল তার হাতে কোনো কাজ নেই। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর মুনিষ খাটার সব আশা ধুয়ে গিয়েছে। এভাবে বেকম্মা হয়ে ঘরে জুতে গেলে ভাত জুটবে না। সকালে ইন্দু তাকে পঞ্চায়েত অফিসে পাঠিয়ে ছিল রিলিফের জন্য। হরিনাথপুর থেকে দুলাল শুনে এসেছে ত্রাণবন্টন আগামীকাল থেকে শুরু হবে। শুকনো খাবার চাল-ত্রিপল দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। দেবগ্রাম থেকে টিন বোঝাই হয়ে ওঁড়ো দুধ এসেছে। সেই গুড়ো দুধও দেওয়া হবে সবাইকে।

রঘুনাথকে দেখে বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকা দুলাল এগিয়ে এল সামনে, গলা খেঁকারি দিয়ে বলল, হা রে রঘু, সকাল থিকে কুথায় গেছিলিস?

-মিতের ঘরে গেছিলাম।

 –তা কখুন ফিলি? তুর সাথে কিছু দরকারি কথা ছিল।

-বলে ফেল। রঘুনাথ গুরুত্ব দিতে চাইল না দুলালের কথাকে। ও দুলাৰ ঘনিষ্ট হয়ে সরে এল, তোর বাপের অবস্থা কিন্তু ভালো বুঝচি নে। আমার মনে হয় গুয়াদাকে বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার।

রঘুনাথ ঝিম মেরে শুনল কথাগুলো, একই কথা মা-ও বলছিল।

বলবে তো। ঘরের মানুষ বলে কথা। তবে এখন বান বন্যায় কুথায় যাবি? চারদিকে তো জল থৈ থৈ করচে। ডাঙা দেখা যায় না।

-হ্যাঁ, তা যা বলেচো।

–যা করার তাড়াতাড়ি করিস। তোদের সময় বড়ো খারাপ চলচে। তোর কাকাও তো। গোপাল থেমে গেল, যা বলতে চেয়েছিল সেটা বলা শোভন হবে কিনা ভাবল। তারপর গলা ছেড়ে নিয়ে সে দেবদারু গাছের মতো সোজা হয়ে দাঁড়াল, এখুন কুথায় যাচ্ছিস? আঁধার নামছে। ঘর যা

-কাকা? রঘুনাথের ডাকে চমকে উঠল দুলাল, ব্যাকুল গলায় সে বলল, কিছু বলবি?

–শুনছিলাম পঞ্চায়েত থেকে রিলিফ দেবে-সত্যি?

-সত্যি-মিথ্যে জানি না, তবে কথাটা শুনে এসেছি। দুলাল অবজ্ঞায় ঠোঁট উল্টাল, শুধু চাপাকলের জল ছাড়া ঘরে আর কিছু নেই রে। বসে খেলে রাজভাণ্ডারও শেষ হয়ে যায়। ভাবচি জল কমে গেলে টেউনের দিকে পেলিয়ে যাবো।

-পেলিয়ে কতদিন আর বাঁচবা?

যতদিন বাঁচা যায়। তোর কাকির শরীরটা ভেঙে গেছে না খেয়ে-খেয়ে। মার শরীরও ভালো নেই। আসলে বয়স হচ্ছে তো। দুলালের স্বর জড়িয়ে এল। দম নিয়ে সে বলল, তোর ঘরে কে এসেছিল রে? দেখে মনে হল বাবুঘরের ছেলে।

–তুমি চিনতে পারোনি।

-সামনা সামনি তো দেখিনি, পেচন থেকে দেখেচি। দেখে কুনো আন্দাজ করতে পারিনি। কপালে ভাঁজ ফেলে কথাগুলো বলল দুলাল। বলে সুখ পেল সে। কোমরের খুঁটে গোঁজা বিড়ি-দেশলাই বের করে সে রঘুনাথকে বলল, বিড়ি খাবি?

প্রস্তাবটা ঝামেলায় ফেলে দিল রঘুনাথকে, ইতস্ততভাব সরিয়ে সে বলল, থাকলে দাও। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে।

বিড়ি ধরিয়ে কাকা-ভাইপো দুজনে চেয়ে আছে বুড়িগাঙের দিকে। বিড়ির ধোঁয়া উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছে মাঠ পেরিয়ে। দুলাল আক্ষেপ করে বলল, এত জমিন অথচ আমাদের আর কিছু নেই! বাবুরা কায়দা করে চরের খাস জমি সব নিজের নামে করে নিয়েছে। সেখানে ফি-বছর আখ হচ্চে। সুগার মিল চলছে। আমাদের কি লাভ হচ্ছে বল?

-এ তো সাহেব জামানা থিকে হচ্চে। এখুন সাহেব নেই, সাহেবের মতুন কিছু মানুষ আচে। রঘুনাথের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, এ সব ব্যাপারে আমাদের হয়ে কথা বলার কেউ নেই। বিদুর কাকা বলছিল লড়াই হবে। চরের জমি জোর করে দখল নেবে ওরা। শুনেচি-কামারশালে লুকিয়ে তীর বানাচ্ছে খাদু কামার। সেই তীরে দেখ আমাদের মরণ হয় কিনা।

-মরার আগে কাউকে সাথে নিয়ে মরব। ছাড়ব না, দেখে নিস। দুলালও তেতে উঠল কথায় কথায়।

ব্রিটিশ আমলে সাহেবরা এ তাটে দাপিয়ে বেড়াত। থানার কাছে মালী পাড়ায় জাহাজ ঘাট ছিল। আর একটু এগিয়ে গেলে হরিনাথপুর ধাওড়ায় ছিল সাহেবকুঠী। এগুলো এখন আর কোননা গল্পকথা নয়, বুড়োগুড়োদের মুখে এ গল্প প্রায়ই শোনে রঘুনাথ।

বনমালী মালাকারের বয়স হয়েছে, তার মাথার একটা চুল কালো নেই। সেই মানুষটা স্মৃতিতে ডুবে গেলে কথার খেই হারিয়ে ফেলে, শ্লেষ্ম উগলে বলবে, তখুন মালীপাড়ার ঠাকঠমক ছিল আলাদা। জাহাজ বোঝাই হয়ে শোলার টুপি যেত কাটোয়া-নবদ্বীপ হয়ে কোলকাতায়। সাহেবরা শোলার বড়ো বড়ো টুপি ছাড়া আর কিছু পরত না। এই লাখুরে- কলীগঞ্জের টুপি চালান যেত বিদেশে।

শুধু টুপি নয় গঙ্গার পাড়ে গঞ্জের বাজার ছিল রমরমা। তিন জেলার ব্যবসায়ীরা আসত এই গঞ্জের হাটে। মুর্শিদাবাদ আর বর্ধমান–সবাই চাইত সবাইকে টেক্কা দিতে। কমসে কম হাজার মানুষের আনাগোনা ছিল সেখানে। এছাড়া ছিল নানা পুজোপার্বন। কার্তিক মাসের কালীপুজো ছিল অন্যতম। সেই কালীঠাকুরের নাম মহিমায় জায়গার নাম হয়ে গেল কালীগঞ্জ। এসব গল্প চুনারামের মন ভালো থাকলে রঘুনাথকে শোনায়। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে তাকিয়ে মুখ হা হয়ে যায় রঘুনাথের, দুলালকে নাড়া দিয়ে সে বলে, কাকা, চারধারে এত জমিন অথচ আমাদের এক কাঠা চাষের জমিন নেই গো। সব জমিন বাবুরা দখল করে নিয়েছে। আমাদের জমিতে আমরা এখুন দিনমজুর। আমাদের দু-বেলা মাড়ভাত জোটে না।

–তা যা বলেছিস। দুলাল দুঃখী মুখ করে তাকাল, দীর্ঘশ্বাস নেমে এল তার বুক ছুঁয়ে, এত বড়ো এট্টা বন্যা তবু দেখ কারোর কুনো সাড়া নেই। মানুষ খেল কি মরল এ খোঁজে কারোর গা নেই। দেশ-দুনিয়া বড়ো স্বার্থপর হয়ে যাচ্চেরে। আমাদের দিনটা হয়ত কোনোমতে কেটে যাবে, তোরা বাঁচবি কি করে?

প্রতিটা দিন পাল্টে যায়। আমরাও পাল্টে যাব। রঘুনাথের কণ্ঠস্বর কঠিন শোনাল।

দুলাল চাপা গলায় বলল, নিজেদের বদলে নিতে তোরা পারবি তো? সবার ভেতরে আগুন আচে রে। আগুনটা উসকে নিয়ে ভালো করে ফুঁ দিয়ে জ্বালতে হয়। না হলে পুড়ে পুড়ে সেই আগুন একদিন ছাই হয়ে যায়। দুলালের কথাগুলো মনে ধরল রঘুনাথের, তুমি ঠিক কথা বলেচ কাকা। আগুন সবার ভেতরেই আচে। বিদুরকাকা বলেছিল–আগুনের ব্যবহার জানতে হয়। আগুনও কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে থাকে। তার ঘুম ভাঙাতে হয়। কথায় কথায় ওরা পাড়ার ভেতর পৌঁছে গেল। টিমটিম করে আলো জ্বলছে প্রায় ঘরে। সেই সীমিত আলোয় অন্ধকার দূর হয় না। ভিকনাথের ঘরের সামনে এসে কি মনে করে দাঁড়িয়ে পড়ল রঘুনাথ। কাকার নিখোঁজ হওয়ার পিছনে এই ঘরটার ভূমিকা কম নেই। ঝারি রহস্যময়ী চরিত্র। তাকে বোঝার সাধ্য লুলারামের হয়নি। সে শুধু আগুন পোকার মতো না বুঝেশুনে ঝাঁপ দিয়েছে রূপের টানে। রূপ তো মরণকূপ–একথা জানত না লুলারাম। শরীরের নেশাটা তার কাল হল। যখন নেশা ভাঙল তখন আর মানুষটা গাঁয়ে থাকল না। হয়ত অনুশোচনায় পুড়ছিল তার মন। মনের জ্বালা হলদিপোঁতায় মেটেনি। হলদিপোঁতার আগুন সে কোথায় গিয়ে নেভাবে?

রঘুনাথের দীর্ঘশ্বাস অন্ধকারে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।

.

রাতে বুকের ব্যথায় পাড়া জাগিয়ে চেঁচিয়ে উঠল গুয়ারাম। বানের জল তখন কমতে শুরু করেছে। পণ্ডিতবিল কানায় কানায় ভরে গিয়ে রাজা মহারাজাদের মতো গম্ভীর। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় জলের সাথে মায়াবী চাঁদের কথা হয় রাতভর।

চুনারাম কঁকিয়ে উঠে বলল, যা রে রঘু, তোর বাপের অবস্থা ভালো বুবচিনে, যা করার অপখপ কর।

দুয়ার গোড়ায় কপালে হাত দিয়ে বসেছিল দুর্গামণি, পাথরের মতো মুখ, চোখ দুটো নিরেট হয়ে আছে দুঃখে। রঘুনাথ কোনোমতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, মা, তুমি কি বলছো?

মুখ তুলে বিষণ্ণ গলায় দুর্গামণি বলল, আমি কিছু বলব না, যা ভালো বুঝিস তোরা তা কর। মানুষটার শরীল কদিন থেকে ভালো যাচ্ছিল না–সেটা আমি টের পেয়েছি। তুই ঘরে থাকলি কতক্ষণ যে তোকে আমি বলব।

কথাটায় সাফাই নয়, ছিল রঘুনাথের উপর অনুযোগ। তর্ক বাঁধানো এসময় উচিত নয় তাই চুপ করে রইল রঘুনাথ। একে একে ওই অত রাতে তাদের উঠোনে হাজির হল দুলাল, ডিকনাথ, বিশু আর পাড়ার কজন। সবার চোখে-মুখে উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা। বুকে তারা যেন আগুনের গোলা নিয়ে ঘুরছে। ভালো মানুষটা নীলাক্ষবাবুর জোড়া পায়ের লাথ খেয়ে নেসকে গেল। এ তো তৈরি করা অসুখ, এর বিহিত দরকার। বাবু বুকের ছাতি ফুলিয়ে ঘুরছে। তার বুকে কে মারবে জোড়া পায়ের লাথি।

ভিকনাথ ফুঁসছিল। রঘুনাথকে বেড়ার ধারে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, টাকার জন্যি ভাবিস নে, তোর কাকিমা এগুলান খুলে দিয়েছে। আগে মানুষটা বাঁচুক। পরে এসব নিয়ে ভাবা যাবে।

আবছা আলো আঁধারে রঘুনাথ দেখতে পেল সোনার গয়নাগুলো। এগুলো সে হাত পেতে নেবে কি করে? পরের সোনা নিলে ফেরত দেবে কিভাবে? তার সে যোগ্যতা কোথায়?

-না কাকা, এ আমি নিতে পারবো নি। রঘুনাথ অসহায়ভাবে ডানে-বাঁয়ে ঘাড় নাড়ল।

–আমি তো দিচ্ছি, তুই নে। পারলে দিবি, না পারলে দিবি না। গয়নার বিনিময়ে মানুষটার জীবনটা যদি বাঁচে-তাহলে এর চাইতে সুখের আর কি হবে। ভিকনাথ মনে প্রাণে চাইছিল গয়নাগুলো দিয়ে দিতে, তোর কাকা থাকলে কি আজ আমাকে এভাবে আসতে হত। তখন সে নিজের কাঁধে দায়-দায়িত্ব তুলে নিত। তাছাড়া গুয়াদা তো আমার আপনজন। আমার নিজের কুনো দাদা নেই। ওই মানুষটাকে আমি জ্ঞানপড়ার পর থেকে দাদার মতো দেখে এসেছি।

রঘুনাথের আর না বলার হিম্মোত হল না। ভিকনাথ কাপড়ে বাঁধা গয়নাগুলো ওর হাতে তুলে দিয়ে বলল, ভালো কাজে ভালো জিনিস লাগলে তবে তা সার্থক হয়। তোর বিপদ তো আমার বিপদ। এই ভাবনাটা যদি মানুষ হয়ে না থাকে তাহলে আর কিসের মানুষ।

রঘুনাথ যত শুনছিল ততই যেন মুগ্ধতা তাকে শুষে নিচ্ছিল। এই মানুষগুলোর উপর কোনোদিন তার আস্থা পূর্ণমাত্রায় ছিল না, আজ সেইসব সংস্কারের বেড়া ভেঙে ওরা যেন হৃদয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে।

রঘুনাথ ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল, দুর্গামণির ফেঁপানীর শব্দে তার সম্বিত ফিরে এল, তুমি কানচো কেনে, মা? বাবার তো কিছু হয়নি। এ কাশি তো মাস দুয়েকের পুরনা।

–সেই জন্যিই তো ভয় বাপ। দুর্গামণি সজোরে ডুকরে উঠল, জল জোলোরা কাশি সেরে যায়, লাথের কাশি কি সারে রে? কাশব্যামোর অক্ত দাবাইয়ে জল হয়–কিন্তু চোট-খাওয়া অক্তের রঙ সহজে ফিকে হয় না। ভয়টা তো ইখানে।

দুর্গামণির জোড়া চোখে টলটল করে জল। চুনারামও সেই ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়। ময়লা ধুতির খুঁটে চোখ রগড়ে নিয়ে সে ধরা গলায় বলল, চৌপায়া বার করে দিয়েছি। গুয়ারে নিয়ে সত্বর হাসপাতালে যা। বড়ি আর ইনজিসিন দিলে ছেলে আমার ঠিক হয়ে যাবে।

গুয়ারাম নেতিয়ে পড়েছিল মেঝেতে পেতে রাখা বিছানায়। সবার কথা কানে আসছিল তার। রাতকালে এত মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করা তার ধাতে নেই। চিরদিন অভাব নিয়েও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সে। আজ তার বিপদে সবাই এসেছে দেখে সে খুশি। রঘুনাথকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে সে বলল, কাশিটা এখুন কমের দিকে। আমার মন চাইছে না হাসপাতালে যেতে। এই বানন্যায় ডাঙা খেয়ে নিয়েছে জল। যা হয় ঘরেই হোক। তোরা যে যার মতো শুয়ে পড়।

-তা কি হয়। ধকধকিয়ে উঠল রঘুনাথের চোখ, শুধু তো কাশি নয়, কাশির সাথে খুন বেরচ্ছে। এ তো ভালো লক্ষণ নয়, বাবা?

চিঁ-চিঁ স্বরে গুয়ারাম বোতে চাইল, খুন তো সেই চোট পাওয়ার পর থিকে হচ্ছে। এসব নিয়ে আমি আর ভাবিনে। যা হবার হোক। হয় ঘরের খাট নইলে শ্মশান ঘাট। মরতে আমার আর কুনো ভয় লাগে না।

ভিকনাথ উঠোনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাকল, কই রে রঘু, দেরি হচ্ছে কেনে? গুয়াদারে ধরে ধরে নিয়ে আয়। অতটা পথ আবার যেতি হবে–

শুয়ারামের মাথার কাছে বসে রঘুনাথ নিচু গলায় বলল, বাবা, এবার দুহাতে ভর দিয়ে উঠে বসো। আমি তুমাকে ধরে ধরে, চৌপায়া অবধি নিয়ে যাবো।

গুয়ারাম কেমন বিপন্ন স্বরে বলল, আমি কি অতটা যেতে পারব?

-কেনে পারবে না, চিষ্টা করো, ঠিক পারবে। কথাগুলো রঘুনাথ জোর দিয়ে বললেও মনের জোর খুঁজে পেল না গুয়ারাম। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে তার শরীর গোবর লাঠির মতো ভেঙে পড়ল।

দেখে শুনে ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল রঘুনাথের, কপালে ভাঁজ ফেলে সে ভাঙা ভাঙা স্বরে ডাক, কাকা গো, খপখপ আসো….।

দুলাল আর ভিকনাথ ভয় পেয়ে ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকে এল, হাঁপাতে হাঁপাতে দুলাল শুধাল, কি হল আবার?

-বাবা আর দেড়তে পারছে না।

–খাওয়া-দাওয়া না থাকলে মানুষ কি দেড়তে পারে রে! হাওয়ায় তো গায়ের জোর বাড়ে ।

ভিকনাথ শুনছিল। রঘুনাথকে সাহস দেওয়ার জন্য সে বলল, সামান্য জ্বরজ্বালা হলে মানুষ হাঁটতে চলতে পারে না। আর এতে হল কাশরোগ! তবে আজকালকার দিনে এরোগ কোন রোগ নয়।

গুয়ারামের হাঁটাচলা করার ক্ষমতা নেই, তাকে খাটিয়া অবধি কোলোজা করে নিয়ে যেতে হবে। অত বড়ো মানুষটাকে কোলপাজা করে খাটিয়া অবধি নিয়ে যাওয়া মুখের কথা নয়। রঘুনাথকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এল দুলাল আর ভিকনাথ। ধরার সময় বুকের কাছটাতে চাপ লাগতেই অব্যক্ত যন্ত্রণায় গুমরে উঠল গুয়ারাম। এবার সে আর তার বিরক্তি চেপে রাখতে পারল না, তোরা যা তো ইবার। মরা মানুষটাকে নিয়ে আর টানহিঁচড়ে করিস নে। আমার শরীলে আর সে বল নেই। অসুখের উইপোকাটা আমাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।

বাঁধে বাঁধে গিয়ে পুরাতন বাজারের ঢালু পথটায় নেমে গেল ওরা। ওখানে চারটে খাম্বা পুঁতেছে ইলেকট্রিক অফিসের লোকে। শোনা যাচ্ছে ট্রান্সফরমার বসবে। কাজ পুরো হয়নি। কাজ শেষ হলে বাতি জ্বলবে বাজারে। গমকলগুলো আর ডায়নামোতে চলবে না, সুইচ-টেপা কারেন্টে চলবে।

ওদের দেখে অত রাতে এগিয়ে এল হারাধন চৌকিদার। তার হাতের লাঠিটা তার চাইতে লম্বা। রোগা খিটখিটে মানুষটার গোঁফ দুটো দেখার মতো। ইলো মুখে গোঁফ দুটো তার আসল সম্পদ।

লাঠি ঠুকে শুধোল,কারা গো তুমরা?

–আজ্ঞে, আমরা হলদিপোঁতা ধাওড়ার।

–কি হয়েছে? খাটিয়ায় কে আছে?

–উগী আচে গো, উগী।

-আগে নামাও। তারপর অন্য কথা। হারাধন চৌকিদার গলা চড়াল। পাশেই থানা। থানার সঙ্গে তার বেশ দহরম মহরম।

অবশেষে খাটিয়া নামাল ভিকনাথ আর দুলাল। কাঁধ রগড়ে নিয়ে তারা একটু আরাম করার জন্য দেহটাকে আলগা করে দিল। তিন ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে হারাধন চৌকিদার ঝুঁকে পড়ে বলল, শুয়ে আছে যে, কি হয়েছে ওর? সাপে কেটেছে বুঝি?

বান বন্যায় এছাড়া আর বিপদের কোনো কারণ খুঁজে পেল না হারাধন চৌকিদার। এ পথ দিয়ে রাত-বেরাতে যে কটা রুগী গিয়েছে প্রায় সব কটাই তো সাপে কাটার কেস। রাতে সাপে কাটলে জান চটকে ছেড়ে দেয়।

রঘুনাথের হাতে হ্যারিকেন টিমটিম করে জ্বলছিল,সে কপা এগিয়ে এসে বলল, সাপে কাটেনি গো, এর কাশব্যামো। বুকে বেদনা হয়। কাশলে মুখ দিয়ে অক্ত বেরয়। এবার কপাল কুঁচকে ভয়ে তিনহাত পিছিয়ে গেল হারাধন চৌকিদার, রোগটাতো ভালো নয়, বড্ড ছোঁয়াচে! কালীগঞ্জের লোক এ রোগটাকে টি.বি বলে।

হারাধন চৌকিদার আধুনিক হতে চাইল, তাহলে এমন কঠিন অসুখ নিয়ে তোমরা কোথায় যাবে ভাবছ?

হাসপাতালে যাবো গো।

-হাসাপাতাল তো সেই কবে থেকে বন্ধ। বাঁধ যেদিন ভাঙল সেদিন থেকে শিবনাথ বাবুর বাড়িতে বড় ডাক্তার আশ্রয় নিয়েছেন।

-তাহলে এখন উপায়? দুলাল মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল।

–উপায় একটা আচে। ষষ্ঠীতলার শিবনাথবাবুর কাছে নিচতলায় দিনমানে অনেক লোক আসে ওষুধ নিতে। তোমরা ওখানেই চলে যাও। আমার মন বলচে ওখানে গেলে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

অন্ধকারের মধ্যে সামান্য আলোর চিহ্ন বদলে দিল ওদের গতিপথ। রঘুনাথ আগে আগে হাঁটছিল। তার হাতে দুলছে হ্যারিকেন। মাঝে মাঝে দপদপ করছে আলোর শিস।

আমি শিবনাথবাবুর ঘরটা চিনি। তোমরা আমার পেছন পেছন আসো। রঘুনাথের কথায় আবার খাটিয়াটা ঘাড়ে চাগিয়ে নিল ভিকনাথ আর দুলাল। বাজারে জল বেশি নেই তবু মাঝে মাঝে হাঁটু ডুবে যায়, কোথাও আবার চেটো ডোবা জল চিকচিক করছে আলো আঁধারির খেলায়।

ডাক্তারবাবু গুয়ারামকে পরীক্ষা করে দেখলেন, তারপর মুখ শুকিয়ে বললেন, অনেক দেরি করে এনেছেন, এখানে কিছু করা যাবে না। ইমিডিয়েট চেস্টের একটা এক্স-রে দরকার। কৃষ্ণনগর ছাড়া এ কেসের প্রপার ট্রিটমেন্ট হবে না। আমি একটা কাজ করতে পারি। কাল সকাল হলে একে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমি সদরে পাঠিয়ে দিতে পারি।

–তাই করুন ডাক্তারবাবু, আমরা তৈরি হয়ে এসেছি। কখন সকাল হবে এই ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়ছিল ভিকনাথ। বারবার সে ঘাড় তুলে আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল। বিপদের রাত বুৰি তাড়াতাড়ি ফুরোয় না।

কথাগুলো আচ্ছন্ন ওয়ারামের কানে ঢুকেছে কিনা বোঝা গেল না। শুধু হাই তুলে রঘুনাথ বলল, কাকা ভোর হতে এখন ঢের বাকি। চলো, বারোয়ারি তলায় গিয়ে বসি। ওখান কমসে কম মাথার উপর ছাদ আচে।

.

৫০.

হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সটা খরগোসের মতো ছুটছিল। চৌত্রিশ নাম্বার জাতীয় সড়কে তখনও বন্যার জল গড়িয়ে নামছিল খেতের দিকে। ভাগা পেরতেই কাশির বেগটা ঝাঁকিয়ে দিল গুয়ারামকে, বাবা গো বলে বুকে হাত দিয়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি সহযোগে কেঁপে উঠল। দলা দলা কাঁচা মাংসের মতো রক্ত উঠে এল মুখ দিয়ে। কাশিটা এত টানা আর দীর্ঘ কেউ তাকে আটকে রাখতে পারল না। পেতে রাখা কাঁথা কানি ভেসে যাচ্ছিল রক্তে।

ভয় পেয়ে চোখ হোট করে রঘুনাথ বলল, ও কাকু, গাড়ি থামাও।

অ্যাম্বুলেন্স রাস্তার এক পাশে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। তখনই স্তব্ধ হয়ে গেল গুয়ারামের জীবন। রঘুনাথের দেওয়া জলটুকুও তার গলা দিয়ে নামল না। দু কোয়াশের পাশ দিয়ে গড়িয়ে গেল বিছানায়।

বাবার বুকে মাথা দিয়ে রঘুনাথ শুনতে চাইল জীবনের পদাবলি। কোনো ছন্দ নেই, ঢেউ নেই–শুধু নিথর একটা দেহ আঁকড়ে কান্নায় ডুবে গেল এক আগুন যুবক।

সবাই মাটি পায় না, সবার ভাগ্যে শ্মশান জোটে না।

মানিকডিহির শ্মশান গিলে খেয়েছে বড়ো গঙ্গা। ঘোলা জল পাগলা ষাঁড়ের মতন দৌড়ে বেড়াচ্ছে পুরো সাহেবমাঠ। কবে যে তার রাগ পড়বে কে জানে। মানুষ এখন ভয়ে এদিকে আসে না। জলের সাথে আর যাই হোক বন্ধুত্ব করা যায় না।

গুয়ারামকে দাহ করা হবে কোথায় এই নিয়ে চুনারাম আর মুনিরামের নিচু গলার আলোচনা আর থামছে না। রঘুনাথ পাগলের মতো ঘুরছে এদিক সেদিক, তারও মাথার কোনো ঠিক নেই। বুক ভরে গেছে একরাশ শূন্যতায়। মাঝ পথ থেকে ফিরে এসেছে অ্যাম্বুলেন্স। ভিকনাথ চোখের জলে কাতর হয়ে বলল, ফিরে চলল গো ড্রাইভারদা। যে মন্দিরে ঠাকুর নেই সেই মন্দিরের আর কি দাম? দুর্গামণি কাঠ হয়ে গিয়েছে শোকে। কেঁদে কেঁদে তার আর এখন শব্দ করে কাদার কোনো ক্ষমতা নেই। রঘুনাথের দিকে পাথর চোখে তাকিয়ে সে যেন কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনো ভাষা বেরল না, শুধু অস্পষ্ট গোভানীর শব্দ বেরিয়ে এল। আর রঘুনাথও চাইছিল না দুর্গামণির মুখোমুখি দাঁড়াতে। মার কাছে গেলে সেই একই কথা উগলে দেবে সে।

-নীলুবাবুকে হাড়বিনে, ও তোর বাপকে খুন করেছে। আমার বুকের দুধ যদি তুই খেয়ে থাকিস তাহলে আমার সিদুরের হিসাব চুকিয়ে নিবি। কথা দে।

.

শ্লেটের মতো মেঘ করেছে আকাশে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় শীত গন্ধ। পাতা আর ঘাস পচার গন্ধগুলো নাক সয়ে নিয়েছে এতদিনে।

দুলাল গিয়েছিল বড়ো গঙ্গার ধার। সে ফিরে এসে হতাশ হয়ে বলল, হরদার সাথে দেখা হল। গোরা সাধুর মতো এটা গাছে চড়ে বসে আছে। নামতে বলতেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওর মুখে শুনলাম–এখন আর মড়া পুড়ছে না শ্মশানে। মা গঙ্গার নাম নিয়ে গাভের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে লাশ। আসলে কি জানিস ডাঙা কুথায় যে মানুষ পুড়বে।

গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়ানো মানুষগুলো হাঁ হয়ে কথা শুনছিল ওর। শীতল হাওয়ায় নড়ে চড়ে উঠতেই রঘুনাথ ঠাণ্ডা গলায় বলল, একটা কিছু তো করতে হবে। তুমরা সবাই মিলে যে রায় দেবে আমি তা মেনে নেব।

এবার ভিড়টা একে অন্যের দিকে চকচকে চোখে তাকাল। কেউ আবার স্তব্ধ হয়ে রইল কিছু সময়। ভিকনাথ ওদের ভেতর থেকে ঠেলে উঠল। গলা চড়িয়ে বলল, পোড়াব যে তেমন ভাঙা নেই। অথচ গুয়াদা ভেষণ মাটি ভালোবাসত। জীবনের বেশির ভাগ সময় মাঠের কাজে তার চলে গেল। আমার মনে হয় বাসি না করে লাশ ভাসিয়ে দিলে ভালো হবে।

পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসেছিল দুর্গামণি। আলোচনার সব কথা তার কানে ঢুকছিল। মানুষটাকে ভাসিয়ে দেবে, কেন? শরীর রিরি করে উঠল দুর্গামণির। নীরবতা ভেঙে সে চেঁচিয়ে উঠল সজোরে, না-আ-আ। ওরে তুমরা ভাসাবে না।

তাহলে কি করতে চাও বৌদি? দুলাল গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল। রঘুনাথ কাঁপাকাঁপা শরীরে এগিয়ে এল দুর্গামণির সামনে, মা, তাহলি পরে তুমি কি চাইচো খোলস করে বলল। আর দেরি করা যাবে না। বেলা ফুরলো বলে।

দুর্গামণি কি খেয়ালে নিজের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল। চিন্তায় তার মাথা বনবন করছিল। কেঁদে কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে গেছে গালে। এলোমলো চুলগুলোয় তাকে বড় অস্বাভাবিক দেখায়। ভিনাথ সাহস করে তার সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল, গাঙে ভাসালে তুমার আপত্তি কেন, বউদি?

সাপের ফণা আছড়ানোর মতো শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়াল দুর্গামণি, রঘুর বাপকে কি সাপে কামড়েছে যে মানুষটাকে গাঙের জলে ভাসিয়ে দেবে? তুমরা কেমন মানুষ, এমন কথা বলছো কি করে?

হতচকিত শোক কাতর মুখগুলো সাদা হয়ে গেল নিমেষে। চুনারাম মাটিতে ভর দিয়ে উঠে। দাঁড়াল কোনোমতে। পুত্রশোক তার চোখের জল শুকিয়ে দিয়েছে। এই বয়সে কাঁদলে মনে হয় এক্ষুনি আকাশ ভেঙে পড়বে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, বউমা, মাথা ঠাণ্ডা রাখো। দশে যা বলছে তাই মেনে নাও।

-না, আমি মানতে পারব না।

–তাহলে কি করতে চাও তুমি? বাসি মড়া ঘরে আগলে রাখবে? চুনারামের বুকের গভীরে পাথরের স্তব্ধতা ছেয়ে গেল। ঘাড় ঝুঁকিয়ে একবার সে সবার দিকে তাকিয়ে নিয়ে শরীরের ভারে ঝুপ করে বসে পড়ল মাটিতে। কান্না ঠেলে উঠল তার গলায়। কান্নর ভাষা বোঝা গেল না, শুধু ক্ষীণ একটা গোঙানী আছড়ে পড়ল বাতাসে।

দুর্গামণির বুকের ভেতরটা টনটন করছিল শোকে-দুঃখে। না সামলাতে পেরে সে অবোধ স্বরে কাতর হয়ে বলল, ঘরের মানুষকে জলে না ভাসিয়ে ঘরের উঠোনে মাটি দাও। এতে তার সদগতি হবে। আমাদের চোখে চোখে থাকবে মানুষটা।

–কি করে সম্ভব? কেউ কিছু বলার আগে চুনারামই গলা ফাটাল। দুর্গামণি বিচলিত হল না, শুধু আহত চোখে তাকাল, ধাওড়াদের এমন চল অনেক বস্তিতে আচে। বামুনরা যদি সমাধি দেয় তাহলে আমাদের দিলে দোষ কুথায়? কামারী, দোয়েমের লোকেরা মরা মানুষকে করে নিয়ে যায়। মাটির শরীর মাটিতে মিশে গেলে আত্মা নাকি পাখি হয়ে ওড়ে।

সবাই হাঁ হয়ে শুনল দুর্গামণির যুক্তিগুলো। রঘুনাথ ভাবছিল তার মায়ের বুদ্ধির কথা। দেখে মনে হয় হাবাগোবা, অথচ সময়ে জ্বলে উঠতে জানে। মায়ের এই যুক্তিকে একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না।

ভিকনাথ একটা সমাধান চাইছিল দ্রুত। সে নিঃশাস ফেলে বলল, রঘু, এই ব্যাপারে তোর কি মত?

একটুও ভাবল না রঘুনাথ, মার যা মত আমারও তাই মত।

–তাহলে তো আর কথা নেই। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য। ভিকনাথ স্বস্তির খাস ছেড়ে এগিয়ে গেল পিটুলিগাছটার গোড়ায়। ঠিক হয়েছিল বাধের ধারের এই গাছটা কেটে দাহ করা হবে গুয়ারামকে।

কুড়ল হাতের লোকটাকে ভিকনাথ বলল, এসো গো, আর গাছ কাটার দরকার নেই। ঘরের মানুষ ঘরেই থাকুক সেই ভালো।

চুনারাম বলল, পয়সা কড়ি জমলে গুয়ার সমাধিটা আমি পাকা করে দিব।

কোপে কোপে মাটি কাটছিল দুজন। রঘুনাথের মুখে কোনো কথা নেই। সে জানে আর একটু পরে একটা মানুষ মাটি চাপা পড়ে যাবে অনন্ত সময়ের জন্য। মাস তিনেক পরে শুধু হাড়গোড় ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। মানুষ জীবনটা বড়ো আশ্চর্য মনে হল তার কাছে।

রাতের আঁধারে বুড়িগাতের দিকে তাকালে সে-ও বুঝি কিছু বলতে চায়। কি বলতে চায় সে? রাতের ভাষা বোঝা গেলেও গাঙের ভাষা বোঝা যায় না।

ভোররাতে সব যখন শান্ত হয়ে গিয়েছে তখন সদ্য খোঁড়া সমাধিটায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল রুদ্রাক্ষ। হাত মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। পাড়ার কুকুরগুলো সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। চাপা গলায় কুকুরগুলোকে সংযত হতে বলছে রুদ্রাক্ষ। ওরা কথা শোনার মন্ত্র জানে না। বিকট চিৎকারে পাড়া মাথায় তুলে চেঁচাতে লাগল।

সারা দিনের ধকলেও ঘুম আসেনি রঘুনাথের। নিঃশ্রুপ পায়ে সে বিছানা ছেড়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। আবছা আলো-আঁধারে বাঁশ গাছ থেকে ভেসে আসছে ভৌতিক শব্দ। রঘুনাথ রোজ শোনে তবু আজ তার গা কাটা দিয়ে উঠল, কে, কে ওখানে?

–আমি রে রঘু। কাঁপা কাঁপা উত্তর ভেসে এল হাওয়ায়।

–আমি কে? নিরীহ গলায় জিজ্ঞাসা করল রঘুনাথ।

–আমি রুদ্রাক্ষ।

জবাব শুনে সারা গায়ে বিদ্যুৎ-এর শিহরণ নেচে গেল রঘুনাথের। টোকে গিলে সে বলল, অসময়ে এলে যে।

-বিপ্লবীদের কোনো সময় অসময় থাকতে নেই। রুদ্রাক্ষ চোখ রগড়ে নিয়ে টিবি হয়ে যাওয়া মাটির দিকে তাকাল। ঊাই করা মাটি দেখে সে একটু অবাক হয়ে শুধোল, এখানে এত মাটি কাটা হয়েছে কেন? এভাবে উঠোন কেউ কি কাটে?

-ওখানে আজ বাবাকে কবর দেওয়া হল। রঘুনাথের চোখ জোড়া আর্দ্রতায় ভরে গেল।

রুদ্রাক্ষ ব্যথিত হয়ে বলল, ওঃ, সরি

রঘুনাথ কিছু বুঝল না, অন্ধকারে ওর চোয়াল কঠিন হয়ে উঠছিল। চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলল, আজ এই মৃত্যুর জন্য তুমার বাবা দায়ী। সে আমার বাপের বুকে জোড়া পায়ের লাথি মেরেছিল। সেই থিকে মানুষটা আর এক দিনের জন্যও হাসেনি। বড়ো অভিমান নিয়ে মানুষটা চলে গেল।

রুদ্রাক্ষ অন্ধকারেই মুখ ঢাকা দিল দুহাতের আড়ালে। কথা হারিয়ে সে মাটির চেয়েও নীরব থাকল অনেক সময়। রঘুনাথ চিৎকার করে বলল, এখুন আর মাঝরাতে যাত্রা করে কুনো লাভে নেই। তুমি যেমন এসেচো তেমন চলে যাও। হলদিপোঁতার মানুষ জাগলে তুমাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবে।

রুদ্রন নিজের মাথার চুল দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল, মরতে আমি ভয় পাই না। এসেছি যখন একবার তোমার মায়ের সাথে দেখা করে যাব। বাবার হয়ে ক্ষমা চেয়ে তার পাপের ভাগ আমি কিছুটা কমাতে চাই।

-সে সুযোগ তুমার আর হবেনি গো। তুমি ঘুরোন যাও। আর এগিও না।

–কেন?

 –আমি এর বদলা নেব।

–তুমি একা কেন, আমিও তোমার সঙ্গে থাকব। চলো।

 গল্পের মতো কথাগুলো শোনাল রঘুনাথের কানে, সে অবিশ্বাসের চোখে তাকাল। রুদ্রাক্ষ বলল, তোমার বুঝি বিশ্বাস হচ্ছে না? বিশ্বাস না হবারই কথা। এই নাও। বলেই সে কোমরে গোঁজা রিভলভারটা ছুঁড়ে দিল রঘুনাথের দিকে, লোড করা আছে। চাইলে তুমি আমাকে খতম করে দিতে পার।

রঘুনাথের হাত কাঁপছিল। এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তাকে স্বপ্নেও ভাবেনি সে। রুদ্রাক্ষ পায়ে পায়ে এগিয়ে এল তার কাছে। হাত বাড়িয়ে ধরলো রঘুনাথের হাত, তুমি আমার ভাইয়ের মতো। আজ তোমার মনের কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। বাবাকে ছোট থেকে দেখছি। তার মতো অত্যাচারী মানুষ আর হয় না। উচ্চবর্ণের মানুষ বলে গর্বে মাটিতে তার পা পড়ে না। চলো কমরেড, আজ সেই বুর্জোয়া মানুষটাকে খতম করে আসি। অমন মানুষকে বাঁচার অধিকার দিলে সমাজের আরও ক্ষতি হবে।

নিজের বাবাকে নিজে মারতে পারবে?

 আমার কাছে বুর্জোয়ার কোনো সংজ্ঞা নেই। খতমের রাজনীতিতে আমরা বুর্জোয়াদের সবার আগে রেখেছি।

রঘুনাথ কথা না বাড়িয়ে পুরনো খড়গাদাটার দিকে এগিয়ে গেল। হাত ঢুকিয়ে খড়গাদার ভেতর থেকে বের করে আনল রিভলভারটা। রুদ্রাক্ষকে রিভলভারটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, তুমার এই মেসিনটার জন্যি আমি কুথাও ভোলা মনে যেতে পারতাম না। হলদিপোঁতায় বন্দি হয়েছিলাম এতকাল। আজ আমার বুকের বোঝা নেমে গেল। এবার তুমি যেতে পারো।

কোথায় যাব, আমি তো তোমার কাছে এসেছিলাম। নাহলে এত ঝুঁকি নিয়ে গ্রামে ঢোকার কোনো অর্থ হয় না।

আমি এত ছোট যে তুমার মতোন মানুষের সাথে থাকতে পারবো নি। রঘুনাথের হাতটা ব্যাকুল হয়ে জড়িয়ে ধরল রুদ্রাক্ষ, আমাকে ভুল বুঝো না। তোমাদের কথা ভেবে আমি অনেক কষ্ট পাই। নিজের কষ্ট দূর করার জন্য আমার এই সংগ্রাম আমৃত্য চলবে। আজ আসি ভাই। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।

অস্ত্রটা নিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল রুদ্রাক্ষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *